ক্রুসেড সিরিজ ৪ – ভয়ংকর ষড়যন্ত্র
মুল লেখক – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
অনুবাদ – আসাদ বিন হাফিজ
ভূমিকা
ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠলো খৃষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক সংঘাত ও সংঘর্ষের পরাজিত হয়ে বেছে নিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিল মদ ও নেশার দ্রব্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাঠাল প্রশিক্ষনপ্রাপ্তা সুন্দরী গোয়েন্দা। বড় বড় অফিসার ও আমীর উমরাদের হারেমগুলোতে ওদের ঢুকিয়ে দিল নানা কৌশলে। ভাসমান পতিতা ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। মদ জুয়া আর বেহায়াপনার সস্রোত বইয়ে দিল শহরগুলোতে।
একদিকে সশস্ত্র লড়াই অন্যদিকে কুটিল সাংষ্কৃতিক হামলা, এ দুয়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ও তার বীরশ্রেষ্ট সাথীরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।
.
ভয়ংকর ষড়যন্ত্র
দীর্ঘদিন থেকে সুলতান মিসরে অনুপস্থিত। বেড়ে গেছে বিরোধীদের তৎপরতা। খ্রিস্টানরা উস্কে দিয়েছে পদচ্যুত ফাতেমী খেলাফতের অংশীদারদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন। খ্রিস্টান গোয়েন্দায় ভরে গেছে সমগ্র কায়রো। অর্থ আর নারী দেহের উষ্ণতায় নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে সুলতানের বিশ্বস্ত কয়েকজন। গোয়েন্দা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইহুদি যুবতীদের কুটজালে ধরা দিয়েছে প্রশাসনের উচ্চভিলাষী কতিপয় কর্মকর্তা। ওদের জাতীয় চেতনাবোধ নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্ষমতার মোহে বিভোর এসব ব্যাক্তিদের হারেমের শোভাবর্ধন করছিল খ্রিস্টানদের রুপসী গোয়েন্দা যুবতীরা।
ঘাতক দলের সদস্যরা ছিল আরও তৎপর। মিসর এখন ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের লীলাভূমি। অবস্থা এমন যে, কেবলমাত্র কোন অলৌকিক ঘটনাই মিসরকে রক্ষা করতে পারে।
খ্রিস্টানদের সহযোগিতায় সুদানীরা মিসর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সেনাবাহিনীর এক অংশ বিদ্রোহের জন্য তৈরী। ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের চোখে ঘুম নেই। সালাহউদ্দীন আয়ুবী সময়মত না এলে মিশর রক্ষা করা যাবে না। একসঙ্গে ভেতরের এবং বাইরের মোকাবিলা করা ভারপ্রাপ্ত গভর্ণরের পক্ষে সম্ভব নয়।
খিজরুল হায়াত। দ্বীনদার এবং বিশ্বস্ত। মিসরের অর্থ সচিব। সাদামাটা জীবন পছন্দ করেন, অমায়িক। সুলতান নিজেই তাকে অর্থ সচিবের পদে নিয়োগ দিয়েছেন। যোগ্যতা এবং আন্তরিকতার সাথে মিসরের অর্থনীতি পুনঃ বিন্যাস করেছেন তিনি। এক রাতে বাইরে থেকে ফিরেছেন হায়াত। সবেমাত্র বাড়িতে পা রেখেছেন। আঁধার ফুঁড়ে ছুটে এল একটা তীর। বিধঁল খিজরুল হায়াতের পিঠে। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল। উপর হয়ে পড়ে গেলেন তিনি। কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল ব্যথাভরা চিৎকার। চিৎকার শুনে চাকর বাকররা ছুটে এল। ছুটে এল পরিবার পরিজন। ঘটনার আকস্মিকতায় থ’ হয়ে গেছে সবাই। কারও মুখে কথা নেই। মারা গেছেন খিজরুল হায়াত। একজন চাকর লক্ষ্য করল মৃত্যুর পূর্বে তিনি মাটিতে কিছু লেখার চেষ্টা করছিলেন। চাকরটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মাটিতে লিখা মুসলেহ। ‘হ’ টা অর্ধেক লিখেছেন হত্যাকারীর পুরো নাম লিখার পূর্বেই মারা গেছেন তিনি। লিখাটা সংরক্ষন করে লাশটা তুলে নেয়া হল। একজনকে পাঠিয়ে দেয়া হল পুলিশ প্রধান গিয়াস বিলকিসের কাছে। গিয়াস ছিলেন সুলতানের বিশ্বস্ত। আলী বিন সুফিয়ানের মত অপরাধ দমনে অভিজ্ঞ।
সংবাদ পেয়েই ছুটে এলেন গিয়াস বিলকিস। গভীর মনযোগ দিয়ে নামটি দেখলেন। ততোক্ষণে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান মুসলেহ উদ্দিনও ছুটে এসেছেন। গিয়াস দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলেন তাকে। সন্তর্পণে মাটির লেখাটা পা দিয়ে মুছে ফেললেন।
‘যত তারাতাড়ি সম্ভব হত্যাকারীকে খুঁজে বের করুন।’ বললেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। ‘আগামীকাল ভোরেই আমি অপরাধীকে দেখতে চাই।’
‘আমি অপরাধীকে খুঁজে বের করব স্যার।‘ পুলিশ প্রধানের কন্ঠ।
সবাই ফিরে গেলেন। রাতে গিয়াস খিজরুল হায়াতের সহকারী অফিস স্টাফসহ তার নিকটস্থ লোকদের ডেকে পাঠালেন। ওদের কাছে জানা গেল, আজ হায়াত সচিবদের এক মিটিংয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন। সংগে ছিলেন সহকারি। মিটিংয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে সামরিক বাজেটের প্রসংগ আসে। হায়াত বললেন, ‘সুলতান সুবাকে নতুন ফৌজ ভর্তি করেছেন। ওদের বেতনাদি দিতে হলে মিসরে অপ্রয়োজনীয় বাজেট কমাতে হবে।’
এর বিরোধীতা করলেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বললেন, ‘নতুন সৈন্য ভর্তি করার পূর্বে আমাদের সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই সেনাবাহিনী সাদা হাতীতে পরিণত হয়েছে। মিসরের ফৌজ অশান্ত হয়ে আছে। তাদের অভিযোগ, সুবাকে প্রাপ্ত গনিমতের মাল থেকে তাদেরকে কিছুই দেয়া হয়নি।’
‘আপনি কি জানেন না, গনিমতের সম্পদ ভাগ-বাটোযারা করে দেয়ার নিয়ম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে?’
হায়াত বললেন, ‘চমৎকার সিদ্ধান্ত। যারা গনিমতের জন্য যুদ্ধ করে তাদের ভেতর জাতীয় চেতনাবোধ বা ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকে না।’
এক পর্যায়ে এ আলোচনা বিতর্কে রূপ নিল। উত্তেজিত হয়ে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান বললেন, ‘সুলতান মিসরীয় সৈন্যদের সাথে ভাল ব্যবহার করেন না, যেমনটি করেন সিরীয় এবং তুর্কি সৈন্যদের সাথে।’
‘মনে হচ্ছে খ্রিস্টান এবং ফাতেমীরা আপনার মুখ দিয়ে কথা বলছে।’
উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে মিটিং সমাপ্ত করে দেয়া হল। অর্থ সচিবের সহকারী জানালেন, মিটিং শেষে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান স্যারের অফিসে এলেন। এখানেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হল। স্যার উপ-রাষ্ট্রপ্রধানকে বললেন, ‘আমি সুলতানের কাছে এ প্রসংগ তুলব। বলব, আপনি ভরা জলসায় সবাইকে বুঝাতে চেয়েছেন যে সেনাবাহিনী অশান্ত। আপনি বলেছেন, সুলতান সবার সাথে সমান ব্যবহার করেন না এবং গনিমতের মাল মিসরের সৈন্যদের না দিয়ে অন্য সৈন্যদের দিচ্ছেন। এছাড়া আপনি আমাকেও আপনার দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছেন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধান কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় বললেন, ‘তুমি বেঁচে থাকলে তো সুলতানকে এসব জানাবে।’
উপ-রাষ্ট্রপ্রধানকে গিয়াস কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ পুলিশ বিভাগ তার অধীন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোলার পূর্বে অবশ্যই প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। পুলিশ প্রধান বুঝলেন এ হত্যা ব্যাক্তিগত কারণে হয়নি। তিনি গোপনে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করতে লাগলেন।
* * *
পুলিশ প্রধান বিভিন্ন প্রমাণে যা জানলেন, তা হল, হত্যা ঘটনার দু’দিন পর মুসলেহ উদ্দীন রাতে বাসায় ফিরলেন। প্রথম স্ত্রী তাকে ডেকে নিলেন নিজের কক্ষে। তিনি ঢুকতেই স্ত্রী বিশটা আশরাফি তার সামনে রেখে বললেন, ‘খিজরুল হায়াতের হত্যাকারী এ বিশ আশরাফি ফিরিয়ে দিয়ে গেছে।’ স্ত্রী এক টুকরা কাগজ স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তাতে লেখা ছিল- ‘পঞ্চাশ আশরাফি এবং দু’টুকরা স্বর্ণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিয়েছেন বিশ আশরাফি। আপনার স্ত্রীর কাছে দিয়ে গেলাম। আমাদের ধোঁকা দিয়েছেন। এখন একশ আশরাফি এবং দু’টি স্বর্ণের টুকরা দিতে হবে। তা নয়তো একটা তীর খিজরুল হায়াতের মত আপনার হৃদপিন্ডেও গেঁথে যাবে।’
মুসলেহ উদ্দীনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিছুটা সংযত হয়ে বললেন, ‘তুমি কি বলছ? ওরা কারা? কাউকে আমি কোন আশরাফি দেয়ার কথা বলিনি। বিশ্বাস কর, হায়াতের হত্যার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’
‘তুমিই হায়াতকে হত্যা করেছ। কি কারণে জানি না, তবে তুমি যে তার হত্যাকারি এতে কোন সন্দেহ নেই।’
মুসলেহ উদ্দীনের প্রথম স্ত্রী সাবেরা। বয়স ত্রিশের কোঠায়, সুন্দরী। দেহের গাঁথুনি এখনও অটুট। পুরুষকে আকর্ষণ করার মত রূপ এখনও তার রয়েছে। মাস খানেক পূর্বে অপরূপা একজন তরুনীকে বাড়ী নিয়ে এসেছেন মুসলেহ উদ্দীন। এরপর থেকেই প্রথম স্ত্রীর কক্ষে যাওয়া বন্ধ। কয়েক দিনই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সাবেরা, কিন্তু তিনি যাননি। তখন একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা বেআইনী ছিল না। স্ত্রীরাও এতে কিছু মনে করতেন না। হত্যাকারীদের চিঠি পেয়ে ভড়কে গেলেন সাবেরা। স্বামীর অকল্যাণ কল্পনায় কেঁপে উঠল তার মন। এজন্যই তাকে নিজের কক্ষে ডেকে এনেছিলেন।
‘মুখ বন্ধ রাখবে সাবেরা।’ গম্ভীর কন্ঠে বললেন মুসলেহ উদ্দীন। ‘এ হচ্ছে আমার দুশমনের একটা চাল। তারা তোমার এবং আমার মাঝে শত্রুতা সৃষ্ঠি করতে চাইছে।’
‘আমার বিরুদ্ধে শত্রুতা ছাড়া তোমার মনে কি অন্য কিছু আছে?’
‘তোমায় আমি ভালবাসি সাবেরা। সেই প্রথম দিনের মত। তুমি কি ওদের কাউকে চিনতে পেরেছ?’
‘ওরা মুখোশ পরেছিল। তবে তোমার মুখোশ খুলে গেছে। তোমায় আমি চিনে গেছি।’
স্বামী কিছু বলতে চাইছিলেন। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে সাবেরা বলল, ‘সম্ভবতঃ তুমি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ আত্মসাৎ করেছ। জেনে ফেলেছে সচিব। এ জন্যই গোপন আততায়ীর মাধ্যমে তাকে খুন করেছ।’
‘কেন আমায় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ। কোষাগারের অর্থ আমি কেন আত্মসাৎ করতে যাব?’
‘তোমার না হলেও যে ফিরিংগী মেয়েটাকে বিয়ে ছাড়া সাথে রেখেছ তার প্রয়োজন আছে। তোমার মদ কেনার জন্য টাকার দরকার। যদি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চাও তবে বল ঘোড়াগাড়ী বোঝাই করে কি এনেছ? তোমার হারেমে প্রতিদিন নতুন নর্তকী আসছে বিনে পয়সায়? তোমার মদের আসরে যে টাকা খরচ হয় তা কোত্থেকে আসে?’
‘চুপ কর সাবেরা। ওরা কারা আমাকে একটু খোঁজ নিতে দাও। ইস! কি ভয়ংকর চাল চেলেছে। ক’দিন পরই সত্যি ঘটনা তুমি বুঝতে পারবে।’
‘না, আমি চুপ থাকব না। আমার বুকে তুমি প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছ। মিসরের সব লোককে ডেকে ডেকে একথা বলব। অলি-গলিতে চিৎকার করে বলব তুমি খিজরুল হায়াতের হত্যাকারী। হত্যা করেছ আমার ভালবাসা। এ হত্যার প্রতিশোধ আমি নিব।
স্ত্রীকে অনেক অনুনয় বিনয় করে মুসলেহ উদ্দীন বললেন, ‘আমাকে দু’দিন সময় দাও। দু’দিনের মধ্যেই আমি ওদের খুঁজে বের করে প্রমাণ করব হায়াতকে আমি হত্যা করিনি। পুলিশ প্রধান সন্দেহজনক কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে আসল খুনীকেও পাকড়াও করতে পারবে।’
পেরিয়ে গেল রাত। পর দিনও। মুসলেহ উদ্দিন বাড়ী ফেরেননি। ফিরিংগী মেয়েটাকেও কোথাও দেখা গেল না। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরলেন মুসলেহ উদ্দিন। সোজা চলে গেলেন স্ত্রীর কক্ষে। আদুরে গলায় কথা বললেন। শোনালেন ভালবাসার কথা। সাবেরা তার ধোঁকার জালে পা দিতে চাইলেন না। কিন্তু জাত খেলুড়ে মুসলেহ উদ্দীনের কপট ভালবাসার ফাঁদে এক সময় ধরা দিলেন স্ত্রী।’
‘আমি দু’দিন পর্যন্ত ওই দু’জন কে খুঁজছি। এখনও পাইনি। আশা করি পেয়ে যাব। আমি যে হত্যাকারী নই তখন তোমায় আশ্বস্ত করতে পারব।’
আরও অনেক কথা বললেন মুসলেহ উদ্দীন। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন সাবেরা। কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। চাকর-বাকরদের ছুটি দিয়ে দিলেন। সমগ্র বাড়ীতে নেমে এল কবরের নিরবতা। পাহারাদার কুকুরটাকে বাড়ীর এক কোণে বেঁধে রেখে নিজের কক্ষে ফিরে এলেন মুসলেহ উদ্দিন।
মাঝ রাত। বাইরের পার্টিশন ঘেঁষে দাঁড়াল এক মুখোশধারী। তার কাঁধে পিঠে দাঁড়াল দ্বিতীয় জন। তৃতীয় ব্যাক্তি তার কাঁধে উঠে পার্টিশনের ভেতর লাফিয়ে পড়ল। খুলে দিল প্রহরীহীন ফটক। বাড়ীর করিডোরে উঠে এল তিনজনে। এগিয়ে চলল বিড়ালের মত নিঃশব্দে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওরা সাবেরার কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকল তিনজন। একজন হাত ছোঁয়াল সাবেরার মুখে। স্বামীর হাত ভেবে আকড়ে ধরে সে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
কোন জবাব না দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলল একজন। বেঁধে দিল হাত। পাজা কোলা করে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে কাঁধে তুলে নিল। চাকর বাকর কেউ নেই। বিনা বাধায় ওরা বেরিয়ে গেল। খানিক দূরে একটা গাছের সাথে তিনটে ঘোড়া বাঁধা ছিল। রশি খুলে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল তিনজন। বস্তা তুলে নিল একজন। মিসর পিছনে ফেলে ইস্কান্দারিয়ার দিকে ছুটে চলল ঘোড়াগুলো।
সকালে চাকর-বাকররা ফিরে এল। মুসলেহ উদ্দীন ওদেরকে সাবেরার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তন্ন তন্ন করে সারা বাড়ী খোঁজা হল। সাবেরা কোথাও নেই। এক চাকরাণীকে একান্তে ডেকে নিলেন মুসলেহ উদ্দীন। অনেকক্ষণ কথা বললেন দু’জন। এরপর তাকে নিয়ে গেলেন পুলিশের কাছে। মুসলেহ উদ্দীন বললেন, ‘আমার স্ত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বিশ্বাস হায়াতকে ওই হত্যা করিয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন যে মুসলেহ উদ্দীনের স্ত্রী। কিন্তু পারেননি। এই চাকরাণীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।’
পুলিশ প্রধানের প্রশ্নের জবাবে চাকরাণী বলল, ‘পরশু রাতে দু’জন লোক এসেছিল। আমার মুনিব তখন ছিলেন না। দেখলাম মুখোশ পরা দু’ব্যাক্তি, ওরা বেগম সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইল। বাড়ীতে কোন পুরুষ না থাকায় আমি বললাম, এখন দেখা হবে না। ওরা বলল, ‘বেগম সাহেবের এই বিশটি আশরাফি ফেরত দিতে এসেছি।’ আমি বেগম সাহেবকে বলতেই তিনি দু’জনকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমাকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। বললেন, ‘কেউ এলে যেন তাকে সতর্ক করে দেই।’
বাইরে থেকে আমি শুনলাম দু’জন কঠোর ভাষায় কথা বলছে আর বেগম সাহেবা অনুনয় বিনয় করছেন। তিনি আরও বললেন, আলি বিন সুফিয়ানের সহকারী হাসানকে হত্যা করতে পারলে পঞ্চাশ আশরাফি এবং দু’টি স্বর্ণের টুকরা দেবেন। এই বিশ আশরাফি বেগম সাহেবা কিভাবে দিয়েছেন আমি জানি না। ওরা পঞ্চাশ আসরাফি দাবী করছিল। বেগম সাহেবা বললেন, ‘তোমরা ভুল লোককে মেরেছ। হাসানকে মারতে পারনি।’
ওরা বলল, ‘তুমি যে সময়ের কথা বলেছ ঠিক সে সময় এ লোকটি বাড়ীতে ঢুকেছিল। লোকটি হাসান না অন্য কেউ আমরা দেখিনি। আমরা তীর ছুঁড়ে পালিয়ে গেছি।’
পঞ্চাশ আশরাফি দেয়ার জন্য ওরা বেগম সাহেবাকে চাপ দিচ্ছিল। বেগম সাহেবা বললেন, ‘আসল লোককে হত্যা করতে পারলে পঞ্চাশ আশরাফি এবং দুটো সোনার টুকরা দেব।’ কিন্তু ওরা বলল, ‘যে কাজ করেছি আগে তার বিনিময় দাও, তারপর অন্য কাজ।’ বেগম সাহেবা অস্বীকার করায় ওরা বলল, ‘টাকা কিভাবে ওসুল করতে হয় আমরা জানি।’ এরপর ওরা দু’জন চলে গেল। বেগম সাহেবা আমায় ডেকে বললেন, ‘খবরদার, এসব কথা কাউকে বলবে না। আমাকে তিনি দুটো আশরাফিও দিয়েছেন। আজ সকালে তার কক্ষে গিয়ে দেখি তিনি নেই। আমার মন বলছে টাকা না দেয়ায় সে দু’জন লোকই তাকে অপহরণ করেছে।’
পুলিশ প্রধান মুসলেহ উদ্দীনকে বসিয়ে রেখে চাকরাণীকে নিয়ে অন্য কক্ষে চলে এলেন।
‘এবার বল এ কথা তোমায় কে শিখিয়েছে, মুসলেহ উদ্দীন, না সাবেরা?’
‘এ জবানবন্দী আমার নিজস্ব।’
‘সত্যি করে বল সাবেরা কোথায়? কার সাথে গিয়েছে?’
চাকরাণী ভয় পেয়ে গেল। পুলিশ প্রধানকে কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না। গিয়াস বললেন, ‘কিভাবে সত্যি কথা বের করতে হয় আমি জানি। তুমি এখন ফিরে যেতে পারবে না। পুলিশের শাস্তি সেলের কথা শুনেছ?’
বিবর্ণ হয়ে গেল চাকরাণীর চাহারা। সে জানত, পুলিশের শাস্তি সেলে সত্য মিথ্যা আলাদা হওয়ার আগে দেহের হাড়গোড় আলাদা হয়ে যায়। সে কাঁদতে লাগল।
‘দেখুন, আমি এক গরীব মেয়ে। সত্যি কথা বললে মুনিব শাস্তি দেবেন। মিথ্যা বললে আপনারা।’
‘তোমার কোন ভয় নেই। তোমার নিরাপত্তার জিম্মা আমি নিচ্ছি।’
চাকরাণী বলল, ‘হত্যার দ্বিতীয় দিন একজন মুখোশধারী এসেছিল। মুনীব বাড়ী ছিলেন না। লোকটা ছিল ফটকের বাইরে। বেগম সাহেবা ভিতরে। কি কথা হয়েছে আমরা কেউ শুনিনি। মুখোশধারী চলে গেলে বেগম সাবেরা ফিরে এলেন। হাতে ছিল একটা প্যাকেট। একরাত পর মুনীব আমাদের সবাইকে একরাতের জন্য ছুটি দিলেন।’
‘ইতিপূর্বেও কি সবাইকে সারা রাতের জন্য ছুটি দিয়েছিলেন?’
‘কখনও না। একজন ছুটিতে গেলে অন্য সবাই থাকত। আরো আশ্চর্য হল, কুকুরটাকে কখনও বেঁধে রাখা হয়না। ভয়ংকর কুকুর। অপরিচিত লোক দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে রাতে মুনিব নিজেই গেলেন কুকুরটাকে বেঁধে রাখতে।’
‘মুসলেহ উদ্দীনের সাথে সাবেরার সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘ইদানীং খুব খারাপ। মুনিব একটা সুন্দরী ফিরিংগী মেয়েকে বাড়ী আনার পর থেকে বেগম সাহেবার সাথে কথা বলেন না।’
চাকরাণীকে বসিয়ে রেখে পুলিশ প্রধান উঠে গেলেন। ফিরে এলেন দু’জন সিপাই নিয়ে। সিপাইরা মুসলেহ উদ্দীনের দু’বাহু ধরে নিয়ে যেতে চাইল। প্রতিবাদ করলেন তিনি। পুলিশ প্রধান বললেন, ‘একে জেলে নিয়ে যাও। তার বাড়ী সীল করে পাহারার ব্যবস্থা কর। কাউকে বাইরে যেতে দেবে না।’
কায়রোর উত্তরে এক সবুজ শ্যামল প্রান্তর। দূরত্ব অনেক। চারপাশে উঁচুনিচু পাহাড়। পাহাড় থেকে প্রান্তর ছুয়ে বয়ে গেছে ঝর্ণা ধারা। পূব আকাশ রাংগা হয়ে উঠেছে। অপহরণকারীরা ঘোড়া থামাল। নেমে এল তিনজন। বস্তার মুখ খুলে সাবেরাকে বের করে আনল। মুখের কাপড় সরিয়ে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সাবেরা অচেতন না হলেও অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। চিৎকার করারও শক্তি নেই। ওরা তাকে পানি পান করাল। খেতে দিল খেজুর আর রুটি। শীতল বাতাসে ওর শক্তি ফিরে এল। আচম্বিত সাবেরা উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে টিলার আড়ালে চলে গেল। একজন মুখোশধারী ঘোড়ায় চেপে ছুটল ওর পেছনে। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল সাবেরা। মুখোশধারী তাকে ঘোড়ায় তুলে সংগীদের কাছে ফিরে এল।
‘পালিয়ে যেতে চাইলে যাও।’ বলল একজন। ‘কোথায় যাবে? এখান থেকে একজন শক্তিশালী পুরুষও এভাবে কায়রো পৌঁছাতে পারবে না।’
সাবেরা কেঁদেকেটে ওদের গালাগালি করতে লাগল।
‘কায়রো ফিরে যেতে চাইলে যাও। কিন্তু ওখানে গেলেও মরবে। তোমার স্বামীই তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘মিথ্যে নয়, সত্য। মজুরী হিসেবে তোমায় দিয়েছে। তোমার হাতে আমরাই আশরাফি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি তাকে বলেছ সে সচিবকে হত্যা করেছে। তুমি আরও বলেছ, এসব কথা পুলিশ প্রধানকে বলে দেবে। আগে থেকেই সে তোমার ওপর বিরক্ত। ফিরিংগী মেয়েটা তার মন দখল করে রেখেছে। মেয়েটা কে, কোথা থেকে এসেছে তোমাকে তা বলা যাবে না। পরদিন তোমার স্বামী আমাদের কাছে এল। আস্ত বেঈমান। বলেছিল কাজটা করলে পঞ্চাশ আশরাফি আর দু’টি সোনার টুকরা দেবে। কিন্তু কাজ শেষে পাঠাল বিশ আশরাফি। আমরা তোমাকে ব্যবহার করলাম। তোমার কাছে টাকা দেয়ার অর্থ যেন তুমিও ব্যাপারটা জানতে পার। বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। পরদিন পঞ্চাশ আশরাফি দিল। স্বর্ণের টুকরা দিল না। আমরা বললাম, ‘এখন পঞ্চাশে চলবে না। আরও বেশী দিতে হবে। না দিলে খবরটা পুলিশ প্রধানের কানে তুলে দেব।’
তার জন্য সমস্যা ছিল ব্যাপারটা তুমি জেনে ফেলেছ। সে বলল, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাও। ওকে বিক্রি করে অনেক টাকা পাবে।’
সাবেরার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সে হতভম্বের মত তিন অপহরণকারীকে দেখতে লাগল। মুখোশের মাঝখান দিয়ে দুটো করে চোখ দেখা যাচ্ছে। হিংস্র এবং ভয়ংকর। ওদের কণ্ঠে কোন হিংস্রতা ছিল না। ওরা বরং তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়।
‘আমি তোমাকে একবার দেখেছিলাম’, বলল একজন।
‘তোমার স্বামীর প্রস্তাব শুনে ইস্কান্দারিয়ার বাজারে তোমাকে কত বিক্রি করা যাবে মনে মনে হিসাব করলাম। তুমি যুবতী, সুন্দরী। তোমাকে অনেক দামে বিক্রি করা যাবে। আমরা রাজি হলাম।’ তোমার স্বামী বলল, ‘রাতে আমার চাকর-বাকররা থাকবে না। কুকুরটাকেও বেঁধে রাখা হবে। রাতে এসে ওকে তুলে নিও।’ এ পারশ্রমিক না পেলে আমরা তাকে হত্যা করতাম। অপহরণ করতাম ফিরিংগী মেয়েটাকে। আমরা রাতে তোমাকে তুলে নিয়ে এলাম।’
‘তোমাকে এসব কথা বলার কারণ, তুমি স্বামীর ঘরের কথা ভুলে যাও।’ বলল দ্বিতীয় জন। ‘আমরা অসহায় কোন নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করিনা। আমরা ব্যবসায়ী। অপহরণ এবং টাকার বিনিময়ে হত্যা করা আমাদের পেশা। তিনজন পুরুষ একজন নারীকে অপহরণ করে ভোগ করার মধ্যে কোন গর্ব নেই।’
‘তোমরা কি আমাকে ইস্কান্দারিয়ার বাজারে বিক্রি করবে?’ কাঁপা কণ্ঠে সাবেরা জিজ্ঞেস করল। ‘শেষ পর্যন্ত এই কি হবে আমার কপালের লিখা?’
