গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
ভূমিকা
বিশ শতকের প্রথম তিন দশক পর্যন্ত গোয়েন্দা গল্প লেখার ক্ষেত্রে বাঙালি মেয়েদের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়নি৷ অথচ উনিশ শতকের শেষ ভাগে এসে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনি শীর্ষক যে নতুন জঁরটির সূচনা, তা ততদিনে অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে৷ দারোগাদের লেখা পুলিশি বিবরণ পেরিয়ে নাগরিক সাহিত্যের দরজায় তখন কড়া নাড়ছে সে৷ যদিও এই দীর্ঘ যাত্রাপথে অপরাধিনী এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধের শিকার হওয়া ছাড়া মেয়েদের অন্য ভূমিকা চোখে পড়েনি, কাহিনির কেন্দ্রে অর্থাৎ বিপদতারণ গোয়েন্দার চরিত্রে অবতীর্ণ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনি৷
প্রশ্ন উঠতে পারে, উনিশ শতকের শেষেই যখন মেয়েরাও ক্রমশ পা রাখছেন লেখালেখির জগতে, সেক্ষেত্রে মেয়েদের কলমেই কি তৈরি হতে পারত না এই গড্ডল প্রবাহের একটা ফিরতি বাঁক! তাহলে মনে করে নেওয়া যাক সৌদামিনী দেবীর কথা৷ বাংলা সাহিত্যে প্রথম অপরাধ-বিষয়ক কাহিনি রচয়িত্রী বলে স্বীকার করা হয় তাঁকে৷ সৌদামিনী দেবীর লেখা অপরাধনির্ভর কাহিনি ‘মাতঙ্গিনী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯৫ বঙ্গাব্দে৷ এক ব্যভিচারিণী স্ত্রীর স্বামীহত্যার ঘটনাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এ বইয়ের আখ্যান৷ যদিও নারীর উদ্দেশে সতীত্বশিক্ষা দিয়ে মূলত পিতৃতন্ত্রের পক্ষেই ওকালতি করেছিলেন সৌদামিনী দেবী, তবু ১৩০২-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা ঘোষণা করে; ‘‘লেখিকা পাপের চিত্র অঙ্কিত করিয়া স্বয়ং অনুতপ্তা হইয়াছেন, ইহা বস্তুতঃ নারী লেখনীর অযোগ্য৷’’ স্পষ্টত, নারীর যে চরিত্রকাঠামো সমকালীন বাঙালি সমাজে পূর্বনির্ধারিত হয়ে ছিল, সেই লক্ষ্মণরেখা বাংলা সাহিত্যে মেয়ে গোয়েন্দা এবং গোয়েন্দাকাহিনির লেখিকা, উভয়েরই আত্মপ্রকাশকে বিলম্বিত করে তুলছিল৷ উনিশ শতকের চলতি ধারা পেরিয়ে গোয়েন্দাকাহিনির নাগরিক সাহিত্যে প্রবেশের জন্য যখন আবশ্যিক শর্ত হয়ে দাঁড়ায় ‘ভালো’ মেয়েদের ‘চরিত্ররক্ষা’, সেখানে আদর্শ নারীর সঙ্গে হিংসাত্মক ঘটনার এমন জলচল ভাগ বজায় রাখার শর্ত মেনে আর যাই হোক, মেয়ে গোয়েন্দার উৎপত্তি সম্ভব ছিল না৷
সুকুমার সেনের মতে, সরলাবালা দাসীর লেখা ‘ঘড়ি চুরি’ ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি মেয়ের কলমে প্রথম গোয়েন্দা গল্প৷ ১৯৪২-৪৪ সালের মধ্যে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত ‘প্রহেলিকা’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামের দুটি সিরিজে মেয়েদের লেখা কয়েকটি গোয়েন্দা গল্পের খোঁজ পাওয়া যায়৷ বাকি লেখিকারা গোয়েন্দার ভূমিকায় পুরুষের একচেটিয়া অধিকার বজায় রাখলেও, এই ‘প্রহেলিকা’ সিরিজেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করল এক মেয়ে গোয়েন্দা৷ গোয়েন্দাসুলভ বুদ্ধি বা শারীরিক সক্ষমতা কেবল পুরুষেরই অর্জন, এই অনড় মিথের শিকড়ে শুধু আঘাত হানাই নয়, পূর্বপ্রচলিত ওই ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলা গোয়েন্দা-সাহিত্যের দুনিয়াকে চমকে দিল যে মেয়ে গোয়েন্দা এবং সেই চমকের জের ধরে রাখল আগামী অনেকগুলো বছর, তার জন্মও আর-এক মেয়ের হাতেই৷ তিনি প্রভাবতী দেবী সরস্বতী৷ দেব সাহিত্য কুটীরের সিরিজ সাহিত্যে প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর সৃষ্ট কৃষ্ণা চরিত্রের জনপ্রিয়তা তাদের সাহস জুগিয়েছিল একখানা সম্পূর্ণ ‘কৃষ্ণা’ সিরিজ তৈরি করতে৷ পুরুষের মতো বাহুবল নয়, ‘আকস্মিক বিপদে পড়ে শুধু উপস্থিত বুদ্ধির জোরে কেমন করে উদ্ধার পেতে পারেন’ মেয়েরা, এ বই যে সেকথা মনে করিয়ে দেয়-সিরিজ প্রবর্তনের এই বিজ্ঞাপনটিই এযাবৎ প্রচলিত মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার মিথকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট৷ কে জানে, নিজের জীবনঅভিজ্ঞতায় মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে যেভাবে চিনেছিলেন তিনি, তা-ই অবচেতনে তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল কি না কৃষ্ণার মতো এমন একটি আত্মপ্রত্যয়ী নারীচরিত্র সৃষ্টি করতে!
