ক্রুসেড সিরিজ ২
সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান
মুল লেখক – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
অনুবাদ – আসাদ বিন হাফিজ
ভূমিকা
ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠলো খৃষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক সংঘাত ও সংঘর্ষের পরাজিত হয়ে বেছে নিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিল মদ ও নেশার দ্রব্য। ঝাঁকে ঝাঁকে পাঠাল প্রশিক্ষনপ্রাপ্তা সুন্দরী গোয়েন্দা। বড় বড় অফিসার ও আমীর উমরাদের হারেমগুলোতে ওদের ঢুকিয়ে দিল নানা কৌশলে। ভাসমান পতিতা ছড়িয়ে দিল সর্বত্র। মদ জুয়া আর বেহায়াপনার সস্রোত বইয়ে দিল শহরগুলোতে।
একদিকে সশস্ত্র লড়াই অন্যদিকে কুটিল সাংষ্কৃতিক হামলা, এ দুয়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ও তার বীরশ্রেষ্ট সাথীরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।
.
রূপের ফাঁদে
কায়রো থেকে দু’মাইল দূরে এক বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের এক দিকে বালিয়াড়ি, ছোট ছোট পাহাড়। বাকি তিন দিকে দিগন্ত বিস্তৃত বালুর সমুদ্র।
এ মাঠ আজ লাখো মানুষের পদভারে কম্পিত। উট, ঘোড়া আর গাধায় চড়ে এসেছে মানুষ। তবে বেশীর ভাগ এসেছে পায়ে হেঁটে। চার পাঁচ দিন থেকে জমা হচ্ছে দর্শক। ভিড়ের চাপে দলিত মথিত হচ্ছে কায়রোর বাজার। সরাইখানায় উপচে পড়া ভিড়।
এরা এসেছে সরকারী ঘোষণা শুনে। এক হপ্তা পর অনুষ্ঠিত হবে সামরিক মহড়া। মিসরের সেনাবাহিনী ঘোড়দৌড়, তীরন্দাজী, অসিখেলা সহ বিভিন্ন যুদ্ধের খেলা দেখাবে। অসামরিক লোকও এসব খেলায় অংশ নিতে পারবে।
এতে সালাহউদ্দীন আয়ুবীর দু’টো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত, যারা মিসরের সেনাবাহিনীকে দুর্বল ভাবছে তাদের ভুল ধারণা দূর করা।
পাঁচ-ছ’ দিন আগে থেকেই লোকজন আসছে। এতে সালাহউদ্দীন আয়ুবী বেজায় খুশী। দর্শক এক লাখ হলে নতুন সেনা ভর্তি হবে পাঁচ হাজার।
কিন্তু সরকারী এ ঘোষণায় আলী ছিলেন উদ্বিগ্ন।
“মাননীয় সুলতান!” বললেন তিনি, ‘এক লাখ দর্শক হলে এর মধ্যে এক হাজার থাকবে শক্রর গুপ্তচর। মেয়েরা আসছে গ্রাম থেকে। এদের বেশীর ভাগ সুদানী। সুদানী মেয়েরা অত্যন্ত ফর্সা, খ্রিস্টান মেয়েরা অনায়াসে এদের সাথে মিশে যেতে পারবে।’
“তোমার সমস্যা আমি বুঝতে পারছি আলী। কিন্তু এ মহড়া কেন জরুরী তা তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ। তোমার সংস্থার তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দাও।”
আমি মেলার বিপক্ষে নই সুলতান। এটা যে খুবই প্রয়োজন তাও বুঝি। আপনাকে উৎকণ্ঠায় ফেলতে চাইনি, মেলা কি সমস্যা নিয়ে আসছে তাই শুধু বলতে চাইছি।
কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিনি পতিতালয়। এ সব পতিতালয় রাতভর খদ্দেরে পূর্ণ থাকে।
শহরের বাইরেও কিছু তাঁবু টানানো হয়েছে। আমার ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী কিছু তাঁবু রয়েছে ভাসমান পতিতাদের। সারারাত নাচগানের আসর জমজমাট থাকে ওসব তাঁবুতে। আগামীকাল মেলা, এর মধ্যে নর্তকীরা দর্শকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রচুর অর্থ।
মেলা শেষ হয়ে গেলে এসব থাকবে না। এর ওপর আমি কোন বিধি নিষেধ আরোপ করতে চাই না। মিসরীদের নৈতিক চরিত্র উন্নত নয়। দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক আবহ দু’একদিনে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
সেনাবাহিনীতে লোক বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য আমার প্রচুর দর্শক প্রয়োজন। তুমি জান আলী আমাদের অনেক সৈন্য প্রয়োজন। সামরিক এবং বেসামরিক অফিসারদের বৈঠকেও আমি এ দিকটা ব্যাখ্যা করেছি।
মিটিংয়ে আপনি বড় বেশী খোলামেলা আলোচনা করেছেন। আপনাকে এ থেকে বিরত রাখতে পারিনি সুলতান। আমার গোয়েন্দা দৃষ্টি বলছে, এসব অফিসারদের অর্ধেক আপনার অনুগত নয়। আপনি জানেন, অনেকে আপনাকে সইতে পারছে না। কারো কারো আন্তরিকতা ও আনুগত্য রয়েছে সুদানীদের সাথে। আমি এদের পেছনে একজন করে টিকটিকি লাগিয়ে রেখেছি। ওরা নিয়মিত আমাকে খোঁজ খবর দিচ্ছে।”
‘কোন বিপজ্জনক তৎপরত কি ধরা পড়েছে?’
‘না, তবে পদমর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে এরা রাতে সন্দেহজনক তাঁবু এবং মিনি পতিতালয়গুলোতে যাতায়াত করে। দু’জন তো দুটি নর্তকীকে বাড়ীতেই নিয়ে এসেছ। অন্যদিকে আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দু’টি পাল তোলা নৌকা, দশদিন আগে নৌকাগুলো রোম উপসাগরের পাড়ে দেখা গেছে।’
“এ তে বিশেষ এমন কি রয়েছে?”
স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে ওদের তৎপরতা রহস্যজনক। ওখানকার সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনার পর দু’জন করে বিভিন্ন স্থানে পাহারা বসানো হয়েছে। খ্রিস্টানরা যেন আকস্মিক আক্রমণ করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা বিভাগের কিছু লোক স্থানীয় বেদুঈন এবং জেলেদের পোশাকে ওখানে ঘোরাফিরা করছে। কিন্তু বিশাল সাগর সৈকতে নজর রাখার জন্য এদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। বিশেষ করে যেখানে যেখানে সাগর থেকে চ্যানেল ভেতরে ঢুকেছে সে এলাকায় নজর রাখা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দিন দশেক আগে একটা চ্যানেল থেকে দু’টো পাল তোলা নৌকাকে বেরোতে দেখা গেছে। হয়ত রাতে এসেছিল। দু’জন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার ছুটে গিয়েও ওদের ধরতে পারেনি, নৌকা দু’টো তখন সাগরের বেশ ভেতরে চলে গেছে। ওগুলো জেলে নৌকা ছিল না। নিশ্চয়ই সাগরের ওপার থেকে এসেছিল।
আমাদের সৈন্যরা পাহাড়ের ফাঁক ফোঁকড় এবং মরুভূমির বিশাল এলাকা খুঁজেও কিছুই পায়নি। নৌকায় কারা ছিল, কেন এসেছে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল মরুভূমিতে ওদের খুঁজে বের করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভবও।
আলী আরো বলল, দেড়মাস থেকে মেলার সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। এ খবর ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছা বিচিত্র নয়। সংবাদ পেলে ওদের গোয়েন্দারা আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কায়রোতে মেয়ে কেনা বেচা শুরু হয়েছে। ক্রেতারা সাধারণ নাগরিক নয়। ব্যবসায়ী, প্রশাসক এবং সেনাবাহিনীর পদস্থ ব্যক্তি ও পতিতাদের দালালরা এসব মেয়েদের কিনছে। এদের মধ্যে খ্রিস্টান মেয়েও থাকতে পারে, শুধু পারে না, আমি মনে করি অবশ্যই আছে।’
এসব সংবাদে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী উৎকণ্ঠিত হলেন না।
রোম উপসাগরের পাড়ে খ্রিস্টানশক্তি পরাজিত হয়েছে বছর খানেক আগে। ওখানে এখন কোন ছাউনিও নেই। আলী বিন সুফিয়া কিছু গোয়েন্দা নিয়োগ করলেও ওরা তেমন শক্তিশালী নয়। সংবাদ এসেছে খ্রিস্টান গুপ্তচরে ছেয়ে গেছে মিসর।
মিসরের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা এখনও জানা যায়নি শোনা যায় বাগদাদ এবং দামেশকে ওদের তৎপরতা বেশী। বিশেষ করে সিরিয়ার মুসলিম আমীর-ওমরারা মদ আর বিলাসিতায় ডুবে যাচ্ছে।
রোম উপসাগরের যুদ্ধের সময় নুরুদ্দীন জংগী খ্রিস্টান রাজ্য আক্রমণ করে ওদের সন্ধি করতে বাধ্য করেছিলেন। বন্দিদের মধ্যে রিনান্ট নামের একজন সেনাপতিও ছিল। ওরা মুসলমান বন্দীদের হত্যা করায় জঙ্গী ওদের ছাড়েননি।
সুলতান জংগী মুসলিম বিশ্বকে সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইয়ুবীর এ বিশ্বাস ছিল। তবুও ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করার জন্য তিনি সেনাবাহিনী তৈরি করছিলেন। তিনি চাইছিলেন মিসরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার সাথে সাথে আরবকে মুক্ত করতে। একই সময়ে আক্রমণ এবং মিসরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অটুট রাখার জন্য প্রচুর সৈন্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেমতো নতুন সেনা ভর্তি হচ্ছিল না।
পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে তার বিরোধী শক্তি ছিল প্রবল। আনুগত্য ছিল যৎসামান্য। নূরুদ্দিন জংগী কিছু সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। মিসরের একটি ফৌজ তৈরী হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো দেখেনি। সুলতান আয়ুবীকেও দেখেনি ওরা। এজন্যই মেলার আয়োজন।
মেলার সময় অফিসার এবং কমান্ডারদের তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মেশার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন ওদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে। ‘ওদের বোঝাতে হবে আমরা সবাই এক। সবাই চাই আল্লাহ এবং রাসূলের দ্বীনকে প্রসারিত করে এ ভূখন্ডকে খ্ৰীষ্টানদের আধিপত্য মুক্ত করতে।’
মেলার আগের দিন আলী, সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে বললেন, ‘সুলতান, শক্রর গুপ্তচরদের আমি ভয় পাই। যেসব মুসলিম ভায়েরা বেঈমানদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে, তাদের নিয়ে আমি শংকিত। এদের ঈমান দৃঢ় হলে চরদের সমগ্র বাহিনীও আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারতো না। নবাগতা নর্তকীদের দিয়ে ওরা জাল ফেলছে। এরপরও আমার বাহিনী দিনরাত তৎপর রয়েছে।’
‘তোমার লোকদের বলো দুশমনের চরদের হত্যা না করে জীবিত গ্রেফতার করতে। ওরা শক্রর জন্য চোখ এবং কান কিন্তু আমাদের জন্য ভাষা। ওদের কাছ থেকে তুমি সব খবর সংগ্রহ করতে পারবে।’
***
মেলার দিনের সূর্য হেসে উঠল পূর্বকাশে। বিশাল বিস্তীর্ণ মাঠের তিন দিকে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়! পাহাড়ের দিক সংরক্ষিত ওদিকে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি।
বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। বন্যার উত্তাল সাগরের গর্জনের ন্যায় ভেসে এল অশ্বক্ষুরধ্বনি। ধুলোয় ভরে গেল আকাশ। দু’হাজারেরও বেশি ঘোড়া ছুটে আসছে তীব্র গতিতে।
প্রথম ঘোড়া মাঠে প্রবেশ করল। আরোহী সালাহউদ্দীন আয়ুবী।
তার দু’পাশে পতাকাবাহী। পেছনে অশ্বারোহী দল।
ঘোড়ার পিঠ রঙীন চাদরে সুশোভিত। আরোহীদের হাতে বর্শা। কোমরে তরবারী। বর্শার মাথায় রঙীন কাপড়ের তৈরী ছোট ছোট ঝাণ্ডা। মাঠে প্রবেশ করেই গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। দুলকি চালে এগুচ্ছে ঘোড়াগুলো। সওয়াররা বসে আছে মাথা উচিয়ে। টানটান বুক। চোখে মুখে দৃঢ়তা।
নিস্তব্ধতা নেমে এল দর্শকদের মাঝে। অর্ধ বৃত্তের মত দাঁড়িয়ে আছে দর্শক। পেছনের দর্শকরা ঘোড়ার পিঠে। তারও পেছনে উট। প্রতিটাতে দুতিন জন করে দর্শক।
দাঁড়ানো দর্শকদের সামনে একখানে চাদোয়া টানানো, নীচে চেয়ার পাতা। ব্যবসায়ী, বড় বড় অফিসার এবং শহরের সন্মানিত ব্যক্তির বসেছেন ওখানে।
প্রথম সারিতে বসে আছেন কায়রোর মসজিদ সমূহের ইমামগণ এরা সকলেই আয়ুবীর শ্রদ্ধাভাজন। ধর্মীয় গুরু এবং আলেমদের তিনি বেশী ভালবাসেন। অনুমতি ছাড়া তাদের মজলিসে বসেন না।
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সবার সাথে সুস্পর্ক গড়ে তুলতে। এ সচিবদেরই একজন খাদেমুদ্দীন আল বারক। আলী বিন সুফিয়ানের পর সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি। রাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনীর সকল গোপন পরিকল্পনা তিনি জানেন। যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং ম্যাপ থাকত তার কাছে।
খাদেমুদ্দীন আল বারকের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। দেহে আরবীয় সৌষ্ঠব। সপ্রতিভ, সুপুরুষ।
মঞ্চে তার পাশে এসে বসল একটা মেয়ে। অপূর্ব সুন্দরী। যুবতীর সাথে এসেছে একজন পুরুষ। বয়স ষাটেরও বেশী। ধনাট্য ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে তাকে।
সামনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে যুবতী বার বার তাকাচ্ছে আল বারকের দিকে। কয়েকবারই মেয়েটার তাকানো লক্ষ্য করলেন আল বারক।
যুবতী আবার তাকাল তার দিকে। চোখাচুখি হতেই সুন্দর করে হাসল মেয়েটা। এভাবে বেশ কবার চোখাচুখি হল তাদের, প্রতিবারই মিষ্টি মধুর হাসি উপহার পেল আল বারক। আবারো হাসতে যাবে, সাথে আসা বুড়োর দৃষ্টি পড়ল তার ওপর, সাথে সাথে ঠোঁট থেকে হাসি উবে গেল মেয়েটার।
দর্শকদের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল ঘোড়সওয়াররা। এগিয়ে আসছে উষ্ট্রারোহী বাহিনী।
উটগুলোকে সাজানো হয়েছে রঙবেরঙের কাপড় দিয়ে। বাঁকানো ঘাড়ের শীর্ষে গর্বোদ্ধত মাথা। আরোহীদের হাতে দীর্ঘ বাটঅলা বল্লম। ফলার খানিক নীচে তিন ফিট চওড়া এবং দেড় ফিট লম্বা রঙিন কাপড় বাঁধা। উড়ছে বাতাসে। সওয়ারের কাঁধে ধনু। উটের পালানে বাঁধা রঙীন তুনীর। আরোহীদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। হাবভাবে রাজসিক ভাব।
উটগুলো দেখতে দর্শকদের উটের মত হলেও ওগুলো যে সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত ওদের ছন্দোবদ্ধ গতি দেখলেই তা বোঝা যায়। চলনে এমন একটা রাজসিক ভাব, মনে হয় ভিন গ্রহ থেকে এসেছে।
আল বারক আবার চাইল মেয়েটার দিকে। চোখে চোখ রাখল। মেয়েটার চোখ থেকে একই সাথে ঝরে পড়ছে আত্মনিবেদন, আকুতি আর নীরব আমন্ত্রণ।
বিদ্যুৎ খেলে গেল আল বারকের শরীরে। যুবতীর ঠোঁটে ভেসে উঠল লাজনম্র হাসি। বুড়োর দিকে দৃষ্টি পড়তেই যুবতীর চোখে মুখে নেমে এল একরাশ ঘৃণা ও হতাশা।
আল বারকের স্ত্রী চার সন্তানের জননী। এ মুহুর্তে স্ত্রীর কথা ভুলে গেলেন তিনি। তাকিয়ে রইলেন যুবতীর দিকে। বাতাসে উড়ছে সুন্দরীর রেশমী নেকাব। কখনও এসে পাশে বসা আল বারকের বুকে, মুখে লুটিয়ে পড়ছে।
আল বারক আলতো হাতে সরিয়ে দিল সে কাপড়। লজ্জা জড়ানো কণ্ঠে ক্ষমা চাইল যুবতী।
মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন, ‘আরে না না, এতে ক্ষমা চাওয়ার কি আছে?”
উষ্ট্রারোহীদের পেছনে পদাতিক ফৌজ, তীরন্দাজ আর তলোয়ারবাজ। পরনে সামরিক পোশাক। অপলক চোখে তাকিয়ে রইল দর্শকরা। প্রতিটি সৈনিকই সুঠাম দেহী। চেহারায় আনন্দের দ্যুতি।
গর্বোদ্ধত বুকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। দর্শকরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। সুলতান আয়ুবী তা-ই চাইছিলেন।
সবশেষে এল সাজোয় বাহিনী। প্রতিটি কামানের পেছনে একটা করে এক্কাগাড়ী। গাড়ীতে বড় বড় পাথর এবং বিভিন্ন সাইজের ভাড়। ভাড়ে দাহ্য পদার্থ।
ধীরে ধীরে দর্শকদের সামনে দিয়ে এরাও পেরিয়ে গেল।
দীর্ঘ চক্কর দিয়ে ফিরে এলেন সুলতান আয়ুবী। সামনে পতাকাবাহী। ডানে, বায়ে এবং পেছনে গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা। তারও পেছনে সেনাপতিদের ঘোড়া।
সুলতান ঘোড়া থামালেন। দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সালাম দিয়ে লাফিয়ে নামলেন ঘোড়া থেকে। চলে গেলেন চাঁদোয়ার নীচে।
দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাল সবাই। তিনি সালামের জবাব দিয়ে নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলেন।
আরোহী এবং পদাতিক সৈন্যরা পাহাড়ের আড়াল হয়ে গেল। ফাঁকা ময়দান। এক দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার মাঠে প্ররেশ করল। একহাতে ঘোড়ার বলগা, অন্যহাতে উটের রশি। মধ্য মাঠে এসে ঘোড়ার পিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সওয়ার। লাগাম ছেড়ে দিয়ে উটের পিঠে লাফিয়ে পড়ল।
আবার ফিরে এল চলমান অশ্বের পিঠে। এরপর লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। ঘোড়া এবং উটের সাথে ছুটে গেল কিছুদূর। আবার একলাফে ছুটন্ত ঘোড়ায় উঠে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল।
সামান্য ডানে ঝুঁকলেন আল বারক। তার মুখ এবং মেয়েটার মাথার-মাঝে দু’তিন ইঞ্চি ফাঁক। মেয়েটা তাকে দেখল। হাসল আল বারক। মেয়েটার ঠোঁটে এখনো সেই লাজুক হাসি। এদিকে চোখ পড়তেই কপাল কুঞ্চিত হল বৃদ্ধের। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।
সহসা পাহাড়ের দিক থেকে উড়ে এল কতগুলো মাটির পাতিল। মাঠে পড়ে ফেটে গেল পাতিলগুলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তরল পদার্থ। আশপাশে একশ গজ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। ভিজে গেল মাঠ।
পাহাড়ের টিলায় ভেসে উঠল দু’জন তীরন্দাজের মুখ। আগুনের ফিতা বাঁধা তীর ছুড়ল ওরা। ভেজা মাঠে তীর পড়তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন।
একদিক থেকে ছুটে এল চারজন ঘোড়সওয়ার। আগুনের কাছে এসেও থামল না। তীব্র গতিতে ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। অবাক দর্শকরা ভাবল ওরা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটতে দেখা গেল ওদের। বেরিয়ে গেল অপর দিক দিয়ে।
দর্শকদের শ্লোগানে প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস। দু’জন আরোহীর কাপড়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। ছুটন্ত ঘোড়া থেকে লাফ দিল ওরা। গড়গড়ি খেল বালিতে। নিভে গেল পোশাকের আগুন।
আল বারকের দৃষ্টি মাঠে নেই। বার বার তাকাচ্ছে যুবতীর দিকে। প্রতিবারই মিষ্টি করে হাসছে তরুণী। আবার দৃষ্টি ফিরে যাচ্ছে বুড়োর দিকে। হঠাৎ বৃদ্ধ উঠে গেলেন। মেয়েটাকে তার সাথে আসতে দেখেছে আল বারক।
‘তোমার আব্বা উঠে গেলেন কেন?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘বৃদ্ধ আমার পিতা নন, স্বামী।’
‘স্বামী!’ আল বারকের কণ্ঠে অবাক বিস্ময়। ‘তোমার পিতা মাতাই, কি এ বিয়ে দিয়েছেন!’
‘সে আমায় কিনে নিয়েছে।’ যুবতীর নিঃস্পৃহ জবাব।
‘গেলেন কোথায়?’
‘আপনার সাথে আমার চোখাচোখির ব্যাপারটা আঁচ করে রাগ করে চলে গেছেন। সন্দেহ করছেন আপনার জন্য আমার আকর্ষণ রয়েছে।’
‘সত্যিই কি আমার জন্য তোমার আকর্ষণ রয়েছে।’
লজ্জায় নত হল যুবতীর চোখ। ঠোঁটে বিনম্র হাসি। অক্ষুট কণ্ঠে বলল, ‘ওকে আর সহ্য করতে পারছি না। হাঁফিয়ে উঠেছি। কেউ আমাকে এ বুড়োর হাত থেকে মুক্তি না দিলে আত্মহত্যাই করব।
মাঠে সৈন্যরা সেনা নৈপূণ্য দেখাচ্ছিল। মল্লযুদ্ধ, অসি চালনা, তীরন্দাজী। দর্শক এ ধরনের ক্রীড়ানৈপুন্য আগে কখনও দেখেনি।
এতকাল এরা দেখে এসেছে সুদানীদের। ওদের হামবড়া ভাবের অন্ত ছিল না। অফিসাররা রাস্তায় বেরুত রাজ রাজড়ার মত। তাদের সংগী সেনাদল গ্রামবাসীদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াত।
চারণভূমি থেকে ওরা লুট করত পশু। কারো কাছে ভাল জাতের উট বা ঘোড়া থাকলে জোর করে নিয়ে যেত। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, সেনাবাহিনী তৈরী করা হয় জনগণের উপর অত্যাচার করার জন্য।
কিন্তু সালাহউদ্দীন আয়ূবীর ফৌজ ছিল তারচেয়ে ভিন্ন। যারা মহড়ায় অংশ নেয়নি, তাদের ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল দর্শকদের মাঝে। জনসাধারণকে বোঝাতে হবে ফৌজ তাদেরই ভাই এবং বন্ধু। শৃঙ্খলা ভংগকারী সৈনিকদের জন্য ছিল কঠোর শাস্তি।
আল বারক মহড়া সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়লেন। ভুলে গেলেন সুলতানের নির্দেশ। যুবতী তার বিবেকের উপর চেপে বসল।
আল বারক তাকে ভাললাগার কথা বললেন। আহ্ববানে সাড়া দিল যুবতী। একান্তে দেখা করতে বললেন আল বারক।
যুবতী বলল, ‘আমি তার কেনা বাঁদি ও আমাকে বন্দী করে রেখেছে। তার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে আসা সম্ভব নয়। ঘরে তার চারজন স্ত্রী। ওরাও আমার উপর দৃষ্টি রাখে।’
স্বীয় পদমর্যাদার কথা ভুলে গেলেন আল বারক। টিনেজারদের মত সাক্ষাতের জন্য বিভিন্ন স্থানের নাম উল্লেখ করতে লাগলেন। একটি স্থান তরুণীর পসন্দ হল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের পোড়াবাড়ী। শহরের বাইরে। ভবঘুরেরাই কেবল ওখানে যায়।
‘ঠিক আছে, আমি ওখানে আসতে পারি, যদি আপনি আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচানোর ওয়াদা দেন।’
‘অবশ্যই। ঐ বুড়োর হাত থেকে তোমাকে মুক্ত করার ওয়াদা করছি আমি।’
‘কখন আসব?’
‘আজ রাতে। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন। কি, আসবে তো?’
মেয়েটি আবারো সেই সলজ্জ হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা’।
***
কায়রোতে রাত নেমেছে।
মেলা শেষ হয়েছে দু’দিন আগে। দর্শকরা যে যার বাড়ী ফিরে গেছে। অস্থায়ী পতিতালয়গুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে সরকারী নির্দেশে। সন্দেহজনক পুরুষ ও নারীদের খুঁজছিল গোয়েন্দারা।
মেলার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দু’দিনে চার হাজার যুবক সেনা ফৌজে ভর্তি হয়েছে।
আল বারক চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পরনে সাধারণ পোশাক। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন কেউ দেখছে কিনা। না, কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই বুঝতে পেরে নিশ্চিন্তে রওনা দিলেন পুরনো সেই ভাঙা বাড়ীর দিকে।
ঘুমিয়ে পড়েছে মরুভূমি। রাতের নিস্তব্ধত ভেঙে থেকে থেকে ডেকে উঠছে পাহাড়ী শেয়াল। মেয়েটা বলেছিল সে বন্দিনী। সবসময় চোখে চোখে রাখা হয়। তবুও আসবে এ আশায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আত্মরক্ষার জন্য একটা খঞ্জর সাথে নিয়েছেন।
নারীর পাগল করা রূপের মোহ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। হৃদয় হয় ভয় শূন্য। আল বারক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ হলেও এখন অবিবেচক যুবক।
ভাঙা বাড়ীটার কাছে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে, আপাদমস্তক ঢাকা। ছায়াটা মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন। ভাঙা দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকে গেলেন ভেতরে।
অন্ধকার কক্ষ। পাখা ঝাপটানোর শব্দ হল। হঠাৎ গালে চড় মারল কেউ। সাথে সাথে ভেসে এল চি, চি, শব্দ। বাদুড়। ওরা বড় বড় নখ দিয়ে মুখ আঁচড়ে দেবে ভেবে ভয় পেয়ে বসে পড়লেন তিনি।
বাদুরগুলো উড়ে বেড়াতে থাকল। ভয় পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে। উড়ন্ত বাদুড়ে ভরে গেল কক্ষ। চি চি শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এল বাদুড়গুলোও।
সতর্ক প্রহরায় থাকা এক বন্দিনী যুবতী কি কর এ ভয়ংকর পোড়াবাড়িতে আসবে এ কথা তিনি একবারও ভাবলেন না। উঠোনে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।
কারো পায়ের ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল। খঞ্জর হাতে তুলে নিলেন তিনি। মাথার উপর বাদুড় উড়ছে, পাখা ঝাপটানোর শব্দ হচ্ছে। আল বারক চাপা কণ্ঠে ডাকলেন, ‘আছেফা।’
এ নামই তাকে বলেছিল মেয়েটা।
‘আপনি এসেছেন!’ আছেফার কণ্ঠ।
ছুটে এসে আল বারকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘শুধু আপনার জন্যই এ ভয়ংকর স্থানে এসেছি। তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। বুড়োকে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। দেরী হলে জেগে উঠতে পারে।’
‘মদের সাথে বিষ মিশাতে পারলে না?”
‘আমি কখনও মানুষ হত্যা করিনি। একজন পর-পুরুষের সাথে এভাবে ভয়ংকর স্থানে আসব, তাও কি ভেবেছি কখনো!
আল বারক যুবতীকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। হঠাৎ পেছনের পথ আলোময় হয়ে উঠল। তার আগমন পথে জ্বলে উঠল দু’টো মশাল। এক ঝটকায় আছেফাকে পেছনে নিয়ে এলেন তিনি। এরা কি প্রেতাত্বা না মেয়েটার পেছনে এসেছে, ভাবছেন আল বারক।
গর্জে উঠল একটা কণ্ঠ, ‘দু’টোকেই জবাই করে ফেল।’
মশাল নিয়ে এগিয়ে এল চারজন বলিষ্ঠ জোয়ান। একজনের হাতে বর্শা, তিনজনের হাতে তরবারী।
মশাল মাটিতে পুতে দিল ওরা। আলোয় ভরে গেল আঙ্গিনা। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত ওরা আল বারকের চার পাশে ঘুরতে লাগল। আছেফা তার পেছনে।
বারান্দা থেকে শব্দ এল, ‘পেয়েছো? জীবন্ত ছেড়ো না কাউকে।’ মেয়েটার বুড়ো স্বামীর আওয়াজ।
আছেফা পেছন থেকে সামনে চলে এল। ঘৃণা এবং ক্ৰোধকম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘এসো, এগিয়ে এসো। খুন কর আমাকে। এ জীবনে আমার আর বাঁচার সাধ নাই। বুড়ো পাঠা, টাকার জোরে আমার জীবনটা তুমি ধ্বংস করে দিয়েছো।
আমার এ যৌবনকে তুমি কি দিতে পেরেছ? আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, আল্লার গজব পড়বে তোমার ওপর। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি। ওকে আমিই এখানে আসতে বলেছি…’
আছেফা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে।
ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চারজন সশস্ত্র লোক। বর্শাধারী এগোল আছেফার দিকে। বর্শার ফলা তার পেটে ঠেকিয়ে বলল, ‘ছিনাল মাগী, আর একটা কথাও না। মরবি তো মর, তার আগে ফলাটা দেখে নে। জাহান্নামে তোর নাগরকে আগে পাঠাব, না তোকে?’
এক ঝটকায় বর্শা ধরে ফেলল আছেফা। হ্যাচকা টানে কেড়ে নিয়ে আল বারক থেকে সরে গেল খানিক। এরপর বর্শা উচিয়ে বলল, ‘আয়, এগিয়ে আয়। দেখি একে আমার আগে কে হত্যা করে।’
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই স্তম্ভিত। আল বারক খঞ্জর হাতে এগিয়ে এলেন। মেয়েটা বর্শাধারীকে আক্রমণ করল। পিছিয়ে গেল সে।
তার সংগীরা আল বারককে আক্রমণ না করে আক্রমণের পায়তারা করছিল। ইচ্ছে করলে ওরা অনেক আগেই তাকে হত্যা করতে পারত।
আছেফা ধমকাচ্ছিল। আঘাত করছিল লক্ষ্যহীন ভাবে।
আল বারক এক ব্যক্তিকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল। তার পেছনে ছুটে এল দু’জন, একলাফে আছেফা ওদের পেছনে চলে গেল। ইচ্ছে করলে বর্শা মেরে ওদের ঘায়েল করতে পারত আছেফা। কিন্তু খঞ্জর দিয়ে তরবারীর মোকাবিলা করা যায় না।
বুড়ো একদিকে দাঁড়িয়ে হস্বিতম্বি করছিল। আক্রমণ প্রতি আক্রমণে কেটে গেল কিছু সময়। কেউ আহত হয়নি। আঁচড়ও লাগেনি কারও গায়ে। এবার বৃদ্ধ বলল, ‘থামো!’
যুদ্ধ থেমে গেল।
‘এমন বিশ্বাসঘাতিনীকে আমি আর বাড়ীতে নেবো না। জানতাম না ও এত দজ্জাল। জোর করে নিয়ে গেলে কখন আমাকে মেরেই ফেলবে!’
‘আমি তোমাকে এর মূল্য পরিশোধ করে দেব।’ আল বারক বলল, ‘তুমি একে কত দিয়ে কিনেছিলে?
‘আমার সম্পদের অভাব নেই। ওকে আমি আপনাকে উপহার দিলাম। আমি অবাক হচ্ছি আপনার প্রতি ওর ভালবাসা দেখে। কি পরিমাণ ভালবাসা থাকলে নিজের জীবন বিপন্ন করে এতগুলো লোকের মোকাবিলা করতে পারে একবার ভেবে দেখেছেন? ও যুদ্ধবাজ বংশের মেয়ে তো, এক যোদ্ধার ঘরেই ওকে মানাবে ভাল।
তাছাড়া আপনি প্রশাসনের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। সুলতানের এক অনুরাগী হিসাবে আপনাকে আমি অসন্তুষ্ট করতে পারিনা। আমি ব্যবসায়ী মানুষ, সারাদিন ব্যস্ত থাকি বাইরে। আর এ বুড়ো বয়সে ওর মত যুবতী ঘরে রাখাও বিপদজনক। আমি ওকে তালাক দিলাম। এবার ও আপনার জন্য বৈধ।’, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল সে। অন্ত্রধারীদের দিকে ফিরে বলল, ‘এই চল, খবরদার, এই ঘটনা কাউকে বলবি না।’
লোকগুলো মশাল তুলে ফিরে গেল। অবাক চোখে ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন আল বারক। তার পায়ের নীচে মাটি কাঁপতে লাগল। কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বৃদ্ধ তার সাথে প্রতারণা করেছে। পথে লুকিয়ে থেকে দু’জনকেই হত্যা করবে।
আছেফার হাত থেকে বর্শা হাতে নিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন ভাঙা বাড়ি থেকে।
আছেফার হাত ধরে দ্রুত হাটছিলেন তিনি। বারবার তাকাচ্ছিলেন ডানে, বায়ে, পেছনে। সামান্য শব্দেও চমকে উঠে থেমে যেতেন। অন্ধকারেই চাইতেন এদিক ওদিক। ধীরে ধীরে হাঁটা ধরতেন আবার। শহরে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আছেফা থামল। তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপনি কি আমায় বিশ্বাস করেন!’
আল বারক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগের কারণে কিছুই বলতে পারলেন না।
এ ঘটনার পর দেখা গেল আল বারক নয়, মেয়েটাই তাকে কিনে নিয়েছে। তার মনে হচ্ছিল আছেফা তার জন্য পাগল। শুধু তার জন্য এতগুলো লোকের সাথে একা লড়াই করেছে আছেফা।
আছেফা তার রূপের জালে আটকে ফেলেছে তাকে। আল বারক স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। সে স্থান দখল করল আছেফা।
সে যুগে মেয়েদের ক্রয় বিক্রয় চলত। স্ত্রীর কোন মর্যাদা ছিল না। চারজন স্ত্রী রাখাকে পুরুষের অধিকার মনে করা হত। বিত্তশালীরা পুষত রক্ষিতা। মুসলমান ওমরাদেরকে নারীরাই ধ্বংস করেছে। স্বামীদের সন্তুষ্ট করার জন্য স্ত্রীরাই সুন্দরী মেয়ে খুঁজে এনে স্বামীদের উপহার দিত।
আল বারক আছেফাকে নিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। সবাই তখন ঘুমিয়ে। সকালে স্ত্রী দেখল স্বামীর বিছানায় এক অনিন্দ্যসুন্দর যুবতী। এতে সে মোটেই অসন্তুষ্ট হলোনা। ভাবল, এমন দু’একজন স্ত্রী বা রক্ষিতা পোষার ক্ষমতা তার স্বামীর রয়েছে। ও আসায় তার কিছুটা দায়িত্ব বরং কমবে। কিন্তু একবারও ভাবল না, আজ থেকে তার ভালবাসা হারিয়ে গেছে।
একদিন যে মেয়েরা পুরুষের সাথে কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এখন তারা শুধুমাত্র পুরুষের ভোগের সামগ্রী- এ কথা ভাবতে কষ্ট হতো আয়ুবীর। এতে সমাজের অর্ধেক শক্তিই নিঃশেষ হয়নি বরং এরা জাতির পৌরুষকেও নিঃশেষ করে দিয়েছে।
ব্যবসায়ী পণ্যের মত মেয়েদের নিলাম হত। অপহরণ, খুন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটত অহরহ। তিনি নারীদের এ অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলেন।
নারীকে পুরুষের এবং পুরুষকে নারীর এই অনাহুত মোহ থেকে মুক্ত করতে তিনি ‘এক স্বামীর এক স্ত্রী’ শ্লোগান তোললেন। তিনি জানতেন দু’তিনজন স্ত্রী এবং রক্ষিতার মালিক আমীর ওমরারা সরাসরি এর বিরোধিতা করবে। কারণ, এরাই ছিল নারীদের প্রধান খরিদ্দার।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সালাহউদ্দীন কুমারী মেয়েদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলেন। এতে হারেমগুলো শূন্য হবে। নারী ফিরে পাবে মর্যাদা। কিন্তু পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে না আসা পর্যন্ত তা সম্ভব ছিল না।
সমাজে তার শত্রুর পরিমাণ ছিল যথেষ্ট। তিনি জানতেন, বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি জানতেন না তাঁর বিশ্বস্ত সংগী, রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক গোপন পরিকল্পনার রক্ষক আল বারকও এক রূপসীর ফাঁদে পড়েছেন। প্রেমের অভিনয় দিয়ে যে রূপসী তাকে আপন কর্তব্য ভুলিয়ে দিচ্ছিল।
***
সেনা মহড়া দেখেছে জনগণ। আয়ুবীর সামরিক শক্তি দেখে ভীত হয়নি, বরং খুশী হয়েছে তারা।
বক্তৃতা বিবৃতিতে বিশ্বাসী নন সালাহউদ্দীন আয়ুবী, কিন্তু মহড়ায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। জনতার সামনে খ্রীস্টানদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, আরবের মুসলমান আমীর ওমরাগণ ভোগবিলাসে মত্ত। সাধারণ মুসলমান খ্ৰীষ্টানদের অত্যাচারে জর্জরিত। খ্ৰীষ্টানরা কাফেলা লুণ্ঠন করে। অপহরণ করে মুসলিম যুবতীদের। ওদের আব্রু ইজ্জত হরণ করার পর বিক্রয় করে দেয়।
সুলতান জনতাকে জাতীয় চেতনাবোধে উজ্জীবিত করতে চাইলেন। মা বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করলেন যুবকদের।
সালাহউদ্দীন আয়ুবীর আগুন ঝরা বক্তৃতায় আবেগে উদ্বেলিত হল দর্শকরা। সেদিন থেকেই সেনাবাহিনীতে নতুন ভর্তি শুরু হল।
দশদিনের মধ্যে নতুন ভর্তি দু’হাজারে গিয়ে পৌঁছল। এরমধ্যে দেড়হাজার নিয়ে এসেছিল উট, একহাজার ঘোড়া এবং খচ্চর। সুলতান পশুর দাম চুকিয়ে দিলেন। শুরু হল ওদের সামরিক প্রশিক্ষণ। মেলার তিন মাস পর। দেখা গেল সেনাবাহিনীতে তিনটি অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। চুরি, জুয়া এবং রাতে যেখানে যার থাকার কথা সেখানে না থাকা।
তিনটি অপরাধের মুল ছিল জুয়া। এক সৈন্য আরেক সৈন্যের ব্যক্তিগত জিনিস চুরি করে বাজারে বিক্রি করে ফেলত।
এক রাতে তিনটি ফৌজি ঘোড়া হারিয়ে গেল, অথচ দেখা গেল সৈন্যদের কেউ অনুপস্থিত নেই। ফলে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হল না। আরেক রাতে দেখা গেল দশটি ঘোড়া নেই।
সৈন্যদের শাস্তির ভয় দেখানো হল কিন্তু অপরাধ কমল না।
একরাতে এক সৈনিককে গেটের বাইরে দেখা গেল। মাতালের মত তার পা কাপছে। সেন্ট্রি ডাকল তাকে। দাঁড়াল সিপাইটি। এরপর এগিয়ে আসতে গিয়ে ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল।
এগিয়ে গেল সেন্ট্রি। সৈন্যটির দেহ রক্তে ভেজা। সেন্ট্রি তাকে সুবেদারের কাছে নিয়ে গেল। চিকিৎসা করা হল। কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।
মৃত্যুর আগে সে বলল, ‘একজন সিপাইকে আমি হত্যা করে এসেছি। ক্যাম্প থেকে আধা মাইল উত্তরে এক তাঁবুতে পড়ে আছে তার লাশ।’
ওখানে ছিল তিনটি বেদুঈন তাঁবু। ওদের কাছে রয়েছে সুন্দরী যুবতী। দিনে সেজেগুজে ক্যাম্পের চারপাশে হাঁটত যুবতীরা। রাতে সৈন্যরা ওদের কাছে চলে যেত। একজনের কাছে শুনে আরেকজন।
এরা কোন সাধারণ পতিতা ছিল না। প্রতিটি খন্দেরের সাথে ওরা প্রেমের অভিনয় করত। কে কখন আসবে বলে দিত যুবতীরা।
দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন এক যুবতীর তাঁবুতে এক সাথে দু’জন সৈনিক এসে হাজির হল। এদের দু’জনের সাথেই অভিনয় করছিল যুবতী।
দু’জনই ওকে পাওয়ার জন্য ছিল উদগ্রীব।
সে রাতে দু’জন একসঙ্গে তাঁবুতে পৌঁছে মেয়েটাকে নিজের অধিকারে নেয়ার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ল। সংঘর্ষে একজন হল নিহত, অন্যজন আহত হয়ে ক্যাম্পে এসে মারা গেল।
একজন কমান্ডার কয়েকজন সিপাই নিয়ে লাশের জন্য ওখানে গেল। গিয়ে দেখে লাশ পড়ে আছে, কিন্তু তাঁবু নেই।
সৈন্যটার লাশ নিয়ে ফিরে এল সিপাইরা। রাতে আর খোঁজাখুজিতে গেল না। আয়ূবীর কাছে রিপোর্ট করা হল। বলা হল, সৈন্যদের মাঝে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কেন অপরাধ বৃদ্ধির পাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে আলীকে হুকুম দিলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। গোয়েন্দাদের তৎপর হতে বললেন এ কাজে। আল বারককে বললেন, ‘আপনিও একটু খোঁজ খবর নেন।
শহরের এমন জায়গায় ছিল এ কেনো’র জবাব, যেখানে যেতে পারত না আলীর গোয়েন্দারা।
শহরের কেন্দ্রে কেল্লার মত বিশাল বাড়ী। মিসরের একটা পরিবার নয় বরং একটা বংশের সকলেই ওখানে থাকত।
এরা ছিল অভিজাত ও সম্মানিত। ওদের দানের হাত ছিল উন্মুক্ত। এতিম, বিধবা এবং গরীবরা কখনো ওখান থেকে শূন্য হাতে ফিরত না। এ বংশের সবাই ছিল ব্যবসায়ী। মহড়ার সময় সেনাবাহিনীকে আশরাফি দিয়েছিল দুই থলে ভর্তি করে।
সালাহউদ্দীন মিসরে আসার আগে সুদানী ফৌজের বড়বড় অফিসাররা এখানে এসে সময় কাটাত। সুদানীরা নিশ্চিহ্ন হবার পর এরা আয়ুবী সরকারের অনুগত হয়ে পড়ল।
সুলতান যখন আলী এবং আল বারককে নির্দেশ দিচ্ছিল সে রাতে ওই বাড়ীর এক কক্ষে চলছিল জমজমাট মদের আসর। আসরে বসেছিল বার জন যুবক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।
কক্ষে প্রবেশ করল এক বৃদ্ধ। সাথে একদল সুন্দরী। এদের মধ্যে এক যুবতীর মুখ নেকাবে ঢাকা।
উঠে দাঁড়াল সবাই। ওরা কক্ষে ঢুকতেই দরজা বদ্ধ করে দেয়া হল। নেকাব খুলে বৃদ্ধের পাশে এসে বসল মেয়েটা।
‘ফৌজে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার সংবাদ গতকাল সুলতানের কানে দেয়া হয়েছে।’ বৃদ্ধ বলল, ‘এজন্য আমাদের আজকের এ বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজে গোয়েন্দাদেরকে অন্তৰ্ভূক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে সুলতান।’
‘আমরা ওদের তৎপরতা সফল হতে দিতে পারি না।’ বলল একজন।
‘তোমাদের জন্য সুসংবাদ হল দু’জন মিসরী সৈন্য এক যুবতীকে নিয়ে ঝগড়া করেছে। নিহত হয়েছে একজন, অন্যজন আহত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে মারা গেছে, এ আমাদের প্রথম সাফল্য।’
তিন মাসে নিহত হল মাত্র দু’জন। এত ধীরগতির সফলতায় সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। যখন আয়ুবীর এক সালার আরেক সালারকে হত্যা করবে তখনই শুধু বলা যাবে আমরা সফল হচ্ছি।’ বলল অন্য একজন।
‘কোন সেনাপতি বা কমান্ডার যদি আয়ুবীকে হত্যা করে তবেই আমরা সফল।’ বৃদ্ধের কণ্ঠ, ‘একহাজার সৈন্য নিহত হলেও কিছু যায় আসে না। আমাদের লক্ষ্য আয়ুবী। গত বছরের কথা তো তোমরা জান, আয়ুবীর প্রতি নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। রোম থেকে আসা লোকগুলো সব মারা পড়ল। ওদের দলের এক হারামী মুসলমান হয়ে গেল। এতে বুঝা যায়, আয়ুবীকে হত্যা করা এত সহজ নয় যা তোমরা মনে কর।’
এওতো হতে পারে, আয়ুবীকে মারলে তার স্থান দখল করবে তারচেয়ে গোঁড়া কোন ব্যক্তি? বাগদাদ ও দামেশকের আমীরদেরকে যেমন যুবতী মেয়ে দিয়ে ধ্বংস করেছি, আয়ুবীর ফৌজকেও সেভাবে নষ্ট করতে হবে।’
খ্রিস্টান এবং সুদানীরা পরাজিত হয়েছে এক বছর হল, একজন বলল, “এ এক বছরে আপনারা কি করেছেন? আপনারা যে পথে এগুচ্ছেন এ পথ বড় দীর্ঘ। এ মুহুর্তে দু’জনকে হত্যা করা অত্যন্ত জরুরী। একজন আয়ুবী, অন্যজন আলী বিন সুফিয়ান।’
‘আপনি ঠিক বলেছেন। আলীকে হত্যা করলে আয়ুবী অন্ধ হয়ে যাবে।” সমর্থন জানাল এক যুবক।
‘আয়ুবীর বুকের সব গোপনীয়তা দেখার চোখ এখন আমাদের হাতে। বৃদ্ধ যুবতীর পিঠ চাপড়ে বলল, এ হল সে চোখ। এর চোখের যাদু দেখে নাও। তোমরা আল বারক নামে সালাহউদ্দীনের এক সচিবের নাম শুনেছ। কেউ কেউ তাকে দেখেও থাকবে। আয়ুবীর হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে মাত্র দু’টো লোক, আলী এবং আল বারক। আলীকে হত্যা করা হবে বোকামী।
আল বারকের মত আমরা তাকেও হাত করে নেব।”
‘আল বারক হাতে এসেছে?”
