ক্রুসেড সিরিজ ৩ – সুবাক দুর্গে আক্রমণ
মুল লেখক – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
অনুবাদ – আসাদ বিন হাফিজ
ভূমিকা
ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠলো খৃষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক সংঘাত ও সংঘর্ষের পরাজিত হয়ে বেছে নিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিল মদ ও নেশার দ্রব্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাঠাল প্রশিক্ষনপ্রাপ্তা সুন্দরী গোয়েন্দা। বড় বড় অফিসার ও আমীর উমরাদের হারেমগুলোতে ওদের ঢুকিয়ে দিল নানা কৌশলে। ভাসমান পতিতা ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। মদ জুয়া আর বেহায়াপনার সস্রোত বইয়ে দিল শহরগুলোতে।
একদিকে সশস্ত্র লড়াই অন্যদিকে কুটিল সাংষ্কৃতিক হামলা, এ দুয়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ও তার বীরশ্রেষ্ট সাথীরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।
.
.
বিষের ছোঁয়া
কায়রোর উপশহরের এক মসজিদ। একদিন সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে শহরতলীর সে মসজিদের কাছে এসে থামল আটজন অশ্বারোহী। মসজিদ থেকে সামান্য দূরে এক সরাইখানার ফটকে এসে ঘোড়া থেকে নামল ওরা। ঘোড়াগুলো তুলে দিল সরাইখানার লোকজনের হাতে। তারপর দু’জন দু’জন করে চারটে দলে ভাগ হয়ে ওরা মসজিদের চারদিকটা ভাল কে ঘুরে দেখল।
এশার নামাজের আযান হল। ওরা একে একে এসে প্রবেশ করল মসজিদে। প্রথম সারিতে নামাজ পড়ল চারজন, চারজন দাঁড়াল মসজিদের ভিতরের সর্বশেষ কাতারে।
নামাজ শেষ হল, মিম্বরে উঠে দাঁড়ালেন ইমাম সাহেব। লোকজন প্রতিদিনের মত আজো ইমাম সাহেবের ওয়াজ শোনার জন্য যে যার জায়গায় বসে পড়ল।
ওয়াজ শুরু করলেন ইমাম সাহেব। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইমাম সাহেব! আল্লাহ আপনার জ্ঞানের আলো আরো বাড়িয়ে দিক। আপনার খ্যাতি শুনে আমরা আটজন অনেক দূর থেকে এসেছি। সমস্যা মনে না করলে জিহাদের বিষয়ে কিছু বলুন। জিহাদের তাৎপর্য আমরা বুঝিনা। লোকজন বলছে আমাদের নাকি জিহাদের ভুল অর্থ বুঝানো হয়েছে।’
‘আমরা জিহাদ সম্পর্কে আপনার বয়ান শুনতে চাই।’ সাতটি কণ্ঠ একসঙ্গে প্রতিধ্বনিত হল।
একজন বলল, ‘এ হচ্ছে সময়ের দাবী। আমাদের জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা শোনানো হয়েছে। আমরা সঠিক অর্থ জানতে চাই।’
‘কোরআনের নির্দেশ কেউ পরিবর্তন করতে পারেনা।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘কোরানের বাণী মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব। একবার নয়, হাজার বার আমি আপনাদের কাছে জিহাদের তাৎপর্য তুলে ধরতে প্রস্তুত। জিহাদের অর্থ অন্যের জমি দখল করা বা কারও গলা কাটা নয়। হত্যা, মারামারি বা খুনাখুনিও জিহাদ নয়।’ তিনি কোরানের আয়াত পড়ে বললেন, ‘এ আমার কথা নায়, খোদার কালাম। সর্বোত্তম জেহাদ হচ্ছে নিজের নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তাইতো আমি বলি, পাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই হচ্ছে আসল জিহাদ। তোমরা শোননি, ইসলাম তরবারীর জোরে নয়, প্রেম এবং ভালবাসা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? পরবর্তী সময়ে জিহাদের অর্থ বলদে গেছে। এর অর্থ পরিবর্তন করেছে ক্ষমতালোভীরা। খ্রীষ্টানরা অন্যের দেশ দখল করাকে ধর্মযুদ্ধ বলে। মুসলমানও একই উদ্দেশ্যে লড়াই ও ঝগড়া করাকে জিহাদ বলে। আর এসব কথা বলে ক্ষমতাসীন শাসকরা। তারা এসব বলে তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। মানুষকে ধর্মের কথা বলে যুদ্ধে লিপ্ত করে রাজা বাদশারা। এতে রাজাদের শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের।’
‘সালাহউদ্দীন আয়ুবীও কি মানুষকে অন্যায়ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে দিয়েছেন?’ প্রশ্ন করল একজন।
‘না! তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। বড়রা তাকে যা বলেছে, আন্তরিকতার সাথে তাই তিনি পালন করছেন। খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে তার মনে ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে। ভেবে দেখো- খ্রীষ্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়! দু’জন নবীর কথাইতো এক। হযরত ঈসা (আ.) প্রেম ভালবাসার কথা বলেছেন। আমাদের নবীও মানুষকে ভালবাসতে বলেছেন। তাহলে এসব যুদ্ধ বিগ্রহ এল কোত্থেকে! আল্লাহর জমিনে যারা নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে গোলামে পরিণত করতে চায় এসব তাদের আবিষ্কার।
আমি মিসরের সম্মানিত আমীরের কাছে যাব। তাঁকে বোঝাব জিহাদের সত্যিকার তাৎপর্য। অশিক্ষা এবং অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তিনি যা করছেন এ হচ্ছে সত্যিকারের জিহাদ। খোতবা থেকে খলিফার নাম মুছে তিনি বড় জিহাদ করেছেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। শিশুদেরকে খোদার নামে যুদ্ধবিগ্রহ শেখানো হচ্ছে। এদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তীর ও তারবারী। এ তীর ও তারবারী ওরা কোথায় ব্যবহার করবে? অবশ্যই কিছু মানুষ দেখিয়ে বলতে হবে, এরা তোমাদের শত্রু। এদের নিশ্চিহ্ন কর।’
ইমাম সাহেবের কণ্ঠে ছিল অবর্ণনীয় আকর্ষণ। যাদুগ্রস্তের মত আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল শ্রোতারা। তিনি আবার শরু করলেন, ‘তোমাদের শিশুদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। তাদের সাথে তোমরাও আগুনে পুড়বে। তোমরাই ওদেরকে পাপের পথে নিক্ষেপ করেছো। সেনাপিত এবং সম্রাটগণ তোমাদের স্বর্গে নিয়ে যেতে পারবে না। শুধু দ্বীন ইসলামের প্রদীপধারী ইমাম এবং আলেমরাই স্বর্গ দিতে পারবে। সমগ্র জীবনের নামাজ পড়লে এবং ভাল কাজ করলেও মানুষের রক্তে রঙ্গীন হাত দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে।
তোমরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাকাত প্রদান কর। কোষাগার হল সরকারের, সরকার গরীব নয়। যাকাত হল গরীবের অধিকার। তোমাদের যাকাতের টাকায় অস্ত্র এবং ঘোড়া কিনে মানুষকে হত্যা করা হয়। যাকাত দিয়ে তোমরা বেহেস্তে যাবে, অথচ এখন পাপের ভাগি হচ্ছো। এজন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাকাত দেয়া যাবে না।’
ইমাম সাহেব আলোচনার বিষয় ঘুরিয়ে বললেন, ‘অনেক কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। বলারও কেউ নেই। মানুষের মধ্যে রয়েছে একটা কামজ রিপু। এ এক জৈবিক সত্বা। তোমাদের কি নারীর প্রয়োজন হয় না! এ হচ্ছে স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা। আল্লাহই এ চাহিদা তৈরী করেছেন। তোমরা এ চাহিদা পূরণ করতে পার। এ জন্যই আল্লাহ একসঙ্গে চার স্ত্রী ঘরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন স্ত্রীও যদি না রাখতে পার তবে টাকার বিনিময়ে কোন নারীর কাছে আকাঙ্খা পুরণ করতে যাওয়া অপরাধ হবে কেন? এ চাহিদা এ আকাঙ্খাতো খোদারই দান। তাই নিরূপায় হলে এ চাহিদা তোমাদেরকে অন্ধগলীতে নিয়ে যায়। এ অপরাধ নয়। এরপরও পাপ থেকে বেঁচে থেকো, কোন পুরুষের কাছে যেয়ো না। কারণ, কোরানে আছে, পুরুষের কাছে যাওয়ার অপরাধে আল্লাহ আ’দ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
এক থেকে চার পর্যন্ত যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পার। নিজের স্ত্রী এবং মেয়েদেরকে ঘরের ভেতর রাখবে। আমি দেখেছি যুবতী মেয়েদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে ঘোড়সওয়ারী, অসি চালনা এবং আহতকে প্রাথমিক চিকিৎকা দানের পদ্ধতি। ওরা যুদ্ধে যাবে। আহতদের সেবা করবে। প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে। ফলে পর্দার বিধান লংঙ্ঘিত হবে। এ চরম পাপ। এ পাপ থেকে নিজে বেঁচে থাকো। যারা মসজিদে আসেনা তাদেরকেও বলো। খোদার বিধানে কেউ হস্তক্ষেপ করোনা। এ বড়ই গুণাহর কাজ।’
ইমাম সাহেবের ওয়াজ শেষ হল। বসার স্থান না পেয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেক শ্রোতা। একজন একজন করে হুজুরের সাথে হাত মিলিয়ে সবাই ফিরে যেতে লাগল। কেউবা ঝুঁকে তাঁর হাতে চুমো খেলো।
ইমাম সাহেবের সামনে দু’জন লোক বসা। পরণে জুব্বা। মাথায় পাগড়ি। জরির কাজ করা রুমালে ঢাকা মুখের একাংশ। কাল দীর্ঘ দাড়ি। পোশাকে আশাকে মধ্যবিত্ত মনে হয়। একজনের এক চোখ হলুদ কাপড়ে বাধা। বললেন, হুজুর, ‘জিহাদ সম্পর্কে আরো কিছু বলুন।’
‘তোমার চোখে কি হয়েছে?’
‘হুজুর, আমার এক চোখ খারাপ।’
ইমাম সাহেব তাকালেন সংগীর দিকে। সংগীটির মুখের একাংশ রুমালে ঢাকা, ঘন দাড়ি। এ দু’জন ছাড়া সবাই চলে গেছে।
‘তোমাদের সন্দেহ এখনো দূর হয়নি?’ মৃদু হেসে ইমাম সাহেব প্রশ্ন করলেন।
‘সন্দেহ দূর হয়েছে।’ জবাব দিল একচোখা লোকটি। ‘আমরা সম্ভবত আপনাকেই খুঁজছি। মিসরের অর্ধেকটা চষে বেড়িয়েছি আপনার জন্য। আমাদেরকে ভুল ঠিকানা দেয়া হয়েছিল।’
‘অর্ধেক মিসরেও আমার মত আলেম পাওনি?’
‘খুঁজছিতো আপনাকে। আমরা কি সঠিক স্থানে আসিনি? ওয়াজ শুনে মনে হল আমরা আপনাকেই চাইছি।’
বাইরের দিকে তাকালেন ইমাম সাহেব। বললেন, ‘আবহাওয়া কেমন হবে জানিনা।’
‘বৃষ্টি আসবে।’ একচোখা লোকটির জবাব।
‘পরিষ্কার আকাশ।’
‘আমরা মেঘের সৃষ্টি করব।’ বলেই হেসে উঠল লোকটি। ইমাম সাহেব মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কোত্থেকে এসেছ?’
‘এক মাস ছিলাম ইস্কান্দারিয়া, তার আগে সুবাক।’
‘মুসলমান?’
‘ঘাতক দলের সদস্য। মুসলমান মনে করতে পারেন।’
এবার দু’জনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
‘আপনাকে ওস্তাদ মানছি।’ লোকটির সংগী বলল। ‘এ যে আপনিই আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না।’
‘আপনি ব্যর্থ হতে পারেন না।’
‘সাফল্য অত সহজ নয়।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আয়ুবীকে তোমরা চেননা। আমি জিহাদ এবং জীবন সম্পর্কে এদের চিন্তাধারা বদলে দিয়েছি। কিন্তু আয়ুবীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সফল হতে দিচ্ছে না। জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য তোমরা কেন আমাকে বারবার চাপ দিচ্ছিলে?’
‘সুবাক থেকে আমাদের বলা হয়েছে এটিই আপনার বড় পরিচয়।’ জবাব দিল একচোখা লোকটি। ‘আপনার বলা প্রতিটি কথাই ওখানে আমাদের শোনানো হয়েছে। আমাদের আরও বলা হয়েছে, আপনার ওয়াজে অবশ্যই যৌনতার প্রসঙ্গ থাকবে। এসব শিখতে আপনি নিশ্চয় অনেক পরিশ্রম করেছেন?’
‘আমার নাম কি?’
‘আপনি কি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন? সন্দেহ করছেন আমাদের? পরস্পরের পরিচিতির জন্য নাম নয় আমরা বিভিন্ন সংকেত ব্যবহার করি।’
‘তোমরা কি জন্য এসেছ?’
‘ঘাতকদল কি কাজ করে?’
‘আমার কাছে পাঠানো হয়েছে কেন?’
‘একটা উষ্ট্রীর জন্য। আপনার কাছে দু’টি রয়েছে। আপনার কাছে আসার কথা ছিল না। আপনি হয়ত খবর পেয়েছেন আয়ুবীর এক কমাণ্ডার রজবের কাছে সুবাক থেকে তিনটি উষ্ট্রী দেয়া হয়েছিল। একটা ছিল আমাদের জন্য। কিন্তু দু’টাই মারা গেছে। রজবের কাটা মাথা আর সবচেয়ে সুন্দরী উষ্ট্রীটা আয়ুবীর হাতে পৌঁছেছে। ওটাও শেষ।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি।’ ইমাম সাহেবের বিষন্ন কণ্ঠ। ‘আমাদের অনেক ক্ষতি হল। সালাহউদ্দীনের এক শক্তিশালী সেনাপতি আমাদের হাতে ছিল। তাকেও জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। ভেতরে চল, এসব কথার জন্য এ স্থান উপযুক্ত নয়।’
দু’জনই ইমাম সাহেবের সাথে বেরিয়ে গেল।
ইমাম সাহেব দু’জনকে নিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। বাড়িটি পরিচ্ছন্ন। দু’ তিনটা কামরা পেরিয়ে একটি কামরার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ওদের সামনে পুরনো এক দরজা। দরজায় তালা লাগানো। মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে খোলা হয়নি। এক পাশে জানালা। ইমাম সাহেব হাত লাগালেন। জানালার পাল্লা খুলে গেল। সবাই ভেতরে তাকাল। সাজানো গোছানো কক্ষ। দেয়ালে ঝুলছে সোনার তৈরী ক্রুশ। একপাশে যিশুর অন্যদিকে মা মেরীর হাতে আঁকা ছবি। ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমার গীর্জা। আমার আশ্রয়।’
‘আকস্মিক বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কি ব্যবস্থা রেখেছেন?’ একচোখা লোকটি প্রশ্ন করল। ‘ক্রুশ এবং ছবিগুলো এভাবে রাখা ঠিক হয়নি।’
‘এখানে আসার দুঃসাহস কেউ করবে না।’ ইমাম সাহেব হেসে বললেন। ‘মুসলমানরা সরল এবং আবেগপ্রবণ জাতি। হালকা যুক্তি আর আবেগময় কথায় ওরা জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয়না। জৈবিক চাহিদা মানুষের বড় দুর্বলতা। আমি এ দুর্বলতা উস্কে দিচ্ছি। এদের শিখাচ্ছি চারটে বিয়ে করা ফরজ। ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছী অশ্লীলতার দিকে। ধর্মের নামে মুসলমানকে দিয়ে ভাল-মন্দ দুটোই করানো যায। হাতে কোরান দেখলে এরা মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়। এ আমার সফল অভিজ্ঞতা। আমি এমন একদল লোক তৈরী করব যারা কোরান হাতে নিয়ে মসজিদে বসেই জিহাদ এবং সৎকর্ম নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আমি মেয়েদের ব্যাপারে ওদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করে দিচ্ছি। আয়ুবী মেয়েদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। আমি ওদের ঘরের কোণে বন্দী রেখে অর্ধেক জনশক্তি বেকার করে দেব।’
‘সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছাড়ানো উচিৎ।’ একচোখা লোকটির সংগী বলল। ‘আয়ুবীর বড় সাফল্য, তিনি ফৌজ এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এ মুহূর্তে যদি ঘোষণা করেন, ফিলিস্তিন জয় করব, তবে মিসরের সব মানুষ তার সংগী হবে।’
‘তিনি এমন ঘোষণা দেবেন না। কারণ তিনি বুদ্ধিমান। আবেগপ্রবণ লোক তিন পছন্দ করেন না। একশ’ উত্তেজিত জনতার চেয়ে একজন প্রশীক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিককে তিনি বেশী প্রাধান্য দেন। তিনি সস্তা শ্লোগান দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার লোক নন, তিনি বাস্তববাদী। মানুষকে বাস্তবতা আর প্রশিক্ষণ থেকে দূরে রেখে আবেগপ্রবণ করাই আমাদের কাজ। চিন্তা ছেড়ে দেবে মুলসমানরা। অবাস্তব আবেগে উত্তেজিত হবে। থমকে যাবে শত্রুর নিক্ষিপ্ত প্রথম তীর দেখে। আবেগ ছাড়া ওদের সব কিছুই আমরা নিঃশেষ করে দেব। দেখনি ওয়াজে আমি আয়ুবীর কেমন প্রশংসা করেছি।’
‘এসব কথা পরে হবে। আমরা উষ্ট্রী দুটো দেখতে চাই। তারপর বলুন, আমাদের কিভাবে আশ্রয় দেবেন। ও দু’জন ছাড়া এখানে কি অন্য কোন লোক থাকে?’
‘না, এখানে আর কেউ থাকে না।’
ইমাম সাহেব এখন সন্দেহমুক্ত। আলাপচারিতা থেকে তিনি নিঃসন্দেহ হয়েছেন যে এরা গোপন ঘাতক দলের সদস্য। তিনি তালা খুলে কামরায় প্রবেশ করে বসতে দিলেন ওদের।
‘আপনারা বসুন, আমি ওদের নিয়ে আসছি।’
কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। একটু পর ফিরে এলেন সঙ্গে দুই অপরূপা যুবতীকে নিয়ে। দু’জনই আরব্য রজনীর পরীদের মত অপূর্ব সুন্দরী। পরনে মখমলের কালো ঘাগরায় সোনালী জরির কাজ, উপরে দুধে-আলতা রংয়ের হাতাকাটা মিনি ব্লাউজের ওপর পাতলা রেশমী ওড়না। চোখে মুখে স্নিগ্ধ কমনীয়তার কোমল পরশ। কচি লাউ ডগার মত সতেজ আর পেলব ত্বক।
লোকজন জানে এরা ইমাম সাহেবের স্ত্রী। আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে ওদের এখানে আনা হয়েছিল। এখন বোরকা নেই। দেহের বেশীল ভাগ উন্মুক্ত। ওদের সাথে যুবতীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আলমারী থেকে মদের বোতল বের করলেন ইমাম সাহেব। গ্লাস ভরলেন। লোক দু’জন ছু’লনা, এমনকি এক নজর দেখেই চোখ ধাঁধাঁনো যুবতীদের দিক থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
‘আগে কাজের কথা বলি, তারপর এসব হবে।’ বলল একচোখা লোকটি।
‘আমরা দু’জনকে হত্যা করতে চাই।’ সংগীর কণ্ঠ, ‘সালাহউদ্দীন আয়ুবী এবং আলী বিন সুফিয়ান। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের আমরা কখনও দেখিনি। ওদেরকে চিনিয়ে দেবেন। আপনি কি দেখেছেন কখনও?’
‘এত্তবেশী, এখন অন্ধকারেও ওদের চিনতে পারব। ওদের চেনাই ছিল আমার এ অভিযানের প্রথম কাজ। আলী ভীষণ ঘাগু। ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ। তবে ছদ্মবেশে এলেও আমি তাকে ঠিকই চিনতে পারব।’
‘আয়ুবীর ব্যাপারে কি অভিমত?’ একচোখা লোকটি বলল।
‘তাকেও চিনতে কষ্ট হবেনা।’
একচোখা লোকটি কানের কাছে তুলে আনলেন হাত। এক ঝটকায় খুলে আনলেন কৃত্রিম দাড়ি, গোঁফ। ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। টেনে ছিঁড়ে ফেললেন চোখের হলুদ পর্দা। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন ইমাম সাহেব। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। বিষ্ফারিত চোখ। আতংকিত মেয়ে দু’টো একবার তাকাচ্ছিল ছদ্মবেশী লোকটির দিকে আবার দেখছিল ভয়ে পাংশু হয়ে যাওয়া ইমাম সাহেবের মুখের দিকে। ভয়, আতংক আর উদ্বেগ মেশানো কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে উঠল ইমাম সাহেব, ‘সালাহউদ্দীন আয়ুবী!’
‘হ্যাঁ বন্ধু! আমি সালাহউদ্দীন আয়ুবী, তোমার খ্যাতি শুনে ওয়াজ শুনতে এসেছিলাম।’
সংগীর দাড়ি মুঠোয় চেপে এক ঝটকায় খুলে ফেললেন সুলতান আয়ুবী।
‘হ্যাঁ চিনি।’ ইমামের কণ্ঠে পরাজয়। ‘আলী বিন সুফিয়ান।’
আকস্মাৎ মেয়ে দু’টো ঘুরে পেছনের আলমিরার ওপর থেকে ছুরি টেনে নিল। সালাহউদ্দীন আয়ুবী ও আলী বিন সুফিয়ান ওদের ক্ষিপ্রতা দেখে মোটেও অবাক হলেন না। ওরা যে সব রকমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তা ওদের ক্ষিপ্রতা দেখেই বুঝে নিলেন।
ওরা যখন মেয়েদের তৎপরতা দেখছিলেন সেই ফাঁকে ইমাম সাহেব পেছনে হাত চালিয়ে বের করে আনলেন তরবারী। চোখের পলকে আঘাত করলেন আয়ুবীর মাথায়।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী এ আঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। চকিতে সরে দাঁড়ালেন তিনি।
ততক্ষণে দু’জনই জুব্বার ভেতর থেকে তরবারী বের করে নিয়েছেন।
তরবারী চালনায় দক্ষ হলেও আরবের বিখ্যাত দুই বীরের সামনে দাঁড়াতে পারল না ওরা।
আলী মেয়েদের ছুরি ধরা হাতের কনুই বরাবর ছেড়ে লাথি চালালেন। সাঁই করে ছুটে গিয়ে ছুরি দুটো দেয়ালে ঠক করে বাড়ি খেল।
আয়ুবীর তলোয়ার স্পর্শ করল ইমামের তরবারী। তলোয়ারে তলোয়ার ঠেকিয়ে চাপ বাড়ালেন তিনি। পেছনে সরে যেতে চাইল ইমাম। সালাহউদ্দীন ওর দু’পায়ের ফাঁকে নিজের পা ঢুকিয়ে দিয়ে ওকে আরেকটু ঠেলে দিলেন পিছনে। ফলে তাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে পড়ে গেল ছদ্মবেশী ইমাম। হাত থেকে ছিটকে গেল তলোয়ার।
আলী এগিয়ে এসে অস্ত্রগুলো তুলে নিল এক এক করে। আয়ুবী আলীকে বললেন, ‘বাইরে তোমার যে বন্ধুরা আছে ডাকো তাদের।’
বেরিয়ে গেলেন আলী। ফিরে এলেন অস্ত্রধারী ছ’জন সংগীকে নিয়ে। এতক্ষণ এরা বাইরে পাহারা দিচ্ছিল।
পরদিন মসজিদের সামনে জনতার প্রচণ্ড ভীড় জমে উঠল। ইমাম এবং মেয়ে দু’টোকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল জনতার সামনে। ছদ্মবেশী ইমাম সাহেব কিভাবে জিহাদ আর যৌনতার বিরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছিল তা তুলে ধরা হল জনতার সামনে।
আয়ুবী আবেগময় ভাষায় বললেন, ‘মুসলিম ভাইয়েরা আমার! আমার কাছে ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর কালাম ও রাসূলের সুন্নাহ। প্রিয় নবী (সা.) যা বলেছেন ও করেছেন ইসলাম বলতে আমি তাকেই বুঝী, এর বেশীও না কমও না। পরহেজগারীর নামে দিনরাত মসজিদ ও খানকায় পড়ে থাকার নাম ইসলাম হতে পারেনা। আল্লাহ যেমন জামাতে নামাজ পড়ার কথা বলেছেন তেমনি বলেছেন নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়ার কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়তে। এটাই ইসলাম।
আপনারা দেখতে পেয়েছেন কিভাবে সুফী ও দরবেশ সেজে আমাদেরকে কর্মবিমুখ করার সুগভীর চক্রান্তে মেতে উঠেছে শয়তানরা। যেখানে প্রিয় নবীর সহধর্মিনীরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, ছুটে গেছেন জেহাদের ময়দানে, পূর্ণ্যময়ী মহিলা সাহাবীগণ শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন, সেখানে পর্দার নামে আমাদের অর্ধেক জনশক্তিকে গৃহবন্দী করার পায়তারা করছে। যেন রাসূলের চাইতে তারা ইসলাম বেশী বুঝে, সাহাবীদের চাইতে তারা বেশী মুত্তাকী ও পরহেজগার। এ ধরণের আলেমদের ব্যাপারে আপনারা সতর্ক থাকবেন, এরা আলেম নয় খ্রীষ্টানদের চর। ইসলাম কোন ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। আমাদের মেয়েরা অবশ্যই পর্দা করবে, তবে ততটুকুই, যতটুকু করার জন্য ইসলাম তাদের নির্দেশ দিয়েছে। আবার আমাদের মেয়েরা সামাজিক ক্রিয়াকর্মেও অংশগ্রহণ করবে, তাবে ততটুকুই, যতটুকু করার অধিকার ইসলাম তাদের দিয়েছে।
ঘরে আগুন লাগলে পর্দার জন্য মেয়েদের ঘরের ভেতর পুড়ে মরতে হবে ইসলাম যেমন এ কথা বলেনা, তেমনি খোলামেলা শরীরে রাস্তায় ঘুরে বেহায়াপনা ছড়িয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অবাধ লাইসেন্সও দেয়না ইসলাম। ইসলাম সর্বাবস্থায় মধ্যমপন্থী জাতি। আমরা আমাদের মাতা-ভগ্নিদেরকে বাজারের পণ্য বানাতে পারিনা, এ ধরনের যে কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে, সেই সাথে শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় ব্যাপকভাবে সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের সকল সুযোগ তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে তাদের মর্যাদা ও অধিকারকেও নিশ্চিত করতে হবে।
বন্ধুরা আমার, ওরা আমাদের ভালবাসার মন্ত্র শোনায়, মানবতার কথা বলে। আমরা ওদের মতো ঘৃণার বেলুনের ওপর ভালবাসার রঙিন মোড়ক লাগাইনা। আমরা মানুষকে ভালবাসি হৃদয়ের গভীর মমতা দিয়ে। আমাদের আদর্শ সেই মহামানব, প্রতিদিন চলার পথে কাটা বিছিয়ে রাখার পরও নিঃসঙ্গ অসুস্থ বুড়িকে সেবা দিয়ে যিনি আপন করে নিতে পারেন।
ভালবাসা ও সেবার ক্ষেত্রে জাত-পাতের কোন ভেদাভেদ করতে শিখিনি আমরা। আমাদের নবী স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে ব্যক্তি পেটপুরে খায় সে আমার উম্মত নয়। এর চে’ অধিক মানব প্রেমের কথা কে কবে বলেছে? যার মাঝে এতটুকু মানব প্রেমের সৃষ্টি না হবে সে মুসলমান হবে কেমন করে। ভেবে দেখুন, যদি আমরা নবীর উম্মতই হতে না পারলাম তবে আমাদের এতসব এবাদত বন্দেগী কোন কাজে লাগবে?
তাইতো আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে মানবতারই জয় ঘোষিত হয়। ইসলাম চায় মানুষ যেন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। তাই মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা একজন মুজাহিদের পবিত্র দায়িত্ব। মানুষের আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য চেষ্টা করা আমাদের কাছে নিছক দুনিয়াবী কাজ নয়, বরং একজন সত্যিকার মুজাহিদের কাছে এটুকু ইসলামের ন্যুনতম দাবী। এ দাবীকে পাশ কাটিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিনা আমরা। আবার আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা বাদ দিয়ে কেবল দুনিয়াবী সমস্যার সমাধান করাকেও আমরা ইসলাম মনে করতে পারিনা।
প্রিয় ভাইয়েরা, আমাদের সংগ্রাম তাই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোের সংগ্রাম। ওরা আমাদের অস্ত্রের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে আমরা রক্তপিপাসু। না, ক্ষমার মহত্তম দৃষ্টান্ত আমরাই দেখাতে পারি। এক ফোটা রক্ত না ঝরিয়েও আমরা মক্কা জয় করতে পারি। তারপরও আমাদের নবীকে অর্ধ শতাধিক লড়াই পরিচালনা করতে হয়েছিল কি জন্য? মানবতার অপমান আমরা বরদাস্ত করতে পারিনা। মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আমরা আপোষ করতে পারি না। আমরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি নিপীড়িত মজলুম মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। চোর যদি ধর্মের কাহিনী শুনতো তবে আমাদের অস্ত্র হাতে নেয়ার প্রয়োজন হতোনা। কিন্তু আমরা জানি, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।
সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য আমাদের এ লড়াই অব্যহত থাকবে। খ্রীষ্টানদের যে কোন হামলা ও ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়ার জন্য সবসময় সজাগ ও প্রস্তুত থাকার জন্য আমি আপনাদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।’
আয়ুবীর বক্তৃতার পর খ্রীষ্টান গোয়েন্দাদের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। অবাক বিস্ময়ে জনতা শুনল ছদ্মবেশী ইমাম এবং মেয়ে দু’টোর স্বীকারোক্তি।
তারপর জনতাকে একজন একজন করে লাইনে দাঁড় করিয়ে ইমাম সাহেবের ঘরে নিয়ে দেখানো হল ক্রুশ, মেরী আর যিশুর মূর্তি। সাধারণ মানুষের সামনে খুলে গেল এক ছদ্মবেশী খ্রীষ্টান গোয়েন্দার অপকর্মের নমুনা।
* * *
সুলতানের নির্দেশে সমগ্র দেশে গুপ্তচরের নিশ্ছিদ্র নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। খ্রীষ্টান গোয়েন্দায় ভরে গিয়েছিল দেশ। ইসলামী সংস্কৃতি বিনষ্ট করার গভীর ষড়যন্ত্র সুলতানকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।
একজন ইমাম ইসলামী চিন্তাধারা পাল্টে দিচ্ছে সংবাদ পেয়ও তিনি তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেননি। বলেছিলেন, ‘আলী! ধর্ম আজ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হতে শুরু করেছে। ইমাম সাহেব হয়ত এমন কোন উপদলের লোক। অথবা তিনি মনগড়া তাফসীর করছেন। ধর্মীয় ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করতে চাইনা। আমি প্রশাসক- আলেম নই, যদি তাকে গুপ্তচর মনে কর ভালভাবে যাঁচাই বাছাই করে নাও। আমার চাইতে একজন ইমামের মর্যাদা অনেক উর্ধে।’
গোয়োন্দা হলে চিনে ফেলতে পারে এ জন্য আলী নিজে মসজিদে যাননি। ক’জন লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দশ থেকে বার দিন গিয়েছে ওরা। আলীকে শুনিয়েছে ইমামের বক্তৃতার হুবহু বর্ণনা।
আলী সুলতানকে বললেন, ‘লোকটা গোয়োন্দা না হলেও ভ্রান্ত আকিদার। তাকে ধরা উচিৎ। সে এমনভাবে জিহাদের ব্যাখ্যা করছে যা শুধু একজন শত্রুর পক্ষেই করা সম্ভব।’
সুলতান মনোযোগ দিয়ৈ আলীর কথা শুনে বললেন, ‘ব্যাপারটা মসজিদ এবং ইমাম সম্পর্কে। কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে আরেকটু যাচাই করা দরকার।’
অবশেষে সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন আলী সহ নিজেই যাবেন ইমামের ওয়াজ শুনতে।
আহমদ কামালের গ্রেফতার করা মেয়েটার কাছ থেকে আলী জেনে নিয়েছিলেন খ্রীষ্টান গোয়েন্দাদের ব্যবহৃত কোড বা সংকেত। মেয়েটা বলেছিল, ‘গোয়েন্দারা কেউ কারো নাম বলে না। ‘আমরা মেঘ নিয়ে আসব’ বলে পরস্পরকে পরিচিত হতে হয়। সুলতান তাই করেছিলেন। ধরা পড়ল ইমাম।
ওদের তিনজনকে কারাগারে পাঠিয়ে তদন্ত শুরু করলেন গোয়েন্দা প্রধান।
তদন্তে জানা গেল, কায়রো উপশহরের এ মসজিদ জামে মসজিদ না হলেও মুসল্লীর অভাব নেই। এলাকাটায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত লোকের বাস। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এখানকার লোকগুলো জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে বেশিরভাগ লোকই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ওরা সহজেই মন ভোলানো আবেগময় কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
ছ’সাত মাস ধরে এলাকার মসজিদের কথা সবার মুখেমুখে। নতুন পেশ ইমাম এশার পর এমন ওয়াজ করেন যা কেবল মর্মস্পর্শীই নয়, অভিনব ও চিত্তাকর্ষকও।
ঘটনার বিবরণে জানা গেল, ‘একদিন দু’জন স্ত্রীসহ একজন লোক এল গাঁয়ে। উঠল এক ব্যাক্তির ঘরে। দেখতে আলেমের মত। মসজিদে আসা যাওয়া করতে লাগলেন তিনি। ধীরে ধীরে ইমাম সাহেবের ভক্ত হয়ে গেলেন নতুন আলেম।
পনের ষোল দিন পর একদিন ইমাম সাহেব মসজিদে এলেন না। খবর নিয়ে জানা গেল তিনি অসুস্থ।
হাকীম সাহেব তার বাসায় গিয়ে দেখলেন ইমাম সাহেবের পেটে ব্যাথা। কোন ওষুধ কাজ হলনা। তিন দিন পর মারা গেলেন ইমাম সাহেব। ইমাম সাহেব যেদিন অসুস্থ হন সেদিন আগন্তুক আলেম গ্রামে ছিলেন না, আগে যেখানে থাকতেন সেখান থেকে জিনিসপত্র আনতে গেছেন।
ইমাম সাহেবের মৃত্যুর পর দিন ফিরে এলেন তিনি।
পরনে লাল জুব্বা, ফর্সা চেহারা, ধূসর দাড়ি, মধুর তেলওয়াত। ইমাম সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুর খবর শুনে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘আহা! অমন ভাল লোক আর হয়না। উনি তো চলে গেলেন, এখন আমাদের কি হবে?’
