গোলাপ সুন্দরী – উপন্যাস – কমলকুমার মজুমদার
প্রথম সংস্করণ ১ বৈশাখ ১৩৫৪
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ – সুনীল শীল
উৎসর্গ – স্নেহের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে
‘গোলাপ সুন্দরী’ গলপটি বই আকারে প্রকাশিত হল। আমার স্বামী, স্বর্গত শ্রীকমলকুমার মজুমদার লিখিত ‘গোলাপ সুন্দরী’ গল্পটি প্রথমে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, পরে কৃত্তিবাসে পুন্ররমুদ্রণ হয় । এই গল্পটি বহুদিন যাবৎ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘গোলাপ সুন্দরী’ গলপটি, বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারে শ্রীমজুমদারের অন্তরঙ্গ-ভক্ত শ্রীমান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশেষ সাহায্য করেছেন । বইটি প্রকাশিত হওয়ায়, মনে হয় বহুমনের প্রত্যাশা পূর্ণ হবে…।
–দয়াময়ী মজুমদার
গোলাপ সুন্দরীর পটভূমিকা
কমলকুমার মজুমদারের ‘গোলাপ সুন্দরী’র পটভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে কিছু কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে পড়বেই। তাতে একালের পাঠকদের পক্ষে কমলকুমারের রচনা সঠিকভাবে উপলব্ধি করার কিছুটা সুবিধে হতে পারে।
১৯৫৩ সালে কমলকুমারের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়। তখন তিনি পরিণত যুবা পুরুষ । বলিষ্ঠ দেহ, মসৃণ কালো রং, চোখ দুটি অতি উজ্জল এবং ওষ্ঠে সব সময় কৌতুক হাস্য । আমরা তখন কলেজীয় ছোকরা, পৃথিবী তো দূরের কথা, এই কলকাতা শহরটাকেই তখনো ভালো করে চিনি না।
তাঁকে আমরা প্রথমে দেখি একজন নাট্য পরিচালক হিসেবে । সেই সময় ‘হরবোলা’ নামে একটি থিয়েটার ক্লাব খোলা হয়েছিল, যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত এবং পরামর্শদাতাদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সয়ীদ আইয়ুব, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ। পরে জ্যোতিরিন্দ মৈত্র এসেছিলেন আমাদের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এবং প্রথম থেকেই ফৈয়াজ খার সাক্ষাৎ শিষ্য সন্তোষ রায় নিযুক্ত ছিলেন গান শেখাবার জন্য । আমরা লক্ষ্মণের শক্তিশেল” পালার মহড়া শুরু করার কয়েকদিনের মধ্যেই কমলকুমার মজুমদার এসে যোগ দিলেন আমাদের মোশান মাস্টার হিসেবে ।
পরিচয়ের আগে আমরা তাঁর নামও শুনিনি । । তিনি যে লেখক এটা জানতে আমাদের ঢের দিন লেগেছিল। তার আগে আমরা জেনেছিলুম যে আমাদের এই নাট্য পরিচালক খুব ভালো ছবি আঁকেন, প্রায় সময়েই মার্গ সঙ্গীত গুনগুন করেন, ফরাসী ভাষা অতি উত্তম জানেন এবং কথা বলেন উনিশ শতকের বাঙালীদের বৈঠকী কায়দায় ।
আমরা নাটকের দল খুলেছিলুম বটে, কিন্তু নাট্য জগতের চন্দ্র-সূর্য হবার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের ছিল না । সাহিত্যের প্রতিই ছিল আমাদের সর্বাঙ্গীণ টান । নাটক মঞ্চস্থ করার চেয়ে মাসের পর মাস ধরে শুধু মহড়া দিয়ে যাওয়াতেই ছিল আমাদের বেশী আগ্রহ এবং সেই সঙ্গে আডিডা । দিলীপকুমার গুপ্ত যেমন ছিলেন এই নাটকের দলের মধ্যমণি, আবার তারই উৎসাহে ও ঔদার্যে আমরা প্রকাশ করতে শুরু করি তরুণতম কবিদের কবিতার পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’ । তিনি