গাঞ্জে ফেরেশতে (চলচ্চিত্র ইতিহাসের দলিলগ্রন্থ) – সাদত হাসান মান্টো
গাঞ্জে ফেরেশতে (চলচ্চিত্র ইতিহাসের দলিলগ্রন্থ) – সা’দত হাসান মান্টো / অনুবাদ : মোস্তফা হারুন / ভূমিকা : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় / সটীক করণ : চণ্ডী মুখোপাধ্যায়
[১৯১২ সালের ১১ মে অমৃতসরের সিমরলো নামক স্থানে মান্টোর জন্ম। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে (হিন্দুসভা) প্রবেশ করে প্রগতিশীল লেখক বারী সাহেবের সংস্পর্শে আসেন। মান্টোর সাহিত্য জীবনের যাত্রা শুরু হয় অনুবাদের মাধ্যমে।
মান্টোর প্রথম গল্প ‘তামাশা’ এতে ছাপা হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পটভূমিকায় রচিত এই গল্প বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেকালে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা তখনও বেজে ওঠেনি। মান্টো বোম্বে চিত্রজগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। মান্টো এখানে সাপ্তাহিক ‘মোসাওয়ার’ নামক পত্রিকায় সম্পাদক নিযুক্ত হ। মান্টো অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে মাত্র দেড় বছর চাকরি করেন। এরপর বোম্বের ফিল্মিস্তান লিমিটেডে কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার হিসাবে নিয়োজিত হন। এখানে থাকতেই তিনি তার বিখ্যাত ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ (বোম্বে নগরীর চলচ্চিত্র উপাখ্যান) রচনায় হাত দেন।
বোম্বে নগরীতে তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অতিবাহিত করেন। একটি শান্তিহীন সংগ্রামমুখর জীবনের পরিশেষে তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে চলে যান এবং ১৯৫৫ সাল অবধি লাহোরে বসবাস করার পর দুঃখ দারিদ্র্য এবং হতাশা নিয়ে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন।]
.
[উর্দু সাহিত্যের অন্যতম আলোচিত নাম সা’দত হাসান মান্টো। গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে তাঁর রচনাগুলি আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়নে বলা হয়েছে, জীবনের এমন অন্তরঙ্গ সুর এবং নির্যাতিত সমাজের যৌন-বিকারগ্রস্ত মানুষের চরিত্র চিত্ৰণ মান্টোর কলমের স্পর্শে যে জীবন লাভ করেছে এমন আর হয় না। মুম্বই চলচ্চিত্র জগতের সাড়া জাগানো নায়ক-নায়িকা, কলাকুশলী ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লেখা তাঁর ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ বইটি এক সময়ে পাঠকমহলে তুমুল হই চই ফেলে দেয়। বইটি সম্পর্কে সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা যেমন থেকেছে, তেমনি রক্ষণশীলেরা নিন্দায় মুখরও হয়েছেন খুল্লামখুল্লা আলোচনায়। এসব সত্ত্বেও অস্বীকার করা যায়নি সা’দত হাসান মান্টোর ‘গঞ্জে ফেরেশতে’ উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি দলিলগ্রন্থ বিশেষ। তৎকালীন সংবাদপত্রে বইটির বিস্তারিত আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘আমাদের সামনে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত ইতিহাসের কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ নেই। ‘গঞ্জে ফেরেশতে’ নিঃসন্দেহে সে অভাব খানিকটা পূরণ করবে।’ উর্দু থেকে বইটির অনুবাদ করেছেন মোস্তফা হারুণ। বইটিতে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন অশোককুমার, নাসিম বানু, চিরঞ্জীব শ্যাম, নার্গিস, ভি এইচ দেশাই, আগা হাশর, হানিফ আজাদ, জিন্নাহ সাহেব, বারী সাহেব, বাবুরাও প্যাটেল, ইসমত চুঘতাই, কবি আখতার শিরাণী ও নূরজাহান।]
.
উৎসর্গ
মরহুম জহির রায়হান
ওবায়েদ-উল-হক
আজিজ মিসির
.
ভূমিকা । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
সা’দত হাসান মান্টো
সা’দত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫) এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধুনিক লেখকদের একজন। এ-কথা বলে, জানি, ভুল বলা হয়নি। কিন্তু, এরকম দায়সারাভাবে বললে যেন এমন একটা বৃত্তের পরিধি দেখানো হল, যার কোনো কেন্দ্রই নেই। সা’দত অন্যতম ঠিকই। আবার, এ উপমহাদেশে এখনও আর-একটি মান্টো খুঁজে পাওয়া যায়নি, এটাও মিথ্যে নয়। সা’দতের গল্পের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হল তার লেখার নিজস্ব স্থান ও সময় (টাইম-স্পেস)। কিন্তু, সে তো প্রেমচন্দেও আছে। পৃথিবীর সমস্ত ভালো লেখায় এটা তো থাকতেই হবে। মানুষকে আগে পুরুষ, নারী বা এমনকি নপুংসক যা হয় একটা হয়ে জন্মাতে তো হবে। তারপর না অন্য কিছু! কিন্তু, সা’দত যে অন্য, তার কারণ অন্যত্র। তার লেখায় আমরা পাই এক নিরঙ্কুশ অবজেক্টিভিটি–যেখানে লেখকের ধ্যান-ধারণার একটুও অনুপ্রবেশ নেই। একটা লেখা পড়ে আছে, কিন্তু লেখকের নাম নেই, এমনটা যদি ভাবতে পারেন তো ব্যাপারটা সেইরকম। এবং লেখক পুরোপুরি অনুপস্থিত বলে পাঠক তার নিজস্ব ভূমিকা এখানে খুব সহজেই নিয়ে নিতে পারে। এক কথায় প্রতিটি পাঠক হয়ে ওঠে এক-একজন লেখক। বেঁচে থাকলে এতদিনে সা’দতর বয়স হত ৮৩। কিন্তু ও আমার এত আপনজন, যে ওকে আমি এখনও আপনি-আজ্ঞে করতে পারি না।