‘কি হবে মানে?’
‘না, বলছিলাম, এখন তো আমাদের একজন ইমাম দরকার।’
‘তা দরকার বৈকি। তবে কিছু মনে না করলে বলব, আপনার যা এলেম-আমল এ দায়িত্বটা যদি আপনি নেন তবে আমাদের আর কোন দুশ্চিন্তা থাকেনা।’
তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আপনারা সবাই চাইলে এ দায়িত্ব আমি নিতে পারি। এখানে থাকলে নিরিবিলিতে কিছু এবাদত বন্দেগীর সুযোগ পাবো। যদিও শহরে ইমামতি করেই দিন কাটাতাম কিন্তু হৈ-হাঙ্গামা এ বয়সে আর ভাল্লাগেনা বলেই এখানে চলে এসেছি।’
তার কথায় লোকজন খুবই খুশি হল। ইমাম হিসাবে এমন একজন অভিজ্ঞ আলেম পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। এলাকার গণ্যমান্য লোকজন সামান্য পরামর্শের পর তাকেই ইমাম হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল।
বেতন নিয়ে তিনি কোন দরকষাকষি করলেন না। বললেন, ‘আপনারা যা বিবেচনা করে দেবেন তাতেই আমার হবে। তবে কারো দেয়া নজরানা, হাদিয়া বা তোহফা আমি গ্রহণ করতে পারবো না। আমার দরকার শুধু খাওয়া-পরা ও স্ত্রীদের নিয়ে পর্দা পুশিদা মত থাকার মত একটা বাড়ি।’
লোকজন মসজিদের পাশেই কয়েক কামরার একটি বাড়ী খালি করে দিল। সবার সামনে তিনি বাড়ীতে এসে উঠলেন। সাথে দুই স্ত্রী। স্ত্রী দু’জনই বোরকা পড়া, হাতে দস্তানা, পায়ে মোজা। লোকজন হুজুরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সরবরাহ করল। তার ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হল সবাই। সকলকে মোহিত করল তার সুরেলা কণ্ঠের যাদু।
মসজিতে আযান দিলেন মৌলভী সাহেব। আযানের শব্দে নিরবতা ছেয়ে গেল সমগ্র এলাকায়। যেন ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে পবিত্র এক সুর। সুরের মূর্চ্ছনায় মসজিদে ছুটে এল মানুষ। যারা বাড়ীতে নামাজ পড়তেন ছুটে এলেন তারাও। এশার পর সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ করলেন তিনি। বললেন, প্রতিরাতে এভাবে ওয়াজ করবেন।
সুরেলা কণ্ঠের প্রতিদিন রাতে এশার নামাজের পর নিয়মিত ওয়াজ করে যাচ্ছেন ইমাম সাহেব। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। ছ’সাত মাসের মধ্যে তিনি পুরো এলাকায় সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। তার ভক্তের সংখ্যা বেড়ে চলল প্রতিদিন। অনেকে মুরিদও হল। এ মসজিদে আগে জুম্মা পড়া হতনা, তিনি প্রথম জুম্মা চালু করলেন।
চারদিকে ইমাম সাহেবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে ওয়াজ শুনতে ছুটে আসতে লাগল দূর-দূরান্তের লোকেরা। তার আলোচনায় স্থান পেত ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো। ইবাদাত এবং ভালবাসা ছিল প্রধান বিষয়। মানুষকে বুঝাতেন, মানুষ নিজে তার ভাগ্য গড়তে পারে না। মানুষ এক দুর্বল কিটাণুকীট। খোদার হাতেই মানুষের ভাগ্য। ওয়াজের সময় পবিত্র কোরান থাকত তার হাতে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রোতারা তার কথা শুনত। তিনি সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ূবীর প্রশংসা করে বলতেন, ‘মিসরের সৌভাগ্য যে, তার মত এমন এক ব্যক্তিত্বকে পেয়েছে শাসক হিসাবে।’
তিনি জিহাদের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। মানুষ নির্দ্বিধায় তা মেনে নিল।
সুলতান আয়ূবী খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে জেহাদে শরীক হওয়ার আহ্বান জানালে দু’টো কারণে এ এলাকার লোকেরা ব্যাপকভাবে তাতে সাড়া দিয়েছিল। প্রথম কারণটি ছিল অর্থনৈতিক। সুলতান সৈন্যদের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিতেন।
দ্বিতীয় কারণ, সালাহউদ্দীন আয়ূবীর দেয়া জ্বালাময়ী ভাষণ। তিনি যখন বললেন, ‘খ্রীষ্টানরা পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের চিহ্ন মুছে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হল জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়া’ তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের ঈমানের শিখা জ্বলে উঠল। জিহাদ যে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ সুলতান ওদেরকে তা ভালভাবেই বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ইসলামের জন্য জীবন দেয়ার উদগ্র বাসনা নিয়েই ওরা সুলতানের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিল। এদের বিশ্বাসে চিড় ধরাবার জন্যই ইমামরূপী গোয়োন্দা এখানে আশ্রয় গেড়েছিল।
গোয়েন্দা ইমামের ঘরে তল্লাশী নেয়া হল। পাওয়া গেল অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং পোটলা ভরা বিষ। কুকুরকে খাওয়ানো হল সে বিষ। তিনদিন পর্যন্ত গড়াগড়ি করে মারা গেল কুকুরটা।
সুলতানের সামনে তদন্তের রিপোর্ট পেশ করলেন আলী।
‘ওদের বন্দী করে রাখ।’ সুলতান বললেন, ‘ভীষণ বিরক্ত করবে এবং আতংকের মধ্যে রাখবে। আমি ওদের জল্লাদের হাতে তুলে দেবনা, বন্দী করেও রাখবোনা।’
‘তাহলে কি করবেন?’
‘স্বসম্মানে দেশে পাঠিয়ে দেব।’
আলী হতবাক দৃষ্টি নিয়ে সুলতানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘আমি একবার ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাই আলী। এখন আমাকে কোন প্রশ্ন করোনা। একটা নতুন খেলা খেলব আমি। দেখি এ খেলার ফল কি হয়।’ খানিক থেমে আবার বললেন, ‘কাল দুপুরে সেনাপতি, সেনা উপদেষ্টা, সেনা কমাণ্ডার এবং সচিবদের মিটিং। তুমিও উপস্থিত থেকো।’
ছদ্মবেশী ইমামের নাম ছিল ডিউক। রাতে তার মুখোমুখি হলেন গোয়েন্দা প্রধান। প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কতজন এসেছ?’
ডিউক নিরুত্তর।
আলী আবার জানতে চাইলেন, ‘মেয়েদের কি জন্য এনেছ?
ডিউক এবারও নিরুত্তর রইল।
আলী বললে, ‘ডিউক, কয়েকটা বিষয়ে আমাদের জানা খুব জরুরী। তুমি কি আমাদের কোন সহযোগিতা করবে না?’
‘শোন আলী! আমরা দু’জন একই যুদ্ধের সৈনিক। আমার বিশ্বাস তুমি আমার হাতে ধরা পড়লে, জীবন দিতে তবুও জাতির সাথে বেঈমানী করতে না। আমিও তাই করব। আমার পরিনতি আমি জানি। তোমাকে সব তথ্য দিলেও আমাকে ক্ষমা করবে না। এখানেই মরতে হবে আমাকে। হোক নির্যাতনের মুখে বা জল্লাদের হাতে। তবে কেন আমার জাতির সাথে প্রতারণা করব?
‘আমার বিশ্বাস তুমি তোমার ইচ্ছে পরিবর্তন করবে। তুমি কি এ মেয়ে দু’টোর সম্ভ্রম রক্ষার খাতিরেও আমার প্রশ্নের জবাব দেবে না?’
‘সম্ভ্রম? এদের কাছে রূপ, সৌন্দর্য আর মেকি প্রেম ছাড়া কিছু নেই। প্রেমের অভিনয় দিয়ে এরা শুকনো পাথরকে গলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ওদের কাছে সম্ভ্রম বলে কিছু নেই। ওদেরকে সম্ভ্রম ও সতীত্ব বিসর্জন দেয়ার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। ওসব অনেক দূরে ছুড়ে ফেলে এখানে এসেছে ওরা। ওদের সাথে যা ইচ্ছে কর। আমার সামনেই ওদের সম্ভ্রম নষ্ট করলেও কিছুই বলব না আমি। মেয়েরাও কিছু বলবে না।’
‘গোয়েন্দা মেয়েদেরকে আমরা মৃত্যুদণ্ড দেই। ওদের সম্ভ্রম নষ্ট করি না। তবে তুমি সহযোগিতা করলে তোমাদের বিষয়টি সুলতান হয়তো সহনশীলতার সাথে বিবেচনা করতে পারেন।’
‘বন্ধু, আমাকে তুমি ভালবাসার লোভ দেখাচ্ছ। দেখাচ্ছ নির্যাতনের ভয়। বিনিময়ে তোমার দেশের মূলোৎপাটনের জন্য আমার যেসব সঙ্গীরা কাজ করছে তাদের নাম জানতে চাইছ। কিন্তু আমি দুঃখিত, এর কিছুই আমি বলতে পারব না। তুমি কথা দিয়েছ, তোমাকে সব কিছু বললে মেয়েদের সাথে তোমরা ভাল ব্যবহার করবে। তোমাকে শুধু আমি এতটুকু বলতে পারি এ লড়াই তোমার আর আমার নয়। এ যুদ্ধ ইসলাম আর ক্রুশের যুদ্ধ।
আমি সংবাদ আদান প্রদান করার মত সাধারণ গোয়েন্দা নই। আমি অনেক উঁচু স্তরের গুপ্তচর। আমি একজন আলেম। নিজের এবং তোমার ধর্ম গভীর মনযোগ দিয়ে পড়েছি। কোরানের গভীর পর্যন্ত অধ্যায়ন করেছি। স্বীকার করি তোমাদের ধর্ম সহজ সরল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রতিটি মানুষ তা সহজেই অনুসরণ করতে পারে। এর মধ্যে কোন শত্রুতা নেই, নেই কারো প্রতি ঘৃণার বীজ। এ জন্যই তোমার ধর্ম এত গ্রহণযোগ্য।
তোমাদের শত্রুরা তোমাদের ধর্ম সম্বন্ধে মানুষের মনে এমন সব প্রশ্ন ও ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছে যার কারণে ইসলামের আসল রূপ জনগণ কিছুতেই দেখতে পাচ্ছেন না। দিন যত যাবে এ বিভ্রান্তি কেবল বাড়তেই থাকবে।
ইহুদীরা মুসলিম আলেমের ছদ্মবরণে এতে জুড়ে দিয়েছে অপ্রয়োজনীয় সব বিধানাবলী। ইসলামে কুসংস্কারের স্থান নেই, কিন্তু আজ মুসলমানরা সবচেয়ে বেশী কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। মাথা নোয়ায় পীর আলীর মাযারে। শিন্নী মানে দরগায়। এমন আরও অনেক নতুন জিনিস তোমাদের ধর্মে সংযোজন করে দেয়া হয়েছে।
আমরাও দীর্ঘ দিন থেকে তোমাদের চিন্তাধারা বদলে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা জানি পৃথিবীতে টিকে থাকবে দুটি ধর্ম। একটি খ্রীষ্টবাদ, অন্যটি ইসলাম। যে কোন একটি নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত কেউ থামবে না। তরবারীর জোরে বা বিরোধিতা করে কোন ধর্ম নিঃশেষ করা যায় না। কোন ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার একটাই মাত্র পথ, ভেতর থেকে রুহটাকে কেড়ে নিয়ে দেহের ওপর রঙের প্রলেপ মাখানো। তুমি কি বলতে পারো কিসের জোরে গুটিকয় মুসলিম সম্রাট নাজ্জাসীর বিশাল দরবারে দাঁড়িয়ে দুঃসাহসীর মত বলেছিল, ইসলাম গ্রহণ কর না হয় জিজিয়া দাও, আর যদি এ দুটোর কোনটাতেই সম্মত না হও তবে তোমাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালা করবে এ তরবারী। এ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই আমাদের মাঝে।
দুনিয়ার স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধির বিচারে এ ছিল স্রেফ আহাম্মকী। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, ওটা আহাম্মকী ছিলনা, তাদের এ দুঃসাহস ছিল ইসলামের অগ্রযাত্রার চাবিকাঠি। দুনিয়ার মানুষের সাথে মুসলমানতো কেবল এ তিন ধরেনের সম্পর্কই সৃষ্টি করতে পারে। হয় ওরা হবে মুসলমানদের ভাই, নইলে অনুগত, আর নয় শত্রু। আমরা কেবল এ আকিদাটুকুই নষ্ট করতে চাই, যাতে মুসলমানরা শত্রু-মিত্র ও আপন-পর ভেদাভেদ করতে না পারে। আমরা সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছি।
এ পথে আমি একা নই, বিরাট একটা দল তোমাদের সভ্যতার ওপর আঘাত করে যাচ্ছি। সংস্কৃতির উপর আঘাত করে যাচ্ছি। তোমরা অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের প্রতিযোগিতার ঘোড়া ছুটাতে থাকবে আর আমরা চুপিসারে তোমাদের ঈমান ও আকিদাটুকু বস্তায় ভরে সটকে পড়ব।’
আলী পায়চারী করছিলেন। মন দিয়ে শুনছিলেন গোয়েন্দা ডিউকের কথা। তিনি ভেবেছিলেন হাত-পা শেকলে বাধা গোয়েন্দাটি নির্যাতনের মুখে সব স্বীকার করবে। কিন্তু তার কথা শুনে বুঝলেন এর কাছ থেকে কথা আদায় করাটা সহজ হবে না।
আলী একজন কারা রক্ষীকে ডেকে তার হাত পায়ের শিকল খুলে দিতে বললেন। বাঁধন মুক্ত হলে খাবারের ব্যবস্থা করে বললেন, ‘কথা বের করার ফন্দি মনে করো না, যে ধর্মেরই হোক, আমি আলেমদের সম্মান করি। তোমাকে আমি কোন প্রশ্ন করব না। যা ইচ্ছে বলতে পার তুমি।’
‘আমি তোমাকে সম্মান করি আলী! আগেও তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তোমার ভেতর রয়েছে গোয়েন্দা শিল্পের যোগ্যতা, আবেগের উত্তাপ, খ্রীষ্টান সম্রাটগণ কেন তোমাকে হত্যা করতে চায় এবার আমি বুঝতে পেরেছি।
আমি স্বীকার করছি, তুমি সালাহউদ্দীন এবং নুরুদ্দীন জংগীর সম-পর্যায়ের। তোমরা জন্য এরচেয়ে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে!
আলী! শত্রু হলেও তুমি বুদ্ধিমান দুশমন। তোমার অন্ততঃ এটুকু বুঝা উচিত, কোন জাতির সংস্কৃতি বদলে দাও, তার ধ্বংসের জন্য আর যুদ্ধের প্রয়োজন হবে না। জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে অশ্লিলতার প্রসার ঘটাও। বিশ্বাস না হলে মুসলিম শাসকদের দিকে তাকিয়ে দেখ।
আত্মসংযম তোমার নবীর শিক্ষা। একথা আজ কে মানছে? ইহুদী সুন্দরীরা রূপের মায়াজাল বিছিয়ে তোমার জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। আজ বেহায়াপনা আর অশ্লীলতায় ডুবে আছে তোমার জাতি। মুসলমান, সে বিত্তহীন হোক বা বিত্তশালী, একাধিক বিয়ে করতে চায়। কিছু টাকা হাতে পেলেই যুবতীদের দিয়ে হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
পোপ ও পাদ্রীরা তোমাদের চিন্তচেতনায় যৌনতাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তোমরা তোমাদের নবীর নির্দেশ পালন করলে মুসলমান পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ জুড়ে থাকত। এখন মুসলমান নামে মাত্র টিকে আছে। সংকীর্ণ হচ্ছে তোমাদের সালতানাত, এ সবাই হচ্ছে আমার মত আলেমদের তৎপরতার ফলে।
বন্ধু আমার! এ তৎপরতা চলতে থাকবে। আমি ভবিষ্যতবাণী করছি, একদিন পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে না। থাকলেও তা হবে বিকৃত। জীবন্ত ইসলমের পরিবর্তে থাবে ইসলামের রঙচঙা লাশ। ইসলামের অনুসারীরা অশালীনতায় ডুবে যাবে। যে কেউ সালাহউদ্দীন বা নুরুদ্দীন জংগী হতে পারে না। এ দু’জনকে একদিন মরতে হবে। আগামী প্রজন্মকে আমরা জৈবিক চেতনার সাগরে ভাসিয়ে দেব। ওরা হবে নফসের গোলাম। বিবেক বলে কিছু থাকবেনা ওদের কাছে।
আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। মরবে না আমাদের তৎপরতা। মানুষ মরে গেলেও তার উদ্দেশ্যের মৃত্যু হয় না। আর একজন এসে আমার স্থান দখল করবে। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করেই তবে আমরা থামব। এবার ইচ্ছে করলে আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে পার। আমি আর কিছুই বলব না।’
আলী তাকে আর কোন প্রশ্ন করেননি। হয়ত ভাবছিলেন কত কঠিন, কত বন্ধুর তার চলার পথ। খ্রীষ্টান গোয়েন্দার প্রতিটি কথা, প্রতিটি বর্ণ সত্য। এক ঝাঁক জীবানু জাতির নৈতিকতাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আরবের আমীল ওমরারা তো শেষ হয়েই গেছে। বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছেন আয়ুবী। কিন্তু ওরা এমন একদিক থেকে আক্রমণ করছে যা বন্ধ করা সুলতানের পক্ষে দুঃসাধ্য।
কারা কক্ষের দরজা বন্ধ করে মেয়েদের কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আলী। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়ে দুটো। আলী কতক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। এরপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
* * *
জরুরী মিটিং ডেকেছেন সুলতান আয়ুবী। উপস্থিত সদস্যরা গোয়েন্দাদের গ্রেফতারের কথা জানত। জানত, এ ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় সে পরামর্শের জন্যই এ সভা।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী আসন গ্রহণ করে সবার দিকে তাকালেন। মনে হল খুঁজছেন কাউকে।
‘বন্ধুগণ!’ তিনি বললেন, ‘আপনারা শুনেছেন এক মসজিদ থেকে এক খ্রীষ্টান গোয়েন্দাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে ছিল সে মসজিদের পেশ ইমাম।’
সুলতান সবার সামনে গোয়োন্দাকে কিভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে সে ঘটনা শোনালেন। ইমামরূপী গোয়েন্দা ডিউক আলীকে যা বলেছে তাও বললেন।
‘খ্রীষ্টান গোয়োন্দাদের অপতৎপরতা থেকে সতর্ক থাকুন, এ ওয়াজ করার জন্য আপনাদে ডাকিনি। যারা শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা জাহান্নাতে যাবে, একথাও বলব না। এখন থেকে কোন গাদ্দারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মুক্তি দেব না। গাদ্দারের সামনে এবং পেছনে ‘আমি গাদ্দার’ লিখিত সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে তাকে বাজারের অলিগলিতে ঘুরানো হবে। চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মৃত্যু হবে ক্ষুধা তৃষ্ণায়। কাউকে তার জানাযা বা দাফন করার অনুমতি দেয়া হবে না।’
‘আমার প্রিয় বন্ধুরা! এতে শত্রুর কোন ক্ষতি হবে না। ওরা অন্য গাদ্দার তৈরী করে নেবে। যতদিন ওদের কাছে নারী, বেহায়াপনা আর অর্থ আছে, আমাদের দুর্বল ঈমানের লোকেরা গাদ্দার হতেই থাকবে। বেঈমান কোরান হাতে নিয়ে আপনাদের মসজিদে আপনাদের নবীর বানী বিকৃত করছে, এ কি আপনাদের বিবেকের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়?
একবার ভেবে দেখুন, যে সব মেয়েদর গুপ্তচরবৃত্তির জন্য এদেশে পাঠানো হয় তার অধিকাংশই মুসলামন। শিশুকালে ওদের তুলে নেয়া হয়েছে কোন কাফেলা থেকে। ওদের অশ্লীলতার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। শেখানো হয়েছো পুরুষ ঘায়েল করার নানান কায়দা কানুন। ট্রেনিং দিয়েছে বেহায়াপনার।
অমুসলিমরা ফিলিস্তিন দখল করে রেখেছে। মুসলমানদের ওপর চলছে সীমাহীন অত্যাচার। লুণ্ঠিত হচ্ছে ওদের সম্পদ। প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে কারাগারে অকথ্য নিস্পেষণে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। সুন্দরী শিশু মেয়েদের অপহরণ করে বেহায়াপনা আর গোয়েন্দা বৃত্তির ট্রেনিং দেয়া হয়। এরপর পাঠানো হয় মুসলিম জনপদে।
ওরা নিজের মেয়েদেরও এ কাজের জন্য ব্যবহার করে। খ্রীষ্টানদের কাছে নৈতিকতা বা ইজ্জত-আব্রুর কোন বালাই নেই। ফিলিস্তিন দখল করে ওরা নতুন বিপ্লব এনেছে, সে বিপ্লব হল নির্বিচারে মুসলিম হত্যা, লুটপাট, মুসলিম শিশুদের অপহরণ। যুবতীদের ইজ্জত বিকাতে বাধ্য করা। সুন্দরী যুবতীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলিম আমীর ওমরাদের হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। এমনকি মুসলিম শিশুদের গলায় ওরা ক্রুশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়েছে।
মুসলিম দেশ সমূহে আশ্রয়প্রার্থী অসংখ্য কাফেলাকে পথিমধ্যে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ইজ্জত হরণ করেছে আমাদের বোনদের, আমাদের মেয়েদের। আমাদের ভাইয়েরা বাধা দেয়নি।
খ্রীষ্টানরা চায় পৃথিবীতে নামমাত্র মুসলমান থাকুক। মুসলিম মেয়েদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসুক ক্রুশধারী খ্রীষ্টান। আমরা ভুলে গেছি সে সব নির্যাতীত বোনদের। ওরা আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে। বলছে, খ্রীষ্টান বর্বরতার শিকার শহীদদের কথা আমাদের মনে নই। কোন নির্দেশ দেয়ার পূর্বে আমার প্রশ্ন, বলুন এখন আপনারা কি করবেন? আপনাদের মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞ সেনা কমাণ্ডার, যোগ্যতর প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সম্মানিত আমীর!’
আয়ুবী থামলে একজন কমাণ্ডার বললেন, ‘প্রতিবেশী মুসলমান নির্যাতীত হলে তাদের সহযোগিতা করা ফরজ। এ হচ্ছে খোদার হুকুম। এ ফরজ আদায় করা থেকে আপনি আমাদের বিরত রাখতে পারেন না। অনতিবিলম্বে মজলুম ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া জরুরী। আমার মনে হয়, মুহূর্তমাত্র কালবিলম্ব না করে আমাদের ফিলিস্তিন আক্রমণ করা উচিত।’
এবার উঠে দাঁড়ালেন একজন সহকারী সেনাপ্রধান। আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘অমুসলিমদেরকে আক্রমণ করার পূর্বে আমাদের উচিত গাদ্দার মুসলিম শাসকদেরকে আক্রমণ করা। সবচেয়ে লজ্জাস্কর কথা হল, আমাদের মধ্যেও বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। ফয়জুল ফাতেমির মত লোক গাদ্দারী করলে কাকে আর বিশ্বাস করবো আমরা? একজন মুসলিম যুবতীর ইজ্জতের জন্য সমগ্র জাতিকে যেখানে মোকাবেলায় দাঁড় করিয়ে দেয়ার কথা সেখানে অসংখ্য নারীর ইজ্জত নষ্ট করা হচ্ছে, আর আমরা ভাবছি কি করব?
খ্রীষ্টানরা আমাদের মেয়েদের অশ্লীল কাজের ট্রেনিং দিয়েছে আর আমরা আমাদেরই মেয়েদের সাথে অশ্লীল কাজ করে যাচ্ছী। সম্মানিত আমীর। আমার কথাগুলোকে উদ্বেলিত ভাবাবেগ না ভাবলে বলব, এ মুহূর্তেই আমাদের ফিলিস্তিন দখল করা উচিত। আমাদের প্রথম কিবলা ওরা কুকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।’
আরো একজন উঠে দাঁড়ালেন। হাতে ইশারায় তাকে বসিয়ে দিলেন সুলতান। বললেন, ‘আপনাদের মুখে এ কথাই আমি শুনতে চেয়েছি। যারা আমার কাছে থাকেন নিশ্চয়ই জানেন আমার প্রথম লক্ষ্য ফিলিস্তিন। মিসরের দায়িত্ব নেয়ার পরই আমি ফিলিস্তিন আক্রমণ করতে চেয়েছিলাম। দু’বছর চলে গেছে। বেঈমানদের অপতৎপরতায় আমি সময়ের চোরাবালীতে আটকে গেছি।
গত দু’ বছরের ঘটনাবলী স্মরণ করুন। আপনারা খ্রীষ্টান গুপ্তচর আর গাদ্দারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আমাদের লোকেরাই সুদানীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। সুদানের কাফ্রীদের দিয়ে মিসর আক্রমণ করিয়েছে আমাদের সেনাপতি এবং কমাণ্ডাররাই। এরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন গ্রহণ করে। দেশের মানুষ আল্লাহার নামে এ টাকা কোষাগারে জমা দেয়।
বেঈমানদের নিশ্চিহ্ন করে আমি ফিলিস্তিন আক্রমণ করব এ আশায় আমি দু’বছর কাটিয়েছি। কিন্তু এখন বুঝেছি, খ্রীষ্টানদের গোয়েন্দা তৎপরতা কখনও শেষ হবে না। এ জন্য আমি এর মূলে আঘাত হানতে চাই। আমাদের মধ্যে গাদ্দার তৈরী করার জন্য আমরাই খ্রীষ্টানদের সুযোগ দিচ্ছি।
আজ আপনাদের সামনে আমি অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করছি, সহসাই আমরা ফিলিস্তিন আক্রমণ করতে যাচ্ছী। সেনা প্রশিক্ষণ আরও জোরদার করুন। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার এবং অবরোধ করার মত ট্রেনিং দিয়ে প্রস্তুত করুন তাদের।
তুর্কী এবং সিরিয় বন্ধুদের আমি বিশ্বাস করি। মিসরী এবং অনুগত সুদানী সৈন্যদের মাঝে জেহাদের জযবা সৃষ্টি করতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে ওদের অনুভূতি শানিয়ে তুলুন। ওদের বলুন, তোমাদের মা-বোন খ্রীষ্টান পশুদের হাতে নির্যাতীত। তোমাদের মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে ওরা। ওদের বিবেকের দুয়ারে আঘাত করে ওদের জাগিয়ে তুলুন।
এ সময় প্রশাসন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অনেক। ইমাম সাহেবদেরকে প্রতিটি মসজিদে জিহাদের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বলুন। যুবকদের সামরিক ট্রেনিং নেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইমাম সাহেবদেরকে ওয়াজ করতে বলবেন। কোন ইমাম ইসলামী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কোন কথা বললে তাদের ইমামতি থেকে সরিয়ে দেবেন। আমাদের নৈতিক মনোবল দৃঢ় হলে কেউ আমাদের অনিষ্ট করতে পারবে না। খেয়াল রাখতে হবে কেউ যেন অলস বসে থাকতে না পারে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। ওখানে শত্রু তাড়াতাড়ি বাসা বাঁধতে পারবে। কবে এবং কখন ফৌজ রওয়ানা করবে পরে বলা হবে। আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করুন।
সাতদিন পর গোয়েন্দা ডিউক এবং মেয়ে দুটোকে সুলতান আয়ুবীর সামনে হাজির করা হল। ওদের হাতে বেড়ি, পায়ে শিকল। সুলতানের নির্দেশে পাশের কক্ষে রাখা হল ওদের। সুলতানের খাস কামরা আর ওদের কক্ষের মাঝে একটি দরজা। দরজার পাল্লা দুটো আলতো করে ভেরানো। মাঝখানের সামান্য ফাঁক ভাল করে খেয়াল না করলে কারো নজরে পড়ার কথা নয়।
সুলতান কক্ষে পায়চারি করছিলেন। বললেন, ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি ক্রাক আক্রমণ করব।’
ক্রাক ফিলিস্তিনের একটি জিলা, আরেক বিখ্যাত জিলা সুবাক। সুবাকে রয়েছে খ্রীষ্টানদের সুদৃঢ় কেল্লা, যাকে কেন্দ্র করে খ্রীষ্টানরা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনানায়ক এবং সম্রাটগণ এখানেই মিলিত হন। এখানেই গোয়েন্দা সংস্থার হেড কোয়ার্টার, ওদের ট্রেনিং হয় এখানেই।
সেনানায়ক এবং প্রশাসনের পদস্থ কর্তকর্তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সুলতান প্রথম সুবাক আক্রমণ করবেন। খ্রীষ্টানদের কেন্দ্র পরাভূত করতে পারলে ওদের কোমর ভেংগে যাবে। কিন্তু প্রথম কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি কেন আক্রমণ করতে চাইছেন তিনি তা কারো বুঝে আসছিল না।
একজন লেফট্যানেন্ট জেনারেল বললেন, ‘সম্মানিত আমীর। আপনার নির্দেশ আমরা নির্দ্বিধায় পালন করব। তবে আমার মনে হয় আগে সুবাক দখল করলে ভাল হয়। দুশমনের কেন্দ্রশক্তি প্রথম ধ্বংস করা উচিৎ। সুবাক হাতে এলে ক্রাক দখল করা আমাদের জন্য পানির মত সহজ হয়ে যাবে। ক্রাকে আমাদের শক্তি ক্ষয় হলে সুবাক দখল করা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।’
দরজার ফাঁক দিয়ে পাশের কক্ষের সবকিছুই শোনা যাচ্ছিল। সুলতানের কণ্ঠ ছিল পরিষ্কার। গোয়েন্দা ডিউক উৎকর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। সুলতান বললেন, ‘আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হব। সুবাকের চাইতে ক্রাক দখল করা সহজ হবে। তখন ওখানেই আমরা আমাদের কেন্দ্র করতে পারব। এরপর সামরিক শক্তি সঞ্চয় করে পূর্ণ শক্তিতে সুবাক আক্রমণ করব। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী সুবাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত দৃঢ়। সুবাক আক্রমণ করলে আমাদের হয়ত দীর্ঘদিন অবরোধ করে রাখতে হবে। আমার ধারণা, ক্রাকে আমাদের বেশী শক্তি ক্ষয় হবেনা। প্রথমে আমাদের এমন এক কেন্দ্র প্রয়োজন যেখান থেকে সহজে সামরিক সাহায্য এবং রসদ পাওয়া যায়।’
গোয়েন্দা ডিউক দরজায় কান লাগিয়ে কথা শুনছিল। মেয়ে দু’টোও এসে দাঁড়াল তার পাশে। এমন গোপন তথ্য পাশের কক্ষ থেকে শুনতে পেয়ে পুলকিত হলো ওরা। ভাবল, আলী হয়ত খেয়াল করেননি বা তিনি ভেবেছিলেন এরা তো আর ফিরে যাবেনা, শুনলেইবা কি?
ডিউক মেয়েদের কানে কানে বলল, ‘ইস, আমাদের একজনও যদি বেরিয়ে যেতে পারতাম! মূল্যবান তথ্য। আগেভাগে সুবাক পৌঁছতে পারলে পথেই ওদের শেষ করা যেত, ওদের আর ক্রাক যেতে হত না।’
‘আমাদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।’ সুলতানের কণ্ঠ। ‘খ্রীষ্টানরা আগেভাগে টের পেলে আমরা ক্রাক পৌঁছতে পারব না। পথেই বাধা দেবে। সমস্যা হল ওদের চাইতে আমাদের সেনা শক্তি দুর্বল। অস্ত্রশস্ত্রও কম। আমাদের তীরন্দাজরা ওদের বর্মধারীদের মোকাবিলা করতে পারবে না। খোলা ময়দানে যুদ্ধ করলে পেছন থেকে ওরা আমাদের রসদের পথ বন্ধ করে দেবে। তখন আমাদেরকে পিছিয়ে আসতে হবে, নয়তো বরণ করতে হবে পরাজয়। সেজন্য আমরা এগোব জারিবের পার্বত্য পথে। বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকায়, ওদের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে না। পথে বাধাপ্রাপ্ত হলে আমাদেরকেই পরাজয় মেনে নিতে হবে।
ফৌজকে তিন ভাগে ভাগ করব। প্রথম দল মার্চ করবে সন্ধ্যা রাতে। মাঝ রাতে যাবে দ্বিতীয় দল। তৃতীয় দল যাত্রা করবে শেষ রাতে। দিনে কোন তৎপরতা থাকবে না।’
আলী বললেন, ‘পথে অপরিচিত কাউকে দেখলে আটক করতে হবে। ক্রাক দখল করার আগ পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে ওদের। এভাবেই ঠেকাতে হবে ওদের গোয়েন্দা তৎপরতা।’
একদিকে পাশের কামরায় বসে যুদ্ধের গোপন পরিকল্পনা শুনছিল তিন গোয়েন্দা। অন্যদিকে সুবাক কেল্লায় চলছিল খ্রীষ্টান রাষ্ট্র প্রধানদের গোপন মিটিং। মিটিংয়ে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিল হাতেম আল আকবর।
হাতেম একজন মিসরীয় মুসলমান। খলিফা আল যায়েদ, রজব, তিনটি গোয়েন্দা মেয়ে এবং ফয়জুল ফাতেমীল মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণ শোনাল সে। বলল, ‘ডিউক গুপ্তচর মেয়ে ‘দু’টো সহ ধরা পড়েছে।’
‘এতে বোঝা যায় আয়ুবীর গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত সতর্ক।’ খ্রীষ্টান সম্রাট এবং সেনানায়ক কোনার্ড বললেন, ‘মেয়ে দু’টোকে মুক্ত করা কি সম্ভব নয়? দীর্ঘ সময়, শ্রম আর অর্থ ব্যয় করে এ মেয়েগুলোকে ট্রেইন্ডআপ করা হয়েছে। এর একেকটা মেয়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট মূল্যবান।’
‘ক্রুশের জন্য এ ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।’ খ্রীষ্টান সেনাপতি লুজিনাম বললেন। ‘ওদের বাঁচাতে গেলে মারা পড়ব আমরা নিজেরাও। যারা ধরা পড়েছে ওদের ভুলে যান। ওখানে পাঠাতে হবে অন্য লোক। ধরা পড়া মেয়ে দু’টো এবং রজবের নামে পাঠানো মেয়ে তিনটে কোত্থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল?’
