খুনের পাহাড়
এবড়োখেবড়ো পাহাড়ী পথে ঝাঁকুনি খাচ্ছে স্টেশন ওয়াগন। ঝিমুনি এসে গিয়েছিল, জোর এক ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ছুটে গেল, সোজা হয়ে বসে বাইরে তাকালাম। কোন পরিবর্তন নেই, সেই একই রকম রয়েছে মরুভূমি, শুধু সামনের দিগন্তরেখার কাছে যে কালো ছায়াটা ছিল, সেটা স্পষ্ট হয়ে একটা পাহাড়ে রূপ নিয়েছে।
‘সামনেই রানাগাট, এই আর মাইল তিন-চারেক হবে,’ বলল পাশে বসা ড্রাইভার হ্যারিস, চ্যাপ্টা মুখ, বাঁ হাত স্টিয়ারিঙে। খুব কাছে না এলে শহরটা দেখতে পাবেন না।
‘মেসাটার কাছে?’
‘ওটার পাশেই আরেকটা পাহাড়ের চূড়ায়। খুবই ছোট শহর, লোকসংখ্যা চারশো মত, তা-ও ওদের অনেকেই থাকে বাইরে। হাইওয়ে থেকে অনেক দূরে রানাগাট, তাছাড়া ওখানে দেখার কিছু নেই। টুরিস্ট আসে না। আপনিই এলেন।’
‘এসব খনি-শহরগুলোর তো এককালে ভীষণ বদনাম ছিল। এটার কি অবস্থা?’
‘এটারও ছিল। পঁচাত্তরজনকে গুলি করে কিংবা ফাঁসি দিয়ে মারার পর ঠাণ্ডা হয়েছে।’
‘খুব খারাপ জায়গা!’
‘এখনও ভাল হয়নি পুরোপুরি। এই তো দিন কয়েক আগে মারা গেল এক বুড়ো। টাকার কুমির ছিল লোকটা, কিন্তু কিপটে কাকে বলে!’
‘খুন?
‘তাছাড়া আর কি? কে খুন করেছে জানা যায়নি, তবে ভয়ের কিছু নেই। শিগগিরই ব্যাটাকে ধরে ফেলবে পণ্ড। আরে, ওই ওয়াল্ট পশু, শেরিফ। বয়েস হয়েছে এখন, শরীরে আগের সেই ক্ষমতা আর নেই, তবুও চালিয়ে নিচ্ছে কোনমতে। পুরানো আমলের কাউবয়দের মত পোশাক পরে, কোমরে পিস্তল ঝোলায়। আগে থেকে জানা না থাকলে হঠাৎ দেখলে চমকেই উঠবেন। সেই ওয়াইল্ড ওয়েস্টের কথা মনে করিয়ে দেয় লোকটা।
ঠোঁটে সিগারেট লাগাল হ্যারিস। এক হাত স্টিয়ারিঙে, অন্য এক হাতেই দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে বেশ কায়দা করে ধরিয়ে ফেলল সিগারেট। কিপটে বুড়োটার নাম ছিল রট হ্যানসন।’ দু-আঙুলে ধরা সিগারেটের জ্বলন্ত মাথাটা দিয়ে বাতাসে খোঁচা মারল সে, মেসার দিকে নির্দেশ করল, ‘ওখানে বাস করত।’
‘চুড়ায়?’ লাল মাটির তৈরি যে পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছি, ওটাই মেসা। চূড়াটা বিরাট ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে দিয়েছে যেন কেউ, টেবিলের মত সমতল। কিন্তু যেরকম খাড়া, কোন মানুষের পক্ষে গা বেয়ে ওঠা অসম্ভব। ‘কি করে উঠত?’
‘মজাটাই তো ওখানে, মিস্টার। একটাই মাত্র পথ রয়েছে ওঠার, রানাগাটের দিকে সেটা। ওখান দিয়ে যে-ই উঠুক, বুড়ো অ্যালেন কিনির চোখ এড়িয়ে উঠতে পারবে না। পাহাড়ের গা গভীর করে কেটে তৈরি হয়েছে পথটা, পাশেই পড়বে বুড়োর কেবিন। শকুনের মত চোখ ব্যাটার, কয়োটের মত ধূর্ত। আরও মজা কি জানেন, ওই দুই বুড়ো ছিল পার্টনার, খনির ব্যবসা এক সঙ্গেই শুরু করেছিল ওরা, তাই কাছাকাছি কেবিন বানিয়েছে। কোম্পানির নাম ছিল হ্যানসন অ্যাণ্ড কিনি। শুরুতে ভালই চলছিল, টাকাও কামাচ্ছিল, হঠাৎ একটা গোলমাল বাধল দুজনের মধ্যে, আলাদা হয়ে গেল।’
‘কিনি খুন করেছে হ্যানসনকে?
‘কেউ কেউ তাই ভাবছে। তবে অনেকে অন্য কথাও বলছে। হ্যানসনের এক ভাস্তি আছে, সুন্দরী, নাম ডিকসি। চাচাকে দেখতে এসেছে রানাগাটে। ও আসার দুদিন পরেই খুন হলো বুড়ো। হ্যানসনের সমস্ত সম্পত্তি আর টাকার মালিক হবে ওই ডিকসি, কাজেই…’ থেমে গেল হ্যারিস।
‘তারমানে, সন্দেহভাজন এখন পর্যন্ত হলো মোট তিনজন: আলেন কিনি, ডিকসি হ্যানসন, আর আমার মক্কেল। আচ্ছা, লেভিট নামে কাউকে চেনো?’
‘স্টার লেভিট? চিনি!’ চোখের কোণ দিয়ে একবার আমার মুখ দেখে নিল হ্যারিস। আমি কি উদ্দেশ্যে রানাগাটে এসেছি অনুমানের চেষ্টা করছে, পারছে না। ‘ওকে চেনেন আপনি?’
‘নাম শুনেছি।’ আমি কেন এসেছি এখানে, হ্যারিসকে বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। যতটা পারি খবর বের করে নেব, নিজে যা জানি বলব না।
‘ওকেও সন্দেহ করা হচ্ছে,’ বলল হ্যারিস। ‘আপনাকে বলি, মিস্টার, লোক সে সুবিধের নয়। ওর সঙ্গে ব্যবহার খারাপ করেছেন কি মরেছেন। ওর সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানে না, অথচ রানাগাটে দশ বছর ধরে আছে লোকটা। আপনার কাজ যদি ওর সঙ্গে থাকে, সাবধান! খুব সাবধানে কথা বলবেন?’
‘ওকেও সন্দেহ করা হচ্ছে কেন?’
‘কারণ আছে। বুড়ো হ্যানসনের সঙ্গে বেধে গিয়েছিল তার। কি নিয়ে কেন তর্কাতর্কি হয়েছিল, লেভিট নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। কাউকে বলেনি। জুয়া খেলে, প্রচুর টাকা আছে, এ-শহরের সবচেয়ে ভাল বাড়িটা তার। কালেভদ্রে কেউ দেখা করতে যায় তার সঙ্গে। বেশির ভাগ সময় একা একা ঘরে বসে থাকে। জানেন বোধহয়, এই পশ্চিম অঞ্চলে চেহারা আর শরীর দেখিয়ে কাউকে ভোলানো যায় না, এমন কি লেভিটের মত চেহারা হলেও নয়। তাই প্রথম প্রথম যখন রানাগাটে এল সে, লোকে পাত্তাই দিল না। তারপর একদিন গ্রিজলির সঙ্গে লেগে গেল তার। গ্রিজলি ভেনার, খনির শ্রমিক। নামের সঙ্গে শরীরের যথেষ্ট মিল, ভালুকই বটে। চ্যালেঞ্জ করে বসল ওরা একে অন্যকে। সেলুনের বাইরে খোলা জায়গায় চলে গেল। তারপর যা একখান লড়াই হলো না, কি বলব আপনাকে। পাক্কা তিরিশ মিনিট পর হাল ছেড়ে দিল গ্রিজলি। চেনা যায় না আর তখন ওকে, এমন পিটুনি খেয়েছে। আরেকটু হলে মরে যেত!’
‘লেভিটও নিশ্চয় আরেকটা গ্রিজলি?’
‘না, ভেনারের মত লম্বা নয়, আপনার চেয়েও ইঞ্চিখানেক কম হবে। তবে প্রস্থে ছোটখাটো একখান হাতি, ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতে কষ্ট হয়। চর্বি নেই গায়ে। যা আছে সলিড…’ আমার দিকে ফিরল হ্যারিস। ‘আপনার ওজন কত? একশো আশি? পঁচাশি?’
‘দু-শোর বেশি।’
‘তাই? আপনিও তো অবাক লোক, সাহেব। দেখে কিন্তু বোঝা যায় না। হাড্ডির ওজন বোধহয় খুব বেশি আপনার। যা-ই হোক, তা-ও সাবধান করে দিচ্ছি, লেভিটের সঙ্গে লাগতে যাবেন না। পারবেন না।’
আমার বসের কথা মনে পড়ে গেল। বস আমাকে বলেছে, খুব সাবধান, বুঝলে, সাংঘাতিক লোক ওই স্টার লেভিট। ভীষণ ধূর্ত। প্রচুর বদনাম তার। গায়ে যেমন জোর, মাথাটাও পরিষ্কার। ওখানে গিয়ে খোঁজখবর করো, তদন্ত করো, ও যে খুনী নয়, পারলে প্রমাণ করে দিয়ে এসো সেটা। কিন্তু বেশি ঝুঁকি নিতে যেয়ো না, যত টাকাই দিক। সব সময় একটা চোখ রাখবে ওর ওপর। কুগারকে বিশ্বাস করা যায়, তবু ওকে নয়।
জোরে আরও কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে যাত্রা শেষ করল স্টেশন ওয়াগন। ধূসর পাথরে তৈরি একটা বাড়ির সামনে থামল। পুরানো সাইনবোর্ড দেখে বোঝা গেল, বাড়িটা হোটেল। রেস্টুরেন্টও অবশ্যই আছে।
শহরের একটা মাত্র মেইন রোড, দুদিকে দু-বার চোখ বোলালেই পুরোটা দেখা হয়ে যায়। পথের পাশে দুটো স্যালুন, একটা গ্যারেজ, একটা কামারশালা, তিনটে স্টোর, আর একটা ক্যাফে। আর আছে গোটা দুই বসতবাড়ি, লোকে ভাড়া থাকে। ওগুলোর পর পথের শেষ মাথায় আরেকটা পাথরের বাড়ি জেলখানা এবং শেরিফের অফিস।
গাড়ি থেকে আমার ব্যাগটা রাস্তায় নামিয়ে রাখল হ্যারিস, তারপর হাত পাতল। তিন ডলার ভাড়া।
ওর ভাব-ভঙ্গিতেই বুঝতে পারলাম, আমার ওপর অসন্তুষ্ট। সারাটা পথ সে-ই কেবল বকবক করেছে, আমি চুপ। আমি কে, কেন এসেছি, কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি, রাগটা তার সেজন্যেই।
গাড়ি বারান্দায় বসে আছে দু-জন লোক। দু-জনেরই চোখা চিবুক, সারা গায়ে মাটি আর ময়লা, যেন একেকটা ভূত। নিশ্চয় খনিজ-সন্ধানী। কি যেন চিবুচ্ছে। কৌতূহলী অলস চোখে আমার দিকে তাকাল ওরা।
হোটেলের লম্বা লবি। একপাশে বড় একটা ঘর, সেঁতসেঁতে, ফায়ারপ্লেসের ওপরে আর আশপাশে কালিঝুলি। একধারে গোটা পাঁচেক বড় বড় চেয়ার আর একটা সোফা, গদিটা কালো চামড়ায় মোড়া। পঞ্চাশ-ষাট বছর বয়স হয়েছে এগুলোর। দেয়ালে বসানো একটা কুগারের মাখা, পোকা ধরে নষ্ট করে ফেলেছে।
পুরানো ডেস্কের ওপাশে নড়বড়ে একটা চেয়ারে বসে আছে এক প্রৌঢ়। প্রায় পঁচিশ বছর আগে হোটেলটা যখন তোলা হয়েছিল তখন থেকেই এর কেরানি সে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ঠেলে দিল ডেস্কের ওপরে রাখা রেজিস্টারটা।
রেজিস্টারে নাম সই করে, চাবি নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। ঘরে ঢুকে ব্যাগ খুলে বের করলাম .৪৫ ক্যালিবারের কোল্ট পিস্তলটা। ব্যাগটা ঠেলে দিলাম খাটের নিচে। শার্টের তলায় কোমরে পিস্তল গুঁজে নিয়ে বেরিয়ে এলাম আবার ঘর থেকে। রওনা হলাম শেরিফের অফিসে।
প্রধান রাস্তা ধরে দুটো ব্লক পেরোতে না পেরোতেই শহরের অধিবাসীদের প্রায় সবার কাছে চেনা হয়ে গেল আমার চেহারা।
রোল-টপ ডেস্কের ওপর পা তুলে দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে ওয়াল পশু, বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখেছে দু-হাত। চ্যাপ্টা চূড়াওয়ালা হ্যাটটা মাথার পেছনে ঠেলে দেয়া। হ্যাটের মতই ধবধবে সাদা তার চুল আর গোঁফ। কাউবয় বুট পায়ে-সোলের নিচে কাটা বসানো, কোমরের বেল্টে মুখ খোলা হোলস্টারে গুঁজে রেখেছে পুরানো ধাঁচের ছ’ঘরা রিভলভার।
পরিচয়পত্র বের করে শেরিফের চোখের সামনে মেলে ধরলাম। চোখ দুটো শুধু নড়ল তার, আমার ছবিটা দেখল। চোখ তুলল আবার। ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ। কে ডেকেছে?’
‘লেভিট।’
‘ভাবনা-চিন্তা করছে তাহলে। এখানে কি করার ইচ্ছে, খোকা?’
‘খুনের তদন্ত। ঘুরব-ঘারব, খোঁজখবর করব। লেভিটকে সন্দেহমুক্ত করে আপনাকে ছাড়িয়ে নেব তার লেজ থেকে।’ শেরিফের মুখ থেকেও তথ্য আদায়ের চেষ্টা চালালাম, ‘শুনলাম, এখানে কাউকে বিশ্বাস করে না সে। তার জেল হলো কি ফাঁসি হলো, তাতে কারোই কিছু এসে যায় না। কোন বন্ধু নেই এখানে।’
‘ঠিকই জানানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। ভাল পোকার খেলে হারলে সঙ্গে সঙ্গে টাকা মিটিয়ে দেয়, জিতলে আদায় করে নেয়, মাঝেসাঝে খুব কড়া মদ খেয়ে নেশাও করে। ব্যস। আইন-বিরুদ্ধ নয় এসব। তবে খনির মালিকরা প্রায়ই এসে নালিশ করে আমার কাছে। সোনা চুরিতে নাকি তার হাত আছে। সোনার খনি থেকে সোনা চুরি হবেই, দুনিয়ার কেউ কোথাও ঠেকাতে পারেনি, আমি কি করে পারব?’
