ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
সম্পাদনা – সুরজিৎ দাশগুপ্ত
প্রথম সংস্করণ – জানুয়ারি ২০০১
প্রচ্ছদ – সমীর সরকার
.
ঘনাদা ২য় খণ্ডের ভূমিকা – সুরজিৎ দাশগুপ্ত
ঘনাদার প্রথম গল্প ‘মশা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে আর প্রথম গল্প সংকলন “ঘনাদার গল্প” প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। তারপর ১৯৭০ পর্যন্ত একে একে প্রকাশিত হয় আরও পাঁচখানি গ্রন্থ। সেই মোট ছ-খানি গ্রন্থ কালানুক্রমিক ভাবে “ঘনাদার সমগ্র ১”-এ গ্রন্থিত হয়ে ২০০০-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ থেকে ১৯৮৮ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্রের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মধ্যে ঘনাদার আরও ন-খানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়—সেগুলির মধ্যে আছে ছ-খানি গল্প-সংকলন আর তিনটে উপন্যাস। “ঘনাদা সমগ্র ২”-এর প্রথম বিভাগে ছ-খানি গল্পগ্রন্থ ও দ্বিতীয় বিভাগে উপন্যাসে তিনটে প্রকাশের কাল অনুসারে পরপর সাজানো হয়েছে। এই ন-খানি গ্রন্থের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত “ঘনাদা ও দুই দোসর” গ্রন্থটির অন্তর্গত ‘ঘনাদার বাঘ’, “পক্ষিরাজ” পত্রিকার ১৯৮৫-র পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘কালো ফুটো সাদা ফুটো”, “কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান”-এর ১৯৮৭-র পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘মৌ-কা-সা-বি-স বনাম ঘনাদা’ এবং শেষোক্ত পত্রিকার ১৯৯১-এর পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত ঘনাদার একটি আরব্ধ কিন্তু অসম্পূর্ণ গল্প। “ঘনাদা সমগ্র”-র প্রথম দু-খণ্ডে ১৯৫৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রেমেন্দ্র মিত্রর সশরীর উপস্থিতি কালে প্রকাশিত ঘনাদার যে-পনেরোটি গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে সেগুলি ছাড়াও ঘনাদার আরও কতকগুলি গল্প-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যেমন “ঘনাদা চতুর্মুখ”, “অফুরন্ত ঘনাদা”, “ঘনাদার সঙ্গীসাথী”, “ঘনাদা বিচিত্রা” ইত্যাদি। কিন্তু এইসব সংকলন আগেই প্রকাশিত কোন-না-কোন গ্রন্থের সংযোগে সংকলিত, তাই এগুলিকে ঘনাদার গল্পের মূল গ্রন্থ বলে গণ্য করা যায় না, উল্লিখিত পনেরোখানা গ্রন্থই শুধু মূল গ্রন্থ। তবে “ঘনাদা বিচিত্রা” বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে ‘পৃথিবী যদি বাড়ত’ নামে একটি নাটিকা যা আসলে “দুনিয়ার ঘনাদা”-র অন্তর্গত ‘পৃথিবী বাড়ল না কেন’ গল্পটারই নাট্যরূপ। চলচ্চিত্রের পর্দায় ও নাটকের মঞ্চে প্রেমেন্দ্র মিত্রের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ছিল; নাটিকাটির রচনায় তিনি সেই অভিজ্ঞতাকে পুরো মাত্রায় কাজে লাগিয়েছেন। এ ছাড়া এই খণ্ডের শেষে রয়েছে কতকগুলি ছড়া যেগুলিকে প্রেমেন্দ্র স্বয়ং ‘ঘনার বচন’ বলে অভিহিত করেছেন বোধকরি বাংলার ঘরে ঘরে বহুকাল ধরে প্রচলিত ‘খনার বচন’-এর সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে। আমাদের বিশ্বাস, “ঘনাদা সমগ্র”র প্রথম দু-খণ্ডে আত্মনেপদীতে কথিত বিশ্বের বিভিন্ন দুৰ্ব্বাত ও দুর্গম স্থানে এক-একটি মোক্ষম মুহূর্তে হাজির ঘনাদার কীর্তি ও কেরামতির সমস্ত কাহিনী সংগৃহীত হয়েছে আর ঘনাদা কথিত তাঁর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস-মূলক কাণ্ডকারখানার কাহিনী সংকলন করা হবে “ঘনাদা সমগ্র”র তৃতীয় খণ্ডে।
উপরে লিখেছি বটে প্রথম দু-খণ্ডে ঘনাদার নিজের সব বাহাদুরির গল্প গ্রন্থিত হয়েছে, কিন্তু কথাটা ষোলো আনা ঠিক নয়, একটু সংশোধন প্রয়োজন, কারণ এই খণ্ডের অন্তর্গত মহাভারত, মৌ-কা-সা-বি-স ও পরাশর নিয়ে গল্পগুলি ভিন্ন জাতের ও ভিন্ন রসের।
প্রথমে পরাশর প্রসঙ্গে বলি। ঘনাদার মতো পরাশর বর্মাও প্রেমেন্দ্র মিত্রের এক অনন্য সৃষ্টি। পরাশর বর্মা এমন এক চরিত্র যিনি একই সঙ্গে গোয়েন্দা ও কবি, যেমন তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তেমনই ছন্দে ও ভাষায় তাঁর কর্তৃত্ব। কবিতার দাঁড় বাইতে বাইতে তিনি রহস্যের দরিয়া পার হন। এই অসাধারণ গোয়েন্দাকে নিয়ে প্রেমেন্দ্র অনেকগুলি গল্প লিখেছেন। সেগুলিতে রয়েছে সূক্ষ্ম সংস্কৃতির পরিচয়। পরাশর নিয়ে দুটি গল্পে ঘনাদাও নিজস্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই গল্প দুটি প্রথমে সংকলিত হয় “ঘনাদা ও মৌ-কা-সা-বি -স” গ্রন্থে আর তাতে সবশেষের গল্প ছিল ‘পরাশরে ঘনাদায়’, তার আগের গল্প আঠারো নয়, উনিশ’ আর তারও আগের গল্প ছিল ‘ঘনাদা ফিরলেন’। এই খণ্ডে এই তিনটে গল্পের অনুক্রম কেন ‘পরাশরে ঘনাদায়’ ‘ঘনাদা ফিরলেন’ ও ‘আঠারো নয়, উনিশ’ করেছি তা গল্প তিনটে পরপর পড়লেই বোঝা যাবে। উল্লিখিত ক্ষেত্র ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই মূল গ্রন্থে প্রদত্ত গল্পগুলির অনুক্রম অনুসরণ করেছি।
