কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র – অনুবাদ : রাধাগোবিন্দ বসাক
কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র — প্রাচীন ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক গ্রন্থ – ডক্টর রাধাগোবিন্দ বসাক কর্ত্তৃক বঙ্গভাষায় কৃতানুবাদ। ডক্টর রাধাগোবিন্দ বসাক এম. এ., পি.এইচ.ডি. কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃতবিভাগের ভূতপূর্ব্ব প্রধান অধ্যাপক ও কলিকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ।
কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র [প্রাচীন ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক গ্রন্থ] – প্রথম খণ্ড
সম্পাদকের নিবেদন
কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের মৎকৃত বঙ্গানুবাদের দ্বিতীয় সংস্করণের সহিত মূল সংস্কৃত গ্রন্থের পাঠ সংযোজিত করার জন্য অনেক কৃতবিদ্য অধ্যাপক ও পাঠকের অনুরোধ আসিয়াছিল। আমি বিশেষভাবে অবগত আছি যে, এই মূল গ্রন্থের অনেকখানি অংশ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. পরীক্ষার জন্য পাঠ্য বলিয়া নিৰ্দ্ধারিত আছে। সম্প্রতি বি. এ. অনার্স পরীক্ষাতেও কতক অংশ পাঠ্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু, বাজারে, বিশেষতঃ বাঙ্গালা দেশের বাজারে, কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের মূল সংস্কৃত গ্রন্থ পাওয়া দুষ্কর হইয়াছে। তাই ছাত্র-ছাত্রী ও অন্যান্য পাঠক-পাঠিকাদিগের সুবিধার জন্য অনুবাদগ্রন্থের সঙ্গে মূল সংস্কৃত অর্থশাস্ত্র সংযোজিত করিয়া প্রকাশ করা হইল। এখন আর ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রন্থাগারের গ্রন্থ হইতে মুলের অনুলিপি প্রস্তুত করার কষ্টের প্রয়োজন হইবে না। আরও একটি প্রকৃষ্ট কথা এই যে, মূল সংস্কৃত গ্রন্থের সঙ্গে মিলাইয়া লইয়া বঙ্গানুবাদ পড়িলে পাঠকের মনে অর্থের সুগমতা প্রতিভাত হইতে পারিবে। মূল সংস্কৃত গ্রন্থের পূর্ব্ববৰ্ত্তী সম্পাদকগণের ধৃত পাঠ পৰ্য্যালোচনা করিয়া যাহা মূল গ্রন্থের সঙ্গত পাঠ বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। তাহাই এই সম্পাদনায় গৃহীত হইয়াছে। ইতি–
শ্ৰীরাধাগোবিন্দ বসাক
ইং ১লা জুলাই, ১৯৬৪ সাল
.
(দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম খণ্ডের মুখবন্ধ)
বিগত ইং ১৯৫০ সালের ১৮ই জুলাই তারিখে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের প্রথম খণ্ডের মৎকৃত বঙ্গানুবাদ কলিকাতায় প্রকাশিত হইয়াছিল এবং দ্বিতীয় খণ্ডের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ ইং ১৯৫১ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে কলিকাতায় প্রকাশিত হইয়াছিল। সুধীসমাজ আমাদের বঙ্গানুবাদের সাহায্যে সুপ্ৰাচীন কৌটিলায় অর্থশাস্ত্রের মত দুরূহ সংস্কৃতগ্রন্থের বিষয়াবলী বুঝিবার অবসর পাইয়া পরিতুষ্টচিত্তে আমাকে নানারূপ সহানুভূতি-পূর্ণ উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন। গত ১১-১২ বৎসরে আমাদের মুদ্রিত ও প্রকাশিত বইগুৰি নিঃশেষভাবে বিক্রীত হইয়া গিয়াছে। বহু মনীষী প্ৰাজ্ঞ পণ্ডিত, অধ্যাপক, অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা আমার গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ শীঘ্ব প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে, এই সুকঠিন সংস্কৃত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হওয়ায়, প্ৰাচীন অর্থশাস্ত্রের পঠনপাঠনের দিকে সামাজিকদিগের দৃষ্টি অনেকটা আকৃষ্ট হইতে পারিয়াছে। এই ভাবিয়া আমি তাহাদের নিকট কৃতজ্ঞচিত্তে বাধিত বোধ করিতেছি।
পূর্ব্বে কলিকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের এমএ পরীক্ষাথিদিগের জন্য কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের কতক অংশ পাঠ্য বিষয় বলিয়া নিৰ্দ্ধারিত ছিল। এখন অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, এই গ্রন্থের অংশবিশেষ কলিকাতা ও বদ্ধমাচন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বি-এ (অনাস) পরীক্ষাথিদিগের পাঠ্য তালিকাভুক্তও ঠতয়াছে। স্নাতকোত্তর সময়ে ভারতীয় ইতিহাস সম্বন্ধীয় গবেষণায় ব্যাপৃত হইবে যে-সব ছাত্র-ছাত্রীরা, তাহাদের পক্ষে প্ৰাচীন রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের জ্ঞান যে অত্যাবশ্যকীয় তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। কাজেই বি-এ ও এম্-এ, পরীক্ষায় এই গ্রন্থের সহিত পূর্ব্ব পরিচয় থাকিলেবদ্যাথিদিগের পরে গবেষণাকার্থ্যে তাহা অতীব প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান মনে হইবে।
প্রথম সংস্করণে আমরা বঙ্গানুবাদের সহিত মূল সংস্কৃত গ্রন্থ মুদ্রিত করিয়া প্রকাশ করিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিলাম। ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই মূল সংস্কৃত পাঠ্যাংশ মূদ্রিত পুস্তক হইতে নিজ নিজ খাতায় স্বহস্তে লিখিয়ালইয়া বিষয় পাঠ করে। তাহাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে এবার আমরা অনুবাদের দুই খণ্ডেরই সহিত মূল সংস্কৃত গ্রন্থ মুদ্রিত করিয়া সম্বদ্ধ করিয়া দিয়াছি। ইহাতে পাঠক-পাঠিকার সুবিধা হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।
আর একটি বিষয়ে পণ্ডিতসমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিতে ইচ্ছা করি। অর্থশাস্ত্রের বঙ্গানুবাদের প্রথম সংস্করণের দ্বিতীয় খণ্ডে পরিশিষ্টরূপে আমি প্ৰাচীন দণ্ডনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক প্ৰায় ৬০ ০৷৷ ৭০ ০ পারিভাষিক শব্দের তালিকা ও সেগুলির অভিধান প্রকাশ করিয়াছিলাম–তাহা হইতে আমাদের বাঙ্গাল প্রদেশের পরিভাষা কমিটির সভ্যগণ কোন কোন নূতন শব্দের চয়ন করিয়া নিয়াছেন কি না, তাহা আমি জানি না। তবে এই বিষয় শুনিয়াছি যে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের কোন কোন পণ্ডিতেরা সেই পারিভাষিক অর্থশাস্ত্রবিষয়ক অনেক শব্দ স্থানীয় ভাষায় ব্যবহার জন্য গ্রহণ করিয়াছেন।
সর্বশেষে বক্তব্য এই যে, কলিকাতার প্রসিদ্ধ জেনারেল প্ৰিণ্টারস এণ্ড পাবলিশারস নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্বত্বাধিকারী আমার পূর্ব্বতন স্নেহাস্পদ ছাত্র শ্ৰীমান সুরেশচন্দ্র দাস, এম-এ, এবার এই গ্রন্থের মূদ্রণ ও প্রকাশনকাৰ্য্যের সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করিয়া আমাকে অধিকতর কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করিয়াছেন।
ইতি—
শ্ৰী রাধাগোবিন্দ বসাক
কলিকাতা, ৬৯নং বালিগঞ্জ গার্ডেনস,
বালিগঞ্জ, কলিকাতা-১৯
১৬ই আশ্বিন, বাং ১৩৭০ সন
.
(প্রথম সংস্করণের প্রথম খণ্ডের মুখবন্ধ)
শ্ৰীভগবানের ইচ্ছায় কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ (প্রথমখণ্ড) মুদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হইল। বিগত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা চলিতে থাকার সময়ে এবং দেশময় স্বাধীনতাসংগ্রাম অব্যাহতগতিতে বৃদ্ধি পাইতে থাকা কালে, সরকারী কলেজের অধ্যাপনাকাৰ্য্য হইতে অবসরগ্রহণের পরে, আমি এই গ্রন্থের অনুবাদকাৰ্য্যে ব্রতী হইয়া প্ৰায় আড়াই বৎসর। পৰ্য্যন্ত ইহাতে অভিনিবিষ্ট থাকিয়া এই শ্রমসাধ্য ব্রত সমাপন করিয়াছিলাম। অনুবাদকাৰ্য্যের অবসানের পরেও, এই অনুবাদটি গ্রন্থাকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করা হইবে কি না, সে সম্বন্ধে গত দুই বৎসর। পৰ্য্যন্ত আমার মনে যে দ্বৈধীভাব ছিল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সহৃদয় কৃতবিদ্য বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায় তাহা অবশেষে ত্যাগ করিয়া আমি ইহার মুদ্রণ ও প্রকাশকাৰ্য্যের ব্যবস্থায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। বৰ্ত্তমান সময়ে গ্রন্থমুদ্রণ অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য, এই জন্য অনুবাদের সঙ্গে মূল সংস্কৃত গ্রন্থ ছাপাইতে না পারায় আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
সংস্কৃত-সাহিত্য-সাগরের একটি প্রধান ও প্রকৃষ্ট রত্নস্বরূপ এই কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রখানি আজ প্ৰায় ৪১ বৎসর পূর্বে আবিষ্কৃত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছিল। এই আবিষ্কার কেবল ভারতীয় সাহিত্যের নহে, পৃথিবীর সর্ব সাহিত্যের একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই গ্রন্থ আমরা সর্বপ্রথম পাঠ করিতে আরম্ভ করি ইং ১৯১১ সাল হইতে। রাজসাহীর বরেন্দ্র-অনুসন্ধানসমিতির যে ত্ৰিমূৰ্ত্তিস্বরূপ ছিলেন ৬/অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয়, ৬/রায় বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ ও দিঘাপতিয়ার রাজকুমার ৬/শরৎকুমার রায়, তাহাদের সাহচর্য্যে প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গবেষণায় নিযুক্ত থাকিয়া বাঙ্গালা দেশের তখনকার নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসন ও প্রস্তরলিপি প্রভৃতির পাঠেদ্ধারসাধন এবং তদব্যাখ্যা ও তৎসমালোচনায় প্রবৃত্ত থাকা সময়ে, আমি বিভিন্ন তাম্রশাসনে “ভূমিচ্ছিদ্র-ন্যায়” কথাটির মূলতথ্য কি হইতে পারে তদগবেষণার ফলে এই কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধিকরণের দ্বিতীয় অধ্যায়ে “ভূমিচ্ছিদ্র-বিধান’–নামক প্রকরণের বিষয় অবগত হই। আমার পক্ষে সর্বপ্রথম এই গ্রন্থে প্রবেশের ইতিহাস হইল ইহাই। এই দুরূহ গ্রন্থের কিছু বিষয় যে তখন বেশী বুঝিতে পারিতাম।–তাহা এখন স্পৰ্দ্ধার সহিত বলিতে পারি না। তারপর, ইহাতে আমাকে অনুপ্রবিষ্ট হইতে হয়, যখন ৬/মহামহোপাধ্যায় ডক্টর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. ক্লাসের ছাত্রদিগুকে এই গ্রন্থের অংশবিশেষ পড়াইবার জন্য আমাকে আদেশ করেন। পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাকে কিছু কাল ইহা পড়াইতে হইয়াছিল। এই পাঠনকাৰ্য্যের সুযোগ না পাইলে, এই গ্রন্থের বঙ্গানুবাদবিষয়ে কোন প্রবৃত্তিই আমার মনে আসিত কি না, তাহা বলিতে পারি না। আমি যখন অনুবাদকাৰ্য্যে ব্যাপৃত ছিলাম, তখন সংবাদ পাইলাম যে, আমার পূর্ব্বতন সহযোগী ৬ অশোকনাথ শাস্ত্রীও এই কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন এবং “ভারতবর্ষ’-নামক মাসিক পত্রিকার কয়েক সংখ্যায়। এই বিষয়ে তাহার কয়েকটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হইয়াছিল, আমি বুঝিয়েছিলাম যে, তাহার মত নানাকাৰ্য্যে ব্যাপৃত অধ্যাপকের পক্ষে এই ১৫০টি অধ্যায়-সমন্বিত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ অনেক বৎসর ব্যাপিয়া করিলেও যদি কখনও শেষ হয়। পরে তিনি অনুবাদকাৰ্য্য হইতে ক্ষান্ত থাকেন এবং আরও কিছুকাল গত হইলে, তিনি দেহরক্ষা করেন। এই শাস্ত্রের অনুবাদকাৰ্য্যে অগ্রসর হইতে থাকিয়া আমি ক্রমশঃ বুঝিতে পারিতেছিলাম যে, কি দুঃসাধ্য কাৰ্য্যে আমি হস্তক্ষেপ করিয়াছি। কারণু, গ্রন্থখানি অতি প্ৰাচীন ও ইহাতে যে-ভাবে বিষয়গুলি আলোচিত হইয়াছে এবং যেরূপ পারিভাষিক শব্দপ্রয়োগ সহ ইহা লিখিত হইয়াছে তাহাতে অনেকস্থলে সম্যগতভাবে অর্থবোধ করিতে সমর্থ হইয়াছি তাহা বলিতে সাহস হয় না। এই গ্রন্থের হস্তলিখিত প্ৰাচীন পাণ্ডুলিপির প্রাচুৰ্য্য না থাকায়, স্থানে স্থানে পাঠশুদ্ধিবিষয়ে সংশয়ও মনে উপস্থিত হয়। ডক্টর শ্যাম শাস্ত্রীর ইংরেজী অনুবাদ ও দক্ষিণাত্যের অশেষশাস্তুনিষ্ণাত মহামহোপাধ্যায়। গণপতি শাস্ত্রী মহোদয়ের সংস্কৃত টীকা প্রকাশিত না হইলে, ভারতীয় অন্য কোনো প্ৰাদেশিক ভাষাতে এই গভীর তথ্যসংবলিত কঠিন গ্রন্থের ভাষান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা কম হইত বলিয়া প্রতিভাত হয়। এই শাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ করিতে যাইয়া, অৰ্থবোধের সৌকর্য্যাৰ্থ আমি ব্যাখ্যাগৰ্ভ অনুবাদেরই চেষ্টা করিয়াছি—কেবল শাব্দিক ভাষান্তররূপ অনুবাদে প্রবৃত্ত হই নাই। ভারতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে বিদ্যাভাস্কর বেদীরত্র উদয়বীর শাস্ত্রীর হিন্দী অনুবাদ হইতেও আমি নিজকাৰ্য্যে বেশ সহায়তা লাভ করিয়াছি।
স্বয়ং কৌটিল্য বহুসংখ্যক পূৰ্বাচাৰ্য্যদিগের রচিত অর্থশাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থরাজি ও রাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক অন্যান্য মতামত পৰ্য্যালোচনা করিয়া যে গ্রন্থখানি লিখিয়াছেন এবং যাহাতে তিনি নানাশাস্ত্র হইতে লব্ধ নিজের পরিপক্ক জ্ঞানের পরিচয় দিয়াছেন, তাহা যে অত্যন্ত দুর্বোধি গ্রন্থ হইবে তদ্বিষয়ে সন্দেহ থাকার অবসর নাই। তিনি যে এই অর্থশাস্ত্ৰে আন্ধীক্ষিকী, ত্রয়ী, বাৰ্ত্তা ও দণ্ডনীতি-এই বিদ্যা চতুষ্টয়েই নিজের অধিকারের প্রমাণ দিয়াছেন তাহা নহে, ইহাতে তিনি শুদ্ধশাস্ত্র, বাস্তুবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগোল ও ইতিহাস, বেদ প্রভৃতি নানাবিদ্যা ও নানাশাস্ত্রের প্রক্লষ্ট জ্ঞানের ও পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। কাজেই আমাদের মত স্বল্পজ্ঞান ও মন্দমতি লোকের পক্ষে এই গ্রন্থের সম্পূর্ণ গ্রন্থিভেদ একরূপ অসম্ভব। তথাপি মহাকবি ভবভূতির সেই প্রসিদ্ধ শ্লোকের অৰ্দ্ধাংশের কথা স্মরণ হয়
“উৎপৎস্যতেহস্তি মম কোহপি সমানধৰ্ম্মা
কালো হ্যয়ং নিরবধির্বিপুলা চ পৃথ্বী”।
আমরা এই গ্রন্থখানি যেরূপ বুঝিয়াছি, সেইরূপেই ইহার অনুবাদ লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিলাম। পৃথিবী ত বাস্তবিকই বিপুল-কোথায় কে এখনই আছেন যিনি আরও অধিকতর উৎকৰ্ষসহকারে অনুবাদ করিতে পারেন। অথবা, কালও নিরবধি-ভবিষ্যতে হয়ত অন্য যোগ্যতার ব্যক্তি অনুবাদের উৎকর্ষ বাড়াইতে সমর্থ হইবেন।
বহুকাল পরে আজ ভারতবর্ষ সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা প্ৰাপ্ত হইয়াছে। ভারতের শাসন ও রক্ষাকাৰ্য্যে যাঁহারা এখন ব্রতী ও দেশের সবগুলি প্রদেশে (বিশেষতঃ বাঙ্গালা প্রদেশে) যাঁহারা মন্ত্রিপদে আরূঢ়, তাহাদেরও নিজদেশে প্ৰাচীনকালে প্রচলিত ও প্রবত্তিত রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি-বিষয়ক গ্রন্থের সহিত সবিশেষ পরিচয় থাকা আবশ্যক। আমাদের দেশের প্রাচীন রাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক বৈশিষ্ট্য কিরূপ ছিল তাহা না জানা থাকিলে, দেশের সভ্যতা, ভব্যতা ও কৃষ্টিরক্ষা দুষ্কর কাৰ্য্য বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। যাহাতে দেশভক্ত রাষ্ট্রনায়কগণের ও বিদ্রৎসমাজের দৃষ্টি এ-দিকে খানিকটা আকৃষ্ট হইতে পারে তজ্জন্যই এই সুপ্ৰাচীন দুরূহ কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের বঙ্গানুবাদে আমার প্রয়াস। প্ৰাচীন রাজনীতি ও অর্থনীতির আলোচনা ও প্রচার বিষয়ে সামাজিকগণের মন ইহা পাঠ করিয়া যদি একটুও পরিবত্তিত ও পরিশোধিত হয়, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রম সার্থক বিবেচিত হইবে।
এ-স্থলে কৃতজ্ঞতাসহকারে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, আমি এই অনুবাদকাৰ্য্যে উৎসাহ পাইয়াছি আমার বন্ধু ও প্রাক্তন সহযোগী ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডাঃ সুশীলকুমার দে, ডাঃ প্রবোধচন্দ্র লাহিড়ী, ডাঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ নীহাররঞ্জন রায়, মহামহোপাধ্যায় যোগেন্দ্রনাথ সাংখ্য-বেদান্ত-তর্কতীর্থপ্রমূখ পণ্ডিত ও মনীষীগণ হইতে। আমার অপর বন্ধু শ্ৰী ললিতকুমার সেন মহাশয়ও আমাকে এই গ্রন্থের প্রকাশবিষয়ে অনেক সুপরামর্শ দিয়া বাধিত করিয়াছেন। কিন্তু, এই শ্রমসাধ্য অনুবাদকাৰ্য্যের প্রধান প্রযোজক ছিলেন আমার পূর্ব্বতন মেহাস্পদ ছাত্র শ্ৰীমান সুরেশচন্দ্র দাস এবং তাঁহার প্রযত্নে ও সহায়তায় এই গ্রন্থ তাহারই জেনারেল প্ৰিণ্টারস এণ্ড পাব্লিশারস-নামক প্রতিষ্ঠান হইতে মূদ্রিত ও প্রকাশিত হইল।
ইতি–
শ্ৰী রাধাগোবিন্দ বসাক
কলিকাতা, ৬৯নং বালিগঞ্জ গার্ডেনস
১৮ই জুলাই, ইং ১৯৫০ সাল।
.