‘না, খারাপ কাজের জন্য জংলী এবং বেদুইন মেয়েদের ক্রয় করা হয়। তুমি সম্মানিতা গৃহ বধু। কোন আমীরের ঘরেই তুমি যাবে। আমরাও দামটা বেশী পাব। এখন কান্নাকাটি বন্ধ কর। কাঁদলে চেহারার লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে বাজারে-মেয়ে হিসাবেই বিক্রি করতে হবে। এবার শুয়ে পড়। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।’
সাবেরা আশ্চর্য হয়েছে এতক্ষণ সময়ের মধ্যে এদের কেউ তার সাথে অশালীন আচরণ করেনি দেখে। মনে মনে স্বস্তিও পেয়েছে। রাতভর বস্তাবন্দী থেকে সমস্ত শরীর ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুম ভেংগে গেল হঠাৎ। তার মাথায় চাপে আছে ভয় এবং আতংক। মনের দিক থেকে সে এ পরিণতিকে গ্রহণ করতে পারছে না। আড়চোখে তাকাল তিনজনের দিকে। ঘুমুচ্ছে ওরা। একবার ভাবল খঞ্জর বের করে ওদের হত্যা করে। বাতিল করে দিল চিন্তাটা। একা তিনজনের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। চোখ পড়ল পাশে বাঁধা ঘোড়ার ওপর। পিঠে জিন বাঁধা। ও উঠে পড়ল। আলতো পায়ে এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। সূর্য নেমে গেছে টিলার ওপাশে। কায়রো কোন দিকে জানে না ও। তবুও বাঁচতে হলে পালাতে হবে ওকে। প্রয়োজনে বিশাল মরুর বিস্তারে ধুকে ধুকে মরবে, তবুও এদের হাতে সম্ভ্রম নষ্ট হতে দেবে না। আলগোছে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল সাবেরা। ছুটিয়ে দিল ঘোড়া।
ঘোড়ার পদশব্দে তিনজনের ঘুম ভেংগে গেল। দু’জন দুটো ঘোড়ায় চেপে ছুটল তার পেছনে। টিলার বেষ্টনী থেকে বের হবার পথ জানা নেই সাবেরার। সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল এক পাহাড়। পেছনে তাকাল ও। ধাওয়াকারীরা কাছে চলে এসেছে। ঘোড়াসহ পাহাড়ে উঠতে লাগল সাবেরা। উপরে উঠে তাকাল বিপরীত দিকে, পথ পেয়ে গেল। নেমে এল নীচে। ধাওয়াকারীরাও তার পেছনে আসছে। কাছে চলে এসেছে ওরা। সামনে সমুদ্র। সমুদ্রের দিক থেকে আসছে চারজন উস্ট্রারোহী। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না ও। সাবেরা চিৎকার শুরু করলঃ ‘বাঁচাও, বাঁচাও, ডাকাতের হাত থেকে বাঁচাও।’
ঘোড়া পৌঁছে গেল উস্ত্রারোহীদের কাছে। উস্ট্রারোহীদের দেখে মুখোশধারীরা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল। ওদের পিছু নিল উটের আরোহীরা। একজন ধনুকে তীর জুড়ে দু’জনকে লক্ষ্য করে ছুড়ল। বিঁধল এক ঘোড়ার ঘাড়ে। ঘোড়ার লাফালাফিতে পড়ে গেল সওয়ার। চার জন মিলে ওপর অশ্বারোহীকে ঘিরে ফেলল। একজনের পক্ষে চারজন তীরন্দাজের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, সে আত্মসমর্পণ করল। সাবেরা ওদের বলল, ‘এদের একজন ওপাশে রয়েছে।’ ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া আরোহীসহ তিনজনকেই গ্রেপ্তার করা হল।
এ চারজন উস্ট্রারোহী ছিল সুলতান আয়ুবীর সেনা বাহিনীর সদস্য। সাগর উপকূল এবং সমগ্র মরুভূমিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেনা দল পেট্রোল ডিউটিতে রত ছিল। আচম্বিত শত্রুর আক্রমণ যেন না আসতে পারে এ জন্যই এই ব্যবস্থা। এরা কয়েক বারই বিপজ্জনক খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের ধরে সুলতানের সামনে হাজির করেছে। সাবেরা সৈন্যদেরকে অপহরণের পুরো কাহিনী শোনাল। সে বলল, ‘উপ-রাস্ট্রপ্রধান আমার স্বামী। এ তিন ভাড়াটে খুনীদের দিয়েই তিনি অর্থ সচিবকে হত্যা করিয়েছেন। আমাকেও তুলে দিয়েছেন এদের হাতে।’
তিন অপহরণকারীর অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হল। হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দুটো ঘোড়ায় করে ওদেরকে সৈন্যরা কমান্ডারের কাছে নিয়ে গেল। সাবেরা বসল উটের পিঠে। সূর্য ডোবার পূর্বেই এরা চার মাইল পথ অতিক্রম করল। সামনের মরুদ্যানে তাঁবু টানানো। ডিউটিরত সেনা দলের হেড কোয়ার্টার। ওরা সাবেরাকে নিয়ে গেল কমান্ডারের সামনে। কঠোর প্রহরায় তিন অপহরণকারীকে বসানো হল তাঁবুর বাইরে। আগামীকাল এদের কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে।
* * *
খ্রিস্টানদের পদতলে পিষ্ট হচ্ছিল প্রিয় ফিলিস্তিন। মুসলমানদের রক্তে ভিজে যাচ্ছিল পবিত্র ভূমির বালুকারাশি। দুর্দশার কালো মেঘ থেকে ঝরে পড়ছিল অত্যাচারের অগ্নি বৃষ্টি। অসহনীয় নির্যাতনের দুঃসহ ব্যথায় কাৎরাচ্ছিল তৌহিদী জনতা। এমনি এক দুঃসময়ে সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুরী পা রাখলেন ফিলিস্তিনের মাটিতে।
সুবাক এখন মুসলমানদের দখলে- দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এ সংবাদ ফিলিস্তিনের মুসলমানদের হৃদয়ে জ্বেলে দিল আশার প্রদীপ। অনাগত মুক্তির আনন্দে হিল্লোলিত হল প্রাণ। কিন্তু ওদের এ অব্যক্ত আনন্দ দুর্বিসহ বেদনা হয়ে দেখা দিল। খ্রিস্টানরা প্রতিশোধের আগুনে পুড়িয়ে দিল জেরুজালেম এবং আশপাশের জেলাগুলোর মুসলিম বসতি। এভাবেই মুসলমানদের ওপর সুবাক দুর্গ হারানোর শোধ তুলতে লাগল ওরা।
মুসলমানদেরকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঘৃণ্য তৎপরতায় মেতে ওঠা খ্রিস্টানরা সুবাকের পর ক্রাক নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ল। আয়ুবী যেন ক্রাক আক্রমণ করতে না পারে এ জন্য ক্রাকে চলল নির্বিচারে মুসলিম হত্যা। বুদ্ধির খেলায় হেরে গেছে ওরা। হাতছাড়া হয়েছে সুবাক দুর্গ। ক্রাক হাতছাড়া করা যাবে না। স্তব্ধ করে দিতে হবে আয়ুবীর অগ্রযাত্রা। ক্রাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করার পাশাপাশি তাই ওরা স্থানীয় মুসলমানদের শিরদাড়া ভেংগে দেয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। এখানেও খোলা হল বেগার ক্যাম্প। সামান্য সন্দেহ হলেই মুসলমানদেরকে নিক্ষেপ করতে লাগল সে ক্যাম্পে।
‘ফিলিস্তিন বিজয় আমাদের মহান উদ্দেশ্য। কিন্তু ক্রাক থেকে নির্যাতিত মুসলমানদেরকে বের করে আনা তারচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।’ সুলতান আয়ুবীকে বলল গোয়েন্দা সংস্থার একজন গ্রুপ কমান্ডার, নাম তালাত চেঙ্গিস। তালাত একজন তুর্কী মুসলমান। সুবাক থেকে পালিয়ে যাওয়া খ্রিস্টানদের ছদ্মবেশে ক্রাকে পৌঁছে ছিল সে। ফিরে এসেছে তিন মাস পরে। গোয়েন্দা প্রধানের সামনেই তালাত সুলতানকে ক্রাকের রিপোর্ট দিচ্ছিল। ‘যে সব খ্রিস্টান সৈন্য’ লুকিয়ে ক্রাক পৌঁছেছে ওদের অবস্থা ভাল নয়। সহসা যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে পারবে না ওরা। তবে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে ওরা স্থানীয় মুসলমানদের ওপর। পুরুষদেরকে এলোপাথাড়ি গ্রেপ্তার করছে। মেয়েরা বাড়ী থেকে বের হতে পারছে না। আমরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য ওখানকার মুসলিম যুবকদেরকে গোপনে সংগঠিত করতে শুরু করেছিলাম। কিছু যুবক পালিয়ে এসে ভর্তিও হয়েছে। কিন্তু চারদিকে খ্রিস্টান সৈন্য থাকায় অধিকাংশই ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আসতে পারছে না। তাছাড়া পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসতে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে।
সবচেয়ে বিপদের কথা হল, কারো ওপর সন্দেহ হলেই তাকে বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখনই ক্রাক আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে এ নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি দেয়া আমাদের কর্তব্য।’
এর আগে গোয়েন্দারা বলেছিল সুলতান ক্রাক আক্রমণ করলে রিমান্ড তার বাহিনী নিয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করবে। সুলতানও সেনা অফিসারদের কাছে পূর্বেই এমন আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন। এ জন্য সেনা সদস্য বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল।
সুলতান আয়ুবী তালাতকে বিদায় দিয়ে আলীকে বললেন, আবেগের দাবী হচ্ছে এ মুহূর্তে ক্রাক আক্রমণ করা। ওখানকার মুসলমানরা কি কষ্টের মধ্যে আছে আমি বুঝি। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, শক্তি সঞ্চয় না করে আক্রমণ করো না। নিশ্চিত না হয়ে আক্রমণ করা যুদ্ধনীতির পরিপন্থী। আলী! আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে পুরুষদের। ইসলামের ইতিহাসে ওরা হচ্ছে নামহারা শহীদ। যে কোন জাতিকেই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এমন কোরবানী দিয়ে যেতে হয়। ওদের আব্রু, জীবন এবং ওদের দ্বীনের হেফাজতের জন্যই আমি ফিলিস্তিন শত্রুমুক্ত করতে চাই। সাধারণভাবে যুদ্ধের উদ্দেশ্য আক্রমণ ও লুটপাট ছাড়া কিছুই নয়। যারা স্বীয় জাতির সন্তানদের ভুলে যায়, মুখ বুজে সহ্য করে শত্রুর নির্যাতন, তারা হয়ে যায় ডাকাত ও দস্যুদের সহযোগী। শত্রুর ওপর প্রতিশোধ না তুলে পরস্পরের সম্পদ লুণ্ঠন করে ওরা। প্রতারিত করে অন্যকে। ওদের শাসকরা গরীবের সম্পদ লুটে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়। শত্রুরা আক্রমণ করলে অমূলক হম্বিতম্বি করে জনগণকে ধোঁকা দেয়। শত্রুর সংগে গোপন আঁতাত করে। দেশের কোন অংশ ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে রক্ষা করে গদী। ভোগ বিলাসের জন্যই ওরা শুষে নেয় জনগণের শেষ রক্তবিন্দু।
অনেক জাতির শাসকগণ কেবল রাজ্য বিস্তারের মোহে যুদ্ধ করেছে। বিলাসিতার সময়টা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বইয়ে দিয়েছে রক্তের বন্যা। আজ পৃথিবী থেকে ওদের নামও মুছে গেছে। খ্রিস্টানদের মত আমরাও লড়াইকারী। কিন্তু দু’জনের মধ্যে বিরাট পার্থক্য। ওরা অনেক দূর থেকে এসেছে আমাদের ধর্মের অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য। এসেছে আমাদের নারীদের অধিকার করে ওদের গর্ভ থেকে খ্রিস্টান জন্ম দেয়ার জন্য। আমরা আত্মরক্ষার জন্য এবং আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য লড়াই করছি। খ্রিস্টানদের এ ঝড়কে প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা বিবেকহীন, আত্মমর্যাদা শূন্য বলে পরিচিত হবো। আর যদি আমরা বাড়ীতে বসে ওদের আক্রমণের অপেক্ষা করি তবে নিশ্চয়ই আমরা ভীত ও কাপুরুষ বলে চিহ্নিত হবো। প্রতিরোধের নিয়ম হলো, যখনি দুশমন তোমাকে হত্যা করার জন্য তরবারী কোষমুক্ত করবে, আঘাত করার পূর্বেই তোমার তলোয়ার তার শিরোচ্ছেদ করবে। সে আগামী কাল আক্রমণ করতে আসবে জানলে আজই তার মোকাবেলায় নেমে যাও যাতে সে আর আঘাত করার সুযোগ না পায়।’
‘নূরুদ্দীন জংগীর কাছে কি সাহায্য চাওয়া যায় না?’ আলী বললেন, ‘সাহায্য পেলে সাথে সাথেই আমরা ক্রাক আক্রমণ করতে পারতাম।’
‘না, তাঁর কাছে সবসময় এমন সৈন্য থাকা দরকার, আমরা পেছন থেকে আক্রান্ত হলে তিনি যেন ওদেরকে পাল্টা আক্রমণ করতে পারেন।’ আয়ুবী বললেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার পক্ষপাতি নই, বরং গেরিলাদের পাঠিয়ে আমরা ওদের ঘুম হারাম করে দিতে পারি। আমার বিশ্বাস, আমাদের গুপ্তচর এবং গেরিলারা মিলে শত্রুর মূল উপড়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু ওখানকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে এর শাস্তি ভোগ করতে হবে। কারণ, কমান্ডো বাহিনী কাজ শেষে এদিক ওদিক পালিয়ে যাবে। কিন্তু ওখানকার নিষ্পাপ মুসলমান ভাই-বোনগুলো পালাতে পারবে না, তারা শত্রুর হাতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বিকল্প হিসেবে ওদেরকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় কিনা দেখ। আক্রমণ করার জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন। এর মধ্যে আমরা অনেক নতুন রিক্রুটও পেয়ে যাব।’
‘আমার মনে হয় এখানকার মুসলমানদের ব্যাপারে আমাদের পলিসি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।’ বলল খ্রিস্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।
ক্রাকের এক দুর্গে ক’জন খ্রিস্টান সম্রাট, উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মিটিং চলছিল। পরাজিত সেনাবাহিনীর দিকে তাকাতেই ওদের ক্রোধ বেড়ে যাচ্ছিল। এ পরাজয়কে ওরা বদলে দিতে চাইছিল বিজয় দিয়ে। এদের মধ্যে কেবল হরমুনই ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছিলেন। ক্রাকের মুসলমানদের ওপর চলছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন। তিনি বললেন, ‘আপনারা এখানকার মুসলমানদের সাথে যেমন ব্যবহার করেছেন আমরাও সুবাকে তেমন করেছিলাম। ফলশ্রুতিতে আমাদেরই এক গুপ্তচর মেয়ে বিপজ্জনক এক বন্দীকে পালাতে সাহায্য করেছিল। সে সুবাক দুর্গের সব কিছু দেখে গেছে। তাছাড়া সালাহউদ্দীন দুর্গপ্রাচীর যেভাবে ভেংগেছে এতে ভেতরের মুসলমানদেরও হাত ছিল। আমাদের ব্যবহারে ওরা এতটা বিরক্ত ছিল যে, জীবন বাজি রেখে ওরা সালাহউদ্দীনের সাহায্য করেছে। এরাই ছিল আয়ুবী সেনাবাহিনীর পথ প্রদর্শক।’
‘এ জন্যই আমরা এখানকার মুসলমানদের সাহস এবং আবেগ নিঃশেষ করার জন্য এরূপ নির্যাতন করছি।’ বলল এক সেনা কমান্ডার।
‘তার পরিবর্তে ওদেরকে আপনাদের বন্ধুতে রূপান্তরিত করুন, ওরা আপনাদের সাহায্য করবে।’ বলল হরমুন। ‘আমায় অনুমতি দিলে ধর্মান্তরিত না করেই ওদেরকে খ্রিস্টানদের বন্ধুতে রূপান্তরিত করব। তখন ওরা মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।’
‘ভুলে যাচ্ছ হরমুন!’ মুখ খুললেন সম্রাট রিমান্ড। ‘দু’একজন মুসলমানকে নারী দেহ আর টাকার লোভ দেখিয়ে গাদ্দারে পরিণত করা যায় কিন্তু গোটা সেনাবাহিনীকে গাদ্দার বানানো যায় না। হরমুন, ওদের ওপর নির্ভর করো না। ওদের আমরা বন্ধু বানাতে চাইনা, আমরা মুসলমানদেরকে নির্বংশ করতে চাই। কোন অমুসলিম কোন মুসলমানকে ভালবাসলে এর অর্থ হচ্ছে সে ইসলামকেই ভালবাসে। অথচ আমরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে চাই। ক্রাক, জেরুজালেম, ওফা এবং আদলিসা যেখানেই খ্রিস্টানদের শাসন রয়েছে সেখানেই মুসলমানদের ওপর এতটা নির্যাতন কর যেন ওরা মরে যায়। না মরলেও খ্রিস্টানদের সামনে মাথানত করে রাখে।’
‘মুসলমানদের সাথে এখানে যা করা হচ্ছে সালাহউদ্দীন আয়ুবী নিয়মিত তার খবর পাচ্ছেন।’ হরমুন বলল, ‘আপনারা তাকে ক্রাকে তাড়াতাড়ি আক্রমণ করতে বাধ্য করছেন। আপনারা ভুলে যাচ্ছেন আমাদের সেনাবাহিনী এ মুহূর্তে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত নেই।’
‘তবে কি এখানকার মুসলমানদেরকে মাথায় তুলে নাচব! বুঝতে পারছি না বন্দীদেরকে হত্যা না করে কেন আমরা লালন পালন করছি।’ জবাব দিলেন গে অব লুজিনাম।
‘কারণ মুসলমান বন্দীদের হত্যা করলে আয়ুবী আমাদের বন্দীদের হত্যা করবে। আমাদের কাছে রয়েছে ওদের তিনশ লোক, ওদের কাছে রয়েছে আমাদের তেরশ বন্দী।’
‘একজন মুসলমান সৈন্য হত্যার বিনিময়ে আমরা চারজন খ্রিস্টান সৈন্য হারাতে পারি না’, বললেন শাহ অগাস্টাস।
‘আয়ুবী আমাদের যে সব সৈন্যদের বন্দী করেছে ওরা ভীরু, কাপুরুষ। যুদ্ধ করার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব গ্রহণ করেছে। ওদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমাদের হাতে মরার চাইতে বরং মুসলমানদের হাতে মরাই ভাল। নিশ্চিন্তে মুসলিম বন্দীদের হত্যা করার পক্ষপাতি আমি।’ একজন সেনা কমান্ডার দাঁড়িয়ে বলল।
‘স্থানীয় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করে, বন্দীদের হত্যা করে আমরা কি আয়ুবীকে পরাজিত করতে পারব? এখন আমাদের সামনে সমস্যা হল আয়ুবী আক্রমণ করলে কিভাবে বাধা দেব, কিভাবে সুবাক দুর্গ পুনরুদ্ধার করব। আপনার কথামত ক্রাকের সব মুসলমানদের মেরে ফেললাম। তারপর কি হবে? শত্রু কি নিশ্চিহ্ন হবে? তারচেয়ে আয়ুবীর মত আমরাও আমাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করছি না কেন?’ বলল একজন।
‘মিশরে আমাদের গোয়েন্দারা কি কাজ করছে অনুগ্রহ করে হরমুন কি বলবেন?’ বলল আরেক সেনা কমান্ডার।
‘হ্যাঁ, আমাদের গোয়েন্দারা আশানুরূপ কাজ করছে। সালাহউদ্দীন সুবাক কেল্লায়। তার অনুপস্থিতিতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কায়রোর উপ-রাষ্ট্রপতি মুসলেহ উদ্দীন ফাতেমীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। মুসলেহ উদ্দিন আয়ুবীর বিশ্বস্ত। এখন আমাদের হাতে ফাতেমীরা গোপনে একজনকে খলিফা নির্বাচন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের সেনা অফিসাররা সুদানী বাহিনী তৈরী করছে। কায়রোতে আয়ুবীর ফৌজের দু’জন উপ-সেনাপ্রধান আমাদের লোক। সুদানীরা আক্রমণ করলেই ফাতেমীরা বিদ্রোহ করবে।’
‘ভুলে যাচ্ছ কেন, মিসরের সংবাদ পেলে আয়ুবী ক্রাক দুর্গ আক্রমণ মুলতবী রেখে ছুটে যাবে।’ বললেন রিমান্ড, ‘এখানেই রাখতে হবে তাকে। এমনভাবে বিরক্ত করতে হবে যেন তার সৈন্যরা মিসর যাবার পথ না পায়।’
হরমুন বললেন, ‘আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, মিসরে তার যে ক’জন সৈন্য রয়েছে ওরা কিছু করতে পারবে না। ওদের বুঝানো হয়েছে যে, সুলতান তোমাদেরকে গনিমতের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন। হাজার হাজার সুন্দরী যুবতী ধরা পড়েছে, ওদেরকে সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এসব গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব পালন করছে প্রশাসনের লোকেরা। আমি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলতে পারি, গোটা সেনাবাহিনী সুদানীদের পক্ষ অবলম্বন করবে। এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য আয়ুবীকে এখানকার ফৌজ নিয়ে যেতে হবে। ততোক্ষণে কায়রো হবে ফাতেমী খেলাফতের পদানত। আমরা আয়ুবীকে আক্রমণ করব না। কায়রোতে স্থান না পেয়ে বিশাল মরুতে ঘুরে ঘুরে একদিন…
‘কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, খলিফার গদিও কিন্তু টিকে থাকেনি।’
হরমুন বলল, ‘তার কারণ, ইসলামী সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার পরিবর্তে ব্যক্তি স্বার্থের দিকে নিবদ্ধ হল সকলের দৃষ্টি। ফলে, একে একে ছুটে যেতে থাকল বিজিত এলাকাগুলো। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা এখন আরবে অবস্থান করছি।
প্রথম দিককার জেনারেলগণ ইসলামী রাজ্যের সীমানা যদ্দুর বিস্তৃত করেছিল, সালাহউদ্দীন আয়ুবী সে পর্যন্ত যেতে চাইছেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, তিনি খেলাফত বা প্রশাসনের তোয়াক্কা করেন না। তার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মিসরের খেলাফত। তিনি তাকে পদচ্যুত করেছেন। সাহস, দূরদর্শিতা এবং সামরিক শক্তি নিজের হাতে থাকার কারণেই তিনি এমনটি করতে পেরেছেন।’
মজলিশে পিন পতন নিরবতা নেমে এল। হরমুনই নিরবতা ভাঙল আবার, ‘বেসমারিক নেতৃত্বের লক্ষ্য ক্ষমতার মসনদ। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা অর্থ, নারী এবং মদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সুলতান তাদের এ দুর্বলতা বুঝতে পেরেছেন। আমরা কেবল উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তাদেরকেই হাত করছি। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আমাদের দ্বিতীয় টার্গেট। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে হলে তাদেরকে জনগণের কাছে হেয় করতে হবে। আমি এ কাজটিই করছি। এ ব্যাপারে আপনারা হয়ত আমার সাথে একমত হবেন না, তবুও আমি বলব, মুসলমানদের হাতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে সে।
মুসলমানদের মানসিকতা আপনারা এখনও বুঝেননি, এ জন্যেই আমার কিছু কিছু পদক্ষেপ ও পরামর্শকে আপনারা ভাল চোখে দেখেন না। প্রশিক্ষণের সময় যদি মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া যায় যে, তোমরা দেশ ও জাতির অতন্দ্র প্রহরী, সিংহাসন উপহার দিলেও ওরা সৈন্য হয়ে থাকতেই পছন্দ করবে। কিন্তু যদি ওদের ভেতর আত্মপূজা, নারী লিপ্সা এবং মদে অভ্যস্ত করে দেয়া যায় তবে আপন ধর্ম ছেড়ে দিতেও ওরা কুণ্ঠিত হবে না। আমাদের পক্ষাবলম্বনকারী প্রশাসনের লোকেরা দ্বিতীয় দায়িত্বটিই পালন করছে।’
‘তবে প্রশাসনের লোকদের মত সেনা ফৌজকে অত সহজে গাদ্দার বানানো যায় না। প্রশাসনের প্রতিটি লোকই রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সৈন্যরা সবাই তেমনটি দেখে না।’ হরমুনের কথার মাঝখানে বললেন অগাস্টাস।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, তবে এটাও ঠিক, তাদের নবীর পরে খেলাফতের জন্য মুসলমানরাই পরস্পর যুদ্ধ করেছিল।’
‘কিন্তু জেনারেলগণ ঈমানদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করে, এমনকি অন্য দেশ দখল করে খেলাফতের অন্তর্ভূক্ত করেছে।’
‘হ্যাঁ, মজাটা এখানেই। জেনারেলরা ঈমানদারীর প্রমাণ দিলেও খলিফারা তার কোন মূল্য দেয়নি, এমনকি খলিফারা তাদের সাথে ভাল ব্যবহার পর্যন্ত করেনি। ফলে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে।’
সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে যুদ্ধের ময়দানে হারানো সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর প্রতিটি সৈন্য তাঁর মতই জানবাজ। যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা এতটাই অবগত যে, মৃত্যু তাদের কোন ভীতির সৃষ্টি করে না।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, তিনি শুধু যুদ্ধ পরিচালনা করেন না, নিজেও লড়াই করেন। তাকে কোন খলিফা বা বেসামরিক নেতৃত্ব থেকে নির্দেশ নিতে হয় না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন পাকা মুসলমান। তাঁর কথা হচ্ছে, আমি সরাসরি খোদা এবং কোরআনের হুকুম পালন করি। আমাদের বাগদাদের গোয়েন্দারা বলেছে, নুরুদ্দীন জংগী যেসব পরামর্শ পাঠিয়েছেন আয়ুবী তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। প্রথমতঃ একজন বড় মুফতি ফতোয়া দিয়েছেন খেলাফতের কেন্দ্র থাকবে বাগদাদ। বিভিন্ন দেশের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে খলিফা সেনা প্রধানের সাথে পরামর্শ করবেন। দ্বিতীয়তঃ সামরিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খলিফা কোন হস্তক্ষেপ করবেন না। তৃতীয়তঃ খোৎবায় খলিফার নাম উচ্চারণ করা হবে না। আয়ুবী আরো নির্দেশ দিয়েছে যে, খলিফা বা তার মনোনীত কোন ব্যক্তি বা কোন কেল্লাদার বাইরে বের হলে জনগণ ফুলের তোড়া নিয়ে আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। খলিফার সম্মানে কোন শ্লোগান দেয়া যাবে না।
সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বড় সাফল্য হল, তিনি শিয়া-সুন্নীর মতভেদ দূর করে দিয়েছেন। এখন শিয়াদের অনেকেই সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে আসীন। শিয়া আলেমদের তিনি বুঝিয়েছেন, ইসলামে নেই এমন কোন কাজ যেন তারা না করেন। এতে আমাদের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন দল উপদল থাকলে আমাদের সুবিধা। এখন আমরা প্রশাসনের মধ্যে সালাহউদ্দীন এবং সেনাবাহিনীর বিরোধী মনোভাব তৈরী করছি।’
‘এ মনোভাব স্থায়ী করতে হবে।’ মুখ খুললেন ফিলিপ অগাস্টাস। ‘শুধু সালাহউদ্দীনই আমাদের শত্রু নয়, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে। আমাদের চেষ্টা হবে আয়ুবীর মৃত্যু হলে এ জাতি যেন অন্য কোন আয়ুবীর জন্ম দিতে না পারে। ওদের আকিদা বিশ্বাসে কুসংস্কার ঢুকিয়ে দাও। প্রতিটি লোকের চিন্তায় থাকবে রাজা হওয়ার স্বপ্ন। ওদেরকে বিলাসিতার গহীনে ডুবিয়ে দাও। দেখবে একজন অন্য জনের মাথা কাটছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, একদিন এরা ক্রুশের গোলামে পরিণত হবে। ওদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ওদের ধর্ম খ্রিস্টবাদের রঙে রঙ্গীন হবে। ক্ষমতার লোভে একজন আরেকজনকে অন্যজনকে হত্যা করবে। সাহায্য চাইবে আমাদের কাছে। তখন হয়ত আমরা কেউ বেঁচে থাকব না। আমাদের আত্মা ওদের এ পরিণতি দেখে খুশী হবে। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইহুদীরা নিজের যুবতী মেয়েদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার কর। ইহুদীরা জেরুজালেম এবং ফিলিস্তিনকে নিজের মনে করে, এজন্য ওরা আমাদের দুশমন। কিন্তু সে কথা বলার সময় এটা নয়। ওদের বল, জেরুজালেম তোমাদের। শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিন তোমাদেরকেই দেব। তোমরা এখন আমাদের সহযোগিতা কর। তবে ইহুদীরা অত্যন্ত সতর্ক। আমাদের মানসিকতা বুঝতে পারলেই মুসলমানদের সাথে যোগ দেবে। সতর্কতার সাথে ফিলিস্তিনিদের লোভ দেখিয়ে ওদের সম্পদ এবং যুবতীদের ব্যবহার কর। বিজয় আমাদের হবেই।
* * *
সুবাক এবং ক্রাক দুর্গ থেকে অনেক দূরে এক বিস্তীর্ণ মরু। চারপাশে উঁচু নীচু এবং পাথুরে পাহাড়। কাকর আর বালুকাময় ভূমিতে মাঝে মাঝে খানাখন্দ। একদিকে খ্রিস্টান শাসকগণ মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিপজ্জনক পরিকল্পনা তৈরী করছিল, অন্যদিকে দেড় মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইল প্রশস্ত এ পাহাড় ঘেরা স্থানে চলছিল আয়ুবীর যুদ্ধের মহড়া, নতুন রিক্রুট করা মুসলিম সৈন্যদের প্রশিক্ষণ।
পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সুলতান মহড়া দেখছিলেন। সাথে দু’জন সহকারী। প্রশিক্ষণরত সৈনিকগণ ঘোড়াসহ লাফিয়ে খানাখন্দ পার হচ্ছিল। প্রতিপক্ষের প্রচন্ড আক্রমণ ঠেকিয়ে করছিলো পাল্টা আক্রমণ।
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সুলতান’, বললেন একজন সহকারী, ‘কিছুদিনের মধ্যেই এরা অভিজ্ঞ সৈনিকে পরিণত হবে। তীর-তরবারী, নেজা-বল্লম, সবকিছুতেই হয়ে উঠবে পারদর্শী।’
নতুন রিক্রুটদের মধ্যে সুবাকের লোক যেমন ছিল, গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় ক্রাক থেকেও যুবকরা এসে শামিল হয়েছিল এতে। ক্রাকে এদের ওপর চলছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন।
নতুনদের আগ্রহ উদ্দীপনায় সুলতান প্রীত হলেন। সহকারীদের বললেন, ‘সুবাক এবং ক্রাক থেকে আরও নতুন নতুন যুবকদের ভর্তি করে ওদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর।’
‘অস্ত্রের ব্যবহার জানলেই অভিজ্ঞ সৈনিক হওয়া যায় না। একজন অভিজ্ঞ সৈনিকের গুণ হচ্ছে বুদ্ধি এবং দূরদর্শিতা। যারা এলোপাথাড়ি দুশমনকে আক্রমণ করে, এমন সৈনিক আমার প্রয়োজন নেই। আমার সৈন্যরা জানবে কে তার শত্রু, যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে থাকবে পরিচ্ছন্ন ধারণা। বিশ্বাস থাকবে তারা আল্লাহর সৈনিক, আল্লাহর পথে লড়াই করছে। এদের মধ্যে দেখছি প্রচন্ড আবেগ রয়েছে। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য এবং নিজের অবস্থান জানা না থাকে অল্প ক’দিনের মধ্যেই এ আবেগ নিঃশেষ হয়ে যাবে। ওদের বুঝিয়ে বল আমরা কেন ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। গাদ্দারীর পরিণাম ওদের বল। ওদের বল, কেবল মাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে নয় বরং দ্বীন এবং ঈমানের জন্য তোমরা যুদ্ধ করছ। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ হলে ওদের জন্য আত্মিক ও মানসিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা কর।’
‘মহামান্য সুলতান’, একজন সহকারী বললেন, ‘প্রতি সন্ধ্যায় ওদের জন্য দ্বীনী আলোচনার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা একদল পশু সৈনিক তৈরী করতে চাই না।’
‘আমাদের যে সব মেয়েদেরকে ওরা অপহরণ করছে, যেসব যুবতীদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে তাদের কথা এদের খুলে বল। খ্রিস্টানরা পবিত্র কোরআন পদদলিত করছে, মসজিদ হয়েছে ওদেরই গোশালা। ওদের বল, নারীর সম্ভ্রম, পবিত্র কোরআন এবং মসজিদের সম্মান রক্ষা করা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব। যেদিন তোমরা এ দায়িত্ব ভুলে যাবে সেদিন এ পৃথিবী তোমাদের জন্য হবে জাহান্নাম। পরকালের শাস্তি তো মৃত্যুর পরে।’
ট্রেনিং চলছিল পর্বতবেষ্টিত বিশাল এলাকা জুড়ে। এরপরও সুলতান পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। যে কোন সময় খ্রিস্টান ফৌজ আক্রমণ করতে পারে। চার পাঁচজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল পাহারায় নিয়োজিত ছিল। সুলতান যে পাহাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার বিপরীত দিকের টিলার উঠে এল এদের একটা দল। তাদের দিকে সুলতানের পিঠ।
দলের একজন বলল, ‘মাত্র আড়াইশ গজ দূরে সে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মারার জন্য একটা তীরই যথেষ্ট। কি বল?’
‘হ্যাঁ’, বলল দ্বিতীয়জন, ‘কিন্তু এরপর পালিয়ে যাবো কোথায়?’
‘তাও ঠিক। ওরা আমাদের মেরে ফেললে তো কোন কথা ছিল না, কিন্তু তা করবে না। এমন শাস্তি দেবে, আমরা আমাদের সংগীদের নাম বলতে বাধ্য হব।’
‘এ কাজ তার দেহরক্ষীরাই করবে।’ তৃতীয়জন বলল, ‘সালাহউদ্দিনকে হত্যা করা এত সহজ হলে এতদিন তার বেঁচে থাকার কথা নয়।’
‘এ কাজ এখনই হওয়া উচিৎ। ফাতেমীরা বলছে আমরা শুধু ওদের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছি, কাজের কাজ কিছুই করছি না।’
‘ভেবো না, খুব শীঘ্রই ওর মৃত্যু হবে। শুনেছি ঘাতক দলের সদস্যরা খুব সাহসী। সুলতানের দেহরক্ষীদের মধ্যে ওদের তিনজন সদস্য রয়েছে। সম্ভবত ওরা ভয় পাচ্ছে, নয়তো একটা লোককে মারতে এতদিন লাগবে কেন?’
কথা বলতে বলতে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এরা ছিল খ্রিস্টানদের নিয়োজিত ভাড়াটে খুনী।
* * *
ক্রাকে খ্রিস্টান সম্রাটদের মিটিং শেষ হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর অপেক্ষা নয়- আয়ুবী আক্রমণ করার পূর্বেই তাকে আক্রমণ করতে হবে। শুরু হল সৈন্য সেটিং-এর পালা। ফ্রান্সের বাহিনী আয়ুবীকে পথেই বাধা দেবে। রিমান্ডের ফৌজ আক্রমণ করবে মুসলিম বাহিনীর পেছন থেকে। ক্রাকের দুর্গ রক্ষা করবে জার্মান বাহিনী। তাদের সাথে থাকবে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের কয়েক প্লাটুন সৈন্য।
আয়ুবীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আক্রমণ করে পালিয়ে আসার পরিকল্পনার বিরোধিতা করল গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের যুক্তি হল, সুলতান আয়ুবী তার বাহিনী তিন ভাগে ভাগ করেছেন। একভাগ যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে আছে। তার সৈন্যরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে সমগ্র মরুভূমিতে ছড়িয়ে আছে। গাছের একটা পাতা নড়লেও আয়ুবীর কানে সে সংবাদ পৌঁছে যায়।
সুলতানের এ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথা শুনে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়া হল।
খ্রিস্টানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল আয়ুবীর চেয়ে চারগুণ বেশী। এর বেশীরভাগ বর্মধারী এবং অশ্বারোহী ওদের স্বাভাবিক আক্রমণ ঠেকানো মুসলিম বাহিনীর জন্য ছিল অসম্ভব। কিন্তু সুবাকের যুদ্ধ ওদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। আতংক ছড়াচ্ছিল পরাজিত সৈন্যরা। সুবাক ছিল ওদের কাছে লৌহ দুর্গ। সুলতানের বাহিনীকে পথে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য ওরা বিশাল এক বাহিনী পাঠিয়েছিল। দুর্গে বসে ছিল নেতৃবৃন্দ। সুলতান মুখোমুখি সংঘর্ষে না গিয়ে ওদেরকে মরুর বালুর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলিম বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার আগুন দেখে আতংকিত হয়েছিল ঘোড়া এবং উটগুলো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত একটু আগুন দেখলেই ওগুলি ভড়কে যেত। সুলতানের প্রচন্ড আক্রমণে লৌহ দুর্গের প্রতিরোধ বুহ্য ভেংগে পড়ল। কাঁপন ধরল খ্রিস্টানদের বুকে।
বিভিন্ন সম্রাটদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল সম্মিলিত বাহিনী। নিজেদের ভেতর ছিল চরম বিরোধ। সবাই চাইছিল নিজ নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে। সম্প্রসারিত করতে চাইছিল স্বীয় রাজ্যের সীমানা। শুধু মুসলমানদেরকে নিঃশেষ করার জন্যই ওরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু হৃদয়ে লালিত বিরোধের কারণে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না ওরা।
খ্রিস্টানরা ছিল ষড়যন্ত্রে পারদর্শী। কোন মুসলিম এলাকা দখল করলে ওখানে চালাত হত্যাযজ্ঞ। লুণ্ঠন করত মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। অপরদিকে মুসলমানরা কোন এলাকা দখল করলে দূরদর্শিতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ভালবাসা দিয়ে শত্রুকে আপন করে নিতেন আয়ুবী। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ছিল আত্মত্যাগের সুষমা। দশজন সৈনিকের কমান্ডো বাহিনী এক হাজার খ্রিস্টান সৈন্যকে পর্যুদস্ত করে দিত। জীবন বিলিয়ে দেয়াকে এরা সাধারণ ব্যাপার মনে করত। সুলতানের নিপুন পরিচালনায় অল্প সংখ্যক সৈন্য বিশাল বাহিনীর বুহ্য ভেংগে দিত। ক্রাকেও তিনি এ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। খ্রিস্টান বাহিনীর মনোবল ভেংগে পড়েছিল। সৈন্যদের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দেখে যুদ্ধের পরিকল্পনা আপাততঃ স্থগিত করা হল। মিসরে অভুত্থান ঘটাতে হবে। মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হল, যুদ্বাস্ত্রসহ এর সমস্ত ব্যয় খ্রিস্টান শাসকগণ বহন করবেন। মিসরের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান খ্রিস্টান শিবিরে নিয়মিত সংবাদ পাঠাচ্ছিলেন। আশাব্যঞ্জক সে সব সংবাদ।
মিসরের অর্থ সচিব নিহত হয়েছেন এবং মুসলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এ খবর তখনও পৌঁছেনি খ্রিস্টানদের কাছে। ক্রাকে এ সংবাদ দেয়া জরুরী। সংবাদ পৌঁছাতে পনের দিনের প্রয়োজন। চারদিকে সুলতানের ফৌজ ছড়িয়ে আছে বলে অনেকটা পথ ঘুরে ক্রাক যেতে হয় বলে খ্রিস্টান গুপ্তচররা চিন্তিত।
যেদিন সাবেরা অপহৃত হয় সেদিন ক্রাক পৌঁছল খবরবহনকারী। দূত বলল, ‘বিদ্রোহের জন্য সব তৈরী, কিন্তু সুদানীরা এখনও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়নি। তাদের ঘোড়ার অভাব রয়েছে, তবে উট আছে অনেক। এ মুহূর্তে শ’পাঁচেক ঘোড়া পাঠানো দরকার।’
‘এখনি পাঁচশ ঘোড়া নিয়ে সাতজন খ্রিস্টান অফিসার রওয়ানা হয়ে যাও।’ নির্দেশ দিলেন ফ্রান্সের সেনা কমান্ডার। ‘সময় সুযোগ বুঝে তোমরা সুদানীদের দিয়ে মিসর আক্রমণ করাবে।’
খ্রিস্টানদের রয়েছে অসংখ্য ঘোড়া। এরপরও তিন দিনের মধ্যেই সাধারণ খ্রিস্টানগণ পাঁচশত ঘোড়া কমান্ডারের কাছে হাজির করল। রওয়ানা হল ঘোড়ার বহর। পথ দেখাচ্ছিল এক গোয়েন্দা। সুদানী এ গোয়েন্দাটি তিন বছর থেকে এ কাজে রয়েছে। সাথে ছিল আটজন খ্রিস্টান সেনা অফিসার। তাদের বলা হয়েছিল আয়ুবীকে এখান থেকে আর মিসরে যেতে দেয়া হবে না।
সুলতান শুনেছেন মিসরের পরিস্থিতি ভাল নয়। মিসর যে এখন জীবন্ত অগ্নিগিরী তা তিনি জানতেন না। আলী তাকে বলেছিলেন, ‘মিসরে আমাদের গোয়েন্দাদের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে তাতে যে কোন সংবাদ আমরা পেয়ে যাব। অর্থসচিব এবং উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের পরিণতির কথাও তাদের জানা ছিল না। সুলতানের কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য কেউ কেউ পুলিশ প্রধানকে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে সাক্ষী প্রমাণ যোগাড় করে নেই। সুলতানকে জানাব তারপর।’
* * *
রাতে সাবেরাকে ভিন্ন একটা তাঁবুতে রাখা হল। তখনো সূর্য উঠেনি। তিনজন অপহরণকারী এবং সাবেরাকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হল। সাথে আটজন সশস্ত্র সৈন্য। দলটি যখন কায়রো পৌঁছলো সূর্য ডুবে গেছে। ওরা সরাসরি পুলিশ প্রধানের অফিসে গেল। গিয়াস বিলকিস মামলার তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যার পর শাস্তি সেলে ঢুকেছেন। মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হয়েছিলো। ফিরিংগী মেয়েটাকে পাওয়া গেছে। ও নিজের পরিচয় দিল উজবেক মুসলমান হিসেবে। পুলিশ প্রধানকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল উল্টাপাল্টা কথা বলে। চেষ্টা করল যৌবনের মায়াজালে আটকে দিতে।
গিয়াস বিলকিস যুবতীকে শাস্তি সেলের কয়েকটা কক্ষ দেখালেন। বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েটার মুখ। পুলিশ প্রধানের উদ্দেশ্য সফল হল, সব স্বীকার করল ও। বলল, ‘আমার নাম মার্থা। জাতিতে খ্রিস্টান। এসেছি জেরুজালেম থেকে।’
মেয়েটা পুলিশ প্রধানকে অর্থ এবং যৌবনের লোভ দেখাল। বলল, ‘মানুষ তো সুখের জন্যই এত কষ্ট করে। আপনি আমাকে মুক্তি দিলে সুখ ও সম্পদে আপনাকে ভরে দেব।’
মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ী থেকে যেসব সম্পদ আটক করা হয়েছে এতেই তিনি হতবাক হয়ে গেছেন। তিনি অনুমান করতে পেরেছেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও মুসলেহ উদ্দীন কেন খ্রিস্টানদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। অর্থ ছাড়াও যুবতীর মাতাল করা রূপ আর ভাষার যাদু থেকে বেঁচে থাকার জন্য পাথর হৃদয় মানুষের প্রয়োজন।
পুলিশ প্রধান ভাবনার অতলে ডুবে গেলেন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে রূপের জ্বলন্ত আগুন আর সম্পদের পাহাড় নিয়ে মেয়েটা জেরুজালেম থেকে এসেছে একজন মুসলিমের কাছে খ্রিস্টানের উপঢৌকন হিসাবে। ফলে তিনি বুঝলেন, ষড়যন্ত্রের মূল অনেক গভীরে।
মেয়েটার দিকে তাকালেন পুলিশ প্রধান। ‘বল মেয়ে, এ দেশে কি জন্য এসেছ? কে তোমায় পাঠিয়েছে?’
