কূটচাল
০১. সেলুনের সামনে হিচরেইলে ঘোড়া
সেলুনের সামনে হিচরেইলে ঘোড়া বাঁধছে এক মাইনার। তার দিকে শহরবাসীর কোন মনোযোগ নেই। হাজারো মাইনারের ভিড়ে সাধারণ একজন মাইনার বলে একে ধরে নিয়েছে সবাই। লোকটার চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করার উপায় নেই, তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বলে মোটামুটি ধরে নেয়া যায়। মুখে কাঁচা পাকা দাড়ির ঘন জঙ্গল, কাপড়চোপড় ধুলো জমে এত শক্ত যে খুলে রাখলে আপনি দাঁড়িয়ে থাকবে। বেশির ভাগ পথচারী একবারও তাকাচ্ছে না লোকটার দিকে। তবে শিগগিরই এই লোক হয়ে উঠবে পুরো শহরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু-মধ্যমণি।
ঘোড়া বাঁধা শেষে ধুপধাপ পা ফেলে তিনটে ধাপ বেয়ে ফুটপাথে উঠল লোকটা, হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ঢুকল ক্যাসিনো সেলুনে। টুইন স্প্রিংসের সেলুনগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। ভেতরে গিজগিজ করছে মানুষ। কনুইয়ের ঠেলাগুতো দিয়ে পথ করে বারকাউন্টারের সামনে চলে এলো সে।
বারটেন্ডারের চোখ ঘুরে গেল মাইনারের ওপর থেকে, স্থির হলো পয়সাওয়ালা এক খদ্দেরের ওপর। তাকে ড্রিঙ্ক দিয়ে কয়েকজন পাঞ্চারের ফরমাশ অনুযায়ী ড্রিঙ্ক দিল বারটেন্ডার, উপেক্ষিত রয়ে গেল মাইনার।
অ্যাই, কি হলো? সেলুনের ভেতরে গমগম করে উঠল মাইনারের চড়া গলা, একটা বোতল চাইছি, শুনতে পাচ্ছ না! তাড়াতাড়ি দেবে!
ধীরেসুস্থে তার দিকে এগিয়ে এলো বারটেন্ডার। লোকটা সে দীর্ঘকায়, সব সময়েই অস্থির হয়ে থাকে নিজের শক্তি দেখানোর জন্যে। একই সঙ্গে সেলুনের বাউন্সারের কাজটাও চালিয়ে নেয় সে অনায়াসে। কোন মাতাল ঝামেলা করলে ঘাড় ধরে শূন্যে তুলে নির্দ্বিধায় ছুঁড়ে দেয় সেলুনের বাইরে। মাইনারের সামনে থামল বারটেন্ডার। তা কিসের বোতল চাই তোমার? অবহেলার সঙ্গে জানতে চাইল।
হঠাৎ মনে হলো মাইনার যুবক হয়ে উঠল, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। ঠোঁট বাঁকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, বোবোঁ।
জো মেয়ার্স মাইনারের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে কাউন্টারের ওপর দিয়ে সামনে ঝুঁকল। হাসি হাসি চেহারায় বলল, আগে পকেট থেকে পয়সা বের করে দেখাও, বোর্বো পাবে। যদি দেখি অন্যান্য মাইনারের মতো তোমার পকেটও ফাঁকা, তাহলে পোঁদে এক লাথি মেরে সেলুন থেকে বের করে দেব।
বড় দেরি করে ফেলল বারটেন্ডার বামপাশ থেকে আসা মাইনারের ডানহাতি ঘুসি এড়াতে গিয়ে। সোজা চোয়ালে হজম করল সে ঘুসিটা। হুড়মুড় করে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে তৈরি হলো আক্রমণে যাবার জন্যে।
গোলমালের গন্ধ পেয়ে সরে গেছে অন্যান্য খদ্দের, সবাই তাকিয়ে আছে। মাইনারের দিকে, কারও কারও চেহারায় ফুটে উঠেছে শ্রদ্ধা। বারটেন্ডারের দিকে খেয়াল নেই আর মাইনারের, কোটে তার অনেক পকেট, সে এখন ব্যস্ত হয়ে কোটের পকেটগুলো হাতড়াচ্ছে। ক্যাসিনো সেলুনের মালিকস্টিভ ডেভিস ছিটকে। বেরিয়ে এলো তার, অফিস থেকে, সন্দিগ্ধ চোখে একবার কর্মচারীর দিকে চেয়ে অসন্তুষ্ট খদ্দেরের দিকে মনোযোগ দিল সে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠল মাইনারের পকেট থেকে পেট মোটা একটা টাকার থলে বেরতে দেখে। মাইনারকে থলের। চামড়ার ফিতে খুলে কয়েকটা বড় বড় সোনার টুকরো বের করতে দেখে পিনপতন নিরবতা নামল সেলুনের ভেতর। কাউন্টারে সোনার টুকরোগুলো রাখল মাইনার। আশপাশের মাথাগুলো ঝুঁকে এলো সোনার টুকরো ভাল মতো দেখার আশায়। নাদুসনুদুস হুঁড়ি দুলিয়ে মাইনারের পাশে চলে এলো স্টিভ ডেভিস, চোখে ফুটে উঠেছে শ্রদ্ধার ছাপ। সাধারণ কোন দু’পয়সা দামের মাইনার নয় এ, রীতিমতো পয়সাওয়ালা লোক।
বারের পেছনে হাত বাড়িয়ে জানতে চাইল ডেভিস, আপনি তো বুরু চেয়েছিলেন, তাই না? একটা বোতল ধরিয়ে দিল মাইনারের হাতে। আশা করি এটা আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে।
ছোট্ট করে নড করে থলে থেকে আরও কয়েকটা বড় বড় সোনার টুকরো বের করল মাইনার, তারপর অনাবিল হাসি হেসে সব কয়টা টুকরো পুরে ফেলল থলেতে, একটা টুকরো ছাড়া। থলেটা চলে গেল তার পকেটে।
আশা করি এতেই উপস্থিত সবার জন্যে ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, সোনার টুকরোটা দেখিয়ে বোতলের কর্ক খুলতে খুলতে বলল সে। চেহারা গম্ভীর তার, কিন্তু চোখ চকচক করছে আনন্দে।
লোভীর মতো ছোঁ মেরে সোনার টুকরো হাতে তুলে দেখল ডেভিস।
এবার জটলা বাঁধতে শুরু করল জনতা মাইনারকে ঘিরে। বোকা বোকা চেহারায় ডেভিসের হাতের সোনার দিকে তাকিয়ে থাকল মেয়ার্স। বোতল মুখে তুলে চো-চো করে আধ পাইন্ট নামিয়ে দিল মাইনার। কোটের হাতায় মুখ মুছে ঢেকুর তুলল বড় করে। বোতলের বাকি তরলটুকু ধীরেসুস্থে শেষ করল সে, তারপর আরেকটা বোতলের জন্যে মাথা কাত করে ইশারা দিল।
ডেভিস নিজে খুলে দিল একটা বোতলের মুখ, সবাই দেখল তৃষ্ণার্তের মতো গিলছে মাইনার, নিজের দিকে একটুও খেয়াল নেই, মাতাল হয়ে শেষে হয়তো হারাবে সবই কোন ছিচকে চোরের হাতে। তবে মাইনার কথা বলতে শুরু করতেই সবার এই ধারণা পাল্টে গেল।
এখানে কোন ল্যান্ড অফিস আছে? জানতে চাইল মাইনার।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ডেভিস। না। কাছেরটা রলিন্সে, এখান থেকে বিশ পঁচিশ মাইল দক্ষিণে।
কনুইয়ের তো মেরে পথ করে নিয়ে টলতে টলতে দরজার দিকে চলল। মাইনার, পাত্তাই দিচ্ছে না চেপে আসা ভিড়কে। সে কয়েক পা এগোতেই পেছন পেছন চলল ডেভিস, চোখে আশার আলো। ক্লেইম ফাইল করবেন আপনি? জানতে চাইল মাইনারের কাঁধের ওপর মুখটা নিয়ে।
জবাব দেয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিল মাইনার, উদগ্রীব মুখগুলোর ওপর ঘুরে এলো তার ঘোলা চোখের দৃষ্টি। ভাব দেখে মনে হলো ঠিক কতটা বলা উচিত হবে, সেব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
বেশ, মনে হচ্ছে তোমাদের বললে কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না আমার, অবশেষে বলল সে। খবরটা এমনিতেই ছড়িয়ে যাবে আমি রলিন্সের ল্যান্ড অফিসে গেলে। তাছাড়া আমাদের ক্লেইমে পাহারা দিচ্ছে আমার বন্ধু।
মাইনার শ্বাস ফেলতেই আরও চেপে এলো তার চারপাশের ভিড়।
এত সোনা একবারে আর কোথাও পাওয়া যায়নি, আমি বাজি ধরে বলতে পারি। পাথরের তলায় পুরো পাঁচ মাইল লম্বা একটা স্তরে সোনা আছে। উপত্যকার, মাটি ঘেঁকে সোনা পাওয়ার কারণ এখন বুঝতে পারছি। স্তরটা দেখে আমার মনে হয়েছে পাহাড়ের তলা দিয়ে ওই পার পর্যন্ত চলে গেছে।
কোন্ পাহাড়? উৎসুক হয়ে জানতে চাইল ডেভিস, তর আর সইছে না তার।
সেমিনো পীক, ওই যে উত্তর-পশ্চিমের ওই পাহাড়টা। কত হবে, চল্লিশ মাইল হবে এখান থেকে। এসেক্স আর উইন্ড রিভার পীকের কাছেই।
সেমিনো পীক! বেশিরভাগ মানুষই নিজের মনে উচ্চারণ করল নামটা। গুঞ্জন উঠল সেলুনে।
ওই পাহাড় তো প্রসপেক্টররা খুঁজে দেখেছে, কিছুই পাওয়া যায়নি, চোখের সামনে সোনার টুকরোটা ধরে সাবধানে বলল ডেভিস। সোনা চিনতে তার ভুল হয় না। জেড অ্যাংগার একবার ধোকা খেয়েছিল ওখানে। সোনা ভেবে কি একটা ধাতু নিয়ে রলিন্স শহরের অ্যাসে অফিসে গিয়ে বোকা বনেছিল।
আমি যে জায়গার কথা বলছি সেখানে কেউ খোঁজেনি, বোতল থেকে আরেক চুমুক খেল মাইনার, ক্যাসপার ক্রীক যেখানে নর্থ প্ল্যাট নদীর সঙ্গে মিশেছে, জায়গাটা ওখানে। ওই ক্ৰীক ধরে উজানে গেলে মাঝ রাস্তায় আরেকটা যে ঝর্না আছে। ওটা ক্যাসপারের সঙ্গে মিশেছে। সেই ঝর্নার পাড় ধরে দুই মাইল গেলে পানির উচ্চতার আন্দাজ বিশ ফুট ওপরে, পাহাড়ের গায়ে আছে সোনা। সোনার সরু একটা পাত, পাঁচ মাইল লম্বা। ঘোলা চোখে চারপাশে তাকাল মাইনার। আমার ধারণা সবার জন্যেই যথেষ্ট আছে ওখানে।
প্রত্যেকে তার কথা শুনেছে। সবাই চেনে জায়গাটা। দ্বিতীয়বার মাইনারকে বলতে হলো না কোথায় সোনা পেয়েছে সে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে কাটল, তারপর একে একে বেরিয়ে গেল সবাই সেলুন ছেড়ে। প্রত্যেকে জানে, এখন সে। রসদপত্র নিয়ে রওনা হবে নিজের জন্যে সোনা খুঁড়তে।
জো, তুমি এদিকটা সামলে নিয়ো, কর্মচারীর দিকে তাকাল ডেভিস, আমি যাচ্ছি আমাদের জন্যে জায়গা দখল করতে।
বিস্মিত চোখে মেয়ার্স দেখল তার বস্ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ব্যাটউইং দরজা ঠেলে। মাইনারের দিকে তাকাল মেয়ার্স। বলল, মনে হচ্ছে তোমার ঘুসির কথাটা ভুলে যাওয়া উচিত আমার। আরেকটা বোবোঁর বোতল মাইনারের হাতে ধরিয়ে দিল মেয়ার্স। এটা সেলুনের পক্ষ থেকে। হাসল লোকটা। মনে হচ্ছে এখানে আর কোন কাজ নেই। এবার সেলুন বন্ধ করে দিয়ে আমিও যাব সোনার খোঁজে। আগামী কয়েকদিন সেলুনে কোন লোক আসবে বলে মনে হয় না।
আস্তে করে মাথা দোলাল মাইনার, সেলুনের বাইরে এসে ঘোলা চোখে দেখল মেয়ার্সও তার বসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হিচরেইলে বাধা একটা ঘোড়ার দড়ি খুলছে। সাড়া পড়ে গেছে শহরে, সবাই ব্যস্ত হয়ে জোগাড়যন্ত্র করছে। সন্তুষ্টির একটা ছাপ ফুটে উঠল মাইনারের চেহারায়।
ঘোড়ার পিঠে তাড়াহুড়ো করে বাঁধা স্যাডল রোল চাপিয়ে শহর ছাড়ছে মানুষ। কেউ কেউ ওয়্যাগন বা বাগি ভর্তি করছে খাবার, কাপড় আর কোদাল শাবল দিয়ে। বিবাহিতরা বউ-বাচ্চাকেও সঙ্গে নিচ্ছে নিরাপত্তার কথা ভেবে। নতুন শহরে কেউ যে থাকবে না সোনার খবর ফাঁস হওয়ার পর, এটা প্রায় নিশ্চিত। ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানগুলোর ঝাঁপ। এরাও কয়েকদিনের জন্যে স্বর্ণসন্ধানী হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না। রাস্তায় উড়ছে ভারী ধুলোর মেঘ। গড়গড় শব্দে গড়াচ্ছে ওয়াগন আর বাগিগুলোর চাকা। খবর দেয়ার আধঘণ্টা পর মাইনার একা দাঁড়িয়ে থাকল টুইন স্প্রিংসের রাস্তায়, তার কাছে মনে হলো সে ছাড়া গোটা শহরে বুঝি আর একজনও নেই।
আবার সেলুনে ঢুকল মাইনার, বার থেকে সংগ্রহ করল কয়েকটা ভাল জাতের। মদের বোতল, তারপর সেগুলো কোটের পকেটে ভরে বাইরে এসে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে গেল নিজের পথে। ধীরেসুস্থে দক্ষিণে, রলিন্সের দিকে চলেছে, যেন তাড়া নেই কোন। ব্যাঙ্ক পার হওয়ার সময় হাসল মাইনার, দেখল ভেতরে দু’জন লোক কাজ করছে এখনও। এরা বোধহয় সোনার খোঁজে যাবে না, আশা করছে সোনাই যথাসময়ে তাদের কাছে আসবে।
রলিন্সের ট্রেইলে কয়েক মাইল এগোনোর পর ট্রেইল ছেড়ে গভীর একটা ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোল মাইনার। এঁকেবেঁকে ওপর দিকে উঠেছে ক্যানিয়নের মেঝে, বাঁকগুলো পার হবার সময় তার ভঙ্গি দেখে মনে হলো এখান দিয়ে আগেও বহুবার যাতায়াত করেছে। বড় একটা বাঁক ঘুরতে ক্যানিয়ন শেষ হয়ে গেল। খোলা একটা জমি সামনে। সে দেখল, দুটো মস্ত বোল্ডারের। মাঝখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে এক লোক।
কি খবর, ডেভ, মাইনারের ঘোড়া থামতেই জানতে চাইল লোকটা। সোনার খবরে হিড়িক উঠেছে?
উঠেছে মানে! এত দ্রুত কোন শহর খালি হতে আমি দেখিনি, স্লিম। শেষ যখন দেখলাম, কয়েক বছর আগে ওগালায় প্লেগের খবর ছড়িয়ে পড়তে সবাই। পালাল, তাতেও কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল, টুইন স্প্রিংসের এরা ওদেরও ছাড়িয়ে গেছে।
হাসল স্লিম, সরে মাইনারকে এগোনোর পথ করে দিল। সামনে বাড়ল মাইনার, একটু পরেই চলে এলো ঘাসে ছাওয়া ছোট্ট একটা উপত্যকায়। উপত্যকার বেশ খানিকটা ভেতরে পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত একটা মস্ত পাথরের নিচে জ্বলছে একটা আগুন। সেই আগুনটাকে ঘিরে বসে আছে একদল লোক বিশ্রাম। নিচ্ছে, সিগারেট ফুকছে, গল্প করছে মৃদুস্বরে। ডেভ তাদের কাছে গিয়ে ঘোড়। থেকে নামতেই বেশির ভাগ লোক উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাল। একজন একটা কফির মগ দিল মাইনারের হাতে।
অবস্থা কেমন?
জানতে যে চেয়েছে সে লম্বা, রোদে পোড়া সুদর্শন চেহারার, চোখ দুটো এত ধূসর যে ওপেক রঙের বলে ভুল হয়। একনজর দেখলেই বোঝা যায় সে এই দলের একচ্ছত্র অধিপতি।
শহরে এখন দু’জনের বেশি নেই, লিউ। আমার ধারণা তাদের দুজনের মধ্যে একজন আবার সন্ধের আগেই চলে যাবে সেমিনোর দিকে।
মাইনারকে দেখে এখন আর মনে হচ্ছে না সে প্রৌঢ়, হাঁটাচলার মসূণ ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে রীতিমতো চঞ্চল এক যুবক সে। চেহারায় সেই ঢিলেঢালা ভাব নেই, কঠোর মুখভঙ্গি। যেকোন বিপদের মোকাবিলায় সক্ষম।
আমার ধারণা ব্যাঙ্কার থাকবে। লোকটা ভাববে ব্যাঙ্কে বসে সোনা নিয়ে আসা লোকজনের সঙ্গে লেনদেন করেই যথেষ্ট টাকা লাভ করতে পারবে সে।
ডেভের কথা শুনে হাসির একটা হুল্লোড় উঠল। লিউয়ের ঠোঁটেও হাসির একটা রেখা দেখা দিল।
সেমিনোয় সোনা নেই এটা প্রচার হয়ে যাবার আগেই তাহলে ব্যাঙ্কার একটা দর্শন দিয়ে আসতে হচ্ছে, শান্ত গলায় বলল সে। সন্ধের সময় রওনা হব আমরা।
টুইন স্পিংসে ঢোকার পর কৌতূহলী হয়ে উঠল দুই রাইডার। কেউ নেই চারধারে, যেন পরিত্যক্ত একটা মৃত শহর। অথচ বাড়িঘর নতুন, সাদা রঙের বেড়াগুলো ঝকঝকে। তাছাড়া রলিঙ্গের কাছে কোন ভুতুড়ে শহর নেই।
এই শহরের বাতাসটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না, বেনন, বলল কানে লোমওয়ালা ত্যাড়াবাকা চেহারার বয়স্ক লোকটা। মোটা গোঁফে তা দিয়ে আরেকবার দেখে নিল সে রাস্তার দু’পাশ।
পাশের দীর্ঘদেহী আরোহী আস্তে করে মাথা দোলাল। একেও দেখতে সুদর্শন বলা যাবে না, তবে চেহারায় একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। চোখ দুটোতে আছে মায়া। ভোলা মনের লোক হলে একে প্রথম দর্শনেই পছন্দ না করে উপায় নেই কারও। মন্ট্যানার বিখ্যাত দস্যু, রক বেনন তার নাম। এখন গভর্নরের ক্ষমার কল্যাণে আইন তাকে ধাওয়া করে না, কাজেই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটাই তার নেশা। ঠিক করেছে বাঁধনে জড়াবে না কখনও জীবনে। এখানে এসেছে একজনের অনুরোধে, বিশেষ একটা কাজে।
ঠিকই বলেছ, ব্যাগলে, অবশেষে মন্তব্য করল বেনন।
আমি যা বলি ঠিকই বলি, সন্তুষ্ট স্বরে বলল ব্যাগলে। অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই। এমনকি বেনন বকলেও, কৃতজ্ঞ ব্যাগলে কিছুতেই ভুলতে পারবে না যে বছরে অন্তত দু’বার যেখানেই থাকুক কষ্ট করে তার ফার্মে আসে বেনন, তার বউকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যাগলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পনেরো দিনের জন্যে। এই ক’টা দিনের অপেক্ষায় বউয়ের বকা আর বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটোর সব জ্বালাতন মুখ বুজে সহ্য করে নিতে পারে ও।
বাড়ির রং দেখে বোঝা যাচ্ছে ভুতুড়ে শহর নয়, অথচ কেউ নেই! চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করল বেনন। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু যায় আসে না, আমরা সেলুনে ড্রিঙ্ক খুঁজে পেলেই খুশি থাকব, কি বলো, ব্যাগলে? গলার ধুলো দূর করা দরকার।
ধুলো না থাকলেও দিনে অন্তত দশ ঘণ্টা মাতাল থাকা দরকারি, গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলল ব্যাগলে। তারপর অভিযোগের সুরে যোগ করল, ফার্মে ওরা আমাকে এক ফোঁটাও খেতে দেয় না।
সবচেয়ে বড় সেলুনটার সামনে ঘোড়া থামাল দুই কাউবয়। সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা রয়েছে, ক্যাসিনো সেলুন। আরেকবার চোখে অস্বস্তি নিয়ে রাস্তায় নজর বুলিয়ে নিল ওরা, তারপর হিচরেইলে ঘোড়া বেঁধে ব্যাটউইং ডোর ঠেলে ঢুকে পড়ল সেলুনের ভেতরে। দুতিনটে ধেড়ে ইঁদুর ওদের দেখে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল নিজেদের আস্তানায়।
দেখে মনে হচ্ছে অনেক লোক সমাগম ছিল এখানে কয়েক দিন আগেও, বলল বেনন চিন্তিত চেহারায়। আঙুল তাক করে মেঝে দেখাল। ধুলোতে অনেক পায়ের ছাপ। এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত, তবে তাজা ছাপ। অনেক কথা বলছে নীরব সেলুনটা। দেখেছ, একটা টেবিল দেখাল বেনন, এত তাড়াতাড়ি চলে গেছে যে গ্লাসের ড্রিঙ্কটুকুও শেষ করতে পারেনি।
ওরা কী বুঝবে ড্রিঙ্কের কদর, নাক কুঁচকাল ব্যাগলে, ওদের বউ যদি আমারটার মতো হতো তবে টের পেত।
তা ঠিক, দ্বিমত পোষণ করতে পারল না বেনন। লম্বা বারের পেছনে চলে এলো ও, চোখ বোলাল সারি সারি বোতলের ওপর। বোবো? না, অত খরচ করার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। রাই হুইস্কি? হ্যাঁ, এটাই তো খুঁজছিল এতক্ষণ। একটা রাই হুইস্কির বোতল নামাল বেনন, দুটো পরিষ্কার গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিল ব্যাগলের দিকে। ব্যাগলেকে চো-চো করে গলায় তরলটুকু ঢালতে। দেখে চুমুক দিল গ্লাসে, চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর বলল, তোমার কি মনে হয়, একসঙ্গে সেলুনের সব লোক বেরিয়ে যাবে এমন কি কারণ থাকতে পারে!
সেটাই তো চিন্তা করে বের করতে চাইছি সেই তখন থেকে।
কাউন্টারের নিচের তাকে চোখ পড়তেই চকচক করে উঠল বেননের চোখ। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল গউচো চুরুটের বাক্সটা। পকেট থেকে কয়েন বের করে মদ আর চুরুটের দামটা রেখে দিল বাক্সের জায়গায়। বাক্স চলে গেল পকেটে। একটা চুরুট ধরাল বেনন। ধোয়া ছেড়ে বলল, মাত্র দুটো কারণে কোন শহর এভাবে খালি হয়ে যেতে পারে, ব্যাগলে। হয় প্লেগের ভয়ে, নাহলে কাছের শহরের বিরাট বড়লোক কেউ মরার আগে ঘোষণা দিয়েছে, এই শহর থেকে যে মা যাবে তাকেই সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেবে।
কারণ হতে পারে তিনটে, নাক কুঁচকে মতামত জানাল ব্যাগলে। তুমি যে চুরুট টানছ সেরকম চুরুট যদি বেশ কয়েকজন একসঙ্গে ধরায়, তাহলেও শহর খালি হতে দেরি হবে না।
বারের কাছ থেকে সরে গেল ব্যাগলে। নির্বিকার চেহারায় ধোঁয়া ছাড়ল বেনন। পা বাড়িয়ে বলল, চলো, ঘুরেফিরে দেখি শহরটা।
রাস্তায় নেমে একধারের বাড়িঘরের সমস্ত দরজা খুলে দেখছে ওরা। সবখানে দ্রুত শহর ছাড়ার চিহ্ন। ব্যাঙ্কে আসার আগে পর্যন্ত দৃশ্যে কোন পরিবর্তন ওদের চোখে পড়ল না।
রাশল্যান্ড ব্যাঙ্ক। বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে বাড়ির সামনে। ভেতরে ঢুকল ওরা, বুঝতে দেরি হলো না মেঝের ধুলোয় পড়ে থাকা লাশ দুটোর মধ্যে ভাল কাপড় পরা লোকটাই ছিল রাশল্যান্ড। দুজনের কোটেই বুকের কাছটা কালচে হয়ে আছে জমাট রক্তে।
বেনন আর ব্যাগলে, দুজনেই গভীর মনোযোগে লোক দু’জনকে পরীক্ষা করে দেখল। অন্তত একদিন আগে মারা গেছে। প্রত্যেকের বেলায় কেবল একটা করে বুলেট খরচ করা হয়েছে।
চোখে চোখে কথা হয়ে গেল বেনন আর ব্যাগলের, ব্যাঙ্কটা সার্চ করে দেখল ওরা। কার্পেটের নিচে পাওয়া গেল একটা ট্র্যাপ ডোর। ওটা খুলে নিচে নেমে এলো। ছোট্ট একটা ডাগআউট। সেটা মজবুত ছিল। এখন দরজাটা খোলা। সম্ভবত খুলিয়ে নেয়া হয়েছে রাশল্যান্ড বা কর্মচারীকে দিয়ে। ভেতরে একটা ফুটো পয়সাও নেই।
একটা ব্যাপার নিশ্চিত, বলল গম্ভীর বেনন, শহরে কেউ একজন রয়ে গিয়েছিল কাজটা সারতে, প্লেগের কারণে শহর খালি হয়নি।
সিঁড়ি বেয়ে ব্যাঙ্কের অফিসে চলে এলো বেনন। চিন্তিত চেহারায় তাকে অনুসরণ করল ব্যাগলে। পেছন থেকে অনিশ্চিত গলায় বলল, আমাদের বোধহয় কেটে পড়া উচিত, বেনন! শিগগিরই কেউ এসে পড়বে, আর এলেই একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকবে। উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে আমাদেরকে ওরা ঝুলিয়ে দিতে পারে।
জবাব দিল না বেনন। অধৈর্য ব্যাগলে বলল, তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে নড়ার কোন ইচ্ছে নেই।
কৌতূহল হচ্ছে, অস্বীকার করব না, বলল বেনন। তবে সেজন্যে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হবার কোন ইচ্ছে আমারও নেই। ঠিকই বলেছ, এখানে থাকার আর কোন মানে নেই। চোখে অস্বস্তি নিয়ে লাশ দুটোর দিকে তাকাল বেনন। ওদের ব্যবস্থা শহরের লোকরাই করবে। চলো, কেটে পড়ি।
ওরা দু’জন ব্যাঙ্কের দরজায় পৌঁছেছে এমন সময়ে স্টেজকোচটা রাস্তার বাঁক ঘুরে ওদের ছাড়িয়ে খানিকটা সামনে থামল। ধুলো থিতিয়ে আসার আগেই লাফ দিয়ে নামল ড্রাইভার, যাত্রীদের মালামাল নামাচ্ছে।
কথা বলবে না, যা বলার আমি বলব, নিচু স্বরে ব্যাগলেকে বলল বেণন। বোর্ডওয়াকে এসে দাড়াল ওরা।
স্টেজ ড্রাইভারের হুড়োহুড়ির কারণ বোক গেল স্টেজ থেকে অপূর্ব সুন্দরী যুবতী মেয়েটা নামতেই। সোনালী চুল মস্তু খোঁপায় আটকানো, নীল একটা পোশাক পরে আছে যুবতী! ঠোঁট দুটো সরু কিন্তু পুরুষ্ট। মুখটা পানপাতার মতো। খাড়া নাক! আত্মসম্মান আছে। ঢিলেঢালা পোশাক তার খাপখোলা যৌবনকে আড়াল করতে পারেনি। পোড়া ঘিয়ের মতো গায়ের রং যুবতীর। একে দেখালে রানী ক্লিওপেট্রা রাগে-দুঃখে লোকসমক্ষে মুখ দেখানো বন্ধ করে দিত। লজ্জা হতো বিশ্বের দ্বিতীয় সুন্দরী হওয়ায়। যুবতীকে হাত ধরে নামাল সুদর্শন এক যুবক। পেটা স্বাস্থ্য তার, পরনের কাপড় বলে দিচ্ছে টাকার কোন অভাব নেই। এই দু’জনের পরে নামল মোটাসোটা বেঁটে এক লোক। তার কোটের পকেটের ওপর একটা টিনের তারা দেখে বোঝা গেল মার্শাল।
বোর্ডওয়াকে উঠল তিন যাত্রী। বেনন আর ব্যাগলেকে পাশ কাটিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার দিকে পা বাড়াল যুবক আর যুবতী। দ্রুত পিছিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার সামনে দাড়াল বেনন, দু’হাত দুদিকে বাড়িয়ে বাধা দিল তাদেরকে ব্যাঙ্কে ঢুকতে। তার পাশে দুর্লঙ্ প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেল ব্যাগলে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কড়া চোখে বেনন আর ব্যাগলেকে দেখল মার্শাল। চেহারায় বিস্ময় চাপা দিয়ে রাখতে পারছে সে। বারকয়েক তাকাল ফাঁকা রাস্তার দিকে। শহরটা এরকম খালি খালি লাগছে কেন সেটা বুঝতে চেষ্টা করায় তার জ কুঁচকে উঠল।
আয়ত নীল চোখে বিস্ময় নিয়ে বেননের দিকে তাকাল মেয়েটা। চেহারায় অনিশ্চিত একটা ভাব।
আমি হলে ভেতরে যেতাম না, ম্যাম, মার্শালকে অগ্রাহ্য করে নিচু গলায় বলল বেনন। ভেতরে লাশ পড়ে আছে।
আশঙ্কার ছাপ পড়ল মেয়েটার সুন্দর মুখে। বেদানা রঙা গাল ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বেননকে একরকম ঠেলে সরিয়ে ব্যাঙ্কের ভেতরে ঢুকে গেল মেয়েটা। সঙ্গের যুবক তার পেছন পেছন ঢুকল।
সবাই গেছে কোথায়? কারা তোমরা? মার্শালের ভাব দেখে মনে হলো। সামনের এই দুই ধূলিধূসরিত লোক দু’জনকেই শহর খালি হবার পেছনে দায়ী করছে সে।
বেনন জবাব দেবার আগেই ব্যাঙ্কের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার শোনা গেল। দ্রুতপায়ে বেননকে পাশ কাটাল মার্শাল, দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। মেয়েটাকে মাটিতে পড়ে থাকা একটা শরীরের পাশে বসে থাকতে দেখে বুঝে নিল যা বোঝার, তারপর ঘুরে মুখোমুখি হলো বেননের। চেহারাটা ভোঁতা হলেও মার্শালের হাতটা চালু। ঝটকা দিয়ে, হোলস্টার থেকে টেনে বের করল সে প্রকাণ্ড সিক্সগান, নিষ্কম্প হাতে তাক করল বেনন আর ব্যাগলের দিকে।
গানবেল্টগুলো খুলে ফেলে দাও, আদেশ দিল গম্ভীর, ভারী গলায়। তাড়াতাড়ি হাত নাড়াতে যেয়ো না, আমি ঠাট্টা করছি না।
দু’জনের কাউকে দেখে মনে হলো না মার্শালের কথাটা কানে গেছে। চোখে করুণা নিয়ে মার্শালকে দেখল বেনন। কোন কিছু না জেনে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেয়ে না, বলল ও।
কোল্টটা নড়ল না একচুল। মার্শালের চেহারাতেও কোন পরিবর্তন এলো না। দৃষ্টি বলে দিল সে কি ভাবছে। সামনের এই দুজনই কুকর্মটা করেছে এব্যাপারে মনে কোন সন্দেহ নেই তার। আবার তস্কর দু’জনকে সে আদেশ দিতে যাবে এমন সময় ব্যাগলে বলে উঠল, বিশ্বাস না হয় তুমি নিজে গিয়ে দেখে এসো, লোক দুটো অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা আগে মারা গেছে। আমাদের ট্র্যাক দেখলেও বুঝবে এই কিছুক্ষণ আগে আমরা এসেছি শহরে। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম কেউ নেই দেখে, সেলুনে গেলাম, সেখান থেকে বেরিয়ে কারণ খুঁজতে বেরিয়ে ব্যাঙ্কে এসে দেখি এই কাণ্ড। মাত্র ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েছি এমন সময়ে তোমরা এলে।
ব্যাগলের কথা শেষ হবার আগেই ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। যুবক তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, নাহলে হয়তো পড়েই যেত যুবতী। যুবকের চেহারাতেও একই অবিশ্বাসের ছাপ দেখল নেন।
ওদের মিষ্টি কথায় কান দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, জেস, খানিকটা নির্দেশের সুরেই মার্শালকে বলল যুবক। কাজটা এদেরই তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। টাকাগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই। এখানে এসেছে যাতে কেউ তাদের সন্দেহ না করে। পাসি খুঁজতে বেরলে পালিয়ে পার পাবে না বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয়ই।
যা মনে আসছে বলে যাচ্ছ তুমি, মিস্টার, আপত্তির সুরে বলল ব্যাগলে, ভাবতে চাইলে কত কিছুই ভাবা যায়। আমি যদি তোমাকে একটা ছাগল ভাবি তাহলে আমাকে ঠেকাচ্ছে কে!
বকবক থামিয়ে গানবেল্ট খুলে ফেলো, ধমক দিল মার্শাল। জেলখানায় আগে ঢোকাই, তারপর বোঝা যাবে তোমরা কি করেছ আর করোনি।
লোকটা অধৈর্য হয়ে উঠছে। ট্রিগারে আঙুলের চাপ বেড়েছে এটা লক্ষ করেছে বেনন আর ব্যাগলে, দু’জনই। কথা না বাড়িয়ে নির্দেশ পালন করল ওরা।
আমারও মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছ তুমি, ডিলন, গানবেল্ট বোর্ডওয়াকে পড়ার পর যুবককে উদ্দেশ্য করে বলল মার্শাল তার মোটা গলায়। যুবতীর দিকে। চোখে সহানুভূতি নিয়ে তাকাল। তোমার বাবার এই দুঃখজনক পরিণতির জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, মিস শার্লি। ভেবো না, আমি দেখব এই হারামী দুটো যাতে এজন্যে ফাঁসিতে ঝোলে।
চোখে চোখে কথা হলো বেনন আর ব্যাগলের। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ড্রাইভার ব্যাঙ্কের ভেতরটা ঘুরে এলো। তাতে অবস্থার কোন উন্নতি হলো না। দেরি না করে এসো ওদের আমরা ঝুলিয়ে দিই, জেস, নাকি গলায় আবেদন জানাল সে। আপনি কি বলেন, মিস্টার ডিলন?
এখনও আমরা নিশ্চিত নই যে এরাই ব্যাঙ্ক ডাকাতি আর খুনগুলো করেছে, রুব, শান্ত স্বরে জবাব দিল ডিলন। তবে সেটা সম্ভবত এরাই খালি করেছে। অপেক্ষা করব আমরা, শহরের সবাই ফিরুক, যদি সিদ্ধান্ত হয় যে এরা দোষী তাহলে আমাদের কিছু করতে হবে না, ওরাই এদের ঝুলিয়ে দেবে।
তা দেবে, সায় দিল ড্রাইভার। কিন্তু কোন জাহান্নামে গেছে সবাই? সেটা বোধহয় এরা বলতে পারবে, মতামত প্রকাশ করল মার্শাল।
সুদর্শন যুবক কিছু না বলে মেয়েটার দিকে তাকাল। শার্লি তার বাবার লাশ দেখার ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। শার্লির বাহুতে আলতো করে হাত রাখল ডিলন। চলো, শার্লি, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি আমি। চিন্তা কোরো না,
আমার ওপর ছেড়ে দাও সব, এদিকটা আমি সামলে নেব।
ধন্যবাদ, লিউ, ক্লান্ত কণ্ঠে বলল শার্লি। সন্দেহের চোখে একবার দেখে নিল বেনন আর ব্যাগলেকে, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল ডিলনের পাশে।
চলো তোমরা, তাড়া লাগাল মার্শাল, বেনন আর ব্যাগলেকে এগোতে ইশারা করে ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল, অস্ত্রগুলো নিয়ে আমার পেছন পেছন আসো, রুব।
একতলা একটা বাড়িতে মার্শালের অফিস। ওটাই জেলখানা। সিক্সগান তাক করে রেখে পেছন না ফিরেই দরজার তালা খুলল মার্শাল, একপাশে সরে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। তার ইশারা পেয়ে ভেতরে ঢুকল বেনন আর ব্যাগলে। ওদের পর মার্শাল ঢুকল। ড্রাইভার রুব দেয়ালে গাঁথা দুটো পেরেকে ঝুলিয়ে রাখল গানবেল্ট দুটো।
নাম কি তোমাদের! হুক থেকে চাবির একটা রিং নামাতে নামাতে জানতে চাইল মার্শাল।
আমি বেনন। রক বেনন। আর আমার সঙ্গে এ ব্যাগলে, হিরাম ব্যাগলে।
কি বললে? চোখ বিস্ফারিত হলো মার্শালের। বেনন? রক বেনন? কোন বেনন? আমাদের এই মন্ট্যানার বেনন?
ওপর নিচে মাথা দোলাল বেনন।
চোখ সরু হয়ে গেল মার্শালের। তাহলে পুরনো সেই পাপী আবার লাইনে ফিরে এসেছে! কড়া চোখে ব্যাগলেকে দেখল। সঙ্গের এটাও নিশ্চয়ই একই নর্দমার কীট?মাথা নাড়ল সে। তোমাদের কপাল খারাপ যে আমার এলাকায়। কাজ সারতে এসেছিলে।
তুমি ভাল করেই জানো যে আমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, বলল বেনন। বিন্দুমাত্র চিন্তিত দেখাচ্ছে না ওকে। পঞ্চোর পকেট থেকে একটা সিগার বের করে ধরাল। ধোয়া ছুঁড়ল ছাদ লক্ষ্য করে, তারপর ঠোঁটের কোনা দিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না তুমি একটা গাধা, মার্শাল। তুমি কি চাও আমি আমার ধারণা পাল্টে ফেলি? মার্শালের চোখে তাকাল বেনন। আমি দোষী হলে কখনও নিজের পরিচয় দিতাম?
ব্যাগলে মাথা দোলাল বেননের যুক্তি শুনে।
আমি জারম্যান জেস, বেনন, নামটা গুরুত্ব বহন করে এমন ভাবে ধীর গলায় বলল মার্শাল। আমার নাম শুনে থাকবে হয়তো। আজ পর্যন্ত কোন আউট ল আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। অফিসের আরেকপ্রান্তে একটা দরজা। দরজাটা খোলা। খাটো একটা করিডরের পর সেলের শিক দেখা যাচ্ছে। অস্ত্রের মুখে করিডরে ওদের নিয়ে এলো মার্শাল, সেলের দরজার দিকে ইঙ্গিত করল। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, এবার ভেতরে ঢোকো।
পিচুটি ভরা চোখে প্রশংসা নিয়ে মার্শাল জেসের কথায় সায় দিয়ে মাথা দোলাল ড্রাইভার রুব, মার্শাল চাবি দিতেই এগিয়ে গিয়ে সেলের দরজার তালা। খুলে দরজা মেলে ধরল। তাকে সরে যেতে বলল মার্শাল, বেনন আর ব্যাগলেকে ঢুকতে বলল সেলের ভেতরে। নির্দেশ পালন করে পিছিয়ে সরে গেল রুব। আইগুই না করে ভেতরে ঢুকল বেনন আর ব্যাগলে। পেছনে দড়াম করে দরজাটা। বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনি আটকাল জেস, হোলস্টারে অস্ত্রটা রেখে রুবের কাছ থেকে চাবি নিয়ে তালায় ঢোকাল লক করার জন্যে, পর মুহূর্তে জমে গেল মূর্তির মতো। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বেনন, শিকের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট ডেরিঞ্জারটার নল ঢুকিয়ে গুঁতো দিয়েছে মার্শালের ভুড়িতে। পেটের দিকে তাকিয়ে ডেরিঞ্জারের নলটাকে কামানের নল বলে মনে হলো মার্শালের, বেননের চোখে শীতল চাহনি বুকে কাপ ধরিয়ে দিল।
দরজাটা খোলো, নাহলে থলথলে হুঁড়ি ফুটো হয়ে যাবে, হুঁশিয়ার করল বেনন।
আরেকবার বলো, বলল ব্যাগলে, ওর গুবরে পোকার সমান মগজে কথাটা ঢুকেছে কিনা কে জানে! ঢুকেছে তাতে সন্দেহ নেই কোন। কাঁপা হাতে ছিটকিনি খুলল মার্শাল জেস। দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো বেনন, লোকটাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল। বেননকে পাশ কাটিয়ে অফিসে চলে এলো ব্যাগলে, পেরেক থেকে গানবেল্ট দুটো খসিয়ে নিজেরটা পরে নিল ব্যস্ত হাতে, বেননেরটা পরিয়ে দিল বেননকে। সিক্সগান বের করে ড্রাইভারের দিকে চোখ গরম করে তাকাল ব্যাগলে। ঝুলিয়ে দেয়া উচিত, না?
কি যেন বলতে চাইল রুব, গলা দিয়ে শুধু গোঁ-গোঁ আওয়াজ বেরল।
ভেবো না পালাতে পারবে তোমরা, শাসানোর সুরে বলে উঠল জারম্যান। এই কাউন্টি ছেড়ে বেরনোর আগেই ধরা পড়তে হবে।
তোমরা হোট শহরের মার্শালরা সব একই রকম, আফসোস করে মাথা নাড়ল বেনন। প্রমাণ ছাড়াই যাকে তাকে ধরে বসো অপরাধী মনে করে।
জবাব দিল না জারম্যান, মনে মনে নিজেকে শাপান্ত করল, বন্দিদের সার্চ না করে বিরাট একটা ভুল করেছে সে কাজে।
আমরা এই কাউন্টিতে থাকব নাকি চলে যাব সেটা আলাদা ব্যাপার, জারম্যান, বলল বেনন। তবে যদি চলে যেতে চাই তাহলে তোমার সাধ্য নেই ঠেকাও। আমার মনে হয় তোমার উচিত রলিন্সে শেরিফ মায়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা, তাহলেই তোমার ধারণা পাল্টে যাবে। বুঝতে পারবে যে আমরা কোন অপরাধ করিনি। মায়ার্স আমাদের ভাল মতোই চেনে।
ভাল লোকের নাম বলেছ! তিক্ত সুরে বলল জারম্যান। কয়েক সপ্তাহ আগে অ্যাম্বুশে মারা গেছে সে। চোখ সরু করল মার্শাল। কে জানে, তোমরাই হয়তো তার হত্যাকারী।
এ তো খামোকা একের পর এক দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে! রেগে গেল ব্যাগলে। বেননের দিকে তাকাল, চোখ চকচক করছে শয়তানিতে। দেব নাকি ব্যাটার পাছায় জোরসে একটা লাথি কষিয়ে, মগজটা নড়ে উঠবে, তাতে বুদ্ধি খুলতে পারে। লোকটার।
হয়তো কাজ হতো, ধীরে বলল বেনন, কিন্তু আমার ধারণা পাছার বদলে মগজটা ওর পায়ের বুড়ো আঙুলে।
আমি যাচ্ছি ঘোড়া আনতে, কথা না বাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল ব্যাগলে। এব্যাটা যখন মানবেই না যে আমরা নির্দোষ, তো সরে পড়া যাক।
নীরবে মাথা দোলাল বেনন।
মার্শালের অফিস থেকে বের হয়ে বোর্ডওয়াক থেকে নামার সময় শহরের শেষ প্রান্ত থেকে ডিলনকে আসতে দেখল ব্যাগলে। পাত্তা না দিয়ে ক্যাসিনো। সেলুনের দিকে চলল ও। সেলুনের হিচরেইলের সামনে শান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে ঘোড়া দুটো। সময় নিয়ে দড়ি খুলল ব্যাগলে, ডিলনকে পাশে আসার সুযোগ করে দিল।
মনে হচ্ছে জেসকে বোঝাতে পেরেছ যে তোমরা খুনি নও, সাইডওয়াকে দাঁড়িয়ে পড়ে মন্তব্য করল ডিলন।
তোমার গায়ে পড়া ভাবটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, বন্ধু। গোঁফে তা দিল ব্যাগলে। মার্শালকে আমরা কি বুঝিয়েছি তাতে তোমার এত কি?
ডিলনের ধূসর চোখ সরু হয়ে গেল, মুখটা দেখে মনে হলো পাথর কেটে তৈরি। পা ফাঁক করে গানম্যানদের মতো দাঁড়াল লোকটা। শান্ত, ভাব-বিবর্জিত গলায় বলল, টুইন স্প্রিংসের সব কিছুতেই আমার স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
কারণটা কি, বন্ধু? ব্যাগলে একেবারেই অবিচল। দরকার পড়লে মুহূর্তের মধ্যে সিক্সগান বের করতে পারবে।
এই শহরটা ডিলনরা তৈরি করেছে, মিস্টার, ডিলনদের টাকাতেই এই শহর চলে।
তার মানে এই নয় যে তুমিই এই শহরের আইন। গায়ে পড়ে লাগতে আসার কোন অধিকারও কেউ দেয়নি তোমাকে।
এক সেকেন্ডের জন্যে মনে হলো ড্র করতে যাচ্ছে ডিলন। দেরি না করে থাবা দিয়ে সিক্সগান বের করে আনল ব্যাগলে, তারপর দেখল শরীরে ঢিল দিয়ে দাঁড়িয়েছে ডিলন, চোখে টিটকারি খেলা করছে। এবার, এই এতক্ষণ পর সতর্ক হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল ব্যাগলে। তার চিনতে ভুল না হলে সামনে দাড়ানো এই লোকটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একজন।
তুমি বোধহয় ভাবো অস্ত্রে তোমার হাত যথেষ্ট চালু, শান্ত স্বরে বলল ডিলন। ধারণাটা পাল্টে ফেলো। আমি যদি ড্র করতাম, এতক্ষণে রাস্তায় পড়ে থাকত তোমার লাশ। হয়তো ড্র আমি করবও, যদি প্রমাণ পাই যে তুমি আর তোমার দোস্ত মিলে রাল্যান্ডের খুনটা করেছ।
অজান্তেই একটা ঢোক গিলল ব্যাগলে। রেগে গেল অস্বস্তি বোধ করছে। বলে। অস্ত্রষ্টা নেড়ে হুকুম দিল, গানবেল্টটা খুলে হাত উঁচিয়ে দাঁড়াও। বাকল খোলার সময় আস্তে হাত নাড়বে। যদি তাড়াহুড়ো দেখি তো গুলি করে পরে জানতে চাই কারণটা।
দেহের পেশি শক্ত হয়ে গেল ডিলনের, কিন্তু ব্যাগলের নির্দেশটা পালন করল সে। লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল গানবেল্ট। ওটা তুলে নিল ব্যাগলে, ডিলনকে বোর্ডওয়াক ধরে আসতে ইশারা করল। ঘোড়া দুটোর দড়ি ধরে নিয়ে চলল জেল হাউজের দিকে।
ও জেলখানার সামনে যাবার আগেই মার্শাল আর ড্রাইভারকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বেনন। বোর্ডওয়াকে থমকে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখল ডিলন, নিচু স্বরে বলল, আচ্ছা, এই তাহলে ব্যাপার!
ওরাই খুনী, কোন সন্দেহ নেই, মতামত জানাল মার্শাল। চোখের ইশারায়। বেননকে দেখাল। এ মন্ট্যানার কুখ্যাত দস্যু রক বেনন। সঙ্গেরটাও পাক্কা হারামি।
কতদূর যাবে, বলল ডিলন। আমার ধারণা দু’দিনের বেশি লাগবে না ওদের ধরে ঝুলিয়ে দিতে।
হয়তো তাই, জবাব দিল ব্যাগলে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমরা যদি ফাঁসিতে ঝুলি তা দেখার ভাগ্য তোমার হবে না।
রাস্তায় পা রেখে ঘোড়ার দড়ি ধরল বেনন। অস্ত্রের নল এখনও মার্শালের। দিকে। পরস্পারের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো বেনন আর ব্যাগলের। মাথা দোলাল ব্যাগলে। ওরা দুজন স্যাডলে উঠতে যাবে এমন সময় শুনতে পেল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে ঘোড়াটা। বন্দিদের চোখে নতুন আশার আলো দেখতে পেল বেনন। ডিলনের চেহারায় ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা খেলা করছে।
০২. পরিস্থিতি বুঝে নিতে দেরি হলো না
পরিস্থিতি বুঝে নিতে দেরি হলো না অশ্বারোহীর। বিশগজ দূরে থাকতেই ঘোড়ার গতি কমিয়ে হাঁটার সমান করে ফেলল সে। যেকোন সময়ে কিছু একটা করে বসবে।
এগিয়ে আসতে থাকো, ডাক দিল ব্যাগলে। কোমরের কাছ থেকে হাত সরিয়ে রাখবে।
ঘোড়াটা একেবারেই থামিয়ে ফেলল যুবক। ওখান থেকেই হাঁক ছাড়ল, আমি বরং এখান থেকেই সুযোগ নেব।
মাথা দোলাল ব্যাগলে। নিতে পার, কিন্তু যদি নাও, লিউ ডিলনকে খতম করে দেব আমি। শুনলাম ও নাকি এই শহরের সবচেয়ে দামী লোক। ঝুঁকিটা নেবে তুমি?
গলা ছেড়ে হেসে উঠল যুবক। আন্তরিক উদার হাসিতে কাঁপছে তার দেহ। বেনন আর ব্যাগলেকে অবাক করে দিয়ে দরাজ গলায় বলে উঠল, ওকে যদি খতম করে দাও তাহলে বিরাট এক ঋণের হাত থেকে বেঁচে যাব আমি। আজকেই টাকাটা ওকে দিতে শহরে এসেছি, বুঝলে? হাত বাড়াব নাকি অস্ত্রের দিকে?
প্রথম দর্শনেই বেনন আর ব্যাগলের ভাল লেগে গেল আন্তরিক যুবককে। সতর্কতায় ঢিল না দিয়ে আরও ভাল করে লক্ষ করল ওরা তাকে। বয়স হবে। বড়জোর পঁচিশ। মাঝারি আকৃতি, দড়ির মতো পাকানো দেহ, কালো চুল, চোখ দুটো নীল, অলস দৃষ্টি তাতে। মুখে রসিকতার ছাপ, কিন্তু চিবুকটা দেখলে বোঝা যায় এই লোকের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়া যায় না। পিছু হটার লোক নয় যুবক।
ব্যাপার কি আসলে? জানতে চাইল যুবক। শহরের মানুষ গেছে কোন্ জাহান্নামে? আমি মনে করি না ওই দুটো সিক্সগান দিয়ে সবাইকে ভাগিয়ে দিতে পেরেছ তোমরা।
আমরাও এসে দেখি শহর খালি, জবাব দিল বেনন। কারা যেন ব্যাঙ্কে ঢুকে দু’জন লোককে খুন করে সেফ খালি করে নিয়ে ভেগেছে। এই মোটা মার্শাল আর ডিলন জোর করে আমাদের দোষী বানাতে চাইছিল।
ব্যাঙ্ক ডাকাতির কথায় একটু চমকে মতো উঠল যুবক। ধীরে ধীরে ঘোড়া থেকে নামল, ভাব দেখে মনে হলো না বেনন বা ব্যাগলের তরফ থেকে বিপদের ভয় পাচ্ছে। বেনন আর ব্যাগলে বাধা দিল না, ব্যাঙ্কে গিয়ে ঢুকল সে, এক মিনিট পরই বেরিয়ে এলো, আবার। মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ দেখল বেননদের দুজনকে। গানবেল্টের ওপর থেকে ঘুরে এলো তার দৃষ্টি, তারপর তাকাল ডিলনের দিকে।
ব্যাঙ্ক ডাকাতদের ধরার আগে পর্যন্ত টাকা না চাওয়াই উচিত হবে বলে মনে করি আমি, ডিলন, শান্ত গলায় বলল সে।
কঠোর চেহারায় মাথা নাড়ল ডিলন। না, ক্লিন্ট। তোমার চেয়ে আমার টাকা ওই সেফে বেশি ছিল, কিন্তু তাতে আমার ব্যবসায় কোন অসুবিধে হবে না। যারা আমার কাছে টাকা পায় তাদের টাকা নিদিষ্ট সময়েই শোধ করব আমি। আমি আশা করছি তুমিও তাই করবে। আগামীকাল যদি টাকা শোধ করতে না পারো তাহলে ট্রিপল বার আমার হয়ে যাবে। কথা থামিয়ে বেনন আর ব্যাগলেকে দেখাল ডিলন। এদের ওপর থেকে যদি চোখ না সরাও তাহলে তোমার ব্যাঙ্কে রাখা টাকা বোধহয় ফেরত পাবে।
আমারও তাই ধারণা, বলল মার্শাল জেস। তার গলায় কোন উৎসাহ নেই। বুঝেছে যে চিপিতে পড়েছে সে আর ডিলন, বেনন আর ব্যাগলেকে হারিয়ে দিয়ে তাদের উদ্ধার করতে পারবে না ক্লিন্ট চাইলেও।
মার্শালকে অগ্রাহ্য করে ডিলনের দিকে তাকাল ক্লিন্ট। গম্ভীর গলায় বলল, ট্রিপল বার দখল করতে চেষ্টা করলে ভুল করবে, ডিলন। আমি চাই না খুনোখুনি হোক। কিন্তু পিছিয়েও যাব না আমি।
ডিলনের মুখটা কালো হয়ে গেল। আমাকে থামাতে চেষ্টা করলে খুনোখুনির দায় তোমাকেই নিতে হবে, ক্লিন্ট, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে। আগামীকাল, ক্লিন্ট। তার আগেই তোমাকে টাকা শোধ করতে হবে। না যদি করো, আইন আমার পক্ষে থাকবে, মার্শালের দিকে তাকাল সে। আমি কি ঠিক বলছি, জারম্যান?
