গৌড়ানন্দ সমগ্ৰ – গৌরকিশোর ঘোষ
সম্পাদনা – অভ্র ঘোষ
প্রকাশক : সুধাংশুশেখর দে, দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : ৫ আষাঢ় ১৪৩০, ২০ জুন ২০২৩
প্রচ্ছদ : রঞ্জন দত্ত
.
সংকলকের নিবেদন
১
১৯৮৯ সালে আনন্দ পাবলিশার্স গৌড়ানন্দ কবি ভনে শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। লেখক গৌরকিশোর ঘোষ। লেখকের জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থের প্রকাশ। স্বভাবতই ধরে নেওয়া যায়, এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত সাতষট্টিটি রচনা তাঁরই নির্বাচন। লেখাগুলিকে সাজিয়েছিলেন চারটি পৃথক পর্বে— ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৮৩ এবং ১৯৮৪ সালে লিখিত নকশাগুলিকে পরপর সাজিয়ে। দুটি রচনা ছিল পরিশিষ্টভুক্ত— সে দুটি লেখা ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের। গৌড়ানন্দ কবি ভনে বইটি এখন আর পাওয়া যায় না, বহুকাল আগেই এই সংস্করণ নিঃশেষিত।
গৌরকিশোর ঘোষের শতবর্ষে আমরা যে গৌড়ানন্দ সমগ্র সংকলনটি তৈরি করছি— সেটি কিন্তু পুরনো সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ নয়। এই গ্রন্থের আকার ও প্রকার আরও বিস্তৃত। পুরনো সংস্করণে ছিল সাতষট্টিটি লেখা, এই সংস্করণে পাওয়া যাবে একশ ঊনচল্লিশটি রচনা। উপরন্তু এই সংস্করণে যুক্ত হল দুটি গুরুত্বময় পরিশিষ্ট। প্রথম পরিশিষ্টে আছে গৌড়ানন্দ কবি ভনে শীর্ষক সেই বিখ্যাত রচনাটি যা ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় (২৬ জুন ১৯৭৫) আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। নিষিদ্ধ সেই রচনা ১৯৭৫ সালেই জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁর কলকাতা পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। কলকাতা পত্রিকার বিশেষ রাজনীতি সংখ্যায় সে লেখার শিরোনাম ছিল ‘পূর্ণ সমর্থন লাভের সহজ উপায়’। প্রথম পরিশিষ্টে আরও দুটি রচনা জুড়ে দেওয়া গেল— গৌড়ানন্দ কবি ভনে-এর সে-দুটি নকশা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে আজকাল পত্রিকায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই সময়ে গৌরকিশোর ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ছেড়ে নতুন দৈনিক আজকাল-এ সম্পাদকরূপে যোগ দিয়েছিলেন। খুব বেশি কাল অবশ্য থাকেননি সেখানে, ফিরে এসেছিলেন আবার আনন্দবাজার পত্রিকায়।
এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট-২ তৈরি করা হল আরও বাইশটি নকশা দিয়ে। আনন্দবাজার পত্রিকাতে এই রচনাগুলির শিরোনাম ছিল হিং টিং ছট্। লিখতেন গৌড়ানন্দ। তখন ‘কবি ভনে’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করতেন না গৌরকিশোর। হিং টিং ছট্ মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হত। ১৯৬০ সালে পাওয়া যাচ্ছে একটি, ১৯৬১-তেও একটি, ১৯৬২-তে চারটি, ১৯৬৩-তে তিনটি, ১৯৬৪-তে তিনটি, ১৯৭২-এ দশটি। সর্বমোট বাইশটি নকশা।
