গান্ধীজি : ফিরে দেখা
সংকলন ও সম্পাদনা – বারিদবরণ ঘোষ
প্রচ্ছদ : রঞ্জন দত্ত
প্রথম প্রকাশ : জুলাই ২০১৯
.
আহরণী
মোহনদাস কর্মচন্দ্র গাঁধি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। এক এক সময় ভাবি যে কেন ভারতবাসী, যাঁরা ছত্রিশকোটি দেবতার পূজারি, তাঁরা আরও একটা মানুষকে ভগবান না হলেও দেবতা বলে মূর্তি গড়ে পুজো করল না কেন? তাঁর কিছু ত্রুটি ছিল বলে? সে তো দেবতাদের তিন মুখ্য—ব্রহ্মা—বিষ্ণু—মহেশ্বর সবার অন্তত গাঁধিজির চেয়ে অনেক বেশি গলদ ছিল। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল সে কি মানুষ বলেই। কৃষ্ণও জরাব্যাধের তিরে মৃত্যুবরণে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি শুধু জাতির জনক হয়েই ছিলেন।
এই ‘জাতির জনক’—এই পরিচয়টিই তাঁকে সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছিল। জাতি একটা মিশ্র সত্তা—তাকে একমুখী রাখা অসম্ভব। সত্য অহিংসার চেয়ে অনেক বড়। অহিংসা একটা মনোবৃত্তি, সত্যাচারণ একটা শ্বাস—প্রশ্বাস—জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠতম উপকরণ। মিশ্রজাতিকে এই পথে নিয়ে আসাটা গাঁধিজির সাধনা ছিল, সাধ্য ছিল কি?
তাঁর শুরুটা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়—জাতিবিদ্বেষ প্রতিরোধের সূত্রে। প্রতিবাদ শুধু নয়, প্রতিরোধকে গতিশীল করা। সেটাই ‘হরিজন’ বোধনির্মাণের সূচক ছিল। ‘অমানিনা মানদেন’। আপামর শব্দটি আমরা আকছার ব্যবহার করি। কিন্তু শব্দটি অতখানি নিরীহ নয়। এই শব্দের জন্ম স্বীকৃতি দেয় ‘পামর’—এর অবচ অবস্থানকে। নীচ কথাটা পরিহারই করতে চাইছি।
ভারতবর্ষ আর দক্ষিণ আফ্রিকা এক নয়। বাঙালি ব্রাহ্মণ খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত হলেও তার জাত্যাভিমান যায় না। সে বলে আমি বামুন খ্রিস্টান! সেই দেশে সর্বসামাজিকতার একমনতা? কুঁজোর চিৎ হয়ে শোবার ইচ্ছে! সেই অসম্ভব কাজটাই তিনি হাতে নিয়েছিলেন। সম্ভব করান যেতো। ধর্মের দেশ ভারতবর্ষে ধর্মের প্রার্দুভাব একটু বেশি পরিমাণেই। এই বিচিত্র ও বিবিধ ধর্মচারী দেশে একজাতির স্বপ্ন দেখা বৃথা—এক প্রাণ একতা তো দূরস্থ। গাঁধি কেন ধর্মাচরণের আগে ‘হিন্দু’ কথাটা বসিয়ে রেখেছিলেন? বন্দেমাতরম লিখে বঙ্কিমচন্দ্র গালাগাল তো কম খাননি। তাঁরও তো একজাতির স্বপ্ন ছিল—আয়েষা আর জগৎ সিংহকে দিয়েই তো বাংলা উপন্যাসের রাজপথ শুরু হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে একটা বিদ্বেষ নিয়ে অচলয়াতনের পাঁচিল ভাঙবে কে? গাঁধিজি হয় তো তা সত্ত্বেও আরও এগোতে পারতেন। কিন্তু গণ্ডগোলটা যে অন্য জায়গায় জন্ম নিচ্ছিল—ধর্মের পাশাপাশি রাজনীতিটাও যে বাপুর হাত ধরে ফেলেছিল। ব্রিটিশদের তাড়ানোর রাজনীতির পাশাপাশি একে তাড়ানো ওকে খোদানোর রাজনীতিটা সুড়ঙ্গ থেকে বেড়িয়ে এসে প্রকাশ্য রাজপথে