‘এদের দু’জন খ্রীষ্টান।’ গোয়েন্দা প্রধানের জবাব, ‘খ্রীষ্টান দু’টো ইটালীর। মুসলমান তিনটাকে শৈশবেই তুলে এনেছিলাম। ওরা যে মুসলমান এখন ওদের তা মনেও নেই। ছোট থেকেই ওদের ট্রেনিং শুরু করেছি। এ জন্য ওরা আমাদেরকে ধোকা দিয়েছে এ সন্দেহ করা যায় না।’
‘হলই বা মুসলমান’, হাতেম আল আকবরের দিকে আঙুলি নির্দেশ করে বলল কোনার্ড, ‘আমাদের প্রিয় বন্ধুও মুসলমান। সে তো ধর্মের ধার ধারেনা।’
মদের গ্লাস হাতেমের হাতে তুলে দিয়ে আবার বলল, ‘হাতেম জানে আয়ুবী মিসরকে দাসত্বের শৃংখে বন্দী করতে চায়। কার্য সিদ্ধি করতে চায় ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে। আমরা চাই মিসরকে মুক্ত করতে। এর একটাই পথ, আয়ুবীকে নিশ্চিন্তে বসতে দেয়া যাবে না।’
মদে মাতাল হাতেম মাথা দুলিয়ে সায় দিল। ‘ওখানে এমন ব্যবস্থা করব তোমাদের কোন লোক আর ধরা পড়বে না।’ হাতেমের জড়ানো কণ্ঠ।
‘মিসরে বিশৃংখল সৃষ্টি করে না রাখলে অনেক পূর্বেই আয়ুবী আমাদের আক্রমণ করে বসত।’ বলল এক কমাণ্ডার।
‘তার শক্তি তার লোকদের মধ্যে নিঃশেষ করলেই আমরা সফল।’
কোনার্ড প্রশ্ন করল, ‘আলীকে নিকেশ করার কোন ব্যবস্থা এখনও হল না?’
‘কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে।’ জবাব দিল গোয়েন্দা প্রধান। ‘কিন্তু সফল হয়নি। আলী এবং সালাহউদ্দীন দু’জনই পাথর। মদও ছোয়না, মেয়েদের প্রতিও লোভ নেই। এ জন্য মদের সাথে কিছু মিশিয়ে বা মেয়েদের দ্বারা ওদের হত্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা এক অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছি। ঘাতক দলের চারজন সদস্যকে তার দেহরক্ষীদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সুযোগ পেলেই ওরা আলী বা আয়ুবীকে শেষ করে দেবে।’
‘আমাদের এদিকেও কি আয়ুবীর গুপ্তচর রয়েছে বলে মনে কর?’ লুজিনাম প্রশ্ন করল।
‘অবশ্যই রয়েছে। যেদিন থেকে আমরা মিসর এবং সিরিয়ায় গুপ্তচরগিরি শুরু করেছি, সেও শুরু করেছে তখন থেকেই। আয়ুবীর দু’জন গোয়েন্দা ধরা পড়েছে। মুখ বুঁজে নির্যাতন সহ্য করতে করতে মরে গেছে, তবু কারও নাম বলেনি।’
‘এক্ষেত্রে সে কদ্দুর সফলতা লাভ করেছে?’
‘অনেক। ক্রাকে আমাদের রসদে ওরাই আগুন লাগিয়েছে। আমাদের যুদ্ধের সব খবরই আয়ুবী পেয়ে যায়। জীবন বাজি রেখে তার গোয়েন্দারা কাজ করে। এ জন্য ওরা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।’
এভাবে ওদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ চলল। হাতেম আয়ুবীর দুর্বল দিকগুরো তুলে ধরর। সিদ্ধান্ত হলো মিসর এবং সিরিয়ায় গুপ্তচর বৃত্তির কাজ আরও জোরদার করতে হবে। গোয়োন্দা কাজের জন্য আপাততঃ হাতেমকে দেয়া হবে তিনজন উদ্ভিন্নযৌনা যুবতী।
* * *
কক্ষে আলী এবং দু’জন কমান্ডার। ক্রাক আক্রমণের ব্যাপারে কথা বলছিলেন সুলতান আয়ুবী। তিনি আক্রমণের সময় নির্ধারণ করলেন বিশ দিন পর।
গোয়েন্দা ডিউক এবং মেয়ে দু’টো সব কথাই শুনছিল। মেয়েদের দিকে তাকালেন ডিউক। কণ্ঠে একরাশ দুঃখ, ‘এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েও সুবাক পৌঁছাতে পারছী না!’
এক যুবতী বলল, ‘চেষ্টা করব আয়ুবীর মন ভুলানোর? সামান্য সময়ের জন্য ওকে একা পেলে দেখতাম ও কেমন পুরুষ। কোন জীবন্ত মানুষ আমার ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যাবে তা হতেই পারেনা। শুধু একটিবার সুযোগ পেলে তার বুদ্ধি বিবেক আপন হাতের মুঠোয় বন্দী করা কোন ব্যাপারই না।’
‘জানিনা কেন আমাদের ডেকেছেন।’ ডিউক বলল, ‘মনে রেখ, একজন একজন করে ডাকলে তাকে পশুতে পরিণত করতে হবে। এত মদ খাওয়াবে যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এখান থেকে পালিয়ে কার কাছে যাবে নিশ্চিয়ই জান? মসজিদের সোজা উল্টো দিকে তার বাড়ী।
‘চিনি।’ মেয়েটা বরর, ‘মেহদি আবদাল।’
‘হ্যাঁ, তার কাছে পৌঁছতে পারলে ও-ই তোমাকে সুবাক পৌঁছে দেবে। আমার পালানোর তো প্রশ্নই উঠে না। তোমরা আয়ুবীর পরিকল্পনা শুনেছ। রওনা হওয়ার তারিখ মনে রেখ। ওরা চলবে রাতে। দিনে কোন তৎপরতা দেখাবে না। আক্রমণ করবে ক্রাক। আগে ভাগে সংবাদ পেলে পথেই সৈন্যদের থামিয়ে দেয়া যাবে। পথে আক্রমণ হতে পারে বলে আয়ুবী শংকিত। একটা কথা অবশ্যই বলবে, আয়ুবীর লোকবল কম। সে খোলা ময়দানে সামনা সামনি যুদ্ধ করতে চায় না।’
মিটিং শেষ হয়েছে। কমান্ডাররা বেরিয়ে যাচ্ছেন, তিন গোয়েন্দাই পূর্বের স্থানে ফিরে এসে বসে রইল হাঁটুতে মাথা রেখে। যেন ওরা কিছুই জানেনা। কক্ষে কারও পায়ের শব্দ শোনা গেল। কারো হাতের আলতো স্পর্শে মাথা তুলল গোয়েন্দা ডিউক।
‘উঠে এসো।’ আলী তিনজনকে সুলতানের কক্ষে নিয়ে গেলেন।
‘আমি তোমাদের জ্ঞান এবং মেধার প্রশংসা করছি।’ ডিউককে বললেন সুলতান আয়ুবী। ‘ওদের শিকল খুলে দাও আলী।’
আলী ওদের শিকল খুলে দিল। সুলতান চেয়ারের দিকে ইংগিত করে বললেন, ‘তোমরা এখানে বস।’
বেরিয়ে গেলেন আলী বিন সুফিয়ান। সুলতান আবার বললেন, ‘কিন্তু তোমরা সে জ্ঞান শয়তানী কাজে ব্যয় করছ। এখানে এসে আপন ধর্মের প্রচার করলে হৃদয়ের গভীর থেকে তোমাকে ধন্যবাদ দিতাম। তোমার ধর্ম কি তোমাকে বলেছে অন্য ধর্মের ইবাদতখানায় দাঁড়িয়ে তার ধর্মকে বিকৃত কর? এ মহা পাপ করতে গিয়ে কি পবিত্র ক্রুশ, হযরত ঈসা (আঃ) এবং মা মরিয়মের কথা একবারও মনে পড়েনি তোমার?’
‘এভাবে বিকৃত করা আমাদের কর্তব্য। যা করেছি পবিত্র ক্রুশের জন্যই করেছি।’
‘তুমিই বলেছ বাইবেল এবং কোরান গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছ তুমি। দুই কিতাবের কোথাও কি যুবতীদেরকে অশ্লীল কাজে নিয়োজিত করার অনুমতি দিয়েছে? অনুমতি দিয়েছে কি ওদেরকে পর পুরুষের সংগী করে গোপন উদ্দেশ্য সাধন করতে? মেয়েদের ইজ্জত আব্রু অন্যের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত কররার অধিকার কি বাইবেল তোমাকে দিয়েছে? মুসলিম মেয়েদেরকে কোরান এবং ইসলামের নামে পর পুরুষের কাছে নিজের ইজ্জত বিকাতে দেখছ কখনো?’
‘ইসলামকে আমরা খ্রীষ্টানদের শত্রু মনে করি। যে বিষ হাতে পাব তাই ইসলামের স্নায়ুতন্ত্রীতে ঢুকিয়ে দেব।’
‘তোমাদের এ বিষ গুটিকতক মুসলমানের নৈতিকতাকে বিপন্ন করতে পারবে, কিন্তু ইসলামের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
মেয়েদের দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন, ‘বলতে পার তোমরা কোন বংশের মেয়ে, জানলে আমায় বল।’
দু’জনকে নিরব দেখে সুলতান আবার বরলেন, ‘তোমরা নিজের চরিত্র নষ্ট করেছ। এখনও ইচ্ছে করলে কোন সম্মানিত ব্যক্তির সম্মানিত স্ত্রী হতে পার।’
‘আমি সম্মানিত স্ত্রী হতে চাই।’ একটা মেয়ে বরল, ‘আপনি কি আমায় গ্রহণ করবেন? তা না হলে আমাকে একজন সম্মানিত স্বামী দিন। আমি মুসলমান হয়ে পাপের জন্য ক্ষমা চাইব।’
সুলতান আয়ুবী মৃদু হাসলেন। খানিকটা ভেবে নিয়ে ডিউকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি চাইনা তোমার জ্ঞান জল্লাদের তরবারীর রক্তে ডুবে যাক। যুবতীর অনন্য রূপ যৌবন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিঃশেষ হয়ে যাক তাও চাইনা। শোন মেয়েরা! সত্যিই যদি পাপের ক্ষমা চাও তোমাদেরকে তোমাদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ওই দেশ তোমাদের নয়, আমাদের। একদিন না একদিন তোমাদের সম্রাটদের কাছ থেকে আমরা আমাদের দেশ ছিনিয়ে আনব। দেশে গিয়ে তোমরা কাউকে বিয়ে কর। আমি তোমাদের তিনজনকেই মুক্তি দিচ্ছি।’
অবাক বিস্ময়ে চমকে উঠল তিন গোয়েন্দা। যেন ওদের গায়ে কাঁটা ফোটানো হয়েছে।
কামরায় এলেন আলী। সুলতানের নির্দেশে খুলে দেয়া হল ওদের হাত ও পায়ের বেড়ি।
‘আলী! আমি ওদের মুক্ত করে দিয়েছি।’
স্তব্ধ বিস্ময়ে সুলতানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘আলী।’ সুলতান বললেন, ‘ওদের জন্য তিনটে উট এবং চারজন সশস্ত্র রক্ষীর ব্যবস্থা কর। রক্ষীরা হবে সাহসী এবং মেধাবী। তিনজনকে সুবাক কেল্লায় রেখে ওরা ফিরে আসবে। পথের খাবার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে দিয়ে দিও। আজই রওয়ানা করিয়ে দাও ওদের।’
ডিউকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওখানে গিয়ে আবার বলোনা আয়ুবী গোয়েন্দাদের ক্ষমা করে দেয়। গোয়েন্দাকে আমি বীজের মত যাতাকলে পিষে হত্যা করি। তুমি আলেম বলে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। তোমার জ্ঞানের আলোর দিকটা দেখার সুযোগ দিচ্ছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোরআনের যে জ্ঞান তোমার আছে তাই তোমাকে একদিন ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসবে। বিশ্বাস কর এ পথেই তোমার মুক্তি। যদি কোন দিন ইসলামের পথে ফিরে আসো চেষ্টা করো তোমার ও বোনদেরকে সে পথে আনতে। ইসলামের অনেক বড় খাদেম হতে পারবে তুমি। তোমার সুবুদ্ধি এলে আমাকে জানিও, আমি তোমাকে দ্বীনের তাবলীগে লাগাতে চাই। তোমাদের মুক্তি দিয়ে আমি দাওয়াতের যে নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করতে চাই আশা করি আমি তাতে সফল হবো। আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করুন, খোদা হাফেজ।’
* * *
এখনো সূর্য ডোবেনি। উটে সওয়ার হল মুক্তিপ্রাপ্ত খ্রীষ্টান গোয়োন্দা ডিউক ও যুবতীদ্বয়। সাথে চারজন দেহরক্ষী।
আলী বললেন, ‘যে করেই হোক ওদেরকে খ্রীষ্টান কমান্ডারদের কাছে পৌঁছতে হবে। পথে মরু ডাকাতের ভয় আছে জানি। সে জন্যই তোমাদের সতর্ক করা জরুরী মনে করছি। সব সময় চোখ-কান খোলা রেখে পথ চলবে।’
ওরা রওনা হল। উন্নত জাতের উটের পিঠে পথ চলার সামগ্রীসহ চড়েছে গোয়েন্দারা। উঁচু জাতের তেজী ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছে রক্ষী চারজন। আয়ুবীর এ দীল-দরিয়ায় সবাই আশ্চর্য। গোয়েন্দাদের তিনি কখনও ক্ষমা করেননি। আলী জিজ্ঞেস করেছিলেন।
‘বলেছিলাম না নতুন একটা খেলা খেলতে চাই।’ সুলতানের জবাব। ‘এ সেই খেলা। হেরে গেলে শুধু তিনটে গোয়েন্দা হারাব, এর বেশী নয়।’
বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলেন আলী। ‘সময় এলে দেখতে পাবে’ বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন সুলতান।
মুক্তিপ্রাপ্ত তিন বন্দীদের অন্তরে খুশীর অন্ত নেই। শুধু মুক্তির জন্য নয়, মূল্যবান গোপন তথ্য নিয়ে যাচ্ছে ওরা সাথে করে।
কায়রো পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। উট তিনটি পাশাপাশী চলছে। রক্ষীদের দু’জন সামনে, দু’জন পেছনে। গোয়োন্দারা আঞ্চলিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। রক্ষীরা সে আঞ্চলিক ভাষার কিছুই বুঝতে পারছিল না।
ডিউক মেয়েদর বলল, ‘পবিত্র যিশুর মোজেযা দেখলে! বুঝা যাচ্ছে তিনি আমাদের ভাল বাসেন। বিজয় আমাদেরই হবে। সালাহউদ্দীন আর আলী বে-আক্কেলের মত বিপজ্জনক তথ্য আমাদের শুনিয়ে দিল। আমাদের সেনাবাহিনীকে সব কথা বললে ওরা আয়ুবীর সৈন্যদেরকে মরুভূমিতেই শেষ করে দেবে। আয়ুবী জিন্দেগীতে আর ক্রাক পৌঁছার সুযোগ পাবেনা।’
‘আমর বিশ্বাস সেনাপতি ওদেরকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হবে না। সহজেই ফৌজ শূন্য মিসরও দখল করে নিবেন, কি বলেন?’ বলল এক যুবতী।
অন্য যুবতী বলল, ‘আপনি একজন অভিজ্ঞ আলেম। আপনার বিবেচনাই হয়তো ঠিক। তবু আপনার দেখা মোজেযায় আমি বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। রক্ষীরা হয়ত আমাদের হত্যা করে ফিরে যাবে। সালাহউদ্দীন আমাদের সাথে উপহাস করেছেন। জল্লাদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে আমাদেরকে এদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। এরা আমাদেরকে নষ্ট করে শেষে মেরে ফেলবে।’
ডিউক এ কথার প্রতিবাদ করল না। আশঙ্কার মেঘ তার মনেও ভির করেছে। সে সায় দিয়ে বলল, ‘তাছাড়া আমরা নিরস্ত্র। তোমার ধারনাই হয়ত ঠিক। কোন শাসকই শত্রুর গুপ্তচরকে ক্ষমা করতে পারে না। মুসলমানরা যা কামুক, তোমাদের মত সুন্দরী মেয়েদের এভাবে ছেড়ে দেবে ভাবা যায় না।’
এতক্ষণে খুশী খুশী ভাব হঠাৎ করেই তাদের চেহারা থেকে সরে গেল।
‘রাতে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে।’ বলল এক যুবতী।
দ্বিতীয় মেয়েটা বলল, ‘রাতে ঘুমালে ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের শেষ করতে হবে। শুধু একটু সাহসের প্রয়োজন।’
‘এ সাহস আমাদের করতেই হবে।’ ডিউক বলল, ‘এবং আজ রাতেই। সকাল পর্যন্ত আমরা অনেক দূর চলে যেতে পারব।’
রক্ষীরা গল্প গুজব করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। দু’জন সুন্দরী যুবতী ওদের হাতের মুঠয় যে এ কথা কারো মনেই নেই।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে, এগিয়ে চলছে কাফেলা। গভীর হচ্ছে মরুভূমির রাত। তিন গোয়েন্দা চলছে পাশাপাশি। রক্ষীদের হত্যার পরিকল্পনা করছে ওরা।
সামনে শ্যামল ভূমি দেখে রক্ষীরা থেমে গেল। তাবু টানিয়ে প্রথমে গোয়েন্দাদের খেতে দিল। এরপর নিজেদের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল তিনজন রক্ষী সেনা। একজন রইল পাহারায়।
এক তাঁবুতে শুলো রক্ষীরা, পাশের তাঁবুতে ডিউক এবং মেয়েরা। ডিউক রক্ষীদের তাবুর দিকে ফিরে নিজেদের তাবুর পাশ ঘেষে শুয়ে রইল। দৃষ্টি তার রক্ষীদের তাবুর দিকে। ষষ্ঠইন্দ্রিয়ে টানটান সতর্কতা।
তাবুর চারপাশে ঘুরছে একজন সেন্ট্রি। দুই ঘন্টা পর ঘুমন্ত এক রক্ষীকে জাগাল সে। তাকে পাহারায় রেখে নিজে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আগের মতই সেন্ট্রি তাবুর চারপাশ ঘিরে চক্কর দিতে লাগল।
ডিউক মেয়েদের বলল, ‘আমরা সফল হতে পারছি না। বদমাইশটা শুধু ঘোরাঘুরি করছে। যা হবার হবে এখন ঘুমিয়ে পড়।’
তিনজনই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরের হালকা আলো ফুটতেই রক্ষীরা ওদের ডেকে তুলল। আবার রওনা হল কাফেলা।
আগের নিয়মে এগিয়ে চলছে ওরা। তিন গোয়েন্দা পাশাপাশি। রক্ষীদের দু’জন সামনে, দু’জন পেছনে।
রক্ষীরা সন্দেহজনক কোন কথা বলেনি। এখন পর্যন্ত কারো সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি। এমন কোন আচরণ করেনি যাতে ওদেরকে বদমাশ বলা যায়।
সূর্য উপরে উঠে এল। অভিযাত্রী দল প্রবেশ করল এক পার্বত্য এলাকায়। পাহাড়ের গা দেয়ালের মত খাড়া। গিরিপথে পাহাড়ের ঘন ছায়া। মেয়েগুলো ভয় পেয়ে গেল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওদের চেহারা। হত্যা করার জন্য উপযুক্ত স্থান। কিন্তু রক্ষীরা ওদের দিকে ফিরেও চাইলনা।
‘ওদেরকে বলুন আমাদের সাথে কথা বলতে।’ ডিউককে বলল একটি মেয়ে। ‘ওরা নিরব কেন। আমাদের ব্যাপারে ওরা এত উদাস কেন! মারতে হলে মেরে ফেলতে বলুন। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ভীষণ কষ্টকর।’
ডিউক নিরব রইল, কোন কথাই বলতে পারল না সে। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আর যে কোন সময় মৃত্যুর হিমশীতল সম্পর্শের আশঙ্কা ওকে যেন বোবা করে দিয়েছে। এখন সে মেয়েদের কোন সাহায্য করতে পারছে না। তিনজনই রক্ষীদের দয়ার ওপর বেঁচে আছে।
সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। থামাল ওরা। এখানে পাহাড় ছাদের মত নুয়ে আছে। ফলে ছায়া রূপ নিয়েছে আঁধারের।
শঙ্কায় বুক শুকিয়ে এল গোয়েন্দাদের। চেহারা থেকে সরে গেল রক্ত।
‘ঈশ্বর, তুমি আমাদের জন্য মৃত্যুকে সহজ করে দাও।’ স্বগতোক্তির মত বলল ডিউক।
কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। রক্ষীরা আগের মতই নির্বিকার। ওরা ওখানে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করল। গোয়েন্দারা ভাবল, মারার আগে শেষবারের মত খাইয়ে নিচ্ছে। মৃত্যুভয় ওদের ক্ষুধা দূর করে দিল, কিছুই খেতে পারল না ওরা।
একজন রক্ষী বলল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা খাচ্ছ না কেন?’
ডিউক বলতে চাচ্ছিল, ‘আর খাওয়ার দরকার নেই, তোমরা তোমাদের কর্তব্য পালন কর, হত্যা করতে চাও তাড়াতাড়ি করে ফের। শুধু শুধু আমাদের পেরেশানী বাড়াচ্ছ কেন?’ কিন্তু কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমারা আমাদের সাথে কথা বলছ না কেন?’
‘কর্তব্যের মধ্যে নয় এমন কথা আমরা বলিনা।’ কমান্ডার বলল। ‘কোন বিশেষ কথা থাকলে বলতে পার, জবাব দেব।’
‘আমাদের পরিচয় তোমরা জান?’
‘তোমরা গোয়েন্দা। মেয়েগুলো নষ্ট। আমাদের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবহার করতে চাও, এদেরকে দিয়ে তাদের পাকড়াও কর। সুলতান কেন তোমাদের ক্ষমা করেছেন জানিনা। তোমাদেরকে সুবাক ফৌঁছে দেয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা এখন সে নির্দেশ পালন করছি। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’
‘তোমাদের সাথে কথা বলতে মন চাইছে। দীর্ঘ সফর। আমাদের ব্যাপারে তোমরা কেমন উদাসীন। তোমাদের এ ছাড়াছাড়া ভাব আমাদের খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে চল।’
‘আমরা সবাই সহযাত্রী। কিন্তু আমাদের পথ ভিন্ন। দু’দিন পর আমরা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাব।’
ডিউক কমান্ডারের কথা শুনল কি শুনলনা, তার দৃষ্টি ছুটে গেল দুরে। সে ছিল মরু ভেদি। মরুর বিপদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ।
তাকিয়ে রইল সে। আতংকে বিস্ফারিত চোখ দুটো বেরিয়ে আসছে যেন। ডিউকের দৃষ্টি অনুসরণ করল কমান্ডার। চোখ বড় হয়ে গেল তারও। শ’খানেক গজ দূরে উঁচু জায়গায় দুটো উট। পিঠে দু’জন লোক নেকাবে ঢাকা মুখ। মাথায় কাপড় বাঁধা। উটের পা দেখা যাচ্ছেনা। ঢালে দাঁড়িয়ে আছে, আরোহীরা নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কাফেলার দিকে।
‘বলতে পার ওরা কারা?’ কমান্ডার ডিউককে প্রশ্ন করল।
‘মরু দস্যু। জানিনা ওরা ক’জন।’
‘তা দেখা যাবে।’ কমান্ডার এক সংগীকে ইশারা করে বলল, ‘আমার সাথে এসো।’
দু’টো ঘোড়ায় চেপে দস্যুদের দিকে এগিয়ে গেল দু’জন। তরবারী ছাড়াও ওদের হাতে বর্শা।
ওদের দু’জনকে এগুলো দেখে উষ্ট্রারোহীরা ঢালের দিকে নেমে গেল। গোয়েন্দাদের একা রেখে বাকী দু’জন রক্ষীও পাহাড়ে উঠে গেল অবস্থা বুঝতে।
ডিউক মেয়েদের বলল, ‘আমার ধারণা এবং তোমাদের আশংকাই ঠিক। ওরা দস্যু নয়, সালাহউদ্দীনের পাঠানো লোক। দেখলে না বির্ণয়ে এরা ওদের কাছে চলে গেছে। আয়ুবী তোমাদেরকে চরম অপমান করবে। আমার তো মৃত্যু অবধারিত, তোমাদের ভাগ্যেও রয়েছে কঠিন শাস্তি।’
‘এর অর্থ আমরা মুক্ত নই?’ একটা মেয়ে বলল, ‘আমরা এখনও বন্দিনী?’
‘তাইতো মনে হয়।’ দ্বিতীয় মেয়েটার জবাব।
দস্যুদের কাছ থেকে ফিরে এল দু’জন রক্ষী সেনা। সবাই তাদের ঘিরে ধরল। কমান্ডার হাদিদ বলল, ‘ওরা মরু দস্যু। ওদের দু’জনের সাথে দেখা করেছি, পাহাড়ের আড়ালে আছে বাকীরা। ওদের সংখ্যা কত জানিনা। যে দু’জনকে তোমরা দেখেছ তাদের কথা অনুযায়ী ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে সকাল থেকে।
ওরা আমাকে বলল, ‘তোমরা সরকারী সৈন্য। মুসলমান। মেয়ে দুটো মুসলমান নয়। ওদের আমাদের হাতে তুলে দাও, আমরা তোমাদের আর বিরক্ত করবো না। আমি বলেছি, এ মেয়েগুলো যে ধর্মেরই হোক, ওরা এখন আমাদের হেফাজতে। তাদের ইজ্জত, সম্মান এবং জীবন সবকিছু আমাদের কাছে আমানত। দেহে প্রাণ থাকতে ওদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেবনা।
ওরা বলল, ‘দুটো মেয়ের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করোনা।’
আমি বলেছি, ‘আগে আমাদের মারবে তারপর মেয়েদের নেবে। তোমরা কি অস্ত্র চালাতে পার?’ ডিউককে প্রশ্ন করল কমান্ডার।
‘আমরা প্রতিটি মেয়েকেই অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেই। তোমাদের কাছে তারবারী, বর্শা এবং তীর ধনু আছে। এর যে কোন একটা আমাদের দাও।’
‘এখন নয়।’ কমান্ডার বলল, ‘ওদের সাথে সংঘর্ষ বাধলে দেব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ এলাকা ছেড়ে আমাদের চলে যাওয়া উচিৎ। উটের সাথে ঘোড়া দিয়ে এখানে আক্রমণ প্রতিহত করা যাবেনা।’
রওনা হল ওরা। রক্ষীরা হাতে নিল তীর ধনু। হাদিদ সবার আগে। একজন রক্ষী তাকে বলল, ‘গোয়েন্দাদের হাতে অস্ত্র দেয়া ঠিক হবে না। শত হলেও ওরা আমাদের শত্রু। ডাকাতদের সাথে মিশে আমাদেরকেই হত্যা করার চেষ্টা করতে পারে।’
ডিউক মেয়েদের বলল, ‘এদের উদ্দেশ্য খারাপ। নইলে আমাদের অস্ত্র দিতে অস্বীকার করত না। আসলে দস্যুরা ওদেরই লোক। তোমাদেরকে ডাকাতদের হাতে তুলে দেবে। আমাকেও মেরে ফেলবে।’
ডাকাত এবং রক্ষীদের ভয়ে ওরা ছিল পেরেশান। হাদিদ রক্ষীদের বলল, ‘মুখোশ পরা কাউকে দেখলে তীর মারবে। আমার অনুমতি নিতে হবেনা। ওদের সাথে অবশ্যই আমাদের সংঘর্ষ হবে। কখন এবং কোথায় তাই দেখতে হচ্ছে।’
দ্রুত চলছিল ওরা। মাঝে মাঝে উট ঘোড়াকে বিশ্রাম এবং দানাপানি দেয়ার জন্য থামতে হচ্ছে। বিপদসংকুল পথ আর ফুরোয় না। দীর্ঘ পার্বত্য এলাকার উঁচু-নীচু ও আঁকাবাঁকা পথ ধরে যথাসম্ভব দ্রুত ছুটছে ওরা। হাদিদের ভয় হচ্ছিল ওরা ওপর থেকে তীর ছোড়া শুরু করে দিতে পারে। তাই গোয়োন্দাদের তাড়া দিয়ে বলল, ‘উটগুলো ঘোড়ার গতিতে চালাও। পাহাড়ের ওপর নজর রেখে এগিয়ে চল।’
পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে গেল কাফেলা। কোন দস্যু নজরে আসেনি। পশ্চিমে নেমে যাচ্ছে সূর্য। অনেক দূরে দেখা গেল দু’টো উট ওদের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চলছে ওরাও।
পথে পানি পাওয়া গেল। উট ঘোড়াকে খাওয়ালো। নিজেরাও তৃষ্ণা নিবারণ করল। সামান্য বিরতি দিয়ে এগিয়ে চলল আবার।
সূর্য ডুবে গেল। আঁধারে ছেয়ে গেল মরু প্রকৃতি।
কমান্ডার থেমে গেল। বলল, ‘যুদ্ধের জন্য এ জায়গাটা উপযুক্ত। আশপাশ কোন বাঁধা নেই।’
ঘোড়ার পিঠে বাধা রইল জিন। খাওয়া শেষে মেয়েদেরকে ডেকে নিয়ে কমান্ডার বলল, ‘সতর্ক থেকো।’
ধনুতে তীর জুড়ে প্রস্তুত রইল রক্ষীরা। ঘুমাল না কেউ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, দস্যুরা রাতে আক্রমণ করবেই।
নিঝুম রাত। আচম্বিত দেখা গেল চারপাশে কালো ছায়া মূর্তি। উটের ভারী পদশব্দে মাটি কাঁপছে। সংখ্যায় দশের অধিক। প্রতি উটে একজন আরোহী। কাফেলাকে আতংকিত করতে চাইছে ওরা।
তিন চার বার চার বার চারপাশ চক্কর দিয়ে এক আরোহী ধমকের সুরে বলল, ‘মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তোমাদের আমরা কিছুই করব না।’
শুয়ে শুয়েই তীর ছুঁড়ল হাদিত। চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল একজন। হাদিদ মেয়েদের বরল, ‘পালিওনা। মাটির সাথে মিশে যাও। আমাদের কাছাকাছি থেকো। আমরা জায়গা বদল করলে তোমরাও অনুসরণ করো।’
উষ্ট্রারোহীদের মধ্য থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলল, ‘আক্রমণ কর, কাউকে জীবিত রেখোনা। মেয়েদের তুলে নাও।’
জোসনা না হলেও রাতের মরুভূমি বেশ ফর্সা থাকে। অনেক দূরের জিনিষও দেখা যায়।
উষ্ট্রারোহীরা লাফ দিয়ে নীচে নামল। শুরু হল দু’দলের সংঘর্ষ। রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে দিল তরবারীর ঝনঝনাৎ শব্দ। মেয়েদের পিছনে সরিয়ে দিয়ে মুখোমুখি লড়ছিল রক্ষীরা।
মেয়েদের পিছন থেকে বার বার বলতে লাগল, ‘আমাদেরও কিছু একটা দিন।’
হাদিদ একজনকে বলল, ‘আমার তরবারী খুলে নাও।’
তারবারী হাতে নিয়ে একজন মেয়ে সামনে না এসে পিছন দিকে সরে গেল। হাদিদ বলল, ‘দূরে যেয়োনা। তোমাদেরকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার জন্যই ডাকাতদের এ আক্রমণ। বিচ্ছিন্ন হলে আর রক্ষে থাকবে না।’
ডিউকের কোন সাড়া শব্দ নেই।
দু’দলই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক। লড়াই করতে করতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দল থেকে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, বিক্ষিপ্ত হাতাহাতি যুদ্ধ। এ অবস্থা চলল অনেকক্ষণ। রক্ষীরা পরস্পরকে ডেকে ওরা যে এখনো টিকে আছে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল। একসময় থেমে গেল ডাকাডাকির শব্দ। যুদ্ধ শেষ।
হাদিদ সংগীদের ডাকল, জবাব এলনা। একটু পর শোনা গেল এক নারী কণ্ঠ, অনেক দূর থেকে তাকেই নাম ধরে ডাকছে।
হাদিদ কান পাতল। ভেসে এল মৃদু অশ্ব ক্ষুরধ্বনি। হাদিদ বুঝল, ডাকাতরা উটের পরিবর্তে রক্ষীদের ঘোড়ায় করে কোন মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছে। হাদিদ দৌঁড়ে নিজের ঘোড়ার কাছে গেল। এরপর পালিয়ে যাওয়া ঘোড়ার শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল।
অন্য মেয়েটা কোথায় তিনি জানেন না।
তার উন্নত জাতের তাজি ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। সামনের ঘোড়া উন্নত জাতের হলেও ওতে আরোহী দু’জন। ফলে হাদিদ আশা করল দ্রুতই ওদের ধরতে পারবে সে।
কিছু দূর যাওয়ার পর মাইল খানেক দূরে ওদের দেখতে পেল হাদিদ। গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত কমিয়ে আনল দূরত্ব। হাদিদের মনে হল পেছনে আরেকটা ঘোড়া আসছে। পেছনের ঘোড়াটি রক্ষী না দস্যুদের বুঝার উপায় নেই।
হাদিদ পেছনে তাকাল। ঘোড়া এগিয়ে এসে কাছাকাছি হল।
‘কে?’ গলা চড়িয়ে জানতে চাইল হাদিদ। জবার এলনা।
হাদিদ সামনের ঘোড়সওয়ারকে ধরার জন্য ঘোড়া ছোটাল আবার। সামনের দস্যুটা সোজা এগিয়ে যাচ্ছে, ও কাছাকাছি হতেই বার বার ডানে বায়ে ঘুরে এগুতে লাগল।
কমে যেতে লাগল গতি। সম্ভবত মেয়েটি বলগা হাতে নিয়েছে।
দস্যুর কাছে পৌঁছলেন হাদিদ। হাতের বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন দস্যুর পিঠে। ঘোড়া একদিকে সরে গেল। দস্যুটা বেঁচে গেলেও আঘাত লাগল ঘোড়ার পিঠে।
ঘুরলেন হাদিদ। দস্যুটা ঘোড়া ঘোরাতে চাইল। মেয়েটা বাধা দিচ্ছে।
হাদিদ মেয়েটাকে ডাক দিল। ও আরো সাহসী হয়ে উঠল।
যুবতীকে সাথে নিয়ে ঘোড়া থেকে লাফ দিল দস্যু। ঢাল হিসাবে ব্যবহার করল নিজের ঘোড়া। হাদিদ আঘাত করতে চাইলেই যুবতিকে সামনে এগিয়ে ধরছে।
ঘোড়া থেকে নেমে এলো হাদিদ। ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে পেছনের আরোহী। রক্ষী নয় দস্যু। সেও ঘোড়া থেকে নামল।
হাদিদ ধমকের সুরে বললেন, ‘তোমরা যুবতীকে নিয়ে যেতে পারবে না।’
এক ডাকাত ওকে ধরে রেখেছে। লড়ছে দ্বিতীয় জন। মেয়েটা নিরস্ত্র। হাদিদের সামনে টিকতে পারছেনা দস্যুটা। তাই দেখে মেয়েটাকে ছেড়ে দু’জন একত্রে হাদিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল।
হাদিদ মেয়েটাকে বললেন, ‘ঘোড়া নিয়ে তুমি সুবাকের দিকে পালিয়ে যাও। এদের আমি ঠেকাচ্ছি।’
নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল তরুনী।
দস্যু দু’জন বার বার বলছিল, ‘একটা রমনীর জন্য নিজের জীবন হারিও না। তুমি পালাতে চাইলে আমরা তোমাকে বাধা দেবনা।’
‘অসম্ভব। ওকে নিতে হলে আগে আমাকে মারতে হবে, তারপর ওকে পাবে।’ হাদিদের স্পষ্ট জবাব।
তিনি কয়েকবারই যুবতীকে পালিয়ে যেতে বললেন। ও বলল, ‘তোমাকে একা ফেলে রেখে আমি যাবনা।’
আহত হলেন হাদিদ। আবার যুবতীকে বললেন, ‘আমি আহত, মারা যাচ্ছি আমি। আমি আবারো বলছি, পালাও তুমি। আমি আরো কিছুক্ষণ ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবো দেরী করোনা, এখনো বলছি, পালাও।’
যুবতী পালিয়ে যায় কিনা তা দেখার জন্য ওদিকে ফিরল এক দস্যু। এ সুযোগে তার পাজরে বর্শা মারলেন হাদিদ। পড়ে গেল সে। অন্য দস্যুটার তরবারীর আঘাত লাগল তার কাঁধে।
তরুণী পড়ে যাওয়া ডকাতের তরবারী তুলে নিয়ে পেছন দিক থেকে দ্বিতীয় ডাকাতের পিঠে আমূল বাসিয়ে দিল। আহত কাঁধ নিয়েই পাঁই করে ঘুরল হাদিদ।
পেছন থেকে যুবতীর তরবারী যখন আঘাত করছিল দস্যুটাকে তখন হাদিদের বর্শাও তার বুক ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে। দু’দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দস্যু।
যুদ্ধ শেষ। ডাকাত দু’জন নিহত। দাঁড়াতে পারছিল না হাদিদ। পড়ে যাচ্ছিল, ধরে ফেলল যুবতী।
হাদিদ বললেন, ‘তুমি সুস্থ? আমায় ছেড়ে একটা ঘোড়া নিয়ে এক্ষুণি সুবাক রওয়ানা কর। সংগীদের দিকে যেয়োনা। ওদের কেউ হয়ত বেঁচে নেই।’
‘কোথায় আঘাত লেগেছে আপনার?’
