গল্প সংগ্রহ – অজেয় রায়
গল্প সংগ্রহ – অজেয় রায়
প্রকাশ : বইমেলা ২০০৯
প্রকাশকের নিবেদন
ছোটোদের জন্য অ্যাডভেঞ্চারের গল্প নিয়ে বই প্রকাশ করার ইচ্ছা অনেকদিন থেকেই মনে ছিল।
‘লীলা মজুমদার রচনাসমগ্র’ ছেপে বের করবার ব্যাপারে শান্তিনিকেতনে যাতায়াতের ফলে অজেয় রায় মহাশয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁরই বাছাই করা রচনা ও নির্দেশ নিয়ে এই সংগ্রহ প্রকাশ করা হল। কিন্তু তাঁর অকস্মাৎ প্রয়াণে তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার আশা অপূর্ণ রইল বলে মর্মাহত।
গ্রন্থশেষে লেখকের ভগিনী শ্রীমতী অপর্ণা দেবী ও তাঁর বন্ধুপ্রতিম শ্রীঅনাথনাথ দাস লেখকের পরিচয় ও অন্যান্য তথ্য সংযোজন করে দেওয়ায় উপকৃত হয়েছি। গ্রন্থপ্রকাশে শ্রীসুবিমল লাহিড়ী, শ্রীকৃষ্ণেন্দু চাকী, শ্রীসুগত রায় ও শ্রীদেবাশিস সেন-এর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।
.
প্ৰকাশক : নিমাই গরাই
প্রচ্ছদ : কৃষ্ণেন্দু চাকী
উৎসর্গ
প্রিয় দেবাশিস ও অভিজিৎকে
.
আমার অগ্রজ – শ্রীমতী অপর্ণা চৌধুরী
অজেয় রায় এবং আমি পিঠোপিঠি ভাইবোন। দাদাকে আমি অনেকসময় একটু ঈর্ষা করতাম। কারণ দাদার নাম রেখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৫ সালে ২৭ আগস্ট দাদার জন্ম হয় শান্তিনিকেতনে। কিন্তু আমার জন্ম কলকাতায়। ছোটো থেকে আমি খুব আলাপী ছিলাম। আমার বন্ধুবান্ধব অনেক। কিন্তু দাদা ছিল খুব লাজুক। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও একান্ত কয়েকজন। আমার বন্ধুবান্ধব এলে দাদা সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে পড়ত।
সাহিত্যের বাইরে নাটক এবং খেলার প্রতি দাদার আগ্রহের কথা অনেকেই জানে না। শান্তিনিকেতনে কলেজে ছাত্রাবস্থায় দাদার পরিচয় ছিল ভালো স্পোর্টসম্যান হিসেবে। ক্রিকেট ফুটবলের সঙ্গে স্পোর্টসের মাঠে ৮০০ মিটার দৌড়, হপস্টেপ জাম্পে প্রথম দুজনের মধ্যে ছিল ধরাবাঁধা পুরস্কার।
ছোটোবেলা থেকেই দাদার খেলার দিকে বেশ ঝোঁক ছিল। তখন আমরা কলকাতায় বালিগঞ্জের যতীন দাস রোডে থাকতাম। আমাদের পাড়ায় ছেলেদের মধ্যে গুলি ডাংগুলি বিট্টু খেলার খুব চল ছিল। দাদার হাতের টিপ ছিল খুব ভালো। তাই সব খেলাতে প্রায়ই দাদা জিতে যেত। বিপক্ষের সব গুলি জিতে গেলে অন্যরা গায়ের জোরে দাদার কাছ থেকে গুলিগুলো কেড়ে নেবার চেষ্টা করত। দাদার বরাবরই রোগা পাতলা চেহারা। আমার সেজো ভাই ছিল একটু ষণ্ডামার্কা। সে তখন অন্যদের মেরে জেতা গুলি সহ দাদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরত। ১৫ বছর বয়সের পর দাদা লম্বা হতে আরম্ভ করে। তখন শুরু হয় ক্রিকেট ফুটবল খেলা। দাদা ওই পাতলা চেহারা নিয়েই বিশ্বভারতী এবং কলকাতায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করার সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট টিমে খেলত। ক্যারাম টেবিল টেনিসেও সমান উৎসাহ ছিল। পরবর্তী সাহিত্যিক জীবনের সঙ্গে অনেকেই দাদার ওই পাতলা চেহারায় খেলোয়াড় জীবন মেলাতে পারত না।