ওপর-নিচে মাথা দোলাল মার্শাল।
আমি সত্যিই দুঃখিত, শার্লি, মৃদু গলায় বলল ক্লিন্ট। এখন ব্যবসার কথা আলোচনার সময় নয়, অথচ অভদ্রের মতোই তা-ই করতে হলো। ক্ষমা করো। আর একটা কথা, আমার টাকা শোধ করার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না।
আস্তে করে মাথা দোলাল হতচকিত শার্লি।
ঘোড়ায় চড়ল ক্লিন্ট, ছুটতে শুরু করল স্ট্যালিয়নটা, এবার দক্ষিণে যাচ্ছে। ওদেরও এখানে অপেক্ষা করার কোন কারণ নেই, শেষবারের মতো চোখে নীরব নিষেধ নিয়ে দুজনকে দেখল বেনন, তারপর ব্যাগলেকে আসতে বলে ছুটল ক্লিন্টের পিছু পিছু। বুঝতে পারছে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও খুশি, যেকাজে এখানে এসেছিল সেই কাজের রূপ কি হতে পারে তার একটা অস্পষ্ট ধারণা পেয়ে গেছে।
শহর থেকে মাইল খানেক দূরে আসার পর ক্লিন্ট টের পেল যে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। রাশ টেনে, ঘোড়া থামিয়ে ফিরে তাকাল সে, হাত ঝুলিয়ে দিল হোলস্টারের পাশে। অপেক্ষা করল বেনন আর ব্যাগলে সামনে এসে থামা পর্যন্ত, তারপর বলল, আমার পিছু নাওনি তো, বন্ধুরা?
বোধহয় রলিন্সে যাচ্ছি, বলল ব্যাগলে। টুইন স্প্রিংস বড় বেশি গরম হয়ে উঠেছিল।
তোমরাই যদি খুন করে থাকো তাহলে বলিঙ্গে গিয়ে বাঁচবে না। স্টেজটা রলিন্সে গেলেই খবর ফাঁস হয়ে যাবে। তাছাড়া পাসি নিয়ে খুঁজতে বেরবে। জারম্যান।
টুইন স্প্রিংস থেকে পাসির লোক জোগাড় করতে হচ্ছে না জারম্যানকে। একটা সিগার ধরাল বেনন। অবশ্য ওসব নিয়ে আমরা ভাবছি না এখন। তীক্ষ্ণ চোখে যুবক র্যাঞ্চারকে দেখল, জরুরী কিছু নয় এমন সুরে বলল, তুমি শহরে ঢুকেছিলে উত্তর থেকে, এখন দেখছি দক্ষিণে যাচ্ছ।
জবাব না দিয়ে ঘোড়া সামনে বাড়াল ক্লিন্ট। তার দু’পাশে চলেছে বেনন আর। ব্যাগলে। কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ওরা, তারপর মুখ খুলল র্যাঞ্চার। এখন যাচ্ছি রলিন্সে। ওখানে কয়েকজন বন্ধু আছে, চেষ্টা করে দেখব তাদের কাছে ধার। পাওয়া যায় কিনা। যাবে বলে মনে হয় না। অনেক টাকা পায় ডিলন আমার কাছে।
খুকখুক করে কাশল,বেনন। কেন:পায় জানতে পারি কি? অবশ্য তোমার যদি বলতে কোন আপত্তি না থাকে।
অন্য র্যাঞ্চারা যা করত তাই করল ক্লিন্ট, চোখে রাগ নিয়ে বোনকে দেখল। ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করাটা, পশ্চিমে রীতি বিরুদ্ধ। তবে বেননের হাসিটা আন্তরিক রাগ কমিয়ে দিল ক্লিন্টের। বেনন আর ব্যাগলেকে কৌতূহলী চোখে। আরেকবার দেখল সৈ। টুইন স্প্রিংসে যে সিদ্ধান্তে এসেছিল সেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছুল আবার। এরা লোক ভাল, কোন কথা দিলে তা রাখতে জানে। সহজ হয়ে এলো যুবক। ভালই তো, নিজের সমস্যা নিয়ে আলাপ করলে হয়তো কোন সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে।
লুক ডিলন, আর আমার বাবা একই সময়ে এই অঞ্চলে আসে, শুরু করল সে। বন্ধু ছিল দু’জন, তাই ঠিক করেছিল পাশাপাশি র্যাঞ্চ করবে। র্যাঞ্চিং ব্যবসায়ে দুজনই সফল হয়। বিয়েও করেছিল একই সঙ্গে। সেই সময়ে অরিগনে যাবার পথে একটী ওয়াগন ট্রেইন থেমেছিল এখানে। সেই ওয়্যাগন ট্রেইনের দুটো মেয়েকে বিয়ে করে তারা একটু থামল ক্লিন্ট, একটা সিগারেট রোল করে নিয়ে আবার বলতে লাগল।
দুর্দান্ত লোক ছিল ডিলন, তবে আমার বাবাও যথেষ্ট কঠোর ছিল। পরবর্তী বছরগুলোয় প্রতিবেশী হওয়াতেই সম্ভবত বাবা আর লুক ডিলনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দু’জনের বউ যদি বান্ধবী না হতো তাহলে হয়তো বিবাদ এড়ানো যেত না। অবশ্য তাদের জীবিত অবস্থাতেই বাবা আর লুক নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছিল। ডিলনের বউ একটা ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যাওয়ার এক বছর পর মারা যায় আমার মা। এরপর থেকেই ডিলন আর ডসনদের মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ।
ছবিটা এখন বেনন আর ব্যাগলের কাছে পরিষ্কার। গভীর মনোযোগে শুনছে ওরা।
বাবা ঠিক করল আমাকে শিক্ষিত করে তুলবে, কাজেই পুবে কলেজে পড়তে গেলাম আমি। ওখানে তিনবছর থাকলাম। আমি অবশ্য জানতাম না যে এই বছরগুলোয় বাবার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ মোড় নিয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষার দুমাস আগে খবর পেলাম বাবা মারা গেছে। তার শেষ কথা ছিল আমি যাতে লেখাপড়া শেষ করে তারপর এখানে আসি। তাই করলাম আমি। এখানে এসে দেখি কারা যেন আমাদের গরু চুরি করে র্যাঞ্চের অবস্থা খারাপ করে তুলেছে। আমাদের ফোরম্যান ডারকিন অ্যাম্বুশে মারা গেল। তার পর পরই মারা গেল আরও কয়েকজন শক্ত কাউবয়। কয়েকজন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। সিগারেটে কষে টান দিয়ে শেষটুকু ফেলে দিল ক্লিন্ট।
রাউন্ডআপের সময় গরু জড় করতে গিয়ে টের পেলাম র্যাঞ্চের অবস্থা কতখানি খারাপ। রেলরোডের খরচা উঠবে না বুঝে শেষ পর্যন্ত ড্রাইভ করিনি। লিউ ডিলনের কাছ থেকে ধারটা তখনই নিই। মোটামুটি ভাল বন্ধু ছিলাম আমরা ছোটবেলা থেকেই। ও যখন আমাকে খারাপ সময়টা পার করার জন্যে বেশ কিছু টাকা সাধল, নিতে দ্বিধা করলাম না আমি। তখনও জানি না ওর বাবার মতোই হয়েছে ও। পরের কয়েকবছরে আমাদের বন্ধুত্বও শেষ হয়ে গেল। বাজি ধরে বলতে পারি আমার গরু রাসলিঙের পেছনে ওর হাত আছে, ওর লোকরাই করছে কাজটা। যাই হোক, দিনরাত খেটে র্যাঞ্চটা আমি মোটামুটি লাভজনক করে তুলতে পারলাম। ব্যাঙ্কে যে টাকা রেখেছিলাম তা দিয়ে ডিলনের ঋণটা আমি শোধ করে দিতে পারতাম, কিন্তু ডাকাতি হয়ে গেল ব্যাঙ্ক।
ব্যাঙ্ক তোমার ক্ষতি পূরণ না করা পর্যন্ত ডিলন অপেক্ষা করতে পারে, বলল ব্যাগলে।
মাথা নাড়ল ক্লিন্ট। ব্যাঙ্কের মালিক রাশল্যান্ড মারা গেছে। আমি মিস রাশল্যান্ডের কাছে টাকা ফেরত চাইব না। তাছাড়া টাকাটা আমি ব্যাঙ্কে জমা রাখিনি, রাশল্যান্ডের জিম্মায় রেখেছিলাম, যাতে ঋণ শোধের সময় ও সাক্ষী থাকে। সচ্ছল ব্যাঙ্কও নয় ওটা। মূল ব্যবসা জমাকারীর টাকা রলিন্সের বড় ব্যাঙ্কে রাখা। রলিন্সের ব্যাঙ্কের দেয়া সুদ আর জমাকারীদের রাল্যান্ড যে সুদ দেয় তার পার্থক্যই ছিল ব্যাঙ্কটার মুনাফা।
কে জানত যে টাকাটা ব্যাঙ্কে আছে? জানতে চাইল বেনন।
রাশল্যান্ড আর ক্রিসি। ওরা দুজনই মারা গেছে কাজেই সন্দেহের বাইরে। এছাড়া জানত লিউ ডিলন আর তার ফোরম্যান কেল। ওরা জানে কারণ কেগকে আমি বলেছিলাম, যাতে ডিলনকে জানিয়ে দেয়।
কেগ হয়তো ডাকাতি করেছে, বলল বেনন। যদি করে থাকে, তাহলে ডিলনকে সে কিছু বলবে না, নিজের স্বার্থে।
দ্বিধান্বিত দেখাল ক্লিন্টকে। মাথা নাড়ল একটু পরে। না। কেগল গানম্যান, নীচ লোক সন্দেহ নেই, কিন্তু ডিলনের পকেটে আছে, সে এরকম কিছু করবে বলে মনে হয় না।
সেটা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে, বলল বেনন।
বিস্মিত চোখে ওকে দেখল ক্লিন্ট, তারপর বলল, তোমার বলার ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল তোমরাই খোঁজ নেবে। আসলে তো বলতে চাইছ আমার খোঁজ নেয়া উচিত, তাই না?
না, ধীর গলায় বলল বেনন, প্রথমবারই তুমি ঠিক বুঝেছ। আমাদের ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। কে ফাঁসিয়েছে, কেন ফাঁসিয়েছে ইত্যাদি জানার আগে এই এলাকা থেকে নড়ব না আমরা।
বেনন আর ব্যাগলেকে বারকয়েক দেখল ক্লিন্ট। ল-ম্যান তোমরা?
বেনন বলল, জারম্যানের উদ্ধত আচরণ আমাদের পছন্দ হয়নি, তাছাড়া ডিলন আমাদের ঘাড়ে খুনের দায় চাপিয়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল-কারণ জানতে চাই। এমনিতে এখান থেকে চলে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগটা রয়েই যাবে। মাথা নাড়ল বেনন। তাড়া খেয়ে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়াতে চাই না আমরা।
আরেকটা ব্যাপার, বলল ব্যাগলে। এটাও জানতে হবে যে আমরা যখন টুইন স্প্রিংসে ঢুকলাম শহরটা তখন খালি ছিল কেন।
মাথা চুলকাল ক্লিন্ট, খানিকক্ষণ ভেবে ক্ষান্ত দিল এই চিন্তা করে যে তার নিজের ঝামেলারই শেষ নেই।
বুড়ো ডিলন এখনও বেঁচে আছে? কথাবার্তা চালিয়ে যাবার জন্যে জানতে চাইল বেনন।
না। বছর খানেক আগে বারান্দার ওপর থেকে উঠানে পড়ে মারা গেছে। হাতে একটা বন্দুক ছিল, ওটার গুলি ছুটে যায়, বুড়োর মাথার অর্ধেকটা উড়ে গিয়েছিল।
অদ্ভুত মৃত্যু, বিড়বিড় করল ব্যাগলে। মনে মনে দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করল।
এব্যাপারে আর কিছু বলল না ক্লিন্ট।
আগামীকাল ট্রিপল বার কেড়ে নিতে আসবে ডিলন, বলল বেনন। ওকে ঠেকাতে পারবে তোমরা?
জানি না, ঘোড়র গতি কমিয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল ডসন। দুই বন্ধু দেখল কপালে চিন্তার গভীর ভঁজ পড়েছে যুবকের। আসলেই জানি না, আবার বলল, রলিঙ্গে গিয়ে যদি টাকা জোগাড় করতে না পারি তাহলে ফিরে এসে ছেলেদের বলতে হবে ফতুর হয়ে গিয়েছি আমরা, বলতে হবে ট্রিপল বারে থাকলে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে। আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত তিনজন থেকে যাবে আমার সঙ্গে। ওদের নিয়ে ডিলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকব না আমি।
বেনন আর ব্যাগলে নিজেদের ভেতরে দৃষ্টি বিনিময় করল। যুবককে আরও ভাল লেগে গেছে ওদের। যেভাবে পরিস্থিতি বিচার করল তাতে বোঝা যায় বুদ্ধি আছে। গর্বে অন্ধও নয়, ক্রুদের খুলে বলবে নিজের অর্থনৈতিক দৈন্য। তাছাড়া ক্লিন্ট বিশ্বাস করেনি ওরা টুইন স্প্রিংসের ব্যাঙ্কে ডাকাতি করেছে।
আমরা তোমার পক্ষে, সোজাসুজি ঘোষণা দিল ব্যাগলে। আপাত দৃষ্টিতে সরল লোক মনে হয় ওকে, কিন্তু যারা ওর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে ওর একটা ভিন্ন রূপ আছে। এই লোকটা হাসি মুখে মরতে তৈরি হয়ে যায়। মৃত্যু ভয়ে পিছায় না কখনও, সে শত্রু তিনজনই হোক বা চারজন।
আমরা দুজন আর তোমার তিন কাউবয় আর তুমি, বলল বেনন। হয়তো আমরা ডিলনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব।
বিপদে আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছ সেজন্যে ধন্যবাদ, বলল ক্লিন্ট, কিন্তু আমি তোমাদের সাহায্য এমনি এমনি নিতে পারি না। তোমরা যদি ট্রিপল বারে কাজ নাও তাহলে আমি রাজি আছি।
ঠিক আছে, রাজি হলো বেনন। মাসের শেষে আমাদের দশ ডলার করে দেবে তুমি। কিন্তু একটা কথা, আমাদের ওপর কোন বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে না। নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করব আমরা।
বেশ। বেনন আর ব্যাগলেকে পালা করে দেখল ক্লিন্ট। কোন যুক্তি নেই, তবু মনের মাঝে আশা জাগল, লোক দুটোকে দেখে মনে হয় পোড় খাওয়া, এরা হয়তো বিরাট সাহায্য হিসেবে দেখা দেবে ভবিষ্যতে।
তাহলে আমার আর ধাগলের রলিঙ্গে যাওয়ার কোন যুক্তি নেই, বলল বেনন। তারচেয়ে বরং তোমার র্যাঞ্চে চলে যাই।
ঠিক আছে। ওখানে গিয়ে জিম ডায়ারকে বললেই হবে তোমাদের আমি কাজে নিয়েছি।
ট্রিপল বারটা কোনদিকে? টুইন স্প্রিংস এড়িয়ে যাওয়া যায় না ওখানে? যায়, তবে দশ মাইল বাড়তি ঘোড়া দৌড় করাতে হবে। ওই যে দুটো চুড়ো দেখছ? উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়টা দেখাল ক্লিন্ট। ওই চুড়োগুলোর উত্তর-পুবে ট্রিপল বার। পাহাড়ের কাছে গেলেই ট্রেইল পেয়ে যাবে। টুইন স্প্রিংস শহরটা ট্রেইল থেকে অনেকটা দক্ষিণে। ট্রেইল প্রথমে উত্তরে গেছে, তারপর পুবে টিলাটরের ভেতর দিয়ে গিয়ে পৌঁছেছে একটা ক্যানিয়নে, চওড়া ওই ক্যানিয়ন ধরে এগোলেই পৌঁছে যাবে ট্রিপল বারে।
হাত নেড়ে যুবক র্যাঞ্চারকে বিদায় জানাল বেনন আর ব্যাগলে, ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওনা হয়ে গেল স্বদন্ত আকৃতির চুড়োগুলোর দিকে। রেঞ্জটা ঝোঁপঝাড়ে ভরা, রুক্ষ জমি, মাঝে মাঝে ঘাস।
ঈগলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের এবড়োখেবড়ো প্রান্তর দেখল নেন। ব্যাগলে হাসতে হাসতে বলল, আমরা আসছি, মার্শাল, তুমি বললেই তোমার কথা মতো। গলায় ফাঁসির দড়ি পরে নেব।
ভাল কথা মনে করেছ, বলল বেনন। জারম্যান বলেছে আইন ডিলনের পক্ষে থাকবে। তারমানে আসল খুনিদের আমরা যদি ধরতে পারি তাহলেও ওর ওয়ান্টেড লিস্টে নাম থাকবে আমাদের।
শ্রাগ করল ব্যাগলে, একটা সিগারেট ধরাল নিশ্চিন্ত চেহারায়। তারপর বলল, ডিলনকে আমার পছন্দ হয়নি। আইন ওর পক্ষ নিলে ভুল করবে। ক্লিন্ট যা বলেছে তার তুলনায় আরও অনেক খারাপ লোক মনে হয়েছে আমার ডিলনকে।
আমার মনের কথা বলেছ, সায় দিল বেনন। একটা চিন্তা মাথায় আসতে জী কুঁচকে বলল, কথা হচ্ছে ডিলন আর ক্লিন্টের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবার ব্যাপারে সুন্দরী মিস রাশল্যান্ডের ভূমিকা কতটুকু।
চট করে একবার বেননকে দেখে নিল ব্যাগলে। গভীর বিশ্বাস আছে ওর বন্ধুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর। গত কয়েক ঘণ্টার স্মৃতিচারণ করে নিয়ে বলল ও, সম্ভবত বিরোধের মূল কারণই হচ্ছে ওই মেয়ে। মেয়েটাকে খুব খাতির করছিল ডিলন। আর মনে আছে, একটু আগেই ক্লিন্ট বলেছে মিস রাশল্যান্ডের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইবে না?
মেয়েটা সত্যিই সুন্দরী, স্বীকার না করে পারল না বেনন। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে বলে দোষ দেয়া যায় না ওদের।
তবু মেয়ে তো, মাথা দোলাল বিজ্ঞ ব্যাগলে, ওদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল।
ব্যাগলের বউয়ের চেহারা মনে পড়তে একান ওকান হাসল বেনন। নীরবে এগিয়ে চলল ওরা। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতির চেহারায় কোন পরিবর্তন নেই। পাহাড়, উপত্যকা, অধিত্যকা, টিলা আর ঢেউ খেলানো সমভূমি। গভীর মনোযোগে চারপাশ দেখছে দু’জন। যাদের বিরুদ্ধে লাগতে হবে তারা এই এলাকা নিজেদের হাতের তালুর মতোই চেনে, ওদেরও চিনে রাখা উচিত, বিপদে কাজে দেবে জ্ঞানটুকু।
করাতের দাঁতের মতো পাহাড় চুড়ো দুটোর মাঝখান দিয়ে পার হলো ওরা, একটু পরেই ক্লিন্টের বলা ট্রেইলটা খুঁজে পেয়ে এগিয়ে চলল। সরু ট্রেইল, দু’পাশে পড়ে আছে বড় বড় কিম্ভুতকিমাকার চেহারার বোল্ডার। শত শত বছর ধরে খসে পড়েছে ওগুলো দু’পাশের ন্যাড়া রুক্ষ টিলাগুলোর গা থেকে। কোন তাড়া নেই বেনন আর ব্যাগলের, ঘোড়া দুটোকে নিজেদের গতিতে চলতে দিচ্ছে ওরা।
আরও কয়েক মাইল এগিয়ে ঘোড়া থামাল ওরা। ট্রেইলটা সামনে উত্তর পশ্চিম থেকে আসা আরেকটা ট্রেইলের সঙ্গে মিশেছে। কয়েকটা ড্রাই ওয়াশের ভেতর দিয়ে যেতে হবে ওই ট্রেইল ধরে এগোলে। পকেট হাতড়াল বেনন আর ব্যাপলে। একটা সিগারেট ধরাল ব্যাগলে, বেনন একটা চুরুট।
টুইন স্প্রিংসের দক্ষিণ দিক দিয়ে এসেছে এটা, বলল ব্যাগলে। টিলা সারি দেখাল হাত তুলে। ক্লিন্টের প্রতিবেশীর রেঞ্জটা ওদিকে।
নড় করল বেনন। ওরা দু’জন, আবার ঘোড়া ছোটাতে যাবে এমন সময় শুনতে পেল ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। বেশ দূরে আছে ঘোড়াটা, তবে এগিয়ে আসছে দ্রুত। অপেক্ষা করল বেনন আর ব্যাগলে। দুই মিনিট পর একটা ড্রাই ওয়াশ পার হয়ে ট্রেইলে দেখা দিল অশ্বারোহী।
আরে, লোকটা ডিলন, না? ভ্রূ কুঁচকে চিবুকে হাতের তালু ডলল বেনন।
কোন সন্দেহ নেই, সায় দিল ব্যাগলে। বেননকে দেখল চোখে আনন্দ নিয়ে। কি মনে হয়, আমাদের শহরে ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে লোকটা?
না। অযথা ঝুঁকি নেবার লোক না সে। হাতের তাস ভাল না হলে খেলবে না।
নিস্পৃহ চেহারায় এগিয়ে এলো ডিলন, মাত্র দু’গজ বাকি থাকতে ঘোড়া থামাল। দু’জনকে দেখল ভ্রু কুঁচকে। মনে হলো না ভয় পেয়েছে। চেহারা থেকে। সমস্ত অনুভূতির ছাপ দূর হয়ে গেল। আরও জোরে ছুটতে হবে তোমাদের জারম্যানকে ফাঁকি দিতে হলে, বলল বরফশীতল কণ্ঠে।
আমাদের জন্যে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে, হাসল বেনন। জারম্যান যখন আমাদের দেখা পাবে তখন নিজেরাই ভেবে নেব কি করব।
শক্ত লোক, না? টিটকারির হাসি হাসল ডিলন। সুন্দর চেহারায় কুটিলতার ছাপ পড়ল। ফাঁসিতে যখন ঝুলবে তখন দেখব তোমরা আসলেই কতটা শক্ত।
ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্যে তুমিই ধরে নিয়ে যাবে ভাবছ নাকি? জানতে চাইল বেনন সমান শীতল গলায়।
সতর্ক লোক ডিলন, হাত দুটো হোলস্টার থেকে সরিয়ে রেখেছে। আমি অপেক্ষা করব, থেমে থেমে বলল সে। জারম্যানের কাজ আমাকে করতে হবে , জারম্যান নিজেই করবে। চোখের পাতা না ফেলে টানা এক মিনিট বেননের চোখে তাকিয়ে থাকল ডিলন শীতল রাগ নিয়ে, তারপর স্পার ছোয়াল ঘোড়ার পেটে। সামনে বাড়ল ঘোড়াটা, বেনন আর ব্যাগলেকে পাশ কাটাল। পেছন থেকে বেনন দেখল স্যাডলে পিঠ সোজা করে বসে আছে লোকটা।
ডিলন চোখের আড়ালে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নড়ল না দু’জন। ব্যাগলে বলল, ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছ তুমি ওর।
তুমি খেয়াল করোনি, মাথা নাড়ল বেনন, শুকনো গলায় বলল, ভয় পায়নি লোকটা, শুধু সতর্কতা দেখিয়েছে। সমান সুযোগ পেলে পিছিয়ে যেত না ওই লোক।
চলো, ট্রেইল ছেড়ে ডিলনের রেঞ্জের ভেতর দিয়ে ট্রিপল বারে যাই, প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে প্রস্তাব দিল ব্যাগলে। হয়তো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে যাবে।
হয়তো। রাজি হয়ে গেল বেনন। চলো। মনের মধ্যে খচ খচ করছে। একটা প্রশ্ন, সেটার হয়তো কোন জবাব পাওয়া যাবে বার কিউয়ে। ডিলন কি শুধু টাকা ফেরত চায়, নাকি ট্রিপল বার দখল করাই তার মূল উদ্দেশ্য?
ডিলন যে-পথে গেছে সেদিকে চলল ওরা ধীর গতিতে। টিলার পর টিলা ঢেউ খেলিয়েছে জমিতে। ঝোঁপঝাড় ভরা অনুর্বর জমি পার হয়ে ঘণ্টাখানেক পর ওরা পৌঁছে গেল ঢেউ খেলানো বিস্তৃত সমতল জমিতে। হাঁটু সমান লম্বা সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি, এখানে ওখানে চরছে হেরিফোর্ড গরু।
চারপাশটা ভাল করে দেখার জন্যে উঁচু জমির দিকে চলল ওরা। একটা ঢালের মাথায় উঠে থামল।
উত্তর-পশ্চিমে একটা নদীর পানিতে ঝিলিক মারছে পড়ন্ত সূর্যের ভাল পর্বতমালার ভেতর দিয়ে বেরিয়েছে নদী, একটা পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে ট্রশন বারের রেঞ্জ টুকেছে।
অফুরন্ত ঘাসজমি, বনভূমি, টিলার অঞ্চল এটা। শীতে টিলার আড়ালে ভয় পাবে গরু। গ্যাঞ্চিঙের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী এলাকা। যত দূর চোখ যায় ডিলনের রেঞ্জে প্রচুর গরু দেখা যাচ্ছে।
চলে যাওয়ার সময় একবারও পেছনে তাকায়নি ডিলন, কিন্তু বেনন জানে, ওরা অনুসরণ করবে এটা না বোঝার মতো বোকা ডিলন নয়। দূরে ডিলনকৈ দেখল ওরা, আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে। একটা ফোঁটার সমান লাগছে এখান থেকে দেখতে। তাপ প্রবাহের কারণে কাঁপছে দৃশ্যটা। আরও কয়েকটা ফোঁটার সঙ্গে মিলে গেল ঙিলন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল বেশ কয়েকটা ফোঁটা বড় হচ্ছে। এত দূর থেকে ধুলোও দেখা গেল।
ওরা আসছে, শান্ত গলায় জানাল, বেনন।
আইনের হয়ে দায়িত্ব পালন করতে, যোগ করল ব্যাগলে। বেননের দিকে তাকাল। সরে পড়া দরকার।
চলো। রাশ টেনে ঘোড়ার পেটে স্পার ছোঁয়াল বেনন, ঘুরে গেল ওর গেল্ডিং। আধ মিনিট পরই পাশে চলে এলো ব্যাগলে। ওরা যখন পাহাড়ের কাছে পৌঁছুল, থামল বেনন, নিশ্চিত করতে চাইল যাতে ডিলনের রাইডাররা ওদের দেখে। রাইডাররা দিক পরিবর্তন করেছে দেখে চোখে তৃপ্তি নিয়ে ব্যাগলেকে দেখল ও, তারপর ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। এখন আর বেনন বা ব্যাগলেকে দেখতে পাচ্ছে না লোকগুলো, তবে জানে ওরা কোথায় যেতে পারে।
পুবদিক দিয়ে পাহাড়ের কাঁধে উঠল বেনন। ব্যাগলে পেছনেই আছে। বেশ জোরে ছোটাচ্ছে ঘোড়া। মাইল আড়াইয়েক পেরিয়ে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল ওরা, সামনেই দেখা যাচ্ছে বার কিউ আর টুইন স্প্রিংসের ট্রেইল। বেনন জানে কোথায় যেতে চায় ও, কাজেই থামল না ওরা, পর পর বেশ কয়েকটা ড্রাই ওয়াশ আর গা পার হয়ে ক্যানিয়নে ঢুকল। ক্যানিয়নটা আস্তে আস্তে সরু হয়ে গেছে। দক্ষিণে এসে দেয়াল দুপাশ থেকে এতই চেপে এসেছে যে কষ্টেসৃষ্টে একটা স্টেজকোচ যেতে পারবে। পর পর কয়েকবার বাঁক নিয়েছে ক্যানিয়ন। একটা বাঁক পার হয়ে এসে জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেল বেননের। সামনে পথের ধারে পড়ে আছে দুটো বড় বড় বোল্ডার। আড়াল নেয়া যাবে ওগুলোর পেছনে। বাঁক ঘুরে হঠাৎ প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে ডিলনের লোকদের।
বোল্ডারের পেছনে এসে ঘোড়া থেকে নামল ওরা। রাইফেল হাতে বোল্ডারের কোনায় দাঁড়াল বেনন, ব্যাগলে ঘোড়া দুটোকে আরেকটু পেছনে সরিয়ে রেখে ওর পাশে এসে দাড়াল।
আসছে ওরা, আওয়াজ শুনে পাঁচ মিনিট পর বলল ব্যাগলে।
এখনও কোন শব্দ শুনতে পায়নি বেনন, তবে কোন কথা বলল না। ব্যাগলের লোভরা কানে যেকোন আওয়াজ আগে পৌঁছে যায় এটা ও অনেকবার লক্ষ করে দেখেছে। বাতাসের কম্পানে কানের লোম কাপে বলেই কি…এবার বেলনও শুনতে পেল আওয়াজটা। ক্যানিয়নের ভেতরে ভারী বৃষ্টিপাতের মতো। কাছে চলে আসছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে আওয়াজ।
পাঁচজন রাইডার। সবকজন ঝুঁকে আছে স্যাডলে। পেছনে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে দ্রুত ছুটে এলো বাঁক ঘুরে।
ওদের আসতে দিল বেনন, যাতে গুলি শুরু করলেই বাঁক ঘুরে ওপাশে চলে যেতে না পারে। তারপর পঞ্চাশ গজ দূরে থাকতে রাইফেল তুলে ক্যানিয়নের দেয়ালে গুলি করল। পাথরে পাথরে বাড়ি খেয়ে ছিটকে এদিক ওদিক গেল বুলেট। ঘোড়া থামিয়ে ফেলল কাউবয়রা মাথা নিচু করে নিল বুলেটের ভয়ে।
নড়বে না! আদেশ দিল বেনন। ক্যানিয়নে গমগম করে উঠল ওর ভরাট কণ্ঠ। সাবধান, ধীরে ধীরে গানবেল্ট খুলে মাটিতে ফেলো।
ধূলিধূসরিত পাঁচ কাউহ্যান্ড বোল্ডারটার দিকে তাকাল। তাদের দলনেতা একজন হালকাপাতলা নিষ্ঠুর চেহারার লম্বা লোক, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যে স্যাডল পমেলে হাত রাখল। চেঁচিয়ে জানতে চাইল, কি চাও তোমরা!
পাথরের গায়ে রাইফেল ঠেস দিয়ে রেখে বেনন বেরিয়ে এলো বোল্ডারের পাশে। কাউবয়রা নড়ল না। ব্যাগলের রাইফেলের নল দেখতে পাচ্ছে ওরা।
সেটা তো আমরাও জানতে চাই, বলল বেনন। আমাদের ধরতে গিয়ে ঘোড়াগুলোকে অনেক পরিশ্রম করিয়েছ তোমরা। হাসল বেনন। এখন আমাদের ধরতে পেরেছ। কি করবে ভাবছ?
এবার তোমার হাতে ভাল তাস, শান্ত গলায় বলল কাউবয়দের দলনেতা। আরও কয়েক ঘন্টা স্বাধীন ভাবে ঘুরতে পারবে। তবে ভেবো না আমরা হাল ছেড়ে দেব, কাজেই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হবে তোমাদের। শহরে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে দু’জনকে।
ডিলন যাই বলুক আমরা খুন করিনি। ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গেও আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। দু’পা ফাঁক করে দাঁড়াল, বেনন। দৃষ্টি নিবদ্ধ দলনেতার ওপর। তোমরা খামোকা আমাদের পেছনে লেগেছ। তাড়া খাওয়া আমার ধাতে নেই। ইচ্ছে করলে অস্ত্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখতে পারো।
নড়ল না কেউ। দলনেতা বেননের দিকে তাকিয়ে আছে। টের পেল অন্য কাউবয়রা তাকে দেখছে, সে কি করবে তার ওপরই নির্ভর করছে ওদের প্রতিক্রিয়া। সিগারেটে কষে টান দিল সে। ঘন ঘন ওঠানামা করল তার কণ্ঠী। বেনন বুঝে গেল গোলাগুলির ইচ্ছে নেই লোকটার।
স্বস্তির শ্বাস ফেলতে গিয়ে চমকে উঠল বেনন। ওকে বোকা বানিয়ে হোলস্টারের দিকে ঝটিতে হাত বাড়িয়েছে লোকটা। পরক্ষণেই একটা গুলির আওয়াজ হলো। ব্যথায় কাতরে উঠল গানম্যান, হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল পিস্তল।
আর কেউ? জানতে চাইল বেনন। নড়ল না কেউ। তাহলে অস্ত্র মাটিতে ফেলো সবাই, নির্দেশ দিল ও।
রাইফেল বাগিয়ে বোল্ডারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ব্যাগলে। ঠোঁটে হাসি ঝুলছে, কিন্তু চোখে হাসি নেই। ওর রাইফেলের নল থেকে চুইয়ে চুইয়ে বেরচ্ছে নীল ধোয়া।
একজন একজন করে গানবেল্ট খুলল কাউবয়রা। তাদের নেতা রাশে দোলা দিয়ে ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে নিল। তার দেখাদেখি অন্যরা। একটু পরেই নেতার পিছু নিয়ে ক্যানিয়নের বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল সবাই, একবারও পেছনে তাকাল না, কেউ। আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, মিলিয়ে গেল একসময়।
০৩. দেখে তো মনে হয় অবস্থা ভালই
দেখে তো মনে হয় অবস্থা ভালই, মন্তব্য করল ব্যাগলে। করালের পাশ দিয়ে এগোচ্ছে ওরা। সবুজ ঢাল বেয়ে নামছে। তাকিয়ে আছে র্যাঞ্চ বিল্ডিঙের দিকে। বাড়িগুলোয় নতুন রং করা হয়েছে। জমিতে ঘাসেরও কোন অভাব নেই।
বন্ধক দেয়া সম্পত্তি, মনে করিয়ে দিল বেনন। ডিলনের কাছে চলে যাবে সব, ক্লিন্ট ঋণ শোধ করতে না পারলে।
ট্রিপল বারের রেঞ্জে ঢোকার পর পঞ্চাশটার বেশি গরু দেখেনি ওরা। যতটা
জায়গা পেরিয়ে এসেছে তাতে অন্তত পাঁচশো গরু থাকা স্বাভাবিক ছিল।
দু’জন লোক র্যাঞ্চ বিল্ডিঙের উল্টোপাশে একটা করালের বেড়া মেরামত করছে। বেনন আর ব্যাগলে উঠানে ঘোড়া থামানোয় কাজ ফেলে চাইল তারা। তাদের একজন মধ্যবয়স্ক, দোহারা গড়ন, অন্যজন বয়সে প্রায় তরুণ, ক্লান্ত চেহারার কাউবয়।
কি চাই? জানতে চাইল মধ্যবয়স্ক লোকটা।
ডায়ারকে খুঁজছি, জানাল বেনন।
আমি ডায়ার। কি দরকার?
ঘোড়া থেকে নামল ওরা। ধুলো ঝাড়ল কাপড় থেকে। খুশি হলাম পরিচিত হয়ে, বলল বেনন। ক্লিন্ট আমাদের চাকরিতে নিয়েছে, বলল এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। রলিন্সে গেছে ও, কালকে ভোরের আগেই ফিরবে, বলেছে। আমি বেনন। ব্যাগলেকে দেখাল বেনন। এ ব্যাগলে। আমার বন্ধু।
চোখে সন্দেহ নিয়ে ওদের দেখল ডায়ার। কি কাজে রলিন্সে গেছে ক্লিন্ট?
টাকা জোগাড় করতে না পারলে কালকে ট্রিপল বার দখল করে নেবে ডিলন। টুইন স্প্রিংস শহরে ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে, দু’জন মারা গেছে, ক্লিন্টের টাকা উধাও।
গম্ভীর চেহারায় দুঃসংবাদগুলো শুনল ডায়ার আর কাউবয়।
এই যদি হয় অবস্থা তাহলে তোমরা চাকরি নিলে কেন? জানতে চাইল তরুণ কাউবয়।
আমরা ডিলনকে পছন্দ করতে পারিনি, বেনন কিছু বলার আগেই বলে উঠল ব্যাগলে। ক্লিন্ট রুখে দাঁড়ালে আমাদের সাহায্য ওর কাজে লাগবে।
আসলে একটা কাজ দরকার ছিল আমাদের, তাড়াতাড়ি বলল বেনন।
তরুণ কাউবয়ের দিকে তাকাল ডায়ার। ওদের ঘোড়াগুলোকে বার্নে নিয়ে যাও, স্টেসি, আমি ওদের খাবারের বন্দোবস্ত করছি।
ঘোড়ার দড়ি কাউবয়ের হাতে দিয়ে ডায়ারের পেছন পেছন র্যাঞ্চ হাউজে ঢুকল ওরা। বসার ঘরটা বড়, আসবাবপত্র সাজানোর অগোছাল ধরন দেখে বোঝা যায় অনেকদিন এগুলোতে মেয়েমানুষের হাত পড়েনি। বেনন আর ব্যাগলেকে দুটো চেয়ার দেখাল ডায়ার, বসতে বলে একটা কেবিনেট খুলে দুটো গ্লাস আর একটা বোতল বের করে রাখল ওদের সামনে, টেবিলের ওপর।
ঢেলে নাও, বলল ডায়ার। হাত-মুখ ধুয়ে নিতে চাইলে নিতে পারো। কিচেনের পাশেই ওয়াশরূম। ঘুরে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকল। সিং! সিং!
দুবলা-পাতলা এক চাইনিজ হাজির হলো ভেতর দরজার পর্দা সরিয়ে। ডায়ারের দিকে তাকাল নিস্পৃহ চেহারায়।
বস বলেছে এরা এখানে থাকবে, বেনন আর ব্যাথলেকে দেখাল ডায়ার। এদের জন্যে খাবার আনো, জনি।
মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল চিনেম্যান।
মোট কতজন কাউবয় কাজ করছে এখানে, ডায়ার? গ্লাস দুটোতে বোবো ঢালার ফাঁকে জানতে চাইল বেনন।
জবাব দেয়ার আগে হাতের উল্টো পিঠে মুখের ঘাম মুছল ফোরম্যান। আট। অন্য ছয়জন গেছে উত্তরের রেঞ্জে, আমি আশা করছি সন্ধের আগেই চলে আসবে। কথা থামিয়ে পকেট থেকে তামাকের একটা ঢেলা বের করে তাতে কামড় বসাল সে। একটুকরো তামাক ছিঁড়ে গালে ফেলে বলল, তবে লড়তে যদি হয় তো ওদের দুজনের বেশি থাকবে না বলেই আমার ধারণা। বাকিরা ভবঘুরে, নগদ টাকার জন্যে কাজ নিয়েছে কয়েকদিন আগে।
ডিলনের বিরুদ্ধে তাহলে মোট সাত জন আমরা, গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল বেনন।
শ্রাগ করল ডায়ার। এনিয়ে দুশ্চিন্তা করে কোন লাভ নেই। দেখা যাবে যখন আসবে ওরা। আর কিছু বলল না সে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
বেনন বুঝল গভীর ভাবে ভেবে দেখেনি ডায়ার। অপেক্ষা করে বসে থাকলে এখন যেরকম পরিস্থিতি তাতে লাভ শুধু ডিলনেরই হতে পারে। ড্রিঙ্ক শেষ করে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিল ওরা, ফিরে এসে টেবিলে বসতেই খাবার নিয়ে এলো চাইনিজ কুক। ধূমায়িত কফি, বেকন আর আলুভাজা।
তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া সারল ওরা। ভাল রাঁধে লোকটা। রান্না শেষে সার্ভ করতে পছন্দ করে। সেধে ওদের প্লেটে খাবার তুলে দিল কয়েকবার।
দারুণ হাত তোমার, উঠে পড়ার আগে বলল ব্যাগলে। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল বেনন।
খুশিতে দাঁত বেরিয়ে গেল চিনেম্যানের। বলল, পছন্দ হয়েছে? তোমরা থাকলে স্পেশাল চাইনিজ রান্না রেধে খাওয়াব। পাখির বাসার সুপ।
ভ্রূ কুঁচকে গেল ব্যাগলের। পাখির বাসার সুপ? বাসায় ইয়েটিয়ে করে না। পাখিরা? না, ওসব আমি খাব না।
রুগ্ন কাঁধ ঝাঁকাল কূক, প্লেটগুলো তুলে নিয়ে রওনা হলো কিচেনের দিকে। বোঝা গেল কিছুটা হতাশ হয়েছে।
সে চলে যেতেই চেয়ারে গা ছেড়ে বসল দু’জন। কফির কাপে চুমুক দিল নীরবে। পাঁচ মিনিট কেটে গেল চুপচাপ, তারপর ব্যাগলে জিজ্ঞেস করল, পাওনা টাকা কালকেই চাইছে কেন, দেরি করলে কী অসুবিধে ডিলনের? ওর রেঞ্জে বিক্রি করার মতো প্রচুর গরু আছে। ইচ্ছে করলে রাউন্ডআপ করে শীত আসার আগেই একটা ড্রাইভ করতে পারবে। তারমানে টাকার অভাবে নেই সে। ক্লিন্টকে আরও দু’তিন বছর সময় দিতে কোন অসুবিধে ছিল না তার।
কাজেই তোমার সন্দেহ হচ্ছে রাশল্যান্ডের ব্যাঙ্কে ডাকাতির পেছনে ডিলনের হাত আছে? জানতে চাইল বেনন। টাকা দরকার নেই ডিলনের, কিন্তু ট্রিপল বার র্যাঞ্চটা পেতে সে এতই উদগ্রীব যে খুন করতেও রাজি?
হয়তো তাই। আবার এসবের পেছনে অন্য কেউ থাকতে পারে। ডিলন বড় র্যাঞ্চার আর ট্রিপল বারের কাছে টাকা পায় বলেই তাকে আমরা খারাপ লোক বলে ধরে নিচ্ছি, এটা হয়তো ভুলও হতে পারে।
খারাপ কিনা জানি না, কিন্তু ও আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিল এটা আমি ভুলছি না, গম্ভীর গলায় বলল বেনন।
কালকে ও যখন আসবে, আইন থাকবে ওর পক্ষে, বলল ব্যাগলে। চোখ চকচক করছে। আইন থাকবে কারণ ঋণের দলিলটা রয়েছে ওর কাছে।
ব্যাগলের দিকে তাকিয়ে হাসল বেনন। আস্তে আস্তে ব্যাগলের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। একটা কথাও হলো না ওদের মাঝে, কিন্তু কর্তব্য স্থির হয়ে গেল।
ডায়ার আর স্টেসি করালে তাদের কাজ শেষ করে এনেছে এমন সময়ে র্যাঞ্চ হাউজ থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, পুবে ধুলোর ঝড় তুলে চার-পাঁচজন রাইডারকে আসতে দেখে কৌতূহলী হয়ে ডায়ারের পাশে থামল। কাজ সেরে ফিরে আসছে কাউবয়রা। তাদের সামনে তাড়া খেয়ে দৌড়াচ্ছে শ’খানেক বাছুর। এতদিন পর রাউন্ডআপ করায় কুগারের মতো হিংস্র হয়ে গেছে গরুগুলো, মানুষের গায়ের। অস্বস্তিকর গন্ধ পেয়ে ছুটছে প্রাণপণে। দুই পাশ থেকে তাদের তাড়া করে একসঙ্গে ধরে রেখেছে কাউবয়রা। কাজ দেখে বোঝা গেল প্রত্যেকেই তারা নিজেদের কাজে দক্ষ। দশ মিনিট পর করালে ঢুকিয়ে দিতে পারল ওরা গরুগুলোকে। এই সময়টা নড়ল না বেনন আর ব্যাগলে। কাউবয়দের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল ডায়ার। দু’জন তরুণ কাউবয় সত্যিকার আন্তরিকতার পরিচয় দিল, বাকিরা দায়সারা গোছের পরিচিতির পর চলে গেল বাঙ্ক হাউজে।
দুই তরুণকে ভাল লেগেছে বেননের। এরা পরিশ্রমী, কাজ করতে ভালবাসে। একজনের নাম রিন্টি ডেনভার অন্যজন কন লেভিস।
সত্যিকার লড়াই হলে যারা থাকবে তাদের মধ্যে এরাই শেষ দু’জন, জানাল ডায়ার। কাউবয়দের খুলে বলল আজকের ঘটনা।
আমরা যে পরিমাণ গরু এনেছি তাতে ক্লিন্টের ঋণ শোধ হবে না, চিন্তিত চেহারায় বলল ডেনভার।
তা হবে না, বলল ডায়ার, তবে সেজন্যে হাল ছেড়ে বসে থাকারও কোন অর্থ নেই। বেনন আর ব্যাগলেকে দেখাল সে। এরা লড়বে আমাদের সঙ্গে।
তার কোন প্রয়োজন নাও পড়তে পারে, বলল বেনন। কালকেই ডিলন ঝামেলা করবে না হয়তো।
কৌতূহলী ফোরম্যানের দৃষ্টি উপেক্ষা করে সোজা বাঙ্ক হাউজে গিয়ে ঢুকল ওরা। টানা তিন ঘণ্টা ঘুম দিল বাঙ্কে শুয়ে। ঘুম ভাঙাল রিন্টি ডেনভার। রাতের খাবার খেয়ে নিল ওরা কাউবয়দের সঙ্গে। তারপর বার্নে গিয়ে ঘোড়ার স্যাডল চাপিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। উঠানে বসে কথা বলছে কাউবয়রা।
ঘোড়ার স্যাডল একটু আগে খুলে রেখেছে স্টেসি, আবার দু’জনকে ঘোড়া নিয়ে বেরতে দেখে অবাক হয়ে ফোরম্যানের দিকে তাকাল সে।
ওদের পাশ কাটানোর সময় রাশে দোলা দিল বেনন। আমরা যাচ্ছি একটা কাজে, ফিরতে দেরি হবে, ফিরে এসে শোব কোথায়?
বাঙ্ক হাউজ দেখিয়ে দিল ডায়ার। দরজা সবসময় ভোলাই থাকে।
আসি তাহলে। ব্যাগলেকে ইশারা করে ঘোড়া সামনে বাড়াল বেনন। ঘণ্টা দেড়েক পর বার কিউয়ের রেঞ্জে প্রবেশ করল ওরা। আকাশে একটা বাঁকা চাঁদ উঠেছে, ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় লম্বা ঘাসগুলোকে কালচে দেখাচ্ছে। পুবদিকে তাকিয়ে কুঁচকাল ব্যাগলে। চাদটা না উঠলেও পারত।
ঝামেলা করবে, সায় দিল বেনন। আমরা যতক্ষণে র্যাঞ্চ হাউজে পৌঁছুব, ওটা উঠে আসবে মাথার ওপর। জোরাল আলো ছড়াবে। আকাশের দিকে তাকাল বেনন মেঘ দেখার আশায়। নাক কুঁচকে বড় করে শ্বাস টানল। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ নেই। আরও দু’মাসের আগে বৃষ্টি হবে না এদিকে।
জমিতে ঢেউ। তার আড়ালে আড়ালে বার কিউয়ের র্যাঞ্চ হাউজের যতটা সম্ভব কাছে চলে এলো ওরা। কয়েকবার ঘোড়া থামিয়ে ছায়ায় অপেক্ষা করতে হলো। ওদের সামনে দিয়ে পার হলো রাতের প্রহরী কাউবয়রা। বসে আছে ঢিলেঢালা ভাবে স্যাডলে গা ছেড়ে। কেউ কেউ গুনগুন করে গানও গাইল। তাদের দু’একজনের গলায় সুরও ছিল। মনে কষ্ট পেল বেনন।
শেষে ওরা থামল লাল সিডার বনে। ঘোড়া নিয়ে চলে এলো গাছের শেষ সারির কাছে। নিচে উঁকি দিতেই দেখতে পেল ডিলনের র্যাঞ্চ হাউজ। এদিকের বেশির ভাগ র্যাঞ্চ হাউজের মতোই বার কিউয়ের র্যাঞ্চ হাউজটাও ইংরেজি এল অক্ষরের মতো, তবে অনেক বড়। নির্মাণশৈলীতে মালিকের রুচি আর প্রাচুর্যের ছাপ পাওয়া যায়। দোতলা বাড়ি। এক পাশে স্টেবল, ব্ল্যাকস্মিথের ঘর আর ওয়াশ হাউজ, অন্য পাশে লম্বা বাঙ্ক হাউজ আর করাল। উঠানটা চৌকো, অত্যন্ত প্রশস্ত।
অপেক্ষা করল বেনন। ওদের চোখের সামনে একটু পর স্টেবল থেকে বেরিয়ে এলো এক অশ্বারোহী। ধীর গতিতে দক্ষিণে রওনা হয়ে গেল। ওদিকের রেঞ্জে পাহারার দায়িত্ব পড়েছে নিশ্চয়ই। লোকটা দূরে চলে যাবার পর আবার নীরবতা নামল। মাঝে মাঝে সে-নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে ঝিঝির কর্কশ ডাক। অনেক দূরে ডাকছে একটা কয়োট, আবছা ভাবে শব্দ আসছে। র্যাঞ্চ হাউজে কোন সাড়াশব্দ বা আলো নেই। ঘুমাচ্ছে সবাই? কেউ পাহারায় নেই তো?
ঘোড়া রেখে পায়ে হেঁটে শামুকের গতিতে এগোল বেনন আর ব্যাগলে। স্টেবলটা পাশ কাটানোর সময় ভেতরে নাক ঝাড়ল কয়েকটা ঘোড়া। মাটিতে খুর ঠুকল। অপরিচিত মানুষের গন্ধ পেয়েছে। ঘোড়াগুলো শান্ত না হওয়া পর্যন্ত বেনন আর ব্যাগলে চুপ করে মাটিতে পড়ে থাকল, তারপর ক্রল করে চলে এলো র্যাঞ্চ হাউজের পাশে।
ব্যাগলে ফিসফিস করল, আমার মনে হয় কালকে সকালে ক্লিন্টের ওখানে যাবার জন্যে তৈরি হয়েই ঘুমিয়েছে ডিলন। ঋণের কাগজটা সম্ভবত হাতের কাছেই রেখেছে। একটু পর পর পড়েছে আর মুচকি মুচকি হেসেছে।
তারপর শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছে, যোগ করল বেনন। কোন্ ঘরে সেটা আমরা বুঝতে পারব বাড়ির ভেতরে পা রাখলে। এখন আমাদের উচিত এবাড়ির অতিথি হওয়া।
বেশিক্ষণ থাকব না কিন্তু, ব্যাগলে এমন ভাবে বলল যেন বাড়ির মালিকের অনুরোধে পেঁকি গিলছে। বেননের দিকে তাকাল। ঠিক আছে তাহলে, চলো।
নিঃশব্দে বারান্দায় গিয়ে উঠল দু’জন। দরজার নবে মোচড় দিয়ে বুঝল তালা মারা। দরজা দিয়ে ডাকাতের মতো ঢুকতে পারলে চোরের মতো জানালা দিয়ে কে ঢোকে! কাজেই শেষ চেষ্টা করল বেনন। গলায় পেঁচানো রুমাল খুলে দরজার
তলা দিয়ে বেশ খানিকটা গুঁজে দিল ভেতরে। একবার দেখে নিল ঠিক তালার। ফুটোর নিচেই রুমাল পেতেছে কিনা। এবার পকেট ছুরি দিয়ে তালার ফুটোর। ভেতর খোঁচা দিল।
ঠং করে আওয়াজ হতেই ব্যাগলের দিকে তাকিয়ে চওড়া একটা হাসি দিল বেনন। তালা মেরে চাবিটা ফুটোর মধ্যেই গুঁজে রাখা হয়েছিল। খোঁচা খেয়ে রুমালের ওপর পড়েছে চাবি।
চাবি পড়ার আওয়াজে স্টেবলে আবার অস্থির হয়ে উঠেছে ঘোড়াগুলো। নাক ঝাড়ছে, মাটিতে পা ঠুকছে। একটু পর থেমে গেল সমস্ত শব্দ।
রুমাল টেনে আনল বেনন। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে পাঁচ সেকেন্ড ব্যয় হলো।
অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল ওরা। জানালা দিয়ে চাঁদের আবছা আলো আসছে। চোখ সয়ে যাবার পর সে আলোয় ঘরের ভেতরে নজর বোলাল। বাতাসে সিগারেটের ধোয়া আর মদের কটুগন্ধ। দোতলা থেকে পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত নাক ডাকার আওয়াজ। একেক নাকের একেক সুর। মনে হলো একসঙ্গে কয়েকটা সোনা ব্যাং সঙ্গত জুড়েছে। মদ খেয়ে টাল হয়ে ঘুমিয়েছে লোকগুলো, এত সহজে উঠবে বলে মনে হয় না। তবে সেজন্যে সতর্কতায় কোন ঢিল পড়ল না বেনন বা ব্যাগলের। ওরা জানে, বেশির ভাগ কাউবয় এক বোতল মদ গিলে মাতাল হয়েও সামান্য একটু ঘুমাবার সুযোগ। পেলে একেবারে তরতাজা হয়ে উঠতে পারে। কোন আওয়াজ করা চলবে না।
হলঘরের খোলা একটা দরজা দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল ওরা। ডানদিকে দোতলায় যাবার সিঁড়ি। পা টিপে টিপে উঠতে হলো। কোন কোন ধাপে পা রাখলেই ক্যাঁচকোচ করে প্রতিবাদ জানাবে। দেহের ভর হালকা করে চাপিয়ে বুঝে নিয়ে তারপর দুর্বল ধাপ এড়িয়ে গেল ওরা।
দোতলায় উঠে থামতে হলো। বামদিকের দুটো ঘর থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। কিন্তু ডানদিকটা একেবারেই নীরব। ওদের ধারণা ডানদিকের ঘরেই আছে ডিলন। কারণ, ওই ঘরের জানালা দিয়ে করাল দেখা যাবে। বেশির ভাগ র্যাঞ্চার করাল দেখা যায় এমন ঘর বেছে নেয়। করালের আকার আকৃতি আর পশুর সংখ্যা তাদের গর্বের তপ্ত আগুনে ইন্ধন জোগায়।
ডানদিকের ঘরটা বাছল ওরা। দরজার নবে মোচড় দিয়ে যে লোকটা তেল দেয় তার মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করল ব্যাগলে। তালা মারা নেই। খুলছে দরজা। একটুও ক্যাঁচকোচ করছে না। তেল লাগানো কাগুলোর কল্যাণে মসৃণ ভাবে খুলে যাচ্ছে। দরজা পুরোপুরি খুলে যাবার পর ঘরে ঢোকার আগে একটু থামল দু’জন। ভেতরে কোথায় কোথায় আসবাবপত্র আছে আন্দাজ করে নিল। তারপর ঢুকল ভেতরে।
লম্বা একটা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরটা বেশ আলোকিত হয়েছে। ঘরের মাঝখানে দেখা যাচ্ছে ডিলনকে, বিরাট চওড়া বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে, ধীরে ধীরে দম নিচ্ছে নিয়মিত। গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে। গায়ের সমস্ত কাপড় বিছানার পাশের চেয়ারে খুলে রেখেছে। গানবেল্টও চেয়ারের পেছনে ঝুলছে।
বেনন,আর ব্যাগলে এগোতেই পাশ ফিরল লোকটা। থামল না ওরা। পায়ের নিচে দামি কার্পেট, কোন আওয়াজ হচ্ছে না, ডিলনের ঘুম ভাঙবে না, গলা
ফাটিয়ে চেঁচিয়ে সব কিছু ভণ্ডুল করবে না, কাজেই থামার কোন প্রয়োজন নেই।
ব্যাগলে পাহারায় থাকল, বেনন গিয়ে চেয়ারে রাখা ডিলনের শার্ট-প্যান্ট খুঁজে দেখতে শুরু করল।
কিছু নেই ওগুলোর ভেতরে। পকেট ফাঁকা। এবার ডিলনের প্রিন্স অ্যালবার্ট কোটের পকেটে হাত ভরল বেনন। নেই। ভেতরের পকেটে খুঁজল। আছে! হাসি হাসি মুখে পেটমোটা এনভেলপটা বের করে আনল ও। জানালার সামনে গিয়ে চাঁদের আলোয় খামের ভেতর থেকে কাগজটা বের করে চোখ বুলাল। এটাই। নিচে মোটা কালিতে নিজের নাম সই করেছে ক্লিন্ট।
কাগজটা ব্যাগলেকে রাখতে দিল বেনন। এনভেলপটা ডিলনের কোটের পকেটে রেখে দিল। শার্ট-প্যান্ট যেমন ছিল তেমনি করে রাখল চেয়ারের ওপর। প্রিন্স অ্যালবার্ট কোটও ঠিকঠাক ভাজ করে রাখল।
চোখে তৃপ্তি নিয়ে বেননের কার্যকলাপ দেখছে ব্যাগলে। ভাবতেই ভাল। লাগছে যে ওদের অনুমান সঠিক ছিল। কাজ সেরে এক সঙ্গে দরজার দিকে পা বাড়াল ওরা। দরজা পেরিয়ে পাল্লা বন্ধ করেছে এমন সময়ে প্যাসেজের একটা দরজা খুলে গেল। ঘরে আলো জ্বলছে। আলো এসে পড়ছে প্যাসেজে। সেই আলোয় একজন লোকের ছায়া দেখা গেল। চৌকাঠ পর্যন্ত চলে এসেছে লোকটা। এবার বাইরে বেরিয়ে আসবে। বেরিয়ে এলেই ওদের দেখে চিৎকার করবে। জেগে যাবে সবাই। জাগলেই ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা।
বিদ্যুৎ খেলে গেল বেননের শরীরে। লাফ দিয়ে সামনে বাড়ল ও। লোকটা প্যাসেজে বের হয়ে ওদের দেখল। বিরাট একটা হাঁ করল চিৎকার করার জন্যে। ওই একই মুহূর্তে কাঁধের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ঘুসি ঝাড়ল বেনন লোকটার কণ্ঠায়। দু’হাতে ধরে ফেলল লোকটার অজ্ঞান শরীর। আস্তে করে শুইয়ে দিল মেঝেতে।
কপালটা এরকম ভাল থাকলে হয়, বেননের পাশে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করল ব্যাগলে।
আজকে ওদের কপাল ভাল। নিরাপদেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। সিডারের বনের কিনারায় যখন চলে এসেছে, দেখল দক্ষিণের রেঞ্জ থেকে প্রহরীরা ফিরে আসছে। বাঙ্ক হাউজের সামনে ঘোড়া থেকে নামল লোকগুলো। আর দেরি করার কোন দরকার নেই, এখানে ওদের কাজ শেষ, ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল বেনন আর ব্যাগলে। প্রহরী এড়ানোর জন্যে কয়েকবার থামতে হলো। তবে কোন বিপদ ঘটল না। ক্লিন্টের রেঞ্জে ফিরে এলো ওরা কারও চোখে ধরা না পড়ে।
ট্রিপল বার র্যাঞ্চ হাউজের একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ওদের ঘোড়া উঠানে এসে থামার পর দরজা খুলে গেল। ক্লিন্ট আর ডায়ার বারান্দায় বেরিয়ে এলো। চাঁদের আলোয় আগন্তুকদের চিনতে পেরে ঘোড়ার পাশে এসে দাড়াল ক্লিন্ট।
কি খবর, ক্লিন্ট? হালকা গলায় জানতে চাইল ব্যাগলে। রলিন্সে গিয়ে লাভ হলো কোন?