এবার মৌ-কা-সা-বিস নিয়ে গল্পগুলি বিবেচনা করা যেতে পারে। এই গল্পগুলিও লেখকের স্বকীয় উদ্ভাবনী প্রতিভায় বিশিষ্ট। এগুলি ঘনাদার অধিকাংশ গল্পের মতো যথাক্ষণে অকুস্থলে উপস্থিত ঘনাদার কোনও কেরামতির বা দুঃসাহসের গল্প নয়, ঘনাদার সামনে ধাঁধার মতো সমস্যার বাজি ফেলে দিলে তিনি কেমন করে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দিয়ে তার মোকাবিলা করেন সেই ওস্তাদির দলিল হল মৌ-কা-সা-বি-স-এর গল্পগুলি। কিন্তু মৌ-কা-সা-বি-স নামের আড়াল থেকে কে বা কারা বাহাত্তর নম্বরের বাসিন্দাদের উদ্দেশে সমস্যাগুলি বিদ্রূপের মতো নিক্ষেপ করত এ এক অনিবার্য তথা স্বাভাবিক প্রশ্ন। কীভাবেই বা সবার চোখ এড়িয়ে সেসব কূটপ্রশ্নের চিরকুট অব্যর্থ প্রবিষ্ট হত মেস-এর ডাকবাকসে? এসবের জবাব ইতিপূর্বে প্রকাশিত ঘনাদার কোনও গ্রন্থে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে এই খণ্ডেই প্রথম গ্রন্থিত ‘মৌ-কা-সা-বি-স বনাম ঘনাদা’ নামক গল্পে।
মহাভারত অবলম্বনে ঘনাদার গল্পগুলিতে রয়েছে পৌরাণিক ঘটনাজালের ঘনাদার ঢঙে বিন্যাসের আস্বাদ। “ঘনাদার হিজ বিজ বিজ” গ্রন্থের নামগল্পে আছে ‘ঘনাদাকে তখন পুরাণের প্রেতে পেয়েছে। দিন-রাত শুধু মহাভারতই দেখছেন সর্বত্র।’ তার পর ওই গ্রন্থের অন্তর্গত শান্তিপর্বে ঘনাদা’ গল্পটিতে রয়েছে যুদ্ধের পর অনাচারে ভ্রষ্টাচারে ভরে যাওয়া দেশের চিত্র। সে-দেশে ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ হয় না। এমনকী মহাভারতের লিপিকার ও বিঘ্নহন্তা বলে পরিচিত শ্রীশ্রীগণেশ মহোদয়কে দিয়ে কোনও কার্যোদ্ধার করতে হলে তাঁর বাহন ইঁদুর বাবাজিকে মোটা ঘুষ খাওয়াবার দস্তুর দাঁড়িয়ে গেছে, ফলে ঘুষ খেয়ে খেয়ে মূষিকপ্রবর বন্য বরাহের মতো বপু ধারণ করেছে। মহাভারতের কালেও যে মামা-ভাগ্নের মধ্যে আঁতের সম্পর্ক এ-কালের মতোই ছিল তার প্রমাণ পাই ‘ঘনাদার শল্য সমাচার’ গল্পটিতে। তখনকার সমাজের সঙ্গে যে এখনকার সমাজের গুণগত সদৃশতা রয়েছে তা গল্পগুলি পড়লে বুঝতে পারি।
‘কীচকবধে ঘনাদা’, ‘ভারতযুদ্ধে পিঁপড়ে’, ‘কুরুক্ষেত্রে ঘনাদা’, ‘খাণ্ডবদাহে ঘনাদা’, ‘আঠারো নয়, উনিশ’ প্রভৃতি গল্পে দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে ও ধর্মসংস্থাপনে আত্মোৎসর্গকারী ঘনাদার কাহিনী পাই না, তার বদলে পাই মহাভারতে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার ঘনাদার দেওয়া বিশ্লেষণ এবং সেসব যেমন অভিনব তেমনই মৌলিক। প্রবাদ আছে, যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে। কিন্তু এই মূল্যবান প্রবাদবাক্যকে ঘনাদা অনেকটাই অসার প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁর কথা থেকে আমরা জানতে পারি যে বহু হাত ঘুরে যে-মহাভারত আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তাতে আসল ঘটনাগুলোর অনেক কথাই বাদ পড়ে গেছে। অথবা কারসাজি করে বাদ দেওয়া হয়েছে। ঘনাদার ব্যাখ্যাগুলি, যেমন ‘জয়দ্রথবধে ঘনাদা’ গল্পে সুদর্শন চক্র দিয়ে সূর্যকে আবৃত করার ঘটনাটির ব্যাখ্যা, তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে সেগুলির পেছনে এক বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী মন অবিরাম কাজ করে চলেছে। এবং সে-মন প্রকৃতপক্ষে প্রেমেন্দ্র মিত্রেরই মন। সেই বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী মন থেকে উদ্ভিন্ন এইসব গল্পও কাশীরাম দাস বিরচিত মহাভারতের মতোই অমৃতসমান।
তবে মহাভারত নিয়ে ঘনাদার কোন গল্পটি যে প্রেমেন্দ্র প্রথম লিখেছিলেন তার কোনও নিশ্চিত সূত্র পাইনি। ‘ভারতযুদ্ধে পিঁপড়ে’র এক জায়গায় আছে, বনোয়ারির দেওয়া খাবারের প্লেট সরিয়ে নেওয়ার ফলে ‘ঘনাদার মুখের চেহারা মহাভারতের হস্তিনাপুর থেকে এক ঝটকায় উনিশশো পঁচাত্তরের বাহাত্তরে এসে পড়ার জন্য ভ্যাবাচাকা।’ তার মানে এই গল্পটি উনিশশো পঁচাত্তরে লেখা। কিন্তু গল্পটির শেষের দিকে শ্রোতৃমণ্ডলী জানতে চেয়েছে যে পিঁপড়ের জ্বালায় শ্রীকৃষ্ণের উলটে শোবার কথা ‘মহাভারত থেকে সরাল কে? সেই আপনার ভীমসেন, দারুক আর বন-বরা মার্কা মূষিক কোম্পানি?’ বোধহয় আরও আগে লেখা হয়েছিল ‘খাণ্ডবদাহে ঘনাদা’ আর তাতেও আছে, ‘দারুক মূষিক কোম্পানি কি বল্মী বিশারদের কাজ এটা নয়।’ আবার শান্তিপর্বে ঘনাদা’ গল্প থেকেও আমরা জানতে পাই যে ভীমসেন যখন আগে একবার মুশকিলে পড়েছিলেন তখন দারুক আর মূষিক মোটা ঘুষের বদলে ভীমসেনকে বাঁচিয়েছিলেন। এর থেকে কি মনে হয় না যে ভীমসেন, কৃষ্ণের সারথি দারুক আর গণেশের বাহন মূষিকের যোগসাজশের কোনও একটি কাহিনী ঘনাদা আগেই কোথাও ফেঁদেছিলেন? এবং একাধিকবার দারুক-মূষিক কোম্পানির উল্লেখে সংশয় থাকে না যে তাঁরা কীভাবে ভীমসেনকে বাঁচিয়েছিলেন তা নিয়ে ঘনাদার একটা কোনও গল্প প্রেমেন্দ্র আগে কোথাও লিখেছিলেন। কিন্তু সে-গল্প ঘনাদার কোনও গল্পগ্রন্থে অথবা প্রেমেন্দ্রের অন্য কোনও গ্রন্থে বা পত্রিকায় এখনও খুঁজে পাইনি। তবে এমন হতে পারে যে ঘনাদার কোনও গল্পে নয়, কিন্তু মহাভারত নিয়ে লেখা কোনও গল্পে দারুক-মূষিক কোম্পানির প্রথম সূচনা। এখানে বলে রাখি, ‘মহাভারতে নেই’ শিরোনামে প্রেমেন্দ্র এমন কতকগুলি গল্প লিখেছিলেন, যেমন ১৯৭১ সালে দেব সাহিত্য কুটির-এর পূজাবার্ষিকী “উদ্বোধন”-এ, যেসব গল্প ঘনাদার গল্প নয়, খোদ লেখকের জবানিতে পেশ করা গল্প।