গৌড়ানন্দ কবি ভনে শিরোনামে নকশাগুলি প্রকাশিত হতে থাকে ১৯৭৩ সাল থেকে ডিসেম্বরে শুরু হয়েছিল। ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫-এর জুন মাস পর্যন্ত এটি ছিল সাপ্তাহিক কলাম। মাঝেমাঝে দু-একবার ছেদ ঘটেছে, কিন্তু মোটামুটিভাবে ছিল ধারাবাহিক। জরুরি অবস্থার সময় লেখকের কারাবাস ঘটায় গৌড়ানন্দ কবি ভনে বন্ধ হয়ে গেল। জেল থেকে মুক্তির পর ১৯৭৭ সালের বাইশে জানুয়ারি আবার আত্মপ্রকাশ করলেন গৌড়ানন্দ। ওই বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবেই বেরোত রচনাগুলি। এরপর গৌরকিশোর চলে যান আজকাল পত্রিকায়, সেখানেও গৌড়ানন্দ কবি ভনে-র দুটি লেখা পাওয়া যাচ্ছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রত্যাগমনের পর ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার পাওয়া গেল গৌড়ানন্দকে। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মোটের ওপর সাপ্তাহিক কলাম। কিন্তু তারপর থেকে খুবই অনিয়মিত এবং সংখ্যায় খুবই সীমিত। শেষ রচনা ১৯৯৩-এর ২২ সেপ্টেম্বরে।
২
প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে গৌড়ানন্দ কবি ভনে— ‘ভণে’ নয়, ‘ভনে’। ‘ভণা’ একটি ক্রিয়াপদ, সহজ মানে বর্ণনা করা বা বলা। যেমন সকলেই জানেন, ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে’। কিন্তু ‘ভনা’- সেও তো ক্রিয়াপদ, সে-শব্দের অর্থও তো প্রচার করা, তুচ্ছার্থে মশামাছির ভনভনও মনে পড়ে। ১৮৭৮ সালে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘মাছির ভনভনানিতে, তৈজসের ঝনঝনানিতে। গৌড়ানন্দ ‘ভণে’ লিখলেন না, লিখলেন ‘ভনে’। এই পার্থক্যটি পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায়, কিন্তু এড়ানো ঠিক নয়। যিনি নকশা লেখেন, তিনি গুরুমশাই নন, তিনি আর্টিস্ট। কথাটা ধার করলাম ১৯৪৪ সালে লেখা বিনয় ঘোষের নববাবুচরিত থেকে। বিনয় ঘোষ লিখেছিলেন, ‘হিউমারিস্ট বা স্যাটারিস্ট গুরুমশাই নন, আর্টিস্ট’। হিউমারিস্ট বা স্যাটারিস্ট-এর দায়িত্ব প্রবল। তাঁকে হতে হবে ক্লাসিক কমেডিয়ান, তাঁর উদ্দেশ্য ‘to Chasten morals with ridicule’। একথার প্রেক্ষিতেই দেখতে পাচ্ছি, গৌরকিশোর ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত গৌরানন্দ কবি ভনে বইটিতে স্বতন্ত্র কোনো ভূমিকার বদলে তিনটি সহজ বাক্য লিখেছিলেন,
বাঙালি বহুদিন যাবৎ মজা করিতে এবং মজা পাইতে ভুলিয়া গিয়াছে। গৌড়ানন্দ কবি বাঙালি পাঠক পাঠিকাকে মজার বাজারে টানিয়া আনিতে চেষ্টা করিয়াছেন। প্রয়াস সফল হইলে তাঁহার পরিশ্রম সার্থক হইবে।
পাঠককে মজানোর জন্য ও নির্মল হাসিতে মুখর করার জন্য গুরুগম্ভীর ‘ভণে’-র প্রয়োজন হয়নি, ‘ভনে’-ই যথেষ্ট। কিন্তু তার সঙ্গে মর্যালও ছিল। রাজনৈতিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সুপ্ত মরাল। কিন্তু বেজায় তীক্ষ্ণ।
ভালো হাসি হাসতে হলে পাঠককে সমাজের মধ্যে এনে দাঁড় করাতে হবে, রাজনীতি-সচেতনতাও বিশেষ প্রয়োজন। তা না হলে রাজা হাসবেন, পারিষদরা হাসবেন অথবা চটে লাল হবেন,— পাঠকের উপভোগ্য হবে না। গৌড়ানন্দ পাঠককে উদ্বুদ্ধ করতে চান। রাজনৈতিক অনুষঙ্গ তাই বিশেষ প্রয়োজন। গৌড়ানন্দ পাঠককে মজার সাগরে ভাসাতে চান, তাই গুরুবিষয়কে লঘু ভঙ্গিতে রসালো করে পরিবেশন করেন। পাঠক সেসব রসের সন্ধান পেয়ে সবসময়ে যে হাসে, তাও নয়, কখনও কান্নাও পায়, রাগও হয়। কারণ গৌড়ানন্দের নকশার বিষয়বস্তু শুধু টিপিকাল নয়, টপিকালও বটে। সমসময়ের ঘটনার ব্যাখ্যা পেলে হাসির সঙ্গে রাগও তো আসবে! কিন্তু হাসিটাই বড়ো কথা, রাগ হলে হবে। এই নকশাগুলি পড়তে পড়তে আমাদের কার্টুনের কথাও মনে পড়তে পারে। নামজাদা কার্টুনিস্ট কুট্টি—কেরালার পি কে এস কুট্টি (১৯২১)— গৌরকিশোর ঘোষের সমসাময়িক ছিলেন। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এ তিনি কলামও লিখতেন— আর কার্টুন তো ছিলই। তাঁর কার্টুন ছাপা হত আনন্দবাজার পত্রিকাতেও। তাঁর লেখা বিখ্যাত আত্মস্মৃতি years of Laughter : Reminiscences of a cartoonist (২০০৯)-এ কুট্টি লিখেছেন, ‘Now I made every Bengali begin his day with a laugh’। কুট্টির কার্টুন কি শুধুই হাসির জন্য? সেকথা কেউই মানবেন না— নকশা ও কার্টুনের চরিত্রে বস্তুত কোনও ভেদ নেই, দুইই পাঠককে মজার ভিতর দিয়ে সচেতন করে তোলে— খবরের কাগজের শুকনো হাজারো খবর যা করে উঠতে পারে না, একটি নকশা বা একটি কার্টুন তা নিমেষে করে ফেলে। সে-কারণেই নকশা-কার্টুন সৃষ্টিধর্মী— আর্টিস্টের কাজ।
বাংলা সাহিত্যে নকশা বহু পুরনো ঐতিহ্য। উনিশ শতকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্যারীচাঁদ মিত্র থেকে তা শুরু। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা তো কিংবদন্তি হয়ে আছে। বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অমৃতলাল, বীরবল, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, কেদারনাথ, পরশুরাম, দিবাকর শর্মা, সজনীকান্ত, বনফুল, বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্র (বিরূপাক্ষ) বা বিনয় ঘোষও নকশা লিখেছেন। এঁদের বেশিরভাগ নকশার বিষয় সমাজ ও সংস্কৃতি। দৈনন্দিন সংকীর্ণ রাজনীতি মুখ্য হয়ে ওঠেনি। সেদিক থেকে গৌড়ানন্দ বা রূপদর্শী (গৌরকিশোরের অপর ছদ্মনাম) ভিন্ন গোত্রের। গৌড়ানন্দের নকশা সরাসরি সমকালের রাজনীতি নিয়ে, আগেই বলেছি, টিপিকাল শুধু নয়, টপিকাল নকশা। প্রায় খবরের কাছাকাছি, খবরের সূত্র ধরে। এই বিচারে গৌরকিশোর অনন্য। বাঙালির রাজনৈতিক সাহিত্য বিষয়ে যদি কোনও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করতে হয়, তবে গৌড়ানন্দের এই রসসম্ভারকে গ্রাহ্য করতেই হবে। রাজনৈতিক জীবনের অভব্য কপটতা ও অসঙ্গতি এই নকশাগুলির মধ্যে অবিরাম বিচ্ছুরিত হয়েছে। রাজনৈতিক জগতের সজ্ঞান ভণ্ডামি ও নির্লজ্জ আস্ফালন গৌড়ানন্দের আক্রমণের বিষয়। সেখানে তাঁর দৃষ্টি শুধু স্বচ্ছ নয়, নিৰ্ভীক এবং মর্মভেদী। ক্ষুরধার ব্যঙ্গ ও তীক্ষ্ণ কষাঘাত গৌড়ানন্দের রচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। শ্লেষ, ব্যঙ্গ, ক্যারিকেচার যে শিল্পবোধসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে গৌড়ানন্দে কবি ভনে-র ছত্রে ছত্রে তার প্রমাণ মেলে। জ্ঞানতাপস সাহিত্যিক রাজশেখর বসু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, কিন্তু পরশুরামের রচনাসম্ভার রসবোধসম্পন্ন বাঙালিকে এককালে চাঙা করে তুলেছিল। অগ্রজ এই সাহিত্যিক রূপদর্শী ও গৌড়ানন্দ পড়ে এতটাই উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি আলাপিত হওয়ার জন্য গৌরকিশোরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