‘আমাকে মরতে দাও, চলে যাও তুমি। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তুমিই পালন কর। ডাকাতদের কেউ আবার এদিকে এসে পড়লে আর পালতে পারবে না।’
যুবতীর মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। ও বুঝেছে তার জন্যই লোকটা নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সে তাকে একা রেখে যেতে অস্বীকার করল। দৌড়ে গেল ঘোড়ার কাছে। জিনের সাথে বাধা মশক এনে হাদিদকে পানি পান করাল। বলল, ‘দেখি, আপনার আঘাতটা কোথায় লেগেছে?
হাদিদ ক্ষতস্থান দেখালেন। যুবতী তাড়াতাড়ি তার ওড়না ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিল।
‘আপনি আমার জন্য আপনার জীবন বিপন্ন করেছেন। আপনাকে একা রেখে আমি কিছুতেই এখান থেকে যাবোনা। যদি আমার ভাল চান তবে উঠুন। ভাগ্য ভাল হলে আমরা বেঁচে যেতেও পারি।’
‘তুমি. . .’
‘আমার নাম সিনথিয়া।’
হাদিদ তাকিয়ে দেখলেন যুবতীকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, ও যা বলেছে তাই করবে। বললেন, ‘কিন্তু সিনথিয়া, আমার যে যাওয়ার শক্তি নেই।’
যুবতী হাদিদকে ধরে দাঁড় করাল। ধীরে ধীরে নিয়ে গেল ঘোড়ার কাছে। এরপর অনেক কষ্টে ঘোড়ার পিঠে বসাল। নিজে অন্য ঘোড়ার উঠতে গেলে হাদিদ বলল, ‘আমি একা বসতে পারব না।’
দু’টো ঘোড়ার রশি একটার জিনের সাথে বেঁধে তরুনী হাদিদের পেছনে উঠে বসল। যুবতী হাদিদের মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সুবাক কোন দিকে?’
হাদিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ডানদিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওদিকে চলো।’
এগিয়ে চরল ঘোড়া। হাদিদ আবার বললেন, ‘হয়ত আমি বাঁচবনা । ক্ষতস্থান থেকে এখনো রক্ত ঝরছে। যেখানেই আমার মৃত্যু হয় মাটি চাপা দিয়ে রেখো। আমার ব্যাপারে কোন সন্দেহ হয়ে থাকলে তা দূর করে আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি আমানতের খেয়ানত করিনি। আল্লাহ তোমাকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিন।’
‘আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে তুলুন। দয়া করে এখন আর কথা বলবেন না।’
ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে! এগিয়ে যাচ্ছে সময়। জনমানবহীন সুনসান দুস্তর মরুভূমিতে শেষ রাতের হিমেল ঠাণ্ডা। সে শীতার্ত ঠাণ্ডা মাড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে আহত মুসলিম কমান্ডার হাদিদের মাথা কোলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সিনথিয়া নামের এক খ্রীষ্টান গোয়েন্দা যুবতী। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার কাছে মনে হচ্ছিল এক দুঃস্বপ্ন।
* * *
হাদিদের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু অত্যাধিক রক্ত ঝরায় দুর্বল হয়ে পড়েছেন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন বার বার। মাথা ঝাকিয়ে তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলেন।
ছোট এক খেজুর বাগানের কাছে এসে থামল তরুণী। আলগোছে নামাল তাকে। পানি পান করাল। জিনের সাথে বাঁধা থলে থেকে খাবার এনে দিল। আচ্ছন্নভাবটা কেটে গেল হাদিদের। স্বগতোক্তি করে বললেন, ‘আগে ছিলাম যুবতীর রক্ষী, এখন ওর বন্দী।’
সিনথিয়া তাকে শুইয়ে দিল। বিশ্রামের পর অনেকটাই সুস্থ বোধ করলেন হাদিদ।
‘আমরা সুবাকের কাছে চলে এসেছি। আর মাত্র একদিনের পথ।’ হাদিদ বললেন, ‘একটা ঘোড়া নিয়ে তুমি চলে যাও। আমি এখান থেকেই ফিরে যাব।’
‘তুমি একা যেতে পারবে না। মরে যাবে। এখান থেকে ফিরে যেতে চাইলে আমাকে সাথে নাও। তুমি আমায় একা ছাড়নি, আমিও তোমাকে নিঃসঙ্গ যেতে দেব না।’
‘আমি পুরুষ। একজন নারী আমার হেফাজত করছে এ কথা মানতে পারছিনা। এরচেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।’
‘যারা ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকে আমি তেমন মেয়ে নই। ওরা পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া এক পাও চলতে পারেনা। মনে কর আমি এক পুরুষ সৈন্য। পার্থক্য, আমার অস্ত্র আমার রূপ, যৌবন, চোখের কটাক্ষ, মুখের হাসি আর কণ্ঠের মধু। তোমার মত আমিও কষ্ট সইতে পারি। ইচ্ছে করলে পায়ে হেঁটেও সুবাক যেতে পারব।’
‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। সিনথিয়া, তোমার এ আবেগকে আমি সম্মান করি। আমার প্রতি তোমার এ সহৃদয়তার কারণ কৃতজ্ঞতাবোধ। দস্যুরা আমাদের দু’জনকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। অথচ আমরা উভয়েই জানি আমাদের দু’জনের পথ ভিন্ন। তুমি আমার জাতির মূল উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছো, আর আমি ক’দিন পর তোমার দেশ আক্রমণ করার স্বপ্ন দেখছি।’
‘আপাততঃ আমার বন্ধুত্ব গ্রহণ কর। তুমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গিয়ে শত্রুতার কথা ভেবো।’
হাদিদের ঘাড়ের নীচে হাত দিয়ে যুবতী তাকে শোয়া থেকে তুলল। হাদিদ এখন হাঁটতে পারছেন।
ঘোড়া পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন তিনি। সিনথিয়া তাকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করল। উঠে বসলেন হাদিদ। সিনথিয়া তার পেছনে উঠতে চাইল। হাদিদ বাধা দিলেন।
‘তুমি অন্য ঘোড়ায় উঠ। আমি এখন একা চলতে পারব।’
‘না’ যুবতীর কণ্ঠে সিদ্ধান্তের সুর, ‘আমি এ ঘোড়ায়ই উঠব। তুমি লেগে থাকবে আমার বুকের সাথে।’
যুবতী হাদিদের পেছনে উঠে বসল। এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল যুবতী। বাধা দিল হাদিদ।
‘আমাকে আমার শক্তিতে বসতে দাও।’
সিনথিয়া তার এ কথায় মোটেই আমল দিল না। জোর করে তাকে ধরে রাখল। হাদিদের মাথা রাখল নিজের কাঁধে। বলল, ‘জানি, বাজে মেয়ে মনে করে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছ।’
‘না, তা নয়। তুমি এক যুবতী। বাজে হও, আর ভাল হও সব অবস্থায় তোমার থেকে দুরে থাকা আমার কর্তব্য। আমি আমার পৌরুষের হেফাজত করতে চাই। ভেবে দেখো, তোমাকে কাছে পেতে চাইলে যে দু’রাত তুমি আমার বন্দিনী ছিলে সে সময় যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। কিন্তু আমি শয়তানকে কাছে আসতে দেইনি। এখন মনে হচ্ছে আমি আমানতের খেয়ানত করছি। আমার ভেতর পাপের বীজ অংকুরিত হচ্ছে। তাই তোমার কাছ থেকে সরে থাকতে চাচ্ছি।’
‘তুমিতো আর পাথর নও। প্রতিটি পুরুষই আমার দিকে তাকায় কামনার দৃষ্টি নিয়ে। সামান্য বিনিময়ের পরিবর্তে তোমার জাতির লোকদের ঈমান কিনে নেয়ার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। কিন্তু তোমার কাছে তো আমি কোন বিনিময় দাবী করছিনা।’
‘কিসের বিনিময়ে ঈমান ক্রয় কর তুমি?’
‘আমার কাঁধে মাথা রাখার, একটু পাশে বসার সুযোগ দিয়ে।’
‘ওদের কাছে ঈমানই ছিল না।’
‘যা-ই ছীল আমি নিয়ে নিয়েছি। ওদের রক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছি গাদ্দারী। আপন জাতির বিরুদ্ধে ওদের হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি ঘৃণা।’
‘ওরা কারা?’
‘এখন বলব না। তোমাদের কর্তব্য তোমার কাছে যেমন প্রিয় আমার কর্তব্যও আমার কাছে।’
হাদিদ চুপ করে রইলেন। ক্রমশঃ আবার তিনি দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। ক্লান্তি অনুভব করলেন তিনি। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন।
সিনথিয়া তাকে শক্ত করে ধরে আছে। যুবতীল দেহের উষ্ণ পরশ অনুভব করলেন তিনি। ওর রেশম কোমল চুল বাতাসে উড়ছিল। ছুয়ে যাচ্ছিল হাদিদের গাল, মুখ।
ঝিমুতে লাগলেন হাদিদ। অনেকক্ষণ পর চোখ খুললেন। দেখলেন, সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে।
তিনি তৃষ্ণা অনুভব করলেন। বললেন, ‘সিনথিয়া, একটু পানি।’
সিনথিয়া পানি এগিয়ে দিল। পানিটুকু পান করে তিনি আবার তাকালেন সূর্যের দিকে। বললেন, ‘সিনথিয়া ঘোড়া জোরে ছুটাও। আরেকটু দ্রুত গেলে আশা করি সূর্যান্তের পরপরই আমরা সুবাকে পৌঁছতে পারব।
ঘোড়া ছোটাল যুবতী। দ্রুত পেছনে সরে যেতে লাগর মরুভূমির বিশাল বিস্তার।
* * *
সূর্য ডুবে গেছে। দরবার কক্ষে খ্রীষ্টান সম্রাট এবং সেনাপতিগণ বসে আছেন। ডিউক মুখ খুলল, ‘মেয়ে দু’টোর কি হেয়েছে জানিনা। আমি ওদের রক্ষা করার চেষ্টা করিনি। আপনাদের কাছে মূল্যবান তথ্য পৌঁছানো জরুরী মনে করে সুযোগ পাওয়ামাত্র একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ডাকাতদের আক্রমণের পর মেয়েদের দিকে একবারও তাকাইনি। তাকানোর কোন সময় ও পরিবেশ ছিলনা। আমি যে আপনাদের কাছে পৌঁছতে পারব তারও কোন আশা ছিল না। যিশুর অসমী দয়ায় ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি। নইলে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনা।
কেউ আমাকে অনুসরণ করেনি। আমার মনে হয় ওরা দস্যু নয়, সুলতানের পাঠানো লোক। ভেবে পাইনা তিনি কেন আমাদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে মেয়েদেরকে নষ্ট করার এ পথ বেছে নিলেন। এখন বুঝতে পাছি, এর পুরোটাই ছিল সাজানো নাটক। মেয়েদের জন্যই এ নাটক সাজানো হয়েছিল। এদেরকে হত্যা না করে এখনো হয়ত ওদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পশুগুলো।’
‘ডিউক, ওদের মুক্ত করার কোন ব্যবস্থা এখন আমরা নিতে পারছিনা। এ ত্যাগ আমাদের স্বীকার করতেই হবে। আমাদের কাছে তো মেয়ের অভাব নেই। যুবতীদের ব্যবহার করে আমরা যে সাফল্য লাভ করেছি সে কথা বিবেচনা করে আমরা আরও অনেক মেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে তৈরী করেছি। ওদের কথা বাদ দিয়ে এবার তোমার মূল্যবান গোপন সংবাদের কথা বল।’ বললেন এক সেনাপতি।
ডিউক সব কথা খুলে বরল। সুলতানে আক্রমণের তারিখ উল্লেখ করে বলল, ‘সালাহউদ্দীন ক্রাক আক্রমণ করবে শুনে একজন কমাণ্ডার বলেছিল, ‘আগে সুবাক দখল করা উচিৎ।’
কিন্তু সালাহউদ্দীন এখানে শক্তি ক্ষয় করতে চাইছেন না। ক্রাককে দুর্বল মনে করে আগে ক্রাক দখল করবেন। ক্রাক হবে তার কেন্দ্র। ওখান থেকেই চারদিকে আক্রমণ পরিচালনা করবেন। আমাদের অজ্ঞানে তিনি আক্রমন করতে চাইছেন। কারণ, তার সৈন্য সংখ্যা কম। অস্ত্রশস্ত্র ওদের চেয়ে আমাদের বেশী।
তিনি সকলকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘খ্রীষ্টান ফৌজ পথে বাধা দিলে পরাজয় অনিবার্য। কোন অবস্থাতেই খোলা মাঠে যুদ্ধ করবেনা। সম্মুক লড়াইয়ের পথ এড়িয়ে আমরা ক্রাকে ঝটিকা হামলা করবো। ওরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই আমাদের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।’ ডিউক থামল।
এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে মেয়েদের প্রসংগ চাপা পড়ে গেল। আয়ুবীকে প্রতিরোধের ব্যাপারে আলাপ শুরু হল। ওরা স্বীকার করল, আয়ুবী নিঃসন্দেহে দূরদর্শী এবং যুদ্ধবাজ। ক্রাক আক্রমণের পরিকল্পনা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পথে যুদ্ধ করে শক্তিক্ষয় করতে না চাওয়াও তার যুদ্ধ পলিসির উজ্জ্বল দিক।
‘পবিত্র যিশুর দয়ায় আমরা আগে ভাগেই তার পরিকল্পনা টের পেয়েছি। নয়তো ক্রাক দখলে রাখা আমাদের জন্য সমস্যা হতো।’ বলল এক সেনাপতি।
আয়ুবীর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পরিকল্পনা তৈরী হতে লাগল। সিদ্ধান্ত হল, সুবাকে থাকবে কেন্দ্রীয় কমাণ্ড। রসদও থাকবে এখানে। ক্রাকে আরও সৈন্য পাঠিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। ক্রাক থেকে অনেক দূরে পার্বত্য স্থানে আয়ুবীকে বাধা দেয়া হবে। অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহী সৈন্যের পরিমাণ থাকবে বেশী। পানির ঝর্ণাগুলো আগে ভাগেই দখল করে নিতে হবে। আয়ুবীর বাহিনীকে ঘেরাও করে শেষ করে ফেলতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হল। সবাই ভীষণ খুশী। এই প্রথম সুলতান আয়ুবীর গোপন পরিকল্পনা ওরা আগেভাগে জানতে পেরেছে। তার মত একজন দূরদর্শী যোদ্ধাও যে সময়ে ভুল করতে পারে তার প্রমাণ এবারের অসতর্কতা। সুলতানের এ অসতর্কতার সুযোগে মূল্যবান গোপন তথ্য পাওয়ার আনন্দে ওরা বিভোর সবাই।
ফ্রান্সের সৈন্য ছিল অনেক দূরে। সিদ্ধান্ত হল, ওদেরকে নুরুদ্দীন জংগীর আসার পথে পাঠিয়ে দিতে হবে।
একজন অফিসার ভেতরে এসে গোয়েন্দা প্রধানের কানে কানে কি যেন বলল। তিনি সকলকে শুনিয়ে বললেস, ‘দু’জন মেয়ের একজন ডাকাতের হাত থেকে বেঁচে এসেছে। সাথে রয়েছে একজন মুসলমান রক্ষী সেনা।’
সর্ব প্রথম ডিউক কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। কামরা থেকে বেরিয়ে ও দেখতে পেল বারান্দায় হাদিদকে শুইয়ে পাশে বসে আছে মেয়েটা। দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে হাদিদের ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে।
খ্রীষ্টান কমাণ্ডারদের কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। তাদের বলা হয়েছিল ডাকাতের আক্রমণ ছিল এক নাটক।
একজন সেনা অফিসার এগিয়ে গেল। মেয়েটাকে বলল, ‘সিনথিয়া, ভেতরে এসো।’
সিনথিয়া বলল, ‘এর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ না বাঁধা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাবনা।’
গোয়েন্দা প্রধান হরমুন ছিলেন একজন জার্মান। কামরা থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন তিনি। সিনথিয়ার কথা শুনে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি ও সাপের বাচ্চার ব্যান্ডেজ করতাে চাইছ? জীবন নিয়ে ফিরে এসেছ এ-তো তোমার সৌভাগ্য। এ জানোয়ার তোমাদেরকে ডাকাতদের হাতেই তুলে দিতে চাইছিল।’
‘মিথ্যে কথা।’ যুবতীর কণ্ঠে দৃঢ়তা। ‘প্রথমে আমিও তাই মনে করেছিলাম। এ যুবক আমার সব সন্দেহ দূর করে দিয়েছে। একা দু’জন দস্যুকে হত্যা করে সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’
যুবতী হরমুনকে সব ঘটনা খুলে বলল। ‘দেখুন! লোকটা বার বার আমাকে বলেছে, আমায় এখানেই মরতে দাও। পালিয়ে যাও তুমি।’
মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রীষ্টানদের হৃদয়ে ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। হাদিদের চিকিৎসার কথা কেউ বলল না। বলল না ডিউকও। মেয়েটা ওর চিকিৎসা ছাড়া ভেতরে যাবে না।
এক অফিসার বলল, ‘মুসলমানটাকে নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দাও।’
হাদিদকে নিয়ে গেলে যুবতী হাঁটা দিল অফিসারের সাথে। অফিসার তাকে নিয়ে কামরায় ঢুকলেন। সম্রাট ও কয়েকজন সেনাপতি তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওরা কামরায় ঢুকলে একজন বলল, ‘বলতো মেয়ে কিভাবে বেঁচে এলে?’
মেয়েটা পথের সব ঘটনা বর্ণনা করল ওদের সামনে।
‘তুমি খুব ইন্টারেষ্টিং গল্প শোনালে।’ বলল এক সেনাপতি। ‘এমন মজাদার কাহিনী শোনার পর একটু আনন্দ না করলে গুণাহ হবে।’
সম্রাট বললেন, ‘সত্যিই আজ বড় আনন্দের দিন। এসো, সবাই মিলে প্রাণ ভরে খাও এবং পান করো।’
ওদের সামনে খাবার এবং মদ পরিবেশন করা হল। মেয়েটা বলল, ‘আহত লোকটির খাওয়া হলে আমি খাব। আমি ওকে একটু দেখে আসি।’
উঠতে যাচ্ছিল সিনথিয়া, হরমুন কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন, ‘দাঁড়াও নিসথিয়া। তুমি এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ফৌজি নির্দেশ অমাণ্য করলে। প্রথববার তোমাকে ভেতরে আসতে বলা হল, তুমি বললে, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা না হলে আমি ভেতরে যাব না। এখন কারো অনুমতি ছাড়াই বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছ। এখানে সম্মানিত সেনাপতিগণ ছাড়াও উপস্থিত রয়েছেন মহামান্য সম্রাট। তুমি জান তোমার এ নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি কি?’
‘দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।’
‘শত্রুর সামান্য একজন কমাণ্ডারের জন্য তুমি আমাদের নির্দেশ অমান্য করেছ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।’
‘লোকটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু শিবিরের একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দার জীবন বাঁচিয়েছে, খ্রীষ্টান সম্রাট এবং সেনা অফিসারগণ কি তাকে এর জন্য কোন প্রতিদান দেবেন না? আমি জানি যে ও শত্রুদের সেনা কমাণ্ডার। আমি তখনই তাকে দুশমন ভাবব, যখন সে নিজ সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবে।’
‘দুশমন সব সময়ই দুশমন থাকে।’ একজন কমান্ডার চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা ফিলিস্তিনে ক’জন মুসলমানকে বাঁচতে দিয়েছি? ওদের বংশ কেন শেষ করেছি আমরা? কারণ ওরা আমাদের শত্রু, ওরা আমাদের ধর্মের শত্রু। পৃথিবীতে শুধু খ্রীষ্টানদের শাসন থাকবে। আমাদের কাছে একজন আহত মুসলমানের কোন মূল্য নেই। তুমি বস।’
বসে পড়ল যুবতী। তার দু’চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা।
সুবাকের কাজকর্ম চলছে স্বাভাবিক গতিতে। সেনাবাহিনীতে চলছে অন্য তৎপরতা। কেল্লা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দলে দলে সৈন্য। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে উট। ওদের পিঠে চাপানো হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী। অফিসাররা সবাই ব্যস্ত, কারো হাতে একদণ্ড সময় নেই। উর্ধতন ক’জন সামরিক অফিসার ইতিমধ্যেই ক্রাক রওয়ানা হয়ে গেছেন। সিনথিয়া নির্লিপ্ত। যেন এ তৎপরতার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
গতকালের সেনা সম্মেলন শেষ হয়েছিল মাঝ রাতে। সিনথিয়া ছিল ক্লান্ত-শ্রান্ত। একজন অফিসার ওকে বলেছিল, ‘আহত ব্যক্তিকে ডাক্তারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুশ্চিন্তার কারণ নেই।’
ফেরার পথে দেখা হল গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান হরমুনের সংগে। তিনি সিনথিয়াকে বললেন, ‘সিনথিয়া, তোমার আচরণ সত্যি খুব আবেগপ্রবণ। তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হলে এ ধরণের আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না।’
‘আমাকে মাফ করবেন। হয়তো আমি সত্যি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। কিন্তু সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। এ কথা আমি ভুলব কেমন করে? তবে আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন আছি। ও নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন আপনার অনুমতি পেলে আমি ওকে একটু দেখতে চাই।’
‘সিনথিয়া, তুমি জান কোনার্ড এবং লুজিনাম কাউকে ক্ষমা করেন না। রাতের ব্যাপারে না হলে ওরা তোমাকে তখনই জেলে পাঠিয়ে দিতেন। তোমার রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমার জন্য নির্দেশ হল, তার সাথে দেখা করতে পারবে না।’
‘কেন?’ সিনথিয়ার হতবাক কণ্ঠ। ‘আমি কি তাকে কৃতজ্ঞতাও জানাতে পারব না!’
‘না, পাবরে না। কারণ সে শত্রু বাহিনীর, তোমার দায়িত্বের কথা তুমি জান। আমি তার সাথে দেখা করার অনুমতি তোমাকে দিতে পারি না। তোমার কাছে সংস্থার দাবীও তাই। আমি দেখতে পাচ্ছী তার ব্যাপারে তুমি মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ। তোমাকে আমি এতটা আবেগপ্রবণ হওয়ারও অনুমতি দিতে পারি না।’
‘আমায় শুধু বলুন তার চিকিৎকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎকার পর তাকে নিরাপদে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
‘সিনথিয়া!’ হরমুনের কণ্ঠে ক্রোধ। ‘তোমার সে ইচ্ছে পূরণ করা হবে। তুমি এক বিপজ্জনক অভিযান থেকে এসেছ। এখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। তোমাকে এক মাস ছুটি দেয়া হল। এখন গিয়ে আরাম কর।’
কনফারেন্স শেষে হরমুনের সংগে এসব কথা হওয়ার পর রাতে নিজের কামরায় ফিরে গেল সিনথিয়া। গোয়েন্দা মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সেনা হেডকোয়ার্টার থেকে অনেক দূরে। এদের অভিযান ছিল বিপজ্জনক, দায়িত্ব পালন কালে ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত। তাই এদর জন্য সব রকম বিলাস উপকরণের ব্যবস্থা ছিল। বলতে গেলে ওরা থাকত রাজকুমারীর মত!
রুমে গিয়েই শুয়ে পড়ল সিনথিয়া। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় ঠেকাতেই ঘুমিয়েও পড়ল। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে।
বিছানা ছাড়তে মন চাইছিল না তার। তবুও উঠে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ল। বেরোতেই দেখা হয়ে গেল লুজিনার সাথে। লুজিনা ওর পাশের কামরায় থাকে। ও কায়রোর অভিযানের কথা শুনতে চাইল।
‘লুজি, আমাকে এখনই একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। ঘুরে আসি, তারপর সব বলল তোকে।’
একটু এগুতেই সিনথিয়া ওর এক বান্ধবীর সামনে পড়ল। সেও থাকে পাশের কক্ষেই। দূর থেকে ওকে দেখেই নেমসি চিৎকার করে ডাকল, ‘হ্যালো সিন!’
সিনথিয়া হেসে বলল, ‘হাই।’
নেমসি এগিয়ে এল ওর কাছে। বলল, ‘আরে সিনথিয়া! কখন ফিরলি? যাচ্ছিস কোথায়? তোকে কেমন উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। একি ক্লান্তি না অন্য কিছু! ছুটি পাসনি?’
হেসে ফেলল সিনথিয়া। ‘এক মাস ছুটি পেয়েছি। তবে…’ তার চেহারায় আবার চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
‘তবে কি?’ উদ্বেের স্বরে জানতে চাইল সে।
‘একটা বিশেষ কারণে আমি আসলেই চিন্তিত।’
‘কি ব্যাপার! কী ঘটেছে বলতো শুনি।’
সব কথা ওকে খুলে বলল সিনথিয়া। অফিসাররা যে শাসিয়েছে তাও বলল। সবশেষে বলল, ‘আমি হাদিদের সাথে দেখা করতে চাই। মনে হয় ওরা তার চিকিৎসা করেনি? না হয় শহর থেকে বের করে দিয়েছে। এমনও হতে পারে, মারার জন্য কোন কক্ষে বন্দী করে রেখেছে।’
‘তোকে না তার সাথে দেখা করতে নিষেধ করা হয়েছে? ধরা পড়লে কি শাস্তি দেবে তা জানিস?’
‘ওর জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত। তোকে তো বলছি, আমার জন্যই ও নিজের জীবন বিপন্ন করেছে। আমার তো জীবনের কোন ভয় ছিল না। ডাকাতরা ক’দিন ব্যবহার করে কোন আমীরের কাছে হয়তো বিক্রি করে দিত। এ কথা হাদিদও জানত। আমার ইজ্জতের জন্যই নিজেকে বিপদে ফেলেছিল সে। দস্যুরা বলেছিল, ‘মেয়েটাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে তুমি চলে যাও। আমরা তোমাকে কিছুই বলবনা।’ আমি যে খারাপ মেয়ে তাও ওর জানা ছিল। কিন্তু তবু আমার ইজ্জত রক্ষা করাকে ওর আমানত মনে করেই ও নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে রক্ষা করেছে।’
‘মনে হয় ওকে তুই ভালবেসে ফেলেছিস?’
‘হ্যাঁ, কথাটা তুই মিথ্যে বলিসনি। হরমুনের সামনে আমার এ আবেগ প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু আমার মনে সব কথাই তো তোকে বলতে পারি। তুই আমার বান্ধবী। নারী হৃদয়ের আবেগ তুই বুঝিস। আমাদের জীবনটা কি? চোখ ধাঁধাঁনো তরবারী, মিষ্টি বিষ। পুরুষদের ধোঁকা দেয়াই আমাদের পেশা। আমরা ট্রেনিং নিয়েছী প্রতারণার ফাঁদ পাতার।
কিন্তু একথা আগে কখনও ভাবিনি, আমরাও মানুষ। আমাদের যে হৃদয় আছে ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর সংস্পর্শে এসে আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। ওকে দেখে আমার আবেগের দারিয়ায় ঝড় উঠল। ওর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় গলে গেল আমার ও ছোট্ট হৃদয়। এ প্রথমবার মনে হল আমি কারও মেয়ে। আবার আমি কারো মা- ও হতে পারি।
এতদিন আমি নিজেকে রাজকুমারী মনে করতাম। ওর পরশ পেয়ে আমি মানুষের মধ্যে ফিরে এসেছি।
আমাদের গোয়েন্দাবৃত্তির ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। সম্রাটগণ আমাদের চোখের ইশারায় উঠাবসা করে। কিন্তু এতে খুশী হওয়ার কিছু দেখিনা আমি। এরাতো আমাদেরকে পণ্যে পরিণত করেছে।
আমি অন্ধগলির মেয়ে না হলেও যেসব মেয়েরা প্রতিরাতে নতুন নতুন খদ্দের খোঁজে আমি তো তাদেরই মত একজন।
হাদিদ আমাকে এ পর্যায় থেকে অনেক উপরে তুলে দিয়েছে। আমি ছিলাম ওর বন্দিনী। ইচ্ছে করলে ও আমাকে সহজেই ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ও আমাদের এড়িয়ে গেছে। আমার ইজ্জত রক্ষার জন্য ও যখন আহত হল আমি নিজকে ধরে রাখতে পারিনি। ওকে জায়গা করে দিয়েছি বুকের মধ্যে। আমি হয়ে গেছি এক সাধারণ মেয়ে। যার হৃদয় আছে, আবেগ ও উচ্ছাস আছে।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কোন সম্মানিত লোককে বিয়ে করছ না কেন?’ তখন মনে হয়েছিল ও মুসলমান সম্রাট কত গবেট। এখন অনুভব করছি, আমাদের শত্রু কত মূল্যবান কথা বলেছেন।
আমি আর গোয়েন্দার কাজ করতে পারব না। শৈশব থেকে দেয়া আমার সব ট্রেনিং হারিয়ে গেছে মরুভূমির ভয়ংকর রাতের আঁধারে। ডাকাতদের ভয়, ওর শরীরের উষ্ণতা আর রক্তের গন্ধ আমার এতদিনের সব শিক্ষা মুছে দিয়েছে।’
‘এত কথা না বললেও তোর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবু চরম বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না। ওকে চলে যেতে হবে। আর ও এখানে কোন কষ্টের মধ্যে থাকলেও তোর করার কিছুই নেই। তার সাথে দেখা না করার জন্য তোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ অমান্য করার পরিণাম কত ভয়াবহ তা কি তোর অজানা?’
