ক্রিস-ক্রস – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী / প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৮
মিষ্টিদাদু, ঠাম্মা
দাদুভাই, দিদুন
না থেকেও এখনও রয়েছ
শুরুর আগে
“সব শালাকে মেরে দেব, পুঁতে ফেলব। সব শালার পেছনে দিয়ে দেব। আমায় রং দেখাচ্ছ? শুধু ভাষণ, শুধু বাতেলা, না? খালি ঢপবাজি? রাস্তায় মানুষ মরে পড়ে আছে, হুঁশ নেই? শালা, কুকুরেরা বাচ্চা মুখে তুলে পালাচ্ছে, হুঁশ নেই? শুধু সলমন খান আর বিপাশা বসুর জামা-কাপড় দেখলে চলবে? সব শালাকে মেরে দেব। সব শালার গায়ে মুতে দেব। চোখে আঙুল ঢুকিয়ে বের করে আনব গুলি। আঁটো প্যান্টুল পরা মেয়েছেলে দেখলেই তাদের পেছনে চোখ সেঁটে যায়, না? ভাল কিছু করতে পারিস না? অন্ধকে রাস্তা পার করাতে পারিস না? ভিখিরিদের দিতে পারিস না দু’-চার টাকা? শুধু রোল চিবোবে, মাগি নিয়ে ফুর্তি করবে, হাফ-ন্যাংটো মেয়েছেলে দেখলেই ফোনে ফোটো তুলবে? সব শালাকে দেখে নেব। মেরে তক্তা বানিয়ে ছাড়ব। কোনও দিকে হুঁশ নেই? ফারদার যদি এসব খুপচামো করবি তো মাটিতে পুঁতে পিচ করে দেব। বুঝলি?”
বড় ছাতিম গাছটার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, লাল গেস্ট হাউসটার পাশের ছোট্ট সিঁড়িটায় গিয়ে বসল নেড়ু পাগলা। শীতের সকাল সবে আড়মোড়া ভাঙছে কলকাতায়। পাতলা কুয়াশার ওড়না কোনও এক অদৃশ্য হাতের টানে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে চারিপাশ থেকে। তাও সূর্যের যেন তেমন তেজ নেই। যেন তেমন আগ্রহ নেই রোদ পাঠাবার। বরং শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে একটা। নেড়ু পাগলার গায়ের চাদর ভেদ করে একদম হাড় অবধি গিয়ে কড়া নাড়ছে ঠান্ডা। অবশ্য চাদরেরই বা দোষ কী? ফুটো হতে হতে ওটার অবস্থা প্রায় মশারির মতো। তাও, যত দূর সম্ভব সেটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে শরীরের সঙ্গে পেঁচিয়ে বসল নেড়ু পাগলা। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। তৃপ্তির। যাক, ও পেরেছে। আজ সকালের কোটা কমপ্লিট। দিয়েছে ছাতিম গাছের মা-মাসি উদ্ধার করে। ওর সঙ্গে ইয়ারকি? পোষা পিঁপড়ে দিয়ে ওকে কামড় খাওয়ানো! ওরা তো চেনে না কে ও! ও হল… ও হল…! কে ও? কী নাম ওর? রোজ ওর চিন্তাটা এখানে এসেই পথ হারিয়ে ফেলে। পেটের ভেতরে তোলপাড় করে ডুবুরিরা। বুকের ভেতর কে যেন চাপ দিতে থাকে। মনে পড়ি পড়ি করেও ঠিক মনে পড়ে না ওর। কিছুতেই নিজের নামটা মনে পড়ে না ওর। ও খুব চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট কামড়ে, পাজামা খামচে ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করে