ক্লেদজ কুসুম (কবিতাগ্রন্থ)
উৎসর্গ —
সাইফুল আলম
প্রিয়বন্ধুবরেষু —
দুজনই একই তীর্থের ছাত্র ছিলাম। দুজনই বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছিলাম দেশের বরেণ্য শিক্ষকদের কাছে। ও হয়ে গেল প্রখ্যাত সাংবাদিক। আর আমি কীনা সামান্য কবিও হতে পারলাম না!
এই গ্রন্থটি কবি হওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস।
— কোয়েল তালুকদার
৬ আগস্ট, ২০২২ ইং
দক্ষিণ খান, ঢাকা।।
১. ক্লেদজ কুসুম
রুপালি কঙ্কণ পরা যে মায়াবী হাত আমি ধরেছিলাম পরম মমতা দিয়ে —
সে অলঙ্কৃত হাত আমি ছেড়ে দিলাম, ঐ হাতে এখন বিশ্বস্ততা নেই।
যে চোখে আদিগন্ত স্বপ্ন দেখেছিলাম জীবনের,
সেই লালিত স্বপ্ন আমি ভেঙে দিলাম,
ঐ চোখ আমার দিকে এখন আর নিমগ্ন হয়ে চেয়ে নেই।
যে পদ্মঠোঁটে আকণ্ঠ চুম্বনে ভরিয়েছি উচ্ছসিত দুপুরে, সেই কমলিত ঠোঁট এখন পবিত্রহীন,
ক্লেদজ কুসুম সেখানে, ঐ ঠোঁটে আর কোনও মাধুরী নেই।
একদিন যে বুকে পৃথিবীর সব চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ ঢেলে দিয়েছিলাম পাগল করে, সেই বুকে এখন
কী সব অচেনা গন্ধ আসে — ঐ বুকের খাঁজে মালবিকার সুবাস নেই।
চুলে নেই চন্দন মাখা, ভ্রু-তে নেই আর প্রথমা চাঁদের বাঁক, ভালবাসা হারিয়েছে পথে পথে। পূর্ণিমার সব আলো তার নিকষ চুলের গভীরে নিভিয়ে দিলাম।
সব আঁধার তার। সব বিষণ্নতাও। চলে যাবার পথ সমান্তরাল। হাঁটছি পা ফেলে সম্মুখে হালছাড়া নাবিকের মতো ক্লান্তিহীন– ফিরে আসার আর কোনও পথ নেই।
২. অমরাবতী
দুরে চলে গেছ। তবু তোমার ছায়া পড়ে থাকে। বর্ণিল ছবি আঁঁকা থাকে মেঘে। দুরে চলে গেছ। তবু বাতাসে গন্ধ ভাসে তোমার চুলের।
উড়ে গন্ধ যেন অমরাবতীর। বাতাসও মাতাল হয় সে রঙে বহু বর্ণময় হয়ে। যেন গান শেষ তবুও তার সিম্ফনী মিশে যায় দশদিকে।
আজ তোমাকে অন্য নামে ডাকতে ইচছা করছে। নাম কী দেব তার?
যদি ডাকি অমরাবতী ।
৩. যদি তুমি রহিতে
বাতাসের গায়ে ভালবাসা খুঁজি
বৃষ্টির গায়ে জল
সারাদিন তোমার পথাপানে চাহি
আঁখি হয় টলমল
যদি সব পাওয়া হয়ে যায় মিছে
যদি সব প্রেম বৃথা হয় পিছে –
এই দায় আর কারোর নয়
দুঃখ গ্লানি পারি যদি সহিতে
এই জীবন কালে তুমি যদি
আমার কাছে রহিতে ।
৪. নির্জন পংক্তিমালা
আমার কবিতার শব্দগুলি মনখারাপ করে ফিরে গেল
ভোরের কাকাতুয়ার মতো উদাসীন হয়ে স্রষ্টার পায়ে।
শব্দেরা এসেছিল পাহাড়ি মেঘের মতো চুপিচুপি
টুপটাপ নিঃশব্দে বকুল আর শিউলি ঝরা সাদা উঠোনে।
শ্যাওলা পড়া দেয়ালের ওপাশ থেকে ভাঁটফুল গুচ্ছ নির্জনতার হাত ধরে কাকে যেন খুঁজতে খুঁজতে কোন্ অজানার দিকে চলে গেল যে……….।
কবিতা আর হয় না। শব্দ গুলো আহত হয়ে পড়ে থাকে পথের ধূলির উপর।
৫. ধ্যানে তুমি মগ্নতায় তুমি
যদি একদিন হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের কাছে চলে যাই
যদি বলি পাহাড় তোমার চূড়া আমি ছুঁইতে এসেছি
যদি একদিন হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে চলে যাই
যদি বলি নদী তোমার জলে আমার ঠাঁই মিলবে তো?
যদি চলে যাই অরণ্যের কাছে
যদি বনের বিহঙ্গেরা কোনও গান শোনাতে না চায়
যদি আঁধারে একাকী হাঁটতে হাঁটতে পথ হারিয়ে ফেলি?
খুব ভয় হয় এখন
এস আমার হাত ধরো —
আজ বাইরে সেই সিদ্ধার্থের পাগল করা পূর্ণিমার রাত —
চলো দূরে কোথাও বোধিবৃক্ষ তলে আসন পাতি
যেথায় আমরা ধ্যানমগ্ন হবো, আমাদের প্রেম হবে কস্তুরী শোভাময়।
৬. ক্যামেলিয়ার গন্ধ
যে গন্ধটি মাতাল করে ক্যামেলিয়ার মতো
সে তোমার চুল
মুহূর্তেই যেন আমি বাগানের মালি হয়ে যাই
সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের নাবিক যেমন কেঁপে ওঠে উত্তাল জলের ঢেউয়ে
আমি তেমনি কেঁপে উঠে মুখ লুকাই তোমার চুলে
ভুল করে কখনও নাভীমূলে যেখানে মদিরার সুবাস!
তুমি জল নিতে দাও উদ্দাম ঝর্ণার মতো
তৃষ্ণার্ত ডাহুক যেমন জল ভরে ঠোঁটে
দ্রাঘিমার দিকে মুখ রেখে,
ক্যামেলিয়ার পাপড়িগুলো ঝরে পড়তে থাকে তখন দিগ্বিদিক
প্রাগৈতিহাসিক বিধ্বস্ত নগরীর যত আঁধার
নেমে আসে নিষ্প্রভ সন্ধ্যায়–
আমি তখনও তোমার অবিন্যস্ত চুলের গন্ধ নিয়ে
মাতালের মতো চূর হয়ে পড়ে থাকি।
৭. সকল মণিরত্নমে
যদি কখনও নিদ্রাহীন রাতে সারারাত জেগে থাকো
যদি বসে থাকো অলিন্দের পাশে ইজি চেয়ারে নির্ঘুম
যদি শোকাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে তোমার বিছানা আমার শূন্যতায়,
তুমি কেঁপে ওঠো, প্রশ্ন করো নক্ষত্র রাত্রির কাছে
যা কিছু সংবেদনশীল যা কিছু জ্যোৎস্নার
তাদের তুমি বলো — এসো।
আকাশ থেকে যে নক্ষত্র ঝরে পড়ে
বাতাসের ভিতর যে নীল গ্লানি ম্রিয়মাণ
এই সবই আমার অনুপস্থিতিকে বলে দেবে — কোথাও আমি নেই।
তারপরও তুমি প্রকাশিত করো
তোমার সকল বিস্ময়কর সম্পদরাজি
সকল আনন্দময়ী আনন্দরূপ —
যেথায় চুম্বনরাশি ঢেলে দিতাম
তোমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত
সকল মনিরত্নমে।
৮. রূপালী মসলিন
রূপালী মসলিন থেকে নয়, জয়পুরের কারুকার্যখচিত ঘাগরা থেকেও নয়
পরেছিলে তুমি বালুচুরি শাড়ি
ঝিমঝিম গন্ধ ঝরেছিল কোথা থেকে কোন্ অন্তঃপুরে
মায়াবী কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিল কোন্ কাননে —
আমি হতে চাই কুসুম হন্তারক
নিঃশব্দে গোপণ গুহায় পৌঁছতে চাই আদিম প্রগলভে, ভূলোকে তোমার বুক কাঁপে
নেশার মতো অবিরাম
শুষে নেয় রক্ত দু’পার্শ্বের ভঙ্গুর পাঁজর থেকে
লোহিত রক্ত কণিকা তখন থেমে যায় হঠাৎ –
বসন্ত হাওয়ায় উড়তে থাকে তোমার
শাড়ির আঁচল।
তারপর কি মধুর পরম্পরায় আকন্ঠ ডুবে থাকি
হে প্রিয়তমা! হে প্রনয়ণী!