গৌরকিশোর শুধু সাহিত্যিক নন, পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। সাহিত্যের ভাষায় সঙ্গে সাংবাদিকতার ভাষার ভিন্নতা আছে। গৌড়ানন্দ সে-বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত। ফলে রঙ্গরসিকতাময় নিষ্ঠুর সমালোচনামূলক এই নকশাগুলিতে গৌড়ানন্দ সাহিত্য-ভাষার চাইতে সাংবাদিকতার ভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ ‘লেখকের বিষয় প্রাত্যহিক রাজনীতির ঘটনাবলি, নেতা ও তাঁর অনুগামীদের কার্যকলাপ। দুর্দশাগ্রস্ত ভণ্ড রাজনৈতিক ঘটনাবলির অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ। সেখানে সাহিত্য-ভাষা আড়ম্বরের কারণ হবে, সত্যসন্ধানে পাঠককে আকর্ষণ করবে না। অতএব আটপৌরে সাংবাদিকতার ভাষা নকশার পক্ষে মানানসই— গৌড়ানন্দ একথা ভালো করেই জানতেন। কিন্তু সাহিত্যিক গৌরকিশোর অন্তর্হিত হন না, কোনও একটি ঘটনাকে বা কোনও এক নেতার বুলিকে কী-আকারে পেশ করলে– তা পাঠকের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠবে— সেকথা লেখক ভালোই জানতেন। গল্পকার বা ঔপন্যাসিকের মুন্সিয়ানা থেকে নকশাগুলি বঞ্চিত হয়নি।
ক্যারিকেচারে সিদ্ধহস্ত গৌড়ানন্দ— তার বহু রূপ। আপাতত একটি রূপের দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সেটি হল নাম-মাহাত্ম্য— প্রপার নেমের ব্যঙ্গাত্মক সংস্করণ। এ-বিষয়ে গৌড়ানন্দ তাঁর পূর্বসূরি পরশুরামপন্থী। পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা সরাসরি ব্যবহার করেন গৌড়ানন্দ তাঁর একটি নকশায় (দ্রষ্টব্য ১৩৮ নং নকশা)। গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়া, সারস্টি কসি, রাজকুমারী পণ্ডচণ্ড, চিত্রতারকা জিগীশা দেবী— পরশুরামকৃত এসব নাম ব্যবহারে মনে পড়ে যায় গৌড়ানন্দ ব্যবহৃত শ্রীতেলুয়ারাম তেলিফুকন, কেবলানন্দ রামমূলাজি, গুঙ্গাবাঈ চাঁটছোড়ে, ভোটরুলু ব্যাঙ্কাপ্পা বজরংবলি সহায়, দালালচাঁদ ফসফরাস, কমরেড দামোদর, রেলবোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রী গড়গড়ি, জাতীয় সার সংস্থার মুখপাত্র শ্রী ওস্লাগাণ্ডি অসার খলু সংসারম ইত্যাদি অজস্র কল্পিত নাম ব্যবহারে।
ক্যারিকেচার এখানেই শেষ নয়, কিছু কিছু নকশায় নাম-বিভ্রাটের উল্লেখও চমকপ্রদ। অদ্ভুত এক শিরোনামে ভাইরাস্ ইনডিক্যানডিকাস্ রচনা শুরু হয় এক নাম-বিভ্রাট দিয়ে। সাংবাদিক বলেন, ‘ড: ভাইয়া ভারালু—’, উত্তরে পার্লামেন্টারি এপিডেমিক কনট্রোল ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলে ওঠেন, প্লিজ জেন্টলম্যান অফ দি প্রেস… আমার নাম ড: পরিষদাপ্পা সংক্রমণ নিরোধন ভাইরা ভায়ালু। বা সংক্ষেপে ড: পি এস এন ভাইরা ভায়ালু।’ ইত্যাকার নাম-বিভ্রাট অনেকগুলি নকশাতেই আছে এবং সেগুলো অকারণ আমোদের জন্য নয়। বিষয়বস্তুর চরিত্রে এমনকিছু কিম্ভূত ঘটনাবলি আছে, যার সঙ্গে এইসব নাম-বিভ্রাট সংগতিসম্পন্ন। যেমন আরেকটি নকশা ‘ও-কে-আ অর্থাৎ ওদের কে আছে’-তে রচনা শুরু হচ্ছে
শ্রীসদা চকচাকাপ্পা অবিনাশী ভাবমূর্তি বললেন, না কখনোই আমার চেহারা খারাপ হয় না। আমাকে এখন যে-রকম দেখছেন, আগেও সেই রকমই দেখেছেন। এবং ফিউচারেও আশা করি, আমাকে এই রকমই তরতাজা দেখবেন।
—আচ্ছা শ্রীসদা চকচকাপ্পা অবিনাশী ভাবমূর্তি—
—যদি অতবড় নামটা বলতে আপনার অসুবিধা হয় তবে আপনি শুধু অবিনাশী ভাবমূর্তিই বলুন না; ওটা আমার ফ্যামিলি নেম্ও বটে…
দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে কাজ নেই, পাঠক গৌড়ানন্দের চমকপ্রদ রচনাগুলি পড়লেই পদে পদে রসসাগরে নিমজ্জিত হবেন।
