কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – এম আর আখতার মুকুল
সাগর পাবলিশার্স
প্ৰথম মুদ্রণ – ১লা ফাল্গুণ ১৩৯৩, ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলংকরণ : ক্রিয়েটিভ গ্রুপ ৭০ কাকরাইল, ঢাকা
KOLKATA KENDRIK BUDHIJIBI By M.R. Akhtar Mukul Published by Mustafa Hasan Nasir (Kabi), Sagar Sagar Publisher’s Baily Rd. Dhaka Bangladesh
উৎসর্গ
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্রষ্টা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে
ভূমিকা
১৮৫৭ সালে একটি ব্যর্থ সিপাহী অভ্যুত্থানের পর ভারতবর্ষে মুসলমানদের জন্য প্রচন্ড দুর্ভোগ ও অসার্থকতা নেমে আসে। ভারতের ইতিহাসে এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যে এ বছরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে ভারতের শাসনভার বৃটিশ প্রশাসনের উপর ন্যস্ত হয় অর্থাৎ ইংল্যান্ডের রাণীর শাসন এদেশে প্রবর্তিত হয়। এ বছর থেকেই বৃটিশ সরকার ভারত শাসনের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী হলো। ভারতে বৃটিশদের অধিকারে কি সৌভাগ্য এল তা বর্ণনা করা যায় না। প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত বৃটিশ সাম্রাজ্যের মূল্যবান সম্পদ ছিল ভারতবর্ষ। অন্যপক্ষে ভারতীয়রা লক্ষ্য করলো কোম্পানীর হাত থেকে ক্ষমতার হস্তান্তর, কোম্পানীর মালিকানা থেকে মুক্ত হয়ে সিপাহী বিদ্রোহে বিপর্যস্ত ভারতীয়রা চরম বিমর্ষতায় প্রভুর পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। তারা অনুভব করলো যে, এখন আর স্বাধীনতার সম্ভাবনা নেই, সম্ভবতঃ চিরকালের জন্য বৃটিশরা তাদের আধিপত্য স্থাপন করেছে। এখন ভারতবর্ষ বৃটিশ সাম্রাজ্যের অংগীভূত।
সিপাহী বিদ্রোহের ফলে বৃটিশদের কাছে মুসলমানরা কুচক্রী এবং দুরভিসন্ধিপরায়ণ বলে চিহ্নিত হলো। এভাবে চিহ্নিতকরণের ফলে মুসলমানরা বৃটিশদের কাছ থেকে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভে বঞ্চিত হলো। একটি মুসলিম বিরোধী মনোভাব বৃটিশ শাসকদের মনে দানা বাঁধতে লাগলো। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বৃটিশদের বিরূপতার আর একটি কারণ ছিলো। বৃটিশরা যে ধর্মের অনুসারী সে ধর্ম, অর্থাৎ খৃষ্টান ধর্ম একটি বিশ্বধর্ম। তেমনি মুসলমানরা যে ধর্মের অনুসারী অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম, সেটাও বিশ্বধর্মী। উভয় ধর্মই সকল মানুষের আনুগত্য দাবী করে। ইসলাম যেমন বিশ্বজনীন ধর্ম তেমনি খ্রীষ্টান ধর্মও। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুসলমানদেরকে নিষ্প্রভ প্রমাণ করবার জন্য বৃটিশ ঐতিহাসিক এবং ধর্মতত্ত্বজ্ঞগণ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ভাষ্য রচনা করতে লাগলেন। তাদের রচনায় ইসলামের প্রতি এক প্রকার অসহনশীল মনোভাব প্রকাশ পেতে লাগলো। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের বহু অংশ অধিকার করেছিলো। অটোমান তুর্কীদের প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ এবং বিরুদ্ধতার কারণে ইউরোপীয় খ্রীষ্টানগণ ইসলামের প্রতি একটি বিকৃত মনোভাব লালন করতে লাগলো। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি মুসলমানদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের বিরূপতার তিনটি কারণ সুস্পষ্ট হচ্ছে। একটি হল সিপাহী বিদ্রোহ, দ্বিতীয়টি হল ইসলামের প্রতি খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিরূপতা এবং তৃতীয় হল অটোমান শাসকদের প্রতি ইউরোপীয় শাসকদের বিরুপতা। ইংল্যান্ডে সে সময় একটি বিশ্বাস ছিল যে, মুসলমানদের নেতৃত্বেই সিপাহী বিদ্রোহ রূপ পেয়েছিলো এবং ভারতে বৃটিশ শাসন রক্ষা পেয়েছে অংশত হিন্দুদের সহায়তায়। এ ধারণার কারণ হল হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ বৃটিশরা লক্ষ্য করেছিলো। স্যামওয়েল স্মিথ নামক বৃটিশ পার্লামেন্টের একজন সদস্য ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বলেছিলেন যে, ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মুসলমানদের কারণেই বৃটিশ বিরোধিতা বিদ্যমান রয়েছে। এই চিন্তা বৃটিশদের মনে বহুদিন পর্যন্ত প্রোথিত ছিলো তার প্রমাণ আমরা পাই ১৯১০ সালে স্যার হ্যানরী জনস্টোন-এর মন্তব্যে। এত পরে এসেও জনস্টোন বলছেন যে, সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতে একটি মুসলিম সাম্রাজ্য স্থাপনের শেষ চেষ্টা এবং এই চেষ্টায় মুসলমানরা হিন্দু এবং ইংরেজ উভয়কেই তাদের বিপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করেছিলো।
