কিশোর কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের বিশ্বনবী (সা.) – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ২০১২
.
উৎসর্গ
ঢাকা জামেয়া দ্বিনীয়া শামসুল উলুম মাদ্রাসার মোহাদ্দেস ও
১১২ নং উত্তর মুগদাপাড়ার মদীনা জামে মসজিদের পেশ ইমাম
মোহতারাম মুফতি আবদুর রহমান,
যাঁকে আমি দ্বীনের খাতিরে ভীষণ মহব্বত করি।
.
১. মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কাহারও পিতা নহেন; কিন্তু তিনি আল্লাহর রসুল এবং সমস্ত নবীর শেষ, আর আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বিষয়েই খুব অবগত আছেন।
আল-কুরআন, সূরা আহযাব, আয়াত নং ৪০, পারা ২২
২. যাহারা অনুসরণ করে এমন রসুলের যিনি নবীয়ে উম্মি যাহাকে তাহারা লিখিত পায় নিজেদের নিকট তওরাতে ও ইঞ্জিলে, তিনি তাহাদিগকে সৎকাজের আদেশ করেন এবং মন্দ কাজ হইতে নিষেধ করেন। আর পবিত্র জিনিসগুলিকে হালাল বলেন এবং অপবিত্র বস্তুগুলিকে তাহাদের উপর হারাম করিয়া দেন।
আল-কুরআন, সূরা আরাফ, আয়াত নং ১৫৭, পারা ৯
৩. প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্য আল্লাহর রসুলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।
আল-কুরআন, সূরা আল আহযাব, পারা ২১
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান রাব্বুল আল আমিনের যিনি মানুষকে সৃষ্টির সেরা করে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সেরা সৃষ্টি মানুষের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন মানুষকে হেদায়েত করার জন্য।
অনেক দিনের আশা কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীদের জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী লেখার; কিন্তু অযোগ্যতার কারণ ভেবে তা সম্ভব হয়নি। ইদানীং মনের সেই আশাকে সংবরণ করতে না পেরে আল্লাহ পাকের কাছে সাহায্য চেয়ে তাঁরই উপর ভরসা করে লিখতে বসলাম। জানি না কতটা কামিয়াব হতে পারব। অপার করুণাময় আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছি, তিনি যেন এই নাদান বান্দার মনের আশা পূরণ করেন।
আমিন সুম্মা আমিন।
.
পাঠক-পাঠিকাদের জন্য অল্প কিছু
কিশোর-কিশোরী দাদুরা, তোমাদের জন্য এমন একজন মহামানবের জীবন কাহিনী লিখতে বসেছি, যাঁর জীবনী বিশ্বের ছোট-বড় নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য একান্ত দরকার। তিনি হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), যাঁকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক কুরআন মজিদে রাহমাতুল্লিল আল- আমিন বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতো আদর্শ শিশু, আদর্শ কিশোর, আদর্শ তরুণ, আদর্শ যুবক, আদর্শ মানুষ, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ যোদ্ধা, আদর্শ সেনাপতি, আদর্শ বিচারক, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীতে আর কেউ জন্মাননি এবং পরে কেয়ামত পর্যন্ত আর কেউ জন্মাবেন না।
পৃথিবীর মানুষ যাতে ইহকালে সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং পরকালে অনন্ত জীবনেও সুখ-শান্তিতে থাকতে পারে সে জন্যে আল্লাহ পাক অগণিত নবী, রাসূল ও পয়গম্বর পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষকে সব রকমের অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য ও সৎপথে চলার জন্য উপদেশ দিতেন। তাঁদের মধ্যে মানুষ জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) প্রথম এবং সবার শেষ হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)! ওনার পরে আর কোনো নবী-রাসূল আল্লাহ পাক দুনিয়াতে পাঠাবেন না। তাই তিনি কুরআনে ওনাকে খাতেমুন নবী (সা.) বলেছেন। [১. সূরা আহযাব, আয়াত নং ৪০, পারা ২২]
অন্যান্য নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ্ পাঠিয়েছিলেন কোনো একটা গোত্র, জাতি বা দেশের মানুষের জন্য; কিন্তু আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- কে পাঠিয়েছেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ও জিন জাতির জন্য। তাই তাঁকে বিশ্বনবী ও রাহমাতুল্লিল আল-আমিন বলা হয়। আর সে জন্যে আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত জীবন- বিধান সংবলিত মহাগ্রন্থ আল কুরআন তাঁর প্রিয় রাসূল (সা.)-এর ওপর নাজিল করেছেন। এই মহাগ্রন্থে আছে ধর্মনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, সমাজনীতি, গার্হস্থ্যনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, বিচার পদ্ধতি এবং ইহলোক ও পরলোকের পথনির্দেশ।
আল্লাহ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সমস্ত সৃষ্টির সেরা, এমনকি সমস্ত নবী-রাসূল ও পয়গম্বরগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করে পয়দা করেছেন। তাই আমাদের উচিত তাঁর নির্দেশমতো জীবনযাপন করা এবং সব সময় সেই মহান নবী (সা.)-এর ওপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা।
আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদেনা মুহাম্মদ
ওয়ালা আলে সাইয়েদেনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মদ।
.
জন্ম ও বংশ পরিচয়
আমাদের দেশের পশ্চিম দিকে আরব নামে একটা দেশ আছে। ওই দেশের মক্কা নগরে বিখ্যাত কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল আরবি মাসের সোমবার সুবেহ সাদেকের সময় হযরত মুহম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। ওনার বাবার নাম আবদুল্লাহ, মায়ের নাম আমেনা, দাদার নাম আবদুল মুত্তালেব। আবদুল মুত্তালিবের ছয়টি কন্যা ও দশটি পুত্র ছিল। পুত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) ছিলেন এঁদের পূর্বপুরুষ। ওনারাই কা’বাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। তাই বংশানুক্রমে কা’বাঘরের হেফাজতের দায়িত্ব এই কুরাইশ বংশের উপর ন্যস্ত ছিল। ওনারা আরবের সবচেয়ে খানদানি বংশ। আদনান এই বংশের নামি লোক ছিলেন। আদনানের বংশধর ফিহির বা কুরাইশ নামে পরিচিত। ওঁরা সকলে বাণিজ্য করতেন বলে এঁদেরকে কুরাইশ বলা হত। এঁরাই কা’বাঘরের কর্তৃত্ব করতেন এবং বিচার-আচার ও শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করতেন। নিচে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশ পরিচয় দেয়া হল।
ফিহর বা কুরাইশ
ঘালিব
লুআঈ
কাব
মুররাহ
কিলাব
কুশাঈ
আবদুর মান্নাফ আবুল হাশিম
আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহ
মুহাম্মদ (সা.)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন মক্কার তথা সমগ্র আরব দেশের পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন গোত্র ছিল। গোত্র সর্দারের হুকুম সবাইকে মেনে চলতে হত। এক গোত্রের সঙ্গে অন্য গোত্রের মারামারি লেগেই থাকত। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও ন্যায়-অন্যায় বা ধর্মবোধ কিছুই ছিল না। পাপ- পুণ্যেরও কোনো জ্ঞান ছিল না। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি-রাহাজানি এগুলো ছিল তাদের প্রতিদিনের কাজ। মেয়েদেরকে তারা মানুষ বলে গণ্য করত না, বরং পাপী বলে মনে করত। তাই মেয়ে জন্মালেই তাদেরকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিত। হাটেবাজারে মেয়েদেরকে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি করে দিত। তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করত। মক্কার কা’বা ঘরেও ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি ছিল। কাফেররা সেগুলোর পূজা করত। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণের সাথে সাথে কা’বাঘরের সব মূর্তিগুলো উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সারা দুনিয়াতে যত দেব-দেবী মূর্তি ছিল সেই সবও উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল। এমনকি দুই হাজার বছরের পারস্যের অগ্নিপূজকদের অগ্নিকুণ্ড নিভে গিয়েছিল। ওই দেশের রাজা নওশেরওয়ার আমলের রাজপ্রাসাদের ছাদে নির্মিত যে বারোটা গম্বুজ ছিল, সেগুলো ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। [এম. এন. এম. ইমদাদুল্লাহ : এমএস, বিএ (অনার্স), এমএ কর্তৃক লিখিত বাংলাদেশ কোম্পানী লি. কর্তৃক প্রকাশিত আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া, ২য় ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৬৯]
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মা আমেনার পেটে থাকতে ওনার বাবা আবদুল্লাহ বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়া গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে মদিনায় আত্মীয়ের বাড়িতে যখন কয়েক দিন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সে সময় কঠিন অসুখে পড়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা যান। দারোন নারকা নামক স্থানে তাঁর দাফন করা হয়।
কা’বা ঘরের কথা
বহু প্রাচীনকাল থেকে কা’বা ঘর প্রসিদ্ধ। তখন ইহার নাম ছিল ‘বায়তুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর ঘর। সেই প্রাচীন যুগ থেকে এই কা’বাঘর সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পবিত্র উপসনালয় হিসেবে পরিচিত ছিল। অজ্ঞানতা ও অন্ধ কুসংস্কারের মোহে পড়ে কুরাইশরা এই পবিত্র কা’বা ঘরে বহু দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন করে পূজা করত। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সময় ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি ছিল। আমাদের নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এর দাদাজান আবদুল মুত্তালিবের সময়ে ইয়েমেনের শাসনকর্তা ছিলেন আবরাহা। তিনি যখন জানতে পারলেন কা’বা ঘরে হজ করার জন্য প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আসে এবং ইহাতে মক্কার কুরাইশদের প্রচুর অর্থ আমদানি হয়; তা ছাড়া ইহা মক্কাবাসী কুরাইশদের জন্য বিরাট সম্মানের ব্যাপার তখন তিনি লোভ-হিংসা ও নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ইয়েমেনে তৈরী করলেন এক নকল কা’বা। তারপর দেশ- বিদেশে প্রচার করলেন যে, মক্কার কা’বার চেয়ে ইয়েমেনে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ কা’বাঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং সবাই যেন মক্কা না গিয়ে ইয়েমেনে এসে নতুন কা’বা ঘরে হজ করতে আসে। কিন্তু আবরাহার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। কেননা কোনো দেশেরই মানুষ ইয়েমেনে নকল কা’বা ঘরে হজ করতে না গিয়ে মক্কার কা’বা ঘরে হজ করতে লাগল। তাই দেখে আবরাহা নিজে বহু সংখ্যক হস্তিবাহনী নিয়ে মক্কার কা’বা ঘর ধ্বংস করার জন্য রওয়ানা দিলেন।
মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছে বিশ্রামের জন্য তাঁবু গাড়লেন। ওই দিন কা’বা ঘর ধ্বংস করার জন্য মক্কায় প্রবেশ না করলেও তার সৈন্যরা সীমান্ত এলাকা থেকে উট, বকরি ও দুম্বা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। এমনকি আবদুল মুত্তালিবের দুইশত উটও লুণ্ঠন করল।
আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের নেতা। মক্কার সবচেয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তি। আবরাহার সঙ্গে উনার আগে থেকে সুসম্পর্ক ছিল। তাই তিনি সীমান্ত এলাকায় লুণ্ঠনের খবর শুনে আবরাহার সঙ্গে দেখা করলেন।
বাদশাহ আবরাহা উনাকে সম্মান দেখিয়ে বসতে দিলেন। তারপর ভালো-মন্দ আলাপ চলাকালে আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞেস করলেন, কী অভিপ্রায়ে আপনি আমাদের দেশে এসেছেন?
আবরাহা বললেন, কা’বা ঘর ধ্বংস করতে।
তাহলে আপনার সৈন্যরা লোকদের উট, বকরি ও দুম্বা লুণ্ঠন করল কেন? ওর মধ্যে আমারও দুশ উট রয়েছে। ওগুলো ফেরত নিতে এসেছি।
আবরাহা খুব অবাক হয়ে বললেন, আমি কা’বা ঘর ধ্বংস করতে এসেছি বললাম, তার নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো কথা না বলে সামান্য দুইশত উটের কথা বললেন? এটা খুব লজ্জার বিষয়।
আবদুল মুত্তালিব বললেন, শুনুন বাদশাহ, আমি ওই উটগুলোর মালিক, সেই উটগুলো ফেরত নিতে এসেছি। আর কা’বা ঘরের মালিক আল্লাহ। তিনিই উহাকে রক্ষা করবেন।
এই কথা শুনে আবরাহা বাদশাহ হো হো করে হেসে উঠে বললেন,
বেশ! দেখা যাক আপনার আল্লাহ কেমন করে কা’বা ঘর রক্ষা করেন। তারপর সৈন্যদেরকে বললেন, তোমরা যা কিছু লুণ্ঠন করে এনেছ সব ফেরত দিয়ে দাও।
আবদুল মুত্তালিব ফিরে এসে কুরাইশদের নিয়ে কা’বা ঘরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, “আয় আল্লাহ, তোমার পবিত্র ঘরের সম্মান তুমিই রক্ষা কর। মাকামে ইবরাহিমের ইজ্জতকে তুমি রক্ষা কর।” তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সবাইকে নিয়ে কাছাকাছি একটা পাহাড়ের উপরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
এদিকে বাদশাহ আবরাহা তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মোহাসসের নামক জায়গায় পৌছাবার সাথে সাথে সব হাতি মাটিতে বসে পড়ল। সৈন্যরা হাতিদের মারধর করেও তাদেরকে ওঠাতে পারল না। বাদশা আবরাহা যে হাতির পিঠে চড়ে এসেছিলেন সেটার নাম মাহমুদ। সে বাদশাহকে নিজের পিঠ থেকে জমিনে ফেলে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে আল্লাহর হুকুমে অসংখ্য ছোট ছোট পাখি ঝাঁক বেঁধে তাদের প্রত্যেকের দু’পায়ে দুটো আর ঠোঁটে একটা মোট তিনটে করে পাথরের টুকরো অর্থাৎ কাঁকর বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে সৈন্য বাহিনীর উপর ফেলতে লাগল। সেগুলো তাদের মস্তক ভেদ করে নিচের দিক দিয়া বের হয়ে যেতে লাগল, হাতিগুলোও পাথরের হাত থেকে রক্ষা পেল না। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে পাপিষ্ঠ বাদশা আবরাহ এবং অগণিত সৈন্য ও হাতি ধ্বংস হয়ে গেল।
পাহাড়ের উপর থেকে কুরাইশরা আবরাহা বাদশাহ ও সৈন্য বাহিনীর পরিণতি দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও জীবনীকারদের মতে, উক্ত ঘটনার চল্লিশ অথবা সাতান্ন দিন পরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিশুকালীন অলৌকিক ঘটনা
তখনকার দিনে আরব দেশের উচ্চবংশের মেয়েরা নিজেদের সন্তানদের ধাত্রীদের কাছে দুধ পান করিয়ে মানুষ করার জন্য দিতেন। তার বদলে তারা অনেক টাকা-পয়সা পুরস্কার পেত। আমাদের নবী করিম (সা.) জন্মের কিছুদিনের মধ্যে তায়েফ থেকে একদল ধাত্রী মক্কায় এসে ধনী লোকদের শিশুদের নিয়ে ফিরে গেল। তাদের মধ্যে কেবল বিবি হালিমাকে কেউ বাচ্চা দিল না। কারণ বিবি হালিমা তায়েফের সম্ভ্রান্ত বংশের পুণ্যবতী মহিলা হলেও ওনার স্বামী গরিব ছিলেন। যে গাধায় চড়ে উনি এসেছিলেন সেটাও খুব রোগা ও দুর্বল ছিল। ঘরে যেসব উট, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা ছিল, সেগুলোও খাবারের অভাবে রোগা ও দুর্বল ছিল। তাই দুধ দেয় না। দেশে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। কিভাবে সংসার চলবে বিবি হালিমা চিন্তা- ভাবনা করে শেষমেশ আমাদের শিশু নবী (সা.)-কে লালন-পালন করার জন্য নিলেন। অন্যান্য ধাত্রীরা শিশু নবী (সা.)-এর ভার কেউ নিতে চায়নি কেননা তিনি ছিলেন এতিম, বাবা নেই, পুরস্কারের আশা কম।
শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে যখন বিবি হালিমা গাধার পিঠে চড়লেন তখন আল্লাহর অপার মহিমায় সেই দুর্বল গাধাটা শক্তিশালী হয়ে দ্রুত বেগে চলতে লাগল, তাই দেখে বিবি হালিমা অবাক হয়ে চিন্তা করলেন, নিশ্চয় এই শিশুর কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে, ঘরে ফিরে আরও অবাক হলেন। দেখলেন, তার রোগা দুর্বল উট, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা বলিষ্ঠ ও হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তাদের বাঁটগুলো দুধে পরিপূর্ণ রয়েছে।
কিছুদিন আগে বিবি হালিমার একটা ছেলে হয়েছে। সেই ছেলের নাম আবদুল্লাহ। বিবি হালিমা শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রথমে ডান দিকের দুধ খাওয়াতেন, তারপর বাম দিকের দুধ খাওয়াতে গেলে খেতেন না। তখন সবাই বুঝতে পারল ওই বাম দিকের দুধটা দুধভাই আবদুল্লাহর জন্য, তাই খেতেন না।
বিবি হালিমার গৃহপালিত পশুগুলো আগে যে চরণভূমিতে ঘাস খেতে যেত, সেগুলোতে তখন তেমন ঘাস ছিল না। সারাদিন খেয়েও পশুগুলোর পেট ভরত না। এখন সেই চরণভূমিতে প্রচুর ঘাস জন্মায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ঘাস খেয়ে পশুগুলোর পেট ভরে যায়। ফলে তারা প্রচুর দুধ দিতে লাগল। আগে অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দিন কাটত। ফলে বিবি হালিমা ও তার স্বামীর এবং ছেলেমেয়ের শরীর প্রায় কঙ্কালের মতো হয়ে গিয়েছিল। এখন তারা স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী হয়েছে। অনাবৃষ্টির ফলে তায়েফের গাছপালা শুকিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর অপার মহিমায় শিশু মুহাম্মদ (সা.) আসার পর প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষ, পশুপাখি ও গাছপালা যেন প্রাণ ফিরে পেল। মাঠগুলো যেমন ঘাসে ভরে উঠল, তেমনি গাছপালাও ফুলে-ফলে ভরে উঠল। এককথায় তায়েফবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দূর হল।
শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে যত দিন বিবি হালিমা লালনপালন করেন, কোনো দিন তিনি বিবি হালিমার কাপড়ে বা বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করেননি। যখন ওনার প্রস্রাব-পায়খানার সময় হত তখন শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেত। তাই দেখে বিবি হালিমা তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রস্রাব- পায়খানা করাতেন। ওনার প্রস্রাব-পায়খানার এতটুকু দুর্গন্ধ ছিল না, বরং সুগন্ধ ছিল। সব থেকে আশ্চর্য বিষয়, তিনি যখন মাটিতে প্রস্রাব-পায়খানা করতেন সঙ্গে সঙ্গে তা অদৃশ্য হয়ে যেত। [বাংলাদেশ তাজ কো. থেকে প্রকাশিত এম.এন.এস. ইমদাদুল্লাহ কর্তৃক লিখিত আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া (২য় ভাগ), পৃষ্ঠ ৩৭৪]
এই সব আশ্চর্য ঘটনা দেখে বিবি হালিমা ভাবতেন এই শিশু নিশ্চয় ভবিষ্যতে মহাপুরুষদের মতো একজন হবেন। তাই তিনি খুব যত্নসহকারে তাঁকে লালন-পালন করতে লাগলেন। দুই বছর লালন-পালন করার পর শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে মা আমেনার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মক্কায় নিয়ে গেলেন।
তখন মক্কা নগরে মহামারী আকারে প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছিল। মা আমেনা কলিজার টুকরো ছেলেকে পেয়ে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আদর- সোহাগে ভরিয়ে তুললেন। পরক্ষণে মরণব্যাধির কথা ভেবে ও ছেলের ভালো-মন্দ চিন্তা করে এবং বিবি হালিমার অনুরোধে আরও কিছুদিন লালন-পালন করার জন্য তাঁর হাতে তুলে দেন। বিবি হালিমা খুশিমনে শিশু নবী (সা.)-কে নিয়ে ফিরে এলেন। ওনার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়ে সায়মা কিশোরী আর ছোট ছেলে আবদুল্লাহ। এই দুজনের সঙ্গে শিশু নবী (সা.) থাকতেন। দ্বিতীয়বার নিয়ে আসার প্রায় দুই-আড়াই বছর পর একদিন শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে দুধবোন সায়মা ও দুধ ভাই আবদুল্লাহ মাঠে খেলা করছিল। তাদের সঙ্গে মহল্লার আরও ছেলেমেয়ে ছিল। হঠাৎ দু’জন লোক এসে শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে ধরে একটা গাছতলায় শুইয়ে দিয়ে ছুরি দিয়ে বুক ফেড়ে ফেললেন। তারপর কালো কুচকুচে মতো কি একটা বুকের ভেতর থেকে ফেলে দিয়ে আবার জোড়া দিয়ে চলে গেলেন।
এই দৃশ্য দেখে দুই ভাই-বোন ভয় পেয়ে দৌড়ে ঘরে গিয়ে মাকে ঘটনাটা জানাল।
বিবি হালিমা এমন ভয়ানক কথা শুনে খুব আতঙ্কিত হয়ে স্বামীকে জানিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। সেই গাছতলায় এসে দেখলেন, শিশু মুহাম্মদ (সা.) মন ভার করে বসে আছেন। বিবি হালিমা তাঁকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কোলে তুলে নিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে? তুমি এমন করে বসে রয়েছ কেন?
শিশু মুহাম্মদ (সা.) সব ঘটনা খুলে বলে বললেন, আমি সে সময় কোনো ব্যথা পাইনি।
হালিমা ও তাঁর স্বামী ঘটনা শুনে খুব ভয় পেয়ে তাঁকে ঘরে নিয়ে এলেন। এরপর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁকে মাঠে পাঠাতেন না। এই ঘটনার পর শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে নিজেদের কাছে বেশিদিন রাখতে সাহস করলেন না। কিছুদিনের মধ্যে মক্কায় গিয়ে মা আমেনার কাছে দিয়ে এলেন। তখন শিশু নবী (সা.)-এর বয়স পাঁচ বছর। ধাইমা বিবি হালিমা, তাঁর স্বামী হারিস, তাঁদের তিন ছেলে-মেয়ে আবদুল্লাহ, সায়মা ও আনিস-এরা সবাই পরবর্তীকালে ইসলাম কবুল করেছিলেন।
শিশু মুহাম্মদ (সা.) মায়ের কোলে ফিরে আসা ও এতিম হওয়া
দীঘ পাঁচ বছর পর নয়নমণিকে পেয়ে মা আমেনার কলিজা ঠাণ্ডা হল। দাদা আবদুল মুত্তালিবও নাতির মুখের লাবণ্য ও সুন্দর স্বভাব-চরিত্র দেখে মুগ্ধ হলেন। বালক মুহাম্মদ (সা.) মা ও দাদার আদর-স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়ে খুব খুশি হলেন।
এই খুশি ও আনন্দ কারও ভাগ্যে বেশি দিন স্থায়ী হল না। মা আমেনার মামাতো ভাইয়েরা মদিনায় বাস করতেন। তাদের সবাইকে দেখার জন্য ও প্রিয় স্বামীর কবর জিয়ারত করার জন্য ছেলে মুহাম্মদ (সা.)- কে নিয়ে মদিনার পথে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে নিলেন দাসী উম্মে আয়মনকে। সেখানে গিয়ে মামাতো ভাইয়েদের বাড়িতে এক মাস রইলেন। তারপর স্বামী আবদুল্লাহর কবর জিয়ারত করে আবার মক্কার পথে রওয়ানা দিলেন। অর্ধেক রাস্তা আসার পর ‘আবওয়া’ নামক জায়গায় পৌঁছে হঠাৎ কঠিন অসুখে পড়ে মারা গেলেন। মরুভূমির মাঝখানে কোনো মানুষ তো দূরের কথা কোনো প্রাণিকুলও নেই। চারিদিকে শুধু বালু আর বালু। বালক মুহাম্মদ (সা.) কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলেন। দাসী উম্মে আয়মন খুব ধৈর্যসহকারে কোনোরকমে সেখানেই মা আমেনাকে কবর দিলেন। তারপর বালক মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন।
তখনও দাদা আবদুল মুত্তালেব বেঁচে ছিলেন। তিনি পুত্রবধূ আমেনার মৃত্যুর খবর শুনে খুব দুঃখ পেলেন। এতিম নাতিকে বুকে চেপে ধরে কাঁদলেন। তারপর তাকে লালন-পালন করতে লাগলেন। দু’বছর পর তিনিও মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে নাতির দায়িত্ব পুত্র আবু তালিবের হাতে দিয়ে যান।
আবু তালিব ছিলেন আপন চাচা। তিনি বাবার উপদেশ ভোলেননি t নিজের ছেলেদের চেয়ে বালক মুহাম্মদ (সা.)-কে বেশি ভালোবাসতেন! সব সময় কাছে রাখতেন। যেখানেই যেতেন সেখানেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। চাচার আদর-স্নেহ পেয়ে শিশু নবী (সা.) মা ও দাদার শোক অনেকটা ভুলে গেলেন।
চাচা আবু তালিবের কাছে হযরত মুহম্মাদ (সা.) কৈশোর ও যৌবনের প্রথম অংশ অতিবাহিত করেন। যখন তাঁর বয়স দশ বছর। চাচার বকরির পাল নিয়ে মাঠে চরাতে যেতেন। একদিন দূরের এক মাঠে যখন বকরি চরাচ্ছিলেন তখন জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) নামে দুজন ফেরেশতা আল্লাহর হুকুমে সেখানে এসে তাঁর বুক ফেড়ে কুপ্রবৃত্তির অংশটুকু বের করে দিলেন এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত বিদ্যা ও জ্ঞান, দয়া, মায়া, মমতা, সততা ও সৎ গুণাবলি দ্বারা তাঁর অন্তর পূর্ণ করে দিলেন। তারপর বুকের চামড়া জুড়ে দিয়ে বললেন, আপনার উপর আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হোক। এই ঘটনাতেও আগের মতো তিনি এতটুকু ব্যথা অনুভব করেননি। এটা ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বিতীয়বার সিনাচক অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আত্মার শুদ্ধিকরণ।
আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া ও ইয়ামেন প্রদেশে যেতেন। তখনকার দিনে মানুষ উটের পিঠে নিজের দেশের মাল বোঝাই করে অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত এবং ফেরার সময় সেই দেশের মাল নিয়ে এসে নিজের দেশে বিক্রি করত। পথে ডাকাতরা বণিকদের মাল লুটপাট করত। তাই বণিকরা দলবেঁধে বাণিজ্য করতে যেত। দলবদ্ধ বণিকদের বলা হত কাফেলা।
একসময় আবু তালিব এক কাফেলার সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স বার বছর। যাবার সময় তিনি চাচাকে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে যাব। আবু তালিব প্রথমে নিতে রাজি হলেন না। পরে তাঁর পীড়াপীড়িতে নিতে বাধ্য হন। যাওয়ার পথে পড়ল বসরা শহর, শহরের অনতিদূরে ছিল খ্রিস্টানদের গির্জা। গির্জার কাছে এক বিশাল গাছতলায় বিশ্রামের জন্য আবু তালিবের কাফেলা অবস্থান নিল।
ওই গির্জায় বোহায়রা নামে একজন পাদরি ছিলেন। তিনি তৌরত ও ইঞ্জিলের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনকাল ও তাঁর লক্ষণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন। আরও জানতেন মক্কা থেকে কিশোর নবী (সা.) এই পথ দিয়ে সিরিয়া যাবেন। তাই বেশ কিছুদিন আগে থেকে ওনাকে দেখার জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ একদিন দেখলেন, একটা বাণিজ্য কাফেলা আসছে আর ওই কাফেলার উপর একখণ্ড মেঘ ছায়া দিতে দিতে আসছে। গাছের তলায় কাফেলা অবস্থান নিলে মেঘ খণ্ডও আকাশে তাদের মাথার উপর স্থির হয়ে রইল। এই দৃশ্য দেখে বোহায়রার দৃঢ় ধারণা হল নিশ্চয় এই কাফেলায় আখেরি নবী (সা.) আছেন। এত দিনে আল্লাহ তাঁর মনের আশা পূরণ করেছেন বুঝতে পেরে আখেরি নবী (সা.)-কে দেখার জন্য ও তাঁর খিদমত করার জন্য একদিন পুরো কাফেলাকে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন।
কাফেলার লোকজন আসার পরও সেই মেঘকে গাছের উপর আকাশে থাকতে দেখে বোহায়রা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি সকলে এসেছেন? না কেউ আসতে বাকি আছে?