কৃষ্ণা সিরিজ প্রচলনের পরে আরও একটি মেয়েকে গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ করালেন প্রভাবতী দেবী৷ যা সেকাল তো বটেই, একালের পক্ষেও বোধহয় দুঃসাহস৷ অগ্নিশিখা রায় ওরফে শিখার একের পর এক অভিযানের কাহিনি নিয়ে ‘কুমারিকা সিরিজ’ নামে প্রকাশিত হল মোট এগারোটি বই৷ শিখা বাঙালি মেয়ে, কিন্তু তৎকালীন বাঙালি ঘরের গতানুগতিক ছাঁচে গড়া ঘরের কোণে বসে থাকা দুর্বল মেয়ে নয় সে৷ শারীরিক ভাবে সে যথেষ্ট সক্ষম, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী, আর সবচেয়ে বড়ো যে অস্ত্রটির ব্যবহার তার করায়ত্ত, তা তার মস্তিষ্ক৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যখন ভারতের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে চাইছে, ঠিক সেই সময় শিখা পাড়ি দেয় চট্টগ্রামে তার কাকার কাছে৷ এই যাত্রার এক উদ্দেশ্য ছিল বইয়ে পড়া যুদ্ধের স্বরূপ নিজের চোখে দেখা, আর-এক উদ্দেশ্য ছিল জন্মভূমি চট্টগ্রামকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত হওয়ার আগে আর-একবার দেখার ইচ্ছা৷ এই অভিযানে তার সঙ্গী হয়েছিল কলেজের বন্ধু মীরা৷ কিন্তু চট্টগ্রামে পৌঁছোনোর দিনই রাত্রিবেলা জাপানি বোমাবর্ষণের সময় শেল্টার খুঁজতে গিয়ে অপহৃত হয় মীরা৷ যুদ্ধের শহরে পুলিশের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়ার আশা না করে বন্ধুকে উদ্ধার করার জন্য শিখা মুখোমুখি হয় দুর্ধর্ষ দস্যুসম্রাট মংপোর৷
গোয়েন্দাগিরিতে এই শিখার প্রথম হাতেখড়ি৷ অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি তার আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই, প্রথম অভিযানের সাফল্য এবং খ্যাতির পর সে এই পথই বেছে নেয়৷ শিখার আরও একটি বৈশিষ্ট্য, পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলেও চাকরি নিতে তার অনীহা৷ কারণ সে কারও হুকুমে কাজ করতে চায় না৷ এই স্বাধীনচেতা মনোভাবই শিখা চরিত্রের মূল সুর৷ যদিও পরিবার বা বন্ধুবান্ধব কারোরই এতে সায় ছিল না৷ কাকা বলেছেন ‘বংশের নাম ডোবাবে নাকি’, কাকিমা বলেছেন ‘মেয়েদের এমন সাহস ভালো নয় বাপু, যা রয় সয় তাই ভালো’, এমনকি ‘নিজের সংসারের কথা ভুলে এমন ভাবে পরের কাজ নিয়ে হৈ হৈ করে’ বেড়ালে বাড়ির চাকর পর্যন্ত মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় তার ওপর৷ কিন্তু ‘‘কুমারী রায় বাঙ্গালী মেয়েদের সামনে আদর্শস্থানীয়া হয়ে থাকুন’’, সংবাদপত্রের এই দাবি থেকে বোঝা যায় সমাজের এক অংশ নারীকে এবার দেখতে চাইছে ভিন্ন অবতারে৷
এই চাহিদাকে চিনতে পেরেছিলেন প্রভাবতী দেবী৷ যাঁর উপন্যাসে গতানুগতিক নারী চরিত্রের ছড়াছড়ি, তাঁর এমন এক অভিনব নারী চরিত্র সৃষ্টির পিছনে পাঠকের চাহিদা মেটানোর এই ব্যবসায়িক তাগিদও ছিল বইকি৷ কুমারিকা সিরিজের শুরুই হয়েছিল কলেজপড়ুয়া মেয়েদের জন্য৷ বইগুলির শুরুতে পাঠিকাদের উদ্দেশে লেখিকা জানান; ‘‘শুধু ছেলেদের ছাড়া মেয়েদের ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র বই এ পর্য্যন্ত কেউ লেখেন নি৷ এই কারণেই ‘কুমারিকা সিরিজের’ আবির্ভাব৷ কোন আকস্মিক বিপদ এলে কলেজের মেয়েদের যা করা প্রয়োজন, ‘কুমারিকা সিরিজ’ পড়লেই তার ইঙ্গিত পেয়ে যাবে৷’’ সেদিনের মেয়েদের মধ্যে থেকে তাঁর নায়িকাকে তুলে আনেননি