তুমি আমাকে যন্ত্রণার ক্লেদ মেশানো কুসুম দাও
সনির্বন্ধ উজ্জ্বল ঠোঁটের চুম্বন দাও
শোণিতের ঋণে প্রেম দাও
আমার ঘুমন্ত প্রণয় সব জেগে উঠুক তখন –
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাক সকল আকুল করা নির্যাসমিশ্রিত রস আস্বাদনে।
৯. কুসুমিত রাত্রি
এই রাত্রিকে সুন্দর করো তুমি
আবার এই রাত্রিকে দুঃখময়ও তুমিই করো
অপার রূপ সুধা নিয়ে তুমি যখন কাছে আসো
নিশীথের স্তব্ধ প্রহর তখন উৎসব করে
তখন খানখান করে ভেঙে পড়ে সকল প্রগল্ভ
মনে হয় ভাঙ্গচুর জীবনকে যুক্ত করছ তুমি
মনে হয় যোজন যোজন আঁধারের পথ
একসাথে হেঁটে চলেছি আমরা দু’জন।
আমরা আলিঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারি না
যেমন বিচ্ছিন্ন হতে পারে না আকাশ থেকে তারা
যেমন ভৈরবী রাগে বাজে ঐকতানের সঙ্গীত
তখন সৌন্দর্য তীব্রতর হয় কুসুমিত রাত্রির গভীরে।
যখন শেষ হয় রাত ভোরের আলোর স্পর্শে
তুমি সম্বিতেই স্পন্দিত হয়ে ওঠো সূর্য কিরণে
আলিঙ্গন থেকে স্বর্গমুখী হয়ে এগিয়ে যাও
অনিঃশেষ আবেগে জড়িয়ে ধরো আরও গভীর আলিঙ্গনে।
১০. ভালবাসা যত
তুমি সেই রমণী যে আমার প্রথম যৌবনকে
হঠাৎ থমকে দিয়েছিলে
যেন দখিনা উদ্ভ্রান্ত বাতাস জানালার কাছে এসে
থেমে গিয়েছিল
ভালোবাসার উদ্বেলিত রং ছড়িয়ে গিয়েছিল
সারা দিগন্তময়
তোমার জ্যোতির্ময় যত আলো এসে পড়েছিল
আমার গায়ে
আমি শুষে নিয়েছি তোমার শরীরের যত মাতাল গন্ধ
হৃৎ স্পন্দনে বুঝতে পেরেছি দেহের খাঁজে খাঁজে লুকায়িত তোমার যত অনুভব।
জগৎ সংসারে তোমার সকল সংসার পরমায়ু
তখন থেকে আমার হয়ে উঠেছিল
তুমি তখন থেকে কেবল পূর্ণতাই দাও —
দাও অতৃপ্তির গ্লানিও আর স্বাপ্নিক ভালবাসা
যত।
১১. আমার সকল একাকীত্বে
একদিন এক নিরাভরণ আয়োজনহীন বিকালে আমরা হেঁটেছিলাম,
পিচঢালা নির্জন সেই পথ, পাশে দূর্বা ঘাসের উপর দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির মুক্তো লেগেছিল। তখন আকাশ ছিল ধূসর নীল।
শ্রাবণে কাশফুল ফোঁটার কথা না। সন্তান সম্ভাবা রমণীর মত শেফালিকাও কোথাও নেই। পিচের পথ ছেড়ে দূর্বা ঘাসের উপর আমাদের চরণ পড়ে দূর্বাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।
যে পাশে ছিল সে ছিল আমার আনন্দময়ী,
আমার প্রাণাধিকা।
বিকালের রোদ্র মেখে স্বর্ণপ্রভা হয়ে উঠেছিল সে। কতকালের পরিচিত মুখশ্রী।
দেখেছি কত সন্ধ্যার ছায়ায়, কত চন্দ্রালোকিত নিশীথে। সে প্রকৃতিভৈরবী হয়ে আমাকে ঘর থেকে কত যে বের করে নিয়ে গেছে।
কতদিন পর আজকে এই বিকালে এখানে এসেছি। পশ্চিম দিগন্তে আলো নেভে নাই, তখনও দিগন্তে কমলা রঙে ছেয়েছিল..
আমরা হেঁটে চলেছি ……..
এমন কত পথ পাশাপাশি হেঁটেছি
হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গেছি
কত কথা বলেছি, কত কথা বলতে ইচ্ছা করত!
পথের পাশে অখ্যাত ঘাসফুলের দিকে চেয়ে
কত প্রাণের ছোঁয়া যে তাকে দিতে চেয়েছি।
আমি দেখেছি তার মাথার চুল উড়ছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূপগন্ধ বাতাসে,
তাকে একাকার করে নিতে ইচ্ছা করত আমার সকল একাকীত্বে..
অন্তরের ভিতর তখন অন্য তরঙ্গ —
‘জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল গান গভীর সুরে,
সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।’
১২. সন্ধ্যার অরণ্যে
আমাকে টেনে নিয়ে যায় আমারই পথ
ধূসর সেই পথে যে গথ চলে গেছে মনুষ্যহীন
দূর অরণ্যে
তুমি হাত ছেড়ে দিয়েছিলে তারও আগে
বলেছিলে– বিদায়!
সেদিন তুমি বলতে চেয়েছিলে আরো অনেক কথাই
বলতে চেয়েছিলে আমারই কানে কানে।
আজ এই নির্জন সন্ধ্যায় আমি চলে যাচ্ছি
একাকী, ক্রন্দনহীন চোখ মেলে —
যে পথে এর আগে আমি হাঁটিনি কখনো।
প্রিয়তমা, আমার যে অনেক পথ যেতে হবে
অন্তহীন সে পথ,
হাঁটতে হাঁটতে যদি ক্লান্তি আসে
আমি যেন সেথায় পৌঁছার আগে থেমে না যাই।
১৩. বাজিগর হতে চাই না
হঠাৎ মধ্যেরাতে ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দ
হঠাৎ প্রান্তর জুড়ে সাওয়ারের আওয়াজ,
এই রাতদুপুরে আমি কোনও বাজিগর হতে চাই না
তুমি ছুটে যাও তোমার মতো দিগ্বিদিক্।
এই ঘোর মধ্যরাত্রি প্রহরে আঁধার আমাকে টানে
না আমি অশ্বারোহী নই
আমি বাজিগরও নই
আমার মাঝে বসত করে এক নিশিমধুবন্তী।
ধবল তুষারপাতের সময়ে কোনও ক্লান্তি আসেনা
সারা গতর জুড়ে তখন ঝঞ্ঝার মতো বেজে ওঠে
মাধুকরী এক হ্রেষাধ্বনি।
১৪. এই স্বর্গ রাত্রিতে
একদিন না একদিন স্বর্গ আমাকে টানবেই
আমার ভালোবাসার জন্য
আমার নিরহংকার সোহাগের জন্য
বিচিত্র এইসব দান প্রতিদানের জন্য!