তাদের মধ্যে একজন বললেন একটা ছেলেকে আমরা মাল-সামান পাহারা দেয়ার জন্য রেখে এসেছি। [এম.এন.এম. ইমদাদুল্লাহ কর্তৃক লিখিত বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী কর্তৃক প্রকাশিত আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া, ২য় ভাগ]
বোহায়রা বললেন, এখানে চুরি হবার ভয় নেই, ওই ছেলেকে নিয়ে আসুন, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করবেন।
বোহায়রার কথা শুনে আবু তালিব ভাতিজাকে নিয়ে আসার জন্য একজন লোককে পাঠালেন।
লোকটা যখন কিশোর নবী (সা.)-কে নিয়ে আসছিল তখন বোহায়রা দেখলেন সেই ভাসমান মেঘখণ্ড তাঁর মাথার উপর ছায়া দিতে দিতে আসছে। কাছে আসার পর তিনি তাঁকে খুব আদর-যত্ন করে খাওয়ালেন। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে বিদায় দিয়ে বোহায়রা আবু তালিবকে বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, আমি কয়েকটা প্রশ্ন করব, এই ছেলেটিকে লাত ও উজ্জার নামে কসম খেয়ে তাকে উত্তর দিতে হবে।
আবু তালিব কিছু বলার আগে কিশোর নবী (সা.) বলে উঠলেন, লাত ও উজ্জার নামে আমি কসম খাব না।
বোহায়রা জিজ্ঞেস করলেন, কেন কসম খাবে না? কুরাইশরা তো সবাই লাত-উজ্জার কসম খায়।
কিশোর নবী (সা.) বললেন, লাত-উজ্জাকে আমি ঘৃণা করি।
পাদরি বোহায়রার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। তারপর আরও কয়েকটা। প্রশ্ন করলেন।
কিশোর নবী (সা.) একে একে উত্তর দিয়ে গেলেন। সবশেষে ওনার দুই কাঁধের মধ্যিখানে মহরে নবুয়ত দেখে নিশ্চিত হলেন ইনি ভবিষ্যতে আখেরি নবী হবেন। আনন্দে মনের মধ্যে ঝড় বইতে লাগল। পরক্ষণে আফসোস হল, হায়! তত দিন যদি আমি বেঁচে থাকতাম। মনের ভাব গোপন করে আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটি আপনার কে হয়?
আবু তালিব মিথ্যে করে বললেন, আমার ছেলে। বোহায়রা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, সত্যি করে বলুন, ছেলেটি কে হয় আপনার?
পাদরির কথাবার্তায় আবু তালিব চিন্তা করলেন, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে। তাই সত্য কথাই বললেন, আমার ভাইপো।
এর আব্বা কোথায়?
এর জন্মের কিছুদিন আগে মারা গেছেন।
পাদরি আবু তালিবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, এই ছেলে আল্লাহর প্রেরিত শেষ নবী হবেন। এর পরশে সমগ্র আরবে তথা সারা বিশ্ব পাপমুক্ত হবে। আরবের পুতুল পূজার অবসান হবে।
আবু তালিব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এসব কথা জানলেন কী করে? পাদরি বললেন, তৌরত ও ইঞ্জিলে শেষ নবীর সম্পর্কে যেসব লেখা আছে, এই ছেলের মধ্যে সেই সব মিলে যাচ্ছে। সব থেকে বড় প্রমাণ ওঁর দুই কাঁধের মাঝখানে মহরে নবুয়ত খোদিত আছে। আরও প্রমাণ হল, ইনি মরু প্রান্তরে গেলে মাথার উপর এক খণ্ড মেঘ ছায়া দেয়। আর যে গাছের কাছ থেকে যাবেন, সেই গাছ অবনত হয়ে ওনাকে সম্মান দেখাবে। ইনাকে খুব সাবধানে রাখবেন, সিরিয়ার ইহুদী ও খ্রিস্টানরা এনার লক্ষণ দেখে চিনতে পারলে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে।
পাদরির কথা আবু তালিবের বিশ্বাস হল। তাই যথাসম্ভব শিগগির মালপত্র বিক্রি করে ভাইপোকে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন। [ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, কাজি গোলাম আহমদ কর্তৃক লিখিত আলোর নবী আল-আমিন, ২৮ পৃষ্ঠা] এরপরও কয়েকবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ব্যবসা উপলক্ষে গিয়েছিলেন। আবু তালিবের পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক ছিল। কিন্তু উনি ছাড়া উপার্জন করার মতো কেউ ছিল না। তাই সংসারে সচ্ছলতা ছিল না। চাচাকে সাহায্য করার জন্য তরুণ নবী (সা.) মেষ চরাতেন। এই সব কারণে আবু তালিব ভাইপোকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। চাচার সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে যেমন ব্যবসায়িক জ্ঞান অর্জন করেন, তেমনি সততা ও আদর্শ চরিত্রের কারণে সুনাম অর্জন করেন।
তরুণ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শান্তি মিশন
নবী (সা.)-এর বয়স যখন চৌদ্দ বছর তখন মক্কার কুরাইশ ও কায়েস বংশের মধ্যে কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে লড়াই বেধে গেল। আগেই বলেছি, তখনকার দিনে একবার লড়াই বেঁধে গেলে তার জের বহু বছর ধরে চলত।
তরুণ নবী (সা.) চাচা আবু তালিবের সাথে লড়াইয়ে অংশ নিলেন এই লড়াইয়ে তিনি কাউকে একটাও আঘাত করেননি। তবু চাচা আবু তালিবকে লক্ষ্য করে শত্রুরা যেসব তীর ছুঁড়েছিল, তিনি সেসব তীর ঠেকিয়ে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। চার দিন পর্যন্ত এই লড়াই চলেছিল। শেষে কুরাইশরা জয়লাভ করে এবং দুই দলে মিটমাট হয়ে যায়। লড়াই শেষ হবার কয়েক দিনের মধ্যে মক্কার সব বংশের লোকেরা আবদুল্লাহ বিন জুদায়ানের বাড়িতে বৈঠক করে ভবিষ্যতে লড়াই না করে মিলেমিশে থাকার জন্য। নবী (সা.)-এর প্রস্তাবমতো শান্তি রক্ষার জন্য একটা অঙ্গীকার পত্র লেখা হয় এবং তাতে সবাই স্বাক্ষর করেন। সেই অঙ্গীকার পত্রে শর্ত ছিল “মক্কার বাসিন্দাদের ও মক্কার বাইরে থেকে যারা মক্কায় মেহমান হয়ে আসবে তাদের উপর কাউকে জুলুম করতে আমরা দেব না। যারা করবে তাদেরকে আমরা কঠোর হাতে দমন করব। ঝগড়া-বিবাদ থেকে আমরা রক্ষা করব, শত্রুকে প্রতিরোধ করব এবং প্রতিশোধ নেব। দেশ থেকে সব রকমের খারাপ কাজ দূর করব। কাউকে খারাপ কাজ করতে দেখলে বাধা দেব। সব সময় আমরা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকব। বিধবা মিশকীনদের সাহায্য করব। নিঃস্ব ও বেকার লোকদের কাজের জোগাড় করার ব্যবস্থা করব।”
এই অঙ্গীকার পত্রকে বলা হয় ‘হিলফুল ফজুল’। এই প্রতিষ্ঠানের চারজন সদস্য ছিলেন। তাদের নাম ফজল, ফাজেল, মুফাজ্জল ও ফাজায়েল। আর মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন এর পরিচালক। ক্রমশ এই ‘হিলফুল ফজুল’ সমিতির ও নবী (সা.)-এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর বিচার, বুদ্ধি ও সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে সবাই আল-আমিন উপাধিতে সম্বোধন করতে লাগল।
শাদি মুবারক
ঐ সময়ে মক্কা নগরে কুরাইশ গোত্রে খুওয়াইলিদ নামে একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর শুধু খাদিজা নামে একমাত্র মেয়ে ছিলেন। তিনি একাধারে বিদুষী, বুদ্ধিমতী, রূপবতী ও গুণবতী ছিলেন। তখন মক্কা নগরে ওনার মতো অন্য কোনো মেয়ে ছিল না। ওনার দুইবার বিয়ে হয়েছিল। দ্বিতীয় স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি বাপের সংসারে ফিরে আসেন। শ্রেষ্ঠ ধনীর রূপবতী ও গুণবতী একমাত্র মেয়ে, তার উপর পূর্বের দুই স্বামীর কোনো ওয়ারিশ না থাকায় তাদের সব সম্পত্তি পেয়েছেন। তাই দু’বার বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও মক্কার ধনী ও উচ্চ বংশের ছেলেরা তাঁকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠাতে লাগল। খাদিজা দ্বিতীয় স্বামী মারা যাবার পর আর বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই সবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বাবা খুওয়াইলিদকে ব্যবসার কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তাই বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি লোকের দ্বারা নিজে বাবার ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) খাদিজার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই হতেন। তাঁর গুণাবলি ও যোগ্যতার কথা শুনে খাদিজা একদিন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। উনি আসার পর বললেন, আমার ব্যবসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনাকে দিতে চাই। অবশ্য উপযুক্ত বেতন আপনাকে দেয়া হবে।
চাচা আবু তালিবের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আগে থেকে ভালো একটা চাকরির কথা চিন্তা করছিলেন। তাই খাদিজার প্রস্তাব পেয়ে বললেন, আমি রাজি, তবে চাচার সঙ্গে পরামর্শ করে জানাব। তারপর ঘরে ফিরে চাচাকে কথাটা জানাতে তিনি খুব খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন।
কয়েকদিনের মধ্যে খাদিজা টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়ের পণ্যসামগ্রী দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে শ্যামদেশ (বর্তমানে সিরিয়া) পাঠালেন। ওনাকে সাহায্য করার জন্য ক্রীতদাস মাইসারাকে সঙ্গে দিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইয়াসরব (মদিনা), হাইফা, জেরুজালেম প্রভৃতি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে পৌঁছিলেন। সেখানে অবশিষ্ট মাল বিক্রি করে অনেক লাভবান হলেন। তারপর মক্কায় ফিরে এসে খাদিজাকে হিসাবপত্র ও টাকা-পয়সা বুঝিয়ে দিলেন।
আগে অন্য লোকের দ্বারা বাণিজ্য করিয়ে যা লাভ হত, এবারে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি লাভ হয়েছে দেখে খাদিজা তাঁর উপর ভীষণ সন্তুষ্ট হয়ে প্রতিশ্রুতি পুরস্কার দিয়ে তাকেও সন্তুষ্ট করলেন।
মাইসারাকে এক সময় খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন।
মাইসারা সে সবের উত্তর দিয়ে বললেন, পথে আমরা যখন কাঠফাটা রোদে কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম হযরত যে উটের পিঠে ছিলেন তার উপর এক খণ্ড মেঘ ছায়া দিয়ে সাথে সাথে চলছে।
খাদিজা আগেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে দেখে ও তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। এখন মাইসারার মুখে এ রকম আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনে ভাবলেন, ইনি নিশ্চয় কোনো মহামানব হবেন। তাড়াতাড়ি চাচাতো ভাই অরাকা বিন নওফেলকে ঘটনা জানালেন।
অরাকা ছিলেন তৌরাত ও ইঞ্জিলের পণ্ডিত। তিনি সব শুনে বললেন, ঘটনা যদি সত্য হয়, তাহলে হযরত মুহাম্মদ (সা.)ই শেষ নবী। খাদিজাও শেষ নবীর আগমন বার্তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী জানতেন। অরাকার কথা শুনে দৃঢ় ধারণা হল ইনিই শেষ নবী।
দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর যদিও খাদিজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বিয়ে করবেন না, তবু হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর সবকিছু জানার পর সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। ওনাকে বিয়ে করে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তাঁর মন আকুলি-বিকুলি হয়ে উঠল। এ ঘটনার তিন মাস পর নাফিসা নামে এক দাসীকে দিয়ে প্রথমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতামত নেন। তারপর ওনার চাচা আবু তালিবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন।
আবু তালিব আনন্দে প্রস্তাব মেনে নিলেন। এর কিছুদিন পর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে হযরত খাদিজার (রা.) বিয়ে হল। . এই সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স ছিল পঁচিশ আর হযরত খাদিজা (রা.)-এর বয়স ছিল চল্লিশ।
হযরত খাদিজা (রা.)-এর বাবা খুওয়াইলিদ প্রচুর সম্পত্তির মালিক ছিলেন। ওনার আর কোনো ছেলে-মেয়ে না থাকায় হযরত খাদিজা (রা.) বাবার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হন। তাছাড়া পূর্বের দুজন স্বামীর কোনো আত্মীয় না থাকায় তাদের সমস্ত সম্পত্তিরও মালিক হন। এক কথায় সে সময় মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে উনিও একজন ছিলেন। বেশি ধন-সম্পত্তি থাকলে যে কেউ অহঙ্কারী হয়; কিন্তু হযরত খাদিজা (রা.) এতটুকু অহঙ্কারী ছিলেন না। শুধু তাই নয়, একাধারে রূপবতী, গুণবতী, বিদুষী, বিচক্ষণা, সূক্ষ্মদর্শিনী, বুদ্ধিমতী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। তাই তো তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপূর্ব সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারি, বিনয়, নম্রতা, ব্যক্তিত্ব, সচ্চরিত্রতা ও ন্যায়নিষ্ঠা গুণাবলি প্রত্যেক্ষ করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আবার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়া সত্ত্বেও চল্লিশ বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে করেন। শুধু তাই নয়, বাসর রাতে হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর অগাধ ধন-সম্পত্তি স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই সমস্ত ধন-সম্পত্তির মালিক এখন থেকে আপনি। এসবের উপর কোনোদিন আমি এতটুকু দাবি করব না। আপনি যেখানে যেভাবে ইচ্ছা খরচ করবেন। আমি এতটুকু অসন্তুষ্ট হব না অথবা কখনও কোনোরকম জবাবদিহি চাইব না। বরং খুব খুশি হব। আমি শুধু আপনাকে সুখী দেখতে চাই আর আজীবন আপনার খিদমত করে আমিও সুখী হতে চাই। উনি স্বামীকে এত ভালোবাসতেন যে, পরবর্তী জীবনে হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্ত্রীর সমস্ত সম্পত্তি অকাতরে দান-খয়রাত ও আর্তের সেবায় খরচ করলেও হযরত খাদিজা (রা.) স্বামীর প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট হননি। এমনকি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পারিবারিক জীবনে কোনোদিন সামান্যতমও ওনাদের মধ্যে মনোমালিন্য বা রাগারাগি হয়নি।
হযরত মুহাম্মদ (দ.)ও বিবি খাদিজা (রা.)-কে এত ভালোবাসতেন যে, উনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন দ্বিতীয় কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি। ওনার মৃত্যুর পর প্রয়োজন বোধে আরও দশজন স্ত্রী গ্রহণ করলেও হযরত খাদিজা (রা.)-এর কথা এতটুকু ভুলতে পারেননি। পরবর্তীকালে তরুণ বয়স্কা বিবি হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) একদিন হুজুর (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল (সা.), সব সময় আপনি আমাদের কাছে বৃদ্ধা হযরত খাদিজা (রা.)-এর প্রশংসা করেন কেন? ওনার থেকে আমার রূপ-গুণ কি কম?”
হুজুর (সা.) বিবি আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কথা শুনে ব্যথিত হৃদয়ে বলেছিলেন, “বিবি খাদিজা যাহা ছিলেন, তাহা তুমি নও।” এই ঘটনায় বোঝা যায় হুজুর (সা.) কত গভীরভাবে বিবি খাদিজা (রা.)-কে ভালোবাসতেন। আগে চাচা আবু তালিবের সংসারে থাকার সময় অর্থ উপার্জনের চিন্তা করতেন, হযরত খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করার ফলে সেই চিন্তা আর রইল না। এখন তিনি সমাজকল্যাণ ও সমাজ সংস্করণের কাজ করতে লাগলেন। তবে বেশিরভাগ সময় আল্লাহর আরাধনায় কাটাতে লাগলেন।
কা’বা মেরামতও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিচক্ষণতার পরিচয়
যে বছর হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করেন, সে বছর মক্কায় ভীষণ বৃষ্টি হওয়ার ফলে কা’বা ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন কুরাইশরা সবাই পরামর্শ করে ওই দেয়াল ভেঙে নতুন দেয়াল বানাবার সময় একটা ব্যাপার নিয়ে কলহের সৃষ্টি হল।
ব্যাপারটা হল, ওই দেয়ালে ‘হাজরে আসওয়াদ’ (কালো পাথর) ছিল। দেয়াল ভাঙার সময় সেই পাথর সরিয়ে অন্য জায়গায় রাখা হয়েছিল। নতুন দেয়ালে যথাস্থানে সেটা স্থাপন করা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের সর্দারদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হল। ওই পাথরের সাথে সামাজিক ও বংশের প্রাধান্যের সম্বন্ধ ছিল। কাজেই প্রত্যেক গোত্রের সর্দার উহা যথাস্থানে বসাবার জন্য জিদ ধরে বসল। এই ব্যাপার নিয়ে প্রথমে বচসা ও পরে তুমুল যুদ্ধ বাধার উপক্রম হল।
তখন আবু উমাইয়া নামে এক বৃদ্ধ জ্ঞানী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। প্রস্তাবটা মেনে নিলে আশা করি এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রস্তাবটা হল, আগামীকাল ভোরে যে ব্যক্তি কা’বা ঘরের চত্বরে সকলের আগে পৌঁছাবে, আমরা সকলে তাকে বিচারক মেনে নেব। সে এ ব্যাপারে যা ফায়সালা করবে, আমরা সেই ফায়সালা মেনে নেব।”
আবু উমাইয়ার প্রস্তাব সবাই মেনে নিয়ে যে যার ঘরে চলে গেল। পরের দিন ভোরে সবার আগে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কা’বা ঘরের চত্বরে আসতে দেখে তাঁকেই সকলে ঘটনাটা বলে মীমাংসা করে দিতে বলল।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) একখানা বড় চাদর এনে বিছিয়ে নিজে পাথরখানা তার মাঝখানে রেখে দিলেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রের একজন করে দলপতিদের বললেন, আপনারা চাদরের প্রান্ত ধরে নিয়ে চলুন। তারা নিয়ে আসার পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে পাথরখানা যথাস্থানে স্থাপন করলেন। ওনার বিচক্ষণতায় গোত্র সর্দাররা খুশি হলেন। শুধু তাই নয়, একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে তারা রক্ষা পেল।
নবী (সা.)-এর সাংসারিক জীবন
হযরত খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করার আগে হযরত মুহাম্মদ (সা.) চাচা আবু তালিবের সংসারে খুব অভাব-অনটনের মধ্যে মানুষ হয়েছেন। বিয়ের পর স্ত্রীর বিপুল ঐশ্বর্য পেয়ে ভোগ-বিলাসের কামনা তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেনি এবং তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতেও পারেনি। স্ত্রীর বিশাল বাণিজ্যের দেখাশোনা করেন। কখনও কখনও নিজেই বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে যান। হযরত খাদিজা (রা.)-এর গর্ভে ওনার তিন ছেলে ও চার মেয়ের জন্ম হয়। ছেলেদের নাম কাসেম, তাহের ও তৈয়ব। মেয়েদের নাম হযরত জয়নব (রা.), হযরত রোকাইয়া (রা.), হযরত উম্মে কুলসুম (রা.) ও হযরত ফাতেমা (রা.)। তিন ছেলেই উনি নবুয়ত পাওয়ার আগে অল্প বয়সে মারা যান। চার মেয়ের মধ্যে সবার ছোট হযরত ফাতেমা (রা.) নবী (সা.)-ওর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। চাচা আবু তালিবের ছেলে হযরত আলী (রা.)-এর সঙ্গে হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে হয়। ওনাদের শুধু দুই ছেলে। বড় হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও ছোট হযরত ইমাম হোসেন (রা.)।
নবী (সা.)-এর তিন ছেলে মারা যাবার পর ওনার মনে যে ব্যথা ছিল তা আল্লাহপাক দূর করার ব্যবস্থা করে দেন। তখনকার দিনে শুধু আরব দেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে হাটেবাজারে দাস-দাসী কেনা-বেচা হত। যারা দাস-দাসী কিনত তারা তাদের উপর যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করত। এমনকি ভীষণ অত্যাচারও করত।
হযরত খাদিজা (রা.) ‘ওকাজ’ নামে এক মেলা থেকে জায়েদ নামে একটা বালককে কিনে আনেন এবং স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খাস খিদমতগার নিযুক্ত করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) জায়েদকে মুক্ত করে দিয়ে বললেন, আজ থেকে তুমি ক্রীতদাস নও, স্বাধীন। তুমি যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পার।
জায়েদ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমধুর ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়ে কোথাও গেলেন না। হযরত মুহাম্মদ (সা.) জায়েদকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই দেখে লোকজন জায়েদকে উনার ছেলে বলে ডাকত। জায়েদ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এত ভালোবাসত যে, তার পিতামাতা খোঁজ পেয়ে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও জায়েদ যায়নি।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.) সংসার ধর্ম ও ব্যবসা- বাণিজ্য করলেও সমাজের তথা মানুষের চরিত্রের অবক্ষয় ও বিভিন্ন মূর্তিপূজা তাঁর মনকে ভীষণ বিচলিত করে তুলল। তাই তিনি নির্জনে বসে আল্লাহর চিন্তায় মশগুল থাকতেন। মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে হেরা নামে এক পাহাড়ের গুহায় ধ্যান করতে লাগলেন কি করে মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা ও মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করবেন।
নবুয়ত লাভ
হযরত খাদিজা (রা.) স্বামীর ভাবান্তর দেখে জ্ঞানের অনুভূতিতে বুঝতে পারলেন, ইনি আখেরি নবী হবেন। তাই যোগ্য স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে সব দিক দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতে লাগলেন। স্বামী যখন হেরা গুহায় আল্লাহর আরাধনা করতে যেতেন তখন তিনি কয়েকদিনের খাবার ও পানি দিয়ে দিতেন। সেগুলো ফুরিয়ে গেলে অনেক সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.) ঘরে এসে খাবার ও পানি নিয়ে ফিরে যেতেন। আবার কখনও হযরত খাদিজা (রা.) কয়েকদিনের খাদ্যসামগ্রী নিজে গিয়ে দিয়ে আসতেন।
নবুয়ত পাওয়ার প্রায় ছয় মাস আগে থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নানা রকম স্বপ্ন দেখতেন এবং রাস্তা দিয়ে চলার সময় কেউ যেন তাঁকে নাম ধরে ডাকছে শুনতে পেতেন। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে যখন কাউকে দেখতে পেতেন না তখন তিনি ভয় পেতেন। এসব কথা তিনি স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.)-কে বলতেন। তিনি শুনে স্বামীকে অভয় দিতেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) চল্লিশ বছর পূর্ণ হবার কিছুদিন আগে থেকে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। যেদিন চল্লিশ বছর পূর্ণ হল, সেদিন ছিল ২১ রমযান মোতাবেক ১০ আগস্ট ৬১০ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার। ওই দিন যথারীতি তিনি হেরা গুহায় ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) তাঁর সামনে এসে তাকে আরবিতে বললেন, “পড়ুন।”
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিলেন, “আমি পড়তে জানি না।”
হযরত জিবরাইল (আ.) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “পড়ুন। “ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবারও উত্তর দিলেন, “আমি পড়তে জানি না।” হযরত জিবরাইল (আ.) আবার তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এইভাবে তিনবার জড়িয়ে ধরার পর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মুখ থেকে বের হল “পাঠ করুন, আপনার প্রভুর নামে যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। যিনি এক বিন্দু রক্ত হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করুন, আপনার সেই মহিমাময় প্রভুর নামে যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, যিনি দয়াপরায়ণ হয়ে মানুষকে দান করেছেন ওই সমস্ত বিষয় যাহা সে জানত না।” [সূরা আনআলক, আয়াত-১ থেকে ৫, পারা-৩০]
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে উক্ত কালাম পাঠ করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফেরার পর হযরত জিবরাইল (আ.)-কে তখনও আকাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যখন ঘরে ফিরে আসছিলেন তখন ওনার অপ্রকৃতস্থ অবস্থা। বারে বারে হযরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাকে দেখতে পাচ্ছিলেন এবং শুনতে পাচ্ছিলেন, “হে মুহাম্মদ (সা.) আপনি আল্লার রাসুল আর আমি জিবরাইল (আ.) ফেরেশতা।” ঘরে এসে হযরত খাদিজা (রা.)-কে বললেন, তাড়াতাড়ি কম্বল দিয়ে আমাকে ঢেকে দাও, আমার খুব ভয় করছে।”
হযরত খাদিজা (রা.) স্বামীকে অপ্রকৃতস্থ দেখে তাড়াতাড়ি একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। কিছুক্ষণ পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন প্রকৃতস্থ হলেন তখন হযরত খাদিজা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এত ভীত ও অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিলেন কেন?