অবতরণিকা
১৯০৯ খ্ৰীষ্টাব্দে মহীশূরের পণ্ডিত ডক্টর আর, শ্যাম শাস্ত্রী কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের সর্বপ্রথম একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন। তৎপূর্বে পৃথিবীর সর্বত্র পণ্ডিতমণ্ডলী এই শাস্ত্রের নামমাত্রই অবগত ছিলেন; এবং কেবল প্ৰাচীন কোন কোন সংস্কৃত গ্রন্থে ইহার উল্লেখের ও সংস্কৃত টীকা পঞ্জীতে এই শাস্ত্র হইতে উদ্ধৃত বচনবিশেষের কথা তাহাদের পরিজ্ঞাত ছিল। দাক্ষিণাত্যের এই মনীষীর। এই গ্রন্থের আবিষ্কার ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের নহে, জগতের সর্বসাহিত্যের ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা। পার্থিব বা অ-পারমার্থিক বিষয়ে লিখিত এই প্রাচীন অর্থশাস্ত্রের মূল্যবত্তা অত্যন্ত অধিক। এই বিপুলায়তন গ্রন্থমধ্যে অত্যন্ত দুরূহ ও প্ৰায় দুর্বোধি অনেক বাক্য ও শব্দনিচয় রহিয়াছে। একজন ভারতীয় শাস্ত্রবিৎ বিদেশীয় পণ্ডিত এই অর্থশাস্ত্রকে একখানি ‘গ্রন্থ’ না বলিয়া ইহাকে একটি “গ্রন্থাগার’-নামে পরিচিত করিতে চাহিয়া বাস্তবিকই ইহার মৰ্যাদা রক্ষা করিয়াছেন। পণ্ডিতমণ্ডলী কর্তৃক ত্রই গ্রন্থখানিতে সমুদ্দিষ্ট বহুবিধ বিষয়ের সম্যক পৰ্যালোচনা, সতর্ক বিচার ও উপযুক্ত মূল্যনিৰ্ণয় সমাপ্ত হইতে আরও বহু বহু বৎসরের পরিশ্রমের প্রয়োজন হইবে-এইরূপ বললে অত্যুক্তি করা হইবে না। এই শাস্ত্রের যে চারিখানি প্রসিদ্ধ সংস্করণে ব্যাখ্যা ও অনুবাদসহ পাঠ এযাবৎ প্রকাশিত হইয়াছে, সেই পাঠ সৰ্ব্ব-শুদ্ধ বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। অনেক স্থলে পাঠ-বিষয়ে সন্দেহ রহিয়া যায়। ভবিষ্যতে ভারতের দিগ বিদিকে অবস্থিত বিভিন্ন প্রদেশের কোন কোন স্থানে এই গ্রন্থের আরও হস্তাক্ষর-লিখিত পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হইতে পারিলে, তৎসাহায্যে পরে ইহার পাঠশুদ্ধি ঘটিতে পারে। বাস্তবিকই এই বিশাল অর্থশাস্ত্রের সাভিনিবেশ পঠন-পাঠন একটি দুরূহ কাজ এবং ইহার শুদ্ধ ব্যাখ্যাকৰ্ম্মও স্থানে স্থানে কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
বিগত চল্লিশ বৎসরের মধ্যে প্ৰাচ্য ও প্রতীচ্য দেশের অনেক মনীষাসম্পন্ন ছাত্র, অধ্যাপক ও প্ৰাজ্ঞ পাঠক এই অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত ও পর্যালোচিত বিষয়বিশেষ অবলম্বন করিয়া গবেষণা চালাইয়া পণ্ডিতসমাজের পত্রিকাদিতে প্রবন্ধকারে, কিংবা স্বরচিত পুস্তকপুস্তিকাতে তাঁহাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করিয়াছেন। এস্থলে আমরা সেগুলির বিস্তৃত উল্লেখের প্রয়োজন বোধ করি না।
এই প্ৰাচীন অর্থশাস্ত্ৰে প্ৰাপ্ত ভাব ও বিষয়সমূহ পাঠ ও বিবেচনা করিয়া আমাদের মনে ইহার ভিত্তিস্বরূপ যেরূপ চিত্র প্রতিফলিত হইয়াছে তাহারই কিঞ্চিৎ আভাস নিম্নে লিপিবদ্ধ হইতেছে। এই অবতরণিকার শেষাংশে আমরা দুইটি তর্কবহুল প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ও তৎসমাধানের প্রয়াস করিব। প্রথম প্রশ্নটি হইল। এই :-খ্ৰীষ্টপূর্ব্ব চতুর্থ শতাব্দে ভারতবর্ষের প্রথম সম্রাট মৌৰ্য্যবংশীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য (তদীয় অপর দুই নাম হইল চাণক্য ও বিষ্ণুগুপ্ত) নিজেই এই অর্থশাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন অথবা তদীয় মতাবলম্বী পরম্পরাপ্ৰাপ্ত পরবর্তীকালের কোন শিষ্য বা শিষ্যসংঘ ইহা রচনা করিয়াছেন? দ্বিতীয় প্রশ্নটি হইল এই :-এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহ কি কোন রাজ্যবিশেষে প্রচলিত অর্থনীতি, রাজনীতি, ও সমাজনীতির চিত্র, অথবা সে-গুলি যে-কোন কালে ও যে-কোন স্থানে সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদর্শস্বরূপ একটি রীতিনীতির কথা? সাধারণতঃ কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রকে লোকের রাজনীতি ও রাজ্যশাসনপ্রণালীর গ্রন্থ বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। দণ্ডনীতি-বিষয়ক গ্রন্থ বলিয়াও এই অর্থশাস্ত্র পণ্ডিতসমাজে পরিচিত হয়।
প্রাচীন ভারতে ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুগে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের সমসময়ে বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমরা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতি বা বৰ্গতন্ত্র ও কুলম্বামিক রাজ্যের শাসনপ্রণালী প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত ছিল বলিয়া জানিতে পারি। কিন্তু, অধিকসংখ্যক রাজ্যেই রাজতন্ত্রশাসনের ব্যবস্থাই নিয়মিত ছিল। রাজ্যের বা রাজশক্তির তত্ত্ববিশ্লেষণে রত প্ৰাচীন রাজনীতিবিদগণ মানব প্রকৃতির দোষভাগের কথা কখনই বিস্মৃত হইতেন না, কারণ, তাহারা ভাবিতেন যে, শীল ও ও সদাচারের ভ্ৰংশকারী ও অন্যের স্বাধীনতা ও অধিকারে হস্তক্ষেপকারী অসজনের অভাব কখনই সমাজে ছিল না। কাজেই দুষ্টজনের অত্যাচার ও পাপাচরণ নিবারিত রাখিবার জন্য শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সর্বদাই উপলব্ধ হইত। অন্যথা, জনগণের জীবন ও সম্পত্তির রক্ষণকাৰ্য্য ও তাহাদের শাস্ত্রবিহিত বৰ্ণাশ্রমধৰ্ম্মের পালনকাৰ্য্য আচল হইয়া যাইতে পারে–এই ভয় অস্বাভাবিক নহে। প্ৰাচীন হিন্দু রাজনীতিতে লোকের জীবন ও সম্পত্তি এবং ধৰ্ম্মরক্ষারূপ দুইটি প্রধান মূল বিষয়ের চিন্তা, আলোচনা ও নির্ণয় পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু, এই দুইটি বিষয়ই নির্ভর করে রাজার দণ্ডশক্তি-প্রণয়নদ্বারা লোকসমাজের কণ্টক বা দোয্যকারীকে শাস্তি দেওয়ার উপর। প্রজাসমূহের হিত ও সুখবিধানই রাজার প্রধান ও প্রথম কৰ্ত্তব্য এবং তাঁহার দ্বিতীয় কৰ্ত্তব্য হইল লোকবিিস্থতি বা সমাজ অধ্যায়ে) রাজ্যের এই সাতটি প্রকৃতি বা অঙ্গের নাম ও ক্রম এইরূপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, যথা-স্বামী, অমাত্য, জনপদ, দুৰ্গ, কোষ, দণ্ড ও মিত্র। শব্দকোষকার অমরসিংহ পরে এই নামগুলির অল্পস্বল্প একটি শাব্দিক ও ক্রমিক পরিবর্তন করিয়াছেন, যথা-(স্বামী স্থলে) রাজা, অমাত্য, (মিত্র স্থলে) সুহৃৎ, কোষ, (জনপদ স্থলে) রাষ্ট্ব, দুর্গ ও (দণ্ড স্থলে) বল। প্রভুশক্তি, মন্ত্রশক্তি ও উৎসাহশক্তিতে শক্তিমান স্বামী বা রাজাই হইলেন ভারতীয় প্ৰাচীন রাজতন্ত্রশাসনপ্রণালীর কেন্দ্ররূপী সর্বপ্রধান ও প্রথম প্রকৃতি। অমাত্য-নামক দ্বিতীয় প্রকৃতিদ্বারা আমরা কেবল রাজার ধী-সচিব বা মতিসচিব ও কৰ্ম্মসচিবগণকেই বুঝিবে না; রাজতন্ত্রশাসনপ্রণালীতে সর্বপ্রকার শাসনাধিকরণ বা শাসন বিভাগেরও যাঁহারা অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁহাদিগকে-এমন কি, অধ্যক্ষগণের নিম্নস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৰ্ম্মচারী বা আমলাগণকেও বুঝিব। তৃতীয় প্রকৃতি জনপদ বা রাষ্ট্রশব্দদ্বারা পুরা বা নগর ব্যতিরিক্ত রাজ্যের অবশিষ্ট দেশ ও দেশবাসী দিগকে বুঝিতে হইবে। দুর্গ-নামক চতুর্থ প্রকৃতির অর্থ কেবল জলদুর্গ, স্থলদুর্গ, বনদুর্গ, পৰ্বতদুর্গ, মরুদুর্গ ও প্ৰান্তদুৰ্গাদি নাহে; প্ৰাচীনকালে ভারতের প্রত্যেক বড় বড় পুর ও নগর প্রাচীর ও পরিখাদিদ্বারা সুরক্ষিত ছিল বলিয়া সেগুলিও দুর্গশব্দবাচ্য ছিল। পঞ্চম প্রকৃতি কোষশব্দদ্বারা রাজভাণ্ডারের রত্নাদি সারবস্তু ও বস্ত্ৰাদি ফন্তু বা অসার বস্তুকে অর্থাৎ যতপ্রকার দ্রব্যরাজি সেখানে থাকে সেগুলিকে বুঝায়। ষষ্ঠ প্রকৃতি দণ্ড বা বলশব্দদ্বারা হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিক—এই চতুরঙ্গ সেনাকে বুঝিতে হইবে। আবার এই পদাতিক সেনারও অনেকপ্রকার ভেদ আছে, যথা-মৌলবল, ভূতকবল, শ্রেণীবল, মিত্রবল, অমিত্রবল ও আটাবীবল। সপ্তম, প্রকৃতি মিত্র বা সুহৃৎশব্দটি দ্বাদশরাজমণ্ডলের মধ্যে যাঁহারা বিজিগীষু রাজার সহিত মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ (অর্থাৎ যাহারা যুদ্ধাদিতে তাঁহার সহায়ক সুহৎ বা allies) তাহাদিগকে বুঝায়। রাজা স্বয়ং ও তাঁহার মিত্রের ‘রাজপ্রকৃতি’-সংজ্ঞায় এবং অমাত্যাদি অবশিষ্ট পাঁচটি প্রকৃতি। ‘দ্রব্যপ্রকৃতি’-সংজ্ঞায়ও অভিহিত হইয়া থাকে। এই সাতটি প্রকৃতি বা অঙ্গ মিলিত হইয়া কাৰ্য্যনিৰ্বাহ করিলে, রাজ্যরূপ শরীর সুচালিত ও পরিপুষ্ট থাকিতে পারে। ইহারা পরস্পরের উপকার সাধন করিলেই সম্যগতভাবে কাৰ্য্যকর থাকে। পরস্পরনিরপেক্ষ হইয়া চলিলে, ইহার রাজ্যের বা State-এর ব্যাধি বা প্রকোপ উৎপাদন করে। এই সপ্তাঙ্গ বা সপ্তপ্রকৃতিক রাজ্যই হইল প্ৰাচীন হিন্দু রাজনীতিতত্ত্বের সারসংগ্রহ।
কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের বিষয়সূচী এইভাবে সমুদ্দিষ্ট হইয়াছে। সমগ্র গ্রন্থখানি, বিনয়াধিকারিক প্রভৃতি নামে পরিচিত পঞ্চদশ আধিকরণে বিভক্ত হইয়াছে। এই অধিকরণগুলিতে অমাত্যোৎপত্তি-প্রভৃতি নামে আখ্যাত ১৮০টি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয় সন্নিহিত আছে। আবার এই প্রকরণগুলি ১৫০টি অধ্যায়ে বিবেচিত ও আলোচিত হইয়াছে। সুতরাং কোন কোনও অধ্যায়ে একাধিক প্রকরণও নির্ণীত দেখা যায়। সাধারণ দৃষ্টিতে এই গ্রন্থখানি সংস্কৃতভাষার গদ্যে রচিত দুষ্ট হয় এবং ইহাতে ব্যবহৃত বহুশব্দকে আৰ্যপ্রয়োগরূপে ধরিতে হয়। প্রত্যেক প্রকরণের আরম্ভাংশে। উক্ত কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বাক্যকে আমরা গ্রন্থের ‘সূত্র’-রূপে ধরিয়া লইতে পারি। কিন্তু, স্বৰ্গীয় মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত গণপতি শাস্ত্রী প্রকরণের নামরূপে উক্ত সংক্ষিপ্ত শব্দনিচয়কেই “সূত্র’ বলিয়া ধাৰ্য্য করিতে চাহিয়াছেন। অবশিষ্ট গ্রন্থাংশকে ‘ভাষ্য’-রূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পালিভাষায় রচিত বৌদ্ধ জাতিক-গ্রন্থাবলীতে, গদ্যাংশের শেষভাগে ও কখন কখন মধ্যভাগেও, যেমন আলোচিত মতবাদ বা তত্ত্বাদির পরিপোষণার্থক কয়েকটি শ্লোক প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রেও প্রকরণোক্ত বিষয়সমূহের সারসংগ্রহহিসাবে এক বা একাধিক শ্লোক অধ্যায়ান্তে ও কখন কখন অধ্যায় মধ্যেও লিপিবদ্ধ দুষ্ট হয়। সে-গুলি কৌটিল্যের নিজের রচিত পদ্য, কিংবা তৎপূর্ব্ববর্তী আচাৰ্য্যবিশেষের উক্তি তাহা নিৰ্দ্ধারণ করা কঠিন। গ্রন্থাবসানে কৌটিল্য একটি আৰ্য্যাশ্লোক এইরূপ লিখিয়া রাখিয়াছেন, যথা
“দষ্টা বিপ্রতিপত্তিং বহুধা শাস্ত্ৰেষু ভাষ্যকারাণাম।
স্বয়মেব বিষ্ণুগুপ্তশ্চকার সূত্ৰং চ ভাষ্যং চা।”
“শাস্তুসমূহের (ব্যাখ্যা-বিষয়ে) ভাষ্যকারগণের মধ্যে বহুপ্রকারের বিপ্রতিপত্তি বা বিবাদ লক্ষ্য করিয়া, বিষ্ণুগুপ্ত স্বয়ং সূত্রও রচনা করিয়াছেন এবং (ইহার) ভাষ্যও রচনা করিয়াছেন।”
কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র রাজতন্ত্র, রাজ্যেরই বিষয়সমূহ অবলম্বন করিয়া লিখিত গ্রন্থ। ইহাতে বৰ্ণিত রাজতন্ত্র অনিয়ন্ত্রিত রাজার আধিপত্যবিষয়ক নহে; ইহাকে সচিবায়ত্ত রাজ্যই বলা চলে। রাজনীতিবিদগণের মতে রাজার প্রথম শ্রেষ্ঠ কীৰ্ত্তব্য হইল প্রজাবর্গের হিত ও সুখ উৎপাদন করা, এবং তাহাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য সমাজে বিধি-ব্যবহার বা আইন ও শৃঙ্খলা সুব্যবস্থিত করার চেষ্টায় ব্রতী থাকা। রাজার নিজ রাজ্যমধ্যে প্রজাদিগের যোগক্ষেমের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া শাসনব্যবস্থা করার পারিভাষিক নাম হইল “তন্ত্ব’। রাজার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ কীৰ্ত্তব্য হইল আসন্ন ও দূরবর্তী পররাষ্ট্রসমূহের রাজাদিগের কাৰ্য্যকলাপের উপর তীক্ষ্ম দৃষ্ট রাখা এবং প্রয়োজন উপস্থিত হইলে তাঁহাদের সহিত যুদ্ধবিগ্রহে প্রবৃত্ত হওয়া। বিজিগীষুর পক্ষে যাড গুণ্যের মধ্যে যে গুণটির প্রয়োগের প্রয়োজন হয়, তাহা প্রয়োগ করিয়া বিদেশীয় শত্রু রাজার প্রতি কূটনীতির প্রয়োগের অভিপ্ৰায়পোষণরূপ ব্যাপারের নাম হইল “আব্বাপ’। * তদীয় অর্থশাস্ত্রপ্রণয়ন প্রসঙ্গে কৌটিল্য “তন্ত্র’ ও ‘আবাপ”-এই উভয়বিধ নীতি স্মরণ করিয়াই সম্ভবতঃ সেই গ্রন্থের অধিকরণ, প্রকরণ ও অধ্যায়গুলির ক্রম ও সাজকল্পনা করিয়া থাকিবেন। শাস্ত্রের তন্ত্রাংশে তিনি পাচটি অধিকরণে ৯৫টি প্রকরণের ও ৯৬টি অধ্যায়ের এবং আবাপাংশে পরবত্তী নয়টি অধিকরণে ৮৪টি প্রকরণের ও ৫৩টি অধ্যায়ের সন্নিবেশ করিয়াছেন। এক প্রকরণাত্মক পঞ্চদশ অধিকরণে ১টি অধ্যায়ে আলোচ্য বিষয়গুলিকে ‘তত্ত্ব’ ও ‘আবাপের” অন্তভূক্ত গণ্য না করিলেও চলিতে পারে। প্রথম পাঁচটি অধিকরণের নাম হইল, যথাক্রমে-(১) ‘বিনয়াধিকারিক” (অর্থাৎ রাজার বিনয় ও বিদ্যাদিশিক্ষার প্রস্তাব-যুক্ত), (২) “অধ্যক্ষপ্রচার’ (অর্থাৎ বিভিন্ন শাসনবিভাগের অধ্যক্ষগণের কৰ্ত্তব্যাদি নির্ণয়-যুক্ত), (৩) ‘ধৰ্ম্মস্থীয়’ (অর্থাৎ দেওয়ানী-আদালত-সম্পৰ্কীয় ব্যবহারস্থাপনা-যুক্ত), (৪) “কণ্টক-শোধন” (অর্থাৎ ফৌজদারী-সম্পৰ্কীয় ব্যবহারে সমাজের কণ্টক বা উপদ্রবকারীদিগের শাস্তি বিধিযুক্ত) এবং (৫) “যোগবৃত্ত’ (অর্থাৎ গূঢ়পুরুষাদি-কর্তৃক উপাংশুবধাদির প্রয়োগযুক্ত)। তৎপরবত্তী নয়টি অধিকরণের নাম হইল যথাক্রমে-(৬) ‘মণ্ডলযোনি’ (অর্থাৎ দ্বাদশ-রাজমণ্ডলের চিন্তাবিষয়ক), (৭) “ষাডগুণ্য” (অর্থাৎ সন্ধিপ্রভৃতি ছয়টি গুণের প্রতিপাদনা-যুক্ত), (৮) “ব্যসনাধিকারিক” (অর্থাৎ সপ্তাঙ্গ রাজ্যের বিপদের ও সঙ্কটের আলোচনা-বিষয়ক), (৯) ‘অভিযাস্যৎকৰ্ম্ম’ (অর্থাৎ বিজিগীয়ু রাজার শক্রির প্রতি অভিযান-সম্বন্ধীয়), (১০) “সাংগ্রামিক’ (অর্থাৎ সংগ্রামবিষয়ক আলোচনা-যুক্ত), (১১) “সংঘবৃত্ত” (অর্থাৎ সংঘ বা শ্রেণী প্রভৃতির প্রতি বিজিগীষুর আচরণ-সম্বন্ধীয়), (১২) “আব্রলীয়াস’ (অর্থাৎ অবলীয়ান বা দুর্বলতর বিজিগীষুর করণীয়-যুক্ত), (১৩) “দুৰ্গলন্তোপায়” (অর্থাৎ শত্রুদুর্গের লাভোপায়সম্বন্ধীয়) এবং (১৪) “ঔপনিষদ” (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে শত্রুজয়ের উপায়-রহস্যের কথা বিষয়ক)। সর্বশেষের প্রকরণের নাম (১৫) “তন্ত্রযুক্তি’ (অর্থাৎ অর্থশাস্ত্রে প্রচলিত ৩২ প্রকারের ব্যাখ্যান-স্যায়-বিষয়ক)।
অর্থশাস্ত্ৰে পাঠকবর্গের সুখপ্রবেশের জন্য, আমরা এস্থলে উপরিউক্ত পঞ্চদশ অধিকরণে অন্তভূক্ত প্রকরণগুলি হইতে কয়েকটি বিশিষ্ট কৌটিলীয় মূলনীতি ও মতবাদের প্রতি তীহাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। সর্বাগ্রে আমাদেরএই কথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, কৌটিলীয় রাজনীতি ব্ৰাহ্মণাদি চতুৰ্বর্ণের ও ব্রহ্মচাৰ্য্যাদি চতুরাশ্রমের স্ব-স্ব ধৰ্ম্মপালনরূপ মূলের উপর প্রতিষ্ঠিত। লোকযাত্রা সুষ্ঠুভাবে রক্ষা করিতে হইলে রাজাকে প্রকৃত দণ্ডধর হইয়া রাজ্যশাসনে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। লোকসমাজে মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতা প্রতিহত করিতে হইলে, রাজাকে যথার্থদণ্ড হইতে হইবে। ” কৌটিল্য মনে করেন যে, বৰ্ণাশ্রমের ধৰ্ম্ম পালিত হইলে, ইহা স্বৰ্গ, ও অনন্তফল মোক্ষেরও সাধন হইতে পারে। স্বধৰ্ম্মের উল্লভঘন ঘটিলে সমাজে কৰ্ম্মসংকর ও বর্ণসংকর উপস্থিত হয় ও সমাজ উচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। সুতরাং তাঁহার মতে রাজার প্রথম কৰ্ত্তব্য সমস্ত লোককে স্বধৰ্ম্ম হইতে ভ্বষ্ট না হইতে দেওয়া [ “স্বধৰ্ম্মঃ স্বৰ্গায়ানন্ত্যায় চ। তস্যাতিক্রমে লোক; সংকরা দুচ্ছিদ্যেত। তন্মাৎ স্বধৰ্ম্মং ভূতানাং রাজা ন ব্যভিচারয়েৎ … ব্যবস্থিতাৰ্য্যমৰ্য্যাদঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতিঃ। ত্রয্যা হি রক্ষিতো লোকঃ প্রসীদন্তি ন সীদতি” ॥ ১।৪ আত্মসম্পদযুক্ত নীতিজ্ঞ রাজা ক্ষুদ্র দেশের অধিকারী হইলেও, সর্বপ্রকার প্রকৃতি সম্পদে সম্পন্ন থাকিতে পারিলে, তিনি সমগ্র পৃথিবী জয় করিয়া চাতুরন্ত সম্রাট বা সার্বভৌম নরপতি হইতে পারেন [ আত্মবাংস্কৃল্পদেশোহপি যুক্ত: প্রকৃতিসম্পদ।। নয়জ্ঞ: পৃথিবীং কৃৎস্নাং জয়ত্যেব ন হীয়াতে ॥ ৬।১ ]। অর্থশাস্ত্রের এক স্থানে (১৩।৪) কৌটিল্য পৃথিবীজয়ের চারি প্রকার পথ বা মার্গের কথা উল্লেখ করিয়া শেষে বলিয়াছেন যে, উক্ত মাৰ্গচতুষ্টয় অবলম্বন করিয়া সমগ্র পৃথিবী জয় করার পর বিজিগীষু রাজা বর্ণ ও আশ্রমগুলির সঙ্গীতরূপে বিভাগ করিয়া স্বধৰ্ম্মানুসারে ইহা ভোগ করিবেন (“জিত্র চ পৃথিবীং বিভক্তবর্ণাশ্রমাং স্বধৰ্ম্মেণ ভুঞ্জীত” ১৩।৪)। কৌটিল্যের মতে রাজৰ্ষির আদর্শচিত্র এইরূপ হওয়া উচিত। যথা—তাহাকে আরিষড বৰ্গত্যাগপূর্ব্বক ইন্দ্ৰিয়জয়, বিদ্যাবৃদ্ধগণের সহিত সংযোগদ্বারা নিজের প্রজ্ঞাবিকাশ, চার বা গূঢ়পুরুষগণের নিয়োগদ্বারা দৃষ্টিকাৰ্য্য উত্থান বা কাৰ্য্যোদ্যমদ্বারা প্রজাবর্গের যোগ-ক্ষেমসাধন, কৰ্ত্তব্যের অনুশাসনদ্বারা প্রজাদিগকে স্বধৰ্ম্মে স্থাপন, বিদ্যার উপদেশদ্বারা তাহাদের বিনয়শিক্ষাদান, সমুচিত কাৰ্য্যে অর্থানিয়োগদ্বারা লোকপ্ৰিয়ত্র লাভ ও হিতসাধনদ্বারা নিজ বৃত্তি অবলম্বন করিতে হইবে (‘তস্মাদরিষড়বৰ্গত্যাগেনেন্দ্ৰিয়জয়ং কুৰুবীতবৃদ্ধসংযোগেন প্রজ্ঞাং, চারণে চক্ষুঃ, উখানেন যোগক্ষেমসাধনং, কাৰ্য্যানুশাসনেন স্বধৰ্ম্মস্থাপনং, বিনয়ং বিদ্যোপদেশেন, লোকপ্ৰিয়ত্রমর্থসংযোগেন, হিতেন বৃত্তিম”। ১।৭)। রাজার পক্ষে উত্থানগুণটি (অর্থাৎ সর্বকালে ও সর্বস্থানে কাৰ্য্যদর্শনে ব্যাপৃত থাকা-রূপ গুণটি) ব্রত বলিয়া গণ্য হওয়ার যোগ্য (“রাজ্ঞে হি ব্রতমুখানম” ১৷১৯); এবং অর্থের (রাজকাৰ্য্যের) মূলই হইল উত্থান এবং অনুত্থান সর্বপ্রকার অনর্থের মূল (“অর্থস্য মূলমুখানিং অনৰ্থস্য বিপৰ্যায়ঃ, ১।১৯)। কৌটিল্য মনে করেন রাজাকে উত্থানগুণবিশিষ্ট লক্ষ্য করিলেই রাজভৃত্যগণ (বা রাজকৰ্ম্মচারিগণা) নিজেরাও তদগুণবিশিষ্ট হইয়া পড়ে। আবার তাহার রাজাকে প্রমাদযুক্ত (অর্থাৎ কৰ্ত্তব্যাকাৰ্য্যে অনবধানযুক্ত) দেখিলে নিজেরাও সঙ্গে সঙ্গে প্রমাদী হইয়া পড়ে এবং রাজকাৰ্য্য নষ্ট করিয়া ফেলে (“রাজনমূত্তিষ্ঠমানং অনুতিষ্ঠন্তে ভৃত্যাঃ, প্রমাদ্যন্তং অনুপ্রমাদ্যন্তি কৰ্ম্মাণি চাস্য ভক্ষায়ন্তি,” ১।১৯)। এই শাস্ত্ৰে স্পষ্টভাবে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, প্রজার সুখ উপস্থিত হইলেই রাজার সুখ হয় এবং প্রজার হিত হইলেই তাহা রাজার হিত বলিয়া বিবেচ্য। যেটা রাজার নিজের প্রিয়, সেটা তাহার হিত নহে, কিন্তু, প্রজাবর্গের যেটা প্রিয়, সেটাই রাজার হিত (“প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম। নাত্মপ্ৰিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্ৰিয়ং হিতম”।৷ ১।১৯)। রাজা ও প্রজার সম্বন্ধ পিতা ও সন্ততির সম্বন্ধের ন্যায় ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত। কৌটিল্য একস্থানে লিখিয়াছেন, সর্বপ্রকার ভয় উপস্থিত হইলে উপহত বা ভয়াপীড়িত প্রজাবৰ্গকে তিনি পিতার ন্যায় রক্ষানুগ্রহ প্রদৰ্শন করিবেন (“সর্বত্র চোপহতান পিতেবানুগুহীয়াৎ”। ৪।৩)। কৌটিল্যের মতে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম-—এই ত্রিবর্গের মধ্যে অর্থই প্রধান, যেহেতু ধৰ্ম্ম ও কাম অর্থ দ্বারাই সাধ্য হয় (“অর্থ এব। প্রধান ইতি কৌটিল্য, অর্থমূলৌ হি ধৰ্ম্মকামাবিতি”। ১৷৭)। কৌটিল্যের মতে রাজপরিবারস্থ পুরুষ ও স্ত্রীগণের উপরও রাজার সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখা বিধেয় নহে। কৌটিল্য বলেন যে, রাজপুত্রেরা কর্কটকের সমান-ধৰ্ম্ম-বিশিষ্ট বলিয়া নিজ জনককে ভক্ষণ করিতে পারে। সুতরাং রাজাকে জন্মাবধি তাহাদের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে (“জন্মপ্রভৃতি রাজপুত্রান রক্ষ্যেৎ। কৰ্কটসধৰ্ম্মাণো হি জনকভক্ষ রাজপুত্ৰাঃ”। ১৷১৭)। কিন্তু, রাজাকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যে রাজকুলে রাজপুত্রেরা অবিনীত বা অশিক্ষিত থাকিয়া যায় তাহা শক্রদ্বারা আক্রান্তমাত্র হইলেই, ঘূণচব্বিত কষ্ঠের ন্যায় স্পর্শমাত্রেই ভাঙ্গিয়া পড়ে (“কাষ্ঠমিব হি ঘুণজঙ্কিং রাজকুলমবিনীতপুত্রমভিযুক্তমাত্ৰং ভজ্যেত”। ১৷১৭)। কাজেই রাজার একমাত্র পুত্রও যদি অবিনীত বা অশিক্ষিত হয়, তাহা হইলে তিনি সেই পুত্রকে কখনই রাজ্যে স্থাপিত করিবেন না (“ন চৈকপুত্রমবিনীতং রাজ্যে স্থাপয়েৎ”-১৷১৭)। রাজান্তঃপুরে রাজাকে মহিষীসমীপে দর্শনার্থ উপস্থিত হইতে হইলে, বিশ্বস্ত বৃদ্ধ পরিচারিকারী দেবীদর্শনে কোন প্রকার বাধা-বিপত্তির সম্ভাবনা নাই বলিয়া রাজাকে জানাইলে পর, তিনি অন্তঃপুরে যাইবেন। (“অন্তগুহাগতঃ স্থবিরত্নীপরিশুদ্ধাং দেবীং পশ্যেৎ”। ১।২০)। এই সম্বন্ধে কৌটিল্য প্ৰাচীনতর। ভারতীয় ইতিহাস, হইতে মহিষীগণ-কর্তৃক রাজহত্যার অনেকগুলি দষ্টান্ত উদ্ধৃত করিয়াছেন। নিজের পরিজনের উপর রাজার অবিশ্বাস এত প্রগাঢ় থাকা উচিত যে, সিদ্ধ ও তাপসজনকে দর্শন দিতে হইলেও তিনি বিশ্বস্ত শস্ত্রগ্ৰাহী রক্ষিপুরুষদ্বারা বেষ্টিত হইয়া তাহা করিবেন এবং সামন্ত ও পরদেশীয় দূতগণের সাক্ষাৎকারসময়ে মন্ত্রিপরিষদদ্বারা অধিষ্ঠিত থাকিবেন। (“আঞ্চ-শস্ত্রগ্রাহাধিষ্ঠিতং সিদ্ধতাপসিং পশ্যেৎ, মন্ত্রিপরিষদ সামন্তদূতম্”। ১৷২১)। আপ্ত নাবিকদ্বারা অধিষ্ঠিত জলপোতাদি রাজাকে ব্যবহার করিতে হইবে। তিনি কখনও জনসঙ্কল প্রদেশে প্রবেশ করিবেন না (“ন পুৰুষসম্বাধমবগাহে ত”— ১।২১)। এমন কি রাজবৈদ্য, ঔষধপাচক ও পেষকাদি পরিচারিকবর্গের দ্বারা পূর্বে আস্বাদিত করাইয়া, রাজাকে ঔষধ, মদ্য ও অন্যান্য পানীয় দ্রব্য ব্যবহার করিতে দিবেন। রন্ধনশালাতে নিযুক্ত মাহানসিক পৰ্ক দ্রব্যাদি আগে স্বয়ং আস্বাদন করিয়া, এবং অগ্নিতে ও কাকাদি পক্ষীর নিকট বলিরুপে প্রদান করিয়া, পরে সেই সব দ্রব্য বিষ শুদ্ধ বলিয়া বিবেচিত হইলে রাজাকে তাহা আহারার্থ প্রদান করিবে। কৌটিল্যের মতে রাজা ইন্দ্রস্থানীয় হইয়া প্রজাদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রদৰ্শন করেন এবং যমস্থানীয় হইয়া নিগ্রহ বিধান করেন। অতএব, রাজাকে অবমানিত করা উচিত নহে! (“ইন্দ্রযমস্থানমেতদ রাজানঃ প্রত্যক্ষ হেডপ্রসাদাঃ। তানবমন্যমানং দৈবোহপি দণ্ড: স্পশতি। তস্মাদ রাজানো নাবমূন্তব্যা”। ১।১৩)। বুরুজসমক্ষে রাজপাদাপজীবী অমাত্যাদিগণের কিরূপ বৃত্তি বা ব্যবহার অবলম্বন করা উচিত তৎপ্রসঙ্গে কৌটিল্যে একটি মূল্যবান আভাণক প্রচার করিয়া তাহাদিগকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন যে, রাজার আশ্রয়লাভকারী উপজীবীদিগের বৃত্তি বা ৰ্যবহার অগ্নিতে খেলার ন্যায় বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ, রাজরূপ অগ্নি একদেশদাহী নহে। অনুজীবী প্রতিকূল হইলে, তিনি তাহার সপুত্রকলাত্র সমগ্র পরিবার নষ্ট করিতে পারেন, এবং সে অনুকুল হইলে, তিনি তাহাকে উন্নতও করিতে পারেন (“অগ্নাবিব হি সংপ্ৰোক্তা বৃত্তী রাজোপজীবিনাম। একদেশং দহোদগ্নিঃ শরীরং বা পরং গত:। সপুত্রদারিং রাজা তু ঘাতয়েন্দ বৰ্দ্ধয়েত বা”।। ৫।৪)।