ও। কিন্তু কিছুতেই পথটা খুঁজে পায় না। শুধু, একটা মাঠ দেখতে পায় এক ঝলক, অনেক পায়রায় ভরা একটা ছাদ দেখতে পায় এক ঝলক, সোনার মোটা মোটা বালা-পরা হাত দেখতে পায়, দেখতে পায় বড় ঝিল, অনেক বই সাজানো ঘরের মধ্যে বসে থাকা একজন মানুষ আর লাল ওয়াটার বটল হাতে দৌড়ে আসা একটা ছোট্ট মেয়েকে। মাথার ভেতরে যন্ত্রণা হয় নেড়ু পাগলার। মনে হয় কে যেন বসে একটা একটা করে শিরা ছিঁড়ছে ওর। ও চোখ খোলে। এরা সব কারা? কাদের দেখে ও? স্পষ্ট করে কিচ্ছু মনে পড়ে না ওর। শুধু কষ্ট হয় একটা। গলায় আটকে থাকা কান্না-না-বেরোনোর মতো কষ্ট।
আজও নিজের নাম মনে করতে সেরকম কষ্ট হল নেড়ু পাগলার। মনে হল একটা রবারের বল যেন আটকে আছে গলার কাছে। তাই ও আর চিন্তা করল না এসব নিয়ে। ও জানে, লাভ নেই। বরং ছাতিম গাছটাকে আজকেও কড়কে দিয়েছে চিন্তা করে ওর ভাল লাগল। রোজ সকালে উঠে এই ভাল লাগাটুকু ও নিজেকে দেয়। দিনের শুরুতে রোজ ছাতিম গাছটাকে বেশ খানিকটা বকাবকি করে ও। ওর সমস্ত খারাপ লাগাগুলোকে উজাড় করে গালাগালি করে, বলে, “নাও, পোষা পিঁপড়ের কামড় খাওয়াও আরও”!
তবে বকাবকির ব্যাপারটা সবটাই খুব ফিসফিস করে হয়। নেড়ু পাগলার চিৎকার চেঁচামেচি ভাল লাগে না বিশেষ। ও সকালে উঠে প্রথম গেস্ট হাউসের পাশের ময়লা ফেলার জায়গায় গিয়ে পেচ্ছাপ করে, তারপর গিয়ে দাঁড়ায় ছাতিম গাছের তলায়। পিঁপড়ের কামড়ের বদলা হিসেবে ও দু’কথা শুনিয়ে দেয় গাছটাকে, তারপর আবার এসে বসে ওর জায়গায়।
পেটের ভেতরে একটা অদ্ভুত মোচড় লাগল নেড়ু পাগলার। খিদে পেয়েছে। এই বকাবকির পরেই খুব খিদে পায় ওর। মনে হয় কে যেন পেটের ভেতরে ঢুকে মাটি কাটছে। আজও তাই মনে হল। সকালের এই সময়টায় খিদে পেলে কোথায় যেতে হয় ও জানে। এই রাস্তা আর বড় রাস্তার সংযোগস্থলে একটা দোকান আছে। ফোন, জেরক্স আরও নানা জিনিসের। সেটা সবচেয়ে তাড়াতাড়ি খুলে যায়। এই সময় ওই দোকানে গেলে ও চা আর পাউরুটি পায়। নুরচাচা দেয়।
নুরচাচার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নেড়ু পাগলা জিজ্ঞেস করল, “চাচা, আজ কত তারিখ বলো তো?”
“চব্বিশ তারিখ। চব্বিশে ডিসেম্বর। কেন রে?”
নেড়ু মাথা চুলকোল। কেন চব্বিশে ডিসেম্বর তা ও জানবে কী করে? ও বলল, “সে আমি কী জানি কেন চব্বিশে ডিসেম্বর? খবরওলাদের জিজ্ঞেস করো।”
নুরচাচা মাথার সাদা উলের টুপিটা টেনে কানের ওপর এনে বললেন, “খবরওলাদের জিজ্ঞেস করব কেন?”
নেড়ু বিরক্ত মুখে বলল, “তুমি জিজ্ঞেস করবে কেন তার আমি কী জানি? আমার টানটু গরম করছ কেন? তবে খবরওলারাই তো সব তারিখ-টারিখ ছাপায়। যত্ত সব ফালতু লোক।”
নুরচাচা হাসলেন, “তোর দেখছি খবরওলাদের ওপর বেজায় রাগ!”
