ক্রুসেড সিরিজ ৫ – ভয়াল রজনী
মুল লেখক – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
অনুবাদ – আসাদ বিন হাফিজ
ভূমিকা
ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠলো খৃষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক সংঘাত ও সংঘর্ষের পরাজিত হয়ে বেছে নিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিল মদ ও নেশার দ্রব্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাঠাল প্রশিক্ষনপ্রাপ্তা সুন্দরী গোয়েন্দা। বড় বড় অফিসার ও আমীর উমরাদের হারেমগুলোতে ওদের ঢুকিয়ে দিল নানা কৌশলে। ভাসমান পতিতা ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। মদ জুয়া আর বেহায়াপনার সস্রোত বইয়ে দিল শহরগুলোতে।
একদিকে সশস্ত্র লড়াই অন্যদিকে কুটিল সাংষ্কৃতিক হামলা, এ দুয়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ও তার বীরশ্রেষ্ট সাথীরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।
.
ভয়াল রজনী
আর আঘাত করলো না ওসমান। জুতা খুলে মসজিদের ভেতরে ঢুকল দু’জন। ক্রুশটা এখনও তার হাতে। ভেতরে গিয়ে বললো ‘তোমার নাম কি যুবক?’
‘ওসমান।’
‘আমি মুসলমান, তুমি কখন থেকে আমার পিছু নিয়েছো?’
‘সারা দিন তোমার পিছনে হেঁটেছি, কিন্তু সু্যোগ হয়নি।’
‘আমাকে কেন মারতে চাইছো?’
‘কারণ আমি ইসলাম এবং সালাউদ্দীনের বিরুদ্ধে কোন কথা সহ্য করি না।’ তুমি পাগল হও আর যেই হও আমি তোমাকে হত্যা করবো।’
‘কিন্তু আমাকে হত্যা করলে ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের কি উপকার হবে?’
‘জানি না তবে ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের একজন দুশমন কমবে।’
‘তুমি কি যে-ই ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের বিরোধীতা করবে তাকেই হত্যা করবে?’
‘অবশ্যই। সু্যোগ পেলে আমি কাউকেই ছাড়বো না।’
‘তুমি কাকে ইসলামের বড় দুশমন মনে করো?’
‘অবশ্যই খৃষ্টানদের। তবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত শক্তি এখনো আমার হয়নি। হলে তাদেরও আমি ছাড়বো না।’
‘ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের বিরোধীতা করলে তাদের হত্যা করতে হবে এই বুদ্ধি তোমায় কে দিয়েছে?’
‘কেউ এ কাজ করতে আমাকে বলেনি। আমি নিজে থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘তুমি কি একাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো, নাকি তোমার সাথে আরো কেউ আছে?’
‘আমি একাই।’
আরো কয়েকটা প্রশ্ন করে পাগল লোকটা বললো, ‘তোমার মত একজন যুবকই আমার প্রয়োজন। তুমি নিজ থেকে এসেছো ভালই হয়েছে। ভেবেছিলাম এমন লোক পেতে আমার বেশ কষ্ট হবে।’
‘শোন, আমি আয়ুবীর একজন গোয়েন্দা। খৃষ্টানদের ধোঁকা দেয়ার জন্য পাগলের অভিনয় করছি। সফর করেছি এই পোষাকেই। তোমার সাথে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শোন- মনে রেখ মসজিদে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে আমি আগের মত আজেবাজে কথা শুরু করবো পাগলরা যেমন করে আরকি!’
তুমি এমন ভাব করবে যেন আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনছো।
যা বলার আমি দ্রুত বলছি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মুসল্লীদের মধ্যেও ওদের গুপ্তচর থাকতে পারে, এজন্য নামাযের আগেই কথা শেষ করতে হবে।’
ওসমান কখনো গোয়েন্দা দেখেনি। ও জানতো না গোয়েন্দারা অসাধারন মেধাবী হয়ে থাকে। ও অবাক হয়ে গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামান্য কয়েকটা প্রশ্ন করেই গোয়েন্দা লোকটি যুবককে চিনে নিয়েছে। বুঝেছে এ যুবক যথেষ্ট হুশিয়ার, বিশস্ত এবং আবেগপ্রবণ।
‘শোন ওসমান তোমার মত আরো কয়েকজন যুবক ও যুবতী যোগাড় করো। তাদের মন-মানসিকতাও তোমার মত হতে হবে। তাদেরকে তোমার মতই হতে হবে সাবধান ও বিশ্বস্ত। তাদের মানসিকতা তৈরী হয়ে গেলে শুরু হবে তোমাদের আসল কাজ। তোমাদেরকে প্রতিটি মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করতে হবে, সুলয়ান আয়ুবী বেচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। তোমরা আরো প্রচার করবে, ক্রাক থেকে মাত্র কয়েক মাত্র কয়েক ঘন্টার দুরত্বে অবস্থান করছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ক্রাক আক্রমনের জন্য মুসলিম বাহিনী শুধু প্রস্তুতই নয়, ওরা খৃষ্টান বাহিনীর আহার নিদ্রা হারাম করে রেখেছে। কায়রোর পরিস্থিতিও এখন পুরপুরি শান্ত। ওখান থেকে সকল ষড়যন্ত্রের মূল উপড়ে ফেলা হয়েছে।’
ওসমানের বুকের ধুপধুপানি বেড়ে গেল। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বললো, ‘আপনি ঠিক বলছেন?’
‘ওসমান, তোমার আর আমার স্বপ্ন এক। আমি যে স্বপ্নের বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবে কাজ করছি আর তুমি আবেগে ভেষে বেড়াচ্ছ। এখন আর এভাবে ভেসে বেড়ালে চলবে না। আজ থেকে তুমি ভাববে, তুমিও আইয়ুবীর একজন সৈনিক। শোন আমি যা বলছি তা ঠিকই বলছি।’
‘আপনি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে দেখেছেন?
‘হ্যাঁ যুবক উনি আমাকে এখেনে পাঠিয়েছেন। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, উনি সুস্থ আছেন এই খবর এখানকার জনগনকে জানিয়ে দেয়া। তোমাকে দিয়েই এই কাজ শুরু হলো।’
‘সুলতান কখন আক্রমন করবেন? আমর তার পথ চেয়ে বসে আছি। আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তিনি বাইরে থেকে আক্রমন করলে আমরা ভেতর থেকে খৃষ্টানদের উপর ঝাপিয়ে পড়বো। আল্লাহর দোহাই লাগে, তাকে তাড়াতাড়ি আক্রমন করতে বলুন।’
‘বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে হবে যুবক। প্রথমে শোন সুলতান আইয়ুবী কি বলেছেন। এরপত প্রতিটি যুবকের হৃদয়ে তা গেঁথে দাও। সুলতান বলেছেন, ক্রাকের মুসলিম যুবকদের বলে দাও তোমরাই ইসলামের রক্ষক। আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষা করতে হলে তোমাদের জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। তুমি তাদেরকে আমার জীবনের কাহিনী শুনাবে।’
তিনি তার জীবন কাহিনী বলতে গিয়ে আরো বলেছেন, আমি প্রথম যুদ্ধ করেছি শৈশবে। একটি দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। নেতৃত্বে ছিলেন আমার চাচা। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন ‘ভয় পেয়ো না। এখন ভয় পেলে ভয়ে ভয়ে কেটে যাবে সারাটা জীবন। ইসলামের পতাকাবাহী হতে চাইলে এখনি পতাকা তুলে নাও। বেরিয়ে যাও দুশমনের ব্যুহ ভেদ করতে। আবার ফিরে এসো। ঝাঁপিয়ে পড় শত্রুর উপর।’
সেদিন আমি ভয় পাইনি। তিনমাস অবরুদ্ধ ছিলাম। না খেয়ে থেকেছি। শেষ পর্যন্ত শত্রুর অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলাম। অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা প্রথমে খেয়েছি শত্রুর থেকে ছিনিয়ে নেয়া খাবার। দানা পানির অভাবে আমাদের যে সব ঘোড়া মরে গিয়েছিল তা পুরন করেছি শত্রুর ঘোড়া দিয়ে।
সুলতান আরো বলেছেন, আমার জাতির সন্তানদের বলবে, শত্রু আমাদের ভালবাসার অস্ত্র দিয়ে আক্রমন করেছে। যদিও এটা মোটেও ভালবাসা নয় বরং ভালবাসার নামে প্রতারনার ফাঁদ মাত্র।
ওরা জানে না ভালবাসা কি জিনিস, শুধু জানে ভালবাসার মিথ্যা অভিনয় করতে। মনে রেখ, কোন অমুসলিম মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না।
খ্রীস্ট্রান শক্তি যুদ্ধের ময়দানে টিকতে পারেনি। ওদের সব পরিকল্পনা আমরা ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। ওরা এখন মুসলমান জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের হৃদয় থেকে বের করে দিতে চাইছে ইসলামী জাতীয়তাবোধ।
সারা দুনিয়ার মুসলমান এক জাতি। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। শত্রুরা এ ভ্রাত্বের বন্ধন ছিন্ন করার উস্কানী দিচ্ছে।
ওরা ধর্মের প্রতি প্রীতি ও ভালবাসার পরিবর্তে আমাদের কিশোর ও যুবকদের হৃদয়ে সৃষ্টি করতে চাচ্ছে পুঞ্জীভুত ঘৃনার পাহাড়। এ জন্য ওরা ব্যবহার করছে নানা রকম বিপজ্জনক অস্ত্র। ইসলামের কথা যারা বলে, ইসলামের পথে যারা চলে, তাদের নানা অপবাদ দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে গালি দেয়া হচ্ছে মোল্লা, গোঁড়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এসব বলে। এভাবে আগামী প্রজন্মের মন বিষিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের ওপর।
মুসলিম যুবকদের বলবে, দুশমন আমাদের ওপর সর্বপ্লাবী হামলা শুরু করে দিয়েছে। সম্মুখ সমরের পাশাপাশি মানসিক চোরাগুপ্তা হামলা করছে। এর জন্য ব্যবহার করছে ভয়ংকর সব অস্ত্র। এ সব অস্ত্রের নাম হলো সম্পদের প্রতি মোহ, বিলাসিতা, আলস্য এবং দায়িত্বহীনতা।
এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য খ্রীস্টান এবং ইহুদী শক্তি সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। ইহুদীরা নিজেদের যুবতী মেয়েদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে তোমাদের পেছনে। তারা তোমাদের পাশবিক শক্তিকে উসকে দিচ্ছে।
ওরা আমাদের যুবকদের হাতে তুলে দিচ্ছে নানা রকম নেশার দ্রব্য। সৃষ্টি করছে মাদকাশক্তি। কোন জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য এ দুটো অভ্যাসই যথেষ্ট।
তুমি যুবকদের বলবে, পাপী মানুষের পরকালের জন্য নির্ধারিত রয়েছে নরকের কঠিন যন্ত্রণা। তুমি এ দুটো অভ্যাস পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য নরক যন্ত্রণা নিয়ে আসবে। তোমরা যাকে আজ স্বর্গের আনন্দ ভাবছো, দু’দিন বাদে দেখবে তা আসলে জাহান্নামের শাস্তি।
এখনি সচেতন না হলে একদিন তোমরা হবে খ্রীস্টানদের গোলাম। ওরা তোমাদের বোনদের আব্রু নষ্ট করবে। শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকবে কোরানের ছেঁড়া পাতা, মসজিদ হবে ঘোড়ার আস্তাবল। চোখের সামনে তোমাদের বাড়িঘর জ্বলবে দাউ দাউ করে।
সুলতান আরো বলেছেন, মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইলে নিজের ঐতিহ্য কখনো ভুলে যেয়ো না। দুশমন একদিকে তোমাদেরকে উত্যক্ত করছে, অন্যদিকে সম্পদ আর নারীদের লোভ দেখাচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, মুসলমান কোন বিলাসপ্রিয় জাতি নয়। মুসলমান সম্পদের দাস হয় না, বরং সম্পদকেই তারা দাসে পরিনত করে। প্রয়োজন হলে খেজুর পাতার চাটাইতে বসে আমরা পৃথিবী শাসন করতে পারি।
রোম ও পারস্যের সম্রাটদের সুবিশাল প্রাসাদ আর অতুলনীয় শানশওকত ও তৈজসপত্রের চেয়ে আমাদের কাছে বেশী প্রিয় তেজী ঘোড়া আর জংহীন তলোয়ার। আমাদের মূলধন কোরআন আর হাদীস, আমাদের আসল সম্পদ ঈমান আর আমল। সহায় আমাদের আল্লাহ। বিশ্বাস ও কর্মের দৃঢ়তাই আমাদের রক্ষাকবচ।
তুমি ওদেরকে বলবে, বিলাসদ্রব্য, সম্পদ আর নারী দেহের লোভ দেখিয়ে ওরা তোমাদেরকে গোলামীর শিকলে বাঁধতে চাইছে। তলোয়ারকে ভয় পেয়েই এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে ওরা।
হে আমার জাতির সন্তানেরা, নিজের হাতে নিজের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ো না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাও।
মনে রেখো, অত্যাচারী শাসক সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকে। প্রতিপক্ষকে জুলুম অথবা অর্থ দিয়ে পরাভূত করতে চায়। অত্যাচারকে ভয় পেয়ো না। পা দিও না লোভের ফাঁদে।
তোমরাই জাতির ভবিষ্যত। আমরা অতীত হয়ে গেছি। জাতির অস্তিত্ব এখন নির্ভর করছে তোমাদের হাতে। তোমরা সচেতন হলে জাতি বাঁচবে, তোমরা ঘুমিয়ে থাকলে জাতি মারা যাবে।
শত্রু তোমাদের মন-মানসিকতার সোনালী ঐতিহ্য অপবিত্র চিন্তা ধারার কালো নেকাবে ঢেকে দিতে চায়। ওরা চায় পৃথিবরীর বুক থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। এর মোকাবেলায় চাই অফুরন্ত সাহস আর হিম্মত।
তোমরা যদি সাহসের সাথে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে পারো বুকের ভেতর, আর প্রতিটি মুহুর্ত সে স্বপ্নকে বুকে নিয়ে নির্ভয়ে পথ চলতে পারো, দেখবে, প্রতিটি সূর্যোদয় তোমাদের জন্য সফল ও বিজয়ের বার্তা বয়ে আনবে।
তোমাদেরকে ভয় পায় বলেই এ কুটিল পথ বেছে নিয়েছে ওরা। শুরু করেছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। মুমীন ঈমান বিকিয়ে দেয় না বলেই তো অস্ত্রের লড়াইতে নামতে হয় ওদের। কিন্তু যদি তোমাদের ঈমানী চেতনা নষ্ট করা যায় তবে আর অস্ত্রের লড়াইকে প্রয়োজন কি?
মনে রেখো, যে হৃদয়ে ঈমানের আগুন নেই সে দেহে ওদের আঘাত করারও প্রয়োজন নেই। কারণ, কোন দেহ কাঠামোর সাথে ওদের কোন বিরোধ নাই, ওদের বিরোধ তো বিশ্বাসের সাথে, ঈমানের সাথে, তাওহীদের সাথে।
তোমাদের হিরন্ময় বিশ্বাস ও চেতনার বিনাশ সাধনই ওদের একমাত্র টার্গেট। সে টার্গেটে পৌঁছার জন্যই ওদের এতসব সাংস্কৃতিক হামলা।
দুঃখের বিষয়, প্রাণে না মেরেও যে আমাদের হত্যা করা যায় এ কথা ওরা বুঝলেও আমরা সহজে বুঝতে চাই না। তাই মুসলমানদের মত জীবন যাপন না করেও আমরা মুসলমান বলে দাবী করতে পারি নিজেদেরকে।
হে যুবক বন্ধুরা, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, ভবিষ্যতে ওদের প্রতিটি কাজের ওপর নিবদ্ধ রেখো তোমাদের সজাগ দৃষ্টি। তাহলেই দেখতে পাবে ওদের প্রতিটি কাজের পেছনে এক অন্তর্গুঢ় লক্ষ্য রয়েছে। আর সে লক্ষ্যটি হচ্ছে তোমাদের ইসলামী চেতনার বিনাশ সাধন করা, ধর্মীয় ভাবধারার প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। তোমরা যে মিশনারী জাতি, তোমাদের ওপর যে খেলাফতের কঠিন দায়িত্ব রয়েছে সে কথা তোমাদের ভুলিয়ে দেয়।
বেঈমানরা তোমাদেরকে কি অবস্থায় নিয়ে এসেছে তা তো আজ নিজেরাই দেখতে পাচ্ছো। হে আমার যুবক বন্ধুরা, তোমরা মানসিকভাবে ওদের গোলামীর নিগড়ে একবার বন্দী হলে সমগ্র মুসলিম জাতিরও একই পরিণতি হবে। কারণ, মুসলিম উম্মাহ আর কিছুই নয়, সে তো তোমাদের সমষ্টি মাত্র।
সময়ের এক চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আজ তাই তোমাদের কাছেই আমি আকুল আহবান জানাচ্ছি, এসো, সংকীর্ণতা পরিহার করো। ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে বাঁচানোর কোন চিন্তা মনেও এনো না, সেটা হবে আত্মহত্যার শামিল। জোট বাঁধো, ঐক্যবদ্ধ হও, এক হয়ে রুখে দাঁড়াও শত্রুর বিরুদ্ধে।’
সুলতানের বাণী শোনানোর পর মুসলিম গোয়েন্দাটি এবার ওসমান সালেমকে তার কাজ ও কর্মপদ্ধতি কি হবে সে বিষয়ে বলতে লাগল।
‘আমাদের প্রধান সেনাপতি বলেছেন, আবেগ তাড়িত হয়ে কোন কাজ করো না। কেবল আবেগ দিয়ে সময়ের গতিকে রোধ করা যায় না। সব সময় খেয়াল রাখবে, আবেগ যেন দূরদর্শীতার উপর বিজয়ী না হয়।
কখনো উত্তেজিত হবে না। সংযম এবং সতর্কতার সাথে কাজ করবে। এই সংযম ও সতর্কতাই বিজয়ের চাবিকাঠি।
আমার আরও দু’জন সংগী বিভিন্ন রূপ নিয়ে তোমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে।
এবার শোন তোমার কাজ কি হবে। এ মুহুর্ত থেকে বিশ্বস্ত মুসলমানদের বাড়ীতে গোপনে তীর, ধনুক এবং বর্শা তৈরী করে লুকিয়ে রাখবে।
যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর সবাইকে অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে হবে। তবে সাবধান, এ কাজ করতে হবে গোপনে। শত্রুরা যেন কোন মতেই তোমাদের প্রস্তুতির টের না পায়।
ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে নারীদেরকেও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেবে। জেহাদ কেবল পুরুষের জন্যই নয়, নারী পুরুষ সবার জন্য ফরজ।
ইহুদী মেয়েদের কথা যেন কেউ কানে না তোলে। তাদের কোনো কথা বিশ্বাস করবে না। ওরা মুসলমানদের মনোবল নষ্ট করার জন্য এবং জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য নানা কৌশলে নানা কথা প্রচার করবে।
সন্দেহ করতে পারে এমন কোন কথা ওদের সাথে বলবে না। কারও সাথে ঝগড়াঝাটি করবে না। ফালতু ঝগড়ায় জড়িয়ে নিজেদের শক্তি ও সময় অপচয় করবে না।
প্রথমে সংগঠিত হয়ে একজনকে নেতা নির্বাচন করে নিও। প্রত্যেকের তৎপরতা নেতার নজরে থাকবে। তার অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো পদক্ষেপ নেবে না। নেতা বানাবে এমন একজনকে, যে পরহেজগার, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী, নির্লোভ আর বিচক্ষণ।
শত্রুর গতিবিধির ওপর ভালভাবে লক্ষ্য রাখবে। তুমি কি করছো সেটা বড় কথা নয়, শত্রু কি করছে সেটাই বড় কথা। কারণ শত্রুর ক্ষমতা ও শক্তি খর্ব করার ওপর নির্ভর করছে তোমার বিজয়।
প্রতিপক্ষ আগামীকাল কি পদক্ষেপ নেবে তা যদি তুমি আজ জানতে না পারো তবে তার আগামীকালের অগ্রযাত্রাকে কিছুতেই তুমি প্রতিহত করতে পারবে না। ফলে নিজে কি করছো তা যেমন তোমানের নখদর্পনে থাকবে ঠিক একই ভাবে শত্রুর প্রতিটি পদক্ষেপও তোমাদের নখদর্পনে থাকতে হবে।’
সূর্য ডুবো ডুবো। মসজিদের পেশ ইমাম এলেন। তাকে দেখে ক্রুশ হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল পাগলা। মসজিদের ভেতর তার কণ্ঠ ভেসে এল, ‘মুসলমান! ক্রুশের আশ্রয়ে এসো। তোমাদের ইসলাম মরে গেছে।’
ওসমানের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন বৃদ্ধ ইমাম।
‘এখানে কি করছিলে?’ ঝাঁঝের সাথে ওসমানকে প্রশ্ন করলেন ইমাম।
‘ওকে ভেতরে বসিয়ে রেখেছিলে কেন? কেন তাকে শেষ করে দাওনি? তোমার দেহে কি মুসলিম পিতার রক্ত নেই? আমি বৃদ্ধ না হলে ওকে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে দিতাম না।’
‘ওকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই আমি ওর পিছু নিয়েছিলাম।’
ইমামকে খঞ্জর দেখিয়ে বললো ওসমান। ‘আল্লাহর শোকর, ও আমার আঘাত ক্রুশ দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। লোকটা পাগল নয়। ইহুদী বা খ্রীষ্টানও নয়। ও মুসলমান। সুলতান আয়ুবীর বাণী নিয়ে এসেছে।’
ইমামকে সুলতানের পয়গাম শুনিয়ে ওসমান বললো, ‘আমি এর বাস্তবায়ন করবো। আজ সন্ধ্যা থেকেই নেমে পড়বো কাজে।’
একটু ভেবে নিয়ে ওসমান আবার বললো, ‘কিন্তু আমাদের একজন নেতা প্রয়োজন। আপনি কি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন? ভেবে দেখুন! সরকার জানতে পারলে প্রথমেই নেতার মস্তক উড়িয়ে দেবে।’
‘আমি এ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব মসজিদে দাঁড়িয়ে এমন কথা কি বলতে পারি? তবে আমি নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য কি না সে ফয়সালা করবে জাতি।’
‘আমি মসজিদের এ পবিত্র অংগনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আমার জীবন, সন্তান-সন্ততি এবং ধন-সম্পদ ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে দেবো।’
সামান্য বিরতি নিয়ে তিনি আবেগের সাথে বললেন, ‘প্রিয় সন্তান, সালাহউদ্দীন আয়ুবীর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কথা গভীরভাবে মনে গেঁথে নাও। তিনি ঠিকই বলেছেন, যুবকরাই হচ্ছে দ্বীন এবং জাতির ভবিষ্যত রক্ষক। ইচ্ছে করলে এর আশার আলো জ্বালাতে পারে আবার ইচ্ছে করলে সমাজকে আঁধারেও ঢেকে দিতে পারে।’
তিনি আরো বললেন, ‘কোন মুসলমান যুবক যখন কোনো ইহুদী বা খ্রীষ্টান যুবতীর দিকে তাকিয়ে থাকে তখন সে এ কথা ভাবে না যে, তার বোনও অন্যের কুদৃষ্টির শিকার হতে পারে।
প্রিয় যুবক! খোদার এই ঘরে দাঁড়িয়ে আজ এই মুহুর্ত থেকে প্রতিজ্ঞা করো, সালাহউদ্দীনের পয়গাম কার্যকরী করার জন্য জীবনপণ চেষ্টা করবে।’
নামাজ শেষে বাড়ী ফিরে গেল ওসমান। বাড়ী গিয়েই ছোট বোন আল নূরকে নিরালায় ডেকে নিল। তাকে শোনাল সুলতান আয়ুবীর বাণী।
বলল, ‘বোন! আমাদের দ্বীন এবং জাতি তোমার কাছে অনেক বড় ত্যাগের প্রত্যাশী। তুমি অন্তপুরবাসী নারী –আজ থেকে এ চিন্তা ছেড়ে দাও। মুসলিম নারীদের জেহাদের জন্য প্রস্তুত কর।’
ওসমান তাকে আরো বলল, ‘আমি তোমাকে খঞ্জর এবং তীর, ধনুক ও তলোয়ারের ব্যবহার শিখাবো। তবে কাজ করতে হবে খুব সাবধানে, কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে আমরা কি করছি।’
আল নূর আবেগে ওসমানের হাত চেপে ধরল।
‘আমি যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ভাইয়া।
আমার বান্ধবীরাও দেশ এবং জাতির জন্য কি করা যায় সে ভাবনায় বেশ কিছুদিন যাবত অস্থির। আমরা তো এতকাল পুরুষের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, এবার ভাবছিলাম আমরাও কিছু করতে পারি কি না।’
ওসমান বললো, ‘সুলতান এবং মুসলিম বাহিনীর ব্যাপারে এতদিন আমরা যা শুনেছি সব মিথ্যা, সব গুজব। প্রতিটি মুসলমানের বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাদের কানে সঠিক খবর পৌঁছে দিতে হবে। তবে মনে রেখো, মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট গাদ্দার এবং খ্রীষ্টানদের গোয়েন্দাও রয়েছে।’
কয়েকটা বাড়ীর উল্লেখ করে ওসমান বললো, ‘আগে এসব বাড়ীর মেয়েদের হাত করে নাও। এরপর সতর্কতার সাথে তাদেরকে বলো, তোমাদের পুরুষগুলি জাতির সাথে গাদ্দারী করছে। ওদের বলো, খ্রীষ্টান এবং ইহুদী মেয়েদের ভালবাসার অভিনয় নিরেট প্রতারণা মাত্র। এ হচ্ছে আমাদের জাতির বিরুদ্ধে এক ধরনের ফাঁদ।’
‘রিনিকে এখানে আসতে বারন করবো? তোমার সাথেও তো ওর সম্পর্ক রয়েছে।’ বলল আল নুর।
‘ওকে যা বলার আমিই বলবো। তুমি কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলবে, শেষে আবার ঝামেলায় পড়ে যাই।’
‘ঠিকই বলেছেন, ও ভীষণ বুদ্ধিমতি এবং সতর্ক।’
