ক্রুসেড সিরিজ ২৪. – সামনে বৈরুত
আসাদ বিন হাফিজ
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ এর ‘ঈমানদীপ্ত দাস্তান’ এর ছায়া অবলম্বনে রচিত
ভূমিকা
রহস্য সিরিজ ক্রুসেড; ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হাজার বছর ধরে চলছে এ ক্রুসেড। গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
কেবল সশস্ত্র সংঘাত নয়, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সে যুদ্ধ ছিল সর্বপ্লাবী। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল খৃস্টানরা। একে একে লোমহর্ষক অসংখ্য সংঘাত ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিয়েছিল মদ ও নেশার দ্রব্য। বেহায়াপনা আর চরিত্র হননের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর শহর-গ্রামে। একদিকে সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে কুটিল সাংস্কৃতিক হামলা- এ দু’য়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল মুসলিম বীর শ্রেষ্ঠরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও স্বাসরুদ্ধকর ঘটনার, মানুষের কল্পনাকেও যা হার মানায়।
.
.
বৈরুত।
খৃস্টান বাহিনীর দুর্ভেদ্য দুর্গ। পর পর দু’বার মুসলমানদের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর সম্রাট বিলডন এখনেই এসে আস্তানা গেড়েছেন। প্রথম পরাজিত হয়েছিলেন সুলতান তকিউদ্দিনের কাছে। তারপর সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে প্রান হাতে সেইযে ছুটতে শুরু করেছিলেন, বৈরুত পৌঁছার আগ পর্যন্ত আর কোথাও থামার সাহস পাননি।
সুলতান তকিউদ্দিনের হাতে পরাজিত হওয়ার পর ছত্রভঙ্গ বাহিনীকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে তিনি যখন পালাচ্ছিলেন, রাগে দুঃখে তার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। এই রাগ ও ক্ষোভ দমন করার জন্য তিনি নিরীহ মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের পথ বেছে নিলেন। পালাবার পথে যেসব মুসলমান গ্রাম ও বস্তি পড়লো সেগুলোতে নির্বিচার ধ্বংস চালাতে চালাতে এগুচ্ছিলেন তিনি।
হেমসে সীমাহীন ধ্বংসযঞ্জ চালিয়ে তিনি আরো পূর্বদিকে সরে এলেন। একদিন ইবনে লাউনের দুর্গম এক পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নেয়ার সময় তিনি এক অযাচিত ও অভুতপূর্ব খবরে পুলকিত হয়ে উঠলেন।
তিনি জানতে পারলেন, সুলতান আইয়ুবী অতর্কিতে এসে ইবনে লাউনের ওপর চড়াও হন এবং ইবনে লাউনকে পরজিত করেন। কিন্তু ইবনে লাউনের বশ্যতা আদায় করে তাকে আবার তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তিনি এখন এই পাহাড়ের উল্টা পাশে নির্বিঘ্নে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
সুলতান আইয়ুবীর ওপর প্রতিশোধ নেয়ার এটাই মোক্ষম সুযোগ। কারন সুলতান আইয়ুবী জানেন, আশেপাশে তাকে চ্যালেন্জ করার মত আর কেউ নেই। পাহাড়ের উল্টো পাশে শত্রুর বাহিনী ওঁৎ পেতে আছে একথা তার জানার কথা নয়। যদি জানতেন তাহলে এমন অলস ভঙ্গিতে এখানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতেন না।
বিলডনের এ চিন্তায় কোন ভুল ছিল না। আসলেও সুলতান এদের সম্বন্ধে কিছু জানতেন না। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে? খৃস্টানদেরই এক স্পাই মেয়ের প্রেমের পরিনতি যে এভাবে মুসলমানদের রক্ষা করবে কে জানতো!
সম্রাট বিলডন মেয়েটির প্রেমিক মুসলিম যুবকটির ওপর যখন নির্যাতন চালাচ্ছিলেন তখন মেয়েটি গোপনে তাকে উদ্ধার করে বলল, ‘যাও! পালিয়ে যাও! পাহাড়ের ওপারে সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী বিশ্রাম নিচ্ছে। তাকে গিয়ে বল, বিলডন তার বাহিনী নিয়ে আপনার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজের জাতিকে বাঁচাও, নিজে বাঁচ। যাও এক্ষুনি পালাও তুমি!’
এভাবেই সুলতান আইয়ুবী এক ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে বেঁচে যান। তার পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। সুলতান এমন ফাঁদ পাতলেন যে, তাতে অল্পের জন্য বিলডন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও তার বাহিনী পুরোপুরি তচনচ ও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
বৈরুত ফিরেই এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাগল হয়ে হয়ে উঠেন বিলডন। দুশ্চিন্তায় রাতে তার ঘুম হয়না। গভীর রাত জেগে পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা করেন। নিজের শক্তিকে সুসংহত করার জন্য শুরু করেন কুটনৈতিক তৎপরতা। অল্প সময়ের মধ্যেই আস সালেহকে নিজের দলে টেনে নিতে সমর্থ হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, আসসালেহ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অগ্রসর হওয়ার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যান।
এদিকে সুলতান আইয়ুবীর গতিবিধি ও তৎপরতার খবর নেয়ার জন্য নতুন করে কায়রোতে জাদরেল গোয়েন্দা পাঠালেন বিলডন। ঠিক এই সময় ইসহাক তুর্কী বৈরুত পৌঁছালো।
ইসহাক বৈরুত পৌঁছেই বিলডনের হাইকমান্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার উপাই খুঁজতে শুরু করলো। কারন বিলডনের মূল পরিকল্পনা জানার এছাড়া আর কোন উপায় নেই।
তুরস্কের বাসিন্দা ইসহাক তুর্কী ছিল ফর্সা চেহারার এক সুদর্শন সাস্হ্যবান যুবক। ঘোড় সওয়ারে সে যেমন পটু ছিল তেমনি তীরন্দাজী এবং তলোয়ার চালনায়ও তার সমকক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর ছিল। সব রকমের কমান্ডো প্রশিক্ষণ ছাড়াও তার সহজাত এমন কিছু গুন ছিল যা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। সে ছিল মিষ্টভাষী এবং লোক পটানোয় ওস্তাদ। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখে এক ধরনের সম্মোহনী শক্তি খেলা করতো, যে কারনে মানুষ সহজেই তার বশীভূত হয়ে যেতো।
সে তার সঙ্গীদের বলতো ‘মানুষের মাথার চাইতে বড় কোন অস্ত্র আজো আবিষ্কৃত হয়নি। একজন মুজাহিদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র তার ঈমান ও মগজ। যদি এ দুটো অস্ত্র তুমি ঠিকমত ব্যবহার করতে পারো, তবে দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই যে, তোমাকে পরাজিত করে।’
সেই ইসহাক বৈরুত এসেই মানুষের চোখে পড়ে গেল এবং নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে লাগলো। সে নিজেকে দূরের এক মুসলিম অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান বলে পরিচয় দিল। এতে লোকের সহানুভূতি আদায় করা তার জন্য সহজ হয়ে গেল।
সে বৈরুত পৌঁছেই দেখতে পেল, সেখনে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যপক প্রস্তুতি চলছে।নতুন সৈন্য ভর্তির জন্য মহা সমারোহে চলছে নানা ধরনের খেলা। সৈন্যরা নানা রকম শারীরিক কসরত, কুস্তি, অসির লড়াই, তীরন্দাজী, বর্শা ছোঁড়ার প্রতিযোগীতা এসব করে যুবকদের আকৃষ্ট করতো সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে।
একদিন ইসহাক তুর্কী তেমনি এক খেলার মাঠে গিয়ে হাজির হল। সেখানে তখন চলছিল অশ্বারোহীদের প্রতিযোগীতা। দুই অশ্বারোহী মাঠের দুই প্রান্তে সংকেতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই বর্শা হাতে ছুটে যাবে একে অন্যে দিকে।
মঞ্চে সম্রাট বিলডনের উর্ধতন সামরিক অফিসাররা বসা। মাঠের এক প্রান্তে মঞ্চ সাজানো হয়েছে।
যথাসময়ে সংকেত প্রদান করতেই প্রতিযোগীরা পরস্পরের দিকে ছুটে এলো মুক্ত বর্শা উঁচিয়ে। কিন্তু প্রথমবার কেউ কাউকে কাঁবু করতে পারলনা।
প্রতিযোগী দুই অশ্বারোহীই লোহার শিরস্ত্রান ও বর্ম পরিহিত। মাঠের চারপাশে লোকে লোকারণ্য। তারা রুদ্ধশ্বাসে উপভোগ করছে এক লোমহর্ষক খেলা।
প্রথম রাউন্ডে কেউ কাউকে ফেলতে না পেরে উভয়েই পরস্পরকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল কিছু দূর। তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আবার ছুটল প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে।
এবার বর্শায় ঠোকাঠুকি হল ঠিকই কিন্তু এবারও কেউ ধরাশায়ী হলোনা।
তৃতীয় রাউন্ডে দু’জনেই আবার মাঠের দুই প্রান্তে চলে গেল এবং সেখান থেকে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে ছুটে এলো পরস্পরের দিকে। কাছাকাছি হতেই দেখা গেল চোখের পলকে একজন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
দর্শকরা প্রচন্ড হাততালিতে মাতিয়ে তুলল মাঠ। সেনাবাহিনীর অফিসাররাও উল্লাসিত।
দর্শকদের উল্লাস কিছুটা কমলে বিজয়ী অশ্বারোহী বর্শা উঁচিয় বলল, ‘আর কেউ আছো, যে আমাকে চ্যালেন্জ করবে?’
লাফিয়ে মাঠে নামলো আরেকজন। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই সে ধরাশায়ী হলো। এরপর একে একে আরো কয়েকজন তাকে চ্যালেন্জ করে ব্যর্থ হলো।
এই অশ্বারোহী ছিল বিলডনের এক উচ্চাভিলাষী নাইট। এবার যখন সে তাকে চ্যালেন্জ করার জন্য আহবান জানালো, তখন কেউ আর মাঠে নামল না।
বিজয়ীর বেশে অশ্বারোহী এগিয়ে আসছিল মঞ্চের দিকে, এ সময় এক অভাবিত ঘটনা ঘটলো। হাজার হাজার দর্শককে অবাক করে দিয়ে খালি হাতে মাঠে নেমে গেল ইসহাক তুর্কী এবং তাকে চ্যালেন্জ করে বসলো।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সামরিক অফিসার এবং দর্শকবৃন্দ। তারা ভেবে পেল না, মরু বেদুঈনের পোষাক পরা এই বুদ্দু কেন মরতে যাচ্ছে।
কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক তাকে পাগল ভেবে মাঠ থেকে সরাতে গেল, কিন্তু সে তাদের উপেক্ষা করে বুক টান করে দাঁড়িয়ে গেল সেই অশ্বারোহীর বিরুদ্ধে। দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মরতে দাও পাগলটাকে। আমরা ওর খেলা দেখতে চাই।’
অগত্যা স্বেচ্ছাসেবকরা ফিরে গেল। কিন্তু অশ্বারোহী তার চ্যালেন্জ গ্রহন না করেই ফিরে যাচ্ছিল। এ সময় সেই নাইটের বন্ধুদের মধ্য থেকে কোন একজন অফিসার চেঁচিয়ে বলল, ‘এক বুদ্দুর চ্যালেন্জ গ্রহন না করেই ফিরে যাচ্ছ কেন? ওকে লড়াই করার স্বাদ একটু চাখতে দাও। ওকে বর্শার আগায় গেঁথে নিয়ে এসো।’
অন্য একজন বললো, ‘সে তোমাকে অপমান করেছে। আমরা চাই তুমি এই অপমানের প্রতিশোধ নাও।’
‘তুমি এক বুদ্দুকে ভয় পেলে নাকি? পালাচ্ছ কেন?’
এবার ফিরে দাঁড়াল অশ্বারোহী। মাঠের মাঝামাঝি থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে মামুলি গতিতে ইসহাকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বর্শা দিয়ে তাকে গাঁথতে গেল। কিন্তু একপাশে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল ইসহাক।
দর্শকরা হাততালি দিতে গিয়েও গুটিয়ে নিল হাত। অশ্বারোহী আবার ঘোড়া ছুটিয়ে মাঠের মাঝখানে চলে গেল। এবার বেশ জোরেই ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো ইসহাকের দিকে। কিন্তু এবারও অপূর্ব দক্ষতায় আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হল ইসহাক।
অশ্বারোহী এবার ক্ষেপে গেল। সে ঘোড়া মধ্য মাঠে নিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে এল ইসহাকের দিকে। ইসহাকের কাছে এসেই সে বর্শার আঘাত হানলো ইসহাকের গায়ে। ইসহাক খপ করে বর্শা চেপে ধরে এমনভাবে ঘোড়ার সাথে দৌড়ে গেল যে, লোকজন ভাবল, বর্শাবিদ্ধ হয়েই সে ঘোড়ার সাথে ছুটছে।
লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়ে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু সে কেবল ক্ষনিকের জন্য। মুহূর্তেই ওরা দেখল, বর্শার হেঁচকা টান খেয়ে অশ্বারোহী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
ইসহাক বর্শা মাটিত বিদ্ধ করে রেখে এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে তুলল। অশ্বারোহী উঠেই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দের জন্য। ইসহাক তার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, ‘সত্যি আমি লড়তে চাই। আমাকে একটি ঘোড়া ও বর্শা দাও।’
অশ্বারোহীর ইঙ্গিতে এক স্বেচ্ছাসেবক তার জন্য ঘোড়া ও বর্শা নিয়ে এলো। দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল খেলার চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য।
উভয়ে খেলার নিয়ম অনুসারে মাঠের দুই প্রান্তে চলে গেল। একদিকে শিরস্ত্রান ও বর্ম পরিহত এক নাইট, অন্যদিকে আত্মরক্ষার ন্যুনতম সুবিধা বঞ্চিত এক বেদুইন। দর্শকরা নিশ্চিত ছিল, এই গ্রাম্য লোকটির আজ অবধআিত মৃত্যু ঘটবে।
খেলা শুরু হল। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই দু’জন ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। নাইট ইসহাকের কাছকাছি হয়েই তার পেট বরাবর বর্শা দিয়ে আঘাত করলো।
ইসহাক কৌশলে ঘোড়ার ওপর শুয়ে পড়ে সে আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সামান্য এগিয়েই ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরে এলো। নাইটও আবার হামলা করার জন্য ছুটে এল তার দিকে। কিন্তু ইসহাকের ক্ষিপ্রতার কাছে হার মানতে হলো তাকে।
ইসহাক দ্রুত ছুটে এসে নাইটের পাঁজরে আঘাত করলো। বর্ম থাকায় নাইট তাতে বিদ্ধ হলো না ঠিক, কিন্তু বর্শার প্রচন্ড ধাক্কা সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল।
নাইটের একটি পা রেকাবে আটকা পড়ে গিয়েছিল। ফলে ঘোড়া তাকে টেনে নিয়েই ছোটে যাচ্ছিল। যদি নাইটের গায়ে বর্ম না থাকত তবে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যেতো।
ইসহাক চকিতে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নাইটের এ অবস্থা দেখে ছুটে গেল তার কাছে। তারপর ছুটন্ত ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তাকে থমিয়ে দিল। এরপর ইসহাক লাফিয়ে নেমে নাইটকে টেনে তুলল।
নাইট উঠে দাঁড়িয়েই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘সত্য করে বলো তো, তুমি কে?’
ইসহাক বললো, ‘আমি মুসলিম এলাকা থেকে পলাতক এক খৃস্টান। নাম রবার্ট।’
‘তুমি কি করো?’
‘এখন কিছু করিনা। তবে আমি মুসলমানদের সেনাবাহিনিতে ছিলাম। আমাদের এলাকায় মুসলমানদের আধিপত্য ছিল। তারা আমাকে এবং আমার মত অন্যান্য খৃস্টান যুবকদের জোর করে সেনাবাহীনিতে ভর্তি করে নিয়েছিল।
ট্রেনিং শেষে যখন আমাদেরকে খৃস্টান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলা হলো তখন এক রাতে আমি সেখান থেকে পালিয়ে দেশান্তরী হলাম।
এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলা না। একজন নিষ্ঠাবান খৃস্টান হয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। আবার সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে দেশে থাকারও কোন উপায় ছিল না।’
‘এখানে কি করছো?’
‘এখনো কিছ করছি না। চাকরীর সন্ধানে আছি। কোথাও রুজি-রোজগারের সামান্য ব্যবস্থা করতে পারলেই দেশ থেকে বিবি বাচ্চাদের নিয়ে আসবো ভাবছি।’
এই নাইট ছিল সম্রাট বিলডনের সামরিক বিভাগের এক প্রভাবশালী অফিসার। খৃস্টান সামরিক বাহিনীতে নাইট একটি সম্মানিত খেতাব। যারা এই খেতাব অর্জন করে, সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তারা পায় বিশেষ ধরনের শিরস্ত্রান ও বর্ম। সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক তাদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করা হয়।
এসব নাইটরা হয় সাহসী ও বীর যোদ্ধা। সাধারন খৃস্টানরা নাইটদের যেমন অতি সম্মানিত মনে করেন তেমনি সম্রাটও তাদের যথেষ্ট মূল্য দেন। তারা কোন ব্যাপারে মতামত দিলে সম্রাট তাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নেন, এমনকি কখনো কখনো নিজের মতামত পরিবর্তন করে তাদের পরামর্শ গ্রহন করে নেন।
ইসহাক তুর্কী বর্ম ও শিরস্ত্রান ছাড়াই এক নাইটকে পরাজিত করায় তার সামরিক যোগ্যতা সম্পর্কে নাইট উচ্চ ধারনা করতে বাধ্য হলো। পৃথিবী চিরকালই বীরভোগ্যা। তাছাড়া সে নাইটকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তাই নাইট তাকে সহজেই বন্ধু হিসাবে গ্রহন করে বললো, ‘চলো, আজ থেকে তুমি আমার মেহমান।’
নাইট তাকে তার বাড়ীতে নিয়ে গেল। সেখানে তার প্রচুর আপ্যায়ন হলো। খাওয়া দাওয়ার পর নাইট নতুন বন্ধুর জন্য উৎকৃষ্ট মদ ও মদের পাত্র নিয়ে হাজির হলো ইসহাকের সামনে।
মুসলমান গোয়ন্দাদের জন্য এটা এক মহা সমস্যা। খৃস্টান অঞ্চলে গিয়ে প্রয়োজনের খাতিরেই তাদেরকে খৃস্টান সাজতে হয়। উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক লোকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর সাথে মেলামেশা করতে হয়। এদের কাছে মদ পানির মতই নির্দোষ পানীয়।
খৃস্টান সমাজে মেহমানদারীর অপরিহার্য অনুসঙ্গ মদ। কিন্তু ইসলামে মদ হারাম। তাই কোন সচেতন মুসলমান মদ স্পর্শও করতে পারেনা। আবার মদ পান না করেও এমন পরিবেশে আত্মরক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এমন জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে অনেক গোয়েন্দাকেই নানা রকম টালবাহানার আশ্রয় নিতে হয়। অনেকে আবার টালবাহানা করতে গিয়ে ধরাও পড়ে যায়। কারন খৃস্টানরা জানে, নিষ্ঠাবান মুসলমানেরা কখনও মদ পান করেনা। কেউ মদ পান করতে অস্বীকৃতি জানালে ওরা সহজেই বুঝে ফেলে, এ লোক মুসলমান।
বিষয়টি একবার সুলতান আইয়ুবীর গোচরে আনা হয়। সুলতান বললেন, কোন হারাম জিনিসকে হালাল করার সাধ্য আমার নেই। গোয়েন্দা বলেই কাউকে আমি মদ পান করার অনুমতি দিতে পারি না। একবার মদ পান করতে শুরু করলে পরে তা অভ্যসে পরিনত হয়ে যায়। মদ মানুষের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি লোপ করে দেয়। তাই গোয়েন্দাদের কঠোরভাবে মদ থেকে দূরে থাকতে হবে। তবে জীবনের আশঙ্কা দেখা দিলে সে যদি ততটুকু পান করে, যতটুকু পান করলে জীবন রক্ষা পায় তাহলে হয়তো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতেও পারেন।’
ইসহাক তুর্কী এমনি এক সমস্যায় পড়ে গেল। কিন্তু সে ছিল মজবুত ঈমানের অধিকারী। তাই মদের পেয়ালা হাতে না নিয়ে সে কৌশলের আশ্রয় নিল। বললো, ‘আপনি তো আমার শক্তি ও কৌশল দেখেছেন। এর মূল কারন, আমি মদ পান করি না। আমার ওস্তাদ আমাকে বলেছিলেন, ‘যেদিন তুমি মদ স্পর্শ করবে সেদিনই এ শক্তি ও কৌশল থেকে তুমি বঞ্চিত হবে। তোমার ঘোড়া অনুভব করবে, তার ওপর বসে আছে এক দুর্বল সওয়ারী। তখন ঘোড়া তোমার আদেশ মানতে শৈথিল্য দেখাবে।’
ইসহাক তার গলায় ঝুলানো ক্রুশটি টেনে বের করে তাতে চুমু খেয়ে বললো, ‘আমি এই ক্রুশ ছুঁয়ে সেদিন শপথ করেছিলাম, জীবনে আর কখনো মদ পান করবো না। সেই থেকে মদ পান আমি ছেড়ে দিয়েছি। দয়া করে আমাকে আমার শপথ থকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করবেন না।’
‘তুমি কোথায় থাকো?’
‘এখনো কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা জোগাড় করতে পারিনি। প্রভু সহায় হলে অচিরেই কোথাও ঠিকানা একটা জোগাড় করে নিতে পারবো আশা করি।’
প্রভু তোমার সহায় আছেন। ঠিকানা নিয়ে আর তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার চাকরীর জিম্মা আমি নিচ্ছি।’
‘কিসের চাকরী?’ জানতে চাইল ইসহাক।
‘তোমাকে আমাদের সেনা বাহিনীতেই দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তা দেব না। আমি তোমাকে আমার বন্ধু এবং রক্ষী হিসাবে চাই।’
‘এ তো আমার জন্য এক অভাবিত ব্যাপার! আপনার অশেষ মেহেরবানী যে, আপনি আমাকে আপনার সঙ্গ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
‘মেহেরবানী বলছো কেন আমাদের মত নাইটদের একাধিক বডিগার্ড রাখার অনুমতি আছে। কিন্তু সজ্জন ব্যক্তির অভাবে এতদিন আমি এক বডিগার্ড দিয়েই কাজ চালিয়ে এসেছি। আমি তোমার মত গুনীর উপযুক্ত সম্মান দিতে চাই। তুমি রাজি থাকলে তুমিই হবে আমার বিশ্বস্ত সহচর ও রক্ষী।
তোমার থাকা খাওয়া এবং উপযুক্ত বেতন ভাতার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমার।’
‘আপনার মত গুনী ব্যক্তির সান্বিধ্যে থাকতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।’
এভাবেই বৈরুতে ইসহাক তুর্কীর কাজের যাত্রা শুরু হয়।
সে যুগটা ছিল যোদ্ধাদের। ইসহাকের মত বীর যোদ্ধার কদর ও সম্মান ছিল সর্বত্র। নাইট খুব খুশির সাথেই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। তাকে দিল তেজস্বী আরবী ঘোড়া। দিল প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম। নির্ধারন করলো তার যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন-ভাতা, যেন এ নিয়ে তার মনে কোন খেদ না থকে।
এবার ইসহাক তুর্কীর যোগ্যতা প্রদর্শনের পালা। আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দূরন্ত সাহস আর চমৎকার মেধা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা। তার অমায়িক ব্যবহার, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও দুর্বার সম্মোহনী শক্তি দু’দিনেই সেই নাইটকে ইসহাকের বিশ্বস্ত ও অনুগত বানিয়ে দিল। এবার নিজের কাজে মন দিল ইসহাক।
‘আমার শুধু একটিই আশা।’ একদিন রাতে কথাচ্ছলে সে নাইটকে বললো, ‘মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস যেমন আজ আমাদের দখলে তেমনি তাদের পবিত্র কাবাঘরও যদি আমরা দখল করে নিতে পারতাম! সারা দুনিয়া জয় করার চেয়েও এটা আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। একবার কাবায় ক্রুশের আধিপত্য কায়েম হলে দুনিয়া হতে ইসলাম এমনিতেই বিলীন হয়ে যাবে।’
‘তুমি এক বিরাট স্বপ্নের কথা বলেছ বন্ধু। প্রতিটি ক্রুসেডারের মনেই হয়তো কখনো কখনো এ স্বপ্ন তার চিন্তার অগোচরেই জেগে উঠে।’ নাইট বললো, ‘কিন্তু এ স্বপ্ন সফল করা খুব সহজ নয়। মুসলমানদের পরাজিত করা কতটা কঠিন সে অভিজ্ঞতা তোমার নেই, থাকলে এমন কথ বলতে না। কাবায় ক্রুশের পতাকা উড়ুক আমিও চাই। কিন্তু কাবায় আঘাত হানা আর ভিমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়া একই কথা। তুমি জানো না, কাবায় আঘাত হানলে শুধু আরবের মুসলমানরা নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর। এমন স্বপ্ন-বিলাস থাকা ভাল, তবে তা কোথাও প্রকাশ করো না।
আমরা সবাই মিলে যেখানে এক সালাউদ্দীন আইয়ুবীকেই পরাজিত করতে পারছিনা, সেখানে সারা দুনিয়ার মুসলিম শক্তিকে ক্ষেপিয়ে তোলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপাতত এসব ভাববিলাস বাদ দিয়ে আইয়ুবির ব্যাপারটা ফায়সালা করো।’
‘আপনারা এখনো মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারনা নিয়েই বসে আছেন।’ ইসহাক তুর্কী বললো, ‘মুসলমান সমাজের বর্তমান চিত্র জানা থাকলে এমন কথা বলতেন না। এখন আর মুসলমানদের মধ্যে সেই ঐক্যের বাঁধন নেই, যা তাদেরকে অপারাজেয় করে রেখেছিল। সেই ঈমানও নেই, যে ঈমান তাদের নিরাপত্তা ও জামিনের রক্ষাকবচ। আমাদের গোয়েন্দারা প্রটিতি মুসলমানের বিবেক থেকে ঈমানের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বুক ঝাঝরা করে দিয়েছে। খোলস ছাড়া তার ভেতরে কোন প্রানের স্পন্দন নেই।
কেন, হলবের শাসক ইয়াজউদ্দীন আর মুসেলের শাসক ইমামউদ্দিন কি আমাদের বন্ধু নয়? আমাদের সামান্য সহযোগিতা করার সুযোগ পেলে তারা কি নিজেদের ধন্য মনে করবে না? আমি বর্তমান মুসলিম সমাজের যে ছবি দেখে এসেছি তা যদি আপনাকে বলি আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন। লোভ, লালসা ও পরচর্চায় তারা এমন মশগুল যে, আপনি যদি কাউকে নিজের ভাইয়ের বুকে ছুরি চালাতে বলেন, তাতেও সে রাজি হয়ে যাবে। তাহলে শুনুন, তারা কতটা অধপাতে নেমেছে।’
ইসহাক তুর্কী নাইটের সামনে মুসলিম সমাজের এমন এক ছবি তুলে ধরলো যে, নাইট বিস্মিত হয়ে বললো, ‘বলো কি?’
ইসহাক তুর্কী বললো, ‘এ জন্যই তো আমি কাবাঘর দখলের স্বপ্ন দেখি। আপনি যদি আমার পরিকল্পনার কথা শোনেন তাহলে আর আমাকে পাগল ভাববেন না।’
‘শুনি তোমার সেই উর্বর পরিকল্পনাটা কি?’
ইসহাক তার সামনে এক অভাবিত পরিকল্পনা পেশ করলো। এ এমন এক পরিকল্পনা, যা কেবল কোন জেনারেল পেশ করলেই মানায়।
ইসাহকের কথায় নাইটের জবান খুলে গেল। নাইট ভাবল, যে পরিকল্পনা আমরা একদল নাইট দীর্ঘদিন বসে বসে সম্মিলিতভাবে করেছি, সেই রকম একটি পরিকল্পনা যে রক্ষী গল্প করতে করতে বলে ফেলতে পারে তাকে অবশ্যই শ্রদ্ধা জানাতে হয়।
নাইট তার পরিকল্পনা ও পরামর্শ শুনে তাজ্জব হয়ে বললো, ‘তুমি আমাকে অভিভুত করার মত বুদ্ধি রাখো। আমরা তো এমন একটা পরিকল্পনার কথায় ভাবছিলাম, যার সাথে তোমার চিন্তা ও সংকল্প হুবহু মিলে যাচ্ছে।’
তাহলে আর দেরী করবেন না। সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মত কমান্ডো বাহিনী গঠন করুন। ইসলামের উঁচু মাথা ভোতা করে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।’
‘ঠিক আছে, বিষয়টি নিয়ে আমি সম্রাট বিলডনের সাথে কথা বলে দেখি।’
‘এখানে আর দেখাদেখির কিছু নেই। আমার কথাটা একটু গুরুত্বের সাথে বুঝার চেষ্টা করুন।’ ইসহাক বললো, ‘আমার হাতে একটি কমান্ডো বাহিনী দিন আমি মুসলমানদের সামরিক ঘাঁটির অবস্থান জানি। জানি কোথায় রাখে তারা যুদ্ধের অস্ত্র ও সরঞ্জাম। আমি তাদের খাদ্য গুদামের খবর জানি। ঘোড়ার আস্তাবল চিনি। এদিকে যেদিন যুদ্ধ শুরু হবে তার পরের দিন শোনবেন তাদের খাদ্য, অস্ত্রসম্ভার ও বাহনাদি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ, এমনটিই করা হবে।’ নাইট বললো, ‘আমরা তোমাকে সুযোগ দেবো।’
* * *
‘আমি তোমাকে শামসুন নেছার সাথে কথা বলতে দেখেছি।’ উনুশী আমের বিন উসমানকে বলল, ‘এই মেয়েটি কি আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী?’
ওরা তখন মুশেলে। শামসুন নেছার অনুরোধে আমের পরিকল্পিতভাবে মেয়েটির প্রেমের ফাঁদে পা দেয়ার অভিনয় করছিল। মধ্য রাতের একটু পরে উনুশী পা টিপে টিপে আমেরের কামরায় এসে প্রবেশ করলো। তার চোখে মুখে অনুযোগের কালিমা।
‘ওই মেয়ের কথা আর বলো না! ‘আমেরও বিরক্তির স্বরে জওয়াব দিল, ‘সে শাহজাদী আমাকে তার চাকর মনে করে। যখন তখন আমার ওপর হুকুম চালায়। সে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আমাকে সেই হুকুম মানতে বাধ্য করে।’
আমের না থেমে বলেই চললো, ‘তোমাকেও আমি ভয় পাই। কারন তোমাকেও আমি শাহজাদীর মতই ক্ষমতাবান মনে করি। অবশ্য শান্তনা এতটুকু, ভালবাসার অধিকার দিয়ে তুমি সে ভয় কিছুটা দূর করেছো। তারপরও আমার ভয় যায় না। কত রকম ভয় যে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়!
কখনো ভাবি, তুমি আমাকে পুতুল বানিয়ে খেলছো না তো? আবার ভাবি, যদি কোন সামরিক অফিসার আমাদের অভিসারের খবর জেনে যায় তাহলে কারাগারের কোন অন্ধ প্রকোষ্ঠে আমার ঠিকানা হবে?’
