ক্রুসেড সিরিজ ২৩ – ইহুদী কন্যা
আসাদ বিন হাফিজ
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ এর ‘ঈমানদীপ্ত দাস্তান’ এর ছায়া অবলম্বনে রচিত
ভূমিকা
রহস্য সিরিজ ক্রুসেড; ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হাজার বছর ধরে চলছে এ ক্রুসেড। গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
কেবল সশস্ত্র সংঘাত নয়, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সে যুদ্ধ ছিল সর্বপ্লাবী। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল খৃস্টানরা। একে একে লোমহর্ষক অসংখ্য সংঘাত ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল ষড়যন্ত্রের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিয়েছিল মদ ও নেশার দ্রব্য। বেহায়াপনা আর চরিত্র হননের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর শহর-গ্রামে। একদিকে সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে কুটিল সাংস্কৃতিক হামলা- এ দু’য়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল মুসলিম বীর শ্রেষ্ঠরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য ও স্বাসরুদ্ধকর ঘটনার, মানুষের কল্পনাকেও যা হার মানায়।
.
.
ইহুদী মেয়েটিকে হারিয়ে হলবের শাসক আল মালাকুস সালেহ উন্মাদ হয়ে গেলেন। সারা রাত চাকর-বাকর ও দাস-দাসীদের নাজেহাল করে ছাড়লেন মেয়েটির জন্য। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজল মহলের প্রতি ইঞ্চি জায়গা। কিন্তু কোথাও তার ছায়াও পেল না।
সারা রাত এই হাঙ্গামায় কেউ ঘুমাতে পারল না। না আল মালেকুস সালেহ, না দাস-দাসীরা। আস সালেহের তর্জন গর্জন, রক্তচক্ষু, অনাকাংখিত ধমকে তটস্থ হয়ে সারা রাত ওরা ছোটাছুটি করল।
আস সালেহ নিজেও ছুটে বেড়ালেন চরকির মত। কিন্তু ফলাফল শুন্য। যুবক সালেহের চিত্তে উন্মাদনা সৃষ্টি করে মেয়েটি উধাও হয়ে গেছে। সেই সাথে উধাও হয়ে গেছে সম্রাট বিলডনের পক্ষ থেকে আগত বনিকবেশী তিন উপদেষ্টা।
সময় থেমে থাকেনা। মানুষের দুঃখ কষ্ট আনন্দ অস্থিরতা কোনোটাই স্থিতিশীল নয়। সময়ের গতি প্রবাহের সাথে সঙ্গতি রেখে পালটে যায় এসবের ধরন, পাল্টে যায় অনুভূতির রং ও রূপ।
সবাই আশা করছিল ভোরে যখন আলোর মুখ দেখবেন আস সালেহ, তখন হয়তো নেশার ঘোর কেটে যাবে। কিছুটা শান্ত হবেন তিনি।
কিন্তু সকালে দেখা গেল পরিস্থিতি উল্টো দিকে গড়াচ্ছে। আস সালেহের চোখ আরও রক্তবর্ণ ধারন করেছে। কাউকে ঠিকমত চিনতে পারছেন বলে মনে হলো না। যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকেই জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছেন। অনবরত প্রলাপ বকছেন।
দাস-দাসীরা তাকে শান্ত করতে পারছে না। তারা তার হেফাজতের জন্য রক্ষী বাহিনীর সহায়তা চাইল। একজন ছুটে গেল ইবনে খতিবের কাছে। বলল, ‘সুলতান খুবই অস্থিরতার মধ্যে আছেন। সারা রাত ঘুমাননি। কখন কি অঘটন ঘটিয়ে বসেন এই ভয়ে আমরা অস্থির। চলুন, দেখবেন সুলতানকে।’
ইবনে খতিব মহলে প্রবেশ করল। দাসীদের সঙ্গে গিয়ে পৌঁছল আল মালেকুস সালেহের সামনে। দেখল তার বিবর্ণ দশা। এক রাতেই লোকটা যেন পাল্টে গেছে।
তাকে দেখতে পেয়েই আস সালেহ পাগলের মত ছুটে এলেন। রক্তবর্ণ চক্ষু মেলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটি মেয়ে এবং বণিক তিনজনকে দেখেছ? ওদেরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বলতে পারো ওরা কোথায়?’
‘হ্যাঁ, আমি তাদেরকে অনুষ্ঠানের সময় সভায় দেখেছিলাম।’ ইবনে খতিন বললো, ‘আমি আমার বাহিনী নিয়ে প্যান্ডেলের বাইরে সতর্ক পাহারায় ছিলাম। মাঝ রাতের সামান্য আগে বণিক তিনজন বাইরে এলো। তাদের সাথে একটি খুবসুরত মেয়েও ছিল।
আমি দেখলাম ওরা কথা বলতে বলতে ওদের বাণিজ্য কাফেলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই তারা অন্ধকারে হারিয়ে গেল। তারা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার খানিক পরে আমি ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দ শুনে দ্রুত এগিয়ে দেখতে পেলাম, ওরা চারজন চারটি ঘোড়ায় চড়ে বসেছে আর ঘোড়া চারটি ওদের নিয়ে পশ্চিমের ফটকের দিকে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম তারা হয়তো ঘুরতে বেড়িয়েছে অথবা আপনার অনুমতি নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। তাই আমি ওদের বাধা দেয়ার দরকার মনে করিনি। কিন্তু তারা সেই যে গেছে আর ফিরে আসেনি। ফিরে এলে আমার বাহিনী তাদের অবশ্যই দেখতে পেতো।’ এ সময় সুলতানের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে এলেন এক সেনাপতি। এ সেনাপতি সুলতান আইয়ুবীর এক বিশ্বস্ত সমর্থক ছিলেন।
তিনি ভাল করেই জানতেন, মেয়েটি এবং তিন খৃস্টান উপদেষ্টা এখন কোথায়। তিনি আস সালেহকে বললেন, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল এরা বণিক নয়।’ বণিক হলে তারা আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের সাথেই যোগাযোগ করতো। বণিকবেশী লোক তিনজন নিশ্চয়ই গোয়েন্দা ছিল। সম্ভবত মেয়েটিও তাদেরই সহযোগী। তারা এত সুন্দরী মেয়ে আপনার কাছে রাখতে চায়নি। আপনাকে ধোঁকা দিয়ে আপনার কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য নিয়ে পালিয়েছে তারা।’
‘তারা আমার কাছ থেকে কি গোপন তথ্য নেবে?’ অনেকটা রাগের সাথেই বললেন আস সালেহ।
‘জানিনা। তবে গোয়েন্দারা তাদের কাজে এতই পারদর্শী হয় যে, যার কাছ থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে তিনি জানতেও পারেন না কি গোপন তথ্য তিনি তাদের সরবরাহ করেছেন। হয়তো তারা এমন গোপন তথ্য নিয়ে গেছে যা আপনার ও জানা নেই।’
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় জানা ছিল না আস সালেহের। একজন শাসক হিসেবে তিনিও জানতেন গোয়েন্দাদের দক্ষতার কথা। সেনাপতির কথা শেষ হলেও তাই তিনি এর কোন জবাব দিলেন না। বরং তিনি হঠাৎ করেই একদম চুপ মেরে গেলেন। এতক্ষণ যে প্রলাপ বকছিলেন সেই প্রলাপ বকাও বন্ধ হয়ে গেল।
তার মনে পড়ে গেল, মেয়েটা দিনের বেলায়ও তাকে মদ পান করিয়ে মাতাল করে রাখত। সেই মাতাল করা ঘোরের মধ্যে মেয়েটা কোন প্রশ্ন করেছিল কিনা তিনি মনে করতে পারলেন না। তবে মনে মনে স্বীকার করলেন, এ সময় অনেক গোপন কথা তার কাছ থেকে জেনে নেয়া সম্ভব।
এ কথা মনে হতেই তার মনে ভীষণ দুঃখ হলো। তার মধ্যে আবার হঠাৎ করেই জাগ্রত হলো দায়িত্ববোধ। এ বোধ তার মন থেকে মেয়েটির চিন্তা দূর করে দিল। কিন্তু সেখানে জন্ম নিল গোপন তথ্য পাচারের দুশ্চিন্তা।
সেই সাথে ভয় হলো, যদি এই কথা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি কোনো ভাবে জেনে যান? তার গোয়েন্দারা তো এ মহলেও থাকতে পারে! এ খবর পেলে তিনি কি ক্ষমা করবেন আমাকে? আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে আমি কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো? তিনি মনে মনে এসব ভাবছিলেন আর শিহরিত হচ্ছিলেন।
এসব ভাবনা তাকে পুরোপুরি পেয়ে বসলে ভয় ও হতাশায় তিনি একেবারে মুষড়ে পড়লেন। একটু পর তিনি সেখান থেকে উঠে আস্তে আস্তে নিজের শয়ন কামরার দিকে হাঁটা দিলেন। বিছানায় শুয়েও তিনি ঘুমোতে পারলেন না। ভয় আর দুশ্চিন্তা তাকে একেবারেই কাবু করে ফেলল।
অনেকদিন থেকেই তিনি রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা মদের নেশায় মাতাল অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন। ছলনাময়ী এক নারীর পাল্লায় পরে এভাবে নিজের উপর অত্যাচার করায় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ ছাড়াও তার মনে জন্ম নিল নিজের প্রতি ক্রোধ ও ঘৃণা। আস্তে আস্তে সেই ক্রোধ ও ঘৃণা অনুশোচনায় রুপান্তরিত হলো। অনুশোচনা যখন তীব্র আকার ধারন করলো তখনই তার মনে পড়লো বাণিজ্য কাফেলার কথা।
বণিকরা পালিয়ে গেলেও বাণিজ্য কাফেলাটি ত আর পালিয়ে যায়নি! হঠাৎ তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি বিছানা ছেড়ে সোজা দরবারে এসে ঢুকলেন। প্রহরীকে বললেন, ‘জলদি রক্ষী কমান্ডার ও সেনাপতিকে খবর দাও।’
খবর পেয়ে সাথে সাথে ছুটে এলেন সেনাপতি ও ইবনে খতিব। তিনি তাদেরকে সামনে পেয়েই অভাবিত এক কড়া হুকুম জারী করে বসলেন। বললেন, ‘বণিকদের সাথে যে বাণিজ্য কাফেলা এসেছে অই কাফেলার সবাইকে বন্দী করো। বণিক তিনজন কোথায় গেছে ওরা যদি তার হদিস ও সন্তোষজনক জবাবা দিতে না পারে তবে ওদের সবাইকে হত্যা করবে। তাদের উট এবং মাল-সামান সরকারী গুদামে সরকারী মাল হিসেবে পাঠিয়ে দাও।’
সেই সন্ধ্যাতেই আল মালেকুস সালেহের পেটে ভীষণ ব্যাথা শুরু হলো। ডাক্তার তাকে ঔষুধ ও ব্যাবস্থাপনাপত্র দিলেন কিন্তু তার বেদনা বেশেই চললো। রাত যত বাড়তে লাগল তার কষ্টও ততই বেড়ে চলল। প্রথমে তলপেটে, তারপর সে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ল নাভী এবং বুক পর্যন্ত।
পরের দিন ৯ই রজব। তার রোগের অবস্থা চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। ডাক্তার সবসময় তার কাছে বসে থেকেও কিছুই করতে পারছেন না। তিনি বার বার মূর্ছা যেতে লাগলেন। রোগ বেড়েই চললো। সেই দিনটি এবং পরবর্তী রাতও এই অবস্থায়ই কেটে গেল।
পরের দিন। তার অবস্থা আরো খারাপ হলো। তিনি বেহুশের মত পড়ে রইলেন বিছানায়। ডাক্তার তার অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি সেনাপতি, রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে তার আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে বললেন, ‘সুলতানের অবস্থা খুবই সংকটপূর্ণ। অচেনা রোগে আক্রান্ত তিনি। আমার কোন ঔষধই কাজ করছেনা। খুব বেশী সময় বাঁচবেন না তিনি।’
মসজিদের ইমাম সাহেবকে খবর দেয়া হলো। তিনি এসে আস সালেহের শিয়রে বসে কোরআন পাঠ করতে লাগলেন।
রাতে আস সালেহের জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। বিষণ্ণ চোখে তাকালেন ইমাম সাহেবের দিকে। ক্ষীন কন্ঠে বললেন, ‘যদি কোরআন সত্য হয়ে থাকে তবে তার বরকতে আমাকে সুস্থ করে তুলুন।’
ইমাম সাহেব বললে, ‘কোরআনের বরকত তার উপরই বর্ষিত হয়, যিনি কোরআনের বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করেন। আমাকে মাফ করবেন, কারো অসন্তুষ্টির ভয়ে সত্য কথা বলা থেকে আমি বিরত থাকতে পারিনা। একজন ইমাম হিসেবে মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেয়াটা আমার দায়িত্ব।
আমার বলতে দ্বিধা নেই, আপনি কোরআনের বিরুদ্ধেই আপনার সারাটা জীবন ও শাসন চালিয়েছেন। এ অবস্থায় আল্লাহর রহমত পেতে হলে আপনাকে খালেছ দীলে তওবা করতে হবে। আল্লাহ যদি আপনার গোনাহ ক্ষমা করে দেন তবেই কেবল আপনি তাঁর রহমত আশা করতে পারেন।’
‘আমি তওবা করবো হুজুর। আপনি আমার তওবার ব্যবস্থা করুন।’
‘কিন্তু তওবার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান হচ্ছে, তিনি মানুষের সাধারন গোনাহ ক্ষমা করলেও অন্য মানুষের সাথে কৃত অন্যায় ক্ষমা করেন ন। কোন মানুষকে কষ্ট দিলে বা কারো অধিকার হরণ করলে সেই ক্ষমা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকেই নিতে হয়। ব্যক্তি মাফ করলেই কেবল আল্লাহ তাকে ক্ষমার যোগ্য বিবেচনা করবেন।
এদিক থেকে আপনার অপরাধ যে সীমাহীন! আপনি তো আপনার মায়ের দুধেরও অপমান করেছেন! আপনি আপনার মায়ের মনে যে কষ্ট দিয়েছেন টা দূর করতে না পারলে আল্লাহ কখনোই আপনার প্রতি সদয় অবেন না।’
এ সময় শামসুন নেছা ভাইয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল আর দোয়া দরূদ পড়ছিল। ইমাম সাহেবের এ তিক্ত কথাগুলো শুনে আস সালেহের মুখ থেকে সহসা বেড়িয়ে এলো, ‘মা, মাগো! তুমি তোমার এ পাপিষ্ঠ সন্তাকে ক্ষমা করে দাও।’
তার কাতর কণ্ঠের ধ্বনি ঘরের বাতাস বিষণ্ণ করে তুলল। শামসুন নেছা এগিয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত রাখল।
আস সালেহ ছোট বোনের একটি হাত আঁকড়ে ধরে বললেন, ‘শামসি! বোন আমার! আমি আর বাঁচবো না। তুই কি পারবি মাকে একটু ডেকে আনতে! আমার যে মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে! শোন, আমি লোক দিচ্ছি, তুই মায়ের কাছে চলে যা। মাকে বলবি, তোমার একমাত্র ছেলে মৃত্যুশয্যায়। সে তোমাকে শেষ বারের মত দেখতে চায়! যদি মা আসেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। আর যদি মা আসতে অস্বীকার করেন, তবে তাকে বলবি, মা, তোমার একমাত্র ছেলে মারা যাচ্ছে! তুমি তার দুধের ঋণ আর পাপ ক্ষমা করে দাও।’
ইমাম সাহেব তাকালেন শামসুন নেছার দিকে। সে তার ভাইয়ের কপালে মমতার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমি এক্ষুণি দামেশকের পথে যাত্রা করছি ভাইয়া! দেখিস, আমি ঠিক মাকে নিয়ে আসবো।’
শামসুন নেছা দ্রুত পদে কামরা থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে যখন আবার কামরায় ঢুকল তখন তার বেশভূষা একদম পালটে গেছে। এক অশ্বারোহীর সাজে সজ্জিত সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের একমাত্র ষোড়শী কন্যা শামসুন নেছা।
আস সালেহ চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। চেহারায় কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। শামসুন নেছা ভাইয়ের শিয়রে গিয়ে দাঁড়াল। হাত রাখল তার কপালে।
চোখ মেলে চাইলেন আস সালেহ। শামসুন নেছা বলল, ‘চলি ভাইয়া! পথ চেনে এমন আটজন বিশ্বস্ত রক্ষী সঙ্গে নিয়েছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না, মাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরব ইনশাআল্লাহ।’
আস সালেহ তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষীন কন্ঠে বললেন, ‘ফী আমানিল্লাহ!’
ভাইয়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহল থেকে বেরিয়ে এলো শামসুন নেছা। রাতের অন্ধকারেই লাফিয়ে চড়লো ঘোড়ার পিঠে। তারপর আটজন সঙ্গী নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল দামেশকের পথে। দুর্বার বেগে ঘোড়া ছুটে চলল দামেশকের দিকে।
ইতিহাসবিদ কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তাঁর বইতে লিখেছেন, ১৩ই রজব শামছুন নেছা রওনা হয়ে যাবার পর আস সালেহের অবস্থা এতই খারাপ হয়ে যায় যে, মহলের দরজা সবার জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। সেনাপতি গুরুত্বপূর্ণ আমীর ও উজিরদেরকে মহলে এনে বসিয়ে রাখলেন পরিস্থিতির আলোকে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য।
দুপুরের পর সামান্য সময়ের জন্য আস সালেহের জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি ইশারায় সেনাপতি ও উজিরকে কাছে ডাকলেন। ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, ‘আমি মারা গেলে সুলতান আইয়ুবীই হবেন হলবের মূল শাসক। তিনি পরবর্তী শাসক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদ হলবের শাসকের দায়িত্ব পালন করবেন।’
সাইফুদ্দিনের মৃত্যুর পর ইয়াজুদ্দিন মাসুদ হলবের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি তখন মুশেলেই ছিলেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাকে হলবেরও শাসনকর্তা নিয়োগ করা হলো।
এটুকু করেই শান্ত হলেন না আস সালেহ। ইশারায় রক্ষী বাহিনীর প্রধানকে ডেকে বললেন সকল আমীর ও সভাসদদের ডেকে আনতে। ইবনে খতিব কালবিলম্ব না করে সমস্ত আমীর ও সভাসদদের জরুরী ভিত্তিতে আস সালেহের নিকট হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠালো।
সবাই হাজির হলে আস সালেহ বললেন, ‘আমি চাই আপনারা সবাই ইয়াজউদ্দিন মাসুদের পক্ষে শপথ বাক্য পাঠ করুন। আমি আপনাদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি দেখে মরতে চাই।’
আস সালেহের শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে দরবারের সকল আমীর ও সভাসদগন ইয়াজউদ্দিন মাসুদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ বাক্য পাঠ করলেন। আস সালেহ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
২৫ রজব। আস সালেহের তখন কোন হুশ ছিল না। অজ্ঞান অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি মৃত্যুর আগেই মুশেলের পথে কাসেদ রওনা হয়ে গিয়েছিল। কাসেদ ইয়াজিউদ্দিন মাসুদের কাছে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আস সালেহের শেষ পয়গাম ও ফরমান। এই ফরমানে উল্লেখ ছিল হলবের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করার কথা। আরো উল্লেখ ছিল, হলবের সকল উজির, আমীর ও সভাসদগন যে তাঁর আনুগত্যের শপথ নিয়েছে এ খবর।
তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন কাসেদকে মুশেলের উদ্দেশ্যে পাথিয়ে দেয়া হলো। তাকে বলা হলো, ‘তুমি গিয়ে মুশেলের বর্তমান শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে জানাবে, সুলতান আস সালেহ মারা গেছেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী এখন আপনিই হলবের শাসক। হলবের সকল আমীর, উজির এবং সেনাবাহিনী আপনার আনুগত্যের শপথ নিয়ে বসে আছে। তারা সবাই আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়।’
সে সময় শামসুন নেছা দামেশকে তার মায়ের পদতলে বসে বলছিল, ‘মা, তোমার একমাত্র সন্তান মৃত্যু শয্যায়। মরার আগে সে তোনাকে একবার দেখতে চায়। চলো মা হলবে! ডাক্তার বলেছে, সে আর বাঁচবে না।
নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন তখনো বলছিলেন, ‘যেদিন বিশ্বাসঘাতকের খাতায় নাম লিখিয়েছে আমার সন্তান, সেদিনই সে মারা গেছে। আমার কোন ছেলে আর বেঁচে নেই যাকে দেখার জন্য আমার হলবে যেতে হবে। তুমি ফিরে যাও, আমি কিছুতেই হলবে যাবো না।
‘মা, আপনার দুধের ঋণ আর পাপের ক্ষমা চেয়ে সে কান্নাকাটি করছে। আপনি মাফ না করলে আল্লাহও যে তাকে মাফ করবে না।’
‘তাকে বলিস, আমি তাঁর দুধের ঋণ ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তার পাপের ক্ষমা আল্লাহ করবেন কিনা জানি না।’
‘আপনি দোয়া করুন মা। আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেন।’
‘না, কোন অপরাধীর জন্য আমি আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করতে পারবো না। গদীর লোভে যে জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারে, যার কারনে শত শত মুজাহিদকে পান করতে হয়েছে শাহাদাতের পেয়ালা, তাঁর জন্য ফরিয়াদ জানাব আমি! অসম্ভব, এ হতে পারে না। কাল হাশরের মাঠে আমি সেইসব মা, বোন ও স্ত্রীদের সামনে লজ্জিত হতে চাই না, যাদের ছেলে, ভাই ও স্বামীর মৃত্যুর কারন ছিল আমার সন্তান।’
সে সময়ই আস সালেহ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। শামসুন নেছা যখন হলবে ফিরে এলো তখন তার একমাত্র ভাই আস সালেহের লাশ নিয়ে লোকজন কেল্লা থেকে বাইরে বের হচ্ছিল। ফটকের বাইরে অনেক লোক। তারা সবাই এসে শামিল হয়েছিল নূরুদ্দীন জঙ্গীর একমাত্র সন্তান আল মালেকুস সালেহের জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য।
ইয়াজউদ্দিন মাসুদের কাছে গিয়ে পৌঁছল আস সালেহের দূত। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ তাঁর উজির ও পরিষদকে জানাল এ খবর।
বৈঠক থেকে তারা তখনো উঠেনি, এ সময় পৌঁছল দ্বিতীয় দূত। আস সালেহের মৃত্যু সংবাদ শুনে উপদেষ্টাবৃন্দ বললো, ‘আপনি এখনি রওনা হয়ে যান। হলবের জনগণকে আশ্বস্ত করুন, তারা যেন নিজেদের অভিভাবকহীন না মনে করে।’ ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আস সালেহের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য তৎক্ষণাৎ হলবের উদ্দেশ্যে রওনা যাত্রা করলেন।
তিনি যত দ্রুত সম্ভব হলবে পৌঁছে যেতে চাচ্ছিলেন। এ জন্য তিনি প্রশস্ত সড়ক পথ পরিহার করে দূরত্ব কমানোর জন্য বিকল্প ছোট পথ ধরলেন। এ পথ চলাচলের জন্য আরামদায়ক না হলেও রাস্তা কমে যাবে অনেক।
আরো একটি কারণে এ পথে যাওয়া তিনি জরুরী মনে করলেন। সুলতান আইয়ুবীর চাই সুলতান তকিউদ্দিন এখন যেখানে সেনা ক্যাম্প করে আছেন সে ক্যাম্প এ পথেই পড়বে। হলবে পৌঁছার আগেই এ ব্যাপারে তিনি সুলতান তকিউদ্দিনের পরামর্শ গ্রহন করা জরুরী মনে করলেন। ইয়াজউদ্দিন মাসুদের ছোট্ট কাফেলা ও বাহিনী সুলতান তকিউদ্দিনের ক্যাম্পের কাছে চলে এলে তিনি তার বাহিনীর অগ্রগতি থামিয়ে দিলেন। ক্যাম্পের রক্ষীকে জানালেন তার আগমনের কথা। সুলতান তকিউদ্দিন নিজে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ হলবের পরিস্থিতি এবং আস সালেহের মৃত্যু সংবাদ তাকে জানিয়ে বললেন, ‘আস সালেহ মৃত্যুর পূর্বে আমাকে হলবের শাসক নিয়োগ করে গেছে। তাঁর সকল আমীর ও উজির এ নিয়োগ মেনে নিয়েছে। আমি এ দায়িত্ব গ্রহনের পূর্বে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।’
সুলতান তকিউদ্দিন বললেন, ‘ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে এবং হলবকে দামেশকের অধীনে রাখতে তোমার ভূমিকা রয়েছে। এক গাদ্দার মরে গিয়ে যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে তাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করো। হলবে যেন আর কোন গাদ্দার মাথা তুলতে না পারে সেদিকে তোমার খেয়াল রাখতে হবে। দামেশকের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতেও সক্রিয় হতে হবে তোমাকে।’
ইয়াজউদ্দিন মাসুদ তাঁর এ নতুন ও কঠিন দায়িত্বের বোঝার কথা ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বললেন, ‘আপনি যে দায়িত্বের কথা বললেন তা নিয়ে আমি আগেও ভেবেছি। আস সালেহের নিয়োগের খবর পাওয়ার পর থেকেই ভাবছিলাম, কিভাবে অগ্রসর হব আমি। আমি জানি দামেশকের সাধারণ জনসাধারণ এখনো মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করে। তাঁর বিধবা স্ত্রী নূরুদ্দিন জঙ্গীর আদর্শ আঁকড়ে ধরে যে ত্যাগ-তিতীক্ষার সাগর পাড়ি দিয়েছেন সেজন্য দামেশকের জনসাধারণ তাকেও সমান শ্রদ্ধা করে। হলব ও দামেশকের সম্পর্ক দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করতে এই মহিলা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারবে। এই মহিলার সহযোগিতা আদায়ের ব্যাপারে আমি আপনার সাহায্য চাই।’
‘এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘এই মহিয়সী মহিলা সম্মত হলে আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। আমি মনে করি আমার আশা পূরণ হলে আপনার প্রত্যাশাও পূরণ হবে। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই এই মহিলাকে আমার পাশে প্রয়োজন।’
‘আমি আজই দামেশকে রওনা হয়ে যাবো তোমার এই প্রস্তাব নিয়ে। আমার বিশ্বাস, তিনি তোমার এই প্রস্তাবকে অশ্রদ্ধা করবেন না।’
এ আলোচনার পর তকিউদ্দিন দামেশকের পথে আর ইয়াজউদ্দিন হলবের পথে রওনা হয়ে গেলেন। তকিউদ্দিন দামেশকে পৌঁছেই রাজিয়া খাতুনের দুয়ারে হাজির হলেন। রাজিয়া খাতুনকে তিনি জানালেন তাঁর ছেলের মৃত্যু সংবাদ।
‘আল্লাহ তাঁর পাপ ক্ষমা করুন।’ ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে বললেন রাজিয়া খাতুন।
তকিউদ্দুন বললেন, ‘আস সালেহ মরার আগেই হলবের পরবর্তী শাসনকর্তা হিসাবে মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে নিযুক্ত করে গেছেন। ইয়াজউদ্দিন মাসুদও এ দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন রাজিয়া খাতুন।
তকিউদ্দিন বললেন, ‘বর্তমান সময়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’
‘আমার সহযোগিতা! কি বলছেন আপনি! আমি তাকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?’
