কৃষ্ণগহ্বর, শিশু মহাবিশ্ব ও অন্যান্য রচনা – স্টিফেন হকিং
ভূমিকা
এই বইটি ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ এর ভিতরে লেখা আমার কয়েকটি রচনার সংগ্রহ। বইটির বিস্তার রয়েছে আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ থেকে বিজ্ঞানের দর্শন অবধি, আর রয়েছে বিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমি যে উত্তেজনা বোধ করি সেটা ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। এ বইয়ের শেষে রয়েছে ডেজার্ট আইল্যান্ড ডিস [Desert Island-Discs] এর অনুলিখন। সে অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম। অনুষ্ঠানটি ব্রিটিশ রীতির একটি বৈশিষ্ট্য। এ অনুষ্ঠানে অতিথিকে কল্পনা করতে বলা হয় যেন তাকে একটি মরুদ্বীপে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত সময় কাটাবার জন্য আটখানা রেকর্ড বেছে নিতে বলা হয়। সৌভাগ্যক্রমে সভ্য জগতে ফিরে আসার জন্য আমাকে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি।
এই রচনাগুলো ১৬ বছর ধরে লেখা। সেজন্য এগুলোতে আমার তদানীন্তন জ্ঞানের প্রতিফলন রয়েছে। আশা করি, কালে কালে আমার জ্ঞানটা একটু বেড়েছে। সেজন্য আমি প্রতিটি রচনার কাল এবং উপলক্ষ লিখে দিয়েছি। প্রতিটি লেখাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। সেজন্য কিছু কিছু পুনরুক্তি হওয়া অবশ্যম্ভাবী এবং তা একটু হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি সেটা কমাতে। তবুও কিছু কিছু রয়ে গেছে।
এই বইয়ের কয়েকটি লেখা ছিল বক্তৃতার পাণ্ডুলিপি। আমার কণ্ঠস্বর তখন এমন অস্পষ্ট ছিল যে বক্তৃতা কিংবা বৈজ্ঞানিক আলোচনাসভায় আমার কথা বলতে হত অন্য কারও মাধ্যমে। সাধারণত তাঁরা ছিলেন আমার কোন গবেষক ছাত্র। তারা আমার কথা বুঝতে পারতেন কিংবা আমার রচনা পাঠ করতেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে আমার একটা অপারেশান হয়, তার ফলে আমার কথা বলার ক্ষমতা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়। কিছুকাল পর্যন্ত আমার যোগাযোগ রক্ষা করার সমস্ত উপায়ই লুপ্ত হয়। পরবর্তীকালে আমি একটি কম্পিউটার সিস্টেম পাই, আর পাই খুব ভাল একটি বাক্য সংশ্লেষক (স্পীচ সিনথেসাইজার speech synthesizer)। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমি সাধারণ মানুষের জন্য একজন সার্থক বক্তা আর বৃহৎ শ্ৰোতৃমণ্ডলীর সামনে ভাল বক্তৃতা করতে পারি । বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে এবং প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার ভাল লাগে। আমি নিশ্চিত যে কাজটা আমাকে আরও ভাল করে শিখতে হবে। কিন্তু আশা করি আমার উন্নতি হচ্ছে। এই বইটি পড়ে আপনি বিচার করতে পারবেন সত্যি আমার উন্নতি হচ্ছে কিনা।
মহাবিশ্ব একটি রহস্য, এ সম্পর্কে অনুভূতি (intuition) থাকতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ কিংবা বোধ সম্ভব নয় : এই দৃষ্টিভঙ্গি আমি বিশ্বাস করি না। যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব গ্যালিলিও চারশ’ বছর আগে শুরু করেছিলেন এবং নিউটন এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন : আমার মনে হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি তার উপর সুবিচার করে না। তারা দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের অন্তত কয়েকটি অঞ্চল যাদৃচ্ছিক (arbitrary) আচরণ করে না। বরং তারা যথাযথ গাণিতিক বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারপর কালে কালে আমরা গ্যালিলিও-নিউটনের গবেষণাকে মহাবিশ্বের প্রায় সমস্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করেছি। আমরা সাধারণত যা অনুভব করি, তার সবগুলো নিয়ন্ত্রিত করার মতো গাণিতিক বিধি আমাদের রয়েছে। আমাদের সাফল্যের একটি মাপকাঠি হল এখন আমরা শত শত কোটি ডলার এমন কতকগুলো যন্ত্র নির্মাণের জন্য ব্যয় করি, যে যন্ত্র কণিকাগুলোকে এমন উচ্চশক্তিতে তুরিত (accil erated) করে যে, তাদের ভিতরে সংঘর্ষ হলে কি হবে আমরা আজও জানি না। এই অতি উচ্চ কণিকাশক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় পৃথিবীতে থাকে না। সেজন্য মনে হতে পারে গবেষণার জন্য এই বিরাট অর্থব্যয় অপ্রয়োজনীয় এবং নেহাতই কেতাবি-বিদ্যা আহরণ। কিন্তু আদিম মহাবিশ্বে এর অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং আমরা নিজেদের মহাবিশ্বের আরশ্ব যদি জানতে চাই তাহলে এই শক্তিতে কি ঘটে সেটা জানা দরকার।
এখনও মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। কিন্তু বিশেষ করে গত ১০০ বছরে যে লক্ষণীয় প্রগতি হয়েছে, তা থেকে উৎসাহিত হয়ে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণ বোঝ হয়ত আমাদের ক্ষমতার অতীত নয়। হতে পারে, আমাদের চিরকাল অন্ধকারে হাতড়াতে হবে না। আমরা হয়ত মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারব। সেক্ষেত্রে আমরা হব মহাবিশ্বের অধিপতি।
এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো লেখা হয়েছে এই বিশ্বাসে যে, মহাবিশ্ব এমন একটি নিয়মে বাধা, যে নিয়ম আমরা এখন অংশত বুঝতে পারি এবং অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমরা সম্পূর্ণ বুঝতে পারব। হতে পারে এ আশা নেহাতই মরীচিকা। চরম তত্ত্ব হয়ত কিছুই নেই : থাকলে হয়ত সেটা আমরা খুঁজে পাব না। কিন্তু মানুষের মন সম্পর্কে হতাশ হওয়ার চাইতে সম্পূর্ণ বোঝার চেষ্টা করা অনেক ভাল।
স্টিফেন হকিং
৩১ মার্চ, ১৯৯৩
Leave a Reply