ঘোর কলি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০২০
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার
শ্রীচরণে
.
নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিয়েছিল। তার আর ফেরা হল না। সমুদ্রে গুলে গেল। আমি মাপতে গিয়েছিলাম ‘কালের সমুদ্র— কালসমুদ্র’, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছি না। বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেছি ‘কালসিন্ধু’তে। আদি, অন্তহীন হে মহাকাল! কার সাধ্য তোমাকে খণ্ড খণ্ড করবে! আতঙ্ক নিয়ে ফিরে আসি বিন্দু-প্রায় নিজের এই অস্তিত্বে। ‘কালচক্র’ ধীর গতিতে ঘুরছে। যুগের পর যুগ আসছে, যাচ্ছে। কে যায়? কাল তো স্থির একটি মহাসমুদ্র। জীবন— সে তো বুদবুদ! জলের বিম্ব জলেতেই যেমন মিলায়, সেইরকম কালের আধার মানুষও প্রাণের ঘড়িতে সময়ের হিসেব রাখে। সংখ্যা— সে তো মানুষের হিসাব! ওই আসে, ওই যায়। ঘটনার ঘনঘটায় ইতিহাস তৈরি হয়। পাণ্ডুলিপির পাতা বাড়ে।
অখণ্ড কালকে আমরাই খণ্ড খণ্ড করি। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি— এই চারটি যুগ। চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। প্রভু! আমাদের হিসাবটা একবার দেখুন:
সত্যযুগের আয়ুষ্কাল— ১৭,২৮,০০০ বছর।
ত্রেতা— ১২,৯৬,০০০ বছর।
দ্বাপর— ৮,৬৪,০০০ বছর।
কলি— ৪,৩২,০০০ বছর।
আর যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের প্রয়োজন আছে কি? আমরা কয়েক কোটি খুচরো, খোলামকুচি সময়ের অতল অঙ্গনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকি। যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা দেখিনি, সব মিলিয়ে জ্ঞানের জগৎটিকে খাড়া রাখার বিকট প্রচেষ্টা। সবটাই একটা গল্প যেন!
মহারাজ! আপনি দ্বাপরের শেষ রাজা। পাণ্ডুবংশের শেষ প্রতিনিধি। রাজা পরীক্ষিৎ! আপনার বিরুদ্ধে আমার কিছু নম্র অভিযোগ আছে। আপনি এই বৃক্ষতলে বসুন। একদিন এই মূলে আপনার জীবনদাতা পাণ্ডব-সুহৃদ শ্রীকৃষ্ণও বসেছিলেন। সে-সব অতীতের কথা। রাজন! আপনি খুব সাজতে ভালবাসেন। মৃগয়ায় যান রাজপোশাকে। মাথায় সোনার মুকুট। গলায় সোনার হার, হীরা, জহরত। আমার অনুরোধ, আপনি আরামদায়ক পোশাকে এই অপূর্ব উদ্যানে, এই ছায়াতরুতলে কিছুক্ষণ বসুন। আপনি দ্বাপরের সীমানা অতিক্রম করে কলিকালে প্রবেশ করেছেন। পেছনে পড়ে আছে কত লক্ষ বছর। দেবপঞ্জিকা মানবপঞ্জিকা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শুনবেন সেই হিসাব! আমি শাস্ত্র থেকে উদ্ধার করে এনেছি। পৃথিবীর এক বছর দেবলোকে দেবতাদের একদিন একরাত। পৃথিবীর তিন কোটি ষাট বছর দেবতাদের এক বছর। দেবতাদের বারো হাজার বছর (অর্থাৎ আমাদের বারো হাজার × তিন কোটি ষাট বছর) এক দিব্যযুগ। এক-একটি দিব্যযুগের এক-একটি নাম— সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। মহারাজ আমরা বসে আছি কলিযুগের প্রারম্ভে। আপনি আছেন, আপনি থাকবেন— কিন্তু আমি এক সামান্য মানুষ, জোনাকি তুল্য, ক্ষণ-পরমায়ু; আমি কীভাবে, কোন স্পর্ধায় আপনার সামনে বসে আছি? মহারাজ! এর উত্তর, আমি হলাম—‘জিজ্ঞাসা’, চিরকালীন ‘প্রশ্ন’। আপনি আমাকে পাবেন বেদ আর উপনিষদের পাতায় পাতায়। আচার্যের অধিকারে জ্ঞান, শিষ্যের মনে প্রশ্ন, এই সৃষ্টি বিরাট এক রহস্য, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে রোমাঞ্চ। মহারাজ! আমি প্রশ্ন, আপনি উত্তর। সময়— সে এক পরম বিস্ময়। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মারও মৃত্যু আছে। ব্রহ্মার আয়ু একশো বছর। না, আমাদের বছর নয়, অনন্তের ঘড়ি। এই হিসাব শুনলে আপনার মাথা ঝিমঝিম করবে। ব্রহ্মার একশো বছরের হিসাবটা আপনাকে শোনাই— সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি একত্রিত হয়ে এক দিব্যযুগ। দেব পরিমিত বারো হাজার বছর। কিন্তু না, এই বিষয়ে আলোচনা করার কোনও অর্থ হয় না। ঋষিদের বেদ বিজ্ঞান চর্চা। কল্পনাও বলা যেতে পারে তবে যথেষ্ট সুগঠিত। একটা কথাই তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, আদি-অন্তহীন এই সৃষ্টি। সময়ের শুরু সৃষ্টির শুরুতে। একটা সময় তো ছিল, যখন কিছুই ছিল না। অবতার তত্ত্ব। দশ অবতার। তারপরে ‘মনু’। এক-একজন মনু সাতটি দিব্যযুগ (অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি— এক দিব্যযুগ) ভোগ করেন। এইরকম চোদ্দোজন মনু। চোদ্দোজন মনুর সাত দিব্যযুগ, অর্থাৎ আঠাশটি দিব্যযুগে ব্রহ্মার একদিন। ব্রহ্মার আয়ু একশো বছর, তারপর তিনি নিজেতে লয় হয়ে যান। না, রাজন! মাথা খারাপ করে লাভ নেই, আপনাকে আমার প্রশ্ন, আপনি কেন হাতে পেয়েও সেই দুরাচারী দুষ্টটাকে ছেড়ে দিলেন?
কার কথা, কোন দুষ্টের কথা তুমি বলছ?
ওই যে, যে-গ্রন্থখানি, যে শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত আপনার কারণেই এই ধরায় অবতীর্ণ হয়ে যুগ যুগ ধরে ভক্তহৃদয়ে ভক্তিহিল্লোল তুলবে, সেই শ্রীমদ্ভাগবতে— এই শুনুন মহর্ষি ব্যাসদেব কী লিখে গেছেন আপনার সম্পর্কে!
একদিন হেরে রাজা আপন নয়নে।
অদূরে কাঁদিছে গাভী নিয়ত পীড়নে ॥
বৎসহীন মাতা সম কাঁদে ধরা পরে।
তার পার্শ্বে এক বৃষ বিষাদে বিচরে ॥
মহারাজ! এই বৃষটি হল ধর্ম আর গাভীটি হল ধরণী। এদের বাক্যালাপ আপনি স্বকর্ণে শুনেছিলেন। আপনি অবাক হয়ে লক্ষ করেছিলেন, বৃষরূপী ধর্মের চারটি পা থাকা উচিত, কিন্তু রয়েছে মাত্র একটি পা। অপর তিনটি কোথায় গেল! কোন নিষ্ঠুর সেই তিনটি পদ কর্তন করল? মনে পড়ছে মহারাজ! আপনারই রাজ্যে, আপনারই শাসনে, কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে এক মহাপাষণ্ড। কালো কুচকুচে, আবলুশ কাঠের মতো গায়ের রং। সে আবার রাজা সেজেছে! আপনাদের আমলে এই এক সমস্যা— রাজারা সবসময় রাজা সেজে থাকেন, ব্রাহ্মণরা সবসময় ব্রাহ্মণের সাজে, চৌকিদার মাথায় পাগড়ি। সুন্দরীরা অপ্সরা, ডানা মেলে উড়ে গেলেই হল। ধনসম্পদে ভরা এই ভারত। রাজার শাসনে প্রেম ছিল, প্রজাবৎসল।
কিন্তু, এ একটা কে? কোথা থেকে এল এই উটকো উৎপাত। কুরুক্ষেত্রের শ্মশান থেকে? এ কি কৌরবপক্ষের শেষ কোনও রাজা! অথবা প্রেত! কী অসীম এর ধৃষ্টতা! অকারণে এই বৃষটিকে নিপীড়ন করছে, শান্ত গাভীটি সাশ্রুনয়নে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে।
আমার রাজ্যে এ কী উদ্ধত অনাচার! মাতার গর্ভে আমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেছি। তিনি আমাকে অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন। আমার পিতা যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মৃত্যু স্বীকার করেছিলেন। আমার পিতামহগণ ধর্ম ও বীরত্বের প্রতীক! ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপাধন্য। সর্বকালের সব যুদ্ধের শেষ ঘণ্টা বেজেছিল কুরুক্ষেত্রে। রক্তাক্ত ভূমিতে উঠে দাঁড়িয়েছে নতুন ভারত। পুরাণের কাল প্রবেশ করেছে ইতিহাসের কালে। সিংহাসনে আরোহণ করবে আমারই এক পুত্র জনমেজয়।
নিশ্চয়! আপনার সব অহংকারই আমরা মেনে নেব। ব্যাসদেব সবই বলে গেছেন। বলে গেছেন, কী কারণে আপনার নাম রাখা হল পরীক্ষিৎ! নামটি অতি সুন্দর। মাতৃগর্ভেই আপনার কৃষ্ণদর্শন হয়েছিল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আপনি এই মনুষ্যলোকে সর্বদাই তাঁকে খুঁজতেন, ‘এই কি সেই?’ মানুষ দেখলেই আপনি মেলাবার চেষ্টা করতেন, ‘এই কি সেই দিব্যপুরুষ, জ্যোতির্ময়?’
স এষ লোকে বিখ্যাতঃ পরীক্ষিদিতি যৎ প্রভুঃ।
গর্ভে দৃষ্টমনুধ্যায়েন্ পরীক্ষেত নরেস্বিহ।। (ব্যাস)
মানুষ দেখলেই অভিমন্যু-পুত্র ‘এই কি সেই মাতৃগর্ভে-দৃষ্ট পুরুষ’ মনে করে পরীক্ষা করতেন বলে তিনি পরীক্ষিৎ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আপনার জন্মের পর ভাগ্যগণনাকারী ব্রাহ্মণগণ বলেছিলেন, ‘কালের প্রভাবে কুরুবংশ ধ্বংসোন্মুখ হলে, তা রক্ষার জন্য ভগবান কৃপা করে এই বালককে দান করেছেন’—
তস্মান্নাম্না বিষ্ণুরাত ইতি লোকে ভবিষ্যতি।
ন সন্দেহো মহাভাগ মহাভাগবতো মহান। (ব্যাস)
আপনি ভগবানের অনুগ্রহের দান। অবশ্যই। সেই কারণেই আপনার আর একটি নাম— ‘বিষ্ণুরাত’। ভগবানের দান নিকৃষ্ট হতে পারে না; সর্বোত্তমই হবে। অতএব এই বালক হবে অশেষ গুণসম্পন্ন, পরম ভাগবত মহাভক্ত। ‘মহাভাগ মহাভাগবতো’। ভাগ্য গণনাকারীদের এই সিদ্ধান্ত। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আরও জানতে চান বিস্তারিতভাবে। এই বালক আমাদের একমাত্র উত্তরপুরুষ, আমাদের কীর্তি, আমাদের গৌরব কি রক্ষা করতে পারবে? ইক্ষ্বাকু বংশের ঐতিহ্য!
উত্তরে তাঁরা ধর্মরাজকে আশ্বস্ত করে বললেন, এই বালক যথাকালে ইক্ষ্বাকুর মতোই হবে। সাক্ষাৎ ইক্ষ্বাকু। ‘ধর্মরাজ! শুনে রাখুন এই বালক কালে কেমন হবে, রামচন্দ্রের মতো প্রজাপালক, সত্যনিষ্ঠ, ব্রাহ্মণদের হিতকারী, শিবিরাজার মতো দাতা, শরণাগতের রক্ষাকারী, ভরতের মতো কীর্তিশালী, পার্থের মতো বীর। অগ্নির মতো তেজ ধারণ করবে। সিংহের মতো পরাক্রম। হিমালয়ের মতো সাধুদের আশ্রয়স্থল, পৃথিবীর মতো ক্ষমাশীল!’ তালিকা বাড়তে বাড়তে বিরাট হয়ে গেল। পরীক্ষিৎ ভগবান। সমস্যা অনেক। পুরাণের সঙ্গে ইতিহাসকে মেলাতে গিয়ে গবেষকরা দু’জন পরীক্ষিৎ আবিষ্কার করলেন। পরীক্ষিৎ—এক, পরীক্ষিৎ—দুই। প্রথম পরীক্ষিৎ রয়েছেন অথর্ববেদে। দেবতারা তাঁর গুণগ্রামে ধন্য ধন্য করছেন। ইন্দ্র তাঁকে দিচ্ছেন অলৌকিক শক্তি। চন্দ্র, সূর্য দিচ্ছেন আলো। সেই একটা সময় ছিল, যখন স্বর্গের দিকে এই ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর অনেক দরজা খোলা ছিল। দেবতারা হামেশাই চলে আসতেন। সুন্দরী অপ্সরারা পৃথিবীর সরোবরে স্নান করতেন। হিমালয়ের শিখরে শিখরে দেবতা আর দেবীদের বৈঠকখানা। কোনও গুহায় ঋষিরা তপস্যা করছেন হাজার বছর ধরে। কোনও গুহায় পাঁচ হাজার বছর ধরে ঠায় বসে আছেন কোনও স্বনামধন্য অসুর। বড় মজার জায়গা। দু’পক্ষই চাইছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের কৃপা। পরস্পর যুদ্ধ করবেন তাঁরা স্বর্গের অধিকারের জন্যে। স্বর্গ হল ভোগের রাজ্য, পৃথিবী দুর্ভোগের। মানুষের বরাত কোনকালে খুলবে হে ভগবান!
মহারাজ! আপনার পূর্বপুরুষরা যখন ধুন্ধুমার যুদ্ধে ব্যস্ত, সেই সময়েই কাল কিন্তু কলি-তে প্রবেশ করেছে। দ্বাপর শেষ। অবশ্য কোনও কোনও হিসাবে বলা হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণের তিরোধানেই ধরাধামে কলির আগমন। তিনিই সব গুটিয়ে নিয়ে পৃথিবীকে লীলাশূন্য করে কোথায় চলে গেলেন! নীরব তাঁর মোহন বাঁশি। অনাথ গাভীকুল। তাঁর লীলা-সহচরীরা দিশাহারা। ‘নন্দপুর চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার।’ প্রেমিক হলে কী হবে বড় নিষ্ঠুর আপনার সেই পিতামহ।
শুনুন তা হলে, ঘটনাটা বলি। নারদ এসেছেন, যেমন আসেন আকাশপথে। স্বর্গে, মর্ত্যে তাঁর অবাধ গতিবিধি। নারদ এসেছেন বিশাল নগরীতে (উজ্জয়িনী)। সেখানে প্রায়ই ধর্মকথা হয়। অতি পুণ্যস্থান। ভূস্বর্গও বলা চলে। নারদমুনির সঙ্গে হঠাৎ চারজন ঋষির দেখা। এঁরা হলেন সনৎকুমার, ‘সনকাদিকুমারগণ’। কুমারগণ নারদকে অতি বিমর্ষ ও চিন্তিত দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘ঋষিবর এত দ্রুতগতিতে আপনি কোথায় চলেছেন, কোথা থেকেই বা আসছেন? এত চিন্তিতই বা কেন?’
নারদ বললেন, ‘কুমারগণ! আমি চিরকালই নির্লিপ্ত। কোনও কিছুই আমাকে বিচলিত করতে পারে না। আমি এই পৃথিবীকে মনে করি সর্বোৎকৃষ্ট লোক। এখানে পুষ্কর, প্রয়াগ, কাশী, গোদাবরী (নাসিক), হরিদ্বার, কুরুক্ষেত্র, শ্রীরঙ্গ, সেতুবন্ধ রামেশ্বর, কত কত তীর্থ! সবই আমি ঘুরে ঘুরে দেখলুম; কিন্তু এ কী হল এবার? কোথাও কেন শান্তি পেলুম না। সর্বত্র কলি— কলি লেগে গেছে পৃথিবীতে। ধর্মকে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে অধর্ম, অনাচার। সত্য, তপস্যা, শৌচ (অন্তরে, বাহিরে পবিত্রতা), দয়া ও দান আদি কিছুই নেই। দীন জীবগণ কেবল নিজের উদরপূরণে রত, অসত্যভাষী, নিষ্প্রভ, আলস্যপরায়ণ, মন্দবুদ্ধি, ভাগ্যহীন, উপদ্রবগ্রস্ত। যারা সাধু বলে পরিচিত, তারা পাষণ্ডকর্মকারী। দেখলে মনে হবে সংসার-উদাসীন, অনাসক্ত, বিরক্ত, কিন্তু নারী ও বিত্তে বিলক্ষণ আসক্ত। গৃহে গৃহে স্ত্রীদের প্রাধান্য, শ্যালকরাই পরামর্শদাতা। লোভবশত মানুষ কন্যা বিক্রয় করছে, প্রতি গৃহেই দাম্পত্য কলহ। মহাত্মাদের আশ্রম, তীর্থ, পুণ্য নদী বিধর্মীদের অধিকারে চলে গেছে। বহু দেবালয় নষ্ট করে দিয়েছে।’
সনৎকুমারদের কাছে নারদ তাঁর ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন, ‘এই একটা সময়!’ সেই সব যোগী ও সিদ্ধপুরুষরা কোথায় অদৃশ্য হলেন! না আছে কোনও জ্ঞানী, কোনও সৎকর্মকারী পুরুষ! সমস্ত সাধনই আজ কলিরূপ দাবানলে ভস্মীভূত।
‘এই কলিযুগে প্রায় সকলেই বাজারে অন্ন বিক্রয় করছে, ব্রাহ্মণরা অর্থের বিনিময়ে বেদের অধ্যাপনা করছে, প্রায় সকল স্ত্রীরাই বেশ্যাবৃত্তিতে রত’, নারদের এই ক্ষোভ দেবভাষায় আরও বলিষ্ঠ:
ন যোগী নৈব সিদ্ধো বা ন জ্ঞানী সৎক্রিয়ো নরঃ।
কলিদাবানলেনাদ্য সাধনং ভস্মতাংগতম।।
তট্টশূলা জনপদাঃ শিবশূলা দ্বিজাতয়ঃ।
কামিন্যঃ কেশশূলিন্যঃ সন্তবন্তি কলাবিহ।।
নারদ বলছেন, ‘তারপর? তারপর আমি সেই যমুনাতীরে উপস্থিত হলাম— যেখানে শ্রীভগবান কৃষ্ণচন্দ্র বহু লীলা করেছিলেন। সেই পুণ্যস্থান এখন অতি বিষণ্ণ এক শূন্যস্থান। শুষ্ক বাতাস, উত্তপ্ত ধুলো, শীর্ণ যমুনা। কোথায় পাখির কলতান! গোপবালাদের কলকণ্ঠ! সবই যেন মৃতপ্রায়। সেই যমুনার তীরে, আমি এক অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম— এক যুবতী স্ত্রী মাথা নিচু করে বসে আছেন। বিষণ্ণ বদন। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ যেন তাঁর ওপর ভেঙে পড়েছে। তাঁর পাশে দুই বৃদ্ধ পুরুষ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। মৃত্যু বুঝি আসন্ন। ওই রমণী মাঝে মাঝে তাঁদের সেবা করছেন। চৈতন্য ফিরিয়ে আনার উতলা চেষ্টা। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সেই বালিকা উঠে দাঁড়াল ও ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগল, ‘হে মহাত্মন্! ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমার চিন্তা দূর করুন। আপনার দর্শন তো মানুষের সকল পাপ সর্বথা হরণ করে। আমার কী ভাগ্য যে এই দুঃসময়ে আপনার দর্শন পেলাম!’
নারদ বললেন, ‘আমি সেই স্ত্রীকে প্রশ্ন করলাম, দেবী! তুমি কে? এই দু’জন পুরুষই বা কে? আর হঠাৎ দেখছি আরও অনেক স্ত্রী কোথা থেকে এসে তোমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন, এঁরাই বা কে?’
সেই বালিকা বললে, ‘আমার নাম ভক্তি, আর অচৈতন্য এই দুই বৃদ্ধ, আমার দুই পুত্র— জ্ঞান ও বৈরাগ্য। কালের ফেরে এঁদের এই অবস্থা হয়েছে। আর এই দেবীরা সব গঙ্গাদি নদীসমূহ। এরা সকলেই আমার সেবার জন্যে এখানে এসেছে; কিন্তু এদের সেবাতেও আমার সুখ-শান্তি হচ্ছে না।’
নারদঋষি কুমারগণকে বলছেন, ‘আমার কাহিনি শেষ হয়নি। ধৈর্য ধরে আরও একটু শুনুন। কালের প্রভাবে ভক্তির কী করুণ অবস্থা! ভক্তিদেবী বললেন, ‘আমি দ্রাবিড় দেশে উৎপন্না হয়ে কর্ণাটকে বর্ধিত হয়েছি। মহারাষ্ট্রে কোনও কোনও স্থানে আমি সম্মানিত হলেও গুজরাতে আমি বৃদ্ধা হয়ে পড়ি। সেখানে ঘোর কলিযুগের প্রভাবে পাষণ্ডরা আমার অঙ্গসকল ভেঙে দেয়। বহুকাল এই অবস্থায় থাকার ফলে দুই পুত্র আর আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি। তখন আমরা অতি কষ্টে বৃন্দাবনে আসি! বৃন্দাবনে আসার পর আমি আবার পরমাসুন্দরী রূপবতী নবযুবতী হলেও আমার পুত্র দুটির কোনও পরিবর্তন হল না। আমি বড়ই কাতর, আমার পুত্র দুটির জন্য উদ্বিগ্ন অতিশয়। আমি এই স্থান পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। হে বুদ্ধিমান যোগসাগর! আমাকে এই অদ্ভুত কাণ্ডের কী কারণ, অনুগ্রহ করে বলুন— মাতা যুবতী, সুন্দরী, পুত্র দুটি অকালবৃদ্ধ। বিপরীতটাই হওয়া উচিত ছিল, মাতা বৃদ্ধা, পুত্র দুটি তরুণ।’
নারদঋষি বললেন, ‘দেবী! সাবধানে শোনো, এখন দারুণ কলিযুগ। জপ-তপ, সদাচার, যাগ-যজ্ঞ লুপ্ত হয়েছে। মানুষের মনে শঠতা, দুষ্কর্ম করার প্রবৃত্তি। সব মানুষই যেন এক-একটি অঘাসুর। জগতের যেদিকেই তাকাবে, দেখবে, সৎপুরুষ দুঃখে ম্লান, দুষ্টরা মহানন্দে দিনাতিপাত করছে। দেবি!
শৃণুস্বাবহিতা বালে যুগোঽয়ং দারুণঃ কলিঃ।
তেন লুপ্তঃসদাচারো যোগমার্গস্তপাংসি চ।।
জনা অঘাসুরায়ন্তে শাঠ্যদুষ্কর্মকারিণঃ।
ইহ সন্তো বিষীদন্তি প্রহৃষ্যন্তি হাসাধবঃ।।
দেবি! তথাপি, উদ্ধারের, নিজেকে রক্ষা করার একটি পথ এই কালেও মুক্ত আছে; ‘ধত্তে ধৈর্যয়ং তু যো ধীমান্ স ধীরঃ পণ্ডিতোঽথবা।’ যে বুদ্ধিমান এই ‘কাল’ সময়ে ধৈর্যধারণ করে, শ্রীভগবানের ওপর সমস্ত অর্পণ করে নির্ভয়ে জীবনযাপন করবেন, তিনিই ধীর, তিনিই পণ্ডিত।
‘এই পৃথিবী অনন্ত কালের প্রবাহে, পাপের ভারে ক্রমশ ভারী হয়ে আরও ভারী হচ্ছে। এত পাপ ধারণ করেছে যে, স্পর্শেরও অযোগ্য। চোখে দেখতেও ইচ্ছে করে না। এখানে জীবের মঙ্গলের কোনও আশা আছে বলে মনে হয় না। দেবি! তুমি ভক্তি! একালে কোনও মানুষের মনে ভক্তি আছে কি? পুত্র কি পিতাকে ভক্তি করে? সন্তান কি তার গর্ভধারিণী মাতাকে ভক্তি করে? দেবতার প্রতি মানুষের প্রকৃত ভক্তি গেল কোথায়? আন্তরিক ভক্তি? সকলেই তো বিষয়ে মত্ত, অন্ধ। আর তোমার দুই সন্তান, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ঘোর তামস অন্ধযুগে কে চায় জ্ঞান? কার মনে জাগে বৈরাগ্য? বিষয় বিষে সব জর্জরিত। এদের গ্রাহক এইকালে কোথায়? এ যে কলিকাল। ভক্তির সঙ্গে জ্ঞান, জ্ঞানের উন্মেষে বৈরাগ্য— এই সংযোগ কি সম্ভব?’
ভক্তি বললেন, ‘ঋষিবর, আমার একটি প্রশ্নের উত্তর আপনি আমাকে দিন, রাজা পরীক্ষিৎ, তিনি বীর, তিনি মহান, তিনি আমাদের বল, বীর্য, ভরসা, কেন তিনি ওই পাপী কলিকে প্রবেশের অধিকার দিলেন? কেন তাকে স্থান দিলেন? সমূলে বিনাশ করলেন না? কলিযুগ আসামাত্রই সকল বস্তুর মহান সারাংশ কোথায় চলে গেল! শ্রীহরি সবই তো দেখছেন, জানেন; তিনিও কেন উদাস!’
নারদ বললেন, ‘বালিকে! শান্ত হও। আমি তোমাকে কারণ বলছি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেদিন এই ভূলোক ত্যাগ করলেন, সেই দিনই এখানে কলিযুগের সূচনা। কলি এসে হাজির। নিঃশব্দে, সবার অলক্ষ্যে।’
হে রাজন! আমারও তো এই একই অভিযোগ, সেই ভয়ংকর রাহুসম চরিত্রটিকে হাতের কাছে পেয়েও তার অপকর্ম প্রত্যক্ষ করেও আপনি তাকে ছেড়ে দিলেন, জগতের বুকে খেলা করার অধিকার দিলেন, কেন মহারাজ! আপনার দিকে কেন অভিযোগের আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে মহাকাল? কেন আপনি জীবজগৎকে ফেলে রেখে গেলেন কয়েক লক্ষ বছরের ঘূর্ণিপাকে?’
সেদিন আপনি কী দেখেছিলেন? অবাক সেই দৃশ্য! ভাগবতপাঠের আসরে পাঠক আজও পাঠ করেন ‘পয়ার’ ছন্দে সেদিনের সেই কথা। সরস্বতী নদীর তীরে যা ঘটেছিল:
সরস্বতী তীরে আসি নৃপতি তখন।
অপরূপ দৃশ্য এক করিল দর্শন।।
নরপতি বেশধারী শূদ্র একজন।
দণ্ডহাতে গোমিথুনে করিছে তাড়ন।।
একটি বৃষ আর একটি গাভী। সেই বিকট দর্শন রাজবেশধারী মানুষটি নির্মমভাবে বৃষটিকে প্রহার করছে; নির্জন সরস্বতী-নদীতটে। সরস্বতী স্বর্গের নদী মর্ত্যেও প্রবাহিত, অধুনা অদৃশ্য। বৃষটির কী অপূর্ব রূপ! ‘শ্বেতশুভ্রবর্ণ তার মৃণালের সম।’ শূদ্রের প্রহারে সেই বৃষ অসহায়। আরও আশ্চর্য, বৃষটির একটি পা, অপর তিনটি পা নেই। ‘দীনভাবে এক পদে দাঁড়ায় সেখানে।/ঘনঘন কাঁপে বৃষ অতি ভয় প্রাণে।’ গাভীটির শরীর কৃশ। কত দিনের অনাহারে তার এই অবস্থা— দীনাহীনা কৃশা! গাভীটি তৃণের সন্ধানে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সেই লোকটির উপর্যুপরি নির্মম পদাঘাত। অতি করুণ, বেদনাদায়ক সেই দৃশ্য আপনি আপনার রথে বসে দেখছেন। গাভীটির দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে।
না, আর সহ্য করা যায় না। আপনি রথ থেকে অবতরণ করলেন, হাতে ধনুর্বাণ। মনে মনে ভাবছেন, অভিমন্যু-পুত্র আমি, অর্জুন পিতামহ— ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমার জীবনরক্ষক, আমি বিষ্ণুরাত! জলদগম্ভীরস্বরে আপনি প্রশ্ন করলেন, ‘কে রে তুই স্পর্ধা তোর হেরিতেছি অতি। আমার রাজ্যে প্রবেশ করে, আমারই প্রজাদের ওপর তোর এই অত্যাচার! আবার নাটুকে রাজবেশ! কৃষ্ণ আর অর্জুন নাই ধরণীতে, তাই বুঝি তোর এত তেজ!’
আজই তোর শেষ দিন! তবে তার আগে আমার জানা দরকার, এই বৃষটি কে! ‘তুমি কে মহাপ্রাণ? মৃণালশুভ্র দেহ। কদাচারী, পশুসম, রাজবেশধারী, কদাকার ওই মানুষটির নির্মম প্রহারে তুমি ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত, ভীত— তুমি কে?’
পাণ্ডবশাসিত, শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা একদা সুরক্ষিত এই রাজ্যে দুষ্কৃতকারী পামরদের কোনও স্থান নেই। হ্যাঁ— এ কথা ঠিক— ধর্ম আর রাজধর্মে কিছু পার্থক্য আছে। পৃথিবীতে স্বাভাবিক কালে অর্থাৎ যখন কোনও বিপদ থাকে না, তখন কিন্তু বিপথগামী, অধার্মিক প্রজাদের প্রতিপালনও রাজধর্ম হিসাবে, রাজার কর্তব্য হিসাবে নির্দেশিত। সেই অঙ্গীকারে আমি দায়বদ্ধ। এই যে বলা হচ্ছে:
রাজ্ঞো হি পরমো ধর্মঃ স্বধর্মস্থানুপালনম্।
শাসতোঽন্যান্ যথাশাস্ত্রমনাপদ্যুৎপথানিহ।।
বিপথগামী, অধার্মিক ব্যক্তিদেরও নিজ নিজ ধর্ম, বর্ণ, আশ্রম অনুসারে পালন করাই প্রজাশাসক রাজার শ্রেষ্ঠ ধর্ম! কিন্তু, এই নৃশংসতা, আমি সহ্য করতে পারব না। হে অলৌকিক, একপদবিশিষ্ট, মৃণালশুভ্র বৃষ! এটি আপনার ছদ্মরূপ, আসলে আপনি কে?