॥ দুই ॥
ঘনাদার গল্প লেখা প্রেমেন্দ্র শুরু করেছিলেন বিজ্ঞান ও ভূগোলের অল্পজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান পরিবেশনের ছলে। আকস্মিকভাবে ঘনাদার গল্প লেখা শুরু হলেও বছরে বছরে নতুন গল্প লেখা চলতে থাকে অনিবার্যভাবে। এ-বিষয়ে প্রেমেন্দ্র “আনন্দমেলা” পত্রিকার ১৯৮৩-র ২৮ মে সংখ্যায় প্রকাশিত কার্তিক মজুমদারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, আবার আর্টসেরও ছাত্র ছিলাম। বিজ্ঞান বলো, ইতিহাস-ভূগোল-রূপকথা বলো, সবকিছুতেই আমার দারুণ আকর্ষণ। ঘনাদাকে নিয়ে মশা নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম তাঁকে নিয়ে আর লিখব না। কিন্তু পাঠকদের কাছ থেকে এত চিঠি আসতে লাগল যে বনমালি নস্কর লেনের মেসবাড়ির ঘনাদা আর আমি কেউ পালাতে পারলাম না।’ ঘনাদা চরিত্র বাস্তবে দেখা কোনও চরিত্রর আদলে গড়েছেন কি না প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লেখার সময় একজন হিরোর দরকার পড়ল। বিদেশী সায়েন্স-ফিকশনের হিরোকে দেখা যায়, যেমন সে বিদ্যাদিগগজ তেমনই তার গায়ের জোর। আমি হিরো করলাম একজন সাধারণ অন্নভুক বাঙালিকে। সে কলকাতার মেসের ভাত খেয়ে এমন শক্তিমান যে তার মুখের জোরের ধারেকাছে কেউ দাঁড়াতে পারা না। পাঠকের কাছে ঘনাদা তাই এত ভালোবাসা পেয়েছে।’
কোন কোন মহলে একটা ধারণা চালু আছে যে বাঙালি কাজের চেয়ে কথায় দড়, বাতের জোরে সে দুনিয়া মাত করে। এই ধারণাটা ঠিক কি বেঠিক সে বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র সেই একই ধারণাকে সাধারণ বাঙালির দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন ঘনাদার গল্পগুলোতে। একদিক থেকে ঘনাদা অবশ্যই বাকসর্বস্ব বাঙালি জাতির একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি, আবার অন্যদিক থেকে দেখলে অভিভূত হতে হয় তাঁর বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডারে, তাঁর প্রখর উপস্থিতবুদ্ধিতে, তাঁর অফুরন্ত উদ্ভাবনী প্রতিভাতে। বাগাড়ম্বরের সঙ্গে প্রভূত পাণ্ডিত্যে ঘনাদা অনন্য। এবং চূড়ান্ত বিচারে ঘনাদার সমস্ত বাকচাতুর্য, সমস্ত ঘটনাবিস্তার, সমস্ত তথ্যসম্ভার, সমস্ত বিন্যাসশৈলীর অদ্বিতীয় ও নিত্যবহ উৎস হল স্বয়ং প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিস্ময়কর সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব।
এই ব্যক্তিত্ব এক জাতের গল্পে মানব-চরিত্রের স্বরূপকে উন্মোচন করেছেন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে গভীর বিশ্লেষণে, আবার অন্য জাতের গল্পে একই ব্যক্তিত্ব অধীত ও অর্জিত জ্ঞানের সংশ্লেষণে নির্মাণ করেছেন কাহিনীর চমকপ্রদ অবয়ব, প্রথম জাতের গল্পে চরিত্রে চরিত্রে যে-সংস্থান তৈরি হয় তার ভেতরে ঢুকে ফুটিয়ে তোলেন জীবনের আলো-আঁধারি রহস্যের ব্যঞ্জনা, এবং দ্বিতীয় জাতের গল্পে বাইরে থেকে সংগৃহীত বিবিধ উপাদানের সমবায়ে গড়ে তোলেন অসম্ভব প্রস্তাবকে সম্ভব করে তোলার প্রীতিময় উত্তেজনা। দুই জাতের গল্পেই প্রেমেন্দ্র মিত্র সিদ্ধহস্ত।
বয়সের গাছপাথর নেই, গত দুশো বছরে হেন ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই এইভাবেই ঘনাদার পরিচয় দেওয়া হয়েছিল সেই ১৯৪৫ সালে লেখা ঘনাদার প্রথম গল্পে। তারপর ১৯৮৭-তে লেখা ‘মৌ-কা-সা-বি-স বনাম ঘনাদা’ গল্পটি পর্যন্ত তিনি মহানায়কের মতো সমান দাপটে বাহাত্তর নম্বরের টঙের ঘরে অটল হয়ে টিকে থেকেছেন। অবশ্য কখনও কখনও এই মেস ছেড়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়েছেন, একবার ছেড়েই গেছেন এক অদ্ভুত কারণে, কিন্তু ঘটনা এই যে এই দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরে বাহাত্তর নম্বরে কোনও রকম মেরামতির জন্য রাজমিস্ত্রি অথবা চুনকামের জন্য রংমিস্ত্রি লাগানো যায়নি ঠাঁই নাড়ানাড়িতে ঘনাদার অসুবিধে হবে বলে। তাঁর অবস্থান পর্বে বাহাত্তর নম্বরে কখনও কখনও নতুন অতিথি এসেছে। যেমন বাপি দত্ত, সুশীল চাকি, ধনু চৌধুরি প্রমুখ। কিন্তু যখনই তেমন কেউ মাতব্বরি শুরু করেছে বা নিজের সীমানা ছাড়িয়ে পুরনো বোর্ডারদের অসুবিধে কি বিরক্তির কারণ ঘটিয়েছে তখনই তাকে মেস-ছাড়া করার দায়িত্ব নিয়েছেন ঘনাদাই। এমনকী তাঁকে নিয়ে খাতিরের বাড়াবাড়ি বা স্থূল আদিখ্যেতা ঘনাদা বরদাস্ত করার পাত্র নন। আবার অন্যদিকে তিনি মেস-এর পুরনো সবার সঙ্গে একটা শোভন, সরস ও সুসম সম্পর্ক বজায় রেখেছেন আগাগোড়া।
