ক্রুসেড সিরিজ ২৭ – ছোট বেগম
আসাদ বিন হাফিজ
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ এর ‘ঈমানদীপ্ত দাস্তান’ এর ছায়া অবলম্বনে রচিত
ভূমিকা
রহস্য সিরিজ ক্রুসেড; ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হাজার বছর ধরে চলছে এ ক্রুসেড। গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
কেবল সশস্ত্র সংঘাত নয়, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সে যুদ্ধ ছিল সর্বপ্লাবী। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল খৃস্টানরা। একে একে লোমহর্ষক অসংখ্য সংঘাত ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিয়েছিল মদ ও নেশার দ্রব্য। বেহায়াপনা আর চরিত্র হননের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর শহর-গ্রামে। একদিকে সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে কুটিল সাংস্কৃতিক হামলা- এ দু’য়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল মুসলিম বীর শ্রেষ্ঠরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও স্বাসরুদ্ধকর ঘটনার, মানুষের কল্পনাকেও যা হার মানায়।
.
.
একদিন বিকাল বেলা। সূর্য অস্ত যাওয়ার সামান্য আগে সুলতান আইয়ুবী ফোরাতের কূলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তার সাথে অশ্বারোহী দলের সেনাপতি ও কমান্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরী। তারা তাদের সামনে কিছু দূরে সাদা জোব্বা পরা এক লোককে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
লোকটির দু’হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে উপরে তোলা। সুলতান আইয়ুবী সেদিকে গেলেন এবং লোকটির কাছে পৌঁছে দেখতে পেলেন, সেখানে চারটি কবর রয়েছে।
এই কবরগুলোর মধ্যে দু’টি কবরের মাথার দিকে একটা করে লাঠি পোতা। তার সাথে কাঠের তক্তা লাগিয়ে কবর ফলক বানানো হয়েছে। সেই ফলকের একটিতে আরবী হরফে লাল রংয়ে লেখা, “উমরুল মামলুক, আল্লাহ তোমার শাহাদাত যেন কবুল করে নেন।” –নাছরুল মামলুক।
তার পাশের কবরের উপরেও একই ধরনের ফলক লাগানো। তাতে লেখা, “নাছরুল মামলুক, আল্লাহ আমার শাহাদাত কবুল করুন।”
সুলতান আইয়ুবী দু’টি লেখাই পাঠ করলেন এবং সেই লোকটির দিকে তাকালেন, যে লোক কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করছিলেন। চেহারা সুরতে বেশ অভিজাত ও লেবাস পোশাকে আলেম ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী তার দিকে তাকালে তিনি সালাম দিয়ে বললেন, ‘আমি এই গ্রামের ইমাম। যেখানেই আমি কোন শহীদের সন্ধান পাই সেখানে গিয়ে তাদের জন্য ফাতেহা পাঠ করি। আমি বিশ্বাস করি, যেখানে শহীদের রক্ত ঝরে সে জায়গা মসজিদের মতই পবিত্র।
আমি লোকদের বলি, ‘মুজাহিদরা সেই মহান ব্যক্তিত্ব যাদের ছুটে চলা ঘোড়ার খুরের আঘাতে যে ধুলো উড়ে সে ধুলোও আল্লাহ কাছে কদর পায়। মহান আল্লাহ তার পথে জেহাদকে উওম ইবাদত বলে গণ্য করে থাকেন।’
‘কিন্তু আল্লাহর নামে জীবন কোরবান করা মানুষ এমন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি যাদের পরিচয় কেউ রাখেনা। যেমন এখানে আপনি দেখছেন। ইতিহাসে তাদের নাম নয়, আমার নামই লেখা হবে। কিন্তু আমার সমস্ত গৌরবের পেছনে রয়েছে এদেরই ত্যাগ ও কোরবানী, রয়েছে অসামান্য অবদান।’ বললেন সুলতান আইয়ুবী।
তিনি তার সেনাপতিদের দিকে তাকালেন। তারপর এগিয়ে কবরের ফলক দুটিতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “এই দু’টি ফলকের লেখাই লাল রংয়ের। মনে হচ্ছে একজন লেখকই নিজের আঙ্গুল দিয়ে লেখা দুটো লিখেছে।”
‘লাল রং নয় সুলতানে মুহতারাম, এ যে রক্ত! উমরুল মামলুকের কবরের ফলক লিখেছেন নাছরুল মামলুক। তারপর নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছেন তার কবরের ফলক এবং তিনিও শহীদ হয়ে গেছেন। আমিও প্রার্থনা করছি, আল্লাহ তাদের শাহাদাত কবুল করুন। এখানে যে চারটি কবর দেখছেন এদের চারজনই আমার কমান্ডো বাহিনীর সদস্য ছিল।’ বললেন কমান্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরী।
সুলতান বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তাই! তুমি চিনতে তাদের?’
‘হ্যাঁ সুলতান। ষোল সতেরো দিন আগে এক রাতে আমরা একটি নৌকা ধরেছিলাম। এই নৌকায় শত্রুর কমান্ডো বাহিনী তাদের সৈন্যদের জন্য রসদপত্র ও সাহায্য সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছিল।’
সালেম মিশরী বললেন, ‘এ খবর তখনই আপনাকে জানানো হয়েছিল। আমাদের আট জন কমান্ডো সেনা সেই নৌকাটিকে আটক করেছিল। কিন্তু আটক করার সময় শত্রুদের সাথে লড়াইয়ে তাদের চারজন শহীদ হয়ে যায়।’
‘ঘটনাটি আবার বলো তো কিভাবে কি ঘটেছিল?’ বললেন সুলতান।
‘আমরা আগেই গোপন সূত্র থেকে জানতে পেরেছিলাম, একটা বড় নৌকা রাতে এদিক দিয়ে যাবে। সে নৌকায় শত্রুদের রসদপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র থাকবে। আমি আমার আটজন কমান্ডোকে পাঠিয়ে দিলাম নৌকাটি আটক করার জন্য। তারা একটি ছোট নৌকায় ছিল। মধ্য রাতে তারা টের পায় অপর পাড় দিয়ে একটি নৌকা যাচ্ছে। আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল তাতে আমরা জানতাম, নৌকায় বড়জোর চার পাচঁজন দুশমন সেনা থাকতে পারে। কিন্তু অপারেশনের পর জানা গেল, তাতে বিশজন শত্রু সেনা ছিল।
আমাদের কমান্ডো বাহিনী দ্রুত ওপাড়ে পৌঁছলো এবং শত্রুর নৌকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত্রুরা আগে টের পায়নি, পেলে তীর মেরে সহজেই তারা পালিয়ে যেতে পারতো।
আক্রান্ত হওয়ার পর ওরা যখন রুখে দাঁড়ালো, তখন দেখা গেল সংখ্যায় তারা অনেক। আমাদের কমান্ডোরা শত্রুর নৌকা কিছু দুরে থাকতেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল এবং নির্ভয়ে সাঁতরে গিয়ে চড়াও হয়েছিল শত্রুর ওপর।
সাঁতারে তারা যথেষ্ট পটু ছিল। তারা যখন দেখলো তাদের তুলনায় দুশমন অনেক তখন একজন গিয়ে নৌকার পালের রশি কেটে দিল। এরপর নৌকার ভেতর শুরু হলো এক ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আমাদের কমান্ডো বাহিনীর যুবকরা অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। আমাদের দু’জন তখনই শহীদ হয়ে যায়, বাকীরাও কম বেশী সবাই আহত হয়।
আমাদের কমান্ডোরা শেষ পর্যন্ত শত্রুর নৌকাটি দখল করতে সমর্থ হয়। লড়াই শেষে তারা দেখতে পায় নৌকাটি দখল করার জন্য দুশমনের আঠারোটি লাশ তাদের ফেলতে হয়েছে। তারা শেষ মুহূর্তে দু’জনকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে। ওই দু’জন সাতঁরে নদীর ওপাড়ে গিয়ে উঠলেও তাদের ধাওয়া করার মত অবস্থা ছিল না আমাদের কমান্ডোদের। তাই তাদের আর ধাওয়া করা হয়নি।
আমাদের কমান্ডোরা দুটো নৌকাই কিনারায় ভিড়িয়ে আমাকে এই বিজয়ের খবর দেয়। সংবাদ পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। ততোক্ষনে সকাল হয়ে গেছে।
আমি এসে দেখতে পেলাম এক নৌকায় উমরুল মামলুক ও তার দুই সঙ্গীর লাশ। জানতে পারলাম একটু আগে উমরুল মামলুক শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছে।
কমবেশী সবাই আহত হলেও নাছরুল মামলুকের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তার সারা শরীর। আমি তার কাছে গেলাম, দেখলাম তখনো তার জ্ঞান আছে। তার ক্ষতস্থানে পট্টি বাধার জন্য দ্রুত তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো। এরপর যখন তাকে আমি ক্যাম্পে দেখতে গেলাম, সে আমাকে বললো, ‘আমাকে দুই টুকরো কাঠ দিন।’
বললাম, ‘এই শরীরে কাঠ দিয়ে তুমি কি করবে’?
ও বললো, ‘আমি আমার শহীদ বন্ধুর কবরে নাম ফলক লাগাতে চাই।’
আমি তাকে কাঠ সরবরাহ করলাম। সে তার আহত আঙ্গুলের ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্ত দিয়ে উমরুল মামলুকের নাম ও এই লেখাগুলো লিখলো। আমি নামফলকটি একটি লাঠির সাথে বেঁধে উমরুল মামলুকের কবরের শিয়রে লাগিয়ে দিলাম।
নাছরুল মামলুকের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছিল না। তৃতীয় দিনে তার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে দেখতে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হতাশা প্রকাশ করে বললো, ‘নাছরুল মামলুককে বোধহয় বাঁচানো গেল না।’
নাছরুল মামলুক নিজেও অনুভব করলো, সে আর বাঁচবে না।
সে পুনরায় আমাকে বললো, ‘আমাকে আরেক টুকরো কাঠ দিন।’
আমি তার ইচ্ছা পূর্ণ করে দিলাম। সে কাঠের টুকরোটি নিজের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে আমি সংবাদ পেলাম, ‘নাছরুল মামলুক শহীদ হয়ে গেছে।’
আমি যখন সেখানে গেলাম এক আহত রুগী আমাকে কাঠের টুকরোটি দিয়ে বললো, ‘নাছরুল মামলুক তার ক্ষত স্থানের রক্ত দিয়ে এই ফলকটি লিখেছে।’
আমি তাকিয়ে দেখলাম তাতে লেখা আছে, ‘নাছরুল মামলুক, আল্লাহ আমার শাহাদাত কবুল করুন।
আহত রোগীটি আমাকে বললো, ‘নাছরুল মামলুক বলেছে, তাকে যেন তার বন্ধু উমরুল মামলুকের পাশে দাফন করা হয়।’
‘এরা দু’জনেই মামলুক ছিল সম্মানিত ইমাম। আপনি কি জানেন এই মামলুক বংশ সম্পর্কে? এরা সেই গোলামদের বংশধর, ইসলামের আগমন যাদের দিয়েছিল মুক্তির স্বাদ। আমাদের প্রিয় নবী রাসূল (সাঃ) ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষনা করলে আরবে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ সুলতান আইয়ুবী ইমামকে বললেন।
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, মানুষ মানুষের গোলাম হতে পারে না। আমরা গোলাম শুধু এক আল্লাহর। তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে যারা আমাদের দায়িত্বশীল আমরা তাদের মান্য করি।
একটু খেয়াল করে দেখুন, একদিন যারা ছিল সামান্য গোলাম, জাতির জন্য তারা আজ কেমন ত্যাগ ও কোরবানীর নজরানা পেশ করছে। এরা মাত্র আটজন ছিল, কিন্তু বিশজনের কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নেয়ার সাহস তারা কোথা থেকে পেল? এই শক্তি তারা পেয়েছে ইসলাম থেকে। আমার সৈন্যদের মধ্যে মামলুক ও তুর্কী সেনারা সাহস, বীরত্ব ও বিশ্বস্ততায় অনন্য।’
‘কিন্তু এখন মানুষ আবার মানুষের গোলামে পরিণত হচ্ছে,’ ইমাম সাহেব বললেন। ‘ক্ষমতার রাজনীতির মূল কথাই হচ্ছে মানুষকে আবার গোলামে পরিণত করা। কিন্তু মানুষ জানে না, ক্ষমতার স্বাদ বেশীদিন উপভোগ করা যায় না। ফেরাউনও মাটিতে মিশে গেছে। তেমনি প্রত্যেক জালিম শাসক, যারা ক্ষমতা ও গদি আঁকড়ে ধরে জনগনকে শোষণ ও নির্যাতন করতো তাদের পরিণতি কখনো শুভ হয়নি। সাধারন মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাদশাহী ধরে রাখতে গিয়ে তারা নিজেরাই রক্তাক্ত হয়েছে।’
সেই সন্ধায় তারা যখন ফোরাতের কূলে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তখন সুলতান আইয়ুবীর রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার এক লোককে সঙ্গে নিয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। লোকটির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল সে দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত। কমান্ডার তাদের কাছে এসে সুলতানকে লক্ষ্য করে বললো, ‘কায়রো থেকে কাসেদ এসেছে।’
‘কোন খারাপ খবর?’ সুলতান আইয়ুবী তাকে বললেন, ‘কি খবর নিয়ে এসেছো তুমি?’
‘সংবাদ ভালো নয় সুলতান।’ কাসেদ এ কথা বলে কোমর থেকে একটি কাগজ বের করে সুলতানের হাতে তুলে দিল।
সুলতান আইয়ুবী চিঠি হাতে নিয়ে তার তাঁবুর দিকে রওনা হলেন। সঙ্গীদের বললেন, ‘চলো।’
তাঁবুতে বসে তিনি চিঠিটা খুললেন। চিঠিটি তার গোয়েন্দা বিভাগের সর্বাধিনায়ক আলী বিন সুফিয়ানের হাতের লেখা।
আমাদের সবচেয়ে ধার্মিক ও বীর সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস দশদিন যাবত নিখোঁজ রয়েছেন। খৃস্টানদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এখানে গোপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাসঘাতক গাদ্দারদের সংখ্যা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু বলবো, এ সমস্যা নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। আমরা এখানে শত্রুদের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেব না।
কিন্তু আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস। তার কোন সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তার সন্ধান না পাওয়াটাই পেরেশানীর একমাত্র কারন নয়। দুশ্চিন্তার আরো কারন আছে।
আপনিতো জানেন, হাবিবুল কুদ্দুস তার বাহিনীর সৈন্যদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তারা তাদের প্রিয় সেনাপতির ইশারায় জান দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না। যদি তিনি স্বেচ্ছায় শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে থাকেন তবে ভয় হচ্ছে, তার বাহিনী যার দ্বারাই পরিচালিত হোক না কেন, তার ইশারা পেলে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে।
আমি এখনো তার সন্ধান চালাচ্ছি। তার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিরাশ নই। তবে আমি আপনার কাছ থেকে একটি ব্যাপারে নির্দেশনা চাই। যদি তার খোঁজ পাওয়া যায় এবং তাকে হত্যা করা জরুরী হয়ে পড়ে, তবে হত্যা করবো কিনা? আপনার নিয়োজিত মিশরের আমীর এ সম্মতি দিতে নারাজ। তিনি আমাকে শুধু এই অনুমতি দিয়েছেন যে, আমি আপনার কাছে পত্র প্রেরণ করে অনুমতি নিতে পারি।
আমি তার সন্ধান করতে ব্যর্থ হই এটা যেমন আপনি চাইবেন না, তেমনি তিনি মনে করেন, সে আমার হাতে মারা যাক এটাও আপনি চাইবেন না। কিন্তু আমাদের এক সেনাপতির শত্রুর হাতে থাকাটাও বিরাট ভয়ের কারন।’
চিঠি পড়া শেষ করে সুলতান আইয়ুবী সঙ্গে সঙ্গে কাতিবকে ডাকলেন। কাতিব এলে চিঠির উওর লিখতে বসে গেলেন তিনি। তিনি লিখলেনঃ
প্রিয় আলী বিন সুফিয়ান, তোমার উপর আল্লাহর করুনা বর্ষিত হোক। হাবিবুল কুদ্দুসের উপর আমার আস্থা ও বিশ্বাস এমন ছিল, যেমন তোমার উপর আছে। যে ব্যক্তি বেইমানী করতে প্রস্তুত হয়ে যায় সে কখনো আল্লাহকে ভয় পায় না। আর যে আল্লাহকে ভয় পায় না সে আমার মতো একজন নগণ্য মানুষকে কেন ভয় পাবে?
তুমি এতে বিস্মিত হয়ো না যে, হাবিবুল কুদ্দুসের মত লোকও ধোঁকা দিতে পারে। ঈমান একটি শক্তি, কিন্তু সেটা হীরা ও পান্নার মত চকচক করে না। এতে সুন্দরী নারীর মত সৌন্দর্য ও আকর্ষণও থাকে না। আর ঈমান গদি ও রাজমুকুটও নয়। যখন মানুষের মধ্যে দুনিয়ার লোভ লালসা বেড়ে যায় ও ধন সম্পদের আকাঙ্খা সৃষ্টি হয় তখন মানুষের বেঈমান হতে বেশী সময় লাগে না।
হাবিবুল কুদ্দুসকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো। যদি কখনো মনে করো যে তাকে হত্যা করা দরকার, তবে অবশ্যই তাকে হত্যা করবে। এতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু এটা জানার চেষ্টা করবে, তাকে তো ছিনতাই করা হয়নি?
এ বিষয়টা তোমার লক্ষ্য ও দৃষ্টিপটে রাখবে। তারপর যেটা ভালো মনে করো তাই করবে। দ্বীন ও দেশের কল্যাণের বিষয়টিই সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাবে। একজন মানুষের জীবন বা মৃত্যুকে এ পথে বাধা হিসেবে মেনে নেয়া যায় না।
দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যেখানে বিপুল সংখ্যক সৈন্য অকাতরে মারা যাচ্ছে, সেখানে একজন গাদ্দারকে হত্যা করতে তোমার দ্বিধা করা উচিত নয়। যেখানে আল্লাহকে খুশি করার জন্য সৈন্যরা হাসি মুখে তাদের জীবন দিয়ে দিচ্ছে, সেখানে কোনো গাদ্দারকে দয়ামায়া দেখানোর প্রশ্নই উঠে না। সে গাদ্দার এটা নিশ্চিত হতে পারলে কালবিলম্ব না করে ফায়সালা করে ফেলবে।
আলী, আল্লাহর কাছে পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকো, কারণ আমরা সবাই গোনাহগার বান্দা। পাক ও পবিত্র একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:)। যদি তোমরা সত্যের উপরে থাকো তবে আল্লাহ তোমাদের সাথেই আছেন। শেষ পর্যন্ত তোমরাই জয়ী হবে।’
সুলতান আইয়ুবী চিঠিতে সিলমোহর মেরে চিঠিটা কাসেদের হাতে দিয়ে বললেন, ‘আজ রাতে এখানেই বিশ্রাম নাও। কাল ঘুম থেকে উঠে খুব ভোরে যাত্রা করবে।’
সে যুগটা ছিল ইতিহাসের অশুভ যুগ। একদিকে আরবের মাটি মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল, অন্যদিকে ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করছিল গাদ্দার ও ষড়যন্ত্রকারী। মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে তাদের ধ্বংস করাই ছিল এ প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।
মিশরেও চলছিল দুশমনের এ তৎপরতা। ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলিম নেতাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টির চেষ্টা চালানোর সাথে সাথে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলারও চেষ্টা করছিল। তারা মিশরের সৈন্য বিভাগকেও অকেজো করে দিতে চাচ্ছিল। সৈন্য বিভাগের ব্যাপারে নানারকম বদনাম ছড়িয়ে জনগনকে বিভ্রান্ত করার জন্য ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওরা এ কাজ করছিল অত্যান্ত গোপনে ও কৌশলে।
আলী বিন সুফিয়ান ও কায়রোর পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিস শত্রুদের এসব অপতৎপরতা বন্ধ ও অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য আরামকে হারাম করে চষে ফিরছিলেন মিশরের সর্বত্র। তাদের বাহিনী কেবল কায়রো নয়, মিশরের বিভিন্ন পরগনা ও শহরে ছুটে বেড়াচ্ছিল।
সেনাবাহিনীর একজন সেনাপতির নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যে গোয়েন্দা বাহিনীর সুনাম সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা নিজেরাই তাদের এক সেনাপতিকে খুঁজে বের করতে পারছে না, এরচেয়ে লজ্জার বিষয় আলীর জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
হাবিবুল কুদ্দুস সম্পর্কে এ কথা ভাবাও মুশকিল যে, তিনি গাদ্দারদের দলে চলে যাবেন। কিন্তু এটা এমনই এক যুগ, এখন কে গাদ্দার আর কে নয় তা নির্ণয় করাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। গাদ্দারী এখন একটা সাধারণ ও সুবিধাজনক উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাবিবুল কুদ্দুস যখন নিখোঁজ হলো তখন সবাই বলতে বাধ্য হলো, ‘তিনিও তো মানুষ, কোন ফেরেশতা তো নন।’
হাবিবুল কুদ্দুসের স্ত্রী ছিল তিনজন। অবশ্য সে যুগে এটা কোন গর্হিত কাজ বলে গণ্য করা হতো না। তার সমসাময়িক অন্যান্য অফিসাররা বরং এ ক্ষেত্রে একটু এগিয়েই ছিল। তাদের বরং বিবি ছিল চারজন করে। যারা আরেকটু সৌখিন ছিল তাদের দু’একজন দাসীও থাকতো।
হাবিবুল কুদ্দুসের কোন দুর্ণাম ছিল না। তার জীবনে মদ ও নাচগানের সামান্যতম প্রভাবও কেউ লক্ষ্য করেনি। তিনি নামাজ রোজার পাবন্দ ছিলেন এবং যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন সত্যিকারের বীর মুজাহিদ। তিনি কেবল শত্রুর উপর কঠোর ছিলেন না, বরং বীরত্ব প্রদর্শন ও রণকৌশলেও ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তিনি যুদ্ধ পরিচালনায় এতই নিপুণ ছিলেন যে, সামান্য সৈন্য নিয়ে বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনার বাহিনীকেও তিনি বার বার পরাজিত ও ধ্বংশ করেছেন।
তার সবচেয়ে বড় গুন ছিল, তিনি সবাইকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। লোকেরাও তাকে ভালোবাসতো। তার অধীনস্ত সৈন্য ও কমান্ডাররা যখন যুদ্ধ করতো তখন তাদের আবেগ এমন হতো যেন তারা কারো নির্দেশে যু্দ্ধ করছে না, বরং নিজের ঈমানের দাবী পূরণের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। বাহিনীর সদস্যরা তাকে বুঝতে পারতো এবং তার ইশারাকেই তারা হুকুম মনে করতো।
সে তার বাহিনী এমনভাবে পরিচালনা করতো যে, কখনো কখনো মনে হতো যেন এটা তার একান্ত নিজস্ব বাহিনী। যেন এরা সুলতান আইয়ুবীর নয়, হাবিবুল কুদ্দুসের আদেশে যুদ্ধ করছে।
এত যে প্রিয় লোকটি, প্রশিক্ষন বা যুদ্ধের মাঠে তার রূপ ছিল সত্যি ভয়াবহ। সৈন্যদের তিনি কঠোর প্রশিক্ষন দিতেন এবং তাদের শৃঙ্খলার প্রতিও রাখতেন কড়া নজর।
তিনি তার সৈন্যদের এমনভাবে প্রশিক্ষন দিতেন যাতে তারা অন্যদের তুলনায় ক্ষীপ্র ও কৌশলী হয়। তার সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার পদাতিক, দুই হাজার অশ্বারোহী ও দুই হাজার তীরন্দাজ। তীরন্দাজদের তিনি এমন নিপুণ তীর চালানো শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, রাতের অন্ধকারে শুধু সামান্য আওয়াজ শুনেই তার সৈন্যরা যে তীর ছুঁড়তো তা গিয়ে শব্দকারীর বুকে বিদ্ধ হতো।
আলী বিন সুফিয়ানও ছিলেন গোয়েন্দাগিরীতে ওস্তাদ। গিয়াস বিলকিসও ছিলেন দক্ষ পুলিশ সুপার। এদের দু’জনেরই ধারনা, হাবিবুল কুদ্দুসকে শত্রুরা যেভাবেই হোক তাদের বশে নিতে সক্ষম হয়েছে, যাতে তার সাত হাজার সৈন্যকে বিদ্রোহী করে তুলতে পারে।
সাত হাজার সৈন্য কোন তুচ্ছ ও নগন্য সৈন্য ছিল না। এ সৈন্যদের বিদ্রোহের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার উপায় তালাশ করছিলেন দু’জনই। গিয়াস বিলকিস বললেন, ‘এদের নিরস্ত্র করে দিলে কেমন হয়?’
আলী বিন সুফিয়ান অনেক চিন্তা ভাবনা করে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। কিন্তু তারা যে কোন সময় বিদ্রোহ করে বসতে পারে গিয়াস বিলকিসের এ আশঙ্কা তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তারা দু’জনই একমত হলেন, আজ না হলেও ভবিষ্যতে তারা বিদ্রোহ করবে।
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আপাতত তাদের নিরস্ত্র না করে বাহিনীর মধ্যে কিছু গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিই। তারা সৈন্য ব্যারাকে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াবে এবং তাদের আলাপ আলোচনা শুনবে। কমান্ডারদের উপরও তারা দৃষ্টি রাখবে।’
তাই করা হলো। কড়া দৃষ্টি রাখা হলো হাবিবুল কুদ্দসের বাড়ীর উপর। তার তিন স্ত্রীর মধ্যে একজনের বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। অন্য দু’জনের মধ্যে একজনের বয়স বিশ, অন্যজনের পঁচিশ। তাদের জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হাবিবুল কুদ্দুস কোথায়?’
তারা বললো, ‘কয়েকদিন আগে এক সন্ধায় তার কাছে দু’জন লোক এসেছিল। হাবিবুল কুদ্দুস তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু তারপর আর ফিরে আসেন নি।’
চাকর বাকরদেরও সন্দেহমূলকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না, কোনভাবেই তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
তার বিবিদের সম্পর্কেও গোপনে অনুসন্ধান করা হলো। কিন্তু তাদের ব্যাপারেও সন্দেহ করার মতো কোন তথ্য পাওয়া গেল না। শুধু এটুকু জানা গেল যে, অল্পবয়সী দুই বিবির মধ্যে একজনের প্রতি হাবিবুল কুদ্দুসের টান একটু বেশী ছিল।
এই বিবির নাম জোহরা। জোহরা তারই অধীনস্ত অশ্বারোহী বাহিনীর এক কমান্ডারের মেয়ে। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী ছিল। এ রকম সুন্দরী বিবি থাকলে তার প্রতি টান একটু বেশী থাকাই স্বাভাবিক।
একদিন জোহরার পিতা সেই কমান্ডারকে তলব করা হলো গোয়েন্দা অফিসে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কেন এত অল্পবয়সী মেয়েকে তোমার সমবয়সী লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছো? হাবিবুল কুদ্দুস কি তোমাকে তার অধীনস্ত পেয়ে বাধ্য করেছিল?’
‘না। সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস ইসলাম ও জিহাদের ব্যাপারে এতই আন্তরিক যে, তা দেখেই আমি তার প্রতি অনুরাগী হই।’ বললেন সেই কমান্ডার।
তিনি বললেন, ‘আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করেছি। তিনি বলতেন, মুমিনের তলোয়ার একবার উন্মুক্ত হলে সে তলোয়ার ততোক্ষণ পর্যন্ত কোষবদ্ধ হবে না, যতোক্ষন তার সামনে একজন দুশমনও বর্তমান থাকে। তিনি আরো বলতেন, ‘যতোক্ষন কাফেরদের ফেতনা শেষ না হবে ততোদিন জিহাদ চালু থাকবে।’
তিনি দেশের গাদ্দারদের প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। যখন সীমান্ত যুদ্ধে সুদানীরা আকস্মাৎ আক্রমন চালালো, তখন আমাদের দুই অশ্বারোহী পালানোর চেষ্টা করেছিলো। তিনি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদের দু’জনকে পাকড়াও করার হুকুম দেন।
দু’জনকে ধরে আনা হলে তাদেরকে ঘোড়ার পিছনে দু’হাত রশি দিয়ে বেঁধে দুই অশ্বারোহীকে ঘোড়া ছুটাতে বললেন। তিনি অশ্বারোহীদের বললেন, ‘ঘোড়া ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত ঘোড়া থামাবে না।’
যখন ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলো তখন ঘোড়াগুলো হাফাচ্ছিল। ঘোড়ার পেছনে বাঁধা দুই সৈন্যের অবস্থা তখন শেষ পর্যায়ে। তাদের সমস্ত শরীরের কোথাও কাপড় ছিল না। তাদের শরীরের চামড়া উঠে গিয়েছিল। শরীরের মাংসও উঠে গিয়েছিল।
যুদ্ধে অধিকাংশ সুদানী মারা গিয়েছিল। কিছু ধরা পড়ে বন্দী হয়েছিল। অন্যরা পালিয়ে গিয়েছিল। হাবিবুল কুদ্দুস সমস্ত সৈন্যদের একত্রিত করে সেই পলাতক সৈন্যদ্বয়ের লাশ দেখালেন।
তিনি তাদের বললেন, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধরত সৈন্যদের পালানোর শাস্তি দুনিয়ায় এমনই হয় আর পরকালে তাদের দেহ হবে আগুনের খোরাক।’
হাবিবুল কুদ্দুসের শ্বশুর বললো, ‘আমরা সবাই জিহাদে শহীদ হওয়ার জন্য প্রেরনা পেয়েছি তার কাছ থেকে।’
‘তোমার মেয়ে সম্পর্কে বলো, কেন তুমি তাকে হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে বিয়ে দিয়েছিলে?’