আমার মুখের দিকে তাকাল পণ্ড। ‘জানো বোধহয় তুমি করে বলে ফেললাম, কিছু মনে কোরো না, এখানে তুমিটাই বেশি চালু…যাই হোক, সব খনিতেই একটা বিশেষ ঘর থাকে, যেখানে কাজে যাওয়ার আগে কাপড়-চোপড় খুলে বিশেষ পোশাক পরে নেয় শ্রমিকেরা। খনি থেকে ফিরে পুরো উলঙ্গ হয়ে গোসল সারে, তারপর যার যার কাপড় পরে বেরোয়। যথেষ্ট কড়াকড়ি থাকে, তার মধ্যেও সোনা চুরি যায়। কোন না কোন ভাবে বের করে নিয়ে আসেই। আনার পর ক্রেতা লাগে, চোরাই মাল কেনার জন্যে মহাজন দরকার হয়। খনি-মালিকদের ধারণা, এখানে সেই মহাজনটি হলো স্টার লেভিট।’
‘তাকে জানিয়েছেন সে-কথা?’
‘না। কোন প্রমাণ ছাড়া বলতে গেলে ফালতু কথা হয়ে যাবে।’
‘ওই খুনের ব্যাপারে আপনার কি ধারণা? কোন সূত্র পেয়েছেন?’
বুকের ওপর থেকে হাত সরাল শেরিফ। ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো। চেয়ার টেনে নাও… না না, ওখানে নয়, আরেকটু বায়ে সরে বসো। পিকদানির কাছ থেকে দূরে থাকো, নইলে থুথু পড়বে গায়ে।’
নীরবে কয়েক মিনিট তামাক পাতা চিবাল শেরিফ। থুক করে থুথু ফেলল পিকদানিতে। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, যে বুড়োটা খুন হয়েছে তার নাম রট হ্যানসন, প্রচুর টাকার মালিক ছিল। মাথামোটা, খুব খারাপ ব্যবহার করত মানুষের সঙ্গে। বাস করত ওই মেসার মাথায়। বয়েস অনেক হয়েছিল, সত্তর, তবু শরীর-স্বাস্থ্য ভাল ছিল। মেরে না ফেললে আরও বিশটা বছর কাটিয়ে দিতে পারত অনায়াসে।’
আবার তামাক মুখে ফেলে চিবাল শেরিফ। থুথু ফেলে বলল, ‘গত সোমবার সকালে বুড়োর লাশ প্রথম দেখল তার ভাস্তি ডিকসি। সম্ভবত, রোববার রাতে কোন এক সময় খুন করা হয়েছে। টেবিলে বসেছিল, পেছন থেকে তিনবার ছুরি মারা হয়েছে পিঠে।’
‘রোববার রাতে মেসায় উঠেছিল দু-জন, ডিকসি হ্যানসন আর স্টার লেভিট। মেয়েটা বলছে, বিকেল পাঁচটায় চাচার সঙ্গে কথা বলেছে সে। খানিকক্ষণ কথা বলে নেমে এসেছে শহরে। লেভিট উঠেছিল এই আটটার দিকে—আলো তখনও ছিল-শেষ পর্যন্ত রটের বাড়িতে ঢোকেনি সে, কোন কারণে মন পাল্টে দেখা না করেই ফিরে এসেছে।’
‘তৃতীয় আরেকজন যাকে সন্দেহ করা যায়, সে অ্যালেন কিনি। ধাড়ি শকুন, রটের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করত সুযোগ পেলেই, গত চারটা বছর ধরে একজন আরেকজনকে সহ্যই করতে পারত না।
মেসার চুড়ায় ওঠার পথের পাশেই কিনি শকুনটার কেবিন, সারাক্ষণ চোখ মেলে রাখে, কান খাড়া। পাশের পথ দিয়ে একটা বেড়াল গেলেও তার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। ডিকসি আর লেভিটকে সে-রাতে রটের কেবিনের দিকে যেতে দেখেছে কিনি, কসম খেয়ে বলেছে, আর কেউ যায়নি। রানাগাটে যাকে খুশি জিজ্ঞেস করো, একবাক্যে বলবে: বুড়ো কিনির চোখ এড়িয়ে স্বয়ং শয়তানও মেসায় উঠতে পারবে না। সে-রাতে সে রটের কেবিনে গিয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করেছি। নাক বাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, গত ছ-বছর মেসায় চড়েনি সে, একবারও না।’
‘তিনজনেরই খুনের মোটিভ রয়েছে, তিনজনেরই সুযোগ ছিল পেছন থেকে রটের পিঠে ছুরি বসানোর। তবে মেয়েটাকে বেশি সন্দেহ হয় আমার। তিনজনের মধ্যে তার পক্ষেই কাজটা সবচেয়ে সহজ ছিল।’
বললাম, ‘লেভিট ঢুকলে ভাল হত। হ্যানসনকে যদি তখনও জীবিত দেখত, সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারতেন মেয়েটাকে।’
মাখা ঝাঁকাল শেরিফ। ‘তা পারতাম। কিন্তু লেভিট বলেছে, সে ঢোকেনি। এটা প্রমাণ করতে পারছি না আমরা। এসেছ, ভালই হয়েছে। কে অপরাধী, বের করতে পারো কিনা শুধু দেখো, ধরার জন্যে ভেব না, সেজন্যে আমরাই আছি। সাহায্য পাবে। আরও খানিকটা তামাক মুখে ফেলল পণ্ড। চিবাতে চিবাতে বলল, এসেছ তো লেভিটের পক্ষ নিয়ে যদি দেখো সে-ই দোষী, তখন কি করবে?’
ঘুরিয়ে জবাব দিলাম, ‘আমাদের ফার্মের একটা সুনাম আছে। তথ্য গোপন করে নির্দোষকে ফাঁসাই না আমরা, দোষী হলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি না। যদি বুঝতে পারি, মক্কেল নিজেই দোষী, তার সঙ্গে আমাদের চুক্তি শেষ।’
‘হু!’
‘খুনটা কোথায় হয়েছে দেখতে পারব?’
‘পারবে,’ ডেস্কের ওপর থেকে পা নামাল শেরিফ, উঠে দাঁড়াল। ‘চলো, আমিও যাচ্ছি। নইলে উঠতেই দেবে না তোমাকে কিনি বুড়োটা।’
পথটা বেয়ে কয়েক মিনিট উঠার পরই বুঝতে পারলাম, কান খাড়া কিংবা চোখ খোলা রাখার দরকার নেই কিনির। যদি সে কালা কিংবা অন্ধ না হয়, তাহলে একটা ইদুর এ-পথে গেলেও টের পাবে, এতই সরু পথ। তার ওপর কাকর আর পাথরের ছড়াছড়ি, শব্দ হবেই। পথ ছেড়ে দু-কদম সরলেই ছোঁয়া যায় বুড়োর কেবিনের দেয়াল।
আমাদের সাড়া পেয়ে দরজায় এসে দাঁড়াল কিনি। লম্বা, হালকা-পাতলা শরীর, চৌকো চোয়াল, পাকানো লম্বা গোঁফের ডগা জুলফি ছুঁই ছুঁই করছে। শেরিফকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছোকরাটি কে?’
‘ডিটেকটিভ। খুনের তদন্ত করতে ওকে ডেকে এনেছে লেভিট।’
‘হু, আরও শিওর হলাম, ব্যাটা নিজেই ক্রিমিন্যাল।’ পিছিয়ে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল কিনি।
হাসল পণ্ড। বুড়ো হ্যানসনও ঠিক এমনই খারাপ ব্যবহার করত। নাহলে কি আর বন্ধুত্ব হয়। তবে শেষ পর্যন্ত নিজেরাও নিজেদের সহ্য করতে পারল না।
একেকটা শকুন পাঁচ লাখ ডলারের মালিক, ভাবতে পারো? একটা তো মরেছে, কিপটেমি করে করে টাকা জমিয়েছে, সেটা এখন ভোগ করবে একটা মেয়ে।’
‘বংশে আর কেউ নেই?’
‘আছে, কিন্তু এখন কোথায় কে জানে। তার এক ভাগ্নে শুনেছি অ্যানিমেল ক্যাচার, জন্তু-জানোয়ারের ব্যবসা করে। বন থেকে ধরে এনে বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে। সার্কাসের খেলাও দেখায়।’
‘মামার মৃত্যুর খবর ওকে জানানোর চেষ্টা করেননি?’
‘করেছি। নিউইয়র্কের একটা ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। ওরা জানাল, সে নাকি এখন জন্তু-জানোয়ারের খেলা দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে কোথায় আছে, বলতে পারল না।’
‘আরও খোঁজ নিলে ভাল হত না? এখানেই আশেপাশে কোথাও যদি থেকে থাকে? থাকতে পারে না?’
মুখ তুলল শেরিফ। আমার দিকে তাকিয়ে রইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ‘তাই তো, একথাটা তো ভাবিনি। সত্যিই, বুড়ো হয়ে গেছি আমি। দাঁড়াও, আজ রাতেই লোক লাগাব।’
‘মেয়েটা কি হ্যানসনের সব টাকা পাবে? নাকি একটা অংশ?’
‘জানি না। মেয়েটা বলছে, সেই সব পাবে। তার চাচার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছিল। চাচা বলেছিল, সব কিছু ভাস্তির নামে দিয়ে যাবে। ভাগ্নেকে হয়তো দেখতে পারত না হ্যানসন। উইলটা এখনও দেখিনি, আগামীকাল খোলা হবে।’
প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে সরু পথটা। দুধারে বিক্ষিপ্তভাবে ঘাস জন্মেছে, তারই মাঝে মাঝে জুনিপারের ঝোপ। আরও প্রায় আধমাইল চলার পর কেবিনটা দেখতে পেলাম।
চূড়ার একধারে একেবারে কিনারা ঘেঁষে তৈরি হয়েছে বাড়িটা। একপাশ থেকে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়। পেছনে একটা পাথুরে বেসিন, প্রাকৃতিক, বৃষ্টি হলে নিশ্চয় পানি জমে ওখানে।
পাথরের বাড়িটা খুব যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে। মোট তিনটে কামরা। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যেখানে যে জিনিস রাখা দরকার ঠিক সেভাবেই রাখা হয়েছে। এক জায়গায় কিছু বই আর ম্যাগাজিন দেখলাম। একটা টেবিলে শুকনো রক্তের কালচে দাগ লেগে আছে। চেয়ারের পায়া আর মেঝেতেও রয়েছে এই দাগ। বেশ কিছু জিনিস রয়েছে টেবিলে, যা দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, রাতের খাওয়া শুরু করতে যাচ্ছিল হ্যানসন, ঠিক এই সময় আঘাত হেনেছে শত্রু।
যে ঘরে খুন হয়েছে হ্যানসন, সেটাতে ঢুকতে হলে একটা বারান্দা পেরোতে হয়। বারান্দার পরে দরজা, পাল্লায় লাগানো স্প্রিঙে এমন মরচে পড়েছে, ঠেলা দিলেই ক্যাচকোঁচ করে ওঠে। তাহলে খুনীর আগমন টের পেল না কেন বুড়ো? দরজা খোলা রেখে বসেছিল? কিন্তু তাতেও তার অলক্ষ্যে ঢোকা সম্ভব ছিল না খুনীর। দরজা আগে থেকেই খোলা থাকলে পাল্লা খোলার শব্দ হয়তো হত না, কিন্তু লোকটাকে আসতে দেখতে পেতে সে। পথের অনেকখানি চোখে পড়ে খোলা দরজা দিয়ে।
ঘরে তিনটে জানালা। দুটো রয়েছে পেছনের দেয়ালে। জানালার বাইরে পনেরো ফুট নিচে পাথরের বেসিন। ওখান দিয়ে মানুষ আসার কোন উপায় নেই। তৃতীয় জানালাটার বাইরে আরও বেকায়দা অবস্থা, ওদিকে রয়েছে পাহাড়ের দেয়াল। এই জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে নিচে তাকালাম।
চৌকাঠের চার ফুট নিচে একটা শৈলশিরা, বাড়ির পেছনে গিয়ে শেষ হয়েছে। শৈলশিরাকে আড়াআড়ি কেটেছে একটা সরু ফাটল, ইঞ্চি চারেক চওড়া আর দশ ইঞ্চি মত গভীর। পঞ্চাশ-ষাট ফুট একেবারে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের দেয়ালটা, একটা পাথরের তাকমত রয়েছে ওখানে, তারপর থেকে আবার শুরু হয়েছে দেয়াল, শেষ হয়েছে প্রায় দুশো ফুট নিচে। পাহাড়ে চড়তে ওস্তাদ, দুঃসাহসী কোন মানুষের পক্ষে নিচের দু-শো ফুট বেয়ে ওঠা হয়তো সম্ভব, কিন্তু পরের ষাট ফুট? একেবারেই অসম্ভব।
ফাটলের পাশে মাটিতে একটা অদ্ভুত দাগ। হেঁচড়ে উঠে এসেছে যেন কোন দানব।
ভালমত ভাবার সময় পেলাম না, তার আগেই পেছন থেকে ডাক দিল শেরিফ, বাইরে লোক অপেক্ষা করছে।
তিনজন ওরা, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আকার দেখেই চিনলাম স্টার লেভিটকে, ছোটখাটো এক পাহাড় যেন। ফ্লানেলের ঢোলা শার্ট পরনে।
দ্বিতীয় নোকটা অ্যালেন কিনি।
তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে তাকাতেই চক্ষু স্থির হয়ে গেল আমার। ঋজু শরীর, সোনালি চুল। হুইপকর্ডের প্যান্ট আর সবুজ উলেন শার্টে অপরূপ লাগছে তাকে। আগে কখনও দেখিনি, তবু ভিকসি হ্যানসনকে চিনতে কোন অসুবিধে হলো না আমার। বড় বড় বাদামী চোখ মেলে তাকাল সে, রক্তে ঝড় তুলে দেয়া চাহনি।
‘এই যে!’ বলে উঠল লেভিট। বিচ্ছিরি কণ্ঠস্বর, খড়খড়ে। ‘এখানে কী? এসেই আগে আমার সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল। অনেক টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি আমি তোমাকে।’
কথার ঢঙ দেখে গা জ্বলে গেল আমার। কোনমতে হজম করে গেলাম। ‘দেখা করার জন্যে তো ডাকোনি, খুনের তদন্ত করতে ডেকেছ, তা-ই তো করছি।’
আমার কথার ধরনও পছন্দ হলো না তার। তাছাড়া তুমি করে বলেছি, সেটাও নিশ্চয় খারাপ লেগেছে। হয়তো ঘুসি মারতে হাত তুলেই নামিয়ে নিল আবার। খপ করে আমার হাত চেপে ধরে টান মারল। ‘এসো আমার সঙ্গে!’ শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে টানল যেন হাতি। কুৎসিত চেহারা হাতিটার, বসা নাক, ঘুসি মেরে ভেঙে দিয়েছে বোধহয় কেউ। ‘কথা আছে। এত মানুষের সামনে বলা যাবে না।’
টেনে আমাকে দূরে নিয়ে গেল লেভিট। মুখের সামনে মুখ নিয়ে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘শোন, একটি হাজার ডলার দিয়েছি তোমাদের কোম্পানীকে। কাজেই তোমাকে আদেশ দেয়ার অধিকার আমার আছে। যা বলব, করবে। মেয়েটার ঘাড়ে দোষ চাপাও, তাকে খুনী প্রমাণ করো। বুঝেছ? আমাকে সন্দেহ করে বসো না আবার। শেষ খুনটা করেছি অনেক বছর আগে। আরেকটা করার জন্যে হাত নিশপিশ করছে।’
তার হুমকির পরোয়া করলাম না। ‘দেখো, টাকা দিয়েছ বলেই মাথা কিনে ফেলনি আমার। অন্যায় ভাবে কারও ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারব না আমি। কোম্পানীকে ফী দিয়েছ, তারা আমাকে পাঠিয়েছে। যে কাজ করতে বলা হয়েছে, তাই করছি। সত্য জানার চেষ্টা করব আমি। কেন, ভয় পাচ্ছ নাকি? বেফাঁস কিছু বেরিয়ে পড়বে?’