হযরত মুহাম্মদ (সা.) সবকিছু খুলে বললেন।
হযরত খাদিজা (রা.) উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “আপনি মোটেই ভয় পাবেন না। আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, তখন কখনও আপনাকে অপদস্ত করবেন না। আপনি কখনও মিথ্যা বলেন না, কারও মালের খেয়ানত করেন না, আত্মীয়স্বজনের ভালো ছাড়া মন্দ করেন না। অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করে থাকেন, দুস্থ ও পীড়িতদের সেবা ও সাহায্য করে থাকেন, ঘোর বিপদে ধৈর্য ধরেন ও সত্য পালন করে থাকেন। কেন তাহলে আল্লাহ আপনার ক্ষতি করবেন? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ঘটনার মধ্যে আল্লাহর কোনো মহান উদ্দেশ্য নিহিত আছে।”
স্ত্রীর কথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কিছুটা স্বস্তি পেলেন। এরপর হযরত খাদিজা (রা.) স্বামীকে নিয়ে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারকা বিন নওফেলের কাছে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) যা কিছু দেখেছেন ও জেনেছেন সব ঘটনা খুলে বললেন।
ওয়ারকা বিন নওফেল খ্রিস্টান ধর্মের একজন জ্ঞানবৃদ্ধ তাপস। সব কিছু শুনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) যাঁকে দেখেছেন এবং যিনি ওনাকে জড়িয়ে ধরেছেন, তিনি হলেন জিবরাইল ফেরেশতা, যিনি হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈশা (আ.)-এর কাছে ঐশীবাণী নিয়ে এসেছিলেন। আমি সাক্ষী দিচ্ছি যে, আপনি সেই আখেরি নবী (সা.), হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈশা (আ.) যাঁর সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আমি যদি তত দিন জীবিত থাকতাম যখন এই দেশের লোকেরা আপনার প্রতি অত্যাচার করবে এবং আপনাকে এই পবিত্র মক্কা শহর থেকে বিতাড়িত করবে, তাহলে আমি আপনাকে জান-মাল দিয়ে সাহায্য করতাম।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি তাঁর জাতি তাঁর সাথে এরূপ ব্যবহার করবে?
ওয়ারকা বিন নওফেল আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন, এর আগে যত নবী-রাসুল এই দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে তাঁর জাতি এইরূপ আচরণ করেছে। তারপর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কপালে চুমো খেয়ে বিদায় দিলেন। এর কিছুদিন পর ওয়ারকা বিন নওফেল ইন্তেকাল করেন।
চাচাতো ভাই ওয়ারকা বিন নওফেলের কথা শুনে হযরত খাদিজা (রা.) এক দিকে যেমন খুশিতে তাঁর অন্তর ভরে উঠল অপর দিকে তেমনি নিশ্চিত হলেন, অচিরেই তাঁর স্বামী পয়গম্বর হবেন।
তিনিই স্বামীর কাছে সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেন। হযরত জিবরাইল (আ.) হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ওজু, নামাজ শিক্ষা দিলে, তিনি ঘরে এসে হযরত খাদিজা (রা.)-কে শিখিয়ে দিতেন। এর মধ্যে সূরা ফাতিহা নাযিল হল। হযরত খাদিজা (রা.) তা শিখে ফেললেন।
তারপর একদিন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর অহি নাযিল হলে-”হে বস্ত্রাবৃত (রাসুল), উঠুন অতঃপর (কাফেরদিগকে) ভীতি প্রদর্শন করুন, এবং নিজের রবের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করুন। আর স্বীয় বস্ত্রসমূহ পাক রাখুন আর মূর্তি সকল হইতে দূরে থাকুন। [সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত নং ১/২/৩/৪/৫, পারা-২৯]
হযরত খাদিজা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পর নবী করিম (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের ছেলে হযরত আলী (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল দশ কি বার, পুরুষ ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি প্রথম ও সর্বকনিষ্ঠ।
নবী করিম (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে নামায আদায় করে ফিরে আসতেন। কিছুদিন এভাবে চলার পর ঘটনাক্রমে একদিন আবু তালিব ওই জায়গায় গিয়ে তাদেরকে নামায পড়তে দেখে খুব অবাক হলেন। নামায শেষ হতে নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার এ কোন ধর্ম পালন করছ?
নবীজি (সা.) জবাব দিলেন, এটা আল্লাহর ধর্ম, তাঁর ফেরেশতাদের ধর্ম, তাঁর নবীদের ধর্ম, আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর ধর্ম। এর সার কথা হল, “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নাই, ইহাই ইসলাম।”
আবু তালিব আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আর তুমি কে?”
নবী করিম (সা.) বললেন, “আমি আল্লাহর রাসুল। আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর বান্দাদেরকে সত্য পথ দেখানোর জন্য। চাচাজান, আপনাকেও এই সত্য পথ অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। আর আপনার উচিত এই সত্য ধর্ম গ্রহণ করা ও তা প্রচার করার কাজে আমাকে সাহায্য করা।”
আবু তালিব নিজের ছেলেকে জিজ্ঞেস করেলন, “তোমার মতামত কী?”
হযরত আলী (রা.) বললেন, “আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর উপর ইমান এনেছি। ওনার পথই আমার পথ।”
আবু তালিব ভাতিজা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই তাঁর কথা শুনে তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হলেন না। বরং একটু নরম সুরে বললেন, “আমি জানি তুমি সত্যবাদী, কিন্তু পূর্বপুরুষদের ধর্ম তো আমি ছাড়তে পারি না। তবে আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন কুরাইশরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।” তারপর ছেলে হযরত আলী (রা.)-কে বললেন, “তোমার ইচ্ছায় আমি বাধা দেব না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ (সা.) কখনও তোমাকে ভালো ছাড়া মন্দ পথে নিয়ে যাবে না।”
প্রথম তিন বছর নবী করিম (সা.) গোপনে ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। হযরত আলী (রা.)-এর পর নবী করিম (সা.)-এর পালক ছেলে যায়েদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম মক্কার সর্বজন শ্রদ্ধেয়, বিজ্ঞ ও সৎ ব্যাক্তি হযরত আবুবকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর আহ্বানে পাঁচজন ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন-(১) উমাইয়া বংশের ওসমান ইবনে আফফান (রা.), যিনি পরবর্তীকালে তৃতীয় খলিফা হন। (২) আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), (৩) সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), যিনি পরবর্তীকালে পারস্য জয় করেছিলেন, (৪) জুবাইর ইবনে আওয়াস (রা.), (৫) তালহা (রা.)। এঁরা সকলেই নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে তাঁর হাতে হাত রেখে ইসলাম কবুল করেন। এই সময়ে মেয়েদের মধ্যে হযরত আবুবকরের ছোট কন্যা আসমা (রা.) ও হযরত ওমর (রা.)-এর বোন ফাতেমা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম তিন বছরে মাত্র ত্রিশজন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সত্যানুসন্ধানী, সচ্চরিত্র ও পবিত্র মনের অধিকারী এঁদের মধ্যে আবু জর গিফারি (রা.)ও একজন। ওনার নামে ঢাকায় একটা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সত্যের ডাক ও সংঘর্ষের সূচনা
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তিন বছর চুপে চুপে ইসলাম প্রচার করলেও মক্কায় প্রায় ঘরে ঘরে নতুন এই ধর্মের কথা পৌঁছে গেল। এরপর একদিন আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.)-কে প্রকাশ্যে প্রচার করার আদেশ দিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) চিন্তা করে একটা উপায় বের করলেন। একদিন তিনি আত্মীয়স্বজন ও কুরাইশ দলপতিদের নিজের ঘরে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। প্রায় চল্লিশজন বিশিষ্ট লোক উপস্থিত হলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, এক অপূর্ব বেহেশতী সওগাত আমি আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি। আমি আল্লাহর কালাম লাভ করেছি। আপনারা মূর্তিপূজা করবেন না। একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করুন। সবাই বলেন “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।) ইহা আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। এই ধর্ম গ্রহণ করুন, ইহকালে ও পরকালে আপনাদের মঙ্গল হবে। কে এই সত্য প্রচারে আমাকে সাহায্য করবেন? যিনি সাহায্য করবেন, তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়ান।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা শুনে কুরাইশ সর্দাররা খুব রেগে গেলেন। বিখ্যাত কুরাইশ নেতা আবু লাহাব রেগে উঠে বললেন, মুহাম্মদ (সা.) ধৃষ্টতা ত্যাগ কর। এখানে তোমার সম্মানীয় চাচারা ও চাচাতো ভাইয়েরা রয়েছেন। তাদের সামনে বাতুলতা করিও না। তুমি কুলাঙ্গার, তোমার আত্মীয়দের উচিত তোমাকে বন্দি করে রাখা।
তারপর আবু লাহাব যখন সকলকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন তখন বালক হযরত আলী (রা.) সামনে এসে উঁচু গলায় বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমি আপনার পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত আছি। আল্লাহর কসম আজ থেকে আমার জীবন আপনার সেবায় নিযুক্ত করলাম।’
সকলে বালক হযরত আলী (রা.)-এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এতটুকু বালকের বেয়াদবি দেখে তারা আরও রেগে গেলেন। আবু তালিবকে লক্ষ্য করে আবু লাহাব বললেন, “আপনার ভাইপোর মঙ্গলের জন্য বুঝি আপনার এই বালক পুত্রের আদেশ আমাদেরকে মেনে চলতে হবে?” এই কথা বলে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন।
এই ঘটনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) মনে দুঃখ পেলেও বিচলিত হলেন না। কীভাবে কী করবেন চিন্তা করতে লাগলেন।
সে সময় একটা প্রথা ছিল যে, বিপদের সময় নগরবাসীদের ডাকতে হলে অথবা কোনো ব্যাপারে কেউ বিচার প্রার্থী হলে, মক্কার সাফা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে কিছু সাঙ্কেতিক শব্দ উচ্চারণ করে চিৎকার করতে হত। সেই সঙ্কেত ধ্বনি শুনে নগরের লোকেরা পাহাড়ের নিচে এসে সমবেত হত। সঙ্কেতদাতা তখন তার বক্তব্য সবাইকে বলত।
একদিন সকালে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাফা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সেই রকম চিৎকার করতে লাগলেন। কোনো বিপদ ঘটেছে ভেবে যখন একে একে সবাই ছুটে এসে পাহাড়ের নিচে জমা হল তখন তিনি বললেন, “যদি বলি এই পাহাড়ের পিছনে একদল শত্রু আপনাদের হামলা করার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে কি আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন?”
সবাই বলে উঠলেন, “নিশ্চয় করব। কারণ তুমি আল-আমিন। কখনও তোমাকে আমরা মিথ্যা কথা বলতে শুনি নাই।”
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন, “তাই যদি হয়, তাহলে বিশ্বাস কর সর্বশক্তিমান মহান বিশ্বপ্রভু এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় দেখাবার জন্য ডেকেছি। শয়তান আপনাদেরকে অত্যাচার, অবিচার, প্রতিমা পূজা ও সব রকমের পাপের পথে পরিচালিত করছে। যদি বাঁচতে চান তবে কা’বা ঘরের দেবতাদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলুন। ওরাই আপনাদের প্রধান শত্রু। এক আল্লাহর উপাসনা করে মনকে পবিত্র করুন। তাহলেই দুনিয়াতে ও আখেরাতে আপনাদের মঙ্গল হবে।”
ওনার কথা শুনে আবু লাহাব খুব রেগে গিয়ে বললেন, “ধ্বংস হোক তোমার হাত-পা। এই জন্যে বুঝি তুমি আমাদেরকে ডেকেছিলে?” তারপর নিজের লোকজন নিয়ে চলে গেলেন। পাপিষ্ঠ আবু জেহেলও নানা রকম গালাগালি করতে করতে চলে গেলেন।
আগেই ঘরের সবাই ইসলাম কবুল করেছেন। এই ঘটনার পর নবী করিম (সা.) পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে ডেকে মূর্তিপূজার নিন্দা করে নিরাকার এক ও অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান মহান রাব্বুল আল-আমিনের ইবাদত করার জন্য বলতে লাগলেন। আরও বলতে লাগলেন, “আপনারা সৎ কাজ করুন, অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকুন, দোজখের আগুন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করুন, সবাই স্বীকার করুন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ।
তাঁকে এইসব করতে দেখে কুরাইশ প্রধানরা ভাবলেন, এটা তো একটা ভারি বিপদ। তখন তারা দলবেঁধে আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললেন, “এত দিন আপনার খাতিরে আপনার ভাইপোকে আমরা কিছু বলিনি। কিন্তু এখন সে আমাদের দেব-দেবীকে ঘৃণা করবে, তাদের বিরুদ্ধে নানান কথা বলে বেড়াবে, বাপ-দাদাদের গোমরাহ বলবে, আমাদেরকে নির্বোধ বলবে এসব আর আমরা সহ্য করব না। হয় আপনি আমাদের মাঝখান থেকে সরে যান নচেৎ তাকে আমাদের হাতে তুলে দেন।”
আবু তালিব মিষ্টি কথায় তাদেরকে বললেন, “আপনারা এখন যান, আমি তাকে এসব না করার জন্য নিষেধ করে দেব।”
তারা চলে যাবার পর একসময় আবু তালিব ভাইপো হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কুরাইশ সর্দারদের কথা বলে এসব না করার জন্য অনেক বোঝালেন। তারপর বললেন, “আমার উপর এমন গুরুভার চাপাইও না, যা বহন করার শক্তি আমার নেই।”
চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নবীজি (সা.) বললেন, “চাচাজান, আমার জন্য আপনি এতটুকু চিন্তা করবেন না। যাঁর হাতে আমার জীবন ও মরণ সেই পাকজাতের কসম খেয়ে বলছি, ওরা যদি আমার এক হাতে সূর্য আর অন্য হাতে চাঁদ এনে দেয়, তবুও আমি আমার কর্তব্য থেকে নিবৃত্ত হব না।”
আবু তালিব ভাইপোর কথা শুনে এত অভিভূত হলেন যে, তিনি তাঁকে নির্ভয়ে ইচ্ছামতো কাজ করার অনুমতি দিলেন এবং তাঁর কাজে সাহায্য করারও আশ্বাস দিলেন।
এরপর নবী করিম (সা.) পুরোদমে ইসলামের বাণী প্রচার করতে লাগলেন।
কুরাইশরাও বসে থাকল না, তারাও নানাভাবে শত্রুতা করতে লাগল। কিন্তু আবু তালিব ও তার অন্যান্য লোকজন নবী করিম (সা.)-এর পিছনে থাকায় তেমন সফল হতে পারল না। শেষে কুরাইশ প্রধান আবু জেহেল ও আবু সুফিয়ান প্রমুখ ব্যক্তি যুক্তি-পরামর্শ করে ওত্ত্বা নামে তাদেরই দলের একজন বিচক্ষণ নেতাকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পাঠালেন।
ওবা নবী করিম (সা.)-এর কাছে গিয়ে অনেক মন ভুলানো কথা বলতে লাগলেন, “হে মুহাম্মদ (সা.) তুমি আমাদেরই বংশের লোক, তা ছাড়া তুমি সম্মানিত লোকদের ছেলে ও নাতি। তাই আমরা তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের মনে তোমার জন্য দুঃখ হয় এই জন্য যে, তোমার কথা ও কার্যকলাপের দরুন সকলেই তোমার উপর অত্যাচার করে ও নির্যাতন চালায়। তাই বলব, বাবা, তুমি এ রকম কর না। আচ্ছা কেন তুমি আমাদের দেব-দেবীর অসম্মান কর, তাদের নিন্দা কর? আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মকে কেন মিথ্যা ধর্ম বল? এসব কথা বলা ভালো নয় বাবা, দেখ তোমার কারণে আমাদের নিজেদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়েছে। নানান লোক নানান কথা বলে। তাই তুমি কী উদ্দেশ্যে এ রকম করছ জানার জন্য তোমার কাছে এসেছি। তোমার মনের বাসনা নিঃসঙ্কোচে খুলে বল। যদি তুমি টাকার জন্য এসব করছ, তাহলে আমরা তোমাকে এত টাকা দেব যে সারাজীবন দু’হাতে খরচ করেও তা শেষ করতে পারবে না। যদি তুমি মান-সম্মানের আকাঙ্ক্ষায় কর, তাহলে আমাদের মধ্যে তোমাকে সর্বপ্রধান নেতা করব। আর যদি সুন্দরী রমণী বিবাহ করতে চাও, তাহলে আরবের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী মহিলার সঙ্গে তোমার বিবাহ দেব। আর যদি কোনো জিন তোমার উপর ভর করে থাকে তাও বল, তাহলে ওঝাকে ডেকে জিন তাড়াবার ব্যবস্থা করব।”
ওবা কথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন, “আপনি এতক্ষণ যা কিছু বললেন, ওইসবে আমার মনে খেয়াল বা আকাঙ্ক্ষা নেই। এর আগে আল্লাহ দুনিয়াতে আরও বহু নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন মানুষকে হেদায়েত করার জন্য। সেই কাজের জন্য আল্লাহপাক আমাকেও পাঠিয়েছেন শেষ রাসুল হিসেবে। আমার একমাত্র কাম্য আপনারা সকলে সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করুন এবং আমাকে তাঁর রাসুল বলে মান্য করুন। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে যেসব আদেশ ও নিষেধ এবং রীতিনীতি প্রচার করব সেসব আপনারা মেনে চলবেন। এককথায় মানুষ ইহকালে ও পরকালে যেন সুখ-শান্তিতে থাকতে পারে সেটাই আমার একমাত্র কাম্য।” তারপর কুরআন শরীফের একটা আয়াত পড়লেন।
“এই বাণী করুণাময় দয়ালু (আল্লাহর) তরফ হইতে অবতারিত। ইহা একটি কিতাব, যাহার আয়াতগুলি বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে অর্থাৎ এমন কুরআন যাহা আরবি জ্ঞানী লোকদের জন্য উপকারী। ইহা সুসংবাদদাতা আর ভয় প্রদর্শক, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই মুখ ফিরাইয়া লইল, সুতরাং তাহারা শুনেই না।” [সূরা হামিম সিজদা, আয়াত-২/৩/৪, পারা-২৪]
এই কথা শুনে ওত্ত্বা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, “এসব কথা আমার মনকে স্পর্শ করে না।” তখন আল্লাহপাকের ওহি নাযিল হল।
“হে নবী, আপনি (ইহাও) বলিয়া দিন, আমি তো তোমাদের মতো মানুষ, আমার নিকট কেবল অহি আসে যে, তোমাদের মাবুদ হচ্ছে একই মাবুদ, সুতরাং যে ব্যক্তি নিজ রবের সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখে, তবে সে যেন নেক কাজ করতে থাকে এবং নিজ রবের ইবাদতে অপর কাহাকেও শরিক না করে।” [সূরা কাহাফ, আয়াত-১১, পারা-১৬]
আল্লাহর এই বাণী শুনে ওরা একেবারে থ হয়ে গেলেন। তাঁহার জীবনে এরকম বাণী আর কোনো দিন শুনেননি। ওনার মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হল। ইচ্ছা হল, এখনই ইসলাম গ্রহণ করেন; কিন্তু অন্যান্য কুরাইশ নেতাদের কথা ভেবে তা করতে পারলেন না। কিছু না বলে চুপচাপ ফিরে এসে কুরাইশ দলপতিদের কাছে বললেন, “আমি মুহাম্মদের মুখে যেসব মূল্যবান বাণী শুনে এলাম, তা জীবনে শুনি নাই। তোমরা যা কিছু মনে কর না কেন আসলে সে খুব ভালো লোক। তোমরা তার প্রতি অত্যাচার কর না।” ওৎবার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠে বলল, “মনে হয় মুহাম্মদ ওবাকে জাদু করেছে। সে তো একজন বড় জাদুকর। তার নিকটে আর কেহ কখনও ভুলে যেন না যায়। নচেৎ যেই যাবে তার অবস্থা বুড়ো ওবার মতো হবে।”
কুরাইশদের অমানবিক অত্যাচার
আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জমিলা রাতের বেলা বাবলা কাঁটা এনে নবীজি (সা.)-এর কা’বাঘরে যাওয়ার পথে ছড়িয়ে দিত।
একদিন নবী করিম (সা.) কা’বা শরীফের চত্বরে নামায পড়ছিলেন। আবু জেহেল জানতে পেরে একজনকে কসাইখানা থেকে উটের গলিত নাড়িভুঁড়ি নিয়ে আসতে বলল। লোকটা নিয়ে আসার পর নবী করিম (সা.) যখন সিজদায় গেলেন তখন সেই নাড়িভুঁড়ি তাঁর পবিত্র কাঁধে ও গলায় চাপিয়ে দিল। তারপর তারা আনন্দ-উল্লাস করতে লাগল।
নাড়িভুঁড়ির ভারে নবী করিম (সা.) সিজদা থেকে মাথা তুলতে না পেরে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। নবী দুলালি ফাতেমা (রা.) দেখতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে সেগুলো সরিয়ে দিলেন।
আর একদিন নবী করিম (সা.) কা’বা ঘরের প্রাঙ্গণে বসে যখন লোকজনকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন তখন একদল কাফের এসে ওনাকে মারতে শুরু করল। হারেস (রা.) নামে একজন মুসলমান তা দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে তাদেরকে বাধা দিতে লাগলেন। কিন্তু কাফেররা ছিল সংখ্যায় অনেক, তার উপর সশস্ত্র। তবু আপ্রাণ লড়াই করে হারেস (রা.) নবী করিম (সা.)-কে তাদের হাত থেকে কোনোরকমে রক্ষা করেন। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। কাফেরদের হাতে শহীদ হয়ে গেলেন। পুরুষদের মধ্যে এই হারেস (রা.) ছিলেন ইসলামে প্রথম শহীদ।
প্রিয় দাদুমণিরা তোমরা নিশ্চয় হযরত বিলাল (রা.)-এর কথা শুনেছ। যিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। তিনি ছিলেন হাবশী ক্রীতদাস। ওনার মনিব উমাইয়া বিন খালফ হযরত বিলাল (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার কারণে ওনাকে দুপুরের গরম বালুতে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বুকে ভারী পাথর চাপিয়ে দিত। গরম বালুতে ওনার পিঠ পুড়ে যেত, ভারী পাথরের চাপে নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হত। গলায় রশি বেঁধে টানত। তবু তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি। সেই অবস্থায় মুখ দিয়ে শব্দ বেরোত আন্তা আহাদুন, আন্তা আহাদুন অর্থাৎ আল্লাহ তুমি এক, তুমি এক।
একদিন হযরত আবুবকর (রা.) এই দৃশ্য দেখে হযরত বিলাল (রা.)- এর কষ্ট সহ্য করতে পারলেন না। উমাইয়ার কাছ থেকে কিনে নিয়ে আজাদ করে দিলেন।
আর এক নও মুসলিম ছিলেন ইয়াসির (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার ফলে নিষ্ঠুর কুরাইশরা তাঁর দুই পা দুই উটের পায়ের সঙ্গে বেঁধে উট দুটোকে দু’দিকে চালিয়ে দিল। ফলে তাঁর শরীর মাঝখান থেকে চিরে দু’ভাগ হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া (রা.) যখন স্বামীকে রক্ষা করার জন্য কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছিলেন তখন কুরাইশরা তাকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পশুর মতো হত্যা করেছিল। নারীদের মধ্যে সুমাইয়া (রা.) প্রথম শহীদ হন।
দিন দিন নও মুসলমানদের উপর যতই কুরাইশদের অত্যাচার বাড়তে লাগল ততই নও মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
মুসলমানদের উপর কুরাইশদের অত্যাচার বাড়তে দেখে নবী করিম (সা.) তাঁদের অনেককে আবিসিনিয়া পাঠিয়ে দিলেন। তাঁদের মধ্যে ৮৩ জন পুরুষ ও ১৮ জন মহিলা ছিলেন। এর মধ্যে ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করার আগে ওমর (রা.) নও মুসলমানদের উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিলেন। তিনি তাঁদের উপর নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করতেন।
একদিন আবু জেহেল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য কুরাইশ দলপতিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভা ডাকল। সবাই আসার পর বলল, “মুহাম্মদ তোমাদের দেব-দেবীকে যা-তা করে বলছে, মানুষদেরকে তার ধর্মে দীক্ষা দিচ্ছে, আর তোমরা এর প্রতিকার না করে কাপুরুষের মতো বসে আছ। আমি এই সভায় শপথ করে ঘোষণা করছি, যে মুহাম্মদকে হত্যা করতে পারবে তাকে একশত স্বর্ণমুদ্রা ও একশ উট পুরস্কার দেব। কেউ রাজি আছ কিনা বল?”
হযরত ওমর (রা.) তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি ওই সভায় ছিলেন। তিনি খুব বীরপুরুষ ছিলেন। আবু জেহেলের কথা শুনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি ওই দুশমনকে হত্যা করব। যত দিন না তা করতে পারি তত দিন বিশ্রাম নেয়া আমার জন্য হারাম।” তারপর তলোয়ার হাতে সভাকক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
সকলে ভাবল, ওমরের মতো বীর যখন প্রতিজ্ঞা করেছে তখন আর মুহাম্মদের রক্ষা নেই।
খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে বীর ওমর চলেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এর সন্ধানে। পথে বন্ধু নঈমের সঙ্গে দেখা। নঈম জিজ্ঞেস করল, “কী রে দোস্ত, এভাবে কোথায় যাচ্ছিস?’