‘যদি কেউ তোমাকে কারাগারে পাঠায় তবে জেনে রেখো, মুশেলের প্রতিটি ইট তার বুকে গিয়ে আঘাত হানবে।’
উনুশী আমেরের একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আবেগ ভরা কন্ঠে বললো, ‘তুমি ভাবছো আমি তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছি। এ ব্যাপারে তোমাকে আমি কি বলবো! আমি নিজেই তো এক মোহন ধোঁকা। আমার অস্তিত্ব এক অনুপম ধোঁকা ছাড়া আর কি! কেউ কি আমাকে মানুষ মনে করে! সবাই ভাবে পরী। পরী তো উড়াল দেবেই। তাই কেউ তাকে আপন ভাবে না। তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, তুমি আমাকে অন্ততঃ একটু রক্ত-মাংসের মানুষ মনে করো। আমাকে তোমার সেবা করার সামান্য সুযোগ দাও।’
উনুশী আপনভোলা মানুষের মতই পড়েছিল আমেরের কোলের ওপর। সে তখন হারিয়ে গিয়েছিল আমেরের মাঝে। তার হাতের চাপাকলির মত আঙ্গুলগুলো বিলি কাটছিল আমেরের চুলে। উনুশী তাকে উজাড় করে আমেরের হাতে সঁপে দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু আমেরের অবস্থা ছিল ভিন্ন।
আমের ছিল অবিবাহিত এক তরুণ যুবক। তার সুগঠিত শরীর ও অঙ্গসৌষ্ঠব প্রথম নজরেই যুবতীদের দৃষ্টি কেড়ে নিত। কিন্তু সে ছিল এক মুমিন মুসলমান। সে তার ঈমানের হেফাজতের জন্য মনে মনে বার বার আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছিল। মনে মনে বলছিল, ‘আয় বারিতালা, তুমি আমাকে ধৈর্য ও সংযম দাও। এই কঠিন পরীক্ষায় আমাকে টিকে থাকার শক্তি দাও।’
উনুশীর স্পর্শে যখনি তার মনে হতো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে, তখনি সে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা শুরু করে দিত।
চাঁদ গড়িয়ে গড়িয়ে ক্রমে দূরে সরে গেল। শেষ হয়ে এলো উত্তাপহীন রাতের আয়ু। তারাগুলো ক্রমে নিস্তেজ হয়ে গেল। আমরের কোল থেকে মাথা তুলে প্রেমে মাতাল উনুশী বেরিয়ে গেল কামরার বাইরে।
উনুশীর সমগ্র সত্ত্বায় জড়িয়েছিল আমেরের অস্তিত্বের নেশা। সেই নেশার ঘোরে পর পর কয়েক রাত সে আমেরের কামরায় কাটিয়ে দিল। আর তখনি সে উপলব্ধি করলো, তার সারা জীবনের সব অভিজ্ঞতা সব ভুল। পুরুষ মাত্রই পশু নয়, এখনো পৃথিবীতে এমন পুরুষ আছে, যাদের মানুষ হিসাবে গণ্য করা যায়।
উনুশীর জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ জীবনে সে এমন আর একজন পুরুষও পায়নি, যার মধ্যে ভোগের তৃষ্ণা ছিল না। আগুনের কাছে মোম যেমন গলে যায়, আলো দেখলেই তাতে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে পতঙ্গ, তেমনি তার রুপের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাদশাহ থেকে ফকির সবাই। তাদের চোখে সে দেখেছে কামনার লেলিহান শিখা। কিন্তু আমের এক ব্যতিক্রমী পুরুষ। তার চোখের তারায় আছে মায়ার অঞ্জন, কিন্তু কামনার লেশমাত্র নেই সেখানে।
উনুশী ভেবে পায় না, কি করে এমনটি সম্ভব? সে এক নারী এবং অভিঞ্জ নারী। পুরুষ মানুষের রক্তের গতিও সে টের পায়। পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারে তার অন্তরের গহীন গোপন খবর। কিন্তু সত্যি কি পারে? না, পারে না। অন্তত আমেরের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কোন কাজে লাগেনি তার। সে টের পেতো তার স্পর্শে আমেরের রক্তে অদ্ভুদ এক ভূকম্পন শুরু হয়ে গেছে। যে ভূকম্পন শুরু হলে পুরুষ মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে। তখন সে আর মানুষ থাকে না, পশু হয়ে যায়। কিন্তু কি এক আশ্চার্য ক্ষমতাবলে আমের অদ্ভুত দক্ষতায় নিজের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এনে তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে, ‘আমার আর এসব মুসলমান আমীর ও শাসকদের মোটেই ভাল লাগে না। এরা শাসক নয় শোষক। জনগনের রক্ত শোষন করে এরা শুধু অত্যাচার আর ভোগ বিলাসেই মত্ত থাকে।’
‘আমারও এদের প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে। এরা চরিত্রহীন, লম্পট। এদের অন্তরে একরত্তি মায়া মমতা নেই। তাদের সব ভালবাসা গিলে ফেলেছে মদ ও গদির মোহ।’
আমের আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় তার উদ্দেশ্যের দিকে। বলে, ‘খৃস্টান শাসকদের আমি কোনদিন দেখিনি। তবে আমার মনে হয় তারা আমাদের শাসকদের চেয়ে অবশ্যই ভাল হবে।’
উনুশী বলে, ‘তারা ভাল হলেই কি মন্দ হলেই কি! গাছে খেজুর রেখে গোঁফে তা দিয়ে লাভ কি, বলো?
‘কেন, এমন কি হতে পারে না, লড়াই করতে করতে একদিন তারা এখানেও এসে পড়লো। মুসলমানদের সাথে তাদের তো হামেশাই লড়াই হচ্ছে। যদি এমন কখনো হয় তবে মনে রেখো, আমি দল ত্যাগ করে তাদের আশ্রয়ে চলে যাবো।’
এভাবেই একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছিল আমের বিন উসমান। প্রশ্ন করে করে জেনে নিচ্ছিল উনুশীর বুকে লুকিয়ে থাকা গোপন খবর।
এদিকে উনুশীও কোন আহাম্মক মেয়ে ছিল না। সে প্রকৃতিগতভাবেই ছিল বেশ চালাক চতুর। তার ওপর গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর জন্য সে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে এখানে এসেছিল। কিন্তু মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে, যখন তার বুদ্ধি বিবেক সকল কিছু লোপ পেয়ে যায়। তখন সে সাধারণ মানুষের চেয়েও সাধারণ হয়ে যায়। সে এমন সব ভুল করে বসে, যা কোন স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে না। যে উনুশী চোখের ইশারায় রাজা-বাদশাহদেরকেও নিজের পুতুল বানানোর ক্ষমতা রাখতো সেই উনুশী নিজেই পুতুল সেজে বসেছিল। আমের বিন উসমান সেই পুতুলের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছিল প্রয়োজনীয় সব গোপন তথ্য। মানুষের অন্তর সব সময়ই পবিত্র প্রেমের কাঙাল থাকে। মানুষের কাছে মানুষ একান্তভাবে যে জিনিসটি চায় তার নাম ভালবাসা। ভোগের সমুদ্রে ডুবে থাকলেও এ তৃষ্ণা তাতে নিবারণ হয় না। ভোগে তৃপ্তি খোঁজে মানুষ কিন্তু ভোগ মানুষের মনে অতৃপ্তি আরো বাড়িয়ে তোলে। উনুশী ভুগছিল সেই অতৃপ্তিতে। পবিত্র প্রেমের তৃষ্ণায় আকুল হয়েছিল তার অন্তর। আমেরের পবিত্রতা তাকে আমেরের গোলাম বানিয়ে দিল। এক রাতে সে নিজেকে মেলে ধরলো আমেরের কাছে। আমেরের পাতা জালে পা দিয়ে ফাঁস করে দিল সব গোপন তথ্য। সে কি মিশন নিয়ে এখানে অবস্থান করছে অকপটে বলে দিল তা।
আমের তাদের ষড়যন্ত্রের কাহিনী শুনে শিউরে উঠল। সে এতদিন কল্পনাও করতে পারেনি, মুসলমানদের সামনে কতটা ভয়ংকর ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।
উনুশী তখনো তার কোলে মাথা রেখে বলে যাচ্ছে তার জীবন কাহিনী। সে ভুলে গেছে খৃস্টানরা তাকে এখানে কি কঠিন দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে। কারন সে তখন কোন গোয়েন্দা ছিলনা, ছিল না কোন ষড়যন্ত্রকারী। সে তখন নিরেট এক প্রেমিকা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
মদের নেশা কতটা তীব্র হয় সে অভিজ্ঞতা ছিল উনুশীর, কিন্তু ভালবাসার নেশা কতটা তীব্র হত পারে সে সম্পর্কে তার কোন ধারনাই ছিল না। সুদানী পরী গ্রামের এক সহজ সহজ বালিকার মত নিজেকে মেলে ধরেছিল আপন প্রেমিকের কাছে।
রাত শেষ হয়ে এলো। উনুশী তার বুকের সমস্ত গোপন তথ্য আমেরের বুকে ঢেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেল ইসহাক তুর্কী বৈরুত এসেছে। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সে পুরোপুরি সচেতন। ইতোমধ্যে সে খৃস্টান নাইটের বিশ্বস্ত বন্ধুতে পরিনত হয়ে গেছে। নাইটের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে খৃস্টানদের পরিকল্পনা সম্পর্কে সে এমন সব তথ্য অনায়াসে পেতে লাগলো, স্বাভাবিক অবস্থায় যা সংগ্রহ করতে তা প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হতো।
সে জানতে পারল, এই নাইট সম্রাট বিলডনের সেনাবাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা। ব্যক্তিগতভাবে এ নাইট খুবই উচ্চাভিলাষী। তার ইচ্ছা, আগামী লড়াইতে সে এমন দক্ষতা প্রদর্শন করবে, যাতে তার ওপর কোন এলাকার শাসনভার অর্পন করতে সম্রাট বাধ্য হন। সে ভাবেই তিনি তার বাহিনীকে সাজাচ্ছিলেন। আর তার এ কাজে তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করছিল ইসহাক তুর্কী।
এই নাইট একবারও চিন্তা করলো না, কোন সাধারণ সৈনিকের পক্ষে এমন নৈপুন্য প্রদর্শন এবং এমন দূরদর্শী আচরণ করা সম্ভব নয়। একজন অপরিচিত লোককে বন্ধু বানিয়ে নেয়া এবং তার কাছে নিজের এবং সেই সাথে সম্রাট বিলডনের সামরিক পরিকল্পনা প্রকাশ করে দেয়াটা সঙ্গত হবে না, এমন চিন্তাও তার মাথায় জাগেনি কখনো।
লোকটি যদি বেশি উচ্চাভিলাষী না হতো এবং ক্ষমতা লাভের নেশায় অন্ধ না হতো তাহলে ইসহাকের তৎপরতায় তার মনে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক ছিল। তখন সে ভাবতো, এ লোক মুসলমানদের গোয়েন্দা নয়তো?
কিন্তু উনুশীর মতো চৌকস গোয়েন্দা যেভাবে মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতার বশে অসহায় হয়ে আমেরের দাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, উচ্চাভিলাষে সেই নাইটও তেমনি ইসহাক তুর্কীর চিন্তাধারার কাছে অসহায় হয়ে পড়লো।
একদিন রাতে হঠাৎ নাইট ইসহাক তুর্কীকে ডেকে বললো, ‘তৈরী হয়ে নাও, অনেক দূরের পথে যাত্রা করতে হবে।’
ইসহাক তুর্কী সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে বললো, ‘আমি তৈরী।’
নাইট ইসহাক তুর্কীকে নিয়ে বৈরুত থেকে বেরিয়ে এলো। ইসহাক তুর্কী জানতে চাইল, ‘কোথায় যাবেন?’
নাইট বললো, ‘চলো, যেতে যেতে বলছি।’
শহর থেকে বেরিয়ে এল দুই অশ্বারোহী। নাইট বললো, ‘দ্রুত পথ চলতে হবে আমাদের। আমাদের বাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। অনেক দূর এগিয়ে গেছে তারা। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ওদের থামতে বলেছি। ওদেরকে ময়দানে সাজিয়ে দিয়েই আবার আমরা ফিরে আসবো।’
নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ইসহাক তুর্কী দেখতে পেলো, নাইটের অশ্বারোহী বাহিনী ও পদাতিক বাহিনী নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা কেউ ক্যাম্প করেনি, বরং পরবর্তী হুকুমের জন্য সটান দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নাইটের জন্য।
নাইট বিভিন্ন বাহিনীর কমান্ডার ও তার অধীনস্ত অন্যান্য নাইটদের ডেকে সৈন্যদের থেকে পৃথক এক জায়গায় জড়ো করলো। তারপর তাদের কে কোথায় অবস্থান করবে এবং কার কি দায়িত্ব একে একে সব বুঝিয়ে দিল।
সব শেষে বললো, ‘তোমাদের যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হলো এবং যাকে যে স্থানে অবস্থান নিতে বলা হলো আশা করি তোমরা তা বুঝতে পেরেছো। এ ব্যাপারে কারো কিছু আর জানার আছে?’
এক নাইট বললো, ‘না। তবে কতদিন এখানে আমাদের থাকতে হতে পারে?’
নাইট বললো, ‘সেটা অনিশ্চিত। তবে একমাস বা তারো কিছু বেশিদিন থাকতে হতে পারে তোমাদের। কায়রো থেকে আজই আমাদের এক গোয়েন্দা এসেছে। তার কাছ থেকে আমরা নিশ্চিত খবর পেয়েছি, সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী সরাসরি বৈরুত অবরোধ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন।
আমাদের ধারনা ছিল, প্রথমে তিনি দামেশকে আসবেন। সেখান থেকে যাবেন হলব ও মুশেলে, নিজের বাহিনীর সাথে সেখানকার সৈন্য শামিল করে নিতে। তারপর সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে তিনি আমাদের মোকাবেলায় আসবেন।
কিন্তু গোয়েন্দা নির্ভরযোগ্য তথ্যের বরাত দিয়ে বলেছে, হলব ও মুশেলের বাহিনীকে গাদ্দারী করার সুযোগ তিনি দিবেন না। তিনি তাদেরকে আর আস্থায় নিতে পারছেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রথমেই তিনি বৈরুত আঘাত হানবেন। এরপর বৈরুত থেকে ফিরে গিয়ে গাদ্দার মুসলমান শাসকদের শায়েস্তা করবেন তিনি।
যদি এমন নিশ্চিত খবর পাওয়া না যেত তবে বৈরুতেই আমরা তার মোকাবেলা করতাম। আমাদের মিত্র মুসলিম শাসক, যাদের সাথে আমাদের গোপন চুক্তি হয়েছে, সময় মতো তারা আইয়ুবীকে পিঠ দেখিয়ে সরে পড়তো। কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়তো যুদ্ধে।
আইয়ুবী হুশিয়ার লোক। তাই সে আমাদের পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েছে যুদ্ধের ছক। সে সরাসরি আমাদের অবরোধ করতে ছুটে আসছে।
তোমরা জানো, আইয়ুবীর অবরোধ মানেই এক ভয়ংকর ব্যাপার। অবরোধ করার পর সে একটি কথাতেই দাঁড়িয়ে থাকে, ‘অস্ত্র সমর্পন করো এবং আনুগত্য মেনে নাও’। এ ছাড়া আর কোন শর্তই তার মুখে আসেনা এবং কানেও ঢোকে না। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় এবার আমরা আগেভাগেই তার অভিযানের খবর পেয়ে গেছি।’
ইসহাক মনযোগ দিয়ে নাইটের কথা শুনছিল। সে কথা শুনছিল আর ভেতরে ভেতরে ঘামছিল। সে খুবই অবাক হলো এই ভেবে, তাহলে মুসলিম বাহিনীতেও তারই মত গোয়েন্দারা ঢুকে পড়েছে? কিন্তু আলী বিন সুফিয়েনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তা কি করে সম্ভব।
ইসহাক তুর্কী জানে, মুসলমানদের মধ্যে গাদ্দারের অভাব নেই। অর্থ, সম্পদ আর ক্ষমতার মোহে ঈমান বিকিয়ে দেয়া লোকের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী কখনো এই জাতীয় লোকদের কাছে ঘেঁষতে দেন না। বিশেষ করে আলী বিন সুফিয়ানের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ফাঁস করে দেয়ার মত অবস্থানে কখনোই কোন লোক যেতে পারে না।
ইসহাক তুর্কী এ খবর শুনে দ্রুত কায়রো পৌঁছার জন্য পেরেশান হয়ে উঠলো। তার ইচ্ছে করছিল, এখনি এখান থেকে একটি ঘোড়া নিয়ে সে ছুটে পালায়। আইয়ুবী যদি সত্যি সত্যি সরাসরি বৈরুত অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তবে খৃস্টানরা এখানে যে প্রস্তুতি নিচ্ছে সে খবর এখনি তার জানা দরকার। নইলে তিনি রমলার মত বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়বেন।
নাইট তখন বলছে, ‘এই সংবাদ আমাদের হাতে এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে। এতদিন আইয়ুবী আমাদের ওপর কমান্ডো হামলা চালাতো, এবার তার কৌশল আমরা তার ওপরই প্রয়োগ করবো। বৈরুতের চারদিকে আমরা তার জন্য ওঁৎ পেতে থাকবো। এরই মধ্যে আমাদের বাহিনী বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীকেও দূর দূরান্তে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু আমরা সুলতানের বাহিনীকে স্বাগত জানাবো না। সুলতানকে স্বাগত জানাবে বৈরুতে আমাদের সে সামান্য সৈন্য থাকবে, তারা। তারা শহরের ফটক বন্ধ করে ভেতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। আর অামরা তখন সুলতান যেভাবে অতর্কীতে আমাদের বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি ঝাঁপিয়ে পড়বো। চারদিক থেকে সুলতানকে এবার পিষে মারবো।’
এক কমান্ডার প্রশ্ন করলো, ‘জনাব, এটা কি জানতে পেরেছেন, তিনি কোন দিক থেকে আসছেন?’
‘এখনও নিশ্চিতভাবে তা জানা যায়নি।’ নাইট বললো, ‘তবে সমর বিশেষজ্ঞরা অধিকাংশই ধারনা করছেন, তিনি এদিক দিয়েই ঝুঁকিটা নেবেন।’
‘আমাদের সামনে দিয়ে তিনি যখন তার বাহিনী নিয়ে যাবেন, তখন কি আমরা তাকে কিছুই বলবনা?’ এক নাইট দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘না।’ সম্রাট বিলডন নির্দেশ দিয়েছেন, রাস্তায় তাকে কোন বাধা দেয়া যাবে না। তাকে পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। তাকে অনেক ভেতরে আসার সুযোগ দিতে হবে এমনকি বৈরুতের উপকন্ঠে যেতে দিতে হবে তাকে। কারণ এবার আমরা তাকে পিষে মারতে চাই।’
‘আপনার তো জানা আছে, বৈরুত ভূমধ্যসাগর তীরে অবস্থিত। আমি যতদূর জানি, সুলতানের নৌবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী। যদি তারা নৌপথে আক্রমন করে?’
‘হ্যাঁ, তিনি নৌবাহিনীও ব্যবহার করতে পারেন।’ নাইট বললো, ‘সে অবস্থায় আমাদের করণীয় কি তা নিয়েও আমাদের মাঝে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নৌ পথে আমরা তাকে বাধা দেব না।
তাকে আমরা সাগর তীরে নামার সুযোগ করে দেব। তারপর এমনভাবে তাদের জাহাজগুলো ধ্বংস করবো বা ধ্বংস না করে দখল করে নেবো, যাতে তারা আর ওই পথে পালিয়ে যেতে না পারে।’
এরপর নাইট উপস্থিত কমান্ডারদের উদ্দেশ্য করে বললো, ‘বন্ধুগন, তোমরা জানো, যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের বিস্তারিত পরিকল্পনা জানানোর নিয়ম নেই। আইয়ুবীর ওখানে যেমন আমাদের গোয়েন্দা আছে, তেমনি আমাদের এখানেও আইয়ুবীর গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। সৈন্যদের মুখের কথা সুলতানের কানে চলে যাবে।
তাই তোমাদেরকে সৈন্যদের থেকে আলাদা করে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে দিলাম। এতে তোমাদের নিজস্ব পদ্ধতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন সহজ হবে।
কিন্তু সৈন্যদের কাছ থেকে এ পরিকল্পনা গোপন রাখতে হবে। সুলতান এ পরিকল্পনার কথা জানতে পারলে তিনি যুদ্ধের ছক আবার পাল্টে ফেলবেন। তাতে আমাদের এ প্রস্তুতি মাঠে মারা যাবে।’
‘আপনার কি জানা আছে, যেসব মুসলমান শাসক আমাদের সাথে গোপন চুক্তি করেছেন তারা এ অবস্থায় কি ভাবছেন? তারা আবার বিগড়ে যাবে নাতো?’
‘তাদের দিক আমাদের কোন ভয় নেই।’ নাইট বললো, ‘হলবের শাসক এখন মুশেলে এসে গেছে আর মুশেলের শাসক গিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে হলবের। তাদের এ পরিবর্তন আমাদের ইচ্ছানুসারেই হয়েছে। সেখানকার অবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রনে আছে।
বরং এমন আশাও করা যায়, আমরা যদি চাই তবে ওইসব শাসকরা গোপনে তাদের সৈন্য আমাদের বাহিনীতে দিয়ে দেবেন। সুতরাং সুলতান আইয়ুবী এবার মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাচ্ছে না, এ ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত থাকতে পারো।’
পরের দিন। ইসহাক তুর্কীকে আজ খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবীকে কিভাবে ঘায়েল করবে এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা পেশ করছিল নাইটের সামনে। নাইটও উৎফুল্ল। ইসহাক তুর্কী খুবই সন্তুষ্ট নাইটের তৎপরতায়। আইয়ুবীকে এবার সে এক হাত দেখে নেবে।
সে এই আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে নাইটকে বললো, ‘এতদিনে আমার আশা পূরনের একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো। আপনার পরিকল্পনার কোন জুড়ি হয় না। এবার ঘুঘুকে ফাঁদে পড়তেই হবে।’
কথায় কথায় ইসহাক তুর্কী নাইটের কাছ থেকে আরো কিছু তথ্য আদায় করে নিল। নাইট টেরও পেল না, সে নিজের অজান্তে একজন সতর্ক গোয়েন্দার হাতে তুলে দিচ্ছে অমূল্য তথ্য।
উৎসাহের সাথে তথ্য আদায় শেষ হতেই চিন্তায় পড়ে গেল ইসহাক তুর্কী। দ্রুত এ খবর কায়রো পাঠানো দরকার। এখানে আর এমন কেউ নেই, যাকে এ দায়িত্ব দেয়া যায়। যেতে হলে তাকেই যেতে হবে এবং রওনা করতে হবে এখুনি।
প্রথমে মনে হলো, পালিয়ে যায়। এটা তেমন কঠিন কোন কাজ নয় একজন গোয়েন্দার জন্য। কিন্তু তখনি মনে হলো, পালিয়ে যাওযার সাথে সাথেই নাইট বুজে ফেলবে, সে একজন গোয়েন্দা ছিল। তখন তারা তাদের পরিকল্পনা পাল্টে ফেলবে। এরপর তারা কি পরিকল্পনা নেয় সে তথ্য জানা না থাকলে আইয়ুবীকে আবার অন্ধকারে পথ চলতে হবে। অর্থাৎ এখন সুলতান যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই থাকতে হবে তাকে। সুলতানকে এ অবস্থায় ফেলা কিছুতেই ঠিক হবে না।
হঠাৎ তার মাথায় এক বুদ্ধি কেলে গেল। সে ভাবলো, নাইটকে তো আগেই জানিয়েছি, আমি আমার পরিবার দেশে ছেড়ে এসেছি। ওদের বলে এসেছি, কোথাও একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারলেই তোমাদের এসে নিয়ে যাবো। এখন তো আমার ঠিকানা হয়ে গেছে। তাছাড়া তাদেরকে এখন বের করে আনতে না পারলে মুসলমানরা তাদের ওপর নির্যাতন চালাতে পারে। অতএব, যুদ্ধের আগেই ওদেরকে আমি এখানে নিয়ে আসতে চাই।
সে নাইটকে বললো, ‘দেখুন,এক-আধ মাস পরেই আমরা বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি। তখন ময়দান ছেড়ে বাড়ী যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এমনও তো হতে পারে, যুদ্ধে আমি মারা যেতে পারি। তাই আমি চাচ্ছিলাম, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ওদেরকে এখানে নিয়ে আসি। যাতে আমার মৃত্যুর পর মুসলমানরা আমার স্ত্রী-কন্যাদের লাঞ্ছিত করতে না পারে।’
বাহানাটা ন্যায়সঙ্গত ছিল। নাইট নিজেও দু’দিন আগে ওকে বলেছিল, ‘রবার্ট, এবার তোমার বউ-বাচ্চাদের কাছে নিয়ে এসো।’
তাই তার কথা শুনে নাইট বিন্দুমাত্র সন্দেহ করলোনা। বরং বললো, ‘তাহলে দেরী না করে আজই রওয়ানা হয়ে যাও এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এসো।’
ইসহাক তুর্কীর তাড়া নাইটের চাইতে অনেক বেশি ছিল। সে আর কাল বিলম্ব না করে নাইটের দেয়া তাজাদম আরবী ঘোড়া নিয়ে তখনি কায়রোর উদ্দেশ্যে বৈরুত ত্যাগ করলো।
ইসহাক তুর্কী ভাবছিল, কায়রো যাওয়ার আগে তার হলব ও মুশেল যাওয়া দরকার। সেখানকার সর্বশেষ অবস্থা কি এটা যেমন জানা দরকার তেমনি হলবে গিয়ে তার রিপোর্ট করাও দরকার। কারণ তার উর্ধতন গোয়েন্দা অফিসার হলবেই অবস্থান করছেন।
হলবের কথা মনে হতেই তার মনে পড়ে গেল মহিয়সী রাজিয়া খাতুনের কথা। তার জানা মতে, তিনি এখন হলবেই আছেন। আর তিনি হলবে থাকলে তার দাসীও হলবেই আছে। এই দাসীই তাকে মহলের অভ্যান্তরে কি ঘটছে তার প্রকৃত তথ্য দিতে পারবে।
সে তার অন্যান্য সাথীদের কথা স্মরণ করলো। তারা নিশ্চয়ই বসে নেই। বসে থাকার লোক তারা নয়। ওখানে গিয়ে তাকে নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে না, সাথীদের সাথে দেখা হলেই সব খবর সে পেয়ে যাবে।
অনুমতি পাওয়ার পর আর দেরী করেনি ইসহাক। সে রাতেই বেরিয়ে পড়েছিল। বৈরুত থেকে বেরিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটছিল মুশেলের দিকে।
সে ছিল দক্ষ অশ্বারোহী। ঘোড়াও ছিল বেশ তাজাদম। তার ইচ্ছে করছিল এক মাসের রাস্তা একদিনে অতিক্রম করতে। যদিও তা সম্ভব নয় তবু সে এমন তীব্রগতিতে ছুটছিল, দূরপাল্লার কোন মুসাফির কখনো এমন জোরে ঘোড়া ছুটায় না।
সে পথ চলছিল আর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছিল, সে পৌঁছার আগেই যেন সুলতান আইয়ুবী অভিযানে বেরিয়ে না পড়েন।
ঘোড়া দ্রুত ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও সে পথে থামতে প্রস্তুত ছিল না। সে তখন ঘোড়ার গতি সামান্য কমিয়ে তাকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিত। কিছুক্ষণ পর আবার বাড়িয়ে দিত ঘোড়ার গতি।
একদিন অনেক রাতে ক্লান্ত ঘোড়ার পিঠে বসেছিল ক্লান্ত পথিক। ঘুমে তার চোখ ঢুলুঢুলু করছিল। যখন আর কিছুতেই বসে থাকতে পারলো না, তখন সে চলন্ত ঘোড়ার পিঠের ওপর জিন আঁকড়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমন্ত সওয়ারী পিঠে নিয়ে ঘোড়া একা একাই এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে।
রাত তখনো শেষ হয়নি। এক সময় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে চোখ মেলে দেখলো, অন্ধকার তখনো কাটেনি। সে তড়িঘড়ি উঠে বসে আবার লাগাম তুলে নিল হাতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, ঘোড়া ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।
তারার আলো ম্লান হয়ে এসেছিল। ইসহাক তুর্কী বুঝতে পারলো, রাত আর বেশি বাকি নেই।
ইসহাক তাড়া না করে মামুলি গতিতেই বিরামহীনভাবে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো।
এক সময় অন্ধকার বিদীর্ণ করে ছুটে এলো ভোরের নরম আলো। সুনসান পথঘাট। আশপাশে কোন বস্তি বা লোকালয় নেই, তাই কোথাও থেকে আজানের সুর ভেসে এলো না। কিন্তু ফজরের সময় হয়ে গেছে বলে এক জায়গায় সে ঘোড়া থামিয়ে দিল।
ঘোড়াকে সবুজ ঘাসের স্তুপে ছেড়ে দিয়ে নামাজ আদায় করে নিল ইসহাক। গোড়াটি ঘাস খাচ্ছে দেখে মায়া লাগলো তার, নিজেও একটি গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিল কিছুক্ষণ। এতে একটু বিশ্রাম নেয়ার সময় পেল ঘোড়াটিও।
একটু পর ইসহাক সামান্য কিছু শুকনো খাবার দিয়ে নাস্তা সারলো। নিজে পানি পান করে ঘোড়াটিকেও সামান্য পানি পান করিয়ে আবার চেপে বসলো ঘোড়ার পিঠে।
কড়া রোদ উঠলো। পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে এগিয়ে চললো ঘোড়া। এভাবে অনেক পাহাড়ের টিলা মাড়িয়ে, মরুভূমির প্রান্তর মাড়িয়ে দুর্বার বেগে এগিয়ে চললো ইসহাক তুর্কী।
দিন গড়িয়ে রাত এলো, রাত গড়িয়ে এলো দিন। বিরামহীনভাবে পথ চলতে চলতে একদিন অপারাহ্নে ক্লান্ত মুসাফিরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো মুশেলের মিনার।
খৃস্টান নাইটের দেয়া আরবী ঘোড়ার পিঠে বসে মুশেলের সেই সুউচ্চ মিনারের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো ইসহাক তুর্কী।
ঘোড়ার গতি কমিয়ে দিল ইসহাক। দিনের আলোয় সে শহরে প্রবেশ করতে চায় না। মাগরিবের নামাজের সময় হলে যখন সবাই সান্ধ্য ব্যস্ততা ও নামাজে দাঁড়াবে, মুশেল প্রবেশের জন্য সে ঠিক সেই সময়টি বেছে নিল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। শহরের উপকন্ঠে ঘোড়ার পিঠে বসে সে ভাবছিল, শহরে কোন বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে যায়নি তো? আমাদের ঘাটিটি নিরাপদ ও অক্ষত আছে তো? সোজা সেই মসজিদের দিকে এগিয়ে গেল, যার ইমাম এথানকার গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান।
রাতটি নিরাপদেই কাটলো তার। অনেকদিন পর দেখা হলো পুরনো বন্ধুদের সাথে। তাদের কাছ থেকে সে জেনে নিল শহরের বর্তমান হাল হাকিকত। শাসকদের মনোভাব সম্পর্কেও মোটামুটি একটি ধারনা পেল।
ইচ্ছে ছিল সকালেই এখান থেকে রওনা হয়ে যাবে। সফরের ক্লান্তি দুর করার জন্য যতটা সম্ভব ঘুমিয়ে কাটাবে রাত। সকালে নাস্তা শেষে ঘোড়া পাল্টে আবার পথে নামবে।
কিন্তু সাথীদের কাছ থেকে সে এমন একটি তথ্য পেলো, যা তার চিন্তারও বাইরে ছিল। সে জানতে পারলো, মহিয়সী রাজিয়া খাতুন এখন হলব নয়, মুশেলে অবস্থান করছেন। হলব ও মুশেলের শাসকরা রাজ্য বদল করার কারনে ইয়াজউদ্দীনের সাথে তাকেও মুশেল চল আসতে হয়েছে।
ইসহাক তুর্কী ভেবে দেখলো, রাজিয়া খাতুন মুশেল থাকার অর্থ হচ্ছে, তার দাসীও এখন হলব ছেড়ে মুশেলে চলে এসেছে। এই দাসীর সাথে দেখা না করে তো যাওয়া যায় না!