বুড়ো যুবতীর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “এ শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলেছি। তোমাদের এই সুসংবাদ শোনানোর জন্যই আজ ডাকা হয়েছে।’
“কি বলছেন আপনি! এ অসাধ্য কি করে সাধন করলেন?” বিস্মিত প্রশ্ন করল বিড়ালমুখো ঢেঙ্গাপাতলা এক লোক।
‘আলী এবং আল বারককে ফাঁসানোর জন্য আমি এক বছর ধরে ঘুরছি। পারিনি। সেনা মহড়ার দিন এক অভাবিত সুযোগ ঘটে গেল। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসার জন্য মঞ্চে উঠলাম। আলী বিন সুফিয়ানকে দেখলাম না আশপাশে, তবে আল বারককে পেলাম।
যুবতীকে দেখিয়ে বলল, ‘একে তো তোমরা চেনই, ওকে পুরুষ ধরার ট্রেনিং দিয়েছি দীর্ঘদিন। সে ট্রেনিং এবার কাজে লাগাবার পালা।
ওকে তার পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আমি সরে যেতেই তার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল ও। আমাকে অত্যাচারী বৃদ্ধ স্বামী বানিয়ে আমার কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ও তার সাহায্য চাইল। তার মায়াবী রূপের জালে আটকে গেল আল বারক। গোপনে ওরা সাক্ষাৎ করল। সাক্ষাতের স্থানে আমরা একটা নাটক করলাম।
আমাদের লোকেরা তরবারী এবং বর্শা নিয়ে আক্রমণ করল ওদের। তার মোকাবেলায় রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করল ও। আল বারক ভেবেছে মেয়েটা তার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতসব করছে। অথচ বেকুবটা একবারও ভাবল না, এত লড়াইয়ের পরও দুই পক্ষের কেউই আহত হয়নি কেন। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে তার হাতে তুলে দিলাম।
সবাই তাকাল মেয়েটার দিকে। তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চায় সবাই। মেয়েটা বলল, ‘তাকে আমার নাম বলেছি আছেফা। আশ্চর্য! এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক আমার ফাঁদে পা দিল! সে কখনও মদ খায়নি, আমি তাকে অভ্যস্ত করিয়েছি। ঘরে তার স্ত্রী সন্তান রয়েছে। ওদের ভুলেই গেছে সে। আল বারককে ফাসানোর বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করল যুবতী।
বৃদ্ধ বলল, এ তিন মাসে ও আমাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সুলতান বিশাল সেনাবাহিনী তৈরী করেছেন। অর্ধেক থাকবে মিসরে, অর্ধেক খ্ৰীষ্টান রাজাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাইরে নিয়ে যাবে। তার লক্ষ্যস্থল ফিলিস্তিন। আল বারক বলেছে, আয়ুবী পরিকল্পনা নিয়েছে সর্ব প্রথম মুসলমান শাসক ও সামন্ত প্ৰভুদের ঐক্যবদ্ধ করার।’
“তার মানে আল বারক এখন আমাদের লোক?’
‘না।’ বৃদ্ধের জবাব, ‘সে আয়ুবীর যেমন একান্ত অনুগত তেমনি এ মেয়েটার প্রতিও তার টান অপরিসীম।”
‘আমি সুলতানের একজন অন্ধ ভক্ত। ইসলামের ব্যাপারে আমি যেমন ভীষণ আগ্রহী তেমনি মুসলিম জাতির উন্নতিই আমার একমাত্র স্বপ্ন। ইসলামের এমন একজন সেবিকার সাথে আলাপ করার সময় সে কোন রকম রাখঢাক করে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনা।’ খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটা।
‘হ্যাঁ, তা তো হবেই। অমন যুবতী দেহের আকর্ষণ যার, তার কাছে আবার গোপনীয়তা কি?’
বৃদ্ধ বলল, ‘তাকে আমাদের সংগী করতে পারছি না, তার দরকারই বা কি? সে তো এখন আমাদের হাতের পুতুল।”
‘সুলতান আয়ুবী আর কি করতে চায়?’ প্রশ্ন করল আরেক সদস্য।
‘তার মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন। খ্ৰীষ্টান রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামের পতাকা উড়াবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সে। আমাদের গোয়েন্দাদের তৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য আলীকে দিয়ে তৈরী করেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আল বারকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সে আলাদাভাবে ত্যাগী ও কর্মঠ যুবকদের নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেছে। ট্রেনিংও শুরু হয়েছে ওদের। ট্রেনিং শেষ হলে ওদেরকে আমাদের দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য পাঠাবে। তার এসব পরিকল্পনা অত্যন্ত ভয়ংকর।’
বিড়ালমুখো ঢেঙ্গা লোকটা মুখ খুলল এবার। বলল, “সেনা মহড়ার মাধ্যমে মুসলমানদের মনে সে আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে। যুবকরা ফৌজে ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন। ছ’সাত হাজার নতুন সৈন্য ইতিমধ্যে যোগাড়ও করে ফেলেছে। ভর্তি এখনও চলছে। অনেক সুদানীও রয়েছে এর মধ্যে। আয়ুবী যথেষ্ট পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিচ্ছে।
“এ তো এক মারাত্মক পরিকল্পনা!’
‘হ্যাঁ, তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাহিনী বড় হলেই যুদ্ধে জেতা যায় না, যুদ্ধজয়ের প্রধান শর্ত যে শৃঙ্খলাবোধ তা আমরা ভেঙে দিচ্ছি। আয়ুবীর সেনাবাহিনীকে জুয়া এবং ব্যভিচারে লিপ্ত করার কাজ বেশ ভালই এগুচ্ছে। সেনাবাহিনীতে আমাদেরও অনেক লোক ভর্তি হয়েছে। ওরা ইতিমধ্যেই জুয়া খেলা জমিয়ে তুলেছে। আর কে না জানে জুয়া ও নারী মানুষকে নানা অপকর্ম, চুরি এবং খুনখারাবীতে সহজেই পৌঁছে দেয়।’
‘তা দেয় ঠিক, কিন্তু খুনখারাবী ব্যাপকভাবে শুরু হচ্ছে কই?’
‘হবে, হবে। যে সব বেশ্যাদের ট্রেনিং দিয়ে ছাউনির আশপাশে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ওরা যে পেশাধারী তা প্রকাশ করে না। সুলতানের সৈন্যদের বিপথগামী করা ছাড়াও ওদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে। গত পরশু এক মেয়ের জন্য দু’জন যুদ্ধ করে নিহত হয়েছে, এ তো সবে শুরু।
কিন্তু আয়ুবী এ সংবাদ পেয়ে আলী এবং আল বারককে তদন্তের নির্দেশ দেয়ায় বুঝা যাচ্ছে ও এ ব্যাপারে সচেতন। এখন ধড়পাকড় শুরু না হলেই হয়।’
‘আমি ভাবছি এখন থেকে কিছুদিন ক্যাম্পের কাছে যেতে মেয়েদেরকে নিষেধ করবো।’
আছেফা জানাল, সে পাঁচ ছ’দিন পর পর পর বৃদ্ধকে সংবাদ পৌছায়। আল বারককে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সে চলে আসে বৃদ্ধের কাছে।
মিটিং চলল গভীর রাত পর্যন্ত। আলোচনা হল অন্যান্য মিনি পতিতালয়গুলো নিয়ে। ফল আশাব্যঞ্জক। এতে সন্ত্রান্ত বংশের যুবকদের নষ্ট করা যাচ্ছে দ্রুত। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মেয়েগুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা দেখাচ্ছে। এখন মুসলমান মেয়েদেরকেও অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনার দিকে নিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে ছড়িয়ে দিতে হবে নেশার দ্রব্য।
গোপন বৈঠক শেষ হল। বেরুল একজন। তার পনের মিনিট পর আর একজন, এভাবে সবাই।
শেষ পর্যন্ত রইল যুবতী ও অন্য একজন গোয়েন্দা। নেকাবে মুখ ঢেকে যুবতীও গোয়েন্দাটির সাথে বেরিয়ে এল।
আল বারক দ্বিতীয় বিয়ের কথা গোপন রাখলেন, কাউকে বললেন না। দীর্ঘদিন এক স্ত্রী নিয়ে ঘর করেছেন, চল্লিশে এসে বিয়ে করলেন এক যুবতীকে, তার ভয় ছিল বন্ধুরা এ জানতে পারলে তাকে উপহাস করবে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানরা সহজ কথা একটু দেরীতেই বোঝে, এ কান ও কান করে তার এ বিয়ের কথাটা যে শেষ পর্যন্ত সবাই জেনে গেছে এ কথাটাও বুঝতে পারল না আল বারক।
***
সেনানিবাসের চারপাশে আলী গোয়েন্দাদের গভীর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলল। একদিন আলীর কাছে রিপোর্ট করল এক গোয়েন্দা, মেলার পর শহরে জুয়া এবং বেহায়াপনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আল বারকের ঘর থেকে একটা মেয়েকে বেরুতে দেখা গেছে। গত তিন মাসে চারবার গভীর রাতে কালো বোরকা পরে মেয়েটা বের হয়েছে। কিছু দূর গেলে তার সাথে যোগ দেয় একজন পুরুষ।
প্রথম দু’বার তেমন গুরুত্ব না দেয়ায় এর বেশী অনুসরণ করা হয়নি। তৃতীয়বার আমাদের এক গোয়েন্দা মেয়েটার পিছু নেয়। শহরের এক সন্ত্রান্ত বাড়ীতে এসে ঢুকে ওরা। একটু পর মেয়েটাকে ওখানে রেখে পুরুষটা চলে যায়।
গত রাতেও তার পিছু নিয়েছিল গোয়েন্দা। এক পৌঢ়ের সাথে ওরা শহরের সম্মানিত বাড়িটায় পৌঁছল। লুকিয়ে রইল গোয়েন্দা। ভেতরে ওদের অনেকক্ষণ কাটল। একসময় বেরিয়ে এল একজন। তার পনের মিনিট পর আরো একজন। এভাবে এক এক করে এগার জন বেরিয়ে গেল। সব শেষে বেরোল মেয়েটা এবং একজন পুরুষ।
গোয়েন্দাটা অন্ধকারে ওদের পিছু নিল। আল বারকের বাড়ীর কাছে এসে পুরুষটা সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেল, ভেতরে ঢুকে পড়ল মেয়েটা।
রিপোর্ট পেয়ে আলী যেমন চিন্তিত হল তেমনি খুশিও। খুশী হল এ, জন্য যে, আলী গোয়েন্দাদের বলেছিল, ‘ব্যক্তি যত বড়ই হোক সন্দেহ হলেই রিপোর্ট করবে। এমনকি সুলতান আয়ুবীর কোন কাজে সন্দেহ হলেও রিপোর্ট করতে হবে. তার লোকেরা কথাটা তাহলে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে।
আলী আল বারকের স্ত্রীকে ভাল করেই জানত। রাতে অন্য পুরুষের সাথে বাইরে যাবার মত মহিলা তিনি ছিলেন না। তার কোন যুবতী মেয়েও নেই। এ নিয়ে আলী অনেক ভাবল।
বন্ধুর জন্য কিছু করা দরকার। আবার ভাবল, শহর ভাসমান পতিতায় ভরে গেছে। তবে কি তিনি কোন বাজে মেয়ের খপপরে পড়লেন!
গোয়েন্দা বিভাগের এক মেয়েকে পাঠালেন তার বাড়ীতে। মেয়েটা গিয়ে বলল, আমি এক গরীব ও দুস্থ মহিলা। স্বামী মারা গেছে, এক মাত্র ছেলেও বেকার। আমাকে একটু দয়া করুন। আমার জন্য কিছু সাহায্য ব্যবস্থা করে দিন।
ওকে ভিক্ষুকের মত দেখাচ্ছিল না। দরিদ্র হলেও মনে হচ্ছিল যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আল বারক তখন ঘরে ছিলেন না। স্ত্রীর সাথে গল্প জুড়ে দিল সে। ভদ্রমহিলা তাকে বসতে দিলেন। বললেন, ’সাহেবতো এখন বাড়ি নেই। তুমি অপেক্ষা করো।’
এটাই চাইছিল সে। একসময় ঘুরতে ঘুরতে চলে এল শোবার ঘরের পাশে। দেখল আছেফাকে। কথায় কথায় বলল, “আপনার এ মেয়ের কি বিয়ে হয়েছে?”
‘ও আমার মেয়ে নয়, আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি মাস তিনেক আগে ওকে বিয়ে করে এনেছেন।”
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, ‘তিনি তো এলেন না। আমি না হয় পরে দেখা করবো। আপনি সাহেবকে একটু বলবেন, আমাকে যেন একটু দয়া করে।’ বেরিয়ে এল গোয়েন্দা মহিলাটি। রিপোর্ট করল এসে আলীকে।
এ সংবাদ শুনে আলী হতবাক হল। বুঝতে পারল, তার এ নতুন স্ত্রী-ই রাতের সে বাইরে যাওয়া যুবতী। কিন্তু রাতের আঁধারে সে কোথায় যায়? কেন যায়? কার কাছে যায়?
মহা চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আলীকে।
আলী আল বারকের প্রথম স্ত্রীকে সংবাদ পাঠাল একটু দেখা করার জন্য। খবর পেয়ে শান্ত মনেই আলীর সাথে দেখা করতে এল ভদ্রমহিলা।
আল বারক তখন অফিসে ব্যস্ত। আলী মহিলাকে অত্যন্ত সম্মান করত। তাকে বসতে বলে বলল, “শুনেছি আল বারক দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন?”
‘আল্লাহর কাছে হাজার শোকর দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, চতুর্থ বা পঞ্চম করেননি।’
‘নতুন বৌ দেখতে কেমন?’
‘ভীষণ সুন্দরী।
‘সুন্দরীদের তো আবার পাখা থাকে, উড়াল দেয় না তো?’ কৌতুক করে বললেন আলী, ‘মানে, আপনি কোন সন্দেহ করছেন না তো!’
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল মহিলা, কোন জবাব দিল না। আল বারকের স্ত্রীর এ মৌনতা থেকে যা বুঝার বুঝে নিল আলী। বলল, ’যদি বলি ও প্রায় রাতেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়, কিছু মনে করবেন না তো?”
মৃদু হেসে মহিলা বলল, ‘আমিও ভাবছিলাম এ নিয়ে কার সাথে কথা বলব? আসলে আমার স্বামী এখন তার গোলাম। আমার সাথেও কথা বলেন না।”
‘আপনি স্বামীকে কিছু বলেন না?’
‘ওর ব্যাপারে স্বামীর সাথে কথা বলতে গেলে ভাববে হিংসা করছি। ওর যা মেজাজ, সাথে সাথেই আমাকে না আবার বাড়ী থেকে বের করে দেয়, এই ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছি না।’
‘মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন?’
“মেয়েটাকে আমার ভাল মনে হয় না। আমাদের ঘরে মদের গন্ধও ছিল না। এখন বোতলকে বোতল শূন্য হয়ে যায়।’
“কি বললেন? মদ!’ চমকে উঠলেন গোয়েন্দা প্রধান আলী। ‘আল বারক মদ ধরেছেন?”
‘শুধু ধরেন নি, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকেন। মেয়েটা মাঝে মধ্যেই ওকে মদ খাইয়ে রাতে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে। আমি নিজে দেখেছি। যে রাতে ও বেরিয়ে যায় সে রাতে আমার স্বামী বেহুশ হয়ে পড়ে থাকেন। সকালেও উঠেন অনেক দেরী করে। ভাবতে পারেন কি বদমাইশ মেয়ে, স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে রাত কাটায় বাইরে?
‘মেয়েটা বদমাইশ নয়, গোয়েন্দা। ধোঁকা দিচ্ছে দেশ এবং জাতিকে।’
‘গোয়েন্দা!’ চমকে উঠলেন মহিলা। ‘আমার ঘরে গোয়েন্দা!’
‘আপনি জানেন আমি এক শহীদ কন্যা। আল বারক একজন খাঁটি মুসলমান। ইসলামের জন্য তার জীবন পণ। আমি আমার সস্তানদের জেহাদের জন্য তৈরী করছি, আর আপনি বলছেন আমার সন্তানের পিতা এক গোয়েন্দার খপ্পরে পড়েছে? সন্তানের পিতাকে আমি কোরবানী দিতে পারি, কিন্তু ইসলাম এবং জাতিকে কোরবানী দিতে পারি না। আমি দু’জনকেই হত্যা করব।”
রাগে কাঁপতে লাগলেন তিনি।
অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করলেন আলী। বললেন, ‘ও যে গোয়েন্দা তা নিশ্চিত হতে হবে। জানতে হবে আল বারক সত্যিই কি ওদের দলে ভিড়েছেন, না মদ খাইয়ে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়। ওর অন্য সংগীরা কোথায় আছে জানার জন্য গোয়েন্দাদের হত্যা না করে গ্রেফতার করতে হয়।
এ অবস্থায় মহিলার কি কি করা উচিত সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়ে তাকে বিদায় জানালেন আলী।
মহিলা ফিরে গেলেন। মনে হল, আলীর কথা মত ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করবেন। কিন্তু আল বারকের স্ত্রীর মনে হচ্ছিল, যে কোন সময় সে ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। সে তো হারেমের মেয়ে নয়, স্বামীর অনুগত এক স্ত্রী। দেশ এবং জাতির জন্য আত্ম্যোৎসর্গকারী বংশের সন্তান।
আলবারকের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা লাগালেন আলী। গোয়েন্দারা সারারাত জেগে থেকে তাকে পাহারা দিতে লাগল।
পাহারা জোরদার করার দুদিন পর। রাতে ঘুমিয়ে আছেন আলী। গাঢ় ঘুম। কিন্তু ঘুম যত গভীরই হোক, আলীর নির্দেশ ছিল, জরুরী কোন খবর থাকলে সাথে সাথে তাকে সে খবর দিতে হবে। প্রয়োজনে ডেকে তুলতে হবে ঘুম থেকে।
সে রাতে চাকর তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘ওমর এসেছে, আতংকিত চেহারা।‘
কক্ষ থেকে তীরের মত বেরিয়ে এলেন আলী। দুতিন লাফে আঙিনা পার হয়ে গেটের বাইরে এলেন। ওমর বলল, চাকরকে পাঠিয়ে দশ বারজন সওয়ার ডেকে নিয়ে আসুন। আপনার ঘোড়া তৈরী করান। কি হয়েছে পরে বলছি।”
চৌদ্দজন সওয়ার এবং নিজের ঘোড়া আনার জন্য চাকরকে পাঠিয়ে দিলেন আলী।
‘এবার বল ওমর, কি সংবাদ নিয়ে এসেছ?’
‘আমি এবং আজর আপনার নির্দেশে আল বারকের বাড়ীর ওপর নজর রাখছিলাম। কিছুক্ষণ পূর্বে তার বাড়ী থেকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা এক মহিলা বেরিয়ে এল। সে পঞ্চাশ কি ষাটগজ দূরে গেছে, বাড়ী থেকে সর্বাঙ্গ ঢাকা আরেকজন মহিলা আগের মেয়েটার পিছু নিল।’
দ্রুত পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেল মহিলা। হঠাৎ প্রথম মহিলা টের পেয়ে গেল যে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আমরা দু’জন লুকিয়ে দেখতে লাগলাম।
দু’মহিলা মুখোমুখি হল। তাদের মধ্যে কি কথা হল বুঝা গেল না, আগের মেয়েটা হাত তালি দিল। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক।
দ্বিতীয় মহিলাকে ধরতে চাইল সে। মহিলা তাকে আঘাত করল। অন্ধকারে অস্ত্রটা শনাক্ত করতে পারিনি। পুরুষটা তাকে পালটা আঘাত করল। প্রথম মেয়েটা বলল, ‘ওকে তুলে নাও।’
দ্বিতীয় মহিলা প্রথম মহিলাকে আক্রমণ করল। চিৎকার করে উঠল প্রথম মহিলাটি। দ্বিতীয় মহিলা আবার আঘাত করার আগেই পুরুষটা ঝাপিয়ে পড়ল তার ওপর। ও প্রতিহত করল। পুরুষের আক্রমণ। ততোক্ষণে দু’জন মহিলাই আহত।
আমি এসেছি আপনাকে সংবাদ দিতে, ওরা কোথায় যায় তা দেখার জন্য আজরকে রেখে এসেছি সেখানে।
আকস্মিক অভিযানের জন্য আলী কিছু যুদ্ধবাজ সৈন্য তৈরী রাখতেন। ওরা ছিল অভিজ্ঞ এবং সাহসী। ঘুমুত ঘোড়ার পাশে। মাথায় থাকত ঘোড়ার জিন এবং অস্ত্র। দিনে রাতে যখনি প্রয়োজন প্রস্তুতি নিত কয়েক মিনিটের মধ্যে।
আলী বিন সুফিয়ান কাপড় পরে তৈরী হতে না হতেই ওরা এসে পৌঁছল। আলীর নেতৃত্বে ঘোড়া ছুটাল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল আল বারকের বাড়ির পাশে, ঘটনাস্থলে।
দু’জনের হাতে মশাল। মশালের আলোয় তারা দেখতে পেল লাশের মত পড়ে আছে দু’জন মানুষ। একজন দ্বিতীয় মহিলা, অন্যজন ওমরের সংগী আজর।
অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলেও দু’জনই এখনো জীবিত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। ‘কাছে গেলাম। হঠাৎ পেছন থেকে আক্রান্ত হলাম খঞ্জর দিয়ে তিনটে আঘাত করল আমাকে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আক্রণকারী পালিয়ে গেল। আগের মেয়েটি আল বারকের বাড়ী যায়নি। প্রতিদিনকার মত ওদিকেই গেছে।’
আলী মহিলাকে দেখলেন। আল বারকের প্রথমা স্ত্রী।
তিনি দু’জন সওয়ারের মাধ্যমে ওদেরকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বাকী সওয়ারদের নিয়ে তিনি ছুটলেন অভিজাত সেই বাড়ীর দিকে। বিশাল প্রাচীন বাড়ি। বাড়িটার চারপাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে আরও কয়েকটা বাড়ি। দেখতে ছোটখাট পাড়া মনে হলেও আসলে, পুরোটা মিলেই একটা অভিন্ন বাড়ি।
বাড়ীর পেছন থেকে ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি ভেসে এল। আলী দুদিক থেকে সওয়ারদের পেছনে পাঠালেন। দু’জনকে দাঁড় করালেন প্রধান ফটকে। বললেন, ‘কেউ বেরোলেই বন্দী করবে। পালাতে চাইলে তীর মেরে শেষ করে দিবে।’
ঘুরে পেছনে যাচ্ছে সওয়াররা, অশ্বক্ষুরের শব্দ ভেসে এল। আলী এক সওয়ারকে বললেন, ‘দ্রুত কমান্ডারকে গিয়ে বল এ বাড়ীটা ঘেরাও করে ভেতরের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে।’
সওয়ার ক্যাম্পের দিকে ছুটলো, আলী উচ্চস্বরে অন্য সৈন্যদের বললেন, ‘ঘোড়া ছুটাও। ওদের অনুসরণ কর। একজন আরেকজনের প্রতি নজর রেখো।”
তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীর বাছাই করা ঘোড়া তীব্রগতিতে ছুটে চলল। পলায়নকারীরাও খাঁটি অশ্বারাহী। ক্ষুরের শব্দে মনে হয় ঘোড়াগুলোও বেশ ছুটতে পারে।
আঁকাবাঁকা গলিপথের শহরে ঘোড়া ছুটাতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। শহর ছাড়িয়ে এল ওরা, সামনে খোলা ময়দান।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে হচ্ছে। খোলা মাঠে পলায়নকারীদের জন্য লুকানো কষ্টকর হয়ে পড়ল। দিগন্তে ওদেরকে ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে।
চারজন, চলছে পাশাপাশি। আলীর নির্দেশে দু’জন সওয়ার ছুটন্ত ঘোড়া থেকে তীর ছুড়ল। সম্ভবতঃ লাগেনি। ওদেরকেও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ল ওরা। একজন থেকে অন্যজনের দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগল।
আলীর দল তীব্র বেগে ছুটছিল। কমে এল দূরত্ব। সামনে টিলা। টিলায় খেজুরগাছ, ঝোপ ঝাড়।
ওদের ঘোড়া দুভাগ হয়ে গেল। একভাগ ঝোপের ডানে, এক ভাগ বায়ে। টিলা পেরোল ওরা। এরপর অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টি থেকে।
ধাওয়াকারীরা টিলায় উঠল। অনেক দূরে দেখা চারটে ছায়া। ছুটছে বিচ্ছিন্ন ভাবে।
আলী উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘চার ভাগ হয়ে ওদের ধাওয়া করো। ঘোড়া আরও জোরে ছুটাও। দূরত্ব কমিয়ে আন। ধনুতে তীর জুড়ে নাও।
সওয়াররা চার ভাগে ভাগ হয়ে ছুটতে লাগল। সবাই ধনুতে তীর গেথে নিল। বেড়ে গেল ঘোড়ার গতি। অশ্বক্ষুরধ্বনির মাঝে তীর ছোড়ার শন শন শব্দ হল।
একজন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘একটাকে শেষ করেছি।’
আলীর আরেক সংগী তীর ছুড়ল। ছুটন্ত ঘোড়া থেকে নিক্ষিপ্ত তীর ওদের গায়ে লাগল না। দূরত্ব আরো কমে এল। আহত হয়ে একটা ঘোড়া পা ভেঙে পড়ে গেল। আলীর এক সংগী দ্রুত আরোহীর কাছে পৌঁছে ঘাড়ে বর্শা দিয়ে আঘাত করল। নুয়ে আঘাত ঠেকাল সে। আরেকজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তার গলা। তার সামনে বসা একটা মেয়ে। অজ্ঞান।
সৈনিকরা পলায়নকারীদের ধরে ফেলল। ডাকাডাকি করে এক জায়গায় সবাইকে জড়ো করা হল। ওদের আহত ঘোড়া দু’টো মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়া হল। পলায়নকারী পাঁচ জন, এর মধ্যে একজন তরুণী।
ওদের একজন বলল, ‘আমাদের সাথে যা ইচ্ছে কর। কিন্তু মেয়েটা আহত। আশা করব ওকে বিরক্ত করবে না।’
ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা মশাল জ্বালানো হল। মেয়েটা সত্যি আহত। অনন্যা সুন্দরী। পাকা খেজুরের মত টসটসে চেহারা। কাপড় রক্তে ভেজা। কাঁধে, ঘাড়ের কাছে খঞ্জরের আঘাতের চিহ্ন।
আলীর এক সহকারী আঘাত পরীক্ষা করল। গভীর ক্ষত। রক্ত ঝরে মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা। এখনো অজ্ঞান। চোখ দুটো বন্ধ।
আলী একটা কাপড় ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন। ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।’
তাড়াতাড়ির প্রশ্ন অবান্তর। ওরা এখন শহর থেকে অনেক দূরে। বন্দীদের মধ্যে ছিল এক বৃদ্ধ।
দলটা কায়রোর দিকে ফিরে চলল। সূর্যোদয়ের সময় পৌঁছুল কায়রো। সুলতান আগেই শুনেছিলেন রাতের ঘটনা।
আলী হাসপাতাল গেলেন।
আজর এবং আল বারকের স্ত্রীর জ্ঞান ফিরলেও অবস্থা আশংকাজনক। ডাক্তার মেয়েটার দিকে নজর দিল।
সুলতানও হাসপাতালে এলেন। আলীকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আল বারকের জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম। আশ্চর্য কথা শোনাল সে। আল বারক নাকি বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছে। কক্ষে মদের সোরাহী এবং গ্লাস। সে কি মদও ধরেছে? স্ত্রী আহত হয়ে বাইরে পড়ে আছে এ অনুভূতিও তার নেই? আমি মহিলার সাথে কোন কথা বলিনি। ডাক্তার নিষেধ করেছেন।”
আল বারকের এক স্ত্রী নয় দু স্ত্রীই আহত। মরুভূমি থেকে যে মেয়েটাকে এনেছি সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী। কথা বলার মত হোক, আমরা অনেক বড় শিকার হাতে পেয়েছি সুলতান।
সূর্য উঠার অনেক পর জাগলেন আল বারক। চাকর বলল, ‘সুলতান তাকে স্মরণ করেছেন।”
হাসপাতালে ছুটে এলেন তিনি। তার দু’ স্ত্রী আহত। পাশে চার গোয়েন্দা। এদের সাথে বৃদ্ধকে দেখে আশ্চর্য হলেন তিনি। তাকে তিনি আছেফার স্বামী মনে করছিলেন।
এদের বিচারের ভার নিজের হাতে নিলেন সুলতান। কারণ এর সাথে প্রতিরক্ষা সচিব জড়িয়ে পড়েছেন।
সুস্থ হওয়ার পর ওদের জবানবন্দী নেয়া হল। আল বারকের প্রথম স্ত্রী বললেন, যখন শুনলাম মেয়েটা গোয়েন্দা, ভীষণ রাগ হল। ইচ্ছে হল স্বামীকে এবং তাকে হত্যা করে ফেলি। কিন্তু আলী যখন বললেন। সংগীদের খোঁজ নেয়ার জন্য গোয়েন্দাকে জীবিত ধরতে হয়, রাগ সামলে বাড়ী গেলাম। নজর রাখলাম মেয়েটার ওপর। এমনকি রাতের ঘুমও ছেড়ে দিলাম। সুযোগ বুঝে তার শয়ন কক্ষের দরজায় একটা ফুটো করলাম। রাতে তাকিয়ে থাকতাম ছিদ্র পথে।
রাতে দেখতাম মেয়েটা আল বারককে মদ খাওয়াচ্ছে। অর্ধ উলংগ দেহ। তার সাথে অশ্লীল আচরণ করছে। এমনভাবে সুলতানের কথা বলছে যেন সুলতান তার পীর মুর্শিদ। গালাগালি করছে খ্ৰীষ্টানদের। বিশেষ করে খ্ৰীষ্টানদের বিরুদ্ধে সুলতানের সামরিক পরিকল্পনার কথাই বেশী বলল। আল বারক হড়হড় করে সুলতানের সব পরিকল্পনার কথা তাকে বলে দিলেন।
এরপর এল প্রতীক্ষিত রাত। আছেফ আল বারককে মদ পান করাতে লাগল। পশু হয়ে উঠল সে। দু’টো গ্রাস নিয়ে পাশের কক্ষে চলে গেল আছেফা। মদ ভরে ফিরে এল। একটা তাকে দিল, অন্যটা নিল নিজে। এরপর অশ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে গেল।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। কাপড় পরল আছেফা। ধীরে ধীরে ডাকল তাকে। জবাব না পেয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল। আল বারক চোখ খুললেন না। সম্ভবতঃ মেয়েটা তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে।
মধ্যরাত। আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢেকে কক্ষের আলো নেভাল মেয়েটা, বেরিয়ে এল বেড়ালের মত নিঃশব্দে।
ক্রোধে ফেটে যাচ্ছিলাম আমি। বোরকা পরে একটা খঞ্জর সাথে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরোতে যাব, দেখলাম এক চাকরানীর সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে ও। বুঝলাম ও চাকরানীটাকেও হাত করে নিয়েছে।
বেরিয়ে গেল আছেফা। চাকরানী ফিরে গেল তার ঘরে। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। পায়ের শব্দ লক্ষ্য করে আমি দ্রুত হাটতে লাগলাম। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ও কোথায় যাচ্ছে?
আছেফা সম্ভবতঃ আমার পায়ের শব্দ শুনেতে পেয়েছে। মোড় ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। অন্ধকারে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না, মোড় ঘুরেই ওর মুখোমুখি পড়ে গেলাম।
হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করব। বললাম, ‘কোথায় যাচ্ছ আছেফা?”
ওর পাহারায় লোক আছে জানতাম না। দেখিনি কাউকে। আছেফা হাত তালি দিল। হেসে বলল, ‘আপনি আমার পেছনে এসেছেন, না কোথাও যাচ্ছেন?’
অকস্মাৎ কেউ পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরল। এক ঝটিকায় নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত খঞ্জর টেনে নিলাম। আঘাত করলাম লোকটাকে। ও পড়ে গেল। লোকটা দ্রুত উঠে আমার পেটের পাশে আঘাত করতে চাইল, সরে গেলাম আমি।
সরতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম আছেফার গায়ে। ঘুরে আমি আছেফাকে আক্রমণ করলাম। খঞ্জর ঢুকে গেল তার কাঁধে, ঘাড়ের পাশে। চিৎকার দিল ও।
লোকটা ছুটে এসে আমাকে আঘাত করল। পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। আবার তাকে আঘাত করলাম তাকে। কিন্তু এ আঘাতও ঠেকাল ও।
আছেফা এসে জাপটে ধরল আমাকে। লোকটা আমাকে আঘাত করল, পড়ে গেলাম আমি।
আজর বলল, ‘ওমর চলে যাওয়ার পর দেখলাম দু’জন মহিলাই মাটিতে পড়ে আছে। সাথের লোকটা প্রথম মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় মহিলা আহত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। মহিলার অবস্থা আশংকাজনক। তার কাছে বসলাম। হঠাৎ কেউ আমাকে পেছন থেকে, খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল। পরপর তিনবার। এরপর পালিয়ে গেল। তারপরের কথা আমার মনে নেই।’
সন্ধার দিকে আল বারকের প্রথম স্ত্রী এবং আজরের অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিল। ডাক্তারদের শত চেষ্টায়ও তাদের বাঁচানো গেল না।
আল বারকের স্ত্রী আলীকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে কোরবানী দিতে পারি। কিন্তু জাতি এবং দেশের ইজ্জতকে কোরবানী দিতে পারিনা। তিনি জাতির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশে আল বারককে জেলে নেয়া হল। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় ঐ অপরাধ করিনি। এরা আমায় ধোঁকা দিয়েছে।’
কিন্তু তিনি মদ আর সুন্দরীর মোহে সামরিক এবং বেসামরিক তথ্য খ্ৰীষ্টানদের দিয়েছেন তা প্রমাণিত হল। সুলতান হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারতেন, কিন্তু মদ পান, ব্যাভিচার এবং শক্রর কাছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের অপরাধ ক্ষমা করতেন না।
সেদিনই আছেফার জবানবন্দী গ্রহণ করা হল। আহত হওয়ার চাইতে ও ভয় পেয়েছিল বেশী। সে ছিল গোয়েন্দা, সৈনিক নয়।
রাজকুমারী রূপে রাজকুমারদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার ট্রেনিং তাকে দেয়া হয়েছিল। এ পরিণতির কথা কখনও সে ভাবেনি।
মুসলমানদের হাতে পড়ায় ও বেশী শংকিত ছিল। ওর ভয় ছিল মুসলমানরা তাকে পশুর মত ব্যবহার করবে। ওর চিকিৎসা করবে না। তার কাছে যাওয়া প্রতিটি লোকের কাছেই সে এ শংকা প্রকাশ করেছে।
ও কাঁদছিল ভয় পাওয়া শিশুর মত। আলী তাকে অনেক বোঝালেন। বললেন, ‘এক আহত মুসলমান মেয়ের সাথে যেমন ব্যবহার করা হয়, তোমার সাথেও তাই করা হবে। কিন্তু ও সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইছিল।’
সুলতানকে তার কথা বলা হল। তিনি এলেন। তার মাথায় হাত হাত দিয়ে বলল,’ ভয় করোনা, তুমি আমার মেয়ের মত।’
‘আমি শুনেছি সুলতান আয়ুবী তলোয়ারের নয়, হৃদয়ের সম্রাট।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল আছেফা, ‘যে সম্রাটকে পরাজিত করার জন্য সকল খ্ৰীষ্টান রাজারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এক অসহায় মেয়ের সাথে প্রতারণা করতে তাঁর কি ভাল লাগবে? আমায় বিষ দিতে বলুন। এ অবস্থায় আমি কোন কষ্ট সইতে পারব না।’
‘তুমি চাইলে আমি সবসময় তোমার কাছে থাকব। তোমাকে ধোঁকাও দেব না, কষ্টও দেব না। তুমি সুস্থ হও। ডাক্তার বলেছেন, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইলে চিকিৎসা করাতাম না, এ অবস্থায়ই জেলে পাঠিয়ে দিতাম। লবণ ছড়িয়ে দিতাম তোমার ক্ষতস্থানে। তুমি চিৎকার দিয়ে অপরাধ স্বীকার করতে। বলে দিতে সংগীদের নাম। কিন্তু আমরা মেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করি না। আল বারকের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। তুমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো আমি।’
‘সুস্থ হলে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন?’
‘তুমি যুবতী এবং সুন্দরী’ এখানকার কোন পুরুষ তোমাকে সে চোখে দেখবে না। মনের সকল সন্দেহ মুছে ফেল। তোমার সাথে ব্যবহার হবে ইসলামী বিধান অনুযায়ী।
অভিজাত ওই বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হল। কারো বসতবাড়ী নয় ওটা। বাড়ীটি ছিল খ্ৰীষ্টান গোয়েন্দাদের আড্ডাখানা। ভেতরেই ছিল আস্তাবল। ওখান থেকে পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হল।
এ পাঁচজন এবং পলায়নকারী চারজন কোন জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করল। ওদূের পাঠানো হল নির্দিষ্ট কক্ষে, যেখানে পাথরও মুখ খুলতে বাধ্য হয়।
শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ স্বীকার করল, মেয়েটাকে দিয়ে সে-ই আল বারককে ফাঁসিয়েছে। প্রথম থেকে পুরো ঘটনা শোনাল সে। অন্যরাও বলতে বাধ্য হল। মানুষ যে বাড়ীকে সম্মানের চোখে দেখত, সেখানে ছিল অনেকগুলো মেয়ে। গুপ্তচরবৃত্তি, সরকারী কর্মকর্তাদের ফাঁসানো এবং যুবকদের চরিত্র হননের জন্য ওদের ব্যবহার করা হত।
ওরা বলল, ফৌজে নিজের লোক ভর্তি করে ওরাই সৈন্যদেরকে জুয়া, চুরি এবং ব্যভিচারে অভ্যস্ত করে তুলেছে। শহরে ছড়িয়ে দিয়েছে পাঁচশরও বেশী পতিতা। মিনি পতিতালয় খুলেছে। সুদানীদের উস্কানি দিয়েছে বিদ্রোহ করার জন্য।
ওরা প্রশাসন এবং ফৌজের বড় বড় ক’জন অফিসারের নাম বলল। এসব অফিসার সুলতানের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
আছেফা ছিল খ্ৰীষ্টান। নাম ফিলমেংগো। বাড়ী গ্রীসে। তের বছর বয়স থেকে তাকে ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়। তাকে শেখানো হয়েছে বিভিন্ন ভাষা, মিসরের সংস্কৃতি, আচার আচরণ।
মুসলমানদের এলাকায় কাজ করার জন্য এরকম হাজার হাজার মেয়ে তৈরী করা হয়েছে। অনেককে এদিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর অকপটে সবই বলেছে আছেফা, কিছুই গোপন করেনি।
আছেফা সম্পূর্ণ সুস্থ হল পনের দিন পর। তাকে বলা হল, তোমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।
সে বলল, আমি সন্তুষ্ট চিত্তে এ শাস্তি গ্রহণ করছি। আমি ক্রুশের মিশন সফল করেছি।’
ওকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হল। অন্যদের এখনো প্রয়োজন ছিল। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী অনেক লোক ধরা হল। এদের দু’একজন ছিল মুসলমান। সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হল।
আল বারককে দেয়া হল একশ বেত্ৰাঘাত।
তিনি সইতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পর সরকার তার সন্তানদের দায়িত্ব গ্রহণ করল।
তার বাড়ীতে সরকারী খরচে চাকর বাকর এবং কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হল। ওরা আল বারকের সন্তান নয়, এক শহীদ মায়ের সন্তান।
.
১১৭১ এর জুন। মরুভূমির সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপে জ্বলছিল মিসর। সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছে খলিফা আল আযেদের দূত এসে বলল, ‘খলিফা আপনাকে স্মরণ করছেন।’
কেন ডেকেছেন বলেছেন কিছু?’