ওমর গম্ভীর স্বরে বললেন, “মুহাম্মদকে হত্যা করতে।”
নঈম আগেই গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ওমরের কথা শুনে তাঁর কলজে কেঁপে উঠল। বললেন, “মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করার আগে নিজের ঘর সামলাও।”
ওমর ভ্রূকুটি করে বললেন, “তার মানে?”
নাঈম বললেন, “তোমার বোন ফাতেমা ও তার স্বামী সাঈদ মুসলমান হয়ে গেছে।”
ওমর খুব রেগে উঠে বললেন, “কী; আমার বোন ও তার স্বামী মুসলমান হয়ে গেছে? এত বড় স্পর্ধা তাদের? ঠিক আছে আগে তাদের মুণ্ডুপাত করব তারপর অন্য কাজ।” কথা শেষ করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য বোনের ঘরের দিকে ছুটলেন।
ওমর যখন ফাতেমার ঘরের কাছে পৌঁছালেন তখন ফাতেমা (রা.) ও সাঈদ (রা.) হযরত খাব্বাব (রা.)-এর কাছে কুরআনের একটা আয়াত পড়ছিলেন। ওমর সরাসরি ঘরে না ঢুকে ফাতেমা কী পড়ছিল তা শুনে বুঝতে পারলেন, সত্যি তারা মুসলমান হয়ে গেছে।
ফাতেমা (রা.) ও সাঈদ ওমরের আগমন বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি ঘরের এক কোণে লুকিয়ে পড়লেন।
ওমর তাদেরকে খুঁজে বের করে দুজনকেই নির্মমভাবে মারতে মারতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা নাকি মুসলমান হয়ে গেছিস?”
চাবুকের আঘাতে ফাতেমা (রা.)-এর শরীরের অনেক জায়গা কেটে গিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। সেই অবস্থায় ফাতেমা (রা.) বললেন, “হ্যাঁ আমরা আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর উপর ঈমান এনে মুসলমান হয়ে গেছি। জীবন গেলেও আমরা ঐ ধর্ম ত্যাগ করব না। তুমি যা খুশি করতে পার।”
আদরের বোনের রক্তাক্ত শরীর দেখে ও ইসলাম ধর্মের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা দেখে ওমরের চেতনা ফিরে এল। একটু নরম সুরে বললেন, “দেখি, তোমরা কী পাঠ করছিলে।”
ফাতেমা (রা.) বললেন, “না দেব না, তুমি ছিঁড়ে ফেলবে।”
ওমর বললেন, “বিশ্বাস কর ছিঁড়ব না।”
ফাতেমা (রা.) বললেন, “আগে ওজু করে এস, নাপাক অবস্থায় আল্লাহর কালাম ধরা নিষেধ।”
ওমর ওজু করে আসার পর ফাতেমা (রা.) কুরআনের সেই লেখা অংশগুলো তাঁর হাতে দিলেন।
ওমর পড়তে লাগলেন, “তোয়া হা, আমি আপনার প্রতি কুরআন এই জন্য নাযিল করি নাই যে, আপনি কষ্টভোগ করেন। বরং এমন ব্যক্তিকে উপদেশ দেওয়ার জন্য যে আল্লাকে ভয় করে। ইহা সেই আল্লাহর তরফ থেকে অবতারিত হইয়াছে যিনি জমিন ও উচ্চ আকাশসমূহকে সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি পরম করুণাময় আরশের উপর কায়েম আছেন। তাহারই অধিকারে রহিয়াছে যাহা কিছু আসমানসমূহে আছে এবং যাহা কিছু জমিনে আছে, আর যাহা কিছু এতদুভয়ের মধ্যে আছে, আর যাহা কিছু মাটির অন্তস্তলে আছে। আর যদি তুমি উচ্চস্বরে কথা বল, তিনি তো নীরবে কথিত কথা এবং তদপেক্ষা অধিক প্রচ্ছন্ন কথাও জানেন।” [ সূরা তোহা, আয়াত ১-৭, পারা-১৬]
আল্লাহর এই বাণী পড়ে ওমরের দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল। বলে উঠলেন, “এই বাণী কখনও মানুষের তৈরী হতে পারে না। নিশ্চয় এটা আল্লাহর বাণী।” তারপর তলোয়ার হাতে নিয়েই সাঈদকে নিয়ে ছুটলেন নবী করিম (সা.)-এর খোঁজে।
আল্লাহর নবী (সা.) তখন সাহাবী জায়েদ ইবনে আরকাস (রা.)-এর ঘরে ছিলেন। হযরত আবুবকর (রা.), হযরত হামজা (রা.), হযরত আলী (রা.) ও অন্যান্য সাহাবীদের তিনি ধর্ম বিষয়ে নসিহত করছিলেন।
তরবারি হাতে ওমর (রা.)-কে আসতে দেখে সাহাবীরা আতঙ্কিত হয়ে নবী করিম (সা.)-কে আড়ালে চলে যেতে বলে ওমরের সঙ্গে মোকাবেলা
করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন।
ঘটনাটা বুঝতে পেরে নবী করিম (সা.) সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা ওমরকে কিছু বল না। তাকে আসতে দাও। আমি একাই তার মোকাবেলা করব।”
ওমর (রা.) ভিতরে আসার পর নবী করিম (সা.) তার চাদরের একটা কোনা ধরে টান দিয়ে বললেন, “এস ওমর, আমি তোমারই প্রতীক্ষা করছি। আর কতকাল অন্ধকারে ঘুরে বেড়াবে? আর কতকাল সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?”
ওমর (রা.) নবী (সা.)-এর পবিত্র মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। তারপর মাথা নিচু করে তলোয়ার নবী (সা.)-এর পাক কদমের কাছে রেখে ভিজে গলায় বললেন, “যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এখন আত্মসমর্পণ করতে এসেছি। দয়া করে এই অধমকে আপনার পাক কদমে আশ্রয় দিন।” কথা শেষ করে তিনি উচ্চস্বরে পড়লেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
ওমর (রা.)-এর পরিবর্তন দেখে নবী করিম (সা.) ও সাহাবীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলেন, “আল্লাহু আকবর। “
নবী করিম (সা.) ওমর (রা.)-কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর তাঁর কপালে চুমো খেলেন।
ওমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণ করার কথা মুহূর্তে মক্কার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। শত্রুরা প্রথমে অবাক হল। পরে আতঙ্কিত হয়ে বলাবলি করতে লাগল, “হায় হায়! ওমর শেষে মুসলমান হয়ে গেল!”
হযরত ওমর (রা.)-এর পরে নবী করিম (সা.)-এর চাচা হযরত হামজা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।
দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যেতে দেখে কাফেররা পরামর্শ করে একটা চুক্তিনামার মাধ্যমে হাশেমী বংশের (নবীজি বংশের) লোকদের একঘরে করার ব্যবস্থা করল।
নবী করিম (সা.)-এর চাচা বৃদ্ধ আবু তালিব খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শেষে তিনি বনি হাশেম ও বনি মুত্তালিব বংশের লোকদের ডেকে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর শিষ্যদের নিয়ে ‘শেব’ নামক পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকায় গিয়ে থাকবে। ওই জায়গাটা বনি হাশেম গোত্রের। শহর থেকে কিছু দূরে এবং বেশ সুরক্ষিত ছিল। সেখানে ওনাদের ত্রিপদ কম হবে এবং সতর্কতার সাথে বের হয়ে খাবারদাবার সরবরাহ করা যাবে, এরকম ওনারা মনে করেছিলেন। ওনাদের কথামতো নবী করিম (সা.) তাঁর শিষ্যদের নিয়ে তিন বছর ‘শেব’ উপত্যকায় ছিলেন। এই তিন বছর অর্ধাহারে-অনাহারে গাছের ফলমূল ও শুকনো চামড়া পর্যন্ত খেয়ে জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রীলোক ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের কান্নায় আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। শেষে কয়েকজন প্রবীণ কুরাইশ সর্দারের হস্তক্ষেপে এই চুক্তি বাতিল হল এবং তাঁরা আবার মক্কায় যে যার বাড়িতে ফিরে এলেন।
নবুয়তের দশম বছর
এই বছরকে শোকের ও দুঃখের বছর বলা হয়ে থাকে। কারণ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একমাত্র অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক, যাঁর সাহায্য ও সহযোগিতায় তিনি এত দিন ইসলামের মর্মবাণী দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন, সেই চাচা আবু তালিব হঠাৎ মারা গেলেন। সেই বিয়োগব্যথা কাটতে না কাটতেই কয়েকদিনের মধ্যে মুমেনদের মাতা যিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুখ-দুঃখের একমাত্র সাথি, যিনি নারী-পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সেই মহীয়সী নারী হযরত খাদিজা (রা.) জান্নাতবাসিনী হন। শোকের উপরে শোক। নবী করিম (সা.) একেবারে ভেঙে পড়লেন। তখন ওনার বয়স পঞ্চাশ।
আবু তালিব ও হযরত খাদিজা (রা.) মারা যাওয়ার পর শত্রুরা নবী করিম (সা.)-এর উপর শত্রুতা বাড়িয়ে দিল। শেষে তিনি শান্তির খোঁজে পালক ছেলে যায়েদ (রা.)-কে নিয়ে তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন। মক্কা থেকে তায়েফ প্রায় ৭০ মাইল দূর। নবী করিম (সা.) যায়েদ (রা.)-কে নিয়ে পায়ে হেঁটে তায়েফে এসে পৌঁছালেন। নবীজি (সা.)-এর চাচা আব্বাস (রা.) ছিলেন তায়েফের জমিদার। নবী করিম (সা.) ভেবেছিলেন, সেখানকার লোকেরা তাঁকে আশ্রয় দেবে, ইসলাম প্রচারে সাহায্য করবে।
তায়েফের লোকেরা মক্কার লোকেদের মতো মূর্তিপূজা করত এবং কা’বা ছিল তাদের তীর্থক্ষেত্র। সেখানে পৌঁছেই নবী করিম (সা.) ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন; কিন্তু কেউ তাঁর ডাকে সাড়া দিল না। বনু সকীফ বংশ তখন তায়েফের মধ্যে বিখ্যাত ছিল। নবী করিম (সা.) তাদের সঙ্গে দেখা করে সত্যের বাণী শোনালেন। তখন তারা তাঁকে ঠাট্টা করে বলল, “আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া নবী করার মতো আর কোনো লোক খুঁজে পেলেন না?” তারপর নানা রকম কথা বলে টিটকারি দিল। শেষে তায়েফ ছেড়ে চলে যেতে বলল।
নবী করিম (সা.) নিরাশ না হয়ে পথে পথে ও ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে লোকজনকে ইসলামের বাণী শোনাতে লাগলেন। তায়েফের লোকেরা ওনার প্রতি বিরক্ত হয়ে শহর থেকে বের করে দেয়ার জন্য একদল লোক ও ছেলেদের লেলিয়ে দিল। নবী করিম (সা.) যে পথ দিয়ে যান, সেই পথেই তারা নানা রকম কটূক্তি করতে লাগল এবং সেই সাথে পাগল বলে পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগল। ফলে নবী করিম (সা.)-এর শরীর মোবারক ক্ষত- বিক্ষত হয়ে পড়ল এবং রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওনাকে রক্ষা করতে গিয়ে সহচর জায়েদ (রা.) শরীর ও পাথরের আঘাতে আহত হয়ে পড়ল। শেষে শহরের এলাকা ছেড়ে যখন পার হয়ে এলেন তখন নবী করিম (সা.)- এর চলার শক্তি নেই। পথের ধারে পাঁচিল দেয়া একটা আঙুরের বাগান ছিল। জায়েদ (রা.) অর্ধ-অচৈতন্য নবী করিম (সা.)-কে কাঁধে তুলে নিয়ে ওই বাগানে আশ্রয় নিলেন। তারপর সেবা-যত্ন করে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ওই বাগানটা ছিল ওৎবা ও শায়বা নামে দুই ভাইয়ের। তারা ছিল খ্রিস্টান। নবী করিম (সা.)-এর ওরকম অবস্থা দেখে তাদের মনে দয়া হল। তারা তাদের ক্রীতাস আদ্দাসকে আঙুর পেড়ে দিতে বলল।
নবী করিম (সা.) বিসমিল্লাহ বলে আঙুর মুখে দিলেন। আদ্দাস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল উনি মক্কার বাসিন্দা। আরও জানতে পারল, হযরত ইউনুস (আ.), হযরত ইউসুফ (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)- এর মতো উনিও আল্লাহর নবী। জানার পর তখনই সে নবী করিম (সা.)- এর পবিত্র হাতে-পায়ে চুমা খেয়ে ইসলাম গ্রহণ করল। তার দুজন মনিব ওবা ও শায়বা তাকে গালাগালি করে বলল, “একটা পাগলের হাতে-পায়ে চুমা খাচ্ছিস কেন?’
আদ্দাস বলল, “ইনার মতো নেক লোক এই দুনিয়ায় আর দুটো নেই। আমাকে এমন এক খবর দিয়েছেন, যা নবী ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না।”
নবী করিম (সা.) তায়েফ থেকে চলে আসার আগে দু’হাত তুলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ। হে আমার প্রভু। এখানকার লোকেরা আজ না বুঝে যে গুরুতর অপরাধ করেছে, সেজন্যে দয়া করে তাদেরকে শাস্তি দিও না। তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। অবিশ্বাসীরা আজ তোমার বাণীকে গ্রহণ করছে না, সে জন্যে তাদের কোনো দোষ নেই, সে আমারই দুর্বলতা, আমারই অক্ষমতা। এই জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। হে রহমানুর রহিম, একমাত্র তুমি দুর্বলের বল, তুমি ছাড়া আর কোনো সাহায্যকারী নেই। হে প্রভু, এই সাধনা কি ব্যর্থ হবে? তুমি আমাকে জয়ী করবে না? তোমার ইচ্ছা যদি তাই হয় তবে তাই হোক। একমাত্র তোমার সন্তুষ্টিই আমার কামনা। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি আমার প্রতি নাখোশ হয়ো না। হে আল্লাহ, তোমার সাহায্য ছাড়া গোনাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো শক্তিই আমার নেই।”
মুনাজাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে হযরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতা এসে সালাম দিয়ে নবী করিম (সা.)-কে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার প্রতি তায়েফবাসীরা যা কিছু অত্যাচার করেছে তা আল্লাহ পাক দেখেছেন, আপনি যা কিছু দোয়া করছেন তাও শুনেছেন। আল্লাহ পাক আমার সঙ্গে একজন ফেরেশতা পাঠিয়েছেন। আপনি যদি হুকুম করেন তাহলে ওই ফেরেশতা এক্ষুনি সমগ্র তায়েফকে ধ্বংস করে দেবে।”
জবাবে দয়ালু নবী করিম (সা.) বললেন, “না না, তা আমি চাই না। বরং তাদের জন্য একটু আগে আল্লাহ পাকের কাছে মাফ চেয়েছি কারণ আল্লাহ হয়তো তাদের বংশে এমন মানুষের জন্ম দেবেন যারা ইসলাম কবুল করে এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরিক করবে না।”
এমন ক্ষমার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। সাথর্ক নাম ওনার রাহমাতুল্লিল আল-আমিন।
ঠিক এই সময়ে নবী করিম (সা.)-এর উপর আল্লাহ অহি নাযিল করলেন, “আপনি ধৈর্য ধরুন এবং এমন ধৈর্য যাহাতে কোনো প্রকার অভিযোগের নামও না থাকে। ইহারা (অবিশ্বাসীরা) ওই দিবসকে বহু দূরবর্তী দেখিতেছে এবং আমি উহাকে খুব নিকটবর্তী দেখিতেছি।” [সূরা মা’আরিজ, আয়াত ৫/৬/৭, পারা-২৯]
এই আয়াত নাযিল হওয়ার ফলে গভীর আশ্বাসে নবী করিম (সা.)-এর হৃদয় ভরে গেল। বিজয়ের সুখ-স্বপ্নে সব দুঃখ-যাতনা ভুলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে জায়েদকে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসতে লাগলেন।
প্রায় ৬০ মাইল আসার পর নাখলা নামক স্থানে বিশ্রাম নেয়ার সময় চিন্তা করলেন, চাচা আবু তালিব নেই। প্রাণপ্রিয় বিবি খাদিজা (রা.) নেই, মক্কার সবাই শত্রু, কে তাঁকে সাহায্য করবে? শেষে মোতায়েম ইবনে আদি নামে এক হৃদয়বান ব্যক্তি তাঁকে সাহায্য করতে রাজি হলেন এবং মক্কায় এসে ঘোষণা দিলেন, আমি মুহাম্মদকে আশ্রয় দিলাম।
মক্কায় ফিরে আসার কয়েকদিন পর নবী করিম (সা.) সওদা (রা.) নামে এক বয়স্কা মহিলাকে বিয়ে করেন। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে ওনার প্রিয় সাহাবী হযরত আবুবকর (সা.)-এর মেয়ে আয়েশা (রা)-কেও নবী করিম (সা.) বিয়ে করেন।
মদিনায় ইসলামের সূচনা
৬২০ খ্রিস্টাব্দে হজ ও ব্যবসা উপলক্ষে মদিনার ছ’জন সম্ভ্রান্ত লোক মক্কায় আসেন। নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা তারা আগেই শুনেছিলেন। মদিনায় এসে নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি (সা.) তাদের সঙ্গে আলাপ করার পর আল্লাহর অমীয় বাণী শোনালেন। নবী করিম (সা.)-এর মধুর ব্যবহার, চারিত্রিক মাধুর্য ও ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরী আল্লাহর বাণী শুনে তারা মুগ্ধ হলেন এবং পবিত্র কালেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তারপর তারা ফিরে গিয়ে সত্য ধর্মপ্রচারক, শান্তির বাণীবাহক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা মদিনাবাসীকে জানালেন। পরের বছর ৬২১ খ্রিস্টাব্দে হজের সময় মদিনা থেকে আরও বারোজন লোক মক্কায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবী করিম (সা.)-এর কাছে একজন ইসলাম প্রচারক চাইলেন। ইসলামের প্রথম ইসলাম প্রচারক হিসেবে মাসয়াব (রা.) নামে একজন সাহাবীকে নবী (সা.) তাদের সঙ্গে মদিনায় পাঠিয়ে দিলেন।
মিরাজের ঘটনা
হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত পাওয়ার মতান্তরে দ্বাদশ বছরে তাঁর জীবনের সর্বাধিক বিস্ময়কর ও তাৎপর্যপূর্ণ মিরাজের ঘটনা ঘটে। রজব মাসের ২৭ তারিখ সোমবার রাতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) উম্মে হানির ঘরে মতান্তরে কা’বা ঘরের চত্বরে (হাতেমে) ঘুমিয়ে ছিলেন। তখন গভীর রাত, এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছে। নবী করিম (সা.)-এর ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখলেন, ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আর অল্প দূরে ‘বোরাক’ নামক ডানা বিশিষ্ট একটা অদ্ভুত জ্যোতির্ময় বাহন অপেক্ষা করছে।
ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) প্রথমে নবী করিম (সা.)-এর বক্ষ বিদীর্ণ করে আগের মতো তাঁর হৃদয়কে শক্তিশালী করে দিলেন। তারপর সালাম দিয়ে আল্লাহ পাকের দিদার লাভের দাওয়াত জানিয়ে বললেন, “আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘বোরাক’ দাঁড়িয়ে আছে। এই বোরাকের গতি বিদ্যুতের মতো। চোখের পলকে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যেতে পারে।”
নবী করিম (সা.) সালামের উত্তর দিয়ে বোরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তের মধ্যে বোরাক ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে ওনাকে নিয়ে জেরুজালেমে বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছে গেলেন। হযরত সোলেমান (আ.) এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই পবিত্র মসজিদে হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) ইহার সাথে চিরবিজড়িত। ইহাকে কিবলাহ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এত দিন নামায পড়েছেন। আজ সেই পবিত্র মসজিদ স্বচক্ষে দেখে নিজেকে ধন্য মনে করলেন। ভিতরে ঢুকে দু’রাকায়াত নামায পড়লেন। তারপর এখান থেকে জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে চললেন। উপরে পরপর সাতটি আসমান। প্রত্যেক আসমানে আছে একটা দরজা। দরজায় আছেন একজন পাহারাদার ফেরেশতা। মুহূর্তের মধ্যে জিবরাইল (আ.) হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে প্রথম আসমানের প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছে বন্ধ দরজায় আঘাত করলেন।
ভিতর থেকে ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনি?”
জিবরাইল (আ.) পরিচয় দিয়ে বললেন, “আমার সঙ্গে আছেন আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.), যিনি আল্লাহর বাণীপ্রাপ্ত হয়েছেন।” তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে জিবরাইল (আ.) একজনকে দেখিয়ে নবী করিম (সা.)-কে বললেন, “ইনি আপনার আদি পিতা হযরত আদম (আ.)। ইনাকে সালাম দিন।’
নবীর করিম (সা.) সালাম দিলে হযরত আদম (আ.) সালামের উত্তর দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মুবারক হো, হে আমার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব।”
তারপর এইভাবে দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া ও হযরত ঈশা (আ.) তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানে প্রবেশ করে নবী করিম (সা.) যথাক্রমে হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত ঈদরীশ (আ.), হযরত হারুন (আ.), হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ইরাহিম (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেলেন। প্রত্যেককেই উনি সালাম জানালেন। ওনারাও প্রত্যেকেই নবী করিম (সা.)-কে খোশ আমদেদ জানালেন।
তারপর জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে বায়তুল মামুরে প্রবেশ করলেন। এখানে ফেরেশতারা নামায আদায় করে থাকেন। এটা কা’বা শরীফের ঠিক উপরে অবস্থিত। নবী করিম (সা.)ও এখানে নামায আদায় করলেন।
এরপর জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামে এক জায়গায় নিয়ে এলেন। এখানে একটা কুলগাছ আছে। এই কুলগাছটা এত বড় যে, মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। এই জায়গাটাই হল ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ অর্থাৎ সীমান্তের কুলগাছ। সৃষ্টি ও স্রষ্টার শেষ সীমানা। এর ওপারে যাওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ কাউকেই দেননি। সপ্ত আসমান ও সিদরাতুল মুনতাহা ভ্রমণের পর জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে নবী করিম (সা.) আসমানের অধিবাসী বিভিন্ন ফেরেশতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎলাভ, পরিচয় ও আলাপ-আলোচনা করলেন। তারপর তাঁকে বেহেশতের নেয়ামতসমূহ ও কী কী নেক কাজ করলে মানুষ বেহেশতে যাবে এবং কী ধরনের নেয়ামত ভোগ করবে সে সব দেখালেন। তারপর দোজখের ভীষণ আজাবের দৃশ্য এবং তার ভয়াবহ আজাবের উপকরণগুলোও দেখালেন। কোন পাপের জন্য কী ধরনের আজাব হবে তাহাও জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-কে দেখালেন। সেসব শাস্তির কথা শুনলে মনে হবে জীবনে কোনোদিন অন্যায় কাজ করবে না। সেই সবের কয়েকটা নমুনা এখানে দেয়া হল :
এক জায়গায় নবী করিম (সা.) দেখলেন, একদল লোকের মাথায় আজাবের ফেরেশতারা পাথর ছুড়ে মারছে। লোকগুলোর মাথা ফেটে চৌচির হয়ে রক্ত গলগল করে পড়ছে; কিন্তু পরক্ষণেই আবার আপনাআপনি আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে। আবার আজাবের ফেরেশতারা পাথর মেরে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে। অনবরত এইভাবে শাস্তি দেয়া চলছে। নবী করিম (সা.) এদের পরিচয় জানতে চাইলে জিবরাইল (আ.) বললেন, “এরা ফরয নামায আদায় করত না।
চলতে চলতে নবী করিম (সা.) আর এক জায়গায় দেখলেন, একদল লোকের পরনে রয়েছে এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়। তারা চতুষ্পদ জানোয়ারের মতো চরে বেড়াচ্ছে আর কাঁটায় ভরা জাক্কুম ও দারী নামক বিষাক্ত গাছ চিবিয়ে খাচ্ছে। নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?”
জিবরাইল (আ.) বললেন, “আল্লাহ এদেরকে অনেক ধন-সম্পদ দিয়েছিলেন, কিন্তু এরা মালের জাকাত দেয়নি।”
সেখান থেকে আবার অগ্রসর হয়ে দেখলেন, একদল লোক পচা দুর্গন্ধ কাঁচা গোশত খাচ্ছে। তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে জিবরাইল (আ.) বললেন, “এরা ছিল অসৎ চরিত্রের লোক। হালাল জিনিস থাকা সত্ত্বেও দুনিয়াতে হারাম খেত এবং হারামের সংস্পর্শে থাকত।”
আরও সামনে অগ্রসর হতে দেখলেন, একটা লোক রক্তের নদীতে সাঁতার কাটছে আর ক্ষুধার্ত মানুষের মতো পাথর গিলে খাচ্ছে। নবী করিম (সা.)-কে সে দিকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে জিবরাইল (আ.) বললেন, “এরা হচ্ছে সুদখোর। সুদের বদলে এরা মানুষকে সর্বস্বান্ত করত।”
আবার চলতে চলতে দেখলেন, একদল লোকের জিভ আর ঠোঁট গরম লোহার কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। কাটার পরেই আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার কেটে দেয়া হচ্ছে। নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?”
জিবরাইল (আ.) বললেন, “এরা ওইসব বক্তা, যারা দুনিয়াতে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে ভুল পথে চালাত, একদলের সঙ্গে অন্য দলের ঝগড়া-বিবাদ বাধাত এবং নিজেরা যেসব ভালো কথা বলত, তা তারা করত না।” [কাজি গোলাম আহমদ কর্তৃক লিখিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত আলোর নবী আল-আমিন, পৃষ্ঠা ৫৬]
আবার কিছু দূর যাওয়ার পর এক জায়গায় দেখলেন, একদল লোকের নখ হয়েছে তামার। আর সেই তামার নখ দিয়ে তারা নিজেদের বুক আর মুখ আঁচড়ে রক্ত বের করছে। নবী করিম (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “এরা এমন করছে কেন?