তাছাড়া সুযোগ পেলে রাজিয়া খাতুনের সাথেও একটু দেখা করতে চায় সে। তিনি কোন পরামর্শ দেন কিনা তা না জেনেই এখান থেকে বিদায় হওয়ার কথা সে ভাবতে পারলো না। ফলে ভোরেই রওনা হওয়ার চিন্তা সে বাদ দিয়ে সে সাথীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘুমুতে চলে গেল।
এতদিনে ইয়াজুদ্দীনের মনে একটি নিশ্চিত ধারনা জন্মেছে যে, রাজিয়া খাতুন তার স্বামীত্বকে বরণ করে নিয়েছে এবং তার বন্যতা মেনে নিয়েছে। কারণ, হলবে সেই যে একদিন তার সাথে তিক্ত কথোপকথন হয়েছিল এরপর থেকে রাজিয়া খাতুন আর কোনদিন রাজনৈতিক ব্যাপারে তাকে কোন প্রশ্ন করেনি এবং অবাধ্যতা দেখায়নি। বরং দু’দিনেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
ইয়াজউদ্দীনের মনে একটি ভয় ছিল, হয়তো হলব থেকে মুশেল আসার ব্যাপারে রাজিয়া খাতুন তাকে প্রশ্ন করবে এবং বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেবে না। কিন্তু ইয়াজউদ্দীন অবাক হয়ে গেল, রাজিয়া খাতুন এটা কেবল মেনেই নেয়নি, বরং তাকে এখন আগের চাইতে সন্তুষ্টচিত্ত দেখাচ্ছে। এতে ইয়াজউদ্দীনও খুশি হলো।
রাজিয়া খাতুন বুদ্ধিমতি মহিলা ছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ইয়াজউদ্দীনকে বিয়ে করেছেন তা সফল হবার নয়। গাদ্দারীর যে রোগে তাকে পেয়েছে তা কোনদিন নিরাময় হবে না। তার সাথে এখন লাগালাগি করতে গেলে বিপদ বরং বাড়বে। এজ্যনই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন এবং নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন।
গাজী সালাউদ্দন আইয়ুবী সর্বত্র গোয়েন্দাদের যে জাল বিছিয়ে রেখেছিলেন তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন তিনি। ইয়াজউদ্দীন তার জন্য যে দাসী নিয়োগ করে রেখেছিলেন সেই দাসী ছিল আইয়ুবীর এক নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা। এই দাসীই তার দুর্দিনে শান্তনার বানী নিয়ে এলো এবং কর্মের এক নতুন পথ তার সামনে মেলে ধরলো
রাজিয়া খাতুনের কন্যা শামসুন নেছা এতদিন রাজমহলে রাজকন্যার মতই নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়েছে। সেই শান্তিময় জীবন থেকে রাজিয়া খাতুন তাকে কঠিন বাস্তবতার ময়দানে টেনে নিয়ে এলেন। যে জগত সম্পর্কে কিছুই জানতো না সে, যে জগতের কোন ধারনাও তার ছিল না, তাকে নিয়ে আসা হলো সেই রহস্যময় জগতের একেবারে কেন্দ্রস্থলে।
এতদিন আমের বিন উসমানকে কেন্দ্র করে সে মনে মনে যে কল্পনার জগত গড়ে তুলেছিল, সেই সাধের পৃথিবী ছেড়ে সে আছড়ে পড়লো এক ঊষর মরুভূমিতে। রাজিয়া খাতুন তার সামনে মেলে ধরলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপি যে ষড়যন্ত্র চলছে তার এক নিখুঁত চিত্র। এ চিত্র দেখে শিউরে উঠলো চির আদরে লালিত এক রাজকন্যা, শামসুন নেছা।
এখন আর সে কোন আদুরে দুলালী নয়, সে হয়ে উঠল জেহাদের জঙ্গী পুরুষ নূরিদ্দীন জঙ্গীর বিপ্লবী চেতনার দোসর। শামসুন নেছা এখন কেবল তাঁর রক্ত সম্বন্ধীয় মেয়ে নয়, তার মানসকন্যাও। রাজিয়া খাতুনের কাছ থেকে বিপ্লবের আহবান পেয়ে মোহের পর্দা ছিঁড়ে জিহাদী জীবন বরণ করে নিল শামসুন নেছা।
অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজিয়া খাতুন তাকে নিবেদিতপ্রাণ এক গোয়েন্দা বানিয়ে নিলেন। গোয়েন্দাগিরিতে নাম লিখিয়েই শামসুন নেছাকে এমন কোরবানী দিতে হলো, পৃথিবীতে কখনো কেউ কাউকে দেয় না। নিজের ভালবাসার জনকে স্বেচ্ছায় ও আপোষে তুলে দিতে হলো এক বদ মেয়ের হাতে।
আমের বিন উসমান উনুশীর কাছ থেকে যেসব গোপন তথ্য বের করে নিয়েছে শামসুন নেছার মাধ্যমে তার সবই জেনে নিয়েছিলেন রাজিয়া খাতুন। তিনি এ সংবাদ অতি দ্রুত কায়রো পাঠানো জরুরী মনে করছিলেন। হলব থেকে আসার সময় দাসী ছাড়াও যে সব গোয়েন্দা তাদের সাথে এসেছিল তিনি তাদের একজনকে বললেন, ‘জরুরী খবর আছে। এ খবর নিয়ে জলদি কায়রো রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।’
মুশেলের গোয়েন্দা প্রধানের কানে গেল এ খবর। তিনি সেই গোয়েন্দাকে বললেন, ‘মোহতারামা রাজিয়া খাতুনকে গিয়ে বলো, ইসহাক তুর্কী নামে আমাদের এক গোয়েন্দাকে বৈরুত পাঠানো হয়েছে। ওখানকার খবর নিয়ে এদিক হয়েই তার কায়রো যাওয়ার কথা। বৈরুতের খবর ছাড়া সব খবরই অসম্পূর্ণ।
আলী বিন সুফিয়ান আমাদের বলে দিয়েছেন, খৃস্টানরা আগামীতে কি পদক্ষেপ গ্রহন করছে তার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু। তাই আমার মনে হয়, ইসহাকের জন্য আরো দু’একদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। যদি তার আসতে খুব বেশি দেরী হয় তবে না হয় আমি এখানকার খবর নিয়েই তোমাকে কায়রো পাঠিয়ে দেবো। উনুশীর দেয়া তথ্যে কোন ফাঁক ছিল না। সে খুব ঝানু গোয়েন্দা ছিল এবং দরবারের সমস্ত আমীরদের সে হাতের ইশারায় নাচাতে পারতো। সে ভাল মতই জানতো, কখন কার সাথে কি ব্যবহার করতে হবে এবং কার কাছ থেকে কি তথ্য বের করে আনতে হবে।
আমের উনুশীর মত দক্ষ গোয়েন্দা না হলেও সে ছিল খুবই দায়িত্ববান লোক। কাজে কর্মে নিষ্ঠা থাকার কারণেই সে এত অল্প বয়সে এত উন্নতি করতে পেরেছে। আমের এমনভাবে উনুশীর সাথে ভালবাসার অভিনয় করছিল যে, উনুশী কখনো তাকে গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করার অবকাশ পায়নি। তাই সে আমেরের কাছে অবলীলায় সব গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়েছিল।
ইয়াজউদ্দীন মাসুদ এখন রাজিয়া খাতুনের ব্যবহারে সন্তুষ্ট। তাই তিনি রাজিয়া খাতুনের মন জুগিয়ে চলার জন্য চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো ওরা বিকেলে শহরের সন্নিকটে শাহী বাগানে বেড়াতে যেতেন। ইয়াজউদ্দীন ব্যস্ত থাকলে রাজিয়া খাতুন কন্যা শামসুন নেছাকে নিয়ে বৈকালিক ভ্রমনে বের হতেন। বাগানটি শহরের বাইরে বলে সবসময়ই তাদের সাথে থাকতো নিরাপত্তা রক্ষী।
ইয়াজউদ্দীন মাসুদ আমের বিন উসমানকে খুব বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি রাজিয়া খাতুনদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমেরের ওপরই দিয়ে রেখেছিলেন। আমের এ দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করছিলো। তারা বাগানে রওনা হলে আমের নিজেও তাদের সাথে বাগানে চলে যেতো।
সেদিনও বিকেলে ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে বাগানের দিকে রওনা দিলেন রাজিয়া খাতুন। সঙ্গে শামসুন নেছা এবং দাসী। রক্ষী হিসাবে তাদের সঙ্গে চললো আমের বিন উসমান।
শহরের পাশেই সবুজ উদ্যানে প্রবেশ করলো তাদের ঘোড়ার গাড়ী। রাজিয়া খাতুন গাড়ী ছেড়ে বাগানে নেমে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে শামসুন নেছা, দাসী এবং আমেরও নেমে তাকে অনুসরণ করলো।
জায়গাটি অতি মনোরম। বাগানের একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী।অন্য পাশে জনগনের চলাচলের রাস্তা।
এ বাগানে জনগনের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র শাহী পরিবারের লোকজন ও মেহমানদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল এ বাগান।
রাজিয়া খাতুন কেবল ভ্রমনের উদ্দেশ্যেই এ বৈকালিক সফরে বের হতেন না। এ সফর থেকে তিনি আরো কিছু ফায়দা হাসিল করে নিতেন। আমের উনুশীর কাছ থেকে যে সব তথ্য সংগ্রহ করতো সে সব তথ্য তিনি জেনে নিতেন এই ফাঁকে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তাদের করণীয় কি হতে পারে তাও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করে নিতেন।
রাজিয়া খাতুন ঝর্ণার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলেন। রাজিয়া খাতুনের পাশে শামসুন নেছা, পেছনে দাসী ও আমের পাশাপাশি।
ওরা যখন বাগানে কথা বলছিল, ইসহাক তুর্কীকে তখন তার এক সঙ্গী বলছিল, ‘তুমি যে দাসীর সাথে দেখা করার জন্য সারাদিন ধরে বসে আছো, সন্ধার পর সে একবার রিপোর্ট করতে আসবে ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছে করলে তার আগেও তুমি তার সাথে দেখা করতে পারো।’
‘কিভাবে?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ইসহাক তুর্কী।
এইমাত্র আমি দেখে এলাম, রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছা শাহী বাগানে বেড়াতে বেরিয়েছে। তাদের সঙ্গে আছে দাসী এবং আমের বিন উসমান নামে এক রক্ষী। এই রক্ষীও গোপনে আমাদের সাহায্য করছে।’
খবরটা ইসহাক তুর্কীকে দারুণভাবে পুলকিত করলো। দাসীর সাথে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে রাজিয়া খাতুনের সাথে একটু দেখা করার ইচ্ছা আগে থেকেই তার মনে উঁকিঝুকি মারছিল। কিন্তু দাসীর সাথে আলাপ না করে এ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ইসহাক তুর্কী আর দেরী করলো না, সঙ্গে সঙ্গে বাগানের দিকে রওনা হয়ে গেল।
রাজিয়া খাতুন ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। শামসুন নেছা এবং দাসীও তার সাথেই ছিল। আমের গত রাতে উনুশীর কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছিল তা ওদেরকে শোনাচ্ছিল।
আমের বলছিল, ‘ইয়াজউদ্দীনের মনোভাব মোটেই সুবিধের নয়। সে এরই মধ্যে সম্রাট বিলডনের সাথে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। প্রকাশ্যে সে সুলতানের সাথে নিজেকে জোটবদ্ধ শক্তি হিসাবেই প্রকাশ করবে। কিন্তু কার্যতঃ সময় মত সে সুলতানকে সহযোগীতা করবে না।
সুলতান রসদ চেয়ে পাঠালে সে প্রতারণা করবে। সেনা চেয়ে পাঠালে বাহানা করে বলবে, ‘আরমেনীয়দের হামলার আশংকায় এমনিতেই আমি অস্থির। তাই একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্বেও এই মুহূর্তে সৈন্য পাঠাতে পারছিন বলে দুঃখিত।’
কথা শেষ হলে ঝরণার পাশ থেকে উঠে এলো আমের। রাজিয়া খাতুন শামসুন নেছা বসে রইল ঝরণার দিকে মুখ করে। দাসীও ওদের সাথেই বসেছিল, একটু পর উঠে ওদের কাছ থেকে সামান্য সরে গিয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখতে লাগলো।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ফুলের সৌন্দর্য দেখছে দাসা, হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো অদ্ভুত এক গানের কলি। তেমন সুরেলা নয়, বোঝাই যাচ্ছে এ লোক পেশাদার কোন গায়ক নয়, কিন্তু বড় দরদ দিয়ে গাইছে গানটি। গানের কথাগুলো নতুন এবং ইঙ্গিতধর্মী। কান পাতলো দাসী। লোকটি তখন গাইছেঃ
আমি এক মরুভূমির যাত্রী
তারার লক্ষ্য পানে ছুটে চলেছি
বহু দূর দেশ থেকে
একবার দেখা পেতে
অনেক কষ্টে আমি ছুটে এসেছি।
বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাই
একবার তব দেখা যদি আমি পাই
এ আশায় আনমনে গেয়ে চলেছি।
ভ্রমনের নাম করে তুমিও এসেছ জানি
লুকিয়ে রেখেছ কি কথার খনি
সে কথা জানতে শুধু ব্যকুল হয়েছি।
আমি এক মরুভুমির যাত্রী
তারার লক্ষ্য পানে বাগানের পাশ ঘেঁষে ছুটে চলেছি।
চমকে উঠল দাসী! এ কেমন কথা! কি কথা জানতে চায় যুবক! কার কাছে জানতে চায়!
সে চোখ তুলে তাকাল বাগানের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেদিকে। তাকিয়েই সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এক যুবক তার দিকেই তাকিয়ে আছে অনিমেষ চোখে। যদিও সে খুব আস্তে ধীরে হাঁটছে, কিন্তু রাস্তার দিকে তার চোখ নেই, মুহূর্তের জন্যও সে চোখ ফেরাচ্ছে না-অন্যদিকে।
দাসী ঝোঁপঝাড়ের আড়াল নিয়ে যুবকের দিকে এগিয়ে গেল। গান শুনেই সে বুঝেছিল, এটা কোন গান নয়। কোন গোয়েন্দা কারো সাথে দেখা করার জন্য এ গানের মাধ্যমে গোপন সংকেত দিচ্ছে। কেউ শুনলে ভাববে, আপনভোলা কোন পথিক আপন মনে গান গাইছে। কিন্তু যাদের গোয়েন্দা কাজের সামান্য অভিজ্ঞতা আছে সেই বুঝবে, এ গান কাউকে ডাকছে।
যুবকটি তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মানে তাকে উদ্দেশ্য করেই এ গান গাইছিল যুবক? কিন্তু কে এই যুবক?
কৌতুহলী দাসী যুবকের আরো কাছে গিয়ে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ ফেললো যুবকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেললো ইসহাককে। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দাসী। ইসহাক বললো, ‘তাড়াতাড়ি শোন, হাতে বেশি সময় নেই।’
দাসী আরো কয়েক কদম এগিয়ে বললো, ‘ভয় নেই, ভেতরে চলে আসুন এবং আমাকে অনুসরণ করুন।
এই বলে দাসী আর দাঁড়াল না, একদিকে হাঁটা দিল। ইসহাক এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে বাগানে ঢুকে গেল এবং কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাসীর পিছে পিছে হাঁটতে লাগলো।
দাসী রাজিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে আস্তে বললো, ‘এদিকে আসুন।’
ওর কন্ঠস্বরে চমকে গেলেন রাজিয়া খাতুন। কিন্তু প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করলেন।
সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। গাছের ছায়ায় জমা হচ্ছিল চাপ চাপ অন্ধকার। দাসী তেমনি এক অন্ধকার ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেল রাজিয়া খাতুনকে। ওখানেই অপেক্ষা করছিল ইসহাক তুর্কী।
রাজিয়া খাতুনকে অনুসরণ করে শামসুন নেছা এবং আমের বিন উসমানও সেখানে পৌঁছে গেল। দাসী বললো, ‘এই হচ্ছে ইসহাক তুর্কী, যার কথা আপনাকে আগেও বলেছি।’
রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘বসো বাছা। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।’
ওরা সেখানে সবাই বসে পড়লো। জায়গাটার চারদিকে ছোট বড় বেশ কয়েকটি ঝোঁপ। দূর থেকে তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। ওরা বাগানের সেই অন্ধকার কোণে বসে আলাপ শুরু করলো।
ইসহাক তুর্কী বললো, ‘আমি জানতাম না আপনি এখানে। এখানে এসেই শুনতে পেলাম, আপনি হলব থেকে মুশেল চলে এসেছেন। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আপনার সাথে দেখা না করে যাবো না আমি। যাক, সহজেই আপনার সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম, সে জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করছি। এবার বলুন, আমার জন্য আপনার কি হুকুম।’
‘তোমাকে হুকুম করবো তেমন অবস্থা আমার নেই। তুমি জানো না, আমি এখন কিভাবে দিন কাটাচ্ছি। মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর কাউকে আমি বিয়ে করবো এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু আমাকে যখন বলা হলো, ইয়াজউদ্দীনকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য আমার তাকে বিয়ে করা দরকার, কেবল ইসলামের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই আমি সে প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম।
কিন্তু আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি, ইয়াজউদ্দীন বিয়ের নামে আমাকে বন্দি করার ফন্দি এঁটেছে। তার ষড়যন্ত্র সে সফল হয়েছে। সে আমাকে তার হেরেমে এনে বন্দি করেছে, যাতে আমি আর দামেশকের জনগনকে জিহাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে না পারি।
মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গী ইসলামকে বিজয়ী করার যে স্বপ্ন দেখতেন, ইয়াজউদ্দীনকে সেই স্বপ্ন পূরনের সেনাপতি বানানোর সংকল্প নিয়ে তার ঘরে এসেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম।
ইয়াজউদ্দীন সুলতান আইয়ুবীর সামরিক জোটে থাকলেও তলে তলে সে যে গাদ্দারীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে, তা আমি বা সুলতান কেউ জানতাম না। তার হেরেমে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি এসবের কিছুই জানতাম না। যখন জানলাম তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না। তবু আল্লাহর শোকর আদায় করি, এই দাসী আইয়ুবীর গোয়েন্দা থাকার ফলে দ্বীনের সামান্য খেদমত করার পথ সে আমার জন্য খুলে দিয়েছে।’
রাজিয়া খাতুনের গলা ধরে এসেছিল। তিনি একটু বিরতি নিয়ে আবার বলতে নুরু করলেন, ‘ইচ্ছে ছিল, ইয়াজউদ্দীনকে সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর দক্ষিণ হস্ত বানাবো। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর সফল উত্তরাধিকারী বানাবো।
কিন্তু সে স্বপ্নের যেদিন মৃত্যু ঘটল, সেদিন নিজেকে সামলাতে পারলাম না, যদি আইয়ুবীর এই গোয়েন্দার সাক্ষাত না পেতাম। আমি তোমাকে এখানকার অবস্থা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি। দ্রুত এ খবর আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দাও, যাতে আমার মত তাকেও ধোঁকায় পড়তে না হয়।’
এরপর তিনি মুশেলের সামগ্রিক পরিস্থিতি ইসহাক তুর্কীর সামনে তুলে ধরলেন।
‘আপনি ইয়াজউদ্দীন ও ইমামউদ্দীনের ওপর কোন ভরসা করবেন না। এরা আমাদের কোন সাহায্য করবে না। আপনি সুলতান আইয়ুবীকে বলবেন, ‘বৈরুত অবরোধের আগে সুলতান যেন হলব ও মুশেলে অভিযান চালিয়ে এইসব গাদ্দারদের আগে শায়েস্তা করেন। এতেই ইসলামের বিরাট খেদমত হবে।’ রাজিয়া খাতুনের কথা শেষ হলে উদ্বিগ্ন শামসুন নেছা আক্ষেপের সুরে বলল।
‘মুসলিম শাসকদের অবস্থা যদি এই হয়, সামান্য লোভ লালসায় পড়ে যদি তারা গাদ্দারীর খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়, তবে আমার ভয় হয়, বায়তুল মুকাদ্দাসের মতো কাবা শরীফও না জানি কবে ইহুদি ও খৃস্টানরা দখল করে নেয়।’ এবার কথা বললো আমের বিন উসমান।
‘এতটা নিরাশ হয়ো না আমের। ইসলামের ইতিহাসে শুধু গাদ্দার নয় মুজাহিদও আছে। নিজের বাপ-দাদাদের ইতিহাসের দিকে তাকাও। যখন শাসকরা দ্বীন ও দেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, মুজাহিদরা বসে থাকেনি, নিজের রক্ত ঢেলে তারা জাতির গৌরব রক্ষা করেছে। তারা অকাতরে রক্ত দিয়েছে, আহত হয়েছে, নিহত হয়েছে। কিন্তু জাতির সম্মান ভূলুন্ঠিত হতে দেয়নি। এ ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।’
এবার মুখ খুললেন রাজিয়া খাতুন, সে আমি জানি বেটা। তবু যখন জাতির বিলাস প্রিয় আমির ও শাসকরা শত্রুদের পাঠানো মদ ও সুন্দরী নারীদের খপ্পরে পড়ে ভুলে যায় জাতির কথা, তখন বড় কষ্ট পাই। যখন দেখি ধনরত্ন ও সম্পদের নিচে চাপা পড়ে যায় মুসলমানদের ঈমান, তখন সে কষ্ট আরো বেড়ে যায়।’
‘শুধু ওদের কথাই বললেন! আপনি কি দেখছেন না আল্লাহর সৈনিকরা দুস্তর মরু, সুউচ্চ পাহাড় আর অথৈ সমুদ্রের বাঁধাকেও থোড়াই তোয়াক্কা করছে? আমাদের প্রিয় নেতা সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী তো পুরোটা জীবনই মরুভূমি ও পাহাড়ে যুদ্ধ করে কাটিয়ে দিলেন।’
‘হ্যাঁ, আমার প্রথম স্বামীও সারা জীবন শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন। কিন্তু এখন যে শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের জ্ঞাতি ভাইয়েরা! যখন তুমি বেঈমান শাসকদের বিরুদ্ধ অস্ত্র ধরবে তখন তারা তোমাদেরকেই জাতির দুষমন ও খুনি বলে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বসবে।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমরা জানি এগুলো নিত্য নতুন ফেৎনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা এসব ফেৎনা ফাসাদের পরোয়া করি না। খৃস্টান ও ইহুদিরা এসব ফেৎনা সৃষ্টি করে আমাদের দুর্বল করতে চাইছে। আমরা এসব ফেৎনার মূল উপড়ে ফেলে জাতির দৃষ্টি থেকে মিথ্যার আবরণ সরিয়ে দেব, আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
‘সাবাস বেটা ! এই তো চাই। তোমরা এসো, এসো ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম বেগে, এসো মরু সাইমুম হয়ে। তুফানের মত সব বাঁধা মাড়িয়ে তোমরা এসো, এসো রহমতের বৃষ্টি ধারার মত। আমি তোমাদের জন্য কেবল দোয়া করবো না। আমিও সেই বৃষ্টি ধারার সামান্য ফোটা হতে চাই। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের জন্য ময়দান পরিষ্কার করে রাখবো। এখানকার প্রতিটি শিশুও তোমার সঙ্গী হবে।’
প্রচন্ড আবেগে তখন তিনি কাঁপছিলেন। চেহারায় খেলা করছিল সাহস ও প্রেরণার জ্যোতি।
ইসহাক তুর্কী আর কথা বাড়াল না, সে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
সে সেই ছায়াঘন জায়গা থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছে, মনে হলো ঝোপের উল্টো দিকে কারো পদধ্বনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। অন্ধকার তখন বেশ চেপে বসেছে, তবু তার মনে হলো ঝোপের ওপাশ দিয়ে একটি ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। সে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেল, ততক্ষনে ছায়াটি ঝোপের মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
এ নিয়ে সে আর খোঁজাখুঁজি করতে গেল না ইসহাক। কারণ কায়রো যাওয়ার চিন্তা তার মনকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, যে প্রকারেই হোক যত দ্রুত সম্ভব তাকে কায়রো পোঁছতে হবে।
সে ওখান থেকে রাস্তায় এসে উঠল। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা রকম চিন্তা, সুলতান আইয়ুবী তো এরই মধ্যে স্বসৈন্যে অভিযানে বেরিয়ে পড়েননি!
এখানকার কাজ তার শেষ। প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সকল সাথীদের সাথেই দেখা হয়েছে। এবার দ্রুত রওনা হতে হয়।
সে যেখানে তার ঘোড়া রেখেছিল সেখানে পৌঁছে গেল। কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো। গন্তব্য তার কায়রো কিন্তু সুলতান যদি হলবের অবস্থা জানতে চান? তাছাড়া তার কমান্ডার হলবে অবস্থান করছেন।
হলবের খবর জানা এবং কমান্ডারকে সব জানানো দু’কারণেই তার হলব যাওয়া জরুরী। পথে নেমেই সে সিদ্ধান্ত নিল, হলব হয়েই সে কায়রো যাবে।
অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে সে হলবে পৌঁছালো। কমান্ডারের দেখা করে সংক্ষেপে খুলে বললো সব কথা। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কমান্ডার তাকে বললো, ‘তুমি সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমি তোমার ঘোড়া পাল্টাবার ব্যবস্থা করছি।’
ইসহাক বিশ্রামে গেল। কমান্ডার তার জন্য উন্নত জাতের তাজাদম ঘোড়া প্রস্তুত করলো। পানির মশক ভরে ঝুলিয়ে দিল ঘোড়ার সাথে। শুকনো খাবার এবং সফরের আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস থলিতে বেঁধে ঘোড়ার সাথে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ইসহাক তুর্কীকে ডেকে বললো, ‘তোমার ঘোড়া প্রস্তুত।’
ইসহাক তুর্কী নতুন ঘোড়ায় চেপে কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।
সে রাতের ঘটনা; যে রাতে ইসহাক তুর্কী সন্ধ্যার অন্ধকারে নিরাপদ শাহী বাগানের নিভৃত কোণে রাজিয়া খাতুনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল।
আমের, রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছা যথাসময়ে মহলে ফিরে এলো। সবাই এটাকে প্রতিদিনের মত এক নির্দোষ ভ্রমণ বলেই ধরে নিল। সেখানে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আদান প্রদান হয়েছে মহলের কারোরই সে কথা জানার কথা নয়।
সে রাতে ইয়াজউদ্দীন তার দরবারে এক মাহফিলের আয়োজন করেছিল। মাহফিল মানে সমাজের উচ্চবিত্ত ও উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের নিয়ে একত্রে খানাপিনা করা, গান শোনা, নাচ দেখা এবং একত্রে বসে মৌজ করে মদ পান করা।
সন্ধার পর থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু করলো। একটু পর শুরু হলো নাচ গান।
ইয়াজউদ্দীন মাহফিলে আসন গ্রহণ করলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন অভ্যাগত লোকদের। শিল্পীদের সারির দিকে তাকিয়ে তার মনটা দমে গেল। একটা শুন্যতা হাহাকার করে উঠলো মনের ভেতর।
উনুশীকে তার খুব পছন্দ। সে শিল্পীদের সারিতে তাকে দেখতে পেল না। ইয়াজউদ্দীন ভাবলো, হয়তো সাজগোছ করতে একটু সময় নিচ্ছে। এসে পড়বে এক্ষুণি।
অনুষ্ঠান চলছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে অনুষ্ঠানের দিকে মন নেই ইয়াজউদ্দীনের। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কাটছে তার কষ্টকর এক যন্ত্রণায়। এক সময় অধৈর্য হয়ে তিনি এক রক্ষীকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘উনুশীর কামরায় যাও। সে এখনো এলো না কেন দেখে এসো। তাকে বলবে, আমি তাকে আসতে বলেছি।’
রক্ষী গেল উনুশীর কামরায়। দেখলো মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে উনুশী।
রক্ষী ইয়াজউদ্দীনের ইচ্ছার কথা জানালো তাকে। উনুশী বললো, ‘তাকে গিয়ে বলো, উনুশীর শরীর খারাপ। সে আজ আসতে পারবে না।’
ফিরে গেল রক্ষী। ইয়াজউদ্দীনকে জানালো উনুশীর কথা। ইয়াজুদ্দীনের মন এতে আরো খারাপ হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, বিকেলেও তো ওকে বেশ হাসিখুশি দেখলাম! চঞ্চল হরিণীর মত গুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। হঠাৎ আবার কি হলো তার?
তিনি তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শেষ করে উনুশীর কামরায় চলে এলেন।
‘মাহফিলে যাওনি কেন সোনা?’ মোলায়েম কন্ঠে জানতে চাইলেন ইয়াজউদ্দীন মাসুদ।
উনুশী তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসলো। বললো, শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল, তাই যেতে পারিনি।’
ইয়াজউদ্দীন উনুশীর ম্লান ও বিষণ্ন চেহারার দিকে তাকালেন। তার দু’চোখে রাজ্যের মায়া ও অবসন্নতা। সে যে কথা বলছে, সেই কথার স্বরও কেমন যেন অস্পষ্ট, বাধো বাধো, অসংলগ্ন।
ইয়াজউদ্দীন দেরী না করে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এসে তার নাড়ি পরীক্ষা করে ঔষুধ দিল। উনুশী সেই ঔষুধ এক পাশে সরিয়ে রেখে বললো,‘আপনারা যান, ঔষুধ আমি নিজেই খেয়ে নেবো। ঔষুধের চেয়ে এখন আমার বিশ্রাম বেশী প্রয়োজন।’
ডাক্তার এবং ইয়াজউদ্দীন বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে। ইয়াজউদ্দীন হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘হঠাৎ আবার কি হলো মেয়েটির?’
‘ও কিছু না সেরে যাবে। দুশ্চিন্তা বা অধিক রাত জাগা ও অতিরিক্ত মদ পান করলে এমনটি হতে পারে। হয়তো মেয়েটি শরীরের ওপর বেশী অত্যাচার করছে, তাই এমন হয়েছে।’
ইয়াজউদ্দীন ও ডাক্তার চলে গেল। উনুশী দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ করে শোয়ার পরিবর্তে কামরায় পায়চারী করতে লাগলো।
উনুশী ছিল খুবই অশান্ত। হঠাৎ একটি ঘটনা জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় এনে ফেলেছে তাকে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সে একবার জানালার পাশে যায়, একবার এসে দাঁড়ায় ঘরের মাঝখানে। কখনো জানালায় এসে পর্দা উঠিয়ে বাইরে তাকায়। কিছুক্ষন এভাবে পায়চারী করে হঠাৎ বিছনায় এসে দপ করে বসে পড়লো। তারপর মাথার কাছ থেকে টেনে নিল তার গহনার ছোট্ট বাক্সটা।
তার এ গহনার ছোট্ট বাক্সটা খুবই সুন্দর। এক আরবী ধনী আমীর এ সৌখিন বাক্সটা তাকে উপহার দিয়েছিল কয়েক বছর আগে।
সে বাক্সটা খুলে দেখলো। তার ভেতর থেকে বের করলো একটা আঙ্গুরী। সুদানী পরী উনুশী আংটির নকশার দিকে তাকিয়ে রইলো তন্ময় হয়ে।
এই আংটির নিচটা ভরাট। কী-তে চাপ দিলে খুলে যায় পাল্লাটা। আসলে এটা একটা ছোট্ট কৌটা।
সে কৌটার মুখটা খুলল। কৌটায় সামান্য সাদা পাউডার। সে বিষন্ন মনে পাউডারের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।
পাউডারের দিকে তাকিয়ে সে মনকে স্থির করতে চেষ্টা করলো। তাতে তার অশান্তি কিছুটা দূর হলো। একটা শান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো মনে।
হৃদয়ের অশান্তি ও উদাস ভাব কিছুটা উপশম হলে সে কৌটার মুখ আবার বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো।
রাত ততক্ষনে অর্ধেক পার হয়ে গেছে। পাশের কামরায় ঘুমুচ্ছে তার নিজস্ব দাসী। উনুশীর অসুস্থতা দেখে দাসী তার কামরাতেই ছিল অনেক রাত পর্যন্ত। শেষে এক সময় উনুশীই তাকে বললো,‘যা, তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ রাতে আর কিছু লাগবে না।’
দাসী তারপরও কিছুক্ষন ছিল, শেষে যখন ঘুমে আর বসে থাকতে পারছিল না তখন উঠে নিজের কামরাই চলে গেল।
উনুশী রাতের কিছু পর দাসীর কামরায় গিয়ে তাকে জাগিয়ে তুললো। তাকে বললো, ‘যা, আমের বিন উসমানকে ডেকে নিয়ে আয়।’
দাসী আমের বিন উসমানের সাথে উনুশীর সম্পর্কের কথা জানতো। সে ছিল তাদের গোপন মেলামেশার একমাত্র সহকারী ও সাক্ষী। সে আমের বিন উসমানে কামরায় গিয়ে তাকে ডেকে তুললো। বললো, ‘উনুশী আপনাকে এখুনি একবার যেতে বলেছে।’
আমেরকে নিয়ে ফিরে এলো দাসী। উনুশী দাসীকে বললো, ‘তুই এখন পাহারা দিবি। বাইরে বসে থাক, আমের না যাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও নড়বি না।’
উনুশী আমেরকে ভেতরে টেনে এনে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।
‘আমের!’ উনুশী এমন স্বরে কথা বললো যে শব্দের সাথে আমেরের পরিচয় ছিল না। ‘তুমি জানো, আমি কে?’