“হবে না?” নেড়ু চোয়াল শক্ত করল, “কী সব ছাপায় বলো তো? মানুষ মরে পড়ে আছে কলকাতার রাস্তায়, কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। কুকুর, বাচ্চা মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। জামাকাপড় খুলে মেয়েছেলে নাচছে আর তাই দেখে আধবুড়ো দামড়াগুলো ফোন দিয়ে ছবি তুলছে। হুঁঃ, আর ছাপাবার জিনিস পায় না? শহরে কি ভাল কিছু হচ্ছে না? মানুষ কি মানুষকে সাহায্য করছে না? ছেলেমেয়েরা কি প্রেমে পড়ছে না? সে সব ছবি ছাপায় না কেন?”
নুরচাচা দোকানের ভেতরে বসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নে রে। হুলো, এটাকে পাউরুটি-চা দে। না হলে বকে আমার মাথার পোকা বের করে দেবে।”
হুলো পাশের বড় ফ্লাস্কের থেকে একটা প্লাস্টিকের কাপে চা ঢেলে আর একটা বড় পাউরুটির টুকরো নিয়ে এসে নেড়ুর হাতে দিল।
নেড়ু চায়ের কাপের মাথাটা সাবধানে ধরে চুমুক দিল একটা। তারপর এক কামড় পাউরুটি খেল।
হুলো জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁগো নেড়ুদা, তুমি কী বললে? প্রেম? তুমি ওসব বোঝো?”
নেড়ু পাউরুটি চিবোতে চিবোতে থেমে গেল। হঠাৎ ওর সামনে ভেসে উঠল সোনার মোটা মোটা বালা-পরা একজোড়া হাত। অনেক বই সাজানো ঘরের মধ্যে বসে থাকা একজন মানুষ।
হুলো আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হল গো? বলো না। তুমি আবার প্রেম-ট্রেম বোঝো নাকি?”
নেড়ু উত্তর না দিয়ে হাতের অর্ধেক খাওয়া পাউরুটিটা ফেলে দিল। তারপর নুরচাচার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আসি গো। রুটিটায় কেমন মেয়েছেলের বুকের গন্ধ। ভাল লাগছে না।”
নুরচাচা একটু অপ্রস্তুত মুখে বললেন, “কী যা তা বলছিস।”
নেড়ু হাসল, বলল, “সত্যিই বলছি। তুমি খেয়ে দেখো। কচি বুকের গন্ধ।”
“আঃ। যা এখন তুই।” নুরচাচা এবার বিরক্ত হলেন। নেড়ু মাথা চুলকে হাসল একটু। তারপর হাঁটা দিল।
নুরচাচা পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন, “অ্যাই, আজ আবার বেশি এদিক ওদিক যাস না। বিকেলের দিকে মিছিল বেরোবে। এতাল-বেতাল ঘুরলে বিপদে পড়বি কিন্তু।”
নেড়ু একবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে হাসল। তারপর হাঁটতে লাগল।
সূর্যও আড়মোড়া ভাঙছে ক্রমশ। পাতিলেবু রঙের রোদ চুঁইয়ে নামছে কলকাতার আকাশ থেকে। নেড়ু আকাশের দিকে নাক তুলে একটু শুঁকল। বেশ পাতিলেবুর গন্ধ পাচ্ছে। মাঝে মাঝে এরকম একটু আধটু গন্ধ পায় নেড়ু। এই যেমন পাউরুটিতে একটু আগে কচি মেয়েদের বুকের গন্ধ পেয়েছিল ও। নুরচাচা মানল না বটে, কিন্তু ও পেয়েছিল।
হাঁটতে হাঁটতে আবার মাথা চুলকোল নেড়ু। ওর মাথাটা মসৃণ গুলির মতো। একটা চুলও নেই। ফলে চুলকোতে গেলে আঙুল পিছলে যায়। তবে শীতের জন্য মাথার থেকে খড়ি উঠছে এখন। চুলকাবার সময় নখের তলায় মরা চামড়া ঢুকে যাচ্ছে।