যুবতীর ঠোঁটে মৃদু হাসির ঝিলিক। বলল, ‘যা বলছি তার বেশী আর কিছু বলার নেই। আর কিছু বললে ক্রুশের সাথে প্রতারণা করা হবে। ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করেছি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব, তবুও গোপন তথ্য প্রকাশ করব না। এখন আমাকে যা ইচ্ছে করতে পারেন। একটা কথাও আর বলব না। আর যদি জেরুজালেম বা ক্রাক পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন, এ দেহ ছাড়াও পাবেন অঢেল সম্পদ। মুসলেহ উদ্দীন তো আপনার হাতে বন্দী, ওকে জিজ্ঞেস করুন, সে আপনার স্বজাতি, কিছু বললে বলতেও পারে।’
গিয়াস মার্থাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, মুসলেহ উদ্দীনের কক্ষে চলে এলেন। তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। হাতের কব্জিতে রশি বেঁধে ছাদের আংটার সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ‘মুসলেহ, বন্ধু! যা জিজ্ঞেস করি জবাব দাও। তোমার স্ত্রী কোথায়? কারা তাকে অপহরণ করেছে? তোমার বান্ধবী মার্থা সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। এবার তোমাকেও বলতে হবে। আমি দেখতে চাই দু’জনের এক কথা বলছ কিনা। তুমি কতটুকু মিথ্যে বলতে পার সেটাও বুঝা যাবে তোমার কথা থেকে।’
‘আমার হাত খুলে দে বদমাশ।’ ক্রোধে দাঁত পিষে বলল মুসলেহ উদ্দীন। ‘সুলতান আসুক, তোকেও এভাবে ঝুলাবো।’
প্রহরী এসে পুলিশ প্রধানের কানে কানে কি যেন বলল। বিস্ফারিত চোখে সেন্ট্রির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুসলেহ উদ্দীনের স্ত্রী এবং তিনজন অপহরণকারী বসে আছে। অপহরণ থেকে শুরু করে এদের গ্রেপ্তার হওয়ার সমস্ত ঘটনা খুলে বলল সাবেরা। পুলিশ প্রধান চারজনকে নিয়ে চললেন আন্ডার গ্রাউন্ড শাস্তি সেলে। মুসলেহ উদ্দীনের কক্ষের তালা খুলে চারজনকে তার সামনে দাঁড় করানো হল। এদের দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।
‘এই তিন জনের মধ্যে হত্যাকারী কে?’ প্রশ্ন করলেন পুলিশ প্রধান।
মুসলাহ উদ্দীন নিরব। আবার প্রশ্ন করলেন। কিন্তু কথা বলল না উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। গিয়াস বিলকিস একজন লোককে চোখের ইশারায় ডাকলেন। লোকটি ভেতরে এসে মুসলেহ উদ্দীনের কোমর জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল। ছিড়ে যাচ্ছে মুসলেহ উদ্দীনের হাতের কব্জি। চিৎকার দিয়ে বলল, ‘মাঝেরটা।’
তিনজনকে সরিয়ে নেয়া হল। গিয়াস বিলকিস ওদের বললেন, ‘সমস্ত ঘটনা খুলে বল। তা নয়তো এখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।’
নিজেদের মধ্যে কি কথা হল ওদের। এরপর বলল, ‘আমরা রাজি।’
ওদেরকে আলাদা আলাদা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। সাবেরাকে নেয়া হল ওপরে।
পূর্বের বলা কথাই আবার বলল সাবেরা। বলল, ‘আমার মা সুদানী, পিতা মিসরী। থাকতাম সুদানে। বছর তিনেক আগে আব্বার সাথে মিসরে এলাম। এক অনুষ্ঠানে মুসলেহ উদ্দীন আমায় দেখলেন। আব্বার কাছে লোক পাঠালেন। আব্বার সাথে তার কত টাকার চুক্তি হয়েছিল জানি না। আমাকে মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ী রেখে আব্বা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় হাতে ছিল এক থলি আশরাফি।
পরদিন মুসলেহ উদ্দীন একজন আলেম এবং ক’জন লোক ডেকে আমাকে বিয়ে করল। এখন আমি তার স্ত্রী। ও আমায় ভীষণ ভালবাসত। আব্বার স্নেহ আমি পাইনি বলে আমি ছিলাম ভালবাসার কাঙ্গাল। মনে হল বিক্রি করার জন্যই আব্বা আমায় মিসরে নিয়ে এসেছিলেন। মুসলেহ উদ্দীন এতটা নীচ কখনও ভাবিনি। ও কখনও মদ পান করেনি। বাইরে কি করত আমি জানতাম না, জানার চেষ্টাও করিনি।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী সুবাক চলে যাবার পর মুসলেহ উদ্দীন কেমন যেন হয়ে গেল। অনেক রাত করে বাসায় ফিরত। আমার আব্বা মদ্যপ ছিলেন। আমি মদের গন্ধের সাথে পরিচিত। দেখতাম মুসলেহ উদ্দীনের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ভালবাসার খাতিরে আমি চোখ বুজে এ সব সহ্য করতাম। তাকে কিছুই বলতাম না।
ক’দিন পর বাসায় অপরিচিত লোকের আনাগোনা শুরু হল। এক রাতে আমাকে দুই থলি আশরাফি এবং দুটি স্বর্ণের টুকরা দেখাল। অন্য এক রাতে মদে মাতাল হয়ে বাড়ী ফিরল। আমার কাছে এসে বলল, ‘তুমি কি মিসরের উত্তরে রোম উপসাগরের এলাকা, নাকি সুদান সীমান্তের এলাকা পছন্দ করবে? তুমি যে এলাকা চাইবে, সেখানকার রাণী হবে তুমি, আমি হব সম্রাট।’
আমি অতশত বুঝি না, চুপ করে রইলাম। ভাবলাম অত্যধিক মদ পান করে আমার স্বামীর মাথা বিগড়ে গেছে।
একরাতে তিনি একজন সুন্দরী ফিরিংগী যুবতীকে বাড়ী নিয়ে এলেন। সাথে আরো অপরিচিত দু’জন লোক ছিল। মেয়েটাকে থাকতে দেয়া হল তার শোবার ঘরে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি ওদের। মেয়েটা আমার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করতাম। এ মেয়েটা আমার স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে। এ হল খিজরুল হায়াতের হত্যার আগের ঘটনা।
* * *
অপহরণকারীরা পুলিশ প্রধানকে প্রথমে ভুল তথ্য দিচ্ছিল, কিন্তু সত্য বলতে ওদের বাধ্য করা হল। ওদের বর্ণনা অনুযায়ী ওরা তিনজনই ঘাতক দলের সদস্য। খ্রিস্টানরা মুসলেহ উদ্দীনের সাথে এদের পরিচয় করে দিয়েছিল। তাদেরকে দিয়েছিল প্রচুর অর্থ এবং সুন্দরী তরুণী। ওরা কথা দিয়েছে, আয়ুবীকে পরাজিত করতে পারলে মিসর সীমান্তে তাকে একটা এলাকার স্বাধীন সম্রাট করে দেয়া হবে।
মুসলেহ উদ্দীন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের হাত করতে লাগলেন। খিজরুল হায়াত তার ফাঁদে পা দেননি। অর্থ বিভাগ কব্জা করতে হলে হয় তাকে বশ করতে হবে, নয়তো সরিয়ে দিতে হবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা ছিল সুলতানের প্রতি অনুগত। তাদের ট্রান্সফার করে নিজের লোক বসাতে হলেও খিজরুল হায়াতকে সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। মুসলেহ উদ্দীন তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। দায়িত্ব দিলেন ঘাতক দলের সদস্যদের। খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ওরা নিয়মিত বখরা পেত। কাজ শেষে কিছু উপরি পাওয়ার চেষ্টা করত। মুসলেহ উদ্দিন পঞ্চাশ আসরাফির বিনিময়ে ওদের নিয়োগ করেছিলেন। কাজ শেষ হওয়ার পর দেননি বলে ওরা ক্ষ্যাপে গেল। গোপন তথ্য জানিয়ে দিল তার স্ত্রীকে।
মুসলেহ উদ্দীন এখনও ঝুলে আছে। জবানবন্দী নেয়ার জন্য হাত খুলে দেয়া হল তার। ততোক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে মুসলেহ উদ্দীন। জ্ঞান ফিরল অনেক পরে। কিন্তু প্রমাদ বকতে লাগল। চোখ বড় বড় করে তাকাতে লাগল সবার দিকে। মেয়েটার কক্ষে গিয়ে দেখা গেল মুখ থুবরে পড়ে আছে। ডাক্তার এসে নাড়ী পরীক্ষা করে বললেন, ‘বিষ খেয়ে মারা গেছে, তবে বেশীক্ষণ হয়নি।’ লাশের পাশে একটা প্যাকেটে বিষের চিহ্ন পাওয়া গেল।
রাতে বিলকিসের কাছে এলেন জয়নুদ্দীন আলী বিন নাজা আল ওয়ারেজ। তিনি মিসরের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্ব বিষয়ে তার ছিল অগাধ পান্ডিত্য। পীর না হলেও প্রশাসনের পদস্ত কর্মকর্তারা তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। পুলিশ প্রধানকে বললেন, ‘শুনেছি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দু’একজন ধরা পড়েছে। আপনাকে আরও কিছু তথ্য দিতে চাই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ক’জন লোক আমায় বলেছে সুলতানের অনুপস্থিতিতে শত্রুরা ফায়দা লুটছে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাজ করছে যেন ধরা না পড়ে। গোয়েন্দা উপ-প্রধান হামাসকে কিছু না বলেই আমি গোপনে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছিলাম। আমার জলসায় ফৌজ অফিসার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোকজন এসে থাকেন। আমার নিজস্ব এবং বিশ্বস্ত লোকদেরকেও তথ্য সংগহের কাজে লাগিয়াছি। যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, মিসরের বিরুদ্ধে বিরাট এক ষড়যন্ত্র চলছে। আপনি ক’জনকে গ্রেপ্তার করার পর গা ঢাকা দিয়েছে বাকীরা।’
জয়নুদ্দীন পুলিশ প্রধানের কাছে সমস্ত গোপন তথ্য প্রমাণাদি পেশ করলেন। গিয়াস বিলকিস ডেকে পাঠালেন হামাস বিন আবদুল্লাকে। এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল এখনি সুলতানকে সংবাদ দেয়া উচিৎ। দূত হিসেবে জয়নুদ্দীনকে নির্বাচন করা হল। পরের দিন বারজন রক্ষী সেনা নিয়ে সুবাকের পথ ধরলেন জয়নুদ্দীন।
* * *
তৃতীয় সন্ধ্যায় জয়নুদ্দীন সুবাক পৌঁছেলেন। সুলতান হতবাক হয়ে গেলেন তাঁকে দেখে। খুশীও হলেন। জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। জয়নুদ্দীন বললেন, ‘আমি কোন ভাল সংবাদ আনিনি। অর্থ সচিব নিহত। হত্যাকারী ভারপ্রাপ্ত উপ-রাষ্ট্রপ্রধান মুসলেহ উদ্দীন এখন জেলে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার।’
বিবর্ণ হয়ে গেল সুলতানের চেহারা। জয়নুদ্দীন তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন। বললেন, ‘মিসরের সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সুবাকের মুসলিম ফৌজকে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং প্রচুর গনিমতের মাল দেয়া হচ্ছে। আপনি খ্রিস্টান ও ইহুদী যুবতীদেরকে ফৌজের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। ওদেরকে আতংকিত করার জন্য বলা হচ্ছে, বিশাল এক সুদানী বাহিনী খুব শীঘ্রই মিসর আক্রমণ করবে। মিসরের স্বল্প সংখ্যক সৈন্য ওদের বাধা দিতে পারবে না। নিহত হবে প্রতিটি সৈন্য। সুলতান আয়ুবীও তাই চাইছেন। আরো বলা হয়েছে, সুলতান গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছেন। বাঁচার কোন আশা নেই। সুবাকের সেনা অফিসাররা ইচ্ছে মত উপভোগ করছে। আপনি গুরুতর আহত একথা এখন সবাই বিশ্বাস করছে। এ জন্যই মুসলেহ উদ্দীন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে খ্রিস্টানদের সহযোগিতা করে যাচ্ছিল।’
সাথে সাথে নুরুদ্দীন জংগীকে সব জানিয়ে চিঠি লিখলেন সুলতান। তার কাছে সামরিক সাহায্য চাইলেন। লিখলেন, ‘এখানে থাকলে মিসর হাতছাড়া হয়ে যায়। চলে গেলে পরাজয়ে বদলে যায় সুবাকের বিজয়। কোন কিছুর বিনিময়ে এ এলাকা ফিরিয়ে দিতে চাই না। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না এখানে থাকব না মিসর ফিরে যাব।’
একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ারকে ডেকে বললেন, ‘রাতদিন ঘোড়া ছুটাবে। থামাবে না কোথাও। ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়লে সামনে যাকে পাবে তার অশ্ব বদলে নেবে। দিতে না চাইলে হত্যা করবে। শত্রুর হাতে পড়লে পালানোর চেষ্টা করবে, না পারলে চিঠি মুখে পুরে গিলে ফেলবে। কোন অবস্থাতেই যেন চিঠি দুশমনের হাতে না পরে।’
দূত রওয়ানা হয়ে গেল। দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন ভাই তকিউদ্দীনের কাছে। ‘তোমার কাছে যা আছে এবং যে ক’জন যুদ্ধ করতে পারে তাদের নিয়ে চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে ঘোড়া ছুটাও। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কোথাও থেমো না। তোমার সাথে কোথায় দেখা হবে অথবা আদৌ দেখা হবে কিনা জানিনা। যদি তোমার আমার সাক্ষাৎ না হয়, যদি আমি মারা যাই তুমি অনতিবিলম্বে মিসরের দায়িত্বভার গ্রহণ করো। মিসর বাগদাদ খেলাফতের অধীন। যাত্রার পূর্বে আব্বাজানকে কদমবুসি করে বলবে, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে। এরপর আম্মাজানের কবরে গিয়ে ফাতেহা পড়ো। আল্লাহ্ তোমার সঙ্গী। আমি যেখানে থাকব সেখানে ইসলামের পতাকা নত হতে দেবো না। তুমিও মিসরে ইসলামের পতাকাকে উড্ডীন রেখো।’ আরেক জন দূত ডেকে তাকেও পূর্বের মত নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হয়ে গেল ২য় দূতও।
নুরুদ্দীন জংগীর পায়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ল দূত। তার বা হাত তরবারীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন। পিঠে বিঁধে আছে একটা তীর। ‘পথে দুশমনের হাতে পরেছিলাম। কিন্তু চিঠি নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছি।’ যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলল দূত। আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই আর বলতে পারল না, তার কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল চির দিনের জন্য।
চিঠি তুলে নিলেন জংগী। চিঠি পড়ে অনতিবিলম্বে সুবাকের কাছে পৌঁছল নুরুদ্দীন জাংগীর বিশাল বাহিনী। সুবাকবাসীরা দেখল এক ধুলিঝড় এগিয়ে আসছে। সকলের মনে শংকিত প্রশ্ন, ‘কারা এরা?’
খ্রিস্টানদের আক্রমণ ভেবে তৈরি হয়ে গেল মুসলিম ফৌজ। হঠাৎ ধূলিঝড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিল কালিমা খচিত পতাকা। ভেসে এল সৈনিকদের তাকবীর ধ্বনি। তাই শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানাল সুবাকের সৈন্যরা। মুসলিম ফৌজকে অভ্যর্থনা জানাতে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ।
* * *
একদিন সকালে মিসরের সেনাবাহিনীকে ময়দানে জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হল। কেন্দ্রিয় সেনা কমান্ডের এ আকস্মিক নির্দেশে হতবাক হয়ে গেল সৈন্যরা। কেউ বলল, ‘সম্ভবতঃ দেশে বিদ্রোহ হয়েছে।’ আবার কেউ বলল, ‘সুদানীরা মিসর আক্রমণ করেছে।’ কিন্তু কেন জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কমান্ডাররাও তা জানতেন না।
নির্দেশ পেয়ে ফৌজ ময়দানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো। একদিক থেকে ছুটে এল সাতজন ঘোড়াসওয়ার। সওয়ারদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সৈন্যদের প্রশ্নমাখা চোখ। অশ্বারোহীদের প্রথমে রয়েছেন সুলতান আয়ুবী। খালি গা। পাজামা ছাড়া পরনে কিছুই নেই। সবাই জানে সুলতান সুবাকের রণাঙ্গনে। সারিগুলোর সামনে দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে গেল আয়ুবীর ঘোড়া। মাঝ বরাবর এসে ঘোড়া থামালেন তিনি। উচ্চস্বরে বললেন, ‘আমার দেহে কি কোন আঘাতের চিহ্ন দেখছো? আমি কি বেঁচে আছি?’
সমস্বরে ধ্বনিত হল, ‘আমাদের সেনা প্রধান, জিন্দাবাদ। আমাদের বলা হয়েছিল আপনি গুরুতর আহত। বাঁচার সম্ভাবনা নেই।’
‘এ খবর যদি মিথ্যে হয় তবে তোমাদের যা বলা হয়েছে তার সবই গুজব। যে সব মুজাহিদদের ব্যাপারে তোমাদের বলা হয়েছে— তাদের স্বর্ণ-রৌপ্য দেয়া হচ্ছে, খ্রিস্টান মেয়েদের নিয়ে স্ফূর্তি করছে ওরা, তার সবই গুজব। অথচ ওরা ঘুরে মরছে বিস্তীর্ণ মরুভুমিতে। ক্রাক দুর্গ, তার পরের এবং তার পরের দুর্গ পদানত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা। ওরা কেন অনাহারে–অর্ধাহারে পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে মরছে? ওরা ঘুরে মরছে শুধুমাত্র খ্রিস্টান পশুদের হাত থেকে তোমাদের মা, বোন এবং মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য। সুবাকে দেখেছি যুবতী মেয়েরা খ্রিস্টানদের হারেমে, পুরুষ আর বৃদ্ধরা ওদের বেগার ক্যাম্পে। জেরুজালেম, ফিলিস্তিন এবং ক্রাকের প্রতিটি গ্রামে মুসলমানদেরকে একই অবস্থায় আমি দেখেছি। আমাদের অনেক মসজিদ এখন ওদের ঘোড়ার আস্তাবল। পবিত্র কোরআনের পাতাসমূহ শহরের অলিতেগলিতে পদদলিত হচ্ছে।’
একজন কমান্ডার চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘তাহলে এখানে আমরা কি করছি? আমাদেরকে কেন যুদ্ধের ময়দানে নেয়া হচ্ছে না?’
‘আমিই সে প্রশ্ন করছি তোমাদের। তোমাদেরকে এখানে রাখা হয়েছে কি এই কারণে যে, শত্রুরা গুজব ছড়াবে আর তোমরা তা বিশ্বাস করবে? তাদের ছড়ানো গুজবে বিশ্বাস করে তোমরা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং খ্রিস্টানদের হাতে তুলে দেবে মিসরের পবিত্র ভূমি? লুণ্ঠিত হবে তোমাদের মেয়েদের সম্ভ্রম, কোরআনের পাতা ছিঁড়ে বাইরে ছুড়ে ফেলা হবে আর তোমরা তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখবে, এজন্য? তোমরা কি খ্রিস্টানদের হাতে কোরআনের অপমান দেখতে চাও? তোমরা নিজের ঈমানেরই হেফাজত করতে পারছ না, স্বাধীনতার হেফাজত কিভাবে করবে?’
একটু থামলেন তিনি। পিনপতন নিরবতা নিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকেরা। তিনি সবার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে দু’একজন কমান্ডার দেখা যাচ্ছে না। ওরা কোথায় তোমরা কি জানো? জানোনা। ঠিক আছে ওদের দেখিয়ে দিচ্ছি আমি।’
সুলতানের ইশারায় একদিক থেকে দশজন লোককে সামনে নিয়ে আসা হল। ওদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ঘাড়ে রশি। অবনত মস্তক। সম্মুখ সারির সামনে দিয়ে ওদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। সুলতান বললেন, ‘এরা ছিল তোমাদের কমান্ডার। জাতির দুশমনের সাথে এদের বন্ধুত্ব। তোমাদের নবী এবং কোরআনের শত্রুর সাথে মিশে গেছে এরা। কিন্তু ধরা পড়েছে।’
সুলতান খিজরুল হায়াতের হত্যা এবং মুসলেহ উদ্দীনের গ্রেপ্তারের কথা শুনালেন। তাকে সামনে নিয়ে আসা হল। মুসলেহ উদ্দীন এখনো স্বাভাবিক হয়নি। গতরাতে সুলতান তাকে গারদে দেখে এসেছিলেন। মুসলেহ উদ্দীন সুলতানকে চিনতে পারছিল না।
তখনও দেশ ভাগ করে নিজে স্বাধীন সম্রাট হবার কথা বলে যাচ্ছিল। সুলতান তাকে সেনাবাহিনীর সামনে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিলেন। সৈন্যদের দেখে মুসলেহ উদ্দীন চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এ হল আমার বাহিনী। মিসর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। আমি তোমাদের সম্রাট। সালাহউদ্দীন তোমাদের এবং মিসরের শত্রু। হত্যা কর তাকে।’ পাগলের মত বলে যাচ্ছিল মুসলেহ উদ্দীন।
সৈন্যদের মাঝখান থেকে শন শন শব্দে ছুটে এল একটি তীর। বিঁধল তার বুকে। পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি, ততোক্ষণে আরও কটা তীর বিদ্ধ করেছে তার দেহ।
হুংকার দিয়ে তীরন্দাজকে থামিয়ে দিলেন সুলতান। কমান্ডারের নির্দেশে তীর নিক্ষেপকারী এগিয়ে এল। দাঁড়াল সুলতানের সামনে।
‘সম্মানিত সুলতান’, বলল সে, ‘আমি এক গাদ্দারকে হত্যা করেছি। এর জন্য মৃত্যুদণ্ড দিতে চাইলে আমি প্রস্তুত।’ মাথা এগিয়ে দিল তীরন্দাজ।
সুলতান তাকে ক্ষমা করে দিলেন। ডাকলেন জল্লাদকে। অন্য গাদ্দারদেরও হত্যা করা হল।
এরপর এক অবিশ্বাস্য নির্দেশ দিলেন সুলতান, ‘তোমরা এখান থেকেই যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে মার্চ করবে। তোমাদের ব্যক্তিগত জিনিষপত্র এবং রসদ যাবে পেছনে।
সঙ্গে সঙ্গেই মার্চ করে রওয়ানা হল বাহিনী। সুলতান চাইলেন কাটা মাথাগুলির দিকে। তাঁর চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা। কাপড় পরে একদিকে হাঁটা দিলেন সুলতান। সঙ্গীদের বললেন, ‘শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে এভাবেই গাদ্দার সৃষ্টি করতে থাকবে। এমন একদিন আসবে যখন সবাই গাদ্দারদের বিরোধিতাকারীদেরকেই শত্রু ভাবতে শুরু করবে। ইসলামের পতাকা উড্ডীন দেখতে চাইলে বন্ধু এবং শত্রু চিনে নাও।’
আকস্মিকভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাবার এ নির্দেশে অনেকে হতবাক হয়েছিল। সুলতান বলেছেন, ‘আমার এ আকস্মিক নির্দেশে আপনারা আশ্চর্য হয়েছেন। এখানকার ফৌজ অনর্থক বসেছিল। ওদের কোন কাজ ছিল না। প্রতিদিন মিসরের বাইরে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ এবং মহড়া দেয়ার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার নির্দেশ পালিত হয়নি। আমি দু’জন পদস্থ সামরিক অফিসারকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছি। ওরাই শত্রুর যোগসাজসে মিসরের সেনাবাহিনীকে বেকার বসিয়ে রেখেছিল। সৈন্যরা মদ এবং জুয়ায় অভ্যস্ত হতে লাগল। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। ওদের মস্তিষ্ক নানান গুজব গ্রহণ করতে লাগল।
আপনারা ভাবছেন সেনাবাহিনী ছাড়া মিসর চলবে কি করে? চিন্তার কিছু নেই। সুবাক বিজয়ী যোদ্ধারা আমার পেছনেই যাত্রা করেছে। শত্রুর পশুত্ব খুব নিকট থেকে দেখেছে ওরা। দেখেছে যুদ্ধের বিভীষিকা। ওদের কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। ওরা সংগী সিপাহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী করবে না। এখন যারা যাচ্ছে ওরা ক্রাক দুর্গ আক্রমণ করবে। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তখন শত্রুমিত্র চিনতে পারবে। যে সৈনিক একবার শত্রুর চোখে চোখ রেখে যুদ্ধ করে কোন লোভ-লালসা ওদের বিচ্যুতি করতে পারে না।
নুরুদ্দীন জংগী এবং ছোট ভাইকে চিঠি লিখে সুলতান গোপনে কায়রো রওয়ানা হয়েছিলেন। রণক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতির কথা গোপন রাখার জন্য পদস্থ কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, জংগী অবশ্যই সাহায্য পাঠাবেন। ওদের এখানে রেখে সমপরিমাণ মিসরী ফৌজ কায়রো পাঠিয়ে দেবে। পথে বিশ্রাম করবে কম। এতে সুলতানের ছিল দুটো উদ্দেশ্য। মিসরে বিদ্রোহ হয়ে থাকলে এরা তা দমন করবে, তা না হলে মিসরের ফৌজ আসবে রণক্ষেত্রে আর এরা থাকবে মিসরে। সুলতান মিসরে পৌঁছলে তার আগমন সংবাদ গোপন রাখা হয়। জয়নুদ্দীনের দেখানো বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার করা হল রাতের মধ্যে। ঘাতক দলের সদস্যরাও কয়েকজনের নাম বলেছিল, ধরা হল তাদেরও।
সুলতানের নির্দেশে জয়নুদ্দীনের হাতে তুলে দেয়া হল সাবেরাকে। একজন ভাল লোক দেখে তার বিয়ের ব্যবস্থার কথাও বলা হল।
ছোট ভাইয়ের আসার অপেক্ষায় রইলেন সুলতান। তকিউদ্দীন এলেন তিনদিন পর। সাথে দু’জন অশ্বারোহী। তাকে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন সুলতান। তকিকে অর্পণ করা হল মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব। সুলতান বললেন, ‘সুদানের ওপর দৃষ্টি রেখো। যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জিম্মা তোমায় দেয়া হল। সুদান আক্রমণ করার প্রয়োজন হলে তাও করবে।’
‘এবার ফিরতে হবে রণক্ষেত্রে’, সংগীদের বললেন সুলতান।
তিনি গোয়েন্দা প্রধান আলীকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন।
‘একটু অপেক্ষা করুন সুলতান’, আলী বললেন, ‘আপনাকে চমৎকার একটা উপহার দেব।’
আলীর সাথে বেরিয়ে গেলেন সবাই।
বিরাট এক মাঠে পাঁচশত অশ্ব। পিঠে জীন চাপানো। খানিক দূরে আটজন খ্রিস্টান সেনা অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা বাঁধা। প্রতেকের বন্দীর পাশে আছে একজন মিসরী সৈন্য।
‘এসব ঘোড়া কোথাকে এসেছে আলী?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।
‘ক্রাক থেকে আপনার জন্য উপহার এসেছে।’
আলী একজন লোককে ইশারায় ডাকলেন। লোকটি এসে সুলতানের সামনে দাঁড়াল।
‘সুলতান!’ আলী বললেন, ‘এ লোকটি আমার গোয়েন্দা দলের সদস্য। গত তিন বছর থেকে খ্রিস্টান গোয়েন্দা দলে যোগ দিয়েছে। ওরা ওকে নিজস্ব গুপ্তচর মনে করে। ও খ্রিস্টান এবং সুদানীদের মাঝে দূত হিসেবে কাজ করে। কয়েকদিন পূর্বে ও ক্রাকে গিয়েছিল। সুদানীদের পক্ষ থেকে খ্রিস্টান সম্রাটদের বলেছে, মিসর আক্রমণ করার জন্য ওদের পাঁচশত যুদ্ধের ঘোড়া প্রয়োজন। ওরা পাঁচশত ঘোড়া পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে আটজন সেনা অফিসার। এরা মিসর আক্রমণে পেছন থেকে সুদানীদের নেতৃত্ব দেবে। আমাদের এ গোয়েন্দা উত্তর দিকে ঘুরিয়ে সীমান্তের সেনা চৌকিতে সংবাদ দিয়েছে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছে অফিসারদের বন্দী করতে। সীমান্তের সৈন্যরা এদের কায়রো নিয়ে এসেছে।’
খ্রিস্টান সেনা অফিসারদেরকে হাসান বিন আবদুল্লাহর হাতে তুলে দিয়ে আলী সুলতানের সাথে সুবাকের পথ ধরলেন।
* * *
কায়রোর বালুকারাশি গাদ্দারদের রক্ত শুষে নিচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে মনে হচ্ছিল দ্বীন এবং স্বাধীনতার পতাকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের রক্ত গ্রহণ করতে কায়রোর মাটিও দ্বিধা করছে। সুলতান যখন লাশগুলো দেখেছিলেন, বললেন, ‘ওদের ছিন্ন মস্তক লাশের বুকের ওপর রেখে দাও। সবচেয়ে বেশী ব্যথা পেয়েছিলেন মুসলেহ উদ্দীনের মৃত্যুতে, তিনি তাকে বেশী বিশ্বাস করতেন। তাকেই করেছিলেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর। অথচ বিশ্বস্ত লোকটিই শত্রুর সাথে হাত মেলাল। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেংগে যে সিপাইটি তাকে তীর ছুঁড়েছিল সুলতান তাকে ক্ষমা করেছিলেন। কারণ তিনি ঈমান এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বেইমানী সহ্য করতেন না।
লাশগুলো দেখে সুলতানের চেহারায় আনন্দের দ্যুতি ঝলকে উঠেনি। এতগুলো গাদ্দার ধরতে পেরে যেখানে খুশী হওয়ার কথা, কিন্তু সুলতান ছিলেন বেদনা ভারাক্রান্ত। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়েছিল বিন্দু বিন্দু অশ্রু। কিন্তু ভেতরে ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। ক্রোধের সাথেই তিনি বললেন, ‘এদের কারও জানাজা পড়া হবে না। লাশ ফেরত দেয়া হবে না আত্মীয়-স্বজনের কাছে। রাতের অন্ধকারে একই গর্তে কাফন ছাড়া সবাইকে পুঁতে রাখতে হবে। এমনভাবে মাটি সমান করবে, পৃথিবীতে যেন কবরের কোন চিহ্ন না থাকে।
‘সম্মানিত আমীর’, মুখ খুললেন সুলতানের বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ, ‘আপনি যা করেছেন। ঠিক করেছেন। তবুও পুলিশ সুপার এবং সাক্ষীদের জবানবন্দীসহ কাজির লিখিত রায় সংরক্ষণ করা উচিৎ। নয়তো কোন এক সময় কেউ বলতে পারে আপনি আদালতের কাছে যাননি। ওদের মৃত্যুদন্ডের সিদ্ধান্ত আপনি একাই দিয়েছেন।’
‘যারা বেঈমানের সাথে মিশে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ওরা আল্লাহ্ এবং রসূলের (সা.) অনুসারীদের মিথ্যেবাদী প্রমাণ করবে, কোরআন কি এই নির্দেশ দিয়েছে? এতগুলো লোক অন্যায়ভাবে হত্যার অপরাধে যদি আমি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য হই, হত্যা কর আমায়। আমার লাশ ফেলে দাও শহরের বাইরে কোন বিজন এলাকায়। লাশের গোশত খুবলে খাবে পাহাড়ী শিয়াল আর কুকুরের দল। তবে বন্ধুরা, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পূর্বে পবিত্র কোরানের আলিফ লাম থেকে ওয়াননাছ পর্যন্ত পড়ে নিও। কোরআন যদি আমাকে মৃত্যুদণ্ডের ফয়সালা দেয়, আমার মস্তক হাজির রয়েছে।’
‘অবিচারের কথা নয় মাননীয় সুলতান,’ উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘সম্মানিত শাদ্দাদ-এর উদ্দেশ্য হল আইনের অবমাননা যেন না হয়।’
‘আমি বুঝেছি,’ সুলতান বললেন, ‘তার উদ্দেশ্য আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার। শুধু বলতে চাই, গাদ্দারীর অপরাধে কোন আসামীকে যদি রাষ্ট্র প্রধানের সামনে উপস্থিত করা হয়, রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব হল বিলম্ব না করে তাকে শাস্তি দেয়া। যদি রাষ্ট্র প্রধান তাকে শাস্তি দিতে গড়িমসি করেন বুঝতে হবে তিনি হয় গাদ্দারের সংগী, অযোগ্য অথবা বেঈমান। তার ভয় বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে আসামী তাঁকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। কিন্তু আমি পরিচ্ছন্ন। আমাকে গাদ্দারদের সারিতে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দাও, আল্লাহর কুদরতী হাত আমাকে আলাদা করে দেবে। তোমাদের বুক যদি কাবার প্রভূর নূরে আলোময় থাকে, তবে অপরাধীর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ো না। বন্ধু বাহাউদ্দীন যে পরামর্শ দিয়েছেন সে অনুযায়ী কাগজপত্র তৈরী কর। কাজীর দ্বারা রায় লিখিয়ে নাও। তবে এ রায় কাজীর হবে না, কাজী লিখবেন মিসরের গভর্নর এবং সেনাপ্রধান নিজস্ব বিশেষ ক্ষমতাবলে আসামীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সাক্ষী প্রমাণে আসামীদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তকিউদ্দীনের দিকে তাকালেন সুলতান। তার চেহারায় দীর্ঘ ভ্রমণের ছাপ। সুলতান বললেন, ‘তোমার চেহারায় আমি দুশ্চিন্তা এবং ক্লান্তি দেখছি। কিন্তু তুমি বিশ্রাম করতে পারবে না। তোমার সফর শেষ হয়নি, সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমাকে সুবাক যেতে হচ্ছে, যাওয়ার আগে তোমার সাথে জরুরী কিছু কথা আছে।’
‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের স্ত্রী এবং সন্তানদের ব্যাপারে কি নির্দেশ মাননীয় আমীর?’ জানতে চাইলেন পুলিশ প্রধান।
‘অতীতের গাদ্দারদের পরিবারের ব্যাপারে যে নির্দেশ ছিল এখানেও তা কার্যকর। ওদের বিধবা স্ত্রীদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নাও। দেখবে খ্রিস্টানদের সাথে কারও সম্পর্ক রয়েছে কিনা। নারী পূজা আমাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করছে। তোমরা দেখেছ খ্রিস্টানরা সুন্দরী যুবতীদের বিনিময়ে ওদের ঈমান কিনে নিচ্ছে। নিরাপরাধ বিধবাদেরকে তাদের পছন্দ পাত্রের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা কর। জোর করে কাউকে বিয়ে দেবে না। লক্ষ্য রাখবে, কোন নারী যেন আশ্রয়হীন না হয়। রুটি রুজির জন্য ওদেরকে যেন কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়। বিধবাদেরকে কেউ যেন বলতে না পারে তাদের স্বামীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বরং ওদের বুঝিয়ে বল, বেঈমান পাপী স্বামীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ায় ওরা ভাগ্যবতি।
বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ওদের সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা কর। ওদের সমস্ত খরচ বহন করবে রাষ্ট্র। মনে রেখো, ওরা পিতৃহীন এ অনুভূতির কখন যেন ওদের ব্যথিত না করে। সন্তানদের যেন পিতার পাপের প্রায়শ্চিত করতে না হয়।’
* * *
সুলতান যতশীঘ্র সম্ভব রণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চাইছিলেন। তাঁর আশংকা ছিল তাঁর অনুপস্থিতিতে খ্রিস্টান বাহিনী কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বসে। নূরুদ্দীন জংগীর পাঠানো সেনা সাহায্য ওখানে পৌঁছেছে। যাচ্ছে কায়রো থেকে পাঠানো ফৌজ। দু’দলকেই রণক্ষেত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।