প্রভাবতী দেবী, বরং নারী যা হয়ে উঠতে পারে, ছাত্রীদের সামনে সেই আগামীর মডেল উপস্থিত করতে চেয়েছিলেন তিনি৷ আসলে গোয়েন্দা-সাহিত্যের ‘নাগরিকত্ব’ লাভের পাশাপাশি যে আমজনতা ছিল তার টার্গেট অডিয়েন্স, তারও তো রূপান্তর ঘটে গেছে৷ কলকাতার তলায় থাকা লোকেদের জায়গা নিয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরোয়া পাঠক, মূলত বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্দরমহল৷ স্ত্রীশিক্ষার প্রথম যুগে প্রহসনজাতীয় লেখায় শিক্ষিতা মেয়েদের কামতাড়িতা এক অস্বাভাবিক জীব বানিয়ে তুললেও, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলন যখন তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, তখন সেই একই ছকে আর নতুন যুগের বাজারকে ধরা যে সম্ভব হবে না, সে কথা বুঝেছিল গোয়েন্দাসাহিত্যও৷ ‘কলেজের মেয়েদের’ নতুন টার্গেট অডিয়েন্স হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাই লেখাতেও তাদের জায়গা দেবার প্রয়োজন ছিল৷ শিক্ষিতা মেয়েদের নিয়ে এত ব্যঙ্গ বিদ্রুপেও তাদের স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা যাচ্ছিল না৷ শিক্ষালাভের ফলে তাদের স্বনির্বাচনের অধিকারকে দমিয়ে রাখার কাজটা যে আর সহজ থাকছে না, এ কথাও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ক্রমশ৷ স্বাতন্ত্র্যের এহেন আকাঙ্ক্ষা রূপ পেয়েছিল শিখার মতো চরিত্রের মধ্যে দিয়ে৷ কিন্তু পিতৃতন্ত্রের সুপ্রাচীন শিকল ভাঙা সহজ ছিল না বলেই ‘স্বৈরাচারী দুর্বৃত্ত নরপশুদের কবল থেকে’ তার ‘নারীধর্ম্ম’ বজায় রাখার পবিত্র কর্তব্যটিও তাকে সম্পাদন করে যেতে হয়েছে বরাবর৷
এহেন দ্বন্দ্বকে ধারণ করে আছে বলেই এই সংকলন যতখানি গোয়েন্দাকাহিনির পাঠকের, নারীর কলমে লেখা নারীকেন্দ্রিক এই সিরিজ সাহিত্য ততখানিই সাহিত্য কিংবা মানবীবিদ্যাচর্চার চিন্তক-গবেষকের সম্পদ৷ কুমারিকা সিরিজ সেকালে প্রবল জনপ্রিয়তা পেলেও বহুদিন অপ্রকাশিত ছিল৷ অথচ বাংলা সাহিত্য, বিশেষত গোয়েন্দাসাহিত্যের গবেষণার ক্ষেত্রে বইগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য৷ বাংলা সাহিত্যে মেয়ে-গোয়েন্দার আবির্ভাবের প্রথম পর্বে যেমন তাদের সঙ্গে বাংলার পাঠকসমাজকে পরিচিত করানোর দায়িত্ব নিয়েছিল দেব সাহিত্য কুটীর, তেমনই আজকের মানবীবিদ্যাচর্চার উন্মুক্ত পরিসরে অধুনা বিস্মৃত এই চরিত্রকে পুনরাবিষ্কারের দায়িত্ব নিতে স্বীকৃত হয়েছেন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই প্রকাশনা সংস্থার বর্তমান কর্ণধারেরা৷ এই সংস্থার কর্মীরা আমার ধন্যবাদার্হ, যাঁরা পুরোনো বইগুলি খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছেন সর্বতোভাবে৷ ধন্যবাদ জানাই আমার শিক্ষক এবং গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডঃ মলয় রক্ষিতকে, গবেষণাধর্মী কাজের উৎসাহ আর শিক্ষা পাওয়া তাঁর থেকেই৷ দেব সাহিত্য কুটীরের সঙ্গে প্রভাবতী দেবীর ব্যবসায়িক চুক্তির কাগজপত্রগুলি উদ্ধার করার শ্রম স্বীকার করেছেন মানস ভাণ্ডারী৷ আমার সামগ্রিক বিদ্যাচর্চায় যিনি নিরলস উৎসাহ জুগিয়েছেন, এখনও যিনি আমার যে-কোনো লেখার সবচেয়ে উৎসাহী পাঠক, তিনি আমার মা, শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া বাহুল্য৷
রণিতা চট্টোপাধ্যায়
Leave a Reply