‘ওকে কিছু বলার দরকার নাই, যা বলার আমি নিজেই বলবো।’
ওসমান নিজের ঘর থেকে কাজ শুরু করে দিল।
রিনি একজন খ্রীষ্টান যুবতী। সুন্দরী। ওসমানদের বাড়ীর অল্প দূরে ওদের বাড়ী। রিনির পিতা বর্তমানে এখানকার পুলিশ প্রধান। ওর পুরো নাম রিনি আলেকজেন্ডার। রিনি আল নুরের বন্ধু। কিন্তু ওসমানকে দেখলে ওর চোখে মুখে আনন্দের দ্যুতি হেসে উঠতো। ওসমান এড়িয়ে চলতো তাকে। তার ধারনা খৃস্ট্রান মেয়েটা এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে আসে। তবে ও যেন ওসমানকে সন্দেহ না করে করে এ জন্য কখনও কখনও তার সাথে হাসি ঠাট্টাও করতো।
ওসমান ভাবলো, এখন রিনিকে এ বাড়ীতে আসতে নিষেধ করা উচিত। ছোট বোনকে সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে, রিনিকে তা জানানো যাবে না।
রিনিকে কিভাবে এ বাড়ীতে আসতে নিষেধ করবে এ নিয়ে ওসমান সারাদিন ভাবল। গভীর ভাবনা চিন্তার পর একটা বুদ্ধি এল তার মাথায়।
পরদিন ওসমান আল নূরকে ডেকে বললো, ‘রিনি যখন আমাদের বাড়ীতে আসে তখন তুমি তাকে কোন ছুতো দেখিয়ে বাইরে নিয়ে যেও। এভাবে কয়েকদিন এড়িয়ে চললে দেখবে একদিন ও নিজে থেকেই এখানে আসা বন্ধ করে দেবে।’
পাগলের কথা এলাকার লোকের মুখে মুখে। পাগলের মুখে মুসলমানদের ধ্বংসের ভবিষ্যত বানী শুনে সবাই খুশী। তাকে খুঁজছে সবাই। সরকারীভাবেও তাকে খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও নেই সে।
সরকার মুসলমানদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে পাগলটাকে ব্যবহার করতে চাইছিলো। তাই সরকার তাকে ধরার জন্য গোয়েন্দা লাগালো।
শহরের কোথাও তাকে না পেয়ে তাকে ধরার জন্য শেষ পর্যন্ত শহরের বাইরেও ঘোড়সওয়ার পাঠানো হল। দশ-বার দিন খোঁজাখুজির পরও লোকটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। যেন বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেছে।
আজ পনের দিন ধরে ওসমান আল নূর এবং নূরের বান্ধবীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষন দিচ্ছে। আল নূর সুলতান আইয়ুবীর বানী শুনিয়ে তার বান্ধবীদের অনেককেই ইতিমধ্যে দলে টেনে এনেছে। তাদেরকে তীর ও তরবারী চালনা শিখাতে ওসমানের যথেষ্ট কষ্ট হল।
মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই অস্ত্রের কারিগর ছিল। ওসমান এবং তার বন্ধুরা অস্ত্র তৈরীর এ সব কারিগরদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করলো। এসব কারিগররা সবাই খ্রীষ্টানদের চাকরী করতো। তবে এই সব কারিগরদের নিজেদের জন্য কোন অস্ত্র তৈরীর অনুমতি ছিল না।
প্রচলিত আইনে মুসলমানদের জন্য অস্ত্র বহন এবং বাড়ীতে অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ ছিল। ওসমান ও তার বন্ধুরা এসব কারিগরদের গোপনে তীর, ধনুক এবং বর্শা তৈরী করে দেয়ার অনুরোধ করল।
ওসমান কারিগরদেরর বললো, ‘ এসব অস্ত্র ছাড়া নিজেদের জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার আর কোন পথ নেই। জাতির এ দুর্দিনে আমরা আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতা চাই। অবশ্যই আমরা এর বিনিময়ে আপনাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়ার চেষ্টা করব।’
কারিগরদের মনে নতুন করা আশার সঞ্চার হলো, তাদের অনেকেই বিনা পারিশ্রমে সানন্দে তাদেরকে অস্ত্র তৈরি করে দিতে রাজি হয়ে গেল। যদিও তারা জানতো, এ কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ন। ধরা পড়লে নিজেদের জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়বে।
যুবকদের কাছ থেকে অর্ডার পেয়ে এসব কারিগররা নিজেদের বাড়িতে গোপনে অস্ত্র তৈরী করতে লেগে গেল।
সময়টা ছিল মুসলমানদের জন্য খুবই খারাপ। কারো উপর সরকারের সন্দেহ হলে তার বিপদের অন্ত থাকতো না। সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করে তাদেরকে ব্যপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হত। প্রশ্ন করা হত মুসলমানদের ঘরে কি হচ্ছে। কোথায় কোথায় গোয়েন্দা রয়েছে ইত্যাদি। এরপর শুরু হত দৈহিক নির্যাতন।
কারিগররা এ জন্য সীমাতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করছিল। এসব কারিগররা বলতে গেলে গরীব। কিন্তু শুধু অর্থের জন্য তারা এমন বিপদজনক কাজ করতো কিনা সন্দেহ। কিন্তু যখন তাদের সামনে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলে ধরা হলো তখন তারা একে নিজেদের ইমানী দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করলো।
ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও তাই তারা নানা বিপদ মাথায় নিয়ে গোপনে মুসলমানদের জন্য অস্ত্র বানানোর কাজ কোন রকমে চালিয়ে যাচ্ছিল।
মুসলমান কারিগরদের বানানো এসব অস্ত্র রাতের মধ্যেই ওসমানরা বিভিন্ন বাড়ীতে লুকিয়ে ফেলতো। দিনে বেলা মেয়েরা বোরকার নিচে খঞ্জর বহন করে পৌঁছে দিত নিজ গন্তব্যে। কিন্তু অস্ত্র তৈরী এবং লুকানোর এ কাজ চলছিল অত্যন্ত ধীরে।
এভাবে ওসমানদের তৎপরতা এবং গোয়েন্দাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে গেল সুলতানের বানী। ওখানেও প্রস্তুতি শুরু হল।
সুলতানকে জানানো হল, মুসলিম গোয়েন্দা পাগলের ছদ্মদেশে ক্রাকের যুবকদের কাছে সুলতানের বানী পৌঁছে দিয়েছে।
সুলতান খুশি হলেন। বললেন, ‘যে জাতির যুবকেরা জেগে ওঠে তাদের কেউ পরাজিত করতে পারে না।’
‘এ সাফল্য আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে মাননীয় সুলতান।’ বললেন, সহকারী গোয়েন্দা প্রধান জাহেদীদ। ‘আপনার অনুমতি পেলে অধিকৃত অঞ্চলের যুবকদের উত্তেজিত করে ক্রাকে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারি।’
‘না।’ সুলতান বললেন, ‘দেখা যাবে এ আগুনে ওরা নিজেরাই পুড়ে মরছে। আমি চাই না যুব সমাজ আগুনে পুড়ে মরুক। তার পরিবর্তে ওদের হৃদয়ে আমি ইমানের আগুন জ্বালাতে চাই।
তিনি বললেন, ‘ যুবকদের উত্তেজিত করা সহজ। আবেগপুর্ন কথায় ওরা সহজের উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এটা তাদের বয়সের ধর্ম। আবার কেও ওদের হাতে কয়েকটা টাকা তুলে দিলে দেখবে ওরা তার হাতের পুতুল হয়ে নাচবে। চেষ্টা করলে ওদের নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করতে পারবে শত্রুরা।
তবে ভেব না এসব যুবক মুর্খ বা বুদ্ধিহীন। বরং ওদের বয়সটাই এমন যে সামান্যতেই ওদের রক্ত গরম হয়ে উঠে।
এরা সাধারনত চঞ্চল, উৎসাহী, কর্মতৎপর। শত্রুরা জানে, যুবকদের অস্থির মনকে যেদিকে ঘুরানো যায় ওরা সেদিকেই ছুটে চলে। এরা যেমন ভাল কাজ করতে পারে তেমনি খারাপ কাজও করতে পারে। শত্রুরা এই সু্যোগটাই গ্রহন করছে।
ওরা যুবকদের ইন্দ্রীয়পরায়ন করে তুলছে। বিলাসিতা ও পাশবিক সত্তাকে উস্কে দিচ্ছে ওরা। ওরা জানে, কাউকে একবার মানসিক লালসার গহীনে ডুবিয়ে দিতে পারলে তাকে আমরা আর শত্রুর বিরুদ্ধে জেহাদে ব্যবহার করতে পারবো না।
তুমি ওদেরকে উত্তেজিত নয় বরং শান্ত রাখার চেষ্টা করবে। মহানবী (স) এর কথাকি মনে নেই? তিনি বলেছেন, নিজেদের জানো এবং শত্রুকে চিনে নাও।
তুমি ওদের বর্তমান চিন্তাধারাকে বদলে দাও। তাদের মধ্যে জাতীয় অনুভুতি জাগিয়ে তোল। জাতির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করো। যুব সমাজ জাতির সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ। উত্তেজিত করে এ সম্পদকে নিঃশেষ করো না।
ওদের দ্বারা শত্রু নিধন কর- তবে তার আগে তাদের মধ্যে শত্রু মিত্র পার্থক্য করার যোগ্যতা সৃষ্টি কর।’
সালাউদ্দীন আইয়ুবী জাহেদীনকে আরো বললেন, ‘শোন জাহেদীন, তোমাকে একটা কথা বলা জরুরী মনে করছি। কোন মুসলমান আমাকে গালি দিলেই সে ইসলামের শত্রু হয়ে যায় না, গাদ্দারও হয়ে যায় না। বড়জোর সে আমার ব্যক্তিগত দুশমন হতে পারে।
তাকে শায়েস্তা করার দ্বায়িত্ব তোমার না। তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য দেশে আইন রয়েছে, আদালত রয়েছে।
কিন্তু আইনের আশ্রয় নিলেও আমি তাকে শাস্তি দেয়ার বিরোধী। কারন আইন- দেশ, জাতি এবং ইসলামকে রক্ষা করার জন্য তৈরী করা হয়েছে। নেতার ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য নয়।
যে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, যে শত্রুর হাত শক্তিশালী করে, গাদ্দার তো সে। নেতারা আসনে বসে কেউ অপরাধ করলে সেও গাদ্দারীর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।
তুমি সহকারী গোয়েন্দা প্রধান। কেবল জনগন নয়, নেতাদের ব্যাপারেও তোমার চোখ কান খোলা রাখতে হবে। এমনকি আমার গতিবিধিও তোমার দায়িত্বের বাইরে নয়।
শয়তানের সাথে আমার এমন কোন আপোষ-রফা হয়নি যে, সে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে না। আর আমি ফেরেস্তাও নই যে মানসিক দুর্বলতা থেকে আমি মুক্ত। তুমি আমার ব্যক্তিগত কর্মচারীও নও, তোমার দায়িত্ব জাতির স্বার্থ রক্ষা করা। এ স্বার্থ যার দ্বারাই বিঘ্নিত হবে তাকে পাকড়াও করার দায়িত্ব তোমার।’
জাহেদীন বললো, ‘আপনার কথা আমার মনে থাকবে সুলতান। এবার বলুন, ওখানে যে যুবক তৈরী হয়েছে ওদের আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো’?
‘ওদের উত্তেজিত করো না। ওদের ভেতর সঠিক চিন্তা করার যোগ্যতা সৃষ্টি করো। কি করতে হবে অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা সেটা নিজেরাই ঠিক করে নেবে। আবেগ দিয়ে কোন কিছু করা যাবে না।
ওখানে আরও বেশী করে গোয়েন্দা পাঠাও। দুশমন আমাদের নয়, আমাদের যুবকদের কর্মধারা নষ্ট করে দিতে চাইছে। ওরা জানে কোন জাতিকে পরাভুত করতে চাইলে সে জাতির যুব সমাজের মন-মানসিকতায় বিলাসিতা ঢুকিয়ে দিলে ওরা তখন যুদ্ধ আর কর্মের ময়দান থেকে নিজেরাই সরে দাঁড়াবে।
আরাম আয়েশ আর বিলাশদ্রব্য তাদেরকে জনগন থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। স্বার্থ চিন্তা তাদের সাধারন মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তারা তখন শুধু নিজেরা নয়, নিজেদের মেয়েগুলোকেও অন্যের হাতে তুলে দেবে প্রগতি আর সভ্যতার দোহাই দিয়ে।
তারা তখন কতটা খারাপ হতে পারে সে তুমি ভাবতেও পারবে না। তুমি যাকে ভাল মানুষ ও সম্মানিত মানুষ ব্যক্তি বলে সমীহ করবে, সে তাদের ততটুকু ভাল যে, সে মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ দেবে। তার নিজের স্বার্থ ও আনন্দের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হলে, সে মনে মনে পৃথিবীর সব মানুষ ভাল হয়ে যাক এটাও চাইতে পারে। কিন্তু নিজের স্বার্থে আঘাত না হলে তাও করবে কিনা সন্দেহ। নিজের চোখের সামনে ওরা তখন নিজের যুবতী বোনদের উলঙ্গ নাচিয়ে গর্ববোধ করবে।’
বলতে বলতে হঠাত সুলতান বলে উঠলেন, ‘ক্রাকের যেসব যুবক অস্ত্র তৈরী করছে তাদের কাছে বোমায় ব্যবহৃত তরল জ্বালানী পৌঁছে দিয়ে তার ব্যবহার শিখাতে বলেছিলাম, তা কি করা হয়েছে?’
‘জী সুলতান, এ তরল জ্বালানি তৈরীর পদ্ধতি ওদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। খবর পেয়েছি, ওখানকার মুসলমানগন এরই মধ্যে তা তৈরী করা শুরুও করে দিয়েছে।’
* * *
ক্র্যাকে হঠাৎ এমন একটি ঘটনা ঘটলো যাতে সেখানকার যুবকরা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। অবস্থা এমন নাজুক পর্যায়ে গিয়েছিল যে, যুব সমাজকে বাধ্য হয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হল।
খ্রীষ্টানরা তাদের অধিকৃত এলাকায় যে সব মুসলিম কাফেলা যাতায়াত করতো সে সব কাফেলা লুট করা শুরু করে দিয়েছিল। মুসলিম ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভ্রমনকারীদের নিয়ে তৈরি হত এ সব কাফেলা। সংখায় দেড় থেকে দুইশ হলেই রওয়ানা করে দিত এই সব কাফেলা। কাফেলায় থাকতো উট, ঘোড়া এবং ব্যবসার মালপত্র। দুই চারটে পরিবারও থাকতো কাফেলার সাথে। খ্রীষ্টানদের নির্যাতনের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মুসলমান প্রধান অঞ্চলে হিজরতের জন্যই এরা কাফেলায় শামিল হতো।
প্রতিটা কাফেলায় সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা থাকত। ফলে, সাধারন ডাকাত দল এসে কাফেলা লুট করার সাহস পেত না। খ্রিস্টানরা সেনাবাহিনীকে এসব কাফেলা লুন্ঠনের দায়িত্ব দিল। ফলে মুসলমানদের কোন কাফেলার কোন সন্ধান পেলেই খ্রিইস্টান সৈন্যরা বেদুইন ছদ্মবেশে লুটতরাজ করার জন্য কাফেলার উদ্দেশ্যে ছুটে যেত।
যেসব খ্রীষ্টান সম্রাটগণ ইতিহাসের পাতায় আজো হিরো সেজে বসে আছেন, এসব লুণ্ঠন ছিল তাদেরই পরিকল্পনার ফসল। লুটের মাল থেকে তারাও নিয়মিত ভাগ পেতো।
কিছু কিছু মুসলমান আমীর ওমরাও এসব অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। এরা ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম প্রদেশের শাসক। ওদের ছিল নিজস্ব সেনাবাহিনী।
লুণ্ঠিত কাফেলার কেউ এসে এ সব মুসলিম শাসকের কাছে অভিযোগ করলে তারা তা শুনেও না শোনার ভান করতো। কারণ লুণ্ঠনকারী খ্রীষ্টানদের পক্ষ থেকে ওদেরকে দেয়া হতো মদ, নারী ও স্বর্ণমুদ্রা।
ইচ্ছে করলে এসব শাসকরা খ্রীষ্টানদের লুটতরাজ বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে মোটেই আগ্রহ প্রকাশ করল না।
শাসকদের মনোভাব জানতো বলেই কখনও কখনও এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যের ভেতরে এসেও খ্রীষ্টান সন্যরা মুসলিম কাফেলার ওপর হামলা করতে দ্বিধা বোধ করতো না।
মুসলিম শাসকদের এ দুর্বলতার সু্যোগে খ্রীষ্টান সম্রাটগণ এবার মুসলিম রাজ্য সমূহের সীমান্ত হজম করতে শুরু করলো। কোন কোন মুসলিম শাসক এ অবস্থায় খ্রীষ্টানদের আনুগত্য স্বীকার করে তাদেরকে কর দেয়া শুরু করলো। এভাবেই ক্রমে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে আসতে লাগলো মুসলিম রাজ্যের সীমানা।
নূরুদ্দীন জংগী এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো খ্রীষ্টানদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। তাদের কাছে এসব মুসলিম শাসকরা ছিল খ্রীষ্টানদের চাইতেও বিপজ্জনক।
সুলতান আয়ুবীর কাছে লেখা এক চিঠিতে নূরুদ্দীন জংগী লিখলেন, ‘বিলাসিতা এব ভোগের জন্য এসব মুসলিম শাসকবর্গ ইসলামী রাজ্যগুলো খ্রীষ্টানদের কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছে।
খ্রীষ্টনরা ওদেরকে ধন-সম্পদ এবং অপহৃত মুসলিম যুবতী উপহার দিয়ে অন্ধ করে ফেলেছে। এদের হাতেই এখন বেশী করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান পবিত্র ইসলাম। এরা কাফের বেঈমানদের চাইতেও ইসলামের জন্য বেশী বিপজ্জনক এবং অপবিত্র।
ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে এরা। এ সু্যোগে খ্রীষ্টান শক্তি ইসলামের মূল উৎপাটনের তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।
খ্রীষ্টানদেরকে পরাজিত করার পূর্বে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো মুসলিম বিশ্বের সাথে একীভূত করা প্রয়োজন। কারণ, এদের হাতে মুসলমানদের জীবন ও সহায় সম্পদ খ্রীষ্টানদের মতই সমান নিরাপত্তাহীন। এ ছাড়া দ্বীন ও ঈমানকে টিকিয়ে রাখার অন্য কোন পথ নেই।’
এ কারণেই খ্রীষ্টানদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার পরও দেখা যেতো, খ্রীষ্টান অধ্যুষিত এবং খ্রীষ্টান প্রভাবিত কাফেলা নিরাপদ এলাকাগুলো থেকে বিরাট বিরাট মুসলিম কাফেলা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নিয়মিত মরুভূমির বিশাল পথ অতিক্রম করে চলেছে।
এমনি এক ক্রাকের কয়েক মাইল দূর দিয়ে যাচ্ছিল। যাত্রীদের সাথে ছিল অনেক ঘোড়া এবং ব্যবসায়িক মালপত্র। ছিল কয়েকটি পরিবার। শিশু-কিশোর ছাড়াও কাফেলার ছিল দু’জন যুবতী। যুবতীরা দুই আপন বোন।
পথ চলছে কাফেলা। খ্রীষ্টানরা খবর পেয়ে সৈন্যদের একটা দল পাঠিয়ে দিল। দলটি দিনে দুপুরেই কাফেলায় আক্রমণ করে বসল।
কাফেলার যাত্রীরা প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করল এ হামলা। আক্রমণের প্রথম ধাক্কা কেটে গেল দেখা গেল উভয় পক্ষেই বেশ হতাহত হয়েছে। সৈন্যরা এবার কাফেলাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল। কাফেলাও সংহত হয়ে আস্তে আস্তে পেছনে সরে যেতে লাগল।
নারী ও শিশুদের নিয়ে কয়েকজন পেছনের পাহাড়ের দিকে সরে গেল। বাকীরা লড়ে যেতে লাগল প্রাণপণে। কিন্তু সৈন্যরা ছিল সংখ্যায় বেশী এবং নিয়মিত যোদ্ধা। ফলে এসব সৈন্যদের সামনে বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না ওরা। মরুর বালুকা রাশি লাল হয়ে গেল যাত্রীদের তাজা রক্তে।
নারী ও শিশুদের নিয়ে যারা পাহাড়ের পাদদেশে জমা হয়েছিল ওদের দিকে এগিয়ে গেল সৈন্যরা। ওরা ততোক্ষণে পাহাড়ের ওপর গিয়ে বিভিন্ন পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। ঘাতকরা তীরের আওতায় আসতেই ওরা তীর ছুড়তে শুরু করল। সামনের সারির বেশ কয়েকজন তীরের আঘাতে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল সৈন্যরা। সামান্য পেছনে সরে চলে এল নিরাপদ দূরত্বে। সৈন্যদের একদল চলে গেল পাহাড়ের উল্টো দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পিছন থেকে হামলা করে বসল লুকিয়ে পড়া যাত্রীদের ওপর।
সাথে সাথেই সামনে থেকে ছুটে এলো সৈন্যদের মূল বাহিনী। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইতি ঘটলো লড়াইয়ের। ঘাতকদের তরবারী থেকে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রক্ষা পেল না। কাফেলার দু’শ জন যাত্রীর অধিকাংশই নিহত হলো।
লড়াই শেষে দেখা গেল পনেরজন আহত যুবক এবং দু’জন যুবতী ছাড়া কেউ বেঁচে নেই।
এদের বন্দী করে মাল সামান নিয়ে ডাকাত দল ক্রাকের পথ ধরল। ডাকাত দল যখন ক্রাকে প্রবেশ করছিল সামনে ছিল বন্দীরা। দুটো ঘোড়ার পিঠে বসে ছিল যুবতী দু’জন।
ক্রাকের জনসাধারণ তাকিয়ে দেখল কাফেলাকে। যুবতী দুজনের পোষাক আশাক মুসলমানদের মত। মেয়ে দুটোর পেছনে মুখোশ পরা খ্রীস্টান সৈন্যদের সশস্ত্র পাহারা। তাদের পেছনে লুণ্ঠিত মাল সামানাসহ উট এবং ঘোড়ার বিশাল সারি।
মেয়ে দু’জন কাঁদছিল। ক্রাকের লোকজন বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলো তামাশা দেখার জন্য। মুসলিম কাফেলা লুণ্ঠিত হয়েছে এ জন্য ওরা খুশী। হাততালি দিয়ে সবাই আনন্দ প্রকাশ করছে।
বন্দীদের মধ্যে এক যুবকের নাম ছিল আশফাক। মেয়ে দু’জন ওরই বোন। কপালে এবং কাঁধে আঘাতের চিহ্ন যুবকের। এখনও রক্ত ঝরছে আহত স্থান থেকে।
রাস্তার দুপাশে দর্শকদের দেখে আশফাক চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ডুবে মর তোমরা। এই অসহায় মেয়ে দু’জনকে দেখো। এরাও মানুষ। তোমরা মানুষ হলে ওরা একা আমার নয় তোমাদেরও বোন। যদিও ওরা মুসলমান।’
একজন খ্রীষ্টান সৈন্য পেছন থেকে তার ঘাড়ে ঘুসি মারল। উপুড় হয়ে পড়ে গেল আশফাক।
অন্য একজন বন্দী তাকে আবার তুলে নিল। আবার চিৎকার দিয়ে বললো ছেলেটা, ‘ক্রাকের মুসলমানেরা, এ দু’জন তোমাদের মেয়ে। ওরা এখন খ্রীষ্টান ডাকাতদের হাতে বন্দী। একটু পর হয়তো তাদের সতীত্ব লুণ্ঠন করা হবে। তাদের আর্ত চিৎকারে বিষাক্ত হয়ে যাবে ক্রাকের বাতাস। সে বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে তোমরা কতক্ষণ বাঁচতে পারবে আমার জানা নেই।’
দু’জন মুখোশধারী ডাকাত এগিয়ে এসে তাকে পিটাতে লাগল। তাই দেখে মেয়েরা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বলতে লাগল, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাদের ভাইকে মেরো না। আমাদের সাথে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করো, দয়া করে ওকে ছেড়ে দাও।’
এক বোন চিৎকার দিয়ে বললো, ‘আশফাক, চুপ করো। তুমি এদের কিছুই করতে পারবে না।’
মুসলিম দর্শকরা অনেক কষ্টে এ দৃশ্য হজম করছিল। ওদের বিবেক, ওদের আত্মমর্যাদা দৃষ্টির সামনে ধূলায় গড়াচ্ছে কিন্তু ওরা কিছুই করতে পারছে না।
যুবক দর্শকদের মধ্যে ওসমানও ছিল। সংগীতের দিকে তাকাল ও। সবার চোখে মুখে ক্রোধের আগুন। দ্রুত লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ড। যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।
ওদের পেছনে পেছনে কিছু দূর এগিয়ে গেল ওসমানরা। সামনে রাস্তার পাশে একজন মুচি জুতো সেলাই করছে।
ওসমান মুচির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জুতা খুলে বসে পড়ল তার সামনে।
মুচিও আশফাকের কথা শুনেছে এবং মেয়েদের দুর্দশা দেখেছে। কিন্তু বেচারা গরীব মুচির কিই বা করার আছে! একজন মুসলমান অনুগ্রহ করে তাকে বারান্দায় থাকতে দিয়েছে, এই তার চরম সৌভাগ্য।
তাকে কেউ কোনদিন মসজিদ, গীর্জা বা ইহুদীদের উপাসনালয়ে যেতে দেখেনি। জুতা মেরামতের দরকার হলেই লোকেরা তার দিকে তাকায়। তাকে কেউ কোনদিন কথা বলতে দেখেনি। মনে হয় সংসার বিবাগী একজন লোক খ্রীষ্টানদের সাথেও কোন সম্পর্ক নেই, মুসলমানদের ব্যাপারেও কোন আগ্রহ নেই।
বন্দীর দল চলে গেছে।
মুচি জুতা সেলাই করছে। মাথা তুলে একবারও ওসমানের দিকে তাকাচ্ছে না।
ওসমান এদিক ওদিক তাকিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, ‘এ দু’জন মেয়েকে আজ রাতে মুক্ত করতে হবে।’
‘জান এরা আজ রাতে কোথায় থাকবে?’ মাথা না তুলেই ফিসফিসিয়ে বললো মুচি।
‘জানি। ওরা আজ রাতে খ্রীষ্টান সম্রাটের কাছে থাকবে। কিন্তু আমি কখনও ভেতরে যাইনি। ভেতরটা দেখিওনি।’
‘আমি দেখেছি। ওখান থেকে মেয়েদের বের কের আনা সম্ভব নয়।’
‘তাহলে তুমি কোন কাজের কাজী?’