মান্টোর ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ বইটির খবর কজন রাখেন আমি তা জানি না। এর বাংলা অনুবাদ আমি প্রথম দেখতে পাই, আর কোথায়, গ্রন্থমানব পার্থসারথি চৌধুরির মান্টো-তাকে। চৌধুরি বইটি সম্পর্কে খুব উৎসাহ না দেখালেও, বইটি উলটে পালটে দেখে আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয় লাগে। আমি বইটি সঙ্গে নিয়ে আসি। এবং প্রাণে-ধরে আজও ফেরত দিতে পারিনি। দেশ বিভাগের পরেই সা’দত হাসান মান্টো বন্ধুদের বুকে দাগা দিয়ে লাহোর চলে যায়। তার আগে ৭ বছর সে বোম্বাইয়ের ফিল্মি-দুনিয়ার সঙ্গে কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে জড়িয়ে পড়ে। গাঞ্জে ফেরেশতে’ সেই সময়ের ক্যানভাসের পর ক্যানভাস। নার্গিস, অশোককুমার, পরিরানি নাসিমবানু, সম্পাদক বাবুরাও প্যাটেল (ফিল্মিন্ডিয়া), শাহির লুধিয়ানভি, কামাল আমরোহি, কোকিলকণ্ঠী নূরজাহান (পুকার ও খানদানের নায়িকা)– এইসব সমকালীন তারকাদের খুব চড়া রঙে আঁকা চরিত্র-প্রতিকৃতি সব। ইসমত চুঘতাই এবং হানিফ আজাদ পাশাপাশি দুটি অধ্যায় পেয়েছেন। ইসমত তো বুঝলাম। বিখ্যাততম উর্দু লেখিকা। কিন্তু হানিফ কে? হানিফ হল মহম্মদ আলি জিন্নাহর ব্যক্তিগত সোফার। এবং মান্টোর এক গ্লাসের ইয়ার। সা’দত এঁদেরই বলেছেন, গাঞ্জে ফেরেশতে’ (বাংলা : টেকো দেবদূত)। বইটি পড়ার আগে পর্যন্ত হেনরি মিলার-এর মারুসির কলোসাস’-ই ছিল স্মৃতিচিত্র হিসেবে আমার সেরা পাঠ-অভিজ্ঞতা।
১৪ অধ্যায়ে ভাগ করা এই বইটি। কত কান্নার কথাই যে সে হাসতে হাসতে বলে গেছে। কত হাসির কথা কাঁদতে কাঁদতে। সব কান্না একা কেঁদে গেছে। সব হাসি একা। হেসে গেছে। কত নতুন নতুন তথ্য। যেমন, অশোককুমার ঘরে বক্সিং খেলতেন। বালির ঝুলন্ত বস্তা পেটানো ছিল তাঁর রোজ সকালের নিত্যকর্ম। প্রতিদিন একজন-না-একজনের নাম উচ্চারণ করে তিনি ওই ক্রুদ্ধ ঘুষিগুলি প্রয়োগ করতেন। তার বাহুদ্বয় ছিল এত শক্তিশালী যে, জানালার শিক বাঁকাতে পারতেন। ভাগ্যিস, বোম্বাই টকিজের নবাগত নায়ক নাজমুল হাসান হিমাংশু রায়ের স্ত্রী, মালকিন তথা নায়িকা দেবিকারানিকে নিয়ে কলকাতা পালিয়েছেন। নায়ক হিসেবে অশোককুমারের ভাগ্যের দরজা এতেই খুলে যায়।
২১-৫-৯৫
.
অশোককুমার
‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ মানে, আমি আগেই বলেছি, টেকো দেবদূতগণ। আর এঁরা হলেন– নার্গিস, নাসিমবানু, নূরজাহান, শ্যাম ও অশোককুমার থেকে শুরু করে কৃষণ চন্দর, ইসমৎ চুঘতাই, শাহির লুধিয়ানভি মায় তার নিজস্ব ড্রাইভার হানিফ আজাদের চোখে মহম্মদ আলি জিন্না পর্যন্ত। ভূমিকায় সা’দত (হাসান মান্টো) লিখেছে, এই পুস্তকে যে সব ফেরেস্তার কথা বলা হল, আমি শুধু তাদের মাথাগুলো মুড়িয়ে দিয়েছি। আর এই কাজটুকু সম্পন্ন করেছি বিশেষ যত্ন সহকারেই।”
মনে রাখতে হবে, এই স্মৃতিকাহিনি সে লিখছে (অ্যালবামের পাতা উলটে ছবির পর ছবি দেখিয়ে যাচ্ছে), ১৯৫২-য়। ততদিনে লাহোরে। কাফের কমিউনিস্ট বলে পাক সরকার তার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছে। ঠান্ডা গোস্ত’ গল্পের জন্য ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৩০০ টাকা জরিমানা হয়ে গেছে। তবে আপিল করেছে, তাই মুক্ত। যদিও হাইকোর্টে এই মামলা চলে ৫৫ পর্যন্ত, যখন সে নিজেই ঠান্ডা গোস্ত। বয়স ৪৩। অসুখ যক্ষ্মা। যাই হোক, সে মরলেও মামলাটি তো অমর হয়েছে!
মারা গেল কে? না, অশোককুমারের বেস্ট ফ্রেন্ড।
জ্যোতিষচর্চায় অশোক ছিল পয়লা নম্বরের ওস্তাদ। যে-কোনো হাত দেখে অন্তত একটি অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী সে করতে পারত। এবং সবশেষে অনেক ভেবে-টেবে সে বলত, আপনার মৃত্যু অবধারিত!’ নখদর্পণ শাস্ত্রেও তার ব্যুৎপত্তি বড়ো কম ছিল না। সারাদিনে অশোক ভাবনাচিন্তা করত মাত্র একবার! “আর সেটা হল, গোসল করার সময় তার বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে।”
৪৬-এর দাঙ্গায় বোম্বাই জ্বলছে। মান্টোর লেখা আটদিন’ গল্পের শুটিং চলছে। পরিচালক মূলত অশোককুমার। মূলত এই জন্যে যে, বম্বে টকিজে তখন গল্প লিখত আমরা সবাই’ এবং পরিচালনাও সেভাবে। অন্যতম অভিনেতা ছিল মান্টো নিজে। একদিন শুটিং শেষে অশোক বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে মান্টোকে। শর্টকাট করার জন্যে চার্চ গেটের কাছে, ক্ষণে-ক্ষণে আল্লা-হুঁ-আকবর ধ্বনির মধ্যে দিয়ে অশোক এক মুসলিম এলাকা ধরে এগিয়ে চলেছে। গাড়ির মধ্যে অশোকের হাত চেপে ধরে মান্টো কেঁদে ফেলল, দাদামণি, এ তুমি কোথায় এলে?
