ক্রীতদাসের হাসি – শওকত ওসমান
ক্রীতদাসের হাসি – শওকত ওসমান
‘ক্রীতদাসের হাসি’ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার এক দৈবী ব্যাপার।
মৌলানা জালাল, মাসুদ সহ, আমরা তিনজনে ছুটি কাটাতে বেরিয়েছিলাম। নেহায়েৎ নিরুদ্দেশের পাড়ি। কিন্তু নানা দুর্বিপাকে এসে পৌঁছলাম এক অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে, আমারই এক সহপাঠিনীর বাড়িতে, নাম রউফন নেসা। খুব ভাল ছাত্রী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের আর এক সেরা ছাত্র তাকে দাগা দিয়ে গিয়েছিল, তার খুঁটিনাটি হদিস আমার জানা আছে। ডিগ্রীর উচ্চতা দিয়ে কত মেয়ে যে প্রতারিত হয়, তার উদাহরণ রফউন। ছাত্রটা পরে এক ঠিকাদারের মেয়েকে বিয়ে করেছিল আট আনা রাজত্ব সহ।
দশ বছর আর রউফনের কোন খোঁজ রাখি নি। হঠাৎ অকুস্থলে পৌঁছে জানা গেল, সে গ্রামে এক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে, সে-ই প্রধান শিক্ষয়িত্রী। সংসারে একমাত্র অবলম্বন পিতামহ শাহ ফরিদউদ্দীন জৌনপুরী। নব্বই বছর বয়স। এখন আর চোখে দেখেন না। কানে ঠিকমত শোনেন না। কানের কাছে মুখ নিয়ে অথবা খুব জোরে কথা বলতে হয়। প্রথম জীবনে তিনি লেখাপড়ার কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন। বর্মাযুদ্ধের সময় লুসাই অঞ্চলে লড়ায়ে যান। পরে গৃহত্যাগ করে যান বিহার-যুক্ত প্রদেশ এলাকায়। ফিরে আসেন আবী-ফার্সির বিরাট মৌলানা-রূপে। বহু সাগরেদ আছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু গত তিরিশ বছর তিনি বাইরের জগতের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ রাখেন না। তাঁর সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিশালা যে-কোন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিরাট সম্পদ।
একদিনের প্রবাস জীবন।
পরদিন সকালে বিদায়। অতিথি আপ্যায়নের ঘটা ছিল বেশী। তাই মৌলানা জালাল রসিকতা করে বলেছিলেন, “রউফন তুমি কী আমাদের সেই ‘সহস্র ও এক রজনী’ বা ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা’র পেটোরোগী বানাতে চাও যে গৃহকর্তা রুটি আনতে গেলে তরকারী খেয়ে বসত আর তরকারী আনতে গেলে রুটি খেয়ে ফেলত।”
তারপর সকলে বেশ তুমুল হাসি হাসছিলাম।
দাদু, শাহ সাহেব, কানে শোনেন না। কিন্তু অত হট্টগোলে সচেতনরউফনকে হাত ইশারায় ডেকেছিলেন।
ফরিদউদ্দীন জৌনপুরীর কানের কাছে রউফন মুখ নিয়ে বলেছিল, “দাদু, ওরা ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা’র গল্প নিয়ে হাসাহাসি করছে।”
দাদু হেসে-হেসে বলেছিলেন, “বন্ধুগণ, ওটা আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা (সহস্র ও এক রাত্রি) নয়। ও কেতাবের পুরা নাম “আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে। সহস্র দুই রাত্রি।”
“দাদু, আমি ইংরেজীর ছাত্র। আমি ত শুনেছি ‘thousand and one night’ সহস্র ও এক রাত্রি।” জবাব মাসুদের।
“ভুল শুনেছ।”
“ভুল?” মাসুদের কণ্ঠস্বরে ঈষৎ চ্যালেঞ্জের ছোঁয়াচ।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভুল। তোমরা ত পড়ো বেঈমান ইংরেজের কেতাব। যাদের গোলাম ছিলে দেড়শ’ বছর। আসল বই ত দ্যাখো নি।”
দাদুর কণ্ঠস্বর তপ্ত। তিনি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। চোখে না দেখলেও, উঠান-ঘর সব তার মুখস্থ। আলমারী খুলে ঠিক তৃতীয় সেফের মাঝখান থেকে একটা জেদ-করা কেতাব বের করলেন।
তারপর একটু অবজ্ঞা-জড়িত সুরেই কেতাবখানা আমাদের টেবিলে ফেলে দিয়ে বলেন, “দোস্তেরা, একবার চোখে দেখে নাও।”
আমরা তিনজনে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। মৌলানা জালাল আরবী জানেন। কিন্তু আমরা ত পড়তে পারি।
বিরাট পাণ্ডুলিপি। ছাপা কেতাব নয়। মলাট খোলর পর দেখা গেল কেতাবের নাম: আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে।
আমরা ত অবাক।
জিজ্ঞেস করল মাসুদ, “দাদু, এ পাণ্ডুলিপি আপনি কোথায় পেলেন?”