শুধুমাত্র ভোজ্যবস্তুর বিষয়ে ঘনাদা বেসামাল হন এবং তাঁর ভোজনপ্রিয়তা বিলাসিতার পর্যায় ছেড়ে লোলুপতার পর্যায়ভুক্ত। তার এই প্রচণ্ড দুর্বলতাটাকে মেনে নিয়েই মেস-এর প্রতিষ্ঠাতা-সভ্যরা তাঁকেই গুরুজনের স্থান ও জ্ঞানীগুণীর মান দিয়েছে। মেস-এর পরিচারকদ্বয়ও তাঁকেই ‘বড়া বাবু’ বলে জানে, এমনকী “তেল দেবেন ঘনাদা” উপন্যাসের নামকরা কোম্পানির উর্দিপরা ড্রাইভারের কাছেও তিনিই ‘বড়া বাবু’। বাহাত্তর নম্বরের শিরোদেশ স্বরূপ এহেন ঘনাদা তথা ঘনশ্যাম দাস মহোদয় এই মেস-এ কবে কেমন করে এসে হাজির হলেন এ-প্রশ্ন পাঠক পাঠিকার মনে বারেবারে জাগা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যাবে ‘ঘনাদা এলেন ‘ গল্পটিতে। যেমন হঠাৎ করে ঘনাদার গল্প লেখা শুরু হয়েছিল তেমনই হঠাৎ করেই ঘনাদা একদিন এসে পড়েছিলেন এই মেস-এ। ঘনাদার গল্পগুলি যদি পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে লেখা হত তবে হয়তো এইটেই হত ঘনাদা গল্পমালার প্রথম গল্প। কিন্তু এই গল্পটি লেখা হয়েছে ঘনাদার প্রথম গল্প লেখার চল্লিশ বছর পরে ঘনাদা ক্লাব-এর সদস্যদের ফরমাশে। ফরমাশী গল্পেও যে কত নৈপুণ্য প্রকাশ পায়, তাও যে কত সম্পূর্ণতা লাভ করে এই গল্পটি তার একটি চমৎকার উদাহরণ। ফরমাশকারীদের ঘনাদা ক্লাব-এর কথা পরে বলব।
ইতিমধ্যে ঘনাদার গল্পগুলির লেখক রূপে উত্তমপুরুষের চরিত্রটি মেস-এর অন্যান্য চরিত্রর মতোই কথায় ও কাজে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। প্রথম দিকের গল্পগুলিতে এই লেখক-চরিত্র নিজেকে অন্যান্য চরিত্রর আড়ালে অনেকখানি গোপন করে রেখেছিল, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সে যে সেই আড়াল সরিয়ে সামনে বেরিয়ে আসতে থাকে তা আমরা “ঘনাদা সমগ্র”র প্রথম খণ্ডেই দেখেছি। সে-খণ্ডে তার নাম জানা যায়নি, তা জানা গেল বর্তমান খণ্ডের প্রথম গল্প ‘ধুলো’তে। ঘনাদাই প্রথম তাঁর কাহিনীকার চরিত্রটিকে সুধীর নামে অভিহিত করেছেন, আবার তাকে ওই নামে সম্বোধন করেছেন ‘কাদা’ গল্পটিতে। ‘ঘনাদার হিজ বিজ বিজ’ গল্পটিতেও কাহিনীকারকে সুধীর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুধীর স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখিত ‘ঘনাদার চিঠিপত্র ও মৌ-কা-সা-বি-স’-এর মতো আরও কোন কোন গল্পে। তবে কাহিনীগুলোতে উত্তমপুরুষ সাধারণত যেমন স্পষ্টভাবে উপস্থিত তাতে তার নাম উল্লেখ করা হল কি হল না তা অবান্তর। তবু কোন কোন স্থলে তাকে সুধীর নামে স্বতন্ত্র পরিচয় দেওয়া হয়েছে তার কারণ বোধকরি এই যে প্রেমেন্দ্ররই ডাকনাম সুধীর। আর মেস-এর অন্যান্য চরিত্রের বাস্তব পরিচয় পূর্ববর্তী খণ্ডের ভূমিকাতেই জানিয়েছি।
ঘনাদার সমস্ত গল্পই গঠিত হয় দুটি অংশের সংযোগে, প্রথম অংশে থাকে মেস-এর সভ্যদের মধ্যে ঘনাদাকে তাতাবার জন্য আলাপ-সলাহ্র উত্তমপুরুষে দেওয়া বিবরণ আর দ্বিতীয় অংশে থাকে ঘনাদার নিজের জবানিতে বলা কাহিনী। ঘনাদার বয়ানই আসল গল্প, পরিস্থিতির আবিষ্করণে ও পরিকল্পনার রূপায়ণে যেমন চমকপ্রদ তেমনই স্মরণীয়, কিন্তু তার প্রস্তুতিপর্বের উপস্থাপনেও সুধীরের বর্ণনা অনবদ্য, কারণ ঘনাদার বয়ানে স্থান-কাল-পাত্র প্রতিবারেই নতুন, অথচ সুধীরের বর্ণনায় প্রদত্ত সমস্ত গল্পে নিত্য সত্য-র মতো সতত একই স্থান-কাল-পাত্র, শুধু পরিবেশনের কৌশলে ও বৈচিত্র্যে প্রতিবারই অভিনব ও আকর্ষী। ঠিক কথা যে ঘনাদা-সাহিত্যের অর্থাৎ ঘনাদাকে দিয়ে গল্প বলাবার জন্য মেস-এর বাসিন্দাদের তোড়জোড়ে ভরা প্রাথমিক কাণ্ড আর ঘনাদার মুখে মূল কাণ্ডের সবটাই প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা এবং স্বতন্ত্রভাবে গল্পের একটি চরিত্রকে নিজের ডাকনামে চিহ্নিত করার বিশেষ আবশ্যকতা ছিল না। তা ছাড়া যাঁরা জানেন না যে লেখকেরই ডাকনাম ছিল সুধীর, তাঁরা মেস-এর কাহিনীকারের নাম সুধীর জেনেও কোনও অতিরিক্ত রস পাবেন না, কিন্তু প্রেমেন্দ্রর দিক থেকে নিজের ডাকনামে কাহিনীর উত্তমপুরুষকে চিহ্নিত করার মধ্যে ঘনাদা-সাহিত্যে একটা অতিরিক্ত মাত্রাদানের ব্যাপার আছে এবং পাঠকের দিক থেকেও সেই মাত্রা তখনই ধরা সম্ভব হবে যখন তিনি জানবেন যে লেখক নিজেকে এমনভাবে প্রক্ষেপ করেছেন যাতে তিনি পরিণত হয়েছেন বিরচিত কুশীলবদেরই একজন। আবার ‘ঘনাদার চিঠিপত্র ও মৌ-কা-সা-বি-স’ গল্পটিতেও ধাঁধার মতো ছড়ার কৌশলে কালীঘাটের গঙ্গার যে-ধারে আলিপুর কারাগার তার অপর ধারে নিজের বসতবাড়িটারই বর্ণনা দিয়েছেন,
‘নদী না খাল?