ছোটোবেলায় দাদা লাজুক স্বভাবের হলেও ভিতরে ভিতরে খুব কৌতুকপ্রিয় ছিল। রসবোধও ছিল প্রখর। শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠানের নাটকগুলো দেখে বাড়িতে এসে একটু মজার ধরনের চরিত্রের নকল করে দেখাত। ‘শ্যামা’ নাটকে কোতোয়ালের অভিনয়ও লম্ফঝম্প করে দেখিয়ে দিত। কিন্তু লাজুক স্বভাবের জন্য নিজে স্টেজে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারত না।
বিশ্বভারতীতে অ্যাগ্রো-ইকনমিক রিসার্চ সেন্টারে কাজ করার সময় একবার বিদ্যাভবনের অধ্যাপক কবি অশোকবিজয় রাহা ‘ফাল্গুনী’ নাটকে নবযৌবনের দলে অভিনয় করার জন্য দাদাকে বললেন। খুবই সামান্য কথা। এইসব চরিত্রে অভিনয় করার জন্য লোক পাওয়া যায় না। দাদা বলত— ‘আমি কিন্তু সেই পার্টটুকু করার জন্য রোজ গিয়ে প্রথম থেকে বসে থাকতাম। সকলের অভিনয় খুব মন দিয়ে লক্ষ করতাম। বাড়িতে এসে ওইটুকু পার্টই কীভাবে বলব, স্টেজে কোথায় কীভাবে দাঁড়াব তার অভ্যেস করতাম।’ এইভাবে দাদা লজ্জা-সংকোচ কাটিয়ে নাটকে অভিনয় আরম্ভ করে। চিকিৎসা-সংকট, ভূতপত্রীর যাত্রা, ভূষণ্ডীর মাঠ নাটকে দাদার অভিনয় সকলের প্রশংসা পেয়েছে।
তখন দাদা দুই মেয়ের বাবা। ‘ভূষণ্ডীর মাঠ’ নাটকের রিহার্সাল চলছে। একদিন সন্ধেবেলা হি-হি-হিঁ করে সরু গলায় এমন হাসি দিল যে বছর চারেকের মেয়ে ঝুমা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। দাদা হেসে বলল, ‘দেখলাম পেত্নীর অভিনয়টা ঠিক করতে পারছি কিনা।’ স্টেজে দাদার সেই পেত্নীর অভিনয় দেখে কে বলবে বাইরে দাদা এত চুপচাপ!
আমাদের বাড়িতে বই পড়ার খুব চল ছিল। ছেলেবেলায় আমাদের জন্মদিনে বাবা এক গোছা বই উপহার দিতেন। অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য-রোমাঞ্চ বইয়ের প্রতি আমাদের দারুণ আকর্ষণ ছিল। হেমেন্দ্রনাথ রায় এবং নীহাররঞ্জন রায় দাদার প্রিয় লেখক ছিলেন। বিশেষত হেমেন্দ্রনাথের অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য-রোমাঞ্চের নায়ক বিমল কুমার এবং জয়ন্ত মানিক ছিল দাদার প্রিয় চরিত্র।
জন্মদিনের বিকেলে বাবা কী কী বই আনবেন অধীর আগ্রহে তার জন্যে দাদা অপেক্ষা করত। দেবসাহিত্য কুটিরের নতুন বইয়ের সুন্দর গন্ধ জন্মদিনের লুচি মাংসের গন্ধকে যেন ছাপিয়ে যেত।
তখন থেকেই ওইসব অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য রোমাঞ্চ বোধহয় দাদার মনে গল্প লেখার বীজ বুনেছিল। কলেজে পড়ার সময় আমাদের থেকে দশ-বারো বছরের ছোটো ভাইবোনদের দাদা বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাত। যদিও গল্প লেখা শুরু করে অনেক পরে, ২৭/২৮ বছর বয়সে।
আমার বিয়ের আগে মেদিনীপুরে পাঁচেটগড়ে দাদা আমার ভাবি শ্বশুরবাড়ি দেখতে গিয়েছিল। আমার স্বামীর কাছে শুনেছি— চৈত্রের খররৌদ্রে সাঁতার কাটবে বলে পুকুরঘাটে বসেছিল আমার স্বামী গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে। এমন সময় পোস্টম্যান এসে রেজিস্ট্রি বুকপোস্টে সই করিয়ে একটা পত্রিকা দাদাকে দিয়ে গেল। ‘শুকতারা’ পত্রিকা। তাতে দাদার গল্প ছাপা হয়েছে। দাদা তখন অন্তু রায় নামে গল্প লিখত।
‘শুকতারা’ পত্রিকায় দাদার গল্প দেখে সবাই হই হই করে উঠল। ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত নিজের প্রথম গল্প দেখে দাদা কিন্তু মনের উচ্ছ্বাস বাইরে বিশেষ প্রকাশ করল না। একটু লাজুক হাসির সঙ্গে পত্রিকাটা অন্যদের দেখতে দিল।
.