অশোক বলল, দ্যাখ না। দ্যাখ না। কিছু হবে না।
রাস্তার দিক থেকে একটা বিয়ের বারাত এগিয়ে আসছিল। মুখোমুখি হতেই আলোয় আলো। স্পষ্ট চেনা গেল চল্ চল্ রে নওজওয়ান’-এর নায়ককে। ‘অশোক’, অশোক’ বলে লোকে চেঁচিয়ে উঠল।
“আমি বলতে যাচ্ছিলাম, সাবধান, আমি মুসলমান। আর আমার হিন্দু বন্ধু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে!” কিন্তু, হা হতোস্মি! কে চেনে সা’দত হাসান মান্টোকে। আর কে-ই বা তার ধার ধারে! আসলে আহ্বাদে, তাদের প্রিয় নায়ক অশোককুমারকে তাদের মধ্যে পেয়ে, জনতা আটখানা। প্রায় শোভাযাত্রা সহকারে তারা মুসলিম এলাকা পার করে দিয়ে, অশোককুমারকে বলল, আপনি এই বাঁ-দিকের রাস্তা দিয়ে কেটে পড়ুন। নলিনী জয়ন্তকে আমাদের শুক্রিয়াদা জানাবেন। বিদায় নেওয়ার আগে অশোক বন্ধুকে বলে গেল, দেখলি তো, তুই অযথা ভাবছিলি। আমি হিন্দু নই রে। এদের কাছে আমি আর্টিস্ট!
পিকাসোর যেমন ‘গার্ল বিফোর দি মিরর’–এই উপমহাদেশের দুজন মুখোমুখি শ্রেষ্ঠ লেকক হলেন সা’দত হাসান মান্টো আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সোনার হাতে সোনার কাঁকন-কে কার অলংকার বলা সত্যিই কঠিন। দুনিয়ামে জেতনি লানতি হ্যায়, ভুখ উনকি মা হ্যায়–সমস্ত বিশ্ব-যন্ত্রণার জননী হল ক্ষুধা–যৌন ও জঠর সে যারই ক্ষুধা হোক না কেন। এ কথা কার, মান্টো না মানিকের, বলা কঠিন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই মান্টোর জীবনেও তো একই ঘটনা ঘটল। ভারতবর্ষে বাঁ-দিকের একটি গলি দিয়ে তাকে কেটে পড়তে হল পাকিস্তানে। কোনো বারাত তো এ উপমহাদেশের, ভারতবর্ষের, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখককে শোভাযাত্রা সহকারে সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে গেল না!
১৪-৬-৯৫
.
নার্গিস, জিদ্দন ও শান্তা আপ্তে
নার্গিস মারা যান ৩মে, ১৯৮১। মান্টোর নার্গিস আরও চার-দশক আগেকার। ২০-র ওদিকেই সে তখন।
তখন কী-একটা অ্যালার্জির জন্যে তার সব সময় সর্দি লেগে থাকত-আর সে কথার ফাঁকে নাক টানত। তাই-না দেখে রাজকাপুর বললেন, নানা, ওটা সারাতে হবে না। ওটাই চাই। ডাল-লেকে নৌকো চালিয়ে ফুল বিক্রি করবে যে মেয়ে, ডায়ালগের ফকে আগাগোড়া ফেঁৎ-ফোৎ শব্দে তার নাক-টানা দিব্যি মানিয়ে গেল। গানগুলোর। মতোই, ঠোঁট কুঁচকে নার্গিসের ওই সর্দি-টানা বাদে ‘বরসাত হয় না।
একটি নিখুঁত টেক্সট হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সদ্গতি’ পৃথিবীতে একখানার মধ্যে একখানা। সেখানেও, শেষ দৃশ্যে দিগন্তে যেই-না দেখা গেছে হাতের তেলের মতো একখানা মেঘ, পরিচালক কাজ বন্ধ করে দিলেন। সিনারিওর মধ্যে অঝোরে ঝরতে লাগল বিহারের গণ্ডগ্রামের আঞ্চলিক বৃষ্টি। ওমপুরির লাশ বৃষ্টির মধ্যে পড়ে রইল দিনভর। সেভাবেই নার্গিসের নাক-টানা ঢুকে যায় বরসাত-এ। আর এই বহুমূল্য তথ্যটি সাদাত হাসান মান্টোর ‘গাঞ্জে ফেরেশতে পড়তে গিয়েই এতদিনে প্রথম জানা গেল। নার্গিসের মা ছিলেন জিদ্দন বাঈ। সেকালের বিখ্যাত বাইজি। নার্গিসের স্বামী ছিল। কিন্তু জিদ্দন বাঈ-এর ছিলেন মোহনবাবু। জিদ্দনের গান শুনে অনেকানেক নবাব-রাজার মতো মজেছিলেন ধনকুবের মোহনবাবুও। স্ত্রী-মাকড়সা যথা, জিদ্দন তাকেও উদরস্থ করেছিলেন। হারেম-রক্ষী জিভ-কাটা খোঁজার ভূমিকা ছিল তার, জিদ্দন-নার্গিসের মেরিন ড্রাইভের মহামূল্যবান ফ্ল্যাটে যখন মান্টো তাকে প্রথম দেখেন। অবশ্য নার্গিসের বাবা বলে জিদ্দনের দিক থেকে একটা আলাদা তোয়াজ ছিল তার। নার্গিসও ড্যাডি বলতে অজ্ঞান। জিদ্দনের আর দুই ছেলে অন্যত্র থাকত। তারা খরচা পেত।
মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে যাতায়াতের সূত্রে মান্টো মা-মেয়ে ছাড়াও আরও যাদের প্রতিকৃতি রচনা করেছে, তার মধ্যে ছবির ভাষায়, বেপরোয়া ব্রাশের কাজ ও মুখর পিগমেন্টের দিক থেকে জিদ্দন বাই-এর ছবিটিই শ্রেষ্ঠ। যদিও, তার ক্যাপশন হবে, মান্টোর ভাষায়, এমন পান-খেকো মেয়েলোক আমি জীবনে দুটি দেখিনি।”
পানের বাটা সাজিয়ে সুপুরি কাটতে কাটতে, মস্ত পিকদানিতে পিক ফেলে কুটুর কুটুর করে কথা বলতেন জিদ্দন বাই : সুরাইয়া? মাশাল্লা, ও খুঁড়ির আছেটা কী? না আছে গলা, না একটু ছিরিছাঁদ। দাঁতগুলো কী বিটকেল, একটার ঘাড়ে আর-একটা। বলাবাহুল্য নার্গিসের সামনে তখন শুধু সুরাইয়া। এদিকে সুরাইয়ার নানী (আসলে মা) মান্টোকে বলেন, নার্গিস? ও কী মেয়ে না মন্দ?