অবসাদ আমাকে ছুঁইতে পারেনা
আমাকে চূর্ণ করো তুমি মোহিনী মায়ায়
আমি চাই তোমার ঘৃণাও
সকল ভোগ সম্ভোগ সকল নিষ্ঠুরতাও!
আমি আর ফিরে যেতে চাই না অভিশপ্ত নরকে,
কোনও বিকৃতিতেও নয়,
নয় কোনও রূপান্তরে অন্য কোনো আশ্লেষে
পরিমার্জন চাই দেহে আর দ্রোহে!
হাজারো প্রগাঢ় চুম্বনেও মন ভরে না
তুমি লুকিয়ে রেখ না তপ্ত সূর্যের ঝাঁজ
জ্বালিয়ে দাও বারবার
জ্বলে ওঠো তুমি এই স্বর্গ রাত্রিতে সহস্রবার।
১৫. হে পুণ্যশীলা
কতটা কালনাগের ছোবল দিলে শরীরের
শ্বেত কমলের পাপড়িগুলো নীল হয়ে ওঠে
শাড়ির রং বদলে যায় ঘাম জলে।
কপাট খুললেই প্রথম উদ্ভিদ প্রান্তর, মুগ্ধতার নজর
পড়ে উচ্ছসিত লতাগুল্মে
রুপালি জল গড়িয়ে পড়ে তরঙ্গায়িত নদী থেকে।
তুমি লজ্জাস্পর্শে সাঁতরাতে থাক ঈর্ষার জলে
প্রতিটি ডুবে হারিয়ে ফেল পরিধেয় অলঙ্কার
অবলীলায় নিরাভরণ হয়ে যাও।
আমি তোমার অস্তনদীর জলে নেমে অবগাহন
করি তখন, শুদ্ধ করি পাপ,
পূণ্যবাণ হয়ে উঠি পূণ্য জলে, হে পূণ্যশীলা।।
১৬. আমি আসবো
যেখানেই থাকি —
নিঃশব্দের পদধ্বনিতে আমার ভালবাসা
তোমার দরজায় এসে কড়া নাড়বে একদিন ,
তুমি অপেক্ষায় থেকো।
দূরের ছায়াপথ থেকে যে ছায়া এসে পড়বে
তোমার বাড়ির উঠোনে,
তোমার দুপাশের রাস্তায় দাঁড়ানো সারি সারি সুপারি গাছের পাতা ছুঁয়ে যে রোদ্রের ঝলকানি তোমার অলিন্দে প্রবেশ করবে, সেখানে সেই আলোয় আমার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা পাবে।
তোমার ঘুমে, স্বপ্নে, জাগরণে, আনন্দে, তোমার শোকসন্তপ্ততায় আমার নিঃশব্দ উপস্থিতি থাকবে — তোমার আনমনা সকল ভালবাসা নিয়ে
অপেক্ষায় থেকো।
আমি একদিন আসব।
১৭. প্রাক্তন
আপনি যেখানেই থাকেন, যতদূরেই যান —
যারই শরীরে মুখ লুকিয়ে অমৃত সুধা করেন পান,
আপনি আপনার প্রথম সঙ্গীকে
কখনোই ভুলতে পারবেন না।
প্রতিক্ষণ মনে হবে —
সেই তুমি আসো হিম অন্ধকারে
প্রজ্বলিত দীপ শিখায় আমাকে দাহ করো
আমাকে অঙ্গার করো
আমার চোখ তোমার মুখ থেকে ফেরাতে পারি না।
এসো তুমি আমার অতল চোখের তারায়
বসন্ত বাতাসে ঝরে পড়া জীর্ণ পাতার মতো
দিগ্বিদিকহীন আমার ওষ্ঠ্য পথে
যেখানে তোমার দীর্ঘ চুম্বনের চিহ্ন লেগে আছে।
১৮. হঠাৎ তুমি ছাড়া
আমি জানি তুমি ছাড়া পুড়ে খাক হয়ে যায়
সবুজের প্রান্তর, ফসলের মাঠ
চৌচির হয়ে যায় উর্বর মাটি
বিরাণ হয়ে যায় লতা গুল্ম বৃক্ষ, সারি সারি তরু।
তুমি না থাকলে গান নেই
গৌরীপ্রসন্নের কলম থেমে যায়
বেটোফোনের ভায়োলিন করুণ সুরে ভেসে যায়
কানে বাজে রাতভর বিসমিল্লা খাঁর সানাই
তুমি না থাকলে দূরাগত কোনও নিক্কণ বাজে না।
সুখ নেই, প্রশান্তির বুক নেই, ভালবাসা নেই
তুমি না থাকলে শুকিয়ে যায়
দীঘির শান্ত জল,
সব কিছুই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, মেঘে মেঘে ভেসে যায়।
আমার সকল মায়াসুধা, হৃদয় গহীনের সকল আকুলতা, সকল ভাবনা,
যমুনা পাড়ের দু’কূলের সকল দীর্ঘশ্বাস —
হঠাৎ তুমি ছাড়া সব কিছুতেই হাহাকার করে ওঠে।
১৯. সে ছিল প্রথম নদী
সে ছিল প্রথম জীবনে লেখা একটি কবিতা।
কি ছিল সেখানে উপমা উৎপ্রেক্ষা অনুপ্রাস,
কোন্ ছন্দে লেখা হয়েছিল কবিতার শরীরখানি ?
কবিতাটি ছিল একটি নদী–
উদ্দাম তরঙ্গমালা, পাহাড়, টিলার বুক চিরে জলপ্রপাত
প্রথম স্রোতধারা, প্রথম বিমুগ্ধ নিম্নচাপ
ফেনায়িত শুভ্র আভা, প্রথম কোনও সঙ্গমস্থলের দিকে অভিযাত্রা
নদীর বাঁকে বাঁকে বু্নো হাঁসের জল মগ্নতা
সে ছিল প্রথম দু’পাড়ে ভাঙ্গন, নোঙ্গর ফেলা ছিল অতল তলে।
নদীর শরীর ছিল ব্যঞ্জনবর্ণ, অনুপ্রাস ছিল স্বরধ্বনির
সে ছিল প্রথম নদী– সে ছিল প্রথম সাঁতার কাটা
প্রথম কোনও শিহরণ, প্রথম জলে ভাসতে থাকা।
২০. নিষিদ্ধ পদাবলী
যাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। যারা সবচাইতে প্রিয়জন। যাদের জন্য বহুকাল বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। তারাই যদি ঘৃণা করে,
তারাই যদি আর ভালো না বাসে
তারাই যদি মৃত্যু কামনা করে —-
তখনই খুব সুবিধা হয়, এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবার। এই সংসার থেকে অনেক দূরে চলে যাবার। সেই সুদূরের পথ কী খুব বেশি দূর?
কেমন হবে সেই প্রস্থানের ক্ষণ?