‘ধরা পড়লে এক সংগে দু’জনই মরব, তবু তার সংগে আমার দেখা করতেই হবে। আমাকে ভুল বুঝিস না বোন, তুই আমাকে একটু সাহায্য কর।’
মিনতি ঝরে পড়ল সিনথিয়ার কণ্ঠ থেকে।
‘বুঝেছি সিন তুই মরেছিস। কিন্তু তবু বলল, এমন কিছু করিস না, যাতে দু’জনকেই বিপদে পড়তে হয়। যা-ই করিস ভেবেচিন্তে করিস। আমার মনে হয়না এ অবস্থায় তার সাথে তোর দেখা করা ঠিক হবে।’
‘কিন্তু ওর কোন খোঁজ না নিয়ে চুপচাপ আমাকে বসে থাকতে বলিস?’
‘আচ্ছা, আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
‘প্লিজ, খোঁজ নিয়ে দেখ ও কোথায় আছে। সুস্থ হয়ে ও ফিরে গেছে শুনলেও আমি স্বস্তি পাব।’
‘ঠিক আছে। তুই রুমে ফিরে যা, আমি ওর খোঁজ নিচ্ছি।’
উঠে দাঁড়াল দু’জন। পরস্পর বিদায় নিয়ে দু’দিকে হাঁটা দিল। হাসপাতালে না গিয়ে সিনথিয়া ফিরে এল তার রুমে।
* * *
কায়রোর সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছাউনীর বাইরে সৈন্যদের ট্রেনিং চলছিল। তৈরী করা হচ্ছিল কমান্ডো বাহিনী। শেখানো হচ্ছিল গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম কানুন।
সুলতান নিজে সব দেখাশোনা করছেন। তিন চার দিন পর অফিসারদের দরবার বসেছে। যুদ্ধের মানচিত্র নিয়ে যুদ্ধ পলিসি ব্যাখ্যা করছেন আয়ুবী।
তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের মূলনীতি হবে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমণ করা। অস্ত্রের চাইতে বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে বেশী। সামনাসামনি আক্রমণ করবে না। একশ জন সৈন্য দু’তিনটে যুদ্ধে যে সাফল্য লাভ করতে পারে দশবারো জনের একটা কমান্ডো বাহিনী ঠিকমত আঘাত করতে পারলে সফলতা লাভ রকতে পারে তারচে’ বেশী।’
দুর্গ অবরোধ এবং প্রাচীর ভাংগার পদ্ধতি শিখান হলো সৈনিকদের। দুর্বল উট, ঘোড়া এবং খচ্চরগুলো বাছাই করে সরিয়ে রাখা হল।
ফিলিস্তিন পুনর্দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আয়ুবী। অন্যদিকে আয়ুবীকে পথে বাধা দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিল খ্রীষ্টান বাহিনী। প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছিল দু’দলই পরস্পরকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
খ্রীষ্টান বাহিনী তাদের সৈন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল সুবাক থেকে মিসর সীমানা পর্যন্ত। বাহ্যত মনে হচ্ছিল সুলতান আয়ুবীর বেঁচে আসার সকল পথ রুদ্ধ। আগে ভাগে সুলতানের পরিকল্পনা জানার কারণেই এভাবে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়েছে।
সেনা প্রস্তুতির বাইরে সুবাকে চলছিল অন্য এক তৎপরতা। হাদিদের সংবাদের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল সিনথিয়া। নিজের কক্ষে ছটফট করছিল ও। নেমসি মেয়েটা দু’দিন থেকে হাদিদকে খুঁজছে। হাদিদ অফিসারদের হাসপাতালে নেই। সাধারণ সৈন্যদের হাসফাতালেও পাওয়া যায়নি তাকে।
গোয়েন্দা হওয়ায় সেনা অফিসাররা ওদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত। মেয়েটা হাদিদের কথা অনেককে জিজ্ঞেস করেছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি।
তৃতীয় দিন একজন অফিসার ওকে গোপনে বলল, ‘ব্যান্ডেজ করে তাকে মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
নেমসি ছুটে এল সিনথিয়ার কাছে। সংবাদ শুনে সিনথিয়া থ’ মেরে বসে রইল। চোখে মুখে ফুটে উঠল আতংক।
মুসলমানদের বেগার ক্যাম্প এক ভয়ংকর স্থান। যুদ্ধবন্দী ছাড়াও বিজিত এলাকার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে এখানে জড়ো করা হয়েছিল। মুসলমানেদর কাফেলা লুট করে ওদেরকেও এখানে এনে রাখা হত।
কারাগার নয় বলে ক্যাম্পে পাহারার কড়াকড়ি ছিল না। এখানে রাখা বন্দীদের কোন তালিকা করা হতো না।
এদের সাথে আচরণ করা হত পশুর মত। কোথাও সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হলে এদেরকে পশুর মতই তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত। খাবার দেয়া হত বেঁচে থাকার মত। রাখা হত তাঁবুতে। সাধারণ রোগে চিকিৎসা করা হত। বেশী অসুস্থ হলে মেরে ফেলত বিষ খাইয়ে।
এখানে বন্দী হওয়ার জন্য কোন অপরাধ করার দরকার হতো না। ও মুসলমান এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে!
হাদিদকে এ ক্যাম্পেই পাঠানো হয়েছিল। হরমুন বুঝেছিলেন সিনথিয়া তার জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। এজন্য হাদিদের সাথে সিনথিয়ার দেখা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
সিনথিয়া মনে প্রাণে এ নির্দেশে গ্রহণ করতে পারেনি। যখন ও শুনল হাদিদ বেগার ক্যাম্পে, বান্ধবীকে বলল, ‘আমি ওকে মুক্ত করব।’
ওকে সহযোগিতা করতে রাজি হল মেয়েটা।
সিনথিয়া শহরের এক প্রাইভেট ডাক্তারের সাথে দেখা করল। বলল, ‘একজন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করতে হবে। শর্ত হচ্ছে এ কথা কাউকে বলা যাবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ লোকটি একজন গরীব মুসলমান। ও আমার বংশের অনেক উপকার করেছে। কোথাও ঝগড়াঝাটি করে আহত হয়েছে চিকিৎসা করার মত সামর্থ নেই। ডাক্তারদের সবাই খ্রীষ্টান। বিনে পয়সায় কেউ ওর চিকিৎসা করতে চাইছে না।
ব্যাপারটা গোপন করার দ্বিতীয় কারণ হল, প্রশাসন যদি জানতে পারে মুসলমানরা ঝগড়াঝাটি করেছে তবে ওদের বেগার ক্যাম্পে পাঠায়ে দেবে। ওদের বন্দী করার জন্যত একটা বাহানা মাত্র প্রয়োজন।
সে আমার পরিবারের যে উপকার করেছে আমি তার প্রতিদান দিতে চাইছি। আমি তাকে নিয়ে আসব রাতে। বলুন আপনাকে কত দিতে হবে? গোপনীয়তা রক্ষার মূল্য আমি দেব।’
ডাক্তার সিনথিয়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। চোখে জ্বলজ্বলে কামনা।
সিনথিয়া এক ভদ্রঘরের মেয়ে হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। ডাক্তার ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। রূপসী তরুনীর কাছে বিনিময় চাওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল ডাক্তার।
ডাক্তারের চোখের ভাষা বুঝে ফেলল সিনথিয়া। নিজের প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাল। গলে গেল ডাক্তার।
সিনথিয়া তার হাতে চারটি স্বর্ণ মুদ্রা ধরিয়ে দিল। ডাক্তার সিনথিয়ার হাত ধরে বলল, ‘তোমার চাইতে দামী মূদ্রা আর কিছুই হতে পারেনা।’
মৃদু হাসল সিনথিয়া। ‘আপনি যা চাইবেন দেব, আগে আমার কাজ করুন।’
ডাক্তার বুঝল ব্যাপার বিপদজনক। কিন্তু সিনথিয়াকে দেখে যে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি হল সে। বলল, ‘আজ রাত বা কাল রাত যখনই ইচ্ছা নিয়ে এস। এ দু’দিন আমি কোন বাইরের কলে এটেন্ড করবো না। আমি ঘুমিয়ে থাকলে জাগিয়ে দিও।’
ডাক্তার এক হাতে স্বর্ণ মুদ্রা এবং অন্য হাতে সিনথিয়ার হাত ধরে ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
হাদিদকে ক্যাম্প থেকে বের করাটাই ছিল বড় সমস্যা। ক্যাম্পে পাহারার কড়াকড়ি নেই ঠিক, কিন্তু সিনথিয়াকে সেখানে দেখলে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ষোল আনা।
ওখানে যারা থাকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ওদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। ক্যাম্পে আনা হয় সূর্যাস্তের পর।
একজন প্রহরী প্রতিদিন পাশের ডাক্তারখানায় নিয়ে যেত আহত বা অসুস্থ বন্দীদের।
পরদিন নেমসিকে নিয়ে ক্যাম্পের কাছে গেল সিনথিয়া। পঁচিশ ত্রিশজন রোগীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডাক্তারের কাছে। প্রহরীর হাতে লাঠি। দ্রুত চলার জন্য সে রোগীদের পিটাচ্ছিল।
মেয়ে দু’জন চলে এল রোগীদের কাছে। ভাব দেখাচ্ছে যেন এ দৃশ্য উপভোগ করছে ওরা। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
হঠাৎ করেই চমকে উঠল সিনথিয়া। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাদিদ। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। চেহারায় আগের সেই জৌলুস নেই। ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে। কাপড়ে চটচটে রক্তের দাগ।
কান্না পেল সিনথিয়ার। অশ্রু এসে জমা হতে লাগল দু’চোখ ভরে।
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল হাদিদ। সামনে চলে গেল রোগীর দল। নেমসি প্রহরীর সাথে কথা জুড়ে দিল। কথার মাঝে প্রকাশ পাচ্ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।
ওদের বাকচাতুর্যে পটে গেল প্রহরী। দুই যুবতীর কান্ডকারখানা দেখছিল প্রহরী, সিনথায়া হঠাৎ করেই বলল, ‘এই, ওদের সাথে আমাদের একটু মজা করতে দেবে?’
নেমসি বলল, ‘ও মাই গড, কি বিচ্ছিরি! তুই যা, আমি ওদের কাছে যাবো না।’
সিনথিয়া এগিয়ে গেল রোগীদের পাশে। প্রহরী কোন আপত্তি করল না। নেসমি প্রহরীর সাথে গল্পে মেতে উঠল।
ডিসপেনসারিতে রোগীর প্রচণ্ড ভীড়। বন্দীদেরকে বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। নেমসি তখনো প্রহরীর সাথে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। বন্দীদের নিয়ে তামাছা করছে সিনথিয়া।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে হাদিদ। ফ্যকাশে চেহারা। সিনথিয়া তাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল। নিয়ে গেল আড়ালে। বলল, ‘কর্তৃপক্ষ তোমার সাথে দেখা করতে আমাকে নিষেধ করেছেন। বসো, আমরা যে কথা বলছি কেউ যেন বুঝতে না পারে।’
‘তোমার কর্তৃপক্ষ আর তোমার ওপর গজব পড়ুক।’ ক্ষোভের সাথে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল হাদিদ। ‘কোন প্রতিদানের আশায় তোমাকে দস্যুদের কবল থেকে রক্ষা করিনি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। কর্তব্যপরায়ণ সব লোকদের সাথেই কি তোমরা এমন ব্যবহার কর?’
‘চুপ কর হাদিদ।’ সিনথিয়ার কান্না ভেজা কণ্ঠ, ‘এসব কথা পরে হবে। রাতে তুমি কোথায় থাক? আজই তোমাকে এ নরক থেকে বের করতে হবে।’
হাদিদ ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল না। সিনথিয়ার চোখে বেদনার সুনীল টলমলে জল দেখে বুঝল, ও আসলেই প্রতারণা করছে না।
হাদিদ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করল ওকে। রাতে কোথায় থাকে বলল, বলল, ‘এখান থেকে পালানো কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু যাব কোথায়?’
এর পর পালানোর একটা পরিকল্পনা তৈরী করল ওরা, যা এ দু’জন ছাড়া আর কেউ টেরও পেল না।
* * *
বেগার ক্যাম্পে মরার মত ঘুমিয়ে আছে বন্দীরা। প্রহরীও ঘুমিয়ে আছে।
এখান থেকে কেউ কখনও পালায়নি। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? বন্দীদের কোন রেজিষ্টার নেই বলে দু’একজন পালালেও কেউ জানতে পারেনা।
রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়েছে। পুরনো ছেড়া এক তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর আড়ালে চলে গেল। এখন প্রহরী সজাগ থাকলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।
ক্যাম্পের গেট পেরিয়ে এগিয়ে চলল লোকটি।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনে খেজুর বাগানের নীচে আঁধার আরো ঘন। কিছুই দেখা যায় না। ও খেজুর বাগানের দিকে পা চালাল।
ওখানে আপাদমস্তক মোটা কাপড় শরীরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি।
তাঁবু থেকে বর হওয়া লোকটা বাগানে ঢুকতেই সন্তর্পনে এগিয়ে এল ছায়ামূর্তি। কাছে এসে বলল, ‘দ্রুত হাঁটতে পারবে হাদিদ?’
‘চেষ্টা করব।’
সিনথিয়া হাদিদের হাত চেপে ধরে বলল, ‘তাহলে চল। সাবধানে হাঁটতে হবে, নাইটগার্ডের চোখে পড়লে বিপদ হবে।’
ক্যাম্প পেছনে ফেলে অনেক দুরে চলে এল ওরা, সামনে বিশাল অনাবাদী ভূমি।
হাদিদ দ্রুত হাঁটতে পারছেনা। সিনথিয়া ওকে সাহায্য করছে হাঁটতে।
চলতে চলতে গোয়েন্দা প্রধান এবং অফিসাররা কি কি বলেছে একে একে সব বলল সিনথিয়া। হাদিদের সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল।
সামনে শহর। শহরে প্রবেশ করেই একটা গলিতে ঢুকল ওরা। কিছুদূর এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে ডাক্তারের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়াল।
হাদিদকে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেল সিনথিয়া। দরজার কড়া নাড়ল তিন চারবার।
ভেতরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন ডাক্তার। দরজা খুলতেই সিনথিয়া দ্রুত হাদিদকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
হাদিদের ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ‘সুস্থ হতে কমপক্ষে দিন বিশেষ লাগবে।’
সমস্যায় পড়ল সিনথিয়া। হাদিদকে এতদিন কোথায় লুকিয়ে রাখবে? বেগার ক্যাম্পে নেয়া যাবেনা। সিদ্ধান্ত নেয়ার শক্তি লোপ পেল ওর।
ততোক্ষণে ডাক্তার হাদিদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। বললেন, ‘ওকে ভাল খাবার দিতে হবে।’
সিনথিয়া ডাক্তারকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ‘ও তো গরীব, ও এত ভাল খাবার পাবে কই? আর ওর এমন কেউ নেই যে ওকে দেখাশোনা করবে। আমার বাড়িতেও ওকে নিতে পারছিনা।
এক কাজ করুন, ওকে বরং এখানেই রাখুন। তাতে বারবার ওকে আনা নেয়ার ঝামেলাও কমবে, আর ঠিকমত দেখাশোনা করারও সুবিধা হবে। আমার কাছে বিনিময় এবং পারিশ্রমিক যা চাইবেন দেব।’
ডাক্তার অস্বাভাবিক পারিশ্রমিক দাবী করল। শুনে চোখ কপালে তুলল সিনথিয়া। বলল, ‘ও মাই গড, বলেন কি আপনি?’
ডাক্তার বলল, ‘আমাকে দিয়ে একটা বিপজ্জনক কাজ করাচ্ছেন। আমি জানি একে বেগার ক্যাম্প থেকে আনা হয়েছে। ও একজন মিসরীয় সৈনিক। আপনার সাথে ওর সম্পর্ক কি, পারিশ্রমিক বেশী হলে ও গোপন তথ্য আমার ঘরের বাইরে যাবে না।’
‘আমি রাজি। তবে এ গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়লে আপনিও বাঁচতে পারবেন না। ওর পরিচয় যখন পেয়ছেন তখন আশা করি আমার পরিচয়ও আপনার জানা আছে।’
ডাক্তার হাদিদকে অন্য এক কক্ষে নিয়ে গেল। বলল, ‘সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে।’
দুধ এবং ফল এনে দিল ভেতর থেকে। দরজা বন্ধ করে ফিরে গেল সিনথিয়ার কাছে।
পরদিন সিনথিয়া এবং তার বান্ধবী হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের কাছে গেল। দেখল ঘুরে ফিরে। কথা বলল প্রহরীর সাথে। কথায় কথায় জেনে নিল হাদিদ যে পালিয়েছে কেউ টের পায়নি।
দিন গিয়ে রাত এল। সিনথিয়ার মত পারিশ্রমিক পেয়ে ডাক্তার মহাখুশী। মন দিয়ে হাদিদের চিকিৎসা করছে, প্রয়োজনীয় খাবার দিচ্ছে। নিজেই সেবা শুশ্রুষা করছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ডাক্তারখানায় আসতো সিনথিয়া। হাদিদের সাথে কথা বলত। সময় কাটাতো ডাক্তারের ঘরে।
এভাবে বিশদিন কেটে গেল। হাদিদ এখন সুস্থ।
সিনথিয়া ডাক্তারকে বলল, ‘কাল রাতে ওকে নিয়ে যাব।’
সিনথিয়ার প্রতি দুর্বল ছিল একজন জুনিয়র অফিসার। ওকে ব্যবহার করল সিনথিয়া। অফিসারকে ভালবাসার কথা বলল, মদ খাওয়াল তাকে।
অতিরিক্ত মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল অফিসার। তার দেহ থেকে সামরিক উর্দি খুলে নিয়ে হাদিদকে পরাল সে পোশাক।
শহরের চারপাশে ছিল মাটির উঁচু দেয়াল। ফটক খোলা হত দিনে। রাতে থাকত বন্ধ।
আয়ুবীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সৈন্যরা ছিল বেজায় তৎপর। ওরা ফটক দিয়ে যাওয়া আসা করছিল হরদম।
সূর্য এখনো ডুবেনি। দুর্গের মূল ফটকের দিকে যাচ্ছিল একজন অশ্বারোহী। পরনে খ্রীষ্টান সেনাবাহিনীর উর্দি। কোমরে ঝুলানো খ্রীষ্টান সৈন্যদের তারবারী। ঝুলছে মুসলমানদের মত বাঁকা করে নয়, সোজা।
খোলা ফটক। উটের বহর যুদ্ধের রসদ নিয়ে বাইরে যাচ্ছে।
অশ্বারোহী পৌঁছল ফটকে। এ সময় খ্রীষ্টানদের গোয়োন্দা প্রধান ভেতরে ঢুকছিলেন, তাকালেন অশ্বারোহীর দিকে। মৃদু হাসলেন তিনি। অফিসার জবাবে হাসল না, বরং তাকে অগ্রহ্য করেই যেন ফটক পেরোল।
হরমুনের কি মনে হল, ঘোড়ার বলগা টেনে ধরলেন তিনি। কয়েক কদম এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়া। তিনি ঘোড়ার মুখ ঘুরালেন।
সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে শ’তিনেক গজ দূরে। হরমুনকে দেখে আড়ালে সরে গেল সে।
ফটকের দিকে ঘোড়া ছুটালেন গোয়েন্দা প্রধান। একটা সন্দেহ দূর করতে চাইছেন। বাইরে এসে দৃষ্টি ছুড়লেন। অশ্বারোহী অনেক দূর চলে গেছে। তাকিয়ে রইলেন তিনি, ঘোড়সওয়ার হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
সিনথিয়ার সহযোগিতায় হাদিদ পালিয়ে গেছে এ কথা আর জানা হল না হরমুনের। কিন্তু সন্দেহটা মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল।
ঘোড়া ঘুরিয়ে গোয়েন্দা প্রদান ছুটলেন মুসলিম ক্যাম্পের দিকে। হাদিদের হুলীয়া বর্ণনা করে কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন কেউ আছে তোমার এখানে?’
কমান্ডার খোঁজ নিল। দেখা গেল এমন কোন লোক নেই এখানে। হরমুনের সন্দেহ গাঢ় হল। ফটকে যাকে দেখেছেন সে হাদিদ কিনা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি সিনথিয়ার কক্ষে গেলেন।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কাঁদছে মেয়েটা।
‘তুমিই কি ওকে পালাতে সাহায্য করেছ?’ গর্জে উঠল হরমুন।
সিনথিয়া ধীরে ধীরে মাথা তুলল।
‘মিথ্যে বলো না, আমি তদন্ত করে সব প্রমাণ করব।’
‘আপনার তদন্তের প্রয়োজন নেই। আমার মিথ্যে বলারও কিছু নেই। আমার জীবনটাই রাজকীয় মিথ্যা, আমি হচ্ছি চোখ ধাঁধাঁনো প্রতারণা। আমার আত্মার মুক্তির জন্য সত্য কথা বলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’
টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়াল সিনথিয়া। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার। পাশের টেবিলে শূন্য গ্লাসে কয়েক ফোটা পানি।
কাঁপা হাতে গ্লাস তুলে হরমুনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি আমাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছি। গ্লাসের অবশিষ্ট ক’ফোটা পানি এর সাক্ষী। আমি জাতির সাথে বেঈমানী করেছি বা বন্দী শত্রুকে পালাতে সাহায্য করেছি বলে এ শাস্তি নেইনি। বরং এ অপবিত্র দেহ দিয়ে এমন মানুষের সাথে প্রতারণা করেছি যারা প্রতারণা বা ধোঁকা বুঝে না।
আমাদের তো কোন সম্ভ্রম নেই। কিন্তু ওরা চারজন আমাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য দশ বারোজন দস্যুর মোকাবিলা করেছে। দ্বিধাহীন চিত্তে বরণ করে নিয়েছে আপন মৃত্যু। অথচ আমাদেরকে ডাকাতের হাতে তুলে দিলে ওরা কোন ক্ষতিরই সম্মুখীন হতোনা।
এরপর এক ব্যক্তি নিজে আহত হয়ে আমাকে দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করেছে। সে জানত, আমি তার শত্রু, তবু আমার জন্য সে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল। অথচ আমার প্রতি তার কোন লোভ ছিলনা।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝেছি সত্য মিথ্যার ফারাক। ঘৃণা এবং ভালবাসার পার্থক্য। আমি সত্য প্রকাশ করে মরতে পারছি, এ জন্য আমি আনন্দিত। এ মৃত্যু প্রশান্তির, এ মৃত্যু গৌরবের।’
ও পড়ে যাচ্ছিল, গ্লাস সহ ওকে ধরে ফেলল হরমুন। ঝটকা মেরে হরমুনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে সরে গেল ও।
অস্ফুট স্বরে বরল, ‘আমার দেহ স্পর্শ করোনা। এ দেহ এখন তোমাদের কোন কাজে আসবে না। তোমাদের প্রয়োজন এক অপবিত্র দেহ। এ বিষে আমার দেহ পবিত্র হয়ে গেছে।
ওকে আমি পালাতে সাহায্য করেছি। বিশ দিন লুকিয়ে রেখে চিকিৎসা করিয়েছি। অস্ত্র ও উর্দি চুরি করে ওকে দিয়েছি। আমার নিজের ঘোড়া দিয়েছি ওকে। ওর সাথে আমি যেতে পারছি না, ওকে ছাড়া থাকতেও পারছি না- এ জন্য বিষ খেয়েছি।’
বিছানায় পড়ে গেল ও। হরমুনের কানে বাজতে লাগল ওর অন্তিম শব্দগুলো।
সত্য বলার পর মৃত্যু কত প্রশান্তির হয় তাই তাকিয়ে দেখছিল হরমুন। চির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে পড়ল সিনথিয়া, সেদিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল হরমুন।
সিনথিয়ার শেষকৃত্যের পর একজন অফিসার বরল, ‘ওর কোন আত্মীয় স্বজন থাকলে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দেয়া উচিত।’
‘আমরাই ওর আত্মীয়।’ জবাবে বলল হরমুন। ‘ওর বয়স যখন এগার, এক কাফেলা থেকে ওকে অপহরণ করা হয়েছিল।’
সুলতানের সেনাবাহিনী মিসর ছেড়েছে তিনদিন আগে। পথে বাধা দেয়ার জন্য খ্রীষ্টানদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সুবাকের বেশীর ভাগ সৈন্য পাঠানো হয়েছে ক্রাকে। নুরুদ্দীন জংগীকে ঠেকানোের জন্য কিছু গেছে সিরিয়ার দিকে। সুসজ্জিত খ্রীষ্টান বাহিনী আয়ুবীকে বাধা দেয়ার জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।
সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী নিজের বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। খানিকটা দুরুত্ব বজায় রেখে ওদের এগিয়ে চলতে নির্দেশ দিলেন। তিন দলে কমান্ডারদেরকে ডেকে পাঠালেন নিজের তাঁবুতে।
সবাই তাঁবুতে একত্রিত হল। সুলতান বললেন, ‘এবার গোপন তথ্য প্রকাশ করার সময় এসেছে। আমি বলেছিলাম ক্রাক আক্রমণ করব। কিন্তু তোমাদেরকে অন্য পথে নিয়ে এসেছি। এতে তোমরা নিশ্চয় আশ্চর্য হচ্ছ। আসলে আমি ক্রাকে আক্রমণ করব না। আমাদের লক্ষ্য হল সুবাক।
খ্রীষ্টান গোয়েন্দাদেরকে পাশের কামরায় রেখে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছিলাম, মৃত্যু দণ্ড না দিয়ে ওদের মুক্তি দিয়েছিলাম, ওদেরকে সুবাক পৌঁছে দেয়ার জন্য দেহরক্ষী দিয়েছিলাম- এর সবকিছুতেই তোমরা আশ্চর্য হয়েছ।
এবার শোন এর হাকীকত। ওদের সাথে যে চারজন রক্ষী দিয়েছিলাম ওদের একজন কাল রাতে সুবাক থেকে ফিরে এসেছে। ডিউক গিয়ে আমাদের কাছ থেকে শোনা যুদ্ধের সব পরিকল্পনা ওদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে। আমি জানতাম এমনটি হবে।
আমি যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই ওরা সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের ফৌজের বায়ের অংশ থেকে চার মাইল দূরে রয়েছে খ্রীষ্টানদের বিশাল বাহিনী।
বাম অংশের কমান্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি দু’মাইল সোজাসুজি এগিয়ে যাবে। এরপর বায়ে মোড় নেবে। চার মাইল এগিয়ে আবার বায়ে মোড় নেবে। দেখবে শত্রু সৈন্য বিশ্রাম নিচ্ছে। তীব্র গতিতে কমান্ডো হামলা করবে ওদের ওপর। পথের সবকিছু তছনছ করে আগের জায়গায় ফিরে আসবে।
দ্বিতীয় দল সন্ধ্যার পর আট মাইল সোজা এগিয়ে বায়ের মোড় নেবে। ওদের রসদ এবং খাদ্য সামগ্রী পাবে ওখানে। তোমরা তখন থাকবে শত্রুর পেছন দিকে। দিনে দুশমনের বাম অংশের পিছনে ধাওয়া করবে, কিন্তু সামনা সামনি যুদ্ধ করবে না।
ওরা মোকাবেলা করতে শুরু করলে পিছনে হটবে। আস্তে আস্তে অনেক দূরে পেছনে চলে আসবে। যেখানে এসে দেখবে দুটো পাহাড় এক জায়গায় মিলেছে, পাহাড়ের সেই সন্ধিস্থলে নিয়ে আসবে শত্রু সেনাদের। তারপর পাথরকুচির ফাঁক গলে সরে যাবে আরো পেছনে।
মূল আক্রমণ করবে রাতে। খ্রীষ্টান সেনাবাহিনী এগিয়ে এলে মাঝের অংশ পেছন থেকে ওদেরকে আক্রমণ করবে। আমি এক অংশ নিয়ে রাতেই রওয়ানা করব। কাল দুপুর নাগাদ সুবাক অবরোধ করব। বাকী দু’ভাগ মরুভূমির বিশাল এলাকায় ওদের ব্যস্ত রাখবে।
ওদের কাছে যেন রসদ পৌঁছতে না পারে। পানির সবগুলো ঝর্ণা দখল করে নেবে। আক্রমণ করবে একপাশ থেকে। যুদ্ধ করার জন্য কোথাও দাঁড়াবে না। সুইসাইড স্কোয়াড প্রতি রাতেই ওদের রসদ, পশু এবং খাদ্য বহরের উপর অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করবে।’
সুবাক অবরোধ করলেন সুলতান আয়ুবী, ওখানকার বেশীর ভাগ খ্রীষ্টান ফৌজকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ক্রাকের পথে।
মরুভূমিতে মুসলিম সেনাবাহিনী ওদের এখান থেকে ওখানে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
রসদ নেই, পানি নেই। মুসলমানরা সামনাসামনি যুদ্ধ করছে না। সুবাক রক্ষার জন্য এগিয়ে যাবে, মুসলিম বাহিনী সে সুযোগও দিচ্ছে না। বলতে গেলে খ্রীষ্টান বাহিনীর এখন ত্রিশংকু অবস্থা।
সুবাক কেল্লার অল্প সংখ্যক খ্রীষ্টান সৈন্য পাঁচিলে উঠে তীর নিক্ষেপ করছিল সর্বশক্তি দিয়ে। কিন্তু স্রোতের মত টুটে পড়ল মুসলিম ফৌজ।
একবার এদিক থেকে আবার ওদিক থেকে অব্যাহত হামলা চালাতে থাকল। দেড় মাস অবরোধের পর দেয়াল ভেংগে শহরে প্রবেশ করলেন সুলতান আয়ুবী।
পাহাড় ও মরুভূমিতে ধাওয়া খাওয়া বিচ্ছিন্ন খ্রীষ্টান বাহিনী ধীরে ধীরে সমবেত হল ক্রাক-এর দূর্গে। কখন সুলতান ক্রাক আক্রমণ করবেন সে অপেক্ষায় বসে রইল ওরা।
.