ইসলামের সংগে খ্রীষ্টধর্মের একটি প্রবল বিরোধ ছিলো। খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারকগণ ভারতবর্ষে ইসলামকে তাদের প্রচন্ড বিপক্ষ হিসাবে ধরে নিয়েছিলো। খৃষ্টান ধর্ম ভারতবর্ষে এসেছিলো ইউরোপ থেকে এবং খৃষ্টধর্মের প্রবক্তাগণ একটি মিথ্যা অহমিকা নিয়ে এদেশের মানুষকে আলো দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। বাইবেলের বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা পেয়েছিলো তারা মুসলমানদের কাছ থেকে। স্যার আলফ্রেড লায়াল ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে লিখেছিলেন যে, ভারতবর্ষে খ্রীষ্টানদের দায়িত্ব হবে বাইবেল প্রচারের ক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করা। অর্থাৎ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এদেশে খ্রীষ্টান ধর্মকে স্থায়ী আসন দেয়ার চেষ্টা করা।
অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে বৃটিশদের চিরকাল রাজনৈতিক ভাবনা ছিলো। প্রথমে বৃটিশরা কিন্তু রুশ ভীতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুরস্ককে সমর্থন জানিয়েছিলো। গ্রাডস্টোন যখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলির ঘটনা নিয়ে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। পুস্তিকাটির নামঃ The Bulgarian Horror and the Question of the East. এই পুস্তিকা প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় দু’শ’ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায় এবং মূলতঃ এই পুস্তিকা প্রচারের ফলে বৃটিশ জনসাধারণের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি বিরূপতা গড়ে ওঠে। এই পুস্তিকাটি এমন এক সময়ে প্রচারিত হয় যখন ভারতবর্ষের মুসলমানদের প্রতি বৃটিশদের বিদ্বেষ সুস্পষ্ট এবং ধর্মযাজকদের প্রচারণায় ইসলামের সংগে খ্রীষ্টধর্মের দ্বন্দ্বও অভিব্যক্ত। এই উভয় ঘটনার সংগে অটোমান তুর্কীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এসে যুক্ত হলো এবং বৃটিশ সরকার এবং বৃটিশ জনসাধারণ তুর্কী সাম্রাজ্যের আশু পতন কামনা করতে লাগলো। তুরস্কের বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিক্ষোভ ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বৃটিশদের বিদ্বেষের সংগে সংশ্লিষ্ট। এ কারণে সংশ্লিষ্ট যে, তুরস্কের সুলতান ভারতীয় মুসলমানদের কাছে খলিফা হিসাবে সম্মানিত ছিলেন। তুরস্কের প্রতি বিদ্বেষ ভারতীয় মুসলমানদেরকে বৃটিশদের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তোলে। ভারতীয় মুসলমানগণ তুরস্কের প্রতি বিরুদ্ধতা ইসলামের প্রতি প্রচন্ড বিরোধিতা বলে গণ্য করলেন। খলিফা সকল মুসলিম দেশের রাষ্ট্রনায়ক নন বটে; কিন্তু ধর্মনায়ক হিসাবে তিনি স্বীকৃত ছিলেন। সুতরাং খেলাফতের উচ্ছেদের অর্থ হচ্ছে ইসলামের উচ্ছেদের সূত্রপাত। মুসলমানরা তখন এভাবেই চিন্তা করছিলো। সুতরাং ভারতবর্ষে মুসলমানদের একটি নতুন রাজনৈতিক চৈতন্যের সূত্রপাত ঘটলো খেলাফতকে কেন্দ্র করে।
এ সময় বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় যে, অনেক ইংরেজ ঐতিহাসিক ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রফেসর মনির উইলিয়াম (Professor Monir William) তাঁর Progress of Indian Reoligious Thought. নামক গ্রন্থে ইসলামকে চিহ্নিত করেছিলেন “ইহুদীবাদের জারজপুত্র’ হিসেবে এবং রসূলের জীবনীকার সার উইলিয়াম ম্যুর লিখেছিলেন যে, বিশ্ব সভ্যতা, স্বাধীন চিন্তা এবং সত্যের কঠোরতম শত্রু হচ্ছে মোহাম্মদের তরবারি এবং কোরান। (The Sword of Muhammad and the Quran are the most Stubborn enemies of cvilization, Liberty and Truth which the world yet known). আর একজন তথাকথিত মহাপণ্ডিত ম্যালকম ম্যাককোল ইসলামকে একটি বর্বর ধর্ম বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামের বর্বরতার চারটি কারণ ছিলো। একটি হচ্ছে বহুবিবাহ, আর একটি হচ্ছে দাসপ্রথা, আর একটি হচ্ছে স্বাধীন চিন্তার অস্বীকৃতি এবং চতুর্থ হচ্ছে মুসলমানদের সংগে পৃথিবীর অবশিষ্ট মানবগোষ্ঠীর চিরকালীন ব্যবধান সৃষ্টি।