নেড়ুর এখন পাতালরেল স্টেশনে ঢোকার সিঁড়ির পাশে বসার কথা। এখানটায় রোদ এসে পড়ে এ-সময়। তা ছাড়া স্টেশনে ঢোকার সময় লোকজন একটা-দুটো টাকা ছুড়েও দিয়ে যায় ওকে। যদিও, যা টাকাপয়সা পায় তা বেশির ভাগ দিনই হারিয়ে ফেলে ও। তবু যখন কেউ দেয়, তখন ভাল লাগে ওর। গোল গোল চ্যাপটা চ্যাপটা সব কয়েন। হাতের মুঠোয় ঠান্ডা ধাতু ধরতে খুব ভাল লাগে।
রোদে বসার আগে, একবার দূরে দাঁড়ানো গাড়িটাকে দেখে নিল নেড়ু। চাকা লাগানো, মাথায় ছাউনি দেওয়া একটা ঠেলা গাড়ি। পটেলের ঠেলা। পটেল ধোসা বিক্রি করে। সকাল থেকে রাত, ওর ঠেলা ঘিরে ভিড় হয় খুব। পটেল খুব মন দিয়ে লোককে খাওয়ায়। শুধু লোকজনই নয়, পটেল নেড়ুকেও খাওয়ায়। দুপুরবেলার খাবারটা নেড়ু পটেলের কাছেই পায়।
নেড়ু দেখল পটেল তাওয়া পরিষ্কার করছে মন দিয়ে। ও আশ্বস্ত হল। যাক আজ পটেল এসেছে। আসলে একটা ভয় কাজ করে নেড়ুর। দু’-একবার এমন হয়েছে যে, পটেল দোকান লাগায়নি। সেদিন দুপুরগুলোয় খুব অসুবিধে হয়েছে নেড়ুর। চেয়েচিন্তে খেতে গিয়ে খুব বেগ পেয়েছে ও। তাই প্রতিদিন সকালে এই জায়গায় বসার আগে ও পটেলকে দেখে নেয় একবার। মনে মনে ভরসা পায়।
পাতাল রেলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ফুটপাথে গুটিসুটি হয়ে বসল নেড়ু। রোদের তাপ সামান্য বেড়েছে। মাথার ওপর হালকা গরম স্পর্শ পাচ্ছে। একটু আরাম পেল ও।
ফুটপাথে বসার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার চেহারাটা অন্য রকম হয়ে যায়। প্রথমেই নেড়ুর যেটা নজরে আসে, তা হল, পা। নানা রকমের, নানা ধরনের পা। প্যান্ট পরা, শাড়ি পরা, লুঙ্গি পরা, ধুতি পরা, হাফ প্যান্ট পরা—ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বাচ্চা সব পা। তার পরেই ওর নজরে আসে জুতো। কত ধরনের জুতো!
আজও প্রথমেই ওর পা আর জুতোই নজরে এল। এর মধ্যে একটা জুতো মনে মনে পছন্দও করে ফেলল ও। বেশ লাল আর কালো রঙের গাবদা একটা জুতো। নেড়ু দেখেই বুঝল যে, খুব নরম হবে জুতোটা। ও নিজের পায়ের দিকে তাকাল। ওর পায়েও জুতো আছে। তবে দু’রকমের। একবার ময়লার গাড়ির থেকে ও তুলে নিয়েছিল দুটোকে। এক পাটি রবারের আর অন্য পাটি চামড়ার।
আজ নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল ওর। ইস, ওর যদি এমন একটা গাবদা জুতো থাকত! গাবদা আর নরম! নরম জুতো? আচমকা স্থির হয়ে গেল নেড়ু। হঠাৎ মনে হল ওরও তো নরম জুতো ছিল। আকাশি নীল রঙের খুব নরম এক জোড়া জুতো। কিন্তু কবে ছিল? কোথায় ছিল? ওর ছিল? কে ও?
খুব অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাল নেড়ু। কিচ্ছু মনে পড়ে না কেন ওর? মনে পড়ি পড়ি করেও কিছু মনে পড়ে না কেন? শুধু মাঝে মাঝে একঝলক একটা মাঠ দেখতে পায়, অনেক পায়রায়-ভরা একটা ছাদ দেখতে পায়, সোনার মোটা বালা-পরা হাত দেখতে পায় ও। দেখতে পায় বড় ঝিল, অনেক বই সাজানো ঘরের মধ্যে বসে থাকা একজন মানুষ আর লাল ওয়াটার বটল হাতে দৌড়ে আসা একটা ছোট্ট মেয়ে!