‘তিনি আপনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।’এ প্রস্তাবের কথা শুনে রাজিয়া খাতুন আকাশ থেকে পড়লেন। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্থলে আর কাউকে বসানোর কথা তিনি কল্পনাও করেননি।
তিনি প্রবল আপত্তি তুলে বললেন, ‘না, না, তা কি করে হয়! মরহুম জঙ্গীর জায়গায় অন্য কাউকে বসানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। না, এ কিছুতেই হতে পারে না। দয়া করে আপনি আপনার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিন। আমাকে অযথা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না।’
‘এ বিয়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ ও আপনার মধ্যে নয়।’ তকিউদ্দিন বললেন, এটা হবে দামেশক ও হলবের সাথে ঐক্যবন্ধনের যোগসূত্র। এ বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব হলে ভবিষ্যতের জন্য গৃহযুদ্ধের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জনশক্তি গড়ে তোলা সহজ হবে। বিশেষ করে আপনার মত বলিষ্ঠ ঈমানদার মহিলা তাঁর পাশে থাকলে ভবিষ্যতে কখনো গাদ্দারির পথে পা বাড়াতে সে সাহস পাবে না। খ্রিষ্টানরা ষড়যন্ত্রে উস্তাদ এবং হলব সব সময়ই ষড়যন্ত্রকারীদের শক্ত ঘাটি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। আমরা চাই না, ইয়াজউদ্দিন মাসুদের মত সম্ভাবনাময় যুবক দুশমনের খপ্পড়ে পড়ে শেষ হয়ে যাক।’
রাজিয়া খাতুনের চোখে তখন টলোমলো অশ্রু। তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে অশ্রু মুছে নিয়ে বললেন, ‘যেই মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, ইসলামের খেদমতের জন্যই আমার জীবন। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের জন্য আমি যে কোন কোরবানী দিতে প্রস্তুত। যদি আমাকে দিয়ে ইসলামের কোন উপকার হবে বলে মনে করেন, তবে নির্দ্বিধায় আদেশ করবেন। আমি সে আদেশ মাথা পেতে নেবো।’
রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আমার নিজস্ব ইচ্ছা ও পছন্দ বলে কিছু নেই। ইসলামের স্বার্থে আমার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা আমি আপনাদের হাতে সোপর্দ করছি। সুলতান আইয়ুবীকে আমি আমার ভাই ও নেতা মনে করি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। তিনি আমাকে যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমি তাই মাথা পেতে নেবো।’
সুলতান আইয়ুবীকে জানানো হলো ইয়াজউদ্দিন মাসুদের অভিপ্রায়। অবশেষে সুলতানের অনুমোদন নিয়ে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারী ইয়াজউদ্দিন মাসুদ ও রাজিয়া খাতুনের বিবাহ সম্পন্ন হলো।
* * *
সাপটি মাত্র এক ফুট লম্বা। কিন্তু এই সাপটিই ইসহাকের তাগড়া জোয়ান ঘোড়াটিকে অচল করে দিল। ইসহাকের গন্তব্যস্থান রখনো অনেক দূরে। সিনাই মরুভূমির দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিচ্ছিল সে। বলা যায় মাত্র অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে, এখনও বাকি আছে আরো অর্ধেক পথ।
ইসহাক জন্মসূত্রে তুরস্কের বাসিন্দা। তুর্কী আভিজাত্য লেপ্টে আছে তার চেহারায়। সুন্দর সুগঠিত শরীর। অটুট স্বাস্থ্য। মুখের গড়ন আর গায়ের রঙ আকর্ষণীয় ও ফর্সা। চোখ দুটো নীল। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে আরবী মুসলমান নাকি ইউরোপীয় খ্রিষ্টান। তার যেমন স্বাস্থ্য ভাল ছিল তেমনি ছিল রূপের জৌলুশ।
কিন্তু এ জন্যই সে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত বলার উপায় নেই। বরং সে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত তার ভরাট কণ্ঠস্বর আর বুদ্ধিদীপ্ত কথার জন্য।
আইয়ুবীর একজন সতর্ক ও চালাক সৈনিক হিসেবে সে ছিল অনেকেরই প্রিয়ভাজন। সে যখন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল মাত্র আঠার বছর।
সৈন্য বিভাগের চাকরী সে শখের বশে বা জীবিকা উপার্জনের জন্যই কেবল গ্রহন করেনি বরং সে সৈন্য বিভাগে নাম লিখিয়েছিল ঈমানের অপরিহার্য দাবী পূরণের তাগিদে।
তার জীবন ছিল একজন মর্দে মুমিনের বাস্তব রূপ। ক্রুসেড বাহিনীর বিরাট সংকল্পের সংবাদ পেয়ে সে ইসলামের হেফাজতের জন্য দামেশক চলে আসে এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। যখন সুলতান আইয়ুবীকে মিশরের শাসক নিযুক্ত করা হয় তখন ইসহাককে পাঠানো হয় মিশরে। সে নিজেকে তুর্কী মুসলমান বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতো।
তার মতো অনেক তুর্কী মুসলমান সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে ছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের উপর যথেষ্ট আস্থা ও বিশ্বাস রাখতেন। তিনি যখন কমান্ডো ফোর্স গঠন করেন তখন বেশির ভাগ সৈন্যই নিয়েছিলেন তুর্কীদের মধ্য থেকে। সেই কমান্ডো বাহিনী থেকেই তিনি বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে গঠন করেছিলেন গোয়েন্দা বিভাগ। এই গোয়েন্দা বিভাগ গঠনের জন্য প্রথম দিকে যাদের বাছাই করেছিলেন, ইসহাক তুর্কী ছিল তাদেরই একজন।
সে তার অসাধারন বুদ্ধি ও সাহসের জন্য অচিরেই কমান্ডো গোয়েন্দাদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠে। এই বুদ্ধি ও সাহসের কারণে অচিরেই তাকে একটি গ্রুপের কমান্ডার বানিয়ে দেয়া হয়। পরে তাকে তার বাহিনী সহ খ্রিষ্টান এলাকায় গোয়েন্দাগিরি করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।
দায়িত্বের ব্যাপারেও সে ছিল খুবই নিষ্ঠাবান। সে জীবন বাজি রেখে মাটির তল থেকেও গোপন তথ্য উদ্ধার করে আনতে পারতো।
সিনাই মরুভূমি পার হয়ে সে যাচ্ছিল কায়রো। কিন্তু এখন এই সিনাই মরুভূমির মধ্যে সামান্য একটি সাপ তাকে বিরাট ও কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিল।
এ সময় সুলতান আইয়ুবী কায়রো অবস্থান করছিলেন। ইসহাক তুর্কী বৈরুত থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কায়রো রওনা হয়েছিল। তথ্য পাওয়ার পর সে আর দেরী করেনি, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া নিয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। পথে সে অল্পই বিশ্রাম নিয়েছে। সবুজ শ্যামল এলাকা অতিক্রম করে বিশাল মরুভূমিতে ঢুকে পড়েছে নির্দ্বিধায়।
সিনাই মরুভূমির নাম শুনলেই অনেকের পিলে চমকে উঠতো। এমন ভয়ংকর মরুভূমিতে একা পা বাড়াবার তো প্রশ্নই উঠে না, দল বেঁধে রওনা দিতেও সাহস পেতো না অনেকে। ইসহাক তুর্কী জানে, এই মরুভূমিতে একবার পথ হারালে কোন মুসাফির আর জীবিত ফিরে আসতে পারে না। এই মরুভূমি মানুষ ও প্রাণীদের জন্য জীবন্ত আতঙ্ক হয়েই বিরাজ করছিল। কিন্তু ইসহাক তুর্কী ছিল নির্ভীক। তাছাড়া মরুভূমির রহস্য সে যতটা ভাল জানে অনেকেরই তা জানা নেই।
সে তার প্রয়োজনীয় পানি ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিয়েছিল। রাস্তা সম্পর্কেও পূর্ণ তথ্য জেনে নিয়েছিল রওনা হওয়ার আগেই। রাস্তার দু’এক স্থানের পানির সন্ধানও জানা ছিল তার। কারণ এ রাস্তায় এর আগে একবার তার যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল।
হলব থেকে বের হয়ে যখন সে মরুভূমিতে প্রবেশ করে তখন তার অন্তরে কোন ভয় বা আশংকা ছিল না। যে দুটো জিনিস কখনোই তাকে ভয় দেখাতে পারেনি তার একটি হলো খ্রিষ্টান, অপরটি মরুভূমি। যুদ্ধ আর দূরযাত্রার কষ্টকে সে বরং উপভোগ করতো। সে বিশ্বাস করত, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এ দুটোই মানুষের সহায়ক হয়।
দুপুরের সূর্য হেলে পড়েছিল। ইসহাক তুর্কী একটানা দুপুর পর্যন্ত ঘোড়া ছুটিয়ে এক টিলার ছায়ায় এসে শুয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে ঘুম এসে গেল। হঠাৎ ঘোড়ার বিকট চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে দেখতে পেল, ঘোড়াটি সামান্য জায়গাতেই চক্রাকারে দৌড়াচ্ছে। ঘোড়ার এ আচরনের কোন কারণ বুঝতে পারল না ইসহাক তুর্কী। সে শোয়া থেকে উঠে বসল।
ঘোড়া আর বেশী দৌড়াতে পারল না, থেমে গেল। তার সারা শরীর তখন কাঁপছে। ইসহাক তুর্কী দেখতে পেল ঘোড়াটি যেখানে শুয়েছিল তার চার পাঁচ গজ দূরে এক ফুট লম্বা একটি সাপ ছটফট করছে। লেজের দিক থেকে অর্ধেক দেহ তার থেঁৎলানো। ঘোড়াটি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল।
ইসহাক বুঝতে পারল, ঘোড়াটিকে সাপে দংশন করেছে। পরে সাপটি ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে গেছে হয়তো। ঘোড়াটির আর চলার ক্ষমতা ছিল না। ইসহাক তুর্কী তার জুতার তলা দিয়ে সাপের মাথাটি থেৎলে দিল। সাপটি মারা গেল নিঃশব্দে।
ঘোড়াটিরও বাঁচার আশা শেষ হয়ে গেল। মরুভূমির সাপ ও বিচ্ছু এমন বিষাক্ত যে, যাকে দংশন করে সে পানি পান করার সুযোগটুকুও ও পায় না। মরুভূমির যাত্রীরা জ্বলন্ত সূর্যের তাপ তাপ এবং ডাকাত ও লুটেরার চেয়ে বেশী ভয় পায় এই সাপ ও বিচ্ছুকে। মরুভূমিতে চলতে হলে এই সাপ ও বিচ্ছুর ব্যাপারে তাই সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। একটু অসাবধান হলেই সীমাহীন বিপর্যয় গ্রাস করতে পারে পথিককে।
সমতল ভূমি বা পাহাড়ী সাপের মত এরা সামনে এগোয় না। বরং এরা আশ্চর্য ভঙ্গিতে পাশে অগ্রসর হয়। ইসহাক তার ঘোড়াটির দিকে তাকাল। সে চোখে লেপ্টে আছে নিরাশার ছায়া। ঘোড়াটি তখন প্রচণ্ড জোরে কাঁপছিল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো জিভ। ঘোড়াটি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, পা ভেঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়লো। তারপর দু’তিনবার পা নেড়ে এক পাশে কাত হয়ে নিরব হয়ে গেল চিরদিনের মত।
ইসহাক ঘোড়াটিকে কোনই সাহায্য করতে পারল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো বোবা জানোয়ারটির করুণ মৃত্যু।
এটা ছিল উঁচু জাতের যুদ্ধের ঘোড়া। এ জাতের ঘোড়া সবসময় সতেজ থাকতো। সহজে পিপাসায় দুর্বল হতো না। ঘোড়াটির মৃত্যু ইশাকের জন্য মহা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল।
এ এমন এক ক্ষতি যা পুরণ হওয়ার নয়। কিন্তু এ ক্ষতিতেও সে কাতর হতো না, যদি স্বাভাবিক সময়ে এর মৃত্যু হতো। কিন্তু ঘোড়াটি মারা গেল এমন এক সময়ে, যখন সে দুর্গম মরুভূমিতে এবং এ ঘোড়াটিই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী ও বাহন।
ইসহাককে এখন পায়ে হেঁটেই কায়রো যেতে হবে এবং তাকে কায়রো পৌঁছতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। সে জানতো, সে যে গোপন তথ্য তার বুকের মধ্যে করে নিয়ে যাচ্ছে, যদি তা শিঘ্রই সুলতান আইয়ুবীকে জানাতে না পারে তবে যুদ্ধের এক বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবেন সুলতান।
সে ঘোড়াটির দিকে নিরাশ দৃষ্টিতে তাকালো। তার দৃষ্টি ঘোড়ার পায়ের খুরের একটু উপরে গিয়ে পড়লো। ওখানে কয়েক ফোঁটা রক্ত জমে আছে। সে বুঝতে পারল, এখানেই সাপটি দংশন করেছিল।
ইসহাক ঘোড়ার জিনের মধ্য থেকে খেজুরের ব্যাগ বের করে নিল। পানির মশকটিও খুলে নিল এবং দ্রুত কায়রোর দিকে যাত্রা করলো। সে মরা সাপটার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘খৃস্টান ও সাপ এই দুই জাতির স্বভাব এক! মানুষের জন্য এদের অন্তরে কোন দয়া মায়া নেই।’
সে মরু অঞ্চল দিয়ে দ্রুত ছুটতে লাগল এবং এক সময় ভয়ংকর মরু অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা পার হয়ে এলো!
সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। কমে গেছে সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপের তীব্রতা।
এটা ছিল ১১৮২ সালের এপ্রিল মাস। দুনিয়ার বুক জুরে তখন চলছিল বসন্তের ঋতুকাল। কিন্তু মরুভূমিতে কোন দিনই বসন্ত আসে না। ইসহাক তুর্কীর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত শুধু ধু ধু বালির সমুদ্র। যার মধ্যে ছোট ছোট শুকনো ঝোপ আর জঙ্গলের কাঁটা ছাড়া আর কিছুই নেই।
বালির দিকে তাকালে মনে হয় সামনে এক আধ মাইল জুড়ে শুধু পানি আর পানি। সে চলতে থাকল এবং চলতে চলতে এক সময় তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। তার মনে হচ্ছিল, সেখান থেকে ভীষণ ভাপ উঠছে।
ইসহাক তখনো খেজুরের ব্যাগ, পানির মশক, তলোয়ার ও খঞ্জরের বোঝা বহন করেই সামনে এগুচ্ছিল। তার চলার গতিতে তখনো ভাটা পড়েনি। দ্রুত কায়রো পৌঁছার কঠিন সংকল্পেও কোন টান পড়েনি। সে কয়েক ঢোক পানি পান করে সমান উদ্যমেই আবার হাঁটা ধরলো।
দেখতে দেখতে চোখের সামনে অস্ত গেল লাল সূর্য। ক্লান্তিতে পা দুটো তার অবশ হয়ে এলো। সে সামান্য সময়ের জন্য থামলো। কিছু খেজুর খেয়ে পানি পান করলো। কয়েক মিনিট লম্বা হয়ে শুয়ে রইলো বালির ওপর। তারপর উঠে বসে স্মরণ করলো তার সংকল্পের কথা।
সে এজন্য খুব খুশী ছিল যে সে খুব গোপন ও মুল্যবান সংবাদ নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাচ্ছে। এই খুশীতে সে খাওয়া এবং পান করার কথাও বেমালুম ভুলে যেতে পারে।
প্রশান্ত মন নিয়েই সে আবার উঠে দাঁড়াল। দায়িত্ববান লোক যখন দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি সক্ষম থাকে তখন তার আত্মাও আনন্দে ভরে থাকে। ইসহাক তুর্কীর আত্মাও তেমনি আনন্দে মশগুল ছিল। সে উঠে তারা দেখলো। দিক নির্ণয় করে নিয়ে আবার যাত্রা করলো।
মরুভূমির রাত খুব ঠাণ্ডা হয়। দিনে যেমন প্রখর উত্তাপ থাকে তেমনি রাতে ঠাণ্ডাও পড়ে প্রচণ্ড। তবে দিনে উত্তাপের কারণে পথ চলতে যে কষ্ট হয়, রাতে ঠাণ্ডায় তা হয়না। বরং পথ চললেই ঠাণ্ডার প্রকোপ কম মনে হয়।
ইসহাক তুর্কী পথ চলছে। বড় নিঃসঙ্গ সে যাত্রা। কোন প্রাণের প্রবাহ নেই কোথাও। শুধু বালি আর বালি। মাথার উপরে মিটিমিটি তারার আলো। প্রকৃতিকে এমন নিবিড়ভাবে উপভোগ করার সুযোগ তার আর হয়নি কখনো। মনে হচ্ছে জগত সংসারে সে ছাড়া আর সকলেই সুপ্তির অতল তলে হারিয়ে গেছে।
পথ চলতে চলতে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছে অনেক পুরনো স্মৃতি। মনে জাগছে অদ্ভুত সব স্বপ্ন-কল্পনা। তার মনে পড়ে গেল প্রিয় নবীর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের কাহিনী। তিনিও তো এভাবেই গভীর রাতে নিঃসঙ্গ মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন মদীনার দিকে।
তখনো নিশ্চয়ই মরুভূমি ছিল আজকের মতই সুনসান। তবে তিনি একা ছিলেন না, তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাছাড়া তাদের সাথে ছিল জীবন্ত বাহন। কিন্তু আমি? আমার যে আজ সে সম্বলটুকুও নেই!
সে এসব চিন্তা করছিল আর পথ চলছিল। অনেক রাতে যখন ঘুম আর ক্লান্তি তাকে কাবু করার জন্য এগিয়ে এল, তখন সে মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল, কোন বাহন ছাড়া এই দীর্ঘ পথ অল্প সময়ে পাড়ি দেয়া আসলেই এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
জীবনে একটি ঘোড়া কত মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় তা আবার নতুন করে উপলদ্ধি করলো সে। কি করে এখন একটি ঘোড়া জোগাড় করা যায় ইসহাক তুর্কী হাঁটতে হাঁটতে সে কথাই ভাবতে লাগল।
এখন ঘোড়া জোগাড় করার দুটি পথ আছে। এক. যদি পথে কোন ঘোড় সওয়ার বা উটের যাত্রী পাওয়া যায় তবে তাদের কাছ থেকে ঘোড়া অথবা উট কেড়ে নেয়া। আর দ্বিতীয় উপায় হলো, যদি কোন কাফেলা চোখে পড়ে তবে সেই কাফেলায় মিশে তাদের কাছ থেকে ঘোড়া অথবা উট চেয়ে নেয়া বা দিতে না চাইলে কৌশলে চুরি করা।
যাই হোক আগে তাকে কোন যাত্রী বা কাফেলা পেতে হবে। কিন্তু দুর্গম এ মরুভূমিতে কে আসবে কাফেলা নিয়ে মরতে! কালেভদ্রে কোন দুঃসাহসী নিতান্ত প্রাণের দায়ে সিনাই মরুভূমিতে পা রাখে। শুধু যাযাবর দস্যুরাই সিনাইকে ভাবে তাদের নিরাপদ অভয়ারণ্য। কখনো আত্মগোপন করার দরকার হলে ঢুকে পড়ে এ মরুভূমিতে।
ইসহাক তুর্কী আদৌ কোন ঘোড়ার সন্ধান পাবে এমন আশা ছাড়াই পথ চলতে লাগলো।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো। তারারা একদিক থেকে হেঁটে গেল অন্যদিকে। আদম সুরত চলতে চলতে এখন যেখানে এসে পৌঁছেছে তাতে বলা যায়, রাত আর বেশী নেই। আর হয়তো এক-দেড় ঘণ্টা, তারপরই উন্মেষ ঘটবে সুবহে সাদিকের।
সারারাত পথ চলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ইসহাক তুর্কী। নিজের পা দুটোকেই এখন মনে হচ্ছে অনেক ভারী। সে তাকালো ধ্রুবতারার দিকে। না, এখনো ঠিক পথেই এগুচ্ছে সে। পথ আর কতো বাকী জানা নেই, কিন্তু ঠিক পথে এগুচ্ছে বুঝতে পেরেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
রাত অতীত হয়ে যাচ্ছিল। পায়ের নিচ থেকে পিছলে সরে যাচ্ছিল বালি। কোথাও বালির ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছিল পা। সেখান থেকে পা টেনে নিয়ে বের করে নিয়ে তারপর সামনে ফেলতে হচ্ছিল। এসব কারণে তার ক্লান্তি আরও বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে এক কমান্ডো সেনা, দীর্ঘ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। একাধারে কয়েক রাত না ঘুমানোর এবং কয়েক দিন ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করে পথ চলার মত ট্রেনিং তার ছিল। তাই সে ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও নিদ্রাহীনতায় এখনো কাঁবু হয়নি। ঘোড়া হারিয়েও হতাশায় মুষড়ে পড়ে নি। সংকল্প থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়ায়নি। বরং নতুন উদ্যমে নতুন পরিকল্পনায় পথের সমস্ত বাঁধা মাড়িয়ে সে মঞ্জিলপানে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তারপরও মানুষের শরীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও আরাম না পেলে ক্লান্ত হবেই। সেই ক্লান্তি তাকে বারবার আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিল, আর সে চাচ্ছিল সেই ক্লান্তিকে কবর দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে।
আর যখনই সে ক্লান্তির চাপ অনুভব করত তখনই প্রাণ খুলে যুদ্ধের গান শুরু করে দিত। সেই গানের সুর ও শব্দের মাঝে লুকিয়ে থাকতো উদ্দীপনার বীজ। এ গানের আওয়াজ তার কানে গেলেই তাঁর ক্লান্তি ও বেদনারা পালিয়ে যেত। তাঁর শরীরে ফিরে আসত উদ্যম ও সতেজতা। সে তখন উচ্চ স্বরে গান গেয়ে আরো জোরে পা চালাতো।
রাতের শেষ প্রহর।
এক স্থানে বালির উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ল ইসহাক তুর্কী। মশক খুলে সামান্য পানি পান করলো। তারপর ক্ষুধা থাকার পরও কিছু মুখে না দিয়েই সেখানে শুয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য, কয়েক মিনিট ঘুমিয়ে নেয়া।
এটাও কমান্ডো বাহিনীর ট্রেনিংয়েরই একটা অংশ। শরীর ও মনকে এসব কমান্ডোরা এমনভাবে তৈরী করে নিতে পারতো, চব্বিশ ঘণ্টার ঘুমের কাজ তারা দশ মিনিটেই সেরে নিতে পারতো।
যখন তার ঘুম ভাঙলো তখনো সূর্য উদয় হয়নি। সে বালির উপর উঠে বসে চারদিকে তাকাল। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ফেলল আকাশের শরীরে। আকাশ তাকে বলল, তৈরী হও যুবক। তোমাকে জব্দ করার জন্য সূর্য উঠে আসবে একটু পরই।
ঘাবড়াল না ইসহাক। সে উঠতে যাবে, তার পেট বলল, পথে নামার আগে কিছু খেয়ে নিলে কি হতো না!
না, পেটের দাবী অগ্রাহ্য করে উঠে দাঁড়াল ইসহাক। সামনে অনেক পথ। এখনই সব খাবার ও পানি শেষ করে ফেললে এই অসতর্কতাই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে কিছু মুখেও দিল না, পানিও পান করলো না। বরং সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সূর্য উঠার আগেই আবার যাত্রা করলো।
ভোরের আলো যখন ফুটলো তখন সে সূর্যের উল্টো দিকে হাঁটছিল। সূর্যের আলো পিঠে পড়তেই রাতের শীত ও ঠাণ্ডার আমেজ হারিয়ে গেল। নতুন করে ফুরফুরে একটা ভাব এসে মনকে চাঙ্গা করে দিল। কিন্তু এই পুলকিত অনুভূতিটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ সামনের একটি দৃশ্য তার আনন্দিত চেহারাটিকে মলিন করে দিল।
সে সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল মরুভূমির মাঝে মাথা উঁচু করে বসে আছে ভয়ঙ্কর এক বিপদ। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে বালির গোল গোল স্তূপ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এগুলো কতটা ভয়াবহ যার অভিজ্ঞতা নেই সে কল্পনাও করতে পারবে না। এগুলো দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। সবগুলো স্তূপই সমান উঁচু।
যাত্রীকে এসব স্তূপ পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এর মধ্যে গিয়ে পড়লে এক ধরনের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে পড়ে মানুষ। চারপাশে যেদিকেই চোখ যায় সর্বত্র একই রকম দৃশ্য। সেখানে কোন নতুন যাত্রী প্রবেশ করলে সহজে বের হতে পারে না। দেখা যায় একই স্তুপের পাশ দিয়ে বার বার ঘুরছে। এই গোলকধাঁধায় একবার পড়লে বিভ্রান্ত মুসাফির একই টিলার পাশ দিয়ে বার বার ঘুরে আর মনে করে সে অনেক পথ অতিক্রম করে ফেলেছে।
মরুভূমির এই রহস্যের খবর ইসহাক তুর্কী ভাল করেই জানতো। সে সহজে ভীত হওয়ার লোক নয়, তারপরও এই টিলাগুলো তাকে ভাবিয়ে তুলল। তার ভয় পাওয়ার কারণ হলো, সে তার গন্তব্যে পৌঁছতে যে পথের কথা জানতো সে পথে এ ধরনের টিলা পড়ার কথা নয়। টিলাগুলো দেখে প্রথমেই তার মনে যে প্রশ্ন জাগলো, তা হলো, তবে কি আমি পথ ভুল করে ফেলেছি? আমার চলার রাস্তায় তো এসব টিলা পড়ার কথা নয়?
সমস্যাটি তাকে অধীর করে তুলল। সে তার আসল রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কিনা বুঝার জন্য এদিক ওদিক তাকাল। কিন্তু আশেপাশে আর কোন রাস্তা নেই। এমন কোন পথ নেই যে পথে সে তার আসল গন্তব্যের দিকে যেতে পারে। উপায়ন্তর না দেখে সে ওই পথেই সামনে অগ্রসর হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে ওই টিলার রাজ্যে গিয়ে প্রবেশ করলো।
সে হাঁটছে তো হাঁটছেই, কিন্তু টিলার অরণ্য শেষ হচ্ছে না। দেখতে দেখতে সূর্য মাথার উপর উঠে এলো। মরুভূমির উত্তপ্ত লূ-হাওয়া কামড় বসালো তার গায়ে। সে টিলাগুলোর পাশ ঘুরে যতটা সম্ভব পথ ঠিক রেখে চলতে লাগলো। একটার পর একটা টিলা পেরিয়ে সে এখন এমন জায়গায় অবস্থান করছে, যার চারপাশে শুধুই সে বালির পাহাড়।
কোথাও কোথাও দুই টিলার বালি গড়িয়ে এসে একাকার হয়ে গেছে। ইসহাক সে এলাকা পেরোতে গেলেই নরম বালি তার পা টেনে ধরছে।
কোথাও বালি ক্ষুদ্র দানার, কোথাও বেশ বড়সড়। হাঁটতে হাঁটতে সে এক পাথুরে প্রান্তরে এসে পৌঁছল। এখানেও সেই ঢিবি আছে, তবে বালির সাথে জড়াজড়ি করে আছে অসংখ্য পাথর।
আগের চেয়ে এ পথ আরো দুর্গম। ইসহাক এ পথে পা দিয়েই বুঝল, এখানে সে নতুন অভিজ্ঞতা নিতে যাচ্ছে। কারণ, মরুভূমি সম্পর্কে তার বিস্তর অভজ্ঞতা থাকলেও এ ধরনের বিচিত্র বালিয়াড়ি সে কখনো দেখেনি। শুধু দেখেনি বললে ভুল হবে, এরকম বালিয়াড়ি পথের কথা সে কারো কাছে শোনেওনি।
তার মনে হলো সে-ই একমাত্র মুসাফির যে এই বিচিত্র পাথর ও বালির রাস্তা দিয়ে এই প্রথম হাঁটছে। এর আগে আর কোন মুসাফির এই পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা লাভ করেনি।
সূর্য এখন পুরোপুরি মাথার উপর। সে বালি ও পাথরের টিলাগুলো পাশ কাটিয়ে মোড় ঘুরে নির্বিকার চিত্তে হাঁটছিল, হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে সে থতমত খেয়ে থেমে গেল।
সে দেখলো সামনে পথের উপর পাথরের পাশে যে বালি, সেই বালিতে কোন মুসাফিরের হেঁটে যাওয়ার পদচিহ্ন। সেই পায়ের ছাপ ডানে মোড় নিয়ে এক টিলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
এবার সে সত্যি ভয় পেল। তার আর বুঝতে বাকি রইল না, সে মরুভূমির ধোঁকায় পড়ে গেছে। এখন সে শত শত মাইল গোলকধাঁধায় পড়ে শুধু ঘুরপাক খাবে কিন্তু এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার সাধ হয়তো তার আর কোনদিনই পূরণ হবে না। এ জন্যই সিনাই মরুভুমিকে অনেকে ‘মরণ ঘর’ বলে অভিহিত করে। সিনাই মরুভূমিতে যারা পা রেখেছে তাদের মধ্যে খুব কম লোকই জীবন নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছে।
ইসহাক তুর্কীর নিজের উপর যথেষ্ট বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। কিন্তু এ দৃশ্য দেখার পর তার সব বিশ্বাস ও আস্থা কর্পূরের মত হাওয়া হয়ে গেল। সেখানে এসে বাসা বাঁধল সীমাহীন বিপদের ভয়। সেই বিপদ ও ভয়ের শিরশিরে অনুভুতি বুকে নিয়েই সে পাশের এক টিলার উপের উঠে দাঁড়ালো। সেখানে দাঁড়িয়ে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দূর দিগন্তে। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু টিলা আর টিলা। ডানে বামে সামনে পেছনে সর্বত্র একই দৃশ্য। এ ছাড়া সেখানে আর দেখার কিছু নেই।
বিপদের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করে মুষড়ে পড়লো ইসহাক তুর্কী। সে ওখানেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবতে লাগল, এখন কি করবে।
মধ্য দুপুরের সূর্য শুষে নিচ্ছিল তার শরীরের অবশিষ্ট রসটুকু। মরুভূমির তপ্ত বালু তাকে করছিল খই ভাজা। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার।
ইসহাক তুর্কী কোন সাধারণ মানুষ ছিল না। সে ছিল এক কমান্ডো গোয়েন্দা। এ ধরনের বিপদ মোকাবেলার জন্য তাদের মত কমান্ডোদের দেয়া হতো দীর্ঘ ট্রেনিং। এতদিন সে ট্রেনিং নিয়েছে, একাধিকবার মহড়া দিয়েছে দুর্গম মরুভূমিতে। কিন্তু আজ?
আজ আর মহড়া নয়, নিরেট বাস্তবতা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। এখন এ কঠিন বাস্তবতার মোকাবেলা তাকে করতে হবে বুদ্ধি ও সাহস দিয়ে। সফল চাল দিতে পারলে বেঁচে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে। কিন্তু মাত্র একবার কোথাও কোন ভুল করে বসলে তার মাশুল হয়তো গুনতে হবে নিজের জীবন দিয়ে।
বিমর্ষ মন নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিক নির্ণয় করে ঢিবি থেকে নেমে এলো ইসহাক তুর্কী। সমতলে নেমে দুটি খেজুর মুখে দিয়ে একটু পানি পান করলো। তারপর স্মরণ করলো নিজের দায়িত্বের কথা। সংকল্পের কথা। সব শেষে আল্লাহর উপর ভরসা করে পা বাড়াল সামনে। এখন তাকে মাথা ঠিক রেখে চলতে হবে। অযথা ঘুরপাক খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার বুদ্ধি বের করতে হবে।
বালি ও পাথরের মধ্যে পা ফেলে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে লাগল ইসহাক তুর্কী। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, প্রতিটি মোড় ঢিবিতে চিহ্ন রেখে এগুবে সে।
ইসাহাক তুর্কী তার ট্রেনিং অনুযায়ী প্রতিটি মোড় ও ঢিবিতে চিহ্ন রেখে এগুতে লাগলো। এক সময় সে দুটি টিলার মাঝ দিয়ে তৈরী হওয়া গিরিপথে নেমে গেল।
দু’পাশের দৃশ্য ভাল মত স্মরণে রেখে পথ চলতে লাগলো ইসহাক তুর্কী। কিছু দূর গিয়ে পিছনে ফিরে দেখতো, তারপর পথের চিহ্ন ভাল মত মনে গেঁথে নিয়ে আবার সামনে পা বাড়াতো।
এভাবে সে অনেক পথ পেরিয়ে এলো। যদি সে বলিষ্ঠ যুবক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক না হতো তবে মরুভুমির এ নিষ্ঠুর পরিবেশ এতক্ষণে তার মাথা গুলিয়ে দিত। কিন্তু তার ধৈর্য ও সহ্য করার শক্তি ছিল অপরিসীম। নিজের এই ধৈর্য দেখে নিজেই সাহসী হয়ে উঠলো ইসহাক তুর্কী। সূর্যের প্রখর তাপ ও লূ হাওয়ার ঝাপটা অগ্রাহ্য করে সে বিরতিহীনভাবে পথ চলতে লাগলো।
সূর্য পশ্চিম দিগন্তের দিকে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে তার পা অবশ হয়ে আসছিল। সে তবু পা টেনে টেনে চলতে লাগল।
এক সময় সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো জোহরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ হতে চললো। সে এক জায়গায় থেমে তায়াম্মুম করে জোহরের নামাযে দাঁড়িয়ে পড়ল। সালাম ফিরিয়ে যখন সামনে তাকাল তখন দেখতে পেল সে মরুভূমির ফাঁদ থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। সামনে আবার সমান্তরাল মরুভূমি।
ক্লান্ত পায়ে সে আবার উঠে দাঁড়াল এবং হাঁটতে শুরু করল। আরো ঘণ্টাখানেক এগিয়ে যাওয়ার পর সে অনুভব করল তার পা আর চলছে না, দেহের বোঝা বহন করতে পারছে না কোমর। সে অসম্ভব দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।
কিন্তু দায়িত্বের বোধ তাকে কোথাও থামতে দিল না, সে সেই দুর্বল শরীর নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে থাকলো।
কিছু দূর যাওয়ার পর সে অনুভব করলো, তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। সামনে সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু থামল না, এগিয়েই যেতে থাকল। তবে বেশী দূর যেতে পারল না ইসহাক তুর্কী, সহসা সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল।
তার জীবনী শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছিল। শরীরের শক্তি নয়, কেবল অটুট মনোবলের কারনেই সে এতদূর পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছে।
মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরও সে মনের জোর হারাল না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। বড় বড় করে দম নিল কয়েকবার। তারপর আবার উঠে বসল এবং দুর্বল পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে গেল।
সে বার বার মাথা ঝাঁকি দিয়ে নিজের চিন্তাশক্তিকে একত্রিত করে কর্তব্য নির্ধারণ করতে চেষ্টা করল। একবার ভাবল, বিশ্রাম নেয়। কিন্তু পরক্ষনেই এ চিন্তা বাতিল করে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
অন্তরের তাগিদেই সে আবার পা চালিয়ে দিল। কিছু দূর যেতেই সে দেখতে পেলো, সামনে এক লাইনে কতগুলো রাস্তা সমান্তরালে এগিয়ে গেছে। সে নিজেকে তারই একটি রাস্তার ওপর নিয়ে গেল।
এক সময় তার মনে হলো পাশের রাস্তাগুলোর দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়ছে এবং দূরত্ব নিয়েই তারা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। সে দেখতে পেল, পাশের একটি রাস্তা দিয়ে কিছু ঘোড়া তাকে অতিক্রম করে ছুটে যাচ্ছে। ঘোড়ার উপর আরোহীও আছে।
সে গলা ছেড়ে আরোহীদের ডাকলো কিন্তু আরোহীরা থামলো না। সে আরও উচ্চস্বরে তাদের ডাকতে লাগলো কিন্তু কোন আরোহীই তার ডাকে সাড়া দিল না।
ইসহাক তুর্কী থেমে গেল, সে চোখ বন্ধ করে মাথা জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। তার বিশ্বাস, সে আসলে কোন ঘোড়া দেখেনি, সবটাই মনের বিভ্রম।
মরুভূমিতে চলতে গেলে এরকম হয়। চলতে চলতে যাত্রী যখন ক্লান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন এ রকম বিভ্রম অনেককেই জড়িয়ে ধরে। এটা মরুভূমির খুবই সাধারণ ঘটনা। মাথা ঠিক হলে দেখা যাবে, এগুলো কোন ঘোড়া নয়, স্রেফ ধাঁধাঁ।
মরুভূমির এ খেলায় কমবেশি সবাইকেই পড়তে হয়। সুস্থ মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে মরীচিকা দেখে আর ভয়ার্ত দুর্বল অসহায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে নানা আজগুবি দৃশ্য দেখতে থাকে। এমন সব দৃশ্য যা আদৌ কখনো ঘটা সম্ভব নয়। আবার এমন দৃশ্যও দেখে, যা সে মনে মনে কল্পনা করে। তখন কল্পনাটাই মনে হয় বাস্তব রূপ ধরে চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে থাকে।
যাই হোক বার বার মাথা ঝাঁকি দিয়ে চোখ কচলে আবার যখন তাকাল, তখন নিজেকেই তার বোকা মনে হল। কোথায় ঘোড়া? চারদিকে সুনসান মরুভূমি। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য আর পায়ের নিচে ঝলসানো বালি। রোদের উত্তাপ বাতাসে ঢেউয়ের মত দুলছে। সেই উত্তাপের জাল অতিক্রম করে দৃষ্টি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না।
ইসহাক তুর্কী আবার চলতে শুরু করল। সে তখন পা টেনে টেনে চলছিল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল চলে এল। কিন্তু তার তখন দিন রাত্রির কোন অনুভুতি ছিল না। পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। গরম বালির ছ্যাকা খেয়ে জ্বলছিল পা দুটো।
সামনে বিস্তর ঢালু ভূমি। সেই ঢালুতে পা দিতেই হঠাৎ পা হড়কে পিছলে পড়ে গেল সে। তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক নিচে গিয়ে যখন থামল তার শরীর, তখন তার হুশ ছিল না।
একটু পরই জ্ঞান ফিরে এল তার। সে সজাগ ও সতর্ক হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। না, কোথেও কোন প্রাণের ছোঁয়া নেই। তার চিন্তাশক্তি তখন লোপ পেয়েছিল, কিন্তু অবচেতন মনে ছিল দায়িত্বের তাগিদ। সে মনের অজান্তেই এক টিলার ওপর গিয়ে আরোহণ করল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সেখান থেকেও সে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে।
আবার যখন উঠে বসলো তখন পানির তীব্র তেষ্টা অনুভব করলো। তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। গলা ছিল খরখরে শুকনো। সামান্য পানি পান করার জন্য সে নিজের মশকের দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু মশক বা খেজুরের ব্যাগ কিছুই তার সাথে নেই।
সে মশক বা খেজুরের ব্যাগ কোথায় ফেলে এসেছে মনে করতে পারল না। হয়তো গড়িয়ে পড়ার সময় সেগুলো তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
সে এদিক ওদিক লক্ষ্য করে দেখলো কোথাও তা দেখা যায় কি না। কিন্তু না, তার শূন্য দৃষ্টি ফিরে এল, কোথাও মশক বা ব্যাগের আভাসও নজরে এল না। সে ওখানে ওভাবেই বসে রইল। বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল অসীম শূন্যতার রাজ্যে।
এ দুটো জিনিস হারানোর পর তার উদ্যম ও সাহস পুরোপুরিই নিঃশেষ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল তার সংকল্প ও মিশনের কথা। তাই সে বসা থেকে উঠারও কোন গরজ অনুভব করল না।
কিন্তু সে কেবল সাময়িক সময়ের জন্য। আবার তার সংকল্পের কথা মনে পড়ে গেল। সে তার দুর্বল পা দুটোকে টেনে তুলল এবং একদিকে হাঁটা দিল।
সে নিরাশ ও অসহায়ের মত পথিকের মতই পথ চলছিল। ঝাপসা দৃষ্টি মেলে ধরে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল, সে ঠিক পথে এগুচ্ছে কি না।
কখন সন্ধ্যা হলো, কখন মরুভূমিতে নেমে এলো শীতল রাত কিছুই মনে করতে পারল না ইসহাক তুর্কী। তার শুধু মনে পড়ল, সামনে সে একবার উজ্জ্বল আলোর শিখা দেখেছিল। যদিও সে আলো তার কাছ থেকে বহু দূরে ছিল। সে অর্ধচৈতন্য নিয়ে অনেকটা বেহুশের মত সে আলোর দিকে তখনো পা পা টেনে টেনে এগিয়ে যাচ্ছিল।
অজ্ঞান অবস্থায় কি হাঁটা যায়? হয়তো যায়। নইলে এতটা পথ সে এলো কি করে! ইসহাক তুর্কী যখন হুশ ফিরে পেওও তখন নিজেকেই প্রশ্ন করতো। তার মনে হলো, সে সজ্ঞানে পথ চলছে না। কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
এই ঘোরের মধ্যে চলতে চলতেই এক সময় সে থেমে গেল। তার মনে হলো, সে দুটি পুরুষ ও একটি মেয়ে মানুষ দেখতে পাচ্ছে। ওরা তিনজনই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাদের পেছনে কিছু দূরে খেজুরের গাছ ও দেখতে পাচ্ছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি টিলা।
ইসহাক তুর্কী এটাকেও দৃষ্টির বিভ্রম মনে করলো। মনে করল, তাকে গ্রাস করার আগে মরুভূমি মায়ার খেলা শুরু করেছে। মরুভূমি দিকভ্রান্ত পথিককে মারার আগে হামেশাই এ খেলা খেলে থাকে।
এ দৃশ্য তার নৈরাশ্য আরও বারিয়ে তুলল। তার শরীরের শেষ শক্তিটুকু যেন নিঃশেষ হয়ে এলো এবার।
সে এ লোকদের ডাক দেয়া বৃথা মনে করলো। কারণ মরুভূমির ধাঁধাঁ কখনো কথা বলে না। এই ধাঁধাঁ মুসাফিরদের আকৃষ্ট করে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। মানুষ তাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে বালির উপর। তখন তাদের দেহের মাংস ও রস চুষে খায় মরুভূমি। তাদের অস্থি ও কংকালটুকুই পড়ে থাকে বালির উপর।
ইসহাক তুর্কীর মন বলছিল, এরা মানুষ নয়, মরুভূমির ধাঁধাঁ। বাঁচতে চাইলে এদের কাছ থেকে পালিয়ে যাও।
এ কথা মনে হতেই ইসহাক তুর্কী তাদের দিকে না এগিয়ে আরও কিছু সময় বাঁচার আশায় পিছু সরে আস্তে চাইল।
সে তার অবশ ও দুর্বল দেহতিকে ঘুরিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু তখন তার আর হাঁটার কোন শক্তি ছিল না। তার সংজ্ঞা লোপ পেল। চোখের সামনে মরুভূমি, মরীচিকা ও ধা ধা সবই গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সুলতান আইয়ূবীর জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া মুল্যবান খবরসহ সে লুটিয়ে পড়লো বালির উপর।
যখন তার সংজ্ঞা ফিরে এলো, তখন তার কানে ভেসে এলো মানুষের কথোপকথন। এতে সে খুবই অবাক হলো এবং ব্যাপার কি বুঝার জন্য কান পাতল গভীর ভাবে। না, ভুল নয়, সত্যি মানুষের কথা এবং সেই কথা সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
‘লোকটিকে ওখানেই মরতে দেয়া উচিত ছিল।’ এক পুরুষের কণ্ঠস্বর, ‘তোমার যত বাড়াবাড়ি। অযথা বাড়তি ঝামেলা বাড়ানোর কোন মানে হয়? কোথাকার কোন পথ ভোলা মুসাফির!’