সর্বভারতের মুসলমানদের জন্য সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাঙালির জন্য বেদনাপূর্ণ একটি ঘটনা পূর্বেই ঘটেছিলো। সেটা ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে। কোম্পানীর শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এবং এ উপমহাদেশে বিদেশী শাসন প্রতিষ্ঠার যে প্রবল প্রতিবাদ সিরাজউদ্দৌলা করেছিলেন তার ফলস্বরূপ চক্রান্তের স্বীকার হয়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের অর্থ হল বাঙালি মুসলমানদের আত্মঅধিকার নিঃশেষিত হওয়া। সিরাজউদ্দৌলার পতনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল কুসিদজীবী মহাজন শ্রেণীর হিন্দুদের ইংরেজের সংগে সহযোগিতা। এর সংগে যুক্ত হয়েছিলো ইংরেজদের কূটকৌশল। সিরাজউদ্দৌলার পতন বাঙালি মুসলমানদের জন্য আশাভংগের কারণ হয়েছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৎসর হচ্ছে ১৭৯৩ সাল। ভারতের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির খাজনা এবং রাজস্ব আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। এই বিশেষ পদ্ধতির ফলে মুসলমানদের ভূস্বামীগত অধিকার কৌশলে বিলুপ্ত করা হয় এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু আমলা এবং গোমস্তারা ক্রমান্বয়ে এসব জমিদারী আত্মসাৎ করেন এবং প্রতিপত্তি জমিদারে পরিণত হন। অর্থাৎ সর্বতোভাবে মুসলমানরা স্বত্বহীন অসহায় মানবগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এর পরে সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতা মুসলমানদের জন্য চরম সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। এই তিনটি ঘটনাই ইংরেজ রাজত্বে মুসলমানদের অসহায়তা প্রমাণিত করে। মুসলমানরা রাজশক্তি হারালো। একই সংগে ইংরেজরা এদেশে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং ইংল্যাণ্ডের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য রাজস্ব ও জমিদারী ব্যবস্থার যেসব সংস্কার করলো তার সবই গেলো মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিকূলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তনের ফলে এবং সংগে সংগে নিস্কর বা লাখেরাজ জমির বাজেয়াপ্তির ফলে মুসলমানরা কপর্দকহীন নিঃস্ব হল এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু তহশীলদার নায়েব মুহরি ও গোমস্তা ইংরেজদের কৃপা-অনুগ্রহে ভূস্বামীর অধিকার লাভ করলো। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর আরেকটি আঘাত এলো যখন লর্ড বেন্টিংক ফার্সীর পরিবর্তে এদেশে ইংরেজীকে রাজভাষা হিসাবে ঘোষণা করলেন। দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এর ফলে যে পরিবর্তন এলো তা সুদূরপ্রসারী ছিলো। কিন্তু মারাত্মক সর্বনাশ হলো ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য। মুসলমানদের যখন এহেন অবস্থা তখন কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা আপন স্বার্থ চিন্তায় সুপরিকল্পিতভাবে ইংরেজদের সহযোগিতা করে। ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শিক্ষা দেয়ার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এবং বাংলা গদ্যসৃষ্টিকে উপলক্ষ করে কোলকাতার মান্যগণ্য প্রতাপশালী হিন্দুদের সংগে ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঘটে। হিন্দু কলেজে বাঙালি হিন্দুরা লেখাপড়া করতে থাকে এবং ইংরেজী শিক্ষায় মনোনিবেশ করে। এ সমস্ত ঘটনা পরম্পরায় প্রমাণিত হয় যে, ঊনিশ শতকরে সূচনা থেকেই হিন্দুরা ইংরেজদের সংগে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলো। রাজস্ব সংস্কারের ফলে ইংরেজদের আশাতীত লাভ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের টাকা এবং কাঁচা মালের সাহায্যে ইংল্যান্ডের ডান্ডী, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার প্রভৃতি বাণিজ্য প্রধান শহরগুলোর দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। সংগে সংগে বাঙালি হিন্দুদের ভাগ্যেরও দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং এদেশে প্রতাপশালী নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঊনিশ শতকে কিছু মুসলমান তাদের উপর যে অন্যায় আচরণ হচ্ছে সেজন্য বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং সেজন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তেও দ্বিধা করেননি। এক্ষেত্রে তীতুমীরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলতঃ তীতু মিয়ার আন্দোলনের সূত্রপাতে ছিল মুসলমান সমাজের জন্য একটি সংস্কার আন্দোলন। এই সংস্কার আন্দোলনকে ফারাজী আন্দোলন বলা হয়। পশ্চিমবংগের চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া জেলাকে কেন্দ্র করে তীতুমীর তাঁর আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। এই সংস্কার আন্দোলনে হাত দিতে গিয়ে তীতুমীরকে হিন্দু জমিদারদের সংগে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। এবং সংঘর্ষ ক্রমশঃ ব্যাপক আকার ধারণ করে হিন্দুরা তীতুমীরের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে ইংরেজের সহায়তা কামনা করে। তখন তীতুমীরকে বাধ্য হয়ে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নারিকেলবাড়িয়ায় একটি স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ইংরেজ সরকার তখন বিচলিত বোধ করে। বারাসাতের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজাণ্ডার তীতুকে দমন করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হন। শেষ পর্যন্ত তীতুকে দমন করবার জন্য মেজর স্কট নামক একজন ইংরেজ কোলকাতা থেকে একটি পদাতিক বাহিনী নিয়ে তীতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তীতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরী করে দুর্ধর্ষ ইংরেজ বাহিনীর সংগে যুদ্ধ করেন এবং ১৮৩১ সালের ২২শে নভেম্বর শহীদ হন। ফারাজী আন্দোলন শুরুতে কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজে ধর্মীয় আচরণের ক্ষেত্রে যেসব ভ্রান্তি অনুপ্রবেশ করেছে সেগুলোর সংশোধন করা কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হিন্দু জমিদারগণ এ আন্দোলনকে তাদের ক্ষমতা উৎখাত করার আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করলো। যার ফলে শেষ পর্যন্ত ফারাজী আন্দোলনটা একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
[দুই]
ঊনবিংশ শতাব্দী বাঙালি হিন্দুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাল। এ সময় কোলকাতায় অবস্থানকারী বিত্তবান এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় মধ্যযুগ অতিক্রম করে তৎকালীন ইউরোপের আধুনিকতার সংগে সম্প্রীতি স্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছে। যে সমস্ত প্রতিভাশালী হিন্দু এ যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই পাশ্চাত্য বিদ্যাবত্তায় দীক্ষিত এবং ভারতীয় হিন্দুর ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন। এঁরা একেকজন একেক ধারার উদ্গাতা হয়েছিলেন। কেউ ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, কেউ ধর্মের ক্ষেত্রে, কেউ সামাজিকতার ক্ষেত্রে, কেউবা হিন্দুত্বের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, প্রিস দ্বারকানাথ ঠাকুর ইত্যাদি। এঁদের প্রত্যেকের সামগ্রিক চিন্তাধারা ছিল হিন্দু সমাজকে সমৃদ্ধ করা এবং হিন্দুত্বের সৌকর্য উদঘাটিত করা। এঁদের কারো দৃষ্টিতেই প্রতিবেশী মুসলমান চিহ্নিত হয়নি। এদের কারো বক্তব্যেই মুসলমানকে নিয়ে নয় এবং মুসলমান ও হিন্দু মিলিয়ে একটি জাতিসত্তার কল্পনা এঁদের কারোই ছিলো না। রাজা রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলন ‘হিন্দু ধর্মের উদ্দেশ্যে ছিল। তিনি আচরণগত দিক থেকে হিন্দু সমাজের বিকলতা এবং বিভ্রান্ত দূর করে আর্য সমাজে উদ্ভূত আদি বৈদিকতার পুনরুজ্জীবন যাচনা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজের ধর্মভিত্তিক কিছু সামাজিক আচরণের সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুদের প্রাচীন গৌরব সম্পর্কে হিন্দু সমাজকে অবহিত করতে চেয়েছিলেন এবং সংগে সংগে হিন্দু মনে গর্ব এবং আত্মপ্রসাদ সৃষ্টির প্রয়াসী হয়েছিলেন। এঁরা কেউ ব্যক্তি জীবনে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না এবং কর্মজীবনে এঁদের আচরণে মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশিত বা প্রমাণিত হয়নি কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই আপন আপন জীবনচর্চায় হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, মুসলমান সমাজের নয়। সুতরাং ঊনিশ শতকের রেনেসাঁ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে সে কথাটি বিভ্রমাত্মক। এঁদের কারো আবেদনই নিম্নবর্ণের অচ্ছ্যুত হিন্দু সমাজের প্রতি ছিল না, এঁদের আবেদন কোলকাতার বাইরে বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলে প্রসারিত ছিল না এবং মুসলমান সমাজ এঁদের চিন্তায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিল। উপরন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনার সাহায্যে হিন্দুকে মুসলমানের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিবেচনায় মুসলমান ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাগুলোতে হিন্দুদের বিরুদ্ধ পক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন উপন্যাসের হিন্দু নায়কগণ মুসলমানকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছে এবং করেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অথবা রাজা রামমোহন রায়ের ঔদার্যের প্রভাব তৎকালীন হিন্দু