‘একদিন আমার মেয়ে আমার সাথে ছিল। আমি মেয়েকে সেই শিক্ষাই দিয়েছিলাম যে শিক্ষা আমার পিতা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার ছেলেও সে সময় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদলে সিরিয়াতে ছিল।
আমি আমার মেয়েকে বললাম, ‘আমাদের সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুসও সুলতান আইয়ুবীর মত বীর মুজাহিদ।’
সেদিনই তিনি আমার মেয়েকে দেখলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ মেয়েটা কে?’ আমি বললাম, ‘এ আমার মেয়ে এবং একজন তরুণী মুজাহিদ।’
বেশ কিছুদিন পর তিনি আমাকে জানালেন, যদি আমার আপত্তি না থাকে এবং আমার মেয়ে সম্মত হয় তবে তাকে তিনি বিয়ে করতে চান। আমি মেয়ের মাকে কথাটা বললাম। মেয়ের মা বলল, ‘মেয়ে আগে থেকেই বলে আসছে সে এমন ব্যক্তিকে বিয়ে করতে চায় যে ইসলামের খেদমতে নিজের জীবনকে বাজী রাখতে প্রস্তুত।
আমি খুশী মনে সেনাপতির সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলাম এবং আমার মেয়েও তাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিল। এখন শুনছি তিনি নিখোঁজ।
আমি আপনাকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলছি, তার এই নিরুদ্দেশে যদি কেউ অন্তর থেকে ব্যাথিত হয়ে থাকে, তবে সে একমাত্র আমার মেয়ে। আমি শুনেছি, সে তাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পরও তার ভালবাসা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি।
তার ধারনা, দুশমনরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে মেরে ফেলেছে বা কোথাও বন্দী করে রেখেছে। আমি এও শুনেছি, তার অন্য দুই স্ত্রী বলেছে, সে যদি মারা যায় তবে তারা অন্যখানে বিয়ে করে নেবে। কিন্তু আমার মেয়ে এ রকম চিন্তা করাও পাপ মনে করে।’
‘এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের পরিকল্পনা আমাদের হাতে এসে গেছে।’
এই আওয়াজ কায়রো থেকে দূরে, বহু দূরে এক ধ্বংসাবশেষে উচ্চারিত হলো। এখানে কোন ফেরাউন তার সময়ে রাজমহল তৈরী করেছিল। সে যুগে এ স্থানটি খুব সুন্দর শহর ও মনোরম বাগবাগিচায় সাজানো ছিল। অঞ্চলটি পাহাড়ী হওয়ার পরও নীল নদের তীরে অবস্থিত হওয়ার কারনে এখানে গড়ে উঠেছিল জমজমাট শহর। আর ফেরাউন সেই শহরকে এমন অপরূপ সাজে সাজিয়েছিল, মনে হতো এটি কোন রূপকথার রাজ্য।
পাহাড়ের উপরে ও আশেপাশে ছিল সবুজ গাছপালা। নদীতে খাল কেটে শহরের ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছিল নদীর পানি। সেই পানিতে চলতো সেচ কাজ। এভাবেই সেই রুক্ষ্ম পাহাড়কে বানানো হয়েছিল নয়নাভিরাম সবুজ উদ্যান।
কোন এক ফেরাউন এখানে শহর ও মহল বানালেও তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে তার জৌলুশ। তারপর কালক্রমে একদিন তা ধ্বংশস্তুপে পরিণত হয়।
সুলতান আইয়ূবীর আমলে এই ধ্বংসাবশেষ এক ভয়ংকর স্থানে পরিণত হয়। শহরের প্রাসাদগুলো রূপ নিয়েছিল ভূতুরে আস্তানায়। মহলের স্তম্ভগুলো জরাজীর্ণ হয়ে বুনো লতাপাতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল। আবর্জনায় ভরে গিয়েছিল তার কামরাগুলো।
বাদুড়, চামচিকা ও চিলেরা বাসা বেঁধেছিল সেই ধ্বংশস্তুপে। পাহাড়গুলো এত উঁচু ছিল যে, কালো মেঘ যখন উড়ে যেত, দূর থেকে মনে হতো সেগুলো পাহাড়ের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
এই জনপদ কিভাবে ধ্বংশ হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে ধ্বংসাবশেষ দেখলে মনে হয় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আকস্মিক বিস্ফোরনে শহরটি ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়। কারন পুরাতন এই ধ্বংসাবশেষের বাইরে ও ভিতরে মানুষের মাথা ও অঙ্গ-প্রতঙ্গের হাড় হাড্ডি ছড়িয়ে আছে। অতীত যুগের অনেক অস্ত্রসস্ত্রও এদিক ওদিক পড়ে আছে।
এখন এই ভূতুরে জায়গায় কেউ যায় না। লোক মুখে গুজব রটে গেছে, এখানে জ্বীন, ভূত ও খারাপ মানুষের প্রেতাত্মারা বাস করে। তারা এর আশেপাশে কোন জীবিত মানুষ পেলে তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে।
ফলে নীলনদ দিয়ে যেসব নৌযান যাতায়াত করে তারাও এই ধ্বংশস্তুপের কাছ ঘেঁষে যায় না। মানুষ এই আতংকময় জায়গাটি ভয়ে সযত্নে এড়িয়ে চলে।
স্থলপথে যারা যাতায়াত করে তারাও এড়িয়ে চলে জায়গাটি। মানুষ জন সেখান থেকে বহু দূর দিয়ে আপন গন্তব্যে এগিয়ে যায়। কেউ ভুলেও সেই ধ্বংসাবশেষের দিকে পা বাড়ায় না।
এক লোক বললো, ‘আমার এখন মনে হচ্ছে, তার মাথাটা যেন আমার হাতে এসে গেছে।’
অন্যজন বললো, ‘যদি না আসে তবে এখান থেকে তাকেও আর জীবিত বের হতে হবে না।’
‘আমরা তাকে এ জন্য এখানে ধরে আনিনি যে, তাকে এখানেই হত্যা করবো।’
অপরজনকে উদ্দেশ্য করে আগের জন বললো, ‘যদি হত্যা করাই আমার উদ্দেশ্য হতো তবে তাকে বাড়ী থেকে উঠিয়ে আনার পর এত দূর নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিল? তাকে তো আমরা পথেই হত্যা করতে পারতাম। তাকে আমাদের কাজের জন্য তৈরী করতে হবে। এখানে তাকে আনা হয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।’
‘হাশিশের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।’ সঙ্গের লোকটি বললো।
‘হ্যাঁ, হাশিশ। এই হাশিশই এখন একজন পাক্কা মুসলমানকে গাদ্দার বানিয়ে দেবে। তুমি কাউকে নেশা পান করিয়ে তার সঙ্গে এমন কথা বলতে পারো, যা জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন কোন ব্যক্তির সাথে বলা সম্ভব নয়। হাশিশ ও নেশা দিয়ে তুমি কারো ঈমান ও মতাদর্শ পরিবর্তন করতে পার।
এ ব্যক্তি আইয়ুবীর বিশাল সামরিক শক্তির অধিকারী। আমার শুধু তাকে প্রয়োজন নয়, তার পুরো বাহিনীটিই দরকার। একটি সুশিক্ষিত বাহিনীর সাত হাজার সৈন্য কোন চাট্টিখানি কথা নয়। তার এই পুরো বাহিনীই আমার নিয়ন্ত্রনে দরকার।
তাদের দিয়ে আমি মিশরের বিরুদ্ধে লড়াই করাবো। আইয়ুবীর বাহিনী লড়বে আইয়ুবীর বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশেষে মিশর একদিন আমাদের হবে। সালাউদ্দিন আইয়ুবীর অবস্থা হবে এমন, যেন খাঁচায় বন্দী বাঘ। অথবা অসংখ্য শিকারীর ঘেরে আটকে যাওয়া সিংহ।
তিনি ঘর কেটে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এই ঘর ফেঁড়ে ফুঁড়ে বের হওয়ার জন্য লম্ফঝম্ফ করবেন। কিন্তু তার ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
যদি সুলতান আইয়ুবীর এই সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস তার বাহিনীকে সামান্য ইঙ্গিত দেয়, তবে তারা কোন কিছু চিন্তা না করেই তার আদেশ মান্য করবে। সেনাবাহিনীতে তার যে প্রভাব সেই প্রভাব আমরা এবার ব্যবহার করবো আমাদের স্বার্থে।’
হবিবুল কুদ্দুস ফেরাউনের মহলের সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক বিরাট কামরায় বসে ছিলেন। কামরাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাসের উপযোগী করা হয়েছে। সেখানে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে আরামদায়ক নরম গদি। সেই সাথে দেয়া হয়েছে বালিশ ও কুশন। কামরাটি সাজানো হয়েছে একজন বিলাসী মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে।
হাবিবুল কুদ্দুসের সামনে এসে এক লোক বসলো। লোকটির চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। সে হাবিবুল কুদ্দুসের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘মিশর আমার দেশ। সালাউদ্দীন আইয়ুবী ইরাকী এবং কুর্দি। তিনি এসে আমার দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছেন। তিনি আমার দেশের সুন্দরী নারীদের নিয়ে তার অন্দরমহলের হেরেম পূর্ণ করছেন। দেশের এ অপমান আমরা কতদিন সইবো?
আমদের কাছে সাত হাজার নিবেদিত প্রাণ সৈনিক রয়েছে। আমরা কি পারি না এই সৈন্য নিয়ে আইয়ূবীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? আপনি কি মনে করেন আমাদের সৈন্যরা ভীরু কাপুরুষ? তারা আইয়ুবীকে ভয় পায়? লড়াই বাধলে তারা ময়দান থেকে পিঠ টান দেবে?’
হাবিবুল কুদ্দুসের চোখে সুদূরের হাতছানি। তিনি যেন দেখতে পাচ্ছেন তার বাহিনী আইয়ুবীর সৈন্যদের দলিত মথিত করার জন্য তার একটু ইশারার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছে।
লোকটির কথা শেষ হলে হাবিবুল কুদ্দুস মুখে মুচকি হাসি নিয়ে তার দিকে তাকালেন। সে চেহারায় খেলা করছে প্রফু্ল্লতা। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, ‘কখনোই না। আমি আমার বাহিনীকে তেমন শিক্ষা দেইনি। তারা লড়াকু। তারা সাহসী। তারা কুশলী। আমার সামান্য ইশারায় তারা জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত।
আমার তলোয়ার কোথায়? তুমি আমার অশ্ব সাজিয়ে দাও। আমিই সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করবো। আমার সাত হাজার জানবাজ সৈন্য একদিনেই মিশরের বাহিনীকে পরাজিত করে তাদেরকে মিশরের মাটি থেকে হটিয়ে দিতে পারবে।’
‘খৃস্টানরা আমাদের বন্ধু।’ লোকটি তার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘বন্ধু তো তাকেই বলে যে বিপদের সময় সাহায্য করে। তারা বলেছে, আমাদের এই দুর্দিনে তারা সাহায্য করবে। আমরা ডাকলেই তারা চলে আসবে।’
‘ডাকো তাদের। বিপদে যে পাশে দাঁড়ায় তার মতো বন্ধু আর কে আছে? আমার বন্ধুদের ডাকো। আমার তলোয়ার দাও।’
হাবিবুল কুদ্দুস স্পষ্ট স্বরে যুদ্ধের উন্মাদনা প্রকাশ করতে লাগলেন।
‘আপনি মহান সেনাপতি। মিশরবাসী তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। আপনি মিশরবাসীকে বিদেশী শাসকের হাত থেকে উদ্ধার করুন। মিশরবাসী আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে।’
‘হ্যাঁ আমি তাই করবো। আইয়ুবীর কবল থেকে রক্ষা করবো আমার দেশবাসীকে। তোমরা কোন চিন্তা করো না। হায় মিশর! কি সুন্দর এই দেশ। এই দেশের আকাশ সুন্দর। প্রকৃতি সুন্দর। মানুষ সুন্দর। সুন্দর এ দেশের মেয়েরা। মিশর আমার। আমিই তাকে মুক্ত করবো। আইয়ুবীকে হত্যা করবো আমি।’ একটি মেয়ে এসে ঢুকলো কামরায়। তার পরণে হাল্কা পোষাক। মাথায় মসৃণ খোলা এলোচুল। উজ্জ্বল গোলাপী তার গায়ের রং। দেহে লাবন্যের ছটা। খাপখোলা তলোয়ারের মত ঝকমক করছে তার উন্মুক্ত ফর্সা বাহুদ্বয়।
মেয়েটি হাবিবুল কুদ্দুসের পাশ ঘেঁষে বসলো। তার কোমল বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো হাবিবুল কুদ্দুসের কাঁধ। বললো, ‘কতদিন ধরে আমরা মুক্তির প্রহর গুনছি। আমাদের কোন নেতা ছিল না। আমাদের কোন সেনাপতি ছিল না। আমরা ভাবতাম, কবে আসবে সেই রাজপুত্র, যে আমাদের মুক্তি দেবে অসুর দানবের হাত থেকে?’
হাবিবুল কুদ্দুস মেয়েটির নরম চুলে তার গাল ঘষতে ঘষতে বললো, ‘আমিই সেই রাজপুত্র। দানবের হাত থেকে আমিই মিশরকে মুক্ত করবো।’
সে তার নেশাগ্রস্ত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘ভেবো না সুন্দরী, তুমি পাশে থাকলে মিশরকে আমি বেহেশত বানিয়ে দিব।’
মেয়েটি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদিকে সরে গিয়ে বললো, ‘কবে? কবে তুমি মিশরকে বেহেশত বানাবে? এদিকে আমরা যে সুলতান আইয়ুবীর অত্যাচারে অসহায়, অতিষ্ঠ।’
হাবিবুল কুদ্দুস থাবা মেরে তার বাহু ধরে কাছে টেনে বললো, ‘তোমার উপরে কেউ অধিকার বিস্তার করতে পারবে না। তুমি অসহায় নও। আমি আছি তোমার সাথে। তুমি আমার। মিশর আমার।’
‘যতদিন সালাউদ্দিন আইয়ুবী মিশরের উপর কর্তৃত্ব করবে ততদিন না আমি তোমার, না মিশর তোমার।’
‘আমি তাকে হত্যা করবো।’ হাবিবুল কুদ্দুস দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘আমি তাকে হত্যা করবোই।’
‘থামো!’ এক কঠিন ও গম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল, ‘আইয়ুবীকে হত্যা করবো বললেই তাকে হত্যা করা যায় না। তাকে হত্যা করতে হলে চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা।’
এই আওয়াজ সেই ব্যক্তির, যে ধ্বংসপ্রাসাদের ভেতর বসে বলেছিল, ‘এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের পরিকল্পনা আমাদের হাতে এসে গেছে।’
লোকটি কামরায় প্রবেশ করে কামরার পুরুষ লোকটিকে বললো, ‘তুমি আমার সাথে বাইরে এসো আর মেয়েটিকে তার সাথেই থাকতে দাও।’
ওরা বাইরে এলে আগন্তুক খৃস্টান লোকটি বললো, ‘তাকে হাশিশ ছাড়াই নিয়ন্ত্রন করতে হবে এবং আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ পর্যন্ত তোমরা তাকে যে পরিমান হশিশ খাইয়েছো তাতে তার শুধু মন-মগজই ধোলাই হয়নি, সে নিজেও ধোলাই হয়ে গেছে। দেখছো না, সে কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে?’
যে লোকটি হবিবুল কুদ্দসের দেমাগ ধোলাই করতে তাকে নেশা ও হাশিশ পান করাচ্ছিল তাকে ধমক দিয়ে খৃস্টানটি আরো বললো, ‘তুমি ফেদাইন নেতা হাসান বিন সাবাহর শিক্ষা কতটা রপ্ত করতে পেরেছো? শুধু হাশিশ পান করানো ও গোপনে হত্যা করা ছাড়া কি আর কিছুই জানো না তুমি? কি করে একজনের মগজ ধোলাইয়ের পর কাজে লাগাতে হয় তা আমার কাছ থেকে শিখে নাও। মেয়েটা এখন তার পাশেই থাকুক। তুমি এদিকে আসো, বসো আমার পাশে।’
ওরা এক জায়গায় গিয়ে পড়ে থাকা এক গাছের গুড়ির ওপর বসলো। খৃস্টানটি তাকে বললো, ‘এখন তাকে আর হাশিশ পান করাবো না। তার নেশার উন্মাদনা শেষ হতে দাও। ওকে দিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করানো শুধু নয়, তার বাহিনী দিয়ে আইয়ুবীর বাহিনীতে বিদ্রোহ করাতে হবে।
আমি অনেক দেরীতে এখানে পৌঁছেছি, নইলে তার এ অবস্থা করতে দিতাম না। স্বজ্ঞানে রেখে তাকে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর শত্রু বানাতে হবে।
তোমরা তাকে অপহরণ করে আনতে পেরেছো এ জন্য তোমাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি তোমাদের সাহসিকতা ও কৌশলের প্রশংসা করি। আর এ জন্য তোমাদের এতো অধিক মূল্য দেবো যা তোমরা এর আগে কোথাও পাওনি।
আমার শুধু আফসোস, তোমরা তাকে হাশিশ পান করিয়ে অসম্ভব দুর্বল করে ফেলেছো। এতে আমার কাজের অসুবিধা হবে। এখন তাকে সেই সরবত ও গুড়ো ঔষধ পান করাও, যাতে তার নেশা ছুটে যায়।’
খৃস্টানরা গোয়েন্দাগিরী ও সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতায় আনাড়ী ছিল না। আইয়ুবী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম শাসকদের আনুগত্য আদায়ের দিকে মনোযোগ দিলে এ ক্ষেত্রে তারা আরো সুযোগ পেয়ে যায়। তারা আইয়ুবীর বাহিনীর কৌশল ও দক্ষতা সম্পর্কে যেমন অবগত ছিল তেমনি জানতো সাধারণ মুসলমান ও আমীর ওমরাদের স্বভাব দুর্বলতা ও চাহিদা সম্পর্কে।
তারা তাদের দৃষ্টি সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর উপর যেমন নিবদ্ধ রেখেছিল তেমনি বিভিন্ন ছোটো রাজ্যের মুসলিম শাসকদের ক্রুটিগুলো সম্পর্কেও সজাগ ছিল। তারা এইসব শাসকদেরকে তাদের ষড়যন্ত্র ও লোভের শিকার বানানোর প্রচেষ্টায় আরো কুশলী হলো, যেন সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে।
এইসব খৃস্টানদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিল ইহুদী জাতি। তারা তাদের অঢেল অর্থ ও সুন্দরী মেয়েদেরকে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষন দিয়ে যাচ্ছিল। ইহুদী বিশেষজ্ঞরা বুদ্ধি, পরিকল্পনা, অর্থ ও মেয়ে দিয়ে খৃস্টানদের অপূর্ণতা পূর্ণ করে দিচ্ছিল।
মুসলমান শাসক গোষ্ঠীকে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত করে নিল। এক দলের পিছনে লেলিয়ে দিল সুন্দরী মেয়েদের। তারা তাদের যৌবন, মদ ও সম্পদের বিনিময়ে তাদের ঈমান কিনে নিচ্ছিল।
অপর দলটিকে উস্কানী দিচ্ছিল তাদের পৃথক রাজ্য গঠনের জন্য। তাদের মনে জাগিয়ে তুলছিল স্বাধীন থাকার বাসনা ও শাসক হওয়ার স্বপ্ন।
আর তৃতীয় দল ছিল যারা দেশ ও জাতির স্বার্থে নিবেদিতপ্রান ও খাঁটি মুসলমান। এদেরকে কোন প্রলোভনে জড়ানো যাবে না ভেবে ওদের নামে নানা মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো, যাতে জনগনের কাছে তারা ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়। দ্বিতীয় পথ হিসাবে তারা বেছে নিয়েছিল গুপ্তহত্যা, অপহরণ এইসব অন্তর্ঘাতমূলক কাজ।
সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর মধ্যে কারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, যাদেরকে ছলে বলে কৌশলে নমনীয় করা সম্ভব তাদেরও একটি তালিকা করে নিয়েছিল তারা। আরেক দলকে তারা কপট বিপ্লবী বানিয়ে ভিড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিল সুলতানের দলে।
তাদের কাজ ছিল সুলতানের গোপন পলিসি সম্পর্কে অবগত হয়ে সে ব্যাপারে খৃস্টানদের সতর্ক ও সজাগ করা। সুযোগ পেলে অতি বিপ্লবী আচরণের মাধ্যমে সৈন্যদের বিভ্রান্ত করে তাদেরকে খৃস্টানদের পাতা ফাঁদে ফেলে দেয়া।
এসব কাজ তারা চালিয়ে যাচ্ছিল পরিকল্পনা মতো এবং বিরামহীনভাবে। শেষোক্ত দলের কিছু সদস্য বিশ্বস্ততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সেনা বিভাগের উপর মহলেও আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছিল। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মুসলিম সৈন্যদের দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করানোর চেষ্টা করছিল।
যদিও অপহরন ও হত্যার পরিকল্পনা তাদের ছিল কিন্তু বাস্তবে তার দৃষ্টান্ত খুবই কম ছিল। এ কাজের জন্য তারা ব্যবহার করতো হাসান বিন সাবাহর পেশাদার ভাড়াটিয়া খুনীদের।
সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস এমন সামরিক অফিসার ছিলেন যাকে প্রলোভন বা ভীতির মাধ্যমে কব্জা করা সম্ভব ছিল না। অথচ তাকে হত্যা করার চেয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে তাদের লাভ হবে প্রচুর।
খৃস্টানরা ভেবে দেখলো, তাকে হত্যা করলে সে একা নিহত হবে, আর যদি তাকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় তবে মিশরের সেনাবহিনীর সাত হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যকে কাজে লাগানো যাবে তাদের নিজেদের বাহিনীর বিরুদ্ধে। এই সাত হাজার সৈন্য যে সাফল্য বয়ে আনতে পারবে খৃস্টানদের পঞ্চাশ হাজার সৈন্য দিয়েও তা সম্ভব নয়, এটা তারা ভালো করেই জানতো।
খৃস্টান গোয়েন্দাদের রিপোর্ট হচ্ছে, ‘এ ব্যক্তি ঈমান বিক্রি করার লোক নয়। এ লোক জীবন দেবে কিন্তু আপোষ করবে না, বশও মানবে না। তার ঈমান এত মজবুত, জেহাদী জোশ এত তীব্র যে, যদি তার নেতৃত্বে তার বাহিনীকে এক লাখ সৈন্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে বলা হয়, তবে সন্ধ্যার সূর্য যত তাড়াতাড়ি আসে তারচেয়েও তাড়াতাড়ি তার সামনে শত্রুর লাশের পাহাড় জমে যাবে।’
সুলতান আইয়ুবী যেভাবে মুসলিম রাজ্যগুলোর আনুগত্য আদায় করে নিচ্ছে তাতে খৃস্টানরা প্রমোদ গুনলো। তারা ভেবে দেখলো, যদি সুলতান আইয়ুবীর দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানো না যায় তবে তার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ফিলিস্তিন।
এ সময় তাকে পেছনে টেনে আনার একটাই উপায়, মিশরে বিদ্রোহ ঘটানো। কাকে দিয়ে এ কাজ করানো যায় তার অনুসন্ধানে লেগে গেল তারা। এ জন্য তারা কয়েকজন সেনাপতিকে টার্গেট করলো।
যুবতী ও অসাধারণ সুন্দরী মেয়েদেরকে অসহায় ও মজলুমের ছদ্মবেশে সাহায্যের নাম করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। আবার কোন সুন্দরীকে পাঠালো তার নিজস্ব প্রয়োজনের উছিলায়। সুন্দরী মেয়েদের অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত পাঠালো। কিন্তু কিছুতেই তাদের কাউকে জালে আটকাতে পারলো না মেয়েরা। যেন এসব অফিসাররা মানুষ নয়, এক একটা পাথর। কিন্তু মিশরে একটি বিদ্রোহ ঘটানো না গেলে আইয়ুবীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার কোন উপায় নেই।
খৃস্টানরা এবার মরিয়া হয়ে উঠলো। এখনি একটা বিদ্রোহ ঘটাতে না পারলে সুলতান আইয়ুবী আরব সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের একচ্ছএ অধিপতি হয়ে বসবে। এরই মধ্যে অধিকাংশ মুসলিম শাসক তার তলোয়ারের ঝলক দেখে তার বশ্যতা মেনে নিয়েছে। এখন যে কোন মুহূর্তে তিনি বায়তুল মোকাদ্দসের পথ ধরতে পারেন।
ইতিপূর্বে খৃস্টানরা সুদানীদেরকে মিশর বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তাদের উস্কানীতে সুদানী বাহিনী মিশর আক্রমনও করেছিল, কিন্তু সুদানী সেনাবাহিনীতে অধিকাংশ ছিল সেখানকার হাবশী সেনা। হাবশীরা সাধারণত আত্মপূজারী হয়। ফলে জীবনের মায়া তাদের বেশী।
তাদের ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারন ছিল, তারা দল বেঁধে যুদ্ধ করে এবং দল বেঁধেই পলায়ন করে। প্রতিরোধের তীব্রতা দেখে একজন যেই পালাতে গেল, দলে হলে তার পিছু নিল অন্যরা। তাই খৃস্টানরা তাদেরকে মিশরের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে সুবিধা করতে পারেনি।
অতীত অভিজ্ঞতার কারনে খৃস্টানরা মিশরের সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ করানো ছাড়া বিকল্প কিছু চিন্তা করতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত তারা এই বিদ্রোহের জন্য বেছে নিল সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দসকে।
তারা জানে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। কিভাবে হাবিবুল কুদ্দুসকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় সে উপায় খুঁজতে গিয়ে অবশেষে খৃস্টান গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা তাকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কাজের দায়িত্ব দিল হত্যা ও অপহরণে পারদর্শী পেশাদার খুনীচক্র হাসান বিন সাবাহর ফেদাইন দলকে। তাদের চাহিদা মতো মূল্য দিয়েই হবিবুল কুদ্দুসকে হাতে পেতে রাজি হল খৃস্টানরা।
ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা পাকা করে এক সন্ধায় দুই লোক তাঁর বাড়ী গেল। তারা একটি গ্রামের নাম নিয়ে বললো, ‘সেখানকার মসজিদের ছাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পুরো মসজিদটা মেরামত বা পুননির্মাণ করতে হবে। সন্ধ্যার পর সেখানে গ্রামের লোকেরা সমবেত হবে। আপনি সেখানে চলুন যাতে সকলেই মুক্ত মনে মসজিদে দান করার উৎসাহ পায়।’
আগত দুই ব্যক্তিকে বেশভূষায় মসজিদের ইমাম ও খাদেম মনে হচ্ছিল। তিনি ইতস্তত করলে তারা মসজিদ নির্মাণ ও মেরামতে সহযোগিতা করলে ইহ ও পরকালে কি সওয়াব ও কল্যাণ পাওয়া যাবে তার এক আবেগময় বক্তৃতা দিয়ে ফেলল তার সামনে। তিনি এই দুই বুজুর্গের আবদার ফেলতে না পেরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন।
তারা যখন শহরের বাইরে এলো তখন আরো চার ব্যক্তি এসে যোগ দিল তাদের সাথে। চেহারা সুরতে তাদেরও আলেম বলে মনে হচ্ছিল। সবাই গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললো মসজিদের দিকে।
রাতের অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছিল প্রকৃতি। তারা এক পুরাতন ও বিধ্বস্ত মহলের কাছাকাছি চলে এলো। এলাকাটা ছিল নির্জন। রাতের অন্ধকারে ছয়জন তাকে জাপটে ধরলো। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন তার নাকে চেপে ধরলো একটি ভেজা রুমাল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারান।
তারা তাকে ধরাধরি করে সেই বিধ্বস্ত নির্জন কামরায় নিয়ে গেল। তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন একজন বললো, ‘এখন কেমন বোধ করছেন? এ ঔষধটুকু খেয়ে নিন, ভালো হয়ে যাবেন।’
এভাবে ছলনার আশ্রয় নিয়ে তাকে প্রথম ডোজ হাশিশ পান করানো হলো। নেশার রাজ্যে ডুবে গেলেন তিনি।
সেই রাতেই তাকে নিয়ে আসা হলো এই নির্জন পরিত্যক্ত শহরে। এখানে আগে থেকেই ফেদাইনরা তাদের ঘাঁটি বানিয়ে নিয়েছিল। নিরাপদ ঘাঁটিতে এনে অপহরণকারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
ফেদাইন নেতা এখানে তাকে ক্রমাগত হাশিশ পান করাতে লাগলো। নেশার ঘোরে চলছিল তাকে সম্মোহিত করার প্রচেষ্টা। এই বিরান কামরায় তার আরাম আয়েশের দিকেও ছিল ছিনতাইকারীদের পূর্ণ মনযোগ।
বিলাসিতার যাবতীয় সামগ্রী এনে জমা করেছিল তার জন্য। তার সেবার জন্য ছিল দুইজন যুবতী মেয়ে। তারা শুধু সুন্দরী ছিল না, মানুষের মন ভুলিয়ে তাদের মধ্যে পশু স্বভাব জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও তারা ছিল সমান পারদর্শী।
তারা জানতো, এই সেনাপতিকে কেন এখানে ধরে আনা হয়েছে। তারা পুরস্কারের আশায় নিজে থেকেই তার মন মগজ ধোলাই করার কাজে লেগে গেল।
মানুষকে হাশিশ পান করিয়ে সম্মোহিত করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। হাশিশ পরিবেশনেরও বিশেষ মাত্রা আছে। তারা নিয়ম মাফিক সেই প্রক্রিয়ায় তাকে হাশিশ পান করাতো এবং চেতনার একটি বিশেষ অবস্থানে এলে তার উপর প্রয়োগ করতো সম্মোহন বিদ্যা।
তার চেতনা যখন উপলব্ধি করার পর্যায়ে এসে পৌঁছতো তখন আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথার যাদু দিয়ে তার মাথার মধ্যে এক নতুন ধারনা সৃষ্টি করা হতো। একেই বলে হিপনোটিজম।
অর্ধ উলঙ্গ সুন্দরী মেয়েরা এ সময় তার সামনে নাচতো। এক ইন্দ্রজালিক আবহ তৈরী করা হতো ঘরের মধ্যে। নতুন এক দুনিয়ায় পদার্পন ঘটতো সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির।
কয়েকদিন ধরে হাবিবুল কুদ্দুসের উপর এই প্রক্রিয়া চালানোর পর দেখা গেল তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তারা তার মধ্যে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো। তাদের সাথে কাজে নেমে পড়লো ফেদাইন নেতা। সে হাবিবুল কুদ্দুসকে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলতে লাগলো।
কয়েকদিন পর তারা ধরে নিল, তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। হাবিবুল কুদ্দুসের চিন্তা চেতনা কব্জা করে নিতে পেরেছে তারা।
ওদিকে মিশরের গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের গোয়েন্দারা অধীরভাবে ছুটাছুটি করছিল তার সন্ধানে। তাদের কারো কারো ধারণা, তিনি হয়তো সুদানী বা খৃস্টানদের কাছে চলে গেছেন।
আলী বিন সুফিয়ান তাকে অপহরণ করা হয়েছে এমন সন্দেহ পোষণ করলেও তার কোন প্রমান তার কাছে নেই। তাই তিনিও ধরে নিলেন, তিনি হয় অপহৃত হয়েছেন নয়তো নিজেই দল বদল করে চলে গেছেন দুশমন শিবিরে।
কিন্তু যখনি তার মানসপটে ভেসে উঠতো দ্বীনের প্রতি হাবিবুল কুদ্দুসের অনুরাগ, জেহাদের ব্যাপারে তার নিষ্ঠা ও তৎপরতা, তখনি তিনি কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যেতেন।
সেনাবাহিনীর এমন একজন বিশ্বস্ত গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তার কোন সন্ধান অবশ্যই পেয়ে যাবেন। গোয়েন্দারা তাঁর খোঁজে চারদিকে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। কিন্তু যতই সময় গড়াচ্ছিল ততোই এটা বুঝা যাচ্ছিল যে, মিশরের মাটিতে তার আশা করা বৃথা।
আলী এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য রাখছিলেন, আইয়ুবীর সেনাদলের আর কোন কমান্ডার বা অফিসার নিখোঁজ হয় কিনা? কিন্তু এতদিনেও এ ধরনের আর কোন ঘটনা ঘটেনি।
খৃস্টান নেতা হাবিবুল কুদ্দুসের সেই বিরান কামরায় ফিরে এলো। এসেই খবর নিল তাকে হাশিশের ক্রিয়া নষ্টকারী ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে কিনা?