জিদ্দন বাই তার আমলের রথী-মহারথী প্রায় সকলকেই চিনতেন। প্রখ্যাত ঠুংরি ও গজল গায়িকার গানের আসরে সেকালে কে না গেছেন। লিখিত আছে, কোনো এক পার্টিতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নার্গিসকে চেনেননি। তখন নার্গিস তাকে বলেন ‘পণ্ডিতজি, আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না, কিন্তু আপনার বাবা লেট মতিলাল নেহরু আমার মা জিদ্দন বাইকে ভালোই চিনতেন। এই খবর বেরিয়েছিল সেকালের ডাকসাইটে ফিল্ম জার্নাল ‘ফিল্মিন্ডিয়া’-য়। সম্পাদক বাবুরাও প্যাটেল। বাবুরাও ছিলেন সেই কালের কুখ্যাত সম্পাদক। নিত্যনতুন স্ক্যান্ডালের জন্য পত্রিকাটি স্টলে পড়তে পেত না। উনি যে কখন কাকে স্বর্গে তুলবেন আর কাকে নরকস্থ করবেন, তা ছিল অননুমেয়।
৪০-এর দশকে যারা কলকাতা রেডিয়োয় শনিবার দুপুর একটা পঁয়তাল্লিশের অনুরোধের আসর’ শুনতেন, আমার মতন প্রায় শিশুবেলায় শুনে থাকলেও, মিস শান্তা আপ্তের গাওয়া দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’ গানটি আশা করি কেউই ভুলতে পারেননি। তখন প্রায় আসরেই বাজত। দী’ অক্ষরটি মিস যেখান থেকে ধরতেন এবং স্বরলিপি-নির্দেশ মান্য না করে বেশ কয়েকটি ভগ্নাংশ-মুহূর্তে সুরকে দাঁড় করিয়ে রাখতেন তার ওপর ভালো-মন্দের বাইরে সেভাবে বোধহয় কেউই ভবিষ্যতে গাইতে পারেননি। আজ খুব, খুবই জানতে ইচ্ছে করে, মিস আপ্তের একমাত্র বাংলা রেকর্ডের ওপিঠে কোন গানটি ছিল।
তো, যে-কথা হচ্ছিল। এই শান্তা আপ্তে পরে বোম্বাই ফিল্মের নায়িকা হিসেবেও যথেষ্ট নাম করেন। আবির্ভাবমাত্রই ‘ফিল্মিন্ডিয়া’ তাকে ভারতের শ্রেষ্ঠ নায়িকা হিসেবে বরণ করে। কিন্তু পরে বদলে গেল মতটা। বাবুরাও লিখলেন, এমন বদসুরত নায়িকা আর হয় না। সঙ্গে জঘন্য কুকথা। কিন্তু, শান্তাও মারাঠা কা বেটি। সে একদিন হান্টার হাতে ঢুকে পড়ল ফিল্মিন্ডিয়ার জাক ও জমকে-ভরা অফিসের মধ্যে। হান্টারওয়ালি বেধড়ক পেটাল বাবুরাও প্যাটেলকে। মান্টোর নাকের ডগায়। মান্টো তখন চাকরি করছেন ওখানে।
বোম্বাইয়ের ফিল্মি গোলোকধামে বছর আটেকের গেরস্থালি মান্টোর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তারই সোনার ফসল এই বই। এখানে একের পর এক ফেরেশতা। শুধু তাদের মাথাগুলো মুড়োনো। এখানে, সা’দত হাসান মান্টোর বলীবর্দ-প্রতিভা এই গ্রন্থের অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে গুঁতিয়ে গিয়েছে বোম্বাই চায়নাশপের বিখ্যাত তারকা-পুতুলগুলোকে।
২৫-৬-৯৫
(সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই লেখা ৩টি প্রথমে আজকাল পত্রিকায় ও পরে প্রতিভাস প্রকাশিত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যসমগ্র (১) গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে নেওয়া হল এই বইয়ের ভূমিকা হিসেবে-প্রকাশক)
.
ভূমিকা
সা’দত হাসান মান্টোর ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি দলিলগ্রস্থ বিশেষ। ১৯৬৬ সালে এই বইটি ধারাবাহিকভাবে চিত্রালীতে ছাপাবার জন্যে আমরা পাঠকদের কাছ থেকে অসংখ্য চিঠি ও অনুরোধ পাই। অনুজপ্রতিম মোস্তফা হারুণ তখন উর্দু অনুবাদে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। তাকে এ ব্যাপারে বলা হলে সানন্দে রাজি হন এবং বইটি সংগ্রহ করে ১৯৬৭ সালের জুন মাস থেকে চিত্রালীতে ধারাবাহিকভাবে দিতে থাকেন। তখনকার দিনে চিত্রালীতে পাঠকদের জন্যে প্রধান আকর্ষণীয় বিষয় ছিল এই ধারাবাহিক লেখাটি।
সিকি শতাব্দী পূর্বে আমাদের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি ছিল বোম্বে। বোম্বের নায়ক-নায়িকা ও চলচ্চিত্র কর্মীগণ আমাদের চিত্রদর্শকদের স্মৃতি জুড়ে আছেন এখনও। তাদের সম্পর্কে কিছু শোনার বা পড়ার নেশা আমাদের সহজাত। আজ আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু ছবির কোয়ালিটি এবং উৎকর্ষের প্রশ্নে এখনও আমরা পরোক্ষভাবে এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দিকে দৃকপাত করি। কারণ, আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়েছে সেখান থেকে। তাই মান্টোর ‘গঞ্জে ফেরেশতে এই উপমহাদেশ তথা আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসেরই আদি উপাদান বলে আমি মনে করি। ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’র রচনারীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে কালক্রমে আমাদের লেখকরাও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের পাঁচালি লিখবেন বলে আশা পোষণ করি।
– (মরহুম) এস এম পারভেজ
সাপ্তাহিক চিত্রালী, ঢাকা
.