উনুশী এ কথা বলে আমেরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমের বুঝে পেল না, এ প্রশ্নের কি জবাব সে দেবে।
আমের চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। উনুশী বললো, ‘আজ সন্ধায় যে লোকটা শাহী বাগে তোমাদের সাথে বসেছিল, কে সে?’
‘কেউ না।’ আমের থতমত খেয়ে না জানার ভান করে উত্তর দিল, ‘আমার কাছে তো কেউ আসেনি!’
‘তোমার কাছে কেউ যায় নি, না?’ উনুশীর কন্ঠে সাপের হিসহিসানির মত শাসানি।
‘আমি তো ওদের সাথে যাই রক্ষী হিসাবে। আমি দূর হতে ওদের অনুসরণ করি মাত্র, আমার কাছে কে আসবে!’
‘আমের!’ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল উনুশীর কন্ঠ। বললো, ‘আমি জানি, তুমি আমার অন্তরের গভীরে যত খবর লুকিয়ে আছে সব সংবাদ জানতে চাও। ঠিক আছে সব খবরই তুমি জেনে নাও। আমি তোমাকে অন্তরের গভীর থেকে ভালবাসি। তাই তোমার চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখবো না।
কিন্তু তুমি আমাকে মরুভূমির সহজ সরল মেয়ের মত যতটা সহজ ও বোকা মনে করেছো, আমি ততটা বোকা নই। তুমি, রাজিয়া খাতুন, শামসুন নেছা এবং খাদেমা বাগানের ভেতর এক সাথেই বসেছিলে। এক আগন্তুককে নিয়ে ঝোঁপের আড়ালে তোমরা গোপন বৈঠক করেছো। সেখানে অনেক গোপন আলাপ হলো তোমাদের মধ্যে। প্রয়োজনীয় আলাপ সারতে সারতে তোমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল। আমি কি এগুলো সব স্বপ্নে দেখেছি?’
মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল আমের, কোন জবাব দিল না। উনুশী বললো, ‘আমি কারো কাছ থেকে শুনে এসব কথা বলছি না। আমি নিজে তখন ঝোপের উল্টো পাশে বসেছিলাম। তোমাদের কানাঘুষা সব শুনেছি। তোমার কথাও শুনেছি। তুমি কি বলেছিলে সে কথা আমার কাছ থেকে শুনতে চাও? বলবো সে কথা?’
আমের চুপ। উনুশী বললো, ‘তোমাদের সবাইকে আমি জানি, চিনি। কিন্তু আগন্তুক লোকটাকে আমি চিনতে পারিনি। তার পরিচয় আমার জানা দরকার। লোকটা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে না পড়লে ঠিকই আমি তার পরিচয় বের করে ফেলতাম। কিন্তু লোকটি সেখান থেকে উঠে চলে গেল। আমিও সেখান থেকে উঠে চলে এলাম বলে তার পরিচয় আর জানা হয়নি।’
ইসহাক তুর্কী যখন ওখান থেকে উঠে চলে যাচ্ছিল, তখন সে কারো পায়ের চাপা পদধ্বনি শুনেছিল। একটু দূরে একটি ছায়া মূর্তিও আবছা দেখতে পেয়েছিল। সেই পদধ্বনি ও ছায়াটি ছিল উনুশীর। সে-ই রাজিয়া খাতুন, শামসুন নেছা ও আমেরের পিছনে লুকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনেছিল।
আমের বিন উসমানের মুখে আর কোন কথা সরলো না। উনুশী ছিল সুদক্ষ গোয়েন্দা। আমেরের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, তার সন্দেহ যথার্থ। আমেরই তার মতই এখানে কারো হয় গোয়েন্দাগিরি করছে। কিন্তু কার? প্রশ্নটা জটিল হলেও উত্তর খুবই সোজা। সে আমাদের গোয়েন্দা নয়। হলব ও মুশেলের লোকদের এখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর একটাই, এ লোক সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর গুপ্তচর। ‘আমের!’ অত্যান্ত মোলায়েম কন্ঠে উনুশী বললো, ‘যদি শুধু শামসুন নেছা একা তোমার সাথে বসা থাকতো, তবে আমি বুঝে নিতাম, সে শাহজাদী তোমাকে বশীভূত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা তো অন্য রকম ছিল। যদিও সব কথা আমি স্পষ্ট কর শুনতে পাইনি, কিন্তু এটা তো ঠিক, সবাই মিলে তোমরা কোন গোপন শলাপরামর্শ করছিলে?’
আমের হাসার চেষ্টা করতে করতে বললো, ‘এ সব কথার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে। আমাকে দয়া করে ওদের কাছে বসতে দিয়েছে এই তো ঢের। সামান্য রক্ষী হয়ে ওদের রাজকীয় ব্যাপারে নাক গলানো কি আমার শোভা পায়, নাকি ওতে জড়ানো আমার উচিত?’
‘আমের!’ উনুশী রাগের সাথে বললো, ‘তুমি জানো, আমি কে? আমার ইশারায় এ শহরের ইট দিয়ে আমি ইট ভাঙতে পারি। ভালবাসার পিপাসায় আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলাম। মন থেকে তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আর সেই সুযোগে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে নিয়েছো। তবুও তোমার জন্য আমার অন্তরে যে অফুরন্ত ভালবাসা জন্মলাভ করেছিল তা আমি নষ্ট হতে দেব না। নইলে এতক্ষনে তুমি পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে না। আমার সামান্য ইশারাতে তুমি কারাগারের অন্ধ কুঠরিতে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে। কারাগারে গোয়েন্দাদের কি কষ্ট দেয়া হয়, কি অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয় সে অভিজ্ঞতা হয়তো তোমার নেই। তাই এখনো তুমি আমার সামনে মিথ্যা বলার সাহস পাচ্ছো।
আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করে তোমাকে সেই জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছি। তুমি এও জানো, ইচ্ছে করলেই আমি তোমাকে এমনভাবে গুম করে দিতে পারতাম, যেমন একটি মশাকে টিপে মারার পর কেউ তার হদিস বের করতে পারেনা। শুধু প্রেমের খাতিরে আমি এসব কিছুই করিনি।
আমের! আমার একমাত্র ভালবাসা! আমার একমাত্র প্রেম! আমার জীবন! আমার মরণ ! তুমি শুধু এইটুকু কথা বলে দাও, যে আগন্তুক এসেছিল, তাকে তোমরা কি তথ্য দিয়েছো এবং এই তথ্য নিয়ে সে কোথায় গেছে?’
থামল উনুশী। একটু দম নিল। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, ‘আমার খাঁটি প্রেমের নিদর্শন দেখো, আমি তোমাদের সেই গোয়েন্দাকে বিনা বাধায় যেতে দিয়েছি। আমি ইচ্ছে করলেই তাকে আটকে ফেলতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে ভালবাসার কারণে সে বিষয়ও আমাকে হজম করতে হয়েছে।’
উনুশীর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। সে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমি যে এক হৃদয়স্পর্শী ধোঁকা। জীবনভর মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এসেছি। অথচ যখন তোমাকে সত্যিকার ভালবাসা দিতে গেলাম তখন নিজেই কেমন মর্মান্তিক ধোঁকার স্বীকার হয়ে গেলাম। তুমি জিতে গেলে আর আমি হেরে গেলাম।
আমের, তুমি সত্যি করে বলো! সত্যি কথা বলো। তুমি যে আমার জীবন! তোমার কোন ভয় নেই। তোমার কোন ক্ষতি হওয়ার আগে আমার ক্ষতি হবে। আমি বেঁচে থাকবো আর তোমার ক্ষতি দেখবো, এমনটি কখনো হবে না।’
‘হ্যাঁ, উনুশী।’ আমের বললো, ‘তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো। আমিও আমার দায়িত্য পালন করেছি। এবার তুমি আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দাও। তোমার যা খুশি করো, আমার কিছু বলার নেই।’
উনুশীর চোখে তখন অশ্রুর বন্যা। কিন্তু সে সজোরেই হেসে উঠলো এবং বললো, ‘ব্যাস আমের! আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো এবং সত্য কথা বলেছো, এটুকুই আমার দেখার ছিল। তুমি নিঃসংকোচে সত্য উচ্চারণ করেছো, এতেই আমি খুশি। তোমাকে আমি কখনো কারাগারে পাঠাবো না আমি প্রেমের মনোরম পিঞ্জরা থেকে মুক্ত হতে চাই না। আমি বাঁচলে তোমাকে নিয়ে বাঁচবো, মরলে তোমার সাথেই মরবো।’
আবেগতপ্ত কন্ঠে কথা বলছিল উনুশী। হঠাৎ সে চোখের পানি মুছে ঠোঁটে জড়িয়ে নিল হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করা হাসি। বললো, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। আজ আমার আনন্দের দিন। আমার ভালবাসাকে আজ আমি একান্ত করে পেয়েছি। আজকের এ আনন্দ দিনে তোমাকে আমি কি দিয়ে বরণ করবো ! তুমি তো মদ পান করো না। ঠিক আছে, মদ আমি তোমাকে দেব না। আজ আমি তোমাকে শাহী শরবত দিয়ে বরণ করে নেবো।’
সে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালো। ওখানে সাজানো ছিল শরবতের পাত্র ও পিয়ালা। তার পিঠ আমেরের দিকে। উনুশী দুটি পিয়ালায় শরবত বানিয়ে নিয়ে আমেরের কাছে এলো। তার আগে আংটির সাথে জড়ানো কৌটাটি খুলে তার ভেতর থেকে সামান্য পাউডার মিশিয়ে নিল শরবতের সাথে।
আমের সে সব কিছুই দেখছিল না। সে তখন হারিয়ে গিয়েছিল ভাবনার অতল তলে। ভাবছিল, জীবন কি? প্রেম কি? উনুশী যে মহত্ব দেখালো তার বিনিময় কি?
উনুশী একটি পিয়ালা আমেরের হাতে দিয়ে দ্বিতীয় পিয়ালাটা তুলে নিল নিজের হাতে।
‘শুঁকে দেখো।’ উনুশী বললো, ‘এটা মদ নয় শরবত, আমার ভালবাসার শরাবান তহুরা! পান করো।’
সে পিয়ালা তার নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে নিল। আমেরও তার পিয়ালা ঠোঁটে লাগালো। এক চুমুক পান করে পিয়ালা থেকে ঠোঁট সরিয়ে তাকালো একে অন্যের দিকে। তারপর দু’জনেই পরষ্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চুমুক দিল। আবারও পিয়ালা থেকে মুখ সরিয়ে মিষ্টি করে হাসলো উনুশী। আমের সে হাসির জবাব দিল হাসি দিয়ে। আবার ওরা চুমুক দিল এবং পিয়ালা শূন্য করে দিল।
উনুশী আমেরের হাত থেকে পিয়ালা নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আমেরের গলা জড়িয়ে ধরে আবেগমাখা কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘এখন আমরা মুক্ত, আমের! পৃথিবীর কোন দ্বন্দ সংঘাত, নষ্টামী, স্বর্থপরতা আর আমাদের পরাজিত করতে পারবে না।’
আমেরের শরীর ঝিম ঝিম করতে লাগলো। গা অবশ হয়ে এলো। চেতনা নিস্তজ হয়ে গেলো। সে কোন রকমে উনুশীর বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো, ‘উনুশী! আমার যেন কেমন লাগছে। আমার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। তুমিও কি ক্লান্তি অনুভব করছো? আমরা কি মারা যাচ্ছি উনুশী!’
‘না আমের!’ উনুশী উত্তর দিল, ‘আমরা গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাচ্ছি। চির শান্তির ঘুম। বড় আরামের ঘুম। দেখো না, আমাদের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৃপ্তির ঘুমে ঢলে পড়ছে নশ্বর শরীর। এ ঘুম আর কোন দিন ভাঙবে না। কেউ আমাদের আর জাগাতে পারবে না।’
উনুশীর শেসের দিকের কথাগুলো কেমন জড়িয়ে গেলো।
‘উনুশী! এ তুমি কি করলে! আমি যে প্রচন্ড ক্লান্তি বোধ করছি। তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবো, ডাক্তার ডাকবো, সে শক্তিটুকুও যে আমার নেই।’
‘আমি তোমার থেকেও অধিক ক্লান্ত আমের। পাপ আমাকে তোমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত করে দিয়েছে। বেশি কথা বলার সময় নেই আমের! শুধু শুনে রাখো, তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা। আমাদের দু’জনকে যে পরকালে একসাথে উঠানো হয় সে জন্য প্রার্থনা করো।’
‘হায় উনুশী! পৃথিবীতে এখনো যে অনেক কাজ পড়ে আছে। আইয়ুবীকে সতর্ক করতে হবে। গাদ্দারদের নির্মূল করতে হবে। কে করবে সে কাজ?’
‘দুঃখ করো না আমের! আমরা আমাদের ফরজ আদায় করেছি। তুমি তোমার ফরজ পূর্ণ করেছো, আমিও আমার ফরজ পূরণ করেছি। আমাদের ফরজ পূর্ণ হওয়ার পর আর কি কাজ বাকী থাকতে পারে! তাই তো আমি এ শরবতে বিষ মিশিয়েছি। যখন আমাদের মত মেয়েদেরকে কোন দায়িত্ব দিয়ে অন্য দেশে পাঠানো হয় তখনই এই বিষ আমাদের সাথে দিয়ে দেয়া হয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে এই বিষ পান করে আমরা শান্তির রাজ্যে চলে যাই। দেখো, এই বিষ কত মধুর ও প্রশান্তিময়। এ বিষ পান করলে কোন কষ্ট ও তিক্ততা বোধ থাকে না। এক মিষ্টি আমেজের মধ্যে আস্তে আস্তে মানুষ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যায়।’
আমের উঠে দরজা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। সে চাচ্ছিল, কোনমতে দরজা খুলে দাসীকে বলে, ‘আমরা বিষ খেয়ে ফেলেছি। জলদি ডাক্তার ডাকো। আমাদের বাঁচাও!’
কিন্তু সে উঠে দরজা খুলতে পারলো না, কিছু বলতেও পারলো না।
উনুশী তাকিয়ে ছিল আমেরের দিকে। আমেরও উনুশীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আমেরকে দরজা খোলার চেষ্টা করতে দেখে উনুশী বললো, ‘পারবে না আমের, পারবে না। আর কেনইবা বেঁচে থাকতে চাও? এখন বেঁচে থাকলে পৃথিবী তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। তুমি কি সেখানে গিয়ে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে চাও? আমি বাঁচতে চাই না। কারাগারে তোমাকে যে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে, তা দেখার জন্য আমার বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া বেঁচে থাকলে কোন মেয়ে যদি এসে আমার আমেরকে তার বলে দাবী করে বসে, সে সুযোগ আমি কেন তাকে দেবো?’
আমের বিন উসমান লুটিয়ে পড়েছিল মেঝের ওপর। উনুশীর কোন কথাই এখন আর সে শুনতে পাচ্ছিল না। তার চোখ দু’টোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
উনুশীর মাথা তখনো সামান্য দুলছিল। সে তার টলোমলো পা নিয়ে দরোজা পর্যন্ত গেল। খাদেমা কাছেই বসেছিল। উনুশী তাকে ডেকে বললো, ‘আমরা দু’জনেই বিষ পান করেছি। তুমি সবাইকে জানিয়ে দিও, আমরা স্বেচ্ছায় বিষ পান করেছি। আমাদের অন্য কেউ বিষ পান করায়নি। কোন খৃস্টান যদি জিজ্ঞেস করে, তবে তাকে বলবে, সুদানের পরী তার দায়িত্ব পালন করেই মরেছে।’
সে আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কন্ঠ দিয়ে আর কোন স্বর এলো না। তার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। সে আমেরের গায়ের ওপরই লুটিয়ে পড়লো।
খাদেমা দৌড়ে পাহারাদারের কাছে চলে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাহারাদারসহ কয়েকজন লোক ছুটে এলো সেখানে।
তারা এসে দেখলো ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলল ওরা। কামরায় ঢুকেই দেখতে পেলো, দরজার পাশেই পড়ে আছে আমের বিন উসমানের লাশ। তার উপর কাত হয়ে পড়ে আছে উনুশী। তার মাথা আমেরের বুকের উপর এবং আমেরের মাথার চুলের মধ্যে তার এক হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকানো।
ইসহাক তুর্কী মুশেল থেকে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিল। সে যে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা এ কথা জেনেও উনুশী তাকে ধরিয় দেয়নি বা পিছু নেয়নি। তাকে গ্রেফতার করার কথা যখন মনে এলো তখনি আমেরের কথা স্মরণ হলো তার। আমের! এক অলীক বাস্তবতা। উনুশী ভেবে দেখলো, যদিও আমেরের ভালবাসা ছলনায় ভরা কিন্তু তার ভালবাসা তো ছলনাবিহীন, নির্ভেজাল। আর আমেরের ছলনাময় ভালবাসার কি কোন মূল্য নেই? যদি এ ছলনাটুকুও সে না দিত তবে কি করতে পারতাম আমি?
আমেরের এই ছলনাময় ভালবাসার খাতিরেই সে সিদ্ধান্ত নিল, না এই আগন্তুককে আমি রেহাই দেবো।
ইসহাক তুর্কীর কায়রো পৌঁছতে আরো কয়েকদিনের রাস্তা বাকি ছিল, এই সময় পাহাড়ী সাপে তার ঘোড়াকে দংশন করলো। তারপর কি অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট সয়ে পায়ে হেঁটে সে এগিয়ে গিয়েছিল সেই বর্ণনা ‘ইহুদী কন্যা’য় বলা হয়েছে।
ইসহাক তুর্কী খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছিল। ইসলামের সম্মান ও অপমান নির্ভর করছিল এ সংবাদ ঠিক জায়গায় সময় মত পৌঁছানো বা না পৌঁছানোর ওপর।
সে ছিল নির্ভিক এক মুজাহিদ। তাই এমন ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর মরুভূমি অতিক্রম করে কায়রো পৌঁছানোর জন্য সে একাকীই পথে নেমে এসেছিল। তার ঘোড়াকে সাপে দংশন না করলে ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।
কিন্তু সাপে দংশন করার পরও দমে যাওয়ার পাত্র সে ছিল না। পদব্রজে হেঁটেই সে নিষ্ঠুর মরুভূমি পাড়ি দেয়ার সংকল্প নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু মানুষের সহ্য গুনেরও একটি সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম হয়ে গেলে এক সময় সে মরুভূমিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে খৃস্টানদের এক ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছিল খৃস্টান গোয়েন্দাদের। বারো জনের এক ছোট্ট কাফেলা। দশজন পুরুষ আর দু’টি মেয়ে কায়রো থেকে যাচ্ছিল বৈরুত। মেয়েদের একজন খৃস্টান, অন্যজন ইহুদী। খৃস্টান কন্যা মেরিনা আর ইহুদী কন্যা বারবারাকে নিয়ে দলে চলছিল এক অঘোষিত যুদ্ধ। ইসহাক তুর্কী বেহুশ অবস্থায় বিড়বিড় করে কথা বলছিল। তার কথা শুনে খৃস্টানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, এ লোক মুসলমান গোয়েন্দা। সে কোন জরুরী সংবাদ নিয়ে কাযরো যাচ্ছে।
কমান্ডারকে নিয়ে মেরিনা ও বারবারার মধ্যে চলছিল প্রকাশ্য শত্রুতা। প্রত্যেকেই কমান্ডারকে নিজের করায়ত্ত্বে রাখার জন্য সচেষ্ট ছিল। কিন্তু কমান্ডার বারবারার সাথে ছলনা করে মেরিনার সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তুললো।
বারবারা এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসহাককে গোপনে সতর্ক করে দেয়।
সে যে খৃস্টান গোয়েন্দাদের ফাঁদে পড়ে গেছে এ তথ্য জানতে পেরে ইসহাক পড়ে যায় মহা ফাঁপড়ে। কারণ ইসহাক এরই মধ্যে স্বীকার করে ফেলেছিল, সে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা এবং হলব থেকে কায়রো যাচ্ছে।
খৃস্টান কমান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছ?’
ইসহাক জবাবে বললো, ‘খবর তো খুবই চমকপ্রদ ও মুখরোচক। নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন রানী হওয়ার লোভে হলবের শাসনকর্তা ইয়াজউদ্দীনকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।’
খৃস্টান কমান্ডার বললো,’ এ সংবাদ তো অনেক পুরানো হয়ে গেছে। এখন তো সুলতান আইয়ুবী বৈরুতের দিকে অভিযানে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তুমি আসল খবর বলছো না কেন।’
‘সুলতান যে বৈরুত অভিযানে বের হচ্ছেন সেই খবরই তে আমি জানি না, তো বলবো কোত্থেকে?’
খৃস্টান কমান্ডার বললো, ‘শোন ইসহাক, আমি তোমাকে একটি সদুপদেশ দিতে চাই। তুমি আইয়ুবির গোয়েন্দা, এ কথা ভুলে যাও। পক্ষ ত্যাগ করে তুমি আমাদের দলে শামিল হয়ে যাও। এতে তোমার অনেক লাভ হবে।
তুমি কায়রোতে কি গোপন খবর নিয়ে যাচ্ছিলে আমাকে বলে দাও। আর বৈরুতে তোমাদের যে গোয়েন্দা আছ তাদের নাম কি, তারা কে কোথায় আছে সব আমাকে বলো।
তুমি যদি স্বেচ্ছায় এসব তথ্য আমাদের না জানাও তবে তোমাকে বৈরুতে নিয়ে গিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবো। কারাগারের গোপন কক্ষে গোয়েন্দাদের কেমন শাস্তি দেয়া হয় নিশ্চয়ই তুমি তা জানো?’
ইসহাক এই প্রস্তাব মেনে না নিয়ে বিদ্রোহ করতে পারতো। কিন্তু তাতে বিপদ বাড়াবে ছাড়া কমবে না। তাই সে কৌশলের আশ্রয় নিল। বললো, ‘আমাকে একটু সময় দাও, ভেবে দেখি।’
সে এই আশায় সময় নিল, যাতে পালাবার কোন পথ পেলে তাকে কাজে লাগাতে পারে। সে ছিল নিষ্ঠাবান এক মুজাহিদ। কোন ভয়ভিতী বা প্রলোভন দেখিয়ে তাকে বিপথগামী করা সম্ভব ছিল না।
খৃস্টান গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পর সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, কিছুতেই খৃস্টানদের গোয়েন্দাদের হাতে আমি আসল গোপন খবর তুলে দেবো না। যত প্রলোভনই দেখানো হোক, তারা জানে না, কোন প্রকৃত মুজাহিদ কখনো দল ত্যাগ করে না। ঈমানদার তো দ্বীনের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়, কিন্তু কখনো মাথা নত করে না। শত্রুর রক্তচক্ষুকেও ভয় পায় না।
সে বৈরুত সম্পর্কে কোন কথাই বললো না ওদের। বরং ওরা যখন বৈরুত সম্পর্কে জানতে চাইলো, সে বললো, ‘আমি তো বৈরুত কখনো যাইনি, তাই বৈরুতের পথঘাট চেনা নেই আমার।’
দলের কমান্ডার বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি ভেবে দেখ কি করবে। মতামত কাল জানালেও চলবে। আমরা রাতেই বৈরুতের পথে যাত্রা শুরু করবো। তুমি সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত বন্দী হিসাবে আমাদের সাথে পথ চলবে।’
ইসহাক যখন শুনলো, তারা বৈরুত যাচ্ছে, তখন তার পেরেশানী আরো বেড়ে গেল। সে অস্থির হয়ে ভাবতে লাগলো, সেখানে গেলেই তো নাইটের সাথে দেখা হবে। নাইট যদি জানতে পারে সে গোয়েন্দা, তাহলে তার আর বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। কিন্তু এটিই তার বড় সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো, সুলতান আইয়ুবীকে সম্রাট বিলডনের যুদ্ধের প্ল্যান ও সামরিক প্রস্তুতির সংবাদ জানানে। এখানে বন্দী হয়ে পড়ে থাকলে এ খবর কখনোই তার কাছে পৌঁছবেনা। আর এ খবর না পেয়ে তিনি যদি বৈরুত অবরোধ করে বসেন তাহলে মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে।
ইসহাক মনে মনে সংকল্প করলো, এই সংবাদ জানানোর জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করবো। প্রয়োজনে এ জীবন বিলিয়ে দেবো কিন্তু এমন মারাত্মক খবর বুকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
রাতে কাফেলা সেখান থেকে যাত্রা শুরু করলো। ইসহাকের দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল এক কমান্ডো। সেই অবস্থায় তাকে তুলে দেয়া হলো এক উটের ওপর। তার সাথে উটে চাপানো হলো নানা রকম সরঞ্জাম।
সুলতান আইয়ুবীর বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কী গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে বৈরুত থেকে রওয়ানা হয়েছিল কায়রো। পথে অন্তহীন সমস্যা ও বিপদে পড়ে এখন আবার বৈরুত ফিরে যাচ্ছে বন্দী অবস্থায়। এ পথও ভয়ংকর বিপদসংকুল। তার ওপর নজর রাখছে দুর্ধর্ষ খৃস্টান কমান্ডোরা। যাত্রা পথ দীর্ঘ।
ইসহাক তুর্কী এদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবার আশা নিয়ে বসে আছে উটের পিঠে। সে জানে না, তার এ আশা আদৌ সফল হবে কিনা।
* * *
‘আমি আর একদিনও এখানে অপেক্ষা করতে পারবো না।’ সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘ সৈন্যদল সব প্রস্তুত হয়ে আছে। এই অবস্থায় সৈন্যদের বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে সৈন্যদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস কমে যাবে। সামরিক দক্ষতা নিস্প্রভ হয়ে যাবে। এমন অবস্থা যুদ্ধের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
তাছাড়া আমি খৃস্টানদের অপ্রস্তুত অবস্থায় অবরোধ করে ঘেরাও করে ফেলতে চাই। আমরা এতদিন যুদ্ধ করেছি নিজেদের মাটিতে পা রেখে। তাতে একটু সাফল্যে আমরা খুশি হয় যেতাম এই ভেবে, আমরা শত্রুদের তাড়িয়ে দিয়েছি।
শত্রুরা আমাদেরই মাটিতে আমাদের আক্রমণ করতো, আমাদের মাটিতেই রক্ত ঝরতো আমাদের। এখন আমার পদক্ষেপ হবে নিষ্ঠুর ও নির্দয় আকারের। বারবার যারা আমাদের ওপর আঘাত হেনেছে এবার আমরা তাদের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে চাই।
কিন্তু তুমি এই প্রথম আমাকে চরমভাবে নিরাশ করলে। তাদের অবস্থা ও তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। এমন অন্ধকারে অভিযান চালানো আমার নীতি বিরুদ্ধ। কিন্তু অবস্থা যা, তাতে আমি নিরুপায়। আমার যে এবার পথে নামতেই হয়।’
‘যদি সম্রাট বিলডন কোন তৎপরতা চালাতো তবে এতদিনে অবশ্যই সে সংবাদ পাওয়া যেতো। আমার ধারণা, সম্রাট বিলডন ও অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটরা এখনো ষড়যন্ত্রেই মেতে আছে। তারা আমাদের মুসলমান শাসকদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এ জন্যই বৈরুত থেকে কোন সংবাদ আমরা পাচ্ছি না।’ বিনয়ের সাথে বললো আলী বিন সুফিয়ান।
‘যদি তাই হয় তাহলেও আমার এখানে বসে থাকার সময় নেই। তারা আর একবার আমাদের মাঝে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর আগেই তাদের ওপর আমাদের চড়াও হতে হবে। তাদের ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে যাওয়ার আগেই আমি বৈরুত অবরোধ করে নিতে চাই। যদি আল্লাহর সাহায্য পাই এবং আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি বৈরুত দখল করে নিতে পারি, তবে তাদের ষড়যন্ত্র আর কোনদিনই তাদের কাজে আসবে না।’
এরপর তিনি তার বিশ্বাসভাজন সেনাপতিদের নিয়ে এক বৈঠকে বসলেন। সেই বৈঠকে সুলতানের নৌবাহিনীর এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলুও উপস্থিত ছিলেন। এই ব্যক্তি সামুদ্রিক যুদ্ধে অসাধারণ যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বৈরুত যেহেতু ভূমধ্যসাগরের তীরে, সে জন্য সুলতান আইয়ুবী বৈরুত অবরোধ করার জন্য নৌবহর পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি তাকে আগেই জানিয়েছিলেন, ‘নৌবাহিনীর যে সকল সৈন্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহন করবে তুমি তাদেরকে আলেকজান্দ্রিয়া পাঠিয়ে দাও। তারা পরবর্তী নির্দেশ পাওয়া পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে অবস্থান করবে। নির্দেশ পেলে তারা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বৈরুত যাত্রা করবে।’
হেশামুদ্দিন লুলু বৈঠকে সুলতানকে জানালেন, ‘নৌবাহিনীর সকল সৈন্য আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছে গেছে।’
সুলতান নৌবাহিনী প্রধান হেশামুদ্দিনকে বললেন, ‘আমি চাই নৌবাহিনীর যুদ্ধযাত্রীরা সমুদ্রপথে বৈরুতের উপকন্ঠে একটু আগেই যেন পৌঁছে যায়। সামরিক বাহিনী স্থলপথে মরুভূমি ও পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে যাবে। নৌ যোদ্ধারা উপকূলে পৌঁছেই যেন কাসেদ পাঠায়।’
তিনি উপস্থিত সেনাপতিদের বললেন, ‘এবার বৈরুতের ওপর যে আক্রমণ হবে, তা হতে হবে ভীষণ ভয়ংকর, তীব্র ও প্রচন্ড। যদি খৃস্টানরা অস্ত্র সমর্পণ না করে তবে তোমরা র্নিদ্বিধায় শহরের ওপর বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করবে না। তবে একটি কথা মনে রাখবে, নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যারা অসুস্থ তাদের ওপর কোন জুলুম যেন না হয়। তাদেরকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়ে নেবে।
আরেকটি কথা, প্রচন্ড ধ্বংসযজ্ঞের সময়ও তোমাদের মনে রাখতে হবে, সৈন্যদের হত্যা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যদি ওরা অস্ত্র সমর্পণ করে তবে সসম্মানে তাদের বন্দী করবে। কখনোই যেন আমাদের সৈন্যরা আক্রোশের বশে কোনরুপ বাড়াবাড়ি না করে। কোন অবস্থাতেই লুটপাট করা চলবেনা।
স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার সময় ফৌজি অভিযান হবে তীব্রতর। পথে বিশ্রাম করতে হবে তাঁবু ছাড়া। অস্ত্র ও অপরিহার্য সামগ্রী ছাড়া সঙ্গে কোন জিনিস বা আসবাবপত্র নেয়া যাবে না। সৈন্যদের জন্য খাদ্য ও পানি থাকবে। কিন্তু সফরের সময় সৈন্য ও অফিসার সবাইকে প্রয়োজনের চাইতে কম খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সবাই যেন সম পরিমান পায়।
সফরে খাবার রান্না করার কোন সুযোগ থাকবে না এ জন্য খেজুর ও অন্যান্য শুকনো খাবার সঙ্গে রাখতে হবে। কিন্তু পশুদের আহার দিতে হবে পরিমাণ মত।’
সুলতান আইয়ুবী বড়সড় একটি বোর্ডে কায়রো থেকে বৈরুত যাওয়ার পথের নকশা আঁকলেন। তারপর সেই নকশায় আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে বললেন ‘এই হলো আমাদের অগ্রাভিযানের রাস্তা।’
বৈঠকে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিল। এই নিরবতা আরো গভীর ভাব ধারণ করলো। সুলতান আইয়ুবী সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘তোমরা সব চুপ করে আছো কেন? কেন বলছো না, আমরা এখন শত্রুর এলাকা দিয় চলেছি। আমরা এখন শত্রুর এই এলাকা অতিক্রম করলাম?
