কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ : অলৌকিক জীবন-কথা – পৃথ্বীরাজ সেন
প্রথম প্রকাশ : কলকাতা বইমেলা, ২০১৭
প্রকাশক : শ্রীপ্রশান্ত চক্রবর্ত্তী
প্রচ্ছদ-শিল্পী : শ্রীসঞ্জয় মাইতি, লেখক
.
উৎসর্গ
কিশোরদাকে মনে রেখে শ্রদ্ধেয়া অপর্ণা বৌদিকে বিনম্র সারস্বত উপহার
.
ভারতীয় অধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাসে মীরাবাঈ এক স্মরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে রাজনন্দিনী হওয়া সত্ত্বেও শৈশবদিন থেকে তিনি কৃষ্ণের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করেন। ধীরে ধীরে তিনি প্রস্ফুটিত শতদলের মতো রূপসী ও সুন্দরী হয়ে উঠলেন। কিশোরীকালে তাঁর অনিন্দ্য তনুবাহার দেখে সকলে চমকিত হতেন। কিন্তু তাঁর মুখমণ্ডলের কোথাও কিশোরীসুলভ ছাপ ছিল না। তাঁর দুটি চোখের তারা নিবদ্ধ ছিল নীল আকাশের দিকে। তখন থেকেই তিনি একেবারে কৃষ্ণগতপ্রাণা হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি বিয়ের বয়সে উপনীত হওয়া সত্ত্বেও মীরাবাঈ সাংসারিক জীবনের প্রতি সামান্যতম আকর্ষণ বোধ করেননি। সমবয়সী সখীবৃন্দের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল না। মনে হতো জগতের সবকিছুর প্রতি তিনি বুঝি নির্লিপ্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন।
দেখতে দেখতে একদিন তাঁকে সত্যিসত্যি বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হতে হয়। মীরা হলেন মেবারের রানি। অথচ বিয়ের পর স্বামীর সান্নিধ্য তাঁর ভালো লাগেনি। কারণ তিনি তাঁর প্রিয় কৃষ্ণকে সবকিছু অর্পণ করেছেন। শয়নে স্বপনে নিশি জাগরণে শুধু কৃষ্ণের নামগান করেন। অনন্ত রাত্রির অন্ধকারে নাক্ষত্রিক আকাশের দিকে তাকালে বিষ্ণুর স্নেহময় মুখখানি মনে পড়ে যায় তাঁর।
পরবর্তীকালে মীরাবাঈকে বৈধব্যজীবন যাপন করতে হয়েছিল। কুচক্রী দেওরের লালসাপূর্ণ দৃষ্টির সামনে থেকে নিজের রূপ—যৌবনকে বাঁচাতে হয়েছিল। সংসার ত্যাগ করে তিনি হলেন এক সন্ন্যাসিনী। বিষ্ণুপ্রেমে উন্মাদিনী। কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবনে গিয়ে তাঁর হৃদ—সমুদ্রে আলোড়ন ওঠে। তিনি আসেন কৃষ্ণের অন্তিম লীলাক্ষেত্র দ্বারকাভূমিতে। সেখানেই প্রভুর বিগ্রহের সাথে লীন হয়ে যান।
এই পৃথিবীতে খুব বেশি দিন বেঁচে থাকার ছাড়পত্র মীরাবাঈ পাননি। স্বল্পকালীন জীবনে যে ক’টি ভজন রচনা করেছেন, তা শুনলে আজও আমাদের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। মীরাবাঈ গানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মধুর লীলাসঙ্গিনী। তাঁর জীবনকাহিনির পাতায় পাতায় এই লীলা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাই মীরাবাঈয়ের সাধনার সঙ্গে আমরা এই লীলার যোগসূত্রতা খুঁজে পাব।
এই বইয়ের মাধ্যমে আমি মীরাবাঈয়ের বর্ণময় জীবন এবং তাঁর সাধনার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। মীরাবাঈয়ের জীবনকথা শুনতে হলে বৈষ্ণবধর্মের সম্পর্কে কিছু বিষয় জেনে রাখা দরকার। কারণ এই ধর্মটির সঙ্গে মীরাবাঈয়ের বুঝি জন্ম—জন্মান্তরের সম্পর্ক।
পুরোদস্তুর একেশ্বরবাদী হিসাবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে দুটি ধর্ম পরিচিত, সে দুটি হল বৈষ্ণব এবং শৈবধর্ম। এদেশে একেশ্বরবাদী ধর্মকে গোড়ার দিকে বলা হতো ভাগবতধর্ম। পরবর্তীকালে এই ধর্ম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়।