জ্বলে উঠল লেভিটের চোখ। ‘মনে হচ্ছে ভুল জায়গাতেই গিয়েছি আমি। তবে সিধে করে ফেলব। কি মনে হয় তোমার? আমি খুন করলে তোমাকে ডাকতে যেতাম? যা বলি শোনো, ওই মেয়েটাই খুন করেছে হ্যানসনকে, বুড়োর টাকার লোভে। দুঃখই হচ্ছে আমার। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ব্যাটাকে খুন করব, পারলাম না। তার আগেই কাজটা সেরে ফেলল আরেকজন।’
‘তোমার সঙ্গে গণ্ডগোলটা কি ছিল?’
অদ্ভুত চাহনি ফুটল লেভিটের কালো চোখে। ‘সেটা তোমার জানার দরকার নেই। আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতেও বলা হয়নি তোমাকে! ওই মেয়েটার সর্বনাশ দেখতে চাই আমি। যাও, কাজে লাগো!’
‘শোন, লেভিট,’ শান্তকণ্ঠে বললাম। ‘কাজে নামার আগে কিছু কথা জানতে হবে আমাকে। নইলে আমাকে দিয়ে সাহায্যের আশা ছাড়তে পারো। সত্যি কথা বলো, তুমি খুন করেছ হ্যানসনকে?’
‘না, পকেট থেকে নোটের মোটা একটা তাড়া বের করল লেভিট!’ বুঝতে পেরেছে, ধমকে কাজ হবে না। কয়েকটা একশো ডলারের নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘রাখো৷ কাজে লাগবে। খরচ হয়ে গেলে আবার চেয়ে নিয়ো। শুধু মনে রেখো, আমার বিরুদ্ধে কোন খারাপ কথা যেন না রটে। আরেকটা ব্যাপার, আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াঁতে পারব না আমি।’
‘ভাল। গোটা দুই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। আরেকটা প্রশ্ন, সত্যিই কি সেদিন হ্যানসনের কেবিনে ঢোকোনি? না ঢুকেই ফিরে এসেছ? কেন জিজ্ঞেস করছি বুঝতে পারছ নিশ্চয়। আমি জানতে চাই, ওই সময় হ্যানসন জীবিত ছিল কিনা।’
হাসি ফুটল আবার লেভিটের চোখে। ‘এসব জানার জন্যেই ভাড়া করা হয়েছে তোমাকে, খোঁজখবর করে জেনে নাও। শুধু মনে রেখো, বুড়োটাকে আমি খুন করিনি। আমি হলে লুকিয়ে করতাম না। সবার সামনেই গলা টিপে ধরতাম। সহজে আমি মাথা গরম করি না। অকারণে মানুষ খুন আমি ঘৃণা করি।’
লেভিটের কথা বিশ্বাস করলাম। ভয়ঙ্কর লোক সে। শিকাগোর অপরাধ জগতের একজন হোমড়া-চোমড়া ছিল এককালে। খুন করেছে কয়েকটা, তবে পুলিশ তার টিকিও ছুঁতে পারেনি। চমৎকার অ্যালিবাই তৈরি করে রেখেছিল, একটা কেসেও কোট তাকে অপরাধী ঘোষণা করে শাস্তি দিতে পারেনি।
কিন্তু তাকে হ্যানসনের খুনী ভাবতে পারলাম না। একটা ব্যাপারে অবাক লাগছে, ডিকসিকে খুনী প্রমাণের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে কেন সে?
কিনির সঙ্গে কথা বলছে পণ্ড। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ডিকসি। আমি কাছাকাছি হতেই চোখ তুলল।
বলতে গেলাম, ‘আমার নাম…’
‘ওটা না বললেও চলবে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠল ডিকসি। ‘আপনি কে, কেন এসেছেন, ভাল করেই জানি। আমাকে খুনী প্রমাণ করতে চান তো? পারলে করুন। কোন প্রশ্ন আছে? থাকলে জলদি সেরে ফেলুন।’
‘আছে। কি সেন্ট ব্যবহার করেন? শ্যানেল কোম্পানীর গার্ডেনিয়া?’
এমন টক-দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল ডিকসি, সেটা দুধের ওপর ফেললে সঙ্গে সঙ্গে দই হয়ে যেত। ‘বাজে কথা রাখুন।’
‘বেশ। অন্য প্রশ্ন করছি। কতদিন পরে চাচার সঙ্গে দেখা করতে এলেন? এর আগে কবে এসেছিলেন রানাগাটে?’
‘রানাগাটে এই প্রথম। চাচাকেও আগে কখনও দেখিনি।’
‘আপনার দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে শুনেছি?’
‘অতটা দূর সম্পর্ক নয়। ফুফাত ভাই। নাম ভিন কার্টার। একটা সার্কাস পার্টিতে কাজ করে, জন্তু-জানোয়ারের খেলা দেখায়। বয়েস ঊনচল্লিশ, খুব ভাল স্বাস্থ্য। আপনার মত টিকটিকিকে ধরে বেদম ধোলাই দেয়ার ক্ষমতা রাখে।’
হাসলাম। ‘যাক, স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন। আপনার মত সবাই বললে কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত আমার। তো, চাচাকে কি আপনিই খুন করেছেন?’
শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল ডিকসি। ‘না। ওর সঙ্গে পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের। ঘৃণা করারও সময় পাইনি, ভালবাসারও না। ভিন ছাড়া ওই চাচাই আমার একমাত্র নিকট-আত্মীয়। তাই তাকে দেখতে এসেছিলাম।’
‘আপনি জানেন, মিস্টার হ্যানসনের সম্পত্তির মালিক হবেন আপনি?’
‘জানি। বছর তিনেক আগে চিঠি লিখে জানিয়েছিল চাচা। গত শনিবারে আবার বলেছিল কথাটা।’
‘কি কাজ করেন? চাকরি-বাকরি, নাকি অন্য কিছু?’
‘চাকরি। পার্সোনাল সেক্রেটারি।’
‘চমৎকার। বেঁচে গেছে নিশ্চয় আপনার বস। আপনাকে ডিঙিয়ে কেউ যে তার ঘরের ত্রি-সীমানায় ঘেঁষতে পারে না, বুঝতেই পারছি।…এখানে উঠেছেন কোথায়?’
‘হোটেলে।’
‘চাচার সঙ্গে কবার দেখা করেছিলেন?’
‘তিনবার। যেদিন এখানে এসেছি সেদিন একবার, দু-ঘন্টা থেকেছি কেবিনে। দ্বিতীয়বার পরদিন দিনের বেলা। তৃতীয়বার, যে রাতে খুন হয়েছে চাচা, সে রাতে।’
‘কি মনে হয়েছে চাচাকে দেখে?’
দ্রুত আমার মুখে চোখ বুলিয়ে নিল ডিকসি। কিছু বোঝার চেষ্টা করল। ‘নিঃসঙ্গ, ক্লান্ত একজন ভাল মানুষ।’
আরও প্রশ্ন করলাম। আমার সব কথারই জবাব দিল ডিকসি, নির্দ্বিধায়।
জানলাম, ডিকসির ভাই ভিন কার্টার সুদর্শন তরুণ। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছে দীর্ঘদিন, জন্তু-জানোয়ার ধরেছে। তারপর কয়েক বছর আগে ওই ব্যবসা ছেড়ে একটা সার্কাস পার্টিতে ঢুকেছে। কর্মচারী নয়, ব্যবসার অংশীদার। যাযাবর জীবন। পার্টি যখন যেখানে যায়, খেলা দেখানোর জন্যে কার্টারও যায় সেখানে।
মাত্র কয়েক দিনেই চাচার সঙ্গে মিষ্টি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ডিকসির। এই অল্প সময়েই রান্না করে খাইয়েছে চাচাকে, কাজে সাহায্য-সহায়তা করেছে।
শেষবার কেবিন থেকে বেরোনোর সময় হ্যানসনকে জীবিত দেখেছে সে, কসম খেয়ে বলল। লেভিটের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল না, কিন্তু কোন কারণে তার ওপর খেপে আছে লোকটা। কি কারণ, তার চাচার সঙ্গে কি নিয়ে গোলমাল, জানে না ডিকসি। লোকটার ওপর তার চাচা হাড়ে হাড়ে চটা ছিল কোন কারণে। শুধু তাই না, সব সময় কাছাকাছি একটা পিস্তলও রাখত হ্যানসন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাছাকাছি বলতে কি বোঝাচ্ছেন? সঙ্গে?’
‘না, তাকের ওপর, কতগুলো কাপ-প্লেটের ভেতর লুকানো। নতুন করে তেল দেয়া। কাপ নামাতে গিয়ে দেখে ফেলেছিলাম।’
‘তারমানে বিপদ আশা করছিল হ্যানসন। কার কাছ থেকে? স্টার লেভিট? নাকি অন্য কেউ?’
সেই দিনই রাতে। ক্যাফেতে এসে ঢুকলাম। বসলাম একটা খালি টেবিল দেখে।
কাউন্টারে বসে কিছু পড়ছিল ওয়েট্রেস, আমাকে দেখে উঠে এল। সোনালি চুল, মুখ গোমড়া, তবে ফিগারটা চমৎকার। অর্ডার নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে।
একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল মেয়েটা, কাউন্টারের ওপর ফেলে রেখে গেছে উপুড় করে। নামটা দেখে কৌতূহল হলো আমার। বিলবোর্ড। মূলত সিনেমা ম্যাগাজিন। থিয়েটার, সার্কাস, মেলা এসব নিয়েও লেখা থাকে ওতে। অনেকেই পড়ে এটা, ওয়েট্রেসও পড়ছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল হ্যানসনের ভাগ্নের কথা। ভিন কার্টার, সার্কাসে খেলা দেখায়।
খাবার দিয়ে গেল ওয়েট্রেস।
এই সময় ঘরে ঢুকল লেভিট। উলেন শার্ট আর টুইডের প্যান্ট পরনে। আমার টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে পড়ল। মৃদু ক্যাঁচকোঁচ করে প্রতিবাদ জানাল চেয়ার। ওজনটা যে সইতে কষ্ট হচ্ছে বুঝিয়ে দিল। বিশাল একটা থাবা টেবিলে রেখে সামনে ঝুঁকল সে। ‘কিছু পেলে? মেয়েটাকে ফাসানোর মত?’
একটুকরো কাবাব কেটে মুখে ফেললাম। চিবাতে চিবাতে জবাব দিলাম, ‘কয়েকটা ব্যাপার জেনেছি। সেগুলো নিয়েই ভাবনা-চিন্তা করছি এখন।’
মেজাজ ভাল লেভিটের। লক্ষ্য করলাম, কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে, কাউকে খুঁজছে। আমাকে ফাঁসানোর মত কিছু পাবে না। বুড়োটার সঙ্গে ঝগড়া ছিল আমার, কিন্তু আমি তাকে খুন করিনি। কেবিনেই ঢুকিনি সে রাতে। কেউ বলতে পারবে না, আমি ঢুকেছি। কিনি বুড়োটাও না। সে কেবিনের দিকে যেতে দেখেছে আমাকে, ফিরে আসতেও দেখেছে। তাকে জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে, যেতে-আসতে কতখানি সময় লেগেছে। ওটুকু সময়ে কেবিনে গিয়ে একজনকে খুন করে ফিরে আসা যায় না। তবুও লোকের সন্দেহ যাচ্ছে না আমার ওপর থেকে। তোমার কাজ আমাকে সন্দেহমুক্ত করা।’
‘সেটা হয়তো করা যাবে।’
চেয়ারে হেলান দিল লেভিট। এই প্রথম নরম চোখে তাকাল আমার দিকে। ওর আচরণে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল, খুনটা সে নিজের হাতে করেনি, কিন্তু জানে কে করেছে। অপরাধটার সঙ্গে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে সে।
ওয়েট্রেস এল। ‘আপনার জন্যে কিছু মিস্টার লেভিট?’