নিবেদন
উপমহাদেশের চলচ্চিত্র-নগরীর উপাখ্যান খ্যাত ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’র মাত্র কয়েকটি অধ্যায় ৬৭ সালে ‘চিত্রালীতে’ ছাপা হয়েছিল। বাকি অধ্যায়গুলো অতি সম্প্রতি অনুবাদ করি। দেশ বিভাগের সময় মান্টো যখন পাকিস্তানে হিজরত করেন, লাউডস্পিকার’ নাম দিয়ে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড বের করেন। আমি এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য লাউডস্পিকারের কয়েকটি অধ্যায় অনুবাদে প্রবৃত্ত হই। কিন্তু যখন জানতে পারলাম অগ্রজ অনুবাদক কাজী মাসুম লাউডস্পিকারের কয়েকটি অধ্যায় অনুবাদ করেছেন, এজন্য তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত একটি চুক্তি সম্পন্ন করে শুধুমাত্র ‘নূরজাহান’ অধ্যায়টি এই বইতে গ্রহণ করি। উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাস-ভিত্তিক এ ধরনের বই বাংলা ভাষায় এই প্রথম। বইটি চলচ্চিত্র-জগৎ তথা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের উপকারে আসলে তবেই বুঝব আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
– মোস্তফা হারুণ
চাকা, ১৯৭৭
.
দ্বিতীয় সংস্করণের প্রসঙ্গে
বেশ কিছুকাল আউট অব প্রিন্ট’ থাকার পর অবশেষে ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’র দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল। গাঞ্জে ফেরেশতে প্রথম বাজারে ছাড়ার পর পাঠকদের মধ্যে এর বিষয়বস্তু ও অনুবাদের যথার্থতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সর্বোপরি এই বইটিতে পাঠকরা টক-ঝাল-মিষ্টি’ ধরনের এমন কিছু স্বাদ পেয়েছিলেন যে, অনেকে হন্যে হয়ে বইটি খুঁজেছেন। এসব বঞ্চিত পাঠকদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল দ্বিতীয় সংস্করণ।
— মোস্তফা হারুণ
১লা বৈশাখ ৮৫
.
তৃতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে
তিন বছর পর গাঞ্জে ফেরেশতের তৃতীয় সংস্করণ আবার বাজারে আসছে। এটা সর্বজনবিদিত, প্রকাশনার ক্ষেত্রে দেশে আজ একটা নিদারুণ সংকট চলছে। প্রকাশনার ব্যয় ও কাগজের মূল্য গত এক দশকে দশগুণ বৃদ্ধি, পাঠকদের পুস্তক পাঠে অনীহা, বইয়ের দোকানগুলো ক্রমান্বয়ে স্টেশনারি দোকানে রূপান্তর বিদেশি বই ও পত্র-পত্রিকা ক্রমবর্ধমান বাজার দখল– এই হচ্ছে বর্তমান প্রকাশনার অবস্থা। এমন অবস্থায় যে-কোনো বইয়ের পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশ হওয়া নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তা সত্ত্বেও ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ আবার বাজারে আসছে, এটা দুঃসাহস বই-কি।
তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের মুহূর্তে আজ বিশেষভাবে আমার মনে পড়ছে তিনজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে। এদের প্রথমজন হলেন চিত্রালী সম্পাদক মরহুম পারভেজ ভাই; যিনি এই বইয়ের প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন হলেন উপমহাদেশের সেরা জনগণনন্দিত নায়িকা নার্গিস ও গায়ক মোহাম্মদ রফি। যতদিন উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাস থাকবে ততদিন এদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
–মোস্তফা হারুণ
২০ জুন, ৮৯
.
বোম্বাই সিনেমা ও নিম্নবর্গের কথাকার মান্টো
চণ্ডী মুখোপাধ্যায়
‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ বইটি যখন ‘প্রতিভাস’-এর বীজেশ সাহা আমাকে সটীকাকরণের জন্যে দেন, তখন আমি বিস্ময়ে আবিষ্কার করি এ কোন মান্টো? আমি যে গল্পকার মান্টোকে চিনি তার সঙ্গে ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’-র মান্টোর তো কোনো মিল নেই। নিম্নবর্গ তো নয়, এ তো উচ্চবর্গ বোম্বাই তারকাদের অন্দরমহল। কিন্তু গাঞ্জে ফেরেশতে’ যখন লিখছেন মান্টো, তখন তিনি লাহোরে সংস্কৃতি জগৎ থেকে অনেক দূরে ব্রাত্যই। ফলে তথ্যের কথা কখনোই ভাবেননি তিনি। স্মৃতি বেদনা ও এক ধরনের অতীত প্রেম থেকেই লিখেছেন এই বইটি। পাশাপাশি বোম্বাই জগৎ নিয়ে আরও দুটি বই। তাই এই বইটিতে ঈষৎ ফুটনোট দিতেই হয়েছে। এগুলো মূল বাংলা অনুবাদে নেই। এটি অবশ্যই একমাত্র ‘প্রতিভাস’ সংস্করণেই থাকছে। আর এই সটীকা ছাড়া বইটিকে আপাতভাবে মনে হতেই পারে খাপছাড়া। মান্টোর প্রতি এক শ্রদ্ধা নিয়েই এই টীকা সংযোজন করা হয়েছে। ফলে গাঞ্জে ফেরেশতে হয়ে উঠেছে তিরিশ-চল্লিশের দশকের বোম্বাই সিনেমার অন্য ইতিহাস। আর এই সূত্রে বোম্বাই সিনেমার সঙ্গে নিম্নবর্গের গল্পকার মান্টো-সংযোগসূত্রটাও আবিষ্কার করা যেতে পারে। নন্দিত ও নিন্দিত। সা’দত হাসান মান্টো ঠিক তাই। মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর থেকে মান্টো যেমন এই উপমহাদেশে ক্রমশই ক্রমশই নন্দিত হচ্ছেন। মৃত্যুর আগে কিন্তু তিনি ছিলেন নিন্দিতই এবং জন্মভূমিতে ব্রাত্যই। প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল কোনো ক্যাম্প-ই তাঁকে সুনজরে দেখেনি। তৎকালীন কমিউনিস্টরা ভাবতেন তিনি প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীলরা ভাবতেন তিনি হলেন কমিউনিস্ট। মৃত্যুর অনেক পরে তার যখন পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়েছে, তখন আমাদের মান্টো সম্পর্কে যে ধারণাটা স্পষ্ট হচ্ছে তা হল মান্টো ছিলেন একজন বাস্তববাদী লেখক এবং যিনি তার গল্পে মানবতাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সারাক্ষণ। ঠিকমতো, ভাবলে, উর্দু সাহিত্যে বাস্তববাদী গল্পের ধারা মান্টো থেকেই শুরু, মান্টো হলেন প্রেমচন্দের সমাজমুখী সম্প্রসারণ। মান্টো নিম্নবর্গের কথাকার। তার গল্পে এসেছে পতিত জীবনের ছবি। পতিতাদের অনুপুঙ্খ জীবন-যৌনতা। তাই তাকে বারবার অভিযুক্ত হতে হয়েছে অশ্লীলতার দায়ে আদালতে। এতবার যে শেষে মান্টো ক্লান্ত হয়ে জরিমানা দেওয়াটাই ভালো মনে করতেন।