‘আমি? যুগ যুগ ধরে আমার যে পরিচয় তা হয়তো সহজে এককথায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেব— কে সেই পুরুষ? কোথায় বসে তিনি জীবের যত দুঃখ অক্লেশে, অকাতরে সৃষ্টি করে চলেছেন? তবে শুনুন এই স্বগতোক্তি:
ন বয়ং ক্লেশবীজানি যতঃ স্মঃ পুরুষর্ষভ।
পুরুষং তং বিজানিমো বাক্যভেদবিমোহিতাঃ।।
হে পুরুষশ্রেষ্ঠ রাজন, আমরা বিভিন্ন পণ্ডিতের মতবাদে বিভ্রান্ত। ভিন্ন, ভিন্ন মতবাদ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোথা থেকে কার দ্বারাই বা জীবগণের দুঃখ সৃষ্টি হচ্ছে, সেই পুরুষের সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।
মহারাজ! পণ্ডিতদের মধ্যে যাঁরা অভেদ, অদ্বৈতবাদী তাঁরা বলবেন, আত্মাই আত্মার সুখ বা দুঃখের কারণ। যাঁরা দেবতায় বিশ্বাসী, তাঁরা বলবেন, দৈবই জীবের সুখ-দুঃখের কারণ। যাঁরা কর্মে বিশ্বাসী, অর্থাৎ মীমাংসক, তাঁরা বলবেন কর্মফল; আর যাঁরা নাস্তিক, তাঁরা বলবেন, জীবের স্বভাব, জীবের প্রকৃতি তার দুঃখ-সুখের কারণ। মহারাজ! আমি তা হলে এই বলতে চাইছি— জীবের সুখ ও দুঃখ বাক্য মনের অগোচর, পরমেশ্বরেরই বিধান। এখন আপনিই বিচার করুন, আমার এই দুঃখ ও নিগ্রহের কারণ।’
রাজা পরীক্ষিৎ কিছুকাল নীরব থেকে, তারপর বললেন, ‘চিনেছি আপনাকে— আপনি স্বয়ং ধর্ম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আপনি পৃথিবীতে বিচরণ করেন। এখন আপনার বৃষ রূপ। আপনি প্রাজ্ঞ তাই সাবধানি। দোষী, অপরাধী যারা, তারা তো নরকে যাবে, সেই সঙ্গে যারা তাদের সন্দেহবশে চিহ্নিত করে, তারাও নরকে যায়। সুতরাং অপরাধীর নাম উল্লেখ না করে আপনিই ঠিক করেছেন। ভগবানের অলৌকিক মায়াশক্তির প্রভাব আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি কী করবেন, কী করবেন না, তা তিনিই জানেন। হে ধর্ম! সত্যযুগে তপস্যা-শৌচ-দয়া ও সত্য এই চারটি চরণ সম্পূর্ণভাবে আপনার শরীর সংলগ্ন ছিল; কিন্তু ক্রমশ অধর্মের সহায়ক অহংকার, পরনারীসঙ্গ, মদ্যপান ইত্যাদি পাপাচারের সংস্পর্শে আসায় আপনার চরণগুলির মধ্যে তিনটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। মানুষের নীচতা, মত্ততার মাশুল আপনাকেই দিতে হয়েছে। এই ক্ষয়রোধের ক্ষমতা আপনার একার হাতে তো নেই! অন্যের আচরণে ধর্মের শরীর গঠিত, তা আমি জানি; যেমন সমুদ্র থেকে উত্থিত জলস্তম্ভ জল দিয়ে গঠিত। হে ধর্ম ইদানীংকালে তোমার ‘সত্য’ নামক চরণটি অবশিষ্ট থাকায় তুমি কোনও প্রকারে তোমার অস্তিত্ব রক্ষা করছ; কিন্তু ‘কলি’ নামক কাল অচিরে ওটিকেও গ্রাস করবে। তা আমি জানি।
হে ধর্ম! শ্রীভগবান কুরুক্ষেত্রে ওই সর্বগ্রাসী যুদ্ধ কেন হতে দিয়েছিলেন! তাঁর হাতেই তো সব। কেন ঘটালেন ওই রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ! এই বিরাট বিশ্বের একটুকরো ভূমির অধিকার নিয়ে কয়েকজন রাজার টানা-হ্যাঁচড়া? না, ওটা সামান্য এক উপলক্ষ মাত্র। তিনি ভূভার হ্রাস করতে চেয়েছিলেন, আবর্জনামুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ধরিত্রীমাতাকে পরিচ্ছন্ন করতে চেয়েছিলেন। মেঘমুক্ত আকাশ, নির্মল বাতাস। সত্যযুগের প্রথম প্রভাতে পৃথিবী ঠিক যেমনটি ছিল ঠিক সেইরকম।
আমার জ্যেষ্ঠ পিতামহ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর শাসনকালের শেষপর্বে সর্বত্র দেখেছিলেন অতি অশুভ সব দুর্লক্ষণ। নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন ‘মহাপ্রস্থানের’ জন্যে। আমাকে সিংহাসনে বসিয়ে বলেছিলেন ‘বিদায় ভারত! পরীক্ষিৎ এইবার শুরু হল তোমার মহাপরীক্ষার কাল।’ তিনি একেবারে বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন। পিতামহ অর্জুন সেই যে দ্বারকায় গেলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কুশলাদি আনতে, সাত মাস হয়ে গেল, তিনি ফিরছেন না। কেন? কী হল সেখানে? কোনও সংবাদ কেন আসছে না! ভ্রাতা ভীমসেন! সর্বত্র এ-সব আমি কী দেখছি? আমার সর্বশরীরে এত অস্বস্তি কেন? রৌদ্রাং ঘোরাম। সেইসব প্রসন্ন সকাল কোথায় গেল? চারদিকে এসব কী দেখছি? কনিষ্ঠ ভ্রাতা! কী অনুভব করছি? হঠাৎ এত ক্লেদ কোথা থেকে এল? ক্ষণকাল স্থির হয়ে আমার সামনে উপবেশন করো বীর। সময় আমাকে স্থবির করেছে, হরণ করেছে আমার সকল গৌরব, রাজমুকুট হয়েছে উপহাসের প্রতীকচিহ্ন—
কালস্য চ গতিং রৌদ্রাং বিপর্যস্ততু ধর্মিণঃ।
পাপীয়সিং নৃনাং বার্তাং ক্রোধালোভানৃতাত্মনাম।।
কালের নিয়ম, শৃঙ্খলা হারিয়ে গেছে। স্বয়ং কালই যখন বিভ্রান্ত তখন আমার অস্তিত্বও তো বিপন্ন। শীত, গ্রীষ্ম আর স্বাভাবিক ছন্দে নেই। চরিত্র হারিয়েছে। ক্রোধ ও লোভপরায়ণ জনসাধারণের জীবন মিথ্যাভাষণ আর অশাস্ত্রীয় আচরণে পূর্ণ। মানুষের ব্যবহারে শুধু ছল, চাতুরি। মিত্রতা শঠতা মিশ্রিত। পিতা-মাতা-ভ্রাতা-বন্ধু-দম্পতি সকলেই পরস্পর কলহে রত; আর এইসব ঘটছে আমারই রাজত্বকালে! ধিক, ধিক আমাকে! আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির!
যুধিষ্ঠির নিজের মনেই বলে চলেছেন। স্বর্ণমুকুরে তাঁর মুখচ্ছায়া। বিশালদেহী ভীমসেন ইদানীং অতিশয় ক্লান্ত। অস্ত্রাগারে তাঁর বিপুল গদা চিরবিশ্রামে। রুধির পরিষেবিত কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণ কৃষ্ণগল্পে আচ্ছাদিত।
যুধিষ্ঠির বলছেন, ‘সাত সাতটা মাস অতিবাহিত হল, অর্জুন এখনও ফিরে এল না দ্বারকা থেকে! সেখানে কী হচ্ছে? অর্জুন কেন এত দেরি করছে? দেবর্ষি নারদ আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মানবদেহ পরিত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, সেই কাল কি তা হলে সমাগত!’ যুধিষ্ঠির স্বগতোক্তি করছেন, ‘কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! তুমিই তো সব, আমাদের যথাসর্বস্ব রাজ্য, ধনসম্পদ, পত্নী, প্রাণ, বংশ, প্রজা। তোমারই কৃপায় যুদ্ধজয়, রাজ্যলাভ, যজ্ঞানুষ্ঠান। সব, সব, সবই তোমার অনুগ্রহ। তিনি আছেন, না চলে গেছেন! বীরশ্রেষ্ঠ ভীমসেন! তুমি কি লক্ষ করেছ চারদিকে ভীতিজনক নানা দুর্লক্ষণ, রাতের আকাশে ঘনঘন উল্কাপাত, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত। আমার সর্বশরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে, বাম ঊরু, বাম চক্ষু, বাম বাহু, বক্ষোদেশ। মনে হচ্ছে, আমারও মৃত্যু আসন্ন। আরও ভয়ংকর সব দৃশ্য আমার চোখে পড়ছে। ঘটছে জীবজগতে। শৃগালী উদীয়মান সূর্যের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করছে, শুধু তাই নয় মুখ দিয়ে অগ্নি উদ্গিরণ করছে। আমাকে লক্ষ করে সারমেয়রা প্লুতস্বরে ক্রন্দন করছে।
‘ভ্রাতা ভীমসেন! আরও আরও সব দুর্লক্ষণ আছে, মঙ্গলসূচক গবাদিপশু আমাকে বামদিকে রেখে চলাচল করছে, আর গর্দভাদি অমঙ্গলজনক প্রাণী আমাকে ডানদিকে রেখে যাতায়াত করছে। অশ্ব, হস্তী প্রভৃতি আমার বাহনগুলি যেন রোদন করছে এইরকমই আমার মনে হচ্ছে। আরও আছে, আরও আরও। ওই যে পায়রাটি অদূরে বসে আছে, মনে হচ্ছে আমার মৃত্যুদূত। রাতে প্যাঁচার কর্কশ চিৎকারে অন্ধকার যেন ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে, দিবাভাগে কাকের ডাক শুনলে মনে হয় পৃথিবী বুঝি শ্মশান হয়ে যাবে। ওই দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে দেখো, ধোঁয়ায় আবৃত অস্পষ্ট মণ্ডলাকারে ধূম্রবর্ণে আবৃত, পৃথিবী আর পর্বতসমূহ কম্পিত হচ্ছে, বিনামেঘে অন্তরিক্ষে মেঘ গর্জন আর অবিরাম বজ্রপাত ধূম্রা ধূসরাঃ দিশঃ, বীভৎস শব্দে বজ্রপাত, কম্পিত চরাচর।
‘উষ্ণ ধূলিঝড়, আঁধি। সমাচ্ছন্ন বালুকণা যেন অগ্নিকণা। আকাশে ঘন কালো মেঘ, যেন এখুনি রক্তবর্ষণ করবে। সূর্য ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। গ্রহদের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে। যে-কোনও মুহূর্তে সংঘর্ষ হবে। উত্তাপে পৃথিবী জ্বলছে। নদনদী, সরোবর, এমনকী প্রাণীদের অন্তর বিক্ষুব্ধ। ঘৃতের দ্বারা অগ্নি আর প্রজ্বলিত হয় না। গোবৎসরা মাতার স্তন পান করছে না। স্তন দুগ্ধশূন্য। গোষ্ঠে গাভীরা অশ্রুমুখী ক্রন্দনরতা; বৃষরা নিরানন্দময়!’
আতঙ্কিত যুধিষ্ঠির! সর্বত্র দেখছেন অশুভ লক্ষণ, আসছে অমঙ্গলের বার্তা। আকাশে বাতাসে জলে স্থলে ধ্বংসের ইঙ্গিত। বাতাস যেন উত্তপ্ত নিশ্বাস। প্রকৃতি ভীত, সন্ত্রস্ত। যুধিষ্ঠির ভ্রাতা ভীমসেনকে বলছেন,
দৈবতানি রুদন্তীব স্বিদ্যন্তি প্রচলন্তি চ।
ইমে জনপদাঃ গ্রামাঃ পুরোদ্যানাকরাশ্রমাঃ।
ভ্রষ্টাশ্রিয়ো নিরানন্দাঃ কিমঘং দর্শয়ন্তি নঃ।।
‘ভীমসেন আমি হতবাক— দেবালয়ে দেবপ্রতিমারা যেন কাঁদছে, ঘর্মাক্ত কলেবর, ছটফট করছে, ইতস্তত চলে বেড়াচ্ছে। রাজ্যের সমস্ত জনপদ, গ্রাম, নগর, উদ্যান, আশ্রম, আকর সর্বত্র শ্রীহীনতা, নিরানন্দের আভাস। জানি না, অবশেষে কী হবে! পৃথিবীর সৌভাগ্যের দিন শেষ হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে সেই অসাধারণ অনন্য শোভাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের পরিত্যাগ করে অনন্তে প্রস্থান করেছেন। ধরণীতে তাঁর শ্রীচরণস্পর্শ আর পড়বে না। তিনি নেই তিনি নেই।’
সেই মুহূর্তে অর্জুন তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। সংবাদ এনেছেন দ্বারকার। জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে প্রণাম করছেন অবনত মস্তকে। অশ্রুবিন্দু। ধর্মরাজ বুঝতে পেরেছেন ভ্রাতা নিয়ে এসেছে সেই মহা দুঃসংবাদ। সরাসরি প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছেন না। যতটা বিলম্ব হয় ততটাই ভাল। ‘বলো বলো দ্বারকার সংবাদ বলো অর্জুন। মধু, ভোজ, দশার্হ, অর্হ, সত্বেত, অন্ধক, বৃষ্ণি সবাই ভাল আছেন তো! আমাদের মাননীয় মাতামহ শূর, মাতুল বসুদেব, কনিষ্ঠ ভ্রাতারা সকলে ভাল আছেন তো! আনন্দে আছেন তো!’
যুধিষ্ঠির চরম প্রশ্নটি করার সাহস পাচ্ছেন না। একটি আবর্তে ঘুরছেন, ‘বসুদেব-মহিষী দেবকী, অন্যান্য মাতুলানী, তাঁদের ভগ্নীরা, পুত্র, পুত্রবধূরা— কেমন আছেন তাঁরা?’ যুধিষ্ঠির আরও অতীতে যেতে চাইছেন, প্রশ্ন করছেন, ‘কংসের মৃত্যুর পর রাজা উগ্রসেন ও তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা দেবক জীবিত আছেন তো? অক্রূর ও তাঁর পুত্র, জয়ন্ত, গদ, সারণ, কৃষ্ণের বিজয়ী ভ্রাতাগণের কুশল তো? আর ভক্তের ভগবান বলরাম? তিনি কেমন আছেন?’
অর্জুন নীরবে অবনত মস্তকে দাদার প্রশ্ন শুনে যাচ্ছেন। যুধিষ্ঠিরের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে— ‘বৃষ্ণিকুলের বীরশ্রেষ্ঠ প্রদ্যুম্ন, মহাবেগবান অনিরুদ্ধের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে তো?’
একে একে নামের পর নাম আসছে— সুষেণ, চারুদেষ্ণ, জাম্ববতীতনয় সাম্ব, কৃষ্ণের অন্যান্য পুত্রগণ। ঋষভ, শ্রুতদেব, উদ্ধব, সুনন্দ, নন্দ; সকলের খবর চাই। সমগ্র যদুবংশের মঙ্গল তো? আলোতে, মালাতে সজ্জিত দ্বারকা হর্ষ পুলকে ভাসছে। সবার ওপরে শোভমান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র। আকাশের চন্দ্র যাঁর কাছে ম্লান। যুধিষ্ঠির জানতে চাইছেন, ‘আমাদের কথা কি তাঁদের স্মরণে আছে?’ শ্রীকৃষ্ণের মহিমায় যুধিষ্ঠির আচ্ছন্ন হচ্ছেন। প্রশস্তি রচনা করছেন, ‘যদুকুলে আবির্ভূত হয়েছিলেন জীবের মঙ্গলের জন্যে। তাঁর বাহুবলে সুরক্ষিত যাদবগণ সকলের পূজিত হয়ে দ্বারকাপুরীতে বিষ্ণুর অনুচর হয়ে পরমানন্দে বিহার করছেন। তাঁর লীলার তো শেষ নেই! অশেষ অনন্ত! মনে পড়ে অর্জুন! সত্যভামা প্রমুখ ষোলো হাজার মহিষী তাঁর শ্রীচরণসেবার পুণ্যফল তাঁকে দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ করিয়েছিলেন, ইন্দ্রমহিষী শচীদেবীর ভোগ্যপুষ্প পারিজাত আমাদের চাই। শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গের পারিজাত মর্ত্যে তাঁদের এনে দিয়েছিলেন। ভক্তের ভগবান! কেন? দেবরাজ ইন্দ্রের সুধর্ম সভা দ্বারকায় যাদবদের এনে দিলেন। বলো অর্জুন আমাদের সেই প্রিয় ভগবান সুখে আছেন তো?’
অর্জুন নীরব। যুধিষ্ঠির অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন। বললেন, ‘অর্জুন! তুমি এত নিষ্প্রভ কেন? তোমার দৈহিক কুশল তো? দীর্ঘকাল দ্বারকায় ছিলে, সেখানে যাদবরা কি তোমাকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেননি? অনাদৃত হয়েছ? সেখানে কেউ কি তোমাকে কটু কথা বলেছে? আচ্ছা! তুমি কি কারওকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছ? কথা দিয়ে কথা রাখোনি? অর্জুন! তুমি তো এতদিন সকলকে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করে এসেছ; কিন্তু সম্প্রতি শরণাগত কোনও ব্রাহ্মণ-বালক-গাভী-বৃদ্ধ-অসহায়-স্ত্রীলোক অথবা প্রাণীকে আশ্রয় না দিয়ে পরিত্যাগ করেছ? তুমি কি কোনও অগম্যা রমণীর নিকটে গমন করেছ অথবা গম্যা কিন্তু মলিন বেশভূষা হওয়ায় তাকে পরিত্যাগ করেছ? অথবা আসার পথে তুমি কি কোনও হীন ব্যক্তির কাছে পরাজিত হয়েছ? তুমি ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ ও বালককে বঞ্চিত করে নিজে আহার করোনি তো? কেন তুমি এমন বিমর্ষ? নাকি, সখা শ্রীকৃষ্ণের মধুর সঙ্গ ছেড়ে আসার কারণে বেদনার্ত?’
অর্জুন তখনও নীরব। বলতে চাইছেন, কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ। অবশেষে অনেক চেষ্টায় বললেন, ‘তিনি নেই। শ্রীকৃষ্ণ ধরাধাম পরিত্যাগ করে চলে গেছেন। তাঁর সমস্ত লীলার অবসান। পৃথিবী শ্রীকৃষ্ণশূন্য। সমগ্র জগৎ তাই শ্রীহীন। তিনি নেই। তাঁরই শক্তিতে আমি মৎস্যচক্ষু শরবিদ্ধ করে দ্রুপদ রাজকন্যা দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলাম। দেবরাজ ইন্দ্রকে মুহূর্তে পরাজিত করে খাণ্ডবদাহ থেকে ময়কে রক্ষা করেছিলাম। বিনিময়ে সে আমাদের নির্মাণ করে দিয়েছিল অপূর্ব শিল্পকর্ম সমন্বিত মায়াসভা। তাঁরই তেজে বলীয়ান হয়ে আমার অগ্রজ ভীমসেন আপনার যজ্ঞপণ্ডকারী জরাসন্ধকে বধ করেছিলেন, কারারুদ্ধ রাজাদের মুক্ত করেছিলেন। মহাভৈরব যজ্ঞ করার জন্যে এই রাজাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। আপনার স্মরণে আছে রাজসূয় যজ্ঞে মহাঅভিষেকের পর মহিষী দ্রৌপদী অতি সুন্দর কবরীবন্ধন করিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক দ্যূতসভায়, প্রকাশ্যে, কপট, দুর্বৃত্ত দুঃশাসন যখন সেই কেশ আকর্ষণ করে দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করছিল, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণের পদতলে পতিত হয়ে ক্রন্দন করেছিলেন। সেই কারণেই কৃষ্ণ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে কৌরবপত্নীদের পতিহীনা করে তাঁদের কেশবন্ধনও মুক্ত করে দিয়েছিলেন। দ্রৌপদী তাঁর চোখের জলে শ্রীপদযুগল সেদিন অর্চনা করেছিলেন বলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তি প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি যে ছিলেন আর্তের একমাত্র ভরসা, দীনের বন্ধু।’ অর্জুন দুটি ঘটনার কথা যুধিষ্ঠিরকে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন। ‘পাশা খেলার আসরে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন না। দ্রৌপদীর কাতর আহ্বানে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনা, দুর্যোধন আর দুর্যোধনের অভিনব ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন। মনে পড়ে কি সেই অলৌকিক ঘটনা! দশ হাজার শিষ্যের সঙ্গে বসে এক পঙ্ক্তিতে এই মুনি রোজ আহার করেন। তিনি উপবেশন করেন সবার আগে। ভয়ংকর সেই পরিকল্পনা। দশ হাজার শিষ্যসহ মুনি দ্রৌপদীর কাছে আমাদের অরণ্যাবাসে এসে বললেন, আমাদের আহার প্রস্তুত করো, আমরা স্নানে যাচ্ছি।’
অর্জুন সম্পূর্ণ চক্রান্তটি জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন! একদিন দুর্যোধনের সেবায় পরিতুষ্ট হয়ে দুর্বাসা বললেন, ‘কী বর চাও?’ দুর্যোধন সেই কালে আমাদের বিনাশের জন্য উন্মাদপ্রায়। দুর্বাসার অভিশাপে মানুষের সাতপুরুষ নিমেষে ছারখার হয়ে যায়। এই তো সুযোগ! দুর্যোধন বললেন, ‘মুনিবর! আমাদের বংশের প্রধান ব্যক্তি যুধিষ্ঠির। আপনি তার গৃহে এই দশ হাজার শিষ্যসহ আতিথ্য গ্রহণ করে তাকে কৃপা করুন। শুধু একটি অনুরোধ দ্রৌপদী যেন ক্ষুধায় কষ্ট না পায়, অতএব তার আহারের পর আপনারা সেখানে উপস্থিত হবেন।’
দুর্যোধনের দুষ্ট পরিকল্পনা, কর্ণের সমর্থন, দুর্বাসার দুর্জ্ঞেয় চরিত্র, সব মিলিয়ে নিপুণ একটি ষড়যন্ত্র। একদিন পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর আহারের পর, দুর্বাসা তাঁর দশ হাজার শিষ্যসহ কাম্যক বনে উপস্থিত হলেন। [যুধিষ্ঠির] আর আপনি ধর্মরাজ, সাদরে সেই রক্তচক্ষু, সদাক্রুদ্ধ মুনিবরকে পূজা করে বললেন, ‘আপনারা নদীতে স্নান-আহ্নিক করে আসুন, আহার প্রস্তুত থাকবে।’
‘আহার! কোথায় আহার! দ্রৌপদীর মহা দুশ্চিন্তা— সর্বনাশ আসন্ন। অগতির গতি শ্রীকৃষ্ণ; দ্রৌপদীর জপ শুরু হল ‘হে দুঃখনাশন, দ্যূতসভায় দুঃশাসনের আক্রমণ থেকে আমাকে রক্ষা করেছিলে, আজ আর একবার এই সংকট থেকে আমাকে রক্ষা করো!’ শ্রীকৃষ্ণ কি শুধু ভগবান! শ্রীকৃষ্ণ যে দ্রৌপদীর বন্ধু। যেমন অর্জুনের বন্ধু শ্রীকৃষ্ণ। আবার অর্জুনের রথের সারথি।
শ্রীকৃষ্ণ নিমেষে সামনে এসে দাঁড়ালেন। শুনতে পেয়েছেন অসহায় দ্রৌপদীর প্রার্থনা। দূরত্ব কোনও বাধাই নয়। ভগবানের তো এখানও নেই ওখানও নেই। সবখানেই তিনি বর্তমান। দ্রৌপদীর মুখে দুর্বাসার কথা শুনলেন। নদীর জলে থিকথিক করছে তাঁর দশ হাজার শিষ্য। জল দেখা যাচ্ছে না, শুধু মাথা।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘কৃষ্ণা! আমি ক্ষুধার্ত। আমাকে সবার আগে কিছু খেতে দাও, তারপর অন্য কথা।’
দ্রৌপদী লজ্জিত। বললেন, ‘সখা, যে-পর্যন্ত আমি না খাই সে পর্যন্তই সূর্যদেবের দেওয়া থালায় অন্ন থাকে। আমার আহারের পর পাত্র শূন্য হয়ে যায়। পাত্রে তো আর কিছুই নেই।’
শ্রীকৃষ্ণ রাগের স্বরে বললেন, ‘কৃষ্ণা! আমি ক্ষুধাতুর, এখন পরিহাসের সময় নয়, তোমার পাত্র নিয়ে এসো, আমি দেখব।’
দ্রৌপদী পাত্রটি এনে সামনে ধরলেন। কৃষ্ণ দেখলেন, তার কানায় সামান্য একটু শাকান্ন লেগে আছে। তিনি সেইটুকু মুখে নিয়ে বললেন, বিশ্বাত্মা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তিলাভ করুন, তুষ্ট হন। তারপর সহদেবকে বললেন, ভোজনের জন্য মুনিদের শীঘ্র ডেকে আনো। সহদেব চললেন নদীর দিকে। দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যরা সেই সময় জলে দাঁড়িয়ে আঘমর্ষণ মন্ত্র জপ করছিলেন। হঠাৎ তাঁদের মনে হল আকণ্ঠ ভোজন করেছেন। উদ্গার উঠতে লাগল। আহার করা আর সম্ভব নয়। তাঁরা দুর্বাসাকে বললেন, গুরুদেব! আশ্চর্য ব্যাপার আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা যেন আকণ্ঠ ভোজন করে তৃপ্ত হয়েছি, এখন আবার কী করে ভোজন করব? দুর্বাসা বললেন, অন্নপাক করতে বলে রাজর্ষি যুধিষ্ঠিরের কাছে আমরা মহা অপরাধী। হরিচরণ আশ্রিত পাণ্ডবরা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতে আমাদের দগ্ধ না করেন! চলো পালাই!
সহদেব নদীতীরে এসে দেখলেন কেউ নেই। নেই, কিন্তু মধ্যরাতে আবার তাঁরা সদলে ফিরে আসবেন না! শ্রীকৃষ্ণ বললেন, দ্রৌপদী আমাকে স্মরণ করেছিল, তাই আমি এসেছি। আর কোনও ভয় নেই, আপনাদের তেজে ভয় পেয়ে তাঁরা পালিয়েছেন। আমার কাজ আপাতত শেষ। আমি বিশ্রামে, আবার বিশ্রামে ফিরে যাই। আপনারা যতদূর সম্ভব নিরাপদে থাকুন।
রাজা পরীক্ষিৎ! এসব সময়ের অতীত কথা। আপনি তখনও প্রবেশ করেননি বায়ুমণ্ডলে। দুর্যোগের ঘন মেঘ ঘনাচ্ছে। অর্জুন জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের কথা। কেন এই স্মৃতিচারণ যুধিষ্ঠির বুঝতে পারছেন না। মনে সন্দেহ জাগছে প্রশ্ন করছেন না। শুনছেন শুধু শুনছেন, আর অভিভূত হচ্ছেন। অর্জুন আর নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারছেন না। নেই, তিনি নেই— তাঁকে হারিয়ে আমি আজ ‘হৃদয়েন শূন্য’ শূন্য হৃদয়, এতটাই শক্তিহীন যে পথে আসার সময়, নীচাশয় গোপদস্যুদের কবল থেকে কৃষ্ণমহিষীদের রক্ষা করতে পারিনি— বিনির্জিতঃ অস্মি— আমি পরাজিত হয়েছি। সাধারণ একদল দস্যুর কাছে সর্বকালের বীর অর্জুন পরাভূত। সেই বিখ্যাত অর্জুন আজ ধ্বংসস্তূপ। কোথায় আমার সেই প্রসিদ্ধ গাণ্ডীব, অব্যর্থ সব বাণ, সেই বিখ্যাত রথ, সেইসব শক্তিশালী অশ্ব, সেই ভুবন বিখ্যাত অর্জুন, পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত ক্ষত্রিয়গণ যাকে দেখে মাথা নত করত, কৃষ্ণকে হারিয়ে সবই যেন ভস্মে ঘৃতাহুতি, ঐন্দ্রজালিক প্রদর্শিত ধনের মতো, মরুভূমিতে রোপিত বীজের মতো, ক্ষণকালের মধ্যেই একেবারে অর্থহীন ভোজবাজি— ছিল আর নেই। শূন্য, শূন্য, সব শূন্য, হাহাকার।’
অর্জুন আর অপেক্ষা করবেন না। চরম কথাটি বলবেন ধর্মরাজকে— কালের কাছে পরাজিত হয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর পরাজয়ে পরাজিত পাণ্ডবরাও। অর্জুন বলছেন, ‘আমাদের মিত্র যাদবদের কথা, দ্বারকার কথা আপনি বারবার জানতে চাইছেন, তা হলে শুনুন, তারা ব্রহ্মশাপে জড়বুদ্ধি, বারুণী নামক মদ্যপানে উন্মত্ত হয়ে এরকা নামক তৃণমুষ্টির দ্বারা পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করে হত্যা করায় তাদের মধ্যে আর মাত্র চার-পাঁচজন জীবিত আছে।’
এই প্রসঙ্গে অর্জুন পরপর দুটি অসাধারণ শ্লোক বলেছিলেন, প্রথমটি হল—
প্রায়েনৈতদ্ভগবত ঈশ্বরস্য বিচেষ্টিতম্।
মিথো নিঘ্নন্তি ভূতানি ভাবয়ন্তি চ যন্মিথঃ।।
জগতে জীবগণ প্রায়ই পরস্পর পরস্পরকে বিনাশ করে আবার পরস্পরকে পালনও করে এসবই সেই জগৎবিধাতার লীলা ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্জুন তাঁর দ্বিতীয় শ্লোকে বললেন—
জলৌকসাহ জলে যদ্বন্মহান্তোঽদন্ত্যর্নীয়সঃ।
দর্বলান বলিনো রাজন্মহান্তো বলি নো মিথঃ।।
হে রাজন! জলাশয়ে জলচর প্রাণীদের মধ্যে যেমন বৃহৎ প্রাণী ক্ষুদ্র প্রাণীকে, বলবান প্রাণী দুর্বল প্রাণীকে আবার অধিকতর শক্তিশালী প্রাণীরা পরস্পরকে ভক্ষণ করে থাকে, ঠিক সেইরকম সর্বনিয়ন্তা ভগবান শক্তিশালী মহৎ যদুগণের দ্বারা দুর্বল যদুগণকে ধ্বংস করিয়ে পৃথিবীর ভার হরণ করিয়েছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ কেন এসেছিলেন, তিনি কী করে গেলেন? কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে দুটি কাঁটাকেই বর্জন করলেন। ‘কণ্টকং কণ্টকেনৈব দ্বয়থশপীশিতুঃ সমম্।’ তিনি তো জন্মরহিত তবু ভূভার হরণের জন্য যদুকুলে শরীর ধারণ করলেন। সেই কাজ সমাধা হতেই শরীর ত্যাগ করলেন। তাঁর এই ভূমিকার কী অপূর্ব এই ব্যাখ্যা!