কেউ কোন কথা বললো না। সুলতান আইয়ুবী নিজেই আবার মুখ খুললেন।
‘হে আমার প্রিয় বন্ধুরা! এতদিন আমরা যুদ্ধ করেছি সতর্কতার নিয়ম মেনে। অগ্রাভিযানের সময় আমরা প্রথমেই খেয়াল রাখতাম, আমাদের পিছন দিকটা যেন সুরক্ষা থাকে। তার পরিনাম ফল এই হয়েছে যে, খৃস্টানরা ফিলিস্তিনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছে। তারা দামেশক ও বাগদাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বার বার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ চেষ্টা সফল হলেই তারা মক্কা ও মদীনার দিকে অগ্রসর হবে।
যদি জিয়াদের পুত্র তারেক দূরন্ত সাগর পাড়ি না দিয়ে মিসরের মাটিতে বসে থাকতেন, তবে ইউরোপের মাটিতে ইসলামের পতাকা কোনদিন উড্ডীন হতো না। কাশেমের বীর সন্তান মুহাম্মাদ যদি ভয়াবহ ও দীর্ঘ সমুদ্র পথ অতিক্রম করে হিন্দুস্থানে না পৌঁছতেন, তবে আজ ভারতের ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল হতো না।
খৃস্টানরা বহু দূর থেকে আমাদের দেশে এসেছিল। যদি আমরা ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করতে চাই তবে আমাদেরও আগুনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সুউচ্চ পাহাড়, দুস্তর মরুভূমি ও উত্তাল সাগরের ঢেউ মাড়িয়ে আমাদের আঘাত হানতে হবে শত্রুর দুর্ভেদ্য দুর্গে।
আর যদি রাজ্য শাসন করাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য, যদি আপনারা শুধু শাসক ও আমীর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান, তবে আসুন, মিশর ও সিরিয়াকে আমরা খন্ড খন্ড করে ভাগ করে নেই। তারপর সবাই বাদশাহ ও আমীর হয়ে আরাম আয়েশের জীবন যাপন করি।
তখন আমাদের নিজেদের রাজ্য রক্ষা ও ভোগের সামগ্রীর জন্য ইহুদী ও খৃস্টানদের কাছে হাত পাতবো। আমাদের কাছ থেকে অর্থ ঋন ও সাহায্য নিয়ে আমরা আমাদের বিলাসী জীবন চালাবো। বিনিময়ে তাদের কাছে আমাদের ঈমান ও ধর্ম বন্ধক রেখে দেবো।’
‘সুলতানে মুহতারাম!’ এক সেনাপতি দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় আছি। আমাদের কেউ ভীত নয়। শত্রুর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের কারো হাত-পা কাঁপবে না। আমরা শুধু জানতে চাই, আমরা কখন রওয়ানা হবো আর কোন নিয়মে অগ্রসর হবো।’
‘হ্যাঁ!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এবার আমি সেই কথাই তোমাদের বলতে চাচ্ছিলাম। প্রত্যেক ডিভিশন স্বাধীনভাবে তাদের অগ্রাভিযান জারী রাখবে।
সামনে, পেছনে, ডানে, বামে কি ঘটছে সেদিকে কারো কোন খেয়াল করার দরকার নেই। আমাদের রসদ বহনের জন্য একাধিক আলাদা ইউনিট করা হয়েছে। তারা নিজ দায়িত্বে যথাসময়ে স্ব স্ব বাহিনীর কাছে রসদ পৌঁছে দেবে। শত্রুরা যাতে রসদ ধ্বংস করতে না পারে সে জন্যও আলাদা বাহিনীর ওপর দায়িত্ব দেয়া আছে।
সমগ্র বাহিনী ও সব কয়টা ডিভিশনের মধ্যে সমন্বয় ও শৃংখলা রক্ষার জন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এই তদারকী ও সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে কমান্ডো গ্রুপগুলো।
এসব গ্রুপের নেতৃত্ব দেবে কমান্ডো বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ সেনাপতি সালেম মিশরী। এ নির্দেশ তিনি অনেক আগেই পেয়েছেন। তিনি কমান্ডো বাহিনীগুলোকে এ জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং দিয়ে রেখেছেন। প্রত্যেকে যার যার দায়িত্ব পালন করবে আর সব সময় খেয়াল রাখবে, বৈরুতের দিকে আমরা কতটুকু এগিয়ে যেতে পারলাম।’
সুলতান আইয়ুবী অভিযানের সমস্ত নির্দেশনা দান করে বললেন, ‘এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের অভিযান কখন শুরু হবে? তার আগে আমি জানতে চাই, আমি যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছি তিনি তা সঠিকভাবে বুঝে নিয়েছেন কিনা? নাকি এখনো কারো কিছু জানার বা বুঝার আছে? এ প্রশ্নের সমাধা হলেই আমি অভিযান শুরু করার সময় ঘোষণা করবো।’
সবাই হাত তুলে সমস্বরে বললো, ‘আমরা আমাদের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছি। এবার আপনি অভিযান শুরু করার সময় ঘোষণা করুন।’
সুলতান আইয়ুবী খানিক বিরতি নিলেন। সবার ওপর দিয়ে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আজ রাতের প্রথম প্রহরেই কাফেলা যাত্রা করবে। তবে সব শেষে আমি একটি সতর্কবানী উচ্চারণ করতে চাই। আর তা হলো, আমাদের লক্ষ্যস্থল কোথায় তা যেন এ কামরার বাইরে কেউ জানতে না পারে। সাধারণ সৈন্য তো দূরের কথা, কমান্ডোদের কানও যেন না জানে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
সুলতান আইয়ুবী পরম বিশ্বাসে তার একান্ত বিশ্বস্ত সেনাপতিদের কাছে এ কথা বলছিলেন, তার অনেক আগেই এ খবর বৈরুত পৌঁছে গিয়েছিল। যখন এ খবর বৈরুত পৌঁছায় তখনো এখানকার অনেক সেনাপতিই জানতেন না, সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী স্বপ্ন কি।
সুলতান নিজেও স্বপ্নেও ভাবেননি, তার এ অভিযানের খবর বৈরুত পৌঁছে গেছে। তিনি জানতেন না, যাদের ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছেন তিনি, তারা এ আক্রমণ চ্যালেন্জ করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। এখন আর আগের মত অতর্কীতে আক্রমণ চালিয়ে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। রাতে যখন মুসলিম বাহিনী সৈন্য অভিযানে বের হচ্ছিল তখন সুলতান আইয়ুবী তাঁর হাই কমান্ডের সেনাপতিদের নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৈন্যদের বিদায় অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। সৈন্যরা প্যারেড করে তাকে সালাম জানাচ্ছিল ও দোয়া নিচ্ছিল।
সুলতানের পাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন আইয়ুবীর সন্তানের এক শিক্ষক। সুলতান আইয়ুবী শিক্ষক ও উলামাদের খুব সমাদর করতেন।
ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ ফরিদ আবু হাদিদ বর্ণনা করেন, সৈন্যদের শেষ ব্যাটালিয়ানও চলে গেল। সুলতান আইয়ুবীও মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, তখন সেই শিক্ষক আরবীতে একটি কবিতা পাঠ করলেন। কবিতাটির অর্থ হলোঃ
‘কায়রো বাসী!
যারা ফুলের সুগন্ধ পছন্দ করো
তারা এই নিরব রাতে ঘরের বাইরে চলে এসো।
দেখো, চারদিক মৌ মৌ করছে
বসরাই গোলাপের গন্ধে।
যত পারো এই সৌরভ মেখে নাও
নিজের অঙ্গে।
হয়তো কাল প্রত্যুষের পর থেকে
এই আমোদিত সৌরভ
আর নাও পেতে পারো
হয়তো যে ফুল আজ রাতে
সৌরভ বিলাচ্ছে এই কায়রো শহরে
কাল সন্ধায় সে ফুল
অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে
হয়তো এ ফুলের সৌরভ
আর পাবে না মিশর।’
মিশরের এক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, এই কবিতা শোনার পর সুলতান আইয়ুবী কেমন নিরব ও উদাস হয়ে গেলেন। আনন্দের পরিবর্তে বিষাদে ছেয়ে গেল তার মন। তিনি বিদায়ের সময় এই কবিতাকে অশুভ ইঙ্গিত মনে করলেন।
তিনি আপন সৈন্য বাহিনীর পিছনে পিছনে যাত্রা করলেন। কিন্তু মনের বিষাদভার তার মোটেও লাঘব হলো না।
রাস্তায় তিনি তার সঙ্গী সেনাপতিদের বললেন, ‘মুরুব্বী বিদায়ের সময় আমাদের জন্য দোয়া দিবেন। তা না করে তিনি এমন এক কবিতা শোনালেন, যে কবিতা আমার বুকে বিরাট বোঝা হয়ে আছে।’
কিন্তু এই শিক্ষকের কবিতাটি অনাগত ভবিষ্যতের অভ্যর্থ ইঙ্গিত হয়ে দেখা দেবে, তা কে জানতো? ইতিহাস এই কবিতাটিকে অভ্যর্থ সত্যে পরিনত করে দিল। সবাই জানেন, সেই যে সুলতান আইয়ুবী কায়রো থেকে যাত্রা করেছিলেন, আর কোনদিন তিনি মিশরে ফিরে আসার সুযোগ পাননি। তার অবশিষ্ট জীবন আরবের ঊষর ভূমিতে যুদ্ধ বিগ্রহেই কেটে গেছে। মিশরবাশীর ভাগ্যে এই ফুল আর কোনদিন ফোটেনি।
১১৮২ সালের মে মাসে সুলতান আইয়ুবী মিশর থেকে যাত্রা করেন। অভিযানের যে নকশা তিনি এঁকেছিলেন, সেই পথটা ছিল দুর্গম মরুভূমির মধ্য দিয়ে। কোথাও অপ্রতিরোধ্য পাহাড়, কোথাও ভয়াবহ কন্টক ও উত্তপ্ত বালির সমুদ্র। এমন ভয়ানক অঞ্চলটা দিয়ে যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল, দুশমন যেন এ অভিযানের খবর না পায়।
কিন্তু সুলতানের জানা ছিল না, তাঁর এ অভিযানের খবর আগেই বৈরুত পৌঁছে গিয়েছিল। খৃস্টান গোয়েন্দা ও দুষ্কৃতিকারীরা ওঁৎ পেতে বসেছিল পথের বাঁকে বাঁকে।
যে সুলতানকে এ ব্যাপারে সতর্ক করতে পারতো, সেই ইসহাক তুর্কী খৃস্টান গোয়েন্দাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছিল। সে কায়রোর পরিবর্তে বন্দী অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল বৈরুত।
যদিও এখন তার হাত বাঁধা নেই, কিন্তু কিছু করারও নেই তার। সতর্ক গোয়েন্দারা নজর রাখছে তার ওপর। পালাবার কোন সুযোগই সে সৃষ্টি করতে পারছেনা।
প্রথম দুই দিন ও দুই রাত খাওয়ার সময় ছাড়া তার হাত বাঁধ তাকতো। তখন সে খৃস্টান কমান্ডারকে বললো, ‘অযথা আমাকে কেন বেধে রেখে কষ্ট দিচ্ছো? তুমি কি মনে করো, মুক্ত থাকলেই আমি পালিয়ে যাবো? কিন্তু একবারও ভাবলে না, কি করে পালাবো আমি? পালিয়ে যাবই বা কোথায়? পায়ে হেঁটে তো আর এই মরুভূমি পাড়ি দিতে পারবোনা, আর তোমাদের এতগুলো লোকের সাথে খালি হাতে আমি লড়াই করেও পারবোনা। নাকি আমাকে ভয় পাও তোমরা?’
কমান্ডারের প্রিয়ভাজন খৃস্টান কন্যা মেরিনা বললো, ‘তোমাকে ভয় পাবো কেন? কি মনে করো তুমি নিজেকে? বাঘ না ভাল্লুক? উস্তাদ, আপনি এখনি ওর হাতের বাঁধন খুলে দিন, দেখি সে কেমন বাহাদুর।’
মার্টিন বললো, ‘মেরিনা ঠিকই বলেছে ওস্তাদ। ওকে যদি এখন ছেড়েও দেই তাহলে সে বেশী হলে দুক্রোশ রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে পারবে। তারপর মরুভূমি তাকে আগের মতই বেহুশ করে ছুড়ে ফেলবে তপ্ত বালিতে। সেখানেই তাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে।
খৃস্টান গোয়েন্দা কমান্ডার সাথীদের পরামর্শে তাকে মুক্ত করে দিল। তবে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বললো, ‘ওকে আমি মরতে দিতে পারি না। তাহলে আমাদের ভাগ্যে কোন পুরষ্কারই জুটবেনা। তাকে আমি জ্যান্ত বৈরুত নিয়ে যেতে চাই। তাই সবাই তার ওপর কড়া নজর রাখবে, সে যেন মরতে না পারে।’
ইসহাক তুর্কী তাদের ওপর প্রভাব ফেলার জন্য নতুন চাল শুরু করলো। তাকে মরুভূমিতে ফেলে না দেয়ায় সে সবার ওপর বেশ কৃতজ্ঞ হয় উঠলো। তাদের সাথে সহযোগিতা করার প্রস্তাব সে মেনে নিল।
কমান্ডার বললো, ‘সত্যি যদি তুমি আমাদের সহযোগীতা করতে রাজি হও তাহলে তোমার ভাগ্য বদলে যাবে। কারাগারের বদলে তুমি পাবে অঢেল সম্পদ। মেরিনার মত মেয়েরা তোমার সেবা করে ধন্য হবে। জীবন তো একটাই, কেন হেলায় ভাগ্যের এ দান ঠেলে ফেলবে?’
‘আমিতো ভাগ্যকে নতুন করে গড়ে নিতেই চাই, যদি আপনি আমাকে সে সুযোগ দান করেন। সুলতান আইয়ুবীর চাকরী করে আমি কোনমতে আমার সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন যদি আপনি আমার ওপর দয়া করেন, তবে আমি আমার ভাগ্যকে কেন গড়ে নেব না?’
এরপর ইসহাক তুর্কী সুলতান আইয়ুবী সম্পর্কে খুব খারাপ খারাপ মন্তব্য করতে লাগলো। তার সঙ্গী সাথীদের গালাগাল ও তাদের জন্য আফসোস করতে লাগলো। বলতে লাগলো, ‘হায়রে দুর্ভাগারা! পোড়া কপাল নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলি, আমি কি করতে পারি! নইলে বলতাম, দেখ, একেই বলে ভাগ্য। নইলে আমি তো মরেই যেতাম। এরা আমাকে বাঁচিয়ে তুলল। আমাকে নতুন জীবন দিল। নইলে আমার মত এক কীটকে মেরে মরুভূমিতে ফেলে দিলে আমি কি করতে পারতাম!’
তার এসব আক্ষেপ শুনে খৃস্টানদের বিশ্বাস জন্মে গেল, এ লোক সত্যি তাদের দলে যোগ দেবে। সুলতান আইয়ুবীর একজন গোয়েন্দাকে নিজের দলে টানতে পারা কম সৌভাগ্যের বিষয় নয়।
খৃস্টান কমান্ডার এবং দলের অন্যান্যরা এজন্য নিজেদের খুব ভাগ্যবান মনে করতে শুরু করলো। বিশেষ করে মেরিনা এ জন্য মস্তবড় পুরুষ্কার পাবে বলে ধারনা করলো। কিন্তু যখনই তাকে জিজ্ঞেস করা হতো, কি গোপন তথ্য নিয়ে তুমি কায়রো যাচ্ছিলে?’ তখন সে সঠিক জবাব না দিয়ে নানা রকম গল্প ফেঁদে তাদের বিভ্রান্ত করে দিত।
দুই খৃস্টান মেয়ের পারস্পারিক রেষারেষী তখন তুঙ্গে। মেরিনা কমান্ডারের প্রিয়ভাজন। এই সুবাদে সে বারবারাকে কথায় কথায় ধিক্কার ও তিরস্কার করতো। মেরিনার বিদ্রুপে ব্যথিত বারবারা এতে অপমানিত বোধ করলেও নিরুপায় হয়ে সে প্রায়ই নিরব থাকতো।
মেরিনা সবসময় ইসহাকের সাথে লেগে থাকতো। কেমন করে তার কাছ থেকে গোপন কথা উদ্ধার করা যায় বিরতিহীনভাবে সে সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছিল।
গভীর রাতে সে চলে আসতো ইসহাকের কাছে। তার পাশে বসে তাকে নানা রকম প্রলোভন দেখাতো, তাকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করতো। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। ইসহাক যেন এক পাথরের মূর্তি। সে পাথরের মতই শক্ত ও নিরব হয়ে বসে থাকতো। কোন রকম আবেগ ও চিত্তচাঞ্চল্যই সে সে বাইরে প্রকাশ করতো না।
বারবারা মেরিনার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি ফিকির আঁটছিল। কিন্তু কি করলে মেরিনাকে জব্দ করা যাবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না সে।
কমান্ডারের পরেই দলে মার্টিনের মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশী। মেরিনাকে দলনেতা কব্জা করে নেয়ায় এই লোক বারবারাকে প্রেমের খাঁচায় বন্দী করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বারবারা তাকে পাত্তা দিচ্ছিল না। এ জন্য সে মার্টিনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল।
বারবারার কাছে পাত্তা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মার্টিন। সে বারবারাকে হুমকী দিল, এর জন্য তোমাকে পস্তাতে হবে। সে বৈরুতে গিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার ভয়ও দেখালো।
এমন ভয় এক সময় তাকে কমান্ডারও দেখিয়েছিল। কিন্তু কমান্ডার কয়েকদিন তাকে ভোগ করে শেষে মেরিনার দিকে ঝুঁকে গেলো। এই প্রতারণায় তার মন পুরুষ মানুষের প্রতি বিষিয়ে উঠেছিল।
বারবারার রাগ তখন চরমে। মেরিনার ব্যঙ্গ বিদ্রুপে অতিষ্ঠ। মেরিনা বারবারাকে বলতো, ‘কে তোমাকে গোয়েন্দা দলে আসতে বলেছিল? মাথায় গোবর নিয়ে স্পাই হওয়া যায় না। তুমি কোন পতিতালয়ে গেলেই ভাল করতে! আমাকে দেখো, মরুভূমিতেও আমি কেমন চমৎকার কৌশলে এক মুসলমান গোয়েন্দা ধরে ফেলেছি।
শোন, এটা কিন্তু আমার শিকার, তুমি এর ধারে কাছেও যাবে না। বৈরুতে গিয়ে আমি যখন পুরুষ্কার নেবো তখন আবার লালা ফেলো না।’
বারবারা এসব কথা যত শুনতো ততোই জ্বলে উঠতো।
সে রাতে মেরিনার তিরষ্কারে এমনিতেই তার মাথাটা খারাপ হয়ে ছিল। মার্টিনের উৎপাতও তখনো বন্ধ হয়নি। হয়তো একটু পরেই মার্টিন তাঁবুর পর্দা তুলে ফিসফিস করে ডাকবে, ‘বারবারা’।
মন খারাপ করে শুয়েছিল সে। সত্যি সত্যি একটু পর মার্টিন এলো। আজ বারবারা তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে বললো, ‘ভেতরে এসো।’
মার্টিন খুশিতে গদগদ হয়ে তাঁবুতে ঢুকলো। বারবারার একটি হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বারবারা বললো, ‘মার্টিন, আমার মনটা খুব খারাপ। মেরিনার অত্যাচারে বিষিয়ে উঠেছে আমার মন। আর সহ্য করতে পারছি না। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।’
‘কি করতে চাও তুমি?’ আগ্রহ নিয়ে বললো মার্টিন।
‘আমি জানি না। কি করলে মেরিনাকে জব্দ করা যাবে সেটাই তো তোমার কাছে জানতে চাই।’
‘বারবারা, একবার বৈরুত পৌঁছে গেলে তুমি আর কিছুই করতে পারবে না। যদি কিছু করতে চাও তবে এখনি করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো, তুমি শুধু বলো, আর কোনদিন আমাকে অবজ্ঞা করবে না?’
বারবারা নিজেকে একান্ত অসহায় মনে করছিল। এ মুহূর্তে তার একজন সহযোগী দরকার। মার্টিন তার প্রেমাকাঙ্খী। তার ওপর সে দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য। বারবারা ভেবে দেখলো, মার্টিনকে প্রত্যাখ্যান করলে তার সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। সে মার্টিনের প্রস্তাব মেনে নিল।
বারবারা এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। সতীত্ব বিসর্জন দেয়ার শিক্ষা তাদের প্রথমেই দেয়া হয়। পাপের মধ্যে প্রতিপালিত এক মেয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মার্টিন এতে দারুণভাবে খুশি হলো। তাকে বললো, ‘এখন থেকে আমি তোমার হয়ে গেলাম। আমি ওয়াদা করছি, মেরিনাকে আমি উপযুক্ত শিক্ষা দেবো। তাকে এমন শিক্ষা দেবো, যাতে সে আর কোনদিন তোমাকে নিয়ে মশকরা করার সাহস না পায়।’
এরপর ওরা অনেক শলাপরামর্শ করলো। মেরিনাকে জব্দ করার নানা রকম ফন্দি আঁটলো। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রই তাদের মনপূত হলো না।
অবশেষে মার্টিন বললো, ‘বারবারা, আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে। পরিকল্পনাটি ভয়ংকর, কিন্তু কাজ দেবে কল্পনার চেয়েও বেশী। একেবারে জোঁকের মুখে নুন দেয়ার মত ব্যাপার।’
সে তার পরিকল্পনাটি খুলে বললো বারবারাকে। শুনে বারবারা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।
‘হ্যাঁ, তোমার এই বুদ্ধি আমার মনপুত হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষা হবে মেরিনার। এটাই করতে হবে।’
মার্টিন বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি প্রস্তুত থেকো। আগামীকাল রাতেই আমরা অপারেশনে নেমে যাবো।’
পরের দিন রাত। মরুভুমির ভয়াবহ এক স্থানে তাঁবু গাড়লো কাফেলা। সেখানে অদ্ভুত ধরণের কয়েকটি টিলা মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে ছিল। কতক টিলা স্তম্ভের মত, কতক মিনারের মত খাঁড়া। কোনটা আবার আঁকাবাঁকা দেয়ালের মত। প্রাণীর আকৃতির মত দুটো টিলা তাঁবুর একেবারে কাছেই।
টিলা গুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পানির নাম গন্ধও নেই সেখানে।
রাতে এই টিলাগুলো দৈত্য দানোর মত ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। সন্ধ্যার পর পরই কাফেলা থামলো সেখানে।
মার্টিন রাতের অন্ধকার গাঢ়তর হওয়ার অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই সে কাজটা সেরে ফেলতে চায়।
সে তার ঘোড়া তাঁবুর সামনে বাঁধলো। ঘোড়া থেকে জীন নামিয়ে তাঁবুর পাশে রেখে দিল। ইসহাকের জন্য আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা ছিল। মার্টিন হাঁটতে হাঁটতে তার তাঁবুর কাছে গেল।
ইসহাক সম্পর্কে কমান্ডারসহ দলের সবাই এখন বেশ আস্বস্ত। সে পালিয়ে যাবে এমন আশংকা দূর হয়ে গিয়েছিল ওদের মন থেকে।
রাতে ঘোড়া ও উটের কাছাকাছি প্রহরীরা শুয়ে থাকতো। এমন কোন সম্ভাবনা ছিল না যে, ইসহাক ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাবে।
কাফেলার লোকেরা দীর্ঘ সফরের কারণে খুব ক্লান্ত ছিল। খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমোতে চলে গেল। ইসহাকও ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রাত তখন গভীর। তাঁবুর পাশে কারো পদধ্বনি ও কানাঘুষা শুনে জেগে উঠলো ইসহাক। শুনতে পেল কেউ যেন তার নাম ধরে ফিসফিস করে ডাকছে, ‘ইসহাক, ইসহাক!’
বিছানায় উঠে বসলো সে। সন্তর্পনে সাড়া দিল, ‘কে?’
এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাইরে থেকে কেউ বললো, ‘পাশের তাঁবুর পাশেই ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। জীনটা তার পাশেই পড়ে আছে। দেরী করো না জলদি পালাও।’ কন্ঠটি এক মেয়ের।
‘কে তুমি?’ আবারও প্রশ্ন করলো ইসহাক।
‘বারবারা!’ মেয়েটি উত্তর দিল।
‘আমাকে আর প্রশ্ন করো না। জানতে চেও না, কেন তোমার প্রতি এত সমবেদনা জাগলো? আমি সেই মেয়ে, যে তোমাকে বলে দিয়েছিলাম, আমরা সবাই ক্রুসেড গোয়েন্দা। তোমাকে ওরা বুঝিয়েছিল, আমরা মুসলমান। সেটা যে ভুল ও প্রতারণা তার প্রমাণ তো তুমি এরই মধ্যে পেয়ে গেছো। আর সময় নষ্ট করোনা, ওরা সবাই শুয়ে আছে , জলদি পালাও।’
মেয়েটি ইসহাককে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা ধরলো। ইসহাক তাঁবুর ভেতর বসেই শুনতে পেল তার পদধ্বনি দূরে সরে যাচ্ছে।
ইসহাক বুঝতে পারলো না কি করবে? এটা কি কোন ফাঁদ? তাই বা হয় কি করে? মেয়েটি আগেও তাকে সতর্ক করেছে। কিন্তু ইসহাকের প্রতি তার এ দূর্বলতা কেন, অনেক চিন্তা করেও ইসহাক তার কোন কারণ বের করতে পারলো না।
ইসহাক আলতো পায়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলো।
বারবারা তার তাঁবুতে চলে গেল। সেখানে তীর ও ধনুক ছিল। বারবারা ধনুকটা উঠিয়ে নিল হাতে। তারপর তীরের কোষটা উঠিয়ে নিয়ে তাঁবুর বাইরে চলে গেল। সে রাস্তার এক পাশে পজিশন নিয়ে বসলো, যে রাস্তা দিয়ে ইসহাক একটু পরেই পালিয়ে যাবে।
ইসহাক দ্রুত ঘোড়ার পিঠে জীন এঁটে ঘোড়ার রশি ও লাগাম খুললো। তারপর ঘোড়ায় না চড়ে হাঁটিয় নিয়ে চললো, যাতে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা না যায়।
কাফেলার সবাই তখন গভীর ঘুমে। ইসহাক তাঁবু থেকে কিছু দূর গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। তারপর সে প্রানের মায়া ছেড়ে এমন জোরে ঘোড়া ছুটালো যে কাফেলার কেউ টের পেলেও যেন তাকে আর ধরতে না পারে। মরুভূমির নিস্তব্ধতা ও রাতের শীতল আবহাওয়ায় হঠাৎ তীরের ‘শা শা’ শব্দ শোনা গেল। একটা তীর এসে ইসহাকের পিঠে বিঁধলো।
একটু পরেই ছুটে এলো আরও একটি তীর। সেটাও সরাসরি তার পিঠে গিয়ে বিদ্ধ হলো। আর সেই সাথেই শোনা গেল একটি মেয়ের চিৎকার ধ্বনি, ‘পালিয়েছে! আসামী পালিয়ে যাচ্ছে! উঠো, জাগো সবাই।’
ঘুমন্ত লোকদের কানে আঘাত করলো এ চিৎকার ধ্বনি। তারা সবাই জেগে উঠে মশাল জ্বাললো। বারবারা তখনো চিৎকার করছিল, ‘কয়েদি পালিয়ে গেছে! কয়েদি পালিয়ে গেছে!’
লোকজন ছুটে তার ওখানে গিয়ে সমবেত হলো। তার হাতে তীর ও ধনুক। সে হাতের ইশারায় দেখালো বন্দী কোন দিকে পালিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডোরা ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সেদিকে। বেশিদূর যেতে হলো না তাদের। পিঠে দুই তীর বিদ্ধ হওয়ার পরই ইসহাক ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ঘোড়া সওয়ারহীন অবস্থায় কিছুদূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
দুটো তীরই ইসহাকের শরীরে গভীরভীবে বিদ্ধ হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যায়, তীর খুব কাছ থেকেই চালানো হয়েছে। কমান্ডোরা তীরবিদ্ধ ইসহাককে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে এলো। ইসহাকের তখনো জ্ঞান ছিল। তাকে ক্যাম্পে এনে উদ্ধারকারী কমান্ডোরা জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, কে তোমাকে পালাতে সাহায্য করেছিল?’
সে উত্তর দিল , ‘কেউ না। আমি এক তাঁবুর কাছে ঘোড়া ও জীন দেখে সুযোগ পেয়ে নিজেই পালাতে গিয়েছিলাম।’
এ ঘটনার কিছুক্ষন পর। সুলতান আইয়ুবীর অসম সাহসী ও বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কী জ্ঞান হারালো এবং অজ্ঞান অবস্থায়ই শহীদ হয় গেল।
‘তখন অনেক রাত। প্রকৃতির ডাকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি তাঁবুর বাইরে এসেই দেখতে পেলাম, সে এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে গেলাম, বন্দী পালিয়ে যাচ্ছে।’
কমান্ডারের প্রশ্নের জবাবে বারবারা বললো, ‘আমার তাঁবুতে তীর ও ধনুক ছিল। আমি সেই তীর ও ধনুক উঠিয়ে নিয়ে তার পিছনে ছুটলাম এবং পর পর দুটি তীর তার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। দুটি তীরই যে তার পিঠে বিদ্ধ হয়েছিল, বুঝতে পারিনি। বন্দী পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে আমি চিৎকার শুরু করলাম। কিন্তু দেখলাম, লোকজন আসার আগেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। আমি যদি তীর না লাগাতে পারতাম তবে বন্দী তো পালিয়েই যেতো।’
‘তোমার তাঁবুতে তো তীর ধনুক থাকার কথা নয়। তীর আর ধনুক তো পুরুষদের তাঁবুতে থাকার কথা! আজ কেমন করে পুরুষদের তাঁবু থেকে তীর ধনুক তোমার তাঁবুতে চলে এলো?’ মেরিনা বারবারাকে জেরা শুরু করলো।
এ প্রশ্নের জবাব দিল মার্টিন। সে বললো, ‘রাতে আমি তীর ধনুক সহও ওর তাঁবুতে এসেছিলাম। পরে যখন বেরিয়ে যাই, নিতে মনে ছিল না।’
‘আর এ ঘোড়াটাও তো তোমার?’ কমান্ডার বললো, ‘ঘোড়াটা কোথায় ছিল? বন্দী জীনই বা পেল কেমন করে?’ প্রশ্নটা মার্টিনের উদ্দেশ্যে।
মার্টিন বললো, ‘ঘোড়া আমার তাঁবুর কাছেই বাঁধা ছিল।’
‘আর জীন?’