মূলত মান্টো-চৰ্চা ঘিরে আছে গল্পকার মান্টোকে। অথচ জীবিকার জন্যেই হোক না কেন, মান্টো এক দীর্ঘ সময় জড়িয়ে ছিলেন বোম্বাই ফিল্ম জগতের সঙ্গে। প্রায় এক যুগ। বোম্বাই ফিল্ম-জগতের অনেক স্টার-সুপারস্টার, বাঘা বাঘা পরিচালক ও ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি এসেছেন তিনি। তিরিশ ও চল্লিশ দশকের হিন্দি ছবির অনেক ইতিহাসেরই সাক্ষী তিনি। দু-ক্ষেপে প্রায় দশ বছর। মাঝখানে কিছুদিনের জন্যে শুধু দিল্লিতে। বোম্বাইকেই নিজের প্রাণের শহর হিসেবে ভাবতেন তিনি। মান্টো বিশ্বাস করতেন–যা কিছু তিনি জীবনের কাছ থেকে শিখেছেন তা এই বোম্বাইতেই। সত্যিই, বোম্বাই-এর ফিল্ম জগৎ তো শহরের মধ্যে আরেক শহর- স্বপ্নের শহর। ড্রিমল্যান্ড। মান্টো নিজেই স্বীকার করেছেন এই বোম্বাই শহরই তাঁর সাহিত্যকে প্রাণ দিয়েছে। মান্টোর যে বোহেমিয়ান জীবনযাপন, যে মেজাজ তা তার বোম্বাই-অর্জিতই। বোম্বাইতেই বিয়ে করেছেন তিনি, বোম্বাইতেই তাঁর প্রথম সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই বোম্বাই তার প্রাণের শহর। বিশেষ করে বোম্বাই-এর ভেতরে যে বোম্বাই। শুধু একা মান্টো নয়, জীবিকার সূত্রেই বোম্বাই ফিল্ম-জগতের সঙ্গে, লেখক বা চিত্রনাট্যকার হিসেবে তখন জড়িয়ে ছিলেন পরবর্তীকালে উর্দু সাহিত্যের সব দিকপাল লেখকেরা ইসমত চুঘতাই, কৃষণ চন্দর, রাহিন্দার সিং বেদি, গুলাম হায়দার, কামাল আমরোহি, হোশ মালিহাবাদি, ক্যায়ফি আজমি প্রমুখ। আজ যখন পতিতাদের পেশাকে শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার দাবি উঠছে, সেই দাবির কথাই কিন্তু মান্টো বলেছিলেন আজ থেকে অন্তত সত্তর বছর আগে।
সিনেমার জগৎ কেন তার গল্পে আসেনি? তার কারণ একটাই মনে হয়, নেহাত জীবিকার জন্যে সিনেমার জগতের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মান্টো–জায়গাটা তার খুব একটা পছন্দের জায়গা ছিল না। যে বাস্তব নিয়ে তিনি গল্প লিখলেন, বোম্বাইয়ের জগতের সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না। সিনেমার জগৎটা তার কাছে ছিল এক স্বপ্নের দুনিয়া তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। নেহাতই জীবনধারনের জন্যেই তাকে টিকে থাকতে হয়েছিল এই জগতে।
এই জগতে তিনি জড়িয়ে পড়লেন কীভাবে? সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র পত্রিকা মুসাওয়ার’-এ সম্পাদক হিসেবে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু। সেটা ১৯৩৬ সাল। আর এই সূত্রেই বোম্বাই ফিল্ম-দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু তার। ১৯৩৭ সালে মুসাওয়ার’ ছেড়ে তিনি সিনেমা দুনিয়ায় কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে যোগ দিলেন। মাস-মাহিনাতে একের পর এক কাজ করলেন তিনি। ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানি, সরোজ ফিল্ম কোম্পানি, হিন্দুস্থান মুভিটোন। ১৯৩৭-এ তার কাহিনি নিয়েই তৈরি হল ‘কিষান কন্যা’। ১৯৪০-এ আপনি নাগরিয়া’। অভিনেতা অশোককুমার হয়ে ওঠেন তার বিশেষ বন্ধু।
তবে সিনেমা জগতের প্রতি একসময় বিতৃষ্ণাও জাগে তার। ১৯৪১ সালে বোম্বাই চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে যোগদান করেন। দিল্লিতে থাকাকালীন গল্পকার হিসেবে তিনি রীতিমতো প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। যদিও অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে জড়িয়ে ফেলতে চান বেশ কিছু সাহিত্য সমালোচক–যা শেষ অবধি। আদালত অবধি গড়ায়।
দিল্লিতে তাঁর পুত্রের মৃত্যু হয়। দিল্লি ছেড়ে আবার বোম্বাইতেই চলে আসেন মান্টো। ১৯৪৩ সালে ফিল্মিস্থান স্টুডিয়োতে পাকাপাকিভাবে কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে যোগ দেন। স্বাধীনতার আগে অবধি তার কাহিনি ও চিত্রনাট্য নিয়ে একের পর এক ছবি হয়– নওকর (১৯৪৩), চল চল রে নওজওয়ান’ (১৯৪৪), ঘর কি শোভা (১৯৪৪), আট দিন (১৯৪৫), ঝুমকে (১৯৪৬), শিকারি (১৯৪৬)।
দেশ বিভাগের পর সাম্প্রদায়িকতার ঝড় সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানের লাহোরে চলে যান তিনি। আশা ছিল, লাহোর’-এর মতো সংস্কৃতিবান শহরে তাঁর যোগ্য স্থান হবে। কিন্তু উলটোটাই হয়। মান্টো হয়ে ওঠেন লাহোরের সংস্কৃতি-জগতে ব্রাত্য-মানুষ। তাই ক্রমশই তিনি খানিকটা হতাশাতেই হয়তো আরও আরও মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মৃত্যুর (১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫) ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে। মদ-ই চেয়েছিলেন।
‘গাঞ্জেফেরেশতে’ কোনো বোম্বাই সিনেমা জগতের তথ্যবহুল ইতিহাস নয়। বরং বোম্বাই সিনেমা জগতের কিছু মানুষের চমৎকার স্কেচ। ১৪ অধ্যায়ে আছে ১৪ মুক্তো। যার মধ্যে রয়েছেন অশোককুমার, নাসিমবানু, কামাল আমরোহি, শাহির লুধিয়ানভি, ফিল্মিন্ডিয়া-র সম্পাদক বাবুরাও প্যাটেল, লেখিকা ইসমত চুঘতাই এবং হানিফ আজাদ। একমাত্র এই হানিফ চিত্রজগতে জড়িয়ে নেই। ইনি হলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহর ড্রাইভার। মান্টোর এক গেলাসের ইয়ার।
১০-১২-২০০৮
.