গৌরকিশোর ঘোষ ঘোষিতভাবেই ফ্যাসিস্ট-বিরোধী, মার্কসবাদ-বিরোধী। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে মানবতাবাদ, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রোজ্জ্বল। তরুণ বয়সে মার্কসপন্থী ছিলেন বটে, কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দর্শনের দিকে আসক্ত হন। এবং তাঁকে ‘রায়পন্থী’ বলেই মানুষ মনে করেন। শিবনারায়ণ রায়-অম্লান দত্তরা ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অম্লান দত্ত তাঁর বন্ধু গৌরকিশোরকে নিয়ে একটি মূল্যবান রচনা লিখেছিলেন অগ্রহায়ণ ১৪১০ বঙ্গাব্দে রচনাটির নাম ‘তলিয়ে যাবার আগে’। অম্লান দত্ত লিখেছেন,
… মৌল মানবতাবাদী নামে পরিচিত রয়েছেন গৌরের যে বন্ধুজনেরা, তাঁদের অনেকের চেয়েই গৌরের যুক্তিনিষ্ঠা ও মানবতাবাদ আরও মৌল। যুক্তির শুদ্ধতার জন্য দরকার হয় হৃদয়ের ব্যাপ্তি ও শুদ্ধতার, সেই সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয় সাহস। গৌরের ভিতর এই দুর্লভ গুণের অভাব ছিল না। আমাদের পরিচিত সমাজ তবু যে গৌরকে অস্বস্তির সঙ্গে দূরে ঠেলে রাখেনি তার বিশেষ কারণ ওর আত্মপ্রকাশের ভঙ্গি। ওর নিঃস্বার্থতা ছিল প্রশ্নাতীত, যুক্তি হয়ে ওঠেনি স্বার্থের দাস।
অম্লান দত্ত তাঁর র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট বন্ধুর চারিত্র বিচার করেছেন গৌরকিশোরের সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করার সূত্রে। আমরা কিন্তু ওই মৌল মানবতা ও প্রখর যুক্তিবোধের সঙ্গে পাচ্ছি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহ অবারিত হাস্যরস। গৌড়ানন্দ কবি ভনে তাই ভিন্ন স্বাদের সাহিত্য বা সংবাদ-সাহিত্য। নকশা নামে যা পরিচিত বাংলা সাহিত্যে।
অম্লান দত্ত গৌরকিশোর ঘোষের ‘মৃত্যুঞ্জয় সাহস’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর সমগ্র জীবনের বাঁকে বাঁকে ওই সাহসের দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের স্তরেও, তাঁর পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল সত্তাতেও। এ-বিষয়ে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বময় দৃষ্টান্ত ১৯৭৫ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় সারা দেশব্যাপী অন্যায্য-ধৃষ্টতামূলক-স্বৈরাচারী জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময়। সাংবাদিক-সাহিত্যিক-কবি-শিল্পীদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। গৌরকিশোর অভিনব উপায়ে তাঁর প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি লেখক। আমার কলমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। আমার মাতৃবিয়োগের থেকে তা কোন অংশে কম?’ একথা জানিয়ে তিনি তাঁর মাথা কামিয়ে ফেললেন, বললেন এতেও যদি কাজ না হয় ‘গলায় কুকুরের বকলস’ লাগিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াবেন। শাসককুল ভয় পেয়েছিল, তাঁকে দীর্ঘ কারাবাসের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। কারাগারের মধ্যে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। রুগ্ন শরীর নিয়েই তিনি পরবর্তী জীবন কাটিয়েছেন। অথচ দমে যাননি, কারামুক্তির পর আবার ক্ষুরধার কলম চালিয়েছেন। একই সঙ্গে দেশ পত্রিকায় রূপদর্শী নামে, আনন্দবাজার-এ গৌড়ানন্দ কবি ভনে শিরোনামে।