মেয়েটার ভাব-ভঙ্গি ভাল মনে হলো না আমার। ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চাইছে না তো? তার হাতের ন্যাপকিন মাটিতে পড়ে গেল, উবু হয়ে সেটা তুলে দিল লেভিট।
ওরা ভেবেছে কি আমাকে? গাধা? আড়চোখে দেখতে পেলাম ছোট একটা কাগজের টুকরো ন্যাপকিনে ভরে ফেলল লেভিট, গুঁজে দিল মেয়েটার হাতে।
শুধু এক কাপ কফি খেলো লেভিট, আরও দু-চারটা কথা বলে উঠে চলে গেল।
বিল দেয়ার জন্যে কাউন্টারে এলাম। তেমনিভাবে পড়ে আছে ম্যাগাজিনটা। খুচরা আছে, তবু ইচ্ছে করেই লেভিটের দেয়া একটা একশো ডলারের নোট বাড়িয়ে দিলাম মেয়েটার দিকে। ভাঙতি এখানেই আছে, নাকি রান্নাঘরে যেতে হবে তাকে?
আমার আশা পূর্ণ হলো। রান্নাঘরেই ভাঙতি আনতে যেতে হলো মেয়েটাকে।
ম্যাগাজিনটা উল্টে চট করে দেখে নিলাম কি পড়ছিল সে। যা ভেবেছিলাম, তাই। নেভাডায় সার্কাস পাটি এসেছে, সেই খবর।
আবার আগের মত করে রেখে দিলাম পত্রিকা।
ভাঙতি নিয়ে ফিরে এল মেয়েটা। বেরিয়ে এলাম ক্যাফে থেকে।
শান্ত রাত। পরিষ্কার আকাশে তারার মেলা। খনির দিক থেকে আসছে। কমপ্রেসর মেশিনের একটানা একঘেয়ে আওয়াজ। কাজ চলছে খনিতে, চব্বিশ ঘণ্টাই চলে।
রানাগাটে আসার পর এই প্রথম একটা ভাল সূত্র পেয়েছি। নেভাডায় সার্কাস পার্টি, রানাগাট থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। কোথাও বুঝি একটা যোগাযোগ আছে, ঠিক ধরতে পারলাম না।
হোটেলে টেলিফোন আছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের লাইন পাওয়া গেল। ঝাড়া বিশ মিনিট কথা বললাম বসের সঙ্গে। ভিন কার্টারের ব্যাপারে ভালমত খোঁজখবর নিয়ে আমাকে জানাতে অনুরোধ করলাম তাকে।
ডিকসি হ্যানসনের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেব আমি, তবে সেটা পরে। অ্যালেন কিনি সম্পর্কেও খোঁজ নেয়া দরকার। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব জানতে হবে আমাকে। খুনটা যখন হয়, তখন ভিন কাটার কোথায় ছিল? রট হ্যানসন আর লেভিটের মধ্যে ঝগড়াটা কিসের? গোমড়ামুখো ওয়েট্রেস আর লেভিটের সম্পর্ক কি? কার্টারের সঙ্গেও সম্পর্ক আছে মেয়েটার? লেভিটের ব্যাপারে কি কিছু গোপন করছে অ্যালেন কিনি?
হোটেলের লবিতে একটা চেয়ারে এসে বসলাম। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এক ঘণ্টা পরেই খবর এসে গেল। বস জানালেন, নেভাডায় যে সাকার্স পার্টি এসেছে, ওতেই খেলা দেখায় ভিন কার্টার। হ্যানসন খুন হওয়ার আগের দিন পার্টিটা ছিল লা ভেগাসে, পরদিন গেছে ওগডেনে।
লবিতে ডেস্ক আছে, তার পাশে একটা র্যাক, তাতে কিছু টাইমট্যাবল আর ম্যাপ পেলাম। একটা ম্যাপ তুলে নিয়ে টেবিলে বিছালাম।
দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। একটাই রাস্তা। ও-পথেই গেছে সার্কাস পার্টি। রাস্তাটা হ্যানসনের মেসা থেকে মাত্র এক মাইল দূরে।
তিনজন ছিল সন্দেহের তালিকায়, এবার হলো চারজন। সবার ওপরই সন্দেহ জোরাল হচ্ছে। লেভিট আর হ্যানসনের কি নিয়ে ঝগড়া ছিল, এটা জানতে পারলেই কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত। অস্থির ভাবে পায়চারি করছি, আর ভাবছি। একনাগাড়ে খুঁচিয়ে চলেছি মগজকে, যদি কোন জবাব দিতে পারে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। সোনা! সোনার খনি! চোরা পথে বেরিয়ে যায় সোনা মেশানো আকরিক।
ডিকসিকে বেরোতে দেখলাম তার ঘর থেকে এগিয়ে আসছে। চাচার কেবিনে না উঠে হোটলে উঠেছে সে। কেন?
আমার চোখে চোখ পড়ল তার। পাশ কেটে চলে যাওয়ার আগে ডাকলাম, ‘একটু দাঁড়াবেন?’
দাঁড়াল ডিকসি।
‘শহরটা বড় বেশি একঘেয়ে,’ বললাম। ‘কথা বলার মানুষ নেই। চলুন না, কোথাও বসি? চা-কফি খাই?’
কড়া একটা জবাব আশা করেছিলাম, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসল সে। এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। ‘কোথায় বসবেন?’
‘এখানেই।’
কফি এল। কাপে চুমুক দিল ডিকসি। মৃদু হাসল। ‘তারপর? শেরিফের হাতে আমাকে তুলে দেয়ার আর কত দেরি?’
‘দেখুন, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার চাচার খুনী ধরা পড়ুক, চান তো? তাহলে উল্টোপাল্টা কথা বাদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করুন?’
‘আমাকে দোষী প্রমাণ করার জন্যে আসেননি আপনি?’
‘না। আমি এসেছি লেভিটকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। ওই লোকটা দুধে-ধোয়া সাধুপুরুষ নয়, জানি আমি; মানুষ খুনও করেছে, কিন্তু হ্যানসনকে সে খুন করেনি, এটা জোর দিয়ে বলতে পারি।’
‘কি করে পেলেন এই জোর?’
‘তার খুন করার রীতি আমার জানা। সে করলে এমনভাবে অ্যালিবাই তৈরি করে রাখত, যাতে তার ওপর সন্দেহই না জাগে। যা বুঝলাম, সে চায় ধামাচাপা না পড়ে বরং ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি হোক। খুনটা সে করে থাকলে এরকম করত না। তবে কিছু একটা সে করেছে। কী করেছে সেটা জানতে পারলে সুবিধে হত।’
‘অ্যালেন কিনিকে সন্দেহ হয় আপনার?
মাথা নাড়লাম না। ‘মিস্টার হ্যানসনের সঙ্গে তার ঝগড়াঝাটি ছিল বটে, কিন্তু খুন করার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বয়েস হলে মেজাজ ক্যাটক্যাটে হয়ই, অযথাই রেগে ওঠে মানুষ। দু-জনের স্বভাব একরকম হলে তো কথাই নেই, এমন লাগা লাগে, একে অন্যের মুখ দেখতে চায় না। পরে আবার ঠিকও হয়ে যায়। বেশি ঘনিষ্ঠ হলেই এমন করে।’
‘তাহলে দাঁড়ালটা কি? লেভিট বাদ, কিনি বাদ, বাকি রইলাম আমি।’
‘আপনাকেও তো খুনী ভাবতে পারছি না।’
ডিকসি হাসল। ‘তাহলে কে? আপনাআপনি তো আর খুনটা হয়ে যায়নি।’
‘তা কি আর হয়।’
একটু দ্বিধা করে শেষে বলে ফেলল ডিকসি, ‘ক্যাফেতে একটা আগুন দেখেছি। মনে হচ্ছে, কিছু পোড়ানোর তালে আছে।’
‘আমারও তাই ধারণা।’
‘ও, আপনিও ধরে ফেলেছেন।’
‘ধরার ব্যাপার হলে তো ধরবই।’
‘মানুষগুলো যেন কেমন এখানকার। মন খুব ছোট। বাইরের কেউ এলেই সন্দেহের চোখে দেখে।’
‘অনেক ছোট শহর তো, সেজন্যেই বোধহয় এরকম।’
‘তা হতে পারে। মিস্টার কানাভান, আপনি সাবধান থাকবেন। লেভিট আপনাকে দাওয়াত দিয়ে এনেছে বলেই ভাববেন না বেঁচে গেছেন, বরং শত্রু আরও বাড়ল আপনার। ও এখানে অনেকেরই চক্ষুশূল।’
‘সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, সাবধান করার জন্যে ধন্যবাদ।’
খানিকক্ষণ চুপচাপ রইলাম দু-জনেই। কেউই আর কথা খুঁজে পাচ্ছি না। এভাবে বসে থাকতেও ভাল লাগছে না। বললাম, ‘এখানে বড্ড গরম। চলুন না, বাইরে থেকে খানিক হেঁটে আসি।’
এবারও আমাকে অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল ডিকসি।
বাইরে ফুরফুরে হাওয়া। দিনের প্রচণ্ড উত্তাপ শুষে নিয়েছে শীতল বাতাস। হোটেলের সামনে দিয়ে চলে গেছে পথ, সামান্য একটু মোড় নিয়ে উঠে গেছে পাহাড়ে। নীরবে ওই পথ ধরে পাশাপাশি হেঁটে চললাম দু-জনে। কোথায় যাব জানি না।
পাহাড়ে উঠে এলাম। নিচে রানাগাট শহর। একপাশে আরেকটা বড় পাহাড়, গোড়ার আছে আলোর সারি। ওখানেই খনি।
চাঁদ মাথার ওপরে। কয়েকটা পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট শহরটা, মনে হচ্ছে যেন হাতের তালুতে তুলে নিয়েছে কোন বিশাল দানব। বাঁ পাশে আমাদের কাছাকাছিই রয়েছে স্টার লেভিটের ক্যালিফোনিয়া-স্টাইল বিরাট র্যাঞ্চ হাউস। ওটার পরে উপত্যকা, তারপরের আধমাইল জুড়ে রয়েছে অনেকগুলো পাকা বাড়ি-হ্যানসন গোল্ড মাইন, খনি এবং কারখানা।
ডানে, শহর থেকে দূরে বিশাল মেসা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, কালো দেখাচ্ছে চাঁদের আলোয়।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমরা। প্রকৃতির অপরূপ শোভা যেন বোৰা করে দিয়েছে আমাদের। স্তব্ধ নীরবতা থাকলে এ-সময় বেশি মানাত, আরও ভাল লাগত, কিন্তু পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে কমপ্রেসরের বিরক্তিকর আওয়াজ।
হঠাৎ চোখে পড়ল কালো মূর্তিটা। একটা বাড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে শহরের একমাত্র পথে উঠছে। আমি দেখেছি, না ডিকসি আগে দেখেছে, জানি না; তার আঙুল চেপে বসল আমার কব্জিতে।
শহরের পথে মানুষ চলাচল করতেই পারে, তাতে আমাদের কি? এভাবে চমকে উঠলাম কেন। জবাব পেলাম না। তবে অনেক অদ্ভুত ব্যাপারই ঘটে পৃথিবীতে, যার কোন ব্যাখ্যা নেই। এটাও হয়তো তেমনি কোন ব্যাপার।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। লুমিনাস ডায়াল, দেখতে অসুবিধে হলো না, দশটা বেজে দশ। সময়ই যেন বলে দিল, শহরের পথে ও কে। কোথায় যাচ্ছে, তা-ও বুঝতে পারছি। অন্ধকার ছায়ায় আবার হারিয়ে গেল মূর্তিটা।
ডিকসির দিকে ফিরে বললাম, ‘হোটেলে যান। আপনাকে সঙ্গে করে পৌঁছে দিতে পারলে ভাল হত, কিন্তু ভদ্রতা দেখানোর সময় এখন নেই।
চাঁদের আলোয় ডিকসির চোখ আর এখন বাদামী লাগছে না, কালো। ‘আপনি ওর পিছু নেবেন?’
‘আমি গোয়েন্দা, সেটাই তো আমার কাজ। ক্যাফের আগুন কোথায় চলেছে। দেখতে চাই। যান। সকালে হোটেলে দেখা হবে।’
‘আমি আপনার সঙ্গে যাব।’
আপত্তি করতে পারি, কিন্তু ডিকসিকে হোটেলে ফিরে যেতে রাজি করাতে পারব কিনা সন্দেহ আছে। কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে হয়তো অহেতুক সময়ই নষ্ট হবে। এখন তাড়াহুড়া। তাই কথা না বাড়িয়ে নিয়ে নিলাম সঙ্গে।
পাহাড় বেয়ে উপত্যকায় নামতে হবে, আমি একা হলে তাড়াতাড়িই পারতাম। কিন্তু সঙ্গে ডিকসি, ফলে দেরি হতেই থাকল। অনেক কষ্টে হাঁটু আর কনুইয়ের ছাল-চামড়া তুলে অবশেষে নিচে আমার পাশে এসে দাঁড়াল সে। আমার চামড়াও অক্ষত নেই। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ক্যাকটাস আর অন্যান্য কাটালতায় লেগে ছড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়।
যা-ই হোক, ঠিক সময়েই পৌঁছেছি আমরা। আধ মিনিট পর পদশব্দ কানে এল।
থেমে গেল একটু পর। ঘন্টার শব্দ হলো। মৃদু ক্যাঁচকোচ করে খুলে গেল গেটের পাল্লা।
র্যাঞ্চ হাউসের সামনের গেটে দারোয়ান থাকতে পারে, তাই সেদিকে গেলাম। চলে এলাম পেছনে। আরেকটা গেট আছে। ঠেলা দিতে হাত বাড়িয়েই থেমে গেলাম। চাঁদের আলোতেও দেখা গেল তারটা। উফ, বড় বাঁচা বেঁচেছি। হাত দিয়ে ফেললে আর রক্ষা ছিল না। ইলেকট্রিক তার। নিশ্চয় হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ বইছে লোহার গেটে। নইলে এখানে এভাবে তার লাগানোর আর কোন কারণ নেই।
সমস্যায় পড়ে গেলাম। ঢুকব কোন পথে? গ্যারেজ দিয়ে? আছে ঢোকার জায়গা?
অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাইরের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্যে যত কড়াকড়িই করা হোক, এমন কিছু ফাক থেকেই যায়, চেষ্টা করলে যেখান দিয়ে ঢুকে পড়া অসম্ভব হয় না। এখানেও রয়েছে তেমন দুর্বল জায়গা, গ্যারেজের একটা জানালা। পকেট থেকে ছোট দু-একটা যন্ত্রপাতি বের করে সহজেই খুলে ফেললাম জানালার পাল্লা। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। ডিকসিকেও ঢুকতে সাহায্য করলাম অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেণ্ড। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই। দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে। নির্জন। কোন সাড়াশব্দ নেই। ছায়ায় ছায়ায় চলে এলাম বসার ঘরের জানালার কাছে।
এখন ধরা পড়লে আমাদের কি অবস্থা হবে, বুঝতে পারছি। শেরিফের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে না লেভিট। যা করার নিজেই করে ফেলবে। বিরাট এক আর্মচেয়ারে বসে থাকতে দেখলাম তাকে। পায়ের তলায় পুরু নাভাজো কার্পেট। এতবড় চেয়ারেও ঠিকমত জায়গা হচ্ছে না হাতিটার, কাঁধের দু-পাশ বেরিয়ে আছে চেয়ারের হেলানের দুদিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি ওয়েট্রেসের ওপর স্থির।
জানালার পাল্লা ভেজানো। সামান্য ফাঁক করতে পারলে ভেতরের কথাবার্তা শোনা যেত। ঘষামাজা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়ি, পাল্লা খুলতে গেলে কি আওয়াজ হবে? নেব ঝুঁকি?
কৌতূহলেরই জয় হলো। ভাগ্যও আমার ভাল। নিঃশব্দেই খুলে গেল পাল্লা। ফাঁক দিয়ে ভেসে এল লেভিটের কর্কশ গলা, ‘কতবার না বলেছি, যখন তখন এখানে আসবে না? রিনি, একটা কথা কেন বুঝতে পারছ না, কাউবয় শেরিফটা বোকা নয়।’
‘কিন্তু আমাকে আসতে হলো, বাধ্য হয়েই। ওই টিকটিকিটা ম্যাগাজিনটা দেখে ফেলেছে। কি পড়ছিলাম, জেনে গেছে।’
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লেভিট। অতবড় দেহটা যেভাবে সচ্ছন্দে নাড়ল সে, অবাকই হয়ে গেলাম। ধমকে উঠল, যেখানে সেখানে ওভাবে রাখো কেন! মনে রেখো, দশ লাখ ডলার… এভাবে চললে ওই টাকার আশায় থুক পড়বে, বলে দিলাম!
‘কিন্তু তোমার ঘাড়ে তো আর চাপাতে পারবে না,’ লেভিটকে নয়, যেন নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছে রিনি।
‘কে বলল, পারবে না? যদি পারে? সেজন্যেই খুব সাবধান থাকতে হবে আমাদের। তোমাকে দলে নেয়াটাই ভুল হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে এখন কখন যে কি গণ্ডগোল করে দেবে কে জানে। সব ভেস্তে যাবে তখন।’ বকাবকি করে রাগ খানিকটা কমল লেভিটের। কণ্ঠস্বর সামান্য কোমল করে বলল, ‘যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এরকম অসাবধান আর হয়ো না। গোয়েন্দাটাকে অত ভয়ের কিছু নেই। ওটা একটা আস্ত গাধা। খালি তেজ আছে, মাথায় একরত্তি ঘিলু নেই।’
রিনি বলল, ‘দেখো স্টার, মানুষকে ছোট করে দেখা তোমার স্বভাব। এজন্যে পস্তাবে একদিন। গোয়েন্দাটাকে যত বোকা তুমি ভাবছ, ততটা বোকা সে নয়।’
আবার রেগে উঠল লেভিট, ‘জানোই যদি, বোকামিটা করলে কেন?’
‘ইচ্ছে করে কি আর করেছি? ভুল হয়ে গেছে।’
‘হয় কেন?’
‘ভুল সবারই হয়। তোমারও হয়। শোনো, লীডার বলেছে…’
‘আরে রাখো তোমার লীডার!’ হাত নেড়ে বাতাসকেই যেন থাপ্পড় মারল লেভিট। ‘ও কি জানে? ওর কোন ক্ষমতা আছে? যা করেছে, ওই পর্যন্তই দৌড়। করতে তো হচ্ছে সব আমাকেই।’
‘যা-ই বলো, স্টার, গোয়েন্দাটাকে ভাড়া করা ঠিক হয়নি। ওর চাহনি দেখেছ?’
‘দেখব না কেন?’ গাধার চাহনি।
কানের কাছে মৃদু হাসির শব্দ, ফিক করে হেসে ফেলেছে ডিকসি, তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরলাম।
‘যা বলি শোনো,’ পিস্তলের নিশানা করার মত করে রিনির দিকে আঙুল তুলল লেভিট, ‘আমি না ডাকলে আর আসবে না। কান খাড়া রাখবে সব সময়। ক্যাফেতে কে কি বলে শোনার চেষ্টা করবে। শেরিফের ওপর চোখ রাখবে, গোয়েন্দাটাকে যখন তোমার এত ভয়, তার ওপরও রাখবে। অ্যালেন কিনির ব্যাপারে কোন কথা কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।’
‘মনে হচ্ছে ওকে তুমি ভয় পাও? ওই বুড়োটাকে ভয়ের কি আছে?’
‘ভয় করলে এ-শহরের ওই একটা লোককেই করতে হয়। ঈগলের চোখ ওর, কয়োটের কান। পিস্তলের নিশানাও খুব ভাল। ওর সঙ্গে লাগতে যাওয়ার আগে দশবার চিন্তা করা উচিত।’
হাত নেড়ে রিনিকে চলে যেতে বলল লেভিট।
ঘুরে দাঁড়াল রিনি। দরজার দিকে এগোল। পেছনে গেল লেভিট। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল দু-জনেই। এর পর কি ঘটবে, আঁচ করতে পারলাম। ওসব আর দেখার ইচ্ছে নেই। যা শোনার শুনেছি, নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া দরকার এখন।
বেরিয়ে এলামও, কিন্তু জানলাম না, মারাত্মক একটা গণ্ডগোল করে ফেলেছে ডিকসি।
সকালে কফি খেতে খেতে অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম। এখানে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে, খতিয়ে দেখলাম মনে মনে। কিছুতেই হ্যানসনের খুনীর আসনে বসাতে পারলাম না লেভিটকে।
সমস্ত ঘটনা একটা দিকেই আঙুল নির্দেশ করছে। বিলবোর্ড ম্যাগাজিনের লেখাটা নিয়ে আবার ভাবলাম। নাহ্, ভিন কার্টারের সঙ্গে দেখা না করলেই নয় আর।
ক্যাফেতে এসে ঢুকল লেভিট। টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসল। কোন ভূমিকা না করে বললাম, ‘তুমি খুনী নও। কে হ্যানসনকে খুন করেছে এখন আমি জানি। শুধু বুঝতে পারছি না, ঢুকল কোনখান দিয়ে।’
নীরবে পকেট থেকে নোটের তাড়া বের করল লেভিট। গুনে গুনে পাঁচটা একশো ডলারের নোট খুলে নিয়ে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘নাও। নিয়ে বাড়ি চলে যাও। তোমার আর কোন কাজ নেই এখানে।’
‘মানে?’
র্যাটল সাপের চাহনি ফুটল লেভিটের কালো চোখে। ‘বুঝলে না? ভাগতে বললাম শহর থেকে। কাজ করতে আনলাম আমার, করছ ওই মেয়েমানুষটার। আমি ভালমানুষ, তাই তার পরেও তোমার পাওনা বুঝিয়ে দিচ্ছি। যাও, চলে যাও।’
‘যদি থাকতে চাই? আমার নিজের খরচে?’
‘তোমার কোম্পানী তাতে রাজি হবে না।’
‘সেটা আমি বুঝব।’
কঠিন হাসি ফুটল লেভিটের ঠোঁটে। ‘আজ রাত বারোটা পর্যন্ত সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে শহর ছাড়বে, আর কোন কথা শুনতে চাই না।’
শব্দ করে পেছনে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল সে।
খানিক দূরে আরেকটা টেবিলে বিশালদেহী এক লোক বসে আছে, খনির শ্রমিক-টমিক হবে। তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল লেভিট! ঢালাও হুকুম দিল, ‘বারভু, রাত বারোটা এক মিনিটের মধ্যে যদি শহর না ছাড়ে ও, কান দুটো ছিড়ে নিও। আর কিছু করার দরকার নেই। একা পারবে না বুঝলে সঙ্গে লোক রেখো।’
আমার দিকে ফিরল লোকটা। চোয়াল বসা, কান দুটো মাথার সঙ্গে লেপটে আছে। ছোট ছোট চোখ। ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আর কাউকে লাগবে না।’
বাইরে বেরিয়ে এলাম। উজ্জ্বল রোদ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম মিনিটখানেক। লেভিটের এই হঠাৎ পরিবর্তন বিস্মিত করেছে আমাকে। রাতেও আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভয় ছিল না তার। মাত্র কয়েক ঘন্টায়ই এতটা বদলে গেল!
রওনা হলাম শেরিফের অফিসে।
প্রথম দিন যেমন দেখেছি, ঠিক তেমনিভাবে ডেস্কের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে আছে ওয়াল্ট পণ্ড। আমাকে দেখে হাসল। ‘নতুন কোন খবর?’
‘হ্যাঁ,’ বললাম। ‘গণ্ডগোল।’
‘সত্যি বলতে কি কেসটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না আমি। ওই কিনি বুড়োটা মুখ খুলছে না। লেভিটও অনেক কিছু জানে, সে-ও বলতে চাইছে না।’
লেভিট যে আমাকে শহর থেকে চলে যেতে বলেছে, জানালাম শেরিফকে। বললাম, ‘কিন্তু আমি যেতে চাই না। আমার ধারণা, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে একটা সুরাহা করে ফেলতে পারব। ব্যাপারটা নির্ভর করছে এখন আপনার ওপর।’
‘আমার ওপর?’
‘হ্যাঁ। আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্যে রানাগাটের ডেপুটি শেরিফ নিযুক্ত করতে হবে আমাকে।’
‘ডেপুটি শেরিফ!
‘হ্যাঁ। ক্ষমতা দরকার আমার।’
আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ শেরিফ। তারপর পা নামাল ডেস্ক থেকে। ড্রয়ার খুলে ব্যাজ বের করল। দেখি, ডান হাতটা দাও তো।’
দরজার কাছে এসে ঘুরে দাঁড়ালাম। ‘ও হ্যাঁ, শোরিফ, কয়েক ঘণ্টার জন্যে শহরের বাইরে যাব আমি। ওগডেনে সার্কাস দেখতে।’
‘গ্যারেজে একটা গাড়ি আছে,’ কেন, কি কারণে যাচ্ছি, কিছুই জানতে চাইল না শেরিফ। শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘কখন?’
‘রাত বারোটা দশ মিনিটে।’
ফিরে এসে চেয়ারে বসলাম আবার। খুলে বললাম আমার প্ল্যান।
শুনে মাথা ঝাঁকাল শেরিফ। ‘রেপ বারভুটা একটা হারামজাদা। সাবধানে থাকবে!’
রাত সাড়ে এগারোটায় গ্যারেজ থেকে শেরিফের গাড়ি বের করলাম। এনে রাখলাম ক্যাফের সামনে। শনিবার রাত, আজ বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
আমাকে দেখেই উজ্জ্বল হলো ডিকসির চোখ। ওর টেবিলে গিয়ে বসলাম। অর্ডার নিতে কাছে এল রিনি। ওয়েট্রেসকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, ‘ডিকসি, লেভিট আমাকে বিদায় দিয়েছে।’
‘কেন?’ ভুরু কোচকাল ডিকসি।
‘তার কাজ নাকি কিছুই করিনি, খালি আপনার সঙ্গে প্রেম করে কাটিয়েছি।’ ঘরের এক কোণে বসা রেপ বারভুকে দেখালাম—আমার দিকেই চেয়ে আছে, ওই জন্তুটাকে আমার বডিগার্ড বানিয়েছে। আজ রাত বারোটা পর্যন্ত সময় দিয়েছে, এর মধ্যে বেরিয়ে যেতে হবে শহর থেকে।’
চট করে হাত ঘড়ি দেখে নিল ডিকসি। আরেকবার তাকাল বারভুর দিকে। ‘তাহলে, তো আপনার সময় হয়ে গেছে।’
‘না, বারভুকে শুনিয়ে জোরে জোরে বললাম, বারোটা এক মিনিট পর্যন্ত এখানেই থাকব। আমার কান ছেড়ার একটা সুযোগ দিতে চাই ভালুকটাকে। তারপর ওর ঠ্যাঙ ভাঙব আমি।’
আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল বারভু। টেবিলে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে পাতা ওল্টাল।
রিনি চলে গেল। নিচু গলায় আলাপ চালালাম আমি আর ডিকসি। আশ্চর্য! খুনের কথা একবারও উঠল না। যার যার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন, কার বাড়ি কোথায়, বড় হয়েছি কিভাবে, ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে, এই সব।
কোথা দিয়ে সময় পেরিয়ে গেল, খেয়ালই করলাম না। টেবিলে কালো একটা ছায়া পড়তেই মুখ তুললাম। বারভু এসে দাঁড়িয়েছে টেবিলের কাছে। ঘড়ি দেখলাম। বারোটা বেজে এক মিনিট। আবার তাকালাম ওর দিকে।
‘প্রথমে কোন কানটা ছিড়ব, দোস্ত?’ খসখসে গলায় জানতে চাইল ভালুক।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গেলাম চেয়ারে। ডান পা বাড়িয়ে জুতোর ডগা আটকালাম বারডুর হাঁটুর পেছনে। হ্যাচকা এক টান দিতেই বেসামাল হয়ে পড়ল সে। সময় পেয়ে আর দেরি করলাম না, উঠে দাঁড়ালাম এক লাফে।
আমার মুখ লক্ষ্য করে ডান হাত চালাল সে। চট করে মুখ সরিয়ে ফেললাম, প্রায় একই সঙ্গে ঘুসি চালালাম তার গলায়।
ভালুকের মতই গোঁ গোঁ করে উঠল বারভু, ঝটকা দিয়ে দুই হাত উঠে গেল গলার কাছে, চেপে ধরল আহত জায়গা। ডান হাতের আঙুল সব সোজা রেখে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার মত করে খোঁচা মারলাম তার তলপেটে, পরক্ষণেই বাঁ হাতে ডান কানে ঘুসি।
পর পর তিনটে মারাত্মক আঘাত, সইতে কষ্ট হচ্ছে বারডুর। তাকে সোজা হওয়ার সময় দিলাম।
পুরোপুরি সোজা হতে পারল না, হারও মানল না। টলতে টলতে এগিয়ে এল ঘুসি বাগিয়ে।
বাড়ানো হাতের কব্জি ধরে ফেললাম। আমি ঘুরতেই তার হাতটা চলে এল আমার কাঁধের ওপর। পিঠ বাকা করে আমার পেছনটা ঠেকালাম তার পেটের সঙ্গে, বিশেষ কায়দায় একটা ঝাঁকুনি দিতেই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল ভারি শরীরটা। ময়দার বস্তার মত ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
তড়পাতে তড়পাতে কোনমতে উঠে বসল ভালুক। মাথা ঝাড়া দিচ্ছে। দুই লাফে এগিয়ে গেলাম। জুতোর ডগা দিয়ে তার ডান কানের সামান্য নিচে আলতো ঠোকর লাগাতেই দু-দিকে হাত ছড়িয়ে পড়ে গেল, আর উঠল না। পনেরো মিনিটের আগে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না।
কাছেই একটা টেবিল। তাতে পরিজ। পাত্রটা তুলে উল্টো করে ঢেলে দিলাম বারভুর মাথায়। চুলে, কানে মাখামাখি হয়ে গেল হালুয়া।
ফিরে দেখলাম, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে রিনি। ভূত দেখছে যেন।
‘চমৎকার দেখিয়েছ, খোকা, ভেরি গুড!’ দরজার কাছ থেকে শোনা গেল শেরিফের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ।
সহজেই খুঁজে বের করলাম সার্কাস পার্টিটা। ঢুকলাম ক্যারাভান দিয়ে ঘেরা সীমানার ভেতর।
দারোয়ানকে আমাদের পরিচয় দিলাম, খবর পাঠালাম ভিন কার্টারকে। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম কি কি আছে। অনেক জন্তু-জানোয়ার। কয়েকটা দুষ্প্রাপ্য জীব দেখা গেল, যা অনেক চিড়িয়াখানাতেও নেই।
প্রথম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটা কুকুরের মত জন্তু। কালচে চামড়া, বুক আর দু-পাশে সাদা সাদা দাগ। এর নাম টাসম্যানিয়ান ডেভিল, ভেড়া আর খরগোশের যম। দেখলাম মালয়ের সিভেট ক্যাট, মেরু-শেয়াল, ছোট লেজওয়ালা বেজি, ধোঁয়াটে চিতা, আঁশওয়ালা পিপিলিকাভূক, লিনসাং টামারু, দুটো পিগমি মোষ, একটা ব্যাবিরুসা, হাঁসের মত ঠোঁটওয়ালা প্ল্যাটিপাস, ছ’টা ব্যাণ্ডিকুট, প্রায় দশ ফুট লম্বা আর তিনশো পাউণ্ড ওজনের একটা কমোডো ড্রাগন, আর কয়েকটা মনিটর লিজার্ড-বৃহৎ আকৃতির গোসাপ, ওজনে, আয়তনে কমোডো ড্রাগনের অর্ধেক।
পেছনে পায়ের শব্দ হলো। ফিরে তাকালাম। সিল্কের সাদা শার্ট আর আঁটো প্যান্ট পরা লম্বা একজন লোেক এগিয়ে আসছে। পায়ে চকচকে কালো বুট। কাছে এলে হাত বাড়িয়ে দিলাম, ‘মিস্টার কার্টার?’