‘এ লোক কোন সাধারণ মুসাফির নয়। আগে ওর জ্ঞান গিরতে দাও।’ শব্দটি এক মেয়ের, ‘সিনাই মরুভূমিতে নিতান্ত দরকার ছাড়া কেউ পা রাখেনা। এ লোক পাগল বা ডাকাত নয়, অন্ততঃ তার চেহারা তাই বলছে। লোকটির পরিচয় জানা জরুরী। তোমরা ওর প্রলাপ শোননি।’
এ লোক যদিও খুব নিচু স্বরে এবং জড়িত কণ্ঠে প্রলাপ বকছিল, তবু আমি তার অনেকটাই উদ্ধার করতে পেরেছি বলে মনে হয়। এ লোক বলছিল, ‘কায়রো…… কায়রো আর কত দূর? সুলতান… সুলতান আইয়ূবী আপনি খুব সাবধানে কায়রো থেকে বের হবেন। ……… আমি অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে এসেছি।’
চোখ বন্ধ রেখেই কথা শুনছিল ইসহাক তুর্কী। তার মনে হলো, এটাও মরুভূমির ছলনা। কিন্তু তাই বা কি করে হয়! আমার মাথা তো এখন ঠিকমতই কাজ করছে। মনে হচ্ছে আমি যাদেরকে দেখে মরুভূমির ধাঁধাঁ মনে করেছিলাম তারা প্রকৃতই মানুষ! ধাঁধাঁ নয়। মেয়েটি তো এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করে ফেলেছে!
‘তুমি ওর পাশে বসো।’ এক লোক বলল, ‘জ্ঞান ফিরলে ওকে পানি পান করাবে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে লোকটি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। ওকে কিছু খেতে দিয়ে ওর পরিচয় জানতে চেষ্টা করবে।’
কথা শেষ করে লোক দুটি সেখান থেকে চলে গেল, ওদের পায়ের আওয়াজ শুনেই তা বুঝতে পারল ইসহাক তুর্কী। ইসহাক ধীরে ধীরে চোখ খুললো। সহসা তার কানে ভেসে এলো ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি। মুহূর্তে সে জেগে উঠে বসে পড়লো এবং সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ঘোড়ার ডাক শুনতে পাচ্ছি! এই ঘোড়াটি আমাকে দাও।’
‘আগে একটু পানি পান করে নাও।’ মেয়েটি কোমল কণ্ঠে বললো। সে তার মুখের কাছে একটু পেয়ালা এগিয়ে ধরে বললো, ‘সামান্য একটু পান করো। এক সাথে বেশী পান করলে মারা যাবে।’
কে তাকে পানি দিচ্ছে দেখার মত অবকাশ ছিল না তার। সে সঙ্গে সঙ্গে পানির পেয়ালা টেনে নিয়ে জলদি দু’তিন ঢোক পানি পান করে ফেললো। মেয়েটি দ্রুত পেয়ালা টেনে নিয়ে বললো, ‘করো কি! মারা পড়বে তো!’
‘আমি জানি এ অবস্থায় বেশী পান করে উচিত নয়। আনি নিজেই পেয়ালা সরিয়ে দিতাম।’ সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো।
মেয়েটি এক যুবতী যাযাবর কন্যা। অন্ততঃ তার পোশাক তাই বলছে। কিন্তু তার চেহারা ও বর্ণ যাযাবরদের মত ছিল না। তার চালচলনেও সন্দেহ হচ্ছিল, এই মেয়ে মরুবাসী যাযাবর কন্যা নয়।
কিন্তু এ অঞ্চলে তো কোন ধনীর দুলালির আধার কথা নয়! মেয়েটিকে দেখে সত্যি ধাঁধায় পড়ে গেল ইসহাক তুর্কী। তার মাথার উপর রুমালে ঢাকা চুলের যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ মেয়ে যাযাবর কন্যা হতে পারে না।
‘তুমি কোন কাফেলার সাথে এসেছো?’ ইসহাক মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো।
‘এটা বণিকদের একটি বাণিজ্য কাফেলা।’ মেয়েটি উত্তর দিল এবং সেই সাথে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কোত্থেকে এসেছো, কোথায় যাবে?’
ইসহাক তুর্কী উত্তর দেয়ার আগে আবার পানির পেয়ালা তুলে নিয়ে মুখে পুরে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিল।
মেয়েটি এই ফাকে আবার প্রশ্ন করলো, ‘তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার ঘোড়া কোথায়? সঙ্গে একটা খেজুর, এক ফোঁটা পানিও নেই কেন? কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিলে?’
পানি পান করে কিছুটা সজীবতা ফিরে এসেছিল ইসহাক তুর্কীর। তার চিন্তা শক্তিও ফিরে এসেছিল। সে ভাবলো, আমি তো সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা! এই মেয়েটিকে সে কথা বলা যাবে না। আমার আসল পরিচয় মেয়েটির কাছ থেকে গোপন করতে হবে।
‘আমিও এক বাণিজ্য কাফেলায় ছিলাম।’ সে উত্তর গুছিয়ে নিয়ে জবাব দিল, ‘বহুদূরে মরুভূমিতে একদিন গভীর রাতে একদল ডাকাত আক্রমণ করলো আমাদের কাফেলা। আমাদের যা কিছু ছিল সবই তারা লুট করে নিয়ে গেল।
উট এবং ঘোড়াও নিয়ে গেল। অনেককে হত্যা করলো। সৌভাগ্যক্রমে আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম প্রাণ নিয়ে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় পথ ভুলে হারিয়ে গেলাম গভীর মরুভূমিতে। বাঁচার কোন আশা ছিল না। তবে মউত না থাকলে কেউ মরতে পারে না, এখন বুঝতে পারছি।’
‘আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।’ মেয়েটি আর কোন প্রশ্ন না করে বাইরে চলে গেল।
ইসহাক তুর্কী যে তাঁবুর মধ্যে ছিল সেখানে প্রদীপ জ্বলছিল। সে তাঁবুর নিচ দিয়ে মাথা গলিয়ে গোপনে বাইরে চোখ ফেলল।
চাঁদনী রাত। বাইরে তিন চারজন লোক পাহারা দিচ্ছে তাঁবুগুলো। মোট কয়টা তাঁবু আছে বুঝতে পারল না সে। পাহারাদাররা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে।
সে মেয়েটির হাসির শব্দ শুনতে পেল। তার হাসি ও কথা শুনে বুঝতে পারল মেয়েটি ফিরে আসছে। সে পিছনে সরে তার জায়গায় গিয়ে সুবোধ বালকের মোট বসে রইল। মেয়েটি তার সামনে খাবার এনে রাখলে সে খেতে আরম্ভ করলো।
‘তুমি তো এখন কায়রো যাচ্ছো?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।
‘না!’ ইসহাক তুর্কী মিথ্যা বলল, ‘আলেকজান্দ্রিয়া যাচ্ছি।’
‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তো এখন কায়রো আছেন।’ মেয়েটি হেসে বললো, ‘আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে কি করবে?’
‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আমার কি সম্পর্ক?’ ইসহাক বিস্ময়ের ভান করে মেয়েটাকে প্রশ্ন করলো।
‘আমাদের তো আছে!’ মেয়েটি বলল, ‘তিনি তো আমাদেরই সুলতান। আমরা মুসলমান, আমরা তার আদেশে জান কোরবান করতে প্রস্তুত।’
‘কিন্তু তুমি আমাকে কেন বললে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন কায়রোতে আছে? এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?’ ইসহাক তুর্কী জিজ্ঞেস করলো।
‘তবে শোন।’
মেয়েটি তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, ‘আমি জানি তোমার ঘোড়ার খুবই প্রয়োজন। সুলতান আইয়ুবীর কাছে তুমি যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পার সেজন্যই ঘোড়া দরকার তোমার। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তোমার জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দেব আমি, যাতে তুমি জলদি সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে যেতে পার।’
‘তুমি কি করে জানলে আমি সুলতান আইয়ুবীর কাছে যেতে চাই?’ এবার সত্যি সত্যি বিস্মিত কণ্ঠে বলল ইসহাক তুর্কী।
‘এ কথা আর জিজ্ঞেস করো না।’
মেয়েটি বলল, ‘তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করছো। আমাকেও আমার দায়িত্ব পালন করতে দাও। আমি তোমাকে ঘোড়া দিয়ে প্রমান করবো, আমার দায়িত্ব আমি ঠিকমতই পালন করছি। তোমার দরকার ঘোড়া, তুমি ঘোড়া নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য ছুটে যাও, এর বেশী জানতে চেয়ো না।’
মেয়েটির বলার ভঙ্গি দেখে ইসহাক ভাবল, তবে তো তার কোন সমস্যাই থাকে না। মেয়েটির কি দায়িত্ব এবং সে তা কিভাবে পালন করছে তা নিয়ে খবরদারী করার কি দরকার আমার! তাই সে বললো, ‘হ্যাঁ, তোমার দায়িত্ব নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন তুলতে চাই না। আমার একটি ঘোড়া দরকার, তার ব্যবস্থা করে দিলেই আমি খুশি।’
‘না বলো যে, সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার একটা তাজাদম দ্রুতগামী ঘোড়া দরকার। আমি তোমাকে সেরকম একটি ঘোড়াই দেবো।’
‘হ্যাঁ, তাই দাও এবং দ্রুত দাও।’
‘কেন, এত তাড়া কিসের? সংবাদটি কি খুবই জরুরী?’
‘আমাকে এমন কথা জিজ্ঞেস করবে না।’ ইসহাক বললো, ‘তোমার ব্যাপারে যেমন আমি আগ্রহ প্রকাশ করিনি তেমনি তোমারও উচিত আমার ব্যাপারে বেশী আগ্রহ প্রকাশ না করা।’
‘ঠিক আছে, তোমাকে আর একটি প্রশ্নও জিজ্ঞেস করবো না। তুমি এখন বিশ্রাম নাও। রাত তো কেবল শুরু হয়েছে। রাতের শেষ প্রহরে তোমাকে আমি জাগিয়ে দেবো।’
মেয়েটি উঠতে উঠতে বলল, ‘আমি তোমার জন্য ঘোড়ার ব্যাবস্থা করছি।’
মেয়েটি তাঁবু থেকে বের হয়ে গেল। ইসহাকেরও শারীরিক অবস্থা এমনিতেই কাহিল ছিল। ঘোড়ার ব্যবস্থা হওয়ায় তার মানসিক পেরেশানীও দূর হয়ে গেল। সে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশান্ত মনে শুয়ে পড়লো।
‘কে বলেছে? তাকে মরতে দেয়া উচিত ছিল?’
মেয়েটি তাঁবু থেকে বের হয়ে তার লোকদের কাছে এসে বললো, ‘আমাকে এখন উস্তাদ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে শেখো। এ লোক সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। সে আমাকে অনুরোধ করেছে একটি ঘোড়া দিতে, যাতে সে সুলতান আইয়ুবীর কাছে দ্রুত ছুটে যেতে পারে।’
‘বাহ! কিন্তু এমন তোফা খবর কি করে উদ্ধার করলে? আহাম্মক মনে হয় তোমাকে তার পরিচয় দেবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল?’
মেয়েটি গর্বিত হাসি দিয়ে বলল, ‘যতই টিটকারী করো, আমার তথ্যে কোন ভুল নেই। সে যখন বেহুশ অবস্থায় বিড়বিড় করছিল, তখন আমি কান পেতে শুনেছিলাম। সে বারবার সুলতান আইয়ুবীর নাম নিচ্ছিল আর বলছিল আমি খুব মুল্যবান তথ্য নিয়ে এসেছি।’
মেয়েটি এরপর ইসহাক তুর্কীর সাথে এ কথা হয়েছে সব সঙ্গীদের খুলে বলল।
এটা কোন বণিকের কাফেলা ছিল না, এটা ছিল ক্রুসেড বাহিনীর একটা গোয়েন্দা ইউনিট। মিশরে কিছু নাশকতামূলক কাজ সেরে তাড়া ফিরে যাচ্ছিল নিজ এলাকায়। দশ-বারো জনের একটি দল। প্রত্যেকেই গোয়েন্দা কর্মে দক্ষ। কাফেলায় মেয়ে ছিল দু’জন। মিশনের সফলতার পেছনে তাদের ভুমিকা ছিল পুরুষদের চাইতে উজ্জ্বল।
এ মেয়ে দুটিকে দলে নেয়ার পেছনে প্রথম যোগ্যতা হিসেবে কাজ করেছিল তাদের অসাধারণ রূপ। দলে নেয়ার পর তাদেরকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কি করে শত্রু এলাকায় কাজ করতে হয়, কি করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে দলের অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, কি করে বশ করতে হয় টার্গেটকে, এসব ছিল ট্রেনিংয়ের প্রথম ধাপ।
তারপর তাদেরকে শেখানো হয় গোয়েন্দাগিরির আরো গোপন ও জটিল সব কৌশল। মেয়ে দুটি এসব প্রশিক্ষণে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে জটিল অপারেশনে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
এই কাফেলা বণিকের বেশে পথ চলছিল। তাদের কাছে উট ঘোড়া সবই ছিল। সিনাই মরুভূমির পাশ ঘেঁষে পথ চলছিল ওরা। যাত্রা পথে এখানে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এখানে পানি ও ছায়া দেখে থেমে যায় ওরা। সিদ্ধান্ত নেয় রাতের মতো এখানেই তাঁবু গাড়ার। এ সময়ই দূরে সিনাই মরুভূমির ভিতরে এক পথিককে আবিস্কার করে ওরা।
সূর্য ডুবতে বসেছে। লোকটি ধীর পায়ে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যার একটু পর লোকটি ওদের কাছে এসে পৌঁছল। তারা দূর থেকে তাকে আসতে দেখে দু’জন খ্রিষ্টান ও এক ইহুদী মেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।
তারা ভেবেছিল, এই লোককে তারা তাদের ক্যাম্পে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু তারা দেখলো, লোকটির অবস্থা এতই সংকটাপন্ন যে, যে কোন সময় লোকটি মারা যেতে পারে।
ইসহাক তুর্কী এদেরকে দেখেই মরুভূমির ধাঁধাঁ মনে করেছিল। পরে সে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলে ওরা তার কাছে গেল। মেয়েটাই মুখ খুলল প্রথমে, ‘এ কোন সাধারণ লোক বা মুসাফির নয়।’
তার এক সঙ্গী বলল, ‘আমার মনে হয় কোন আনাড়ি পথিক বা পাগল। নইলে এর এমন অবস্থা হবে কেন?’
ওপর সঙ্গীও তার সাথে একমত পোষণ করে বলল, ‘মরতে দাও একে। যত সব জঞ্জাল!’
কিন্তু মেয়েটি বেঁকে বসল। বললো, ‘আমি তোমাদের সাথে একমত হতে পারলাম না। এ লোক ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর এবং অমানুষিক পরিস্রমের কারণে এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এর শরীরে একটু দানাপানি ঢুকলেই সে এক বলিষ্ঠ যুবকে পরিণত হবে। তোমরা এর আকৃতি ও শারীরিক গঠন লক্ষ্য করো। এমন শরীর বহু কসরত করে তৈরী করতে হয়।’
‘তুমি কি মনে কর সে কোন কুস্তিগির? মরুভূমির সাথে লড়তে এসে এ অবস্থা করেছে নিজের?’
এ কথা শুনে হেসে উঠলো ওপর সঙ্গী।
মেয়েটি বলল, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে, এ লোক কোন গোয়েন্দা। একে আগে বাঁচিয়ে তোলার ব্যবস্থা করো। আমার সন্দেহ ঠিক হলে এ লোক আমাদের যথেষ্ট কাজে লাগবে।’
‘আর যদি তোমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়?’
‘তাতে তো কোন ক্ষতি দেখছি না। ভুল হলে এ লোক তো আমাদের খেয়ে ফেলবে না!’
যাই হক অনেক বাকবিতণ্ডার পর লোকটিকে তাঁবুতে তুলতে রাজি হলো ওরা। তবে কিছুটা রসিকতার ছলে। কিছুটা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে।
তাকে উঠিয়ে এনে একটি তাঁবুতে শুইয়ে দেয়া হলো। তারপর তার মুখে কিছু পানি ও মধু একত্রে মিশিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে তুলে দিল মেয়েটি।
এ সময়ই ইসহাক বিড়বিড় করে কিছু বললো। মেয়েটি কান পাতল। অস্পষ্ট কথাগুলো শুনল মনোযোগ দিয়ে।
ইসহাক তখনো বেহুশ অবস্থায় পড়েছিল। অজ্ঞান বা ঘুমন্ত অবস্থায়ও মানুষের আত্মা জেগে থাকে। স্বপ্নের ঘোরে তখন কথা বলে মানুষ। এ জন্যই শত্রু এলাকায় গোয়েন্দাদের ঘুমের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়। এমন কোথাও তাদের ঘুমানো নিষেধ, যেখানে ঘুমন্ত অবস্থায় মনের গোপন কথা অন্যের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে।
নিষ্ঠুর মরুভূমি ইসহাককে অসহায় ও মৃতপ্রায় করে তুলেছিল। অসম্ভব প্রানশক্তির বলেই সে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার ইসহাক তুর্কী অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে তখনো অটুট হয়ে বিরাজ করছিল সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাওয়ার সংকল্প। সে সংকল্পই প্রলাপের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল। যদি অজ্ঞান অবস্থায় তার কথা বন্ধ থাকত তবে তার আসল পরিচয় কেউ জানতে পারতো না।
ইসহাকের মত চালাক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দা এভাবে একটি মেয়ের জালে আটকা পড়ে যাবে ভাবা যায় না। কিন্তু ক্রমাগত বিপদ তার মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। আর মেয়েটিও ছিল এ লাইনে কুশলী উস্তাদ।
মেয়েটির কথা এত অল্পতে তার বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। সে মেয়েটিকে মুসলমান মনে করে তার গোপন পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে যে যে ভুল করেছে এখন তার মাশুল গোণার পালা।
মেয়েটির কথা শুনে তার সঙ্গীরা বললো, ‘তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তবে তো বলতে হয় তুমি এক বিরাট শিকার পাকড়াও করে ফেলেছো।’
কাফেলার কমান্ডার বললো, ‘এখন তার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, সে কি গোপন তথ্য নিয়ে যাচ্ছে এবং এ গোপন তথ্য সে কোত্থেকে সংগ্রহ করেছে।’
অন্য একজন বললো, ‘তার কাছ থেকে আরো জেনে নিতে হবে তার সঙ্গীদের এখন কি অবস্থা? কে কোথায় আছে?’
‘কিন্তু তাকে কোনক্রমেই জানতে দেয়া যাবে না আমরা কারা?’
কমান্ডার বললো, ‘আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের ভালমতই জানি। তারা মৃত্যু কবুল করবে তবুও মুখ খুলবে না। তাই তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে হবে কৌশলে। শক্তি খাতিয়ে তার কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না।’
‘আমি মুসলমানদের খুব ভালভাবেই জানি।’ মেয়েটি অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো, ‘গোপন তথ্য তো দূরের কথা, সে নিজের খঞ্জর দিয়ে আপন প্রাণ ত্যাগ করবে, তবুও কথা বলবে না। ওরা জীবন দিতে রাজি কিন্তু নিজের ঈমান নষ্ট করতে রাজি নয়।’
‘হ্যাঁ, এটা মুসলমানদের চরিত্রের একটি দিক। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও আছে। তুমি কি সেই মুসলমানদের জানো, যারা রাজ্য, গদি, ক্ষমতা ও অর্থের নেশায় মত্ত হয়ে জাতির সর্বনাশ করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে?’
এক খ্রিষ্টান বললো, ‘এসব মুসলমান খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শুধু গোপন তথ্যই তোমাকে দান করবে না, তোমার হুকুমে আপন ভাইদের বুকে ছুরি বসাতেও দ্বিধা করবে না। তাদের কাছে কচুপাতার পানির মতই ঈমান মূল্যহীন। ক্ষমতা আর প্রতিপত্তিই তাদের কাছে একমাত্র সম্পদ।’
পাশেই আরেক খ্রিষ্টান মেয়ে বসেছিল। সে চুপচাপ বপ্সে শুনছিল ওদের কথা। নিজে থেকে কিছুই বলেনি। কমান্ডার তার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো, ‘তুমি কি এই মুসল্মানের মুখ থেকে কোন গোপন তথ্য বের করতে পারবে বারবারা?’
মেয়েটি তার দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকালো, কোন জবাব দিল না। কমান্ডার বললো, ‘তুমি কায়রোতে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছো। মেরিনার উস্তাদি দেখেছো? তার কাছ থেকে কিছু শেখো। আমি তোমাকে আর কোন সুযোগ দেব না। মেরিনার বুদ্ধির দিকে একটু খেয়াল করো, আমরা তো সকলেই ওই লোককে একজন পথভোলা পথিক মনে করেছিলাম। একজন বেকার ও নিরর্থক লোক ভেবে তাকে ফেলে আসতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু মেরিনা তাকে চিনতে পেরেছিল। এই দৃষ্টি একজন মহিলা গোয়েন্দার থাকা উচিত। তার কাছ থেকে তোমার অনেক কিছু শেখার আছে। তুমি খ্রিষ্টানদের উপকার করার বদলে বরং কিছু ক্ষতি সাধন করেছ। এ জন্যই তোমাকে মিশর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি। এখনো সময় আছে, সাবধান হও। নইলে পরে পস্তাবে।’
‘তোমার পরিণতি খুব খারাপ হবে বারবারা।’ অন্য এক খ্রিষ্টান বললো, ‘তোমাকে এই পেশা থেকে বহিস্কার করা হবে। যেখানে তোমাকে রাজকুমারীর মতো রাখা হয়েছে সেখান থেকে তোমাকে বের করে দেয়া হলে তুমি হবে কারো দাসী বা রক্ষিতা। অথবা তোমার ঠিকানা হবে পতিতালয়। কমান্ডার তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমাকে সাবধান হতে বলেছে।’
‘হুম!’ মেরিনা ঘৃণা ভরে বললো, ‘ও তো সেই কাজেরই যোগ্য। এর বেশী আর কি পাবে সে।’
বারবারা মেরিনার দিকে রাগে কটমট করে তাকাল। তার মুখের বর্ণ রাগে লাল হয়ে গেল, কিন্তু তবু সে মুখ খুলল না, তেমনি চুপচাপ বসে থাকলো।
বারবারাও মেরিনার মতই অপূর্ব রূপসী ছিল এবং কাজে কর্মেও চৌকস ছিল। কিন্তু যখন তাকে মিশর পাঠানো হল তখন থেকেইসে কেমন ঠাণ্ডা ও নির্জীব হয়ে গেল। এর কারণ ছিল মেরিনা।
প্রথম দিকে মিশরে গোপন ষড়যন্ত্রে সে খুবই সক্রিয় ছিল। দলনেতার সাথে তার ভাব ছিল খুবই নিবিড়। তাদের দলনেতা ছিল গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার। দেখতে খুবই সুপুরুষ ও সুদর্শন ছিল লোকটি।
ওরা সবাই এক স্থানে মিলিত হতো। দলনেতা তাকে পছন্দ করে এজন্য সে ছিল খুবই খুশী। দলনেতা যে বারবারাকে পছন্দ করে এটা কোন গোপন ব্যাপার ছিল না। দলনেতা তাকে বিয়ে করার আশ্বাসও দিয়েছিল।
দলনেতা কোন গোয়েন্দার পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করলে তার উন্নতি ছিল অবধারিত। বারবারা এতে খুবই খুশী ছিল যে, একদিন তারও যথেষ্ট উন্নতি ঘটবে। কিন্তু মেরিনা কমান্ডারের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করলো যে,কমান্ডারের অন্তর থেকে বারবারা বিদায় হয়ে গেল। সে স্থান দখন করলো মেরিনা।
এখন সে কমান্ডারের উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে যে মেরিনা বলতে কমান্ডার অজ্ঞান। সে কমান্ডারের মনে বারবারার বিরুদ্ধে বাজে ধারনা সৃষ্টি করে রেখেছে।
মেরিনা কমান্ডারের সাথে খোলামেলা প্রেম শুরু করলে বারবারা আহত হয়। সেই থেকে সে মনমরা ও নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। এখন গোয়েন্দাগিরি করতেও আর তার মন বসে না। কমান্ডার এখন তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। আর এ সবই ঘটছে মেরিনার জন্য।
সুলতান আইয়ুবীর এর বড় সামরিক অফিসারের পেছনে লাগানো হয়েছিল বারবারাকে। কিন্তু সে কাংখিত ফল লাভ করতে পারেনি। নেতার মনে ধারণা জন্মে গেছে, সে আইয়ুবীর অফিসারকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছে।
বারবারার ব্যাপারে মেরিনা সতীনের মতই আচরণ শুরু করছিল। নেতা ওদের এই বিবাদ মিটাতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে কেন্দ্রে। উদ্দেশ্য, পুরানো লোকজন বাদ দিয়ে নতুন করে গ্রুপ তৈরী করা, যাতে গ্রুপের মধ্যে শৃঙ্খলা অটুট থাকে। এরপর তাদের নিয়ে আবার সে মিশরে ফিরে আসবে।
এতে বারবারা মেরিনার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল। মেরিনার জন্যই এখন নেতা তার শত্রু হয়ে গেছে। মেরিনাও তার সাথে তিরস্কার ও ঘৃণার স্বরে কথা বলতো। এভাবেই তার পরিণাম খারাপ হয়ে গেল।
মেরিনা বললো। ‘গায়ের রঙ ফর্সা হলেই কেউ গোয়েন্দা হতে পারে না। গোয়েন্দা হতে হলে ঘটে কিছু বুদ্ধিও রাখতে হয়। ওর যদি সে যোগ্যতাই থাকে তবে তো সাদা ঘোড়াকেও গোয়েন্দা বলতে হবে!’
এ কথার পরও কোন জবাব দিল না বারবারা, মনে মনে শুধু প্রতিশোধের আগুন নিয়ে জ্বলতে লাগলো।
’এই লোকের ভেতর থেকে আমি গোপন তথ্য বের করে নিতে পারবো।’ মেরিনা বললো, ‘এ কাজ করার সাধ্য বারবারার নেই।’
এ কথার পর আর এখানে বসা যায় না। বারবারা রাগে সেখান থেকে উঠে চলে গেল।
’সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা রাতে তো পালিয়ে যাবে না আবার?’ নেতা জিজ্ঞেস করলো।
’এখন তো তার পালাবার কোন কারণ নেই।’
’তবুও সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। তাকে অজ্ঞান করে রাখার ব্যবস্থা করো।’
কিছুক্ষণ পর।
ইসহাক তুর্কী যেখানে শুয়েছিল সে তাঁবুতে প্রবেস করল মেরিনা। তাঁবুতে প্রদীপ জ্বলছিল। মেরিনার হাতে একটি রুমাল। সে রুমালে অজ্ঞান করার ঔষুধ মাখানো।
সে আলতো পায়ে ইসহাকের কাছে গেল এবং তার শিয়রে বসে হাতের রুমালটি ইসহাকের নাকে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর যখন বুঝল কাজ হয়ে গেছে, রুমাল সরিয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল। কমান্ডারের কাছে গিয়ে বললো, ‘কাল সূর্য উঠার পরেও তাকে ঘুমের মাঝেই পাবেন।’
’ঠিক আছে। আবার তুমিও গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তাকে সামলাবার জন্য আবার তোমাকেই ডাকতে হবে।’
’আপনার ডাকার দরকার হবে না। তার আগেই আমি আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবো।’
কমান্ডার বললো, ‘কাল আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এই গোয়েন্দাকে তার আবদার অনুসারে অবশ্যই ঘোড়া দেবো। কিন্তু সে ওই ঘোড়ার পিঠে চড়ে কায়রো নয়, বৈরুত যাবে।’
’এ লোক আমাদের সহযাত্রী হবে?’ প্রশ্ন করল মেরিনা।
’হ্যাঁ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এর গোয়েন্দাকে পাকড়াও করা আমাদের জন্য বিরাট সফলতা। এই সাফল্য আমাদের সম্রাট চাক্ষুস দেখতে পেলে আমাদের মর্যাদা কতটা বেড়ে যাবে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
’সরদার!’ এক গোয়েন্দা বলল, ‘আসুন এই সাফল্যকে আমরা স্মরণীয় করে রাখি মেরিনার হাতের সুধা পান করে।’
কমান্ডারের হুকুমে মদ পরিবেশিত হলো। সবাই মদ পান করে আনন্দ উল্লাস করতে লাগল। মেরিনা তো আনন্দে নাচতে লাগল।
কিন্তু বারবারা সে আনন্দ উৎসবে শামিল হতে পারল না। তার মন আরো উদাসীন হয়ে গেল। মেরিনার প্রতি তার বিষিয়ে উঠা মনে ক্ষোভ আরো একটু বাড়ল এতে। সে উৎসব স্থল থেকে উঠে নিজের তাঁবুতে চলে গেল।
অনেকক্ষণ পড় যখন সবাই একে একে আপন তাঁবুতে চলে গেল, কমান্ডার মেরিনাকে বলল, ‘চলো এ আনন্দময় রাতকে আরো আনন্দময় করে তুলি।’
মেরিনা তো এ প্রস্তাবের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘চলো।’
ওরা সেখান থেকে বেরিয়ে হেঁটে বহুদূরে চলে গেল। হারিয়ে গেল সবার দৃষ্টির আড়ালে।
বারবারা তার তাঁবুতে একা শুয়ে শুয়ে নিজের ব্যর্থতার কথা স্মরণ করছিল। তার মন ডুবেছিল উদাসীনতায়। অন্তরে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। বাইরের আনন্দ স্ফূর্তির শোরগোল তার মনের উদাসীনতাকে আরো উসকে দিচ্ছিল। যখন আনন্দ উল্লাসের রোল শেষ হলো তখন সে উপলব্ধি করল, তার মনের আগুন না নিভে তাকে আরও অস্থির ও উত্তেজিত করে তুলছে।
সে তার তাঁবুর পরদা সরিয়ে বাইরে তাকাল। দেখলো কমান্ডার ও মেরিনা দূরে এক টিলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাঁদনী রাত। তারা দু’জন হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে, স্পষ্ট দেখতে পেল বারবারা।
যতক্ষন তাদের দু’জনকে দেখা গেল, অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল বারবারা। তারা দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে তার বুক চিড়ে বেরিয়ে এল এক গভীর দীর্ঘশ্বাস।
বারবারার মনে মেরিনার সেই হুল ফুটানো কথাগুলো স্মরণ হলো, ‘গায়ের রঙ ফর্সা হলেই কেউ গোয়েন্দা হতে পারে না। গোয়েন্দা হতে হলে ঘটে কিছু বুদ্ধিও রাখতে হয়। ওর যদি সে যোগ্যতাই থাকে তবে তো সাদা ঘোড়াকেও গোয়েন্দা বলে হবে!’