তার ওপারে শুরু
লম্বা লাল দেওয়াল।
দেওয়ালের ওখানে কারা?
ওখানে রইল ইশারা।
এখন খুঁজলে বাড়ি
পাবে তাড়াতাড়ি।
।।তিন।।
এই বাড়িতেই প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে গেছেন, তবে কখনও হয়তো কাউকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনি থাকতে পারেননি, কিংবা কখনও হয়তো তিনি নিজেই কাজের কারণে মুম্বাইয়ে বাস করেছেন, কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গেই তাঁর সমগ্র শারীরিক অভ্যাসের স্মৃতি জড়িত এবং তাঁর জীবনযাপনার প্রায় সমগ্র অংশই এখানে অতিবাহিত। এই বাড়িতেই তাঁর অধিকাংশ সাহিত্য লিখিত। উপকরণে ও স্থাপত্যে এই প্রাচীন বাড়ি এই কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে এক কৃতীজন একই বাড়িতে প্রায় গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন এমন নজির আজকের বাঙালি সমাজে দুর্লভ।
এই বাড়িতেই ১৯৮৪ সালে গল্পের ঘনাদার অনুরাগী কয়েকজন বাস্তব চরিত্র মিলে ঘনাদা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইংল্যান্ডের শার্লক হোমস ক্লাব-এর আদর্শে ঘনাদা ক্লাব গড়ার প্রস্তাব তুলেছিলেন সিদ্ধার্থ ঘোষ “কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান” পত্রিকায় একটি পত্রের আকারে ১৯৮৩ সালে। এই ক্লাবের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন রবীন বল, কিন্নর রায় প্রভৃতি। দু-বছর পরে রবীন বল-এর ব্যবস্থাপনায় “কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান”-এর ১৯৮৬ জুন সংখ্যাটি বিশেষ ঘনাদা সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হয়। তাতে রন্ধন-পটিয়সী বিখ্যাত লেখিকা লীলা মজুমদার লেখেন ঘনাদার ভোজনপ্রিয়তা সম্বন্ধে। তিনি লেখেন, ‘ভোজন বিলাসী যিনি তিনি নিজের হাতে পাক না করলেও, যারা করবে তাদের হাড়-জ্বালানি ডিটেল সহকারে, রিগা বা মিকিউ বা কংগো বা বোদরুমের এবং বিশেষ করে মঙ্গলগ্রহের পাক-প্রণালীর বিষয়ে প্রশিক্ষিত করবেন না? ভোজন-বিলাসীদের ওই করে কত সুখের সংসার ছারখার করে দিতে কি আমি দেখিনি? অবিশ্যি এমনও হতে পারে যে প্রথম জীবনে ওইসব করতে গিয়েই বাড়ি থেকে তাড়া খেয়ে এমন নির্বান্ধব পরিচয়বিহীন জীবন তাঁকে (ঘনাদাকে) কাটাতে হচ্ছে।’ একটু পরে লেখিকার মনে পড়েছে, ‘কিন্তু প্লেট বোঝাই শিক-কাবাব, ফিশ ক্রোকেট, হরি ময়রার বাদশাহি শিঙাড়া, কালীঘাটের তোতাপুলি-ল্যাংচা প্লেটের পর প্লেট নিঃশেষ করে দিচ্ছেন ঘনাদা, এ-দৃশ্য বারবার দেখতে পাচ্ছি। খেতে ভালো হলেই খেয়ে ফেলেন।’ এটা তো ঠিক ভোজনবিলাসীর চরিত্রানুগ হতে পারে না। লেখিকার মতে, আসলে ‘শিবু, শিশির, গৌর এবং বিশেষ করে ভিজে বেড়াল সুধীর—ঐ চারটে ছেলে দারুণ পেটুক এবং তার চেয়েও সাংঘাতিক কথা তারা জানে যে দুনিয়ার পেটুকপনার সুবিধা নিয়ে সবাইকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো যায়। প্রথম খণ্ডের ভূমিকাতে শিবু, শিশির ও গৌরের প্রকৃত পরিচয় জানিয়েছি আর একটু আগে জানিয়েছি স্বয়ং সুধীরের–আসল চরিত্রগুলি যে কে কোনজন তা জানতে পারলে ঘনাদাকে ভোজনবীর হিসেবে দেখানোর মধ্যে একটা অতিরিক্ত মজা পাওয়া যায় না কি? কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, ভোজনকর্মে প্রেমেন্দ্র নিজে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন জীবনের শেষ বিশ বছর। সেই অক্ষমতা থেকেই কি তাঁর হিরো-কে ভোজনবীর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন? এখানে আরও একটু জানিয়ে রাখি যে শিবু নামের আড়ালধারী বিখ্যাত রস-সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী “ঈশ্বর পৃথিবী, ভালোবাসা” নামে আত্মকথা মূলক গ্রন্থের একস্থানে নিজস্ব রসিকতায় লিখেছেন, তাঁর কাছে কেউ যদি জানতে চান যে তাঁর বিবেচনায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে কে বড় তাহলে তিনি নিঃসংশয়ে জানাবেন ওই দুজনের মধ্যে প্রেমেন্দ্ৰই বড়।
বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য ‘বিজ্ঞানী ঘনাদা’ নামক প্রবন্ধে লেখেন, “নিজের হাতে বিজ্ঞানের গবেষণা না করলেও নানা বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে এসে তিনি যেসব তথ্য পরিবেশন করেন তা কিন্তু সত্যি অস্বাভাবিক মনে হলেও মোটামুটি বিজ্ঞাননির্ভর—বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্র বা নিয়মকে মেনে নিয়েই তা রচিত। আর খুঁটিনাটি সেই তথ্যগুলো এত নিখুঁত যে মনেই হয় না, এ কোনও বিজ্ঞানীর নিজস্ব গবেষণালব্ধ ফল নয়। … প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রথম জীবনে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও নিজে বিজ্ঞানী নন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর কৌতূহল অদম্য আর তারই ছায়া এসে পড়েছে এইসব গল্পে।’ আর ঘনাদা ক্লাব গড়ার প্রথম প্রস্তাবক সিদ্ধার্থ ঘোষ ‘ঘনাদার বিশ্বপরিক্রমা’ সম্বন্ধে লেখেন, ‘ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন বহু দ্বীপই ধন্য হয়েছে ঘনাদার আগমনে। …তা বলে কেউ যদি মনে করে ঘনাদা শুধু বেপট জায়গাতেই ঘুরেছেন—সে কিস্তু জানে না। দুনিয়াময় টহলদারি করছেন তিনি দু-শো বছর ধরে। নামী-দামী জায়গাই বা বাদ পড়বে কেন।… তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, রাশিয়া, ইউরোপ সর্বত্রই গেছেন তিনি, কিন্তু সংখ্যায় অনেক বেশি তাঁকে টেনেছে আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার রহস্যময় জঙ্গল, আর দুই মহাসাগর প্যাসিফিক ও আতলান্তিকের ছিটেফোঁটা বহু দ্বীপ।’ বিজ্ঞান-শিক্ষক সাহিত্যিক সমরজিৎ কর লেখেন, ‘গল্পের ভেতর দিয়ে কঠিন বৈজ্ঞানিক বিষয় যে এত সহজ করে বলা যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের আগে বাংলা ভাষায় আর কখনও ঘটেনি। ঘনাদার অ্যাডভেঞ্চার শুনতে শুনতে বিজ্ঞানের কত অজানা কথাই না আমরা মনের অজান্তে শিখে ফেলেছিলাম!’
যখন ঘনাদা ক্লাব গঠিত হয় তখন ঘনাদার স্রষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্রর বয়স আশি, দৃষ্টি ক্ষীণ, ইন্দ্রিয়গুলো পতনোন্মুখ, স্বাস্থ্য জীর্ণ, শরীর অশক্ত, কিন্তু মন তখনও তাজা, কল্পনা তখনও উড়ন্ত, তখনও তিনি শুধু ঘনাদাকে নিয়ে নয়, মামাবাবু-ঘনাদা-পরাশরের থেকে নতুনতর চরিত্র “ভূত শিকারি মেজোকর্তা”কে নিয়ে অদ্ভুত রসের আরও গল্প রচনার আগ্রহে চঞ্চল, আর ঘনাদাকে নিয়ে তো লিখছেনই। ঘনাদা ক্লাব প্রতিষ্ঠার ফলে ঘনাদার আরও নতুন গল্প লেখায় প্রেমেন্দ্র যে-উৎসাহ পেলেন তাতে লিখে ফেললেন “মান্ধাতার টোপ ও ঘনাদা” নামে এমন এক অভিনব উপন্যাস যার রহস্যের সূত্র উদ্ধার করেছেন নতুন কোনও গ্রন্থ বা তথ্য থেকে নয়, নিজেরই স্মৃতিতে নিমজ্জিত জয়দেব-এর বিখ্যাত রচনা “গীতগোবিন্দম”-এর একটি বহুল প্রচারিত শ্লোক থেকে। কিন্তু কাহিনীটি উপস্থাপন করেছেন স্কটল্যান্ডের এমন এক হ্রদের উপকূলে যার সঙ্গে সমুদ্রের এক গোপন সংযোগ রয়েছে আর উপন্যাসটিতে তিনি ওই হ্রদ সংলগ্ন শহরের তথা স্কটল্যান্ডের জীবন ও প্রকৃতির এমন বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন যাতে মনে হয় লেখক স্বয়ং স্কটল্যান্ড-এ গিয়ে সরেজমিনে সব তদন্ত ও চাক্ষুষ করে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখেছেন। ঘনাদার অধিকাংশ গল্পেই দেখা যায়, যেসব অখ্যাত বা দুর্গম স্থানে ঘনাদা গিয়ে হাজির হন সেসব স্থানে লেখক নিজে কখনও যাননি বা যেতে পারেন না তবু সেসব স্থানের যে বর্ণনা তিনি দেন তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য ও সত্য বলে প্রতিভাত হয়। ওই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রেমেন্দ্রের নিজস্ব কল্পনাশক্তি ও উদ্ভাবনী প্রতিভার সৃষ্টি।