‘জ্বী, না।’
মেজাজ বিগড়ে গেল আয়ুবীর। দূতকে বললেন, ‘খলিফাকে আমার সালাম দিয়ে বলে তিনি খুব ব্যস্ত। তাঁকে আরো বলো, আমার সামনে যে কাজ পড়ে আছে তা খলিফার কাছে হাজির হওয়ার চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তবে জরুরী কোন কিছু হলে তিনি যেন তা জানিয়ে তলব করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া খোশগল্প করার জন্য দরবারে হাজিরা দেয়ার সময় আমার নেই।”
দূত ফিরে গেল।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী কক্ষে পায়চারি করতে লাগলেন। চোখে মুখে তার উৎকণ্ঠা।
তখন ফাতেমী খেলাফতের যুগ। খলিফারা ছিলেন সম্রাটের মত। জুম্মার খোতবায় আল্লাহ এবং রাসুলের (সা.) নামের সাথে তাদের নামও উচ্চারণ করতে হত। এসব খলিফারা ছিল বিলাসপ্রিয়, নারী ও মদে মাতোয়ারা।
নুরুদ্দীন জংগী এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী না থাকলে এরা হয়ত মুসলিম দেশগুলোকে বিক্রি করে ফেলত।
আল আযেদও ছিলেন এমন একজন খলিফা। সালাহউদ্দীন আয়ুবী মিসর আসার পর তাকে তিনি কয়েক বারই ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনিও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে খলিফার দরবারে ছুটে গেছেন। কিন্তু ওখানে স্রেফ গল্পগুজব ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
আয়ুবী যেন নিজেকে দেশের প্রধান মনে না করেন, খলিফা হলেন দেশের সর্বেসর্বা। আয়ুবীকে এ অনুভূতি দেয়ার জন্যই এত ডাকাডাকি।
কিন্তু খলিফা আল আযেদ, আয়ুবীকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য আয়ুবীকে ভালও বাসতেন। আয়ুবী গেলে তাকে কাছে বসিয়ে কথা বলতেন। তবে আচরণে হামবড়া একটা ভাব থাকত। কথাবার্তায় প্রকাশ পেত রাজকীয় দেমাগ। যতবারই আয়ুবীকে ডেকেছেন, প্রয়োজনীয় কোন কথা বলেননি তিনি।
খ্রিষ্টানদের পরাজিত এবং সুদানীদের বিদ্রোহ দমনের পর আয়ুবী খলিফাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। খলিফার প্রাসাদের শান-শওকত আয়ুবীর মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি ভাবতে পারতেন না, মূল্যবান তৈজষপত্র, কারুকার্যখচিত স্বর্ণের প্লেট গ্লাস আর হীরা-মুক্তা বসানো মদের সোরাহী ও পানপত্র সংগ্রহ করাই কোন খলিফার একমাত্র কাজ হতে পারে।
পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার কঠিন দায়িত্ব যে খলিফার ওপর ন্যস্ত, কি করে তার হারেম ভরা থাকে সুন্দরী তরুণীতে, এ কথা কিছুতেই বুঝতেন না আয়ুবী। অথচ আরব, মিসর, মরক্কো, সুদান এবং তুরস্ক ছাড়াও খলিফার হারেমে থাকত ইহুদী এবং খ্রিষ্টান মেয়ে। এটাই ছিল সে সময়ের বিলাসপ্রিয় খলিফাদের প্রাসাদের চিত্র।
আল আযেদের দেহরক্ষীদের সবাই ছিল সুদানী। ওমরাদের মধ্যেও ছিল বিদ্রোহী সুদানী বাহিনীর কমান্ডার এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। আয়ুবী এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আয়ুবীর নির্দেশে খলিফা আল আযেদের প্রাসাদ কর্মচারীদের সাথে গুপ্তচরদের অন্তৰ্ভূক্ত করলেন আলী বিন সুফিয়ান। হারেমের দু’জন মেয়েও হাত করে নেয়া হল।
ওদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রমানিত হল, খলিফা সুদানীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন। ষাট পয়ষট্টি বছর বয়সেও যুবতীদের মাহফিলেই সময় কাটতেন তিনি। আর তাঁর এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল আয়ুবী বিরোধী সুদানী ও অন্যান্যরা।
১১৭১ এর দ্বিতীয় কি তৃতীয় মাসে খলিফার হারেমে এল নতুন এক যুবতী। খাপখোলা তলোয়ারের মত ঝলসানো রূপ। যেমন রূপ তেমনি প্রাণবন্ত ও সপ্রতিভ।
তাকে নিয়ে এসেছিল আরবী পোষাক পরা চার ব্যক্তি। সাথে ছিল প্রচুর উপটোকন সামগ্ৰী। মেয়েটাও উপহার হিসেবেই এসেছে। নাম উন্মে আমারা। যেমন চৌকস তেমনি বুদ্ধিমতী। অল্প ক’দিনেই রূপের চমক আর মুখের যাদু দিয়ে মেয়েটা খলিফাকে বশ করে ফেলল।
আয়ুবী রাজপ্রাসাদের সব অপকর্মের কথা জানতেন। কিন্তু তখনও ক্ষমতায় বাগডোর মজবুতভাবে ধারণ করতে পারেননি বলে খলিফার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছিলেন না।
পূর্বের গভর্ণররা সব সময় খলিফার সামনে নত হয়ে থাকত। এতে মিসর হয়ে পড়েছিল বিদ্রোহীদের স্বৰ্গরাজ্য। নামে ইসলামী খেলাফত হলেও সেখানে ইসলামের পতাকা মাটিতে লুটাচ্ছিল। খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলিম সেনাবাহিনীর বড় বড় অফিসারদের ছিল গোপন সম্পর্ক। এরাই কায়রো এবং ইস্কান্দারিয়ায় ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের পূর্নবাসন করেছিল।
সুদানী সেনাবিদ্রোহ দমন করলেও তাদের কিছু জেনারেল চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারত। রাজপ্রাসাদের সাথে এদের ছিল গভীর সম্পর্ক। তাছাড়া দেশের কিছু মানুষ তখনও খেলাফতকে মনে করত ইসলামের রক্ষক। ওরা খলিফাকে সম্মান করত। আবার কিছু ছিল যারা এ আবেগকে আহত করতে চাইতেন না।
এ ছাড়া চাটুকার ও খোশামুদে তো ছিলই। গভর্নর হওয়ার স্বপ্ন দেখত ওরা। কিন্তু ওদের আশার গুড়ে বালি দিলেন আয়ুবী।
ওদের চর দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়েছিল। খ্রিষ্টানদের আক্রমণের ভয় ছিল বলে সালাহউদ্দীন আয়ুবী এদের বিরুদ্ধে তখনো কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
সার্বিক পরিস্থিতি ভালভাবে জানা থাকায় আয়ূবী বিলাসী খলিফাকে ঘাটাতে চাননি। কিন্তু এবার খলিফার কাছে যেতে তিনি সরাসরি অস্বীকার করলেন।
দূত বেড়িয়ে যেতেই সালাউদ্দিন আয়ুবী প্রহরীকে ডেকে বললেন আলী বিন সুফিয়ান, বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ, মুফতি ঈসা আল হুকারী এবং আল নাসেরকে এক্ষুণি আমার কাছে আসতে বল।
***
কয়েক মিনিট পর। সালাহউদ্দীন আয়ুবীর চারজন বিশিষ্ট সভাসদ বসে আছেন সুলতানের সামনে। আয়ুবী বললেন, আপনাদেরকে আজ এক বিশেষ উদ্দেশ্যে ডেকে এনেছি। এই মাত্র খলিফার দূত আমাকে নিতে এসেছিল। আমি যাইনি। ইসলামের নামে ভোগ-বিলাস, নারী আর মদে ডুবে থাকতে খলিফাকে আমরাই সুযোগ করে দেই। পাপাচার না করেও আমরা হই পাপাচারের অংশীদার।
আল্লাহর হুকুম এবং রাসুল(সঃ) এর সুন্নাহর বিরুদ্ধে চলার অধিকার আমাদের নেই, অথচ আমরা তাই করে চলেছি। আমি মনে করি পাপ করা আর পাপের দোসর হওয়া সমান অপরাধ। তাই পাপ না করেও পাপের দোসর হিসাবে আমরা খলিফার মতই অপরাধী।
এ পথ থেকে আমাদের সরে দাঁড়ানো উচিত। এখন থেকে তাই আমি জুম্মার খোৎবা থেকে খলিফার নাম বাদ দিতে চাই। এ ব্যাপারে আপনাদের অভিমত কি?’
‘পদক্ষেপটা সময়ের আগে হয়ে যাচ্ছে না,’ শাদ্দাদ বললেন। ‘খলিফাকে মানুষ নবীর মত সম্মান করে। এতে হয়ত সাধারণ মানুষ ক্ষেপে যেতে পারে।’
‘এখন নবীর মত সম্মান করে,’ সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘ক’দিন পর তাকে খোদা ভাববে। আমরা যারা আল্লাহ এবং রাসূলের (সা.) নামের সাথে তার নাম জুড়ে দিচ্ছি, তারাই তাকে খোদা এবং নবীর আসনে বসিয়েছি। এ অপরাধ যতটুকু না তাঁর তারচেয়ে বেশী অপরাধী আমরা।”
‘আমি একমত।’ বললেন মুফতি ঈশা, ‘খোৎবায় আল্লাহ এবং রাসূলের সাথে মানুষের নাম উচ্চারিত হবে কোন মুসলমান তা সহ্য করতে পারে না। তাও এমন একটা লোক, যে মদ্যপ এবং ব্যাভিচারী। এতদিন খলিফাকে নবীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে সে ভিন্ন কথা, আমি শহরের ধর্মীয় ইমাম হিসাবে সুলতানের সাথে একমত পোষণ করছি। তবে খোৎবা থেকে খলিফার নাম বাদ দিলে রাজনীতি বা সেনাবাহিনীতে কি প্রতিক্রিয়া হবে তা আপনারা জানেন।’
‘প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক।’ শাদ্দাদ বললেন, ‘বিরোধিতা কেবল খেলাফতের পক্ষ থেকেই আসবে না, খেলাফতের সুবিধাভোগীরাও এর বিরুদ্ধে কোমর বেধে নামবে। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন মানুষকে আমরা অন্ধকার ও কুসংস্কারে ডুবিয়ে রাখতে পারিনা।
হকের পথে চলতে চাইলে এটুকু ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। ঝুঁকি ছাড়া কোন বিকল্প ছিলনা কোন কালে এখনো নেই। আমি চাই এ কুসংস্কার দূর হোক, প্রয়োজনে সাহসিকতার সাথে আমরা উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করব।”
আমরা একটি বেদয়াত থেকে মুক্তি চাইছি। যদি খলিফাকে সোজা পথে আনা সম্ভব হতো তবে হয়তো আমরা এ ঝুঁকি এড়াতে পারতাম। কিন্তু আমরা সবাই জানি তা কখনো হবার নয়। খলিফার মন রক্ষা করার চাইতে শরিয়ত পালন করা অনেক বেশি জরুরী,’ মুফতি ইশা আবারো কথা বললেন।
‘সাধারণ মানুষের মতামত আমি বেশী জানি’, গোয়েন্দা প্রধান আলী বললেন, ‘ওরা খলিফাকে চেনেনা, কখনও খলিফার চেহারাও দেখেনি। আমি হলপ করে বলতে পারি, সাধারণ মানুষ খলিফার চাইতে সালাহউদ্দীন আয়ুবী নামের সাথে বেশী পরিচিত এবং তাকে তারা ভালও বাসে।’
তিনি আরো বললেন, ‘আমার ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী আপনার দু’বছরের শাসনামলে মানুষ তাই পেয়েছে, যার আশাও তারা করেনি। শহরে কোন ক্লিনিক বা হাসপাতাল ছিলনা। সামান্য রোগেও মানুষ মারা যেত। এখন সরকারী ভাবে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্ত। ছিনতাই, রাহাজানি এবং সন্ত্রাস নেই। অন্যান্য অপরাধের পরিমানও কম। ইচ্ছে করলেই মানুষ আপনার কাছে যে কোন অভিযোগ পৌঁছাতে পারে।
আপনি আসার আগে মানুষ সরকারী আমলা, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে ভীষণ ভয় করত। ওরা এখন নিজেকে জাতি এবং দেশের অংশ মনে করে।
খেলাফত ওদের দিয়েছে অন্যায় এবং নির্যাতন, আপনি দিয়েছেন ন্যায় ইনসাফ এবং অধিকার। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, সাধারণ মানুষ খেলাফতের নয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তই মেনে নেবে।’
‘জানিনা আমি দেশে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কিনা। মানুষকে তার অধিকার দিতে পেরেছি কিনা তাও আমার জানা নেই, কিন্তু জাতিকে এক অপ্রয়োজনীয় কু-সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখতে পারিনা আমি, চলতে দিতে পারিনা শিরক এবং কুফরী। যে কুসংস্কার ধর্মের অঙ্গ হয়ে গেছে, তা ভেংগে টুকরো টুকরো করে ফেলা আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করি। না হলে এর থেকে জন্ম নেবে আরো পাপ, আর সে পাপের দায়ভাগ পোহাতে হবে আমাকে।
এ নিয়ম চলতে থাকলে দেখা যাবে কাল আমিও খোৎবায় আমার নাম জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। এক প্রদীপ থেকে আরেক প্রদীপ জ্বালানো হয়। যে দ্বীপ শিখা শিরকের পথ আলোকিত করে আমি সে দ্বীপ নিভিয়ে দিতে চাই।’
মনযোগ দিয়ে কথা শুনছেন চার প্রধান সভাসদ। তাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী।
তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, ‘আপনাদের কারো অজানা নয় যে, রাজপ্রাসাদ এখন ব্যাভিচারের আখড়ায় পরিনত হয়েছে। সুদানীরা যে রাতে আমাদের আক্রমণ করেছিল, সে রাতেও হারেমে মেয়েদের সাথে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে ছিলেন খলিফা। খোদার সৈনিকেরা যখন শহীদ হচ্ছিল তখনও তার হাতে ছিল মদের পিয়ালা। আপনারা সেদিন ব্যর্থ হলে ইসলামের পতাকা মিসর থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিত।
নিয়ম অনুযায়ী খলিফাকে সব কিছু অবহিত করা দরকার বিজয়ের পর আপনাদের পক্ষ থেকে বিজয়ের খবর নিয়ে আমি গিয়েছিলাম খলিফার দরবারে। তিনি সে বিজয়ের খবর শুনে তিনি কি করলেন? মাতাল ষাঁড়ের মত চিৎকার করে তিনি বললেন, শাবাশ! আমি খুব খুশী হয়েছি। আমার বিশেষ দূতের মাধ্যমে তোমার কাছে উপহার পাঠাব।’
আমি বললাম, খলিফাতুল মুসলেমিন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আপনাকে বা আমার পিতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়, বরং আল্লাহ এবং রাসুলকে খুশী করার জন্য আমার ওপর যে কর্তব্যের বোঝা আপনি দিয়েছিলেন আমি তা পালন করেছিমাত্র।’
বৃদ্ধ খলিফা বললেন, ‘সালাহউদ্দীন, তুমি এখনও শিশু, কিন্তু কাজ করেছ বড়দের মত ’ এমনভাবে কথা বললেন যেন আমি তার চাকর। ” অপ্রিয় হলেও আমি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য এরা শ্বেতহস্তি বিশেষ, যা পোষার জন্য ব্যয় হয় প্রচুর, কিন্তু মানবতার জন্য তা কোন কাজে আসে না।”
সালাহউদ্দীন আয়ুবী পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, এটা নুরুদ্দীন জংগীর চিঠি। পাঁচ ছ’দিন আগে পেয়েছি আমি। তিনি লিখেছেন,
“খেলাফত তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাগদাদের অধিনস্ত দু’জন খলিফার ওপর এখন কেন্দ্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মিসরের খলিফাও যেন কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। প্রয়োজনে সে খ্রিস্টান বা সুদানীদের সাথে গাঠছড়া বাঁধতে কুণ্ঠিত হবেনা। আমি ওদের ষড়যন্ত্রের আশংকা করছি। মিসরের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও ভাল নয়, ওখানে আরেকটি বিদ্রোহের সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য সতর্কতা জরুরী।
মিসরের খলিফাকে তার তৎপরতা প্রাসাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করবেন। খ্রিস্টানদের সহযোগিতা নিয়ে তিনি যেন মুসলিম বিশ্বের কোন অনিষ্ট করতে না পারে সে ব্যাপারে আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে যে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করবেন না। আমি আপনাকে সামরিক এবং আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি। সুদানীদের প্রতিও কড়া দৃষ্টি রাখবেন।
-নূরুদ্দীন।
চিঠিপড়া শেষ করে আয়ুবী বললেন, খলিফা যে শ্বেতহস্তি এতে সন্দেহ নেই। আপনারা দেখেছেন, খলিফা ভ্রমণে বের হলে অর্ধেক ফৌজকে ছড়িয়ে দেয়া হয় তার নিরপত্তা দেখার জন্য। তার চলার পথে গালিচা বিছিয়ে দেয়ার জন্য, ফুল ছোঁড়ার জন্য জনগণকে বাধ্য করা হয়। তার ভ্রমণের জন্য অপব্যয়ের টাকা জনকল্যাণে এবং দেশরক্ষার কাজে ব্যয় হতে পারত।” জনগণ এবং বিভিন্ন ধর্মের লোকদের বোঝাতে হবে যে, ইসলাম শুধু রাজা বাদশার ধর্ম নয়, ইসলাম মরুচার বেদুঈন কৃষক-শ্রমিক এবং খেটে খাওয়া মানুষের ধর্ম। আল্লাহ মানুষকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, ইসলাম মানুষকে সে মানবতাই শিক্ষা দেয়।
সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বক্তব্য শেষ হলে কথা বললেন বাহাউদ্দীন শান্দাদ, নিজে শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্যই খলিফার বিরোধিতা করছেন আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসতে পারে।’
‘সত্য সবসময় বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে,’ বললেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। ‘আজকে মিথ্যা এবং বাতিলের শিকড় এতটা মজবুত হতে পেরেছে এজন্য যে, বিরোধিতার ভয়ে লোকেরা সত্য বলা আজ ছেড়েই দিয়েছে। বুকের ভেতর আটকে গেছে সত্যের কন্ঠ। রাজকীয় বিলাস-ভ্রমণ এবং বাদশাহী দাপট প্রজাদের স্বাধীন চেতনা হরণ করেছে। সাধারণ মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে, মানুষের উপর জোর করে বাদশাহী চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে এমন শিকলে বাঁধা হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) যে শিকল ছিড়ে টুকরো টুকরো করেছিলেন।
আমাদের রাজারা জাতিকে পতনের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। ভোগ বিলাসের জন্য তারা খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করছেন। ওদের ভোটগ্ৰহণ করছেন। ফলশ্রুতিতে খ্রিষ্টানরা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। আপনি বিরোধিতার কথা বলেছেন শাদ্দাদ। এ বিরোধিতায় ভয় পেয়ে সত্যকে তুলে ধরা থেকে পিছিয়ে থাকলে আল্লাহ যেদিন পাকড়াও করবেন সেদিন কি জবাব দেবেন?’
‘মহামান্য আমীর’ সামরিক প্রধান আল নাসের বললেন, ‘আমরা বিরোধিতাকে ভয় পাই না। আপনি আমাদের যুদ্ধের ময়দানে দেখেছেন। অবরুদ্ধ হয়েও নিঃশঙ্কচিতে লড়াই করেছি আমরা। যুদ্ধ করেছি ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ে। যখন আমরা নগন্য ছিলাম তখনও শত্রুর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে দিয়েছি। সুলতান! আপনার একটা কথা সবসময়ই মনে পড়ে আমার। আপনি বলেছিলেন, ‘বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব কিন্তু ভেতর থেকে আক্রান্ত হলে চমকে গিয়ে ভাবতে হয়, এসব কি হচ্ছে। শাসক যখন দেশের দুশমনে পরিণত হবে তখন আপনার তরবারী খাপের মধ্যেই নিশপিশ করবে, বাইরে আসতে পথ পাবে না।’
আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার তরবারী কোষের ভেতরই নিশপিশ করছে, শাসকদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত হতে চায় না। শাসকদের আমি সব সময়ই সম্মান করি। শাসকরা জাতির গৌরব, দেশের অহংকার। বলতে পারেন, আমাদের শাসকদের কি সে সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে?
আমি শুধু খলিফা আল আযেদের কথাই বলছি না। আলীকে জিজ্ঞেস করুন। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী হলব, মুসেল, দামেস্ক, মক্কা এবং মদিনার খেলাফতও ভোগ বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ওখানকার আমীর এবং গভনররা নিজেরাই স্বাধীন শাসক। খেলাফত এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, আমীর ওমরা এবং গভর্নররা তাকে নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে।
আমি জানি, এ ছিন্নভিন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে গেলে এরা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের সামনে বাঁধার পাহাড় দাড় করাবে। এরপরও আমি ভীত নই। আমার বিশ্বাস আপনারাও এতে ভয় পাবেন না। আপনাদের মতামতকে আমি সম্মান করি। আগামীতে কোন সুনির্দিষ্ট জরুরী কাজে ডাকলেই কেবল আমি খলিফার ডাকে সারা দেব। এখন থেকে খোৎবায় আর খলিফার নাম থাকবে না।”
সুলতানের সাথে একমত হলেন সবাই। এরপর সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যে যার কাজে ফিরে গেলেন।
খলিফার খাস কামরা। দূত ফিরে গিয়ে বলল, ‘কোন জরুরী কাজ থাকলে সালাহউদ্দীন আয়ুবী আসবেন। এখন তিনি ভীষণ ব্যস্ত। কি জন্য ডেকেছেন তা জানাতে বলেছেন তিনি।’
খাস কামরায় খলিফার পাশে বসেছিল উম্মে আমারা। দূতের মুখে সালাহউদ্দীন আয়ুবীর জবাব শুনে সে বলল, ‘সালাহউদ্দীন আপনার নফর। আপনিই তাকে মাথায় চড়িয়েছেন। এ বেয়াদবকে পদচ্যুত করছেন না কেন? সৈন্য পাঠিয়ে কেন তাকে বন্দী করছেন না?’
‘পরিনাম ভাল হবেনা বলেই তাকে পদচ্যুত করছি না। খলিফার কণ্ঠে ক্ষোভ। সেনাবাহিনী তার হাতে। সে আমার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে।’
রজব ছিল সুদানী বাহিনীর এক সালার। বর্তমানে খলিফার গার্ড বাহিনীর কমান্ডার। গার্ড বাহিনীর সবাই ছিল সুদানী কাফ্রী। রজবই ওদের বাছাই করেছিল। সে ছিল চাটুকার এবং সুলতান আয়ুবীর ঘোর বিরোধী।
দূতের খবর শুনেই তাকে ডেকে পাঠালেন সুলতান। রজব এসে কুর্নিশ করে দাঁড়াল একপাশে।
ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে খলিফা বললেন, ‘সালাহউদ্দীন আয়ুবী! আমি আগেই জানতাম কমবখত স্বাধীনচেতা বেয়াড়া। আমি তাকে ডেকেছিলাম, সে আসতে অস্বীকার করেছে। বলেছে কোন জরুরী কাজ থাকলে আসবে, নয়তো তার কাছে আমার ডাকের কোন গুরুত্ব নেই। এখন তার হাতে নাকি খুব জরুরী কাজ….’
বলতে বলতে খলিফার হেঁচকি উঠল। সাথে কাশি। দুহাতে বুক চেপে ধরলেন তিনি। বিবর্ণ হয়ে গেল চেহারা। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি যে অসুস্থ বদবখত তাও দেখল না। আমি হার্টের রোগী। রাগ করা ঠিক না। আমি শরীর স্বাস্থ্যের চিন্তায় অস্থির, আর সে আছে জরুরী কাজ নিয়ে।’
‘আপনি তাকে কেন ডেকেছিলেন আমাকে বলুন।’
‘ডেকেছিলাম যেন সে বুঝে তার উপরও একজন আছে,’ বুক চেপে কাৎরাতে কাৎরাতে বললেন খলিফা। ‘তুমি বলেছিলে সে স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। আমি বার বার তাকে এখানে ডেকে আনতে চাই। চাই নির্দেশ দিতে যেন সে আমার সামনে মাথা নুইয়ে রাখে। কোন জরুরী কাজ হলেই তাকে ডাকব এমন তো কথা নেই।’
উম্মে আমারা মদের পেয়ালা খলিফার ঠোঁটের সামনে তুলে ধরল।
আপনাকে একশ বার বলেছি রাগ করবেন না। হৃদরোগের জন্য রাগ ভীষণ ক্ষতিকর।
একটা স্বর্ণের কৌটা থেকে কিছু পাউডার জাতীয় জিনিস খলিফার মুখে তুলে দিল মেয়েটা। খলিফা তার রেশম কোমল চুলে বিলি কেটে বলল, ‘তুমি না থাকলে এতদিনে আমি মরেই যেতাম। সবার আকর্ষণ আমার সম্পদ আর আমার মর্যাদার সাথে। আমার কোন স্ত্রীও আমাকে ভালবাসে না। তুমি আছ বলেই আজো বেঁচে আছি।
‘খলিফাতুল মুসলেমীন।’ রজব বলল, ‘আপনার মনটা খুব নরম। ভীষণ ভাল মানুষ আপনি। এ জন্যই সালাহউদ্দীন এত সাহস পায়। সে যে আরব বা ফাতেমী বংশের নয় বরং একজন কুর্দি, তা আপনি ভুলেই গেছেন। বাইরের লোককে এত বড় পদ না দিলে আজ এমন সমস্যা দেখা দিত না। মানি, সে একজন ভাল সৈনিক। সে যুদ্ধ করতেও জানে, করাতেও জানে, শুধু এজন্যেই তাকে মিসরের গভর্নর করতে হবে?’
খলিফা মন দিয়ে তার কথা শুনছে দেখে সে বলল, ‘একবারও কি ভেবে দেখেছেন, সেনাবাহিনীতে যখন সুদানীরা ছিল, নাজি এবং এডরোসের মত সেনাপতি ছিল, তখন প্রজারা আপনার কুকুরের সামনেও মাথা নোয়াত। আপনার নির্দেশ পালনের জন্য এক পায়ে খাড়া থাকত সুদানী সালাররা। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, অধিনস্তকে ডাকলেও সে আসতে সরাসরি অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখায়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, সুদানীদের এতবড় ফৌজকে যে খেলনার মত নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, কোন দিন জানি সে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।’
‘রজব!’ গর্জে উঠলেন খলিফা। ‘এ জন্য তুমিই দায়ী।’
রজবের চেহারার রং বদলে গেল। চমকে সরে গেল উম্মে আমারা। খলিফা তাকে টেনে জড়িয়ে ধরে মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘ভয় পেয়েছে? আমি রজবকে বলতে চাইছি, আইয়ুরীর তৈরী ফৌজের চেয়ে আগের ফৌজ ভাল ছিল ও আমাকে আগে বলেনি কেন? চুপ করে আছ কেন রজব? গভর্নর যখন তার আসন পাকাপোক্ত করেছে তখন বলছ এরা খেলাফতের দুশমন।’
‘আপনি রাগ করবেন ভেবে ভয়ে বলিনি। আপনার সাথে পরামর্শ করে বাগদাদের খলিফা আয়ুবীকে পাঠিয়েছে, আমি খেলাফতের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন সাহসে মুখ খুলব। আজ আপনার সাথে গভর্নরের ঔদ্ধত্বের কারনেই শুধু বলেছি।
আমি কয়েকদিনই সালাউদ্দিনকে হুজুরের সাথে বেয়াদবি করতে দেখেছি। যে কোন বিপদ সম্পর্ক আপনাকে অবহিত করা এবং আপনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য।”
উন্মে আমারা খলিফার গালে গাল ঘসছিল। কিছুক্ষণ খেলা করল আঙ্গুল নিয়ে। এরপর দু’হাত খলিফার দুগলে রেখে মুখের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল, ‘শরীর ঠিক হয়েছে?’
খলিফা মেয়েটার চিবুক নেড়ে বললেন, ‘ওষুধের চাইতে তোমার আদরের প্রভাব অনেক বেশী। খোদা তোমাকে যে রূপ ও আবেগ দিয়েছেন আমার রোগ মুক্তির জন্য তাই যথেষ্ট।’
মেয়েটার মাথা নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে রজবের দিকে তাকালেন। ‘রজব! পরকালে আমাকে যখন বেহেস্তে দেয়া হবে, আমি খোদার কাছে হুরের বদলে উম্মে আমারাকে চাইব।’
‘উম্মে আমারা শুধু সুন্দরী নয়, বুদ্ধিমতী এবং মেধাবী। হুজুরের প্রাসাদতো যড়যন্ত্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ও এসে সব ঠিক করেছে। এখন কেউ কারো বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটি করতে পারে না।’
রজব সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বিরুদ্ধে খলিফার কান ভারী করতে লাগল। উন্মে আমারা বলল, ’ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং সালাহউদ্দীনের একটা বিহিত করুন।’
‘তুমি কি বলছিলে রজব!’
‘গভর্নরের বিরুদ্ধে কিছু বললে আপনি রাগ করবেন ভেবে মুখ খুলিনি। সালাহউদ্দীন একজন যোগ্য সেনাপতি।
তার এ গুণটা আমার খুব পছন্দ। যুদ্ধের মাঠে সে ইসলামের পতাকা অবনমিত হতে দেয়না। যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম বিশ্বের মর্যাদা রক্ষা করার মত এমন একজন সেনাপতিই আমাদের প্রয়োজন।
আমি ক্ষমা চাইছি খলিফাতুল মুসলেমিন! খেলাফত আমাদের যুদ্ধের ময়দানে পরীক্ষা করেনি। সালাহউদিনের ব্যাপারে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সে মুসলিম বিশ্বের জন্য লড়াই করছেনা, করছে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য।
যে কোন সৈনিককে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সে এমন রাজ্যের জন্য যুদ্ধ করে যার কোন সীমা থাকবে না। এতে বুঝা যায়, সে নিজেই বাদশা হতে চাইছে। তাকে সহযোগিতা করছে নুরুদ্দীন জংগী। আয়ুবীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য সে দু’হাজার অশ্বারোহী এবং দু’হাজার পদাতিক সৈন্য পাঠিয়েছে। সৈন্য পাঠাতে জংগী কি বাগদাদের খলিফার অনুমতি নিয়েছিল? মিসরে ফৌজি সাহায্য প্রয়োজন আছে কিনা, আপনাকে কেউ কি একথা জিজ্ঞেস করেছিল? যা হয়েছে সব খেলাফতের অজান্তে।’
‘তুমি ঠিকই বলছ। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি। এখন মনে পড়ছে ফৌজতো ফিরেও যায়নি।’
‘পুরনো সৈন্যদের কৃষক এবং ভিখিরী বানানোর জন্যই এ সাহায্য এসেছিল। নাজি, এডরোস, কাকিশ, আবদ, ইয়াজদাম, আবি আজরের মত সেনানায়করা এখন কোথায় হুজুর কখনো ভাবেননি। আয়ুবী এদের গোপনে হত্যা করেছে। ওদের অপরাধ ওরা আয়ুবীর চাইতে যোগ্য। এ হত্যার জন্য দায়ী কে? সালাহউদ্দীন প্রশাসনের লোকদের সামনে বলেছে মিসরের খলিফা এদেরকে গাদ্দারী এবং বিদ্রোহের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন।’
“মিথ্যে কথা’, খলিফা খেকিয়ে উঠলেন, ‘ঢাহা মিথ্যা কথা। সালাহউদ্দীন আমাকে বলেছিল এরা দেশদ্রোহী। আমি বলেছি, সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে মামলা কর।’
‘অথচ কি আশ্চর্য, মামলা না করে সে নিজেই বিচারকার্য শেষ করল, খলিফার অনুমোদন পর্যন্ত নিল না। খলিফার অনুমোদন ছাড়া কোন রায় যে কার্যকরী করা যায় না এ কথা কি তার জানা ছিলনা?
সে সব হতভাগ্য সেনাপতিদের অপরাধ তারা খ্রিষ্টান সম্রাটদের সাথে সুসম্পর্ক গড়েছিল। তারা চেয়েছিল যুদ্ধ বন্ধ করতে। যুদ্ধ কোন জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না, খ্রিষ্টানরা আমাদেরকে শক্ৰ মনে করে না। নুরুদ্দীন জংগী এবং শেরে কুহীর আক্রমণের ভয়েই ওরা যুদ্ধের জন্য তৈরী থাকে। শেরে কুহী মরে গিয়ে আয়ুবীকে তার স্থানে রেখে গেছে। এ লোকটার জীবন কাটবে খ্রিস্টানদের সাথে যুদ্ধ করে। এতে আমাদের শক্র সংখ্যাই বৃদ্ধি পাবে। সালাহউদ্দীনের স্থানে অন্য কেউ গভর্নর হলে খ্রিস্টান রাজারা আপনার, কাছে আসতো বন্ধু হয়ে। এত রক্তপাত হতোনা। এভাবে হারিয়ে যেতনা আমাদের অভিজ্ঞ সেনাপতিরা।’
‘তাহলে রোম উপসাগরে খ্রিস্টানরা আক্রমণ করল কেন?’
‘সালাহউদ্দীন আয়ুবী ওদেরকে আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য করেছে। আক্রমণ হচ্ছে সে জানল কিভাবে? আসলে সে-ই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। প্রতিরোধের ব্যবস্থাও পূর্ব থেকেই করে রেখেছে। না হয় সে কি ফেরেস্তা যে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারবে?
তার কারণে হাজার হাজার শিশু পিতৃহীন হয়েছে। বিধবা হয়েছে অসংখ্য নারী। অথচ আমার সামনেই আপনি তাকে ধন্যবাদ দিলেন।
সুদানী ফৌজ ছিল আপনার অনুগত। রাতের অন্ধকারে সে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিল, এজন্যও আপনি তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। আসলে আপনি খুব সহজ সরল। কারও ধোঁকা আর প্রতারণা বুঝতে পারেন না।’
খলিফার সাথে মেয়েটার অশ্লীল তৎপরতা তার মদের পিপাসা বাড়িয়ে দিল। খলিফা এখন তার হাতের পুতুল। রজবের প্রতিটি কথা তাঁর মনের গভীরে দাগ কাটতে লাগল।
উম্মে আমারার প্রতি খলিফার দৃষ্টি নিবন্ধ, এ সুযোগে রজব আয়ুবীর উপর একটা মিথ্যে আঘাত করল। বলল, ‘সালাহউদ্দীন এখন মেয়েদের নিয়ে শয়তানী শুরু করেছে। সুন্দরী মেয়েদের এনে কদিন আমোদ ফুর্তি করে। এরপর গুপ্তচরীর অভিযোগ এনে মেরে ফেলে। মারার সময় প্রচার করে, খ্রিষ্টানরা মিসরে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য এবং যুবকদের চরিত্র নষ্ট করার জন্য এসব মেয়েদের পাঠিয়েছিল।’
‘আমি এ শহরের মানুষ। এখানকার বেশ্যালয়গুলোতে রয়েছে মিসর এবং সুদানী মেয়ে। খ্রিস্টান দু’একটা মেয়ে থাকলেও গুপ্তচর নয়। ওরা পেশাজীবী। আমাকে হারেমের তিন চারটে মেয়ে বলেছে, আয়ুবী ওদের নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে নষ্ট করেছে।” উম্মে আমারা বলল।
খলিফার চোখ দুটো রাগে রক্তজবার মত লাল হয়ে উঠল। সগর্জনে তিনি বললেন, ‘আমার হারেমের মেয়ে! একথা আমাকে আগে বলনি কেন?”
‘আপনি অসুস্থ। এ খবর শুনলে আপনার শরীর আরো খারাপ হবে। এখন কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আমি এমন ব্যবস্থা করেছি, কেউ ডাকলেও কোন মেয়ে আর বাইরে যাবে না।’
‘আমি তাকে দোররা মারব, এর প্রতিশোধ নেব আমি।’
‘প্রতিশোধ নেয়ার অনেক পথ আছে।’ বলল রজব, ‘সাধারণ মানুষ এখন আয়ুবীর পক্ষে। কিছু করতে গেলে তারা আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে।’
‘এ অপমান কি আমি মুখ বুজে সহ্য করব?’
‘আপনার অনুমতি এবং সহযোগিতা পেলে সেনাপতিদের মত আয়ুবীকেও গুম করে দেয়া যাবে।’
‘কিভাবে করবে?”
‘ঘাতক দলের মাধ্যমে। তবে ওদের চাহিদা অনেক বেশী।”
‘যত টাকা লাগে আমি দেব। তুমি ব্যবস্থা কর।’
***
দুদিন পর জুম্মা। খোৎবায় খলিফার নাম না নেয়ার জন্য মুফতি ঈসা আল হুকারি খতিবকে অনুরোধ করেছিলেন। খতিব ছিলেন তুর্কি। ইতিহাসে তার পুরো নাম পাওয়া যায়না। আমিরুল আলম হিসেবে পরিচিত।
সে যুগের পুরনো দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, তিনি কয়েকবারই এ বিদআত বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কারও মতে সুলতান আয়ুবী তাকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন। দু’জন ঐতিহাসিকের মতে এ কৃতিত্বের দাবিদার মুফতি ঈসা। মূলতঃ এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। ধর্মগুরু হিসেবে তা বাস্তবায়ন করেছেন খতিব এবং মুফতি ঈসা।
জুম্মার দিন। মসজিদের মাঝামাঝি কাতারে বসেছেন সালাউদ্দীন আয়ুবী। আলী বিন সুফিয়ান বসেছেন আরো দুসারি পেছনে। আয়ুবীর উপদেষ্টা এবং কর্মকর্তারাও বসে আছেন বিভিন্ন স্থানে।
আলী সমগ্র মসজিদে গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছেন। খতিব মিম্বরে উঠলেন। খোৎবা পাঠ করলেন, খলিফার নাম নিলেন না। তার এ পদক্ষেপ খেলাফতের আইনের বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধ। নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেবল খলিফাই মসজিদে অনুপস্থিত ছিলেন।
নামাজ শেষ হল। উঠে দাঁড়ালেন সালাউদ্দীন আয়ুবী। খতিবের সাথে হাত মেলালেন। তার জুব্বায় চুমো খেয়ে বললেন, “আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন।’
খতিব বললেন, “এ নির্দেশ দিয়ে আপনি বেহেস্তে নিজের জন্য ঘর তৈরী করে নিলেন।”
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও কি ভেবে আবার দাঁড়ালেন আয়ুবী। খতিবকে বললেন, খলিফা আপনাকে ডাকলে সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমিও আপনার সাথে যাব।”
‘অপরাধ না নিলে বলব, বাতিল এবং শিরকের বিরুদ্ধে কাজ করা এবং হক কথা বলা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে আমি একাই শাস্তি ভোগ করব। এ জন্য আপনার সাহায্য নেবনা। খলিফা ডাকলে আমি একাই যাব। আপনার নির্দেশে নয় বরং খোদার নির্দেশেই খোৎবা থেকে খলিফার নাম বাদ দিয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ সুলতান।’
সন্ধ্যার পর শহরের রিপোর্ট দিচ্ছিলেন আলী। সুলতানের সাথে রয়েছেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এবং আরও ক’জন উপদেষ্টা। আলী বললেন, “এ ব্যাপারে কোথাও কোন কথা হয়নি। আমাদের গোয়েন্দারা নিজেরাই কয়েক জায়গায় বলেছে আজ খোৎবায় খলিফার নাম নেয়া হয়নি। কাজটা ভাল করেনি খতিব।
লোকজন আশ্চর্য হয়ে গেছে। খোৎবায় খলিফার নাম নেয়া হয়েছে কিনা একথাই তারা জানে না। কেউ কেউ বলেছে, খলিফাতো খোদা বা নবী না, খোৎবায় তার নাম বলা হয়নি তাতে এমন কি হয়েছে?
নিশ্চিন্ত হলেন সুলতান। জনগণের বিরোধিতার যে ভয় ছিল তা হচ্ছে না।
সেদিনই তিনি নুরুদ্দীন জংগীর কাছে চিঠি লিখলেন। লিখলেন, “খোৎবা থেকে খলিফার নাম তুলে দিয়েছি। এতে জনগণের মাঝে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আপনিও খলিফার নাম খোৎবা থেকে তুলে দিন।’
প্রাসাদে গোয়েন্দাদের আরও সতর্ক করার নির্দেশ দিলেন আয়ুবী। আলীকে বললেন, সন্দেহজনক কিছু দেখলে সাথে সাথে যেন আমাকে অবহিত করা হয়।
তিনি জানতেন রজবকে খলিফা তার নিজস্ব গার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার করেছেন। এজন্য আলীকে বললেন, তার সাথে একজন লোক দাও, যে তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করবে।’
খলিফার রাতের মাহফিল জমজমাট। রজব নেই, সে চলে গেছে গুপ্তঘাতকদলের কাছে। যতশীঘ্র সম্ভব সালাহউদীন আয়ুবীকে হত্যার ব্যবস্থা করতে সে ব্যস্ত খলিফা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর, উম্মে আমারার মাদকতাময় রূপের সাগরে ডুবে আছেন তিনি।
খোৎবা থেকে তার নাম তুলে দেয়া হয়েছে একথা কেউ তাকে বলেনি। আয়ুবীকে হত্যার ব্যবস্থা হচ্ছে এজন্য তিনি ভীষণ খুশী।
বুড়োর হাত থেকে তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মেয়েটা তাকে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। ঘুমিয়ে পড়লেন খলিফা।
আলো নিভিয়ে ও কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। এগিয়ে গেল নিজের বিশ্রামের জন্য আলাদা করে রাখা এক বিশেষ কক্ষের দিকে, যেখানে মাঝে মধ্যে রজব গোপনে এসে দেখা করে।
কামরায় ঢুকতে যাবে, পেছন থেকে কেউ তার ওপর কম্বল ছুড়ে মারল। কোন শব্দ করার আগেই আরেকজন তাকে কম্বলসহ জাপটে ধরল। চিৎকার করতে যাবে সে, কিন্তু ততক্ষণে কম্বলসহ আরেকটা কাপড় দিয়ে মেয়েটাকে বেঁধে কাধে তুলে নিয়েছে সে।
উম্মে আমারা তৃতীয় কোন লোকের অস্তিত্ব টের পেল না। বুঝল, ওরা মাত্র দু’জন।
তাকে নিয়ে চলতে শুরু করেছে ওরা।
ওরা এদিক ঘুরে, ওদিক ঘুরে যেভাবে দ্রুত ওকে নিয়ে এগুচ্ছিল তাতে তার মনে হল, প্রাসাদের পথঘাট অপহরণকারীদের চেনা।
অন্ধকারেই সিড়ি ভাঙতে লাগল অপহরণকারীরা। উঠে এল ছাদে। ছাদ থেকে নিচের দিকে রশি ঝুলে আছে। মেয়েটাকে সহ একজন রশি বেয়ে নেমে এল নিচে। পেছনে নামল দ্বিতীয় জন। তারপর দু’জনই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
একটু দূরে চারটে ঘোড়া বাধা ছিল। দ্রুত ওখানে চলে এল অপহরণকারীরা। ঘোড়ার পাশে বসে ছিল দু’জন লোক। সংগীদের আসতে দেখে ওরা ঘোড়াসহ এগিয়ে এল।
নিশ্চয়ই এ সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাজ।
‘গভর্নর ছাড়া আর কেউ এমন সাহস করবে না।’ ‘
‘এ কাজ সে ছাড়া আর কে করতে পারে!’