গৌরকিশোর ঘোষিতভাবেই মার্কসবাদ-বিরোধী— একথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তাই বলে তিনি জাতীয় কংগ্রেস বা অন্য কোনও দলকেও সমর্থন করেননি। দলীয়তার ঊর্ধ্বেই ছিল তাঁর চলাচল। ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনৈতিক দলাদলির কলঙ্কপঙ্ক তাঁকে ছুঁতে পারেনি। তিনি সারাজীবন ক্ষমতার পাঁকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন— ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নিক্ষেপ করেছেন শানিতভাবে। রাজনৈতিক স্বৈরাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, নীতিবিবর্জিত পার্টি-পলিটিক্সকে নির্মমভাবে আক্রমণ করেছেন তিনি তাঁর সাংবাদিক জীবনে। অন্যদিকে তাঁর সুবিশাল সাহিত্যকর্ম নিয়োজিত হয়েছে নৈতিকতার পক্ষে, সামাজিক কল্যাণের সপক্ষে। হিংসার বিরুদ্ধে, নির্বীর্যতার বিরুদ্ধে তাঁর কলম ঝলসে উঠেছে।
আর তাঁর লড়াই ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। প্রেম নেই জাতীয় উপন্যাস-গল্পে তা স্পষ্ট ধরা পড়ে। রূপদর্শীর কলামেও তার মুহুর্মুহু প্রকাশ ঘটেছে। আর সাম্প্রদায়কিতার মতো বিষাক্ত বস্তুটিকে ব্যবহার করে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি যে ভোটের রাজনীতিতে সুযোগ গ্রহণ করার ফন্দি-ফিকির করে, তা ব্যক্ত করে ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে তিনি লিখেছিলেন ‘ধর্মান্ধতা এবং সেকুলারিজম’-এর মতো রচনা। অল্প একটু অংশ উদ্ধৃত করছি :
আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, তিনি বামপন্থীই হোন কি দক্ষিণপন্থী হোন সেকুলারিজমের চর্চা ত্যাগ করে ভোট কুড়োবার ফিকিরকেই সার বলে আশ্রয় করেছেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষিত অংশও আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে পারেননি, সমাজের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করতে তাঁরা ভয় পেয়েছেন। ফলে তাঁরা মাইনরিটি কমপ্লেক্সকে মূলধন করে এক চক্ষু হরিণের মতো কেবল চান এমন সুবিধা যে তার দ্বারা কয়েকজন মাতব্বর স্থানীয় লোকই ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হচ্ছেন। গোটা সমাজটা রয়ে গেছে সেই তিমিরে। ফলে হচ্ছে এই যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সুবিধালোভী কিছু লোক তাঁদের পথের কাঁটা সরাবার জন্য নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রকৃত বঞ্চিত লোকদের উসকে দিচ্ছেন। ভোট-নির্ভর রাজনীতির আবর্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষ কেমনভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে— তার এক অব্যর্থ বিশ্লেষণ এটি। সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু— দুই পক্ষকেই গোলকধাঁধায় ছেড়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা। এর মুক্তি যে সংসদীয় রাজনীতি বা অন্য কোনও ভোটের রাজনীতিতে নেই, আছে সমাজবিপ্লবে আর স্বার্থহীন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে— সেকথা গৌরকিশোর যথার্থ বুঝেছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় যে-মৌল