‘জীনটা কেমন করে বন্দীর কাছে গেল বুঝতে পারছিনা। হয়তো আমি যখন বারবারার ওখানে ছিলাম তখন চুরি করেছে।’
বারবারা বললো, ‘আমি একটা সফল কাজ করলাম, সে জন্য তোমরা আমায় বাহবা দেবে, তা না, তোমরা আমার কাজটাকে মলিন ও ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য অহেতুক নানা রকম প্রশ্ন তুলছো?’
‘অহেতুক নয় বারবারা, যা জানতে চাচ্ছি প্রয়োজনেই চাচ্ছি। এর মাঝে কিছু রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই রহস্যটা কি তা আমাদের জানতে হবে।’ কমান্ডার রুঢ় কন্ঠে বললো।
বারবারা রাগের মাথায় বললো, ‘এই গোয়েন্দা কোন গোপন খবর কায়রো নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে পালাতে দেইনি, বরং একটা গোপন তথ্য কায়রো পৌঁছা থেকে বাঁচিয়েছি, এই অপরাধে আমাকে জেরা করা হচ্ছে?’
‘ব্যাস ব্যাস! থামো।’ কমান্ডার বললো, ‘ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আসল ঘটনা বুঝা হয়ে গেছে আমার। এই নাটকটা মার্টিন সাজিয়েছে। কয়েদীকে পালানোর ব্যবস্থা করেছে সে। তোমার ওপর দায়িত্ব ছিল তীর মেরে তাকে ঘায়েল করার, যাতে এই কৃতিত্বটা তোমার খাতাতেই লেখ হয়।’
এই কমান্ডার বড়ই ঝানু দক্ষ গোয়েন্দা ছিল। সে মার্টিনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘মার্টিন! আমি এই পেশাতে তোমার চেয়ে অনেক আগে এসেছি। আমার ওপর টেক্কা দেয়া তোমার উচিৎ হয়নি।’
কমান্ডার একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, ‘বৈরুত পৌঁছার আগ পর্যন্ত সময় দিচ্ছি তোমাদের। এর মধ্যেই তোমাদের বাঁচার একটি পথ খুঁজে নিতে হবে। তোমরা কেন এমন কাজ করলে তা আমাকে খুলে বলতে হবে।’
মেরিনা বললো, ‘তোমাদের বোকামীর কারণে তার কাছে কোন তথ্য আদায় করতে পারলাম না আমরা। নইলে বৈরুত পৌঁছে তাকে টর্চার সেলে নিলেই অনেক গোপন তথ্য বেরিয় আসতো।’
‘হ্যাঁ, মেরিনা ঠিকই বলেছে। এই ঘটনায় আমরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আশা করছি বুঝতে পারছো। আমি চাই, তোমর দু’জনেই নিজেদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে সত্য কথা খুলে বলবে আমাকে।’ রায় ঘোষণার মতো করে কথাগুলো বললো কমান্ডার।
কমান্ডার তখনো জানতো না, এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাফেলার লোকদের ব্যক্তিগত হিংসা ও রেষারেষীর কারণেই ঘটেছে। দুই মেয়ের চাওয়া পাওয়া ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জীবন দিয়েছে সুলতান আইয়ুবীর একজন বিশিষ্ট গোয়েন্দা।
সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী দুর্বার বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল বৈরুতের দিকে। পথ অনেক দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল। কিন্তু সব বিপদ বাঁধা মাড়িয়ে ছুটছিল দুরন্ত বাহিনী।
তারা সেই অঞ্চল প্রবেশ করলো যেখানে খৃস্টানরা তাদের আসার খবর পেয়ে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে বসেছিল। দুশমন বাহিনীর এই ওঁৎ পেতে থাকার খবর জানা ছিলনা আইয়ুবীর বাহিনীর। তারা নির্বিকার চিত্তে আগের মতই প্রচন্ড গতিতে ছুটছিল।
তাদের চেহারা তখন দেখার মত। ধুলায় ধূসরিত সর্ব শরীর। মুখ দেখে কাউকে চিনার উপায় নেই।
মে মাসের প্রচন্ড গরমে মরুভূমি তখন লোহার মত উত্তপ্ত। উপরে জ্বলন্ত সূর্য, নিচে তপ্ত বালি। সৈন্যরা অসহ্য গরম থেকে বাঁচার জন্য সারা শরীর ও মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। এই গরমেও অনুমতি ছাড়া কারো এক ফোটা পানি পান করার সুযোগ ছিলনা।
বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়া ও উটের আরোহীরা পালা করে পদাতিক বাহিনীকে উট ও ঘোড়ার পিঠে তুলে নিচ্ছিল। চারদিকের রৌদ্রকরোজ্জল পরিবেশ ওদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।
ওরা পথ চলছিল আর গুন গুন কর জিকির করছিল। সবার কন্ঠে একই সুর -‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।’ তাদের সে গুঞ্জন ধ্বনি দূর দূরান্ত পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল।
সৈন্যদের সেই সম্মিলিত কন্ঠের ধ্বনি গানের মত এক অপূর্ব ছন্দ দোলা সৃষ্টি করছিল মরুভূমির খোলা প্রন্তরে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ঈমানী জযবা ও আবেগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বৈরুতের দিকে আর গুন গুন করে গানের মত সুর করে জিকির করছিল -‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।’
সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীর সাথে রওয়ানা না দিলেও অচিরেই তিনি তাদের সাথে গিয়ে মিলিত হলেন। অন্য দশজন সৈনিকের জন্য যে আইন তার জন্যও তিনি একই বিধি মেনে চলছিলেন। তিনি নিজেও অতিরিক্ত পানি পান করার সুযোগ নেননি।
সহসা তিনি থেমে গেলেন। এবং ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকিয়ে দেখলেন। তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ঘোড়াকে ডানদিকে তাড়া করলেন।
তাঁর সঙ্গের সেনাপতিগন, বিভিন্ন সহকর্মী ও কাসেদরা তার পিছনে ছুটল। ডান দিকেই ছিল সেই এলাকা, যেখানে ইসহাক তুর্কী শহীদ হয়েছিল। ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি সেই ভয়াবহ আকৃতির টিলার কাছে গেলেন। দানবাকৃতির টিলাগুলোর মাঝখানে গিয়ে ঘোড়া থামালেন সুলতান আইয়ুবী। তারপর কমান্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সালেম, বন্ধু! এখান থেকেই তোমার কাজ শুরু করো। তোমার কমান্ডো বাহিনীকে গ্রুপ গ্রুপ করে চারদিকে ছড়িয়ে দাও। তোমাদের প্রত্যেক গ্রুপ যেন পরষ্পরের সাথে সংযোগ রাখে এবং দূরে দূরে গেরিলা তৎপরতা চালায়। সামনের গ্রুপ জলদি সামনে চলে যাক। সেনাবাহিনীর গতির সাথে তাদের তাল মেলাবার দরকার নেই। তারা তাদের মত চলবে এবং সেনাবাহিনীকে ছাড়িয়ে তাদের আগে চলে যাবে।’
এরপর অন্যান্য সেনাপতিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আর সমস্ত বাহিনী একই গতিতে চলতে থাকবে। কমান্ডোদের গতির সাথে তাল মেলাবার দরকার নেই তাদের।’
সালেম মিশরী সুলতানকে সালাম জানিয়ে চলে গেল নিজের বাহিনীর কাছে। সুলতান আইয়ুবী অন্য সেনাপতিদের তখন বলছিলেন, ‘পথ যা কিছুই ঘটুক আমাদের অগ্রাভিযান চলতেই থাকবে। কারণ আমরা এখন শত্রুদের এলাকাই এসে গেছি। যে কোন সময় আমরা আক্রান্ত হতে পারি।’
তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘আক্রান্ত হলে সবার তাতে জড়িয় পড়ার দরকার নেই। যে বাহিনী আক্রান্ত হবে তারাই ওদের মোকাবেলা করবে, বাকীরা এগিয়ে যাবে সামনে।
’সুলতান আইয়ুবী প্রয়োজনীয় নির্দেশনামা জারি করে ধীরে ধীর ঘোড়া চালিয়ে এই দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। সহসা তাঁর চোখে এমন এক দৃশ্য ভেসে উঠল, যা তিনি আশা করেননি। দূরে তিনি অচেনা এক মুসাফিরকে দেখতে পেলেন। মনে হলো, মুসাফির মৃত। লাশটি যদিও বালির মাঝে বেশ খ নিকটা দেবে আছে কিন্তু তার অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলেন সেই লাশের কাছে। এক সৈনিক লাশটি সোজা করলো। দেখ গেল , তার পিঠে দুটি তীর বিদ্ধ হয়ে আছে। রোদে তার চেহারার মাংস শুকিয়ে গেছে। এখন আর এই চেহারা দেখ লোকটিকে সনাক্ত করার উপায় নেই।
‘যেতে দাও ওসব!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কোন কাফেলার মৃত যাত্রী হবে। মরুভূমিতে এসে মানুষ কতভাবে মারা পড়ে! কেউ কেউ তো পাগলও হয়ে যায়।’
সুলতান আইয়ুবী বুঝতে পারলেন না, এ লাশটি তার নিজেরই এক বিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দার। যে ইসহাক তুর্কীকে তিনি বৈরত পাঠিয়েছিলেন সেখনকার খবর নিয়ে জলদি ফিরে আসতে, এটা সেই বিশ্বস্ত গোয়েন্দার লাশ। যদি লাশ কথা বলতে পারতো তবে এখন সে চিৎকার করে বলতো, ‘সম্মানিত সুলতান, দয়া করে এমুহূর্তে বৈরুত যাবেন না। ওখানে আপনাকে অভ্যার্থনা জানানোর জন্য সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে।’
খৃস্টানরা বৈরুতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তার পূর্ণাঙ্গ সংবাদ ও নকশা তার অন্তরে সুরক্ষিত ছিল কিন্তু ইসহাকের দেহ পিঞ্জিরা সেই সংবাদ কিছুই বলতে পারলো না।
সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী এমনভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, অগ্রাভিযানে অংশগ্রহনকারী সৈন্য বাহিনীর দুই পাশের দুই তিন মাইল দূর পর্যন্ত তারা তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিয়েছিল।
কয়েকটি কমান্ডো দল সামনে বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। পিছনেও কমান্ডো বাহিনী মূল সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিল।
বৈরুত থেকে অনেক দূরে থাকতেই এই কমান্ডোদের সাথে খৃস্টানদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
যুদ্ধটা শুরু হল এক ভয়ংকর এলাকায়। দুর্গম পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক দল খৃস্টান বাহিনী। সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো দল ওখানে পৌঁছতেই সম্রাট বিলডনের কথা ভুলে গেল ওরা। এই ক্ষুদ্র বাহিনী নিকেশ করা কোন ব্যাপারই নয় ভেবে তারা হামলা করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয় গেল সুলতানের কমান্ডোরা।
পাল্টা আক্রমণ করে ওদের কবল থেকে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে নিতে সন্ধ্যা ধনিয়ে এলো। ততক্ষনে আইয়ুবীর মূল বাহিনী সেখানে চলে এসেছে। কমান্ডোরা তাদেরকে এই ঘটনার কিছুই জানালো না। মূল সেনাবাহিনী সামনে চলতেই লাগলো।
রাত যখন অর্ধেক অতীত হয়ে গেছে তখন ক্যাম্প করার অনুমতি পেল ওরা। ক্যাম্প করার আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে সৈন্যরা থেমে গেল। তারা বাকী রাতটুকু বিশ্রাম করার জন্য থামলেও কমান্ডো বাহিনী থামলো না সেখানে। তারা সারা রাত বিরতিহীন পথ চলে সামনে এগিয়ে গেল।
এসব কমান্ডোদের জন্য নির্দেশ ছিল, ‘পথে কোন সন্দেহজনক লোক চোখে পড়লে তাকে পাকড়াও করবে। যদি সে পালাতে চেষ্টা করে তবে তাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করবে না। যদি পথে কোন কাফেলার সাক্ষাত পাও তবে তাদেরও গতি থামিয়ে দেবে। একমাত্র আমাদের সেনাবাহিনীকেই তোমাদের অতিক্রম করে অগ্রসর হতে দেবে। তাদের অগ্রাভিযানে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। তবে সব সময় চেষ্টা করবে তোমরা যেন তাদের থেকে এগিয়ে থাকতে পারো।’
সেনাবাহিনীর কোন দল বিশ্রাম নিতে থাকলেও দেখা গেল অন্য দল চলছে তো চলছেই। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল মৃত্যুভয়হীন সেই সামরিক কাফেলা।
রাত শেষ হয়ে সূর্য আবার উদয় হচ্ছিল। মুজাহীদ বাহিনীর এই কাফেলা সূর্যের অনেক উদয় অস্ত দেখতে দেখতে বৈরুতের কাছাকাছি চলে এলো।
তারা তাদের অগ্রাভিযানের খবর নিয়মিত সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল। খৃস্টানদের অনেক সীমান্ত ফাড়ি কমান্ডোদের রাতের অতর্কীত আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে। মরুভূমিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
অনেক দূর থেকে দু’একটা গাছপালা চোখে পড়ছে সৈনিকদের। কোথাও কোথাও সবুজ মাঠও দেখা যাচ্ছিল। শহরের বাইরের ছোট ছোট গ্রামও দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল ওদের।
বৈরুতে সম্রাট বিলডন তার বিভিন্ন সৈন্য বাহিনীর তৎপরতার রিপোর্ট সংগ্রহ করছিলেন। তিনি সংবাদ পেলেন, সুলতান আইয়ুবী বৈরুতের উপকন্ঠে চলে এসেছেন। অচিরেই তিনি বৈরুত অবরোধ করতে যাচ্ছেন।
তিনি আইয়ুবীর এ হামলার প্রতিকার ব্যবস্থা আগেই সেরে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি সুলতান আইয়ুবীর অগ্রাভিযানের নকশাটি তখনো হস্তগত করতে পারেননি। এই সময় কায়রো থেকে আগত খৃস্টান গোয়েন্দা কাফেলাটি বৈরুত এসে পৌঁছে।
এই কাফেলাই ইসহাক তুর্কীকে বন্দী করেছিল। পরে সে ওদের এক মেয়ের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিহত হয়।
গোয়েন্দা দলটি বৈরুত পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই সম্রাট বিলডন ওদের কাছে আইয়ুবীর অগ্রাভিযানের নকশা জানতে চান। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। ফলে সম্রাটকে তারা নকশা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়।
সম্রাট বিলডন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের অবস্থা জানার জন্য পঁচিশ জনের একটি অশ্বারোহী দলকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু দেখ গেল, তারা আর ফেরত আসেনি। একটা সময় পরে তিনি বুঝলেন, তারা আর কোন দিনই ফিরে আসতে পারবে না।
অশ্বারোহীদের এই দলটি অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। তারা দূরে ধুলি ঝড় উড়ে আসতে দেখলো। ধুলিঝড়টি কোন কাফেলার না অন্য কিছু তা দেখার জন্য তারা এক টিলার ওপর চড়লো। মাটি থকে উঠে আসা এই ধুলিঝড় সৈন্যদেরই হতে পারে ভেবে তারা টিলার মধ্যে অবস্থান নিল।
তাদের এক কমান্ডার টিলার ওপর উঠে চারদিকে লক্ষ্য করতে লাগলো। কোথা থেকে এক তীর এসে কমান্ডারের গর্দানে বিদ্ধ হলো।
কমান্ডারের চিৎকার শুনে আরেক অশ্বারোহী ব্যাপার কি দেখার জন্য উপরে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেও তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গেল।
বাকী আরোহীরা নিচেই ছিল। হঠাৎ তীরের বর্ষণ টের পেয়ে তারাও পজিশন নিল এবং পাল্টা তীর ছুঁড়তে াগলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, লড়াইটা তাদের বিপক্ষে গেল।
অবস্থা বেগতিক দেখে তাদের দু’একজন পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সালেম মিশরীর কমান্ডো বাহিনী তাদের কাউকে জীবিত ফেরত যেতে দেয়নি। মূল বাহিনী সেখানে পৌঁছার আগেই তাদের অশ্ব ও অস্ত্রশস্ত্র সব নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী।
কোন সংবাদ না পেলেও সম্রাট বিলডন এবং তার জেনারেলরা বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। আইয়িুবীকে স্বাগত জানানোর যে ব্যবস্থা তারা নিয়েছে তাতে তারা সন্তষ্ট।
কারণ বৈরুত শহর এমনিতেই যথেষ্ট সুরক্ষিত। সহজে একে কেউ কব্জা করতে পারবেনা। তাছাড়া বৈরুতের সুরক্ষার জন্য শহরে সম্রাট বিলডনের নিজস্ব বাহিনী ছাড়াও রয়েছে দক্ষ কয়েকজন নাইটের নেতৃত্বে শক্তিশালী এক বাহিনী।
অপর দিকে সুলতানকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য মূল বাহিনী বিভিন্ন নাইটের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গা ওঁৎ পেতে বসে আছে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে, তারা যেন মুসলিম বাহিনীকে বৈরুতের উপকন্ঠ পর্যন্ত আসার সুযোগ দেয়। যাতে লড়াই শুরু হলে এবার আর সুলতান আইয়ুবী পালিয়ে যেতে না পারেন।
সুলতান আইয়ুবীর সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার যাবতীয় ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে রাখা ছিল বলে তারা এবার বেশ নিশ্চিত ছল।
খৃস্টান গোয়েন্দাদের যে দলটি বৈরুত এসেছিল তারা সম্রাট বিলডনকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী এখনো কায়রো। আমরা নিজের চোখে তাকে কায়রো দেখে এসেছি। এ বাহিনীর সাথে সুলতান নেই। হয়তো আপনাকে ব্যতিব্যস্ত ও বিভ্রান্ত করার জন্য তিনি কোন বাহিনী পাঠিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এরা সুলতানের মূল বাহিনী নয়।’
গোয়েন্দাদের মন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার পর তা অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। এখবরে সম্রাট বিলডনের নিশ্চিন্ত বিশ্বাস জন্মে গেল ,সুলতান আইয়ুবী এখনও কায়রোতেই আছেন। তিনি যখন ময়দানে আসেননি তখন মূল যুদ্ধ শুরু হতে এখনও অনেক দেরী।
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল ভিন্ন। শহরের বাইরে প্রকৃত যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে।
সুলতান আইয়ুবী যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন ততোই কমান্ডো বাহিনীর আক্রমণ ও সফলতার খবর পাচ্ছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি ভিন্নরকম একটি সংবাদ পেলেন।
কয়েক মাইল দূরে শত্রুদের এক বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অনেক কমান্ডো শহীদ হয়ে গেছে, আহতের পরিমাণও কম নয়।
খবরটি শুনে সুলতান আইয়ুবী শুধু বললেন , ‘শহীদদের কোথাও দাফন করে দাও আর আহতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে এসো।’
এটাই সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ বিদ্যার অনন্য কৌশল। তিনি একটি নির্দিষ্ট টার্গেট নিয়ে ময়দানে নামেন। পথে যত রকম বাঁধাই আসুক না কেন, তিনি মূল টার্গেটের কথা কখনো ভুলে যান না। দুশমনের বাঁধাগুলো যতটা সম্ভব পাশ কাটিয়ে তিনি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান। কখনো আক্রাম্ত হলে দিশেহারা হয়ে যান না।
এখানেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে সৈন্য পরিচালনা করছিলেন। তিনি তার সৈন্যদেরকে এমন এলাকা দিয়ে অক্ষত ও নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে সর্বত্রই শত্রু সেনারা ওদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে ছিল। তিনি তাদের মোকাবেলার জন্য কমান্ডো বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন।
এই কমান্ডো বাহিনী মূল বাহিনীর অগ্রযাত্রার পথের দুই পাশের শত্রু শিবিরগুলো রাতের আঁধারে অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে তছনছ করে দিত। কোথাও শত্রুদের কেবল বিছিন্ন ও অকেজো করে দিয়েই তারা পথ করে দিত মূল বাহিনীর জন্য। কোথাও শত্রুদের ছিন্নভিন্ন ও নিশ্চিহ্ন করে দিত। আবার কোথাও কমান্ডো বাহিনী বিরাট বাঁধার সম্মুখীন হয়ে লড়াই অব্যাহত রাখতো, সেই ফাঁকে মূল বাহিনী এগিয়ে যেত সামনে।
মূল বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে না বলে তাদের অগ্রগতি ছিল ধারনার অধিক। তাদের পথ নিষ্কন্টক রাখার জন্য কমান্ডোরা ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছে দুশমনের সঙ্গে। তারা মরছে, মারছে, পালাচ্ছে, দৌঁড়াচ্ছে। কখনও প্রবল আঘাত হানছে। কখনো প্রবল আঘাতের মোকাবিলা করছে সাহসিকতার সঙ্গে। কিন্তু এইসব আক্রমণ ও খুনোখুনি সবই ঘটছিল সুলতান আইয়ুবীর মূল বাহিনী থেকে দূরে।
আলেকজান্দ্রিতে হেশামুদ্দিন লুলুর সমুদ্র জাহাজগুলো প্রস্তুত ছিল। নৌবাহিনী সব সৈন্য ও অফিসাররা অবস্থান নিয়েছিল জাহাজগুলোতে।
হেশামুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর দূরত্ব ও গতির একটা হিসাব অনুমান করে রেখেছিলেন। একদিন তিনি সৈন্যদেরকে জাহাজগুলোর পাল তুলতে আদেশ দিলেন। রাতের আঁধারে জাহাজে পাল তুলে জাহাজগুলো সমুদ্র যাত্রা শুরু করলো।
জাহাজগুলো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে এগিয়ে চললো বৈরুতের দিকে। সাগরের মাঝখানে গিয়ে হেশামুদ্দিন জাহাজগুলোকে দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়তে বললেন।
তিনি একজন অভিজ্ঞ এ্যাডমিরাল ছিলেন। জাহাজের সৈন্য ও সেনাপতিরা সবাই সুলতান আইয়ুবীর কাছে প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের জানিয়েছিলেন কোন মহান উদ্দশ্য হাসিলের জন্য তারা লড়াই করছে।
তাদের অন্তরে বিরাজ করছিল আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার আকুল আকুতি। শাহাদাতের তামান্না ছিল প্রতিটি অন্তরে। এমনি এক জিন্দাদীল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হেশামুদ্দিন।
বৈরুতের উপকন্ঠে পৌঁছে গভীর সমুদ্রে তিনি জাহাজগুলো থামিয়ে দিলেন। তারপর জাহাজ থেকে নামালেন ছোট ছোট জেলে নৌকা। একদল নৌ-কমান্ডোকে ওসব নৌকায় তুলে দিয়ে তীরের অবস্থা দেখার জন্য পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
কমান্ডোরা জেলেদের পোষাক পরে ছোট ছোট নৌকায় পাল উঠিয়ে উপকুলের দিকে রওনা হয়ে গেল।
সমুদ্রে তারা একাধিক দিন ও রাত কাটিয়েছে। পাড়ি দিয়ে এসেছে দুস্তর উত্তাল সাগর। জাহাজের ডকে দাঁড়িয়ে ওরা দেখতে পাচ্ছিল বৈরুত শহরের আবছা আভাস। কিন্তু যে নৌকাগুলোকে উপকূলের খবর আনার জন্য পাঠানো হয়েছিল দীর্ঘ সময় পরও তারা কেউ ফির এলো না।
এ্যাডমিরাল চিন্তিত হলেন। এমন অভ্যার্থনা তিনি আশা করেননি। তিনি অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করলেন। সেনাপতিদের পরামর্শে তিনি আরো কয়েকটি নৌকাকে নতুন করে পাঠালেন উপকূল অভিমুখে।
সতর্কতার সাথে আরও কয়েকটি ছোট ছোট নৌকা রাতের আঁধারে এগিয়ে গেল। তারা এক সাথে না গিয়ে পর পর সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। উপকূলে পৌঁছার আগেই আক্রান্ত হলো তারা। সামনের দুটো নৌকা উল্টে গেল। আহত সৈন্যরা সমুদ্রে সাঁতার কেটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে লাগলো। বাকী নৌকাগুলোকে ওরা সামান্য পিছনে সরিয়ে নিয়ে এক সারিতে দাঁড় করালো। এরপর আক্রমণ প্রতিহত করে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছার সংকল্প নিয়ে ওরা আবার এগিয়ে গেল।
বেশী দূর যেতে হলো না, একটি নির্দিষ্ট সীমানায় পৌঁছতেই আবার আক্রান্ত হলো ওরা। ওরাও পাল্টা হামলা করলো। দু’পক্ষের মধ্যে তীর বিনিময় হতে লাগলো থেমে থেমে।
একটি নৌকা এই খবর নিয়ে ছুটলো গভীর সমুদ্রের দিকে। জাহাজের কাছে পৌঁছে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘রশি ফেলো! রশি ফেলো! জাহাজ নোঙ্গর করো। ওরা সমুদ্র উপকূলে আমাদের কমান্ডোদের ওপর হামলা করে দিয়েছে।’
নৌকা থেকে এক কমান্ডোকে আধ মরা অবস্থায় জাহাজে তোলা হলো। দুশমনের পর পর তিনটি তীর বিদ্ধ হয়েছিল তার শরীরে।
নৌকা নিয়ে ফিরে আসা কমান্ডো বললো, ‘আমাদের দুটো নৌকা প্রথম ধাক্কাতেই উল্টে যায়। খৃস্টানরা আমাদের একটি নৌকা আটক করতে সমর্থ হয়েছে। বাকীরা লড়াই করছে ওদের সাথে।’
‘তোমরা কি টহল বাহিনীর পাল্লায় পড়েছিলে?’
‘এরা কোন টহল বাহিনী নয়। খৃস্টান নৌবাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য ওরা। তাদের নৌকাগুলো সবই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।’
হেশামুদ্দিন এবার তার নিয়মিত বাহিনীর একটি বড়সড় দলকে পাঠালেন আক্রান্ত নৌকাগুলোকে উদ্ধার করতে। বললেন, ‘ওদের বিতাড়িত করে তীরে নামার ব্যবস্থা আমাদের করতেই হবে। তোমরা চেষ্টা করে দেখো, না পারলে আমি অন্য ব্যবস্থা করবো।’
এই বাহিনী যুদ্ধরত বাহিনীর সাথে গিয়ে মিলিত হলো। তারা দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে পাশ থেকে আক্রমণকারীদের ওপর আঘাত হানলো। ডানে বায়ে এবং সামনে থেকে একযোগে আক্রান্ত হয়ে খৃস্টান নৌসেনারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো আত্মরক্ষার্থে। এ যুদ্ধে ওদের কিছু সৈন্য মারা পড়লো এবং কিছু লোক ধরা পড়লো।
ওদেরকে নিয়ে আসা হল জাহাজে। ওদের কাছ থেকে জানা গেল, হেশামুদ্দিন প্রথমে যে দলটিকে পাঠিয়েছিলেন, অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রায় সবাইকে বন্দী করা হয়।
এতে বোঝা গেল, মুসলিম নৌবহরের আগমন সংবাদ তারা আগে থেকেই জানতো। এখন বন্দীদের কাছ থেকে মুসলিম নৌবাহিনীর শক্তি সম্পর্কেও তারা একটি পরিষ্কার ধারণা নিয়ে নিতে পারবে।
হেশামুদ্দিন তার নৌবহরকে সমুদ্রের এতটা গভীরে নিয়ে গেলেন যে, সন্ধ্যায় জাহাজ ছাড়লে অর্ধ রাতের একটু পর যেন জাহাজগুলো বৈরুতের কূলে ভিড়তে পারে। তিনি শেষ রাতের দিকে খৃস্টান বাহিনীর অগোচরে তার বাহিনী তীরে নামিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।
খৃস্টানরা মুসলিম বাহিনীকে বাঁধ দেয়ার জন্য আগে থেকেই সমুদ্র উপকূল হালকা ও ভারী মেনজানিক স্থাপন করে বসেছিল। জাহাজের অগ্রযাত্রা রোধে এ এক পরীক্ষিত পদ্ধতি। মেনজানিক দ্বারা অগ্নি গোল নিক্ষেপ করলে জাহাজ এগুতে পারে না। কারণ জাহাজে গোলা পড়লে সেই জাহাজ বাঁচানো মুস্কিল।
হেশামুদ্দিন সবই বুঝতে পারলেন। খৃস্টানরা যে তাদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য মেনজানিক কামান ব্যবহার করবে একথা বুঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। এই সহজ প্রতিরোধ পদ্ধতির কথাই প্রথমে সবার মনে পড়বে।
কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে বসে থাকা যায় না। সুলতান আইয়ুবী এখন যুদ্ধের ময়দানে। এ যুদ্ধে জিততে হলে সমুদ্রের দিক থেকেও তার বিশেষ সাহায্য দরকার। উপরে যুদ্ধ হবে আর সাগরে বসে বসে মুজাহিদরা সেই দৃশ্য দেখবে, তাতো হয় না। মনে মনে ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন।
এ সময় দেখা গেল তীরের দিক থেকে একটা নৌকা এগিয়ে আসছে। নৌকাটা মুসলিম নৌবাহিনীর। নৌকা আরো কাছে এলে দেখ গেল, মুসলিম নৌসেনারা দু’জন খৃস্টান নৌসেনাকে ধরে এনেছে। এর সেই খৃস্টান সেনা, জেলে সাজা মুসলিম নৌকমান্ডোদের ধরে যারা বন্দী করেছিল। হেশামুদ্দিনের পাঠানো নৌবহরের সাথে মোকাবেলা করতে গিয়ে ওর যখন দেখলো অবস্থা বেগতিক, তখন এরাও অন্যান্যদের সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরা সাঁতার কাটতে কাটতে বহু দূরে সরে যাওয়ায় মুসলিম বাহিনী আগে তাদের দেখা পায়নি। পরে অনেক দূর থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।
ওদেরকে যখন হাত পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হলো তখন তারা বললো, ‘সমুদ্র উপকূলে বিলডনের সৈন্যরা প্রস্তুত হয়ে আছে। আর জাহাজে আগুন লাগানোর জন্য মেনজানিক কামান পাতা হয়েছে উপকূলে।’
এই সৈন্যদের কাছ থেকেই হেশামুদ্দিন জানতে পারলেন, ‘শহর রক্ষার জন্য বৈরুতের অভ্যান্তরে অল্প সংখ্যক সৈন্য রেখে বাদবাকি সব খৃস্টান সৈন্য শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন সম্রাট বিলডন। বিপুল সংখ্যক সৈন্য এখন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর পেছনে এবং তার রাস্তার দুই পাশে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে। সুলতানকে ফাঁদে ফেলে পিষে মারতে চায় তারা।’
এই সংবাদ মারাত্মক এক বিপদের বার্তা বহন করছিল। এই ভয়ংকর সংবাদে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন ও তার সেনাপতিগণ। তারা গভীরভাবে বিষয়টি চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, খৃস্টানরা আমাদের আগমনের সংবাদ আগেই পেয়ে গেছে। আমরা জানি না, সুলতান আইয়ুবী এ সংবাদ জানেন কিনা।
হেশামুদ্দিন সেনাপতিদের বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী এ সংবাদ জানেন কিনা আমরা জানি না। আমরা যখন বিষয়টি জানতে পেরেছি তখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এ খবর অবিলম্বে সুলতানকে পৌঁছানো। এখন তাকে বৈরুতের কাছাকাছি পাওয়ারই সম্ভাবনা। আমি তাঁর কাছে এ খবর পাঠানোর জন্য এখুনি কাসেদ পাঠাতে চাই।’
সেনাপতিরা এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হলো। তারাও বললো, ‘আপনার চিন্তা নির্ভুল। আমরাও কাসেদ পাঠানোর পক্ষে।’
সঙ্গে সঙ্গে একটি নৌকায় দুটি ঘোড়া ও দু’জন কাসেদকে তুলে দিয়ে তাদের বললেন, ‘এখন তোমরা এ উপকূলে নামতে পারবেনা। তোমরা নৌকা নিয়ে গভীর সমুদ্র পথে উজানের দিকে চলে যাও। রাত নামার পর অন্ধকারে কোন গ্রামের পাশে নির্জন উপকূলে নেমে যাবে। সেখান থেকে ঘোড়া নিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাবে বৈরুতের কাছাকাছি।
বৈরুত শহরের বাইরে আমাদের যে বাহিনী আছে সাবধানে তাদের কাছে পৌঁছ যাবে তোমরা। তারপর সুলতানকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলবে।’
এক সেনাপতি সেইসাথে যোগ করলো, ‘বিশেষ করে তাকে জানাবে, আপনার পেছনে শত্রুদের বিশাল বাহিনী ওঁৎ পেতে আছে। তারা যেকোন সময় আপনার ওপর বড় ধরনের হামলা করে বসতে পারে। আপনার এ অভিযানের খবর খৃস্টানরা আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারা এবার আপনাকে পিষে মারার ফন্দি এঁটেছে।’
এ ছাড়া তারা সুলতানকে আরো কি কি বলবে সব বুঝিয়ে দিয়ে কাসেদকে হুকুম করলেন, ‘এবার বেরিয়ে পড়ো অভিযানে। মনে রেখো, যুদ্ধের মোড় পাল্টে দেয়ার জন্য এ খবর সুলতান আইয়ুবীর কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। যে করেই হোক, সুলতানের কানে এ খবর পৌঁছাতে হবে তোমাদের।’
হেশামুদ্দিন থামলে কাসেদ দু’জন তাকে সালাম জানিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল।
পাল তোলা নৌকায় করে জাহাজ থেকে ক্রমে দূরে যাচ্ছে কাসেদ দু’জন। যতক্ষণ তাদের দেখা গেল, তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন হেশামুদ্দিন। এক সময় দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল ওরা। বাতাস বইছিল উপকূল বরাবর। সন্ধ্যার পর বৈরুত থেকে দূরে দক্ষিণের এক সমুদ্রকুলে গিয়ে নৌকা ভিড়ালো কাসেদ দু’জন। সেখানকার সাগরের পাড়টা ছিল এক পাহাড়ের ঢালে।
ওরা নৌকা থেকে ঘোড়া নামালো। নৌকাটা টেনে একদম চরায় তুলে ফেললো। পাহাড়ী এক বৃক্ষের গোড়ায় শক্ত কর বাঁধলো নৌকাটা। তারপর তারা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো।
সওয়ারী পিঠে চাপতেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া দু’টো রওনা হলো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল তারা। তারপর ঘোড়ার মুখ বৈরুতের দিকে ফিরিয়ে হাওয়ার বেগে ছুটলো সেদিকে।
প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে শেষ রাতের দিকে তারা বৈরুতের উপকন্ঠে পৌঁছলো।
মুসলিম বাহিনীর নাগাল পেতে বেশী বেগ পেতে হয়নি তাদের। ফজরের আগেই তারা সুলতান আইয়ুবীর সামনে গিয়ে হাজির হলো।
রাতভর আইয়ুবী সেনাপতিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। খৃস্টানদের তৎপরতা তার কাছে বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। শহরের ভেতর থেকে যে প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন তিনি, তেমন কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি তাদের মধ্যে। এর একটাই কারণ থাকতে পারে, খৃস্টানরা এবার যুদ্ধের কোন নতুন চালের কথা চিন্তা করছে। কিন্তু কি হতে পারে তাদের সেই নতুন চাল?