ছিলেন বিদগ্ধ ব্যক্তি, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে গভীর জ্ঞান ছিল, বিশেষত বাংলা কবিতার প্রতি ছিল তার তীব্র ভালোবাসা । ‘হরবোলা’র আসরে তিনি সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের বিষয়ে নানান অশ্রুতপূর্ব কাহিনী শোনাতেন আমাদের । এবং আমাদের সৌভাগ্য এই যে, আমাদের সঙ্গীত পরিচালক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র একজন বিশিষ্ট কবি, তিনিও যোগ দিলে আমাদের সেই আডডায় আমরা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য রস পেতাম এবং পরের সপ্তাহের জন্য তৃষিত হয়ে রইতাম। কিছুদিন পরেই আমরা আবিষ্কার করলাম যে আমাদের নাট্য পরিচালকেরও প্রধান আসক্তি সাহিত্যে, অগাধ তার পড়াশুনো এবং দেশী-বিদেশী সাহিত্যের বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও তার অসাধারণ। অবশু তখনও টের পাইনি যে তিনি নিজেও একজন লেখক ।
আমরা অল্পদিনেই তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়লুম এবং হরবোলার আড্ডার শেষে আমরা একই সঙ্গে বাসে চেপে বাড়ি ফিরতুম বলে (হরবোলার দপ্তর ছিল এলগিন রোডে সিগনেট প্রেসের বাড়িতে, আর আমরা প্রায় সকলেই থাকতুম শ্যামবাজারের কাছাকাছি, কমলকুমার আরও উত্তরে) আরও অনেকক্ষণ তাঁর সঙ্গ পেতুম, এর পরেও পাঁচ মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্পে গল্পে মধ্য রাত্রি পার করা । শব্দ ব্যবহারের অসীম ক্ষমতায়, শুধু কথা দিয়ে তিনি আমাদের মন্ত্ৰমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন ।
হরবোলা নামের প্রতিষ্ঠানটি বেঁচে ছিল কিঞ্চিৎঅধিক চার বছর । এর পরেও আমরা কমলকুমার মজুমদারের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে যাই ।
কমলকুমারের রচনা প্রসঙ্গে এই হরবোলা-পর্বটি তুলে ধরার বিশেষ কারণ আছে। এর আগে তিনি সাহিত্যপত্র ও চতুরঙ্গে কয়েকটি ছোট গল্প লিখেছিলেন মাত্র এবং মাঝখানে বেশ কিছুদিন সাহিত্যরচনা থেকে সম্পূর্ণ বিরত ছিলেন । হরবোলা-আসরের ধারাবাহিক সাহিত্য প্রসঙ্গ নিশ্চয়ই তাকে নতুন ভাবে উদ্বুদ্ধ করে। এই সময়েই তিনি হাত দেন তার প্রথম উপন্যাস রচনায় । অকস্মাৎ একদিন তিনি আমাদের একটি অখ্যাত পত্রিকা উপহার দিলেন, তাতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পূর্ণ উপন্যাস ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ ।
পুস্তকাকারে প্রকাশের পর ‘অন্তর্জলি যাত্রা পাঠক মহলে কোনো সাড়া জাগায় নি। তাঁর খ্যাতি কিছু নবীন লেখকদের, বিশেষত কবিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমরা এই উপন্যাস পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলুম বলা যায়। এরকম কোনো রচনা আমরা বাঙলা ভাষায় আগে পড়িনি। প্রথমে বেশ শক্ত লেগেছিল, এক একটি বাক্য, খুবই দীর্ঘ, বারবার পড়েও সঠিক অর্থ বোঝা যায় না, কিন্তু শব্দ ব্যবহারের অপূর্ব ব্যঞ্জনায় এটা ঠিকই বুঝতুম যে অসাধারণ কিছু আস্বাদন করছি। ফৈয়াজ খানের তালগুলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছন্দ এবং কারিকুরি আমরা যেমন সব বুঝতে পারি না কিন্তু অনুভব করতে পারি যে একজন মহৎ শিল্পীকে শ্রবণ করছি । অন্তর্জলি যাত্রা সাধু ক্রিয়াপদে লেখা এর বাক্য গঠনরীতির সঙ্গে পরিচিত বাংলার কোনো মিলই নেই। আমরা তখন কারংকা ও জয়েসে দীক্ষিত হয়েছি, তবু বুঝেছিলুম, কমলকুমারের রচনার জাত ওঁদের থেকেও আলাদা ।
