গীতগোবিন্দ – জয়দেব গোস্বামী
গীতগোবিন্দ – জয়দেব গোস্বামী
.
‘গীতগোবিন্দ’ কবি জয়দেব গোস্বামী বিরচিত সংস্কৃতি ভাষায় রচিত কাব্য।
বাঙালী পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে এখানে কবি জয়দেবের মূল সংস্কৃত গীতগোবিন্দ-এর সাথে সংযোজন করা হলো শ্রী শরচ্ছন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রী নগেন্দ্রনাথ ঘোষ কর্ত্তৃক প্রণীত ও প্রকাশিত (বঙ্গাব্দ ১৩০১ সাল) শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দের বাংলা পদ্যানুবাদ।
.
ভূমিকা
শ্রীজয়দেব গোস্বামীর বিখ্যাত গীত-গোবিন্দের বাঙ্গালা পদ্যানুবাদ নাই বলিলেই হয়। এ পর্য্যন্ত কেবল রসময় দাস নামে জনৈক-ভক্ত-কৃত একখানি পদ্যানুবাদ বাঙ্গালায় মুদ্রিত হইয়াছে। কিন্তু সেখানি বাস্তবিক অনুবাদ নয়; কেবল বাঙ্গালা পদ্যে মূলের ব্যাখ্যা। সেখানিকে গীত-গোবিন্দের বাল-বোধিণী-নামক টীক্র বাঙ্গালা পদ্যানুবাদ বলিলে অত্যুক্তি হয় না। বাঙ্গালী-হস্ত-প্রসূত জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গীতিকাব্যের বাঙ্গালা অনুবাদ নাই বলিয়া আমরা এ কার্য্যে সাহস করিয়া অগ্রসর হইয়াছি।
সম্প্রদায়-বিশেষের মতে জয়দেবের ভাষা ও ভাব অনেকস্থলেই রুচি-বিরুদ্ধ। এজন্য হয়ত কেহ কেহ বর্ত্তমানকালে তাহার বাঙ্গালায় অনুবাদ অনুচিত বলিয়া মনে করিতে পারেন। সমাজের অবস্থা-ভেদে কাব্যের ভাষার ও ভাবের গতি ভিন্ন হইয়া থাকে। কিন্তু কেবল সেই জন্যই যদি কোন প্রাচীন কাব্য বর্ত্তমানকালের রুচিসঙ্গত না হয় তাহা হইলেই যে সে কাব্য প্রকৃত কবিত্বের আদর্শ হইতে পারে না এমন নয়। আমাদের মত এই যে পরিবর্ত্তনশীল সাময়িক রুচির অনুরোধে চিরন্তন বিশ্ব-বিমোহনকারী কবিত্বের অবমাননা করা উচিত নয়। এ বিষয়ে পূর্ব্ব হইতেই অনেক আন্দোলন সকল দেশেই হইয়াছে। কিন্তু সে বিষয় এখানে আলোচনা করা আমাদের অনাবশ্যক। কারণ যাঁহাদের জন্য এ কার্য্যে ব্রতী হইয়াছি তাঁহারা শ্রীরাধাকৃষ্ণের ব্রজলীলা পার্থব চক্ষে দেখেন না। সেই প্রকৃত-ভক্তগণের পরিতোষ হইলেই আমরা আমাদের এ পরিশ্রম সার্থক মনে করিব।
পরিশেষে বক্তব্য যে তমলুক-নিবাসী বিখ্যাত সঙ্গীতাধ্যাপক শ্রীযুক্ত বাবু কিশোরীমোহন চট্টোপাধ্যায় ও শান্তিপুর-দিগ্নগর-নিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু যোগেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী গানগুলিতে সুর ও তাল যোজনা করিয়া আমাদের বিশেষ ধন্যবাদার্হ হইয়াছেন।
————————————
শ্রী শ্রী কৃষ্ণ-বন্দনা
বন্দ নারায়ণ শ্রীমধুসূদন
গোলোক বিহারী হরি।
বৈকুণ্ঠ বামন ব্রহ্ম সনাতন
দীনেশ দনুজ অরি।
মুকুন্দ মাধব যজ্ঞেশ যাদব
কেশী কংস বিনাশন।
কলুষ বারণ কমল লোচন
কৃষ্ণ অরিষ্ট দমন।
অচ্যুত মুরারি ভব-ভয়-হারী
শ্রীধর শ্রীনিকেতন।
কালিয় গঞ্জন যোগীন্দ্র রঞ্জন
বিষ্ণু বিপদ ভঞ্জন।
ত্রিভুবন গতি ত্রিভুবন পতি