‘যথা মৎস্যাদিরূপাণি ধত্তে জহ্যাদ্ যথা নটঃ।
ভূভারঃ মায়িতো যেন জহৌ তচ্চ কলেবরম্।।
শ্রীকৃষ্ণ যেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। অভিনেতা যেমন অভিনয়ের প্রয়োজনে যখন যে রূপ প্রয়োজন সেটি ধারণ করেন এবং অভিনয়শেষে সেই রূপ পরিত্যাগ করে নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন, ভগবানও সেইরকম ভূভার হরণের জন্য যখন যে রূপ প্রয়োজন সেই রূপ ধারণ করে কার্য সম্পন্ন করেন তারপর কার্য শেষে সেই বিগ্রহ পরিত্যাগ করেন।
তিনি অভাবনীয় তিনি বন্দনীয়। আমরা ভাগবতকারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এই স্তুতি করব, যুগ যুগ ধরে করব—
যদা মুকুন্দো ভগবানিমাং মহীং
জহৌ স্বতম্বা শ্রবণীয়সৎকথঃ।
তদাহরেবাপ্রতিবুদ্ধচেতসাম্
অভদ্রহেতুঃ কলিরন্ববর্তত।।
নিত্যশ্রবণযোগ্য যাঁর অপূর্ব লীলাকথা, সেই ভগবান শ্রীহরি পৃথিবী থেকে তাঁর তনুটিকে অন্তর্হিত করামাত্রই অবিবেকি জীবের অমঙ্গলকারী দুষ্ট কলি পৃথিবীতে প্রবেশ করল।
মহারাজ পরীক্ষিৎ! এ যেমন স্তুতি সেইরকম আমাদের পক্ষে এ এক নিষ্ঠুর নিয়তি। শ্রীকৃষ্ণ-শূন্য পৃথিবী থেকে আপনার পূর্বপুরুষরা একযোগে মহাপ্রস্থান করলেন। বিরাট এক শূন্যতা। সেই শূন্যতায় একা আপনি সিংহাসনে। ভগবান কৃষ্ণ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুললেন। যদুবংশ ধ্বংস করলেন; কিন্তু ভয়ংকর কলির বিচরণভূমি যে অবাধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে জগৎ আর জীবনকে গ্রাস করার সুবর্ণসুযোগ এল তার অধিকারে। ভেবে দেখুন, আপনার বৃদ্ধ পিতামহ রাজা যুধিষ্ঠিরের কী আতঙ্কিত অবস্থা। সমগ্র দেশে, এমনকী নিজগৃহ, নিজদেহেও লোভ-হিংসা-কপটাদি, কলির প্রভাবজাত দুর্নীতির বিস্তার লক্ষ করলেন। অপ্রতিরোধ্য। রাজ্য জয় করা যায়, নৈতিক অধঃপতন অজেয়। কালের কুটিল গতি কে রোধ করতে পারে! স্বয়ং ভগবান নিজেকে তুলে নিলেন। যুধিষ্ঠির রাজপরিচ্ছদ ত্যাগ করে মহাপ্রস্থানে যাবার বেশ ধারণ করলেন। তারপর? তারপর আপনার রাজ্যাভিষেক। আপনার ওপর তাঁর গভীর আস্থা ছিল। পঞ্চমুখে প্রশংসা। বলতেন, অভিমন্যু-পুত্র গুণে আমারই সমতুল্য, উদ্ধত নয় অত্যন্ত বিনীত। সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর রূপে আপনাকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করলেন। কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রনাভকে শূরসেন-রাজ্যের অধিপতিরূপে মথুরার সিংহাসনে বসালেন। বজ্র বা বজ্রনাভ কৃষ্ণপুত্র অনিরুদ্ধের সন্তান।
তারপর আপনি সেই শোকাবহ দৃশ্য দেখলেন, চিরবাস পরিহিত, নিরাহারী, মৌনী, অবিন্যস্ত কেশ যুধিষ্ঠির কখনও জড়, কখনও উন্মত্ত, আবার কখনও পিশাচের মতো ভাব নিয়ে অনপেক্ষ হয়ে, বধিরের মতো কোনও কথা শ্রবণ না করে প্রাসাদ থেকে বহির্গত হলেন।
উদীচীং প্রবিবেশাশাং গতপূর্বাং মহাত্মাভিঃ।
হৃদি ব্রহ্মপরং ধ্যায়ন্নাবর্তেত যতো গতঃ।।
অন্তরে ভগবানের ধ্যান করতে করতে যুধিষ্ঠির, মহান পূর্বপুরুষগণ যেদিকে গিয়েছেন, আর প্রত্যাবর্তন করেননি, সেই উত্তরদিকে প্রবেশ করলেন, গমন করলেন। উত্তর থেকে উত্তরে— যেখান থেকে কখনও কোনও প্রত্যুত্তর আসে না। অধার্মিক কলি পৃথিবীর জীবগণকে আক্রমণ করেছে লক্ষ করে যুধিষ্ঠিরের অনুজগণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। পৃথিবী আর বাসযোগ্য নয়— কলি-কীট-দুষ্ট জনপদ, নদী, অরণ্য। সবশেষে সেই মহাযাত্রায় শামিল হলেন। অন্তরিক্ষে বাজছে সেই অজেয় বাসুদেবের বাঁশি। কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ। বিদুরের কী হল? কৃষ্ণধ্যানে নিমগ্ন হয়ে কৃষ্ণময়তা প্রাপ্ত হলেন। প্রভাসতীর্থে শরীর রাখলেন।
মহারাজ এইবার শুরু হল আপনার শাসনকাল। হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে রাজা পরীক্ষিৎ। প্রজারা জানেন, আপনি মহাগুণশালী, পরমভক্ত, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠগণের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত। কিন্তু, বিরাট একটা যুগ কীভাবে শেষ হয়ে গেল! সকলেই স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন।
আপনার বিবাহে পূর্বপুরুষদের কেউই উপস্থিত রইলেন না। সহধর্মিণী হয়ে আপনার জীবনে এলেন বিরাট রাজার পুত্র উত্তরের কন্যা ইরাবতী। তিনি আপনাকে চারটি পুত্র উপহার দেবেন— জনমেজয়, উগ্রসেন, ভীমসেন, শ্রুতসেন। আপনার অবসানের পর জনমেজয় হবেন বিখ্যাত। কিছু মনে করবেন না মহারাজ, আপনাকে নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। ঐতিহাসিকরা কূলকিনারা করতে না পেরে— একজন নয়, দু’জন পরীক্ষিৎকেই স্বীকার করে নিয়ে সিদ্ধান্তে এলেন, পরীক্ষিৎ (এক), পরীক্ষিৎ (দুই)। ওই অশান্তির আবর্তে দিশাহারা না হওয়াই ভাল। আপনি আমার রাজা পরীক্ষিৎ, অভিমন্যু আপনার পিতা, মাতা উত্তরা। সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে উদাসীন পূর্বপুরুষরা সদলে চলে গেলেন উত্তরের অস্তাচলে। শুরু হল কলিকাল।
মহারাজ! শুনুন, কলি কিন্তু অনেক আগেই, নিঃশব্দে, চুপিচুপি দ্বাপরে ঢুকে বসে আছে। কোনও কালই বিশুদ্ধ নয় মহারাজ। তা হলে এই কাহিনিটি শুনুন। আপনার আগমনের বহু পূর্বেই ঘটে গেছে। নিষধরাজ নল এবং দময়ন্তীর স্বয়ংবর সভা। নল ছিলেন বীরসেনের পুত্র। রূপবান, বলশালী, সর্বগুণান্বিত। ব্রাহ্মণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের পালন করতেন। নিজে ছিলেন বেদজ্ঞ, সত্যবাদী, আবার অশ্বতত্ত্বজ্ঞ— ঘোড়াদের আচার, আচরণ, স্বভাব ভীষণ ভাল বুঝতেন, সেইভাবে তাদের পরিচর্যা করতেন, নানা কৌশল শেখাতেন। বৃহৎ অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। দ্যূত প্রিয় পাশাখেলায় আকর্ষণ, তা, সেকালের রাজাদের এই এক দোষ বা গুণ— যাই বলুন না কেন! এখন হল কী— সেই সময় বিদর্ভ দেশে ভীম নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ও তাঁর মহিষী, ব্রহ্মর্ষি দমনকে সেবায় তুষ্ট করে একটি কন্যা ও তিনটি পুত্র লাভ করেন। কন্যার নাম দময়ন্তী। তিন পুত্রের নাম দম, দান্ত আর দমন। দময়ন্তী ভীষণ সুন্দরী, মনুষ্যলোকে অমন সুন্দরী বিরল— দেবতারাও চোখ ফেরাতে পারতেন না।
মহারাজ পরীক্ষিৎ আসুন, আমরা এইবার নল-দময়ন্তীর অদ্ভুত প্রেম-কাহিনি খানিক শুনি আর অবাক হয়ে দেখি— কলি কেমন দ্বাপরের অগোচরে তার অশুভ প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। ঘুণপোকা যেভাবে সুন্দর ইমারতের কাঠের কড়ি-বরগা কুটি কুটি করে। এই কাহিনির অন্তরালে কলি আপাতত গুপ্ত থাক।
নলের কানে দময়ন্তীর কথা, দময়ন্তীর কানে নলের কথা লোকমুখে চালাচালি হতে থাকল। দেখা তখনও না হলেও অদৃশ্য প্রেমতরঙ্গে দু’জনই চঞ্চল। একদিন নল নির্জন উদ্যানে বেড়াতে বেড়াতে কয়েকটি কনকবর্ণ হংস দেখতে পেলেন। সোনালি হাঁস। তিনি একটিকে ধরে ফেললেন। হাঁস বললে, রাজা, আমাকে মারবেন না, আমি আপনার প্রিয় কাজ করব, দময়ন্তীর কাছে গিয়ে আপনার কথা এমনভাবে বলব যে তিনি আর অন্য পুরুষ কামনা করবেন না।
নলের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সেই হাঁস তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেল বিদর্ভনগরে দময়ন্তীর কাছে। রাজকন্যা ও তাঁর সখীরা সেই আশ্চর্য হাঁসদের দেখে মহানন্দে ধরতে গেল। দময়ন্তী যে হাঁসটির পেছনে ছুটছিলেন সেই হাঁসটি মানুষের ভাষায় বললে, নিষধরাজ নলের মতো সুন্দর মানুষ এই বিশ্বে আর দ্বিতীয় নেই। আপনি যেমন নারীরত্ন নলও সেইরকম নরশ্রেষ্ঠ, উত্তমার সঙ্গে উত্তমের মিলন খুব শুভ হবে। দময়ন্তী বললেন, তা হলে এই কথা তুমি তাঁকে গিয়েও বলো। হাঁস এই আদেশ পালন করল। দু’জন দুই রাজ্যে, স্বর্ণবর্ণ হংসের দৌত্যে স্বপ্নের জাল বোনা।
দিবা-নিশি নলরাজার চিন্তায় দময়ন্তী কৃশ হতে শুরু করলেন। গাত্রবর্ণ ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে। সর্বক্ষণ চিন্তাক্লিষ্ট। তাঁর সখীদের মুখে কন্যার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে, রাজা ভীম ভাবলেন, কন্যার যৌবন শুরু হয়েছে, এখন তার স্বয়ংবর হওয়া উচিত। রাজা ভীম স্বয়ংবরের আয়োজন করলেন। তাঁর সাদর আমন্ত্রণে বহু রাজা বিদর্ভে সমবেত হলেন।
এই সময় দেবর্ষি নারদ ও দেবর্ষি পর্বত তাঁদের ভ্রমণপথে ইন্দ্রের রাজসভায় উপস্থিত হলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর ইন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলো তো, যুদ্ধে মৃত বীর রাজারা অক্ষয় স্বর্গলোক লাভ করে এখানে আসতেন। দীর্ঘদিন তাঁরা আর আসছেন না। ওখানে যুদ্ধবিগ্রহ কি সব বন্ধ হয়ে গেল? নারদ বললেন, দেবরাজ, কারণটা শুনুন, বিদর্ভ রাজকন্যা দময়ন্তী তাঁর রূপে পৃথিবীর সমস্ত নারীকে অতিক্রম করেছেন, শীঘ্রই তাঁর স্বয়ংবর হবে। সেই সুন্দরীকে লাভ করার আশায় সব রাজা ও রাজপুত্ররা স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন, সেই কারণেই আপনার এখানে কেউ আসছেন না। নারদ যখন এই সব বলছেন, সেই সময় এসে হাজির হলেন অগ্নি, বরুণ প্রমুখ লোকপালগণ। দময়ন্তীর রূপের কথা শুনে তাঁরা বললেন, আমরাও যাব।
ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ ও যম তাঁদের বাহন ও অনুচর সহ বিদর্ভে যাত্রা করলেন। যাত্রাপথে, তাঁরা কন্দর্পকান্তি নলকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক— এত সুন্দর! ভাবলেন, আমাদের কোনও আশা নেই; কিন্তু, দেবতাদের সম্বলে অনেক ছলাকলা! তাঁরা বিমান থেকে অবতীর্ণ হয়ে নলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কোনও ভূমিকা না করে দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, নিষধরাজ, তুমি সত্যব্রত, তুমি দূত হয়ে আমাদের সাহায্য করো।
নল একসঙ্গে দেবতাদের দেখে অভিভূত হয়েছিলেন, তাই কোনও প্রশ্ন না করেই বললেন, সাহায্য করব; কিন্তু আপনারা কে? আমাকে কার দৌত্য করতে হবে? ইন্দ্র বললেন, আমরা অমর, দময়ন্তীর জন্য এসেছি। আমি ইন্দ্র, আর এই যে, অগ্নি, বরুণ, যম। তুমি গিয়ে দময়ন্তীকে বলবে যে দেবতারা তাঁকে চান, তিনি ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম এই চারজনের একজনকে বরণ করুন। নল বললেন, আমিও যে তাঁকে চাই। আমি নিজেই যখন প্রার্থী তখন অন্যের জন্য কী করে বলব? দেবগণ আমাকে ক্ষমা করুন।
দেবতারা বললেন, তুমি করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, এখন তার অন্যথা করতে পারো না, অতএব শীঘ্র যাও।
নল বললেন, সুরক্ষিত অন্তঃপুরে আমি কী করে প্রবেশ করব? ইন্দ্র বললেন, তুমি প্রবেশ করতে পারবে। তার মানে, একটা ক্ষমতা দিয়ে দিলেন, অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা। দেবতাদের তো শক্তির অভাব নেই। কিন্তু মানুষের জগতে মানুষ হয়েই নেমে আসেন, মানুষের মতোই আচরণ। দময়ন্তী সখী-পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। নল এসে হাজির। তখন দু’জনের মধ্যে এইরকম কথা হল—
দময়ন্তী: তুমি কে? আমার হৃদয় হরণ করতে কেন এসেছ এখানে?
নল: কল্যাণী, আমি নল, ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ ও যমের দূত হয়ে তোমার কাছে এসেছি। এই চার দেবতা তোমার স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়েছেন। তুমি তাঁদেরই একজনকে পতিরূপে বরণ করো।
দয়মন্তী: রাজা! আমি এবং আমার যা কিছু আছে সবই তোমার, তুমিই আমার প্রতি প্রণয়শীল হও। তোমার হংসদূতের কাছে বার্তা পেয়ে তোমাকে পাবার জন্যই আমি এই স্বয়ংবরে রাজাদের আনিয়েছি। তুমি যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করো তবে বিষ, অগ্নি, জল বা রজ্জু দ্বারা আত্মহত্যা করব।
নল: দেবতারা থাকতে মানুষকে চাও কেন? আমি তাঁদের চরণধূলির তুল্যও নই, তাঁদের প্রতিই তোমার মন দেওয়া উচিত।
দময়ন্তী: [চোখে জল, জোড় হস্ত] দেবগণকে আমার প্রণাম; মহারাজ, আমি তোমাকেই পতিরূপে বরণ করব।
নল: কল্যাণী, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেবগণের দূত রূপে তোমার কাছে এসেছি, এখন নিজের স্বার্থ কীভাবে সাধন করব? সে তো, নীচতা, গুরুতর অপরাধ, ক্ষমার আযোগ্য।
দময়ন্তী: আমি নির্দোষ উপায় বলছি শোনো। ইন্দ্রাদি লোকপালগণের সঙ্গে তুমিও এসো, আমি তাঁদের সামনেই তোমাকে বরণ করব।
দেবতাদের কাছে ফিরে গিয়ে নল বললেন, আপনাদের বার্তা আমি দময়ন্তীকে নিবেদন করেছি। কিন্তু তিনি আমাকেই বরণ করতে চান। তিনি আপনাদের সকলকে এবং আমাকেও স্বয়ংবর সভায় আমন্ত্রণ করেছেন। দেবতারা শুনলেন। সকলের মুখে স্মিত হাসি। কী ভাবলেন, কী করবেন, প্রকাশ করলেন না। যথা দিনে, শুভক্ষণে স্বয়ংবর সভা শুরু হল। বিরাট আয়োজন। নানা দেশের রাজাগণ সুগন্ধী মালা ও মণিকুণ্ডলে সজ্জিত হয়ে আসন অলংকৃত করেছেন। দময়ন্তী সভায় এলেন। তাঁর আবির্ভাবে সবাই যেন রুদ্ধশ্বাস। সকলের চোখ সেই দেহসৌন্দর্যে নিবদ্ধ, অন্য কোনও বস্তুর দিকে দৃষ্টি ফেরাবার শক্তি নেই। এ কী দেখছেন তাঁরা! স্বপ্ন! না সত্য! প্রথামতো রাজন্যবর্গের নামকীর্তন শুরু হল। এদিকে দময়ন্তী খুঁজছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিতকে। চারজন দেবতা এক কৌশল করেছেন, ছলনা। তাঁরা প্রত্যেকেই নলের রূপ ধারণ করেছেন। দময়ন্তী দেখছেন সভায় বসে আছে পাঁচজন নল— কোনজন আসল! দময়ন্তী মহা সমস্যায় পড়লেন। তখন কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবতাদের চরণে নিজেকে নিবেদন করে দিলেন, বললেন, দেবগণ! সভামধ্যে আপনারা উপস্থিত আছেন, আমি জানি। মায়ার আবরণে নিজেদের ঢেকে রেখেছেন। দেব-লক্ষণ প্রকাশ করছেন না। হংসদূত এসে আমাকে রাজা নলের কথা বলামাত্রই আমি মনে মনে তাঁকে বরণ করেছি; কিন্তু এই সভামধ্যে তিনি কোথায় এবং কোন জন, কৃপা করে আমাকে বলে দিন— আপনাদের কাছে অসহায়ের এই প্রার্থনা।
দেবতারা সেই প্রার্থনা উপেক্ষা করতে পারলেন না। নিমেষে নিজ নিজ রূপ ধারণ করলেন, দেব-লক্ষণ প্রকাশ করলেন। মহারাজ! মূল মহাভারতের এই সুন্দর অংশটি আপনাকে শোনাই, আপনাদেরই কীর্তিকাহিনি: দেবতারা কী দেখলেন, পরমাসুন্দরী দময়ন্তীর মধ্যে কী শুনলেন!
নিশম্য দময়ন্ত্যাস্তৎ করুণং পরিদেবিতম।
নিশ্চয়ং পরমং তথ্যমনুরাগঞ্চ নৈষধে।।
মনোবিশুদ্ধিং বুদ্ধিঞ্চ ভক্তিংরাগঞ্চ নৈষধে।
যথোক্তং চক্রিরে দেবাঃ সমস্ত লিঙ্গধারণম।।
তখন দেবতারা দময়ন্তীর সেই করুণ বিলাপ শুনে আর নলের প্রতি তাঁর নিশ্চয়, পরমসত্য, অনুরাগ, মনের নির্মলতা, বুদ্ধির প্রখরতা, আর নলের প্রতি ভক্তি ও আসক্তি দেখে নিজেদের দেব-চিহ্ন সমূহ ধারণ করলেন। সেইসব দেব-চিহ্ন কী কী? দময়ন্তী কী দেখলেন?
সহাপশ্যদ বিবুধান সর্বান অস্বেদান স্তব্ধলোচনান্।
হৃষিতস্রগ্ রজোহীনান স্থিতানস্পৃশতঃ ক্ষিতিম্।।
ছায়াদ্বিতীয়ো ম্লানস্রগ্ রজঃস্বেদসমন্বিতঃ।
ভূমিষ্ঠো নৈষধশ্চৈব নিমেষেণ চ সূচিতঃ।।
দেখলেন— দেবতাদের শরীরের ছায়া নেই, নয়নে নিমেষ নেই, গাত্রে ধূলি নেই, মালা ম্লান হয়নি, আর তাঁরা ভূতল স্পর্শ না করেই রয়েছেন। আর দেখছেন, ওই পাঁচজনের মধ্যে একজন— তাঁর শরীরের ছায়া আছে, মালা মলিন হয়েছে, শরীরে ধূলি ও ঘর্ম আছে এবং তিনি ভূতল স্পর্শ করে রয়েছেন, নয়নে নিমেষ রয়েছে। দময়ন্তী তাঁকে নল বলে চিনতে পারলেন। ‘তখন লজ্জমানা বসনপ্রান্ত ধারণ করে নলের স্কন্ধদেশে পরমশোভন মাল্য অর্পণ করলেন। রাজারা হা হা করে উঠলেন, দেবতা ও মহর্ষিগণ বললেন সাধু সাধু। নল হৃষ্টমনে দময়ন্তীকে বললেন, তুমি দেবগণের সন্নিধিতে মানুষকেই বরণ করলে, আমাকে তোমার ভর্তা ও আজ্ঞানুবাহী বলে জেনো। সুহাসিনী যতদিন দেহে প্রাণ থাকবে ততদিন আমি তোমারই অনুরক্ত থাকব।
দেবতারা অত্যন্ত প্রীত হয়ে নলকে বর দিলেন। ইন্দ্র বললেন, যজ্ঞকালে তুমি আমাকে প্রত্যক্ষ দেখবে, আর দেহান্তে উত্তম গতি লাভ করবে। অগ্নি বললেন, তুমি যেখানেই ইচ্ছা করবে সেখানেই আমার আবির্ভাব হবে এবং অন্তিমে তুমি প্রভাময় দিব্যলোকে যাবে। যম বললেন, তুমি যে খাদ্য পাক করবে তাই সুস্বাদু হবে, তুমি চিরকাল ধর্মপথে থাকবে। বরুণ বললেন, তুমি যেখানে জল চাইবে সেখানেই পাবে। দেবতারা সকলে মিলে নলকে উত্তম গন্ধ মাল্য এবং যুগল সন্তান লাভের বর দিলেন।
বিবাহের পর কিছুকাল বিদর্ভে অবস্থান করে নল তাঁর পত্নীর সঙ্গে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। অশ্বমেধাদি যজ্ঞ করলেন। যথাকালে তাঁরা একটি পুত্র ও একটি কন্যা লাভ করলেন।
মহারাজ! এই পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই, কাহিনির গতি কত সুখকর, মসৃণ; কিন্তু অন্তরালে ঘুরছে কলির কালচক্র। স্বয়ংবর সভা থেকে ফেরার পথে দেবতাদের সঙ্গে দ্বাপর আর কলির দেখা। আশ্চর্য এক জুটি। দেবতারা প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার! দু’জনে চললে কোথায়? কলির উদ্ধত জবাব, দময়ন্তীর উপর আমার মন পড়েছে, তাকে স্বয়ংবরে পাবার জন্যে যাচ্ছি। ইন্দ্র হেসে বললেন, সব শেষ। দময়ন্তী রাজা নলকে আমাদের সামনেই বরণ করেছেন। এইবার কলির খেলা দেখুন মহারাজ। দেবতাদের কথা শুনে যেন ভীষণ অসন্তুষ্ট— কী! এতবড় আস্পর্ধা, দেবতাদের ছেড়ে একটা তুচ্ছ মানুষকে বরণ করেছে! কী করে ওর সর্বনাশ করতে হয়, এইবার আমি দেখাচ্ছি। ইন্দ্র বললেন, ওহে কলি! তোমার কোনও ধারণা নেই, নলের মতো সর্বগুণসম্পন্ন রাজাকে যে অভিশাপ দেয়, সে নিজেই অভিশপ্ত হয়ে ঘোর নরকে যায়। এই কথা বলে দেবতারা চলে গেলেন।
শুরু হল কলির কেরামতি। দ্বাপরকে বললেন, আমি ক্রোধ সংবরণ করতে পারছি না, আমি নলের দেহে অধিষ্ঠান করে তাকে রাজ্যভ্রষ্ট করব। এই শাস্তিই তার প্রাপ্য। তুমি আমাকে সাহায্য করার জন্য অক্ষের মধ্যে প্রবেশ করো।
আবার পাশা! দ্বাপরের রাজাদের পাশাখেলা ধর্মের অঙ্গ। শকুনির পাশায় যুধিষ্ঠিরের সর্বনাশ। এইবার কলির পাশায় নলরাজার কী গতি হয় দেখুন মহারাজ পরীক্ষিৎ। কলি দ্বাপরকে ভুল বুঝিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে নলের নিষধরাজ্যে এলেন। নলের ছিদ্র অনুসন্ধান করতে লাগলেন— যে ছিদ্রপথে কলি নলকে গ্রাস করবেন। নলের বোধ-বুদ্ধি-নৈতিকতা-সংযম, বিচার—সব এসে যাবে কলির মুঠোয়।
দীর্ঘ অপেক্ষা। বারো বছর পরে সেই সুযোগ এল। নলের অসতর্কতা। কলি একদিন দেখলেন, নল মূত্রত্যাগ করে পা না ধুয়ে শুধু আচমন করে সন্ধ্যা করলেন। সেই অবসরে কলি নলের দেহে প্রবেশ করলেন। শুরু হল কলির কেরামতি। কলি নলের ভ্রাতা পুষ্করের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি নলের সঙ্গে পাশা খেলো, আমার সাহায্যে নিষধরাজ্য জয় করতে পারবে। পুষ্কর রাজি হয়ে নলের কাছে চললেন। কলি বৃষের রূপ ধারণ করে পেছনে পেছনে। এইবার দেখবেন মহারাজ, কাল কীরকম কালকে নিয়ে খেলা করে। দ্বাপর হয়েছেন পাশা আর কলি আশ্রয় করেছেন, গ্রাস করেছেন রাজার ধর্ম। সংস্কার, বোধ-বুদ্ধি। কলির গ্রাসে নলরাজা।
নল পুষ্করের চক্রান্তে প্রবেশ করলেন। শুরু হল পাশাখেলা। দানের পর দান পড়ছে আর রাজা নল একে একে সব হারাচ্ছেন। সুবর্ণ, যানবাহন, বসন, অর্থ, বিত্ত— সর্বস্ব। মন্ত্রী, পুরবাসীগণ, দময়ন্তী, আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নলকে নিবৃত্ত করতে, তিনি শুনবেন কেন? কলির আবেশে তিনি আত্মহারা। পুষ্কর দানের পর দান ফেলছেন আর উল্লাসে চিৎকার করছেন— কিস্তি মাত। দময়ন্তীর শত চেষ্টা ব্যর্থ হল। তিনি রাজার ধাত্রী বৃহৎসেনাকে পাঠালেন। সব চেষ্টাই ব্যর্থ। তখন দময়ন্তী সারথি বার্ষ্ণেয়কে ডেকে বললেন, রাজা বিপদে পড়েছেন, তুমি তাঁকে সাহায্য করো। তিনি পুষ্করের কাছে যত হেরে যাচ্ছেন ততই তাঁর খেলার আগ্রহ বাড়ছে। রাজা মোহগ্রস্ত, হয়তো তিনি রাজ্য হারাবেন। সারথি তুমি দ্রুতগামী রথে আমার পুত্র কন্যাকে কুণ্ডিন নগরে তাদের মাতামহের কাছে নিয়ে যাও। সেখানে আমার দুই সন্তান, রথ ও অশ্ব রেখে তুমি সেখানেই থেকো বা যেখানে ইচ্ছা হয় যেয়ো। সারথি বার্ষ্ণেয় দময়ন্তীর আজ্ঞা পালন করলেন। তারপর এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে অযোধ্যায় গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণের সারথি হলেন।
এদিকে পুষ্কর হাসতে হাসতে বললেন, সবই তো আমার অধিকারে, বাকি শুধু দময়ন্তী, শেষ বাজি, ধরবেন নাকি? নল শিউরে উঠলেন, তিনি কিছু না বলে তাঁর সব অলংকার খুলে ফেললেন, বিপুল ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একবস্ত্রে, অনাবৃত দেহে রাজ্য ত্যাগ করলেন। দময়ন্তীও এক বস্ত্রে তাঁর অনুগামী হলেন।
মহারাজ পরীক্ষিৎ! সময় কখনও নায়ক, কখনও খলনায়ক। যেমন বাতাস— যখন শ্বাসে-প্রশ্বাসে তখন জীবন, যখন ঝড় তখন ধ্বংস, তখন মৃত্যু। কলি দ্বাপরকে বশীভূত করে স্থিতধী রাজাকে বিভ্রান্ত, বিপথচালিত করলেন। কী লাভ হল তাঁর, কিছুই না; এক ধরনের তৃপ্তি। কাম, ক্রোধ, লোভ, ত্যাগ, বৈরাগ্য, প্রেম, প্রতিহিংসা, আচার-অনাচার— এই হল অস্তিত্বের ত্বক, জগতের আবরণ, একটা জাল। সমস্ত পরিণতিই বিদ্যমান। আলো, অন্ধকার, গতি, স্থিতি। পাঁচটি উপাদান একত্রিত হয়ে প্রাণের স্পর্শে কী কী স্বভাব প্রকাশিত হবে, তা মনে হয় সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। মহারাজ! মানুষ নামক প্রাণীটি অতি অসহায়। স্বয়ংবর সভায় দময়ন্তীকে যে-সব অঙ্গীকার দিয়েছিলেন, মোহগ্রস্ত নল সে-সব বিস্মৃত হলেন। দেবতারা বর প্রদান করেছিলেন, সে-সব ভেসে গেল। ভয়ংকর কলি তাঁর শুভ বুদ্ধিকে গ্রাস করেছে। অজগর যেমন শিকারকে গিলে ফেলে! তা হলে দেখুন মহারাজ, সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ— এই তিনটি গুণের হ্রাস আর বৃদ্ধিই কালকে চিহ্নিত করে। সত্যযুগে সাত্ত্বিক মানুষের সংখ্যা বেশি। সকলেই সত্ত্বগুণী— ধ্যান, জপ, যাগ, যজ্ঞ— এই হল কর্ম, জীবনের লক্ষ্য। ত্রেতায় ঢুকছে রজোগুণ, অহংকার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বৈষয়িকতা। সিংহাসন, রাজদণ্ড, ছত্র, রথ, অশ্ব, গজ, রাজা, প্রজা, দানব, মুনি, ঋষি, বৃত্তিজীবী। কখনও সুখ, কখনও দুঃখ। প্রকৃতি সুজলা, সুফলা। রাজারা ধার্মিক, প্রজাপালক। মুনি, ঋষিরা উপদেষ্টা। দ্বাপরে তমোগুণের বাড়াবাড়ি, কিন্তু শ্রীভগবান মানে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি, স্বয়ং বর্তমান। প্রয়োজনে অশুভ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, সৎকে আশ্রয় দিচ্ছেন, কৃপা করছেন, যেন দুরন্ত নদীকে বাঁধ দিয়ে সামলাচ্ছেন।
মহারাজ! এত জ্ঞানের কথা না বলে রাজা নল আর দময়ন্তীর পরিণতির কথা বলি। নলের পদস্খলনে দময়ন্তীর মতো এক দেববাঞ্ছিত বনিতার কী দুর্দশা! পুষ্করের শাসনে ভীত কোনও প্রজাই নল-দময়ন্তীর এই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়াল না। এই তো মানুষের মানসিকতা। দু’জনে শুধুমাত্র জলপান করে নগরের উপকণ্ঠে পরপর তিনটি রাত কাটালেন। ক্ষুধার্ত নল খাদ্যের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে কতকগুলি পাখি দেখতে পেলেন। তাদের পালক স্বর্ণবর্ণ। অদ্ভুত একঝাঁক পাখি! কে কবে কোথায় দেখেছে! নল ভাবলেন, ভাগ্য সুপ্রসন্ন। এই পাখিগুলিই আজ আমাদের ভক্ষ্য হবে, আর সোনার পালকগুলি হবে ধন। কত, কত সোনা! ঈশ্বরই পাঠিয়েছেন।
নল অতি সন্তর্পণে এগোচ্ছেন। পরিধানের বস্ত্রটি খুলে ফেলেছেন। মাছধরা জাল ফেলার কায়দায় কাপড়টি পাখিদের ওপর ছুড়ে দিলেন। একসঙ্গে সব পাখি চাপা পড়ে গেল। তারপর, অতি আশ্চর্য কাণ্ড, পাখির ঝাঁক সেই কাপড়টি নিয়ে একসঙ্গে আকাশে উড়ে গেল। শুধু উড়ল না, পরিষ্কার মানুষের ভাষায় বললে—
বয়মক্ষাঃ সুদুর্বুর্দ্ধে! তব বাসো জিহীর্ষবঃ।
আগতা ন হি নঃ প্রীতিঃ সবাসসি গতে ত্বয়ি।।
অতিশয় দুর্বুদ্ধি নল। আমরা পক্ষী নই, আমরা সেই পাশা, তোমার বস্ত্র হরণ করবার ইচ্ছাতেই এসেছিলাম; কারণ তুমি সবস্ত্রে গেলে আমাদের পরিপূর্ণ আনন্দ হবে না।
সেই সর্বনাশা পাশাগুলি সোনার পাশার রূপ ধরে এসেছিল। শুধু আসেনি, কাণ্ডজ্ঞানহীন নলকে তিরস্কার করছে। সোনার পাখি হয়ে এসেছে নলরাজাকে বিবস্ত্র করতে। উলঙ্গ রাজা পথে, বিপথে, অরণ্যে, প্রান্তরে কুকুরের মতো ঘুরবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাল, দ্বাপরের অন্তরে বসে কলিরাজ পাশার দান চালবে।
বিবস্ত্র নল অবাক হয়ে দেখছেন, তাঁর লজ্জা নিবারণের একমাত্র বস্ত্রটি পালতোলা নৌকার মতো আকাশগঙ্গায় ভেসে গেল, দূর থেকে দূরে, দিগন্তের পরপারে। পাশাপক্ষীর হাহা-হাসি ভাগ্যের নৃশংস উপহাসের মতো, ঝাঁক ঝাঁক বাণের মতো উলঙ্গ রাজার দিকে উড়ে আসছে।
নল দময়ন্তীকে বলছেন, ‘অনিন্দিতে! যাদের কোপে আজ আমি ঐশ্বর্য্যভ্রষ্ট, দুঃখিত, ক্ষুধার্ত, তারাই পাখির রূপ ধরে এসে আমাকে বিবস্ত্র করে দিয়ে গেল। আমি সংকটাপন্ন, দুঃখিত, চৈতন্যহারা। তোমার হিতের জন্যেই আমার এই পরামর্শ বিচার করো— তাকিয়ে দেখো, কত পথ অবন্তীদেশ ও ঋক্ষবান্ পর্বত অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্যের দিকে চলে গেছে। এই বিন্ধ্যনামক মহাপর্বত এই সমুদ্রগামিনী পয়োষ্ণী নদী, এই মহর্ষিগণের প্রচুর ফলমূলযুক্ত আশ্রমসমূহ দেখা যাচ্ছে। এইটি বিদর্ভের পথ। এটি চলে গেছে অযোধ্যার দিকে। এরপর দক্ষিণ দিকে দাক্ষিণাত্যদেশ দেখা যাচ্ছে। আমি তোমার স্বামী, আমি তোমাকে বলছি— এই অপদার্থ, অপরাধীকে পরিত্যাগ করে তুমি পিতৃগৃহে গমন করো। সেখানে আমার যাওয়া সম্ভব নয়। ছিলাম মান্য রাজা, হয়েছি নগ্ন ভিখারি। লোকচক্ষুর আড়ালে গভীর অরণ্যেই আমাকে থাকতে হবে।
মহারাজ, দময়ন্তী স্বামীকে কী বললেন শুনুন। বললেন, ‘আপনি হৃতরাজ্য, হৃতদ্রব্য, বিবস্ত্র, ক্ষুধার্ত, পরিশ্রান্ত, এই অবস্থায়, এই নির্জন বনে আপনাকে পরিত্যাগ করে আমি কি যেতে পারি? মহারাজ এই নির্জন বনে, এই দুরবস্থায় আপনি যখন অতীতের সুখের দিনগুলির কথা ভেবে বিষণ্ণ হবেন, হতাশ হবেন, মৃতপ্রায় হবেন, আমি আপনার পাশে থেকে সান্ত্বনা দেব, সাহস দেব, ক্লান্তি দূর করব।’ এরপরে দময়ন্তী যা বললেন, তা যুগ যুগ ধরে মানুষের আলোচনায় বেদবাক্যের মতো উদ্ধৃত হবে—
ন চ ভার্য্যাসমং কিঞ্চিদ্ বিদ্যতে ভিষজাং মতম্।
ঔষধং সর্ব দুঃখেষু সত্যমেতদ্ ব্রবীনিতে।।
চিকিৎসকদের এই অভিমত— সর্বপ্রকার দুঃখে শান্তিলাভ বিষয়ে ভার্যার তুল্য কোনও ওষুধ নেই।
নল বললেন, ‘অতি সত্য কথা, আমি নিজেকে ত্যাগ করতে পারি, তোমাকে ত্যাগ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’ নল-দময়ন্তী একই বস্ত্র পরিধান করে ঘুরতে ঘুরতে একটি পান্থশালায় এলেন। পথিকদের বিশ্রামস্থল। শ্রান্ত, ক্লান্ত। দু’জনে ভূতলেই শয়ন করলেন। দময়ন্তী তখনই ঘুমিয়ে পড়লেন। রাজা নল জেগে আছেন। কলি তো তখনও তাঁকে ভূতে ধরার মতো ধরেই আছে। বসে আছে তাঁর চিন্তা, ভাবনা, ধর্ম ও কর্মকে আচ্ছন্ন করে। কিছু আগে তিনি দময়ন্তীকে যেসব কথা বলেছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেসব যেন মেঘের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা রোদের মতো। কলির মেঘে তাঁর বোধ-বুদ্ধি আবার আচ্ছন্ন হল। স্ত্রীর নিদ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, কলি তাঁকে ভাবালেন আমার জন্যেই দময়ন্তীর এই দুঃখভোগ, আমি না থাকলে দময়ন্তী পিতৃগৃহেই যাবে। অতএব এই সুযোগ, আমি পালাই।
সমস্যা একটাই, একই বস্ত্র দু’জনে পরে আছেন। দ্বিখণ্ডিত করতে হবে। সে ব্যবস্থাও কলি করে রেখেছেন। পান্থশালার দেয়ালে ঝুলছে শাণিত একটি খড়্গ। বস্ত্রের অর্ধভাগ কেটে নিলেন। নিদ্রিতা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ করে নল দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হলেন। কিছুদূর গিয়ে ফিরে এলেন। নিদ্রিত দময়ন্তীর প্রশান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনুশোচনা। বারকতক এইরকম হল, যাচ্ছেন, আসছেন, অবশেষে আর ফিরলেন না। কোথায় কোনদিকে চলে গেলেন, নিরুদ্দেশ যাত্রা। কলির জয়!