ওসমানের কন্ঠ ঝলকে উঠল আবেগ এবং ক্ষোভে।
‘আমাদের পথ দেখাও। মেয়েদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই হলো।
মুক্ত করার সু্যোগ না পেলে ওদের হত্যা করবো। তবুও বদমায়েশ রাজাদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না। আমাদের দুই অসহায় বোনকে।’
‘এ জন্য ক’জন যুবকের জীবন উৎসর্গ করতে পারবে?’
‘আপনি যা চাইবেন।’
‘ঠিক আছে, কাল রাতে দেখা যাবে।’
‘না আজ রাতে।’ ওসমানের দৃঢ় কণ্ঠ। ‘যা করার আজ রাতেই করতে হবে।’
‘ইমামের কাছে যাও।’
‘ক’জন যাবো?’
‘আটজন। অস্ত্র হবে খঞ্জর এবং কোমর ব্যবহৃত জ্বালানী।’
ওসমান জুতা পরে চলে গেল।
* * *
সূর্য এখনও ডুবেনি। সাতজন বন্ধুর সাথে দেখা করল ওসমান। ওদেরকে ইমাম সাহেবের কাছে যেতে বলে নিজেও মসজিদের দিকে পা বাড়াল।
পাগলের সাথে কথা বলার পর ওসমান ইমাম সাহেবকে নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেছিল। দলের সবাই কাজ করছিল তার নেতৃত্বে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাড়ীতে দলের গোপন বৈঠক চলত।
অপহৃত দু’জন যুবতীকে উদ্ধার করতে হবে, ওসমানের এ সিদ্ধান্ত ছিল আত্মহত্যার শামিল।
মুচির পরামর্শ অনুযায়ী ওসমান ইমাম সাহেবের বাড়ী চলে এল। তিনি অস্থিরভাবে বারান্দায় পায়চারী করছিলেন, থেমে গেলেন ওসমানকে দেখে।
‘ওসমান! বন্দী ছেলেটার চিৎকার তুমি শুনেছো? সম্ভবতঃ মেয়ে দু’জন ওর বোন।’
‘তার চিৎকারের জবাব দিতেই এখানে এসেছি সম্মানিত ইমাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সাতজন বন্ধুও এখানে পৌঁছে যাবে।’
‘কি করবে তোমরা? আর কিইবা করতে পারি।……. জানি, আমাদের অনেক মেয়েই ওদের কাছে রয়েছে। কিন্তু এ দু’টো মেয়ে আমাকে পরীক্ষায় ফেলে দিল।’
পায়চারী করতে করতে বললেন ইমাম।
মুখ উপরের দিকে তুলে ইমাম সাহেব বেদনা মাখা কণ্ঠে বললেন, ‘খোদা, শুধু একটি রাতের জন্য আমার যৌবন ফিরিয়ে দাও। এক রাত পর আমার জীবন ছিনিয়ে নিয়ো। যদি বেঁচে থাকি মৃত্যু পর্যন্ত মেয়ে দুটোর অসহায় বিলাপধ্বনি আমার কানে বাজবে। আমি পাগল হয়ে যাবো।’
‘আপনি আমাদেরকে পরামর্শ দিন। আশা করি আজকের এ রাতের পর আর আপনাকে মেয়েদের নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না।’
ওসমানের দু’জন সংগী ভেতরে ঢুকল। পাশাপাশি তিনজন বসলো ইমাম সাহেবের বিছানায়।
ইমাম সাহেব বললেন, ‘আজকে মনে হয় আমার বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলেছি। এতটা অধৈর্য্য হওয়া আমার সাজে না। কিন্তু কোন বিবেকবান মানুষ এ চিৎকার শুনে বসে থাকবে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতরের আবেগ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য যুবক হতে হয়। কিন্তু আমার সন্তানেরা! আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। সহ্য শক্তিও কমে গেছে। তোমরা যাই করতে চাও সাবধানে করো।’
একে একে সাতজন যুবক এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণ পরই এল মুচি।
মুচির মাথায় টুকরিতে পুরনো জুতা এবং জুতা মেরামতের যন্ত্রপাতি। টুকরিটা এক পাশে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই হেসে উঠলেন তিনি। এখন কে বলবে এই লোকটা সারাদিন কুঁজো হয়ে বসে পৃথিবীর সাথে সম্পর্কহীনভাবে বসে বসে জুতো সেলাই করে।
ইমাম সাহেব দরজা বন্ধ করে দিলেন।
বারজেস এখন আর মুচি নন, গোয়েন্দা সংস্থার একজ অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান গুপ্তচর।
বারজেস ইমাম সাহেবকে বললেন, ‘এ যুবকেরা আজই যে মেয়ে দুটোকে ছাড়িয়ে আনতে চাইছে, এ কাজে শুধু ধরা পড়ার ভয় নয়, নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে।’
‘আমরা জেনে বুঝেই মৃত্যুর এ ঝুঁকি নিচ্ছি সম্মানিত বারজেস।’ বললো এক যুবক। ‘আপনি এ পথের গুরু। আমাদের পথ দেখান।’
‘আমরা পরামর্শ চাইলে বলি, খ্রীষ্টানদের কাছে আমাদের অনেক মেয়ে রয়েছে। কাউকে এনেছে চুরি করে। কাউকে আবার কাফেলা থেকে লুট করেছে।
ওদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাবৃত্তিতে ব্যবহার করছে। কাউকে পাঠাচ্ছে তোমাদের চরিত্র নষ্ট করতে। প্রতিটি মেয়েকে তো তোমরা ছাড়িয়ে আনতে পারবে না।
যতি আমার অভিজ্ঞতা কাছে লাগাতে চাও তো বলবো, দু’টি মেয়ের জন্য আটজন যুবককে উৎসর্গ করা ঠিক হবে না। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে ধৈর্য ধারণ কর।’
‘এ অবস্থায় কি করে ধৈর্য ধরতে পারি?’ ঝাঁঝের সাথে বললো ওসমান।
‘আমার মত।’ বললেন বারজেস।
‘আমি কি সত্যি সত্যি মুচি? মিসরে আমার রয়েছে উৎকৃষ্ট আরবী ঘোড়া। রয়েছে নিজের বাড়ী, রয়েছে অনুগত চাকর-বাকর। একজন সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী ব্যক্তি হয়েও এখানে বসে সারাদিত আমি মানুষের ময়লা ছেড়া জুতা সেলাই করি।
তোমরা তোমাদের ঈমানী দাবী পুরণ করেছো দুটো মেয়ের মুক্তির জন্য নিজেদের জীবনকে পেশ করে। কিন্তু এ দু’জন মেয়েসহ অসংখ্য মেয়ের মুক্তি এবং ক্রাকসহ বিশাল এলাকা মুক্ত করার জন্য তোমাদের বেঁচে থাকা দরকার। এ জন্য ধৈর্যের সাথে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা উচিত তোমাদের।’
ইমাম সাহেব বললেন, ‘সম্মানিত বারজেস অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আমি মেয়েদের মুক্তি অবশ্যই চাই, তবে বারজেসের যুক্তিও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শের বাইরে আমাদের কিছু করা উচিত নয়।’
ওসমান এবং তার সঙ্গীদের সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গেল। বারজেস ও ইমাম সাহেবের কথা-বার্তা শুনেও তাদের মনে কোন প্রবোধ এলো না। ইমাম ও বারজেসের কথা ছাপিয়ে তাদের কানে বাজতে লাগল আশফাকের চিৎকার ও মেয়ে দুটোর করুণ চাহনি।
মেয়ে দুজনকে উদ্ধার করার অভিযান থেকে বিরত থাকার শত যুক্তি তাদের কাছে মেয়ে দুটোর চাহনির তুলনায় নিষ্প্রভ মনে হলো।
ওরা বলল, ‘মেয়েরা যেখানেই থাকুক, যে অবস্থায়ই থাকুক, আর তাদের উদ্ধার অভিযান চালাতে যত বড় ত্যাগই স্বীকার করতে হোক, আমরা সেখানে আক্রমণ করবোই।’
‘আপনাদের দেহের খুন বাসি হয়ে গেলেও আমাদের শিরায় তাজা খুনের অভাব নেই। আপনাদের খুনের দিকে তাকিয়ে নয়, সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের দিকে তাকিয়ে।’ বলল আরেক যুবক।
ওসমান বললো, ‘অপারেশনে আপনারা নন আমরা যাবো, আপনারা শুধু বলুন, কোন পথে গেলে আমরা বেশী সফলতার আশা করতে পারি।’
ইমাম সাহেব ও বারজেস তৎক্ষণাত কোন জবাব দিতে পারল না।
কক্ষে দশ জন প্রাণী, কেউ মুখ খুলছে না। গুমোট নীরবতায় ছেয়ে গেল কক্ষ। এ যেন বিস্ফোরণের পূর্ব মুহুর্ত। আটজন যুবকের চেহারায় আগুন ঝরা দৃঢ়তা। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ওরা।
অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভেংগে বারজেস বললেন, ‘খ্রীষ্টান রাজাদের পানশালায় আমাদের দু’জন গোয়েন্দা সাধারণ চাকরের কাজ করে। সুবাক বিজয়ের পর খ্রীষ্টানদের ছদ্মবেশে ওরা চলে এসেছিল। এখানে এসে পানশালায় চাকরি নিয়ে গুপ্তচরের কাজ করছে।
বৃটেন, ইটালী, ফ্রান্স, জার্মানী এবং অন্যান্য দেশের সম্রাটগণ যেখানে বসে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে তোমরা নিশ্চয়ই সে প্রাসাদ দেখেছে। সে প্রাসাদের বিশাল এক কক্ষ ওদের পানশালা।
রাতে সেখানে নৃত্য গীতের আসর বসে। আনন্দ স্ফুর্তি করার জন্য মেয়ে থাকে। মাঝ রাত পর্যন্ত মদ পান ও আনন্দ স্ফুর্তির জলসা চলে।
কক্ষটা উপর তলায়। ওখান থেকে সমগ্র শহর চোখে পড়ে।
কক্ষের চারপাশে কড়া সেনা প্রহরা। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সম্রাটরা ছাড়া অন্য কোন মহা সম্মানিত ব্যক্তিও সে কক্ষের কাছে যেতে পারে না।
মেয়ে দু’জন রাতে কোথায় থাকবে আমি এ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবো। কিন্তু ওরা সেখানে থাকলে সে পর্যন্ত যাওয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
‘সেখানে পৌঁছার কোনই উপায় কি নেই?’
‘না নাই। তবে বাইরে সেনাবাহিনী আক্রমণ করলেই কেবল ওখান পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
সেনাবাহিনী আক্রান্ত হলে সম্রাটগণ কক্ষের বাইরে চলে আসবে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। কক্ষেরপ্রহরীরাও হয়তো তখন সরে আসবে সেখান থেকে। কিন্তু আজ রাতে ক্রাকে কোন সেনা অভিযান হচ্ছে না। সুলতান আয়ুবী কবে নাগাদ ক্রাক আক্রমণ করবেন তাও বলা যায় না।’
‘বাইরের দিক থেকে শুধু আক্রমণ করা দরকার?’ জানতে চাইল ওসমান।
‘আপনি বলতে চাইছেন, আক্রান্ত হলে লোকজন মেয়েদেরকে রেখে ওখান থেকে চলে আসবে। এ সু্যোগে এ ছেলেরা মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে আসতে পারবে, এই তো?’ বারজেসের কাছে ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ। আমি তাই বলতে চাইছি।’
‘শহরে বড় কোন ঝামেলা বা আক্রমণ হলে অথবা যুদ্ধের রসদে আগুন লাগলেও কি সবাই ওখানে ছুটে আসবে?’
‘হ্যাঁ।’ জবাব দিলেন বারজেস।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন ইমাম সাহেব। ইসলামী ইতিহাসের একটি ঘটনা ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। একে একে বারজেস এবং আটজন যুবকের দিকে তাকালেন তিনি।
বললেন, ‘সম্মানিত বারজেস ও আমার মুজাহিদ বন্ধুরা! আমাদের সামনে আজ এক কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কি সে ব্যাপারে আপনারা নিজ নিজ মতামত পেশ করেছেন।
বারজেসের বক্তব্যে আছে বাস্তবতা ও যুক্তি, যুবক বন্ধুদের বক্তব্যে আবেগ। কিন্তু কোন সচেতন মুসলমান কেবল যুক্তি বা আবেগ দিয়ে এ ধরনের সমস্যার ফায়সালা করে না। তার সামনে থাকে কোরআন ও সুন্নাহ। কোরআন ও সুন্নাহর মূলনীতিই এ ক্ষেত্রে স্টান্ডার্ড হিসাবে আমাদের পথ দেখাতে পারে।
এ ধরনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ইসলামী রীতি কি হতে পারে তা বুঝার জন্য আমি আপনাদের সামনে ইসলামী ইতিহাসের একটি ঘটনা তুরে ধরতে চাই। হয়তো ঘটনাটি আপনাদের সবার জানা, তবু এর উল্লেখ করছি এ জন্য যে, আজকের উদ্ভুত সমস্যা সমাদানে এ ঘটনা হয়তো আমাদের নতুন করে দিকনির্দেশনা দিতে পারবে।
মদিনায় ইসলামের ছোট্ট রাষ্ট্রটির সবেমাত্র উদ্ভব ঘটেছে। অস্ত্রবল নেই, জনবল নেই। মক্কা থেকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় মুহাজিররা এসে আশ্রয় নিয়েছেন মদিনায়। তাঁদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতেই হিমশিম খাচ্ছেন মদিনার গুটিকয়েক আনসার। মহানবী (স) আর তাঁর নিবেতিপ্রাণ সেই মুষ্টিমেয় সাহাবীদের সামনে এখন বেঁচে থাকার কঠিন পরীক্ষা।
একদিন তাঁরা খবর পেলেন, সিরিয়ার দিক থেকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিপুল পরিমান মাল-সামানাসহ এগিয়ে আসছে একটি বাণিজ্য কাফেলা। এর পরপরই খবর এলা, উল্টো দিক থেকে অর্থাৎ মক্কা থেকে সশস্ত্র কাফেরদের এক বিশাল সেনাবাহিনী মদিনা আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে।
এ ধরনের নাজুক ও কঠিন পরিস্থিতিতে সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন মহানবী (স.) বললেন, ‘একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা, অন্যদিকে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসছে কুরাইশদের সৈন্যবাহিনী। আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন এর মধ্যে একটা তোমরা লাভ করবে। এখন তোমরাই বলো, কোনটার সাথে তোমরা মোকাবেলায় যেতে চাও?’
জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবী বাণিজ্য কাফেলার ওপর হামলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাদের এ ইচ্ছায় যথেষ্ট বাস্তবতা ছিল। কারণঃ
১.মুসলমানরা ছিল সহায় সম্বলহীন, দুর্বল এবং সংখ্যায় মাত্র তিনশ জনের মত।
২. যুদ্ধ করার মত কোন অস্ত্রপাতি এবং বাহন তাদের হাতে নেই। ঘোড়া মাত্র দু’তিনটি, উট সত্তরটি, ষাটটি বর্ম, ঢাল তলোয়ারের অবস্থাও তথৈবচ।
৩. যুদ্ধ শুরু হলে মদিনায় ইহুদীরা যে কোন ছুতায় কুরাইশদের সহযোগিতায় চলে যেতে পারে। কারণ, মদিয়ায় মুসলমানদের এ নব উত্থানকে তারাও খুব একটা ভাল চোখে দেখছে না।
৪. অপরদিকে কুরাইশ বাহিনীতে আছে আরবের নামকরা বীরেরা। মক্কার ঝানু ঝানু নেতা ও সমরবিশারদরা শামিল হয়েছে তাতে।
৫. মাত্র শ’তিনেক মুসলমানের মোকাবিলায় ওখানে সমবেত হয়েছে সহস্র যোদ্ধা। তারা প্রত্যেকেই তেজী, বাহন ও উৎকৃষ্ট অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত।
স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, এ অবস্তায় কুরাইশ বাহিনীর মোকাবিলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আর আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের মধ্যে কোন পার্থক্য করার উপায় নেই। কোন বিবেকবান সুস্থ মানুষই এধরনের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে না।
অন্যদিকে রয়েছে বাণিজ্য কাফেলা। মক্কার প্রায় সকল ব্যবসায়ীর মালামাল ছিল এ বাণিজ্য বহরে। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, পঞ্চাশ হাজার আশরাফীর পণ্যদ্রব্যে বোঝাই ছিল এ বিশাল কাফেলা। অথচ কাফেলার সাথে রক্ষী ছিল মাত্র ত্রিশ-চল্লিশজন। এ ধরনের একটা কাফেলা কব্জা করা মোটেই কঠিন কিছু ছিল না।
আর এ কাফেলা কব্জা করতে পারলে নিঃস্ব মুহাজিরদের অভাব ঘুচানো যাবে, আনসারদের দারিদ্র দূর করা সম্ভব হবে।
দারিদ্রের বদলে এ পরিমাণ অর্থ পেলে মদিনার প্রতিটি মুসলমান আরবের শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হয়ে যাবে। শিশু ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় অর্থের কোন অভাব থাকবে না, উন্নয়নের গতিধারা ত্বরান্বিত করা যাবে। দ্বীনের তাবলীগ ও মানুষকে আকৃষ্ট করার কাজে এ অর্থ প্রভূত কাজে লাগবে।
সবচেয়ে বড় কথা, যে অস্ত্র আর বাহনের অভাবে আজ যুদ্ধের ময়দানে পা বাড়াতে পারছে না মুজাহিদরা, সে অস্ত্র আর যুদ্ধের বাহন ক্রয়ের পথে আর কোন বাধা থাকবে না।
তাই বাণিজ্য কাফেলা মোকাবিলা করার সাহাবীদের এ চিন্তাকে সকলেই সঠিক ও নির্ভুল মনে করবে এতে অবাক হবার কি আছে?
কিন্তু মহানবী (সা) চিন্তা করছিলেন অন্য রকম। তিনি চাচ্ছিলেন, বাণিজ্য কাফেলা নয়, মক্কা থেকে ধেয়ে আসা সামরিক বাহিনীটির মোকাবিলা করতে। এই কারণে প্রশ্নটি তিনি আবার করলেন। সাহাবীরা বুঝলেন তাঁদের দেয়া এ প্রস্তাবের সাথে রাসূল (সা) পুরোপুরি একমত হতে পারছেন না।
মুহাজিরদের মধ্য থেকে তখন মিকদাদ ইবনে আমর (রা) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যেতে আদেশ করছেন আপনি আমাদের সেদিকেই নিয়ে চলুন। আপনি যেদিকেই যান আমরা আপনার সাথে আছি। বনি ইসরাইলের মত আমরা বলবো না, যেমন তারা মুসা (আ) কে বলেছিলঃ ‘তুমি আর তোমার খোদা গিয়ে লড়াই কর, আমরা এখানেই রইলাম।’
(আমরা কথা দিচ্ছি) ততক্ষণ পর্যণ্ত আমরা আপনার সাথে প্রাণপণ লড়ে যাবো, যতক্ষণ আমাদের একটি চোখও দেখতে পাবে।’
এবার আনসারদের দিকে তাকিয়ে মহানবী (সা) প্রশ্নটি আবার করলেন। সাহাবীরা বুঝলেন, এবার তিনি আনসারদের মতামত জানতে চাচ্ছেন।
তখন আনসার সায়াদ ইবনে মুয়াজ (রা) উঠে দাঁড়ারেন এবং বললেন, ‘আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি, আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি, আপনি যা নিয়ে এসেছেন তাই চিরন্তন সত্য। আপনার কথা শোনা ও তা মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতিও আমরা আপনাকে দিয়েছি।
অতএব হে আল্লাহর রাসূল (সা), আপনার যা ইচ্ছা আপনি তাই করুন। যে খোদা আপনাকে মহাত্য সহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সাগরে গিয়ে পৌঁছেন এবং তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তবে আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবেনা।
আপনি যদি কাল আমাদের নিয়ে দুশমনের মোকাবেলায় যান তবে তা আমাদের জন্য মোটেই দুঃসহ হবে না। যুদ্ধে আমরা দৃঢ় ও অটল থাকবো। লড়াইয়ের ময়দানে অকাতরে বিলিয়ে দেবো আমাদের প্রাণ।
অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ আমাদের দ্বারা আপনাকে এমন কিছু দেখাবেন, যা দেখে আপনার চোখ খুশীতে শীতল হয়ে যাবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ওপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে রওনা হোন।’
মুহাজির ও আনসারকের পক্ষ থেকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোন সহজসাধ্য কাজ ছিল না। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কখনো এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব ছিল না। মুসলমানরা যখন ঈমানের বলে বলীয়ান হয় তখনই কেবল এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। আর মুসলমানরা যখন এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখনই কেবল আল্লাহর সাহায্যের আশা করা যায়।
এসব বক্তৃতা-ভাষনের পর ঠিক হলো যে, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে শত্রু-সেনা বাহিনীরই মোকাবেলা করা হবে। এ সিদ্ধান্তের পর মুসলমানরা মক্কার দিকে রওনা হলো এবং বদর প্রান্তরে দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। ইতিহাসে এ যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মুষ্টিমেয় মুসলমানের হাতে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তাদের বাঘা বাঘা নেতাদের অধিকাংশই নিহত হয় এবং সত্তরজনের মত বন্দী হয়।
এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, তুলনামূলকভাবে সহজ পথটি ধরে চলতে চায় মানুষ, কিন্তু রাসূলের সুন্নাহ হচ্ছে, বিপদ থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে লাভ নেই, বরং বিপদ যত কঠিন আর দুরূহ হবে ততই তাড়াতাড়ি তার মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে।
এটি শুধু রাসূলের সুন্নাহ নয়, আল্লাহও চান তাঁর প্রিয় বান্দারা যেন সহজ পথের পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ পথেই অগ্রসর হয়। সুরা আনফালে আল্লাহ এ প্রসংগে বলেন, ‘স্বরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন আল্লাহ তোমাদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, দু’টি দলের মধ্যে একটি তোমরা পাবে।
তোমরা চাচ্ছিলে দুর্বল দলটি তোমাদের হস্তগত হোক, কিন্তু আল্লাহ চাইলেন তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্য রূপে প্রতিভাত করতে, কাফেরদের শিকড় কেটে দিতে ও বাতিলকে বাতিল বলে প্রমাণ করতে –পাপীদের পক্ষে তা যতই দুঃসহ হোক না কেন।’
আজ আমরা যে সমস্যায় পড়েছি সেখানেও আমাদের জন্য দু’টো পথ খোলা রয়েছে। ইচ্ছে করলে হেকমতের কথা বলে আমরা চুপ করে যেতে পারি।
তাতে এ আটজন মুজাহিদের জীবনই কেবল রক্ষা পাবে তা নয়, অভিযান পরিচালনা করলে এ এলাকার মুসলমানদের ওপর যে বিপদ নেমে আসার সম্ভাবনা আছে তার থেকেও তারা রেহাই পাবে।
আবার আমরা ইচ্ছে করলে চূড়ান্ত আঘাত হেনে মেয়েদের উদ্ধার করার একটা প্রচেষ্টাও চালাতে পারি। ভাল করে ভেবে দেখুন কোন পথে আপনারা এগুবেন?’
দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে থামলেন ইমাম সাহেব।
ওসমান বললো, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দেখানো পথেই আমরা এগুবো। কোন রকম ঝুঁকিরই আমরা পরোয়া করি না। যদি বলেন, এ আত্মহত্যার ফয়সালা তবু আমরা পিছবা হবো না।
সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছ থেকেও আমরা এটাই শিখেছি যে, দুনিয়াতে ভীরু আর কাপুরুষের কোন জায়গা নেই। বরং যারা প্রতিদিন এমনি করে একবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে শুধু তারাই।’
বারজেস বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে আমি বলবো, একটিমাত্র স্থানে আগুন লাগলেই কেবল মেয়েদেরকে উদ্ধারের সু্যোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
‘তাড়াতাড়ি বলুন!’
অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে ওসমান, ‘কোথায় আগুন লাগাতে হবে? বলেন তো সমগ্র শহরে আগুন লাগিয়ে দেবো।’
বারজেস বললেন, ‘সামরিক ঘোড়া কোথায় বাঁধা থাকে তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছো। একই স্থানে রয়েছে ছয়শ’ ঘোড়া। বাকিগুলো বিভিন্ন স্থানে। এর পাশেই রয়েছে সমপরিমাণ উট।
আরেকটু এগিয়ে গেলেই দেখবে শুকনো ঘাস এবং খড়ের স্তুপ রয়েছে। তারও পরে সৈন্যদের তাঁবু। ওখানে ঘোড়া ছাড়াও রয়েছে যুদ্ধের সরঞ্জাম।
শুকনো ঘাস এবং খড়ের স্তূপে আগুন লাগার সাথে সাথেই সেগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।
তবে ওতে আগুন লাগানো সোজা ব্যাপার নয়। পুরো এলাকা পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র সেন্ট্রি।
রাতে ও পথে কেউ যেতে পারে না। তবে তোমরা যদি ঘাসের স্তুপে আগুন দিতে পারো আমি হলপ করে বলতে পারি, পৃথিবী ভুলে সম্রাটগণ ওখানে ছুটে আসবেন। ঘাস, যুদ্ধের সামান এবং কাপড়ের আগুন আকাশ পর্যন্ত উঠবে। আতংকিত হয়ে পড়বে শহরবাসী।
আগুন লাগানোর সাথে সাথে ঘোড়ার রশি কেটে দিতে পারলে মহা প্রলয় ঘটিয়ে দেবে ঘোড়াগুলো।
এখন কথা হলো, ওখানে কে যাবে আগুন লাগাতে, কে ঘোড়ার রশি কাটবে, ওখানে যাবেই বা কি করে?’
‘মনে করুন আগুন লাগান হলো’, একজন যুবকের প্রশ্ন, ‘সম্রাটগণ কক্ষ খালি করে ওখানে ছুটে গেলেন। তখন আমাদের করণীয় কি?’
‘আমি তোমাদের সাথে থাকবো। আমাকে ছাড়া তোমরা ওখানে যেতে পারবে না। আমারা যে দু’জন লোক ওখানে আছে ওদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারবো মেয়ে দু’জন কোথায় আছে।’
তিনি আরো বললেন, ‘কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে মেয়েদেরকে এনে লুকাবে কোথায়? তা ছাড়া, এ অভিযান সফল হলে ক্রাকের মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাবে। খ্রীষ্টানরা নিশ্চিত ধরে নেবে মুসলমানরা ছাড়া আর কেউ এ কাজ করেনি। সে অবস্থায় আমাদের করণীয় কি তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।’
‘এখন মুসলমানরা কত শাস্তিতে আছে!’
আক্ষেপ মেশানো কণ্ঠে বললেন ইমাম সাহেব। ‘আমার কথা হচ্ছে, এ কাজ আমরা করবো। ওদের বুঝিয়ে দিতে চাই মুসলমান অসহায় হলেও ওদের গোলাম নয়। ওদের আঘাত আমাদের কলিজায় বিদ্ধ হয়েছে।’
বারজেস ঝানু গোয়েন্দা হলেও নিয়মিত লড়াইয়ের ব্যাপারে তার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। তবু তিনি এ অভিযানের নেতৃত্ব নিলেন। কারণ, তিনিও মনে করছিলেন মুসলমানরা দুর্বল নয় একথা বুঝানোর জন্য এ অভিযানের যে প্রয়োজনীয়তার কথা যুবকরা বলেছে, সে কথায় যুক্তি আছে।
কি করতে হবে তিনি সবাইকে বুঝাতে লাগলেন। দু’টি সমস্যা সামনে এলো। প্রথমতঃ আগুন লাগানো এবং দ্বিতীয়তঃ প্রাসাদ আক্রমণ করা।
সিদ্ধান্ত হলো, এ অভিযানের সূত্রপাত ঘটাবে মেয়েরা। তারা সেখানে গিয়ে সেন্ট্রির কাছে কোন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার খোঁজ করবে। সেন্ট্রি নিশ্চয় তাদের সন্দেহ করবে না। সেই ফাঁকে তাকে হত্যা করতে হবে মেয়েদের।
এই হত্যার কাজটা যদিও মেয়েদের জন্য কঠিন হবু এটা তাদেরই করতে হবে। কারণ পুরুষরা সেখানে গেলে সেন্ট্রি অবশ্যই তাদের সন্দেহ করবে। হত্যার পর তারা সেই খড়ের গাদার কাছে পৌঁছবে এবং সেখানে আগুন লাগাবে।
এরপর আলোচনা হলো প্রাসাদ আক্রমণ সম্বন্ধে। বারজেস এবং ইমাম সাহেবের পরামর্শ হল এ কাজে নয় জনের বেশী লোক নেয়া ঠিক হবে না। এতে লোকের নজরে পড়ার যেমন ভয় আছে, তেমনি ধরা পড়ার আশংকাও রয়েছে।
মেয়েদের প্রসংগে ওসমান বললো, ‘আমার ছোট বোন আল নূর অভিযানে অংশ নেবে।’
আরেক যুবক তার বোনের কথা বললো। অপর ছ’জনের কোনো বোন নেই। সিদ্ধান্ত হ’ল দু’বোন দুইজন বান্ধবীকে সংগে নেবে।
মেয়েদেরকে কর্ম পরিকল্পনা বুঝানোর দায়িত্ব বারজেসকে দেয়া হল।
আলোচনা শেষে ইমাম সাহেব প্রথমে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর যুবকরা একজন একজন করে বাইরে বেরিয়ে গেল।
বারজেস বেরুলেন সবার শেষে। টুকরিটা মাথায় তুলে নিলেন তিনি। হাঁটতে লাগলেন মাথা নুইয়ে। ধীরে ধীরে। তাকে দেখে মনে হয় পৃথিবীর সকল দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়ে একটা লোক এগিয়ে যাচ্ছে।
ওসমান একাকী বাড়ীর পথ ধরল। তার বাড়ী এখনও বেশ খানিকটা দূরে। হঠাৎই অন্ধকার ফুঁড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল কেউ।
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল ওসমান। অন্ধকারে শোনা গেল কারো খিলখিল হাসির শব্দ।
ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল ওসমানের পাশে। ওসমান দেখল একটি নারীর মূর্তি।
ওসমান ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘কে?’
ছায়ামূর্তি ওসমানের আরো কাছে সরে এসে বলল, ‘আমি।’
ওসমান তখনো তাকে চিনতে পারেনি। বলল, ‘আমি কে?’
রিনি আলেকজাণ্ডার মুখের কাপড় সরিয়ে বলল, ‘ওসমান, ভূত না আমি রিনি।’
রিনি আলেকজাণ্ডার পাশের বাড়ির সেই খ্রীষ্টান যুবতী যার সাথে আল নূরের বন্ধুত্ব। আশপাশের বাড়িগুলোর চাইতে ওসমানদের বাড়িতেই ওর যাতায়াত বেশী। যখন তখন হুটহাট চলে আসে।
ভাই বোন দু’জনের সাথেই রিনির খোলামেলা সম্পর্ক। বিশেষ কাজে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে ওসমান চাইছে, ও আর এ বাড়ীতে না আসুক। কিন্তু সরাসরি নিষেধ করে সন্দেহের পাত্র হতে চায় না বলে ইদানিং ওসমান তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে।
রিনি সব সময় ওসমানের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। এতদিন এ নিয়ে ওসমানের মনে কোন প্রশ্ন দেখা দেয়নি। কিন্তু মুজাহিদের কাতারে যেদিন নাম লেখালো সেদিন থেকেই তার মনে ভয় ঢুকল, মেয়েটা গোয়েন্দা নয়তো?
কখনো তার মনে হতো এ খ্রীষ্টান মেয়েটা তার নৈতিকতা নষ্ট করতে চাইছে নাতো? তার জাতীয় চেতনাবোধ বিনাশ করার জন্য কি একে তার পিছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে?
রিনিকে চিনতে পেরে মৃদু সৌজন্যের হাসি উপহার দিয়ে কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল ওসমান। সামনে একে পথ রোধ করে দাঁড়াল রিনি।
একজন খ্রীষ্টান যুবতীর সাথে কথা বলছে ওসমান, ধরা পড়লে শাস্তি পাবে, এমন কোন আশংকা নেই। বরং একজন সন্দেহভাজন মুসলিম যুবক এক যুবতীর ফাঁদে পা দিয়েছে ভেবে ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা খুশীই হবে।
থেকে গেল ওসমান। বললো, ‘আমার একটু তাড়া আছে রিনি।’
‘তোমর কোন তাড়া নেই।’ কলকলিয়ে উঠল রিনির কণ্ঠ। ‘এত সহজে আমাকে ছাড়াতে পারবে?’
‘তোমাকে ছাড়ানোর কথা তো বলিনি!’
‘মিথ্যে বলো না ওসমান।’ রিনির কণ্ঠে অভিমানের সুর।
‘এখন তোমাদের বাড়ী থেকেই আসছি। তোমার বোন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে ‘তুমি আর এসো না। ভাইয়া রাগ করেন।’ কেন ওসমান, এ কথা তো তুমিই আমায় বলতে পারতে!’
ওসমান নিশ্চুপ। বোনটা খুব তাড়াহুড়া করেছে। কি জবাব দেবে তাই ভাবছে ওসমান।
তাকে নিরব থাকতে দেখে রিনি বললো, ‘বল তো কেন তোমাদের বাড়ী যাব না?’
এসব কথা বলার বা শোনার সময় ওসমানের হাতে নেই। তার হৃদয়ে ঝড় বইছে। এক অন্ধ আবেগ পিষে মারছে তার অন্তর। কি জবাব দেবে ভেবে পেল না। হৃদয়ের সত্যি কথাটাই মুখ ফসকে বেরিয়ে এল।
‘আমাদের বাড়ীতে আসতে কেন তোমায় নিষেধ করেছি জানি না। শোন রিনি, আমরা একজন আরেকজনকে যতই ভালবাসি তবুও আমরা পরস্পর দু’টি শত্রু জাতির অন্তর্ভূক্ত।
তুমি ব্যক্তিগত ভালবাসার কথা বলবে। আমি বলবো জাতীয় চেতনাবোধের কথা। ক্রুশ এবং কোরআন কখনো এক হতে পারে না।
এটা আমার দেশ। তোমার জাতি এখানে কি করছে? তোমার জাতির শেষ ব্যক্তিটি যতক্ষণ পর্যন্ত এখানে থাকবে আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রেম তৈরী হতে পারে না। আমি আমার মনের কথাটাই তোমাকে বললাম।’
‘তা হলে আমার হৃদয়ে কি আছে তাও শুনে নাও। আমার হৃদয়ে রয়েছে তোমার জন্য ভালবাসা। ক্রুশ বা কোরআন সে ভালবাসার অন্তরায় হতে পারবে না।
তোমাকে না দেখলে আমার ভাল লাগে না। তোমাকে হাসিখুশী দেখলে আমার মন আনন্দে ভরে উঠে। ওসমান, তোমাদের বাড়ীতে যেতে আমাকে নিষেধ করলে তা দু’জনের কারুর জন্যই ভাল হবে না।’
‘ভয় দেখাচ্ছো? তা দেখাতেই পার। কারণ তুমি যে শাসক জাতির মেয়ে।’
‘আমার মনে শাসকের অহমিকা থাকলে এতক্ষণ তুমি এখানে থাকতে না। থাকতে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তুমি কি ভেবেছো তুমি কি করছো আমি কিছুই জানি না?
বল তো তোমার গোপন তৎপরতার কথা বলে দিই। আমার জাতি এবং দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য যে অস্ত্রসম্ভার তোমার ঘরের মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছ সে খবর কি তোমায় বলবো? আল নূরকে তুমি সামরিক ট্রেনিং দিয়েছ। তোমার সংগীদের অনেককেই আমি চিনি। তুমি জান না ওসমান তোমার এবং জেলের মাঝে আমিই এখন বাঁধা হয়ে আছি।
তুমি জান কে আমার পিতা। কতবার তিনি বলেছেন, ‘ওসমানকে গ্রেফতার করা জরুরী হয়ে পড়েছে।’
প্রতিবারই আমি অনুনয়-বিনয় করে বলেছি, ‘ওসমানের বোন আবার বন্ধু। তা ছাড়া ওর পিতার একটা পা নেই।’
আব্বা আমায় শাসিয়ে বলেছেন, ‘ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো। মুসলমানরা ভালবাসার পাত্র নয়।’
আমি আমার পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। এ জন্য তার আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছেন না। নইলে কবেই তুমি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঢুকে যেতে।’
রিনির কথা শুনে ওসমান পাথরের মত জমে গেল। তার ঠোঁট দু’টো যেন কেউ শক্ত আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু কিছুতেই ঠোঁট দু’টো আলাদা করতে পারল না।
রিনির চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রুর ফোটা পড়তে লাগল। গলা বসে এল তারও। আর কোন কথা না বলে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
ওসমান আবারও কথা বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু এবারও তার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হলো না।
সূর্য ডুবেছে অনেক আগে। জেঁকে বসে আছে রাতের আঁধার। পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দুই যুবক যুবতী। কারো মুখে কোন কথা নেই।
ওসমান বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর যখন সম্বিত ফিরে পেল রিনিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সে এক পা এগুতেই রিনি আবার তার সামনে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়াল।
পলকে দু’জনের মাঝের সব ব্যবধান ঘুচে গেল। ওসমানের বুকের সাথে মিশে গেল রিনি। ওর দু’টো হাত ওসমানের কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। ওর শরীরের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ওসমানের চারপাশে। দু’জনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ওসমানের গাল স্পর্শ করেছে রিনির রেশম কোমল চুল।
ওসমান মুক্ত হবার চেষ্টা করতেই রিনি ছেড়ে দিল তাকে।
‘আমায় মুক্তি দাও রিনি।’ ওসমানের বিধ্বস্ত কণ্ঠ। ‘আমায় পাথর হতে দাও। আমার আর তোমার পথ এক নয়। দু’জন কখনও একত্রে চলতে পারবো না। তোমার বাপ-মা যেমন এটা মেনে নেবে না তেমনি আমারও। আমরা নিরূপায় রিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো, তোমার প্রেম-বন্ধন থেকে মুক্তি দাও আমায়।’
‘ওসমান, এই কি তোমার মনের কথা? তুমি কি পারবে তোমার হৃদয়ের গোপন কুঠরীতে আমার যে ছবি আকাঁ আছে তা মুছে ফেলতে? বল, পারবে?’
‘এ ছাড়া আমি আর কি করতে পারি রিনি! আবেগ দিয়ে তো জগত চলে না। বাস্তবতাকে অস্বীকার করবো সে শক্তি আমার কোথায়?’
‘প্রেম উৎসর্গ চায়।’ রিনির কণ্ঠে মাদকতা। ‘বল কি ত্যাগ চাও তুমি আমার কাছে?’
‘এ মুহুর্তে তোমার কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই। শুধু চাই, আমাকে ভুলে যাও, ক্ষমা করো আমাকে।’
‘অসম্ভব। তুমিই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ মনের মানুষ। তোমাকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
তবে তুবি চাও বা না চাও, আমি কথা দিচ্ছি, আজ থেকে তোমার যা ইচ্ছে তুমি করে বেড়াও, এতে তোমার যে বিপদ আসবে সে বিপদ আমার। তোমায় আমি কখনও গ্রেফতার হতে দেব না।’
ওসমান গভীর হতাশা ছড়িয়ে বলল, ‘আর বাস্তবতা আমাকে বলছে, ওসমান, এ মাদকতাময় দেহ আর রেশম কোমল চুলের ফাঁকে তুমি কোনদিন জড়াতে পারো না। এ অনুচিত, এ অসম্ভব।
আর তাই আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, আমার মনে কি আছে তা তোমাকে কখনোই বলবো না। প্রাণ গেলেও আমি আমার জাতির শত্রুপক্ষের কোন ঘরের কোন যুবতীর প্রেমের ফাঁদে পা দেবো না।’
‘ঠিক আছে ওসমান, তোমার প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে জমা থাক। আমার ভালবাসার জন্য আমি কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারি আজ থেকে সে পরীক্ষায় আমি দিয়ে যাবো।
যাও ওসমান, তোমার খুব তাড়া। তোমাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি বলে দুঃখিত। তবে তুমি চাও বা না চাও তোমার বাড়ী আসা আমি কখনোই বন্ধ করবো না।’
পথ ছেড়ে দাঁড়াল রিনি। দ্রুত পা চালাল ওসমান। তার অনেক সময় এরই মাঝে নষ্ট হয়ে গেছে।
ওসমানের গমন পথের দিকে অনেকক্ষণ বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিনি। ওসমানের পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেলে নিজেও বাড়ির দিকে হাঁটা দিল রিনি।
* * *
ওসমান সালেম বাড়ীতে পৌঁছে দেখল বারজেস বসে আছেন।
অন্দরে ঢুকে পিতা-মাতা এবং আল নূরকে সব কথা খুলে বললো। বললো, ‘আমাদের সাথে আল নূরকেও যেতে হবে।’
ওসমানের পিতার একটা পা নেই। যৌবনে খ্রীষ্টানদের সাথে যুদ্ধে তিনি তার পা টা হারিয়েছেন। তার দুঃখ ছিল আর কোন দিন জেহাদে যেতে পারবেন না বলে।
সব শুনে তিনি ওসমান বললেন, ‘তোমরা এক বিপজ্জনক অভিযানে যাচ্ছ। আমাকে যেন শুনতে না হয় তুমি বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ।
এ অভিযানে ধরা পড়ার ভয় সবচেয়ে বেশী। তুমি ধরা পড়লে যদি তোমার সংগীরা পালিয়ে আসতে পারে তবে জীবন দেবে কিন্তু সংগীদের নাম বলবে না।
আমি সুলতান আয়ুবীর সেনাবাহিনীর জন্য তোমাকে বড় করেছি। ভেবেছিলাম, আল নূরের বিয়ের কাজটা সেরে তোমাকে বিদেয় করবো। যাও। আমার হৃদয় শান্ত করো। আবারো বলছি, শোন, কেউ যেন আমায় বলতে না পারে ওসমানের দেহে সালেমের রক্ত নেই।’
সালেম আল নূরকেও এ অভিযানে অংশ গ্রহণের জন্য সানন্দে অনুমতি দিলেন।
ওসমান বললো, ‘বারজেস বৈঠকখানায় রয়েছেন। এ অভিযানের নেতৃত্ব তিনি দেবেন।’
ওসমানের পিতা সালেম, বারজেসের কাছে চলে গেলেন।
‘আল নূর!’ ওসমান বললো, ‘এ অভিযানে যেতে পারে তোমার এমন দু’জন বন্ধুকে ডেকে নিয়ে এসো।’
বেরিয়ে গেল আল নূর। খানিক পর ফিরল দু’জন বান্ধবীকে নিয়ে। ততোক্ষণে ওসমানের সংগীর বোনও এসে গেছে। এরপর একজন একজন করে এসে পৌঁছল সাতজন যুবক।
কোন পথে যেতে হবে মেয়েদেরকে বুঝিয়ে বললেন বারজেস। বললেন, ‘পথে সেন্ট্রি তোমাদেরকে বাঁধা দেবে। তখন তোমরা সেন্ট্রিকে উপরে যাবার পথ জিজ্ঞেস করে বলবে, সম্রাট রিমাণ্ড ডেকে পাঠিয়েছেন।
সেন্ট্রি বলবে, এটা সম্রাট রিমাণ্ডের কাছে যাবার পথ নয়।
তোমরা বলবে, তাহলে কোন দিকে? এভাবে তার সাথে আলাপ জমিয়ে তাকে ঘিরে ফেলবে।
চারজনের একজন থাকবে চাকরানী। মাথায় রেশমী রুমালে ঢাকা থাকবে একটি ঝাকা। ঝাকায় থাকবে জ্বালানী। সেন্ট্রিকে ঘিরে ফেলার পর এক ফাঁকে তাকে মেরে ফেলতে হবে। আগুন লাগাবে তারপর।
অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ে বাধা রশি একত্রিত করে একেকটা খুটির সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ রশি কেটে দিতে হবে।
রশি কাটার পর কয়েকটা ঘোড়াকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করবে। এরপর সু্যোগ পেলে উটের রশিও কেটে দেবে।’
বারজেস মেয়েদের পোশাক পাল্টে দিলেন। একজনকে চাকরানী সাজিয়ে তার হাতে মুখে ছাই মেখে দেয়া হল।
এরপর বারজেস ওসমান এবং তার সংগীদের সাথে কথা বললেন। তাদেরকে অভিযানের সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন।
প্রত্যেককে একটি করে খঞ্জর দেয়া হল। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। অনেক সময় কেটে গেছে। ওসমানের সংগীরা ছটফট করতে লাগল।
বারজেস বললেন, ‘এখনও শহর জেগে আছে। শহর ঘুমুলেই কেবল জেগে উঠে প্রাসাদের পানশালা।’
রাত আরেকটু গভীর হলো। কমে এলো শহরের কোলাহল। এক সময় বারজেস বললেন, ‘এবার উঠা যায়।’
একজন একজন করে বেরিয়ে পড়ল সবাই। ছেলে এবং মেয়েদের পথ ভিন্ন। ওরা যে যার পথে পা বাড়াল।
আগুন লাগানোর জন্য মেয়েদেরকে একটা নির্দিস্ট সময় ঠিক করে দেয়া হল। সে মুহুর্তে ওসমানরা থাকবে প্রাসাদের কাছে।
বিপজ্জনক অভিযান। সামান্য ভুল বা সময়ের ঈষৎ হেরফের হলেই অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবে। ওদের ভাগ্যে ঘটবে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
মেয়েদের কাজ ছিল আরও বিপজ্জনক। ধরা পড়লে ওদের কি অবস্থা হবে কল্পনাও করা যায় না। আল নূর বললো, ‘ধরা পড়লে আমরা আত্মহত্যা করবো। জীবিত থেকে কিছুতেই বেঈমানদের ভোগের সামগ্রী হবো না।’
সমগ্র শহরে নীরবতা নেমে এলো। কোন বাড়ীতে আলো নেই। সুনসান সড়ক।কেবল মাত্র সম্মিলিত সামরিক হেড কোয়ার্টারে এখনও আলো জ্বলছে।
পানশালায় হাজির হয়েছেন খ্রীষ্টান সম্রাটগণ। জমে উঠল পানশালা। আজকের আলোচনার বিষয় অপহৃত দু’জন মুসলিম যুবতী এবং লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ।
একজন প্রশ্ন করল, ‘মেয়ে দুটো কি কাজে আসবে?’
জবাবে একজন সেনা কমাণ্ডার বললো, ‘মেয়েরা বুদ্ধিমতি এবং প্রাপ্ত বয়স্কা। একজনের বয়স ষোল, দ্বিতীয় জনের বাইশ। ওদেরকে দিয়ে গুপ্তচরের কাজ করানো যাবে না। কিছুদিন আনন্দ উপভোগে ব্যবহার করা যায়।’
‘এরপর কোন সেনা অফিসারের হাতে তুলে দিলেই হবে।’ চীফ কমাণ্ডার বললেন। ‘অফিসাররা তাদের বিয়ে করে নেবে।’
মেয়েদের নিয়ে অশ্লীল আলোচনা চলল দীর্ঘক্ষণ। ওরা তখন ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে।
দু’জন মধ্য বয়েসী মহিলা ওদের গোসল করিয়েছে। মহিলা দু’জন এ বিষয়ে পারদর্শিনী। ওরা মেয়েদের কাপড় পরাচ্ছিল।
সকাল থেকে ওরা কিছুই মুখে তোলেনি। শুধু কাঁদছে। তাদের এমন খাবার দেয়া হয়েছে যা তারা কোনদিন দেখেনি। কিন্তু ওরা সে খাবার ছুঁয়েও দেখেনি।
কে কোথায় আছে দু’জনের কেউই জানে না।
মহিলারা ওদেরকে এক স্বপ্নীল জগতের লোভ দেখাচ্ছিল। একজন বলছে, ‘ফ্রান্সের সম্রাট তোমাকে পছন্দ করেছেন। তুমি হবে ফ্রান্সের রাণী।’
অন্যজন বলছে, ‘তোমাকে জার্মানীর রাজার মনে ধরেছে। কি সৌভাগ্য তোমার।’
কখনো আবার মিষ্টি করে ধমকাচ্ছিল, ‘সম্রাটদেরকে নাখোশ করলে তোমাদেরকে সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়া হবে।’
মেয়ে দু’জন মরুচারী বেদুইন। ওরা ভীরু তাও নয়। কিন্তু অসহায়। নিজেকে রক্ষা করার শক্তিও নেই।
পিতামাতা ওদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই খ্রীষ্টান এলাকা থেকে হিজরত করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওদের, শেষ পর্যন্ত খ্রীষ্টানদের হাতেই ধরা পড়তে হল।
পিতামাতা নিহত। ভাইটা বন্দী। এখন আল্লাহ ছাড়া ওদের সাহায্য করার আর কেউ নেই।
নিজেদের সম্ভ্রম ছাড়াও ভাইয়ের জন্য ওরা উদ্বিগ্ন। আশফাক তখন বেগার ক্যাম্পে কাৎরাচ্ছে। আহত ভাইটিকে পশুরা অনেক পিটিয়েছে।
সন্ধ্যায় ডিউটি শেষে বেগার ক্যাম্পে ঢুকেছে বন্দীরা। ওরা নতুন বন্দীদের দেখল। শুনল ওদের ধরা পড়ার কাহিনী। পনের জনের মধ্যে আশফাকই বেশী আহত।
লুকিয়ে রাখা ওষুধ দিয়ে বন্দীরা ওর ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল।
ব্যাণ্ডেজ বাঁধার পর আশফাক অনেকটা আরাম বোধ করল। ক্ষতস্থানে এখন আর ব্যথা অনুভব করছে না সে।
বোনদের কথা ওর বার বার মনে পড়ছে। বন্দীদের জিজ্ঞেস করল, ‘তার বোনেরা এখন কোথায়? এখান থেকে কিভাবে পালানো যায়?’