এবার ‘গোলাপ সুন্দরী’ প্রসঙ্গে আসি। এই রচনাটির সঙ্গে গোড়া থেকেই আমরা কয়েকজন জড়িত। আমাদের ‘কৃত্তিবাস’ ছিল তখন শুধুই কবিতার পত্রিকা, অন্য কিছু তাতে ছাপা হতো না । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই গদ্য লেখক বন্ধুরাও এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। তখন আমরা ঠিক করেছিলুম যে কবিতার কৃত্তিবাসে গদ্যের অনুপ্রবেশ ঠিক হবে না বটে, কিন্তু ঐ কৃত্তিবাস নামেই আর একটি গল্পের পত্রিকা প্রকাশিত হবে । অর্থাৎ গল্প ও কবিতার জন্য একই নামে দুটি আলাদা পত্রিকা । এই গল্প-কৃত্তিবাসের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়
কমলকুমারের গল্প ফৌজ-ই-বন্দুক। দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য তিনি রচনা করতে শুরু করেন
‘গোলাপ সুন্দরী’ ।
প্রত্যেকদিন আমরা গোলাপ সুন্দরীর একটু একটু অগ্রগতির কথা শুনতুম। যেমন, টি বি স্যানাটোরিয়ামের রোগীদের জন্য একজন বিনামূল্যে এপিটাফ লিখে উপহার দিতে চায় ; একটি নারী যে একবার জল রং-এর চিত্র আবার কখনো ভাস্কর্য ; একজন কারুর ছেলেবেলা তার বাগানের গোলাপে ফুটে উঠবে ; একজন কারুর খরচ করার মতন নিঃশ্বাস কম আছে বলে সে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে না,… ইত্যাদি । ছোট গল্প হিসেবে শুরু হয়ে লেখাটি ক্রমশ বড় হতে থাকে। গোলাপ সুন্দরী সমাপ্ত হবার পর এক সন্ধ্যায় ওয়েলিংটনের মোড়ে একটি সাঙ্গুভেলি রেস্তোরায় আমাদের কয়েকজনকে কমলকুমার সেটি পুরো পাঠ করে শোনান । মনে আছে, প্রচণ্ড নেশার ঘোরে বাড়ি ফিরেছিলাম সেই রাত্রে । সেই বয়েসে, এ রকম একজন লেখককে সামনাসামনি দেখছি, এজন্য আমি নিজেকে ধন্য জ্ঞান করেছিলুম।
প্রবল অর্থাভাবে আমরা গল্প-কৃত্তিবাসের দ্বিতীয় সংখ্যা আর প্রকাশ করতে পারিনি। সেই সময় আমাদেই বন্ধু নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘এক্ষণ’ নামে একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ হচ্ছিল, লেখকের সম্মতিক্রমে ‘গোলাপ সুন্দরী’ দেওয়া হয় সেই পত্রিকায়। পরে তিনি ‘এক্ষণ’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে যান এবং তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগুলির মধ্যে ‘দেশ’ পত্রিকার দুটি বাদে বাকি সব ঐ পত্রিকাতেই বেরিয়েছে । এই সূত্রে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় ইন্দ্রনাথ মজুমদারের, যিনি কমলকুমারের বাকি জীবন ভাই-বন্ধু-পুত্রের মতন সঙ্গে থেকেছেন এবং কমলকুমার মজুমদারের গল্প সংগ্রহ প্রকাশ করে তাকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দেন ।
গোলাপ সুন্দরী কমলকুমারের শ্রেষ্ঠ রচনা কি না জানি না, তবে তার সম্পূর্ণাঙ্গ সার্থক দু’ তিনটি রচনার অন্যতম নিশ্চয়ই । ‘গোলাপ সুন্দরী’ অনেককাল দুর্লভ হয়ে ছিল, পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবার ফলে বাংলা সাহিত্যের গৌরব বৃদ্ধি হলো ।