নিজের অফিসে গিয়ে ছোট ভাই, হাসান, পুলিশ প্রধান এবং আরও ক’জন পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। তিনি তকিউদ্দীনকে মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর এবং এখানকার সেনাপ্রধান ঘোষণা করলেন। বললেন, ‘আমার মতই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সমস্ত ক্ষমতা তকীউদ্দীনকে দেয়া হল।’
‘তকী উদ্দীন’, সুলতান বললেন, ‘তুমি আমার ভাই, এ কথা আজ থেকে মন থেকে মুছে ফেল। অযোগ্যতা, বিশ্বাস ভংগ, গাদ্দারী, ষড়যন্ত্র, দুর্বলতা, দায়িত্বে অবহেলা এবং শাস্তি ইসলামের বিধান অনুযায়ী তুমি পাবে।’
‘দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে আমি ওয়াকিফহাল সম্মানিত আমীর’, তকীউদ্দীন বললেন, ‘মিসরের আকাশে বিপদের যে কাল মেঘ ঘনিয়ে আসছে তা আমি অবহিত।’
‘শুধু মিসর নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিপদের সম্মুখীন। এ ঝড় ইসলাম এবং মুসলিম সালতানাত বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। একটা কথা সবসময় মনে রেখ, মুসলিম বিশ্ব কোন একক জায়গায় নয়, কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। এ জমিন আল্লাহর, আমরা সবাই এর রক্ষক। এ ভূমির প্রতিটি ধূলিকণা আমাদের কাছে আমানত। এ ভূমির মাটি ব্যবহার করার পূর্বে ভাবতে হবে তুমি কি কারও অধিকার খর্ব করছ? আল্লাহর দেয়া আমানতের খেয়ানত করছ না তো? আমার কথা মন দিয়ে শোন তকি, বড় দুর্ভাগ্য হল, ইসলামের অনুসারীদের মধ্যেই গাদ্দার আর ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা বেশী। মুসলিম জাতি যত বিশ্বাসঘাতকের জন্ম দিয়েছে, অন্য কোন জাতি তা দেয়নি। এমনকি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল জিহাদের ইতিহাসও বিশ্বাসঘাতকতার কালিতে কলংকিত। আলীকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ওর গোয়েন্দারা খ্রিস্টান এলাকায় গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত। তাদের রিপোর্ট হল- খ্রিস্টান শাসক, ধর্মীয় গুরু এবং সমাজের নেতারা জানেন মুসলমানরা নারী পাগল এবং ক্ষমতা লিপ্সু। নারী, ক্ষমতা এবং অর্থের জন্য এরা ধর্ম, দেশ এবং স্বীয় জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পিছপা হয়না।
সুলতান উপস্থিত সকলের প্রতি দৃষ্টি বুলিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা বলেছে, খ্রিস্টান গুপ্তচরদের ট্রেনিং দেয়ার সময় বলা হয়, মুসলিম ইতিহাসে যত বিজয় রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতাও সে পরিমাণে। ওরা ততগুলি বিজয় লাভ করেনি যত গাদ্দার তৈরী করেছে। আল্লার রসূলের ওফাতের পর ওরা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই খেলাফতের জন্য যুদ্ধ করেছে। খলিফার বিরুদ্ধবাদীরা ইসলামের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়েছে। গদীকে নিষ্কণ্টক করার জন্য নেতাদের হত্যা করেছে। এভাবেই নিঃশেষ হয়ে গেল আমাদের জাতীয় চেতনা। দেশ জুড়ে চলল ব্যক্তি পূজার জয় জয়কার। সংকীর্ণ হয়ে এল বিশাল মুসলিম সালতালাত। শেষ হয়ে গেল মুসলমানদের প্রতিরোধ শক্তি। খ্রিস্টান জাতি আমাদের এ দুর্বলতার কথা জানে। মুসলমান ক্ষমতার জন্য দেশের বিশাল এলাকা ছেড়ে দিতেও প্রস্তুত। যুগে যুগে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
আমার বন্ধুরা। অতীত ইতিহাস আর বর্তমানকে যখন দেখি- আমার ভয় হয়, এমন এক সময় আসবে যখন এরা নিজের ইতিহাসের সাথেও বেঈমানী করবে। ঐতিহাসিকগণ লিখবেন, মুজাহিদরা দেশ এবং জাতির জন্য বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে শত্রুর সব পরিকল্পনা। অথচ গোপনে ওদের কিছু সংখ্যক সঙ্গী শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করেছে। পরাজয়কে ঢেকে দিয়েছে মিথ্যার আড়ালে। সংকীর্ণ করেছে মুসলিম রাষ্ট্রের সীমানা।
বন্ধুরা, রাষ্ট্র প্রধান এর দায়দায়িত্ব অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করবেন। একদল মুসলমান থাকবে যারা হবে শ্লোগান সর্বস্ব। কেউবা গর্বের সাথে দুশমনের শ্লোগান অনুকরন করবে। এরা হবে আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ। ইসলামের পতাকাবাহীগণ দ্বীন ও ঈমান রক্ষার জন্য বিশাল মরু, পাহাড়, উপতাক্য আর দুরদেশে গিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, ওদেরকে একথা বলার মতও কেউ থাকবে না। এদের পূর্ব পুরুষ ঝড়-ঝঞ্ছার মধ্যে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন, সমুদ্রের ভয়ংকর ঝড় তাদের গতি রোধ করতে পারেনি, ওরা এমন স্থানে গিয়ে যুদ্ধ করেছে যেখানে পাথরও ছিল ওদের শত্রু। ওরা যখন ক্ষুৎপিপাসায় অধীর এবং অস্ত্র ও ঘোড়া শূন্য তখনও যুদ্ধ করেছে। আহত হয়ে সহযোদ্ধাদের ব্যান্ডেজ করার সুযোগ দেয়নি, পান করেছে শাহাদাতের অমীয় সুধা, কিন্তু কবর খুড়ে সময় নষ্ট করার সুযোগ দেয়নি সংগীদের। মরুর বালি সিক্ত হয়েছে নিজের এবং শত্রুর রক্তে। অন্যদিকে ওদের শাসক দল রাজপ্রাসাদের মধ্যে অকুণ্ঠ ডুবেছিল। উপভোগ করছিল উলংগ নৃত্য। ইহুদীরা যুবতীর রূপ আর সোনার মোহর দিয়ে ঠুলি এঁটে দিয়েছিল ওদের চোখে।
শাসকগণ যখন দেখলেন জনগণ যোদ্ধাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ওদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া শুরু করলেন। যে বীররা ইউরোপ থেকে ভারত পর্যন্ত উড্ডীন করলেন ইসলামের পতাকা তাদের জন্য রসদের যোগান বন্ধ করে দেয়া হল। কাসেমের যুবক সন্তানটির কথা আমি ভুলতে পারি না। ভারতের অত্যাচারী এক শক্তিধর শাসককে পরাজিত করে সে দখল করে নিয়েছিল তার রাজ্য। শাসকদের কাছে কোন সাহায্য চায়নি। তার সুন্দর ব্যবস্থাপনায় জনগণ প্রীত হল। তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হল ভারতবাসী। ইসলাম গ্রহণ করল অনেকেই। খলিফা তার সাথে কি ব্যবহার করেছিলেন! ব্যভিচারের অপবাদ দিয়ে তাকে দেশে ডেকে পাঠানো হল। হত্যা করা হল এক বর্বর পন্থায়।’
কান্নায় গমকে হারিয়ে গেল সুলতানের ভাষা। নীরব হলেন তিনি। হাজার হাজার শহীদের লাশ দেখলে সুলতানের চোখে ফুটে উঠত অপার্থিব আলো। কিন্তু একজন গাদ্দারের মৃত্যুদেহ দেখলে কেঁদে ফেলতেন।
নীরবতা ভেংগে সুলতান আবার বললেন, ‘মুহম্মদ বিন কাশিমকে নিজের জাতি হত্যা করলেও শত্রুরা তাকে বিজয়ী হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।’ বলতে বলতে আবারো আবেগপ্রবণ হয়ে পরলেন সুলতান। অথচ তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি অতীতকে ভুলতেন না, তবে তার দূরদৃষ্টি আটকে থাকত সোনালী ভবিষ্যতের প্রচ্ছদপটে।
‘খ্রিস্টানদের দৃষ্টি আমাদের ভবিষ্যতের ওপর নিবদ্ধ। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে খ্রিস্টান শাসক এবং সেনাপতিরা। ওরা আমাদের দেশ নয় দখল করতে চায় আমাদের ঈমান। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস এর কথা হচ্ছে, “আমার জাতির একটা বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর থাকবে। এ বিজয় তরবারীর জোরে হবে এমন কোন কথা নেই। ওদের চিন্তা চেতনা এবং সংস্কৃতি বদলে দিতে পারলেই আমরা বিজয়ী।”
‘তকীউদ্দীন, খ্রিস্টানদের মত আমাদের দৃষ্টিও ভবিষ্যতের ওপর নিবদ্ধ থাকবে। ওরা আমাদের মধ্যে গাদ্দার তৈরী করছে। আমরা গাদ্দারীর জীবাণু চিরদিনের জন্য নিঃশেষ করে দেব। গাদ্দার হত্যা করলেই এ পথ রুদ্ধ হবে না বরং বন্ধ করতে হবে গাদ্দার তৈরীর সকল পথ। মানুষের মধ্যে শুধু আল্লাহ্ এবং নবীর ভালবাসা সৃষ্টি করলেই এ পথ বন্ধ হবে। মানুষকে বুঝতে হবে খ্রিস্টানদের সভ্যতা সংস্কৃতি আর আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি এক নয়। বেলেল্লাপনা এবং উলংগ নৃত্য ওদের সংস্কৃতি। মদ এবং ব্যভিচার ওদের কৃষ্টি। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ওদের সৌন্দর্য। ওদের আর আমাদের মাঝে বড় পার্থক্য হল, আমরা ইজ্জত-আব্রুর রক্ষক আর ওরা তা দিয়ে ব্যবসা করে। আমাদের মুসলমান ভায়েরা এ পার্থক্য মুছে দিচ্ছে। তকি! তোমাকে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুটো ক্ষেত্রেই যুদ্ধ করতে হবে। সামনাসামনি যুদ্ধ করবে শত্রুর সাথে, অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ করবে নিজেদের প্রতিকূলে। আমাদের মধ্যে গাদ্দার তৈরী না হলে এতদিনে আমরা থাকতাম মধ্যে ইউরোপে। ওরা আমাদের বিরুদ্ধে সুন্দরী যুবতিদের পরিবর্তে ব্যবহার করত অন্য অস্ত্র।
ঈমান দৃঢ় হলে তার আগুনে পুড়ে মরতো সমগ্র খ্রিস্টান জগত।’
‘আপনি কি সমস্যায় রয়েছেন এখানে এসে বুঝতে পেরেছি।’ তকিউদ্দীন বললেন। ‘আপনি যে গাদ্দারদের বেষ্টনীর মধ্যে আছেন হয়তো নুরুদ্দীন জাংগীও তা জানেন না। তার কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠালে ভাল হয় না?’
‘তকি, ভাই আমার! সাহায্য শুধু আল্লাহর কাছ থেকে চাইতে হয়। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও কাছে সাহায্য চাইতে গেলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। খ্রিস্টান বাহিনী বর্মাচ্ছাদিত। আমার সৈন্যরা সাধারণ কাপড় পরে মাঠে নেমেও ওদের পরাজিত করে। লোহার মত মজবুত ঈমান হলে বর্মের প্রয়োজন নেই। বর্ম এবং পরিখা নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করে, ফলে সৈন্যরা নিজেই নিজের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে। মনে রেখো! ময়দানে পরিখার বাইরে থেকে এদিক ওদিক ঘুরে যুদ্ধ করতে হয়। কখনও শত্রুকে পিঠ দেখাবে না, সতর্ক থাকবে যেন শত্রু পেছন থেকে হামলা করতে না পারে। সেনাবাহিনীর কেন্দ্র অক্ষত রেখো। দুপাশে ছড়িয়ে শত্রুকে ঘেরাও করো। কমান্ডো বাহিনী ছাড়া যুদ্ধ করো না। কমান্ডো বাহিনী শত্রুর কাছে রসদ আসার পথ বন্ধ করে দেবে। শত্রুর বাহন হত্যা করে ওদের ভয় পাইয়ে দেবে। কখনও শক্তি সঞ্চয় না করে নিয়মিত লড়াইয়ে যাবে না। আত্মরক্ষামূলক লড়াই না করে উল্টো সব সময় শত্রুকে ব্যস্ত রাখবে যেন ওরা সুস্থির হতে না পারে। এখানে যে সব সৈন্য রেখে যাচ্ছি ওরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এসেছে। এরাই পদানত করেছে সুবাক দুর্গ। শত্রুর চোখে চোখ রেখে যুদ্ধ করেছে ওরা। ভাইকে শহীদ হতে দেখেছে চোখের সামনে। এদের সাথে রয়েছে সে কমান্ডো বাহিনী, সামান্য ইশারা পেলে যারা নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে। আমি যাদের রেখে যাচ্ছি ওদের ভেতর রয়েছে ঈমানের অনির্বাণ শিখা। নিজে সম্রাট সেজে ওদের ঈমানের উষ্ণতা নষ্ট করো না।
খ্রিস্টানরা আমাদের ঈমানের ওপর আঘাত করেছে। তীব্র গতিতে মিসরের দিকে ধেয়ে আসছে ওদের অপসংস্কৃতির ঝড়। অপসংস্কৃতির এ ঝড় রোধ করতে না পারলে ঈমান টিকিয়ে রাখা যাবেনা। ফলে সাংস্কৃতিক লড়াই অস্ত্রের লড়াইয়ের মতই গুরুত্বপূর্ণ। একে অবহেলা করে যতই অস্ত্রের লড়াই জারী রাখো বিজয়ের নাগাল পাবেনা কখনো। মনে রেখো, সাংস্কৃতিক সীমানা টিকিয়ে রাখতে না পারলে কোন রাজনৈতিক বিজয়ই টিকে থাকেনা।’
সুলতান ছোট ভাইকে বুঝিয়ে বললেন, ‘সুদানে মিসর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। মিসরের পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহী সৈন্যও রয়েছে ওদের সাথে। কিন্তু ঘরে বসে শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষা করো না। গোয়েন্দারা সব সময় তোমায় সংবাদ দেবে। গোয়েন্দা উপ-প্রধান হাসান থাকবে তোমার সাথে।
শত্রুর প্রতিটি চাল সম্পর্কে সচেতন থাকবে। প্রতিপক্ষের তৎপরতা ও গতিবিধি সম্পর্কে সব সময় সুস্পষ্ট ধারনা যে কোন বিজয়ের পূর্বশর্ত। যদি মনে কর শত্রু আক্রমণের জন্য প্রস্তুত, সংগে সংগে আক্রমণ করবে। তবে পেছনের ব্যবস্থাপনা অবশ্যই মজবুত রাখতে হবে।
যুদ্ধ ক্ষেত্র সম্পর্কে জাতিকে অন্ধকারে রেখো না। খোদা না করুক পরাজিত হলে নিজের ভুল স্বীকার করবে। জনগণের সামনে এর কারণ ব্যাখ্যা করবে। সাধারণ মানুষের রক্ত এবং অর্থ দিয়ে যুদ্ধ করা হয়। নিহত বা আহত হয় জাতির সন্তানেরা। এজন্য জাতির আস্থা অর্জন করতে হবে। যুদ্ধকে রাজা-বাদশার খেলা মনে করো না। এটা একটা জাতীয় সমস্যা। এ জন্য সব সময় জনসমর্থন প্রয়োজন। মনে রেখো, জনগণকে ভালবেসেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয়। তোমার ভালবাসা নিখাদ হলে জনগণ তোমাকে ভাল না বেসে পারবে না। জনগণের ভালবাসা অর্জন করার এটাই একমাত্র পথ।
আমি ফাতেমী খেলাফতকে পদচ্যুত করেছি। তার অনুসারীরা আমার বিরুদ্ধে তৎপর। শুনেছি তারা গোপনে একজন খলিফা নিয়োগ করেছে। আল আযেদ মরে গেলেও ক্ষমতালোভীরা বেঁচে আছে। সুদানীদের দিয়ে ওরা গদি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। ফাতেমীরা ঘাতক দলের সমর্থক পাচ্ছে। আমি আলীকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি, হাসান এবং পুলিশ প্রধান তোমার সাথে থাকবে। ফৌজে নতুন ভর্তি আরও জোরদার কর। ওদের প্রশিক্ষণ দাও।’
‘মহামান্য সুলতান, ইদানিং মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীতে নতুন ভর্তি হচ্ছে না।’ হাসান বললেন, ‘এলাকার লোকজনও সেনাবাহিনীর ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছে।’
‘এর কারণ অনুসন্ধান করেছ?’ আলীর প্রশ্ন।
‘আমার দু’জন গুপ্তচর ওখানে নিহত হয়েছে।। আমি নতুন গোয়েন্দা পাঠিয়েছি।’
‘আমি আমার মত চেষ্টা করছি।’ বললেন পুলিশ প্রধান। ‘সম্ভবত সে অঞ্চলের লোকজন নতুন কোন কুসংস্কারের পাল্লায় পড়েছে। ওখানকার যাতায়াত খুব কষ্টসাধ্য। এলাকার লোকজন কষ্ট সহিষ্ণু হলেও কুসংস্কারে বিশ্বাসী।’
‘কুসংস্কার এক গুজব’, সুলতান বললেন, ‘সে অঞ্চলের ওপর কঠোর দৃষ্টি রেখো। ওদেরকে কুসংস্কার থেকে রক্ষা করা তোমাদের দায়িত্ব।’
* * *
ক্রাক দুর্গে জরুরী মিটিং চলছে। এতে উপস্থিত রয়েছেন কয়েকজন খ্রিস্টান সম্রাট এবং পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। সুবাক হাতছাড়া হয়ে গেছে। ক্রাকদুর্গ মুসলমানদের দখলে গেলে জেরুজালেম রক্ষা করা যাবে না। ওরা বুঝতে পেরেছে, কিছুটা সময় নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতির পর আয়ুবী চুড়ান্ত আক্রমণ করবে। তার আগ পর্যন্ত থেমে থেমে আক্রমণ চালাতে থাকবে সে। এ জন্য ক্রাকের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হচ্ছে। দুর্গের বাইরে এসে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু সে পরিকল্পনায় কিছুটা রদবদল আনতে হচ্ছে।
গোয়েন্দারা বলেছে, ‘এখানকার ফৌজ মিসরে নিয়ে মিসরের বাহিনীকে সুলতান রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে নূরুদ্দীন জংগীর সেনা সাহায্যও পৌঁছে গেছে তার কাছে। মিসরের ভারাপ্রাপ্ত গভর্নর আয়ুবীর ভাই তকীউদ্দীন। আয়ুবী নিজে মিসর গিয়ে বিদ্রোহ দমন করেছেন। বিদ্রোহীদের দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
গোয়েন্দাদের দেয়া এ সংবাদে খ্রিস্টান সম্রাটগণ বিচলিত হলেন। আহত হলেন বিশ্বস্ত এজেন্ট মুসলেহ উদ্দীনের মৃত্যুতে। মিসরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গোয়েন্দা প্রধান হরমুন বললেন, ‘মুসলেহ উদ্দীনের মৃত্যু ক্ষতিকর হলেও তকিউদ্দীনের ক্ষমতা গ্রহণ আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক সে আয়ুবীর ছোট ভাই হলেও আয়ুবী নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে আমার গোয়েন্দাদের জালে ধরা দেবে। সালাহুদ্দীন এবং আলী দু’জনের কেউ মিসর নেই।’
‘আমি আশ্চর্য হচ্ছি, ঘাতক দল কি করছে?’ বললেন রিমান্ড। ‘ওরা আবার দু’পক্ষেরই কাজ করছে নাতো? হারামীরা এখন আয়ুবী কে হত্যা করতে পারল না। ওদের পেছনে এ পর্যন্ত আমাদের অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে।’
‘টাকা নষ্ট হয়নি।’ হরমুন বলল, ‘দেখবেন সালাহউদ্দীন যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। কায়রো যাবার সময় তার সাথে ছিল কুড়িজন দেহরক্ষী। এদের চারজন ঘাতক দলের সদস্য। আয়ুবী কে যেন পথেই শেষ করে দিতে পারি আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
‘মিথ্যা আশায় বসে থাকা উচিৎ নয়।’ বললেন ফিলিপ অগাস্টাস। ‘আয়ুবী নিরাপদে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছবে এ ধারণা করেই এখন পরিকল্পনা করতে হবে। তার সাথে রয়েছে নতুন সৈন্য। আনকোরা সৈনিকদেরও ট্রেনিং দেয়া শেষ। নুরুদ্দীন জংগীর পাঠানো সৈন্যও পৌঁছে গেছে। সুবাকের মত শক্তিশালী দুর্গ তার হাতে। এখন রসদপত্র কায়রো থেকে আনতে হবে না, সুবাকে প্রচুর রসদ জমা করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কি? সে ক্রাক অবরোধ করুক, আর আমরা অবরুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করি, এ সুযোগ তাকে দিতে চাই না।’
‘অবরোধ করার সুযোগই সে পাবে না’, বললেন একজন সেনা কমান্ডার। ‘আমরা দুর্গের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করব এবং সুবাক অবরোধ করব।’
‘সালাহউদ্দীন মরুর শিয়াল’, বললেন ফিলিপ। ‘তাকে মরুভূমিতে পরাজিত করা সহজ নয়। সে আমাদেরকে সুবাক অবরোধ করার সুযোগ দিয়ে আমাদেরকেই অবরোধ করবে। আপনারা তার যুদ্ধ পলিসি এখনও বুঝতে পারেননি। যদি তাকে মুখোমুখি এনে লড়াই করা যায় তবে আমি বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারি। কিন্তু আপনারা তা পারবেন না। আয়ুবী কখনই সামনা সামনি যুদ্ধ করবে না।’
এ বিষয়ের ওপর কথা হল দীর্ঘক্ষণ। সিদ্ধান্ত হল অর্ধেক ফৌজ দুর্গের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওরা মুসলিম বাহিনীর একটু দূরে তাঁবু ফেলে তাদের গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখবে। এদের সংখ্যা হবে মুসলিম ফৌজের দ্বিগুণ। আয়ুবী কে পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্য একদল সৈন্যকে নির্ধারণ করা হল। সুবাক থেকে মুসলিম ফৌজের কাছে রসদ আসার পথে পাঠিয়ে দেয়া হল কয়েক প্লাটুন সৈন্য। কমান্ডারদের অভিমত হল, প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নিরূপায় হয়ে আয়ুবী মুখোমুখি লড়াইয়ে বাধ্য হবে।
খ্রিস্টান সেনানায়কগণ লৌহ বর্ম পরিহিত সৈন্যদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। তাদের বেশীর ভাগ ফৌজই ছিল বর্ম পরিহিত। এমনকি উটগুলোকেও বর্ম পরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
যুদ্ধের জন্য ঘোড়া সংগ্রহ করেছিল ইউরোপ থেকে। কিছু ছিল আরবী ঘোড়া। কিছু সৈন্য আর কিছু মুসলিম কাফেলা থেকে চুরি করা। সুলতান আয়ুবীর সবকটা ঘোড়াই ছিল আরবী।
সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখা হল।
‘সুলতান আয়ুবী মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকাতে নতুন ভর্তির কোন লোক পাবে না।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন। ‘ওরা প্রকৃতিগতভাবে যুদ্ধবাজ এবং পরিশ্রমী। আমরা ওখানে নিরবে কাজ করছি। সে এলাকার লোকজন এখন যুদ্ধের বিরোধিতা করছে। আমাদের গোয়েন্দাদের জন্য এলাকাটি মজবুত দুর্গের মত কাজ করছে। মুসলমানদের দু’জন গোয়েন্দাকে ওখানে গায়েব করে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন সীমান্তের এলাকাগুলোতে কাজ করব। ধীরে ধীরে এর প্রভাব পরবে মিসরের কেন্দ্রে।
আমি এসব অঞ্চলে মুসলমানদের একটা দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছি। ওরা পীর, ফকির এবং দরবেশদের ভীষণ শ্রদ্ধা করে। কাউকে তসবিহ নিয়ে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে দেখলে তার ভক্ত হয়ে যায়। তলিয়ে দেখে না ওরা খাঁটি না অখাঁটি। এ সব পীর এবং ফকীর এবং দরবেশরা ইসলামী আন্দোলন এবং জেহাদের বিরোধী।
যদি কোনক্রমে বিশ্বাস করানো যায় এসব ফকীরদের সাথে খোদার সম্পর্ক রয়েছে, ব্যাস, দলে দলে লোক পানি পড়া, তেল পড়া এবং তাবিজ কবজের জন্য ওদের পিছু নেবে। মুসলিম বাহিনী ঘাম এবং রক্ত দিয়ে যে সুনাম অর্জন করছে এসব পীর ফকীর তা বরদাশত করতে পারে না।
ওরা আন্দোলনের নাম শুনলে ভড়কে যায়, সন্ত্রস্ত্র হয় জিহাদের নামে। সুলতান এবং নূরুদ্দীন জংগী মুসলিম সমাজের শ্রদ্ধার পাত্র। অন্যদিকে খলিফাদের কার্যকলাপে সচেতন মানুষ বীতশ্রদ্ধ। তাদের মধ্যে একদল আলেম জন্ম নিয়েছে যারা ময়দানকে ভয় পায়। খলিফাদের সহযোগিতায় এরা জিহাদের অর্থ বদলে দিচ্ছে। রাজনীতিকে হারাম বলে ফতোয়া দিচ্ছে। মানুষকে ইসলামী আন্দোলন থেকে বিমুখ করে নিজের স্বার্থ হাসিল করছে।
এরা কথা বলে বিশেষ পদ্ধতিতে। সাধারণ মানুষ মনে করে আল্লাহ্ যে সব গোপন রহস্য অন্যকে জানাননি এরা তা জানেন। সাধারণ মুসলমান সহজেই এসব পীর ফকির এবং দরবেশের ফাঁদে আটকা পড়ছে। আমি সে সব আলেম এবং পীর ফকিরদের ব্যবহার করছি। ইসলামের নামে মুসলমানদেরকে ইসলামের মৌলিক নীতিমালা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ইহুদীরা মুসলমানদের ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আমিও তাদের পথেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
খ্রিস্টানদের এ তৎপরতা নিয়ে সুলতান উদ্বিগ্ন ছিলেন। স্বজাতির লোকেরা অদৃশ্যে থেকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে করছে। এ রণক্ষেত্রের দুশমন সুলতানের সামনে নেই। সরাসরি ওদের সাথে কোন যুদ্ধ হচ্ছে না, কন্তু দৃশ্যমান শত্রু একজনকে শহীদ করার সুযোগ পাওয়ার আগে এরা একশ’জনকে বিভ্রান্ত করে ফেলে।
ছোট ভাই এবং কর্মকর্তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে সুলতান রণক্ষেত্রে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সঙ্গে চব্বিশজন দেহরক্ষী। খ্রিস্টান গোয়েন্দারা এ খবর জানত। চাতুর্যের সাথে ঘাতক দলের চারজন সদস্য দেহরক্ষী পদে চাকুরী নিয়েছিল। সুলতানকে হত্যা করাই ছিল তাদের কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। কারণ, চারজনের ডিউটি একত্রে পড়েনি। তাছাড়া সব সময় কমপক্ষে বিশজন পাহারায় থাকত। রক্ষীদের কমান্ডার ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক এবং বুদ্ধিমান। রক্ষী দলে ঘাপটি মেরে আছে ঘাতকদের চারজন সদস্য জানতেন না তিনি। সুলতান সফরে, সুতরাং তিনি আরও বেশী সতর্ক। সঙ্গে আরও বেশী রক্ষী নিতে চেয়েছিলেন কমান্ডার। সুলতানের আপত্তির জন্য রক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো যায়নি।
কায়রো থেকে সুলতানের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিকেলে। সফর চলল মাঝ রাত পর্যন্ত। এরপর বিশ্রাম। ভোর রাতে আবার যাত্রা শুরু হল। দুপুরের মরু রোদে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঘোড়াগুলো। পানি, ছায়াদার বৃক্ষ এবং টিলা দেখে থামল কাফেলা। তাঁবু টানানো হল সুলতানের জন্য। রক্ষীদের দু’জন তাঁবুর সামনে, দু’জন পেছনে। অন্যরা ধারে কাছে ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কয়েকজন ঘোড়াকে পানি খাওয়াতে ব্যস্ত। আলী বিন সুফিয়ান এবং সুলতানের অন্য সংগীরা তাঁবু টানাননি। একটা টিলার পাশে গাছের ছায়ায় সবাই শুয়ে পড়েছেন। ঝোপ ঝাপের কারণে সুলতানের তাঁবু ছিল দৃষ্টির আড়ালে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে মরু সূর্য। যে যেখানে পারছে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে।
এই প্রথম একসঙ্গে সুলতানের তাঁবুর প্রহরায় এসেছে ঘাতক দলের দু’জন সদস্য। বাকী রক্ষীরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। সহিসরাও উট এবং ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াচ্ছে। ঘাতক দলের অন্য দু’সদস্য বাকী রক্ষীদের সাথে। প্রহরারত দু’সৈন্যকের একজন তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করল। চকিতে ফিরে তাকাল দ্বিতীয় প্রহরীর দিকে। সুলতান ঘুমিয়ে আছেন। পিঠ তাঁবুর দরজার দিকে।
প্রহরী হাতের বর্শা তাঁবুর বাইরে রেখে আলতো পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল। খাপে ভরা তরবারী, খজ্জরও হাতে নেয়নি। এ প্রহরী অন্যদের চাইতে শক্তিমান, বয়সে যুবক। শরীরে অসুরের শক্তি। সতর্ক পায়ে সে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের কাছে।
আচমকা দু’হাতে চেপে ধরল সুলতানের ঘাড়। সুলতান ঘুমাননি, জেগেই ছিলেন তিনি। পাশ ফিরার সময় টের পেলেন দু’টো লৌহ কঠিন হাত গলায় চেপে বসছে।
আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র। এরপর চিরদিনের জন্য নিভে যাবে তার জীবনের আলো। উপুড় হয়ে পড়ে আছেন তিনি। ঘাতক সুলতানের পিঠ হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে ঘাড় থেকে একটা হাত সরিয়ে নিল। আরেক হাতে চেপে রাখল সুলতানের ঘাড়। কোমরের বেল্ট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বের করল। প্যাকেটের মুখ খুলে ভেতরের পাউডার ঢেলে দিতে চাইল সুলতানের মুখে।
লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি। অসহায়ের মত পড়ে আছেন সুলতান। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘাতকের হাতে প্যাকেট দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন লোকটা তাকে বিষ খাওয়াতে চাইছে। মুখবন্ধ করে ফেললেন তিনি।
বিষ খাওয়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল প্রহরী, এ ফাঁকে কোমর থেকে খঞ্জর খুলে নিলেন সুলতান। ঢুকিয়ে দিলেন লোকটার পাঁজরে। বের করে আবার আঘাত করলেন। ষাঁড়ের মত শক্তিশালী প্রহরী এতেও কাবু হল না।
সুলতান খঞ্জর বের না করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লোকটার অন্ত্রনালী কেটে ফেললেন। ঢিলে হয়ে গেল আক্রমণকারীর হাত। পড়ে গেল হাত থেকে কাগজের প্যাকেট। ধাক্কা দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান। লোকটা পড়ে গেল নিচে। ক্ষতস্থানে হাত চেপে পড়ে আছে, উঠার সাধ্য নেই।
পতনের শব্দে দ্বিতীয় প্রহরী তাঁবুর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল। সঙ্গীর অবস্থা দেখে তরবারী নিয়ে ছুটে এল। আঘাত করল সুলতানকে লক্ষ্য করে। চকিতে জায়গা বদল করে আঘাত ঠেকালেন সুলতান। সুলতান যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার পাশের খুটিতে আটকে গেলো তরবারী।
এ সুযোগে সুলতান প্রহরীকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করলেন। দেহ বাঁকিয়ে আঘাত এড়াল প্রহরী। সুলতান উচ্চস্বরে কমান্ডারকে ডাকলেন। দ্বিতীয় আঘাত করল প্রহরী। সরে আক্রমণকারীর পাশে চলে এলেন তিনি। আঘাত করলেন পাঁজরে। আমূল ঢুকে গেল খঞ্জর। সুলতানের ডাক শুনে আরও দু’জন প্রহরী ছুটে এল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতানের ওপর।
সুলতান সাহস হারালেন না। তিনজনের বিরুদ্ধে একা লড়ে যেতে লাগলেন।
কয়েকজন প্রহরী নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন কমান্ডার। ঢুকেই আক্রমণকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
একপাশে সরে দাঁড়ালেন সুলতান। মনে পড়ল, এর আগেও তিনি এমনি এক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে দু’জন প্রহরীর যুদ্ধ দেখতে লাগলেন সুলতান। শোরগোল শুনে আলী এবং তার সংগীরাও এলেন। পরিস্থিতি দেখে বিবর্ণ হয়ে গেল আলীর চেহারা। রক্তাক্ত হয়ে চারজন প্রহরী মাটিতে পড়ে আছে। মারা গেছে দু’জন। তৃতীয় জন জ্ঞান হারিয়েছে। পাজর থেকে পেট পর্যন্ত ফাঁড়া। বুকে গভীর ক্ষত।
চতুর্থ জনের আঘাত লেগেছে পেটে এবং উরুতে। হাত জোড় করে সে জীবন ভিক্ষা চাইছে। ‘আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমার বোনের জন্য আমায় বেঁচে থাকতে দিন। ক্ষমা করুন আমায়।’
সুলতান ইঙ্গিতে প্রহরীদের থামিয়ে দিলেন।
‘ওকে মেরো না, দ্রুত ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।’
একটু পর তৃতীয় প্রহরীরও জ্ঞান ফিরে এল। এক দেহরক্ষী এগিয়ে ওর বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিল।
ব্যক্তিগত চিকিৎসককে ডাকলেন সুলতান। বললেন, ‘যে কোন মূল্যে ওকে বাঁচাতে হবে। চিকিৎসার কোন ত্রুটি যেন না হয়।’
সুলতান সম্পূর্ণ সুস্থ। একটা আঁচড়ও লাগেনি তাঁর গাঁয়ে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি আশ্চর্য হইনি। এমনটি হওয়ারই কথা।’
আলীর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কপালে চিন্তার বলিরেখা। চেহারা বিবর্ণ। সুলতানের দেহরক্ষী নির্বাচন করার দায়িত্ব তাঁর। দলের অন্যান্য সদস্যরা বিশ্বস্ত কিনা এখনই দেখা উচিৎ।
সুলতানের বিছানা থেকে ঘাতকের হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাগজের প্যাকেট তুলে নিলেন ডাক্তার। পরীক্ষা করে বললেন, ‘ভয়ংকর বিষ। এর সামান্য পাউডার কাউকে খাওয়াতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। নিশ্চিন্তে মারা যায় লোকটি।’ ডাক্তারের নির্দেশে বিছানা বাইরে নিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে আনা হল।
আহত প্রহরীকে তুলে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন সুলতান। পেটের চাইতে তাঁর উরুর ক্ষতটা বেশী মারাত্মক।
প্রহরী হাত জোড় করে সুলতানের কাছে জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগল।
সুলতানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। সে একজন ভাড়াটিয়া খুনী।
ক্ষতস্থানের ব্যথার চাইতে সে বেশী কাঁদছিল অবিবাহিত বোনের জন্য। বোনের নাম নিচ্ছিল বারবার।
‘মহামান্য সুলতান’, বলল সে, ‘আমি একজন মুসলমান। ক্ষমা করুন আমায়। আমার জন্য না হলেও আপনার একজন মুসলিম বোনের জন্য আমায় মার্জনা করুন।’
‘জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহর হাতে,’ দৃঢ় অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান, ‘কে মারে কে বাঁচায় দেখলে তো? কিন্তু আমার বন্ধু! এ মুহূর্তে আমার হাতে তোমার জীবন তুমি দেখতে পাচ্ছ, কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে নিজের পাপের দিকে তাকাও। দেখ কত অসহায় তুমি।
তোমার মৃত সংগীদের সাথে মরুভূমিতে ফেলে দেব, মারব না তোমায়। শিয়াল-শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে তোমার মাংস। তোমার জ্ঞান থাকবে, কিন্তু পালাতে পারবে না, এক সময় মরে যাবে। এভাবেই পাবে তোমার পাপের শাস্তি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রহরী। আঁকড়ে ধরতে চাইল সুলতানের হাত।
‘কে তুমি?’ প্রশ্ন করলেন সুলতান, ‘কোথেকে এসেছে? আমার সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?’