ত্রিভুবন বিমোহন।
স্থাবর জঙ্গম সর্ব্ব জীবে সম
নির্ব্বিশেষ নিরঞ্জন।
খগেশ বাহন দৈত্যেশ দলন
নবীন নীরদ শ্যাম।
সৃজন পালন প্রলয় কারণ
শ্রীগোবিন্দ গুণ-ধাম।
সর্ব্ব সুশোভন যশোদা জীবন
কেশব করুণা সিন্ধু।
সরসিজাসন শমন শাসন
কমলা-কুমুদ-ইন্দু।
বন্দুক-অধর পীতাম্বর-ধর
চন্দন-চর্চ্চিত-অঙ্গ।
সুন্দর-বরণ ইন্দীবরানন
অনঙ্গ-গরিমা-ভঙ্গ।
রাধিকা-রমণ মুরলী-বদন
বৃন্দাবন-বন-চারী।
শ্রীনন্দ-নন্দন জয় জনার্দ্দন
ব্রহ্ম-গোপ-বেশধারী।
শ্রীশ্রীরাধিকা-বন্দনা
(রাগ ভঁয়রো। তাল ঠুংরি)
বন্দ ব্রজেশ্বরী বিশ্বেশ-সুন্দরী
ভানু-নরেশ্বর-বালা।
কুঞ্জ-বিহারিণী মঞ্জীর-ধারিণী
শ্যাম-তনু-হেম-মালা।
গোপ-বিলাসিনী গোলোক-বাসিনী
মাধব-মোহন-কান্তি।
সর্ব্ব-সুশোভিনী কেশব-তোষিনী
তাপস-মানস-শান্তি।
চারু-নিতম্বিনী কুঞ্জর-গামিনী
বিশ্ব-বিলোচন-লোভা।
পীন-পয়োধরা বন্ধু-জীবাধরা
ইন্দু-বিনিন্দিত-শোভা।
বিশ্ব-বিরঞ্জিনী বিঘ্ন-বিভঞ্জিনী
চঞ্চল-কাঞ্চন-হারা।
শীধুধরাননা নীরজ-লোচনা
নিত্য-নিরঞ্জন-দারা।
চঞ্চল-কুণ্ডলা চাঁচর-কুন্তলা
বংশী-বিনিন্দিত-নাশা।
রাস-রসেশ্বরী গোকুল-ঈশ্বরী
কোকিল-কূজিত-ভাষা।
বেণু-বিনোদিনী মোক্ষ-বিধায়িনী
পাপ-পয়োনিধি-পারা।
রক্ষ রাধারাণী শর্ম্মদা সর্ব্বানী
শ্যাম-সীমন্তিনী-সারা।
শ্রীশ্রীজয়দেব-গোস্বামী-বন্দনা
রাগিণী পিলু। তাল জৎ।
বঙ্গ-কাব্য-বনমালে নীল-কুবলয়
অন্তর তোমার শ্যাম-প্রেম-জ্যোতির্ম্ময়;
ভারতের জগতের গীতি-কাব্য-বনে,
তমাল-বিলাসী-কল-কোকিল সুতানে।
চির-বসন্তের চারু বিহার-কানন
হৃদয় তোমার পুণ্য বৃন্দাবন-বন।
দুলিছে লবঙ্গ-লতা ধীর সমীরণে সেথা,
পুঞ্জে পুঞ্জে বসন্তের কুসুম ফুটিছে।
গোপিনীগণের সঙ্গে নাচে শ্যাম রাস-রঙ্গে,
কুলে কূলে কল কল কালিন্দী ছুটিছে।
সেই হৃদি-কুঞ্জবনে মাহাইয়ে প্রেম-গানে
মাধব-মুরলী কভু মধুর বাজিছে।
কিশোরী সে বাঁশী-স্বরে আগুসারি অভিসারে
তব হৃদি কুঞ্জে শ্যাম সঙ্গে বিহরিছে।
সেথা সদা ঘন-শ্যাম-রূপ বিরাজিত
হেরিছেন রাধারাণী হয়ে বিমোহিত।
কভু বা বাজিছে সেই হৃদি-কুঞ্জবনে
বিরহ-বিধুর-বংশী সুকরুণ-স্বনে;
সে বাঁশরী-রব যেন চক্রবাক-স্বর
তব হৃদি-বৃন্দাবন-সরোবর-পর।
কভু প্রেম-সম্মিলনে সুখ-প্রস্রবণ
ভাসায়ে জগত করে সুধা-বরষণ।
ভাঙ্গিতে মানিনী-মান কৌশল সুন্দর
প্রথমে দেখালে তুমি সুকবি-প্রবর।
বৃন্দাবন-বিহারের প্রিয় সহচর
ছিলে তুমি মাধবের,রসিক-প্রবর।
শুনেছিলে বুঝি তাঁর মুরলী-মোহন
দ্বাপরে যাহার স্বরে মাতে বৃন্দাবন।
কোন শাপ বশে তাই আসি এ মরতে
পুন সেই বংশী রব শুনালে জগতে।
কুহকী-কল্পনা-বলে করিলে সৃজন
কলিতে এ বঙ্গে দ্বাপরের বৃন্দাবন।
হীনবল মোরা বৃথা হয়েছি প্রয়াসী
দেখাতে এ বঙ্গে পুন সে লীলা প্রকাশি।
ছায়া মাত্র তার যদি দেখাইতে পারি
গোসাঁই তোমার পদাম্বুজ অনুসরি,
সফল গণিব তবে মোদের জনমে
আশীর্ব্বাদ কর দেব এ দুই অধমে।
Bilash Deb
Hare Krishna. Is it the book original content probu?