মেয়েটি জানালো, তাকে সে ঔষধ সেবন করানো হয়েছে। লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসের নেশা ছুটে যাওয়ার অপেক্ষায় সেখানে বসে রইলো।
রাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাবিবুল কুদ্দুসের নেশার ঘোর কাটছিল না। খৃস্টান নেতা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে তার নেশার ঘোর কাটার অপেক্ষা করলো। রাত অধিক হয়ে যাওয়ায় শেষে সে শুতে চলে গেল। যাওয়ার সময় মেয়েদের বলে গেল, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে তাকে যেন খবর দেয়া হয়।
পরের দিন। হাবিবুল কুদ্দুসের পাশে এসে বসলো খৃস্টান নেতা। তিনি তখনও নেশার ঘোরে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছেন। খৃস্টান নেতা চিন্তায় পড়ে গেল। সে ফেদাইন নেতাকে অতিরিক্ত হাশিশ পান করানোর জন্য গালাগালি করে মনের ঝাল ঝাড়তে লাগল।
ফেদাইন নেতা কাচুমাচু হয়ে বললো, ‘আমার কি দোষ? একজন সেনাপতি যে এত দুর্বল তা আমি কেমন করে জানবো?’
অনেক বেলায় ঘুম ভাঙলো হাবিবুল কুদ্দুসের। তিনি চোখ খুলে এদিক ওদিক দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলেন। যখন তার দৃষ্টি খৃস্টান নেতার উপর পড়লো সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে বসলেন এবং গভীরভাবে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।
‘আমার বড়ই দুঃখ যে, এই লোকেরা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।’ খৃস্টান নেতা বললো, ‘আপনি বেশী অধীর ও বিস্মিত হবেন না। এই হতভাগারা আপনাকে হাশিশ পান করাচ্ছিল এবং আপনাকে মজার মজার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
আপনি ফেদাইনদের কার্যকলাপ ও হাশিশের ক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চয় অবগত আছেন? ফেদাইনরা মুক্তিপণের লোভে আপনাকে অপহরণ করেছিল। খবরটা জানতে পেরেই আমি ছুটে এসেছি।
এখন থেকে আপনি আর নিজেকে বন্দী মনে করবেন না। আমি তাদের পাওনা মিটিয়ে দেবো এবং আপনার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবো। আগে জানতে পারলে আপনার ওপর যে অত্যাচার হয়েছে সেটুকুও করতে দিতাম না।’
‘এই লোকেরা আমাকে ধোঁকা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘এরা সম্ভবত আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিল।’
তিনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারদিকে দেখলেন এবং বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘সেই জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল। কে আমাকে এখানে এনেছে?’
‘আপনি নিজেকে সজাগ করুন।’ খৃস্টান নেতা বললো, ‘আগে যা দেখেছেন সেটা হাশিশের প্রভাব। আপনি প্রথম থেকেই এখানে আছেন।’
‘আপনি বলছেন আমাকে ছিনতাই করা হয়েছিল এবং ছিনতাই করেছিল ফেদাইনরা।’ হাবিবুল কুদ্দুস সত্য উদঘাটনের জন্য গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কে?’
‘আমি আপনার এক মুসলমান ভাই।’ খৃস্টান লোকটি বললো, ‘আমি আপনার কাছ থেকে কিছু চাই না, বরং আপনাকে কিছু দিতে চাই।’
‘যদি আমি দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করি?’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন।
‘তবে আপনি এখান থেকে কোনদিনই জীবিত বেরোতে পারবেন না।’ খৃস্টানটি তাকে বললো, ‘আপনি কায়রো থেকে এত দূরে যে, যদি আপনাকে মুক্তি দেয়া হয় তবুও আপনি রাস্তাতেই মারা যাবেন।’
‘সেই মৃত্যুই তো আমি চাই। তাতেই আমার জীবন ধন্য হবে।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘কিন্তু আমি শত্রু শিবিরে বন্দী অবস্থায় মরতে চাই না।’
‘আপনি বন্দী নন আর আমিও আপনার শত্রু নই।’ খৃস্টানটি বললো, ‘এই শয়তানেরা আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আপনার মনে অহেতুক ভয় ও সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনাকে অপহরণ করেছে ফেদাইনরা। আর আপনি ভাল করেই জানেন ফেদাইনরা পেশাদার খুনি ও সন্ত্রাসী। আপনাকে অপহরণ করার উদ্দেশ্য কিছু মুক্তিপণ আদায় করা। এরাও আপনার দুশমন নয়, আমি তো নই-ই। আপনার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা ছিল।’
‘সে কথা বলার জন্য আমাকে ছিনতাই করে এত দূরে নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিল?’
‘আমি ছিনতাই করিনি বরং ছিনতাইকারীদের থেকে আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি।’
‘কেন আপনি আমাকে মুক্ত করবেন? তাতে আপনার লাভ?’
‘লাভ তো অবশ্যই কিছু আছে। সে কথাই আপনাকে বলতে চাই। সে জন্যই তো আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’
‘তাতে বুঝা যাচ্ছে, অপহরণকারীরা জানতো আমাকে তোমার দরকার। তাই তারা অপহরণ করে তোমাকে খবর দিয়েছে। তাতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, তুমিই তাদের দিয়ে আমাকে অপহরণ করিয়েছো?’
‘যদি আপনি এমনটি মনে করেন তাতেও আমার করার কিছু নেই। সত্যি আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। আমার বুকে এমন কিছু কথা আছে যা আপনার বুকে দেয়া দরকার।’
‘সে কথা তুমি আমাকে কায়রোতেও বলতে পারতে!’
‘যদি আমি সে কথা কায়রোতে আপনার সঙ্গে বলতাম তবে দু’জনেই কায়রোর কারাগারে বন্দী থাকতাম।’ খৃস্টান বললো, ‘কারণ সেখানে আলী বিন সুফিয়ান ও পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিসের গোয়েন্দারা দ্বারে দ্বারে ও পদে পদে তল্লাশী চালাচ্ছে।’
হাবিবুল কুদ্দুসের চেতনা ও জ্ঞান সম্পূর্ণ ফিরে এসেছিল। তাঁর মস্তিষ্ক নেশার ঘোর থেকে মুক্ত হয়ে আবার স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি এখন খৃস্টান দুর্বৃত্বদের হাতে পড়ে কোন দুর্গম স্থানে অবস্থান করছেন। তিনি গলার স্বর ও ভঙ্গি পাল্টে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি ক্রুসেডার, নাকি সুদানী?’
‘আমি মিশরের লোক।’ লোকটি উওর দিল, ‘আর আপনিও মিশরী। আপনি ইরাকী, সিরিয়ান বা আরবী নন। মিশর মিশরীয়দের। এটা নূরুদ্দীন জঙ্গী বা সালাউদ্দীন আইয়ুবীর বংশগত জায়গীরদারী নয়। এটা ইসলামী রাজ্য, এখানে আল্লাহর শাসন থাকবে। তবে তার দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং শাসনকার্য পরিচালনা করবে মিশরীয় মুসলমানরা। আপনি কি মনে করেন, মিশরের উপর শাসন চালানোর জন্য বাগদাদ বা দামেশক থেকে লোক আমদানী করতে হবে?
সালাউদ্দীন আইয়ুবী নিজে ইরাকী, শাসক হয়েছেন মিশরের। এখন সিরিয়ার সাথে তাকে যুক্ত করে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাচ্ছেন।’
‘তুমি কি মিশরকে সালাউদ্দীন আইয়ুবীকে পয়গম্বর মনে করেন না। তবে তাকে আপনি নিজের মুরশিদ বা নেতা মনে করেন।’ খৃস্টান লোকটি বললো, ‘আমি তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলবো না। কারন সুলতান আইয়ুবীর মধ্যে অনেক ভাল গুন আছে। আমিও তাঁকে আপনার মতই যোগ্য মনে করি।
কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে, তিনি আর কতকাল জীবিত থাকবেন? তাঁর পরে তাঁর সন্তান বা ভাইয়ের হাতে শাসন ক্ষমতা যাবে। তারা তো আর সালাউদ্দীন আইয়ুবীর মত হবে না, তখন মিশরের ক্ষমতা চলে যাবে আরেক ফেরাউনের হাতে।’
‘আমাকে দিয়ে তুমি কি কাজ উদ্ধার করতে চাও?’
‘যদি আপনি আমার কথা বুঝে থাকেন তবে আমি আপনাকে বলবো, আপনি কি করতে পারেন।’ খৃষ্টান লোকটি বললো, ‘যদি আপনার মনে আমার সম্পর্কে সন্দেহ থাকে তবে তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। প্রথমে আপনার মনের সন্দেহ দূর হওয়া দরকার। আপনি ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে নিন।’
লোকটি বললো, ‘আপনি এইমাত্র জেগেছেন। ফেদাইন হতভাগাদের দেয়া হাশিশের ক্রিয়া এখনও আপনার উপরে কাজ করছে। আগে আপনি সুস্থ হোন, তারপর ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন আমার কথা।
এখন আর কথা নয়। আমি আপনার কাছে খাবার পাঠাচ্ছি, আগে খেয়ে নিন। কয়েকদিন ধরে শয়তানরা আপনার গোসলেরও কোন ব্যবস্থা করেনি দেখছি।
আমি আপনাকে এক ঝর্ণার ধারে পাঠাচ্ছি। আগে পুরোপুরি সুস্থ হোন। ভালভাবে চিন্তাভাবনা করেই যে কোন কাজের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তাতেই মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত থাকে বলে আমার বিশ্বাস।’
লোকটি সেখান থেকে উঠে অন্য কোথাও চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে এক লোক এসে বললো, ‘আমার সাথে চলুন, আহারের পূর্বে গোসলটা সেরে নিবেন।’
বিরান মহলের সেই কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। তাকে এমন এক রাস্তা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো যে রাস্তা দুই পাহাড়ের সংকীর্ণ ফাটলের মধ্য দিয়ে চলে গেছে।
তারা কিছু দূর যাওয়ার পর একটু ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল এবং তার সামনেই দেখা গেল স্বচ্ছ এক ঝরণা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানি যেখানে পড়ছিল সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে তৈরী হয়েছিল একটি গভীর জলাশয়। তারপর সেই পানি জলাশয় থেকে একটি প্রশস্ত নালা বা খাল দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ফোরাতের দিকে।
ঝর্ণার পানি ছিল খুবই স্বচ্ছ। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন পাহাড়ী ঝর্ণার পানি যেখানে পড়ছে সেখানে দু’টি মেয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় একে অন্যের দিকে হাত দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে।
এ দৃশ্য দেখে হাবিবুল কুদ্দুস থেমে গেলেন এবং নিজের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলেন। হাবিবুল কুদ্দুসের সঙ্গে লোকটি বললো, ‘কি হলো, থামলেন কেন? চলুন।’
মেয়ে দু’টি আওয়াজ শুনে ওদের দেখতে পেয়েই চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে পাড়ে উঠে এলো এবং পড়িমড়ি করে ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
তিনি এই নির্জন ও বিরান অঞ্চলে এমন সুন্দরী পরীর মত মেয়েদেরকে জ্বীন পরী বা ভূত বলে ধারনা করলেন। সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস মেয়েদের চিৎকার শুনে নিজের অজান্তেই আবার ফিরে তাকালেন ওদিকে। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন সেখানে কোন মেয়ে নেই।
তিনি চারদিকে তাকালেন। সর্বত্রই শুধু পাহাড় ও বিরান মহলের ধ্বংসাবশেষ। নিজের সাথে আসা লোকটিকে ছাড়া আশেপাশে তিনি আর কাউকে দেখতে পেলেন না।
তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সাথে আসা লোকটি ‘চলুন’ বলেই খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। হাবিবুল কুদ্দুস দ্রুত এগিয়ে গেলেন তার কাছে এবং তাকে কোন কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই ঝট করে নিজের দৃঢ় বাহু দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরলেন।
লোকটি ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমত ঘাবড়ে গেল। হাবিবুল কুদ্দুসের দৃঢ় হাতের চাপে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো।
সেনাপতি এক হাতে পিছন থেকে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে অন্য হাতে তার পেটে ও বুকে ভীষণ জোরে ঘুষি চালালেন।
হাবিবুল কুদ্দসের বেদম মারের চোটে লোকটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রায় মরতে বসেছিল, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ঘুষি বন্ধ করে তার নুয়ে পড়া মাথাটি উঁচু করে ধরলেন এবং হাতের চাপ ছেড়ে দিলেন। লোকটি ভুস করে দম ছাড়লো।
হাবিবুল কুদ্দুস আবার তার গলা টিপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে এক ঘন ঝোঁপের মধ্যে ফেলে দিলেন এবং দ্রুত সেখান থেকে পালালেন।
পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটি সরু রাস্তা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। চারদিকে চোখ বুলাতে গিয়ে আগেই রাস্তাটি দেখেছিলেন তিনি। পেছনে মহলের ধ্বংসাবশেষের দিকে না গিয়ে তিনি সেই রাস্তা দিয়ে ছুটলেন। কিছু দূর গিয়ে পাহাড়ের বাঁক ঘুরেই থমকে দাড়াঁলেন তিনি। সেখানে এক লোক বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসকে দেখলো। তার মধ্যে বিস্ময় বা ভয় কোনটাই নেই। যন্ত্রচালিতের মত সে শুধু একটি কথাই বললো, ‘ফিরে যান।’
হাবিবুল কুদ্দুস ছিলেন নিরস্ত্র। এর হুকুম অমান্য করলে লোকটি যে তাকে শিকারী পশুর মতই বর্শাবিদ্ধ করে মহলে ফিরিয়ে নেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় খালি হাতে তার সাথে লাগতে যাওয়া নিরর্থক ভেবে তিনি মাথা নত করে পিছনে ফিরলেন।
তিনি মাত্র কয়েক পা এগিয়েছেন এই সময় খৃস্টান প্রহরী তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো এবং হেসে বললো, ‘আমি আপনাকে জ্ঞানী মনে করেছিলাম।’ খৃস্টান প্রহরী তাকে আরো বললো, ‘আপনি এ ধ্বংসাবশেষ থেকে বের হতে পারবেন না। আহাম্মকি না করে গোসল করে নিন। আসুন আমার সঙ্গে।’
তিনি সেই ঝর্ণার পানিতে গোসল করে কাপড় পাল্টে চলে এলেন। খৃস্টান প্রহরী তাঁকে মহল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। পথে তিনি খৃস্টানটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই মেয়েগুলো তোমাদের সাথেই আছে?’
‘এমন জনশূন্য বিরান স্থানে কিছু আলো তো সঙ্গে রাখাই দরকার।’ খৃস্টানটি বললো, ‘আপনার কি তিনটি স্ত্রী নেই? বাড়ীতে যার এক সাথে তিন স্ত্রী দরকার হয় এমন জনশূন্য বিরান প্রান্তরে তার কি কোন মেয়ে মানুষের দরকার হতে পারে না?
আপনার যদি প্রয়োজন না থাকে ভাল কথা, কিন্তু যদি আপনি এই নির্জন স্থানে একাকীত্বের কষ্ট পান তবে এই মেয়েদের যাকে খুশী ডাক দেবেন, আপনার কষ্ট তারা দূর করে দেবে।’
মহলে প্রবেশ করলে এক মেয়ে নাস্তা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার কামরায় এলো। হাবিবুল কুদ্দুস এ মেয়েটিকে আগেও দেখেছেন। মেয়েটি তার সামনে নাস্তা রেখে নিজেও তার পাশে বসে গেল। কামরায় খৃস্টান নেতা ছিল, সে বাইরে চলে গেল। মেয়েটি তার পাতে খাবার তুলে দিতে লাগলো এবং তার সাথে আপনজনের মত গল্প জুড়ে দিল। মেয়েটির কথার যাদু ও অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন হাবিবুল কুদ্দুস। খাওয়া শেষ হওয়ার পরও গল্প চলতে লাগলো তাদের।
অনেকক্ষন পর খৃস্টান নেতা ফিরে এলে মেয়েটি সেখান থেকে উঠে চলে গেল। হাবিবুল কুদ্দুস অনুভব করলেন, মেয়েটি চলে যাওয়ায় তার বেশ খারাপ লাগছে।
‘আপনি স্বাধীন মিশরের প্রধান সেনাপতি হবেন।’ খৃস্টান তাঁকে বললো, ‘আপনার বাহিনীতে যে তিন হাজার পদাতিক সৈন্য, দুই হাজার অশ্বারোহী ও দুই হাজার তীরন্দাজ আছে তারা আপনার একান্ত অনুগত ও ভক্ত। আপনি তাদের সাহায্যে মিশরের শাসন ক্ষমতা দখল করতে পারবেন।’
‘সালাউদ্দিন আইয়ুবী আক্রমন চালালে আমি কি এই বাহিনী দিয়ে মিশরকে তাঁর আক্রমন থেকে বাঁচাতে পারবো?’
‘সুদানী মুসলমান, যারা এক সময় মিশরের সেনাবাহিনীতে ছিল, তারা আমাদের সাথে থাকবে।’ খৃস্টানটি বললো, ‘সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যদের মধ্যেও যারা মিশরের অধিবাসী, তাদের কাছে আমি এ খবর পৌঁছে দেবো। তাদের জানাবো, এটা গৃহযুদ্ধ নয়, বরং এটা মিশরকে স্বাধীন করার এক চূড়ান্ত প্রচেষ্টা।’ খৃস্টান লোকটি আরো বললো, ‘আপনি আপনার বাহিনী দিয়ে বিদ্রোহ করাবেন। আপনাকে সামরিক সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা আমি করবো।’
কিভাবে এই বিদ্রোহ তিনি সংগঠিত করবেন তার একটি নীলনকশা হাবিবুল কুদ্দুসের সামনে তুলে ধরলো খৃস্টান নেতা। বিস্তারিত আলোচনার পর জিজ্ঞেস করলো, ‘এবার বলুন, এ পরিকল্পনা আপনার কেমন লাগছে?’
হাবিবুল কুদ্দুস বিষয়টিকে আর হালকাভাবে নিতে পারলেন না। তিনি এটুকু বুঝলেন, খৃস্টানরা আটঁঘাট বেঁধেই এ কাজে নেমেছে। অতএব এ পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়ন করবেই।
তিনি খৃস্টান নেতার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। খৃস্টানটি আবার বললো, ‘কি ভাবছেন?’
‘ভাবছি, তুমি যে পরিকল্পনা দিলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?’
খৃস্টানটি বুঝে নিল টোপ গিলতে শুরু করেছেন হাবিবুল কুদ্দুস। অনেকক্ষন পর হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘যদি আমি কায়রো ফিরে যেতে না পারি তবে আমার বাহিনীকে কেমন করে বিদ্রোহে রাজি করাবো?’
‘আপনাকে ফিরে যেতে হতে না।’ খৃস্টানটি বললো, ‘আপনি এখান থেকেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আপনার খুব বিশ্বাসভাজন কাউকে আপনি চিঠির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠাবেন। সে চিঠি পৌঁছানো এবং তার মাধ্যমে কাজ উদ্ধার করার ব্যবস্থা আমিই করতে পারবো।’
‘কিন্তু আমি যদি তাতে রাজি না হই?’
‘অমন কথা বলবেন না।’ খৃস্টানটি বললো, ‘আপনি আমার এক প্রাণপ্রিয় সাথীকে হত্যা করেছেন। সেই অপরাধে আমি আপনাকে হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু মিশরের স্বার্থে আমি আমার সব রাগ ও ক্ষোভ দমন করে নিয়েছি। দয়া করে আপনি আমাকে আবার উত্তেজিত করে তুলবেন না।’
লোকটি বললো, ‘আপনি যদি আমার কথা না মানেন তবে আমাকে আপনার ও আপনার পরিবারের সাথে হিংস্র আচরণ করতে হবে।’
‘তবে তো আমাকে এখানে দীর্ঘ দিন থাকতে হবে।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন।
‘কিছু সময় তো লাগবেই।’ খৃস্টানটি উওর দিল, ‘এখানে আপনার কষ্ট হয় এমন কিছু ঘটতে দেবো না আমি। আপনার যখন যা প্রয়োজন হয় বলবেন, আপনার সব প্রয়োজন আমি পূরণ করে দেবো।’
‘তবে আমার একটা প্রয়োজন আপাতত মিটিয়ে দাও।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘তুমি আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য দু’টি মেয়েকে নিয়োজিত করেছো। কিন্তু আমি পাপ থেকে বাঁচতে চাই। এমনও হতে পারে, এই সুন্দরীদের মোহে পড়ে আমি আমার দায়িত্ব ভুলে যেতে পারি। তার চেয়ে একটি ব্যবস্থা করো, আমার ছোট বিবি জোহরাকে এখানে এনে দাও। তাতে লাভ হবে এই যে, তাকে দিয়েই আমি সংবাদ আদান প্রদানও করতে পারবো।’
‘তাহলে যে তাকেও ছিনতাই করতে হবে।’ খৃস্টান লোকটি বললো, ‘যদি তাকে আমি বলি যে, আপনি তাকে ডাকছেন, সে তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বরং আমাকে ধরিয়ে দেবে। তার বদলে আমি আপনাকে যে জিনিষ দিচ্ছি তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। সংবাদ বা যোগাযোগের জন্য অন্য কোন বিশ্বস্ত লোকের নাম ঠিকানা বলুন।’
‘তারচেয়ে তুমি আমাকে বিশ্বাস করে নাও।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘তুমি আমাকে কায়রো পৌঁছে দাও। আমি তোমার কাছে ওয়াদা করছি, এক মাসের মধ্যেই আমি সেখানে বিদ্রোহ ঘটাবো।’
‘এটা অসম্ভব! এ হতে পারে না।’ খৃস্টানটি উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ‘সম্মানিত সেনাপতি! আমি যা করছি সেটা মিশরের ভালোর জন্যই করছি। আর এর মধ্যে আপনারও কল্যাণ নিহিত আছে। আমি অথবা আমার সংগঠন কোন ব্যক্তিই মিশরের শাসক হতে পারবো না। আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন, মিশর স্বাধীন হলে তার দায়িত্ব ও শাসনভার আপনাকেই গ্রহন করতে হবে।’
‘আমি তোমার কথা ভাল করেই বুঝতে পেরেছি।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘আর এখন আমি চিন্তা ভাবনা করেই কথা বলছি। আমার ছোট বিবি জোহরার কাছে সংবাদ পৌঁছে দাও। তাকে বলো, আমি তাকে আমার কাছে আসতে বলেছি। সে যে কাজ করতে পারবে তা আর কেউ পারবে না। কারন তার বাপ আমার বাহিনীতে আছে। তার আসার পর দেখবো, এই পরিকল্পনা কিভাবে সফল করা যায়।’
এক বুড়ি ভিখারিনী একদিন জোহরাকে পথে থামিয়ে দিল। বুড়ি দু’তিন দিন ধরেই লক্ষ্য করছে, জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসের বাড়ী থেকে দুপুরে তার মা বাবার বাড়ী চলে যায় আর সন্ধ্যায় ফিরে আসে।
সেদিন জোহরা বাপের বাড়ী যাওয়ার জন্য পথে বেড়িয়েছে। এক ভিখারিনী তার পথ আগলে হাত প্রশস্ত করে বললো, ‘সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস আপনাকে ডেকেছেন। এই চিঠি তার নিজের হাতের লেখা। নিশ্চয়ই তার হাতের লেখা আপনি চিনতে পারছেন?’
জোহরা কাগজটি হাতে নিয়ে তাঁর কাছে লেখা হাবিবুল কুদ্দুসের চিঠিটি পড়লো। এ চিঠি যে তার স্বামীরই হাতের লেখা তাতে কোন সন্দেহ নেই।
চিঠি পড়া শেষ হতেই ভিখারিনী তার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘তিনি যেখানেই যান না কেন, স্বেচ্ছায় একাকীই গেছেন। এতবড় ক্ষমতাবান লোককে কেউ ধরে নিয়ে যেতে পারে না।
তিনি শুধু আপনাকেই চান। তিনি বলেছেন, ‘জোহরাকে ছাড়া এ চিঠি আর কারো হাতে দেবে না। আর তাকে বলবে, সে যেন তোমার সাথে আমার কাছে চলে আসে। তিনি এ চিঠির প্রসঙ্গ কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন।’
এও বলেছেন, ‘জোহরাকে বলবে, সে যেন তোমাকে বিশ্বাস করে। সে যদি এ চিঠি বিশ্বাস না করে তোমাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বা থানায় সংবাদ পাঠায় তবে আমি ও জোহরা দু’জনেই মারা পড়বো।’ আমার কথা বিশ্বাস করুন, হাবিবুল কুদ্দুসের কাছে আপনার যাওয়া দরকার।’
‘আমি তোমার কথা কেমন করে বিশ্বাস করি?’ জোহরা ভীত-চকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, এমন কথা আমি কেমন করে বিশ্বাস করি?’
‘আমি ভিক্ষুক নই।’ ভিখারিনী বললো, ‘এটা আমার ছদ্মবেশ। আমিও আপনার মত ধনীর দুলালী। আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ও পবিত্র। বিশ্বাস না করলে কি ক্ষতি হবে সে কথা আপনার স্বামীই বলে দিয়েছেন। আপনি কি জানেন না, তিনি আপনাকে কতটা ভালবাসেন? এই হাতের লেখা কি তার নয়? তাহলে কেন অযথা সন্দেহ পোষণ করে নিজের ও স্বামীর বিপদ ডেকে আনবেন?’
‘কিন্তু তিনি নিরুদ্দেশ হতে গেলেন কেন? আমি তো এর কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন এক মহৎ ও বিরাট উদ্দেশ্য নিয়ে। সব কথা আমিও জানি না, আর যা জানি তাও আপনাকে বলতে পারবো না। কারন সে তথ্য প্রকাশ করার অনুমতি তিনি আমাকে দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, দেশ আজ এক মহা ষড়যন্ত্রে পড়েছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যই তাকে নিরুদ্দেশ হতে হয়েছে।’
মেয়েটি তাকে আরও অনেক কথাই বললো। জোহরা তার কথায় এটুকু বুঝলো যে, ঘটনা যাই হোক, তার স্বামী এখনো জীবিত আছেন। তিনি যে কারণেই নিরুদ্দেশ হোন না কেন, তার জীবন ও দেশের স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখীন। ফলে সে মেয়েটির প্রস্তাবে রাজী হল। ওকে বললো, ‘তুমি সন্ধ্যার সময় অমুক জায়গায় অপেক্ষা করো, আমি চলে আসবো।’
জোহরা ওকে বিদায় দিয়ে বাপের বাড়ী চলে গেল। সারাদিন সে চিন্তা করলো। শেষে সন্ধার একটু আগে প্রতিদিনের মতই বাড়ী ফেরার নাম করে রাস্তায় নামলো। কিন্তু আজ তার গতি বাড়ীর দিকে ছিল না, ছিল সেই দিকে, যেখানে দুপুরের দেখা মেয়েটিকে থাকতে বলেছিল।
কিন্তু ওখানে পৌঁছে সে দুপুরের ভিখারিনীর কোন হদিস পেলো না। সে মহা দুর্ভাবনায় পড়ে গেল। চিন্তা করতে লাগলো, কাউকে কিছু না জানিয়ে তার এভাবে চলে আসাটা কি ঠিক হচ্ছে?