কৌটিল্যের রাজ্যপরিকল্পনায় রাজার স্বেচ্ছাচারিত্বের কোন নিদর্শন প্রকটভাবে পাওয়া যায় না। ইহা একরূপ সচিবায়ত্ত রাজতন্ত্র। অমাত্যগুণসম্পদের নিপুণভাবে বিচার করিয়া রাজাকে ধী-সচিব ও কৰ্ম্মসচিব নিযুক্ত করিতে হইবে। কারণ, তিনি বলেন রাজ্যপরিচালনা সহায়সাধ্য ব্যাপার। সুতরাং অমাত্যনিৰ্বাচন ও তাহাদিগের নিয়োগ অবশ্যকৰ্ত্তব্য (“সহায়সাধ্যং রাজত্বং চক্রমেকং ন বৰ্ত্ততে”,–১।৭)। ধৰ্ম্মোপধা, অর্থোপধা, কামোপধ্যা ও ভয়োপধা-এই চারি প্রকার উপধাদ্বারা রাজা সচিবগণের শৌচাশৌচ পরীক্ষা করিয়া তাহাদিগকে বিভিন্ন শাসনবিভাগের অধ্যক্ষতা প্রভৃতি কাৰ্য্যে নিযুক্ত করিবেন। মন্ত্রিসংখ্যার বিচার উত্থাপন করিয়া কৌটিল্য পূর্ব্বতর আচাৰ্য্যদিগের মত উদ্ধার করিয়া তাহা খণ্ডন করিয়া বলিয়াছেন যে, তাহাদের মতে যে, এক হইতে আরম্ভ করিয়া বহুসংখ্যক মন্ত্রীকে লইয়া রাজা গুহ্যবিষয়ের মন্ত্রণা করিতে পারেন। বলা হইয়াছে, সেই মতের সহিত তিনি স্বমত মিলাইতে পারেন না। তাঁহার মতে মন্ত্রীসংখ্যা তিন বা চারিজনের কম বা বেশী হওয়া উচিত নহে। এই সংখ্যা কম হইলেও রাজার কাৰ্য্যনাশ হইতে পারে, বেশী হইলে বিষয়নির্ণয় অসিদ্ধ হইতে পারে এবং মন্ত্রভেদের সম্ভাবনাও থাকিয়া যায় (“মন্ত্রিভিন্ত্রিভিশ্চতুৰ্ভিৰ্বা সহ মন্ত্বয়েত”—১৷১৫)। মন্ত্রিপরিষদের সভ্যসংখ্যা কাৰ্যানুষ্ঠানের প্রয়োজনানুসারে নিৰ্দ্ধারিত হওয়া উচিত, ইহাই কৌটিল্যের মত। মন্ত্রিপরিষদের ধী-সচিব ও কৰ্ম্মসচিবদিগকে একত্র ডাকাইয়া আত্যয়িক বা শীঘ্রকরণীয় সমস্যাবহুল বিষয়সমূহের আলোচনা করিয়া সেই সভায় অধিকসংখ্যক সচিবেরা যাহা করিতে মত দিবেন, রাজা তাহা গ্রহণ করিয়া কাৰ্য্য করিবেন। অথবা, অল্পসংখ্যক সচিবেরাও যাহা কাৰ্য্যসিদ্ধিকর উপায় বলিয়া নিৰ্দ্ধারিত করিবেন, রাজা তাহা অবলম্বন করিয়াও কাৰ্য্য করিতে পারেন (“আত্যয়িকে কাৰ্য্যে মন্ত্রিণো মন্ত্রিপরিষদং চাহয় ক্রয়াৎ। তত্র যদি ভূয়িষ্টা: কাৰ্য্যসিদ্ধিকরং বা ক্রয়ুস্তৎ।
কৌটিলীয় রাজনীতিতে গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচর-নিয়োগের অদ্ভুতপ্রকার ব্যবস্থা পরিদৃষ্ট হয়। প্ৰাচীন ভারতে শাসনপ্রণালী চালাইবার জন্য নিযুক্ত অধ্যক্ষাদির কাৰ্য্যের সুসমাধান গুঢ়পুরুষদিগের সহায়তা ব্যতিরেকে সম্ভবপর দেখা যায় না। গুপ্তচরগণের নানাপ্রকার শ্রেণীবিভাগ আছে। এস্থলে তাহার সম্যক বিবরণ লিপিবদ্ধ করা সমীচীন হইবে না। সংক্ষেপে এই বলা যায় যে, প্রচ্ছন্নভাবে কাৰ্য্য করিয়া গূঢ়পুরুষের রাজার প্রতি প্রজাবর্গের কিরূপ মনোভাব দৃষ্ট হয়,অমাত্যাদি রাজপাদোপজীবিগণের রাজার প্রতি কতখানি অনুরাগ বা বিরাগ বৰ্ত্তমান আছে, কি ভাবে প্রজা-জনের দ্বারা কৃত অপরাধ পরিজ্ঞাত হওয়া যায়, পররাজ্যের কোষবিল ও সেনাবল কিরূপে অবগত হওয়া যায়, কি প্রকারে অগ্নি ও বিষাদির প্রয়োগদ্বারা দূস্যজন ও শত্রুর উপাংশুবধ, সাধিত হইতে পারে এবং কণ্টকশোধনকাৰ্য্যে ব্যাপৃত বিচারকদিগেরও কি ভাবে সাহায্য হইতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদ বহন করিয়া ও অন্যান্য কৰ্ত্তব্য সম্পাদন করিয়া গুপ্তচরেরা রাজার রাজ্যশাসনকাৰ্য্যের নানারূপ সুবিধাবিধান করিয়া দিতে পারে। একশ্রেণীর গুপ্তচরের নাম ছিল “উভয়বেতন”। তাহারা স্বপ্রভুর বেতনভোগী হইয়া শক্রির রাজ্যে অপসৰ্প বা চারের কাৰ্য্য করিত। কিন্তু, স্বপ্রভুর অনুমোদনসহকারে তাঁহার স্বার্থের জন্য তাহারা শত্রু রাজার নিকট হইতেও বেতনগ্রহণপূর্ব্বক তাহারও কাজ করিত। পাছে তাহারা বিশ্বাসঘাতক হইয়া পড়িয়া শত্রুর কাৰ্য্যেই চিরকাল ব্যাপৃত হয়, এইজন্য তাহাদের স্বরাজ্যে অনুপস্থিতিকালে তাহাদের স্ত্রীপুত্রেরা নিজ প্রভুর বশে রক্ষিত থাকিত (“গৃহীতপুত্রদারাংশ্চ কুৰ্য্যাদুভয়বেতনান”-১॥১২)। চরপ্রণিধির অঙ্গবিশেষ বলিয়া মনে করিতে পারি। গূঢ়পুরুষদিগকে অপ্রকাশ চর এবং দূতাদিগকে প্রকাশচর বলিয়াও মনে করা যাইতে পারে। দূতের কাৰ্য্য অত্যন্ত কষ্টকর। সব রাজারাই দূতমুখ অর্থাৎ তাহারা দূতের মুখ দিয়াই নিজ বক্তব্য অপর রাজাকে শুনাইয়া থাকেন। দূতের বাক্য তাহার নিজ বাক্য নহে, তাহা তাহার প্রভুর প্রযুক্ত বাক্য। সুতরাং জাতিতে চণ্ডাল হইলেও দূত অবধ্য, ব্ৰাহ্মণজাতীয় দূতের ত কোন কথাই নাই (“দূতমুখী বৈ রাজানস্থং চান্যে চ। তস্মাদুৰ্দ্যতোধপ্রি শস্ত্ৰেষু যথোক্তং বক্তারঃ। তেষামন্তাবসায়িনোহপ্যবধ্যাঃ, কিমাঙ্গ পুনব্রিাহ্মণা:; পরস্যৈতাদ বাক্যমেষ দূতধৰ্ম্ম ইতি। –১।১৬)
প্ৰাচীন ভারতের রাজ্যশাসনতন্ত্র কি ভাবে পরিচালিত হইত। তাহার একটি সম্পূর্ণ ও সুন্দর চিত্র অর্থশাস্ত্রে লিখিত পাওয়া যায়। ইহা একরূপ আধুনিককালের আমলাতন্ত্রের মত বলিয়া প্রতীয়মান হয়। শাসনবিভাগগুলি বহুপ্রকারের অধ্যক্ষদ্বারা অধিষ্ঠিত ছিল। বড় বড় মহামাত্য বা মহামাত্র এবং “উপযুক্ত’ (উচ্চকৰ্ম্মাধ্যক্ষ) ও “যুক্ত’ (নিম্নকৰ্ম্মচারী), লেখক, গাণনিক বা হিসাবরক্ষক, সমাহৰ্ত্ত (ধনসংগ্রহকারী মহামাত্র), সন্নিধাতা (রাজধনাদির নিচয় ও রক্ষণকৰ্ম্মে ব্যাপৃত মহামাত্র) ইত্যাদির বহুবিধ কৰ্ত্তব্যকৰ্ম্মের বর্ণনা এই শাস্ত্রেনিৰ্দ্ধারিত ও নিণাত পাওয়া যায়। অর্থনীতি-হিসাবে একালের ন্যায় প্ৰাচীনকালেও গ্রামই ছিল সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র কেন্দ্র এবং রাজনীতি-হিসাবে ইহাই ছিল স্বায়ত্তশাসনবিষয়ে একরূপ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। নূতন গ্রামের নিবেশসময়ে রাজাকে লক্ষ্য রাখিতে হইত যেন ইহাতে শূদ্রজাতীয় ও কর্ষকশ্রেণীভূত জনেরই সংখ্যাধিক্য বিদ্যমান থাকিতে পারে। এইরূপ দশটি গ্ৰাম লইয়া যে গ্রামসংহতি রচিত হইত। তাহার নাম ছিল ‘সংগ্রহণ’, দ্বিশতগ্রামাত্মক সংহতির নাম ছিল “কার্বটিক’ বা “খাৰ্বটিক’। এইরূপ চতুঃশতগ্রামাত্মক ও অষ্টশতগ্রামাত্মক সংহতির নাম ছিল যথাক্রমে ‘দ্ৰোণমুখ’ ও ‘স্থানীয়”। দুর্গ-নামে পরিচিত বড় বড় পুর বা নগর তৎকালে প্ৰাকারাদিপারিবেষ্টিত ছিল। কৌটিল্যের সময়ে সমস্ত ভূমি বা জমির স্বামিত্র রাজাতেই পৰ্য্যবসিত ছিল কিনা সেই প্রশ্নের সমাধান সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধ হয় না। কিন্তু, তথাপি দেখা যাইতেছে যে, নূতন গ্রামনিবেশসময়ে রাজা ঋত্বিক, আচাৰ্য্য, পুরোহিত ও শ্ৰোত্রিয়াদিগকে সর্বপ্রকার দণ্ড ও কর হইতে রহিত করিয়া ব্রহ্মদেয়-নামক ভূমি দান করিতেন। ফসল উৎপাদনের উপযোগী, “কৃতক্ষেত্র’-নামক ক্ষেত্র একপুরুষমাত্রের ভোগ্য করিয়া রাজা করদায়ী কৃষকদিগকে দিতেন এবং যাহারা ‘অরুতক্ষেত্র’-নামক ক্ষেত্র (অর্থাৎ যে ক্ষেত্র অপ্রহত বা খিলভূমি সেগুলি) ফসল উৎপাদনের উপযোগী করিতে পারিত, সেই সব ক্ষেত্র রাজা কৃষকদিগের নিকট হইতে ফিরাইয়া লইতেন না, বরং সেগুলির স্বামিত্র তাহাদের উপর। পৰ্য্যবসিতও হইত বলিয়া মনে হয় (“করদেভ্যঃ কুতক্ষেত্রণ্যৈকপুরুষিকাণি প্রব্যচ্ছেৎ। অকৃতানি কৰ্ত্তভো না নাদেয়াৎ”-২।১)। রাজকোষের উন্নত অবস্থার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া রাজা কৃষকদিগকে (বীজাদি-দানরূপ) “অনুগ্রহ’ ও (করমুক্তিরূপ) “পরিহার’ বিতরণের ব্যবস্থা করিবেন। কোষের উপঘাতক হইলে তিনি এই রীতি বৰ্জন করিবেন। কারণ, অল্পকোষযুক্ত রাজা পুরবাসী ও জনপদবা সীদিগকে গ্ৰাস করিতে পারেন (“অল্পকোষো হি রাজা পৌরজনপদান গ্রসতে”-২।১)। সম্ভবতঃ জাতিশক্তির বৃদ্ধি ও তাৎকালিক বৌদ্ধধৰ্ম্মের উপদিষ্ট সন্ন্যাস বা প্রব্রজাগ্রহণনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান উদ্দেশ্য করিয়াই কৌটিল্য এইরূপ একটি সমাজনীতির প্রচলন করিতে, রাজাকে উপদেশ দিয়াছিলেন যে, যে ব্যক্তি নিজ স্ত্রীপুত্ৰাদির ভরণব্যবস্থা না করিয়া সংসার-ত্যাগী হইবে, কিংবা নিজের স্ত্রীকেও প্রব্রজিত করিবে, সে ব্যক্তি রাজদ্বারে দণ্ডাহঁ হইবে। তাঁহারমতে কেবল সেই পুরুষই রাজদ্বারের ধৰ্ম্মস্থ বা বিচারকগণের অনুমতি লইয়া প্রব্রজ্য গ্রহণ করিতে পারিবে, যাহার মৈথুনশক্তি সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হইয়াছে, অন্যথা তাহার দণ্ড হইবে কারানিবাস (“পুত্রদারমপ্রতিবিধায় প্রব্রজতঃ পূর্বঃ সাহসদণ্ডঃ স্ক্রিয়ঞ্চ প্রব্ৰাজয়তঃ। লুপ্তব্যবায়ঃ প্রব্রজেদা পৃচ্ছ্য ধৰ্ম্মস্থান, অন্যথা নিয়ম্যেত”-২।১)। আরও একটি অত্যন্ত বিস্ময়কর সমাজরীতির প্রবর্তন করিবার জন্য তিনি একটি নিয়মের উপদেশ করিয়াছিলেন যে,-রাজার নূতনজনপদনিবেশে বানপ্রস্থ ব্যতীত অন্য কোন প্রকার সন্ন্যাসী বা প্রব্রজিত থাকিতে পারিবে না; রাজ্যের কল্যাণার্থ রচিত কোন সংঘ ব্যতীত অন্য কোন প্রকারের দুৰ্জাত সংঘ সেখানে স্থান পাইবে না; এবং প্রজার হিতার্থে অনুকুল কাৰ্য্যকারী দলব্যতীত অন্যপ্রকার অনিষ্টকারক সংবিৎ বা চুক্তিতে আবদ্ধ অন্য কোন প্রকার সংহতদলের উপস্থিতি রাজসরকার সহ্যু করিতে পারিবেন না (“বানপ্রস্থাদ্যঃ প্রব্রজিতভাবঃ সুজাতাদিন্য: সংঘঃ, সামূখায়কাদন্য: সময়ান্তবন্ধে বা নাস্ত জনপদমুপনিবিশেত”-২।১)। রাজ্যের আয়ব্যয়ের বরাদাভার নিরূপণ সমাহৰ্ত্তার উপর ন্যস্ত থাকিত।