সমস্যাটা ভাবিয়ে তুললো সুলতানকে। এই নিয়েই সারা রাত দরবার করেছেন তিনি। তবে কি আমরা ওদের কোন ফাঁদের মধ্য পা দিয়েছি? সারা রাত বৈঠক করেও এর কোন নিশ্চিত জবাব বের করতে পারেননি তিনি।
তিনি সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘বৈরুতকে আমরা অবরোধ করে নিয়েছি। বৈরুত কোন যেনতেন শহর নয়। এটা রক্ষা করার জন্য খৃস্টানদের মরিয়া হয়ে চেষ্টা করার কথা। কিন্তু গতকাল আমি আমার রিজার্ভ ফোর্সের একটি অংশকে পাঠিয়েছিলাম পরীক্ষামূলক আক্রমণ করার জন্য।
কিন্তু তাদের কথা হচ্ছে, খৃস্টানরা খুব অবহেলার সাথে তাদের মোকাবেলা করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, রিজার্ভ বাহিনী ছাড়াই এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা নয়।
শহরের বাইরে যে যুদ্ধ হচ্ছিল সেখানকার রিপোর্ট হচ্ছে, কমান্ডো বাহিনী আঘাত হানলেই তারা পিছনে সরে যাচ্ছে। কোথাও বড় আকারের সংঘাতের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না তারা। এটাও কোন ভাল লক্ষণ নয়।’
তখন মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। সুলতানের বৈঠক তখনো চলছিল, এ সময় কমান্ডো বাহিনীর একটি গ্রুপের মাত্র একজন সৈন্য রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটে এল সেখানে।
কমান্ডো বৈঠকের সদস্যদের সামনেই সুলতানকে একটি দুঃসংবাদ শুনালো। বললো, ‘আমরা খৃস্টানদের একটি ক্যাম্পে হানা দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা রাতে বিশ্রামে না গিয়ে যে কোন ধরনের আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল। আমরা হামলা করতেই ওরা আমাদেরকে চারদিক থকে ঘিরে ফেলল।
তারা আমাদের সবাইকে শহীদ কর দিয়েছে। আমি যে তাদের ঘেরাও থেকে বেঁচে আসতে পারবো তেমন কোন সম্ভাবনা ছিল না। হয়তো আপনাকে এখবর জানানোর জন্যই আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
এক সেনাপতি বললো, ‘আমার মনে হয় অবরোধ করতে আসা আমাদের বাহিনী খৃস্টানদের বিরাট অবরোধের মধ্যে পড়ে গেছে।’
এ ঘটনার একটু পরেই নৌবাহিনীর কাসেদ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তারা সাগরের অবস্থা বর্ণনা করে বললো, ‘এ্যাডমিরাল হেশামুদ্দিন লুলু বলছেন, আমরা যে অভিযানে আসছি এ খবর খৃস্টানরা অনেক আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারা আমাদের প্রতিরোধ করার জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাই নিয়েছে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে সমুদ্র অভিযান ব্যর্থ কর দেয়ার জন্য তারা শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্থায় আমার জন্য আপনার কি আদেশ তা কাসেদ মারফত জানিয়ে বাধিত করবেন।’
‘খৃস্টানদের এমন সবদিক থেকে সতর্ক ও প্রস্তুত অবস্থায় আমি এর আগে কোন দিন দেখিনি।’ সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘এখন স্পষ্ট বোঝা গেল, আমাদের পরিকল্পনার খবর সঙ্গে সঙ্গেই গোয়েন্দা মারফত বৈরুতে পৌঁছে গিয়েছিল। যে বৈরুত আমরা গোপনে অবরোধ করতে এসেছি সেখানে কোন গোপনীয়তাই গোপন থাকেনি।’
‘এটা জানার পর আমরা ওদের পাতা ফাঁদে পা দিতে পারি না। এই অবরোধ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবা উচিৎ।’ বললেন এক সেমাপতি।
সুলতান এর সাথে একমত হয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। আমরা অবশ্যই নতুন করে যুদ্ধের ছক আঁকবো।’
তিনি এ্যামিরাল হেশামুদ্দিনের পাঠানো কাসেদদের দিকে ফিরে বললেন, ‘হেশামুদ্দিনকে বলবে, তাঁর নৌবহর যেন সে বৈরুতের উপকন্ঠ থেকে সরিয়ে নেয়। সবাইকে নিয়ে তাকে আলেকজান্দ্রিয় ফিরে যেতে বলবে। সৈন্যদেরকে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে অবতরণ করিয়ে তাদেরকে যেন সোজা দামেশকে পাঠিয়ে দেয়।’
কাসেদরা বিদায় হয়ে গেল। পরদিন ভোরে সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীকে মুশেলের দিকে পিছু সরে যেতে আদেশ দিলেন। বললেন, ‘কমান্ডোরা খৃস্টান সৈন্যদের সাথে মোকাবেলা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু মূল বাহিনী ধীরে ধীরে পিছু হটে মুশেলের দিকে এগিয়ে যাবে।’
এই পিছু হটার বিষয়টাও সহজ ব্যাপার ছিল না। পিছু হটতে গিয়েও কমান্ডো বাহিনীর সাহায্য নিতে হলো মূল বাহিনীকে। নইলে খৃস্টানদের লুকিয়ে থাকা বাহিনীর আক্রমণে তাদের নাস্তানাবুদ হতে হতো।
কমান্ডো বাহিনী তাদের জীবন ও রক্ত দিয়ে সৈন্যদেরকে অবরোধ মুক্ত করে আনে। খৃস্টান সম্রাট বিলডনের ধারণা ছিল, সুলতান আইয়ুবী এখনো ময়দানে এসে পৌঁছাননি। সময় ক্ষেপনের জন্য মুসলিম বাহিনী জায়গা বদল করছে। তাই তিনি পিছু হটা বাহিনীকে ধাওয়া করার আদেশ জারী করেননি। মুসলিম বাহিনীর সৌভাগ্য যে, সম্রাট বিলডন একটি ভুলের মধ্যে ছিলেন, নইলে অবস্থা আরো অনেক বেশী নাজুক হতে পারতো।
মুশেলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ সুলতান আইয়ুবীর সাথে মুশেল থেকে আসা এক গোয়েন্দার সাক্ষাত হলো। ইসহাক তুর্কী বৈরুত থেকে ফিরে এলে এই গোয়েন্দার সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিল। ইসহাক তুর্কীর কাছ থেকেই সে শুনেছিল বৈরুতের সর্বশেষ পরিস্থিতি।
সুলতান আইয়ুবীর কাছে গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কীর কথা উল্লেখ করে বললো, সে আমাদের কাছে বৈরুতের ঘটনা উল্লেখ করে আর দেরা করেনি। আমাদের কাছ থেকে মুশেলে আপনার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তার বিবরণ শুনে পরদিনই কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা করে যায়। এটা বেশ কিছুদিন আগের কথা।’
‘মুশেলে আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে?’ প্রশ্ন করলেন সুলতান আইয়ুবী।
গোয়েন্দা ইয়াজউদ্দিন মাসুদের সমস্ত পরিকল্পনা সুলতানের সামনে তুলে ধরলেন।
গোয়েন্দার রিপোর্ট শুনে সুলতান আইয়ুবী রাগে লাল হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গ তিনি আদেশ দিলেন, ‘এখনি মুশেল অবরোধ করে তাকে দখল করে নাও।’
বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার ডাইরিতে লিখেছেন, ‘সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী ১০ নভেম্বর ১১৮২ সালে মুশেলের নিকটে এসে পৌঁছেন।
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী মুশেল আসছেন এ খবরে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ চলে গেলেন খলিফার সাহায্য চাইতে। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আমাকে বলেছেন, ‘সুলতানের আগমনের খবর পেয়ে আমি দজলার স্রোতে দ্রুতগামী নৌকায় চড়ে বাগদাদ পৌঁছে গেলাম। মাত্র দুইদিন দুই ঘন্টায় আমি আমি এ দূরত্ব অতিক্রম করেছিলাম।
খলিফার কাছে আমি সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি শায়খুল উলামাকে গিয়ে বলো সুলতান আইয়ুবীর সাথে তিনি যেন তোমাকে আপোষ করিয়ে দেন।’ কিন্তু শায়খুল উলামা আমার পক্ষ কথা বলবেন, এমনটা আমি আশা করতে পারিনি বলে সেখান থেকে আমি আজারবাইজান চলে গেলাম তাদের কাছে সাহায্য চাইতে। আজারবাইজানের শাসক সাহায্যের বিনিময়ে যে শর্ত আরোপ করলেন, আমার মনে হলো তার চেয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করা অনেক ভাল। ফলে আমি ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সেখান থেকেও ফিরে এলাম।’
সুলতান মুশেল এসেই ইয়াজউদ্দিন মাসুদের কাছে অস্ত্র সমর্পণের প্রস্তাব পাঠালেন।ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সংঘাতে না গিয়ে অস্ত্র সমর্পণের জন্য কয়েকদিন সময় প্রার্থনা করে। পরে বাগদাদের খলিফার পরামর্শ মতে শায়খুল উলামার মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে আপোষ মিমাংসা হয়।
১১৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুলতান আইয়ুবী মুশেল থেকে অবরোধ উঠিয়ে নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করেন। তিনি নাসিবাকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে পরবর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করে দেন।
‘বৈরুতের অবরোধ খৃস্টানরা ব্যর্থ করেনি, করেছে আমার বেঈমান ভাইয়েরা।’ সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বললেন, ‘আমি শুধু রক্তক্ষয় থেকে বিরত থাকার জন্যই এই আপোসরফা মেনে নিলাম।’
বৈরুতের অবরোধ ব্যর্থ হওয়া সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর দ্বিতীয় নিষ্ফল অভিযান হিসাবে বিবেচিত হয়। এ ব্যর্থতায় তিনি কিছু হারানওনি, কিছু পানওনি। সে কারণেই তার এ অভিযানকে পরাজয় না বলে ঐতিহাসিকরা ব্যর্থতা বলেই চিহ্নিত করেছেন।
অবশ্য কেউ কেউ এটাকে সুলতান আইয়ুবীর ব্যর্থতা না বলে তার গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা বলেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কেমন কথা যে, সুলতান বৈরুত অবরোধ করবেন এ কথা আগেই সেখানে পৌঁছে যায়?
খৃস্টানদের কাছে এ সংবাদ নিশ্চয়ই কায়রো থেকেই পৌঁছেছিল। কিন্তু এটাতো ছিল এক গোপন সংবাদ। সুলতান আইয়ুবীর একান্ত বিশ্বস্ত এবং সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুটিকয় সেনাপতি ছাড়া এখবর তো কেউ জানতো না।
সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী লক্ষস্থল কোথায় এ কথা যারা জানতে পারে, তাহলে তাদের মধ্যেও গাদ্দার আছে? প্রশ্নটা সঙ্গত এবং এর উত্তরও হ্যাঁ-বাচক। তাহলে বলতেই হয় সেই গাদ্দার কে? কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছেই ছিল না।
‘আপনি একে পরাজয় বলবেন না।’ সুলতান আইয়ুবীর চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে এক সেনাপতি বললো, ‘বৈরুত যেখানে ছিল সেখানেই আছে, আর সেখানেই থাকবে। আমরা আবারো সেই শহরে আক্রমণ চালাবো এবং দখল করে নেবো।’
‘এত বড় শিকার আমাদের হাত থেকে ছুটে গেল!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তো সেই শহর অবরোধ করে সেখানে ইসলামের ঝান্ডা উড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখতে পেলাম, আমি নিজেই ওদের অবরোধের মধ্যে পড়ে আছি। যুদ্ধের ছক এমনভাবে পাল্টে গেল যে, অবশেষে নিজেদেরকেই সেই অবরোধ থেকে বের করে আনতে হলো। এটা পরাজয় নয়তো আর কি?’
‘হ্যাঁ, এভাবে দেখলে এটা আমাদের পরাজয়ই। তবে ওদের পেটের মধ্যে ঢুকে আমরা যে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, এটাও কম কথা নয়। ওরা চাইলে আমাদের আরো অনেক ক্ষতি করতে পারতো।’
‘এই শান্তনা নিয়েই বসে থাকো। কিন্তু কেন এ ব্যর্থতা বরণ করতে হলো সেটা স্মরণ করলে তোমার চোখের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। দুশমন আমার চাল ব্যর্থ করে দিয়েছে, এটাকে আমি কখনোই পরাজয় মনে করি না। একবার সে আমার চাল ব্যর্থ করেছে, আমি দশবার তার চাল ব্যর্থ করে দিয়ে এর প্রতিশোধ নিতে পারি। কিন্তু দুশমন তো আমাকে আঘাত করার সময়ই পায়নি, তার আগেই তো আমি কুপোকাত হয়ে বসে আছি।’
তিনি বললেন, ‘আমার ঘরে যে অদৃশ্য সাপ ঘুরে বেডাচ্ছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিনা, এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? তুমি বলো, আমি বৈরুতে অভিযান চালাতে চাই এ খবর কয়জন জানতো?’
আমি যাদেরকে নিজের চাইতেও বেশী বিশ্বাস করি তারা ছাড়া কোন কাক পক্ষীও তো এ খবর জানতো না। আমি যদি তোমাদের বিশ্বাসই করতে না পারি তবে তোমাদের নিয়ে কোন সাহসে অভিযানে বের হবো?’
পৃথিবীর সবচেয়ে তিক্ততম সত্য কথাটিই বেরিয়ে এসেছিল সুলতানের কন্ঠ থেকে। এর কোন জবাব দেয়ার ভাষা ছিল না কারো কাছে। সত্যি তো! সুলতান এখন কাকে নিয়ে পরামর্শ করবেন? কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে কারো না কারো কাছে তো তা প্রকাশ করতেই হবে। কে সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি, যার কাছে গোপন পরিকল্পনা বলে সুলতান স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবেন?
সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর মধ্যে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। নাসিবা নামক স্থানে সেনা ক্যাম্পে বসে ছিলেন তিনি। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অবস্থান করছেন।
এখানে এভাবে অবস্থান করার নানা কারণ নানা জনে বলে। কেউ বলে, তাঁর সেনাদল বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক সৈন্য আহতও ছল। এই সৈন্যবাহিনা দুর্বার গতিতে পথের সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে কায়রো থেকে বৈরুত পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিল।
এক মাসের পথ তারা কয়েক দিনে অতিক্রম করেছে। পথের বিশাল দূরত্ব অল্প সময়ে অতিক্রম করে এসেই তারা দুশমনের অবরোধে আটকা পড়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি খৃস্টানদের সেই অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে তাদের রক্তাক্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে।
অবশেষে অনেক কষ্টে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে নিরাপদ স্থানে ফিরতে হয়েছে তাদের। সুলতান আইয়ুবী এই সব সৈন্যদের পূর্ণ বিশ্রাম দেয়ার জন্যই নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করে সৈন্যদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু এই বিশ্রাম ও ক্লান্তি শুধু সৈন্যদের জন্যই ছিল। সুলতান আইয়ুবীর জন্য ছিল সীমাহীন দুশ্চিন্তা আর নিদ্রাহীন রাত। তিনি নিকট বন্ধুদের মধ্যে শত্রু খুঁজতে খুঁজত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। নিরাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল তার আশার প্রতিটি স্ফুলিঙ্গ।
দিনের বেলা তিনি অশান্তভাবে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতেন। সেনাপতিরা সেই তাঁবুর মধ্যে এসে সুলতানের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কোন কথা বলার সাহস পেত না। তারা দীর্ঘক্ষণ তাঁবুর মধ্যে বসে থেকে আবার চলে যেতো।
তিনি বিশ্বস্ত সেনাপতিদের সাথে কথা বলতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। একদিন তিনি এমনি অশান্ত চিত্তে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন। এক সেনাপতি তাঁবুর মধ্যে ঢুকে সাহস করে তাকে শান্তনা দিতে গেলো। বললো, ‘মুহতারাম, একে আপনি পরাজয় মনে করবেন না।’
সুলতান আইয়ুবী এ কথার কোন উত্তর দিলেন না, তিনি চুপ করে রইলেন। সেনাপতি আর কোন কথা না পেয়ে নিরব হয়ে গেল।
সুলতান আপন মনে তাঁবুতে পায়চারী করতে লাগলেন। এ সময় আরো একজন সেনাপতি সেখানে এলো। অনেক্ষণ পর্যন্ত দুই সেনাপতিই চুপ করে তাকিয়ে রইলো সুলতানের দিকে। আইয়ুবীর চেহারায় রাগ বা ক্ষোভ নেই, আছে শুধু দুশ্চিন্তা। এই চিন্তা কি করে দূর করবে ওরা?
সহসা তাদের সামনে এসে থামলেন সুলতান। বললেন, ‘তোমরা কিছু বলবে?’
‘আমরা আপনাকে বলতে চাচ্ছি, এটা দুশ্চিন্তা করার সময় নয় সুলতান। আপনি এভাবে দুশ্চিন্তা করতে থাকলে আমরা স্বপ্নহীন মানুষে পরিনত হয়ে যাবো।
অথচ পৃথিবীর নির্যাতীত মানুষের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমাদের মাঝে একজন গাদ্দার থাকলে দশজন আছে মুজাহীদ। এইসব মুজাহিদরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় বসে আছে। আপনি তাদের অনন্তকাল এভাবে নিশ্চল বসিয়ে রাখতে পারেন না।’
তারা সুলতান আইয়ুবীকে আরো বললো, ‘আপনাকে এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই দুশ্চিন্তা আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। আমাদের আবেদন, আপনি আবার গা ঝাড়া দিন। আবার আমাদের ময়দানে নিয়ে চলুন। আমরা কেবল আপনাকে পরাজয়ের কষ্টই দেইনি, বিজয়ের আনন্দও তো দিয়েছি।’ আবেগ ভরা কন্ঠে বললো এক সেনাপতি। আমরা এর আগেও পরাজিত হয়েছি। রমলায় আমাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল সে সময়ও আপনাকে এতটা বিমর্ষ হতে দেখিনি।এবারের ব্যর্থতা রমলা পরাজয়ের চাইতে মারাত্মক তো নয় সুলতান! রমলার পরাজয়কে যদি আমরা বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পারি তবে এবারের ব্যর্থতাকেও আমরা সফলতায় রুপান্তরিত করতে পারবো। আপনি নিজের আবেগকে ঠান্ডা করুন। আবেগ মুক্ত হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে নির্ধারণ করুন। আঁধার রাতের পর নিশ্চয়ই সোনালী সূর্য উঠবে।’
‘আমি চিন্তা করছি, কাফেররা তো আমাদের ডালপালা কেটে এবার মূল শিকড় কাটা ধরেছে। এ শিকড় কাটা হয়ে গেলে আমাদের জাতিসত্ত্বা বলে কিছু থাকবে কি? আমাদের জাতির অস্তিত্ত্ব বলে কিছু থাকবে কি?’
‘মোহতারাম সুলতান! আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহ নিজেই হেফাজত করবেন। আল্লাহর দ্বীন টিকে থাকলে এ জাতিও টিকে থাকবে। অনন্ত কালের দায়িত্ব আমাদের কাঁধে বর্তাবে না। আমরা শুধু আমাদের সময়ের জন্য দায়িত্বশীল। জয়-পরাজয়ও আমাদের হাতে নয়, ওটাও আল্লাহই নির্ধারণ করেন।
ভবিষ্যতে আমাদের চাইতে যোগ্যতর কেও এ জাতির হাল ধরবে না, এমন কথা আমরা বলতে পারিনা। আমরা আমাদের যোগ্যতার যথাযথ ব্যবহার করলাম কিনা, পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলাম কিনা, হায়াতের যে সময় আমাদের আল্লাহ দিয়েছেন সেই সময়ের সঠিক ব্যবহার করলাম কিনা, কাল হাশরে আমাদের কাছে আল্লাহ শুধু তাই জানতে চাইবেন। যদি এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা হ্যাঁ বলতে পারি, তবে আমি মনে করি আমরা আমাদের জীবনকে সফল জীবন হিসাবে গণ্য করতে পারি।’
‘আর এ দায়িত্ব কাঁধ নিয়ে আমরা যে গাদ্দারী করি তাকে কি বলবে? যে গাদ্দারীর কারণে আমাদের মুখে কলঙ্কের কালি মাখতে হয় সেই পাপের শাস্তি কে ভোগ করবে?’
‘মোহতারাম সুলতান! শত কলঙ্কের পরও এখনো আমরা আমাদের মাটিতেই দাঁড়িয় আছি। দুশমন আমাদের কব্জা করতে পারেনি, বরং আমরাই এখন আমাদের প্রথম কেবলা ফিলিস্তিন মুক্ত করার স্বপ্ন দেখছি। আমরা এখন খৃস্টানদের সাথে তাদের মাটিতে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করছি।’
বার বার খৃস্টানরা আমাদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সশস্ত্র আঘাত হেনেছে, আমরা সেইসব আক্রমণের মোকাবেলা করেছি। এই অর্জন আমাদের নয়, আমাদের সততা, আন্তরিকতার ও বিশ্বস্ততার। আল্লাহ আমাদের অন্তর দেখেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের এই সব সফলতা দান করেছেন। আল্লাহর এই দয়ার শোকরিয়া আদায় করার উপায় হলো তার কাজে আরো বেশী নিবেদিত হওয়া। দুশ্চিন্তা করে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারবো না।’
‘তুমি নির্ভুল ও সময়োচিত কথা বলেছো, এ জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তোমার কাছ থেকে আরো কিছু কথা শুনতে চাই। এ সব প্রশ্নের কিছু জবাব আমার কাছে আছে। তবু আমি তোমার জবাবের সাথে আমার জবাব মিলিয়ে দেখতে চাই।
জাতির নেতৃত্ব এখন যাদের হাতে আল্লাহর কাছে তো তাদেরও জবাবদিহি করত হবে। মুসলিম মিল্লাতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো এখন তাদেরই কাঁধে। হলবের শাসক ইমামুদ্দিন এবং মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দীন এখন কোথায়? বিভিন্ন পরগণার শাসক ও আমিররা এখন কি করছে?
তারা তো আমাদের সামরিক জোটের অংশীদার, ইসলামের পথে লড়াই করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারা কি এখন এই প্রয়োজনের সময় আমাদের সৈন্য ও রসদ দিয়ে সাহায্য করবে? তাদের শিথিল মনোভাব প্রমাণ করছে, তারা এখনও খৃস্টানদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখনও তাদের খেলার পুতুল সেজে কাজ করছে। তাহলে এখন আমরা কার সাথে লড়াই করবো? জাতির এইসব গাদ্দারদের বিরুদ্ধে নাকি শত্রুর বিরুদ্ধে?’
‘আপনি বারবার এদেরকে আমাদের ভাই আখ্যায়িত করে এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্ত তাদের কাজ প্রমাণ করছে, দুশমনের চাইতেও এরা মুসলিম জাতিসত্ত্বার অধিক অন্তরায়।
আমি তাদের মুনাফিক বলতে চাইনা, কারণ ফতোয়াবাজি করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু কোরআন ও হাদিসে মোনাফিকরা যেসব কাজ করবে বলা হয়েছে, এরা এখন তাই করছে। আর হাদিসে আছে, মোনাফিকরা দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। এতে প্রমাণিত হয়, কাফেরের চাইতেও জাতির জন্য তারা অধিক ক্ষতিকর। আপনি যতই ওদের ক্ষমার চোখে দেখেন না কেন, সুযোগ পেলেই ওরা জাতির শিরায় আঘাত হানবেই।’
সুলতান আইয়ুবী তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন। হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। উপরের দিকে মুখ করে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হায়! আমার প্রিয় রাসুলের উম্মতের মধ্যে আজ একি অবক্ষয় ও অধপতন শুরু হয়ে গেছে!’
তিনি সেনাপতিদের দিকে ফিরে বললেন, ‘যখন বাতিল ধর্মের প্রভাব জাতি গ্রহন করে নেয় তখন তাদের পরিণাম এমনটিই হয়, যেমনটি তোমরা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছো। ইহুদি ও খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে গোলাম ও তাবেদার বানানোর জন্য মানব চরিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক থেকে আঘাত করছে। এই দুর্বল দিকটার নাম হলো লালসা।
এই লালসার আছে বিচিত্র রুপ। স্রোতের টানে দুই পাড় ভেঙ্গে যেমন নালা কেবল বড় হয়, এই লালসার স্রোতও তেমনি। মানুষের আকাঙ্খা ও অতৃপ্তি কেবল তাতে বাড়তেই থাকে।
মানুষের উপর আধিপত্য করার লালসা, শাসন ক্ষমতা লাভের লালসা, রাজা বা শাসক হওয়ার লালসা, রাজকুমার হওয়ার লালসা, সোনার পালংকে নরম গদিতে থাকার লালসা, লাল গালিচা বিছানো পথ দিয়ে চলার লালসা, এই লালসার কি শেষ আছে?
শাসকরা ভাবে, জনগন বালি, কংকর ও কাঁটার মধ্য দিয়ে খালি পায়ে পথ চলবে। তারা পর্ণকুটির ও খড়ের চালার নিচে বসবাস করবে। জীবন ধারনের জন্য নিম্মমানের খাদ্য খেয়ে খুশি থাকবে। কখনো কোন সমস্যায় পড়লে রাজার কাছে মাথা নত করে আবেদন জানাবে।
প্রিয় বন্ধুরা আমার! যখন মানুষের মনে এমন প্রভূত্ব করার লালসা জেগে উঠে তখন তার অন্তর থেকে ঈমান, ভালবাসা, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্ষমতা ও সম্পদ মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির উপর এমন কালো পর্দা টেনে দেয় যে, সেই পর্দা ছিন্ন করার কোন শক্তি আর তার মধ্যে থকে না।
তখন তার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতীয় স্বকীয়তা বোধ বলে কিছু থাকে না। এ সবই তখন অর্থহীন হয়ে যায়।
মানুষের অন্তরে যখন লালসা চরম আকার ধারন করে তখন সে বিশ্বাসঘাতক, গাদ্দার ও প্রতারক সেজে গর্ব বোধ করে। যে যত বড় প্রতারক সমাজ তাকেই তত বড় বুদ্ধিমান গণ্য করে। অত্যাচারীকে মনে করে শক্তিমান।
ইহুদি ও খৃস্টানরা আমাদের শাসক গোষ্ঠিকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, এখন আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের কোন কদর নেই তাদের কাছে।
এইসব শাসকদের কারণেই আজ মুসলিম সমাজ নির্লজ্জতা ও অসভ্যতায় ছেয়ে গেছে। যখন সমাজে সভ্যতা বলে কিছু থাকে না তখন ধর্ম একটি দুর্বল আবরণ মাত্র হয়ে যায়। সে আবরণ যেকোন সময় ছুঁড়ে ফেলে দেয়া সম্ভব। আবার প্রয়োজনে বা জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য যখন তখন তা গায়ে তুলে নেয়াও যায়।’
দুই সেনাপতিই অখন্ড মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর হৃদয় মথিত কথাগুলো। কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় নিরব হয়ে গেলেন। সেনাপতিরা তখনো চুপ করে বসা। তাদের চোখগুলো ছেয়ে আছে নির্মম উদাসীনতায়। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে পতনশীল এক সমাজের দ্রুত পতনের ভয়ার্ত মুহূর্তের শংকিত চিত্র।
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন সুলতান। বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো না, এটাও আমাদেরই ব্যর্থতা? আমরা জনগনকে সজাগ রাখতে পারিনি, শাসকদের ফেরাতে পারিনি অন্ধকারের অরণ্য থেকে? এটাও কি আমাদের পরাজয় নয়, যখন মুজাহিদ বেশে আমাদের রনাঙ্গনে থাকার কথা তখন আমরা নারীর মত তাঁবুর পর্দার ভেতর দাঁড়িয়ে কথা বলছি? এখন তো আমাদের বায়তুল মুকাদ্দাসে থাকার কথা ছিল। মসজিদুল আকসায় লুটিয়ে পড়ে অধীর হয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার কথা ছিল।’ চুপ করলেন সুলতান।
এক সেনাপতি বললো, ‘আমরাও সেই কথাই বলছি সুলতান। আমাদের যে সাথীরা আপন রক্ত দিয়ে ফিলিস্তিনের পথ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছে সেই সব শহীদদের রক্তের প্রতিদান দিতে হবে আমাদের। যারা ফিলিস্তিনের সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য জীবন কোরবান করেছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এনে তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে।’
সুলতান আইয়ুবীর চেহারা বেদনায় মলিন হয় গেল। তিনি পায়চারী করতে করতে সেনাপতিদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার অস্থিরতা দেখে তোমরা পেরেশান হচ্ছো। কিন্তু অস্থির না হয় আমার উপায় কি বলো? আমি সেই এতিম শিশুদের সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো, যারা আমার আদেশ পালন করতে গিয়ে ওদের পিতৃহীন করেছে?