ঋগ্বেদে বিষ্ণু খুব প্রভাবশালী দেবতা ছিলেন না। তবে তিনি একজন প্রধান দেবতা ছিলেন। বিষ্ণুকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনি আছে আমাদের বৈদিক সাহিত্যে। বিষ্ণু প্রজাকুলের প্রতিপালক হিসাবে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন, এমন কথা বারবার বলা হয়ে থাকে। মহাভারতের পাতায় পাতায় কৃষ্ণের নানা কীর্তিকলাপের বিবরণ আছে। আমরা অনায়াসে কৃষ্ণকে মহাভারতের মূল ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। তাঁর চাতুর্য না থাকলে পাণ্ডবপক্ষ কখনও এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারত না। এই কৃষ্ণকে অনুসরণ করলে মনে হয় তিনি বুঝি দারুণ বুদ্ধিমান এক নরপতি।
আবার কোথাও কোথাও কৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে মহান শক্তির প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে একাধিক শাখা—প্রশাখা বিদ্যমান। সেইসব শাখা—প্রশাখার অন্তর্গত কাহিনিতেও বিষ্ণু এবং তাঁর অবতারসমূহের অলৌকিক লীলা বারেবারে বর্ণিত হয়েছে। বিষ্ণু এই ধরাধামে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা।
ভারতে বৈষ্ণবধর্মের জয়যাত্রা সূচিত হয় গুপ্তবংশীয় রাজাদের আমল থেকে। গুপ্তরাজারা বিষ্ণুভক্ত ছিলেন এবং তাঁদের পারিবারিক চিহ্ন ছিল গরুড়। সেই সময় ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৈষ্ণবধর্ম বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই সংক্রান্ত নানা শিলালিপি এখনও আমরা দেখতে পাই। পরবর্তীকালে অবশ্য নানা কারণে বৈষ্ণবধর্মের আধিপত্য কিছুটা কমে আসে।
বৈষ্ণবধর্ম সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে প্রথমে রামানুজের কথা বলা উচিত। তিনি বিশিষ্টাদ্বৈতাবাদের প্রচারক ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে একটি বৈষ্ণব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। তাকে শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায় বলা হয়।
আর এক মহান পণ্ডিত হলেন নির্বাক। তাঁর দ্বৈতাদ্বৈতবাদের সমর্থক অনেকে আছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে সনাতনি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে।
মধ্ব দ্বৈতবাদ প্রচার করেছিলেন। তিনিও দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। তাঁর ভাবাদর্শ অনুসররকারীদের ব্রহ্ম সম্প্রদায় বলা হয়।
পল্লব এলেন তাঁর শুদ্ধাদ্বৈতবাদ নিয়ে। তিনি তৈরি করলেন রুদ্র সম্প্রদায়। বাংলার শ্রীচৈতন্য অচিন্ত্যবাদের জনক। তিনি গৌড়ীয় সম্প্রদায় তৈরি করেছিলেন।
পরবর্তীকালে বিষ্ণু এবং শক্তির মধ্যে সাযুজ্য আনয়ন করা হয়েছিল। বিষ্ণুর সঙ্গে আদিতে যে দু’জন দেবী সম্পর্কিত ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন শ্রী (লক্ষ্মী) এবং ভূমি (পৃথিবী)। এই দুই দেবীর বিকাশ হয়েছিল স্বাধীনভাবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিষ্ণুর সংস্পর্শে এসেছিলেন। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে পৃথিবীর আকাশ দেবতা দৌ—এর প্রণয়িণী। মহাভারতে বা পুরাণে তিনি বিষ্ণুর বরাহরূপের সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রী বা লক্ষ্মী কিন্তু প্রথমদিকে তান্ত্রিক দেবী ছিলেন না। তাঁর ক্রমবিকাশ হয়েছিল ঐশ্বর্যের ও সমৃদ্ধির দেবীরূপে। পরবর্তীকালে তান্ত্রিক ধর্মে তাঁর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, প্রজাপতির দেহ থেকে শ্রী দেবীর উদ্ভব।