বারবারা উত্তেজনে দমন করে মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, যে করেই হোক, সে মেরিনার আশা ব্যর্থ করে দেবে।
কিন্তু কিভাবে? বারবারা ভেবে দেখলো, যদি সে ইসহাক তুর্কীকে বলে দেয়, আমরা কোন বণিক কাফেলা নই, আমরা সবাই খ্রিষ্টান গোয়েন্দা, তাহলে সে তার গোপন তথ্য আর ফাঁস করবে না।
সে এ কোথাও চিন্তা করল, পারলে তাকে এখান থেকে পালানোর ব্যবস্থা করে দেবে। তাতে করে মেরিনার আশার গুড়ে ছাই পড়বে।
প্রতিশোধের উপায় হিসেবে সে এসব বিষয় চিন্তা করছিল আর অপেক্ষা করছিল, কখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে।
চারদিক এখন নিঝুম নিস্তব্ধ। হয়তো সবাই এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে, কমান্ডার ও মেরিনা ছাড়া। বারবারা এসব ভাবছিল কিন্তু তার চোখে ঘুম ছিল না। এ সময় কেউ একজন তার তাঁবুর পাশে এসে আস্তে ডাক দিল, ‘বারবারা!’
কণ্ঠটি চিনতে পারল বারবারা। কিন্তু কোন জবাব দিল না।
সে আবারও ডাকল, কিন্তু বারবারার জবাব না পেয়ে পর্দা উঠিয়ে আস্তে ভেতরে ঢুকে গেল। আগন্তুক তার কানের কাছে বসে আবার ডাকল, ‘বারবারা!’
’চলে যাও মার্টিন।’
বারবারা রাগে ও দুঃখে হিসহিস করে বললো, ‘তোমাকে তো নিষেধ করেছি, আমার দিকে নজর দিও না। কোন সাহসে তুমি আবার আমার তাঁবুতে এসে ঢুকেছো? যাও, এখান থেকে চলে যাও বলছি।’
মার্টিন চলে যাওয়ার পরিবর্তে তার আরও কাছ ঘেঁষে বসে বললো, ‘আচ্ছা, তোমার হলো তা কি বলতো? তুমি কি ভাবছো আমাদের কমান্ডার মেরিনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! তাকেই মন দিয়ে বসে আছেন তিনি?’
একটু থামল মার্টিন। তারপর খুবই ধীর কণ্ঠে বলল, ‘তুমি জানো না, এরা সবাই বদমাশ। বারবারা, তুমি অযথাই অন্তরে ব্যথা নিয়ে দায়িত্ব পালনে অসাবধান হয়ে পড়েছো। কমান্ডার কাউকেই ভালবাসে না। না তোমাকে, না মেরিনাকে।
তাই মেরিনার সাথে তাকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে তোমার কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। যদি সত্যিকার ভালবাসা চাও তবে তা আমার কাছেই পাবে। আমি কি কোনদিন তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি, বলতে পারো?’
’তুমি আপাদমস্তক একটা ধোঁকার জাল!’ বারবারা বলল, ‘আমরা সবাই ধোঁকাবাজ। মানুষকে ধোঁকা দেয়াটা আমাদের নেশা, পেশা, সব।’
’যাই বলো, দায়িত্বের ব্যাপারে তোমার এমন উদাসীন হয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়।’
’আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীন নই। আসলে আমার মন এ দুনিয়া থেকে উঠে গেছে। তাই কোন কাজ করতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমাকে বিরক্ত করো না।’
’বারবারা! এভাবে বলো না। আমরাও তো মানুষ! মানবিক দুর্বলতা আমাদের থাকতেই পারে। সেই দুর্বলতার কথা স্মরণ করে নিজেকে কষ্ট দেয়া ও বঞ্চিত করার কোন মানে হয় না।’
’দেখো, যারা প্রতারক, ধোঁকাবাজ তাদের উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। আমি আবারও বলছি, আমাকে বিরক্ত করো না।’
’তুমি ধোঁকার কথা বলছ? আরে ওটাতো আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। আমরা আমাদের দুশমনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করি ক্রুশের মর্যাদা রক্ষার জন্য। ওতে কোন পাপ নেই, ওটা কোন অন্যায় নয়।’
’অন্যায় না হলে তুমি হাজার বার ধোঁকা দাও গিয়ে, তবে আমাকে নয়। আমি আর ধোঁকার জালে বন্দী হতে চাই না।’
‘বারবারা, আমাকে ভুল বুঝ না। আমি কখনো তোমাকে ধোঁকা দেইনি, দেবো না। আমার ভালবাসা মিথ্যে নয়, মিথ্যে হতে পারে না!’
’ভালবাসার অহংকার মানায় না তোমাকে। শিশুকাল থেকে ছলচাতুরীর ট্রেনিং পেয়ে ধোঁকা দেয়াটা চরিত্রের ভূষণ হয়ে গেছে আমাদের। মুসলমানদের ধোঁকা দিতে দিতে আমরা এমন ধোকাবাজে পরিণত হয়েছি যে, নিজের সাথে প্রতারণা করতেও আমরা এখন মজা পাই।
আমরা ক্রুশ চিহ্ন গলায় ধারণ করে বদমাইশি করে বেড়াচ্ছি, শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার সাথে সাথে ছলনা করছি নিজের সাথিদের সাথে। আমার এ কথা মিথ্যে নয়, নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বলছি আমি।’
’বারবারা, চুন খেয়ে মুখ পুড়েছে তোমার। একবার দই খেয়ে দেখো, অনেক ভাল লাগবে।’
’আমাদের কারখানায় দই তৈরীই হয় না, তুমি কোত্থেকে দেবে? যদি মুসলমান হতে, তাও না হয় বিশ্বাস করা যেতো।’
’কি! তুমি মুসলমানদের সাফাই গাইছো?’
’কেন গাইবো না? তোমাদের তুলনায় মুসলমানরা অনেক ভাল এবং বুদ্ধিমান। তারা গোয়েন্দাগিরি করার জন্য মেয়েদের ব্যবহার করে না।
আমাদের কমান্ডার প্রথমে আমাকে ভালবাসার লোভ দেখিয়েছে। যেহেতু মেরিনা বেশি চালাক এবং ধুরন্ধর, সে জন্য সে কমান্ডারকে মুঠোর মধ্যে পুর নিয়েছে। তুমি আমার উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছো। ফলে আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা একে অন্যকে শত্রু বানিয়ে নিয়েছি। তাই তো ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে এখন আমাদের বৈরুত ফিরে যেতে হচ্ছে।’
’ব্যর্থতা আর সফলতা দুই বোন। এরা সবসময় গলাগলি ধরে থাকে। সামান্য ব্যর্থতা দেখে তোমার নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। এই আমরাই আবার সাফল্য ছিনিয়ে আনবো।’
’আমি নিরাশ, কারণ তোমরা ব্যর্থতার কারণ দেখতে পাও না। যদি আমরা দুটি মেয়ে তোমাদের সাথে না থাকতাম, তবে তোমরা তোমাদের দায়িত্ব সাহস ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারতে। পুরুষের মাঝে মেয়েদের অবস্থান করার অর্থই হল শত্রুতা সৃষ্টি করা, ঝগড়া বিবাদের সূত্রপাত করা। আমাদের সঙ্গে রাখার কারনেই আজ তোমাদের মাঝে এই ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। যদি কেউ বলে, যত নষ্টের গোড়া এই দুই মেয়ে, আমি তা অস্বীকার করতে পারবো না।’
’এ কারনেই তো আমরা মুসলমানদের মাঝে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের রেখে দেই।’ মার্টিন বলল। ‘তাদের মধ্যে পরস্পর শত্রুতা সৃষ্টি করাই আমাদের কাজ। আমরা সে কাজ এজন্য করি যাতে ইসলামের অবক্ষয় সৃষ্টি হয় আর বিশ্বব্যাপী খৃষ্টানদের আধিপত্য কায়েম হয়।’
মার্টিন বারবারাকে তার দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘এত সুন্দর চাঁদনী রাতকে এমন নিরস কোথায় ব্যর্থ করে দিও না বারবারা। এসো বাইরে যাই। দেখো তো চাঁদনী কতো সুন্দর!’
‘আমার মন ভেঙ্গে গেছে।’ বারবারা বলল, ‘আমি ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগছি। তোমাদের সবার প্রতি আমার ঘেন্না জমে গেছে। আমি কোথাও যাব না, তুমি একাই যাও।’
এবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মার্টিন। বলল, ‘একদিন তুমি আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদবে বারবারা! আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, মার্টিন, আমাকে বাঁচাও! দেখো, এরা আমাকে কুকুরের মাঝে ছেড়ে দিচ্ছে। তখন কিন্তু আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারবো না।’
‘আমি এখনো কুকুরদের মাঝেই আছি।’ বারবারা ঘৃণা ভরে বললো, ‘আমি তোমার সাহায্য কোনদিন চাইবো না। এবার তুমি এখান থেকে যাও।’
ক্ষিপ্ত মার্টিন রাগে উঠে দাঁড়ালো এবং গরগর করতে করতে চলে গেল।
সে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে মার্টিনের চলে যাওয়া দেখলো। মার্টিন চলে যেতেই আবার তার মন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তখনি বিছানা ছেড়ে উঠলো না সে, অপেক্ষা করতে লাগলো মার্টিনের ঘুমিয়ে পড়ার।
সে ধারণা করলো, কমান্ডার ও মেরিনার ফিরতে অনেক দেরী হবে। তারা ফিরে আসার অনেক আগেই সে ইসহাকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো।
কিছুক্ষণ পড়।
তাঁবুর বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো বারবারা, কোন তাঁবুর বাইরেই কেউ দাঁড়িয়ে নেই। মার্টিন ঘুমিয়ে না পড়লেও নিশ্চয়ই সে তার তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
হামাগুড়ি দিয়ে নিজের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো বারবারা। দাঁড়ালো না, ক্রল করে পিছিয়ে গেল। সামনে একটু গর্ত মত জায়গা ছিল, সেখানে নেমে উঠে বসলো। তারপর সেখান থেকে উঠে তাঁবুগুলো থেকে দূরে সরে গেল আস্তে ধীরে।
অনেক দূর ঘুরে নিঃশব্দে এগিয়ে এলো ইসহাকের তাঁবুর দিকে। কোন রকম বাঁধা ও বিপদ ছাড়াই এক সময় সে ইসহাকের তাঁবুর কাছে পৌঁছে গেল।
ইসহাক তুর্কী বেহুশ হয়ে পড়েছিল তাঁবুর ভেতর। বারবারা জানতো না, মেরিনা তাকে বেহুশ করে রেখে গেছে। সে খুব সাবধানে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে, পা টিপে টিপে তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করলো।
তাঁবুর ভেতর প্রদীপ জ্বলছে। সে ইসহাককে ডাকল, সাড়া দিল না ইসহাক। এবার তার কাঁধ ও বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিল, তাতেও কাজ হল না। নিরুপায় বারবারা তার মাথার ছুল ধরে জোরে টানাটানি করল, কিন্তু ইসহাক তুর্কী এ সবের কিছুই টের পেল না।
‘ওরে হতভাগা ওঠ!’ সে ইসহাকের মুখে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘তুই যে গর্দভের মত ঘুমাচ্ছিস, তুই কি জানিস তুই কি ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়েছিস? আমরা সবাই খৃস্টান ও ইহুদী গোয়েন্দা। এখন পালাতে না পারলে তুই আর কোনদিন কায়রো যেতে পারবি না। বৈরুতের কারাগারের নিষ্ঠুর কক্ষে ভীষণ যন্ত্রনায় ভুগে ভুগে মারা যাবি।’
ইসহাক বেহুশের মত পড়ে রইলো, যেন মারা গেছে। বারবারা তাঁবুর বাইরে মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেল কিন্তু সে ভয় পেল না। সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়ে, শব্দ কাছে এসে গেল তবু সে ওখানেই বসে রইল।
শব্দ তাঁবুর আরও কাছে এলে সে বুঝলো, এই কণ্ঠস্বর মেরিনার। সে কমান্ডারকে সাথে নিয়ে বন্দীকে দেখতে আসছে।
‘আমরা সবাই মুসলমান।’ বারবারা ইসহাককে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরেই বলছে, ‘আমরা তোমাকে এমন ঘোড়া দেব যে ওই ঘোড়ার সাহায্যে তুমি দুই দিনেই কায়রো পৌঁছে যেতে পারবে।’
‘বারবারা!’ সে তার কমান্ডারের কণ্ঠ শুনতে পেল, পিছন ফিরে দেখল, তাঁবুর মধ্যে কমান্ডার ও মেরিনা দাঁড়িয়ে আছে। কমান্ডার বলল, ‘তুমি এখন যাও। তোমার আর দায়িত্ব পালন করতে হবে না। একজন বেহুশ মানুষকে তুমি কখনোই তোমার কথা শোনাতে পারবে না।’
‘এটা আমার শিকার বারবারা!’ মেরিনা বিদ্রুপ মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘আমিই শুধু জানি তার মুখ থেকে কেমন করে গোপন তথ্য বের করতে হবে।’
কমান্ডার ও মেরিনার বিদ্রুপ গায়ে মাখলো না বারবারা। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল, ‘আমি তো আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
‘যাও, আর চেষ্টা করতে হবে না। তুমি তোমার তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়।’
কমান্ডারের হুকুম শিরোধার্য করে সে উঠে দাঁড়ালো এবং মেরিনার দিকে একবার বাঁকা দৃষ্টি হেনে বাইরে চলে গেল।
গোয়েন্দা কমান্ডার ইসহাকের নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলো। তার অবস্থা স্বাভাবিক দেখে মেরিনাকে সঙ্গে নিয়ে কমান্ডার তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল।
ইসহাক তুর্কী সুলতান আইয়ুবীর জন্য বয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বুকে নিয়ে বেহুশের মত পড়ে রইল বিছানায়।
* * *
‘আলী বিন সুফিয়ান!’ কায়রোতে সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘ওদিক থেকে এখনও কোন সংবাদ এলো না। তার মানে তুমি যদি বলো, সেখানে কোন ঘটনা ঘটেনি, কোন তৎপরতা চলছে না, সেকথা আমি মানতে পারি না।’
‘আর আমিও একথা মানে পারি না যে, সেখানে কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে আর আমরা তা জানতে পারবো না।’
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘সেখানে আমাদের যে লোক কাজ করছে সে কোন সাধারণ গোয়েন্দা নয়। ইসহাক তুর্কীকে আপনিও ভালমত জানেন। সে মাটির তলার গোপন তথ্যও সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে। তার মত বুদ্ধিমান ও চালাক গোয়েন্দা আমাদের অন্ধকারে রাখবে, এটা ভাবা যায় না। শুধু সে কেন, তার দলের প্রতিটি সদস্যই হুশিয়ার গোয়েন্দা।’
‘খৃস্টানরা তাদের লাভ অবশ্যই খুঁজে বের করবে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘বিলডনের খৃস্টান বাহিনী হলব ও মুশেলের পাশে অযথা ঘুরাঘুরি করছে, এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই।’
‘কিন্তু এখন তো আল মালাকুস সালেহ নেই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এখন হলবের শাসনকর্তা ইয়াজউদ্দিন মাসুদ। সে খৃস্টানদের সাথে মিতালী করার লোক নয়।’
‘আলী!’ সুলতান আইয়ুবী বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘তুমিও নিশ্চিত শান্তনায় রয়েছো? তাকে আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলি বলেই কি তুমি তাকে পাক্কা মুসলমান বলছো? কিন্তু তুমি কি লক্ষ্য কর নি আমি তার সাহায্য ছাড়াই আর্মেনীয়দের অস্র সমর্পণ করতে বাধ্য করলাম আবার শর্ত সাপেক্ষে তাদের হাতে ক্ষমতাও তুলে দিলাম। আমি জানি, তারা চুক্তি ভঙ্গ করতে সাহস পাবে না। কিন্তু আমি আমার মুসলমান শাসকদের বিশ্বাস করতে পারছি না।
ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আমার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ঠিক, কিন্তু তার দরবারে এখনো গাদ্দার উজির ও খৃস্টান উপদেষ্টারা রয়ে গেল কিসের ভিত্তিতে? কেন সে তাদের বিদায় করার ব্যবস্থা করলো না? আলী, তুমি তো নিজেই সাক্ষী, তোষামোদকারী উজির ও উপদেষ্টাদের পক্ষে ষড়যন্ত্রকারীদের জালে আটকাতে সময় লাগে না। জাতি ও দেশের স্বার্থকে তারা ব্যক্তি স্বার্থে যে কোন সময় বিকিয়ে দিতে পারে।
আমি কোন উপদেষ্টা রাখার বিরোধী নই। এটা কোরআনেরই নির্দেশ যে, কোন সিদ্ধান্তে আসার আগে পরামর্শ নাও। আল্লাহ্ পাক তার প্রিয় রাসুল (সা.)কেও এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু উজির ও উপদেষ্টাদের সে পরামর্শ সঠিক কিনা টা বুঝবার মত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকা দরকার শাসকের।
তাদের উদ্দেশ্য দেশ ও জাতির অনুকূল না প্রতিকূল সে বিষয়টি বুঝতে পারার মত সূক্ষ্ম জ্ঞান না থাকলে সেই শাসক ও নেতা তোষামোদকারীদের হাতের পুতুল হয়ে যায়। চাতুকাররা নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে তাদের নেশায় পরিণত করে দেয়। ইতিহাস সাক্ষী, এ ধরনের শাসকদের সময়ই দেশ ও জাতির ভাগ্যে দুর্ভাগ্য নেমে আসে।
কোনটা সত্য ভাষণ আর কোনটা তোষামোদী যখন বুঝতে পারে না শাসক, তখন আপনাতেই সে তোষামোদকারীদের বেশী প্রিয় ভাবতে থাকে। তাদের মিষ্টি মধুর ঘুম পাড়ানি গানে মজে গিয়ে সত্যভাষণ শোনার ধৈর্য ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তোষামোদ-প্রিয়তার কারণেই নিষ্ঠাবান রাজকর্মচারী অপ্রিয় আর ষড়যন্ত্রকারীরা আপন ও প্রিয়ভাজনদের মধ্যে শামিল হয়ে যায়।
যখন কোন নেতা ও শাসক আপন-পর চিনতে এভাবে ভুল করে বসে তখন তার পতন কেউ ঠেকাতে পারে না। ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পড়ে একের পর এক গর্তে পা দেয় আর নামতে নামতে পতনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। এ ধরনের মাথামোটা শাসক যত বড় বীর বা গাজীই হোক না কেন, দেশ ও জাতিকে তারা ডুবিয়েই ছাড়ে। ইয়াজউদ্দিনকে নিয়ে আমার এমন ভয়ই হচ্ছে।’
‘আমি এই ভরসার কথা বলছি যে, নুরুদ্দিন জঙ্গির বিধবা স্ত্রী ইয়াজউদ্দিনের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।’
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আপনি তো এ সংবাদ ও পেয়েছেন, মহীয়সী রাজিয়া খাতুন শুধু এই শর্তেই এ বিয়েতে রাজি হয়েছেন যে, মুশেল ও হুলেবের সেনাবাহিনী আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। তাকে সঠিক পথে রাখার উদ্দেশ্য ছাড়া এই মহীয়সী মহিলার এ বিয়েতে রাজি হওয়ার আর কোন কারণ দেখি না।’
‘তবু আমার সন্দেহ আছে তাকে নিয়ে। কেউ নিজে লোভী হলে আপনজনেরা তাকে কতক্ষণ আগলে রাখবে?’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমার সন্দেহের আরো কারণ আছে। ইয়াজউদ্দিন ক্রুসেড বাহিনীর একদম তোপের মুখে। সে নিজেকে নিরাপদ করার জন্য আমার সাহায্য চায়নি। তাহলে তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দিল? নিশ্চয়ই সে গোপনে খৃস্টানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আছে। সেখানকার অবস্থা আমাকে জলদি জানতে হবে। তুমি আমার চোখ ও কান আলী! তুমি জানো, আমি অন্ধকারে কখনও সামনে চলি না !’
‘আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন সুলতান।’ আলী বিন সুফিয়ানের কন্ঠ।
‘বেশী দিন অপেক্ষা করার মত সময় আমার হাতে নেই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তুমিতো জানোই, আমি সৈন্যদের প্রস্তুত করে ফেলেছি। নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছো, আমি রাতদিন সৈন্যদের যুদ্ধের মহড়া ও কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। আমার মনের গহীন গোপনে যে আশা ও স্বপ্ন লুকিয়ে আছে তাও তোমাকে বলি, আমি হলব ও মুশেলের দিকে যাবো না। এবার আমার টার্গেট হবে বৈরুত।’
‘বৈরুত?’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘হ্যাঁ, বৈরুত। আমি আর প্রতিরক্ষা যুদ্ধ করতে রাজি নই। হলব ও মুশেলের দিকে যাওয়ার অর্থ, সে এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু এখন আমার লক্ষ্য হলো ঘোরতর যুদ্ধ। যে প্রলয় এর আগে আমি আর কোথাও সৃষ্টি করিনি।’
সুলতান যখন কথা বলছিলেন তখন তার দৃষ্টি ছিল দূর দিগন্তে। মনে হচ্ছিল তিনি বৈরুতের অলিতে গলিতে ঘুরছেন। প্রলয় ঝঞ্ছার মত তছনছ করছেন দুশমনের দুর্ভেদ্য ঘাটিঁগুলো। আলী বিন সুফিয়ান এক বুক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে তাকিয়েছিলেন তার প্রিয় নেতার দিকে। সে দৃষ্টিতে ছিল অপরিসীম মুগ্ধতা।
সুলতান আইয়ুবী আবার মুখ খুললেন, ‘বৈরুত খৃষ্টানদের প্রাণকেন্দ্র। হাত পায়ে আঘাত করার চেয়ে সরাসরি বুকে আঘাত করি না কেন? শত্রুদের কলিজার উপরে একটি মোক্ষম আঘাত হানতে পারলে পৃথিবী মুসলমানদের জন্য অনেক প্রশস্ত হয়ে যাবে।
সেই চূড়ান্ত আঘাত হানার বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলার জন্যই এত ট্রেনিং, এত প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনী ও জাতিকে আমি এমনভাবে প্রস্তুত চাই, যেন নির্মম, নিষ্ঠুর ও নির্দয় আক্রমণে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
আমরা কি চিরকাল নিজেদের এলাকাতেই যুদ্ধ করবো? না, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকলে বায়তুল মুকাদ্দাস আমরা কোন দিনই পৌঁছতে পারবো না। বায়তুল মুকাদ্দাস যেতে হলে আমাদেরকে ঘর থেকে বেরোতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে নিজের এলাকার বাইরে গিয়ে।
দুশমন যেভাবে আমাদের ব্যস্ত রেখেছে নিজেদের ঘর সামলানোর কাজে সেই কাজ আমি দুশমনের হাতে তুলে দিতে চাই। এখন আমি এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে চাই, যাতে ওরাই নিজেদের ঘর সামলানোর ব্যস্ত থাকে। এসব কথা একটু ভাবো আলী। তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন আমি চারদিকের সংবাদের জন্য এত পেরেশান হয়ে আছি।’
‘সুলতান! আপনি ঠিক কি খবর ও তথ্য এ মুহুর্তে জানতে চান?’
‘আলী! এ মুহুর্তে মাত্র দুটো গোপন বিষয় জানা আমার জরুরী। একটি হলো, বৈরুতে খৃষ্টানদের সামরিক তৎপরতা ও শক্তির একটি নিরেট বাস্তব চিত্র। আর দ্বিতীয়টি হলো, হলব ও মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদের প্রকৃত মনোভাব ও পরিকল্পনা কি! আমাকে কি আরও একবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে, নাকি ইসলামের উদার মুক্ত শান্তির বাণী নিয়ে আমি ছুটে যেতে পারবো বিপন্ন মানবতার কাছে?’
‘বৈরুতে ইসহাক তুর্কী আছে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘জরুরী সংবাদ থাকলে সে নিজেই তা নিয়ে ছুটে আসতো। আর নেহায়েত নিজে না পারলে অন্য কাউকে দিয়ে সে খবর সে অবশ্যই পাঠিয়ে দিত। আপনি এখন যা জানতে চাইলেন তা দ্রুত জানার উপায় হলো, এখান থেকে কাউকে এ খবর আনার জন্য এখনি পাঠিয়ে দেয়া। সে যেন জলদি খবর নিয়ে ফিরে আসে সে ব্যাপারে আমি তাকে বিশেষভাবে বলে দেবো।’
‘আমি বেশী দিন অপেক্ষা করতে পারবো না আলী!’
সুলতান আইয়ুবী পেরেশানী নিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে তুমি কাউকে পাঠাবে, সে ওখানে পৌঁছে সেখানকার অবস্থা জানবে, তারপর সেই খবর নিয়ে সে আবার ফিরে আসবে- এ তো দেখছি তিনমাসের লম্বা এক পরিকল্পনা। না আলী না, এত সময় আমি অপেক্ষা করতে পারবো না। আমি তার আগেই সেনাবাহিনী নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই। আমার বাহিনী মার্চ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আমার আদেশের অপেক্ষা করছে।’
‘তবে তো আপনি অন্ধকারেই অভিযান চালাবেন?’
আলী বিন সুফিয়ান সুলতানকে এত তাড়াতাড়ি অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখার জন্য বললেন, ‘আপনি চাইলে কমান্ডো বাহিনীকে আমি আপনার পরিকল্পিত পথে অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়ে দিতে পারি। তারা অনেক দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে দুশমনের গতিবিধির খোঁজ খবর নেবে। সে খবর আমাদের কাছে আসার আগেই কোন অভিযানে বেরিয়ে পড়া আপনার উচিত হবে না।’
‘কিন্তু আমার তো প্রস্তুতির কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন বসে সময় অপচয় করার ধৈর্য আমার নেই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আল্লাহর পথের এক সৈনিক। আল্লাহর হুকুম অমান্যকারীদের হাত থেকে আল্লাহর জমিনকে মুক্ত করার কঠিন দায়িতব কাঁধে নেয়ার পর আমি তো আমার নিরাপত্তা ও আরাম আয়েসের জন্য জন্য মিশরে বসে থাকতে পারি না!’
* * *
১১৮২ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাস।
সুলতান আইয়ুবী ও আলী বিন সুফিয়ান যখন গোয়েন্দাদের কাছ থেকে বৈরুত ও হলবের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তার আগেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দেয়ার আগমনী সংবাদ বয়ে এনেছিল।
আলী বিন সুফিয়ান খৃষ্টান এলাকায় তার ঝানু গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দিয়ে তাদের খবরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হলবেও তিনি অভিজ্ঞ গোয়েন্দা মোতায়েন করে রেখেছিলেন। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর ছেলে আল মালেকুস সালেহের কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলছিল তার অবসান হয়েছিল। সুলতান আইয়ুবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরও যে আস সালেহ ক্ষমতার লোভে নতুন করে খৃষ্টানদের সাথে গোপন চুক্তিতে শামিল হয়েছিল সেই সালেহ দু’মাস আগে মারা গেছে।
আস সালেহ মারা যাওয়ার আগে মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে ক্ষমতা অর্পন করে গেলে মাসুদ হলবে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেই সাথে তিনি সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এসবই ছিল খৃষ্টান ও সুলতান আইয়ুবী উভয়ের জন্য বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা।
মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্ত্রী অর্থাৎ আস সালেহের মা রাজিয়া খাতুন ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে বিয়ে করার ব্যাপারে মোটেই ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু অনিচ্ছাসত্বেও তিনি এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন যে কারণে তা ব্যক্তিগত কোন বিষয় ছিল না, বরং তা ছিল বৃহত্তর জাতীয় সবার্থ রক্ষার তাগিদ।
সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন যখন তাঁর কাছে ইয়াজউদ্দিনের সাথে বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন তখন তিনি সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তকিউদ্দিন যখন বললেন, ‘এই বিয়ে দামেশক ও হলবের মধ্যে ঐক্যের ভিত রচনা করবে এবং ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধের সকল সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেবে’, তখন বিষয়টি নিয়ে তিনি নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন।
তিনি জানেন, গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে গেলে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা আবার ঐক্যবদ্ধভাবে ময়দানে নামতে পারে তবে তার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।
তাই রাজিয়া খাতুন এই বলে প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছিলেন, ‘আমার নিজসব ইচ্ছা ও পছন্দ বলে কিছু নেই। ইসলামের স্বার্থে আমার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমি আপনাদের হাতে সোপর্দ করছি। সুলতান আইয়ুবীকে আমি আমার ভাই ও নেতা মনে করি। এ ব্যপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমি তাই মেনে নেবো।’ তিনি অনিচ্ছাসতবেও কেবল ইসলামের স্বার্থেই এ কোরবানী দিয়েছিলেন।
খৃষ্টানদের সক্রিয় প্রভাবের কারণে হলব ও মুশেল দীর্ঘদিন ধরেই ছিল ক্রুসেড বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যার পরিণামে এ দুটি রাজ্য সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ফলে তিনটি বছর মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত হয় বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধ।
এখন রাজিয়া খাতুন ও ইয়াজউদ্দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় খৃষ্টানদের মধ্যে এ চিন্তা জাগাই স্বাভাবিক, রাজিয়া খাতুন যেহেতু তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী, সে কারণে তিনি হলব ও মুশেলে খৃষ্টানদের প্রভাব নিঃশেষ করতে চেষ্টা চালাবেন।
অপর দিকে মিশরে বসে সুলতান আইয়ুবী চিন্তা করছিলেন, খৃষ্টানদের আধিপত্য বিনষ্টের চেষ্টা শুরু হলে ক্রুসেড বাহিনী হলব ও মুশেলের সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে।
সুলতান আইয়ুবী এটাও চিন্তা করেছিলেন, ওই এলাকায় তার অনুপস্থিতির কারণে খৃষ্টানদের ফায়দা লুটের চেষ্টা করতে পারে।
সুলতান আইয়ুবী বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থা পর্যালোচনা করে করে সিদ্ধান্ত নিলেন, ক্রুসেড বাহিনী যাতে আগেই মুশেল ও হলব অবরোধ করতে না পারে, সে জন্য বিদ্যুৎ গতিতে অভিযান চালিয়ে তিনি বৈরুত অবরোধ করে বসবে।
এই প্রেক্ষাপটে দ্রুত অভিযান চালানোর তাগিদ যেমন তীব্র ছিল তেমনি দুশমনের শক্তি ও তৎপরতার রিপোর্ট পাওয়াও সমান জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় তিনি তিনি ছিলেন খুবই পেরেশান।
অন্য দিকে তাঁর বাহিনী সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিয়ে তৈরী হয়ে আছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট না নিয়ে তিনি কখনও যুদ্ধ ক্ষেত্রে নামেন না বিধায় তিনি তাদেরকে মার্চ করার হুকুম দিতে পারছিলেন না।
এই পেরেশানীর কারণেই তিনি হলব ও মুশেলের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। হলবে নতুন কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা, ইয়াজউদ্দিনের বর্তমান মনোভাব কেমন, সেখানে রাজিয়া খাতুনের কোন প্রভাব পড়েছে কিনা, ঘুরে ফিরে তিনি কেবল এসবই চিন্তা করছিলেন।
আলী বিন সুফিয়ান ভাবছিলেন, আমার পাঠানো গোয়েন্দা আনাড়ী বা ভীতু নয়। গোপন তথ্য সংগ্রহ ও তা কায়রো পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বও তাদের অজানা নয়। এ জন্য প্রয়োজনে ওরা নিজের জীবন বাজী রাখবে, কিন্তু দায়িত্বে অবহেলা করবে না, এ বিশ্বাসও আছে আমার। কিন্তু আমার আস্থা ও বিশ্বাস যে আজ নিঃশেষ হতে বসেছে!
তারা কি জানে না, যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগেই অর্ধেক জয় করতে হয় গোয়েন্দাদের! শুধু একজন গোয়েন্দার একটি ভুল সংবাদ যেমন সমস্ত সেনাবাহিনীকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দিতে পারে তেমনি মাত্র একজন গোয়েন্দার সময়োচিত একটি সঠিক রিপোর্ট শত্রুর বিশাল বাহিনীকে অস্র সমর্পনে বাধ্য করতে পারে!