সেই সহজ মানুষটি – শ্রীঅনাথনাথ দাস
কোনো অগ্রিম সংকেত না দিয়ে, অনেক কিছু কথা অসমাপ্ত রেখে অজয়দা চলে গেলেন। ছোটোদের কাছের মানুষ ছিলেন তিনি, সৃজনশীল জগতে তাঁর বিচরণ ছিল। আমাদের কাজের সঙ্গে ব্যবধান থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু হয়তো কোথাও একটা সম্বদ্ধতা ছিল বলে ক্রমশ অজেয়দা আমাদের কাছের মানুষ হয়ে পড়েছিলেন। সময় পেলেই তিনি বাড়িতে এসে যেতেন, আর আমিও চলে যেতাম তাঁদের কাছে। মঞ্জুবৌদি আর অজেয়দা— এই দম্পতির সান্নিধ্য ভালো লাগত, মনে হত নিজের বাড়িরই অংশ। কতদিন কত বৎসর ধরে এই যাতায়াত, তার কোনো হিসেব নেই। আমাদের পরিবারের সবাই অজেয়দা এলে খুশি হত। তাঁর শূন্য স্থানটি আর ভরাট হবে না।
মৃত্যুসংবাদ শান্তিনিকেতনে এসেছে অজেয়দার চরিত্রের সঙ্গে যেন সামঞ্জস্য রেখে— কতকটা নিঃশব্দে, ব্যক্তিটির প্রচারবিমুখতার কথা যেন মনে রেখে। কলকাতার এক প্রকাশক আমাদের আগেই সংবাদটি জেনেছিলেন। দূরভাসে তাঁর অশ্রুভারাক্রান্ত অবরুদ্ধ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেওয়া তখন সম্ভব হয়নি। ‘পরে যোগাযোগ করছি’—বলে এখনো পর্যন্ত চুপ করে আছি।
স্মৃতি সবসময়ই সুখের। এ কথা বলা যায় না। কিছু সুখের, কিছু দুঃখের, কিছু বা সুখ-দুঃখ মিশ্রিত। অজেয়দার সঙ্গে অনেক দিনের যোগাযোগসূত্রে যে-সমস্ত স্মৃতি, তা এই মুহূর্তে সুখ দুঃখের সীমানা ছাড়িয়ে স্বতন্ত্র এক অনুভবের জগতে নিয়ে আসছে। গভীর রাত্রিতে সোনাঝুরি বনের পিকনিকে ঘুমিয়ে পড়া, ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন রেশমকুঠির আদিম লতাগুল্মময় জগতে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানো, সাহেবদের গোরস্থানে গিয়ে ফলকের গায়ে সেইসব মৃত অশ্বারোহীদের নাম পড়া, পাশের বিশাল দিঘির গভীর জলে বেলাশেষে দীর্ঘ গাছের ছায়া পড়ার ছবিতে নিমগ্ন থাকা, গ্রামের মানুষের সঙ্গে সান্ধ্য আলাপনে তাঁর সরল আচরণে তাঁদের মুগ্ধতা, অথবা বনবাসী অধ্যাপক বিকাশদার বাড়িতে দিনভর গল্পগুজব, অথবা রাসযাত্রায় পঁচেটগড় যাব বলে বেরিয়ে পড়ে কয়েক ঘণ্টা রাস্তার ধারে শুয়ে বসে বাস না পেয়ে মোটামুটি ললাটের লিখন ধরে নিয়ে বাড়ি ফেরা— এইসব কত মিশ্রিত অনুভব।