কিন্তু যেখানে স্বামীর জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, সেখানে যদি তাকে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয় তাতে পিছপা হতে পারে না জোহরা। কারন তার পিতা ও স্বামী উভয়েই তাকে মুজাহিদ হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। সামনে যাই ঘটুক না কেন, তা মেনে নেয়ার জন্য সে নিজের মনকে বুঝাতে লাগলো।
সূর্য যখন ঠিক ডুবতে বসেছে তখন সেখানে এক বোরকাওয়ালী যুবতী এলো। এই মেয়েই দুপুরে বুড়ি সেজেছিল। মেয়েটি তাকে বললো, ‘চলুন।’
জোহরা তাকে অনুসরণ করলো। তারা শহর ছেড়ে গ্রামে নেমে এলো। ততোক্ষণে রাতের আধাঁর গিলে ফেলেছে সেই গ্রামের বাড়িঘর ও বৃক্ষরাজি। রাস্তার পাশে এক বৃক্ষের আড়ালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল দু’জন লোক।
একটু পর সেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল ওরা। মেয়েটি গাছের কাছে পৌঁছতেই বিড়ালের ডাক ডাকলো দুই বার। এটা ছিল এক গোপন সংকেত। সংকেত পেয়ে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো সেই দুই লোক।
মেয়েটি তখন আর ভিখারিনীর ছদ্মবেশে ছিল না। সে এখন এক সুন্দরী যুবতী নারী। সে জোহরাকে বললো, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ওদের সাথে চলে যাও, মনে কোন ভয় রাখবে না।’
জোহরাকে একটি অশ্বের পিঠে আরোহন করানো হলো। লোক দু’জনও দুই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বসলো। তারপর অন্ধকারের মধ্যেই অপরিচিত দুই লোকের সাথে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো জোহরা।
জোহরা এমন এক সফরে যাত্রা করলো যে পথের মঞ্জিল তার জানা নেই। মেয়েটি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। জোহরাদের ঘোড়ার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে সে একাকী শহরের পথে ফিরে চললো।
অনেক রাত পর্যন্ত পথ চললো ওরা। জোহরা পথঘাট কিছুই চেনে না। রাত বলে সে আশেপাশে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। কোথায় যাচ্ছে, কতদূর যেতে হবে কিছুই জানা নেই তার। তবু তার চলার বিরাম নেই।
রাত তখন অর্ধেকেরও বেশী পার হয়ে গেছে। এক পাহাড়ের কোলে থামলো ওরা। একজন আরেকজনকে বললো, ‘ওর চোখ বাঁধা প্রয়োজন।’
এই মধ্য রাতে অন্ধকার পথে যেখানে জোহরা কোন দিকে যাচ্ছে তাই জানে না, সেখানে হঠাৎ করে তার চোখ বাঁধার কি দরকার পড়লো বুঝতে পারলো না জোহরা। কিন্তু সে একা এবং অসহায়। তাদের বাঁধা দেয়ার কোন ক্ষমতাই নেই জোহরার। তাই সে কোন বাঁধা দিল না। ওরা তার চোখে কালো কাপড়ের পট্টি বেঁধে দিল।
জোহরা যেদিন বাড়ী থেকে পালালো তার দুই দিন পর ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেল। সবাই জানলো, সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুসের ছোট বিবিও নিখোঁজ হয়েছে।
গোয়েন্দারা সন্দেহ করলো, তাকেও ছিনতাই করা হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ থেকে তো কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তাই আসলে কি ঘটেছে বলতে পারলো না কেউ।
লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, ‘তিনি হয়তো খৃস্টান বা সুদানীদের সাথে মিলিত হয়েছেন। তার স্ত্রী জোহরাও হয়তো তাঁর কাছেই চলে গেছে।’
কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ভাবছিলেন অন্য কথা। একজন সেনাপতির অন্তর্ধানের পর তার পরিবারের প্রতি গোয়েন্দাদের যে নজরদারী ছিল তার ফাঁক গলে কেমন করে তার স্ত্রী হারিয়ে যেতে পারে? সে পালিয়ে যাক বা অপহৃত হোক, গোয়েন্দাদের সে ফাঁকি দিতে পেরেছে, এতে তো কোন সন্দেহ নেই?
কায়রোতে যখন এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছিল ততোক্ষণে জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসের কাছে পৌঁছে গেছে। তার চোখের পট্টি যখন খোলা হলো তখন সে দেখতে পেলো তার স্বামী হাবিবুল কুদ্দুস তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সেদিন সারা রাত এবং পরের দিনও অর্ধদিবস তাদের রাস্তায় কাটাতে হয়েছে। রাস্তায় শুধু আহারাদির সময় তার চোখ খুলে দেয়া হতো। তার সঙ্গে আসা দু’জন পুরো পথে তার সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি, অপ্রয়োজনীয় কথাও বলেনি। বরং তাকে আরো শান্তনা দিয়ে বলেছে, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার হেফাজতের জিম্মা আমাদের।’
হাবিবুল কুদ্দুসকে দেখতে পেয়ে তার দেহে প্রাণ ফিরে এলো। খৃস্টান লোকটিও হাবিবুল কুদ্দুসের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাই নিজের আবেগকে সংযত করে সে কোন মতে বললো, ‘আপনি কেমন আছেন?’
হাবিবুল কুদ্দুস হেসে জোহরার একটি হাত ধরে বললেন, ‘এরা আমার বন্ধু! এখানে তুমি নিজেকে বন্দী মনে করবে না। তুমি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছো। এখন খাওয়া দাওয়া করো। রাতে আরাম করে একটা ঘুম দাও, দেখবে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। কাল সকালে তোমাকে আমি বলবো, কেন তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি।’
‘কোন বিপদ!’ জোহরার শঙ্কিত প্রশ্ন।
‘আরে না। তুমি সব সময় বলতে, তুমি পুরুষের মত খোলা ময়দানে যুদ্ধ করতে চাও। আমার এই বন্ধুরা তোমাকে সে রকম একটা সুবর্ণ সুযোগ দিতে চাচ্ছে। সবই জানতে পারবে। এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।’
মেয়ে দু’টি তাকে পথ দেখিয়ে খাওয়ার রুমে নিয়ে গেল।
জোহরা বধু হলেও এখনও পূর্ণ যুবতী। তার রূপ ও সৌন্দর্য তে রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। একহারা দেহের গড়ন। স্বভাবে বন্য হরিণীর চঞ্চলতা ও ক্ষিপ্রতা সহজেই অন্যের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। সন্ধ্যার একটু আগে হাবিবুল কুদ্দুসের কামড়ায় এলো সেই মেয়েরা, যাদেরকে হাবিবুল কুদ্দুস জলাশয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় গোসল করতে দেখেছিলেন। তারা তাঁর কামরায় এসে নির্বিবাদে জোহরাকে বান্ধবীর মত টেনে বাইরে নিয়ে গেল।
এই বিরান ধ্বংশপ্রাপ্ত মহলটা ছিল দেখতে ভয়ংকর স্থান। কিন্তু মেয়ে দুটো এখানেই থাকতো। তারা যে কেবল কামরা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতো তাই নয়, পুরুষদের মনোরঞ্জনের দিকেও খেয়াল রাখতো তারা।
জোহরা যে কামরায় ছিল সেখানে ধ্বংসাবশেষের কোন চিহ্নই ছিল না। উচ্চবিত্তের বিলাসী সামগ্রী দিয়ে ঘরটা রুচিস্নিগ্ধভাবে এ মেয়েরাই সাজিয়ে দিয়েছিল।
জোহরাকে কামরা থেকে বের করে নেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই সে ওদের সাথে একেবারে মিশে গেল। তাদের মধ্য থেকে এক মেয়ে জোহরাকে বললো, ‘তোমার মত এমন ফুলের কলিকে তোমার মা বাবা কেমন করে এই বুড়ো লোকের হাতে তুলে দিল। তারা কি খুবই নিষ্ঠুর? নাকি তিনি তোমাকে খরিদ করে এনেছেন?’
‘হ্যাঁ,’ জোহরা রাগান্বিত কন্ঠে বললো, ‘তিনি আমাকে খরিদ করেছেন। সেনাপতি মানুষ তো, ক্ষমতা ও সম্পদের অভাব নেই। সেই ক্ষমতাবলে আমাকে তার হেরেমে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমার তো আর সেই শক্তি নেই যে, পালিয়ে যাবো।’
‘যদি কোথাও আশ্রয় পাও তবে পালিয়ে যাবে?’ প্রশ্ন করলো মেয়েটি।
‘যদি সে আশ্রয় বর্তমান জীবনের চেয়ে উন্নত হয় তবে পালাবো না কেন, অবশ্যই পালিয়ে যাবো।’ জোহরা বললো, ‘তিনি আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন? তিনি কি আমাকে এখানে বিক্রি করে দেবেন? তোমরা কারা? তোমরা এখানে কেন? তোমাদেরও কি কেউ এখানে বিক্রি করে দিয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, আমাদেরকেও এখানে বিক্রি করা হয়েছে। তবে তাতে আমরা অখুশি নই। বরং এতে আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেছে। যদি তুমি চাও তোমাকেও আমাদের সাথে নিতে পারি। আমরা এখানে রাজকুমারীর মত আছি। এত সুখে আছি যা জীবনে কোনদিন কল্পনাও করিনি।’
ওরা হাঁটতে হাঁটতে ঝর্ণার কাছে চলে এসেছিল। এক মেয়ে তাকে বললো, ‘আমরা কারা সে পরিচয় তুমি অবশ্যই পাবে। তবে তার আগে দেখতে হবে তুমি আমাদের সাথে থাকার যোগ্য কিনা?’
‘তোমাদের সাথে থাকতে গেলে কি যোগ্যতার দরকার?’
‘তুমি আমাদের সাথে ওই ঝর্ণার পাশে গিয়ে কাপড় চোপর খুলে রেখে এ জলাশয়ে গোসল করতে পারবে?’
‘ওই পশুটার কাছ থেকে যদি আমাকে মুক্ত করতে পারো তবে তোমরা যা বলবে তাই করতে পারবো।’ জোহরা বললো।
এ সময় এক লোক সেখানে হাজির হয়ে জোহরাকে বললো, ‘কামরায় বিকালের নাস্তা দেয়া হয়েছে। সেনাপতি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’
জোহরা চলে গেল স্বামীর কাছে। হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে যে খৃস্টান কথা বলছিল সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। হাটঁতে হাটঁতে সে চলে এলো মেয়েদের কাছে।
মেয়েরা তাকে দেখে খুশীতে হাততালি দিল। উচ্ছল আনন্দে কলকলিয়ে বললো, ‘কেল্লা ফতে সরদার। এ মেয়েটা আমাদের ভালই কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে। সে তার বুড়ো স্বামীকে ভীষণ ঘৃণা করে।
তুমি আদেশ দিলে তাকে আমরা আমাদের মত করে গড়ে তুলতে পারি। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো মেয়েটি অসম্ভব রূপসী। তার মধ্যে চঞ্চলতা ও দুষ্টুমী ভাবও আছে। তাকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তীরের মতই লক্ষ্য ভেদ করতে পারবে সে।’
‘কিন্তু হাবিবুল কুদ্দুস তো বলেছে, এই স্ত্রীর উপর তার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে এবং এ মেয়ে তার যোগাযোগ রক্ষার কাজ ঠিক মতই করতে পারবে।’ খৃস্টানটি বললো, ‘কিন্তু যদি তোমাদের কথা সত্যি হয় এবং এ মেয়ে সত্যি সত্যি তাকে ঘৃণা করে তবে তো তা খুবই ভয়ের কথা। এ মেয়েবত তবে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে এবং আমাদের সবাইকে ধরিয়ে দিতে পারে।’
‘তার ঘৃণার কারণটা তুমি বুঝবে না। এটা তার বয়সের দোষ। একজন যুবতী মেয়ে কখনোই একজন বুড়োকে ভালবাসতে পারে না। সেনাপতির বউ বলে প্রকাশ্যে গর্ব করলেও অন্তরের দহন তাতে চাপা পড়ে না। হাবিবুল কুদ্দুসের চাইতেও সহজে আমরা এই মেয়েকে আমাদের দলে টেনে নিতে পারবো।’
‘এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। খাচায় বন্দী পাখি এক সময় পোষ মানবেই, ও নিয়ে আমি ভাবি না। আমাদের টার্গেট মেয়েটা নয়, হাবিবুল কুদ্দুস। আসল সুখবরটা তাহলে আমার কাছ থেকে শোন।
এ লোক আমাদের জালে পড়ে গেছে। সে আমাকে মিশরী এবং দেশপ্রেমিক মুসলমান বলে বিশ্বাস করেছে। সে আমাদের পরিকল্পনা মত কাজ করতেও রাজী হয়েছে।’
‘আর মেয়েটির ব্যাপারে তোমার কি ফয়সালা?’
‘যদি মেয়েটি হাবিবুল কুদ্দুসকে ধোঁকা দিতে রাজি থাকে তবে তাকে আমি অন্যভাবে কাজে লাগাবো। আগে মেয়েটিকে যাচাই করে দেখি। তুমি রাতে কিছুক্ষনের জন্য তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। তারপর মেয়েটিকে আমার কামরায় রেখে কোন বাহানায় বাইরে চলে যাবে।’
বৈকালিক নাস্তা শেষ হওয়ার পর মেয়েরা গিয়ে পুনরায় তাকে নিয়ে এলো। তারা হাসতে খেলতে ও গল্প গুজব করতে লাগলো জোহরাকে সঙ্গে নিয়ে। জোহরাকে তারা আগের চেয়ে খোলামেলা বেপর্দা করে ফেললো। রাতে খাওয়ার পর আবার তারা গল্পগুজবে মেতে উঠলো। মেয়েরা তাকে নিয়ে এলো নিজেদের কামরায়। এক মেয়ে গিয়ে খৃস্টান লোকটিকে খবর দিল, ‘মেয়েটাকে আমাদের কামরায় নিয়ে এসেছি। আপনি ওখানেই তার সাথে দেখা করুন।’
খৃস্টান লোকটি সেখানে গেল। সে জোহরার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। মেয়েরা এক ফাঁকে তাদের একা রেখে বাইরে চলে গেল।
খৃস্টান লোকটি তার সঙ্গে গল্প করছিল আর তাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল। এক সময় সে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো এবং তার বাহু ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলো।
জোহরা তার বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বললো, ‘আমি এত সাধারণ ও সস্তা মেয়ে নই যে, সামান্য ইশারাতেই আপনার কোলে গিয়ে পড়বো।’
খৃস্টান লোকটি জোহরার এমন স্পষ্ট কথায় বেজার না হয়ে বরং বেশ খুশিই হলো। বুঝলো, মেয়েটির মধ্যে ব্যক্তিত্ব আছে। এমন মেয়েই দরকার যে সহজে কারো হাতের খেলনা হয় না। লোকটি জোহরার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখে চমৎকৃত হলো। গোয়েন্দাগীরিতে এমন মেয়েদেরই প্রয়োজন। সে মেয়েদের সাথে একমত হলো, এমন মেয়েকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিলে সে তীরের মতই নিশানা ভেদ করতে সমর্থ হবে।
লোকটি আলাপ করে বুঝলো, স্বামীর প্রতি এ মেয়ের যথার্থই ঘৃণা আছে। তবে নিরূপায় বলেই সে মুখ ফুটে বা আচরণের মাধ্যমে তার অবজ্ঞার কথা প্রকাশ করে না। আর তাই হাবিবুল কুদ্দুস মনে করেন, এ মেয়ে তার জন্য পাগলপারা।
লোকটি জোহরাকে বললো, ‘তুমি তোমার মনের ভাব এখনি ওর কাছে প্রকাশ করতে যেও না। আমি ওর থেকে তোমাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবো। তোমাকে এমন জীবন দান করবো যাতে তুমি রাজকুমারীর মত জীবন যাপন করতে পারো। তুমি এখানেই বসো, আমি তোমার বান্ধবীদের তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
সে কামরা থেকে বের হয়ে গেল। মেয়েদের কাছে গিয়ে বললো, ‘তোমরা ঠিকই বলেছো। মেয়েটি আসলেই চালাক চতুর ও কাজের মেয়ে। তাকে তোমরা পাশে পাশে রেখে গড়ে তোলার চেষ্টা করো।’
সে আরো বললো, ‘হাবিবুল কুদ্দুস তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। এই মেয়েকে দিয়েই আমি হাবিবুল কুদ্দুসকে বশে রাখবো এবং আমার কাজ আদায় করে নিবো।
মেয়েটিকে তোমরা বুঝাও, সে যেন হাবিবুল কুদ্দুসকে উন্মাদিনীর মত ভালবাসার অভিনয় করে যায়। তাহলে তিনি তাঁর বিশ্বাসী কমান্ডারদের সাথে এই মেয়ের মাধ্যমেই যোগাযোগ করিয়ে দেবেন আমাদের।
তোমাদের কাজ হলো এই মেয়েকে জালে আটকে রাখা। তাকে জীবনের এমন রঙিন স্বপ্ন দেখাবে যাতে সে মনে মনে রাজকুমারী বনে যায়। আর কিভাবে তাকে এ কাজের জন্য প্রস্তুত করতে হবে তা তো তোমাদের ভালো করেই জানা আছে।’
জোহরা অন্তর থেকেই স্বামীকে ভালবাসতো। এখানে এসে তার সে ভালবাসা বহুগুন বেড়ে গেল। খৃস্টান মেয়েরা ভাবলো, জোহরা তাদের নির্দেশে হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে প্রেমের অভিনয় ভালই করছে।
জোহরা সুযোগ পেলেই মেয়েদেরকে বুঝাতে চাইতো, এই বুড়ো স্বামীকে সে কোন কালেই ভালবাসেনি। তাদের অনুরোধে ভালবাসার অভিনয় করলেও এখন সে তার স্বামীকে আগের চাইতেও বেশী ঘৃণা করে।
মেয়েরা তাকে তাদের কাছে রাখে। একান্ত অন্তরঙ্গ বান্ধবীর মতই তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যায়। তাকে নিয়ে ঝর্ণার জলাশয়ে সাতাঁর কাটে মনের আনন্দে।
প্রথম দিকে গোসলের সময় বিবস্ত্র হতে ইতস্তত করতো জোহরা। মেয়েরা তাকে বুঝালো, ‘এতে কোন অপরাধ নেই। জীবনকে উপভোগ করতে শেখো। এমন লাজুক হয়ে থাকলে তুমিতো ভীতুর ডিম হয়ে যাবে। আর যারা ভীতু তারা জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারে না।’
খুব দ্রুত জোহরা সাহসী হয়ে উঠলো। সে ওদের মত বিবস্ত্র হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে শিখলো। ওদের মত স্বল্প বসনে পুরুষদের সাথে মেলামেশা করতে শিখলো। শেষে এ সব বিষয় তার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলো।
রাতটি সে স্বামী হাবিবুল কুদ্দুসের সাথেই কাটায়। কিন্তু দিনের অধিকাংশ সময় তার কাটে মেয়ে দুটির সাথে। মাঝে মাঝে খৃস্টান লোকটির সঙ্গেও বন্ধুর মত গল্প করে।
জোহরা চার পাঁচ দিনের মধ্যেই মেয়ে দুটির মত অসভ্য হয়ে গেল। তার দুষ্টামী ও নির্লজ্জতা দেখে মেয়েরা এবার তার সামনে মেলে ধরতে শুরু করলো তাদের রহস্যময় জীবনের কথা।
ইতিমধ্যে খৃস্টান লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে বসে বিদ্রোহের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেললো। হাবিবুল কুদ্দুসও এ পরিকল্পনা গ্রহণে তাকে অনেক তথ্য দিয়ে সাহায্য করলো। যে সব তথ্য জানা না থাকলে তাদের পরিকল্পনা সফল হতো না বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো খৃস্টান লোকটি।
হাবিবুল কুদ্দুসের প্রতি এখন এ লোকের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে গেল। হাবিবুল কুদ্দুস মিশরের সেনাদলের কয়েকজন বড় বড় সামরিক অফিসারের নাম বললো যারা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সেনাদলে থাকলেও তারা মূলত আইয়ুবী বিরোধী। তারা মনে করতো, আইয়ুবীর মতই একটি বিশাল বাহিনী পরিচালনা করার মত ক্ষমতা ও দক্ষতা তাদের আছে, কিন্তু আইয়ুবীর বর্তমানে তাদের সে দক্ষতা প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই।
খৃস্টান লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসকে সব সময় বলতে লাগলো, ‘একজন দেশপ্রেমিক মিশরীয় মুসলমান বলেই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। আইয়ুবীর মতাদর্শের সাথে আমার কোন সংঘাত নেই। মিশরকে স্বাধীন করতে পারলে আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত হবে ইসলাম। তখন যদি আইয়ুবী চান, আমরা স্বাধীন দেশের সেনা পাঠিয়ে তাকে ফিলিস্তিন উদ্ধারেও সহায়তা করতে পারি।’
সে যে একজন খৃস্টান ষড়যন্ত্রকারী সে কথা সে বেমালুম চেপে গেল। কারন সে ভেবে দেখলো, হাবিবুল কুদ্দুসকে এ পথেই ব্যবহার করা অধিক সহজ।
জোহরা ততদিনে মেয়েদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। বলতে গেলে এখন সে তাদেরই একজন হয়ে উঠেছে। তার কথাবার্তা বা চলন বলন দেখে ওদের থেকে আলাদা করা অসম্ভব। সে যে কোন ভদ্র ঘরের সন্তান এবং একজন সেনাপতির বেগম এ কথা তাকে দেখে বুঝার কোন উপায় নেই। অথচ হাবিবুল কুদ্দুস তাকেই তার সবচেয়ে অনুগত ও বিশ্বস্ত বেগম মনে করতেন।
জোহরা তখনো জানতো না এই বিজন পাহাড় ও ধ্বংসাবশেষটি কোথায় অবস্থিত। একদিন সে কথায় কথায় মেয়েদের জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বিরান ধ্বংসস্তুপ ও পাহাড় ঘেরা ক্ষুদ্র পরিবেশ ছাড়া কি আর কোন দুনিয়া নেই? খোলামেলা প্রান্তর, মরুদ্যান বা কোন শহর?’
মেয়েরা বললো, ‘থাকবে না কেন? দাঁড়াও, কাল তোমাকে এক সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব।’
পরদিন সত্যি সত্যি তারা তাকে ওই এলাকা থেকে দূরে এক জায়গায় নিয়ে গেল। পাহাড়ের সংকীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে এক ঝিলের পাশ দিয়ে যখন তারা আরও সামনে এগিয়ে গেল তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নীলনদের উত্তাল ঢেউ।
নীলনদ থেকে একটি নালা ভেতরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, এতোক্ষন তারা সেই নালার পাশ দিয়েই হেটে এসেছে। নীলনদের পানি সেই নালা দিয়ে পাহাড়ে প্রবেশ করেছে। আবার পাহাড়ী ঝর্ণার পানিও সেই নালা দিয়েই নীলনদে এসে পড়েছে। জোহরা দেখতে পেল নালার মুখে একটি নৌকা বাঁধা। নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে দুটো বৈঠা। নদী ও নালার সঙ্গমস্থলটা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত।
ওরা সেখানে পৌঁছে ঘাসের উপর লুটোপুটি খেল। হাসাহাসি ও খেলাধুলায় মেতে উঠলো।
‘এখানে ফেরাউনের রাজকন্যারা খেলা করতো।’ এক মেয়ে বললো।
‘আর তোমরা দু’জন যেন নব্য ফেরাউনের কন্যা।’ জোহরা হেসে বললো, ‘তাই তো বলি তোমাদেরকে রাজকন্যার মত লাগছে কেন?’
‘তোমার রূপের কাছে আমরা তো নস্যি। অমন ঢলোঢলো অঙ্গ আর যৌবন নিয়ে আমাদের টিটকারী মারছো! আরে, তুমি যদি রাজকন্যা হও তবে বড়জোড় তার প্রেতাত্না হতে পারি।’ চোখ উল্টে বললো অন্য মেয়েটি।
‘শোন জোহরা।’ এক মেয়ে তাকে বললো, ‘নিশ্চয়ই তুমি জেনেছো, তোমার বৃদ্ধ স্বামী এখানে কেন লুকিয়ে আছে এবং তোমাকেই বা কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে?’
‘সে তো তিনি প্রথম দিনেই জানিয়ে দিয়েছেন।’ জোহরা বললো, ‘আমিও তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু তিনি কেন যে কাজে নামছেন না!
যখনি আমি তাকে তাড়া দেই, তিনি বলেন, ‘সবুর করো রাণী, কাজটা জটিল। সাবধানে এগুতে হবে। একবার ফেঁসে গেলে সব ভেস্তে যাবে। তখন তুমিও রাণী হতে পারবে না, আমার মাথায়ও রাজমুকুট জুটবে না। তাই ভালোমতো চিন্তা ভাবনা করে আটঁঘাট বেঁধে নামতে হবে।’
তিনি বলেছেন, পরিকল্পনা হয়ে গেছে। এখন আবার পুরো পরিকল্পনাটা খতিয়ে দেখছি কোথাও কোন ত্রুটি রয়ে গেল কিনা? ভেবো না, শিগগিরই কাজে নেমে পড়বো।’
‘তাহলে তুমি এটাও জানো, আমরা স্বাধীন মিশরের রাজকুমারী হতে যাচ্ছি?’
‘হ্যাঁ। তা তো জানিই।’ জোহরা মুখ ভার করে বললো, ‘তোমাদের কপাল ভালো, তোমরা হবে স্বাধীন মিশরের রাজকুমারী। আর আমাকে আমার বুড়োহাবড়া স্বামীর রংমহল আলো করে বসে থাকতে হবে।’
জোহরা মন খারাপ করে বললো, ‘তোমরা বলছো, তোমাদের কথা মত কাজ করলে আমাকে তার বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? তিনি তো তখন হবেন দেশের সর্বেসর্বা। তার হাত থেকে তোমরা আমাকে কেমন করে রক্ষা করবে?’
‘বোকা মেয়ে! এই নিয়ে ভাবছো তুমি? আরে আমরা যদি শাহজাদী হই তুমি আমাদের সাথে থাকবেনা ভাবলে কি করে? বরং তোমার যা রূপ তাতে তোমাকে শাহজাদী বানিয়ে আমরা হবো রাজকন্যার বান্ধবী, কি বলিস রে সই?’ ওদের সম্পর্ক এখন তুই-তোকারী পর্যায়ে নেমে এসেছে। জোহরা বললো, ‘কিন্তু কেমন করে? দেখ, আমাকে খুশী করার জন্য মিছেমিছি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবি না।’
‘মিথ্যে গল্প বানাতে যাবো কেন? তাহলে শোন আমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু ভাবছি, তোকে এখনি বিষয়টা বলা ঠিক হবে কি না? তুই তো আবার বুড়োর খাস প্রেমিকা, যদি মুখ ফসকে তার সামনে বলে ফেলিস?’
‘যদি বলেই ফেলি তাহলে তোদের তো কোন ক্ষতি দেখি না। তোরা কি মনে করেছিস আমি এতই বোকা যে, আমার ফাঁসির দড়ি আমিই বাঁধবো? ভয় নেই, আমি অত কাঁচা মেয়ে নই। তোরা কি ভেবেছিস আমাকে খুলে বলতে পারিস।’
‘আমরা যা ভেবেছি তা সফল করতে হলে তোকেও কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। প্রয়োজনে কিছুটা নিষ্ঠুরতা দেখাতে হবে। কাউকে হত্যা করতে হলে তখন তো আবার মায়া মমতা এসে তোর হাত খামছে ধরবে না?’