মহারাজ পরীক্ষিৎ এইবার শুনুন, কলির চক্রান্তে দময়ন্তীর জীবনের দুর্দশার কথা। ‘অরণ্যে একা এক রাজকন্যে! নিদ্রাভঙ্গ হল। উঠে দেখলেন, পরিধানে বসনের অর্ধভাগ। বাকি অর্ধভাগের সঙ্গে উধাও তাঁর পরম আরাধ্য পতিদেব। নিষ্ঠুর প্রেমিক। কথার ছলনায় নিশ্চিন্ত করে নিদ্রার আবেশে নিরুদ্দেশ। কোথায়, কোথায়? অজানা অরণ্যে দিশাহারা। মহাকায় ক্ষুধার্ত এক অজগর শিকারের অপেক্ষায় হাঁ করেই ছিল। দময়ন্তী তার গ্রাসে। অসহায় রমণীর চিৎকার শুনে ছুটে এল এক ব্যাধ। অজগরের মুখ চিরে উদ্ধার করল দময়ন্তীকে। প্রক্ষালনের জন্যে জল এনে দিল। এনে দিল আরণ্যক আহার। এরপর ব্যাধের প্রশ্ন, কে তুমি সুন্দরী, গভীর এই অরণ্যে? দময়ন্তী তাঁর জীবনের এই দুর্দশার কথা ব্যাধকে বললেন। সব শোনার পর ব্যাধের সম্ভোগ ইচ্ছা জাগল। অজগরের আক্রমণের পর, ব্যাধের আক্রমণ। অসহায় দময়ন্তী প্রার্থনা করলেন, যদি আমি নিষধরাজ ভিন্ন অন্য পুরুষকে মনে মনেও চিন্তা না করে থাকি তবে এই ক্ষুদ্র মৃগয়াজীবীর মৃত্যু হোক। ব্যাধ তখনই প্রাণ হারাল। এই ঘটনায় আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি মহারাজ! কলির অধর্ম আর ধর্মের ধর্ম, এই দ্বন্দ্ব সর্বকালের। কখনও ধর্মের জয়, কখনও অধর্মের।
দময়ন্তী নিজের জীবন-মরণ তুচ্ছ করে, সেই ঝিল্লিমুখরিত, ব্যাঘ্র, সিংহ, মহিষ, ভল্লুক-অধ্যুষিত অরণ্যের গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করতে লাগলেন। অসামাজিক দস্যু, তস্কর, ম্লেচ্ছ মানুষের গুপ্ত অবস্থান। প্রতি পদে বিপদ। এখানে জীবনকে চলতে হয় মৃত্যুর পেতে রাখা ফাঁদ টপকে টপকে। দময়ন্তী যেন দেহমুক্ত এক আবেগ। এক অন্বেষণ। বৃক্ষ, লতা, পর্বত, পশু, পক্ষী, প্রত্যেককেই উন্মাদিনীর ন্যায় প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন— আমার নলকে তোমরা দেখেছ? অবিরাম হেঁটে চলেছেন উত্তরদিকে। তিন দিন অহোরাত্র হাঁটার পর তিনি এক রমণীয় তপোবনে এসে হাজির হলেন। তপস্বীরা জিজ্ঞেস করলেন, সর্বাঙ্গসুন্দরী, তুমি কে? তুমি কি এই অরণ্যের বা পর্বতের বা নদীর দেবী? দময়ন্তী তাঁর সব কথা বললেন, বললেন, তাঁর জীবনের দুঃখের ইতিহাস। শেষে জানালেন তাঁর সংকল্প— যদি আমি কয়েকদিনের মধ্যে নলরাজার দেখা না পাই, তা হলে দেহত্যাগ করব। তপস্বীরা বললেন, কল্যাণী, তোমার মঙ্গল হবে, আমরা দেখছি তুমি শীঘ্রই নিষধরাজের দর্শন পাবে। তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়ে সর্বরত্ন সমন্বিত হয়ে নিজ রাজ্য শাসন করবেন, শত্রুদের ভয় উৎপাদন ও সুহৃদগণের শোক নাশ করবেন।
কথা শেষ হতেই তপস্বীরা বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। কোথায় তপোবন! কোথায় আশ্রম! সব যেন মরীচিকা! স্বপ্ন! তাপসরা কোথায় গেলেন? তাঁদের আশ্রম, পুণ্যসলিলা নদী, ফল, ফুলশোভিত বৃক্ষ, কোথায় গেল সব। যে অরণ্য, সেই অরণ্য।
আবার শুরু হল পথচলা। দময়ন্তী এসে দাঁড়ালেন এক নদীতীরে। দেখছেন, বৃহৎ এক বণিকের দল অনেক হস্তী অশ্ব রথ নিয়ে নদী পার হচ্ছে। দময়ন্তী সেই যাত্রীদলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁর উন্মত্তের মতো অর্ধনগ্ন, কৃশ, মলিন মূর্তি দেখে কয়েকজন ভয়ে দূরে সরে গেল, কেউ অন্যজনকে ডাকতে লাগল, কেউ হাসতে থাকল। ওরই মধ্যে একজন সাহসভরে প্রশ্ন করল, তুমি কি মানবী, দেবতা যক্ষী, না রাক্ষসী? আমরা তোমার শরণ নিলাম, আমাদের রক্ষা করো, আমাদের বাণিজ্য-যাত্রা নিরাপদ করো। দময়ন্তী নিজের পরিচয় দিয়ে, নলের সংবাদ জানতে চাইলেন। দেশে-বিদেশে ভ্রমণকারী বণিকরা রাজ্যচ্যুত, পরিব্রাজক রাজা নলকে কোথাও দেখেছেন কি? তখন শুচি নামক এক সার্থবাহ, অর্থাৎ বণিকদলের নায়ক বললেন, এই অরণ্যে আপনাকে ছাড়া অন্য কোনও মানুষকে আমরা দেখিনি। আমরা যাচ্ছি চেদিরাজ সুবাহুর রাজ্যে।
নলের দেখা পাওয়ার আশায় দময়ন্তী সেই বণিকদলের সঙ্গে চললেন। এলেন বৃহৎ এক জলাশয়ের ধারে। সকলেই শ্রান্ত, ক্লান্ত। বিশ্রামের প্রয়োজন। স্থির হল, আজ এখানেই রাত্রিযাপন। সকলেই যখন নিদ্রিত, প্রায় মধ্যরাত। হঠাৎ একদল মদমত্ত বন্য হস্তী অরণ্যের গভীর থেকে এসে বণিকদের পালিত হস্তীদের আক্রমণ করল। বিশাল যুদ্ধ। বণিকরা সকলেই ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ আক্রমণে, অরণ্যের অন্ধকারে প্রাণভয়ে ছোটাছুটি। পদপিষ্ট হয়ে অনেকে প্রাণ হারালেন, আহত হলেন।
যাঁরা রক্ষা পেলেন, তাঁরা বললেন, আমরা বাণিজ্যদেবতা মণিভদ্রের এবং যক্ষাধিপ কুবেরের পূজা করিনি তারই এই ফল। কয়েকজন বললে, সেই উন্মত্তদর্শনা, বিকৃতরূপা নারীই মায়াবলে এই বিপদ ঘটিয়েছে। নিশ্চয় সে রাক্ষসী, যক্ষী বা পিশাচী, তাকে দেখলে আমরা হত্যা করব। দময়ন্তী প্রাণভয়ে আরও গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি ছুটছেন, আর ভাবছেন, হায় বরাত! এই নির্জন অরণ্যে যে জনসংঘে আশ্রয় পেয়েছিলাম তাও হস্তীযূথ এসে বিধ্বস্ত করলে। এসবই আমার মন্দভাগ্যের ফল। স্বয়ংবরে আমি ইন্দ্রাদি লোকপালগণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাঁদেরই কোপে আজ আমার এই দুর্দশা। বণিকদলের সঙ্গে কয়েকজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁরা হাতির আক্রমণে নিহত হননি। বনপথে তাঁদের সঙ্গে দময়ন্তীর দেখা হল। কয়েকজন সঙ্গী পেলেন। ভয় কিছুটা কাটল। কিন্তু, পথ কবে শেষ হবে! দীর্ঘদিন পরে একদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি চেদিরাজ সুবাহুর নগরে উপস্থিত হলেন। গ্রাম্যবালকরা তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল, কোথা থেকে এক উন্মাদিনী এসেছে! দময়ন্তী রাজপ্রাসাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। রাজমাতা তাঁকে দেখতে পেয়ে এক ধাত্রীকে বললেন, ওই অসহায়, শরণার্থিনী নারীকে লোকে নির্যাতন করছে, তুমি উদ্ধার করে আমার কাছে নিয়ে এসো।
দময়ন্তী রাজমাতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, এত দুর্দশাতেও তোমাকে রূপবতী দেখছি, যেন মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের দীপ্তি, তুমি কে?
ন চ তে মানুষং রূপং ভূষণৈরপি বর্জিতম্।
অসহায়া ন রেভ্যশ্চ নো দ্বিজস্যমর প্রভে।।
তোমার এই রূপ অলংকারবিহীন হলেও মানুষের মতো নয়। হে দেবিতুল্যে! তুমি সহায়শূন্য হয়েও মানুষকে ভয় করছ না। তুমি কে? কোথা থেকে এলে?
দময়ন্তী বললেন, মাতা, আমি কোনও দেবী নই, আমি পতিব্রতা সদ্বংশীয়া সৈরিন্ধ্রী। আমার স্বামীর গুণের সংখ্যা করা যায় না, কিন্তু দুর্দৈব, দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে তিনি বনে এসেছিলেন, সেখানে আমাকে নিদ্রিত অবস্থায় পরিত্যাগ করে চলে গেছেন। সেই থেকে আমি আমার পতির অন্বেষণ করছি।
রাজমাতা বললেন, কল্যাণী! আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, আমার স্নেহ গ্রহণ করো। আমার কাছেই তুমি থাকবে। আমার লোকেরাই তোমার পতির খোঁজ করবে। এমনও হতে পারে, তিনি ঘুরতে ঘুরতে নিজেই এখানে এসে পড়বেন।
দময়ন্তী বললেন, মা, আমি আপনার কাছে থাকব কিন্তু কারও উচ্ছিষ্ট খাব না, বা পা ধুইয়ে দেব না। পতির অন্বেষণের জন্যে আমি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দেখা করব, কিন্তু অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলব না। যদি কোনও পুরুষ আমাকে প্রার্থনা করে তবে আপনি তাকে প্রাণদণ্ড দেবেন। রাজমাতা সানন্দে সব মেনে নিলেন এবং কন্যা সুনন্দাকে বললেন, এই দেবরূপিণী সৈরিন্ধ্রী তোমার সমবয়স্কা, ইনি তোমার সখী হবেন। সুনন্দা সানন্দে দময়ন্তীকে নিজের আবাসে নিয়ে গেলেন।
মহারাজ পরীক্ষিৎ, আপনি অবশ্যই জানতে ইচ্ছা করবেন, রাজা নলের কী হল? কোথায় কোন অরণ্যে তিনি হারিয়ে গেলেন। দময়ন্তীর মতো তিনিও কি নানা দুর্ভোগে পড়লেন! কলি তো তাই চায়। মানুষের সুখ, শান্তি, ধর্ম-কর্ম, শুভবুদ্ধি সব উচ্ছন্নে যাক। সদ্ভাব নয় বিবাদ। উচ্ছৃঙ্খল জীবন, বিশৃঙ্খলা, বিধ্বস্ত পরিবার, তিক্ততা। কোথাও কোনও ভাল যেন না থাকে। স্বর্গ নয়, নরকই কাম্য। রাজদম্পতিকে উলঙ্গ করেছি, বনবাসী। মহারাজ, তবে কলিকালের দাওয়াই হল বিষ দিয়ে বিষ তোলা। বিষের ওষুধ বিষ। এইবার শুনুন সেই কাহিনি।
রাজা নলকে সিংহাসন থেকে উৎপাটিত করে কলিমহাশয় অরণ্যের ব্যবস্থা করলেন। অরণ্যচারী প্রাণীরা মানুষের বন্ধু হতে পারে না, সে তো জানা কথা। নলের জন্যে আর একটি বিপর্যয়ও কলি তৈরি করে রেখেছিল— দাবানল। দময়ন্তীকে ত্যাগ করে নল গহন বনে গিয়ে দেখলেন দাবানল জ্বলছে, আর কেউ তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকছে— পুণ্যশ্লোক নল শীঘ্র আসুন। নল অগ্নিবলয়ের কাছে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, এক কুণ্ডলীকৃত নাগরাজ করুণ কণ্ঠে বলছেন, রাজন! আমি কর্কোটক নাগ, মহর্ষি নারদকে প্রতারণা করায় তিনি আমাকে শাপ দিয়েছিলেন, অরণ্যের এই স্থানে স্থাবরের মতো পড়ে থাকো, যতদিন না রাজা নল এসে তোমাকে উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যান। আপনিই আমাকে শাপমুক্ত করবেন। সেই থেকে আমি আপনাকে ডেকে চলেছি। আপনি আমাকে রক্ষা করুন, আমিও সখা হয়ে আপনাকে সৎ পরামর্শ দেব। এই বলে নাগেন্দ্র কর্কোটক অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ হলেন। নল তখন নাগরাজকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চললেন।
যেতে যেতে কর্কোটক বললেন, মহারাজ, আপনি গুনে গুনে পা ফেলুন, এক, দুই, তিন এইভাবে। নল দশম পদক্ষেপ করামাত্রই কর্কোটক রাজাকে দংশন করলেন। আর তখনই নলের রূপ বিকৃত হয়ে গেল। কর্কোটক সঙ্গে সঙ্গে নিজরূপ ধারণ করে বললেন, লোকে আপনাকে যাতে চিনতে না পারে, তাই আপনার প্রকৃত রূপ বদলে দিলাম। কলি আপনার ভেতর প্রবেশ করে, আপনাকে অধিকার করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করছে। মহাদুঃখের ভাগী করেছে আপনাকে, এইতেই তার আনন্দ। এইবার আমার বিষে তার কী অবস্থা হয়— আপনি দেখবেন। এইবার আপনাকে যা করতে হবে শুনুন— আপনি অযোধ্যায় গমন করুন। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা ঋতুপর্ণের কাছে গিয়ে বলুন, আমি এক সারথি, আমার নাম বাহুক। রাজা ঋতুপর্ণ তখন আপনার কাছ থেকে ‘অশ্বহৃদয়’ শিক্ষা করে আপনাকে ‘অক্ষহৃদয়’ দান করবেন। ঋতুপর্ণ আপনার সখা হবেন। যে দ্যূতক্রীড়ায় আপনি পরাজিত হয়েছেন, সেই ক্রীড়ায় আপনি এতটাই পারদর্শী হবেন যে আপনার সমকক্ষ কেউ থাকবে না। আপনি আপনার পত্নী, পুত্র-কন্যা ও রাজ্য ফিরে পাবেন। এইবার, যখন পূর্বরূপ ধারণের ইচ্ছা হবে তখন আমাকে স্মরণ করে এই বসন পরিধান করবেন। এই বলে কর্কোটক নলকে দিব্য বস্ত্রযুগল প্রদান করে অদৃশ্য হলেন।
নল দশদিন পরে অযোধ্যায় এসে পৌঁছলেন। দশ যেন রহস্যময় একটি সংখ্যা। মানব মনের দশটি দশা, মানব জীবনের দশটি দশা, সাধকের সাধনজীবনের দশটি দশা, গ্রহের দশটি দশা। আশ্চর্য এই দশ সংখ্যাটি! নল রাজদরবারে রাজা ঋতুপর্ণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিজের পরিচয় দিলেন, আমার নাম বাহুক। অশ্বচালনায় আমার মতো নিপুণ পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। আপনার বিপদে-আপদে মন্ত্রণা দেবার ক্ষমতা আমার আছে। তা ছাড়া রন্ধনবিদ্যাও আমি বিশেষরূপে জানি। সর্বরকমের শিল্পে আমি পারদর্শী, সমস্ত রকমের দুরূহ কাজ আমি সম্পন্ন করতে পারি অক্লেশে। ঋতুপর্ণ বললেন, বাহুক তোমাকে আমার প্রয়োজন, তুমি আমার কাছে থাকো। দশ সহস্র মুদ্রা বেতনে তুমি অশ্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে। বার্ষ্ণেয় ও জীবল তোমার সেবা করবে। এই বার্ষ্ণেয় পূর্বে নলেরই সারথি ছিল। নলের রূপান্তরিত আকৃতি দেখে চেনার উপায় নেই। জীবল ঋতুপর্ণের পূর্ব সারথি।
পরিকল্পনা মতো কাজ এগোচ্ছে। কী কাজ? প্রথমে কলি নামক কীটটিকে ধ্বংস করতে হবে, তারপর স্ত্রী, পুত্র, কন্যার সঙ্গে মিলন, তারপর রাজ্য উদ্ধার। এসব দুর্ঘটনা ঘটল কেন? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ মহিমায় জগতে উপস্থিত। তিনি সব দেখছেন। বিবদমান দুই রাজপরিবার ক্রমশ চরম সংঘাতের দিকে এগোচ্ছেন। কালচক্র কারও নিয়ন্ত্রণে নেই— এইটিই সত্য। আর একটি সত্য— কর্ম এবং কর্মফল। জগৎখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান বিচরণ করছেন— যেন মহাকালের দূত। দেখছেন, আর মৃদু মৃদু হাসছেন। কেন হাসবেন না! তিনি যখন মানুষ, তখন তিনি ভুবন-ভ্রমণ করছেন যেন সাধারণ এক গোপবালক, কত লীলা তাঁর, মুহূর্তে যখন রূপান্তরিত হচ্ছেন অনাদি অনন্ত ব্রহ্মস্বরূপ ভগবানে তখন তিনি প্রবেশ করছেন গীতায়। তিনটি গুণের খেলা চলেছে মানুষের জগতে। আর তারই ফল হাতে হাতে। আমি কেন বলব, তুমি কী করবে! তোমার বুদ্ধি খাটাও। কাকে বলছেন? অর্জুনকে। সাত্ত্বিক পুণ্যকর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ, তামসিক কর্মের ফল অজ্ঞান বা মূঢ়তা। শোনো অর্জুন,
সত্ত্বাৎ সঞ্জায়তে জ্ঞানং রজসো লোভ এব চ।
প্রমাদমোহৌ তমসো ভবতোঽ জ্ঞানমেব চ।।
সত্ত্বগুণ হতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; রজোগুণ হতে লোভ আর তমোগুণ হতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ। কেউ যদি স্বখাত সলিলে ডুবে মরেন ভগবান কী করবেন! নলরাজার সেই অবস্থা। খানিক নাকানিচোবানি খেয়ে কূলে উঠবেন। একটু একটু করে সময় ফিরছে। ছিলেন দেবতার মতো সুন্দর, হয়েছেন কুশ্রীদর্শন এক পুরুষ। কিন্তু গুণী। সেই জোরেই ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে সসম্মানে বাস করতে লাগলেন। আর দময়ন্তীকে স্মরণ করে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা একটি শ্লোক সোচ্চারে বলতেন—
ক্বণুসা ক্ষুৎপিপাসার্তা শ্রান্তা শে তে তপস্বিনী।
স্মরন্তি তস্য মন্দস্য কং বা সাঽদ্যোপতিষ্ঠতি।।
ক্ষুধা পিপাসায় কাতর তুমি, তুমি শ্রান্ত দুঃখিনী, তুমি আজ কোথায় শুয়ে আছ? এই হতভাগ্যকে স্মরণ করে আজ কার আশ্রয়ে বাস করছ!
সান্ধ্যকালীন এই বিলাপ প্রতিদিন শুনতে শুনতে জীবল একদিন প্রশ্ন করে ফেলল, বাহুক! সে কোন নারী, যার জন্যে তুমি রোজ এইভাবে শোক প্রকাশ করো। নল বললেন, তা হলে শোনো জীবল— সে এক মন্দবুদ্ধি পুরুষ, তার অনিন্দ্যসুন্দরী এক স্ত্রী ছিল, দু’জনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। দু’জনে যেন এক অভিন্ন, অবিচ্ছেদ্য আত্মা। কিন্তু জীবল, মানুষের মতিভ্রম! সেই ভ্রষ্টবুদ্ধি পুরুষ, কোনও কারণে সেই প্রাণের প্রাণকে পরিত্যাগ করে কোথায় অদৃশ্য হয়েছে। এই শোকগাথা সেই বিচ্ছিন্ন মানুষটির মর্মবেদনা। রোজ রাতে সেই হতভাগ্য পুরুষটি তার বেদনা এই শ্লোকটির ভাষায় প্রকাশ করে। এর অক্ষর বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে গাঁথা বর্ণহীন, গন্ধহীন একটি মালিকা। সে কোথাও আছে, বড় কষ্টে আছে। আর সেই নারী, সেও আছে কোথাও দুঃখের শয়ানে। জীবল! সেই নারী কিন্তু দুর্গম অরণ্যেও সেই পুরুষের অনুগমন করেছিল। সেই মন্দভাগ্য পুরুষ কর্তৃক পরিত্যক্তা, একাকিনী বালিকা, পথের অনভিজ্ঞা, আবার এই ভয়ংকর দুঃখভোগের অযোগ্যা সেই নারী এখনও যদি জীবন ধারণ করে থাকে, তা হলে দুষ্কর কাজই করছে। তুমি কী বলো জীবল?
ক্ষুৎ-পিপাসা পরীতাঙ্গী দুষ্করং যদি জীবতি।
শ্বাপদাচরিতে নিত্যং বনে মহতি দারুণে।
ত্যক্তা তেনাল্পভাগ্যেন মন্দপ্রজ্ঞেন মারিষ।
জীবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটি কে? এ তো সাধারণ কোনও সারথি নয়, যতই অশ্ববিশেষজ্ঞ হোক! এ কি তার নিজের জীবনের কোনও অভিজ্ঞতা! মানুষটা কি কবি! কোনও কুশ্রীদর্শন প্রেমিক!
মহারাজ পরীক্ষিৎ! এইসব ঘটনা কিন্তু ঘটছে আপনার জীবনদাতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বলয়ে। আপনার প্রপিতামহ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কালে। তিনিও অক্ষক্রীড়ায় সর্বস্ব হারাতে বাধ্য হবেন। শকুনির পাশা, দুর্যোধনের অট্টহাসি, দ্রৌপদীদের ভাগ্য! সব আসবে, একে একে আসবে, তারপর আপনি আসবেন।
চলুন মহারাজ, এইবার দেখা যাক দময়ন্তী কী করছেন। কলির নজর এই সুন্দরীর দিকে পড়েছিল। দাঁতে দাঁত চেপে দ্বাপরকে বলেছিল, ভোগ করব ভোগ— আমার ভোগ অন্যের দুর্ভোগ। আমার হাসি অন্যের কান্না, আমার সুখ অন্যের দুঃখ, আর অন্যের অধর্ম আমার ধর্ম। শ্রীকৃষ্ণের ক্ষমতা কী আমাকে আটকাবেন? লোহাতে মরচে ধরবে, অরণ্য দাবানলে পুড়বে, হরিণ হবে বাঘের শিকার, জলে কুমির, আকাশে শকুন, মেঘে বজ্র, নদীতে প্লাবন, মরুভূমির তৃষ্ণা। দশটি দশা, দুর্দশা, কলির শেষ দশা। কে কাকে রক্ষা করবে! উদ্বেগ, প্রলাপ, উন্মাদ ব্যাধি, জড়তা, মরণ— আমি কলিরাজ, এই সব আমার অনুচর। মহারাজ! এসবই আপনি বুঝবেন ক্রমে ক্রমে। প্রস্থান আর মহাপ্রস্থান— একই ব্যাপার। দুটোই না-থাকা।
বিদর্ভরাজ ভীম কন্যা দময়ন্তী ও জামাতা নলের খোঁজে অনেক ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন। প্রচুর পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সুদেব নামে এক ব্রাহ্মণ চেদি রাজ্যে এসে রাজভবনে যজ্ঞ করবার সময় দময়ন্তীকে হঠাৎ দেখতে পেলেন। সুদেব দময়ন্তীকে নিজের পরিচয় দিলেন। দময়ন্তীর পিতা-মাতা ও পুত্রকন্যার কুশল জানালেন। সুদেব দময়ন্তীর ভ্রাতার প্রিয় সখা। তাঁকে দেখে দময়ন্তী কাঁদছেন। খবর পেয়ে রাজমাতা তখনই সেখানে এলেন। সুদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্রাহ্মণ! ইনি কার স্ত্রী, কার কন্যা? আত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন কেন? আপনিই বা এঁকে জানলেন কী করে? সুদেব তখন নল-দময়ন্তীর সমস্ত বৃত্তান্ত রাজমাতাকে বললেন। দেবি এঁর খোঁজে আমরা সর্বত্র ভ্রমণ করেছি, অবশেষে আপনার প্রাসাদে এঁর দর্শন পেলাম। এঁর অতুলনীয় রূপ ও দুই ভ্রুর মধ্যস্থানে পদ্মাকৃতি যে জটুল রয়েছে তা দেখেই ধূমাবৃত অগ্নির ন্যায় এঁকে আমি চিনেছি।
সুনন্দা তখন এগিয়ে এলেন— সত্যই তো ললাটের মধ্যস্থানে অপূর্ব একটি ব্যাপার রয়েছে। জায়গাটি পরিষ্কার করামাত্রই সেই জটুল মেঘমুক্ত চন্দ্রের ন্যায় প্রকাশিত হল। সেইটি দেখে সুনন্দা ও রাজমাতা দময়ন্তীকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন! রাজমাতা আবেগজড়িত গলায় বললেন, তুমি আমার ভগিনীর কন্যা। ওই জটুল দেখে তোমাকে আমি চিনেছি। দশার্নরাজ সুদামা তোমার মাতার ও আমার পিতা। তোমার জন্মকালে দশার্নদেশে পিতার গৃহে তোমাকে আমি দেখেছিলাম। দময়ন্তী আমার এই গৃহ তোমার পিতার গৃহেরই সমান।
এতদিন পরে দময়ন্তীর মুখে হাসি ফুটল। মাতৃষ্বসাকে প্রণাম করে বললেন, আমি অপরিচিত হয়েও আপনার কাছে এতকাল সুখে বাস করেছি, এখন আরও সুখে থাকতে পারব, কিন্তু মাতা দীর্ঘদিন আমার পুত্রকন্যাদের দেখিনি, বড় দুঃখ, তাই আজ্ঞা দিন, আমি বিদর্ভে যাব।
মহাভারতকার লিখছেন, রাজমাতা তাঁর পুত্রের অনুমতি নিয়ে বিশাল সৈন্যদল সহ দময়ন্তীকে মনুষ্যবাহিত যানে বিদর্ভরাজ্যে পাঠিয়ে দিলেন। রাজা ভীম আনন্দিত হয়ে সহস্র গো, গ্রাম ও ধন দান করে সুদেবকে সন্তুষ্ট করলেন। দময়ন্তী তাঁর জননীকে বললেন, যদি আমার জীবন রক্ষা করতে চান তবে আমার পতিকে আনাবার চেষ্টা করুন। রাজার আজ্ঞায় ব্রাহ্মণগণ চতুর্দিকে যাত্রা করলেন। দময়ন্তী তাঁদের বলে দিলেন, আপনারা সকলে জনসংসদে, সকল রাষ্ট্রে এই কথা বারবার বলবেন, ‘দ্যূত করে বস্ত্রার্ধ ছিন্ন করে নিদ্রিতা প্রিয়াকে অরণ্যে ফেলে কোথায় গেছ? সে এখনও অর্ধবস্ত্রে আবৃত হয়ে তোমার জন্য রোদন করছে। রাজা, দয়া করো, প্রতিবাক্য বলো।’ আপনারা এইরকম বললে কোনও লোক যদি উত্তর দেন তবে ফিরে এসে আমাকে জানাবেন, কিন্তু কেউ যেন আপনাদের চিনতে না পারে।
দীর্ঘকাল অতিবাহিত হল। কোনও দিক থেকেই কোনও খবর এল না। অবশেষে পর্ণাদ নামে এক ব্রাহ্মণ ফিরে এসে বললেন, আমি ঋতুপর্ণ রাজার সভায় গিয়ে আপনি যা বলতে বলেছিলেন, তাই বলেছিলুম, কিন্তু সভাসদদের দিক থেকে কোনও উত্তর এল না। তখন আমি এক রাজভৃত্যের কাছে গেলুম। তার নাম বাহুক, রাজার সারথি, কুরূপ, খর্ববাহু, দ্রুত রথ চালনায় নিপুণ, সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করতেও জানে। এই বাহুক বহুবার নিশ্বাস ফেলে ও রোদন করে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলে তারপর বললে, সতী কুলস্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পক্ষী যার বসন হরণ করেছিল, সেই মোহগ্রস্ত বিপদাপন্ন ক্ষুধার্ত পতি পরিত্যাগ করে চলে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না। এই খবর শুনে দয়মন্তী তাঁর জননীকে বললেন, আপনি পিতাকে কিছু জানাবেন না। এখন সুদেব, আপনি অবিলম্বে অযোধ্যায় গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণকে বলে নলকে আনার চেষ্টা করুন।
দময়ন্তী পর্ণাদকে উপযুক্ত পারিতোষিক দিয়ে বললেন, বিপ্র নল ফিরে এলে আমি আপনাকে আরও ধনদান করব। পর্ণাদ কৃতার্থ হয়ে চলে গেলেন। দময়ন্তী তখন সুদেবকে বললেন, বিলম্ব না করে অযোধ্যায় গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণকে বলুন, ভীম রাজার কন্যা দময়ন্তীর আবার স্বয়ংবর হবে। আগামীকাল প্রভাতে তিনি দ্বিতীয় পতি বরণ করবেন, কারণ রাজা নল জীবিত আছেন কি না জানা যাচ্ছে না। অনেক রাজা ও রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন, আপনিও যান।
তারপর! সুদেবের কাছে এই বার্তা পেয়ে ঋতুপর্ণ বাহুকরূপী নলকে বললেন, বাহুক! আমি একদিনের মধ্যে বিদর্ভরাজ্যে দময়ন্তীর স্বয়ংবরে যেতে চাই। রাজার ইচ্ছা জেনে বাহুক থমকে গেলেন। দময়ন্তী দ্বিতীয়বার স্বয়ংবর হচ্ছেন! এমন কথা কি সত্য হতে পারে! নাকি অন্য উদ্দেশ্য! আমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্যেই এই ছল, এই উদ্ভাবন! কিন্তু, এ-কথা তো অস্বীকার করা যায় না, অত্যন্ত হীনমতী, অপরাধী আমি, আমি এক প্রতারক। এইবার কি তার প্রতিশোধ নেবার পালা? না, তা কখনও হতে পারে না। তিনি প্রতিশোধপরায়ণ, সামান্য কোনও রমণী নন, তা ছাড়া তাঁর সন্তান রয়েছে, তিনি জননী!