মাথা নাড়ল যুবক। কোন লাভ হয়নি। হবে সে-আশাও অবশ্য করিনি আমি। অনেক টাকার ব্যাপার। আমার বন্ধুদের অত টাকা নেই। তবে চেষ্টা করেছে ওরা। জোগাড় করতে পারেনি।
ঘোড়ার দায়িত্ব ডায়ার নিল। ক্লিন্টের পেছন পেছন র্যাঞ্চ হাউজের দিকে পা বাড়াল বেনন আর ব্যাগলে। ঘরে ঢোকার পর ওদের চেয়ারে বসতে বলল ক্লিন্ট। গ্লাসে ড্রিঙ্ক ঢেলে ওদের হাতে ধরিয়ে দিল। কোন প্রশ্ন করল না, কিন্তু চেহারা। দেখে বোঝা গেল কৌতূহল বোধ করছে সে। জানতে চায় বেনন আর ব্যাগলে কোথায় গিয়েছিল।
একটা চুরুট ধরাল বেনন। তীক্ষ্ণ চোখে যুবক র্যাঞ্চারের দিকে তাকাল। এখন তোমার খারাপ সময়। কয়জন কাউবয় থাকছে?
ডায়ার ছাড়া তিনজন। হাসার চেষ্টা করল ক্লিন্ট। না পেরে খুক খুক করে কাশল। রলিন্স থেকে ফিরেই সবাইকে আমাদের অবস্থা জানিয়েছি আমি। ওদের বেশির ভাগই বলল পাওনা টাকা মিটিয়ে দিতে, চলে যাবে ওরা। গ্লাসে চুমুক দিল। ক্লিন্ট। ওদের পাওনা মেটানোর মতো টাকা অবশিষ্ট ছিল আমার। একটু ইতস্তত করল যুবক, তারপর বলল, ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পারো। নিজের ইচ্ছেয় এসেছিলে, নিজের ইচ্ছেয় চলে যাবে। আমি কিছু মনে করব না। এটা তোমাদের লড়াই নয়।
বাতাসে হাত নেড়ে ক্লিন্টের কথা উড়িয়ে দিল ব্যাগলে। বেননের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা থাকছি, তাই না, পার্টনার?।
মাথা দোলাল বেনন। সিগার ধরিয়ে ছাদের দিকে ধোয়া ছাড়ল ও। ভাবছে একে রাতের অভিযানের কথা ক্লিন্টকে বলবে কিনা। আপাতত কোন প্রয়োজন নেই। যত কম লোক জানে ততই ভাল। ক্লিন্টের র্যাঞ্চে ডিলনের লোক নেই তা বলা যায় না। যে কজন কাউহ্যাঁ আছে তাতে তোমার অবশিষ্ট গরু সামলাতে কোন অসুবিধে হবে না, মন্তব্য করল ও। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি না, তবে ডিলন যখন আসবে, নিজেদের দায়িত্বে কাজ করব। আমরা সাগলেকে উঠতে ইশারা করে দরজার কাছে চলে এলো নেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ডিলন যখন টাকা চাইতে আসবে, তুমি জিজ্ঞেস করবে, কিসের টাকা?
যদি গালাগালি দেয় তাহলে তুমিও দেবে, উৎসাহের সঙ্গে বলল ব্যাগলে। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল বেনন।
ডিলন যদি বলে ঋণের কাগজের বদলে যে-টাকা নিয়েছিলে সেই টাকা ফেরত নিতে এসেছে, তাহলে বলবে, কিসের ঋণের কাগজ? আমার ধারণা গরম গরম কথা বলবে লোকটা, কিন্তু ঋণের দলিলটা বের করতে পারবে না। বিস্মিত যুবকের দৃষ্টি কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। জবাব দিল না বেনন। শুধু বলল, ডিলনকে বলে দিয়ে কাগজ দেখালেই ওকে ওর পাওনা টাকা শোধ করে দেবে তুমি।
বেনন আর ব্যাগলে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর বিস্ময় ফুটল, ক্লিন্টের মুখে। এখন আন্দাজ করতে পারছে ওরা দু’জন কোথায় গিয়েছিল।
উঠানে দাঁড়িয়ে ব্যাগলের কাঁধে হাত রাখল বেনন।
সূর্য উঠতে বড়জোর আর এক ঘণ্টা, ব্যাগলে। উত্তর দিকের ঢালে যে জঙ্গলটা দেখছ, আমার মনে হয় ওই জায়গাটা আমাদের জন্যে সেরা হবে।
হা, আস্তে আস্তে মাথা দোলাল ব্যাগলে। ওখান থেকে এদিকে চোখ রাখতে পারব আমরা। পালা করে ঘুমানোও যাবে।
স্টেবলে চলে এলো ওরা। দেখা হয়ে গেল ডায়ারের সঙ্গে। ওদের ঘোড়ার স্যাডল মাত্র খুলে রেখেছে লোকটা। ওদের আবার ঘোড়ার দিকে এগোতে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ভেবেছিলাম তোমরা ক্লিন্টের পক্ষে লড়বে।
লড়ব, তবে দূর থেকে, জবাব দিল বেনন।
ঘোড়ায় স্যাডল চাপাল ওরা। স্টেবলের ভেতরে লণ্ঠনের মৃদু আলো। ব্যাগলের মনে হলো ডায়ার হাসছে। বেনন আর ব্যাগলে, ঘোড়া নিয়ে বেরোনোর। জন্যে দরজার দিকে এগোতেই সরে পথ করে দিল ডায়ার, কোন প্রশ্ন করল না। ওরা উত্তর দিকে রওনা হচ্ছে দেখেও বলল না কিছু।
ট্রেইল ধরে আধমাইল যাওয়ার পর রেঞ্জে নেমে ঘাসজমির ওপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে জঙ্গলের দিকে এগোল ওরা। লাল সিডার আর, কটনউডের মিলিত জঙ্গল। ঘোড়া গ্রাউন্ড হিচ করে গাছের সীমানায় একটা মরা গাছের গুঁড়ির আড়ালে বসল ওরা। তিনশো গজ দূরে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে ক্লিন্টের র্যাঞ্চ হাউজ। সূর্যোদয়ের পর কুয়াশাটুকু কেটে যাবে।
ডিলন অলস লোক নয়। সূর্য ওঠার একটু পরই দক্ষিণ দিক থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ হলো।
মনে হচ্ছে সবাইকে নিয়ে আসছে লোকটা, মন্তব্য করল ব্যাগলে।
বেনন তার রাইফেলটা খুঁড়ির ওপর রাখল। নলটা তাক করেছে র্যাঞ্চ হাউজের উঠানে।
ধুলোর একটা ঝড়ের ভেতর দিয়ে আসতে দেখা গেল ঘোড়সওয়ারীদের। ঝড়টাকে ওরা সঙ্গে নিয়ে আসছে। ট্রিপল বারের উঠানে থামল ঘোড়াগুলো। ধুলো থিতিয়ে আসতে দেখা গেল প্রায় বিশজন লোক। সশস্ত্র প্রত্যেকে। দলের ঘোড়ার দড়ি মাটিতে ফেলে রাখা। অভ্যন্ত ঘোড়া দড়ির কাছ থেকে সরে না।
মাঝখানে বিরাট একটা বে গেল্ডিঙে চড়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে লিউ ডিলন। তার পাশের লোকটা লম্বা, মাথাটা নারকেলের মতো। স্টেটসন হ্যাট মাথার পেছনে হেলিয়ে রেখেছে সে। এই লোকটাই ওদের ধাওয়া করার সময় কাউবয়দের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ওর নামই কেল, আন্দাজ করল বেনন। কয়েকজন রাইডার বাঙ্ক হাউজ আর বার্নের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল কেউ তৈরি হয়ে লুকিয়ে বসে আছে কিনা। কেউ নেই। ফিরে এসে ডিলনকে জানাল তারা। এবার র্যাঞ্চ হাউজের দিকে মনোযোগ দিল ডিলন।
ভেতরে কি আছ, ক্লিন্ট? হাঁক ছাড়ল। বাইরে আসো, র্যাঞ্চটা আর তোমার নয়।
হেসে উঠল কাউবয়রা। হাসির আওয়াজ শুনতে পেল বেনন আর ব্যাগলে। কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না, তারপর দড়াম করে খুলে গেল র্যাঞ্চ হাউজের দরজা। বারান্দায় এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল ক্লিন্ট। ডিলনকে একবার দেখে নিয়ে কাউবয়দের ওপর নজর বুলাল। জানতে চাইল, লড়াই করতে এসেছ?
হয়তো। চোখ সরু করে ক্লিন্টকে দেখল ডিলন। টাকা যোগাড় হয়েছে? কিসের টাকা? ক্লিন্টকে দেখে মনে হলো অবাক হয়েছে। কিসের টাকা তুমি ভাল করেই জানো, ক্লিন্ট। সময় নষ্ট করে কোন লাভ হবে, হয় টাকা ফেরত দাও, নয়তো বেরিয়ে যাও আমার জমি থেকে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে কাটল। বেনন আর ব্যাগলে রাইফেল তাক করে রেখেছে কাউবয়দের ওপর। র্যাঞ্চ হাউজের উঠানে টান টান উত্তেজনা, দূর থেকেও অনুভব করতে পারছে ওরা।
ঋণের দলিলটা দাও, তোমার টাকা পেয়ে যাবে, নিচু স্বরে বলল ক্লিন্ট।
তুমি টাকা যোগাড় করতে পারোনি।
অত নিশ্চিত হচ্ছ কি করে?
সময় নষ্ট করছ। বেশ দিচ্ছি ঋণের দলিল। স্যাডলে নড়েচড়ে বসল ডিলন। কোটের পকেটে হাত ভরে বের করে আনল খামটা। চোখ সরু হয়ে গেল। খামটা একটু পাতলা লাগছে যেন! ভেতরে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল র্যাঞ্চারের চেহারা। খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল লোকটা। বিষ দৃষ্টিতে ক্লিটের দিকে তাকাল। তুমি ভাল করেই জানোনা কাগজটা আমার কাছে নেই।
আমি জানি না, ডিলন, শান্ত গলায় বলল ক্লিন্ট, তবে প্রমাণ ছাড়া তোমাকে আমি কিছুতেই টাকা দেব না। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না, ডিলন।
নিজের লোকদের ওপর চোখ বুলিয়ে আবার ক্লিন্টের দিকে তাকাল ডিলন। কথা যথেষ্ট হয়েছে, ক্লিন্ট। কাগজটা তুমি চুরি করায় পরিস্থিতি বদল হয়নি। মার্শাল জারম্যান জানে আজকে ঋণ শোধ করার দিন। আমার লোকরা সবাই সাক্ষী যে তুমি আমাকে টাকা দাওনি। কথা যথেষ্ট হয়েছে, এবার তোমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বেঁধে নিয়ে আমার জমি থেকে দূর হও।
তোমার আর আমার লোকরা সাক্ষী আছে, তোমাকে আমি বলেছি, দলিলটা ফেরত দিলেই টাকা শোধ করে দেব।
মাথা নাড়ল ডিলন। আমি ট্রিপল বারের দখল নিচ্ছি। লড়তে না চাইলে জিনিসপত্র বেঁধেছেধে পালাও, ক্লিন্ট।
কাউবয়দের হাত অস্ত্রের কাছাকাছি চলে গেছে। একটু ছড়িয়ে অবস্থান নিচ্ছে তারা। নড়াচড়া থেমে যেতে সবকিছু মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। অপেক্ষা করছে সবাই। অশুভ একটা পরিবেশ। যেকোন সময় রক্ত ঝরতে শুরু করবে।
আর একটু পরই অধৈর্য হয়ে অস্ত্র বের করে বসবে কেউ। শুরু হয়ে যাবে গোলাগুলি।
তার আগেই কিছু একটা করা দরকার। নিশানা ঠিক করে ট্রিগারে চাপ দিল বেনন। ডিলনের সমব্রেরো উড়ে গেল মাথা থেকে। মাটিতে পড়ল। কয়েক গড়ান খেয়ে স্থির হলো। ওটার ক্রাউনে দুটো ফুটো। গুলিটা র্যাঞ্চ বিল্ডিঙের কাঠের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে থামল।
চমকে স্যাডলে সোজা হয়ে বসল ডিলন। হুড়োহুড়ি শুরু হলো। কাউবয়রা ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দেখল জঙ্গলের কিনারায় রাইফেল কাঁধে তুলে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন লোক। কেউ কেউ চিনল লোক দুটোকে। কেগলের চেহারাটা গম্ভীর হয়ে উঠল। চাপা গলায় ডিলনকে কি যেন বলল সে।
কেউ নড়লে খুন হয়ে যাবে ডিলন, হুমকি দিল বেনন। নড়ল না কেউ। এবার বলল, ডিলন এখানেই থাকবে। তোমরা চলে যাও। ডিলন পরে যাবে। আবার বলছি, কেউ উল্টাপাল্টা করলে ডিলন মারা পড়বে।
নির্দেশের আশায় ডিলনের দিকে তাকাল কাউবয়রা। ডিলন কিছু না বলায় কে কি যেন বলল অত্যন্ত নিচু স্বরে। একে একে উঠান ছেড়ে বেরিয়ে গেল কাউবয়রা। দক্ষিণে যাচ্ছে। একটু পরই ডিলন ছাড়া আর কেউ রইল না উঠানে। দূরের একটা ঢাল পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কাউবয়রা।
ডিলন ঘোড়ায় বসে আছে পিঠ সোজা করে। মুখটা যেন পাথর খোদাই করে তৈরি।
০৪. টাকা হয়তো সত্যিই আছে
টাকা হয়তো সত্যিই তোমার কাছে আছে, বেনন আর ব্যাগলে ঘোড়া থেকে নেমে ক্লিন্টের পাশে দাঁড়ানোর পর মন্তব্য করল ডিলন। তীক্ষ্ণ চোখে প্রতিদ্বন্দ্বী র্যাঞ্চারকে দেখল। এখন বুঝতে পারছি তুমিও এদের মতো ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। রাশল্যান্ড আর ক্রিসির খুনের দায় থেকে বাঁচবে না। তোমাদের ঝোলানোর জন্যে যা যা দরকার সবই আমি করব।
শ্রাগ করে হুমকিটা উড়িয়ে দিল ক্লিন্ট।
আমার ধারণা এরাই বার কিউতে গিয়ে আমার কাছ থেকে ঋণের কাগজ চুরি করেছে। চোখে শীতল ক্রোধ নিয়ে দুই পাঞ্চারকে দেখল ডিলন।
তোমার ধারণা হলেই সেটা সত্যি হতে হবে এমন কোন কথা নেই, বলল বেনন। সায় দিয়ে ঘন ঘন গোঁফে তা দিল ব্যাগলে। সত্যি সত্যি কাগজ চুরি হয়েছে তারও কোন প্রমাণ নেই। এটাও প্রমাণ করা যাবে না যে ক্লিন্ট তোমার টাকা পরিশোধ করেনি। আইনত ট্রিপল বারের ওপর কোন অধিকার নেই তোমার। ওর জমিতে তুমি গোলমাল করলে ক্লিন্ট আইনের সাহায্য চাইতে পারে। রলিঙ্গে গিয়ে শেরিফকে খবর দিলেই রেঞ্জ ওঅর ঠেকাতে চলে আসবে সে। তোমার পক্ষ যে নেবে না এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?
আমি বুঝেছি, ধীরে ধীরে বলল ডিলন। ঝড়ের গতিতে মাথা কাজ করছে তার। জারম্যান পারতপক্ষে তার বিরোধিতা করবে না। কিন্তু রলিন্স থেকে শেরিফ এসে তদন্ত শুরু করলে পরিস্থিতি জটিল হতে বাধ্য। সে-ভয়ে চুপ করে বসে থাকাও যায় না। রলিন্সের রাস্তায় সর্বক্ষণ প্রহরার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ট্রিপল বারের কেউ রলিলে যেতে না পারে। তবে এখনই ট্রিপল বার আক্রমণ করা যাবে না। আসলে তার কোন দরকারও নেই। আস্তে আস্তে চাপ প্রয়োগ করে ওদের কোণঠাসা করা যাবে। তারও দরকার নেই। ক্লিন্ট মারা গেলে ট্রিপল বারে কেউ থাকবে না। কারও কোন স্বার্থ নেই, স্বার্থ উদ্ধারের সম্ভাবনাও নেই। ক্লিন্ট মারা গেলেই…
ক্লিন্টের দিকে তাকাল ডিলন। এবার তুমি জিতে গেলে, ক্লিন্ট। আমি তোমাকে সৎ লোক বলে মনে করতাম। তুমি তোমার বাবার মতো হওনি।
আমি কিন্তু বলিনি টাকা দেব না, বলল গম্ভীর ক্লিন্ট। একথাও বলিনি তুমি টাকা পাও না। আমি বলেছি ঋণের কাগজ ফেরত দিলেই পাওনা টাকা দিয়ে দেব। তুমি দিতে পারছ না। টাকা শোধ করার পর তুমি আবারও দাবি জানাবে না তার নিশ্চয়তা কি?
তোমার কথা শেষ হয়েছে? শীতল স্বরে জানতে চাইল ডিলন।
চুপ করে থাকল ক্লিন্ট। মাথা কাত করে ডিলনকে বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। বেনন।
ধীরেসুস্থে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল র্যাঞ্চার। অপমানে মুখটা লাল হয়ে আছে। স্পারের খোঁচা খেয়ে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা। কিছুক্ষণ পর দক্ষিণের ঢালের ওপাশে চলে গেল।
এতক্ষণ পর বাঙ্ক হাউজ, বার্ন আর র্যাঞ্চ হাউজ থেকে রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলো ডায়ার, রিন্টি ডেনভার, স্টেসি আর কন লেভিস। তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল ওরা। ডায়ারের চেহারায় স্বস্তির ছাপ সুস্পষ্ট। তরুণ কাউবয়রা একটু হতাশ।
আইন আসলে ওর পক্ষই নেবে, বলল ক্লিন্ট। আমি যতদূর জানি, জারম্যান সৎ লোক। কিন্তু যুক্তিতর্ক বোঝে কম। সে তোমাদের ব্যাঙ্ক ডাকাত এবং খুনি ভাবছে। আমার এখানে তোমরা আছ। তারমানে ডিলন ঠিক কাজ করছে এটা সে ধরেই নেবে।
তবুও রাতের আগে হামলা হবে বলে মনে হয় না, মতামত জানাল ব্যাগলৈ। ডিলন ঝুঁকি কমাতে চাইবে।
আমাদের ব্যাপারে জারম্যানের ধারণা পাল্টাতে হবে, বলল বেনন। ক্লিন্টের দিকে তাকাল। রলিন্সে আগে কোন টেলিগ্রাফ অফিস ছিল না। এখন হয়েছে?
বিস্মিত হয়ে বেননকে দেখল ক্লিন্ট। মাথা দোলাল। ফারগো অফিসে টেলিগ্রাফ আছে।
তাহলে জারম্যানকে নিয়ে রলিগে গিয়ে একটা টেলিগ্রাফ করতে হবে।
তুমি যাবে ভাবছ নাকি! ধরতে পারলেই তোমাকে জেলে পুরে দেবে সে।
ধরতে যাতে না পারে সে-ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাগলের দিকে তাকাল বেনন। তুমি এখানে থাকবে। রিন্টি ডেনভার আর স্টেসিকে নিয়ে শহরে যাব। আমি। এরমধ্যে ডিলন যদি আক্রমণ করে বসে তাহলে ঠেকানোর চেষ্টা না করে পিছিয়ে যাবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
প্রতিবাদ করতে চাইল ব্যাগলে, তুমি শহরে ঢুকলেই তো…
হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল বেনন। রিন্টি, স্টেসি, ঘোড়া নিয়ে আমার সঙ্গে এসো তোমরা।
ক্লিন্টের দিকে তাকাল দুই তরুণ। শ্রাগ করল ক্লিন্ট। বেনন কি করবে সে জানে না, কিন্তু ইতিমধ্যেই ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে সে।
একটু পরই ট্রিপল বার ছেড়ে রওনা হয়ে গেল তিনটা ঘোড়া। টুইন স্প্রিংসের দিকে চলেছে বেনন, স্টেসি আর রিন্টি ডেভিস।
পেছন থেকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকল ব্যাগলে। ও নিশ্চিত, যত মজা বেননের কপালেই জুটবে। ওর যা কপাল, আজকে হয়তো ট্রিপল বারে হামলাই করবে না ডিলন।
টুইন স্প্রিংসের কিছুটা বাইরে টিলার আড়ালে ঘোড়া দাঁড় করাল বেনন। তার দেখাদেখি রিন্টি আর স্টেসিও থামল। একটা চুরুট ধরাল বেনন, ধোঁয়া ছেড়ে আচমকা বলল, স্যাডলের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো তোমরা।
কি বললে? ভুল শুনেছে ভাবল স্টেসি।
বলছি শুয়ে পড়ো সা্যডলের ওপর। তোমাদের বাঁধব আমি। এমন করে বাঁধব যে দেখে মনে হবে মমি। ময়দার বস্তার মতো স্যাডলের ওপর পড়ে থাকবে তোমরা, যেভাবে লাশ পড়ে থাকে।
তারপর? কৌতূহলী হয়ে উঠেছে দুই কাউবয়। আগ্রহে চোখ চকচক করছে।
তারপর ঘোড়া দুটো শহরের রাস্তা দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেব। মুখ নিচু করে পড়ে থাকবে তোমরা। লোকে মনে করবে লাশ। ভিড় করবে সবাই। তোমাদের দিকে সবার মনোযোগ আকৃষ্ট করে সেই সুযোগে শহরের অন্যদিক দিয়ে ভেতরে ঢুকব।
হাসল দুই কাউবয়। স্টেসি জিজ্ঞেস করল, লোকে যখন জিজ্ঞেস করবে। আমাদের এই অবস্থা হলো কি করে, তখন কি জবাব দেব?
বলবে দুই ব্যাঙ্ক ডাকাতকে দেখে বন্দি করতে গিয়েছিলে তোমরা। কিন্তু তোমরা অস্ত্র বের করার আগেই অস্ত্র বের করে তোমাদের বন্দি করে ফেলে ওরা। তারপর ঘোড়ার পিঠে বেঁধে ছেড়ে দিয়েছে। বলবে ঘোড়া শহরে এসে না পৌঁছুলে বিপদে পড়ে যেতে।
চুপ করে থাকল দুই তরুণ।
আর কিছু? জানতে চাইল বেনন। স্টেসি আর রিন্টি জবাব না দেয়ায় ঘোড়া থেকে নামল। বেশি দেরি হলো না ওদের বেঁধে ফেলতে।
মড়ার মতো পড়ে থাকবে, কাজ সেরে বলল বেনন।
একটু পরই টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ও। দড়ি ধরে সঙ্গে নিয়ে আসছে দুই কাউবয়ের ঘোড়া দুটো। উপুড় হয়ে পড়ে আছে দুই কাউবয়। মাঝে মাঝে খিকখিক করে হেসে উঠছে স্টেসি।
ঢালের আড়ালে আড়ালে শহরের সিকি মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেল ও। ট্রেইলের পাশে থেমে একে একে ছেড়ে দিল ঘোড়াগুলোর দড়ি। একটা ঘোড়ার পেছনে জোরে এক চাপড় লাগাতেই ট্রেইল ধরে ছুটল ওটা। একটু ইতস্তত করে তাকে অনুসরণ করল পরের ঘোড়াটা। ওরা শহরেই যাবে। ওখানে মানুষ আছে, স্টেবলের গন্ধ টানছে ঘোড়াগুলোকে। পাঁচ মাইল দূর থেকেও গন্ধ পায় ঘোড়া।
ঘোড়াগুলো উত্তর দিক থেকে শহরে ঢুকবে নিশ্চিত হয়ে দ্রুত ছুটল বেনন। পশ্চিম ঘুরে দক্ষিণে চলে এলো সাত মিনিটের মাথায়।
সঙ্গে সঙ্গে শহরে না ঢুকে অপেক্ষা করল ও। একটু পরই হৈ-চৈ শুরু হলো। বোর্ডওয়াকে ছুটন্ত পদশব্দ শোনা গেল। উত্তেজনার ছোয়া শহরে। উত্তর দিকে যাচ্ছে সবাই কি ঘটেছে বোঝার জন্যে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুটো ঘোড়া, ওগুলোকে ঘিরে জটলা করছে কিছু মানুষ।
কেউ দেখল না বেনন দক্ষিণ দিক দিয়ে শহরে ঢুকেছে। জেলখানার সামনে থামল ও। ঘোড়াটা বাঁধল রাস্তার উল্টোপাশের হিচরেইলে। জেলাখানার দিকে পা বাড়িয়ে দেখল ঠেলাগুতো মেরে লোক সরিয়ে কি ঘটেছে দেখতে চাইছে মার্শাল জারম্যান।
মার্শালের অফিসের দরজায় তালা মারা নেই। ঠেলতেই খুলে গেল দরজা। ভেতরে পা দিয়ে থেমে দাঁড়াল বেনন। চোখ বড় বড় হয়ে উঠল বিস্ময়ে, তারপর মাথা থেকে সমব্রেরো নামিয়ে নর্ড করল ও। পায়ের ঠেলায় পেছনে বন্ধ করে দিল দরজা। ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। চোখে ভয় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাঙ্কার রাশল্যান্ডের মেয়ে শার্লি।
মেয়েটা সত্যিই সুন্দরী। গায়ের চামড়া থেকে গোলাপী আভা ঠিকরে বেরচ্ছে। মুখটা পানপাতার মতো। নীল রঙের চোখ দুটো বড় বড়। চোখের পাপড়ি দীর্ঘ আর ঘন কালো। মেয়েটা এই মুহূর্তে নার্ভাস। বারবার চোখের পলক ফেলছে। দৃষ্টিতে শঙ্কা।
ভয় পাবার কিছু নেই, ম্যাম, বলল বেনন। চেয়ারে বসো। জারম্যান আসার আগে পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকছি।
পিছিয়ে গিয়ে টেবিলে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। অভিযুক্ত করার ভঙ্গিতে আঙুল তুলল বেননের দিকে। আমার বাবাকে যারা মেরে ফেলেছে তুমি তাদের। একজন।
ফুঁপিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিল শার্লি। পাশ কাটাতে পারল না, হাত ধরে ফেলল বেনন। জোর করে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে।
মিস রাশল্যান্ড, গম্ভীর হয়ে গেল বেননের চেহারা, বিশ্বাস করো আর না করো, আমি বা আমার বন্ধু তোমার বাবাকে খুন করিনি। এই কথাটা জারম্যানকে বোঝাতেই এসেছি এখানে। আমি দুঃখিত যে তোমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার হত্যাকারীকে ধরতে যদি কোন সাহায্য করতে পারি তাহলে অবশ্যই করব।
বেননের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে গেল মেয়েটা। মুখে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক রং ফিরে এলো। একটু ইতস্তত করে বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি। তোমাকে দেখে মনে হয় না ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করার মতো লোক তুমি।
ধন্যবাদ, ম্যাম, আবার বাউ করল বেনন। আমাদের ব্যাপারে ক্লিন্ট ডসনেরও একই ধারণা। সেজন্যেই ওর ব্ল্যাঙ্কে আমাদের আশ্রয় দিয়েছে ও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুবতীকে দেখে নিল বেনন। ক্লিন্টের নাম শুনেই অজান্তে গলার কাছে হাত নিয়ে গেছে মেয়েটা। দুর্বলতা না থাকলে এরকম প্রতিক্রিয়া মেয়েদের হয় না। তবে দুঃখের কথা হচ্ছে দু’একদিনের মধ্যে ক্লিন্টের নিজেরই আশ্রয় দরকার হয়ে পড়বে।
তাই? কেন? বিস্ফারিত চোখে জানতে চাইল শার্লি।
ডসন তোমার বাবার কাছে টাকা জমা রেখেছিল। ভেবেছিল ডিলনের ঋণ শোধ করে দেবে। কিন্তু ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে যাওয়ায় এখন ওর কাছে আর শোধ দেবার মতো টাকা নেই। ডিলন ওর র্যাঞ্চটা কেড়ে নেবে।
কথা থামিয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল বেনন। শার্লি চিন্তিত, কিন্তু কেন চিন্তিত তা বোঝার কোন উপায় নেই। রাস্তায় কোলাহল থেমে গেছে। বোধহয় সবার কৌতূহল মিটিয়ে ফিরতি পথ ধরেছে স্টেসি আর রিন্টি। দরজার কাছে চলে এলো বেনন, কান পাতল দরজায়। বলল, জারম্যান বোধহয় শিগগিরই আসবে। লোকটা আমাকে খুনি ভাবছে। আমাকে হয়তো অস্ত্র বের করে হুমকি দিতে হবে। তোমার ভয় পাবার কোন কারণ নেই, মিস রাশল্যান্ড।
বাইরে কিসের গোলমাল হচ্ছিল? জানতে চাইল শার্লি।
আজকে সকালে ট্রিপল বারে ডিলনের উপস্থিতির কথা জানাল বেনন। বলল কিভাবে দুই কাউবয়কে লাশ সাজিয়ে শহরে ঢুকেছে ও।
ডিলনের মারমুখী ভঙ্গির কথা শুনে জ কুঁচকে উঠল যুবতীর। ঠোঁটের ওপর আঙুল নিয়ে মেয়েটাকে শব্দ করতে নিষেধ করল বেনন। বোর্ডওয়াকে বুটের ভারী আওয়াজ এগিয়ে আসছে। দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল বেনন। অস্ত্র বের করে নিল হোলস্টার থেকে। বাইরে থেমে গেল পায়ের শব্দ। দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে।
তোমাকে একা বসিয়ে রাখতে হয়েছে সেজন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মিস শার্লি, ঘরে পা রেখে বলল জারম্যান। আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেয়েটার চোখের দৃষ্টি ওর পেছনে লক্ষ করে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরল। একই সঙ্গে পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। বঁট ছোঁয়ার আগেই থেমে গেল হাত। বেননের সিক্সগান বুকের দিকে তাক করা দেখে কুঁচকে গেল। ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। খসখসে গলায় বলল, তোমার সাহস দেখে হতবাক হচ্ছি। এখানে কি চাও?
তোমাকে চাই, জারম্যান, কনুই দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল বেনন। তুমি মাথা মোটা লোক বলেই বিশ্বাস করছ না যে আমি আর আমার বন্ধু তোমাদের ব্যাঙ্কারকে খুন করিনি। কিন্তু এখন তোমাকে এমন লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেব যার কথা তুমি বিশ্বাস না করে পারবে না। আমার সঙ্গে রলিন্স যাচ্ছ তুমি। ওখান থেকে পিঙ্কারটন এজেন্সিতে টেলিগ্রাফ করবে। উইলিয়াম পিঙ্কারটন তোমাকে জানাবে এখানে আমরা কেন এসেছি।
অবিশ্বাসের ছাপ পড়ল জারম্যানের চেহারায়। বেননের কথা উড়িয়ে দিতে চাইল হাত নেড়ে। তারপর থেমে গেল ওর চোখের গভীর দৃষ্টি দেখে। ঠাট্টা করছে লোকটা!
বললেই তোমার সঙ্গে রলিন্সে যাব সেটা ভাবলে কোন সাহসে? ধমকের সুরে জানতে চাইল মার্শাল।
স্বেচ্ছায় না গেলে স্যাডলে বেঁধে নিয়ে যাব, ঠাণ্ডা গলায় জানাল বেনন। ঊরুর পাশে থাবা দিয়ে অন্য অস্ত্রটাও বের করল। ট্রিগার গার্ডে আঙুল ঢুকিয়ে অস্ত্র ঘোরাল বার কয়েক, তারপর হঠাৎ করেই তাক করল মোটা মার্শালের পেটে। আমি হলে কিন্তু দেরি করতাম না।
যাব তোমার সঙ্গে, গম্ভীর চেহারায় বলল জারম্যান। ভয় পেয়ে যাচ্ছি তা নয়। আমি দেখতে চাই তুমি সত্যি কথা বলছ কিনা। সত্যি বলে থাকলে অন্যভাবে তদন্ত শুরু করতে হবে আমাকে।
তাহলে গানবেল্ট খুলে ফেলো, নির্দেশ দিল বেনন। মোটকু ওদের ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যাপারে ডিলনের সঙ্গে একমত হয়েছিল সেটা ভুলতে পারছে না। একে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না। সুযোগ পেলেই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে পেটমোটা মার্শাল।
গানবেল্ট খুলে মেঝেতে ফেলে দিল জারম্যান। বেনন দেখল চোখে ভয় নিয়ে ওদের দেখছে শার্লি। মেয়েটার উদ্দেশে হাসল ও। মনে হলো কিছুটা স্বস্তি পেল, মেয়েটা।
চলো তাহলে, মার্শালকে বলল বেনন। একেবারে ভদ্রলোকের মতো স্যাডলে বসে থাকবে। কোন দিকে তাকাবে না। সোজা বেরিয়ে যাবে শহর থেকে। কোন বেচাল দেখলে গুলি করব আমি। মনে রেখো, চালাকি করলে মরতে
অস্ত্রের নল দিয়ে ইশারা করল। জারম্যান বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। সেলের করিডর হয়ে জেলখানার পেছনে চলে এলো। জায়গাটা ছোট্ট একটা উঠান মতো। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। একটা দরজা আছে। মার্শালের ঘোড়া এখানেই রাখা হয়। জারম্যানের একটু পেছনেই থাকল বেনন। আসার আগে মিস শার্লিকে আরেকবার বাউ করে এসেছে ও, আশা করছে মেয়েটা চিৎকার চেঁচামেচি করে ওকে বিপদে ফেলবে না।
ঝামেলা না করে ঘোড়ায় স্যাডল চাপাল জারম্যান। লোকটাকে নিয়ে উঠান থেকে বেরিয়ে এলো বেনন। কপালের ওপর টেনে এনেছে টুপি। কাছ থেকে কৌতূহলী হয়ে কেউ না তাকালে সহজে ওকে চিনতে পারবে না। আর চেনার কথাও নয়। ও যখন এসেছিল শহর ছিল খালি। বিপদ ঘটাতে পারে জারম্যান, সে হৈ-হট্টগোল করলে মানুষ জড় হয়ে যাবে। কিন্তু লোকটা ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।
হিচরেইল থেকে ঘোড়ার দড়ি খুলে স্যাডলে চেপে তারপর জারম্যানকে ঘোড়ায় উঠতে ইশারা করল বেনন। রাস্তায় লোক চলাচল কম। আগ্রহ নিয়ে কেউ ওদের দিকে তাকিয়ে নেই।
পাশাপাশি চলল বেনন আর মার্শাল। দূর থেকে দেখে যে কেউ ভাববে কোন বন্ধুর সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে তাদের মার্শাল।
শহর ছাড়িয়ে আসার অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল জারম্যান। উইলিয়াম পিঙ্কারটনের মতো নামকরা লোক তোমার পক্ষে সাফাই গাইবে কেন?
কারণ তার অনুরোধেই এদিকে এসেছি আমি।
অনুরোধে? তোমাকে…আউট-ল রক বেননকে অনুরোধ করেছে উইলিয়াম পিঙ্কারটন? আমাকে একথাও বিশ্বাস করতে হবে?
টেলিগ্রাফ করলেই জানতে পারবে।
ধরলাম তুমি সত্যি বলছ। ব্যাঙ্ক ডাকাতি বা খুনের সঙ্গে তোমাদের কোন যোগাযোগ নেই। তোমাদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ না থাকে তাহলে কি তোমরা চলে যাবে?
না। কিছু প্রশ্নের জবাব না পেলে এখান থেকে নড়ছি না আমরা। যখন এলাম শহরটা কেন খালি ছিল, কে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করল, ব্যাঙ্কার আর কর্মচারীর খুনি কে–এসব না জানা পর্যন্ত ঠিক করেছি থাকব।
ক্লিন্টের লোকদের ওভাবে শহরে পাঠানো সাজানো ব্যাপার, তাই না?
হতে পারে।
ওদেরকে এমনিতেই শহরে চলে আসতে হবে। ডিলন টাকা না পেলে ট্রিপল বার নিয়ে নেবে। সে নিশ্চয়ই ক্লিন্টের কর্মচারীদের রাখবে না।
আজকে সকালে ট্রিপল বার দখল করতে গিয়েছিল ডিলন। তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।
ঐ কুঁচকাল জারম্যান। ব্যাঙ্ক-ডাকাত ধরা না পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত লিউ। বেননের দিকে তাকাল। তুমি কি ক্লিন্টের পক্ষ নিচ্ছ নাকি?
পিঙ্কারটন আমাকে অনুরোধ করেছে ক্লিন্টের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে বের করার জন্যে।
ও। শুনেছি বুড়ো ডসনের বন্ধু ছিল লোকটা।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ক্লিন্টের বাবার মৃত্যুর পর মাঝে মাঝে খোঁজখবর নিত সে। পরে ক্লিন্ট মানা করে দেয়। বিনা পয়সায় একটা গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নেবার মানসিকতা হয়নি ওর। তারপর থেকে পিঙ্কারটন গোপনেই খোঁজ নিয়েছে। ট্রিপল বারে রাসলিং হচ্ছে এব্যাপারে বুড়ো পুরোপুরি নিশ্চিত।
তোমার সঙ্গে পিঙ্কারটনের পরিচয় কিভাবে?
তার হয়ে দু’একটা অ্যাসাইনমেন্টে গেছি আমি।
আউট-লকে কাজে লাগাল? তার তো অ্যালার্জি ছিল।
অ্যালার্জি এখনও আছে। কিন্তু উপায় নেই তার। পুব আর উত্তর-পুবে পিঙ্কারটনের নিয়মিত এজেন্টরা ব্যস্ত। কয়েকজনকে অফিসওয়ার্ক থেকে তুলে অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হয়েছে। খানিকটা বাধ্য হয়েই আমাকে অনুরোধ করল পিঙ্কারটন। আমিও এদিকেই আসতাম, রাজি হয়ে গেছি। সমস্ত খরচ বুড়ো দিচ্ছে, আপত্তি করব কেন?
ফোঁশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জারম্যান। যেভাবে বললে তাতে আমার মনে আর কোন সন্দেহ নেই। কষ্ট করে রলিন্সে না গেলেও চলে। তোমাদের ওপর থেকে অভিযোগ উঠিয়ে নেবার ব্যবস্থা করব আমি।
রলিন্সে যাচ্ছি আমরা, গম্ভীর হয়ে গেল বেনন। তোমাকে নিশ্চিত হতে হবে। এখন আমার কথা শুনে বিশ্বাস করছ, একটু পরেই অন্য কারও কথায় মতামত পাল্টে ফেলতে পারো। এখন এদিকে যেরকম পরিস্থিতি তাতে তোমার ইচ্ছেমতো গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না।
আপত্তি করতে গিয়েও চুপ করে গেল জারম্যান।
জিজ্ঞেস করল বেনন, আমরা যখন শহরে আসি তখন শহরটা খালি ছিল। কারণ জানা গেছে?
বেননের দিকে মার্শাল এমন ভাবে তাকাল যেন, বেননই আসলে দায়ী এই অঘটনের জন্যে। বেনন নাচানোয় অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে বলল মাইনারের কথা। বেশির ভাগ লোক ফিরে এসেছে। তবে এখনও কয়েকজন রয়ে গেছে আশায় আশায়। শিগগিরই ফিরবে তারাও। মানুষজন এত রেগে আছে যে মাইনারকে পেলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে খালি হাতে।
খুবই বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, প্রশংসা না করে পারল না বেনন। তারপর বলল, তবে মাইনার একটা খুঁটি মাত্র। এসবের পেছনে আসল লোকটা শহরের কেউ। সে জানত ব্যাঙ্কের সেফে কত টাকা আছে। বাইরের কোন ডাকাত দল দিনে বা রাতে ডাকাতির চেষ্টা করত, কিন্তু শহর খালি করার চেষ্টা করত না। কাজটা এই এলাকার পরিচিত লোকরাই করেছে। তীক্ষ্ণ চোখে মার্শালকে একবার দেখে নিল বেনন। মাইনারকে ট্রেইল করার চেষ্টা করেছিলে তুমি?
তোমার সঙ্গে আসতে না হলে আজকে ট্রেইল খুঁজতে শুরু করতাম।
খোঁচাটা নীরবে হজম করল বেনন। সারা রাস্তা দুজনের মাঝে আর কোন কথা হলো না।
ওয়েলস ফারগো অফিসে গিয়ে পিঙ্কারটন এজেন্সির নামে একটা টেলিগ্রাফ পাঠাল ওরা। জবাব এলো ছয় ঘণ্টা পর। টেলিগ্রাফার কাগজটা বেননের দিকে এগিয়ে দিতে, বেনন মার্শালকে দিতে বলল। বেশ বড় মেসেজ। পড়া শেষে বেননের দিকে তাকাল জারম্যান। চোখে আর অবহেলার ভাব নেই।
পড়বে? জানতে চাইল সে।
বেনন মাথা নাড়ল। এখানে আর কোন কাজ নেই ওর। জারম্যান এখন জানে ওরা অপরাধী নয়, কাজেই ফিরতি পথ ধরা যায় নিশ্চিন্তে। দেরি করা ঠিক হবে না। ওদিকে হয়তো বিপদের মুখে আছে ব্যাগলে।
মার্শালের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বিশ্রাম না নিয়ে সে রলিন্স থেকে নড়বে। দু’এক কথায় জারম্যানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো বেনন। জারম্যান বোর্ডওয়াকে পা রাখার আগেই ঘোড়ায় চড়ে বসল। টুইন স্প্রিংসের দিকে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা।
বেনন আর জারম্যান বেরিয়ে যাওয়ার পরও বসে রইল শার্লি। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। লিউ ডিলন আর ক্লিন্ট ডসন লড়াই করবে ভাবতেই বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দুজনই বন্ধু। দুজনকেই ও পছন্দ করে। ওরা দুজনই চায় তাদের একজনকে ও জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিক। কোন তাড়া নেই শার্লির। এখনও ঠিক করেনি কাকে মন দেবে। ডিলন আর ডসন দুজনই সুপুরুষ। ওদের বন্ধুত্ব আর সঙ্গ রীতিময়ে উপভোগ করে ও। তবে এটাও জানে, একদিন সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সেদিন যেকোন একজনের প্রতি ওর অনুভূতি গভীর হতে দেবে।
একটু বিস্মিতই বোধ করছে শার্লি এখন। কিছুক্ষণ আগে আবিষ্কার করেছে, শুধু ক্লিন্ট ডসনের কথাই ভাবছে ও। কারণ খুঁজতে গেল না শার্লি। একটা কথা অন্তর থেকে পরিষ্কার অনুভব করল, বিপদের মধ্যে আছে ক্লিন্ট। ক্লিন্টের ক্ষতি। হোক এমন কিছু চাইতে পারবে না ও। অস্থির করা চিন্তাগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে মার্শালের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো শার্লি, নিজের বাড়িতে ফিরে এলো। একটু পরই রাইডিং ড্রেস পরে নিয়ে বেরিয়ে এলো আবার। বাড়ির পেছনে স্টেবল। সেখানে গিয়ে পিঠে স্যাডল চাপিয়ে বের করে আনল মেয়ারটাকে। কড়া রোদে দগ্ধ হচ্ছে টুইন শ্রিংস। রাস্তায় মানুষ নেই। বার কিউয়ের দিকে চলল শার্লি। প্রথম দিকে ঘোড়ার গতি থাকল কম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর গতি বাড়াল মেয়েটা। অস্থিরতা তাতেও কাটছে না, মনে হচ্ছে আরও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছুনো দরকার, ডিলনকে বোঝাতে হবে, কথা আদায় করতে হবে, যাতে কোন গোলমালে জড়িয়ে না পড়ে ডসনের সঙ্গে। ঘোড়ার গতি আরও বাড়াল শার্লি। বার কিউতে যখন পৌঁছুল, দরদর করে ঘাম ঝরছে মেয়ারের গা থেকে, ফেঁশ ফোশ করে শ্বাস ফেলছে।
বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছে ডিলন। পরিশ্রান্ত ঘোড়ার ওপর থেকে ঘুরে এলো তার বিস্মিত দৃষ্টি। শার্লিকে স্যাডল থেকে নামতে দেখে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে, তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠানে স্বাগত জানাল মেয়েটাকে।
ঘোড়াটাকে অনেক বেশি খাটিয়েছ, শার্লি, অভিযোগ নয়, মন্তব্য করল ডিলন। এত তাড়া কিসের? উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পাঞ্চার। তাদের একজনকে চোখের ইশারায় ডাকল র্যাঞ্চার। ধমকের সুরে বলল, জানোয়ারটাকে স্টেবলে নিয়ে যাও। পাঞ্চার এগিয়ে আসছে দেখে নিয়ে এবার শার্লির দিকে তাকাল ডিলন, এক হাতে মেয়েটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
শার্লিকে দামী চামড়া মোড়া একটা আর্ম চেয়ারে বসিয়ে কিচেনে চলে এলো সে, একটু পরেই ফিরে এলো অ্যাপল জ্যাকের জাগ নিয়ে। একটা গ্লাসে অ্যাপল জ্যাক ঢেলে শার্লির হাতে দিয়ে ফায়ারপ্লেসের চওড়া গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল, চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল শার্লির দিকে।
আমি… একটু ইতস্তত করল শার্লি। ডিলনের চোখের দিকে তাকাল না। আমি শুনলাম আজকে সকালে ক্লিন্টের ওখানে গিয়েছিলে তুমি। কেন?
কালো হয়ে গেল ডিলনের সুদর্শন মুখ। কথা বলার আগে একটু ভেবে নিল। তারপর শব্দ চয়ন করে নিয়ে বলল, অনেক দিন হলো আমার টাকায় র্যাঞ্চ চালাচ্ছে ক্লিন্ট ডসন। আজকে আমার ঋণ শোধের শেষ দিন ছিল। শোধ দেয়নি সে। র্যাঞ্চ ছেড়ে যেতেও রাজি হয়নি। উল্টো হুমকি দিয়েছে আমাকে অস্ত্রের মুখে। আমি আমার পাওনা টাকা চেয়ে কোন অসঙ্গত আচরণ কি করেছি?
ক্লিন্ট শোধ দেয়নি সেটা তো ওর ইচ্ছেকৃত নয়। শোধ দেবার ইচ্ছে ছিল ওর। সেজন্যেই আমার বাবার কাছে টাকা জমা রেখেছিল। ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে সেজন্যে ক্লিন্টকে দোষ দেয়া যায় না। চোখে অনুরোধ নিয়ে ডিলনের দিকে তাকাল শার্লি। টাকা যোগাড় করার আরেকটা সুযোগ তুমি ক্লিন্টকে নিশ্চয়ই দেবে, লিউ?
মাথা নাড়ল ডিলন। শার্লি, আমি তোমার সঙ্গে তর্কে যেতে চাই না। যথেষ্ট সময় পেয়েছে ক্লিন্ট। আর দেরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কখনোই আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না ক্লিন্ট। আমার ঋণ শোধ করতে পারবে না। আমি যদি অপেক্ষা করি তাহলে একদিন হয়তো দেখব ওর জায়গায় আর কেউ ট্রিপল বার চালাচ্ছে। নতুন লোক এখানে জমি কিনলে আমার সঙ্গে ঠোকাঠুকি করবে। সে-ঝুঁকি আমি নিতে পারি না।
বড় বড় চোখে অবাক বিস্ময় নিয়ে ডিলনের কথা শুনল শার্লি। তারপর বলল, ক্লিন্ট তার জমি বেচবে না। তাছাড়া ব্যাঙ্কের হিসেব পরীক্ষা শেষ হলেই জমা রাখা টাকা ফেরত পাবে ও, তখন পাওনা শোধ করে দিতে পারবে।
কি বলছ তুমি? অজান্তেই চড়ে গেল র্যাঞ্চারের গলা। কর্কশ ভাবটুকু শার্লির কান এড়াল না।
যদি সম্ভব হয় তাহলে রাশল্যান্ড ব্যাঙ্ক তার পাওনাদারদের পাওনা মিটিয়ে দেবে। বাবা থাকলেও তাই করত, কাজেই এটা আমারও কর্তব্য।
কিন্তু ক্লিন্ট তোমাদের গ্রাহক ছিল না, বোঝানোর চেষ্টা করল ডিলন। ক্লিন্ট তোমার বাবার ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখেনি। রাল্যান্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে কোন ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল না ওর। যাদের টাকা পাওনা আছে তাদের টাকা শোধ করতেই তোমার কষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। গ্রাহকদের পাওনা মেটানো তোমার প্রথম কর্তব্য। আমিও গ্রাহকদের একজন।
চুপ করে থাকল শার্লি। ডিলন যা বলছে শুনতে খারাপ লাগলেও সেটা সত্যি কথা। আমি ভুলে যাইনি যে তুমিও পাওনাদারদের একজন, কিছুক্ষণ পর বলল
আমি তোমাকে সে-টাকা ফেরত দেবার জন্যে চাপ দিচিং না, নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্যে দ্রুত বলল ডিলন। ওই টাকা না পেলেও আমি আইনের সাহায্য নেব না। তবে এটাও ঠিক, আমি চাইব ক্লিন্ট তার টাকা ফেরত পাবার আগে যাতে আমি আমার টাকা ফেরত পাই। আমি অন্যায় কিছু বলেছি?