জীবনশিল্পী মান্টো
সা’দত হাসান মান্টো–একটি নিপীড়িত কণ্ঠ। দুঃখ, যন্ত্রণা আর তিতিক্ষা-ক্লান্ত এই অমর কথাশিল্পীর কথামৃতের সঙ্গে পরিচিত নয় এমন বাঙালি পাঠক বিরল। তিনি কারাবরণ করেছিলেন একটি লেখার জন্যে। একটি গল্পের জন্যে, নাম, ঠান্ডা গোস্ত’। এ দেশের লাঞ্ছিত অবহেলিত মানবতার নিপুণ রূপকার এবং মহান জীবনবাদী সাহিত্য-শিল্পী সা’দত হাসান মান্টো যেন একটি যন্ত্রণামুখর এবং অস্থির অগ্নিকুণ্ডের মতো ধিকিধিকি জ্বলে একদিন নির্বাপিত হয়েছিলেন আমাদের অজান্তে, অলক্ষে। মান্টো আমাদের চেতনার রাজ্যে যুগযন্ত্রণা এবং জীবনানুভূতির যে নির্যাস রেখে গেছেন আমরা তার সংস্পর্শে এসে বিস্মিত হয়েছি, বিমোহিত হয়েছি। হৃদয়ের গভীর কন্দরের বাণী খুঁজে পেয়েছি আমরা তাঁর লেখায়। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই পাক ভারতীয় উর্দু লেখকের মিল ছিল আশ্চর্যরকম। মান্টোর কোনো কোনো লেখা যেন মানিকেরই কোনো লেখার নকল অথবা মানিকের কোনো লেখা মান্টোর লেখা বলে ভ্রম হত। জীবনের এমন অন্তরঙ্গ সুর এবং নির্যাতিত সমাজের যৌন-বিকারগ্রস্ত মানুষের চরিত্রচিত্ৰণ মান্টোর কলমের স্পর্শে যে জীবন লাভ করেছে এমন আর হয় না।
।শিল্প-সাধনার রাজ্যে এসে মান্টো ব্যক্তিজীবনকে নিয়ে যতখানি উপহাস করেছেন এবং দুঃখ-দারিদ্র্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তার নজির বাংলা সাহিত্যে একমাত্র নজরুল ছাড়া আর কারও জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। দারিদ্র্য এবং অভাব-অনটনক্লিষ্ট জীবনের গভীরে প্রবেশ করে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দুনিয়া মে জেতনী লানতেঁ হ্যায় ভুখ উনকি মা হ্যায়’ (বিশ্বের সকল যন্ত্রণার জননী হচ্ছে ক্ষুধা)। প্রবাস যাপনের সময় তিনি একবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আমার জন্ম এমন এক দেশে যেখানে লেখক। বা বুদ্ধিজীবীদের বাড়িও নেই, গাড়িও নেই।
মান্টো আমাদের জন্য প্রচুর লিখেছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাস এই উপমহাদেশের সাহিত্য জগতে কালান্তর ঘটিয়েছে। কিন্তু তাকে আমরা কিছু দিতে পারিনি। সাম্প্রদায়িক কলহ এবং অনিশ্চিত জীবন আর সহ্য করতে না পেরে একদিন তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাহোর নগরীর সাহিত্যমহল ও চিত্রাঙ্গন এই উন্নতনাসা চওড়া কপালের লোকটিকে বরণ করতে পারেনি যথার্থ সমাদরে। লাহোরে মান্টো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন জীবিকার তাগিদে। দুঃখ, যন্ত্রণা ও তিতিক্ষা-ক্লান্ত এই লেখক অবশেষে আমাদের সামনে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে বিদায় নিলেন।
.