যাঁরা কমলকুমারের রচনায় দীক্ষিত, তাদের কাছে গোলাপ সুন্দরীর ভাষারীতি বেশ সহজ ও সাবলীল মনে হবে, কেন না, শেষের দিকে ক্রমশ তাঁর রচনা আরও জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিল। একেবারে শেষ জীবনের দু একটি লেখা বারবার পড়ে আমিও যেন সঠিক মর্ম-উদ্ধার করতে পারছি না মনে হয়েছে । সেই তুলনায় গোলাপ সুন্দরী সরল নিশ্চয়ই। তবু, সদ্য নতুন পাঠকদের কাছে এই গোলাপ সুন্দরীর ভাষাও প্রাথমিক বাধার সৃষ্টি করতে পারে বোধহয় । সেই জন্য কয়েকটি কথা বলা দরকার ।
কমলকুমারের ভাষা একেবারেই অন্য রকম । কেন এরকম ভাষায় ৷ তিনি লেখেন, সে প্রশ্ন অনেকবার করেছি। এক এক সময় এক এক রকম উত্তর দিয়েছেন তিনি । যেমন, বাংলা গদ্যের বাক্য বিন্যাস তৈরি হয়েছে ইংরেজির অনুকরণে । কমলকুমারের মতে, যদি বিদেশী রীতি নিতেই হয়, তবে ফরাসী বাক-ভঙ্গী অনেক বেশী কাম্য । তিনি ইংরেজি-প্রভাব অস্বীকার করে ফরাসী-রীতিতে বাংলা গদ্য লেখেন । আবার কখনো বলেছেন, হাটে-বাজারে, বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে যে-ভাষায় আমরা কথা বলি, সে ভাষায় সাহিত্য রচনা উচিত নয় । সাহিত্য হচ্ছে সরস্বতীর সঙ্গে কথা বলা, তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ভাষা তৈরি করে নিতে হয় ।
তবে, এগুলোও বোধহয় সঠিক যুক্তি নয় । আধুনিক বাংলা গদ্য অনেকখানিই রবীন্দ্র-অনুসারী। গদ্যে এই রবীন্দ্র-প্রভাব তার তেমন মনঃপূত ছিল না, তিনি পছন্দ করতেন বঙ্কিমের গদ্যের দৃঢ়তা এবং মনে করতেন, বাংলা গদ্য বঙ্কিম-দৃষ্টান্তেই চলা উচিত ছিল । তবুও, সাধু ক্রিয়াপদ আঁকড়ে ধরে থাকলেও, কমলকুমারের গদ্য ঠিক বঙ্কিমী গদ্য নয়, এ তাঁর নিজস্ব তৈরি করা ভাষা। নিজের লেখার জন্য একজন লেখক আলাদা ভাষা তৈরি করে লিখেছেন, এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বেশী নেই।
তাঁর বিষয়বস্তুও অভিনব । তিনি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের লেখক হলেও তার গল্পউপন্যাসে সমসাময়িক জীবন প্রসঙ্গ কদাচিৎ এসেছে। তিনি গত শতাব্দীর বাঙালী-গৌরবে মুগ্ধ ছিলেন বলে তার অনেক রচনারই পটভূমি গত শতাব্দী। অথবা, এই শতাব্দীর গোড়ার দিক । তার শৈশব-কৈশোরের পর্যবেক্ষণ ও স্মৃতি নিয়ে লিখতেই তিনি ভালোবাসতেন । গোলাপ সুন্দরীর পটভূমিও স্বাধীনতার আগের আমলের। তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠাটিই বেশী জটিল । যেন তিনি পাঠকদের পরীক্ষা করতে চান । শাল-সেগুনের জঙ্গল দেখেই যারা ফিরে যেতে চায় তাদের তিনি চন্দনের বনে পৌঁছোবার পথের সন্ধান দিতে চান না । সেইজন্য পাঠকদের বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন । যেমন, গোলাপ সুন্দরীর প্রথম বাক্যটি : “বিলাস অন্যত্ৰে, কেননা সম্মুখেই, নিম্নের আকাশে, তরুণসূৰ্য্যসবর্ণ কখনও অচিরাৎ নীল, বুদ্বুদসকল, যদৃচ্ছাবশতঃ ভাসিয়া বেড়াইতেছে”। প্রথমেই তিনি একটা রঙের । প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করলেন, এবং এর একজন দ্রষ্টা আছে, তার নাম বিলাস, সে একজন যুবক, তার মন এখন অন্যত্র । কমলকুমারের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি মানুষের অনুভূতি, তার পরিবেশ, তার রচিত দৃশ্যের বর্ণনা দেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে, সেই তুলনায় চরিত্রগুলিকে আঁকেন কয়েকটি মাত্র আঁচড়ে । বিলাসের জামাইবাবু মোহিতের চেহারাটি কেমন তিনি বললেন না, কিন্তু তার গাড়িটির বর্ণনা চমৎকার। মোহিতকে অবশ্য তার বাক-ভঙ্গীর জন্য আমাদের চিনতে একটুও অসুবিধে হয় না, কারণ সে নিজের কাছে নিজেই অত্যন্ত