আস্তে করে মাথা নাড়ল শার্লি। ডিলন লক্ষ করল শার্লির গ্লাস খালি। গ্লাসটায় অ্যাপল জ্যাক ঢেলে দিল সে। তারপর বসল শার্লির উল্টোদিকের চেয়ারে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টিতে। যুবতীর মিষ্টি মুখ আর নিখুঁত দেহ রক্ত চলাচলের গতি বাড়িয়ে দিল তার।
হঠাৎ আজকে তুমি ক্লিন্টের হয়ে কথা বলছ কেন, শার্লি? যখন কোন মানুষ ব্যর্থ হয়, ডুবে যেতে হয় তাকে।
ক্লিন্ট ব্যর্থ হয়েছে কিনা সে-ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে। আমার ধারণা ভাগ্যটা ওকে সহায়তা করছে না।
হ্যাঁ, ভাগ্য ওকে সহায়তা করছে না। আমাকেও করেনি। আর করেনি বলেই ক্লিন্টকে আমি ধার দিয়েছি। শ্রাগ করল ডিলন। বিনিময়ে কি পেলাম আমি? লোকসান সর্বস্ব একটা র্যাঞ্চ। লাভের মুখ দেখতে হলে আরও অনেক টাকা ওখানে বিনিয়োগ করতে হবে আমার।
উঠে দাঁড়িয়ে থমথমে মুখে ডিলনের দিকে তাকাল শার্লি। অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে। আসন্ন সংঘাতের কথা চিন্তা করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর। ক্ষণে ক্ষণে টাইট হয়ে যাচ্ছে ব্লাউজ। বুকের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে ডিলনের।
লিউ, মৃদু স্বরে বলল শার্লি। বাবা মারা যাবার পর তুমি আর ক্লিন্টই শুধু আমার সত্যিকারের বন্ধু। আমি চাই না তোমরা পরস্পারের বিরুদ্ধে লড়াই করো।
চেয়ার ছাড়ল ডিলন, যুবতীর কাছে এসে দাঁড়াল। ডিলনের চোখের ভাষা পরিষ্কার পড়তে পারল শার্লি। বুঝতে পারল কি ভাবছে এখন লোকটা। অনুভব করল স্বেচ্ছায় ডিলনের ইচ্ছে পূরণের মতো মন মানসিকতা এই মুহূর্তে নেই ওর। ডিলন বা ডসন, কাকে স্বামী হিসেবে বেছে নেবে এখনও স্থির করেনি ও।
ডিলনের পরবর্তী কথায় নিজেকে বন্দি একটা পশুর মতো মনে হলো শার্লির।
ডিলন আবেগ জড়ানো গলায় বলছে, বুঝতে পারছি তোমার কেমন লাগছে, শার্লি। তোমার কথা রাখতে পারলে খুবই খুশি হতাম। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বোবঝা, ক্লিন্ট তোমার বন্ধু বলেই তাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি না। তবে… একটু থামল ডিলন। তুমি যদি আমার বউ হতে তাহলে ব্যাপারটা আমি অন্যভাবে নিতাম। ক্লিন্টকে কিছুটা ছাড় দিতেও আপত্তি করতাম না হয়তো।
কথা শেষে শার্লিকে সে কাছে টেনে নিল। আপ্রাণ চেষ্টা করল শার্লি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার। শক্তিশালী পুরুষ ডিলন। প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে কাছে টানছে ওকে। চুমু খেতে শার্লির ঠোঁট খুঁজল ডিলনের মুখ। এত বাড়াবাড়ি ঠিক হচ্ছে না। মুখ। সরিয়ে নিল শার্লি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এখন নয়, লিউ! এখন নয়। লিউ, বাবার শেষকৃত্য শহরে। আমাকে যেতে হবে…
হ্যাঁ, ঠিক, যেতে হবে তোমাকে। ফোশ ফেঁশ করে শ্বাস নিচ্ছে ডিলন। শার্লিকে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল। একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা কোরো। আসলে তুমি এত সুন্দর যে কাছে থাকলে দুনিয়ার আর কোন চিন্তা মাথায় থাকে না।
কালকে আসছ, লিউ? জিজ্ঞেস করল শার্লি। নিজেকে ফিরে পেতে এখনও লড়াই করছে ও ভেতরে ভেতরে।
মাথা দোলাল ডিলন। চোখ পড়ে আছে যুবতীর উন্নত বুকের দিকে।
আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে ট্রিপল বারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবে না তুমি, কথা দিচ্ছ?
প্রথম চিন্তা যেটা মাথায় এসেছিল চেপে গেল ডিলন। কথা দিতে অসুবিধে কি? নিজে জড়িত না হয়েও ক্লিন্টের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে ও। কি দরকার মেয়েটাকে চটিয়ে, যখন আসলেই মেয়েটাকে ওর এত প্রয়োজন!
ঠিক আছে, শার্লি, তোমার কথা রাখব, বলল সে। তবে ভবিষ্যতে আমার মতামতকে প্রভাবিত করতে হলে বিয়েতে দেরি করা চলবে না।
আমাকে তাড়া দিয়ো না, লিউ, দীর্ঘশ্বাস ফেলল শার্লি। গ্লাভস আর হ্যাট তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। আমাকে একটু ভাবতে দাও।
উঠানে বেরিয়ে এলো ডিলন, চেঁচিয়ে আদেশ দিল, যাতে শার্লির ঘোড়াটা কেউ এনে দেয়। করালের সামনে দাড়িয়ে একটা বুনো মাস্ট্যাং ঘোড়াকে বশ মানাতে দেখছে কে। তাকে ডাক দিল ডিলন। বলল, তুমি মিস শল্যান্ডের সঙ্গে শহরে যাবে। খেয়াল রাখবে কেউ যাতে তাকে পথে বিরক্ত না করে।
আস্তে করে নড় করল কেগ। দৃষ্টি স্থির হলো শার্লির ওপর। মাত্র এক মুহূর্ত, তারপরই চোখ সরিয়ে নিল গানম্যান। কিন্তু ওই একটি মুহূর্তে কাপ ধরে গেল শার্লির বুকের ভেতর। খর রোদে দাঁড়িয়ে শীত লেগে উঠল।
০৫. ঘুম ভাঙল ব্যাগলের
ঘুম ভাঙল ব্যাগলের। আবছা ভাবে মনে হলো একটু আগেও এই ঘরে কেউ একজন ছিল। জানালা দিয়ে এখনও সূর্যের আলো আসছে। বাঁকা রশি দেখে আন্দাজ করল ব্যাগলে, দু’ঘণ্টার বেশি ঘুমায়নি ও। কেউ একজন এসেছিল। তাতে কি? আবার ঘুমিয়ে পড়তে চাইল ব্যাগলে। তারপর মনে পড়ল চেয়ারের ওপর ফেলে রাখা স্নিকারের পকেটে আছে ডিলনের কাছ থেকে নিয়ে আসা ঋণপত্রের নকল। বেনন বলেছিল ডিলনের লোক এখানে থাকলে জানা যাবে।
লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল ও, স্নিকারের পকেট খুঁজে দেখল। কাগজটা নেই! ব্যাগলের ইচ্ছে হলো কাপড় পরে ছুটে বেরিয়ে যায় বাঙ্ক হাউজ থেকে, জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে চেষ্টা করে কে নিয়েছে কাগজটা। কিন্তু কিছুই করল না। বিছানার ধারে বসে সিগারেট ধরাল একটা। দ্বিতীয় সিগারেট প্রায় মাঝামাঝি শেষ করে এনেছে এমন সময়ে উঠানে শুনতে পেল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। দ্রুত পায়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল ব্যাগলে।দেখল হালকা ধূসর একটা মেয়ারে চড়ে বাইরে যাচ্ছে ডায়ার।
সিগারেট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ব্যাগলে। আরাম করে শুলো। ভাবতে চেষ্টা করল ডায়ার কেন বিশ্বাসঘাতকতা করবে। হাসল আপনমনে। বেনন আর ও ভাল বুদ্ধি করেছিল! ঋণের দলিলের বদলে একই সমান একটা কাগজে যাবতীয় গালাগাল লিখে সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখেছিল ও স্নিকারের পকেটে। সেটা ডায়ার নিয়ে গেছে। যাক। গালাগাল খেয়ে মাথা থেকে ভূত পালাবে লোকটার। ঠিক দু’ঘণ্টা পর পরিপূর্ণ বিশ্রাম শেষে র্যাঞ্চ হাউজে এসে ঢুকল ব্যাগলে, চলে এলো কিচেনে। জনি সিং রান্না করছে। আগুনে চাপানো পটে ফুটছে গরম কফি। ওকে দেখে একটা মগে কফি ঢেলে এগিয়ে দিল চাইনিজ কুক।
চুমুক দিল ব্যাগলে। কৃতজ্ঞ হয়ে বলল, কফিটা ভাল হয়েছে। …একটা প্যাকেটে রাতের খাবার দিয়ে দাও। বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হতে পারে।
লম্বা ডান্ডিওয়ালা চামচ দিয়ে একটা সাইডবোর্ড দেখিয়ে দিল কূক। ওখানে আগেই গোটা কয়েক প্যাকেটে খাবার রাখা আছে। দরকার মতো নিয়ে নাও, বলে রান্নায় আবার মনোযোগ দিল সে।
কফি শেষ করে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে এলো ব্যাগলে। মাঠের ধারে একটা বেড়া মেরামত করছে ক্লিন্ট, স্টেসি আর ডেনভার। রাউন্ডআপের সময় একটা বুনো গরু বেড়ার ওই অংশ ছিঁড়ে ফেলেছিল। ওদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার কোন ইচ্ছে নেই ব্যাগলের, বার্নে চলে এলো ও, ডান গেল্ডিঙে স্যাডল চাপিয়ে বেরিয়ে এলো উঠানে, তারপর ডায়ার যেদিকে গেছে সেদিকে চলল।
ডায়ারকে ট্র্যাক করতে কোন অসুবিধে হলো না। প্রথমে উত্তরে গেছে লোকটা, তারপর র্যাঞ্চ হাউজ থেকে দেখা যায় না এমন একটা জায়গায় এসে এগিয়েছে দক্ষিণে। সরাসরি বার কিউয়ের দিকে যাচ্ছে ট্র্যাক।
নিজের গতিতে ঘোড়াটাকে এগোতে দিল ব্যাগলে। কোন তাড়া নেই ওর। ডায়ারের ট্র্যাক বার কিউয়ের রেঞ্জে ঢোকার পর সরে গেল ও, এগোল টিলাগুলোর। দিকে। টিলার গায়ে ঘোড়া চলার মতো চওড়া জমি আছে। মাঝখান দিয়ে সরু সরু পথ। টিলারাজ্যের অনেক গভীরে যাওয়া যাবে ওসব পথ ধরে। ডিলনের রেঞ্জে প্রচুর টিলা আছে। ওগুলোর মাঝ দিয়ে অনেকদূর যাওয়ার পর ডিলনের রেঞ্জের গভীরে ঢুকে গেল ব্যাগলে। টিলার ফাঁকে ফাঁকে ঘাসজমি। অসংখ্য গরু চরছে। দূরে দেখা যায় একটা লাইন ক্যাম্প। ওখানে কাজ করছে কয়েকজন পাঞ্চার। দৃশ্যটা পরিষ্কার নয়। তাপ প্রবাহের কারণে কাঁপছে সামনের সব কিছু।
কিছুক্ষণ পর ঝিরঝিরে বাতাসের কারণে ঝাঁপসা ভাবটা ক্ষণিকের জন্যে দূর। হলো, পর্বতের গা ঘেঁষে একটা নদী দেখতে পেল ও। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে পানি, সাতরঙা ঝিলিক মারছে বহুমূল্য হিরের মতো।
দিক নির্বাচন করে আবার এগোল ও। থামল বহুদূরে বার কিউয়ের র্যাঞ্চ হাউজ দেখতে পেয়ে। ছোট ছোট বাক্সের মতো লাগছে বিল্ডিংগুলোকে, মাঝখানে বড় আর উঁচু একটা বাক্স। ওটাই র্যাঞ্চ হাউজ।
ঘোড়া থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরাল ব্যাগলে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল র্যাঞ্চ হাউজের দিকে। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো ওকে, তারপর, ছোট একটা বাক্স থেকে বেরিয়ে এলো একটা ফোঁটা। নড়ছে ফোঁটাটা। ধুলো উড়ছে পেছনে। অশ্বারোহী আসছে। লোকটা কে হতে পারে আন্দাজ করতে পারল ব্যাগলে। ফিরতি পথ ধরল ও। আগের পথেই ফিরে চলেছে, কিন্তু খেয়াল রাখছে যাতে দূরবর্তী অশ্বারোহী কিছুতেই চোখের আড়াল না হয়।
বার কিউয়ের রেঞ্জ পেরনোর আগেই বাঁক নিল অশ্বারোহী। সামনে একদল গরু দক্ষিণে চলেছে, ওগুলোকে এড়াতে চায়। টিলার কাছে চলে এলো লোকটা। চেহারাটা চেনা গেল। শক্তপোক্ত, বিশ্বস্ত ডায়ার। পেছনে আনুগত্যের প্রমাণ রেখে ট্রিপল বারের দিকে ফিরছে লোকটা। ঘৃণায় ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল ব্যাগলের। ডায়ারকে অনুসরণ করতে গিয়েও থেমে গেল। দূরে, পুবে কয়েকজন পাঞ্চার পঞ্চাশটা মতো গরু তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। খোলা জমি ছাড়িয়ে রুক্ষ জমিতে প্রবেশ করল ওরা। একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি টিলার সামনে গরুগুলোকে ঘিরে ফেলল। আগুন জ্বালল কে যেন। ধোয়া দেখা গেল দূর থেকে।
কৌতূহল বোধ করল ব্যাগলে। কাছে যাওয়া দরকার। দেখা দরকার লোকগুলো কি করছে। চারপাশের জমি ভাল করে দেখে নিল। টিলার আড়ালে ওদের চারশো গজের মধ্যে পৌঁছুনো সম্ভব। তারপর ঘোড়া রেখে ঘাসের আড়ালে বুকে হেঁটে আরও কাছে যাওয়া যাবে।
লম্বা একটা গালি ধরে টিলার গোড়ায় নেমে এলো ব্যাগলে। ও যেখানে আছে তার চেয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি টিলার সামনের জমি বেশ উঁচুতে। হাঁটার গতিতে ঘোড়া নিয়ে এগোল ও। পাঞ্চারদের তিনশে গজ দূরে কাছের টিলাটা। ওটার পেছনে ঘোড়া থামিয়ে টিলার বাঁক ঘুরে ক্রল করে এগোতে শুরু করল ও ঘাসের ভেতর দিয়ে। একটু পর লক্ষ করল ঘাস এখানে যথেষ্ট লম্বা। হামাগুড়ি দিলেও কারও দেখার সম্ভাবনা নেই। হামাগুড়ি দিয়ে চলার গতি দ্রুত করল ব্যাগলে। প্রায় আধঘণ্টা পর পাঞ্চারদের পাশ কাটিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি টিলার পেছনে চলে এলো। ওকে লোকগুলো দেখতে পাবে না বুঝতেই টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিনারায় এসে উঁকি দিল নিচে।
ওরা পাঁচজন। তিনজন ব্যস্ত হয়ে দড়ি ছুঁড়ে বাছুর ধরছে, বাকি দু’জনের একজন আগুনে ব্র্যান্ডিং আয়রন গরম করছে, অপরজন ডিলনের বার কিউ ব্র্যান্ড কেটে দিয়ে ক্লিন্টের ট্রিপল বার ব্র্যান্ড বসাচ্ছে। ব্যাগলের চোখের সামনে নতুন ব্র্যান্ড করা একটা বাছুরকে ছেড়ে দিল পাঞ্চাররা। হাঁচড়াচড় করে উঠে দাঁড়াল গরুটা, গগনভেদী হাম্বা হাম্বা করতে করতে ফিরে চলল দলের কাছে। ওটার চামড়া থেকে এখনও ধোঁয়া বেরচ্ছে।
পরপর মোলোটা গরু নতুন করে ব্র্যান্ডিং করল পাঞ্চাররা। তারপর আগুনের পাশে বসে আয়রন গরম করছে যে লোকটা, সে বলল, আমার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে।
এতেই চলবে। সায় দিল আরেকজন।
অপেক্ষায় থাকল ব্যাগলে। একটু পরই গরুগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে ট্রিপল বারের দিকে রওনা হলো পাঞ্চাররা।
দৌড়ে টিলা থেকে নেমে এলো ব্যাগলে, ছুটল ঘোড়ার দিকে। পেছনে কেউ তাকাবে না কারণ গরু তাড়িয়ে নিতে লোকগুলো ব্যস্ত। স্যাডলে উঠে অনেক দূর থেকে পাঞ্চারদের অনুসরণ করল ব্যাগলে। দেখল ট্রিপল বারের রেঞ্জে গরুগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। একটা ড্রাই ওয়াশে আরেকটা আগুন জ্বেলেছে বার কিউ কাউবয়রা।
কিছুক্ষণ পর তারা সবাই বার কিউয়ের দিকে ছুটল।
লোকগুলো বার কিউ রেঞ্জে ঢুকে চোখের আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত টিলার ওপরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে নড়ল না ব্যাগলে। পরিস্থিতি যখন নিরাপদ। মনে হলো, যেখানে কাউবয়রা আগুন জ্বেলেছিল, সেই টিলার গোড়ায় চলে এলো ও। এমন ভাবে ব্যাপারটা সাজানো হয়েছে যে কাঁচা লোকও বুঝবে এখানে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছিল। আগুনটা নিভে গেছে। পাশে পড়ে আছে ব্র্যান্ডিং আয়রন আর ব্লক।
ভ্রূ কুঁচকে জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল ব্যাগলে। ভাবল কি করবে। কেন কাউবয়রা একাজটা করেছে? ডিলনের কি সুবিধা ভাবতেই সমস্ত জবাব পেয়ে গেল ও। ধীরে ধীরে ঠোঁটে ফুটে উঠল চওড়া হাসি।
একঘণ্টা এক নাগাড়ে পরিশ্রম করল ব্যাগলে। কাজ শেষে ট্রিপল বারের পথ ধরল। চেহারা দেখে ওকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। ট্রিপল বারের জমিতে এখন আর ব্র্যান্ডিঙের কোন চিহ্ন নেই। নতুন ব্র্যান্ড করা গরুগুলোও ট্রিপল বারে নেই, ওগুলো এখন বার কিউয়ের জমিতে চরছে।
অস্বস্তি লাগছে শার্লির। বুকের ভেতরে কাপ ধরিয়ে দিচ্ছে সঙ্গী গানম্যানের শীতল চাহনি। রক্ত জমে যেতে চাইছে। মনে হচ্ছে দেহ অবশ হয়ে যাবে। লোকটার তাকানোর মধ্যে নোগ্র কি একটা আছে। কেগল তাকালেই নিজেকে উলঙ্গ মনে হচ্ছে। চোখে রাগ নিয়ে বারকয়েক ও তাকানোর চেষ্টা করেছিল কেগলের চোখে, কিন্তু লাভ হয়নি। রাগটা খুব দ্রুত ভয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। কখন ও নিজেও জানে না, হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে ওর। তখন থেকে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। কেগল এমন কিছু করবে না যাতে লিউ ডিলনের বিরাগভাজন হতে হয়। টুইন স্প্রিংসের ট্রেইলে পড়ার পর থেকেই মেয়ারটাকে। কেগলের ঘোড়ার কিছুটা সামনে রাখার চেষ্টা করছে শার্লি। আগে কেগল সামনে ছিল। তখন চেষ্টা করেও লোকটার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারেনি ও। মনে, হলো কোল বুঝছে ভয় আর অসহায়ত্ব নিয়ে তাকিয়ে আছে ও। কিছুক্ষণ পর ধারণাটা শিকড় গাড়ল গভীরে। এভাবে চললে মনোবল বলতে কিছুই থাকবে না টের পেয়ে কেগলের ঠাণ্ডা দৃষ্টির সামনে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে গেছে ও। এখন আর কেগলকে দেখতে হচ্ছে না এটা একটা বড় স্বস্তি।
সামনে সামনে যাচ্ছে শার্লি। বুঝতে পারল না ওর দেহে সেঁটে আছে কেগলের আঠালো দৃষ্টি।
মেয়েমানুষ কখনোই তেমন একটা আকর্ষণ করেনি কেগলকে। শার্লির দিকে তাকাল কেগল। মেয়েমানুষ যতটা ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে সে-তুলনায় দিতে পারে অতি সামান্য। কোন কারণ না থাকলে শার্লির দিকে দ্বিতীয়বার তাকাত না ও। কিন্তু মেয়েটার আড়ষ্ট ভঙ্গি অত্যন্ত অপমানকর। চাহনি দিয়ে মেয়েটা বুঝিয়ে দিয়েছে কেগল তার সমাজের উপযুক্ত নয়। সামান্য একজন গানম্যান কেগল! ভাবনাটা যতই কেগল তাড়াতে চেষ্টা করল ভাবনার মূল মগজে গেড়ে বসল ততই। শেষে তীব্র রাগে শরীর জ্বলতে লাগল ওর। মনে হলো মেয়েটাকে শিক্ষা। দিতে হবে। এমন শিক্ষা যাতে কোনদিন আর কাউকে ছোট নজরে দেখতে না। পারে। মিস রাশল্যান্ডের গর্ব মাটিতে মিশিয়ে দিতে না পারলে স্বস্তি পাবে না ও।
কাঁদবে মেয়েটা, অনুনয় করবে, ক্ষমা চাইবে, বললে এমনকি হামাগুড়ি দেবে সামনে। মান-সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না।
গভীর মনোযোগে শার্লির ভরাট যৌবন লক্ষ করল কেগল। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। হাসি এসে যাচ্ছে ওর। আস্তে আস্তে ঠোঁট প্রসারিত হলো অশুভ হাসিতে। মেয়েটা নিশ্চয়ই নিজেকে নিরাপদ ভাবছে! মনে করছে ডিলনের ভয়ে কেউ তাকে কিছু বলবে না। ভুল ধারণাটা ভেঙে দেয়া দরকার। সময় এলে ডিলনের ব্যবস্থাও। করতে হবে। তখন দেখা যাবে আসলে কে এই অঞ্চলের রাজা। গলার গভীরে সন্তুষ্টিসূচক ঘড়ঘড় আওয়াজ হলো ওর। স্পার দাবিয়ে ঘোড়াটাকে শার্লির পাশে নিয়ে এলো।
টিটকারির সুরে জানতে চাইল, এত, তাড়া কিসের, ম্যাম? ভয় পাচ্ছ। কাউকে?
একবার লোকটার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল শার্লি। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে প্রয়াসকৃত শান্ত গলায় বলল, শহরে অনেক কাজ পড়ে আছে।…কষ্ট করে সঙ্গে আসার দরকার নেই। আমার গতি যদি পছন্দ না হয় তাহলে ফিরে যেতে পারো।
হাত বাড়িয়ে শার্লির মেয়ারের রাশ ধরে ফেলল কেগল। ঘোড়া দুটোকে দাঁড় করিয়ে ফেলল। রাগে জ্বলছে দু’চোখ। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমাকে আমার। গতিতে যেতে হবে। একটা আঙুল যুবতীর বুকে তাক করল সে। আমার সঙ্গে গরম দেখিয়ো না, আমি জানি কি করে তোমার মতো মেয়ের গরম কমাতে হয়।
ভয়ে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল শার্লির চোখ। চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল যাতে অসভ্য লোকটাকে এড়ানো যায়। নোংরা ইঙ্গিত করছে লোকটা! কাপ উঠে যাচ্ছে শার্লির শরীরে, কিন্তু ভয় পেলে মাথায় উঠবে কেগল নামের এই পিশাচটা। নিচু গলায় বলল শার্লি, আমাকে যেতে দাও। অভদ্রতা করলে ফিরে গিয়ে লিউ ডিলনকে বলে দেব আমি। ডিলন তোমাকে…
হেসে উঠল কেগল। তারপর হাত ঘুরিয়ে গায়ের জোরে চড় মেরে বসল শার্লির গালে। শার্লির অবিশ্বাস মাখা চাহনি দেখে হাসিটা আরও চওড়া হলো। হিমশীতল গলায় বলল, আমি যখন তোমাকে ছাড়ব, ইচ্ছে হলে যেতে পারবে ডিলনের কাছে। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি যাবে না। কাউকে যদি আমার কথা বলতে পারোও, ডিলনকে বলতে পারবে বলে মনে হয় না। অবশ্য তুমি যদি ডিলনের বউ হতে চাও তাহলেই।
খামচি মেরে রাশের ওপর থেকে কেগলের হাত সরাতে চাইল শার্লি। একটুও ঢিল হলো না মুঠি। তালুর উল্টোপাশ দিয়ে আবারও চড় কসাল কেগল মেয়েটার গালে। স্যাডল থেকে পড়ে গেল শার্লি। উঠে দাঁড়াবার আগেই ঘোড়া থেকে নামল কেগল, হাত বাড়িয়ে এগোল মেয়েটার দিকে। লালসায় বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা। শার্লি বুঝল, আজ আর নিস্তার নেই। সর্বস্ব খোয়াতে হবে আজকে এই নরপশুর হাতে। চড় লেগে ঠোঁট কেটে গেছে শার্লির। অসচেতন ভাবে ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত মুছল মেয়েটা। পিছাবার চেষ্টা করল।
কেগলের গলার গভীর থেকে আনন্দের ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। শার্লি এখন তার হাতের মুঠোয়। পালাতে পারবে না মেয়েটা। আজকের পর থেকে চোখ তুলে আর কথা বলতে পারবে না। তবে ট্রেইলের মাঝখানে নয়, কোন পাথর টাথরের আড়ালে শার্লিকে নিয়ে যেতে হবে। দ্রুত পায়ে সামনে বেড়ে খপ করে শার্লির হাত চেপে ধরল কেগল, হ্যাচকা টানে নিয়ে এলো বুকের কাছে। কোমর পেঁচিয়ে ধরে নিয়ে চলল ট্রেইলের ধারে। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো শার্লি। অসুরের শক্তি ভর করেছে গানম্যানের শরীরে।
রক্তে বান ডেকেছে কেগলের, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ফলে মাথা থেকে সমব্রেরো উড়ে যাওয়ার পরপর তীক্ষ্ণ আওয়াজটা শুনেও চট করে বুঝতে পারল না কি ঘটেছে। মাটিতে লুটোচ্ছে হ্যাট। ওটার গায়ে ফুটো দেখে বুঝতে পারল গুলি করেছে কেউ। সামনে ছিটকে পড়েছে হ্যাট। পেছনে আছে লোকটা!
শার্লিকে ছেড়ে দিয়েই চরকির মতো ঘুরল কেগল। পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখতে পেল অনাহুত লোকটাকে। পরবর্তী গুলি কেগলের হাত থেকে অস্ত্রটা ফেলে দিল। ব্যথায় হাত ঝাড়া দিল কেগল। তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। বেননের চোখে। নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। বুঝতে পারছে না লোকটা নিঃশব্দে এত কাছে এলো কি করে।
রলিন্স থেকে ফেরার পথে বিশ্রাম নিতে থেমেছিলাম, গম্ভীর চেহারায় বলল বেনন। মিস রাশল্যান্ডের দিকে সর্বক্ষণ চেয়ে না থাকলে আমার ট্র্যাক দেখতে পেতে। একটা, ঘোড়া খানিক আগে ট্রেইল ছেড়েছে এটা বুঝতে পারতে। সন্দেহ হতো। কিন্তু তুমি ব্যস্ত ছিলে। লক্ষ করোনি।
তুমি আজকে আমার সম্মান বাঁচিয়েছ, কাঁপা গলায় বলল শার্লি। কি বলে তোমাকে ধন্যবাদ দেব…
নড করল বেনন। রাইফেল তাক করে ধীরে সুস্থে এগোল। বলল, সত্যি প্রতিদান দিতে চাও, ম্যাম? তাহলে কেগলের অস্ত্রটা কুড়িয়ে নাও। ওটা তাক করে রাখবে। প্রয়োজনে ওর মাথায় গুলি করবে। পারবে না?
পারব। একটু বিস্মিত হলেও কোলের অস্ত্র তুলে নিয়ে সরে দাঁড়াল শার্লি। শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল, কি করতে চাও?
শিক্ষা। ওকে পশ্চিমের রীতিনীতি শেখাব। মহিলাদের সম্মান করতে ভুল করবে না আর।
আমি রক্তপাত চাই না, আতঙ্কিত গলায় বলল শার্লি।
বেশ, রক্তপাত হবে না। আর কোন কথা না বলে রাইফেলটা মাটিতে ফেলে এগোল বেনন কেগলের দিকে। চোখ দুটো জ্বলছে ওর ক্ষুধার্ত শ্বাপদের মতো। পেছানোর কোন সুযোগ পেল না গানম্যান, ঝাঁপিয়ে পড়ল বেনন। আঘাত না করে দু’হাতে বেননকে ঠেলে দিয়ে গার্ড নিতে চাইল কেগল। শরীরে যথেষ্ট শক্তি ধরে সে। হাতাহাতি লড়াইয়ের কৌশলও কিছু জানে। আত্মবিশ্বাস আছে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু আজকে প্রচলিত কোন নিয়মে লড়াই করার ইচ্ছে বা রুচি নেই বেননের। খপ করে দু’হাতে কেগলের গার্ড নেয়া দু’কজি আঁকড়ে ধরল বেনন। শক্তিশালী কাঁধের পেশি ফুলে উঠল। ওর তালুর ঘষায় পড়পড় করে লোম ছিড়ছে কেগলের। হাত পিছলে যাচ্ছে বেননের। চাপ আরও বাড়াল। মোচড় দিল গায়ের জোরে। মটমট করে উঠল গানম্যানের কনুইয়ের হাড়। ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল। ছাড়া পাবার চেষ্টা করল। সরার জন্যে ঝটকা মারল। একচুল নড়তে পারল না। হাতের চাপ না কমিয়ে হাঁটু দিয়ে তলপেটে গুতো মারল বেনন। কুঁজো হয়ে গেল কেগল। ফুপিয়ে শ্বাস নিল। আবার তো দিল বেনন। এবার গোপনাঙ্গে।
গোঙাতে শুরু করল কেগল। ছটফট করছে। চোখ উল্টে গেল। জ্ঞান হারাবে যেকোন সময়। হাত ছেড়ে দিল বেনন। মাটিতে পড়ে গেল কেগল। দু’হাতে নিম্নাঙ্গ ধরে গোঙাচ্ছে। বুটের ডগা দিয়ে এবার গায়ের জোরে কেগলের বুকে লাথি মারল ও। ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল গানম্যান। ভুশ করে বেরিয়ে গেল দম। তড়পাচ্ছে মাটিতে শুয়ে। ছাড়া পেল না। মনের সাধ মিটিয়ে পাজরে কয়েকটা লাথি মারল বেনন। চোখে আতঙ্ক নিয়ে ব্যাপারটা দেখছে শার্লি।
কোল জ্ঞান হারানোর পর থামল রক। হাঁপাতে হাঁপাতে শার্লিকে বলল, তুমি কি একা শহরে ফিরতে পারবে, ম্যাম?
পারব, দ্রুত জবাব দিল শার্লি। কেগলের চেয়ে ওর কাছে রক বেননকে আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক আর ভয়ানক লাগছে।
ঠিক আছে, ম্যাম, রাইফেলটা তুলে নিতে নিতে কেগলকে একবার দেখে নিল বেনন। আমার মনে হয় না লোকটা আর কখনও জ্বালাবে তোমাকে।
বেঁচে আছে? জিজ্ঞেস করল শার্লি। অসুস্থ বোধ করছে ও।
কাঁধ ঝাঁকাল বেনন। থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। এটুকু বলতে পারি, স্বর্গে যাবে না ও।
অনেক দূর চলে আসার পর পেছনে তাকাল শার্লি। দেখল রাস্তার ধারে পাথরের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বেনন। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে ঠিকই, তবু। ভয় লেগে উঠল শার্লির। লোকটা ভয়ঙ্কর। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল যাতে কারও অমন অন্ধ ক্রোধ চাক্ষুষ করতে না হয় আর।
শার্লি বাঁক ঘুরে চোখের আড়ালে চলে যাওয়ায় হাঁটতে শুরু করল বেনন। পঞ্চাশ গজ দূরে রাস্তার পাশে একটা বড় বোন্ডারের পেছনে ওর ঘোড়াটা আছে। একটু পরই ট্রিপল বারের দিকে চলল। ওর মনে কোন কৌতূহল নেই। কোল মরে গিয়ে থাকলে পরে জানা যাবে।
০৬. ড্যানিয়েল রাশল্যান্ড
ড্যানিয়েল রাশল্যান্ড আর এব ক্রিসির শেষকৃত্যে অনেক লোক হলো। আন্ডারটেকার সবার চেয়ে বেশি গম্ভীর। একে বলে পেশা। যাজক বিড়বিড় করে বাইবেল থেকে শ্লোক আওড়াচ্ছে। শার্লির একপাশে দাঁড়িয়ে আছে লিউ ডিলন, অন্যপাশে ক্লিন্ট ডসন। শ্লোকে মনোযোগ দিতে পারছে না ক্লিন্ট, বারবার ওর চোখ চলে যাচ্ছে ডিলনের লোকদের দিকে। আজকে সবকয়জন গানম্যানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে ডিলন। তবে কোল আসেনি। একটু আগে শার্লিকে ডিলন বলছিল কেগল ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে। লোকটা কি জানে না আসল ঘটনা? বেননের কাছে শুনেছে ক্লিন্ট। ডিলনকে বলে দেবে? না, আগ বাড়িয়ে বলার কোন দরকার নেই। শার্লির ব্যাপার। শালিই ইচ্ছে হলে জানাবে ডিলনকে।
বার কিউয়ের গানম্যানরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ডিলন কি শহরেই ওর ওপর হামলা করবে? মনে হয় না। শার্লির সামনে গোলমাল করবে না লোকটা। ভাগ্যকে অভিশাপ দিল ক্লিন্ট। ব্যাঙ্কে ডাকাতি বড় অসময়ে হয়েছে। ডাকাতি না হলে ঋণ শোধ করে দিতে পারত ও। ভেবেছিল একবার ঋণমুক্ত হলেই শার্লিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। তা আর হলো না। আগামী কয়েক বছরে বিয়ে করার মতো সচ্ছলতা ওর হবে কিনা সন্দেহ। ততোদিন শার্লি বসে থাকবে না। ডিলন ওকে ঠিকই বিয়েতে রাজি করিয়ে ফেলবে। ক্ষমতাশালী বিত্তবান ডিলনকে বাদ দিয়ে ওর মতো একজন কপর্দকশূন্য যুবককে বিয়ে করবে কেন শার্লি?
অহেতুক রাগ নিয়ে ডিলনের সুদর্শন চেহারা দেখল ক্লিন্ট। শার্লির পাশে দুঃখিত মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। শার্লির সামনে লোকটা ওর সঙ্গে লাগতে যাবে না। প্রমাণ করতে চাইবে ওর মতো দু’পয়সা দামের মানুষের সঙ্গে ঝগড়া চলে না লিউ ডিলনের। সে বড় র্যাঞ্চার। মনস্থির করে ফেলল ক্লিন্ট। শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষ হওয়া মাত্র ট্রিপল বারে ফিরে যাবে। কোন মেয়ের কারণে নিরাপত্তা পেতে অভ্যস্ত নয় ও রুচিতে বাধছে ভাবতেই।
যাজকের শ্লোক পড়া শেষ হতে কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল শার্লি। চাপা কান্না নিয়ে দেখল কফিন, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে।
ক্লিস্ট আর ডিলন, দু’জনই মেয়েটাকে অনুসরণ করল। পরস্পারের মধ্যে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি বিনিময় হলো ওদের। বার কিউয়ের কাউবয়রা পেছন আর দু’পাশ থেকে চেপে এলো। ডসন এখন মুঠোর ভেতর, কিন্তু ঝামেলা শুরু করার অনুমতি পায়নি তারা।
ক্যাসিনো সেলুনের সামনে হিচরেইলে ঘোড়া বেঁধে রেখেছে বার কিউয়ের লোকরা। সেলুনের সামনেই থামল তারা। ক্লিন্ট আর ডিলন শার্লিকে এগিয়ে দিতে চলল বাড়ি পর্যন্ত। কয়েক পা এগিয়েই থেমে গেল ডিলন, কাঁধের ওপর দিয়ে একজন কাউবয়কে বলল, স্লিম, জারম্যানকে একটা খবর দাও। কাউবয়, নড করায় দ্রুত পায়ে ক্লিন্ট আর শার্লির পাশে চলে এলো সে।
বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ডিলন আর ক্লিন্টের দিকে আকুতি নিয়ে তাকাল শার্লি। অনুরোধের সুরে বলল, লিউ, ক্লিন্ট, দয়া করে তোমরা লড়াই শুরু কোরো না। ব্যাঙ্কের হিসেবপত্র দেখা শেষে ক্লিন্ট যে টাকা জমা রেখেছিল সেটা ফিরিয়ে দেয়া হবে। লিউয়ের দিকে ফিরল মেয়েটা। তোমার টাকা ফেরত পেয়ে যাবে।
চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করল ডিলন। বলল, অপেক্ষা করতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে মনে হয় না ক্লিন্টকে টাকা দিলে ওর উপকার হবে। ক্লিন্টের নিয়তি হাজতবাস।
হাজতবাস? কি কারণে? কড়া চোখে ডিলনকে দেখল ক্লিন্ট। মুখে হাত চাপা দিল শার্লি, চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল।
কারণটা তোমাকে জারম্যান বলে দেবে। আইনের প্রয়োগ ওর দায়িত্ব। ডিলনের চোখে বিদ্রূপ খেলা করছে। আমি হয়তো আমার প্রভাব খাটাব, যাতে ফাঁসিতে ঝুলতে না হয় তোমাকে।
কেন? কি করেছে ও? ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল শার্লি।
হঠাৎ করেই অন্তরে কৃতজ্ঞতা অনুভব করল ক্লিন্ট মেয়েটার আন্তরিকতা বুঝতে পেরে।
সময় হলে সবই জানবে, শার্লি, নিচু স্বরে বলল ডিলন। ঘুরে পা বাড়িয়ে বলল, তবে ডসন হয়তো আগেই বলবে তোমাকে।
কাউবয়দের কাছে ফিরে গেল সুদর্শন দীর্ঘ র্যাঞ্চার। ওখানে, জারম্যানও আছে। স্লিম এইমাত্র তাকে জেলখানা থেকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে।
কি ব্যাপার, ক্লিন্ট? বেসুরো গলায় জানতে চাইল শার্লি। দুশ্চিন্তায় কুঁচকে আছে।
নিশ্চিন্ত করতে শার্লির বাহুতে হাত রাখল ক্লিন্ট। হাসল এক চিলতে। শান্ত স্বরে বলল, চিন্তা কোরো না, শার্লি। ডিলন ভাবছে আমার বিরুদ্ধে রাসলিঙের একটা অভিযোগ দাঁড় করাতে পেরেছে। কিন্তু ওর কপাল মন্দ, কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। ডিলনের কাউবয়রা চলে যাবার পর সমস্ত চিহ্ন নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
বেশির ভাগ কথাই বুঝল না শার্লি। তবে ক্লিন্টের শান্ত ভঙ্গি দেখে একটু স্বস্তি পেল। গভীর দৃষ্টিতে ক্লিন্টের চোখে তাকাল। বারান্দায় উঠে অনুরোধের সুরে বলল, ডিলনের সঙ্গে লাগতে যেয়ো না, ক্লিন্ট, প্লীইইজ। ওরা সংখ্যায় অনেক।
মাথা দোলাল ক্লিন্ট। সমান সুযোগ না পেলে অস্ত্র বের করব না আমি। চোখের কোণে দেখল কাউবয়দের ছেড়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে জারম্যান। কোন একটা উদ্দেশ্য আছে, হাঁটার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে তা। শার্লির বাহু ছেড়ে দিল ক্লিন্ট। চোখের ইশারায় দরজা দেখাল। জারম্যান আসছে। কোন চিন্তা কোরো না। বন্দুকযুদ্ধ হবে না। তুমি ভেতরে যাও।
ক্লিন্টের চোখ থেকে চোখ ফেরাল না শার্লি, যুবক র্যাঞ্চারের পুরুষালী চেহারায় মায়ার ছাপ, ঠিকই অনুভব করল। তার চেয়েও গভীর একটা অনুভূতি হলো ওর। বুঝে গেল ক্লিন্টকে বাঁচাতে গিয়ে যদি লিউ ডিলনকে বিয়ে করতে হয় তাহলেও আপত্তি করবে না ও। ওকে লোকটা পণ্যের মতো ব্যবহার করবে, সাজিয়ে রাখতে চাইবে, দামী একটা আসবাবপত্রের মতো। তবু! ক্লিন্টের বাহুতে একবার চাপ দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল শার্লি। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকল, দেখতে চায় কি হয়।
ক্লিন্টের দু’গজ সামনে থেমেছে জারম্যান। ঐ কুঁচকে একবার যুবক র্যাঞ্চারকে দেখে নিয়ে বলল, ঘোড়া নিয়ে আমার সঙ্গে একটু যেতে হবে, ক্লিন্ট। এসো। ডিলনের ধারণা তুমি ওর গরু রাসলিং করছ।
কিছু না বলে তাকিয়ে থাকল ক্লিন্ট। ঢোক গিলল জারম্যান। আমি ওর কথায় নাচছি না। ওকে বলেছি আমরা সবাই যাব, দেখব গিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় কিনা। যদি আসলেই দোষী না হয়ে থাকো তাহলে চিন্তার কোন কারণ নেই। তোমার।
বোর্ডওয়াক থেকে নেমে পড়ল ক্লিন্ট। চলো, যাওয়া যাক।
কয়েক মিনিট পর শহর থেকে বেরিয়ে গেল বড়সড় দলটা। মুখে কিছু না বললেও জারম্যান আর ডিলন দু’পাশ থেকে প্রহরা দিচ্ছে ক্লিন্টকে।
ওই যে আসছে ওরা। দূরের ধুলোর দিকে আঙুল তুলল বেনন।
নির্দেশিত দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল ব্যাগলে। মাথা দোলাল। অনেকেই দেখি আসছে! ভাবো একবার ডিলনের মনটা কি খারাপ হবে যখন ও জানবে রাসলিঙের কোন প্রমাণ নেই! আসছিল ক্লিন্টকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা। করতে, ফিরে যাবে বোকা একটা গাধা হিসেবে।
আগের জায়গা থেকে সরে এলো ওরা দু’জন। বেনন একটা সিগার ধরাল, ব্যাগলে একটা সিগারেট। ক্রমেই কাছিয়ে আসছে ধুলো। তাতে অসুবিধা নেই। ড্রাই ওয়াশের উত্তর পাড়ের দুটো বোন্ডারের মাঝখানে আছে ওরা, নিজেরা দেখা না দিলে নিচে থেকে কেউ দেখে ফেলবে সেটা সম্ভব নয়। ওদের ঘোড়াগুলো পেছনে খানিকটা নিচুতে গ্রাউন্ডহিচ করা, পাথুরে জমিতে গজানো দুবলা ঘাস চিবাচ্ছে।
ওরা এদিকেই আসছে, বেনন। চিন্তিত দেখাল ব্যাগলেকে। ক্লিন্ট আর জারম্যান ওদের সঙ্গে থাকবে বলে মনে করো?
নিশ্চয়ই। ডিলন আজকে এত রাগা রাগবে যে নিজের মাথার চুল খামচে তুলে নিতে পারে।
কয়েক মিনিট পর বেননের কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। ড্রাই ওয়াশের সামনে থামল দলটা। জারম্যান আর ডিলনের মাঝখানে থামতে বাধ্য হলো ক্লিন্ট। নির্দিষ্ট কয়েকজন কাউবয়কে হঠাৎ খুব বিস্মিত দেখাল। তাদের দিকে একবার তাকিয়ে ড্রাই ওয়াশের দিকে চোখ ফেরাল ডিলন। প্রথমে তাকে উদগ্রীব বলে মনে হলো। কিন্তু মুহূর্ত পরেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল চেহারা। মুখটা লাল হতে শুরু করল। রাগে দাঁতে দাঁত চাপল। কুঁচকে গেল নাক। ক্লিন্টের মৃদু হাস্যরত চেহারা দেখে কান দিয়ে ভাপ বেরচ্ছে বলে মনে হলো তার। কোথায় রাসলিঙের চিহ্ন। কোথায় আগুনের দাগ আর ব্র্যান্ডিং আয়রন, ব্লক?
এটাই তো সেই জায়গা? হাতের তালুর উল্টোপিঠে ঘর্মাক্ত মুখ মুছল, জারম্যান।
হ্যাঁ, এটাই সে-জায়গা, হিসহিস করে বলল ডিলন। ওরা প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা যদি ড্রাই ওয়াশ ধরে সামনে এগোই তাহলে নিশ্চয়ই ক্লিন্টের চুরি করা গরুগুলোর দেখা পেয়ে যাব।
অবিশ্বাসের ছাপ পড়ল জারম্যানের চেহারায়। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তোমার কথা বিশ্বাস করে ক্লিন্টকে আমি গ্রেফতার করব না। নিজে যদি কোন প্রমাণ পাই তাহলে ওকে গ্রেফতার করতে দ্বিধাও করব না। সেক্ষেত্রে জুরিদের সামনে বিচার হবে ওর। তবে আগে প্রমাণ চাই আমার। প্রমাণ!
আরে, বুড়ো ছাগল, তুমি বরং ক্লিন্টকে নজরে রাখো, চোখ গরম করে বলল ডিলন, আমি এখনই গিয়ে প্রমাণ জোগাড় করে নিয়ে আসব।
এখান থেকে নড়বে না তুমি, ডিলন।
বেননের কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় পরিষ্কার নির্দেশের সুর। ওপরে তাকিয়ে পরিচিত দুই আগন্তুককে দেখতে পেল বার কিউয়ের কাউবয়রা, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোল্ডারের গায়ে। দু’জনের হাতে চারটে সিক্সগান।
ডিলনের হাত হোলস্টারের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে থাকল, কিন্তু মার্শালের দিকে তাকাল সে অগ্নিদৃষ্টিতে। ক্রোধে কাঁপা চড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, অপেক্ষা কিসের, জারম্যান? একটু আগেও তো আইনের বুলি কপচাচ্ছিলে, এখন সুযোগ এসেছে আইন প্রয়োগের। ওরা খুনি ডাকাত। ধরবে না ওদের?
গাল ফুলিয়ে মুখ দিয়ে সশব্দে শ্বাস ছাড়ল জারম্যান। বুঝতে পারছে ঠিক কতখানি দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে তার সঙ্গে এই এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী লোকটার। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই, কোলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আছে, বার কিউয়ে তার স্বার্থ ঠিকই সিদ্ধি হবে। মাথা নাড়ল জারম্যান।
তোমার কপাল ফাটা, ডিলন, বলল বেনন। আমি আর ব্যাগলে যে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করিনি জারম্যান সেটা এখন জানে। সে এটাও জানে যে আমরা খুন করিনি। তবে তোমাদের উদ্দেশ্য জারম্যান জানত না। এখন জানে। মিথ্যে অভিযোগে প্রতিবেশীর সর্বনাশ করতে চেয়েছিলে তুমি। মিথ্যে অভিযোগের মাধ্যমে কাউকে বিপদগ্রস্ত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তোমার জেল জরিমানা হয়ে যেতে পারে ক্লিন্ট মানহানির মামলা করলে।
দেখার মতো হলো ডির্লনের চেহারা। কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিতে পারল সে। তার কয়েকজন গানম্যান উসখুস করে উঠল, আসন্ন বিপদ মোকাবিলার জন্যে হাত ঝুলিয়ে দিল হোলস্টারের পাশে। ডিলন বুঝতে পারছে লড়াই একবার শুরু হয়ে গেলে জিত তারই হবে। কিন্তু ব্যক্তিগত ঝুঁকির ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে। সে হবে শক্রর প্রথম টার্গেট। তারই যদি মৃত্যু হয় তাহলে বার কিউ জিতল না হারল তাতে কি যায় আসবে আর? দেরি করা উচিত হচ্ছে না, গানম্যানদের কেউ একজন ধৈর্য হারিয়ে অস্ত্রে হাত দিয়ে বসলেই ঘটনা শুরু হয়ে যাবে।
গলা খাকারি দিয়ে জারম্যানের দিকে তাকাল ডিলন। প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে বলল, ওদের তাহলে আর খুঁজছ না তুমি, মার্শাল?
ধীরে ধীরে মাথা দোলাল জারম্যান।
কথাবার্তা যখন চলছে, আস্তে আস্তে সরে গেছে ক্লিন্ট। সবার অজান্তে কখন যেন সিক্সগানও বের করে ফেলেছে। সিক্সগানটা সে তাক করেছে ডিলনের পেটে। কথা যখন বলল, বলল জারম্যানের উদ্দেশে।
আমি যখন তোমার সঙ্গে শহর ছেড়ে রওনা হই, আমি জানতাম এখানে এসে কি দেখতে পাব। গতকাল ব্যাগলে দেখেছে বার কিউয়ের কাউবয়রা তাদের নিজেদের গরুর গায়ে আমার ব্র্যান্ড করেছে। গরুগুলোকে তারা আমার জমিতে ছেড়ে দেয়। এখানে একটা আগুন জ্বেলে রানিং আয়রন আর ব্লক ফেলে দিয়ে চলে যায়। ডিলন ভেবেছিল আমাকে এই সুযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে। কিন্তু ব্যাগলে ডিলনের পরিকল্পনা বরবাদ করে দিয়েছে। গরুগুলোকে ডিলনের রেঞ্জে খেদিয়ে দিয়েছে ও।
তীব্র আক্রোশ ভরা চোখে ব্যাগলের দিকে তাকাল লিউ ডিলন। জবাবে অকপট আনন্দের হাসি হাসল ব্যাগলে।
জানতে চাও কারা ব্র্যান্ড করছিল? ভ্রূ নাচাল ও। তোমার পেছনেই আছে সবকয়টা। ওই যে এক চোখ ট্যাড়া বদমাশটার পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘোড়ায় বসা হাড় হারামী চারজন-ট্যাড়া বদমাশ আর ওরা প্রত্যেকে ব্র্যান্ড করছিল।
ট্যাড়া কাউবয়ের চেহারা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বিপদের ভয়ে স্যাড়ল পমেলে গায়ের জোরে হাত চেপে রাখল সে। আশা করছে সে ড্র করবে না বুঝলে কেউ তাকে গুলি করবে না।
ব্যাগলে যাদের কথা বলল তাদের একবার দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না ডিলন। জারম্যানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল সে। গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ক্লিন্টের পক্ষ নিলে মার্শাল থাকতে হবে না এটা জেনেও যদি পক্ষ নাও, আমার কিছু বলার নেই। তবে একটা কথা শুনে রাখো, স্রেফ দুইদিন, হ্যাঁ, দুইদিন সময় দিচ্ছি ওকে। এরমধ্যেই ট্রিপল বার ছেড়ে দিতে হবে। যদি ক্লিন্ট না যায়। তাহলে রক্তপাত হবে। রক্তপাতের জন্যে ব্যক্তিগত ভাবে তোমাকে আমি দায়ী করব, জারম্যান। ট্রিপল বার আমার। দুইদিন শেষ হবার পর ওই জমিতে যদি কোন অনধিকার অনুপ্রবেশকারী দেখতে পাই, কথা বলার আগে গুলি করা হবে।
জারম্যান কিছু বলার আগেই বলে উঠল ব্যাগলে, দু’দিনের অপেক্ষা কিসের? এখনই নয় কেন?
শীতল হাসল ডিলন। এখন তোমরা সুবিধেজনক অবস্থানে আছ। অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই আমার।
ঠিক আছে, অস্ত্র চাল বেনন, গানবেল্ট খুলে নিজেদের পথে রওনা হয়ে যাও। অপেক্ষা করতে থাকো। দেখো কি হয়।
কি আর হবে, বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে খুন হয়ে যাবে তোমরা।
আগেও এধরনের হুমকি শুনেছি তোমার মুখ থেকে। হুমকি কার্যকর হতে দেখিনি। ফাঁকা বুলি না কপচে যা বলছি করো, নাহলে খুলি ফুটো করে দেব।
কড়া চোখে বেননের দিকে তাকিয়ে থাকল লিউ ডিলন। তার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে কাউবয় আর গানম্যানরা। সে নির্দেশ দিলেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যাবে। সবাই চোখে আগ্রহ নিয়ে দেখছে কি করে সে। তিক্ত চেহারায় নড় করল ডিলন, গানবেল্ট খুলতে শুরু করল। তার দেখাদেখি হাত চালাল অন্যরা,
দু’মিনিটের মাথায় সবাই গানবেল্ট আর অস্ত্র ফেলে দিল মাটিতে।
ভেবো না জিতে গেলে, বেননকে বলল ডিলন। এই মুহূর্ত থেকে আমার লোকদের ওপর নির্দেশ থাকল, দেখামাত্র গুলি করা হবে। দুইদিন আমরা নিজেদের রেঞ্জে থাকব, তারপর আসব ট্রিপল বার নিতে।
ক্লিন্ট রেগে উঠে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, হাতের ইশারায় তাকে থামাল বেনন। বলল, দুদিন যথেষ্ট সময়, ডিলন। আমার ধারণা তার আগেই আমরা বের করে ফেলব কে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছে। ক্লিন্টও তার টাকা ফেরত পাবে।
কথা বাড়াল না ডিলন, তাকে মুহূর্তের জন্যে একটু হতচকিত দেখাল। ড্রাই ওয়াশ থেকে বেরিয়ে বার কিউয়ের দিকে ঘোড়া ছোটাল সে। তার পিছু নিয়ে চলে গেল স্যাঙাতরা। একটু পরই ঘোড়ার খুরের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল।
ঘোড়া ধরে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলো বেনন আর ব্যাগলে।
ব্যাঙ্ক ডাকাতির রহস্য সমাধান করে ফেলবে দুদিনে বলছিলে, ডিলন চলে যাবার পর বলল জারম্যান। একথা বলার পেছনে নিশ্চয়ই জোরাল কোন কারণ আছে তোমার? মার্শালের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। প্রয়োজনীয় কোন তথ্য গোপন করছ না তো দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে?
করছি না, বলল চিন্তিত বেনন, তবে আমরা কিছু একটা জানি এই খবর ছড়ালে হয়তো বেরিয়ে আসবে কেউ আড়াল ছেড়ে।
বেননের কথা জারম্যানকে প্রভাবিত করল বলে মনে হলো না। ঘোড়া থেকে নেমে গানবেল্ট আর অস্ত্র সংগ্রহ করল সে। চোখে কৌতূহল নিয়ে লোকটার কর্মকাণ্ড দেখল ক্লিন্ট, বেনন আর ব্যাগলে। কাজ সেরে হাতের ভঁজে বেল্টগুলো নিয়ে ঘোড়ায় উঠল জারম্যান, স্যাডল ক্যান্টলে হাত রেখে কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে নিল। তারপর ক্লিন্টকে বলল, আর কিছু করার নেই তোমার। আমার যতটুকু সাধ্য ছিল করেছি, ওকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। পরিস্থিতি এখন খারাপ। মনে হয় ডিলনের কথা মতো চলে যাওয়াই তোমার জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ডিলন ট্রিপল বারে ঢুকে সবাইকে মেরে ফেললেও আইন ওর বিপক্ষে যাবে না। আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি জানতে চাও তো বলব দেখামাত্র গুলি করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে ওর।
কথা শেষে রওনা হয়ে গেল মার্শাল। বার কিউয়ের দিকে চলেছে সে।
পেছন থেকে ক্লিন্ট জিজ্ঞেস করল, তুমি বলছ ডিলনকে ঠেকানোর কোন চেষ্টা করবে না?
ঘাড় ফিরিয়ে মাথা দোলাল মার্শাল।
তাহলে তোমার উচিত কয়েকজন ডেপুটি নিয়োগ করা।
নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করল জারম্যান। তাই? তা কাদের ডেপুটি করব আমি?