‘আমি ফাতেমীদের লোক। আমরা চারজনই ঘাতক দলের সদস্য। তিন বছর পূর্বে আপনার সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। কিভাবে আপনার দেহরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল।’
প্রহরীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল অনেক মুল্যবান তথ্য। একদিকে ডাক্তার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করছেন, অন্যদিকে লোকটি বলে যাচ্ছে। ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত আয়ুবীর বিরুদ্ধে কি কি ষড়যন্ত্র করেছে, কি চুক্তি হয়েছে খ্রিস্টান এবং ঘাতক দলের সাথে সব কথাই সে বলল।
ডাক্তার ব্যান্ডেজ শেষ করেছেন।
লাশগুলো বাইরে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন সুলতান। আলীকে বললেন, আহত প্রহরীকে এখান থেকেই কায়রো নিয়ে যেতে। বললেন, ‘প্রহরী ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত যে সব লোকের নাম করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’
সাথে সাথে আহত প্রহরীকে নিয়ে উটে চাপলেন আলী। ছুটলেন কায়রোর দিকে।
* * *
মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকা। এরপরই সুদানের বর্ডার। এখানে রয়েছে পুরনো পোড়াবাড়ী। শত শত বছরের অব্যবহৃত বাড়ীগুলো ভয়ংকর এবং দুর্গম। হয়ত ফেরাউনদের সময় এ এলাকা ছিল সবুজ শ্যামল। ছিল পানির ঝর্ণা। শুকনো ঝিল আর পানি শূন্য নদী তার সাক্ষ্য বহন করছে। এখানে ছিল পাথুরে পর্বত আর বালিয়াড়ি। পর্বতগুলো দেখতে ছিল বিশাল অট্টালিকার মত। থামের মত পর্বতশৃঙ্গ। কোথাও দেয়ালের মত। সমতল ভূমিতে বালি আর বালি।
এলাকার বাইরে কোথাও কোথাও পানি। গাছ-গাছালিও রয়েছে। অধিবাসীদের পেশা কৃষি। চল্লিশ মাইল লম্বা এবং বার মাইল চওড়া অঞ্চল জুড়ে জনবসতি। জনসংখ্যার বেশীর ভাগ মুসলমান। অন্য ধর্মেরও কিছু লোক রয়েছে। সবাই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ফারাওদের এসব অট্টালিকাকে মানুষ ভয় পেত। লোকজন ভুলেও মাড়াত না এসব এলাকা। তাদের বিশ্বাস, এখানে থাকে ফেরাউনদের অতৃপ্ত আত্মা।
দিনের বেলা পশুর রূপ ধরে ওরা ঘুরে বেড়ায়। ওদের কখনও দেখা যায় উস্ট্রারোহী সৈনিকের বেশে, আবার কখনও সুন্দরী যুবতীর রূপে। কখনও শোনা যায় ভয়ংকর শব্দ।
বছর খানেক থেকে এসব পড়োবাড়ী মানুষকে আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। মুসলিম সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির জন্য আয়ুবীর লোকজন যখন ওখানে গিয়েছিল, এলাকার লোকজন তাদেরকে পড়োবাড়ী সম্পর্কে ভয়ংকর গল্প শুনিয়েছিল। ওরা ওখানে যেতে নিষেধ করেছে তাদের।
প্রথমবার অনেকেই ভর্তি হয়েছে সেনাবাহিনীতে। পরের বার চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। সীমান্ত প্রহরীরাও ভয়ে ও পথ মাড়ায় না। ওরা কোন মানুষকে পড়োবাড়ীতে যেতে দেখেনি। ইদানীং ওখানে লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়েছে। ওখান থেকে যখন ফিরে আসে, ওদের চোখে মুখে থাকে তৃপ্তি। দেখতে দেখতে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ওখানে মেলা বসতে শুরু করেছে। ঘটছে আশ্চর্য সব ঘটনা। সেদিন পাঁচজন সীমান্ত রক্ষী টহল দিতে দিতে পড়োবাড়ীর কাছে গেল, কিন্তু তারপর কি যে হলো, ওদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সমগ্র মিসরে ছড়িয়ে ছিল সুলতান আয়ুবীর গোয়েন্দা বাহিনী। রহস্যঘেরা পড়োবাড়ী সম্পর্কে ওরা কেন্দ্রে রিপোর্ট পাঠাল। রিপোর্টে বলা হল, ‘এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তাধারা বলে যাচ্ছে। মুসলিম সেনাবাহিনীকে ওরা ঘৃণার চোখে দেখে। সুলতান আয়ুবীর নামও ওরা শুনতে চায় না।’
এ রিপোর্ট পাঠানোর পর দু’জন গোয়েন্দা কর্মী নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, গোপনে হত্যা করা হয়েছে ওদের। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের লোকজন ভয়ংকর পড়োবাড়ীতে যাওয়া আসা শুরু করল। অথচ ক’দিন আগেও ওই স্থানের নাম শুনলে ভয়ে আঁতকে উঠত সবাই।
শুরুটা ছিল, একদিন গাঁয়ে এল একজন অপরিচিত উস্ট্রারোহী। লোকটি মিসরীয় মুসলমান। উটের মত তার চেহারাও নাদুশ নুদুশ। গাঁয়ের লোকদের একত্রিত করে সে বলল, ‘আমি অর্থ কষ্টে ছিলাম। দিনে একবেলার আহার জোটাতে পারতাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম ডাকাতি করব। বাড়ী থেকে বের হলাম একদিন। বাহন নেই। পায়দল হাঁটতে লাগলাম।
এ এলাকায় জনবসতি নেই। ভাবলাম ডাকাতি করে এখানে নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারব, ধরা পড়ার ভয় থাকবে না। অনেকদিন ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু কোন শিকার পেলাম না।
হাঁটতে হাঁটতে পড়োবাড়ী এলাকায় একটা পাহাড়ের কাছে পড়ে গেলাম। দেহে শক্তি নেই। অনেক কষ্টে দু’হাত ওপরে তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। কানে ভেসে এলো এক গুরুগম্ভীর শব্দ, ‘তুমি ভাগ্যবান, এখনও কোন পাপ করোনি, পাপের ইচ্ছে করেছ মাত্র। ডাকাতি করে এখানে এলে এতক্ষণে দেহের পরিবর্তে হাড়ের ছাউনি পড়ে থাকত। পাহাড়ী জন্তু জানোয়ার তোমার গোশত ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত।’
সে বলল, ‘শব্দ শুনে আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। মনে হল কে যেন আমাকে টেনে তুলছে। চোখ খুলে দেখলাম এক আজব দৃশ্য। সেখানে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। দেখলাম দুধ সাদা শুভ্র শুশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধকে। বৃদ্ধের দুচোখ থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। তাহলে এ বৃদ্ধের কণ্ঠই শুনেছি আমি?’
ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আমি। বৃদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘কোন ভয় নেই পথিক। যারা এখানে আসতে ভয় পায় ওরা হতভাগা। শয়তান ওদেরকে এখানে আসতে দেয় না। যাও, গাঁয়ের লোকদের গিয়ে বল ফারাওদের খোদা এখন আর নেই। এ এলাকা এখন মুসার খোদার রাজত্ব। হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে এখানেই অবতরণ করবেন। এ বিরাণ ভূমি থেকেই প্রজ্জ্বলিত হবে ইসলামের আলো। জ্যোতিতে জ্যোতিমান হবে সমগ্র পৃথিবী। যাও বৎস, গাঁয়ের লোকদের আমার কথা বলবে। এখানে নিয়ে এস ওদের।’
আমি হাঁটতে পারছিলাম না। দেহ শক্তিহীন, দুর্বল। বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘যাও গুণে গুণে পঞ্চাশ পা উত্তর দিকে এগুবে। খবরদার, একবারও পেছনে তাকাবে না। লোকদের কাছে আমার এ কথাগুলো পৌঁছে দাও। নয়তো তোমার ভীষণ ক্ষতি হবে। সামনে দেখবে একটা উট বসে আছে। তার সাথে রয়েছে ঘাস-পাতা, তোমার খাবার এবং পানি। উটের সাথে আর যা পাবে সব তোমার।’
এ কথা শুনে আমি হাঁটতে লাগলাম। কোন দুর্বলতা নেই। বৃদ্ধকে ফেরাউনের আত্মা ভেবে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, এ জন্য পেছনে তাকাইনি, যেন পালাতে পারলে বাঁচি।
গুণে গুণে পঞ্চাশ পা এগোলাম। এখানে এসে পথ খানিকটা বেঁকে গেছে। সামনে দেখলাম একটা উট। এগিয়ে গিয়ে উটের সাথে বাঁধা পুটুলী থেকে খাবার বের করে নিলাম। তৃপ্তির সাথে খেয়ে পানি পান করলাম। দেহে এল অবর্ণনীয় শক্তি।’
একটি থলির মুখ খুলল অপরিচিত লোকটি। লোকদের দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন স্বর্ণ মুদ্রা, এটিও উটের সাথে বাঁধা ছিল। তাই উটে চেপে আপনাদের কাছে এলাম বৃদ্ধের বাণী শোনানোর জন্য।’
কথা শেষ করে অপরিচিত লোকটি ফিরে গেল। লোকটির বাচনভংগী গাঁয়ের মানুষকে ভয়ংকর স্থানে উদ্বুদ্ধ করল। মুরুব্বীরা বললেন, ‘লোকটি অপরিচিত। আমরা কেউ কখনও তাকে দেখিনি। লোকটি নিজেই ফারাওদের আত্মা কিনা কে জানে!’
নিসিদ্ধ জিনিষের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণের ফলে যুবকরা সে ভয়ংকর স্থানে যেতে তৈরী হল। ওরা দেখতে চায় পড়োবাড়ীর গোপন রহস্য। স্বর্ণ মুদ্রার হাতছানি এড়াতে পারল না গাঁয়ের লোকজনও।
* * *
চল্লিশ মাইল দীর্ঘ এলাকায় এ অপরিচিত লোকটির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। কেউবা সিদ্ধান্ত নিল যাবার জন্য, কিন্তু মন থেকে ভয় দূর করতে পারছিল না। কিছু লোক পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এসেছে।
ক’দিন পর দু’জন যুবক উস্ট্রারোহী সমগ্র এলাকা ঘোরাঘুরি করল। আগের লোকটির মত গল্প বললেও এদের বলার ধরন ছিল ভিন্ন। ওরা ঘোড়ায় চেপে অনেক দূরে যাচ্ছিল। সাথে ছিল অতিরিক্ত দুটো ঘোড়া। ওতে মূল্যবান মালপত্রে বোঝাই। ওরা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছিল সুদান।
পথে ডাকাত দল ওদের সব কিছু কেড়ে নিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। যুবক দু’জন হাঁটতে হাঁটতে পার্বত্য এলাকায় এসে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পরল। চলার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল ওদের। ক্লান্ত দেহ নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল।
ওরা দেখল শুভ্র পোশাক পরা একজন বৃদ্ধ ধীরপায়ে ওদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শয়তান তোমাদের সম্পদ লুট করেছে। তোমরা খুব ভাল। পঞ্চাশ কদম এগিয়ে দুটি উট দেখতে পাবে। উটের সাথে যা থাকবে সব তোমাদের। সোনা গয়না দেখে পরস্পর মারামারি করো না। তাহলে দু’জনই চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে গিয়ে লোকদের বলো পার্বত্য এলাকাকে যেন ভয় না পায়। এখানে ভয়ের কিছু নেই।
সাহস করে লোকজন পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত শুরু করল। দেখা গেল অনেকেই পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত শুরু করল। দেখা গেল অনেকেই ভয়ংকর পড়োবাড়ীতে আসা যাওয়া করছে। ওরা বলল, ‘ভেতরে একজন দরবেশ রয়েছেন। তিনি গায়েব জানেন। আকাশের খবর বলতে পারেন।’
কেউ কেউ বলল, ‘তিনি ইমাম মেহদী।’ কেউ বলল, ‘তিনি মুসা (আ.)।’ আবার অনেকের ধারণা তিনিই হযরত ইসা (আ.)। তিনি যেই হোন একজন দরবেশ। পাপীদের সাথে দেখা দেন না, কেবলমাত্র মন পবিত্র করে গেলেই তাকে দেখা যায়। দু’একজন বলেই ফেলল, ‘তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন।’
এসব রহস্যময় গল্প মানুষকে পড়োবাড়ীর দিকে টানতে লাগল। ভয়ংকর স্থানে শুরু হল মানুষের আনাগোনা। ভেতরে গুহার মত কক্ষে ঢোকার আঁকাবাঁকা পথ। একটা বিশাল কক্ষের ছাদ অনেক উঁচু। ছাদে মাকড়সার জাল। কিন্তু ফুলের সুবাসে ম ম করছে। কোথাও নীচের দিকে নেমে গেছে সিঁড়ি। পাতালপুরীতে গিয়ে শেষ হয়েছে শেষ ধাপ।
এসব প্রাসাদ ছিল ফারাওদের। ওরা নিজেরা খোদার আসনে বসেছিল। ওদেরকে সবাই দেখতে পেত না। মানুষকে এ প্রাসাদে একত্রিত করে শুধু কণ্ঠ শোনানো হতো। বড় কক্ষে মিশে ছিল এক সুড়ং মুখ। সুড়ংয়ের অপর প্রান্ত থেকে কথা বলা হত। কে কথা বলছে লোকেরা তা দেখত না, শুধু কণ্ঠ শোনা যেত।
এ শব্দটি খোদার কণ্ঠ ভেবে তৃপ্তি পেত মানুষ। বড় কক্ষে ছিল পর্যাপ্ত আলো। কোন প্রদীপ ছিল না। এ জন্য আয়না ব্যবহার করা হত। আলোর প্রতিবিম্ব কক্ষে এসে পড়ত। খোদাই নুরের এ কারিশমা দেখে হতবাক হয়ে যেত মানুষ।
শত শত বছরের সেই পুরনো পদ্ধতি ফিরে এল আবার। মানুষ সুড়ংয়ের শব্দকে খোদার শব্দ মনে করে মোহিত হল। দূর হয়ে গেল পড়োবাড়ীর ভয়। অনেক পথ ঘুরে বিভিন্ন কক্ষ পেরিয়ে যেতে হত বড় কক্ষে। সবগুলো কক্ষে ছিল কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। ইথারে ভেসে বেড়াত একটি কণ্ঠ। ‘আমি তোমাদেরকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছি। মরে গেছে ফেরাউনের আত্মা। খোদার নূর দেখ। এ হল কোহে নূরের জ্যোতি। মুসা এ জ্যোতিই দেখেছিলেন। ঈসা (আ.) কে এ নূর জ্যোতিষ্মান করবে। আল্লাহ্কে ভয় কর। মুখে কালিমা পড়।’
হতবাক হয়ে লোকজন পরস্পরের দিকে চাইত। গুণ গুণ করে কালিমা পড়ত সবাই।
ইথারের শব্দে মুসা, ইসা এবং কালিমার কথা না থাকলে মানুষ হয়ত বিশ্বাস করত না। এরা সবাই মুসলমান। ধর্মের নামে ওরা সব কথাই বিশ্বাস করছে। ইথারে গুঞ্জরিত হল দ্বিতীয় কণ্ঠ, ‘আমাদের নবী (সা.)অন্ধকার হেরা গুহায় আল্লাহ্কে দেখেছিলেন। তোমরাও অন্ধকার কক্ষে আল্লাহ্কে দেখতে পাবে।
ভক্তির আবেশে মাথা নোয়াল সবাই। যিনি পথিকদের উট, খাবার এবং স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছেন এরা তার কাছে যেতে চাইছে। যিনি মৃত্যুকে জীবন দিতে পারেন, এরা তাকে দেখতে চায়।
মানুষের আগ্রহ এবং সেই সাথে উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছিল। ওরা যখন বাড়ী ফিরল, মহিলারা বলল, ‘একজন অপরিচিত লোক এসে দরবেশের অলৌকিক কাজের বর্ণনা দিয়েছে। ওরা নাকি দরবেশকে দেখেছে।’
বড় মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে লোকজন দরবেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করল। ইমাম সাহেব বললেন, ‘তিনি একজন পবিত্র মানুষ। হযরত ঈসার বাণী নিয়ে এসেছেন। ঈসার বাণী হল ভালবাসা আর সম্প্রীতির শিক্ষা। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, কাউকে আহত করোনা বরং আহত ব্যক্তির চিকিৎসা কর। তোমরা এ নিয়ম মেনে চললে দরবেশ বাবা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেখা দেবেন।’ ইমাম সাহেবের মুখে শোনার পর দরবেশ সম্পর্কে মানুষের মনে আর কোন সন্দেহ রইল না। দলে দলে লোক পড়োবাড়ীতে যেতে লাগল। দরবেশ ঘোষণা করল, ‘শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার রাতে লোকজন এখানে আসতে পারবে।’
সে অনুযায়ী প্রতি বৃহস্পতিবার বাবার সাথে দেখা করার দিন ধার্য করা হল। পুরুষের সাথে মেয়েরাও ওখানে যেতে লাগল। এখন কেউ ইচ্ছে মত পড়োবাড়ীতে যেতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে উট, ঘোড়া আর খচ্চরে চেপে আসতে লাগল। রহস্য ঘেরা পড়োবাড়ীর বাইরে বৃহস্পতিবার আসার অপেক্ষায় বসে থাকে দর্শনার্থী।
ভেতরের চিত্রও বদলে গেল। আলো আঁধারীতে পাপী আর পূণ্যবানের ছবি দেখানো হল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখতো পাপীর ছবি শূন্যে ভাসছে, শাস্তি পাচ্ছে।
সূর্য ডোবার সাথে সাথেই খুলে যেত রহস্যে ভরা সুড়ং মুখ। সুড়ংটি মুলতঃ প্রাসাদের ভেতরকার প্যাসেজ। দু’পাশের দেয়ালে ছোট ছোট খুপড়ি। সুড়ং পথ দশগজ পরে পরে ডানে বায়ে মোড় নিয়েছে। সুড়ং মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন লোক। পাশে খেজুরের স্তূপ। মনে হত দর্শকদের দেয়া খেজুরের তোহফা এখানে জমা করা হচ্ছে। খেজুরের পাশে পানির মশক। সুড়ং পথে যেতে চাইলে দর্শনার্থীদেরকে দুটো খেজুর এবং কয়েক ঢোক পানি দেয়া হয়।
অন্ধকার সুড়ং পেরিয়ে এরা পৌঁছত আলো ঝলমলে বিশাল কক্ষে। ওখানে ভেসে আসত গায়েবী আওয়াজঃ ‘ কালিমা পড়, আল্লাহ্কে স্মরণ কর। হযরত মুসা এসেছেন। ঈসা (আ.) আসবেন। মন থেকে পাপ এবং শত্রুতা মুছে ফেল। যুদ্ধ বিগ্রহের কথা ভুলে যাও। বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে যাদের দিয়ে যুদ্ধ করানো হয়েছিল তাদের পরিণতি দেখে নাও।
দর্শনার্থীদেরকে একদিকে মুখ করে দাঁড় করানো হত। শব্দ শেষ হলেই ছুটে আসত চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো। একটু পর সে আলো কমে আসত ধীরে ধীরে। তারপর আবার তীব্র আলোতে ভরে যেত ঘর।
এভাবে কয়েকবার আলোতে খেলা চলার পর সামনের দেয়ালে ভেসে উঠত অসংখ্য ছবি। ধ্বনিত হত গায়েবী আওয়াজঃ ‘এরাও তোমাদের মতই যুবক এবং সুন্দর ছিল। খোদার বিধান মানেনি। কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চেপে খোদার সৃষ্ট মানুষ হত্যা করেছে। ওদের ধোঁকা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল তোমরা যুদ্ধ করে শহীদ হলে স্বর্গ পাবে। ওদের পরিণতি দেখো। খোদা ওদেরকে শয়তানের রূপ দিয়েছেন।’
এর সাথে শোনা যেত মেঘের গর্জন আর বজ্রের চমক। শোনা যেত বিভিন্ন পশুর শব্দ। চোখ ধাঁধানো আলোয় দর্শকরা চোখ পিটপিট করে তাকাতো দেয়ালের দিকে। ভঙ্কর দাঁতালো পশুর দল একদিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে। শুধু মুখটা মানুষের মত, বাকী সব ভয়ঙ্কর হায়নার মত।
একটু পর দেখা গেল, ওরা দু’বাহুতে জড়িয়ে রেখেছে দুই উলংগ সুন্দরী যুবতী। ছাড়া পাওয়ার জন্য তড়পাচ্ছে যুবতীরা। বজ্রের শব্দ ছাপিয়ে গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হল, ‘এদের ছিল রূপের অহংকার। খোদার দেয়া সৌন্দর্য সুষমাকে এরা অপবিত্র করেছে।’
এরপর দেয়ালে ভেসে বেড়াত সুন্দর যুবক আর রূপসী রমণীর দল। প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশী। গায়েবী শব্দ তুলে ধরত এদের পরিচয়। এসব যুবক যুবতী যুদ্ধ বিগ্রহে যায়নি। মানুষকে শুনিয়েছে প্রেম ও ভালবাসার বাণী। কেউ কারো মনে আঘাত দেয়নি। ওরা সন্তুষ্ট করেছে মানুষকে, আল্লাহও ওদের প্রতি সন্তুষ্ট তাই।
এরপর ওদের নিয়ে যাওয়া হত অন্য একটি কক্ষে। ওখানে ছিল মৃত মানুষের হাড়গোড়। সুন্দরী যুবতীরা এদিক ওদিক হাঁটছে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির ঝিলিক।
একটু পর ভেসে আসত গায়েবী শব্দঃ ‘হযরত ঈসা আসছেন। যুদ্ধ বিগ্রহ এবং ঘৃণা বিদ্বেষ মন থেকে মুছে ফেল। খলিফা আল আযেদ পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।
দৃষ্টিকাড়া রূপসীদের দিকে তাকিয়ে থাকতো দর্শকরা। কিন্তু ওদের বের করে দেয়া হত অন্য পথে। দর্শকদের মনে হত এইমাত্র ওরা স্বপ্ন দেখে জেগে অনভূতিতে ভরা। ওরা আবার ফিরে যেতে চাইত সে স্বপ্নের জগতে। কিন্তু ওদের আর সুড়ং মুখে যেতে দেয়া হতো না।
লোকজন ওখান থেকে বেরিয়ে বাড়ী ফিরে যেতো না কেউ। রাত কাটাতো প্রাসাদের বাইরে পর্বতে, উপত্যকায়। দু’তিন জন বসে ফিস ফিস করে কথা বলত। আল্লাহর বাণী নিয়ে যিনি এসেছেন গায়েবী শব্দ তার। তিনি বললেন, হযরত ঈসা আসছেন। খলিফা আল আযেদ আবার পৃথিবীতে এসেছেন।
আল আযেদের মৃত্যুর পর ফাতেমীরা খ্রিস্টান এবং ঘাতক দলের সাথে মিশে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানে তৈরী হচ্ছিল শক্তিশালী বাহিনী। দিন দিন পড়োবাড়ীর অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে রটে গেল ঈসা (আ.) আসছেন। তিনি আল আযেদকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরা শপথ নিয়েছে আয়ুবীর সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবে না। যুদ্ধ বিগ্রহ করা মহাপাপ। সালাহউদ্দীন একজন পাপী সম্রাট। সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির জন্যে তিনি যুবকদের স্বর্গের লোভ দেখিয়ে ফৌজে ভর্তি করছেন।
পড়োবাড়ী এখন এ অঞ্চলের লোকদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। অনেকে পার্বত্য এলাকায় স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেছে। দরবেশকে একনজর দেখার জন্য এরা বাড়ী ঘর ছেড়ে অপেক্ষার প্রহর গোণে দিনের পর দিন। কখন আসবে সেই শুভ লগ্ন, কখন বাবা দেখা দেবেন। জীবন থেকে মুছে যাবে অভাব, আশান্তি আর মলিনতা।
* * *
আহত বন্দীকে নিয়ে কায়রো পৌঁছলেন আলী বিন সুফিয়ান। বন্দীর নাম আকিল। আলাদা বাড়ীতে রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। বাড়ীর সামনে সেন্ট্রি দাঁড় করিয়ে দিলেন আলী। আকিল তখনও সুস্থ হয়নি, সে-ই পড়োবাড়ীর ঠিকানা দিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হল, আকিল সুস্থ হলে গোয়েন্দা দল তাকে নিয়ে পার্বত্য এলাকায় যাবে। উদ্ধার করবে পড়োবাড়ীর রহস্য। আলী কায়রো এসে সহকারী গোয়েন্দা প্রধান হাসান এবং পুলিশ প্রধানকে বললেন ওই এলাকায় যেন কোন লোক পাঠানো না হয়। ওখানকার লোকজনের ভেতর সেনাবাহিনী বিরোধী আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আলীর ধারণা ওখান থেকে রহস্যময় ষড়যন্ত্র বের করা যাবে।
আকিলের ধারণা সে মরে যাবে। বিলাপ করছিল সে। নিজের গ্রামের নাম নিয়ে বলছিল, ‘আমার বোনকে এনে দাও। আমি এ জীবনে ওকে আর কোনদিন দেখতে পাব না।’
তার এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি বন্দীর কাছ থেকে সব গোপন কথা বের করার চেষ্টা করছিলেন। লোকটি বোনের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। একে একে সবকিছুই বলে দিল আলীর কাছে। গোয়েন্দা প্রধান বুঝলেন ওর কাছে আর কোন তথ্য নেই। দু’জন দূতকে ডাকলেন আলী। আকিলের গাঁয়ের ঠিকানা, বোনের নাম ধাম দিয়ে বললেন, ‘ওর বোনকে সাথে নিয়ে আসবে। মিসরের দক্ষিণ পশ্চিমে ওর বাড়ী।’
দূত দু’জন সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে বসল।
সুবাক দুর্গে পৌঁছে গেছেন সুলতান আয়ুবী। তাকে হত্যা করার জন্য এত বড় একটা আক্রমণ হল চেহারায় উদ্বেগের চিহ্ন মাত্র নেই। রক্ষীদের কমান্ডার এবং কর্মকর্তাদের নির্ঘুম রাত কাটে। ভয়ে তটস্থ থাকে সবাই। এই বুঝি সুলতান তাদেরকে ডেকে বলবেন, কেন এমনটি হল? শাস্তি না দিলেও অন্যত্র বদলি করে দিবেন। কিন্তু সুলতান নির্বিকার। এ প্রসংগের ধারে কাছেও গেলেন না। কেন্দ্রীয় সেনা নেতৃবৃন্দকে ডেকে বললেন, ‘আপনারা দেখেছেন আমার জীবনের কোন ভরসা নেই। আমার যুদ্ধের চাল আপনাদের গভীরভাবে বুঝে নিতে হবে। শত্রুরা আরেকটা রণক্ষেত্র তৈরী করেছে। ওদের গুপ্তচরদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের গোয়েন্দাদের কেউ কি ফিরে এসেছে?’
‘মহামান্য আমীর। দু’জন গোয়েন্দা কর্মী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছেন।’ একজন সেনা অফিসার বললেন।
সুলতান তাদের ডেকে পাঠালেন। খ্রিস্টানদের সমস্ত পরিকল্পনা সুলতানকে অবহিত করা হল। নূরুদ্দীন জংগীর পাঠানো ফৌজের সালার এবং মিসর থেকে আসা ফৌজের সালারকে আসতে বলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
চারদিন পর আকিলের বোনকে নিয়ে দূত কায়রো ফিরে এল। সাথে চারজন লোক। ওরা বন্দীর চাচা এবং চাচাত ভাই। বোনটি মনকাড়া সুন্দরী। তার চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। সেই আকিলের একমাত্র বোন। বাবা মা নেই ওদের।
বন্দীর সাথে দেখা করতে চাইল ওরা। আলীর অনুমতি প্রয়োজন। বোনকে অনুমতি দিলেন গোয়েন্দা প্রধান। সংগীরা অনেক অনুরোধ করল। বলল, ‘আমরা তার সাথে কথা বলব না। এক নজর দেখেই চলে আসব।’
অনুমতি মিলল। কিন্তু সঙ্গে রইলেন আলী। পাঁচজনকেই বন্দীর কাছে নেয়া হল। আকিলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটা। ভায়ের চোখে মুখে চুমো খেয়ে কাঁদতে লাগল।
‘এদের সাথে হাত মেলাও।’ চাচা এবং চাচাত ভাইকে দেখিয়ে বললেন আলী।
করমর্দনের পর ওদের বের করে দেয়া হল। আলী বললেন, ‘এর সাথে আর কখনও দেখা করতে পারবে না, এবার তোমরা বাড়ী যেতে পার।’
গাঁয়ের পথ ধরল ওরা। মেয়েটা আলীর পায়ের কাছে বসে পড়ল।
‘আমার ভায়ের সেবা-শুশ্রূষা করার সু্যোগ দিন।’ অনুরোধ ঝরে পড়ল যুবতীর কণ্ঠ থেকে।
বোনের এ আবেগ ফেলতে পারলেন না আলী। একজন মহিলাকে ডেকে বললেন, ‘ওর দেহ তল্লাসী কর।’
দেহ তল্লাশী করা হল। এরপর মেয়েটাকে বন্দীর কাছে রেখে সবাই ফিরে গেলেন। কক্ষে ভাই-বোন ছাড়া কেউ নেই। কি হয়েছে জানতে চাইলে ভাই সব ঘটনা খুলে বলল।
‘এখন ওরা আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করবে?’