রাজপ্রাসাদে কানাঘুষা চলছে সালাউদ্দিন আয়ুবী উম্মে আমারাকে অপহরণ করিয়েছেন।
রজব ফিরে এসেছে। তল্লাশী নেয়া হয়েছে প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষে। রক্ষীদের উপর মনের ঝাল মেটাচ্ছে কমান্ডার। যেনতেন অপরাধ নয়, খলিফার হারেমের হীরকখণ্ড অপহৃত।
দেখা গেল প্রাসাদের পেছনে একটা রশি ঝুলছে। পায়ের চিহ্ন খানিক দূর গিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্নের সাথে মিশে গেছে। সন্দেহ নেই, মেয়েটাকে দড়ি বেয়ে নামানো হয়েছে।
মেয়েটা স্বেচ্ছায় কারো সাথে পালিয়ে গেছে এমন সন্দেহও প্রকাশ করল কেউ কেউ।
খলিফা একথা বাতিল করে দিলেন। ‘মেয়েটা আমাকে জীবনের চাইতে বেশী ভালবাসে।”
“এ সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাজ। রজব খলিফাকে বলল, ‘প্রাসাদের সবাই বলছে সে ছাড়া এমন দুঃসাহস কারো নেই।’
প্রাসাদে এ কথা ছড়িয়েছে রজবই। মহল তল্লাশী নেয়ার সময় প্রতিটি লোককেই বলেছে, এ সুলতান আয়ুবীর কাজ। তার এ রটনা কাজ দিয়েছে। মহলের প্রতিটি লোকের মুখে এখন এক কথা, এ কাজ সুলতান আয়ুবী করেছে।’
খলিফা একবারও ভাবলেন না, এ অপবাদ মিথ্যেও হতে পারে। আগেই তাকে বলা হয়েছিল সুলতান হারেমের মেয়েদের নষ্ট করেছেন।
তিনি বিশেষ দূতকে ডেকে বললেন, ‘আয়ুবীকে গিয়ে বল মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে, আমি তাকে কোন শাস্তি দেব না।’
দূত সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছে পৌঁছল।
দূত যখন সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে খলিফার নির্দেশ শোনাচ্ছিল, কায়রোর দশ বার মাইল দূরে ঘটছিল অন্য ঘটনা।
তিনটি উট ধীরে ধীরে কায়রোর দিকে এগিয়ে আসছে। আরোহী তিনজন মিসরীয় সৈন্য। পেট্রোল ডিউটি থেকে ফিরছিল ওরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুশমনের গুপ্তচরবৃত্তি, দেশদ্রোহীদের তৎপরতা এবং সুদানীদের হামলার আশংকায় সালাহউদ্দীন আয়ুবী সৈন্যদের অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রাতের বেলা বিস্তীর্ণ মরু এবং পার্বত্য এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াত ওরা। ওদের বাহন ছিল উট এবং ঘোড়া। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ত্বরিত আয়ুবীর কাছে সংবাদ পৌঁছে দিত।
ডিউটি শেষে কায়রো ফিরে আসছিল তিন উস্ট্রারোহী। সামনে মাটি এবং পাথুরে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা।
উপত্যকা দিয়ে চলছিল ওরা, একটা মেয়ের কান্নার শব্দ ভেসে এল। সাথে পুরুষালী কণ্ঠ। মনে হয় কাউকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
উট থেকে নেমে এল একজন সৈনিক। পায়ে পায়ে পাহাড়ে উঠে গেল। শব্দ আসছে ওপাশ থেকে। লুকিয়ে পড়ল সৈন্যটা।
ওপাশে চারটে ঘোড়া বাঁধা। কাছেই চারজন সুদানী কাফ্রী। একটা সুন্দরী মেয়ে দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে ছুটছে এক কাফ্রী। কিছুদূর গিয়েই মেয়েটার নাগাল পেয়ে গেল সে। মেয়েটার বাহু ধরে সংগীদের কাছে নিয়ে এল।
একজন কাফ্রী তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘তুমি পবিত্র মেয়ে। নিজেকে কষ্টের মধ্যে ফেলে আমাদের পাপী করো না। দেবতার অভিশাপে আমরা পুড়ে যাব। দেবতা আমাদের পাথরে পরিনত করবেন।’
‘আমি মুসলমান!” চিৎকার করে বলল মেয়েটা। ‘আল্লাহর গজব পড়ুক তোমাদের দেবতাদের ওপর। আমাকে ছেড়ে দাও, নইলে খলিফার কুকুর দিয়ে তোমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলব।’
‘তুমি এখন খলিফার মালিকানায় নেই, দেবতাদের মালিকানায় রয়েছ। দেবতাদের রয়েছে বজ্রের শক্তি, নাগনাগিনীর বিষ আর সিংহের দাঁত। তোমাকে কেউ লুকানোর চেষ্টা করলে মরুভূমির উত্তপ্ত বালু তাকে ছাই ভস্ম করে দেবে।’
এক কাফ্রী বলল, “তোমাদেরকে থামতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। ওর হাত পা বাঁধা থাক। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা পৌঁছে যেতে পারব।’
‘আমাদের ঘোড়াগুলোর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। তুমি নিজেও জান, দ্রুত যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কারোরই আপত্তি নেই।’
‘এখন কথা না বলে আবার ওকে বেঁধে ফেলো।’
একজন মেয়েটাকে ধরল। একটা তীর এসে বিধল তার পিঠে। ঢিলে হয়ে গেল মেয়েটাকে ধরা হাত। তাকে ধাক্কা দিয়ে আবার দৌড় দিল মেয়েটা।
একজন এসে আহত লোকটাকে ধরে ঘোড়ার আড়ালে নিয়ে গেল। আরেকটা তীর এসে বিধল অন্য কাফ্রীর ঘাড়ে।
একজন দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরে আনল আবার। দ্বিতীয় লোকটা তীরবিদ্ধ হতেই যে লোকটা মেয়েটাকে ধরে রেখেছিল সে উটের লাগাম তুলে নিয়ে দ্রুত নীচের দিকে নেমে গেল। সাথে তার সংগীও ছুটলো।
তীর দুটো ছুড়েছিল যে সেন্ট্রি সে পরে বলেছে, ‘দেবতাদের নাম শুনে প্রথমটায় আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। মেয়েটা যখন বলল আমি মুসলমান, গজব পড়ুক দেবতাদের উপর, তখন জেগে উঠল আমার ঈমানী শক্তি। খলিফার নাম শুনে বুঝলাম ও হারেমের মেয়ে। পোশাক আশাকেও তাকে বড় ঘরেরই মনে হল। মেয়েটাকে অপহরণ করে সুদানীদের মেলার বিক্রি করা হতে পারে ভেবে আর স্থির থাকতে পারিনি, সাথে সাথে তীর ছুড়লাম।
সেনাবাহিনীর প্রতি সুলতানের নির্দেশ ছিল এক ডজন মানুষ হত্যা করতে হলেও একটা মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে। এ জন্যই সৈন্যটি দু’জনকে হত্যা করেছে। দু’জনকে জীবিত ধরার জন্য নীচে এসেই ভুল করেছিল সে।
পাহাড় থেকে নেমে ও উটে সওয়ার হল। সংগীদের নিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে এসে দেখল দু’টো লাশ পড়ে আছে। মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে বাকী দু’জন।
উট নিয়ে ঘোড়ার পিছু নেয়া সম্ভব নয়। তিন জনের একজনের কাছে তীর, দু’জনের কাছে তরবারী এবং বর্শা। কাফ্রীরা চারটে ঘোড়াই নিয়ে গেছে।
সেন্ট্রিরা পার্বত্য এলাকায় অনেক খোঁজাখুজি করল তাদের। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ কানে এলেও ওরা তাদের নাগাল পায়নি।
মেয়েটার মুখে খলিফার নাম শুনেছে বলে লাশ দু’টোকে তুলে নিল ওরা। অপহরণকারীদের চেনার জন্য ওরা লাশগুলো সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছে নিয়ে গেল।
***
কক্ষে পায়চারী করছেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। চোখে মুখে ক্রোধ আর উৎকণ্ঠা। কয়েকজন উপদেষ্টা মাথা নুইয়ে বসে আছেন। এর আগে সুলতানকে তারা কখনো রাগান্বিত হতে দেখেননি।
আবেগ তাকে কাবু করতে পারেনি কোনদিন। রাগান্বিত হবার মত ঘটনা ঘটলেও সব সময় ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি। শত্রু বেষ্টিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন, কেল্লায় খাবার নেই, সাহস হারিয়ে ফেলেছে সৈন্যরা। সবাই অপেক্ষা করছে কমান্ডার আত্মসর্পণের নির্দেশ দেবেন, এ পরিস্থিতিতেও সুলতান সাহস হারাননি। ফৌজকে সাহসে উদ্দীপ্ত করে ঝাপিয়ে পড়েছেন শক্রর ওপর। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। কিন্তু আজ সুলতান নিজকে সংবরণ করতে পারছেন না। তার চেহারায় ক্রোধের সাথে ভয়। এ জন্য কক্ষের সবাই চুপ মেরে আছেন।
“এই প্রথম আমার মাথা কাজ করছে না।”
‘সুলতান, আপনি কি খলিফার,এ নির্দেশটাকে ভুলে যেতে পারেন না?’ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান আল নাসের বললেন।
‘চেষ্টা করছি, কিন্তু অপবাদের ধরনটা দেখেছেন? আমি হারেমের একটা মেয়েকে চুরি করেছি! আস্তাগফিরুল্লাহ। আল্লাহ আমায় ক্ষমা করুন। সে আমাকে চরমভাবে অপমানই করেনি, দূত পাঠিয়ে ধমক দিয়েছে। আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতো।’
‘এর পরও আমার পরাশর্ম হল আপনি শান্ত হোন।’ বললেন শাদ্দাদ।
‘ভাবছি, সত্যিই কি হারেমের কোন মেয়ে অপহৃত হয়েছে? আমার মনে হয় না। খোৎবা থেকে তার নাম বাদ দিয়েছি, হয়ত কোনভাবে জেনে ফেলেছে। মেয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে সে তার জবাব দিয়েছে। প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে। মুফতি ঈশা, মিসরের প্রতিটি মসজিদে নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিন, আগামী জুম্মা থেকে থোৎবায় কোন মসজিদেই খলিফার নাম নেয়া হবে না।”
‘আপনি নিজে গিয়ে খলিফার সাথে কথা বলুন।’ আল নাসের বললেন। ‘তাঁকে স্পষ্ট বলে দিন, খলিফা জাতির ইজ্জতের প্রতিভূ হলেও দেশে তার হুকুম কার্যকর করা এখন সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন দেশের মাতাল। খলিফার গার্ড বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমিয়ে দিন। সুদানীদের পরিবর্তে মিসরী সৈন্য দিন। প্রাসাদের জন্য নির্ধারিত সম্মানীও কমিয়ে দিন। জানি, আমাদেরকে তার মোকাবিলা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের পুরোপুরি আল্লাহর উপর নির্ভর করা উচিৎ।’
’আমি সব সময় আল্লাহর উপরই নির্ভর করেছি। তিনি নিশ্চয়ই এ অপবাদ ও অপমান থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দেবেন।’
প্রহরী ভেতরে ঢুকল। সবাই তাকাল তার দিকে। প্রহরী বলল, ‘একজন কমান্ডার এসেছেন। সাথে পেট্রোল ডিউটি থেকে আসা তিনজন সিপাই এবং সুদানীদের দুটো লাশ।’
প্রহরীর আগমনে কক্ষের সবাই বিরক্ত হলো। এ মূহুর্তে সুলতান এক জরুরী মিটিং করছেন। সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
কমান্ডার ভেতরে এল। ধুলোমলিন চেহারা।
তাকে বসিয়ে সুলতান প্রহরীকে বললেন ওর খাবারের ব্যবস্থা কর।
কমান্ডার বলল, ‘টহলরত সৈন্যরা চারজন কাফ্রীর হাত থেকে একটা অপহৃত মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তীর মেরে দু’জনকে মেরে ফেলেছে। বাকী দুই কাফ্রী মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। ওরা বলেছে মেয়েটা বেদুঈন নয়, মনে হয় কোন বড় ঘরের মেয়ে। ও নাকি বলেছিল ও খলিফার প্রাসাদে থাকে ৷’
‘হয়ত’ সুলতান বললেন, “হয়ত আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।”
তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করল সবাই।
বাইরে মাটিতে দু’টো লাশ পড়ে আছে। একটা উপুড় হয়ে। তীর বিধে আছে পিঠে। দ্বিতীয় লাশের তীর ঘাড়ে। পাশে দাঁড়ানো তিনজন সৈনিক। ওরা গভর্নর এবং সেনাপতিকে এই প্রথম দেখেছে।
স্যালুট করে একপাশে সরে গেল ওরা।
সুলতান ওদের সাথে করমর্দন করে বললেন, ‘এ শিকার কোথেকে নিয়ে এলে?”
তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যটি এগিয়ে এসে সুলতানকে পুরো ঘটনা শোনাল।
‘এ মেয়েটাই কি খলিফার রক্ষিতা!’ উপদেষ্টাদের দিকে তাকিয়ে সুলতান প্রশ্ন করলেন।
‘তাই মনে হয়।’ দু’টো খঞ্জর দেখিয়ে বললেন আলী।
সৈন্যটি যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল, আলী তখন লাশের তল্লাশী নিচ্ছিলেন। ওদের পরনে গোত্রীয় পোশাক। ভেতরে বেল্টের সাথে খঞ্জর আটকানো। খলিফার গার্ড বাহিনীর বিশেষ খঞ্জর। বাটে খেলাফতের মোহর অঙ্কিত।
‘খঞ্জর দু’টো চুরি না করে থাকলে এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য। এরাই খলিফার রক্ষিতা মেয়েটাকে অপহরণ করেছে।’
‘লাশ তুলে নাও, খলিফার কাছে যাব।’
‘আগে নিশ্চিত হতে হবে এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য কি না।” বললেন আলী।
কিছুক্ষণ পর রক্ষীদের একজন কমান্ডার এল। লাশ দেখানো হল তাকে। কমান্ডার বলল, ‘এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য। তিনদিন আগে ওরা এক হপ্তার জন্য ছুটি নিয়েছে।’
‘আর কেউ ছুটিতে আছে?’ প্রশ্ন করলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী।
‘এদের সাথে আরও দু’জন ছিল।’
‘এরা কি একত্রেই গেছে?”
‘হ্যাঁ।’
কমান্ডার এমন তথ্য প্রকাশ করল, শুনে সবাই চমকে উঠলেন। সে বলল, ‘এরা সুদানের জংলী উপজাতির লোক। ফেরাউনের সময় থেকে ওদের মধ্যে কিছু রসম চলে আসছে। প্রতি তিন বছর পর ওদের একটা উৎসব হয়, মেলা বসে। চলে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত। চতুর্থ রাতে থাকে ভরা পূর্ণিমা।
এ গোত্রের লোক ছাড়া অন্যরাও মেলায় অংশ গ্রহণ করে। ওরা যায় ফুর্তি করার জন্য। ওখানে মেয়েদের বেচাকেনা হয়।
মেলা বসার একমাস আগে থেকেই কায়রো পর্যন্ত আশপাশের যুবতী মেয়েদের পিতামাতারা আতঙ্কে সময় কাটায়। যতটা সম্ভব সতর্ক থাকে ওরা। মেয়েদের একা বের হতে দেয়না। বেদুঈনরা মেয়ে চুরি করার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। যুবতীদের ধরে এনে মেলায় বিক্রি করে।
এ চারজন সুদানীও মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য ছুটি নিয়েছে। তিন দিন পর মেলা শুরু হচ্ছে।’
‘হারেমের মেয়েটাকে এরাই চুরি করেছে?’ আলী প্রশ্ন করলেন।
‘নিশ্চিত করে বলা যায়না। তবে এ সময় জীবনবাজি রেখেও ওরা মেয়ে চুরি করে। কোন অভিভাবক মেয়েকে আনতে গেলে তাকেও হত্যা করে। মিসরের আমীর-ওমরা, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তারাই এসব মেয়েদের গ্রাহক। মেলায় অস্থায়ী পতিতালয়ের ব্যবস্থা থাকে। মদ আর জুয়া চলে রাতভর। শেষ রাতটি হয় রহস্যে ঘেরা।
গোপন স্থানে অনন্যা সুন্দরী এক যুবতীকে বলি দেয়া হয়। মেয়েটাকে কোথেকে আনা হয় বা কিভাবে বলি দেয়া হয় কেউ জানেনা। এ কাজ সম্পন্ন করে ধর্মীয় গুরু। জংলীরা তাকে ঈশ্বরের মত সম্মান করে।
বলি অনুষ্ঠানে ধর্মীয় গুরু ছাড়াও চার পাঁচজন যুবতী এবং ক’জন বিশিষ্ট লোক উপস্থিত থাকে। দর্শকদের দেখানো হয় মেয়েটার কাটা মাথা এবং রক্ত। জংলীরা তখন মদপান করে পাগলের মত নাচতে থাকে।’
খলিফার গার্ড বাহিনীকে ষ্ট্যান্ডবাই করে রাখা হয়েছিল। সকাল থেকে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এখন সূর্য ডুবোডুবো। খাদ্য পানি কিছুই দেয়া হয়নি।
রজব বার বার ওদের সামনে এসে ঘোষণা করছিল, ‘তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া অপহরণ সম্ভব নয়। যে অপহরণকারীকে সাহায্য করেছ সামনে আস। না হয় সবাইকে না খাইয়ে মারা হবে। সে যদি স্বেচ্ছায় গিয়ে থাকে তবুও তোমরা দেখেছ।’
কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছিল না। সবাই বলছে, তারা কিছুই জানেনা।
খলিফা রজবকে একদম বিশ্রাম দিচ্ছেন না। ‘রজব! মেয়েটাকে অপহরণ করা হয়েছে এতে আমার দুঃখ নেই। ভাবছি এমন কঠোর প্রহরা থেকে যে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে সে আমাকেও হত্যা করতে পারে। সালাহউদ্দীন এ কাজ করেছে এর প্রমাণ হাজির কর।’
সুলতান আয়ুবীর উপর মেয়ে চুরির অপবাদ দেয়া সহজ, কিন্তু রজব তার প্রমাণ দেবে কিভাবে? সে মহা ফ্যাসাদে পড়ল।
রাগের চোটে সে একবার যাচ্ছে রক্ষীদের কাছে, আবার খলিফার ডাকে ছুটে যাচ্ছে তার কাছে।
রক্ষীদের ধমকাচ্ছিল রজব। প্রহরী ফটক খুলে ঘোষণা করল, ‘মিসরের গভর্নর আসছেন।”
ভেতরে প্রবেশ করল আয়ুবীর ঘোড়া। সামনে দু’জন দেহরক্ষী। পেছনে আটজন ঘোড়সওয়ার। একজন ডানে, একজন বায়ে, উপদেষ্টারা পেছনে। এদের সাথে আলীও রয়েছেন।
রজব সুলতানের আগমনের সংবাদ দিল খলিফাকে। একে একে সবাই ভেতরে ঢুকল। পেছনে একটি টাংগায় দুটি লাশ। একটা রয়েছে চিৎ হয়ে, অন্যটা উপুড় হয়ে। তীর বিধে আছে দু’টো লাশের শরীরে।
খলিফা এগিয়ে এলেন। সালাহউদ্দীন আয়ুবী নামলেন ঘোড়া থেকে। সাথে সাথে সংগীরাও নেমে পড়ল। সুলতান এগিয়ে খলিফাকে সালাম করে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
হারেমের চুরি যাওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেবার নির্দেশ আমি পেয়েছি। আমি নিয়ে এসেছি আপনার দু’জন রক্ষীর লাশ। এরাই আমাকে নিরপরাধ প্রমাণ করবে। আপনাকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আয়ুবী আপনার সেনাবাহিনীর সৈন্য নয়। আপনি যে খেলাফতের প্রতিনিধি, আয়ুবীকে সেখান থেকেই পাঠানো হয়েছে।
আয়ুবীর মনের অবস্থা বুঝে ফেললেন খলিফা। পাপের ভারে পিষ্ট হচ্ছিল তার বিবেক। সালাহউদ্দীন আয়ুবীর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি তার ছিল না।
সুলতানের কাঁধে হাত রেখে খলিফা বললেন, ‘তোমাকে আমি নিজের সন্তানের চাইতে বেশী স্নেহ করি সালাহউদ্দীন।‘
‘আমি এখন আসামী। আমাকে এখন নিজের সাফাই পেশ করতে হবে। আল্লাহ আমার সাহায্যে এ দু’টো লাশ পাঠিয়েছেন। ওদের নীরবতা এবং ওদের দেহের বিদ্ধ তীর বলবে, আয়ুবী অপরাধী নয়। নিজকে নিরপরাধ প্রমাণ না করা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাব না।”
তিনি লাশের দিকে হাঁটা দিলেন। খলিফা কাঁচুমাচু হয়ে তার পেছনে চললেন। সুলতান গার্ডদের সামনে লাশ দুটি রেখে বললেন, ‘প্রথমে কমান্ডার ও পরে আটজন করে এক সাথে এগিয়ে এসে বল কার এ লাশ।’
এগিয়ে এল কমান্ডার। লাশ দেখে ওদের নাম বলল। ‘এরা আমাদের গার্ডবাহিনীর সদস্য।’ আটজন করে এসে লাশ দু’টো গার্ড বাহিনীর বলে শনাক্ত করল।
‘সালাহউদ্দীন, বুঝলাম এ দু’টো গার্ড বাহিনীর সদস্যের লাশ। তার আগে বল এদের কে হত্যা করেছে?’
সালাহউদ্দীন আয়ুবী পেট্রোল ডিউটির সৈন্য তিনজনকে ডাকলেন। ওরা খলিফাকে রাতের কাহিনী শোনাল। ওদের বলা শেষ হলে সুলতান সুদানী কাফ্রীদের মেলায় বিক্রি করার জন্য।’
খলিফা সুলতানকে ভেতরে যেতে বললেন। তিনি ভেতরে যেতে অস্বীকার করে বললেন, আমি মেয়েটাকে এনে আপনার সামনে হাজির হব। শুধু বলব, উপহার হিসেবে পাওয়া এ মেয়েটা আপনার স্ত্রী নয় রক্ষিতা। আমার কাছে এ মেয়ে মূল্যহীন। আল্লাহ আমাকে এরচেয়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন।
একটা মেয়ে চুরি হয়েছে বলে আমি শঙ্কিত নই। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে এভাবে মেয়েরা অপহৃত হতে থাকলে দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির কি হবে?
আর আমার দুঃশ্চিন্তা হল মুসলিম বিশ্ব অপহৃত হচ্ছে, এর থেকে জাতিকে কিভাবে রক্ষা করা যায়। আপনি ভাববেন না, আমার গোয়েন্দারা মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে।’
সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে খলিফা বললেন, ‘সালাহউদ্দীন, কিছুদিন থেকে দেখছি তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি তোমার পিতা নাজমুদ্দীনকে ভীষণ সম্মান করতাম। কিন্তু তুমি আমাকে মোটেও সম্মান করনা। আজই শুনলাম জামে মসজিদের খতিব আমিরুল আলেম নাকি থোৎবা থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছে। তার এ অপরাধের শাস্তি আমি দিতে পারি। কিন্তু ভাবছি, সে তো তোমার আশকারা পেয়ে এমনটি করেনি?’
‘আমার আশকারা পেয়ে নয় আমার নির্দেশে খতিব এ কাজ করেছেন। শুধু আপনার নাম নয়, এখন থেকে আপনার পরে যত খলিফা আসবেন থোৎবায় কারও নামই থাকবে না।”
‘এ পদক্ষেপ ফাতেমী খেলাফতকে দুর্বল করার জন্য নেয়া হয়েছে। মনে হয় এখানে আব্বাসী খেলাফত নিয়ে আসার পরিকল্পনা হচ্ছে।’
‘হুজুরের অনেক বয়স হয়েছে। মাথাটাও ঠিকমত কাজ করে না। কোরানে মদ হারাম করেছে কারণ মদ মানুষের মস্তিষ্ক দুর্বল করে দেয়। আমি ভাবছি আপনার গার্ডবাহিনী পরিবর্তন করব। রজবের স্থানে অন্য কমান্ডার দেব। ’
‘কিন্তু রজবকে তো আমি রাখতে চাই।’
‘সামরিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য হুজুরের কাছে অনুরোধ করব।”
আলীর দিকে তাকালেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। পাঁচজন কাফ্রী সেপাই নিয়ে এগিয়ে আসছেন তিনি।
এ পাঁচজন সেই গোত্রের। কমান্ডার বলেছে, ‘এরা আগামী পরশু ছুটিতে যাচ্ছে। আমি এদেরকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। অপহরণে ওদের হাত থাকতে পারে।’
সালাহউদ্দীন আয়ুবী রজবকে ডেকে বললেন, ‘কাল থেকে এখানে অন্য কমান্ডার আসবে। তুমি যাবে আমার কাছে। তোমাকে মেনজানিক কামানের দায়িত্ব দেব।’ রজবের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কাফ্রী দু’জন মেয়েটাকে নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল। এখন আর ধরা পড়ার ভয় নেই। থামল ওরা। আরেকবার পালাতে চাইল মেয়েটা।
কাফ্রী বলল, ‘পালানোর বৃথা চেষ্টা করছ। পালাতে পারলেও এ বিজন মরু থেকে যেতে পারবে না। আমরা তোমার ইজ্জত নষ্ট করতে চাই না।’
অবশ্য এখন পর্যন্ত ওরা সে চেষ্টা করেনি। আশ্চর্য হল উম্মে আমারা।
তার মাদকতাময় দেহ ওদের আকর্ষণ করেনি। যে দু’জন মারা গেছে তাদের একজন তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নিজকে কষ্টে না ফেলার জন্য আবদার করেছিল। ও জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
ওরা বলল, ‘তুমি হবে আকাশের দেবতার রাণী’।
ওরা আমারার চোখ বেঁধে ঘোড়ায় তুলে নিল। পালানোর চেষ্টা করা বৃথা। ও আর মুক্ত হবার চেষ্টা করল না, ঘোড়ায় বসে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগল।
এক জায়গায় থেমে ওকে পানি পান করান হল। অনেকক্ষণ পর বাতাসের শীতল স্পর্শ অনুভব করল ও। রাত হয়েছে, ভাবল ও। দীর্ঘ পথশ্রমে ও ক্লান্ত শ্ৰান্ত। ব্যথায় শরীর ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ে আতংকে চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলছে।
ঘোড়া থামল। ভেসে এল চার পাঁচজন নারী পুরুষের কণ্ঠ। পথে কাফ্রীরা ওর সাথে আরবীতে কথা বলেছে। এখন ওদের ভাষা বোঝা যাচ্ছে না। ওরা ওর চোখের বাঁধন খুলল না।
বোবা হয়ে গেছে উম্মে আমারা। এক ব্যক্তি ওকে পাল্কীতে তুলে দিল। শুরু হল দ্বিতীয় যাত্রা।
দফের শব্দের সাথে ভেসে এল নারী কণ্ঠের গান। গানের ভাষা ও বুঝতে পারল না। সুরে এক মোহময় আবেশ।
আতংক বেড়ে গেল ওর। রাতের নিঃশব্দ প্রকৃতিতে এক মাতাল করা আবহ সৃষ্টি হল। উম্মে আমারা পালকি থেকে লাফিয়ে পালাতে চাইছিল, চাইছিল এরা ওকে মেরে ফেলুক। কিন্তু সাহস হলনা।
ওর মনে হল এরা মানুষ নয়, ভিন গ্রহের অন্য কোন শক্তি। নিজের ইচ্ছায় সে এখন কিছুই করতে পারবে না।
বেহারারা সিড়ি ভাঙছে। প্রায় ত্ৰিশটা সিড়ি অতিক্রম করে সমতল ভূমিতে চলতে লাগল ওরা। থামল বেহারারা। কাঁধ থেকে পাল্কি নামাল।
চোখের বাঁধন খুলে একজন চোখের ওপর হাত রাখল। ধীরে ধীরে ফাক হল আঙ্গুল। ঝাপিয়ে পড়ল আলো। হাত সরে গেল। ও দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরের এক পুরনো বাড়িতে।
বাড়িটি পুরোনো হলেও আলোয় ঝলমল করছে বিরাট হলঘর। প্রাচীরের সাথে আটকানো লাঠির মাথায় মশাল জুলছে। দফ বাজছে। ভেসে আসছে নারী কণ্ঠের গান। কক্ষের বাতাসে অনাঘ্ৰাত সুবাস। এ যেন এক স্বপ্নপুরী।
সামনে তাকাল ও। উঁচু বেদী। আট দশটি সিড়ি রয়েছে। বেদীর ওপর অবাক করা এক পাথরের মূর্তি।
মাথা এবং মুখ বিশাল। থুতনির ঈষৎ নিচে গলা, ঘাড়। থুতনি থেকে মাথা পর্যন্ত উচ্চতা দু’জন মানুষের সমান। দাঁতের মাড়ি দেখলে মনে হয় মুর্তিটি হাসছে। হা করা মুখ। একজন মানুষের মাথা সে পথে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে অনায়াসে।
মূর্তির দু’কানে গোঁজা লাঠির মাথায় মশাল। দু’হাত লম্বা চোখ। এক সময় চোখ দুটি জ্বলে উঠল। স্বচ্ছ নীল আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল কক্ষে। বদলে গেল গানের সুর।
মূর্তির মুখের ভেতর আলোকিত হয়ে উঠল। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দু’জন লোক। পরনে আজানুলম্বিত জুব্বা। লোক দু’টো কাল। মাথায় রং বেরঙের পালকের মুকুট।
চত্বর থেকে নীচে নামার তিনটে সিড়ি। লোক দু’টো সিড়ির দুপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুর্তির মুখ থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। বয়স্ক মানুষ, পরনে লাল জুব্বা। মাথায় মুকুট। দু’কাঁধে ফনা ধরে কুণ্ডুলি পাকিয়ে আছে দু’টো কাল সাপ।
বৃদ্ধ এ গোত্রের পুরোহিত। মোহাবিষ্টের মত দাঁড়িয়ে আছে উম্মে আমারা।
বৃদ্ধ সিড়ি ভেঙে নেমে এল। হাঁটু গেড়ে বসল মেয়েটার কাছে। ওর দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমো খেল। অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভাগ্যবতী। আমাদের দেবতা তোমাকে পছন্দ করেছেন। তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।”
উম্মে আমারা কেঁদে বলল, ‘আমি দেবতা বিশ্বাস করি না। তোমরা যে দেবতাকে মানো তার দোহাই, আমায় ছেড়ে দাও। আমাকে এখানে কেন এনেছ?
এখানে যে আসে প্রথম প্রথম সে এ কথাই বলে। যখন এ পবিত্র স্থান সম্পর্কে জানতে পারে আর যেতে চায় না।
তুমি মুসলমানদের খলিফার প্রেমিকা, কিন্তু পৃথিবীর রাজা বাদশা এবং দেবদূতরা যার সামনে মাথা নোয়ায় তিনি তোমায় পসন্দ করেছেন। তুমি স্বর্গে এসেছ।
জুব্বার ভেতর থেকে একটা ফুল নিয়ে পুরোহিত মেয়েটার নাকের সামনে তুলে ধরল। উম্মে আমারা হারেমের রাজকুমারী। বিভিন্ন আতর গোলাপের গন্ধের সাথে পরিচিত। এ ফুলের ঘ্ৰাণ তার কাছে নতুন মনে হল। হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে গেল ফুলের সুবাস। তার দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটল। বদলে গেল অভিব্যক্তি।
ফুলটা সরিয়ে নিয়ে পুরোহিত বলল, “দেবতার দেয়া উপহার।
হাত প্রসারিত করল উম্মে আমারা। পুরোহিতের ফুল ধরা হাত টেনে আবার নাকের কাছে নিয়ে এল। জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘চমৎকার উপহার। আমায় দেবেন না?”
‘তুমি এ উপহার খুশি মনে গ্রহণ করছ?’ পুরোহিতের ঠোঁটে মৃদু হাসি।
‘হ্যাঁ, আমি এ উপহার আনন্দের সাথেই গ্রহণ করছি।”
ও আবার ফুল শুকল। আবেশে বন্ধ হল ওর চোখ দু’টো।
‘তুমি দেবতার ফুল গ্রহণ করেছো, দেবতাও তোমায় গ্রহণ করেছেন!’ পুরোহিত বলল, এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?’
পুরোহিতের দিকে তাকাল মেয়েটা। স্মরণ করার চেষ্টা করছে। মাথা ঝুকিয়ে বলল, ‘এখানেইতো ছিলাম, নাকি অন্য এক কোথাও ছিলাম, কি জানি, কোথায় ছিলাম মনে করতে পারছি না।’
‘কে তোমাকে এখানে এনেছে?’
কেউ না, আমি নিজেই এসেছি।’
‘তুমি ঘোড়ায় চড়ে আসনি?’
‘না, আমি উড়ে এসেছি।’
‘আসার পথে বিজন মরু, পাহাড় আর বন জংগল পড়েনি?’
‘না তো! চারদিকে ছিল সবুজের সমারোহ।’
“তোমার চোখ বেঁধে দেয়া হয়েছিল?”
‘না, না, আমার চোখ খোলাই ছিল? পথে কত রংবেরঙের সুন্দর সুন্দর পাখী, ফুল, প্রজাপতি দেখেছি।”
পুরোহিত তারপর কি যেন বলল, উম্মে আমারা বুঝতে পারল না। উম্মো আমারা দেখল তার চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে চারটি মেয়ে।
ওরা তার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর হাত দিল উম্মে আমারার গায়ে। মেয়েগুলো তার দেহের সব কাপড় খুলে নিল। উম্মে আমারা বিবস্ত্র হয়ে পড়ল।
মৃদু হেসে উম্মে আমারা বলল, ‘দেবতা এভাবে আমাকে পছন্দ করবেন?’
‘না, তোমাকে দেবতাদের কাপড় পরানো হবে।’
মেয়েরা তার কাঁধের উপর চাদর বিছিয়ে দিল। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে গেল সে চাদরে।
চাদরের মাথায় বেঁধে দেয়া হল রংগীন ফিতা। উম্মে আমারার সোনালী চুল আঁচড়ে কাধে ছড়িয়ে দিল একটা মেয়ে।
পুরোহিত মুচকি হেসে ঘুরে মুর্তির দিকে হাঁটা দিল। মেয়েরা উম্মে আমারার হাত ধরে পুরোহিতের পিছু নিল।
রাজকুমারীর মত এগিয়ে চলল ও। কোন দিকে তাকাচ্ছে না।
গানের সুর আরও আকর্ষণীয় মনে হল তার কাছে। সিঁড়িতে পা রাখল ও। মূর্তির মুখে প্রবেশ করল পুরোহিত। সিড়ি পেরিয়ে ঢুকে গেল মুর্তির ভেতরে।
মুর্তির কাছে এসে থেমে গেল মেয়েরা। মুর্তির গলা থেকে সিড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে। ও সিড়ি ভেংগে একটা অপ্রশস্ত কক্ষে এল।
সুবাসিত কক্ষে আলো জুলছে। দেয়াল এবং ছাদ গাছের পাতা ফুলে ঢাকা। একপাশে সুন্দর সোরাহী এবং গ্লাস।
পুরোহিত সোরাহী থেকে দু’টো গ্লাস ভরল। উম্মে আমারাকে একটা দিয়ে নিজে অন্যটা ঠোঁটে ছোয়াল।
‘দেবতা কখন আসবেন?’ প্রশ্ন করল ও।
‘তুমি এখনো তাকে চিনতে পারনি? তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছেন?’
তার পায়ের কাছে বসে ও বলল, ‘হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। তুমি উপরের সে লোক নও। তুমি দেবতা। তুমি কি আমায় গ্রহণ করেছ?”
‘হ্যাঁ, আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী।’
‘বাবার কাছে শুনেছি, পুরোহিত মেয়েটাকে ফুল শুকতে দেয়। সে তখন নিজের পরিচয় ভুলে যায়। কোথেকে এসেছে, কিভাবে আনা হয়েছে কিছুই মনে থাকে না। পুরোহিত যা বলে তাই করে। নিকৃষ্ট জিনিসও তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। পুরোহিতের সাথে মাটির নীচের কক্ষে থাকতে হয় তিন দিন। এর বেশী আমি আপনাকে বলতে পারবনা।” পাঁচজন কাফ্রীর একজন বলল আলী বিন সুফিয়ানকে।
উম্মে আমারা অপহরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনি খলিফার পাঁচজন দেহরক্ষীকে নিয়ে এসেছিলেন। এরা ছিল সে জংলী গোত্রের লোক।
গোয়েন্দা প্রধান ওদেরকে মেয়েটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। অজ্ঞতা প্রকাশ করল ওরা।
তিনি ওদের লোভ দেখালেন। বললেন, ‘তোমাদেরকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না।’ কিন্তু মুখ খুললনা ওরা।
ওদের গোত্র ছিল জংলী এবং হিংস্র প্রকৃতির। শাস্তির ভয়ে ভীত নয়। পাঁচজনই অনড়। কেউ মেয়েটার ব্যাপারে কিছুই জানে না।
আলী ওদের পাঠিয়ে দিলেন শাস্তি সেলে। সেখানে মুর্তির মুখ থেকেও কথা বের হয়। পাঁচজন সুদানী ছিল অত্যন্ত কঠোর প্রাণ। রাতভর ওদেরকে শাস্তি দেয়া হল। ওদের সাথে জেগে রইলেন আলী।
অবশেষে শেষ চেষ্টা করা হল। উপুর করে শুইয়ে হাত পা রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। পা আটকানো হল আংটার সাথে। হাতের রশির প্রান্ত বাধা হল একটা চাকার সাথে।
এ শাস্তিতে চাকা ঘুরলেই বাহু কাঁধ থেকে এবং পা উরুর গোড়া থেকে ছিড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। হঠাৎ চাকা থামিয়ে দেয়া হয়। ঘুরানো হয় আবার। অজ্ঞান হয়ে যায় অপরাধী। ওদের উপর এ শাস্তি চলল।
শেষ রাতে মাঝ বয়েসী এক কাফ্রী বলল, আমি সব জানি, কিন্তু দেবতার ভয়ে কিছুই বলব না। দেবতা আমায় নিকৃষ্ট মৃত্যু দেবেন।
যে ভাবে তোমাদের মারা হচ্ছে এরচেয়ে ভয়ংকর মৃত্যুও কি হতে পারে? আলী বললেন, ‘তোমাদের দেবতা সত্যি হলে এ শাস্তি থেকে তোমাদের সে অবশ্যই রক্ষা করতো। তোমরা যদি সত্যি কথা বলো, তাহলে আমাদের কাছে এমন দেবতা আছে যে তোমাদেরকে তোমাদেরদের দেবতার আক্রোশ থেকে রক্ষা করবেন।’
বন্দীর চোখে দেবতার পরিবর্তে ভেসে উঠছিল মৃত্যুর বিভীষিকা। মুখ খুলতে রাজি হল কাফ্রী। তার বাঁধন খুলে দেয়া হল। তাকে খাবার ও পানি দেয়া হল। খাওয়ার পর শুইয়ে দেয়া হল আলাদা এক ঘরে।
লম্বা ঘুম দিল লোকটা। ঘুম থেকে জেগে সে স্বীকার করল, তার গোত্রের লোকেরাই উম্মে আমারাকে অপহরণ করেছে। চারজন ছুটিতে যাওয়ার সময় অপহরণের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিল। সে রাতে এ পাঁচজনের ডিউটি ছিল। চারজনের দু’জন ভেতরে এসেছিল। অপহরণে এরা পুরো সহযোগিতা করেছে।
প্রতি তিন বছর পর মেলা হয়। বলি দিতে হয় একটা মেয়ে। তবে শর্ত হচ্ছে, মেয়ে সে গোত্রের হতে পারবেনা। সে হবে বিদেশী কোন উঁচু বংশের। ফর্সা এবং সুন্দরী। এমন সুন্দরী যার দিকে দর্শকরা হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে।
তার মানে প্রতি তিন বছর পর তোমাদের গোত্র একটা মেয়েকে বলি দেয়, আর তোমরা একটা সুন্দরী যুবতী অপহরণ কর!’
তা ঠিক নয়। তিন বছর পর মেলা বসে। প্রতি পাঁচ মেলার পর একটা মেয়ে বলি দেয়া হয়। যারা জানে না প্রতি মেলায় বলি দেয়া হয় এ কথা কেবল তারাই বলে।
‘বলিটা কোথায় দেয়া হয়?’