‘সেটা সময় হলে দেখতে পারবি।’ জোহরা বললো, ‘আমি এক সৈনিক পরিবারের কন্যা। আমার বাপ সৈনিক, ভাই সৈনিক। তারা আমাকে শিখিয়েছে, উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য কাউকে খুন করা নিষ্ঠুরতা নয়, বরং ওটা কর্তব্য। আর যে সৈনিক নিজের কর্তব্য ঠিক মতো করে না, সে নিজেই নিজেকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট। আমি এই পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বাচঁতে চাই, তাই নিজেকে খুন করার কোন ইচ্ছা আপাততঃ আমার নেই।’
‘তাহলে সবুর কর। তোর মুক্তির ব্যবস্থা আমরা অবশ্যই করবো।’
পরের দিনও জোহরা মেয়েদের সাথে নদীর পাড়ে চলে গেল। প্রথমদিন মেয়েরা যে রাস্তায় তাকে নদীর তীরে নিয়ে গিয়েছিল, সে রাস্তাটি ছিল প্রাকৃতিক, বহু পুরানো এবং খুবই সংকীর্ণ।
অনেক কাল সে পথে লোক চলাচল করে না বলে রাস্তার চিহ্ন জায়গায় জায়গায় মুছে গিয়েছিল। এমন গোপন পথ সহজে কারো পক্ষে খুঁজে পাওয়া যেমন কষ্টকর তেমনি একবারের যাতায়াতে তা মনে রাখাও সহজসাধ্য ছিল না। পথটি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেছে। ঝোপঁঝাড় ও লতাপাতায় হারিয়ে গেছে পথের নিশানা।
জোহরা সে পথটি মনের আয়নায় গেথে নিতে চাচ্ছিল। তাই সে দ্বিতীয় দিনের মত সে পথে তাদের নিয়ে নদী দেখতে এলো। এসে বুঝলো, একা এলে সে কিছুতেই রাস্তা খুঁজে নদী পর্যন্ত পৌঁছতে পারতো না।
নদী তীরে পৌঁছে জোহরা তাদের বললো, ‘চলো নৌকায় চড়ে নদী ভ্রমণ করি।’
মেয়েরা তাকে বাঁধা দিয়ে বললো, ‘মেয়েদের একা নৌকায় চড়া বারণ আছে। এখানে কোন পুরুষ নেই যে কোন দুর্ঘটনায় পড়লে তারা এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে।’
ফলে জোহরার নৌকায় চড়া হলো না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল, মেয়েরা বললো, ‘চল ফিরে যাই।’
হাবিবুল কুদ্দুসের উপর এখন আর আগের মত নিষেধাজ্ঞা জারী নেই। তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তিনি এখন স্বাধীন মিশরের প্রত্যাশী এবং সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর গদি দখল করতে বদ্ধপরিকর।
খৃস্টান লোকটি বিদ্রোহের সময় নিয়ে কথা বলতে এলে তিনি বললেন, ‘চাঁদের দিকে খেয়াল রেখো। অমাবশ্যার রাতে বিদ্রোহ ঘটবে। এর তিন দিন আগে তুমি জোহরাকে নিয়ে কায়রো যাবে। তবে কায়রো ঢুকবে রাতের বেলা। আর জোহরাকে ছদ্মবেশে সাজিয়ে নেবে।
জোহরাকে বলে দেবো সে কেমন করে আমার লোকদের সাথে দেখা করবে এবং তাদেরকে তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমি কয়েকজন অফিসারের নামে চিঠি দেবো। তুমি সেই চিঠি দেখিয়ে বাকী কাজ তাদের পরামর্শ মত আঞ্জাম দেবে।’
এরপর থেকে সেই লোক আর তার সাথে বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করে না। তবে জোহরার সঙ্গে এ নিয়ে সেনাপতির আলোচনা হয় গভীর রাতে, খুবই গোপনে ও নিচু কন্ঠে, যাতে তাদের এ আলোচনা আর কারো কানে না যায়।
দুদিন পরের কথা। ধ্বংসস্তুপের গোপন মহলে হাবিবুল কুদ্দুসের কক্ষে আরো দু’জন নতুন লোক এলো। তাদের একজন সুদানী ও অপরজন মিশরী। তারা হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে সাক্ষাত করে বললো, ‘বিদ্রোহের ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু আলাপ করতে চাই।’
তিনি লোক দু’জনকে চিনলেন না, তবে অনুমান করলেন তারা সামরিক বিশেষজ্ঞ। তাদের কাছে মিশর, সুদার ও আরবের ম্যাপ ছিল এবং কিছু কাগজপত্রও ছিল। তারা সেই ম্যাপ মেলে ধরে হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিদ্রোহের বিষয়ে শলাপরামর্শ করলো।
হাবিবুল কুদ্দুস এ ব্যাপারে শুধু আগ্রহই প্রকাশ করলেন না, বরং তাদেরকে এমন সব পরামর্শও দিলেন, যা তারা চিন্তাও করেনি।
তারা হাবিবুল কুদ্দুসের আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে সুলতান আইয়ুবীর কয়েকজন সেনাপতি ও কমান্ডারের নাম বললো, যারা মিশরের সেনাবাহিনীতে থাকলেও গোপনে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ছিল। তারা জানালো, ‘এরা আমাদের সাথে আছে। আপনি অভিযানের সময় যে কোন ব্যাপারে এদের ওপর নির্ভর করতে পারবেন।’
হাবিবুল কুদ্দুসের কাছে এ তথ্যটুকুর মূল্য ছিল অনেক। তিনি চিন্তা করে পেলেন না, আলী বিন সুফিয়ানের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এরা কি করে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার সাহস পেলো।
তারা হাবিবুল কুদ্দুস কে আরো জানালো, মিশর সীমান্তে মিশরের যে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আছে সেখানেও আমরা ফাঁক খুজে পেয়েছি। সময় মত ওখানেও আমাদের লোকজন সক্রিয় হয়ে উঠবে। আপনি শুনে খুশি হবেন, সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর একটি ফাঁড়ির সৈন্যদের সেদিন এমন নির্দেশ দেয়া হবে যাতে তারা অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক ফাঁকে সুদানের কিছু সৈন্য ভেতরে প্রবেশ করবে এবং তারা আপনাকে সম্ভাব্য সাহায্য সহযোগিতা করবে।’
‘বিদ্রোহ সফল হওয়ার পর মিশরের শাসক কে হবেন?’ হাবিবুল কুদ্দস জিজ্ঞেস করলেন।
‘এ ব্যাপারে আমরা আলাপ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, যেহেতু প্রধান সেনাপতি আপনি থাকবেন এবং আপনার নেতৃত্বেই এই বিপ্লব সাধিত হবে সে জন্য আমীরও আপনিই হবেন।’ মিশরের লোকটি বললো।
সে আরো বললো, ‘সালাউদ্দিন আইয়ুবী অবশ্যই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। প্রথম ধাক্কায় ক্ষমতা দখল করতে না পারলে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সে জন্য এমন একজনের নামে এই স্বাধীনতার ডাক দিতে হবে যার প্রতি সেনাবাহিনী ও জনগন আস্থাশীল হতে পারে।
আমরা গভীর পর্যালোচনা করে সবাই এ ব্যাপারে একমত হয়েছি, মিশরে এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা সবাই চাই, আমাদের প্রথম আমীর আপনিই থাকবেন।’
‘যুদ্ধকালীন অবস্থায় কোনো বেসামরিক লোককে গদীতে বসানো ঠিক নয়। তাই আপনার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি।’ বন্ধুর কথার সূত্র ধরে বললো সুদানী লোকটি।
এ কথা শুনে হাবিবুল কুদ্দুসের বুক ফুলে উঠলো এবং বলিষ্ঠ প্রত্যয় নিয়ে তিনি ঘাড় সোজা করে বসলেন।
‘আশা করি এ ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি থাকবে না। খৃস্টানরা আইয়ুবীর চির শত্রু। সেই হিসাবে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যারাই দাঁড়ায় তাদেরকে তারা সাহায্য করে কোন শর্ত ছাড়াই। আমরা খৃস্টানদের সাথেও যোগাযোগ করেছি। তারাও আমাদের সাহায্য করবে বলে ওয়াদা করেছে।’ সুদানী বললো।
‘বিনিময়ে ওরা কি মূল্য নেবে?’ হাবিবুল কুদ্দুস প্রশ্ন করলেন।
‘বিনিময়ে ওরা কিছুই চায় না। আমরা সম্মিলিত ভাবে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মিশরের স্বাধীন করলেই ওরা খুশী।’ মিশরের লোকটি বললো, ‘তারা মিশর চায় না, চায় মিশরকে ঘাঁটি বানিয়ে আইয়ুবী যে ফিলিস্তিন দখলের পাঁয়তারা কষছে তার হাত থেকে রক্ষা পেতে। আমরা যে পরিমাণ সাহায্য চাইবো তাই নিয়ে তারা মিশর ছুটে আসতে প্রস্তুত। তবে তাদের সাথে কথা হয়েছে, মিশরের বিদ্রোহ সফল হলে অর্থাৎ মিশর আইয়ুবীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে গেলে তারা ফিরে যাবে।
তাদের বলা হয়েছে, যদি তারা মিশরের উপর সামরিক অভিযান চালানোর চিন্তা মাথায় নিয়ে আসে তবে মিশরের সৈন্যরা তা বরদাশত করবে না। এমনটি করলে মিশরের সৈন্যরা আইয়ুবীর সাথে মিলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।’
সব শুনে হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘প্রস্তুতি মোটামুটি ভালই মনে হচ্ছে। এখন বাকী কাজ সুচারু রূপে সমাধা হলেই হয়।’
হাবিবুল কুদ্দুস তাদের দু’জনকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমার অধীনে যে সাত হাজার সৈন্য আছে তারা আমার ইশারায় যে কোন সময় জীবনবাজি রাখতে প্রস্তুত। সময়মত বিদ্রোহের সূচনা তারাই করবে। আমাদের যারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত তাদের সাথে কিভাবে সমন্বয় করা যায় এখন সেটাই ঠিক করা দরকার।’
‘হ্যাঁ, এটা করতে হলে আগে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার আপনি কোথায় থেকে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন এবং কি পদ্ধতিতে বিদ্রোহ পরিচালনা করবেন?’
‘সবচেয়ে উত্তম হতো যদি আমি সশরীরে ফিরে গিয়ে সরাসরি নেতৃত্ব হাতে নিতে পারতাম।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, আমার সেখানে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ আমাকে পেলেই প্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো, এতদিন আমি কোথায় ছিলাম?
স্ত্রীর মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি, আমি যে স্বেচ্ছায় শত্রুদের দলে চলে গেছি এ কথা আলী বিন সুফিয়ান গিয়াস বিলবিসকে রিপোর্ট করেছেন। ফলে কায়রো গেলে তারা আমাকে বন্দী করে ফেলবে। তাতে আমাদের খেলা শুরু হওয়ার আগেই সব পন্ড হয়ে যাবে।
আমি আসলে একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছি। আমার স্ত্রীকে এখানে ডেকে আনা ঠিক হয়নি। যদি সবার এরকম সহযোগিতা পাবো জানতাম তবে তাকে ডেকে আনতাম না। এখন তাকে ফেরত পাঠালে তার সঙ্গেও ভাল ব্যবহার করা হবে না। সে জন্য আমাকে এখানেই থাকতে হবে।
তোমরা যে তথ্য দিলে তাতে আমাকে নতুন করে একটু চিন্তা করতে দাও। তোমাদের সাথে কোন কোন কমান্ডারকে ভিড়িয়ে দিলে ভালো হবে ভেবে দেখি।’
হাবিবুল কুদ্দুসের এ আলোচনা শোনার পর তার ব্যাপারে আর কারো কোন সন্দেহ রইল না যে তিনি অচিরেই বিদ্রোহ করবেন।
‘হলবের অবরোধ কোন খেল তামাশার ব্যাপার নয়।’ সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী ফোরাত কূলে বসে তার সেনাপতিদের বললেন, ‘তোমাদের সকলেরই মনে থাকার কথা, আমরা আগেও একবার এ শহর অবরোধ করতে গিয়ে হলবের বাসিন্দাদের দিয়ে প্রচন্ড বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছিলাম। শেষে বাধ্য হয়ে আমাদের অবরোধ উঠাতে হয়েছিল। সেটা হলবের বাসিন্দাদের বীরত্ব। তারা আমাদের ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল।
এখন আর সে অবস্থা নেই, তবুও আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এখান থেকে যাদের সৈন্য দলে ভর্তি করা হয়েছে তাদের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না। মিশর থেকে সামরিক রসদ ও সাহায্য চাইতে হবে। ভাবছিলাম হাবিবুল কুদ্দুসের বাহিনীই নিয়ে আসবো।’
এই কথা বলে সুলতান আইয়ুবী নিরব হয়ে গেলেন। তার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। তিনি ধীরস্থির কন্ঠে বললেন, ‘আমি মেনে নিতে পারছি না, হাবিবুল কুদ্দুসের মত বিশ্বস্ত সেনাপতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তবে সে গেল কোথায়?
আমি যখন মিশর থেকে যাত্রা করলাম তখন সে আমাকে বলেছিল, ‘আপনি মিশরের চিন্তা মন থেকে দূর করুন। খৃস্টান ও সুদানীরা যদি আপনার অনুপস্থিতিতে মিশরে আক্রমণ চালায় তবে আমার তিন হাজার পদাতিক ও দুই হাজার অশ্বারোহী বাহিনীই তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে।’
সে আরো বলেছিল, ‘আর যদি কেউ মিশরে বিদ্রোহ করে তবে তার মাথা আর দেহের সাথে থাকবে না। আমরা আল্লাহর সৈনিক, কিন্তু সে আল্লাহর দুশমন।’
‘মনে হয় তার এ সব গুণ লক্ষ্য করে শত্রুরা তাকে অপহরণ করেছে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘কারন তার সৈন্যদের উপর তার গভীর প্রভাব রয়েছে। এই কারণে তিনি নিজেকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করেন। শত্রুরা আমাদেরকে সেই শক্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে।’
‘যদি তাকে পাওয়া না যায় তবে তার বাহিনীকেই আমি এখানে নিয়ে আসবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাদের নিয়ে আসা সম্ভব না। কারণ মিশরের প্রতিরক্ষা তাতে দূর্বল হয়ে পড়বে। সেখানে নতুন ফৌজ পাঠাতে হবে।
কিন্তু ভয় ও আশংকার কারণ হচ্ছে এটাই যে, বাইরের আক্রমণের চেয়ে ভেতরে কেউ বিদ্রোহ করে বসে কিনা। কারণ অচেনা বেঈমান গাদ্দারের দল ভেতরে বসে আছে। তারাই তো ফিলিস্তিনকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।’
সুলতান যখন ফোরাতের কূলে বসে এই আলাপ করছিলেন, সুলতানের বিশ্বস্ত সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস তখন কায়রো থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা এক ভয়ংকর স্থানে পুরাতন মহলের ধ্বংসস্তুপের এক কামরায় বসে মিশরে বিদ্রোহ ঘটানোর পরিকল্পনা করছিলেন।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে সেই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে সে রাতে তারা আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠছিল। যদি বাইরের কেউ সে সময় সেখানে আসতো তবে তারা ভয়ে পালিয়ে যেতো। তারা ভাবতো, জ্বীন পরীরা সেখানে আনন্দ নৃত্য করছে। যে সুন্দরী মেয়েরা নাচছিল তাদের কেউ মানুষ না ভেবে ভাবতো পরী।
ওখানে মানুষ ছিল মাত্র আটজন। হাবিবল কুদ্দুস ও এক খৃস্টান তো প্রথম দিন থেকেই ছিল। আর ছিল দুই রূপসী ও এক পাহারাদার। মিশরী ও সুদানী দু’জন যোগ দিলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় সাত-এ। আর আছে হাবিবুল কুদ্দুসের স্ত্রী জোহরা।
বিদ্রোহের নীল নকশা ও পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। হবিবুল কুদ্দুস ও জোহরা সবার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেখানে কেউ শত্রু নেই। ফলে সেখানে পাহারায় সতর্কতারও কোন প্রয়োজন বোধ করলো না কেউ।
তাদের একজনকে হাবিবুল কুদ্দুস শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এটা তখনকার ঘটনা যখন হাবিবুল কুদ্দুস তাদের পরিকল্পনা জানতেন না। এখন আর সেখানে পাহারার প্রয়োজন ছিল না, কারণ এই সেনাপতি এখন তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু। তাঁকে তারা গোপনে পরীক্ষা করে দেখেছে, বিদ্রোহের ব্যাপারে তিনি সত্যি দৃঢ়সংকল্প।
রাতে পুরো দলটিই আনন্দে মেতে উঠলো। একেবারে উৎসবের আমেজ। রাজকীয় খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে সবার জন্য। মদের পাত্রগুলো হাতে হাতে ফিরছে। দুই মেয়ে প্রাণ খুলে নাচছে, গাইছে।
হাবিবুল কুদ্দুসও উৎসবে শরীক হয়েছেন। তার সামনে তুলে ধরা হলো সুরার পাত্র। তিনি অবজ্ঞা ভরে ফিরিয়ে দিলেন সে পাত্র। এ নিয়ে আর জোরাজুরি করলো না কেউ।
উৎসবে হাজির জোহরাও। মেয়েরা হাতে তুলে নিল সুরাপাত্র। পাত্র তুলে দেয়া হলো জোহরার হাতেও। সে হাত পেতে তা গ্রহণ করলো কিন্তু পান না করে কৌশলে তা ফেলে দিল সবার অলক্ষে।
খৃস্টান লোকটি মিশর ও সুদান থেকে আগত লোক দু’জনের সাথে কথা বলছিল। সুদানী বললো, ‘জোহরা মেয়েটাকে বলে দাও, ও যেন খুব সতর্কতার সাথে হাবিবুল কুদ্দুসের দিকে নজর রাখে। নইলে যে কোন সময় মত বদলে ফেলতে পারে সেনাপতি।’
জোহরা অন্য মেয়েদের মতো নির্লজ্জ আচরণ না করলেও আনন্দ উৎসবে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছে যাতে তার ব্যাপারে কারো মনে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।
মধ্যরাত পর্যন্ত সবাই এ আনন্দ মাহফিলে কাটিয়ে দিল। মদের নেশায় যখন চোখগুলো ঢুলুঢুলু তখন একে একে উঠতে শুরু করলো জলসা থেকে।
মিশরী ও সুদানী দু’জন চলে গেল তাদের কামরায়। মেয়েরাও নিজেদের কামরার দিকে পা বাড়াল। কেউ কেউ নেশায় বেহুশ হয়ে ওখানেই পড়ে রইলো। জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।
তিনিও সেখান থেকে উঠে গেলেন। জোহরা সেখান থেকে বেরিয়ে মেয়েদের কামরার দিকে গেল। কামরা খালি, দু্’জনের কেউ কামরায় নেই।
জোহরা মিশরী ও সুদানী লোক দু’জন যেখানে থাকে সেখানে গেল। কামরা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে নারী ও পুরুষের জড়িত কন্ঠ। সমস্ত পরিবেশটাই বেহুশ মাতালদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।
জোহরা জানতো এই দুস্কৃতকারীদের অস্ত্রসস্ত্র কোথায় থাকে। সে একটি বর্শা, একটি তলোয়ার, দু’টি ধনুক ও ব্যাগ ভর্তি তীর উঠিয়ে নিল।
হাবিবুল কুদ্দুস তার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়। জোহরা সেখানে পৌঁছলে তিনি জোহরার হাত থেকে তলোয়ারটি নিয়ে নিলেন। একটি ধনুক ও তীর কোষ নিজে কাধেঁ নিয়ে অপর ধনুক ও তীর কোষ জোহরার কাঁধে লটকে দিলেন। বর্শাটা জোহরার হাতেই রইলো।
‘চলো এদেরকে হত্যা করে ফেলি।’ জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসকে বললো।
‘না, এখন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেড়িয়ে যাওয়া উচিত।’ তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে নদী পর্যন্ত নিয়ে যাও।’
জোহরা নদী পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা ভাল করে দেখে রেখেছিল। যদি এ রাস্তা তার দেখা না থাকতো তবে তাদের পক্ষে সেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হতো বলে মনে হয় না।
জোহরা আগে, হাবিবুল কুদ্দুস তার গা ঘেঁষে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছিল নদীর দিকে। তাদের কান দুটো বনের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছিল। হাবিবুল কুদ্দুস তার তলোয়ার খাপে না ভরে হাতে নিয়ে এগুচ্ছিল। জোহরা এগুচ্ছিল তার হাতের বর্শা বাগিয়ে।
জোহরা তার স্বামীকে নৌকা পর্যন্ত নিয়ে গেলো। নৌকাটি পাহাড়ের আড়ালে নালার খানিকটা ভেতরে যেখানে পানি জলাশয়ের রূপ নিয়েছিল সেখানে বাঁধা ছিল।
দু’জনেই নৌকা খুলে শান্তভাবে তাতে চড়ে বসলো। তারা অতি ধীরে ধীরে বৈঠা মারতে লাগলো যেন শব্দ না হয়। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাটছিল ভয় ও আতঙ্ক এর মধ্যে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি টের পেয়ে গেল ষড়যন্ত্রকারীরা। এই বুঝি অদৃশ্য থেকে ছুটে এলো কোন তীর।
কিন্তু না, সব আশঙ্কাকে ভিওিহীন ও অমূলক প্রমাণ করে নৌকা পাহাড়ের সংকীর্ণ নালা বেয়ে নদীর দিকে এগিয়ে চললো।
সংকীর্ণ নালা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সামনেই নদী। নদীর কলতানের শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা। হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘আল্লাহকে স্মরণ করো। মনে হচ্ছে ওদের ফাঁকি দেয়া সম্ভব হবে। এখন আর বৈঠার শব্দ শুনতে পাবে না ওরা। তুমিও একটা বৈঠা হাতে নাও।’
হাবিবুল কুদ্দুস জোহরাকে বললেন, ‘তুমি জিহাদে অংশ নেয়ার ইচ্ছা করেছিলে। আল্লাহ তোমাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে।’
‘আপনার কি মনে হয় আমরা এখন বিপদ মুক্ত?’
‘না, আমরা এখনও বিপদ মুক্ত হইনি। নৌকা ফোরাতের স্রোতে পড়লে বিপদ আরো বাড়বে। এত ছোট নৌকা সেই প্রবল তরঙ্গের ঝাপটা কেমন করে সইবে তাই ভাবছি।’
জোহরা একটা বৈঠা নিয়ে পানিতে ফেললো। হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে সমান তালে সে বৈঠা চালাতে লাগলো। দু’জনে বৈঠার ঘায়ে নৌকা এগিয়ে চললো তরতর করে। অল্পক্ষণ পরেই নৌকা নালা থেকে বেরিয়ে স্রোতস্বিনী ফোরাতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
হাবিবুল কুদ্দুস শক্ত হাতে হাল ধরে নৌকার গতি থামাতে চেষ্টা করলো। চিৎকার করে বললো, ‘বৈঠা রেখে পাটাতন আঁকড়ে ধরো জোহরা।’
জোহরা ভয় পেয়ে বৈঠা রেখে পাটাতন আকঁড়ে ধরলো। তাকিয়ে দেখলো, নৌকা তীরের মত মাঝ নদীর দিকে ছুটে চলেছে। হাবিবুল কুদ্দুস সর্ব শাক্তি দিয়ে নৌকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করলো। সে নৌকার মুখ ভাটির দিকে ঘুরিয়ে ধরলো। শেষ পর্যন্ত নৌকা মাঝ নদীতে না গিয়ে তীর ধরে ছুটে চললো ভাটির দিকে।
ওদের দৃষ্টি থেকে পাহাড়ের কালো ছায়ারা ভূতের ধীরে ধীরে পিছনে সরে যেতে লাগলো। দেখতে দেখতে সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণী ছোট হয়ে এলো।
নদীতে তখন ভরা জোয়ার। উত্তাল ঢেউয়ের মাতামাতিকে অগ্রাহ্য করে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে নৌকা। প্রচন্ড ঢেউ এসে গ্রাস করে ফেলতে চাচ্ছে ক্ষুদে নৌকাটি। যখন নৌকা ঢেউ এর ভেতর ঢুকে যায় তখন চারদিকে পানি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। নিচে পানি, মাথার ওপর পানি, মনেহয় পানিময় দুনিয়া।
ভয় ও আতঙ্কে জোহরা চিৎকার দিতেও ভুলে গেল। ভাবলো, পানি নয়, এ তো মৃত্যুদুত আজরাইল।
পরক্ষনে ঢেউয়ের চূড়ায় চড়ে বসে নৌকা। ঢেউয়ের ঝাপটায় ছিটকে আসা পানিতে ভেসে যায় পাটাতন। হাবিবুল কুদ্দুস নৌকাটি তীরের দিকে নেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন।
নদীর মাঝখানে প্রবল স্রোতের বেগ ও ঢেউ। এ ছোট্ট নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে যাওয়ার কথা পাগলেও ভাববে না। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে বাচঁতে হলে তাদের নদীর ওপারে চলে যাওয়া উচিত। মাঝ নদীর সেই স্রোত ও ঢেউয়ের মোকাবেলা না করে ওপারে যাওয়ার কোন উপায় নেই।
হাবিবুল কুদ্দুস জানতেন এ ঢেউয়ের কথা। কিন্তু তা এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে ভাবেন নি তিনি। নদীর তীর ধরে এগুনোর মাঝেও বিপদের আশংকা আছে। কোন পাথরে আঘাত লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে নৌকা। ওরা যে পালিয়েছে দুশমন যদি তা কোন মতে টের পায় তবে ঘোড়া নিয়ে ওরা ছুটে আসতে পারে তীর ধরে। মোট কথা, বিপদ সর্বত্র গুখরো সাপের মতোই ফনা তুলে আছে।
প্রবল স্রোতের টানে ভাটির দিকে তীব্র বেগে ছুটছিল নৌকা। উত্তাল তরঙ্গ দোলায় উপর নিচে উঠানামা করছিল। একবার হারিয়ে যাচ্ছিল ঢেউয়ের ভেতর আবার ভেসে উঠছিল দুই বিস্মিত নর-নারীর চোখের সামনে।
হাবিবুল কুদ্দুস জোহরাকে বললেন, ‘ভয় পেও না। আমরা ডুববো না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ যখন খৃস্টান দুর্বৃওদের কবল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিয়েছেন, এই উত্তাল তরঙ্গেও তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।’
‘আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।’ জোহরা বললো, ‘ডুবে গেলেই বা কি? কাফেরদের জাহান্নাম থেকে তো উদ্ধার পেয়েছি।’
হাবিবুল কুদ্দুস শক্ত হাতে হাল ধরে পিছন ফিরে তাকালেন পাহাড়ের দিকে। এখন পাহাড়টিকে মাটির উপরে ছোট্ট এক ঢিবির মতো দেখাচ্ছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর আবেগের সাথে বললেন, ‘আমি এই স্থানটি চিনি। এই পাহাড়ী অঞ্চল ও বিজন মরু প্রান্তরে আমি আমার বাহিনীকে যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন নদীর দিকে আসিনি।
জোহরা, আমরা এখন সোজা কায়রোর দিকে যাচ্ছি। নীল নদের স্রোত আমাদের দ্রুত কায়রোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাও জোহরা। এটা আল্লাহর অপরিসীম দয়া ও মদদ।’
‘আল্লাহ আমাদের নিয়ত ভাল করেই জানেন। আমরা তার দ্বীনের জন্য বাচঁতে চাই, মরলেও দ্বীনের জন্যই মরতে চাই। ফলে আমাদের বাচা বা মরায় কোন পার্থক্য নেই। শুধু দোয়া করুন, তিনি যেন আমাদের কবুল করেন। এখান থেকে কায়রো কতদূর?’
‘কায়রো এখনো অনেক দূর।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘কিন্তু কায়রো পৌঁছার আগেই আমাদের এক জায়গায় থামতে হবে। পথে কায়রোর আগেই নদীতে একটা বাঁক পড়বে।
সেখানে আমাদের একটি সেনা ছাউনি আছে। নদীতে পাহাড়া দেয়ার জন্য তাদের কাছে শক্ত এবং বড় নৌকাও আছে। আমি তোমাকে সেই শিবিরে রেখে সেখানকার সৈন্য নিয়ে ওই পাহাড়ে অভিযান চালাবো। আমি এই দুর্বৃও কাফেরদের গ্রেফতার করবো।’
‘আপনি অভিযানে যাবেন আর আমি বসে থাকবো শিবিরে? না, তা হবে না। আল্লাহ যখন সুযোগ দিয়েছেন তখন আমিও আপনার সাথে জেহাদের ময়দানেই ছুটে বেড়াবো। দয়া করে আমাকে একাকী রেখে আপনি কোথাও যাবেন না।’
কিন্তু তারা তো ততোক্ষণে জেনে যাবে আমাদের পালিয়ে আসার কথা। তারা নিশ্চয়ই সচেতন হয়ে উঠবে এবং আমার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করবে। ওখানে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি আমার মত এক মুজাহিদকে দুশমনের কবল থেকে উদ্ধার করে এনেছো, এ কি কম বড় কৃতিত্বের কথা? আল্লাহ তোমাকে এর জাযা দান করুন।’
‘আমি আশা করি কাল দুপুর পর্যন্ত তাদের কেউ জেগে উঠবে না।’ জোহরা বললো, ‘আমি নিজ হাতে তাদেরকে প্রচুর মদ পান করিয়েছি। সেই মদের মধ্যে মেশানো ছিল এক প্রকার গুড়ো পাউডার।’
‘গুড়ো পাউডারটা আবার কি জিনিস?’
‘হাশিশ। যেই মেয়েরা আমাকে তাদের দলের একজন বানাতে চেয়েছিল গতকাল তারা আমাকে হাশিশ দেখিয়েছিল এবং তার ব্যবহার শিখিয়েছিল।
তারা একটা কৌটা খুলে হাশিশের পাউডার দেখিয়ে বললো, ‘কোন লোককে অজ্ঞান করার প্রয়োজন হলে এর সামান্য অংশ সরবত বা পানির সাথে মিশিয়ে অথবা খাবারের সঙ্গে খাইয়ে দিলে তাতেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখন তাকে যেখানে খুশি নিয়ে যাও, সে কিছুই টের পাবে না।
রাতে যখন আনন্দ উৎসব চলছিল তখন হাশিশের কৌটা থেকে কিছু পাউডার আমি মদের সুরাহীর মধ্যে ঢেলে দিলাম। মেয়েদের কথা যদি সত্যি হয়, তবে যে পরিমাণ হাশিশ মিশিয়েছি তাতে আগামী কাল সন্ধ্যার মধ্যে তাদের চেতনা ফিরে আসবে না।’
হাবিবুল কুদ্দুস আবার পিছন ফিরে তাকালেন পাহাড়ের দিকে। অন্ধকারের জন্য এখন আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। নৌকা অনেক কিনারে চলে এসেছে। এখানে ঢেউয়ের প্রচন্ডতা কম। হাবিবুল কুদ্দুস আবেগ ভরা কন্ঠে বললো, ‘আমি তোমাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলাম জোহরা। আমি তোমাকে যে দুনিয়ার সন্ধান নিতে বলেছিলাম, সে দুনিয়া রহস্যময়। সে দুনিয়া বড় বিচিত্র বর্ণিল কিন্তু পাপের কালিমায় ভরা। তুমি আমার জন্য বিরাট কোরবানী দিয়েছো জোহরা।’
‘আমি আপনার জন্য নয়, ইসলামের গৌরবের জন্য এ কোরবানী দিয়েছি।’ জোহরা বললো, ‘আমি আপনার কাছে এ জন্য কৃতজ্ঞ যে, আপনি আমাকে পবিত্র দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দিয়েছেন। পাপের আকর্ষণীয় জগতে পা রেখেও আমি যে আমার পবিত্রতা রক্ষা করতে পেরেছি, মনে হয় আপনি তা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
সত্যি এ এক অভিনব বিচিত্র জগত। মনে হয়, এতসব ঘটনা বাস্তবে ঘটেনি, সবই আমার স্বপ্ন বা অলীক কল্পনা। আপনি বুদ্ধি করে আমাকে এখানে না আনলে আমি এই জগতের কিছুই জানতে পারতাম না।’
‘আর ওরা যদি তোমাকে বিশ্বাস করে আমার সঙ্গে একাকী রাতে থাকার সুযোগ না দিত তবে আমিও তোমাকে বলতে পারতাম না, আমি কেন তোমাকে ডেকেছি।’
‘আমিও জানতে পারতাম না, এরা আপনাকে দিয়ে বিদ্রোহ করানোর জন্য ছিনতাই করে এখানে নিয়ে এসেছে। তবে আমাকে এই মেয়েরা নির্লজ্জ হতে বাধ্য করেছে।’
‘কিন্তু তুমি তো এইসব ট্রেনিং পাওয়া মেয়েদেরও টেক্কা মেরেছো। ওদের মনে কোন রকম সন্দেহ না জাগিয়েই ওদেরকে বুঝাতে পেরেছো, তুমি আমাকে ঘৃণা কর এবং সুযোগ পেলেই তুমি ওদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত।’ হাসি মাখা কন্ঠে বললেন হাবিবুল কুদ্দুস।
হাসি দেখা দিল জোহরার ঠোঁটেও। বললো, ‘আপনি যখন বললেন, ওই মেয়েদের চরিত্র খারাপ এবং আরো বললেন, তাদের সাথে মিশে যেতে, আমি প্রথমে একটু ভয়ই পেয়ে ছিলাম। কারণ আমি কল্পনাও করতে পারিনি, আমি তাদের ধোঁকা দিতে পারবো। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম সব বিনা চেষ্টাতেই হয়ে গেল।’
এটাই আল্লাহর কুদরত। তিনিই তোমাকে সাহায্য করেছেন। শত চেষ্টা করেও যা তুমি করতে পারতে না, আল্লাহ তোমাকে দিয়ে তাই করিয়ে নিয়েছেন। তোমাকে সফলতাও দান করেছেন।’
‘যদি ওই মেয়েরা আমাকে নদী পর্যন্ত রাস্তা না দেখাতো তবে আমরা সেখান থেকে বেরই হতে পারতাম না। আপনি কি আমাকে এই কারনেই এখানে ডেকে এনেছিলেন?’