বোনেরা এখন কোথায় এবং তাদের সাথে কি ব্যবহার করা হচ্ছে বন্দীরা শোনাল তাকে সে খবর।
বললো, ‘এখানে কোন প্রাচীর নেই। কারো পায়ে শিকলও পরানো হয়নি। তবুও পালানো সম্ভব নয়। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? ধরা পড়তেই হবে। আর ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত।’
কোন কোন বন্দী কয়েক বছর থেকেই এখানে আছে। পালিয়ে গেলে পরিবারের উপর নেমে আসবে অকথ্য নির্যাতন। এ জন্যই বন্দীরা পালাচ্ছে না। তবুও আশফাকের মনে বোনদের মুক্ত করার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও তার এখন চলার শক্তিও নেই।
সারাদিনের হাড়ভাংগা পরিশ্রমের পর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে বন্দীরা। জেগে আছে শুধু আশফাক। ওর দু’চোখে ঘুম নেই। অসহায় বোনদের নানা বর্ণের ছবি ভেবে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে।
* * *
‘মেয়েরা না আবার ধরা পড়ল!’ ফিসফিসিয়ে বলল ওসমান।
‘এমন অলক্ষুণে কথা বলো না।’ বললেন বারজেস। ‘আল্লাহকে স্মরণ কর। এখন আমরা মৃত্যুর মুখে আছি। মন থেকে সব ভয় দূর করে ওখানে খোদাকে বসাও। তোমার বন্ধুরা কি নির্ভরযোগ্য?’
‘ওদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়। আমি ওদের নিয়ে ভাবছি না। মেয়েদের নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।’
‘আল্লাহর সাহায্য চাও। আমরা চুরি করতে আসিনি। অবশ্যই তিনি সাহায্য করবেন।’
সেনা হেড কোয়ার্টারের পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল ওরা। দৃষ্টি প্রাসাদের দিকে। কোন সংকেতের কি কাজ করতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বারজেস।
ওসমানের মনে ঘুরে ফিরে উদয় হচ্ছিল চারজন তরুণীর কথা। মেয়েরা গিয়েছে অনেক আগে। এতোক্ষণে আগুন লাগানোর কাজ শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ওদের অভিযান সফল হলে অগ্নিশিখা এখান থেকেও দেখা যাবে। প্রাসাদের সবাই তখন ছুটে যাবে আগুনের কাছে।
কথা ছিল ওরা চলে গেলেই যুবকরা প্রাসাদে ঢুকবে। কিন্তু আগুনের কোন শিখা এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবে কি সেন্ট্রি ওদের যেতে দেয়নি। ধরে রেখেছে না ফিরিয়ে দিয়েছে কে জানে।
মেয়েরা তখনও সেন্ট্রিকে পায়নি। নির্দিষ্ট স্থানে নেই সেন্ট্রি। সেন্ট্রির এই না থাকাটা বিপদের লক্ষণ। তাকে জীবিত রেখে আগুন লাগাতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশী। ওরা সেন্ট্রিকে খুঁজতে লেগে গেল। খড়ের পালান অতিক্রম করছিল ওরা।
অন্ধকারে সৈন্যদের তাঁবু নজরে আসছে না। একত্রে হাঁটছে চারজন।
সামনে একটা মশাল দেখা যাচ্ছে। মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে। মশালের দিকে এগুল ওরা।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলা সেন্ট্রি। মশাল হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো মেয়েদের দিকে।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল মেয়রা। মশাল হাতে সেন্ট্রি মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়াল।
ওদের ঝলমলে পোষাক দেখে ইতস্ততঃ করলো একটু তাকিয়ে দেখল একজন চাকরানীর মাথায় কাপড়ে ঢাকা একটা ঝাকা।
‘আপনারা কে? কোথায় যাচ্ছেন?’ প্রশ্ন করল সেন্ট্রি।
‘সম্ভবত ভুল পথে এসেছি।’
বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে উঠল আল নূর।
‘শাহ রিমাণ্ডকে কথা দিয়েছিলাম রাতে আসব। একটু দেরী হয়ে গেছে। সামনে তো মনে হয় উট-ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়েছে।’
সেন্ট্রিকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য রিমাণ্ডের নাম উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল। খ্রীষ্টান সম্রাটগণ কি চরিত্রের জানতো সেন্ট্রি। হয়ত আনন্দ-স্ফুর্তি করার জন্য এদের ডেকে এনেছে, ভাবল সেন্ট্রি।
মেয়েদের পোষাক আশাক এবং কথা বলার ঢং দেখে সেন্ট্রি নিশ্চিত, রিমান্ডই এদের ডেকে পাঠিয়েছেন। সে ওদেরকে পথ বলে দিতে লাগল।
কথা বলার ফাঁকে একজন যুবতী সেন্ট্রির পেছনে চলে এল। তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে পিঠে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল।
মশালটি পড়ে গেল। সেন্ট্রির হাত থেকে। আল নূর পাঁয়ে পিষে নিভিয়ে ফেলল মশাল।
অন্য মেয়েরাও পড়ে থাকা সেন্ট্রির গায়ে পরপর কয়েকটি আঘাত করল। চিৎকার করারও সময় পেল না সেন্ট্রি। তার আগেই মারা গেছে।
চাকরানী বেশী যুবতী মাথা থেকে ঝাকা নামাল। চট জলদি খড়ের পালান এবং ঘাসের স্তুপে জ্বালানী ছড়িয়ে দিল। এরপর একে একে সবকটা স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিল। জ্বলে উঠল শুকনো ঘাস।
এবার নজরে তাঁবুর সারি। সৈন্যদের রসদ এবং পোষাক। একদিকে হাজার হাজার টাংগা। ওরা তাঁবু এবং টাংগায় জ্বালানী ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল।
ঘাসের স্তূপ থেকে অগ্নিশিখা লকলকিয়ে আকাশ ছুইছে।
ঘোড়ার দিকে ছুটল মেয়েরা। সৈন্যরা এখনও জাগেনি। খঞ্জর দিয়ে ঘোড়ার রশি কাটতে লাগল ওরা। একেকটা রশিতে পঞ্চাশটা করে ঘোড়া বাঁধা।
দুজন ঘোড়ার রশি কাটা বাদ দিয়ে বাঁধা ঘোড়াগুলোর পাশে দিয়ে দাঁড়াল। কয়েকটা ঘোড়াকে পর পর খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল ওরা। হ্রেষা শব্দ তুলে ছুটতে লাগল আতংকিত ঘোড়াগুলো।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে উটগুলো নিশ্চিন্তে জাবর কাটছিল। ওদের পায়ের রশিও কেটে দিল মেয়েরা।
উট, ঘোড়া ছুটছে, পালাচ্ছে, আতংকে চিৎকার করছে। মেয়েরা ওদের ছুটোছুটির ভেতর পড়ে গেল।
ছুটন্ত উট ও ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি ও খুরের শব্দে জেগে উঠল সৈন্যরা।
অপহৃত দু’জন যুবতীকে কনের সাজে সাজানো হয়েছে।
দুই কক্ষে একই সময় প্রবেশ করল দু’জন লোক, দুটি খ্রীষ্টান রাজ্যের সম্রাট। মদে মাতাল।
চাকরানীরা বেরিয়ে গেল। সম্রাটরা এগিয়ে গেল মেয়েদের দিকে। সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য কক্ষের এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগল মেয়েরা।
আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদের রক্ষা করতে পারে না। একজন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। হাত উপরে তুলে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগল।
অট্টহাসিকে ফেটে পড়ল খ্রীষ্টান সম্রাট। পা বাড়ল যুবতীর দিকে।
এ সময় হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এল সৈনিকদের ডাক-চিৎকারের শব্দ। যেন প্রসাদে ডাকাত পড়েছে। বিরক্তিতে কুঞ্চিত হলো সম্রাটের কপাল।
শোরগোলের অস্বাভাবিক শব্দে মেয়েদের দিকে এগুনো বন্ধ করে দরজা খুলে বাইরে তাকালেন সম্রাট। দেখলেন আলোয় ভরে গেছে পুরো প্রাঙ্গণ।
তার মনে হল সমগ্র শহরে আগুন লেগে গেছে।
দেখলেন, আতংকিত ও ছুটন্ত ঘোড়ার কয়েকটি প্রাসাদেও এসে ঢুকে পড়েছে।
নেশা ছুটে গেল সম্রাটের। দ্বিতীয়জনও বেরিয়ে এলেন। কয়েকজন লোক ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘ঘাস, তাঁবু এবং গাড়ীতে আগুল লেগেছে। ছুটন্ত পশুর পদতলে পিষে যাচ্ছে সৈন্যরা।’
সমগ্র শহর পুড়ে গেলেও সম্রাটরা এত চিন্তা করতেন না। কিন্তু জ্বলছে ফৌজি রসদ, সৈনিকদের পোষাক আশাক, শত শত টাঙ্গা। যুদ্ধের বাহন হাজার হাজার উট, ঘোড়া পালিয়ে যাচ্ছে।
প্রাসাদের সবাই ছুটে বেরিয়ে গেল। দেখতে দেখতে জনশূন্য হয়ে গেল প্রাসাদ। প্রাসাদের চারপাশের সমগ্র প্রহরীরাও ছুটে গেছে আগুন লাগার স্থানে।
বারজেস যুবকদের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘প্রাসাদে ঢুকার এই সু্যোগ, চলো।’
ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল যুবকরা। ছুটে প্রাসাদে ঢুকে গেল আট জন যুবক।
বারান্দায় উঠেই দুই সংগীর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন বারজেস।
চাকর-বাকরদের মধ্যে পাওয়া গেল একজনকে। বারজেস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকের অপহৃত মেয়ে দুটো কোথায়?’
ও ইশারায় কক্ষের একটা সারি দেখিয়ে দিল। বলল, ‘এ সারিরই কোন ঘরে আছে ওরা।’
দৌড়ে কক্ষগুলোর দিকে এগুলো সবাই।
প্রাসাদে কোন দায়িত্ববান পুরুষ নেই। ভালই হয়েছে ওদের জন্য।
করিডোরে কয়েকজন অর্ধ উলংগ মেয়ে পাওয়া গেল। ওরা ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে। পর পর কয়েকটা মেয়েকে থামিয়ে আজকের অপহৃত মেয়েদের সম্পর্কে যুবকরা ওদের কাছে জানতে চাইল। কিন্তু মেয়ে দুটো কোথায় আছে ওরা জানে না।
কয়েকটা কক্ষে খোঁজ করার পর একজনকে পাওয়া গেল এক রুমের ভেতর। মেয়েটি রুমের মাঝখানে বিহবল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ওসমান এবং তার সংগীরা মেয়েটাকে দেখেই চিনতে পারল। কারণ দিনের বেলা ওদের নিয়ে আসার সময় যুবকরা মেয়ে দুটোকে দেখেছিল।
মুখোশধারী আট-দশজন লোক দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। বারজেস বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, চিৎকার থামাও, আমরা মুসলমান। তোমাদের উদ্ধার করতে এসেছি।’
কিন্তু মেয়েটা বিশ্বাস করল না। সে রুমের একদিকে সরে গেল।
বারজেস ওকে বললেন, ‘বাঁচতে চাইলে এখুনি পালাতে হবে। জলদি এসো।’
ওরা দরজার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু মেয়েটা তার জায়গা থেকে নড়ল না। ওরা আবার ডাকল ওকে। কিন্তু মেয়েটা তাও সাড়া দিল না।
বারজেস যুবকদের বললেন, ‘এখানে সময় নষ্ট করা যাবে না। ওকে ধরে নিয়ে এসো।’
যুবকরা ওকে ধরতে গেল। কিন্তু মেয়েটি সরে গেল সেখান থেকে। যুবকরা আবার এগুলো, এবারও সরে গেল সে, কিছুতেই ধরা দিচ্ছিল না।
বারজেস বললেন, ‘কুইক, তাড়াতাড়ি করো।’
শেষে আরো দুজন যুবক এগিয়ে গিয়ে জোর করে ওকে তুলে নিল।
আরো কয়েকটি কক্ষ পার হওয়ার পর পাওয়া গেল দ্বিতীয়জনকে। ওসমানরা তাকেও জোর করে তুলে নিল।
মেয়েরা হাত-পা ছুড়ছিল আর চিৎকার করছিল, ‘ছাড়ো, ছাড়ো আমাদের।’
বারজেস ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘পাজী মেয়ে, বলছি না আমরা মুসলমান। তোমাদের চিৎকার শুনে খ্রীষ্টানরা এসে পড়লে আমরা সবাই মারা পড়বো। আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো, একটু শান্ত হও।’
‘আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’ চিৎকার করতে করতেই বলল একটি মেয়ে।
‘আপাততঃ শহরে কোন মুসলমানের বাড়ীতে লুকিয়ে রাখবো। তারপর সু্যোগ বুঝে শহর থেকে বের করে যেখানে যেতে চাও পাঠিয়ে দেব।’
বারজেসের কথায় শান্ত হল মেয়ে দু’জন।
মুখোশধারী দলটি বেরিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে। আশেপাশে বা সদর দরজা কোথাও কোন খ্রীষ্টান সৈন্যের দেখা পেল না ওরা। সবাই তখনও আগুনের কাছে।
বিনা বাধায় মেয়ে দুজনকে নিয়ে প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে এলো আটজন যুবক। কয়েক মিটিনের মধ্যেই সামনের রাস্তা পেরিয়ে ওরা একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
যুবকরা খুশী, কোন রকম লড়াই, লক্তপাত ছাড়াই ওদের অভিযান সফল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে দুই মুসলিম যুবতী।
মেয়েরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যাক, আল্লাহ তাদের আবেদন কবুল করেছেন। খ্রিষ্টানদের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন তাদের জীবন ও সম্ভ্রম।
আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁইছিল। আগুনে জ্বলছিল সেনাবাহিনীর সমস্ত রসদ-সামান। শহরের অলিগলি আর রাস্তায় ছুটছিল লাগামহীন ঘোড়া।
জেগে উঠেছে শহরবাসী। সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা আতঙ্ক। কি ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না তারা।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পথে পথে উট-ঘোড়ার ছুটাছুটি দেখে দরজা বন্ধ করে বসে রইল মানুষ। কি ঘটেছে দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে আসতে সাহস পেল না কেউ।
উট ও ঘোড়ার লাফালাফি না থাকলে আগুন নেভানোর জন্য হয়তো বেরিয়ে আসতো লোকজন। কিন্তু একদিকে সেনা সদরে আগুন ও অন্য দিকে রাস্তায় রাস্তায় উট, ঘোড়ার দাপাদাপি দেখে লোকজন ভাবল, তবে কি সালাহউদ্দীন আয়ুবী শহরে আক্রমণ করেছে?
এ ভাবনা মনে আসতেই খ্রীষ্টান পরিবারগুলো ভীত বিহবল হয়ে পড়ল। কেউ কেউ পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
আয়ুবীর গোয়েন্দারা এ সু্যোগ হাতছাড়া করল না। তারা বিভিন্ন গলি ও মহল্লায় ছুটাছুটি শুরু করে দিল। লোকজন বাড়ীর গেট দিয়ে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কি হয়েছে ভাই?’
‘আয়ুবীর বাহিনী শহরে আক্রমণ করেছে। ওরা খ্রীষ্টান বাহিনীর রসদপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে। উট, ঘোড়া সব ছেড়ে দিয়েছে। খ্রীষ্টান সৈন্যরা এখন শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। আমরাও পালিয়ে যাচ্ছি।’
মুহুর্তে সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ‘মুসলিম বাহিনী ক্রাক আক্রমণ করেছে। আগুন লাগিয়ে দিয়েছে শহরে।’
এ গুজব মুসলমানদের সাহস বাড়িয়ে দিল। ইহুদী ও খ্রীস্টানরা আতংকিত হয়ে পড়ল ভীষণভাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় নেমে এল ভীত সন্ত্রস্ত লোকজন। ভয়ে পালাতে শুরু করল ইহুদী ও খ্রীষ্টান পরিবারগুলো।
খ্রীষ্টান সম্রাট এবং সেনা কমাণ্ডাররা আগুন লাগার স্থানে গেলেন। কোন জন মানুষের চিহ্নও নেই সেখানে। তারা ভাবলো, মুসলিম ফৌজ হয়ত সিঁড়ি লাগিয়ে পাঁচিল টপকে ভেতরে চলে এসেছে।
সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা অংশকে তারা শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিল। দ্বিতীয় অংশ প্রস্তুত হয়ে বসে রইল আয়ুবীর বাহিনীর সাথে মোকাবিলার জন্য।
কমাণ্ডার কয়েকজন সৈনিককে শহরের প্রাচীরের ওপর তুলে দিল। ভয়ে ভয়ে তারা তাকাল বাইরের দিকে।
বাইরে সুনসান নিরবতা। কোথাও কোন সৈনিকের নড়াচড়া চোখে পড়ল না। আয়ুবীর আক্রমণের চিহ্নমাত্র নেই বাইরে।
খ্রীষ্টান সৈন্যদের বাইরে যাবার জন্য দুর্গের পেছনের জরদা খুলে দেয়া হল। রাতে কখনও এ ফটক খোলা হয় না।
শহরের বাইরে গিয়ে সুলতান আয়ুবীর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এসব সৈন্যদেরকে বাইরে পাঠানো হচ্ছে।
তারা ধারণা করল, ভেতরে হয়ত আয়ুবীর দু’একটা সুইসাইড গ্রুপ ঢুকে এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। এতে সৈনিকদের ভয় কিছুটা দূর হলো। সাহসে ভর করে অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল, আয়ুবীকে তারা কিছুতেই দূর্গের কাছেও ঘেষতে দেবে না।
আতংকের মধ্যে ফটক খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অমুসলিম পরিবারগুলো পেছনের ফটক খোলা দেখে এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগল সেদিকে।
দূর্গ থেকে বের হচ্ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু জনতার ভিড় তাদের পথরোধ করে দাঁড়াল। শহরের শান্তি শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে পলায়নপর এসব লোকদের প্রচণ্ড ভীড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল।
আগুন প্রসারিত হচ্ছে। খড়ের গাদা থেকে এসে আগুন লাগল তাঁবুর সারিতে। সেখান থেকে সৈনিকদের মূল ব্যারাক, কিচেন, আস্তাবল আশপাশের সব কিছু গ্রাস করছে।
অবলিম্বে এ আগুন নেভানো দরকার। নইলে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়বে আগুন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল পানির স্বল্পতা নিয়ে।
শহরে কোন পুকুর নেই, আশপাশে নদীও নেই। শহুরে লোকজন পাত কুয়ার পানি ব্যবহার করে। সব বাড়ীতে হাউজও নেই। কোত্থেকে কে পানি আনবে?
লোকজন যারা পালাচ্ছে তো পালাচ্ছেই, বাকীরা দরজা বন্ধ করে বাড়ীতে অবস্থান করতে লাগল।
আগুন নেভানোর জন্য সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেয়া হল। কিন্তু আয়ুবীর আক্রমণের ভয়ে সবাইকে এ কাজে লাগানো সম্ভব হলো না। সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় সদস্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও আগুন আয়ত্বে আনতে পারছিল না।
এ অবস্থা দেখে একজন সেনা কমাণ্ডার বললেন, ‘বেগার ক্যাম্পের মুসলিম বন্দীদের দিয়ে পানি টানানো যায়।’
সাথে সাথে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষনা দেয়া হল, ‘আগুন নেভাতে পারলে কাল ভোরেই বন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে।’
বাইরের ডাক চিৎকারে জেগে উঠেছিল বন্দীরা। প্রহরী ওদেরকে সরকারী ঘোষণা শুনাল। বললো, ‘সরকার ঘোষণা করেছেন, আগুন নিভালে কাল সকালে সবাইকে মুক্তি দেয়া হবে।’
আশফাক একজন সঙ্গী বন্দীকে বললো, ‘খ্রীষ্টানদের গোটা দেশ পুড়ে গেলেও আমি আগুন নেভাবে যাবো না।’
‘পাগলামী করো না আশফাক। ওরা বলেছে আগুন নেভাতে পারলে কাল ভোরে মুক্তি দেবে।’
আশফাককে বুঝাতে চাইল সেই বন্দী।
‘ওরা মিথ্যাবাদী, ওরা আমাদের সাথে প্রতারণা করছে। আমি এখনি পালাবো, তুমিও আমার সাথে চল। পানি দেয়ার ফাঁকে সু্যোগ বুঝে ওখান থেকেই আমাদের পালাতে হবে, নইলে আর সু্যোগ পাওয়া যাবে না।’
‘আমরা যেতে পারছি না। এরা আমাদের বাড়ীঘর চেনে। তোমার তো সে সমস্যা নেই, তুমি যাও।’
‘কিন্তু পালিয়ে আমি যাব কোথায়?’
বন্দীটি তার নিজের বাড়ীর ঠিকানা দিয়ে আশফাককে বললো, ‘পরিবেশ বুঝে আমাদের বাড়ী চলে আসতে পারো। মুক্তি পেলে আমিও ওখানেই উঠবো।
কিন্তু সেখানে বেশী দিন থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। ধরা পড়লে ওরা যে কেবল তোমাকেই শাস্তি দেবে তা নয়, আমাদের পরিবারেরও কাউকে রেহাই দেবে না। তবু তুমি এসো, কতদূর কি করা যায় আমি দেখবো।’
বন্দীদেরকে বিভিন্ন কুয়া থেকে পানি টানার কাজে লাগানো হলো। সৈন্যরা পানি তুলে দিচ্ছে। বন্দীরা সে পানি এনে আগুনে ঢালছে।
কিছুক্ষণ বন্দীদের সাথে প্রহরী ছিল। কিন্তু একটু পরেই সৈন্য আর বন্দীরা সব একাকার হয়ে গেল।
কমাণ্ডার দ্রুত কাজ করার জন্য সমানে সৈন্যদের গালি গালাজ করছিল।
হঠাৎ একদিক থেকে ছুটে এল একপাল ঘোড়া। লোকজন এদিক ওদিক সরে গেল। ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেল কয়েকজন।
আশফাক সংগী বন্দীকে বললো, ‘এই সু্যোগ, চলো পালিয়ে যাই।’
সু্যোগ পেয়ে বন্দীটিও আশফাকের সাথে সটকে পড়ল।
আয়ুবীর ফৌজ দূর্গে ঢুকেছে এ কথা ভেবে মুসলমানগণ বেজায় খুশী। তারা বাড়ীঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এল।
বন্দী আশফাককে নিয়ে বাড়ীতে ঢুকল। বন্দীর বাড়ীর সবাই জেগেই ছিল সবাই বন্দীকে দেখে খুশী হল তারা। এগিয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরল।
বন্দী আশফাককে পরিবারের লোকজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওকে লুকিয়ে রাখুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে শহর থেকে বের করে দেবেন। খ্রীষ্টানরা বলেছে, কাল আমাদেরকে ছেড়ে দেবে। ওকে এখনও কেউ চেনে না। আমি এখন যাই, থেকে গেলে হয়ত কখনও ছাড়া পাব না।’
‘মুসলিম ফৌজ কি দূর্গে প্রবেশ করেছে?’ বন্দীর পিতা জিজ্ঞেস করলেন।
‘জানি না। আগুনের অবস্থা ভয়াবহ। কখন যে নিভে ঠিক নেই।’
‘আমাদের সৈন্যরা ভেতরে ঢুকে থাকলে ওকে লুকিয়ে রাখার ঝুঁকি নিতে পারি।’
‘আগামীকাল ও নিজেই এখান থেকে চলে যাবে।’
‘কিছুক্ষণ পূর্বে তোমার ছোট ভাই দু’জন মুসলমান মেয়েকে নিয়ে এসেছে। সালেমের ছেলে ওসমান প্রাসাদ থেকে ওদের উদ্ধার করে এনেছে।’
‘ওদের পরিচয় কি?’
‘গতকাল খ্রীষ্টান সৈন্যরা একটি মুসলিম কাফেলা লুট করেছিল। মেয়ে দুটো সে কাফেলায় ছিল। ওদের ভাইকেও না কি বন্দী করেছে খ্রীষ্টান সৈন্যরা।’
চমকে উঠল আশফাক।
‘মেয়ে দু’জন এখন কোথায়?’ উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল আশফাক।
‘ভেতরেই আছে।’ জবাব দিল বন্দীর পিতা।
একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর যুবতীদের কানে এলো। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল ওরা।
অপরিচিত একজন যুবকের সাথে আশফাককে সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবকিছু ভুলে ছুটে এলো দু’বোন। ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে।
তিনজনের চোখেই বইছে আনন্দের অশ্রু। পিতামাতা হারিয়ে বন্দী হয়েছিল ওরা। সাহায্য করার মত কেউ ছিল না। ফরিয়াদ জানিয়েছিল খোদার কাছে। আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
অলৌকিক প্রাপ্তির আনন্দে ওরা কাঁদছে। বন্দী যুবকটি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আবেগময় দৃশ্য দেখল।
মেয়েদেরকে রেখে ওসমান এবং বন্দীর ছোট ভাই আবার বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু বন্দীর আর অপেক্ষা করার সময় ছিল না। ফলে বন্দী যুবকটি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বন্দী বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ ওসমান এসে ঘরে ঢুকল। সাথে বারজেস এবং তার বন্ধুরা।
ঘরে ঢুকেই বারসেজ যুবতীদের ডেকে বলল, ‘শীঘ্র তৈরী হয়ে নাও। শহর থেকে বের হবার সু্যোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখুনি আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাবো।’
ওসমান ও তার সংগীরা আশফাককে দেখেই চিনতে পারল। এ ছেলেটির চিৎকার করে ওদের বিবেকের দুয়ারে আঘাত করেছিল।
ওসমান দ্রুত আশফাকের কাছে গিয়ে বললো, ‘তুমি এখানে! কি করে এখানে এলে তুমি?’