বলির স্থানের বর্ণনা করল কাফ্রী। পুরোহিতকে মনে করা হয় দেবতার সন্তান। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে মাইল দেড়েক দূরে পার্বত্য এলাকা। সে পার্বত্য এলাকার এক দূর্গম জংগলে দেবতা থাকেন। দেবতার সেবার জন্য আছে অন্সরী।
ধুধু মরুভূমির মাঝে দ্বীপের মত এক জায়গায় দেখা যাবে সবুজের সমারোহ। মনে হবে প্রকৃতির লীলা।
ওখানে রয়েছে ফেরাউনের সময়কার পুরাকীর্তি। ঝিলে রয়েছে ছোট। ছোট কুমীর। গোত্রের কেউ মারাত্মক অপরাধ করলে পুরোহিতের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। পুরোহিত তাকে নিক্ষেপ করে ঝিলে।
তিনি ওই প্রাচীন বাড়ীতেই থাকেন। প্রতি পনের বছরের শেষ দিন বাইরে থেকে একটা মেয়ে চুরি করে বলি দেয়া হয়। মেয়েটা তার সাথে থাকে কয়েকদিন। এছাড়া থাকে চারজন পুরুষ এবং চারজন সুন্দরী তরুণী।
অন্য কেউ ওখানে যেতে পারেনা। বেদিতে নেয়ার সময় মেয়েটা বুঝতেই পারেনা তাকে হত্যা করার জন্য নেয়া হচ্ছে। তার চেহারায় থাকে আনন্দ এবং গর্ব। দেহ থেকে মাথা কেটে দেহটা ফেলে দেয়া হয় ঝিলে। চুলগুলো গোত্রের লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। এ চুল ওদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র।
এরপর কাটা মাথা শুকিয়ে একটা গুহায় রেখে দেয়া হয়। পনের বছর পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এখন মেয়ে বলি দেয়া হবে। আমরা একই গোত্রের নয়জন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। সাহসী এবং জংলী বলে আমাদেরকে গার্ড বাহিনীতে নেয়া হয়েছে। দু’মাস আগে মেয়েটাকে দেখে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। এত রূপসী মেয়ে আমরা আর কখনও দেখিনি।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে বলি দেয়ার জন্য চুরি করব। আমাদের একজন গোত্রের সর্দারকে বলেছে বলি দেয়ার জন্য এবার আমরা মেয়ে দেব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা উম্মে আমারাকে অপহরণ করেছি।’
এসব কথা সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে শোনানো হল। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। আলী বিন সুফিয়ান তার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। এলাকার ম্যাপ খুলে সুলতান বললেন, “এ স্থান আমাদের সীমানার বাইরে। আলী! তোমার দেয়া তথ্য শুনে মনে হয় ফেরাউন মরে গেলেও এখনও ফেরাউনের প্রেতাত্মা বেঁচে আছে। মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য সর্বপ্রকার শিরক এবং কুফরের মূলোৎপাটন করা, আজ পর্যন্ত কত নিষ্পাপ মেয়ে বলি দেয়া হয়েছে, মেলায় বিক্রির জন্য অপহৃত হয়েছে কত যুবতী তার হিসেব নেই। মানুষের মন থেকে দেবতার ভয় দূর করতে হবে। এদের ধর্মীয় গুরুরা মেয়েদের অপহরণ করিয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে।
আমাদের কিছু ফৌজি অফিসার এবং শহরের বিত্তশালীরা মেয়েদের কিনে নিয়ে আসে। আলী বললেন, সমাজের চরিত্র নষ্ট হওয়া ছাড়াও আমাদের সাবেক সুদানী ফৌজের সাথে বর্তমান সেনা সদস্যরা মেলামেশা করছে। এর পরিণতি শুভ নয়।
এরপর খানিকটা সংকোচের সাথে আলী বললেন, ‘মেয়েটাকে জীবিত এনে খলিফার হাতে তুলে দেয়া জরুরী। তাহলে খলিফা বুঝবেন আপনাকে দেয়া অপবাদ ভিত্তিহীন।’
‘খলিফা কি বলল না বলল তার পরোয়া করিনা। আমি নিজকে নিয়ে ভাবিনা। ইসলামের কাজ করতে গিয়ে আমাকে যে যত নিকৃষ্টই বলুক তাতে কিছু যায় আসে না।
আলী, নিজের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাও। নিবদ্ধ কর দেশের কল্যাণের দিকে। ইসলাম এবং দেশ রক্ষার দায়িত্ব খলিফার। কিন্তু এখন আমাদের খলিফারা আত্মপূজায় হারিয়ে গেছে। ওরাই এখন ইসলামের সবচেয়ে দুর্বল দিক। এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে খ্রিষ্টান শক্তি। সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করতে চাইলে নিজের কথা ভুলে যাও।
খলিফার দেয়া অপবাদ আমি অনেক কষ্টে বরদাশত করেছি। এর জবাব দিতে পারতাম। কিন্তু এতে রাজনীতি ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার হতে থাকবে। আমার আশংকা ছিল, মুসলিম বিশ্ব কোন এক সময় ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিপূজা, আত্মম্ভরিতা, স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিন্সার ক্রীড়নকে পরিণত হবে।’
অপরাধ ক্ষমা করুন সম্মানিত আমীর। মেয়েটাকে বাঁচাতে চাইলে আমাদের হাতে সময় খুব কম। আগামী পরশু মেলা শুরু হবে।’
কোন সেনা সদস্য মেলায় শরীক হতে পারবে না, আমার এ নির্দেশ এখনি ছাউনিতে পৌঁছে দাও। নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি পঞ্চাশ বেত্ৰাঘাত। এ জন্য কারও পদমর্যাদা দেখা হবে না।’
নির্দেশ পৌঁছে দেয়া হল। সেনা অফিসারদের ডেকে সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, “ওদের কুসংস্কার ভেঙে দিতে হবে। মনে হচ্ছে এটিই ফেরাউনের শেষ চিহ্ন।‘
প্রথমেই সেনা অভিযানের প্রস্তাব এল। কিন্তু এতে গোত্রের লোকেরা সামরিক আক্রমণ ভেবে বেঁকে যেতে পারে। ফলে মারা পড়বে অনেক দর্শক এবং নিরপরাধ নারী ও শিশু।
কাফ্রী পাঁচজনকে সাথে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করল কেউ। সুলতান এ প্রস্তাবও নাকচ করলেন। কাফ্রীরা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করতে পারে।‘
উপ সামরিক প্রধান আল নাসের এবং আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘পার্বত্য এলাকায় যাবে বারজন কমান্ডো সদস্য। কাফ্রীদের দেয়া তথ্যে মনে হয় মেলা হয় জাঁকজমকের সাথে। অথচ মেয়েটাকে কোথায় বলি দেয়া হয় দর্শকদের কেউ তা জানে না।
তাই সাধারণ পোশাকে পাঁচশত সশস্ত্র সৈনিক দর্শকদের সাথে মিশে যাবে। বলির স্থান খুঁজে বের করবে এরা। ওদের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কমান্ডোরা অভিযান চালাবে। কমান্ডোরা কাপড়ে আগুন লাগিয়ে উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেই কেবল পাঁচশত সৈনিক সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করবে।
কমান্ডো বাহিনীর সদস্যদের বলা হল, মেয়েটাকে যখন বেদীতে চড়ানো হবে তখনই কেবল হামলা করবে। এর আগে পাহারাদারদের মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ আগে হলে ওরা হয়ত মেয়েটাকে বন্ধ কক্ষেই হত্যা করবে অথবা লুকিয়ে ফেলবে।
মেয়েটাকে বলি দেয়া হবে মাঝ রাতে। কমান্ডো বাহিনীকে তার পূর্বেই পৌঁছতে হবে পার্বত্য এলাকায়। ধরা পড়লে সমগ্র পরিকল্পনাই পন্ড।
নুরুদ্দীন জংগীর পাঠানো বাহিনী থেকে অভিযানের জন্য সদস্য নির্বাচন করা হল। এরা ছিল আরব। সুদানের নোংরা রাজনীতি এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত। ইসলাম ছিল ওদের একমাত্র লক্ষ্য। ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী প্রতিটি কাজের বিরুদ্ধে এরা ছিল সোচ্চার।
ওদেরকে অভিযানের গুরুত্ব এবং কর্মপদ্ধতি বুঝিয়ে দেয়া হল। এ অভিযানে যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে ঠিকই, আবার এমনও হতে পারে, হয়ত কোন সংঘর্ষই হবে না।
বলি দানের আর মাত্র ছ’দিন বাকী। তিনদিন তিন রাত ওদের ট্রেনিং দেয়া হল। চতুর্থ দিন কমান্ডো বাহিনীকে পাঠানো হল উটে চড়িয়ে।
দেড় দিনের সফর। উটের চালককে নির্দেশ দেয়া হল ওদেরকে পাহাড় থেকে খানিক দূরে নামিয়ে ফিরে আসতে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পাঁচশ সৈন্য রওয়ানা হল উট ও ঘোড়ায় চড়ে। বাহন এবং অস্ত্রশস্ত্র ওদেরকে সাথে রাখতে হবে। ছদ্মবেশে সৈন্যদের সংগী হলেন কমান্ডার।
মেলার শেষ রাত। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় হাসছে মরুর বালুকারাশি। মেলায় উপচে পড়া ভিড়। কোথাও নাচছে অর্ধ নগ্ন মেয়েরা। গানের আসর জমেছে কোথাও।
সবচেয়ে বেশী ভিড় মেয়ে বিক্রির হাটে। একটা মেয়ে তুলে আনা হয় চত্বরে। গ্রাহকরা দেখে।
কেউ দেখে দাঁত, কেউ চুল। দেহের বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গ দেখার পর নিলামে ডাক উঠে। সবচেয়ে বেশি দরদাতার হাতে মেয়েটাকে তুলে দেয়া হয়।
জুয়ার আড্ডা এবং মদের আসরও জমে উঠেছে। এসব ব্যাপারে এখানে আইনের কোন কড়াকড়ি নেই।
মেলার চারপাশে দর্শকদের জন্য টানানো তাঁবু। নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম এবং সামাজিকতার বাধন থেকে মুক্ত এরা। এরা এসেছে অবাধ স্ফুর্তি ও আনন্দের জন্য। পাশের পাহাড়ে কি হচ্ছে তা জানার কোন আগ্রহ নেই তাদের।
ওরা জানত, পাহাড় ঘেরা স্থানটি দেবতাদের আবাস। দেবতাদের পাহারা দেয় জীন এবং ভূতের দল। কোন মানুষ ওখানে গেলে জীবন নিয়ে ফিরতে পারে না। ওরা জানেনা খানিক দূরের সেই পাহাড়ের কোলে এক সুন্দরী যুবতীকে বলি দেয়ার জন্য তৈরী করা হচ্ছে। দেবতা হচ্ছেন একজন মানুষ।
ওরা এও জানত না, দর্শক বেশে মেলায় রয়েছে পাঁচশ খোদার সৈনিক। বারজন কমান্ডো সদস্য পৌঁছে গেছে দেবতাদের পাহাড় ঘেরা আস্তানায়।
কমান্ডো বাহিনীকে বলা হয়েছিল পাহাড়ের আশপাশে দৃশ্যতঃ কোন পাহারা থাকবে না। ওখানে পাহারা দেয় অদৃশ্য জীন ও ভুত। কিন্তু দেখা গেল কাফ্রীর বক্তব্য ঠিক নয়। আস্তানার চার পাশে সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে।
পার্বত্য এ এলাকাটা মাইলখানেক দীর্ঘ এবং প্রশস্ত। কমান্ডো সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগিয়ে চলল আস্তানার দিকে।
হঠাৎ একজন দেখল গাছের কাছে একটা ছায়া নড়ছে। হামাগুড়ি দিয়ে ছায়ার পেছনে চলে গেল সে ঝাপিয়ে পড়ল ছায়াটার ওপর। এক হাতে পেচিয়ে ধরল গলা। অন্য হাতের খঞ্জর তার বুকে ছুইয়ে বলল, “এখানে কি করছ? কিভাবে পাহারা দিচ্ছ তোমরা?”
আরবী বুঝল না কাফ্রীটা ততোক্ষণে আরেকজন কমান্ডো চলে এসেছে। এবার তাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করা হল, কিন্তু কিছু বলল না সে। আরও পাহারাদার আছে বলে সন্দেহ হল ওদের। কাফ্রিটাকে নিকেশ করে ওরা সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল। কিছুদূর গিয়েই আবার দেখা পেল পাহারাদারের। এভাবে বেশ কয়েকটা বাধা ডিঙিয়ে ওরা জংগলের প্রান্তে এসে পৌঁছল।
সামনে জংগল, তারপর পাহাড়। চাঁদ উঠে আসছে উপরে। ওরা গাছের ছায়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে জংগল পেরিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল।
আস্তানার ভেতরে ওরা দেখতে পেল পাথরের মূর্তি। সামনের চত্বরে কার্পেট বিছানো। সে কার্পেটের ওপরে ফুল ছড়ানো। ফুলের ওপর পাশাপশি রাখা আছে চওড়া তরবারী ও পেতলের থালা।
চত্বরের চারপাশে মশাল জুলছে। চারজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে চার কোণায়। ওদের সারা দেহ অনাবৃত। গাছের দুটি পাতা দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকা। এক জায়গায় শরীরে শাদা চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারজন কাফ্রী।
উম্মে আমারা তখনও নীচের অন্ধকার কামরায়। পুরোহিত তার চুল নিয়ে খেলা করছিল। নেশায় ঢুলুঢুলু চোখ, জড়ানো কণ্ঠে ও বলে যাচ্ছে, ‘আমি আংগুকের মা। তুমি আংগুকের পিতা। আমাদের সন্তান হবে মিসর এবং সুদানের সম্রাট। ওদেরকে আমার রক্ত পান করতে দাও।
প্রতিটি ঘরে বিলিয়ে দাও আমার সোনালী চুল। তুমি দূরে কেন? কাছে এস।”
‘আংগুক’ গোত্রের দেবতা। নেশার ঘোরে এক আরব মেয়ে হয়েছে জংলী গোত্রের মা এবং পুরোহিতের স্ত্রী। দেবতার নামে বলি দেয়ার জন্য পুরোহিত নানা রকম রসম রেওয়াজ পালন করছিল।
বারজন কমান্ডো সদস্য পাহাড় বেয়ে এগিয়ে আসছিল। কাঁটা ঝোপে ভরা এবড়ো থেবড়ো পাহাড় পেরুতে কষ্ট হচ্ছিল ওদের। চাঁদ মাথার উপর উঠে এসেছে। গাছের ছায়ার কারণে ওদের দেখা যাচ্ছে না।
ওরা দেখল, পাহাড়ের ওপর চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে এক কাফ্রী। এক হাতে বর্শা, অন্য হাতে ঢাল।
মনে হচ্ছে প্রহরী। এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, পেছন থেকে তাকে আক্রমণ করা সম্ভব নয়। আবার সামনাসামনি সংঘর্ষে যাওয়াও ঠিক হবে না। কিন্তু তাকে হত্যা করা জরুরী।
একজন কমান্ডো সদস্য লুকিয়ে পড়ল। আর একজন তার সামনে পাথর নিক্ষেপ করল।
আকস্মিক শব্দে চমকে উঠল কাফ্রী। এগুলো পাথর নিক্ষিপ্ত স্থানের দিকে।
ঝোপের কাছে আসতেই কমান্ডো সদস্য জাপটে ধরে বুকে খঞ্জর সেধিয়ে দিল। নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল কাফ্রীর লাশ। সতর্ক পায়ে আবার এগিয়ে চলল কমান্ডো বাহিনী।
উম্মে আমারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। পুরোহিত ওকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করল। এরপর হাত ধরে সিড়ির দিকে এগিয়ে চলল। চারজন উলঙ্গ যুবতী এবং চারজন কাফ্রী তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল মূর্তির মুখ। সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ওরা।
পুরোহিত তার আগমন ঘোষণা করে বেরিয়ে এল। সঙ্গে উম্মে আমারা। ওকে চত্বরে তুলে দেয়া হল। ঘিরে দাঁড়াল কাফ্রী এবং যুবতীরা।
মেয়েটা আরবী ভাষায় বলল, আমি আংগুকের সন্তানদের জন্য আমার মাথা কাটাচ্ছি। ওদের পাপের প্রায়শ্চিত করছি। আমার মাথা কেটে ফেল। দেবতার পদতলে রেখে দাও কাটা মস্তক। দেবতা এ মাথার উপর মিসর এবং সুদানের মস্তক স্থাপন করবেন।
যুবতী এবং কাফ্রীরা আবার সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। পুরোহিত উম্মে আমারাকে হাঁটু গেড়ে বসাল। মাথা নোয়াল ও। হাতে তরবারী তুলে নিল পুরোহিত।
পর্বত চূড়া থেকে এক কমান্ডো সদস্যের দৃষ্টি পড়ল চত্বরে। অনুচ্চ কণ্ঠে সঙ্গীদের বলল সে, ‘মেয়েটা মাথা নুইয়ে বসে আছে, উলংগ।’
ঝকঝকে জোসনা আর মশালের আলোয় ওরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সবকিছু। পাহাড় চুড়া থেকে নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে। পাহাড়ের গা ঢালু নয়, খাড়া দেয়ালের মত। হাতে সময় নেই। উড়ে গেলেও ওকে বাঁচানো সম্ভব নয়। চূড়া থেকে নীচে তাকাল ওরা। ঝিল। শুনেছে ঝিলে কুমির থাকে।
ডানদিক কিছুটা ঢালু হলেও মসৃণ দেয়ালের মত। কিছু ঝোপঝাড় রয়েছে। কমান্ডোরা একে অপরের হাত ধরে নামতে লাগল। সর্বশেষ আরোহীর দৃষ্টি পড়ল এক কাফ্রীর উপর। দাঁড়িয়ে আছে বর্শা নিয়ে। হাত উচিয়ে আছে নিক্ষেপের জন্য।
হয়ত সে সন্দেহ করেছে কিছু। কমান্ডো সদস্যদের দেখা যাচ্ছেনা। একজন তীর ছুড়ল। শোঁ শোঁ শব্দ তুলে ছুটে গেল তীর। বক্ষ ভেদ করল কাফ্রীর পড়ে গিয়ে গড়াতে লাগল দেহটা৷
কমান্ডোরা নেমে আসছে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে। যে কোন মুহুর্তে পা পিছলে পড়ে যেতে পারে অনেক নীচের টলটলে পানির ঝিলে।
পুরোহিত উম্মে আমারার মাথার উপর তরবারী তুলল। সিজদা থেকে সোজা হল কাফ্রী এবং যুবতীরা।
হাঁটু গেড়ে বসে ওরা গান ধরল। হালকা অথচ মিষ্টি সুর। সুরের আবহ সৃষ্টি করছিল এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশ।
‘পাহাড় ঘেরা এ ক্ষুদ্র উপত্যকা মানুষের নয় দেবতাদের আবাস,’ কমান্ডোদের মনে হল যে কোন মানুষকে এ পরিবেশে এ কথা বিশ্বাস করানো সম্ভব।
পুরোহিতের তলোয়ার আরও উপরে উঠে ধীরে ধীরে নেমে আসছে নীচে। আর মাত্র দু এক সেকেন্ড, হয়ত তারপরেই ভেসে আসবে মেয়েটার আর্ত চিৎকার।
তরবারী উম্মে আমারীর ঘাড় স্পর্শ করার আগেই একটা তীর এসে বিদ্ধ হল পুরোহিতের পাজরে। তরবারী তার হাত থেকে খসে পড়ার আগেই পরপর তিনটে তীর বিঁধল তার দেহে।
চিৎকার করে উঠল মেয়েরা। কাফ্রীরা ডাক-চিৎকার শুরু করল। পুরোহিতের দেহটা একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল। তরবারী ছিটকে পড়ল দূরে।
কঠিন শিলায় পড়ে ঝনঝন শব্দ হলো তরবারীর। ঘাড় তুলে তাকাল মেয়েটা।
দু’জন কাফ্রী মুর্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একঝাঁক তীর এসে শুইয়ে দিল ওদের।
মেয়েরা যে দিকে পারল ছুটে পালাল। রক্তে তড়পাচ্ছে তিনটে দেহ। উম্মে আমারা নির্বিকার ভাবে মাথা নত করে বসে আছে। দৌড়ে চত্বরে এসে একজন কমান্ডো উম্মে আমারাকে তুলে নিল কাঁধে। ওকে নিয়ে গেল মুর্তির পেছনে।
তখনো তার নেশ কাটেনি। নিজের জামা খুলে মেয়েটাকে পরিয়ে দিল কমান্ডো। একদিক থেকে বারজন কাফ্রী ছুটে এল। হাতে বর্শা এবং ঢাল।
ছড়িয়ে গেল কমান্ডোরা। ওদের চারজনের হাতে রয়েছে তীর ধনু। তীর ছুড়তে লাগল ওরা। অন্যরা একদিকে লুকিয়ে পড়ল।
কাফ্রীরা এগিয়ে এলে ওরা পেছন থেকে আক্রমণ করল। পেছনে আরও কাফ্রী থাকতে পারে ভেবে পরিকল্পনা মত তীরের মাথার কাপড়ে আগুন জ্বেলে উপরের দিকে ছুড়ে দিল এক কমান্ডো।
মেলা তখনো জমজমাট। নিজস্ব বাহনে চড়ে পাঁচশ দর্শক মেলা থেকে খানিক দূরে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। ওদের চোখে পড়ল। আগুনের ফিতা বাধা তীর।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ওরা। একটু দূরে গিয়ে ঘোড়া ছুটাল তীব্র গতিতে।
মেলার আনন্দে ডুবে থাকা দর্শকরা ভাবতেও পারেনি কি বিপদে পড়েছে দেবতারা। দেবতাদের আবাসে পৌঁছুল পাঁচশ সওয়ার। কাফ্রীদের কয়েকটা লাশ পড়ে আছে। শহীদ হয়েছেন দু’জন কমান্ডো সদস্য। ভেতরে আর কোন কাফ্রী নেই।
কমান্ডোরা মুর্তির মুখপথে ভেতরে ঢুকল। হাতের কাছে যা পেল তুলে নিল। অন্যান্য জিনিসের সাথে পাওয়া গেল কাপড়ের তৈরী একটি ফুল। ফুলটি কাপড়ের হলেও সুবাসিত। হালকা, মোলায়েম কিন্তু ইন্দ্রিয় অবশ করা সুবাস।
কমান্ডো সদস্যরা উম্মে আমারাকে সাথে নিয়ে পাহাড় পেরোল। এরপর ঘোড়া ছুটাল কায়রোর দিকে।
মেলা শেষ হয়ে গেছে। মাতাল হয়ে পড়ে আছে অনেকে। ব্যবসায়ীরা মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে মেয়ে বিক্রেতার দল। মরুভূমিতে বাড়ীমুখো মানুষের সারি।
চুলের জন্য অপেক্ষা করছে পাশের গাঁয়ের মানুষ। দুর গাঁয়ের মানুষজন তাকিয়ে আছে দেবতার আবাসের দিকে।
প্রবীণ বুড়োরা বলাবলি করছে, এখনি পুরোহিত এসে বলি দানের সুসংবাদ দেবেন। আমাদের দেবেন পবিত্র কেশ।
কিন্তু কেউ এলনা। দেবতার আস্তানা কবরের মত নিস্তব্ধ। এরা জানেনা দেবতার ঘোষণা আর কোনদিন আসবে না। দেবতার আস্তানা এখন মুসলিম ফৌজের দখলে।
রাত শেষে দিন এল, তারপর দেখা গেল দিনও পেরিয়ে যাচ্ছে। লোকজনের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। বলির কথা সবার মুখে মুখে। যুবকরা বলাবলি করতে লাগল, দেবতা না ছাই, সব ধোঁকাবাজি, সবই মিথ্যা।
ডুবে গেল সূর্য। দেবতার আস্তানায় গিয়ে কি ঘটেছে দেখার সাহস হলনা কারো।
***
‘ডাক্তার নিয়ে এসো। সুলতান আয়ুবী নির্দেশ দিলেন, ‘মেয়েটা এখনো নেশার ঘোরে রয়েছে।”
উম্মে আমারা সুলতানের সামনে বসে আছে। ও বলছে, ‘আমি আংগুকের মা! তুমি কে? তুমিতো দেবতা নও। আমার স্বামী কোথায়? আমার মাথা কেটে দেবতার পায়ের কাছে রেখে দাও। আমাকে আমার সন্তানদের জন্য উৎসর্গ কর।”
ও নেশার ঘোরে বকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে জড়িয়ে এল কণ্ঠ। ডাক্তার এসে ওকে ওষুধ খাওয়ালেন। একটু পর চোখ বন্ধ করল ও। তাকে শুইয়ে দেয়া হল, ও হারিয়ে গেল গভীর ঘুমের অতলে।
মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। সুলতানকে শোনানো হল আক্রমণের বিস্তারিত ঘটনা।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী সামরিক উপপ্রধান আল নাসের এবং বাহাউদ্দিন শাদ্দাদকে নির্দেশ দিলেন তোমরা এখনি পাঁচশ সৈন্য নিয়ে ওখানে যাও। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নেবে। সেনাবাহিনী জায়গাটা ঘিরে রাখবে। তোমরা মূর্তিটা ভেঙে ফেলো। আক্রমণ এলে মোকাবিলা করবে, এলাকার মানুষ সংঘর্ষে না এলে লড়াই করোনা। ওদের বুঝিয়ে বলবে এ ছিল স্রেফ ধোঁকা, শুধুই ভাওতাবাজি।
শাদ্দাদ তার ডাইরীতে লিখেছেন আমরা পাঁচশ সৈন্য নিয়ে ওখানে গেলাম। পথ দেখাল কমান্ডো বাহিনীর কমান্ডার। হাজার হাজার কাফ্রীরা দূরে দাঁড়িয়েছিল। এদের কেউ উটের পিঠে, কেউ ঘোড়ার পিঠে। হাতে বর্শা, তলোয়ার এবং তীর ধনুক।
আমরা পাহাড়ের দিকে পিঠ করে চারপাশে সৈন্যদের দাঁড় করালাম। যাদের তীর ছিলনা ওদের হাতে ছিল বর্শা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রস্তুতি। আমি এবং নাসের ভেতরে গেলাম। মূর্তি দেখে সে বলল, ফেরাউনের স্মৃতি।
চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কাফ্রীদের লাশগুলো পড়ে আছে দু’পাহাড়ের মাঝের সেই প্রাচীন বাড়ীতে।
ফেরাউনের সময় হয়ত এটা সুন্দর অট্রালিকা ছিল। দেয়ালের গায়ে প্রাচীন লিপি। পর্বতের পাদদেশে ঝিল। ঝিলে ছোট ছোট অনেকগুলো কুমির।
পাহাড় কেটে ভেতরে ঢুকে গেছে ঝিলের পানি। ঝিলের উপর পাহাড়কে ছাদের মত মনে হয়। ভয়ংকর স্থান।
অনেকগুলো কুমির কিনারে এসে আমাদের দেখতে লাগল। সৈন্যদের বললাম, কাফ্রীদের লাশ ঝিলে ফেলে দাও। কুমিরগুলো ক্ষুধার্ত।
ওরা লাশগুলো টেনে নিয়ে এল। ফেলে দিল ঝিলে। কুমিরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল লাশের ওপর। ছোট বড় অগণিত কুমির। মনে হল লাশগুলো দ্রুত সাঁতরে পাহাড়ের ভেতর দিকে ছুটে যাচ্ছে।
এরপর এল পুরোহিতের লাশ। বহু মৃত মানুষকে কুমিরের মুখে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। আমরা তার দেহটাও ঝিলে ফেলে দিলাম।
দু’জন সিপাই চারজন সুদানী মেয়েকে ধরে নিয়ে এল। বিবস্ত্র। সিড়ির নীচে লুকিয়েছিল ওরা।
আমি এবং নাসের দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। সিপাইদের বললাম, ‘ওদের কাপড় পরাও।’
কাপড়ে ঢেকে দেয়া হল ওদের দেহ। প্রতিটি মেয়েই অপূর্ব সুন্দরী। ওরা কাঁদছিল। দোভাষী ওদের কাহিনী বুঝিয়ে বলল আমাদের।
লজ্জাকর ও বেদনাদায়ক সে কাহিনী। কোন মুসলমান মেয়েদের এ অপমান সইতে পারে না। নারী যে কোন ধর্মের হোক, ইসলাম তার আব্রু রক্ষা করে।
এরা ফেরাউনকে খোদা মনে করত। ফেরাউনের অনুপস্থিতিতে গোত্র প্রধানকে পূজা করত খোদা হিসাবে।
আমরা পুরো এলাকাটাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চমৎকার স্থান। মরুর বুকে যেন সবুজের মেলা বসেছে। পাহাড়ী ঝর্ণায় তৈরী হয়েছে ঝিল। ঝিলের ওপর বিশাল ছায়াবৃক্ষ।
স্থানটি কোন ফেরাউনের পছন্দ হয়েছিল, শখ করে সে এখানে বিনোদন কেন্দ্র বানিয়েছে। নিজের খোদায়ীত্ব প্রমাণ করার জন্য মূর্তি তৈরী করেছে। ভোগ বিলাসের জন্য মাটির নীচে তৈরী করেছে সুদৃশ্য কক্ষ।
সূর্য সরে গেছে। বদলে গেছে আকাশের রূপ৷ খসে পড়েছে ফেরাউনের ক্ষমতার নক্ষত্র। মিসরে এসেছে অন্য ধর্ম, অন্য সম্রাট। শেষ পর্যন্ত কালিমার বিজয় হয়েছে।
সত্যের ফৌজ ঘিরে রেখেছে পার্বত্য এলাকা। ভেঙে ফেলা হল পাথরের মূর্তি। মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হল বেদী। মাটির নীচের কক্ষ ভরে ফেলা হল পাথর দিয়ে।
বাইরে হাজার হাজার কাফ্রী আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। কি হচ্ছে ওরা বুঝতে পারছিল না কিছু। দেবতাদের আস্তানা আক্রান্ত হতে পারে এমনটি ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি। অথচ তাদের চোখের সামনে দেবতাদের সব স্মৃতি একদল লোক কেমন নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।
দাঁড়িয়ে থাকা এসব কাফ্রীদের ডেকে ভেতরে নিয়ে দেখানো হল। খুলে দেয়া হল পুরোহিতের প্রতারণার মুখোশ। মেয়ে চারজনকে তুলে দেয়া হল ওদের হাতে।
চারজনেরই পিতা এবং ভাইয়েরা উপস্থিত ছিলেন ওখানে। ওদের বলা হল, এখানে থাকত এক বদমাশ। এখন সে কুমিরের পেটে।
হাজার হাজার কাফ্রীকে শোনানো হল উপত্যকার পাপের কাহিনী।
নীরবে শুনছিল ওরা। কখনও মনে হত ওদের চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।
ওদের বলা হল, যদি সত্যিকার খোদাকে দেখতে চাও, দেখানো হবে। তোমরা যেখানে বসে আছ, মনে করছ দেবতার আস্তানা, আসলে তা ছিল ভন্ডদের আখড়া। আমরা মিথ্যা খোদার এ পাবর্ত এলাকা ধূলায় মিশিয়ে দেব। তারপর দেখবে কোন খোদা সত্য।”
উম্মে আমারার জ্ঞান ফিরে এসেছে। সে তার ওপর দিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলল। ও যা বলল, মনে হয় তা এক দুঃস্বপ্ন।
উম্মে আমারা বলে যাচ্ছে পুরোহিত দিন রাত কয়েকবার করে আমার ইজ্জত হরণ করেছে। পুরোহিত কিছুক্ষণ পরপর আমাকে ফুল শুকতে দিত। সে ফুল শুকলে আমি ভুলে যেতাম আমার অতীত।
ওকে যখন বলা হল, “তোমার শিরচ্ছেদ করা হচ্ছিল। কমান্ডো বাহিনী সময়মত না পৌঁছলে এতক্ষণে থাকতে কুমীরের পেটে, তখন ভয়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটা।’
কী ভয়ংকর অবস্থায় ও পড়েছিল বুঝতে পেরে কাঁদতে লাগল উম্মে আমারা। সুলতানের হাতে চুমো খেয়ে বলল, ‘আল্লাহ আমায় পাপের শাস্তি দিয়েছেন। আমি প্রায়শ্চিত্য করব। আপনি আমার আশ্রয় দিন।’
উম্মে আমারা ছিল বিত্তশালী ব্যবসায়ী পিতার সন্তান। তার পিতার সাথে সিরিয়ার আমীরদের ছিল গভীর হৃদ্যতা।
এসব আমীররা কেন্দ্রের অধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা শাসন করত। দশম শতাব্দীর পর এরা ডুবে গেল ভোগের সাগরে। অর্থের প্রয়োজনে সম্পর্ক গড়ে তুলল বড় বড় ব্যবসায়ীর সাথে। হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত সুন্দরী যুবতীরা। রাতভর মদে মাতাল হয়ে পড়ে থাকত রঙমহলে।
উম্মে আমার বার বছর বয়সেই পিতার সাথে আমীরদের নৃত্যের আসরে অংশ নিয়েছিল। ও ছিল অসম্ভব সুন্দরী।
পিতা কৈশোর থেকেই তাকে আমীর ওমরাদের আসরগুলোতে নাচ-গানে অভ্যস্ত করে তুলল।
উম্মে আমারা বলল, আমার বয়স তখন চৌদ্দ। আমার ওপর আমীরদের লোলুপ দৃষ্টি পড়তে লাগল। দু’জন আমীর আমাকে মূল্যবান উপটৌকন দিল। তাদের সাথে আমার গড়ে উঠল গভীর সম্পর্ক। ধীরে ধীরে আমি পাপের মধ্যে ডুবে গেলাম।
ষোল বছর বয়সে এক আমীরের রক্ষিতা হলাম বাবাকে না জানিয়ে। থাকতাম নিজের বাড়ীতে। অর্থ বিত্তের মাঝেই আমি বড় হয়েছি। আমার পরিবেশে লাজলজ্জা বলে কিছু ছিলনা।
দু’তিন বছর পর বাবার সংসার থেকে সরে গেলাম। সম্পর্ক গড়লাম আরও দু’জন আমীরের সাথে। পুরুষ আমার চোখের ইশারায় উঠাবসা করতে লাগল।
এর পর বাবা আমার সাথে সমঝোতা করলেন। গত দু’বছর থেকে তিনজন আমীর এবং বাবা আমাকে নতুন এক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। মুসলিম খেলাফতের মূলোৎপাটন করার জন্য তারা আমাকে ব্যবহার করতে চাইলেন। কদিন পর বাবার এ ষড়যন্ত্রে শরীক হল এক খ্রিস্টান।
আমীররা চাইছিল স্বাধীন শাসক হতে, খ্রিস্টানদের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। আমাকে বলা হল নুরুদ্দীন জংগী এবং খেলাফতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির করতে হবে। এ কাজে সহযোগিতার জন্য সাথে দেয়া হল খ্রিষ্টানদের তিনজন গুপ্তচর মেয়েকে।
আমাকে আরো বলা হল, সালাহউদ্দীন আয়ুবী মিসরে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। তার তৎপরতায় জনগণ তাকে রাজার মত সম্মান করে।
সবকিছু বুঝিয়ে আমাকে খলিফা আল আযেদের কাছে উপটৌকন হিসেবে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য ছিল নুরুদ্দীন জংগী, আয়ুবী এবং খলিফার মধ্যে শক্রতা সৃষ্টি করা এবং সুদানীদেরকে আরেকবার বিদ্রোহের জন্য উসকে দেয়া।
উম্মে আমারা সুলতানকে আরো জানাল, সে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছে। তার পিতাই তাকে মুসলিম শক্তি ধ্বংস করার ট্রেনিং দিয়েছে। ও-ই খলিফার হৃদয়ে আয়ুবীর প্রতি শক্রতা সৃষ্টি করেছিল। রজবও ছিল এ ষড়যন্ত্রের একজন। রজব খলিফার দেহরক্ষী দলে মিসরীদের পরিবর্তে সুদানীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
খলিফার কাছে ও এসেছে মাত্র আড়াইমাস। এর মধ্যেই সে হয়ে উঠেছিল মহলের রাণী। ও স্বীকার করল, ‘খলিফা আয়ুবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। রজব এজন্য ঘাতক দলের সাথে চুক্তি করেছে।’
খলিফার ভোগ বিলাসে বিরক্ত হয়েই সালাউদ্দিন তার বিরোধিতা করেছিলেন। উম্মে আমারার অপহরণ, উদ্ধার এবং গোপন তথ্য প্রকাশ হওয়া ছিল কাকতালীর ব্যাপার। সুলতান উম্মে আমারাকে নিজের আশ্রয়ে রাখলেন।
এ ঘটনায় ওর চিন্তা চেতনা বদলে গেল। ও চাইছিল পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে। দেশ এবং জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেবেন সুলতান ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলেন।
ফেরাউনের শেষ চিহ্ন ধুলায় মিশিয়ে পরদিন শাদ্দাদ এবং আল নাসের সসৈন্যে কায়রো ফিরে এলেন।
***
আটদিন পর।
রাতের শেষ প্রহর। সালাউদ্দিন আয়ুবী গভীর ঘুমে অচেতন। চাকর তাকে ডেকে তুলে বলল, আল নাসের, আলী বিন সুফিয়ান এবং দু’জন নায়েবে সালার এসেছেন।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী বিছানা ছেড়ে বৈঠক রুমে চলে এলেন। অভ্যাগতদের একজন পেট্রোল ডিউটিরত সৈন্যদের কমান্ডার।
সুলতানকে বলা হল, ‘ছ’হাজার সুদানী ফৌজ মিসর সীমান্তে ছাউনি ফেলেছে। এদের সাথে রয়েছে মূর্তি ভেঙে ফেলা গোত্রের কাফ্রী এবং বিদ্রোহী সুদানী সৈন্য।
কমান্ডার দু’জন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়েছিলেন সংবাদ নেয়ার জন্য। ওরা সুদানী হলেও সুলতানের বিশ্বস্ত ছিল। সুদানীরা পরাজিত হওয়ার পর সুলতানের সাধারণ ক্ষমা এবং পূনর্বাসনের প্রস্তাব ছিল তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত। আয়ুবী আগ্রহী সুদানী সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের অনুমতি দিলে তারা সুলতানের কাছে আত্মসমর্পন করে ফৌজে যোগ দিয়েছিল।
ওরা সুদানী সেনাপতির সাথে দেখা করল। কথা বলল সুলতান আয়ুবীর বিরুদ্ধে। জানাল, ওরা কায়রো আক্রমণ করলে তাদেরকে তারা সব রকমের সাহায্য দেবে।
‘তোমরা শহরের অবস্থা এবং সালাউদ্দীন আয়ুবীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যতটুকু পার খবরাদি সংগ্রহ করে আমাকে জানাতে পারবে?’ জানতে চাইলেন সেনাপতি।
তারা সেনাপতিকে আশ্বস্ত করল। বলল, ‘কখন আপনাকে রিপোর্ট করব?”
আজ রাতেই আমাদের আরো ফৌজ এসে আমাদের সাথে মিলিত হবে। তোমরা যদি রাতের মধ্যেই খবর দিতে পার তবে আগামী কালই আমরা কায়রোর দিকে রওয়ানা করব।”
ওরা সেনাপতিকে আশ্বস্ত করে ফিরে এল শহরে।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, খলিফার দেহরক্ষী ফৌজে পঞ্চাশজন সৈন্য এবং একজন কমান্ডার থাকবে। বাকীদের ছাউনিতে নিয়ে এস। খলিফা বাধা দিলে বলবে, এ আমার হুকুম।
আলী! তোমার সংস্থায় যারা সুদানের ভাষায় কথা বলতে পারে এমন একশ লোক উট্রারোহী দু’জনের সাথে ওদের কাছে পাঠিয়ে দাও। ওরা যাবে বিদ্রোহীদের পোশাকে। ওদের সেনাপতিকে বলবে এরা সুদানী ফৌজে যোগ দিতে এসেছে। এদের কাজ হবে ফৌজের গতিবিধি কেন্দ্রকে অবহিত করা। রাতে ওদের পশু এবং রসদ কোথায় থাকে তাও জেনে নেবে।
নাসের, তুমি ছোট ছোট মেনজানিক কামান সহ কমান্ডো বাহিনীকে প্রস্তুত রেখো।’
‘আমি ভেবেছিলাম মুখোমুখি আক্রমণ করে শহরের বাইরেই ওদের শেষ করে দেব। ”
‘না! মনে রেখো নাসের, শক্ৰ যত কমই হোক মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলবে। রাতে কমান্ডো হামলা করবে। ডানে বাঁয়ে পেছনে আঘাত করে গেরিলারা পালিয়ে যাবে। শক্রর রসদ এবং পশু ধ্বংস করে দেবে। ব্যতিব্যস্ত করবে ওদের। ওদের শৃংখলা ভেংগে দেবে।
ওদেরকে আর সামনে এগোতে দেবে না। ডানে বাঁয়ে ছড়িয়ে যেতে বাধ্য করবে। যদি সামনাসামনি যুদ্ধ করতে হয়, পানি রাখবে নিজেদের দখলে।
সূর্য এবং বাতাস থাকবে ওদের প্রতিকূলে। যুদ্ধ করার জন্য তোমার পছন্দ করা ময়দানে নিয়ে আসবে ওদের। ওরা কায়রো এসে সেনাবাহিনীর সাথে সামনাসামনি লড়াই করতে চায়, আমি তাদের সে ইচ্ছা পূরণ হতে দেব না।
আলী! তোমার পাঠানো লোকদের বলবে, ওরা সুদানী বাহিনীতে প্রচার করবে সুলতান ছ’সাত দিনের মধ্যে ফিলিস্তিন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। এ জন্য তার অনুপস্থিতিতে কায়রো আক্রমণ করতে হবে।’
প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পর সুলতান বললেন ‘আজ সন্ধ্যায় আমি কায়রো থাকব না।’ কায়রো থেকে দূরে একটা স্থানের উল্লেখ করে বললেন ওখানেই হবে আমার হেড কোয়াটার।
বৈঠকখানায় সবাই ফজর আদায় করলেন। নামায শেষে বেরিয়ে গেলেন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য। নিজের কক্ষে ঢুকলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী।
***
সুদানী সেনা ছাউনিতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিপূর্বে সুদানী বিদ্রোহ দমনের পর তারা আরেকটি বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিয়েছিল। খ্রিস্টান সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিল ওরা। ওদের গুপ্তচর কাজ করছিল মিসরে। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে আয়ুবীর প্রস্তুতির খবর পেয়ে সে অভিযান ওরা মুলতবী করেছিল।
আয়ুবী জানতেন আবার একদিন পরাজিত সুদানীরা আক্রমণ করবে। ওদের একটা গোত্রের দেবতার আশ্রম ধ্বংস করেছেন সুলতান। এটা মামুলি কথা নয়। মিসরে সুলতান বিরোধীরা এ সুযোগ কাজে লাগাল। সুযোগ পেল পরাজিত বিদ্রোহী কমান্ডাররা।
সুদানের মুসলমানও আক্রমণের জন্য ওদের উত্তেজিত করছিল। দেবতাদের অপমান করা হয়েছে, প্রতিশোধ নিলেই কেবল দেবতার অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
প্রতিশোধের লক্ষ্যে জংলী উপজাতিও যোগ দিল বিদ্রোহীদের সাথে। এক হপ্তার মধ্যে সৈন্য জমা করে ওরা কায়রো অভিমুখে রওয়ানা করল।
পথে সংবাদ পেলেই বিভিন্ন গোত্র থেকে সুদানীরা এসে ওদের সাথে যোগ দিত।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী ওদের ছাউনির কাছাকাছি চলে এসে আত্মগোপন করলেন।
উষ্ট্রারোহী দু’জন সুদানী সেনাপতিকে বলল, ‘কয়েকদিনের মধ্যেই আয়ুবী ফিলিস্তিনের দিকে যাবেন।’
সেনাপতি ভীষণ খুশী। আয়ুবীর অনুপুস্থিতিতে মিসর আক্রমণ করা যাবে এ আশায় ছাউনিতে অবস্থানের মেয়াদ আরও কদিন বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
পরের রাতে পাঁচটি মেনজানিক কামান এবং তরল দাহ্য পদার্থ সহ পাঠিয়ে দেয়া হল পঞ্চাশ জন কমান্ডো সদস্য। মাঝরাতে ঘুমিয়ে আছে সৈন্যরা। রসদের স্থানে তরল পদার্থের ভান্ড এসে পড়তে লাগল। এর পরেই উড়ে এল আগুনের সলতে বাঁধা তীর।
জ্বলে উঠল আগুন। ছুটাছুটি শুরু হল ছাউনিতে, সাজোয়া বহর পেছনে সরিয়ে দিল কমান্ডোরা। তিন চার ভাগ হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল ছাউনির ভেতর দিয়ে।
সুদানী সৈন্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আয়ুবীর লোকদের বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল। ওদের দলিত মথিত করে কমান্ডোদের ঘোড়াগুলো পৌঁছে গেল অন্য প্রান্তে। মিশে গেল মরুর অন্ধকারে।
আগুনের লেলিহান শিখায় ভয় পেয়ে ছাউনির উট ও ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। সুলতানের সওয়ার দল তীর ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে গেল।
রাতে আর আক্রমণ করল না। আগুনে পুড়ে, ঘোড়ার পায়ে পিষে এবং তীরের আঘাতে নিহত হল সুদানীদের চারশ’ লোক। রসদ এবং তীরের স্তুপ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
রাতেই সেনাবাহিনী অন্যস্থানে গিয়ে ছাউনি ফেলল। চারপাশে মাটির ঢিবি। এখানে কমান্ডো হামলার ভয় নেই। পোট্রাল ডিউটির জন্য দূর দূরান্ত পর্যন্ত সৈন্যদের ছড়িয়ে দেয়া হল। এরপরও আক্রমণ হল গতরাতের মত।
পেট্রোল ডিউটিরত দু’টি দল কমান্ডো সদস্যদের হাতে মারা গেছে সেনাপতি তা জানত না। আগুনের সলতে বাধা তীর নিক্ষেপ করে পালিয়ে গেল গেরিলারা।
থেকে থেকে আক্রমণ চলল ভোর পর্যন্ত। গতরাতের চেয়ে এ রাতে ওদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশী।
সন্ধ্যায় আলী সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে বললেন, ‘ওরা কমান্ডো বাহিনীর আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে।
সুলতান সে রাতে কোন আক্রমণ করলেন না। এ রাতে ওরা সতর্ক থাকবে।”
পরদিন। চারশ করে পদাতিক ওদের ডানে এবং বায়ে আধা মাইল দূরে পাঠিয়ে দিলেন। ওদেরকে সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হল। সুদানীদের দু’পাশ দিয়ে ওরা মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছিল।
যতই এগুচ্ছিল ততই দুদিকে সরে যাচ্ছিল ওরা। পেছন থেকে এবং দু’পাশ থেকে আক্রমণের ভয়ে সুদানীরাও ফৌজ দুদিকে ছড়িয়ে দিল।
অকস্মাৎ টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সুলতানের পাঁচশ অশ্বারাহী। ঝাঁপিয়ে পড়ল সুদানী বাহিনীর মধ্যখানে। আক্রমণের তীব্রতায় ওদের মধ্যে ছুটাছুটি শুরু হল। দু’পাশ থেকে তীর ছুঁড়তে লাগল পদাতিক ফৌজ।
মাত্র তেরশ সৈন্যের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল দু’হাজারের সুদানী বাহিনী। লাশে ভরে গেল মরু ময়দান। বন্দী হল অনেকে। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যের সংখ্যা ছিল নিতান্ত নগণ্য।
সুদানীদের দ্বিতীয় বিদ্রোহ সুলতান ওদেরই রক্তে ডুবিয়ে দিলেন। এবার ডিপ্লোম্যাসী নয়, বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বিদ্রোহে শরীক সকল কমান্ডার এবং কর্মকর্তাদের বন্দী করলেন। গোয়েন্দাদের গ্রেফতার করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হল।
সালাউদ্দিন আয়ুবী সেনাকমান্ডারদের ডেকে বললেন, “প্রতিরক্ষার স্বার্থে যত শীঘ্র সম্ভব সুদান আক্রমণ করতে হবে।”
খলিফা আল আযেদকে পদচ্যুত করে সুলতান আয়ুবী ঘোষণা করলেন, ‘এখন থেকে মিসর আব্বাসী খেলাফতের অধীন থাকবে। খেলাফতের কেন্দ্র থাকবে বাগদাদ।’
এরপর তিনি উম্মে আমারাকে আটজন দেহরক্ষীর সাথে নুরুদ্দীন জংগীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
.