‘না!’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘এ পথ তোমার আসার পরে এমনিতেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমি অন্য রকম চিন্তা করেছিলাম। আমার মুক্তির জন্যই তোমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। অর্থাৎ তোমাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা দেখে আমার মনে নতুন চিন্তা এলো। তাই তোমাকে খুলে বললাম নতুন পরিকল্পনা। আর তুমিও চমৎকার কাজ করে দেখালে।
তুমি এত সুচারুরূপে কাজ সমাধা করতে পারবে, ধারনা করিনি আমি। তুমি আমার আশার চাইতেও বেশী করেছো। তোমার সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় আমি অভিভূত।’
‘আমার ধারণা ছিল, ওরা খুব চালাক ও সাবধান। তাই আমিও সতর্ক ছিলাম। তবে আমার সফলতার কারণ আমি মনে করি আমাদের মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আমাদের ঈমান ছিল অটুট। নিজের জ্ঞান বুদ্ধিকে আমরা কাজে লাগিয়েছিলাম নিবিড় করে। তাই আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন। আল্লাহর সাহায্য ছিল বলেই আমরা ওদেরকে বোকা বানাতে পেরেছি। মিশরী লোকটি নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করলেও আমি প্রথম দিনই জানতে পেরেছিলাম, লোকটা খৃস্টান। আমরা যে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্রের জালে ফেঁসে আছি এ কথা আমার সব সময়ই মনে ছিল।’
সেই পাহাড়ী অঞ্চল অনেক পিছনে ফেলে এসেছিল ওরা। নীলনদের গতি তখনো তীব্র। নৌকা প্রকৃতির দয়ার উপর উঠানামা করছিল। হাবিবুল কুদ্দুস চেষ্টা করছিলেন তীরের কাছাকাছি থাকতে কিন্তু বড় বড় ঢেউ বারা বার ঠেলে নৌকা মাঝনদীতে নিয়ে যাচ্ছিল।
স্রোতের টানে নৌকা এগুচ্ছিল দ্রুত গতিতে। হাল ধরে বসে থাকা ছাড়া হাবিবুল কুদ্দুসের করার কিছুই ছিল না। জোহরার কাজ ছিল পাটাতন আকড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করা। দাঁড় টানা বা বৈঠা চালানোর কোন অবস্থা ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না।
সামনে নদী কিছুটা চাপা। দুই দিকের পাহাড় এগিয়ে আসার ফলে সংকীর্ণ হয়ে গেছে নদী। ফলে নদীর বেগ ও স্রোত সেখানে তীব্র আকার ধারণ করেছে।
হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘জোহরা সাবধান হও। সামনে বাঁক আছে। এই বাঁকের পরেই আমাদের সেনা ক্যাম্প। কিন্তু বাঁকে স্রোত খুব প্রচন্ড। নৌকার তাল সামলানো কঠিন। আর যদি নৌকা ঘুর্ণিপাকে পড়ে যায় তাহলে মুহুর্তে তলিয়ে যেতে পারে।’
ওরা বাঁকের কাছাকাছি চলে এলো। হাবিবুল কুদ্দুস নিজের সমস্ত মনোযোগ একত্র করে শক্ত হাতে বৈঠা ধরলেন। প্রচন্ড আক্রোশে ফুঁসছে নদী। ঢেউ ভাঙার অবিরাম শব্দ বিকট আওয়াজ তুলছে।
ভুস করে নৌকা ঢুকে গেল স্রোতের চক্রে। হাবিবুল কুদ্দুস স্রোতের সাথে দিক বদল করলো নৌকার। নৌকা বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে গিয়ে এক ঘূর্ণিচক্রে পড়ে ঘুরতে লাগল চড়কির মত। মুহূর্তে করণীয় ঠিক করে ফেললো হাবিবুল কুদ্দুস। নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে জোহরাকে নিয়ে লাফ দিল। পলকে দেখতে পেলো ঘূর্ণিপাকের কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে নৌকা। সঙ্গে সঙ্গে সেই পাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল তাদের দুঃসময়ের একমাত্র বাহন নৌকাটি।
ওদের ভাগ্য ভালো, সময় মত লাফিয়ে পড়ে হাবিবুল কুদ্দুস সর্বশক্তি নিয়োগ করে চক্রের বাইরে চলে যেতে পেরেছিলেন।
‘জোহরা!’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘তুমি শক্ত করে আমার গলা জড়িয়ে ধরে পিঠের উপর শুয়ে পড়ো।’
জোহরা তাঁর দুই কাঁধ দু্’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে পিঠের উপর চড়লো। হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘খুব শক্ত করে ধরে থাকবে, যেন সামান্যও শিথিল না হয়। নইলে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্রোতের টানে হারিয়ে যাবে।’
নৌকা ঘুর্ণিপাকে পড়ায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জোহরাকে নিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে দেহের সর্বশক্তি নিয়োগ করে পাঁকের বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রচন্ড ঢেউ আর স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখনো। এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন জোহরাকে, অন্য হাতে চেষ্টা করছিলেন ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে। জোহরা তার কাঁধ আকড়ে ধরলে একটু দম নেয়ার সুযোগ পেলেন হাবিবুল কুদ্দুস।
এখানে নদীর দুই পাড়েই পাহাড়। জোহরা সাঁতার জানতো না, সে শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগলো।
হাবিবুল কুদ্দুস তার ভার পিঠে নিয়ে সেই উত্তাল ঢেউ ও স্রোতের মধ্য দিয়ে সাঁতরে চললেন তীরের দিকে। তার সবচেয়ে বড় ভয়, স্রোত টেনে নিয়ে যে কোন সময় শক্ত পাথরের উপর আছরে ফেলতে পারে। সে জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন নিজের ও জোহরার মুখটা পানির উপর রাখতে। কিন্তু প্রবল ঢেউ বার বার তাদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। তখন আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না তারা।
শিঘ্রই তারা বাঁক পেরিয়ে নদীর সংকীর্ণ মুখ থেকে প্রশস্ত এলাকায় গিয়ে ঢুকলো। হাবিবুল কুদ্দুসের বাহু ও পা ততোক্ষনে শিথিল ও নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। তিনি তার শেষ শক্তি প্রয়োগ করে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন।
তিনি অনুভব করলেন, জোহরার বাহু বন্ধন শিথিল হয়ে আসছে। তিনি জোহরাকে ডাকলেন, কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। তার বাহু সম্পূর্ণ ঢিলা হয়ে গেলো।
তিনি বুঝতে পারলেন, জোহরার নাক মুখ দিয়ে সমানে পানি ঢুকছে। অজ্ঞান জোহরাকে বাঁচানো ও তাকে নিয়ে সাঁতার দেয়া কঠিন হয়ে গেল হাবিবুল কুদ্দুসের জন্য। তারপরও তিনি এক হাত দিয়ে জোহরাকে ধরে রাখলেন এবং অন্য হাত দিয়ে প্লাবনের গতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালালেন।
স্রোতের বেগ আগের চাইতে এখানে কম ছিল। কিনারা তখনো দূরে। ঢেউয়ের চাপ কম থাকায় সাঁতার দেয়া সহজ হয়ে উঠলেও এতটা পথ জোহরাকে নিয়ে সাঁতরে পার হওয়া তার কাছে অসম্ভব বলেই মনে হলো। তিনি সাহায্যের আশায় চিৎকার দিতে শুরু করলেন।
তিনি তীরের দিকে আরো কিছু দূর এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তার আড়ষ্ট হাত থেকে ফসকে গেল জোহরা। তিনি ডুব দিয়ে আবার তাকে ধরে ফেললেন। এ সময় একটি নৌকা তাদের কাছে এসে গেলো। তিনি জোহরাকে ধরে সাঁতার বাদ দিয়ে কেবল ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন। এ সময় তিনি একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন, ‘আপনি কে?’
নৌকাটিকে দেখতে পেলেন তিনি। একদম কাছে এসে গেছে। তিনি উওর না দিয়ে থাবা দিয়ে ধরে ফেললেন নৌকার কাঠ। আস্তে করে বললেন, ‘আগে একে আমার পিঠের উপর থেকে উঠিয়ে নাও।’
নৌকার সিপাইরা তার পিঠ থেকে জোহরাকে টেনে নৌকায় তুলে ফেললো। জোহরা তখনও অজ্ঞান। নৌকাটি তাদেরই ছিল, কারণ সুলতান আইয়ুবী এখানে একটি সেনা ক্যাম্প করেছিলেন নদীতে পাহারা দেয়ার জন্য।
তারা হাবিবুল কুদ্দুসের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিল কোন বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করতে। কিন্তু তারা জানতো না তাদেরই এক সেনাপতি সাহায্যের জন্য ডাকছে।
জোহরাকে তোলার পর তারা তাকেও টেনে নৌকায় তুলে নিল। তারপর তাদের নিয়ে গেল সেনা ফাঁড়িতে।
ক্যাম্পে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস। আগে মেয়েটির জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করো। কিভাবে কি ঘটেছে আমি সব বলছি।’
ফাড়ির কমান্ডার তাঁকে চিনতে পারলেন এবং তাকে এভাবে দেখতে পেয়ে খুবই বিস্মিত হলেন। জোহরা তখনো বেহুশ হয়ে পড়েছিল। হাবিবুল কুদ্দুসের নির্দেশ পেয়ে কমান্ডার জোহরাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন এবং তার পেটে ও পাশে প্রবল চাপ দিলেন। চাপ খেয়ে জোহরার মুখ ও নাক দিয়ে হরহর করে বেরিয়ে এলো পানি।
হাবিবুল কুদ্দুস উঠে বসলেন। জোহরার জ্ঞান তখনও ফেরেনি। তিনি কমান্ডারকে বললেন, ‘দুটি বড় নৌকায় দশ জন করে বিশ জন সৈন্য দাও।’
তিনি কমান্ডারকে জানালেন সেই দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চল ও ধ্বংসপ্রাপ্ত মহলের কথা। বললেন, ‘ওখানে এখনি অভিযান চালাতে হবে। সেই পাহাড়ী অঞ্চলের দুর্ভেদ্য ভগ্নাবশেষের মধ্যে কয়েকজন খৃস্টান দুর্বৃও বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। তাদের পাকড়াও করতে হবে। এমনও হতে পারে, সেখানে তাদের আরও কিছু লোক আছে, যাদের আমরা দেখিনি।’
‘নৌকা নিয়ে উজান ঠেলে ওখানে পৌঁছতে অনেক সময় ব্যয় হয়ে যাবে।’ কমান্ডার বললো, ‘আমরা স্থলপথে যেতে পারি না?’
‘স্থলপথে যাওয়ার রাস্তা আমার জানা নেই।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন।
‘আমার জানা আছে।’ কমান্ডার বললো, ‘স্থলপথে যাওয়া অনেক সহজ হবে।’
‘ঠিক আছে। তাহলে বিশ জন অশ্বারোহীকে তৈরী হতে বলো।’
কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশ জন অশ্বারোহী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে হাজির হলো হাবিবুল কুদ্দুসের সামনে। তার জন্য ব্যবস্থা করা হলো শুকনো কাপড়ের। তিনিও পোশাক পাল্টে প্রস্তুত হলেন। ততোক্ষণে জ্ঞান ফিরে এলো জোহরার। কিন্তু সে খবর না নিয়েই তিনি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন।
বিশজন অশ্বারোহীর অগ্রভাগে হাবিবুল কুদ্দুস ও সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার। প্রভাতের আলো তখনো স্পষ্ট হয়নি। যখন তারা পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করলো তখন তিনি হুকুম দিলেন, ‘ঘোড়া এখানেই রাখো। অশ্বখুরের আওয়াজ তাদের কানে পৌঁছুক, চাই না আমি।’
নিরবতার খাতিরে অশ্বগুলো পাহাড়ের বাইরে রেখে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হলো তারা। নদীতে সাঁতরানোর কারনে হাবিবুল কুদ্দুসের অবস্থা ছিল কাহিল। তবুও তিনি দুর্বল শরীর নিয়েই হাঁটতে লাগলেন সৈনিকদের সাথে। আবেগ ও আক্রোশ তার শরীরের দুর্বলতা দূর করে দিয়েছিল।
তিনি এখনো জানেন না, ক্যাম্পে তাঁর স্ত্রীর জ্ঞান ফিরেছে কি না। তা দেখার মত সময় তার হাতে ছিল না। তিনি তখন অনুভব করছিলেন দুর্বৃওদের ধরার ব্যাগ্র ব্যাকুলতা।
তিনি পাহাড় ও জঙ্গলের আঁকাবাঁকা গোলক ধাঁধাঁর রাস্তা অতিক্রম করে দ্রুত সেই মহলে পৌঁছতে চাচ্ছিলেন, যেখানে রাতে তাদের হাশিশ মেশানো মদ পান করানো হয়েছিল। কিছু দুর যেতেই তার সামনে ভেসে উঠলো সেই পুরাতন ধ্বংসাবশেষ ও মহল। মহলে প্রবেশ করলেন হাবিবুল কুদ্দুস ও তার বাহিনী। তাদের সামনে প্রথমেই পড়লো সেই খৃস্টান নেতা। তখনও নেশায় তার পা টলমল করছিল। তাকে গ্রেফতার করা হলো। পরিপূর্ণ জ্ঞান ফিরে আসার আগেই গ্রেফতার হওয়ায় সে বুঝতে পারলো না কি ঘটেছে। সে গালাগালি ও বকবক শুরু করে দিল।
বাকীদেরও বেহুশ অবস্থায় পাকড়াও করা হলো। মেয়ে দু’টিকে পাওয়া গেল মিশরী ও সুদানী লোক দুটির রুমে। ওদেরও বন্দী করা হলো। মহলে যত আসবাবপত্র ও সোনা রূপা ছিল উঠিয়ে নিল সৈনিকরা। তারপর সবাইকে অশ্বপিঠে চাপিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো।
ক্যাম্পে ফিরেই হাবিবুল কুদ্দুস খোঁজ নিলেন স্ত্রী জোহরার। জানতে পারলেন জোহরার জ্ঞান ফিরেছে।
দিনের প্রথম প্রহর যখন শেষ হলো তখন দুর্বৃওদের জ্ঞান ফিরলো। হাবিবুল কুদ্দুসের বাহিনী তখন দুর্বৃওদের নিয়ে কায়রোর পথে রওনা হয়ে গেছে।
দুর্বৃওরা সজাগ হয়ে নিজেদের আবিষ্কার করলো অশ্বপৃষ্ঠে। হাত পা বাধাঁ অবস্থায় তারা তখন বিশজন সৈনিকের পাহারায় এগিয়ে চলেছে কায়রোর দিকে।
জ্ঞান ফিরলেও হাবিবুল কুদ্দুস তাদের সাথে কোনো কথাই বললেন না। তার নির্দেশে কোন রকম বিরতি ছাড়াই কাফেলা এগিয়ে চললো।
কায়রো শহর। মধ্য রাত। চমৎকার নিরবতা বিরাজ করছিল শহর জুড়ে। হাবিবুল কুদ্দুস কাফেলা নিয়ে সোজা হাজির হলেন গভর্ণর হাউজে। ঘুম থেকে জাগানো হলো কায়রোর ভারপ্রাপ্ত আমীরকে।
একটু পর আলী বিন সুফিয়ানের চাকর তাকে জাগিয়ে বললো, ‘আমীর সাহেব আপনাকে এখুনি তার মহলে যেতে বলেছেন।’ বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে ভেবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হলেন। হাবিবুল কুদ্দুসকে সঙ্গে নিয়ে গিয়াস বিলকিস বসে ছিলেন সেখানে। আলী বিন সুফিয়ান গিয়াস বিলকিসের সঙ্গে হাবিবুল কুদ্দুস কে বসে থাকতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলেন।
হাবিবুল কুদ্দুস আবার তার অপহরণ হওয়া থেকে শুরু করে মুক্তি ও দুর্বৃওদের পাকড়াও করার অভিযান কাহিনী ওদের সামনে তুলে ধরলেন। এরপর তিনি সবাইকে চমকে দিয়ে এমন কয়েকজন সামরিক অফিসার ও বেসামরিক নেতার নাম উল্লেখ করলেন, যারা ছিল খৃস্টান ষড়যন্ত্রকারী দুর্বৃওদের দোসর। এ নাম কয়টি তিনি পেয়েছিলেন বন্দী অবস্থায় খৃস্টান নেতা এবং মিশর ও সুদান থেকে আগত দুই আগন্তুকের কাছ থেকে।
এই অফিসার ও নেতারা সবাই গাদ্দার ও ষড়যন্ত্রকারী ছিল। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এরা সত্যি বিদ্রোহ সফল করার কাজে জড়িত ছিল কিনা আগে তা প্রমাণিত হওয়া দরকার। সত্যি ওরা দোষী সাব্যস্ত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে ওদের।’
আমীরের আদেশে তখুনি কমান্ডো বাহিনী রাতের আধারে সংশ্লিষ্ট অফিসার ও নেতাদের বাড়ীগুলো ঘিরে ফেললো। বাড়ীতেই পাওয়া গেল সবাইকে। কমান্ডোরা তাদের সবাইকে গ্রেফাতার করে নিয়ে এলো দরবারে। তাদের ঘরে যে সব উপঢৌকন ও বিলাস সামগ্রী পাওয়া গেল তাতেই তাদের অপরাধ সত্য বলে প্রমাণ হয়ে গেল।
সে সময় সুলতান আইয়ুবী হলব শহর অবরোধের জন্য শহরের পাশেই আল আখদার ময়দানে সামরিক ঘাঁটি করে অবস্থান করছিলেন। তিনি সিরিয়া ও বিভিন্ন রাজ্যে তার যে সেন্য ছিল তা থেকে কিছু কিছু অংশকে ডেকে নিজের বাহিনীর সাথে সামিল করার কাজে ব্যস্ত।
হলব সম্পর্কে তিনি তার সেনাপতিদের আগেই জানিয়ে ছিলেন, এই শহরের নাগরিকবৃন্দ দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, তারা আগেও এমন প্রমান রেখেছে। ফলে এখানে বিজয় পেতে হলে কঠিন মোকাবেলার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ওদিকে তার গোয়েন্দা সংস্থা হলবের অভ্যন্তরীন অবস্থা সম্পর্কে যে রিপোর্ট দিয়েছে তার চিত্র ভিন্ন। গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন গৃহযু্দ্ধ করার ফলে তাদের আগের সেই অবস্থা নেই। গৃহযুদ্ধের ফলে শুধু শক্তির দিক দিয়েই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন নয়, তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সেখানকার শাসক সুলতান ইমামুদ্দিনকে এখন হলবের অধিকাংশ নাগরিক ক্ষমতালোভী ও সৈরাচারী মনে করে। বিলাসবহুল জীবন যাপনের কারনে তিনি এখন জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন।
সুলতান আইয়ুবী এ সব শোনার পরও তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলেন না। কারণ ইমামুদ্দিন যথেষ্ট হুশিয়ার ও কুশলী সমরনায়ক। ইয়াজউদ্দিনের চাইতে তিনি সাহসীও বটে। তাই সুলতান এদিক ওদিক থেকে সৈন্য এনে আল আখদার ময়দানে জড়ো করতে থাকেন।
সৈন্য সংগ্রহ শেষ হলে তিনি তার সেনাপতিদের একত্রিত করলেন। অভিযান শুরুর আগে তিনি সেনাপতিদের শেষ বারের মতো নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এ সময় কায়রো থেকে তার কাছে এক কাসেদ এলো।
কায়রোর কাসেদ এসেছে শুনেই তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে কাসেদকে ডাকলেন। কাসেদ তাঁর হাতে আলী বিন সুফিয়ানের চিঠি তুলে দিলো।
আইয়ুবী মনোযোগ দিয়ে চিঠিটি পড়লেন। খুশীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তার চেহারা। তিনি হাসিমুখে সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার মন বলছিল, হাবিবুল কুদ্দুস আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না। আল্লাহ ইসলামের প্রত্যেকটি মেয়েকে যেন জোহরার মত ঈমান ও জোশ দান করেন।’
আলী বিন সুফিয়ান সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুসের অন্তর্ধান থেকে শুরু করে ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার করার কাহিনী পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে লিখেছেন চিঠিতে। সব শেষে তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘সেনাবাহিনীর যেসব অফিসার এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হয়েছিল তাদের ব্যাপারে আপনার নির্দেশ কি?’
তিনি দেরী না করে চিঠির উওর লিখতে বসে গেলেন। তিনি লিখলেন, ‘গাদ্দারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার, যাতে অন্যরা লোভে পড়ে এই রোগে আক্রান্ত হতে সাহস না পায়। তুমি তাদের জন্য সে রকম শাস্তিরই ব্যবস্থা করবে। তাদেরকে ঘোড়ার পেছনে বেঁধে শহরের রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। যতোক্ষণ তাদের মাংস ও চামড়া শরীর থেকে খসে না পড়বে ততোক্ষণ ঘোড়া থামাবে না।’
কাসেদকে বিদায় করার দু্’দিন পর। সুলতান আইয়ুবী তার মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে হলবের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালালেন। এবার আর অবরোধ নয়, সরাসরি আক্রমণ।
বড় মেঞ্জানিক দিয়ে শহরের মূল ফটকে পাথর ও পেট্রোলের বোমা নিক্ষেপ করা হলো। শহরের দেওয়ালেও নিক্ষেপ করা হলো পাথর। দূর থেকে দেয়ালের ওপর দিয়ে শহরের ভেতরে পেট্রোলের হাড়ি নিক্ষেপ হলো। প্রাচীরের উপর থেকে যেসব সৈন্য তীর বর্ষণ করে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল তাদের ওপর চালানো হলো অগ্নি তীর।
মেঞ্জানিকের পেট্রোল বোমা ও অগ্নি তীরের তুমুল আক্রমণের ফাঁকে একদল সৈন্য ছুটে গেল দেয়ালের পাশে। তারা ওখানে পৌঁছেই দেয়াল ভাঙ্গার কাজ শুরু করে দিলো।
কিন্তু আইয়ুবীর বাহিনীর এই প্রবল আক্রমণের তুলনায় শহরবাসীর প্রতিরোধ ছিল খুবই অনুল্লেখযোগ্য। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ততা তো ছিলই না, শহরের সৈন্যদের তরফ থেকেও প্রতিরোধের ধরন ছিল মামুলী।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, হলবের আমীর ইমামুদ্দিন, তার মন্ত্রীবর্গ ও অফিসাররা খৃস্টানদের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য ছাড়াও প্রচুর আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন। তারা খৃস্টানদের কাছ থেকে নিয়োমিত সোনা, রূপা ও মূল্যবান উপহার সামগ্রী পেতো। ইমামুদ্দিন, তার মন্ত্রী ও অফিসারদের দৃষ্টি সবসময় সেদিকেই নিবদ্ধ ছিল।
তারা জানতো এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতো, একদিন সুলতান আইয়ুবী নিশ্চয়ই হলব আক্রমণ করবেন। ইমামুদ্দিনও আগে থেকেই সুলতান আইয়ুবীর প্রচন্ড আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন। ফলে তাদের মধ্যে আইয়ুবী আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আক্রান্ত হওয়ার পর তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো।
ইমামুদ্দিন অবস্থা বেগতিক দেখে হলবের কেল্লাধিপতি হিশামুদ্দিনকে পাঠালেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে। তিনি হিশামুদ্দিনের মাধ্যমে সুলতানের কাছে এই আর্জি পাঠালেন, ‘মাননীয় সুলতান, এই কেল্লা ও রাজ্য আপনি গ্রহণ করুন। বিনিময়ে আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিন।
আপনি যদি আমাকে মুশেলের কোথাও থাকার অনুমতি দান করেন তাহলে আমি ওয়াদা করছি, আমি আর কখনো আপনার বিরুদ্ধে কোন তৎপরতায় অংশ নেবো না।’
সুলতান আইয়ুবী তার এ শর্ত মেনে নিলেন। এ সংবাদ যখন শহরে পৌঁছলো তখন শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বিদ্যুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো এ খবর। শহরের জনগন দলে দলে এসে ইমামুদ্দিনের কাছে জানতে চাইলো, ‘আমরা যা শুনছি তা কি সত্য?’