ইসহাক তুর্কীর ওপর আলী বিন সুফিয়ানের অগাধ আস্থা ও ভরসা ছিল। ইসহাক তুর্কীও সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার জন্য গুরুতবপুর্ণ তথ্য নিয়ে দুর্গম সিনাই মরুভূমির ভয়ংকর পথে ছুটছিল কায়রোর দিকে। সে সুলতান আইয়ুবীকে জানাতে চাচ্ছিল, সম্রাট বিলডনের খৃষ্টান সৈন্যরা বৈরুতের আশেপাশে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আর হলবে ইয়াজউদ্দিন খৃষ্টানদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
সে সুলতানকে সাবধান করতে চাচ্ছিল, যেন তিনি বৈরুতের দিকে না যান। কিন্তু তারপরও যদি সুলতান বৈরুতে অভিযান চালানোর ব্যাপারে অটল থাকেন, তবে ইসহাক তুর্কী সুলতানকে নকশা করে দেখিয়ে দেবে, খৃষ্টান সৈন্যরা কোথায় কোথায় তাদের শক্তির পরিমাণ কত। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সে পথেই খৃষ্টান গোয়েন্দাদের ফাঁদে পড়ে আটক হয়ে আছে।
* * *
‘তোমাকে তো একটা ভাল ঘোড়াই দিতে হয়।’ খৃস্টান গোয়েন্দা কমান্ডার ইসহাক তুর্কীকে বললো, ‘মেরিনা আমাকে সব বলেছে। তুমি নাকি আমাদের সুলতানের জন্য গুরুত্বপুর্ণ সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো। তুমি যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারো সে জন্য সে আমাদের শ্রেষ্ঠ ঘোড়াটি দাবি করেছে। তোমার ব্যস্ততা দেখে আমি তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। তুমি কি কোন খারাপ খবর নিয়ে যাচ্ছো?’
‘সে কথা আমি সুলতানকেই বলবো।’
‘তা তো ঠিকই। তবে আমরাও সুলতানের অনুগত এবং ভক্ত কিনা তাই জানার আগ্রহ জেগেছিল। তুমি যখন আমাদের বিশ্বাস করতে পারছো না তখন এ নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করতে চাই না। তোমার জন্য ঘোড়া তৈরী। ঘোড়া এবং তোমার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় ঘোড়ার সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।’
‘আল্লাহ তোমাদের মত অনুগত ও ভক্তদের থেকে সুলতানকে যেন রক্ষা করেন।’ ইসহাক তুর্কী কিছুটা ক্ষোভের সাথে বললো, ‘আমি অই মেয়েটাকে বলেছিলাম, মাঝরাতের পর আমাকে যেন জাগিয়ে দেয়। আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কায়রো পৌঁছা দরকার। কিন্তু তোমরা আমাকে জাগাওনি কেন?’
ইসহাক এ প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করেই মুখে বিরক্তি টেনে বললো, ‘ইস! কত বেলা হয়ে গেছে! রাতে ঘোড়া যত দ্রুত ছুটতে পারতো এখন এই গরমে তা কি আর পারবে! খামাখা একগাদা সময় নষ্ট হলো!’
ইসহাকের খেদ ও তিরস্কারে কেউ মন খারাপ করলো না, বরং সহানুভূতির সুরে কমান্ডার বলল, ‘তুমি খুব ক্লান্ত ছিলে, মেরিনা তোমাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো, তুমি গভীর ঘুমে। তার এত মায়া লাগলো যে সে তোমাকে না জানিয়ে ফিরে গিয়ে বলল, এখন তাকে ডাকলে তার ওপর অবিচার করা হবে। চিন্তা করো না, তোমার ঘোড়া খুব ভাল। যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছে, এ ঘোড়া তা পুষিয়ে দিতে পারবে।’
ইসহাকের চোখ জুড়ে তখনও ঘুম ঘুম ভাব জড়িয়ে ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এর কারণ কি? তাছাড়া ঘুমের পরে শরীরে যে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে আসার কথা সে শক্তিও সে পাচ্ছিল না। কেমন একটা ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব।
সে ভেবে পাচ্ছিল না, এত ঘুম তার কোত্থেকে এলো? তাকে কেউ ঘুমের ঔষুধ প্রয়োগ করেছে এমন চিন্তা তখনও তার মাথায় আসেনি।
যদিও সে যাত্রা করার জন্য অস্থির হুয়ে উঠেছিল কিন্তু যাত্রা করার মত অবস্থা তার ছিল না। রাজ্যের ক্লান্তিতে শরীরটা তার ভেঙ্গে আসছিল।
মধ্যরাতে জেগে উঠার কথা ছিল। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখলো, ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে এসেছে। এত বেলা পর্যন্ত তার মত একজন মানুষ কখনোই ঘুমাতে পারে না, কিন্তু সে ঘুমিয়েছে। কেন? এ প্রশ্নটা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।
খৃস্টান কমান্ডার ও মেরিনা ঘুম ভাঙ্গার আগেই তার পাশে এসে বসে তার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করছিল। সে যখন চোখ খুললো তখন তারা তার সাথে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলো যে, সে নতুন করে কিছুই ভাবতে পারছিল না।
তারা এমনভাবে কথা বলছিল, যেন ইসহাক তুর্কীর মনে তাদের সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহও না জাগে। তারা এমনসব কথা বলছিল, যাতে সে তাদেরকে মুসলমান এবং সুলতান আইয়ুবীর একান্ত ভক্ত মনে করে।
তারা সুলতান আইয়ুবীর কাছে কি খবর নিয়ে যাচ্ছে জানার জন্য নানাভাবে প্রশ্ন করতে লাগলো।
ইসহাক তুর্কী তাদেরকে মুসলমান মনে করলেও গোয়েন্দাসুলভ সতর্কতার কারণে তাদের প্রশ্নের সঠিক জওয়াব দিতে ইতস্ততঃ করছিল।
তার ইতস্ততা লক্ষ্য করে খৃস্টান কমান্ডার চকিতে চাইল মেরিনার দিকে এবং চোখ টিপে ইশারায় কিছু বলে বাইরে চলে গেল।
মেরিনা কমান্ডারের ইঙ্গিত বুঝতে পারল। সে ইসহাকের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বপসে তাকে যৌবনের ফাঁদে আটকানোর জন্য আদিরসাত্মক গল্প জুড়ে দিল। কিন্তু ইসহাক তাতে উত্তেজিত না হয়ে বরং হতভম্ব হয়ে তার দিকে অবাক করা চোখে তাকিয়ে রইল।
মেরিনা বলল, ‘আচ্ছা! তুমি কি জাদু জানো?’
‘কেন?’
‘তোমাকে সে কথা বলতে সাহস হচ্ছে না।‘
‘কেন! আমিও তো ভয়ংকর কেউ নই? খুন বা ডাকাতি করে সিনাই মরুভূমিতে পালাতে আসিনি আমি।কিছু বলার থাকলে তুমি নির্ভয়ে তা বলতে পারো।’
‘তুমি ঠিক বলছো? আমার কথা শুনে আমার সম্পর্কে কোন বাজে ধারণা করবে না তো!’
‘না, অযথা তোমার সম্পর্কে আমি বাজে ধারণা করতে যাব কেন?’
মেরিনা তার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ফিসফিস করে বলল, ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার যে কি হলো আমি বুঝতে পারছি না। রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে দেখার জন্য মন-প্রাণ ছটফট করে উঠলো। আমি উঠে এসে তোমার শিয়রের পাশে বসে রইলাম। সারা রাত আমি তোমার পাশেই বসেছিলাম। তোমার কাছ থেকে সরে গিয়ে দেখেছি, আমার কিছুই ভাল লাগে না।’
‘আমার এখন ভালবাসা ও মন দেয়া নেয়ার মত সময় নেই। কায়রো চলো, সেখানে অনেক সময় পাওয়া যাবে।’ ইসহাক বললো, ‘যদি তুমি আমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালই বেসে থাকো তবে আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে সাহায্য করো। আমাকে জলদি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দাও।’
সে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল।
মেরিনা তার পিছু পিছু তাঁবু থেকে বেরিয়ে তার একটি হাত ধরে বললো, ‘কিছু মুখে দিয়ে নাও। সন্ধ্যেবেলা অসুস্থ শরীরে সেই যে কিছু মুখে দিলে তারপর তো আর পেটে কিছু পড়েনি।’
মেরিনা তাকে হাত ধরে টেনে তাঁবুতে নিতে নিতে বললো, ‘আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় যেতে দেবো ভাবলে কি করে! আর আমাকে সঙ্গে নিতে চাইলে আমাদের লোকেরা কি তা মেনে নেবে? তাহলে তো আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। পালাতে গেলে কিভাবে পালাবো তার বুদ্ধি বের করতে হবে না?’
মেরিনা ইসহাকের বুকে নিজের মাথা চেপে ধরে কান্নাকাতর কণ্ঠে বললো, ‘ইসহাক! তুমি কি আমাকে সঙ্গে না নিয়েই এখান থেকে চলে যাবে! তোমাকে না পেলে যে আমি বাঁচবো না!’
মেরিনা ইসহাকের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ইসহাকের দায়িত্ববোধ তাকে পাথর বানিয়ে রেখেছিল। সে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না।
মেরিনাকে বুক থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘আহ! কি পাগলামো করছো! থামো! থামো! মনকে শান্ত করো, কান্না থামাও। আমাকে একটু ভাবতে দাও।’
মেরিনা চোখ মুছে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘ছি! কিছু মনে করো না, তুমি চলে যাচ্ছো ভেবে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।’
তারপর একদম স্বাভাবিক হয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে জোরে ডেকে বললো, ‘জলদি খাবার নিয়ে এসো, সময় বয়ে যাচ্ছে।’
বারবারা খাবার নিয়ে এলো। ইসহাকের সামনে খাবার রেখে মেরিনা পিছনে গিয়ে দাঁড়াল ইসহাকের খাওয়া দেখতে লাগল।
মেরিনার কথা শুনছিল আর খাচ্ছিল ইসহাক। তার দৃষ্টি গেল মেরিনার পিছনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। বারবারা ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে হাত দিয়ে নিজের গলার ক্রুশটি কাপড়ের ভেতর থেকে টেনে বের করল এবং তার সামনে কয়েকবার নাড়াচাড়া করে আবার জামার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল।
মেয়েটির এ সামান্য ইঙ্গিতই একজন গোয়েন্দাকে সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুহূর্তে কেটে গেল তার মাথার জট। সে পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠলো।
সে আবার তাকাল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তার বুকে হাত রেখে মেরিনার দিকে ইশারা করলো এবং আঙুল দুলিয়ে নিষেধ করলো তার কথা বিশ্বাস করতে। তারপর সে তাঁবুর বাইরে চলে গেল।
এই ইশারা এত স্পষ্ট ছিল যে, ইসহাক সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে গেল। এরা যে খৃস্টান এবং তার শত্রু একথা বুঝতে আর তার কষ্ট হলো না।
সে ছিল এক সতর্ক গোয়েন্দা। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে যেভাবে খাচ্ছিল সেভাবেই খেয়ে চলল। কিন্তু এর মধ্যেই সে তার মনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।
কেন তারা বার বার সুলতান আইয়ুবীর জন্য কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছে জানতে চাচ্ছিল, বুঝে ফেলল সে। তখন তার মনে পড়লো, ঘুম তো আমাকে কোন দিন এত দুর্বল করতে পারে না? তবে কি তারা আমার ওপর কোন ঔষধ প্রয়োগ করেছে?
নিশ্চয়ই করেছে। নইলে দুপুর পর্যন্ত আমার ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। ঘুম থেকে জেগে উঠার পর কেন তার এত ক্লান্তি লাগছিল এ প্রশ্নেরও উত্তর পেয়ে গেল ইসহাক।
কিন্তু তার এ প্রশ্নের কোন উত্তর সে খুঁজে পেল না। অন্য মেয়েটা কেন তাকে ইশারা করে সতর্ক করে দিয়ে গেল। মেয়েটি কি তবে কোন মুসলমানের মেয়ে? সে কি তারই মত তাদের জালে আটকা পড়ে আছে?
মেরিনা তাকে তার কথা ও যাদুময় হাসি দিয়ে, অভিনয় দিয়ে জালে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিল। আর ইসহাকের মাথায় খেলা করছিল এদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চিন্তা।
সে এখন কি করবে, কেমন করে এ লোকদের হাত থেকে মুক্তি পাবে চিন্তা করে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছিল না।
মেরিনাকে বলল, ‘পালাবো বললেই কি পালানো যায়! তোমাদের দলে এখন কত লোক আছে?’
মেরিনা ইসহাকের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি, সে তার দলের লোকদের সংখ্যা বলে দিল।
ইসহাক বলল, ‘ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। চলো, বাইরে চলো। খোলা হাওয়ায় মাথা ঠাণ্ডা করি আর ভেবে দেখি। তাড়াহুড়ো না করে আমাকে একটু ভাবতে দাও।’
সে বাইরে বের হয়ে এলো। দেখতে চাইলো এ কাফেলায় কত লোক আছে। এখান থেকে পালানোর কোন সম্ভাবনা আছে কিনা।
বাইরে বেরিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। তাঁবুগুলোর কাছাকাছি কোন ঘোড়াই নেই! তাকে বলা হয়েছিল, তার জন্য বাইরে ঘোড়া প্রস্তুত। কিন্তু এটা যে মিথ্যা, তখন সে তা ভাবতে পারেনি।
মেরিনা তার পাশে এসে দাঁড়ালো। ইসহাক বললো, ‘আমার জন্য নাকি ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছো? সে ঘোড়া কোথায়?’
‘আছে। দাঁড়াও, আমি আসছি।’
ইসহাকের সামনে থেকে সরে পড়লো মেরিনা।
‘তুমি ঠিক বলেছো।’ মেরিনা কমান্ডারকে গিয়ে বললো, ‘এ লোক সত্যি পাথর। সে ঘোড়া ছাড়া আর কোন কথাই বলছে না। আইয়ুবীর কাছে কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম আমি। কিন্তু সে বড় হুশিয়ার, আমার কথার ধারে-কাছেও যাচ্ছে না সে।’
‘তার মনে তো কোন সন্দেহ দেখা দেয়নি?’
‘দেয়ার কোন কারণ তো দেখি না।’ মেরিনা উত্তর দিল, ‘তবে সে কোন গোপন তথ্য বলবে বলে মনে হয় না।’
‘তার অর্থ হলো, তুমি ব্যর্থ হয়েছো।’ কমান্ডার মেরিনার দিকে তাকিয়ে বলল।
তারা বুঝতে পারেনি, বারবারা তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে। সে এটাও প্রমাণ করে দিয়েছে, মেরিনার সকল যাদুই ব্যর্থ হয়েছে।
বারবারা ভেবেছিল, সে সুলতান আইয়ুবীর এই গোয়েন্দাকে মুক্ত করে দেবে। তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু এখন তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
ইসহাক ক্যাম্পটি ঘুরে দেখতে চাইল। সে তাঁবুগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পরই সে মেরিনা ও কমান্ডারকে দেখতে পেল এল জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আমার ঘোড়া কোথায়?’
‘কিসের ঘোড়া? ঘোড়া তুমি পাবে না।’
কমান্ডারের কণ্ঠে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর। সে গম্ভীর স্বরে বললো, ‘তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’
ইসহাক তার কোমরে হাত রাখলো। সেখানে না তার তলোয়ার আছে, না আছে খঞ্জর।
এরই মধ্যে বারবারার মাধ্যমে সে তাদের পরিচয় জানার পরও বললো, ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি, মুসলমান হওয়া সত্বেও তোমরা আমার পথে বাঁধা দিচ্ছো?’
‘যদি তুমি তোমার ভাল চাও তবে বলে দাও, সুলতানের জন্য তুমি কি সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো?’ কমান্ডার কঠিন কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করল।
‘সংবাদ তেমন কিছু নয়, আমাদের এক আমীর ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুনকে বিয়ে করেছে।’ ইসহাক বললো।
‘এ তো অনেক পুরনো খবর!’ কমান্ডার বললো, ‘তোমার সুলতান দু’মাস আগেই এ সংবাদ পেয়ে গেছেন। তিনি এখন তার বাহিনীকে প্রস্তুত করে রণাঙ্গনে যাওয়ার পায়তারা করছেন। বলো, সেটা কোন রণাঙ্গন? এবার সুলতান কোন দিকে অভিযান চালাবেন?’
‘কি বললে! সুলতানের বাহিনী প্রস্তুত হয়ে বসে আছে? অভিযানের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত? না ভাই, রণাঙ্গনের কোন খবর আমার জানা নেই।’
‘অহেতুক সময় নষ্ট করে লাভ কি?’ কমান্ডার বললো, ‘তোমার ব্যস্ততাই প্রমাণ করে তুমি কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে যাচ্ছো। আমি জানতে চাই, কি সেই খবর?’
ইসহাক দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললো, ‘আমার কাছে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবে না, যাতে তোমাদের পরাণ ঠাণ্ডা হতে পারে।’
‘কিন্তু আমরা জানি, কি করে কারো পেট থেকে আসল কথা বের করতে হয়।’ কমান্ডার বললো, ‘ঠিক আছে, আমাদের সাথে চলো, দেখি তোমার কাছ থেকে কোন তথ্য পাই কি না।’
‘তোমাদের সাথে কোথায় যাবো? কেন যাবো? ঠিক আছে, ঘোড়া না দাও আমি হেঁটেই চললাম। আমার পথে বাঁধা দিতে চেষ্টা করো না।’
‘তুমি এখন নিরস্ত্র, অসহায়। তুমি নিরস্র না হলেও আমাদের এতগুলো লোকের সাথে যুদ্ধ করে তুমি পারবে না। শোন বন্ধু, আমি তোমাকে বেঁচে থাকার এবং রাজপুত্রের মত জীবন যাপন করার একটা উপায় সৃষ্টি করে দিতে পারি। তুমি আমাদের প্রস্তাব মেনে নাও এবং আমাদের সাথে চলো।’
কমান্ডার আরো বলল, ‘আমাদের সাথেও সেই কাজ করো যেমন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্য করছো। আমাদের সাথে যোগ দিলে তুমি অর্থ সম্পদ ও ভোগ বিলাসে ডুবে থাকবে।’
সে মেরিনার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ‘এই ধরনের মেয়েরা তোমার খেদমতের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। অযথা কেন মরুভূমিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছো!’
‘কি! আমি খৃস্টানদের হয়ে কাজ করবো?’
‘না করলে আমাদের কারাগারের কোন গোপন কক্ষে বন্দী থাকবে সাড়া জীবন।’ বলল মেরিনা।
কমান্ডার বললো, ‘সেটা এমন এক জাহান্নাম, তুমি সেখানে মরতেও পারবে না, বেঁচে থাকাটাও হবে সীমাহীন কষ্টের। যে শাস্তি সেখানে তোমাকে দেয়া হবে সে শাস্তির কথা তুমি এখন কল্পনাও করতে পারবে না। সে এ বিভীষিকার রাজত্ব। এবার চিন্তা করে জবাব দাও, তুমি স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে যাবে, নাকি তোমাকে আমরা সেই জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলার জন্য ধরে নিয়ে যাবো।’
‘তোমরা আমার উপর কি করে নির্ভর করবে?’ ইসহাক তুর্কী বললো, ‘যদি তোমাদের দলে যোগ দেই তবে গোয়েন্দা হিসেবে তোমরা আমাকে আমাদের মুসলমান এলাকাতেই পাথাবে। সেখানে আমি তোমাদের পক্ষে কাজ করবো এটা তোমরা কেমন করে বিশ্বাস করো? একবার মুসলিম এলাকায় পৌঁছতে পারলে আমি তোমাদের সাথে প্রতারণা করবো না, এমন নিশ্চয়তা তোমাদের কে দেবে?’
‘এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের কাছে তার ব্যবস্থা আছে।’
খৃস্টান কমান্ডার তাকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য আরো বললো, ‘তুমি তো কেবল তোমাদের এলাকার কথা বলছো! কিন্তু তুমি জানো না, আমি তোমাকে তোমার ঘরের গোপন কোণ থেকেও বের করে নিয়ে আসতে পারবো। তোমার কি ধারণা, তোমার দেশে আমাদের যে সব গোয়েন্দা আছে তারা সবই খৃস্টান? স্থানীয় মুসলমানরা আমাদের সঙ্গে নেই?
ভুল। হয়তো অবাক হবে, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের দশজন গোয়েন্দার মাত্র দু’জন খৃস্টান, বাকি আটজনই স্থানীয় মুসলমান, তোমাদের ভাই। সেখানেও আমাদেরকে কেউ ধোঁকা দিতে সাহস করে না। তারা জানে, বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি কেমন হয়। আমরা তাদের শুধু হত্যাই করি না, আগে তার বিবি বাচ্চাকে এক এক করে তার সামনে জবাই করি। তারপর তাকে জাহান্নামে পাঠাই।
আর যে আমাদের বাধ্য ও অনুগত থাকে তার জন্য এ দুনিয়াকে আমরা স্বর্গের বালাখানা বানিয়ে দেই। এদের মধ্যে কেউ ধরা পড়লে তার স্ত্রী সন্তান্দের এমন অর্থ সম্পদ দান করি যাতে তারা কয়েক পুরুষ বসে বসে খেতে পারে।’
‘আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও।’ ইসহাক বললো, ‘এখান থেকে কবে রওনা দেবে?’
‘আজকেই।’ কমান্ডার বললো, ‘মধ্যরাতের পর। তুমি এর মধ্যে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও। তবে মনে রেখো, তুমি অস্বীকার করলে যে পরিণতি তোমার হবে তার জন্য আমাদের দায়ী করতে পারবে না।’
‘তা আমি জানি।’
‘আর তোমাকে একথাও বলতে হবে, কি গোপন তথ্য নিয়ে তুমি কায়রো যাচ্ছিলে।’ কমান্ডার বললো।
‘হ্যাঁ বলবো।’ ইসহাক উত্তর দিল, ‘আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও। যদি হাত মিলাই সব তথ্যই তুমি পাবে। আর হাত না মিলালে তো আমি তোমাদের হাতেই আছি।’
‘ঠিক আছে যাও। এখন বিশ্রাম করো। সন্ধ্যার পর তোমার মতামত জানালেই চলবে।’ কমান্ডার বললো।
ইসহাক তুর্কী আর কথা না বাড়িয়ে নিজের তাঁবুর দিকে ফিরে গেল।
দুই মাস আগের ঘটনা।
ইয়াজউদ্দিনের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেয়ার পরও সুলতান তকিউদ্দিনের অনুরোধে মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা পত্নী রাজিয়া খাতুন শুধু এই আশাতেই ইয়াজউদ্দিনকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছিলেন, যাতে ইয়াজউদ্দিনকে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে পারেন।
হলবের সামরিক বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর অনুগত ও সহযোগী থাকলে সেটা হবে মুসলিম মিল্লাতের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। এমনিতেই গত তিন বছরের গৃহযুদ্ধে মুসলমান সৈন্যদের বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এত সৈন্য নষ্ট হয়েছে, যা দিয়ে আরবের মাটি থেকে খৃস্টানদের বহিষ্কার করে ফিলিস্তিনও মুক্ত করা সম্ভব ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলিম মিল্লাতের, মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ কথা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
তকিউদ্দিনের কথায় রাজিয়া খাতুনের মনে হয়েছিল, ইয়াজউদ্দিন তাঁকে উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু বিয়ের পরের দিন যখন দেশের অবস্থা নিয়ে রাজিয়া খাতুন তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেন, ইয়াজউদ্দিন সে কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে সেখান থেকে সরে পড়েছিল।
তারপরও কয়েকবার রাজিয়া খাতুন তার সাথে দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। ইয়াজউদ্দিন নিজের একক চিন্তা ভাবনায় সিন্ধান্ত গ্রহণ করছে দেখে তিনি আহত হলেন। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে ইয়াজউদ্দিন তাঁর কামরা থেকে বেরিয়ে মহলের অন্য কামরায় গিয়ে শয়ন করলেন।
রাজিয়া খাতুন তবু আশাহত হননি। ভেবেছেন, সবেমাত্র হলবের শাসনভার গ্রহণ করে তিনি খুব চিন্তায় আছেন। হঠাৎ এত বড় দায়িত্ব গ্রহণ করা আসলেই কঠিন ব্যাপার। দু’দিন বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাজিয়া খাতুন নিজে হলবের প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছিলেন। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর অনেক কাজেও তিনি সহযোগিতা করতেন। তিনি দামেশকে মেয়েদের সামরিক ট্রেনিং দিয়ে একটি বাহিনী গঠন করে রেখে এসেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন যোদ্ধা ও মুজাহিদ হিসেবেই নিজেকে কল্পনা করতেন।
তিনি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর একজন ভক্ত ও অনুগত হিসাবে তাকেও বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে এসেছেন। তাঁর সামরিক জ্ঞান ও দক্ষতাকে সুলতান আইয়ুবীও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ফলে তিনি চাচ্ছিলেন এই জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে মুসলিম বিশ্বের খেদমত ও ইয়াজউদ্দিনকে সহযোগিতা করতে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ইয়াজউদ্দিনের ব্যবহার তাঁর কাছে প্রশ্নবোধক হয়ে উঠল।
একদিন সকাল বেলা তিনি তাঁর কামরা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাসাদের বাইরে বাগানে নেমে এলেন।
বিরাট প্রাসাদের বাইরে বিশাল বাগান। মহলের এ অংশে এর আগে তিনি আর আসেননি, এ বাগানেও প্রবেশ করেননি।
তিনি দেখতে পেলেন পাঁচ ছয়জন যুবতী মেয়ে সেখানে খেলা করছে। তিনি তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
তখনও তিনি তাদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। এক মধ্যবয়সী মহিলা তাঁকে দেখতে পেল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন? আপনি আপনার কামরায় চলে যান।’
‘কেন, কি হয়েছে?’
‘এটাই আমাদের সম্মানিত বাদশাহর হুকুম। চলুন, আমি আপনাকে সে জায়গা দেখিয়ে দেই যেখানে আপনি ঘোরাফেরা করতে পারবেন।’
‘না, আমি নিজেই মহলের বিভিন্ন অংশ ঘুরে ফিরে দেখতে চাই।’
‘কিন্তু বেগম সাহেবা, আপনার এখানে আসা নিষেধ।’ মহিলা ব্যাকুল কণ্ঠে রূঢ়ভাবে বলল।
‘যদি আমি এ আদেশ না মানি তবে কি হবে?’ রাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করলেন।
‘আপনি আমার অপরাধ নেবেন না।’ মহিলা বিনয়ের সাথে বললো, ‘আমাকে আমার মালিকের আদেশ মানতে সাহায্য করুন।’
এ সময় মেয়েদের মধ্য থেকে অন্য এক মধ্য বয়সী মহিলা রাজিয়া খাতুনের পাশে এসে এগিয়ে তাঁর হাত ধরে বলতে লাগলো, ‘আমি আপনার দাসী। আমাকে সবসময় আপনার পাশে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমাকেও বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া আপনার বাইরে যাওয়া নিষেধ। আসুন, আমি আপনাকে আপনার বাগান ও মহলের সেই নির্দিষ্ট এলাকা চিনিয়ে দেই।’
সে রাজিয়া খাতুনের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘আসুন।’
রাজিয়া খাতুন একথা শুনে খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি বাগানে পায়চারী বাদ দিয়ে নিজেই কামরার দিকে হাঁটা দিলেন। দাসী তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘আপনি শঙ্কিত হবেন না। আমি জানি আপনি কি স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছেন। আপনার সকল স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমি আপনার দুঃখের দরদী ও স্বপ্নের গোপন সঙ্গী। আপনাকে এখানকার সব গোপন তথ্যই আমি আপনাকে জানিয়ে দেবো।’
‘গোপন তথ্য! কি গোপন তথ্য?’ রাজিয়া খাতুন বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।
‘এই মহলের ওপর এখনও ক্রুসেড বাহিনীর অশুভ ছায়া বিরাজ করছে। আপনার সন্তান ছিল তাদের হাতের পুতুল। এখন যে শাসক আপনার স্বামী হয়েছেন তিনিও তাদের হুকুমেরই তাবেদারী শুরু করেছেন। এখানকার অধিকাংশ উজির উপদেষ্টা খৃস্টানদের কেনা গোলাম।’
‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে মহলের লোকদের কি ধারণা?’ রাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করলেন, ‘এখানে কি তার কোন প্রভাব নেই?’
‘খৃস্টানদের চেয়ে বেশী প্রভাব তাঁর নেই।’ দাসী বললো, ‘এই মহলেও সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা আছে। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। আমি আপনাকে ভাল করে চিনি বলেই নির্ভয়ে আপনার কাছে আমার পরিচয় প্রকাশ করলাম।’
রাজিয়া খাতুন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এ আমি কি শুনছি! এখন আমি কি করবো?’
‘আপনি ইয়াজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করুন কেন তিনি আপনাকে মহলের এক কামরায় বন্দী করে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, তা তো আমি জিজ্ঞেস করবোই। কিন্তু তুমি বলো তো এখানে কি ঘটছে?’
‘এক্ষুণি আপনাকে সমস্ত কথা বলা যাবে না। আগে আপনি তার কাছ থেকে তার নিয়ত ও উদ্দেশ্য কি বুঝতে চেষ্টা করুন।’
দাসী বললো, ‘পরে আমি আপনাকে সবকিছুই খুলে বলবো।’
‘তাহলে অন্তত এটুকু বলো, সে আসলে কি করতে চায়?’
‘আসল সত্য খুবই ভয়ংকর। তিনি আপনাকে বিয়ে করেছেন শুধু আপনাকে বন্দী করার জন্য। তিনি জানেন, সুলতান আইয়ুবীর সাথে আপনার সম্পর্ক ভাল। দামেশকের জনসাধারণ আপনার প্রচণ্ড ভক্ত এবং তারা আপনার কারণেই সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক।
আপনাকে দামেশক থেকে বের করতে পারলে তারা অবাধে সেখানে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে পারবে।’
‘তিনি কি আইয়ুবী বিরোধী জোটে শরীক হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, তিনি আইয়ুবী বিরোধী জোটে শরীক হয়েছেন এবং খৃস্টানরা যাতে দামেশকে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে তার পথ করে দেয়ার জন্য আপনাকে দামেশক থেকে সরিয়ে এনেছেন।’
‘এর অর্থ হলো মুসলমানরা আবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?’
রাজিয়া খাতুনের চেহারা দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘খৃস্টানরা বিনা বাধায় আমাদের এলাকায় আবার আধিপত্য বিস্তার করে বসবে?’
কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। এক সময় রাজিয়া খাতুনই আবার মুখ খোললেন।
‘এই সংবাদ কি সুলতান আইয়ুবীকে পৌঁছানো যাবে?’ রাজিয়া খাতুন দাসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘এ ব্যবস্থা আগেই হয়ে গেছে।’ দাসী বললো, ‘আমাদের বিজ্ঞ কমান্ডার একজন সাহসী লোককে দিয়ে এ সংবাদ সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
‘লোকটি বিশ্বস্ত তো!’
‘হ্যাঁ, তার নাম ইসহাক তুর্কী। সে এক তুর্কী মুসলমান। আমি তাঁকে ভাল করেই চিনি। আপনার ছেলের মৃত্যুর পর ক্রুসেডদের বর্তমান তৎপরতা কেমন দেখার জন্য সে খৃস্টানদের অধিকৃত অঞ্চল বৈরুত গিয়েছে। ওখান থেকে সোজা সে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সুলতানের কাছে খবর পৌঁছে দিয়েই সে আবার ফিরে আসবে।’
‘সে ফিরে এলে আমাকে বলো। আমি এই গোয়েন্দার সাথে কথা বলতে চাই।’
‘অবশ্যই। সে এলেই আমি আপনার সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবো।’
‘তুমি আরো আগে এসব জানালে না কেন?’