সে ক্ষণ কী কোনো অন্ধকার রাত্রি ?
কোজাগরি চাঁদনি রাত ?
ঝুমঝুম শ্রাবণ বৃষ্টির দিন?
প্রভাত কিরণের উজ্জ্বল সময়?
মর্মর পাতা ঝরার কোনও স্তব্ধ দুপুর?
নাকি সন্ধ্যার অস্তরাগের মুহূর্ত !
জীবন বড়ই নির্ভার মনে হচ্ছে। বাতাসে কোথাও মায়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। নেই কোনো ক্রন্দণ ধ্বনিও।
২১. যখন তুমি থাকবে না
এই প্রেম তোমার, এই নির্জনতাও তোমার
সমস্ত স্মৃতিতে বিস্মৃতির ধূলো জমবে একদিন
যখন তুমি থাকবে না।
শোক বিহবল কক্ষের অসীম নীরবতায়
মন ছুটে চলবে দিগন্তে, যেখানে উড়ে একাকী চিল
তার ডানা মেলার কোনও শব্দ নেই
মেঘ আকাশ জলরাশি নক্ষত্রমণ্ডলী
প্রত্যেকেই আর্তনাদ করবে তোমার অনুপস্থিতিতে।
পার্কের পাশে পাইন গাছ ছিল
ছাতিম গাছের তলায় নির্জনতাও ছিল
লেকের জল স্থির হয়ে ছিল
দুইজনের নিঃশ্বাস মাতাল করতে পারত হাওয়া।
অবসর আর কর্মহীন প্রহরে তোমার ছায়া পড়বে না
পাখি কলরব করবে মোয়াজ্জিনের আযান হবে
মন্দিরে শঙ্খধবনি বাজবে, গীর্জায় নিনাদ হবে
এই আকাশ এই নক্ষত্র সবই থাকবে যেখানে আছে
শুধু তুমি থাকবে না।
তখন মাতাল হবেনা কোনও বাতাস
তখন মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকবে না কোনও আকাশ।
২২. এই প্রেম সেই প্রেম ছিল না
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস থেকে জেনে নিয়েছি
যে হাওয়া বইছে আজ এখানে
যে গানের সুর ভেসে আসছে পূরবী ঝংকারে
সেই সুর ঝংকার আমার জন্য বাজেনি —
তোমার ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত কাপড় বলে দিচ্ছে
গর্ভধারণের আড়ালে যে তুমি
সে তুমি কখনোই আমার ছিলে না।
এই প্রেম, সেই প্রেম ছিল না কস্মিনকালেও
এ ছিল প্রেমহীনতার উৎসব উৎসব খেলা
প্রেমের আড়ালে ছিল শূন্য করে দেবার দহন
জ্যোৎস্নার আড়ালে যে উদ্বাস্তু প্রান্তর ছিল
সেখানে হতো কেবল বেদনাহতদের কান্নার উৎসব।
এই রকম শোকাচ্ছন্ন উৎসবের রাতে —
এই রকম অন্ধকার পথের প্রান্তের উপর
অনিশ্চিত গোপণ রক্ত ক্ষরণের ভিতর
পূর্ব পুরুষদের বিদ্ধ করতে চাই না কোনও পাপ স্খলণে।
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস সেই বার্তাই দিয়ে গেল।
২৩. ভালো থেকো
আমি যখন থাকব না, তখন তুমি ভালো থেকো।
তখন —
একাকী ভোরের পাখিদের গান শুনবে
বন্ধ ঘরে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনবে
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঝুম দুপুরে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি শুনবে
বিকেলে পশ্চিম দিগন্তে চেয়ে দেখবে আবীর মাখা
লাল মেঘ,
সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে পায়চারি করে খুঁজবে আমার পায়ের চিহ্ন।
রাত্রিতে জানালা খুলে দেখ তারাভরা আকাশ
দেখ পঞ্চমীর চাঁদ, স্নাত হবে জোছনায়।
যদি ঘুমিয়ে যাও তবে স্বপ্ন দেখ না —
আমাকে দেখতে পাবে না কোথাও,
না জাগরণে, না ঘুমে, না স্বপ্নে। উত্তরের হাওয়া থেকে নিঃশ্বাস নিতেও যেওনা , সেথা থেকে আমার শরীরের গন্ধ আসবে না ।
আর…
আমার দেখা যদি তুমি পেতেই চাও
তবে দূর কক্ষপথ ধরে চুপিচুপি চলে এস পরিযায়ী পাখির মতো, দেখা পেয়ে যাবে হয়ত আমায় অপার্থিব কোনও এক ছায়াপথে।
২৪. দিবারাত্রির কাব্য
কেমন যেন বিষণ্ণের দিন। কেমন যেন বিষণ্ণের রাত্রি। একাকীত্বের অস্থিরতা। নৈঃশব্দ্য চারদিক। কিছুই হলো না। এখন শুধুই ক্লান্তি।
তোমার কী হয়েছে? কেউ জানে না। অন্ধকার জানে। বিষাদ রাত্রি জানে।
এলমেল ভাবনা যত। তোমাকে অনেক নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে। ডাকব? আজকে তুমি প্রথম শ্রাবণ। সঙ্গে চাঁপার গন্ধ মাখব।
কত কথা মনে পড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পশ্চিম পাড়। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছি কত পদ্মার ঢেউ। ব্রিজের লাল পাতে লিখে রেখেছিলাম সাহানা জোয়ার্দারের নাম।
সে নাম মুছে গেছে। এখন সবই চাঁদের রাতের আবছায়া অন্ধকার। তারপর এল তোমার নাম। সে নাম নিয়ে কবিতা লেখা হয়। সে তুমি আমার সকল দিবারাত্রির কাব্য।
২৫. হিবিজিবি স্বপ্নের কথা
পৃথিবীতে এমন কেউ একজন থাকে
যে জীবনেও থাকে মরণেও থাকে। যাকে দেখতে পাই বহু যুগের ওপারে —
কত স্বপ্ন নিয়ে সে পড়ে থাকে, কত জীবনের স্মৃতির জীর্ণ স্তুপে।
বহুকালের একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনার জন্য কান পেতে থাকি। ফিরে যেতে থাকি সেই অতীত বিন্দুতে, যেথায় অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে কেউ একজন বসে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে।
সব হিবিজিবি লেখার পাতাগুলো সরিয়ে বিনম্র চোখ সেই একটি পাতা খুঁজতে থাকে
যেখানে তার অনেক স্বপ্নের কথা লেখা আছে —
আমি নির্লিপ্ত দু’চোখ মেলে দেখি তা।
২৬. শূন্যতার ধ্বনি প্রতিধ্বনি
তুমি চলে যেতে চাইলে চলে যাবে
সাথে নিয়ে যেও আমার শূন্যতাও
একটি মুখর জীবন ছিল আমার, সেই মুখরিত সময়ে
তোমাকে বেঁধেছিলাম,
তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যেও আমার আনন্দও।
তুমি থাকবে না তাই রাস্তা ধরে হাঁটব উড়নচণ্ডীর মতো
পথের ধারে ফুটে থাকবে বুনোফুল আর ঈষৎ শিশির ভেজা রাস্তা এই…
আকাশমুখী মহাদ্রুম অনন্ত ছায়া মেলে রাখবে সেই রাস্তার ওপর। তেরছা হয়ে সূর্যের দু’একটি আলো এসে পড়বে সেখানে।
ফিরে যাব আমি হয়ত কুসুমপুরেই
যখন হেঁটে যাব অস্তমিত সূর্যের আলো পড়বে যমুনার স্বচ্ছ জলে, আমার ঝুলানো ব্যাগ থেকে শোনা যাবে তখন তোমার শূন্যতার চুড়ির টুং টুং আওয়াজ …
২৭. তোমার সেই আমি
তোমাকে দেখতে দেখতেই চোখ বন্ধ হয়ে যাবে
নিরাভরণ ছায়া নামবে যখন কোনও বিকেলে
অথবা নিঃস্তব্ধ কোনও মৌন সন্ধ্যায়
তারপর প্রতিরাতে প্রতিরাত জাগা সময়ে তোমার চোখ খুঁজবে আমাকেই আঁধার ছেনে।
আমার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দেবে সন্ধ্যার বাতাসে
তোমার চোখে ও চুলে
যদি কোনও সন্ধ্যায় বাতাস না বয়ে আসে
যদি সুগন্ধ না ঝরে শিউলির ঝাড় থেকে
স্বর্গলোকের ধূপের গন্ধ আসবে তখন তোমার ঘরে
তুমি বুঝতে পারবে আমারই শরীরের সেই পুরনো গন্ধ মিশে আছে সেখানে।
আমি যেথায় থাকি কিংবা না থাকি
আমার আত্মা থাকবে, বাজবে অনন্তকালের বাঁশি
দূর বহু দূর থেকে —
এই ব্রহ্মাণ্ডেই তোমার অস্তিত্ব জুড়ে রবে আমারই আত্মা, অনুভবে বুঝে নিও সে যে তোমারই সেই
আমি!