রক্তের বাঁধন
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। সুবাক দুর্গ আয়ুবীর পদানত হয়েছিল ডিসেম্বরে। শহর এখনও অশান্ত। কিছু কিছু খ্রীষ্টান পরিবার এখনও পালানোর চেষ্টা করছে।
এতদিন মুসলমানরা ওদের জন্য শান্তিতে থাকতে পারেনি। শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল অনেক পরিবার। সুবাকের মাটি লাল হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের রক্তে। শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লুন্ঠিত হয়েছিল তাদের ঘরবাড়ি।
মুসলমানরা সুবাক দখল করে নিয়েছে। অত্যাচারিত মুসলমানদের প্রতিশোধের ভয়ে পালাচ্ছে এখন খ্রীষ্টানরা।
সুলতান ঘোষণা করলেন, ‘কোন খ্রীষ্টান পরিবারকে পালাতে হবে না। নিশ্চিন্তে ওরা নিজেদের বাড়ীতে থাকতে পারবে। ওদেরকে কেউ উত্যক্ত করবে না।’
তিনি পলায়নপর খ্রীষ্টানদের বাধা দেয়ার জন্য মুসলিম সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠল।
ওরা কাউকে পালিয়ে যেতে দিচ্ছে না। যারা পালিয়ে গেছে তাদের খুঁজে আনছে মরুভূমি আর উপত্যকা থেকে। ওদের ছেড়ে যাওয়া বাড়ী ঘর ওদের বুঝিয়ে দিয়ে বলছে, ‘তোমাদের কোন ভয় নেই। মুসলমানরা তোমাদের ওপর কোন প্রতিশোধ নেবেনা। তোমরা নিশ্চিন্ত, স্বাধীন।’
খ্রীষ্টানরা তবুও ভয় পাচ্ছিল। মুসলমানদেরকে ওরা শান্তিতে থাকতে দেয়নি। প্রায় দু’হাজার মুসলমান এখনও বেগার ক্যাম্পে মানবেতর কাল কাটাচ্ছে।
সুবাক দখল করে সুলতান আয়ুবী প্রথমেই গিয়েছিলেন বেগার ক্যাম্পে। দু’হাজার বন্দী যেন মৃত লাশ। ওদের পশুর মত খাটানো হয়েছে। শহরের নোংরা আবর্জনা বহন করেছে ওরা। অনেকে এসেছে যৌবনে। এখন বৃদ্ধ। ভুলে গেছে ওরাো স্বাধীন মানুষ ছিল এককালে।
খ্রীষ্টানদের সাথে প্রথম যুদ্ধে যেসব মুসলমান বন্দী হয়েছে তাদেরকে যেমন এখানে রাখা হয়েছে তেমনি শহর থেকে জোর করে ধরে আনা বন্দীদেরও এখানেই রাখা হয়েছে।
তবে কাফেলা থেকে অপহরণ করে আনা বন্দীর সংখ্যাই এখানে বেশী। এদোে কেউ ছিল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কেউ সুন্দরী যুবতী কন্যার পিতা। খ্রীষ্টানরা ওদের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়েছে এবং যুবতী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। এদের একমাত্র অপরাধ ছিল ওরা মুসলমান।
খ্রীষ্টানদের ভয়ে শহরের মুসলমানরা সব সময় তটস্ত হয়ে থাকত। ওরা নামাজ পড়ত গোপনে, কোরান তেলাওয়াত করত অনুচ্চ স্বরে। মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে যেতে দিতনা। সুন্দরী মেয়ে ওদের চোখে পড়লে রক্ষে নেই। যে কোন বাহানায় তুলে নিয়ে যাবে।
সম্ভ্রান্ত মুসলমানকেও একজন সাধারণ খ্রীষ্টানকে ঝুঁকে কুর্ণিশ করতে হত। এসব অত্যাচারের কথা মনে ছিল বলেই এখন প্রতিশোধের আশঙ্কায় খ্রীষ্টানরা সপরিবারে পালিয়ে যাচ্ছিল।
বেগার ক্যাম্পের দু’হাজার জীবন্ত লাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতান। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রু। এক সময় আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘ওদের মুক্ত করার বিনিময়ে আমি সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ছেড়ে দিতে পারি।’
তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলৈন, ‘এরা এখানেই থাকবে। তোমরা এদের থাকা খাওয়া এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা কর। এরা আগে সুস্থ হোক, তার পর সিদ্ধান্ত নেব এদের কি করা যায়।’
সুলতানের যুদ্ধপলিসির কাছে খ্রীষ্টানরা হেরে গেছে। বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে মুসলমানদের কমান্ডো হামলা ওদের অতিষ্ঠ করে তুলছিল। বিপদে পড়ে পেছনে সরে যাচ্ছিল ওরা।
সুলতান আশংকা করছিলেন ক্রাক দুর্গ থেকে খ্রীষ্টান সেনাবাহিনী ওদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। ওদের বাধা দেয়ার জন্য সুলতানের কাছে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। ও মুহূর্তে মিসর থেকেও সৈন্য আনা সম্ভব নয়। ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর মিসর হয়ে পড়েছিল ষড়যন্ত্রের লীলাভূমি। গাদ্দাররা যে কোন সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
এ পর্যন্ত গাদ্দারী আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনি যাদের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই মুসলমান এ জন্য সুলতানের হৃদয় ছিল বেদনা ভারে জর্জরিত।
সুবাক কেল্লার পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুলতান আয়ুবী, সাথে সামরিক বেসামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ।
শহরের মুসলিম অধিবাসীরা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছিল। অন্যদিকে ছিল শহীদদের বহনকারী উটের সারি। সুলতান গভীর চিন্তায় ডুবেছিলেন।
আনন্দ মিছিল থেকে ভেসে আসছিল শানাইয়ের সুর ঝংকার। উল্লসিত জনতা পাচিলের পাশে এসে থামল। সেদিকে তাকিয়ে রইলেন আয়ুবী।
তার নির্বাক ঠোঁটে কোন হাসি নেই। তিনি দেখছিলেন মুসলমানদের উচ্ছসিত আনন্দ। ওরা নাচছে পাগলের মত। মিছিল থেকে কেউ কেউ চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘নাজমুদ্দীনের ছেলে সালাহউদ্দীন আয়ুবী সুবাকে তোমাকে স্বাগতম। তুমি এক মুক্তিদূত। তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।’
মিছিল থেকে শ্লোগান উঠল, ‘কুর্দির কৃতি সন্তান আয়ুবী আমরা তোমায় সিজদা করি।’
জেগে উঠল আয়ুবীর ঈমানী চেতনা। দরাজ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমায় গুনাহগার করো না বন্ধুরা। আমি আল্লাহর এক নগন্য গোলাম মাত্র। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা বৈধ নয়।’
কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল বলে মনে হলোনা। তারা আগের মতই লাফাচ্ছে, শ্লোগান দিচ্ছে।
একজন সেনা অফিসারকে ডেকে তিনি বললেন, ‘ওদের এসব বলতে নিষেধ কর। বলবে, এসব শ্লোগানে সুলতান রাগ করেন।’
সেনা অফিসার হাঁটা দিতেই আবার তাকে ডেকে বললেন, ‘শোন, ওদের ধমকের সুরে নয়, শান্তভাবে বলবে। ওরা যেন মনে ব্যাথা না পায়। ওদের নাচতে দাও, গাইতে দাও। ওরা জুলুমের জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে সে জন্য আমিও খুশী। আমার জীবন এই মজলুম মানুষগুলোর জন্যই। কিন্তু আমার নামে শ্লোগান দেয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে আমাকে সিজদা করার মত নাজায়েয কথা যেন কেউ না বলে।’
তিনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠ। তিনি আর কিছুই বলতে পারলেন না। আবেগে চোখে এসে জমা হল অশ্রুরাশি। উদগত অশ্রু আড়াল করার জন্য তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
একটু পর সবার দিকে নজর বুলিয়ে বললেন, ‘আমরা এখন ফিলিস্তিনের আঙ্গিনায় পা রেখেছি। মঞ্জিল এখনও অনেক দূরে। এ মরুভূমি রোম উপসাগর ঘুরে সেখান থেকে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে, আমাদের যেতে হবে সেখান পর্যন্ত। শত্রুদের ক্রুশ ডুবিয়ে দিতে হবে রোম উপসাগরের অথৈ জলে।’
সুলতান শহর-প্রধানকে বললেন, ‘প্রতিটি অলীগলিতে ঘোষণা করে দাও, ‘কোন অমুসলমানের প্রাণ-ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার দরকার হবে না। কেউ তাদের উত্যক্ত করবে না। যদি কোন নাগরিক কাউকে বিরক্ত করে সরাসরি দূর্গের ফটকে এসে অভিযোগ করবে। প্রশাসন প্রতিটি নাগরিকের সমস্যা দূর করার চেষ্টা করবে।
আমি আবারও বলছি, আমরা কাউকে কষ্ট দিতে আসিনি। আসিনি কারও বিপদের কারণ হতে। আমরা এসেছি স্নেহ ও ভালবাসার বারতা নিয়ে। ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতার বিচার ইসলামী আইনেই করা হবে। এ আইন মসুলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান।
শহরে যদি খ্রীষ্টানদের কোন গুপ্তচর লুকিয়ে থেকে থাকে আশ্রয়দাতা সহ তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার জন্য আমি জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
উপদেষ্টাদের নিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে এলেন সুলতান। প্রথমেই গোয়োন্দাদের সদর দপ্তরে তল্লাশী নেয়া হল। কোন কাগজপত্র পাওয়া গেল না। খ্রীষ্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন এবং তার সংগীরা পালিয়ে গেছে।
আটজন তরুণী গোয়েন্দা পালাতে পারেনি। তাদেরকে আলী বিন সুফিয়ানের হাতে তুলে দেয়া হল। জবানবন্দীতে ওরা বলল, ‘মেয়েদের সবাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পালিয়েছে। কোন পুরুষ ওদের সহযোগিতা করেনি।’ ওরা আরও জানাল, ‘লুজিনা (এটা সিনথিয়া হবার কথা? লুজিনা লিখা কেন?) নামে আমাদের এক সঙ্গিনী ছিল। একজন মুসলমান সৈন্যকে পালাতে সাহায্য করে সে নিজে আত্মহত্যা করেছে।
আলী ওদের নিরাপত স্থানে আটকে রাখলেন।
নিরাপত্তা এবং শান্তি সৃষ্টির জন্য সুলতানের নির্দেশে তৎপর ছিল সুবাকের প্রশাসন।
ক্রাকের খ্রীষ্টান শিবিরে চলছিল সুবাক আক্রমণের পরিকল্পনা । কিন্তু আয়ুবীর পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা নিশ্চিত না হয়ে চটজলদি কিছু করে বসার বোকামী করতে আর রাজী নয়, তাই ওদের তৈরী হতে হচ্ছিল।
বিশেষ করে সুবাকের বিপর্যয় তাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। যেকােন গোয়োন্দাদের কাছ থেকে তারা নিশ্চিত রিপোর্ঠ পেয়েছিল সুলতান আয়ুবী ক্রাক আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কায়রোরহ অন্যান্য এলাকার গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকেও একই রকম তথ্যাই পাওয়া যাচ্ছিল, তারা এ খবরও পেয়েছিল যে আয়ুবীর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী ক্রাকের দিকে যাত্রা করেছে এবং তারা দ্রুত এগিয়ে আসছে। ফলে আয়ুবীর উদ্দেশ্য ছিল তাদের কাছে স্পষ্ট। এজন্য পথেই মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেয়ার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু এসবই যে ছিল সুলতানের সাজানো খেলা, বিস্ময়কর যুদ্ধ চাল তা কে জানত।
শেষ মুহূর্তে দেখা গেল সুলতান ক্রাকে আক্রমণ না করে সুবাকে হামলা করলেন। মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য যাদের পাঠানো হয়েছিল পথে ওঁৎ পেতে থাকা সেই সব খ্রীষ্টান সৈন্যরা অযাচিত কমান্ডো হামলার শিকার হল। অথচ যুদ্ধের সমুদয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল গোয়েন্দাদের নিশ্চিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই।
ক্রাকের খ্রীষ্টান শিবিরে কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। কয়েকজন সম্রাট এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এতে শরীক হয়েছেন। অপরাধীর বেশে এসেছেন গোয়োন্দা প্রধান হরমুন। আলেমরূপী গোয়েন্দা ডিউককে আনা হয়েছে হাতে হাতকড়া পরিয়ে। তার ভুল তথ্যের কারণে খ্রিষ্ঠান সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে, হাতছাড়া হয়েছে সুবাকের মত গুরুত্বপূর্ণ দূর্গ।
এ তথ্য কিভাবে পেয়েছে ডিউক আবার কনফারেন্সে তা শুনালো। সব শেষে বললো, ‘আমার দেয়া তথ্যে সন্দেহ হলে আপনারা সে অনুযায়ী কাজ করলেন কেন? গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে কেন যাচাই বাছাই করেনি?’
হরমুনকে প্রশ্ন করা হল, ‘গোয়েন্দা বৃত্তিতে অভিজ্ঞ হওয়ার পরও কিভাবে আপনি এ ভুল করলেন?’
হরমুন বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার অনেক কিছু বলার আছে। অবশ্যই আমি গুপ্তচর বৃত্তি এবং গোয়োন্দা কাজে অভিজ্ঞ। এরপরও কোন কোন ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা এবং পরিশ্রমকে ওভারলুক করা হয়েছে।
আমাদের পরাজয় আমার একার ভুলে হয়েছে এ কথা বলার কোন অবকাশ নেই। সত্য প্রকাশের খাতিরে আমাকে কিছু তিক্ত কথা বলতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।
আমি সেই সব সেনাপতি ও শাসকদের হুকুমের সামনে অসহায় ছিলাম যারা আমার পরামর্শের তোয়াক্কা না করে আমার যোগ্যতাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এখানে তিনজন সম্রাট এবং সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। কেন আমরা পরাজিত, সুবাক হাত ছাড়া হল কেন, এক বিশাল এলাকা কেন আমাদেরকে হারাতে হল, এক্ষেত্রে আমাদের ভুলগুলি কি ছিল তা কনফারেন্সে তুলে ধরা আমার কর্তব্য বলে মনে করছি।
যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বিনয়ের সাথে বলতে চাই আমরা সবাই ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করেছিলাম। শপথ করেছিলাম ক্রুশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেব। ব্যক্তিগত মর্যাদা নয় ক্রুশের মর্যাদা বৃদ্ধিই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু আমরা অনেকেই আমাদের শপথের মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি।’
কোনার্ড, গে অব লুজিনাম এবং শাহ অগাষ্টাস-এর মত আত্মম্ভর সম্রাটগণও হরমুনের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বলার সাহস পেতেন না। গোয়েন্দা জগতে তার ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতা। যে কোন শাসককেই তিনি গুপ্তভাবে হত্যা করতে পারতেন।
কনফারেন্সের পিনপতন নিরবতার মাঝে হরমুন প্রশ্ন করলেন, ‘বুঝতে পারছি না শত্রুর গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?’
‘কারণ নারী হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।’ কোনার্ড বললেন। ‘মানুষের চরিত্র নষ্ট করার জন্য নারীর বিকল্প নেই। হোক সে রক্ত মাংসের মানুষ বা সাহিত্যের মোড়কে নারীর শারীরিক বর্ণনা। তুমি কি অস্বীকার করতে পার হরমুন, নারীদের দিয়েই আমরা আরবের অনেক আমীল ওমরাকে আমাদের গোলামে পরিণত করেছি?’
‘না অস্বীকার করিনা। কিন্তু এখন মুসলিম শাসন আমীর ওমরাতের হাতে নয়, সেনাবাহিনীল হাতে। মিসরের শাসক একজন গভর্ণর হয়েও খলীফাকে বরখাস্ত করেছেন। সুরুদ্দীন জংগী একজন সেনাপতি এবং মন্ত্রী। তিনিও কেন্দ্রীয় নির্দেশের তোয়াক্কা করেন না।
এ জন্য ক‘জন আমীল ওমরাকে হাত করলে বড়জোর ক’জন গাদ্দার বৃদ্ধি পাবে। ওরা দেশের এক ইঞ্চি মাটিও আপনাদের দিতে পারবে না।
এখন সেনাবাহিনীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা। আয়ুবী এবং জংগী সৈন্যদেরকে এমন ট্রেনিং দিচ্ছে নারীদের দিয়ে আপনারা ওদের নৈতিক স্খলন ঘটাতে পারছেন না এবং পারেননি। ইসলাম মদ হারাম করেছে। ফলে সৈন্যদের জন্য মত কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তাই কেউ বিবেকশূন্য হয়না। আয়ুবী মদে অভ্যস্ত হলে বিজয়ী হয়ে নয় সুবাক আসত বন্দী হয়ে।’
‘হরমুন,’ বিরক্তি প্রকাশ করল এক সেনাপতি, ‘তোমার কথা মেয়েদের মধ্যেই সীমাবন্ধ রাখ। মুসলমানের প্রশংসা শোনার জন্য আমরা এখানে আসিনি।’
‘আমি বলতে চাই, গুপ্তচর বৃত্তিতে মেয়েদের ব্যবহার করে আমরা ব্যার্থ হয়েছি। গত দু’বছরে মিসর পাঠিয়ে আমরা অনেক মূল্যবান মেয়ে হারিয়েছি। মনে রাখতে হবে মেয়েরা সাধারণভাবেই আবেগ্রবণ। যত ট্রেনিং-ই দেয়া হোক ওরা পুরুষের মত কঠিন হতে পারে না।
আমরা ওদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করি। কখনও অবস্থা পাল্টে যায। যুবতীদেরকে ভোগ না করে বরং নিরাপদ আশ্রয় দান করে মুসলমানরা। এর ফলে মেয়েদের ভেতর প্রচন্ড আবেগ জন্ম নেয়। ওদের চারিত্রিক দৃঢ়তায় অভিভুত হয়ে অনেকেই তাদের ভক্ত হয়ে যায়।
কিছুদিন পূর্বে সালাহউদ্দীনের এক কমান্ডার আমাদের একটা মেয়েকে দস্যুর কবল থেকে মুক্ত করে নিজে আহত হয়ে পড়ে। মেয়েটা কমান্ডারকে সুবাক নিয়ে এসেছিল। আমরা তাকে মুসলমানদের ক্যাম্পে স্থানান্তর করেছিলাম। মেয়েটা আমাদের এক অফিসারের উর্দি পরিয়ে তাকে দুর্গ থেকে পালাতে সাহায্য করেছে। হোষ্টেলে ফিরে নিজে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে। মৃত্যুর সময় আমি ওর পাশে ছিলাম। আমাদের শাস্তির ভয়ে ও আত্মহত্যা করেনি। প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে নিজের দেহ ব্যবহার করেছে, এ অনুভূতি ওকে বিষপানে বাধ্য করেছে।
এ প্রসঙ্গে আমি আরও দু’একটা উপমা দিচ্ছি। আমাদের বেশীর ভাগ গোয়েন্দা মেয়েকে শৈশবে কোন মুসলিম কাফেলা বা মুসলমানদের বাড়ী থেকে অপহরণ করে এসেছি। পরে ওদেরকে আমাদের ধর্মের রঙে রাঙিয়ে ট্রেনিং দিয়েছি। যৌবনে এসে মেয়েরা ভুলে গেছে তাদের অতীত, তাদের মৌলিক অস্তিত্ব। ওরা জানেনা ওরা মুসলিম ঘরের সন্তান। আমরা ওদের নাম, ধর্ম এবং কর্ম বদলে দিয়েছি, কিন্তু ওদের রক্ত পরিবর্তন করতে পারিনি।
আমি মানুষের সাইকোলজি বুঝি। মুসলমানের মানসিকতা অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের মানসিকতার চেয়ে ভিন্ন। এসব মেয়েরা কোন মুসলমানের হাতে পড়লে অস্তিত্বে নতুন অনুভূতি জন্ম নেয়, সে তখন ভাবে আমার দেহেও বইছে মুসলিম পিতার রক্ত। মুসলিম রক্ত থেকে ইসলামকে কোন ভাবেই আলাদা করা যায় না।’
‘তুমি কোন মেয়েকে গোয়েন্দা কাজে পাঠাতে চাইছ না?’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করল।
‘না, কারণ সে সব মেয়ের দেহে মুসলিম রক্ত বইছে। আমার সংস্থা থেকে মেয়েদের বাদ দিলেই বরং ক্রুশের জন্য ভাল হবে। আপনারা মুসলমান আমীর ওমরাদের হারেমে মেয়েদের পাঠিয়ে সহজেই ওদের শিকার করতে পারছেন। কারণ ওরা যুদ্ধের ময়দান দেখেনি। আমাদের তরবারীর সাথে ওদের তরবারীর সংঘর্ষ হয়নি। শুধু সৈন্যরাই আমাদের চেনে। সেনাবাহিনীই কেবল দুশমন এবং বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এজন্য ওরা আমাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেয় না।’
সম্রাট অগাষ্টাস ছিলেন জটিল ও কুটিল মনের অধিকারী। মুসলমানদের বিরোধিতায় অন্যদের তুলনায় একধাপ এগয়ে ছিলেন তিনি। বললেন, ‘তোমার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হরমুন। তুমি দেখছ নুরুদ্দীন জংগী এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম। আমরা এ ধর্মটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন ওদের নৈতিকস্খলন।
ওদের চিন্তা চেতনায় সন্দেহ সৃষ্টি করতে হবে। মুসলমানদেরকে এক আকর্ষণীয় সংস্কৃতির জালে আটকে ফেল। আমরা বেঁচে থাকতেই এ উদ্দেশ্য পুরণ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দিয়ে যাব আমাদের দায়িত্ব। এরপর এমন একক সময় আসবে যখন ইসলামের নাম নিশানাও থাকবে না। থাকলেও সে ধর্ম থেকে জন্ম নেবে না কোন নুরুদ্দীন বা আয়ুবী।
আমি দৃঢ়তার সথে বলছি, ধর্ম হবে মুসলমানদের নিজস্ব, কিন্তু তার দেহে থাকবে আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির পোশাক। আমাদের চিন্তা চেতনায় রঙ্গীন হবে ওই ধর্ম।
হুরমুন, আজ থেকে শত বর্ষ পরে দেখ। জয় পরাজয় ক্ষণস্থায়ী। আবার আমরা সুবাক জয় করব। মিসরে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে দাও। ফাতেমী, সুদানী এবং কাফ্রীদের সাহায্য কর। ব্যবহার কর গুপ্ত ঘাতকদের। বিজয়ী আমরাই হব। ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি, ওদের চিন্তা চেতনা এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্ব হবে আমাদের।
কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করল একজন খ্রীষ্টান অফিসা। ধুলো মলিন চেহারা। আয়ুবীকে পথে বাধা দেয়ার জন্য পাঠানো একটা দলের কমান্ডার। এরা মুসলীম কমান্ডো বাহিনীল চাপে ক্রাকের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কমান্ডার বলল, ‘আমাদের সৈন্যদের অবস্থা ভাল নয়। এ পরিস্থিতিতে আমি একটা প্রস্তাব পেশ করতে চাই।’
‘কি তোমার প্রস্তাব?’ কোনার্ড বললেন।
‘ক্রাকে অবস্থানকারী সৈন্যদের সাথে আরও কিছু যোগ করে এ মুহূর্তে সুবাক আক্রমণ করা উচিৎ। এতে মুসলমানরা সামনা সামনি যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। কেন্দ্রের নির্দেশে আমাদের ফৌজ ক্রাকের দিকে পিছিয়ে আসছে। মুসলমানদের কমান্ডো বাহিনী রাতে আচম্বিত আক্রমণ করে পালিয়ে যায়। তীরন্দাজ গ্রুপ হঠাৎ করেই তীর বর্ষন শুরু করে। ওদের টার্গেট আমাদের ঘোড়া এবং উট। আহত পশুগুলো বেসামাল হয়ে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। আমরা জওয়াবী হামলা করতে যাব ততোক্ষণে ওরা হাওয়া হয়ে গেছে। ওরা সামনা সামনি যুদ্ধ করছে না। ওদের মনমত স্থানে এনে ওরা আমাদের অনেক সৈন্য হত্যা করেছে। সাহস হারিয়ে ফেলছে আমাদের সৈন্যরা। এভাবে আর কদিন চলবে? এজন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে আমরা ওদেরকে মুখোমুখী যুদ্ধ করতে বাধ্য করব।’
এ বিষয়ের ওপর আলোচনা শুরু হল।
এ মুহূর্তে আক্রমণ করার জন্য ওদের সামনে বড় সমস্যা হল লড়াকু সৈনিকদের বেশীর ভাগই বিস্তৃত মরুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভীষণ বিপদে আছে ওরা। মুসলিম ফৌজ দিনে লুকিয়ে থেকে রাতে গেরিলা আক্রমণ করছিল। সুবাকের উত্তরপূর্ব সীমান্তে পাঠানো খ্রীষ্টান ফৌজের কোন কাজ ছিল না। নুরুদ্দীন জংগীর আক্রমণের বয়ে ওদের আনাও যাচ্ছিল না।
অন্যদিকে নগন্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সুবাকে অবস্থঅন করছিলেন সুলতান আয়ুবী। তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। খ্রীষ্টানদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে তিনি খ্রীষ্টানদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে খ্রীষ্টান বাহিনী প্রতি -আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। খ্রীষ্টানদের পরিকল্পনা জানার জন্য ক্রাকে অনেক গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন সুলতান আয়ুবী। খ্রীষ্টানদের ছদ্মবেশে ওরা ক্রাকে প্রবেশ করেছিল। গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র মরুভূমিতে। ওরা সুলতানকে নিয়মিত যুদ্ধের সংবাদ সরবরাহ করছির। সুবাকের আশপাশের এলাকা থেকে নতুন সৈন্য ভর্তি শুরু করে দুর্গেই ওদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হল। ওদের দেয়া হল খ্রীষ্টান বাহিনীর ফেলে যাওয়া উট, ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র।
মরুভূমিতে যুদ্ধরত সৈন্যদের তিনি নির্দেশ পাঠালেন, পশুগুলো না মেরে যেন দুর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
‘ক্রাকের কনফারেন্সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মেয়েদের ব্যবহার না করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হল। ছেড়ে দেয়া হল আলেম গোয়েন্দাকে। তাকে বলা হল, মুসলমানদের সংস্কৃতি এবং চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
হরমুনকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘সুবাকে এখন কতজন গোয়েন্দা রয়েছে?’
জবাবে হরমুন বলল, ‘কয়েকজন মেয়ে এবং পুরুষ মুসলমানদের হাতে ধরা পড়েছে। পুরুষদের বেশীর ভাগই সুবাক রয়ে গেছে। কয়েকজন গোয়েন্দা পালিয়ে এসেছে। গুটি কতক মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মুসলমানদের ছদ্মবেশে কাজ করার জন্য আমি পুরুষ গোয়েন্দাদের খবর পাঠিয়েছি।’
কোনার্ড বললেন, ‘বন্দী মেয়েদের হায়ত মুক্ত করা যাবে না। খ্রীষ্টানদের ঘরে যে সব মেয়ে আত্মগোপন করে আছে তাদেরকে বের করে আনা উচিৎ।’
সিন্ধান্ত হল সুলতান আয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীর মত বিভীন্ন ভাষায় পারদর্শী আত্মত্যাগী একটা গ্রুপ তৈরী করে সুবাক পাঠাতে হবে। ওরা বলবে ক্রাকের খ্রীষ্টান নির্যাতনের কারণে ওরা পালিয়ে এসেছে। ওদের কাজ হবে গোয়েন্দা মেয়েদের খুঁজে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। সাজাপ্রাপ্ত সে সব বন্দীদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল ওদেরকে ও গ্রুপের সদস্য করবে। যারা সুবাক ছিল প্রাধান্য দেবে তাদের।
সুলতান আয়ুবীর ফৌজ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে মরুভূমি ছড়িযে গিয়েছিল। কেউবা পথ ভুলে পাহাড়ের ফাঁকে ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যু বরণ করছির। খ্রীষ্টান বাহিনী ইচ্ছে করলেই প্রতি-আক্রমণ করে সুবাক ফিরিয়ে নিতে পারত। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যাপারে মনযোগ দিতে গিয়ে এ দিকে তারা দৃষ্টি দিতে পারেনি।
আয়ুবীকে দুর্বল করার জন্য নুরুদ্দীন জংগীর সাথে আয়ুবীর সম্পর্ক নষ্ট করার প্রয়োজন ছিল। এ জন্য গোয়েন্দারা ছিল তৎপর। নুরুদ্দীন জংগীকে বুঝানো হল আয়ুবী কোন খেলাফতের তোয়াক্কা করে না। নিজেই স্বাধীন সুলতান হওয়ার জন্য রাজ্য বিস্তারে মন দিয়েছে।
এ সংবাদ আয়ুবীর পিতা নজমুদ্দীন এর কানে গেল। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি সুবাক পৌঁছলেন এর সত্যতা যাচাই করার জন্য। পিতাকে সুবাকে দেখে আশ্চর্য হলেন সুলতান। ভাবলেন সুবাক বিজয় করায় তিনি ধন্যবাদ দিতে এসেছেন। মোসাফেহা করে তার হাতে চুমো খেলেন।
মুখ খুললেন নজমুদ্দীন আয়ুবী। ‘আমার মত এক অখ্যাত ব্যক্তির সন্তানকে মিসরের গভর্নর করে জংগী কি ভুল করেছেন? নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমার ছেলে জংগীর শত্রু হয়ে গেছে, এ কথাও আমায় শুনতে হল। যাও, গিয়ে নুরুদ্দীন জংগীর কাছে ক্ষমা চাও।’
সুলতান পিতাকে বুঝালেন। বললেন, ‘আমি মাননীয় জংগীর কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে চেয়েছি।’
তিনি নুরুদ্দীন জংগীল কাছে চিঠি লিখে ইসা আল হুকারীর হাতে দিয়ে পিতার সাথে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। সাথে সুবাকের কিছু উপহার সামগ্রী। তিনি লিখলেন, ‘সবচেয়ে মূল্যবান সুবাক দূর্গ আপনার পদতলে নিবেদন করছি। ইনশাল্লাহ ক’দিন পর ক্রাকের দুর্গও আপনার খেদমতে পেশ করব। খ্রীষ্টানদের ষড়যন্ত্রের সাথে কিছু মুসলিম আমীর ওমরাও জড়িত। বিধর্মীদের চাইতে ওরাই ইসলামের বড় ক্ষতি করছে।
ইসলামের জন্য লড়াই করছে সেনাবাহিনী। মরুর বালুকারাশি শুষে নিচ্ছে ওদের তাজা রক্ত। মরুর নেকড়ে আর শকুনের আহার হচ্ছে ওদের লাশ। আপন আত্মীয় স্বজন ছেড়ে মরুর বিশাল বিস্তারে শত্রুর পেছনে ঘুরে মরছে ওরা। ওরা ইসলামের মর্যাদা যদ্দুর বুঝতে পারে অন্য কেউ তা পারে না।
অসামরিক আমীর ওমরারা যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে নিরাপদে অবস্থান করে। ইসলামের জন্য, দেশের জন্য ওদের রক্ত ঝরে না। ওরা হারেমের আনন্দে ডুবে থাকে সর্বক্ষণ। ইসলামের দুশমনের সাথে হাত মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।
আমি যখন ফিলিস্তিনের আঙ্গিনায় পা রেখেছি ফিলিস্তিন শত্রু মুক্ত না করে ফিরব না ইনশাল্লাহ। এসময় বেসামরিক প্রশাসনের দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
প্রতিটি মসজিদে ঘোষণা করে দিতে হবে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বাগদাদ খেলাফতের অধীন। খেলাফতের আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। কিন্তু জুম্মার খোৎবায় খলিফার নাম নেয়া যাবে না। শিয়া সুন্নীর বিভেদ উসকে দেয়া হচ্ছে। এ দিক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
নুরুদ্দীন জংগী সুলতান আয়ুবীর চিঠি পেয়ে অত্যন্ত প্রীত হলেন।
খ্রীষ্টানদের কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ড মরুভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সৈন্যদের কাছে সংবাদ পাঠাল মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ না করে ধীরে ধীরে ক্রাকে ফিরে আসতে। এরপর চল্লিশ সদস্যের কমান্ডো বাহিনী তৈরী করা হল। ওরা মুসলমানদের ছদ্মবেশে সুবাক প্রবেশ করবে এবং মেয়েদের মুক্ত করার চেষ্টা করবে।
আয়ুবী মিসরে নেই। তার অনুপস্থিতিতে মিশরে গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করার জন্য হরমুনকে নির্দেশ দেয়া হর। গোয়েন্দারা সুদানী এবং ফাতেমীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে মিসরে আক্রমণ করার জন্য সবরকম সাহায্য করবে।
সুবাক এবং ক্রাকের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সবটাই মরুভূমি ছিল না। কোথাও বালিয়াড়ি, কোথাওত পাথুরে পর্বত আবার কোথাও পাহাড় শ্রেণী।
পথ ভুলে কেউ পাহাড়ের ফাঁকে ঢুকে পড়লে আর বেরোবার রাস্তা খুঁজে পেত না। মরতে হত ওখানেই। এভাবে দু’ বাহিনীর সৈন্যরাই মারা যাচ্ছিল। সুবাক থেকে পালিয়ে আসা লোকজনও মরছিল এসব পাহাড়ে।
আকাশে উড়ছিল শকুনের ঝাঁক। পার্বত্য শৃগাল আর নেকড়েরা ছিড়ে খাচ্ছিল নিহতদের লাশ। শরুভূমির কোথাও ছিল খেজুর বীথি এবং পানির ঝর্ণা। ক্লান্ত শ্রান্ত সৈনিক গভীর তৃষ্ণায় ছুটে আসত সেসব পানির উৎসের কাছে।
আরমান হাশেমী মুসলিম বাহিনীর একজন প্লাটুন কমান্ডার। নিজকে পরিচয় দিত সিরীয় হিসেবে। তার হৃদয়ে ছিল খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। এ ঘৃণার সাথে ছিল প্রচণ্ড প্রতিশোধ স্পৃহা।
সবাই জানত আরমান এতিম। তার আপন বরতে কেউ নেই। কিন্তু আরমানের ধারণা, সে পিতৃহীন নয়। পিতা তার সামনে মরেননি।
ও বাড়ী ছেড়েছে চৌদ্দ বছর বয়সে। থাকত সুবাক।
তার স্পষ্ট মনে আছে তখন খ্রীষ্টান সৈন্যরা সুবাক দখল করে মুসলিম নিধনে মেতে উঠেছে। খ্রীষ্টানদের নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেই বড় হয়েছে সে। দেখেছে নিরপরাধ মুসলিম বন্দীদের। নিহত হতে দেখেছে অসহায় মানুষ।
দেখেছে মুসলমানদের সুন্দরী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। যুবকদের পাঠাচ্ছে বেগার ক্যাম্পে।
সুবাকের মুসলমানদের বলত, ‘খ্রীষ্টান সৈন্যরা কোথাও পরাজিত হলে আমাদের ওপর তার প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে।’
আরমানের পরিবারও নিরাপদ ছিল না। সাত আট বছর বয়সী এক বোনের কথা ও মনে আছে। ভীষণ সুন্দরী ছিল। মনে হত পুতুল। পিতা এবং বড় একজন ভাই ছিল।
ছোট বোন একদিন খেলতে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। একজন মুসলমান প্রতিবেশী বলেছীল ওকে খ্রীষ্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে গেছে।
আরমানের পিতা শহর প্রধানের কাছে অভিযোগ পেশ করলেন। তিনি মুসলমান শুনে জ্বলে উঠল শহর প্রধান। শাসক জাতির বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ।
তার পিতা বাড়ী ফিরে এলেন। বড় ছেলেকে নিয়ে মহল্লার সবাইকে জানালেন। এক রাতে তাদের বাড়ী আক্রান্ত হল। বড় ভাই এবং মা নিহত হল আরমানের চোখের সামনে।
আরমান পালিয়ে একজন মুসলিম প্রতিবেশীর ঘরে আশ্রয় নিল। তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। তাকেও মেরে ফেলতে পারে ভেবে কয়েকদিন ওখানেই লুকিয়ে রইল।
কয়েকদিন পর প্রতিবেশী আরমানকে আর একজন মুসলমানের হাতে তুলে দিল। লোকটি গোপনে তাকে শহর থেকে বের করে এক কাফেলায় সংগী করে দিল।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কাফেলা পৌঁছল সিরিয়া। আরমান একজন আমীরের বাড়ীতে চাকরি পেয়ে গেল।
বেঁচে থাকার তাগিতে আরমান আমীরের বাড়িতে চাকরী করছে। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল। তার হৃদয়ে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। এ চাকরীর চাইতে সেনাবাহিনী তার ভাল লাগত।
আমীরের চাকরী ছেড়ে ও একজন সেনা কমান্ডারের বাড়ীতে কাজ নিল। কমান্ডারকে শুনাল তার অতীত কাহিনী। আবেদন জানাল সেনা ফৌজে ভর্তি হওয়ার জন্য।
ষোল বছর বয়সে কমান্ডার আরমানকে সেনাবাহিনঢীতে ভর্তি করে দিলেন। তিন চারটে যুদ্ধে শরীক হল ও। সুলতান আয়ুবীর অনুরোধে নুরুদ্দীন জংগী যে ফৌজ মিসর পাঠিয়েছিলেন ও ছিল তাদের সংগে।
ও এখন আটাশ বছরের টগবগে তরুন। মিসরে কাটল দু’বছর। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন।
সুবাক দুর্গ আক্রমণকারী বাহিনীল সাথে ওকেও নেয়া হল। হৃদয়ে ওর ঝড় বইছিল। কিছুদিন পরই যুদ্ধ হবে খ্রীষ্টান বাহিনীর সাথে।
আরমানের কমান্ডো বাহিনী প্রতিপক্ষের ওপর শিকারী বাজের মত ঝাঁপিয়ে পড়ত। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল তার নাম। অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে মরুময় ঘুরে বেড়াত আরমান। খ্রীষ্টান সৈন্য দেখলেই চিতাবাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ত।
হৃদয়ের আগুন এতে নিভত না। একমাস পর তার গ্রুপের চারজন মাত্র বেঁচে রইল। বাকীরা শহীদ হল যুদ্ধ করে।
একরাতে সে পঞ্চাশ জনের একটা দলকে আক্রমণ করল। দিন ভর লুকিয়ে অনুসরণ করেছিল ওদের। আক্রমণ করেনি। দিনের বেলা পঞ্চাশ জনকে আক্রমণ করা চারজনের পক্ষে সম্ভব নয়।
খ্রীষ্টান সেনা দলটি অনেক দূরে এগিয়ে গেল। রাতে থামল ওরা। ছাউনি ফেলল বিশ্রামের জন্য। কজন সান্ত্রীকে পাহারায় রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
মাঝ রাতে ছাউনির মাঝ বরাবর ঘোড়া ছুটাল আরমান। ডানে বায়ে তরবারীর আঘাত করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘোড়ার পায়ের চাপে থেতলে গেল ক’জন খ্রীষ্টান সৈন্যের দেহ। সান্ত্রীরা তীর ছুড়ল। অন্ধকারে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল তীর।
সামনে গিয়ে সংগীদের থামাল আরমান। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল। একবারও ভাবল না শত্রু এতক্ষণে সতর্ক হয়ে গেছে।
ছাউনির কাছে গিয়ে আবার ঘোড়া ছুটাল ওরা। সৈন্যদের দলে পিষে বেরিয়ে গেল সামনে।
ওরা এখন তিনজন। দু’জন শহীদ হয়েছে খ্রীষ্টানদের তীরের আঘাতে। আরমানের রক্তে আগুন ধরে গেল। সংগীদের বলল, ‘এবার প্রতিশোধ নেব।’
এ ছিল এক ভয়ংকর দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। দু’জন সংগীকে নিয়ে আরমান আবার ফিরে এল ছাউনির কাছে।
ততক্ষণে জেগে উঠেছে ছাউনির সবাই। ঘোড়াগুলো ক্লান্ত। ঘোড়া ছুটাল ওরা। খ্রীষ্টান সৈন্যরা হামলে পড়ল তাদের ওপর। নিমিষে তার সংগী দু’জন শহীদ হয়ে গেল।
এখন বেঁচে আছে শুধু আরমান। তাকে ধাওয়া করছে দু’জন খ্রীষ্টান সৈন্য। পেছন থেকে ভেসে এল খ্রীষ্টানদের সতর্কবানী, ‘থামো! পালাতে পারবে না, তুমি এখন একা।’
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল ও।
তারবারী দিয়ে আক্রমণ করল দুই ধাওয়াকারী। বর্শা দিয়ে একাই দু’জনের মোকাবিলা করল আরমান।
দীর্ঘ সময় ধরে চলল মুখোমুখী যুদ্ধ। কাফেলা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা।
শেষ পর্যন্ত আরমান বিজয়ী হল। নিহত হল দু’জন খ্রীষ্টান সৈন্য।
সুবাক পাঠানোর জন্য ওদের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিল ও। বুঝতে পারছে না কোথায় এসেছে। ঘোড়াটা ক্লান্ত। বিশ্রাম প্রয়োজন। আরো কিছু দূর এগিয়ে এক পাহাড়ের কোলে থামল আরমান।
খ্রীষ্টান সৈন্যরা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে ভেবে রাতভর জেগে রইল।
আকাশের নক্ষত্র দেখে সুবাক এবং ক্রাক কোন দিকে নির্ধারণ করল ও। কোন দিকে গেলে মুসলিম সৈন্যদের পাওয়া যাবে তাও বুঝল আরমান।
ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়ল ও। মরুভূমিতেই ও বড় হয়েছে, সুতরাং পথ হারাবার ভয় নেই। ও এক অভিজ্ঞ কমান্ডো সদস্য। দূর থেকেই বিপদের গন্ধ পায়।
অনেক দূরে খ্রীষ্টান সৈন্যদের কয়েকটা দলকে যেতে দেখল ও। অতিরিক্ত ঘোড়া দুটো সাথে না থাকলে একাই আক্রমণ করে বসত ওদের।
খ্রীষ্টান সৈন্যদের দৃষ্টি বাঁচিয়ে এগিয়ে চলল আরমান। পথের বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে উট ঘোড়া এবং খ্রীষ্টান সৈন্যদের মৃত লাশ। শিয়াল শকুন খাবলে নিচ্ছে লাশের মাংস।
ও পথ চলছে, মাথার উপর উঠে এসেছে সূর্য। সামনে পাহাড় শ্রেণী। এখানে পথ এঁকে বেঁকে চলে গেছে।
পাহাড়ের ফাঁকে খ্রীষ্টান সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ওরা রাতে বিশ্রামের জন্য এখানে থামতে পারে।
সূর্য ডোবার পূর্বেই পার্বত্য এলাকা পেরিয়ে যেতে চাইছে ও। চোখ-কান সতর্ক। কোন টিলা থেকে যে কোন সময় ছুটে আসতে পারে শত্রুর নিক্ষিপ্ত তীর।
পাহাড়ের কোল ঘেষে এগিয়ে যাচ্ছে আরমান সামনের পথ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঘুরে গেছে। এলাকাটা ভয়াবহ দুর্গম।
আচম্বিত ভেসে এল ছুটন্ত পায়ের শব্দ। কেউ পাশের টিলার আড়ালে লুকিয়েছে কিনা না দেখরা জন্য দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে ও টিলার ওপাশে পৌঁছল। সামনে বেরোবার পথ নেই। স্থানটি এক বিশাল গর্তের মত।
আরমানের বিশ কদম দূরে লম্বা জুব্বা পরে এক ব্যক্তি উপরে উঠার চেষ্টা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। লোকটির মাথাও ঢাকা। ওখানে আর কেউ নেই।
আরমান ওকে ডাকল। কিন্তু লোকটি পাহাড়ে উঠার চেষ্টা থামাল না। এগিয়ে গেল আরমান।
লোকটি দ্রুত উপরে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ক্লান্ত হাত ফসকে এসে পড়ল আরমানের ঘোড়ার কাছে।
মুখের কাপড় সরে গেল লোকটার। আরমানের হতবাক দৃষ্টি অপলক তাকিয়ে রইল সে চেহারার দিকে।
এ-তো এক সুন্দরী যুবতী। এমন অপরূপা নারী ও জীবনে দেখেনি।
আরমান ঘোড়া থেকে নামল।
মেয়েটি উঠে বসল। ভীত হরিণীর মত কাঁপছে সে।
‘কে তুমি?’ আরমান প্রশ্ন করল।
জবাবে পানি চাইল ও। আরমান ঘোড়ার সাথে বাধা মশক থেকে পানি এনে দিল। মেয়েটি ঢক ঢক করে পানি পান করল।
ক্লান্তি বা ভয়ে বন্ধ হয়ে আসছিল মেয়েটির চোখের পাতা।
চোখ বন্ধ করে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি।
আরমান এগিয়ে ওর চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। জ্ঞান ফিরল ওর। আরমান থলে থেকে কিছু খাবার এনে তুলে দিল মেয়েটির হাতে। খাওয়া শেষে কিছুটি স্বাভাবিক হল মেয়েটা।
আরমান বলল, ‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কি তোমার পরিচয়। তুমি কোত্থেকে এসেছ?’