‘সুলতানের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছি, এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। অনুগ্রহ করে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও আজীবন কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।’
‘তবে কি আপনাকে আর কোন দিন দেখতে পাব না?’
‘না শারজা।’ বেদনা মাখা কণ্ঠে বলল আকিল। ‘কারাগারে আমি মরবও না আবার বাঁচবও না। কারাগার অত্যন্ত ভয়ংকর স্থান।’
শিশুর মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল শারজা। ‘আমি তখনই আপনাকে বাঁধা দিয়েছিলেম। এসব লোকের পাল্লায় পড়তে। কিন্তু আপনি বললেন আয়ুবী কে হত্যা করা বৈধ। আপনি ওদের লোভের ফাঁদে পা দিলেন। আমার কথা একবারও ভাবলেন না। এখন আমার কি হবে? আপনি ছাড়া কে আশ্রয় দেবে আমায়?’ আকিলের ভেতর চলছিল মানসিক দ্বন্দ্ব। কখনও ওর কণ্ঠে ধ্বনিত হত অনুশোচনা, ‘ওদের ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করেছি। শারজা! সালাহউদ্দীন মানুষ নয়, ফেরেস্তা। আমরা চারজন তাগড়া যুবক তার কিছুই করতে পারিনি। একটু আঁচড়ও লাগেনি তার দেহে। অথচ শূন্য হাতে সে একা আমাদের তিনজনকে মেরে ফেলল। আর আমি মৃত্যুর দুয়ারে।’
‘লোকে যে বলে, সালাহউদ্দীনের ঈমান অত্যন্ত মজবুত। কোন পাপী তাকে হত্যা করতে পারে না, এ কথা তাহলে মিথ্যে নয়। আপনারা চারজনই মুসলমান। তাকে মারতে যাওয়ার আগে একবারও ভাবলেন না, আয়ুবী একজন মুসলিম।’
‘আয়ুবী খলিফাকে অপমান করেছে।’ আকিলের কণ্ঠে উত্তেজনা। ‘তুমি জান না আল আযেদ আল্লাহর খলিফা।’
‘খলিফা যেই হোন আর আয়ুবী তার সাথে যে ব্যবহারই করুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু এখন আপনি যে আপনার একমাত্র বোনকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছেন, এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় বের করা যায় না না?’
‘হয়ত যায়। আমার শাস্তি মওকুফ করার আশ্বাস পেয়েই সব গোপন তথ্য প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমার পাপ এত মারাত্মক যে ক্ষমা না-ও করতে পারে।
এতক্ষণে আকিলের ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ ছিল। কিন্তু বোনকে কাছে পেয়ে আবেগে ও উত্তেজনায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল সে। এতে পেটের ক্ষতস্থানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তবুও কথা বন্ধ করল না বন্দী।
হঠাৎ ক্ষতস্থানে ব্যথা হতে লাগল। পেট চেপে ধরে বোনকে বলল, ‘শারজা! সম্ভবত আমি মরে যাব। বাইরে লোক আছে, ওকে বল ডাক্তার ডেকে দিতে।’
ছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল শারজা। বেরোতেই সামনে পড়ল এক সেন্ট্রির, বাইরে দাঁড়িয়ে অও পাহারা দিচ্ছিল। শারজা বলল, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ। প্লিজ, একটু একটু দেখুন।’
সেন্ট্রি শারজাকে ডাক্তারের বাসা দেখিয়ে বলল, ‘আমি যেতে পারছি না, ডাক্তারকে বললেই তিনি চলে আসবেন।’
কাছেই ডাক্তারের বাসা। শারজা তাকে ভাইয়ের কথা জানাল। ডাক্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, বন্দীকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। দৌড়ে বন্দীর কাছে পৌঁছলেন ডাক্তার। পেটের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বন্দীকে দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার ঔষধ খাওয়ানো হল। তারপর ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।
ঔষধের প্রভাবে আকিল ঘুমিয়ে পড়ল। অবাক চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল শারজা।
সুদর্শন যুবক ডাক্তারের জন্য তার হৃদয়ে সৃষ্টি হতে লাগল শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মিশ্রিত অনুভূতি। এত রাতে একজন অপরাধীকে চিকিৎসা করার জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে ডাক্তার ছুটে আসবেন, শারজা এতটা আশা করেনি। ব্যান্ডেজ বাধার সময় ডাক্তারের আন্তরিকতা ও লক্ষ্য করেছে। ব্যান্ডেজ শেষে দু’হাত ওপরে তুলে ডাক্তার অনুচ্চকণ্ঠে রোগীর জন্য প্রার্থনা করলেন। ‘জীবন এবং মৃত্যুতো তোমারই হাতে প্রভু! এ হতভাগাকে রহম কর। মালিক আমার, ওর জীবন ফিরিয়ে দাও। সুস্থ করে দাও ওকে।’
শারজার চোখ ভিজে উঠল। ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল ওর মন। হাঁটু গেড়ে বসে ডাক্তারের দু’হাতে চুমো খেল শারজা।
‘বন্দীর সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ ডাক্তারের প্রশ্ন করলেন।
‘আমি ওর বোন। ডাক্তার সাহেব! আমার ভায়ের জন্য আপনাদের এত দরদ, এ ভালবাসা কেন? তিনি আপনাদেরকে সব গোপন কথা বলে দিয়েছেন এই জন্য কি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন?’
‘ও কাকে কি গোপন তথ্য দিয়েছে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি ডাক্তার। ওকে সুস্থ করে তোলা আমার কর্তব্য। আমার কাছে মুমিন আর অপরাধীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’
‘ও কি অপরাধ করেছে হয়ত আপনি জানেন না। জানলে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না করে ওখানে লবণ ছিটিয়ে দিতেন।’
‘আমি সব জানি। তবুও আমি ওকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা করব।’
শারজা ডাক্তারের কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজের সব কথা ওকে খুলে বলল।
‘বাবা-মা মারা গেছেন, আমি তখন খুব ছোট। ভায়ের বয়স দশ কি এগার। তিনিই আমায় লালন-পালন করেছেন। আমি যুবতী হয়েছি। ভাইজান না থাকলে কেউ আমাকে হয়ত অপহরণ করে নিয়ে যেত। তিনি তার জীবন আমার জন্য উৎসর্গ করেছেন।’
গভীর মনযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছেন ডাক্তার। ওদের কথার শব্দে আহত লোকটা জেগে উঠতে পারে ভেবে দু’জন বারান্দায় চলে এলেন। অনেকক্ষণ পর যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। হাত ধরল শারজা, ‘আপনি চলে গেলে আমার ভয় করবে।’
‘কিন্তু তোমাকে আমি সাথে নিতে পারছি না, কারণ আমি একা থাকি। আবার এখানে তোমার সাথে রাতও কাটাতে পারছি না। ঠিক আছে, আরো কিছুক্ষণ থাকি।’
আবার বসে পড়লেন ডাক্তার। কথায় কথায় রাতের দুই প্রহর কেটে গেল। ডাক্তার শেষরাতে বাসায় ফিরলেন। পরদিন সূর্য উঠার আগেই আহত বন্দীকে দেখার জন্য আবার ফিরে এলেন ডাক্তার। নতুন করে ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। বন্দীকে দুধ এবং খাবার দেয়া হল। হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল শারজা। এমন খাবার কেউ বন্দীকে দিতে পারে ও জীবনে কখনও কল্পনাও করেনি।
নাস্তা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলেন আলী বিন সুফিয়ান। বন্দীকে দেখে ফিরে গেলেন আলী। থেকে গেলেন ডাক্তার।
শারজা আবার কথার ঝাপি খুলে দিল। তার জীবন-পাতা মেলে ধরল ডাক্তারের সামনে। অনেক বেলা করে ঘরে ফিরলেন ডাক্তার।
আকিল লক্ষ্য করল, সন্ধ্যা পর্যন্ত ডাক্তার তিন বার বন্দীকে দেখতে এসেছেন, অথচ আগে দিনে একবারের বেশী আসতেন না। ডাক্তার ফিরে গেলে আকিল বোনকে বলল, ‘শারজা! এই ডাক্তারের হাতে আমার জীবন। বুঝতে পারছি তোমাকে দেখার পর সে আমার চিকিৎসার ব্যাপারে বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি মরতে রাজি, কিন্তু ও তোমার কাছে যা চায় তা হতে দেব না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার জীবনের বিনিময়ে ও তোমার ইজ্জত নষ্ট করতে চাইছে।’
‘আপনি কি বলছেন ভাইয়া! আমি তো তাকে ফেরেস্তার মত পবিত্র মনে করি। আমি বড় হয়েছি। সবকিছু বুঝার বয়স হয়েছে। এই পর্যন্ত সে খারাপ ইশারা তো দূরের কথা, খারাপ কোন কথাও বলেনি। তার সাথে অনেক কথা বলেছি। তাকে আমার খারাপ মনে হয়নি।’
শারজার কথায় দ্বন্ধের মধ্যে পড়ে গেল আকিল। ডাক্তারের প্রতি তারও আগ্রহ বেড়ে গেল।
* * *
রাতে ডাক্তার আবার এলেন। আকিল ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শারজা। বারান্দায় চলে এল দু’জন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বললেন, ‘তোমার ভাইকে যে ওষুধ দিয়েছি সকালের পূর্বে জাগবে না। আমার সাথে বাসায় চল।’
খানিকটা সংকোচ করলেও শারজা ডাক্তারের প্রস্তাব অস্বীকার করতে পারল না। ডাক্তার সুদর্শন যুবক। এখনো বিয়ে করেননি। বাসায় একা থাকেন। শারজা যুবতি এবং সুন্দরী। মনে মনে ভাবল, আজ রাতেই হয়ত ডাক্তার নিজের মুখোশ খুলে দেবে।
বাসায় ফিরে দু’জন দু’টো চেয়ার টেনে বসল। ডাক্তারের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল নিরেট আন্তরিকতা এবং স্নেহ। আশ্চর্য হল শারজা। ডাক্তার এখনও তাকে খারাপ কোন প্রস্তাব দিচ্ছে না কেন? নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করল, ‘আমি একজন মরুচারী বেদুইন। গরীব যুবতী। এমন এক অপরাধীর বোন যে সম্রাটকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছে। আপনি কেন আমার সাথে এত সুন্দর ব্যবহার করছেন? একজন বন্দীর বোন এ স্নেহ পাওয়ার উপযুক্ত নয়।’
মৃদু হাসলেন ডাক্তার। কোন জবাব দিলেন না।
‘আমি একজন তরুণী এবং রূপসী, এই জন্যেই কি আমার জন্য এ আন্তরিকতা।’
‘তুমি রূপসী এবং যুবতী। তোমার তৃতীয় সৌন্দর্যের কথা তুমি জান না। তোমার বয়সী আমার একটা বোন ছিল। দেখতে অবিকল তোমার মত। তোমার মতই আমাদের পিতা-মাতা শৈশবে মারা গেছেন। সংসারে দু’জন ছাড়া কেউ ছিল না। বোনটাকে আমিই লালন-পালন করেছিলাম। আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলাম তার জন্য। বেঁচে ছিলাম ওর ভালবাসা নিয়ে। একবার ওর অসুখ হল। অনেক চিকিৎসা করলাম, কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। নিজের হাতেই ওকে কবর দিতে হয়েছে। আমি হয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ, একা।
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, চমকে উঠেছিলাম। মনে হল, আমার বোনটা আবার ফিরে এসেছে। তুমি দেখতে অবিকল আমার বোনের মত। যদি তুমি তোমার রূপ-যৌবনকে ভয় পাও, আমাকে সন্দেহ কর, তবে আর কখনও তোমার কাছে আমার স্নেহময় আবেগ প্রকাশ করব না। কথাও বলব না তোমার সাথে। ভয় নেই, পূর্বের আন্তরিকতা নিয়েই তোমার ভায়ের চিকিৎসা করব। তাকে সুস্থ করে তোলা আমার দায়িত্ব। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
শারজাকে বন্দীর কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন ডাক্তার। শারজার মনে এখন কোন সন্দেহ নেই। ডাক্তার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না নিশ্চিত সে।
পরদিন নিয়ম করে ডাক্তার এলেন। বন্দীকে ওষুধ দিয়ে ফিরে গেলেন। শারজার সাথে একটি কথাও বললেন না। শারজা বারান্দায় এসে ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল।
‘আপনি কি আমার সাথে রাগ করে চলে যাচ্ছেন?’ আমার সাথে একটি কথাও বলেননি কেন?’
‘তোমার সাথে রাগ করিনি শারজা। তবে তোমাকে কোন সন্দেহে ফেলতে চাই না।’
রাতে আকিল ঘুমিয়ে পড়ল। আলতো পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল শারজা। কি এক আকর্ষণে ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে। তার মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। হয়ত ডাক্তারই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন।
‘খলিফা কি আল্লাহর প্রেরিত দূত।’ প্রশ্ন করল ও।
‘খলিফাও একজন মানুষ। আল্লাহর প্রেরিত দূত হলেন নবী এবং রাসূলগণ। আমাদের নবী (সা.) পর্যন্ত এসে আল্লাহ্ প্রেরিত নবীর আগমন ধারা শেষ হয়ে গেছে।’
‘সালাহদ্দীন আয়ুবীও কি আল্লাহর দূত।’
‘না তিনিও আমাদের মত মানুষ। তবে উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। আল্লাহ এবং নবীর (সা.) বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’
‘সুলতান যে যুদ্ধ করছেন, মানুষ মারছেন, এটা কি বৈধ?’
‘মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর বিধান পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। এ প্রচেষ্টায় কেউ যদি বাঁধা দেয়, তা দূর করা ফরজ। সুলতান শুধু এ ফরজ আদায় করছেন। তিনি করও ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেননি, বরং ইসলামকে ঠেকাতে চাইছেন।’
এভাবেই অনেক প্রশ্ন করল শারজা। এখন সে সন্দেহ মুক্ত। সুলতান আয়ুবী সম্পর্কে তার এতদিনের ধারণা বদলে গেছে।
‘তা হলে আমার ভাই তো মহা অন্যায় করেছেন। আপনি যেভাবে বলছেন, এভাবে তাকে বললে তিনিও এ পাপের পথে পা দিতেন না। এখন তো তাকে ক্ষমা করা হবে না।’
‘হবে। সুলতান তাকে বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। তার উচিৎ পাপের প্রায়শ্চিত্য করা। আমার বিশ্বাস, সুলতান তাকে কোন শাস্তি দিবেন না।’
‘আমি জীবনভর আয়ুবী এবং আপনার খেদমত করব।’ কেঁদে বলল শারজা। ‘আমার ভাই আপনাদের গোলাম হয়ে থাকবে।’
ডাক্তারের একটা হাত দুহাতে তুলে নিয়ে ও বলল, ‘আপনি আমার কাছে যে মূল্য চাইবেন, আমি দেব। আপনার বাদী হয়ে থাকব সারা জীবন। বিনিময়ে আমার ভাইকে সুস্থ করে দিন। ওকে বাঁচিয়ে তুলুন।’
‘বিনিময় নেয়া হয় আল্লাহর কাছ থেকে।’
শারজার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তার বললেন। ‘বোনকে ভায়ের পাপের শাস্তি দেয়া হয় না। ভায়ের স্বাস্থের মূল্য বোন থেকে উসুল করা হয় না। পাপের প্রায়শ্চিত্য পাপ দিয়ে নয়। আমাদের সবার রক্ষক আল্লাহ্। প্রতিটি মুসলমান সকল নারীর ইজ্জতের রক্ষক। তোমরা আমাদের কাছে আমানত। তোমার ভাইয়ের সুচিকিৎসা করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর আমি যেন আমানতের খেয়ানত না করি। অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারি। তোমার ভায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া কর একজন অসুস্থ ভায়ের জন্য বোনের দোয়া আল্লাহ্ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।’
ডাক্তার মেয়েটাকে যেন যাদু করেছেন। তার মিষ্টি ব্যবহারের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। শারজা যা ভাবছিল ডাক্তার তা নন। ডাক্তারের নৈতিকতাই ওকে বেশী প্রভাবিত করেছে। নিঃসঙ্গ রাতে এমন এক সুন্দরী তরুণীকে একা পেয়েও ডাক্তার অশালীন কোন ইঙ্গিত করেননি। ডাক্তার চাইলে তাকে বাঁধা দেয়া সম্ভব ছিল না। ভায়ের চিকিৎসার জন্য হলেও তাকে ডাক্তারের প্রস্তাবে রাজি হতে হত। কিন্তু ডাক্তারের চোখে কামনার আগুন নেই। স্নেহ ভালোবাসার এক অব্যক্ত অনুভূতি তার চেহারায় আলো হয়ে জ্বলছে। মোহিত হল শারজা। কখন যে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে টের পেল না। ও হারিয়ে গেল ভাবনার অতলে। সম্বিত ফিরল ডাক্তারের ডাকে।
‘চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার ভাইকেও দেখে আসব।’
দু’জন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আকাশে চাঁদ উঠেনি। আবছা অন্ধকার। ওরা হাঁটছে ধীরে ধীরে। ওরা দু’বাড়ীর মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলছে। সামনের ছোট্ট গলিপথ পেরোলেই আকিলকে যেখানে রাখা হয়েছে সে বাড়ী। বাড়ীটাতে সব সময় সশস্ত্র সেন্ট্রির প্রহরা থাকে। দু’জনের কারো মুখে কোন কথা নেই। হাঁটছে নিঃশব্দে।
গলির মুখে এসে পড়েছে ওরা। আকস্মাত ওদেরকে পেছন থেকে জাপটে ধরল কেউ। কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হল চোখ-মুখ। ওরা এখন শব্দ করতে পারছে না। ডাক্তার একজন শক্তিশালী যুবক। আচমকা আটকে পড়ায় কিছুই করতে পারছেন না। আক্রমণকারীরা চারজন। ওরা দু’জনের হাত-পা বেঁধে ফেলল। এরপর দুটো দেহ কাঁধে তুলে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
খানিক দূরে দু’টা ঘোড়া দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারকে একটা ঘোড়ায় চাপিয়ে ওদের একজন পেছনে উঠে বসল। শারজাকে উদ্দেশ্য করে একজন বলল, ‘শব্দ করোনা শারজা। তোমার কাজ হয়ে গেছে। পঞ্চম ঘোড়াটায় উঠে বস।’
শারজার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হল।
‘ওকে ছেড়ে দাও।’ আক্রমণকারীদের বলল শারজা। ‘ওর কোন দোষ নেই, ও খুব ভাল মানুষ।’
‘ওকে আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ওদের একজন।
‘ওকে তোমাদের কি দরকার?’
‘শারজা!’ ভেসে এল অন্য কণ্ঠ। ‘চুপচাপ ঘোড়ায় উঠে বস।’
চকিতে ওদিকে ফিরে শারজা বলল, ‘আপনি!’
‘উঠে বস। সময় নষ্ট করো না।’ ও খুব ভাল সওয়ারী। কায়রো পেছনে ফেলে ঘোড়াগুলো এগিয়ে চলল মরুভূমির বালি মাড়িয়ে।
প্রভাত সূর্য উঁকি মারছে আকাশে। এখন সেন্ট্রি পরিবর্তনের সময়। নতুন প্রহরী ডিউটিতে এসে দেখল রাতের প্রহরী নেই। জানালা দিয়ে উঁকি দিল কক্ষের ভেতরে আহত বন্দী কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। গেটে গিয়ে দাঁড়াল নতুন সেন্ট্রি। সে জানত, বন্দীকে দেখার জন্য সকালেই ডাক্তার আসবেন। তারপরে গোয়েন্দা প্রধান। বন্দীর সাথে আছে তার বোন। তার অনুমতি ছাড়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু বোনকে কোথাও দেখা করল না। কিছুক্ষণ পর আলী এসে সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার কি প্রহরী দেখে চলে গেছে?’
‘ডাক্তার এখন আসেননি। আমি এসে রাতের প্রহরীকে পাইনি। বন্দীর বোনকেও কোথাও দেখছি না।’
আলী ভাবলেন, বন্দীর অবস্থা খারাপ বলে মেয়েটা হয়ত ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। শুধু মিসর নয়, মুসলিম বিশ্বের জন্য বন্দী অত্যন্ত মুল্যবান। তাকে দিয়ে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করতে হবে।
কক্ষের ভেজানো দরজা ঠেলে দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন আলী। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে বন্দী। এক ঝটকায় বন্দীর মুখের কম্বল সরিয়ে ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে এলেন। যেন মানুষ নয়, কম্বলের নীচে শুয়ে আছে এক বিষধর সাপ।
সেন্ট্রিকে ডাকলেন আলী। দৌড়ে ভেতরে ঢুকল প্রহরী।
‘ওকে চিনতে পারছ? রাতের সেন্ট্রি নয়তো!’
আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেল সেন্ট্রির চেহারা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘রাতে ও-ই ডিউটি করেছে। ও এখানে ঘুমিয়ে আছে কেন? বন্দী কোথায়?’
‘ও ঘুমায়নি, মারা গেছে।’
কম্বল তুলে একদিকে ফেলে দিলেন আলী। বিছানা রক্তে লাল হয়ে গেছে। প্রহরীর বুকের মাঝ বরাবর খঞ্জরের দুটো আঘাত। বারান্দা এবং বাইরের অবস্থা গভীর মনযোগ দিয়ে দেখলেন আলী। এক ফোটা রক্ত নেই কোথাও। তার অর্থ সেন্ট্রিকে জীবিত কক্ষে ঢোকানো হয়েছিল। খঞ্জর মারা হয়েছে বিছানায় শুইয়ে। চেপে ধরার কারণে দাপাদাপি করতে পারেনি, তা নয়তো এদিক ওদিক রক্তের ছিটে ফোঁটা দেখা যেত। মৃত্যুর পর গায়ের ওপর কম্বল চাপিয়ে বন্দীকে তুলে নেয়া হয়েছে। এ অপহরণে বোনটা সাহায্য করেছে। রূপের লোভ দেখিয়ে হয়ত সেন্ট্রিকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটার সংগীরা ওকে হত্যা করে ভাই-বোন দু’জনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বন্দীর গ্রাম থেকে আসা চারজন লোককে দেখা করার অনুমতি দিয়ে ভুল করেছেন বলে আফসোস হল আলীর। নইলে ওরা এখানকার অবস্থা, পাহারা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারত না। মেয়েটাকে তার সাথে থাকার অনুমতি দেয়াও ঠিক হয়নি। ও আসলেই বন্দীর বোন কিনা কে জানে? এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটাও ওদের দলেরই সদস্য।
নিজের ওপর ক্রোধ হচ্ছিল তার। অনুতাপ করছিলেন ভুলের জন্য। দক্ষ একজন গোয়েন্দা হিসেবে আলীকে ধোঁকা দেয়া সহজ নয়, অথচ এরা তাকে বোকা বানিয়ে গেল! এক প্রশ্নের জবাবে সেন্ট্রি বলল, ‘আগের রাতে আমার ডিউটি পড়েছিল। দেখেছি মেয়েটা ডাক্তারের বাড়ী গিয়ে অনেক রাতে ফিরে এসেছে।
আলীর মনে সন্দেহ জাগল। মেয়েটা রূপ যৌবন দিয়ে ডাক্তারকে হয়ত হাত করে নিয়েছিল। সেন্ট্রিকে বললেন, ‘ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো। দ্রুত যাবে।’
চলে গেল সেন্ট্রি। আলী বাইরে পায়ের চিহ্ন পরীক্ষা করতে লাগল। বন্দী আহত। নিশ্চয়ই একা পালায়নি। অস্পষ্ট পায়ের ছাপ থেকে আলী কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না। বন্দীর গ্রামে কমান্ডো অভিযান চালানো যায়। কিন্তু কায়রো থেকে সে গ্রাম অনেক দূরে। কি করণীয় কোন কূল কিনারা পেলেন না আলী।
ফিরে এল প্রহরী। বলল, ‘ডাক্তার বাসায় নেই। তার বাসার চাকর বলেছে, কিছুদিন থেকে একটা মেয়ে ডাক্তারের কাছে আসত। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলত। গত রাতেও মেয়েটা এসেছিল। অনেক রাতে দু’জনই বাসা থেকে বেরিয়েছে। আর ফিরে আসেনি।’
আলীর দৃঢ় বিশ্বাস জমল, ডাক্তারও বন্দীকে পালাতে সাহায্য করেছে। মেয়েটার রূপই এর জন্য দায়ী।
গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ডাকলেন আলী, বন্দীর পালিয়ে যাওয়ার কথা বললেন ওদের গোয়েন্দা কর্মীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। একস্থানে পাওয়া গেল অনেকগুলো ঘোড়ার পদচিহ্ন। আশ-পাশের লোকজন বলল, ‘গতরাতে অনেকগুলো ঘোড়ার পদশব্দ শোনা গেছে। ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে শহরের শেষ সীমা পর্যন্ত গেল গোয়েন্দা দল। সামনে যাওয়া অনর্থক। রাতের ঘোড়ার পদচিহ্ন এখন অনেকটা মুছে গেছে। তবে ওরা কোন দিকে গেছে বুঝা যাচ্ছে।
সংবাদটা মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের কানে তোলা দরকার। আলী ভাবলেন, বন্দীর দেয়া তথ্য নিশ্চয়ই ভুয়া। পালানোর পথ করার জন্যেই বন্দী অভিনয় করেছে। শুধু তাকে নয়, সুলতানকেও লোকটা বোকা বানিয়ে গেল। দুপুরের দিকে সংবাদ দেয়ার জন্য বেরিয়ে গেলেন আলী।
কায়রো থেকে অনেক দূরে ছ’টি ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে চলছে। একটার পিঠে আকিল, অন্যটায় ডাক্তার। ডাক্তারের হাত পা বাঁধা। আড়াআড়িভাবে উপুড় করে তাকে শোয়ানো হয়েছে। একদিকে মাথা এবং অন্যদিকে পা ঝুলছে। নিঃসাড় পড়ে আছেন তিনি। চোখ বাঁধা বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। ঘোড়া যখন মোড় ঘুরছে, উঁচু নীচু টিলা অতিক্রম করছে, অমনি শুধু অনুভব করছেন।
ডাক্তারের সাথে রয়েছে অপহরণকারীদের একজন। খুরের শব্দে মনে হচ্ছে পেছনে আরো ঘোড়া আসছে। একই গতিতে ঘোড়া ছুটেছে রাতভর। পথে কোথাও বিশ্রাম নেয়নি অপহরণকারীরা।
আকাশে উঠে এসেছে মরু সূর্য। কিন্তু থামার কোন লক্ষণ নেই। রোদের তেজ বাড়ছে। সূর্য এখন মাথার উপরে। পেছন থেকে ভেসে এল কানফাটা চিৎকার। কেউ পড়ে গেছে ঘোড়ার পিঠ থেকে।
তার ঘোড়াটিও থামল। পেছনে গেল খানিক। কেউ একজন বলল, ‘তুলে ছায়ায় নিয়ে চল। অজ্ঞান হয়ে গেছে। হায়, হায়! রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’
‘ডাক্তারের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দাও।’ মেয়েলী কণ্ঠ। ‘রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে আমার ভাই মরে যাবে।’
রাতভর তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটেছে। ঝাঁকুনিতে ফেটে গেছে আকিলের ক্ষতের সেলাই। লোকটি দাঁত কামড়ে ব্যথা সহ্য করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অত্যাধিক রক্তক্ষরণে অজ্ঞান হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে।
একটা গাছের ছায়ায় চলে এল ওরা। পানি দেয়া হল আকিলের মুখে। ভেতরে না গিয়ে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রক্তে লাল হয়ে গেছে তার কাপড়।
ডাক্তারের হাত-পা এবং চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হল। চোখ রগড়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন তিনি।
‘এদিক-ওদিক তাকিয়ো না। সোজা সামনে চল।’ পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে বলল একজন অপহরণকারী।
হাঁটা দিলেন ডাক্তার। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকিলকে ছায়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে বসে আছে শারজা। কাঁদছে। ডাক্তারকে দেখেই ও বলল, ‘দোহাই ডাক্তার, আমার ভাইকে বাঁচান।’
বসে রোগীর নার্ভ দেখলেন ডাক্তার। এদিক-ওদিক তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। এখনও পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে রেখেছে লোকটা। আকিলের শিরা থেকে হাত সরিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চকিতে পেছনে ফিরলেন। মুখোশ পরা চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একজনের হাতে খঞ্জর।
ক্রুদ্ধ স্বরে ডাক্তার বললেন, ‘গযব পড়ুক তোমাদের ওপর। বাঁচানোর পরিবর্তে লোকটাকে তোমরা মেরে ফেলেছ। তোমরা সবাই এর হত্যাকারী। আমি ওকে বিছানা থেকে নামতে দেইনি। তোমরা সারা রাত ঘোড়ার পিঠে রেখেছ ওকে। ক্ষতস্থান ফেটে দেহের সব রক্ত ঝরে ও মারা গেছে।’
লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শারজা। অনেক কাঁদল মেয়েটা। ওকে সরিয়ে লাশ ঘোড়ার পিঠে চাপানো হল। পাহাড়ের ঢাল থেকে সরে এসে পথে নামল কাফেলা। ডাক্তারের চোখ এবং হাত-পা বেঁধে দেয়া হল। এখনও শারজার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। ডাক্তার তার পেছনে বসা আরোহীকে বলল, ‘লোকটা সুস্থ হয়ে যেত। তোমরা মেরে ফেললে। সুলতান ওকে কোন শাস্তিই দিতেন না।’
‘আমরা ওকে বাঁচানোর জন্য আসিনি। ওকে নয়, ওর ভেতরের গোপন তথ্য অপহরণ করেছি। সে মরে গেছে এ জন্য আমাদের কোন দুঃখ নেই। আমরা খুশী। কারণ, তোমরা এবং তোমাদের সুলতান কোন গোপন তথ্য জানতে পারল না ওর কাছ থেকে।’
‘তোমরা আমাকে কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছ?’
আমরা তোমাকে নবীদের মত সম্মানে রাখব। মরুর সামান্য বাতাসও তোমাকে স্পর্শ করবে না। পথে রোগীর কোন সমস্যা হলে তুমি চিকিৎসা করবে, এ জন্যই তোমায় এনেছি। তখন ভাবিনি, তোমার কাছে ওষুধ বা যন্ত্রপাতি কিছুই নেই, কি দিয়ে চিকিৎসা করবে?’
মেয়েটাকে আনার প্রয়োজন ছিলো, তোমাকে ছেড়ে ওকে নিয়ে এলে তোমাদের গোটা সেনাবাহিনী আমাদের ধাওয়া করতো। আমাদের যাত্রা নিরাপদ করার জন্যই তোমাকে আনতে হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের একজন ভাল ডাক্তারও দরকার। এখন থেকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে।’
‘দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এমন কোন লোকের চিকিৎসা আমি করব না। তোমরা খ্রিস্টান এবং সুদানীদের বন্ধু। ফাতেমীদের সাহায্যকারী। তোমরা ওদের হাতের পুতুল। ওদের নির্দেশে তোমরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো।’
‘তবে তো তোমাকে মরতে হবে।’
‘তাই আমার জন্য ভাল।’
‘তোমার সাথে এমন ব্যবহার করব যা ভাল না। তখন আমাদের প্রতিটি নির্দেশ পালন করতে তুমি বাধ্য হবে। তবে আমার মনে হয়, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার কোন প্রয়জনই পড়বে না। তুমি সুলতান আয়ুবীর রাজত্ব দেখেছ, আমাদেরটা দেখলে বলবে এখান থেকে যাব না। এ তো এক স্বর্গ। আমাদের প্রস্তাব না মানলে নরকের ছবিটাও এক নজর দেখিয়ে দেব।’
ঘোড়া ছুটছে। চোখ বাঁধা থাকায় ডাক্তার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কল্পনায় নিজের ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করছেন শুধু। শারজার কথা বার বার মনে পড়ছে। কিন্তু হতাশ হচ্ছেন এই ভেবে যে, মেয়েটা হয়ত ওদের দলেরই সদস্য। ও তাকে কোন সাহায্য করবে না।
* * *
সীমান্তে প্রহরাবত মুসলিম সৈনিকদের ভয়ে অপহরণকারীদেরকে অনেক পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে। দিনভর একটানা চলেছে সন্ধ্যার পরও থামেনি। মাঝরাতে কাফেলা একটা উপত্যকায় এসে থামল। অন্ধকার রাত। ডাক্তারকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে চোখ এবং হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সামনে দিল খাবার এবং পানীয়। পথশ্রমে ক্লান্ত সবাই। ঘোড়াগুলোর জিন খুলে পানি খাওয়ানো হল। ঘাস পাতা দিয়ে বেঁধে রাখা হল একটু দূরে।
খাওয়ার পর হাত-পা বেঁধে ডাক্তারকে ওরা শুয়ে পড়তে বলল। ওরাও শুয়ে পড়ল। গতরাতে কেউ ঘুমুতে পারেনি, শোয়ার সাথে সাথে ঘুম নেমে এল সবার চোখে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের চোখ খুলে গেল। ভাবলেন হত্যা করার জন্য সম্ভবত তাকে জাগানো হচ্ছে। মরার জন্য ডাক্তার তৈরী। কে যেন পায়ের বাঁধন খুলছে। পায়ের কাছ থেকে ছায়ামূর্তি হাতের কাছে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে হাতের বাঁধনও খুলে ফেলল। এরপর ডাক্তারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘দুটো ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়েছি।’ শারজার কণ্ঠ। ‘নীরবে আমার সাথে আসুন। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। এখুনি পালাতে হবে। ওরা অজ্ঞানের মত ঘুমুচ্ছে। সহজে জাগবে না।’
নিঃশব্দে শারজাকে অনুসরণ করলেন ডাক্তার। নরম বালিতে হাঁটার শব্দ হচ্ছে না। সামনে দুটো ঘোড়া প্রস্তুত। দু’জন দুটোর পিঠে উঠে বসল।
‘ঘোড়া ভাল চালাতে না পারলেও ভয় নেই’, শারজা বলল, ‘পড়বেন না। লাগাম ঢিলা করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিন। ডানে বায়ে ঘুরাতে পারবেন তো?’