২৮. গতস্য শোচনা নাস্তি
যারা একদিন ভালবেসে ভালবাসা পায়নি, তারা অনেকেই নক্ষত্রের আড়ালে চলে গেছে। কত অসমাপ্ত চুমুর দাগ পড়ে আছে নির্গন্ধহীন।
রাতে সারা ঘর অন্ধকার হলে পাশে ঝোপের ভিতর জ্বলে ওঠে দু-একটি জোনাকি। কবেকার নির্মাল্য ভালবাসার কথা মনে পড়ে গিয়ে মনখারাপ হয়।
স্টেশনের হুইসেল বাজে দূর থেকে। শুনি বাঁশি।
এমন গভীর রাতে, অনেক দূরের সুর ভেঙে হঠাৎ গান জেগে ওঠে। কথা বলে। বলে, ঘুমালে নাকি?
কে যে বাঁশি বাজায়? যেই বাজাক বাঁশি।
মনে পড়ে প্রেমিকার ঠোঁট। ঠোঁট কাঁপছে তার।
চোখ বন্ধ করি। এই আঁধারেও অজস্র ঘাসফড়িং
উড়ে চরাচরে। ‘সুরে সুরে বাঁশি পুরে তুমি আরও
আরও আরও দাও তান…।’
শিউলিবনে ভালবাসার মানুষ কোমল গান্ধারে
কাকে যেন কী বলে।
বলে — তোমার ঠোঁটে ধানের ছায়া। কুসুমপুরের আম ছায়ার মতো সুনিবিড়।
সেই নিবিড় গহিন ছায়ায় হারিয়ে যায় এই শহরের এক রাখাল বালক।
জীবনের কত হাস্নাহেনা সুরভিত দিন গ্লানিতে ভেসে গেছে। গতস্য শোচনা নাস্তি।
২৯. মৃত্যু
মানুষ মরে গেলে আর ফিরে আসে না, এ কেমন প্রস্থান মানুষের ?
নদীর জল শুকিয়ে গেলেও বৃষ্টিতে ভরে নদী
পানকৌড়ি’রা আবার ফিরে আসে জলে, মানুষ কেন ফেরে না
আমি অমরত্ব চাই, কীভাবে রুখব মৃত্যু ?
কীভাবে ফিরাব আযরাইলের থাবার পবিত্র হাত,
প্রেমিকাও কেঁদে কেঁদে ফিরে পায় প্রেমিককে
বাতাস না থাকলেও ঝড় এসে বন্ধ করে দখিনের জানালা,
মানুষ মরে গেলে কেন সে ফেরে না।
এই যে আমি এখান থেকে একদিন চলে যাব
আমার শোবার পালঙ্কও বেঁচে থাকবে অনেকদিন
আমার বসার চেয়ার, আমার পড়ার টেবিল,
পুরু লেন্সের চশমা
আমার কবিতার খাতা, অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি,
সব থাকবে
আমি কেন থাকতে পারব না —
আমি কেন আর ফিরে আসতে পারব না ?
চাঁদ ডুবে গেলে চাঁদ ওঠে, জ্যোৎস্নায় ভাসে পৃথিবী
আকাশ থাকে না খালি, শূন্যস্থান ভরে দেয় মেঘ এসে,
মানুষ মরে গেলে আর ফেরে না, কেন শূন্য হয়ে থাকে তার স্থান।
৩০. সেই চোখ
ছোট কাঠের জানালার মধ্য দিয়ে একটি অচিন মুখ দেখতে পাই
মনে হয় তারই মুখ যাকে দেখেছিলাম দেবদারু গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক বিকালে,
রোদ পড়া লজ্জামাখা এক আচমকা ক্ষণ ছিল তখন।
তার মুখ মাঝে মাঝে সত্যি দেখতে পাই
আসলে সেই মুখ কী আমি দেখি? নাকি কোনও দিন তাকে দেখি নাই,
অন্য কোনও মুখের সাথে না হয় মিলিয়ে নেব সেই মুখ
এই জীবনে।
কত মলয় বাতাস বইছে, কত মানুষ আসে এই শহরে, কত ট্রেন চলে যায়, কত চিঠি নিয়ে আসে ডাক পিয়ন রঙিন খামে।
সময় পুরনো হয়ে ম্লান হয়ে আসে
ঝাপসা হয়ে আসে চোখ, মনে হয় সেই চোখ কোথাও কাঁদছে।
৩১. ভালবাসার পাগলামিগুলি
সকালবেলা হয়তো আমার আগে ঘুম ভেঙেছে,
তখনও যদি ঘুমিয়ে থাকে তার সারারাতের
নির্ঘুম দুটি চোখ
আমি তার চোখের পাতায় স্পর্শ দিয়ে বলি —
জাগবে না? আমাকে দেখবে না? ভালবাসবে না?