দশ মিনিট ধরে তিনি ইতিহাস বলেন। হালাকু খানের বগ্দাদ ধ্বংসের সময় এই পাণ্ডুলিপি আসে হিন্দুস্থানে। নানা হাত-ফেরীর পর পৌঁছায় শাহ্ সুজার কাছে। তিনি আরাকানে পলায়নের সময় পাণ্ডুলিপি মুর্শিদাবাদে এক ওমরাহের কাছে রেখে চলে যান। সেখান থেকে জৌনপুর। ফরিদ উদ্দীন সাহেব জৌনপুর থেকে এটা উদ্ধার করেন।
তিনি বলেন, “নাস্তালিখ অক্ষরে লেখা। অনেকে এটা ঠিকমত পড়তে পারে না। পর্যন্ত।”
জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই তা-হেলে আসল আলেফ লায়লা?
“হ্যাঁ, ভাই।”
আমরা উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলাম। মাসুদ বলে, “দ্যাখেন ত শেষ গল্পটা কি? অর্থাৎ হাজার এক রাত্রির গল্পটা।”
“শাহজাদা হাবিবের কাহিনী।”
“তা-হোলে ঠিক আছে। তারপরের কাহিনীর নাম কি?”
মৌলানা জালাল পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে জবাব দিলেন, “জাহাকুল আব্দ অর্থাৎ গোলামের হাসি।”
আমরা বিস্মিত। কিন্তু মৌলানা জালাল আৰী জানেন, সহজে মেনে নেবেন কেন? তিনি পাতা উল্টে জিজ্ঞেস করলেন, “হুজুর, আলেফ লায়লায় প্রত্যেক গল্প দুনিয়াজাদীর অনুরোধে শাহরেজাদী বলা শুরু করে। এখানে ত তা দেখছি না।”
“ওই কটা পাতা নেই। সংখ্যা দেখো।”
মৌলানা তা মিলিয়ে নিয়ে খুবই অবাক! আমাদের দিকে তাকালেন।
বিশ্বের বিস্ময় এই পাণ্ডুলিপি। আমি প্রস্তাব দিলাম, “দাদু, এটা আমরা কপি করিয়ে নিতে চাই আমাদের লাইব্রেরীর জন্য। তারপর আপনার কপি পাঠিয়ে দেব।”
ঈষৎ কাঠখড় পোড়ানোর পর দাদু রাজী হোয়ে গেলেন। রউফনের মুখে শুনেছিলাম, সাধারণত তিনি এসব কাছছাড়া করেন না। সেদিন আমাদের জন্য তার স্নেহের ঢল নেমেছিল বোঝা যায়।
শুকরিয়া, ধন্যবাদ মৌলানা জালাল, তুমি এখানে আমাদের পথ দেখিয়ে এনেছিলে! এই আবিষ্কার আমাকে পাগল করে তুলেছিল।
আরো দু-দিন হয়ত থাকা যেত, কারণ চতুর্থ দিনে কলেজ খুলছে। কিন্তু আর না। এই রত্নগুহা থেকে আবিষ্কৃত একটি রত্ন পৃথিবীকে না দেখানো পর্যন্ত আমার আর স্বস্তি ছিল না।
সেদিনই বিদায় নিলাম দুপুরের পর। রউফনের মিনতির কোন দাম দিতে পারলাম, দুঃখ।
শা’ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিতে সত্যি কষ্ট হচ্ছিল। তাঁকে ধরে-ধরে আনা হোলো দলিজ পর্যন্ত।
সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে এল রউফন। জীবনের কাছে পরাজয় না-মানা বীরেরই পৌত্রী। সে কিন্তু তার সজল চোখ আজ লুকাতে পারল না। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সেই সেরা ছাত্রটির কাছে প্রত্যাখ্যাত হোয়ে রউফন এমনি চোখেই আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। জীবনকে কিন্তু সে খোয়র হোতে দেয় নি। বীরের পৌত্রী আপ্ত-মানবী।
গাড়িতে উঠে মাথা ঝুঁকিয়ে হাত তুলোম। শ্রদ্ধা স্নেহ মমতা–সব কিছুর পতাকা যেন আমার করতালু।
আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল।
মাথা নীচু করে রউফন সড়ক থেকে বাড়ি অভিমুখে এগোতে লাগল।
.
শহর ফিরেই মৌলানা জালালের সহায়তাআলেফ লায়লা ওয়া লায়লানের শেষ কাহিনীটা বাংলায় তরজমা করে ফেলোম।
বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাঁদের মমতার জন্যেই ত পৃথিবীতে বাঁচা।
.
জাহাফুল আবদ
:
ক্রীতদাসের হাসি
Monitaj
Nice