দাপাদাপি করতে লাগল। উত্তরপ্রদেশ—বিহার—বঙ্গে লড়াই লাগল। হিন্দু—মুসলমানের মধ্যে লড়াইটা কোনও কালে থেমেছিল বা চাপা পড়েছিল—ইতিহাস খুঁজে এমন একটা তারিখ কেউ খুঁজে পাবেন কিনা জানি না। কিন্তু ওর চেয়েও ভয়াবহ ঘরভেদী বিভীষণদের ক্রিয়াকাণ্ড। সত্য সেখানে পাত পাতবে কোথায়? ঘরটাই সামলানো গেল না তো বাইরেটা সামাল দেবে কেমন করে। একটা মানুষ সত্যের ব্যাপারকে তুলে ধরেছেন নিঃশর্তভাবে—শ্বাস—প্রশ্বাসের মতো সহজ গ্রহণ নির্গমনে। এত যোগধর্ম। কিন্তু যাঁরা দীক্ষা নিয়েছে, আরও কঠিন করে বললে যাঁরা জন্ম নিয়েছে বিয়োগধর্মে দীক্ষিত হবার জন্যে—গাঁধির সাধ্য কি তাকে যোগধর্ম শেখান। রবীন্দ্রনাথ মানবধর্ম কথাটি বারবার উচ্চচারণ করেছেন। গাঁধিজিকে শেষ পর্যন্ত বলতে হয়েছে ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’! হিংসাজড়ানো কথা কিনা বলা যাবে না নির্বিবাদে—কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা যুদ্ধ তো চলেই ছিল। সেটাতে ক্রমাগত ইন্ধন জুগিয়ে চলেছিল তাঁরই ঘরের মানুষেরা। ১৯১৭, ১৯২১ আর ১৯৯৫—এর গাঁধির মধ্যে তাই এত বদল। তবুও হাঁটুর নিচে বসন আনত হয় না, তার পদক্ষেপ অনুসরণ করার সাধ্যি তাঁর অনুগামীদের কজনের মধ্যে ছিল। কে তাঁর আত্মজীবনী নামকরণ করতে পারেন—জীবন আমার সত্য পরীক্ষার একটা উপকরণ।
দেখতে দেখতে তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পার হয়ে যাবে। গাঁধি চর্চার গতি কালের প্রবাহে কিন্তু ধুয়ে মুছে যাবে না। কারণ যতদিন আমরা থাকব—তাঁর দর্পণে নিজেকে দেখতেই হবে আমাদের। কত মানুষ তাঁকে কতভাবে দেখেছেন। সেই দেখাটা তাঁর জীবনীর চেয়ে অনেক কঠিন এবং কঠোর। কারণ তাতে নয়নলোভন কিছু নেই। তাঁর জীবৎকাল এবং তাঁর মরণোত্তর কালের চর্চা করেছেন বহু মানুষ। তিল তিল করে তাঁরা নিজেদের মতো করে বিস্ফোরণ করেছেন। কেউ কট্টর গাঁধিবাদী, কেউ তাঁর পরমবিরোধী। কিন্তু যুযুধান পক্ষের সবাই তার সত্যের প্রতি আগ্রহ, সত্যাচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেননি—কারণ সত্যকে তিনি সহজভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কেউ তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলির বিচার করে সেখানে গাঁধিকে দেখতে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই সহস্রলোচন আলোচকদের মধ্যে কিছু লেখাকে বেছে নিয়ে গাঁধিজির একটা সম্মিলিত জীবনী উপস্থাপিত করার জন্যেই এই সংকলনেই প্রকাশ। এও একটা দর্শন। সেখানে আমার দেখা আমার লেখা আশ্রহহীন। এবং তাঁদের লেখার আমারও আশ্রয়।
সেই আশ্রয় এই বইয়ের পাঠকও পাবেন। প্রীতিভাজন প্রদীপ আমাকে নৈবেদ্য সাজাবার ভার দিয়েছেন। সকলের পত্র—পুষ্পে এর সজ্জা। এ এক ধরনের আহরণ। সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা, ঋণস্বীকার।
বারিদবরণ ঘোষ
Leave a Reply