ঘর হতে বেরিয়ে যাব,
সে আমার টাইয়ের নট ঠিক করে দিচ্ছে,
বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছে কোটের,
চুলের গন্ধ আসছিল আমার নাকে,
মাথা ভর্তি চুলে মুখ রেখে বলি —-
যেতে ইচ্ছা করছে না, এস ভালবাসি।
স্নানের পর হয়ত সে চুল শুকা্চ্ছে
তখনও টপ টপ করে চুল থেকে ঝরে পড়ছে জল
আমি হয়ত এসেছি বাহির থেকে,
শরীরে আমার ঘামের গন্ধ, সার্টে লেগে আছে ধূলো
তার শীতল বুকে তখন উষ্ণতা রেখে বলি —-
এস ভালবাসি, আবারও স্নান করো আমার সাথে।
বিকেল বেলা পার্কে হাঁটছি
ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ছে তার শাড়ির উপর, দুটো শালিক বসে আছে ঘাসে
মাধবীলতা জড়িয়ে আছে সোনালের ডালে
ছাতিমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মুখে পড়ছিল
বিকেলের রোদ,
সেই মৌন বিকেলে কানের কাছে মুখ রেখে বলি —-
চল যাই ঐ হাস্নাহেনার ঝাড়ে
ভালবাসো শালিকের মতো, মাধবীলতার মতো জড়িয়ে।
সন্ধ্যায় জ্বালাতে দিই না সন্ধ্যা বাতি
আঁধার নামে দুজনের মাঝে, কথা সব থেমে যায়
নৈঃশব্দ ঝুমঝুম করে ঘরের ভিতরে
পাখিদের গান বন্ধ হয় তারও আগে,
আমি তার চোখে দেখি তারার আলো,
বিমুগ্ধ মুখ তুলে তাকে বলি —-
আঁধার নামতে দাও, রাত আসতে দাও, আমাদের ভালবাসাবাসি হবে।
৩২. অহংকার ছিল যৌবনের
তোকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, অহংকার ছিল যৌবনের
অহংকারে হেঁটেছিস তোর বাড়ির উঠানে
কাঁদা লাগাসনি পায়ে, জলে ভিজাসনি শাড়ি
বলেছিলাম তোকে — ‘আয়, বু্নো জ্যোৎস্নায় স্নান
করি এক সাথে।’
তুই খুলেসনি শাড়ি, খুলেসনি অন্তর্বাস,
কিসের এত অহংকার ছিল তোর ?
যৌবন তো শুকিয়ে ফেলেছিস, অহংকার চূর্ণ করেছিস বলিরেখায়
নদীর জল শুকিয়ে ফেলেছিস
কোথায় সেই ফেনায়িত ঝর্নাধারা ?
অনুর্বর ভুমি, শুকিয়ে চৌচির হয়েছে মৃৃত্তিকা
এমন অনুর্বর ভুমি এমন জলহীন নদী পছন্দ করি না
যদি পারিস আবার নদী হ, আবার জলে ভর্ নদী
আবার উর্বর কর্ ভূমি
তবেই আমি লাঙ্গলের ফলা চালাব, সাঁতরাব নদী।
৩৩. রমণী
আমাদের দেহ নদীর মতোন, নুড়ির মতোন, বালিয়ারীর মতোন, ঝর্নার মতোন
রিমঝিম ঝরে, এ কূলে ভাসে, ও কূলেও প্লাবিত হয়।
আমাদের চান্দ্র চুম্বনগুলি চিকচিক জলের মতোন,
সমুদ্রের ফেনার মতোন, হাঙরের কামড়ের মতোন আশ্লেষ লেগে থাকে ঠোঁটে ও চিবুকে।
আমাদের দেহ স্বচ্ছ আয়নার মতোন, বিধৌত চরাচরের মতোন বিবশ,
আমাদের আঙ্গুলের আচড়গুলো রক্তক্ষরিত,
কোনও করুণা নেই, কোনও মমতা নেই।
প্রতিক্ষণ ক্ষত হই, খুলে যায় সকল বন্ধন, সকল বন্ধনী, উপত্যকা চূর্ণ হয়, চাঁদ বিক্ষত হয়,
তারা খসে পড়ে,
কে যে তুমি, কে যে প্রেমিকা, কে যে কুল বধূ —
সবই রমণী।
৩৪. চলে গেলে চলে যাবি
চাল নেই চুলো নেই ছাদ নেই গাছতলাও নেই
খোলা আকাশ দেখি —
কি সুন্দর তারা ঝরা পড়তে দেখি
তুই এই সবের মধ্যে থাকলে থাকতে পারিস
না হলে চলে যাবি।
বুক চিনচিন করবে, সিগারেট খাব
তারা গুণব রাতভোর
ঘাসের বিছানায় ঘুম পাবে
তোকে মনে পড়লে পড়বে, তারপরেও
তুই চলে গেলে — চলে যাবি।
তুই চলে গেলে একা লাগবে
ফার্মেসীতে আসা যাওয়া বাড়বে
না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকব
উদ্বাস্তু বাড়ির চারদিকে জোনাক জ্বলবে
তারপরেও তুই চলে গেলে, চলে যাবি।
৩৫. প্রেমাংশুর আগুনে জ্বলে
এক বিকেলে আমরা হঠাৎ প্রেমিক প্রেমিকা
হয়ে গেলাম
আমি প্রথমেই ছুঁয়ে দেখলাম তোমার হাত
তুমি চোখ বন্ধ করে থাকলে।
আকাশের বিনম্র মেঘ সরে গেল
আমি মুহূর্তে বুঝতে পারি দীপ্তমান মানব অস্থি
তোমার ভিতরের সব বিন্যাস
যেখানে অলকানন্দার জল বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে।
আমার শক্ত উদ্বাহু হাত
ধীরে ধীরে ধাবমান হলো তোমার দিকে
তুমি নৈঃশব্দে আসমানের ছায়ায় শুয়ে থাকলে
তোমার শরীরের কোমল কিনারায় পাড় ভাঙ্গছে।
আমার হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে
তোমার আন্তঃসিমানা থেকে বহিঃসিমানায়
তোমার সকল কক্ষপথ পেরিয়ে সুনির্মল নাভি তলে
সকল গোপন প্রান্ত সীমারেখায়।
আমি অনুভব করি দেহের সকল তপ্ত দাহে
শীৎকারের সকল ধ্বনিতে
প্রেমাংশুর আগুনে জ্বলে আমাদের সকল শৌর্য বীর্য একসময় পুড়ে খাক হয়ে যায়।
৩৬. প্রেমক্ষুধা
হে আমার জন্ম আজন্ম প্রিয়তমা
আমার সর্বগ্রাসী প্রেমিকা এৰং সকল অবাধ্য রমণীকূল
তোমরাও প্রেমজ, তোমরাও মন ভোলাও সকল পুরুষদের, তোমাদের মতো করেই বশ করো সকল প্রেমিককে, তারা সহজেই নতজানু হয়
তোমাদের কাছে।
হে আমার স্ত্রী পরস্ত্রী যুবতী স্বৈরিণীরা
যদি তোমাদের প্রেম মিথ্যা হয়
যদি তোমাদের মুখ মিথ্যে কথা বলে,
যদি তোমাদের শরীরের সমস্ত দৃশ্যপট মিথ্যে হয়,
যদি পিকাসোর আঁকা নারীদের মতো তোমাদের
সৌন্দর্যগুলো সৌন্দর্যের না হয়
যদি তোমাদের প্রগাঢ় চুম্বনগুলো
গভীর আলিঙ্গনগুলো
যদি স্বপ্নলোকের গানগুলো বেসুরো হয়
যদি প্রতারণা করো
যদি সন্ধ্যারাতের তারাগুলি আর না জ্বলে,
দিনের রোদ্রশুলি যদি আঁধারের হয়
যদি হৃদয়ের স্পন্দনগুলো স্পন্দিত না হয়
যদি চোখের তারা অনুজ্জ্বল হয়
যদি সব স্বপ্নসৌধ ভেঙে খানখান হয়ে যায়
তাহলে মনে করব জগতে কোনও প্রেম নেই।
তোমাদের শরীরের সকল ঐশ্বর্যগুলি যদি
অব্যবহৃত থাকে
যদি আলোগুলো আলেয়া হয়ে যায়
যদি প্রাচীন নগরীর সকল আঁধার নামে এই ভূলোকে
যদি হঠাৎ সমস্ত মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়
যাতে তোমাদের প্রবঞ্চনাগুলি কখনও আর
ফাঁকি দিতে না পারে
যেন কোনদিনই প্রেম মুছে না যায় এই পৃথিবী থেকে।
হে রমণীকুল হে আমার জন্ম আজন্ম স্বৈরিণীরা তোমরাই আমার সকল বৈভব, আমার প্রেম ক্ষুধা
যদিও আমি স্ত্রৈণ নই।
৩৭. অজ্ঞাত যাত্রা
আমি আগে কখনও প্রেম বুঝিনি
তাই তো ঠোঁটকে মনে করতাম রক্তকরবী
চোখকে মনে করতাম সন্ধ্যাতারা
শরীরকে শরীর মনে হতো না
মনে হতো মনিখচিত সর্প এক, এঁকেবেঁকে চলেছে
নদীর মতো।
সবকিছু রহস্যময় মনে হতো, বুঝতাম না গন্তব্য কী!