সেই বিধবাদের আমি কি বলবো, যাদের স্বামীরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে আমার সঙ্গে জিহাদে এসেছিল আর তাদের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে অশ্বপদ তলে পিষে মাংসের পিন্ড হয়ে গেছে? সেই সব সুদর্শন যুবক, যারা কমান্ডো বাহিনীতে শামিল হয়ে শহীদ হয়ে গেছে তাদের আমি কেমন করে ভুলবো?
তার নিজের দেশ ও জাতি থেকে বহু দূরে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করেছে, গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে দরা পড়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রনা সহ্য করতে করতে শহীদ হয়ে গেছে, আমি তাদের মায়েদের সামনে যেতে ভয় পাই।
আমি এজন্য ভয় পাই যে, যদি সেই মা আমাকে বলে, আমার বেটাকে ফেরত দাও নইলে যেই মসজিদুল আকসা উদ্ধার করবে বলে আমার বেটাকে জেহাদে শরীর হতে বলেছিলে সেই মসজিদে আমাকে নিয়ে চলো। আমি সেই মসজিদ লুটিয়ে পড়ে আমার সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবো, আমি সেই মাকে কি উত্তর দিব?’
‘শহীদদের রক্তের দান কোন দিন বৃথা যায় না মুহতারাম সুলতান! কমান্ডো বাহিনীর প্রধান সালেম মিশরী তাঁবুতে ঢুকে আইয়ুবীর বক্তব্য শুনে বললো, ‘কোন শহীদের মা তার সন্তানের রক্তের হিসাব আপনার কাছে চাইতে আসবে না। যে মায়েরা তাদের বুকে আল্লাহর কালাম ও রাসুলের বাণী ধারণ করেছে সেই মায়েদের দুধ আবে জমজমের মতই পবিত্র ও বিশুদ্ধ।
সেই দুধে পালিত সন্তান আপনার আদেশে নয় আল্লাহর হুকুমে যুদ্ধ করেছে। আপনি তাদের রক্তের প্রতিদানের দায়িত্ব নিজে নিতে যান কেন? আমরা অবশ্যই তাদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জানাবো, কিন্তু সেই রক্তের জন্য কখনো আফসোস করবো না।
আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে তারা এখন আল্লাহর মেহমান হয়ে গেছে। আপনি বরং সেইসব বেঈমান ও গাদ্দারদের কথা বলুন, যাদের গাদ্দারীর কারণে তাদের রক্তের ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। আমাদের তলোয়ার এই সব বিশ্বাসঘাতকদের রক্তের পিপাসায় কাতরাচ্ছে। আপনি আমাদের তলোয়ারের পিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা করুন।’
‘তুমি আমার চেতনার প্রাণ সঞ্চার করেছো সালেম।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার এই দুই বন্ধুও আমাকে ঠিক তাই বলেছে। তারাও আমাকে বলেছে, আমাদের নিরাশ ও উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই।’
সালেম মিশরী বললেন, ‘তারা ঠিক কথাই বলেছেন। পরাজয় কোন চিরস্থায়ী জিনিস নয়। আমরা পরাজয়কে বিজয়ে রুপান্তরিত করতে পারি। অতীতেও আমরা এর প্রমাণ দিয়েছি, ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ আমরা পরাজয়কে বিজয়ে পরিনত করে দেখাবো।’
‘যদি এ আলোচনা যুদ্ধের ময়দানের হতো তবে আমার একটি বাহু ছিন্ন হলেও তোমরা আমার মুখে হাসি দেখতে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার অস্থিরতার কারণ, শত্রু এখন আমার ঘরের মধ্যে বসবাস করছে। ইহুদি ও খৃস্টানরা আমাদের জাতির মধ্যে এমন বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে বিষের প্রভাব খুবই আকর্ষণীয় ও জাদুময়। এ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা বড়ই কঠিন।
জাতির সৈনিকদের ব্যাপারে আমার ভরসা আছে। সৈনিক ও জনতা এসব কুপ্রভাব থেকে এখনো মুক্ত। সমস্যা হচ্ছে জাতির শাসক, আমীর ও প্রভাবশালী লোকদের নিয়ে। এ কুপ্রভাব তারাই গ্রহণ করে নিচ্ছে। তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে জাতির ওপর।
শাসক, আমীর ও প্রশাসনের উচ্চস্তরের লোকেরা আরো উর্ধে উঠার জন্য ন্যায়নীতি বিসর্জন দিচ্ছে। গাদ্দারীর খাতায়ও তারাই নাম লেখাচ্ছে। সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হচ্ছে, কতিপয় ধর্মীয় নেতাও শামিল হয়েছে এই ষড়যন্ত্রকারীদের দলে।’
‘হ্যাঁ সুলতান, এই ধর্মীয় নেতারাই এখন ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমনে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর কালামকে অল্প মূল্যে বিক্রি করতে নিষেধ করেছে কোরআন। অথচ তারা তাই করছে। কোরআনকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন না করে তাকে আংশিকভাবে এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে।
আপনার ওপর তারা অসন্তুষ্ট এ কারণে যে, আপনি তাদের রুটি রুজির ওপর হাত দিয়েছেন। কোনরকম কাজকর্ম না করেও এতদিন তাদের সংসার ভালই চলছিল। জনগণ ভক্তিভরে তাদের নজর নিয়াজ দিচ্ছিল। প্রথমে তারা জনগণকে কিছু দোয়া কালাম শিখিয়ে দিচ্ছিল, যাতে তারা পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারে। জনগনও সহজে বেহেশত পাওয়ার পথ পেয়ে তাদের ওপর সন্তুষ্ট ছিল।
কিন্তু আপনি জাতির যুবকদের মনে নতুন চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেন। তাদের শোনালেন জেহাদের মন্ত্র। বললেন, কোরআন পড়তে, হাদিস পড়তে এবং দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে জানতে ও গ্রহণ করতে। নতুন জোশ, নতুন আশা ও উদ্দিপনায় উজ্জীবিত হয়ে যুবকরা দলে দলে জেহাদের ঝান্ডা তলে শামিল হলো। ইসলাম যে পরিপূর্ণ জীবন বিধান তারা তা বুঝতে পারলো। জীবনের প্রতিটি কাজ ইসলামের আলোকে সাজিয়ে নেয়ার জন্য জনগণ যখন উদ্যোগী হলো তখন প্রমাদ গুনলেন ধর্মব্যাবসায়ীরা।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অপর সেনাপতি বললো, ‘এখন তারাও জেহাদের কথা বলে। জনগণকে জেহাদের মর্ম বুঝাতে গিয়ে বলে, জিহাদ ফরজ। কিন্তু এই ফরজ আদায় করতে হলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।
এখন আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়। জিহাদ করতে হলে আমাদের অস্ত্র কিনতে হবে। অস্ত্র কিনতে অর্থের দরকার। অতএব স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রামই এখন আমাদের মূল সংগ্রাম। নজর নিয়াজের পরিবর্তে এভাবেই তারা এখন সম্পদ সংগ্রহ করছে এবং এভাবেই নিজেদের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখছে।’
‘শুধু তাই নয়।’ বললো অন্য সেনাপতি, ‘এরা গোপনে শত্রুর সাথে আঁতাত করে আপনার অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার নানা রকম বুদ্ধি নিচ্ছে। দুশমনও তাদের সাহায্য করতে খুবই আগ্রহী। কারণ দুশমনের পক্ষে যা সম্ভব নয় সেই অসাধ্য তারা সফলতার সাথেই সাধন করছে। গোপনে তাদের সহযোগীতা করছে বিভিন্ন মুসলিম শাসকরাও। কারণ এইসব শাসকরা মনে করছে, তাদের গদি কেবল এইসব আলেমরাই নিরাপদ রাখতে পারে।’
‘শুধু তাই নয়।’ কথা বললো সেনাপতি সালেম মিশরী, ‘বেঈমান ও গাদ্দাররা সাধারণ লোকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মের ধোঁকা দিয়ে তাদের মধ্যে উম্মাদনা সৃস্টি করছে। মুসলমানদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে সংঘাত জিইয়ে রেখে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।
ইহুদি ও খৃস্টানরা এইসব আলেমদের বলছে, ‘তোমরা জনগণকে অন্ধের হাতি দেখার মত ইসলাম দেখাবে। কেউ হাতির কান দেখে বলবে, হাতি হচ্ছে কুলার মত, কেউ লেজ দেখেে বলবে ঝাড়ুর মত, কেউ পা দেখে বলবে থামের মত। হাতিই দেখাবে তাদের কিন্তু হাতির আসল অবয়ব যেন তারা কিছুতেই জানতে না পারে।
তোমরা কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তাদের পথ দেখাবে, কিন্তু ইসলামের প্রাণসত্ত্বার সাথে যেন তাদের কখনো দেখা না হয়। শুধু মুসলমান নয়, মানবতা এবং বিশ্বসভ্যতা রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার ইসলাম, এ কথা যেন মুসলমানরা জানতে না পারে।
তারা যদি জেনে যায়, এ বিশ্ব সংসার আল্লাহর। আল্লাহর বান্দা হিসাবে এ বিশ্ব সংসার দেখার দায়িত্ব মুসলমানদের, তাহলে তাদের মধ্যে যে উদারতা এবং ভালবাসা জন্মাবে সেই ভালবাসা দিয়ে তারা সারা বিশ্ব জয় করে নেবে। তখন তোমার বা আমার স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করার আর কোন উপায় থাকবে না।’
‘কিন্তু আমরা সবজান্তা নই।’ এক সেনাপতি তার বক্তব্যের মধ্যে বাধা দিয়ে বললো, ‘আমরা মসজিদের খতিবও নই, ইমামও নই। অস্ত্র ত্যাগ করে জনগনকে ওয়াজ নসিহত করে সৎপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের নয়।
আপনার কথাগুলো সত্য, কিন্তু দুনিয়ার সব কাজের দায়িত্ব আমরা কাঁধে নিতে পারি না। যে সকল সমস্যা তলোয়ার দিয়ে সমাধান করা যায়, আমাদের দায়িত্ব তার সমাধান করা। অন্যায় যেখানেই হবে এবং যেই করবে আমাদের তলোয়ার সেখানেই ঝলসে উঠতে দ্বিধা করবে না।
মুসলমনারা আজ খৃস্টানদের হাতে নির্যাতীত হচ্ছে, তাই খৃস্টানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছি আমরা। ইহুদীরা আঘাত করছে মুসলমানদের ওপর তাই আমরা ওদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। তেমনি যদি কোন অমুসলমান অঞ্চলে আজ নির্যাতন চলে, তাদের হেফাজত করার জিম্মাও আমাদেরই কাঁধে তুলে নিতে হবে।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কোন ব্যক্তি বা ধর্মের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ নয়, আমাদের লড়াই সততা ও নীতির পক্ষে। অন্যায়ের পাথর পিন্ডকে অশ্বখুরের আঘাতে গুঁড়ো করে দিয়ে সরল রাস্তা বানানোই আমাদের কাজ।
তোমাদের দু’জনের চেতনাতে কোন পার্থক্য নেই। সালেম মিশরী যাদের কথা বলেছে এ সব লোকেরা কুরআনের বিরোধী।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কুরআন স্পষ্ট বলে দিয়েছে, বিধর্মী কাফেরদের তোমরা বন্ধু বানিও না। তাদের কথা ও পরামর্শ গ্রহন করো না। তোমরা জানো না, তাদের মন সর্বদা আমাদের মন্দ ও ক্ষতির চিন্তায় থাকে।’
‘এর শুধু নামে মুসলমান।’ সালেম মিশরী বললো, ‘কুরআন ও সুন্নার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এই অবস্থা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ এরা এক হাতে কুরআন ধরে রেখেছে অপরদিকে কাফেরদের ইশারায় নাচতে শুরু করেছে।
জাতি সর্বদা এমন নেতা ও শাসকদের হাতে মার খেয়ে আসছে। কারণ এদের হাতে রয়েছে কোরআন আর অন্তরে রয়েছে ক্রুশ। জাতি তাদের আসল রুপ দেখতে পায় না, তাদের অন্তরের ধ্বনিও শুনতে পায় না। এমন অবস্থার মধ্যে পড়েই আমরা বারবার গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছি আর একে অপরের রক্ত প্রবাহ করছি। পরবর্তী গৃহযুদ্ধের তলোয়ারও আমাদের ঘাড়ের উপর ঝুলছে।’
‘এই তুফানকে আমাদের অবশ্যই বাধা দিতে হবে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘এ জন্য আমি বলতে চাই, এখন আর কোন আপোষ চুক্তির অবকাশ নেই। এখন গাদ্দারদের খুঁজে বের করতে হবে। জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের মারতে এবং মরতেও প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।’
এ কথায় সুলতান আইয়ুবীর চেহারা আবার উদাস হয়ে গেল। শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে জমা হচ্ছিল অপরিসীম বেদনা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে।
তাঁবুতে অখন্ড নিরবতা বিরাজ করছিল। তিন সেনাপতিই অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল সুলতানের দিকে। তারা সুলতান আইয়ুবীকে চিনতো। জানতো, গৃহযুদ্ধের কথা শুনলেই তিনি উদাস হয়ে যান। তাই তারা চুপ করে রইলো।
‘হে আমার প্রিয় বন্ধুরা!’ সুলতান আইয়ুবী বেদনামাখা স্বরে বললেন, ‘আমার চোখে ভাসছে আমাদের প্রিয় নেতা রাসুলে মকবুলের উম্মতের রক্তাক্ত চেহারা। ভবিষ্যতের দিক তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, রক্তের নদীতে ভাসছে মুসলমানরা। তারা নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ করে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এই আপোসের গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রাখছে ইহুদী ও খৃস্টানরা। এ জন্য আজ একে উস্কে দিচ্ছে, তো কাল তাকে। প্রয়োজনে দু’পক্ষকেই সাহায্য ও সহযোগীতা দিতে ওরা প্রস্তুত।
শাসন ক্ষমতা লাভের লোভ দেখিয়ে ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। সেই রক্তে লালে লাল হচ্ছে ফিলিস্তিনের মাটি। আমি দেখতে পাচ্ছি, মুসলিম রাজ্যগুলো খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। বিভক্ত রাজ্যের শাসকরা সবাই রাজা বাদশাহ বনে যাচ্ছে। তারা বিলাসিতা ও আরাম আয়েসের জীবন বেছে নিয়েছে।
এ অবস্থায় আমি জানি, আমাদের প্রথম কেবলা রাসুলের প্রিয় উম্মতকে ডাকতে থাকবে, কিন্তু সে আহবানে সাড়া দেয়ার প্রয়োজন মনে করবে না কোন মুসলমান। তারা সে ডাক কানেও তুলবে না।
যদি কোন লোক ফিলিস্তিন মুক্ত করার সংকল্প করে তবে তাকে আমাদের মত উন্মাদ হতে হবে। জাতির কিছু লোক যদি স্বাধীনতার জন্য পাগলপারা হতে না পারে তবে সে জাতি কোনদিনই স্বাধীনতার স্বাদ পাবে না।’
‘কিন্তু আজাদী পাগল এই সব মুসলমানদের মুসলিম শাসকরাই ধোঁকা ও প্রতারণায় ফেলে ঠান্ডা করে দেবে। তারা প্রকাশ্যে মিল্লাতের রক্ষাকর্তা সাজবে আর গোপনে বন্ধু হবে ওদের।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তোমরা বলছো, আমরা এই তুফানকে থামিয়ে দিতে পারবো। আল্লাহ চাইলে হয়তো আমরা সত্যি এ তুফান থামিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু আমাদের মরার পর এই তুফান আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’
‘পুনরায় আর এক সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম হবে।’ সেনাপতি সালেম মিশরী বললেন, ‘আরও এক নুরুদ্দিন জঙ্গীর জন্ম হবে। মুসলিম মায়েরা এমন বীর মুজাহিদ সেনাদের জন্ম দিতেই থাকবে। নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাজত করবেন।’
‘আমিও জানি, নিশ্চয়ই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাজত করবেন। তবে এই মুজাহিদদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে বিলাস ও আরাম প্রিয় শাসক।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এমন সময়ও আসবে, সেনাবাহিনীও অলস ও আরাম প্রিয় হয়ে উঠবে। আর তাদের সেনাপতিরা কাফেরদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে যাবে।’
সুলতান আইয়ুবী এ কথা বলেই আবার নিরব হয়ে গেলেন। তার চোখ বলছিল, তিনি ভবিষ্যতের সেই অনাগত দুর্যোগময় দিনগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।
সালেম মিশরী বললেন, ‘কিন্তু সুলতান, আমরা এমন কথা আর কতকাল বলতে থাকবো? আমরা চারজন এই তাঁবুর মধ্যে বসে যতই আলাপ করি না কেন, তাতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না।’
‘আল্লাহর সৈনিকদেরকে কথা নয় কাজে পারঙ্গম হতে হবে।’ এক সেনাপতি বললো, ‘সুলতান, ময়দান আমাদের ডাকছে। আমাদের কাজ দিন, আবার আমাদের ময়দানে নিয়ে চলুন।’
সুলতান আইয়ুবী সেই সেনাপতির দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন সালেম মিশরীর দিকে। বললেন, ‘বন্ধু সালেম! তুমি আমার নির্দেশিত স্থানগুলোতে কমান্ডো বাহিনী ছড়িয়ে রেখেছো। তুমি জানো, আমার এই ক্যাম্প কেমন বিপদ ও আশংকাজনক স্থানে আছে।’
‘হ্যাঁ, ভাল করেই জানি সুলতানে মুহতারাম! ‘ সেনাপতি সালেম মিশরী বললেন, ‘আমরা বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে এই দিকে এসেছিলাম। আমাদের আশংকা মতো খৃস্টানরা আমাদের পিছু ধাওয়া করেনি। কিন্তু এতে এই খুশিতে বিভোর হওয়া উচিত নয় যে, খৃস্টানরা আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছে।
আমি দৃঢ়তার সাথ বলতে পারি, তারা আর আগের মত আমাদের ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ চালাতে আসবে না। এখন থেকে তারাও আমাদের মত অন্ধকারে কমান্ডো আক্রমণ চালাবে। তাদের সেই কমান্ডো আক্রমণ ও অতর্কিত হামলার পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ক্যম্প থেকে বহু দূরে খৃস্টান সৈন্যরা আমাদের প্রহরীদের উপরে ছোট খাটো হামলা করা শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যেই এমন কিছু হামলার সংবাদ আমাদের কানে এসেছে।
আমি আমার কমান্ডো দলগুলোকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছি। আমি খবর পেয়েছি, কাফেরদের তৎপরতা এখন মুশেলেই অধিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন তাদেরকে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে।’
‘যদি এ খবর সত্যি হয় তবে এর ব্যবস্থা আমি করবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি মুশেলেই খৃস্টানরা গোপন আড্ডা বানিয়ে থাকে তবে তার ব্যবস্থা করতে আমাদের বেশী বেগ পেতে হবে না।’
তিনি সেনাপতিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমাদের সাথে আমি একমত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখন আমাকে সেই সিদ্ধান্তই গ্রহন করতে হবে, যা আমার জন্য কষ্ট ও যাতনার কারণ। আমাদেরকে এখন সেই দূর্গগুলো আগে দখল করতে হবে, যেগুলো মুশেল ও হলবের মধ্যে রয়েছে।
আমি এই দুই শহরকে পরষ্পর বিছিন্ন করে দিতে চাই, যাতে পরে তারা আর একে অন্যকে সাহায্য করার সুযোগ না পায়। তাদের কাসেদ চলাচলের পথও বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে তারা সংবাদ আদান প্রদান করতে না পারে।’
সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় খেলা করছিল সেনাপতিসুলভ দৃঢ়তা। একটু আগের বিষন্নতার জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছিল ইস্পাতকঠিন সংকল্প।
তিনি উপস্থিত সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আমার তলোয়ার যেন কোন মুসলমান নামধারীর বিরুদ্ধে কোষমুক্ত না হয়। কিন্তু এখন আমি নিরুপায়। আমি আমার ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমি সেই সব আমির ও শাসকদের শেষ দেখে ছাড়বো, যারা খৃস্টান কাফেরদের বন্ধু। আমি নিজে কখনো জাতির জন্য বোঝা হবো না, বোঝা হয়ে কাউকে জাতির ঘাড়ে চেপে থাকতেও দেবো না। যারা জাতিকে বিভ্রান্ত ও বিপদগামী করছে তাদের সে খেলা আমি বন্ধ করে দেবো।’
সুলতান আইয়ুবী তাঁর নতুন প্ল্যান সেনাপতিদের সামনে ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন।
***
বৈরুতে সম্রাট বিলডনের মহল। কয়েকজন খৃস্টান ছাড়াও দাওয়াত পেয়েছেন সেনাবাহিনীর অফিসার, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নাইট, বিভিন্ন বাহিনী প্রধান ও সেনাপতিরা। সুলতান আইয়ুবীর নিষ্ফল আক্রমণের ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করার জন্যই এ বিরাট আয়োজন।
রাজকীয় এ ভোজসভায় নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন অসংখ্য মেহমান। তাদের প্রায় সকলেই সমাজের নেতৃস্থানীয় খৃস্টান। এই অসংখ্য মেহমানের মধ্যে দেখা গেল দু’জন মুসলমানও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তারা কেবল আমন্ত্রণই পাননি, যথাসময়ে অনুষ্ঠানে হাজিরও হয়েছেন।
উর্বশী মেয়েরা ঘুরেঘুরে মদ পরিবেশন করছিল। মেয়েদের পরনে চুমকি বসানো হালকা রেশমী কাপড়। ফিনফিনে কাপড়ের ভেতর থেকে উপচে পড়ছিল রুপের জৌলুস। মেহমানরা মদের পিয়ালা হাতে করে ঘুরে ঘুরে পরষ্পরের সাথে কুশল বিনিময় করছিল। যতই মদের পরিবেশন বেড়ে চলছিল ততই মেহমানদের হাতগুলো জড়িয়ে ধরছিল মেয়েদেরকে। মেয়েরাও ক্রমশ নির্লজ্জ হয়ে উঠছিল।
মুসলমান মেহমান দুজনও খৃস্টানদের চাইতে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। তারাও সমানে মদ পান করছিল। দুটো মেয়ে তাদের ক্রমাগত তাদের মদ ঢেলে দিচ্ছে মনে হচ্ছে, মুসলমান মেহমানদের আদর আপ্যায়নের দিকে বিশেষ নজর রাখার জন্য তাদের ওপর হুকুম রয়েছে। মেয়ে দুজন বিলোল কটাক্ষ হেনে তাদের পাশে ঘুর ঘুর করছিল। যেন তারা এই দুই মেহমানকে মদ পান করাতে বিশেষ মজা পাচ্ছে।
ওরা এই মেহমান দু’জনের সাথে হাসি ঠাট্টা ও রং তামাশা করছে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ওদের গায়ের ওপর, এ সময় এক খৃস্টান এসে ওদের দু’জনকে বললো, ‘সম্রাট বিলডন আপনাদেরকে তাঁর খাস কামরায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’
এই দুই মুসলমান অতিথির পোষাক-পরিচ্ছদ ও চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল এরা কোন শাহী খান্দানের লোক।
মেয়েরা সরে দাঁড়ালো। এই দুই অতিথি সেই খৃস্টানদের সাথে এগিয়ে গেল সম্রাট বিলডনের খাস কামরার দিকে। ওরা সম্রাট বিলডনের কামরায় প্রবেশ করলো। কামরার বাইরে দুই সিপাই বর্শা হাতে পায়চারী করছে। তাদের পোষাক সাধারণ সৈনিকদের মতো নয়। আরো কেতাদুরস্ত ও জমকালো। তাদের কোমরে শোভা পাচ্ছে শাহী তলোয়ার। তলোয়ারের খাপ বিশেষভাবে পালিশ করা, তাই সে খাপ চমকাচ্ছে। একই রকম চমকাচ্ছে তাদের মাথার শিরস্ত্রাণ।
এই মহলেরই এক রক্ষী, যার দায়িত্ব ছিল মেহমানদের দেখাশোনা করা, বহিরাগত আগন্তুকদের প্রতি নজর রাখা এবং গোপন দেয়ালের অভ্যন্তরে যেসব মেয়েরা আছে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা, মেহমানদের পিছু পিছু সেও বিলডনের কামরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
ঝাড়বাতির আলোকে তার পোষাকও চমকাচ্ছিল। সে সাধারণ সিপাই ছিল না, বরং সে ছিল এক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যোদ্ধা, যার দায়িত্ব ছিল মাহফিলে আগত সকলের নিরাপত্তা বিধান করা।
সে দুজন মুসলমানকে সম্রাট বিলডনের কামরায় নিয়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেখানে। তার গায়ের রং ছিল ফর্সা, বলিষ্ঠ দেহের গড়ন, চেহারায় বুদ্ধির শানিত ছাপ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দুই অতিথিকে সম্রাট বিলডনের কামরায় প্রবেশ করতে দেখলো। মেহমানরা কামরায় প্রবেশ করতেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সম্রাটের দুই রক্ষীর একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যালো জ্যাকোব, এদিকে ঘুরছো কেন? ওদিকে যাও, পরীর নাচ দেখো গিয়ে। যে রসের কপাল নিয়ে জন্মেছো, তাকে সার্থক করে তোল। আমাদের কপাল মন্দ, কখনো এক পাও এদিক ওদিক হতে পারি না।’
জ্যাকব তাদের কৌতুকের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘এই যে দু’জন ভেতরে গেল, এদেরকে তো মুসলমান মনে হয়! এরা কারা? ‘
‘এদের ব্যাপারে এত আগ্রহ দেখনোর কি আছে? এর তো আর তোমার নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে যাচ্ছে না! সম্রাট যখন নিজেই তাদের ডেকে এনেছেন, তাদেরকে নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।’
‘কি বলছো তোমরা! এদের সম্পর্কে আগ্রহ থাকবে না তো কার সম্পর্কে থাকবে?’ জ্যাকব বললো, ‘তোমরা কি জানো না, মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমাদের মনে কি প্রচন্ড ঘৃণা কাজ করছে? সমগ্র খৃস্টান সমাজ পারলে তেতো ঔষধর মতোই ওদের গিলে ফেলতো। এরা তো অচিরেই কোন ইহুদী বা খৃস্টানের হাতে খুন হয়ে যাবে! এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, অথচ আমাকে এখনো জানানো হয়নি, এরা সত্যি মুসলমান, নাকি আমাদেরই কোন ভাই মুসলিম এলাকায় থাকে বলে এই ছদ্মবেশ ধারণ করেছে!’
‘এরা মুসলমান এবং মুসলিম এলাকাতেই থাকে।’ এক প্রহরী বললো, ‘নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও যতদূর জানি, এরা মুশেল থেকে এসেছে এবং সম্ভবত ইয়াজউদ্দিন মাসুদের দূত।’
‘সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সাহায্য নিতে এসেছে?’ জ্যাকব বললো, ‘এই দূতদের বলে দাও, সালাউদ্দিন আইয়ুবী শেষ হয়ে গেছে। রমলার রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার এসেছিল বৈরুত অবরোধ করতে। কিন্তু আমাদের দেখেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে যায়, সাগরের পানিও তার সেই ভয়ের পিপাসা মিটাতে পারেনি। তার সামুদ্রিক নৌবহর কূলে ভেড়ার সাহস পায়নি। সামরিক বাহিনী আঘাত করা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকারও হিম্মত রাখেনি।’
জ্যাকব তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, ‘আমার সব সময়ই এই আফসোস থেকে যাবে, তাঁর পরাজিত সৈন্যদেরকে আমাদের সৈন্যরা কেন পিছু তাড়া করলো না। নইলে আজ সালাউদ্দিন আইয়ুবী আমাদের হাতে বন্দী অবস্থায় থাকতো।’
‘তুমি তোমার কাজ করো বন্ধু!’ বিলডনের প্রহরী বিরক্ত হয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী বন্দী হলেও তোমার হাতে রাজ্য আসবে না, সম্রাট বিলডন মারা গেলে বৈরুত শহরের বাদশাহীও তোমার ভাগ্যে জুটবে না।’
জ্যাকব সেখান থেকে সরে এলো বটে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও বিলডনের বন্ধ দরজা থেকে চোখ সরালো না। তার সমগ্র অস্তিত্ব আছন্ন করে রেখেছিল দুই মুসলিম দূত।
ওরা দু’জন সত্যি সত্যি ইয়াজউদ্দিন মাসুদের রাজদূত ছিল। সুলতান আইয়ুবী যখন বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে মুশেলের দিকে চলে যান, তখন ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বাগদাদের খলিফার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন ভয়ে। বাগদাদের খলিফা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শায়খুল উলামার মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবীর সাথে একটা আপোষ রফায় আসতে। শায়খুল উলামার অনুরোধে সুলতান আইয়ুবী ইয়াজউদ্দিন মাসুদক ক্ষমা করে দেন। বিনিময়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ প্রকাশ্যে সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্র সমার্পনের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তিনি গোপনে দূতকে খৃস্টান সম্রাট বিলডনের দরবারে পাঠিয়ে দেন। এরাই সে দূত, যারা সম্রাট বিলডনের কামরায় বসেছিল।
‘মুশেলের শাসক বলেছেন, আপনি সুলতান আইয়ুবীর পিছু ধাওয়া না করে একটা বিরাট ভুল করেছেন।’ এক দূত বিলডনকে বললো, ‘আপনি তার সৈন্যদের বিশ্রাম করার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
‘ইয়াজউদ্দিন মাসুদের অভিপ্রায় কি? তিনি কি তোমাদের কোন লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন?’ জানতে চাইলেন সম্রাট বিলডন।
‘রাস্তায় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকায় তিনি কোন লিখিত পয়গাম পাঠাতে পারেননি। যা বলার তা আমাদের বুকে গেঁথে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহামান্য সম্রাট! আমাদের সম্মিলিত দুশমন আবার ময়দানে নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। কিন্তু তার আগের উদ্যম ও সাহস আর নেই। তাই সে বৈরুত অবরোধ করেও পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। তাকে শায়েস্তা করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দামেশকের দিকে অভিযান চালান। এই শহরই সুলতান আইয়ুবীর শক্তি ও ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুলতান এখন এই শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। এই সুযোগে আপনি যদি শহরটাকে অবরোধ করে আপনার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারেন তবে আমার বিশ্বাস সুলতান আইয়ুবী আর কখনোই দামেশকে উঠতে পারবে না।
মহামান্য সম্রাট! আপনি অভিযান দ্রুত চালাবেন। আপনার দামেশক পৌঁছার সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা করবো সুলতান আইয়ুবীকে আটকে রাখতে। তিনি এখন মুশেলের কাছে নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প করে বসে আছেন। আমি সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর সারাক্ষণ নজর রাখছি।’
সম্রাটের কামরায় বসে কথা বলছিল ওরা। জানালা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল আকাশের চাঁদ। রাতের সেই চাঁদ অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছিল রাসূলের প্রিয় উম্মতের মধ্যে থেকে জন্ম নেয়া দুই বিশ্বাসঘাতকের কর্মকান্ড। চাঁদের কলঙ্কের মতই মুসলিম জাতির মধ্যে কলঙ্ক হয়ে ওরা যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকে, পার্থক্য শুধু এটুকু, চাঁদের কলঙ্ক দেখা যায় কিন্তু জাতির কলঙ্ক সহজে সনাক্ত করা যায় না।
সমাপ্ত
Leave a Reply