ইমামুদ্দিন বললেন, ‘এ সংবাদ সত্য। আমি হলব শহর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছি। তোমরা ইচ্ছে করলে নতুন আমীর মনোনীত করে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাতে পারো। তোমরা সুলতানের সাথে আপোষও করতে পারো আবার ইচ্ছে করলে লড়াইও করতে পারো। আমি আর এসবের মধ্যে নেই, তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো।’
শহরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ জার্দুক আন নুরী ও জয়নুদ্দিনকে প্রতিনিধি করে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠালেন। জার্দুক আন নুরী ছিলেন দাস বংশের। ১১৮৩ সালের জুন মাসে তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে গেলেন।
সুলতান আইয়ুবীর সাথে আলাপ শেষে তারা শহরে এসে সমস্ত সৈন্যদেরকে নিয়ে শহরের বাইরে গেলো এবং হলবের সেনাবাহিনীকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে সমর্পণ করে দিল।
সেনাবাহিনীর সাথে হলবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, ইমামুদ্দিনের উজির ও সভাসদবৃন্দও সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নিল। তিনি সবাইকে মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদ প্রদান করে তাদের বরণ করে নিলেন।
অভিযানের ষষ্ঠ দিন। হলবের বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী মুজাহিদ বাহিনীর বিজয় সুসম্পন্ন হয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী এই সফলতার আনন্দে ছিলেন উৎফুল্ল। সেই মুহূর্তে তার কাছে সংবাদ এলো, তাঁর ভাই তাজুল মুলক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাজুল মুলুক এই রণাঙ্গনেই আহত হয়েছিলেন। তার শাহাদাতের খবর সুলতান আইয়ুবীর আনন্দকে নিরানন্দে পরিনত করে দিল।
তাজুল মুলকের জানাজা অনুষ্ঠিত হলো হলবের এক বিশাল ময়দানে। সুলতানের বাহিনী ছাড়াও এই জানাজায় শরীক হলো হলবের আত্মসমর্পিত বাহিনী। ইমামুদ্দিন তখনো হলব ত্যাগ করেননি। তিনিও জানাজায় শরীক হলেন।
জানাজার পর তাজুল মুলুককে নিয়ে যখন বিশাল মিছিল রওনা হলো তাকে দাফন করতে, ইমামুদ্দিন তখন তার দীর্ঘদিনের মসনদ, পরিচিত শহর ও তার সকল অনুগত সৈন্য, উজির-নাজির, চামচা-চাটুকার সবাইকে রেখে হলব থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলেন মুসলের দিকে।
সুলতান হলবকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে নতুন প্রশাসক নিয়োগ করলেন। এরপর তিনি মনযোগ দিলেন নতুন একটি বিষয়ের প্রতি।
তার যে সমস্ত সৈন্য দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ করছিল তাদেরকে সাময়িক বিশ্রামের সুযোগ দেয়ার কথা ভাবলেন তিনি। তিনি পুরনো সৈন্যদের কিছুদিনের ছুটি দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। নিজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন হলবের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও নবাগত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ কাজে।
তার চোখে তখনো ভাসছিল অবরুদ্ধ বায়তুল মোকাদ্দাস। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাহিনীকে সংগঠিত করে তাদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারে বেরিয়ে পড়তে চান তিনি। তিনি সেনাপতিদের হুকুম দিলেন, ‘আমার মূল বাহিনীর সদস্যরা ছুটি থেকে ফিরে আসার আগেই হলবের এই বাহিনীকে উপযুক্ত করে গড়ে নাও। এবার আমাদের টার্গেট হবে ফিলিস্তিন। আমাদের প্রথম কেবলা দুশমন মু্ক্ত না হওয়া পর্যন্ত আরামে ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই।’
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর চেহারায় খেলা করছিল আনন্দের আলো। তার এ উৎফুল্ল ভাব দেখেই তার সেনাপতি ও কমান্ডাররা বুঝে নিলেন, সুলতান কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। কারন তাদের জানা ছিল, সুলতানের মুখে এমন আনন্দের আভা তখনি দেখা দেয়, যখন তিনি কোন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান।
কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে তিনি বিস্তর ভাবেন। তখন তার চেহারায় খেলা করে গাম্ভীর্য। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করেন। উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের সাথে মত বিনিময় করেন। সবার মতামতের সাথে নিজের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি মিলিয়ে তিনি যখন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছান তখনই এমন আলোকিত হয়ে উঠে তার চেহারা।
একটি কথা তার শত্রুরাও জানে, তিনি কোন ব্যাপারে একবার সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে সহজে ফেরেন না। শত বিপদ মুসিবতেও তিনি তার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে থাকেন সদা তৎপর।
১১৮৭ সালের মার্চ মাস। হিজরী সন অনুযায়ী মুহাররম মাস চলছে। তিনি দামেশকে অবস্থান করছেন। ইতিমধ্যে তিনি সমস্ত মুসলিম জাহানের শাসকদেরকে তার অধীনে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন।
কেউ তার আনুগত্য কবুল করেছেন সানন্দে, কেউ বা নিরূপায় হয়ে। তিনি তার এই বিশাল বাহিনীর প্রত্যেকের ওপর কড়া নজর রেখেছিলেন। ছোট ছোট কেল্লার আমীররা কি করছে এটা যেমন তিনি জানতেন, তেমনি জানতেন দুশমনরা এখন কি ভাবছে। আর এ সবই সম্ভব হচ্ছিল তার চৌকশ গোয়েন্দা বাহিনীর কল্যাণে।
এখন তিনি জানেন, প্রকাশ্যে এমন একজন মুসলিম শাসকও নেই যিনি খৃস্টানদেরকে তার বন্ধু বলে ঘোষনা করতে পারে। যারা খৃস্টানদের বন্ধু বানিয়ে রেখেছিল এবং তাদের নিয়ে জোটবদ্ধ হয়েছিল, তিনি সেই সব গাদ্দারকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। আর এ কাজ তাকে কঠোর হাতেই সমাধা করতে হয়েছিল। এদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশী বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন হলব ও মুসলের আমীর ইয়াজউদ্দিন ও ইমামুদ্দিনের কাছ থেকে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধের পর তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তিনি তাদের পরাজিত করে তাদের সৈন্যবাহিনী নিজের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করে নিযেছিলেন। এভাবেই মুসলিম বিশ্বের বিশাল সামরিক শক্তি একটি একক কমান্ডের অধীনে চলে আসে।
তিনি তখনই দামেশকে ফিরে গিয়েছিলেন যখন তিনি তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি শপথ করেছিলেন, ফিলিস্তিন আক্রমণের আগে তিনি সমস্ত গাদ্দারদের বিষঁদাত ভেঙ্গে দিবেন। তিনি বিশ্বাসঘাতকদের মাথা হাটুঁর নিচে নামিয়ে তারপরই দামেশকে ফিরেছিলেন।
অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন, যতবার তিনি ফিলিস্তিন অভিযানকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবেন ততবারই জাতির ভেতর লুকিয়ে থাকা সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে পেছন থেকে তাকে ছোবল মারার জন্য ফনা তুলবে। তাই তিনি চাচ্ছিলেন, প্রথম কেবলা উদ্ধার অভিযানের প্রাক্কালে আর যেন তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে না হয়।
কিন্তু তিনি সাপের বিষদাঁত ভাঙতে গিয়ে জাতির শিরা উপশিরাকে রক্তাক্ত করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি যেসব গাদ্দারকে তলোয়ারের ঝলক দেখিয়ে পথে এনেছিলেন তাদেরকে শুধু একারনেই নিঃশেষ করে দেন নি। তিনি তদের সঠিক পথে এনে কখনোই বলেননি, ‘দেখো, সুলতান আইয়ুবীর তলোয়ারের ধার দেখো।’
তিনি তাদের কথা স্মরণ করে শুধু একটি কথাই বলতেন, ‘হায়, ইসলামের ইতিহাসে এই অধ্যায়টা বড়ই ঘৃণিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। কারণ ইতিহাসে লেখা থাকবে, সুলতান সালাউদ্দিনের যুগটা ছিল অন্ধকার যুগ। ফেতনার তুফানের মোকাবেলা করতে গিয়ে তিনি সত্যের বীজটুকু বোনার মত সময়ও পাননি।
ইতিহাস আরো লিখবে, হাজার হাজার খোদার সৈনিক বর্তমান থাকার পরও মুসলমানদের প্রথম কেবলা খৃস্টান বিধর্মীদের দখলে ছিল। তারা যখন বায়তুল মোকাদ্দাসে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসেছিল তখন মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে প্রকারান্তে মদদ যোগাচ্ছিল খৃস্টানদের। আর যদি আমরা সবাইকে একত্রিত করে ফিলিস্তিন অভিমুখে অভিযান চালাতে পারি তখন ঐতিহাসিকরা লিখবে, ঐক্যবদ্ধ মুসলিম শক্তি খৃস্টানদের পরিকল্পনা ধ্বংস করে ছিল।
সেদিন যখন সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের সভা আহবান করেন, সবাই সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় খুশীর ঝলক লক্ষ্য করে নিজেরাও উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল। তারা বুঝতে পারছিল, সুলতান কোন অভিযানে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। আর তাঁর সেই অভিযানের লক্ষ্যস্থল যে বায়তুল মোকাদ্দাস তাও তারা অনুমান করতে পারছিল।
তারা এ ব্যাপারে সুলতানের মুখ থেকে ঘোষণা শুনতে চাচ্ছিল। তারা জানতে চাচ্ছিল, কোন দিন কোন সময় তারা যুদ্ধ যাত্রা করবেন আর কি প্রক্রিয়ায় তিনি যুদ্ধ চালাবেন। তারা এটাও জানতে চাচ্ছিল, এ অভিযান কোন রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হবে।
‘হে আমার বন্ধুগণ! হে আমার সঙ্গীগণ!’ সুলতান আইয়ুব থেমে থেমে বলতে লাগলেন, ‘আপনারা অবশ্যই আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। আমরা এখন বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত। আজ আমি আপনাদের সামনে যে কথা বলবো, আমি জানি তা একদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
আপনারাও এ অভিযানের ব্যাপারে খোলামেলা মতামত প্রকাশ করুন। আপনাদের মতামত, আপনাদের সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা সবই একদিন ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আপনারা থাকবেন না, কিন্তু আপনাদের শপথের বাণী যুগ যুগ ধরে এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রেরণা জোগাবে সত্য পথের সৈনিকদের। আমাদের কথা, আমাদের প্রতিজ্ঞা ইতিহাসের অংশ হয়ে পৌঁছে যাবে আমাদের শেষ বংশধর পর্যন্ত।
একটি কথা মনে রাখবেন, এ দুনিয়ায় আমরা আমাদের কর্ম রেখে যাবো, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাবো আমাদের কর্মফল। দুনিয়ার প্রতিটি কর্মের ফলই সঙ্গী হবে আমাদের এবং আমরা সেই কর্মফল নিয়েই আল্লাহর দরবারে হাজির হবো।
এখন আপনাদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আনবে কল্যাণ। যে সিদ্ধান্ত ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদের মুখ করবে উজ্জ্বল। যে সিদ্ধান্ত আল্লাহর দরবারে লজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে আমাদের।
বিজয়ের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কারণ বিজয় দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীন। কিন্তু আমরা যে নিশ্চয়তা দিতে পারি তা হচ্ছে, আমরা প্রাণপণে যুদ্ধ করবো। আমরা মরবো কিন্তু পিছু হটবো না। আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে। আমরা শপথের মর্যাদা রক্ষা করবো।
লাশের পাহাড় আর রক্তের নদী সাঁতরে আমরা এগিয়ে যাবো আমাদের মঞ্জিলের দিকে। কোন ভয়-ভীতি, লোভ, দুনিয়ার টান, কিছুই আমাদের অগ্রযাত্রার গতি রোধ করতে পারবে না।’
সুলতান আইয়ুবী একে একে তাকালেন তার উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের দিকে। দেখলেন সবার চোখে মুখে শপথের দৃঢ়তা। প্রতিটি চোখে খেলা করছে অনড় ও অনমনীয় আপোষহীনতার ছাপ।
তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের বিজয়ের ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে আমাদের মধ্যে যেন কারো এ ভয় না হয় যে, খৃস্টান বাহিনী আমাদের দ্বিগুন এবং আমরা বহু দূর থেকে যুদ্ধ করতে এসেছি।’
তিনি একটু দম নিলেন। তারপর সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা এখন সংখ্যায় ততো নগন্য নই। বরং এর চেয়েও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল শত্রু বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে আমরা বিজয় লাভ করেছি।
যুদ্ধ শুধু সংখ্যা দিয়ে হয় না, বুদ্ধি, কৌশল ও প্রেরণা দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। যদি ঈমান মজবুত হয় তবে তার বাহু, তলোয়ার আর মনও দৃঢ় হয়ে যায়। আমাদের মাঝে ঈমানের দুর্বলতা নেই। অতএব বলা যায়, আমাদের কিছুই অভাব নেই।’ সুলতান থামলেন।
‘আমাদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যে শত্রুর সাথে নিজের শক্তির তুলনা করে।’ কমান্ডো বাহিনীর সেনাপতি ছালেম মিশরী দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের শুধু জানা প্রয়োজন, আমরা কোন দিক দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছবো আর আমাদের গতি কেমন হবে?’
‘তবে আমি চলার পথে প্রতি কদমে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী মনে করি। আমাদের অহংকারী হওয়া যেমন মানায় না, তেমনি স্বপ্নবিলাসী হওয়াও কোন সৈনিকের কাজ নয়।’ বললেল সুলতান।
সালেম মিশরী বললো, ‘আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বাস্তবতার নিরিখে। আর আপনি যেমন বললেন, ঈমান, সাহস, বুদ্ধি ও কৌশল হবে আমাদের অস্ত্র।’
‘আমি আপনাদেরকে একথাই বলতে চেয়েছি।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যুদ্ধের প্ল্যান পরিকল্পনা আপনাদের পরামর্শক্রমেই তৈরী করেছি। আমি গত কয়েক রাত চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে হাতিন। যুদ্ধের কৌশলগত ক্ষেত্র হিসাবে আপনারা হাতিনের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত আছেন। সেখানে আমরা তেমন স্থান পেয়ে যাবো যেখানে আমরা খৃস্টানদেরকে ময়দানে পেতে চাই।
আমরা এবার কোন নীতিতে যুদ্ধ চালাবো সে কথা আমি আপনাদের আগেই জানিয়েছি। আমি আবারো বলছি, যুদ্ধের জন্য আপনারা সেই স্থান নির্বাচন করবেন, যেখানে ময়দানে আপনাদের প্রাধান্য বজায় থাকবে।
ময়দান নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার পূর্ব শর্ত হচ্ছে অনুকূল স্থানে শত্রুকে টেনে আনা, যাতে ময়দান আপনাদের উপকারে আসে ও শত্রু বিপাকে পড়ে যায়। এমন ময়দানে একমাত্র হা’তিনেই পাওয়া সম্ভব।
যুদ্ধ জয়ের শর্ত হচ্ছে, গোপনীয়তার সাথে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে ময়দানে পৌঁছা এবং শত্রুকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।’
তিনি সেনাপতিদের হা’তিনের ম্যাপ দেখিয়ে বললেন, ‘হা’তিন এলাকায় উচ্চ ভূমিও আছে, পানিও আছে। আপনারা এই দুটো জয় করতে যুদ্ধ অর্ধেক জয় হয়ে যাবে।
কিন্তু এমন ময়দানে শত্রুকে নিয়ে আসা সহজ নয়। আমাদের পরিকল্পনার প্রত্যেকটা অংশ কার্যকরী হতে হবে। নয়তো একটা অংশের জন্য সমস্ত পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হতে পারে।
আমরা এই মাসের মাঝামাঝি দামেশক থেকে যাত্রা করতে পারি। আমি হলব ও মিশরে কাসেদ পাঠিয়ে বলেছি তারা যেন প্রস্তুত থাকে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন দ্রুত গতিতে এসে আমাদের সাথে রাস্তায় মিলিত হয়।
তারপর আমাদের সমস্ত সৈন্য এক জায়গায় একত্রিত করে বাইরে থেকে আসা সৈন্য ও আমাদের নিয়মিত সৈন্যদের মিশিয়ে দিয়ে নতুন করে সাজাতে হবে। নতুন সৈন্য বিন্যাস ও প্ল্যান সেনাপতি ও কমান্ডারদের বুঝিয়ে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।
আমাদের অগ্রাভিযানের ধরন ও পথ হবে ভিন্ন। এ মুহূর্তে গোপনীতার দিকে আমাদের সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকবো। সেনাপতি ও কমান্ডাররা ছাড়া আর কেউই কিছু জানতে পারবে না। আমাদের গোয়েন্দারা শত্রু এলাকায় থেকে প্রতিনিয়ত তাদের গতিবিধি জানিয়ে যাচ্ছে। আমরা দুশমন গোয়েন্দাদের এমন সুযোগ দিতে চাই না।
এখন প্রয়োজন দুশমন গোয়েন্দাদের অন্ধ ও বধির করে দেয়া। বিভিন্ন পথে সৈন্য চালনা করে আমরা তাদের বিভ্রান্ত করে দিব যাতে তাদের পাঠানো সংবাদগুলো পরস্পর বিরোধী হয়।
হাসান বিন আবদু্ল্লাহ এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমি এ ব্যাপারে তাকে কিছু নির্দেশ আগেই দিয়ে রেখেছি। আমি আপনাদের একটি ব্যাপার জানিয়ে রাখছি, সৈন্যদলের একটি অংশ আমার সাথে ক্রাকে পৌঁছবে। আমার গতি সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। চার বছর আগের প্রতিজ্ঞা পূরণের সময় হয়েছে এখন।
সুলতান আইয়ুবীর প্রতিজ্ঞাটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। চার বছর আগের ঘটনা তিনি সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন। তখন খৃস্টান সরকার মুসলমানদের হজ্জের কাফেলায় হামলা চালিয়ে পুরুষদের হত্যা ও মহিলাদের ইজ্জত লুট করতো। আর বাচ্চা মেয়ে শিশুকে নিয়ে এনে গোয়েন্দা ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দিত মুসলমানদের চরিত্র হননের জন্য। ছেলে শিশুকে হত্যা করতো যাতে মুজাহিদের সংখ্যা বাড়তে না পারে।
হজ্জ মৌসুমে ক্রাকের খৃস্টান সম্রাট আরনাতের নির্দেশে খৃস্টান সৈন্যরা হাজীদের লুট করার জন্যে ওত পেতে বসে থাকতো। এ জন্য সম্রাট আরনাত গর্ব করে বেড়াত। নিরস্ত্র হাজীদের লুট ও খুন করার সংবাদে তার বুক আনন্দে ও গর্বে ভরে উঠতো। এই ডাকাতি করাটাই তার কাছে যুদ্ধ জয়ের সমান বলে পরিগণিত হতো।
১১৮৩ সালের হজ্জ মৌসুমে হেজাজ থেকে মিশরের পথে অগ্রসর একটি হজ্জ কাফেলা লুট করলো আরনাতের সেনাবাহিনী। এই কাফেলায় ছিল সুলতান আইয়ুবীর এক কন্যা।
এই খবর যখন সুলতানের কানে পৌঁছলো, সুলতান আইয়ুবী চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘হায়! এ কাফেলায় যে আমার মেয়ে ছিল।’ সুলতান তখুনি এর প্রতিশোধের কসম খেয়ে বললেন, ‘আরনাতের এই অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচারের মাধ্যমে সে শুধু আমার মেয়েকেই অপবিত্র করেনি, পুরো মুসলিম নারী সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি তাকে ক্ষমা করবো না, আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবো।’
উপস্থিত সবারই চোখ পানিতে ভরে গেল। তাদের মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি। তারা সবাই সুলতানের মনোবেদনা অনুভব করে নিজেরাও কাতর হয়ে পড়লো। সুলতানকে তারা এমন ভঙ্গিতে আর কখনো কথা বলতে দেখেনি।
মাথা নিচু করা লোকগুলো এক সময় চোখ তুলে তাকাল সুলতানের দিকে। দেখলো রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে সুলতানের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে খেলা করছে শপথের দৃঢ়তা ও তীব্র উত্তেজনা।
পরিস্থিতি যাই হোক, সুলতান উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হওয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু আজ তার ক্ষিপ্ত ও এই উত্তেজিত চেহারা দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। সবাই বুঝে নিল, যে আজকের এই প্রতিজ্ঞা থেকে সুলতানকে কেউ ফেরাতে পারবে না।
সকল খৃস্টান সম্রাটই ইসলাম বিরোধী ও মুসলমানদের শত্রু। তবে সম্রাট আরনাতের সাথে আর কারো তুলনা চলে না। সে রাসুল (সাঃ) কে অবমাননা করতো। বন্দী মুসলমানদের নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাসুল (সাঃ) কে অপবাদ দিত ও গালমন্দ করতো। বন্দীদের বলত, এখন ডাকো তোমার আল্লাহকে। ডাকো তোমার রসুল কে। পড় তোমার আল্লাহর বানী। দেখি কেমন করে তুমি ছাড়া পাও। হা হা হা।’
এভাবে বন্দী মুসলমানদের তিরষ্কার করতো এবং উচ্চস্বরে হাসতো। তার এ আচরণ সম্পর্কে সবাই জানতো, আইয়ুবীও জানতেন।
আজ চার বছর পর যখন তাঁর মনে হলো চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তখনি তার মনে পড়ে গেল অতীতের সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি। তিনি কমান্ডার ও সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই হতভাগা আরনাতের সাথে বোঝাপড়ার সময় হয়েছে। আমি নিজে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চাই। বন্ধুরা তোমরা দোয়া কর যাতে আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ ও সাহস দান করেন, যাতে আমি আমার প্রিয়তম রাসুলের অবমাননাকারীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারি।’
আমি আশা করি, তিন মাসের মধ্যেই আমি তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারি। তিন মাস পর নতুন ঋতু শুরু হবে। তার আগেই আমি হাতিন এলাকায় পৌঁছে যাবো।
তোমরা জানো যে আগামী ঋতুতে প্রচন্ড গরম থাকবে। মরুভূমি তখন ফুটতে থাকবে জলন্ত অঙ্গারের মত। আমি খৃস্টানদের তখন যুদ্ধে নামাবো। প্রচন্ড গরমে তাদের লৌহবস্ত্রগুলো আগুনের মত গরম হয়ে তাদের সিদ্ধ করে ফেলবে। আমরা আঘাত হানার আগেই খৃস্টানরা নিজের দেহে জড়ানো অগ্নিকুন্ডে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।’
ঐতিহাসিকগণ ও ইউরোপের যুদ্ধ অভিজ্ঞ সমালোচকগণ সুলতান আইয়ুবীর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তিনি যুদ্ধের জন্য যে ঋতু বেছে নিয়েছিলেন সেটা ছিল জুন মাস। এ সময় মরুভুমি জ্বলন্ত কয়লার মত গরম থাকে।
গ্রীষ্মের এ প্রচন্ড দাবদাহ খৃস্টান সৈনিকদের জন্য ছিল মৃত্যুর ফাঁদের মত। লোহার শিরস্ত্রান ও পোষাক তাদের নিরাপদ না করে বরং তন্দুরের মত ভাজা ভাজা করছিল।
খৃস্টান নাইটরা আপাদমস্তক লৌহবর্ম ও মোটা চামড়ার পোষাক পরতো। তাই তীর ও তলোয়ারের আঘাত তাদের সহজে ক্ষতি করতে পারতো না। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তাদের এ লোহার বর্ম ও পোষাককে তাদের জন্য বড় বিপদ ও ক্ষতির কারন বানিয়ে দিলেন।
একে তো তিনি কমান্ডো ধরনের যুদ্ধ করতেন। সামান্য সৈন্য দিয়ে পাশ থেকে বিদ্যুৎ বেগে আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে সরে পড়তেন। এই ধরনের আক্রমণ চালানোর জন্য দরকার ক্ষীপ্ত গতির সৈনিক। কিন্তু লোহার পোষাক পড়ে খৃস্টান সৈন্যদের পক্ষে দ্রুত গতিতে চলা সম্ভব ছিল না। আইয়ুবী এই সুযোগটাই নিতেন। তার সৈন্যরা ক্ষীপ্ত গতিতে আক্রমণ চালাতো এবং দ্রুত গতিতে সরে পড়তো।
জুনের খরতাপে রোদ্দুর যখন মাথার উপর থাকে মরুভুমি তখন আগুনের কুন্ড হয়ে যায়। লোহার পোষাক তপ্ত তাওয়ার মত জ্বলতে থাকে। পিপাসায় কন্ঠ ও শরীর শুকিয়ে যায়।
মরুভুমির ঝলসানো তাপ মুসলিম সৈন্যদেরও অসুবিধার সৃষ্টি করতো। কিন্তু তাদের পোষাক হালকা পাতলা হওয়ায় তাদের অবস্থা থাকতো তুলনামূলকভাবে ভালো।
যুদ্ধের আগেই সুলতান আইয়ুবী পানি নিজের দখলে নিয়ে নিতেন। আর তিনি তার সৈন্যদের এমন কঠিন প্রশিক্ষণ দিতেন যাতে যুদ্ধের সময় কেউ ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর না হয়। তিনি সৈন্যদের বলতেন, ‘বদরের যুদ্ধ হয়েছিল রমজান মাসে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করে জেহাদের প্রেরণা আমাদের সেখান থেকে নিতে হবে।
শারিরীক ট্রেনিং ছাড়াও তিনি মানসিক ও আধ্যাত্নিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, ‘মানসিক শক্তি শারিরীক শক্তির চেয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অনেক বেশী উপকারী। যেই সেনাপতি তার সৈন্যদের এই শক্তিতে বলীয়ান করতে পারে তারা যুদ্ধ বিজয়ী হয়।
তিনি সৈন্যদের বলতেন, ‘তোমরা আল্লাহর সৈনিক। ইসলামের সতন্ত্র প্রহরী। কারো চাকর নও যে তোমাদের ত্যাগ বিফলে যাবে। আল্লাহই তোমাদের এই বিরল সম্মানের অধিকারী করেছেন, আর মৃত্যুর পর তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। গনীমত জিহাদের আসল পুরস্কার নয়, আসল পুরস্কার আল্লাহর হাতে।
সৈন্যদেরকে জাতীয় দায়িত্বের কথা ও বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের কথা শুনানো হতো। বলা হতো, ‘তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো। তোমাদের মা, বোন যাদেরকে খৃস্টানরা ধরে নিয়ে গেছে তাদের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কেপে উঠছে।
তোমরা জানো খৃস্টান শাসিত অঞ্চলে মুসলমানদের পশুর মত জীবন যাপন করতে হয়। তাদের অশ্রু মোছানোর দায়িত্ব তোমাদের। পৃথিবীর যেখানেই অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, সেখানেই তোমরা জালিমের মুলোচ্ছেদ করবে। এখন হোক সে জালিম খৃস্টান, ইহুদী অথবা নামধারী মুসলমান। যদি কোন মুসলমান মানবতার বিরুদ্ধে যায়, সে মুসলমান নামের কলঙ্ক, সে রাসুলের সুন্নাতের বিরোধী, আল্লাহর নাফরমান।’
তিনি বলতেন, যারা শহীদদের ভুলে যায়, নির্যাতিত মানুষের কথা ভুলে যায়, তারা বিজাতির গোলাম হয়। যে জাতি গাদ্দারদের মাথায় তুলে নাচে তাদের অন্ধকার রজনী কোনদিন ভোরের আলো দেখেনা। আর গাদ্দাররা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস খুজে পায়। বিবেক বর্জিত পথে ঠেলে দেয় মানুষকে।
বিপদ দেখলে পিছিয়ে পড়া বা আবেগের বশবর্তী হয়ে আগুনে ঝাপ দিলে সে মুমিন মুজাহিদ নয়। মুমীনের সিদ্ধান্ত হবে দায়িত্বপূর্ণ, আচরণ হবে সহানুভূতিপূর্ন আর শপথ হবে আপোষহীন।’
এমন সব আলোচনা সেনাপতি ও কমান্ডারদের মুখে সবসময় উচ্চারিত হতো বলে সৈনিকরা ব্যাপক প্রভাবিত হতো। সুলতান নিজেও সৈনিকদের মধ্যে ঘোরাফিরা করতেন এবং আলোচনায় মিলিত হতেন। উপদেশ ও নির্দেশও দিতেন।
তিনি বলতেন, ‘সৈন্যদের ওপর জাতি যে দায়িত্ব দিয়েছে, সৈনিকরা তা ঠিকমতো পালন না করলে তাদের ভাগ্যে দুনিয়ায় জোটে ভীষন লাঞ্ছনা আর পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি।
সামনে বিশাল এক ক্রুশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আক্রার সবচেয়ে বড় পাদ্রী। খৃস্টানদের বিশ্বাস, হযরত ঈসা (আঃ) কে এই ক্রুশেই বিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এখনো এখানে তার রক্ত লেগে আছে। এই ক্রুশ ও এর রক্ষাকারী পাদ্রী খৃস্টান জগতে মহা সম্মানিত। সে সম্রাটের চেয়েও বেশী অধিকার ও গুরুত্ব লাভ করে। সম্রাটরা সবাই তার তাবেদার।
তিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম হত্যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা গ্রহনকারী। তার নির্দেশে সম্রাটরা ও গোয়েন্দারা তাদের কার্য পরিচালনা করেন। প্রকাশ্যে তিনি মানবতার কথা বলেন, কিন্তু তলে তলে তিনি মানুষ মারার পরিকল্পনা ও নির্দেশ সরবরাহ করেন খৃস্টান গোয়েন্দা বাহিনীকে। গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে তার ট্রেনিং শেষে কাজে যাওয়ার আগে এই ক্রুশ ছুয়ে ও এই মহান পাদ্রীর দোআ নিয়ে যেতে হয়। বিদায়ের আগে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিত একটি ছোট ক্রুশ।
নাসিবা নামক স্থানে খৃস্টান সৈন্য, তাদের সম্রাটগণ ও তাদের মহান সেই পাদ্রী উপস্থিত হলো। সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট গে অব লুজিয়ার, ত্রিপলীর সম্রাট রিমান্ড, গ্রান্ড মাস্টার গ্রাড, মাউন্ট ফ্রেড, হামফ্রে, ইমারাস্ক, ও ক্রাকের সম্রাট আরনাত আরো অনেক নামী দামী সম্রাট এখানে একত্রিত হয়েছেন।
ত্রিপলী থেকে আনা মোটা সিল্কের কাপড়ের সামিয়ানা দিয়ে রংমহলের বাহিরের ও আলোকসজ্জা দিয়ে ভিতরের অন্দরমহল সাজানো হয়েছে সম্রাটদের জন্য। চাকর ও সেবাদাসীতে ভর্তি রংমহল যেন ঝাড়বাতির আলোয় রাজমহল থেকে আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।
সম্রাটদের তাঁবুর পাশেই নাইট ও নাইটদের তাঁবুর পাশে বিপুল সৈন্যের তাঁবুর সারি। সামিয়ানার নিচে সম্রাটরা সুন্দরী যুবতীদের পরিবেশন করা মদ পান করছে ও নারীদের উপভোগ করছে। এই নারীরা ভাইকে ভাইয়ের শত্রু ও বাবাকে ছেলের শত্রু বানাতে খুবই পারঙ্গম।
এক সামিয়ানার নিচে মহলের মত সাজানো হয়েছে বিশাল কামরা যেখানে সেই মহান পাদ্রী তার বিশাল ক্রুশসহ অবস্থান করছেন। তার সামনে সম্রাটগণ ও সেনাবাহিনীর জেনারেলগন।
এই ঐতিহাসিক মহাসম্মেলন এর মাধ্যমে ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করতে যাচ্ছে খৃস্টান সম্রাটগন। তারা এক নতুন অভিযান শুরু করবেন এখান থেকে যার নাম ‘কিলিং ইসলাম।’
‘হে মহান ক্রুশের রক্ষকগন।’ পাদ্রী বলা শুরু করলেন, ‘এই মহান ক্রুশ আপনাদের পূর্বের শপথের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আক্রা থেকে আজ এখানে আনা হয়েছে। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তোমাদের চেতনাকে পূনঃজাগ্রত করাই এটার আসল উদ্দেশ্য। তোমাদের মনে রাখতে হবে, তোমরা তোমাদের অঙ্গিকার রাখতে পারনি, পারনি আইয়ুবীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। বরং এখন সে আগের থেকে অনেক শক্তিশালী।
এখন তোমাদের ওয়াদা রক্ষা করার একটাই উপায়। তা হলো এক চূড়ান্ত যুদ্ধের মাধ্যমে আইয়ুবীকে শেষ করে ইসলামের পতন ঘটানো আর সারা জাহানে ক্রুশের রাজ্য তৈরী করা। আমি তোমাদের ধর্মীয় নেতা। তাই আমি তোমাদের ক্রুশের কথা বলি। কিন্তু ময়দানে লড়াইয়ের দায়িত্ব তোমাদের। তোমরা সবাই তোমাদের সারা জীবন এই কাজেই ব্যয় করেছো। তাই এই যুদ্ধ তোমাদেরই করতে হবে।
ইসলামকে মুছে ফেলতে চাইলে শুধু বায়তুল মোকাদ্দাস নয়, আমাদের মক্কা ও মদীনা জয় করতে হবে। মক্কা ও মদীনাকে খৃষ্টের ধর্মীয় স্থান বানাতে হবে। তোমাদের মনে আছে তোমরা একবার মদীনা থেকে মাত্র তিন মাইলের মত দূরে ছিলে। কিন্তু তারপরও তা দখল করতে পারনি মুসলমানদের উন্মাদনার কারনে। সুতরাং তা দখল করতে চাইলে আমাদেরও সেরকম উন্মাদনা চাই।
সালাউদ্দিন আইয়ুবী আটঘাঁট বেঁধে এবার জেরুজালেমের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। তার হাত থেকে জেরুজালেম রক্ষা করতে হলে তোমাদের দৃষ্টি দিতে হবে মক্কা ও মদীনার দিকে। মনে রেখ, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের সাথে, আইয়ুবীর সাথে নয়। এটা ধর্মযুদ্ধ। আমরা না পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা চালিয়ে যাবে।
মনে রেখো, শেষ পর্যন্ত একটা ধর্মই থাকবে। তা হলো খৃষ্টধর্ম। ইসলাম বিলুপ্তির দিনটি বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরনীয় দিন হবে আর খৃষ্টধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত কোন শক্তি থাকবে না।
পাদ্রী একটু থামলেন। আবার শুরু করলেন, ‘আপনারা জানেন মুসলমানদের থামানোর জন্য আমরা অন্য উপায় অবলম্বন করেছিলাম। তবে তাতে কিছুটা লাভ হলেও আসল উদ্দেশ্য এর কিছুই পূরণ হয়নি। বিনিময়ে আমরা আমাদের কত মেয়ে, কত সম্পদ, কত সেনা নষ্ট করেছি। হয়তো আইয়ুবীর কিছু দক্ষ সৈনিকের প্রাণ নিতে পেরেছি আর মুসলমানদের মধ্যে সম্পদের মোহ তৈরী করতে পেরেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’
‘সম্মানিত পিতা’! এক সম্রাট বললো, ‘আপনি এটাকে বিফল বলতে পারেন না। এর কারনে আমরা সাত আট বছর তার আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিলাম। এই সময় আমরা আমাদের সামরিক শক্তিকে অনেক মজবুত ও সুসংহত করেছি। জেরুজালেমের প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করেছি। অর্থনৈতিক অবরোধ করে তাদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছি। সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা গৃহযুদ্ধের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কি আমাদের সফলতা নয়?’