কোন কথা না বলে ঘোড়া ছুটালেন ডাক্তার। শারজা বলল, ‘আমার পেছনে আসুন, আমি পথ চিনি। সাবধান, অন্ধকারে যেন বিচ্ছিন্ন হবেন না।’
অশ্বের ক্ষুরের শব্দে জেগে উঠল অপহরণকারী দল। কারা যাচ্ছে প্রথম দিকে বুঝতে পারল না ওরা। শারজার পালানোর প্রশ্নই ওঠে না। ডাক্তারের হাত পা বাঁধা। তাহলে কে যাচ্ছে? চিন্তা-ভাবনা করে কিছু সময় নষ্ট হল ওদের। ঘোড়ার কাছে ছুটে গেল ওরা। দুটো ঘোড়া নেই। খোঁজাখুজি করে বুঝল, ডাক্তারও নেই, শারজাও নেই।
ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাল ওরা। দ্রুতগামী দুই ঘোড়সওয়ার তখন অনেক দূর চলে গেছে। তবুও ওরা বারবার পেছন ফিরে চাইছিল।
অনেকক্ষণ শারজাকে বলল, ‘এখানে কোথাও সীমান্ত ফাঁড়ি রয়েছে। কোথায় জানি না।’ জানে না শারজাও। ফাঁড়ির রক্ষীদের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অনেক পথ ঘুরে ওরা এগিয়েছে। শারজা বলল, ‘সোজা পথে আমাদের গ্রাম এত দূরে নয়। আপনি নিশ্চিত থাকুন আমরা কায়রোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
দুপুরে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিদ্দীনের কাছে পৌঁছলেন আলী বিন সুফিয়ান। তাকে সব কথা খুলে বললেন। গভর্নর বললেন, ‘চারজন অপরিচিত লোককে বন্দীর সাথে দেখা করতে দেয়া এবং সন্দেহভাজন মেয়েটাকে তার কাছে থাকতে দেয়াটা ছিল মারাত্মক ভুল। আপনার মত অভিজ্ঞ ব্যক্তি এ ভুল করার পরও আমি ততটা আশ্চর্য হইনি, যতটা আশ্চর্য হয়েছি ওদের দুঃসাহস এবং দক্ষতা দেখে।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন’, আলী বললেন, ‘সেন্ট্রিকে হত্যা করে বন্দীকে অপহরণ করা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক কাজ।’
‘আমার ধারণা ডাক্তার এবং যুবতী মেয়েটা এ অপহরণকে সহজ করে দিয়েছে। সুলতান আমাদের এ দুর্বলতা নিয়েই উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, নারী এবং ক্ষমতার লোভ এ জাতিকে ধ্বংস করবে। আমি ডাক্তারকে একজন ভাল মানুষ মনে করতাম। অথচ অবাক লাগছে, একটা সাধারণ মেয়ে তাকে অন্ধ করে ফেলল!’
‘বন্দীর গ্রামের ঠিকানা সংগ্রহ করে আমি এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের যে পর্বত ঘেরা পড়োবাড়ীর কথা বন্দী বলেছে সে ব্যাপারে কি চিন্তা করেছেন?’
‘মনে হয় বন্দী মিথ্যা বলেছে। জীবন বাঁচানোর জন্যই একটা মিথ্যে গল্প ফেঁদেছিল ও, এরপরও খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য ওখানে গোয়েন্দা দল পাঠাব।’
প্রহরী ভেতরে এসে বলল, ‘ডাক্তার একজন তরুণীকে নিয়ে এইমাত্র এখানে এসে পৌঁছেছেন, উনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।’
এ সংবাদ শুনে থ’হয়ে গেলেন দু’জনই। একজন আরেকজনের দিকে চাইতে লাগলেন। কারও মুখে কথা সরছে না।
‘অন্য কেউ হবে হয়ত’ বলে বেরিয়ে গেলেন আলী। পেছনে গেলেন গভর্নর। ডাক্তার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সাথে বন্দীর বোন শারজা। ধূলোমলিন বিধ্বস্ত চেহারা ওদের, ঘোড়াগুলো হাপাচ্ছে।
‘বন্দীকে কোথায় রেখে এসেছ?’ আলীর কণ্ঠে ঝাঝ। হাত দিয়ে ইশারা করে ডাক্তার বুঝালেন, তারা ভীষণ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।
ভেতরে নিয়ে তাদেরকে পানি এবং খাবার দেয়া হল। খাওয়া শেষে ডাক্তার সব ঘটনা খুলে বললেন।
‘আহত বন্দী আমাদের সাথে রয়েছে জানতাম না। পরদিন ঘোড়া থেকে পড়ে লোকটা যখন মারা গেল তখনই শুধু জেনেছি বন্দীকেও অপহরণ করা হয়েছে।’
এরপর শারজার জবানবন্দী নেয়া হল। তার কথা শুনে আলী বুঝলেন, যতটা চতুর মনে করা হয়েছিল ও ততটা নয়। গ্রামের একজন সাধারণ মেয়ে হলেও সাহস আছে।
শারজা বলল, ‘ভাইয়ের আশ্রয়ে এতদিন আমি বেঁচে ছিলাম তার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হতাম না। ডাক্তার নিষ্পাপ, আন্তরিকতা ও দরদ নিয়েই তিনি ভাইয়ের চিকিৎসা করেছেন। তার পবিত্র ব্যবহারে আমি মোহিত হয়েছি। ভেবেছি লোকটা মানুষ নয়, ফেরেস্তা। আমার সাথে যে চারদিন লোক এসেছিল। ওদের সাথে আমার আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। যারা সুলতানকে হত্যা করতে চায় এরা তাদের দলের লোক।
আপনার লোকেরা যখন আমাদের গ্রামে গিয়েছিল তখন এ চারজন গ্রামে ছিল। ভায়ের বন্দী হওয়ার কথা শুনে ওরা সাথে এসেছে। ভাইয়া ওদের অনেক গোপন কথা জানতেন। ওদের আশংকা ছিল ভাইয়া না আবার সব প্রকাশ করে দেয়। ভাইয়া কোথায় এবং কি কাজে গিয়ে আহত হয়েছেন তাও তারা জানত। তাই সুযোগ পেলে ভাইয়াকে অপহরণ করার টার্গেট ছিল তাদের।
আমারও ইচ্ছা ছিল ভাইয়াকে ওরা অপহরণ করুক। দুটো কারণে আমি ভাইয়ার কাছে থাকতে চেয়েছি। প্রথমতঃ তার সেবা করা। দ্বিতীয়তঃ সুযোগ পেলে তাকে অপহরণ করতে সাহায্য করা।
আমার সাথে আসা সে চারজন লোক গ্রামে ফিরে যায়নি। কায়রোতে আত্মগোপন করেছিল ওরা। আমার ইঙ্গিত পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। জিন্তু ডাক্তার আমার চিন্তা বদলে দিলেন। তিনি বলেছেন, ভাইয়াকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। সুলতান আয়ুবী সম্পর্কে আমাদের এতদিন যা বলা হয়েছিল, ডাক্তার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বললেন। আমরা সুলতানকে হত্যা করা বৈধ মনে করতাম, কিন্তু ডাক্তার বললেন, তিনি ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছেন। ডাক্তারের উন্নত নৈতিক চরিত্র সুলতান এবং ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে দিল। অধিকাংশ সময় তার কাছে গিয়ে এসব কথা শোনার জন্য বসে থাকতাম।
একদিন ডাক্তারের বাসায় যাচ্ছি। পথে সেই চারজনের সাথে দেখা হল। ওরা ভাইয়াকে অপহরণ করার কথা বলল। আমি বললাম, ‘আমার ইচ্ছে পরিবর্তন করেছি। ভাইয়া এখানেই থাকবেন।’
ওরা বলল, ‘শহরে এসে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।’
ওদের সহযোগিতা না করলে ওরা আমাকে হত্যা করে ভাইয়াকে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিল।
আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। বললাম, ‘অপহরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করবো না।’ ওদের একজন বলল, ‘ডাক্তারের বাসায় তোমার আসা-যাওয়া দেখে ভেবেছিলাম তুমি তাকে ফাঁসিয়েছ। এখন দেখছি নিজেই তার জালে ফেঁসে গেছ।
আমি ওদের ধমক দিয়ে বললাম, ‘এসব কথা আবার বললে পরিণতি ভাল হবে না। ডাক্তারের সাথে আমার খারাপ কোন সম্পর্ক নেই।’ ওরা এতটা দুঃসাহসী হয়ে এ কাজ করবে ভাবিনি, এ জন্য ডাক্তারকেও বলিনি কিছু।
রাতে ডাক্তারের বাসা থেকে বাসা থেকে ফেরার সময় ওদের হাতে ধরা পড়লাম। একটা ঘোড়ার পিঠে আমার ভাইকেও দেখলাম। ভাইয়া মুক্ত হয়েছেন দেখে খুশীও হলাম। পালানোর জন্য প্রস্তুত হলাম। ডাক্তারকে অপহরণ করুক আমি চাইনি। আমার বাঁধা উপেক্ষা করে ওরা তার হাত-পা বেঁধে ঘোড়ায় তুলে নিল।
ভাইয়াকে কিভাবে অপহরণ করেছে জানতে চাইলাম। ওরা বলল, ‘আমাদের দু’জন গিয়ে সেন্ট্রির কাছে একটা ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। সেন্ট্রি তাদেরকে ঠিকানা বুঝাতে লাগল। এ সু্যোগে দু’জন ঢুকে গেল ভেতরে বাইরের দু’জনও সেন্ট্রিকে নিয়ে ভেতরে গেল। ভাইয়া তাদেরকে দেখে উঠে বসলেন।
ভাইয়ার বিছানায় সেন্ট্রিকে শুইয়ে দেয়া হল। খঞ্জর দিয়ে বুকে দুটো আঘাত করে বেরিয়ে এল ওরা। ওরা ধারণা করেছিল, আমি ডাক্তারের বাসায় রয়েছি। ওদের ভয় ছিল, আমি অপহরণে বাঁধা দেব। এজন্য দু’জন লুকিয়ে রইল ডাক্তারের বাসায় যাওয়ার পথে। ডাক্তার যখন আমায় এগিয়ে দিতে আসছিলেন তখনই ওরা আমাদেরকে ধরে ফেলল। আর সাথে সাথেই সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল।
* * *
দু’জনের জবানবন্দীর ওপর নির্ভর করেলেন না গোয়েন্দা প্রধান। এদের ফিরে আসাও ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে।
দু’জনকে আলাদা কক্ষে নিয়ে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আলী বাধ্য হলেন ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করতে।
মেয়েটার প্রসঙ্গে ডাক্তার বললেন, ‘এর সাথে আবেগ জড়িত। ও দেখতে অবিকল আমার মৃত বোনের মত। এ জন্য ওকে আন্তরিকতা দেখিয়েছি, নিয়ে গিয়েছি আমার বাসায়। বন্দীর ঘরেও ওর কাছে বেশী সময় কাটাতাম। আমার ভেতর কোন পাপ বোধ ছিল না, এ কারণে ও বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বাস করেছে আমাকে। জানতে চেয়েছিল অনেক কিছু। ও মুসলমান এবং গ্রামের এক সহজ সরল মেয়ে। সুলতান সম্পর্কে ওর ভেতর কাজ করছিল বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া। গ্রামে যা শুনেছে তাই বিশ্বাস করেছে। আমি ইসলাম, সুলতান এবং মিসর সম্পর্কে ওর খারাপ ধারণা দূর করেছি। তার কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, তাদের এলাকায় ইসলাম এবং সুলতানের বিরুদ্ধে প্রাকাশ্য ষড়যন্ত্রে চলছে।
শারজার নিয়মিত জবানবন্দী গ্রুহণ না করে আলী তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওর জবাবেও পড়োবাড়ীর প্রসঙ্গ এসেছে। শারজা নিজেও পড়োবাড়ীর রহস্যময় পীরের ভক্ত।
ও বলল, ‘ভাইয়া সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। বাড়ীতে আমি থাকতাম একা। গ্রামের লোকেরা আমাকে ওখানে চলে যেতে বলেছে পবিত্র বাবা নাকি সুন্দরী যুবতী কুমারীদের পছন্দ করেন। আমাদের গ্রামের ক’জন সুন্দরী যুবতী রহস্য ঘেরা বাড়িতে গিয়ে ফিরে আসেনি। এক ছুটিতে ভাইয়া বাড়ী গেলেন। আমি পড়োবাড়ীতে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি নিষেধ করলেন।
পড়োবাড়ী সম্পর্কে শারজা পরিষ্কার করে কিছুই বলতে না পারলেও ওখানে কি হচ্ছে বুঝা যায়। ডাক্তারের প্রসংগ তোলা হলে ও বলল, ‘অপহরণকারীরা তাকে বন্দী করে রাখলেও আমি তাকে মুক্ত করে দিতাম। আমি বাঁচব কি মরব এ তোয়াক্কা করতাম না।
ভাইয়ার মৃত্যুর পর গ্রামে যাবার আর কোন আকর্ষণ আমার নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম পথেই ডাক্তারকে মুক্ত করব। ভেবেছিলাম অপহরণকারীরা আপন। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, ওরা পাপী এবং অপরাধী। নিজের দেশের বিরুদ্ধে ওরা ষড়যন্ত্র করছে। পরে বুঝেছি, ভাইয়ার জন্য ওদের কোন আন্তরিকতা নেই। ভাইয়া তাদের গোপন তথ্য জানতেন বলেই তাকে ওরা মেরে ফেলেছে।
‘এখন কি করবে?’ প্রশ্ন করলেন আলী। ‘নিজের ব্যাপারে কি ভেবেছ?’
‘আমি সারা জীবন ডাক্তারের পায়ের ওপর পরে থাকব। তিনি আগুনে ঝাপ দিতে বললে তাও দেব। আমার চোখে ছিল পাপের পর্দা। ডাক্তার তা সরিয়ে দিয়েছেন। আপনারা যদি রহস্যঘেরা বাড়ীতে যেতে চান, আমি নিয়ে যাব। আমাদের এলাকায় যারা সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে আমি সবাইকে চিনি। ওদের গ্রেফতার করতে চাইলে আমি সহযোগিতা করব। এ জন্য মরতে হলেও পিছপা হব না। ওরা দেশ ও জাতির শত্রু এ কথা ডাক্তার আমাকে ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আলীর পরামর্শে পদস্থ সেনা অফিসার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মিটিং ডাকা হল। আলোচনা হল পরিস্থিতি নিয়ে।
অধিকাংশ সদস্যের অভিমত হল, তকীউদ্দীন যেহেতু মিসরে নতুন, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ। এক বিশাল এলাকা জুড়ে যেহেতু ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছে, এত লোকের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ হবে না। মনে হচ্ছে রহস্যময় বাড়ী ঘিরা নতুন মতাদর্শের জন্ম নিয়েছে। মতাদর্শের অনুসারীরা এর বিরুদ্ধে কোন সেনা অভিযান সহ্য করবে না। ওরা দ্বীনের সত্যিকার কথা তুলে ধরে আবেগকে আহত করা যাবে না।
কেউ পরামর্শ দিলেন, ‘ঘটনা সুলতানকে অবহিত করে তার নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।’
‘এর অর্থ হচ্ছে আপনারা মানুষকে ভয় পাচ্ছেন।’ মুখ খুললেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর। যে আল্লাহ্ এবং রাসুলের দ্বীনকে বিকৃত করা হচ্ছে সে ব্যাপারে আপনাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। মিসরে কি হচ্ছে সব সুলতানকে জানিয়ে তাকে বিব্রত করা ঠিক হবে না। সুলতান এক শক্তিমান শত্রুর মোকাবেলা করছেন তা আপনাদের অজানা নয়। তাকে কি বুঝাতে চাইছেন আমরা দু’চার হাজার শত্রুর ভয়ে আতংকিত! আমি সরাসরি এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে চাই।’
‘অপরাধ নেবেন না মাননীয় আমীর!’ বললেন একজন সেনাপতি। ‘আমাদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের অভিযোগ হচ্ছে আমরা তরবারীর জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা এ অপবাদ মুছে ফেলতে চাই। আমরা ওখানে যাব প্রেম এবং ভালবাসার বাণী নিয়ে।’
‘তাহলে কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন?’ গভর্নরের কণ্ঠে তিরস্কার। ‘এত টাকা খরচ করে কেন সেনাবাহিনী লালন পালন করা হচ্ছে? সেনাবাহিনীকে ছুটি দিয়ে একদল ধর্মপ্রচারক তৈরী করি। ওরা গ্রামে গ্রামে, দেশে দেশে ঘুরে ধর্ম প্রচার করবে। অস্ত্রভান্ডার নীল দরিয়ায় ফেলে দিয়ে বলুন সবাই দরবেশ হয়ে যাই।’
গভর্নরের কণ্ঠে উথলে উঠল এক রাশ আবেগ। ‘রাসূল (সা.) এর বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের তরবারী উন্মুক্ত হলে ইসলামের তরবারী কোষমুক্ত থাকবে না। একবার যদি ইসলামের তলোয়ার কোষমুক্ত হয় তবে নবীর (সা.) সামনে মাথানত করতে অস্বীকারকারী প্রতিটি বেঈমানের শিরোচ্ছেদ করা হবে। কালিমার বিরুদ্ধাচারণকারী প্রতিটি জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলা হবে।
ইসলামের তরবারীর জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ অভিযোগকারীদের কাছে আমরা ক্ষমা চাইতে যাব না। কেন সংকীর্ণ হয়ে এসেছে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা? স্বয়ং মুসলমানই কেন ইসলামের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে! কারণ, খ্রিস্টান যুবতীদের রূপ, মদ, সম্পদ, আর ক্ষমতার মোহ মুসলমানদের তরবারী ভোঁতা করে দিয়েছে। যুদ্ধ আমাদের ইতিহাস।
যেহেতু যুদ্ধের ময়দানে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না তাই বিভিন্ন অভিযোগ দিয়ে ওরা আমাদের ইতিহাসের ঐতিহ্যকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে। ওদের পদাতিক এবং নৌ-অভিযান ব্যর্থ। আমাদেরকে নিঃশেষ করার জন্য ওরা বিছিয়েছে ষড়যন্ত্রের জাল। নারী, মদ আর সম্পদের মাধ্যমে দ্বীনের সামনে দাঁড় করিয়েছে বাধার প্রাচীর।
আমাদের চরিত্র, আমাদের নৈতিকতা আর আমাদের ঈমানী চেতনা ধ্বংস করার জন্য সামনে এগিয়ে দিচ্ছে রূপসীদের রাঙ্গা ঠোঁটের মৃদু হাসি। আপনারা এদের বিরূদ্ধে তরবারী কোষমুক্ত করতে নিষেধ করছেন!
শুনুন আমার বন্ধুরা! ভালবাসার অভিনয় করে শত্রু আপনাদের হাত থেকে তরবারী ছিনিয়ে নিতে চাইছে। আঘাত করতে চাইছে আপনাদের পিঠে। ‘কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে অন্য গাল পেতে দাও’, ওদের এ শ্লোগান একটা প্রতারণা। ক্রাকের মুসলমান কি অবস্থায় আছে আপনারা জানেন না? ওদের তৈরী বেগার ক্যাম্প সুবাকে দেখেননি? ওখানে লুণ্ঠিত হয়েছে মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। অধিকৃত ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমান নারীরা হারাচ্ছে ইজ্জত। প্রচন্ড আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে ওরা।
খ্রিস্টানরা মুসলমানদের কাফেলা থেকে যুবতী এবং সুন্দরী মেয়ে ও শিশুদের অপহরণ করে নেয়ে যাচ্ছে। এসব জনোয়ারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে আপনারা নিষেধ করছেন? বলছেন এ অন্যায়! এ অন্যায় করতে আমি লজ্জিত হব না। নিরস্ত্র মুসলিম রক্তে রংগীন হচ্ছে খ্রিস্টানদের তরবারী। ওদের অপরাধ, ওরা আল্লাহ্ এবং রাসূলকে বিশ্বাস করে, ভালবাসে। ওরা ক্রুশ পুজা এবং শিরক করে না। যেখানে আল্লাহর বাণী কায়েম হবে শুধু সেখানেই তোমাদের তরবারী কোষবদ্ধ হবে।
‘ওদের আবেগকে আহত করা যাবে না’ আমি এ কথায় বিশ্বাসী নই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসক আর অযোগ্য আমীর ওমরাহর দল আকর্ষণীয় কথা বলে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। মানুষের মিথ্যে আকীদা বিশ্বাস ওদের পূঁজি। জনগণকে কুসংস্কারের সাগরে ডুবিয়ে নিজের লালসা এবং ভোগ বিলাসে মত্ত থাকলে চলবে না। সত্যের পথে চলতে গিয়ে কারও কারও কষ্ট হবে। এ ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।
কয়েকজনের সন্তুষ্টির জন্য জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারি না। কিছু মানুষের আবেগ আহত হবে বলে দেশের এক বিশাল এলাকা ষড়যন্ত্রকারী গাদ্দারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। আপনারা দেখেছেন ওখানকার মানুষ সহজ সরল এবং অশিক্ষিত। গোত্রপতিরা ধর্মের ইজারাদার হয়ে বসে আছে। শত্রুর পক্ষ হয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।’
সভার সদস্যগণ কল্পনাও করতে পারেনি গভর্নর এমন কঠিন পদক্ষেপ নিবেন। তিনি যে সব যুক্তি পেশ করেছেন তা খন্ডন করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অন্য কোন পরিকল্পনা পেশ করার সাহস পায়নি কেউ।
গভর্নর বললেন, ‘বর্তমানে মিসরে অবস্থানগত সেনাবাহিনীর ময়দানের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এদের মধ্য থেকে পাঁচশত ঘোড় সওয়ার, দু’শ উস্ট্রারোহী এবং পাঁচশত পদাতিক সৈন্য আজ সন্ধ্যার মধ্যে রওয়ানা করবে। এরা রহস্য ঘেরা বাড়ী থেকে এতদূর দূরে থাকবে, যেন, প্রয়োজনে আক্রমণ করতে পারে।
দামেশক থেকে যে দু’শ সওয়ার এসেছে তারা পার্বত্য এলাকায় গিয়ে পড়োবাড়ী অবরোধ করবে। বাড়ীর ভেতরে চলবে কমান্ডো অভিযান। ওরা তৈরী করে একদল চাটুকার। চাটুকারের দল ঘুরে ঘুরে প্রচার করে, ওলি যা বলেছেন তা আল্লাহর কথা। আমির ওমরা বা রাজার কথা না মানলে পাপ হবে।
এ ভাবেই মানুষ লম্পট পাপীদের গোলামীর শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে। সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটো শ্রেণীতে। একদল শাসক, আর একদল শাসিত। একদল অত্যাচারী, অন্যদল অত্যাচারিত। তখন জনগণ হয় ক্ষমতাসীনদের বলির পাঠা।
আমরা দেখছি শত্রু আমাদের মূলে আক্রমণ করছে। আমাদের ভাইদেরকে নিয়ে যাচ্ছে কুফরীর গহীন অন্ধকারে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এর অর্থ হবে আমরা বেঈমানদের সহযোগিতা করছি। আমার ভাই সুলতান আয়ুবী বলেছেন, গাদ্দারী এবং গাদ্দারীতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।
আমি দেখতে পাচ্ছি, সমাজে শাসক এবং শাসিত এ দুটো শ্রেনী সৃষ্টি হয়েছে। শাসক মদের পিয়ালায় ডুবিয়ে দেবে দেশের সম্পদ। অনাহারে অর্ধাহারে মারা পড়বে জনগণ। ভাইজানের কথাই ঠিক। তিনি বলেছেন, স্বীয় জাতি এবং ধর্মের ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ আমাদের। জাতির চিন্তা চেতনা এবং কর্মধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী প্রজন্ম আমাদের কবরের কাছে জবাব চাইবে। জাতি এবং ধর্মের জন্য কল্যাণকর কোন কাজ থেকে আমাদেরকে দূরে থাকলে চলবে না। সভা শেষ হল। সবাই যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
* * *
দলে উপদলে বিভক্ত করে সুলতান সেনাবাহিনীকে সমগ্র মরু এলাকায় ছড়িয়ে দিলেন। দখল করে নিলেন পানি এবং মরুদ্যান। শত্রু যেন এসব এলাকায় আসতে না পারে এ জন্য পাহারা দেয়ার জন্য স্থাপন করলেন মেনজানিক কামান। প্রস্তুত রইল তীরন্দাজ। পর্বত চূড়ায় বাংকার তৈরী করা হল।
মুসলিম ফৌজকে নির্দেশ দেয়া হল, শত্রু মুখোমুখি আক্রমণ করলে চার দিকে ছড়িয়ে যাবে। ওরাও তখন ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। সুলতান এমন ভাবে সৈন্যদের সংগঠিত করলেন এমন ভাবে সৈন্যদের সংগঠিত করলেন, কোনটা সামনের দিক আর কোনটা পেছনের বুঝার কোন উপায় রইল না।
সেনাবাহিনীর এক অংশ রিজার্ভ রাখা হল প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য। প্রস্তুত রইল কমান্ডো বাহিনী। সুলতান খ্রিস্টানদের তৎপরতার বিস্তারিত খবর পাচ্ছিলেন। ওদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল সুবাক দুর্গ পুনরুদ্ধার করা। সুবাক অবরুদ্ধ হলে সুলতানের ক্ষুদ্র বাহিনীকে মরুভুনিতেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে।
ভেতরের সাহায্য থেকে সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনলেন। বাহ্যত সুবাক এখন অরক্ষিত। খ্রিস্টান গুপ্তচর ছুটল ক্রাকে। বলল, ‘সুবাক এখন অরক্ষিত। নিরদ্ধিধায় আক্রমণ করা যায়। বিনা বাধায় সুবাক দুর্গ দখল যাবে।’
সাথে সাথে মুখোমুখি আক্রমণকারী বাহিনীকে দিক পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হল। নতুন নির্দেশ পেয়ে খ্রিস্টানদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে চলল সুবাকের দিকে। পেছনে রসদের বহর। রসদ বোঝাই হাজার হাজার গাড়ী পেছনে আসছে। বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও একজন মুসলিম সৈন্যও দেখা যায়নি। নির্ভয়ে এগিয়ে চলল রসদবাহী কাফেলা।
খ্রিস্টান সম্রাটদের খুশীর আন্ত নেই। সুবাক দুর্গ তাদের হাতের মুঠোয়। রাত নেমেছে। কেউ ঘুমিয়েছে, কেউ আবার আনন্দ উৎসব করছে। অকস্মাৎ দৃষ্টি ছুটে গেল ফৌজের পেছনে। মাইল পাঁচেক দূরের আকাশ রংগীন হয়ে উঠছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। একদল দ্রুতগামী সওয়ার পাঠিয়ে দেয়া হল। ওরা যখন সেখানে পৌঁছল তখন সব শেষ। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে আগুনের দিকে। ওদের চোখের সামনে পুড়ছে ওদের রসদ সামান। লাগামহীন ঘোড়াগুলো দিক-বিদিক ছুটাছুটি করছে। আগুনে পুড়ে গেছে পশুর খাবার, শুকনো ঘাস আর খড়ের স্তুপ।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সেনাপতিরা ছুটে গেলেন সেখানে। তাদের বিষণ্ণ চোখে অবাক দৃষ্টি। কিছু নেই। এক মাসের রসদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওরা বুঝতে পারল এবারও ওরা সুলতান আয়ুবী র ফাঁদে পা দিয়েছে। ‘রসদ’ ছাড়া দুর্গ অবরোধ করা যাবে না। এখন সুবাক যাওয়ার পথও নিরাপদ নয়।’ সেনাপতি সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘অভিযান মুলতবী করা হল।’
গুপ্তচরের দ্বিতীয় সংবাদে আরও হতাশ হয়ে পড়ল খ্রিস্টান বাহিনী, ‘গত রাতে খ্রিস্টানদের দ্বিতীয় বাহিনীর রসদও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
খ্রিস্টান সম্রাট এবং সেনাপতিরা বৈঠকে মিলিত হলেন। পরিকল্পনা রদবদল করতে হবে। কি আশ্চর্য! মুসলিম বাহিনীর ‘টিকি’টি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। গোয়েন্দারাও বলতে পারল না কোথায় জমায়েত হয়েছে মুসলিম বাহিনী। বিশাল মরুভূমির কোথাও নেই ওরা।
খ্রিস্টানদের দুই বিশাল বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে দিলেন সুলতান। কমান্ডারদের ডেকে বললেন, ‘খ্রিস্টান ফৌজ যুদ্ধ মুলতবী করলেও আমাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। ওরা দুই বাহিনীর মুখোমুখি লড়াইকে যুদ্ধ বলে। আমি তা করব না। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে। ওদের নিশ্চিন্তে যেতে দেব না। কমান্ডো আক্রমণে ওদের ব্যস্ত রাখবে। পেছনে বা ডানে বায়ে ঝটিয়ে আক্রমণ করে পালিয়ে রণক্ষেত্রে। সেখানের ধূলিকণাও তোমাদের সহযোগিতা করবে।
সুলতান এক জায়গায় বসে থাকতেন না। আজ এখানে তো ওখানে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন সমগ্র মরু এলাকা। খ্রিস্টান গোয়েন্দারাও জানে না সুলতান কোথায় আছেন। পরবর্তী বিপর্যয়ের ভয়ে তটস্থ রইল খ্রিস্টান ফৌজ।
* * *
মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের পার্বত্য এলাকা। এখানকার রহস্য বাড়ীতে আকাশ থেকে নেমে আসলো হযরত ঈসা (আঃ)। ফেরাউনদের ভাংগা বাড়ী থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন এক ধর্ম বিশ্বাস। এ অঞ্চলের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নতুন এ ধর্ম মত গ্রহণ করছে।
বৃহস্পতিবারের এক মনোরম সন্ধ্যায় বাড়ীর প্রবেশ পথে দর্শনার্থীর প্রচন্ড ভীড়। সারিবদ্ধভাবে ভেতরে ঢুকছে সবাই। ভেতরের প্রশস্ত কক্ষে গুঞ্জরিত হচ্ছে অদৃশ্য কণ্ঠ। পাশের দেয়ালে ভাসছে পাপীর শাস্তির দৃশ্য। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মত আজও মানুষ আগ্রহ নিয়ে সে দৃশ্য দেখছে।
হঠাৎ কণ্ঠ থেমে গেল। যে পবিত্র বাবাকে পাপী চক্ষু দেখতে পায় না তার কণ্ঠের পরিবর্তে ভেসে এল নতুন কণ্ঠ, ‘পথভ্রষ্ট মানুষ! আজ রাতে বাড়ী ফিরে যেওনা। যে রহস্য উন্মোচনের জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন, কাল সকালে তা দেখতে পাবে। যে বাবার দর্শক লাভের জন্য তোমরা ব্যাকুল, ভোরেই তার দেখা পাবে। এখনই এ পড়োবাড়ীর বাইরে চলে যাও। হযরত ঈসা আসছেন। বাইরে গিয়ে সবাই শুয়ে পড়।’
কক্ষের দেয়ালে ভেসে উঠা তারকারাজী ম্লান হয়ে এসেছে। যুবতীরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। সৈন্যদের পোশাক পরা কিছু লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের। চিৎকার ভেসে আসছে। থেমে গেছে মেঘের গর্জন। পবিত্র স্থানে এসব কি ঘটছে! ভয়ার্ত মানুষ কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
কি ঘটছে দর্শনার্থীদের কেউ বুঝতে পারল না। তখন দলে দলে লোক ভেতরে যাচ্ছে। সংগী হচ্ছে কমান্ড সদস্যরা। কেউ কেউ ঢুকছে মশাল নিয়ে। ভেতরে মশাল নেয়ার নিয়ম নেই। আশ্চর্য হল দর্শনার্থী, বুঝতে পারছে না কেন মশাল নেয়া হচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশটি মশাল এবং একশজন গলি পথে এগিয়ে গেল ওরা। এ পথে বাইরের কারও চলাচল নিষিদ্ধ। এরা সবাই সশস্ত্র। কারও কাছে খঞ্জর, তরবারী আবার কারও হাতে রয়েছে তীর ধনুক। লোকজনের বেরোবার পথেও ঢুকে পড়েছে কমান্ডো সৈন্য। ছড়িয়ে প্রতিটি অন্ধকার গলিতে।
দামেশকের দু’শ অশ্বারোহী ঘিরে ফেলল বাড়ীর চারদিক। ওরা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দর্শনার্থীদের একত্রিত করছিল। বাড়ীর ভেতরটা অন্দ্রনালীর মত পেছানো। আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে কমান্ডো দল প্রশস্ত কক্ষে। চাঁদ অনেক উঁচু। কক্ষে অনেক নারী-পুরুষ। কারো কারো চেহারা নেকড়ের মত।
মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিউদ্দীন এবং আলী বিন সুফিয়ানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পর সেনা সদস্যের একটি দল পার্বত্য এলাকায় পৌঁছল। পথ দেখাচ্ছিল শারজা। পাঁচশ ঘোড় সওয়ার, দু’শ উস্ট্রারোহী এবং পাঁচশ পদাতিক সৈন্যের বহর লুকিয়ে রইল খানিক দূরে। পড়োবাড়ী আক্রান্ত হলে সুদানীরা আক্রমণ করতে পারে।
সেনাদলের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল সীমান্তের দিকে দৃষ্টি রাখা। সীমান্ত রক্ষীদেরকেও এ দলের অন্তর্ভুক্ত করা হল। সেনাদলের প্রতিটি সদস্য ছিল নির্বাচিত। দামেশক থেকে আসা দু’শ অশ্বারোহী এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল। অন্যরা ছিল সুলতান আয়ুবীর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিক। অনেকেই কমান্ডো আক্রমণে পারদর্শী।
সন্ধ্যায় কমান্ডো বাহিনী পড়োবাড়ীর গেটে পৌঁছল। সারি বেঁধে লোকজন ঢুকছে। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে তিনটে করে খেজুর এবং পানি। দর্শনার্থীদের সাথে মিশে ছয় ব্যক্তি এগিয়ে গেল। দাঁড়াল গেটে দাঁড়ানো দু’জন লোকের সামনে। গেটে একটি মশাল জ্বলছে। সামনেটা আলোকিত, কিন্তু দরজার ভেতরে অন্ধকার। কিছু দূরে গিয়ে আলোকিত বড় কক্ষ।
ছ’জনের হাতে বেরিয়ে এল চকচকে খঞ্জর। দরজার অন্ধকারের আড়াল নিয়ে দাঁড়াল দু’জনের পেছনে। খঞ্জর ঠেকাল দু’জনের পিঠে। অনুচ্ছ কণ্ঠে বলল, ‘বাঁচতে চাইলে এখান থেকে সরে যাও। সেনাবাহিবী তোমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলেছে।‘
প্রতিবাদ না করে দু’জন সরে এল। দু’জন কমান্ডো দখল করল ওদের জায়গা। চার কমান্ডো সরে আসা দু’জনকে বলল, ‘ভেতরে চল।’ ওদের ভয়ঙ্কর চেহারার দিকে একপলক তাকিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াল ওরা। দেখা গেল ভেতরের কক্ষে অনেক সুন্দরী তরুণী ঝলমলে কাপড় পড়ে আছে।
একদিকে যুবক-যুবতী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, অন্যদিকে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত পর্দা ঝুলানো। পর্দা একবার ডানে আবার বায়ে ঘুরছে। অন্যদিক থেকে ছুটে আসছে চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো।