জিবরাইল (আ.) জবাব দিলেন, “এরা দুনিয়াতে পরের দোষ খুঁজে বেড়াত আর পরনিন্দা ও পরচর্চায় মেতে থাকত।”
তারপর একটা প্রান্তর অতিক্রম করার সময় খোশবুদার ঠাণ্ডা বাতাস এসে তাঁর শরীর ও মন জুড়িয়ে দিল। সেই সাথে শুনতে পেলেন, “আয় আল্লাহ! আমাকে যা ওয়াদা করেছ তা দাও। দাও আমার এই প্রাচুর্য ভোগের বাসিন্দা।”
বেহেশতের আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের কথা আল্লাহ পাক কুরআনে ও তার রাসুল (সা.)-এর হাদিসে যেসব বর্ণনা করেছেন সেসবের কল্পনাও মানুষ করতে পারবে না।
নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “এ কার আওয়াজ?”
জিবরাইল (আ.) বললেন, “বেহেশতের।”
পরক্ষণে নবী করিম (সা.) শুনলেন, আল্লাহর গায়েবি আওয়াজ। তিনি বেহেশতকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “ধৈর্য ধর, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী, প্রত্যেক ঈমানদার বান্দা, যারা আমার সাথে শরিক করবে না, যারা আমাকে এক ও অদ্বিতীয় বলে মানবে ও নেক কাজ করবে, যারা আমাকে ভয় করে আমার আদেশ মেনে চলবে ও আমার উপর ভরসা করবে, তাদের সবাইকে আমি তোমার জন্যে ঠিক করে রেখেছি। নিশ্চয় ঈমানদাররা কামিয়াব হবে এবং আল্লাহ পবিত্র ও উত্তম স্রষ্টা, তিনি কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।” আল্লাহর এই বাণী শুনে বেহেশত আশ্বস্ত হল।
ঠিক এমনভাবে ক্ষুধার্ত দোজখের আহ্বান নবী করিম (সা.) শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ পাকের গায়েবি আওয়াজও শুনলেন। “প্রত্যেক অবিশ্বাসী নর-নারী, যারা আখেরাত ও কিয়ামতের দিনে তাদের কাজের হিসাব- নিকাশ দেয়াকে বিশ্বাস করে না, যারা বেঈমান, অহংকারী এবং আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধে, তাদের সবাইকে আমি তোমার জন্যে ঠিক করে রেখেছি।” এই কথায় দোজখও আশ্বস্ত হল।
তারপর জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-কে কিছু দূর নিয়ে যাওয়ার পর বললেন, “এরপর আমার আর যাওয়ার ক্ষমতা নেই। এবার আপনাকে একাই যেতে হবে। কারণ আর এক চুল পরিমাণ আমি যদি এগোই, তাহলে নূরের প্রচণ্ডতায় জ্বলে ছাই হয়ে যাব।” এমন সময় হঠাৎ ‘রফরফ’ নামে একটা জ্যোতির্ময় আসন নেমে এল এবং নবী করিম (সা.) তাতে আরোহণ করে আরশে মুয়াল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন।
আল্লাহপাক নবী করিম (সা.)-কে আহবান করে বললেন, “হে আমার প্রিয় হাবিব! আপনি আমার আরশে মুয়াল্লায় আসন গ্রহণ করুন।”
তখন নবী করিম (সা.)-এর মনে পড়ল হযরত মুসা নবী (আ.) আল্লাহকে দেখার জন্য যখন তূর পাহাড়ে গিয়েছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে জুতা খুলে তূর পাহাড়ে আরোহণ করতে বলেছিলেন। এখন আল্লাহ তাঁকে আরশে মুয়াল্লায় আরোহণ করার কথা বলায় সেই কথা ভেবে যখন জুতা খুলতে গেলেন তখন আল্লাহ বললেন, “আপনি জুতা খুলবেন না, উহা পরেই আরশে মুয়াল্লায় আরোহণ করুন। আপনার জুতার ধুলায় আমার আরশে মুয়াল্লাহ পবিত্র হয়ে যাক।” সুবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিবকে কতটা সম্মান দেখালেন তা মানুষ চিন্তাই করতে পারবে না। তারপর নবী করিম (সা.) জুতো পায়ে দিয়েই আরশে মুয়াল্লায় আসন গ্রহণ করলেন। এখানে এসে নবী করিম (সা.) আল্লাহর নৈকট্য লাভ করলেন। একটা পর্দার আড়াল টেনে আল্লাহ তাঁকে দেখা দিলেন এবং তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-এর সঙ্গে অনেক কতাবার্তা বললেন। সৃষ্টিলীলার যে রহস্য তখনও নবী করিম (সা.)-এর অজানা ছিল, এই বার তাহা সম্যকরূপে উপলব্ধি করলেন। স্রষ্টা এবং সৃষ্টিকে তিনি সত্য বলে চিনতে পারলেন।
মিরাজ অনুষ্ঠানের পর ফেরার সময় নবী করিম (সা.) তাঁর উম্মতের জন্য আল্লাহপাকের কাছ থেকে বেহেশতের সওগাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উপঢৌকন নিয়ে ঠিক যেভাবে গিয়েছিলেন, সেইভাবে মক্কায় ফিরে এলেন। এই পবিত্র মিরাজ দুনিয়ার সময়ের হিসেবে খুব কম সময়ের মধ্যে ঘটেছিল।
পরের দিন সকালে নবী করিম (সা.) কা’বা শরীফে গিয়ে তাঁর সাহাবীদিগের কাছে মিরাজের ঘটনা বললেন। অনেকে ইহা বিশ্বাস করলেন। আবার যাদের ঈমান দুর্বল ছিল, তারা এটাকে অসম্ভব ও কল্পনা বলে মনে করলেন। কয়েকজন সাহাবা হযরত আবুবকর (রা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, “হযরত মুহাম্মদ (সা.) নাকি গত রাত্রে বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে গত রাতেই ফিরে এসেছেন।
আবুবকর (রা.) বললেন, “যদি তিনি কথাটা বলে থাকেন, তাহলে সত্য বলেছেন। আমি তাঁর কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।” এই কথা বলে তিনি কা’বা শরীফে গিয়ে নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “লোকেরা যা বলছে, তা কি সত্য?”
হযরত নবী করিম (সা.) বললেন, “হ্যাঁ সত্য!”
তখন আবুবকর (রা.) বললেন, “আমি সাক্ষ্যি দিচ্ছি, সত্যিই আপনি আল্লাহর রাসুল (সা.)।”
কিন্তু কুরাইশরা যখন শুনল তখন তারা বিশ্বাস করল না, হেসে উড়িয়ে দিল। আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ, বেহেশত-দোজখ দেখা তো দূরের কথা মক্কা থেকে এক মাসের পথ এক রাতে বায়তুল মোকাদ্দাস ভ্রমণ করে ফিরে আসা অসম্ভব বলে তারা মন্তব্য করল। তাদের মধ্যে অনেকে জেরুজালেম গিয়েছে। বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ কোথায় এবং মসজিদের কোথায় কি আছে জানে। তারা মসজিদের বিভিন্ন জিনিস যেমন কয়টা দরজা, জানালা ও নকশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগল।
নবী করিম (সা.) বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়ে নামায পড়েছেন; কিন্তু কোথায় কী আছে তা দেখেননি। তাই তাদের প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তাই দেখে আল্লাহপাক হযরত জিবরাইল (আ.)-কে ওনাকে সাহায্য করার জন্য পাঠালেন।
ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাসের একখানা অদৃশ্য ছবি ওনার সামনে ধরলেন। সেই ছবি নবী করিম (সা.) ছাড়া আর কারও দৃষ্টিগোচর হল না। হুজুর (সা.) ওই ছবির দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসী কুরাইশদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর বলে দিলেন। এই ঘটনার ফলে তাদের মধ্যে অনেকে ইসলাম কবুল করল। বাকিরা ওনাকে যাদুকর বলে সেখান থেকে চলে গেল।
আকাবার শপথ
নবুয়তের তৈর বছর অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হজ উপলক্ষে মদিনা থেকে আরও ৭২ জন লোক মক্কায় এলেন। জিলহজ মাসের ১২ তারিখের গভীর রাতে মক্কা ও মদিনার মধ্যস্থলে ‘আকাবা’ নামক এক পাহাড়ঘেরা জায়গায় নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনায় যাওয়ার জন্য ওনাকে অনুরোধ জানালেন।
নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে ওনার চাচা হযরত আব্বাস (রা.) ছিলেন। তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাদের কথা শুনে বললেন, “সব জায়গায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শত্রু আছে। আমরা ওনাকে এসব শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে আসছি। আপনারা যদি ওইসব শত্রুদের হাত থেকে ওনাকে রক্ষা করতে রাজি থাকেন, তাহলে নিয়ে যেতে পারেন। নচেৎ আপনাদের আশা পূরণ হবে না।”
মদিনাবাসীরা বললেন, আল্লাহর নবী (সা.) যদি আমাদের দেশে যান, তাহলে আমরা আমাদের জান-মাল সমস্ত কিছু ওনার জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছি। আমরা সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে হলেও সত্য ও ন্যায়ের জন্য মোকাবেলা করতে প্রস্তুত আছি। তারপর নবী করিম (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমরা জানতে চাই যখন আপনার দল ভারী হবে অর্থাৎ মুসলমানদের সংখ্যা এখানে বেড়ে যাবে তখন কি আমাদেরকে ছেড়ে আপনার জন্মভূমি মক্কায় ফিরে আসবেন?”
হযরত নবী করিম (সা.) ছলছল চোখে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, “না, জেনে রাখ তোমাদের রক্ত আমাদের রক্ত। আজ থেকে তোমরা আমার, আমিও তোমাদের।”
তখন মদিনাবাসীরা নবী করিম (সা.)-এর হাতে হাত রেখে শপথ নিল-
(১) আমরা আজ থেকে আর আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুর শরিক করব না।
(২) চুরি করব না।
(৩) দরিদ্র হওয়ার ভয়ে ও ইজ্জত রক্ষার জন্য সন্তানকে হত্যা করব না।
(৪) নারীদের বেইজ্জতি করব না।
(৫) কারও নামে অপবাদ দেব না বা পরনিন্দা করব না।
(৬) আল্লাহর নাফরমানি করব না।
(৭) সুখে-দুঃখে রাসুল (সা.)-এর আদেশ মেনে চলব। (৮) কোনো বিষয় নিয়ে পরস্পর ঝগড়া করব না।
(৯) সব সময় সত্য কথা বলব এবং আল্লাহর রাস্তায় কোনো নিন্দাকে ভয় করব না।
ইতিহাসে এই শপথকে ‘আকাবার শপথ’ বলা হয়।
হুজুর (সা.) ওই লোকদের মধ্যে বারজন লোক নির্বাচন করে তাঁদেরকে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশ দিলেন।
পরের দিন সকালে এই ঘটনা কুরাইশরা জানতে পেরে ভীষণ ক্ষেপে গেল। এরপর থেকে মুসলমানদের উপর তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। তাই দেখে নবী করিম (সা.) আল্লাহর হুকুমে মুসলমানদের সবাইকে মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাবার পরামর্শ দিলেন। মুসলমানরা সময়-সুযোগমতো একে একে সবাই মদিনায় চলে গেলেন। যাবার সময় বিধর্মী কুরাইশরা তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতে ছাড়ল না। নবী করিম (সা.) শুধু আবুবকর (রা.) ও আলী (রা.)-কে নিয়ে তাঁর নিজের হিজরতের সম্পর্কে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন।
নবী করিম (দ.)-এর মদিনায় হিজরত
ইসলামের আলোর জোয়ার মদিনা ভেসে উঠল। তাই দেখে মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশদের মনে ভয়ের সঞ্চার হল। ভাবল, এবার বুঝি মক্কাতেও ইসলামের আলোর জোয়ার ভেসে উঠবে। তাই কুরাইশরা অচিরে এক পরামর্শ সভা ডাকল। মক্কার সব গোত্রের সর্দাররা হাজির হয়ে এক একজন এক একরকম বক্তৃতা দিতে লাগল। কেউ বলল, এর একটা প্রতিবিধান এখনই করতে হবে, এর মূল উপড়ে ফেলে দিতে হবে। নচেৎ সারা আরবে আমাদের নাম-নিশানা মুছে যাবে।
তখন অন্য একজন বলল, হযরত মুহাম্মদকে ধরে সারাজীবন কয়েদখানায় বন্দি করে রাখা হোক, আবার অন্য একজন বলল ওনাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হোক। এসব কথা অনেকের মনঃপূত হল না। শেষে আবু জেহেল বলল, মুহাম্মদকে হত্যা করাই উত্তম। এর থেকে আর কোনো ভালো পন্থা নেই। তার কথা সব সর্দার একবাক্যে মেনে নিল। কিন্তু কে এই কাজ করবে? তখন আবু জেহেলই বলল, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে সাহসী যুবক বেছে নিয়ে একটা দল তৈরী করা হোক। তারা সবাই মিলে এই কাজ করবে। কথাটা সকলের মনে ধরল এবং তখনই দল গঠন করা হল। ঠিক হল গভীর রাতে তারা সকলে মুহম্মদ (সা.)-এর ঘর ঘেরাও করে রাখবে। ভোরবেলা মুহাম্মদ (সা.) ঘর থেকে যেই বেরিয়ে আসবেন তখনই সকলে একযোগে তাঁকে হত্যা করবে।
এদিকে হযরত নবী করিম (সা.)-কে জিবরাইল (আ.) ফেরেশতা এই ভীষণ ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে বললেন, আজ রাতের মধ্যেই আল্লাহ আপনাকে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করার হুকুম দিয়েছেন।
ততক্ষণাৎ নবী করিম (সা.) তরুণ যুবক আলী (রা.)-কে ডেকে বললেন, “আল্লাহর তরফ থেকে আমার মদিনায় হিজরত করার হুকুম হয়েছে। তাই আজ রাতেই আমি মদিনার পথে রওয়ানা দেব। তুমি আমার বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে। আর এই সব মালপত্র রেখে গেলাম, এগুলো প্রতিবেশীরা বিশ্বাস করে আমার কাছে আমানত রেখেছিল। তুমি এগুলোর প্রকৃত মালিককে ডেকে ফিরিয়ে দেবে।” তিনি নবী করিম (সা.)-এর কথামতো রাতের বেলা তাঁরই বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন আর নবী করিম (সা.) দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন কাফের সর্দাররা খোলা তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তখন তিনি জমিন থেকে এক মুষ্ঠি বালি হাতে নিয়ে কুরআনের কিছু আয়াত পড়ে দম করে সেই বালি কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। তারপর নিশ্চিন্তে শত্রুদের সামনে দিয়ে চলে গেলেন; কিন্তু তারা তাঁকে দেখতে পেল না।
নবী করিম (সা.) ঘর থেকে বেরিয়ে হযরত আবুবকর (রা.)-এর বাড়িতে এলেন। আগে থেকে মদিনায় হিজরত করার ব্যাপারে নবী করিম (সা.) তাঁর সঙ্গে আলাপ করে রেখেছিলেন। কী করতে হবে না হবে সব ঠিক করা ছিল। নবী করিম (সা.) আবুবকরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। স্থির হল, মক্কার তিন মাইল দূরে ‘সওর’ পাহাড়ের গুহায় তারা লুকিয়ে থাকবেন। তারপর সুযোগ-সুবিধামতো সেখান থেকে মদিনা রওয়ানা দেবেন।
আবুবকর (রা.) ঘর থেকে বেরোবার সময় ছেলে আবদুল্লাহ (রা.) ও মেয়ে আসমা ও আয়েশা (রা.)-কে বলে গেলেন, তারা যেন প্রতিদিন রাতে গোপনে ‘সত্তর’ গুহায় খাবার পাঠিয়ে দেয়।
জন্মভূমি ছেড়ে যাবার সময় পবিত্র কা’বা ঘরের দিকে তাকিয়ে নবী করিম (সা.) চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভিজে গলায় বললেন, “হে আমার জন্মভূমি মক্কা বিদায়। পৃথিবীর সকল জায়গার চেয়ে তুমি আমার কাছে প্রিয়। কিন্তু হায়, তোমার সন্তানেরা আমাকে তোমার বুকে থাকতে দিল না।” ওনার এই কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি তিনি তাঁর জন্মভূমিকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এজন্য তিনি বলে গেছেন, “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।” পথ চলত চলতে ভোর হয়ে এলে ‘সত্তর’ পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন।
এদিকে সকাল হয়ে যেতেও যখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) ঘর থেকে বের হলেন না তখন কুরাইশ সর্দাররা জোর করে ঘরে ঢুকে চাদর মুড়ি দিয়ে আলী (রা.)-কে শুয়ে থাকতে দেখে মনে করল মুহাম্মদ (সা.) শুয়ে আছেন। আবু জেহেল চাদরখনি হেঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে অবাক হয়ে বলল, “একি, এ তো আলী!” খুব রেগে গিয়ে আলী (রা.)-কে জিজ্ঞেস করল, “মুহাম্মদ কোথায়?
বলদৃপ্ত কণ্ঠে আলী (রা.) উত্তর দিলেন, “আমি জানি না। তোমরা কি আমাকে তোমাদের চর নিযুক্ত রেখেছিলে যে আমাকে জিজ্ঞেস করছ? নিজেরা খুঁজে দেখ।” তারপর নির্ভীকচিত্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে মদিনায় হিজরত করবেন সে কথা তারা বুঝতে পেরেছিল। তাই আলী (রা.)-এর পিছনে সময় নষ্ট না করে সেই অনুমানের উপর নির্ভর করে তাঁকে খোঁজার কাজ আরম্ভ করল। তারা ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করল, “যে মুহাম্মদ (সা.)-কে জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারবে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে।”
এদিকে ‘সত্তর’ পাহাড়ের গুহায় ঢোকার পর নবী করিম (সা.) ক্লান্ত হয়ে আবুবকর (রা.)-এর জানুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আবুবকর (রা.) গুহার চারপাশে চেয়ে দেখলেন, ছোট ছোট অনেক গর্ত। গর্তের ভিতর বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু থাকতে পারে ভেবে নিজের মাথার পাগড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেই সব গর্ত বন্ধ করে দিলেন। তখনও পায়ের কাছে একটা গর্ত রয়েছে, অথচ পাগড়ির কাপড় শেষ। তাই সেই গর্তে নিজের একটা পায়ের গোড়ালি দিয়ে চেপে রাখলেন। ওই গর্তের মধ্যে সত্যি একটা সাপ ঝিল। সাপটা গর্ত থেকে বেরোতে না পেরে আবুবকর (রা.)-এর পায়ে বারবার ছোবল মারতে লাগল। বিষের জ্বালায় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত হবে ভেবে নীরবে সেই জ্বালা সহ্য করতে লাগলেন। অসহ্য বিষের জ্বালায় চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি নবী করিম (সা.)-এর মুখের উপর পড়তে ওনার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে গিয়ে আবুবকর (রা.)-এর অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারলেন ওনাকে সাপে কামড়েছে তখন তিনি নিজের মুখের লালা আবুবকর (রা.)-এর পায়ে যেখানে সাপে কামড়েছিল সেখানে লাগিয়ে দিলেন। আল্লাহর হুকুমে ততক্ষণাৎ জ্বালা-যন্ত্রণা সেরে গেল।
শত্রুরা খুঁজতে খুঁজতে ‘সত্তর’ পাহাড়ের সেই গুহার মুখের কাছে আসার আগে গুহার মুখে মাকড়সা জাল তৈরী করেছে আর তাতে দুটো পায়রা ডিম পেড়ে তা দিচ্ছে। শত্রুরা সেখানে এসে পায়ের দাগ পরীক্ষা করে তাদের একজন বলল, “এ গুহাতেই আছে।”
এই কথা শুনতে পেয়ে আবুবকর (রা.) ভয়ে আঁৎকে উঠে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), এবার কী হবে? আমরা মাত্র দুজন।”
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, “ভয় পেয়ো না, আমাদের সঙ্গে আরও একজন আছেন, তিনি হলেন আল্লাহ।”
শত্রুদের ওই লোকটা যখন ‘সত্তর’ গুহা দেখিয়ে বলল, মুহাম্মদ (সা.) এই গুহাতেই আছ তখন অন্যরা সবাই বিশ্বাস করল না। বলল, “এই গুহায় ঢুকলে মাকড়সার জাল ছিঁড়ে যেত আর পায়রার ডিম ভেঙে যেত।” কথাটা যুক্তিসঙ্গত ভেবে দুশমনরা আর গুহায় না ঢুকে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেল। হযরত নবী করিম (সা.) আবুবকর (রা.)-কে নিয়ে ‘সওর’ গুহায় তিন দিন তিন রাত থাকলেন। এই সময়ে আবুবকর (রা.)-এর বালক পুত্র আবদুর রহমান তাদের সঙ্গে থাকতেন আর খুব ভোরে উঠে মক্কায় চলে যেতেন। তারপর শত্রু কুরাইশদের আলাপ-আলোচনা শুনে রাতে এসে তাঁদেরকে জানাতেন। আর আবুবকর (রা.)-এর চাকর রাতের আঁধারে বকরির দুধ দিয়ে যেতেন।
তিন দিন পর আবদুল্লাহ নামে এক বিশ্বাসী ভক্ত রাতের অন্ধকারে দুটো দ্রুতগামী উট নিয়ে গুহার কাছে হাজির হলেন। নবী করিম (সা.) ও আবুবকর (রা.) সেই উটে চড়ে মদিনা রওয়ানা হলেন। সঙ্গে চললেন আবুবকর (রা.)-এর চাকর আমের এবং পথপ্রদর্শক ও উট চালক আবদুল্লাহ বিন অরিকত। ইনি ছিলেন বিধর্মী Į
কোদাইদ নামে একটা জায়গা দিয়ে যখন ওনারা যাচ্ছিলেন তখন একটা লোক তাঁদেরকে পাশ কেটে মক্কায় আসছিল। মক্কায় পৌছে সে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হিজরত করার কথা লোকদের মুখে শুনে বলল, “আমি কিছুক্ষণ আগে চারজনের একটা ছোট কাফেলা মদিনার দিকে যেতে দেখেছি।”
কথাটা শুনেই এক কুরাইশ সর্দার ‘সোরাকা’ একশ উটের লোভে চুপে চুপে একট তেজি ঘোড়া নিয়ে রওয়ানা দিল। কিছু দূর গিয়ে দেখতে পেল সত্যি সত্যি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাফেলা যাচ্ছে। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে সোরাকা এগোল; কিন্তু কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ তার ঘোড়ার সামনের দুটো পা বালির মধ্যে পুঁতে গেল। সোরাকা ঘোড়া থেকে পড়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও ঘোড়ার পা আর ওঠাতে পারল না। তখন সোরাকা মনে এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। সে নবী করিম (সা.)-এর কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলল, “দো’য়া করুন আমার ঘোড়াটা যেন এই বিপদ থেকে উদ্ধার পায়।
নবী করিম (সা.) আল্লাহর কাছে দোয়া করতেই ঘোড়ার পা মুক্ত হল। তখন সোরাকা পৌত্তলিক কুরাইশদের পুরস্কারের কথা জানিয়ে ওয়াদা করল, নবী করিম (সা.)-এর সন্ধান তাদেরকে জানাবে না। আল্লাহর কুদরতে শত্রু সোরাকা মিত্রে পরিণত হয়ে মক্কায় ফিরে গেল।
তারপর নবী করিম (সা.)-এর ছোট্ট কাফেলা নির্বিঘ্নে মদিনার পথে এগিয়ে চলল।
মদিনা শরীফে হযরত মুহাম্মদ (সা.)
রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখে মদিনা থেকে দুই মাইল দূরে কো’বা নামক জায়গায় এসে নবী করিম (সা.) থামলেন। এখানে তিনি সাদবিন খায়সামার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে আলী (রা.) হিজরত করে কো’বায় এসে পৌঁছালেন। নামায আদায় করার জন্য সর্বপ্রথম নবী করিম (সা.) ভক্তবৃন্দদের নিয়ে এখানে একটা মসজিদ তৈরি করলেন। সেই মসজিদ এখন কো’বা মসজিদ নামে প্রসিদ্ধ। ইহাই ইসলামের প্রথম মসজিদ। এখানে ১২ দিন থাকার পর ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার নবী করিম (সা.) আল কাসোয়া নামক উটের উপর চড়ে মদিনা রওয়ানা দিলেন।
মদিনার আগে নাম ছিল ইয়াসরিব। আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে এখানে হিজরত করার পর ইয়াসরিব হয়ে গেলে মদিনাতুননবী অর্থাৎ নবী (সা.)-এর শহর। বিদ্যুৎ গতিতে মদিনার অলিতে- গলিতে নবী করিম (সা.)-এর রওয়ানা হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল। সমগ্ৰ মদিনায় আনন্দের বান ডেকে উঠল। যাঁকে এক নজর দেখার জন্য নারী- পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল, তাঁর আসার খবর পেয়ে উন্মত্ত পতঙ্গের মতো দলে দলে ছুটে বেরিয়ে এল রাস্তায়। ছোট ছোট বালক-বালিকারা নেচে নেচে ইয়া রাসুলুল্লাহ বলে গান গেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। বড়রা সবাই চাইল রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ঘরে উঠুন।
ঘটনা বুঝতে পেরে নবী করিম (সা.) চিন্তা করলেন, একজনের ঘরে উঠলে অন্যরা মনে কষ্ট পাবেন। তাই আল-কাসওয়া উট থেকে নেমে লাগাম ছেড়ে দিয়ে বললেন, “এই উট যার ঘরের সামনে বসে পড়বে, তার ঘরে থাকব।”
অবশেষে উট হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর ঘরের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে নবী করিম (সা.)-এর মালপত্র নিয়ে নিজের ঘরে তুললেন।
মসজিদে নববী ও আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্ব
ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার ও সব মুসলমানদের একত্রে মিলিত হওয়ার এবং একসঙ্গে ইবাদত করার জন্য মসজিদের প্রয়োজন দেখা দিল। যেখানে নবী করিম (সা.)-এর উট আল-কাসওয়া বসে পড়েছিল, সেখানেই তৈরি হল মসজিদে নববী। জায়গাটা কেনার জন্য টাকা দিলেন হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.), মতান্তরে হযরত আবুবকর (রা.)। আর সাহাবারা সকলে মিলে মসজিদ তৈরি করতে লাগলেন। নবী করিম (সা.) ও তাঁদের সঙ্গে একাত্মা হয়ে কাজ করতে লাগলেন। এই মসজিদের পাশেই পরে তৈরি হল হযরত নবী করিম (সা.)-এর পরিবার-পরিজনের জন্য থাকার ঘর। পরবর্তীকালে এই মসজিদে থেকেই সমস্ত আরব আর অর্ধেক দুনিয়ার শাসন কাজ পরিচালিত হত।
হযরত নবী করিম (সা.) ও তাঁর প্রিয় সহচর হযরত আবুবকর (রা.) পরিবারবর্গ মক্কায় শত্রুদের মধ্যে রেখে আল্লাহর হুকুমে মদিনায় চলে এসেছিলেন। এবার তাঁদেরকে নিয়ে আসার জন্য পালক ছেলে জায়েদ (রা.)-কে ও আবু রাফে নামে আর একজন মুক্ত ক্রীতদাসকে দুটো উট ও পাঁচশ দিরহাম সঙ্গে দিয়ে ওনাদের নিয়ে আসার জন্য মক্কায় পাঠালেন।
যথাসময়ে নবী করিম (সা.) ও হযরত আবুবকর (রা.)-এর পরিবারবর্গ মদিনায় এসে পৌঁছালেন। এবারে কুরাইশরা বিশেষ বাধা দেয়নি। নবীজি (সা.) নিজের ও যারা মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসেছেন, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করে দিলেন।
নবী করিম (সা.)-এর আগে ও পরে যারা মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসেছেন তাদেরকে মুহাজির বলে। আর যারা (মদিনাবাসীরা) মুহাজিরদেরকে সাহায্য করেছেন তাদেরকে আনসার বলে।
নবী করিম (সা.) এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, এ কথা সবাইকে জানিয়ে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে এমন এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে দিলেন, যা পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আজানের প্রচলন
মসজিদে নববীর তখন পরিমাপ ছিল লম্বায় ১০০ হাত আর চওড়াও ১০০ হাত। জমিন থেকে তিন হাত উঁচু করে পাথর দিয়ে ভিত দেয়া হয়। তার উপর ইটের দেয়াল তোলা হয়েছিল। চারকোণে চারটে মিনার ছিল; কিন্তু ছাদ পাকা ছিল না। খেজুর গাছের খুঁটির উপর তক্তা এঁটে ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন ইহার কেবলা ছিল জেরুজালেমের মসজিদুল আকসার দিকে।
মসজিদ হয়ে যাবার পর সবাই নির্বিঘ্নে নামায পড়তে লাগলেন; কিন্তু কী করে প্রতি ওয়াক্তে নির্দিষ্ট সময়ে একসঙ্গে জামাতে নামায পড়তে পারা যায় সে ব্যাপারে একদিন নবী করিম (সা.) সবাইকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন।
একজন বললেন, “নামাযের সময় একটা নিশান উঁচুতে উঠিয়ে দিলে সবাই বুঝতে পারবেন নামাযের সময় হয়েছে।” আর একজন বললেন, “তার চেয়ে শিঙ্গায় ফুঁ দিলে সবাই শুনতে পেয়ে মসজিদে চলে আসবেন।” আবার কেউ বললেন, “ঘণ্টা বাজান হোক, না হয় আগুন জ্বালান হোক।”
নবী করিম (সা.)-এর নিকট এগুলোর কোনোটায় পছন্দ হল না। কারণ ইহুদীরা শিঙ্গায় ফুঁ দেয়, নাসারারা ঘণ্টা বাজায় আর অগ্নি উপাসকরা আগুন জ্বালায়।
শেষে হযরত ওমর ফারুক (রা.) বললেন, “নামাযের সময়ে ডেকে আনার জন্য একজন লোক ঠিক করা হোক।”
কথাটা সবাই মেনে নিলেন। হযরত বিলাল (রা.)-কে এই দায়িত্ব দেয়া হল। তিনি প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নামাযের সময় হয়েছে বলে ডাকতেন।
এভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন হযরত আবদুল্লাহ বিন জায়েদ (রা.) স্বপ্নে দেখলেন, সবুজ পোশাক পরা একজন বুজুর্গ তাকে নামাযে লোকজনকে ডাকার জন্য (বর্তমানে আমরা যা বলে আজান দিই) তা শিখিয়ে দিলেন। ভোর হতেই তিনি নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে স্বপ্নের বিষয় জানালেন।
নবী করিম (সা.) বললেন, “তোমার স্বপ্ন সত্য। তুমি বেলালকে এটা শিখিয়ে দাও।”
আবদুল্লাহ বিন জায়েদ (রা.) বিলাল (রা.)-কে আজান শিখিয়ে দিলেন। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল (রা.)-এর কণ্ঠে একদিন ফজরের ওয়াক্তে সেই আজান দিক হতে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল।
আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ)। আল্লাহু আকবর, আলাহু আকবর (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ)। আশহাদু আল লাইলাহা ইল্লাল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই)।
আশহাদু আল লাইলাহা ইল্লাল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই)।
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ)
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ)
হাইয়া আলাস সালাহ (নামাযের জন্য এস)।
হাইয়া আলাস সালাহ (নামাযের জন্য এস)।
হাইয়া আলাল ফালাহ (সফলতার জন্য এস)।
হাইয়া আলাল ফালাহ (সফলতার জন্য এস)।
আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই)।
জোহর, আসর, মাগরিব ও এশার ওয়াক্তে এই আজান দেয়া হলেও ফজরের ওয়াক্তে হাইয়া আল্লাল ফালাহ বলার পর অতিরিক্ত একটা কথা বলতে হয় তা হল, আসসালাতু খায়রুম মিনান নাওম (ঘুমের চেয়ে নামায উত্তম)। এই আজান কিয়ামত পর্যন্ত সারা পৃথিবীর কোথায়ও না কোথাও দিন-রাত্রি চব্বিশ ঘণ্টা সব সময় মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকবে।
মদিনায় ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন
নবী করিম (সা.) দেখলেন, মদিনায় প্রধানত তিন শ্রেণীর লোক বাস করে।
(১) মদিনার আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়।
(২) বিদেশি ইহুদী সম্প্রদায়।
(৩) নবদীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়।
এদের কারও সঙ্গে কারও আদর্শের মিল তো ছিলই না, বরং ছিল দলগত হিংসা-বিদ্বেষ। এখানকার ইহুদীরা ছিল প্রতাপশালী। এরা চিরকাল অর্থলোভী, সুদখোর, সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর। তারা বিশ্বাস করত শেষ নবী তাদের বংশেই আসবে কিন্তু তা যখন হল না তখন তারা নবী করিম (সা.)- কে দলে ভিড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু সফল হতে না পেরে নবী করিম (সা.) ও নবদীক্ষিত মুসলিমদেরকে শত্রু ভাবতে লাগল। পৌত্তলিক মদিনাবাসীরা প্রথমে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ তাদের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরে ইসলামকে একটা স্বতন্ত্র শক্তিরূপে দেখে মনে মনে তারাও নবী করিম (সা.) ও মুসলমানদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল।
দেশবাসীর মনোভাব বুঝতে পেরে নবী করিম (সা.) সব সম্প্রদায়ের নেতাদের ডেকে একটা বৈঠক করলেন। বৈঠকে সাম্প্রদায়িক একতা ও সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলে একটা চুক্তিনামা করে সই করিয়ে নিলেন।
চুক্তিনামায় লেখা হল-
(১) মদিনার ইহুদী, নাসারা, পৌত্তলিক ও মুসলিম সকলেই একই দেশবাসী। তাই সকলের নাগরিক অধিকার সমান।
(২) প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
(৩) কেউ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিনা অনুমতিতে কারও সঙ্গে যুদ্ধ করবে না।
(৪) নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ ঘটলে আল্লাহর ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মীমাংসা মেনে নিতে হবে।
(৫) বাইরের কোনো শত্রুর সাথে কোনো সম্প্রদায় গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না।
(৬) যদি বাইরের কোনো শত্রু মদিনা আক্রমণ করে, তাহলে চার সম্প্রদায় একসঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে বাধা দেবে এবং যুদ্ধকালে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেদের খরচ বহন করবে।
(৭) নিজেদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহী হলে অথবা শত্রুর সঙ্গে কোনোরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তাকে সমুচিত শাস্তি দেয়া হবে। সে যদি আপন পুত্ৰও হয়, তবু তাকে ক্ষমা করা হবে না।
এভাবে নবী করিম (সা.) মদিনায় মুহাজীর, আনসার, ইহুদী, নাসারা ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সর্বপ্রথম এই চুক্তিনামা সম্পাদন করলেন। সবার সম্মতিক্রমে নবী করিম (সা.) এই ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান মনোনীত হলেন।
কিবলা পরিবর্তন
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছর থেকে হিজরী সাল গণনা করা হয়। নবী করিম (সা.) মক্কা শরীফে থাকাকালে আল্লাহর হুকুম অনুসারে কা’বা শরীফের দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। কিন্তু মদিনায় হিজরত করার পর আল্লাহর আদেশে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়তে শুরু করেন। তাই মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দিস। এটা ইহুদী ও খ্রিস্টানদের কিবলা। তাই এই দুই জাতি থেকে পৃথক করার জন্য তাদের কিবলাকে বাদ দিয়ে মক্কার কা’বা শরিফকে কিবলা করার জন্য আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযিল করলেন, “আমি আকাশের দিকে বারবার আপনার মুখমণ্ডল উঠতে দেখিতেছি। তাই আপনাকে আমি ফিরাইয়া দিব সেই কিবলার দিকেই যাহা আপনি পছন্দ করেন। তবে আপনার চেহারা (নামাযে) মসজিদে হারামের (কা’বার) দিকে ফিরাইয়া লউন। আর তোমরা যেখানেই থাক না স্বীয় চেহারা এই দিকেই ফিরাও।” [সূরা বাকারা, আয়াত-১৪৪, পারা-২]
আল্লাহর এই আদেশের পর থেকে মুসলমানদের কিবলা হল দুনিয়ার সর্বপ্রথম ইবাদত ঘর খানায়ে কা’বা। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা যেখানেই থাকুক না কেন সবাই ওই কা’বা শরীফের দিকে মুখ করে নামায আদায় করবে। তাই কা’বা শরীফ যে দেশের যে দিকে পড়বে সেই দেশের মুসলমানরা সেই দিকে মুখ করে নামায আদায় করবে।
প্রথম জিহাদ বদরের যুদ্ধ
সে সময় মদিনার খাজরাজ বংশের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নামে একজন ধনী ও প্রতাপশালী লোক ছিল। ইসলাম গ্রহণের আগে আনসার গোত্র ওই লোককে নিজেদের গোত্রের অধিপতি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু নবী করিম (সা.) আসার পর সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। ফলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নবী করিম (সা.)-এর প্রতি অসন্তুষ্ট ও ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে প্রতিপক্ষ মনে করল। আসলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল মুনাফেক। মুনাফেক তাকেই বলে যে মুখে বন্ধুর ভান করে আর মনে শত্রুতা পোষণ করে। মোট কথা, কথায় একরকম আর কাজে অন্য রকম। এরা প্রকাশ্য দুশমনের চেয়ে খারাপ। এদের সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, “মুনাফেকদের স্থান জাহান্নাম। আর জাহান্নাম অতি নিকৃষ্ট স্থান।”
নবী করিম (সা.) তাঁর অনুসারীদেরসহ মক্কা থেকে মদিনায় চলে যাওয়ায় মক্কার কাফেরদের যেমন খুব অনুশোচনা হল তেমনি রেগে গিয়ে মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করল।
এদিকে মদিনার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মুখে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করত আর সেই সুযোগে তাদের সব কথা জেনে নিয়ে গোপনে মক্কার কুরাইশদের কাছে পাচার করে দিত এবং মদিনা আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্য উৎসাহিত করত। মাঝে মাঝে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা মদিনার সীমানা থেকে মুসলমানদের উট, দুম্বা, ভেড়া, বকরি ও জমির ফসল লুট করাত।
নবী করিম (সা.) ওদের মতলব বুঝতে পেরে আত্মরক্ষার জন্য মুসলমানদের সামরিক কায়দায় তৈরী করলেন এবং তাদের সঙ্গে নিজেও রাত জেগে পাহারা দিতে লাগলেন। কারণ কাফেররা নিয়ম মাফিক যুদ্ধ না করে অতর্কিত হামলা করত। এরপরও কুরাইশ দস্যুরা মাঝে মাঝে মদিনার সীমান্তে দস্যুপনা চালাতে লাগল। তখন হুজুর (সা.) তাদের দস্যুপনা বন্ধ করার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-এর নেতৃত্বে মদিনার উপকণ্ঠে একটা পর্যবেক্ষক দল পাঠাইয়া দেন। তাঁহাদের দ্বারা একবার একটি দুষ্কৃতকারী কুরাইশদের একজন লোক নিহত হয় ও তিনজন বন্দি হয়। এর ফলে মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করল।
অন্যদিকে ওই সময়ে অন্যতম কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ব্যবসার পণ্য ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরছিল। সেই সময় মক্কা হতে সিরিয়া যাতায়াতের পথ ছিল বদরের গিরিপথ। বদর ছিল মক্কা, মদিনা ও সিরিয়ার রাজপথের সন্ধিস্থল এবং মদিনার এলাকাধীন।
মক্কার কুরাইশদের মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনার কথা নবী করিম (সা.) আগেই শুনেছিলেন। এখন আবার যখন জানতে পারলেন, কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে ব্যবসার পণ্য ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে মক্কায় ফিরছে তখন তিনি (সা.) খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
একদিন নবী করিম (সা.) মদিনার সমস্ত মুসলমানদের ডেকে মক্কার কুরাইশদের মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনার কথা ও সিরিয়া থেকে আবু সুফিয়ানের যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে মক্কায় ফেরার কথা জানিয়ে বললেন, “আবু সুফিয়ানকে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে মক্কায় নির্বিঘ্নে ফিরে যাবার সুযোগ দিলে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। তাই আমাদের উচিত হবে আৰু সুফিয়ানের কাছ থেকে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম কেড়ে নেয়া।”
নবী করিম (সা.)-এর কথা শুনে মুহাজিরদের পক্ষে হযরত আবুবকর (রা.) এবং আনসারদের পক্ষে হযরত মিকদাদ (রা.) ও হযরত সায়াদ ইবনে ওবায়া (রা.) বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আমরা আপনার সঙ্গে একমত এবং ইসলামের জন্য আমরা জান-মাল সব কুরবান করতে প্রস্তুত।”
তখন নবী করিম (সা.) মাত্র তিনশত তেরজন মুজাহিদ, যারা নাকি জীবন দিতে প্রস্তুত, এই রকম বাছাই করা মুসলমানদের নিয়ে একটা পদাতিক বহিনী গঠন করে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম কেড়ে নেয়ার জন্য বদরের পথে রওয়ানা দিলেন। একসময় তাঁরা মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে বদরে এসে তাঁবু গাড়লেন। তারপর নবী করিম (সা.) দুজন লোককে বদরের নিকটবর্তী জায়গায় প্রহরী হিসেবে মোতায়েন রেখে আবু সুফিয়ানের অপেক্ষায় থাকলেন।
আবু সুফিয়ান মদিনার মুনাফেকদের মারফত এই খবর জানতে পেরে বদরের পথ ছেড়ে নতুন পথে মক্কায় যেতে লাগল এবং জমজম নামে একজন কুরাইশ দূতকে দ্রুতগামী একটা উটে মক্কায় পাঠিয়ে দিল। দূত আবু জেহেলকে জরুরি খবর দিল যে আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে হামলা করার জন্য মুহাম্মদ (সা.) বদরে উপস্থিত হয়েছেন। মক্কা থেকে যথেষ্ট সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র না পাঠালে আবু সুফিয়ানের রক্ষা থাকবে না।
এই খবর পাওয়া মাত্র আবু জেহেল মক্কার কুরাইশদের ডেকে এই বিপদের কথা জানাল এবং তৎক্ষণাৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসার আহ্বান জানাল।
আবু জেহেলের কথা শুনে তার কথা যাচাই না করেই মক্কার কুরাইশরা এক হাজার যোদ্ধা আবু জেহেলের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রওয়ানা দিল। তাদের মধ্যে একশ অশ্বারোহী, সাতশ উষ্ট্রারোহী ও দুইশত পদাতিক। এই সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি ছিল সত্তর বছর বয়স্ক আবু জেহেল।
এই খবর পেয়ে নবী করিম (সা.) খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন। তখন তাঁর উপর আয়াত নাযিল হল, “আর তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর তাহাদের সঙ্গে যাহারা তোমাদের সঙ্গে প্রবৃত্ত হয় এবং সীমা লঙ্ঘন করিও না। কারণ সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। আর তাহাদের যেখানে পাও হত্যা কর অথবা তাহাদিগকে বহিষ্কার কর যে স্থান হইতে তাহারা তোমাদিগকে বাহির হইয়া যাইতে বাধ্য করিয়াছিল। আর দুষ্কৃতি হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।” [সূরা বাকারা, আয়াত ১৯০-১৯১, পারা ২]
আল্লাহতায়ালার এই নির্দেশে মুসলমানদের মনে সাহস সঞ্চার হল।
নবী করিম (সা.) তাঁদের সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন, “এই জিহাদ শুধু আল্লাহর পথে আল্লাহর উদ্দেশ্যে, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। যে যুদ্ধ প্রভুত্ব, রাজ্য বিস্তার, ধন-সম্পদ লাভ বা বাহাদুরি দেখাবার জন্য করা হয়, সেটা জিহাদ নয়। একমাত্র আল্লাহর কালামকে জয়যুক্ত করা এবং বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করার জন্য ও কাফেরদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যই জিহাদ। নিজেকে ও নিজের ধর্মকে রক্ষার জন্য জিহাদ, অন্যকে আক্রমণ করার জন্য নয়। জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধে যারা নিহত হন, তাদেরকেই বলে শহীদ। আর যারা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসেন তাদেরকে বলে গাজী।”
ওদিকে কুরাইশ বাহিনী অর্ধেক রাস্তা আসার পর আবু সুফিয়ানের দ্বিতীয় দূত এসে আবু জেহেলকে বলল, “আৰু সুফিয়ানের কাফেলা মুহাম্মদ (সা.)-এর লোক-লস্করকে এড়াইয়া ভিন্ন পথে নিরাপদে মক্কায় ফিরে যাচ্ছে। কাজেই তাকে আর সাহায্য করার জন্য আপনাদেরকে যেতে হবে না।”
এই খবর পেয়ে কুরাইশ বীরদের অনেকে নিরুৎসাহ হয়ে ফিরে যেতে মনস্থ করল। কিন্তু আবু জেহেল ও অন্যান্য নেতৃবৃদ্ধ বলল, আমরা যখন এত কষ্ট করে বদরের কাছাকাছি চলে এসেছি তখন মদিনার মুসলমানদেরকে শায়েস্তা না করে মক্কায় ফিরে যাব না। মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে কতই বা লোক-লস্কর আছে? অস্ত্রশস্ত্রই বা কত আছে? যুদ্ধ করতেই বা কয়জন জানে? কাজেই এই সুযোগ ছাড়া হবে না। এখান থেকে ফিরে গেলে আমাদেরই আত্মীয়স্বজনরা আমাদিগকে কাপুরুষ বলবে। আর আমরা যে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁহার লোক-লস্করকে পরাজিত করব সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।”
নেতৃবৃন্দের কথা শুনে আর কেউই বদরে যেতে আপত্তি করল না। একসময় তারা এসে নবী করিম (সা.) যেখানে শিবির স্থাপন করেছিলেন তারই কিছুটা দূরে শিবির স্থাপন করল।
নবী করিম (সা.) যেদিকে তাঁবু গেড়েছিলেন, সে দিকটা ছিল বালুকাময়। আল্লাহর কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। একসময় হঠাৎ মেঘে ঢেকে গিয়ে প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। মুসলমানরা সেই পানি মশকে ভরে রাখল পান করার জন্য ও অজু করার জন্য। বৃষ্টির ফলে মুসলমানদের শিবিরের ধুলা-বালি বসে গেল। অপর দিকে কুরাইশদের শিবির কাদা হয়ে তাদের চলাচলের অসুবিধা সৃষ্টি হল।
পরের দিন ভোরে কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য তৈরি হল। নবী করিম (সা.)ও যুদ্ধের জন্য ব্যূহ রচনা করলেন। তাদেরকে যা কিছু উপদেশ দিয়ে নিজের শিবিরে ঢুকে আল্লাহ পাকের দরবারে মুনাজাত করলেন, “হে আমার প্রভু! আমার সঙ্গে তুমি যে ওয়াদা করেছিলে তা পূর্ণ কর। এই মুষ্টিমেয় সত্যের সৈন্যদলকে তুমি বাঁচিয়ে রাখ। ইহারা যদি আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে দুনিয়ায় তোমার নামের মহিমা প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে।”
এই প্রার্থনার উত্তরে আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.)-কে আশ্বাসবাণী শোনালেন। হযরত নবী করিম (সা.) হাসিমুখে বেরিয়ে এসে হযরত আবুবকর (রা.)-কে ডেকে বললেন, “তুমি সৈন্যদের মধ্যে প্রচার করে দাও, শত্রুরা পরাজিত হবে এবং পালিয়ে যাবে।”
হযরত আবুবকর (রা.) কথাটা প্রচার করার ফলে মুসলমান সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ করার মনোবল হাজারগুণ বেড়ে গেল।
তখনকার দিনে যুদ্ধের নিয়ম ছিল, এক দলের বাছাই করা বীর আর অন্য এক দলের বাছাই করা বীরকে সম্মুখযুদ্ধে ডাক দিত। সে সময় আজকালের মতো কামান, বন্দুক, রকেট এসব ছিল না। আচমকা কেউ বোমা ফেলে দিয়ে পালাত না। তখন যুদ্ধ হত ঢাল-তলোয়ার আর তীর- ধনুক ও বল্লম দিয়ে। সম্মুখ যুদ্ধে একজন নিহত হলে আবার একজন এগিয়ে আসত শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য।
প্রথমে কুরাইশদের পক্ষ থেকে তিনজন মহাবীর, ওত্ত্বা, তার ভাই শায়বা এবং ওলিদ হুংকার দিয়ে এগিয়ে এসে বলতে লাগল, “ওরে কাপুরুষ মুসলমানগণ কার এমন বুকের পাটা আছে আয় তো দেখি। দেখি তোদের আল্লাহর কত ক্ষমতা। কেমন করে আজ তোরা রক্ষা পাস দেখব।”
হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে মুসলমানদের সেনাপতি। তিনি কুরাইশদের হুংকার স্তব্ধ করার জন্য মুজাহিদদের মধ্যে থেকে হযরত হামজা (রা.), হযরত ওবায়দা (রা.) ও হযরত আলী (রা.)-কে এগিয়ে যাবার আদেশ দিলেন।
তাঁর সিংহবিক্রমে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মুহূর্তের মধ্যে হযরত আলী (রা.)-এর এক আঘাতেই ওলিদের মাথা কেটে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে হযরত হামজা (রা.) ওত্ত্বাকে হত্যা করলেন। হযরত ওবায়দা (রা.) শায়বাকে নিহত করলেন বটে, কিন্তু শায়বার তরবারির আঘাতে তিনিও গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং তাঁবুতে নিয়ে আসার অল্পক্ষণের মধ্যে শাহাদাত লাভ করেন। ইতিমধ্যে কুরাইশদের সেনাপতি আবু জেহেল, মুয়াজ ও মায়াজ নামে দুটো কিশোরের হাতে নিহত হল। কুরাইশরা হায় হায় করে উঠল, তারপর বিপুল বিক্রমে মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালাল।
এবার মুসলমানদের উপর আল্লাহর সাহায্য নেমে এল। সবুজ পাগড়িধারী বহু সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য মুসলমানদের হয়ে যুদ্ধ করলেন। ইনারাই ছিলেন আল্লাহর ফেরেশতা। মুসলমানদের প্রথম এই জিহাদে আল্লাহপাক যে সাহায্য করেছিলেন সে কথা কুরআনপাকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, “প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন অথচ তোমরা ছিলে শক্তিহীন-দুর্বল।”[ সূরা আল ইমরান, আয়াত ১২৩, পারা ৪] যুদ্ধের এই দৃশ্য দেখে কাফেররা পালাতে লাগল এবং অবিলম্বে তাহাদের চূড়ান্ত পরাজয় হল।
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে ১৭ জন মুজাহিদ শহীদ হন। অপরপক্ষে কুরাইশ নেতাদের ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। তারা মুসলমানদের কাউকে বন্দি করতে পারেনি। যুদ্ধে মুসলমানরা ১৫০টি উট, ঘোড়া ও প্রচুর পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও অস্ত্রশস্ত্র গণিমতের মাল হিসেবে লাভ করেছিলেন। এভাবে কুরাইশরা পরাজিত হবে, তা তারা কল্পনাও করেনি।
বদর যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মুসলমানরা এবার একটা শক্তিশালী জাতি হিসেবে দুনিয়ায় প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করল।
যুদ্ধের পরে কাফের বন্দিদিগকে মদিনায় নিয়ে আসা হল। তারপর তাদের কাছ থেকে অবস্থা অনুযায়ী মুক্তিপণ নিয়ে, কাউকে বিনা মুক্তিপণে আবার কাউকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হল।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিবাহ
হিজরি দ্বিতীয় সালে বদরের যুদ্ধ হয় রমজান মাসে। আর নবী দুলালী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে হয় জিলহজ মাসে হযরত আলী (রা.)-এর সাথে। তাঁকে ছোটবেলা থেকে নবী করিম (সা.) মানুষ করেন। হযরত আলী (রা.)-এর বিষয়-সম্পত্তি বা টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না। নিজের সম্বল বলতে একটা লোহবর্ম ছিল। সেটা হযরত ওসমান (রা.)-এর কাছে বিক্রি করে সেই টাকায় বিয়ের কিছু জিনিসপত্র কেনেন এবং মোহরানা আদায় করেন।
নবী করিম (সা.) নিজের মেয়ের বিয়েতে দড়ি দিয়ে বোনা একটা চারপায়া দুটো ইয়ামনী চাদর, দুটো খেজুর পাতা ভরা তোষক, দুটো রুপোর বাজুবন্দ, একটা বালিশ, একটা কম্বল, একটা পেয়ালা, দুটো গম পিষার যাঁতা ও দুটো মাটির কলসি দেন। এই বছরেই মুসলমানদের উপর রোযা ফরয হয় আর সেই সাথে জামাতে ঈদুল ফিতরের নামায ও ফিতরা- সাদকা দেবার হুকুম হয়।
ওহুদের যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধে হেরে গিয়ে কুরাইশরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা স্বামীকে ও অন্যান্য সর্দারদের প্রতিহিংসা নানাভাবে জাগিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। তার পিতা ওৎবার মৃত্যুতে সে ভীষণ ব্যথা পেয়েছিল। পিতৃহন্তা হযরত হামজা (রা.)-এর রক্ত পান করার প্রতিজ্ঞা করল।
কিন্তু খ্যাতনামা নেতারা বদর যুদ্ধে মারা যাওয়ায় কুরাইশ সৈন্যদের সেনাপতির ভার পড়ল আবু সুফিয়ানের উপর। আবু সুফিয়ান ৩০০০ (তিন হাজার) সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণ করার জন্য রওয়ানা হল। তাদের মধ্যে ৭০০ বর্মধারী, ২০০ অশ্বারোহী অবশিষ্ট উষ্ট্রারোহী ও পদাতিক
নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম চাচা হযরত আব্বাস (রা.) তখনও ইসলাম গ্রহণ না করলেও সব সময় হযরত (সা.)-এর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি তখন মক্কায় ছিলেন। কুরাইশদের মদিনা আক্রমণের বিশাল আয়োজন দেখে একখানা চিঠিতে সব কিছু জানিয়ে একজন বিশ্বস্ত দূতকে মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে আল্লাহপাক ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আ.)-কে পাঠিয়ে এই খবর নবী করিম (সা.)-কে জানিয়ে দিলেন।
নবী করিম (সা.) সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে কুরাইশদের প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কুরাইশরা ওহুদ প্রান্তরে শিবির করেছে জানার পর তিনি মাত্র এক হাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত হলেন। এদের মধ্যে মুনাফিকদের দলপতি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ সৈন্য নিয়ে সরে পড়ল। সে কিছুতেই যুদ্ধে যেতে রাজি হল না। ফলে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ৭০০। তাদের মধ্যে ১০০ জনের ছিল বর্ম আর মাত্র দুটো অশ্ব।
নবী করিম (সা.) জুমার নামায পড়ে তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন। ওহুদ পাহাড়কে পিছনে রেখে ব্যূহ রচনা করলেন। আর তাঁদের পশ্চাৎদিক রক্ষা করার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.)-এর নেতৃত্বে ৭০ জন দক্ষ তীরন্দাজ সৈন্যকে একটা গিরিপথের মুখে মোতায়েন করলেন। তাঁদেরকে নির্দেশ দিলেন যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পরেও পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তাঁরা যেন নিজের স্থান থেকে কোনো কারণেই পরিত্যাগ না করে। পাহাড়ের উপরের ঘাঁটি পথ রক্ষার ভার নিলেন নিজে, ডান দিকের পরিচালনার ভার দিলেন হযরত জোবায়ের ইবনে আওয়াস (রা.)-কে, বাম দিকের রক্ষার ভার দিলেন হযরত মুনজের ইবনে আমের (রা.)-এর উপর এবং বাহিনীর মূল পতাকাধারী নিযুক্ত করলেন মোসহাব ইবনে উমাইর (রা.)-কে।
যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের নিশান হাতে মহাবীর তালহা এগিয়ে এসে বলল, “আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো মুসলমানদের মধ্যে কেউ আছে কি?”