অজেয়দার পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতনের যোগ কয়েক পুরুষের। মাতামহী ননীবালা রায় রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন কর্মের একজন সার্থক ধাত্রী। নিবিড়ভাবে তিনি নিজেকে গ্রামসেবায় উৎসর্জন করে গিয়েছেন। অজেয়দার মা লতিকা মাসিমা রবীন্দ্রনাট্যে যোগ দিয়ে যেমন রবীন্দ্রনাথ ও দর্শকমণ্ডলীকে আনন্দ দিয়েছেন, অন্যদিকে প্রায় গৌরী বসুর মতোই ইতিহাস তৈরি করেছেন নাট্যমঞ্চে নারীর আবির্ভাবে। যদিও তিনি প্রথমা নন।
অজেয়দা এই পরিবারের ব্যক্তি। তাঁর জগৎটি ছিল শিশুসাহিত্যকেন্দ্রিক। তাঁর বইগুলি আমরা পড়েছি। গল্প জমানোর শিল্পটি তিনি অনুসরণ করে গিয়েছেন। ‘মুঙ্গু’, ‘ফোরোমন’, আমাজনের গহনে’– এইসব লেখার আগে শুধু প্লট নয়, সেইসঙ্গে তিনি নিবিষ্টভাবে পড়েছেন বাংলা ইংরেজি অনেক বিজ্ঞানের বই। একটু অন্য ধরনের বই ‘ফসিল’। বিষয়টি নিয়ে একটি ছোট্ট তথ্যপূর্ণ সহজ ভাষায় লেখা বিজ্ঞানের বই।
অজেয়দাকে নবপর্যায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার লেখক বলাই ঠিক বলে মনে করি। আমাদের ছাত্রাবস্থায় শারদীয়া ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ‘মুঙ্গু’ উপন্যাস বের হলে শান্তিনিকেতনের পাঠকসমাজ খুব খুশি হয়েছিলেন। আগাগোড়া চিত্রালংকরণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত অজেয়দার প্রায় সব গল্প উপন্যাসই সত্যজিৎ রায়ের তুলির ছোঁওয়া পেয়েছে। অজেয়দাকে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠির সংখ্যা শতাধিক হতে পারে, তেমনি লীলা মজুমদারেরও। এইসব চিঠিপত্রগুলি একটি বইয়ের আকারে হাতে পেলে অনেকেই আনন্দিত হবেন, একটু অন্যভাবে অজেয়দাকে স্মরণ করাও হবে।
সত্যজিৎ রায়ের মেঘমন্দ্রস্বরে ‘কী অজেয়, কী লেখা নিয়ে আছ’ এখনও কানে বেজে ওঠে। আর লীলাদির এখানকার বাড়িতে পড়ন্ত বিকেল থেকে রাত্রি প্রায় আটটা পর্যন্ত যে আসর জমত, অজেয়দা তার মধ্যে অবশ্যই একটি বিশেষ স্থান নিতেন। ‘পাকদণ্ডী’র শেষের দিকে লীলাদি তার একটু ছোঁওয়া দিয়ে গিয়েছেন।
সেই লীলাদির অতি স্নেহের অজেয় হঠাৎই যেন কোনো এক কুয়াশা ঘেরা ছোট্ট স্টেশনে ‘আসি’ বলে নেমে গেলেন। এদিকে শান্তিনিকেতনে সান্ধ্য আড্ডায় চায়ের দোকানে অমল-অতনু-অমর্ত্যরা যে অপেক্ষা করে আছে এই খেয়ালটুকু করলেন না, এটাই আশ্চর্য!
অজেয়দা নেই। আজ, এখন, এই মুহূর্তে ‘অজয়াদ্রি’ বাড়িতে তাঁর স্ত্রী, তাঁর স্ত্রী, কন্যা, ভাইবোন, আত্মীয় বন্ধুসমাজ একটি স্মরণসভায় নিমগ্ন আছেন। শেষপর্যন্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী!
.