‘আমাদের কমান্ডারের হুকুমে আজই এ তথ্যটুকু আপনাকে জানানোর জন্য বলেছেন। কমান্ডারের হুকুম ছাড়া আপনাকে কিছু বলা আমি ঠিক মনে করিনি।’
বৃদ্ধা দাসী রাজিয়া খাতুনের কাছে যখন মহলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ও ইয়াজউদ্দিনের গোপন রহস্য ফাঁস করে দিল তখন রাজিয়া খাতুনের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলেন, সে স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। যে কারণে তিনি হলবের আমীর ইয়াজউদ্দিনকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছিলেন সে স্বপ্ন তার দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হলো।
রাজিয়া খাতুন এক মহীয়সী মহিলা। ইসলামের ইতিহাসের এই বীরাঙ্গনা মুজাহিদ তাঁর মরহুম স্বামী নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্বপ্ন পুরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই পা রেখেছিলেন ইয়াজউদ্দিনের মহলে। ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম নূরুদ্দিন জঙ্গী এবং তাঁর স্বপ্নের দোসর মহাবীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মত রাজিয়া খাতুনও চাইতেন ইসলামী সম্রাজ্যের ঐক্য ও বিস্তৃতি।
দ্বীনের প্রয়োজনে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যাওয়ার জন্য তাঁর মন সব সময় উদগ্রীব থাকতো। আল্লাহ তাঁকে ইসলামের খেদমতের জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। সব সময় সচেষ্ট থাকতেন দ্বীনের মুজাহিদদের সহযোগিতায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য।
দাসীর কাছ থেকে যে গোপন তথ্য শুনেছেন তাতে তাঁর হৃদয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। অজানা ভয় ও শঙ্কা এসে গ্রাস করতে চাইল তাঁর হৃদয়-মন। কিন্তু এই বীরাঙ্গনা মহিলা মুখ বুঁজে সব সহ্য করবেন এমনটি আশা করার কোন কারণ ছিল না। তিনি যখন দেখলেন তাঁর সব আশা গুড়িয়ে গেছে, তিনি রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
ইয়াজউদ্দিন ভাবছিল, ইসলামের একনিষ্ঠ এক খাদেমাকে সে নিস্ক্রিয় ও বন্দী করতে সমর্থ হয়েছে। ভাবছিল, ইসলামের এক ধারালো তলোয়ারকে সে ভোতা করে দিতে পেরেছে। কিন্তু ঈমানের আলোয় আলোকিত হৃদয়কে যে এত সহজে কাবু করা যায় না, জানা ছিল না তাঁর।
রাজিয়া খাতুন জানতেন তাঁর যুবতী মেয়ে শামসুন নেছা এই মহলেই আছে। যদিও এখনো তার সাথে তার সাক্ষাত হয়নি। মেয়ের কথা স্মরণ হতেই তিনি স্মৃতির জগতে হারিয়ে গেলেন।
তার মনে পড়ে গেল, সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী যখন মারা যান তখন এ মেয়ের বয়স মাত্র আট কি নয়। তার একমাত্র পুত্র আল মালেকুস সালেহের বয়সও এগারো।
অথচ সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওফাতের পর স্বার্থপর আমীররা এই নাবালেগ শিশুকেই সুলতান বানিয়ে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাকে নামে মাত্র শাসক করে নিজেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ এলাকার শাসক সেজে বসেছিল।
এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ইসলামের স্বার্থে সুলতান আইয়ুবীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। তার ডাক পেয়ে মিশর থেকে ছুটে এসেছিলেন সুলতান। তারপর তার সহযোগিতায় দামেশক তথা সিরিয়া সুলতান আইয়ুবীর শাসনাধীনে যুক্ত হয়।
তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে হারানো সেই দিনগুলোর কথা। প্রাণের টুকরো ছেলে আল মালেকুস সালেহ তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে গিয়ে হলবে আশ্রয় নেয়। সঙ্গে করে নিয়ে যায় ছোট বন শামসুন নেছাকেও।
বুকে পাথর বেঁধে কেবল ইসলামের স্বার্থেই সেদিন তিনি দামেশকে থেকে গিয়েছিলেন। শামিল হয়েছিলেন ক্রুসেডদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে। এভাবেই কেটে গিয়েছিল আটটি বছর।
তারপর একদিন শামসুন নেছা ফিরে এলো মায়ের কাছে। তখন সে ষোল বছরের পূর্ণ যুবতী। জানালো, তার ভাই আল মালেকুস সালেহের অবস্থা মরণাপন্ন। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে সে মাকে এক নজর দেখার জন্য কান্নাকাটি করছে।
শামসুন নেছা সেদিন বলেছিল, ‘চলো মা, ভাইয়া তোমার দুধের দেনার ক্ষমা চাইতে চায়।’
কিন্তু কেবল ইসলামের দিকে তাকিয়েই সেদিন মা মেয়েকে খালি হাতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। নিজের মরণাপন্ন ছেলেকে এক নজর দেখার ইচ্ছে কি সেদিন জাগেনি তার মনে!
কিন্তু মনের আবেগ দমন করে রাজিয়া খাতুন সরাসরি তার প্রস্তাব অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘তার মা তো সে দিনই মারা গেছে, যেদিন সে ইসলামের খাদেম সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে।’
শামসুন নেছা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল। সে হলবে পৌঁছার আগেই তার ভাই আল মালেকুস সালেহ মারা যায়।
রাজিয়া খাতুন ভাবছেন, এই মহলেই তো থাকতো আমার বেটা! সে মারা গেছে বলেই তো আজ ইয়াজউদ্দিন গদীনশীন হতে পেরেছে! হায়, ইয়াজউদ্দিনও আমার ছেলের মত গাদ্দার! এতদিন আমি ছিলাম এক গাদ্দারের মা আর এখন এক গাদ্দারের বেগম!
স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন তিনি। মেয়ের কথা মনে পড়ল তাঁর। শামসুন নেছা এই মহলেই আছে অথচ একবারও মায়ের সাথে দেখা করতে আসেনি!
মনের কষ্ট গোপন করে রাজিয়া খাতুন দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার মেয়ে কোথায়? সে কি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?’
‘সে এই মহলেই আছে।’ দাসী উত্তরে বললো, ‘আপনি নিজেই আপনার স্বামীর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন, সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবে কিনা।’
‘কিন্তু যদি তাতেও নিষেধাজ্ঞা জারী করে গাদ্দার!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘যে তার মুনিবের সাথে গাদ্দারী করতে পারে, সে পারে না এমন কোন অপকর্ম নেই। মুখে সে আল্লাহর গোলাম এবং আইয়ুবীর অনুগত বললেও সে সাক্ষাত শয়তানের চেলা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি তার কাছ থেকে এখন আর ভাল কিছু আশা করতে পারি না।’
‘আপনি নিরাশ হবেন না।’ দাসী বললো, ‘তিনি নিষেধাজ্ঞা জারী করলে আমি গোপনে আপনার সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারবো।’
‘তুমি যে কমান্ডারের কথা বলেছো, তার সাথে আমার দেখা করাতে পারবে?’ রাজিয়া খাতুন বললেন।
‘কিছু দিন যেতে দিন। আগে জেনে নেই আপনার উপর কি কি নিষেধ জারী আছে।’ দাসী বললো, ‘কোন ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না। সব সমস্যারই সমাধান আছে। তবে ধীরে ধীরে সমাধানের দিকে যেতে হবে।’
‘আমি এমন কঠিন পরীক্ষায় পড়বো ভাবতে পারিনি। আগে বুঝতে পারলে এই ফাঁদে আমি পা দিতাম না।’
‘আপনার বিয়েটা এমন হুট করে হয়ে গেল যে, আমাদের আর করার কিছু ছিল না। আমরা আরেকটু আগে জানতে পারলে আপনাকে সতর্ক করে দিতে পারতাম!’
দাসীর দেয়া সংবাদে রাজিয়া খাতুন এতটাই উদ্বিগ্ন ও দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন যে, স্বাভাবিক বিবেচনা বোধ তার লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি দাসীর সাথে একান্ত বান্ধবীর মত অন্তরঙ্গ হয়ে আলাপ করছিলেন। হঠাৎ তার সম্বিত ফিরে এলো।
ভাবলেন, এ মেয়ে কি সত্যি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নাকি গোয়েন্দা! ভাবনাটা মনে জাগতেই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘আমি কেমন করে বিশ্বাস করবো, তুমি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী? তুমি যে গোয়েন্দা নও তার প্রমাণ কি?’
দাসীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রাজিয়া খাতুনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘আমি যদি কোন ধনীর দুলালী হতাম বা নামী দামী মহিলা হতাম, তাহলে হয়তো এমন প্রশ্ন আপনার মনে জাগতো না। আমি কোন মহলের শাহজাদী বা বেগম হলে আপনি আমাকে এমন প্রশ্ন করতেন না। বরং তখন প্রতিটি মিথ্যাকে সত্য জেনে তা বিশ্বাস করতেন এবং প্রতারণার শিকার হতেন।
কিন্তু আপনার জানা উচিত, গাদ্দার গরীবের চাইতে ধনীর ঘরেই বেশী জন্মায়। আমাদের তো আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই, তাই আমরা সত্যকেই আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকি।
জানি, এখন আপনার সামনে কঠিন পরীক্ষা, আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন! দ্বীনের প্রতি মহব্বত পোষণকারী এক দাসীকে, নাকি আপনার স্বামী হলবের বাদশাহকে।
আপনার মনে যখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে তখন পরীক্ষা দেয়া ছাড়া আপনার উপায় নেই। আমি যে গোয়েন্দা নই এ কথা প্রমাণ করার কোন উপায় নেই এখন। তবে আপনি যদি আমার উপর ভরসা ও বিশ্বাস করার ঝুঁকিটা নিতে পারেন তবে সেটাই হবে কল্যাণকর। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আপনাকে ও আমাকে তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যে শামিল করে নেন।’
রাজিয়া খাতুন এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। দাসী তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে।
এক সময় তিনি মুখ তুলে বললেন, ‘আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’
দাসী কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। রাজিয়া খাতুন ভেসে বেড়াতে লাগলেন চিন্তার রাজ্যে। রাজকীয় মহলকে তাঁর মনে হচ্ছিল এক অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠ। কামরার মূল্যবান আসবাবপত্রগুলো বিষাক্ত সাপের মত ফণা তুলে নাচছিল তাঁর চোখের সামনে।
দু’তিন দিন রাজিয়া খাতুন তার নতুন স্বামী ইয়াজউদ্দিনের কোন দেখা সাক্ষাত পেলেন না। তার কামরার দাসী ও চাকরানীরা খাবার ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে গেল। তিনি সে সবের দিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না।
দাসিরা তার খেদমতে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাঁর শান্তি ও আরামের জন্য কি লাগবে জানতে চাইতো। কিন্তু তিনি নির্বিকার।
তিনি জানতেন, তিনি আজ মহারাণী। অসংখ্য দাসদাসী তার সেবার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এ বাদশাহী তাকে মানসিক যন্ত্রণা ও পীড়া ছাড়া আর কিছুই দিচ্ছে না।
তিনি আগেও একজন সুলতানের সহধর্মিণী ছিলেন। কিন্তু জীবনে কোনদিন নিজেকে ঘুণাক্ষরেও মহারাণী ভাবার অবকাশ পাননি। শুধু ভাবতেন জেহাদের কথা, ভাবতেন যুদ্ধের ময়দানের কথা।
দুর্গম পাহাড় ও মরুভূমিতে লড়াই করার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই বিভোর থাকতেন তিনি। ভাবতেন, একদিন তার সুযোগ আসবে। একদিন রক্তাক্ত শহীদদের সাথে তারও লাশ উঠানো হবে ময়দান থেকে। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল, তা আর পূরণ হলো না।
দু’তিন দিন পর সুলতান ইয়াজউদ্দিন তার কামরায় এলেন। কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘অনেক ঝামেলা ও ব্যস্ততার মাঝে আছি, এ জন্য এ কয়দিন আসতে পারিনি।’
‘আমি তো আপনার অনুপস্থিতির জন্য কোন অনুযোগ বা অভিযোগ করিনি!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আমি তো নতুন বউ সেজে এখানে আসিনি যে, সব সময় আপনি আমার পাশে পাশে থাকবেন। আমার মনে তেমন ইচ্ছাও নেই। আমার জীবনের বেশীর ভাগ সময়ই কেটেছে নিঃসঙ্গভাবে। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী মরহুম প্রায়ই রণক্ষেত্রে থাকতেন। যখন যুদ্ধ থাকতো না তখন রাজ্যের বিভিন্ন কাজ ও সৈন্যদের প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
স্বামী সঙ্গ পাওয়ার জন্য আমি কখনো লালায়িত ছিলাম না। বরং আমি তাকে তাঁর কাজে ফাঁকে ফাঁকে সাহায্য করতাম। রাজ্যের টুকিটাকি কাজ ছাড়াও শহীদদের পরিবার দেখাশোনা ও তদারকের কাজ আমার উপর ন্যস্ত ছিল।
আমি যুবতী মেয়েদেরকে আহতদের সেবা করার ট্রেনিং দিতাম। তাদেরকে তিরন্দাজী, তলোয়ার চালনা এবং অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ দিতাম। আমি সুলতান জঙ্গীকে রণক্ষেত্রে বিজয়ী বা শহীদ হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিলাম। আমি তাঁর মহলের কোন কামরায় বন্দী থাকতাম না, যেমন এখানে বন্দী হয়ে আছি। এ বন্দিখানা আমার মোটেই পছন্দ নয়।’
‘আমি তাঁর সমালোচনা করবো না। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁর শাসন কার্যের কিছু দায়িত্ব বিবিকে দিয়ে ভাল করছিলেন কি মন্দ করেছিলেন, এ নিয়ে আমি কিছুই বলবো না।’
ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু আমি কাউকে এ কথা বলার সুযোগ দেবো না যে, হলবের ভাগ্য গড়া ও ভাঙ্গার পিছনে কোন মহিলার হাত আছে। আমি জানি তুমি আমার বিবি। আমি তোমার উপর এমন কোন বোঝা চাপাতে চাই না, যে কাজ আমাদের পারিবারিক বিষয় নয়।’
যেহেতু রাজিয়া খাতুন ইয়াজউদ্দিনের মনোভাব তাঁর দাসীর কাছ থেকেই জেনে নিয়েছিলেন সে জন্য স্বামীর এমন রূঢ় কথা ও ব্যবহার তিনি বেশী মনক্ষুন্ন হলেন না। তিনি বরং দাসীর কথা সত্য কিনা যাচাই করে দেখছিলেন।
যখন বুঝলেন দাসীর তথ্য নির্ভুল তখন তিনি স্বামীর সাথে আচরণে আরো হুশিয়ার হয়ে গেলেন। ইয়াজউদ্দিনের সাথে এখনই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া সমীচীন মনে করলেন না তিনি, তার বদলে ভালবাসার ভাব প্রকাশ করে বললেন, ‘কিন্তু যেভাবে আমাকে এই কামরাতে বন্দী করে রাখা হয়েছে এটা আমার পছন্দ নয়।’
রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আপনার শাসন কাজে আমার সহযোগিতা দরকার না হলে নেবেন না, কিন্তু আমি তো আপনার হেরেমের কেনা দাসী নই?’
রাজিয়া খাতুন নববধূ বা কচি খুকি ছিলেন না, তিনি একজন অভিজ্ঞ ও রাজনীতির জ্ঞান সমৃদ্ধ মহিলা ছিলেন। ইয়াজউদ্দিনের সাথে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই নতুন করে রাজনীতির খেলা শুরু করলেন তিনি।
‘রাজিয়া খাতুন!’ ইয়াজউদ্দিন কামরায় পায়চারী করতে করতে বললেন, ‘তোমাকে সে পারিবারিক জীবনের কথা ভুলে যেতে হবে, যে জীবন তুমি নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের সাথে কাটিয়েছো। তিনি তোমাকে যে স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে রেখেছিলেন, সেটাও আমি পছন্দ করি না। আর তেমন স্বাধীনতা কোন স্বামীই পছন্দ করবে না।’
‘তার মানে আমাকে এই ঘরে বন্দী জীবন কাটাতে হবে?’
‘তুমি কি তবে বাইরে ঘোরাফেরা করতে চাও? চার ঘোড়ার গাড়ী বাইরে প্রস্তুত আছে, যখন ইচ্ছা বাইরে বেড়াতে যেতে পারো।’
‘যার মহলের মধ্যে ঘোরাফেরার অনুমতি নেই তার বাইরে বেড়ানোর অনুমতি কেমন করে হয়?’ রাজিয়া খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সত্যি মহলের মধ্যে আমার ঘোরাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন?’
‘আমি এ আদেশ তোমার নিরাপত্তার জন্যই দিয়েছি।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তুমি তো জানো, হলব ও দামেশকের মধ্যে কেমন রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বেঁধেছিল। সুলতান আইয়ুবী তোমার ছেলেকে পরাজিত করে তার আনুগত্য আদায় করেছিলেন। কিন্তু এখানকার জনগণের মন থেকে এখনও সে শত্রুতা দূর হয়নি।
মহলে এমন সব লোক আছে যারা তোমাকে ও সুলতান আইয়ুবীকে শত্রু ভাবে। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের হাতে তাদের অনেকের ঘর ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে। তাদের যুবক সন্তানরা মারা গেছে। তারা জানে, তুমি সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক এবং তার একনিষ্ঠ ভক্ত। দামেশকে সুলতান আইয়ুবীর আধিপত্য কায়েমের মূল শক্তি ছিলে তুমি। এদের যে কেউ তোমাকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নিতে পারে।’
‘তবে তো তারা আপনাকেও হত্যা করতে পারে! কারণ আপনিও সুলতান আইয়ুবীর বন্ধু এবং আইয়ুবীর ঐক্যজোটের একজন বিশ্বস্ত শরীক।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘এ অবস্থায় আমাদের দায়িত্ব কি এই নয় যে, এ ধরনের লোক যারা ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, যারা জাতীয় ঐক্যের মূলে আঘাত হানতে পারে, তাদেরকে ধরে ধরে বন্দী করা? আপনার কাছে কি এমন গোয়েন্দা নেই, যারা জাতির দুশমনদের চিহ্নিত করে আপনার সামনে হাজির করতে পারে?’
‘আমি সে ব্যবস্থাই করছি।’
ইয়াজউদ্দিন এমন টেনে টেনে উত্তর দিলেন, যেন তার কাছে যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য আর কোন উত্তর নেই। তিনি দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার জীবন বিপদের মধ্যে ফেলে দিতে চাই না।’
‘তবে কি এ ভয় ও আশংকা শুধু আপনার মহলের মধ্যেই রয়েছে?’
রাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো আমাকে চার ঘোড়ার গাড়ীতে চেপে যেখানে ইচ্ছা বেড়ানোর আদেশ দিয়েছেন। তবে কি বাইরে আমাকে হত্যা করার কেউ নেই? মানুষ মহল বানায় নিরাপত্তা জন্য, অথচ আপনি বলতে চাইছেন, বাইরের চেয়ে মহলই এখন অধিক নিরাপত্তাহীন?’
ইয়াজউদ্দিনের চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি ও অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। তিনি এ প্রশ্নের কি জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাজিয়া খাতুনই আবার মুখ খোললেন। বললেন, ‘আমি আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম এ জন্য যে, মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর অসমাপ্ত কাজ আপনি ও সুলতান আইয়ুবী মিলিতভাবে তা সম্পন্ন করবেন। কারণ আমি যতদূর জানি, আপনিও সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ও হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।
আপনার এখন কর্তব্য, এখনও যারা আবার একটা গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টায় ময়দান সমান করছে, তাদেরকে অতি সত্বর নির্মূল করা। জাতির মধ্যে অটুট ঐক্য সৃষ্টি করে খৃস্টানদের আরব ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করাই এখন সময়ের দাবী।’
‘আমি জানি এবং সে জন্য আমার চেষ্টার অন্ত নেই।’ ইয়াজউদ্দিন নিজেকে সামলে উত্তর দিলেন।
‘আপনি কি আমাকে এই আশ্বাস দিতে পারবেন, এই মহলে খৃস্টানদের সেই প্রভাব নেই, যা আমার ছেলে সৃষ্টি করে রেখে গিয়েছিল?’ রাজিয়া খাতুন আবেগের সাথে বললেন, ‘আপনার সমস্ত আমীর ও সেনাপতিরা কি বাগদাদের খেলাফতের অনুগত?’
‘তুমি কি আমার এখানে আইয়ুবীর দূত হয়ে এসেছো, নাকি আমার বিবি হিসেবে?’ ইয়াজউদ্দিন বিরক্তির স্বরে তিক্ত কণ্ঠে বললেন কথাগুলো।
‘আমি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, তা আপনাকে আগেই বলেছি।’
রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আমি শুধু আমার গর্ভে আপনার সন্তান জন্ম দিতে ও ঘরকুনো বিবি হতে এখানে আসিনি। আরাম আয়েশে গড়াগড়ি খাওয়া পাটরানী আমি নই। আপনি যদি ভেবে থাকেন কোন আলিশান কামরায় বন্দী থেকে আমি খুশী হবো, ভুল ভেবেছেন।
আমি আপনার স্ত্রী হিসাবে যদি এই মহলের রানী হয়ে থাকি তবে এখানে রানীর মতই বসবাস করতে চাই। আমি আমার মহল ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই। জানতে চাই এ মহল খৃস্টানদের অশুভ ছায়া মুক্ত করতে কিনা। যদি তা না হয়ে থাকে তবে একে শত্রুর ছায়া মুক্ত করতে হবে। আমি এ সংকল্প থেকে একটুকুও বিরত হবো না।’
‘আমিও তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমার কোন কাজে তুমি হস্তক্ষেপ করবে না।’
ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তুমি আমার বিবি, আর এটিই তোমার জন্য আমার হুকুম। যদি বাড়াবাড়ি করো তবে তোমার জন্য ঘোড়ার গাড়ীতে বেড়ানোর যে অনুমতি দেয়া হয়েছে তাও বন্ধ করে দেয়া হবে।’
‘আর আমি যদি আপনার এ হুকুম না মানি তখন কি হবে?”
‘তখন এই হবে যে, তুমি আর এ কামরা থেকে বেরোতে পারবে না, এখানেই বন্দী জীবন যাপন করবে।’
ইয়াজউদ্দিন একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আর তোমাকে এটাও বলে দেয়া দরকার মনে করি, আমি তোমাকে কোন অবস্থাতেই তালাক দেবো না আর তোমাকেও তালাক দিতে দেবো না।’
ইয়াজউদ্দিন এটুকু বলেই রাগে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন।
‘আপনি বড্ড ভুল করে ফেললেন।’
ইয়াজউদ্দিন কামরা থেকে বেরিয়ে গেলে দাসী কামরায় প্রবেশ করে বললো, ‘যদি আপনি জিদ করেন তবে এ ব্যক্তি আপনাকে সত্যি সত্যি কয়েদী বানিয়ে ফেলবে। আমি তো আগেই আপনাকে বলেছি, আপনার স্বাধীনতা খর্ব করার জন্যই তিনি আপনাকে বিয়ে করেছেন।
আপনি যেনো আর কখনো আইয়ুবীর সহযোগিতা করতে না পারেন সে জন্যই এ পথ বেছে নিয়েছেন। এখন আপনার বাড়াবাড়ির ফলে তিনি আপনাকে এমন জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, যা আপনি কখনো কল্পনা করেননি। আপনাকে নিকৃষ্টতম সাজা দিতেও বাঁধবে না তার।’
‘কিন্তু তাই বলে আমি তার বশ্যতা কবুল করে নেবো? আমাকে এত দুর্বল ঈমানদার ভেবো না।’
‘না, আপনাকে আমরা কখনো দুর্বল ঈমানদার ভাবি না। ঈমানের দাবী পূরণের জন্যই আমি আপনাকে সতর্ক হতে বলি। বোকামী নয়, বুদ্ধিমত্তাই ঈমানদারের গুণ। আপনি তো আপনার স্বামীর মতলব সম্পর্কে এখন নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন। এবার আপনার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব! যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রের ঝনঝনানি কখনো আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। কিন্তু এমন মহা সংকটে আমি আর কখনো পড়িনি। এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন উপায় যে আমি দেখছি না।’
‘আমার কথা শুনুন। আপনি এ সম্পর্কে আর তার সাথে কোন কথা বলবেন না। আপনার সংকল্প তার কাছে ফাঁস করবেন না। এখন আপনাকে কৌশলী হতে হবে। তাঁর সামনে সর্বদা হাসি খুশী মন নিয়ে থাকবেন। প্রকাশ্যে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেবেন।
আজকের তিক্ত পরিবেশকে কিভাবে সহজ ও স্বাভাবিক হলে আপনার মুক্তির উপায় নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলবো।’
‘আমি যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছি তার কি হবে?’
‘আপনার সে ইচ্ছা ও আশা আমি পুরণ করতে করতে চেষ্টা করবো। আপনি জানেন, আপনার মালিক আপনার ভ্রমণের জন্য বাইরে চার ঘোড়ার গাড়ী সাজিয়ে রেখেছেন। এই গাড়ীই আপনার মুক্তির পথ বের করে দেবে।
আমি আমার কমান্ডারের সাথে আপনার সাক্ষাত করাবো। ইসহাক তুর্কী এসে গেলে তার সঙ্গেও আপনার সাক্ষাত করাবো। তারপর তারাই আপনার মুক্তির একটা পথ বাতলে দেবেন।’
দাসীর কথা তখনো শেষ হয়নি, কামরার দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। দু’জনই দেখলো, রাজিয়া খাতুনের কন্যা শামসুন নেছা সে দরোজার মুখ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
মুখটি তার হাস্যোজ্জ্বল বটে কিন্তু চোখে চিকচিক করছে অশ্রু। সহসা তার হাসি মিলিয়ে গেল, বাঁধভাঙ্গা অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে গেল চোখের মনি।
মা উঠে এগিয়ে গিয়ে কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দু’জনের চোখ থেকেই তখন গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। কান্নার আবেগ সামাল দেয়ার পরিবর্তে দু’জনেই ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
দাসী বাইরে বেরিয়ে এল। মা-মেয়ে আল মালেকুস সালেহের কথা স্মরণ করে আরো কিছুক্ষণ কাঁদলো প্রাণ উজাড় করে।
‘তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’ একটু শান্ত হয়ে রাজিয়া খাতুন জিজ্ঞেস করলেন।
‘চাচা ইয়াজউদ্দিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেছিলেন।’
‘তাকে কি কোন কারণ জিজ্ঞেস করেছিলে, কেন তিনি দেখা করতে বারণ করেছেন?’
‘এসব প্রশ্নের তিনি কোন জবাব দেন না। শুধু বাজে প্যাঁচাল আর রহস্যভরা কথা বলেই তিনি বক্তব্য শেষ করেন।’ শামসুন নেছা উত্তর দিল।
‘তাহলে এখন এলে কিভাবে?’
‘এই মাত্র তিনি আমার কামরায় গিয়ে বললেন, শামসুন, এবার তুমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে পারো।’
‘আর কি বললেন?’
‘বললেন, তিনি খুবই ব্যস্ত থাকবেন। আমি যেন মাকে বেশী করে সময় দেই।’
‘তিনি একথা বলেননি, তোমার মায়ের ওপর দৃষ্টি রেখো আর আমাকে জানিও, তার সাথে কে কে কথা বলে আর কি বিষয়ে আলাপ করে?’
‘হ্যাঁ।’ শামসুন নেছা সরলভাবে বললো, ‘তিনি এমন কিছু কথাও বলেছেন যার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি। আমি বলেছি, ঠিক আছে, আমি খেয়াল রাখবো। তিনি বললেন, ‘তাহলে এখন তোমার মায়ের কাছে চলে যাও, পড়ে আমি তোমার কাছ থেকে সব জেনে নেবো।’
‘আমার সম্পর্কে আর কি বললেন?’
‘বললেন, তোমার মা বড় জিদ্দি মহিলা এবং ঝগড়াটে। তাকে বলে দিয়ো, আমি দেশের কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে, ঘরে ফিরে তার এমন মেজাজ দেখলে আমি অধীর হয়ে পড়ি, কষ্ট পাই।’
‘শোনো বেটি!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘এখন তোমার এই ছেলেমানুষী সরলতা বাদ দাও। তুমি এখন যুবতী হয়ে গেছো। আমি এটা বলতে চাই না যে, এখন তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। মুজাহিদদের কন্যার হাতে মেহদীর পরিবর্তে রক্তের ছাপ থাকে।’
শামসুন নেছা মায়ের কথা মর্মার্থ কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।
মা বললেন, ‘শোন মেয়ে, উজ্জীবিতপ্রাণ কন্যাদের বিয়ের পালকি খুব কমই বইতে দেখা যায়। তাদের লাশই শুধু যুদ্ধের ময়দান থেকে উঠানো হয়।
তোমার দুর্ভাগ্য এই যে, তুমি তোমার ভাই ও তার উপদেষ্টাদের সাহচর্যে লালিত পালিত হয়েছো। এরা সবাই বিশ্বাসঘাতক, তোমার ভাইও একজন গাদ্দার ছিল।
তুমি তোমার ভাইয়ের সৈন্যদেরকে তার পিতার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে দেখেছো। তোমার পিতার আদর্শের সৈনিক সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের সাথেও তাদের তুমি যুদ্ধ করতে দেখেছো। এ জন্যই তাকে আমি আমার ছেলে পরিচয় দিতেও ঘৃণা বোধ করতাম।
সে খৃস্টানদের বন্ধু এবং তাদের ষড়যন্ত্রের সহযোগী ছিল। আর এই খৃস্টানরা আমাদের জাতির শত্রু, ধর্মের শত্রু। তোমার বাবা আজীবন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন।’
‘কিন্তু ভাইয়া যে বলতেন, খৃস্টানরা বড় ভাল লোক, আমাদের অমায়িক বন্ধু!’ শামসুন নেছা বললো, ‘আর ভাইয়া সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলতেন, রক্তপিপাসু, খুনী।’
মা শামসুন নেছাকে খৃস্টানদের পরিকল্পনা ও সংকল্প কি বুঝিয়ে বললেন। বললেন, ‘তাদের বন্ধুত্বের মধ্যেও থাকে কঠিন শত্রুতা।’
রাজিয়া খাতুন কথা বলে যাচ্ছিলেন, ধীরে ধীরে শামসুন নেছার দৃষ্টি ও জ্ঞানের পর্দা খুলে যাচ্ছিল। মায়ের এক একটি কোথায় মেয়ের অন্তরে সৃষ্টি হচ্ছিল ভাবান্তর।
‘মুসলমানের বন্ধু কেউ না।’
রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘যারা আল্লাহর কালাম ও রাসুলের সুন্নতের অনুসারী নয় তারা মুসলমানের ভাল কামনা করতে পারে না।
শত্রুদের শত্রুতার সবচে কঠিন দিক হলো প্রকাশ্যে বন্ধুত্বের ভান করা। খৃস্টানরা হলব, মুশেল ও হারানের আমীরদের সাথে বন্ধুত্ব করে আমাদের জাতির ঐক্যবদ্ধ দেহকাঠামোকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে।
তোমার ভাই তাদের হাতের পুতুল ছিল। আল্লাহ ও তার রাসুলের আদেশ হলো, তোমরা দ্বীনের রজ্জু ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে ধারণ করো। ইসলামের এই ঐক্যে ফাটল ধরানো মহা পাপ। কারণ অনৈক্যের এ ফাটল দিয়েই প্রবেশ করে ধ্বংসের বীজ। ভাইয়ে ভাইয়ে জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। তাতে বিনষ্ট হয় মুসলমানদের অঢেল সহায় সম্পদ ও জীবন। বিলীন হয়ে যায় আপন অস্তিত্ব।
এ জন্যই কুরআন বার বার ঐক্যের তাগিদ দিয়েছে। বলেছে, কাফেরকে বিরুদ্ধে তোমরা সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্য গড়ে তোল। এ ঐক্য গড়ে তুলতে হয় নিজের ব্যক্তিগত লাভ ও লোভকে দমন করে।
যদি নিয়মিত নামাজ রোজা করার পরও নিজের মনে ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে, মনে করবে তুমিই ইসলামের দুশমন। নিজের ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের আকাঙ্ক্ষা জয় করতে না পারলে তোমার হাতেই ঘটতে পারে জাতির সমূহ সর্বনাশ।’
‘কিন্তু ভাইয়া তো নিজে লড়াই করে ক্ষমতা দখল করেনি, আমীররাই তাকে গদীতে বসিয়েছিল। এতে তার দোষটা কোথায়?’
‘দোষ তার নেতৃত্বের লোভের। যদি তার মনে বিলাসিতা ও নেতৃত্বের লোভ না থাকতো তবে আমীরদের ফাঁদে সে পা দিত না। এক নাবালক শিশুর এমন কি যোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল যে, সে জাতির নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য এগিয়ে যায়?
জাতির যারা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তাদেরকে কখনো নিজের মত কোরবানী করতে হয়, কখনো ত্যাগ করতে হয় সহায় সম্পদের মায়া। ঐক্যের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে হয় তাকে। কিন্তু তোমার ভাই তা পারেনি।’
‘এক নাবালেগ শিশুর মধ্যে এমন অদূরদর্শিতা তো থাক্তেই পারে।’
‘হ্যাঁ, পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অদূরদর্শিতাও এক ধরনের অপরাধ। কাফেররা এমন অদূরদর্শী মুসলমানই খুঁজে বেড়ায়। তাদের কাঁধে সওয়ার হয়ে কবর খোঁড়ে মুসলমানদের।’
‘মা, কি বলছো তুমি!’ বিস্মিত শামসুন নেছা বলল, ‘এ তো দেখি সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র!’
‘হ্যাঁ, এই ষড়যন্ত্রের পথই বেছে নিয়েছে খৃস্টানরা। তারা বিলাসিতা ও ভোগের সামগ্রী সরবরাহ করে মুসলমানদের ঐক্যের দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে।
নারী, মদ, সম্পদ ও ক্ষমতার নেশা মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হলে আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় শয়তানের চেলা।
শয়তানের কোথায় যাদু থাকে। সেই যাদুর প্রভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তার মানবিক সত্ত্বা।
শয়তানের এ কাজ এখন করছে খৃস্টানরা। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষের নৈতিকতা ধ্বংস করা, সে কাজই এখন করছে ওরা।
‘হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই বলেছো। আমি এই মহলেই এমন সব কার্যকলাপ হতে দেখেছি।’
শামসুন নেছা বলল, ‘আমি তখন খুব ছোট ছিলাম, কিছু বুঝতাম না। যখন ভাই আমাকে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নিকট এজাজ দুর্গ চেয়ে পাঠালেন তখন আমি কিছু না বুঝেই সুলতানের কাছে গিয়েছিলাম। তখন আমাকে কেউ বলেনি, আমি কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছি। তখন আমার এটাও জানা ছিল না যে, এটা এক গৃহযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধ খৃস্টানরাই মুসলমানদের মধ্যে বাঁধিয়েছে।
আমি এসবের কিছুই জানতাম না মা। তুমি এখন যা বললে তাতে আমার চোখ খুলে গেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি কেন খৃস্টান মেয়েরা ভাইয়ার কাছে আসতো। কেন আসতো খৃস্টানদের দূত ও বণিকেরা। কেন তারা ভাইয়াকে নানা রকম উপহার সামগ্রী দিত।’
রাজিয়া খাতুনের চোখে অশ্রু এসে গেল। তাহলে মেয়েকে তিনি সত্য কথা বুঝাতে পেরেছেন! দীর্ঘদিন যে পর্দা দিয়ে তার চোখ ঢেকে রাখা হয়েছিল সেই আবরণ তিনি সরিয়ে দিতে পেরেছেন!