‘তোমরা মুসলমান মারতে চাও কারন এতে ইসলাম বিপন্ন হবে। কিন্তু তা তো হয়নি। বরং ইসলামী সব নেতারা এখন একত্রিত হয়েছে। ইসলামও আগের থেকে শক্তিশালী হয়েছে।
আমাদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা হয়েছে। তার সাথে গাদ্দারদের শেষ করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের গৃহযুদ্ধ আমাদের ষড়যন্ত্রের ফল। ফলে মুসলিমরা বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে আগের থেকে বেশি সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যুদ্ধে জিততে হলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। নয়তো তোমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তোমাদের মত সালাউদ্দিন আইয়ুবীও তার আগের অবস্থা থেকে এখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী। এখন হলব ও মুশেলের বাহিনীও তার সাথে হাত মিলিয়েছে। আমাদের আগের বন্ধুরাও যারা আগে তার শত্রু ছিল, তারাও এখন তার সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে।
আমরা যাদেরকে কিনেছিলাম তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আর অন্যদের তিনি দুর্বল ও অসহায় করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা কেউ এখন কোন কাজে আসবেনা। এখন আর কোন মুসলমান শাসক নেই যে তাকে পিছন থেকে আক্রমণ করবে। আমাদের মদ ও হাশিশ ব্যবহারও কার্যকারিতা লাভ করেনি। এখন তার বিরদ্ধে আমাদের সম্মিলিত আক্রমণ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এক জেনারেল বললো, ‘আপনার পরামর্শ অত্যন্ত মূল্যবান। তবে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি তাকেই আগে আক্রমন করতে দেওয়া উচিত। এর কারন হলো,
প্রথমত আমাদের সৈন্যদের বেশী দূরে নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। তাতে খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় রসদের যথেষ্ঠ নিরাপত্তা থাকবে। সৈন্যরা তাদের পরিচিত জায়গায় পূর্ণ শক্তি নিয়ে লড়াই করতে পারবে।
অপর কারনটি হলো, আইয়ুবীর যুদ্ধ স্টাইলটা অনেক ছড়ানো ছিটানো সৈন্যদের নিয়ে গঠিত। এখন মুসলিম এলাকায় আমাদের বন্ধু নেই। তাই তাকেই আমাদের অনুকূল জায়গায় এনে বেকায়দায় ফেলে দিলেই সে শেষ। তবে আমাদের অনেক ভাবনা ও চিন্তা করতে হবে এই ব্যাপারে।’
পাদ্রী বললেন, ‘আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এখন ভাবনা চিন্তার সময় নেই। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী সে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলছেন। তাই আমাদেরও সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে যে, আমরা কি তাকে তার পথে রাখবো, নাকি মক্কা মদীনা আক্রমণ করে তার পথ থেকে সরিয়ে দিব।’
‘আমরা তাকে জেরুজালেমেই ফাদে ফেলতে পারি এবং গতবার তাই হয়েছিল। তবে গতবারের মত তাকে ছেড়ে না দিয়ে তাকে ওখানেই পিষে মারতে হবে।’
‘তাহলে তার পথ তোমাদের চিনে রাখতে হবে। আর তার মত আমাদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে।’
এবার পাদ্রী উপস্থিত সকল সম্রাট, জেনারেল ও নাইটদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই পবিত্র ক্রুশ এখানে আনা হয়েছে তোমাদের সকলের একসাথে শপথ গ্রহনের জন্য। তোমরা এটা ছুয়ে ওয়াদা করবে সব দলাদলি বাদ দিয়ে তোমরা নিজেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলবে। এই শপথ হবে শুধুমাত্র পবিত্র ক্রুশ ও মহান যিশুর নামে। তোমরা কি আমার এই প্রস্তাব মেনে নিতে প্রস্তুত?’
সবাই উঠে দাঁড়ালো এবং বিনীত কন্ঠে বললো, ‘আপনার প্রস্তাব আমাদের জন্য আদেশ, আর সেই আদেশ মানা আমাদের জন্য শিরোধার্য।’
পাদ্রী তাদেরকে শপথের আহবান করলে তার ডাকে সারা দিয়ে সবাই সেই পবিত্র ক্রুশের সামনে এসে তা ছুয়ে পাদ্রীর সাথে জোরে জোরে শপথ বাক্য পাঠ করলো।
পরের দিন। সকলেই ঘুম থেকে দেরি করে উঠলো। রাতে পাদ্রীর শপথ অনুষ্ঠান শেষ হলে শুরু হয় মদ ও নাচের আসর। সেই আসর চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সবাই নিজ নিজ পছন্দ মতো মেয়ে নিয়ে বসে যায় সেই আসরে।
নাচ গান ও সম্রাটদের মনোরঞ্জনের জিন্য সেরা রূপসীদের হাট বসে যায় সেখানে। তাদের রূপের জৌলুস,
চোখের বিলোল কটাক্ষ আর দামী মদের প্রাচুর্য সে স্থানটিকে তাদের জন্য পৃথিবীর স্বর্গ বানিয়ে দিয়েছিল।
সেই স্বর্গ থেকে বেরিয়ে ওরা যখন ঘুমাতে যায় তখন ভোর হওয়ার বেশি বাকি ছিল না। পরেরদিন সূর্য উঠে তখন খৃষ্টানদের সেই রাজকীয় ক্যাম্পে মৃত্যুর নিরবতা বিরাজ করছিল।
সম্রাট আরনাতের তাঁবু থেকে এক অপূর্ব রূপসী লম্বা একহারা গড়ন বিশিষ্ট যুবতী বেরিয়ে এলো। মেয়েটি দেখতে আরবীয় মেয়েদের মতো। তাকে সম্রাট নিজে এখানে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। তাকে সম্রাট ডাকতো প্রিন্সেস লিলি বলে আর তাকে দেখাতো রাজকুমারীর মতো।
সে বের হওয়া মাত্রই তার চাকরাণী ছুটে এলো। চাকরাণীকে সে বললো তার নাস্তা ও পালকি গাড়ী তৈরী করতে। সে এই এলাকাটা একটু ঘুরে দেখতে চায়।
এই সাত সকালে অন্যান্য সকল সম্রাটের মত সম্রাট আরনাতও গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। পাদ্রীও তার প্রাতকালীন উপাসনা সেরে শুয়ে পড়েছেন।
প্রিন্সেস লিলিরও কোন কাজ নেই। কিন্তু সকালে ঘুরে বেড়ানো তার এক প্রিয় অভ্যাস। নাস্তা আনতে আনতে সে তার পোষাক পাল্টে নিল। নাস্তা এলে দ্রুত নাস্তাও খেয়ে নিল।
ইতিমধ্যে দুই ঘোড়ার টানা পালকি গাড়ী নিয়ে প্রস্তুত সহিস। সে সহিসকে বললো, এলাকাটা সে ঘুরে দেখতে চায়। সহিস এলাকাটা ভালো করে না চিনলে সে যেন একজন গাইড নিয়ে নেয়।
সহিস বললো, এই এলাকাটা তার আগে থেকেই ভালো করে জানা আছে। এখানে এর আগেও অনেকবার সে সম্রাটকে নিয়ে এসেছে। সে আরো বললো, ‘আপনি শিকার করতে চাইলে তীর ধনুক নিই। এখানে অনেক খরগোশ ও পাখী আছে। ওগুলো আপনি শিকার করতে পারেন।’
প্রিন্সেস লিলি হেসে বললো, ‘তুমি কি আমাকে শিকারী ভাবো? হরিণ পাওয়া যায় এখানে? তোমার ইচ্ছা হলে তীর ধনুক নিতে পারো।’
সহিস বললো, ‘হরিন মাঝে মাঝেই দেখা যায় এবং সংখ্যায় খুবই কম। খরগোশ প্রচুর। আমি এক্ষুনি তীর ধনুক নিয়ে আসছি।’
‘আমিতো তীরন্দাজ নই, দেখবে সব তীর শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু একটিও কারো গায়ে লাগেনি।’
‘তাতে কোন সমস্যা নেই। আপনি তো আর যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছেন না। তীর মিছ হলেও শিকারের আনন্দে ভাটা পড়েনা।’ বলেই সে দৌড়ে গিয়ে তীর ধনুক নিয়ে এল।
প্রিন্সেস লিলিকে নিয়ে পালকির গাড়ী অনেক দূরে চলে গেল। অঞ্চলটিতে সবুজের সমারোহ আর আছে উচু নিচু পাহাড়।
এখন বসন্তকাল। প্রকৃতিতে নবদিগন্তের সূচনা ঘটছে চারিদিকে। গাড়ী চলছিল ধীরে ধীরে। রাস্তার পাশে এক বড় গাছের নিচে গাড়ির চালক সায়বল লিলির নির্দেশে গাড়ী থামালো।
সায়বল জাতিতে খৃস্টান ও আক্রার অধিবাসী। বয়স ত্রিশ। সুদর্শন ও সুঠামদেহের কারনে সম্রাট তাকে এ চাকরি দিয়েছে। লিলিরও এ যুবককে ভালো লাগে তার সপ্রতিভ, ভদ্র ও কর্মঠ গুনের কারনে। লিলি আরনাতের কাছে আসার এক বছর পর সায়বল এখানে এসেছে।
লিলি গাছের নিচে বসে সায়বল কে বললো পানি দিতে। লিলি জিজ্ঞেস করলো, ‘সীমান্ত আর কত দূর?’
সায়বল বললো, ‘সামনে সাত-আট মাইল পরে এক হ্রদ, নাম গেলিলি সাগর। তারপরে তিববিয়া গ্রাম। এরপরেই মুসলমানদের এলাকা।’
‘তারমানে সীমান্ত খুব কাছেই। আমরা কি হ্রদ পর্যন্ত যেতে পারবো?’
‘আমরা এ গাড়ীতে করে ক্রাক থেকে এসেছি, আর হ্রদ তো এখানেই। আমরা অনায়াসে পৌঁছে যাবো।’
‘তুমি হ্রদের রাস্তা ঠিক চিনো তো? রাস্তা কি ভালো? গাড়ী কি যেতে পারবে? তুমি আগে কখনো গিয়েছো?’ শিশুর মত প্রশ্ন লিলির।
সায়বল তাকে একটা ম্যাপ একে বুঝাতে থাকে হ্রদের রাস্তা। লিলির সব প্রশ্নের উত্তর দেয় একে একে। সব প্রশ্ন শেষে লিলি তাকে তীর ধনুক বের করতে বলে শিকার করার জন্য।
সায়বল তাকে তীর দিলে সে তা ধনুকে সংযোজন করে একটি পাখীর দিকে তাক করে। তীরটি ছুড়লে তা অনেক দূর দিয়ে যায় আর পাখিটিও চলে যায় সেখান থেকে।
সায়বল তাকে তীর চালনার কৌশল শিখিয়ে দেয়। সে উদাহরন সরূপ কিছু তীর এদিক ওদিক চালিয়ে দেখালো।
লিলি বললো, ‘আর একটু সামনে যাও। দেখি হরিণ পাওয়া যায় কিনা?’
সায়বল আরো দু-আড়াই মাইল এগিয়ে এক স্থানে গাড়ী থামালো। লিলির দিকে তীর ধনুক এগিয়ে দিয়ে সে লিলির জন্য একটা হরিণ খুঁজতে লাগল।
লিলির দিকে ছিল তার পিঠ। লিলি সায়বলের পিঠকে নিশানা করে তীর ছুড়লে তা সায়বলের পিঠের উপর দিয়ে গিয়ে এক গাছে বিদ্ধ হয়।
সায়বল চমকে উঠে লিলির দিকে তাকিয়ে দেখে লিলির চেহারায় অনমনীয় প্রতিজ্ঞার ছাপ। তবুও সে হেসে বললো, ‘আপনি আমার উপর তীর চালানো শিখছেন?’
এমন অবস্থায় লিলি আরেকটি তীর কোষ থেকে বের করে তা ধনুকে সংযোজন করে সায়বলকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে বললো।
সায়বল বুঝতে পারলো ব্যাপারটি কি ঘটতে যাচ্ছে। সে লিলির দিকে ছুটলো তাকে ধরতে। লিলিও তীর ধনুক ফেলে একদিকে ছুটলো। সায়বল দ্রুত দৌড়ে লিলিকে ধরে ফেললো এবং তার কাছ থেকে তীর কোষটি ছিনিয়ে নিল।
সে লিলিকে বললো, ‘আমি সম্রাটের অন্যান্য চাকরদের মত নই যে আমাকে সম্রাট খুব উৎপীড়ন করে। তুমি কি আমার উপরেই তীরের নিশানা করবে? এই কি আমার বিশ্বস্ততা ও তাবেদারীর ফল?’
লিলির ঠোঁট কাপতে লাগল। কোন উওর না দিয়ে সে কাঁদতে লাগল।
সায়বল তীর ধনুক ফেলে ধীরে ধীরে লিলির কাছে গিয়ে সসম্মানে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কেন আমার উপর তীর চালালেন? কেনই বা আপনার চোখে পানি?’
লিলি বললো, ‘কারন তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। আমার অসহায়ত্ব সবসময়েই আমার সাথী।’
‘শাহজাদী আমি আপনার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি। এখন বলুন আপনার কি সাহায্য দরকার?’
‘তোমাকে ধনী বানিয়ে দিব। যদি আমাকে চাও তবে তাও পাবে। তুমি আমাকে মুসলমানদের এলাকায় পৌঁছে দাও। এই গাড়ী ও ঘোড়া তোমারই থাকবে। আর পুরস্কার পাবে আলাদাভাবে।’
‘আপনার উপর মনেহয় জ্বিন ভূতের আছর পড়েছে। চলুন ফিরে যাই।’ সায়বল বললো।
‘না, যদি তুমি আমার কথা না মানো তাহলে সম্রাটকে বলে তোমাকে ফাঁসাবো।’ লিলি বললো।
‘ভালোই হলো আপনি আমাকে আগে বলে দিয়েছেন। তাহলে এখন আর আমি ফিরে যাবো না। আপনাকে কোন শহরের পতিতালয়ে বিক্রি করে দিবো। আমিও আর সম্রাটের কাছে যাবো না, আপনিও যেতে পারবেন না। এখন বলুন আপনি কেন মুসলমানদের এলাকায় যেতে চান?’
তখন লিলির মনে হলো, সে এক ফাঁদে আটকা পড়েছে। সে বসে ফুঁপিয়ে কাদতে লাগল। সায়বল কিছু না বলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল।
এই মেয়েটাকে তার কাছে এখন অপরিচিত মনে হলো যদিও তিন বছর ধরে মেয়েটাকে তার খুব পরিচিত বলে মনে হতো। আর এই মেয়েটা অন্য দশটা খৃস্টান মেয়ের মত নয়। তাকে আরবীয় মেয়ে বলে মনে হয়। সে জানতো খৃস্টানরা মুসলমান মেয়েদের লুট করে। এই মেয়েটাও হয়তো সে রকমই কোন কাফেলা থেকে লুট কৃত।
সে মেয়েটার পাশে বসে মোলায়েম কন্ঠে বললো, ‘তুমি মুসলমান হলে বল। তোমাকে কি কোন কাফেলা থেকে ছিনাতাই করে আনা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, আমি তোমাকে সব বলে দিই আর তুমি সম্রাটের কাছে গিয়ে সব ফাঁস করে দাও আর বলো যে আমি মুসলিম গোয়েন্দা। তুমি তোমার এই পবিত্র ক্রুশে হাত রেখে বলো যে, তুমি আমাকে ধোঁকা দিবে না। সম্রাটকে সব বলে দেবে না। তাহলে আমি তোমাকে সব খুলে বলব।’ লিলি বললো।
সায়বল বুঝলো মেয়েটা কি বলতে চায়। সে তার ক্রুশের মালা ছিড়ে ফেলে বললো কোন মুসলমান ক্রুশের উপর হাত রেখে শপথ করতে পারে না।
লিলি বিশ্বাস করতে পারলো না এই ঘটনা। কোন খৃস্টান সে যতই বেদ্বীনই হোক না কেন, সে ক্রুশের এমন অবমাননা সহ্য করতে পারবেনা। লিলি সায়বলের মুখের দিকে তাকালো যাতে পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও বুঝা যায়। সায়বলের নিশ্চিত বিশ্বাস জম্মে গিয়েছিল যে, মেয়েটা মুসলমান। কোন বিপদে হয়ত খৃস্টানদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছে।
‘আমি আমার গোপন কথা তোমার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছি। এখন তুমি বল তুমি কি করে খৃস্টানদের খপ্পড়ে পড়লে?’ সায়বল বললো।
‘আমি এক হজ্জ কাফেলার সাথে হজ্জ শেষে আমার মা বাবার সঙ্গে মিশরে ফিরছিলাম। ক্রাকের সম্রাট আরনাত সেই হজ্জ কাফেলা লুট করে কাফেলার লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করলো। এটা ছিল আজ থেকে চার বছর আগের ঘটনা। সেই সময় আমার বয়স ষোল কি সতের। আমি জানি না আমার মা-বাবা বেঁচে আছেন কিনা? এত লোক মারা পড়লো, কিন্তু আমাকে কেউ মারলো না। এই দুর্ভাগ্য ছাড়াও আরো দুর্ভাগ্য আমার সঙ্গি ছিল। আর তা হলো আমার সৌন্দর্য। আমার রূপের কারনে সম্রাট আমাকে বাছাই করলেন।
আমি এত সুন্দরী না হলে হয়ত অন্য কারো হাতে পড়তাম আর পালাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সম্রাটের নিরাপওা ভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আজ চার বছর পর এই একবার চেষ্টা করলাম, তাও তোমার হাতে পড়লাম। জানি না কি হবে। তবে জীবনের প্রতি আমার মায়া নেই। এর চেয়ে মরন ভালো।’
সায়বল বললো, ‘আমি তো তোমাকে কয়েক বছর এর মধ্যে কখনো বিমর্ষ দেখিনি।’
লিলি বললো, ‘তোমার চাকরী পেতে পেতে ততোদিনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল।
আমি সম্রাটের পা ধরে কত কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু তিনি বলেছেন, ‘আমি রাজ সিংহাসন ছাড়তে পারি, কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না। তোমাকে আমি রাজরানীর মতোই রাখবো।’ সে তার কথা রেখেছে। আমাকে রাজরানীর মতই রেখেছে। কিন্তু সে আমাকে বিয়ে করেনি, আমাকে ধর্ম ত্যাগ করতেও বলেনি। আমাকে শুধু তার আনন্দের সাথী করে রেখেছে।
সে আমার এতই ভক্ত হয়ে গেল যে তার মহলের অন্যান্য সুন্দরী মেয়েদের সাথে আমার শত্রুতা হওয়ার পরও তারা আমার কিছুই করতে পারলো না। সবশেষে আমি আমার এই অবস্থাকে আমি মেনে নিলাম। এছাড়া আমার আর করার কিছুই ছিল না।
তুমি কি এসব কথা সম্রাটকে জানিয়ে দেবে? সম্রাটকে বললে আমাকে কি শাস্তি দিবে?’
সায়বল বললো, ‘আমি তো খৃস্টান না। মুসলমান, তাই বলবো না। সিরিয়া আমার দেশ ও আমার নাম বাকার বিন মুহাম্মদ।’
‘তুমি কি সালাউদ্দিনের গোয়েন্দা? যাদের ব্যাপারে আরনাত আমাকে বলতো যে খৃস্টানদের মতো মুসলমানরাও শত্রু দেশে গোয়েন্দাগিরী করে। আর আমার মুসলমান নাম ছিল কুলসুম।’ লিলি বললো।
‘আমি একজন মুসলমান, আমি তোমাকে ধোঁকা দিবো না। আমি গোয়েন্দা কি না তা জেনে তোমার কাজ নেই। আমি শুধু জানতে চাই, তুমি কি শুধুই পালাতে চাও নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যও আছে?’
‘বিরাট উদ্দেশ্য আছে। তুমি কি জানো আক্রার পাদ্রী কেন সমস্ত বড় বড় খৃস্টান সম্রাটদের এখানে একত্রিত করেছেন? রাতে আরনাত আমাকে বললো, আমি অনেক বড় দেশের রানী হবো। সালাউদ্দিন নাকি তাদের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে।
আমি খুশির ভান করে প্রশ্ন করলাম, ‘কিভাবে?’ সে বললো, ‘আমরা এবার নিজেদের সব বিভেদ ভুলে সবাই একসাথে ক্রুশ ছুয়ে সালাউদ্দিনের সাথে যু্দ্ধ করার পণ করেছি। আর এবার আমরা সালাউদ্দিনকে আগে আক্রমণ করার সুযোগ দিবো। ফলে তার নিজস্ব এলাকা সে ছেড়ে আসবে আর তার রসদপত্র পৌঁছানোর পথ দীর্ঘ হয়ে যাবে। আর এই সুযোগে কোন এক জায়গায় আক্রমণ করে তার রসদপত্রের যোগান বন্ধ করে দেওয়া হবে।
যদি সুলতান আইয়ুবী নিজের থেকে দীর্ঘদিন ধরেও আক্রমণ না করেন, তবে সবাই একসাথে আক্রমণ করে তার সাঙ্গলীলা ভঙ্গ করা হবে। আর নয়তো তারা একযোগে মক্কা ও মদীনা অভিমুখে অভিযান করে শহর দুটো দখল করে নিবে। তাদের ধারনা, এতে সারা দুনিয়া থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে যাবে।’
‘তোমার মনে হঠাৎ এটা মনে হলো কেন যে এটা সুলতান আইয়ুবীকে জানাতে হবে। যদি বলি তুমি আরনাতের আদেশেই এটা সুলতান আইয়ূবীকে দিতে যাচ্ছো তাহলে কি উত্তর দিবে?’ বাকার বিন মুহাম্মদ বললো।
‘তোমাকে এখন এতই বোকা মনে হচ্ছে যে এতক্ষন যে মনে হচ্ছিল তুমি একজন মুসলমান গোয়েন্দা, সেই বিশ্বাসের অপমান করতে হচ্ছে। যদি আইয়ুবীকে বিভ্রান্ত করাই আরনাতের উদ্দেশ্য হতো তাহলে নিশ্চই অন্য উপায় অবলম্বন করতেন। আর যদি আমাকেই বেছে নিতেন, তবে তিনি নিজেই আমাকে গাড়ীতে করে মুসলিম এলাকায় পৌঁছে দিতেন।
শোন বাকার, আমি তোমাকে প্রথম তীর মেরেছিলাম আমার ইচ্ছাতেই। আর এই ইচ্ছাটা হঠাৎ করেই আমার মাথায় এসেছিল। আমি তো নিখাদ ভ্রমনই করতাম, তুমিইতো আমাকে শিকারের জন্য তীর ধনুক এনে দিলে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম বর্ডারের দূরত্ব। কারন এটাই আপাতত আমার জানা দরকার ছিল।
তুমি যখন বললে কয়েক মাইল পরেই বর্ডার, তখন আমার মনে পালাবার চিন্তা আসলো। প্রথমে মনে করেছিলাম, লোভ দেখাবো তোমাকে। পরে যখন তোমার বিশস্ততার কথা মাথায় আসলো তখন ভাবলাম তুমি আমাকে সাহায্য করবে না। উল্টো আমাকে মুসলিম গোয়েন্দা বলে সম্রাটের কাছে ধরিয়ে দেবে এবং অনেক পুরস্কার জিতবে। ঠিক তখনি আমার মাথায় তোমাকে খুন করার কথা ধরা দিল।
তুমি তখন গাছের সাথে আমার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ, আমি ভাবলাম এটাই তো মহাসুযোগ। তোমাকে মেরে তোমার দেখানো পথে পালিয়ে যাবো। আমার প্রথম তীর লক্ষভ্রষ্ট হলো আমার আবেগের কারনে। জীবনে এই প্রথম নিজ হাতে কোন মানুষ মারতে যাচ্ছিলাম। এরপর যখন তুমি টের পেয়ে গেলে তখনো আমার হুঁশ হলো না যে, তোমাকে বলি, ভুলক্রমে ছুটে গেছে। তাহলে তুমি সহজেই বিশ্বাস করতে। কারন তুমি জানো যে আমি তীর চালাতে জানি না।
এই রকম ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা হলো না। উল্টো নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলাম।’
বাকার বললো, ‘তোমার কি এর আগে কখনো পালানোর চিন্তা মাথায় এসেছিল?’
কুলসুম বললো, ‘প্রথম দিকে সারাক্ষনই আমার মাথায় তাই ঘুরপাক খেতো। কিভাবে এখান থেকে পালানো যায়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও কোন বুদ্ধি বের করতে পারিনি।
একবার একটা সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল যখন সুলতান আইয়ুবী ক্রাক অবরোধ করেছিলেন। তখন তিনি গোলা নিক্ষেপ করে শহরের বিশেষ ক্ষতি সাধন করেছিলেন। আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে, যদি আমাদের বাহিনী শহরে প্রবেশ করে তবে আরনাতকে নিজ হাতে হত্যা করে আমাদের কাফেলা লুট করার প্রতিশোধ নিবো।
কিন্তু আরনাত সুলতান আইয়ুবীর সাথে সন্ধি করায় আমার ইচ্ছা দমে গেল। সে আমাকে বললো, ‘আইয়ুঢ়বীকে বোকা বানিয়েছি। আমি তাকে ওয়াদা দিয়েছি যে আমি আর হজ্জ কাফেলা লুট করবো না। আর আগামীতে তার সাথেও আর কোন যুদ্ধ করবো না।’
তখন আমার মনে খুব দুঃখ হলো যে, আমাকে উদ্ধার না করে সুলতান আইয়ুবীর ফিরে যাওয়া উচিত হয়নি।’
‘সুলতান আইয়ুবীর আরো বড় লক্ষ্য আছে। তিনি আমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে দুশমনের হাত থেকে উদ্ধার করতে চান। যদি সুলতান আইয়ুবী প্রত্যেকটি মুসলমান মেয়েকে উদ্ধার করতে চান, তবে তিনি তার লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে চলে যাবেন। দ্বীন ও স্বদেশ যখন বিপদগ্রস্থ হয় তখন জাতির সন্তানদের বিভিন্নভাবে কোরবানী দিতে হয়। মুজাহিদরা কোরবানী দিচ্ছে একভাবে, আর তুমি কোরবানী দিচ্ছ আরেকভাবে।’ বাকার বললো।
‘আমি মুসলমানের মেয়ে হওয়ায় আরনাতের এক বিশ্রি অভ্যাস সহ্য করতে পারছি না। সে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শানে খুবই বেয়াদবী করে। সে একথাও বলে, সুলতান আইয়ুবী প্রথম কেবলা উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে আর আমরা চেষ্টা করছি কাবা শরীফ ধ্বংস করে সেখানে গির্জা বানাতে।’ কুলসুম বললো।
ক্রুসেডারদের এমন সংকল্পের কথা ইউরোপের ঐতিহাসিকরাও উল্লেখ করেছেন। ক্রুসেড বাহিনী সম্মিলিত শক্তি নিয়ে কাবা শরীফ ও রাসুলের রওজা মোবারক ধ্বংস করারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহর নিজস্ব মদদে মক্কা ও মদীনার মুসলমানরা তাদের রুখে দেয় রাসুলের রওজা মোবারক হেফাজত করে।
ক্রাকের যে অবরোধ সুলতান আইয়ুবী করেছিলেন এবং এক মাস পরে তা উঠিয়ে নিয়েছিলেন সেটাও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার কারণ এ নয় যে, আরনাত যুদ্ধ না করার ও হাজীদের কাফেলা লুট না করার অঙ্গিকার করেছিলো। সুলতান আইয়ুবী ভালো করেই জানতেন খৃস্টানরা ওয়াদা ভঙ্গে ওস্তাদ। অবরোধ উঠানোর আসল কারন ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের প্রস্তুতিতে ভীষন ব্যস্ততা।
আরনাত সে চুক্তি করার দুই বছর পর হাজীদের আর একটি কাফেলা লুট করেছিল। তার চুক্তির মেয়াদ ছিল ১১৮৮ সাল পর্যন্ত।
সুলতান আইয়ুবী ১১৮৭ সালে হাতিন এলাকার দিকে অভিযান চালান। তিনি এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই দামেশক থেকে বের হন, তিনি নিজ হাতে আরনাতকে হত্যা করবেন।
অপরদিকে খৃস্টানরা তাকে শেষ করার জন্য আক্রার পাদ্রীর আহবানে নসিবায় মিলিত হয়ে শপথ গ্রহন করল। একটি রক্তাক্ত ও চূড়ান্ত সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত উভয়েই। সুলতান আইয়ুবী সব জেনেও হাতিনের দিকে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন।
সমাপ্ত
Leave a Reply