আমাদের, বলল বেনন। আমাকে আর ব্যাগলেকে। ব্যাঙ্ক ডাকাতদের ধরতে গিয়ে ডিলনের লেজে যদি মোচড় মেরে বসি তাহলে আইনী সুবিধে পাব। রেঞ্জওয়ার ঠেকাতেও সুবিধে হবে।
তোমরা ক্লিটের লোক। চোখ সরু করে ওদের দেখল জারম্যান। তোমাদের ডেপুটি করলে সবাই ধরে নেবে আমিও পক্ষপাতদুষ্ট। পক্ষ যদি নিতেই হয় তাহলে আমি বরং ডিলনের পক্ষই নেব।
তাই তুমি নিতে, ধীর গলায় বলল ক্লিন্ট, বেনন আর ব্যাগলে না থাকলে। মার্শালকে তার শীতল দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল যুবক র্যাঞ্চার। ডিলনকে বলে দিয়ো, আমি থাকছি। যদি ট্রিপল বার দখল করতে হয় তাহলে অনেক গানপাউডার পোড়াতে হবে ওকে।
নিস্পৃহ হয়ে গেল জারম্যানের চেহারা। কাঁধ ঝাঁকাল। রওনা হতে গিয়েও তাকাল বেননের দিকে। ব্যাঙ্ক ডাকাত ধরতে গিয়ে ডিলনের লেজে মোচড় মারতে হবে বলেছিলে। কেন?
কারণ বার কিউয়ের এলাকায় ডাকাতির পরিকল্পনা করা হয়। ট্রেইলে একজায়গায় অনেক লোক উঠেছে দেখে কৌতূহল হয়েছিল। ব্যাক ট্র্যাক করি আমি। একটা ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে গেছে পথ। বার কিউ রেঞ্জে একটা উপত্যকায় তাদের চিহ্ন দেখেছি। একটা আগুন জ্বেলেছিল। পরে ওখান থেকে শহরের দিকে গেছে সবাই দল বেঁধে। ট্র্যাক দেখে মনে হয়েছে ব্যাঙ্কে লাশ পাবার। আগের দিনের ঘটনা।
এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না, ক্রু কুঁচকে বলল জারম্যান। ডিলনের বিরাট রেঞ্জ। ওর রেঞ্জ থেকে ডাকাতরা বের হয়েছে বলে ডিলনকে দায়ী করা যায় না।
চুপ করে থাকল বেনন। ধীরে ঘোড়া চালিয়ে ড্রাই ওয়াশ থেকে বেরিয়ে গেল জারম্যান।
লোকটা ভাববে, মার্শাল চলে যেতে বলল ক্লিন্ট। ওকে তোমরা চিন্তায় ফেলে দিয়েছ। ও জানে ডিলনের কাছে গেলে কপাল পুড়বে না, কিন্তু এখন আর ততটা নিশ্চিত নয় যে ডিলনের হাতে সবগুলো ভাল তাস আছে।
এখান থেকে সরে পড়া উচিত, বলল ব্যাগলে। ডিলনরা এখনও বেশিদুর যায়নি। মার্শাল অস্ত্র ফিরিয়ে দিলে আবার এখানে আসার ইচ্ছে জাগতে পারে ওদের।
ব্যাগলে কথাটা মিথ্যে বলেনি। বার কিউ রাইডাররা যেদিকে গেছে তার উল্টোদিকে ছুটল ওরা দেরি না করে।
কয়েক মাইল যাওয়ার পর ক্লিন্টকে বলল ব্যাগলে, আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম তাহলে ডিলনের কথা মেনে নিয়ে আপাতত ট্রিপল বার ছেড়ে দিতাম।
জবাবে কড়া চোখে ব্যাগলেকে দেখল ক্লিন্ট, কোন জবাব দিল না।
শহরে থাকলে ডিলনের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা যাবে। হামলার ভয় থাকবে না। ট্রিপল বারের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হবে না। সুবিধে মতো আবার দখল করে নেয়ার সুযোগ তো থাকছেই।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটল, তারপর মতামত চাওয়ার দৃষ্টিতে বেননের দিকে তাকাল ক্লিন্ট।
ব্যাগলে ঠিকই বলেছে, সায় দিল বেনন। তবে শহরে যাবে কি থাকবে সেটা নির্ভর করে তোমার ওপর। তুমি যদি সিদ্ধান্ত নাও ট্রিপল বারে থেকে হামলা মোকাবিলা করবে তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা থাকব।
দীর্ঘক্ষণ নীরবে এগিয়ে চলল ওরা। চিন্তা করে চলেছে ক্লিন্ট। বুঝতে পারছে এ দু’জনকে ট্রিপল বারে থাকতে অনুরোধ করা ওর উচিত হবে না। এরা ওর চেয়ে কম বোঝে না। তবে র্যাঞ্চটা ওদের নয়। ক্লিন্টের অনুভূতি ওরা বুঝবে না। ট্রিপল নার ছেড়ে চলে যাওয়াটা এক অর্থে পরাজয়ের মতো লাগবে ক্লিন্টের কাছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ক্লিন্ট, কথা বলার আগে বড় করে দম নিল, তারপর বলল, আগে ঝোঁপঝাড় থেকে গরু বের করে এনে ব্র্যান্ডিং করব। ওগুলোকে ব্র্যান্ডিং শেষে ছেড়ে দিয়ে তারপর যাওয়া যাবে শহরে। তোমরা কি বলে?
মাথা দোলাল বেনন আর ব্যাগলে। দু’জনকেই যুবক র্যাঞ্চারের সিদ্ধান্তে তৃপ্ত বলে মনে হলো।
ড্রাই ওয়াশ থেকে বেরিয়ে এলো লিউ ডিলন, রাগে কালো হয়ে আছে চেহারা। বেনন আর ব্যাগলের একটা ব্যবস্থা আর না করলেই নয়। লোকদুটো পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ওর প্রতিটি পরিকল্পনায় বাদ সাধছে। ওরা থাকলে শেষ পর্যন্ত হয়তো ট্রিপল বার হাতের মুঠোর বাইরে রয়ে যাবে।
একটু দূরে ডিলনের রাইডাররা, অপেক্ষা করছে, কিন্তু সেদিকে ডিলনের খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে একা একজন অশ্বারোহীর দিকে। বেশ দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে লোকটা। কাছে আসতে ভ্ৰ কুঁচকে গেল ডিলনের! চিনতে পেরেছে, শার্লি রাল্যান্ড। মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গেল ডিলনের। ক্লিন্টের ব্যাপারে উদ্বেগ! মেয়েটা উদ্বিগ্ন। সেজন্যেই এত তাড়াহুড়ো করে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে। ঘোড়া থামিয়ে নিজেকে সংযত করল ডিলন। চেহারা থেকে মুছে ফেলল একটু আগের ঈর্ষার ছাপ।
একেবারে কাছে এসে থামল শার্লি। শহর থেকে বেরোতে ভয় লাগছিল, মনে আসছিল কেগলের কথা, ডিলনের কথা, কিন্তু ক্লিন্টের কিছু হয়ে যাবে এই দুর্ভাবনা এতই পেয়ে বসে ওকে যে শেষ পর্যন্ত আসতে বাধ্য হয়েছে শার্লি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। কি হয়েছে, লিউ? জানতে চাইল উদ্গ্রীব হয়ে। ক্লিন্ট কোথায়?
হাতের ইশারায় ড্রাই ওয়াশ দেখাল ডিলন। কিছুই হয়নি। ওদিকের ড্রাই ওয়াশে দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছে ডসন।
স্বস্তিতে বুক ভরে উঠল শার্লির, চেহারায় তার ছাপ পড়ল। বিব্রত হয়ে বলল, আমি..আমি আর শহরে থাকতে পারছিলাম না। তোমরা আসলে এত রাগী আর জেদী! ভয় হচ্ছিল কি না কি হয়ে যায়।
ড্রাই ওয়াশের দিকে যেতে চেয়ে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়েছিল শার্লি। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, চট করে রাশ ধরে ঘোড়াটাকে থামিয়ে ফেলল ডিলন।
ডিলনের চোখে আগুন দেখে চমকে গেল শার্লি।
তোমার কাছ থেকে এই পরিমাণ মনোযোগ পাবার যোগ্যতা নেই ডসনের, থমথমে গলায় বলল ডিলন। ডসন এখন সাধারণ এক ভবঘুরে। তার দিকে এত ঝুঁকে পড়া তোমাকে মানায় না। ডসনের ভাল-মন্দের দায়িত্ব তোমার নিজের মনে। করে এভাবে তুমি ছোটাছুটি করে বেড়াবে, সেটা আমি চাই না। কি বলছি বুঝতে পারছ?
সুযোগ পেলেই ক্লিন্ট তার র্যাঞ্চ ধরে রাখতে পারবে, কিছুটা উত্তপ্ত গলায় বলল শার্লি। তখন ওকে আর ভবঘুরে হতে হবে না।
সুযোগ ক্লিন্ট পেতে পারে, ধীরে ধীরে গম্ভীর গলায় বলল ডিলন, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে, যেন দেখে নেবে অন্তরের গভীরে কি আছে। সুযোগ সে পাবে, যদি তুমি আমাকে বিয়ে করো। সময় চেয়েছিলে তুমি। সময় দিলাম। এক সপ্তাহ সময় পাচ্ছ। এরমধ্যে তোমাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
প্রত্যাখ্যান চলে এসেছিল জিভের ডগায়, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল শার্লি। নীরব বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল অন্তরটা। ডিলন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখ থেকে ঝরে পড়ছে লালসা। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে শার্লি বলল, আমার মনে হয় না বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার জন্যে এজায়গা উপযুক্ত। একটু থামল ও, তারপর কম্পিত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, আর হুমকির মুখে কাউকে বিয়ে করতে হলে তাকে ঘৃণা করা ছাড়া উপায় থাকবে না আমার।
কয়েকদিনের মধ্যেই তুমি ভুলে যাবে কেন আমাকে বিয়ে করেছিলে, গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল ডিলন। হাসল সন্তুষ্টির হাসি। ভাল লাগবে তোমার।
আমি তোমাকে এতটাই ব্যস্ত রাখব যে মাথা থেকে আর সব চিন্তা উবে যাবে।
ভদ্রভাবে নোংরা কথা বলছে ডিলন। গালে রক্ত জমল শার্লির। অপরাধবোধ জাগল শার্লির মনে। নিজেকে কলঙ্কিতা মনে হলো। এত অসহায় ও! নিজের ওপর ঘেন্না ধরে যাচ্ছে! ক্লিন্টকে ভালবাসে, অথচ বিয়ে করতে হবে সামনে দাড়ানো এই সুপুরুষ অমানুষকে। কান্না পেল শার্লির। কোনমতে চেপে রাখল চোখের জল।
ডসন টিকে থাকার সুযোগ পাবে কিনা সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে, আবার বলল ডিলন। এখন যদি ডসনের সঙ্গে দেখা করে ওর প্রতি সহানুভূতিশীল হও, এত দ্রুত ওকে আমি তাড়াব যে মন্ট্যানার এই অংশে কোথাও থামার সাহস পাবে না সে। শার্লির চোখের গভীরে দৃষ্টি রাখল র্যাঞ্চার। অবশ্য ডসন যদি বাঁচে তবেই থামার প্রশ্ন। সম্ভবত বাঁচবে না ও। কিন্তু তুমি যদি এখন শহরে ফিরে ওয়েডিঙের প্রস্তুতি নাও, ডসনকে কিছু বলব না। আমার ধারণা নিজের অক্ষমতা বুঝতে পেরে কিছুদিনের মাথায় নিজেই চলে যাবে ও এখান থেকে।
কথা বলার প্রতিটি মুহূর্ত চিন্তা করে চলেছে ডিলন, কিভাবে নিজের ওপর দায় না ফেলে ক্লিন্টকে সরিয়ে দেবে জগৎ থেকে। ট্রিপল বার দখল করা ঠিক কতটা প্রয়োজন তা শার্লি কখনও ভাবতেও পারবে না। শার্লিকে এখন যে-কথাই দেয়া হোক না কেন তার আসলে কোন মূল্য নেই। ক্লিন্টের প্রতি শার্লির আগ্রহের। মাত্রা দেখে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিত করতে হবে ট্রিপল বার দখল, সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে ক্লিন্টের অকাল মৃত্যু।
ঠোঁট কামড়ে রেখেছে শার্লি। মনের মাঝে চিন্তার ঝড় উঠছে ওর। হতাশ। লাগছে ভাবতেই যে ডিলন ওকে এক হপ্তার সময় বেঁধে দিয়েছে। এরমধ্যে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। এখন যদি ও ক্লিন্টের কাছে। যায়? কোন সুযোগ পাবে না ক্লিন্ট। ক্লিন্টকে স্রেফ পিষে মেরে ফেলবে ডিলন। কিন্তু এক হপ্তা কম সময় নয়। এরমধ্যে হয়তো এমন কিছু ঘটবে যে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। ক্লিন্টের দুই সঙ্গীর কথা মনে এলো ওর। ওরা কঠোর, যোগ্য, বিশ্বাসভাজন লোক। এক হপ্তা সময় পেলে ওদের সহযোগিতায় ক্লিন্ট হয়তো কিছু করতে পারবে। হয়তো ব্যাঙ্ক ডাকাত ধরা পড়বে, বা আরও কত কিছুই তো হতে পারে। স্যাডলে সোজা হয়ে বসল শার্লি, ডিলনের চোখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে মাথা দোলাল। ঠিক আছে, এখন শহরে ফিরে যাচ্ছি আমি।
ঠোঁট প্রসারিত হলো নিঃশব্দে। হাসল ডিলন। অনুভব করল রাগটা চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সুদর্শন চেহারা থেকে মেঘ কেটে গেল। শালির ঘোড়ার রাশ ছেড়ে দিল সে। নিজের ঘোড়াটা সরিয়ে নিল যাতে শার্লি মেয়ারটাকে ফিরিয়ে নিয়ে শহরের দিকে যেতে পারে। শান্ত গলায় বলল, এই তত বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছ, শার্লি। বেশিদিন লাগবে না, আমার সঙ্গে মানিয়ে চলা শিখে যাবে তুমি।
ওকে যেতে দিচ্ছে সেই স্বস্তিতে হাসল শার্লি। ডিলন ধরে নিল মেয়েটা সায় দিয়ে হাসছে।
শার্লি ঘোড়া ফিরিয়ে নিয়ে শহরে ফিরে চলল। পেছন থেকে তাকিয়ে আছে ডিলন। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। শার্লির যৌবন পরিপূর্ণ শরীর যতক্ষণ দেখা গেল দেখল ডিলন। মেয়েটা অনেক দূরে ধুলোর আড়ালে চলে যাবার পরও কিছুক্ষণ নড়ল না, ভাবল আরামদায়ক বিছানা আর আনন্দ বিলাসের কথা।
০৭. ব্যস, কাজ শেষ
ব্যস, কাজ শেষ, আর গরু নেই, বলল ক্লিন্ট। শার্টের হাতায় মুখের ঘাম মুছল। এত কম জানলে কষ্ট করে ঝোঁপঝাড় থেকে বের করতাম না।
সান্ত্বনা দিয়ে হাসল বেনন আর ব্যাগলে। ব্যাগলে বলল, ওগুলোর গায়ে এখন তোমার ব্র্যান্ড আছে।
ভ্রূ কুঞ্চন কমল না ক্লিন্টের। বলল, ওদের গায়ে আমার ব্র্যান্ড আছে ঠিকই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আগামীকাল নিজের বলে কোন জমিই থাকবে না আমার যে ওগুলোকে চরাব।
স্বাভাবিক কারণেই হতাশা বোধ করছে ক্লিন্ট। বেনন এবং ব্যাগলে ওকে মিথ্যে আশ্বাস দিল না। ক্লিন্টের সমস্ত গরু জড় করে ব্র্যান্ড করেছে ওরা। ব্র্যান্ড করা শেষে ছেড়ে দিয়ে এসেছে উত্তরের ঝোঁপঝাড় ভরা দুর্গম রেঞ্জে। আসার পথে আরও গোটা পঞ্চাশেক গরু ওরা ধরে এনেছিল, সেগুলোও সব ব্র্যান্ড করা শেষ হয়ে গেছে। সেজব্রাশের জঙ্গলে ওগুলোকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে।
ডায়ার, রিন্টি ডেনভার, কন লেভিস আর স্টেসি ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। তরুণ কাউবয়রা সিগারেট ধরাল, ডায়ার চিউয়িং টোবাকোর একটা টুকরো কামড় দিয়ে কেটে মুখে পুরল। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছে, ক্লিন্ট ডসন ওদের পরবর্তী নির্দেশ দেবে।
এবার আমরা শহরে চলে যাব, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ক্লিন্ট।
তরুণ কাউবয়দের চেহারায় আপত্তির ছাপ পড়লেও ডায়ারের চৌকো চেহারা বেশ নিশ্চিন্ত দেখাল। ডিলনের কাছ থেকে চুরি করে আনা ঋণপত্র গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাগলে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বেশ খানিকটা বিস্মিত বোধ করছে সে। কেউ এব্যাপারে কিছু বলছে না কেন? জিজ্ঞেস না করাটা ভাল লক্ষণ। তাছাড়া ব্যাগলে ঘুমিয়ে ছিল, কোন প্রমাণ নেই যে কুকীর্তিটা সে করেছে। কিন্তু কেউই কিছু বলবে না? যতবার ব্যাগলে ঢুলুঢুলু চোখে ওর চোখে তাকাচ্ছে। বা নিচু স্বরে বেননের সঙ্গে কথা বলছে, বুকের ভেতরে অস্বস্তির ছুরি খচখচ করছে ডায়ারের। স্থির করেছে বেনন আর ব্যাগলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। এখন ডসনের কথা শুনে মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এবার চলে যেতে কোন বাধা নেই। র্যাঞ্চই নেই তো সে থেকে কি করবে! এখন চলে গেলে কেউ কোন সন্দেহ করবে না। তবে কথাবার্তায় অতি উৎসাহ দেখানোটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তাহলে আমার বাড়তি ঘোড়াটা নিয়ে আসি, কিছুক্ষণ চিন্তার ভান করে বলল ডায়ার। রলিন্সের এক লোক ওটার জন্যে আমাকে ভাল টাকা দিতে চেয়েছিল।
বিরক্ত দৃষ্টিতে ডায়ারের দিকে তাকাল ক্লিন্ট। তারপর চোখ থেকে বিরক্তিটুকু মুছে গেল অতি দ্রুত। যেভাবে ডায়ার বলেছে তার বাড়তি কোন ঘোড়া দরকার নেই, রাগিয়ে দিয়েছিল ওকে। ঠিকই বলেছে লোকটা। ট্রিপল বারে তার আর কোন কাজ নেই। ডেনভার, লেভিস আর স্টেসির দিকে তাকাল ক্লিন্ট। শান্ত গলায় বলল, বাড়তি ঘোড়া শহরে নিয়ে যাব আমরা। মিস রাশল্যান্ডের করালে জায়গা আছে। আশা করি সেখানে ঘোড়া রাখতে দেবে সে আমাদের।
সিগারেট নিভিয়ে করালে গেল তরুণ তিন কাউবয়। তাদের পিছু নিল ডায়ার। বেনন আর ব্যাগলের দিকে ফিরল ক্লিন্ট। তোমরা আসছ?
এখনই নয়। শহরে দেখা হবে। দূরের টিলাগুলো দেখল বেনন। এদিকের অনেক জায়গা আছে আমরা একেবারেই চিনি না। শহরে যাবার আগে এই এলাকা একবার ভাল মতো দেখে যেতে চাই।
তাহলে শহরে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে করালের দিকে চলল ক্লিন্ট। হাত তুলে ওকে বিদায় জানাল বেনন আর ব্যাগলে, দেখল অবশিষ্ট ক্রুদের সঙ্গে আলাপ করছে ক্লিন্ট।
চলো তাহলে, বলল বেনন। তাকিয়ে আছে টিলাসারির দিকে।
চলো। সায় দিল ব্যাগলে।
দু’জন পাশাপাশি ঘোড়া ছোটাল ওরা। একটা ঢাল পার হতেই ট্রিপল বারের। বাড়িগুলো অদৃশ্য হলো। সামনে ঢেউ খেলানো ঘাসজমি। এখানে ওখানে। ঝোঁপঝাড়। টিলার যত কাছে যাওয়া যাবে, ঘাসের পরিমাণ কমে যাবে, বাড়তে থাকবে ঝোঁপ আর বুনো আগাছা।
ট্রিপল বারের সীমানায় যে টিলাগুলো মাথা তুলেছে সেগুলোর একটার সঙ্গে অন্যটার চেহারায় কোন মিল নেই। কিছু আছে ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে, দেখে। মনে হয় ঘাসজমির তলায়, কেউ একজন আঙুল দিয়ে খোঁচা দিয়েছিল। ওই। টিলাগুলোর মাথা সবুজ ঘাসে ছাওয়া। আবার কিছু আছে একেবারেই উলঙ্গ। গায়ে কিছু নেই। কালো পাথর মুখ ভেঙচি কাটছে। এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ, প্রাণহীন। ওগুলোর চুড়ে কুকুরের দাঁতের মতো চোখা। একেকটা টিলার ওরকম দশ বারোটা করে চুড়ো আছে। মন্ট্যানার এই অংশ পাহাড়-পর্বত, র্যাভিন, গোপন উপত্যকা, গুহা, আর ঝোপে ভরা দুর্গম এলাকা। ট্রিপল বারের রেঞ্জ ভাল মতো চিনতে হলে বেনন আর ব্যাগলের অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। হাতে অত সময় নেই। মোটামুটি ভাবে এলাকার একটা ধারণা পেতে চাইছে ওরা। চোখ কান খোলা রেখেছে, এগিয়ে চলেছে ট্রিপল বার রেঞ্জের ভেতর দিয়ে বার কিউয়ের দিকে।
গোল একটা টিলার কাঁধে উঠে নিচের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছে ওরা। বেশ কিছুক্ষণ পর বাঁক নেয়ার সময় ঘোড়া থামিয়ে ফেলল বেনন। আঙুল তাক করে নিচের দিকে দেখাল। একটা লোক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। তার পেছনে একটা আরোহীবিহীন ঘোড়া।
ওই যে ডায়ার, বলল ব্যাগলে। রিলিঙ্গে যাবে বলেছিল। সে-তুলনায় অনেক সরে এসেছে দেখছি!
হাসল বেনন। ও জানে ও কোথায় যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আমরা জানি না।…এখন জানব।
প্যাঁচ আছে ডায়ারের মধ্যে, মন্তব্য করল ব্যাগলে। ক্লিন্টের তুলনায় অনেক ভাল করে জানে লোকটা, এখানে আসলে কি হচ্ছে।
চুপ হয়ে গেল ওরা। নীরবে অনুসরণ করতে শুরু করল প্রাক্তন ফোরম্যানকে। মাইল খানেক পথ টিলার কাঁধে কাঁধে চলতে পারল ওরা, তারপর সামনে পড়ল টিলার খাড়া দেয়াল। বাধ্য হয়ে আরেক দিক দিয়ে পথ খুঁজে নামতে হলো। ডায়ারকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু পরিষ্কার ধারণা আছে ওদের, কোথায় থাকতে পারে লোকটা।
ডিলনের হেডকোয়ার্টার পাশ কাটাচ্ছে ডায়ার, মাইল দেড়েক পর বিড়বিড় করে বলল বেনন। র্যাঞ্চ হাউজে যদি যেতে চাইত তাহলে দক্ষিণ-পুবে বাঁক নিত।
মাঝে মাঝেই ডায়ারকে দেখতে পাচ্ছে ওরা, বসে আছে স্যাড়লে কুঁজো হয়ে। অনেকটা পেছন থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে। টিলার রাজা পেরিয়ে নদীটা যেখানে সমতল জমিতে বেরিয়ে এসেছে, সেখানে নদী পেরল ওরা। আরও এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, এখনও এগিয়ে চলেছে ডায়ার। টিলার গা ঘেঁষে যাচ্ছে কোথায় নোকটা!
কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের একটা ফাটলে ঢুকে পড়ল ডায়ার। খুবই সরু ফাটল। চওড়ায় সাত ফুট হবে না। পাশাপাশি দুটো ঘোড়া চলতে পারবে কোনমতে।
ঘোড়া থেকে নামল বেনন আর ব্যগিলে। স্যাডল রোল থেকে পুণে শার্ট বের করে ছিড়ল টুকরোগুলো ঘোড়ার খুরে বেঁধে দিল যাতে আওয়াজ কম হয়। তারপর ঢুকলা পাহাড়ী ফাটলে। এগিয়ে চলল সাবধানে এতক্ষণ আলোর মাঝে ছিল, এখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো। ফাটলের সামনে থেকে সামান্য আলো আসছিল, বাক মুরতে সে-আলোও আর থাকল না। ওপরের একচিলতে আকাশ। থেকে আবছা একটু আলো আসছে। ওটুকুই ভরসা।
ফাটলের বাইরে যত্ন করে সমস্ত চিহ্ন মুছে রাখা হয়েছিল। ভেতরে ঢোকার পর আবছা আলোতেও প্রচুর গরুর চিহ্ন দেখা গেল। পাহাড়ী কাট-এর ভেতরে গোবরের গন্ধ বেশ জোরাল। মেঝেতে ঘোড়ার খুরের চিহ্ন যত্রতত্র। নিয়মিত এজায়গা রাসলিঙের কাজে ব্যবহার করা হয়। চোখ-কান খোলা রেখে অতি ধীরে সামনে বাড়ছে ওরা। অস্ত্রের বাঁট ছুঁয়ে আছে দু’জনেরই হাত। বিপদের একটু আলামত দেখলেই গুলি করবে।
পুরো এক ঘণ্টা হলো ভুতুড়ে এই কাট-এর মধ্যে দিয়ে চলছে ওরা। শেষ মাথায় কি আছে কে জানে। দু’পাশ থেকে মাঝে মাঝে চেপে আসছে দেয়াল। কখনও কখনও মাথার ওপরের সরু আঁকাবাঁকা আলোটাও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। একসময় শেষ হলো পথ চলা। সামনে পাথুরে নির্জীব খাড়া দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই দেয়ালের পায়ের কাছে পড়ে আছে বড় বড় কয়েকটা বোল্ডার। ওগুলোর যেকোনটার পেছনে অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পাররে দু’জন অশ্বারোহী। সাবধানে এগোল ওরা। কেউ ওদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে নেই। স্যাডল থেকে নামল বেনন আর ব্যাগলে, ঘোড়া দুটো একটা বোল্ডারের পেছনে লুকিয়ে রেখে গভীর মনোযোগে দেখল আকাশ ছোঁয়া পাথুরে দেয়াল।
কিছুক্ষণ পর শ্রাগ করে দেয়ালের দিক থেকে ফিরল বেনন, নিজের পদক্ষেপের চিহ্ন দেখতে দেখতে এগোল সামনে। পাথুরে মেঝেতে পুরু ধুলো। তাতে নানারকমের চিহ্ন। মেঝের দিকে চোখ থাকায় এবার অনায়াসে পেয়ে গেল ও যা খুঁজছিল। গরু আর রাসলাররা বাতাসে মিলিয়ে যায়নি। একটা জায়গা আঙুল তুলে দেখাল বেনন। পাশে দাড়িয়ে গলা বাড়িয়ে সেদিকে তাকাল ব্যাগলে।
খানিক দূরে একজায়গায় হঠাৎ করেই প্রশস্ত হয়ে গেছে পাহাড়ী খাদ। ওখানে, ডানদিকের দেয়ালে একটা গুহা! যথেষ্ট চওড়া। একসঙ্গে চারটে করে গরু ঢুকতে পারবে। গুহার সামনে একটা বড় বোল্ডার এমন ভাবে আছে যে খাদ ধরে সামনে এগোনোর সময় গুহাটা দেখা যায় না। অন্ধকারে কালো দেয়ালের সঙ্গে প্রায় মিশে আছে গুহার ঘোর কালো মুখ।
ঘোড়া যেখানে আছে সেখানেই থাক, ফিসফিস করে বলল বেনন। ভেতরে কি আছে কে জানে!
কোমাঞ্চিদের মতো নিঃশব্দ সতর্কতায় গুহায় ঢুকল ওরা। একশো গজ সামনে হঠাৎ করেই ডানদিকে বাঁক নিয়েছে সুড়ঙ্গ, সেখান থেকে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেছে সুড়ঙ্গের মেঝে। আধ মাইল হাঁটার পর আবার বামদিকে ঘুরল সুড়ঙ্গ। দূর থেকে একটা গরুর ডাক শুনতে পেল ওরা। ব্যাগলেকে থামতে ইশারা করল বেনন, নিজে সাবধানে সামনে বাড়ল। মিনিট দশেক পর ফিরে এলো, ব্যাগলেকে সঙ্গে আসতে বলল।
এখনও উঁচুতেই উঠছে গুহার মেঝে। একটু পরেই নামতে শুরু করল। মাথার ওপর এখন আর পাহাড় নেই। আবার দেখা যাচ্ছে ওপরের একচিলতে নীল আকাশ। আস্তে আস্তে আলোকিত হয়ে উঠছে ফাটলের ভেতরটা। একটা বাঁক ঘুরতেই ফাটল থেকে বেরোনোর পথ দেখা গেল, চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে সূর্যের আলো।
বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। এদিক ওদিক পড়ে আছে কয়েকটা প্রকাণ্ড বোল্ডার। কিছুটা নিচে, সামনে একটা উপত্যকা। ঢালু হয়ে উপত্যকায় মিশে গেছে পাহাড়ের গা। জমিতে তাজা সবুজ ঘাস। চরছে অসংখ্য গরু। এক হাজারের কম হবে না। সবগুলোই মোটাতাজা। পুরো উপত্যকা দেখতে পাচ্ছে না বেনন আর ব্যাগলে। আরও কত গুরু আছে কে জানে। বড় একটা র্যাঞ্চ গড়া যাবে শুধু যেগুলো দেখতে পাচেছ সেগুলো দিয়েই।
ওগুলো একই ব্র্যান্ডের গরু নয়, বেনন, ফিসফিস করে বলল ব্যাগলে।
মাথা দোলাল চিন্তিত বেনন। ট্রিপল বার, বার কিউ আর লেজি জে-এর ব্র্যান্ড দেখতে পাচ্ছি। আরও কোন্ ব্র্যান্ডের আছে কে জানে!
ধরে নিতে হয় কোন অন্ধ লোক নিজের গরুর সঙ্গে অন্যের গরু মিশিয়ে ফেলেছে! বিড়বিড় করল ব্যাগলে।
ওই দেখো! আঙুল তুলল বেনন। যেখানে আঙুল তাক করেছে সেখানে একটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেছে উপত্যকা। ওখানে দু’জন অশ্বারোহী। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আসছে লোক দুটো।
কেগল আর ডায়ার। ভ্রূ কুঁচকে গেল ব্যাগলের। ভাল ফন্দি করেছে। দুই শত্রু-র্যাঞ্চের দুই ফোরম্যান একজোট হয়ে মিলেমিশে চুরি শুরু করবে এটা কেউ ভাবতে পারবে না।
এখানে আসতে বড়জোর দশ মিনিট লাগবে ওদের, বলল কেনন। বড় কোন বোল্ডারের পেছনে লুকিয়ে পড়লে দেখতে পাবে না, পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।
ঘোড়াগুলো যদি বেশি ভীতু না হয়, যোগ করল ব্যাগলে। ওগুলো আমাদের উপস্থিতি জানান দিলে গানফাইট ছাড়া উপায় থাকবে না।
বোল্ডারগুলোর একেবারে পাশ দিয়েই পথ। তবে ধরা পড়ার ভয় খুব কম। সূর্যালোকিত উপত্যকা থেকে প্রায়-অন্ধকার গিরিপথে আসছে কেগল আর ডায়ার। বেননের ইশারায় বড় একটা বোল্ডারের পেছনে চলে এলো ব্যাগলে। বিপদ আশা করছে না ওরা, তবে অস্ত্র বের করে রেখেছে হাতে।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেগলের কথা কানে এলো। তোষামোদ সব সময় কাজে আসে। ডিলন ভাবছে সে এই এলাকার অঘোষিত রাজা। দম্ভে সারাক্ষণ এতই ফুলে আছে যে গড়বড় আছে টেরও পাচ্ছে না। ঝামেলা করে ফেলেছিলাম শালার প্রেমিকার গায়ে হাত তুলে। ভেবেছিলাম হারামজাদী ডিলনকে বলে দেবে। তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম, ডিলন কিছু বললেই চাকরি ছে দিতাম। দরকার হলে। ডিলনকে খুন করতাম। কিন্তু বেটি কিছু বলেনি।
ডিলনকে মেয়েটা ঘৃণা করে। যেকোন মেয়ে করবে ওরকম জোর খাটাতে গেলে। ডিলন সবকিছুতে এতই নিশ্চিত যে আর কারও মানসিকতা বোঝার, ক্ষমতা ওর নেই। শালা একটা গাধা! ডায়ারের প্রাণখোলা হাসি গিরিপথের দুদিকের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। এবারের ড্রাইভ শেষ হবার পর আর ফিরে আসার দরকার নেই, সোজা পুবে চলে যাওয়া যাবে, কি বলো? ওখানে আমরা…
দুই রাসলার দূরে চলে গেছে। পুবের কথা কি যেন বলল কেগল, শুনতে পেল না বেনন আর ব্যাগলে। লোক দু’জন অনেক দূরে চলে গেছে নিশ্চিত হয়ে বোল্ডারের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, হাঁটতে হাঁটতে একসময় ফিরে এলো প্রায়-অন্ধকার গিরিপথে রেখে যাওয়া ঘোড়র কাছে। নিরাপদেই আছে, ওদের ঘোড়া দুটো, ঝিমাচ্ছে।
ট্রিপল বারের পাঁচশোর বেশি গরু আছে ওই উপত্যকায়, একটা সিগার। ধরিয়ে বলল বেনন। অনেকদিন ধরেই গরু সরাচ্ছে কেগল আর ডায়ার। ক্লিন্ট যখন শেষ রাউন্ডআপ করে তার আগেই গরু এনে রেখেছে এখানে, তা নাহলে ক্লিন্ট টের পেয়ে যেত কত গরু আছে ওর।
আমারও তাই ধারণা। সিগারেটে কষে টান দিয়ে স্যাড়লে উঠল ব্যাগলে, বেননের পেছনে পেছনে ঘোড়া সামনে বাড়িয়ে বলল, তারমানে কেগল আর ভায়ার এখান থেকে চলে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির না করা পর্যন্ত হাতে সময় পাচ্ছি আমরা। কোন তাড়াহুড়ো নেই। গরুগুলোকে জড় করে এখনই ক্লিন্টের রেঞ্জে না ছাড়লেও চলে।
এখন বুঝতে পারছি ঋণের কাগজ নিয়ে ডিলন কেন বাড়াবাড়ি করেনি, বলল বেনন। এটা যখন চুরি যায়, আমি ভেবেছিলাম আমার গালাগালগুলো। ডায়ার ডিলনকে দিয়েছে। কিন্তু আসলে ওটা এখন আছে কেগলের পকেটে। পড়েছে কিনা খোদা জানেন। পড়লে ডায়ারকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে চাইবে।
আবছা অন্ধকার গিরিপথ থেকে এক সময় শেষ বিকেলের সূর্যালোকিত পাহাড়ী এলাকায় বেরিয়ে এলো দুই বন্ধু। দুজনই চিন্তিত। দুজনই ওরা একই। সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। হাতে অনেকগুলো ভাল তাস নিয়ে খেলছে কেগল। ক্লিট বা ডিলন, যে-ই জিতুক, আখেরে লাভ কিছু কম হবে না কেগলের। ঋণের প্রমাণ নেই, তবু যদি ডিলন উপলবার দখল করে, আইনের চোখে সেটা বৈধ হবে না। এই এলাকা থেকে আইন খুব দূরে নেই। রলিন্সে শেরিফ আছে, জাজ আছে। তারা যদি হস্তক্ষেপ করে, বিপদে পড়ে যাবে ডিলন। কিন্তু কোলের কিছু হবে না।
সে বলবে সাধারণ এক কর্মচারী সে। মালিকের নির্দেশে অন্ধবিশ্বাসে কাজ করে। গেছে, ভেবেছে মালিক আইনসিদ্ধ ভাবেই ট্রিপল বার দখল করেছে।
বিকেলে টুইন স্প্রিংস শহরে ঢুকল ক্লিন্ট, লেভিস, ডেনভার আর স্টেসি। শহরের প্রান্তে রাশল্যান্ডের বিরাট করাল। ওখানে নিজের পছন্দের ঘোড়াগুলোকে রাখত ব্যাঙ্কার। ট্রিপল বার থেকে নিয়ে আসা গোটা দশেক ঘোড়া রাখতে সেখানে থামল কাউবয়, তিনজন। ক্লিন্ট গেল শার্লির সঙ্গে দেখা করতে। বাড়িতে নেই মেয়েটা, কাজেই সেখানে হয়ে সদর রাস্তা ধরে ব্যাঙ্কের দিকে চলল সে।
হিচরেইলে ঘোড়া বেঁধে বোর্ডওয়াকে উঠল ও, ব্যাঙ্কের দরজা ঠেলে ঢুকল ভেতরে। একটা ডেস্কের পেছনে বসে আছে শার্লি, কাঁধের ওপর স্থূপ হয়ে আছে সোনালী একরাশ চুল। কাউন্টার পার হয়ে শার্লির পাশে চলে এলো ক্লিন্ট। এতক্ষণ একটা লেজারে গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছিল শালি, সদর দরজা। খোলার আওয়াজে মুখ তোলেনি। আগন্তুক কাছে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেয়ে চোখ তুলে তাকাল। অভ্যর্থনার হাসিটা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হলো, মুহূর্ত পরেই শার্লির চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়ল। কি-কি চাও, ক্লিন্ট? দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইল মেয়েটা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
নিজেকে হঠাৎ করেই অনাকাক্ষিত মনে হলো ক্লিন্টের। অজান্তেই এক পা এগিয়ে গিয়েছিল ও, শার্লিকে পিছাতে দেখে অপমানিত বোধ করল। বিচলিত চোখে তাকিয়ে আছে শার্লি, হাত দুটো বুকে ভাজ করে রেখেছে।
র্যাঞ্চ থেকে ঘোড়াগুলো নিয়ে শহরে চলে এসেছি, আড়ষ্ট গলায় বলল ক্লিন্ট। ভাবলাম তুমি হয়তো তোমার করালে ওগুলো রাখতে দেবে।
মাথা দোলাল শার্লি। তাকাচ্ছে না, চোখ মেঝের দিকে। একবার মুহূর্তের জন্যে চোখ তুলেও দৃষ্টি, সরিয়ে নিল। অবশ্যই, ক্লিন্ট। যতদিন ইচ্ছে করাল ব্যবহার করতে পারো।…তুমি কি শহরেই থাকবে এখন থেকে? শেষ কথাটায় মেয়েটার স্বরে স্বস্তির সুর ক্লিন্টের কানে বাজল। আনন্দশূন্য হয়ে গেল অন্তরটা। ট্রিপল বার ছেড়ে আসায় ডিলনের সঙ্গে সংঘাত হবে না, এটাই কি শার্লির স্বস্তির। কারণ? ডিলন সুপুরুষ, সুঠামদেহী, বিত্তশালী, ক্ষমতাবান। আর ও? বলতে গেলে পথের ফকির।
আপাতত শহরেই থাকব, বলল ও নীরস গলায়। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে।
আমিও তাই চাই। কোন রক্তপাত ছাড়াই ঝামেলা মিটে যাক।
মেয়েটার চেহারায় উদ্বেগ আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফিরে এসেছে আবার। বুকের খাঁচায় ধড়াস ধড়াস করে বাড়ি খেতে শুরু করল হৃৎপিণ্ডটা, গলা শুকিয়ে এলো, নিজেকে মনে হলো করুণার পাত্র, তিক্ত হয়ে গেল ক্লিন্টের মনটা। শার্লি চাইছে ক্লিন্ট এখন। চলে যাক। অথচ কত কথা ওর বলার আছে শার্লিকে! কত কথা ও শুনতে চায় প্রাণভরে। কিন্তু মেয়েটা আচরণ দিয়ে এমন একটা অদৃশ্য দুর্লজ্জ দেয়াল তুলে দিয়েছে যে ডিঙানো যায় না চাইলেও।
আঙুলের ডগায় বার কয়েক সমব্রেরো হ্যাট হোরাল ক্লিন্ট, অস্বস্তি কাটাতে চাইল। তারপর অনিশ্চিত ভঙ্গিতে পা বাড়াল দরজার দিকে। দু’পা গিয়ে থেমে বলল, করালে ঘোড়া রাখতে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, শার্লি। স্টেবলে রাখতে হলে যে খরচ হতো তাতে পোষাতে পারতাম না। আমার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়।
ক্লিন্ট, আশা করেছিল শার্লি কিছু বলবে। মেয়েটা যখন কিছু বলল না, এক বুক হতাশা নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল ও। কাউন্টার পার হয়ে এসেছে, এমন সময়ে পেছন থেকে ডাক দিল শার্লি।
ক্লিন্ট!
ঘুরে দাঁড়াল যুবক র্যাঞ্চার। শিরায় শিরায় বেড়ে গেছে রক্তের গতি। কয়েক পা এগিয়ে এসেছে শার্লি। এক হাত সামনে বাড়ানো। ক্লিন্টকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে থেমে গেল। কি যেন বলার আছে, কিন্তু দ্বিধার ছাপ পড়ল চেহারায়, কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মনস্থির করল, বলবে না। হাত নামিয়ে নিল।
শার্লির কিছু বলার নেই বুঝতে পেরে ব্যাঙ্ক থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো ক্লিন্ট। ঠোঁট দুটো শক্ত ভাবে বসে আছে পরস্পারের ওপর। চিনচিনে একটা ব্যথা বুকের ভেতর। কেমন করে যেন দূরে চলে গেছে শার্লি। প্রতিনিয়ত আরও দূরে চলে যাচ্ছে। যাবে। যাওয়াই নিয়তি।
রাশল্যান্ডের করালে চলে এলো ক্লিন্ট, দেখল ঘোড়াগুলোকে একটা একটা করে ছাড়ছে ডেনভার, স্টেসি আর লেভিস। ওদের কাজ শেষ হলে একসঙ্গে লিভারি স্টেবলে এলো চারজন, ব্যক্তিগত ঘোড়া ওখানে রেখে হেঁটে বেরোল স্টেবল থেকে, ঠিক করেছে সেথ হারবেনের গিমক্র্যাক হোটেলে গোসল আর খাওয়া সেরে শহরের পরিবেশ বুঝতে বেরবে।
হোটেলের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেথ হারবেনন, স্টেজকোচটাকে রলিন্সের উদ্দেশে ছাড়তে দেখছে। ক্লিন্টকে দেখে জ নাচাল।
সেমিনো পীকে সোনা পাবার ব্যাপারটা কি? জানতে চাইল ক্লিন্ট। একটু বলো তো শুনি! তুমি পেলে কিছু?
হারবেনের মাথায় পাতলা চুল, কোনমতে টাক ঢেকেছে। লজ্জিত চেহারায় চুলে হাত বোলাল সেথ হারবেনন। কি আর বলব, সবার মতোই লোভে পড়ে ঠক খেয়েছি। সেজন্যে দুঃখ নেই, দুঃখ এজন্যে যে শয়তান মাইনারের কথায় শহরটা আমরা খালি করে চলে গেলাম বলেই বুড়ো রাল্যান্ড আর ক্রিসি বেচারা বেঘোরে মরল। আসলে আমার মতো মানুষের লোভের কারণেই ওদের মৃত্যু হলো।
নিজেকে খামোকা দোষ দিচ্ছ, সেথ, সান্তনা দিল ক্লিন্ট। সোনা এমনই জিনিস যে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি ঘোলা করে দেয়।
রুব বাতাসে তার চাবুকের শিস তুলল। ঘোড়াগুলো ধুলোর ঝড় তুলে ছুটতে শুরু করল, ক্যাঁচকোচ শব্দ করে দুলতে দুলতে চলল স্টেজকোচ রলিন্সের উদ্দেশে। ধুলো থিতিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ক্লিন্ট, তারপর মত বদলে সেথের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বোর্ডওয়াক ধরে এগোল। ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসও পেছন পেছন চলেছে। গল্প করছে ওরা। অনেকদিন পর শহরে এসেছে, আলাপ করছে সময়টা কিভাবে উপভোগ করা যায়।
ক্যাসিনো সেলুনের সামনে বোর্ডওয়াকে থামল ওরা, দক্ষিণ দিক থেকে আসতে দেখল ছয়জন অশ্বারোহীকে। তাদের মাঝে লিউ ডিলনকে চিনতে কষ্ট হয় না, বসে আছে বিরাট একটা বে গেল্ডিঙে { বাছা বাছা কয়েকজন গানম্যান আছে ডিলনের দলে। লোকগুলো সামনে চলে আসায় আড়ষ্ট হয়ে গেল ক্লিন্ট। পরিবেশটা হঠাৎ করেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, টের পেল তরুণ কাউবয়রা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। হাত চলে গেল হোলস্টারের পাশে। ঠিক ওদের সামনে থামল ডিলনের দলটা। ট্রিপল বারের কাউবয়রা সংখ্যায় কম, তবে ক্লিন্ট জানে, প্রয়োজনে লড়তে ভয় পাবে না ওর ছেলেরা।
ডিলনের লোকরা একটু ছড়িয়ে অবস্থান নিল। গোলমাল করার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে জ্বলজ্বল করছে ওদের চোখ। দৃষ্টিতে আশা, ক্লিন্ট ত্যাড়ামি করলে ঝামেলা পাকিয়ে বসবে। সংখ্যাধিক্য ওদের মনে বাড়তি সাহস যোগাচ্ছে।
ডিলন তাকিয়ে আছে ক্লিন্টের চোখে, দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট টিটকারি। কাউবয়দের সহ ক্লিন্টকে শহরে দেখেই বুঝে নিয়েছে সে যা বোঝার। হার মেনে নিয়েছে। ক্লিন্ট। কিন্তু মনে পরিপূর্ণ শান্তি পাচ্ছে না ডিলন। ক্লিন্ট যদি লড়াই করে হেরে যেত তাহলে অনেক বেশি মানসিক তৃপ্তি পেত সে, কিন্তু ক্লিন্টের আচরণে কোন উগ্রতা নেই। টিটকারির হাসিতে ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল ডিলনের, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শার্লিকে সে কথা দিয়েছে ক্লিন্টের সঙ্গে গোলমালে জড়াবে না, কাজেই বলছে না কিছু। কিন্তু মনে মনে আশা করছে কথা না বলেও ক্লিন্টকে উসকে দিতে পারবে।
অফিস থেকে বের হয়ে বোর্ডওয়াকে দাঁড়িয়ে আছে জারম্যান, তাকে পাত্তা দিল না ডিলন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্লিন্ট। ধীরে ধীরে রক্ত চড়ে যাচ্ছে মাথায়। ডিলনের ইচ্ছে পূরণ হতো, কিন্তু এই সময় খুলে গেল ব্যাঙ্কের দরজা। বাইরে পা দিয়েই পরিস্থিতি আঁচ করে ফেলল শার্লি রাশল্যান্ড। ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল ক্লিন্টের দিকে চেয়ে। ক্লিন্ট যে চরম কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটা ওর চেহারাতেই পরিষ্কার। রাস্তার দু’ধারের বোর্ডওয়াকে থেমে দাঁড়িয়েছে পথচারীরা। সবার চোখ মুখোমুখি দু’পক্ষের ওপর। বাতাসে টানটান উত্তেজনা। থমথমে পরিস্থিতি। যেকোন সময় রক্ত ঝরবে। লোভী শকুন যেমন মৃত্যুপথযাত্রীর দেহত্যাগের জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, ঠিক তেমনি করে লড়াই শুরু হবার প্রতীক্ষায় আছে টুইন স্প্রিংসের মানুষ।
লিউ! লিউ!
আর্তকণ্ঠে ডাকল মেয়েটা। কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা ধারাল ছুরির মতো চিরে দিল নৈঃশব্দ। অপেক্ষারত মানুষগুলো ঘুরে তাকাল শার্লির দিকে। বোর্ডওয়াক থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে মেয়েটা, দৌড়ে এগোচ্ছে ডিলনের ঘোড়ার দিকে। রাজকীয় ঘোড়াটায় পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে ডিলন, চোখের হিমশীতল স্থিরদৃষ্টি ক্লিন্টের ওপর।
মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল ক্লিন্টের। ডিলনের হাঁটুতে হাত রেখে মুখ উঁচু করে মৃদু স্বরে কি যেন বলছে শার্লি। ভঙ্গিটা অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মনে হলো ক্লিন্টের। শার্লির কথা শুনে আস্তে আস্তে হাসির রেখা দেখা দিল ডিলনের গম্ভীর মুখে।
সমস্ত রাগ দূর হয়ে গেল ক্লিন্টের, সেজায়গা দখল করল অপরিসীম ক্লান্তি। ডিলনের লোকরা হাসছে। দেখেও দেখল না, কিছু যায় আসে না ওর। দেখল শার্লির কাঁধে একটা হাত রেখেছে ডিলন, নরম গলায় বলল কি যেন। ক্লিন্ট ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল, ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসকে একরকম ঠেলে সরিয়ে ব্যস্ত পায়ে ঢুকে পড়ল ক্যাসিনো সেলুনের ভেতরে। আরও একটু অপেক্ষা করলে দেখতে পেত শার্লির চেহারায় কি পরিমাণ অসহায়তা জমেছে। নির্বাক বোবা দৃষ্টিতে ক্লিন্টের গমনপথের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা।
এমনিতে মদ বলতে গেলে পান করে না ক্লিন্ট, কিন্তু আজকে ওকে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে হবে, ভুলে যেতে হবে হৃদয়ের সমস্ত দুর্বলতা। মেয়ার্সের কাছ থেকে একটার পর একটা ড্রিঙ্ক নিল ও, ঢকঢক করে গিলল তরল। আগুন। ওর দু’পাশে ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি। খাচ্ছে ওরাও, তবে ওদের বসের মতো অতটা নয়। এইমাত্র সেলুনে ঢুকেছে ডিলনের গানম্যানরা। ওদের। সতর্ক থাকতে হবে। ডিলন যদি লাগতে আসে তাহলে সাধ্যমতো উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। তবে ডিলন বোধহয় তার লোকদের ঝামেলা না করার কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। ট্রিপল বারের কাউবয়দের ঘাটাল না তারা, একটা টেবিল ঘিরে পোকার খেলতে বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর ডিলন এলো। তার সঙ্গে জারম্যানও আছে। দুজনের কেউ হাবভাবে প্রকাশ করল না তারা ক্লিন্টকে দেখতে পেয়েছে। তবে ডিলন কাউন্টারে এসে দাঁড়াতেই তার এবং ক্লিন্টের মাঝখানে দাঁড়াল মার্শাল, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল সংঘাত ঠেকানোই তার উদ্দেশ্য।
কড়া চোখে মার্শালের দিকে তাকাল ক্লিন্ট। ড্রিঙ্ক করতে এসেছ দেখছি, বলল তিক্ত গলায়। সময় পাচ্ছ কি করে বুঝতে পারছি না। তোমার তো এখন ব্যাঙ্ক ডাকাতদের পেছনে ব্যস্ত থাকার কথা!
লাল হয়ে গেল জারম্যানের মুখ। তড়িৎ জবাব চলে এসেছিল জিভের ডগায়, শেষ মুহূর্তে সামলে নিল। শ্রাগ করে মনোযোগ দিল বারটেন্ডারের দিকে। লোকটা এখন ডিলনের ড্রিঙ্ক ঢেলে দিচ্ছে। ডিলন জানে, জিতে গেছে ও। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকাতেই সম্ভবত মহৎ হয়ে উঠেছে। জারম্যান অবাধ্য হয়েছিল ভুলে গেছে সেটাও, অথবা মনে রাখার প্রয়োজন দেখছে না। ক্ষতটায় মলম লাগানোর জন্যে অন্তরে তাগিদ অনুভব করছে জারম্যান।
আমি কি বলতে চাই বুঝতে পেরেছ, জারম্যান? জিজ্ঞেস করল ক্লিন্ট। জবাবে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল মার্শাল। অবজ্ঞার ছাপ পড়ল চেহারায়।
পেরেছি, ক্লিন্ট, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল। চোখ খোলা রেখেছি। আগে হোক পরে তোক কেউ একজন পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে শহরে আসবে। তখন তদন্ত এগোবে। এমনিতে ঘুরে কোন লাভ নেই, ঘোড়া দাবড়ে পাছায় ফোস্কা ফেলাই সার হবে।
তোমার মগজে তো বুদ্ধি নেই, হয়তো ফোস্কাগুলোর কোন একটাতে কিছু মগজ থাকতে পারে, নিচু গলায় মন্তব্য করল ডেনভার।
অগ্নিদৃষ্টিতে তরুণ কাউবয়ের দিকে তাকাল মার্শাল। ঈশ্বরের শপথ, মুখ বন্ধ রাখলে খালি হাতে ছিঁড়ে ফেলব তোমাকে আমি?
হুমকিতে ভয় পেল না ডেনভার। ড্রিঙ্কে মনোযোগ দিল সে। ক্লিন্ট খালি গ্লাসটা চোখের সামনে তুলে ধরে দেখল। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না আবার অর্ডার দেবে কিনা। শেষ পর্যন্ত কাউন্টারের ওপর দিয়ে গ্লাসটা ঠেলে দিল, বারটেন্ডারকে ইশারা করল ভরে দেবার জন্যে।
ধীরে ধীরে কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। এরমধ্যে সেলুনে আরও লোক এলো। লোক সমাগম বাড়তেই চাপা একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। সবাই অপেক্ষা করছে, দুই ব্র্যাঞ্চের কাউবয়দের মধ্যে যেকোন সময় লেগে যেতে পারে। প্রথম বোতল শেষ করে এখন দ্বিতীয় বোতলে আছে ক্লিন্ট। ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসও স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি ড্রিঙ্ক করেছে। ক্লিন্টের মনোযোগ সামনের বোতলে, কিন্তু তরুণ কাউবয়রা গরম চোখে ডিলন আর তার গানম্যানদের দেখছে। শহরের লোক যারা সেলুনে উপস্থিত আছে, পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভালই অবগত তারা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছে, কিন্তু সেলুন ছেড়ে যাচ্ছে না–যদি দেখার মতো কিছু একটা ঘটে যায়!
আরও দু’জন লোক ব্যাটউইং ঠেলে সেলুনে ঢুকল। কেগল আর ডায়ার। দরজার কাছে দাড়িয়ে পরিস্থিতি যাচাই করে দেখে নিল তারা। কেগল কাউন্টারের দিকে পা বাড়াল, ডিলনের সঙ্গে আলাপ জুড়ল। ডায়ার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল তার প্রাক্তন বসকে। ক্লিন্টের কাছ থেকে বেশ দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসল।
ডিলনের কাছ থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে তরলটুকু গিলে ফেলল কেগল, তাকাল ঘরের চারপাশে। দৃষ্টি স্থির হলো ট্রিপল বারের তিন কাউবয়ের ওপর। চোখ সরু করে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি। দু’পক্ষের চোখ থেকেই ঝরে পড়ল বিদ্বেষ। রাগতে শুরু করল কেগল। নিজেদের মাঝে নিচু গলায় আলাপ করছে তিন কাউবয়, আলাপের ফাঁকে হাসছে টিটকারির হাসি। শার্লির ব্যাপারটা? বেনন বলেছে? দাঁতে দাঁত পিষল কেগল। কর্কশ স্বরে জানতে চাইল, আমাকে কিছু বলার আছে?