সেই শক্তি ও প্রতিভা, প্রেমেন্দ্রর শেষ পর্যন্ত অটুট ও জীবন্ত ছিল, কিন্তু বাদ সাধছিল তাঁর বয়স ও ব্যাধি। উল্লিখিত বিশেষ ঘনাদা সংখ্যাটির জন্য তাঁর যে-সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কিন্নর রায় তার শিরোনাম ছিল ‘ঘনাদা এলো কোথা থেকে’। তাতে তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আসলে কী জানো? আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একজন ঘনাদা আছে যে বাগাড়ম্বর প্রিয়, কল্পনায় অনেক সাহস দেখায়। আবার বিজ্ঞানমনস্ক, ইতিহাসমনস্ক, সবার ওপর অভিযান প্রিয়।” কিন্নর রায় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ঘনাদা নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার পরিকল্পনা কী?’ উত্তরে প্রেমেন্দ্র বলেন, ‘অনেক কিছুই তো পরিকল্পনা আছে। কিন্তু পেরে উঠছি কই? একে তো শরীর খুব খারাপ। তার ওপর চোখে দেখতে পাই না, ব্ল্যাঙ্ক ফোল্ড লিখি। নিজের লেখা লাইন নিজেই বুঝতে পারি না। পড়ে দেওয়ার লোক নেই। না পড়লে ঘনাদা লেখা অসম্ভব এ তো জানোই।’ দৃষ্টিশক্তির ক্রমাবনতি তাঁর শেষ বছরগুলির দুর্গতি ছিল। কখনও আগের লাইনের ঘাড়ে পরের লাইন চড়ে বসত, আবার কখনও লিখতে লিখতে লাইন বাইরে বেরিয়ে যেত পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মুখে শুনেছি যে তিনি যখন “আনন্দমেলা” পত্রিকার সম্পাদক তখন প্রেমেন্দ্রর লেখার প্রুফ নিজে দেখতেন, লেখার পাঠে যেসব গোলমাল ও ঘাটতি থাকত সেসব নিজে শুধরে ও পূরণ করে দিতেন এবং চূড়ান্ত পাঠটি প্রেমেন্দ্রর কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে পড়ে শোনাবার পর তাঁর অনুমোদন নিতেন।
প্রথম খণ্ডের ভূমিকাতেই জানিয়েছিলাম, একবার কাগজেকলমে লিখে ফেলা রচনার আর-একবার মুদ্রণের সময় প্রুফ সংশোধনের মেজাজ প্রেমেন্দ্রর ছিল না। কোনও যান্ত্রিক কাজের জন্য ধৈর্যও ছিল না তাঁর। ফলে কোন কোন ছাপার ভুল চলে এসেছে প্রথম প্রকাশের সময় থেকেই। এবং পরের মুদ্রণে ভুলের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই গেছে। এই মেজাজের সঙ্গে যখন তাঁর বয়স ও তার সঙ্গে শারীরিক অপটুতা যোগ হল তখন অবস্থা দাঁড়াল বেশ শোচনীয়। তাঁর হাতে লেখা কপির পাঠ উদ্ধার করাই হল প্রেস-এর কর্মীদের পক্ষে এক দুরূহ ব্যাপার।
প্রেমেন্দ্রর শেষ জীবনে ভগ্নস্বাস্থ্য ও দৃষ্টিদুর্বলতার ফলে কী ধরনের বিভ্রাট হয়েছে তার দু-একটি নমুনা এখানে দিতে পারি। ‘কাঁটা’ গল্পের এক স্থানে মধ্যপ্রদেশের সাতনা স্টেশনটির নাম ছাপা হয়েছিল ‘যাতনা’, তবে এই ধরনের ভুল অনেকেই চট করে ধরে ফেলতে পারবেন। কিন্তু আলাসকার রাজধানী Juneau যদি ছাপা হয় ‘ব্যুনো’ তাহলে অনেকের পক্ষে সেটা ধরা কঠিন হবে বলে সন্দেহ করি; তেমনই ‘মাত্তো প্রসসো’ যে আসলে Mato Grasso এটাও বোধহয় কেউ কেউ বুঝতে পারবেন। তবে banderillero-র জায়গায় যদি বাংলা হরফে ‘ব্যাণ্ডেলিয়োরো’ ছাপা হয় তাহলে ঠিক শব্দটা ধরা অনেকের পক্ষেই বেশ কঠিন হবে বলে মনে হয়। কেউ কেউ ঘনাদার গল্পকে বানানো গুল গল্প মনে করলেও ঘনাদার জোগানো সব তথ্যই মোটের উপর সত্য, সেখানে গুলের কোনও ব্যাপারই নেই, তাই ছাপার ভুলের দোহাই দিয়ে ভুল তথ্য জোগালেই লেখকের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধতাচারণ করাই হবে। তা ছাড়া কোন লেখকই বা নিজের লেখায় ছাপার ভুল বরদাস্ত করতে রাজি? তাই যেখানে ছাপার ভুলের ঠিক রূপ সম্বন্ধে নিশ্চিত বোধ করেছি সেখানে ভুল শোধরাবার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু কোন কোন স্থলে মুদ্রণপ্রমাদের সমুদ্রে নাকানিচোবানি খেয়েছি, যেমন ‘ঘনাদা ফিরলেন’ গল্পটি যে-গ্রন্থে এর আগে সংগৃহীত হয়েছিল তাতে এক জায়গায় ছিল যে ঘনাদার খোঁজ করার জন্য পরাশর বর্মার কাছে যাওয়ার ঠিক আগেই বনোয়ারি খবর দিল যে কে একজন বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তার পরে ওই গ্রন্থে যা ছিল তা হুবহু নীচে তুলে দিচ্ছি :
বনোয়ারীর এই বিবরণটুকু দেওয়ার মধ্যেই সিঁড়ির নিচে আগন্তুকদের দেখা গেল। হ্যাঁ, আর একজন নয় দুজন।
এমন বেয়াড়া সময়ে কে আবার ঘনাদার সঙ্গে দেখা করতে এল?