জবাব দেয়ার আগে আমাকে ভালমত দেখল লোকটা। ‘আপনাকে তো চিনলাম না?’
‘আমি রানাগাটের নতুন ডেপুটি শেরিফ,’ নাম বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার মামার খবর শুনেছেন?’
কঠিন হলো কার্টারের চোয়াল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অবচেতন মন হুঁশিয়ার করে দিল আমাকে: বিপজ্জনক লোক। সাবধান!
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল কার্টার। ‘শুনেছি। শেরিফের মেসেজ পেয়েছি গতকাল। তবে আগেই জেনেছি, খবরের কাগজে। তো, আপনার আসার কারণ?’
‘কিছু যদি মনে না করেন, কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’
দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘এদিকটা দেখো’। আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আসুন।’
কার্টারের হাঁটার ভঙ্গিতে মিলিটারি ডবল মার্চের দ্রুততা। ছোট একটা তাঁবুতে নিয়ে এল আমাকে। ক্যানভাস চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। ‘ড্রিংক?’
‘দিতে পারেন।’
দুটো গেলাসে মদ ঢেলে একটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল সে। মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসল। বলুন, ‘কি জানতে চান?’
‘রোববার রাতে কোথায় ছিলেন?’
‘পথে। পার্টির সঙ্গে।’
‘কোথায় যাচ্ছিল পার্টি?’
‘এখানে আসছিল। শেষরাতে পৌঁছেছি আমরা।’
‘একটানা নিশ্চয় চলতে পারেন না, মাঝে মাঝে থামতে হয় আপনাদের। কতক্ষণের জন্যে থামেন?’
‘প্রতি এক ঘণ্টা পর, দশ মিনিট করে। গাড়ির টায়ার, জন্তু-জানোয়ারের খাঁচা চেক করে নিই ও-সময়। কোনদিকে তাকে নিয়ে যাচ্ছি আমি, বুঝতে পারছে কার্টার, কিন্তু সেটা প্রকাশ করছে না। সোজাসুজি জবাব দিচ্ছে। পেপারে পড়েছি, তিনজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ। আপনার মামাতো বোন ডিকসি, অ্যালেন কিনি আর স্টার লেভিট।’
গেলাসের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকাল লেভিট। কঠোর হয়ে উঠেছে দৃষ্টি। ‘আশা করি খুনীকে ধরতে পারবেন?’
জবাবটা ছুঁড়ে দিলাম তার দিকে, ‘কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতকড়া পরাব।’
‘তাই নাকি?’
হাসলাম। ‘ভাবছেন না তো আবার আপনাকে সন্দেহ করছি?’
শ্রাগ করল কাটার। ‘একজন মানুষ খুন হলে অনেককেই সন্দেহ করা হয়। মামা আমাকে দেখতে পারত না, অনেকেই তা জানে। আমার বাপকেও দেখতে পারত না বুড়ো। তার মৃত্যুতে আমার লাভ লোকসান কিছুই নেই। সম্পত্তি যদি দিয়েও যেত, ভোগ করতে পারতাম না। সার্কাসের জগৎ ছেড়ে কোথাও আমি যাব না।’
‘আপনার ওই কমোডো ড্রাগনটা দেখলে ভয় লাগে। মাংস খায় বুঝি?’
ভুরু কোঁচকাল কার্টার। তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। মাথা ঝাঁকাল, ‘হ্যাঁ, খায়। লোকে বলে ঘোড়া-মানুষ কোন কিছুকেই পরোয়া করে না ওরা। যা পায়, তাই মেরে খায়। এটা অবশ্য লোকের বাড়িয়ে বলা। তবে, দুনিয়ার ভয়ঙ্করতম কয়েকটা জীবের একটা ওই ড্রাগন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাছাকাছি কেউ না থাকলে ওর গর্তে আমিও নামব না।’
কার্টারের বলার ভঙ্গিতে শিরশির করে উঠল আমার ঘাড়ের কাছটা। ‘আর কোনও প্রশ্ন?’ জিজ্ঞেস করল কার্টার।
‘হ্যাঁ। স্টার লেভিটের কাছ থেকে শেষ কখন খবর এসেছে আপনার কাছে?’
চেয়ারে সামান্য নড়েচড়ে বসল কার্টার। ‘ও আমাকে খবর পাঠাবে এ-ধারণা হলো কেন আপনার? ওকে চিনিই না আমি।’
‘রিনিকেও নিশ্চয় চেনেন না?’
এতক্ষণ কঠোর ছিল কার্টারের চাহনি, এখন বরফ-শীতল হয়ে গেল। বরফের মাঝেই আগুনের ধিকিধিকি আভা। ‘না, ও চিনি না।’
মোলায়েম গলায় বললাম, ‘আপনাকে কিন্তু ওরা দুজনেই চেনে। লেভিটের ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। ও বড় ভয়ঙ্কর লোক। শিকাগো শহরেও বহু লোককে জ্বালিয়ে এসেছে। তার পথে বাধা হলে আপনাকেও নিস্তার দেবে না।’
একটু যেন চমকে গেল সে। তাকে সামলানোর সুযোগ না দিয়েই বললাম, ‘আপনাদের কিছু গোপন কথা জানি আমি। টাকাগুলো হাতাতে যাচ্ছেন আপনারা। তবে বলা যায় না, আপনাকেও বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে লেভিট, পুরোটাই কেড়ে নেবে। হুঁশিয়ার করে দিলাম।’
‘অনেক বেশি জানেন আপনি!’ মুখ বিকৃত করে ফেলেছে কার্টার, কুৎসিত হয়ে উঠেছে সুন্দর চেহারা। ছোট্ট শহরের অতি সাধারণ এক ডেপুটি শেরিফ, বড় বেশি কঠিন কাজে হাত দিয়ে ফেলেছেন।
শুধু হাসলাম, কিছু বললাম না।
কার্টারের সঙ্গে আর কোন কথা নেই আমার। বললাম, ‘এবার যেতে হবে। উঠি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
কিসের দেরি, জানতে চাইল না কার্টার। ‘ঠিক আছে। প্রমাণ জোগাড় করতে পারলে আসবেন আবার, আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন।’
‘তা তো আসবই,’ হেসে বললাম। ‘ভাববেন না, তাড়াতাড়িই আসব।’
আমাকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে সঙ্গে এল কার্টার। জন্তু-জানোয়ারের খাঁচার ধার দিয়ে এগিয়ে চলেছি, আমার পেছনেই রয়েছে সে। নীরবতার মধ্যে তার নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ কানে আসছে।
ড্রাগনের গর্তের কাছাকাছি আসতেই নাকে লাগল বোটকা পচা গন্ধ। বাতাসে উড়ছে তাঁবুর কানা, পতপত শব্দ হচ্ছে। গর্তটার দিকে চেয়েই থমকে দাঁড়ালাম। পেছনে রয়েছে কার্টার, ধাক্কা দিয়ে যদি গর্তে ফেলে দেয় আমাকে? দ্রুত সরে গেলাম দূরে।
ব্যাপারটা টের পেল কিনা সে, জানি না, তবে পেলেও প্রকাশ করল না। গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম।
‘আপনার ধারণা, আমি মামাকে খুন করেছি?’ আচমকা প্রশ্নটা যেন ছুঁড়ে দিল কার্টার।
‘হ্যাঁ।’
‘প্রমাণ করতে পারবেন?’
জবাব দিলাম, ‘আটি আটি, সোবাট বিবিন সালাহ।’
ঝট করে মুখ তুলল কার্টার। স্থির হয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর কোন কথা না বলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল তাঁবুর দিকে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। একটা খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দারোয়ান, আমার দিকে নজর। তার কাছে এসে দাঁড়ালাম। লাইটার আছে আমার পকেটে, তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘ম্যাচ আছে?’
নীরবে পকেটে হাত দিল সে। একটা সিগারেট দিলাম তাকে। দেশলাই বের করে কাঠি জ্বেলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল লোকটা।
পাটিটা কয়েক দিন আগে লা ভেগাসে ছিল, ‘তাই না?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ। ওখান থেকে এসেছেন?’
‘না। তবে ওদিকের পথ ধরেই এসেছি। রাস্তা খুব খারাপ দেখলাম।’
‘হ্যাঁ। বার বার থামতে হয়।’
‘টায়ার, খাঁচা চেক করার জন্যে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে তো খুব বিরক্তিকর।’
‘আর বলবেন না। এক-আধ ঘণ্টা পর পরই যদি থামতে হয়, আধঘণ্টা করে নষ্ট হয়, কেমন বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে আরও দেরি হয়। এভাবে চলতে ভাল্লাগে!’
‘নাই। আচ্ছা, চলি।’ গাড়ির দিকে রওনা হলাম আবার।
একেকবার থামলে কতটা সময় নষ্ট হয়, এ-ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে কার্টার। কেন? হঠাৎ বুঝে গেলাম ব্যাপারটা। খাপে খাপে মিলে গেল অনেক কিছু।
পশ্চিম দিকে ছুটে চলেছে গাড়ি। দীর্ঘ যাত্রা। দু-পাশে মরুভূমি, পাহাড়, মাঝে মাঝে ছোট্ট ওয়েস্টার্ন শহর।
এক জায়গায় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথটা। সামনে একটা বাক। গতি কমালাম। মোড় নিতেই চোখে পড়ল গাড়িটা। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুড তোলা। এদিকে পেছন ফিরে ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে।
এতরাতে এরকম জায়গায় মেয়েমানুষ! নিশ্চয় গাড়ি খারাপ হয়ে বিপদে পড়েছে।
গাড়ি থামিয়ে নেমে গিয়ে দাঁড়ালাম মেয়েটার পেছনে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
ঝটকা দিয়ে সোজা হলো মেয়েটা। পাই করে ঘুরল। হাতের পিস্তল নাচিয়ে বলল, হয়নি এখনও, তবে হবে!’
‘রিনি।’
পায়ের আওয়াজ হলো। পাশ ফিরে দেখলাম একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে রেপ বারডু। তার হাতেও পিস্তল।
রাতের বেলা রাস্তার ওপর গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিন খারাপের ভান করে অন্য গাড়ি থামানো একটা অতি সহজ কৌশল, খুব ভাল করেই জানি আমি, তারপরেও বোকার মত ফঁদে পা দিলাম।
অন্য একটা পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আরও একজন, ওকে চিনি।
‘চলো, টিকটিকি,’ আদেশ দিল বারভু, ‘ওদিকে চলো। পথের ওপর কাজ সারতে পারব না।’
প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরের ছোট একটা টিলার অন্য পাশে নিয়ে এল আমাকে ওরা। এখান থেকে পথটা দেখা যায় না।
‘এইবার শুরু করো,’ হাসি হাসি গলায় বলল বারভু। ‘যা যা জানো, গড়গড় করে উগড়ে দাও তো। পেটে রেখে আর কি করবে,’ হাতের পিস্তলটা নাড়ল সে।
প্রথমে বলল, ‘কার্টারকে কি বলেছ?’