শ্রী হলেন বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী। পুরাণের পাতায় পাতায় লক্ষ্মী এবং নারায়ণকে যুগলবন্দী দেবতা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কালের যাত্রাপথে শাক্তধর্ম বৈষ্ণব দেবদেবীকে আত্মস্থ করে। তখন থেকেই বোধহয় বৈষ্ণবধর্মের আধিপত্য ক্রমশ কমতে থাকে।
এই ক’টি কথা মনে রেখে আমরা মীরাবাঈয়ের লীলার ওপর আলোকপাত করব। মীরাবাঈ শ্রীকৃষ্ণের গোপিণী হিসাবে জগতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অসম্ভব আকর্ষণ বোধ করতেন। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ছিল তাঁর দেহাতীত প্রেমের সম্পর্ক। তাই বোধহয় তাঁর প্রেম এত নিষ্কলুষ হতে পেরেছে। তাঁর লেখা এক—একটি ভজন বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁর মনোগত এই বাসনার কথা জানতে পারব। এই ভজনগুলি পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি কতখানি উতলা হয়েছিলেন। নারী—পুরুষের প্রেমের মধ্যে সাধারণত শরীর—সম্পর্ক এসে দাঁড়ায়। তখন সত্যিকারের নিষ্কাম প্রেম কোথায় হারিয়ে যায়। কিন্তু মীরাবাঈ ও শ্রীকৃষ্ণের ভালোবাসার মধ্যে এই বন্য আবেগ এসে পথ আটকায়নি। তাই তাঁরা একে অন্যকে অপার্থিব আবেগে ভালোবাসতে পেরেছেন। প্রভাত সূর্যের আলিম্পন রাগে রঞ্জিত করেছেন তাঁদের দেহ। সেখানে নীল আকাশের নিচে জ্যোৎস্না বাহিত রাত এসেছে। তখন তাঁদের দু’জনের হৃদয় এক অনাস্বাদিত আনন্দে পরিপূর্ণ হয়েছিল। জানতে ইচ্ছে করে, সত্যি সত্যি কি মীরাবাঈ তাঁর ইষ্টদেবতার সন্ধান পেয়েছিলেন? নাকি এসবই হল রূপক কল্পনা। তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত সম্পর্কে বলা আছে যে, ভাবোন্মাদ হয়ে গান গাইতে গাইতে তিনি শ্রীকৃষ্ণের রণছোড়জি মূর্তির সাথে একাত্ম হয়ে যান। তখন আর কোনও কিছু সামনে ছিল না। শুধু ছিল তাঁর দেহ আবরণের একটু অংশ।
দার্শনিকেরা ভিন্নতর বিচারে এই মুহূর্তটির বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, তখন মীরাবাঈ এমন ভাবোন্মাদ অবস্থার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, তাঁর মধ্যে কোনও আলাদা অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ এই ঘটনাকে আমরা তাঁর শারীরিক মৃত্যু হিসাবে তুলে ধরব।
এই বইটির মধ্যে আমি সংক্ষেপে মীরাবাঈয়ের জীবন এবং তাঁর তাত্ত্বিক মনোভাবের ওপর আলোকপাত করেছি। এই বইটি পাঠ করলে আপনার হৃদয় এমন এক আনন্দে প্লাবিত হবে, যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। একুশ শতকের পৃথিবী আরও বেশি যন্ত্রনির্ভর এবং প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। এখন আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পারছি না। এই অবস্থায় এই বইটি আপনাদের কাছে এক বিশেষ উপহার স্বরূপ বিবেচিত হবে বলেই আমার স্থির বিশ্বাস।
পৃথ্বীরাজ সেন
কলকাতা বইমেলা
২০১৭
Leave a Reply