মানবতাবাদী দর্শনের কথা বলেছিলেন, ‘বিয়ন্ড মার্কসিজমের’ প্রশ্ন তুলেছিলেন— রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীকে সংলগ্ন করে গৌরকিশোরের মনোভাব সেই যুক্তির পথেই চালিত হয়েছে। এ-বিষয়ে সোহিনী ঘোষ তাঁর এক রচনায় জানিয়েছেন, গৌরকিশোর তাঁর এক মাস্টারমশাই গৌরীপ্রসাদ বসুর দ্বারা প্রথম এই মানবতাবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। মাস্টারমশাই অবশ্য পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে গেছেন, গৌরকিশোর মানবেন্দ্রনাথের দর্শনেই আস্থা রেখেছিলেন। (নিপাতনে সিদ্ধ, রূপদর্শী গৌরকিশোর, দে’জ পাবলিশিং, ২০২২)
৩
এই সংকলনটি তৈরি করতে গিয়ে আমরা লেখক-কৃত বানান বজায় রেখেছি। রচনার কোনও অংশ বাদও দিইনি, পরিমার্জনাও করিনি। পুরনো লেখা সংকলন করতে গিয়ে সংকলকেরা এই কাজগুলি কখনও কখনও করে থাকেন বলেই প্রসঙ্গটা তুললাম। এক্ষেত্রে রচনার অংশবিশেষ বাদ দেওয়া বা পরিমার্জনা করা আমাদের চরম ধৃষ্টতার পরিচয় হবে— সেরকম বিপজ্জনক ঝুঁকি নেওয়ার কথা কল্পনাতেও আসেনি।
গৌরকিশোর ঘোষের কনিষ্ঠ কন্যা অধ্যাপক সোহিনী ঘোষ গৌড়ানন্দ কবি ভনে এবং হিং টিং ছট্-এর সমস্ত রচনাগুলির ফটোকপি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। ফলে আনন্দবাজার পত্রিকা বা আজকাল পত্রিকার দপ্তরে আমাকে যেতে হয়নি, ঘরে বসেই কাজটা করতে পেরেছি। এই সুত্রে জানানো কর্তব্য, কয়েকটি রচনার শিরোনাম আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশের সময় যা ছিল, গৌড়ানন্দ কবি ভনে বইটিতে (১৯৮৯, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড) লেখক পরিবর্তন করেছিলেন। বর্তমান গ্রন্থে আমরা লেখক-কৃত পরিবর্তিত শিরোনাম ব্যবহার করেছি। সংশ্লিষ্ট রচনাগুলির পাদটীকায় পত্রিকায় ব্যবহৃত শিরোনাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ-বিষয়ে সোহিনী ঘোষের সাহায্য পেয়েছি। নকশাগুলির প্রসঙ্গ-সূত্র সন্ধান করার ব্যাপারে আমাকে অপরিসীম সাহায্য করেছে আবাহন দত্ত ও সেমন্তী ঘোষ। আর কয়েকটি সূত্র-সন্ধানের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার লাইব্রেরি এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরির কর্মীদের সাহায্য পেয়েছি। তাঁদের প্রতি আমার সকৃতজ্ঞ অভিবাদন জানাই বিশেষ কৃতজ্ঞতা শ্রী শক্তিদাস রায়ের কাছে, তাঁকে আমার নমস্কার জানাই সোহিনী আমার অসমবয়সি বন্ধু— তাঁর সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জানাই অপার প্রীতি ও ভালোবাসা। সেমন্তী আর আবাহনের জন্যও স্নেহ-ভালোবাসা। গ্রন্থটি নির্মাণের সময় একটি বিশেষ সংকট পার হতে সাহায্য করেছেন শুভলক্ষ্মী ও শ্রীরূপা— তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। গ্রন্থের প্রচ্ছদ-শিল্পীকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। মুদ্রণ-কর্মীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। দে’জ পাবলিশিং এর কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
গৌরকিশোর ঘোষের রচনাসম্ভার আবাল্য পাঠ করেছি— সমৃদ্ধ হয়েছি। তাঁর শতবর্ষে এই কাজটি করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের সুযোগও ঘটে গেল এই সূত্রে।
অভ্র ঘোষ
Leave a Reply