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কক্ষে পায়চারী করছেন সুলতান সালাউদ্দীন আয়ুবী। একপাশে বসে আছেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এবং আলী বিন সুফিয়ান।
আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বিষন্ন দৃষ্টি।
‘আলী!’ বেদনা ঝরে পড়ছে সুলতানের কণ্ঠ থেকে, ‘জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, কিন্তু উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালিপসু আমীর ওমরা এবং নেতারা জাতিকে গোপনে বিক্রি করে দেয়ার যে চক্রান্ত করছে তা রোধ করা বড় কষ্টসাধ্য। তোমরা দেখেছ আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোন অভিযোগ নেই। গাদারী করছে শুধু বড়লোকেরা। আমার সাথে ওদের ব্যক্তিগত শক্রতা নেই। শক্রতা ক্ষমতার জন্য, গদির জন্য লালায়িত ওরা।’
জুন-জুলাইতে সুদানী বিদ্রোহ দমন করার পর পরই সালাউদ্দিন আয়ুবী খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। এর আগেও সুদানী সেনা বিদ্রোহ দমন করেছেন, বিদ্রোহী নেতা অথবা সেনা কমান্ডারদেরকে শাস্তি দেননি। কুটনীতি এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন।
এবার তা করেননি, পদ এবং মর্যাদার তোয়াক্কা না করে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন। অধিকাংশকে দিয়েছেন মৃত্যুদন্ড। কাউকে কারাদন্ড দিয়েছেন, কাউকে তাড়িয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে।
‘দু’মাস ধরে দেশের উন্নয়ন এবং কল্যাণের দিকে নজর দিতে পারছিনা’, সুলতান বললেন, ‘অপরাধীদের আনা হচ্ছে, আদালত বসিয়ে বিচার করছি, বিদ্রোহীদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। দুর্ভাগ্য আমাদের, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশই মুসলমান।’
‘সম্মানিত আমীর’, মুখ খুললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ, মুসলমান এবং কাফের সমান অপরাধ করলে মুসলমানের শাস্তি বেশী হওয়া উচিৎ। তার কাছে এসেছে সত্য সুন্দর জ্যোতির্ময় দ্বীন। কাফেরের তো ধর্ম এবং বিবেকের দুয়ার রুদ্ধ। মুসলমানদের শাস্তি দিচ্ছেন বলে দুঃখ করবেন না। ওরা গাদ্দার, দেশদ্রোহী। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বেঈমানদের সাথে গাটছড়া বেঁধেছে।
‘আমার দুঃখ অন্যখানে শাদ্দাদ। আমি শাসক হয়ে মিসরে আসিনি। সম্রাট হতে চাইলে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতি তার জন্য উপযুক্ত। যে শুধু গদিকে ভালবাসে সে মিথ্যাবাদী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের দলে টানে। চরিত্রহীন লোকেরা হয় তার বেশী আপন। গালভরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছাড়া ওরা জনগণকে কিছুই দিতে পারেনা। তাদের অধিনস্তরা নিজেদেরকে রাজকুমার মনে করে।
আমার হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নাও, তবে কথা দিতে হবে আমার পথে কোন বাঁধা সৃষ্টি করবে না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি ঘর ছেড়েছি তা আমাকে পূর্ণ করতে দাও।
মিসর এবং সিরিয়ার সাথে ঐক্য সৃষ্টির জন্য নুরুদ্দীন জংগী হাজার হাজার জীবন কোরবান করেছেন। আরব মুজাহিদদের খুনে রঙিন হয়েছে নীলের পানি। এই সাম্রাজ্যের সীমা আরো বিস্তৃত করতে হবে। সুদানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে মিসরের সাথে। খ্রিস্টানদের নিয়ে যেতে হবে মধ্য ইউরোপে। আমার রাজ্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং খোদার হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ বিজয় প্রয়োজন। কিন্তু মিসর আমার জন্য চোরাবালিতে পরিণত হয়েছে। এমন একটা এলাকার কথা বল, যেখানে ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ আর গাদার নেই।’
‘এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে খ্রিস্টানদের হাত রয়েছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান। ‘ভাবতেও অবাক লাগছে, নিজের যুবতী মেয়েদেরকে অশ্লীলতার ট্রেনিং দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ওদের বিবেকে বাঁধছে না। তাদের মনভুলানো হাসি, চোখ ধাঁধাঁনো রূপ যৌবন, পটলচেরা কটাক্ষ, মধুভরা কণ্ঠের আকর্ষণ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা না গেলে জাতির পতন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এ বড় কঠিন অস্ত্র।”
‘যতই দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় কান দিওনা বলে প্রবাদ আওড়াও বাস্তবে তা কোন কাজে আসে না। জিহ্বা যাদু জানে। ভাষার আঘাত তলোয়ারের চেয়েও তীব্র। ওরা তোমার দুর্বলতা বুঝে এমন ভাষা ব্যবহার করবে যা তোমার তরবারী কোষবদ্ধ করতে বাধ্য করবে। স্বেচ্ছায় তুমি দুশমনের পদতলে রেখে দেবে তোমার অস্ত্র।’
‘আমাদের চাইতে খ্রিস্টানদের দুটি হাতিয়ার বেশী আছে। একটি ভাষার যাদু, অন্যটি মানুষের পাশব শক্তি উস্কে দেয়ার ক্ষমতা। এ পাশবশক্তিকে উস্কে দেয়ার জন্য ওরা ব্যবহার করছে সুন্দরী তরুণীদের। মুসলমান আমীর ওমরা এবং শাসকদের হৃদয় থেকে ওরা মুছে দিচ্ছে ন্যায়-অন্যায়বোধ! শুধু শাসকদের মন থেকেই নয়, সম্মানিত আমীর এমনকি সাধারণ মানুষও এখন পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অশ্লীলতার বান ডেকেছে আজ অভিজাত ও বিত্তশালী মুসলমানের ঘরে ঘরে, এটা খ্রিস্টানদের বড় রকমের সাফল্য।’
‘আর এটিই হচ্ছে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
‘আমি সমগ্র খ্রিস্টান শক্তির মোকাবিলা করতে পারি, কিন্তু তাদের এ আঘাত সামাল দিতে পারছি না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি শিউরে উঠছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে মুসলমান থাকবে শুধু নামে। খ্রিস্টানদের মতই হবে ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি। অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় ওদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। তুমিই বলো, আমার স্বভাব ও আচরণ যদি একজন অমুসলমানের মতই হয় তবে আমাকে মুসলমান বলার স্বার্থকতা কি?’
মুসলমানের দুর্বলতা হচ্ছে ওরা আপন পর চিনে না। বন্ধু আর শক্রর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সহজেই দুশমনের আকর্ষণীয় ফাঁদে আটকে যায় ওরা।
খ্রিস্টানদের দুর্বলতাও আমি বুঝি। মুসলমানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলেও ওদের হৃদয় চূর্ণ বিচূর্ণ। ফ্রান্স এবং জার্মান একে অপরের শক্র। বৃটেন এবং ইটালী কেউ কাউকে পছন্দ করে না। মুসলমানরা খ্রিস্টানদের শত্রু বলেই কেবল ওরা একত্রিত হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওদের মধ্যে রয়েছে বিভেদ, বিসম্বাদ।
অথচ অর্থবিত্ত আর নারীর রূপ যৌবন দিয়ে মুসলমানদেরকে অন্ধ করে রেখেছে ওরা ৷
মুসলিম বিশ্ব ঐক্যদ্ধ হলে অল্প ক’দিনের মধ্যেই ওরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ফাতেমী খেলাফত বাতিল করে আমি শক্রর সংখ্যাই বাড়িয়েছি। গদির জন্য ফাতেমীরা সুদানী এবং খ্রিস্টানদের সাথে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।’
‘ওদের একজন কবিকে তো কাল মৃত্যুদন্ড দিলেন।’ আলী বললেন।
‘এতে আমারও দুঃখ হচ্ছে। আম্মারাতুল ইয়ামানীর কবিতা আমার হৃদয়েও দাগ কেটেছিল। কিন্তু তার শব্দ এবং ছন্দ অগ্নিশিখার মত ইসলামের আচ্ছাদন জ্বালানোর চেষ্টা করছিল।’
আম্মারাতুল ইয়ামানী ছিল একজন নামকরা কবি। তখনকার সময় মানুষ কবিকে পীরের মত সম্মান ও মান্য করত। তার কাব্যের ছন্দ এবং শব্দ সৈন্যদের মাঝে সৃষ্টি করত নতুন আবেগ। কবি সমাজে তার এ জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো শুরু করল। একদিকে সে মানুষকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত, অন্যদিকে মানুষের মনে ফাতেমী খেলাফতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করত।
ধীরে ধীরে তার কবিতার বিষয় হয়ে উঠল সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বিরোধিতা। ফাতেমীরা নিয়মিত অর্থ যোগান দিত তাকে। তার শেষ কবিতা ছিলঃ
“ফাতেমী খেলাফতকে ভালবাসার অপবাদ দিচ্ছ আমায়।
আমাকে তোমরা অভিশাপ দাও।
অথচ আমার কাছে তোমরাই অভিশপ্ত।
অশ্রু ঝরাও ফাতেমীদের মহলের প্রাচীরে, দেয়ালের গায়।
মহলে এখনও যারা আছে তাদের বল,
তোমাদের জন্য যে ক্ষত হয়েছে আমার হৃদয়ে
তা মুছবে না কখনো, না কখনোই মুছবে না।
দুর্ভাগ্য ফাতেমীদের
তাদের এ দুর্ভাগ্যের কারণ যে মানুষটি
সে আয়ুবীকে আজো কোন দুর্ভাগ্য স্পর্শ করল না।’
একদিন অকস্মাৎ তার বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হল। দেখা গেল, শুধু ফাতেমীরাই নয়, মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তাকে নিয়মিত অর্থ যোগান দিচ্ছে খ্রিস্টানরাও। আয়ুবীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করার জন্য ওরা তাকে নিয়োগ করেছিল। গাদ্দারীর অভিযোগে তাকে দেয়া হল মৃত্যুদন্ড।
‘যে জাতির কবিরা দুশমনের কাছে বিবেক বিকিয়ে দেয়, সে জাতির ভাগ্যে অপমান এবং লাঞ্ছনা ছাড়া আর কি থাকতে পারে?’ বললেন সুলতান।
প্রহরী ভেতরে এসে বলল, ‘পদচ্যুত খলিফার দূত এসেছে।’
আয়ুবীর কপাল কুঞ্চিত হল। বললেন, “খেলাফতের গদি ছাড়া এ বুড়ো আমার কাছে আর কি চাইতে পারে? দূতকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।”
দূত ভেতরে এসে সালাম দিয়ে বলল, ‘খলিফার সালাম গ্রহণ করুন।’
‘সে খলিফা নয়।’ সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘দু’মাস আগেই সে পদচ্যুত হয়েছে। আল আযেদ এখন গৃহবন্দী।’
‘ক্ষমা চাইছি মাননীয় সুলতান। পুরনো অভ্যাস, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আল আযেদ আপনাকে সালাম দিয়ে বলেছেন, তিনি ভীষণ অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে। সম্মানিত আমীর, একটু কষ্ট স্বীকার করলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।’
সালাহউদ্দীন আয়ুবী নিজের উরু চাপড়ে বললেন, ‘সে আমায় ডাকছে কারণ, সে এখনও নিজকে খলিফা মনে করে।’
‘তা নয় মহামান্য সুলতান! তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রাসাদের ডাক্তার সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি হার্টের রোগী। একটু রাগ হলেই রোগ বেড়ে যায়। এখনতো বিছানা থেকেই উঠতে পারেন না।’ দূত একটু থেমে সংকোচ জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘আপনাকে একা যেতে বলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় কথা আছে। অন্য কারও সামনে তা বলা যাবে না।’
‘তাঁকে সালাম দিয়ে বলো আয়ুবী গোপন কথা সবই জানেন। এখন তিনি যেন খোদার সাথেই গোপন কথা বলেন। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।”
নিরাশ হয়ে ফিরে গেল দূত।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘সে আমায় একা যেতে বলেছে। এতে কোন ষড়যন্ত্র নেইতো?”
‘আমার মনে হয় প্রাসাদে ডেকে নিয়ে সে আপনাকে শেষ করে দিতে চাইছে।’
প্রহরীকে ডাকলেন আয়ুবী। বললেন, ‘ডাক্তারকে সালাম দাও।’
ডাক্তার এলে সুলতান বললেন, ‘আল আযেদের কাছে যাও। আমি জানি সে অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। হয়ত তার পারিবারিক ডাক্তার নিরাশ হয়ে গেছে, তুমি গিয়ে তার চিকিৎসা কর। অবস্থা মারাত্মক হলে আমাকে খবর দিও।’
সাবেক খলিফা আল আযেদ তার প্রাসাদে গৃহবন্দী। তার প্রাসাদ ছিল পৃথিবীর স্বর্গ। হারেমের শোভা বৃদ্ধি করেছিল দেশ-বিদেশের রূপসী যুবতীরা। তন্বী তরুণী দাসী বাঁদীর সংখ্যা ছিল অগণিত। হাজার হাজার দেহরক্ষী সবসময় প্রস্তুত থাকত। সেনা অফিসাররা দাঁড়িয়ে থাকত নির্দেশ পালনের জন্য।
সুলতান আয়ুবীর নতুন বিপ্লব মহলের চেহারা বদলে দিল। খলিফার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলেও তার ভোগবিলাস সামগ্রীতে হাত দেয়া হয়নি, কিছু সৈন্য রয়েছে, যাদের কাজ এখন পাহারার সাথে সাথে ষড়যন্ত্রের এ কেন্দ্রের প্রতি গভীরভাবে নজর রাখা।
গৃহবন্দী আল আযেদ একে তো বৃদ্ধ তার ওপর হার্টের রোগী। গদি হারানোর দুশ্চিন্তা, বয়সের ভার আর অতিরিক্ত মদপান ও ভোগবিলাস তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল।
ক’দিনেই চেহারা হয়েছে মরার মত। দু’জন আধ বয়েসী মহিলা এবং একজন চাকর ছাড়া তার কক্ষে কেউ নেই। বৃদ্ধ চোখ খুলে ওদের দেখে আবার বন্ধ করে নিতেন চোখ।
একটু আগে ডাক্তার তাকে ওষুধ খাইয়েছেন। হারেমের দু’জন যুবতী ভেতরে ঢুকল। একজন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে শরীরের অবস্থা জানতে চাইল। অন্যজন দু’হাতে তার মুখমন্ডল ধরে সুস্থ হওয়ার জন্য দোয়া করল। এরপর পরস্পর চোখের দিকে তাকিয়ে একজন বলল, ‘বিশ্রাম করুন। এখন আপনার বিশ্রাম নষ্ট করা ঠিক হবেনা। আমরা পাশের কামরায় আছি, প্রয়োজন হলে ডাকবেন।’ দু’জনই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
আল আযেদ দীর্ঘশ্বাস টেনে পাশের মহিলাকে বললেন, ‘এরা আমার সেবা করতে আসেনি। দেখতে এসেছে আমি কখন মরব। আমার সম্পদের সাথেই ওদের সম্পর্ক। ওরা শকুন, ওরা শুধু আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের লোলুপ দৃষ্টি আমার সম্পদের দিকে। তোমরা তিনজন ছাড়া আমার সমব্যর্থী আর কেউ নেই। না, কেউ নেই, কেউ নেই। যারা ফাতেমী খেলাফতের নামে শ্লোগান তুলত তারা এখন কোথায়?’
বুকে হাত চেপে পাশ ফিরলেন বৃদ্ধ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
দূত কক্ষে প্রবেশ করে বলল, ‘গভর্নর আসবেন না। তিনি আসতে অস্বীকার করেছেন।”
‘হায় হতভাগ্য আয়ুবী। আল আযেদের কণ্ঠে বিষগ্নতা, ‘আমার মৃত্যুর পূর্বে একবারতো আসতে পারতে।’
তাঁর বুকের ব্যথা বেড়ে গেলো। থেমে থেমে ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমি ডাকলে দাসীবাদীরাই এখন আসে না, মিসরের গভর্নর আসবে কেন? এ সবই আমার পাপের শাস্তি। আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ এখন পর্যন্ত আসেনি, ওরা আসবে জানাযায়, প্রাসাদের যা পাবে নিয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ ব্যথায় কাৎরালেন তিনি। দু’জন সেবিকা আতংক নিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। শান্তুনা দেয়ার কোন ভাষা এলনা ওদের মুখে। ওরা সে খোদার অভিশাপকে ভয় পাচ্ছিল, যিনি আমীরকে ফকীর আর সম্রাটকে ভিক্ষুকে পরিণত করেন।
ঘরের ভিতর কারো ছায়া পড়ল। চকিতে দরজার দিকে তাকাল ওরা। দেখল শুভ্রকেশধারী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়।
ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে এলেন আল আযেদের কাছে। নাড়িতে হাত রেখে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম, আমি গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। আপনার চিকিৎসার জন্য তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।’
‘আমাকে দেখে যাওয়ার সৌজন্যবোধটুকুও গভর্নর হারিয়ে ফেলেছেন? আমি ডাকলাম, তারপরও এলনা!’
‘কি জানি, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। তিনি আমাকে ডেকে আপনার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন, তা না হলে আমায় পাঠাতেন না।’
আল আযেদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ডাক্তার তাকে বাধা দিয়ে বললেন, আ‘পনি এখন কথা বলবেন না, তাহলে আপনার রোগ বেড়ে যেতে পারে।’
‘আমার চিকিৎিসা হয়ে গেছে, যা বলছি মন দিয়ে শোন। এর প্রতিটি শব্দ আয়ুবীকে পৌঁছে দেবে। নাড়ি থেকে হাত সরাও। তোমাদের পৃথিবীর চিকিৎসা এবং ওষুধ থেকে আমি এখন অনেক দূরে। আয়ুবীকে বলো, আমি তার শক্র নই। দুশমনের চালে আটকে গিয়েছিলাম। আমার অথবা সালাহউদ্দীনের দূর্ভাগ্য, এমন সময় অপরাধ স্বীকার করছি যখন আমি মাত্র কয়েক মুহুর্তের অতিথি।
সালাহউদ্দীনকে বলো, আমার হৃদয়ে সবসময়ই তার জন্য স্নেহ ছিল। তার জন্য ভালবাসা বুকে নিয়েই আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। টাকা পয়সা এবং গদির লোভ আমার সব ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। লোভ এবং মোহ আমার হৃদয়কে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যা আমাকে ইসলাম থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এ ছিল আমার মস্তবড় ভুল। আজ আমার নেশা ছুটে গেছে।
আমার পায়ের কাছে বসে যারা কথা বলত, তারা এখন আমাকে চেনেনা। যেসব দাসীবাদী আমার চোখের ইশারায় নাচত, তারা আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। উলংগ নৃত্য করেছে যেসব মেয়েরা ওরাও আমাকে ঘৃণার চোখে দেখছে।
মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এবং আল্লাহর কাছেই মানুষকে আবার ফিরে যেতে হবে। সেখানে কারও পাপের বোঝা কেউ বহন করবে না- মানুষের কথায়, চাটুকারদের চাটুকারিতায় এ সত্যকে ভুলে যাওয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামী। এ ভুল আমি করেছি।
ওসব কমবখতের দল আমাকে খোদার আসনে বসিয়েছিল। যখন আসল খোদার ডাক এসেছে, চোখ খুলে গেছে আমার। আমি বুঝতে পারছি, অপরাধ স্বীকার করার মধ্যেই আমার মুক্তি। সালাহউদ্দীনকে এমন সব তথ্য দেব যা সে জানেনা। তাকে বলো, আমার গার্ড বাহিনীর কমান্ডার রজব মরেনি। সুদানের কোথাও না কোথাও সে আত্মগোপন করে আছে। সে আমাকে বলে গেছে, ফাতেমী খেলাফত পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য সে সুদানী এবং আয়ুবী বিরোধী মিসরীদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে। সামরিক সাহায্য নেবে খ্রিস্টানদের কাছ থেকে।
সালাহউদ্দীনকে বলো, তার দেহরক্ষীদের দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে। রাতে যেন একা বের না হয়। রজব তাকে হত্যা করার জন্য ঘাতক বাহিনীর সাথে চুক্তি করেছে। মিসর তার জন্য এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরী।
তাকে বল তুমি যাদের বন্ধু মনে কর তাদের সবাই তোমার বন্ধু নয়, এদের মাঝে অনেক শক্রও আছে। ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যারা তোমার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায় তাদের মধ্যেও রয়েছে খ্রিস্টানদের পালিত বিষাক্ত সাপ। এমন অনেক আলেম পাবে ক্ষমতার লোভেই যারা ইসলামের পক্ষে কথা বলে।
তিনি কয়েকজনের নাম বললেন, এদের তোমরা মনে কর মস্ত বড় মুজাহিদ। অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ তাদের পিছনে। জানেনা এরা কখনো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেনা। ওরা মুখে বলে পরকালের কথা, কিন্তু বাস্তবে পুঞ্জীভুত সম্পদ ও ক্ষমতা হারাবার ভয়ে সব সময় অস্থির থাকে। একদিন হয়তো তারাও নিবেদিতপ্রাণ ছিল, কিন্তু যতই ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা বাড়ছে ততই তা হারাবার ভয়ও বাড়ছে, আর এ ভয় তাদেরকে ইসলাম থেকে ঠেলে দিচ্ছে দূরে। কেউ কেউ এগিয়ে গেছে আরো এক ধাপ। দুনিয়ার মোহে ওপরে দ্বীনের শ্লোগান দিচ্ছে আর গোপনে শক্রর সাথে হাত মিলাচ্ছে।
এদেরই একজন ফয়জুল ফাতেমী, সেনা সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে সে। বন্ধু ভেবে তাকে অনেক বড় পদ দিয়ে রেখেছে আয়ুবী। সে তোমাদের বন্ধুবেশী দুশমন। তোমরা জাননা, কিন্তু আমি জানি সে রজবেরই সংগী।
সেনাবাহিনীর মধ্যে তুর্কী, সিরীয় এবং অন্যান্য আরব বংশোদ্ভূত সদস্যদের ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করোনা। এরাই তোমার অনুগত এবং ইসলামের সৈনিক।
মিসরী সৈন্যদের মধ্যে বিশ্বস্ত অবিশ্বস্ত দু’দলই আছে। তুমি যখন সুদানীদের আক্রমণ করেছিলে দুটো প্লাটুনের কমান্ডার সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলে। আরব সৈন্যরা কমান্ডারের নির্দেশ উপেক্ষা করেই আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, তা না হলে যুদ্ধের ফল হত উল্টো।
আল আযেদ ক্ষীণ কণ্ঠে থেমে থেমে বলে যাচ্ছেন। ডাক্তার বাধা দিয়েছেন কয়েকবার, তিনি হাতের ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। যেন কেউ পানি ছিটিয়ে দিয়েছে সারা শরীরে।
ঘাম মুচছে দু’জন সেবিকা। মনে হয় ঝর্ণা বইছে শরীর থেকে। তিনি সামরিক বেসামরিক কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্রের বর্ণনা দিলেন। বললেন, ‘এসব কর্মকর্তাদের মুসলমান মনে করোনা। ওরা নিজেদের ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে।
সালাহউদ্দীনকে বলো, আল্লাহ তোমায় সফল করবেন। মনে রেখো, একদল রয়েছে ধোঁকাবাজ, অন্যদল চাটুকার। চাটুকাররা খোদার আসনে বসিয়ে তোমাকে নিঃশেষ করে দেবে। এরা মোনাফেকদের চেয়েও বেশী ক্ষতিকর। দুশমনকে পদানত করে তুমি যখন নিশ্চিন্তে মসনদে বসবে, তখন আমার মত দুই জাহানের সম্রাট হয়ে যেও না। রাজত্ব আল্লাহর। এ পরিণতি থেকে রক্ষা করে চলো।’
জড়িয়ে এল আল আযেদের কণ্ঠ। চোহারার বিষন্নতা কেটে গিয়ে ফুটে উঠল প্রশান্তি। আবারো কিছু বলতে চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু নিস্তব্ধ হয়ে গেল কণ্ঠ। মাথা কাত হয়ে গেল একদিকে আল আযেদ চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন।
এ ঘটনা ঘটেছিল ১১৭১ সনে।
ডাক্তার সুলতানের কাছে খবর পাঠালেন। প্রাসাদেও এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। কান্না দূরে থাক, সামান্য আফসোসও কেউ করল না। শুধু সেবিকা দুজনার চোখ ছিল অশ্রুভেজা।
সংবাদ পেয়েই সুলতান কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রাসাদে পৌঁছলেন। চাকর বাকরদের তৎপরতায় তার মনে সন্দেহ জাগল। তিনি নারী পুরুষ এবং হারেমের যুবতীদেরকে বাইরের বারান্দায় বসিয়ে রাখ। যতবড় প্রয়োজনই হোক কাউকে বাইরে যেতে দেবে না। আস্তাবলেও কাউকে যেতে দেবে না। গোটা প্রাসাদ নিজের কব্জায় রেখো।’
কি আশ্চর্য! সুলতান লক্ষ্য করলেন, যেই আল আযেদ ছিলেন এক সম্রাট, নারী আর মদ ছিল যার জীবন, যার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল রূপসী তরুনীরা, চাকর বাকর দাস দাসীতে গমগম করেছে যার মহল, তার জন্য এক ফোটা চোখের পানি ফেলার মত কোন লোক নেই।
ডাক্তার সুলতানকে নিভৃতে ডেকে আল যায়েদের শেষ কথাগুলো শুনিয়ে বললেন, ‘আপনার আসা উচিৎ ছিল।’
সালাহউদ্দীন আয়ুবী তাকে বললেন, “আল আযেদকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আর যে ঈমান বিক্রি করে দেয় তাকে আমি ঘৃণা করি বলেই তখন আসিনি।”
ডাক্তারের কাছ থেকে আল আযেদের শেষ কথাগুলো শুনে সুলতান দুঃখ করলেন। বললেন, ‘আমি এলে আরও কিছু তথ্য বের করতে পারতাম।’
আল আযেদ যদিও বিলাসপ্রিয় ছিলেন এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী বিরোধী ষড়যন্ত্রে তিনি সহযোগিতাও করেছেন তবুও আয়ুবীর জন্য তার ভালবাসা ছিল। সুলতান বুঝতে পারছিলেন, আল আযেদের এ আহবানে কোন ষড়যন্ত্র ছিল না। তার অন্তিম কথাগুলো শুনতে পারেননি বলে সুলতান দীর্ঘদিন অনুতাপ করেছিলেন।
আলীকে ডাকলেন সুলতান। আল আযেদের দেয়া নামগুলো দিয়ে বললেন, ‘এদের পেছনে গোয়েন্দা লাগাও। প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। কারও প্রতি যেন ন্যূনতম জুলুমও না হয়।’ পরে প্রমাণিত হল প্রতিটি লোকই ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত।
সুলতান আল আযেদের দাফনের ব্যবস্থা করলেন, দাফন করা হল সাধারণ কবরস্থানে। কালের প্রবাহে সে কবরের চিহ্ন মুছে গেছে।
মহলে তল্লাশী নেয়া হল। সোনা রূপা এবং সম্পদের স্তুপ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী।
হারেমের রূপসী এবং অন্যান্য যুবতীদেরকে আলীর হাতে দিয়ে বলা হল, ‘খোঁজ খবর নিয়ে যার যার বাড়ীতে পৌঁছে দাও। ফিরিংগী এবং অমুসলিম মেয়েদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নাও। সন্দেহ হলে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা কর।”
প্রাসাদের সমস্ত ধন সম্পদ সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালে বন্টন করে দিলেন।
মৃত্যুর পূর্বে আল আযেদ বলেছিলেন, ‘রজব বেঁচে আছে। ফৌজ তৈরী করছে আয়ুবীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য।’ দু’জন দুঃসাহসী গুপ্তচর বাছাই করলেন আলী বিন সুফিয়ান। দু’জনই রজবের পূর্ব পরিচিত। ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে ওদেরকে সুদান পাঠিয়ে দেয়া হল। নির্দেশ দেয়া হল রজরকে জীবিত ধরে আনতে। সম্ভব না হলে হত্যা করতে।
গুপ্তচর দু’জন সুদানের পথ ধরল। রজব তখন সুবাক কেল্লায়।
সুবাক ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানদের হেড কোয়ার্টার। এখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করে ওরা।
ওদের অত্যাচারে মুসলিম পরিবারগুলো দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কারও ইজ্জত নিরাপদ নয়। ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানরা ডাকাতের ভূমিকায় লুণ্ঠন করছে মুসলমানদের কাফেলা। মেয়েদের অপহরণ করছে। এ কারণেই সুলতান আয়ুবী ফিলিস্তিন অধিকার করতে চাচ্ছিলেন।
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ওরা দখল করে রেখেছে। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে নির্যাতিত মানুষের বুক ফাটা কান্নায়। ইজ্জত আব্রু লুন্ঠিত নারীর অশ্রু শুষে নিচ্ছে মরুর বালুকারাশি। কিন্তু মুসলমান আমীর ওমরাদের সম্পর্ক সাধারণ মুসলমানদের চেয়ে অভিজাত খ্রিস্টানদের সাথেই বেশী।
রজব আয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সামরিক সাহায্যের জন্য এসেছে সুবাক ঘাটিতে। তার সম্মানে নৃত্যগীতের আসর জমানো হল। নাচনেওয়ালী যুবতীদের অধিকাংশই মুসলমান। অল্প বয়সে অপহরণ করে ওদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পুরুষ ঘায়েলের জন্য। রজব একবারও তা ভাবল না, স্বজাতির মেয়েরা অমুসলিমের আসরে উলংগ নাচছে। সে উপভোগ করছে আর মদপান করছে। সাথে দু’জন মুসলমান কমান্ডার। রাত ভর আসরে মত্ত হয়ে রইল ওরা।
কথা শুরু হল সকালে, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পুইলজিনান এবং কোনার্ড। এ ছাড়াও ছিলেন ক’জন পদস্থ সামরিক অফিসার।
রাতে রজব ওদের বলেছিল, ‘আয়ুবী সুদানে এক কাফ্রী গোত্রের মন্দির ভেঙে দিয়েছে। হত্যা করেছে পুরোহিতকে। সুদানীরা আক্রমণ করেছিল, সফল হয়নি। সে খলিফা আল আযেদকে সরিয়ে মিসরকে আব্বাসী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে। এতে মনে হয় আয়ুবী মিসরের একচ্ছত্র সম্রাট হতে চাইছে।’
রজব মিটিংয়ে আরো বলল, ‘আমি সামরিক সাহায্যের জন্য এসেছি। সুদান ফিরে ফৌজ তৈরী করবো। মিসরের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্যও আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি।’
এ মুহুর্তে দুটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিৎ। বললেন কোনার্ড, “যে গোত্রের মন্দির ভাঙা হয়েছে তাদেরকে প্রতিশোধের জন্য উত্তেজিত করা। অন্যদিকে সুদানের সব ধর্মের লোকদের বলা যে, সুলতান আয়ুবী অন্য ধর্মের ইবাদতখানা, দেবতা এবং মূর্তি ভেঙে ফেলে। আঘাত হানে অন্য ধর্মের ওপর। সে যতদিন বেঁচে থাকবে কোন ধর্মই নিরাপদ নয়। ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে সুদানীদের আয়ুবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়।’
‘মিসরের মুসলমানদেরকেও আমরা আয়ুবীর বিরুদ্ধে দাড় করাতে পারব।”
এক খ্রিস্টান কমান্ডার বলল, ‘মিঃ রজব, মনে কিছু না করলে বলব, মুসলমানদের ভেতর ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টি করে একজনকে দিয়ে অন্যজনকে হত্যা করানো কঠিন নয়। আমাদের ধর্মে বান্দা এবং খোদার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছেন কোন কোন পাদ্রী। ইসলামেও কোন কোন ইমাম মসজিদ দখল করে খোদার এজেন্সি নিয়ে বসে আছে।
আমাদের সম্পদ আছে। টাকা দিয়ে মৌলভী তৈরী করে আমরাও মিসরের মসজিদে বসিয়ে দিতে পারি। খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেকে কোরান এবং ইসলামের জ্ঞানে পারদর্শ। ওদেরকেও মুসলমানদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ করা যায়। সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে মসজিদে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মৌলবীরা ওয়াজের মাধ্যমে মানুষকে কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ করবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই আয়ুবীর সম্মান কমে যাবে।’
‘এ কাজ এখনি শুরু করা উচিৎ।’ বলল রজব, ‘আয়ুবী মিসরে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। শিশু, কিশোর, যুবক সবাই ওখানে ধর্মের সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে। সে আসার পূর্বে মিসরে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। লোকজন মসজিদের খোৎবা শুনত, যেখানে বেশীরভাগ থাকত খলিফার প্রশংসা।
মানুষের জ্ঞানের চোখ খুলে গেলে আমাদের কাজ করতে কষ্ট হবে। দেশ শাসন করতে হলে মানুষকে দৈহিক এবং মানসিকভাবে পরিনির্ভরশীল রাখতে হয়।’
‘মিঃ রজব!’ এক কমান্ডার মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার দেশে গোপনে কি হচ্ছে তাই জানেন না আপনি। সালাহউদ্দীন যেদিন আমাদের রোম উপসাগরের পাড়ে পরাজিত করেছিল, সেদিন থেকেই এ কাজ শুরু মুসলমানদের বিকলাঙ্গ করার জন্য সবকিছুই করা হচ্ছে।
ভেবে দেখুন, দু’বছর আগে কায়রো শহরে কয়টা পতিতালয় ছিল, আর এখন কটা? বিত্তশালী পরিবারের তরুণ তরুণীরা অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় ডুবে যায়নি?
আমাদের পাঠানো খ্রিস্টান মেয়েরা মুসলমানের ছদ্মবেশ নিয়েছে। হত্যা করাচ্ছে। কায়রোর স্থানে স্থানে এখন আকর্ষণীয় জুয়ার আখড়া। দুটো মসজিদে রয়েছে আমাদের পাঠানো ইমাম। ওরা ইসলামের রূপ পাল্টে দিচ্ছে। জেহাদের তাৎপর্য ব্যখ্যা করছে ভিন্ন ভাবে।
ওখানে আলেমের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে আমাদের বেশ কিছু লোক। ওরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বুঝাচ্ছে। বন্ধু এবং শক্রর ধারণা পাল্টে দিচ্ছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, ক’বছর পর ওরা নিজেরা মুসলমান বলে গর্ব করলেও ওদের মনমানসিকতায় থাকবে খ্রিস্টানদের সভ্যতা সংস্কৃতি, কথা বলবে আমাদেরই ভাষায়, চিন্তা করবে আমাদের মস্তিষ্ক দিয়ে।’
‘সালাহউদ্দীনের গোয়েন্দারা অত্যন্ত সতর্ক,’ রজব বলল, ‘গোয়েন্দা প্রধান আলীকে শেষ করতে পারলে আয়ুবী অন্ধ এবং বধির হয়ে যাবে।’
‘এর অর্থ আপনি নিজে কিছুই করতে পারছেন না!’ কোনার্ড বলল, ‘একজন সরকারী কর্মচারীকেও আপনি হত্যা করতে পারছেন না। এতটা বুদ্ধিহীন হলে আমাদের লোকদেরকেও ধরিয়ে দেবেন। ওরাও মারা পড়বে, অহেতুক নষ্ট হবে আমাদের সম্পদ।’
“ঠিক আছে, এ কাজ আমি নিজেই করব। ঘাতকদলের সাথে কথা বলেছি, ওরা সালাহউদ্দীনকে হত্যা করতে প্রস্তুত।’
‘আপনি সুদানের দিক থেকে মিসর সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি করবেন।’ কোনার্ড বললেন, ‘দেশের ভেতরে আমরা ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করার তৎপরতা চালাব। আরবের কয়েকজন আমীর ওমরাকে আমরা হাত করে নিয়েছি। মুসলমানদের মধ্যে এখন দু’টো লোকই বেঁচে আছে, নুরুদ্দীন জংগী এবং আয়ুবী। ওদের শেষ করতে পারলে পৃথিবী থেকে ইসলামের সূর্য ডুবে যাবে। তবে আপনাদেরকে অটল থাকতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এরপর মিসর হবে আপনাদের।’
এভাবে আলাপ চলল দীর্ঘক্ষণ। আয়ুবীকে প্রতিহত করার বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হল। বিদায়ের সময় রজবের হাতে তুলে দেয়া হল তিনটে অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী। দেয়া হল প্রচুর স্বর্ণমূদ্রা। কায়রোর দু’জন সম্মানিত ব্যক্তির ঠিকানা দিয়ে বলা হল, ‘মেয়ে তিনটিকে গোপনে তাদের কাছে পৌঁছে দেবেন।’
দু’জনের একজন ফয়জুল ফাতেমী।
‘মেয়েদের কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তিনি জানেন। মেয়েরাও জানে কি করতে হবে ওদের। ওরা কয়েকটা ভাষায় পারদর্শী।’
বিদায় নিল রজব। সাথে তিনটে মেয়ে এবং দশজন সৈনিক।
আংগুক গোত্রের কাছে যাচ্ছে সে। ওদের দেবতা এবং মন্দির ভেঙেছেন আয়ুবী। মিসর থেকে পালিয়ে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিল রজব। জংলী কাফ্রীদের নিয়ে মিসর আক্রমণ করেছিল, সফল হয়নি। গোত্রের বেশীর ভাগই মারা গেছে।
এখনও পাহাড় ঘেরা স্থানকে ওরা দেবতার আশ্রম মনে করে। ভয়ে কেউ ভেতরে ঢোকেনা। গোত্রের ধর্মীয় গুরু আরও তিনজনকে নিয়ে দেবতার আবাসে গেলেন। নিজেকে নিজে পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত করলেন। এ তিনজন তার দেহরক্ষী। দেবতার আশ্রমে কেবল এ চারজনই আসা যাওয়া করত।
পাহাড়ের এক নিভৃত স্থানে আস্তানা গাড়ল রজব। ওখান থেকেই একদিন ফিলিস্তিন অভিমুখে ছুটল।
আংগুক গোত্র ছিল ভীত সন্ত্রস্ত্র। দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া যায়নি, পুরোহিত মারা গেছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে দেবতার বিগ্রহ। তাছাড়া দেবতার অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছে হাজার হাজার যুবক। ঘরে ঘরে মাতম।
কেউ কেউ ভাবতে লাগল, যে দেবতার আশ্রম ভেঙে দিতে পারে, সে নিশ্চয়ই বড় দেবতা।
বর্তমান পুরোহিত গোত্রের অবস্থা দেখে বললেন, ‘দেবতাদের কুমীর ক্ষুধার্ত। ওদের খাবারের ব্যবস্থা কর।’
কাফ্রীরা উট, ভেড়া, ছাগল পাঠিয়ে দিল। কিন্তু মানুষের অন্তর থেকে দেবতাকে নাখোশ করার ভয় দূর হল না।
এক রাতে পুরোহিত গোত্রের সবাইকে একত্রিত করলেন পাহাড়ের বাইরে। বললেন, ‘আমি দেবতাদের সাথে কথা বলেছি। সময়মত বলি না দেয়ায় এ বিপদ এসেছে। দেবতারা বলেছেন, এক সংগে দু’টো মেয়ে বলি দিলেই কেবল এ বিপদ দূর হবে। তা না হলে দেবতা কাউকে ছাড়বে না।’
দুঃসাহসী যুবকেরা উঠে দাঁড়াল। মিসর থেকে তুলে আনবে দু’টো মুসলমান বা ফিরিংগী মেয়ে।
ফিলিস্তিন থেকে আসছে রজব। সাথে তিন যুবতী এবং দশজন সৈন্য। দীর্ঘ বিপজ্জনক সফর। সে আয়ুবীর ফৌজের বিদ্রোহী এবং পলাতক কমান্ডার। সীমান্তে পেট্রোল ডিউটি দিচ্ছে সুলতানের সৈন্য। ধরাপড়ার আশংকা রয়েছে। অনেক ঘুরপথ দিয়ে চলছে সে। খাবার এবং পানি বোঝাই তিনটি উট। ওদের বাহন ঘোড়া।
ক’দিন পর ওরা দেবতার আশ্রম পাহাড়ে পৌঁছল। এর একদিন আগে পুরোহিত মেয়ে বলি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
রজব প্রথমেই দেখা করল পুরোহিতের সাথে। তিনটে সুন্দরী যুবতী দেখে পুরোহিতের চোখ ঝলসে উঠল। বলির জন্য উপযুক্ত। মেয়েদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল পুরোহিত। রজব বলল, ‘এদেরকে বিশেষ উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে।”
তিনদিকে পাহাড় ঘেরা এক মনোরম জায়গায় মেয়েদের নিয়ে গেল রজব। তাঁবু টানাল। সুযোগ পেলেই ওদেরকে কায়রো পাঠিয়ে দেবে। পথে কোন ঝামেলা হয়নি, নিরাপদেই পৌঁছতে পেরেছে এ খুশীতে রাতে উৎসব জমাল। জমল মদের আসর। খ্রিস্টান সৈন্যরাও অংশ নিল এতে। পান করল মেয়েরাও।
মধ্যরাত। ঘুমিয়ে আছে সবাই। একটা মেয়ের হাত ধরে নিজের তাঁবুর দিকে যেতে চাইল রজব। উদ্দেশ্য বুঝে ফেলল মেয়েটি। বেঁকে বসল। বলল, ‘আমি পতিতা নই। এসেছি ক্রুুশের দায়িত্ব পালন করার জন্য। আপনার সাথে মদপান করতে পারি, কিন্তু বাজে প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারি না।”
রজব হেসে ওকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা। রজব বাড়াবাড়ি করতেই ও হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে সংগী মেয়েদের কাছে ছুটে গেল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল অন্য দু’জন। ওরা রজবকে বুঝিয়ে বলল, ‘বিশেষ প্রয়োজনে ওদের আসা। রজব যেন ওদের বেশ্যা মনে না করেন।’
ক্ষেপে গেল রজব। তোমরা কেমন সতী আমি জানি। তোমাদের পেশাই হল বদমাইশি আর বেশ্যাগিরি।
দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনেই কেবল আমরা এ পেশা ব্যবহার করি। ভোগবিলাসের জন্য করিনা।
রজব কোন কথা শুনতে নারাজ। তাকে বুঝাতে না পেরে মেয়েরা বলল, আমাদের সাথে দশজন সৈন্য আছে। আমাদের হেফাজতের জন্য এসেছে ওরা। কাল ওদের ফিরে যাবার কথা। কিন্তু আমরা প্রয়োজন মনে করলে ওদের রেখে দিতে পারি বা বাড়বাড়ি করলে আমরা ফিরেও যেতে পারি।
হুমকিটা ঠিকমতই কাজে লাগল, চুপ মেরে গেল রজব। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হল সে মেয়েদের সহজে ছাড়বে না।
পরদিন সৈন্যদের বিদায় করে দিল সে। দিন গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যায় মেয়েদের সাথে গল্প করছিল রজব, পুরোহিত এলেন চারজন কাফ্রী সাথে নিয়ে। রজবকে বললেন, “আমাদের দেবতা অসন্তুষ্ট। তিনি দু’টি ফিরিংগী অথবা মুসলমান মেয়ের রক্ত চেয়েছেন। এ মেয়েরা বলির জন্য উপযুক্ত। এখান থেকে দু’টো মেয়ে আমাদের দিতে হবে।’
রজবের মাথায় বাজ পড়ল যেন। বলল, ‘এদের বলি দেয়ার জন্য আনা হয়নি, এদের দিয়ে অন্য কাজ করাব। যারা তোমাদের অপমান করেছে তাদের হত্যা করব এদের সাহায্য নিয়ে।’
‘তুমি মিথ্যে বলছ।’ পুরোহিত বলল, ‘তুমি ভোগের জন্য এদের এনেছ। এদের দু’জনকে অবশ্যই আমরা বলি দেব।’
রজব অনেক যুক্তি পেশ করল, কোন কিছুই শুনতে রাজি নন পুরোহিত। দেবতা তার মনমানসিকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি এগিয়ে পর পর দু’টো মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আংগুকের মুক্তি এ দু’টো মেয়ের হাতে।’
চলে যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন তিনি। রজবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েদের নিয়ে পালানোর চেষ্টা করোনা। তুমি যেখানেই যাবে, খুঁজে বের করে ফেলবে আমাদের ছেলেরা।’
চলে গেলেন পুরোহিত। মেয়েরা ওদের ভাষা বোঝেনি। ওরা সবাই রজবকে ঘিরে দাঁড়াল। বলল, ‘কি বলেছে কাফ্রীটা।’
রজব বলল, ‘পুরোহিত দেবতাদের নামে বলি দেয়ার জন্য তোমাদের দু’জনকে চেয়েছে।’
একটা মেয়ে বলির ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বলল, ‘মাথা কেটে রোদে শুকাবে। দেহটা ফেলে দেবে ঝিলে। ওখানে অনেক কুমির রয়েছে।’
বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েদের চেহারা। বলল, ‘আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য আপনি কি চিন্তা করেছেন?’