নল ঋতুপর্ণকে বললেন, পারব, একদিন অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টা! রথ চালনায় আমার সে-দক্ষতা আছে। আমি রথ প্রস্তুত করছি। নল অশ্বশালায় গিয়ে কয়েকটি সিন্ধুদেশজাত কৃশকায় অশ্ব বেছে নিলেন। তা দেখে রাজা ঋতুপর্ণ একটু রুষ্ট হয়ে বললেন, বাহুক, এই ক্ষীণজীবী অশ্বদের নিচ্ছ কেন, তুমি কি আমাকে প্রতারিত করতে চাও! নল বললেন, মহারাজ, এই অশ্বগুলির ললাট মস্তকপার্শ্ব ইত্যাদি স্থানে দশটি রোমাবর্ত আছে, দ্রুতগমনে এরাই শ্রেষ্ঠ। তবে আপনি যদি অন্য অশ্ব শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তাই নেব। ঋতুপর্ণ শান্ত স্বরে বললেন, তুমি অশ্বতত্ত্বজ্ঞ, যে অশ্ব ভাল মনে করো তাই নাও। তখন নল নিজের নির্বাচিত চারটি অশ্ব রথে যুক্ত করলেন।
ঝড়ের গতিতে রথ ছুটছে। নলের পাশে বসে আছেন সহকারী বার্ষ্ণেয়। বার্ষ্ণেয় রথ চালনা দেখে ভাবছেন; এই সারথি কে? ইনি কি ইন্দ্রের সারথি মাতলি, নাকি স্বয়ং নলরাজা? নলের বয়সি হলেও, এঁর সেই রূপ কোথায়! বাহুকের রথ চালনা দেখে ঋতুপর্ণ ভীষণ খুশি। হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় তাঁর উত্তরীয়টি উড়ে গেল। রাজা বললেন, রথ থামাও, বার্ষ্ণেয় আমার উত্তরীয় নিয়ে আসুক। নল বললেন, আমরা এক যোজন [প্রায় আট মাইল] ছাড়িয়ে এসেছি, এখন উত্তরীয় পাওয়া অসম্ভব। এই কথা শুনে ঋতুপর্ণ বিরক্ত হলেন, বললেন, বাহুক সকলে সব কিছু জানে না, জানা সম্ভবও নয়। তুমি ওই বহেড়া গাছের কাছে রথ রাখো, আমার গণনার শক্তি তোমাকে দেখাই। এই গাছ থেকে মাটিতে যে পাতাগুলি পড়ে আছে তার সংখ্যা হল একশো এক, ফলের সংখ্যাও তাই। এই গাছের শাখায় পাঁচ কোটি পাতা আর দু’হাজার পঁচানব্বইটি ফল আছে। তুমি গুনে দেখতে পারো। রথ থামিয়ে নল বললেন, মহারাজ, আপনি গর্ব করছেন, আমি এই গাছটি কেটে ফেলে এর সব পাতা ও ফল গণনা করব। রাজা বললেন, এখন দেরি করবার সময় নয়। নল বললেন, আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আর যদি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন তবে সামনের পথ ভাল আছে, বার্ষ্ণেয় আপনাকে নিয়ে যাক। ঋতুপর্ণ তখন অনুনয় করে বললেন, তোমার মতো সারথি পৃথিবীতে দুটি নেই, আমি তোমার শরণাপন্ন, গমনে বিঘ্ন কোরো না। যদি আজ সূর্যাস্তের আগে বিদর্ভ দেশে যেতে পারো তবে তুমি যা চাইবে তাই দেব।
নল বললেন, আমি পত্র আর ফল গণনা করে তবেই বিদর্ভে যাব।
রাজা অনিচ্ছায় বললেন, আমি শাখার এক অংশের পত্র ও ফলের সংখ্যা বলেছি। তাই গণনা করে সন্তুষ্ট হও।
নল শাখা কেটে গণনা করে বিস্মিত হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শক্তি অতি অদ্ভুত, আমাকে এই বিদ্যা শিখিয়ে দিন, তার পরিবর্তে আপনি আমার বিদ্যা অশ্বহৃদয় নিন।
ঋতুপর্ণ অশ্বহৃদয় শিখে নলকে অক্ষহৃদয় দান করলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কলি কর্কোটক— বিষ বমন করতে করতে নলের দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অন্যের চোখে অদৃশ্য হয়ে জোড় হাতে ক্রুদ্ধ নলকে বললেন, নৃপতি, আমাকে অভিশাপ দিয়ো না। আমি তোমাকে অভূতপূর্ব কীর্তি দান করব। যে লোক তোমার নাম কীর্তন করবে তার কলিভয় থাকবে না। এই বলে কলি সেই বহেড়া বৃক্ষে প্রবেশ করলেন। এইভাবে কলির প্রভাব থেকে মুক্ত নলরাজার সন্তাপ দূর হলেও চেহারার বিকৃতি থেকেই গেল।
মহারাজ পরীক্ষিৎ এই পর্যন্ত শুনলেন— নলরাজা কলিমুক্ত হলেন, কিন্তু এখনও তিনি তাঁর হৃতভাগ্য ফিরে পাননি। কলিও কিন্তু বহালতবিয়তে থেকে গেলেন একটি বৃক্ষের আশ্রয়ে। আপনিও কলির মুখোমুখি হবেন, প্রশ্ন করবেন, তাঁর সঙ্গে রফা করবেন। কিন্তু তাঁকে নির্মূল করবেন না। জানি, সে ক্ষমতা আপনার নেই। আপনার মহান পূর্বপুরুষদের নেই। এমনকী স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরও নেই। অপেক্ষা করুন, সময়ের ব্যবধানে এই ভয়ংকর কলি আপনাকেও ছাড়বে না। আপনারও মতিভ্রম হবে। আর একটি তক্ষকের দংশনে হরিদ্বারের গঙ্গার তীরে প্রাণত্যাগ করবেন। না, না, এসব কথা এখন নয়। সময়ের পথে। সময়ের দেনাপাওনা মেটাতে মেটাতে যুগ থেকে যুগান্তরে অবনত মস্তকে পরাজিত নায়কের মতো— বিদায় পৃথিবী। আপনার মহান পূর্বপুরুষদের দেখুন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীতসন্ত্রস্ত, চিরবসন পরিহিত ম্লান, উদাস চলেছেন যমলোকে। সঙ্গী একটি সারমেয়। পেছনের পার্বত্য পথে পড়ে আছেন অন্যান্য পাণ্ডবগণ। হায় কুরুক্ষেত্র! হায়! রাজসিংহাসনের অহংকার। না, পুরনো কথা পুরনো পেটিকাতেই থাক। নল-দময়ন্তীর অবশিষ্ট কাহিনিটি আপনাকে শোনাই। বুঝতে পারবেন এই জগৎ রঙ্গমঞ্চে মানুষ নয়, দেবতা নয়, কাল কীভাবে খেলা করছে!
বিদর্ভ রাজ্যে তখন সন্ধ্যা নামছে। ঋতুপর্ণের রথ কুণ্ডিন নগরে প্রবেশ করল। সারা নগর রথচক্রের মেঘগর্জনে কম্পিত। দময়ন্তী বিস্মিত। তিনি অনুমান করলেন, নিশ্চয় মহীপতি নল নগরে প্রবেশ করেছেন। আমি যদি তাঁর দর্শন না পাই, আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। দময়ন্তী উন্মাদের মতো প্রাসাদের ছাদে উঠে ঋতুপর্ণ, বার্ষ্ণেয় ও বাহুককে দেখতে পেলেন।
ঋতুপর্ণ অবাক— কোথাও কোনও স্বয়ংবরের আয়োজন নেই। কেন! বিদর্ভরাজ ভীম। তিনিও তো কিছুই জানেন না। সবই দময়ন্তীর কৌশল। রাজা ভীম ঋতুপর্ণকে সসম্মানে সংবর্ধনা করে তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। হতবাক ঋতুপর্ণ দেখলেন কোথাও কোনও রাজা ও রাজপুত্র আসেননি। তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর রথের সামনে। অপ্রস্তুত। তিনি বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনাকে অভিবাদন করতে এসেছি। অত্যন্ত বিস্মিত রাজা ভীম মনে মনে ভাবছেন, শত যোজনের অধিক পথ অতিক্রম করে কেবল অভিবাদনের জন্য আসার কারণ কী!
রাজভৃত্যরা ছুটে এলেন। ঋতুপর্ণকে নিয়ে গেলেন তাঁর জন্য নির্দিষ্ট গৃহে। বার্ষ্ণেয় তাঁর সঙ্গে গেলেন। বাহুকরূপী নল রথশালায় রথ রেখে অশ্বদের যথাবিধি পরিচর্যা করে রথেই বসে রইলেন। দময়ন্তী নলকে না দেখে খুবই দুঃখ পেলেন। তিনি কেশিনী নামে এক দূতীকে বললেন, তুমি জেনে এসো তো হ্রস্ববাহু বিরূপ রথচালকটি কে?
দময়ন্তীর আদেশে কেশিনী নলের কাছে গিয়ে কুশল প্রশ্ন করে বললে, দময়ন্তী জানতে চান আপনারা অযোধ্যা থেকে কেন এখানে এসেছেন? আপনি কে, আপনাদের সঙ্গে যে তৃতীয় ব্যক্তিটি এসেছে, সেই বা কে? নল বললেন, দময়ন্তীর দ্বিতীয়বার স্বয়ংবর হবে শুনে রাজা ঋতুপর্ণ এখানে এসেছেন। আমি অশ্ববিদ্যায় বিশারদ। সেজন্য রাজা আমাকে সারথি করেছেন, আমি তাঁর আহারও প্রস্তুত করি। তৃতীয় ব্যক্তিটির নাম বার্ষ্ণেয়, আগে সে নলের সারথি ছিল, নল রাজ্য ত্যাগ করার পর থেকে সে রাজা ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে আছে। কেশিনী তখন বললে, বাহুক, নল কোথায় আছেন বার্ষ্ণেয় কি তা জানেন?
নল বললেন, সে বা অন্য কেউ নলের সংবাদ জানে না। তাঁর রূপ নষ্ট হয়েছে। তিনি আত্মগোপন করে বিচরণ করছেন। কেশিনী বললে, যে ব্রাহ্মণ অযোধ্যায় গিয়েছিলেন তাঁর কথার উত্তরে আপনি যা বলেছিলেন দময়ন্তী আবার তা আপনার কাছে শুনতে চান। নলের চোখে জল এল। গলা ধরে গেছে, তিনি আগের মতোই বললেন, সতী কুলস্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পক্ষী যার বস্ত্রহরণ করেছিল সেই মোহগ্রস্ত, বিপদাপন্ন, ক্ষুধার্ত পতি পরিত্যাগ করে চলে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না।
কেশিনীর কাছে সমস্ত শুনে দময়ন্তী অনুমান করলেন, বাহুকই নল। তিনি কেশিনীকে বললেন, তুমি আবার বাহুকের কাছে গিয়ে তাঁর আচরণ ও কার্যের কৌশল লক্ষ করো।
মহারাজ পরীক্ষিৎ, এইবার শুনুন, দময়ন্তীর কী অসাধারণ বুদ্ধি, কী অদ্ভুত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা! সাধে তিনি অদ্বিতীয়া রমণী! আপনাদের এই ভারত কাহিনিতে তাঁর দ্বিতীয় কে আছেন? দ্রৌপদী নাকি! সে বিচার পরে করা যাবে। এখন শুনুন, দময়ন্তী কেশিনীকে কী আদেশ করছেন— কেশিনী তুমি আবার বাহুকের কাছে যাও, তাঁর আচরণ ও তাঁর কার্যের কৌশল লক্ষ করো। তিনি চাইলেও তাঁকে জল দিয়ো না। কেশিনী বাহুকের কাছে ফিরে এসে বললে, আপনি এখন কী করবেন? আমার কোনও সাহায্যের প্রয়োজন আছে? নল কিছু বললেন না। কেশিনী একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। ফিরে এলেন দময়ন্তীর কাছে। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করলেন, বলো কী দেখে এলে। কেশিনী বললেন, এমন শুদ্ধাচার মানুষ আমি কখনও দেখিনি। অনুচ্চ দ্বারে প্রবেশকালে নত হন না। দ্বারই তাঁর জন্য উঁচু হয়ে যায়। ঋতুপর্ণের আহারের জন্য আমাদের রাজা বিবিধ পশুমাংস পাঠিয়েছেন। মাংস ধোয়ার জন্য কলসও সেখানে আছে। বাহুকের দৃষ্টিপাতে কলস জলপূর্ণ হয়ে গেল। মাংস ধুয়ে উনোনে চড়িয়ে বাহুক এক মুষ্টি তৃণ সূর্যকিরণে ধরলেন, তখনই তৃণ প্রজ্বলিত হল। তিনি অগ্নি স্পর্শ করলে দগ্ধ হন না, পুষ্পমর্দন করলে তা বিকৃত হয় না, বরং আরও সুগন্ধী ও বিকশিত হয়। দময়ন্তী বললেন, কেশিনী, তুমি আবার যাও, তাঁকে না জানিয়ে তাঁর রাঁধা মাংস কিছু নিয়ে এসো। কেশিনী মাংস আনলে দময়ন্তী তা চেখে বুঝলেন নলই তা রেঁধেছেন। তখন দময়ন্তী তাঁর পুত্র-কন্যাকে কেশিনীর সঙ্গে বাহুকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নল পুত্র ইন্দ্রসেন ও কন্যা ইন্দ্রসেনাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন, তারপর কেশিনীকে বললেন, এই বালক-বালিকা আমার পুত্র-কন্যার সদৃশ। সেইজন্য আমি কাঁদছি। ভদ্রে, আমরা অন্য দেশের অতিথি, তুমি বারবার এলে লোকে দোষ দেবে, অতএব তুমি যাও।
দময়ন্তী তাঁর মাতাকে বললেন, আমি বহু পরীক্ষায় বুঝেছি যে বাহুকই নল, কেবল তাঁর রূপের জন্য আমার সংশয় আছে। এখন আমি নিজেই তাঁকে দেখতে চাই, আপনি পিতাকে জানিয়ে বা না জানিয়ে আমাকে অনুমতি দিন। পিতা-মাতার সম্মতিক্রমে দময়ন্তী নলকে তাঁর গৃহে আনালেন। কষায়বসনা জটাধারিণী মলিনাঙ্গী দময়ন্তী সরোদনে বললেন, বাহুক। নিদ্রিত পত্নীকে বনে পরিত্যাগ করে চলে গেছেন এমন কোনও ধর্মজ্ঞ পুরুষকে জানো কি? পুণ্যশ্লোক নল ভিন্ন আর কে সন্তানবতী পতিব্রতা ভার্যাকে বিনা দোষে ত্যাগ করতে পারে? নল বললেন, কল্যাণী, যার জন্য আমার রাজ্য নষ্ট হয়েছে সেই ‘কলির’ প্রভাবেই আমি তোমাকে ত্যাগ করেছিলাম। তোমার অভিশাপে দগ্ধ হয়ে কলি আমার দেহে বাস করছিল। এখন আমিই তাকে জয় করেছি। সেই পাপ দূর হয়েছে। কিন্তু তুমি দ্বিতীয় পতি বরণে প্রবৃত্ত হয়েছ কেন? দময়ন্তী কৃতাঞ্জলি হয়ে কম্পিত দেহে বললেন, নিষধরাজ, আমার দোষ দিতে পারো না, দেবগণকে বর্জন করে আমি তোমাকেই বরণ করেছিলাম। তোমার খোঁজে আমি সর্বত্র লোক পাঠিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণ পর্ণাদের মুখে তোমার বাক্য শুনেই তোমাকে আনাবার জন্য আমি স্বয়ংবর রূপ উপায় অবলম্বন করেছি। যদি আমি পাপ করে থাকি তবে বায়ু, সূর্য, চন্দ্র আমার প্রাণ হরণ করুন।
অন্তরিক্ষ থেকে বায়ু বললেন, নল, এর কোনও পাপ নেই, আমরা তিন বৎসর এর সাক্ষী ও রক্ষী হয়ে আছি। তুমি ভিন্ন কেউ একদিনে শতযোজন পথ অতিক্রম করতে পারে না, তোমাকে আনাবার জন্যই দময়ন্তী অসাধারণ উপায় স্থির করেছিলেন। আকাশ থেকে তখন পুষ্পবৃষ্টি হল। বাজতে লাগল দেবদুন্দুভি। নাগরাজ কর্কোটকের বস্ত্র পরিধান করে নল তাঁর পূর্বরূপ ফিরে পেলেন। দময়ন্তী তাঁকে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। অর্ধসঞ্জাত শস্য, ভূমি, জল পেয়ে যেমন হয় সেইরূপ দময়ন্তী ভর্তাকে পেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন।
মহারাজ পরীক্ষিৎ, মহামতী ব্যাসদেবের লেখনীমুখ হতে যে শ্লোক নির্গত হয়েছিল, তা আপনাকে শোনাতে ইচ্ছা করি—
দময়ন্ত্যপি ভর্ত্তারমাসাদ্যাপ্যায়িতা ভূশম্।
অর্দ্ধসঞ্জাতশস্যেব তোয়ং প্রাপ্য বসুন্ধরা।।
মহারাজ পরীক্ষিৎ কী বুঝলেন! দ্বাপরের শক্তি বেশি না কলির শক্তি বেশি। সুকার্যের সঙ্গে কুকার্যের যে দ্বন্দ্ব তা যেন ভীম ও দুর্যোধনের দীর্ঘ গদাযুদ্ধ। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ হলেও তিনি সবার আগে স্বর্গে পৌঁছলেন। বিচার, সুবিচার, নির্বিচার— এই যে সব শব্দের খেলা এর কি কোনও তাৎপর্য আছে! নদী যেমন চলতে চলতে গ্রহণ ও বর্জন করতে করতে বিরাট এক লবণহৃদয়ে প্রবেশ করে, ঠিক একই ব্যাপার, সময়ের এক হাতে ধর্ম আর এক হাতে অধর্ম— যেন দুটি গোলক, দুটিই সুবর্ণময়— জাদুকরের ভেল্কিবাজি— এ হাতে ও হাতে লোফালুফি করতে করতে, সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।
এইবার নলের রাজ্য-উদ্ধারের কথা বলি। সেটি না বললে কাহিনি তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই কাহিনি প্রথম শুনেছিলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, অতঃপর শুনছেন আপনি। একটি উক্তি এই কলিতে বারে বারে শোনা যায়— সাধু সাবধান! কিন্তু রাজাদের সেইকালে এটিকেই রূপান্তরিত করে বলা যেতে পারে— রাজা সাবধান।
অপূর্ব মিলনের এই রাত দূর অতীতে চলে গেল। যেন বাহুকের রথ যে দুর্জয় গতিতে এদিকে এসেছিল ঠিক সেই গতিতেই চলতে লাগল অতীতে। ভোর হল দোর খোলো, নলরাজা সুসজ্জিত হয়ে সুসজ্জিতা স্ত্রী দময়ন্তীর সঙ্গে শ্বশুর ভীমরাজার কাছে গিয়ে অভিবাদন জানালেন। ভীম মহানন্দে নলকে পুত্রের মতো গ্রহণ করলেন। উৎসব তো হবেই, রাজধানী ধ্বজ, পতাকা ও পুষ্পে অলংকৃত করা হল। চতুর্দিকে নগরবাসীদের হর্ষধ্বনি। রাজা ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে নলকে বললেন, নিষাধপতি, ভাগ্যক্রমে আপনি পত্নীর সঙ্গে আবার মিলিত হলেন। আমার গৃহে আপনার অজ্ঞাতবাস কালে যদি আমি কোনও অপরাধ করে থাকি নিজ গুণে তা ক্ষমা করুন। নল বললেন, মহারাজ, আপনি কিছুমাত্র অপরাধ করেননি। আপনি পূর্বে আমার সখা ও আত্মীয় ছিলেন এখন আরও প্রীতিভাজন হলেন। এইবার কিছু আদান-প্রদান— রাজা ঋতুপর্ণ নলের কাছ থেকে অশ্বহৃদয় শিক্ষা করলেন। বিনিময়ে অক্ষহৃদয় দান করে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন।
এক মাস পরে নল সসৈন্যে নিজের রাজ্যে প্রবেশ করে পুষ্করকে বললেন, আমি বহু ধন উপার্জন করেছি। এসো আর একবার দ্যূতক্রীড়ায় বসি। আমার সমস্ত ধন ও দময়ন্তীকে পণ রাখছি, তুমি রাজ্য পণ রাখো। যদি তুমি এই ক্রীড়ায় অসম্মত হও তা হলে এসো দ্বৈরথ যুদ্ধ করি। পুষ্কর হাসতে হাসতে বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনি আবার এসেছেন। আমি আপনার ধন জয় করে নেব, সুন্দরী দময়ন্তী আমার সেবা করবেন। সেই মুহূর্তে নলের ইচ্ছা হল খড়্গাঘাতে পুষ্করের শিরশ্ছেদ করেন। কিন্তু ক্রোধ সংবরণ করে বললেন— বাক্যব্যয়ে লাভ কী, আগে জয়ী হও তারপর তো বাকি কথা।
এরপরেই নল পুষ্করের সর্বস্ব জয় করলেন। নল বললেন, মূর্খ, তুমি বৈদর্ভীকে পেলে না, নিজেই সপরিবারে তাঁর দাস হলে। শোনো, আমার পূর্বের পরাজয় কলির প্রভাবে হয়েছিল, তোমার তাতে কৃতিত্ব ছিল না। সেই কারণেই পরের দোষ তোমাতে অর্পণ করব না, তুমি আমার ভ্রাতা, আমার রাজ্যের এক অংশ তোমাকে দিলাম। তোমার প্রতি আমার স্নেহ কখনও নষ্ট হবে না, তুমি শত বৎসর জীবিত থাকো। এই কথা বলে নল ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করলেন। পুষ্কর তখন ভ্রাতা নলকে অভিবাদন করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার কীর্তি অক্ষয় হোক, আপনি আমাকে প্রাণ ও রাজ্য দান করলেন। আপনি অযুত বৎসর জীবিত থাকুন। ঠিক একমাস পরে পুষ্কর আনন্দিত চিত্তে নিজের রাজধানীতে চলে গেলেন। অমাত্যগণ, নগরবাসী— সকলে আনন্দে ভক্তিভরে নলকে বললেন, মহারাজ, আমরা পরম সুখ লাভ করেছি। দেবগণ যেমন দেবরাজের পুজো করেন আমরাও আপনাকে সেইভাবেই পূজা করার অধিকার লাভ করে ধন্য।
এই উপাখ্যানটি বৃহদশ্ব যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন। বলেছিলেন, এই কাহিনি আর রাজর্ষি ঋতুপর্ণের ইতিহাস শুনলে কলির ভয় দূর হয়। মহারাজ পরীক্ষিৎ, এতবার কলির নামটি উচ্চারণ করা হল, সে কি সময়! তার কোনও আকার-আকৃতি আছে? আপনি তো তাকে দেখেছেন। তাকে শাসনও করেছেন। আবার জানতে চেয়েছেন তুমি কে? সেই উপাখ্যানটি আপনার একটু শোনা দরকার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোলোকে গমন করলেন। আর বিরাট একটা কাল, যার স্থায়িত্ব হবে চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর। সেই কাল একটি রূপ পরিগ্রহ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করলেন। তাকে তো অবজ্ঞা, অস্বীকার করা চলবে না। কবে কল্কি অবতার আসবেন ও সত্যযুগ ফিরিয়ে আনবেন সে তো চার লক্ষ বছর পরের কথা। সৃষ্টিকর্তা পিতামহ ব্রহ্ম প্রলয়ের শেষে নিজের পৃষ্ঠদেশে এই কলিকে সৃষ্টি করলেন। অসিতবরণ অর্থাৎ কালো এবং বীভৎসদর্শন এই পুরুষ— যাকে বলা হবে অধর্ম। তা হলে কী দাঁড়াল! ব্রহ্মার সম্মুখভাগে ধর্ম, পশ্চাদভাগে অধর্ম। সামনেও অনন্তকাল, পশ্চাতেও অনন্তকাল। সামনে ধর্মের পথরেখা আর পশ্চাতে অধর্মের ঘোর তমনিশা। অধর্মের প্রিয়তমা যে রমণী তাঁর চোখ দুটি বেড়ালের মতো। আর তাঁর নাম হল মিথ্যা। তা হলে দেখুন, একটি দম্পতি পুরুষ অধর্ম, তাঁর সহধর্মিণী হলেন মিথ্যা। তিনি মার্জার নয়নী। ভীতিপ্রদ অবশ্যই। তাঁদের একটি সন্তান হল, তার নাম হল দম্ভ। মহারাজ, নামগুলি লক্ষ করুন। প্রতিটি মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি। তাঁদের একটি কন্যাও হল, তার নাম মায়া। ব্যাপারটা আপনার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হবে। পুরুষ আর রমণীর মিলনে কোনও রীতিনীতি রইল না। বিস্তীর্ণ ব্যভিচার। দম্ভ আর মায়া— এদের মিলনে জন্ম নিল লোভ। একটি কন্যাও হল, তার নাম শঠতা। মিলনে তো কোনও বাধা নেই। শঠতা আর লোভের মিলনে পরবর্তীকালে যার জন্ম হল তার নাম হিংসা। চারণকবি কী লিখছেন শুনুন—
ক্রোধ হিংসা সহযোগে জন্মিল কুমার
এ জগতে প্রচারিত ‘কলি’ নাম তার।
এই কলি, সেই পুরুষটি কেমন? বলতে দ্বিধা হলেও বলছি— বাম হাত দিয়ে ধরে থাকে নিজের লিঙ্গ, কালো কুচকুচে গাত্রবর্ণ। কাকের মতো পেট। লোল জিহ্বা, অতি কুৎসিত আকার, গায়ে দুর্গন্ধ, দ্যূতক্রীড়া, সুরাপান, গণিকা আর স্বর্ণব্যবসায়ীর সঙ্গেই তার বাস। এই চরিত্রটির কোনও বাছবিচার তো নেই। নিজের ভগ্নী দুরুক্তির গর্ভে একটি পুত্র জন্মাল তার নাম ভয়। আর একটি কন্যা জন্মাল, তার নাম মৃত্যু। পরিবারের যেমন ধারা— ভয়ের ঔরসে মৃত্যুর গর্ভে জন্মাল পুত্র নরক। আর কন্যা যাতনা। আবার মিলন। নরক আর যাতনার গর্ভে জন্মাল অসংখ্য সন্তান। চারণকবি সুর করে গাইছেন—
আধিব্যাধি, জরা গ্লানি দুঃখ শোক ও ভয়।
কলির সন্তানগণ সবের আশ্রয়।।
দাম্ভিক ও কামুকের স্বভাব শুনুন। পিতামাতাদের প্রতি হিংসুক। কেবল খাবার চিন্তা, সঙ্গমে মন, পরস্ত্রী আসক্ত, জারজ সন্তান সৃষ্টি করে, গুরু নিন্দাকারী, সাধুগণে বঞ্চনাকারী, জাতি-ধর্ম সব বিলুপ্ত হবে, সৎ কর্ম বলে কিছু থাকবে না, যজ্ঞ-হোম-বেদ অধ্যয়ন ইত্যাদি কর্ম সব বন্ধ হয়ে যাবে। ধর্ম বলে কোথাও কিছু থাকবে না।
মহারাজ, শাস্ত্র লিখছেন—
দম্ভাচার দুরাচারাস্তাত মাতৃ-বিহিংসকাঃ।
বেদহীনা দ্বিজা দীনাঃ শূদ্রসেবাপরাঃ সদা।।
কুতর্কবাদ বহুলা ধর্মবিক্রয়িনোহধমাঃ।
বেদবিক্রয়িনো ব্রাত্যা রসবিক্রয়িনস্তথা।।
মাংসবিক্রয়িনঃ ক্ররাঃ শিশ্নোদর পরায়ণাঃ।
পরদাররতা মত্তা বর্ণসংকরকারকাঃ।।
হ্রস্বাকারাঃ পাপাচারাঃ শঠ মঠনিবাসিনঃ।
ষোড়শাব্দায়ুষঃ শ্যাল বান্ধবা নীচসঙ্গমাঃ।।’
কলির আজ্ঞায় এইসব দুরাচার ও দুরাচারী সারা পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য ঘুরে বেড়াবে। বাইরে তাদের দেখা না গেলেও মানুষের ভেতরে, স্বভাবে-চরিত্রে, রক্তবীজে অসংখ্য কীটের মতো, ছোট ছোট লাল পিঁপড়ের মতো অস্তিত্ব নামক পিষ্টক খণ্ডটিকে ফোঁপরা করে দেবে। মহারাজ একটু ইংরেজি বলি,— লক্ষণগুলি হল— Incest, Fratricide, Licentious, Polygamy। সবই যেন বিক্রয়যোগ্য পণ্য। কুতর্ক করিতে এরা সদা ভালবাসে।/বেদ-ধর্ম-রস বিক্রি করে অনায়াসে/মাংস বিক্রি করিতেও কুণ্ঠা বোধ নাই/প্রমত্ত স্বভাব আর নিষ্ঠুর সদাই/খাইবার চিন্তা সদা সঙ্গমেতে মন/জারজ সন্তান তারা করে উৎপাদন। মহারাজ, সত্যযুগে মানুষের চেহারা ছিল দীর্ঘকায়, গাত্রবর্ণ ছিল উজ্জ্বল, মুখমণ্ডলে ভাসত দেবভাব, আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘ কেশ, তীক্ষ্ণ নাসিকা। কলিতে কী হবে শুনুন— খর্ব দেহ, পাপাচারী, পরস্ত্রী আসক্ত, স্বল্পায়ু, দেবস্থানে যাবার মতি নাই, যেখানে শঠতা, অনাচার, ব্যভিচার সেখানেই যত মানুষের ভিড়। আর একটি সত্য, অতি সত্য— শ্যালকই একমাত্র বন্ধু। ঘরে ঘরে বিবাদ, অনবরত কলহ, মতান্তর, বাক্যে না কুলোলে বলপ্রয়োগ। ‘কলিকালে কেশ-বেশ অলংকার প্রিয়।/ ধনী কুলীন হবে জানিবে নিশ্চয়।।/ সুদলোভে টাকা খাটাইয়া দ্বিজগণ।/ অতি পূজনীয় হবে সর্বজন।।/ কলির সন্ন্যাসীগণ গৃহাসক্ত হয়।/ গৃহীরা বিবেকহীন হবে অতিশয়।।/ মানব সকলগুরু নিন্দাকারী এবে।/ সাধুগণে সর্বজন বঞ্চনা করিবে।।’ কলির এইসবই লক্ষণ। সকলেই ব্যস্ত অপরের দান নিতে। দাতার সংখ্যা কমবে গ্রহীতার সংখ্যা বাড়বে। সুযোগ পেলেই পরের ধন হরণ করবে। বিবাহের কোনও নিয়ম থাকবে না। যখন একজনের অনিষ্ট করার ক্ষমতা কমে তখনই সে ক্ষমাশীল হয়। যে মানুষ অসমর্থ তাকে আবার সবাই এড়িয়ে চলবে, দেখলে বিরক্ত হবে। পাণ্ডিত্য হবে বাচালতা। আর ধর্মকর্ম হবে পুরোটাই লোকদেখানো। কলিকালে যে ধনবান হয় সবাই তাকেই সাধু বলে সম্মান করবে। এরপরে নানারকমের ছোটখাটো বঞ্চনা তো থাকবেই। চারণকবি বড় সুন্দর লিখছেন—
দূর হতে জল আনি ‘তীর্থজল’ কবে।
তাহাই বিশ্বাস সবে নিশ্চয় করিবে।।
যাহার গলায় পইতা করিবে দর্শন।
তাহাকেই বিপ্র মধ্যে করিবে গণন।।
কলিকালে যেই জন দণ্ডধারী হবে।
সকলে তাহাকে পরিব্রাজক কহিবে।।
বসুমতী স্বল্পশস্যা হইবে তখন।
তীরগত হইবে সকল নদীগণ।।
বেশ্যা সম্ভাষণে যত কুলবধূগণ।
সুখলাভ করিবে অবশ্য তখন।।
আপন পতির প্রতি তাহাদের মন।
কভু না আসক্ত হবে শুনো সর্বজন।।
মহারাজ, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ অপরের অন্ন মহাসুখেই গ্রহণ করবেন। চণ্ডাল যদি যাজক হন তা হলে মানুষের কোনও আপত্তি হবে না। বিধবা না হলেও নারীরা নিজের মতেই স্বাধীনভাবে চলবেন। মেঘ হলেই বৃষ্টি হবে এমন কোনও কথা নেই। খরায় ভূমি ফুটিফাটা হবে। রাজারা প্রজাদের রক্ষা করার বদলে প্রজাগণে নাশ করিবেক রাজগণ। করভার প্রপীড়িত হবে সর্বজন। কলির প্রথম পাদে সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিন্দা করবেন। কলির দ্বিতীয় পাদে কৃষ্ণনাম কেউই উচ্চারণ করবেন না। তৃতীয় পাদে বর্ণসংকরের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে যাবে। আর চতুর্থ পাদে সব হয়ে যাবে এক বর্ণ। জাতি-ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। আর ঈশ্বর— তিনি কে! কোনওরূপ সৎ কর্ম হবে না তখন। কলিতে বিনষ্ট হবে যতসব ধর্ম।
মহারাজ, শুষ্ক, বিবর্ণ একটি সময়ের নাম কলি। সমস্ত বস্তু তার আদিরূপ হারাবে। সবই হয়ে যাবে বর্ণসংকর, জন্মসংকর। বিস্বাদই হবে স্বাদ। বিরূপই হবে রূপ। নগ্নতাই হবে শালীনতা। অবিদ্যাই হবে বিদ্যা। অসভ্যতাই হবে সভ্যতা। উন্মত্ততাই হবে উৎসব। অকারণই হবে কারণ। অভাবই হবে স্বভাব। লুণ্ঠনই হবে দান। প্রতিদানই হবে আগ্রাসন। দলনীতিই হবে রাজনীতি। এইসবই কলির সুনিপুণ কারিগরি। অন্তঃসারশূন্য একটি সময় প্রবাহের মতো মানুষের জীবনকে তছনছ করে চলতেই থাকবে। মানুষ ক্রমশই অসংবেদনশীল, অননুভবী প্রাণীতে পরিণত হবে। মারলে মার খাবে, মরলে মরে যাবে। জন্ম আর মৃত্যুর তফাতটাই ভুলে যাবে। বোধশূন্য একটি সময়ের নাম কলি। এবং তারই চেহারা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, কুৎসিত, দুর্গন্ধী, লোভের জিহ্বা সামনে ঝুলছে লকলক করে। যেন পুরুষ কালী।
মহারাজ, যে পথে পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে গেলেন সেইসব পুণ্যতীর্থ, যা তাঁদের স্পর্শপূত সেইসব স্থান ভ্রমণের জায়গা হবে। সাধন-ভজন নয় মানুষ যাবে বেড়াতে। পর্বতশীর্ষে ফেলে রেখে আসবে যত বর্জ্যপদার্থ। সাধকের গুহাগুলি ভ্রমণবিলাসীদের বিশ্রামের স্থান হবে। মদ এবং মাংস নির্বিচারে গৃহীত হবে। ব্যাবসা— এই হবে এক শ্রেণির মানুষের আদি এবং অন্তকথা। প্রকৃত যাঁরা সাধক, যাঁরা নির্জনতায় বসে ঈশ্বরের সান্নিধ্য খুঁজতেন তাঁদের আর দেখা যাবে না। সব যেন হয়ে যাবে ছায়াছবি। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে! অবতার আবার আসবেন এই কলিতে। তখন তাঁর নাম হবে কল্কি অবতার। সে এখন অনেক পরের কথা। আপনার সঙ্গে কলির মুখোমুখি দেখা হওয়ার পর আপনি তার সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিলেন কোন যুক্তিতে!