‘বলেছি, সে রট হ্যানসনকে খুন করছে। জিজ্ঞেস করেছি, লেভিট তার কাছে কি চায়, শেষবার কখন যোগাযোগ করেছে। ওকে তোমরা বোকা ভেবে ভুল করেছ। ভুল লোকের সঙ্গে যোগ দিয়েছ। আমি অবশ্য এই ভুলটা করব না।’
‘কি বললে?’ এক পা এগিয়ে এল রিনি।
‘এত সহজ কথাটা বুঝলে না? লেভিটের দলে ভিড়তে চেয়েছিলাম, পাত্তা দেয়নি সে। দু-চারশো টাকা দিয়েই আমার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু কার্টার ভদ্রলোক। সে ভাল টাকা দিতে রাজি হয়েছে। তোমাদেরও তাই করা উচিত। কার্টারের দলে ঢুকে যাও।’
বারভু বলল, ‘স্টার লেভিটের সঙ্গে বেঈমানী!… না বাবা, আমি তারই লোক। এখনও আরও কিছুদিন বাঁচার সাধ আছে।’
‘সে বাঁচবে কিনা সেটা জানো? শোনো, ভাল চাও তো যা বলছি করো। কার্টারের সঙ্গে ভিড়ে যাও।’
ধাপ্পা দেয়ার চেষ্টা করছি বটে, কিন্তু কতখানি সফল হব জানি না। ওরা আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে, বুঝতে পারছি। কথা বলে যতক্ষণ দেরি করাতে পারি ততই লাভ। কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবে আর জানি না। রিনির দিকে ফিরে বললাম, ‘তোমাকে এখানে দেখৰ আশা করিনি।’
চুপ!’ ধমক দিল বারভু। ‘বড় বেশি কথা বলো!’
‘ওকে বলতে দাও,’ রিনি বলল। ‘যা যা জানে, বলুক না।’
‘কি আর বলব, তোমাদের মত আমিও টাকার জন্যেই দল বদল করতে চাইছি। লেভিট আমাকে দাম দেয়নি। ফাঁকিঝুঁকি দিয়ে পশুকে রাজি করিয়ে তার ডিপুটি হয়ে গেলাম। রানাগাটে থাকব, অন্তত টাকার বখরা যতদিন না পাব যাব না। লেভিটকে কেউ চায় না। পশু, বুড়ো কিনি এবং আরও দু-চারজন খনির মালিক, সবাই চায় লেভিটকে শহর থেকে বের করে দিতে। কোন একটা ছুতোয় যদি খুন করে ফেলতে পারে, তাহলে ওদের জন্যে আরও ভাল। চিরতরে আপদ বিদেয় হবে। যত চেষ্টাই করুক, দিন কয়েকের বেশি আর রানাগাটে টিকতে পারছে না লেভিট। তখন টাকার বখরা কার কাছ থেকে নেবে? একমাত্র লোক, ভিন কার্টার।’
‘কিন্তু,’ প্রতিবাদ করল বারভু, ‘কার্টারের কাছে যে উইলটা আছে, তাতে লেখা, বুড়ো হ্যানসন তার সম্পত্তি ভাগ্নেকে দিয়ে গেছে। নগদ টাকাও। বৈধ জিনিস, ওই টাকার ভাগ কেন সে দিতে যাবে আমাদের?’
‘দেবে, আমি তাকে দিতে বাধ্য করব। কারণ, আমি প্রমাণ করতে পারব, হ্যানসনকে খুন করেছে কার্টার।’
‘কি করে?’
দরাজ হাসি হাসলাম। ‘সেটা এখন বলব কেন? আগে আমাকে সাহায্য করো, তখন বলব।’
‘না,’ কর্কশ গলায় বলল বারডু। ‘তোমাকে মেরে ফেলার আদেশ হয়েছে আমাদের ওপর, তা-ই করব।’
‘দাঁড়াও রেপ,’ হাত তুলল রিনি। ‘একটা কথা ভাবছি। ধরো, এখানে ওকে মারলাম না আমরা, শহরে ধরে নিয়ে গেলাম। ক্যাফের নিচে ভাঁড়ারে আটকে রাখলে কেউ জানবে না। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার সময় পাব আমরা, খোঁজখবর করব। লেভিটকেই বা কেন পুরোপুরি বিশ্বাস করতে যাব? সে কি অতটা বিশ্বাসী?’
‘এ-ব্যাটা মিছে কথা বলছে না, কি করে জানব? ধাপ্পা দিয়ে…’
‘দাঁড়াও, দেখি মিথ্যে কিনা,’ আমার দিকে ফিরল রিনি। ‘তুমি বলছ, কার্টারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ। তারমানে আগে থেকেই ওর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ। উইলটা সম্পর্কেও নিশ্চয় জানো তাহলে। কি জানো, বলো।’
ঠাণ্ডা ঘাম বেরোতে শুরু করল। এইবার পড়েছি ফাঁদে। এটা ঠিকমত বলতে না পারলে এরপর আমার একটা কথাও আর বিশ্বাস করবে না ওরা। এখানেই খুন করে রেখে যাবে। ভয় যে পেয়েছি, সেটা বুঝতে দিলাম না ওদেরকে।
পথে এক জায়গায় সাইনবোর্ড দেখেছি:
জনি লীডার,
ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট পেনম্যান।
‘লীডার’ নামটা সেদিন রাতে লেভিট আর রিনির মুখেও শুনেছি। সাইনবোর্ডে দেখার পর থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ভেবেছি তাকে নিয়ে। যা থাকে কপালে ভেবে সেইটাই ঝেড়ে দিলাম, ‘কেউই জানে না, আমি জানব কি করে? তবে এটুকু জানি, ওই উইলটা লিখেছে জনি লীডার। এ-ও জানি, হ্যানসনকে খুন করার পর উইলটা গায়েব করে ফেলেছে কার্টার।’
মাথা দোলাল রিনি, ‘স্টারেরও তাই ধারণা। রেপ, ও সত্যি কথাই বলছে।’
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা একটু একটু করে ছাড়লাম।
অবশেষে মাথার ওপর থেকে হাত নামাতে দিল আমাকে ওরা। গাড়ির কাছে নিয়ে এল। বিপদ এখনও কাটেনি পুরোপুরি, তবে আপাতত বেঁচে গেলাম। সময় পাওয়া গেল। মুক্তির সুযোগ আসতে পারে।
‘রিনি,’ বারভু বলল, ‘আমি এই উজবুকটার গাড়িতে চড়ছি। ‘তুমিও এসো আমার সঙ্গে। আমাদেরটা রিকি চালাবে। চলো, আগে রানাগাটে যাই।’
আমার গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল রিনি। ওর পাশে আমাকে বসতে হলো। বার বসল পেছনের সীটে। আমার .৪৫টা রয়েছে সামনের দুটো সীটের মাঝের ফাঁকে, লুকানো।
গাড়ি ছুটে চলল। মনে মনে নানা রকম ফন্দি আঁটছি। ওই ক্যাফের নিচে ভাড়ারে আটকা পড়ে থাকলে কিছুই করতে পারব না। সুতরাং ওখানে ঢোকা চলবে না। ঠেকাতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
ভাবার সময় পেলাম না, কথা বলে উঠল বারডু, ‘রিনি, শেরিফ আর কিনি যে তাকে খুন করতে চায়, এটা কিন্তু লেভিট জানে না। সে ভাবছে, ডিকসিকে খুন করে সহজেই পাড় পেয়ে যাবে। আত্মহত্যার মত করে সাজাবে কেসটা-চাচাকে খুন করে অনুশোচনায় ভুগে ভুগে, যন্ত্রণা সইতে না পেরে, ছোট্ট একটা চিঠি লিখে রেখে আত্মহত্যা করেছে ডিকসি।’
পেছনে খস করে দিয়াশলাই কাঠি জ্বলে উঠল। সিগারেট ধরিয়ে আবার বলল বারভু, ‘আজ রাতেই মেয়েটাকে খুন করবে লেভিট। রাতের বেলা চুরি করে র্যাঞ্চে ঢুকেছিল ডিকসি, এটা জেনে গেছে সে।’
রিনি কিছু বলল না।
‘কি করে জানল?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম বারভুকে। হাতটা চলে গেল সীটের ফাঁকে, পিস্তলটা ঠেকল আঙুলে।
‘গ্যারেজের জানালার নিচে গ্রিজ ছিল, তাতে পা দিয়ে ফেলেছিল মেয়েটা। সারা বাড়ি ছড়িয়েছে পায়ের ছাপ। লেভিটের ঘরের জানালার নিচেও পড়েছে।’
ও, এই তাহলে কারণ। এতক্ষণে বুঝলাম, হঠাৎ করে আমার ওপর খেপে গেল কেন লেভিট, কেন পাগল হয়ে উঠল শহর থেকে তাড়ানোর জন্যে। ইস, ডিকসিকে সঙ্গে নিয়েই ভুল করেছি। না নিলে এখন এই ঝামেলায় পড়তে হত না।
খানিকক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ আমার দিকে ফিরল রিনি। ‘ওই মেয়েটাকে তোমার পছন্দ, না?’
‘ওকে?’ শ্রাগ করলাম। ‘না। বরং তোমাকেই আমার পছন্দ। স্মার্ট মেয়ে ভাল লাগে আমার।’
ড্যাশবোর্ডের সবুজ আলোয় পরিবর্তন লক্ষ করলাম রিনির চেহারায়। প্রিন্সের মত চেহারা নয় আমার, তবে লেভিটের তুলনায় গরিলার পাশে দেবশিশু, এটা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই। হাসলাম মনে মনে। ঢিলটা জায়গামতই লেগে গেল বোধহয়।
ভোরবেলা পৌঁছলাম রানাগাটে। অফিসের দরজায় দাঁড়ানো দেখলাম শেরিফকে। আমাদের গাড়ির দিকে চেয়ে আছে।
পাশ ফিরে তাকালাম। একটা কালো কনভারটিবল গাড়ি চোখে পড়ল। কার্টারের ওখানে দেখেছি ওটা গতরাতে। ক্যারাভানগুলোর কাছে রাখা ছিল। চট করে পেছন ফিরে তাকালাম। ডান কনুই সীটে রেখে কাত হয়ে বাঁ হাতে পকেট হাতড়াচ্ছে বারডু। ঠোঁটে নতুন সিগারেট, তারমানে দিয়াশলাই খুঁজছে।
চোখের পলকে পিস্তলটা বের করে আনলাম সীটের ফাঁক থেকে। হাতলে মোচড় দিয়ে এক ধাক্কায় খুলে ফেললাম বাঁ পাশের দরজা। একই সঙ্গে ডান কনুই দিয়ে আঘাত করলাম রিনির স্টিয়ারিং ধরা হাতে।
অকস্মাৎ ঘুরে গেল গাড়ির নাক। পাশের একটা দেয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ততক্ষণে আমি বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। পড়েই এক গড়ান দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাতে উদ্যত পিস্তল।
ধ্রাম করে গিয়ে দেয়ালে তো মারল গাড়িটা। চুরচুর হয়ে গেল উইশীল্ড। পাশ কেটে শাঁ করে বেরিয়ে গেল রিকির গাড়ি।
চিৎকার করে বললাম শেরিফকে, ‘গুলি করুন, গুলি করুন ব্যাটাকে! পালাচ্ছে তো!’
‘বেঈমান! হারামজাদা!’ বারভু চিৎকার করছে। জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে পিস্তলধরা হাত।
পর পর দুবার গুলি করলাম বুক সই করে।
হাঁ হয়ে গেল বারভুর মুখ। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল তার পাশের দরজা। গড়িয়ে রাস্তায় পড়ল রক্তাক্ত লাশটা। ধুলোর মধ্যে।
একটানা আওয়াজ হচ্ছে পিস্তলের গুলির। গুলি করে চলেছে শেরিফ। রিকির গায়ে লাগল কিনা, দেখার সময় পেলাম না। আমার নজর রিনির দিকে। ছোঁ মেরে পাশে রাখা হাতব্যাগটা তুলে নিয়েছে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সে। ততক্ষণে আমিও পৌঁছে গেছি। ব্যাগটা খোলার আগেই কেড়ে নিলাম। চিতার মত ফুসে উঠল রিনি। ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। নাকেমুখে খামচি মারতে লাগল। মাথা সরানোর সময় পেলাম না, গালের চামড়া ছিলে দিল। আমার এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে পিস্তল, রিনির হাত ধরতে পারছি না।
দু-পাশ থেকে এসে রিনির দু-হাত চেপে ধরল শেরিফ আর একজন খনিশ্রমিক। টেনে সরিয়ে নিল আমার সামনে থেকে।
‘ধরে রাখুন!’ চেঁচিয়ে বললাম। ‘সে-ও জড়িত!’