আশফাক তার মুক্তির কাহিনী বারজেস ও ওসমানের সংগীদের কাছে বলল।
দুই বোন এবং আশফাককে নিয়ে আঙ্গিনায় নেমে এলো ওরা। তিনটে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে আঙ্গিনায়।
তিন ভাইবোনকে তিনটে ঘোড়ায় তুলে দিয়ে ওসমান বলল, ‘এর থেকে বেশী কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দোয়া করি তোমাদের সফল নিরাপদ হোক। আর এক মুহুর্তও এখানে অপেক্ষা করো না। পেছনের ফটক এখনো খোলা আছে। যে কোন মুহুর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি করো, খোদা হাফেজ।’
আশফাক ও যুবতীদের চোখ কৃতজ্ঞতায় অশ্রুতে ভরে উঠল। আশফাক বললো, ‘সবকিছুই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এখনো আমি বুঝতে পারছি না আমি স্বপ্ন দেখছি, না আসলেই এ বাস্তব। যদি যা দেখছি তা সত্যি হয় তাহলে আপনাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কোন ভাষা আমার জানা নেই।’
আবেগে আশফাকের গলা বসে গেল। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘এ হয়তো আমাদের পূর্ব পুরুষের কোন মহৎ কাজের ফল। আমি আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করছি এবং তার কাছেই আপনাদের এ কাজের বদলা দেয়ার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি।’
‘খোদা হাফেজ বন্ধুরা! বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। তোমরা সতর্ক থেকো।’ বললো ওসমান।
বারজেস ও ওসমানরা হাঁটা দিল। কয়েক কদম গিয়ে পেছন ফিরে চাইল একবার। দেখল তিনটি ঘোড়া পেছন দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
ওসমান বন্ধুদের নিয়ে বাড়ীর পথ ধরল, বারজেস শহরের পেছনের ফটকের দিকে এগিয়ে চললেন।
গেটে পলায়নপর মানুষের প্রচণ্ড ভীড়। খানিক পূর্বে বারজেস এসে দেখে গেছেন এ ভীড়। ভীড় দেখেই তার মনে এলো, এদের সাথে তিনিও মেয়েদের নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।
এ ভাবনা মনে আসতেই তিনি দ্রুত ওসমানের কাছে গেলেন এবং সংগ্রহ করলেন তিনটে ঘোড়া। দুটো দু’বোনের জন্য, নিজের জন্য একটা। কিন্তু আশফাক অতিরিক্ত হওয়ায় তিনি হেঁটেই গেটের দিকে যাত্রা করলেন।
চারজনই এসে গেছেন ফটকের কাছে। সেনা কমাণ্ডার যখন দেখল শহরের লোকজন দলে দলে পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন ফটক বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে ফটক বন্ধ করা যাচ্ছিল না। সৈন্যরা লোকজন সরিয়ে ফটক বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগল। লোকজনকে এদিক ওদিক হাকিয়ে ফিরতে লাগল তারা।
সৈন্যদের হাকডাকে জনতার চাপ কিছুটা কমে এল। সু্যোগ পেয়ে ধীরে ধীরে ফটক বন্ধ করতে লাগল সৈন্যরা। মানুষের মিছিল ফটকের কাছে আটকে পড়ল।
বারজেস, আশফাক এবং যুবতীরাও আটকা পড়ল সেই সাথে। ফটক বন্ধ হয়ে গেলে আর বের হওয়া যাবে না। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয় এলে ওদের ধরা পড়ারও সমূহ সম্ভাবনা। বিপদ টের পেল বারজেস। সাথে সাথেই সে ছুটে গেল গেটের কাছে। ওখানে পৌঁছেই বারজেস চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘পেছনে সৈন্যরা আসছে। তাড়াতাড়ি ফটক খুলে দাও। জলদি করো।’
বারজেসের চিৎকার শুনে বন্ধ হতে হতেও তা আর বন্ধ হলো না। আবার খুলে গেল গেট। সু্যোগ পেয়ে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন হুড়মুড় করে পুনরায় বেরিয়ে যেতে লাগল। বেড়ে গেল মানুষের চাপ। বাধ ভাংগা জোয়ারের মত জনতার স্রোত ছুটে চলল বাইরের দিকে। সে স্রোতের সাথে মিশে বাইরে বেরিয়ে এল বারজেস ও তার সংগীরা।
ফটকের বাইরে এসে বারজেস বললেন, ‘আশফাক, তুমি তোমার কোন বোনের সাথে উঠে বসো। একটা ঘোড়া আমাদের দু’জন পুরুষের ভার বইতে পারবে না। নিরাপদ জায়গায় পৌঁছতে হলে আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।’
আশফাক নিজের ঘোড়া থেকে নেমে ছোট বোনের ঘোড়ায় গিয়ে উঠে বসল। আশফাকের ঘোড়ায় উঠে বসলেন বারজেস। ছুটে চলল তিনটি ঘোড়া।
শহরের বাইরে খ্রীষ্টানদের টহল ছাউনিগুলো জানতেন বারজেস। তাই ওদের চোখ বাঁচিয়ে চলার জন্য বড় রাস্তা ছেড়ে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে শহরের দাবানল।
মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। হিমেল বাতাস বয়ে চলেছে মরুভূমির বিশাল প্রান্তর জুড়ে। আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। হালকা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর। মিটিমিটি জ্বলছে ধ্রুবতারা। আদম সুরাত উঠে এসেছে মাথার ওপর। অপরূপ এক নৈসর্গিক পরিবেশে নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে ছোট্ট একটি কাফেলা। যে কাফেলার এখন মাত্র তিনটি ঘোড়ায় চারজন মানুষ।
অথচ গতকালও বিশাল এক কাফেলার সাথে পথ চলছিল ওরা। সে কাফেলায় ছিল প্রায় দুইশ সংগী সাথী, ছিল প্রচুর মাল সামান, ছিল আত্মীয় পরিজন। কিন্তু কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সবই এখন অতীতের দুঃখময় স্মৃতি হয়ে আছে।
চুপচাপ পথ চলছিল ওরা। কারো মুখে কোন কথা নেই। আশফাকের মনে পড়ল তার বাপ-মায়ের কথা। গতকালও তার পিতা তাকে শান্তনা দিয়ে বলছিল, ফেলে আসা বাড়ী ঘরের কথা মনে করে মন খারাপ করো না। যেখানে যাচ্ছি সেখানে খ্রীস্টানদের নির্যাতনের ভয় নেই। ওখানে গিয়ে আমরা নতুন করে ঘর বাঁধবো।
তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, বেটা অনেক বড় হয়ে গেছে। এবার একটা বউ ঘরে আনতে হয়।
আর আজ! আজ ওরা এতীম। দুটো যুবতী বোনের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। কোথাও তাদের আশ্রয় নেই। কোন সম্পদ নেই। এই রাতটুকু কেটে গেলে কাল সকালে তারা কি খাবে তারও কোন খবর জানা নেই আশফাকের। বোন দুটোকে নিয়ে কোথায় চলেছে, কোথায় এ সফরের শেষ সে কথাটুকু জানা নেই তার।
আশফাক জানে না বোনদের কিভাবে মুক্ত করা হয়েছে। সে কানিহী শোনারও সময় পায়নি সে। বারজেসও নীরব। দু’একবার শুধু জিজ্ঞেস করছেন ওরা ভয় পাচ্ছে কি না।
দাবানল পেছনে ফেলে তীব্র গতিতে ছুটে চলছে ঘোড়াগুলো। বারজেস ছাড়া বাকীরা জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়।
আশফাক বোনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভয় পাচ্ছো বুবু?’
‘না।’ ছোট্ট করে জবাব দিল বোন।
‘দুশ্চিন্তা লাগছে?’
‘না। আল্লাহ যখন খ্রীষ্টানদের কবল থেকে একবার বেরিয়ে আসতে দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই তিনিই কোন নিরাপদ আশ্রয়েরও ব্যবস্থা করবেন।’
আর কোন কথা হলো না। শেষ রাতের বাতাস চিরে বারজেসের পিছু পিছু সমান তালে ছুটে চলল আশফাক ও তার বোনের ঘোড়া।
* * *
সূর্যোদয়ের পর পরই বারজেস মুসলিম সেনাবাহিনীর এলাকায় পৌঁছলেন। একটা পাহাড়ের মোড় ঘুরতেই আয়ুবীর টহল বাহিনীর সামনে পড়ে গেল ওরা।
টহল বাহিনী ওদের থামতে বলল। ঘোড়ার বাগ টেনে ধরলেন বারজেস। সাথে সাথে বাগ টেনে ধরল আশফাক এবং সামিরা। অজানা আতঙ্কে ছেয়ে গেল ওদের মন।
টহল বাহিনী এগিয়ে গেল ওদের কাছে। কমাণ্ডার সামনে বেড়ে ওদের পরিচয় জানতে চাইল।
বারজেস কমাণ্ডারের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন সুলতানের অবস্থান। বললেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে। অবিলম্বে আমার সুলতানের কাছে পৌঁছা দরকার।’
তিনি খ্রীষ্টানদের সামরিক রসদ ধ্বংস হওয়ার সংবাদ সুলতানকে দিয়ে যতশীঘ্র সম্ভব ক্রাক আক্রমণের পরামর্শ দিতে চাইছিলেন। কমাণ্ডার সবার ওপর দিয়ে একবার নজর ঘুরিয়ে বলল, ‘আমার সাথে আসুন।’
ক্রাকের দাবানল নিভে গিয়েছিল। তবুও কোথাও কোথাও কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল ধোঁয়া। রাতভর ছুটাছুটি করে ক্লান্ত ঘোড়াগুলো ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ফাঁকা ফটক দিয়ে কিছু ঘোড়া চলে গিয়েছিল শহরের বাইরে।
এখানে সেখানে পড়েছিল উন্মত্ত ঘোড়ার পায়ে পিষে মরে যাওয়া মানুষের লাশ।
সৈন্য এবং বন্দীরা মিলে এখনো কুপ থেকে পানি তুলে ক্লান্ত হয়ে সে পানি আগুনে ফেলছিল।
দূর্গের কোথাও মুসলিম ফৌজের চিহ্নও নেই। দূর্গের বাইরেও বিস্তৃত ময়দান জুড়ে খ্রীষ্টানদের সেনা ছাউনি। আগুন কিভাবে লাগল, কে লাগালো, কিছুই জানে না কেউ।
সম্রাটগণ প্রাসাদের ভেতর পরামর্শ সভায় বসলেন। একজন সম্রাট বললেন, ‘এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। আয়ুবীর বাহিনী আমাদের আক্রমণ করেনি অথচ আমাদের সমস্ত রসদ সামান তছনছ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়েছে। যুদ্ধের বিপুল পরিমাণ উট ও ঘোড়া হারিয়ে গেছে। জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কার জন্য, কিভাবে এত বিপুল পরিমান ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের হতে আগে তার তদন্ত হওয়া দরকার।’
উপস্থিত সম্রাটদের সম্মতির ভিত্তিতে গোয়েন্দা প্রধান রেমুনের নেতৃত্বে গঠিত হলো তদন্ত কমিশন। তিনদিনের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট পেশ করতে বলা হলো তদন্ত কমিশনকে। কালবিলম্ব না করে কমিশন তদন্ত কাজে নেমে পড়ল।
সেন্ট্রির লাশ পাওয়া গেল খড়ের গাদা থেকে সামান্য দূরে। কেউ তাকে হত্যা করেছে এমন কোন আলামত পাওয়া গেল না তার লাশ দেখে।
ঘোড়ার পায়ে পিষে মুছে গেছে খঞ্জরের আঘাতের দাগ। ইউনিফর্ম দেখেই শুধু বুঝা গেল সে ডিউটিরত সেন্ট্রি ছিল।
একটু দূরে পাওয়া গেল চারটি মেয়ের মৃত দেহ। দেহের কোন অংশ অক্ষত নেই। হাজার হাজার ঘোড়া ওদের দেহের উপর দিয়ে ছুটে গেছে।
ওরা কার মেয়ে, কোন ধর্মের কিছুই বলার উপায় নেই। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কাপড়ের টুকরা থেকে ওদের মেয়ে বলে মনে হয়।
মেয়েদের লাশ দেখে আশ্চর্য হল সবাই। এখানে মেয়েরা এলো কি করে? নিষিদ্ধ এ এলাকায় কোন সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। না কোন পুরুষ, না কোন মেয়ে। কেন এবং কোত্থেকে এ মেয়েরা এলো এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই কারো কাছে।
কতগুলা লাশ পাওয়া গেল রসদের আশপাশে। লাশগুলো সব সাধারণ সৈনিকদের।
তদন্ত কমিশন মেয়েদের লাশগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
রাতে মেয়েরা কেন এসেছিল এর হদিস কেউ বের করতে পারল না। তদন্ত কমিশণ ধারণা করল, এসব নিহত সৈন্যরা হয়ত পেশাদার মেয়েদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিল।
তাহলে আগুল লাগল কিভাবে? চলাচলের পথ থেকে খড়ের গাদা বেশ দূরে। আগুন নিয়ে সেন্ট্রির তো খড়ের গাদার কাছে যাওয়ার কথা নয়। মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করলেও মশাল তো রাস্তায় রেখে যাওয়ার কথা!
আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রেমন মেয়ে চারটের লাশের ময়না তদন্ত করার প্রয়োজন অনুভব করলেন। দলে যাওয়া চারটে লাশ তুলে আনা হলো ময়না তদন্তের জন্য। প্রথমেই ওদের চোখে পড়ল প্রতিটি লাশের গলায় ঝুলে আছে একটি করে ক্রুশ।
এরা তাহলে খ্রীষ্টান মেয়ে? তদন্ত অফিসার খ্রীষ্টান পরিবাগুলোতে অনুসন্ধান করার জন্য বললেন সহকারীদের।
অনুসন্ধানের জন্য গোয়েন্দা বাহিনী ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। শহরের প্রতিটি খ্রীষ্টান পরিবারে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য এলাকা ভাগ করে নিল তারা।
পরদিন তারা রিপোর্ট করল, অধিকাংশ এলাকারই অর্ধেকের বেশী খ্রিষ্টান পরিবার শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ফলে মেয়েদের পরিচয় পাওয়ার কোন উপায় নেই এখন। পরিস্থীত শান্ত হলে যদি সে সব খ্রীষ্টান পরিবারগুলো ফিরে আসে তবেই এর হদিস নেয়া সম্ভব।
আল নূর এবং অন্য তিনজন যুবতীর পরিজন উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটাচ্ছিল। এখনও কেউ ফিরে আসেনি। তবে কি ধরা পড়ল ওরা?
ওসমান এবং তার সংগীরা আগুনের পাশে দর্শকদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। চারটে মেয়ের মৃত দেহকেই সামনে দেখতে পেল ওরা। লাশগুলো এত বিভৎসভাবে থেতলানো যে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। অন্যরা তো দূরের কথা, ওসমানের পক্ষেও সম্ভব হলো না তার নিজের বোনকে সনাক্ত করার।
ওসমানের চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এল। অশ্রুতে ভরে গেল বন্ধুদের চোখগুলোও। ওরা জানে এ লাশ কার, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বোনের জন্য কান্নারও কোন উপায় নেই।
সাবধানে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ভীড় থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বোনেরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়ে গেছে। ওদের দেহ কত ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়েছে কে জানে।
দু’জন যুবতীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য জীবন বিলিয়ে দিল চারজন তরুণী।
ধরা পড়লে যেন আত্মরক্ষা করতে পারে এ জন্য বারজেস ওদের গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সে ক্রুশ গলায় নিয়েই সেখানে পড়ে রইল লাশগুলো।
ভাইয়েরা দেখল বোনদের লাশ কিন্তু সে লাশের জানাযা দিতে পারল না ওরা। লাশগুলো সেখান থেকে তুলেও আনতে পারল না। কারণ লাশগুলো যে খ্রীষ্টান মেয়েদের তার প্রমাণ ঝুলে আছে তাদের গলায়। সে পরিচয়কে মুছে দেওয়ার সাধ্য নেই কারো।
খ্রীষ্টানদের কবরস্থানেই সমাহিত করা হল চারজন মুসলিম তরুণীর মৃতদেহ। ওদের পরিবারের লোকজন গোপনে কোরানখানি করল। গায়েবানা জানাযা পড়ল।
এ সব মেয়েদের পিতা-মাতারা ইসলামের জন্য ছেলেদের উৎসর্গ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ ছেলেদের আগেই মেয়েদেরকে পছন্দ করে নিলেন। এ কোরবানী বড়ই দুঃসহ, বড়ই বেদনাদায়ক।
অত্যন্ত গোপনে তাদের জন্য দোয়া অনুষ্ঠান হলো। অনুষ্ঠানে বাঁধ ভাংগা কান্না শুরু হলে ইমাম সাহেব বললেন, ‘আল্লাহর ফয়সালা বুঝার সাধ্য আমাদের নেই। আজ আপনারা নিজেদের মেয়েদের জন্য কাঁদছেন, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস পড়লে আপনারা দেখতে পাবেন, মহানবীর (সা) নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানেও প্রথম শহীদ ছিলেন একজন মহিলা।
আজ আপনাদের সৌভাগ্য দেখে নিজেকে বড় দুর্ভাগা মনে হচ্ছে। না নিজে শহীদ হতে পারলাম, না শহীদের পিতা বা ভাই হতে পারলাম!’
* * *
মুসলমানদের বাড়ী বাড়ী তল্লাশী শুরু হয়ে গেছে। ধরা পড়ার আশংকায় ওসমানরা অস্ত্রশস্ত্র মাটির নীচে লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল মেয়েদের নিয়ে।
প্রতিবেশীরা যদি মেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করে কি জবাব দেবে তারা?
ওরা এ সমস্যা নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে গেল। দূরদর্শী ইমাম চারজন মেয়ের পিতাকে নিয়ে গেলেন পুলিশের সদর দফতরে।
পুলিশ অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি এদের ইমাম। আমার কাছে এরা এক গুরুতর নালিশ নিয়ে এসেছে। সবাই যখন আগুন নেভাতে ছুটে গেছে তখন সৈন্যরা এদের যুবতী মেয়েদেরকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে গেছে।’
‘সেনাবাহিনীর নামে কোন অপবাদ দেয়ার পূর্বে ভাল করে ভেবে নাও।’ বললেন পুলিশ অফিসার।
‘মাননীয় পুলিশ সুপার, আমি একজন ধর্মীয় ইমাম। আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেন। সৈন্যদের অপরাধ ঢেকে তাদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন। এ ক্ষমতা আপনার আছে।
কিন্তু আমি বলছি, আপনি শাসক হলেও খোদা নন। সৈন্যদেরকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য এরা সারা রাত আগুনের সাথে যুদ্ধ করেছে। আর এভাবেই আপনি তাদের সে সেবার প্রতিদান দিচ্ছেন? সৈন্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে এ কথাটুকু স্বীকারই করতে চান না?’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি সৈন্যদের নির্দোষ বলিনি, আমি শুধু বলেছিলাম সেনাবাহিনীর নামে কোন কথা বলার আগে ভালভাবে ভেবে দেখতে। আপনি যদি তারপরও অভিযোগ করতে চান তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমরা এর তদন্ত করে দেখবো।’
পুলিশ প্রধানের মুখে এ কথাটিই শুনতে চাইছিলেন ইমাম সাহেব। বাইরে এসে মেয়েদের পিতাদের বললেন, এখন এ কথা সর্বত্র ছড়িয়ে দাও যে, তোমরা যখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত, তখন সৈন্যরা এসে ওদের ধরে নিয়ে গেছে। এখনো সেই মেয়ে ঘরে ফিরে আসেনি, সে কোথায় আছে, কেমন আছে তোমরা কেউ তা জানো না।’
সাথে সাথে পরিবারের লোকজন এ কথা সবার কাছে প্রচার করে দিল।
রাজকীয় ডাক্তার আশফাকের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করছেন। বরজেস তাকে ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে সুলতানের তাঁবুর দিকে পা চালালেন।
সুলতানের তাঁবুতে এসে ঢুকলেন বারজেস। সুলতান তাকে বসতে বলে বললেন, ‘এবার বলো কি খবর নিয়ে এসেছো?’
বারজেস সুলতানের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। ঘটনা বর্ণনা শেষ হলে বারজেস সুলতানকে বললেন, ‘সুলতান, এখনই ক্রাক আক্রমণ করা দরকার।’
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান। একটু পর মাথা তুলে প্রহরীকে বললেন, ‘উপদেষ্টাদেরকে ডেকে আনো।’
প্রহরী বেরিয়ে গেলে তিনি তাকালেন বারজেসের দিকে। বললেন, ‘মেয়ে দুজন এবং ছেলেটাকে কায়রো পাঠিয়ে দাও। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এদের থাকা খাওয়া ব্যবস্থা করা হবে।’
সামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ এসে হাজির হলেন সুলতানের তাঁবুতে। উপদেষ্টারা সবাই এসে পৌঁছলে বৈঠক শুরু হলো। সুলতান বললেন, ‘বারজেস, এদের সামনে ক্রাকের অবস্থা বর্ণনা করো।’
বারজেস নতুন করে ক্রাকের পরিস্থিতি আবার বর্ণনা করলেন উপদেষ্টাদের সামনে। বর্ণনা শেষ হলে আবারো ক্রাক আক্রমণ করার জন্য অনুরোধ রাখলেন তিনি।
উপদেষ্টাদের কেউ কেউ এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে সুলতানকে পরামর্শ দিলেন, ‘বারজেস ঠিকই বলেছে, অবিলম্বে আমাদের ক্রাক অবরোধ করা উচিত।’
অনেকক্ষণ ধরে অভিযানের ফলাফল কি হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা হলো। আশু অভিযানের লাভ-ক্ষতি খতিয়ে দেখার পর দীর্ঘ আলোচনার শেষে উপদেষ্টাগণ অভিযানের স্বপক্ষেই তাদের মতামত ব্যক্ত করলেন।
সকলের মতামত শুনে সুলতান বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি শীঘ্রই ক্রাক আক্রমণ করবো। তবে আপনারা জানেন, তাড়াহুড়া আমি পছন্দ করি না।
খ্রীষ্টানদের সেনাবাহিনী এখন বাইরে ছড়িয়ে আছে। আমরা অবরোধ করলে ওরা বাইরে থেকে আক্রমণ করে আমাদের অবরোধ ব্যর্থ করে দিতে পারে।
তা ছাড়া ক্রাকের মুসলমানদেরকে আরও প্রস্তুত করা প্রয়োজন। তারা আল্লাহর মদদে এক আকস্মিক অভিযানে সফল হলেও সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মত অবস্থায় তারা আসেনি।
আমি মনে করি, এ মুহুর্তে আমরা অভিযান পরিচালনা করলে, আমরা দূর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও যুদ্ধ হবে বাইরে। কারণ, খ্রীষ্টান বাহিনীর একটা বিপুল অংশ এখন শহরের বাইরে অবস্থান করছে। আমরা অবরোধ করার আগেই তারা আমাদের মোকাবেলায় ছুটে আসবে।
আমরা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে দূর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও বাইরের শক্তিকে একেবারে নিঃশেষ করে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে আমরা ভেতর-বাহির দু পক্ষের মাঝখানে পড়ে যাবো।’
‘মাঝখানে হস্তক্ষেপ করার জন্য ক্ষমা চাইছি সম্মানিত সুলতান।’ বললেন বারজেস।
‘এ মুহুর্তে কিছু কমাণ্ডো সৈনিক ক্রাক পাঠানো যেতে পারে। যে সব লোক শহর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ওরা আবার ফিরে আসছে। ওদের সাথে কমাণ্ডো বাহিনীও ভেতরে ঢুকতে পারবে। পরে আর সম্ভব হবে না। যখনি অভিযান হোক এ সব কমাণ্ডোরা তখন কাজে দেবে।’
উপদেষ্টাগণ এবারও বারজেসকে সমর্থক করলেন। বললেন, ‘সুলতানের কথাই ঠিক। আজই অভিযান চালালে আমরা দুপক্ষের মাঝখানে পড়ে যেতে পারি। তবে কমাণ্ডো বাহিনী পাঠালে সে ভয় থাকে না।’
সুলতানও এ প্রস্তাবের পক্ষে একমত হলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, এ মুহুর্তে আক্রমণ না করে বারজেসের নেতৃত্বে একটি কমাণ্ডো বাহিনীকে ক্রাকে পাঠানো হবে।
বারজেস সুলতানকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিলেন।
আশফাকের কাছে গিয়ে তাকে শোনালেন সুলতানের ইচ্ছার কথা।
‘আমার বোনেরা কায়রো যাক’, আশফাক বললো, ‘আমি আপনার সাথেই থাকবো। আমি আমার পিতা-মাতার খুনের বদলা নিতে চাই।’
‘যুদ্ধ আবেগ দিয়ে হয় না। এ জন্য কঠোর অধ্যবসায় এবং কঠিন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তুমি তোমার পিতা-মাতার রক্তের প্রতিশোধ নিতে চাইছো। আর আমরা খ্রীষ্টান পশুদের দ্বারা নির্যাতিত সকল পিতা এবং মেয়েদের ইজ্জতের প্রতিশোধ নিতে চাই। শান্ত হও বেটা, সুলতানের ফয়সালা মেনে নাও।’
কিন্তু আশফাক অটল। তার এক কথা, সে কায়রো যাবে না।
শেষ পর্যন্ত বারজেস তাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আমার পরামর্শ শোন, যে কোন মুহুর্তে সেনাবাহিনী এ জায়গা ছেড়ে দিতে পারে। অসুস্থ অবস্থায় তাদের সাথে চলা তোমার সম্ভব হবে না। এখন তুমিও কায়রো চলে যাও, আমি কথা দিচ্ছি, সুস্থ হলে তোমাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো।’
কমাণ্ডো বাহিনী গঠিত হলো। বারজেস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। ওদের বিদায় জানানোর জন্য সেনা অফিসাররা বেরিয়ে এলো তাঁবুর বাইরে।
সুলতান কমাণ্ডো সৈন্যদের উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘তোমরা ক্রাকের মুসলমানদের মুক্তির জন্য ওখানে যাচ্ছো। ওরা তোমাদের সহযোগিতার করবে। কিন্তু ওদের ওপর নির্ভর না করে নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করবে।
কমাণ্ডো অভিযানের সফলতা নির্ভর করে শত্রুর কাছ থেকে নিজেদের অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতা গোপন রাখার মধ্যে। ক্ষিপ্রতা ও সাহসিকতার মধ্যে। শত্রুর অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখার মধ্যে। আশা করি এসব বিষয়ে তোমরা সজাগ ও সচেতন থাকবে।’
সুলতানের কথা নিষ্ঠার সাথে পালন করার শপথ নিয়ে বারজেসের নেতৃত্বে কমাণ্ডো বাহিনী সন্ধ্যার একটু পরেই ক্রাকের পথ ধরল।
আশফাক এখন মোটামুটি সুস্থ। আঘাতের ক্ষতগুলো শুকিয়ে এসেছে। তাঁবুর বাইরে বসে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে তাকিয়েছিল সে। পিতা মাতার রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ছটফট করছিল তার অশান্ত হৃদয়। আমিনা ও সামিনা কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি সে।
আমিনা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। আশফাক চমকে উঠে মুখ তুলে চাইল।
‘আশফাক, এখন কেমন বোধ করছিস?’