এসব কোন জন্মের স্মৃতি? এইসব মানুষজন কারা? এই কলকাতা শহরে কোত্থেকে এসে পড়ল নেড়ু? নেড়ু— কে ওর এই নামটা দিল? অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাল নেড়ু। অনেক গাড়ি, অনেক মানুষ, অনেক অনেক কোলাহল। কেউ চেনা নয়। কিচ্ছু চেনা নয়। বিরাট মেলার মাঝে ও যেন হারিয়ে যাওয়া এক মানুষ। নেড়ু দেখল দিন গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ।
স্থির হয়ে এই চলন্ত ভিড় দেখতে দেখতে একসময় চোখ বুজে এল নেড়ুর। দেওয়ালের কোনায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল ও। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখল বিশাল বড় একটা দরজা। তার সামনে দিয়ে লাল রাস্তা চলে গেছে। দূরে সাদা টেবিল পাতা রয়েছে ঘাসের ওপর। তার চারিধারে চেয়ার। কারা যেন বসে রয়েছে ওখানে। স্পষ্ট দেখা না গেলেও ওর মধ্যে যে একজন মহিলা রয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই বসে থাকা মানুষগুলোর থেকে আবছা কথা শোনা যাচ্ছে, হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ও এগোতে লাগল লাল ওই পথ ধরে। শব্দগুলো বাড়তে লাগল ক্রমশ, হাসিও তীব্র হতে লাগল। আর মহিলাটি? তাকেও তো চেনা মনে হচ্ছে। মহিলাটির পাশ ফেরানো মুখটা দেখল ও। ঘাড়ের ওপর নুয়ে আসা খোপা, গালের পাশে ঝুলে থাকা চুলের কুচি। মহিলাটি চায়ের কাপের মধ্যে চামচ ডুবিয়ে নাড়ছে। রিনরিন শব্দ হচ্ছে একটা। ও দেখল হাতের সোনার বালাজোড়া শব্দ করছে। ও কাছে এগিয়ে গেল আরও। আর ওর পায়ের শব্দে মহিলাটি মুখ ফিরিয়ে তাকাল এবার। আরে, এ তো…
“এই যে, এই নিন।” আচমকা চোখ মেলে তাকাল নেড়ু। আর সঙ্গে সঙ্গে কট করে উঠল ঘোর-লাগা চোখটা। সূর্য এসে ধাক্কা মারছে চোখে। চোখ কুঁচকে নেড়ু ওপর দিকে তাকাল। একটা ছেলে। আলো পেছন দিকে থাকায় নেড়ু মুখটা দেখতে পাচ্ছে না স্পষ্ট। তবু বুঝল, ছেলেটা ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে একটা কয়েন। বলছে, “এই যে, এই নিন।”
নেড়ু কয়েনটা নিল। তারপর শুনল, ছেলেটার পেছনে দাঁড়ানো সুন্দরমতো মেয়েটা বলছে, “ডোন্ট ইগনোর মি লাইক দ্যাট। আমি কী জিজ্ঞেস করছি তোমায়? তুমি আমার কথার উত্তর না দিয়ে ওই বেগারটাতে কনসেনট্রেট করছ কেন? কান্ট ইউ টেক এনিথিং সিরিয়াসলি?”
নেড়ু দেখল ছেলেটা একটু পিছিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে একটা ক্যামেরা বের করল ব্যাগ থেকে। তারপর সেটা চোখে লাগিয়ে তাগ করল ওর দিকে।
নেড়ুর অবাক লাগল। মেয়েটা ইংরেজি বলে যাচ্ছে সমানে। আর নেড়ু তো দিব্বি বুঝতে পারছে সব কথা! তার মানে ও কি ইংরেজি জানে? নেড়ু দেখল, ছেলেটা, মেয়েটার কথায় উত্তর না দিয়ে ক্যামেরাটার সামনের লম্বা চোঙটা ধরে ঘোরাচ্ছে। হঠাৎ নেড়ু বুঝতে পারল যে, ওর ছবি তোলা হচ্ছে। আর ছবি তোলা হলে কী করতে হয় সেটা নেড়ু জানে। তাই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ও সোজা হয়ে বসল। তারপর হাসিহাসি মুখ করে বলল, “চিজ।”
Leave a Reply