‘ডিকসিকে দেখেছ?’ আমাকে জিজ্ঞেস করল শেরিফ। ‘তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘দেখিনি, তবে জানি কি হয়েছে। ধরে নিয়ে গেছে লেভিট।’
শেরিফের গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ, খারাপ হয়ে গেছে কিনা জানি না। সেটা পরখ করে দেখারও সময় নেই এখন।
পথের পাশে সামান্য কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো কনভারটিবল। ছুটে গিয়ে হ্যাচকা টানে খুলে ফেললাম ওটার দরজা। চাবি রয়েছে জায়গামত। মোড় দিতেই স্টার্ট হয়ে গেল। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরালাম, গাড়ি উঠে এল পথে।
গাড়ি নিয়ে গেট ভেঙে ঢুকে পড়লাম লেভিটের র্যাঞ্চ হাউসের আঙিনায়। বাড়ির ভেতরে কিছু একটা ভাঙার শব্দ হলো। আর্তনাদ করে উঠল একজন মানুষ। আরেকটা কিছু ভাঙল। আবার চিৎকার।
গাড়ি থেকে নেমেই ছুটলাম। লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে বারান্দা পেরিয়ে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারলাম সদর দরজায়। কাঁচ ভাঙল, কব্জা থেকে ছুটে গেল পাল্লা, প্রায় হুমড়ি খেয়ে গিয়ে ভেতরে পড়লাম আমি।
উপুড় হয়ে কার্পেটের ওপর পড়ে আছে ভিন কার্টার। রক্তাক্ত শরীর। গোটা দুই চেয়ার ভেঙে পড়ে আছে তার কাছাকাছি। আধভাঙা আরেকটা চেয়ার লেভিটের হাতে। বাড়ি মারার জন্যে তুলেছিল, সে অবস্থায়ই স্থির হয়ে গেল।
ফিরল আমার দিকে। ভাঙা চেয়ারটা হাতে নিয়ে এগোল।
পিস্তল তুললাম, কিন্তু গুলি করার সময় পেলাম না। তার আগেই চেয়ারের বাড়ি খেয়ে হাত থেকে উড়ে চলে গেল পিস্তলটা। দ্বিতীয়বার চেয়ার তুলল সে। পাশে সরিয়ে মাথাটা বাঁচাতে পারলাম কোনমতে, কিন্তু কাঁধ বাঁচল না। আগুন লাগিয়ে দিল যেন কেউ ডান কাঁধে।
ক্ষণিকের জন্যে দিশেহারা হয়ে গেলাম। ওই দানবের সঙ্গে খালি হাতে লড়াই করতে পারব বলে মনে হলো না।
আমার অসহায় অবস্থা দেখে হাসল লেভিট! হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল চেয়ারটা।
লাফিয়ে তার সামনে চলে এলাম। দ্রুত ঘুসি মারলাম চারবার। দু-বার তার বুকে, দুবার পেটে।
কিছুই হলো না লেভিটের, হাসি একান-ওকান হলো। ধীরে সুস্থে এগোল আমার দিকে।
হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ খামচে ধরল। হ্যাচকা টানে এনে ফেলল বুকের ওপর। দু-হাতে জড়িয়ে ধরে পিষতে শুরু করল। ভয়ঙ্কর গ্রিজলি ভালুকের বাহুবন্ধনে আটকা পড়েছি যেন। বেরোনোর জন্যে হাঁসফাস করেও কিছুই করতে পারলাম না।
ছেড়ে দিল আমাকে লেভিট। প্রচণ্ড এক ঘুসি খেলাম নাকেমুখে। পলকের জনো আঁধার হয়ে গেল দুনিয়া। মাথা ঝাড়া দিয়ে আবার চোখ মেলতেই চুলে হ্যাচকা টান পড়ল। পরমুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করলাম লেভিটের মাথার ওপর। উড়ে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেলো আমার দেহটা। ওখান থেকে ধপ করে পড়লাম মেঝেতে।
হাঁচড়েপাচড়ে উঠে বসলাম, মাথা ঝাড়া দিয়ে পরিষ্কার করতে চাইলাম জড়তা। আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে লেভিট। হাসছে।
উঠে দাঁড়ালাম। হাঁটু কাঁপছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিলাম পাঁচ সেকেণ্ড। আমাকে সময় দিল লেভিট, এবং দিয়েই বোকামিটা করল।
দৌড় দিলাম সামনে। লেভিটের কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে এসে লাফিয়ে উঠলাম শূন্যে। শূন্যেই ডিগবাজি খেলাম। এতই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল লেভিট, সাবধান হয়নি। ফলে পুরোপুরি লাগাতে পারলাম আঘাতটা। গলায় লাথি খেয়ে জানোয়ারের মত চিৎকার করে উঠল সে। মেঝেতে পড়েই লাফিয়ে সোজা হয়ে দেখলাম, দু-হাতে গলা ধরে টলছে দানব।
স্থির হওয়ার সময় দিলে আর সুযোগ পাব না। আবার ছুটে গেলাম। গায়ের জোরে লাথি মারলাম দুই উরুর ফাঁকে। হি করে অমানুষিক একটা চিৎকার বেরোল তার মুখ থেকে। কুঁজো হয়ে গেল সামনে। দা দিয়ে কোপানোর মত করে হাতের পাশ দিয়ে মারলাম ভীষণ মোটা ঘাড়টাতে। প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম হাতে, শক্ত রবারের নিরেট পাইপে আঘাত করেছি যেন।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল লেভিট।
একটা চেয়ার তুলে নিয়ে নির্দ্বিধায় বাড়ি মারলাম মাথায়। তারপর মেরে চললাম শরীরের যত্রতত্র। মটমট করে কাঠ ভাঙছে। থামলাম না। উঠতে দেয়া চলবে না কিছুতেই।
ব্যস ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে, পেছন থেকে বলে উঠল শেরিফ। ভাঙা চেয়ারটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে ফিরলাম। তার হাতে উদ্যত পিস্তল। হাসি হাসি মুখ। এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।
পিত্তি জ্বলে গেল রাগে। ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে দেখলেন, কিছু করলেন না !’
‘দেখতে চেয়েছিলাম স্টারকে পেটানোর ক্ষমতা কারও আছে কিনা,’ শেরিফের হাসি বাড়ল।
‘সরি।’
গোঙানি শোনা গেল লেভিটের। ফিরে চেয়ে দেখলাম, নড়ছে। চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘জলদি হাতকড়া লাগান। ও আবার উঠলে জানালা দিয়ে পালাব আমি!’
একটা ঘরে বন্দী ডিকসিকে খুঁজে পেলাম। আমাকে দেখেই ছুটে এল সে, জড়িয়ে ধরল। বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, ‘বিল… বিল তুমি এসেছ।’
ডিকসির মুখ তুলে চুমু খেতে গেলাম। ব্যথা করে উঠল আমার কাটা তেঁতলানো ঠোঁট। মিষ্টি ব্যাপারটা আর মিষ্টি লাগল না।
কয়েক ঘন্টা পর। ক্যাফেতে বসে কফি খেতে খেতে কথা বলছি। টেবিল ঘিরে বসেছে শেরিফ, বুড়ো অ্যালেন কিনি আর ডিকসি।
গায়ের ব্যথা বেড়েছে আমার। দেয়ালে আছাড় দিয়ে হাড়গোড় সব যেন গুড়ো করে ফেলেছে লেভিট।
‘পুবে একটা খুন করে এসেছিল স্টার,’ বলল শেরিফ। ‘পালিয়ে এসেছিল রানাগাটে। খুঁতখুঁতে একজন গোয়েন্দা ব্যাপারটার তদন্ত করছিল, আরও তিনটা খুনের সঙ্গে প্রায় জড়িয়ে ফেলেছিল স্টারকে। অবশেষে তাকেও খুন করল সে। পুলিশ বুঝল সবই, কিন্তু প্রমাণ করতে পারল না কিছু। ওখানে থাকার ঝুঁকি আর নিল না স্টার। চলে এল অনেক দূরে, এই শহরে।’ গালটা চুলকে নিয়ে বলল, ‘আরও একটা খুনের দায় তার ঘাড়ে চাপতে পারে। কার্টারের পাঁজরের তিনটে হাড় ভেঙেছে। একটা ঢুকে গেছে ফুসফুস ফুটো করে। বাঁচলে হয় এখন… তো, তুমি বলছ, হ্যানসনকে কার্টারই খুন করেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘অসম্ভব!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিনি। ‘আমার ঘরের সামনে দিয়ে সে যায়নি। তাহলে উঠল কোনখান দিয়ে?’
‘ঠিক?’ কিনির কথায় সুর মেলাল ডিকসি। ‘কোন পথে?’
‘আমারও সেই কথা,’ শেরিফ বলল। ‘রানাগাটে এসেছি তিরিশ বছর। ওই মেসার মাথায় অন্য কোন ভাবে কাউকে চড়তে দেখিনি। পথ ওই একটাই, কিনির বাড়ির সামনে দিয়ে।’
‘ও পথে যায়নি সে,’ জোর দিয়ে বললাম।
প্রচণ্ড কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে তিনজোড়া চোখ।
সুযোগ পেয়ে ছোটখাট একটা বক্তৃতা ঝাড়লাম, ‘অনেক বছর ধরে অপরাধ আর অপরাধীদের নিয়ে কারবার করছি আমি। অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। অনেক ধরনের চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মানুষের স্বভাব কত বিচিত্র, তার কিছুটা আমি জেনেছি। ভিন কার্টার লোক আসলে খারাপ নয়। অভাবে স্বভাব নষ্ট, তার হয়েছে তাই। কয়েকটা বাজে দোষ আছে তার, যার ফলে প্রচুর টাকা নষ্ট করেছে। ঋণে জড়িয়ে পড়েছে। সেটা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়েই মামার ওপর নজর পড়েছে তার। জানে, মামা তাকে পছন্দ করে না, টাকা চাইলে দেবে না। মামার সঙ্গে তার যে রকম সম্পর্ক ছিল, তাতে তার মৃত্যুর পরও সম্পত্তি বা টাকা-পয়সা পাওয়ার কোন আশা ছিল না। কাজেই অন্য পথ ধরল। খুন করার সিদ্ধান্ত নিল মামাকে। তার উইল জাল করে টাকা হাতানোর ফন্দি করল।
এখন আসি, কি করে হ্যানসনের কেবিনে ঢুকল কার্টার। কেবিনের পেছনে একটা ফাটল আছে, ফাটলের পাশে একটা অদ্ভুত দাগ দেখেছি। কি করে দাগটা হয়েছে প্রথমে বুঝতে পারিনি, বুঝলাম গত রাতে সার্কাসের ক্যাম্পে গিয়ে। দেয়াল বেয়ে মেসায় চড়েছে কার্টার।’
‘অসম্ভব! প্রতিবাদ করল শেরিফ। ‘ওই খাড়া দেয়াল বেয়ে কোন মানুষ উঠতে পারবে না।’
‘কিন্তু কার্টার পেরেছে,’ বললাম। ‘কেবিন থেকে কেউ তাকে সাহায্য করেছে?’
‘না।’
‘কার্টারই করেছে খুনটা, কি করে শিওর হলে?’
‘গত রাতে মালয়ী ভাষায় কার্টারকে বলেছিলাম, সাবধান! ভুল করেছ! শুনে এমন চমকে উঠল, বুঝে গেলাম, তারই কাজ দীর্ঘদিন মালয়ের জঙ্গলে জন্তুজানোয়ার ধরেছে সে, ভাষাটা শিখতে হয়েছে।’
‘মালয়ী ভাষার সঙ্গে খুনের কি সম্পর্ক?’ জানতে চাইল কিনি। ‘লেভিটই বা কি করে ঢুকল এর মধ্যে?’
‘মালয়ী ভাষার সঙ্গে খুনের সম্পর্ক হলো একটা গোসাপ। আমার মতই লেভিটও বুঝে গিয়েছিল ব্যাপারটা। টাকার লোভ দেখিয়ে রিনিকে জড়াল প্রথমে, শাসানোর জন্যে পাঠাল কার্টারের কাছে। ব্লেকমেল।’
‘হ্যানসনের উইল চুরি করে কার্টারের কি লাভ?’ শেরিফ জানতে চাইল। সে তো জানে তাকে কিছুই দিয়ে যাবে না মামা।’
‘চুরিটা করেছেই তো সে-জন্যে। পেনম্যান জনি লীডারকে তো চেনেন, এক নম্বর জালিয়াত। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কমপক্ষে আধডজন জালিয়াতির জন্যে তাকে খুঁজছে লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ। আসল উইলটা চুরি করে নিয়ে গেছে কার্টার। তার জায়গায় একটা নকল উইল রেখে গেছে। হ্যানসনের সই জাল করে দিয়েছে লীডার। সেটা রিনিও জানে।’
‘হুঁ! এবার আসল কথায় এসো। মেসায় চড়ল কি করে কার্টার?’
‘একটা দানবীয় গোসাপের সাহায্যে। মনিটর লিজার্ড।’
‘বলো কী!’ এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল শেরিফ আর কিনি।
‘হ্যাঁ, বিশ্বাস করা শক্ত,’ হেসে বললাম। ‘ভারতে বানরের সাহায্যে বড় বড় বিল্ডিঙের ওপর উঠে পড়ে চোর-ডাকাতরা। বানরের হাতে রশি ধরিয়ে দেয়। সেটা নিয়ে গিয়ে ওপরতলার জানালার শিকে বেঁধে দেয় ট্রেনিং পাওয়া বানর। চোর তখন রশি বেয়ে উঠে যায়। কার্টার আরও চালাক। সে বেছে নিয়েছে গিরগিটি। মালয়ের জঙ্গল থেকে ধরেছে ওগুলো। রানাগাটের কাছ দিয়ে সার্কাস পার্টি যাওয়ার সময় সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্যে থেমেছিল ক্যারাভান। সেই সময় এক ফাঁকে সবার অলক্ষে একটা গিরগিটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল কার্টার। কোমরে দড়ি বেঁধে ওটাকে তুলে দিয়েছিল মেসায়। পাহাড়ে চড়তে ওস্তাদ মনিটর লিজার্ড। পাথরের খাঁজে বা পাহাড়ের ফাটলে পা ঢুকিয়ে দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা এই প্রাণীগুলোর, যত টানাটানিই করা হোক, সহজে খুলে আনা যায় না। দড়িতে টান পড়তেই আঁকড়ে ধরেছিল গিরগিটিটা। নোঙরের মত আটকে গিয়েছিল পাহাড়ের গায়ে। দড়ি বেয়ে তখন উঠে গেছে কার্টার। একটা গিরগিটির ওপর এভাবে ভরসা করে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু টাকার জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সে।’
‘অবিশ্বাস্য!’ বিড়বিড় করল কিনি।
‘হ্যাঁ। তবে প্রমাণ করে দিতে পারি। হ্যানসনের কেবিনের জানালার নিচে যে ফাটলটা আছে, তার পাশে এখনও আছে দাগ। গিরগিটির বুকের চাপে হয়েছে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল বলে গভীর হয়ে পড়েছে দাগটা। ফাটলের নিচের মাটিতে খুঁজলে জুতোর ছাপও পাওয়া যেতে পারে। গিরগিটিটা ঠিক কোন পথে উঠেছে, তার চিহ্নও থাকতে পারে। শেরিফের দিকে চেয়ে বললাম, গিয়ে দেখে আসতে পারেন।’
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ডিকসির। ‘গিরগিটির কথা তোমার মাথায় ঢুকল কি করে! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার!’
ঠিক প্রশ্ন নয়, প্রশংসা; নীরবে হাসলাম শুধু, জবাব দিলাম না।
‘এক সময় গোয়েন্দা হওয়ার শখ ছিল,’ বলল শেরিফ। ‘এখন বুঝতে পারছি, চেষ্টা করলেও হতে পারানাম না। এর জন্যে মগজটা খুব বেশি পরিষ্কার হওয়া দরকার। ভালই করেছি ওপথে না গিয়ে। বন্দুকবাজদের নিয়ে আছি, সে-ই ভাল।’
‘তোমার মত কাউবয় এছাড়া আর কি করবে?’ মুখের ওপর বলে দিল কিনি।
বুঝলাম, লেগে যাবে এখন দুই বুড়ো। লাগুক। ডিকসিকে নিয়ে বেরিয়ে চলে এলাম।
সন্ধ্যা নামছে। লাল পাহাড়ের চূড়ায় ছায়া। পশ্চিম দিগন্তে মেঘের রঙ মলিন হয়ে এসেছে, জায়গায় জায়গায় কালো ছোপ। অপরূপ দৃশ্য।
হাঁটতে হাঁটতে উঠে এলাম পাহাড়ের চূড়ায়। ফিরে তাকালাম শহরের দিকে। ডিকসিও দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘বিল, এখনও তোমার ঠোঁট ব্যথা করছে?’
‘করছে, তবে তখনকার মত ব্যথা পাব না।’
***
Leave a Reply