তার কথা শুনে হযরত আলী (রা.) এগিয়ে এসে বললেন, “এই যে আমি আছি।”
ওনার কথা শুনে তালহা তাঁকে আক্রমণ করল। হযরত আলী (রা.) তাহা ঢালে প্রতিরোধ করে তরবারির এক আঘাতেই তালহাকে যমালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। সাথে সাথে তালহার ভাই ওসমান ছুটে এসে পতাকা ধরল। হযরত হামজা (রা.) তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন।
কুরাইশরা চিন্তা করল, এভাবে তারা মুসলমানদের সঙ্গে পারবে না। তাই এবার একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসলমানদের উপর। উহ! সে কী ভীষণ যুদ্ধ। একদিকে অস্ত্র বলে বলীয়ান তিন হাজার সৈন্য আর অন্যদিকে মাত্র সাতশ সৈন্য। তাও আবার প্রায় নিরস্ত্র, কিন্তু কম হলে কী হবে মুসলমানরা ঈমানের বলে বলীয়ান। হযরত হামজা (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আবু দোজানা (রা.) এবং আরও অনেক বীরের তরবারির মুখে কচুগাছের মতো কাফেরদের কল্লা কাটা যেতে লাগল।
অবস্থা বেগতিক দেখে কুরাইশদের সৈন্যরা যে যেদিকে পারল জান নিয়ে পালাতে শুরু করল। সেনাপতি আবু সুফিয়ান শত চেষ্টা করেও সৈন্যদের একত্র করতে পারল না।
এদিকে কুরাইশদের নিশ্চিত পরাজয় দেখেও তাদের ভেড়ার পালের মতো পালাতে দেখে মুসলমান সৈন্যরা আনন্দে যুদ্ধের কথা ভুলে শত্রুদের ফেলে যাওয়া মাল-মাত্তা জমা করতে লেগে গেল।
নবী করিম (সা.) যাঁদেরকে মুসলমানদের পিছনের গিরিপথ রক্ষার ভার দিয়ে বলেছিলেন, “আমার নির্দেশ ব্যতীত কোনো অবস্থাতেই তোমরা এই ঘাঁটি ছেড়ে যাবে না”, তারা যখন দেখলেন, সবাই গণিমতের মাল জমা করছে তখন তারাও নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশ ভুলে শত্রুদের মালপত্র জমা করতে লাগলেন। সেখানে মাত্র বারোজন সৈন্য ও দলপতি আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) রইলেন। তিনি অন্যদের বারবার নিষেধ করেছেন। কিন্তু তারা শোনেননি।
কুরাইশদের অন্যতম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিল খুব বিচক্ষণ। সে ব্যাপারটা লক্ষ করে অতি দ্রুত তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঐ গিরিপথ দিয়ে পিছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করল। উক্ত বারোজন ঘাঁটিরক্ষক প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। এই অবস্থা দেখতে পেয়ে পলায়নপর শত্রু সৈন্যরা ফিরে এসে মুসলমানদেরকে সামনে থেকে আক্রমণ করল। ফলে মুসলমানরা সামনে-পিছনে দু’দিকের শত্রুদের মাঝখানে পড়ে গেলেন। তাদের উপর নেমে এল বিপর্যয়। নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করার ফল হাতে হাতে ফলল।
হযরত হামজা (রা.) যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলেন। সেই সাথে ইসলামের পতাকাবাহী হযরত মোসয়াব বিন উমায়ের (রা.) শহীদ হলেন। এই সময় শত্রুপক্ষের একজন চিৎকার করে বলল, “মুহাম্মদ নিহত হয়েছেন।” ফলে মুসলমানদের মনোবল ভেঙে গেল। ঠিক এই সময়ে কাব ইবনে মালেক (রা.) দূর থেকে নবী করিম (সা.)-কে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “মুসলিম সৈন্যগণ তোমাদের জন্য সুসংবাদ আমাদের নবী (সা.) জীবিত আছেন।”
এদিকে নবী করিম (সা.)-কে হযরত আলী (রা.), হযরত আবুবকর (রা.) এবং আরও নয়জন সাহাবী চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছেন, যাতে তাঁর পবিত্র দেহে যেন কেউ আঘাত করতে না পারে। শত্রুদের সমস্ত আঘাত নবী করিম (সা.)-কে আড়াল করে ওনারা নিজেরা গ্রহণ করেছেন।
কাফেররা মরিয়া হয়ে নবী করিম (সা.)-এর দিকে তীর ও পাথর ছুঁড়তে লাগল। হঠাৎ একজন কাফেরের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে নবী করিম (সা.)-এর দুটো পবিত্র দাঁত শহীদ হয়ে গেল। ঠিক এই সময়ে নরপিশাচ ইবনে কুমাইয়া নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র চেহারা লক্ষ্য করে তরবারির আঘাত করল। ফলে ওনার পরিহিত লৌহবর্মের দুটো পেরেক কপালে ঢুকে গেল। আঘাতের প্রচণ্ড ধাক্কায় তিনি একটা পাহাড়ের গর্তে কাত হয়ে পড়ে গেলেন।
হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররা (রা.) দৌড়ে এসে দাঁত দিয়ে কামড়ে হুজুর (সা.)-এর কপাল থেকে পেরেক দুটো তুলে ফেললেন। পেরেক দুটো তোলার সময় তাঁরও দুটো দাঁত ভেঙে গেল। হুজুর (সা.)-এর জখমের জায়গা থেকে রক্ত পড়তে লাগল। সেই অবস্থায় মুসলমান সৈন্যদের ভুলের জন্য নবী করিম (সা.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, আমার জাতিকে তুমি মাফ করে দাও। কারণ তারা অবুঝ, তারা জানে না তারা কী করেছে।” আল্লাহপাক তাঁর হাবিবের দোয়া কবুল করে তাঁদের ক্ষমা করলেন। নেমে এল আল্লাহর সাহায্য। মুসলমানরা তাদের হারানো জোশ, সাহস ও শক্তি ফিরে পেল। একজন জীবন উৎসর্গকারী সাহাবী নবীজী (সা.)-কে নিয়ে পাহাড়ের ওপারে চলে গেলেন। অন্যরা প্রাণপণে কাফেরদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগলেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যুদ্ধের মোড় মুসলমানদের পক্ষে ঘুরে গেল। নবী করিম (সা.)-এর মৃত্যুর গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় মুসলমান সৈন্যরা নবউদ্যমে দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তাই দেখে কুরাইশ সৈন্যরা আর অগ্রসর হতে সাহস করল না। তারা ফিরে গেল। কোনো পক্ষেরই জয়-পরাজয় হল না।
এই যুদ্ধে আল্লাহপাক মুসলমানদের শিক্ষা দিলেন যে, যুদ্ধের ময়দানে নেতার আদেশ না মেনে যারা নবী করিম (সা.) নির্দেশ ভুলে যায়, যারা পার্থিব ধন-সম্পদের মোহে আপন কর্তব্য পালন করে না, যারা বিপদে ধৈর্য ধরে না, যারা একতাবদ্ধ না থাকে, তাদের পরিণতি এমনই হয়। ভবিষ্যতের জন্য মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার এটা সাবধান বাণী।
এই যুদ্ধে হযরত হামজা (রা.) ও হযরত মোসয়াব বিন উমায়ের (রা.)সহ মোট সত্তরজন মুসলমান শহীদ হন এবং প্রায় সকলেই কমবেশি জখম হন। আর পৌত্তলিক কুরাইশ রমণীরা ইসলামের শহীদদের লাশের প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল, তা জানলে যে কেউ শিউরে উঠবে। কাফের রমণীরা শহীদদের লাশ থেকে হাত-পা, নাক-কান কেটে নিয়ে গলার মালা বানিয়েছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দা হযরত হামজা (রা.)- এর লাশের বুক ফেঁড়ে কলজে বের করে রাক্ষসীর মতো চিবিয়ে খেয়েছিল। উহ! কী নিষ্ঠুর আচরণ।
ইহুদীদের ষড়যন্ত্র
চতুর্থ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে বনি নজির ইহুদী কাবিলার সর্দার আমর ইবনে উন্মিয়া মুসলমানদের সাথে পূর্বশর্ত ভঙ্গ করে নবী করিম (সা.)-এর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। নবী করিম (সা.) সে কথা জানতে পেরে তাদের মহল্লায় গিয়ে আমর বিন উম্মিয়াকে বললেন, “আমাদের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েও শত্রুতায় লিপ্ত হওয়া কি ভালো কথা?”
আমর ইবনে উম্মিয়া নবী করিম (সা.)-কে তাঁর সহচরদেরসহ একটা পাঁচিলের পাশে বসিয়ে বলল, “আমরা আপনার কথার জবাব একটু পরে দেব”, বলে ভিতরে চলে গেল। ভিতরে গিয়ে কাবিলার অন্যান্য লোকদের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করল হযরত মুহাম্মদ (সা.) সহচরদের নিয়ে যেখানে বসে আছেন, সেখানে উপর থেকে পাথর গড়াইয়া তাঁদেরকে হত্যা করবে। এমন সময় আল্লাহপাক হযরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দুশমনদের দুরভিসন্ধির কথা জানিয়ে দিলেন। নবী করিম (সা.) তাড়াতাড়ি সহচরদের নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং পরে তাদের উপর আক্রমণ করে সমুচিত শাস্তি দেন।
বীরে মাউনার ঘটনা
চতুর্থ হিজরি সালেই নজদের কাবিলার সর্দার আবুবরাহ দুটো উট ও দুটো ঘোড়া উপঢৌকনসহ নবী করিম (সা.)-এর নিকট এসে বলল, “আমাদের কাবিলার লোকেরা ইসলামের শিক্ষায় মুগ্ধ হয়েছে। তারা সবাই মুসলমান হতে চায়। আপনি যদি মেহেরবানী করে কয়েকজন ভালো ও জ্ঞানী লোককে ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমার সঙ্গে পাঠান, তাহলে আমরা খুব খুশি হব।”
নবী করিম (সা.) বললেন, “নজদের লোকদের দ্বারা আমাদের অনিষ্টের আশঙ্কা করি।”
আবু বারাহ বলল, “আমি ওই কাবিলার সর্দার। ওনাদের জীবন রক্ষার দায়িত্ব আমার। আমার উপর কেউ কিছু করতে পারবে না। আপনি কিছু ভাববেন না।”
তার কথা শুনে সত্তরজন আনসার তার সাথে যেতে রাজি হলেন। কী করবেন না করবেন নবী করিম (সা.) চিন্তা করছিলেন। আনসারদের আগ্রহ দেখে মত দিলেন।
আবু বরাহ মুসলমানদের হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করে এসেছিল। সে সত্তরজন আনসারদের নিয়ে যখন ‘বীর মাউনা’ নামে একটা নির্জন জায়গায় পৌঁছাল তখন আমের ইবনে মালহাম নামে একজন লোক তার বিরাট বাহিনী নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আনসাররা ছিলেন নিরস্ত্র-অসহায়। তাই প্রায় সবাই শহীদ হয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে মাত্র দুজন সাহাবী পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছিলেন। এই ঘটনায় হযরত নবী (সা.) মনে এত বেশি ব্যথা ও আঘাত পেয়েছিলেন, অত ব্যথা ও আঘাত তিনি জীবনে আর কখনও পাননি।
ইহুদীদের মদিনা থেকে বহিষ্কার
মদিনার ইহুদীরা শিক্ষিত, ধনী ও জমিদার শ্রেণীর লোক। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাদের হাতে। তারাই ছিল মদিনার সভ্য এবং সমাজের নেতা। অন্যরা বেশিরভাগ ছিল গরিব। তারা ওইসব ইহুদীদের নির্দেশমতো চলত এবং তাদের জমিতে খেটে খেত। অভাবের সময় তাদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিত। টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তাদের জমি-জায়গা, ঘর-বাড়ি এমনকি ছেলে-মেয়ে-বউ পর্যন্ত বন্ধক দিতে হত। শুধু তা-ই নয়, অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারে ইহুদীরা সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
ইসলামের আবির্ভাবে নবীজি (সা.)-এর শিক্ষায় সেই সব সাধারণ মানুষ যখন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করল তখন ইহুদীদের মাথা খারাপ হয়ে গেল। ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধনীরা গরিবদের সাহায্য করার ফলে তারা ক্রমশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখলেন। তাদের স্বভাব চরিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। তা ছাড়া ইহুদীরা যে বারবার আল্লাহর নাফরমানি করেছে, নবী (সা.)-দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কোনো কোনো নবী (আ.)-কে হত্যা করেছে, সেসব কথা আল্লাহপাক অহির মাধ্যমে প্রকাশ করে দিলেন। ফলে ইহুদীরা মুসলমানদের উপর ক্ষেপে গিয়ে একজোট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। এমনকি গোপনে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল।
আল্লাহর অসীম রহমতে সর্বক্ষেত্রেই ইহুদীরা বিফল হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। দয়ালু নবী করিম (সা.) তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে বললেন, “তোমরা আর মদিনায় থাকতে পারবে না। তোমরা তোমাদের টাকা-কড়ি ও ধন-দৌলত নিয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে যাও।”
শেষমেশ ষড়যন্ত্রকারী বনু কায়নুকা ও বনু নাজির দুই শক্তিশালী ইহুদী গোত্রের সকলে মদিনা ছেড়ে সিরিয়ায় চলে গেল। তাদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি নবী করিম (সা.) পরে মুহাজিরদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। ফলে মক্কার মুহাজিররা সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হল।
খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ
খন্দকের যুদ্ধের কতকগুলো কারণ ছিল। ওহুদ যুদ্ধে কুরাইশ কাফেররা দৃশ্যত জয়লাভ করলেও তাদের আসল উদ্দেশ্য সফল হয়নি। প্রথমত, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, মদিনাকে মক্কার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রতিরক্ষার কোনো সৈন্যবাহিনী মদিনায় রেখে যেতে পারেনি। তৃতীয়ত, তাদের বাণিজ্য পথের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হল না। যার ফলে ওহুদ যুদ্ধের পর কয়েক মাসের মধ্যে মদিনার মুসলমানরা আবার নিজেদেরকে সুসংগঠিত করে আগের থেকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন।
মুসলমানদের এই শক্তিবৃদ্ধিতে মক্কার কুরাইশরা শেষবারের মতো তাদের সাথে লড়াই করার জন্য সব দিক থেকে প্রস্তুতি নিল। মদিনা থেকে যেসব ইহুদী বিতাড়িত হয়েছিল তারাও কুরাশইদের সঙ্গে যোগ দিল। যার ফলে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে প্রায় বার হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণ করার জন্য রওয়ানা হল। তাদের সাথে ঘোড়া, উট ও বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ছিল।
নবী করিম (সা.) এই খবর পেয়ে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করা ঠিক হবে না। কারণ এত বড় বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের তিন হাজার সৈন্য খুবই সামান্য।
পারস্যবাসী হযরত সালমান ফারসি (রা.)-এর পরামর্শে মদিনার তিন দিকে গভীর পরিখা (খাল) খনন করা হল। বাকি একদিকে পাহাড় থাকায় সেদিকে পরিখা খনন দরকার হল না। মদিনার সকল মুসলমান পরিখা খননের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। এমনকি নবী করিম (সা.)ও এই কাজে শরিক হয়েছিলেন। পরিখা খননের কাজ শেষ করে মদিনাবাসীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে তাদেরকে পাহারায় নিযুক্ত করা হল। তারপর মুসলিম সৈন্যরা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য পরিখার তীরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
মক্কার কুরাইশ সৈন্যরা মদিনার উপকণ্ঠে এসে মদিনা রক্ষার এই অভিনব কৌশল দেখে অবাক হয়ে গেল। তারা পরিখা পার হয়ে আক্রমণ চালাতে না পেরে ২৭ দিন মদিনা অবরোধ করে রাখল। এর মধ্যে যতবার তারা পরিখা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে, ততবারই মদিনার পরিখার সীমানার মুসলিম সৈন্যরা পাথর ও তীর ছুঁড়ে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। হঠাৎ একদিন আল্লাহর কুদরতে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। ঝড়ে দাপট সহ্য করতে না পেরে আবু সুফিয়ান অবরোধ তুলে নিয়ে মক্কায় ফিরে গেল। এই যুদ্ধ ইতিহাসে খন্দকের (পরিখার) যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই যুদ্ধের আগে ও পরে আরও কয়েকটা ছোটখাটো যুদ্ধ কুরাইশদের সঙ্গে মুসলমানদের করতে হয়েছে। যেমন বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ, খায়বরের যুদ্ধ, মুতার যুদ্ধ ইত্যাদি। তবে খন্দকের যুদ্ধের ফলে মক্কার কাফের কুরাইশদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার খায়েশ মিটে গিয়েছিল।
হুদায়বিয়ার সন্ধি
খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর হয়ে গেল নবী করিম (সা.) ও তাঁর অনুসারীরা মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেছেন। ওই ছয় বছর তাঁরা কা’বা শরীফ জিয়ারত করেননি। এমনকি প্রিয় জন্মভূমিতে যাননি। এ বছর মক্কায় জন্মভূমিতে যাবার জন্য ও কা’বা শরীফ জিয়ারত করার জন্য তাঁদের মন বিচলিত হয়ে উঠল। নবী করিম (সা.)-এরও সেরূপ ইচ্ছা জাগল। তাই তিনি সবাইকে সে কথা জানিয়ে বললেন, “আমরা এ বছর হজ করতে মক্কায় যাব। তবে সঙ্গে কেউ কোনো প্রকার অস্ত্র নিতে পারবে না।” প্রতি বছর হজের সময় মক্কায় ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকত। তখন যে যার খুশিমতো মক্কায় যেতে পারত। কেউ কাউকে বাধা দিত না। কারণ হজের মাসকে তারা পবিত্র মনে করত। কা’বা আল্লাহর ঘর। সেই ঘর জিয়ারত করার অধিকার সকলের। এই সময় শত্রু-মিত্র সব সমান। আর এই নিয়ম সকলেই মেনে চলত। তাই এই সুযোগে নবী করিম (সা.) ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে প্রায় ১৫০০ ভক্ত সাহাবী নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় হজ করার জন্য রওয়ানা দিলেন। কুরবানির জন্য ৭০টি উটও নিলেন।
নবী করিম (সা.)-এর হজ করতে আসার কথা ঠিক সময়ে মক্কায় পৌঁছে গেল। ওই সময়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিষেধ জানা সত্ত্বেও তারা সিদ্ধান্ত নিল, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের মক্কায় আসতে দেয়া হবে না। সে জন্যে খালিদ ও ইকরামা দুইশ সৈন্য নিয়ে তাঁদেরকে বাধা দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
দুই মঞ্জিল আসার পর নবী করিম (সা.) ওসফান নামক জায়গায় পৌঁছেই খবর পেলেন, কুরাইশরা যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসছে। এই খবর পেয়ে তিনি ভিন্ন পথ ধরে শত্রুর চোখ এড়িয়ে মক্কা থেকে নয় মাইল দূরে হোদায়বিয়া নামক জায়গায় এসে তাঁবু গাড়লেন।
কুরাইশরা যখন এই কথা শুনল তখন তাঁরা পিছিয়ে এল নগর রক্ষা করার জন্য। তারা ভেবেছিল, এতক্ষণ হয়তো মুহাম্মদ (সা.) মক্কা আক্রমণ করে বসেছেন।
মক্কার ‘খোজা’ সম্প্রদায় পৌত্তলিক হলেও সব সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তাঁর আসার কথা শুনে এই গোত্রের সর্দার বোদায়েল নিজের গোত্রের কয়েকজন প্রতিনিধিসহ হোদায়বিয়ায় এসে নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করে বলল, কুরাইশরা আপনাদেরকে কিছুতেই মক্কায় ঢুকতে দেবে না। তাই তারা যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। এখন আপনি কী করবেন?
