গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
সম্পাদকের নিবেদন
ন’বছর বয়সে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফেলে-আসা বাড়ির জন্য মনখারাপ করায় বাঁকা কথা কানে এসেছিল। মুহূর্তে নতুন বাড়ি আর সম্পর্ক, দুই-ই ছেড়ে সে ফিরে এসেছিল পুরোনো ঠিকানায়। কিছুদিন পরে আবার ঠিকানা বদল হল, এবার ভাইয়ের পড়াশোনার জন্য। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের সংসারে বোনের স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর চেয়ে ভাইয়ের কলেজে ভরতি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল বইকি।
বারবার এমন ছেড়ে যাওয়ার বাধ্যতাই হয়তো তাঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল মেয়েদের নিজের ঘর গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে। তাই চলতি ছকের মধ্যেও বারবার তাঁর কলমে উঠে আসছিল শিক্ষিতা, কর্মপটু, স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়েদের ছবি। যার গহনে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায় গতবন্দি তকমা পাওয়া এই লেখিকা পৌঁছোতে চাইছেন নারীর অনাশ্রয় আর সহায়হীনতার ইতিহাসে। সেই একই পরম্পরার অংশভাক প্রভাবতী দেবী তাদের সমাজ-নিয়তির প্রতারণা থেকে বাঁচাতে চাইছিলেন আত্মশৃঙ্খল আর কর্মশৃঙ্খলার নিদান দিয়ে। আর এই প্রণোদনা থেকেই হয়তো জন্ম গোয়েন্দা কৃষ্ণার। কে জানে, নিজের জীবনঅভিজ্ঞতায় মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে যেভাবে চিনেছিলেন তিনি, তা-ই অবচেতনে তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল কি না কৃষ্ণার মতো এমন একটি আত্মপ্রত্যয়ী নারীচরিত্র সৃষ্টি করতে!
যাঁর কথা বলতে চাইছি, তিনি প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। এগারো বছর বয়সে ‘তত্ত্বমঞ্জুরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা। শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশে লেখা ‘গুরুবন্দনা’। প্রথম উপন্যাস ‘প্রতীক্ষায়’। ১৯২৪ সালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে তাঁর প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘বিজিতা’। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না-পারা সেই মেয়েটি, লিখেছিলেন তিনশোরও বেশি বই। উপন্যাস, গল্প, নাটক, গান-কী নেই তাতে! তাঁর বই রঙ্গমঞ্চ আর চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয়। কেবল বাংলা নয়, হিন্দি ও মলয়ালমেও। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী রমা দেবীর সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে যোগাযোগ ছিল ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে। শোনা যায়, ‘মাটির দেবতা’ উপন্যাসটি লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ‘কল্লোল’, ‘বাঁশরী’, ‘সারথী’, ‘উপাসনা’, ‘উদ্বোধন’, ‘সম্মিলনী’, ‘সোহম্মদী’-র মতো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রচুর গল্প। নবদ্বীপের বিদ্দ্বজ্জন সভা থেকে পেয়েছিলেন ‘সরস্বতী’ উপাধি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লীলা পুরস্কার’। জীবদ্দশায় এতখানিই জনপ্রিয় ছিলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, যে, তাঁর নাম নকল করে বাজারে প্রচলিত উপন্যাসের বাড়াবাড়ি রুখতে তাঁকে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছিল। জামশেদপুর নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ পরিচালক ছিলেন প্রভাবতী। শ্যামাপ্রসাদই তাঁকে পরামর্শ দেন, নকল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে ‘সরস্বতী’ উপাধিটি বরং নামের সঙ্গেই জুড়ে নিন প্রভাবতী। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তাঁর লেখা উপন্যাসের চাহিদা এমন তুঙ্গে উঠেছিল যে একটি উপন্যাস শেষ হতে না হতেই প্রকাশ করতে হত পরবর্তী উপন্যাসের বিজ্ঞাপন। আর সেই জনপ্রিয়তার কারণেই দেব সাহিত্য কুটীরের বিখ্যাত দুটি সিরিজ ‘প্রহেলিকা’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-তে তাঁর সৃষ্ট কৃষ্ণা চরিত্রের সাফল্য, প্রকাশককে একখানা সম্পূর্ণ ‘কৃষ্ণা’ সিরিজ প্রকাশে প্ররোচিত করেছিল। উনিশ শতকের প্রৌঢ়ত্বে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনি বলে একটি নতুন জঁরের জন্ম হলেও রীতিমতো গোয়েন্দার ভূমিকার মেয়েদের অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। গোয়েন্দাসুলভ বুদ্ধি বা শারীরিক সক্ষমতা কেবল পুরুষেরই অর্জন, এই অনড় মিথের শিকড়ে শুধু আঘাত হানাই নয়, পূর্বপ্রচলিত ওই ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের দুনিয়াকে চমকে দিল যে মেয়ে গোয়েন্দা এবং সেই চমকের জের ধরে রাখল আগামী অনেকগুলো বছর, তার জন্মও হল আর-এক মেয়ের হাতেই। ‘আকস্মিক বিপদে পড়ে শুধু উপস্থিত বুদ্ধির জোরে কেমন করে উদ্ধার পেতে পারেন’ মেয়েরা, এ বইয়ে যে রয়েছে তার ইঙ্গিত-‘শুকতারা’-র বৈশাখ, ১৩৫৯ সংখ্যায় সিরিজ প্রবর্তনের এই বিজ্ঞাপনটিই এযাবৎ প্রচলিত মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার মিথকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। আর ‘মহিলা গোয়েন্দা’ বিষয়টিই যখন প্রায় অচেনা, সেকালে এই ঝুঁকি নেওয়া যে বিফল হয়নি, তা বোঝা যায় অব্যবহিত পরেই মেয়ে গোয়েন্দা অগ্নিশিখা রায়কে নিয়ে প্রভাবতী দেবীর আরও একটি সিরিজ প্রবর্তনে। লেখিকা জানান-”শুধু ছেলেদের ছাড়া মেয়েদের ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র বই এ পর্য্যন্ত কেউ লেখেন নি। এই কারণেই ‘কুমারিকা সিরিজের’ আবির্ভাব। কোন আকস্মিক বিপদ এলে কলেজের মেয়েদের যা করা প্রয়োজন, ‘কুমারিকা সিরিজ’ পড়লেই তার ইঙ্গিত পেয়ে যাবে।”
উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে সুগঠিত চেহারা, মাতৃভাষা ছাড়াও পাঁচ-সাতটা ভাষায় অনর্গল বাক্যালাপের দক্ষতা, অশ্বারোহণ, মোটর চালানো, এমন সব গুণের সমাহারে কৃষ্ণাকে নির্মাণ করেছিলেন লেখিকা। মা-বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই অকুতোভয় কৃষ্ণা পা বাড়িয়েছিল রহস্য উদঘাটনের পথে। আর সেখান থেকেই স্থির করে নিয়েছিল তার আগামী যাপনের গতিপথ। সে পথে অন্তর্নিহিত ছিল নিজের জীবন নিজের শর্তে বাঁচার ঘোষণা। সেই কারণেই কৃষ্ণা নিছক একটি গোয়েন্দা চরিত্র মাত্র নয়। সেদিনের নারী নয়, বরং নারী যা হয়ে উঠতে পারে, ছাত্রীদের সামনে সেই আগামীর মডেল উপস্থিত করতে চেয়েছিলেন চিরন্তনী শিক্ষিকা প্রভাবতী দেবী। তাঁর ধারণার আদর্শ নারী গড়ে তোলার তাগিদেই কৃষ্ণার জবানিতে জানিয়েছিলেন-”মেয়েরাও মানুষ মেসোমশাই! তারাও যে শিক্ষা পেলে ছেলেদের মতোই কাজ করতে পারে, আমি শুধু সেইটাই দেখাতে চাই। চিরদিন মেয়েরা অন্ধকারে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে, আমি তাদের জানাতে চাই, পিছিয়ে নয়-সামনে এগিয়ে চলার দিন এসেছে, কাজ করার সময় এসেছে-মেয়েরা এগিয়ে চলুক, তাদের শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিক।” এমন মেয়ে স্বপ্নে ছিল তাঁর! স্বপ্ন বলেই লাগাম ছিল না তাতে। ছিল আতিশয্য আর অতিনাটকীয়তা। পাশাপাশি মেয়েদের সম্বন্ধে