১৯১২ সালের ১১ মে অমৃতসরের সিমরলো নামক স্থানে মান্টোর জন্ম। মান্টোর পূর্বপুরুষরা ছিলেন কাশ্মীরি। বাবা ছিলেন মুন্সেফ। অমৃতসরের কুচাওকায়লান এলাকায় মান্টোদের বাড়ি ছিল। পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে মান্টোর জন্ম। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে (হিন্দুসভা) প্রবেশ করে প্রগতিশীল লেখক বারী সাহেবের সংস্পর্শে আসেন।
মান্টোর সাহিত্য জীবনের যাত্রা শুরু হয় অনুবাদের মাধ্যমে। বারী সাহেবের পরামর্শক্রমে তিনি ‘ছেরগুজাস্তে আসির’ নামে ভিক্টর হুগোর একটি উপন্যাস তর্জমা। করেন এবং যথাসময়ে তা প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি অস্কার ওয়াইল্ড-এর একটি নাটকও তর্জমা করেন।
বারী সাহেব ‘খাক’ নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করতেন। মান্টোর প্রথম গল্প তামাশা’ এতে ছাপা হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পটভূমিকায় রচিত এই গল্প বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেকালে। এরপর মোপাসা, সমারসেট মম ও গোর্কির মতো লেখকদের রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ করেন। তিনি লাহোরের হুমায়ুন ও আলমগির পত্রিকার ফরাসি এবং রুশ সংখ্যা প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি দেখার জন্য মান্টো একবার কাশ্মীর পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাশ্মীরের স্মৃতি বিবৃত করেছেন তিনি তার বিগু এবং ‘একখত’ গল্পে। কাশ্মীর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আলিগড়ে ভর্তি হন। আলিগড়ে অবস্থানের সময় হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারের পরামর্শক্রমে এক্স-রে তোলা হল এবং যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ডাক্তার রিপোর্ট দিলেন। এখানেই তার শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর তার পিতা পরলোকগমন করেন। জীবিকার অন্বেষণে তিনি লাহোরে চলে যান এবং করমচান্দের ‘পারেস’ নামক একটি পত্রিকায় চল্লিশ টাকা বেতনে চাকরি গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর পত্রিকার মালিকের সঙ্গে মান্টোর মতদ্বৈধতা দেখা দেয় এবং চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা তখনও বেজে ওঠেনি। মান্টো বোম্বে চিত্রজগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সেখানেই জীবিকার সন্ধান করতে লাগলেন। বোম্বে চিত্রজগতের কাহিনিকার, গীতিকার ও কলাকুশলীরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন করছিলেন। মান্টো এখানে সাপ্তাহিক ‘মোসাওয়ার’ নামক পত্রিকায় সম্পাদক নিযুক্ত হন। মোসাওয়ার সম্পাদনার মাধ্যমে মান্টো আবার লেখার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এখানে তিনি যেন নবজীবন লাভ করেন। বোম্বে চিত্রজগতের বিচিত্র জীবনপ্রবাহ নিয়ে মান্টো গভীর অনুসন্ধিৎসায় অবতীর্ণ হন এবং এ সময় তিনি জীবনের সবচাইতে পরিণত ও ভাবসমৃদ্ধ গল্প রচনা করেন। বোম্বেতেই মান্টো দারপরিগ্রহ করেন ১৯৩৯ সালে। বড়ো ছেলে আরিফ এখানেই জন্মলাভ করে।
১৯৪১ সালে মান্টো ‘মোসাওয়ার’-এর চাকরি ছেড়ে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে যোগ দেন। রেডিয়োতে থাকাকালীন প্রচুর একাঙ্কিকা ফিচার ও কথিকা রচনা করেন, যা শ্রোতাদের বিশেষ মনোরঞ্জন করেছিল। দিল্লিতে পুত্র আরিফ হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে। মান্টো এই পুত্রশোক কোনোদিন ভুলতে পারেননি।
।মান্টো অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে মাত্র দেড় বছর চাকরি করেন। এরপর বোম্বের ফিল্মিস্তান লিমিটেডে কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার হিসাবে নিয়োজিত হন। এখানে থাকতেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গাঞ্জে ফেরেশতে’ (বোম্বে নগরীর চলচ্চিত্র উপাখ্যান) রচনায় হাত দেন। তা ছাড়া কতকগুলি জনপ্রিয় ছায়াছবির কাহিনিও তিনি এখানে থাকতেই লেখেন। ‘আটদিন’ নামক তার লিখিত একটি ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেন। বিখ্যাত পরিচালক সোহরাব মোদি মহাকবি গালিবের ওপর যে প্রামাণ্য ছবি করেছিলেন মান্টোই তার কাহিনি লিখেছিলেন।
বোম্বে নগরীতে তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অতিবাহিত করেন। একটি শান্তিহীন সংগ্রামমুখর জীবনের পরিশেষে তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে চলে যান এবং ১৯৫৫ সাল অবধি লাহোরে বসবাস করার পর দুঃখ-দারিদ্র্য এবং হতাশা নিয়ে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
খুল দো খালিবোতল, শহিদ, বদনাম ও টাঙাওয়ালার মতো কাহিনির স্রষ্টা তার জীবনে এতটুকু শান্তি যেমন পাননি, তেমনই পাননি স্বীকৃতি। জীবনের অতৃপ্ত আশা আকাঙ্ক্ষা আর বেদনাবিদ্ধ-আত্মা নিয়ে মান্টো ছুটোছুটি করেছেন পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গের মতো, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন:
দুঃখ-দুর্দশার এক চরম সন্ধিক্ষণে আমি বেঁচে আছি। সারা দিনমান অক্লান্ত পরিশ্রম করেও দৈনন্দিন প্রয়োজনটুকু মেটাবার মতো উপার্জন করতে পারি না। এই গ্লানি এবং তিতিক্ষা আমাকে সারাক্ষণ নিস্পিষ্ট করছে আজ যদি দু-চোখ মুদে ফেলি তাহলে স্ত্রী এবং তিনটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকার কী উপায় হবে?
মান্টোর গল্পে সমাজের বিকারগ্রস্ত, অপ্রকৃতিস্থ ও যৌন বিকৃত চরিত্ররা এসে ভিড় করেছে। সব রকম সামাজিক অনাচার ও বিবর্তনের মূলে মানুষের এমন একটি প্রবণতা কাজ করে যাচ্ছে, যা তথাকথিত সমাজ সকল আইনের অনুশাসনে চাপা দিয়ে রেখেছে একথাই সাচ্চারে বলতে চেয়েছেন তার প্রতিটি লেখায়। সে প্রবণতাটি ক্ষুধা এবং যৌন অতৃপ্তি। মান্টো বলেন, বিশ্বের সকল যন্ত্রণার জননী হচ্ছে ক্ষুধা। ক্ষুধা পাপের জন্ম দেয়। ক্ষুধা দেহ বিক্রি করতে বাধ্য করে। ক্ষুধা চরমপন্থী সৃষ্টি করে। ক্ষুধার হামলা অত্যন্ত ভয়াবহ। ক্ষুধা মানুষকে দিশেহারা করে তোলে এবং বে-দিশায় পড়ে মানুষ আবার ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে।
–মোস্তফা হারুণ
৭ই ভাদ্র ১৩৮২, দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত
Leave a Reply