রাজা অমাত্যসম্পদযুক্ত ও উপযুক্ত-নামক অধিকারীদিগের কৰ্ম্মশক্তি পরীক্ষা করিয়া সৰ্ব্বকাৰ্য্যে তাহাদিগকে নিযুক্ত করিবেন। কারণ, কাৰ্ঘ্যে নিযুক্ত হইলে অধ্যক্ষগণ ও নিজ নিজ স্বভাব দোষগ্রস্ত করিয়া ফেলিতে পারেন, যথা স্নাথবাহনাদি কাৰ্য্যে নিঘুক্ত হইয়া শান্ত অশ্বগুলি ও বিকারগ্রস্তু হইয়া পড়ে (“অশ্বসধৰ্ম্মাণো হি মনুষ্য নিযুক্তাঃ কৰ্ম্মসু বিকুর্দতে”-২।৯)। যাহাতে রাজকৰ্ম্মচারিগণ রাজার্থ আত্মসাৎ করিতে সমর্শ না হইতে পারেন, সেইজন্য কৌটিল্য এইরূপ নিয়ম সমর্থনা করিয়াছেন যে, প্রত্যেকটি অধিকরণ বা কাৰ্য্যদাপার এমনভাবে স্থাপিত হওয়া চাই যেন, তাহাতে অনেক মূখ্য বা প্রধান প্রধান কৰ্ম্মচারী নিযুক্ত থাকিতে পারেন এবং কোন কৰ্ম্মচারীই এককাৰ্য্যে বহুকালব্যাপী হইয়া নিযুক্ত থাকিতে না পারেন (“বহুমুখ্যমনিত্যং চাধিকারণং স্থাপয়েৎ”-২।৯)। অর্থবিভাগে ব্যাপৃত রাজকৰ্ম্মচারিগণ গোপনে স্বল্পপরিমাণে রাজার্থ আস্বাদন না করিয়া থাকিতে পারেন না। কৌটিল্য লিখিয়াছেন যে, যেমন কোন ব্যক্তির জিহ্বাতলে মধু বা বিষ স্থিত থাকিলে সে অনিচ্ছায়ও তাহা আস্বাদন না করিয়া থাকিতে পারে না, তেমন রাজার্থবিষয়ে নিযুক্ত কৰ্ম্মচারীরা স্বল্প হইলেণ্ড রাজার্থ আস্বাদন না করিয়া থাকিতে পারে না (“যথা হনাস্বাদয়িতুং ন শক্যং জিহ্বাতিলস্থং মধু বা বিষং বা। অর্থস্তথা হৰ্থচরেণ রাজ্ঞঃ স্বল্লোহপানাস্বাদগ্নিতুং নং শাক্যঃ” ॥—২।৯)।
দুৰ্গনিবেশকালেও রাজাকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে, দুর্গমধ্যে দুৰ্গস্থ লোকের নিত্যপ্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার (তৈলাদি) স্নেহ, (ধান্যাদি) ক্ষারবস্তু, লবণ, ভৈষজ্য, যাবস, তৃণ কাষ্ঠ, লৌহ, চৰ্ম্ম, বেণু, অস্ত্রাদিপ্রহরণ, কবচাদি আবরণ প্রভৃতি দ্রব্যগুলি এমন পরিমাণে রাখিতে হইবে যেন তাহারা অনেক বর্ষ পৰ্য্যন্ত বিনা অভাবে তাহা উপভোগ করিতে পারে এবং পুরাতন দ্রব্যগুলি খরচ করিয়া নূতনগুলির সঞ্চয় অক্ষঃ রাখিতে হইবে (“নবেন।ানবং শোধয়েৎ”-২।8)। বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয় কৌটিলীয় শাস্ত্ৰে উল্লিখিত পাওয়া যায় যে, লবণ রাজপণ্যপৰ্য্যায়ে অন্তভুক্ত ছিল অর্থাৎ লবণের কারবার রাজসরকারের একচেটিয়া ব্যাপার ছিল। আগন্তু লবণের অর্থাৎ পরদেশ হইতে আমদানীকৃত লবণের কারবারীকে মূল্যের ষষ্ঠভাগ রাজকোষে শুষ্করূপে দিতে হইত (“আগন্তলবণং ষড়ভাগং দদ্যাৎ”—২৷১২)। এস্থলে অর্থনীতিবিষয়ক আরও দুইটি মতবাদের কথা বলা যাইতে পারে। নিজদেশের প্রজাবর্গের রক্ষণহেতু রাজা কখনই পরদেশ হইতে স্বরাষ্ট্বপীড়াকর ও অল্পফলবিশিষ্ট ভাণ্ডাদি (বিক্রেয় দ্রব্যাদি) অনাইতে দিবেন না; কিন্তু প্রয়োজনবোধে তিনি যে সব ধন্যবীজাদি দ্রব্য মহোপকারক এবং যাহা স্বরাষ্ট্রে দুল্লাভ তাহা বিনাশুল্কেও স্বরাজ্যে আনাইতে অনুমতি দিতে পারেন (“রাষ্ট্রপীড়াকরং ভাণ্ডমূচ্ছিন্দ্যাদফলং চ যৎ। মহোপকারমুম্বুস্কং কুৰ্য্যাদা বীজং চ দুল্লািভম” ॥-২।২১)।
কৌটিল্যের সমসাময়িক ভারতে নাগরিক-নামক মহামাত্রের পর্য্যবেক্ষণে নগরসমূহে পৌরশাসনবিধি কিরূপ প্রচলিত ছিল তাহা পাঠ করিলে ময়ে হন। ইহা আধুনিক পৌরপ্রতিষ্ঠানের প্রধান অধিকারীর (Mayor-এর) শাসনবিধির সহিত তুলন। করা যাইতে পারে। নাগরিকের অধীনস্থ স্থানিক ও গোপীনামক কৰ্ম্মচারীরা নগরে বিদ্যমান স্ত্রীপুরুষদিগের জাতি, গোত্র, নাম ও ব্যবসায় সহ তাহাদের সংখ্যা, আয় ও ব্যয়ের কথা হিসাবপুস্তকে নিবদ্ধ রাখিতেন। ধৰ্ম্মশালার তত্ত্বাবধায়কের নাগরিকের অত্যুমতি লইয়া পথিকগণকে সেখানে বাস করিতে দিতে পারিতেন। গৃহস্বামীকে তাহার গৃহ হইতে প্রস্থানকারী ও গৃহে আগমনকারীর নামও নাগরিকের কাৰ্য্যালয়ে জানাইতে হইত। নগরে কোনপ্রকার অগ্নিদাহ উপস্থিত হইলে অগ্নিনির্বাপণের জন্য গুহ হইতে সাহায্যাৰ্থ ধাবিত না হইলে, গৃহস্বামী ও তাহার ভাড়াটিয়া রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইত। অন্যের গৃহে অগ্নি সন্দীপনকারীকে অপরাধের জন্য সেই অগ্নিদ্বারাই বধ করিতে হইবে (“প্রদীপিকোহগ্নিনা বধ্যঃ” ২।৩৬)। রাজা নূতন দেশ জয় করিলে, যুবরাজের অভিষেক হইলে, কিংবা রাজপুত্রের জন্ম হইলে, নগরকারাগারে আবদ্ধ লোকদিগের কারামুক্তি আৰ্দষ্ট হইত। রাজার জন্মনক্ষত্রদিবসে ও পৌর্ণমাসীতেও কারারুদ্ধ বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত ও অনাথজনদিগকে কারামুক্ত করা হইত। (“অপূৰ্বদেশীধিগমে যুবরাজাভিষেচনে। পুত্রজন্মনি বা মোক্ষে বন্ধনস্য বিধীয়তে ॥”-২।৩৬; “বন্ধনাগারে চ বালবৃদ্ধব্যাধিতানাথানাং জাতনক্ষত্র–পৌর্ণমাসীয়ু বিসর্গ”—২।৩৬)
দেওয়ানী ও ফৌজদারী ব্যবহারবিধি-নিরূপণ জন্য কৌটিল্য যে দুইটি অধিকরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, সৰ্ব্বপ্রকার ব্যবহার-নির্ণয়ে রাজাই সর্বশ্রেষ্ঠ চরম অধিকারী। প্রথমতঃ দেওয়ানী মোকদ্দমার বিচারকাৰ্য্য পরিচালনা করেন তিন তিন জন ধৰ্ম্মস্থ-নামক মহামাত্র এবং ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচারকাৰ্য্য পরিচালনা করেন তিন তিন জন প্রদেষ্টনামক মহামাত্র। কৌটিল্যের অনুশাসিত ব্যবহারবিধিতে দ্বাদশবৰ্ষীয় স্ত্রী ও ষোড়শবর্ষীয় পুরুষ প্ৰাপ্তব্যবহার বলিয়া গণ্য। ধৰ্ম্মস্থ বা বিচারকগণ ছল প্রয়োগ অবলম্বন না করিয়া বিচারকাৰ্য্য পরিচালনা করিবেন এবং বিচারকালে তাঁহারা সর্বদাই সমদৰ্শী হইয়া লোকের বিশ্বাসভাজন ও প্রিয় হইতে চেষ্টা করিবেন (“এবং কাৰ্য্যাণি ধৰ্ম্মস্থাঃ কুযুরিচ্ছলাদৰ্শিনঃ। সমাঃ সৰ্ব্বেষু ভাবেযু বিশ্বাস্যা লোকসস্তিপ্রয়াঃ” ॥-৩।২০)। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র জনসাধারণের মনে অপরাধীর গ্রহণ বা গ্রেপ্তার-বিষয়ে রাজার সর্বজ্ঞতার প্রভাবই খ্যাপন করে। এই প্রসঙ্গে সমাহতৃ-নামক মহামাত্র, পুরবাসী ও জনপদবাসীদিগের নিকট রাজপ্রভাবেই তাহাদের গ্রেপ্তার হইয়াছে ইহা ঘোষণা করিয়া চৌরাদি অপরাধী দিগকে উপস্থাপিত করিবেন (“পূর্ব্ববচ্চ গৃহীত্বৈতান সমৰ্হৰ্ত্তা প্ররূপয়েৎ। সৰ্ব্বজ্ঞখ্যাপনং রাজ্ঞ: কারয়ন রাষ্টবান্সিযু”।–৪।৫)। কণ্টকশোধন-নামক অধিকরণে কৌটিল্য একটি সামাজিক নীতির প্রবৰ্ত্তন করিয়া উপদেশ করিয়াছেন যে, কোন ফৌজদারী অপরাধের জন্য ব্ৰাহ্মণকে উৎপীড়ন করা বিধেয় হইবে না এবং তাহার প্রতি বাধাদণ্ডও অবিধেয় হইবে। উৎকট অপরাধে তাহাকে রাজ্য হইতে অভিশপ্ত চিহ্নদ্বারা ব্ৰিণিত করিয়া নির্বাসিত করা যাইতে পারে, অথবা, আকর-প্রদেশে বা খনিময় প্রদেশে বাস করাইতে পারা যায়। (“সৰ্ব্বাপরাধেঘপীড়নীয়ো ব্ৰাহ্মণঃ ….ত্ৰাহ্মণং পাপকৰ্ম্মাণমৃদঘ্যাঙ্করুতরণম। কুৰ্য্যান্নিবিষয়ং রাজা বাসয়েদা করেষু বা”।–৪।৮)। দণ্ডবিধানে রাজার কোন ত্রুটি লক্ষিত হইলে কৌটিল্যের মতে তিনিও পতিগ্রহণ করে, তাহা হইলে সে তাহার স্ত্রীধন হইতে বঞ্চিত হইবে (“পুত্রবতা বিন্দমান স্ত্রীধনং জীয়েত”-৩।২)। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিবাহযোগের ভঙ্গসম্বন্ধে এই শাস্ত্রে এরূপ বিধান লিপিবদ্ধ পাওয়া যায় যে, দ্বেষপরায়ণা হইলেও স্ত্রী পতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে মোক্ষ বা বিবাহ-বন্ধনত্যাগ লাভ করিতে পারিবে না। সেইরূপ আবার পতি দ্বেষপরায়ণ হইলেও স্ত্রীর অনিচ্ছায় স্ত্রীকে ত্যাগ করিতে পারিবে না। যখন স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি দ্বেষ বা অরাগ সত্য বলিয়া ধাৰ্য্য হইবে, কেবল তখনই মোক্ষ বা ছাড়াছাড়ি বিহিত হইতে পারে (“আমোক্ষ্য ভৰ্ত্তরকামস্যা দ্বিষতী ভাৰ্য্যা, ভাৰ্য্যাশ্চ ভৰ্ত্ত। পরস্পরং দ্বেষান্মোক্ষঃ”-৩।৩)।
রাজকোষে অথকৃচ্ছতা পরিদৃষ্ট হইলে রাজা প্রজাবিশেষের নিকট হইতে অসদুপায়ে ও বলপ্রয়োগে অত্যধিক অর্থের সংগ্রহ করিতে পারেন (“কোশমকোশঃ প্রত্যুৎপন্নার্থকৃষ্ণুঃ সংগৃহীয়াং’-৫।২)। ‘প্রণয়’-নামক যে অর্থযাচনার কথা অর্থশাস্ত্ৰে উল্লিখিত পাওয়া যায়, তাহা ব্যবহারী (কারবারী), কৰ্মক ও যোনি-পোষক (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পশুপক্ষিপালক)–গণের নিকট হইতে ও সংগ্রহ করিবার বন্দোবস্ত রাজা করিতে পারেন; কিন্তু, এই প্রকার করপ্রণয় বা অতিরিক্ত অর্থসংগ্রহ একবারই মাত্র করা বিধেয়, দুইবার নহে (, “সক্লদেব ন পিঃ) প্রযোজ্যঃ”—৫।২)। এই প্রসঙ্গে কৌটিল্য রাজাকে সতর্ক করিয়া দিতেছেন যে, যাহারা দূস্যজন ও অত্যন্ত অধাৰ্ম্মিক, কেবল তাহাদিগের উপরই যেন তিনি রাজকোষ-বৰ্দ্ধনের জন্য এইরূপ অতিরিক্ত অর্থসংগ্রহের উপায় প্রয়োগ করেন, ধাৰ্ম্মিক ও নিরপরাধ লোকের উপর নহে। কারণ, যেমন বাগান হইতে পাকা ফল ‘সংগ্রহ করাই বিধেয়, কাঁচা ফল নহে, তেমন দোষপরিপাকযুক্ত দুষ্ট ব্যক্তি হইতেই এমন ধন সংগ্রহ করা উচিত, অদোষ ব্যক্তি হইতে নহে, তাহা করিলে প্রজামধ্যে কোপ উৎপাদিত হইতে পারে এবং তজজন্য রাজার নিজের নাশ ও আশঙ্কিত হইতে পারে (“পাঙ্কং পক্কমিবারামাৎ ফলং রােজ্যাদিবাপুয়াৎ। আত্মচ্ছেদ্যভয়দামিং বর্জয়েৎ কোপকারিকান।”-৫।২)।
রাজ্যপ্রতিসন্ধান ও একৈশ্বৰ্য্য-নামক প্রকরণে কৌটিল্য পূর্বাচাৰ্য্য ভারদ্বাজের একটি মত আলোচনা-পূর্ব্বক খণ্ডন করিয়া স্বমতের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। ভারদ্বাজ মনে করিতেন যে, রাজার মৃত্যুর পর প্রধান মন্ত্রীর পক্ষে বলপূর্ব্বক সিংহাসন অধিকার করা ন্যায়ানুমোদিত বলিয়া সমৰ্থিত হইতে পারে। তাঁহার মতে অমাতাই রাজ্যের একমুত্র নিয়ামক এবং রাজার মৃত্যুর পরে তাঁহার নিজ সমক্ষে স্বয়ং উপস্থিত রাজ্যকে তিনি উপেক্ষা করিতে পারেন না। এইরূপ সুযোগ ত একবারই উপস্থিত হয় (“কালাশ্চ সরুদভ্যোতি”—৫।৬)। কিন্তু, কৌটিল্য লিখিয়াছিলেন যে, অমাত্যকে এইরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে যেন রাজার মৃত্যুর পরে একৈশ্বৰ্য্য (অর্থাৎ একই রাজবংশের আধিপত্য)। চলিতে থাকে। তিনি আর ও মনে করেন যে, অমাত্যের স্বয়ং রােজ্যাধিকাররূপ বিশ্বাসঘাতী কাৰ্য্য রাজ্যে প্রকৃতিকোপ উৎপাদিত করিতে পারে, ইহা ধৰ্ম্মসঙ্গত কৰ্ম্ম ও নহে এবং ইহা ঐকান্তিক কার্দ্যসাধক নহে। এই প্রসঙ্গে তিনি উপদেশ করিয়াছেন যে, রাজব্যসনে প্রধান অমাত্যের কর্তব্য হইবে আত্মগুণসম্পন্ন রাজপুত্রকে রাজ্যে স্থাপিত করা। আত্মসম্পন্ন রাজপুত্র না পাওয়া গেলে, কোন ব্যসনাসক্ত কুমারকেও মহামায়াগণ সমক্ষে উপস্থাপিত করিয়া প্রধানমন্ত্রী এইরূপ বলবেন, “এই রাজপুত্র ত ধ্বজমাত্র, বাস্তবিকপক্ষে আপনারাই প্রভুস্তানীয়, বলুন ত এই বিষয়ে কি করা: যাইতে পারে?” (“রাজপুত্রমাত্মিসম্পন্নং রাজ্যে স্থাপয়েৎ -পূবজমাত্ৰোহয়ণ, ভবন্ত এবং স্বামিনঃ, কথং বা ক্রিয়তামিতি”-৫।৬)।