হ্যাঁ। তুমি একটা ছিচকে গরুচোর। চোখের পলক ফেলল না, ডেনভার।
তোমার বাবা কে সেটা তোমার মা জানত না, বলল লেভিস। কেগলের দিকে তাকিয়ে মেঝেতে গুহ করে থুতু ফেলল স্টেসি।
তিনজনই বার কাউন্টারের সামনে থেকে খানিকটা সরে এসেছে। টলছে ওরা অল্প অল্প। মাতাল চোখে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে সবকিছু। উপস্থিত সবার নজর সেঁটে গেছে তরুণ কাউবয়দের ওপর। ডিলন কেগলকে কি যেন বলতে গিয়েও মত, বদল করল। জারম্যান বারের ওপর ধরে রাখল নিজের মনোযোগ। অতীত স্মৃতিচারণে, নিমগ্ন ছিল ক্লিন্ট, হঠাৎ করেই ও টের পেল গুরুতর কোন গোলমালে জড়িয়ে পড়েছে ওর লোকরা। সচেতন হতে চাইল ক্লিন্ট, বুঝতে চাইল ঘটনা কি ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু সময় পেল না। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল।
ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল। খাপের দিকে মসৃণ ভাবে নেমে গেল কেগলের হাত। গুলির শব্দ হলো, কিন্তু কে করল জানতে পারল না ক্লিন্ট। জ্ঞান হারিয়েছে আগেই। তার মাথায় একটা বোতল ফাটিয়েছে সেলুনমালিক স্টিভ ডেভিস।
কেগলের দ্রুততার সামনে কোন সুযোগই পেল না ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি, অর্ধেকটা অস্ত্র বের করতে পারল না ওদের কেউ। বুকে গুলি খেয়ে ধুলোময় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল তিন কাউবয়। তাদের গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অজ্ঞান ক্লিন্টের দেহ। কিছুটা দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেগল। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কোনদিকে কোন খেয়াল নেই। দুহাতে তার দুটো সিক্সগান। ধোঁয়া বের হচ্ছে অস্ত্র দুটোর নল থেকে।
তুমি দেখেছ, জারম্যান, কিছুক্ষণ পর বলল সে। ওরা অস্ত্রের দিকে হাত বাড়িয়েছিল।
বাড়িয়েছিল, প্রতিধ্বনি তুলল জারম্যান। তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই আমার।
লোকজন এগিয়ে এলো কোলের হাতের কাজ দেখতে। ক্লিন্টের অচেতন দেহ সরিয়ে লাশগুলো পরখ করে দেখল তারা।
জারম্যান এবার কর্তৃত্ব নিল। কয়েকজনকে হাতের ইশারা করে বলল, লাশ। সরিয়ে নাও। ফিউনারাল পার্লারে দিয়ে আসবে। আর রেমন, হ্যারি, তোমরা ক্লিন্টকে জেলখানায় নিয়ে যাও। ওখানে আজ রাতটুকু থাকুক ও। আবার কোন ঝামেলা হোক সেটা আমি চাই না।
নির্দেশ পালিত হলো। লাশ নিয়ে বেরিয়ে গেল চারজন লোক। তাদের পেছনেই ক্লিন্টকে বয়ে নিয়ে জেলখানায় চলল রেমন আর হ্যারি। তাদের সঙ্গে মার্শালও বেরিয়ে এলো সেলুন থেকে।
ডায়ার তখনও টেবিলে একা বসে আছে। কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখল অনেকে। ডায়ার কি ট্রিপল বারের অসমাপ্ত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে?
সেলুনে এখনও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
কিন্তু চুপচাপ নিজের টেবিলে নির্বিকার চেহারায় বসে থাকল ডায়ার। খানিক পরে সেলুনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এলো।
০৮. বেনন আর ব্যাগলে যখন টুইন স্প্রিংসে
বেনন আর ব্যাগলে যখন টুইন স্প্রিংসে ঢুকল, দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। ক্যাসিনো সেলুনের দরজা খুলে যেতে দেখল ওরা। দেখল কয়েকজন লোক নিহত কাউবয়দের নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তাদের পেছনে দু’জন লোক ধরাধরি করে অচেতন ক্লিন্টকে বের করে আনল। বোতল যেখানে লেগেছিল, মাথা। সেখানে ফেটে গেছে ক্লিন্টের। তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ঘোড়া থামিয়ে দৃশ্যটা মনোযোগের সঙ্গে দেখল বেনন। ক্লিন্ট বেঁচে আছে বুঝতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলল, কিন্তু মনের তিক্ততা কাটল না। বাচ্চা তিনটে ছেলেকে মেরে ফেলেছে ডিলনের লোকরা, এটা ভাবলেই শীতল একটা রাগ উথলে উঠছে অন্তরে। ঘন ঘন গোঁফে তা দিচ্ছে ব্যাগলে। অত্যন্ত উত্তেজিত বোধ করছে এটা তারই লক্ষণ! ব্যাগলে এগিয়ে যেতে চাইছিল, হাতের ইশারায় তাকে ঠেকাল বেনন। গম্ভীর গলায় বলল, ওদের কোন সাহায্যে আমরা আসতে পারব না, ব্যাগলে। কঠোর হয়ে গেছে বেননের চেহারা।
রাস্তার ধারে ঘোড়া সরিয়ে নিল ওরা। বোর্ডওয়াক ধরে জেলখানার দিকে গেল জারম্যান, ওদের দেখতে পেল না। কোনদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না লোকটা, একমনে ভাবছে কি যেন।
যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, বেনন, গোঁফে তা দিল ব্যাগলে। আমাদেরই করতে হবে। ক্লিন্টকে সাহায্য করার আর কেউ নেই।
উনি ছাড়া, আকাশে তর্জনী তাক করল বেনন। ঘোড়া পিছিয়ে ছায়ার আরও ভেতরে চলে এলো ও। ব্যাগলেও তাই করল। দু’জনই চিন্তা করছে, কি করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা শুধু বাড়ছেই। এখনই সমাধান করতে না পারলে একসঙ্গে এত সমস্যা জমে যাবে যে শেষে কিছুই করা যাবে না।
ওদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়ার এটাই সময়, বলল ব্যাগলে। কাজটা সম্ভব।
কিভাবে?
কেগল আর ডিলন। কেগল আর শার্লি। আবার ডিলন আর শার্লি।
অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বেননের চেহারা। দাবা খেলা! ঠিকই বলেছ, ব্যাগলে! সঙ্গে যোগ করো কেগল আর ডায়ার, ডায়ার আর ডিলন। চকচকে চোখে বন্ধুকে দেখল বেনন। কার কাছ থেকে বুদ্ধিটা ধার নিলে?
তোমার কাছ থেকে নয়, গোমড়া মুখে জবাব দিল ব্যাগলে।
ঠাট্টা করেছে বলে লজ্জিত বোধ করল বেনন। এখন ঠাট্টার সময় নয়। বাচ্চা কয়েকটা ছেলে খুন হয়ে গেছে। ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসের বয়স কতই বা হবে! জীবনটাকে মাত্র উপভোগ করতে শুরু করেছিল ওরা। এখন ওরা বেঁচে নেই। খুনিদের শাস্তি হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কয়েকদিন পর কেউ মনেও রাখবে না নিষ্ঠুর গানম্যানদের হাতে ঝরে গেছে কচি কয়েকটা প্রাণ। শপথ নিয়ে ফেলল বেনন, ও বেঁচে থাকতে পার পাবে না ডেনভার, স্টেসি এবং লেভিসের হত্যাকারী।
ক্যাসিনো সেলুনের উল্টোদিকে দুটো বিল্ডিঙের ফাঁকে ঘোড়া রেখে শহুরে মানুষের ঢলে মিশে গেল বেনন আর, ব্যাগলে। তরুণ কাউবয়দের হত্যাকাণ্ড মুখরোচক খবরে পরিণত হয়েছে। যারা গানফাইট দেখেছে তাদের কাছে কাউবয়দের মৃত্যু কোন তাৎপর্য বহন করে না। কাউবয়রা কাউবয়, ওদের ভাই বেরাদার নয়। গানফাইটের বর্ণনা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলছে তারা। দর্শক হতে পারাটাকে সৌভাগ্য বলে মনে করছে। টুকরো টুকরো বর্ণনা শুনে সেলুনের ভেতরে কি ঘটেছিল বুঝে নিল বেনন আর ব্যাগলে।
ঘোড়াগুলো স্টেবলে রেখে আসা দরকার, কিছুক্ষণ পর বলল বেনন। আজ রাতে শহর ছেড়ে কোথাও যাওয়া হবে না আমাদের।
মুখে কিছু বলল না ব্যাগলে, মাথা দুলিয়ে সায় দিল। ভাবছে বেনন কিভাবে কি করবে।
স্টেবলে ঘোড়া রেখে চাইনিজ চপ হাউজে রাতের খাবার সেরে নিল ওরা তাড়াহুড়ো করে। তারপর বেরিয়ে এসে ক্যাসিনোর দরজার ওপর চোখ রাখল। রাত বাড়তেই বরফের গা ছুঁয়ে পাহাড় থেকে বইতে শুরু করল ঝিরঝিরে শীতল বাতাস, কাপ ধরিয়ে দিল হাড়ে। স্লিকার চাপিয়ে নিল ওরা, হাঁটাহাঁটি করে শরীর গরম করতে চাইল। সারারাত অপেক্ষা করার মতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে বেনন। ব্যাগলেরও ধৈর্যের অভাব নেই। কষ্ট হলেও অভিযোগ করবে না ও।
সারারাত অপেক্ষা করতে হলো না। মাঝরাতে যাকে চাইছিল তাকে দেখতে। পেল ওরা, সেলুনের ব্যাট উইং ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
লণ্ঠনের আলোয় ক্ষণিকের জন্যে দেখা গেল ডায়ারের মুখ। বোর্ডওয়াক থেকে নেমে পড়ল ডায়ার, হিচরেইলের কাছে চলে এলো। ওর ঘোড়াটা। হিচরেইলে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে। ডায়ার ঘোড়ার দড়ি খুলতে যাবে এমন সময় বেননের অস্ত্র খোঁচা দিল ওর পিঠে।
আপাতত তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, নিচু স্বরে বলল বেনন। শান্ত ছেলের মতো আমার সঙ্গে চলো, বেঁচেও যেতে পারো।
নরম সুরে বলা হলেও হুমকিটুকু কান এড়াল না ডায়ারের, চমকে উঠেছিল, ঝটপট সামলে নিল নিজেকে। মাথার ওপর হাত তুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। খোঁচা দিয়ে লোকটাকে সামনে বাড়াল বেনন। স্টেবল পেরিয়ে আসার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। এখন ডায়ার গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও সাহায্য আসার আগে সরে পড়তে পারবে ওরা।
ঠিক আছে, দাঁড়াও, নির্দেশ দিল বেনন! ডায়ারের হোলস্টার থেকে সিক্সগান বের করে দূরে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
ব্যাপারটা কি? এতক্ষণে জবান ফিরে পেয়ে দাবির সুরে জানতে চাইল ডায়ার। ভাব দেখে কে বলবে ভেতরে ভেতরে থরহরিকম্প হয়ে গেছে!
সহজ ব্যাপার, ঠাণ্ডা গলায় বলল বেনন। তুমি ভেবেছিলে অতি চালাকি করে পার পেয়ে যাবে, কিন্তু আসলে পার পাবে না। মাথা নাড়ল ও। সিক্সগানের। নলটা ইঞ্চিখানেক সেঁধিয়ে দিল ডায়ারের কোমরের চর্বিতে। আমরা জানি তুমি ক্লিন্টের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। এটাও জানি যে তুমি আর কেগল মিলে গরু চুরি করে পাহাড়ে ঘেরা একটা উপত্যকায় জড় করেছ। বুঝতেই পারছ আমরা অনেক কিছুই জানি! যেসব প্রশ্ন করব সেগুলোর জবাব মিথ্যে হলে টের পাব। তার ফল ভাল হবে না। যদি ঝেড়ে কাশো তাহলে জুরির সামনে দাঁড়িয়ে ন্যায় বিচার পাবে। আর সহযোগিতা যদি না করে তাহলে এখানেই গুলি করে মেরে রেখে যাব। একটু থামল বেনন। লোকটাকে ভাবার সময় দিল। তারপর বলল, কোনটা ঠিক করলে?
কি জানতে চাও? কর্কশ ভাঙা গলায় জানতে চাইল ডায়ার। ব্যাঙ্কে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলে?
না।
কেগল?
আমি জানি না।
বোনের ইশারায় ডায়ারের চুল খামচে ধরল ব্যাগলে। লোকটাকে মুখ বিকৃত করতে দেখেও নির্বিকার ভাবে টান বাড়াল। আর একটু টান বাড়ালেই গোড়া থেকে ছিঁড়ে আসবে দু’মুঠো চুল।
উহ্! ব্যাগলের মুঠো আলগা করতে চেষ্টা করল ডায়ার। আঙুলগুলো যেন লোহার আঁকশি! না পেরে ব্যথায় ঢোক গিলল। নাক-মুখ কুঁচকে বলল, বললাম তো আমি জানি না। ঈশ্বরের শপথ! কেগল যদি ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে থাকেও, আমার কাছে মুখ খুলবে কেন!
এব্যাটা ঠিকই বলছে, মন্তব্য করল ব্যাগলে। বেননের ইশারায় মুঠোর চাপ একটু কমাল।
বেনন জিজ্ঞেস করল, কেগল আর তুমি যে গরু চুরি করেছ তার সঙ্গে ডিলন জড়িত?
না। তবে রাউন্ডআপের সময় ক্লিন্টের বাছুরের গায়ে নিজের ব্র্যান্ড বসিয়েছে। সে। আমরা শুধু ওর লাভে সামান্য একটু ভাগ বসিয়েছি। রাসলিঙের সময় ওর গরুও চলে এসেছে কিছু।
ডিলন কিভাবে সামলাবে বুঝতে পারছ কিছু? ব্যাগলেকে বলল বেনন। আমরা যদি অভিযোগ তুলি তাহলে ডিলন বলবে, ওর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। ডায়ার আর কেগল ডিলনের গরু চুরি করেছে এটাও তার পক্ষে যাবে। ডায়ারকে একটা খোঁচা দিল বেনন। নিজের চামড়া বাঁচাতে তোমাকে ফাঁসি দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে ডিলন।
বেননের কথায় একটু ভরসা মতো, পেল ডায়ার। বেনন তাহলে বোধহয় তাকে খুন করার কথা ভাবছে না। কিন্তু স্বস্তিটুকু বড় ক্ষণস্থায়ী। ডিলন ক্ষিপ্ত হয়ে। উঠবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেল ওর। বুকের ভেতরে ধড়ফড় করছে। হাত-পা কাঁপতে লেগেছে বলে নিজেকে দোষ দিতে পারল না। বিপদ! বিরাট বিপদে পড়েছে সে! নিজের বিপদ দেখলে কেগল কি ওকে ছাড়বে? কেগল ছিল বলে এতদিন ডিলনের ভয় মনে, জেঁকে বসতে পারেনি, কিন্তু এখন কেগল ওর বিরুদ্ধে। ওর মুখ বন্ধ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে না কেগল? তাহলে? এরা যদি ছেড়ে দেয় তাহলে পালিয়ে যাবে? কোথায়? গরু বিক্রি না করলে হাতে টাকা। আসবে না। নিঃস্ব অবস্থায় চলে যেতে হবে এত কষ্টের পর? উপায় কি আর? গরু নিয়ে একা সরে পড়া যাবে না। রুখে দাঁড়ানোর কথা ভাবাও যায় না। গানম্যান নয় সে। অস্ত্রে হাতও ভাল নয়।…আর নিজের কাছে স্বীকার করতে দোষ কী, তার বুকে সাহসও বেশি ছিল না কোনকালে। মিথ্যে ব্যক্তিত্বের একটা শক্ত খোলস তৈরি করে তার ভেতরে লুকিয়ে ছিল এতকাল। এখন খোলস ভেঙে গেছে। লোতে পড়ে কেগলের মতো অসৎ লোকের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লে আজকে…
জেলখানায় চলো, নির্দেশ দিল বেনন। তোমাকে জারম্যানের জিম্মায় রেখে ডিলন আর কেগলকে খুঁজতে বেরোব আমরা। জানা দরকার তোমার কথার বিরুদ্ধে কি বলার আছে ওদের।
কলে আটকা পড়া ইঁদুর মনে হলো নিজেকে ডায়ারের। পালাতে পারলে বেঁচে যেত। ডায়ার একবার ভাবল বেননের পা চেপে ধরে ক্ষমা চাইবে কিনা। কিন্তু কঠোর মুখটা দেখে ভরসা পেল না। মাথা নিচু করে বেনন আর ব্যাগলের আগে আগে চলল সে জেলখানার দিকে। হাঁটার সময় প্রায়ই দু’হাঁটু বাড়ি খাচ্ছে তার। তবু বুকের মাঝে একটু ভরসা, জেলখানায় মরতে হবে না ওকে। ডিলন নিশ্চয়ই জারম্যানের উপস্থিতিতে সরাসরি কিছু করতে পারবে না।
গুঙিয়ে উঠল ক্লিন্ট। বিরক্ত দৃষ্টিতে ক্লিন্টের দিকে তাকাল জারম্যান। মাত্র জ্ঞান ফিরেছে ট্রিপল বারের মালিকের। হাত দিয়ে মাথার আঘাতটা পরখ করে দেখল।
খড়ের বিছানায় আধবসা হলো। মার্শাল বসে আছে উল্টোদিকের বাঙ্কে।
তোমার কপাল ভাল যে বেঁচে আছ, বলল জারম্যান। গোঙানি থামিয়ে ঈশ্বরকে বরং ধন্যবাদ দাও।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে ক্লিন্টের। একে অতিরিক্ত মদ্যপান, তার ওপর বোতলের বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে কে যেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল ও। দৃষ্টি পরিষ্কার করার জন্যে বার বার চোখ পিটপিট করল। একটু পর নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ মনে হলো। বিষদৃষ্টিতে মার্শালকে দেখল ও। মাথার ক্ষতটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এটা করেছ?
মাথা নাড়ল জারম্যান। না, ডেভিস। মাতাল অবস্থায় কিছু না বুঝেই গানফাইটে জড়িয়ে পড়ছিলে তুমি, ও তোমাকে বাঁচিয়েছে। বোতল দিয়ে বাড়ি মেরেছে মাথায়। জ্ঞান না হারালে এখন ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসের মতোই আন্ডারটেকারের অফিসে পড়ে থাকতে তুমি।
কারা মেরেছে ওদের?
কেগল। একাই। লাগতে যাওয়া উচিত হয়নি ওদের।
তীব্র কষ্টে মুখ বিকৃত হলো ক্লিন্টের। সে-কষ্ট মাথাব্যথার কারণে নয়। অনেক, অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল ও। ডেনভার, লেভিস আর স্টেসিকে ছোট ভাইয়ের মতোই স্নেহ করত ও। বিশ্বাস হতে চায় না ওরা আর নেই। ওরা যে ট্রিপল বারের জন্যে লড়তে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এটা কষ্টের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। ওর লড়াই নিজেদের বলে মনে করেছিল তাই প্রাণের ভোয়াক্কা করেনি বেপরোয়া ছেলেগুলো। বিনিময়ে ভাল ব্যবহার ছাড়া কিইবা দিতে পেরেছে সে ওদের? বাপ-মা খেদানো কয়েকটা ছন্নছাড়া ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ওর বাবা, তার প্রতিদান দিয়ে গেছে ওরা নিজেদের জীবন দিয়ে।
চোখ গরম করে তাকানোর কোন কারণ নেই, খোঁচাতে শুরু করল জারম্যান। ওদের ওপর তোমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। গায়ে পড়ে লাগতে যাওয়া ওদের অনুচিত হয়েছে। ডিলনের লোকরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওয়েডিং উপলক্ষে আগাম একটু ফুর্তি করছিল ওরা। কথা শেষে ক্লিন্টের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে চকচকে চোখে তাকাল জারম্যান।
কার ওয়েডিং? ভোঁতা সুরে জানতে চাইল ক্লিন্ট। ওর মনে কোন সন্দেহ নেই কার ওয়েডিং।
লিউ ডিলন আর শার্লি রাশল্যান্ডের ওয়েডিং। কয়েকদিন পরই ওদের বিয়ে।
ফাঁকা দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল ক্লিন্ট। তাহলে এই ব্যাপার! বিকেলে এই সম্ভাবনাই উঁকি দিয়েছিল ওর মনে। ডিলনের সঙ্গে ওর গোলাগুলি না হোক তাই চেয়েছিল শার্লি। চেয়েছিল ওর কথা ভেবে নয়, ডিলনের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তিক্ত হাসিতে ঠোঁট বেঁকে গেল ক্লিন্টের। বুড়োরা হয়তো ঠিকই বলে, সব মেয়েমানুষ আসলে একই রকম। বিত্তবান, ক্ষমতাশালী মানুষের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে ভালবাসে মেয়েরা। প্রতিহিংসার চিন্তার মাঝেও একটা আলাদা চিন্তা ক্লিন্টকে নাড়িয়ে দিল। সত্যিই ও ভালবাসে শার্লিকে। শার্লির সুখ। নিশ্চিত করতে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে ও শার্লির সুখ ডিলনের বেঁচে থাকার ওপর নির্ভর করলে ট্রিপল বারের দখল নিয়ে ওর লড়াই একরকম শেষ হয়ে গেছে বলেই ধরে নেয়া চলে।
তবে স্টেসি, ডেনভার আর লেভিসের হত্যাকারীকে ও ছাড়বে না। আজ ও নিঃস্ব, রিক্ত, একা। চলে যাবে ও এই অঞ্চল থেকে। আর কখনও আসবে না। কিন্তু তার আগে প্রতিশোধ নেবে। রক্তের বদলে রক্ত নেবে ও। কেগলের লাশ ফেলে তারপর যাবে এখান থেকে।
সেল থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাতে দরজায় তালা মেরে দিল জারম্যান, বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না ক্লিন্ট।
প্যাসেজ হয়ে অফিসে চলে এলো মার্শাল, কাবার্ড থেকে নতুন একটা বোতল নিয়ে গ্লাসে রাই হুইস্কি ঢালল। চুমুক দেবে এই সময় রাস্তার দিকের দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল ডায়ার। তার পেছনে অস্ত্র হাতে বেনন আর ব্যাগলে। ডায়ারের খালি হোলস্টারের ওপর থেকে ঘুরে এলো জারম্যানের চোখ। চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ পড়েই মিলিয়ে গেল। তাকাল গম্ভীর দুই বন্ধুর দিকে। কি চাও তোমরা! কর্কশ গলায় জানতে চাইল।
ধাক্কা দিয়ে ডায়ারকে ঘরের আরও ভেতরে ঠেলে দিয়ে পায়ের ঠেলায় পেছনে দরজা বন্ধ করে দিল বেনন।
একে চোখে চোখে রাখো। কেগলের সঙ্গে রাসলিং করছিল। পাহাড়ের মাঝে বিরাট এক পাল গরু জড় করেছে এ আর কেগল।
তোমরা জানলে কি করে! একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল জারম্যান।
ওর কাছ থেকে জেনে নিয়ে সত্যি বলছি কিনা, বলল বেনন। আমরা যাচ্ছি ডিলনকে নিয়ে আসতে। আমার ধারণা ডিলন যখন জানবে রাসল করা গরুর মধ্যে ওর গরুও আছে তখন ডায়ারকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাইবে। সেটা ঠেকানো তোমার দায়িত্ব।
সম্মতিসূচক নড় করল জারম্যান। চোখ চকচক করছে তার। ইশারায় টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে ডায়ারকে বসতে বলল সে। বেনন আর ব্যাগলে। বাইরের বোর্ডওয়াকে পা রাখার আগেই নিয়ে ফেলল দ্রুত সিদ্ধান্ত। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ডায়ার, তাড়াতাড়ি কার্যকরী কিছু না করলে ফেঁসে যাবে তুমি। ডায়ারের ভীত চেহারা দেখল, তারপর গ্লাস ভরে রাই হুইস্কি দিল লোকটার হাতে। বলল, এটা শেষ করো, ততক্ষণে আমি ক্লিন্টকে ছেড়ে দিয়ে আসছি। পেছন-দরজা দিয়ে বের করে দেব।
ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে তেমনি করে গ্লাসটা ধরল ডায়ার। দীর্ঘ চুমুকে খালি করে ফেলল। বোতল থেকে ঢেলে নিল আবার। শুনতে পেল প্যাসেজের ওপাশে সেলের দরজা খুলেছে জারম্যান। দরজাটা ফাঁক হয়ে আছে। জারম্যানকে দেখতে পাচ্ছে ও। কত নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে মার্শালের চেহারা। ও নিজেও যদি ওরকম নিশ্চিন্ত হতে পারত! দ্বিতীয় গ্লাসটাও খালি করে ফেলল ডায়ার।
সেলের দরজা খুলে সরে দাঁড়াল জারম্যান। বেরোও, কর্কশ স্বরে নির্দেশ দিল। আজকে সেলে লোক থাকবে, কাজেই তোমাকে আর এখানে রাখতে পারব না।
বাঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকাল ক্লিন্ট, তিক্ত সুরে বলল, আমি নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না, জারম্যান! ঠিক আছে, যাচ্ছি। তুমি ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে রাতভর মদ গিলবে তাতে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব কেন। তবে ডিলনকে বলে দিয়ো, কোলকে আমি ছাড়ব না। চোখ সরু করে তাকাল মার্শাল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। প্যাসেজের শেষ মাথায় গিয়ে লোহার দরজার ডাবল বোল্ট খুলে দিল। হাত নাড়ল অধৈর্য ভঙ্গিতে বেরিয়ে যেতে বলছে ক্লিন্টকে।
হ্যাট আর স্নিকার তুলে নিয়ে সেল থেকে বেরিয়ে এলো ক্লিন্ট। সে বাইরে পা রাখতেই পেছনে দরজা বন্ধ করে দিল মার্শাল, বোল্ট লাগিয়ে ফিরে এলো অফিসে। দাঁড়িয়ে আছে ডায়ার। এরইমধ্যে মার্শালের রেখে যাওয়া বোতল এক তৃতীয়াংশ খালি করে ফেলেছে। ব্যাপারটা দেখেও দেখল না জারম্যান, হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে রেখে দিল টেবিলের ওপরে।
এবার? কি করব আমরা? ডায়ারের গলায় আত্মবিশ্বাসের ভাবটা ফিরে এসেছে।
এই মাত্র ক্লিন্টকে ছেড়ে দিলাম, বলল জারম্যান। আমাদের সম্পর্কে যত কম জানে ততই ভাল। ও গেলে তুমিও চলে যাবে। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে, কেউ টের পাবে না। বাইরে আমার ঘোড়ায় স্যাডল চাপানো আছে, কোথায় লুকাতে হবে তা তো জানোই। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে গরুগুলো আমরা সরিয়ে নেব।
সাইডওয়াকে পায়ের শব্দ পাওয়া যায় কিনা শোনার জন্যে কান খাড়া করে রেখেছে ডায়ার। বলল, কোথায় লুকাব সেটা জানি, কিন্তু গরু সরাতে দেরি করা চলবে না। বেনন আর ওর বন্ধু জানে কোথায় আছে ওগুলো।
কচু জানে। ওরা আন্দাজ করছে কিছু একটা গড়বড় আছে। ভাবছে ডিলনের সামনে ভেঙে পড়বে তুমি। ক্রু কুঁচকে ডায়ারকে দেখল জারম্যান। বলল, ওরা আসার পর উপত্যকার কোন কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। ওরা জায়গাটা চেনে না। মাথা নাড়ল। না, ওরা সন্দেহের বশে কাজ করছে।
দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। অস্থির হয়ে উঠল ডায়ার। বাইরে যখন পায়ের আওয়াজ পেল, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। বিড়বিড় করে বলল, ওরা আসছে!
ঠোঁটে তিক্ত হাসি নিয়ে ট্রিপল বারের ফোরম্যানকে দেখল জারম্যান। কোন অস্থিরতা নেই তার মাঝে। পেছনের দরজা দিয়ে, শান্ত গলায় বলল।
ডায়ার প্যাসেজে ঢোকার দরজার কাছে পৌঁছে গেছে এমন সময় পেছন থেকে জারম্যান বলল, ডায়ার, এটা তোমার কাজে লাগবে।
থামল ডায়ার, জারম্যানকে নিজের একটা সিক্সগান এগিয়ে দিতে দেখে মাথা দোলাল। আসলেই যখন তখন দরকার পড়তে পারে ওটার।
ধরো! ডায়ারের দিকে সিক্সগানটা ছুঁড়ে দিল জারম্যান।
শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে ডায়ারের দিকে গেল অস্ত্র। ডায়ারের চোখ অস্ত্রের ওপর, কাজেই সে দেখতে পেল না কখন মার্শালের হাত হোলস্টার থেকে তুলে এনেছে। অন্য সিক্সগানটা। সুন্দর ক্যাচ ধরল ডায়ার, ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে তাকাল মার্শালের দিকে। আর ঠিক ওই মুহূর্তেই গুলি করল মার্শাল। একটা মাত্র গুলি করল। নিখুঁত ভাবে ফুটো করে দিল ডায়ারের হৃৎপিণ্ড।
বাইরের দরজায় পায়ের শব্দ থামল। সেদিকে ঘুরে গেল জারম্যান। তার সিক্সগানের ব্যারেল থেকে চুইয়ে চুইয়ে উঠছে ধোয়া
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে ধোয়া ভরা সেলুনের ভেতরে ঢুকল বেনন আর ব্যাগলে। কাউন্টার আর টেবিলগুলোর ওপর ঘুরে এলো ওদের সতর্ক চোখের দৃষ্টি। সাধারণ মানুষ দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকাল না, কিন্তু বারে দাঁড়িয়ে আছে ডিলন তার লোক পরিবেষ্টিত হয়ে, তারা ওদেরকে চোখের দৃষ্টিতে ভস্ম করে দিল। গানম্যানদের হাত চলে গেল উরুর পাশে। কেগল হোলস্টারের দিকে হাত নামাতেই ইশারায় তাকে বারণ করল ডিলন। টেবিলগুলোর মাঝখানের সরু পথ ধরে ডিলনের দিকে এগোল বেনন আর ব্যাগলে, দু’জনই গানবেল্টের ভেতরদিকে
বুড়ো আঙুল গুঁজে রেখেছে। ডিলনের লোকদের সামনে থামল ওরা, তারপর ওদের উপেক্ষা করে তাকাল বারটেন্ডার মেয়ার্সের দিকে।
রাই, ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল বেনন। ডিলনের লোকরা সামান্য সরে গেল যাতে মেয়ার্স ড্রিঙ্ক দিতে পারে।
ড্রিঙ্ক সেরে র্যাঞ্চারের দিকে মনোযোগ দিল বেনন। জেলখানায় একজনকে রেখে এসেছি, সে রাসলিঙের ব্যাপারে কথা বলবে তোমার সঙ্গে। কেগলের ওপর থেকে ঘুরে এলো ওর দৃষ্টি। মনে হচ্ছে এদিকের রেঞ্জে রাসলারদের কাছ থেকে গরু চুরি হয়ে যাচ্ছে। চোরের ওপর বাটপারি করছে কেউ কেউ। লোকটা আমাদের কাছে মুখ খুলেছে। তোমাকেও কিছু বলার আছে তার। আমার ধারণা ওর কথা শুনলে উপকার হবে তোমার।
দৃষ্টিতে পরিষ্কার অপছন্দ নিয়ে ধূলিধূসরিত বেনন আর ব্যাগলেকে দেখল ডিলন। ঝগড়া বাধাবার কোন ইচ্ছে নেই তার মধ্যে, তাছাড়া এখন এদেরকে। ততটা আর বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না। ক্লিন্ট হার স্বীকার করে ট্রিপল বার ছেড়ে চলে এসেছে। গ্লাসে ছোট্ট করে চুমুক দিল ডিলন। দুদিন পরই শার্লি রাশল্যান্ডের সঙ্গে ওর বিয়ে হচ্ছে। বেনন আর তার বন্ধু থাকলেও এখন তার পরিকল্পনায় কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
কে লোকটা? আমি চিনি তেমন কেউ? ডিলনের কণ্ঠে নিরুৎসাহ। বেনন আর ব্যাগলের কথায় গুরুত্ব দিতে চাইছে না।
ধীরেসুস্থে মাথা দোলাল বেনন। লোকটা ডায়ার। অদ্ভুত কিছু তথ্য আমাদের দিয়েছে সে।
কেগলের দিকে এক ঝলক তাকাল বেনন। মুখে কোন ভাব নেই। কেগলের, যেন মুখোস পরে আছে। তবে চোখ দুটো জ্বলছে। জারম্যান ডায়ারকে আটকে রেখেছে, ইচ্ছে করলে জেলখানায় যেতে পারো আমাদের সঙ্গে।
জারম্যানের নাম শুনে কেগলের ঠোঁটে শীতল হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। হঠাৎ করে বেননের মনে হলো কি যেন ভুল করে ফেলেছে ও।
গ্লাস চোখের সামনে তুলে গভীর মনোযোগে ভেতরের তরল দেখল ডিলন। চিন্তার ছাপ পড়ল চেহারায়। হুইস্কিটুকু গিলে নিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল কাউন্টারে। দুআঙুলে ধরে কপালের ওপর টেনে আনল হ্যাট। দলের সবাইকে একপলক দেখে নিয়ে বলল, তোমরা এখানেই অপেক্ষা করবে।
ক্রুরা সবাই শরীরে ঢিল দিল। কাউন্টারে কনুই রেখে দাঁড়িয়ে আছে কেগল। চকচকে চোখে তার দিকে তাকাল ব্যাগলে।
বেনন বলল, কেগল সঙ্গে এলে ভাল হয়। ডায়ারের দেয়া তথ্যগুলো শুনতে ভাল লাগবে ওর।
মাথা কাত করে ইশারা করল ডিলন, কেগলকেও সঙ্গে আসতে বলছে। অলস দৃষ্টিতে বেনন আর ব্যাগলেকে দেখে নিয়ে বারের কাছ থেকে সরে এলো গেল।
একসঙ্গে ওরা চারজন বেরিয়ে এলো সেলুন থেকে। বার কিউয়ের কাউবয়রা ছাড়া আর কেউ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল না। স্টিভ ডেভিসের নর্তকীদের নাচের সময় হয়ে গেছে। এক কোণে পিয়ানোয় সুর তুলল একজন নিগ্রো। পেছনের ছোট একটা ঘর থেকে স্বল্প পোশাক পরিহিত ছয়জন মেয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলগুলোকে ঘিরে ঘিরে নাচতে লাগল। সবার মনোযোগ তাদের দিকে।
বাইরে, বেনন আর ব্যাগলের আগে আগে হেঁটে চলেছে ডিলন। তার মনে কোন ভয় আছে বলে মনে হয় না। অন্য তিনজন র্যাঞ্চারের কয়েক পা পেছনে চলেছে। কথা বলছে না কেউ। ওদের বুটের আওয়াজ ফাঁপা শোনাচ্ছে কাঠের বোর্ডওয়াকে। পাশের একটা সেলুন থেকে মাতাল এক কাউবয় বেরিয়ে এসে ডিলনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ডিলন, বিড়বিড় করে অভিশাপ দিল। ব্যাগলে খুশি হয়ে উঠল। ডিলনের কপালে শনিগ্রহের প্রভাব শুরু হয়েছে। মাতাল কাউবয় গায়ে পড়ছে, একটু পর ডায়ার জানাবে ক্লিন্টের বাছুরের গায়ে ব্র্যান্ড করেছে ডিলন। রাসলারের সঙ্গে আর কোন তফাৎ থাকল না লোকটার। নিশ্চয়ই দেখার মতো হবে লোকটার চেহারা? কি করবে? সম্মান রক্ষা করে এই ঝামেলা থেকে বাঁচবে কিভাবে?
জেলখানার দরজার কাছে প্রায় চলে এসেছে ওরা, এমন সময় রাতের শহরের স্বাভাবিক শব্দমালা ছাপিয়ে গুলির আওয়াজ হলো। জেলখানার ভেতরে গুলি করেছে কেউ। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বেনন, হাতে অস্ত্র চলে এসেছে। ওটা বাগিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল ও। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল ও। ধোয়া বেরনো সিক্সগান হাতে দাড়িয়ে আছে জারম্যান। তার পেছনে মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ডায়ার। এক পলক দেখেই বোঝা যায়, বেঁচে নেই।
বেননের পর পরই ভেতরে ঢুকল ডিলন, ব্যাগলে আর কেগল। জারম্যানের নজর ক্ষণিকের জন্যে সেঁটে থাকল কেগণের ওপর। জারম্যানের ওপর থেকে ঘুরে মৃত ডায়ারের ওপর স্থির হলো ডিলনের দৃষ্টি, তারপর আবার তাকাল সে জারম্যানের দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল। বলল, কি ব্যাপার?
হোলস্টারে অস্ত্র রেখে ধীরেসুস্থে টেবিল থেকে বোতল তুলে নিয়ে চুমুক দিল মার্শাল, তারপর বেনন আর ব্যাগলেকে দেখিয়ে বলল, এরা ডায়ারকে নিয়ে এসেছিল। এদের ধারণা হয়েছিল ডায়ার এমন কিছু জানে যেটা তোমাকে জানানো প্রয়োজন। সম্ভবত রাসলিঙের ব্যাপারে কিছু একটা। ডায়ারকে আমার জিম্মায় রেখে তোমাকে ডাকতে গেছিল এরা।
সেই দুঃখে আত্মহত্যা করে বসল ডায়ার? চোখ সরু করে মার্শালের দিকে তাকাল বেনন। অস্ত্র পেল কই?
বেননকে পাত্তা দিল না জারম্যান, নজর সরল না ডিলনের ওপর থেকে। খুব উত্তেজিত ছিল ডায়ার, আমি বুঝতে পারিনি। বারবার বলছিল এরা দু’জন হুমকি দিয়েছে মেরে ফেলবে ওকে। জোর করে নাকি রাসলিঙের ব্যাপারে স্বীকারোক্তিও আদায় করেছে। প্রাণের ভয়ে ওকে বলতে হয়েছে যে কেগল আর সে মিলে সবার গরু চুরি করেছে।
তীক্ষ্ণ নজরে মার্শালের ভেতরটা দেখে নিতে চাইল ডিলন। বোতলে লম্বা একটা চুমুক দিল জারম্যান।
আমি ডায়ারকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম আমি। নিরপেক্ষ, কাজেই দোষ না করে থাকলে তোমার চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু সে বারবার বলতে লাগল বেনন আর ব্যৗগলের কথামতো কাজ না করলে তাকে মেরে ফেলা হবে। থামল জারম্যান। ইচ্ছে করেই বেনন আর ব্যাগলের দিকে তাকাচ্ছে। না। ঝুঁকি নিতে ভয় পেয়েছিল ডায়ার। পালাতে চেয়েছিল। যাই হোক, আমি তাকে ড্রিঙ্ক দেবার জন্যে কাবার্ডের কাছে গেলাম। ঘুরে দেখি আমারই একটা অস্ত্র নিয়ে প্যাসেজের দরজার কাছে চলে গেছে সে। দরজা খুলতে চেষ্টা করল। পারল না। আমাকে বলল চাবিটা দিতে। আমি আপত্তি জানাতেই গুলি করতে চাইল। কাঁধ ঝাঁকাল জারম্যান। ডায়ারের গতি খুব ধীর ছিল।
ঘাড় ফিরিয়ে শীতল চাহনিতে বেনন আর ব্যাগলেকে দেখল ডিলন। নিচু স্বরে বলল, তোমাদের কপাল মন্দ, যে উদ্দেশ্যেই কাজটা তোমরা করে থাকো না কেন, তা সফল হয়নি।
কপাল যদি কারও মন্দ হয় তো সে তুমি, উত্তপ্ত স্বরে বলল ব্যাগলে। ডায়ারের কথা শোনার সুযোগ হলো না তোমার। ও যা বলত সেটা তুমি ঠিকই জানবে, কিন্তু জানবে অনেক দেরিতে।
কেউ ওকে জোর করে কিছু বলতে চায়নি, যোগ করল বেনন। মার্শাল হয় মিথ্যে বলছে, নাহলে ভুল ধারণা পেয়েছে।
আমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়াই তোমাদের উদ্দেশ্য, এতক্ষণে মুখ খুলল কেগল। ঠোঁটে টিটকারির হাসি। ক্লিন্ট বোধহয় তোমাদের বলেনি যে বার কিউয়ের কাউবয়রা অন্যের প্ররোচনায় কান দেয় না? ওর বলা উচিত ছিল। ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকলে নিজেদের মাঝে আলাপ করে সমস্যার সমাধান করি আমরা।
কোলের দিকে তাকিয়ে আছে ডিলন। তার চোখে সামান্য একটু সন্দেহের আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। ব্যাপারটা খেয়াল করল কেগল। নির্মল হাসল। বসের দিকে চেয়ে।
নিশ্চিত হয়ে বেনন আর ব্যাগলের দিকে তাকাল ডিলন। বিরক্তির সুরে বলল, আর কিছু বলবে তোমরা?
একটা কথাই শুধু বলব, বলল বেনন। তোমার প্রেমিকা শার্লি রাশল্যান্ডকে ট্রেইলের ওপর ধর্ষণ করতে যাচ্ছিল কেগল, আমি না ঠেকালে মেয়েটাকে কলঙ্কিত করত সে।
ছলাৎ করে রক্ত উঠে এলো ডিলনের মুখে। চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরল।
শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কেগল, মুখটা হাসি হাসি। তবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যে কেউ বুঝবে ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে লোকটার শরীর। যোলো আনা তৈরি হয়ে আছে ড্র করার জন্যে।
ঝটকা দিয়ে হোলস্টার থেকে অস্ত্রটা বের করে ফেলল মোটা জারম্যান। কর্কশ স্বরে সতর্ক করল, গোলাগুলি করতে চাইলে খবর আছে। অস্ত্রের দিকে কেউ হাত বাড়ালে ফুটো হয়ে যাবে।
বেননের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শ্রাগ করল ডিলন। দাঁতে দাঁতে পিষে বলল, অপেক্ষা করতে পারব আমি। বেনন হও আর ক্যানন হও, সময় এলে বুঝিয়ে দেব লাশের কিছু করার থাকে না।
পাশ ফিরতে শুরু করল বেনন, যেন ব্যাগলেকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে জেলখানা থেকে, পর মুহূর্তেই ঝটকা দিয়ে ঘুরল, বিদ্যুৎ গতিতে বের করে আনল সিক্সগান। বন্ধ জায়গায় গম্ভীর, একটা গর্জন ছাড়ল ৪৫ বুলেট। গুলির ধাক্কায় জারম্যানের হাত থেকে ছিটকে পড়ল অস্ত্র। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল জারম্যান। মাঝপথে জমে গেল হতভম্ব কেগলের হাত। সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে ডিলন, নড়ল না। হাসল বেনন, ইশারায় ডায়ারের মৃতদেহ দেখিয়ে বলল, তোমার হাত একটু বেশি চালু, জারম্যান। এতক্ষণ স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। এবার আমরা একটু শান্তিতে কথা বলতে পারব।
কিছু বলল না জারম্যান, দৃষ্টিতে ঝরে পড়ল অপরিসীম ঘৃণা।
ক্লিন্ট কোথায়? মৃদু গলায় জানতে চাইল বেনন। প্রচ্ছন্ন হুমকিটুকু চাপা থাকল না।
ডায়ারকে দিয়ে যাওয়ার একটু পরই চলে গেছে ও। শ্রাগ করল জারম্যান। কোথায় গেছে বলে যায়নি। বেননের অবজ্ঞার দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে বোতলে মনোযোগ দিল সে, চুমুক দিল মুখে তুলে।
ডিলনের দিকে তাকাল বেনন। পরামর্শ দেবার সুরে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না হলে শার্লি রাশল্যান্ডকে জিজ্ঞেস করে দেখো। ওর কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাস হবে? কোলের দিকে সিক্সগানের নল তাক করল ও। কেগল, বেশি চালাকি করতে যেয়ো না, শেষে হয়তো দেখবে তোমার হাতে ভাল কোন তাস নেই।
ডিলন বা কেগল, মুখে কেউ কিছু বলল না। কিন্তু ফোরম্যানের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল ডিলন।
ইশারা করল বেনন। জবাবে মাথা দোলাল ব্যাগলে। ব্যাগলের সহায়তায় দুই মিনিটের মাথায় উপস্থিত সবাইকে নিরস্ত্র করে ফেলল বেনন। ডায়ারের মৃতদেহের হাতে শক্ত হয়ে আটকে আছে জারম্যানের দেয়া সিক্সগান। ওটা খুলে নিল ব্যাগলে, দেয়ালের ব্র্যাকেট থেকে সগ্রহ করল একটা শাপস রাইফেল।
আমাদের পিছু পিছু বাইরে যাওয়া স্বাস্থ্যকর হবে না, মৃদুস্বরে উপদেশ দিল বেনন। শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা। লিভারি স্টেবলে তোমাদের অস্ত্র রেখে যাব, ওখান থেকে সগ্রহ করে নিয়ে।
লোকটা নিজেকে ভাবে কী! ক্রোধে রক্ত গরম হয়ে উঠল তিন বন্দির। সেটা জারম্যান আর কেগলের চেহারা দেখে বোঝা গেল। তবে ডিলনকে আগের মতোই শান্ত দেখাচ্ছে। হিসেব কষে দেখছে সে, জিত তারই হয়েছে। ক্লিন্ট ট্রিপল বার ছেড়ে দিয়েছে। বেনন আর ব্যাগলে, এই দুই উটকো ঝামেলাও এবার চলে যাবে নিজেদের পথে। ওদের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে দেরি করিয়ে দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই।
বাড়াবাড়ির সীমা ছাড়িয়ে গেছ তোমরা, হিসহিস করে বলল জারম্যান। উইলিয়াম পিঙ্কারটন কি মন্তব্য করেছে তাতে আর কিছু যায় আসে না। এর পরেরবার এই শহরে দেখলে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেব। সার্কিট জাজ আসার আগে পর্যন্ত পচতে হবে তোমাদের।
তার আগেই ওরা আমার হাতে মরবে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল কেগল। বৃটহিলে পচতে হবে ওদের।
কে কোথায় পচে সেটা দেখা যাবে সময় এলে, গম্ভীর চেহারায় বলল বেনন। ব্যাগলেকে ইশারা করে পিছাতে শুরু করল ও, দরজার কাছে চলে এলো। দেয়ালের পেরেক থেকে তুলে নিল জেলখানার সামনের দরজার চাবি।
ব্যাগলে আগে বেরল। তারপর অস্ত্রের মুখে শত্রুপক্ষকে রেখে বেরিয়ে এলো বেনন, দরজা বন্ধ করে তালা মেরে চাবিটা ফেলে দিল বোর্ডওয়াকের ফাঁক দিয়ে।
লিভারি স্টেবলে ঘোড়া আনতে গেল ব্যাগলে। রাস্তার উল্টোদিকে ছায়ায় সরে এসে জেলখানার ওপর লক্ষ রাখল নেন। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল, কেউ বেরল না। হাসল বেনন, আগুনটা হাতের আড়ালে রেখে একটা সিগার ধরাল। হুমকিটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ডিলন, কেগল আর জারম্যান।
দশ মিনিট পর সেলুনের চাপা গুঞ্জন ছাপিয়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেল ও! রাস্তার দু’পাশের আলোয় ব্যাগলেকে চেনা গেল। তার পাশে ঘোড়া ছুটিয়ে কে যেন আসছে। এক মুহূর্ত পর লোকটাকে চিনতে পারল বেনন। ক্লিন্ট ডসন!
ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো ও। ব্যাগলে ওর ঘোড়াটা নিয়ে এসেছে। চুপচাপ স্যাডলে উঠে বসল বেনন। একটু পরই রলিন্সের ট্রেইল ধরে টুইন স্প্রিংস শহরের বাইরে চলে এলো তিনজনের দলটা। শহরের বাইরে এসে থামল। ব্যাগলের মুখে ডায়ারের বিশ্বাসঘাতকতার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল ক্লিন্ট।
এখন বুঝতে পারছি ডিলন সব সময়েই সুবিধেজনক অবস্থানে ছিল, কিছুক্ষণ পর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল সে। ফোরম্যানই যদি বিরুদ্ধে কাজ করে তাহলে র্যাঞ্চ টেকানো অসম্ভব।
আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, সান্ত্বনা দিল বেনন। সায় দিয়ে মাথা দোলাল ব্যাগলে। আশা আছে। কি হয় বলা যায় না।
আমার আর কোন আশা নেই, হতাশ কণ্ঠে বলল ক্লিন্ট। ব্যর্থতা যেন গ্রাস করেছে ওকে। তিক্ত একটু হাসল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এখানে আর থাকব না। আমার লড়াই শেষ হয়ে গেছে। হেরে গেছি আমি। বিপদের সময় তোমরা সঙ্গী হয়েছিলে, অসংখ্য ধন্যবাদ। আজকেই এশহরে আমার শেষ দিন। এখন রলিন্সে যাব আমি। সেখান থেকে কোথায় যাব জানি না।
পকেটে হাত দিল ক্লিন্ট। বেনন আর ব্যাগলের মজুরীর টাকা বের করে গুনতে শুরু করল। ওদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার পর অতি সামান্য টাকাই থাকবে ওর কাছে।
চুরুটে কষে টান দিয়ে চাঁদের আবছা আলোয় ক্লিন্টের চেহারা গভীর মনোযোগে দেখল বেনন। খুক খুক করে কাশল। তারপর বলল, উপত্যকায় অন্তত পাঁচশো গরু আছে তোমার। এখনও আশা আছে র্যাঞ্চ টিকিয়ে রাখতে পারবে। তবুও তুমি চলে যেতে চাইছ। কারণটা কি? পিছিয়ে যাওয়ার লোক বলে তোমাকে মনে হয়নি আমার। মানুষ চিনতে খুব একটা ভুল করি না আমি।
ব্যক্তিগত কারণে চলে যাচ্ছি, বলল ক্লিন্ট। তোমরা বন্ধু স্থানীয়, তোমাদের বলতে আপত্তি নেই, ভয় পেয়ে পালাচ্ছি না আমি। লড়াইয়ে হেরে যাব সে-ভয়ে চলে যাচ্ছি না। আসলে মনটা ভেঙে গেছে আমার। করুণ হাসল ক্লিন্ট। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিল। ভেবেছিলাম ট্রিপল বারে বউ করে তুলব শার্লি রাশল্যান্ডকে। আমার ধারণা হয়েছিল ও আমাকে ভালবাসে। আজকে সেই ভুল ধারণা ভেঙে গেছে। দুদিন পর ডিলনকে বিয়ে করছে শার্লি। তাই আমি চলে যাচ্ছি। বুঝে গেছি শার্লির পছন্দের মানুষকে আমি খুন করতে পারব না। চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার। বলতে পারো শার্লিকে ভালবেসে আমি হেরে গেছি। ডিলন হারিয়ে দিয়েছে আমাকে।
বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল বেননের। নিজের কিছু স্মৃতি মনে পড়ল। মুখ ফুটে ভালবাসার মেয়েটিকে কিছু বলতে পারেনি ও। তার আগেই তো ও আউট-ল হয়ে গেল। পরে গিয়েছিল ও, দেখেছিল মেয়েটি সুখে সংসার করছে। দূর থেকেই দেখেছিল। মনে কোন তিক্ততা জন্মায়নি। এ তো স্বাভাবিক। মন। থেকে মেনে নিয়েছিল। ক্লিন্টের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওর নিজের বুকের ভেতরটাও হঠাৎ ফাঁকা ঠেকল।
চোখ ছলছল করে উঠল ব্যাগলের। অনুভব করল কত বড় মনের মানুষ হলে প্রেমিকার সুখের জন্যে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেউ।
তোমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু বলব না, কিছুক্ষণ পর বলল বেনন। তবে একটা অনুরোধ করব। আমাদের বেতন আপাতত তোমার কাছেই রাখো। চলে যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাও। তোমার সাহায্য দরকার হবে আমাদের।
ঠিক আছে, রাখছি আমি তোমাদের বেতন। সাহায্য? আমার সাহায্য লাগবে তোমাদের? হাসার চেষ্টা করল ক্লিন্ট। সাধ্য মতো সবকিছুই করব। বলল কি করতে হবে।
আমার ধারণা একটু পরই চিরতরে শহর ছাড়বে কেগল, বলল বেনন। ওকে আমি অনুসরণ করব। সঙ্গে তোমাকে চাই। ব্যাগলে এখানেই থাকবে, ডিলনের ওপর চোখ রাখবে।
নিশ্চয়ই যাব তোমার সঙ্গে। ভাবছ উপত্যকা থেকে চোরাই গরু সরাতে যাবে কেগল
যেতে পারে। সম্ভাবনা আছে। টুইন স্প্রিংসের দিকে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিল বেনন। চলো তাহলে। শহর থেকে বেরোনোর দুটো পথই দেখা যায় এমন জায়গায় থামব আমরা, লক্ষ রাখব কারা আসছে যাচ্ছে। কেগলকে কোথাও যেতে দেখলে অনুসরণ করব।
ব্যাগলেও চলল ওদের সঙ্গে। শহরের কাছে কোথাও অবস্থান নিয়ে ডিলনের জন্য অপেক্ষা করবে। দেখবে লোকটা কি করে। অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
০৯. ওদের এভাবে ছেড়ে দেবে নাকি
ওদের এভাবে ছেড়ে দেবে নাকি? বেননের পেছনে জেলখানার দরজা বন্ধ হতেই মার্শালের দিকে তীব্র চোখে তাকাল ডিলন।
চোখে কপট বিস্ময় নিয়ে র্যাঞ্চারকে দেখল জারম্যান। আশ্চর্য হয়ে গেছে। এমন ভঙ্গিতে বলল, আমি কি করব! আমি টুইন স্প্রিংসের মার্শাল হতে পারি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তোমার লড়াই নিজের কাঁধে নিতে হবে। ওদেরকে
ধরা যদি তোমার কাছে অত জরুরী হয়, তাহলে তুমি ধরো না গিয়ে।
রাগে লাল হয়ে উঠল ডিলনের চেহারা। জারম্যানের দিকে আঙুল তুলে বলল, যদি ভেবে থাকো আমার বিরুদ্ধে গিয়ে মার্শাল থাকতে পারবে তাহলে ভুল ভাবছ। তোমার পদবী কেড়ে নিতে দু’মিনিটও লাগবে না আমার। কেগলের দিকে ফিরল সে। আয়েস করে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট রোল করছে কেগল।
জিজ্ঞেস করল ডিলন, বেনন বলল শার্লিকে তুমি ধর্ষণ করতে চেষ্টা করেছিলে। কথাটা সত্যি?