‘ভাল আপু। দুদিন থেকে জ্বর আসছে না। গায়ে ব্যথা বেদনাও তেমন নেই।’
‘সেনাবাহিনী ক্রাকে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের অবিলম্বে কায়রো রওয়ানা হয়ে যাওয়া দরকার।’
‘হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম।’
‘ওরা জানিয়েছে তুই চলতে পারলেই ওরা আমাদের নিয়ে রওনা হবে। আমাদের সাথে ছয়জন প্রহরীও যাবে।’
‘আমি প্রস্তুত। তুমি ওদেরকে রেডি হতে বলো।’
সেদিনই রাতে সুলতান ওদের ডেকে পাঠালেন। ভাই বোন তিন জন সুলতানের তাঁবুতে পৌঁছলে তিনি তাদের বসতে বললেন।
ওরা বসলে সুলতান বললেন, ‘কাল সকালে ছ’জনের একটি কমাণ্ডো গ্রুপের সাথে তোমরা কায়রো যাত্রা করবে। বারজেস আমাকে জানিয়েছে, আশফাক পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধের ময়দানে থাকতে আগ্রহী। কিন্তু আমরা তো কেবল প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধ করছি না, আমরা লড়াই করছি দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। আমাদের লড়াই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, জালিমের বিরুদ্ধে। সেখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানোর কোন সু্যোগ নেই। কেবল দ্বীনের জন্য লড়াই করতে চাইলেই তোমাকে আমরা সাথে নিতে পারি।’
আশফাক বললো, ‘আমরা কি নির্যাতিত নই, আমাদের ওপর কি জুলুম করা হয়নি?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে, কিন্তু এ জুলুমের হাত থেকে কেবল দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারলেই নিস্তার পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহ মহান। সারা দুনিয়ার সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি। তার বিচারে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই বলেই আল্লাহর বিধানের বিজয় চাই আমরা। যেখানে জুলুমের কোন অবকাশ নেই।’
‘আমি আপনার বাহিনীতে যোগ দিতে চাই।’
‘আশফাক, ক্রাকের বাহিনীতে এ মুহুর্তে তোমাকে শামিল করতে পারছি না। তবে তুমি চাইলে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমাকে পাঠাতে পারি।’
‘আপনি আমাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করবেন। আমি আমার জীবন দ্বীনের কাজে আপনার হাতে তুলে দিলাম।’
‘আশফাক, তোমার মত যুবকদের চোখ, কান খুলে দেয়াই আমি আমার প্রথম কর্তব্য মনে করি। মুসলিম বিশ্বে আল্লাহর দ্বীনের পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মত যুবকদের অভাব নেই। যে কোন মুসলিম জনপদে গিয়ে ডাক দিলে হাজার হাজার যুবক পাবে, যারা অকাতরে দ্বীনের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া।
আমাদের আসল অভাব উপযুক্ত নেতৃত্বের, আর প্রধান শত্রু শয়তান। শয়তান আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে বিপথগামী করার শপথ নিয়েছিল। সে সব সময় আমাদের বিরুদ্ধে তৎপর। এখন তোমার যে আবেগ আছে কাল সে আবেগ নাও থাকতে পারে। সচেতন না তাকলে লোভ, ভয়, মোহ কখন তোমাকে তোমার পথ থেকে সরিয়ে নেবে তা তুমি টেরও পাবে না।’
‘আমি সব সময় সচেতন থাকবো সুলতান।’
‘কিন্তু কেবল নিজের ব্যাপারেই সচেতন থাকলে চলবে না। কায়রো পৌঁছে সেখানকার উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা, আমরা ও আমীর ওমরাদের উপর তোমাকে নজর রাখতে হবে। সেখানে গোয়েন্দা কাজের জন্য তোমাকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ট্রেনিং শেষে কায়রোয় অবস্থিত আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের সাথে কাজ করবে তুমি।’
‘কিন্তু তাদের আমি কোথায় খুঁজে পাবো?’
‘তোমাকে খুঁজে পেতে হবে না, আমাদের লোকই তোমাকে খুঁজে নেবে।’
আমিনা সুলতানের দিকে অনুনয় ভরা চোখে বলল, ‘মাননীয় সুলতান, আপনি জানেন আমরা এতীম। সহায় সম্পদ বলতে আমাদের কিছু নেই।’
সুলতান বললেন, ‘এ নিয়ে তোমাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তোমাদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ ইতিমধ্যেই আমার কাছ থেকে চলে গেছে।’
‘মাননীয় সুলতান, আমরা এ কথা বলতে চাইনি। আমরা বলতে চাচ্ছি, আমরা কি আপনার কোন কাজে লাগতে পারি না?’
‘কেন নয় বোন, কাজের কি অভাব আছে? তোমরা চাইলে আশফাককে আমি বলে দেবো। সেই তোমাদের পছন্দ অনুযায়ী কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।’
‘সুলতান, আমরা এমন কাজে জড়িত হতে চাই যাতে জাতি উপকৃত হয়। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পুরুষের পক্ষে পৌঁছা কঠিন, অথচ মেয়েরা অনায়াসেই যেতে পারে। আমার মনে হয় গোয়েন্দা কাজে আপনার মেয়ে কর্মীও দরকার। আপনি কি আমাদেরকে এ জাতীয় কোন কাজে লাগাতে পারেন না?’
‘প্রিয় বোন, এ খুব কঠিন ক্ষেত্র। এ কাজে জড়ানোর আগে ভালভাবে চিন্তা করে নাও। যদি তোমরা তারপরও গোয়েন্দা বিভাগেই কাজ করতে চাও আমার আপত্তি নেই।’
‘সুলতান, আমাদের কোন পিছু টান নেই। আমাদের হারাবারও কিছু নেই। আপনি আমাদের নিশ্চিন্তে এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন।’
‘তোমরা আল্লাহর পথে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চাইলে তার থেকে নিবৃত্ত করার কোন অধিকার আমার নেই। আমি তোমাদের হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহর হাতে সোপর্দ করছি।
কিন্তু তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ কাজ বড়ই কঠিন। প্রতিপক্ষের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তৎপরতাও থাকবে তোমাদের চোখের সামনে। নিজের প্রতিটি সহকর্মীর প্রতিও তোমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আস্থা ও সন্দেহের সম্পদে ভরা থাকবে তোমাদের হৃদয়।
কারো কোন কাজে সন্দেহ হলে তার অতীত বিশ্বস্ততার কথা স্মরণ করে না তার পদমর্যাদার কথা ভেবে সেদিক থেকে চোখ ফেরানোর কোন সু্যোগ নেই তোমাদের। আবার নেতৃবৃন্দ ও সহকর্মীদের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা না থাকলেও তুমি কোন কাজই করতে পারবে না।
এই আস্থা ও সন্দেহের সমন্বয় সাধন করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কিন্তু এই বিভাগে যারা কাজ করবে এ কঠিন কাজে তাদের স্বচ্ছ ও পারদর্শী হতেই হবে।’
সুলতানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় হেদায়াত ও নির্দেশনা নিয়ে ভাই বোন বেরিয়ে এলো আয়ুবীর কামরা থেকে।
পরদিন ভোরে ছয়জন কমাণ্ডোর সাথে কায়রোর উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসল তিন ভাই বোন। দেখতে দেখতে সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী ও তার সেনাবাহিনীর তাঁবুগুলো পেছনে ফেলে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে। মরুভূমির ধূলি উড়িয়ে এগিয়ে চলল নয়টি ঘোড়া।
মরুভূমির সূর্য বেরিয়ে এল একটা বালির পাহাড়ের আড়াল থেকে। তিন সারিতে পথ চলছে ওরা। সামনে তিন জন কমাণ্ডো, মাঝখানে তিন ভাই বোন, পেছনে বাকী কমাণ্ডো তিন জন।
মাথার ওপর রোদের তেজ বাড়ছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মরুভূমির বাতাস।
ঘণ্টা দুই নির্বিঘ্নে চলার পর দলটির চোখে পড়ল প্রথম চৌকি। আরো বিশ মিনিট লাগল তাদের সে চৌকিতে পৌঁছতে।
ওখানে পৌঁছে তারা নাস্তা সারল। আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার ঘোড়ায় চাপল তারা। আরো দু’ঘণ্টা পথ চললে দ্বিতীয় চৌকিতে পৌঁছে যাবে ওরা। দুপুরের আগেই সেখানে পৌঁছতে চায় দলটি।
ধূলিঝড় তুলে এগিয়ে চলল ওরা দ্বিতীয় চৌকির উদ্দেশ্যে। আজকের মত যাত্রা বিরতি করবে ওরা ওখানে। গরম লু হাওয়া ঝাপটা মারছে ওদের চোখে মুখে। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত বালির সমুদ্র। রোদ পরে চিকচিক করছে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর তারা একটি ওয়েসিসকে পাশ কাটাল, কিন্তু থামল না ওখানে।
ওয়েসিসের পাশে খেজুর গাছের ছায়ায় বসে আছে চারজন বেদুঈন। পাশে চারটি ঘোড়া বাঁধা।
ছোট্ট কাফেলাটিকে চলে যেতে দেখল ওরা। কেউ কোন মন্তব্য করল না।
সূর্য মাথার ওপর উঠে আসার আগেই দ্বিতীয় চৌকিতে পৌঁছে গেল ওরা। কমাণ্ডার বলল, ‘রোদ না কমা পর্যন্ত এখানেই বিশ্রাম নেবো আমরা।
রাতে আকাশে চাঁদ থাকবে। পথ চিনতে অসুবিধা হবে না। সন্ধ্যার পর আমরা আবার যাত্রা করবো। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিন সবাই। পারলে ঘুমিয়ে নেঁবেন যাতে রাতে বেশী পথঅতিক্রম করতে পারি।’
কায়রো তিন দিনের পথ। আরো দুটি রাত তাদেরকে মরুভূমিতে কাটাতে হবে।
আশফাক ও মেয়েদের কাছ থেকে ঘোড়ার বাগ হাতে নিল দুজন কমাণ্ডো। ঘোড়াগুলো যত্ন নিয়ে তাদের দানাপানি দিয়ে ফিরে এল ক্যাম্পে। মেয়েরা খাওয়া দাওয়ার পর জোহরের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ল তাদের তাঁবুতে। দুজনকে পাহারার জন্য রেখে আশাফাক এবং কমাণ্ডোরাও ঢুকে গেল তাঁবুর ভেতর।
সূর্য ডোবার খানিক আগেই উঠে পড়ল সবাই। আছরের নামাজ শেষে প্রস্তুতি হলো আবার যাত্রার জন্য।
সামনে আরো একটা চৌকি পাওয়া যাবে আয়ুবীর। তারপর পাড়ি দিতে হবে বিশাল উন্মুক্ত মরুভূমি। মাঝে মধ্যে দু একটা বেদুঈল পল্লী ছাড়া সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের পুরোটাই ফাঁকা।
সন্ধ্যায় রক্তলাল সূর্যটা হারিয়ে গেল দূর বালিয়াড়ির আড়ালে। একটু পরেই পূর্ব দিক থেকে উঁকি মারল গোলগাল চাঁদ। তারার মেলা বসল চাঁদের হাটে। যেন মস্ত কোন পুকুরে কেউ শাপলার চাষ করেছে।
শরীর জুড়ানো মৃদুমন্দ কোমল হাওয়া বইছে। উজ্জ্বল রূপালি চাঁদের ঠাণ্ডা আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমস্ত মরুভূমি।
দীর্ঘ বিশ্রামের পর ঝরঝরে চাঙ্গা শরীর নিয়ে নিজ ঘোড়ায় চেপে বসল ক্ষুদ্র দলটি। কমাণ্ডারের সাথে সাথে কায়রোর দিকে ঘোড়া ছুটাল সবাই।
ধীরে ধীরে চাঁদ উপরে উঠতে লাগল। চাঁদের মায়াবী আলো গায়ে মেখে এগিয়ে চলল কাফেলা।
একটানা তিন ঘণ্টা চলার পর ছোট্ট একটা পাহাড় পড়ল সামনে। মেয়েরা একটানা পথ চলায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
কমাণ্ডার বলল, ‘আধ ঘন্টার জন্য আমরা এ পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নেবো। এর মধ্যে প্রাকৃতিক ক্রিয়া ও এশার নামাজ সেরে নিতে হবে সবাইকে। রাতের খাবার সবাই চাইলে এখানেই হতে পারে, নইলে আরো দু’ঘণ্টা চলার পর একটা ওয়েসিস পাবো, সেখাতে হতে পারে।’
মেয়েরা বলল, ‘আমরা এখন খাবো না। তাহলে ক্লান্তি এসে ভর করবে।’
কমাণ্ডার বলল, ‘তাহলে সামান্য নাস্তা হতে পারে। সবাই খেজুর ও পানি খেয়ে নাও, তাহলে আরো দু ঘন্টা চললেও ক্ষুধায় কষ্টা পাবে না।’
ওরা যখন ওখান থেকে রওনা হলো তখন একজন কমাণ্ডোর মনে হলে চকিতের জন্য যেন পাহাড়ের চূড়ায় দুটো মুখ দেখতে পেল।
আরো ঘণ্টাখানেক চলার পর একটা বেদুঈন পল্লী সামনে পড়ল। পল্লীটাকে বায়ে রেখে দ্রুত ওরা সামনে বাড়ল।
ঘণ্টা দুই চলার পর আরো একটা ওয়েসিস পড়ল ওদের সামনে। পাশে খেজুর বাগান। চাঁদ প্রায় চলে এসেছে মাথার ওপর। খেজুর গাছের ছায়াগুলো ছোট হয়ে এসেছে।
অভিযাত্রীর দলটি থামল ওখানে। রাতটা এখানেই কাটাবে ওরা। নয় জন লোকের জন্য তিনটি তাঁবু খাটানো হলো। ঘোড়াগুলোর ব্যবস্থা নিয়ে একত্রেই খাওয়া সারল সবাই।
একেক তাঁবুতে দুজন করে শোয়ার ব্যবস্থা হলো। কমাণ্ডার তিনজনকে পাহারার জন্য রাখলেন। তাঁবুর দু পাশে সশস্ত্র দুজন সেন্ট্রি পায়চারী শুরু করল। একজন চলে গেল তাঁবু থেকে অনতিদূরে একটা বালির ডিবির আড়ালে। বাকীরা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল তাঁবুর ভেতর।
নির্বিঘ্নে সময় বয়ে চলল। কোথাও কোন শব্দ নেই। বাতাস এখন অনেক বেশী ঠাণ্ডা। শীত শীত ভাব।
দু ঘণ্টা পর ডিউটি পরিবর্তন হলো। পাহারারত কমাণ্ডোরা বন্ধুদের ডেকে দিয়ে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভেতর। কমাণ্ডার আজীম সংগী দুজনকে তাঁবুর পাশে রেখে নিজে চলে গেলেন বালিয়াড়ির আড়ালে। কোন রকম বিপদের সম্ভাবনার কথা তার মনেও এলো না। কিন্তু কমাণ্ডোর স্বভাবসুলভ সতর্কতা অটুট রেখে পাহারায় লেগে রইলো সবাই।
তাঁবুর পাশের সেন্ট্রি দুজন পায়চারী থামিয়ে প্রায় আধঘণ্টা যাবত বসে বসে পাহারা দিচ্ছে। বালির ঢিবির আড়াল থেকে তীর ধনুক প্রস্তুত রেখে পলকহীন ভাবে তাঁবুর দিতে তাকিয়ে আছে কমাণ্ডার আজীম।
হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল তার ইন্দ্রিয়। মনে হলো আশপাশে কোথাও একাধিক মানুষ খুব সন্তর্পনে হেটে বেড়চ্ছে। সে বিন্দুমাত্র মাথা না নাড়িয়ে যতদূর সম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
সে পিছনটায় একবার দৃষ্টি বুলানোর জন্য মাথাটা যেই ঘুরাবে ভাবল, অমনি তার চোখ আটকে গেল খেজুর বাগানের মধ্যে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল তাঁবুর দুদিক থেকে দুজন করে বেদুঈন শিকারী নেকড়ের মত পায়ে পায়ে তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে।
সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধের কথা চিন্তা করছিল কমাণ্ডার। তীর মেরে বড়জোর একজনকে কাবু করা সম্ভব। সাথে সাথে অন্য তিনজন সতর্ক হয়ে যাবে। বাগানের অন্ধকার ও গাছের আড়াল তাদের নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে। কিন্তু ও সামান্য নড়াচড়া করলেই চাঁদের ফকফকা আলোয় পরিস্কার ওদের চোখে পড়ে যাবে।
শত্রুরা তাঁবুর ত্রিশ গজের মধ্যে চলে এসেছে। দ্রুত চিন্তা চলছে কমাণ্ডারের মাথায়। সেন্ট্রি দুজন এখনো উঠে দাঁড়াচ্ছে না কেন? ওরা কি কিছুই টের পায়নি এখনো? না কি ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা? বেদুঈনরা আরো এগিয়ে এসেছে। ক্রমে তাঁবু ও ওদের মাঝের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে। এখন বড়জোর আর বিশ গজ, না আরো কমে আসছে ব্যবধান।
দশ গজ দূরে এসে খানিক থমকে দাঁড়াল ডাকাতরা। বোধ হয় সেন্ট্রিরা সজাগ না ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে চেষ্টা করল। তারপর খাপ থেকে সাবধানে তরবারী বের করে সেন্ট্রি দুজনের দিকে পা বাড়াল।
ওদের চলাফেরা এতটাই নিঃশব্দ ছিল যে তখনো পর্যন্ত সেন্ট্রিরা কোন কিছু টের পায়নি।
আততায়ীরা সেন্ট্রিদের দু’গজের মধ্যে এসে যখন তরবারী উপরে তোলা শুরু করল তখন কমাণ্ডারের প্রথম তীরটি একজন বেদুঈনের বক্ষ ভেদ করল এবং বলতে গেলে প্রায় একই সময়ে অন্য পাশের আরেক জনকেও ধরাশায়ী করল তার তীর।
চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়াল সেন্ট্রি দু জন এবং পাঁই করে ঘুরে তরবারীর প্রথম আঘাত ঠেকাল নিজের তলোয়ার দিয়ে।
দু জোড়া তলোয়ারের ঠোকাঠুকির আওয়াজ শেষ রাতের মরুভূমির নিস্তব্ধতা বিনষ্ট করে দিল। সতর্ক ও দুঃসাহসী বেদুঈনরা তীব্র আঘাত হানলো কমাণ্ডোদের ওপর। হতচকিত কমাণ্ডোরা কোন রকমে সে আঘাত ঢেকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করল।
যখন ওরা বুঝল শত্রু মাত্র দুজন তখন পাল্টা আঘাত হানলো কমাণ্ডোরা।
ততোক্ষণে কমাণ্ডার অন্যদের ডাকতে ডাকতে সেখানে এসে পৌঁছল। কমাণ্ডারের ডাক চিৎকারে তাঁবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অন্যান্য কমাণ্ডোরাও।
আহতদের মধ্য থেকে একজন বেদুঈন উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে তার তরবারী দিয়ে লড়াইরত কমাণ্ডো সৈন্যটিকে আঘাত করতে উদ্যত হতেই কমাণ্ডারের তলোয়ারের আঘাতে দেহ থেকে তার মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিসমাপ্তি ঘটলো এ লড়াইয়ের।
সৈন্যদের ডাক চিৎকারে আশফাক এবং যুবতী দু জনেরও ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাঁবুর বাইরে এসে তারা দেখতে পেলো চারজন বেদুঈনের লাশ।
কমাণ্ডার ওদের শান্তনা দিয়ে বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা সাধারণ ডাকাত মাত্র।’
সকাল হয়ে এসেছিল। কমাণ্ডার সবাইকে সফরের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে বলল।
হাত মুখ ধুয়ে সফরের পোশাক পরে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো আমিনা ও সামিনা। কমাণ্ডার বলল, ‘নামাজ সেরে নিন।’
ওরা নামাজ সেরে নিতে নিতে সৈন্যরা তাঁবু গুটিয়ে নিল। সবাই চড়ে বসল যার যার ঘোড়ায়।
সূর্য উঠার আগেই বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেল তারা। মরুভূমিতে কোমল আলো ছড়িয়ে সূর্য উঁকি দিল আবার। যেন মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে ঘনিষ্ট আপন জন। যাত্রীরা ঘোড়ার পিঠে বসেই মিঠে রোদের আলতো পরশ অনুভব করল সর্ব অঙ্গে।
বাকী পথটুকু নিরাপদেই কাটলো তাদের। পরদিন সন্ধ্যার একটু আগেই ওদের চোখে পড়ল কায়রো শহর।
* * *
কয়েকদিন থেকেই ব্যাপকভাবে মুসলমানদের ধরপাকড় চলছে ক্রাকে। স্রেফ সন্দেহের বশে অনেককে বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হল।
ক্রাকে শুরু হয়ে গেল মুসলিম নির্যাতনের নতুন অধ্যায়।
ওসমানের দু’জন বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত নির্যাতনের পরও ওরা মুখ খোলেনি।
ওদের কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য একদিন স্বয়ং হরমুন জেলে এলেন। একজন একজন করে সব বন্দীদের দিকে তাকালেন তিনি।
তার চোখ এসে আটকে রইল দুই যুবকের ওপর। চরম নির্যাতন করেও ওদের মুখ থেকে কোন কথা বের করা যায়নি।
হরমুন ওদেরকে নিজের দপ্তরে নিয়ে গেলেন। ভাল ব্যবহার করলেন ওদের সাথে।
ওদেরকে উন্নতমানের খাবার দেয়া হলো। ডাক্তার ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। তারপর তাদের শোবার জন্য দেয়া হল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বিছানা। ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল ওরা। ঘুমন্ত দুই যুবকের মাঝখানে বসে রইরেন হরমুন। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে উঠলো একজন।
‘আমার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলো, আমি কিছুই জানি না। জানলেও আমি তোমাদেরকে কিছুই বলবো না। তোমরা গলায় ক্রুশ ঝুঁলিয়ে রাখো আর আমি বাঁধি পবিত্র কোরআনের আয়াত।’
‘তুমি সেনা ছাউনিতে আগুন লাগিয়েছিলে?’ হরমুন প্রশ্ন করলেন।
যুবক কোন জবাব দিলেন না।
হরমুন আবার বললেন, ‘তোমরা খ্রীষ্টানদের কোমর ভেংগে দিয়েছ। আমি স্বীকার করছি, তুমি অবশ্যই সাহসী। কিন্তু সাহস থাকলেই মরতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। এই বয়সেই মরে গিয়ে কি লাভ হবে তোমার?’
‘মরে গেলে’ বিড়বিড় করল যুবক, ‘যদি মরে যাই, এ দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে ঈমানও আছে। দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলেও ঈমান যাবে না।’
‘তাহলে তুমি কি চাও যে, দেহ থেকে তোমার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাক? এই তোমার শেষ ইচ্ছা?’
‘না, আমি আরো হাজার বছর বেঁচে থাকতে চাই। আর যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন জেহাদ করতে চাই। কিন্তু কারো দয়ার ওপর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই আমার। মরণকে ভয় পাই না আমি।’
‘কিন্তু এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার মাঝে কোন স্বার্থকতা নেই যুবক। আমরা যা জানতে চাই বলো, কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমরা মুক্তি দিয়ে দেবো।’
‘আমাদের জীবনে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই হরমুন। জীবনেও লাভ, মরণেও লাভ। বাঁচলে বাঁচবো আল্লাহর দ্বীনের জন্য, মরবোও দ্বীনের পথে থেকে।
ব্যর্থ তো তার জীবন, যে ভয়ে, লোভে বা মোহে পড়ে আপোষের পথ ধরে। নীতির সাথে আপোষ করে, সত্যের সাথে আপোষ করে, বিবেকের সাথে আপোষ করে। যত চেষ্টাই করো আমার কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারবে না তুমি।’
অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন হরমুন। তার মনের কথা যুবকের মুখ দিয়ে কিছুতেই বের করাতে পারলেন না।
এবার তিনি ফিরলেন দ্বিতীয় যুবকের দিকে। চেষ্টা করলেন কথা বের করার। কিন্তু দ্বিতীয় যুবকের মুখ থেকেও কোন কথাই বের করতে পারলেন না তিনি।
শেষ পর্যন্ত হরমুন সংগী গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনর্থক চেষ্টা। ওদের মুখ থেকে কিছুই বের হবে না।’
‘মনে হচ্ছে এরা ঘটনার সাথে জড়িত নয়। থাকলে কোন না কোন সূত্র পাওয়া যেতোই। তবে নিজের বিশ্বাসের ওপর এরা বড় বেশী দৃঢ়।’
‘ওদের যে পরিমাণ হাশিস খাইয়েছি একটা ঘোড়াকে খাওয়ালে ঘোড়াও কথা বলত।’
‘এদের ভেতর জাতীয় চেতনাবোধ অত্যন্ত প্রবল। সে চেতনাকে ওরা বলে ঈমান। এ যুবকদের মধ্যে ঈমানী দৃঢ়তা বেশী এ কথা ঠিক, কিন্তু আমার মনে হয় এর নির্দোষ।’
বলল আরেক অফিসার।
এই দুই যুবক ছিল ওসমানের দুই সংগী। এরা মূলতঃ নির্দোষ ছিল না। প্রাসাদ আক্রমণে ওরাও ওসমানের সাথে ছিল। কিন্তু এদের ঈমান ছিল এত দৃঢ় যে, সেখানে হাশিসও কোন কাজ করেনি।
অজ্ঞান অবস্থায়ই ওদের দু’জনকে অনেক দূরে নিয়ে মরুভূমির মধ্যে ফেলে আসা হলো। ওদের জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে।
জ্ঞান ফিরলে পরস্পরের দিকে চাইল ওরা। দেখল, বেগার ক্যাম্প নয়, ওরা দুজনই পড়ে আছে খোলা আকাশের নীচে।
ওরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরল। এরপর উঠে বাড়ীর দিকে হাঁটা দিল দু’জনেই।
ওসমানের তৎপরতা আরও বেড়ে গেছে। পেছনে ছায়ার মত রেগে আছে রিনি।
একদিন পথে ওসমানের সাথে দেখা হলো রিনির। দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনই। রিনি জিজ্ঞেস করল, ‘ওসমান, আল নূর কোথায়?’