আদ্যন্ত শিশু-কিশোর সাহিত্যিক অজেয় রায় – শ্রীদেবাশিস সেন
শিশু-কিশোর সাহিত্যিক অজেয় রায়। হ্যাঁ, তাঁর সাহিত্য-জীবনের একশো শতাংশই ছোটোদের। বড়োদের জন্য লেখার ফাঁকফোকরে ছোটোদের জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বে কলম ধরা নয়— দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের সাহিত্য জীবনের পুরোটাই তিনি ভেবেছেন ছোটোদের জন্যই। ১৩৭০ থেকে ১৪১৫— এই পঁয়তাল্লিশ বছরে অজেয় রায় ছোটোদের জন্য লিখেছেন অজস্র গল্প, উপন্যাস এবং সামান্য কিছু প্রবন্ধও। ১৩৭০-এর মাঘ মাসের ‘শুকতারা’য় প্রকাশিত হয়েছিল অজেয় রায়ের প্রথম গল্প— ‘যেমন ইচ্ছা সাজো’। আর শেষ গল্প? না, সঠিকভাবে কোনো একটি গল্পকে তাঁর শেষ প্রকাশিত লেখা বলে চিহ্নিত করা যাবে না। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ বছরে অন্তত তিনটি শারদীয়ায় তাঁর তিনটি ছোটো গল্প প্রকাশিত হয়েছে— শারদীয়া ‘কিশোর ভারতীতে মামাবাবুর অ্যাডভেঞ্চার ‘মহাসাগরে মহাদুর্যোগ’, শারদীয়া ‘শুকতারায় ইনভেস্টিগেটিং রিপোর্টার দীপক রায়ের ‘মরণ ভয়’ এবং বার্ষিক ‘ঝালাপালা’তে ‘মন্দ বরাত’।
ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং অ্যাডভেঞ্চার— এই তিনের অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে মামাবাবুর অভিযানগুলিতে। এবং একইসঙ্গে নানান ধরনের অজস্র চরিত্র চিত্রণ। সুনন্দ এবং অসিতের সঙ্গে আমরাও হয়ে যাই মামাবাবুর ভাগ্নে-কাম-সহকারী।
বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ে ছোট্ট গ্রাম চন্দনার দুই কিশোর শিব আর দেবুর নানান কীর্তিকলাপ নিয়ে বেশ ক-টি উপন্যাস লিখেছেন অজেয় রায়। তিনি নিজে পছন্দ করতেন উপন্যাস লিখতে। তাঁর মতে একজন সাহিত্যিকের সঠিক মূল্যায়ন হয় উপন্যাস রচনাতেই।
কিন্তু আমার মতে অজেয় রায়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর অসাধারণ কিছু ছোটো গল্প। খুবই সাধারণ বিষয়বস্তুকে তাঁর লেখনীর গুণে করে তুলতেন সরল গল্প। কখনো বা মানবিকতার ছোঁয়ায় আপ্লুত হতাম আমরা। ‘ভূতো’ (আনন্দমেলা) গল্পের বাচ্চা ভূতটির মনখারাপের সঙ্গী হয়ে থাকি আমরা, গল্প শেষ করার পরও বহুক্ষণ, বহুদিন। ‘লেজকাটা’ গল্পের ইঁদুরটির সঙ্গী হয়ে যাই আমরা। প্রচুর দৌরাত্ম্য করলেও আমরা কিন্তু ওকে ভালোবেসে ফেলি। ‘বেটুদার ফেয়ারওয়েল’ গল্পে আমাদের চারপাশে দেখা বহু ক্রিকেট পাগলেরই প্রতিনিধিত্ব করেন বেটুদা। ‘মোটর সাইক্লিস্ট’ (সন্দেশ) গল্পের মানুষ এবং যান্ত্রিক বাহনের আত্মিক টানকে কখনোই অবাস্তব মনে হয় না। ‘কবিতা স্যার’ (সন্দেশ), ‘ছানা’ (সন্দেশ), ‘বটুকবাবুর ছুরি’— প্রতিটি গল্পই বাংলা শিশু কিশোর সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছে। পার্ট টাইম নন, শিশু-কিশোর সাহিত্যের ফুলটাইম লেখক অজেয় রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরেই শিশু-কিশোর সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। বড়োদের জন্য লেখার সম্ভাবনা তাঁর কলমে থাকলেও তিনি সেই চেষ্টা কখনো করেননি। শিশু কিশোর সাহিত্যের আগামী প্রজন্মের পাঠকেরাও আশা করি মামাবাবু, দীপক, ভূতো, বেটুদাদের ভুলে যাবে না।
.