সময় নিয়ে নিখুঁত ভাবে সিগারেট রোল করল কেগল। ধীরে সুস্থে ধরাল। তারপর চোখ তুলে তাকাল বসের দিকে। লোকটার চোখের ভাষা পড়ে চমকে গেল ডিলন। এতদিন ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাধেনি। সব সময়েই কেগল ফোঁশ নামিয়ে চলেছে। কিন্তু এখন তার দৃষ্টিতে আনুগত্যের কোন ছাপ নেই। আছে অবজ্ঞা আর বেপরোয়া দুঃসাহস।
বেনন মিথ্যে বলেনি, শান্ত স্বরে বলল সে। বেনন বাগড়া না দিলে দেমাগী মেয়েছেলেটাকে আমি জন্মের শিক্ষা দিতাম। ডিলনের চেহারায় পরিবর্তন দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল কেগল। হালকা সুরে বলল, অত চিন্তার কিছু নেই, ওকে আমি শেষ পর্যন্ত শিক্ষা দেইনি।
জবাব দিল না ডিলন, দ্রুত পায়ে সামনে বেড়ে ঘুসি মারল কেগলের চোয়ালে। পরপর কয়েকটা ঘুসি বসিয়ে দিল বুকে আর মুখে। পিছিয়ে গেল কোল, প্রস্তুত হয়ে নিল, তারপর পাল্টা আক্রমণ করে বসল। চমৎকার ওর ফুটওয়ার্ক, ডিলনকে ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিল। বিদ্যুৎ গতিতে কয়েকটা পাঞ্চ ঝাড়ল সে ডিলনের পেট লক্ষ্য করে।
কেগলের চেয়ে ডিলনের দেহ ভারী। শক্তিও বেশি। দ্রুততায় খুব একটা কম নয় সে। অবলীলায় পাঞ্চগুলো উপেক্ষা করল সে, ডানহাত ঘুরিয়ে কাঁধের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুসি মারল কেগলের চোয়ালে। ঝাঁকি খেয়ে মাথা পেছনে হটে গেল কেগলের। তাকে সামলে উঠতে না দিয়েই চটপট দুটো মাঝারী ওজনের পাঞ্চ বসাল পেটে। নড়বড়ে হয়ে গেল কেগল। আরও কয়েকবার পিস্টনের মতো। আগুপিছু করল ডিলনের হাত। মুখে পরপর কয়েকটা জোরাল ঘুসি বসিয়ে দিল। কলার ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে আরও কয়েকটা ঘুসি মারল সে আক্রোশ মেটাতে, তারপর ছেড়ে দিল লোকটাকে। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেল কেগল।
অখুশি চেহারায় ঘটনা ঘটতে দেখল মার্শাল। বুঝল আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া কোল তেমন একটা কাজের নয়।
মেঝেতে অনড় পড়ে আছে কেগল। বিষদৃষ্টিতে তাকে একবার দেখে নিয়ে মার্শালের টেবিলের কাছে চলে এলো ডিলন, বোতলটা তুলে চুমুক দিয়ে গলা ভেজাল।
নড়ে উঠেছে কেগল। মাথা নাড়ল কয়েকবার। মেঝেতে হাতের ভর দিয়ে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল। টলছে। গলা থেকে রুমাল খুলে ফাটা ঠোঁট আর ভাঙা নাকের রক্ত মুছল। একটু পরে পায়ে কিছুটা জোর ফিরে পেয়ে স্থির হয়ে দাড়াতে পারল।
তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করল ডিলন। বোতল থেকে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে।
বাইরে ঘোড়ার আওয়াজ হলো। থামল ঘোড়াগুলো। তারপর আবার চলে গেল। বেনন আর ব্যাগলে শহর ছেড়ে চলে গেছে। নিশ্চিত হয়ে জানালার ফ্রেমে প্রচণ্ড একটা লাথি মারল ডিলন। ভাঙা কাঁচের টুকরো ছিটকে পড়ল বোর্ডওয়াকে। জানালার ফাঁক দিয়ে বোর্ডওয়াকে বেরিয়ে এসে ক্যাসিনো সেলুনের দিকে পী। বাড়াল র্যাঞ্চার।
এবার কি? টেবিল থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে কোলের দিকে বাড়িয়ে দিল জারম্যান।
কাঁধ ঝাঁকাল কেগল। ওর দৃষ্টি ডায়ারের মৃতদেহের ওপর। রুমাল দিয়ে মুখের রক্ত মুছল। বলল, গরুগুলো বেচার ব্যবস্থা করতে হবে। আগামীকাল। দুপুরের আগে ড্রাইভ শুরু করতে পারব আমরা। বার কিউতে গিয়ে লোক নিয়ে উপত্যকায় চলে যাব।
ডিলনের কি হবে? পিট্টি খাওয়ার পরও ওকে ছেড়ে দেবে? তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে জারম্যান। কেগলের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়। কিন্তু কেগল শুধু হাসল। গোপন পরিকল্পনার সফলতা সম্বন্ধে ভাবলে মানুষ ওরকম করে হাসে।
ওকে খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছে নেই আমার। তবে সামনে যদি পাই তাহলে সীসে দিয়ে হিসেব চুকিয়ে দেব। হাসল গেল। সামনে পাব তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের পেছনে ছুটে আসবে সে। তখন আমার কাছে দুটো সিক্সগান থাকবে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মার্শাল। বুঝতে পারছে কিছু একটা তার কাছে গোপন রাখছে কেগল। কিন্তু এই মুহূর্তে গানম্যানকে ঘাঁটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। চুপ করে থাকল জারম্যান।
মুখ থেকে রক্তের শেষ ফোঁটাগুলোও মুছে ফেলল কেগল। ফাঁসফেঁসে গলায় জানতে চাইল, আসছ তুমি? ডিলন যদি অনুসরণ করে তাহলে এজেন্টের হাতে গরুগুলো তুলে দিয়ে আবার ফিরে আসা যাবে। যদি সে পিছু না নেয় তাহলে গরু বেচে চলে যাব আর কোথাও।
জেলখানার ভেতরে ঘুরে এলো জারম্যানের দৃষ্টি। ডায়ারের মৃতদেহের দিকে তাকাল না। শ্রাগ করল। আফসোস করার কিছু নেই। এখানে মূল্যবান কিছু ফেলে যাচ্ছে না সে। দুর্নীতিপরায়ণ ইন্ডিয়ান-এজেন্টের কাছে চোরাই গরু বেচে যে টাকা লাভ পাবে তা মার্শালের আট বছরের বেতনের চেয়ে বেশি।
ঠিক আছে, বলল জারম্যান। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
ভাঙা জানালা দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেল কেগল, বাইরে অপেক্ষা করল। ব্যস্ত হাতে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল জারম্যান। দেয়াল সিন্দুক খুলে একতাড়া টাকা বের করে পকেটে পুরল। তারপর কেগলের সঙ্গে চুলল স্টেবলে।
ওই যে ওরা আসছে, ফিসফিস করে বলল ব্যাগলে। বেনন আর ক্লিন্ট কান পাতল। কোন শব্দ শুনতে পেল না। প্রায় দশ সেকেন্ড পেরিয়ে গেল, তারপর শীতল বাতাসের ফিসফিসানি ছাপিয়ে আওয়াজটা শুনতে পেল ওরা। একাধিক অশ্বারোহী আসছে।
মাথার ওপর চাঁদটা বেশ জোরাল আলো ছড়াচ্ছে। একটা টিলার মাথায় পাইন জঙ্গলের সীমানায় গাছের নিচে অন্ধকারে আছে ওরা। ট্রেইলের খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছে। দুটো টিলা টুইন স্প্রিংস শহরের গা ঘেঁষে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওদুটোর মাঝ দিয়ে বেরিয়েছে ট্রেইল। এমুহূর্তে চন্দ্রালোকিত। চাঁদের আলোয় লোক দুজনকে চিনতে দেরি হলো না ওদের কারও।
জারম্যানের স্যাডল রোলটা আমার বউয়ের চেয়েও মোটা, বিড়বিড় করল ব্যাগলে। গলা একটু উঁচিয়ে বলল, এলাকা ছাড়ছে মার্শাল।
আমারও তাই ধারণা, সায় দিল ক্লিন্ট। কেগলের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছে লোকটা? নিশ্চয়ই ব্যাঙ্ক ডাকাতদের ট্র্যাক করতে নয়?
ডিলন শহরেই আছে তাহলে, বলল ব্যাগলে। আজ রাতে একটু ঘুমাতে পারব।
অতটা আশা কোরো না, বলল বেনন। এক্ষুণি রওনা হয়ে যাও। টুইন স্প্রিংসে গিয়ে চোখ-কান ভোলা রাখবে। কি হয় বলা যায় না।
একটা বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেছে কেগল আর জারম্যান। তাদের ঘোড়ার খুরের শব্দও আর নেই। টিলা থেকে নেমে শহরের দিকে চলল ব্যাগলে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল বেনন আর ক্লিন্ট, তারপর ওরাও টিলা থেকে নেমে এলো, কেগল আর জারম্যানকে অনুরণ করতে শুরু করল। ঘোড়ার গায়ে বাড়তি যা কিছু ছিল সব বেঁধে নিয়েছে ওরা, যাতে কোন আওয়াজ না হয়। স্পারগুলো খুলে রেখে দিয়েছে স্যাডল ব্যাগে। স্যাডলে তেল মালিশ করেছে ক্যাচকোচ আওয়াজ কমানোর জন্যে। ঘোড়াগুলোর খুরে কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছে। রাতে অনেক দূর থেকে আওয়াজ পাওয়া যায়।
সতর্কতায় কোন ঢিল নেই বেননের। ওর সাবধানতা দেখে ক্লিন্টও সমান সজাগ হয়ে উঠেছে। সামনে কোথাও থামতে পারে কেগল আর জারম্যান। তাদের ফাঁদে পড়ার কোন ইচ্ছে নেই ওদের। কাজেই সাবধানে এগোচ্ছে ওরা। গতি খুব একটা দ্রুত নয়।
বার কিউয়ের ট্রেইল যেখানে মূল ট্রেইলের সঙ্গে মিশেছে সেখানে এসে আরও মনোযোগী হয়ে উঠল বেনন। এতক্ষণে বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার কথা। কেগল আর জারম্যানের। বার কিউয়ের ট্রেইলে উঠেছে তারা, ট্র্যাক গোপন করার কোনরকম চেষ্টা করেনি। লোকগুলো হয় ধরে নিয়েছে কেউ তাদের অনুসরণ করবে না, নয়তো তোয়াক্কা করছে না।
দীর্ঘ ক্যানিয়ন পার হয়ে খোলা জমিতে চলে এলো বেনন। ট্রেইল এখানে সরু একটা ধুলোময় দাগ। দু’পাশে হাঁটু সমান লম্বা ঘন তাজা ঘাস। ক্ষণিকের জন্যে কেগল আর জারম্যানকে একটা রিজের ওপর দেখতে পেল ওরা। ক্লিন্টকে শান্ত করার জন্যে কাঁধে একটা হাত রাখল বেনন। ফিসফিস করে বলল, এখন থেকে আরও অনেক হুঁশিয়ার হয়ে চলব আমরা। কেগল সাবধানী লোক। হাতটাও। চালু। অসাবধান হলে হঠাৎ হয়তো দেখব ওর সিক্সগানের নলের দিকে চেয়ে। আছি।
ওরাও দু’জন আমরাও দু’জন, বলল গম্ভীর ক্লিন্ট। লড়তে আমার আপত্তি নেই। কেগলকে আমি নেব।
বিরক্ত হলেও বিরক্তি প্রকাশ করল না বেনন। বলল, দরকার হলে আমি একাই কেগল আর জারম্যানের মুখোমুখি হতে পারব। আমার কথা সেটা নয়। আমি জানতে চাই ওরা কি করতে চাইছে। ওদের উদ্দেশ্যটা কি।
অনিচ্ছুক চেহারায় বেননের কথা মেনে নিল ক্লিন্ট। বেননকে ঘোড়ার গতি নির্ধারণ করতে দিল। পেছনে পেছনে ঘোড়া চালাচ্ছে সে, চোখ সর্বক্ষণ বেননের ওপর। উত্তেজিত হয়ে আছে স্নায়ু। বিপদ দেখলেই অস্ত্র বের করবে।
সামনের রিজটার ওপরে উঠে ঘোড়া থেকে নামল বেনন। টিলার ওপাশটা ঢালু হয়ে অতি ধীরে মিশে গেছে সমতল জমির সঙ্গে। জমিতে প্রচুর ঘাস। চাঁদের আলোয় গরুর ছোট ছোট দল দেখা যাচ্ছে। প্রথম দলটাকে এখন পাশ কাটাচ্ছে কেগল আর জারম্যান। ওখানে একটু থামল তারা। আরও তিনজন লোক উদয় হলো অন্ধকার থেকে। কিছুক্ষণ কোন একটা বিষয়ে কথা হলো তাদের মাঝে। তারপর দল থেকে আলাদা হয়ে একজন এগোল বার কিউয়ের র্যাঞ্চ বিল্ডিঙের। দিকে। অন্যরা আরও কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর ধীর গতিতে গরুগুলোকে পাশ কাটিয়ে উত্তর-পশ্চিমে চলল।
লোকগুলো অনেকদূরে চলে যাওয়ার পর জায়গা থেকে নড়ল বেনন। এখন ও জানে উত্তর-পশ্চিমে কোথায় যাচ্ছে অশ্বারোহীরা। আন্দাজ করতে পারছে বার। কিউয়ের দিকে যে-লোকটা গিয়েছে সে কেগল ছাড়া আর কেউ নয়।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, বলল বেনন।
কি?
জারম্যান এখন আইনের পক্ষে কাজ করছে না। স্যাডলে চাপল বেনন।
বোকাও বুঝবে মুখ বন্ধ করার জন্যেই ডায়ারকে খুন করেছে মার্শাল।
ডায়ার মারা গেছে?
চলো, যেতে যেতে বলি। ঢাল বেয়ে নামছে বেনন। পাশে চলেছে ক্লিন্ট। গভীর মনোযোগে বেননের কথা শুনছে। আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে কঠোর এই লোকটা মাঝপথে থামার মানুষ নয়। একবার যখন জড়িয়ে গেছে, শেষ দেখে ছাড়বে। তাতে ওর কোন লাভ নেই, ভাবল ক্লিন্ট। শার্লির ভালবাসা পাবে না ও। কিন্তু শেষটা দেখে যেতে অসুবিধে কী? নাহয় চিরতরে চলে যাবার আগে একটু বেশি সময় রয়েই গেল প্রিয় এই অঞ্চলে।
গরুগুলোকে অনেক দূর দিয়ে পাশ কাটাল বেনন! কোন পাঞ্চার বা রাতের প্রহরীর মুখোমুখি হবার ইচ্ছে নেই ওর। গোলাগুলি হলে সচেতন হয়ে যাবে। কেগল। তারচেয়ে গতি বাড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা ভাল। ওর ঘোড়াটা সাবধানী, রাতেও জোরে ছুটতে অসুবিধে নেই, কোন গফারের গর্তে পড়ে পা মচকাবে না। ক্লিন্টের ঘোড়ারও একই গুণ থাকবে, মনে মনে আশা করছে ও।
মাঝে মাঝে গতি বাড়িয়ে, কখনও কখনও ঘুরপথে এগোলেও কেগলকে ঠিকই নজরে রাখল বেনন। একবার এত কাছে চলে গেল যে কেগলকে চিনতেও। পারল চাঁদের আলোয়। কাছে চলে আসছে ডিলনের র্যাঞ্চ হাউজ। আর মাইল। তিনেক, তারপরই ট্রেইল বাঁক নিয়ে ঢুকেছে ডিলনের র্যাঞ্চ হাউজের উঠানে। জমির ঢেউগুলো অতি সাবধানে পার হচ্ছে বেনন। উল্টোপাশে কি আছে আগে থেকে জানার কোন উপায় নেই।
আধঘণ্টা পর শেষ ঢেউটা পেরিয়ে এলো ওরা। এক পাশে লাল সিডারের জঙ্গল। সামনে দেখা যাচ্ছে ডিলনের র্যাঞ্চ হাউজ। কেগল বড়জোর এক মিনিটের পথ সামনে আছে দেখে নিজের দক্ষতায় খুশি হয়ে উঠল বেনন। জঙ্গলের সীমানায় ঘোড়া গ্রাউন্ড হিচ করে পায়ে হেঁটে সামনে বাড়ল এবার। বেননের পাশে নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুত পায়ে হাঁটছে ক্লিন্ট।
নিজে কিছু করতে যাবে না, তরুণ র্যাঞ্চারকে বলল বেনন। যা করার আমি করব। দূর থেকে চোখে চোখে রাখতে চেষ্টা করবে কেগলকে। ও বার কিউ ছেড়ে বেরনোর পর আমরা পিছু নেব।
আপত্তির ইচ্ছে থাকলেও মুখে কিছু বলল না ক্লিন্ট।
বিনা বাধায় করালের কাছে চলে আসতে পারল ওরা। এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে বাতাসের গতি দেখে নিল বেনন। করালের দিক থেকে ওদের দিকে বইছে বাতাস। এবার চলার গতি মন্থর হয়ে গেল। ঘোড়াগুলো অপরিচিত গন্ধ পাবে না, কিন্তু একটু আওয়াজ পেলেও হ্রেষাধ্বনি করে উঠবে। নিরাপদেই কঁরাল ছাড়িয়ে র্যাঞ্চ হাউজের ছায়ায় চলে এলো বেনন আর ক্লিন্ট। সেখান থেকে বাঙ্ক হাউজের কাছে। দরজা খোলা। পাশে দাঁড়িয়ে সাবধানে উঁকি দিল বেনন। মাত্র একজন আছে। ঘুমাচেছ। আর সব বাঙ্ক খালি।
ব্ল্যাক স্মিথের ঘরের কাছে চলে এলো ওরা। এখানে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। স্টেবলে অস্থির ভাবে পা ঠুকছে একটা ঘোড়া। শক্ত করে ক্লিন্টের হাত ধরে থাকল বেনন, যাতে উঠানে পা না বাড়ায় ক্লিন্ট। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, ঘোড়ার পা ঠোকার শব্দে কেউ খোঁজ নিতে এলো না।
বারান্দার নিচে একটা হিচরেইলে কেগলের ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে। বেনন আর ক্লিন্ট পা বাড়াতেই ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দেখল জন্তুটা, কিন্তু ডেকে উঠল না।
ক্লিন্টকে এগোতে ইশারা করল বেনন। নিজে চলে এলো র্যাঞ্চ বিল্ডিঙের পেছনে। ওখানে একটা ছোট ঘর দেখে তার পেছনে অবস্থান নিল। ওটা পেইন্ট স্টোর। ঘর থেকে রঙের গন্ধ আসছে। একটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেনন। কোল আগে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিক, তারপর বাড়ির ভেতরে ঢুকবে ও।
দোতলার একটা জানালায় আলো জ্বলল। জানালার পাল্লায় ছায়া নড়ছে। চৌকো আলোটার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল বেনন। কেগল চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পর আলোটা নিভে গেল।
একটা বন্ধ জানালা খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেনন। নিঃশব্দ পায়ে বারান্দায় উঠল ক্লিন্ট, জানালার কিনারায় উঁকি দিল।
ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এসেছে কেগল। ওর হাতে একটা লণ্ঠন। হলদেটে আলোয় ওকে দেখতে পেল ক্লিন্ট। লণ্ঠনের কাঁচের একটা দিক টিনের পাত দিয়ে ঢাকা, যেকারণে আলোটা শুধু সামনের দিকে যাচ্ছে। দেয়ালের পাশ থেকে একটা টেবিল সরাল কেগল। নামিয়ে ফেলল একটা অয়েল পেইন্টিং। পেছনে সিন্দুকের ডালা, দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে। টেবিলের ড্রয়ার ঘেঁটে একটা চাবি নিয়ে সিন্দুকটা খুলে ফেলল কেগল। টেবিলের ওপর লণ্ঠনটা রেখে সিন্দুকের যাবতীয় জিনিস টেবিলের ওপর রাখল। হাসল হলুদ দাঁত বের করে।
টেবিলের ওপর টাকার বান্ডিল রেখেছে কেগল। সেগুলোর মধ্যে দুটো বান্ডিলের গায়ে ইস্ট ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের লেবেল সাঁটা। মাথাটা ঝাঁঝ করে উঠল ক্লিটের। বান্ডিল দুটো চিনতে পারছে ও। ওগুলো ওর টাকা, মিস্টার রাশল্যান্ডের কাছে রাখতে দিয়েছিল। গরু বেচে টাকাগুলো পেয়েছিল ক্লিন্ট। ক্রেতার কাছ থেকে নগদ না নিয়ে একটা চেক নেয় সে। সেই চেক ভাঙানো টাকা ওগুলো। ডিলনের শত্রুতার মাত্রা ক্লিন্টকে বিস্মিত করল। একই সঙ্গে এই ধারণাও হলো যে মিস্টার রাশল্যান্ড আর ক্লার্ক ক্রিসির মৃত্যুর জন্যে ডিলনই দায়ী। আর দুদিন পর ডিলন বিয়ে করবে শালিকে!
অদম্য রাগে চোখে আঁধার দেখল ক্লিন্ট। কি করছে বুঝতে পারল না, তার আগেই পৌঁছে গেল দরজার কাছে। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলল। নিজেও জানে না কখন সিক্সগান বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে।
খবরদার, কেগল! চিৎকার করল ক্লিন্ট। কিন্তু কেগল অনেক দ্রুত এবং অভ্যস্ত।
বাঁকিয়ে রাখা পাকা বাঁশের কঞ্চি ছেড়ে দিলে যেমন ঝটকা দিয়ে সোজা হয়, তেমনি করে সটান দাঁড়িয়ে গেল কেগল, লণ্ঠনটা তুলে নিয়েই ছুঁড়ে দিল ক্লিন্টকে লক্ষ্য করে। পর মুহূর্তে লাফ দিয়ে সরে গেল। অস্ত্র বের করে গুলি করল সাবলীল। ভঙ্গিতে।
কেগলের অবস্থান লক্ষ্য করে আন্দাজে গুলি করল ক্লিন্ট, তারপর প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা, পড়ে গেল মাটিতে। জ্ঞান হারাল। ওর অচেতন দেহের দুই ফুট দূরে মেঝেতে পড়ে ফেটে গেল লণ্ঠনের কাঁচ, কাঠের মেঝেতে তেল ছড়িয়ে পড়ল। আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে।
টেবিলের ওপর থেকে টাকাগুলো তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি একটা স্যাডল ব্যাগে ভরে ফেলল কেগল, দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি ছেড়ে।
বাঙ্ক হাউজ থেকে এক হাতে চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এসেছে কাউবয়, অন্য হাতে একটা সিক্সগান। র্যাঞ্চে সে ছাড়া আর কারও থাকার কথা নয়। কেগলকে দেখে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।
বাড়ির পেছনে যাও, পাল্টা চেঁচাল কেগল। হামলা করেছে। পেছনে আছে! একজনকে আমি আহত করেছি।
আচ্ছা, কেগল! ভারী শোনাল সদ্য ঘুম থেকে ওঠা কাউবয়ের গলা। দুপদাপ পা ফেলে র্যাঞ্চ হাউজের কোনা ঘুরে ছুটল সে।
দাঁত বের করে হাসল কেগল। ডাকাতির সঙ্গে ক্লিন্টকে সুন্দর ভাবে জড়ানো গেছে। জলদি করে ঘোড়ায় উঠে রওনা হয়ে গেল সে। একটু পরই খোলা প্রান্তরে চলে এলো। একবার পেছনে তাকাল। আগুন ধরে গেছে র্যাঞ্চ হাউজে। একটু পর করালেও লাগবে। ঝতাস ছাড়লে বাঙ্ক হাউজটাও রক্ষা পাবে না। তাতে কি এলো গেল! গুলির আওয়াজ পেয়েই বাড়ির সামনে যাওয়ার জন্যে দৌড়াতে শুরু করল বেনন। লোকটার সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খেল ও। পরস্পারকে জড়িয়ে ধরল। দূর থেকে দেখলে কেউ ভাববে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলাকুলি করছে।
কে তুমি! কর্কশ স্বরে জানতে চাইল চমকিত কাউবয়।
তাতে তোমার কী! চড়াৎ করে এক চড় বসিয়ে দিল বেনন লোকটার গালে। কাউবয়ের সম্বিৎ ফেরার আগেই বের করে আনল সিক্সগান, ওটার নল দিয়ে মাঝারী একটা বাড়ি মেরে আবার কিছুক্ষণের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে দিল ঘুম ভাঙা কাউবয়কে। লোকটাকে শুইয়ে দিয়ে দৌড়ে এগোল সামনে। বাড়ির কোনা ঘুরে আগুনের আভা দেখতে পেল। বারান্দায় লাফ দিয়ে উঠল ও, দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল ক্লিন্টকে। আগুন প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে র্যাঞ্চারকে। দু’হাতে। অচেতন দেহটা তুলে উঠানে চলে এলো বেনন। জ্ঞান ফিরছে: ক্লিন্টের। ব্যথায় মুখটা কুঁচকে গেল। চোখ খুলল। ঠোঁট ফাঁক করে অস্ফুট স্বরে গোঙাতে শুরু করল।
ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখছে বেনন। কাঁধের মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেছে গুলি, গুরুতর কিছু নয়। তবে রক্ত পড়ছে বেশ। বন্ধ করতে না পারলে একটু পরই। কাহিল হয়ে পড়বে র্যাঞ্চার। রুমাল দিয়ে প্যাড বানিয়ে আপাতত রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা করল বেনন। মুখে বলল, অবস্থা এরচেয়ে অনেক খারাপ হতে পারত।
ওকে ধরতে পেরেছ? ফাসফেঁসে গলায় জানতে চাইল ক্লিন্ট।
না। ভেগেছে।
ডিলনের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে ও, বিড়বিড় করল ক্লিন্ট। ব্যাঙ্ক ডাকাতির টাকা চুরি তো করেইছে, র্যাঞ্চ হাউজটাও পোড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। ডিলনের সিন্দুকে আমার টাকাও ছিল। দেখেছি আমি।
আমি জানতাম ডাকাতির সঙ্গে ডিলন জড়িত। প্যাডের ওপর আরেকটা রুমাল দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করল বেনন। কি মনে হয়, শরীরের এই অবস্থায় ঘোড়ায় চড়ে শহরে ফিরতে পারবে?
পারব। উঠে বসল ক্লিন্ট। আমি দুঃখিত, তোমার নিষেধ না শুনে কেগলের ওপর চড়াও হতে গিয়েছিলাম। উচিত ছিল ও রওনা হবার পর পিছু নেয়া।
তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। শ্রাগ করল বেনন। ব্যাঞ্চ হাউজের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, তুমি থাকো, আমি একজনকে নিয়ে আসছি। আশা করছি ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাব।
ক্লিন প্রমাণ করে দিল দুর্বল চিত্তের মানুষ নয় সে। চোখের কোণে বেনন দেখল স্টেবলের দিকে যাচ্ছে ক্লিন্ট। একটু পরই স্টেলে আগুন লাগবে। আগুনের ভয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠছে ঘোড়াগুলো। ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া দরকার। সে-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে ক্লিন্ট।
র্যাঞ্চ হাউজের পেছনে যেখানে শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেখানেই কাউবয়কে পেল বোন। লোকটাকে কাঁধে করে উঠানে ফিরে এলো। মুখে হালকা কয়েকটা চড়চাপড় মারতেই তার চটকা ভাঙতে শুরু করল।
আগেই ভয় দেখিয়ে রাখলে কাজ আদায় করা সহজ হবে। সিক্সগানের মল লোকটার চোখের ওপর তাক করল বেনন। টের পেল ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়ে পাশে এসে দাড়িয়েছে ক্লিন্ট। চুপ করে অপেক্ষা করছে র্যাঞ্চার। চোখ খুলল লোকটা। প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু মাত্র দু’সেকেন্ডে ঘোলা দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে গেল তার। আগুনের তাপে লালচে দেখাচ্ছে মুখ।
একটা মিথ্যে বললেই স্রেফ শকুনের ভোজ হয়ে যাবে, ভয়ঙ্কর চেহারা করে হুমকি দিল বেনন। পিছিয়ে সরে দাঁড়াল। ওঠো!
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল কাউবয়। বেননকে নিঃসন্দেহে চিনতে পেরেছে। চোখ পিটপিট করে তাকাল। দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তা। ক্লিন্ট আছে কি নেই সেটা বোধহয় জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না। সমস্ত মনোযোগ বেননের ওপর।
তোমার দু’চোখে আমি ভয় দেখতে পাচ্ছি না, বলল বেনন। এ সেই ট্যাড়া কাউবয়। একটা চোখ বেননের ওপর থাকলেও আরেকটা চোখ তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত স্টেবলের দিকে। গলা খাঁকারি দিল বেনন। নাম কি?
জিম হরিবল।
হরিবল? হাসি চাপল বেনন। মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল। হরিবল কেন?
ছেলেবেলায় বন্ধুরা ডাকত। পরে নামের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছি। শুনতে ভাল লাগে।
তো, হরিবল, বার কিউতে কোন মাইনারকে দেখেছ তুমি?
হ্যাঁ। মাথার ফোলা জায়গাটায় হাত বোলাল ট্যাড়া জিম। ব্যথায় মুখ কুঁচকাল। কয়েক মাস আগে বুড়ো ডিন লেভার এসেছিল।
তারপর? সে কোথায়?
মারা গেছে। পাহাড় থেকে যখন আসে তখনই অসুস্থ ছিল। পাইনের জঙ্গল দেখাল জিম। ওখানে ওকে কবর দেয়া হয়েছে।
তারপর? তারপর কি?
অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল বেনন। অস্ত্র নেড়ে নীরব হুমকি দিল। তার ঘোড়া নিয়ে শহরে কে গিয়েছিল?
ইতস্তত করল জিম হরিবল। তারপর বেননের চোখের দিকে তাকিয়ে আত্মার পানি শুকিয়ে এলো ওর। বরফের মতো শীতল চোখে খুনির দৃষ্টি। ভয় পেয়েছে বোঝাতে মুখ কুঁচকে বিদঘুঁটে একটা চেহারা পাকাল। বেনন কটমট করে তাকাতেই তাড়াতাড়ি করে বলল, ডেভ কওসন। দুই সপ্তাহ দাড়ি কামায়নি, ব্যাটা নোংরা ভূত! তারপর একদিন ডিন লেভারের ঘোড়া নিয়ে শহরে গেল। ফিরে এসে দাড়ি কামিয়ে ফেলল। তারপর আর শহরে যায়নি, পাওনা বেতন বুঝে নিয়ে চলে গেছে।
ওকে সেই মাইনার বলে চিনতে পারবে শহরের কেউ?
না। ওয়ালনাটের কষ মেখে সোনালী দাড়ি কালো করে নিয়েছিল ও। কেউ যদি বলে মাইনারের চেহারার সঙ্গে মিল আছে তার, তাহলে দাড়ি রেখে দেখিয়ে দেবে তার দাড়ি সোনালী।
বাহ্, ভাল উপকার করছ তুমি। চালিয়ে যাও। আর মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন। ঠিক মতো যদি জবাব দাও তো মরবে না।…যেদিন রাশল্যান্ড আর ক্রিসি মারা গেল
সেদিন শহরে গিয়েছিলে তুমি?
গত দু’মাসে আমি শহরে যাইনি, মিস্টার! ভাঙা গলায় বলে উঠল জিম। তার ভয় হলো বেনন সন্দেহ করে গুলি করে দেবে। আবেদনের ভঙ্গিতে দুহাত সামনে বাড়াল। র্যাঞ্চের কাজ করছি আমি। তিনজনের কাজ আমাকে দিয়ে একা করিয়ে নিচ্ছে ডিলন।
ভাল মতো আগুন ধরেছে র্যাঞ্চ হাউজে। একতলা ছাড়িয়ে দোতলাকে জিভ দিয়ে চাটছে লেলিহান শিখা। স্টেবলের ছাদেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের মতো আলোকিত হয়ে আছে উঠান। আঁচ এসে লাগছে ওদের গায়ে। ঘামছে বেনন আর জিম হরিবল। ক্লিন্ট কিছুটা দূরে গিয়ে মাটিতে বসে আছে।
যেদিন ব্যাঙ্ক ডাকাতি হলো সেদিন কতজন ছিল র্যাঞ্চে?
জ কুঁচকে ভাবল জিম। উত্তর সোজাসুজি দেয়াই ভাল। ডিলন তাকে কিছু করতে পারবে না। এখানে যা হচ্ছে আর এখানে থাকা চলে না। ডিলন তাকে খুঁজে পেলে তো! লোকটা ওকে দিয়ে চোরাই গরু ব্র্যান্ড করিয়েছে, তিনজনের কাজ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, এরপর এমন কিছু করতে বলবে যে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে চড়তে হবে। না, সোজাসুজি বলে দেয়াই ভাল। গানম্যানদের একজনও ছিল না ব্যাঙ্ক ডাকাতির দিন। পরদিন্ লাশ যখন পাওয়া গেল তখন অবশ্য সবাই এখানে ছিল।
আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাসল বেনন, হোলস্টারে পুরে রাখল সিক্সগান। ফোঁশ করে জিমকে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে দেখে বলল, শহরে যদি যেতে চাও, আমাদের সঙ্গে যেতে পারো। আমার বন্ধুর কাছে শুনেছি তোমার হাতের কাজ ভাল। ক্লিন্টের ওখানে ভাল বেতনে চাকরি পাবে।
ডিলন মেরে ফেলবে আমাকে।
ডিলন নিজেই মরবে, গম্ভীর হয়ে গেল বেননের চেহারা। তোমাকে আমাদের দরকার। তুমি সাক্ষ্য দিতে পারবে। ভয়ের কিছু নেই, লক্ষ রাখা হবে যাতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে না পারে। একটু থামল ও, তারপর বলল, অবশ্য তার দরকার হবে বলে মনে হয় না। ডিলন এখন নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে থাকবে।
জ্বলন্ত র্যাঞ্চ হাউজটা দেখল জিম হরিবল। এই প্রথম হাসল। আস্তে করে মাথা দোলাল। বলল, ঠিক আছে, তোমাদের সঙ্গে যাব আমি।
১০. টুইন স্প্রিংসের স্টেবলে ঘোড়া
টুইন স্প্রিংসের স্টেবলে ঘোড়াটা রেখে ক্যাসিনো সেলুনের কাছে চলে এলো ব্যাগলে। গাঢ় ছায়া দেখে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে উঠল। উঁকি দিল ক্যাসিনোর ব্যাট উইং ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে।
ওর কপালটা ভাল। ডিলনকে দেখতে পেল ও। পাঞ্চারদের সঙ্গে কথা সেরে ভেতর-দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে ডিলন। ওদিকে ক্যাসিনো সেলুনের হোটেল সেকশন।
সরে এলো, ব্যাগলে, রাস্তার উল্টোদিকে ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল। আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল অতি ধীরে। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন পাঞ্চার সেলুনে ঢুকেছে এবং বের হয়েছে, কিন্তু ডিলনের কোন দেখা নেই। নরম বিছানায় গরম কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছে ডিলন, ভাবল ব্যাগলে। হঠাৎ করে মনে হলো অনেকদিন ভাল ঘুম হচ্ছে না ওর। একটু ঘুমিয়ে নিলে বেনন নিশ্চয়ই রাগ করবে না? বেনন তো আর চাইবে না ঘুমের অভাবে পাগল হয়ে যাক ও!
কাজেই সেথ হারবেনের হোটেলে একটা কামরা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পনেরো মিনিটের বেশি সময় নিল না ব্যাগলে।
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল ওর। মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কুরকুর করতে লাগল। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে নিয়ে হারবেনের দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ও। সামনেই সদর রাস্তা। তেমন ভাবে লোক চলাচল শুরু হয়নি এখনও। এই মাত্র ছেড়ে গেল রলিন্সের স্টেজকোর্চ। রাস্তার বাঁক ঘুরল ভারী একটা স্কুনার, হার্ডওয়্যার স্টোরের সামনে থামল। নেমে এলো ড্রাইভার, দমাদম পেটাচ্ছে দোকানের বন্ধ দরজা। একটু পর দোকানের দরজা খুলে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে বউনিতে ব্যস্ত হয়ে গেল দোকানদার। ক্যাসিনো সেলুন থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এলো কয়েকজন পাঞ্চার। হিচরেইল থেকে ঘোড়ার দড়ি। খুলল তারা, ধীর গতিতে চলল রলিন্সের পথে। পাঞ্চারদের চেহারা দেখে ব্যাগলে বুঝল, রলিন্সের পথে অর্ধেক যাওয়ার আগে নেশা কাটবে না লোকগুলোর। বেশ কয়েকজন ঢুকল চাইনিজ চপ হাউজে। পশ্চিমের শহরে সকালবেলায় এগুলো স্বাভাবিক দৃশ্য। আয়েস করে দরজার পাল্লায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল:ব্যাগলে, একটা গি ধরল।
একটু পর সেথ হারবেনন এলো। নাগলের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে খানিক পর ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। ব্যাগলের মনে শান্তি নেই। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বারবার বেননের চেহারা চোখে ভাসছে! সহজ একটা দায়ত্ব দিয়ে। গিয়েছিল বেনন। ব্যর্থ হতে হলে খুবই লজ্জার কথা।
আরও দু’ঘণ্টা পর ব্যাগলের মনের মেঘ কাটল। আফসোস হলো হারবেশের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারেনি বলে। ওই তো দেখা যাচ্ছে ডিলনকে! ক্যাসিনো সেলুনের দরজা ঠেলে এই মাত্র বোর্ডওয়াকে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা। ধীরেসুস্থে একটা সিগার ধরাল।
দরজার কিছুটা ভেতরে সরে এলো ব্যাগলে। এখন ডিলন ওকে খেতে পাবে, কিন্তু ও ঠিকই ডিলনকে দেখতে পারবে।
ভাল জায়গা বেছেছে ব্যাগলে। জরুরী কিছু ওর নজর এড়াচ্ছে না। উল্টোপাশের বোর্ডওয়াক ধরে হেঁটে আসছে শার্লি রাশল্যান্ড। ডিলনকে দেখে চলার গতি একটু কমে গেল। ক্ষণিকের জন্যে চেহারায় ছায়া ফেলল অপছন্দের ছাপ। পাশের একটা দোকানে চট করে ঢুকে গেল মেয়েটা। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল ডিলন, তারপর রাস্তা পার হয়ে সে-ও দোকানে ঢুকল। একটু পরই বেরিয়ে এলো শার্লি। তার পাশে আঠার মতো লেগে আছে ডিন। এক হাতে মেয়েটার কাঁধ জড়িয়ে ধরেছে। শার্লির আচরণে একটা আড়ষ্ট ভাব আছে, নজর এড়াল না ব্যাগলের। তবে অনুভূতি গোপন করতে চেষ্টা করছে মেয়েটা।
সিগারেটে কষে টান দিল ব্যাগলে। মনটা হঠাৎ করেই খুব ভাল হয়ে গেল। একটা ব্যাপারে ক্লিন্ট ভুল করেছে। এই মেয়ে ডিলনের প্রেমে পড়েনি। ক্লিন্টকে যদি ফিরিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে তার অন্য কোন কারণ আছে।
ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন কাউবয়। তাকে উদ্দেশ্য করে হাঁক ছাড়ল ডিলন, কেগলকে বলো সবাইকে নিয়ে বার কিউতে যাবার জন্যে যেন তৈরি হয়ে যায়।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল ব্যাগলে। দেখল হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাচ্ছে কাউবয়। বলল, রাতে ক্যাসিনোয় ফেরেনি কেগল।
পুরো একমিনিট পাঞ্চারের দিকে তাকিয়ে থাকল ডিলন, তারপর শার্লিকে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। দেরি না করে লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো বোর্ডওয়াক থেকে। গলা চড়িয়ে নির্দেশ দিল, মাগো, সবাইকে স্যাড়লে উঠতে বলো। আমরা এক্ষুণি শহর ছাড়ব।
ক্যাসিনো সেলুনে ঢুকে গেল পাঞ্চার। ডিলন চলল জেলখানার দিকে। তড়িঘড়ি করে রাস্তা পার হলো শার্লি, তারপর তালা খুলে ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়ল।
ডিলন জেলখানায় ঢোকার পর হারবেনের হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে ব্যাঙ্কে চলে এলো ব্যাগলে। ওর কপাল ভাল ডিলনের কোন লোকের চোখে পড়ল। দরজা সামান্য ফাঁক করে ভেতরে ঢুকল ব্যাগলে, পেছন ফিরে বন্টু আটকে দিল।
মিস শার্লি রাশল্যান্ড মাত্র ডেস্কের পেছনে বসেছে এমন সময়ে ব্যাগলেকে চোরের মতো আচরণ করতে দেখল ও। ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল তুলে। আওয়াজ করতে নিষেধ করছে ব্যাগলে। একটা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর পিঠের দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকাল শার্লি, তারপর কৌতূহলী হয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল ডিলন সামনের বোর্ডওয়াক দিয়ে ঝড়ের গতিতে ব্যাঙ্কটাকে পাশ কাটাচ্ছে। আঁধার হয়ে আছে চেহারা। র্যাঞ্চার পার হয়ে যাবার পর হাসল ব্যাগলে, চলে এলো অফিসের মাঝখানে।
ব্যাপারটা কি! একহাতে সোনালী চুলের খোঁপা ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করল শার্লি। ব্যাগলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
শার্লির ডেস্কের এক কোনায় বসল ব্যাগলে। কোমল দৃষ্টিতে মেয়েটাকে দেখল। সহজ গলায় বলল, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। শার্লির বড় বড় নীল চোখ দুটো ব্যাগলের মুখে স্থির। মাথা দোলাল মেয়েটা। শুনতে চায় ব্যাগলের কথা। ক্লিন্ট যদি তার র্যাঞ্চ ফিরে পায় তাহলে ডিলনকে বিয়ে করবে তুমি? ধরো ক্লিন্টকে আর কেউ বিরক্ত করবে না। তাহলে?
বিস্মিত হলো শার্লি, ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় বিরক্তও হলো। মুখে লাল ছোপ পড়ল। রাগ লাগছে। কিন্তু ব্যাগলের চেহারা অত্যন্ত আন্তরিক। শেষ পর্যন্ত মৃদু গলায় বলল শার্লি, ডিলনকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি আমি।
আমিও তাই ভেবেছিলাম, নরম সুরে বলল ব্যাগলে। এখানে থাকলে যদি ডিলনকে মেরে ফেলতে বাধ্য হয় সেজন্যে ক্লিন্ট চলে যাবে ঠিক করেছে। ওর মনে হয়েছে ডিলনকে ভালবেসে বিয়ে করছ তুমি।
চোখ নামিয়ে নিল শার্লি। ফিসফিস করে বলল, ও ভাবুক আমি ডিলনকে ভালবাসি। ওকে সত্যি কথাটা জানিয়ো না। দূরে কোথাও চলে গেলে প্রাণে তো। বাঁচবে।
মেয়েটাকে গভীর মনোযোগে লক্ষ করল বাগলে। এই তাহলে ব্যাপার! নিজের জীবনটাকে বিষিয়ে তুলবে শার্লি, তিলে তিলে সহ্য করবে আত্মবঞ্চনা, তবু ভালবাসার মানুষের ক্ষতি হতে দেবে না? হঠাৎ করে মেয়েদের প্রতি ওর সমস্ত জমাট ক্ষোভ দূর হয়ে গেল। মনে হলো ওর বউ আসলে মানুষ হিসেবে ওর চেয়ে অনেক ভাল। বাচ্চাগুলো যদিও অমানুষ, তবু।
শার্লির দিকে তাকাল ব্যাগলে। বলল, জারম্যান আর কেগল রাসলিং করে একটা উপত্যকায় গরু, জড় করেছে। হাজারখানেক হবে। আজকে ওখানে যাচ্ছে। ওরা গরু সরিয়ে নিয়ে বেচে দেবে বলে। ওদের পিছু নিয়েছে ক্লিন্ট আর বেনন। ক্লিন্ট বেননের সঙ্গে যাচ্ছে কারণ বেনন ওর সাহায্য চেয়েছে। কাজ শেষে চলে যাবে ও নিজের পথে। থামল ব্যাগলে। বাইরে অনেকগুলো ছুটন্ত ঘোড়ার আওয়াজ। সদলবলে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে ডিলন। বেশ তাড়া আছে তার। দ্রুত ছুটছে ঘোড়াগুলো। ওই যে ডিলন গেল, আওয়াজ দূরে চলে যেতে বলল ব্যাগলে। কেগলের পিছু নেয়ার নিজস্ব কারণ আছে ডিলনের। ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। বেনন আর ক্লিন্ট দুটো দলের মাঝখানে পড়ে যাবে।
কথাটা শুনে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল শার্লির। কল্পনায় দেখতে পেল দুই দলের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে গেছে ক্লিন্ট। আহত হয়েছে। মারা যাচ্ছে। কেউ নেই ওকে সাহায্য করার। ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল শার্লি।
আমার মনে হয় প্রথম সুযোগেই তোমার উচিত ক্লিন্টকে মনের কথাটা জানানো। তাতে আর কিছু না হোক, দুটো জীবন হয়তো নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচবে। ডিলনের মুখোমুখি দাঁড়াক না ক্লিন্ট। যদি মরেও যায় আফসোস থাকবে ওর। জেনে যেতে পারবে ওকে ভালবাসার মানুষ আছে। এখন ক্লিন্ট যদি চলে যায়, বাকি জীবন নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াবে ও।
চুপ করে ভাবছে শার্লি। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল ব্যাগলে। ডিলনের লোকরা কেউ শহরে নেই বলে মনে হচ্ছে। দরজার দিকে পা বাড়াল ও।
কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
ডিলনের পিছু নেব, দরজার বল্ট খুলতে খুলতে বলল ব্যাগলে।
এগিয়ে এলো শার্লি। চেহারায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
এসো, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল ব্যাগলে। বুঝতে পেরেছে মেয়েটাকে মানা করলেও শুনবে না। যেতে চাইছে চলুক না। ওর মন বলছে শার্লির কোন ক্ষতি হবে না। দরজা খুলে একপাশে সরে শার্লিকে বেরোবার পথ করে দিল ব্যাগলে।
একটু পরই শহর ছাড়ল ওরা।
আহত ক্লিন্ট আর চোখ ট্যাড়া হরিবলকে নিয়ে বিধ্বস্ত বার কিউ হেডকোয়ার্টার ছাড়ল বেনন। একটু পরই পুবাকাশে উঁকি দিল সূর্য। কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে নিজেকে জাহির করতে আরও অনেক সময় নেবে ওটা।
স্যাডল পমেল খামচে ধরে ঘোড়ার পিঠে কোন রকমে টিকে আছে ক্লিন্ট। বেনন ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়ার পরও রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে বেশ সময় লেগেছে তার। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে চেহারা। মুখটা কুঁচকে আছে ব্যথায়। চোখে ঝাঁপসা দেখছে। জিম হরিবলও মুখ বিকৃত করে রেখেছে। মাথার ফোলাটা টিশ-টিশ করছে তার।
ক্লিন্টকে নজরে রেখেছে বেনন। মাঝে মাঝেই পাশে চলে আসছে। নীরব সাহচার্যে মনোবল বাড়িয়ে দিতে চাইছে। ভদ্রতা করে হাসছে ক্লিন্ট।
পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগবে ক্লিন্টের। ব্যথা না পেয়ে ঘোড়ায় চড়তে লেগে যাবে মাস খানেকের বেশি। ঘোড়ার গতি কমিয়ে রেখেছে বেনন। অধৈর্য হয়ে উঠছে মনে মনে। কেগলের পিছু ধাওয়া করার বদলে ক্লিন্টকে শহরে পৌঁছে। দেয়াই ওর প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মুহূর্তে দূরে চলে যাচ্ছে কেগল। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, শেষ পর্যন্ত দেখা কেগলের সঙ্গে হবেই।
দীর্ঘ ক্যানিয়ন পার হয়ে শহরের ট্রেইলে পড়ল ওরা। খাড়া একটা ড্রয়ের ওপর উঠতেই দেখতে পেল মাইল খানেক দূরে নিচু জমিতে ধুলোর ঝড় তুলে বার কিউয়ের দিকে আসছে একদল অশ্বারোহী। চট করে ক্লিন্টের ঘোড়ার রাশ ধরে দাঁড় করিয়ে ফেলল বেনন, পিছিয়ে এলো, চড়া গলায় জিমকে নির্দেশ দিল পিছু নেয়ার। ট্রেইলের ধারে লুকোনোর অনেক জায়গা আছে। একধারে একটু উঁচু জমিতে জন্মেছে এক ঝাড় জুনিপার গাছ। গাছের জটলার পেছনে আশ্রয় নিল। ওরা।
একটু পরেই কানে এলো ঘোড়ার খুরের শব্দ। প্রায় বিশজন রাইডার ঝড়ের বেগে ছুটে এলো। ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখল বেনন, ট্রেইল ধরে সবার আগে ছুটছে ডিলন। সামনের ট্রেইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। শরীরটা টানটান। মুখে দৃঢ় সিদ্ধান্তের ছাপ।
ধুলোর আড়ালে পড়ে গেল অশ্বারোহী দল। ক্যানিয়নে ঢুকে যাওয়ায় তাদের আর দেখা গেল না। দূরে চলে যাচ্ছে খুরের শব্দ। ক্যানিয়নের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। একটু পরই আর কোন আওয়াজ থাকল না। হাসল বেনন। কল্পনায় দেখতে পেল পোড়া র্যাঞ্চ হাউজ দেখে ডিলনের চেহারাটা কেমন হবে। ক্লিন্ট আর জিম হরিবলকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ও গাছের পেছন থেকে, লম্বা ড্র ধরে শহরের দিকে চলল।
সূর্যের তাপ বেড়ে গেছে। স্যাডলে কুঁজো হয়ে বসে আছে ক্লিন্ট, দু’চোখ। বন্ধ। ব্যথা আরও বাড়ছে। বেননের সন্দেহ হলো ক্লিন্ট শহর পর্যন্ত টিকবে না। ভাবল জিমকে ডাক্তার আর ওয়্যাগনের জন্যে শহরে পাঠাবে কিনা। কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। ডিলনের কোন লোক যদি শহরে থাকে তাহলে বেফাস কথা বলে বিপদে পড়তে পারে জিম। ওদের জন্যেও বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে। সামনে একটা বাঁক। বাকটা ঘুরতেই শিসের আওয়াজ পেল ও। সুরটা ব্যাগলের প্রিয়। চারপাশে তাকাল বিস্মিত বেনন। ট্রেইলের পাশে একটা টিলার কাঁধে ব্যাগলেকে দেখতে পেল। ওর মনে হলো ঈশ্বর প্রেরিত হয়ে এখানে এসেছে ব্যাগলে। ব্যাগলের পেছনে আরেকটা ঘোড়ায় কে যেন: আসছে। ওর বিস্ময় আরও বাড়ল শার্লি রাশল্যান্ডকে চিনতে পেরে।
ব্যাগলেও বেননের দলটাকে দেখতে পেয়েছে। ঘোড়া থামিয়ে ফেলল সে। তারপর দ্রুত বেগে টিলা থেকে নেমে বেননের সামনে এসে থামল। দু’একটা কথা হলো ওদের মাঝে। ইতিমধ্যে ক্লিন্টের পাশে চলে এসেছে শার্লি। বেনন আর ব্যাগলে লক্ষ করল, গভীর মমতা নিয়ে ক্লিন্টের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শার্লি, মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছে আঘাতটা কতখানি গুরুতর।
ক্লিন্ট! ক্লিন্ট! অস্থির চেহারায় বিড়বিড় করল শার্লি। গুলি লেগেছে? কষ্ট হচ্ছে খুব?
চোখ খুলল ক্লিন্ট। হাসার চেষ্টা করল। কষ্ট হচ্ছে সামান্য। ডাক্তার দেখালেই ঠিক হয়ে যাবে।
চোখে নীরব-কাকুতি নিয়ে বেননের দিকে তাকাল আতঙ্কিত শার্লি।
শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখালেই ঠিক হয়ে যাবে, ক্লিন্টের কথাই পুনরাবৃত্তি করল বেনন। ওকে সেথ হারবেনের হোটেলে বিশ্রামে থাকতে হবে কয়েকদিন, ব্যস। শেষ কথাটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছে বেনন। শার্লি ফুঁসে ওঠায় নির্মল হাসল বেনন।
কী! সেথ হারবেনের ওই জঘন্য হোটেলে থাকবে ক্লিন্ট? ওখানে তো ওর কোন যত্নই হবে না! ওকে আমি বাসায় নিয়ে যাব। তাতে এটুকু অন্তত নিশ্চিত হওয়া যাবে যে কেউ ওর সেবা শুশ্রূষা করছে।
ব্যথায় ভোতা হয়ে আছে ক্লিন্টের বুদ্ধি, একটু দেরিতে হলেও শার্লির কথার মানে বুঝতে পারল। একচিলতে তৃপ্তির হাসি দেখা দিল ওর ঠোঁটে। স্যাডল পমেলটা আরও জোরে চেপে ধরল। মনে হলো জ্ঞান হারাবে ও যেকোন সময়ে, তবুও বুকের মাঝে অনুভব করল আশ্চর্য প্রশান্তি।
শার্লির দিকে তাকিয়ে বলল বেনন, তাহলে শহরে ফিরে যাও তোমরা। এদিকে আমাদের কাজ পড়ে আছে তাই সঙ্গে যাচ্ছি না। চিন্তিত চেহারায় জিম হরিবলকে দেখল ও। লোকটাকে আগের চেয়ে সুস্থ দেখাচ্ছে। বলল, ট্রিপল বারে যদি সত্যি কাজ করতে চাও তো এখন থেকেই শুরু করে দিতে পারো। শহরে। গিয়ে ডাক্তারকে একটা খবর দাও, বলো ওয়াগন নিয়ে আসতে। ক্লিন্ট যদি শহরে পৌঁছুনোর আগে জ্ঞান হারায় তাহলে ওয়্যাগটা কাজে আসবে।
এক্ষুণি যাচ্ছি আমি। দেরি না করে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে গেল লোকটা শহরের ট্রেইলে।
কৃতজ্ঞ চোখে বেনন আর ব্যাগলেকে দেখল শার্লি। তারপর ক্লিন্টের ঘোড়ার রাশ ধরে জিম হরিবলের পেছনে এগোল।
পেছন থেকে ব্যাগলে বলল, দুশ্চিন্তা কোরো না, ম্যাম। আমরা যদি বেঁচে থাকি তাহলে কোন বিপদ ছুঁতে পারবে না তোমাদের।
অনেক ধন্যবাদ তোমাদের, গ্রীবা ফেরাল শার্লি। দু’চোখে পানি টলটল করছে ওর। বলল, সাবধানে থেকো তোমরা।
থাকব, কথা দিল ব্যাগলে। বেনন আর ব্যাগলে তাকিয়ে থাকল, একটু পরেই একটা বাঁক ঘুরে চোখের আড়ালে চলে গেল মেয়েটা।
শহর পর্যন্ত টিকতে পারবে ক্লিন্ট?