সমাজে পড়েনি। কিন্তু বঙ্কিমের মুসলিম বিদ্বেষ হিন্দু সমাজকে আনন্দিত করেছে। ঔপন্যাসিক হিসাবে বঙ্কিম অসাধারণ গুণান্বিত কিন্তু সামাজিক ও ধর্মীয় নীতির ক্ষেত্রে তিনি সংকীর্ণতাকে সমর্থন জানিয়েছিচলেন এবং এ কারণেই তিনি হিন্দু সমাজে ঋষি বলে সম্মানিত। তাই একথা সুনিশ্চিত করে বলা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র বাঙালির জন্য কোনো রেনেসাঁ গড়ে ওঠেনি। এবং কোলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞানের বিকাশে যে রেনেসাঁর আগমন ঘটেছিল বলে বলা হয় সেই রেনেসাঁ ছিল অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক লোকের জন্য। সুতরাং আমাদের অর্থাৎ মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের জন্য উপরে বর্ণিত পটভূমি যথার্থভাবে গুরুত্বের সংগে পর্যালোচনা করেই ঊনিশ শতকের মুসলমানদের চরিত্র উদ্ঘাটন করতে আমরা সক্ষম হবো।
[তিন]
এই প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা যে, ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় বছর দেড়েক ধরে দৈনিক ইত্তেফাকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে এম আর আখতার মুকুল-এর যে তত্ত্ব ও তথ্যমূলক লেখা ছাপা হয়েছে তা’ এখন ‘কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বুদ্ধিজীবী’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। এম আর আখতার মুকুল পাকিস্তান আমলের একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক এবং বেতার ব্যক্তিত্ব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইনি নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের প্রচার অধিকর্তার দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মারফত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এ সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় ‘চরমপত্র’ নামক অনুষ্ঠান এম আর আখতার মুকুল-এর এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় সাত মাস ধরে প্রতিদিন এই আশাবাদী ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান গ্রন্থনা এবং স্বীয় কণ্ঠে তা প্রচার করা বিস্ময়কর ব্যাপার বৈকি! ফলে তিনি সমগ্র জাতির প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।
‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থে এম আর আখতার মুকুল অসংখ্য বই থেকে উদ্ধৃতির সাহায্যে ঊনিশ শতকের হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি পরিচয় উদ্ঘাটন করবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ঊনিশ শতকের মানুষদের ভূমিকা এবং মনমানসিকতা সম্পর্কে আমাদের মনে চৈতন্যোদয়ের সৃষ্টি করা। আলোচ্য সময়ে বর্ণহিন্দুদের কর্মকাণ্ড কি ছিল এবং সেই প্রেক্ষিতে অথবা ভিন্নভাবে মুসলমানদের ভূমিকাই বা কি ছিল, এই গ্রন্থ পাঠ করলে তা’ আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হবে। এক কথায় বলতে গেলে আমাদের জাতীয় ইতিহাস রচনায় এবং ঐতিহ্য নির্ণয়কালে এম আর আখতার মুকুল-এর উপস্থাপিত বক্তব্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থে লেখক একটা ভিন্নধর্মী অথচ পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভংগীতে ১৭৫৭ থেকে ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন। এটা নিশ্চিতভাবে এম আর আখতার মুকুল-এর দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা।
প্রসংগতঃ বলতে হয়, যেভাবে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষকরা ‘থিসিস’ রচনা করে থাকেন, এই গ্রন্থ সে ধরনের কোন আনুষ্ঠানিক থিসিস নয়। অথচ লেখক তাঁর প্রতিটি বক্তব্যের সমর্থনে অসংখ্য বই থেকে গবেষণাধর্মী উদ্ধৃতি উল্লেখ করে গ্রন্থটি আশানুরূপভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে এসব ব্যাখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই এতদিনকার প্রতিষ্ঠিত বক্তব্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু লেখকের বক্তব্য বিতর্কমূলক হলেও তা খণ্ডন করা খুবই দুরূহ এবং অসম্ভব মনে হয়।
গবেষণার কঠিন বিষয়বস্তুগুলোকে এম আর আখতার মুকুল যেভাবে কথকতার ভংগিতে পাঠকদের কাছে অত্যন্ত সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপিত করেছেন, তা’ নিশ্চিতভাবে প্রশংসার দাবী রাখে। প্রবন্ধ-সাহিত্যের পাঠককুল সব সময়েই সীমাবদ্ধ বলে এতদিন ধরে আমাদের যে ধারণা ছিল, এম আর আখতার মুকুল সেই ধারণা ভেংগে দিতে সক্ষম হয়েছেন। দৈনিক ইত্তেফাকে যখন এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন এর জনপ্রিয়তা আমাদের হতবাক করেছে। এক্ষেত্রে লেখকের বক্তব্য উপস্থাপনার ভংগি ও ভাষার ব্যবহার নতুনত্বের দাবী রাখে। সাম্প্রতিককালে বহুল প্রচারিত ‘আমি বিজয় দেখেছি’ গ্রন্থের লেখক এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থটিও জনপ্রিয় করতে চেয়েছেন এবং আমার স্থির বিশ্বাস— এই বইটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হবে।