তোমার এত অভিযোগ, আমার সম্পর্কে কী ধারণা তা আমি জানি না। কিন্তু যেহেতু আমি রাজা, শুধু রাজা নয় মহান এক ঐতিহাসিক বংশের উত্তরাধিকারী, যাঁরা ভারতের ইতিহাসে অনেক পদচিহ্ন রেখে গেছেন, যুদ্ধ আর যুদ্ধজয় আমার লক্ষ্য নয়। প্রজাপালনের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত। দেখো, তুমি কে আমি জানি না। হতে পারে তুমি একটি উপলক্ষ, কালের সঙ্গে কালান্তরের সংলাপ, একটা কথা জেনে রাখো, রাজার কর্তব্য প্রজাপালন। ওই যে কুৎসিত লোকটি। যে নিরীহ একটি বৃষকে নির্যাতন করছিল, সম্ভবত আমাকে উত্তেজিত করার জন্য। আমি তার পাতা ফাঁদে পা দিইনি। রাজা হিসেবে আমি জানতে চেয়েছিলাম তুমি কে? আমার সুশাসিত রাজ্যে প্রবেশ করে এই অন্যায় কাজ কেন করছ? যে কাজ অকারণ, তখন সেই মানুষটি তার পরিচয় দিয়ে আমাকে বলেছিল, আমাকে হত্যা করবেন না। নলের শরীর থেকে কলি বেরিয়ে এসে এই একই প্রার্থনা করেছিল। রাজা নল তাকে ক্ষমা করেছিলেন। আমিও ঠিক তাই করেছি। বরং একটু বেশিই করেছি, বলেছি, তুমি আমার রাজ্যের ত্রিসীমানায় থাকবে না। তুমি তোমার এলাকায় চলে যাও। সেই এলাকাটি তো তুমি জানো! ধর্মহীন, অন্ধকার এক এলাকা, যেখানে ঋষিরা বেদপাঠ করেন না। গৃহে গৃহে পূজার মন্ত্র উচ্চারিত হয় না। শাঁখ বাজে না। যেখানে মানুষে মানুষে কোনও সম্প্রীতি নেই। শুধু কাম। নীচ নারীসঙ্গ, ব্যভিচার, অত্যাচার, জুয়া, ধনলুণ্ঠন, নির্বিচার হত্যা, প্রাণীবধ, নারী নির্যাতন, শিশুদের পরিচর্যা করা হয় না, পথের পাশে পরিত্যক্ত হয়, ভ্রূণ হত্যা। শোনো ভাই; পাপের ফর্দ বিশাল। ধর্মের এলাকা খুবই সংক্ষিপ্ত। সেখানে মানুষের একটিই প্রয়াস— বহির্লোক থেকে অন্তর্লোকে কোন সাধনায় পৌঁছতে পারি। বিষয় তৃষ্ণার নিবারণ। দৃষ্টির স্বচ্ছতা। চিন্তার উদারতা। অতলে বসে থাকলেও আমার মন যেন শিখরগামী হয়। যেখানে দেবাদিদেব বসে আছেন ত্রিশূল আর ডমরু হাতে, যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মিশে গেছেন নীলিমার নীলিমায়। সেই কুৎসিত মানুষটি আমার কাছে একটু স্থান চেয়েছিল। যেখানে সমস্ত পাপ একত্রিত হয়ে আছে। আমি বলেছিলুম, যাও চলে যাও, কাম আর কাঞ্চনে। ওই একটি সংযোগে পাপের সমুদ্র তৈরি হয়। বলো, আমি কিছু ভুল করেছিলাম। ব্রহ্মার যদি পৃষ্ঠদেশ থাকতে পারে তা হলে কালেরও অকাল আছে। সকালের বিপরীতে আছে সন্ধ্যা। সূর্য যখন দিবসের আলো হরণ করেন তখন নিশাচরেরা মুক্তি পায়। বন্ধু, এই সৃষ্টি তো আমার নয়। আমি তো এসেছি। আমাকেও তো যেতে হবে। পথের তো শেষ নেই। তুমি বোঝো না কেন, আমরা সবাই একটা আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। শুরু আর শেষ— খুবই পাশাপাশি। দুটি পা ফাঁক করে দাঁড়ালেই সেই পাটাতনটি তুমি পেয়ে যাবে। যার নাম সময়। একে অনন্ত বলতে পারো, আবার শান্তও বলতে পারো। আছে বলতে পারো, আবার নেইও বলতে পারো। তুমি আছ, তোমার সময় আছে। তুমি যখন নেই তখন কেউ না কেউ আছে। সে তো অনেক কথা। বেদ, বেদান্ত, পুরাণে লেখা আছে। বলা আছে ‘দৃষ্টি সৃষ্টি’। তুমি দেখছ তাই আছে, তুমি না দেখলে নেই। এই জগৎ তোমারও নয় আমারও নয়। আয়নাতে সবাই মুখ দেখে। আয়না কি আয়নাকে দেখে? আমি রাজা পরীক্ষিৎ। তুমি আমাকে সম্মান করতেও পারো, নাও পারো।
মহারাজ, আপনাকে অসম্মান করার ঔদ্ধত্য আমার নেই। এ শুধু যুগান্তরের প্রশ্ন। আপনি কলিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু সে যাবার আগে আপনার ভেতরে একটা ছায়া প্রবেশ করে দিয়েছিল। ছোট্ট একটা দাগ। সামান্য একটা কলঙ্ক। সে যেভাবে নলরাজার শরীরে প্রবেশ করেছিল অনেকটা সেইরকম।
কেন, একথা বলছ কেন?
আপনি মহানন্দে মৃগয়ায় গেলেন। ব্যাসদেব সেকথা লিখেছেন। একদা রাজা পরীক্ষিৎ মৃগয়ার উদ্দেশ্যে অরণ্যে গমন করে মৃগের পশ্চাতে ধাবিত হয়ে একসময় অত্যন্ত পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে জলাশয় দেখতে না পেয়ে এক আশ্রমে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি এক শান্ত, ধ্যাননিমীলিত নেত্র মুনিকে দেখতে পেলেন। সেই মুনি ইন্দ্রিয়, মন, প্রাণ, বুদ্ধি সংযত করে জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি— এই অবস্থাত্রয় অতিক্রম করে সর্বোচ্চ ব্রহ্মভূত অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এবং তাঁর মস্তক ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জটাজালে সমাচ্ছন্ন ছিল ও তিনি রৌরবাজিনে সর্বাঙ্গ আবৃত করে অবস্থান করছিলেন। এমন সময়ে পিপাসায় শুষ্কতালু পরীক্ষিৎ তাঁর নিকটে পানীয় জল প্রার্থনা করেন।
পরীক্ষিৎ ঋষির নিকট উপবেশন করার আসন, পাদ্যার্ঘ, এমনকী সম্ভাষণাদি দ্বারাও আপ্যায়িত না হওয়ায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ক্রুদ্ধ হলেন।
মনে পড়ে মহারাজ, সেই ঘটনাটিও আপনি দেখছেন। সেই ঋষি ধ্যানলোকে এতটাই মগ্ন যে বহির্জগৎ সম্পর্কে তাঁর কোনও বোধ নেই। তিনি সমাহিত। আপনি কিঞ্চিৎ উদ্ধত। আপনার ভেতরে একটি নিরেট অহংকার মাথা তুলে আছে। যেমন সাপ তুলে থাকে ফণা। যথোচিত আপ্যায়ন না পেয়ে আপনি সেই ঋষির আচরণে রেগে গেলেন। আপনি বিনীত না হয়ে দুর্বিনীত হলেন। কেন হলেন? মহারাজ, কলির প্রভাব। পূর্বেই আপনি বলেছিলেন, কলি যে-কোনও মুহূর্তে শুদ্ধ, সুন্দর মানুষকে আক্রমণ করতে পারে, বিচলিত করতে পারে। সুস্থবুদ্ধি হরণ করতে পারে। নিমেষে একটা অন্ধকার তৈরি করতে পারে। যা সুস্থ চেতনাকে গ্রাস করবে। সেই মুহূর্তে আপনার তাই হল।
ব্যাসদেব লিখছেন, ঋষির কাছে আপ্যায়িত না হওয়ায় রাজা পরীক্ষিৎ ক্ষুধা-পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হলেন এবং সহসা তিনি ঋষির প্রতি অভূতপূর্ব বিদ্বেষ ও ক্রোধ অনুভব করলেন।
মহারাজ, কলির খেলা! আপনি বিভ্রান্ত।
ব্যাসদেব লিখছেন, তখন রাজা অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে আশ্রম থেকে চলে যেতে যেতে ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে মৃত একটি সর্প ধ্যানমগ্ন ব্রহ্মর্ষির স্কন্ধে স্থাপন করে নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করলেন।
এরপর আপনি ফিরে গেলেন রাজধানীতে। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, সত্য সত্যই মুনি কি সকল বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রতিনিবৃত্ত করে নিমীলিতনেত্রে সমাধিমগ্ন? অথবা আশ্রমে রাজার আগমনে কী এমন হবে এইরূপ অবজ্ঞাভরে কপট সমাধিতে মগ্ন হয়ে রয়েছেন?
দেখুন মহারাজ, আপনার মতো একজন মহান ব্যক্তির কী অদ্ভুত সন্দেহ। আপনি সেই মুনিকে ভাবছেন ভণ্ড! ভাবছেন ইচ্ছে করে আপনাকে অপমান করার জন্য এমন একটি কপটাচার করছেন! এও কি কলির প্রভাব নয়?
ঘটনাটি ঘটছে শমীক মুনির আশ্রমে। তাঁর অতি তেজযুক্ত বালকপুত্র শৃঙ্গী তার বালক বন্ধুগণের সঙ্গে বিচরণ করতে করতে শুনতে পেল রাজা পরীক্ষিৎ তাঁর পিতাকে লাঞ্ছিত করেছেন। একথা শুনেই সে বন্ধুদের বললে… কী বললে শুনবেন?
অহো অধর্মঃ পালানাং পীব্লাং বলিভুজামিব।
স্বামিন্যঘং যদ্দাসানাং দ্বারপাণাং শুনামিব।।
একটি বালক আপনাকে বলছে, ধনপুষ্ট, গর্বিত রাজাদের কী ঘোর অন্যায় তাঁরা দাস হয়ে প্রভু ব্রাহ্মণের প্রতি বলিভুক বায়সের মতো কিংবা দ্বারস্থিত সারমেয়র মতো অধর্ম আচরণ করছেন! অর্থাৎ উচ্ছিষ্টভোজী কাকের মতো অথবা গৃহদ্বারে স্থিত কুকুরের মতো। অতি লজ্জার কথা মহারাজ। একটি বালকের চোখে আপনার পরিমাপ।
বালক আরও বলছে, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের প্রভু। সেই কারণে তার থেকে হীন ক্ষত্রিয়কে সে গৃহরক্ষার জন্য দ্বারপ্রান্তে স্থান দিয়েছে। দ্বারে অবস্থিত হয়ে সেই ক্ষত্রিয় কীভাবে গৃহস্থিত পাত্রে খাদ্যবস্তু গ্রহণ করতে পারে! উন্মার্গগামীদের শাসনকর্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বধামে প্রত্যাবর্তন করেছেন। এখন আমি ব্রাহ্মণের মর্যাদা লঙ্ঘনকারীকে শাসন করব। তোমরা আমার বলের পরিমাণ দেখো।
বন্ধুদের এই কথা বলে ক্রোধে রক্তবর্ণ চক্ষুযুক্ত ঋষিবালক শৃঙ্গী কৌশিকী নদীর জল স্পর্শ করে রাজার উদ্দেশে বজ্রসদৃশ কঠোর অভিশাপ বাক্য উচ্চারণ করল। বললে, পাপিষ্ঠ পরীক্ষিৎ, আমার পিতার প্রতি ক্রোধপরায়ণ হয়ে মর্যাদা লঙ্ঘন করেছে। সেই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আমার দ্বারা প্রেরিত তক্ষক নামক সর্প সপ্তম দিবসে তাকে দংশন করবে।
রাজাকে অভিশাপ দেবার পর শৃঙ্গী আশ্রমের দিকে এসে গলদেশে মৃত সর্পযুক্ত পিতাকে দর্শন-দুঃখে কাতর হয়ে উচ্চকণ্ঠে ক্রন্দন করতে লাগল। শমীকমুনির ধ্যানভঙ্গ হল। তিনি পুত্র শৃঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছ কেন? কেউ কি তোমার কোনও অনিষ্ট করেছে? ঋষি বালক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বললে, সেই এক রাজা পরীক্ষিৎ আপনাকে এইভাবে হেয় ও তুচ্ছ করে চলে গেছেন। আমি তাঁকে শাপ দিয়েছি। সাতদিনের মধ্যে তক্ষক দংশনে তাঁর মৃত্যু হবে। মুনিবর বললেন, ছি, ছি, ছি! তুমি অপরিণত বুদ্ধি বালক বিষ্ণুতুল্য রাজাকে সাধারণ মানুষ ভাবলে! তুমি জানো না কত বড় অন্যায় তুমি করেছ? রাজার দুর্বিষহ প্রতাপেই প্রজাদের জীবন সুরক্ষিত। নিঃশঙ্কচিত্তে তারা সংসারধর্ম পালন করে। পুত্র এ কী করলে তুমি? রাজার অবর্তমানে পৃথিবীতে দুর্বৃত্তের সংখ্যা বাড়বে। জগতের জীবকুল রক্ষকহীন মেষ দলের মতো অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
শমীক মুনি রাজার মৃত্যু হলে পৃথিবীতে যেসব দুর্যোগ নেমে আসবে পুত্রকে তা শোনালেন। বললেন, সেই পাপের ফলভাগী কিন্তু আমরাও হলাম। দস্যুপ্রায় মানুষ পরস্পরকে হত্যা করবে, অভিশাপ দেবে, অপরের পশু, স্ত্রী ও অর্থ হরণ করবে। ছি, ছি, ছি, তুমি এ কী করলে!
মহারাজ পরীক্ষিৎ, যে ঋষির গলায় মৃত সাপ জড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরই মুখে রাজার অর্থাৎ আপনার কী প্রশংসা! মুনিবর পুত্রকে আপনার মতো রাজার অবর্তমানে কী কী হতে পারে পরপর শোনাচ্ছেন। আপনিও হয়তো জানেন না যে আপনি কোন রাজধর্ম পালন করছেন, তার গুরুত্ব কতটা! আপনার চলে যাওয়া মানেই কলিরাজের জাঁকিয়ে বসা। ঋষি যে শ্লোকটি বলেছিলেন সেটি আপনাকে শোনাই, দেবভাষায় শুনলে গুরুত্ব অনেক বাড়বে, এই আমার ধারণা—
তদার্যধর্মঃ সুবিলীয়তে নৃণাংবর্ণাশ্রমাচার যুত স্ত্রয়ীময়ঃ।
ততোঽর্থকামাভিনিবেশি তাত্মনাং শুনাং কপীনামিব বর্ণসংকরঃ॥
পৃথিবী থেকে বেদবিহিত বর্ণ ধর্ম, আশ্রম ধর্ম ইত্যাদি সমস্ত ভাল অনুষ্ঠান মানবজীবন থেকে উধাও হয়ে যাবে। ক্রমশই তারা অর্থ আর বিষয়ভোগে অত্যন্ত আকৃষ্ট হওয়ায় সকলেই প্রায় কুকুরের মতো হয়ে যাবে। বর্ণসংকর সৃষ্টি করবে। এইসব অধোগামীরা সমাজটাকে করে তুলবে নরকের মতো। মুনি তাঁর পুত্রকে আপনার প্রশংসা করতে গিয়ে বলছেন— পরীক্ষিৎ মহাযশস্বী, পরমভক্ত, অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছেন, ধার্মিক, প্রজাপালক, তিনি রাজর্ষি, তিনি ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে শ্রান্ত কলেবরে আশ্রমে এসে আমাদের নিকট অভিশপ্ত হলেন। পুত্র এটি ন্যায়সংগত হল কি? মুনি প্রার্থনা করছেন, ভগবান, এই অপরিণত বুদ্ধি বালক যে অপরাধ করল সেই অপরাধ আপনি মার্জনা করুন।
ঋষিপ্রবর শমীক তাঁর পুত্রের এই অন্যায় কাজের জন্য অনুতাপে ভেঙে পড়লেন। পরীক্ষিৎ-এর অবমাননা তিনি গণ্যই করলেন না। না জেনে একটি মৃত সাপ যদি গলায় জড়িয়েই দিয়ে থাকে সেটিকে পুষ্পমাল্যই মনে করলেন। এই হল ভারতের ঋষি, তাঁদের সাধনা।
মহারাজ, এই ভারতের সাধন ও সাধক, তাঁদের মহান আদর্শ এই একটি শ্লোকে কীভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে তা শুনে রাখুন—
প্রায়শঃ সাধবো লোকে পরৈর্দ্বন্দেষু যোজিতাঃ।
ন ব্যথন্তি ন হৃষ্যন্তি যত আত্মাঽগুণাশ্রয়ঃ।।
এই সংসারে ভগবদ্ভক্ত সাধুব্যক্তিগণ অপরের দ্বারা সৃষ্ট সুখদুঃখে উৎফুল্ল বা বিষণ্ণ কিছুই হন না। কারণ তাঁরা জানেন আত্মাকে কোনও গুণ আশ্রয় করতে পারে না। কেবল দেহ-মনই গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
শোনো, শোনো, একালের সমালোচক শোনো। আমি রাজা, আমি ঋষি নই। ক্রোধবশে যে কাজ করেছি তার শাস্তি পেতে আমি ভীত নই। আমি অন্যের অপরাধের বিচার করি, আমার অপরাধের বিচারক স্বয়ং ভগবান। আমি অভিমন্যুর পুত্র। অর্জুন আমার পিতামহ। আমি শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সুরক্ষিত। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। দেবস্বরূপ ঋষির অমর্যাদা করেছি। বিপদে তো আমাকে পড়তেই হবে। আর সেই বিপদই হবে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের মতো। শুনেছ নিশ্চয়ই শাস্ত্রের কথা— রাজার পাপে রাজ্যনাশ। সেই কারণেই আমি চাই সমস্ত বিপদ আমার কাছেই আসুক। আর ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। অতএব বুঝতে পারছ, আমি এখন আমার মৃত্যুকে সাজাব। আমি শুনেছি, আমার কাছে বার্তা এসেছে ঋষিপুত্র শৃঙ্গী আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন। আমার হাতে রয়েছে এই পৃথিবীর মাত্র সাতটি দিন, সাতটি রাত। আমি ভীত নই। আমি মনে করি এইটিই আমার মঙ্গলজনক পরিণতি। আমি সাধন করিনি কিন্তু সাতটি দিনের এই সীমারেখা আমার মনে বৈরাগ্যের সিংহদুয়ার খুলে দিয়েছে।
রাজা পরীক্ষিৎ জীবনের একটি নতুন পরিসরে প্রবেশ করলেন। হাতে আছে মাত্র সাতটি দিন। তিনি প্রথমেই উপলব্ধি করলেন স্বর্গ, মর্ত্য— সবই অতি তুচ্ছ। একমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণসেবাই সর্বাপেক্ষা মঙ্গলজনক। ইহলোক আর পরলোকে সমস্ত কামনাবাসনা পরিত্যাগ করে গঙ্গাকূলে আমৃত্যু প্রায়োপবেশনে রত হলেন। পুণ্যসলিলা প্রসিদ্ধা গঙ্গা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদস্পর্শে অতি শোভমানা। তুলসী ও চরণধূলি মিশ্রিত হয়ে আরও অধিক জলধারা বহন করেন। যিনি দেবতা ও মর্ত্যবাসীর দেহমন পবিত্র করেন। কোন মরণোদ্যত ব্যক্তি সেই গঙ্গার সেবা না করে থাকতে পারেন? অমর্ত্যনদী সুরধুনী এই গঙ্গা।
মৃত্যু পর্যন্ত অনশনে অপেক্ষা করাই কর্তব্য। এইরকমই সিদ্ধান্ত করলেন পাণ্ডবেয় পরীক্ষিৎ। শান্তভাবে অনাসক্ত চিত্তে, একান্ত মনে বিষ্ণুপদবিগলিতা গঙ্গাতীরে ভগবান মুকুন্দের শ্রীচরণ ধ্যান করতে লাগলেন। সেই সুরধুনী তীরে পৃথিবীর পবিত্রতা সৃষ্টিকারী মহানুভব ঋষিগণ, যাঁরা তীর্থ আগমন উপলক্ষ করে অসৎ সংসর্গে মলিন তীর্থগুলিকে পুনরায় পবিত্র করেন, তাঁরা একে একে সশিষ্য পরীক্ষিৎ সমীপে উপস্থিত হলেন। মুনিদের মধ্যে ছিলেন অত্রি-বশিষ্ঠ-চ্যবন-শরদ্বান-অরিষ্টনেমি-ভৃগু-অঙ্গিরা-পরাশর-বিশ্বামিত্র-পরশুরাম-উতথ্য-ইন্দ্রপ্রমদ-সুবাহু-মেধাতিথি-দেবল-আর্ষ্টিষেণ-ভরদ্বাজ-গৌতম-পিপ্পলাদ-মৈত্রেয়-ঔর্ব-কবয়-অগস্ত্য-ব্যাসদেব-নারদ প্রমুখ। রাজা পরীক্ষিৎ নতমস্তকে তাঁদের সকলকে বন্দনা করলেন। ঋষি সম্প্রদায় সকলে আসন পরিগ্রহ করলেন। রাজা তাঁদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে প্রণাম করে তাঁর সংকল্পের কথা নিবেদন করলেন। তিনি বললেন, কী পরম সৌভাগ্য আমার! আপনারা সবাই সমবেত হয়ে আমাকে কৃতার্থ করলেন। আমি তীব্র সংসারাসক্ত এবং ঋষির প্রতি অমর্যাদা দেখিয়ে ঘোর পাপকর্ম করেছি। আমার ওপর বর্ষিত হয়েছে ব্রহ্মশাপ। সংসারী মানুষ সাধারণত মৃত্যুভয়ে ভীত হন। কিন্তু সেই মৃত্যুভয়ই আমার বৈরাগ্যের কারণ। মুনিপুত্রের অভিশাপ যেন আশীর্বাদ হয়েছে আমার জীবনে। ব্রাহ্মণগণের চরণে আমার প্রণাম আমি আর একবার নিবেদন করি। আশীর্বাদ করুন জন্মজন্মান্তরেও অনন্ত ভগবানে আমার গভীর অনুরাগ যেন থাকে। অতি ধীর ও ধৈর্যশীল রাজা পরীক্ষিৎ পুত্র জনমেজয়ের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করে পবিত্র গঙ্গার দক্ষিণ কূলে কুশাসনে উত্তরমুখী হয়ে অবস্থান করতে লাগলেন। সমবেত মহর্ষিরা সকলেই রাজার এই প্রায়োপবেশনকে সর্বান্তঃকরণে সাধুবাদ জানিয়ে ভগবদ্লীলা কথা শুরু করলেন। তাঁরা বললেন, পরমধার্মিক রাজা পরীক্ষিৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর নশ্বর কলেবর পরিত্যাগ করে পরমধামে গমন করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সকলেই এই গঙ্গাতীরে প্রতীক্ষা করব।
রাজা পরীক্ষিৎ করজোড়ে এই প্রশ্ন করলেন— আপনাদের নিকট পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে আমার কর্তব্য বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছি— মরণোন্মুখ ব্যক্তির পক্ষে কোনটি বিশুদ্ধ নিষ্কাম কর্ম তা আপনারা বিচার করে বলুন।
মহারাজ, এই প্রশ্নের পরেই একটি ঘটনা ঘটবে, যা ধর্মের জগতে এক বিস্ময়কর উদয় বলে চিহ্নিত হবে। অসাধারণ সুন্দর ষোড়শবর্ষীয় এক অবধূত বালকদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে সেই সভাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। কোনওদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, আত্মারাম, জ্যোতির্ময়, উদাসীন। বেশ বোঝা যায় তিনি যদৃচ্ছা ভ্রমণ করতে করতে এখানে এসে পড়েছেন। সমস্ত ঋষিরা স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন— এ কী আবির্ভাব! তিনি কি স্বর্গের দুয়ার খুলে এলেন? তাঁর চেহারার বর্ণনা, তাঁর রূপের বর্ণনা ব্যাসদেব স্বয়ং বিবৃত করছেন। অতি কোমল হস্তপদাদি— অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট, আয়ত সুন্দর দুটি লোচন, উন্নত নাসা, সমান আকার দুটি কর্ণ, সুন্দর ভ্রু, শঙ্খসদৃশ গ্রীবা, মাংসল কণ্ঠাস্থি, উন্নত ও সুবিস্তৃত বক্ষদেশ, আবর্তযুক্ত নাভি, রমণীয় বলিরেখাঙ্কিত উদর, দিগ্বসন, চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশদাম। আজানুলম্বিত বাহু, শ্যামবর্ণ, সুমধুর মৃদু হাস্যের দ্বারা সর্বদা রমণীকুলের নিকট আকর্ষণীয়। তিনি এলেন। মুনিগণ দেহলক্ষণ দেখে বুঝতে পারলেন— এক মহাপুরুষ। তাঁরা প্রবীণ হলেও উঠে দাঁড়িয়ে এই নবীনকে অভ্যর্থনা জানালেন। কে এই মহামানব? ব্যাসপুত্র শুকদেব!
রাজা পরীক্ষিৎ সহসা আগত শুকদেবকে পাদ্য-অর্ঘ্যাদি দ্বারা নতমস্তকে পূজা করলেন। শুকদেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগত নির্বোধ বালক ও স্ত্রীলোকের দল প্রতিনিবৃত্ত হলে শুকদেব উচ্চাসনে উপবেশন করলেন। ভাগবতকার লিখছেন—
স সংবৃতস্তত্র মহান্মহীয়সাং ব্রহ্মর্ষিরাজর্ষিদেবর্ষিসংঘৈঃ।
ব্যরোচ্চতাপং ভগবান্ ষথেন্দুগ্রহক্ষর্তারানিকরৈঃ পরীতঃ।।
মহত্তম শুকদেব ব্রহ্মর্ষি, রাজর্ষি ও দেবর্ষিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গ্রহনক্ষত্র-তারকাবেষ্টিত চন্দ্রের ন্যায় শোভা পেতে লাগলেন। পরীক্ষিৎ বললেন, ব্রহ্মণ, আপনি কৃপা করে অতিথি রূপে এসে এই স্থানটিকে তীর্থে পরিণত করেছেন। কেবল তাই নয়, নগণ্য আমি এমন মহৎ ব্যক্তির সেবার সুযোগ পেয়েছি, যাঁর স্মরণমাত্রই গৃহ পবিত্র হয়। মহাযোগী শুকদেব আপনার সান্নিধ্যে মানুষের পাপরাশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ভগবানের কৃপা যদি না পেতাম তা হলে কি আপনার মতো অব্যক্তগতি, পূর্ণকাম মহাপুরুষ আমাকে দর্শন দিতেন! হে ব্যাসনন্দন, আপনি যোগীদের গুরু পরমযোগী। এই জগতে সিদ্ধিলাভের জন্য সর্বদা মরণশীল ব্যক্তিদের যথার্থ করণীয় কী— সেই বিষয়ে আপনাকে জিজ্ঞাসা করি। হে ব্রহ্মণ! আপনি সর্বশক্তিমান। গৃহস্থগণের গৃহে গোদোহনকালটুকু মাত্র আপনাকে অবস্থান করতে কখনও দেখা যায় না। তখন শুকদেব রাজার মধুর ভাষণে অত্যন্ত প্রীত হয়ে বলতে শুরু করলেন— এই সেই মুহূর্ত, গঙ্গা যেমন মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ঠিক সেইভাবেই ভাগবত পৃথিবীতে প্রকাশিত হতে শুরু করল। অধ্যায়ে, অধ্যায়ে। এটি যেমন শ্রীমদ্ভাগবতের জন্মকাল বা আবির্ভাবকাল ঠিক সেইরকম এটি আপনার তিরোধান কালেরও ঘণ্টাধ্বনি। একদিন, একদিন— সাতদিন।
বড় মন খারাপ লাগছে মহারাজ। শ্রীকৃষ্ণের সমগ্র জীবনকথা শুনতে শুনতে আপনি ক্রমশ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন আপনার জীবনের অন্তিম মুহূর্তে। প্রদীপের একটি ভাসমান শিখা ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতরলোকে অদৃশ্য হবে। দ্বাপরের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠবে কলির অশ্বক্ষুরধ্বনিতে। মুখর হবে প্রান্তর। পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরের এই ধর্মসভা চিরতরে অদৃশ্য হবে। অক্ষরে অক্ষরে থাকবে স্মৃতি। মহারাজ, আপনার সাতদিনের জীবনরেখায় গাঁথা থাকবে এই চিরস্মরণীয় শ্রীকৃষ্ণকথা।
মহারাজ, আপনাকেই বলি, আর নিজের অশ্রুজল বারে বারে মুছি। আপনার চিরবিদায় বড় বেদনাদায়ক। আপনাকে নয় নিজেকেই বলি সে কাহিনি। শুকদেব শেষ করলেন তাঁর কথা। আর ওদিকে শমীকপুত্র শৃঙ্গী দুর্মদ, বিষধর তক্ষককে আদেশ করলেন— তক্ষক, শুকদেব শেষ করলেন— এইবার তোমার কাজ শুরু করো। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট কোরো না। এখনই পরীক্ষিৎকে দংশন করো। পরীক্ষিৎ-এর মৃত্যু না হলে আমার অভিশাপ ব্যর্থ হবে। এতটুকু ত্রুটি যেন না হয়। যদি হয় তা হলে তোমার মৃত্যুও অনিবার্য। শৃঙ্গীর আদেশ লঙ্ঘন করার সাহস তক্ষকের ছিল না। সে বিনীতভাবে বললে, মুনিবর, আমি এখনই যাচ্ছি। আপনার দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। অপ্রতিরোধ্য আমার দংশন। রাজা পরীক্ষিৎ-এর মৃত্যু অবধারিত।
শৃঙ্গী আপনাকে ক্ষমা করেনি। তক্ষককে আশীর্বাদ করে মুনিপুত্র বললেন, বিষধর তুমি সফল হও। তবু মনে রাখো, যদি ব্যর্থ হও তোমার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তক্ষক তখন অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে অতি সতর্কভাবে পরীক্ষিৎ-এর সভাস্থলের দিকে যাত্রা করল। যত গঙ্গার দিকে এগোচ্ছে ততই শরীরে এসে লাগছে পুণ্যতীর্থের পুণ্যবাতাস। তবু বিষধর সেই একই বিষধর।
একটি দংশনেই যখন মানুষের জীবন শেষ হবে তবু শৃঙ্গী কেন এত উৎকণ্ঠিত! একটু পরেই বোঝা যাবে কেন! পথ তখনও শেষ হয়নি, আরও অনেকটা যেতে হবে। পথরোধ করে দাঁড়ালেন কাশ্যপ নামের এক ব্রাহ্মণ। পেশায় তিনি চিকিৎসক। যে-কোনও বিষ নামানোতে বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ একজন বিষ-চিকিৎসক। ব্রাহ্মণ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তক্ষক যাচ্ছ কোথায়? ক্রুদ্ধ তক্ষক উত্তর দিল, যেখানেই যাই না কেন তাতে তোমার কী? ব্রাহ্মণ মৃদু হেসে বললেন, তোমার দুটো চোখ তোমার মনের কথা প্রকাশ করছে। নিশ্চয়ই নিষ্ঠুর কোনও মতলব আছে! কী ব্যাপার বলো তো? তক্ষক বললে, তোমাকে বলতে যাব কেন? তুমি কে? কাশ্যপ বললেন, বলতে তোমাকে হবেই। আমি তোমার পেছন ছাড়ছি না। নিশ্চয়ই তোমার কোনও কুমতলব আছে! তক্ষক আরও রেগে গিয়ে বললে, তুমি কে হে বাপু! এত স্পর্ধা তোমার? আমার দাঁতের সামান্য স্পর্শে এখনই তোমাকে যমলোকে পাঠাতে পারি। ব্রাহ্মণ হা-হা করে হাসতে হাসতে বললেন— সে ক্ষমতা তোমার নেই। আমি কাশ্যপ, অপ্রতিরোধ্য বিষ-চিকিৎসক। যে-কোনও মারাত্মক বিষ আমার স্পর্শে নির্বিষ হয়। ভাই, এই আমার সামান্য পরিচয়। তক্ষক আরও জোরে হেসে বললে, তাই নাকি! তা হলে আমার ক্ষমতাটা একবার দেখো। এই যে সামনের বৃহৎ সবুজ গাছটি, আমি একে দংশন করছি। দেখি তুমি কী করতে পারো! ব্রাহ্মণ বললেন, এই কথা! তুমি দংশন করো। তক্ষক গাছটিকে দংশন করামাত্রই পুষ্পপত্র সমন্বিত গাছটি নিমেষে শুকিয়ে গেল। ঝরে পড়ল শাখা-প্রশাখা, পত্র এবং পুষ্পাদি। সামনে দাঁড়িয়ে রইল বাজে পোড়া একটি গাছ। বজ্রাহত একটি বৃক্ষ। তক্ষক হাসতে হাসতে বলল, কী দ্বিজবর, কী দেখছ? দেখলে তো আমার ক্ষমতা।
বিষ-চিকিৎসক কাশ্যপ একটু অভিনয় করলেন। যেন ভয় পেয়েছেন, ঘাবড়ে গেছেন, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন বিষদগ্ধ সেই গাছটির দিকে। পরম মমতায় সেই গাছটির গায়ে হাত বোলাতে লাগলেন। অন্তহীন প্রয়াস। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ব্রাহ্মণের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাশের একটি সরোবর থেকে সেই গাছটির গায়ে জল ছিটিয়ে দিলেন। মুহূর্তে সেটি আগের মতোই পত্র-পুষ্পে ভরে উঠে মৃদু বাতাসে এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল— জীবনের খুশিতে। ব্রাহ্মণ একটু হেসে তক্ষককে বললেন, তক্ষক কোনটি ভাল— প্রাণ নেওয়া না প্রাণ দেওয়া?