খোঁজ করতে নিচে যাবার পথে সিঁড়িতেই তাদের সঙ্গে দেখা। হ্যাঁ, এসেছেন একজন নয় তাঁরা দুজন। প্রথম জন কাশ্মীরী শালওয়ালা আর দ্বিতীয় জন তাঁর বেচতে আনা শাল-দোকানের বোঝার বাহন।
এই পাঠ প্রেমেন্দ্র জীবদ্দশাতেই বিক্রয়ের জন্য প্রকাশিত হয়, সুতরাং ধরে নিতে হয় যে উদ্ধৃত পাঠটি তিনি নিজেই কবুল করেছিলেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে নীরেন্দ্রনাথের মতো সম্পাদক জোটেনি বলে তিনি নিরুপায় হয়ে এ-বিষয়ে চোখ বুজে থেকেছিলেন।
এই রকম আরও একটি উদাহরণ উদ্ধৃত করছি ‘মৌ-কা-সা-বি-স ও ঘনাদা’ গল্পটির শেষ দিক থেকে। তার আগে প্রসঙ্গটি জানিয়ে দিই যে ঘনাদার বিবরণে রয়েছে, বিদেশিরা যখন বান্টুদের দেশে এসে মোটা ঘুষ দিয়ে তাদের ওঝাদের হাত করে গোটা দেশটাই হাত করার তালে ছিল তখন তাদের সব গমের খেত ঝলসে যেতে লাগল কী যেন এক অভিশাপে। তখন ঘনাদা-ভক্তরা জানতে চায় যে ওই বিদেশিদের চাষবাসের বিদ্যেও ছিল আর হাতে স্থানীয় ওঝারাও ছিল, তবু খেতগুলোর অমন হাল হল কেন? এবার আদি-পাঠ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
‘—তা ছিল! ঘনাদা স্বীকার করলেন। কিন্তু ওঝাদেরও ভির্মি খাওয়ানো ক্ষ্যাপা হাতির পিঠে চড়া অমন কাঁধে ঝোলা জড়ানো ক্ষ্যাপা অসুরের মতো ওঝাদেরও আতঙ্ক এসে সব ফসলের ক্ষেতে দেখা দেবে, আর তারপর কিছুদিন বাদে কি এক ফসলদানার মতো পোকার ঝাঁকে আকাশ অন্ধকার হয়ে যাবার পর সমস্ত ক্ষেত ঝলসে যাবে এত আর কেউ ভাবেনি।’
এই দুটি অংশের পাঠ সংশোধন করে যে-পাঠ নির্ধারণ করেছি তা যথাস্থানে দ্রষ্টব্য। এসব ক্ষেত্রে খোদার উপর খোদকারি করে স্বয়ং প্রেমেন্দ্রর মোহরাঙ্কিত রচনার উপর নিজের বিবেচনা অনুসারে রদবদল করতে বাধ্য হয়েছি বলে প্রেমেন্দ্রানুরাগীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। জানি যে এটা প্রেমেন্দ্রর লেখার উপর কলম চালাবার ঔদ্ধত্য, তবু সে-অন্যায় কাজ করেছি তার কারণ যা আদিপাঠে ছিল তা অবিকল রাখলে লেখকের মর্যাদা রক্ষিত হত না বলেই আমার বিশ্বাস।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন পাঠকপাঠিকার পক্ষে প্রেমেন্দ্র মিত্র কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে ভেবেও সংশোধনের চেষ্টা করিনি। যেমন ‘পৃথিবী বাড়ল না কেন’ গল্পে জাইর নামে একটি রাজ্যের উল্লেখ আছে, কিন্তু জাইর বলে কোনও রাজ্য আর নেই, যা আছে তা জাইর নামে একটি নদী আর যে-রাজ্যের নাম বেলজিয়মের শাসন থেকে স্বাধীনতা পাবার পরে জাইর হয়েছিল তার নাম আবার আগের নাম কঙ্গোই হয়েছে। ‘ঘনাদার ফুঁ’ গল্পে মঙ্গোলিয়ার রাজধানীর নাম আগে Ulan Bator ছিল, বর্তমানে এর নাম Ulaanbaatar. এই রকম আরও কিছু কিছু পরিবর্তন সম্পাদনের অবকাশ ছিল বা আছে যেগুলি লেখক সশরীরে থাকলে হয়তো করতেন, কিন্তু আমি সেগুলো স্পর্শ না করাই উচিত মনে করেছি।
ঘনাদার মতো বিশ্ব-ভ্রমণ না করলেও ঘনাদার স্রষ্টা প্রেমেন্দ্রও কিছু কিছু বিদেশ-ভ্রমণ করেছিলেন। প্রথমবার তিনি বিদেশ যান ১৯৫৭ সালে, উপলক্ষ ছিল, বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-কবিতা-উৎসব, তাতে যোগদানকারী ভারতীয় প্রতিনিধি-দলের নেতা ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সেই সূত্রে তিনি ইটালি ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিডারস গ্রান্ট লাভ করে। আর সোভিয়েত দেশ থেকে নেহরু পুরস্কার পেয়ে রাশিয়া ও উজবেকিস্তান পরিক্রমা করেন ১৯৭৬ সালে। নেহরু পুরস্কার ছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর কালের সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত। এসব পুরস্কারের মধ্যে আছে ঘনাদার গল্পগুলির জন্য রাজ্য সরকার প্রদত্ত ১৯৫৮ সালের শিশু সাহিত্য পুরস্কার; কিন্তু ক্রমশই স্পষ্ট হতে লাগল যে ঘনাদার গল্পগুলি শুধু শিশুদের জন্য নয়, সব-বয়সিদের জন্য। তিনি অন্যান্য যেসব পুরস্কার পেয়েছেন সেগুলির মধ্যে আছে ১৯৫৪ সালের শরৎ-স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৫৭-র সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, ১৯৫৮-র রবীন্দ্র পুরস্কার, ১৯৭৩-এর আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪-র বিদ্যাসাগর পুরস্কার ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি যেসব সম্মান পান সেগুলির মধ্যে ১৯৮১-তে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত সাম্মানিক ডি. লিট, ওই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত জগত্তারিণী পদক, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৮-র ১৬ জানুয়ারি তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বিশ্বের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশিকোত্তম উপাধির সম্মান গ্রহণ করেন। অল্পকাল পরে তাঁর স্বাস্থ্যর দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। অবশেষে ৪ মার্চ তাঁকে সাদার্ন অ্যাভেনিউ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের সংযোগে অবস্থিত এক নার্সিং হোম-এ নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু তাঁর বিশেষ ইচ্ছাক্রমে ক-দিন বাদেই ফিরিয়ে আনতে হয় বাড়িতে। ৩ মে তাঁর মহাপ্রয়াণ। এবং সেই সঙ্গে ঘনাদারও নতুন নতুন বিশ্বব্যাপী কীর্তিকাহিনীর অবসান।
এই খণ্ড সম্পাদনে প্রচুর সাহায্য পেয়েছি শ্রীমান শুভেন্দু দাশমুন্সীর কাছ থেকে— বিশেষত ঘনাদার অগ্রন্থিত গল্পগুলি তিনিই সংগ্রহ করে দিয়েছেন—তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আরও অগ্রন্থিত রচনার সন্ধান যদি কারও কাছ থেকে পাই তাহলে আমাদের তা অনুগ্রহ-পূর্বক দিলে আমরা সেটি পরবর্তী মুদ্রণে স্বীকৃতি-সহ সংযোজন করতে পারব।
এই খণ্ডের শেষে পরিশিষ্ট বিভাগে আছে প্রথম দু-খণ্ডে সংকলিত গল্পগুলির মধ্যে যেগুলির প্রথম প্রকাশের কাল পাওয়া গেছে সেগুলির প্রাসঙ্গিক তথ্য। এই পরিশিষ্টও শুভেন্দুর রচনা। প্রেমেন্দ্র-র অনুরাগিবৃন্দের কাছে অনুরোধ—যেসব গল্পের প্রথম প্রকাশের কাল জানানো গেল না সেসবের সংবাদ যদি কেউ জানান তাহলে তা যথোচিত স্বীকৃতি সহ আমরা প্রকাশ করব।
সুরজিৎ দাশগুপ্ত
১ ডিসেম্বর ২০০০ কলকাতা
Leave a Reply