‘সুবাক থেকে আমার পরিবারের সাথে এসেছি।’ মেয়েটির দুর্বল কণ্ঠ। ‘মুসলীম সৈন্যদের আক্রমণে পরিবারের সবাই মারা গেছে। বেঁচে আছি আমি একা।’
আরমান বরল, ‘তুমি ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছো কেন? তুমি যা বললে এর সবটাই মিথ্যে। আমাকে তোমার আসল পরিচয় দিচ্ছ না কেন?’
‘মিথ্যে হলে হলো।’ একই সাথে আতংক ও ঝাঁঝ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল মেয়েটি। তারপর সুর সামান্য নরম করে বরল, ‘আমি তোমার করুণা ভিক্ষা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্রাক পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’
‘সুনাক পর্যন্ত। আমি তোমায় সুবাক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি, ক্রাক নয়। দেখতেই পাচ্ছ আমি মুসলমান। তোমাকে ক্রাক পৌঁছাতে গিয়ে পথে খ্রীষ্টান সৈন্যদের হাতে মরার কোন ইচ্ছে নেই আমার।’
‘তাহলে আমাকে একটা ঘোড়া দাও।’
‘তোমায় ঘোড়াও দিতে পারছি না, এখানেও একা ছেড়ে যেতে পারছি না। তোমায় সুবাক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব।’
‘কমান্ডারের হাতে তুলে দেব।’
‘আমি যুবতী বলে কি আমাকে সুবাক নিতে চাচ্ছ?’
‘ভয় নেই, তুমি যে আশংকা করছ তেমন ব্যবহার কেউ তোমার সাথে করবে না।’
মেয়েটা ক্রাক যাবার জন্য জিদ করছিল। আরমান বলল, ‘পথে কারো হাতে পড়লে কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছ?’
‘সুবাক গেলে অবস্থা তারচেয়ে ভাল হবে এর নিশ্চয়তা কি?’
‘নিশ্চয়তা হচ্ছে আমাদের সুলতানের নির্দেশ। আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সুবাক থেকে কোন খ্রীষ্টান পরিবার যেন পালিয়ে যেতে না পারে। কাউকে পালিয়ে যেতে দেখলে ফেরত পাঠাতে বরা হয়েছে। সুলতান সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন। তাছাড়া তুমি একা ক্রাক পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না।’
তরুণী ভেবেছিল মুসলিম যুবকটি হয়ত তার সম্ভ্রম নষ্ট করবে। সে সিদ্ধান্ত নিল দেহের লোভ দেখিয়ে এর কাছ থেকে একটা ঘোড়া বাগাতে হবে। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল ও।
‘আমি ভীসণ ক্লান্ত। আপনি চাইলে আমরা রাতটা এখানে কাটিয়ে সকালে সুবাকের পথ ধরতে পারি। কিন্তু এখন আমার পক্ষে সফর করা কঠিন।’
আরমান নিজেও ক্লান্ত। ঘোড়াগুলোর ওপর অনেক ধকল গেছে। মেয়েটাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ওখানেই রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল আরমান।
এর আগে মেয়েটা তাকে ভাল ভাবে দেখেনি। ওর কাছে মুসলিম সৈন্য মানেই এক হিংস্র পশু। তার কাছে অনুকম্পা আশা করা যায়না। কিন্তু আরমান এখানেই রাত কাটাতে রাজি হওয়ায় ও বুঝল ওকে হয়তো বাগানো যাবে।
মেয়েটি এবার গভীর চোখে আরমানের দিকে তাকাল।
আরমানও তাকালো মেয়েটির দিকে। ভাবল চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে, এর মাঝে অনিন্দ্য এক সুন্দরীর একা থাকা কত বিপদজনক। এমনও হতে পারে এ মেয়েটার জন্যই কমান্ডাররা পরস্পর ঝগড়া করে নিহত হয়েছে। ও রয়ে গেছে একা। সেও তো একজন মানুষ।
ও তরুনীর চোখে চোখ রাখল। মেয়েটা তার দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইল আরমান। কিন্তু ওর মায়াভরা চোখ দুটো যেন আরমানের দৃষ।টি আটকে ফেলেছে। দেহে খেলে গেল অপরিচিত শিহরণ। চোখ সরিয়ে নিল ও।
পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি স্থির হল যুবতীর চোখে। হৃদয়ে উৎকণ্ঠিত তোলপাড়। মেয়েটার ঠোঁটে ফুটে উঠল একটুকরো মিষ্টি হাসি।
‘সম্ভবত তুমি এখনও কুমারী।’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল আরমান।
‘হ্যাঁ।’ মেয়েটি চটপট জবাব দিল। ‘পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। তুমি আমাকে ক্রাক পৌঁছে দিলে আমি তোমায় বিয়ে করব।’
আরমান সচকিত হয়ে বরল, ‘এরপর বলবে তোমার ধর্ম ত্যাগ কর, যা আামর দ্বারা সম্ভব নয়। কেন, সুবাক গিয়ে মুসলমান হয়ে আমায় বিয়ে করতে পার না?’
‘আমাকে অবশ্যই ক্রাক যেতে হবে। আমার সাথে চল, তোমার পৃথিবী বদলে যাবে।’
মেয়েটা আরমানকে দেহের লোভ দেখাল। কিন্তু আরমানের ভাবনাগুলো ও বুঝতে পারছিল না।
ও চোখ তুলে তাকাত মেয়েটার দিকে। ওর চেহারা, রেশম কোমল চুল, ওর দুটো মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত অনেকক্ষণ। এরপর মাথা নুয়ে হারিয়ে যেত ভাবনার গভীরে।
যুবতীর কোন কথাই ওর কানে যাচ্ছিল না। জোৎস্নাহীন মেঘলা রাতের আঁধারে ছেয়ে গেল ওর চেহারা।
উঠাে দাঁড়াল ও। ঘোড়ার পালানে বাধা থলে থেকে খাবার বের করে এনে মেয়েটাকে দিল। নিজেও কিছু খেল।
ক্লান্তিতে ভেংগে আসছিল ওদের দেহ। পাথরে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনই।
শেষ রাতে হঠাৎ করেই যুবতীল চোখ খুলে গেল। দু’হাতে চোখ তুলে সামনে তাকাল। আরমান নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে ক’কদম দূরে।
টিলার মাথায় শেষ রাতের চাঁদ। মরুর স্বচ্ছ জোৎস্নায় ঘোড়ার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল মেয়েটা। পিঠে জিন বাধা। ঘুমানোর পূর্বে আরমান ওগুলো খুলে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
মেয়েটা আবার আরমানের দিকে তাকাল। সহসা জেগে উঠবে বলে মনে হয় না।
খাওয়া এবং বিশ্রামের ফলে নিজকে ঝরঝরে মনে হচ্ছে। যুবতী জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল চকচকে খঞ্জর। শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরল বাঁট।
ঝলমলে চাঁদনী রাতে আরমানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যুবতী দৃষ্টি ফেরাল খঞ্জরের দিকে।
আরমান ঘুমের ঘোরে কি যেন বলছে। মেয়েটা ভাবল হয়ত অবচেতন মনে জেগে থাকা আত্মীয়কে স্মরণ করছে ও।
মেয়েটার দৃষ্টি নিবন্ধ হল আরমানের বুকে। অনুমান করছে হৃদপিন্ড কোথায় হতে পারে। প্রথম আঘামের পর দ্বিতীয় আঘাত করা যাবে না। মরতে মরতেও সে তাকে মেরে ফেলতে পারবে।
খঞ্জরের বাটে মেয়েটার হাত আরও শক্ত হল। ঘোড়াগুলোর দিকে চাইল একবার। পরিকল্পনাটা মেন মনে ঝালাই করে নিল।
ওর বুকে খঞ্জর মেরে ছুটে যাবে ঘোড়ার কাছে। ঘোড়ার পিঠে চেপে দ্রুত পালিয়ে যাবে।
ও সৈনিক নয়, হলে এত কিছু ভাবতে হত না। নির্দ্বিধায় আরমানের বুকে খঞ্চর ঢুকিতে দিত। তাকে হত্যা করার বড় যুক্তি হচ্ছে সে মুসলমান এবং তার শত্রু। কিন্তু ও যতবারই আরমানের দিকে তাকিয়ে খঞ্জরের বাট শক্ত করে ধরত, শুরু হত হৃদস্পন্দন। ও শুনতে পেত হৃদয়ের ধুকপুক শব্দ।
ঘুমের ঘোড়ে আবার বিড়বিড় করতে লাগল আরমান। আগের চেয়ে পরিষ্কার। স্বপ্নেই ও বাড়ী গেছে। ডেকেছে মাকে, বোনকে। এর পরের শব্দগুলোতে মনে হল ওদের কেউ হত্যা করেছে এবং তাকেও খুঁজছে।
কি এক অজানা অনুভূতি মেয়েটাকে বাধা দিচ্ছিল। ভয়ও হতে পারে, অথবা কাউকে হত্যা না করার মানসিকতা।
আনচান করতে লাগল ও। না, তাকে হত্যা করব না, মনে মনে ভাবল, আস্তে আস্তে ঘোড়ার কাছে গিয়ে একটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাব। খঞ্জর হাতে নিয়ে ও ঘোড়ার দিকে পা বাড়াল।
কিন্তু পা নড়ছে না। বালিতে আটকে গেছে যেন।
দাঁড়িয়ে আরমানের দিকে চাইতেই কতগুলো প্রশ্ন এসে ওকে জড়িয়ে ধরল । এক সুন্দরী যুবতীকে বিজন মরুতে নিঃসঙ্গ পেয়েও কি তার মনে কোন অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি। সে একবারও ভাবল না খ্রীষ্টান মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই তাকে হত্যা করতে পারে!
লোকটা ঘোড়ার জিন খোলেনি, অস্ত্রগুলোও সাবধানে রাখেনি। কেন? সে কি আমায় বিশ্বাস করে। তার অনুভূতি কি এতই ভোতা, আমার মত রূপসী তরুনী তার আবেগ জাগাতে পারল না। ওর মনে হল লোকটা তাকে ঘোড়ার চাইতে বেশী মূল্যবান মনে করেনি।
ও ধীরে ধীরে পৌঁছল ঘোড়ার কাছে। ডেকে উঠল একটি ঘোড়া। চমকে আরমানের দিকে চাইল ও। ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনিতেও আরমানের ঘুম ভাংগেনি।
ও এখন তিনটে ঘোড়ার আড়ালে। একটা ঘোড়ার পিঠে উঠতে যাবে আচম্বিত পেছন থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘কে তুমি?’
চকিতে পেছন ফিরে চাইল ও। দু’জন সৈনিক। এক ব্যক্তি শিষ কেটে বলল, ‘আমাাদের সৌভাগ্য।’
হাসল দ্বিতীয় জন। ভাষায় বুঝা যাচ্ছে এরা খ্রীষ্টান সৈন্য। একজন মেয়েটার হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষন করল। মেয়েটা বলল, ‘আমি খ্রীষ্টান।’
দু’জনই ওর কথায় শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ‘তবে তো তোমার পুরোটাই আমাদের।’
‘আগে আমার কথা শোন’, যুবতী বলল, ‘আমি সুবাক থেকে পালিয়ে এসেছি। নাম আইওনা। আমি গোয়েন্দা। ক্রাক যাচ্ছি। ওই দেখ একজন মুসলমান সৈন্য ঘুমিয়ে আছে। ও আমায় ধরে রেখেছে। ওকে ঘুমে রেখেই আমি পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে সাহায্য কর। এ ঘোড়াগুলো সাথে নাও আর আমাকে ক্রাক পৌঁছে দাও।’
খ্রীষ্টানদের জন্য ও কত দামী সৈন্যদের বুঝিয়ে বলল আইওনা। একজন সৈন্য ওকে বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে বলল, যেখানে বলবে পৌঁছে দেব।’
দ্বিতীয়জন একটা অশ্লীল মন্তব্য করল। দু’জনই ঠেলে ওকে টিলার অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগল।
খ্রীষ্টান বাহিনীর পদাতিক দুই সেপাই মুসলিম কমান্ডোদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করার জন্য ওরা এ পাহাড় কুচিতে ঢুকেছে। যুবতীর রূপ ওদের পশুতে পরিণত করে দিল। ও যখন দেখল খ্রীষ্টানের দোহাই দিয়েও বাঁচা যাচ্ছে না, জোরে জোরে চিৎকার শুরু করল। তার চিৎকার শুনে আরমান হয়ত জেগে উঠবে।
হঠাৎ একজন ভয়ার্ত কণ্ঠে সংগীর নাম নিয়ে বলল, ‘সাবধান।’ সৈন্যটি সতর্ক হবার পূর্বেই আরমানের বর্শা তার বুক এফোড় ওফোড় করে দিল।
দ্বিতীয় লোকটির হাতে উঠে এল তরবারী। মেয়েটা তার পাঁজরে খঞ্জর সেঁধিয়ে দিল। পরপর কয়েকটা আঘাত করে চিৎকার করে বলল, ‘তোমাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তোমরা খ্রীষ্টান নামের কলংক।’
খ্রীষ্টান সৈন্যদের দু’টো লাশ পড়ে আছে। আইওনা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। আরমান তাকে শান্তনা দিয়ে বলল, ‘কেঁদোনা। এখানে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। ওদের দলের অন্যরা এসে পড়তে পারে। আমরা এখুনি সুবাকের পথ ধরব। ওরা কি তোমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে?’
‘না, আমি জেগে ছিলাম। দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘোড়ার কাছে।’
‘ঘোড়ার কাছে কেন?’
‘ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে যাবার ইচ্ছে ছিল না।’
‘এ খঞ্জর কোথায় পেয়েছ?’
‘আমার কাছেই ছিল। আগেই বের করে নিয়েছিলাম।’
‘আগেই বের করেছ! কেন? ও বুঝেছি, আমি যদি জেগে উঠি তাহরে মেরে ফেলবে?’
আইওনা আরমানের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমি তোমায় হত্যা করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি আমায় মেরে ফেলার আগেই বলছি, এ খঞ্জর তোমাকে হত্যা করার জন্যই বের করেছিলাম। কিন্তু পারিনি।
তোমায় কেন মারতে পরিনি জানি না। তোমার জীবন ছিল আমার হাতের মুঠোয়। আমি ভীতু নই। এর পরও তোমায় হত্যা করতে পারিনি। কেন, আমি বরতে পারব না। হয়ত তুমি বলতে পারবে।’
‘জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তিনিই তোমার হাত স্তব্ধ করে রেখেছিলেন, তিনিই তোমার সম্ভ্রম রক্ষা করছেন, আমি তো এক উপলক্ষ মাত্র। এখন একটা ঘোড়ায় চেপে বস। আমরা রওয়ানা করব।’
মেয়েটা আরমানের দিকে খঞ্জর বাড়িয়ে বরল, ‘রাখ। নয়তো আমি তোমায় মেরে ফেলতে পারি।’
‘তার প্রয়োজন নেই। বরং আমার তরবারীও তুমি নিয়ে নিতে পার। তুমি আমায় হত্যা করতে পারবে না।’
উপহাস নয়, দু’জনের কণ্ঠেই ছিল দৃঢ়তা। দু’জন দু’টো ঘোড়ায় চেপে তৃতীয় ঘোড়াটা সাথে নিয়ে চলতে লাগল।
সুর্যোদয়ের আগেই ওরা অনেক দূর এগিয়ে গের। আশাপাশে কোন খ্রীষ্টান সৈন্য দেখা যায়নি। পথে একটা মুসলিম সেনাদলের দেখা পেয়েছিল ওরা। মুসলিম সেনাদলটির কাছে গিয়ে আরমান কি যেন বলে ফিরে এসে আবার চলতে লাগল।
এপ্রিলের উত্তপ্ত সূর্য উঠে এসেছে মাথার ওপর। মুখ মাথা ঢেকে ওরা চলা অব্যাহত রাখল। দূরের বালুকারাশি দেখে মনে হয় এক সাগর টলটলে স্বচ্ছ পানি। বায়ে পাথুরে পর্বত।
দু’জন নিরবে চলছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ ওদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। একটা লাশও অক্ষত নেই। শৃগাল শকুন খুবলে নিয়েছে ওদের মাংস। কোন কোন লাশের শুধু হাড়গুলো পড়ে আছে।
আরমান মেয়েটাকে বরল, ‘এরা তোমার জাতির সৈনিক। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী সহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসে যে সব রাজরাজড়া মুসলিম বিশ্বকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে এরা তাদেরই ইচ্ছের বলী।’
মেয়েটা নিশ্চুপ। বার বার তাকাচ্ছে আরমানের দিকে। মাথা ঝুকিয়ে কি যেন ভাবছে আবার।
আরমানে পাহাড়ের দিকে গতি ফেরাল। সে জানত, ওখানে পানি এবং ছায়া দুটোই পাওয়া যাবে।
পশ্চিম আকাশে নেমে এসেছে সূর্য।
ওরা পার্বত্য এলাকায় পৌঁছল। খুঁজে বের করল ঘেষো জমিন। আশাপাশে কিছু বৃক্ষও রয়েছে। পাহাড় কেটে বয়ে চলছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা।
ঘোড়া থেকে নামল ওরা। নিজেরা পানি পান করল। ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে ছেড়ে দিল ঘেসো মাঠে।
‘কে তুমি?’ যুবতী প্রশ্ন করল। ‘তোমার নাম কি? কোথায় থাক?’
‘আমি মুসলমান। নাম আরমান। থাকি সিরিয়া।’
‘ঘুমের ঘোরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’
‘মনে নেই। হয়ত স্বপ্ন দেখছিলাম। সংগীরা বলে, আমি নাকি ঘুমের মধ্যে কথা বলি।’
‘তোমার মা আছে, বোন আছে? সম্ভবতঃ ঘুমে তাদেরকে স্মরণ করছিলে।’
‘এক সময় ছিল।’ আরমানের কণ্ঠে বিষন্নতা। ‘এখনও ওদের স্বপ্নে দেখি।’
মেয়েটা আরো অনেক কিছু জানতে চাইল। কিন্তু জবাব না দিয়ে আরমানের বলল, ‘তুমি নিজের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছ। আর তোমার পরিচয় জানতে চাইব না। তোমাকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে ফিরে আসব। নিজের ব্যাপারে সত্য বলতে চাইলে বলতে পার। তবে তুমি খ্রীষ্টানদের গুপ্তচর নও একথা বলো না।’
‘তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি গোয়েন্দা, নাম আইওনা।’
‘তুমি কি কাজ কর তোমার পিতা মাতা জানেন?’
‘আমাদের পিতা মাতা নেই। কোনদিন আমি ওদের চেহারাও দেখিনি। গোয়েন্দা সংস্থা আমার মা, গোয়েন্দা প্রধান হরমুন আমার পিতা।’
মেয়েটা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আমার সংগী একটা মেয়ে একজন মুসলমান সৈন্যকে বাঁচানোর জন্য আত্মহত্যা করেছে। আমি তখন আশ্চর্য হয়েছিলাম। একজন খ্রীষ্টান যুবতী এক মুসলমানের জন্য এতবড় ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? এখন বুঝতে পারছি, এমনটি হতে পারে।
সেই মুসলমান সৈন্যটিও তোমার মত ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ করে মেয়েটির জীবন রক্ষা করেছিল। আহত হওয়ায় মেয়েটা তাকে সুবাক নিয়ে এসেছিল। তোমার মতই সে মেয়েটার রূপ যৌবনের প্রতি দৃষ্টিও দেয়নি। অথচ ও ছিল ভীষণ সুন্দরী। আমিও ওর মত তোমার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারি।’
‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করে থাকি। আমার কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আগেও তোমায় কোথাও দেখেছি। হয়ত এ আমার আবেগপ্রবণ মনের কল্পনা, হয়তবা সত্যি।’
‘দেখে থাকবে। তুমি মিসর গিয়েছ না, ওখানেই দেখেছ হয়তো।’
‘মিসর আমি গিয়েছি ঠিক, কিন্তু তোমাকে আমি মিশরে দেখিনি।
মুচকি হেসে আইওনা বলল, ‘আমার ব্যাপারে তোমার কি ধারণা। আমি কি সুন্দরী নই?’
‘তুমি সুন্দরী অস্বীকার করিনা।’ আরমানের কণ্ঠে গাঢ়তা। ‘বুঝেছি কেন এ প্রশ্ন করেছ। ভেবে আশ্চর্য হচ্ছ, তোমার খ্রীষ্টান ভায়েরা তোমার সাথে যে ব্যবহার করতে চেয়েছে আমি কেন তা করিনি। এখনও হয়ত মনে করছ আমি তোমার সাথে প্রতারণা করছি। সুবাক নিয়ে তোমায় নষ্ট করব। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমায় বিয়ে করব অথবা বিক্রি করে দেব।
তোমার এ আশংকা অমূলক। নারী সে নিজের ধর্মেরই হোক বা অন্য ধ্যমের, আমি কাউকে খারাপ চোখে দেখতে অভ্যস্ত নই।
আমার বয়স যখন চৌদ্দ, আমার এক বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওর বয়স ছিল সাত বছর। ষোল বছর পেরিয়ে দেছে। ওকে অপহণ করেছে খ্রীষ্টানরা। জানিনা বেঁচে আছে কি মরে গেছে। বেঁচে থাকলেও আছে কোন আমীরের হারেমে বা হয়তো তোমার মত গোয়েন্দাগিরী করেই ফিরছে।
এ জন্য প্রতিটি মেয়েকেই আমার বোন মনে হয। তাকে খারাপ চোখে দেখিনি। সে আমার বোনও তো হতে পারে।
শুধু নিরাপত্তার জন্যই তোমায় সুবাক নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি মরুভূমিতে একা ছেড়ে দিলে তোমার কি অবস্থা হবে। কারো হাতে পড়লে তোমার খ্রীষ্টান ভায়েরা যা করতে চেয়েছিল তাই হত।
আমাকে রূপের ফাঁদে জড়ানোর চেষ্টা করোনা। সে অনুভূতির দিক থেকে আমি মৃত। খ্রীষ্টানদের পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের রক্ত দিয়ে মরুর বালুকারাশি ভিজিয়েই শুধু আমি আনন্দ পাই।’
হতবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল আইওনা। চোখে মদির আবেশ। তার সাথে তো এভাবে কেউ কথা বলেনি।
ওকে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। ও নিজে এক চমৎকার প্রতারণা।
মদ্যপ হয়ে ওর রূপের মোহে ডুবে যায় মানুষ। ও নৈতিকতা আর সতীত্ব বঞ্চিত ট্রেনিং শেষে অন্য মেয়েদের মত ও নিজেকে পুরুষের হৃদয়রানী ভেবেছে।
পিতা মাতার কথা ওর মনে নেই। বাড়ী কোথায় জানেনা। আরমানের আবেগপ্রবণ কথাগুলো ওর ভেতর উসকে দিল নারীত্বের অনুভূতি। ভাবনার অতলে হারিয়ে গেল ও। ভুলে গেল আরমানের উপস্থিতি।
চিন্তার গহীন সাগরের অতল থেকে ও বরল, ‘এক ভয়ংকর স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আমাকে কোন এক বাড়ী থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। তখন বয়স কত ছিল মনে নেই।’
দু’হাতে মাথা চেপে ধরল ও। দু মুঠোয় চুল চেপে মাথা ঝাকুনি দিতে লাগল। হারানো অতীত স্মরণ করার চেষ্টা করছে।
শেষে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিছু মনে আসছে না। মদ, বিলাসিতা আর অশ্লীলতার গহীনে হারিয়ে গেছে আমার অতীত। আমার পিতা মাতা কে, কেমন ছিলেন কখনও ভাবিনি। বাবা মায়ের প্রয়োজনই হয়নি।
কোন কালে আমার ভেতর মানবিক অনুভূতি ছিল না। পুরুষ যে পিতা এবং ভাইও হতে পারে জানিনা।
পুরুষ আমাকে মনে করে ভোগের সামগ্রী। আমি ওদের ব্যবহার করি। আমার রূপ যৌবন দিয়ে যাকে বশ করতে না পারি তার জন্য রয়েছে মদ এবং হাশিশ।
তুমি আমার ভেতর এমন অনুভূতি সৃষ্টি করেছ, যা মা, বাবা এবং ভাই বোনের স্নেহের পিয়াসী।’
ওর অস্থিরতা বেড়ে গেল। কথা বলতে লাগল থেমে থেমে। শেষে একদম চুপ হয়ে গেল। কখনও তাকাচ্ছে আরমানের দিকে কখনও দু’হাতে ধরে মাথা ঝাকুনি দিচ্ছে।
ও ঘুরে ফিরছিল হারানো অতীত আর বর্তমানের মাঝে। আরমান বলল, ‘চল রওয়ানা হই।’
সহজ সরল বালিকার মত ও ঘোড়ায় চেপে বসল। পার্বত্য এলাকা ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল ওরা। তখনও ও আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে।
একবার শুধু হেসে বলল, ‘পুরুষের কথা এবং প্রতিশ্রুতি আমি কখনই বিশ্বাস করিনি। বুঝতে পারছি না কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে যাওয়া উচিৎ।’
আরমান ওর দিকে চেয়ে মৃদু হাসল শুধু।
পরদিন সূর্যোদয়ের সময় ওরা সুবাক পৌঁছল। মরুভূমিতে কেটেছে একরাত একদিন।
ফটকে পৌঁছে আরমান নিজের পরিচয় দিল। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে যাবার কথা বলে ওরা এগিয়ে চলল।
শহরের রাজপথ মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। পথে দু’পাশের লোকেরা আইওনাকে দেখছে।
চরতে চলতে হঠাৎ একটা বাড়ীর সামনে থেমে গেল আরমান। বাড়ীর ফটক বন্ধ।
আইওনা প্রশ্ন করল, ‘থামলে কেন?’
জবাব না দিয়ে দরজার কাছে এল আরমান। ঘোড়ার পিঠে বসে বসেই দু’তিনবার করাঘাত করল। একজন সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ দরজা খুললেন।
‘এখানে কে থাকে?’ আরমান আরবী ভাষায় প্রশ্ন কর।
‘কেউ না। একটা খ্রীষ্টান পরিবার ছিল। আমাদের সেনাবাহিনী আসার পর সবাই পালিয়ে গেছে।’
‘এরপর আপনি দখল করেছেন?’