কাশ্যপের ক্ষমতা দেখে তক্ষকের মুখ শুকিয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারল— এই ব্রাহ্মণকে নিরস্ত করতে না পারলে শৃঙ্গীর হাতে তার মৃত্যু অনিবার্য। ভীত তক্ষক ব্রাহ্মণের পায়ে ধরে বললে, দ্বিজবর আমাকে বাঁচান। শমীকপুত্র ক্রোধী ঋষি শৃঙ্গীর আদেশে মহারাজ পরীক্ষিৎ-এর প্রাণ নিতে যাচ্ছি। ব্যর্থ হলে আমার আর নিস্তার নেই। আপনি আমাকে দয়া করুন। কাশ্যপ পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, পরীক্ষিৎ-এর মতো এক মহান রাজার তুমি প্রাণ হরণ করতে যাচ্ছ! আর আমি সব জেনেও চুপ করে বসে থাকব? এ কি সম্ভব! তক্ষক মহাসংকটে পড়ল। পরীক্ষিৎ-এর প্রাণ হরণ করতে না পারলে শৃঙ্গীর ব্রহ্মশাপে সে নিজেই ভস্ম হয়ে যাবে। করুণ কণ্ঠে তক্ষক বললে, এবং বেশ একটি কায়দার কথাই বললে— চিকিৎসা করে আপনি বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করেন। কিন্তু ব্রহ্মশাপ প্রতিরোধ করার শক্তি বা শিক্ষা কি আপনার আছে? ব্রহ্মশাপ ব্যর্থ হলে তার প্রভাব আপনার ওপর কি পড়বে না! ঋষির রোষবহ্নি থেকে আপনি নিজেকে কি মুক্ত করতে পারবেন? এখন দয়া করে আমার কথা শুনুন। আপনি আর পথ আগলে দাঁড়াবেন না। যত অর্থ চান দেব, শুধু সরে দাঁড়ান।
অর্থলোভ! সে তো বিষের চেয়েও কার্যকরী। যত অর্থ চাইব তাই দেবে? অর্থ উপার্জনের এত সহজ রাস্তা। অর্থের জন্যেই তো সব। তা হলে পরীক্ষিৎকে রক্ষা করে আমার লাভটা কী? ব্রহ্মশাপ তো ব্যর্থ হওয়ার নয়। ব্রাহ্মণ গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, তক্ষক আমি রাজি। তবে আমাকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিতে হবে। নাগলোকের ধনাঢ্য তক্ষক, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তার কাছে কিছুই নয়। সে বললে, আপনি অপেক্ষা করুন ব্রাহ্মণ, আমি এখনই আপনার অর্থের ব্যবস্থা করছি। তক্ষক নিজের শক্তিবলে নিমেষের মধ্যে নাগলোক থেকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা এনে ব্রাহ্মণকে দিল। কাশ্যপ বড় খুশি। বললেন, যাও তক্ষক, তোমার উদ্দেশ্য সফল হোক।
সময় খুব কম। পথে অনেকটা বিলম্ব হয়ে গেছে। শুকদেব তাঁর কথা শেষ করছেন। মহারাজ পরীক্ষিৎ তাঁর আসনে বিমুগ্ধ হয়ে বসে আছেন। মুহূর্তের হিসাব তিনি জানেন। সময় শেষ হয়ে এল, জীবনের সময়। তিনি কর গণনা করছেন। তক্ষকের হঠাৎ মনে হল— ছদ্মবেশে না গেলে ওই ঋষিদের সভায় কেউ প্রবেশ করতেই দেবে না। যাঁরা বসে আছেন তাঁরা বিতাড়িত করবেন। তক্ষক জানে পরীক্ষিৎ-এর কাছে ব্রাহ্মণের অবাধ গতি। সে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করল। পরিধানে সূক্ষ্ম-শুভ্র বস্ত্র, অঙ্গে নামাবলি, কপালে চন্দনের প্রলেপ, শিখায় শুভ্র পুষ্প। পরীক্ষিৎ ভক্তিভরে সেই সুদর্শন ব্রাহ্মণকে প্রণাম করার জন্য অবনত হতে থাকলেন, ক্রমশ, ক্রমশ, তিনি নিচু হয়ে ব্রাহ্মণরূপী তক্ষকের পায়ের দিকে ঝুঁকছেন। আর একটু, আর একটু। তক্ষক প্রস্তুত। এইবার সময়। ঘাড়ে তীব্র একটি দংশন। যতটা বিষ ছিল সবই চলে গেল রাজদেহে। অসহ্য যন্ত্রণায় পরীক্ষিৎ কুঁকড়ে গেলেন। তাঁর ক্লেশ ও যাতনা দেখে সমবেত ঋষিরা হায় হায় করে উঠলেন। সবাই সম্মিলিত উচ্চকণ্ঠে শ্রীহরির নাম করতে লাগলেন। সেই হরিনাম পরীক্ষিৎ-এর যন্ত্রণার ওপর প্রলেপের কাজ করল। তিনিও সকলের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কৃষ্ণনাম জপ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তিনি যন্ত্রণা ভুলে গেলেন। আনন্দ, আনন্দ! মা গঙ্গার পবিত্র শীতল বাতাস, চতুর্দিকে হরিনাম সংকীর্তন— রাজা পরীক্ষিৎ মৃত্যুপথযাত্রী হলেন। না, না, এ তো মৃত্যু নয়, এ তো মহাযাত্রা! কাল থেকে চলে যাচ্ছেন কালাতীত জগতে। যেখানে রয়েছেন তাঁর পূর্বপুরুষরা। রয়েছেন শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী সেই নীলমাধব।
মহারাজ পরীক্ষিৎ-এর প্রয়াণ হল। এইবার কলির পূর্ণ সুযোগ। সর্বত্র শুরু হবে কলিরাজের খেলা। যত কিছু বিরূপতা, লোভ, লালসা, রিরংসার উন্মাদ নৃত্য।
দ্বাপর শেষ হল। মহারাজ পরীক্ষিৎ আসর ছেড়ে চলে গেলেন। কল্পনার চোখে যেন দেখতে পাচ্ছি— তাঁর কুশাসনটি পড়ে আছে উচ্চ একটি বেদিতে। গঙ্গার বাতাসে সেটি ক্রমশ ক্রমশ স্থানচ্যুত হচ্ছে। ঋষিরা ফিরে গেছেন। ফেলে গেছেন কিছু না কিছু স্মৃতিচিহ্ন। একটি যষ্টি, একটি কমণ্ডলু, কিছু পুথি-পত্র, বস্ত্রখণ্ড, শরীরের সুগন্ধ, উচ্চভাবের তরঙ্গ। সেই ঘনীভূত পরিমণ্ডল ক্রমশই তরল হতে হতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ভাবতে তো দোষ নেই। শুকদেব যেমন সদলে এসেছিলেন, নিরাসক্ত, ঠিক তেমনই বালক পরিবৃত হয়ে তিনি হয়তো চলে গেলেন জনকরাজার দেশে। পিতা ব্যাসদেবের দিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি যে এক ছাড়া দুইকে জানেন না। তিনি যে ব্রহ্মকে স্পর্শ করেছিলেন। পাছে মায়ার জগৎ তাঁকে গ্রাস করে তাই মাতৃগর্ভে ষোড়শবর্ষ ছিলেন। শেষে পিতার সানুনয় অনুরোধে ভূমিষ্ঠ হয়েই উদ্দাম গতিতে হাঁটতে শুরু করেছিলেন রাজা পরীক্ষিৎ-এর সভা লক্ষ্য করে।
পরীক্ষিৎ-এর পুত্র জনমেজয়, তিনি তো ছেড়ে কথা বলবেন না। তিনি সর্পকুলকে ধ্বংস করার জন্য সর্পযজ্ঞ করবেন। তক্ষক তোমার এত বড় স্পর্ধা! তোমাদের সর্পবংশ আমি লোপাট করে দেব। একটি সর্পও যেন কোথাও জীবিত না থাকে।
শুকদেব বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে— কার বিদায়? রাজা পরীক্ষিৎ-এর তিরোধান আর শুকদেবের অন্যত্র গমন। যিনি এক জায়গায় এক চুমুক-কাল মাত্র থাকেন তিনি সাতদিন রাজার ধর্মসভায় থেকে বিদায় নিচ্ছেন। ফিরেও তাকাচ্ছেন না। আগত হাজার হাজার বছর ধরে এই স্থানটির তীর্থমাহাত্ম্য বজায় থাকবে। মহারাজ পরীক্ষিৎকে তক্ষকের বিষ-দংশনের জন্য প্রস্তুত করে দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে একবার তাকালেন। ওই আসে ওই অতি হরষে, গোরাবাদ্য বাজিয়ে আসছে ওই কলি। শুনো, নরপতি! কলিকালে হবে সেই পৃথিবীর গতি। কলিকাল বলবান হইবে যখন, সত্য আদি-ধর্ম সব হইবে নিধন। কলিতে হইবে ধন মানবের সার। আর সব গুণ আদি যতেক আচার। সকলি ধনের বশ হইবে নিশ্চয়। আর শুনো পরীক্ষিৎ কহি সমুদয়। কলির সমস্ত লক্ষণ শুকদেব বলতে শুরু করলেন। রাজা পরীক্ষিৎ-এর সেই কথা শুনে কী লাভ! আর কয়েক দণ্ড পরেই তিনি তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। শুকদেব মনে হয় আগত কালকে শোনালেন। সাবধানবাণী।
অজস্র মানুষ থাকবে, অজস্র প্রাণী। এই হাত ধরাধরি তো এই হাত ছাড়াছাড়ি। তারপরেই ছোরাছুরি। এই গঙ্গাজলের আচমন তো পর মুহূর্তে রক্ত তর্পণ। প্রেম, ভালবাসা, গৃহ, গৃহসুখ, পরিবার, পারিবারিক বন্ধন— কিছুই থাকবে না। দুষ্ট প্রজাগণে সব পরিপূর্ণ হবে। যে বলবান, যে ধনবান, যে মানুষকে ধাপ্পা দিতে পারে— সেই হবে সেসময় ধরণীর রাজা। যারাই শাসন করবে, শাসক দল, তাদের মধ্যে এতটুকু প্রেম, ভালবাসা থাকবে না। নির্দয় চিত্ত হবে সর্বক্ষণ। প্রজার ওপরে বহু পীড়ন করিবে। প্রজাসব পলাইবে সব পর্বত কাননে। এদেশের মানুষ ওদেশে, ওদেশের মানুষ এদেশে। আইন তাড়া করে ফিরবে। বল ব্যাটা, তুই কোন দেশের! হায় কবীর! তুমি বারাণসীর গঙ্গার তীরে বসে বললে, এই দুনিয়া আমার নয়, এই দুনিয়া তোমারও নয়, দুনিয়া সবসে বসেরা, সকলের জন্যেই এই পৃথিবী। দস্যুকার্যে সকলেতে উন্মত্ত হইবে। এলোমেলো করে দিয়ে লুটেপুটে খাবে। ফল, পুষ্প, শাক, মূল সব কিছু স্বাদ হারাবে। অনাবৃষ্টি আর মহাবৃষ্টি— দুটোই চলবে। ঘোষিত অঘোষিত দুর্ভিক্ষ। ধর্মের উপদেশ দেবে যতেক ‘পামর’।
শুকদেব আসন ছেড়ে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে রাজা পরীক্ষিৎ ও সমবেত ঋষিদের দিকে তাকিয়ে বললেন— কহি শুনো, নরপতি ও ঋষিগণ— চৌর্য, হিংসা, মিথ্যা আরও অনেক ভ্রষ্টাচার মানুষের মধ্যে দেখা যাবে। গোরুগুলোর আকার-আকৃতি হয়ে যাবে ছাগলের মতো। আশ্রম হইবে সব গৃহের মতো। স্নেহশূন্য হবে সব মাতা-পিতৃগণ। গুণহীন হবে সব ঔষধি সকল। ওষুধ থাকবে কিন্তু আরোগ্য থাকবে না। বহুল বিদ্যুৎদৃষ্ট হবে মেঘদলে। এইভাবে কলি যখন বেশ চেপে বসবে তখন মানবে করিবে গর্দভের আচরণ।
শুকদেব দশম অবতার কল্কিদেবের কথা বলে গেলেন। তিনি যেদিন বললেন, তারপরে চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আসবেন কল্কি অবতার। অর্থাৎ তিনি যুগের প্রথমেই আসবেন এবং এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে থেকেই আবার সত্যযুগের দিকে জীবগোষ্ঠীকে পরিচালিত করবেন। শাস্ত্র বলছেন, তিনি আসবেন কলিযুগের শেষ পাদে। অর্থাৎ রূপ পরিগ্রহ করবেন। কলিকালের স্থায়িত্বের কথা শুনলাম আমরা, লক্ষ লক্ষ বছর। এই মুহূর্তে আমরা হাজার পাঁচেক বছর কাটাতে পেরেছি। অবতার শ্রীশ্রীকল্কি আসবেন, দেহ ধারণ করবেন চার লক্ষ সাতাশ হাজার বছর পরে।
বৈশাখ মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে কল্কি মহারাজ অবতীর্ণ হবেন। সাল কিন্তু বলা নেই। তিনি এলেন শম্ভল গ্রামে, একদিন আসবেন সিংহলে। দ্বাপরে তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, এইবারে তিনি হবেন মাধব। শ্রীকৃষ্ণেরই আর-এক নাম। সিংহল দেশের রাজা বৃহদ্রথ, তাঁর পত্নী কৌমদী। এই কৌমদীর গর্ভে আসবেন এক অসাধারণ কন্যা, তাঁর নাম পদ্মা। পদ্মা এখন এখানে থাকুন, আমরা আর একবার অতীত থেকে ঘুরে আসি।
সেই একই দৃশ্য, দেবতারা অবনত মস্তকে ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার সামনে, মর্ত্যের অবস্থা খুবই খারাপ। এই দেবগণের মধ্যে যাঁরা প্রধান তাঁরা হলেন শনক, সনন্দ আর সনাতন। আর ইন্দ্রাদিদেবগণ তো রয়েছেন। ব্রহ্মা জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যাটা কী? —সমস্যা হল কাল এবং কলি। পূর্বের অবস্থায় যদি ধরাকে ফিরিয়ে আনা না যায় তা হলে আমাদের বেঁচে থেকে লাভটা কী! ব্রহ্মার সেই একই কথা— আমার তো কিছু করার নেই। সৃষ্টির দায়িত্ব তো শ্রীবিষ্ণুর। চলো, যাই তাঁর কাছে। দেবতা ও সিদ্ধগণের সেই বিরাট বাহিনী বিষ্ণুলোকে বিষ্ণুর কাছে গেলেন। বিষ্ণু বললেন, বুঝতে পেরেছি। আমাকেই তা হলে নামতে হবে। ‘শীঘ্রই শম্ভল গ্রামে হয়ে অবতীর্ণ।/পূর্বেকার মতো ধর্ম করিব স্থাপন।।/এবার আমার পিতা হবেন বিষ্ণুযশা, আর মা হবেন সুমতি।/তাঁর গর্ভে আমি জন্ম লভিব সম্প্রতি।।’ আমার সঙ্গে থাকবেন আরও চার ভাই। আমরা এই পাঁচজনে কলির নিধন করব। আর তোমাদের কাছে অনুরোধ— তোমরাও আমার সঙ্গে সঙ্গেই জন্মগ্রহণ করবে। তৈরি হবে আমাদের দেবগোষ্ঠী। বিষ্ণুদেব মুচকি হেসে লাজুক মুখে বললেন, এই মোর প্রিয়া লক্ষ্মীদেবীই যাইবে। ধরাধামে অবশ্যই জন্ম লভিবে। আমরা ওদিকে রেখে এসেছি লক্ষ্মীদেবীর বর্তমান রূপ পদ্মাকে।
দু’দিকে দু’জন বড় হবেন। পৃথিবীর নিয়মেই তাঁদের দেহধারণ করার ফল ভোগ করতে হবে। মাধব ভূমিষ্ঠ হলেন। শ্রীহরির গুণগানে আনন্দে গন্ধর্বগণ বাদ্য বাজাইবে। যতেক অপ্সরাগণ আনন্দে নাচিবে। এ তো যে-সে জন্ম নয়, শ্রীহরির জন্ম! ধাত্রীমাতা হলেন মহাষষ্ঠী অম্বিকা। এরপরে সাবিত্রী আসবেন। গঙ্গাজলে নবজাতকের অঙ্গ মার্জনা করতে। দিকে দিকে যত মাতৃকাগণ আছেন তাঁরা সমবেত কণ্ঠে মঙ্গলাচরণ করলেন। ব্রহ্মা পবনকে বললেন, এখনই শম্ভল গ্রামে যাও, দেখো গিয়ে সেই ‘দুর্লভ দর্শন’। সেখানে শ্রীবিষ্ণু মাধব হয়ে আর একবার জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সমস্যাটা হল এই— তিনি তো চতুর্ভুজ রূপ ধারণ করে বসে আছেন। তাঁকে গিয়ে বলো, কলিকালে চতুর্ভুজ শোভে না কখন। দ্বিভুজ মানব দেহ করহ ধারণ।। সুরভিত বায়ু ব্রহ্মার আদেশে সূতিকা গৃহে প্রবেশ করল। বাতাস তাঁর বাতাসি কণ্ঠে ছোট্ট বিষ্ণুর কানে বললেন, চতুর্ভুজ নয় দ্বিভুজ, দ্বিভুজ। বিষ্ণুর বাড়তি দুটি হাত অদৃশ্য হল। জনক-জননী এই দৃশ্য দেখে অভিভূত হলেন। কিন্তু পরমুহূর্তে মায়া তাঁদের এই দৃশ্যটিকে ভ্রম বলে ভাবালেন। শম্ভল গ্রামে শুরু হল মহা উৎসব। তাঁরা সকলেই কিছু না জেনেই বিষ্ণুযশার পুত্র লাভ হয়েছে শুনে আনন্দে আত্মহারা হলেন।
সেবার বিষ্ণু অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতি যুগের সূচনা পর্বে ভগবানের মর্ত্যলোকে আবির্ভাবের কথাটি এইভাবে বলে গেছেন— যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি, তখনই অবতার রূপে ভগবানকে আসতে হবেই। এই অলৌকিক পুত্রটির নামকরণ তো করতে হবে। ব্রাহ্মণ বিষ্ণুযশা ঋক, যজু, সামবেদী শ্রেষ্ঠ বিপ্রগণে নিমন্ত্রণে আনিবেন আপন ভবনে। অশ্বত্থামা ভৃগু ব্যাস ও কৃপ তখন বাল্যরূপী শ্রীহরিকে করিতে দর্শন।। সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে তাঁরা ব্রাহ্মণের গৃহে এলেন। বিষ্ণুযশা তাঁদের সমাদরে অর্চনা করলেন, উপবেশনের জন্য কুশের আসন দিলেন। ব্রাহ্মণীর ক্রোড়ে দেখি শিশুর বদন। পরম আনন্দ তাঁরা লভিবে তখন।। হরিকে দর্শন করি মানব আকার। সেই মুনিগণ করিবেন নমস্কার।। তাঁরা বুঝবেন, অধর্মের নাশের জন্য প্রভু আবার এলেন। কল্কি অবতার রূপে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন বিপ্রের ভবনে।।
দেবভাষায় কী দাঁড়াল তা হলে!
‘তং বালকং নরাকারং বিষ্ণু নত্বা মুনীশ্বরাঃ।
কাল্কিং কল্পবিনাশার্থাবির্ভূতং বিদুর্বুধাঃ।।
নামাকুর্বং স্ততস্তস্য কল্কিরিত্যভিবিশ্রুতম্।
কৃত্বা সংস্কার— কর্মাণি যযুস্তে হৃষ্ট মানসাঃ।।’
সেই চারজন ঋষি নবজাতককে চিহ্নিত করলেন কল্কি অবতার রূপে। ধর্মে ধর্মে কত মিল! আকাশে একটি নতুন নক্ষত্র দেখে প্রাচ্যের একদল জ্ঞানী অনুসন্ধান করতে করতে যিশুখ্রিস্টের সূতিকাগৃহে এসে হাজির হলেন— Wise men from the East। অর্থাৎ প্রাচ্যের প্রবীণ একদল ঋষি আকাশের সেই নক্ষত্র দেখে ভূতল চিহ্নিত করে এসে দেখলেন, মাতৃক্রোড়ে এক জ্যোতির্ময় শিশু। পিতা এলেন পৃথিবীতে, সন্তানদের মুক্তি দিতে। অতঃপর তাদের দ্বারাই ক্রুশবিদ্ধ হতে। এর আগের বারে শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন কংসের কারাগারে। মুক্তি এলেন বদ্ধ কুটিরে, বধ্যভূমি থেকে জীবকে আত্মার অমৃতলোকে মুক্তি দেবার জন্য। এ যেন সেই মাতৃসংগীতের একটি লাইন— দেহযন্ত্রে বন্ধ খাঁচায় পঞ্চভূতে তোমায় নাচায়। এবার শ্রীহরির যে যুদ্ধ হবে কলির সঙ্গে তা অতি ভয়ংকর। দ্বাপরের শ্রীকৃষ্ণ কাহিনিকেও ম্লান করে দেবে। প্রায় এই একই সময়ে মহিষাসুরমর্দিনী হিমালয়ে আবির্ভূতা হবেন। আর মহিষাসুরকে বলবেন— গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়, আমি ততক্ষণ একটু মধু খেয়ে নিই। আহা! মানুষ আর কত লীলাখেলা দেখাবে। ঈশ্বর আর ঈশ্বরীর লীলায় এই সবুজ গোলকটি আদিগন্ত ভরপুর। শুধু তো ভারত নয়, গোটা বিশ্বই এক রঙ্গমঞ্চ। আর্যভট্ট বললেন, সূর্য স্থির, পৃথিবীই ঘুরছে। তার আবার একটি আহ্নিক গতিও আছে। যে কারণে এই দিবারাত্রি। মানুষের সময় পত্রিকা— ক্যালেন্ডার। আর্যভট্টের কথা যখন গ্যালিলিও প্রকাশ করলেন তখন খ্রিস্টের ভক্তরা তাঁকে কারারুদ্ধ করলেন পামর বলে। গ্যালিলিও হাসলেন, অশ্রু বিসর্জন করলেন, চিরশেষে হয়ে গেলেন চিরঅন্ধ। হে মানব! তোমার লীলা দেবতাদেরও অগম্য।
তা হলে কল্কি অবতার এলেন। অবতীর্ণ হয়েছেন বিপ্রের ভবনে। মাতা সুমতি একই সঙ্গে মাতা যশোদা, মাতা দেবকী হয়ে শিশুটিকে প্রতিপালন করছেন, লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। ‘পঞ্চম বৎসরে কল্কি হলে উপনীত। বিদ্যাশিক্ষা তরে যবে হবে উপযুক্ত।। ধীর সর্বগুণবান কল্কিকে ডাকিয়া। বিষ্ণুযশা কহিবেন আদর করিয়া।। শুনো তাত, উপযুক্ত হইলে এবার। এবে করাইব উপনয়ন তোমার।।’
সেবারে তিনি এসেছিলেন গোপবংশে ক্ষত্রিয়ের রূপ ধারণ করে। হয়েছিলেন রাখাল রাজা। আর এবার এলেন ব্রাহ্মণের ঘরে। গলায় ধারণ করবেন যজ্ঞসূত্র। উপনয়নের পর তাঁর দ্বিজন্ম হবে। তাঁর শরীরটি হবে বিপ্রের শরীর। হবে গায়ত্রী সংস্কার। বেদাদি পাঠে দিবে তুমি মন। কল্কি প্রশ্ন করবেন, বেদ কারে কহে পিতা। সাবিত্রী কাহাকে কহে? বালকের আবার প্রশ্ন, বিপ্রকারে সূত্র দ্বারা সংস্কার হইলে। ‘বিপ্র’ নামে অভিহিত করিবে সকলে।।
এ সবই মাধবের ছল। তিনি প্রশ্ন করছেন আমাদের জানাবার জন্য। পিতা বলবেন পুত্রকে, শ্রীহরির বাক্য ‘বেদ’ নিশ্চয় জানিবে। ‘সাবিত্রী’ যে বেদমাতা নামে প্রতিষ্ঠিত।। ত্রিগুণিত সূত্রগ্রন্থী হয় যজ্ঞসূত্র।। দশযজ্ঞে সংস্কার হয়েছে যে ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মবাদী রূপে তিনি পরিচিত হন।।
বিষ্ণুযশা দেবভাষায় ব্রাহ্মণত্বের মহিমা ব্যাখ্যা করছেন—
ব্রাহ্মণ্যাং ব্রাহ্মণাজ্ঞাতো গর্ভধানাদিসংস্কৃতঃ।
সন্ধ্যাত্রয়েণ সাবিত্রী— পূজাজপে পরায়ণঃ।।
তপস্বী সত্যবাগ্ ধীরো ধর্মাত্মা ত্রাতি সংসৃতিম্।
বিষ্ণুর্চ্চনমিদং জ্ঞাত্বা সদানন্দ ময়োদ্বিজ।।
বিষ্ণুযশা পুত্রকে দশবিধসংস্কারের কথা বললেন। দশটি সংস্কার। কলিতে দক্ষিণেশ্বরে মহামায়ার মন্দিরে এসেছিলেন অবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনিও হিন্দুর এই দশবিধ সংস্কারের কথা বারে বারেই ভক্তদের বলতেন। উপনয়ন, পইতে ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, একটি দেহকে চিহ্নিত করে দেয়। কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে তিরোধানের প্রাক্মুহূর্তে গভীর রাতে তাঁর প্রধান শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ওরে এটা যে ব্রাহ্মণ শরীর। শরীর বলেছিলেন আত্মা বলেননি। সমসময়ে বিদ্রোহী লালনসাঁই বললেন, সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। পইতা দেখে ব্রাহ্মণ চিনি, ব্রাহ্মণী চিনি কেমনে!
পুত্রের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিষ্ণুযশা প্রকারান্তরে তার (বালকের) মনে ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডটি প্রবেশ করিয়ে দিলেন এই বলে— পুত্র অবশ্য জানতে চেয়েছিলেন, প্রকৃত ব্রাহ্মণ কোথায় আছেন? বিষ্ণুযশা কহিবেন পুত্র পতি। মহাবল, ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষী ধর্মঘাতী।। কলির জ্বালায় যত ধার্মিক ব্রাহ্মণ। মনদুঃখে অন্যদেশে করেছে গমন।। আর স্বল্পতপা যত বড় বিপ্রগণ। কলি-অধিকারে বটে রয়েছে এখন।। পুত্র তাঁরা পূজার্চনা ভুলে গেছেন, ভুলেও গায়ত্রী জপ করেন না। আহার, নিদ্রা, মৈথুন— এই তিনটিই হয়েছে প্রধান।
পিতার বাক্য শুনে বালক কল্কি সংকল্প করলেন, কলির ঝাড়ে বংশ আমি ধ্বংস করব।
কল্কিদেব হলেন পঞ্চম পুত্র। উপনয়নের পর শুরু কল্কির বিদ্যাভ্যাস। পিতা বিষ্ণুযশা তাঁকে পাঠালেন ভগবানের ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের কাছে। তিনি কল্কিদেবকে চতুঃষষ্ঠী কলা সহ বেদ অধ্যয়ন করালেন। এরপর তিনি কল্কিকে পাঠালেন শিবের কাছে। বিল্বোদকেশ্বর-এ গিয়ে কল্কি শিবকে প্রণাম করলেন, স্তুতি করলেন। মহাদেব তুষ্ট হয়ে কল্কিকে দিলেন একটি দ্রুতগামী শ্বেত অশ্ব আর একটি সর্ববেত্ত শুকপাখি। এ ছাড়াও দিলেন একটি করবাল। অস্ত্রটি হাতে তুলে দিয়ে মহাদেব বললেন, পৃথিবীর ভার লাঘব করবে এই আমার আদেশ ও আশীর্বাদ। শিবের থেকে প্রাপ্ত শ্বেত অশ্বে আরোহণ করে কল্কিদেব ফিরে এলেন নিজগৃহে। সেই সময় দেশের রাজা ছিলেন বিশাখযূপ। তিনি কল্কির খবর পেলেন এবং শুনলেন তিনি ভগবানের অবতার। রাজা একদিন স্বয়ং এসে কল্কিকে প্রণাম করে রোমাঞ্চিতকায়। হবেন বৈষ্ণব ভক্ত তাঁর করুণায়।। রাজাকে অনেক উপদেশ দেবেন কল্কিদেব।
সময় অতিবাহিত হচ্ছে। একদিন শিবের দেওয়া মহাজ্ঞানী সেই শুকপাখি বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসে কল্কিদেবকে প্রণাম করে বলবেন, দেব! আমি সমুদ্রবেষ্টিত একটি দ্বীপ দেখে এলাম। দ্বীপটির নাম সিংহল। সেখানকার রাজা বৃহদ্রথ, রানির নাম কৌমদী। দেব আপনার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা যাচ্ছে কেন! বুঝেছি আপনি সবই জানেন। সেইখানেই তিনি আছেন। পদ্মাবতী নামে তাঁর কন্যা সুবদনী। অতীব সুন্দরী আর ধন্যা যশস্বিনী।। দেব! এমন রূপবতী জগতে আর দুটি নেই। তাঁর সমস্ত কাহিনি জেনে এসেছি। তিনি শিবের তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে হরপার্বতী দর্শন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কন্যা, তুমি নারায়ণকেই পতিরূপে পাবে। আর একটি অদ্ভুত বর দিয়েছিলেন, কোনও পুরুষ যদি কামভাবে তোমার দিকে তাকায় সঙ্গে সঙ্গে সে নারী হয়ে যাবে। তাঁরা অন্তর্হিত হলেন। শিবের বর লাভ করে পদ্মাবতী বিষ্ণুচিন্তায় বিভোর হলেন। কন্যার এই অবস্থা দেখে রাজা বৃহদ্রথ স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলেন। সব দেশের রাজারা এলেন। বসিল সকল রাজা যথাযোগ্য স্থানে। পুরন্দর সভা যেন অমর ভুবনে।। পদ্মাবতী নানাবিধ অলংকারে সুসজ্জিত হয়ে হাতে বরমাল্য নিয়ে সখীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সভায় গেলেন। একজন সহচরী প্রত্যেক রাজার কুলশীল বর্ণনা করে পরিচয় দিলেন। পরমাসুন্দরী রাজকন্যাকে দেখে খুব স্বাভাবিক কারণেই রাজারা কামে বিমোহিত হলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা নারীরূপ ধারণ করলেন। সকলেই নারী, পুরুষ কোথায়? রাজকন্যা ফিরে গেলেন আপন প্রাসাদে, আর সেই সব নারীরূপী রাজারা তাঁকে অনুসরণ করলেন সখী হয়ে।
কল্কিদেব আমি সেই দৃশ্য দেখেছি— শুক বলছেন, পদ্মাবতী তাঁর শরীর থেকে একে একে সমস্ত অলংকার খুলে এদিকে-সেদিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। ছুটে গেলেন তাঁর কুঞ্জকাননে। তিনি কাঁদছেন আর স্বয়ং বিষ্ণুকে চিন্তা করছেন। সখী বিমলার কাছে দুঃখ করে বলছেন, আমার বড় মন্দভাগ্য। আমাকে দেখে সব রাজা নারীতে রূপান্তরিত হলেন। এখন আমি কী করি! শিবের বাক্য যদি মিথ্যা হয়, শ্রীহরি আমাকে যদি গ্রহণ না করেন, তবে আমি হরি, হরি নাম করতে করতে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করব। প্রভু, আমি পদ্মাবতীর এই সংকল্প শুনে গাছের ডালে বসে পাতার আড়াল থেকে বলে এসেছি, রাজকন্যা, তোমার তপস্যা আর শিবের বর বিফলে যাবে না। দেবাদিদেব যা বলেছেন তাই হবে। এখন আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে জানাতে।
কল্কিদেব বললেন, শোনো, শুকপাখি, তুমি আমার পরমবান্ধব। তুমি আবার উড়ে যাও সিংহলে। কিছু না, পদ্মাকে আমার রূপ-গুণের কথা শুনিয়ে এখানে ফিরে এসো। তুমি মধ্যস্থতা করে আমাদের দু’জনের মিলন ঘটাও। কল্কিদেবের আদেশে শুক তাঁকে প্রণাম করে আবার সিংহলে ফিরে যাবে। রাজপ্রাসাদের যে কক্ষে পদ্মাবতী থাকবেন তার পাশে একটি নাগকেশর গাছে বসে মানুষের কণ্ঠে শুক বলবেন, হে দেবি! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী। বিধাতাপুরুষ সমস্ত রূপলাবণ্য একত্র করে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। এমন রূপ জগতে তো আর দেখিনি।
পদ্মাবতী বলবেন, ওহে পাখি, কোন ডালে পাতার আড়ালে বসে আছ! এলেই বা কোথা থেকে? আগেও তুমি একবার আমাকে দর্শন দিয়েছ। তখন এসব কথা তুমি বলোনি। আমার সন্দেহ হচ্ছে তুমি পাখি, না তুমি দেবতা, না ছদ্মবেশী কোনও মানব!