তিনি মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, এই মহলে এখনও শয়তানের শাসন ও কর্তৃত্ব চলছে। ইয়াজউদ্দিন আমাকে রানী বানানোর জন্য বিয়ে করেনি, সে বিয়ে করেছে আমাকে বন্দী করার জন্য। আমি যাতে আর আল্লাহর সৈনিকদের উজ্জীবিত করতে না পারি সে জন্য এই রাজমহলের জিন্দাখানায় বন্দী করেছে আমাকে।’
শামসুন নেছা উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘কি বলছো মা! তাহলে তুমি তাকে বিয়ে করলে কেন?’
‘আমি বিয়েতে এ জন্যই রাজী হয়েছিলাম, যাতে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। সুলতান আইয়ুবীর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সময় এ কথাই বলেছিলেন।
তিনি চাচ্ছিলেন আমি যেন ইয়াজউদ্দিনকে বিয়ে করে হলব ও দামেশকের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাই। খৃস্টানরা যেন ইয়াজুদ্দিনকে কব্জা করতে না পারে আমি যেন সেদিকে খেয়াল রাখি। আমি এ আশা নিয়েই তাকে কবুল করতে সম্মত হয়েছিলাম।
আমি চাচ্ছিলাম, আমার এ কোরবানীর বিনিময়ে জাতির মধ্যে আবার একতার বন্ধন সৃষ্টি হোক। ভ্রাতিঘাতি সংঘাতের পরিবর্তে তারা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলুক সম্মিলিত সামরিক শক্তি।
কিন্তু জীবনে আমি এই প্রথম ধোঁকা খেলাম। আর এ ধোঁকা কোন সাধারণ ধোঁকা নয়, মারাত্মক এক ভুলের মাশুল গুণতে হবে এখন আমাকে। কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাই, আমি এত সহজে পরাজয় মেনে নেবো না। এ অবস্থার মধ্যেও আমি আমার স্বপ্ন পূরণের সংকল্পে অটুট।
এ জন্য তোমার সহযোগিতার প্রয়োজন হবে আমার। তুমি যাতে আমাকে সাহায্য করতে পারো সে জন্যই তোমাকে এত কথা বললাম।’
‘আমাকে বলুন, আমার কি করতে হবে।’
শামসুন নেছা ব্যাকুল কণ্ঠে বললো, ‘আপনি তো জীবনে এই প্রথম ধোঁকায় পড়লেন আর আমার তো জীবনটাই কেটে গেল ধোঁকার মধ্যে। এই প্রথম আমি আসল সত্য সম্পর্কে অবগত হলাম। মা, আমাকে বলুন, এখন আমাকে কি করতে হবে।’
‘গোয়েন্দাগিরী!’
রাজিয়া খাতুন অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘তোমাদের খুঁজে বের করতে হবে, এই মহলে এখনও কারা খৃস্টানদের পক্ষে কাজ করছে। ইয়াজউদ্দিনের সাথে কাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সে খৃস্টানদের কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।’
রাজিয়া খাতুন কিভাবে কি করতে হবে বিস্তারিত শামসুন নেছাকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।
যখন শামসুন নেছা রাজিয়া খাতুনের কামরা থেকে বের হলো তখন সে অনুভব করলো, সে আর আগের শামসুন নেছা নেই। তার জীবনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে গেছে। জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপারে উদাসীন কোন সাধারণ নারী সে আর নেই। সে এখন সত্যের সপক্ষে এক নির্ভীক বিপ্লবী। আল্লাহর রাহে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত এক সত্য-সৈনিক।
যখন সে রাজিয়া খাতুনের কামরায় ঢুকেছিল, সে ছিল রাজমহলের আদরে লালিত এক স্বপ্ন-বিলাসী কন্যা, আর এখন সে আল্লাহর পথে জীবন কোরবানের সংকল্পে অটুট এক অকুতোভয় তরুণী। শামসুন নেছা তার এই পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয়ে গেল।
‘আপনাকে কে বললো যে আমার মা ঝগড়াটে ও ভুল ধারণায় আছে?’
শামসুন নেছা ইয়াজউদ্দিনকে বললো, ‘আপনি কি জানেন তাঁর জীবনটা কিভাবে কেটেছে? তিনি আপনাকেও আমার পিতা নূরুদ্দিন জঙ্গীর মত প্রসিদ্ধ রণবীর ও ইসলামের বীর মুজাহিদ বানাতে চেয়েছিলেন।’
‘সে তো আমার কাজে বাঁধা দিতে চায়।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তাঁর ধারণা আমি খৃস্টানদের বন্ধু!’
‘আমি তাঁর সে ভুল ভেঙ্গে দিয়েছি।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তাঁর চলাফেরায় অহেতুক বিধি-নিষেধ আরোপ করায় তার মনে আপনার সম্পর্কে সামান্য সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি তার সে সন্দেহ দূর করে দিয়েছি।
আপনি অযথা তাঁর সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা পোষণ করবেন না। তাঁর চলাফেরায় অপ্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধ আরোপ না করলে আপনার ব্যাপারে তার কোন খারাপ ধারণা সৃষ্টি হবে না।’
‘আমি তো তার প্রতি কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চাইনি।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘গাড়ী সব সময় প্রস্তুত আছে। যখন খুশী তোমার মাকে নিয়ে তুমি বেড়াতে যেতে পারো।’
ইয়াজউদ্দিন শামসুন নেছার কথাকে সত্য বলে ধরে নিলেন। তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল ইয়াজউদ্দিনের অফিসে বসে। কথা শেষ করে শামসুন নেছা সেখান থেকে বের হয়ে এলো।
বাইরে বেরিয়েই সে দেখতে পেল দরজার বাইরে আমের বিন উসমান দাঁড়িয়ে আছে।
আমের বিন উসমানের বয়স এখনও ত্রিশ পার হয়নি। ছেলেটা বেশ চালাক চতুর। চেহারা আকর্ষণীয়। তলোয়ার যুদ্ধ ও তীরন্দাজীতে তার সমকক্ষ কেউ নেই হলবে।
আল মালেকুস সালেহের দেহরক্ষীর দলের কমান্ডার ছিল আমের বিন উসমান। এই বয়সেই শারীরিক নৈপুণ্য ও বুদ্ধিমত্তার কারণে এতবড় পদে আসীন হতে পেরেছে সে।
এত বড় দায়িত্বশীল কাজের ভার তার ওপর ন্যস্ত করে কর্তৃপক্ষ মোটেই চিন্তিত ছিল না, বরং দক্ষতার কারণে সবাই তার ওপর সন্তুষ্ট ছিল।
এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে মহলের ভেতরই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল।
যুবতী শামসুন নেছার রূপ ও যৌবন কিছুদিন থেকেই এ যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। যতই সে শামসুন নেছাকে দেখছিল ততই তার প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছিল।
রাজমহলের বাসিন্দা হওয়ার কারণে শামসুন নেছার সাথে তার মেলামেশার অবাধ সুযোগ ছিল না। কিন্তু শামসুন নেছার ছিল খেলাধুলার শখ। সে রোজ বাগানে খেলতে নামতো আর দূর থেকে তার অপরূপ রূপের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতো আমের বিন উসমান।
সুলতানের বোন হিসাবে মহলে ছিল শামসুন নেছার বিশেষ মর্যাদা ও আধিপত্য। ফলে সারা মহলে তার অবাধ বিচরণ ও খেলাধুলায় কোন বিধি-নিষেধ ছিল না।
চঞ্চল প্রজাপতির মতই মহলের সর্বত্র সে ঘুরে বেড়াতো মনের আনন্দে। ভাই মারা যাওয়ার পর ইয়াজউদ্দিন এসে দায়িত্ব গ্রহণের পরও তার অবাধ স্বাধীনতায় কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি। ইয়াজউদ্দিন তাকে সরল, সহজ ও চঞ্চল আমুদে এক মেয়ে হিসাবেই গণ্য করেছিলেন।
এই বয়সী মেয়েরা একটু খেলাধুলাপ্রিয় ও চপল স্বভাবের হয়েই থাকে ভেবে তিনি শামসুন নেছার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
এই সুবাদেই আমের বিন উসমানের দৃষ্টির সামনে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল শামসুন নেছা। এমনকি তার সাথে মেলামেশা এবং কথা বলারও সুযোগ পেয়েছিল। আমেরের মত শামসুন নেছাও কি বলিষ্ঠ এই সুশ্রী যুবকের দিকে দিন দিন ঝুঁকে পড়ছিল?
প্রশ্নটা মাঝে মাঝে নিজের মনেই উঁকি মারতো শামসুন নেছার। সে এখন পূর্ণ যুবতী, ষোড়শী কন্যা। এ বয়সে চোখে রঙ না লাগলে আর কবে লাগবে?
সে যুগে মেয়েদের আরো কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যেতো।
কিন্তু অভিজাত ঘরের মেয়েদের বিয়ে একটু দেরীতেই হতো। সেই কারণে এবং উপযুক্ত ও দায়িত্ববান অভিভাবক না থাকার ফলে শামসুন নেছার বিয়ে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, এমনকি সে নিজেও না।
শামসুন নেছা ছিল এক সুলতানের কন্যা। পিতার অবর্তমানেও এক শাহজাদার আদরের বোন হিসাবেই সে প্রতিপালিত হয়েছে রাজমহলে। ফলে কোনদিন তাকে অযত্নের শিকার হতে হয়নি।
প্রকৃতিও তার অফুরন্ত রূপ সুধা হাতে বিলিয়ে দিয়েছিল এই শাহজাদীর জন্য। স্বাভাবিক সৌন্দর্যের চাইতে একটু বেশীই সুন্দরী লাগতো তাকে। যেন এক অভিজ্ঞ মালীর সযত্ন পরিচর্যায় বেড়ে উঠা কোমল পেলব এক পুস্পকলি।
আমের বিন উসমানের প্রতি তার আগ্রহ যেমন ছিল সহজাত, তেমনি তার প্রকাশও ঘটেছিল স্বাভাবিকভাবেই।
সে তাকে যখন তখন বিরক্ত করতো। কিন্তু আমের ধরতে গেলেই পালিয়ে যেতো। এ ছিল চঞ্চলা কিশোরীর চপলতা মাত্র। কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন।
কিশোরীর চপলতা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে এসে বাসা বেঁধেছে যুবতীর লাজনম্র ভীরুতা। তাই সে এখন তাকে দেখলেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওঠে।
উসমান সব বুঝতে পারে। কিন্তু রাজ পরিবারের দিকে হাত বাড়াবার সাহস পায় না সে। সেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
কিন্তু এই গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টাই পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ আরো তীব্রতর করে তোলে। সেই আকর্ষণের টান এড়াতে না পেরে তারা গোপনে মনের ভেতর পরস্পরকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে।
এ জাল বুনতে বুনতেই তারা একে অন্যের আরো নিকটতর হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের কাছে মেলে ধরে নিজেকে। বিয়ের স্বপ্নও দেখে। কিন্তু বিয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাদের সামাজিক মর্যাদা।
আমের বিন উসমানের পক্ষে শামসুন নেছার মত বংশীয় মেয়ের আশা করাই দুরাশা। কিন্তু তবু তারা মন দেয়া-নেয়ার এ খেলা থেকে বিরত থাকার কথা কেউ চিন্তা করতে পারছিল না।
শামসুন নেছা ইয়াজউদ্দিনের অফিস থেকে বের হয়ে দেখলো আমের বিন উসমান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শামসুন নেছা তাকে দেখে হেসে ফেলল এবং কিছু একটা ইঙ্গিত করে চলে গেল।
আমের সে ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাথা সামান্য নেড়ে তাতে সায় জানাল। এর অর্থ হলো, সে অবশ্যই যাবে।
তারা যে জায়গাটিতে মিলিত হলো সে জায়গাটি গাছপালা ও ঝোপঝাড়ে ঢাকা। তার ওপরে রাতের অন্ধকার জায়গাটিকে ভূতুরে করে রেখেছে। আমের বিন উসমান এবং শামসুন নেছা মহলের আলো থেকে দূরে সেই নির্জন স্থানে গিয়ে বসল।
‘আজ আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করেছি।’ শামসুন নেছা বললো, ‘এখন থেকে মায়ের সাথেই থাকবো।’
‘তোমার মা-ও শাহী পরিবারের মহিলা।’ আমের বললো, ‘তিনি তো তোমার বিয়ে কোন শাহজাদার সাথেই দিতে পছন্দ করবেন।’
‘না।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তিনি শাহী পরিবারের মেয়ে সত্য, কিন্তু তিনি তাঁবুতে থাকতে পছন্দ করেন ও রণাঙ্গনের পাশে ক্যাম্পে থাকতে চান। তিনি আমাকেও সামরিক শিক্ষা দিয়ে বীর সেনানী বানাতে চান।’
‘তুমি কি আশা করো তোমার ও আমার সম্পর্ক এবং ভালবাসার কথা জানলে তিনি তা মেনে নিবেন?’ আমের প্রশ্ন করলো।
‘যদি আমি তার আশা পূরণ করি তবে আমার বিশ্বাস, তিনিও আমার আশা পূরণ করবেন। তার কিছু পরিকল্পনা আছে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি আমার সহযোগিতা চেয়েছেন। আমার সাথে তোমাকেও এ কাজে সহযোগিতা করতে হবে।’ শামসুন নেছা বললো।
‘তুমি কি তাকে আমার কথা বলেছো নাকি?’
‘না।’ শামসুন নেছা উত্তর দিল, ‘তিনি শুধু আমাকে তাঁর উদ্দেশ্য বলেছেন। সেটা কার্যকর করতে তিনি আমার সহযোগিতাও চেয়েছেন। কিন্তু বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম জানার আগে তোমাকে এর গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি না সে ব্যাপারে কথা দিতে হবে।’
‘যদি আমি প্রতিজ্ঞা না করি এবং কথা না দেই তবে কি হবে?’ আমের হেসে বললো এবং তাকে কাছে টেনে নিল।
শামসুন নেছা আমেরের এ আকর্ষণে সাড়া না দিয়ে বরং নিজেকে একটু দূরত্বে সরিয়ে নিল। তার চেহারায় স্পষ্ট অভিমান।
আমের বিষয়টা হালকা করার জন্য বললো, ‘আমি আগেও তোমাকে বলেছি, এখনও প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাকে ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার। সুতরাং প্রতিজ্ঞা করানোর দরকার নেই, তুমি যা বলবে আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।’
‘আমিও তোমাকে স্পষ্ট বলেছি, আমার বিয়ে তোমার সাথেই হবে। তোমাকে ছাড়া আমি এ জীবনে আর কাউকে গ্রহণ করতে পারবো না। তবে তার আগে আমাকে সেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে, যে কাজ মা আমাকে দিয়েছেন। আর তুমি এর গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি না দেয়া পর্যন্ত তোমাকে আমি সে বিষয়ে কিছুই বলবো না।’
আমের বিন উসমান শামসুন নেছার এ কোথায় একটু আহত এবং আশ্চর্য হলো। এমন শর্ত তো সে কোনদিন আরোপ করেনি! কি এমন কথা, যা শপথ না করলে বলা যায় না!
সে চমকে গিয়ে বললো, ‘তোমার অন্তরে কি আমার ভালবাসা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে শামছি? এতদিনেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না! মুখের হলফ কি অন্তরের ভালবাসার চেয়েও শক্তিশালী?’
‘কাজটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমার জীবনের চাইতেও তাকে অধিক মূল্যবান মনে করি। এই গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই আমি শপথ নেয়া জরুরী মনে করেছি।’
শামসুন নেছা আবেগভরা কণ্ঠে বললো, ‘আমি আমার মায়ের আদেশে জান দিয়ে দেবো, যদি তুমি সাথে না থাকো তবুও।’
‘আমিও তোমার ভালবাসার খাতিরে জীবন দিয়ে দেবো, যদি তুমি আমাকে সাথে না নাও তবুও।’
‘না।’ শামসুন নেছা বললো, ‘ভালবাসার জন্য নয়, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য। তবে এই ইসলামের জন্য নয়, যে ইসলাম আমরা এ মহলে দেখছি।
আমি সেই ইসলামের কথা বলছি, যে ইসলামের জন্য আমার মহান পিতা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁর জীবন শেষ করে গেছেন আর যে ইসলাম রক্ষার জন্য সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখনো লড়ছেন।’
‘আমি কোরআন ছুঁয়ে শপথ নেবো, আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হবে আমি সে দায়িত্ব জীবন বাজি রেখে পালন করে যাবো।’
আমের বিন উসমান শামসুন নেছার হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললো, ‘যদি আমি শপথ ভঙ্গ করি বা শপথের বিরুদ্ধে কোন কাজ করি তবে তুমি আমাকে হত্যা করে আমার লাশ কুকুর শৃগালকে দিয়ে দেবে। এখন বলো আমাকে কি করতে হবে?’
‘গোয়েন্দাগিরি।’ শামসুন নেছা বললো, ‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিশরে আছেন। তিনি এই ভরসাতেই সন্তুষ্ট আছেন যে, তিনি আমার ভাই আল মালেকুস সালেহের সাথে যে বন্ধুত্ব ও চুক্তি করেছিলেন তা অটুট আছে।
আমার ভাই মারা গেছেন। এখন সে চুক্তি ঠিক আছে কিনা সে বিষয় তুমি আমার চেয়ে ভাল জানো। বর্তমান হলব সরকারের ওপর খৃস্টানদের প্রভাব আছে কিনা জানতে হবে আমাদের।
ইয়াজউদ্দিনকে সুলতান সালাহউদ্দিন নিজের বন্ধু জানেন। কিন্তু আম্মাজান সে বিষয়ে শংকা বোধ করছেন।’
‘আমার মালিক তোমার মাকে বিয়ে করার পর তো তেমন আশংকার কোন কারণ দেখি না। তিনি তো এজন্যই তোমার আম্মাকে বিয়ে করেছেন, যাতে ইসলামী জগতের সাথে তার সম্পর্ক আরো অটুট হয়।’ আমের বললো।
‘বাহ্যতঃ জগত তাই মনে করবে। কিন্তু বস্তবতা অন্য রকম মনে হচ্ছে বলেই তো ভয় পাচ্ছি। সমস্যা তো এই বিয়ে থেকেই শুরু হয়েছে।’
আমের কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ‘সেটা কি রকম?’
শামসুন নেছা বললো, ‘ইয়াজউদ্দিন মাকে বন্দী করার কৌশল হিসাবে এ বিয়ে করেছেন। আম্মা যাতে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সহযোগিতায় আর কখনো এগিয়ে যেতে না পারেন সে জন্য বিয়ের ছলে মাকে আসলে এ মহলে বন্দী করা হয়েছে।’
‘কি অবাক করা কথা বলছো তুমি?’
‘হ্যাঁ, অবাক করা কথাই বটে। ইয়াজউদ্দিন শুধু এ জন্যই মাকে বিয়ে করেছেন, যাতে দামেশকের জনগণ তার সঠিক নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। আম্মা কার্যত এখানে বন্দী। মহলের একটি নির্দিষ্ট অংশে তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মহল ঘুরে দেখার অনুমতিটুকু পর্যন্ত ইয়াজউদ্দিনের কাছ থেকে পাননি আম্মা।’
‘বলো কি!’ বিস্মিত আমের বিন উসমান বললো, ‘তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো তো!’
‘আমি কি বলছি আমি ভাল করেই জানি। ইয়াজউদ্দিন এখানে ষড়যন্ত্রের বিশাল ফাঁদ পেতে বসেছে। কিন্তু সে কি করতে চাচ্ছে এবং কতদূর এগিয়েছে, আমরা এখনো তা জানি না।’
আমের বিন উসমান কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইল। এ ধরনের কোন দুঃসংবাদ শোনার জন্য সে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। এ খবর তাকে হতবুদ্ধি করে ফেলল।
সে সহসা বলে উঠল, ‘তাহলে এখন উপায়? এ অবস্থায় আমরা কতটুকু কি করতে পারবো? তোমার আম্মা এ নিয়ে কি চিন্তা করেছেন?’
‘এ মহলের গোপন তথ্য উদ্ধার করে সে তথ্য কায়রো পৌঁছাতে হবে। আর এটাও আমাদের জানতে হবে, খৃস্টানরা কি গোপন দুরভিসন্ধি নিয়ে ইয়াজউদ্দিনের সাথে হাত মিলিয়েছে? তারা কি আবারও আমাদের ঐক্যবদ্ধ সেনাদলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে চায়? তারা কি কোন বড় আকারের যুদ্ধ বাধানোর গোপন প্রস্তুতি নিচ্ছে?
তুমি এমন এক স্থানে আছো যেখানে বসে তুমি সবদিকেই নজর দিতে পারবে। আজ থেকে তুমি ভুলে যাও, তুমি ইয়াজউদ্দিনের রক্ষী দলের কমান্ডার। তুমি ইসলামের এক বীর সৈনিক, সকাল সন্ধ্যা প্রতিটি মুহূর্ত এ অনুভুতি নিয়েই এখন থেকে তোমাকে কাজ করতে হবে।’
‘হ্যাঁ, আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো, আমি এমন স্থানে আছি যেখানে বসে আমি সব কিছুই দেখতে পাই।
শামছি! আমি যা দেখে আসছি এবং এখনও দেখছি, সেদিকে আমি কোনদিনই খেয়াল করিনি। আমি একজন মর্দে মুজাহিদ ছিলাম, আর এখন একজন চাকুরীজীবী হয়ে গেছি। যখন সৈনিক মুজাহিদ থেকে চাকরিজীবী হয়ে যায় তখন তার দশা এমনই হয়।
এই মহলে আমার চোখের সামনে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটছে, অথচ আমি তার কিছুই দেখতে পাইনি।
সৈন্যদের চাকরীর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে চাকরী বাঁচাতে যখন সে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বাদ দেয় তখন তাকে গ্রাস করে নানা রোগ। তখন সে তোষামোদকারী হয়ে যায়। উপরওয়ালাকে খুশী করতে ও তার কাছ থেকে বখশিশ নিতে গিয়ে সে আর সৈনিক থাকে না, পদোন্নতির আশায় সে হয়ে পড়ে চাটুকার।
যুদ্ধ ও তোষামোদকারীর মধ্যে এত পার্থক্য, যেমন পার্থক্য জয় ও পরাজয়ের মধ্যে। আমাকে একথা কেউ বলেনি যে, সৈন্যদের শুধু বাইরের শত্রুর সাথেই যুদ্ধ করতে হয় না, ঘরের, এমনকি অন্তরের শত্রুর সাথেও যুদ্ধ করতে হয়।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো, এটাও সৈনিকের দায়িত্ব। যখন কোন সরকার জাতি ও দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়, দেশের স্বাধীনতাকে হুমকির সম্মুখীন করে তোলে, তখন তার বিরুদ্ধে সিপাহী বিপ্লব করে সেই গাদ্দার সরকারকে নির্মূল করে দেশের স্বাধীনতাকে হেফাজত করা।
সেনাবাহিনী সরকারের নয়, দেশপ্রেমিকের জনতার। তাদের দায়িত্ব দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা, সৈন্যদের কখনো এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।’
আমের বিন উসমান শামসুন নেছার হাত চেপে ধরে বললো, ‘ব্যস আর বলতে হবে না। তুমি আমাকে আমার আসল দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছো। তুমি আমার চোখের পর্দা সরিয়ে দিয়েছো। এখন আমাকে বলো, কাউকে হত্যা করতে হবে, নাকি শুধু গোপন তথ্য উদ্ধার করার মধ্যেই আমার কাজ সীমাবদ্ধ রাখবো।’
‘প্রয়োজন হলে আমাদের দুটি কাজই করতে হবে।’ শামসুন নেছা উত্তরে বলল, ‘গোপন তথ্য নিতে গিয়ে যদি কোন গাদ্দারকে হত্যা করতে হয়, তাও করতে হবে।’
‘শোন শামছি।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘আমি এখন আর চাকরের মত কথা বলবো না, একজন মুজাহিদের মত কথা বলবো। গোপন কথা হলো, হলব এখন খৃস্টানদের জালে বন্দী।
ইয়াজউদ্দিন যদি সুলতান আইয়ুবীর বন্ধুও হন এবং নিজে ইসলামের পক্ষেও হন তবুও তিনি হলবের সেনাদলকে মিশরের সৈন্য দলের ঐক্যজোটে শামিল করাতে পারবেন না। কারণ তাঁর গভর্নর, উজির, উপদেষ্টা এমন কি সেনাপতিরাও খৃস্টানদের কাছে ঈমান বিক্রি করে বসে আছে। এরা তোমার ভাই মারা যাওয়ার আগেই ঈমান বিক্রি করেছিল, ইয়াজউদ্দিন ক্ষমতা গ্রহণের পরও তারা গাদ্দারই রয়ে গেছে।’
আমের বিন উসমান আরো বললো, ‘তারা সরকারী কোষাগার শূন্য করে ফেলেছে। দেশের অর্থ, সোনা দানা সব উধাও করে দিয়েছে।’
‘আমার ধারণা, এটাও ষড়যন্ত্রকারীদেরই কাজ। তারা দেশকে দেউলিয়া করে ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য করবে খৃস্টানদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিতে।’
‘ইয়াজউদ্দিন নিজের গদি রক্ষার জন্য যে যা চাচ্ছে, তাই দিয়ে দিচ্ছেন।’
‘এতে প্রমাণিত হয়, ইয়াজউদ্দিন এক দুর্বল ও অযোগ্য শাসক।’ শামসুন নেছা বললো।
‘তুমি ঠিকই বলেছো। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, তিনি গদি আঁকড়ে থাকতে চান। যে কোন মূল্যে গদি ধরে রাখার জন্যই তিনি এভাবে বেহিসাবী খরচ করছেন।’
আমের বিন উসমান আরো বললো, ‘আমি তাঁর যে বক্তব্য শুনেছি তাতে বলতে পারি, তিনি তাঁর গদী টিকিয়ে রাখার জন্য খৃস্টানদের সঙ্গে মিতালী করতে মোটেই দ্বিধা করবেন না। আমি এখন থেকে তাঁর ও তাঁর সভাসদবর্গের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো এবং তোমাকেও সে কথা বিস্তারিত জানাবো।’
‘এ কথা কিন্তু সব সময় খেয়াল রাখবে, এ মহল ও তাঁর আশেপাশে খৃস্টানদের গোয়েন্দারা সারাক্ষণ তৎপর আছে।’
শামসুন নেছা বললো, ‘এখানে আমাদের গোয়েন্দারাও নিশ্চয়ই কাজ করছে। কোনদিন তাদের সঙ্গেও তোমার সাক্ষাত হয়ে যেতে পারে।’
শামসুন নেছা একটু হেসে বললো, ‘তোমার সুদানী পরী কি অবস্থায় আছে? সে কি এখনও তোমার সাথে দেখা করে?’