জীবনপঞ্জি
অজেয় রায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালে শান্তিনিকেতনে। দিদিমা ননীবালা রায় শ্রীনিকেতন সেবাবিভাগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। অজেয় রায়ের মা লতিকা রায় শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। রবীন্দ্রনাথের নাট্য-অভিনয়ে লতিকা রায় একাধিক বার নৃত্য পরিবেশন করেছেন। তাঁর পুত্রের নাম ‘অজেয়’ রাখেন রবীন্দ্রনাথ। পিতা পূর্ণেন্দু রায়। অজেয়রা ছয় ভাইবোন। অজেয় বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বিশ্বভারতীর কৃষি-অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষককর্মী রূপে যুক্ত ছিলেন ও যথাসময়ে অবসর গ্রহণ করেন। অজেয় শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন বহু বছর ধরে। লেখিকা লীলা মজুমদারের উৎসাহ ও উপদেশ তাঁর লেখক জীবনের প্রধান প্রেরণা।
প্রচুর গল্প ও একাধিক উপন্যাস লিখেছেন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, শুকতারা প্রভৃতি পত্রিকায়। সরস ও রহস্য রচনা, বিজ্ঞানভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চার ইত্যাদি ছিল অজেয়র প্রিয় বিষয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে ‘মুঙ্গু’, ‘ফেরোমন’’মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে’ ইত্যাদি। তাঁর কিছু ছোটো গল্প হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে।
শিশু সাহিত্যিক অজেয় রায় অনেকগুলি সাহিত্য-সম্মান লাভ করেছেন। জগত্তারিণী স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতী-প্রদত্ত আশালতা সেন স্মৃতি-পুরস্কার, ‘সন্দেশ’-প্রদত্ত সুবিনয় রায় স্মৃতিপদক ও পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিশুসাহিত্যে বিদ্যাসাগর স্মৃতি-পুরস্কার প্রভৃতি।
৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ হায়দ্রাবাদে অল্পকাল রোগ ভোগ করে প্রয়াত হয়েছেন অজেয় রায়। তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও নাতি নাতনি বর্তমান।
.
‘আমার অগ্রজ’ ও ‘সেই সহজ মানুষটি’ শান্তিনিকেতনে অজেয় রায়ের স্মরণসভায় (১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮) প্রকাশিত হয়।
.
শিক্ষা : কলকাতায় ও শান্তিনিকেতনে। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন তার পর বিশ্বভারতীর কৃষি অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষক কর্মী রূপে যুক্ত থাকেন দীর্ঘকাল।
শিশু ও কিশোরদের জন্য লিখেছেন অনেক বছর ধরে। সরস, রহস্য, বিজ্ঞাননির্ভর, অ্যাডভেঞ্চার— ইত্যাদি বিভিন্ন স্বাদের ছোটোদের লেখায় বিশেষ পারদর্শী। প্রচুর গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন সন্দেশ, আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী প্রভৃতি ছোটোদের পত্রপত্রিকায়। তাঁর কিছু গল্প ছোটোদের হিন্দি পত্রিকায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
অজেয় রায় লাভ করেছেন নানান সাহিত্য সম্মান- বিশ্বভারতী-প্রদত্ত ‘আশালতা সেন স্মৃতি পুরস্কার, শিশু সাহিত্য পরিষদের পুরস্কার ও পদক, সন্দেশ পত্রিকার ‘সুবিনয় রায় স্মৃতি পদক’ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার -প্রদত্ত শিশু সাহিত্যে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার’।
.
লেখকের কথায়
সম্পাদিকা (লীলা মজুমদার)-র নির্দেশ একটি রচনা সম্পর্কে
সম্পাদিকার এক চিঠি পেলাম। পড়ে আমি থ! লিখেছেন— তোমার রোমাঞ্চকর উপন্যাসটা শিগগির পাঠাও। সামনের পুজোসংখ্যায় আমাদের পত্রিকায় (সন্দেশ) ছাপতে চাই।
সেই শুরু। তার পর থেকে লিখেই চলেছি। নানা রকম ছোটো গল্প। বড়ো বড়ো অ্যাডভেঞ্চার।
S
Apnader onek dhonyobad boi tindear jonno. Ajeyo ray er “rohosyo samagra” boi ti o dile kub Khushi hobo.
Maruf
ধন্যবাদ। পারলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলোও দিবেন।