ভড়কে গেল বৃদ্ধ। একজন সৈনিক তাকে জিজ্ঞেস করছে কেন এ বাড়ী দখল করেছেন। সুলতান ঘোষণা করেছেন কোন মুসলমান যদি কোন খ্রীষ্টানকে কষ্ট দেয় কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।
বৃদ্ধ বলল, ‘এ বাড়ী আমি দখল করিনি, হেফাজত করার জন্য এসেছি। এখনি বন্ধ করে দেব। এ বাড়ীর মালিক মুসলমান। এখনও বেঁচে আছেন। পনর ষোল বছর ছিলেন খ্রীষ্টানদের বেগার ক্যাম্পে।’
‘সুলতান কি তাকে ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেননি?’
‘সবাই মুক্ত। কিন্তু এখনও তিনি ক্যাম্পেই আছেন। অসুস্থ, দুর্বল। ওখানেই সুলতান ওদের জন্য ভাল খাবার এবং ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করেছেন। ডাক্তার সবসময় দেখাশোনা করেন। সুস্থ হলেই তাকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
‘তা আপনি এখানে কেন?’
‘ওখানে যারা আছে তাদের আত্মীয় স্বজন প্রতিদিন ওদের সাথে দেখা করে। এ বাড়ীর মালিকও ক্যাম্পেই আছেন। একে তো বৃদ্ধ, তার ওপর দীর্ঘদিনের যন্ত্রণায় বেচারা শুধু বেঁচে আছে। আমি প্রতিদিনই দেখতে যাই। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। বাড়ীটা খালি হয়েছে আমি তাকে বলে এসেছি।’
‘তার আত্মীয় স্বজনরা কোথায়?’
‘কেউ বেঁচে নেই।
বৃদ্ধ হাত তুলে বা দিকে দেখিয়ে বললনে, ‘এখান থেকে চারটা বাড়ীর পরের বাড়ীটা আমার। এরা আমার প্রতিবেশী। আত্মীয়ও বলতে পারেন।’
ঘোড়া থেকে নেমে আরমান ভেতরে গিয়ে একটা কক্ষের ঢুকল। আইওনাও নেমে এল ঘোড়া থেকে।
আরমানের দিকে তাকাল ও। চোখ মুছছে।
আইওনা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করায় ও বলল, ‘আমার শৈশবকে খুঁজছি। একদিন এ বাড়ী থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলাম। এ-ই আমাদের বাড়ী।’
সাথে সাথে ওর চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা।
ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা আবার উঠোনে এল। বৃদ্ধ তখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে।
আরমান কান্না ভেজা কণ্ঠে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ‘আত্মীয় স্বজন মরে গেছে। এর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না?’
‘একটা মাত্র ছেলে বেঁচে ছিল। খ্রীষ্টান ডাকাতদের হাত থেকে পালিয়ে উঠেছিল আমার বাড়ীতে। আমি গোপনে তাকে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখানে থাকলে সেও মারা যেত।’
আরমানের মনে পড়ল সে দুঃসহ রাতের কথা। পালিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ীতে উঠেছিল। এই সেই প্রতিবেশী।
বৃদ্ধকে সে বলল না, যে বালককে আপনি সুবাক থেকে গোপনে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সে বালকই আপনার সাথে কথা বলছে।
উদগত কান্না রোধ করা আরমানের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ল। কিন্তু ও কঠিন হৃদয় সৈনিক। বৃদ্ধকে বলল, ‘আমি বাড়ীর মালিকের সাথে দেখা করব। তার নামটা বলুন।’
বৃদ্ধ তাকে তার পিতার নাম বলল। এ নামটি তার হৃদয়ের মনি কোঠায় অতিযত্নে রক্ষিত আছে।
‘ছেলেটার এক বোন ছিল’, বৃদ্ধ বললেন, ‘ছোট। খ্রীষ্টানরা ওকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তার কারণেই এ বাড়ীর সবাই নিহত হয়েছে।’
আইওনার দিকে ফিরল আরমান।
‘পবিত্র ক্রুশের পূজারীদের কাহিনী তো নিজের কানেই শুনলে।’
আইওনা এর কোন জবাব দিল না।
ও ছাদে দিকে তাকাতে লাগল। দরজার একটা পাল্লা বন্ধ করে দেখল কি যেন। কিছু আঁকি বুকি খোদাই করা।
বসে ও মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। আরমান তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
আইওনা আঁকাগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করল। তারর উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। হঠাৎ কি হল, ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ও ছুটে গেল অন্য কক্ষে। ওখানকার দরজার পাল্লায়ও কি যেন খুঁজছে।
আরমান এগিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কি দেখছ?’ মেয়েটা মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার মত আমিও আমার শৈশব খুঁজছি। এটাই কি তোমাদের বাড়ি ছিল? তুমি কি এখান থেকেই পালিয়েছ?’
‘হ্যাঁ, এ বাড়ী থেকেই আমি পালিয়েছিলাম।’
আরমান ওকে শুনাল তার পালানোর কাহিনী।
কিভাবে খ্রিষ্টানরা এ বাড়িতে আক্রমণ করে তার পিতা এবং ভাইকে হত্যা করেছিল তাও বলল। বলল, ‘ভেবেছিলাম আব্বাকেও ওরা মেরে ফেলেছে। কিন্তু এ বৃদ্ধ বললেন তিনি বেঁচে আছেন।’
‘বৃদ্ধকে কি বলেছ, যাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তুমিই সেই বালক?’
‘এ মুহূর্তে একথা বলতে চাই না।’
আইওনা গভীর চোখে আরমানকে দেখতে লাগর। বৃদ্ধ দূর থেকে ওদেরকে আশ্চর্য হয়ে দেখছিল। আরমান আনমনা হয়ে পড়ল।
বৃদ্ধ এগিয়ে গেল ওদের কাছে। বলল, ‘আমার জন্য কি হুকুম?’
চমকে বাস্তবে ফিরে এল আরমান। নির্দেশের ভঙ্গিতে বলল, ‘এ বাড়ী এখন আপনার অধিকাের, এর হেফাজত করবেন। চল, আইওনা।’
‘তোমার পিতার সাথে দেখা করবে না?’ অনুচ্চ কণ্ঠে বরল আইওনা।
‘আগে আপন কর্তব্য পালন করব। মরুভূমিতে কমান্ডার নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছেন। এতক্ষণে হয়ত ভেবেছেন আমি মরে গেছি। ওখানে আমার প্রয়োজন রয়েছে। আমার সাথে এসো। এ আমানত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেব।
‘নারী, নারী, নারী’, সুলতান আয়ুবীর উত্তেজিত কণ্ঠ। গোয়েন্দা প্রধান আলীকে বললেন, ‘বদমাশ খ্রীষ্টানগুলো কি পেয়েছে? ওরা কি আমার সামনে নারীদেহের প্রাচীর তৈরী করতে চায়? আমার সামনে যুবতীদেরকে নাচিয়ে কি সুবাক দুর্গ ফিরিয়ে নেবে?’
‘সম্মানিত আমীর’, আলী বললেন, ‘মেয়েরা দেয়াল নয় নিষিদ্ধ গন্ধম। আপনার এবং জংগীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়েছে ওদের মাধ্যমে। এ নারীই মুসলিম আমীল ওমরাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মদ আর হাশিম। ওদের দেহের উত্তাপে গলে যাচ্ছে আমীর ওমরার দল। ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে।’
‘এ প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। থাক ওসব কথা। এ মেয়েগুলোর ব্যাপারে কিছু বল। ওরা আটজনই তো গোয়েন্দা। ওদের কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে পারলে?’
‘ওরা বলেছে সুবাকে খ্রীষ্টানদের অনেক গুপ্তচর এখনও কাজ করছে। কারও ঠিকানা জানা নেই। ট্রেসও করা যাচ্ছে না। এদের তিনজন ক’দিন মিসরে ছিল। কি কাজ করেছে তা তো আপনাকে বলেছি।’
‘এদেরকে কোথায় রেখেছ? জেলে?’
‘না, আগের জায়গায়ই আছে। তবে পাহারার ব্যবস্থা করেছি।’
প্রহরী ভেতরে এসে স্যালুট দিয়ে বলল, ‘আরমান নামে একজন কমান্ডার একজন খ্রীষ্টান মেয়েকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছেন। মেয়েটাকে পেয়েছেন ক্রাকের পথে। ও নাকি গুপ্তচর।’
‘দু’জনকেই ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
আরমান এবং আইওনা ভেতরে ঢুকল। সুলতান আরমানকে বললেন, ‘মনে হয় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছ। তুমি কার সাথে ছিলে?’
‘আমি সিরিয়ার ফৌজে ছিলাম। আমার কমান্ডারের নাম এহতেশাম বিন মুহম্মদ। আমি কমান্ডো বাহিনী ‘আল বারক’-এর কমান্ডার।’
‘আল বারক এখন কি অবস্থায় আছে?’
প্রশ্ন করেই সুলতান আলিকে বললনে, ‘আল বারক’ অর্থ বিদ্যুৎ। আসলেই ওরা বিদ্যুৎ। আমরা যখন সুদানীদের আক্রমণ করেছিলাম, তখন কমান্ডো হামলায় ছিল আর বারক। ওরা তুলনাহীন।’
‘মাননীয় সেনাপতি। গ্রুপের সবাই আল্লার পথে জীবন উৎসর্গ করেছে। বেঁচে আছি শুধু আমি।’
‘তোমার কারণে তো এতগুলো জীবন নষ্ট হয়নি? মৃত্যু আর উৎসংর্গের মধ্যে অনেক তফাৎ।’
‘না, মাননীয় সেনাপতি! আল্লাহ সাক্ষী, আমরা প্রতিটি জীবনের বিনিময়ে অন্তত বিশজনকে হত্যা করেছি। ওদের দলের দু’একজন ক্রাক পৌঁছলেও আহত অবস্থায় পৌঁছেছে। খ্রীষ্টানদের রক্তে ফিলিস্তিনের মাটি রঙীন হয়ে গেছে।
আমাদের দ্বিতীয় দলটিও শত্রুর জন্য ছিল আতংক। খ্রীষ্টানদের মধ্যে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষমতা নেই।’
‘আর তুমি?’ যুবতীর দিকে তাকিয়ে সুলতান বললেন, ‘তোমার ব্যাপরে সব কথা কি আমাদের খুলে বলবে?’
‘সব কিছুই বলব।’ ওড়নায় চোখ মুছে বলল আইওনা।
‘আরমান?’ সুলনাতন বললনে, ‘তুমি যাও। খাওয়া গোসল সেরে বিশ্রাম কর। কাল আবার নিজের দলের কাছে ফিরে যেতে হবে।’
‘শত্রুর দুটি ঘোড়া এবং অস্ত্রও নিয়ে এসেছি।’
‘ঘোড়াগুলো আস্তাবল আর তীর তরবারী অস্ত্রাগারে জমা দাও।
একটু ভেবে সুলতান বললেন, ‘ওগুলো তোমার ঘোড়ার চাইতে ভাল হলে বদলে নিও। ময়দানের ঘোড়াগুলো কি অবস্থায় আছে?’
‘চিন্তার কোন কারণ নেই। আমাদের একটা ঘোড়া নষ্ট হলে খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে দু’টো ঘোড়া পেয়ে যাই।’
সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল আরমান। আমানত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়েছে ও। কিন্তু ওর হৃদয়ে এক অব্যক্ত বেদনাভারে পিষ্ট হচ্ছিল। এ ছিল আবেগের ভার। শৈশবের হারানো স্মৃতির বেদনা। পিতা পুত্রের ভালবাসার ব্যথা।
যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও পিতার সাথে দেখা করতে চাইছিল না। আশংকা ছিল পিতৃস্নেহ, আর অতীত বেদনা কর্তব্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঘোড়াগুলো সাথে নিয়ে ও আস্তাবলের দিকে হাঁটা দিল। আশপাশের কোন খেয়াল নেই।
ও আনমনে হাঁটছে। সামনে সুবাকের অলিগলি। ওর জন্মস্থান। এখানে ওর শৈশব কেটেছে। দুরন্ত কৈশোর পেরিয়েছে। কিন্তু তাকে দেশছাড়া করা হয়েছিল। ওর উদাস চোখ দুটো বিষন্ন ব্যথায় ছলছল করে উঠল।
‘পথ ছাড় অশ্বারোহী!’
কারো ডাকে চমকে উঠল ও। ঘুরে পেছনে তাকাল। একদল ঘোড়সওয়ার আসছে।
ও দ্রুত রাস্তার পাশে সরে গেল। শেষ আরোহীটি অতিক্রম করার সময় ও বলল, ‘বাইরে থেকে এসেছ? ময়দানের কি খবর?’
‘আল্লাহর রহমতে সব ভাল দোস্ত। প্রতিদিনই শত্রু নিঃশেষ হচ্ছে। সুবাকের জন্য কোন বিপদ নেই।’
অশ্বারোহীর দল সামনে চলে গেলে ডান দিকে মোড় নিল আরমান।
‘আমি আপনার সামনে কিছুই লুকাইনি।’
সুলতান এবং আলীর সামনে বসে আইওনা বলল। কোন প্রশ্ন ছাড়াই ও শুনাল গোয়েন্দাবৃত্তির বিস্তারিত কাহিনী।
নির্যাতনের পরও গোয়েন্দারা যা বরে না ও বলল তারচেয়ে বেশী। সন্দেহে পড়ে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান।
‘আইওনা!’ আলী বললেন, ‘আমিও তোমার বিষয়ে পারদর্শী। স্বীকার করি তুমি উঁচু স্তরের গোয়েন্দা। আমাদের নির্যাতন এবং জেল থেকে বাঁচার জন্য তোমার পদ্ধতি প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আমি তোমার প্রতারণার জালে পা দেব না।’
‘আপনার নাম কি?’
‘আলী বিন সুফিয়ান। হরমুনের কাছে আমার নাম শুনে থাকবে।’
আইওনা দাঁড়াল। আলীর কাছে গিয়ে বলল হাঁটু গেড়ে। আলীর ডান হাত তুলে নিল নিজের হাতে।
চুমো খেয়ে বলল, ‘আপনাকে জীবিত দেখে আমি ভীষণ খুশী হয়েছি। আপনার সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু বলা হয়েছে। হরমুন বলত, আলী মরে গেলে যুদ্ধ ছাড়ই আমরা মুসলমানদের নিঃশেষ করে দিতে পারি।’
যুবতী আবার নিজের স্থানে গিয়ে বসল।
‘কায়রোতে আমি আপনাকে দেখার অনেক চেষ্টা করেছি। দেখা হয়িন। আমার সামনেই আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা জানার আর সুযোগ হয়নি, কারণ আমাকে তখনই সুবাক ডেকে আনা হয়েছিল।’
‘আমরা কিভাবে বিশ্বাস করব তুমি যা বলেছ সত্য বলেছ?’ আলী বললেন।
‘আমাকে বিশ্বাস করছেন না কেন?’ আইওনার কণ্ঠে ঝাঁঝ।
‘কারণ তুমি খ্রীষ্টান।’ বললেন সুলতান আয়ুবী।
‘যদি বলি আমি খ্রীষ্টান নই মুসলমান, তাও হয়ত বিশ্বাস করবেন না। আমার কাছে এর কোন প্রমাণ নেই। ষোল বছর পূর্বে এ শহর থেকেই আমি অপহৃত হয়েছিলাম। এখানে এসে শুনেছি আমার পিতা ক্যাম্পে আছেন।’
আইওনা পিতার নাম উল্লেখ করে বলল, ‘তার নামটাও এখানে এসে জেনেছি। আমি তো বলেছি আরমানকে হত্যা করতে গিয়ে আমার হাত উঠেনি। দিনে ওর চেহারা এবং চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল ওকে আমি কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করায় ও বলেছে এ সম্ভব নয়। দু’জন খ্রীষ্টান সৈন্য আমার সম্ভ্রম লুটে নেয়ার চেষ্টা করছে। তখনও ওরাই আমার আপন।
একজনকে আরমান হত্যা করল। অন্যজনকে আমি। ওকে মেরে আমার সম্ভ্রম রক্ষা করেছি এজন্য নয় বরং খুশী হয়েছি আরমানের জীবন বাঁচাতে পেরেছি বলে।
পথে ওর মুখে আবেগভরা কিছু কথা শুনে এই প্রথম আমার হৃদয়ে অনুভূতি জন্ম নিল। সমস্ত পথেই আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। স্মৃতির পাতা হাতড়ে এদ্দুর মনে হয়েছে, শৈশবে কেউ আমায় অপহরণ করেছিল।
আপনি তো জানেন মেয়েদেরকে কিভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। মন থেকে হারিয়ে যায় শৈশবের স্মৃতি। আমারও তাই হয়েছে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতে লাগল আমি আরমানকে চিনি।
এ ছিল রক্ত সম্পর্কের দাবী। চোখ চোখকে এবং হৃদয় চিনেছে হৃদয়কে।
হয়ত আরমানের হৃদয়েও এমন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তা নয়তো আমার মত অপরূপা যুবতীকে আমলেই আনেনি। যেন সে একা। তার সাথে কেউ নেই। আমার দিকে অনেকবারই সে গভীর চোখে তাকিয়েছে।
সুবাক এসে আরমান একটা বাড়ীতে ঢুকল। আমিও পিছু নিলাম। ভেতরে ঢুকে আমার স্মৃতি জেগে উঠল। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দরজার পাল্লায় খোদাই করা আঁকিবুকি চোখে পড়ল। দেখলাম।
বড় ভাইজানের খঞ্জর দিয়ে আমি নিজেই দরজার পেছনে এভাবে খোদাই করেছিলাম।
আবার আরমানের দিকে তাকালাম গভীর চোখে। দাড়ি থাকলেও ষোল বছর পূর্বের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম।
ওকে বলিনি আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন। ও এত পবিত্র আর আমি কত অপবিত্র। ওকে বলে দিলে ও কি করত জানিনা।’
মেয়েটির বলার মাঝে আলী কয়েকবারই সুলতানের দিকে তাকালেন। এখনও ও সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু উচ্ছাসিত আবেগ, উদগত অশ্রু এবং বেদনামাখা বর্ণনায় দু’জনই প্রভাবিত হচ্ছিল।
তার ফোঁপানির শব্দে মনে হচ্ছিল ও সত্য কথাই বলছে।
শেষ পর্যন্ত তার বলা কথা এবং তথ্যাবলী যাচাই বাছাই করার জন্য মেয়েটির দেয়া প্রস্তাব দু’জনেই মেনে নিলেন।
ও বলল, ‘আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, জেলে পাঠান বা যা ইচ্ছে তাই করুন, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমি বেঁচে থাকতে চাই না, যদি আপনারা অনুমতি দেন পাপের প্রায়শ্চিত্য করে মরতে চাই।
‘কি করবে?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।’
যদি আমাকে ক্রাক পৌঁছে দেন তবে খ্রীষ্টানদের চারজন সম্রাট এবং গোয়েন্দা প্রধান হরমুনকে হত্যা করতে পারি।’
‘আমরা তোমাকে ক্রাক পৌঁছে দিতে পারি। তবে কাউকে হত্যা করার জন্য নয়। ইতিহাস বলবে সুলতান আয়ুবী মেয়েদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নিজে দুর্গে বসেছিলেন। না মেয়ে, এ অপবাদ নিয়ে আমি মরতে চাই না।
যদি সংবাদ পাই কোন খ্রীষ্টান সম্রাট অসুস্থ আমি তার কাছে আমার ডাক্তার পাঠিয়ে দেব। তাছাড়া তোমাকে আমরা বিশ্বাসও করতে পারছি না। অবশ্য তুমি যদি ইচ্ছে কর তোমায় ক্ষমা করে ক্রাক পাঠিয়ে দেব।
‘না। এমন কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি এখানেই মরব। তবে আমার অনুরোধ আরমান যেন জানতে না পারে আমি তার বোন। আমার পিতাকে দেখতে যাব। তাকেও বলব না আমি তার মেয়ে।’
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকল আইওনা।
আলী বিন সুফিয়ান ওকে প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্ন করে সুলতানের দিকে তাকালেন।
‘ওকে এখন কি করব?’
কিছুক্ষণ ভেবে সুলতান বললেন, ‘ওর আরাম আয়েশের প্রতি লক্ষ্য রোখো। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেব।’
আলী ওকে সাথে নিয়ে গেলেন। অন্যান্য গোয়েন্দা মেয়েরা যেখানে থাকে তার একটা কক্ষ দিলেন ওকে।
আইওনা সেখানে থাকতে সরাসরি অস্বীকার করে বলল, ‘এ কক্ষগুলোকে আমি ঘৃণা করি। যেখান থেকে আমি অপহৃদ হয়েছিলাম সে বাড়ীতে কি আমায় রাখা যায়না?’
‘না, আবেগের কারণে আমি নিয়ম কানুন বদলে দিতে পারি না।’
প্রহরী এবং চাকরবাকরদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে রেখে ফিরে গেলেন আলী।
সামরিক বিশ্রামাগারে গোসল সেরে শুয়ে পড়ল আরমান। দেহ ক্লান্ত, অবসন্ন। তবু ঘুম আসছিল না। হৃদয়ে চরছিল তোলপাড় করা অন্তর্দ্বন্দ্ব। পিতার সাথে কি দেখা করবে?
নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়াল ও। কক্ষ থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পের দিকে হাঁটা দিল। লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে পিতার কাছে পৌঁছল আরমান।
কংকালসার এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন বিছানায় হাড় ছাড়া দেহে কিছু নেই।
বৃদ্ধের সাথে হাত মেলাল আরমান। বড় কষ্টে নিজকে সংযত রাখল।
নিজের পরিচয় না দিয়ে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল আরমান। ষোল বছরের অমানুষিক নির্যাতনের কারণে ভাল খাবার এবং ওষুধ কোন ক্রিয়া করছে না।
দুর্বল কণ্ঠে কথা বলছিলেন বৃদ্ধ। কিন্তু আরমানের মন ছুটে গিয়েছিল ষোল বছর পূর্বের সেই হারানো অতীতে। পিতার চেহারা তো ভোলার মত নয়।
কয়েকবারই ভাবল পিতার কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করবে। কিন্তু এতবড় আনন্দ তার এ দুর্বল শরীর সইতে পারবে না ভেবে নিজের পরিচয় গোপন রাখল।
তাছাড়া পিতৃস্নেহ যুদ্ধের ময়দানে যাবার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পিতার সাথে করমর্দন করে ও ফিরে এল।
বিশ্রামাগারে এসে ও কেন্দ্রের নির্দেশ পেল। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রে কি কাজ থাকতে পারে ভেবে আশ্চর্য হল ও। নির্দেশ পাঠিয়েছেন গোয়েন্দা প্রধান।
আইওনার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য লোক পাঠিয়ে দিলেন তিনি। ক্যাম্পে তার পিতার কাছেও খোঁজ নেয়া হল। তিনি বরলেন, ‘ষোল বছর পূর্বে তার সাত বছরের একটি মেয়ে অপহৃত হয়েছে। খ্রীষ্টানদের হাতে নিহত হয়েছে বড় ছেলে এবং স্ত্রী। ছোট ছেলে পালিয়ে গেছে। পরে শুনেছি সে সুবাক থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।’
নিশুতি রাত। আইওনার ঘুম আসছিল না। সে বুঝতে পেরেছে আলী তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এখন তার কি হবে! কিভাবে বিশ্বাস করাবে তার বলা প্রতিটি কথাই সত্য।
একই সাথে হৃদয়ে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। আরমানের সাথে বাড়ী গিয়ে শৈশবের হারানো স্মৃতি মনের কোণে ভীড় জমিয়েছে।
অপহরণের দিনটি তার স্বপ্নের মত মনে পড়ছে। অপহরণের পর তাকে ভাল খাবার দেয়া হয়েছে। আদর যত্নের কোন অভাব ছিল না। এরপর পাপের সমুদ্রে তাকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।
ওর ভেতরের প্রতিশোধ স্পৃহা দুঢ় হতে লাগর। শোয়ার পরও ও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
পিতার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কক্ষ থেকে বাইরে যাবার অনুমতি নেই। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দু’জন সেন্ট্রি।
ও বিছানা থেকে উঠল। দরজা খুলে উঁকি দিল বাইরে। প্রহরী দু’জনকে দূরে দেখা যাচ্ছে। কথা বরছে ওরা। মাথা নীচু করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল আইওনা।
আরও দূরে সরে গেল প্রহরী। ও আলতো পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। প্রাচীরের গা ঘেষে এগিয়ে চলল।
বড় গেট পর্যন্ত স্থানটি ঘাসে ছাওয়া। ও বসে নিঃশব্দে বিড়ালের মত হেঁটে ফটকে পৌঁছলে।
প্রহরী এদিকে আসেনি। বেরিয়ে গেল ও। হাঁটা দিল ক্যাম্পের দিকে। এখন আর কোন সান্ত্রীর ভয় নেই।
পিতার চেহারা ওর মনে নেই। এখানে এসে শুধু নাম শুনেছে। ও দ্রুত হাঁটতে লাগল।
কারও পদশব্দে পেছনে তাকাল। কেউ নেই। আবার হাঁটতে লাগল ও। আবার কারও পদশব্দ শুনে ও দাঁড়িয়ে পড়ল।
আচম্বিত ওর মুখ কাল কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল কেউ। শক্ত সমর্থ দুটি বাহু তুলে নিল ওকে।
হাত পা ছুঁড়ে নিজকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল আইওনা।
নিরব রাতের সুনসান সড়ক ধরে এগিয়ে চলল অপহরণ কারীরা।
সামনে গিয়ে ওরা ওকে কম্বল দিয়ে ঢেকে গাঠুরীর মত কাঁধে তুলে নিল। আধ ঘন্টা চলার পর ওকে কাঁধ থেকে নামিয়ে কম্বল সরিয়ে দেয়া হল।
একটা কক্ষে চারজন লোক বসে আছে। পাশে দুটি মাটির প্রদীপ। ও হতবাক হযে চারজনের দিকে তাকাল।
‘তোমরা এখনও এখানে? মিঃ ডিউক আপনিও?’
‘আমরা গিয়ে আবার ফিসে এসেছি।’ জবাব দিল ডিউক, ‘তোমাদেরকে মুক্ত করার জন্য। তোমাকে পেয়ে ভালই হল।’
গোয়েন্দা মেয়েদেরকে মুক্ত করার জন্য ক্রাক থেকে পাঠানো হয়েছে চল্লিশজন কমান্ডো সদস্য। মিঃ ডিউক এদের কমান্ডার। বৃটেনের অধিবাসী। নাশকতামূলক কাজে অভিজ্ঞ। এদের বলা হয়েছে সুবাকে যেসব গোয়েন্দা রয়ে গেছে তাদের সংগঠিত করে নাশকতামূলক কাজ করতে।
আস্তাবলে ঢুকে ঘোড়ার খাদ্যে বিষ মিশানো, ছাউনীর লংগর খানার খাবারে বিষ মিশানো সহ বিভিন্ন প্রকার সন্ত্রাসী কাজ করবে।
এর আগেও এবার ডিউক আইওনাদের দলপতি ছিল। ডিউকের সাথে ছিল ওর ভাল সম্পর্ক। কিন্তু এখন তাকে দেখেই ওর মনে প্রচন্ড ঘৃণা এবং প্রতিশেধের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু সংযত হল ও। এখন ঘৃণা প্রকাশের সময় নয়।
ডিউক ভাবতেও পারেনি আইওনার পৃথিবী বদলে গেছে। ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছিলে?’
আইওনা বলল, ‘সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এসেছি।’
আমরা চল্লিশজন কমান্ডো গোয়েন্দা নির্যাতীত মুসলমানের ছদ্মবেশে সুবাক এসেছী। বিচ্ছিন্ন গোয়েন্দাদের একত্রিত করেছি।
তোমরা যেখানে থাক দু’রাত থেকে সে বাড়ীতে নজর রাখা হচ্ছে। প্রহরীদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য আজও দু’জন গিয়েছিল। অযাচিত ভাবেই তোমাকে পেয়ে গেছি। এবার বলতো, ওদেরকে বের করা যায় কিভাবে?’
‘ওদেরকে বের করে আনাটা কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয। ওখানে মাত্র দু’জন প্রহরী থাকে। বিভিন্ন কক্ষে থাকে মেয়েরা।’ আইওনা বলল।
রাতেই পরিকল্পনা তৈরী হল সিদ্ধান্ত নেয়া হল ওদের বের করে আনা হবে। অভিযানে কতজন যাবে, অন্যরা কোথায় থাকবে তাও বলা হল।
আইওনা বলল, ‘আমার ফিরে যাওয়া উচিৎ। আমাকে না পেলে অন্য মেয়েদের ওপর পাহারা আরও শক্ত হবে। তখন ওদের বের করা সম্ভব হবে না।’
ডিউকের পছন্দ হল ও প্রস্তাব। এরপর নিজেই ওকে ফটকের কাছে রেখে এল। মেয়েটিকে আসতে দেখে প্রহরী জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গিয়েছিলে?
‘ধারে কাছেই। বেশী দূরে যাইন।’
সেন্ট্রি কোন উচ্চবাচ্য করল না। তাদের দুর্বলতার কারণেই মেয়েটা বাইরে গিয়েছে। কমান্ডার শুনলে ওদের দু’জনেরই চাকরি যাবে।
পরদিন গোয়েন্দা প্রধান কি এক কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আইওনা সেন্ট্রিকে বলল, ‘আমাকে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে নিয়ে চল।’ অস্বীকার করল প্রহরী। বলল, ‘প্রয়োজন হলে তিনিই ডেকে পাঠাবেন।’
‘দেখো, তার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। যদি ক্ষতি হয় তোমাকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।’
শাস্তির কথা শুনে ভয় পেল প্রহরী। গোয়েন্দা প্রধানের কাছে আইওনার সংবাদ পৌঁছে দিল।
সাথে সাথেই ওকে তিনি ভেতরে ডেকে নিলেন।
আইওনা তার কক্ষ থেকে আর বের হল না।
গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। সুনসান নিঝুম প্রকৃতি। সতর্ক পায়ে নিঃশব্দ রাতের আঁধারে চিরে এগিয়ে চলেছে আটটি ছায়ামূর্তি। মুর্তিগুলো গোয়েন্দা প্রসাদের প্রধান ফটকে পৌঁছল।
আশ্চর্য কোন প্রহরী নেই। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা। আইওনার দেয়া তথ্য অনুযায়ী দু’জন মেয়েদরে কক্ষে ঢুকে পড়ল। অন্যরা বাইরে।
দু’জন সেন্ট্রিকে কাবু করা অসম্ভব হবে না। যারা ভেতরে ঢুকল আর বের হল না।
ডিউক অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে। এতক্ষণে ওদের ফিরে আসার কথা। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বাড়ীতে রয়েছে বিশজন। বাড়ীটা এক খ্রীষ্টান ব্যবসায়ীর। বিশাল বাড়ী।
অন্যরা শহরের বিভিন্ন বাড়ীতে। সবাই প্রস্তুত। মেয়েরা এলেই ওরা ক্রাকের পথ ধরবে।
দরজায় করাঘাতের শব্দ হল। পরিচিত শব্দ। তাড়াতাড়ি দরজার কবাট খুলল ডিউক। একটা পাল্লা খুলতেই কেউ তাকে টেনে বের করে নিল। সাথে সাথেই এক দল সৈন্য ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে বসেছিল বিশজন। কেউ পালানোর সুযোগ পেল না। বাড়ীর মালিকসহ সবাইকে গ্রেফতার করা হল। একই সময়ে আক্রমণ করা হল আইওনার চিহ্নিত এগারটি বাড়িতে।
সকালে চল্লিশজন কমান্ডো সদস্য এবং চল্লিশজন গোয়োন্দাকে হাজির করা হল সুলতান আয়ুবীর সামনে।
বাড়ীগুলোতে তল্লাশী নিয়ে পাওয়া গেল প্রচুর অস্ত্র, দাহ্য পদার্থ, বিষের পুটুলী, হাশিম এবং নগদ টাকা পয়সা।
বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান বন্দী ছিল ডিউক। সুলতানের নির্দেশে ওদের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হল।
গোয়েন্দাদের সমস্যা শেষ করার পর আইওনা সেসব মুসলমানদের নাম উল্লেখ করল যারা গোপনে খ্রীষ্টানদের সাথে গাটছাড়া বেঁধেছে। ও সুলতান এবং আলীকে বলল, ‘এবার তো আমায় বিশ্বাস করা উচিৎ?’
আরমানকে ডেকে পাঠালেন আলী বিন সুফিয়ান। আরমান এলে তাকে বলা হল, ‘আরমান, ও আইওনা, তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন।’
ভাই বোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হল তখণ। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল অশ্রুসজল চোখে।
দু’ ভাই-বোনকে পিতার সামনে হাজির করা হল। আনন্দে অজ্ঞান হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। জ্ঞান ফিরলে দু’সন্তানকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। বললনে, ‘ওর নাম আইওনা নয়, আশা।’
সুলতান বৃদ্ধের জন্য ভাতা নির্ধারণ করলেন। আলীকে বললেন, ‘সবকটি গোয়েন্দা মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর নাও। খোঁজ পেলে ওদেরকে আত্মীয় স্বজনের হাতে তুলে দিও।
এদেরকেও হয়তো খ্রীষ্টানরা কোন মুসলমানদের বাড়ী থেকে অপহরণ করেছে।’
বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে গেলেন সুলতান। এবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৈন্যদের এক করতে হবে।
আয়ুবী এবার তার হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর করলেন মরুভূমিতে। অল্প কদিনের মধ্যেই সকল সৈন্য হেডকোয়ার্টারে জমায়েত হল।
সুলতান সেনাবাহিনীকে তিন ভাগ করলেন। এক ভাগ পাঠালেন সুবাকের প্রতিরক্ষার জন্য। এক ভাগ রাখলেন নিজের কাছে। তৃতীয় ভাগ ছেড়ে দিলেন বিশাল বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে পেট্রোল ডিউটির জন্য।
আলী সুলনাতের কাজকর্ম দেখছিলেন আর ভাবছিলেন, খ্রীষ্টানরা কিছুতেই এ পরাজয় মেনে নেবে না। আবার তারা হামলা করবে। কিন্তু কোন পথে? তারা কি আমাদের সামনাসামনি লড়তে বাধ্য করবে, নাকি ভয়ংকর কোন ফাঁদ পাতবে আগের মত?
(সমাপ্ত)
Leave a Reply