রাজমণ্ডলের কল্পনায় কৌটিল্য বিজিগীষু রাজার অনন্তর বা ব্যবধানবিহীন প্লাজাকে অরিস্থিানীয় বলিয়া মনে করেন। মনে রাখিতে হইবে যে, বিজিগীষুব সম্মুখ দিকের পর-পর নরপতির নাম হইবে (১) আরি, (২) মিত্র, (৩) অরিমিত্র, (৪) মিত্র-মিত্র ও (৫) অরিমিত্র-মিত্র এবং পশ্চাতের পর-পর নরপতির নাম টবে (১) পাণিঃগ্ৰাহ, (২) আক্রান্দ, (৩) পাঞ্চিগ্রাহাসার ও (৪) আক্রান্সার। বিজিগীষুর বিদগদিকে অবস্থিত অপর দুই নরপতির পারিভাষিক নাম (১) মধ্যম (২) উদাসীন। এই দ্বাদশ রাজপ্ৰাকৃতি লইয়াই দ্বাদশ রাজমণ্ডল রচিত হয়। সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধীভাব ও সমাশ্রয়-এই ছয়টি গুণের উপৗসুন্স প্রয়োগদ্বারা প্রত্যেক বিজিগীয়ুকেই লক্ষ্য রাখিতে হইবে—কেমন ‘করিয়া তিনি ক্ষয়ের অবস্থা হইতে স্থানের এবং স্থানের অবস্থা হইতে বৃদ্ধির অবস্থায় উপনীত হইতে পারিবেন। শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতে অবতীর্ণ হইলে প্রত্যেক রাজারই মান্তব্যক্ষয়, অথব্যয়, অজ্ঞাতপূর্ব্ব দূরবত্তী রাজ্যে অভিযান ও নানাবিধ নৃশংস আচরণ প্রভৃতি অনেকপ্রকার ক্লেশ ও অসুবিধা ভোগ করিতে হয়। এই কারণে, বিগ্রহের অবস্থা হইতে সন্ধি বা শান্তির অবস্থাকে প্রত্যেক রাজার অধিকতর উপযোগী বলিয়া মনে করা উচিত। যখন বিগ্রহ অবলম্বন একান্ত অপরিহার্য্য হইয়া উঠিবে তখন কি প্রকার যুদ্ধ শ্রেয়স্কর বলিয়া বিবেচিত হইবে সে-বিষয়ে কৌটিল্য নিজগুরুর একটি মত খণ্ডিত করিয়াছেন। গুরুর মত হইল —প্রকাশযুদ্ধ অপেক্ষায় মন্ত্রযুদ্ধ (অর্থাৎ সস্ত্রী, রসদ, তীক্ষ্ণাদি গূঢ়পুরুষীদিগের প্রয়োগদ্বারা শত্রুনাশের চেষ্টা) অধিক লাভজনক, কারণ, যুদ্ধ উপস্থিত হইলে উভয়পক্ষেরই লোকক্ষয় ও অর্থব্যয় অনিবাৰ্য্য এবং যুদ্ধে জয়লাভকারীরও সেনাবল ও ধন্যবল ক্ষয়প্রাপ্ত হয় বলিয়া জেতাও পরাজিত-প্রায়ই হইয়া থাকেন। কিন্স, কৌটিল্য স্বয়ং মনে করেন যে, যত লোকক্ষয় ও ধনব্যয়ই হউক না কেন, ব্যায়ামযুদ্ধদ্বারাই শক্রির বিনাশসাধন করা আবশ্যক (“জিত্বাপি হি ক্ষীণদণ্ডকোশঃ পরাজিতো ভবতীত্যাচাৰ্য্যাঃ। নেতি কৌটিল্যঃ। সুমহতাপি ক্ষয়ব্যয়েন শত্ৰুবিনাশোহত্যুপগন্তব্যঃ ”—৭।১৩)। তবে বিজিগীষু অভিধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে নিজের ও শত্রুর বলাবল পরীক্ষা করিয়া যদি নিজকে। বলীয়ান মনে করেন এবং যুদ্ধে জয়ী হইলে তাহার অধিকতর লাভের ও শক্রর অধিকতর ক্ষয়ের সম্ভাবনা আছে। এরূপ বুঝেন, তাহা হইলেই তিনি অগ্রহায়ণ, চৈত্র বা জ্যৈষ্ঠমাসে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে প্রবৃত্ত হইবেন। যুদ্ধে প্রবৃত্ত বিজিগীয়ুর পক্ষে প্রজাবৰ্গ হইতে সৈন্য উত্থাপন করিতে হইলে, ব্ৰাহ্মণজাতীয় লোক যথাসম্ভব ত্যাগ করিতে হইবে, কারণ, কৌটিল্যের মতে ব্ৰাহ্মণের। প্ৰাণিপাতদ্দ্বারাই সন্তুষ্ট হয়েন এবং সম্ভবতঃ তজজন্য তাঁহারা সহজেই শত্রুর হস্তগত হইয়া পড়িতে পারেন। প্রহরণবিদ্যায় সুশিক্ষিত ক্ষত্ৰিয়সেনাই সৰ্বোত্তম। কিন্তু, কৌটিল্য ইহাও মনে করেন যে, বৈশ্যসেনা ও শূদ্রসেনাও অধিকতর শ্রেয়াশার হইতে পারে, যদি তাঁহাদের মধ্যে অধিকসংখ্যায় সারসমন্বিত প্রবীর পুরুষ থাকে। শত্রু বধে উদ্যত বিজিগীষুদ্বারা কুটিযুদ্ধ প্রবৰ্ত্তিত করা অন্যায় হয় না-ইহাই কৌটিল্যের মত। যুদ্ধে কূট উপায় ও নানাপ্রকার ছল ও চাতুরীর প্রয়োগ কৌটিল্যের অভিমত বস্তু। যুদ্ধে আগ্নেয় অস্ত্র, উপনিষৎ-প্রয়োগ (অর্থাৎ বিষাদি প্রয়োগ), উপজাপি ও অসত্য উক্তি প্রভৃতির ব্যবহার অনিবাৰ্য্য। শব ক্রঘাতের জন্য মন্ত্রৌষধির প্রয়োগও প্রতিষিদ্ধ বলিয়া কৌটিল্য গণনা করেন না। শত্রুপ্রিযুক্ত অনুরূপ, অনিষ্টকর ও ক্রুর উপায়ের প্রতীকারের বিধানও এই শাস্ত্ৰে উপদিষ্ট হইয়াছে। নানারূপ কৃটি উপায়দ্বাপ শক্রির উদ্বেগ বৰ্দ্ধন না করিতে পারিলে, যুদ্ধে বিজিগীষুর পক্ষে জয়ের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। প্রসঙ্গক্রমে মারিতেও পারে, না-ও মারিতে পারে; কিন্তু, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির প্রযুক্ত মতি বা বুদ্ধি গর্ভস্থিত প্ৰাণিসমূহেরও নাশ ঘটাইতে সমর্থ হয় (“একং হন্যান্ন বা হন্যাদিযু ক্ষিপা ধনুষ্মতা। প্রাজ্ঞেন তু মতি: ক্ষিপ্ত হন্যাদ গর্ভগতানপি” ॥ ১০।৬)–
সংগ্রাম উপস্থিত হইলে রাজা স্বয়ং যোদ্ধৃপুরুষদিগকে কিরূপ উক্তিদ্বারা প্রোৎসাহিত করিবেন এবং মন্ত্রী ও পুরোহিত্যদ্বারাও তাহা করাইবেন, সেসম্বন্ধে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে একটি সুন্দর চিত্র অঙ্কিত পাওয়া যায়। বিজিগীষু রাজা তাহাদিগকে বলিবেন যে, তিনি স্বয়ং এবং যোদ্ধপুরুষেরা উভয়ই তুল্যবেতনভোগী অর্থাৎ উভয়েরই যুদ্ধজয়লব্ধ লাভ সমান; এবং বিজিত রাজ্যও উভয়ে একসঙ্গে ভোগ করিবেন। মন্ত্রী ও পুরোহিতেরাও তাহাদিগকে বলিবেন যে, যুদ্ধে মৃত শূরগণের স্বৰ্গলােভ শাস্ত্রান্সমোদিত এবং ভর্তৃপিণ্ডের বিনিময়ে যাহারা যুদ্ধ করিতে অসম্মত হয় তাহারা নরকগামী হইয়া থাকে। (‘তুল্যবেতনেহশ্মি, ভবস্থিঃ সহ ভোগ্যমিদং রাজ্যম্-নবং শরাবং সলিলন্ত পূৰ্ণং সুসংস্কৃতং দর্ভকুতোত্তরীয়ম। তৎ তস্য মা ভূন্নরকং চ গচ্ছেদ যে ভর্তুপিণ্ডস্য রূতে ন যুদ্ধেৎ ॥—১০।৩)। বাৰ্ত্তোপজীবী ও রাজশব্দোপজীবী কতিপয় সংঘ বা শ্রেণীর পরিচয় দিয়া কৌটিল্য বলিয়াছেন যে, বিজিগীয়ু এই সংঘগুলি হইতে সেনোলাভ করিতে পারিলে, তাহা অন্যান্য সেনোলাভ ও মিত্রলাভের অপেক্ষায় অধিকতর প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। কারণ, সংহত সংঘগুলি শক্রগণের অধুন্য হইয়া থাকে (“সংঘা হি সংহতত্বাদধূস্যাঃ পরেষাম”—১১।১)
বিজিগীষু রাজা নিজের ও নিজের রাজ্যের এবং তদীয় শত্রুর ও তাহার রাজ্যের প্রকৃতিব্যসনসম্বন্ধে চিন্তা ও বিবেচনা করিবেন। রাজ্যের সাতটি অঙ্গের বা প্রকৃতিরই ব্যাসন বা বিপদের গুরু-লঘুভাব একান্ত চিন্তনীয়। এই প্রসঙ্গে কৌটিল্য এরূপ মতবাদ প্রচার করিয়াছেন যে, যে কোন রাজ্যের পক্ষে রাজব্যসনই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর অহিতকর এবং বাহকোপ অপেক্ষ আভ্যন্তর কোপই বেশি ভয়াবহ।
যদি বিজিগীষু স্বয়ং শত্রুর অপেক্ষায় অবলীয়ান হয়েন, তাহা হইলে তাঁহার কৰ্ত্তব্য কি হইবে সে-বিষয়ে কৌটিল্য এই মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, তাঁহাকে ভারদ্রজ আচাৰ্য্যের মত অনুসরণ করিয়া বলীয়ান শত্রুর নিকট বেতসবৃত্তি অবলম্বনপূর্ব্বক প্রণতিপরায়ণ হইতে হইবে না; অথবা, বিশালাক্ষ আচাৰ্য্যের তাবলগী হইয়া পরাক্রমকে ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম বলিয়া মনে করিয়া, যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়া তীহাকে বিনাশের পথে অসগ্রর হইতে হইবে না। বলীয়ান শত্রুর আক্রমণে বলীয়ান বিজিগীয়ুকে অধিকতর শক্তিসম্পন্ন অন্য কোন রাজাকে, কিংবা শত্রুর অপ্রধর্ষণীয় কোন দুর্গ, আশ্রয় করিয়া আক্রমণকারীর প্রতি যুদ্ধব্যাপারে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, তাহা না করিলে তাঁহাকে তরণসাধনবিহীন হইয়া সমূদ্রে অবগাহনকারীর দশা প্ৰাপ্ত হইতে হইবে (“যুদ্ধ্যমানশ্চাল্পসৈন্যঃ সমূদ্রমিবাপ্লবােহবাগাহমানঃ সীদতি। তদ বিশিষ্ট্রং তু রাজানমাশ্ৰিতো দুৰ্গমবিষহং বা চেষ্টতে”।-১২।১)।
নবরাজ্যলাভের পরে বিজিগীষু রাজা সেই রাজ্যের প্রজাবর্গের মধ্যে প্রশমন বা শাস্তিস্থাপনের ব্যবস্থা করিবেন। নিজগুণদ্বারা পরাজিত শত্রুর দোষ তিনি আচ্ছাদিত করিতে চেষ্টা করিবেন এবং নিজের গুণ দ্বিগুণ বদ্ধিত করিবেন। নিজের রাজধৰ্ম্ম সম্যক পালন করিয়া তিনি লব্ধরাজ্যের প্রজাদিগের উপকার সাধনে ব্রতী হইবেন। নবরাজ্যের কৃত্যপক্ষীয়দিগকে দানাদিদারা প্রসন্ন রাখিবেন। তিনি নিজের উপকারের প্রতিশ্রুতি কখনই ভঙ্গ করিবেন না। বরং লন্ধরাজ্যের প্রজাদিগের সমান শীল, বেষ, ভাষা ও আচার অবলম্বন করিয়া তাহাদেরই পূজ্য দেবতার ও আশ্রমের পূজা করিবেন এবং তাহাদের উৎসব, সমাজ ও বিহার-সম্বন্ধে ভক্তিভাবাপন্ন হইবেন। অনুগ্রহ ও পরিহারদ্বারা দুঃস্থ প্রজাবর্গের হিতসাধন তাহাকে করিতে হইবে। নবলব্ধ দেশে তিনি অধৰ্ম্ম্য ব্যবহার বািসন করিয়া ধৰ্ম্ম্য ব্যবহারের প্রবর্তন কপ্লিবেন (“চরিত্রমরুতং ধৰ্ম্ম্যং কৃতং চাঙ্গ্যৈঃ প্রবৰ্তয়েৎ। প্রবৰ্ত্তয়েন্ন চাধৰ্ম্ম্যং ক্লতং চান্যৈনিবাৰ্কয়েৎ”। — ১৩।১)।
এই কৌটিলীয় অৰ্থশাস্ত্র নানাবিধ জ্ঞাতব্য বিষয়ের খনিস্বরূপ গ্রন্থ। রাজনীতি অর্থনীতির ও সমাজনীতিবিষয়ক আরও বহুপ্রকার তথ্য ইহাতে সন্নিবিষ্ট আছে। সে-সবের বিস্তৃত বিবরণ প্রদান এই অবতরণিকায় অসম্ভব। উপরি পর্ম্যালোচিত নীতিবাদ-সমূহের পাঠ ও সমালোচনাত্বারা ছাত্র ও শিক্ষকমণ্ডলী যদি এই অর্থশাস্ত্রের মূল সংস্কৃত গ্রন্থ ও আমাদের এই বঙ্গানুবাদের সহিত পরিচয় লাভ করেন, তাহা হইলে তাঁহার। প্রাচীন ভারতের জনুগণের জ্ঞানবিষয়ে অনুপ্রবিষ্ট হইতে পারিবেন। এবং তাঁহাদের সভ্যতা ও ক্লািষ্টসম্বন্ধে গবেষণায় ও প্রবৃত্ত হইতে পারিবেন। — ইহাই আমার বিশ্বাস।
অতঃপর আমরা কয়েকটি প্রয়োজনীয় প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া তদ্বিচারে প্রবৃত্ত হইতেছি।
অর্থশাস্ত্ৰে-প্রণয়নের প্রারম্ভে কৌটিল্য ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন নীতিশাস্ত্রজ্ঞ ও নীতিশাস্ত্র-রচয়িত শুক্র (উশনাঃ) ও বৃহস্পতিকে প্রণাম করিয়াছেন। রাজনীতি ও অর্থনীতিবিৎ পূর্বাচাৰ্য্যদিগের প্রবত্তিত ও রচিত অর্থশাস্ত্র-সমূহ অধ্যয়ন করিয়া তিনি সেগুলি হইতে শাস্বীয় বিষয়সমূহ সংক্ষেপ করিয়া নিজনামে প্রচলিত (কৌটিলীয়া) অর্থশাস্ত্র রচনা করিয়াছেন। তিনি যে স্বয়ং অর্থশাস্ত্রের সম্প্রদায় প্রবৰ্ত্তক নহেন, তাহা ইহা হইতেই প্রমাণিত হয়। তদীয় শাস্ত্র পাঠ করিলে বুঝা যায় যে, এই আগশাস্ত্রের উৎপত্তি-সঙ্গন্ধে একটি ঐতিহ্য অবশ্যই আছে এবং ইহা ক্রমবৰ্দ্ধনশীল রাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক বিধান ও সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। কৌটিল্যকর্তৃক উল্লিখিত, প্রাক্তন অর্থশাস্ত্র-প্রস্থানসমূহের প্রবর্তকদিগের নামমধ্যে আমরা মনু, বৃহস্পতি, উশনা, পরাশর ও আম্ভির নাম পাই; এবং তাঁহাদের মতবাদ ও সিদ্ধান্ত যাঁহারা স্বীকার ও অবলম্বন করিতেন, তাহাদিগকে যথাক্রমে ‘মানব,” “বাৰ্হস্পত্য’, ‘ঔশনস’, ‘পরাশর” ও “আম্ভীয়” বলিয়া তিনি পরিচিত ও নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন। তন্মধ্যে আমরা প্রথম চারিজন আচাৰ্য্যকে ভারতীয় রাজনীতি ও স্মৃতিসংহিতার প্রাচীন রচয়িতা বলিয়া জানিতে পারি। কিন্তু সংস্কৃত-সাহিত্যে আম্ভি-নামক নীতিবিদের কথা আমরা ‘অন্য চু। এ পি পাই নাই। এ-স্থলে মনে করাইয়া দেওয়া যাইতে পারে যে, ভারতে প্রতীচ্যদেশীয় আলেকজাণ্ডার-দি-গ্রেটের অভিযানসময়ে তিনি যখন উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে অনেকদূর পর্য্যন্ত পূৰ্ব্বদিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, তখন তক্ষশীলার রাজার আম্ভি-নামক একটি কুমার বর্তমান ছিলেন। এই আম্ভি পিতাকে উপদেশ দেন যেন তিনি বিদেশীয় বিজিগীযু আলেকজাণ্ডারের সহিত মিত্রতাদ্বারা মিলিত হইয়া ভারতীয় রাজা পৌরব পোরস্প্বভৃতির বিরুদ্ধে অভিযানে প্রবৃত্ত হয়েন। দদেশের রাজগণের সহিত একত্র মিলিত হইয়া বিদেশীয় আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান না হইয়া, তক্ষশীলাধিপ পুত্রের পরামর্শে ভারতগুহে বিদেশীয় শত্রুর প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করিয়া দিয়াছিলেন। স্বদেশদ্রোহী রাজপুত্র আস্তির