‘হ্যাঁ, সে দেখা করে।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘সে আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। গত পরশু সে দেখা করে কেঁদেই ফেললো। বললো, ‘একবার আমার কামরায় আসো না।’
‘শামছি, আমি অই মেয়েকে বড্ড ভয় পাই। তুমি জানো, তার সৌন্দর্যে জাদু আছে। তার যাদুতে যে একবার পড়েছে সে আর বের হতে পারে না। আমি তাকে এ জন্য ভয় পাই না যে, সে খুব সুন্দরী এবং আমার উপর ভীষণ আকৃষ্ট। সে আমাকে তার জালে আটকে ফেলবে এ ভয়েও ভীত নই আমি।’
‘তাহলে তাকে নিয়ে তোমার কিসের ভয়?’ শামসুন নেছা জানতে চাইল।
‘তাকে নিয়ে ভয় হলো, সে হলবের বাদশাহ ইয়াজউদ্দিনের হেরেমের মূল্যবান হীরা। মহলের ভেতরে সবাই তাকে সুদানী পরী বলে ডাকে।
যদি ইয়াজউদ্দিন বা তাঁর সভাসদরা জেনে যায়, মেয়েটি আমাকে চায়, তবে মেয়েটিকে তারা কিছুই বলবে না। সোজা এসে আমার ঘাড় মটকে ধরবে। আমাকে কারাগারের গোপন কক্ষে রেখে এমন কঠিন শাস্তি দেবে যা শুনলেই তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে।
আবার ওকে যদি আমি সরাসরি নিরাশ করি তবে তাঁর প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে আমাকে। সে আমার চরিত্রের ওপর দোষ দিয়ে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে দ্বিধা করবে না।’
‘সে তো জানে না যে, তুমি আমাকে ভালবাসো এবং আমাদের সাক্ষাতও হচ্ছে?’ শামসুন নেছা জিজ্ঞেস করলো।
‘সে এ কথা জানতে পারলে আমাদের দু’জনের ভাগ্যে কি ঘটবে তা আমি কল্পনাও করতে পারি না।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘এ মেয়ে কতটা হিংস্র আর ক্ষমতাধর তুমি জানো না, এ মেয়ে আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।’
এ মেয়ের নাম উনুশী। খৃস্টানদের উপঢৌকন হিসাবে সে হলবে এলেও সে এক ইহুদী কন্যা। মহলে যখন এ মেয়ে প্রথম আসে তখন আল মালেকুস সালেহ অসুখে পড়ে মারা যায়।
ইয়াজউদ্দিন হলবের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলে সে ইয়াজউদ্দিনের সম্পত্তি হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই এ মেয়ে ইয়াজউদ্দিনকেও কব্জা করে ফেলে।
সে যুগে নিয়ম ছিল, রাজ মহলে শাসকের স্ত্রীদের জন্য পৃথক স্থানে খাস কামরা থাকতো আর অবিবাহিত বাদী দাসীদের জন্য থাকতো আলাদা অন্দর মহল।
খৃস্টান এবং ইহুদীদের মত মুসলমান শাসকদের চরিত্র নষ্ট করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের পাঠিয়ে দিত মুসলিম শাসকদের অন্দরে। তারা মুসলমান শাসক গোষ্ঠীকে ধ্বংসের অতল তলে পৌঁছে দিত।
খৃস্টান এবং ইহুদীরা একই পদ্ধতি অবলম্বন করতো মুসলিম আমীর ওমরা ও সেনাপতিদের চরিত্র নষ্টের জন্যও। তাদের কাছেও সুন্দরী মেয়েদের তারা উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতো।
সে মেয়েদের কাজ ছিল প্রভুকে খুশী করে গোপন তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা যথাসময়ে যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়া।
এক মুসলমানের সাথে অপর মুসলমান আমীরের ঝগড়া বিবাদ বাঁধানো, নিজের মুনীবকে খৃস্টানদের অনুগত বানানোসহ নানা রকম অপকর্মের কৌশল শিক্ষা দিয়ে তাদের পাঠানো হতো মুসলিম এলাকায়।
উনুশী এমনি এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়ে। সে ইয়াজউদ্দিনের মহলের মেহমানদের মদ পান করাতো। সে নিজেও তাদের সাথে মদ পান করতে অভ্যস্ত ছিল।
সে ইয়াজউদ্দিন ছাড়াও হলবের দু’জন বিশিষ্ট সভাসদকে তার রূপের জালে বন্দী করে ফেলেছিল। তারা হলবের ভাগ্যকে ভাঙতেও পারতো, গড়তেও পারতো। তাদের সহায়তায় উনুশী ইয়াজউদ্দিনের চরিত্রই কেবল নয় তার উদ্দেশ্যও কলুষিত করতে সফল হয়েছিল।
মেয়েটির সর্ব শরীরে ছিল পাপের আবেদন। আমের বিন উসমান ইয়াজউদ্দিনের দেহরক্ষী দলের কমান্ডার হওয়ার সুবাদে সব সময় তার কাছাকাছিই থাকতো।
এ যুবকের দৃষ্টি ছিল ঈগল পাখীর মতো সুদূরপ্রসারী, চালচলন ছিল ক্ষিপ্র। উনুশী যখন তাকে দেখল তখনই এ সুদর্শন যুবক তার দৃষ্টিতে আটকে গেলো। সে তাকে পাওয়ার জন্য এবং তাকে নষ্ট করার জন্য পিছু লেগে গেল।
কিন্তু আমের বিন ছিল হুশিয়ার যুবক। শামসুন নেছাকে সে ভালোবাসতো। তাই সব সময় সে উনুশীর নাগালের বাইরে থাকার চেষ্টা করতে লাগলো।
সে ভালমতই জানতো, এই হেরেমের হীরা মুক্তা শুধু তার মনীবদের জন্য। এদের দিকে দৃষ্টি দেয়া আর মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো একই কথা। এদের সাথে কথা বলার বিষয়টিও কেউ লক্ষ্য করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
উনুশী মাঝে মধ্যে আমের বিন উসমানের সাথে সাক্ষাত করে তাকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করতো। আমের নানা অজুহাতে তাকে সরিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করতো।
‘আমি তো শুধু এই মহলের চাকর মাত্র।’ আমের একদিন তাকে বললো, ‘যদি তোমার অন্তরে আমার জন্য ভালবাসা জন্মে থাকে তবে আমার প্রতি দয়া করো ও আমার কাছ থেকে দূরে থাকো।’
‘কে বলেছে তুমি এক চাকর! তুমিই তো এ মহলের সেরা তীর। তুমি বাদশাহর রক্ষীদলের কমান্ডার, তোমার পদমর্যাদাই বা কম কিসে।’
‘তবু তোমার দিকে আমার চোখ তুলে তাকাবারও অধিকার নেই।’
উনুশী তাকে বললো, ‘এক সময় সুযোগ করে আমার কামরায় এসো, অধিকার আমি নিজের হাতেই তোমার কাছে তুলে দেবো।’
এই মেয়ে ইয়াজউদ্দিনকে নানা শলাপরামর্শ দিয়ে তার মাথাটা বিগড়ে দিয়েছিল। মেয়েটি তার মনে প্রচণ্ড ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল সুলতান আইয়ুবী সম্পর্কে।
মেয়েটির প্ররোচনায় ইয়াজউদ্দিনের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, হলবের প্রতি সুলতান আইয়ুবীর নজর পড়েছে। হয়তো শীঘ্রই তিনি হলব অধিকার করে নেবেন।
ইয়াজউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর সাথে প্রকাশ্যে যুদ্ধে জড়াতে ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি তার এক যোগ্য ও সাহসী সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিন কাকবুরীর সঙ্গে এ নিয়ে পরামর্শ করলেন। তিনি তার অন্তরের সাত পর্দার অন্তরালে ঢাকা গোপন রহস্য ও তথ্য তুলে দিলেন কাকবুরীর হাতে।
ইয়াজউদ্দিনের হলবের দায়িত্ব গ্রহণের পর মুশেলের শাসন কাজ চালানোর জন্য তিনি তার ভাই ইমাদউদ্দিনকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। ইমাদউদ্দিন প্রকাশ্যেই সুলতান আইয়ুবীর বিরোধী ছিলেন।
কয়েকদিন পর এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। কার পরামর্শে এবং কিভাবে তা ঘটলো ইতিহাসে তার কোন বিস্তারিত বর্ণনা না থাকলেও এই ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিল। একদিন হঠাৎ করেই পাল্টে গেল হলব ও মুশেলের ক্ষমতার দৃশ্যপট। ইয়াজউদ্দিন গিয়ে মুশেলের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন আর ইমাদউদ্দিন হলবে এসে হলবের শাসনকর্তা সেজে বসলেন।
রাজ্য ও শাসন ক্ষমতার এই রদবদলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে একটা ধাঁধাঁর সৃষ্টি করলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই পরিবর্তনের ব্যাপারে ভিন্ন মতামত ব্যক্ত করলেও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে এর কোন কারণ দর্শাতে পারেননি।
ইয়াজউদ্দিন হলব থেকে মুশেলের কেল্লার দিকে রওনা হলে সঙ্গে তার বিবি রাজিয়া খাতুন এবং তার কন্যা শামসুন নেছাও যাত্রা করল। ইয়াজউদ্দিনের সঙ্গে এই মুশেল যাত্রায় আরো রওনা হলো তার রক্ষিতা রমনী এবং তার একান্ত নিজস্ব বিশ্বস্ত রক্ষীদল ও সে দলের কমান্ডার আমের বিন উসমান।
এ ছিল এক বিরাট কাফেলা। অনেকগুলো উটের পিঠে পালকির মত হাওদা বসানো। সে হাওদা পর্দা দিয়ে ঢাকা। তাতেই বসেছে নারীরা।
রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছার উট সবার আগে। রাজিয়া খাতুনের দাসীও আছে তাদের সঙ্গে।
এক স্থানে গিয়ে রাতের মত বিশ্রামের জন্য থামলো কাফেলা। ইয়াজউদ্দিন রাজিয়া খাতুনকে বললেন, ‘তোমরা বিশ্রাম নাও। আমাকে একটু সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের নিয়ে বসতে হবে।’
ইয়াজউদ্দিনের উপদেষ্টারা বলল, ‘আপনার খুব তাড়াতাড়ি মুশেল পৌঁছা দরকার।’
‘আমিও এ কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।’
সেনাপতি বলল। ‘এত লটবহর ও মহিলাদের নিয়ে কাফেলা দ্রুত ছুটানো সম্ভব নয়। সৈন্যদের একটা দল নিয়ে আপনি বরং আগে চলে যান।’
এ প্রস্তাব সবারই মনপূত হলো। একজন আমীরকে দলনেতা নিয়োগ করে তিনি কাফেলা ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে গেল একদল সৈন্য ও দু’তিন জন উপদেষ্টা।
তিনি রাতে বিশ্রাম না নিয়ে সফর অব্যাহত রাখলেন। বাকীরা রাতের মত তাঁবু টানিয়ে নিল।
আমের বিন উসমানকে রাখা হলো কাফেলার সাথে। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ব্যবস্থা হলো।
রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছার তাঁবু হেরেমের দাসী বাদীদের তাঁবু থেকে সামান্য দূরে স্থাপন করা হলো। এটা ইয়াজুদ্দিনেরই নির্দেশ ছিল। তিনি হুকুম জারী করে বলেছিলেন, ‘রাজিয়া খাতুনের মর্যাদার দিকে খেয়াল রেখো। ওদেরকে দাসী বাদীদের থেকে দূরে রাখবে।’
এলাকাটা ছিল শস্য শ্যামল এক পার্বত্য উপত্যকা। রাতে আমের বিন উসমান মশালের আলোয় তার গার্ড বাহিনী নিয়ে তাঁবুর চারদিকে পাহারা বসালো।
সময়টা ছিল শান্তিপূর্ণ। কোন যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল না, কোন ভয়েরও আশংকা ছিল না।
সুলতান আইয়ুবী তখন মিশরে। খৃস্টান বাহিনীও সেখান থেকে বহু দূরে বসে সুলতান আইয়ুবীর পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়েছিল। তবুও আমেরের দায়িত্ব ছিল, ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য টহলের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে মরু ডাকাত বা হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে কাফেলাকে সুরক্ষা করা।
আমের ও তার বাহিনী তাঁবুর চারপাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমের ডিউটি দিচ্ছিল হেরেমের দাসীদের তাঁবুর পাশে। ওখানে তখন সে একাই ডিউটি দিচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে সে তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল। জায়গাটা আলো-আঁধারীর কারণে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
আমের বিন উসমান তাকালো পাহাড়ের দিকে। মনে হলো পাহাড়ের কাছে এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
সে আরেকটু এগিয়ে গেল। ছায়ামূর্তি এবং সে কাছাকাছি হলো। ‘কে তুমি?’ আমের বিন উসমান ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘আমি তোমাকে অন্ধকারেও এতদূর থেকে চিনতে পেরেছি, আর তুমি কাছে এসেও আমাকে চিনতে পারছো না?’ উনুশীর কণ্ঠস্বর।
আমের বিন উসমান তার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে বলল, ‘উনুশী! তুমি এত রাতে এখানে কি করছো? যাও, তাঁবুতে ফিরে যাও।’
‘আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি জানতাম ডিউটি দিতে দিতে তুমি এদিকে একবার আসবেই। সে আশাতেই অপেক্ষা করছিলাম আমি। এত তাড়া কিসের? চলো পাহাড়ের খাঁজে গিয়ে একটু বসি।’
‘না উনুশী, এখন আমি ডিউটিতে ব্যস্ত। ডিউটি ফেলে গল্প করার মত সময় আমার নেই। তুমি তাঁবুতে ফিরে যাও।’
‘ডিউটি দিতে তোমাকে কেউ নিষেধ করেনি। এখানে এই মরুভূমিতে তোমাকে কেউ কামড়াতে আসবে না সবাই ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। এসো আমরা গল্প করি।’
‘কি বলছো তুমি! আমার এখন অনেক কাজ। বিশাল এলাকা জুড়ে ক্যাম্প। দূরে পশুর পাল। সর্বত্র আমাকে টহল দিয়ে বেড়াতে হবে। সবাই ঠিকঠাক মত ডিউটি করছে কিনা দেখতে হবে। এখন তো আমি বসতে পারবো না।’
উনুশী তার ঘোড়ার সামনে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে নিয়ে বললো, ‘অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে এস আমের, যার ভয় ছিল তিনি ত মুসেল চলে গেছেন। এখন আর ভয় কি, নেমে এসো বলছি।’
উনুশীর কণ্ঠ অনুনয় নয়, আদেশের সুর। আমের অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামলো। উনুশী তার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাকে এক পাথরের ওপর বসিয়ে দেল। আমের পোষমানা বিড়ালের মত কোন বাঁধা ছাড়াই তার ইশারা মেনে নিল।
‘আমের!’ আবেগ মাখা স্বরে উনুশী বললো, ‘তুমি আমাকে পাপিষ্ঠা ও শয়তান মেয়ে মনে করে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াও। আমি জানি, তুমি আমার সম্পর্কে ভালমতই জানো।
আমি এও জানি, তুমি নিজেকে দরবেশ ও পবিত্র মনে করো আর তোমার যৌবন ও আকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠব নিয়ে গর্ববোধ করে। কিন্তু তুমি এখনও সেই আসল সত্যটি উপলদ্ধি করতে পারছো না, যা তোমার জানা দরকার।
একদিন তোমার এই সুন্দর দেহ রক্তে রঞ্জিত লাশ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকবে।
কারণ এখন সময়টা হচ্ছে যুদ্ধের। এখন সময়টা হচ্ছে, মানুষকে মারার ও মরার। কেবল যুদ্ধের ময়দান নয়, কেল্লা বা মহলের মধ্যেও চলছে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র। এই গোপন ষড়যন্ত্র কখন কাকে উঠিয়ে নেবে দুনিয়া থেকে কেউ জানে না। তুমি যে কখনো এমন হামলার শিকার হবে না তার নিশ্চয়তা কি? তাই বলছি, তোমার পৌরুষ ও সৌন্দর্য নিয়ে বড়াই করো না।’
‘তুমি কি আমাকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছ?’
‘না, তা নয়।’ উনুশী উত্তর দিল, ‘আমি তোমাকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করছি যে, যদি তোমার ধারণা হয়, আমি তোমার সৌন্দর্য ও সুঠাম দেহ দেখে পাগল হয়ে গেছি, তবে সে ধারণা মন থেকে মুছে দাও।
দেহপসারিনীর দেহ বিলাসের অভাব হয় না। কিন্তু দেহ বিনোদনই সব কথা নয়। দেহের সাথে মানুষের একটা মনও থাকে। মানুষ যতই নিজেকে পাথর মনে করুক না কেন, মন কোনদিন পাথর হয় না। আত্মা শুকিয়ে যায়, কিন্তু মরে না।
মন ও আত্মাকে সেই ভালবাসাই জীবিত রাখে, যে ভালবাসার সঙ্গে দেহের কোন সম্পর্ক নেই। আমাকে আরও গভীরভাবে দেখো। আমার শরীরের সৌন্দর্য ও যাদু লক্ষ্য করো।
আমি এতই রূপসী যে, লোকেরা আমাকে শাহজাদী না বলে পরী বলে। তোমার বাদশাহ ও আমীররা আমার পদতলে এসে তাদের ঈমান বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু আমি এমন এক পিপাসায় মরছি, যে পিপাসা আমি আজও মিটাতে পারিনি। তোমাকে দেখে আমার এত ভাল লেগে গেল যে, আমি তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য অধীর হয়ে উঠলাম।
স্বীকার করছি, আমি যখন প্রথম বার তোমার কাছে এসেছিলাম, আমার নিয়ত পাক ছিল না। তুমি যখন আমাকে প্রত্যাখান করে মিষ্টি ভাষায় আমাকে বুঝিয়ে দূরে সরে গেলে, তখনই আমার মনে আবার সেই পিপাসা জেগে উঠল। আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমার পিপাসাটা আসলে কিসের এবং সে পিপাসা সেই থেকে আমাকে পেরেশান করে তুলেছে।
মন থেকে আমি তোমাকে গভীর ভালবেসে ফেলেছি। এর পেছনে তোমার সৌন্দর্য বা দেহ সৌষ্ঠব নয়, কাজ করেছে তোমার চরিত্র ও ভদ্রতার আকর্ষণ। এই আকর্ষণের প্রভাবই আমাকে অন্যদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছে।
যারা আমাকে বিলাসিতা ও বিনোদনের খেলনা বানিয়েছে আমি তাদের ঈমান ছিনিয়ে নিয়েছি। তারা আমার হাতে তাদের জাতীয় গৌরব সঁপে দিয়ে আমার কাছ থেকে লুফে নিয়েছে শরাবের পিয়ালা।
আমি সেই পিয়ালায় ডুবিয়ে দিয়েছি তাদের নীতি নৈতিকতা। কিন্তু তোমাকে আমি সেভাবে চাইনি। তোমাকে ভেবেছি, পথশ্রান্ত মুসাফিরের সামনে সতেজ মরুদ্যানের মত। আমের, তুমি আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।’
সে আবেগে আপ্লুত হয়ে নিজেকে উজাড় করে নিবেদন করছিল আমেরের কাছে। আমের বিন উসমান উৎকট মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে তার কথা শুনছিল আর মনে মনে ভাবছিল, ‘হায়, যদি কেউ দেখে ফেলে! এ মেয়ে তো আমাকে খুন করে ফেলবে!’
আবার অন্য ভয়ও তাড়া করছিল তাকে। যদি শামসুন নেছা তাকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে এসে পড়ে তবে তো তার ভালবাসাও শহীদ হয়ে যাবে।
এসব ভাবনা তাকে এতটাই অস্থির করে তুলছিল যা, সে উনুশীর বক্তব্য শুনছিল ঠিকই, কিন্তু গভীর রাতে নির্জন প্রান্তরে এক সুন্দরী মেয়ের আবেগ ভরা কথা তার কানে ঢুকলেও মনে কোনই প্রভাব ফেলতে পারছিল না।
‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’ অস্পষ্ট আলোয় আমেরের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল উনুশী, ‘তুমি চুপ করে আছো কেন? কথা বলো। বলো, তোমার কি মন বলে কিছু নেই?’
উনুশী তার গাল দু’হাতে চেপে ধরে বললো, ‘যদি আমার মন মরে না গিয়ে থাকে তবে আমি মানতেই পারি না, তোমার মন মরে গিয়েছে।’
আমের কোন কথা বলছিল না, সে নিশ্চল পাথরের মত বসেছিল। উনুশীর আহবানে সে সাড়াও দিতে পারছিল না, সরেও যেতে পারছিল না।
উনুশী তার রেশম কোমল সৌরভমাখা নরম চুলের গোছা পেছনে সরিয়ে আমেরের বুকে মাথা রেখে বলল, ‘নিষ্ঠুর হয়ো না আমের, আমাকে ফিরিয়ে দিও না।’
সে আমেরের বুক থেকে মাথা তুলে আমেরের গাল মুখ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘কি ভাবছো আমের? তুমি কি আমার কোন কথারই জবাব দেবে না?’
শত হলেও আমের এক যুবক। এমন নির্জন প্রান্তরে আগুনের মত টকটকে আর মাখনের মত নরম এক যুবতীর স্পর্শে তার সমগ্র সত্ত্বায় শুরু হলো ভীষণ তোলপাড়।
উনুশী একটু হাসলো। তার সে হাসিতে ছিল সুরের অপূর্ব মূর্চ্ছনা। সে হেসে বললো, ‘তোমার মন সতেজ ও সজীব আছে। আমি টের পাচ্ছি তোমার মন ভীষণ ধড়ফড় করছে। আমের, আমি তোমার কাছে কি চাই? কিছুই না। তুমি আমার কাছে চাও। হীরা, মানিক, মুক্তা ও স্বর্ণের টুকরো, বলো কি চাও তুমি?’
‘সুদানী পরী, তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না।’
এতক্ষণে মুখ খুলল আমের। বলল, ‘এবার আমাকে যেতে দাও, আমাকে আমার ডিউটি পালন করতে দাও।’
‘আমাকে শুধু উনুশী বলো।’ মেয়েটি বললো, ‘সুদানী পরী বলার লোকেরা ভালবাসা জানে না। তারা পাপী! তুমি তাদের চেয়ে অনেক মহান, অনেক উঁচুদরের লোক। তুমি আমার সমস্ত সহায় সম্পদ নিয়ে নাও, তার বিনিময়ে শুধু একটু পবিত্র ভালবাসা দাও।’
সে কথা বলতে বলতে তার গাল আমেরের গালের কাছে নিয়ে গেল। আমের চমকে পিছনে সরে গেল। তার মনে হলো, সে ভয়ংকর কোন ফনা তোলা সাপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পালাতে গেলেও ছোবল খেতে হবে, দাঁড়িয়ে থাকলেও রেহাই নেই।
‘মনে হচ্ছে তোমার অন্তর আগেই অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিয়েছো?’
উনুশীর স্বর পাল্টে গেল। সেখানে ক্রোধ ও ক্ষোভের উত্তাপ, ‘কে সেই ভাগ্যবতী! কার পায়ের তোলে নিজেকে সঁপে দিয়ে দেউলিয়া বলে গেছো তুমি? কার জন্য তোমার সব ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছো?’
আমের এবার ভয়ে কাঁপতে লাগল। তার মুখ শুকিয়ে গেল। গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না।
উনুশী তাকে ছেড়ে দিয়ে হিসহিস করে বলল, ‘আমার যাদুর ফাঁদে পড়ে কেউ তোমার মত এমন করে ছটফট ও অনুতাপ করেনি। তুমি কেমন করে রক্ষীদলের কমান্ডার হলে? পুরুষ মানুষ এমন ভীতুর ডিম হয় আমার জানা ছিল না।
কাউকে যদি ভালই বাসো মুখ ফুটে তার নামটা বলার বলতে দোষ কি? আর আমাকে যদি তোমার ভাল না লাগে সেটা সাহস করে বললেই পারো! তুমি আমাকে ভালবাস না এ কথাটা বলার সাহসও নেই তোমার?’
আমের উপলদ্ধি করলো তার কিছু বলা দরকার। কিন্তু কি বলবে ভেবে পেল না। উনুশীই মুখ খুলল আবার।
সে রাগে দাঁত কটমট করে বললো, ‘তোমার এতটুকু অনুভূতি নেই যে, তুমি কাকে প্রত্যাখান করলে। তোমার চোখে এক পাপিষ্ঠা মেয়ে তোমার কাছে ভালবাসা ভিক্ষা চাচ্ছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারতো, সে গোনাহ থেকে তওবা করে তোমার এক আল্লাহর পূজারী হয়ে যেতে পারতো।
অরে হতভাগা! তুই একটুও চিন্তা করলি না তুই কোন মেয়েকে নিরাশ করলি। যে মেয়ে তোর সরকারের গদীই উলটে দিয়েছে। যে মেয়ে ভাইয়ের হাতে ভাইকে হত্যা করায়, তুই তাকেই নিরাশ করলি! সেই তুলনায় তুই তো আমার কাছে একটা কীট পতঙ্গের বেশী কিছু না।’
‘তবে তুমি আমাকে তোমার পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলো।’ আমের বললো, ‘আমি তো বার বার বলেছি, আমি তোমার যোগ্য নই।’ সে উঠে দাঁড়ালো।
‘আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না আমের।’ উনুশী আবার তার স্বর পাল্টে ফেলল। আমেরের হাত দুটি আঁকড়ে ধরে বললো, ‘শুধু এইটুকু দয়া করো, তুমি আরো কিছুক্ষণ আমার কাছে বসে থাকো। আমাকে তোমার আশ্রয়ে নিয়ে নাও।’
আমের তার এ আবেদনে সাড়া না দিয়ে জলদি সরে গিয়ে তার ঘোড়ার কাছে পৌঁছে গেল। উনুশী ছুটে গিয়ে তার পথ আগলাতে চাইল, কিন্তু আমের তার তোয়াক্কা না করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে একদিকে ঘোড়া চালিয়ে দিল।
আমের বিন উসমানের ঘোড়া সরে গেল সেখান থেকে। ঘোড়া চলছিল ধীরে ধীরে। আমের মাথা নত করে বসেছিল ঘোড়ার পিঠে। তার নাকে তখনো উনুশীর চুলের ঘ্রাণ লেগেছিল। গালের উপর অনুভব করছিল উনুশীর হাতের নরম ছোঁয়া। তার মাদকতাময় কণ্ঠের ধ্বনি সুর লহরী তুলে বাজছিল কানে।
আমের বিন উসমান এই মোহন ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। সে অনুভব করছিল, যদি উনুশী এভাবে তার সাথে আরেকবার নির্জন অন্ধকারে সাক্ষাত করতে পারে, তবে তার প্রতিজ্ঞা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
সে তার চিন্তার গতি শামসুন নেছার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সন্ধ্যায় তাঁবু টানানোর সময় শামসুন নেছার সাথে তার সাক্ষাতের কথা স্মরণ হলো তার। সেই সাক্ষাতের সময়ই তারা রাতে কখন কোথায় মিলিত হবে ঠিক করে নিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি সেদিকে তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ধরলো।
এ সময় সে আবার উনুশীর ডাক শুনতে পেল। সে ফিরে পিছনে তাকালো, কিন্তু অন্ধকারে সে উনুশীকে দেখতে পেল না। সে এক টিলার পাশ ঘুরে সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছলো, যেখানে শামসুন নেছার আসার কথা।
আমের যেমন ভাবে উনুশীর ছায়া দেখেছিল ঠিক তেমনি সে শামসুন নেছার ছায়াও দেখতে পেলো। তার ঘোড়া সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কাছাকাছি গিয়ে আমের ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলো।
‘এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?’ শামসুন নেছা উদগ্রীব কণ্ঠে তাকে বললো, ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আমার কাজ তো তুমি জানোই।’ আমের মিথ্যা বললো, ‘ডিউটি সাজাতে গিয়ে পথে পথে নামতে হলো, সে জন্য দেরী হয়ে গেছে।’
‘নিজের লোকদের কথাও মনে রেখো।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তাড়া সবাই খুব সতর্ক। তাদের ওপর আস্থা রাখলে তোমার কাজ সহজ হবে।’
শামসুন নেছা সেই লোকদের কথা বলছিল, যারা হলবে সুলতান আইয়ুবী ও রাজিয়া খাতুনের হয়ে গোয়েন্দাগিরি ও তথ্যানুসন্ধানের কাজ করছে। এদের মধ্যে মহলের চাকর বাকরও আছে। তারাও এই কাফেলার সাথে যাচ্ছে। আরও কিছু লোককে সঙ্গে আনা হয়েছে যারা দিন মজুরের কাজ করতো।
তাদের আনা হয়েছে তাঁবু খাটানো, গুটানো ও অন্যান্য কাজের জন্য। তাদের সঙ্গে ওয়াদা করা হয়েছে, মুশেলে পৌঁছে তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। রাজিয়া খাতুনের দাসী এসব মজুর সংগ্রহ করে দিয়েছে। শামসুন নেছা এবং আমের বিন উসমানও দেখেছে তাদের।
একটা পাথর দেখিয়ে আমের বলল, ‘এসো, এখানে বসি।’
শামসুন নেছা তার হাত ধরল। আমের তার কোমর বেষ্টন করে পা বাড়াল পাথরের দিকে।
কোমর বেষ্টন করার কারণে দু’জন একেবারে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো।
এক কদম সামনে এগিয়েই শামসুন নেছা থেমে গেল। সে তার নাক আমেরের বুকে লাগিয়ে শুকলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছেড়ে দিয়ে দু’কদম দূরে গিয়ে বললো, ‘সত্যি করে বলতো, তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? কার কাছে ছিলে?’
‘ডিউটি ভাগ করে একটু পশুগুলোকে দেখে এলাম।’ আমের আবারও মিথ্যা বলল।
‘তোমাদের পশুগুলোও এখন সুগন্ধি মাখতে শুরু করেছে নাকি?’
শামসুন নেছা তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে চাপা রাগের সাথে বলতে লাগলো, ‘তুমি তো কোনদিন সুগন্ধি ব্যবহার করো না! আর এ সুগন্ধ কোন পুরুষের শরীরের নয়, মেয়ে মানুষের।’
আমের নিরব হয়ে গেল। বুঝতে পারল, এভাবে মিথ্যে বলা ঠিক হয়নি তার। এখন সত্য কথাও শামসুন নেছার কাছে মিথ্যাই মনে হবে। একবার বিশ্বাস হারালে সেই আস্থা ও বিশ্বাস আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
শামসুন নেছার কাছে সত্য গোপন করার পরিবর্তে ঘটনা খুলে বলার জন্য সে বললো, ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমার কাছে মিথ্যে বলতে চাইনি। কিন্তু ভাবলাম, সব কথা তোমাকে শুনিয়ে লাভ কি? তাই একটি ঘটনা তোমাকে বলা হয়নি।’
‘বুঝতে পারছি, তুমি অই সুন্দরী ডাইনীর পাল্লায় পড়েছিলে। তাহলে তুমিও শেষে ওই ডাইনীর ফাঁদে পা দিলে?’
‘না শামছি, বিশ্বাস করো এখনও তেমন কিছু ঘটেনি।’
আমের বললো, ‘আমি আসার পথে সে আমাকে রাস্তায় আটকে দিল। আমি সে কথা তোমাকে জানাতে চাচ্ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু এ নিয়ে তোমার সন্দেহ করা উচিত নয়। আমি এত নির্বোধ নই যে তার ফাঁদে পড়বো। স্বীকার করছি, তুমি আমার বুকে যে সুগন্ধির ঘ্রাণ পেয়েছো সে ঘ্রাণ তারই। কিন্তু এতেই যে আমি তার হয়ে গেছি এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই।’
‘বাহ! কি চমৎকার কথা! তুমি কোনদিন আমার কাছে মিথ্যে বলবে, ভাবিনি। অথচ এক ডাইনীর শরীরের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে বলছো তুমি আমার হওনি। তাহলে সে তোমার বুকের নাগাল পেল কেমন করে?’
আমেরের বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল। সে ভয়ের ভাব বুকে নিয়েই বলল, ‘আমি খুবই অস্থির আছি শামছি। আমাকে একটু শান্ত হতে দাও, সব তোমাকে খুলে বলবো। আমি কোন শাসক, আমীর বা সেনাপতি নই; সামান্য চাকরিজীবী মাত্র।
উনুশী আমাকে সহজেই তার প্রতিশোধের টার্গেট বানাতে পারে। আমি যে অবস্থায় তার হাত ফসকে বেরিয়ে এসেছি, তা সে সহজভাবে মেনে নাও নিতে পারে। বিশ্বাস করো, আমার খুব ভয় করছে।’
আমেরের কথার চেয়েও তার কণ্ঠস্বরে প্রভাবিত হয়ে শামসুন নেছা বললো, ‘মনে হচ্ছে আজ সে তোমাকে একটু বেশীই বিরক্ত করেছে?’
‘অনেক বেশী।’ আমের বিন উসমান উত্তর দিল, ‘আজ সে আমার কাছে তার হৃদয় উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। সে এ পর্যন্ত বলেছে, সে গোনাহগার ও বদকার মেয়ে হলেও আমার সাহচর্য পেলে সে ভাল হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি তাকে প্রত্যাখান করায় সে আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেছে। আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, সে যেখানে সরকার পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, ভাইকে দিয়ে খুন করাতে পারে সেখানে আমি এক কীট-পতঙ্গের বেশী কিছু নই।
আমি যখন তাকে ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে আসি তখনো সে আমার পিছু পিছু ছুটছিল আর আমাকে ডাকছিল। আমার খুব ভয় করছে শামছি!’
‘শান্ত হও! এত উতলা হলে বিপদ বাড়া ছাড়া কমবে না। সে যখন এত করেই তোমার ভালবাসা চাচ্ছে তখন কিছু ভালবাসা না হয় তাকে দিলেই!’
‘কি বলছো তুমি! সে তার যত ধন রত্ন সব আমার পদতলে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে আমার কাছে পবিত্র ভালবাসা চায়। কিন্তু জীবন গেলেও আমি তোমাকে ধোঁকা দিতে পারবো না, শামছি!’
‘তবে তুমি তাকেই ধোঁকা দাও। ভালবাসার ধোঁকা।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তাকে সে ভালবাসা দাও যে ভালবাসা সে চায়। তার বিনিময়ে তুমি তার কাছ থেকে জেনে নাও সেই গোপন তথ্য, যা আমাদের দরকার।
সে তো তার ক্ষমতার কথা তোমাকে বলেই দিয়েছে। এখন সে ক্ষমতা তুমি তোমার স্বার্থে ব্যবহার করার ফন্দি বের করো। তুমি তো আর কোন আনাড়ি ব্যক্তি নও, তুমি এক সতর্ক সৈনিক। ব্যাপারটা কি করে সামাল দিবে ভাল করে চিন্তা করো। তার কাছ থেকে জেনে নাও তাদের ভেতরের খবর। তারপর সে খবর আমাকে জানাও।’
শামসুন নেছার কোথায় দৃষ্টিভঙ্গির নতুন দিগন্ত খুলে গেল আমের বিন উসমানের। বলল, ‘আমি তো এভাবে চিন্তা করিনি!’
‘এবার করো।’
‘আমি তো আরো ভয় পাচ্ছিলাম তুমি আমকে ভুল বুঝে বুঝবে।’
‘আমি তোমার ও আমার ভালবাসাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিয়েছি।’
শামসুন নেছা বললো, ‘মা আমাকে প্রতিদিন যে কথা বলেছেন, সে কথা আমার অন্তরে গেঁথে গেছে। আমার ভালবাসার মৃত্যু নেই। মায়ের আশা সফল করার জন্য সব রকম কোরবানীর জন্য প্রস্তুত হতে হবে আমাদের।
প্রথমে আল্লাহ ও পরে আমার কাছে শপথের কথা স্মরণ রাখবে, তখন আর কোন ভুল হবে না। সে কি জেনে গেছে, তুমি আমার সাথে দেখা করো?’
‘না।’ আমের বললো, ‘আমি এ ব্যাপারে তাকে কিছুই বলিনি।’
‘একটা কাজের কথা শোনো।’ শামসুন নেছা বললো, ‘হলবের থেকে বিদায় নেবার কিছুক্ষণ আগে কায়রো থেকে এক লোক এসেছে। সে জানতে চায়, ইয়াজউদ্দিনের নিয়ত কি আর খৃস্টানদের পরিকল্পনাই বা কি। তাকে সঠিক কোন উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খুব শীঘ্রই কায়রো থেকে অভিযানে বের হবেন। সে লোক বলেছে, সুলতান আইয়ুবী এ জন্য আগেই অভিযান চালাতে বাধ্য হচ্ছেন যে, খৃস্টান বাহিনী মুশের, হলব ও দামেশকের দিকে অগ্রসর হলে কায়রো থেকে সৈন্য সঠিক সময়ে এসে পৌঁছতে পারবে না।
এখানে ভয় হলো, সুলতান আইয়ুবী তার সেনাবাহিনীকে এদিকে পাঠালেন, আর খৃস্টানদের চাল অন্য রকম হলো, তখন তাঁর সেনাবাহিনীকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আমাদেরকে অতি সত্বর জানতে হবে, গাদ্দার মুসলিম শাসকদের স্বপ্ন কি আর খৃস্টানদের সংকল্পই বা কি?’
‘আমি শুনেছি, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা আকাশের খবরও নিতে পারে।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘কেন, খৃস্টানদের এলাকায় কি তাঁর কোন গোয়েন্দা নেই?’
‘মা আমাকে যা বললেন, তাতে তিনি এ কথাই বললেন এ, ইসহাক তুর্কী নামে এক যোগ্য ও সুচতুর গোয়েন্দা আছে।’ শামসুন নেছা বললো, ‘সে বৈরুত গিয়েছিল। সঠিক খবর তারই দেয়ার কথা। কিন্তু তার কাছ থেকে কোন সংবাদ এ পর্যন্ত কায়রো পৌঁছেনি। ফলে সুলতান অন্ধকারে পড়ে গেছেন।
দেখো আমের, সৈন্যদের তৎপরতা ও আনাগোনা শুরু হলে সে খবর আর গোপন থাকে না, জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু এখানে তেমন কোন চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না। ফলে ধরে নিতে পারো, গোপন পরিকল্পনা ও তথ্য যা আছে তা সবই ইয়াজউদ্দিন ও ইমাদউদ্দিনের মনের খাতায় লেখা। এসব উদ্ধার করা ভেতরের লোকের পক্ষেই সম্ভব। আর এ গোপন সংবাদ তোমাকে উনুশীই দিতে পারে।’
‘কিন্তু সে যে মূল্য চায় সে মূল্য তো আমি তাকে দিতে পারবো না।’ আমের বললো।
‘তোমাকে এ মূল্য দিতেই হবে।’ শামসুন নেছা বললো, ‘এর জন্য যে কোন মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত। আমি আমার ভাইয়ের গোনাহের কাফফারা দিতে চাই। মুসলিম মিল্লাতের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমার অন্তরের ভালবাসা এবং জীবনের সব আশা আকাংখাও কোরবান করতে প্রস্তুত আমি। আমাদেরকে সেইসব শহীদদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যারা ইসলামের জন্য তাদের যুবতী স্ত্রীদের বিধবা করে গেছে। আমের! আর কিছু চিন্তা করো না। সবকিছু কোরবানী দাও। আমি যা বলছি তাই করো।’
রাত গভীর হয়ে এসেছিল। উনুশীর ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর সংকল্প নিয়ে ওরা তাঁবুর দিকে হাঁটা ধরল।
সমাপ্ত
Leave a Reply