পারবে। একটা সিগার ধরাল বেনন। ব্যাগলেকে পকেট হাতড়াতে দেখে ম্যাচটা বাড়িয়ে দিল। তবে শক্তি বলতে শরীরে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। আঘাতটা কাঁধে, মারা যাবার মতো নয়। কিন্তু অনেক রক্ত হারিয়েছে বেচারা।
একটা সমস্যার সমাধান হলো, সিগারেট ধরিয়ে বলল ব্যাগলে। মেয়েটাকে কে পাবে সেটা স্থির হয়ে গেল।
মাথা দুলিয়ে সায় দিল বেনন। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল, তা হয়েছে। এবার চলো নিজেদের কাজে যাই। ট্রেইলের শেষে কি আছে জানতে জীবন দিতেও আপত্তি নেই আমার।
আমারও নেই। বেননের পাশে পাশে ঘোড়া ছোটাল ব্যাগলে।
যেতে যেতে বেনন ওকে বলল রাতে কেগলের পিছু নিয়ে বার কিউতে যাওয়ার পর কি ঘটেছে।
আমরা যা ভেবেছিলাম তাই, সব শুনে মন্তব্য করল ব্যাগলে।
কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও পরিষ্কার নয়, বলল বেনন? ট্রিপল বার দখল করার জন্যে ডিলন এত ব্যগ্র হয়ে উঠেছে কেন?
কাঁধ ঝাঁকাল ব্যাগলে। কে জানে কেন! তবে ডিলনের খেল্ খতম। ব্যাঙ্কার আর ক্রিসির খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে ওকে।
বেড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধবে কে? ডিলন গানম্যানের দল সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে।
জবাব দিল না ব্যাগলে। বেননও নিজে থেকে কিছু বলল না। দু’জন ওরা দু’জনকে চেনে। প্রয়োজনে সমস্ত বিপদ উপেক্ষা করে ডিলনকে আক্রমণ করার সাহস আছে ওদের। ওরা জানে একটু ভুল হলেই মারা পড়তে হবে বেঘোরে, কিন্তু সেজন্যে ওরা ভীত নয়। ট্রেইলে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা, ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে ট্রেইলের শেষে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে পিকনিক পার্টি। ওরা বিশেষ
অতিথি। ওরা না গেলে খাওয়াদাওয়া আরম্ভ হবে না।
ক্যানিয়নে ঢুকে সূর্যের আলোর হাত থেকে বাঁচল ওরা। কিন্তু একটু পরেই ক্যানিয়ন বাঁক নিয়ে সরু হয়ে গেল, দু’পাশের পাথর সূর্যের আলো পড়ে উত্তপ্ত হয়ে আছে, ভাপ ছাড়ছে রীতিমতো। ওদের মনে হলো খোলা জায়গায় সূর্যের তাপেই ওরা ভাল ছিল। খোলা জায়গায় অন্তত বাতাস আছে। মাঝে মাঝে বাতাস বইলে তাপ কমে যায় কিছুক্ষণের জন্যে।
ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে চলল ওরা। রাতে ওদিকে গেছে কোলের সঙ্গীরা। পরে কেগলও গেছে। ওদিকের একটা উপত্যকায় আছে চোরাই গরুগুলো। পোড়া র্যাঞ্চ হাউজ আর ফাঁকা সিন্দুক দেখে ডিলনও ওদিকেই যাবে।
সামনে মাথা তুলেছে একসারি নিচু টিলা, ওগুলো পার হয়ে কিছুদূর পর্যন্ত ঘাসে ছাওয়া জমি, তারপর নীল টলটলে জলের নদী। অগভীর একটা শাখা নদী আছে ওখানে। ওটাও ট্রিপল বারের ভেতর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে। জল তাতে অল্পই। ট্রিপল বারের অনেক গভীরে ঢুকেছে শাখা নদীটা, তারপর বয়ে গেছে উত্তর-পুব দিকের টিলাসারির দিকে। ওদিকের টিলাগুলো টুইন স্প্রিংসের গায়ের ওপর ঝুঁকে আছে।
বার কিউয়ের পানির অভাব নেই। চমৎকার তাজা ঘাসে ভরা অফুরন্ত জমি। আপন মনে মাথা নাড়ল ব্যাগলে। পানির অভাবে ট্রিপল বার দখল করতে চাইছে ডিলন, বোধহয় অতি লোভ। পুরো এলাকার অধিকার চায়।
এখন যেদিকে যাচ্ছে বেনন আর ব্যাগলে, তাতে দুর্গম সেই উপত্যকায় পৌঁছোতে দিক বদল করতে হবে না। ডিলন বার কিউয়ের দিকে গেছে। ওখান থেকে কোলের ট্র্যাক ধরে উপত্যকায় পৌঁছে যাবে সে ঠিকই। তার আগেই ওখানে যেতে চাইছে বেনন।
নদীর পাড়ে থামল ওরা, ঘোড়াগুলোকে তৃষ্ণা মেটাতে দিল। শহর ছাড়ার আগে শার্লি কিছু খাবার সঙ্গে নিয়েছিল, সেগুলো ভাগ করে খেল। ঘোড়াগুলো ততক্ষণ তাজা ঘাসে মুখ ডুবিয়ে রাখল। এটুকু দেরি কোন সমস্যা করবে না। ডিলন যত তাড়াহুড়োই করুক, অন্তত দেড় ঘণ্টার পথ এগিয়ে আছে বেনন।
খাওয়া সেরে আধঘণ্টা বিশ্রাম নিল ওরা, শুয়ে থাকল নদীর পাড়ে। তৈরি হয়ে নিল। তারপর এগোল আবার। এখন দুজনের দেহে ক্লান্তির লেশমাত্র নেই।
১১. একেবারেই অসতর্ক, বলল ব্যাগলেব
একেবারেই অসতর্ক, বলল ব্যাগলে। জমিতে অসংখ্য ট্রাক, সেগুলো দেখাচ্ছে ও। উপত্যকার দিকে যাওয়ার সময় গতির দিকে খেয়াল রাখলেও ট্র্যাক গোপন করার দিকে মনোযোগ ছিল না অশ্বারোহীদের।
মনে হচ্ছে ডিলনকে ডাকছে কেগল, সায় দিল বেনন। এত আত্মবিশ্বাস থাকা ঠিক নয়।
ঘোড়ার গতি কমিয়ে ফেলল ওরা। দু’জনের মাথায় একই চিন্তা ঢুকেছে। গেল যদি ডিলনের জন্যে ফাঁদ পেতে বসে থাকে, তাহলে আরও অনেক সতর্ক হয়ে এগোনো উচিত ওদের।
সামনেই সেই পাহাড়ী ফাটল। ঘোড়র পায়ে পট্টি বেঁধে নিল ওরা। মনে মনে দেখে নিল সুড়ঙ্গ কোথায় শেষ হয়েছে। পাহাড়ী ফাটলে মাত্র তিনটে জায়গা আছে। যেখানে ওপর থেকে ওদের দেখা যাবে। হামলা হতে পারে। কথাটা ব্যাগলেকে বলল বেনন।
আমরা যদি একজন আরেকজনের পেছনে যাই তাহলে দরকারের সময় কাভার দেয়া যাবে বলল ব্যাগলে। গুলি ছুঁড়ে শক্রদের ব্যস্ত রাখতে পারব আমরা, পিছিয়ে আসতে পারব।
আবার ঘোড়ায় ওঠার আগে সিক্সগান আর রাইফেল পরীক্ষা করে দেখে নিল, ওরা। সন্তুষ্ট হয়ে ঢুকে পড়ল গিরিখাতে। একটা বাঁক ঘুরতেই দিনের আলো প্রায় বিদায় নিল। এখানে পিছিয়ে গেল ব্যাগলে, বেননকে এগিয়ে যেতে দিল। পূর্ণ সজাগ হয়ে আছে ও, রাইফেলটা কোলের ওপর রেখেছে, প্রয়োজনের মুহূর্তে ঝটকা দিয়ে তুলে নিতে পারবে, তাক করতে হবে না, নিখুঁত লক্ষ্যে পাঠিয়ে দেবে। গুলি। নিশ্চিন্তে এগোল বেনন। ব্যাগলের ওপর আস্থা আছে ওর, জানে ব্যাগলের চোখ এড়িয়ে গিরিখাতে লুকিয়ে কেউ হামলা করতে পারবে সে-সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
প্রতি বাকে থামছে ওরা। সামনেটা ভাল করে দেখে নিচ্ছে ব্যাগলে। কান। খাড়া করে অপেক্ষা করছে কিছুক্ষণ, তারপর বেননকে এগিয়ে যেতে ইশারা। করছে। খুব ধীর ওদের গতি।
আর একটা মাত্র বাঁক, তারপরই সেই পাথুরে দেয়াল, যে দেয়াল দেখলে মনে হয় পথের শেষ। বাঁক নেয়ার আগে আবার থামল ওরা, গিরিখাতের দু’দিকের দেয়ালে নজর বোলাল। নড়ছে না কিছু। বেননকে এগিয়ে যেতে ইশারা করল ব্যাগলে। বাঁক ঘুরল বেনন। সামনে খাদের একধারে পড়ে আছে গির্জার চুড়োর মতো দেখতে সেই রোল্ডারটা।
বামদিকের দেয়ালের মাথায় নড়ে উঠল কি যেন। বিদ্যুতের ঝলকের মতো রাইফেলটা তুলে তাক করল ব্যাগলে। কিছু একটা নড়েছে। নড়েই থেমে গেছে। গুলি করার মতো কোনকিছু দেখা যাচ্ছে না। বোল্ডারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বেনন।
শ্বাসরুদ্ধকর একটা মিনিট পেরিয়ে গেল। সুড়ঙ্গমুখের কাছে চলে গেছে বেনন। এক্ষুণি ঢুকবে ভেতরে। বাঁকের কাছে অপেক্ষা করছে ব্যাগলে, দেখতে পেল দেয়ালের কিনারা থেকে আস্তে আস্তে নামছে একটা রাইফেলের নল। লোকটার ইচ্ছে, বেননের পিঠে গুলি করবে। ধৈর্য ধরল ব্যাগলে। ফলও পেল। সাইটে চোখ রাখল লোকটা। এবার তার মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ফাটলের পাড়ে শুয়ে মাথা বাড়িয়ে সাইটের ভেতর দিয়ে দেখছে বেননকে। শুধু মুখ, শরীরটা আছে পাহাড়ের ওপর। মুখই যথেষ্ট। গুলি করল ব্যাগলে। গুরুগম্ভীর গর্জন ছাড়ল শার্পস। স্যাডলে প্রায় লাফ দিল বেনন, ঢুকে গেল সুড়ঙ্গে। ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রাইফেলের আওয়াজ। পাথুরে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ধাতব আওয়াজ তুলে নিচে পড়ল ঘাতকের রাইফেল।
সমস্ত আওয়াজ থেমে যাবার পর নিরেট নিস্তব্ধতা গিরিখাতটাকে গ্রাস করল। লোকটা কোন আওয়াজ করছে না। করবে না। নিচ থেকে মুখে গুলি খেয়েছে, ইচ্ছে করলে কেউ ওর মাথার পেছন দিয়ে মুঠো করে হাত ঢুকিয়ে দিতে পারবে। সুড়ঙ্গে ঢুকে বেননের পাশে চলে এলো ব্যাগলে।
ধন্যবাদ দিল না বেনন, এ প্রসঙ্গে বলল না কিছু। ওদের বন্ধুত্বটা এমনই। প্রয়োজনের সময় সাহায্য করে ঋণ শোধ করে দেবে বেনন, কোন ধন্যবাদ আশা করবে না।
সাবধানতায় কোন ঢিল পড়ল না ওদের, যদিও জানে উপত্যকায় এখন কেউ থাকবে না। পাহাড়ের ওপরে প্রহরী রেখে গিয়েছিল গেল, যাতে ডিলনের আগমনবার্তা পায়। লোকটার কাছে নিশ্চয়ই আয়না ছিল। ডিলন এলেই দূর থেকে কোলকে জানিয়ে দিত, তারপর সরে পড়ত। কিন্তু বেননকে একা দেখে, শেষ করে দেবার লোভ সামলাতে পারেনি।
গিরিখাতে গরু বের করার কোন চিহ্ন নেই। তারমানে উপত্যকা থেকে বেরোবার আরও কোন পথ আছে। সে-পথে গরু নিয়ে এতক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে কেগল। পাহাড়সারির মাথায় আয়নাসহ লোক থাকার কথা। কেউ পিছু নিয়েছে খবর পেয়েই নিশ্চয়ই সে কেগলকে জানাতে ছুটেছে। ও নিজে হলে তাই করত, ভাবল বেনন।
উপত্যকার সবুজ ঘাস: মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে, দেখে মনে হয় ঢেউ উঠেছে। সাগরে এখন আর একটা গরুও নেই। এগিয়ে চলল বেনন আর ব্যাগলে। পাহাড়ের বাঁক ঘুরে আরেক দিকে চলে গেছে উপত্যকা, সেদিকে চলেছে। জমিতে তাজা চিহ্ন। বড়জোর আটঘন্টা আগের। ট্র্যাক করতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।
যতটা মনে হয়েছিল উপত্যকা তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ। দূরে দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি দুটো টিলা, সেখানে গিয়ে শেষ। টিলা দুটো ঢালু হয়ে এসে সমতলে মিশেছে। মাঝখানের পথ দিয়ে সহজেই একসঙ্গে পঞ্চাশটা গরু পার করা সম্ভব। খানিকদূরে আরেকটা টিলা বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পথ আটকে। তবে টিলার বুকে খনির মুখের মতো বিরাট একটা গর্ত। নির্জন পরিবেশে কালো মুখটা হঠাৎ করে মনের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
ওপথে যাওয়া নিরাপদ নয়, কেগল লোক রেখে যাবে। সতর্ক হয়ে এগোতে হলে সময় লাগবে অনেক বেশি। দু’পাশ দেখে নিল বেনন। পাহাড় দু’পাশে। গরু উঠতে পারবে না, কিন্তু দক্ষ চালক ঘোড়া নিয়ে ঠিকই পাহাড়ে উঠে যেতে পারবে। উঠতে পারলে নামার পথও নিশ্চয়ই থাকবে। লক্ষ রাখতে হবে যাতে টিলার কাছ থেকে বেশি দূরে যেতে না হয়। একসময় না একসময় গরুর ট্র্যাক ঠিকই পাওয়া যাবে। অতগুলো গরু স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না। একবার ক্যাটল ড্রাইভের চিহ্ন দেখলে তখন পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে পাহাড় থেকে নামলেই চলবে। আরেকটা কাজ করা যায়। ডিলনের জন্যে অপেক্ষা করলে ক্ষতি কি! ডিলন কেগলের মুখোমুখি হলে গোলাগুলি হবে, শত্রু কমবে। লোকবল না থাকলে বাড়তি অনেক সুবিধে পাবে বেনন আর ব্যাগলে।
পাহাড়ে উঠে অপেক্ষা করব আমরা, বলল বেনন।
নীরবে মাথা দোলাল ব্যাগলে। বেননের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে ওর। বেনন বুঝে কোন কাজ করবে না।
পাহাড়ে উঠে এলো ওরা। সময় লাগল। অনেক কসরৎ করতে হলো। কিন্তু উঠে এলো। পাহাড়ের মাথা ন্যাড়া নয়, এখানে ওখানে সবুজ গাছের সমারোহ। গাছের নিচে প্রশান্তি মাখা ছায়া। ঝিরঝির করে বইছে বাতাস।
একটা গাছের নিচে ঘোড়া থেকে নেমে বসল বেনন আর ব্যাগলে। পাহাড়ের কিনারা থেকে জায়গাটা বেশি দূরে নয়। উপত্যকার দিকে চোখ রাখতে হবে।
বেশি পেছনে থাকার কথা নয় ডিলনের।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে যাচ্ছে। ওদের মনে কোন অস্থিরতা নেই। লোকটা যদি আয়না ব্যবহার করে সংকেত দিয়ে থাকে, এতক্ষণে কেগল ভাবছে ভুল করে সংকেত দিয়েছে, একটা সিগারেট ধরাল ব্যাগলে। ডিলনের পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল এক ঘণ্টা আগে। আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল ও, হঠাৎ চুপ করে, গেল।
কান খাড়া করল বেনন। পাখি ডাকছে। সরসর করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে গাছের পাতা ছুঁয়ে। কোন অস্বাভাবিক শব্দ নেই।
আসছে ডিলন, বলল ব্যাগলে।
ঘোড়ার খুরের তবলা আরও দেড় মিনিট পর শুনতে পেল বেনন। খুবই মৃদু আওয়াজ। অনেক দূরে আছে ঘোড়াগুলো।
কেগল তৈরি থাকলেই হয়, মন্তব্য করল ব্যাগলে।
কেগল তৈরিই থাকবে। বেনন তাকিয়ে আছে দূরের পাহাড়ের দিকে। বাঁক ঘুরে ছুটে আসছে একদল অশ্বারোহী। রাসলিঙের সঙ্গে ডিলন জড়িত না হলেও ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। ওর পাওনা বুঝে নিতে আসছে। কেগল ওকে ভাগ দিতে চাইবে কেন? কেগল চাইবে নিজেই সব মেরে দিতে। আমার বিশ্বাস সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন হলে জারম্যানকেও ছাড়বে না সে। অন্যরা সামান্য টাকার বিনিময়ে কাজ করছে, কেউ নেতা গোছের নয়, কাজেই তাদের কোন বিপদ হবে না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ওরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে সংখ্যায় কমুক, তারপর আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করব।
ডিলনের দলটাকে লক্ষ করো। ওরা কেগলকে ধরতে এতই ব্যস্ত যে সাবধানতা ভুলে গেছে। রাতে আক্রমণ করলে ডিলন ভাল করত, কিন্তু সে-ইচ্ছে ওর আছে বলে মনে হয় না। হাসল বেনন। মাথা গরম করলে পরে সব সময়েই পস্তাতে হয়।
কাছে চলে আসছে অশ্বারোহী দল। সবার সামনে আঠারো হাত উঁচু বে গেন্ডিঙে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঋজু হয়ে বসে আছে ডিলন। তার একটু পেছনে ছুটছে আঠারোটা তরতাজা ঘোড়া। এতদূর থেকেও লোকগুলোর উত্তেজনার ছোয়া পাচ্ছে বেনন আর ব্যাগলে। নিজেরা লড়াইতে জড়িয়ে পড়লে উত্তেজনাটুকু তাৎক্ষণিক ভাবে বোঝা যায় না। দেখতে দেখতে জোড়া টিলার ফাঁক পেরিয়ে গেল আরোহী দল, ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ল সামনের টিলার গহ্বরে।
এগোনো দরকার, অনুভব করল বেনন। দেরি করলে দূরে চলে যাবে ডিলন। পাহাড়ী এলাকায় সহজে ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাগলেকে ইশারা করে ঘোড়ায় উঠল বেনন। পরমুহূর্তেই গোলাগুলির আওয়াজ পেল। আবার ডিলনের দলটাকে দেখতে পেল ওরা,, এবার ঊর্ধ্বশ্বাসে গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। দলে মাত্র তিনজন আছে তারা, তাদের মধ্যে ডিলন ছুটছে আগে। আতঙ্কে বড় বড় হয়ে আছে সবার চোখ। স্যাডলে কাত হয়ে পেছনে গুলি করছে। তাদের সামান্য পেছনেই সাক্ষাৎ মৃত্যু। প্রচণ্ড আঘাতে কাঁপছে উপত্যকার মেঝে। একটানা বজ্রপাতের মতো শব্দ হচ্ছে।
বেনন আর ব্যাগলের চোখও বিস্ফারিত হয়ে গেল। কেগল, দারুণ বুদ্ধি করেছে। কোথাও যায়নি সে, গরুগুলোকে গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। ডিলন সদলবলে ভেতরে ঢুকতেই গরুগুলোকে পেছন থেকে স্ট্যাম্পিড করিয়েছে কেগল। পনেরোটা ঘোড়া আর পনেরোজন গানম্যানের দেহ খুরের নিচে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছে গরুর পাল। বাঁ-বাঁ করে ডাকছে, ছুটছে প্রাণপণে। মাঝখানে একচিলতে ফাঁক নেই।
গুহায় যখন ঢুকল, তখনও ডিলন আগে ছিল। তারপরও বেঁচে আছে। লোকটা। এটাই প্রমাণ করে কী পরিমাণ সতর্ক লোক সে। গুহার ভেতর অন্ধকারে বিপদ হতে পারে ভেবে নিশ্চয়ই পিছিয়ে গিয়েছিল র্যাঞ্চার।
ঈশ্বর! ফিসফিস করে শুধু বলতে পারল ব্যাগলে।
জান নিয়ে পালাচ্ছে ডিলন আর দুই কাউবয়। পাহাড়ের বাঁক ঘুরে চোখের আড়ালে চলে গেল। কাউবয়রা আর ফিরবে না। দুই মিনিট পর গুহা থেকে শেষ গরুটাও বের হয়ে এলো। ওটা এলো একা। ছুটছে না। আপনমনে হাঁটছে।
বড়জোর পাঁচশো গরু, হিসেব করল বেনন। গুহার মুখ দিয়ে একসঙ্গে দশটার বেশি গরু বেরোতে পারেনি। প্রতি দুই সেকেন্ডে বেরিয়েছে দশটা। মিনিটে তিনশো। শেষ দিকে কম বেরিয়েছে। বাকি গরু কোথায়? একটু ভাবতেই জবাবটা পেয়ে গেল বেনন। ওগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। শুধু প্রয়োজনীয় সংখ্যক গরু রেখে যেতে নির্দেশ দিয়েছে কেগল। এতবড় একটা দায়িত্ব দিয়ে অন্যকে বিশ্বাস করেছে সে, নাকি নিজেই স্ট্যাম্পিডটা করেছে? নিজেই, বেননের মন বলল। কাউকে বিশ্বাস করার মতো লোক নয় কেগল।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিজের পথে চলে গেছে গানম্যান।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল বেনন। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে। একটু পর বেননের ধারণার সত্যতা মিলল। একা ফিরে আসছে ডিলন। কাউবয়রা নিশ্চয়ই মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছে এভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারবে না ওরা।
মাঝারি গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে আবার গুহার ভেতর ঢুকল ডিলন। চুপচাপ কিছু সময় পার করল বেনন, তারপর ব্যাগলেকে নিয়ে নেমে এলো পাহাড় থেকে। গুহার ভেতরে ঢুকল। একেবারেই অন্ধকার গুহা। ভেতরে তাজা রক্ত-মাংসের গন্ধ। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর কিসে যেন হোঁচট খেল বেননের ঘোড়া। সঙ্গে সঙ্গে থামল বেনন, স্যাডল থেকে নেমে ম্যাচের কাঠি জ্বালল। গুহার ছাদে নিপ্রাণ দৃষ্টি নিবদ্ধ, চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে মার্শাল জারম্যান। ম্যাচের আলোয় বুকে ঝিলিক মারছে টিনের তারা। খুন করা হয়েছে লোকটাকে। স্ট্যাম্পিডে মরলে আস্ত খুঁজে পাওয়া যেত না। বুকে গুলি করেছে কেগল। বোধহয় জারম্যানকে সঙ্গে রেখেছিল সে, কাউবয়দের গরুসহ পাঠিয়ে দিয়ে ডিলনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ডিলন যখন এলো, গুলি ছুড়ে স্ট্যাম্পিড় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল, গুলিটা তখন কেগল খামোকা খরচ করেনি।
আইনের তারা পরে থাকার কোন অধিকার নেই এব্যাটার, জারম্যানের বুক থেকে টিনের তারাটা খুলে নিল ব্যাগলে। মরেছে বলেই ভাল ল-ম্যান হয়ে যায়নি লোকটা।
আরেকটা কাঠি জ্বালল বেনন। জারম্যানের পকেট হাতড়ে দেখল। সিগারেট পেপার, তামাক, একটা পকেট ঘড়ি, একটা চিরুণি আর কিছু কাগজপত্র ছাড়া আর কিছু নেই। জিনিসগুলো নিয়ে নীরবে স্যাডলে উঠল বেনন, সামনে বাড়ল। ব্যাগলে চলেছে পাশে পাশে।
কয়েকবার বাঁক নিয়ে শেষ হলো গুহা। গুহা থেকে বেরল না বেনন আর ব্যাগলে। ডিলন বা কেগল কাছাকাছি থাকলে খুন করার সুযোগ পাবে। সুড়ঙ্গমুখের কাছে আলোয় এসে কাগজগুলো পড়ে দেখল বেনন। একটা কাগজ খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো। ক্যাশ মেমো একটা। পাঁচ মাস আগে ইন্ডিয়ান এজেন্টের কাছে তিনশো গরু বেচেছে কেগল আর জারম্যান। জা কুঁচকে গেল বেননের, সমস্ত প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে শহর ছাড়ছিল তাই এই কাগজটা সঙ্গে রেখেছিল মার্শাল? মনে হয় না। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল। বোধহয় বদমাশ ইন্ডিয়ান এজেন্টকে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল জারম্যান। কাগজটা সযত্নে নিজের কাছে রেখে দেয়ার সেটাই কারণ। হয়তো ভেবেছিল দূর থেকে চাপ সৃষ্টি করবে। সাধ্যের মধ্যে হলে তার চাহিদা অবশ্যই পূরণ করত এজেন্ট। লোভনীয় একটা পদ-থেকে সরে দাঁড়াতে চাইত না।
কাগজটা পকেটে রেখে দিল বেনন। ব্যাগলে জমির দিকে তাকিয়ে আছে, ট্র্যাক পরীক্ষা করে দেখছে। মুখে বলছে না কেউ, কিন্তু দু’জনই মনে মনে জানে, কোটি টাকা দিলেও আর পেছনে ফেলে আসা ওই মৃত্যুগুহায় ঢুকবে না ওরা।
কয়েকদিন পর খণ্ডবিখণ্ড মাংসের দলা পচলে গুহার ভেতরটা দোজখ হয়ে উঠবে।
১২. তুমি সোজা রলিন্সে যাবে
তুমি সোজা রলিন্সে যাবে, ব্যাগলের হাতে গরু বিক্রির কাগজটা দিয়ে বলল বেনন। ওখানে শেরিফের সঙ্গে দেখা করে তাকে সব খুলে বলবে। পুরো দলটাকে ধরতে কমপক্ষে বিশজনের পাসি লাগবে তার। প্রয়োজনে পিঙ্কারটন এজেন্সিতে টেলিগ্রাফ করে আমার ব্যাপারে সে খোঁজ নিতে পারে। কিন্তু দেরি যাতে না করে। রাসলার আর ইন্ডিয়ান এজেন্টকে হাতেনাতে ধরার এটা একটা বিরাট সুযোগ। কি বলেছি বুঝতে পেরেছ?
বিরস চেহারায় মাথা দোলাল ব্যাগলে। মজা সব একাই লুটে নেবে বেনন, এটা ওর পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। এমনকি অনুযোগ করাও চলে না। জরুরী কাজে ওকে পাঠাচ্ছে বেনন। নিম-তেতো চেহারায় ঘোড়া ফিরিয়ে নিল ব্যাগলে, রলিন্সের দিকে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা।
গুহার বাইরে অসংখ্য খুরের ছাপ। ঘাসগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে। বাইরে এসে ছড়িয়ে পড়েছে গরু, সেই সঙ্গে চওড়া হয়েছে ট্র্যাক। তাড়া নেই বেননের, সময় নিয়ে কেগল আর ডিলনের ট্র্যাক খুঁজতে শুরু করল ও।
বেশ অনেকক্ষণ পর যা খুঁজছিল পেয়ে গেল। একটা ঘোড়া গরুর পালের ট্র্যাক থেকে সরে পাহাড়ের দিকে গেছে। অনুসরণ করতে শুরু করল বেনন। ধীরেসুস্থে এগোচ্ছে। সতর্ক। সামনে আছে কেগল আর ডিলন।
জমিটা সামনে ঢালু। বাতাস বইছে সামনে থেকে। সামনেই আছে কেগল আর ডিলন। একটা সিগার ধরাল বেনন। লক্ষ করল ট্রিপল বার আর বার। কিউয়ের দিকে কোনাকুনি ভাবে যাচ্ছে ট্রাক। পাহাড়ী পথ। দু’পাশে পাহাড়, পাইনের সবুজ রেখা তাদের গা ছুঁয়ে আছে।
সমতল চুড়োওয়ালা একটা টিলা পেরিয়ে বাঁক নিল বেনন। সামনে ঢালু টিলার রাজ্য। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় লাল-হলদে ঢেউ বইছে। কেগল আর ডিলন সেদিকেই যাচ্ছে। ওগুলো পেরিয়ে গেলে আবার খোলা রেঞ্জে পড়বে ওরা। দিক না বদলালে আকাশে মাথা উঁচু করে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়শ্রেণীর কাছে চলে যাবে। ওই পাহাড়শ্রেণীর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, সমতলের জমিকে করে তুলেছে উর্বর। ওদিকে যাচ্ছে কেগল। কেন? কোন জবাব। জানা নেই বেননের। অনুসরণ করছে ও। চারদিক লক্ষ করতে করতে চলেছে। সেজন্যেই ডিলন কতটা সামনে আছে সে-ধারণা পেয়ে গেল। আগেও লক্ষ করেছে ঘাসের ডগায় ঘোড়ার মুখের ফেনা। পরপর খুব কাছাকাছি দু’জায়গায় ফেনা দেখে স্যাডল থেকে নামল ও, একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে ফেনা নাড়াচাড়া করল। এখনও শুকাতে শুরু করেনি। বড়জোর মাইল খানেক সামনে আছে ডিলন। ঘোড়াটাকে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়েছে লোকটা, ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। প্রয়োজনের সময় ঘোড়াটা এখন দ্রুত ছুটতে পারবে না। সেকারণে ডিলন কম বিপজ্জনক হয়ে যায়নি, আরও সাবধান হয়ে গেল নেন। চলার গতি আরও কমে গেল।
একটা ক্যানিয়ন ধরে এগোচ্ছে ও এখন। পাথরের মেঝেতে ঘোড়ার নালের ঘষা খাওয়ার দাগ ওর চোখ এড়ায়নি। এক জায়গায় নাদিও দেখেছে। কাঠি দিয়ে খুচিয়ে দেখেছে, নরম। আঙুল দিয়ে ঘাঁটলে বোঝা যেত গরম কিনা, ঠিক কতক্ষণ আগে ঘোড়াটা গেছে এপথে। কিন্তু ইচ্ছা করেনি বেননের।
এক ঘন্টা পর পুবের পাহাড়ে উঠল বেনন। এখানে থামল। নিচে, বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে-টিলা, ক্যানিয়ন, জঙ্গল আর খোলা ঘাস জমি এবং ট্রিপল বার আর বার কিউয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নদী। সূর্যের আলোয় ঝিলিক মারছে ঢেউয়ের মাথা। ডিলনকে খুঁজল ওর চোখ। ডিলন বা কোলের কোন চিহ্ন নেই। হরিণের তৈরি পাহাড়ী ট্রেইলটা পাহাড়ের গায়ে বাঁক নিয়ে ওপরে উঠেছে, সেদিকে তাকাল। ট্রেইলে দুটো ঘোড়ার ছাপ। একটা কোলের অন্যটা ডিলনের। কেগল এগিয়ে আছে, ডিলন চাইছে তাকে ধরতে। কেগলের ঘোড়াটা পরিশ্রান্ত নয়, কিন্তু ডিলনেরটা পরিশ্রান্ত। কেগল চাইবে নিজের সুবিধে মতো জায়গায় গিয়ে রুখে দাঁড়াতে।
পাহাড় থেকে ধীরেসুস্থে নেমে এলো বেনন। নদী যে-পাহাড়শ্রেণীর কোল ঘেঁষে গেছে, সেদিকে যাচ্ছে ট্র্যাক। চোখের ওপর হ্যাট টেনে দিয়ে সামনের জমি ভাল করে লক্ষ করল বেনন। অনেকদূরে, ছোট্ট একটা বিন্দু নড়ছে না? প্রায় ওই পাহাড়সারির কাছে?
দ্রুত ঘোড়া ছোটাল বেনন। পনেরো মিনিট একই গতি ধরে রাখল। সামনের অশ্বারোহী এখন আর বিন্দু নয় ওর চোখে। অনেক কাছে চলে এসেছে ও লোকটার। তবে এতটা কাছে নয় যে ওর ঘোড়ার খুরের শব্দ পাবে ডিলন।
এক ঝলকের জন্যে কেগলকেও দেখতে পেল বেনন। লোকটা ডিলনের রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে আছে, পেছনে তাকাচ্ছে না একবারও। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে। দ্রু কুঁচকে গেল বেননের। কেগল কি আর জানে না ডিলন তাকে ধাওয়া করছে? বদমাসের হাড় এই কেগল লোকটা, শিয়ালের চেয়েও ধূর্ত। বেড়াল যেমন মারার আগে ইঁদুরকে নিয়ে খেলে, তেমনি করে ডিলনের সঙ্গে খেলছে কেগল। নিজের পছন্দ মতো জায়গায় নিয়ে লিনকে শেষ করে দেবে। আত্মবিশ্বাস আছে লোকটার। তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। ডিলন লোকটাও বোকা নয়। তারও হাত চালু। নেতৃত্বের একটা সহজাত ক্ষমতাও আছে। দেখা যাক কি হয় শেষ পর্যন্ত।
ডিলন আর কোল যেদিকে যাচ্ছে তাতে একমাইল পর পৌঁছে যাবে নদীর কাছে। নদী ওখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গেছে। পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল কেগল। একটু পরই ধূসর ধোঁয়ার একটা ছোট্ট কুণ্ডলী দেখল বেনন। কয়েক সেকেন্ড পর রাইফেলের আওয়াজ পেল। পাহাড়ের কিনারায় টলমল করছে ঘোড়াটা। পড়ে গেল কিনারা থেকে। তার আগেই লাফ দিয়ে স্যাডল থেকে নামল কেগল, স্যাডলব্যাগ আর রাইফেল বুকে চেপে ধরে বাউলি কেটে দৌড়ে একটা বোন্ডারের পেছনে চলে গেল।
ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে এগোচ্ছে ডিলন, একটু পরই তাকে পাহাড়ের পায়ের কাছে দেখতে পেল বেনন
কড়াৎ!
পাহাড়ে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হলো শব্দটা। খিচে দৌড় দিল ডিলন, রাইফেলটা দুহাতে ধরে আছে বুকের কাছে, একটা বোল্ডারের পেছনে ঝাপিয়ে পড়ে আশ্রয় নিল। রাইফেল ব্যবহার করেছে কেগল। তারমানে স্যাডলরোলে একটা রাইফেল ছিল তার। বিরক্ত হলো যেনন। লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা বেশি।
মনোযোগ দিয়ে পাহাড়টা লক্ষ করল ও। কেগল আর ডিলন যেখানে আছে তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘোড়া নিয়ে ওঠা সম্ভব। তাতে চোখে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। ঝোঁপের মধ্যে ঘোড়া লুকিয়ে পাহাড়ে চড়লে? কপাল ভাল হলে কেউ দেখতে পাবে না। ওই জায়গায় পাহাড়টা ভেতরের দিকে ডেবে গেছে। উঁহু, সহজে ওকে দেখা যাবে না। কেগল আর ডিলনের মাথার ওপর একবার চড়ে। বসতে পারলে…
ঠিক করে ফেলল বেনন, পাহাড়ে উঠবে। এখন একটু পরপরই রাইফেলের গর্জন শুনছে। ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গুলির আওয়াজ, একটার সঙ্গে আরেকটা মিশে যাচ্ছে, জোরাল হয়ে উঠছে আরও। পরস্পারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে কেগল আর ডিলন। একজন আরেকজনকে শেষ করতে না পারলে সন্তুষ্ট হবে না। এই তো সুযোগ। এখন দূর দিয়ে ঘুরে পাহাড়ের কাছে চলে যেতে পারবে বেনা, ঝোঁপের ভেতর ঘোড়া রেখে পাহাড়ে চড়ার সুযোগ পাবে।
কোনাকুনি ঘোড়া ছোটাল বেনন, তীরবেগে দূরত্ব অতিক্রম করছে। পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে কেগল আর ডিলনের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আড়াল পেতে বেছে নিচ্ছে ঝোঁপগুলোকে।
ঘোড়া রেখে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে গেল বেনন, ডিলনের অবস্থানের দিকে তাকাল। নদীখাতের পঞ্চাশ গজ দূরে, তিনশো ফুট ওপরে পাহাড়ী ঢালে আছে সে। কয়েকটা বোল্ডারের পেছনে ঘাঁটি গেড়েছে। কেগল ওপরে আছে। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করল বেননের চোখ। একটু থমকে গেল। ডিলন যেখানে আছে তার ফুট তিরিশেক বায়ে কিছুটা ওপরে একটা নালা মতো দেখা যাচ্ছে। চওড়ায় নয় ইঞ্চির বেশি হবে না। ভেতরটা অন্ধকার। গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না। পাহাড়ের গা বেয়ে ওই নালা কতদূর উঠেছে কে জানে! দরকার কি জানার, নালা, দিয়ে বেনন উঠতে পারবে না, ধরা পড়ে যাবে ডিলনের চোখে। কিন্তু চোখ সরাতে পারছে না বেনন। নালাটা চুম্বকের মতো ওর চোখ আটকে রেখেছে। জ কুঁচকে উঠল বেননের। ভুল দেখছে না তো? গোলাগুলির আওয়াজের সাথে সাথে যেন চওড়া হচ্ছে নালাটা! একটু যেন আগুপিছু করছে পাহাড়ের ওই অংশ। চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বেনন। নিচে চিহি করে উঠল ওর ঘোড়াটা। কোন কারণে ভয় পেয়েছে।
পর পর আরও দুবার হুঙ্কার ছাড়ল ডিলন আর কেগলের রাইফেল, তারপর শুরু হলো একটানা গুরুগম্ভীর আওয়াজ। থরথর করে কাঁপতে শুরু করল পাহাড়। পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকির বিকট শব্দ হচ্ছে। আতঙ্কিত বেননের চোখের সামনে চওড়া হলো নালা, পাহাড়ের বিরাট একটা অংশ এগিয়ে আসছে সামনে, যেন পেছন থেকে ঠেলছে কেউ। পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত গেছে মালা, ওখান থেকে ধুলো আর বালি ঝরে পড়তে শুরু করল। গড়াচ্ছে ছোট-বড় নানা আকারের পাথর খণ্ড। আওয়াজটা শুধু বাড়ছেই। কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতো আওয়াজ। ধুলোর মেঘে আকাশ দেখা যাচ্ছে না। হাঁ হয়ে গেছে বেননের মুখ। জীবনে এমন দৃশ্য দেখেনি। দেখবে তা কল্পনাও করেনি। পালানোর কথা ভুলে বোকার মতো তাকিয়ে আছে, সম্বিৎ নেই ওর।
অ্যাভালাশ!
আস্ত পাহাড়টার দশ ভাগের এক ভাগ, প্রকাণ্ড পাথরের সুবিশাল স্থূপ, কাত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে! প্রবল ভূমিকম্পে থরথর করে কাঁপছে চারপাশ। নদীর খাত বুজে গেল ধসে পড়া কয়েক মিলিয়ন টন পাথরে। ডিলন যেখানে ছিল সেই জায়গাটা এখন ছুটন্ত পাথরের একটা শুকনো নদী। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে যেমন করে ধোয়া বেরোয়, তেমনি করে ধুলোর মস্ত কুণ্ডলী নিজের ভেতরে পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়ছে।
এখনও পাহাড়ের গায়ে সেঁটে আছে বেনন। ঘন ঘন ঢোক গিলছে। ওর মাত্র বিশ গজ দূর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর। নানা আকৃতির। ছোট নুড়ি থেকে শুরু করে বিশ টনী বোল্ডার। এই স্রোত পুরোপুরি থামতে কয়েকদিন লাগবে। পাহাড়ের নিরেট পাথুরে দেয়াল যতক্ষণ বেরিয়ে না আসছে, ততক্ষণ পাথর খসতেই থাকবে, নেমে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসবে আরও পাথর।
ডিলন চাপা পড়েছে কয়েকশো টন পাথরের নিচে।
আরও কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর বেননের মধ্যে অনুভূতি ফিরতে শুরু করল। বুঝতে পারল নিরাপদ জায়গায় আছে ও।
ধুলোর একটা ঘন মেঘ চারদিক ঢেকে রেখেছে। আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসছে ধুলো। হালকা বাতাসে সরে যাচ্ছে আরেকদিকে।
দুই মিনিট তাকিয়ে থাকার পর বেনন দেখতে পেল কেগল যেখানে ছিল তার আড়াই ফুট দূর থেকে ধসে গেছে পাহাড়। কেগল কোথাও নেই। তাকে দেখতে পাবার কথাও নয়। পাথরের পেছনে লুকিয়েছিল সে।
চিন্তা করছে বেনন, কেগল ওকে দেখেছে তা হতে পারে না। পাহাড় ধস বাদ দিয়ে অন্যকিছু দেখবে সেই ক্ষমতা স্বয়ং শয়তানেরও নেই। কেগল যেখানে আছে সেখানে পাথর পড়েনি। তারমানে লোকটা এখন ভাবছে সমস্ত বিপদ কেটে গেছে।
পাহাড়ের গা থেকে সরে এক ছুটে ঝোঁপের ভেতর ঢুকে পড়ল বেনন, অপেক্ষা করে দেখতে চাইছে কেগল কি করে। ধুলো কমছে, কিন্তু পাথর গড়ানোর আওয়াজ এখনও চলছে একটানা। নদীটা যে খাদ দিয়ে বইছিল অনেকদূর পর্যন্ত সেটার কোন অস্তিত্ব নেই।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো বেননকে, তারপর বোল্ডারের আড়াল থেকে বেরল কেগল। ঘোড়া থেকে লাফ দেয়ার সময় স্যাডল ব্যাগটা হাতছাড়া করেনি দেখা যাচ্ছে, কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে ওটা। বেশ ভারী। ওজন সামলাতে সামনে ঝুঁকে আছে লোকটা, পাহাড়ী ছাগলের দক্ষতায় নেমে আসছে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে।
তাকে পাহাড় থেকে নামতে দিল বেনন, তারপর উদ্যত সিক্সগান হাতে বেরিয়ে এলো ঝোঁপের ভেতর থেকে।
ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল কেগল। চোয়াল স্কুলে পড়ল বিস্ময়ে। পরমুহূর্তেই সামলে নেবার চেষ্টা করল। বলল, হঠাৎ এদিকে? আমি ভেবেছিলাম কালকেই চলে গেছ তোমরা।
আমি সবই জানি, কেগল, শান্ত, ধীর গলায় বলল বেনন। রাতে তুমি ডিলনের র্যাঞ্চে কি করেছ সেটা যেমন জানি তেমনি গরু স্ট্যাম্পিড় করানোর, সময় জারম্যানকে খুন করেছ সেটাও জানি। তোমার কোন কুকীর্তি আমার কাছে গোপন নেই। সামনে বাড়ল ও। চালাকির কোন চেষ্টা কোরো না, কেগল, আমি গুলি করব।
সময় থমকে দাঁড়াল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। চোখের পলক ফেলছে না কেউ, যেন ফেললেই হেরে যাবে। কেগলের চোখ সাপের মতো চকচক করছে। গানম্যানের চোখে একই সঙ্গে অনেকগুলো চিন্তার ছাপ দেখতে পেল বেনন। ঝুঁকি নেবার প্রবণতা, ভয়, ঘৃণা, আক্রোশ এবং সবশেষে পরাজয় স্বীকার।
স্যাডলব্যাগটা পিঠ থেকে নামানোর চেষ্টা কোরো না, নির্দেশ দিল বেনন। আস্তে আস্তে সামনে বাড়ছে। দৃষ্টি সরাচ্ছে না গানম্যানের চোখ থেকে। কথা দিচ্ছি ন্যায় বিচার পাবে তুমি।
দাঁতে দাঁত চাপল কেগল। ন্যায় বিচার মানেই ফাঁসি। কিন্তু এখন তো বেঁচে আছে! বেনন ঠাট্টা করছে না, গুলি করতে দ্বিধা করবে না। কিছু করা ঠিক হবে না। আপাতত নয়। পরে সুযোগ আসবে। আসতেই হবে। আসে সবসময়। পালানো যাবে। দরকার শুধু একটু সুযোগ। বিচারের আগেই।
মাপা হাতে কেগলের মাথায় সিক্সগানের নল নামিয়ে আনল বেনন। অজ্ঞান দেহটা ধরে শুইয়ে দিল মাটিতে। স্যাডল ব্যাগ থেকে দড়ি এনে ভাল-মতো হাত পা বেঁধে ফেলল। তারপর পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল। কেগল যেখানে ছিল তার ফুট পঁচিশেক নিচে একটা পাথুরে চাতালে দাঁড়াল। একসময় যেখানে নদী বয়ে যেত সেখানে এখন পাথরের স্থূপ ছাড়া আর কিছু নেই। বিরাট একটা বাঁধ তৈরি করেছে প্রকৃতি। বাঁধে বাধা পেয়ে ক্রমশ পানির উচ্চতা বাড়ছে নদীর। উচ্চতা আরও পঞ্চাশ ফুট বাড়লে বাঁধ ডিঙিয়ে পানি উপচে পড়ত, কিন্তু ট্রিপল বারের দিকে যে শাখাটা গেছে সেটাতে পানির স্রোত বাড়ছে। বাঁধ আর ডিঙাবে না নদী, নতুন পথে ছুটবে। প্রয়োজনে নদী নিজেই তার পথের গভীরতা বাড়িয়ে নেবে। কিছুদিন পর বার কিউয়ের ওপর দিয়ে যাওয়া পুরনো নদীখাতটা প্রায় শুকিয়ে যাবে। সেজন্যেই ট্রিপল বার দখল করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল ডিলন। ডিলন জানত-পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। একদিন না একদিন নদীর মূল। স্রোত পাহাড় চাপা পড়ে হারিয়ে যাবে।
কৌতূহল মিটিয়ে নেমে এলো বেনন, কেগলকে কাঁধে তুলে নিয়ে স্যাডলে বাঁধল, তারপর রওনা হয়ে গেল টুইন স্প্রিংসের উদ্দেশে। নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ঝেড়ে কাশবে গেল, কাজেই সমস্ত রহস্যের সমাধান এবার হয়ে যাবে। তবু একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না বেনন। ব্যাগলে ওদিকে কি করছে কে জানে।
১৩. বেশ বড়সড় একটা ভিড়
বেশ বড়সড় একটা ভিড় জমেছে জেলখানার সামনে।
কেগলকে জেলখানায় ভরে সেলের তালার চাবি পকেটে পুরে বেরিয়ে এলো বেনন, ধৈর্য ধরে কি ঘটেছে ব্যাখা করল। সবার কৌতূহল মিটিয়ে স্টেবলে রেখে এলো ঘোড়াটা, তারপর ক্লান্ত পায়ে বোর্ভওয়াক ধরে হোটেলের দিকে চলল।
হারবেনের হোটেলে একটা ঘর নিল ও, সেখানে বিশ্রাম করল ঘন্টা দুয়েক। অপেক্ষা করছে, ব্যাগলে ফিরবে। ফিরছে না ব্যাগলে।
চাইনিজ চপ হাউজে রাতের খাওয়া সেরে শার্লি রাশল্যান্ডের বাড়িতে গিয়ে একবার আহত ক্লিন্টকে দেখে এলো। জামাই খাতির পাচ্ছে র্যাঞ্চার। বেনন যখন গেল, মস্ত বিছানায় ধবধবে সাদা চাদরে শুয়ে ছিল, পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে হরেক জাতের ফলমূল আর বাড়িতে বানানো সুস্বাদু খাবার। সেবাযত্নের অভাব হচেছ না।
টাকাভরা স্যাডলব্যাগ শার্লির কাছেই রাখতে দিয়েছে বেনন। বলেছে ব্যাগে যা আছে সেগুলো ব্যাঙ্কের টাকা। ডিলনের ব্যাপারে খুলে বলেছে, জানিয়েছে পরিণতি। গভীর আগ্রহ নিয়ে বেননের কথা শুনেছে শার্লি আর ক্লিন্ট। শার্লির চেহারায় কোন দুঃখের ছাপ পড়েনি। এখন মেয়েটা জানে, কে ওর বাবার হত্যাকারী। শহরে আসার পথে কোলের জ্ঞান ফিরেছে, অনেক কথা বলেছে লোকটা। ডিলন ট্রিপল বার দখল করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। ডিলন জানত পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। একদিন না একদিন নদীর মূল স্রোত পাহাড় চাপা পড়ে হারিয়ে যাবে, শুকোতে শুরু করবে বার কিউয়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া নদীর অংশ। ট্রিপল বার নিজেদের জমিতে খাল কাটতে না দিলে মরুভূমি হয়ে যাবে বার কিউয়ের অধিকাংশ জমি। উপায় ছিল না ডিলনের। ট্রিপল বার দখল করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে গিয়েছিল। ক্লিন্টের কাছে কোন সাহায্য চেয়ে ছোট হবার মানসিকতা ছিল না ডিলনের।
শার্লি তার বাড়িতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে, সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে বেনন, ফিরে এসেছে হোটেলে।
হোটেলের ঘরে বসে সময় কাটছে না, বাইরে যাওয়ার জন্যে বেরিয়ে এলো বেনন। ওর ঘরটা দোতলায়। সিঁড়িতে ব্যাগলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওকে দেখেই চওড়া একটা হাসি উপহার দিল ব্যাগলে, হাত ধরে বেননকে টেনে নামিয়ে নিয়ে চলল। সেথ হারবেনন হোটেল চালায় বটে, তবে মদও বিক্রি করে। কাউন্টারের পেছনে বসে আছে সে। দু’বন্ধু দুটো ড্রিঙ্ক নিল।
তারপর? জিজ্ঞেস করল বেনন।
আর কি, কাঁধ ঝাঁকাল ব্যাগলে। একেবারে সহজ কাজ দিয়েছিলে। শেরিফকে তোমার নাম বলতেই সে চিনল। এমনিতেই আমার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনছিল, তারপর যখন জারম্যানের ক্যাশ মেমো দেখালাম, বললাম ইচ্ছে করলে পিঙ্কারটন এজেন্সিতে টেলিগ্রাফ করে খবর নিতে পারে, তখন একেবারে করিৎকর্মা হয়ে উঠল। সেলুনে গিয়ে পাসির জন্যে সদস্য চাইতেই ছাব্বিশজন লোক হাত তুলল। আমি নিজে গুনে দেখেছি। সবাইকে নিয়ে আমরা এজেন্টের অফিসে গেলাম। শেরিফই ইন্ডিয়ান এজেন্টকে খুঁজে বের করল। ব্যাটা প্রথমে স্বীকার করছিল না। কিন্তু ক্যাশ মেমোটা দেখে একেবারে কানে ধরে ধরে অবস্থা। বলল আগেও কয়েকবার এই কাজ করেছে। লোকটা এখন রলিন্সের জেলখানায় শেরিফের বন্দি। এজেন্টই আমাদের নিয়ে গেল রাসলারদের কাছে। গোলাগুলি হলো। পালাবার সময় দু’জন মারা গেছে; অন্যদের ধরা যায়নি। গরু চুরিতে কাদের হাত ছিল সেটা ক্লিন্ট যদি জানাতে পারে তো ওয়ারেন্ট ইন্ড্য করবে শেরিফ। গরুগুলো রলিন্সের রেল স্টেশনের পেনে আছে। একনাগাড়ে কথা বলে বিরাটুকরে দম নিল ব্যাগলে। তারপর জানতে চাইল, ক্লিন্টের কি অবস্থা?
ভাল, সংক্ষেপে জবাব দিল বেনন। খুলে বলল ব্যাগলৈকে বিদায় দেয়ার পর কি ঘটেছে। অ্যাভালাশের কথা শুনে ব্যাগলের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। ওর চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজনাময় সময় কাটিয়েছে বেনন। ও থাকলে••ফোশ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ব্যাগলে। সবার কপালে সব হয় না।
পরদিন সকালে ওদের হোটেল ঘরে এলো ক্লিন্ট আর শার্লি। হাত ধরাধরি করে আছে ওরা। আজকে ক্লিন্টকে অনেকটা সুস্থ দেখাচ্ছে। অকুণ্ঠ চিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল ও দু’বন্ধুর কাছে। ওর কথা শেষ হবার পর রীতিমতো লজ্জা লাগল বেনন আর ব্যাগলের। ক্লিন্টের জন্যে এতকিছু করেছে তা নিজেদেরও যেন জানা ছিল না ওদের। মনের মধ্যে একটু সন্দেহও হলো, ভদ্রতা করে বাড়িয়ে বলছে। যুবক র্যাঞ্চার। ওদেরকে ট্রিপল বারে থেকে যেতে অনুরোধ করল ক্লিন্ট।
সব তত ভালয় ভালয় শেষ হলো, জবাবে বলল বেনন। এবার বিদায় নেব। জরুরী কাজ পড়ে আছে আমার। তাছাড়া ব্যাগলেকেও ফার্মে ফিরতে হবে। ওর বউ অপেক্ষা করে আছে।
আরও একটু অপেক্ষা করলে বিরাট কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না, তাড়াতাড়ি করে বলল ব্যাগলে। বেনন ভুল বলছে, সব কাজ এখনও শেষ হয়নি। বিয়ে না খেয়ে আমি যাচ্ছি না। তাকিয়ে আছে ও শার্লির নিষ্পাপ অপরূপ মুখের দিকে।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল শার্লি। ঘনঘন মাথা দুলিয়ে ব্যাগলের কথায় সম্মতি দিল ক্লিন্ট।
ফোঁশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেনন। একবার যখন মুখ ফুটে বলে ফেলেছে ব্যাগলে থাকবে, থাকবেই ও। কথা সেখানে নয়। কথা হচ্ছে, দেরি করার কারণে ব্যাগলের বউয়ের কাছে আর কাউকে নয়, জবাবদিহি বেননকে করতে হবে। ব্যাগলে তখন পেছনে লুকিয়ে থাকবে।
থাকছি আমরা, মুখ চুন করে বলল বেনন। তবে একটু খুশিও লাগছে, সুচারু ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে।
M H Shamim
এত এত ভুল কোন প্রিন্টেড বইতে দেখিনি আজ পর্যন্ত! তাও আবার সেবা’র!