কোন বিশিষ্ট রাজনীতিবিষয়ক মতবাদ গ্রহণ করিয়া নিয়া কোন রাজনীতিবিদেরা তৎপ্রতিষ্ঠার জন্য কোন অর্থশাস্ত্ৰাদি রচনা করিয়াছিলেন। কিনা, তাহা স্পষ্ট বুঝা ধায় না। তবে এই আম্ভির মতবাদ যাঁহারা স্বীকার করিয়া নিয়াছিলেন, সেই-সব মতানুসরণকারীরাই “আম্ভীয়’-নামে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে উল্লিখিত হইয়া থাকিবেন, এইরূপ মনে করা অযুক্তিযুক্ত না-ও হইতে পারে। কৌটিল্য তদীয় গ্রন্থের একটিমাত্র স্থলে (প্রথম অধিকরণের সপ্তদশ অধ্যায়ে) এই আন্তীয়দিগের মত উদ্ধৃত করিয়াছেন। রাজপুত্রগণ হইতে রাজার আত্মরক্ষাবিষয়ক আলোচনার প্রসঙ্গে, পূৰ্ববৰ্ত্তী অন্যান্য আচাৰ্য্যগণের মতের উল্লেখ করার সময়ে, কৌটিল্য আন্তীয়দিগের মতও লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন যে, আম্ভীয়েরা ভাবিতেন যে, বিনয়শিক্ষার অধীন রাজকুমারকে সত্রি-নামক কোন গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচর “মৃগয়া, দূত (জুয়াখেলা), মদ্যপান ও স্ত্রীসঙ্গের প্রলোভন দেখাইবে,” এবং সে তাঁহাকে “পিতার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাইয়া নিজহস্তে রাজ্য গ্রহণ করার জন্য উপদেশও দিবে”। আম্ভীয়েরা এইপ্রসঙ্গে ইহাও অবশ্য বলিয়াছেন যে, অপর একজন সত্রী (চর) সেই কুমারকে এমন কৰ্ম্ম করিতে প্রতিষেধ করিবে। কিন্তু, কৌটিল্য স্বয়ং এইপ্রকার মতের অত্যন্ত বিরোধী ছিলেন, কারণ, তিনি ভাবিতেন যে, অপকাবুদ্ধি রাজপুত্রকে এইরূপ অনুপাদেয়। উপদেশ করা দোষদুষ্ট; পিতৃদ্রোহরূপ অজ্ঞাতপূৰ্ববিষয়ের অবতারণা করা অন্যায় কাৰ্য্য এবং ইহা কুমারের মনে অসদভাব উৎপাদন করিয়া ভবিষ্যৎ অনর্থ ঘটাইতে পারে। আন্তীয়দিগের সম্বন্ধে এইটুকুমাত্র কথা আমরা কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র হইতে জানিতে পারি।
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্ৰে ৫৩ বার ‘আচাৰ্য্যাঃ’ এই বহুবচনান্ত সংস্কৃত শব্দটি দ্বারা অজ্ঞাতনামা নীতিবিৎ কোন পূর্বাচাৰ্য্যকে উদ্দেশ্য করিয়া বিষয়বিশেষসম্বন্ধে তাহার মত উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই শব্দটি দ্বারা তিনি তাঁহার নিজ শিক্ষাগুরুকেই লক্ষ্য করিয়াছেন বলিয়া আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। কারণ, সংস্কৃতসাহিত্যে গৌরবার্থে এইরূপ বহুবচনান্ত পদের ব্যবহার দৃষ্ট হইয়া থাকে। এই বহুবচনান্তক শব্দদ্বারা আমরা “পূৰ্ববৰ্ত্তী আচাৰ্য্যগণ।” এইরূপ ব্যাখ্যা গ্র হ করিতে ইচ্ছক হই না, যে-হেতু অজ্ঞাতপরিচয় ও অজ্ঞাতি-নাম কোন কোন আচাৰ্য্যকে তিনি ২ বার ‘ইত্যেকে’ ও ২ বার ‘ইত্যপরে’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, এবং যাঁহারা কোন প্রসিদ্ধ আচাৰ্য্যের মতবাদগ্ৰাহী ছিলেন, তাঁহাদিগকে কৌটিল্য “মানবাঃ” ইত্যাদিরূপ বিশিষ্ট শব্দদ্বারাই পরিচিত করিয়াছেন।
কৌটিল্য নিজ গ্রন্থে অন্য যে-সব পূর্বাচাৰ্য্যের মতবাদ ও সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাঁহাদের নাম হইল ভারদ্বাজ (= দ্রোণ, ৭বার উল্লেখ), বিশালাক্ষ (= শিব, ৬বার), পিশুন (= নারদ, ৬বার), কৌণিপদস্থ (= ভীষ্ম, ৪বার), বাতব্যাধি (= উদ্ধব, ৫বার), বাহুদন্তিপুত্র (= ইন্দ্র, ১ বার), পরাশর (১ বার) এবং পারাশির (= ব্যাস? ১বার)। অমাত্য-নির্বাচন, রাজপুত্রগণের উপর রাজার তীক্ষ দৃষ্টিপাত, মিথ্যাসাক্ষ্যপ্রদান, রাজ্যপ্রতিসন্ধান ও কূটযুদ্ধাদি নানাবিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি উক্ত পূৰ্বাচাৰ্য্যদিগের নামোল্লেখপূর্ব্বক তাঁহাদের মতবাদ উত্থাপন করিয়া তৎখণ্ডনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের সহিত নিজ মতের অনৈক্য বা তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে মতপ্রভেদ প্রদৰ্শন করিবার উদ্দেশ্যে, তিনি তাঁহাদের নাম ও মতের উল্লেখ করিয়াছেন। অনেক স্থলে তাঁহাদের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য, কৌটিল্য “আপদেশ”–নামক তন্ত্রযুক্তিদ্বারা বিধির জন্য “ইতি কৌটিল্যঃ” ও নিষেধের জন্য “নেতি কৌটিল্যঃ” এইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিয়া নিজের নাম নিজেই উল্লেখ করিয়াছেন। ছন্দের প্রয়োজনে একটি শ্লোকে (১।১০) তিনি “এতৎ কৌটিল্যদর্শনম” —এইরূপ বাক্যদ্বারা নিজের মত পোষণ করিয়াছেন; গদ্যাংশের স্থানে স্থানে প্রযুক্ত “ইতি কৌটিল্যঃ” এইরূপ বাক্য সেখানে ব্যবহার করিতে পারেন নাই। এই প্রসিদ্ধ ও প্ৰাচীন নীতিশাস্ত্ররচয়িত আচাৰ্য্যদিগের সম্বন্ধে যতটুকু ইতিহাস সংগৃহীত হইতে পারে, তাহা আমার পরমবন্ধু মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত শ্ৰীযোগেন্দ্রনাথ তর্ক-সাংখ্য-বেদান্ততীৰ্থ মহাশয় তদীয় অচিরপ্রকাশিত “প্ৰাচীন ভারতের দণ্ডনীতি’-নামক উচ্চাঙ্গগ্রন্থের প্রথম ও পঞ্চম পরিচ্ছেদে অতি সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। পাঠকবর্গ সেই গ্রন্থ পাঠ করিলে তাহা সবিশেষ জানিতে পারিবেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে (৫৮-৫৯ অধ্যায়।) আমরা বৃহস্পতি বিশালাক্ষ, কাব্য (উশনাঃ), মহেন্দ্র (সহস্ৰাক্ষ), প্ৰাচেতস মনু, ভরদ্বাজ (বৃহস্পতি-পুত্র) ও গৌরশিরাঃ-এই কয়েকজন রাজশাস্তু-প্রণেতার নাম এবং বৈশালাক্ষ, বাহুদন্তক, বাৰ্হস্পত্য প্রভৃতি শাস্ত্রের উল্লেখ পাইয়া থাকি। এই স্থলে বলিয়া রাখা উচিত যে, ভগবান শঙ্করাচাৰ্য্যের শিষ্য বিশ্বরূপাচাৰ্য্যের (তাহার অপর নাম সুরেশ্বরাচাৰ্য্য)। তদীয় “বালক্রীড়া’-নামক যাজ্ঞবল্ক্যস্থতির টীকাতে (১।৩২৮) বৃহস্পতি ও বিশালাক্ষের নাম উল্লিখিত পাওয়া যায়। এই টাকাতে তিনি বৈশালাক্ষতন্ত্র ও কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র হইতে বচনও উদ্ধৃত করিয়াছেন। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত গণপতি শাস্ত্রী মহাশয় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রখানিকে যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতির পরবত্তী কালের রচনা বলিয়া যে মতবাদ প্রচার করিতে চাহিয়াছেন।–তাহা আমরা সঙ্গত বলিয়া বিবেচনা করি না।
বিষ্ণুগুপ্তাপিরনামা পণ্ডিত চাণক্য, “কৌটিল্য”-এই অপবাদসূচক তৃতীয় নামেও পরিচিত ছিলেন। প্ৰাক-কৌটিল্য নীতিশাস্ত্রবিৎ বাহুদন্তিপুত্র, পিশুন, বিশালাক্ষ, বাতব্যাধি ও কৌণিপদন্ত প্রভৃতি নিন্দনীয় নামসমূহের সহিত কৌটিল্যের নিজের নামও তুলিত হইতে পারে। নীতিশাস্ত্র-প্রবক্তা। এই আচাৰ্য্যগণের নামের সহিত দৈহিক ও মানসিক বিকলতা ও ব্যাধির বা দোষের আভাস লক্ষিত হয়, এবং তাঁহারা কেন যে সমসাময়িক জনসমাজে এইরূপ পামে আখ্যাত ও পরিচিত হইতেন তাহা সম্যাগ, ভাবে বুঝিতে পারা যায় না। যে বিপ্লবী দণ্ডনীতিজ্ঞ তীক্ষ্মধী মহামন্ত্রী কৌটিল্য কূটনীতি ও যুদ্ধাদিবিষয়ের সব প্রশ্নের সমাধানে, প্রয়োজনের অনুরোধে, ধৰ্ম্ম ও সুনীতির পথ ত্যাগ করিয়া নানাবিধ নৃশংস ও ভয়াবহ উপায় অবলম্বনের উপদেশ করিতে দ্বিধাবোধ করেন। নাই, তাহার নাম কুটিল-শব্দ হইতে উৎণন্ন ‘কৌটিল্য’ হইতে পারে, ইহাতে সংশয়ের কোন কারণ উপলব্ধ হয় না। তথাপি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত গণপতি শাস্ত্রী তাহাকে “কুটিল-গোত্রে উৎপন্ন মনে করিয়া তাঁহার চিরপ্রসিদ্ধ কৌটিল্য নামটিকে “কৌটল্য’-নামে পরিবত্তিত করিয়া প্রচারের প্রয়াসী হইয়াছিলেন। কৌটিল্য-শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় অপশব্দ নহে; এবং ইহা প্ৰাচীন পুরাণাদি গ্রন্থে ও মহাকবি দণ্ডী, বাণ, বিশখাদত্ত এবং কামন্দকের গ্রন্থাদিতেও তেমন ভাবেই পাওয়া গিয়াছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্ৰাপ্ত এইসব গ্রন্থের প্ৰাচীন হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে কৌটিল্যরূপেই এই নাম পঠিত হয়। মুদ্রারাক্ষসনামে সুপরিচিত প্রাচীন নাটকে নাটকপ্রণেতা মহাকবি বিশাখদত্ত একটি শ্লোকে (১৮) চাণক্যের কুটিল বা বক্রবুদ্ধির কথা স্মরণ করিয়া তাঁহাকে “কৌটিল্যঃ কুটিলমতি”, ইত্যাদিরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। তাহার কুটিলমতিত্বের নির্ণতই আছে। এই শ্লোকেই মহাকবি আরও বর্ণনা করিয়াছেন যে, সেই কৌটিল্যই বলপ্রয়োগসহকারে নিজের ক্রোধাগ্নিদ্বারা (বিনাগ্নিদ্বারা দগ্ধ বংশের বা বাঁশের মত) নন্দ বংশের ধ্বংস সাধন করিয়াছিলেন। কাজেই অর্থশাস্ত্রপ্রণেতার নাম ‘কৌটিল্য’ হওয়াই যুক্তিসহ (“কেটল্য’ নহে)।
এখানে এখন একটি তর্ক ও বিবাদসংস্কুল প্রশ্ন উত্থাপিত হইতেছে। প্রশ্নটি এই :-সূত্র ও ভাস্যময় কৌটিলীয়ী অর্থশাস্ত্র-নামক গ্রন্থখানি কি মৌৰ্য্যযুগে স্বয়ং কৌটিল্যই রচনা ও প্রণয়ন করিয়াছিলেন, অথবা, ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরবর্তী কোন যুগে কৌটিলীয় সিদ্ধান্তনিচয় অবলম্বন করিয়া অপর কোন ব্যক্তি বা মনীষীসংঘ তাহা করিয়াছিলেন? এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্বিতীয় একটি প্রশ্নের আলোচনাও কথঞ্চিৎ করিতে ইচ্ছুক। সেই–প্রশ্নটি হইল এইরূপ–এই অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত বিষয়সমূহ কি কোন ঐতিহাসিক রাজ্যে প্রচলিত শাসনপ্রণালীর চিত্র বলিয়া গৃহীত হইতে পারে, অথবা, সে-গুলিকে যে-কোন কালে প্রচলিত হওয়ার যোগ্য একটি আদর্শ শাসন পদ্ধতির বস্তু বলিয়া মনে করা যাইতে পারে? যে যে মনীষীরা এই দুইটি প্রশ্নের আলোচনায় প্রবৃত্ত হুইয়া স্ব-স্ব মত প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া অতি সংক্ষেপে তাঁহাদের নাম ও মতাসম্বন্ধে এইরুপ্ত একটি বিবরণ দেওয়া যাইতে পারে, যথা–
ইয়াকবি (Jacobi)-ভিনসেন্ট স্মিথ-টমাস মেয়ার (Meyer)-হপকিনসমোনাহান (শুষ্ঠামশাস্ত্রী ও গণপতি শাস্ত্রীর মত-পোষকগণ এবং জয়স্বাল, নরেন্দ্রনাথ লাহা, নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতিদ্বারা অনুস্থত)-প্রথম পক্ষ
বনাম
ইয়োলী (Jolly)-ভিণ্টারনিজ-কিথ (ডাঃ হেমচন্দ্র রায়-চৌধুরী,
ডাঃ অতীন্দ্র বসু প্রভৃতিদ্বারা অনুস্থত)–দ্বিতীয় পক্ষ