শুক বললেন, আমি সর্বশাস্ত্রজ্ঞানী। আমি দেবাদিদেবের পাখি, আমি শুকপাখি। আমি যেখানে-সেখানে যেতে পারি। দেবসভা, রাজসভা, গন্ধর্বসভা— সর্বত্রই আমার সমান সম্মান। দেবি, তোমার দুঃখে দুঃখিত হয়ে আমি আবার এখানে এলাম। তোমার দুঃখের কারণ তো আমার অজানা নয়। তোমাকে গোপনে একটি কথা বলি। তোমার রূপের যোগ্য এক পুরুষকে আমি দেখেছি সাগরপারে। শ্রীহরির সঙ্গে তাঁর কোনও প্রভেদ খুঁজে পাইনি গো! শম্ভল গ্রামে বিষ্ণুযশা ব্রাহ্মণের গৃহে ভগবান শ্রীহরি অবতীর্ণ হয়েছেন। পরশুরামের কাছে বিদ্যা অর্জন করে আর দেবাদিদেবের কাছে অশ্ব, অসি ও আমাকে লাভ করেছেন। পৃথিবীতে এসেছেন ধর্মের পুনরুদ্ধারের জন্য।
পাখির কথায় পদ্মাবতী বড় আনন্দ লাভ করলেন। নানাবিধ স্বর্ণ অলংকারে শুকপক্ষীকে সাজিয়ে বললেন, তুমি সেই পুরুষরতনকে যেভাবেই হোক আমার কাছে নিয়ে এসো। শুক ফিরে এলেন কল্কিদেবের কাছে। তাকে স্বর্ণ অলংকারে সজ্জিত দেখে কল্কিদেব খুব আনন্দ পেলেন। শুকপক্ষীর মুখে পদ্মাবতীর সকল কথা শুনলেন। তারপর আর বিলম্ব না করে কল্কিদেব তাঁর শ্বেত অশ্বে আরোহণ করে শুকপক্ষীকে নিয়ে সিংহলে গেলেন। রাজপ্রাসাদের অদূরে একটি সুন্দর উদ্যান ও সরোবর। কল্কিদেব সেই সরোবরে স্নান করলেন। শুক উড়ে গিয়ে পদ্মাবতীকে বললেন, তাঁকে এনেছি।
পদ্মাবতীর শিবিকা প্রস্তুত হল। শুকপক্ষীর পরামর্শে সখীদের নিয়ে চললেন জলকেলিতে। দলে আটজন সহচরী। চারজন বহন করবে শিবিকা, আর চারজন নিয়ে চলল স্নানের যাবতীয় সরঞ্জাম। শুরু হল তাঁদের জলকেলি। সরোবরের তীরে উঠে বস্ত্রপরিধান ও মণিময় অলংকার ধারণ। সুসজ্জিতা পদ্মাবতী মণিময় বেদির দিকে এগোচ্ছেন। সেখানে কল্কিদেব স্নানস্নিগ্ধ হয়ে সুখনিদ্রায় প্রায় অচেতন। পদ্মাবতী দেখছেন, আজানুলম্বিত বাহু, তমাল বরণ, পদ্মপলাশ লোচন, পীতাম্বরধর। অপূর্ব সেই রূপ দেখে পদ্মাবতী মোহিত। সেই তমাল বৃক্ষতলে মণিময় বেদি।
তমালনীলং কমলাপতিং প্রভুং পীতাম্বরং চারুসরোজলোচনম্।
আজানুবাহুং পৃথুপীনবক্ষসং শ্রীবৎসসৎকৌস্তুভ কান্তিরাজিতম্।।
তদদ্ভুতং রূপমবেক্ষ্য পদ্মা সংস্তম্ভিভা বিস্মৃতসৎক্রিয়ার্থা।
সপ্ত ভু সংবোধয়িতুং প্রবৃত্তং নিবারয়ামাস বিশঙ্কিতা সা।।
পদ্মাবতী আড়াল থেকে চুপিচুপি কী দেখছেন! সেই রূপ, যা আমরা দেখেছি দ্বাপরে শ্রীবৃন্দাবনে, গোকুলে। সেই মাধব, সেই গোবিন্দ। মণিময় বেদিপরে দেখিবে সম্মুখে। ভগবান কল্কিবর নিদ্রা যায় সুখে।। সর্ব অঙ্গে মহামণি তেজে সূর্য তেজ মলিন। আজানুলম্বিত বাহু তমালবরণ।। শুকপক্ষী প্রভুকে জাগাতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু পদ্মাবতী বাধা দেবেন। তার কারণ পদ্মাবতীর সেই ভয়— ‘যদি মোরে দেখি নারীভাব প্রাপ্ত হন।’
ভগবান অন্তর্যামী তাঁর নিদ্রা আর জাগরণ একই। কল্কিদেব জেগে উঠলেন। সামনেই পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে। কল্কিদেব ক্রীড়াচ্ছলে বললেন, সুন্দরী তোমার মুখপদ্ম দেখে আমি কামরূপ ভুজঙ্গের দ্বারা দংশিত। পদ্মাবতী আশ্চর্য হলেন। কামার্ত! কিন্তু নারীরূপ তো ধারণ করলেন না, তা হলে। নিশ্চয় তিনিই এই দেবতা, শ্রীহরি।
পদ্মাবতী ও সখীগণ কল্কিদেবকে প্রণাম করলেন। বললেন, খুব নিকট সম্পর্কেই বললেন, তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। আমি অন্তঃপুরে যাচ্ছি। পিতাকে পাঠাচ্ছি তোমার কাছে। প্রাসাদে ফিরে পদ্মাবতী সমস্যায় পড়লেন। নির্লজ্জের মতো পিতাকে কেমন করে বলবেন? সমস্যার সমাধান করলেন তাঁর সখীরা। তাঁরা গিয়ে রাজাকে বললেন, রাজ উদ্যানে দেবতা এসেছেন। রাজা তাঁর পুরোহিত, পাত্রমিত্র, পূজার যাবতীয় উপকরণ নিয়ে কল্কির কাছে গমন করলেন। কী দেখলেন তিনি—
ঘনাঘনোপরি যথা শোভন্তে রূচিরাণ্যহো।
বিদ্যুদিন্দ্রোয়ুধাদীনি তথৈব ভূষণান্যুত।।
শরীরে পীতবাসাগ্রঘোরভাসা বিভূষিতম্।
রূপলাবণ্যসদনে মদনোদ্যম নাশনে।।
মেঘপরে মনোহর তড়িৎ যেমন। রামধনু দ্বারা হয় অপূর্ব দর্শন।। তেমনি শ্যামল অঙ্গ কল্কির শরীরে। রমণীয় হয় নানাবিধ অলংকারে।। মদনের রূপ যথা মানে পরাজয়। রাজা কল্কিদেবকে চতুর্দোলায় বসিয়ে প্রাসাদে নিয়ে এলেন। শুভলগ্নে পদ্মাবতীকে সম্প্রদান করলেন কল্কির হাতে। সেই সভায় কল্কিদেবকে দেখামাত্রই নারীরূপী রাজারা আবার পুরুষ হয়ে গেলেন। কল্কিদেব তাঁদের আদেশ করলেন— নদীতে গিয়ে স্নান করে এসো। স্নান করে এসে রাজারা তাঁকে ঘিরে বসলেন। স্বয়ংবর সভা রূপান্তরিত হল ধর্মসভায়।
কল্কিদেব বললেন, আমি এখন একজনকে আহ্বান করব, যিনি অলোক থেকে এই লোকে আসবেন। তাঁকে সবাই অনন্তমুনি নামে চেনেন। রাজন্যবর্গ আপনারা তাঁর মুখে একটি কাহিনি শুনবেন। অনন্তমুনি এসে সামনে দাঁড়ালেন। বলতে লাগলেন তাঁর জীবনের কথা। পুরিকা নামক স্থানে বিদ্রুম নামে এক মুনি ছিলেন। বেদ, বেদান্তে পারদর্শী। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সোমা। তাঁদের বৃদ্ধবয়সের আমিই একমাত্র সন্তান। কিন্তু আমি ক্লীব অবস্থায় জন্মগ্রহণ করি। সেই কারণেই আমার পিতামাতার মনে বড় দুঃখ ছিল। আমার আকৃতি দেখে সকলেই খুব উপহাস করত। আমার ক্লীবত্ব দূর করার জন্য আমার পিতা শংকরের উপাসনা করলেন। তখন শিব তুষ্ট হয়ে আমাকে পুরুষত্ব দান করলেন। যৌবনে আমার বিবাহ হল। সংসারে প্রবেশ করে আমি হয়ে গেলাম স্ত্রৈণ। কিছুকাল পরে আমার পিতামাতা পরলোকগমন করলেন। তাঁদের মৃত্যুর পর আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে পুরীধামে গেলাম। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে এক আশ্রমে শুরু হল আমাদের জীবন। দু’জনে পরমানন্দে শ্রীহরির সেবা করি। কেটে গেল বারোটা বছর। একদিন দ্বাদশী পারণের কালে সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে যেই জলে ডুব দিয়েছি স্রোত আমাকে টেনে নিয়ে গেল দক্ষিণ সাগরে। সেখানে বৃদ্ধশর্মা নামে এক ব্রাহ্মণ আমাকে উদ্ধার করে তাঁর গৃহে নিয়ে গিয়ে পুত্রবৎ পালন করলেন। আমি কোথায় এসেছি বুঝতে পারছি না। চারুমতী নামে তাঁর এক কন্যা ছিল। সেই কন্যার সঙ্গে আমার পুনরায় বিবাহ হল। আমাদের পাঁচটি পুত্র হল। জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহের জন্য কন্যা নির্বাচন করলাম। পিতৃতর্পণের জন্য দক্ষিণসাগর তীরে যেতে হল। সমুদ্রতীরে গিয়ে দেখলাম আমার পুরীধামবাসকালের বন্ধুরা সব দাঁড়িয়ে আছে। কেউ স্নান করছে কেউ তর্পণ করছে। তাদের দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক। আমি হঠাৎ আমার অতীতকে ফিরে পেলাম। সেই বয়স, সেই রূপ। দক্ষিণ সমুদ্রকূলে আমার এতগুলো বছর যেন এক নিমেষেই ঘটে গেল।
‘শ্রীহরির মায়া আমি করেছি দর্শন।
বুঝিতে না পারি কী বা করিব এখন।।’
এতদিন আমার জীবনে যা ঘটে গেল সবই মনে হল স্বপ্নবৎ।
এমন সময় সেখানে এক সাধু এলেন। তিনি আমাকে বললেন— আমি তোমাকে চিনি, চারুমতী তোমার ভার্যা। তার গর্ভে তোমার পাঁচ পুত্র, তোমার জ্যেষ্ঠপুত্রের আজ বিবাহের কথা আছে, তুমি এখানে এলে কবে? সেখানে তুমি সত্তর বছরের বৃদ্ধ ছিলে, এখানে কেমন করে যুবক হলে! তমোগুণা এই মায়ার প্রভাব নিশ্চয়, এই মায়া অতি বলবতী। ব্রহ্মাদি দেবতাগণও এর আকর্ষণে নাজেহাল। যারা লোভী এই মায়া তাদের ভবচক্রে সদাই ঘোরায়। যদি সেই মায়াকে জয় করতে চাও, তা হলে শ্রীহরির প্রতি দৃঢ়ভক্তি স্থাপন করো। তবেই সকল কাজ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। সুখ আর মোক্ষ লাভ হবে।
সেই মহর্ষির উপদেশ মতো আমি ভক্তিভরে শ্রীহরির অর্চনা করলাম। বর্তমানে কল্কির দর্শনে এখানে এলাম। আর তাঁর চরণপদ্ম স্পর্শ করে ধন্য হলাম। এবার আমি যাই। এই কথা বলে সেই মুনিবর চলে গেলেন। তারপর পদ্মা সহ কল্কিদেবের অর্চনা করে স্বয়ংবর সভায় যে নৃপতিগণ এসেছিলেন তাঁরা মহানন্দে নিজ নিজ রাজ্যে গমন করলেন।
দেবরাজ ইন্দ্র কল্কিদেবের জন্য শম্ভল গ্রাম সুসজ্জিত করতে শুরু করলেন। দেবস্থপতি বিশ্বকর্মা এলেন। ঠিক যেমন শ্রীবৃন্দাবনে ঘটেছিল, শম্ভল গ্রামেও বিশ্বকর্মা একের পর এক অতি মনোহর প্রাসাদ নির্মাণ করতে লাগলেন। মহারাজ বৃহদ্রথ প্রচুর উপহারসামগ্রী দান করে কন্যা ও জামাতাকে বিদায় জানালেন। সমুদ্রতীরে এসে কল্কিদেব স্নান করবেন। তখন তিনি দেখবেন, এক শৃগাল সমুদ্র পার হচ্ছে। শৃগাল যেন পথ দেখাতে এসেছিল। এ দেবতাদেরই কৌশল। কল্কিদেব সেই পথেই সৈন্যাদিসহ অশ্বাদি পার করে নেবেন।
কল্কিদেব সস্ত্রীক শম্ভল গ্রামে ফিরবেন। পদ্মার সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাবেন। তাঁর অন্যান্য ভ্রাতাদের দুটি করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে। পাঁচজনের দশটি পুত্র। বিষ্ণুযশা ওই পৌত্রদের লাভ করে মহা আনন্দ পাবেন।
একদিন বিষ্ণুযশা পুত্র কল্কিকে বললেন, এইবার অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে কেমন হয়? কল্কি সম্মতি দিলেন। বেরলেন দিগ্বিজয়ে। প্রথমে এলেন কীকটপুরে। সেই অঞ্চলটিতে বাস করতেন বৌদ্ধরা। তাঁরা এলেন কল্কির সঙ্গে যুদ্ধ করতে। পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন। এলেন তাঁদের রাজা জিন। তিনি কল্কিদেবের অশ্বটিকে শূলের দ্বারা বিদ্ধ করে আহত করলেন। জিনের শরাঘাতে ভগবান কল্কিদেব অচেতন। ভাবলেন বন্দি করবেন। রাজা জিন ব্যর্থ হলেন। বহু চেষ্টা করেও দেবতাকে ভূমি থেকে তোলা তো দূরের কথা, একটু নাড়াতেও পারলেন না। কল্কির এই অবস্থা দেখে নৃপতি বিশাখযূপ যুদ্ধে এলেন। গদাঘাতে জিনকে অচেতন করে ভগবানকে তুলে নিলেন নিজের রথে। সজ্ঞানে ফিরে এসে কল্কিদেব আবার যুদ্ধ করে সমস্ত বৌদ্ধদের বিনাশ করলেন। এরপরে তিনি আক্রমণ করলেন ম্লেচ্ছদের। তখন যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ম্লেচ্ছ নারীরা এলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কল্কিদেব বললেন, নারীদের অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করা উচিত নয়। সেই নারীরা তবুও বিরত হলেন না। তাঁরা অস্ত্রাঘাত করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু অস্ত্রই তুলতে পারলেন না। সেই নারীরা পরাজয় স্বীকার করলেন। কল্কিদেব তাঁদের ভক্তিযোগে দীক্ষা দিলেন। একে একে তাঁরা মোক্ষ লাভ করবেন।
কল্কিদেব এইবার সৈন্য নিয়ে যাবেন চক্রতীর্থে। সেখানে মহর্ষিরা এক রাক্ষসীর ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতেন। সেই রাক্ষসীর বিশাল দেহ। আকাশ-বাতাস জোড়া বিশাল চেহারা। তাঁর নাম কুথোদরী। সে নিকুম্ভ রাক্ষসের কন্যা। সে এক বিরাট উপস্থিতি। হিমাচলে তার মাথা, আর তার দুটি পা নিষাদ পর্বতে। এটি যেন এক ভৌগোলিক অঞ্চল। যেন একটি মানচিত্র। দানব-দৈত্য অধ্যুষিত। একটি ছায়া, যেখানে আলো নেই, শুধুই কালো। রূপকের মাধ্যমে অসাধারণ এক বর্ণনা। রাক্ষসী তার সন্তান বিকজ্ঞকে স্তন্যপান করাচ্ছে। একটি স্তন তার মুখে আর অন্যটি দিয়ে হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসছে দুধ। নদীর আকার ধারণ করেছে, শ্বেত নদী। এদের দু’জনকেই কল্কিদেব অনায়াসে বিনাশ করবেন।
এরপরে ভগবানের সাক্ষাৎ হবে সূর্যবংশজাত মেরুরাজ ও চন্দ্রবংশজাত দেবাপীর সঙ্গে। যে সত্যযুগ কল্কিদেব পুনরায় প্রবর্তন করবেন সেই আগামী সত্যযুগের তাঁরাই হবেন প্রথম রাজা। বিশাখযূপ রাজার কন্যার সঙ্গে মেরুর এবং রুচিরাশ্বের কন্যার সঙ্গে দেবাপীর বিবাহ হবে। কল্কিদেব দুই রাজাকে ইন্দ্রের প্রেরিত রথে আরোহণ করিয়ে তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে পাঠিয়ে দেবেন।
কলির দ্বারা পরাজিত হয়ে ধর্ম দ্বিজবেশে কল্কিদেবের কাছে এসে তাঁর দুঃখের কথা বিস্তারিত জানাবেন। বলবেন, কলির নিগ্রহে তাঁর অবস্থার কথা। তখন কল্কিদেব ধর্মকে আশ্বাস দিয়ে কলির রাজ্য আক্রমণ করবেন। কল্কিদেব যুদ্ধে আসছেন শুনে কলিরাজ প্রস্তুত। তাঁর রথের মাথায় উড়ছে পেচকধ্বজ। তার সঙ্গে আসছে রীতের সঙ্গে দম্ভ, প্রসাদের সঙ্গে লোভ, অভয়ের সঙ্গে রোষ, সুখের সঙ্গে ভয়, প্রীতির সঙ্গে নিরয় ইত্যাদি।
ধর্ম একা আসেননি, তাঁর সঙ্গে ধর্মের সমস্ত গুণগুলি মূর্তি ধারণ করে এসেছিল। যেমন রীত, সুখ, যোগ, প্রীতি, প্রসাদ, অনহংকার, স্মৃতি। এসেছিলেন ধর্মের স্ত্রী, পুত্র— শ্রদ্ধা ও মৈত্রী। এরা সবই গুণ।
‘শ্রদ্ধা মৈত্রী দয়া শান্তি স্তুষ্টিঃ পুষ্টিঃ ক্রিয়োন্নতিঃ।
বুদ্ধির্ম্মেধা তিতিক্ষা চ হ্রীর্স্মূর্ত্তিধর্ম্মপালকাঃ।।’
কলিরাজ এসেছেন তাঁর রথে চড়ে। এসেছে তাঁর সৈন্যবাহিনী। শুরু হল যুদ্ধ। আপন বিভূতি সহ যত দেবগণ। আসিবে আকাশপথে করিতে দর্শন।। এ যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। সে ছিল পুরাণের কাল, এ হল ইতিহাসের কাল। খশ আর কম্বোজদের সঙ্গে শুরু হল মেরুর যুদ্ধ। চিন আর বর্বরদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল দেবাপীর। আর একটি জাতি পুলিন্দদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে বিশাখযূপের। ওদিকে কোক ও বিকোক আসবে কল্কির সঙ্গে যুদ্ধ করতে। ভয়ংকর সেই যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের থেকেও ভয়ংকর হবে। মৃত সৈন্যদের শরীরের অংশ রণক্ষেত্রে স্তূপাকার।
কলি কি অত সহজে পরাস্ত হবে! মহাবলবান এই কলিকাল ঘোর কলি। কোনও যুদ্ধেই তাকে পরাজিত করা যাচ্ছে না। যুগ ও ধর্ম একত্রিত হলেন— সত্যযুগ আর ধর্ম। সত্যযুগের লক্ষণই হল ধর্ম। সত্যযুগের লক্ষণই হল সত্য— Truth। এই সত্য আর ধর্ম একত্রে যুদ্ধে এলেন। কলির রথে ঘোড়া ছিল না, ছিল গর্দভ। সে পালাচ্ছে, ঢুকে পড়েছে নিজের এলাকায়। অন্ধকারের রাজা। তার পেচকধ্বজ রথ ছিন্নভিন্ন। তার সর্বাঙ্গে রক্তের ধারা। তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে বিশ্রী এক দুর্গন্ধ— পচা কালের পচা গন্ধ। যেন গন্ধগোকুল। প্রাসাদের অন্দরে তার পত্নী ও আত্মীয়স্বজনের ক্রন্দন। অর্থাৎ বিপ্রদের আর্তনাদ। সেই যেমন সংগীতে আছে— ছ’জন কুজন। সত্যযুগ আর ধর্ম প্রবেশ করেছেন কলির নগরে। আধুনিক যুদ্ধে যা হয়। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনী সব চুরমার করতে করতে প্রবেশ করেছিল বার্লিনে। কলির এই নগরটির নাম বিশসন। অগ্নিবাণ ছুড়ে সমস্ত রাজ্যে আগুন ধরিয়ে দেবেন সত্য ও ধর্ম। যেমন রাশিয়া সমস্ত বার্লিন নগরটিকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যেমন আমেরিকা দুটি আণবিক বোমা ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল হিরোসিমা ও নাগাসাকিকে।
যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ! স্থলে, জলে অন্তরিক্ষে। প্রকৃত যুদ্ধ তো মনের কুরুক্ষেত্রে। ‘রামচরিতমানস’-এর একটি দোঁহায় তুলসীদাস বলছেন:
রাজা করে রাজা বশ, যোদ্ধা করে রণ জই।
আপনা মনকো বশ করে যো, সবকো সেরা ওই।।
রাজ্য বশ করলেই রাজা, যুদ্ধে জয়ী হলেই বীর যোদ্ধা; কিন্তু দুর্দান্ত মনকে বশ করতে পারলে কী রাজা, কী বীর, সব পড়ে থাকবে পেছনে। সে-ই হবে রাজার রাজা, সব উড়ে যাবে ফুৎকারে।
তা তো বটেই; কিন্তু কালের কলস থেকেই তো বেরবে কলি। কুচকুচে কালো তার গাত্রবর্ণ, ধূসর কেশ। চক্ষুদ্বয় পেচকের মতো, রক্তবর্ণ, ঘূর্ণিত। কণ্ঠস্বর যেন লোহার পাতে কেউ করাত ঘষছে, অঙ্গে নরকের গন্ধ। কালই কালী, মহাকালের বুকে দুর্দান্ত এক প্রকাশ শক্তি, যার মধ্যে নিহিত, নাশ, বিনাশ, সর্বনাশ। তল, অতল, বিতল, মহীতল। শাক্তকবির দর্শনে, ‘ভবরোগ’:
ভবরোগে ব্যথিত জীবন, করি কি এখন?
কলুষ-পৈত্তিকে অঙ্গ করিছে দহন।
বাসনা-বাত প্রবল, টুটাইছে জ্ঞান— বল,
প্রবৃত্তি-কফেতে কণ্ঠ করিছে রোধন।।
বিষয় কুপথ্য যত, আহার করি সতত,
ক্রমশ রোগ বর্ধিত, বিকার লক্ষণ,
আশা-রূপ-পিপাসায় অস্থির করিছে আমায়
বুঝি এ বিষম দায় নাহি বিমোচন।
মোহ-তন্দ্রা প্রতিক্ষণ, প্রলাপ কু-আলাপন,
মায়া-রূপ ভ্রম ভীষণ, করি দরশন,
তন্নান অরুচিকর, জীবন রাখা দুষ্কর,
বুঝি যা কাল-কিঙ্কর করে আক্রমণ।
কাল-কিঙ্কর, অর্থাৎ কালের অনুচর, কলির বাহিনী, এক ডজন ইন্দ্রিয়, জীবনের ঘাড়ে চেপে ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে। তুলসীদাস আরও তীব্র। তিনি লিখলেন:
গোউয়া দোফে কুত্তা পালে ওস্কি বাছুর ভুখা।
শালেকে উত্তম খিলাওয়ে বাপ না পাওয়ে রুখা।।
ঘরকা বহুরি প্রীত না পাওয়ে চিত চোরাওয়ে দাসী।
ধন্য কলিযুগ তেরি তামাসা দুখ লাগে ওর হাসি।।
গোরুর দুধ দোহন করে পোষা কুকুরকে আদর করে খাওয়ানো হল, তার বাছুরের বরাতে এক ফোঁটা জুটল না। শ্যালককে খাতির চর্ব্যচুষ্য খাওয়ানো হচ্ছে, ওদিকে মা-বাপের কপালে একখানা শুকনো রুটি জোটে না। নিজের স্ত্রী জাহান্নামে যাক বারাঙ্গনার সঙ্গে হলায় গলায় প্রেম। হে কলিযুগ, তুমি ধন্য! তোমার কাণ্ডকারখানায় হাসিও পায়, দুঃখও হয়। জয় শিব-শম্ভু। জয়, জয়, জন্ম-মৃত্যু, মৃত্যু-জন্ম, ক্ষয়-অবক্ষয়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ-মহাকালের মহাভাণ্ডে কল-কল-খল-খল। চুনো-পুঁটি-বৃহৎ-রোহিত, কালাবউশ (কালবোস) মকর-কুম্ভীরাদি প্রাণী সেই সময়ের ‘সরসী নীরে’ কাতরে-অকাতরে সন্তরণ করছে। সে কোন ভক্ত অজ্ঞাতজন ওই আবর্তে বসে লিখছেন:
জগৎ তোমাতে, তোমারি মায়াতে
মোহিত জগৎ-জন।
রবি শশী তারা, আজ্ঞাকারী তারা,
সদা নিয়ম করে পালন।।
সংসার-খেলনা দারা-সুত লয়ে,
ভুলায়ে রেখেছ মা মোহিত করিয়ে!
তুমি দিয়েছ যে খেলা, আমি খেলি মা দু’বেলা।
তাইতে করি হেলা নিত্যধন।
ইচ্ছাময়ী, তব ইচ্ছায় সব হয়…
সে কোন ইচ্ছাময়, যাঁর মায়া এই ইচ্ছাময়ী?
ত্বং কালী কালী দুর্গা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী ধূমাবতী
ত্বং বগলা ভৈরবী ছিন্নমস্তকা অন্নপূর্ণা ভাগদেবী
ত্বং দেবী কমলালয়া সর্বশক্তি স্বরূপাত্মং সর্বদেবা মোহিতাং।।
কে জানে মা তব মর্ম!
এ-কালে জেনেছিলেন এক মহাবতার, তাঁর নাম ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর অবস্থানের শেষ চার বছরে আমাদের বারে বারে সতর্ক করেছেন:
‘জীব সাজসমরে রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।’
‘ঘরে’, মানে দেহে, সমাজে, জনজীবনে, জীবনধারায়, স্থলে, জলে, অন্তরিক্ষে, বিষের জ্বালায় জ্বলবে জীবন, মরবে দগ্ধে দগ্ধে; যেন তুষের আগুন, দপ করে নয়, ধিকিধিকি, অল্প গোলাপি ধোঁয়া, পোড়া তামাক পাতার গন্ধ, যেন বাবুর ঠোঁটে সিগার, কলিরাজের ধূম্রপান। উন্মত্ত আঁধার ঘরে শত জীবন নৃত্য করে বেসামাল, স্খলিত পদে। ঠাকুরের (ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের) ‘ব্যবস্থাপত্র’ ‘প্রেসক্রিপশান’।
কলিতে অন্নগত প্রাণ, দেহ বুদ্ধি যায় না।
শাস্ত্রে যে-কর্ম করতে বলা হয়েছে, কলিকালে করা বড় কঠিন, এখন অন্নগত প্রাণ। বেশি কর্ম চলে না। জ্বর হলে কবিরাজি চিকিৎসা করতে গেলে এদিকে রোগীর হয়ে যায়। বেশি দেরি সয় না। এখন ডি. গুপ্ত [সেকালে, জ্বরের একটা পেটেন্ট ওষুধ]।
অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার নাম কর্মযোগ। ভারী কঠিন। একে কলিযুগ, সহজেই আসক্তি এসে যায়। জানতে দেয় না। কলিতে ভক্তিযোগ, নারদীয় ভক্তি।
নারদীয় ভক্তি, মানে, সর্বদা ভগবানের নামগুণ কীর্তন। প্রার্থনা।
সত্য কথা কলির তপস্যা, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়ঃ, পরোপকারনিরত।
নাম মাহাত্ম্য, হাততালি দিয়ে নাম করলে দেহবৃক্ষ হতে পাপ পাখি পালিয়ে যায়।
এক দিন, এক রাত কাঁদলে ঈশ্বরদর্শন হয়।
কলিকালে বেদমত চলে না। এখন একটিই তপস্যা, সত্য কথা, সত্যে থাকলে ঈশ্বরলাভ।
তুলসীদাস বলছেন, সত্য কথা, অধীনতা, পরস্ত্রী মাতৃসমান— এই সে হরি না মিলে তুলসী ঝুট জবান। আমি ‘রামকৃষ্ণ’ শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে এইটি তুলে নিয়েছি আমার সাধনে— ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।’
কলিতে ধ্যান জপ হয় না। মন সদা চঞ্চল; তাই নাম গুণগান। দু’ হাত তুলে নেচে নেচে হরি হরি বলো রে ভাই!
এই প্রসঙ্গে ঠাকুর নিজেকে সাবধান করছেন। কলি এবং কলির সামগ্রিক প্রভাব সম্পর্কে কতটা সচেতন, তা তাঁর এই সাবধানতা থেকে সুস্পষ্ট। আমাদের দিক থেকেও খুবই চিন্তার কারণ। ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি, কাশীপুর উদ্যানবাটীতে অপরাহ্ণে তিনি ‘কল্পতরু’ হয়ে সমবেত ভক্তদের সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে আশীর্বাদ করেছিলেন ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। এর আগে তিনি থিয়েটারে বিনোদিনীর মাথায় তাঁর শ্রীহস্ত দুটি রেখে ভাবাবেগে বলেছিলেন, ‘হরি গুরু, গুরু হরি। বলো মা হরি গুরু, গুরু হরি।’ তারপর প্রায় সমাধিমগ্ন অবস্থায় আশীর্বাদ, ‘মা তোমার চৈতন্য হোক’। সেদিনের তারিখটি ছিল, ১৮৮৪, ২১ সেপ্টেম্বর, রবিবার। এই সময়কালে তাঁর কেবলই মনে হত, একটা তাগিদ অনুভব করতেন— বদ্ধ মানুষগুলো সব চৈতন্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক। স্পর্শ করে বলতেন, ‘চৈতন্য হোক’। নিমেষে লোহা হয়ে যেত সোনা। এরপর ঠাকুরের শরীরে এল কাল-ব্যাধি। ১৮৮৬ সাল, ২২ এপ্রিল। কাশীপুর উদ্যান। দ্বিতলে ঠাকুরের ঘর। উপস্থিত রয়েছেন Galaxy— নরেন্দ্রনাথ, হীরানন্দ, মাস্টারমশাই, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্ত ফুল হাউস। নানা আলোচনা। নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে হীরানন্দের ঠাকুর-অনুপ্রাণিত তর্ক-বিতর্ক, নরেন্দ্রনাথের সংগীত। সবশেষে, ঠাকুর হঠাৎ বললেন, ‘অবস্থা বদলাচ্ছে, মনে করেছি ‘চৈতন্য হউক’ সকলকে বলব না। কলিতে পাপ বেশি, সেই সব পাপ (নিজের ওপর) এসে পড়ে।’ তিনি ‘পাপ’ শব্দটি অপছন্দ করতেন। ‘তোমাদের বাইবেলে কেবল পাপ, আর পাপ!’ সেই ঠাকুর ভরা কলিতে দেখছেন— চতুর্দিকে থকথকে, দগদগে, চ্যাটচ্যাটে পাপ। জেলির মতো শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে। কাল (Time) হল কলি, মহাকাল হলেন রুদ্র, মহাকালী হলেন রুদ্রাণী, আদ্যাশক্তি মহামায়া:
খড়্গং চক্রগদেষু চাপ পরিঘান্ শূলং ভুশুণ্ডীং শিরঃ
শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গ ভূষাবৃতাম।
ভয়ংকরী— সুন্দরী, স্বর্ণালংকারে ভূষিতা; কিন্তু সশস্ত্রা। ঠাকুর সচেতন হয়েছেন, কালের বিপরীতে গেলে ক্ষমা নেই। তা হলে উপায়? প্রভু উপায় বলো না?
অপেক্ষা, লক্ষ বছর পরে, লক্ষ লক্ষ বছর পরে— আসবেন অবতার। সহজ ঠাকুরের সহজ কথা— অত পুথিপাটার প্রয়োজন নেই। ভক্তগণ! শোনো, একলাইনে ‘দশম অবতার’ শ্রীশ্রীকল্কিদেবের আগমন কথা। ঠাকুর বললেন সেই কল্কিঠাকুরের কথা— ‘কলির শেষে কল্কি অবতার হবে। ব্রাহ্মণের ছেলে— সে কিছু জানে না, হঠাৎ ঘোড়া আর তরবারি আসবে।’
ও ঠাকুর! এ যেন ঠিক আপনি! ব্রাহ্মণের ছেলে, জানেন না কিছুই। আর নরেন্দ্র সেই খাপ খোলা জীবন্ত তরবারি।
সাহায্যকারী গ্রন্থ:
১. শ্রীমদভাগবত [মূল সংস্কৃত], ২. মহাভারত [মূল সংস্কৃত], ৩. কল্কিপুরাণ,
৪. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ৫. শ্রীশ্রীচণ্ডী।
———
Leave a Reply