সৈয়দ আলী আহসান
দু’টি কথা
তা’হলে খোলাখুলিভাবে বলাই ভালো। ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে আমি হচ্ছি তিন তিনটা ঐতিহাসিক ‘সময়-কালের মানুষ। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গাংগেয় বদ্বীপ এলাকা বাংলাদশে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জীবনের প্রথম ১৭ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ বাল্যে ও কৈশোরে আমি ছিলাম সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ ভারতের নিগৃহীত ‘নেটিভ’। তখন আমার জন্মভূমির নাম বাংলা প্রেসিডেন্সী (বৃহত্তর অবিভক্ত বাংলা)।
মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে যৌবনের বছরগুলো। আমার যৌবনের ২৪ বছর উপনিবেশবাদী পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে অতিবাহিত করলাম। প্রতি মুহূর্তে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম এই বিষ-যন্ত্রণা। ধর্মের নামে সীমাহীন অন্যায় আর অবিচারের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ অবলোকন করলাম। এ সময় আমার দেশের নাম হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান।
শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে একটা ভয়াবহ গণহত্যার পটভূমিতে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার চৌহদ্দিতে যখন আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির গৌরব অর্জন করলাম, তখন আমি ৪২ বছরে পা দিয়েছি। যৌবনের এই প্রান্তদেশে দাঁড়িয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করলাম। আমার মাতৃভূমিটা আবার পুরোনো ও আদি নামকরণ ফিরে পেলো। আমার দেশ হলো বাংলাদেশ। তাও তো আজ প্রায় ১৪ বছর আগেকার কথা।
১৯৮৫ সালে এসে এখন আমার প্রৌঢ় ত্বের সময় চলছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ‘তিন তিনটা ঐতিহাসিক সময়-কালের মানুষ’ হিসেবে বহু উত্থান-পতন আর ভাংগা-চোরা ঘটনাবলীর সাক্ষী হয়েও তো’ বাঙালি জাতির একটা পরিচ্ছন্ন, প্রকৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ দেখতে পাই না। সবখানেই গরমিল।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রচিত বাংলার ইতিহাস বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থে একটা চমৎকার বক্তব্য রেখেছেন। “……বাঙলার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙালী কখনও মানুষ হইবে না। বাঙলার ইতিহাস নাই, যাহা আছে তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙলার বিদেশী বিধর্মী অসার পরপীড়কদের জীবনচরিত মাত্র। বাঙলার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙলার ভরসা নাই।…..তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙালী তাহাকেই লিখিত হইবে।……আইস, আমরা সকলে মিলিয়া বাঙলার ইতিহাসের অনুসন্ধান করি। যাহার যতদূর সাধ্য, সে ততদূর করুক…….।”
এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বংকিমচন্দ্র বাঙালি বলতে বাঙালি হিন্দুদের চিহ্নিত করেছেন এবং ‘তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে’ বলে তৎকালীন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহিত করেছেন। এ জন্যই এতগুলো বছর পরে বিংশ শতাব্দীর আশি দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা, বাঙালি কৃষ্টি, বাংলা সাহিত্য আর বাঙালী সংস্কৃতির দ্রুত প্রবহমান এবং পরিবর্তনশীল ইতিহাসের ধারার অনুসন্ধান করতে বসে নানা বিভ্রাট ও বিপাকের মুখোমুখি হচ্ছি।
এ সম্পর্কে বিশিষ্ট প্রবন্ধকার শ্রী বিনয় ঘোষ-এর মতে “ইতিহাসের ধারা অনুসন্ধানকারীর একটা নিজস্ব ‘দৃষ্টি’ থাকা চাই। এই দৃষ্টিকোণটাই আসল। এই দৃষ্টিকোণের পার্থক্যের জন্য ইতিহাস উপন্যাস হয়, ঘটনাপঞ্জী হয়, জীবনচরিত হয়, আবার দ্বন্দ্বমুখর বিরোধবন্ধুর বাস্তব জীবনেতিহাসও হয়।”
একজন যথার্থই বলেছেন, বাঙলার ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে এবং আর একজন দ্ব্যর্থহীনভাবে পথ-নির্দেশিকা দিয়েছেন যে, ইতিহাসের ধারা অনুসন্ধানকারীর একটা নিজস্ব ‘দৃষ্টি’ থাকা চাই। এই প্রেক্ষিতেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এক্ষণে আমি বাঙালি জাতির সামগ্রিক ইতিহাস সন্ধান করছি। আমি আমার পিতা-প্রপিতামহদের আসল ইতিহাস খুঁজে বের করতে আগ্রহী। আমি বাংলাদেশের বাঙালি জাতির মূল সূত্র এবং ঐতিহ্যের সবটুকু উদ্ঘাটন করতে চাই।