উক্ত পক্ষদ্রয়ের মধ্যে প্রথম পক্ষের পণ্ডিতেরা চন্দ্রগুপ্তমৌর্য্যের (আনুমানিক ৩২৩-২৯৮ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দ) কূটনীতিবিৎ ব্রাহ্মণজাতীয় প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যকেই অর্থশাস্ত্রের একমাত্র লেখক ও প্রণেতা বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। দৃষ্টান্তরূপে এখানে টমাসের মত উদ্ধত করা যাইতে পারে। তিনি মনে করিয়াছেন যে, এই গ্রন্থে কৌটিল্য যে চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন তাহাতে মৌৰ্য্যসাম্রাজ্যে প্রবৰ্ত্তিত ও প্রচলিত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিরই কথা প্রকাশিত হইয়াছে। ভিনসেন্ট স্মিথ ও বিশ্বাস করিতেন যে, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থখানি কৌটিল্যের নিজেরই রচনা এবং বাস্তবিক ইহা মৌৰ্য্যযুগেরই শুদ্ধ ও প্রাচীন নিদর্শন, এবং তাঁহার মতে ইহার অধিকাংশ ভাগই সেই যুগের খাটি রচনা, তবে ইহাতে কোন কোন অংশ পরবত্তী কালে প্রক্ষিপ্ত হইয়া থাকিবে। তিনি আরও লিখিয়াছেন যে, ইহাতে বর্ণিত বিষয়সমূহ মৌৰ্য্যসাম্রাজ্যস্থাপনের অনতিপূৰ্ববৰ্ত্তী কালে সংঘটিত শাসন-তন্ত্ববিষয়ক ঘটনাবলীর প্রতিধ্বনিমাত্র। এস্থলে ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, ষ্ট্রাবো, জাষ্টিন, প্রিনী, মিগাসথেনিস প্রভৃতি গ্ৰীক পুরাবিদগণ সেই কালের যে-সব ঘটনা ও সামাজিক অবস্থার বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, সে-সব অর্থশাস্ত্ৰে বৰ্ণিত বিষয়দ্বারা সুব্যাখ্যাত হইতে পারে; এবং মৌৰ্য্যসম্রাট অশোকের (আনুমানিক ২৭৩-২৩২ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দ) প্রস্তরশাসনসমূহে উল্লিখিত অনেক বিষয়ের অর্থবোধ কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের সাহায্যে সুগম হুইয়া থাকে-পরবত্তীকালে রচিত রাজনীতি শাস্ত্রগুলিদ্বারা ইহার ব্যাখ্যা কঠিন বলিয়া প্রতিভাত হয়।
দ্বিতীয়পক্ষের বাদিগণ মনে করেন যে, অর্থশাস্ত্রখানি কৌটিলীয় সিদ্ধান্তসমূহে লঙ্ক প্রত্যয় পরবর্তী যুগের কোন শিষ্য বা শিষ্যসংঘ দ্বারা রচিত হইয়া থাকিবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, কিথ সাহেব মনে করিতেন যে, ইহা প্ৰায় ৩০০ খ্ৰীষ্টাব্দের রচিত গ্রন্থ এবং ইহার বিষয়বিশেষগুলি কোন বিশিষ্ট রাজ্যের সমাজচিত্র নহে-সেগুলি একটা আদর্শী তন্ত্রের স্বরূপ বলিয়া গৃহীত হওয়ার যোগ্য এবং ইহাতে বর্ণিত ও পৰ্য্যালোচিত রীতিনীতিগুলি সাৰ্ব্বত্রিক ও সার্বকালিক যে-কোন রাজতন্ত্রে প্রচলিত হইবার যোগ্য বলিয়া ধৃত হইতে পারে। প্ৰাচীনতর ধৰ্ম্মশাস্ত্রগুলির রচনাভঙ্গির সহিত কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের রচনার ভঙ্গি বেশী মিলে না, বরং ইহা আরও পরবত্তীসময়ে ধৰ্ম্মশাস্ত্রগুলির ভঙ্গির সহিত বেশী মিলে-এইরূপ যুক্তি প্রদৰ্শন করিয়া ডাঃ রায়-চৌধুরী ও ডাঃ বস্তু এই গ্রন্থখানি খ্ৰীষ্টাব্দের প্রথম শতকে রচিত বলিয়া বিবেচনা করেন। মনীষী ইয়োলী এই গ্রন্থে রসায়ন ও খনিবিদ্যার অনেক বিষয় নিহিত আছে দেখিয়া ইহাকে ৪০০ খ্ৰীষ্টপূৰ্ব্বাব্দের রচনা বলিয়া গ্রহণ করিতে অনিচ্ছক, কারণ, তাহার মতে ভারতবাসীরা তত প্ৰাচীনকালে এই দুই বিদ্যায় বিশেষ কোন বৈশারদ্য লাভ করিয়াছিল বলিয়া জানা নাই। এই দ্বিতীয় পক্ষের পণ্ডিতগণ এইরূপও মনে করেন যে, কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র যেন একখণ্ড রাজনীতি ও অর্থনীতির দর্শনশাস্ত্র এবং ইহা বাস্তল শাসনসম্বন্ধীয় ঘটনাবলীর কোন বিশিষ্ট বিবরণনিবন্ধক গ্রন্থ নহে।
কিন্তু, মনীষা সম্পন্ন যে-কোন পাঠক এই অর্থশাস্ত্রের পাঠ্যকালে অবশ্যই লক্ষ্য করিবেন যে, ইহার বিষয়গুলি কোন ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কোন সাম্রাজ্যবিশেষের বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া লিখিত হয় নাই। স্বপ্রভু চন্দ্রগুপের ন্যায় যে কোন বিজিগীষু রাজা কেমন করিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্যান্য রাজ্যগুলিকে নিজের রাজশক্তির প্রভাবের ভিতর আনয়ন করিয়া, একীকরণ দ্বারা এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া নিজে একরাট, হইতে পারিবেন, তাহারই সূচনার জন্য অর্থশাস্ত্রখানির রচয়িত এই গ্রন্থ রচনা করিয়া থাকিবেন। এইরূপ ভাব পোষণ করিয়াই আমরা কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের আবাপ-সম্বন্ধীয় অধিকরণ-সমূহের (৬১১ অধিকরণ) বিশেষ মূল্যবত্তী স্বীকার করিতে অভিলাষী। সুতরাং কৌটিল্য নিজের প্রতিষ্ঠিত মৌৰ্য্যসাম্রাজ্যের ন্যায় নাতিবৃহৎ সাম্রাজ্যের বিষয় সূচনা করিয়াই সম্ভবতঃ এই গ্রন্থ রচনা করেন নাই। কৌটিল্যের মত রাজনীতিবিশারদ মহামন্ত্রীর পক্ষে তৎপূর্ব্ববৰ্ত্তী যুগের মগধপ্রভৃতি রাজ্যের ইতিহাসের সহিত সুপরিচিত থাকা একান্তই সম্ভবপর ছিল। তিনি যে মগধের শিশুনাগবংশীয় নন্দ দিগের রাজ্যের বিলোপসাধন করিয়া মৌর্ঘ্য চন্দ্রগুপ্তকে সেখানে সিংহাসনে অধিরূঢ় করাইয়াছিলেন এবং নিজের মতিসচিবতার ফলে বহু বহু কৰ্ম্মসচিবের সাহায্যে ও কূটনীতির প্রয়োগকুশলতায় ক্রমশঃ ভারতবর্ষে একখানি সাম্রাজ্যের পত্তন করিতে প্রয়াসী হইয়া কৃতকাৰ্য্যও হইয়াছিলেন, তাহা ত সত্য ঐতিহাসিক ঘটনা। খ্ৰীষ্টপূর্ব্ব চতুর্থ শতকের লোক হইয়া কৌটিল্যের পক্ষে পঞ্চম ও ষষ্ঠ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দের মহামানব বুদ্ধদেবের (আনুমানিক ৫৬৭-৪৮৭ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দ) সমসাময়িক, ভারতবর্ষের উত্তরভাগে প্রবৰ্ত্তিত ছোট ছোট রাজ্যসমূহে প্রচলিত রাজতন্ত্রের সব বিষয়ও জানা সম্ভবপর ছিল। কাজেই বৌদ্ধধৰ্ম্মের প্রবর্তন ও প্রচলনসময়ে অবস্থী, কোসল, বৎস ও মগধ প্রভৃতি রাজতন্ত্র রাজ্যসমূহের ও পালিভাষায় রচিত গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজ্যসমূহের বিষয় অধিকতরভাবে কৌটিল্যের অবগত থাকা আমরা অনুমান করিয়া নিতে পারি। পালিগ্রন্থসমূহে তাৎকালিক যে ষোড়শ গণতান্ত্রিক রাজ্যের নামতালিকা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে (পালি বানান অনুসারে) বজজী (ও লিচ্ছবীি), মল্লা, কম্বোজ, কুরু ও পাঞ্চালা এবং আরও একাদশ তাদৃশ গণরাজ্যের নাম পাওয়া গিয়াছে। ইহা বড়ই কৌতুহলোদ্দীপক বলিয়া বোধ হইতে পারে যে, কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের একাদশ অধিকরণে যে-সব সংঘবদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজ্যের নাম করিয়া, তাহাদিগের অধুন্যতা-গুণের জন্য তন্মধ্যে হইতে সৈন্য ও মিত্রলাভের চেষ্টা করিবার উদ্দেশ্যে বিজিগীষু রাজাকে উপদেশ করিয়াছেন, সে-সব রাজ্যের সংঘ বা গণের নামমধ্যে আমরা লিচ্ছবিক (রাজধানী উত্তর বিহারের বৈশালী নগর), ব্ৰিজিক (বিদেহ রাজ্যের “বজী’-নামে পরিচিত গণ), মল্লক (কুশিনগর ও পাবা-নগরের গণ), মদ্রেক (উত্তর-পশ্চিম প্ৰান্তদেশের সাকল-নগর রাজধানী), কুকুর (উত্তর কাঠিবার ও গুজরাতের আনৰ্ভ-প্রদেশের গণ), কুরু (রাজধানী প্রাচীন ইন্দ্রপ্রস্থ), ও পাঞ্চাল (কুরুদিগের পূর্ব্বদিকে উত্তর পাঞ্চলের রাজধানী কম্পিলানগর ও দক্ষিণ পাঞ্চলের রাজধানী কান্যকুব্জ)-এই সংঘগুলির নামও পাইয়া থাকি। কৌটিল্য এই সংঘগুলিকে “রাজশব্দোপজীবিনঃ” অর্থাৎ রাজোপাধিধারী সংঘোপজীবী বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। পালিগ্রন্থ হইতেও জানা যায় যে, বক্ষজী বা ব্রজিকের নিজগণসম্বন্ধে রাজশব্দ ব্যবহার করিতেন। অর্থশাস্ত্রের এই ক্ষত্ৰিয়শ্রেণী দিগকেও উল্লিখিত পাইতেছি। এই কাম্বোজগণের দেশ ছিল ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্ৰান্তসমীপে অবস্থিত, এবং সুরাষ্ট্রগণের দেশ ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে কাঠিবার ও গুজরাত দেশের অংশবিশেষ। অর্থশাস্ত্ৰে উপরি উল্লিখিত সংঘ বা গণসমূহের বিকিরণ বিচার করিলে, ঐতিহাসিক পণ্ডিত ভিনসেন্ট স্মিথের একটি মত অত্যন্ত সমীচীন বলিয়া আমাদের নিকট প্রতিভাত, হয়। এই মনীষী বৌদ্ধযুগের গণতান্ত্রিক রাজ্যাদিসম্বন্ধে যে কাল নির্ণয় করিয়াছেন, কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে আলোচিত অর্থনীতি ও রাজনীতির বিষয়গুলিতে যেন সেই কালেরই ছাপ উপলব্ধ হয়। স্মিথ-সাহেবের মতে সেই কাল হইল-যখন উত্তরে হিমালয় হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণে নৰ্ম্মদা নদী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ও নিয়মিতভাবে ব্যবস্থিত দেশবিভাগে স্ব-স্বপ্রধান বহুসংখ্যক রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের রাজ ব্য প্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং সেই রাজ্যগুলি বিদেশীয় দূরবত্তী অন্যান্য রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিয়া ও পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ লইয়া ব্যস্ত রহিয়া, কোন সুপ্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের অন্তভুক্ত হইতে চাহিত না-সেই কাল। এই ভাব লইয়া আলোচনা করিলে বলিতে হয় যে, পূর্বোল্লিখিত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের উৎপত্তিকাল ও বিষয়সমূহের প্রকৃতিসম্বন্ধে যে বিতর্ক চলিতেছে তাহার সমাধান হইতে পারে এবং খ্ৰীষ্টপূর্ব্ব চতুর্থ শতকে কৌটিল্য নিজেই এই অর্থশাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন এরূপ র্যাহাঁদের মত, সেই মতই সমীচীন; এবং ইহা পরবর্তী কোন যুগে রচিত হইয়া থাকিবে এইরূপ মত ততটা সমাদরণীয় হইতে পারে না। মৌৰ্য্যসম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্বে, অথবা (ইহাই অধিকতর সম্ভাবনার কথা), মগধের সিংহাসনে মৌৰ্য্যরাজ চন্দ্রগুপ্তকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া তদীয় রাজ্যটিকে লব্ধপ্রশমন-রীতিতে দৃঢ়সংহত করার পরে, কৌটিল্য, মহামন্ত্রীর কঠিন ও শ্রমবহুল কৰ্ত্তব্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া এই অর্থশাস্ত্রখানি প্রণয়ন করিয়া থাকিবেন। এই মতের পরিপোষণার্থ আমরা অর্থশাস্ত্রের যে চারিটি শ্লোকে (১।১, ২।১০, ১৫।১ ও গ্রন্থাবসানের শ্লোক) কৌটিল্যাকে (ওরফে বিষ্ণুগুপ্তকে) অর্থশাস্ত্ৰীকৃৎ বলিয়া উল্লিখিত পাই, সে-কথা ভুলিয়া যাইতে পারি না অতএব, এইরূপ বিশ্বাস অযুক্তিযুক্ত হইবে না যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌৰ্য্যের সচিবায়ত্ত সাম্রাজ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির যে প্রচলিত অবস্থা মহামগ্ৰিহিসাবে কৌটিল্য লক্ষ্য করিয়াছিলেন তাহা, এবং চাতুরন্ত মহীপতিত্বের আকাজকী যে-কোন বিজিগীযুর পক্ষে যেরূপ আদর্শ শাসনপ্রণালী ও ব্যবহারপদ্ধতির প্রচলন করা আবশ্যক তাহা-এই উভয়বিধ অবস্থা উদ্দেশ্য করিয়াই তিনি নিজ রচিত অর্থশাস্ত্রের আলোচ্য ও প্রতিপাদ্য বিবিধ বিষয়ের অবতারণা ও মীমাংসা লিপিবদ্ধ করিয়া থাকিবেন।
শ্ৰী রাধাগোবিন্দ বসাক
সেতু
এই বইটার পিডিএফ পাওয়া যাবে কি ???
Bangla Library
হ্যাঁ, দেয়া যাবে।
Jannatul Qaishari
Full pdf ta kothai pabo?
संजीत दास
এই বইটির সম্পূর্ণ পোস্ট পাওয়া যাবে কি
Bangla Library
চেষ্টা করব দিতে।
Maksud
এই বইটার Pdf কপি আমাকে ইমেল করে দিবেন।
Shuvo Koiri
নমষ্কার!!বইটার পিডিএফ কপি কি পেতে পারি?
সুমন আমীন
বইটার pdf কপি দিলে উপকৃত হতাম
Ap
আমাকে এই বইয়ের pdf দেওয়া যাবে
হাসান সিদ্দিক
Pdf দিলে উপকৃত হব।