সালভাদর দালির তুলির মতো হাতের আঙ্গুল
উপত্যকা ছুঁয়ে চলে যেত অরণ্যপথে,
সেই পথ চেনা ছিল না কখনও আগে
আ়ফ্রোদিতিও এসে শেখায়নি কোনও প্রেমশাস্ত্র
কোনও কলাকৌশল।
আমার ছিল না কোনও বোধ কিভাবে সন্ততি হয়
জানতাম না কিভাবে সভ্যতার বিস্তার হয়
কিভাবে জল ভেঙে জলধিতল থেকে মুক্তা তুলে আনতে হয়
তারপরেও সাগরতলে অজ্ঞাত যাত্রার অভিযাত্রী আমাকে হতে হয়েছিল।
৩৮. পদ্ম কুসুম
তুমি শুধু একবার খুলে দাও হৃদয়ের কপাট
এই উচ্ছ্বল যুবকের সামনে বন্ধ করো না দরজা
একবার খুলে ফেলো লজ্জার অবগুন্ঠণ।
তোমাকে শেখাব কীভাবে ভালোবাসতে হয়
সব তছনছ করে, সব ভেঙ্গেচুরে কীভাবে গড়তে হয় শরীরশিল্প, হৃদয় ভাঙ্গতে হয় হৃদয়ের গহীনে
যেয়ে।
আমি হাঁটু মুড়ে দু’হাতে স্পর্শ করতে চাই স্বর্ণরেণু
ভুলে যাওয়া ঢের ভাল স্মৃতি কাতর যন্ত্রণা
তুমি এই উন্মূল যুবকের বুকে মাথা রাখো
তোমার সব মণিকাঞ্চন বিলিয়ে দাও অকাতরে।
আমরা মিলব নদীর মতো, অন্তঃশীল স্রোত ধারার মতো – ভেসে ভেসে তুলে আনব অলক্ত পদ্ম-কুসুম।
৩৯. এখন ভালবাসার সময়
মন শোনে না মনেরই কথা, তোমার কথা কী
শুনব আমি?
আমি যে অবাধ্য এখন তোমার প্রেমে।
তুমি যখন তখন এস নেমে
গ্রীবায় লাগাও এসে তোমার সূর্যের ঝলক
অগ্ন্যুৎসব হয় তখন দুজনের মর্মরে মর্মরে।
অবাধ্য হই সকল নিয়ম বিধি নিষেধে
পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থ দূরে সরিয়ে রাখি
আমার যে তখন ভালবাসবার সময়।
ডাক্তার চলে যাক হাসপাতালে
উকিল চলে যাক কোর্টে
বিচারপতি বসুক তার এজলাসে
সাংসদেরা চলে যাক সংসদে
আইন তৈরি করুক, আমার বিরুদ্ধ প্রেমে।
আমি এসব আইন মানিনা —
আমার যে এখন ভালবাসার সময়।
৪০. তুমি এসেছিলে
হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় তাকে —
চেয়ে দেখি সে যে নান্দী মুখ আবার ভৈরবীর
ঠুমরির সুরও যেন ভেসে আসে
মেঘদূতম্ শ্লোকও শোনা যায়
যেন যমুনা তীরে অকালে বান এসেছে।
‘বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে,
পথিকেরে লহ ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে।’
এই গান গেয়েছিলো কে প্রথম —
এখন সে কোথায়?
এখন আছো তুমি, এখন সে আহ্বানও দাও তুমি।
সেই কোন জনমে শিউলী ফুটেছিল বাগানে
আগে মাতাল হতাম এর গন্ধে , এখনও হই —
এখন হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁই
যেন সায়গল এসে থামে ‘পিয়া নাহি আয়ে’।
নাহ্! তুমি এসেছিলে আমারই গানে।
৪১. বয়স যখন একুশ
ভালবেসেছিলি ঠিক ছিল
ভালবাসা দিয়েছি।
কেন আবার বিয়ে করতে চাস?
অভাব সন্তাপ সইতে পারবি তো?
অবহেলা করবি না জানি
অযত্নও করবি না তুই
চোখের জল রাখার মতো আছে তোর যমুনা চোখ?
নিতে পারবি শোক?
হাওয়ায় তোর আঁচল উড়ে
প্রজাপতি উড়ে এসে বসে তোর চুলে
তুই আকাশের নীল দেখিস
স্বপ্ন দেখিস স্বপ্নখোর তোর দুচোখ ভরে
তুই কি ঘর করতে পারবি এই উড়নচণ্ডীর?
আচ্ছা, আসবি যখন আয়
আগুন যখন লাগিয়েছিস লাগুক
তুই যদি জ্বলতে পারিস আমিও জ্বলব
তুই যদি ছাই ভস্ম হতে পারিস আমিও হব
ভালবাসা পুড়ুক।
ঘর নেই, নেই!
দুজনেই খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকব।
রৌদ্র ঝড়ুক। বৃষ্টি পড়ুক।
পাখি হয়ে উড়ে যাব শূন্য দিগন্তে। ফুল হয়ে ফুটে থাকব কোনও পুষ্প কাননে।
৪২. আরাধ্য পুরুষ
হে আমার বিষাদ ক্লীষ্ট রমণী’রা, আমার অনন্ত গ্লানি, এখানে এই কবিতায় তোমাদের আক্ষেপের কথা লেখা থাকবে।
লেখা থাকবে অতৃপ্ত বাণীবদ্ধ দীর্ঘশ্বাসের কথা, হাজার নিশীথের না পাওয়ার ক্রন্দনের কথা। নির্ঘুম চোখের ক্লান্তির কথা।
তুমি জেগে রও আরও দীর্ঘ রাত্রিকাল, মৌনতার আকাশ থেকে তারা’রা খসে পড়বে যখন, নীভে যাবে আকাশ প্রদীপ —
ঠিক তখনই তোমাদের অনারাধ্য পুরুষদের আগমনের পথ উন্মুক্ত হবে।
৪৩. প্রতিশ্রুতি
ডাইরীর পুরনো পাতা উল্টাতেই একজায়গায় দেখতে পাই —
দুর্গম পথ মাঝে পথ হারিয়ে যখন পথ খুঁজছিলাম, তখনই তোমার দীপ্ত উচ্চারণ —
‘ আমি চেয়ে আছি, ঠিক তোমার পথের দিকেই, ধরো তুমি আমার উদ্যোত হাত, পথ হারাবে না।’
আরেক জায়গায় অস্পষ্ট লেখা — যদি শান্তি না পাও,
যদি শান্ত্বনা না চাও,
দুঃখের অন্ধকারে যদি সুখ দেখতে না পাও
তবে আমি প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে ধরব।’
আরো কিছু লেখা আছে —
‘পাড়ি দিতে হবে অথৈ নদী, হাল ভাঙে যদি, জীর্ণ বাদাম ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, যদি যেতে না পারি তোমার কাছাকাছি।’
‘কি এক আশ্চর্য ঘোর লাগা আবেশে তুমি তোমার হাত দুটি হাতে রেখে অকম্পিত স্বরে বলেছিলে —
মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে বলব, ‘আমি তোমার, আমি তোমার আছি। আমি তোমারই থাকব।’
৪৪. যেদিন প্রথম এলে
আমার বাড়ির আঙিনায় যেদিন তুমি
প্রথম পা ফেলেছিলে
কোথা থেকে সেদিন শুকপাখিরা উড়ে এল দলে দলে
সাদা মেঘের মতো গন্ধরাজ ফুলগুলো ফুটে উঠল
মেঘ ভেঙে বৃষ্টিও হলো অঝোরে ।
কবিতার খাতার সাদা পাতায় কত অজস্র
কবিতা লেখা হলো– লেখা হলো তোমার কত নাম,
কত মধুবন্তী গানের চরণে খাতা ভরে গেল,
ভরে গেল কত সঞ্চারীতে ….