‘আমি অনেক বুঝিয়েছি, পুরোহিত কিছুই শুনতে চাচ্ছে না। এখন তার দয়ার ওপর নির্ভর করছে আমাদের জীবন। ওরা বলছে, আমার ফৌজে ওরা যোগ দেবে, তবে তার পূর্বে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।’
রজবের কথায় ওদের সন্দেহ হল, পুরোহিতকে খুশী করতে চাইবে লোকটা। ওদের বাঁচানোর চেষ্টা সে করবে না। গত রাতেই তাকে চিনে ফেলেছে ওরা। লোকটা ওদের একটু শান্তনাও দেয়নি।
মেয়েরা তাঁবুতে ফিরে গেল। ভাবতে লাগল কি করা যায়। দেবতাকে খুশী করতে বা রজবের ভোগের সামগ্রী হতে ওরা এখানে আসেনি। উদ্দেশ্যহীনভাবে মরতেও চায়না ওরা। সিদ্ধান্ত নিল, ওরা পালিয়ে যাবে। কিন্তু পালিয়ে ফিলিস্তিন পর্যন্ত যাওয়া সহজ নয়। তবু আত্মরক্ষার জন্য ওদেরকে এ ঝুঁকি নিতেই হবে। ওরা শুধু সুন্দরী নয়, জাতির খেদমতের জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ওদের। এভাবে মরার জন্য ওদের ট্রেনিং দেয়া হয়নি।
রাত কেটে গেল। দিনের বেলায় ওরা ঘোড়ার আস্তাবল দেখল। যে পথে এসেছে তাও দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পুরোহিত এসে রজবকে কি বলে চলে গেল।
রজব মেয়েদের বলল, ‘পুরোহিত আগামীকাল তোমাদের নিয়ে যাবে। বাঁধা দিলে আমাকে হত্যা করে ঝিলের কুমির দিয়ে খাওয়াবে বলে শাসিয়ে গেছে।’
মেয়েরা পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ কথা রজবকে বলল না।
‘মরুভূমিতে এত সবুজ কোথেকে এসেছে? কি সুন্দর পরিবেশ। আমাদের একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন?’ বলল শায়লা, ‘মেয়েদের একজন।’
রজব ওদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল ঝিলের কাছে। কিনারে শুয়ে আছে পাঁচটি কুমীর। পানিতে দুৰ্গন্ধ। এক যুবতী বলল, ‘ঝিল কি পাহাড়ের ভেতরে চলে গেছে?’
একসঙ্গে তাকাল সবাই। কুমীর দেখে তিনটি মেয়ে একত্রে চিৎকার করে উঠল।
রজব বলল, ‘বলি দেয়া মেয়েদের দেহ এবং গোত্রের অপরাধীদের দেহ এসব কুমীরকে খেতে দেয়া হয়।’
এ ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ওদের পালানোর চিন্তা আরো দৃঢ় হল। রজবের সাথে ঘুরে ফিরে পালানোর সম্ভাব্য পথ দেখে নিল ওরা।
সুসংবাদ শোনাতে আশ্রম ছেড়ে গাঁয়ে ছুটে গেলেন পুরোহিত। লোকদের ডেকে বললেন, “তোমাদের জন্য সুসংবাদ। আজ থেকে চার রাত পর ভরা পূর্ণিমায় দেবতার আশ্রমে দুটি ফিরিঙ্গী মেয়ে বলি দেয়া হবে। বলিদান শেষ হলেই মন্দির মেরামত করব। এরপর যারা আমাদের দেবতাদেরকে অপমান করেছে তাদের উপর প্রতিশোধ নেব।”
মধ্যরাত। মেয়েগুলো রজবের হাতে তুলে দিচ্ছে মদের গ্লাস। একটার পর একটা গ্লাস নিঃশেষ করে চলেছে রজব। অতিরিক্ত মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে গেল, ভোর পর্যন্ত জাগার সম্ভাবনা নেই।
নিজেদের তাঁবুতে ফিরে গেল মেয়েরা। সফরের প্রস্তুতি নিতে লাগল। জিন বাধল ঘোড়ার পিঠে, আলগোছে সওয়ার হয়ে দিনের দেখা পথ ধরে এগিয়ে চলল।
কাফ্রীদের চারজন পাহারাদার খানিক দূরে ঘুমিয়ে আছে। ওরা জানত, এখান থেকে পালানোর সাহস কারো নেই। পালিয়ে গেলেও হারিয়ে যাবে বিশাল মরুভূমির বিস্তারে। কিন্তু শ্যামল সবুজ এক ভয়ংকর কারাগার থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েরা।
যে পথে রজব ওদের এনেছিল সে পথ ধরেই ওরা ফিয়ে যাচ্ছিল। ওরা ছিল মেধাবী, বুদ্ধিমতি। ওদের ছিল সামরিক ট্রেনিং। তাই ওরা ভাবল, কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু ওরা জানত না উষর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তৃতিতে ধু ধু বালুর সমুদ্রে হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। আদিগন্ত বালির রাজ্যে একজন বুদ্ধিমান মানুষও অবলীলায় প্রতারিত হতে পারে, দিকভ্রান্ত হয়ে হাড়িয়ে জেতে পারে সীমাহীন সীমানায়। এজন্যই লোকেরা মরুভূমিতে ভ্রমণের সময় দলবদ্ধভাবে বের হয়। মরুভূমির এ বিপদ প্রতিরোধের কোন অস্ত্র ওদের হাতে ছিল না।
নিশীথ রাতের নিস্তব্ধতা মাড়িয়ে কিছু দূর পর্যন্ত ধীরে ধীরেই পথ চলল ওরা। এরপর ঘোড়া ছুটাল তীব্র গতিতে। রাতের উত্তাপহীন মরু বাতাস কেটে যতদূর সম্ভব দ্রুত এগিয়ে চলল ওরা। অনেক দূর গিয়ে গতি কমাল। ততক্ষণে রাত একদিকে হেলে পড়েছে। কমে এসেছে ধরা পড়ার আশঙ্কা। এরপর ঢিলেঢালা ভাবেই পথ চলল বাকী রাতভর।
ভোরে সূর্য উঠল। চারপাশে বালিয়াড়ী। সামনে দূরে দেখা যাচ্ছে উঁচু উঁচু পাহাড়। কোন দিকে কোন পথ নেই, যেদিকে চোখ যায় কেবল অন্তহীন বালু আর বালু। ওরা সূর্য দেখে দিক ঠিক করে উত্তরমুখো এগিয়ে চলল।
ঘোড়াগুলো তৃষ্ণাৰ্ত। ওদের পিঠে বাধা মশকে যে পানি আছে তাতে বড়জোর একদিন চলবে। মেয়েরা চারদিক তাকিয়ে কোন খেজুর বাগান বা ওয়েসিস পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে লাগল।
আকাশে উঠে এসেছে সূর্য। তাপ বাড়ছে, উত্তপ্ত হচ্ছে মরুর পরিবেশ। কোন দিকে কোন ছায়া নেই, খর্জুর বীথি নেই, একফোটা পানির চিহ্ন নেই কোথাও।
মাথার উপরে উঠে এসেছে সূর্য। রজবের ঘুম তখনো ভাঙ্গেনি। তিনজন কাফ্রীকে সাথে নিয়ে তাঁবুতে এলেন পুরোহিত। প্রথমেই গেলেন মেয়েদের তাঁবুতে। নেই। ফিরে এসে রজবকে জাগালেন।
‘মেয়েরা কোথায়?’ পুরোহিত বললেন, ‘মেয়ে দু’টোকে আমার হাতে তুলে দাও।
‘এমন মূল্যবান মেয়েগুলোকে নষ্ট করবেন না।’
কিন্তু পুরোহিত নিজের সিদ্ধান্তে অটল। চিৎকার করে বললেন, “মেয়েরা কোথায়?’
তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল রজব। ডাকল মেয়েদের। মেয়েদের তাঁবু থেকে কোন জবাব এল না। এগিয়ে গিয়ে মেয়েদের তাঁবুর ভেতর উঁকি দিল। তাকাল এদিক ওদিক। না, কোথাও নেই ওরা।
দৃষ্টি ফেলল আস্তাবলে, জিনসহ তিনটি ঘোড়া গায়েব। ফ্যাকাশে হয়ে গেল রজবের চেহারা। পুরোহিতকে বলল, ‘ওরা তোমাদের ভয়ে পালিয়ে গেছে। তোমরা আমার মহা মূল্যবান মেয়েগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছ।’
‘তুমিই ওদের ভাগিয়ে দিয়েছে।’ পুরোহিত সংগীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে বেঁধে ফেল। ও আবার আংগুকের দেবতাদেরকে অসন্তুষ্ট করেছে।’
পুরোহিতের সংগীরা রজবের দিকে এগিয়ে গেল। পুরোহিত একজনকে বললেন, ‘গাঁয়ে যাও। দ্রুত ঘোড়া ছুটাতে পারে এমন যুবকদেরকে এখনি এখানে ডেকে নিয়ে আস। মেয়েরা নিশ্চয়ই এখনো বেশী দূর যেতে পারেনি। ওদের পিছু নাও।’
শত অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও রজবকে পিছমোড়া করে গাছের সাথে বেঁধে ফেলল ওরা। তার সংগীদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হল। বলা হল, তাঁবুর বাইরে পা বাড়ালেই হত্যা করা হবে।
একটুপর জন দ্রুতগামী অশ্বারোহী মেয়েদের পেছনে ছুটল। বালিতে ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্ন স্পষ্ট। ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ওরা। আট দশ ঘন্টা আগে পালিয়েছে মেয়েরা। কিন্তু কাফ্রীরা মরু সন্তান। চরম কষ্ট সহিষ্ণু উপজাতি। ভয়ংকর বিপদ মোকাবেলা করেই জীবন কাটে ওদের। ধুলোঝড় সৃষ্টি করে ওদের রেখে যাওয়া ট্রেইল ধরে ঘোড়া ছুটল তীব্র গতিতে।
সামনে ট্রেইল নেই। বালু উড়ে ঘোড়ার পদচিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে। তবুও অনুমান করে দ্রুত এগিয়ে চলল ঘোড়সওয়ার দু’জন।
চার ঘন্টা একটানা ঘোড়া ছুটিয়েছে ওরা। হঠাৎ দূর দিগন্তে দেখা গেল ধুসর লালচে বালু ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছে। আতংকিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চাইল ওরা। ছুটে আসছে মরু ঝড় সাইমুম।
ঘোড়া ঘুরিয়ে পেছন দিকে ছুটতে লাগল ওরা। প্রাণপনে সরে যেতে চাইছে ওরা সাইমুমের ছোবল থেকে।
সাইমুমের প্রচন্ডতা ওদের চাইতে আর কেউ বেশী জানে না। এ ঝড় নিমেষে লন্ডভন্ড করে দেয় বালির পাহাড়। কেউ থেমে গেলে বা বসে পড়লে তার উপর মুহুর্তে তৈরী হয়ে যায় আরেকটা বালির পাহাড়। ছুটতে থাকলে উড়িয়ে নিয়ে যায় মাইলকে মাইল দূরে। পাথুরে কোন পাহাড়ের সুবিধাজনক খাঁজে লুকোতে পারলেই কেবল কিছুটা বাঁচার আশা করা যায়।
আশপাশে তাকাল ওরা। ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার মত কোন শক্ত পাহাড় নেই ধারে কাছে। ওরা যেতে চাচ্ছিল সামনের পাহাড় শ্রেণীতে, যা এখনও অনেক দূরে।
ঝড় পৌঁছে গেছে দেবতার পার্বত্য আবাসে। কুমীরগুলো আশ্রয়, নিয়েছে পাহাড়ের গর্তে। মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে গাছগাছালী। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পুরোহিত চিৎকার করে বলছেন, “আংগুকের দেবতা! তোমার এ অভিশাপ তুলে নাও। আমরা খুব শীঘ্রই দু’টো রূপসী যুবতী তোমার উদ্দেশ্যে বলি দেব।’
পুরোহিত ঝড়কে দেবতার অভিশাপ মনে করছিলেন।
মেয়ে তিনটেও ঝড়ের কবলে পড়ল। আশ্রয় নেয়ার কোন আড়াল ছিল না। ওরা কাফ্রীদের নাগাল থেকে অনেক দূরে এক বিজন মরুতে। ঝড়ের আঘাতে আতংকিত ঘোড়া এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগল। সামরিক বাহিনীর ঘোড়া, শত বিপদেও তাই ওরা বিচ্ছিন্ন হলো না। এক সাথে ছুটছে ঘোড়াগুলো, কোথায় গিয়ে থামবে জানেনা ওরা।
সাইমুম সরাসরি ওদের ওপর আঘাত হানেনি। নিস্তেজ একটি শাখার ঝাপটা খেয়েই মেয়েগুলোর অবস্থা কাহিল। কাহিল ঘোড়াগুলোও। ঘোড়াগুলো যেমন দ্রুত ছুটতে পারছে না, তেমনি মেয়েরাও ওদের সামলানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
তৃষ্ণার্ত ঘোড়াগুলো মাঝরাত থেকে একনাগাড়ে ছুটেছে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলো। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল একটা ঘোড়া সাথে সাথে ছিটকে পড়ল আরোহিনী। ঘোড়াটা ডিগবাজি খেয়ে পড়ল গিয়ে মেয়েটা ওপর। উপরে ঘোড়া, নীচে মেয়েটা। বুঝতে পারল মারা যাচ্ছে ও।
অন্য ঘোড়া দু’টো খানিক এগিয়ে গেল। ওদের থামাতে চাইল মেয়েরা। টেনে ধরল লাগাম। হঠাৎ গতি পড়ে যাওয়ায় সামনের দিকে বুকে পড়ল আরেকটা মেয়ে। ঘোড়ার জিন ঢিলা হয়ে কাত হয়ে গেল একদিকে। মেয়েটা পড়ে গেল নীচে। পা দানিতে আটকে গেল বাম পা। দৌড় থামালেও ঘোড়াটা তার হাঁটা থামাল না, মেয়েটা মাটির সাথে হেঁচড়াতে থাকল।
তৃতীয় মেয়েটা ওদের কোন সাহায্য করতে পারছে না। ওর নিজের ঘোড়াও বশে নেই, এলোমেলো ছুটছে সে। কানে ভেসে আসছে মেয়ে দুটাের হৃদয় ফাটা চিৎকার। দীর্ঘক্ষণ এ চিৎকার ধ্বনি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। এক সময় থেমে গেল চিৎকার। একটা মেয়ের লাশ ঘোড়ার সাথে হিঁচড়ে যাচ্ছিল, সেদিকে বোবার মত তাকিয়ে রইল ও ভয়ার্ত ও আতংকিত দৃষ্টি। দুঃসাহসী গোয়েন্দা হলেও ও একটা মেয়ে। হঠাৎ কি হল, নিরবতা ভেঙে সেও চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
তার চিৎকার শুনেই কিনা আল্লা মালুম, হঠাৎ থেমে গেল সামনের ঘোড়াটা। ও নিশ্চিত জানে, মরে গেছে তার বান্ধবী। তবু কি এক অব্যক্ত আশা নিয়ে সে তাকিয়ে রইল ওদিকে। জলে ভরে গেল চোখ। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চাইল পেছন দিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, ঘোড়ায় চাপা পড়া বান্ধবী বা ঘোড়া কিছুই দেখা গেল না সে অন্ধকারে।
তৃতীয় মেয়েটা এখন একা, নাম রেশমা। রেকাব থেকে পা খানিকটা পেছনে সরিয়ে নিল ও। বলগা ছেড়ে দিয়ে দু’হাত আকাশের দিকে তুলল মেয়েটা। চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘হে মহান প্ৰভু! হে আকাশের মালিক! আমায় ক্ষমা কর। পাপী আমি, পাপের সাগরে আকণ্ঠ ডুবে আছি। পাপ করার জন্যই এসেছিলাম দুনিয়ায়। বড় হয়েছি পাপের মধ্যে। খোদা আমার! আমি তখন খুব ছোট। বড়রাই আমাকে পাপের পথে টেনে এনেছে। পাপের প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করেছে আমাকে। ওরা আমায় বলেছে, যাও, এ চোখ ধাঁধানো রূপ আর দেহ দিয়ে মানুষকে নষ্ট কর, মিথ্যা কথা বল, একজনের হাত দিয়ে আরেকজনকে হত্যা করাও। প্রতারিত কর মানুষকে। ওরা বলেছে, এ হচ্ছে ক্রুশের পক্ষে পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলে তুমি স্বর্গ পাবে।’
ও প্রলাপ বকছিল আর চিৎকার করছিল পাগলের মত। শ্লথ হয়ে এল ঘোড়ার গতি। কাঁদতে কাঁদতে ও বলল, “তোমার কাছে যে ধর্ম সত্য, আমাকে তার মোজেযা দেখাও প্রভু। আমি তোমার সত্য দ্বীনকে চিনতে চাই। মৃত্যুর আগে একবার দেখতে চাই তোমার মহিমা।
তার বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। অনুশোচনায় পিষ্ট হচ্ছে তার কোমল হৃদয়। সে কোন ধর্মের অনুসারী মৃত্যু ভয় তাও ভুলিয়ে দিয়েছে। সে শুধু ভাবছে তার পাপে ভরা জীবনের কথা। চেতনার পরতে পরতে সে পাপের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। ও ভাবছে, আমি কি কেবলই পুরুষের ভোগের সামগ্ৰী? মানুষকে প্রতারিত করার জন্যই কি আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? হায়! এখন আমাকে দেখার আর কেউ নেই।
মাথা ঝাঁকিয়ে তন্দ্রা দূর করে বিলাপের সুরে ও বলতে লাগল, হে খোদা, আমাকে সাহায্য কর। এখনি আমি মরতে চাই না।
হঠাৎ ওর মনে হল ও এক পিতৃহারা। মৃত্যু সামনে এলে মানুষ অতীতে ফিরে যায়। এক যুবতী তার হারানো অতীতে ফিরে যেতে চাইছিল। কিন্তু ওখানে কিছুই নেই। মা নেই, বাবা নেই, নেই কোন ভাইবোন। ওর শুধু মনে আছে, খ্রিস্টানরা ওকে লালন পালন করেছে। ওরাই এ পথে নিয়ে এসেছে ওকে। ও এক মনকাড়া প্রতারণার যন্ত্র।
নিজের উপর ঘৃণা হল ওর ও ক্ষমা চাইছে, মুক্তি চাইছে। আবার তন্দ্রা এসে জাপটে ধরল ওকে। ঘোড়াটা ধীরে ধীরে হাটছে। থেমে গেছে ঝড়। মরুভূমিতে নেমে এসেছে রাতের আঁধার। প্রকৃতির সে সীমাহীন বিশালতা, অন্ধকারে রাতে ঘোড়ার উপর পরে আছে এক অসহায় মেয়ে।
সীমান্ত রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়েছিলেন সুলতান আয়ুবী। সীমান্ত রক্ষীদের হেডকোয়ার্টার ছিল মিসর এবং সীমান্তের চার পাঁচ মাইল ভেতরে এক পাহাড়ের কোল ঘেষে। ওখানে ছিল তিন প্লাটুন সৈন্য। থাকত তাঁবু খাটিয়ে। সীমান্তের বিভিন্ন চেকপোস্টে পাঠিয়ে দেয়া হত সৈনিকদের। এক চেকপোস্ট থেকে আরেক চেকপোস্ট পর্যন্ত টহল বাহিনী নিয়মিত টহল দিয়ে বেড়াত।
আজকের ঝড়ে তাঁবুগুলোর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। উট ঘোড়া সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল সৈন্যরা। ঝড় থামার পর ওরা তাঁবু মেরামতে লেগে গেল। ওদের কমান্ডার একজন তুর্কি। আহমদ কামাল। চমৎকার দেহের গড়ন। ফর্সা আকর্ষণীয় চেহারা।
ঝড় থামতেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মালপত্র এবং উট ঘোড়া দেখলেন। দিগন্ত ফর্সা হয়ে গেছে। একজন সৈনিক দক্ষিণ দিকে ইশারা করে বলল, ‘কমান্ডার, ওই দিকে দেখুন, মনে হয় কোন সওয়ারী।’
‘হ্যাঁ, তাই। দূরে নজর দিয়ে বলল কমান্ডার, এবং মনে হয় সওয়ারী কোন পুরুষ নয় মহিলা।’
‘এ সওয়ারী ও ঘোড়া কি আমাদের?’
‘আমাদের সেনাবাহিনীতে এখনও কোন মেয়ে ভর্তি করা হয়নি। দেখছনা চুল ছড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দু’টো ঘোড়া নিয়ে এসো, অন্ধকার গ্রাস করার পূর্বেই ওর কাছে পৌঁছতে হবে আমাদের।’
মেয়েটাকে নিয়ে ঘোড়াটা তখন ওদের দিকেই আসছিল। ওরাও ঘোড়া ছুটাল ওদিকে। সামনের পথটুকু চোরাবালিতে ভরা। তাই দ্রুত ছুটতে পারছিল না। মেয়েটার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল।
সিপাইকে সাথে নিয়ে কমান্ডার যখন ওখানে পৌঁছল তখন রাতের অাঁধার নেমে এসেছে। ঘোড়াটা মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। ঘ্রাণ শুকে শুকে যাচ্ছে তাঁবুর দিকেই। আরোহী এক যুবতী। মাথা নোয়ানো। ঘোড়ার ঘাড়ের খানিকটা পেছনে অবিন্যস্ত চুল ছড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। অজ্ঞান।
কমান্ডার রেকাব থেকে মেয়েটার পা ছাড়িয়ে পাজাকোলা করে নামিয়ে আনলেন। সিপাইকে বললেন, ‘বেঁচে আছে, মনে হয় ফিরিংগী।’
তুমি ওর ঘোড়াটাকে সামলাও।
মেয়েটাকে নিজের ঘোড়ায় তুলে ওরা যতটা সম্ভব দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে এল। ওকে এক তাঁবুতে নিয়ে গেলেন কমান্ডার। চুলে বালি লেগে আছে। পানির ঝটকা দিলেন মেয়েটার চোখে মুখে। এরপর ফোটা ফোটা পানি দিতে লাগলেন মুখের ভেতর।
চোখ খুলল মেয়েটা। তাকাল আহমদ কামালের দিকে। কয়েক মুহূর্ত হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কমান্ডার। রেশমা বিহবলতা কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি এখন ফিলিস্তিন?”
এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে কমান্ডার বোঝালেন, এ ভাষা তিনি বোঝেন না। মেয়েটা আরবীতে প্রশ্ন করল, “তুমি কে? আমি এখন কোথায়?’
আমি মুসলিম ফৌজের সাধারণ এক কমান্ডার আহমদ কামাল। বললেন, ‘তুমি এখন মিসরে।’
আতংকে বিস্ফারিত হল মেয়েটার চোখ। যেন এখনি জ্ঞান হারাবে আবার। আহমদ কামাল বললেন, ‘ভয় নেই, সুস্থির হও, নিজেকে সংযত কর।”
আহমদ কামালের কথায় তার ভয় ও আতংক মোটেই কমল না, বরং সে আরো অবাক হলো। তার সে অবাক করা ভাব ফুটে উঠল চেহারায়।
আহমদ কামাল আবার বললেন, ‘বুঝেছি, তুমি ফিরিংগী। কিন্তু এখন তুমি আমার অতিথি। ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি একজন মুসলমান। মুসলমান অসহায় নারীদের ইজ্জত করতে জানে। তুমি যে ধর্মেরই হওনা কেন, তোমার ইজ্জত আব্রুর হেফাজত করা এখানকার প্রতিটি সৈনিকের পবিত্র কর্তব্য।’
কমান্ডার একজন সেপাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘এর জন্য খাবার এবং পানি নিয়ে এস।’
পানি আনতেই মেয়েটা পানির গ্লাস লুফে নিয়ে ঢকধক করে পানি পান করতে শুরু করল। আহমদ কামাল তার ঠোঁট থেকে গ্লাস সরিয়ে দিলেন।
‘আস্তে। আগে খেয়ে নাও, পরে পানি পান কর।’
মেয়েটা খাবার খেল, পানি পান করল। চেহারায় ফিরে এল দ্যুতি।
কমান্ডার ওর গোসলের ব্যবস্থা করলেন। গোসল শেষে তাঁবুতে ঢুকল ও। তাঁবুটা ছিল কমান্ডার আহমদ কামালের। কোন তাঁবু খালি না থাকায় এখানেই এনে তুলেছিলেন তিনি ও যখন গোসল করছিল ততক্ষণে কমান্ডার পর্দা টানিয়ে তাঁবুটা দুভাগ করে নিলেন। ও তাঁবুতে ঢুকতেই পর্দা টেনে দিলেন তিনি।
ওর আতংক তখনো কাটেনি। ও জানে, এখন ও শক্রর আশ্রয়ে। এদের কাছে ভাল ব্যবহার আশা করা যায়না। শৈশব থেকেই ওকে বুঝানো হয়েছে মুসলমানরা হল পশু। নারীদের জন্য আস্ত জানোয়ার। এই সাথে ওর মনে ছিল কাফ্রীদের কুমীর এবং মরু ঝড়ের কবলে পড়ার দুঃসহ আতংক।
সংগী দুজনের ভয়ংকর মৃত্যু এখনও ওর চোখে ভাসছে। গোসল করার সময় ওর মনে হয়েছিল, সে এতটাই অপবিত্র যে পৃথিবীর সব পানি ঢাললেও তার সে অপবিত্রতা আর পরিষ্কার করা যাবে না।
এমন অসামান্য রূপবতী তরুণী কোন সাধারণ ঘরের মেয়ে হতে পারেনা, আহমদ কামাল ভাবলেন। এ ফিরিংগী তরুণী এই দুর্গম অঞ্চলে কি করে এল এ ভাবনা তোলপাড় করছিল তার মনে। জিজ্ঞেস করায় যদিও ও বলেছে, ঝড়ের কবলে পড়ে কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ও, কিন্তু সে কথা বিশ্বাস হয়নি কমান্ডারের। গত দু’দিনেও এ অঞ্চলে কোন কাফেলা দেখা যায়নি, গেলে টহল বাহিনীর নজরে তা অবশ্যই পড়তো।
আহমদ কামাল আবারো বললেন, ‘সত্যি করে বলো তো, তুমি, এখানে কি করে এলে?’
‘বলেছি তো, কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।’
‘যদি বলতে, তোমাকে অপহরণ করা হয়েছিল, ঝড় তোমাকে অপহরণকারীর কাছ থেকে বিছিন্ন করে দিয়েছে, তবুও বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি যা বলছে তা বিশ্বাস করা যায়না। এ স্রেফ মিথ্যা। আমার কাছে মিথ্যে বলার কোন দরকার ছিল না।”
কমান্ডারের সাথের সিপাইটা তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে একটা থলি এবং মশক দিয়ে বলল, “ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা ছিল।’
থলিটা খুলতে গেলেন কমান্ডার মেয়েটা চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কমান্ডার তা লক্ষ্য করে তার হাতে থলিটা দিয়ে বললেন, ‘নিজেই খোল, খুলে দেখ সব ঠিক আছে কিনা।’
মেয়েটা যেন বোবা হয়ে গেছে। থলিটা শিশুর মত পিছনে সরিয়ে নিল।
‘বলতে পারি না তুমি চলে যাও।’ কমান্ডার বললেন, ‘তোমাকে আটকে রাখার অধিকারও আমার নেই। কিন্তু যে মেয়েটাকে বিজন মরুতে ঘোড়ার উপর অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে তাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। তোমার হেফাজত করা আমার মানবিক দায়িত্ব। বাড়ীর ঠিকানা বল, সেপাইদের দিয়ে পাঠিয়ে দেব। দেখে মনে হয় তুমি মিসরী নও, সুদানীও নও।’
মেয়েটার চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে এল। পেছনের ভয়ংকর আতংকগুলো ওর স্নায়ু অবশ করে রেখেছে। ও থলি আহমদ কামালের দিকে ছুড়ে দিল। থলির মুখ খুললো কমান্ডার। কিছু খেজুর, মেয়েদের ব্যবহার্য সামান্য টুকিটাকি জিনিস এবং একটি পুটুলী পাওয়া গেল। পুটুলীর মধ্যে অনেকগুলো স্বর্ণ মুদ্রা। একটা স্বর্ণের চেইনের সাথে কাঠের তৈরী ক্রুশ। কমান্ডার ওকে বললেন, এখানে আমার প্রশ্নের জবাব নেই।
‘এ স্বর্ণ মূদ্রাগুলো যদি তোমাকে দেই, আমাকে সাহায্য করবে?’ মেয়েটা প্রশ্ন করল।
‘কেমন সাহায্য?’
‘আমাকে ফিলিস্তিন পৌঁছে দাও। কিন্তু কোন প্রশ্ন করোনা।’
‘তোমাকে অবশ্যই ফিলিস্তিন পৌঁছে দেব তবে প্রশ্নও করব।’
‘আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করলে অন্য পুরষ্কার পাবে।’
‘কি পুরষ্কার?’
‘আমার ঘোড়া তোমায় দিয়ে দিব। তিন দিনের জন্য আমার দেহ হবে তোমার।”
আহমদ কামাল এর আগে এত স্বর্ণ একত্রে দেখেননি। দেখেননি এমন অনন্যা সুন্দরী যুবতী স্বর্ণমূদ্রার দিকে তাকালেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে নিলেন যুবতীর দিকে। তার রেশম কোমল চুল সোনার তারের মত ঝলমল করছে। তাকালেন ওর মায়াবী চোখের দিকে। ও চোখের যাদু এক সম্রাটকে আরেক সম্রাটের শক্রত্বে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। আহমদ কামাল এক স্বাস্থ্যবান যুবক, সীমান্ত রক্ষীদের কমান্ডার। তাকে জিজ্ঞেস করার বা বাঁধা দেয়ার কেউ নেই।
তিনি স্বর্ণমূদ্রা এবং ক্রুস পুটুলীতে বাধলেন। থলিটা ফিরিয়ে দিলেন মেয়েটার হাতে।
‘বিনিময় কি খুব কম?’ মেয়েটার প্রশ্ন।
‘অনেক কম! ঈমানের মূল্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না।”
মেয়েটা কিছু বলতে চাইল, কমান্ডার তাকে সে সুযোগ না দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার কর্তব্য এবং ঈমান বিক্রি করতে পারিনা। আমি আছি বলেই সমগ্র মিসর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে। মাস তিনেক পূর্বে করলে ওরা দখল করে নিত কায়রো। ওদের চাইতে তোমাকে বেশী ভয়ংকর মনে হচ্ছে। তুমিতো কোন গোয়েন্দা নও?’
‘না, বরং বল ঝড় এক অত্যাচারীর কবল থেকে তোমায় রক্ষা করেছে।”
মেয়েটার অর্থহীন জবাব শুনে কমান্ডার বললেন, ‘তুমি কে, কোথেকে এসেছ আমার জানার প্রয়োজন নেই। কাল তোমাকে কায়রোয় আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেব। এর পর কি হবে তা তোমার আর তাদের ব্যাপার।”
অনুমতি পেলে খানিকটা বিশ্রাম করব। কাল কায়রো পাঠানোর সময় তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারব।
গতরাতে ঘুমুতে পারেনি রেশমা। দুঃস্বপ্লের মত ভয়ংকর এক ভ্রমণে ক্লান্ত, শ্ৰান্ত। শোয়ার সাথে সাথেই ও ঘুমিয়ে পড়ল। কমান্ডার তাকিয়ে রইলেন ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করছে। মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক। দুঃস্বপ্ন দেখছে হয়ত। স্বপ্নের মধ্যেই ও কাঁদছে। কমান্ডার সংগীদের বললেন, ‘মেয়েটাকে সন্দেহ হচ্ছে। ওকে কাল কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
সংগীরা কমান্ডারকে জানত। যুবতীকে নিজের তাঁবুতে রেখেছেন বলে কেউ তাকে সন্দেহ করেনি। আহমদ কামাল মেয়েটার ঘোড়া দেখলেন। উন্নত জাতের। জিনের নীচে মিসরী ফৌজের চিহ্ন। মেয়েটা যে গোয়েন্দা এখন আর সন্দেহ নেই।
ঝড়ের কারণে মেয়েদের ধাওয়া করা থেকে কাফ্রীদের বিরত থাকতে হল। জীবন নিয়ে কোনমতে পৌঁছল দেবতার আশ্রমে। পুরোহিত বললেন, ‘মেয়েগুলো ঝড়ের কবলে পড়েছে। ওদের কেউ বেঁচে নেই। বলি দেয়ার সময়ও চলে গেছে। সুতরাং ওদের পিছু নেয়া বৃথা।’
বিপদে পড়ল রজব। বার বার কাফ্রীরা প্রশ্ন করছিল, ‘বল মেয়েরা কোথায়?’
সে শপথ করে বলতে লাগল, ‘আমি জানিনা।’
কাফ্রীরা এতে সন্তুষ্ট নয়। নির্যাতন শুরু হল। তরবাবীর মাথা দিয়ে খোঁচা মেরে একই প্রশ্ন করতে লাগল ওরা। অত্যাচার চলল রজবের সংগীদের উপরও। ওরা দেশ এবং জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিণাম ভোগ করছিল। সারা রাত চলল এ নির্যাতন ঝাঝরা হয়ে গেল তিনটা দেহ।
কমান্ডারের তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিল মেয়েটা। সারাটা দিন ঘুমিয়েই কাটাল। জাগল সূর্য ডোবার খানিক আগে। আহমদ কামাল বলল, ‘যাক বাবা, ঘুম তাহলে ভাঙল। দেখো, খাবার রাখা আছে। আবার ঘুমোনোর আগে চারটে খেয়ে নিও।’
খেয়ে দেয়ে ও ঘুমিয়ে পড়ল আবার। কমান্ডার ঘুমিয়েছিল মেয়েটার কয়েক কদম দূরে। তাঁবুতে জুলছে প্রদীপের আলো। ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে।
গভীর রাতে হঠাৎ মেয়েটা চিৎকার করে উঠল। চোখ খুলে গেল কমান্ডারের। মেয়েটা বসে আছে। কাঁপছে। চোখে মুখে আতংক।
কাছে এলেন কমান্ডার। মেয়েটা কমান্ডারকে জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। ওরা আমায় কুমীরের মুখে ছুড়ে দিবে। আমার মাথা কেটে ফেলবে ওরা।’
‘কারা?”
‘কাল কাফ্রীরা।’ মেয়েটার কন্ঠে ভীতি। ‘ওরা এখানেও এসেছিল।’
কাফ্রীদের বলির কথা জানতেন কমান্ডার। ভাবলেন, একে হয়ত বলি দেয়ার জন্য নেয়া হচ্ছিল। মেয়েটাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোমাকে কি বলি দেয়ার জন্য অপহরণ করা হয়েছিল?’
ও কমান্ডারের গলা জড়িয়ে রেখেই বলল, “আমাকে এ নিয়ে আর প্রশ্ন করোনা। আমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।”
কামাল তার ফ্যাকাশে চেহারা দেখে শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে কেউ তোমাকে নিতে পারবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’
‘আমার আর ঘুম আসবে না। তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারবে? একা একা জেগে থাকতে পারব না। আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব।”
‘ঠিক আছে যখন ভয় পাচ্ছ, তোমার সাথে আমিও জেগে থাকব।’
মেয়েটাকে শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ এখানে আছ ভয়ের কারণ নেই।’
তবে তিনি ওকে কাফ্রী বা নিজের সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ওরা কথা বলে কাটিয়ে দিল বাকি রাতটুকু। কথার বেশীর ভাগ ছিল তুর্কিস্তান এবং মিসরের গল্প। এক সময় ও ঘুমিয়ে পড়ল।
সূর্য উঠার দেরী নেই। মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসল সে। দেখল ফজরের নামায পড়ছেন আহমদ কামাল। ও নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নামাজ শেষ করে দোয়ার জন্য হাত তুললেন কমান্ডার। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘তুমি খোদার কাছে কি চেয়েছ?’ মুনাজাত শেষ হলে প্রশ্ন করল তরুণী।
‘অন্যায় প্রতিরোধ করার শক্তি।’
‘তুমি স্বর্ণ এবং সুন্দরী যুবতী পাওয়ার জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করনি?’
‘না চাইতেই এ দু’টো খোদা আমায় দিয়েছেন। কিন্তু তার ওপর আমার কোন অধিকার নেই। হয়ত তিনি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন।’
‘তুমি কি মনে কর তিনি তোমাকে পাপের মোকাবিলা করার শক্তি দিয়েছেন?”
‘কেন, দেখনি। তোমার স্বর্ণ এবং তোমার রূপ যৌবন আমাকে আমার কর্তব্যচ্যুত করতে পারেনি। এ হল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং আমি তার কাছে এটাই চাই।’
‘তিনি কি পাপ মোচন করেন?’
‘হ্যাঁ, তিনি পাপ মোচন করেন। তবে শর্ত হল সে পাপ বার বার করা যাবে না।”
মাথা নোয়াল মেয়েটা। ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। কমান্ডার ওর মাথায় হাত রাখলেন। ও আহমদ কামালের হাত দু’টো ধরে কয়েকবার চুমো খেল। কামাল হাত সরিয়ে নিলেন। ও বলল, ‘আজ আমায় পাঠিয়ে দেবে কায়রো, তোমার সাথে হয়ত আর কোন দিন দেখা হবেনা। যাবার আগে আমি কে, কোথেকে এসেছি তোমাকে বলে যেতে খুব মন চাইছে। তুমি অনুমতি দিলে আমার বর্তমান অবস্থা বলব।’
যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমি নিজেই তোমার সাথে যাচ্ছি। এ ধরনের বিপজ্জনক দায়িত্ব সাধারণত আমি অন্য কাউকে দেইনা।
‘আমি কে, কোথেকে এসেছি তাও শুনবে না?’