আমার মনে অনেক প্রশ্ন আর কৌতূহল। ইতিহাসের কোন্ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠী যুগের পর যুগ, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহিরাগত আর্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং আর্যদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব কিছুকেই বর্জন করেছিলো? আবার ইতিহাসের কোন্ প্রেক্ষিতে স্থানীয় এই বিশাল জনগোষ্ঠী খৃষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে কয়েকশ’ বছর ধরে এদেশে আগমনকারী সুফী পীর, ফকির, দরবেশ ও আউলিয়াদের প্রচারিত উদারপন্থী (রক্ষণশীল শরিয়ত পন্থী নয়) ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো? আর কেনই বা বাংলাদেশের স্থানীয় ও বহিরাগত এই মুসলিম জনগোষ্ঠী নব্য জাতীয়তাবাদ দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে সোচ্চার হয়েছিলো, “এই দেশ, এই মাটি আমার, ভাষা, এই সাহিত্য আমার— এখানকার সংস্কৃতি আর লোকাচার সব কিছুই আমার। আমি এই দেশের বাঙালি সন্তান এবং আমাদের অধিকাংশই ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান।”
আমি বুঝতে চাই, কোন্ মন-মানসিকতার দরুন বাস্তবতাকে স্বীকার করতে না পেরে সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের সময় আর্যদের উত্তরসূরী বর্ণ হিন্দুরা গাংগেয় বদ্বীপ এলাকার বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলো এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘শরাফত’ ও ‘খানদানী’ মুসলমানত্বের দাবীদার অবাঙালী মুসলমানরা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
আমি জানতে চাই, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লায়লা-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, ইমাম বিজয়, রসুল বিজয়, আলিফ লায়লা, হানিফ-কয়রাপরী, দাস্তান-ই আমীর হামজা, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান প্রভৃতি আরবী ও ফারসী কাহিনীভিত্তিক পুঁথি সাহিত্যের পাশাপাশি চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, চৌতিশা, বিদ্যাসুন্দর, মনসা মঞ্জিল, সোনাভান, জ্ঞান সাগর (আলীরাজা প্রণীত), জ্ঞান প্রদীপ (সারইদ সুলতানকৃত), কাফনচোর, যোগ কলন্দর (সৈয়দ মুর্তজা প্রণীত), পদ্মাবতী, মধুমালতী, মৃগাবতী, সতী ময়না ও চন্দায়ন প্রভৃতি কাব্য কাহিনীগুলোও গণমানুষের হৃদয় জয় করে রয়েছে?
আমি অনুধাবন করতে চাই, আমার মায়ের মুখের ভাষা কিভাবে দ্রাবিড় সভ্যতা ও বৌদ্ধ চর্যাচর্যবিনিশ্চয়-এর মাঝ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের বাহক সংস্কৃত ভাষার আধিপত্যের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে সুফী মনীষীদের প্রভাব, মুসলিম সুলতানদের অবিস্মরণীয় অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতা, বৈষব সাহিত্যের মাধুর্য এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকে আধুনিক সাহিত্যের গৌরবকে বক্ষে ধারন করে আজ সম্মুখপানে কেমন করে ধাবিত হয়েছে?
আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে চাই, প্রথমে জাতিগতভাবে বাঙালি এবং একই সঙ্গে অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এই বিরাট জনগোষ্ঠী কেন দল বেঁধে ঈদের নামাজ পড়ে, নিয়মিত জুম্মার নামাজ আদায় করে, রোজা রাখে, দাদী-নানীর কথায় বাড়ীতে মিলাদ পড়ায়, জানাজায় শরীক হয়, পীরের দরগায় মানত করে, হাতে তাবিজ লাগায়, আজান শুনলে মেয়েরা মাথায় কাপড় দেয়— আরও কত কিছু করে?
এঁরাই আবার কেনইবা একুশে ফেব্রুয়ারীতে ভাষা আন্দোলনের বার্ষিকী উদযাপন করে, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী পালন করে, বাংলা নববর্ষে হালখাতা করে, বসন্তের আগমনে মেয়েরা কপালে টিপ দিয়ে বাসন্তী কাপড় পরে, অবসর সময়ে কিংবা বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সংগীত উপভোগ করে, কবিতার আসরের আয়োজন করে, নবান্নের উৎসব করে, কুনজরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শিশদের কপালে কাজলের টিপ দেয়, উৎসব-পার্বণে বাড়ীর উঠোনে আলপনা আঁকে, বিয়ে বাড়ীতে কলাগাছ লাগায়, কুলায় ধান-দুর্বা দিয়ে আর বাড়ীর আংগিনায় ঘড়া ভর্তি পানি ঢেলে নববধূকে বরণ করে, ছেলের মুখে ভাত আর হাতে খড়ির উৎসব করে, দূর দেশে যাওয়ার আগে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করে আরও কত কি?
এতসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবমুখী এবং নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালি জাতির সামগ্রিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসন্ধান করে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশী। এ ইতিহাসের মূল ধারা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে জীবন সংগ্রামের ইতিহাস— এ ইতিহাস নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে সৰ্পিল রেখায় যুগ থেকে যুগান্তর অতিক্রম করে সম্মুখ পানে ধাবিত হচ্ছে।
আগেই বলেছি যে, বাঙালি জাতির একটা পরিচ্ছন্ন বাস্তব ইতিহাস দেখতে পাই না। সবখানেই গরমিল— নানা বিভ্রাট আর বাহানা। বাঙালি জাতির যেটুকু ইতিহাস পাচ্ছি, হলফ করে বলতে পারি যে, সেখানে আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি গণমানুষের কথা তেমন করে লেখা নেই। সেখানে তো অনেকগুলো পরিচ্ছদই হয় বিকৃত না হয় অনুপস্থিত? এ সব ইতিহাস প্রণেতা আর সাহিত্যিকদের দৃষ্টিকোণের সংগে কার্যতঃ আমাদের দৃষ্টিকোণের বিস্তর ফারাক। আমরা তো আসলে গাংগেয় বদ্বীপ এলাকা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বাঙালি জাতির ইতিহাস ও. ঐতিহ্য অনুসন্ধান করছি। এ ইতিহাস এ দেশের মাটি আর বাতাসে গড়ে-ওঠা অকৃত্রিম সন্তানদের আদি পুরুষের জীবন সংগ্রাম এবং কৃষিভিত্তিক বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস।
এ রকম এক প্রেক্ষাপটে পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে শুধুমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালের বিবৃত ইতিহাসের গরমিল এবং বিভ্রাটের তথ্য উপস্থাপিত করেছি।
আমাদের জীবদ্দশায় যদি বাঙালি জাতির প্রকৃত ইতিহাস রচনা সম্ভব নাও হয়; তথাপিও আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য এই নিবন্ধগুলো একটা পথ-নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস রয়েছে।
পরিশেষে ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থের রচনা ও প্রকাশকালে যাঁদের অকৃত্রিম সহযোগিতা লাভ করেছি তাঁদের কথা বলতে হয়। ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে পরবর্তী দেড় বছরকাল ধরে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে এই লেখা প্রকাশের সুযোগ প্রদান করায় আমি ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এঁদের মধ্যে সর্বজনাব মইনুল হোসেন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আখতার-উল আলম এবং কবি আল মুজাহিদী অন্যতম। প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আলী আহসান অত্যন্ত নিষ্ঠার সংগে এ বইটির ভূমিকা লিখে দেয়ায় আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ গ্রন্থের প্রুফ দেখা ও তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি বেলাল চৌধুরী। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অংকনে শিল্পী কালাম মাহমুদ এবং রূপায়নে মুনীর খান কৃতিত্বের দাবীদার।
সবশেষে গ্রন্থটি রচনাকালে প্রাসংগিক বিধায় আমার মরহুম পিতৃদেব সা’দত আলী আখন্দের কথা বলতে হয়। ইতিহাসের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র ও আজীবন পড়ুয়া হিসেবে ইনি জীবদ্দশায় প্রায়শঃ যেসব কথাবার্তা বলতেন তারই সূত্র ধরে আমার এই রচনা। মরহুম সা’দত আলী আখন্দের জীবন থেকেই আমি অত্র গবেষণার মূল প্রেরণা লাভ করেছি। এই প্রেরণার উপর ভিত্তি করে সুদীর্ঘকালের গবেষণার ফসল হচ্ছে, ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’। আমার স্থির বিশ্বাস, বইটি পাঠক মহলে সমাদৃত হবে।
এম আর আখতার মুকুল
১লা ফালগুণ ১৩৯৩, ১৪ই ফেব্রুয়ারী
১৯৮৭ রমনা, ঢাকা
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
শেখ সেলিম (বাংলার বাণী), মিজানুর রহমান মিজান (দৈনিক খবর), খান মোহাম্মদ ইকবাল (শিল্পপতি), শফিকুল আজিজ মুকুল (সাংবাদিক), মুস্তাফা হাসান নাসির কবি (প্রকাশক), গাউসউদ্দিন খান মনি (মনি প্রিন্টার্স), ওয়াহিদুল হক (গবেষক), কৌশিক আহমেদ (বেতার কথক), ডঃ মাহমুদা খানম (বাংলা একাডেমী), ত্রিদিব দস্তিদার (কবি), রফিকুল ইসলাম (বিসিক), পুর্নেন্দু পত্রী (লেখক ও চিত্রশিল্পী), মোশাররফ হোসেন (শিল্পপতি ও ব্যাংকার), জাকীউদ্দিন আহমদ (স্বদেশ), আবুল মোকসেদ (সাংবাদিক), আনিসুল হক (এ্যাবিজ লিঃ), হাসনাত করিম (সাংবাদিক), ফজলে রাব্বি (জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র), কে এম আমীর (পদ্মা প্রিন্টার্স), ইমামুর রশীদ (কবি), মোস্তফা আল্লামা (শিল্পপতি), এম এস কামাল (শিল্পী ও কলাকার), শাহ মোহাম্মদ রেজা (গবেষক), মোস্তাক আলী (পাভেল প্রিন্টিং), কালাম মাহমুদ (শিল্পী), বাদল রহমান (চলচ্চিত্র পরিচালক), গাজী শাহবুদ্দিন (সচিত্র সন্ধানী), মুনীর খান (শিল্পী), ফরিদ উদ্দিন (মুদ্রাক্ষরিক) এবং হাফিজুল ইসলাম হাবলু, এম এম সোলায়মান রানা ও আফরোজা পারভীন প্রমুখ।
Leave a Reply