ফেমাস ম্যান ।
গল্পের শুরু একটি স্যানাটোরিয়ামে। যক্ষ্মা যেমন এক সময় ছিল রাজরোগ, তেমনি এক সময় সাহিত্যে বিষয়বস্তু হিসেবেও এই রোগটি রাজ-স্থান পেয়েছিল । দেশ-বিদেশের অনেকগুলি বিখ্যাত উপন্যাস লেখা হয়েছে এই রোগীদের নিয়ে । ন্যানাটোরিয়ামের বর্ণনা টমাস মান-এর উপন্যাসে আছে অসাধারণ, কমলকুমার সেই স্যানাটোরিয়ামকে আনলেন সম্পূর্ণ নতুন রূপে । হাসপাতাল মানেই রক্তহীনতা, আর তিনি প্রথমেই সেই হাসপাতালকে ভরিয়ে দিলেন রক্তে । বিলাস হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছে, তার দিদি-জামাইবাবু তাকে নিতে এসেছে, সেই সময় বাইরে মোহিতের গাড়ির ফুটবোর্ডে (এখনকার গাড়িতে এ জিনিস থাকে না ) বসে একটি গ্রাম্য বালক সাবানজলের ফেনার বুদ্বুদ ওড়াচ্ছে অসংখ্য। সেই সব স্থডেল, ছাতিসম্পন্ন, সুন্দর, উজ্জল, বাবু, অভিমানী,আশ্চর্য বুদ্বুদগুলি ভরিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল । সেই ভ্ৰাম্যমাণ বুদ্বুদ, গতিশীল বর্ণচ্ছটা, যা কয়েক মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়, তা দেখে বিলাস মুগ্ধ, কারণ সে ছুটি পেয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক রোগী চঞ্চল ও ব্যথিত হয়। চেট্টি নামে একজনের মনে হয় সেই বুদ্বুদ ভ্ৰাম্যমাণ নিদ্রা, চলন্ত এপিটাফ। এবং সে তার প্রিয় এপিটাফটি উচ্চারণ করে । এখানে লেখক বাংলা অক্ষরে আট লাইনের একটি ফরাসী এপিটাফ লিখে দিলেন, অর্থ বলে দেবারও চেষ্টা করলেন না, পাঠককে তিনি এমনই শিক্ষিত মনে করেন । গোলাপ সুন্দরী প্রথম পাঠের সময় আমরা অবশ্য সেরকম শিক্ষিত ছিলুম না, তাই অনুসন্ধান করে জেনেছি, সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী কবি স্কারোঁ-র রচনা ঐটি, তার নিজের এপিটাফ, কেউ যেন শব্দ না করে, কারণ এই প্রথম রাত্রে স্কারোঁ ঘুমোচ্ছে ।
এই পর্যন্ত দু’ তিনগুণ মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করলে, গোলাপ সুন্দরীর বাকি অংশের রস গ্রহণ করতে কোনো পাঠকের অসুবিধে হবার কথা নয় । গোলাপ সুন্দরীর মূল কাহিনীটি অতিশয় রোমাটিক । হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবার পর বিলাস কোনো স্বাস্থ্যকর নিরালা জায়গায় একটি বাগান বাড়িতে একা থাকে। সে বাগানে গোলাপ ফোটায়, বিশেষত একটি গোলাপ, যার রং ঠিক কী রকম লাল হবে তা সে নিজেই জানে না, যে গোলাপের জন্য নির্দিষ্ট একটি নারী আছে, সেই নারী কখনো সেই গোলাপের কাছে এলে তাকে আর ভালোবাসার কথা মুখে উচ্চারণ করতে হবে না । এক সময় আসে সেই নারী, তার নাম মনিক চ্যাটার্জি । সত্যিই সে এক সময়ে জলরঙের চিত্র, পরে ভাস্কর্য হয় । কাহিনীর চেয়েও বড় এর কাব্য সৌন্দর্য, কয়েকটি মাত্র চরিত্র তবু জীবনের কত দিক উদ্ভাসিত করেছেন লেখক, মৃত্যুকে দিয়েছেন মহান সংজ্ঞা ।
এই বই একাদিক্রমে বারবার পড়তে হবে । এমন বই বাংলা ভাষায় তেমন বেশী নেই, যা প্রত্যেকবার নতুন করে পড়লে প্রত্যেকবারই নতুন নতুন সূক্ষ্ম রসের সন্ধান পাওয়া যাবে।
–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Leave a Reply