‘চল, এ কথা শোনার দায়িত্ব আমার নয়।’ বলে কমান্ডার তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কায়রো অভিমূখে রওয়ানা হল দু’টি ঘোড়া। সামনে আহমদ কামাল। পেছনের ঘোড়ায় চেপেছে মেয়েটা। তার পেছনে আড়াআড়িভাবে চারজন রক্ষী সেনা। সব শেষ প্রয়োজনীয় খাবার দাবার সহ একটি উট। প্রায় ছত্রিশ ঘন্টার সফর। রেশমা দু’বার কমান্ডারের পাশাপাশি চলার চেষ্টা করল।
‘তোমার ঘোড়া সৈন্যদের মাঝখানে রেখো।’ কমান্ডার বললেন।
সূর্যাস্তের পর আহমদ কামাল কাফেলা থামিয়ে তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন। রাতে মেয়েটাকে শোয়ালেন নিজের তাঁবুতে। আলো জ্বলছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর রাতে কারো আলতো স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখেন মেয়েটা পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
তড়াক করে উঠে বসলেন কমান্ডার। মেয়েটার চোখে চোখ রাখলেন। ও কাঁদছে।
আহমদ কামালের হাত নিজের দুহাতে তুলে নিল বিদেশিনী। ঠোঁট ছোঁয়াল তার হাতে। এর পর শিশুর মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তাকিয়ে রইলেন কমান্ডার। মেয়েটা অশ্রু মুছে বলল, “আমি তোমার দুশমন। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য তোমার দেশে এসেছি। এসেছি বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদের মাঝে শক্রতা সৃষ্টি করতে। সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে হত্যা করার জন্য আমাকে ফিলিস্তিন থেকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, এখন আমার মনে কোন শক্রতা নেই।’
‘তুমি খুব ভীতু মেয়ে। কেন আপন জাতির সাথে গাদারী করছ। শূলির কাঠে দাঁড়িয়ে বল, আমি ক্রুশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিচ্ছি।‘
‘আমার মনে শক্রতা নেই কেন জান? তুমিই প্রথম পুরুষ যে আমার অনন্য রূপ যৌবনকে ঘৃণা করেছ। প্রত্যাখ্যান করেছ আমার আহবান। আপন পর সবাই আমাকে পাওয়ার জন্য উন্মুখ। পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে, ওদের সাথে প্রতারণা করে বিলাসিতার জীবনকেই জীবনের উদ্দেশ্য মনে করেছিলাম। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাকে ট্রেনিংও দেয়া হয়েছে।’
‘তোমাদের কাছে যা অশ্লীলতা, আমাদের কাছে তা শিল্প, এক মোক্ষম অন্ত্র। ধর্ম কি জানি না, খোদার বিধান বুঝি না। শৈশব থেকে পরিচিত হয়েছি ক্রুশের সাথে। বলা হয়েছে ক্রুশ হচ্ছে খোদার চিহ্ন। খৃষ্টানদের মর্যাদার প্রতীক। সমগ্র বিশ্ব শাসন করার অধিকার কেবল ক্রুশধারীদের। মুসলমানরা হচ্ছে ক্রুশের দুশমন। ওদের কাছে এই হচ্ছে ধর্মের মূলনীতি।
‘ওদের ধর্মের মূলনীতি আমরা জানি। তোমার কাহিনী আমাকে বলার দরকার নেই, যা বলার কায়রো গিয়ে ব’লো।’
‘রজব নামের কোন কমান্ডারকে চেন!”
‘সে ছিল খলিফার রক্ষী ফৌজের কমান্ডার। সুদানী ষড়যন্ত্রের সাথে সেও শরীক ছিল।’
“এখন কোথায়?’
‘জানিনা, আমাদের শুধু বলা হয়েছে রজব সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গেছে। দেখা মাত্র যেন তাকে গ্রেফতার করি। পালাতে চাইলে তীর মেরে শেষ করে দেয়ার অনুমতিও আছে। কেন? তুমি কিভাবে তাকে চেন? সে এখন কোথায় তুমি জান কিছু?’
‘সে এখন সুদানে কাফ্রীদের কাছে। ওখানে আছে এক মনোরম স্থান। কাফ্রীরা ওখানেই যুবতীদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়। রজব ওখানেই আছে। ফিলিস্তিন থেকে তার সাথেই আমাদের তিনজনকে পাঠানো হয়েছে।’
‘অন্য দু’জন কোথায়?’
‘ওরা মারা গেছে।’ তরুণীর কণ্ঠে বিষন্নতা। ‘ওদের মৃত্যুই আমাকে বদলে দিয়েছে।’
‘কিভাবে ওরা মারা পড়ল?’
কাফ্রীরা দু’টো মেয়েকে বলি দিতে চেয়েছে, রজব ওদের বাঁচানোর চেষ্টা করেনি থেকে শুরু করে ওখান থেকে পালিয়ে আসা এবং ঝড়ের কবলে দু’জনের মৃত্যুসহ সকল কাহিনী কমান্ডারকে খুলে বলল সে।
মেয়েটা আরো বলল, ‘একদিন এই আমি নিজেকে শাহজাদী মনে করতাম। আমি ছিলাম সম্রাটদের হৃদয়রাণী। খোদা বা মৃত্যু আছে এ কথা কখনও ভাবিনি। আমাদেরকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, আমরাও সানন্দে তাতেই ডুবেছিলাম। সে ছিল ভোগ বিলাসের এক মোহময় জগত।
আমাদেরকে কুমীর দেখানো হল, মস্তকবিহীন যুবতীদের দেহ যাদের আহার। কিনারে শুয়েছিল কুমীরগুলো। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। যে দেহের সামনে বড় বড় সম্রাটদের মাথা নুয়ে থাকে, সে দেহ হবে কুমীরের খাদ্য!
আমার মাথা কাটার জন্য যে সব কুৎসিত কাফ্রীরা এসেছিল আমি তাদের দেখেছি। চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত্যুর বিভীষিকা। আমার বিবেক জেগে উঠল। আত্মার ভেতর থেকে শব্দ হল, নিজের অনন্য রূপ আর মাদকতাময় দেহের পরিণাম দেখ।
মরণ পণ করেই বেরিয়েছিলাম আমরা। আমাদেরকে রজবের হাতে তুলে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘এ লোকটি তোমাদের হেফাজত করবে। কিন্তু ও আমাদের দিকে লোভের হাত বাড়াল, আমরা পালালাম।
ঝড়ের কবলে পড়ে ঘোড়াগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ল। প্রথমে একটা মেয়ে পড়ে গেল। তার ওপর পড়ল ঘোড়াটা। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, কিছুই করার ছিল না। এরপর দ্বিতীয় মেয়েটা ঘোড়ার সাথে ঝুলতে ঝুলতে মারা গেল। ওর কলজে ফাটা চিৎকার এখনও আমি শুনতে পাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব আমার কানে বাজতে থাকবে ওর সে বুকফাটা আর্তচিৎকার।
আমার ঘোড়াটা ছুটছিল, কিন্তু আমার বশে ছিল না। আমি তখন একা। দুটি মেয়েকে মেরে খোদা আমাকে আমার পরিণতি বুঝিয়ে দিলেন। ওরা ছিল আমার চেয়ে সুন্দরী এবং হাসি খুশী ৷ রূপ যৌবন নিয়ে ওদের অহংকার ছিল। কত রাজা বাদশাকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়েছে ওরা। কিন্তু মরার পর কেউ জানলওনা, বালির পরিচয়হীন কবরে ওরা সমাহিত হয়ে আছে।
আমি নিঃসঙ্গ। ঝড়ের ভেতর থেকে ভেসে এল মৃত্যুর অট্টহাসি। ডানে বায়ে ওপরে এবং নীচে প্রেতাত্মা আর ভূতপ্রেতের ক্রুর হাসি শোনা যাচ্ছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম, এ সবই আমার পাপের ফল। খোদাকে মনে পড়ল। পাপের জন্য তার কাছে বার বার ক্ষমা চাইলাম। বেঁচে। থাকার জন্য সাহায্য চাইলাম তার কাছে। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি তোমার কব্জায়।
তোমার সাদা চামড়া দেখে খুশী হয়েছিলাম। তুমি ইউরোপীয়, আমি ফিলিস্তিনের। নিজের ভাষায় নিজের পরিচয় দিলাম। যখন বুঝলাম মুসলমানের হাতে পড়েছি, দমে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঝড় থেকে বেঁচে এলাম শক্রর কাছে!
আমাদের বলা হয়েছিল, মুসলমানরা মেয়েদের সাথে পশুর মত ব্যবহার করে। কিন্তু আমি ধারণাও করিনি তুমি এমন ব্যবহার করবে। ফিরিয়ে দিয়েছ আমার দেয়া স্বর্ণ। গ্রহণ করনি আমার দেহের সৌরভ।
আমি ছিলাম আতংকিত। যে কেউ আমাকে আশ্রয় দিলে তাকে বুকে স্থান দিতাম। তোমার উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে তখনও আমার ধারণা ছিল না। ভেবেছিলাম রাতে বিরক্ত করবে।
স্বপ্নে কুমীর দেখলাম, কাফ্রী এবং ঝড় দেখলাম। জেগে গেলাম আতংকে। তুমি শিশুর মত আমায় অভয় দিলে। তোমার গল্প শুনতে শুনতে আমার সব ভয় দূর হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন জাগলাম তুমি নামাজ পড়ছ। দোয়া করার জন্য হাত তুললে, তোমার নিমিলীত চোখে আমি দেখেছি এক অনাবিল প্রশান্তি, এক অবিশ্বাস্য আলোর ঝলক। সন্দেহ হল তুমি মানুষ না দেব-দূত। কোন মানুষ সোনা আর আমার মত নারীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এ আমার কাছে অবিশ্বাস্য।
তোমার চেহারার প্রশান্তি এবং আনন্দের দ্যুতি আমার চোখে অশ্রু এনে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, তোমাকে কে দিয়েছে এ প্রশান্তি!
তোমাকে ভুলের মধ্যে রাখতে মন চাইল না। ইচ্ছে হল আমার ব্যাপারে সব কথা তোমাকে খুলে বলি। বিনিময়ে তুমি আমাকে তোমার সে প্রশান্তি দাও, দূর করে দাও আমার সকল ভীতি, যে আতংক এখনো আমাকে পিষ্ট করছে। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না। কর্তব্যবোধ তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।”
রেশমা আহমদ কামালের হাত ধরে বলল, ‘হয়ত এসব কথা তুমি প্রতারণার নতুন কৌশল মনে করছ। তুমি যা ইচ্ছে ভাবতে পার, কিন্তু আমি আমার আত্মার সাথে প্রতারণা করতে পারব না।
আমার হৃদয়ের গভীরে তোমার জন্য যে ভালবাসা জন্ম নিয়েছে সে জন্য কি আমি দায়ী? আমি তো তোমাদের খুন করতেই এসেছিলাম, কিন্তু তোমার ব্যবহারে এবং তোমার হৃদয়ে প্রশান্তি দেখে আমারও লোগ জাগল সে প্রশান্তিময় জীবনের প্রতি।
আমার মনে হয়, এ জীবনে আমি তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনো বাঁচতে পারব না। কাল তোমাকে পাপের জন্য আহবান করেছিলাম। এখন! জীবন ভর তোমার পায়ের কাছে বসে থাকব। আমায় দাসী হিসেবে গ্রহণ কর, বিনিময়ে সে প্রশান্তি দাও, যা নামাজ পড়ার সময় তোমার মধ্যে দেখেছি।”
আহমদ কামাল মুখ খুলল। বলল, ‘আমি বলব না, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করছ। তবে এটুকু তোমাকে জানিয়ে দেয়া দরকার মনে করছি যে, আমি আমার জাতি এবং ফৌজকে ধোঁকা দিতে পারব না। তুমি আমার কাছে আমানত। এ আমানতের খেয়ানত আমি করতে পারি না। তোমার সাথে যে ব্যবহার করেছি তা ছিল আমার কর্তব্য কায়রোর নির্দিষ্ট সংস্থার কাছে তোমাকে তুলে দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ। এরপর আমাকে নির্দেশ দেয়া হবে, কামাল, এবার তুমি ফিরে যাও।’
রেশমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। কান্না একটু সামলে ওঠে মিনতি ঝরা চোখে তাকাল কামালের দিকে। বলল, ‘তোমার কাছে আমার ছোট্ট আবেদন তোমাদের সুলতান আমাকে যখন মৃত্যুদন্ড দেবেন তখন তুমি আমার হাত ধরে পাশে শুধু দাঁড়িয়ে থেকো।”
রেশমার চোখ আবারো জলে ভরে উঠল। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ‘এখন আর ফিলিস্তিন পৌঁছে দিতে তোমাকে অনুরোধ করব না। বাঁধা হয়ে দাঁড়াব না তোমার কর্তব্যের সামনে। শুধু একবার বল, তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছ।
এ অপবিত্র দেহ নিয়ে তোমার কাছে স্ত্রীর মর্যাদা চাইনা, ট্রেনিং দিয়ে আমাদের হৃদয়টাকে পাথরে পরিণত করা হয়েছিল। ভাবতাম, আমাদের মধ্যে মানবিক অনুভূতি বলে নেই। কিন্তু খোদা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, মানুষ পাথর নয়, কোন একদিন কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়, মুসাফির, পথ আর কতদূর ঠিক পথে চলছি তো! এসো না দু’জনে হাতে হাত রেখে আরো কিছু পথ চলি নীরবে।’
রাত এগিয়ে যাচ্ছে, কথা বলছে দু’জন। আহমদ কামাল প্রশ্ন করলেন, “তোমাদের মত মেয়েদেরকে ওরা আমাদের দেশে পাঠায় কেন? মেয়েরা কি কাজ করে এখানে?”
‘অনেক কাজ। মুসলমান আমীর ওমরাদের হারেমে মুসলমানের ছদ্মবেশে ঢুকিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের। ওরা আমীর ওমরা এবং মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের হাত করে নেয়। খ্রিস্টানদের মনোমত লোককে ক্ষমতায় বসাতে সহযোগিতা করে। খ্রিস্টান বিরোধী আমীর ওমরাদের হত্যা করতে বা ক্ষমতাচ্যুত করতে প্ররোচিত করে।
মুসলিম যুবতীদের রূপের অহমিকা থাকলেও ওরা ততোটা চতুর নয়। ইহুদী বা খ্রিস্টান মেয়েরা কৌশলে ওদের দাসীবাদীতে পরিনত করে। ওদের কারণে আমীর, মন্ত্রী এবং কেল্লাদারদের অধিকাংশ থাকে আমাদের পক্ষে। কোন কোন মেয়ে পদস্থ ও বড় লোকদের রক্ষিতা হয়ে থাকে। এরা যুবক-যুবতীদের চরিত্র নষ্ট করে। যুবকদেরকে অশ্লীলতার পথে টেনে নিয়ে আসে। সংস্কৃতির নামে নারী পুরুষকে বেহায়াপনার শেষ সীমানায় পৌঁছে দেয়।
আমার মত অভিজাত ও রূপসী খ্রিস্টান মেয়েরা তোমাদের পদস্থ লোকদের কাছে আসে গোপনে। তখন কর্মকর্তারা হয় খ্রিস্টানদের হাতের পুতুল। গোপন অভিসারে আমরা ওদের প্রেম নিবেদন করি, ভালবাসারজনকে দেই নানা উপহার, মূল্যবান সামগ্ৰী আর স্বর্ণমূদ্রা। কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে এজন্য মেয়েদের লুকিয়ে রাখা হয়।
সালাহউদ্দীন আয়ুবী এবং নুরুদ্দীন জংগীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির জন্যও ওরা কাজ করছে। আমাদের তিনজনকে এ উদ্দেশ্যেই রজবের হাতে দেয়া হয়েছিল।
খ্রিষ্টানদের গোপন তৎপরতার কাহিনী বলে যাচ্ছিল মেয়েটা, নীরবে শুনছিলেন আহমদ কামাল।
সূর্য ডোবার খানিক আগেই-কায়রো পৌঁছল কাফেলা। কমান্ডার গোয়েন্দা প্রধানের সাথে দেখা করলেন। মেয়েটার ব্যাপারে সব কথা বলে তাঁর হাতে তুলে দিলেন। আরও বললেন, ‘রজব কাফ্রীদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। থাকে দেবতার আশ্রমে। অনুমতি দিলে তাকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য অভিযান চালাব।’
আলী চারজন কমান্ডো সৈন্য তাকে দিয়ে বললেন, ‘এখন বিশ্রাম করগে।’
গোয়েন্দা প্রধান আলী মেয়েটাকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। প্রশ্নের জবাবে ও বলল, আহমদ কামাল আমার সামনে বসে থাকলে সব প্রশ্নের জবাব দেব। তা না হলে আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিলেও মুখ খুলব না।
আলী আহমদ কামালকে ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি ওর পাশে বসো।’
মৃদু হেসে রেশমা বলতে শুরু করল। সবকিছুই খুলে বলল সে, কিছুই গোপন করলনা। শেষে বলল, ‘আমাকে মৃত্যুদন্ড দিন দুঃখ নেই, কিন্তু আমার একটা শেষ ইচ্ছে পুরণ করতে হবে। আমি আহমদ কামালের হাতে মরতে চাই।”
‘আহমদ কামাল তোমার কাছে একজন শত্রু সৈন্য, তার হাতে মরতে চাচ্ছ কেন?’
আহমদ কামালকে কেন এত ভালবাসে তা খুলে বলল ও। আলী ওকে জেলে না পাঠিয়ে আহমদ কামালের হাতে তুলে দিলেন। নিজে ছুটলেন সুলতানের কাছে। মেয়ের বলা কথাগুলো সুলতানকে শোনালেন। বললেন, ‘সুলতান! আপনার বিশ্বস্ত ফয়জুল ফাতেমী আমাদের দুশমন। মেয়েরা তার কাছেই আসছিল।’
“মিথ্যে কথা।’ সালাউদ্দীন আয়ুবীর কণ্ঠে ঝাঁঝ। মেয়েটা মিথ্যে কথা বলে তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। ফয়জুল ফাতেমী এমন হতেই পারেন না।”
সম্মানিত সুলতান সে ফাতেমী বংশের, আপনি তা ভুলে গেছেন। সম্ভবত এও ভুলে গেছেন, ফাতেমীরা ঘাতকদলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা আপনার অনুগত হতেই পারে না। খলিফা আল আযেদ তাকে আপনার শক্ৰ বলে উল্লেখ করেছিল।”
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী। কাকে আর তিনি বিশ্বাস করবেন! কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আলী, প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি তোমাকে দেব না। প্রমাণসহ সুযোগ মত ধরতে হবে তাকে, সে সুযোগ সৃষ্টি করা তোমার দায়িত্ব। আমি হাতে নাতে ধরতে চাই তাকে। ফয়জুল সেনা প্রশাসনের প্রধান কর্মকতা। যুদ্ধের সব গোপন পরিকল্পনা সে জানে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রমাণ পেশ কর।’
‘সুলতান, এ জন্য আমি এক পরিকল্পনা পেশ করছি। মেয়েটার উপর দিয়ে ভয়ংকর ঝড় বয়ে গেছে। আতংক জড়িয়ে আছে ওর মন মস্তিষ্কে। আহমদ কামালের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে সে। আহমদ কামাল তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, এ জন্য কৃতজ্ঞ সে। তা ছাড়া তার ব্যবহারেও সে চমৎকৃত হয়েছে। আহমদ কামালের অনুপস্থিতিতে সে কথাই বলতে চায়নি। আশা করি মেয়েটার এ দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ওকে ব্যবহার করতে পারব।”
‘চেষ্টা করে দেখ। তবে মনে রেখ, বাস্তব প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি দেবনা।’
আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটার কাছে গেলেন। বুঝিয়ে বললেন উদেশ্য।
কামাল বললে আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারব।
আলী চাইলেন আহমদ কামালের দিকে। চোখে চোখে কথা হলো দু’জনের।
‘হ্যাঁ, উনি যেভাবে বলেন কর।’ আহমদ কামাল বললেন, “কি করতে হবে বুঝে নাও।’
‘আমি সফল হলে আমাকে কি পুরষ্কার দেয়া হবে?’
“তোমাকে নিরাপদে ফিলিস্তিনের শুবাক কেল্লায় পৌঁছে দেয়া হবে।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ‘এখানে যতদিন থাকবে সম্মানের সাথে রাখা হবে।’
‘না, এ বিনিময় খুবই নগণ্য। আমি আরও বড় পুরষ্কার চাই। আমি মুসলমান হব। আমায় বিয়ে করবে আহমদ কামাল।’
আহমদ কামাল এ প্রস্তাব সরাসরি অস্বীকার করলেন। তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বুঝিয়ে বললেন প্রস্তাবে রাজি হতে।
আহমদ কামাল বললেন, ‘জানি ও মুসলমান হবে। এরপরও ওকে আমি ইসলামের শক্রই মনে করব।”
‘ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে নয়, আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট। ও আমার চাইতেও খাঁটি ঈমানদার হবেনা এমন কথা আমি বলতে পারিনা। দীলের মালিক আল্লাহ, ও ইসলামে ফিরে এলে শক্রর অনেক গোপন খবর জানতে পারব আমরা। বিয়েটা যদিও তোমার একান্ত নিজের পছন্দের ব্যাপার, তবু দেশ এবং জাতির স্বার্থে তোমাকে এ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’
গোয়েন্দা প্রধানের কথা মেনে নিলেন আহমদ কামাল। ওরা আবার ভেতরে গেলেন। আহমদ কামাল মেয়েটাকে বললেন, “তোমাকে এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। যদি তুমি আমার জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পার, আমার ধর্মের প্রতি অনুরাগী হও, তোমাকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’
মেয়েটা আলীকে বলল, ‘বলুন কি করতে হবে। দেখব মুসলমান প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে কিনা। তবে ওকে আমার সাথে থাকতে হবে?’
আলী তার এ শর্ত মেনে নিলেন। একজন অফিসারকে ডেকে ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। দরজা বন্ধ করে আহমদ কামালের সামনে ওকে দায়িত্ব বুঝাতে লাগলেন আলী বিন সুফিয়ান।
তিন দিন পর। উটে চড়ে দেবতার আশ্রমে পৌছুল ছ’জন সৈন্য। পরনে সামরিক পোশাক। হাতে তীর ও বর্শা। কোমরে ঝুলানো তরবারী। মেয়েটার বর্ণনা শুনে এভাবে এদের পাঠিয়েছেন আলী।
আশ্রম প্রাঙ্গনে ঢুকতেই একটা বর্শা এসে ওদের সামনে মাটিতে গেথে গেল। থেমে গেল ওরা। এগিয়ে এলেন পুরোহিত। সাথে তিনজন কাফ্রী। হাতে বর্শা।
কাফ্রীরা বলল, “তোমরা এখন তীরন্দাজদের আওতার মধ্যে। নড়াচড়া করলে সবাইকে হত্যা করা হবে।’
কাফ্রীদের সামনে ওরা অস্ত্র ফেলে দিল। নেমে এল উটের পিঠ থেকে। দলনেতা পুরোহিতের সামনে এসে বলল, ‘আমরা তোমাদের বন্ধু। বন্ধুত্ব নিয়ে এসেছি, ফিরে যাব বন্ধুত্ব নিয়ে। তোমরা কি তিনটে মেয়েকে বলি দেয়ার কাজ শেষ করেছ?”
‘আমরা কোন মেয়ে বলি দেইনি!’ পুরোহিতের কন্ঠে ক্ষোভ। ‘তোমরা এ প্রশ্ন করছ কেন?’
‘আমরা মিসরের বিদ্রোহী সৈন্য, মুসলমানরা তোমাদের দেবতার অপমান করেছে, এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যে ফৌজ তৈরী হয়েছে আমরা সে দলের। আমরা পরাজিত হয়েছি। তোমাদের লোকেরা বলেছে, মেয়ে বলি দেয়া হয়নি বলে দেবতা আমাদের অভিশাপ দিয়েছেন।
আমরা ছিলাম রজবের সংগী। একটার পরিবর্তে তিনটা ফিরিংগী মেয়ে অপহরণ করে তার হাতে তুলে দিলাম। অনেক দূর থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লোভ দেখিয়ে ওদের এনেছি। রজব ওদের এখানে নিয়ে এসেছে। গত পরশু ওর ফিরে যাবার কথা ছিল। ও ফিরে না যাওয়ায় মেয়েদেরকে বলি দেয়া শেষ হয়েছে কিনা আমরা তা দেখতে এসেছি।”
দল নেতার কথায় গলে গেলেন পুরোহিত। বললেন, ‘রজব আমাদের সাথে বজ্জাতি করেছে। মেয়েদের এখানে এনে তার নিয়ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে ওদের এখান থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে পালাতে দেইনি, শাস্তি দিয়েছি। মেয়েরা আমাদের হাত থেকে পালিয়ে গেছে। তোমরা কি আরও দুটা মেয়ের ব্যবস্থা করতে পার? দেবতা আমাদের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট।’
‘অবশ্যই করব। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা নতুন দু’টো মেয়ে নিয়ে ফিরে আসব। দেবতাকে অসন্তুষ্ট করে বারবার পরাজিত হতে চাইনা। রজব বেঈমানী করে থাকলে ওকে আমরা খুন করে ফেলব। আমাদেরকে রজবের কাছে নিয়ে চল। দেখি বেঈমানটা কি বলে?”
পুরোহিত সকলকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। মাটির তৈরী একটা ভাঁড়ের কাছে গিয়ে থামলেন তিনি। অন্য একটা পাত্র দিয়ে ঢাকা ভাঁড়, পুরোহিত ঢাকনা তুলে ভেতরে হাত ঢুকালেন। ধীরে ধীরে বের করে আনলেন হাত।
হাতে রজবের কাটা মাথা। অক্ষত চেহারা, আধখোলা চোখ, মুখ বন্ধ। চুল থেকে পানি ঝরছে। নষ্ট না হওয়ার জন্য মাথাটা ওষুধে ডুবানো হয়েছে।
পুরোহিত বললেন, ‘ওর দেহটা কুমীরকে খেতে দিয়েছি। সংগী দুটোকে ঝিলে ছেড়ে দিয়েছি জীবন্ত। আমার কুমীরগুলো ক্ষুধার্ত।’
‘মাথাটা আমাদের দিতে হবে। আমরা এ মাথা আমাদের সকল সংগীকে দেখাব। ওদের বলব, আংগুকের দেবতার অপমান করলে এই পরিণতিই হবে। ভবিষ্যতে আর এমন কাজ করতে সাহস পাবেনা কেউ।’
‘নিতে পার, তবে আগামীকাল সুর্যাস্তের আগেই ফেরত দিতে হবে। আংগুকের দেবতা এ মস্তিষ্কের মালিক। ফিরিয়ে না দিলে তোমাদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’
দুদিন পর সৈনিকরা ফিরে এসে সুলতানের পায়ের কাছে রেখে গেল রজবের কাটা মাথা।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সুলতান আয়ুবী। গভীর রাত। আহমদ কামাল ঘুমিয়েছিল নিজের কামরায়। তার পাশের বিছনায় শুয়ে আছে রেশমা। এ কক্ষে তাদের দুদিন কেটে গেছে। রেশমা বার বার বলেছে, ‘আমি মুসলমান হব। তুমি আমায় বিয়ে কর।’
‘আগে কর্তব্য পালন কর।’ আহমদ কামালের স্পষ্ট জবাব।
আহমদ কামাল ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন এ দু’দিন। রেশমা তাই তার সাথে প্রতারণা করা হতে পারে বলে কয়েকবার সন্দেহ প্রকাশ করল।
‘তোমার এ সন্দেহ ভিত্তিহীন। যে নীতি-নৈতিকতার কারণে তোমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছি সে নীতিই ওয়াদা পালনে আমাকে বাধ্য করবে। তুমি তোমার কাজ শেষ কর, আমি আমার ওয়াদা পালন করব।”
আহমদ কামালের এসব কথায় ওর মনের ভয় ও সন্দেহ দূর হয়ে গেল। তার মাঝে ফিরে এল স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি। গভীর ভাবনায় ডুব দিল ও।
এক রাতে দু’জন বারান্দায় শুয়ে আছে। বাইরে সেন্ট্রি। মাঝ রাতে সেন্ট্রি হাঁটতে হাঁটতে একদিক থেকে আরেক দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
সহসা পেছন থেকে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল কেউ। সাথে সাথে অন্য দু’জন এসে কাপড় দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলল। শক্ত করে বেঁধে ফেলল হাত-পা।
অন্ধকারে চারজন বাড়ীর ফটকে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ। একজন দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অন্যজন তার কাঁধে পা রেখে দেয়াল টপকাল। ভেতর থেকে খুলে দিল ফটক। ভেতরে ঢুকল তিনজন।
একজন মেয়েটার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। তুলে নিল কাঁধে। অন্য তিনজন আহমদ কামালকে রশি দিয়ে খাটের সাথে শক্ত করে বাঁধল। প্রতিরোধ করার কোন সুযোগই তিনি পেলেন না।
বাইরে গিয়ে মেয়েটার গায়ে কম্বল চাপিয়ে দিল। একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল চারটি ঘোড়া। চারজন চারটি ঘোড়ায় চেপে বসল। একজন তার সাথে তুলে নিল মেয়েটাকে। কেউ যেন সন্দেহ না করতে না পারে সে জন্য নির্জন পথ ধরে ওরা শহর থেকে বেরিয়ে এল।
শহরের পাঁচ মাইল দূরে ফেরাও পাহাড়ে ফেরাউনের আমলের পতিত ভাঙা বাড়ী। বাড়ীটা বিশাল এক পাথুরে টিলায়। টিলা কেটে বানানো হয়েছে কামরা, একটা দুটো নয় অনেকগুলো।
এ কামরাগুলোর নীচের দিকে এগিয়ে গেছে সিড়ি। সে সিড়ি ভেঙে নীচে গেলে ওপরের মতই পাওয়া যাবে সারি সারি কামরা, পেঁচানো বারান্দা, এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়ার অপ্রশস্ত পথ। অচেনা লোক কখনো ওখানে গেলে পথ চিনে ফিরে আসা কষ্টকর।
বাড়িটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ভয়ংকর সব কথা প্রচলিত আছে বাড়িটি সম্পর্কে। ভয়ে কেউ ও পথ মাড়ায়না। কাছে গেলেই কেমন গা ছমছম করে। সবাই মনে করে ওখানে জিন ভুতের আড্ডা। বিষাক্ত সাপের ভয়ে ভেতরে ঢোকার সাহস করেনা কেউ। এমনকি দিনের বেলায়ও কেউ বাড়িটার ধারে কাছে যায়না।
অপহরণকারীরা মেয়েটিকে নিয়ে ভূতুড়ে বাড়ীটার ভেতর প্রবেশ করল। ওরা এমন ভাবে হাঁটতে লাগল যেন ওটা ওদের নিজের বাড়ী। অবলীলায় পথ ভেঙে অতিক্রম করছে কামরার পর কামরা। সামনে মশালের আলো ধরে হাঁটছে একজন। পায়ের শব্দে চামচিকা, বাদুর, টিকটিকি ছুটে পালাচ্ছে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে মাকড়সার জাল।
পাথরের তৈরী বিশাল এক কামরায় প্রবেশ করল ওরা। মশালবাহী লোকটি দেয়ালের এক জায়গায় হাত রাখল। এক কোণার মেঝের খানিকটা জায়গার পাথর সরে গেল।
বেরিয়ে এল সুড়ংগ সিঁড়ি। নীচের দিকে নেমে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। ওপরের কামরার মত বিশাল কামরা এখানেও। কামরায় ফরাশ বিছানো। ফরাশে চমৎকার চাদর। সাজানো গুছানো কক্ষ।
কামরায় পৌঁছে মেয়েটার মুখের কাপড় খুলে দেয়া হল।
মুখ খুলতেই রাগের সাথে চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘কেন আমাকে ধরে এনেছ তোমরা? কি চাও আমার কাছে? বদমতলব থাকলে শুনে রাখ, মরে যাব, তবুও কাউকে কাছে আসতে দেব না।’
‘এভাবে তুলে না আনলে আগামীকাল ভোরে ওরা তোমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিত। আমার নাম ফয়জুল ফাতেমী। আমার কাছেই তোমাদের আসার কথা ছিল। অন্য দু’জন কোথায়? রজব কোথায়? তুমি একা ধরা পড়লে কিভাবে?’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা বলল, ‘খোদার শোকর তিনি আমাকে এক ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আমি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে পেরেছি।’
এরপর ফয়জুল ফাতেমীকে রজব এবং কাফ্রীদের কথা, ঝড়, আহমদ কামালের হাতে ধরা পড়া, সব ঘটনা খুলে বলল ও। শোনাল দু’টো মেয়ের মৃত্যুর করুণ কাহিনী। ফয়জুল তাকে শান্তনা দিলেন।
অপহরণকারী চারজনকে ছ’টি করে স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে বললেন, যে যার স্থানে চলে যাও। আমিও বেরিয়ে যাব একটু পর। ও এখানে তিন চার দিন থাকবে। প্রতিরাতেই আমি আসব। বাইরে ওর খোঁজাখুজি শেষ হলে নিয়ে যাব নিরাপদ আশ্রয়ে।
লোক চারজন বেরিয়ে গেল। লুকিয়ে রইল বাড়ীর পাশে। ফয়জুল ফাতেমীর সাথে রইল একজন সেনা কমান্ডার।
ফয়জুলের খুশীর অন্ত নেই। তার অভিযান সফল হয়েছে।
মেয়েটার কাছ থেকে দু’টো মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে যদিও তিনি দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না।
রজবের পরিণতি তিনি জানেন না। বললেন, ‘রজবকে ওখান থেকে বের করে আনতে হবে। সে সালাহউদ্দীন এবং আলীকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছে। ঘাতক দলের সাথে কি কথা হয়েছে আমি জানিনা। যতশীঘ্র সম্ভব এ দুটো লোককে হত্যা করতে হবে।’
তারপর রেশমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এখন নতুন করে পরিকল্পনা করব, অন্যদের সাথে কথা বলে তোমাকে কি করতে হবে কাল বলব তোমায়। এখন বিশ্রাম কর, আমাকে জরুরী কাজে ফিরে যেতে হচ্ছে। তোমার দেখাশোনার জন্য লোক থাকবে এখানে, কোন অসুবিধা হবে না।”
‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আপনাকে কতটা বিশ্বাস করেন?’ প্রশ্ন করল রেশমা।
‘নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও আমার সাথে পরামর্শ করেন।’
‘শুনেছি উধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে সুলতান আয়ুবীর অনুগতদের সংখ্যা বেশী। সেনাবাহিনীও তার অনুগত।’
‘একথা ঠিক!’ কমান্ডার কথা বলল এবার। ‘তার গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত সতর্ক। কেউ কোথাও মাথা তুললে সাথে সাথে ওরা টের পেয়ে যায়। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যারা সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বিরুদ্ধে কাজ করছে সম্মানিত ফয়জুল ফাতেমী আপনাকে বলবেন।’
ফয়জুল ফাতেমী ওদের নাম উল্লেখ করে মৃদু হাসলেন।
‘তোমাকে উঁচু পর্যায়ে কাজ করতে হবে। দু’জনের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে হবে। দু’জনকে খাওয়াতে হবে বিষ। এ দু’টো কাজই তোমার জন্য সহজ। তবে সমস্যা হল, তোমাকে কোন জলসা বা সভায় নেয়া যাবে না। পর্দানসীন মুসলমান মেয়েদের মত বোরকা না পরলে ধরা পড়ে যেতে পার। তা না হয় তোমাকে ফিলিস্তিন ফেরত পাঠিয়ে অন্য কোন অপরিচিত মেয়ে নিয়ে আসতে হবে। তবে একটু সমঝে চললে আশা করি কোন অসুবিধা হবে না।’
‘আমার গ্রুপ অত্যন্ত তৎপর এবং চৌকস। ওরা সবাই প্রায় কমান্ডার পর্যায়ের। যে চারজন সাহসের সাথে তোমাকে তুলে এনেছে ওরাও আমার নিজের লোক। আয়ুবীর সেনাবাহিনীতে আমরা অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। ফৌজের বিরুদ্ধে জনগণের মাঝে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ চলছে।”
‘সিরীয় এবং তুর্কী সৈন্যদেরকে মানুষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে। সুদানীদের পরাজিত করায় শহরের লোকজনও সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধা করে বলে শুনেছি।”
‘সাধারণ মানুষের এ অনুভূতিকে আহত করতে হবে। সেনা অফিসারদের অপদস্ত করতে হবে। তা না হলে খ্রিস্টান বা সুদানীরা আমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। এ ব্যাপারেও আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে, তবে এখনি সব বলা যাবে না।’
‘আমি এ কয়দিন ওদের হাতে থেকে বুঝেছি, আয়ুবীর বাহিনী বাইরের যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিক থেকে খ্রিস্টান বাহিনী অন্যদিক থেকে সুদানীরা আক্রমণ করলেও পরাজিত হবে। জনগণ সেনাবাহিনীর সাথে মিশে কায়রোকে এমন দূর্গে পরিণত করবে যা জয় করা সম্ভব হবে না। ’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। কায়রো জয়ের জন্য আমাদেরকে ময়দান তৈরী করতে হবে। সাধারণের মাঝে বিদ্বেষ ছড়াতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে যুবকদের চরিত্র এবং নৈতিকতা।’
‘আমাকে বলা হয়েছে দু’বছর থেকেই এ কাজ চলছে।’
‘আমরা যথেষ্ট সফলতা লাভ করেছি। বেহায়াপনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আইয়ুবী দেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। খোতবা থেকে খলিফার নাম সরিয়ে ইসলামের সত্যিকার রূপ তুলে ধরছে। তা ছাড়া মেয়েদেরকে সামরিক ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। তার এসব তৎপরতা আমাদের কিছুটা ক্ষতি করছে।’
‘এখন বাইরে যাবেন না।’ পাহারাদারদের একজন ভেতরে এসে বলল, ‘মনে হয় কিছু সমস্যা হয়েছে।’
ভয় পেয়ে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। মশাল নিভিয়ে লোকটার সাথে বেরিয়ে এলেন কি হয়েছে দেখার জন্য।
ফকফকা জ্যোৎস্না বাইরে। একটা উঁচু বেদীর ওপর লুকিয়ে তিনি চারদিকটা দেখলেন ভাল করে। বললেন, ‘তোমরা যথেষ্ট সতর্কতার সাথে কাজ করতে পারনি। মনে হয় সৈন্যরা ঘেরাও করে ফেলেছে বাড়ি। ঘোড়াও আছে, দেখো, আমি কোন দিক দিয়ে বেরোতে পারি।”
‘আমরা চারদিকই ভাল করে দেখেছি। ওরা আমাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। আপনি ভেতরে যান। আলো জ্বালাবেন না। কক্ষ থেকে বের হবেন না। ওরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাঁধা দেব আমরা, কেউ ওখান যেতে পারবে না।”
বাড়ীর ভেতর চলে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। ওপর থেকে নেমে এল পাহারাদার। ভেতরে না ঢুকে অন্ধকারে পা টিপে টিপে দেয়াল ঘেষে বেরিয়ে এল বাইরে।
পঞ্চাশজন পদাতিক ও জনাপঁচিশেক ঘোড়সওয়ার ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। লোকটা একজন সৈন্যকে জিজ্ঞেস করে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গেল। আলীর সাথে দাঁড়িয়েছিল কমান্ডার আহমদ কামাল।
লোকটি বলল, ‘ভেতরে কোন সমস্যা নেই। আপনার সাথে দু’জন লোকই যথেষ্ট, আমার সাথে আসুন।’
আলী দু’টো মশাল জ্বালালেন। হাতে কোষমুক্ত তরবারী। আহমদ কামাল এবং চারজন সিপাইকে সাথে নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি।
একজন পাহারাদার ভেতরের দিকে দৌড় দিল। আলীর সংগী লোকটি বলল, “এ লোকটা তার নিজস্ব। ওদেরকে সাবধান করার জন্য গেছে।’
তাড়াতাড়ি চল।
ছুটে যাওয়া পাহারাদারের পিছু নিয়ে ছুটলেন ওরাও। সংগী লোকটি না থাকলে আকাবাঁকা পথে এতক্ষণে ওরা হারিয়ে যেত।
একদিক থেকে ভেসে এল ছুটন্ত মানুষের পায়ের আওয়াজ। কেউ একজন অনুচ্চ কন্ঠে বলল, ‘আমি আগে আগে যাচ্ছি, আপনারা দ্রুত আসুন।’
দলটি পাথুরে কক্ষে পৌঁছুল। এখান থেকে সিড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। কেউ একজন বলছে, আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এ দু’জন ওদের লোক।
তলোয়ারে তলোয়ার টক্কর খেতে লাগল। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল দু’দল। ভেতর থেকে শব্দ এল, ‘ওকেও শেষ করে দাও। যেন সাক্ষী দিতে না পারে।’
আলী এবং আহমদ কামাল লাফিয়ে সিড়ি ভাঙলেন। কক্ষের মেঝেয় রক্ত বইছে। দুহাতে পেট চেপে ধরে বসে আছে রেশমা। তার মুখ ঢেকে রেখেছে তার এলোমেলো রেশমী চুল।
ফয়জুল ফাতেমীর সংগী কমান্ডার এবং অন্য একজন ফয়জুল ফাতেমী আর এক পাহারাদারের সাথে লড়ছে। বিপক্ষের তলোয়ারগুলো দেখে দমে গেলেন ফয়জুল ফাতেমী। অস্ত্র ছেড়ে দিলেন।
রেশমার কাছে গেলেন আহমদ কামাল। পেট চিরে ফেলা হয়েছে তার। বিছানার চাদর চিরে কষে বেঁধে আলীকে বললেন, ‘অনুমতি দিলে ওকে বাইরে নিয়ে যাব।’
রেশমাকে কোলে তুলে নিলেন আহমদ কামাল। ব্যাথা ভূলে গেল সে। মুচকি হেসে বলল, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, ধরিয়ে দিয়েছি অপরাধীকে।’
অপহরণকারী দলের দু’জন সহ ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করা হল। বাকী দু’জন ছিল আলীর লোক।
সুলতান আইয়ুবী বলেছিলেন, ‘খোঁড়া অজুহাত দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।’
আলী বিন সুফিয়ান রেশমার কাছ থেকে পারস্পরিক পরিচিতির নির্দিষ্ট সংকেত জেনে নিয়ে তিনজন চৌকস গোয়েন্দা পাঠালেন ফয়জুল ফাতেমীর কাছে। তিনজনের একজন কমান্ডার।
ওরা নির্দিষ্ট সংকেত ব্যবহার করে ফয়জুল ফাতেমীর সাথে দেখা করল। বলল, ‘একটা মেয়ে ধরা পড়েছে। ওরা তাকে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে। একটু চেষ্টা করলেই মেয়েটাকে বের করে আনা যায়।’ ওরা আরও বলল, ‘মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য রজব আমাদের পাঠিয়েছেন।’
গোয়েন্দাদের বিশ্বাস করলেন ফয়জুল ফাতেমী। তিনি ভাবলেন নির্যাতনের মুখে মেয়েটা তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারে। আত্মরক্ষার স্বার্থেই ওকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কমান্ডারকে রাখলেন নিজের কাছে।
আলীর পাঠানো দু’জনের সাথে অন্য দু’জন সহ চারজনকে অপহরণের দায়িত্ব দেয়া হল। মেয়েটাকে তুলে ওরা ভাঙা বাড়িটায় চলে পাশে বসে থাক।
সুলতানের সামনে ওর কাছে বসতে আহমদ কামাল দ্বিধা করছিলেন। সুলতান বললেন, ‘তুমি ওর পাশে বস।”
সুলতান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন সুস্থতার জন্য।
তৃতীয় রাতে যুবতীর পাশে বসে আছেন আহমদ কামাল। আবেগ জড়িত কন্ঠে ও বলল, ‘আহমদ! তুমি আমায় বিয়ে করেছ? না, আমি আমার প্রতিশ্রুতি পুরণ করেছি, তুমিও তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছ। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, নইলে তোমাকে আমার কাছে পাঠাতেন না। আমি কি ভাগ্যবতী, আমার সব আশা ও স্বপ্ন আল্লাহ পূরণ করেছেন। তুমি আমার পাশে বসে থাকলে মরতে আমার মোটেই কষ্ট হবে না।’
কথা জড়িয়ে গেল ওর। আহমদ কামালের হাত মুঠোয় চেপে ধরল ও। ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে গেল তার হাতের বাঁধন।
আহমদ কামাল ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলে ঢেকে দিলেন ওর মৃতদেহ। পরদিন সুলতানের নির্দেশে তাকে মুসলমাদের কবরস্থানে সমাহিত করা হল।
দু’দিন পর ফয়জুল ফাতেমী এবং তার সংগীরা অন্য সদস্যদের নাম বলে দিতে বাধ্য হল। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেফতার করা হল ওদের।
ফয়জুল ফাতেমীর মৃত্যুদন্ডের কাগজে দস্তখত দেয়ার সময় সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কান্নায় ভেংগে পড়লেন।
(সমাপ্ত)
Leave a Reply