কিশোর পঞ্চাশ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সম্পাদনা – অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
দেব সাহিত্য কুটীর প্রাঃ লিমিটেড
প্রথম প্রকাশ: পয়লা বৈশাখ ১৪২৬, এপ্রিল ২০১৯
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: রঞ্জন দত্ত
প্রসঙ্গ-কথা
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ক্ষমতবান, প্রথিতযশা ও পাঠক-প্রিয় সাহিত্যিক যখন ছোটদের রাজ্যে পা রাখেন, নিছক প্রতিভার প্রসাদগুণেই সেই অভিযাত্রা হয়ে ওঠে অনন্য, অভিনব, মনকাড়া এবং নির্ভেজাল রোমাঞ্চকর৷ তাঁর সুগভীর অন্তর্দৃষ্টির আতশকাচে ছোটদের মনের মানচিত্রটাই যে নিঁখুতভাবে প্রস্ফুটিত; তাদের খেয়ালখুশির সুলুক-সন্ধানও সব নখদর্পণে৷ তাই তো সুনীলের লেখা কিশোর-মনস্ক কাহিনিগুলির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এত মায়া, এত মমত্ববোধ৷ গল্পগুলি খুঁটিয়ে পড়লেই হৈ হৈ করে ফিরে যাওয়া যায় সেই কোন সুদূরকালের ছেলেবেলার হট্টমেলার মাঠে৷ সেখানে রামধনুর সাতরং-মেখে ঝকমক করছে ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষা, একবিঘত স্বপ্নেরা…সুনীলের চিরতরুণ মনের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে আরও অপূর্ব, মধুর; মানবিক দেখায় তাদের৷
ব্যক্তিজীবনে খুবই যুক্তিনিষ্ঠ ছিলেন সুনীল৷ কোনওপ্রকার অতিলৌকিকতায় বিশ্বাস ছিল না একেবারেই৷ কিন্তু ছোটদের জন্যে কলমধরলেই এক সম্পূর্ণ আলাদা জগতে পৌঁছে যেতেন—যেখানে যুক্তি-তর্কের বেড়াজাল থাকলেও ফাঁক-ফোকর দিয়ে অন্য এক পৃথিবীর ছবি ভেসে ওঠে৷ সেই ভিন্ন পৃথিবীর রহস্য-রোমাঞ্চ-মজা আর অ্যাডভেঞ্চারের টানেই তো শেষ হয়ে যায় পাতারপর পাতা৷ ছোটদের জগতটাও যে তাই-ই! বাস্তবের বনিয়াদের ওপর ভর দিয়ে এক অবাস্তবের হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার প্রচেষ্টা৷ কত যে দুষ্টু বুদ্ধি, অজানা ভয়ের শিরশিরানি, নিয়ম-ভাঙার রোমাঞ্চ আর হরেক মজার সাত-সাতেরো মিশে আছে আমাদের প্রত্যেকের কিশোরবেলার দিনগুলোতে—তা লিখে শেষ হবে না! সুনীলের এই ছোটদের জন্য লেখা কাহিনিগুচ্ছের প্রতিটিতেই ছোটরা পায় সেইসব অনাবিল খুশি-মজার মনমাতানো আস্বাদন; যেন বা ঠাকুমার হাতে তৈরি রোদে দেওয়া কুলের আচার, মায়ের বানানো জন্মদিনের পায়েসের সৌরভ৷ তাই কখনও তারা ঢুকে পড়ে গল্পের একেবারে অন্দরমহলে; তারই চরিত্র হয়ে৷ কখনও বা রোজকার একঘেয়ে দিনযাপনের মধ্যেই খুঁজে পায় অসম্ভবের ইচ্ছে আর মুক্তির মন্ত্রশক্তি…বড়রাও পড়তে পড়তে অনায়াসে ফিরে যান কবেকার ছেলেবেলার থই হারানো আজব-দেশের চিরনতুন আনন্দে৷
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা অগণন কিশোর-কাহিনির সম্ভার থেকে সচেতনভাবে এই বইটির জন্য বেছে নেওয়া হল যে ‘গল্প পঞ্চাশ’—তাতে পরিতৃপ্তির সমস্ত উপাদান-ই মজুত৷ ভূত, রহস্য, কল্পবিজ্ঞান, হাসি-মজা, ছেলেবেলা, অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চ, পাওয়া-না-পাওয়া, স্বপ্নপূরণ—আর কত বিচিত্র ভাবনা ভরে রেখেছে এইসব গল্পের আকাশ-ভুবন; ঠিকঠিকানা মেলা ভার!…তবে প্রতিটি গল্পেই কাহিনির চমককেও ছাপিয়ে যায়; ভালোবাসা আর মানবিক গুণ৷ ব্যক্তি সুনীলের তো বটেই, লেখক সুনীলের সৃষ্টি-চরিত্রেও যা ছিল অপরিহার্য৷ গল্পগুলির উত্তরণ ঘটেছে সেই বৃহত্তর মানবিক বোধে—কিশোর মনের সুকুমার বিকাশের সাপেক্ষে যে-বোধ বা গুণ অনস্বীকার্য সম্পদ৷… দীর্ঘকাল লেখকের সঙ্গলাভ করার সৌভাগ্য থাকায় একথা জানি, বড়দের লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও ছোটদের জন্যে একেবারে অন্য এক জায়গা ছিল তাঁর অন্তরে৷ ছোটদের লেখার ব্যাপারে খুঁতখুঁতেও ছিলেন অসম্ভব রকম৷…নিজে ছোট হয়ে, তাদের মতন করে, সেইভাবে দেখে, তাদের কথা লিখেছেন সুনীল৷
নির্বাচিত এই পঞ্চাশটি কাহিনিতে অভিনবত্বের সঙ্গে বিষয়-বৈচিত্র্যকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ চেনা গল্পের পাশাপাশি রাখা হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম-চেনা এমনকি, হারিয়ে যাওয়া প্রায় অচেনা আখ্যানও৷ প্রতিটি গল্পকেই বিবেচনা করে ছাপার অনুমতি দিয়েছেন যিনি তিনি লেখক পত্নী—স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়৷ আমাদের স্বাতীদি৷ তাঁর ঋণ শোধ হওয়ার নয়৷ আর অবশ্যই বলতে হয়, দেব সাহিত্য কুটীরের কর্ণধার শ্রীমতী রূপা মজুমদারের কথা; যাঁর প্রাগঢ় সাহিত্যবোধ, সনিষ্ঠ উৎসাহ এবং যথাযথ প্রচেষ্টা ছাড়া এই বইটি প্রকাশের আলো দেখত না৷ এই অবকাশে শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে৷
এখন তাহলে প্রবেশ করা যাক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-সৃষ্ট সেই মায়াদর্পণের ভিতর; যেখানে চেনা জগতের প্রতিচ্ছবি অন্যরকম, নকশাকাটা, রহস্যময় হয়ে ধরা দেয়৷ সময় থমকে থাকে ছোটবেলায়৷
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
Leave a Reply