‘তোমাদের জাতির কোন পাপীর কাছে। তার ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসুক।’
‘গজব নয় ওসমান, বল রহমত। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মারা গেলে তাকে তোমরা শহীদ বলো। আমি জানি, আল নূর শহীদ হয়ে গেছে।’
ওসমান নির্বাক হয়ে গেল।
রিনিই আবার মুখ খুলল, ‘সেই দুই যুবতীকে প্রাসাদ থেকে যারা বের করে এনেছে তার মধ্যে তুমিও একজন। গ্রেফতার হচ্ছো না কেন জানো? তোমার গ্রেফতারের পথে আমি বাধা হয়ে আছি। বলো, আর কত ত্যাগ চাও ওসমান, আর কত পরীক্ষা নিতে চাও আমার প্রেমের?’
‘আমার কাছে কি চাও তুমি?’
‘প্রথমে তোমার ভালবাসা চাই। এরপর চাই তুমি এই বিপজ্জনক তৎপরতা থেকে সরে দাঁড়াও।’
‘তুমি তোমার জাতিকে ভালবাস। আমাকে ভালবাসলে আমার জাতিকে কেন ভালবাসো না?’
‘তোমার বা আমার কারো জাতির সাথেই আমার ভালবাসা নেই। বিপজ্জনক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলছি, কারণ, নইলে তুমি মারা যাবে।
আমি কেবল তোমাকেই ভালবাসি ওসমান! তুমি মারা গেলে আমিও বেঁচে থাকবো না। আমি তোমায় জীবিত এবং হাসিখুশী দেখতে চাই।’
মাথা নিচু করে নিল ওসমান। এ কথার কোন জবাব ছিল না তার কাছে। কয়েক মিনিট সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর কোনকিছু না বলেই হাঁটা দিল ওসমান।
রিনি গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়েছিল ওসমানের দিকে। ও যখন হাঁটা ধরল রিনি পেছন থেকে বলে উঠল, ‘ওসমান। অন্য জাতির এক নারীর কথা মনে করে আমার প্রস্তাব উড়িয়ে দিও না তুমি। আমার শৈশব ও কৈশোরের স্বপ্নকে তুমি ভেংগে দিও না।’
* * *
‘আমি আবারও বলছি ক্রাক সুবাক নয়।’ কমাণ্ডারদের সামনে শেষবারের মত যুদ্ধনীতি ও রণকৌশল ব্যাখ্যা করছিলেন সুলতান আয়ুবী।
‘খ্রীষ্টানরা আগের চাইতে অনেক বেশী সতর্ক। গোয়েন্দারা আমাকে যা বলেছে তাতে আমি নিশ্চিত, ক্রাকের যুদ্ধ হবে দুর্গের বাইরে।
ভেতরে মুসলমানদের তৎপরতা আপনাদের কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। ওরা বেশী নড়াচড়া করলে অহেতুক মারা পড়বে। আমি ওদেরকে এত বড় পরীক্ষায় ফেলতে চাই না। ওদের রক্ষা করার একটাই মাত্র পথ, আমাদেরকে প্রচণ্ড আক্রমণ করতে হবে।’
এ ভাবে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সুলতান সূর্যাস্তের পর ক্রাকগামী সৈন্যদেরকে মার্চ করার নির্দেশ দিলেন।
পরদিন ভোরে সৈন্যবাহিনী ক্রাকের সীমান্ত এলাকায় পৌঁছল। এখান থেকেই দূর্গ অবরোধের প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে হবে।
পথে খ্রীষ্টান সৈন্যদের কোন টহল বাহিনী বা সশস্ত্র প্লাটুন চোখে পড়েনি ওদের। গোয়েন্দারা জানিয়েছে, খ্রীষ্টান বাহিনী দূর্গের বাইরে তাঁবু গেড়ে প্রস্তুত হয়ে আছে।
কোথায় তারা তাঁবু গেড়েছে জেনে নিয়ে মুসলিম বাহিনী অন্য পথে অগ্রসর হলো। ফলে বিনা বাধায়ই এরা দূর্গ অবরোধ করতে সক্ষম হলো। দূর্গ অবরোধ করার সাথে সাথে পাঁচিল থেকে শুরু হল তীব্র তীর বৃষ্টি।
মুসলিম বাহিনী জওয়াবী হামলায় কঠোর আক্রমণ করল না, বরং হালকা চালে যুদ্ধ চালিয়ে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল ভেতের ঢুকার কোন সম্ভাবনা আছে কি না। সাথের গোয়েন্দারা কমাণ্ডারকে ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বর্ণণা দিচ্ছিল।
মুসলিম বাহিনীর অবরোধের খবর দূর্গের অভ্যন্তরে এখনও প্রচার হয়নি। অবরোধকারীদের পেছনটাও এখনো অরক্ষিত। হঠাৎ অভ্যন্তরে সামরিক এলাকায় অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। পাঁচিলে উঠে এল খ্রীষ্টান সৈন্যরা।
শহরে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরে বসে রইল।
মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের জন্য মুসলমানগণ দোয়া করতে লাগল। ওসমান ও তার সংগীরা দুর্গের মেইন ফটক খুলে দেয়ার বা পাচিল ভেংগে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।
শহরের বিপুল সংখ্যক মুসলিম যুবক যুবতী কিভাবে আয়ুবীর সহযোগিতায় আসতে পারে সে জন্য স্বতঃস্ফুর্তভাবে আলাপ আলোচনায় মেতে উঠল। মুসলমানদের মহল্লাগুলোতে লোকজন জোট বেঁধে জটলা করতে থাকলো।
কাঠের তৈরী মজবুত ফটক লোহার পাতে মোড়া, বাইরে থেকে নিক্ষিপ্ত অগ্নি গোলায় আগুন লাগল না।
পাঁচিলের ওপর থেকে ছোড়া তীরে কামানধারীদের কয়েকজন শহীদ হয়ে গেলেন। কামানগুলো পেছনে সরিয়ে নেয়া হল।
শেষ পর্যন্ত সৈন্যদেরকে পাঁচিলের ওপর তীর নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হল।
খ্রীস্টান সৈন্যরা উপরে থাকায় মুসলমানদের বেশী ক্ষতি হচ্ছিল। দেয়াল ভাংগার যন্ত্র নিয়ে আটজনের একটা দল প্রাচীরের দিকে এগিয়ে গেল। পাঁচিলের তীর বৃষ্টি তাদের শহীদ করে দিল।
রাতের প্রথম প্রহর। ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরেছেন রিনির আব্বা। এসেই শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর আবার ডিউটিতে যেতে হবে।
তিনি খবর পেয়েছেন শহরের মুসলমান অধিবাসীরা ভয়ংকর কোন ষড়যন্ত্র করছে। ওদের চলাফেরা এবং হাবভাব মোটেই সুবিধের নয়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখন থেকে ওদের প্রতিটি বাড়ীতেই নজর রাখতে হবে। সেভাবেই তিনি চারদিকে গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি শুয়ে পড়ার খানিক বাদে দরজার নক করল কেউ। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল রিনি।
বাইরে একজন মুসলমান দাঁড়িয়ে আছে। চেনে তাকে রিনি। খ্রীস্টানরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে।
দরজা খুলতেই লোকটি বলল, ‘আপনার আব্বা কোথায়? তাকে ডাকুন। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে, এখুনি আপনার আব্বাকে তা জানানো দরকার।’
‘আব্বা তো এইমাত্র শুয়েছেন। রাতেই নাকি আবার বেরোবেন। তাকে তো এখন ডাকা যাবে না।’
‘আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করুন। খুবই জরুরী সংবাদ, এখুনি তাকে বলা দরকার।’
‘আমাকে বলো, আব্বা উঠলেই তাকে আমি তা পৌঁছে দেবো।’
‘আজ রাতে কিছু মুসলিম যুবক ও যুবতী পাঁচিল ভেংগে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছে।’
‘তুমি কি করে জানলে এ কথা?’
রিনির প্রশ্নে জবাবে লোকটি বললো, ‘আমি ওদের বন্ধু সেজে সব জেনে এসেছি। রাস্তার মোড়ে যে গরীব মুচিকে দেখতে পান সে আসলে মুচি নয়, সে আয়ুবীর একজন গোয়েন্দা। ওরই পরামর্শে যুবকরা এ পরিকল্পনা নিয়েছে।’
‘পাঁচিলের কোন দিকে আঘাত হানতে পারে সে ব্যাপারে বলেছে কিছু?’
‘আস্তাবলের পেছনে উত্তর দিকের ময়লা ফেলার পাশের দেয়াল স্যাতস্যাতে হয়ে আছে। ওখানে যে বড় গাছটা আছে সেখানে বেশ অন্ধকারও থাকে রাতে। ওখান দিয়েই ওরা প্রথমে চেষ্টা করবে বলেছে।’
‘তুমি এসব মুসলিম যুবকদের নাম জানো? কারা কারা আছে এ দলে না জানলে ওদের গ্রেফতার করবে কিভাবে?’
‘আমি সব জেনে এসেছি।’
লোকটি অভিযানকারীদের নাম বলর রিনির কাছে। বলল, ‘ওসমান এদের দলনেতা।’
ওসমানের নাম শোনা মাত্র রিনির ভেতরটা কেঁপে উঠল। কিন্তু মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘সালেমের ছেলে ওসমান তো! ঠিক আছে, আমি বলবো আব্বাকে।’
‘কিন্তু ওনি যদি আরো কিছু জানতে চান? আমি কি একটু পর আবার এসে ঘুরে যাবো?’
‘ঠিক আছে এসো।’
লোকটি বলল, ‘তারচেয়ে বরং আমি একটু বসি, যাতে উনি উঠলেই দেখা করতে পারি।’
‘আব্বা তো মাত্র শুয়েছেন, কতক্ষণ বসে থাকবে তুমি? তারচে বরং ঘুরেই আসো।’
কিন্তু লোকটা যেতে চাইছে না। পুরস্কার পাবার এই সু্যোগ সে কিছুতেই হারাতে রাজি নয়। সে দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
রিনি দেখলো এ তো মহা বিপদ। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো, ‘এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বললে আব্বার ঘুম ভেংগে যেতে পারে। চলো বাইরে থেকে হেঁটে আসি।’
এত বড় অফিসারের সুন্দরী মেয়ের সাথে একটু সময় কাটানোর লোভ সংবরণ করতে পারল না লোকটা। রিনি দরজা টেনে বাইরে বেরিয়ে আসতেই পোষা কুকুরের মত সে রিনির সাথে সাথে চলল।
হাঁটতে হাঁটতে একটা কুপের কাছে চলে এল ওরা। কুপটি গভীর করে খোঁড়া হয়েছিল। থামল রিনি। উঁকি দিয়ে বলল কুয়োর ভেতর।
মুসলমানদের গোপন তৎপরতার সংবাদ বলে যাচ্ছিল লোকটি। সেও গলা বাড়িয়ে চাইল কুয়োর ভেতর। রিনি দেহের সমগ্র শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিল। সোজা কুয়োয় গিয়ে পড়ল তার দেহ। তার কলজে ফাটা চিৎকার ‘ধড়াম’ শব্দের সাথে শেষ হয়ে গেল।
রিনি ভীষণ খুশী। ওসমানের মৃত্যুর সংবাদ ও কুপের গহীনে ডুবিয়ে দিতে পেরেছে।
এক ছুটে ওসমানের বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছল রিনি। তার মায়ের সাথে আল নূরের প্রসংগে কিছুক্ষণ আলাপ করল। ওসমানের কথা জিজ্ঞেস করলে তার মা বললেন, ‘সেই যে সন্ধ্যায় বেরিয়েছে এখনও ফেরেনি।’
হয়ত অভিযানে চলে গেছে, ভাবল রিনি। বেরিয়ে এল ওসমানের বাড়ী থেকে।
তার আশংকা হলো অন্য কোন ‘সোর্স’ সেনাবাহিনীকে সংবাদটি দিয়ে থাকতে পারে। যেখানে দেয়াল ভাংগা হবে রিনি সেদিকে ছুটল। ওসমানকে সে বাঁধা দেবে। বলবে, তোমাদের আজকের অভিযানের কথা সবাই জেনে গেছে।
রিনি পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখল কেউ নেই। ও এদিক ওদিক চাইতে লাগল।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ তাকে জাপটে ধরে অন্ধকারে নিয়ে গেল। লোকটি ক্রাকের একজন সেনা সদস্য। ও পিতার পরিচয় দিয়ে নিজের নাম বললো। রিনিকে ওখান থেকে চলে যেতে বললো সৈন্যরা।
কিন্তু ও যাবে না। ও বুঝতে পারছে ওসমানদের ধরার জন্যই সৈন্যরা এখানে এসে লুকিয়ে আছে।
রিনি সৈন্যদেরকে এখান থেকে যেতেও বলতে পারছে না। থাকতেও দিতে পারছে না। ওরা থাকলে ওসমানকে বাঁচানো কষ্ট হবে। কিন্তু ওযে যে কোন মূল্যে ওসমানকে বাঁচাতে চায়।
একজন সৈন্য বললো, ‘খবর মিথ্যে নয়। ওই যে ওরা আসছে।’
চমকে উঠল রিনি। চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ওসমান ফিরে যাও।’
কমাণ্ডার ওর মুখ চেপে ধরে বললো, ‘মেয়েটা মনে হয় ওদের গুপ্তচর। ওকে বন্দী করো।’
কিন্তু সে সু্যোগ আর পাওয়া গেল না। ওসমানরা এসে পড়েছে। ওরা লড়াই করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে খ্রীষ্টান সৈন্য, সামনে ওসমানদের গ্রুপ। ওদের হাতে বর্শা, খঞ্জর এবং দেয়াল খোদাই করার যন্ত্রপাতি।
ওসমানের এ অভিযানে যুবকরা ছাড়াও দলে ছিল এগার জন যুবতী।
কমাণ্ডোর মধ্য থেকে একজন চিৎকার দিয়ে বললো, ‘মুজাহিদ, পালিয়ো না। প্রতিটি মেয়েকে রক্ষা করার জন্য একজন করে থাকো, বাকীরা লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ো।’
দু’দলের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হল। খ্রীষ্টানরা ছিল সংখ্যায় অধিক। কমাণ্ডো সদস্যরা একজন একজন করে শহীদ হতে লাগল।
যুদ্ধের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ধ্বনিত হচ্ছিল রিনির কণ্ঠ, ‘ওসমান পালিয়ে যাও। পালিয়ে যাও ওসমান।’
খুব বেশী সময় লাগলন না। অল্পক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি খ্রীষ্টানদের আয়ত্বে চলে এলো।
খ্রীষ্টান কমাণ্ডার বললো, ‘মেয়েদের মেরো না, ওদের জীবিত গ্রেফতার করো।’
লড়ে যাচ্ছে ওসমান। একজন খ্রীস্টান সৈনিক তরবারী নিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। ওসমানের হাতে খঞ্জর।
আচম্বিত সৈন্যটার পিঠে খঞ্জর আমূল বিদ্ধ হল। মৃত সৈনিকের তরবারী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিনি। ওসমানের সাহায্যে এগিয়ে গেল দ্রুত। কিন্তু কয়েকজন সৈনিক দ্রুত ছুটে এসে ঘিরে ফেলল তাদের।
রিনি তরবারীটি এগিয়ে ধরল ওসমানের দিকে। তরবারী হাতে পেয়েই ওসমান প্রবল বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। চোখের পলকে দুজন সৈন্য লুটিয়ে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
রিনিও তার হাতের খঞ্জর ফেলে দিয়ে একটি তলোয়ার তুলে নিল। আক্রমণকারীরা মুহুর্তে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে।
এখানে ওখানে লড়ে যাচ্ছিল মুজাহিদরা। খ্রীষ্টান কমাণ্ডার পেছনে সরে পড়া মেয়েদের ধরার জন্য একটা গ্রুপকে পাঠিয়ে দিল। ওরা এগিয়ে গেল মেয়েদের দিকে।
দুজন মেয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ময়লার স্তূপের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
সেখান থেকে ওরা দেয়াল ঘেষে অন্ধকারে লুকিয়ে এক পা এক পা করে এগুলো খ্রীষ্টান কমাণ্ডার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে।
কমাণ্ডার পাঁচিল থেকে হাত পাঁচেক দূরে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্তা পর্যবেক্ষণ করছিল। মেয়ে দুজন সন্তর্পনে এসে কমাণ্ডারের ঠিক পেছনে পৌঁছে গেল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নয়জন যুবতী ও এগারজন যুবকের দলটির ওপর আঘাত হানল খ্রীষ্টানরা। প্রথকে এগিলে গেল এগারজন যুবক। লড়াই করতে করতে ওরা সবাই শহীদ হয়ে গেল।
এবার এগিয়ে এল মেয়েরা। ধরা না দিয়ে তারাও ঝাপিয়ে পড়ল খ্রীষ্টানদের ওপর। দেখতে দেখতে ওদের সাতজন শহীদ হয়ে গেল।
ওসমান ও রিনি তখনো লড়ে যাচ্ছে একদল খ্রীষ্টানের সাথে। হঠাৎ একজন সৈনিকের তরবারীর আঘাত ঠেকাল সে নিজের তরবারী দিয়ে। এ সময় পাশ থেকে তাকে আঘাত করল আরেকজন।
রিনির হাত থেকে তরবারী ছুটে গেল। চিৎকার দিয়ে আহত রিনি এক দিকে কাত হয়ে পড়ে গেল।
রিনির চিৎকার শুনে ওসমান সামান্য সময়ের জন্য ঘাড় ফিরিয়ে ছিল সেদিকে। একটা তরবারী ওসমানের বুক এফোড় ওফোড় করে দিল। শহীদ হয়ে গেল ওসমান।
খ্রীষ্টান কমাণ্ডার তাকিয়েছিল ওসমানের পড়ন্ত দেহের দিকে।
ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতী দুজন বিদ্যুৎ বেগে এসে ঝাপিয়ে পড়ল তার ওপর। এক সাথে তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল দুটো খঞ্জর। কমাণ্ডার কোনো রকম বাঁধা দেয়ার সু্যোগই পেল না। তার আগেই দেহ থেকে প্রাণ বায়ু উড়ে গেল তার।
সব শেষ। বেঁচে এছে দু’জন আহত যুবতী। খ্রীষ্টান সৈন্যরা তাদের ঘেরাও করে ফেলল। একজন বলল, ‘অস্ত্র ফেলে দাও। যুদ্ধ শেষ। তোমাদের সবাই মারা পড়েছে। বাঁচতে চাইলে আত্মসমর্পন করো।’
যুবতী সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা অনেক আগেই আত্মসমর্পণ করেছি, তবে তোমাদের কাছে নয়, আল্লাহর কাছে। তোমরা সরে দাঁড়াও। আমাদের চলে যেতে দাও।’
কমাণ্ডার সংগীদের বলল, ‘খবরদার, ওদের কেউ হত্যা করো না। ওদের নিরস্ত্র করে বন্দী করো। আমাদের জানতে হবে ওদের সাথে আর কারা কারা আছে।’
সৈন্যরা তাদের ঘেরাও সংকুচিত করে আনল। যুবতী দু’জন একজন তাকাল অন্যজনের দিকে। এরপর দু’জনই পলকে হাতের খঞ্জর নিজের বুকে বসিয়ে দিল। সৈন্যরা যখন তাদের ধরল, দেখা গেল দুজনই মারা গেছে।
আহত রিনিকে গ্রেফতার করল সৈন্যরা। তাকে নিয়ে আসা হল সেনা হেডকোয়ার্টারে। তার ক্ষতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেয়া শেষ হলে একজন সেনা অফিসার এসে কামরায় ঢুকল।
‘তুমি পাঁচিলের পাশে কি করছিলে? ওখানে গিয়েছিলে কেন?’
রিতি তার এ প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।
অফিসার আবার তাকে একই প্রশ্ন করলে তার জবাবে ও আবোল তাবোল বকতে লাগল।
ডাক্তার এগিয়ে এলেন অফিসারের কাছে। বললেন, ‘মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওকে কোন প্রশ্ন করে লাভ হবে না।’
দূর্গের দেয়াল ভাংগার আশা শেষ হয়ে গেছে। শহীদ হয়ে গেছে অভ্যন্তরের মুসলিম কমাণ্ডো মুজাহিদরা। কিন্তু সুলতান দূর্গ পদানত করার সংকল্পে অটল।
বললেন, ‘আমরা আমাদের সর্বস্ব বাজী রেখেছি। কয়েকজন আত্মত্যাগী ভাইকে আমরা হারিয়েছি ঠিক, কিন্তু নিজেরা তো এখনো নিঃশেষ হইনি।
ত্যাগের পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে বিজয় আমাদের হবেই। কারণ বিজয়ের মালিক আল্লাহ, আর আল্লাহ মোটেও দুর্বল নন। আমাদের ঈমানই আমাদের বিজয়ের গ্যারান্টি।
কেবল তো অবরোধের দ্বিতীয় দিন গেল, আগামী কালও সূর্য উঠবে, এবং তারপর দিন, তারপর দিনও । বিজয়ের আগ পর্যন্ত আমার আমাদের ধৈর্য ও ত্যাগের পরীক্ষা দিয়েই যেতে থাকবো।
প্রাসাদের ভেতর যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসলেন খ্রীষ্টান সম্রাটগন। একজন বললেন, ‘মানুষ যত হুশিয়ারই হোক একবার না একবার ভুল সে করেই। এবার যে ভুল আয়ুবী করেছে তার মাশুল তাকে দিতে হবেই।’
‘কি ভুল করেছে সে?’ প্রশ্ন করলেন অপর এক সম্রাট।
‘অতীতের প্রতিটি লড়াইয়ে আয়ুবী আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। আমরা ঠিকমত প্রস্তুত হওয়ার আগেই বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে সে। কিন্তু এবার তাকে আমারা বাগে পেয়েছি। এবার তাকে মুখোমুখি লড়তেই হবে।’
অন্য এক সম্রাট বললেন, ‘আরে শুধু কি তাই? এবার আমরা যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছি সেটা বলবেন না?’
তিনি সুবিধাজনক অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের যে ফৌজ বাইরে আছে তাদেরকে আমরা দুভাবে ভাগ করে নেবো। এক ভাগ থাকবে আয়ুবীর ফৌজের চোখের সামনে, আরেক ভাগকে সরিয়ে নেবো দূরে।
এরপর আয়ুবী যখনি দূর্গে হামলা করবে তখন পাঁচিলের ওপর থেকে তার মোকাবেলা করবে আমাদের ভেতরের ফৌজ।
আয়ুবীর চোখের সামনে বাইরে আমাদের যে ফৌজ আছে ওরা তখন পাশ থেকে আঘাত হানবে আয়ুবীর বাহিনীর ওপর। ফলে সে সেদিকেও মনযোগ দিতে বাধ্য হবে। অন্যান্য বারের মত বেপরোয়াভাবে একদিকে আর ছুটে যেতে পারবে না।
এরপর আমরা চালবো। সেই চাল, যা সে এতদিন আমাদের ওপর চেলেছে। আয়ুবী ভাবতেও পারবে না আমাদের আরেকটা বাহিনী তাদের ঠিক পেছনে ওঁৎ পেতে আছে।
দু পক্ষের সাথে লড়াই করে তারা যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়বে তখন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে আমাদের মূল বাহিনী।
তারা অতর্কিত পেছন থেকে ঝাপিয়ে পড়বে আয়ুবীর সেই ক্লান্ত শ্রান্ত বাহিনীর ওপর। সে হামলার মোকাবেলা করার সাধ্য আয়ুবীর কিছুতেই হবে না।’
ফ্রান্সের সম্রাট বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। জীবনে এমন সু্যোগ আর পাওয়া যাবে না। সত্যি, এবার ওকে বাগে পাওয়া গেছে।’
জামানীর সম্রাট বললেন, ‘ঠিক, বার বার ঘুঘু এসে খেয়ে যেতে দেবো নাকো আর ধান।’
এরপর সেনাপতিদের নিয়ে বসলেন সম্রাটগণ। তাদেরকে বললেন এসব পরিকল্পনার কথা। সেনাপতিরা একমত হলেন সম্রাটদের এ প্রস্তাবের সাথে।
সম্রাটদের সামনে তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিজ্ঞা করল, ‘কিছুতেই আমরা এ দূর্গ সালাহউদ্দীন আয়ুবীর হাতে তুলে দেবো না। পবিত্র যিশুর কসম, এ দেহে প্রাণ থাকতে আয়ুবীর সাধ আর পূরণ হতে দেবো না আমরা।’
একদিকে আয়ুবীর সংকল্প আর অন্য দিকে খ্রীষ্টানদের প্রতিজ্ঞা। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কইতে রাজি নয়। কেউ পিছু হটতেও রাজি নয়। এক নাজুক ও জটিল সময় উভয়ের সামনে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ও সংঘাতপূর্ণ হতে পারে এ ধারণাও নেই কারো।
সবাই অপেক্ষা করতে থাকল, দেখা যাক আগামী কাল কি ঘটে?
Leave a Reply