প্রচলিত দীর্ঘদিনের নির্বুদ্ধিতার মিথ ভাঙতে পারলেও সহজ ছিল না সুপ্রাচীন পিতৃতন্ত্রের শিকল ভাঙা। কৃষ্ণা সিরিজের বিজ্ঞাপনে সদ্যস্বাধীন দেশের ‘মা-বোন’দের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হবার ডাক দিলেও সে স্বনির্ভরতার মধ্যে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভাবনার চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছিল ‘স্বৈরাচারীদের অত্যাচার’ থেকে আত্মরক্ষা। উনিশ শতকের চলতি ধারা পেরিয়ে গোয়েন্দাকাহিনির নাগরিক সাহিত্যে প্রবেশের জন্য এ তো আবশ্যিক শর্ত, ‘ভালো’ মেয়েদের ‘চরিত্ররক্ষা’। আসলে গোয়েন্দাসাহিত্যের নাগরিকত্ব লাভের পাশ-পাশি যে আমজনতা ছিল তার টার্গেট অডিয়েন্স, তারও তো রূপান্তর ঘটে গেছে। কলকাতার তলায় থাকা লোকেদের জায়গা নিয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরোয়া পাঠক, মূলত বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্দরমহল। কৃষ্ণার স্বাবলম্বী হওয়ার মধ্যে একইসঙ্গে পূর্ণতা পাবে তাদের অপূর্ণ ইচ্ছে, আবার তার সতীত্বরক্ষার আখ্যানে নিশ্চিন্ত হবে অভ্যস্ত পিতৃতান্ত্রিকতা। তাই প্রবল জনপ্রিয়তায় কৃষ্ণার মতো চরিত্রকে মর্যাদা দেওয়ার ছলে নারীকে তার পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞা মনে করিয়ে দেওয়ার রাজনীতিও হয়তো রয়ে গেল কোথাও। আর এই দ্বন্দ্বের ইতিহাস থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বিশ শতকের মানবীবিদ্যাচর্চার প্রেক্ষিতে কী প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে নারীর কলমে লেখা নারীকেন্দ্রিক এই সিরিজ সাহিত্য। এই বই তাই যতখানি গোয়েন্দাকাহিনির পাঠকের, ততখানিই সাহিত্য কিংবা মানবীবিদ্যার চিন্তক-গবেষকের সম্পদ।
‘প্রহেলিকা’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজে কৃষ্ণাকে কেন্দ্র করে চারটি উপন্যাস এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণা সিরিজের সাতটি উপন্যাস, সর্বমোট এগারোটি উপন্যাস স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। কৃষ্ণা সিরিজ সেকালে প্রবল জনপ্রিয়তা পেলেও বহুদিন অপ্রকাশিত ছিল। অথচ বাংলা সাহিত্য, বিশেষত গোয়েন্দাসাহিত্যের গবেষণার ক্ষেত্রে বইগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যের এই প্রথম মেয়ে-গোয়েন্দার সঙ্গে বাংলার পাঠকসমাজকে পরিচিত করানোর দায়িত্ব নিয়েছিল দেব সাহিত্য কুটীর। আজকের মানবীবিদ্যাচর্চার উন্মুক্ত পরিসরে অধুনা বিস্মৃত এই চরিত্রকে পুনরাবিষ্কারের দায়িত্ব নিতে স্বীকৃত হয়েছেন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই প্রকাশনা সংস্থার বর্তমান কর্ণধারেরা। এজন্য তাঁরা ধন্যবাদার্হ। কৃষ্ণা সিরিজের প্রথম বই, ‘কারাগারে কৃষ্ণা’-র সন্ধান পাওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ‘মলাট’ শীর্ষক একটি বই-বৈঠকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ জানাই আমার শিক্ষক এবং গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মলয় রক্ষিতকে, গবেষণাধর্মী কাজের উৎসাহ আর শিক্ষা পাওয়া তাঁর থেকেই। প্রভাবতী দেবী সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানিয়েছেন বন্ধু আবাহন দত্ত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য দুই সহপাঠী বন্ধু সৃজিতা সান্যাল ও বিবস্বান দত্তের সহযোগিতার কথা। আর গবেষণার পরিশ্রমকে পাশে থেকে সহজ করে তোলেন যাঁরা, আমার মা শিপ্রা চট্টোপাধ্যায় এবং বন্ধু ব্রতেশ, তাঁদের ধন্যবাদ দেওয়া বাহুল্য।
রণিতা চট্টোপাধ্যায়
বইমেলা, ২০২০
Leave a Reply