লিখে রাখা হয়ছিল মেহেদী মাখা তোমার হাতের কথা
মায়াবী রাতের কথা, চাঁদের কথা–
চাঁদমুখী কুঞ্চিত মুখের কথা, কত যে আরও রূপকথা !
৪৫. ঘরের বাহির করে
তুমি উদ্বাস্তুও নও, গৃহহীনাও নও তারপরও বললে– ঠাঁই দাও তোমার গৃহকোণে।
আমি বললাম, স্থান নেই, ঘর পরিপূর্ণ।
তুমি বললে — ‘দিগন্ত পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, ঐ দূরে
অশ্বত্থ ছায়াতল আছে, নদীর কূল আছে, ভাঙা নাটশালা আছে,
লতা গুল্মের আচ্ছাদন আছে, তারাভরা আকাশ আছে , আকুল করা জোছনা আছে… নৈঃশব্দের গান আছে .
সেথায় নিয়ে গিয়ে দাও স্থান।’
বললাম– এইসবের কাছে আমাকে নিও না, উন্মাতাল হই, লোভ হয়! পরিপাটি সব ফেলে এই গৃহত্যাগ করে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
পাহাড়, টিলা, মহুয়াগাছ, ঘেঁটুফুলের গন্ধ,
শান্ত জলের নদী, ফুলজ জারুল বৃক্ষ,
বসন্তের পাতা মর্মর, এই সবই আনন্দ দেয়,….. আমাকে ঘরের বাহির করে…
৪৬. ভাবনা যত
যখন আমি তোমার চোখের সামনে থাকি না, যখন তোমার থেকে আড়ালে থাকি। তখন তোমার কেমন লাগে? কর্মের মধ্যে তোমার হাত কী অবশ হয়ে যায় কখনও? চোখের সামনে যা দেখ, সেই সব বস্তু ভেদ করে আমাকে কী তুমি দেখতে পাও? আমার কোনও ছায়া রূপ?
আমার কোনও কথা ধ্বনিত হয় কী তোমার চারপাশে? শ্রাবণের মেঘ ঘুম ঘুম বর্ষণে, কিংবা রাত ভোরের রিমঝিম বারি পতনে?
একটি গানের কথার মাঝে আমাদের দেখা হয়। একটি ঘাসফুল যখন নিশ্চুপ ফুটে থাকে নির্জন পথের পাশে, সেখানে আমাদের কথা হয়।
আমরা হাঁটি কত পথে, কত নদীর কূল ধরে। আমাদের পথচলা, হাঁটার যত ক্লান্তি, কিছুই থাকবে না। শুধু থাকবে ধূলিতে লেগে থাকা আমাদের পায়ের দাগগুলো।
কত আশা ফুরিয়ে যায়। কত ভালবাসা, স্নেহ মায়া রয়ে যায় অপার্থিব হয়ে। আমরা ভেসে যাই গুণের সেই কবিতার মতো —
‘আমরা মিশিনি ভালোবেসে সব
মানুষ যেভাবে মেশে,
আমরা গিয়েছি প্রাজ্ঞ আঁধারে
না-জানার টানে ভেসে।
ভাসতে ভাসতে আমরা ভিড়িনি
যেখানে নদীর তীর,
বুনোবাসনার উদ্বেল স্রোতে
আশ্লেষে অস্থির।’
৪৭. সেই তুমি
কতকাল চলে গেছে, কত বিষণ্ন
প্রহর, কত রাত্রি।
কত মুগ্ধ মুখ দেখেছি নতুন করে।
কিন্তু —
সেই পুরোনো আরক্ত সুন্দর
মুখখানি বহু যুগের কঠিন শীলার
উপর আজও খচিত,
আজও চির মর্মরিত অভিজ্ঞান
হয়ে আছে।
কত বৃষ্টি ঝরেছে, কত রোদ্দুরের উত্তাপ,
স্বপ্নঘোরে কত স্পন্দন
স্পন্দিত হয়েছে —
সেই মুখ, সেই তুমি তেমনি আছ।
৪৮. নাম লিখি তার
হাতটা এগিয়ে দাও। সূর্যমুখী ফুলের মতো করোতলে কালি লাগিয়ে লিখি তোমার নাম। লিখি তুমি আমার যা হও তাই।
নাম লেখালিখি ছিল আমার ছোটবেলার অভ্যাস। মাটিতে আঁচড় কেটে লিখতাম প্রিয় ফুলের নাম, পাখির নাম, নদীর নাম। মনে মনে কতজনকে যে ছদ্মনাম রেখেছিলাম। জানত না কেউ-ই তারা।
মা বলত, মাটিতে আঁচড় কাটতে হয় না। অমঙ্গল হয়।
মা এখন নেই। কোথায় কোন মঙ্গল আলেকে সে ঢেকে আছে কে জানে !
এখন কিন্তু একটাই নাম। তাকেই শত নামে ডাকি।
কখন কোন নামে ডাকি মনেও থাকে না। যে সব নামে ডাকি, সেই নামগুলোই লিখে দেব তার হাতে।
এসো। হাত পাতো। লিখি নাম।
৪৯. উপেক্ষা
তপ্ত দুপুরবেলা কিংবা পরন্ত বিকেলে, সন্ধ্যায়,
বা নিশীথ রাত্তিরে যখনই ঘরে ফিরি না কেন,
দরজার কড়া নাড়লেই একজন মায়াবতী এসে দরজা খুলে দেয়।
আমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না ।
টেবিলে খাবার রেডি পাওয়া যায়।
পরিপাটি থাকে বিছানা। ফুলদানিতে ফুলের সুবাস ঝরতে থাকে।
শোবার সময় মশারিটাও টানাতে হয় না ।
অথচ শুক্লপক্ষ জ্যোৎস্না রাতে, কি়ংবা কোনও কৃষ্ণনিশিথে
এই মায়াবতীর জন্য কখনও আনিনি একটি
রজনীগন্ধার বৃন্ত !
কিংবা নীলকন্ঠ পাখির একটি পালক।
৫০. আঁধারভেদী
চোখ খুলে রাখলে নীল আকাশ দেখি
বৃক্ষ দেখি, পাখি দেখি
দূরের প্রান্তর দেখি
চরাচর দেখি, ভাসমান মেঘ দেখি
জনারণ্যে হাজার মানুষ দেখি —
চোখ বন্ধ করলে এসব কিছুই দেখতে পাই না
শুধু দেখতে পাই মায়ের মমতাময় মুখ।
Leave a Reply