ভেতরে কোন ভূতপ্রেত বা দৈত্য দানো নেই, পূর্বে কমান্ডো সদস্যদের এসব কথা বলা না হলে ওরা ভয়ে ছুটে পালাত। কমান্ডো দু’জন গেটের দায়িত্ব নেয়ার পার একদল কমান্ডো সৈন্য ভেতরে ঢুকল।
সৈন্যদের দেখে ভয়ংকর প্রাণীগুলো বিকট শব্দ করতে লাগল। বিভিন্ন অঙ্গভংগীর মাধ্যমে সৈন্যদের ভয় দেখাতে চাইল। ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে একজন তেড়ে এল সৈন্যদের দিকে। সৈন্যরা ওদের ঘিরে ফেলল। ধস্তাধস্তির সময় কয়েক জনের মুখোশ খুলে পড়ল। সৈন্যরা সবার মুখ থেকে নেকড়ে বা বিভিন্ন পশুর মুখোশ খুলে নিল। বেরিয়ে এল মানুষের চেহারা। একপাশে পড়ে আছে মদের পাত্র।
সশস্ত্র প্রহরায় সৈন্যরা ওদের বাড়ীর বাইরে নিয়ে গেল। বাড়ীর অন্যপ্রান্তে তল্লাসী নেয়া হল। এক ব্যাক্তি একটি সুড়ংয়ের মুখে মুখ লাগিয়ে বলছে, ‘পাপের প্রায়শ্চিত্য কর। হযরত ঈসা (আঃ) আসছেন……….।’
সুড়ংয়ের ওপর প্রান্ত শেষ হয়েছে আলোকিত প্রশস্ত কক্ষে। ওখানে দর্শনার্থীরা গায়েবী শব্দ শুনে আর পাপীদের শাস্তির ছবি দেখে আতংকিত হয়। লোকটাকে বেধে ফেলল সৈন্যরা।
একজন সৈন্য সুড়ংগ মুখে মুখ লাগিয়ে বলল, ‘পথভ্রষ্ট মানুষ আজ রাতে বাড়ী যাবে না। এতদিন যে রহস্যময় বাবাকে দেখার অপেক্ষা করছিলে, কাল ভোরেই তাকে দেখতে পাবে তোমরা।’
বন্দীদের জিজ্ঞেস করে সৈন্যরা আলোর উৎসের কাছে পৌঁছল। এখানে জ্বলছে অনেকগুলো মশাল। পেছনে কাঠের পাটাতন। পাটাতনের ওপর স্থাপন করা হয়েছে বিশাল আয়না। মশালের আলো আয়নায় পড়ে তার প্রতিবিম্ব সামনে ছড়িয়ে পড়ে। কাঠের পাটাতন ঘুরিয়ে আয়নার প্রতিসরণ এদিকে ওদিক ঘোরানো যায়। কক্ষের দেয়ালে ঝুলানো পর্দার মাঝে মাঝে কাঁচ সেটে দেয়া হয়েছে। আয়নার প্রতিবিম্ব কাঁচে পড়লে মনে হয় আকাশে তারা জ্বলছে।
দেয়ালের রঙের সাথে মিলিয়ে পর্দায় রং করা হয়েছে। একজন সচেতন ব্যক্তি দেখা মাত্রই বুঝতে পারত এ হল আলোর কারসাজি। কিন্তু নেশাযুক্ত খেজুর আর পানি পান করিয়ে দর্শনার্থীদের মোহগ্রস্থ করা হয় বলে এতদিন মনে করেছে সত্য।
সুড়ং পথে আসা শব্দে দর্শনার্থীরা আরও হতবাক হয়। এজন্যই একবার বেরিয়ে এলে প্রতিটি লোক আবার ভেতরে যেতে চাইত। এ ছিল নেশার প্রভাব। এজন্যই এতদিন মানুষকে নেশাগ্রস্থ করে ধর্মীয় অনুভূতির নামে প্রতারিত করা হয়েছে সবাইকে।
খেজুর এবং পানির মশক ‘সিজ’ করা হল। বন্দী করা হল ভেতরের সবাইকে। দুটো দলকেই জনগণের সামনে একটু উঁচুতে দাঁড় করানো হল। সেনা কমান্ডারের নির্দেশে মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলল ওরা। বেরিয়ে এল মানুষের চেহারা।
লোকজনকে বলা হল সারি বেঁধে ওদের অতিক্রম করতে। আশ্চর্য হল গ্রামবাসীরা, এরা আকাশের অধিবাসী নয়, ওদেরই গাঁয়ের লোক। মেয়েগুলোও চেনা জানা। মেয়েদের মধ্যে চারজন ইহুদী, সাতজন খ্রিস্টান আর অন্যরা মুসলমান।
এরপর মূল অপরাধীদেরকে সামনে আনা হল। এদের ছ’জনই খ্রিস্টান। আরবদের মতই মিসরের ভাষায় পারদর্শী ওরা। এরা অর্থের লোভ দেখিয়ে এলাকার লোকদের হাত করেছে। চারটি মসজিদের ইমামও ওদের নিজস্ব লোক। ধর্মের নামে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য এরা এসব ইমামদের নিয়োগ করেছিল।
এ অঞ্চলের মানুষ যাতে সেনাবাহিনীতে ভর্তি না হয় এ জন্য খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ওরা এ নাটকের অভিনয় করেছে। সফল হয়েছে ওরা। এলাকার মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে সুদানীদের প্রতি ভালবাসা। আয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের হৃদয়ে। এমনকি ওদেরকে ফাঁদে জড়িয়ে মানুষ নিজের ধর্মকেও বিসর্জন দিয়েছে।
কেউ পালিয়ে আছে কিনা দেখার জন্য খোঁজ করা হল প্রতিটি কক্ষ। বাইরে দু’শ ঘোড় সওয়ার বাড়ী ঘিরে রেখেছে। জ্বলছে শত শত মশাল। সেনাবাহিনীর এক অংশ সুদান সীমান্তে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
রাত গিয়ে ভোর হল। সুদানের দিক থেকে কোন আক্রমণ এল না। কোন বাধা এলনা পড়োবাড়ীর ভেতর থেকে। গ্রামের কেউ বাড়ী ফিরে যায়নি, ওরা প্রতারক সেই অদৃশ্য বাবাকে দেখতে চায়।
* * *
সকালে গ্রামে খবর পাঠানো হলো যে, অদৃশ্য বাবা একটু পর দর্শন দেবেন। দলে দলে গ্রামবাসীরা ছুটল পাহাড়ের পাদদেশে জমায়েত হল প্রায় চার হাজার গ্রামবাসী। ওরা সবাই নতুন ধর্ম মতের অনুসারী। সবাই বাবাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল। বাবা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবেন।
সৈন্যরা লোকজনকে বসিয়ে দিল। সবাই তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে পড়োবাড়ীর দিকে। স্বর্গীয় জ্যোতিতে স্নাত দরবেশ এখনই বেরিয়ে আসবেন। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না।
হঠাৎ দেখা গেল পড়োবাড়ীর দিক থেকে সেনাবাহিনীর প্রহরায় একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। কারও চেহারা নেকড়ের মত, কারও বানর বা ভাল্লুকের মত। দর্শনার্থীরা বড় কক্ষের দেয়ালে এদের ছবি দেখেছিল। গায়েবী আওয়াজ বলেছিল পরকালে এদেরকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কারণ এরা যুদ্ধ করেছিল সেনা ফৌজে।
প্রায় পনের জন সুন্দরী তরুণী আসছে আলাদা ভাবে। এদের সাথে রয়েছে সুদর্শন যুবক। লোকজনকে পড়োবাড়ীর ভেতর নিয়ে ওদের প্রতারণার পদ্ধতি দেখান হল। এতদিন কিভাবে ধোঁকা দেয়া হয়েছে নিজের চোখে দেখল মানুষ। ভেতরটা দেখা শেষ হলে আবার তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করা হল।
ঈষৎ উঁচু জায়গায় দাঁড়ালেন মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিউদ্দীন। বললেন, ‘খেজুরের সাথে হাশিশ মিশিয়ে তোমাদেরকে নেশাগ্রস্ত করা হতো। দেখানো হতো স্বর্গ নরক। বলা হতো মুসা, ঈসা আর আল আযেদের কথা। এর সবই ছিল প্রতারণা। হাশিশের প্রভাবে তোমরা সবকিছুই বিশ্বাস করেছিল। এরা ধোঁকার জাল বিছিয়ে সমগ্র অঞ্চলকে বিভ্রান্ত করেছে।
তোমাদের শোনানো হয়েছে এক দরবেশের কাহিনী। দরবেশ মানুষকে উট, ঘোড়া এবং টাকা দেন। আসলে মিথ্যা বলে এরা তোমাদের লোভ দেখিয়েছে। মিথ্যা বলার বিনিময়ে পেয়েছে অঢেল সম্পত্তি। এরা এসেছে তোমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। এসেছে তোমাদের ঈমান নষ্ট করতে।’
জনতার মাঝে দেখা দিল মৃদু গুঞ্জন উত্তেজিত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও ওদের ঠেকাতে পারল না।
জনতার সম্মিলিত ক্রোধ অপরাধীদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। যুবক-যুবতী আর পুরুষদের কেউ রক্ষা পেল না।
সেনাবাহিনী ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র এলাকায়। বন্দী করা হল খ্রিস্টান গোয়েন্দা এবং চরদের। চারজন ইমামকেও গ্রেফতার করা হল। উত্তেজিত জনতা ভেংগে গুড়িয়ে দিল সে রহস্যময় বাড়ী।
কায়রো ফিরে গেলেন তকিউদ্দীন। শারজা এবং ডাক্তারকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি দিলেন। সুদান আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হল।
এ অভিযানে গিয়ে তিনি দেখেছেন মিসরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশটি কি ষড়যন্ত্র করছে। ওদের আক্রমণ না করলে এ যড়যন্ত্র বন্ধ করা যাবে না। তিনি বুঝতে পেরেছেন সুদানীরা এখন খ্রিস্টানদের সহযোগী। সুদানের কিছু এলাকা দখল করতে না পারলেও আক্রমণের ফলে ওদের ষড়যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাবে। কায়রোতে শুরু হলো যুদ্ধের প্রস্তুতি।
* * *
চুরমার করে দেয়া হল ষড়যন্ত্রের একটি কেন্দ্র। কিন্তু গভর্নর তকিউদ্দীন এতেও সন্তুষ্ট নন। খ্রিস্টানদের প্রত্যক্ষ মদদে সুদানীরা এ ষড়যন্ত্র বিস্তৃত করেছে। ওদের প্রতিহত না করলে নতুন ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করবে। এ জন্যেই তিনি সুদান আক্রমণ করতে চাইছিলেন। ওখানেও ছিল সুলতান আয়ুবীর গুপ্তচর। নিয়মিত ওরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাচ্ছিল। এসব তথ্য দিয়ে সুলতান যেভাবে উপকৃত হতে পারতেন তকিউদ্দীনের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। দু’ভায়ের আবেগ এক হলেও বুদ্ধিমত্তা এবং ধীরশক্তিতে ছিল বিস্তর ফারাক। দু’জনই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু একজনের সিদ্ধান্তে থাকত দূরদর্শিতা এবং ধৈর্য, অন্যজনের থাকত আবেগ এবং তাড়াহুড়ো।
সামরিক উপদেষ্টাগণ যখন গভর্নরকে বললেন, ‘সুদান আক্রমণ করার পূর্বে সুলতানের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ।’
এ প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন গভর্নর। বললেন, ‘আপনারা কি সুলতানকে বুঝাতে চাইছেন, তাকে ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। কি ঝড়ের মোকাবেলা করছেন সুলতান তা আপনাদের অজানা নয়। আমরা তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকলে সুদানীরাই মিসর আক্রমণ করে বসবে। এখনই ফৌজকে মার্চ করতে বলুন। রসদ সামান ছাড়াই সেনাবাহিনী রওয়ানা করবে।’
‘এতবড় এক অভিযানে যাওয়ার পূর্বে একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ।’ বললেন একজন কমান্ডার।
‘স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারব।’
‘সুলতানকে এ ব্যাপারে জানানো উচিৎ যাতে তিনি সম্মানিত জংগীকে অবহিত করতে পারেন।’ বললেন আরেকজন।
‘আপনারা মিসরে একজন একজন করে গাদ্দার গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন, আমি গাদ্দারী এবং ষড়যন্ত্রের উৎসের উৎপাটন করতে চাই। এ জন্য আর কারও সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন নেই। আমার নির্দেশই যথেষ্ট।’ বললেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর।
তকিউদ্দীন এমন কতগুলো বিষয়ে মনযোগ দেননি যা তার জন্য পরাজয় বয়ে আনতে পারে। কায়রোতে ছিল খ্রিস্টান এবং সুদানের গুপ্তচর। সেনাবাহিনীর প্রতিটি নড়াচড়া ওরা লক্ষ্য করছিল। তকিউদ্দীনের দুর্ভাগ্য এসব গুপ্তচরের মধ্যে ছিল প্রশাসনের পদস্ত কর্মকর্তা এবং সুদানী অফিসার। কয়েক বছর পূর্বে মিসরের সুদানী বাহিনী ভেংগে এসব মেধাবী অফিসারদের রেখে দিয়েছিলেন সুলতান। সুলতানের যুদ্ধ পলিসি সম্পর্কে এরা ছিল অভিজ্ঞ। অন্যদিকে মুসলিম গোয়েন্দারা সুদানী ফৌজের যুদ্ধ পলিসি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। খ্রিস্টান সম্রাটগণ সুদানী বাহিনীকে উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত করে রেখেছিল।
সুদান আক্রমণ করতে হবে বিশাল মরু পেরিয়ে। জংগল এবং পর্বত ঘেরা অঞ্চলে রসদ পৌঁছনো সহজ নয় ভাবেননি তকিউদ্দীন। দেশের স্বাধীনতা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে প্রচন্ড ক্ষোভ এসব দিকগুলো দৃষ্টির আড়ালে রেখেছিল।
তকিউদ্দিনের সদিচ্ছার কোন অভাব ছিল না, কিন্তু সুলতান আয়ুবীর মত দূরদর্শী হতে পারেননি তিনি। শুরু হল যুদ্ধের প্রস্তুতি। সিদ্ধান্ত নেয়া হল এ ব্যাপারে সুলতানকে কিছুই জানানো হবে না।
সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবীর অনুভূতি নিয়েই তিনি একক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলতান প্রচন্ড ঝড়ের মোকাবেলা করছেন তার এ ধারণা অমুলক ছিল না। তার চিন্তাধারা ছিল সঠিক।
তখন সুলতান ছিলেন ক্রাকের আট মাইল দূরে, অস্থায়ী ক্যাম্পে। তার হেড কোয়ার্টার ছিল বেদুইনদের মত। আজ এখানে তো কাল ওখানে। যে এলাকায় কমান্ডো আক্রমণ হবে তার আশেপাশেই থাকতেন তিনি। কোন সময় কোথায় থাকবেন কমান্ডাররা শুধু জানতেন।
কমান্ডো বাহিনী খ্রিস্টানদের সকল রসদ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ অদৃশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ওদের জন্য ছিল আতংক। যদিও খ্রিস্টানদের ক্ষতি হচ্ছিল, পাশাপাশাই মুসলিম শহীদদের সংখ্যাও কম ছিল না। কখনও দশজনের কমান্ডো দল থেকে ফিরে আসত তিন কি চার জন। খ্রিস্টানদের বাড়তি সতর্কতার ফলে জানের ক্ষতি হচ্ছিল বেশি। নতুন করে যুদ্ধ পলিসি পরিবর্তন করার জন্য সুলতান চিন্তা-ভাবনা করছিলেন।
‘মনে হয় মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য খ্রিস্টান আমাদের বাধ্য করছে’, সেনা অফিসারদের বললেন সুলতান। ‘ওদের এ ইচ্ছে পুরণ হবে না, মরতে দেব না এত বেশী কমান্ডো জওয়ান।’
‘এ জন্য কমান্ডো সৈনিকের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।’ একজন অফিসার বললেন। ‘শুধু আবেগের বশে দুশমনের শক্তিকে খাট করে দেখা ঠিক নয়। আবেগের বশে একজন সৈনিক যুদ্ধ করে জীবন দিতে পারে কিন্তু বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। খ্রিস্টানদের তুলনায় আমরা অনেক কম। এ ছাড়া ওদের বেশীর ভাগ সৈন্যই বর্মাচ্ছাদিত।’
মৃদু হেসে সুলতান বললেন, ‘যে লৌহবর্ম ওরা পরে থাকে তা তাদের নয়, আমাদের সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই দেখেছেন ওরা রাতে বা ভোরে মার্চ করে। কারণ, সূর্যের উত্তাপে ওদের লৌহবর্ম আগুনের মত উত্তপ্ত হয়ে যায়। সৈন্যরা তখন ছুড়ে ফেলে দিতে চায় পরিধেয় বর্ম। বর্মের অত্যাধিক ওজন কমিয়ে দেয় ওদের চলার গতি। আমি ঠিক দুপুরে ওদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করব। ঘাম ঝরে ঝাপসা হয়ে যাবে ওদের দৃষ্টি। আমরা সংখ্যায় কম, আবেগ এবং স্থান বদলে সে ঘাটতি পূরণ করব।’
আলীর সহকারী জাহেদীন এসে সালাম করল। সাথে দু’জন লোক। সুলতানের চোখে ফুটে উঠল আলোর দ্যুতি। দু’জনকেই পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদিককার কি খবর?’
জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দু’জনেই বের করে আনলেন গলায় ঝুলানো কাঠের তৈরী ক্রুশ। একটানে ঝুলানো রশি ছিড়ে ক্রুশ ছুড়ে ফেললেন দূরে। দু’জনই মুদলিম গোয়েন্দা। একজন বিস্তারিত রিপোর্ট দিলেন সুলতানের কাছে।
গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সুলতান যুদ্ধের নতুন পরিকল্পনা তৈরী করলেন। আক্রমণের স্থান নির্দেশ করে মানচিত্র তৈরী করলেন। গোয়েন্দা যখন ক্রাকে মুসলমানদের ওপর খ্রিস্টানদের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করছিল সুলতানের চেহারার রং তখন বদলে গেল। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, কপাল কুঞ্চিত। তাঁবুর ভেতর পায়চারী করলেন খানিক।
গোয়েন্দারা বলল, ‘সুবাক থেকে পালিয়ে যাওয়া খ্রিস্টানরা ক্রাকের মুসলমানদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। ব্যবসায়ীগণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কোন অমুসলিম তাদের দোকানে যায় না। মুসলমানরা গেলেও তাদের ওপর খবরদারী করা হচ্ছে। মসজিদের বারান্দাকে ওরা উট, ঘোড়ার বাথান বানিয়েছে। আজান শুরু হলে হুল্লোড় করে গান গায় রেলিংয়ে বসে।’
মুসলমানদের মানসিক অবস্থা দুর্বল করার জন্য নানা গুজব ছড়নো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘আয়ুবী গুরুতর যখম হয়ে দামেশক গিয়ে মারা গেছেন। তার নেতৃত্বহীন যার যেদিকে ইচ্ছে পালাচ্ছে। সমগ্র মরুভূমির কোথাও মুসলিম সেনাবাহিনীর ছাউনি নেই। কিছুদিনের মধ্যেই সুবাক দুর্গ আমাদের হাতে আসছে। এদিকে সুদানীরা মিসর আক্রমণ করেছে। মিসরের সেনাবাহিনী ওদের সাথে হাত মিলিয়েছে।’
প্রতিদিন সকালে পাদ্রীরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে এসব গুজব ছড়িয়ে মুসলমানদের জন্য দোয়া করে। ভালবাসার কথা বলেন।
এতে একদিকে মুসলমানদের মানসিক শক্তি দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে খ্রিস্টানদের মনের জোর বেড়ে যাচ্ছে। যুবতী মেয়েরা মুসলিম মেয়েদের বলে বেড়াচ্ছে, ‘আয়ুবীর সৈন্যরা অধিকৃত এলাকায় যুবতীদের নষ্ট করছে। তোমাদেরকেও ছাড়বে না। দেশ শত্রুমুক্ত হলে আমরা এবং তোমরা সবাই নিরাপদে থাকতে পারব।’
এর আগেও ক্রাকের মুসলমানদের দুর্দশা সম্পর্কে সুলতানকে বলা হয়েছে। ওরা সুলতানের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, তবুও শুনতে হচ্ছে। দেয়ালেরও কান আছে, এ জন্য ওরা থাকে নির্বাক। দু’জন একস্থানে বসে কথা বলতেও ভয় পায়। মসজিদে, এমনকি শব যাত্রীদের সাথেও থাকে খ্রিস্টানদের গুপ্তচর।
ওদের দুর্ভাগ্য, মুসলিম ভায়েরাও খ্রিস্টানদের চর হিসেবে কাজ করে। নিজের বাড়ীতে কথা বললেও ফিসফিসিয়ে বলতে হয়। ‘এরা খ্রিস্টান শাসকের বিরোধী’ বেগার ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য এ কথাটুকু যথেষ্ট।
‘মাননীয় সেনাপতি’, অপর গোয়েন্দা বলল, ‘ক্রাকে খ্রিস্টানদের নতুন চাল শুরু হয়েছে। মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করছে ওরা। ক’দিন পূর্বে সরকারী খরচে একটা ভাংগা মসজিদ মেরামত করা হয়েছে। বেগার ক্যাম্প থেকে মুসলমানদের মুক্ত না করলেও শ্রমের সময় কমিয়ে দিয়েছে। ওদের বলা হচ্ছে, ‘তোমরা সরকারের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছ এরপরও তোমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হচ্ছে।’
এ প্রেম এবং ভালবাসার অস্ত্র অত্যন্ত মারাত্মক। অমুসলিম যুবকরা মুসলিম যুবকদের চরিত্র নষ্ট করার কাজে লিপ্ত।
ক্রাক আক্রমণের দেরী হলে ওরা নামমাত্র মুসলমানে রূপান্তরিত হবে। কোরআন বাদ দিয়ে গলায় ঝুলাবে ক্রুশ। তখন ওরা আমাদের কোন সাহায্য করবে না।
প্রেমের কথা বললেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি আরও জোরদার করা হয়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে প্রতিদিন। এখন পর্যন্ত মুসলমানদের আবেগ টিকে আছে। দু’একজন ছাড়া ওদের ভালবাসার ফাঁদে এখনো পা দেয়নি। কিন্তু কতদিন পর্যন্ত এ আবেগ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে ওরা তাই ভাববার বিষয়।’
সুলতানকে উদ্বিগ্ন দেখাল। তিনি জাহেদীনকে বললেন, ‘তোমরা কি মুসলমানদের সাথে কথা বলেছ? প্রেমের টোপ যেমন ভয়াবহ, চরিত্র হনন তারচে বেশী মারাত্মক। আলীকে কি কায়রো থেকে ডেকে আনবো না তুমিই তার স্থান পূরণ করতে পারবে? মুসলমানদেরকে গুজব এবং ভালবাসার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে।’
‘কায়রোর অবস্থা ভাল নয়। আলীকে ডাকার দরকার নেই, তিনি ওখানেই থাকুন। তার পরিবর্তে হাসান বিন আব্দুল্লাহ আমাদের সাথে থাকলেই চলবে। ক্রাকের ব্যাপার আমিই সামাল দেব।’
‘এ ব্যাপারে কি ভেবেছ তুমি?’
জাহেদীন আলীর স্থান পুরণ করতে পারবে কি না সুলতান তা বুঝতে চাইছিলেন। জবাবের প্রতীক্ষা না করে তিনি আবার বললেন, ‘জাহেদীন! আমি কখনও যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত হইনি। এ ক্ষেত্রেও পরাজয় চাই না। খ্রিস্টান শক্তি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অংগনে আক্রমণ করেছে। আমি খ্রিস্টানদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আগ্রাসন থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে চাই।’
‘আপনি জানেন ক্রাকে আমাদেরও গোয়েন্দা কর্মী রয়েছে। ওরা ওখানকার অধিবাসীকে আপনার ব্যাপারে, আমাদের ফৌজ এবং মিসরের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেবে, আপনার বাণী পৌঁছাবে প্রতিটি মুসলমানের কানে।’
‘ওখানকার নারীদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধের অভাব রয়েছে।’ বলল একজন গোয়েন্দা।
‘আমরা যুবতী মেয়েদের বলব, প্রতিটি বাড়ীতে গিয়ে যেন মুসলিম নারীদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। আমি দেখেছি, ওখানকার মেয়েরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’
‘মেয়েরা যদি সন্তানের শিক্ষা দীক্ষার দিকটা ঠিক মত দেখে তাহলে মুসলিম জাতি আরও উন্নত হবে।’ বললেন সুলতান। ‘প্রতিটি শিশু ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হলে অমুসলিমরা তাদের অপচেষ্টায় ব্যর্থ হবে। শিশুদের কচি মনে ইসলাম এবং নবীর ভালবাসা সৃষ্টি হলে বড় হয়ে ওরা অন্য কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। এ জন্য ওদের সঠিক ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা কর। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্রাক আক্রমণ করব। সুবাকের মুসলমানদের মত ক্রাকের মুসলমানদেরকেও মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ। জাহেদীন, এ জন্য কাকে ক্রাক পাঠাতে চাও।’
‘এ দু’জনকে। এরা ক্রাকের নিয়ম নীতি যেমন জানে; পথ ঘাটও চেনে। এরা মেধাবী এবং বুদ্ধিমান।’
* * *
ক্রাকের মুসলমানদের উপর ভালবাসার বিষাক্ত অস্ত্র চালানো হচ্ছিল গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের পরামর্শে। সুবাক হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর হরমুন খ্রিস্টান সম্রাটদের বলেছিল, প্রেমের অভিনয় করে ক্রাকের মুসলমানদেরকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব। পক্ষে না এলেও আয়ুবীর ওপর ওদের মন বিষিয়ে তোলা যাবে। কিন্তু খ্রিস্টান সম্রাটগণ মুসলমানদের ঘৃণা করতেন। ভালবাসার অভিনয় করতেও তারা রাজী নন। তাদের ধারণা, শক্তি প্রয়োগ করেই এদের জাতীয় চতনা নিঃশেষ করা যাবে।
হরমুন ছিলেন একজন মনোবিজ্ঞানী। তার মতে মন জয় করতে পারলে গোটা জাতি হাতের মুঠোয় এসে যাবে। শেষ পর্যন্ত তিনি সম্রাটগণকে তার স্বমতে আনতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গোপনে গ্রেফতার করে গায়েব করে দিন, কিন্তু অন্যান্য মুসলমানদের আতংকিত করা যাবে না। মেয়েদের দিয়ে মেয়েদের বেপর্দা করতে হবে। যুবকদের করতে হবে মাদকাসক্ত। মানসিক গোলামীর মাধ্যমে ওদের বিলাসপ্রিয় করে তুলতে হবে।
সংস্কৃতির নামে যুবক-যুবতীদেরকে ঘর থেকে বের করে বেহায়াপনার তামিল দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, প্রগতির জন্য এসব নাচগান প্রয়োজন। ধর্মান্ধরা তোমাদের নিষেধ করবে, কিন্তু সংস্কৃতিবান না হলে উন্নতির শিখরে উঠা যাবে না।
হরমুন বললেন, একদিন দেখা যাবে, এরা নামে মুসলমান থাকলেও কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং চিন্তা-ধারায় থাকবে খ্রিস্টান। ওরা ওদের সমাজে আমাদের হয়ে কাজ করবে।’
সেদিন থেকেই হরমুনের এ প্রস্তাবের বাস্তবায়ন শুরু হল। প্রস্তাব মতে নির্বাচিত করা হবে একজন সুদর্শন মুসলিম যুবক। তাকে দেয়া হবে শক্ত সামর্থ্য ঘোড়াগাড়ী, মুল্যবান পোশাক এবং সম্পদ। তাকে এবং তার পরিবারকে রাজ দরবারে নিমন্ত্রণ করে সম্মান দেয়া হবে। এভাবে তাদের মন থেকে উপরে ফেলতে হবে ইসলামী আবেগ এবং ভালবাসা।
হরমুন খ্রিস্টান সম্রাটদের বললেন, মুসলমানদেরকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে চাইলে ওদের মাথায় রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পোকা ঢুকিয়ে দিন। অমনি আপনাদের চোখের ইশারায় সে নাচবে। মদপান করবে, নিজ জাতির যুবতীদেরকে নিজের হাতে উলংগ করে আপনাদের হাতে তুলে দেবে।
মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে চাইলে আমার এ ফর্মূলা পরীক্ষা করে দেখুন। নৈতিক চরিত্র নষ্ট করার জন্য ইহুদীরা পূর্ব থেকেই নিজের যুবতী মেয়েদেরকে মুসলমানদের হাতে তুলে দিচ্ছে। মুসলমানরা ইহুদীদের সবচেয়ে পুরনো শত্রু তা আপনাদের অজানা নয়। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইহুদীরা মেয়েদের আব্রু এবং শেষ সম্বলটুকুও ত্যাগ করাতে প্রস্তুত। লড়াই জারী রাখতে হবে, তবে লড়াই দিয়ে ইসলামকে শেষ করা যাবেনা।
ইহুদী জাতি মুসলিম নিয়ম-নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ওদের মেয়েদের গড়ন প্রায় মুসলমানদের মত। কোন ইহুদী নারী বোরকা পরে ওদের বাড়ীতে প্রবেশ করলে কেউ সন্দেহ করে না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে ইহুদীরা। মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
জাহেদীনকে বিদায় করার বিশ দিন পর ক্রাকের রাস্তায় একজন নতুন পাগলের আবির্ভাব ঘটল। মুখে দাড়ি, গায়ে লম্বা জুব্বা, মাথায় পাগড়ী, কাঁধে ঝুলানো রুমাল। চেহারা এবং পোশাক ময়লা। দেখলে মনে হয় দূর থেকে এসেছে। হাতে কাঠের তৈরী ক্রুশ।
ক্রুশ উপরে তুলে পাগল চিৎকার দিয়ে বলছে ‘মুসলমান ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে গেছে। সুবাকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুসলিম যুবতীদের ইজ্জত আব্রু নিধনের পালা। মিসরের সব মুসলমান মদে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রভু যিশু বলেছেন, এ জাতি পৃথিবীতে আর বেশীদিন থাকবে না। নূহের দ্বিতীয় প্লাবন না হলে ইহুদীদের খোদাকে সিজদা কর। মসজিদের সিজদা তোমাদের কোন কাজে আসবে না।’
পোষাকে এবং কথাবার্তায় লোকটাকে পাগল মনে হচ্ছিল। কেউ ডাকলে থেমে যেত, কিন্তু কোন প্রশ্নের জবাব দিত না। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আগের কথাগুলোই বলে যেত। লোকটা কে, কোথাকে এসেছে জানতে চাইল না কেউ।
তার হাতে ক্রুশ এ জন্য খ্রিস্টানরা খুশী। ইহুদীদের কথা বলছে বলে তারাও সন্তুষ্ট। মুসলমানদের ধ্বংসের সংবাদ দিচ্ছে বলে দু’দলই আনন্দিত। ক’জন টহল সৈনিক তার ধমক শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পাগল ভেবে এড়িয়ে গেল পুলিশের লোকেরা। কোন মুসলমান সাহস পেল না পাগলটার মুখ বন্ধ করে দিতে। ক্রোধে ফেটে যাছিল মুসলিম হৃদয়গুলো, কিন্তু ওরা অসহায়।
লোকটি শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে একই কথা বলে যাচ্ছিল। কখনও আগের কথার সাথে নতুন কথা যোগ করত। ‘মুসলিম বাহিনী আর ক্রাকে আসবে না। তাদের সালাহউদ্দন মরে গেছে।’ আবার কখনও এমন অর্থহীন কথা বলত যাতে মনে হচ্ছিল লোকটা আসলেই পাগল। তার পেছনে হাঁটছিল একদল শিশু-কিশোর। বয়স্করা খানিক গিয়ে ফিরে আসত। অনেকক্ষণ থেকে এক যুবক তাকে বলল ‘ওসমান, ক্রুশের আশ্রয়ে চলে এসো।’
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে চুপ রইল ওসমান। ওসমানের কাপড়ের নীচে লুকানো খঞ্জরের কথা ওরা জানে না। পাগলটাকে হত্যা করার জন্যই তার পিছু নিয়েছে।
ওসমান সালেমের পিতামাতা বেঁচে আছেন। ছোট বোন আল নূরের বয়স কুড়ি। ওসমানই সংসারে বড়। দারুণ আবেগপ্রবণ ছেলে। ইসলামের নামে জীবন দিতে প্রস্তুত। খ্রিস্টান গোয়েন্দাদের সন্দেহভাজনদের তালিকায় তারও নাম আছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুসলিম যুবকদেরকে খ্রিস্টান সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে এ যুবক। তবে গোয়েন্দারা এখনও তাকে হাতেনাতে ধরতে পারেনি।
পাগলের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। পাগলটা ক্রুশ হাতে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলছে দেখে রক্ত গরম হয়ে গেল ওসমানের। লোকটা আসলেই পাগল কিনা তাও ভাবে দেখল না। বাড়ী ফিরে খঞ্জর তুলে নিল। জামার নীচে কোমরে গুঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছু নিল পাগলটার।
পথে দুইজন খ্রিস্টান যুবকের কথায় রক্ত চড়ে গেল মাথায়। কিন্তু নীরব রইল সে। পাগলটাকে হত্যা করার ইচ্ছে আরও জোরালো হল। পাগলটার পেছনে অনেক শিশু-কিশোর। বড়রাও রয়েছে। এখানে কিছু করা যাবে না।
বিকেল হয়ে এসেছে, কমে এসেছে পাগলের গলার জোর। তার পেছনের জটলাও হালকা হয়ে এসেছে। সূর্য ডোবার আর একটু বাকী।
গলির মোড়ে মসজিদের কাছে গিয়ে পাগলটা বসে পড়ল। এখনও ক্রুশ উঁচিয়ে রেখেছে। বলল, ‘এটা এখন থেকে গির্জা, মসজিদ নয়।
পাশে এসে দাঁড়াল ওসমান। সে জানত পাগলটাকে হত্যা করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। কারণ তার হাতে রয়েছে ক্রুশ, কথা বলছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওসমান পাগলের আরও কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ক্রুশসহ এখনি এখান থেকে পালিয়ে যাও। নয়তো খ্রিস্টানরা তোমার লাশ তুলে নেবে।’
পাগল অনেকক্ষণ ওসমানের দিকে তাকিয়ে রইল। সামনে এখনও কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওসমানের কথার কোন জবাব না দিয়ে কিশোরদের ধমক দিল। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল ওরা। পাগল মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়ল। হত্যা করার সুবর্ণ সুযোগ। কিছু না ভেবেই ওসমান ভেতরে ঢুকে গেট বন্ধ করে দিল। দ্রুত খঞ্জর বের করল। পেছনে ফিরে চাইল পাগল লোকটি।
ওসমান খঞ্জর দিয়ে আক্রমণ করেছে। কাঠের ক্রুশ দিয়ে আঘাত ঠেকাল পাগলটা। ‘থাম যুবক। ভেতরে চল। আমি মুসলমান।’
(সমাপ্ত)
Leave a Reply