বোদাইলের কথা শুনে নবী করিম (সা.) মর্মাহত হয়ে বললেন, “তুমি গিয়ে কুরাইশদের বল, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, এসেছি হজ করার জন্য। হজ করে আমরা ফিরে যাব। এতে তারা যেন বাধা না দেয়। “
বোদাইল মক্কায় গিয়ে নবী করিম (সা.) যা বলতে বলেছিলেন, কুরাইশ নেতাদের সেসব বলল। তার কথা কুরাইশরা হেড়ে উড়িয়ে দিল।
অতঃপর নবী করিম (সা.) প্রথমে খারাজ বিন উমাইয়া (রা.) ও পরে হযরত ওসমান (রা.)-কে শান্তি আলোচনার জন্য মক্কায় পাঠালেন।
হযরত ওসমান (রা.) মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের অনেক বোঝালেন। কিন্তু তারা ওনার কথা না শুনে তাঁকে বন্দি করে রাখল।
এদিকে তাঁর ফিরে আসতে দেরি দেখে মুসলমানরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এরই মধ্যে যখন গুজব ছড়িয়ে পড়ল হযরত ওসমান (রা.)-কে কুরাইশরা হত্যা করেছে তখন তাঁরা যেমন রেগে গেলেন, তেমনি অধৈর্য হয়ে উঠলেন। তখন নবী করিম (সা.) সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “যত দিন আমরা এর প্রতিকার করতে না পারব, তত দিন এখান থেকে আমরা ফিরে যাব না।” কিছুক্ষণ পরে খবর এল যে, ঐ খবর সত্য নয়, হযরত ওসমান (রা.) বেঁচে আছেন।
হযরত ওসমান (রা.)-কে বন্দি করায় অন্যান্য গোত্রের লোকেরা কুরাইশদের উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, ওনাকে যদি না ছাড় এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হজ করতে না দাও, তাহলে আমরা আমাদের দলবল নিয়ে তোমাদেরকে পরিত্যাগ করব।
তাদের কথা শুনে কুরাইশরা দমে গিয়ে হযরত ওসমান (রা.)-কে ছেড়ে দিল। তারপর কুরাইশরা পরামর্শ করে সন্ধি করতে রাজি হয়ে সুহাইল ইবনে আমর নামে তাদের এক নেতাকে পাঠাল।
সুহাইল ইবনে আমর এসে নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করে একটা চুক্তি হল। এই চুক্তিকে হোদায়বিয়ার সন্ধি বলে।
চুক্তির শর্তগুলো হল-
১. মুসলমানরা এবারের মতো হজ না করে ফিরে যাবে।
২. পরের বছর মুসলমানরা হজ করতে আসতে পারবে; কিন্তু মক্কায় তিন দিনের বেশি থাকতে পারবে না। এই তিন দিন কুরাইশরা নগর ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় অবস্থান করবে।
৩. আগামী বছর হজ করতে আসার সময় কেউ যুদ্ধাস্ত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে পারবে না। তবে আত্মরক্ষার জন্য শুধু কোষবদ্ধ তরবারি আনতে পারবে।
৪. মক্কায় যেসব মুসলমান আছে তাদেরকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সঙ্গে করে মদিনায় নিয়ে যেতে পারবেন না।
৫. মদিনার কোনো লোক মক্কায় কুরাইশদের কাছে ফিরে এলে কুরাইশরা তাকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট মদিনায় ফিরিয়ে দেয়া হবে না। কিন্তু মক্কার কোনো লোক যদি মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নেয়, তাহলে তাকে কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
৬. আরবের যে কোনো গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে অথবা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে।
৭. দশ বছরের জন্য কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ স্থগিত থাকবে।
সন্ধিপত্র লেখা হবার পর উভয় পক্ষ স্বাক্ষর করলেন।
নবী করিম (সা.)-এর এই চুক্তিকে অনেক সাহাবী অসম্মানজনক ও ক্ষতিকর বলে মনে করলেন; কিন্তু এই সন্ধিকে যখন আল্লাহপাক কুরআন শরীফে ‘ফতুহাম মুবীন’ উল্লেখ করে অহি নাযিল করলেন তখন তারা ইহার মর্ম বুঝতে পেরে খুশি হয়ে গেলেন। এই চুক্তির ফলে মুসলমানরা মক্কায় যাতায়াত করার সুযোগ পেলেন। কুরাইশদের সঙ্গে মেলামেশা করারও সুযোগ হল। মুসলমানদের আচার-ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষা ও ধর্মভীরুতা ধীরে ধীরে কুরাইশদের মন জয় করে ফেলল। মহাবীর খালিদ আমের ইবনুল আস ও আরও অনেকে মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এইভাবে ইসলামের আলো দিন দিন মক্কায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের কাছে ইসলামের দাওয়াত
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মনোবল দৃঢ় হল। সপ্তম হিজরিতে অনারব রাজা-বাদশাহদের কাছে দূত মারফত ইসলামের মহান বাণী পৌঁছানোর জন্য ধর্মীয় নিমন্ত্রণপত্র প্রেরণ করেন।
১. নবী করিম (সা.) প্রথমে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে সাহাবী দহিয়া কালবী (রা.)-কে ইসলামের দাওয়াতি পত্র দিয়ে প্রেরণ করেন। ওই পত্র রোম সম্রাটের অধীন সিরিয়ার শাসনকর্তা হারেস গাসসনির কাছে দিলে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থানরত সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে পাঠিয়ে দেন।
পত্র পড়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুগ্ধ হন এবং সভাসদগণকে বললেন, “খুঁজে দেখ এই শহরে মক্কার মুহাম্মদের সম্প্রদায়ের কোনো লোক আছে কি না। যদি থাকে তাকে দরবারে নিয়ে এস।”
ঘটনাচক্রে ওই সময় কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্য করতে ঐ শহরে গিয়েছিলেন। বাদশাহর লোক তাকে দরবারে হাজির করল। আবু সুফিয়ান নবী করিম (সা.)-এর আত্মীয় হলেও এক নম্বর দুশমন ছিল, সে কথা আমরা আগেই জেনেছি। কিন্তু রোম সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা বলতে পারল না। যা সত্য তাই বলতে হল। নবী করিম (সা.)-এর পরিচয়, স্বভাব-চরিত্র ও কার্যকলাপ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন সম্রাট।
জবাবে আবু সুফিয়ান বললেন, “হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবের সম্ভ্রান্ত বংশের লোক। তিনি নিজেকে আল্লাহর রাসুল (প্রেরিত পুরুষ) বলে প্রচার করেন। তিনি আরও প্রচার করেন, আল্লাহ এক, তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকেই শরিক কর না। নামায কায়েম কর এবং পরস্পরকে ভালোবাস। তিনি গরিবদের ভালোবাসেন। মিথ্যা, চুরি, দুর্নীতি, ব্যভিচার ও অত্যাচার হতে লোককে বিরত রাখেন। যারা একবার তাঁর ধর্ম গ্রহণ করে তারা জীবন গেলেও আর কখনও পরিত্যাগ করে না। গরিব লোকেরাই বেশি তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেছে।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, “তুমি যদি সত্য বলে থাক, তবে মুহাম্মদ (সা.) নিশ্চয় আল্লাহর রাসুল এবং নিশ্চয় তিনি আমার রাজ্যও পদানত করবেন। শিগগিরই শেষ পয়গম্বরের আবির্ভাব হবে আমি জানতাম; কিন্তু তিনি যে আরবের মক্কা নগরে জন্মাবেন তা জানতাম না। যদি আমি এখন তাঁর নিকট থাকতাম, তাহলে তাঁর পা ধুইয়ে দিতাম।
হিরাক্লিয়াস মনেপ্রাণে ইসলামের প্রতি আস্থা এনেও সভাষদবৃন্দের চাপে বাহ্যিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারেননি।
২. পারস্যের সম্রাট খসরু ছিলেন অগ্নিপূজক। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে হাযাকা (রা.)-কে ইসলামের দাওয়াতের পত্র লিখে তার কাছে পাঠান। তিনি সম্রাটের উজির মুনজের ইবনে মারির দ্বারা ওই পত্র সম্রাট খসরুর কাছে পৌঁছে দেন।
খসরু দাওয়াতি পত্র পড়ে খুব রেগে গেলেন এবং উহা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন।
এই খবর যখন নবী করিম (সা.)-এর কাছে পৌঁছাল তখন তিনি বললেন, “আল্লাহ একদিন খসরুর রাজ্যকেও ওই পত্রের মতো টুকরো টুকরো করে দেবেন।”
নবী করিম (সা.)-এর কথা সত্য হয়েছিল। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সময় পারস্য সাম্রাজ্য মুসলমানরা জয় করে ইসলামের পতাকা উড়িয়েছিলেন।
৩. আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশীর দরবারে নবী করিম (সা.) ইসলামের দাওয়াতি পত্র দিয়ে পাঠিয়েছিলেন উমর ইবনে উম্মিয়া জমিরী (রা.)-কে। তিনি যখন পত্রটি বাদশা নাজ্জাশীর সামনে রাখলেন তখন বাদশাহ সেটা হাতে নিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে চোখে-মুখে ছোঁয়ালেন। তারপর সিংহাসন থেকে নেমে জমিনে এসে প্রকাশ্য রাজদরবারে সমস্ত সভাষদবৃন্দ ও অন্যান্য লোকদের সামনে ঘোষণা করলেন, “নিশ্চয় হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত নবী। আমরা আহলে কিতাবীগণ তাঁহারই আগমনের অপেক্ষায় ছিলাম।” তরপর তিনি নবী করিম (সা.)-এর পত্রের জবাবে লিখলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমি আপনার পাঠানো পত্র পেয়ে আপনার চাচাতো ভাই হযরত জাফর ইবনে আবু তালেবের হাতে হাত রেখে ইকরার করলাম, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ।”
৪. হযরত নবী করমী (সা.) হাতেব (রা.)-কে মিসরের বাদশাহ মুকাউকিসের কাছে ইসলামের দাওয়াতি পত্র দিয়ে পাঠান।
মুকাউকিস প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে না পারলেও তাঁর মন যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পায়ে নিবেদিত করার জন্য অনুপ্রেরিত হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিনয়-নম্র ভাষায় তিনি নবী করিম (সা.)-এর চিঠির উত্তর দিয়াছিলেন এবং বশ্যতা স্বীকার করার নিদর্শন হিসেবে একটা দুষ্প্রাপ্য সাদা ঘোড়া ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় মেরী ও শিরী নামে দু’টি খ্রিস্টান মহিলা উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন।
নবী করিম (সা.) নিজে মেরীকে বিবাহ করলেন এবং শিরীকে কবি হাসমানের সঙ্গে বিবাহ দিলেন। হযরত মেরী (রা.)-এর গর্ভে নবী করিম (সা.)-এর পুত্র ইবরাহিম জন্মগ্রহণ করেন। আর সাদা ঘোড়াটা নিজে ব্যবহার করতেন। ইহার নাম ছিল দুলদুল। ওনার ইন্তেকালের পর হযরত হাসান (রা.) এই ঘোড়া ব্যবহার করতেন।
৫. এরপর ইয়েমেনের বাদশাহ বাহজারের দরবারে ইসলামের দাওয়াতি পত্র লিখে নবী করিম (সা.) সুলাইভ (রা.)-কে পাঠালেন। পত্র পাঠ করে বাদশাহ বাহজার ইসলাম কবুল করা দূরের কথা পত্রের জবাব পর্যন্ত দিল না। সুলাইভ (রা.) ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন।
৬. সিরিয়ার বাদশাহ হারেস ইবনে আবু সমরের দরবারে নবী করিম (সা.) দাওয়াতি পত্র দিয়ে শুজা ইবনে ওয়াহাব (রা.)-কে পাঠালেন। হারেস পত্র পাঠ করে রেগে গিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল।
নবী করিম (সা.) যেসব দাওয়াতি পত্র পাঠিয়েছিলেন, সবগুলোই আরবি ভাষায়। পত্রগুলোতে লেখা ছিল-
‘বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম’
“আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে সত্যের অনুসারীদের প্রতি সালাম। অতঃপর আমি আপনাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করছি। বলুন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসুল।’ ইসলাম কবুল করুন আপনার কল্যাণ হবে। ইসলাম কবুল করলে আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। আর যদি না করেন, তাহলে আপনার বিনাশ ও ধ্বংস অবধারিত!”
প্রত্যেক পত্রের শেষে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের মোহরাঙ্কিত থাকত।
খায়বারের যুদ্ধ
সিরিয়ার প্রান্তরে বিশাল শ্যামল ভূখণ্ডের নাম ছিল খায়বার। মদিনা থেকে খায়বার প্রায় একশ মাইলের পথ। এখানে আগে থেকে ইহুদীরা বসতি স্থাপন করেছিল। বনি কাইনুকা ও বনি নাজীর গোত্রের ইহুদীরা মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। খায়বারের ইহুদীরা এদেরকে দলে ভিড়িয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রয়োজন শুরু করল। ইসলামের চিরশত্রু গফ্ফান গোত্রও ইহুদীদের সঙ্গে যোগ দিল।
প্রথমে ইহুদীরা ছোট ছোট আক্রমণ দ্বারা মুসলমানদের উত্তেজিত করতে লাগল। পরে ‘আমির’ নামে জনৈক ব্যক্তি ইহুদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করল।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন জানতে পারলেন, ইহুদীরা মদিনা আক্রমণ করার আয়োজন করছে তখন তিনি ১৪০০ মুসলমান সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে অগ্রসর হলেন। এই যুদ্ধের প্রধান নায়ক ছিলেন হযরত আলী (রা.)। যুদ্ধে হেরে গিয়ে ইহুদীরা আত্মসমর্পণ করল এবং নবী করিম (সা.)-এর কাছে মাফ চেয়ে প্রতিজ্ঞা করল, ভবিষ্যতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা কখনও অস্ত্র ধরবে না। আর অনুরোধ জানাল অন্যদের মতো তাদেরকে তাড়িয়ে না দিয়ে এখানে যেন থাকতে দেয়া হয়।
নবী করিম (সা.) তাদেরকে শুধু ক্ষমাই করলেন না তাদেরকে নিজ ধর্ম পালন করারও পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। ঘর-বাড়ি, জমি-জায়গা সব ফিরিয়ে দিলেন। তবে একটা শর্ত দিলেন, তাদের উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বর্গা হিসেবে মদিনায় পাঠিয়ে দিতে হবে। শুধু কি তাই? ইহুদীদের সঙ্গে সম্প্রীতি স্থানের জন্য আরও একটা ধাপ অগ্রসর হলেন। কয়েকটি অপরাধে কামুস দুর্গের অধিপতি কেনানার প্রাণদণ্ড হয়। কেনানার স্ত্রী সুফিয়া আগে থেকে ইসলামের অনুরাগিণী ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের খ্যাতি তাকে মুগ্ধ করেছিল। তাই স্বামীর মৃত্যুর পর ইসলাম কবুল করে নবী করিম (সা.)-এর সহধর্মিণী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নবী করিম (সা.) সে কথা জেনে তাকে বিয়ে করেন।
নবী করিম (সা.) ইহুদীদের প্রতি এত মহানুভবতা দেখাবার পরও তারা তাদের হিংসার মনোভাব পরিত্যাগ করল না।
একবার এক ইহুদী সর্দার হারেসের স্ত্রী জয়নাব নবী করিম (সা.)-কে তার বাড়িতে দাওয়াত দিল। তার ইচ্ছা নবী করিম (সা.)-কে নিজের হাতে খাওয়াবে। সে এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল যে, নবী করিম (সা.) দাওয়াত না নিয়ে পারলেন না। কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে সরল বিশ্বাসে দাওয়াত খেতে গেলেন।
ইহুদীনী জয়নাব অতি সুন্দর করে গোশত রান্না করে সবাইকে খেতে দিল। নবী করিম (সা.) একটু গোশত খেয়েই বলে উঠলেন, “এই গোশত তোমরা কেউ খেও না, এতে বিষ মেশানো হয়েছে।” কিন্তু উনি বলার আগে বশর (রা.) নামে একজন সাহাবী দু-এক টুকরা গোশত খেয়ে ফেলেছিলেন। কাজেই তিনি অল্পক্ষণের মধ্যে মারা গেলেন। কিন্তু আল্লাহর কি কুদরত নবী করিম (দ.)-এর কিছুই হল না।
পাপিষ্ঠা জয়নাবকে ডেকে গোশতে বিষ দেয়ার কথা জিজ্ঞেস করা হল। সে স্বীকার করে নবী করিম (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমার কারণে আমার বাবা, দাদা ও স্বামী যুদ্ধে মারা গেছে। তুমি নিজেকে পয়গম্বর বলে দাবি করতেই আমাদের এই সর্বনাশ হয়েছে। আমার ইচ্ছা হল, যদি তুমি সত্যিই পয়গম্বর হও, তাহলে আগেই বিষের কথা জানতে পেরে এই গোশত খাবে না। আর যদি তুমি ভণ্ড পয়গম্বর হও, তাহলে এই বিষ মাখানো গোশত খেয়ে মারা যাবে। তখন আমরা তোমার জ্বালাতন থেকে রক্ষা পাব। এটাই ছিল আমার মতলব। এখন দেখছি তুমি পয়গম্বর নও, ভণ্ড। কারণ গোশতে যে বিষ মেশানো আছে, তা তুমি জানতে না পেরে খেয়েছ, তোমার মৃত্যু অনিবার্য।”
নবী করিম (সা.) মৃদু হেসে বললেন, “জয়নাব তোমার আশা পূর্ণ হবার নয়। আল্লাহর দয়ায় আমি বেঁচে যেতে পারি। এই তো দেখ না আমার একজন সাহাবী এই গোশত খেয়ে মারা গেলেও আমি তো মরি নাই।”
নবী করিম (সা.)-এর কথা শুনে জয়নাবের মনে সন্দেহ হল, তাহলে কি মুহাম্মদ সত্যিই পয়গম্বর? তারপর তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল।
নবী করিম (সা.) ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করলেন; ইচ্ছা করে বশরের মৃত্যু ঘটাইবার অপরাধে বাধ্য হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হল।
মুলতবি হজ
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে সপ্তম হিজরিতে নবী করিম (সা.) মুলতবি হজ আদায় করার জন্য ২০০০ হাজার মুসলমান সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। কুরবানির জন্য ৬০টি উট নেয়া হল।
সন্ধির শর্তানুযায়ী প্রত্যেক মুসলমান মাত্র একখানা তরবারি সঙ্গে নিলেন, তাও কোষবদ্ধ অবস্থায়।
কুরাইশরা এই খবর পেয়ে মুসলমানদের জন্য মক্কা শহর খালি করে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিল।
নবী করিম (সা.) শিষ্যদের নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। মুহাজিরগণ তাঁদের পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর ও পরিচিত জায়গাগুলো দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন; কিন্তু কেউ ঘর-বাড়িতে ঢুকলেন না। বাইরে তাঁবু ফেলে বাস করতে লাগলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ভক্তবৃন্দকে নিয়ে কা’বা ঘরে ঢুকলেন। ছাদের উপর উঠে হযরত বিলাল (রা.) উচ্চকণ্ঠে আজান দিলেন। আজান শুনে মুসলমানরা দলে দলে ছুটে এলেন। হুজুর (সা.) সকলকে নিয়ে জোহরের নামায পড়লেন। তারপর সব মুসলমানদের নিয়ে যথারীতি হজ সমাপন করলেন। সাতবার সাফা ও মারওয়া পবর্ত প্রদক্ষিণ করে সেখানেই কুরবানি দিলেন। সব মুসলমানদের নিয়ে হুজুর (সা.) তিন দিন অবস্থান করে মদিনায় ফিরে এলেন।
কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। নবী করিম (সা.) এই তিন দিন কারও ঘরে না ঢুকলেও কোনো কোনো কুরাইশ নাগরিকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। সেই সূত্রে দূর সম্পর্কের আত্মীয়া এক বিধবা রমণী মায়মুনা (রা.) হযরত (সা.)-কে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠান। হযরত (সা.) তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে তাকে বিয়ে করেন এবং সঙ্গে করে মদিনায় নিয়ে আসেন।
এই বিবাহের ফলে এক আশ্চর্য ফল ফলল। বীর কেশরী খালেদ ছিলেন হযরত মায়মুনা (রা.)-এর আপন বোনের ছেলে। হযরত মায়মুনা (রা.)-এর বিয়ের পরপর খালিদ অপ্রত্যাশিতভাবে মদিনায় গিয়ে নবী করিম (সা.)-এর এর হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। শুধু কি তাই, তিনি আরও দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তিনজনেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এই দুজনের মধ্যে একজন হলেন মক্কার বিখ্যাত কবি আমর ইবনুল আস, অন্যজন কা’বা ঘরের চাবিরক্ষক ওসমান বিন তালহা।
মুতা অভিযান
মুলতবি হজ আদায় করে মদিনায় ফিরে এসে কয়েক জায়গায় দূত মারফত ইসলামের দাওয়াত পাঠান। জামাদিউল আউয়াল মাসে হুজুর (সা.) হারেস ইবনে উমাইর (রা.)-কে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য সিরিয়া পাঠালেন। তিনি যখন মুতা পৌঁছালেন তখন সিরিয়ার খ্রিস্টান শাসনকর্তা শারজিল গাসসানী তাঁকে হত্যা করেন।
এই খবর পেয়ে নবী করিম (সা.) দূত হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ৩০০০ হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী মুতা অভিমুখে পাঠালেন। হুজুর (সা.)-এর আজাদ করা ক্রীতদাস যায়েদ (রা.)-কে এই বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করলেন।
এদিকে সিরিয়ার শাসনকর্তা শারজিল গাসসানি মুসলমানদের অভিযানের কথা শুনে এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে মোকাবিলা করার জন্য রওয়ানা হল।
যখন উভয় পক্ষ সামনাসামনি হল তখন শত্রুপক্ষের বিপুল সংখ্যক সৈন্যবহর দেখে মুসলিম মুজাহিদগণ বললেন, “বিষয়টা নবী করিম (সা.)- কে জানানো দরকার।” কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়া (রা.) বললেন, “তাঁকে জানাবার কী দরকার? আমাদের তো দুটো পথই খোলা রয়েছে, হয় আমরা জয়লাভ করে গাজি হব অথবা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করব।”
এরপর কেউ আর কিছু বললেন না। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ঘোরতর যুদ্ধের ভিতর মুসলিম সেনাপতি যায়েদ ইবনে হারেস (রা.) শহীদ হলেন। সঙ্গে সঙ্গে হুজুর (সা.)-এর অসিয়ত অনুযায়ী জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.) এসে ইসলামের পতাকা ধরলেন। তিনি কিছুক্ষণ শত্রুসেনা নিধন করতে করতে একসময় শাহাদত বরণ করলেন। হুজুর (সা.)-এর অসিয়ত অনুযায়ী এবার সেনা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা:)। তিনিও শত্রুসেনা নিধন করতে করতে শাহাদত বরণ করলেন। এবার তাড়াতাড়ি পরামর্শ করে নও মুসলিম খালিদ বিন ওয়ালিদকে সেনানায়ক মনোনয়ন করা হল। তিনি সমকালীন জগতের সেরা সমর কৌশলী সেনানায়ক ছিলেন। তিনি কৌশল অবলম্বন করে মুসলিম বাহিনীকে নবউদ্যমে বলীয়ান করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং যুদ্ধে জয়লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, এই মুতা যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)- এর যোগ্যতার পুরস্কারস্বরূপ নবী করিম (সা.) তাঁকে ‘সায়ফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তরবারি উপাধি দিয়েছিলেন।
মক্কা বিজয়
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর দু’বছর কেটে গেল। সন্ধির একটা শর্ত ছিল যে, আরবের যে কোনো গোত্র মুসলমানদের সাথে অথবা কুরাইশদের সাথে স্বাধীনভাবে যোগ দিতে পারবে। তাতে কোনো পক্ষই বাধা দিতে পারবে না। এই সন্ধির ফলে মক্কার ‘খোজা’ সম্প্রাদায় মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিল। আর বনি বকর সম্প্রদায় মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে যোগ দিল। বনি খোজা ও বনি বকর গোত্রের মধ্যে আগে থেকে ভীষণ শত্রুতা চলে আসছিল। কাজেই খোজারা মুসলমানদের পক্ষে যোগ দিতে বনি বকররা তাদের উপর খুব রেগে গেল। সেই সাথে কুরাইশরাও খোজাদের উপর রেগে গেল। তারা খোজাদিগকে জব্দ করার জন্য বনি বকরদিগকে উসকে দিল।
‘ওয়াতির’ নামে একটা পল্লীতে খোজা গোত্র বাস করত। একদিন রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন কুরাইশ ও বনি বকর গোত্রের লোকেরা তাদের পল্লী আক্রমণ করে বহু নিরীহ খোজাদের নর-নারীকে হত্যা করল। অনেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য ছুটে গিয়ে কা’বা ঘরে আশ্রয় নিল। কা’বা ঘরের চারদিকের সীমানার মধ্যে মানুষ হত্যা করা নিষেধ সত্ত্বেও পাষণ্ডরা খোজাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল।
এই হত্যাকাণ্ডের পর খোজারা মদিনায় গিয়ে নবী করিম (সা.)-এর কাছে প্রতিকার চাইল।
দয়াল নবী (সা.) খোজাদের অবস্থা জেনে খুব দুঃখ পেলেন। বললেন, “ঠিক আছে আমি এর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।” তারপর সরাসরি কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান না পাঠিয়ে তিনি তাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন।
১. হয় তোমরা বনি খোজা গোত্রকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিকার করবে।
২. নয়তো বনি বকর গোত্রের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
৩. আর দুটো প্রস্তাব যদি মেনে না নাও, তাহলে হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়েছে বলে ঘোষণা দাও।
কুরাইশরা তিনটি শর্তের মধ্যে শেষের শর্তটি গ্রহণ করে দূতকে জানিয়ে দিল আমরা তিন নম্বর শর্ত মেনে নিলাম
দূত মদিনায় ফিরে এসে নবী করিম (সা.)-কে কুরাইশদের কথা জানালেন।
নবী করিম (সা.) বুঝতে পারলেন, যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সে কথা মদিনার সমস্ত মুসলমানদের আহ্বান করে জানিয়ে বললেন, “সুদীর্ঘ একুশ বছর ধরে মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের উপর নানাভাবে জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তিনবার মদিনা আক্রমণ করে আল্লাহর দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। সন্ধি করে সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করেছে। বারবার মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এবার তাদেরকে কোনো সুযোগ দেয়া উচিত নয়। এখন সময় হয়েছে দুশমনদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে সমুচিত জবাব দেয়ার।”
নবী করিম (সা.)-এর এই ঘোষণা শুনে মুহাজির ও আনসারদের নিয়ে এক বিরাট বাহিনী তৈরী হয়ে গেল। তারপর অষ্টম হিজরির দশই রমজান দশ হাজার মুজাহিদের এক সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে নবী করিম (সা.) মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। এই বিরাট সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি হলেন স্বয়ং আল্লাহর নবী (সা.)।
মক্কার উপকণ্ঠে মার-উজ-জাহরান নামক গিরি উপত্যকায় এসে যখন পৌঁছালেন তখন রাত হয়ে গেছে। নবী করিম (সা.) এখানে শিবির স্থাপন করলেন। তারপর সৈন্যরা রান্নার জন্য আগুন জ্বালালেন।
মক্কা থেকে কুরাইশরা এত বিশাল জায়গা জুড়ে আগুন জ্বলতে দেখে হতভম্ব হয়ে ভাবল, নিশ্চয় মুসলমানরা বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা আক্ৰমণ করতে এসেছে। তখন কুরাইশরা দুজন সঙ্গীসহ আবু সুফিয়ানকে খবর দেয়ার জন্য পাঠাল। তারা দূর থেকে মুসলিম বাহিনীর তাঁবুর চারদিকে ঘুরেফিরে দেখতে লাগল। আগুনের শিখার উজ্জ্বল আলোতে মুসলমান প্রহরীরা দূর থেকেই আবু সুফিয়ানকে দেখে চিনে ফেললেন। তারপর তাঁরা বন্দি করে নবী করিম (সা.)-এর কাছে নিয়ে এলেন।
হুজুর পাক (সা.) তাঁর দীর্ঘদিনের পরম শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়ে কিছু বললেন না। বরং ক্ষমা করে নরম সুরে বললেন, “আবু সুফিয়ান, এখনও কি তোমার ভুল ভাঙবে না? এখনও কি তুমি আমাকে আল্লাহর রাসুল বলে স্বীকার করবে না? এখনও কি দেব-দেবীকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে? প্রাণের শত্রুকে ক্ষমা করার এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে বিরল।”
নবী করিম (সা.)-এর কথা শুনে ও এ রকম ক্ষমার মহত্বে মুগ্ধ হয়ে আবু সুফিয়ান নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং তখনই ওনার কাছে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তারপর নম্রস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কি তুমি কুরাইশদিগকে ধ্বংস করে ফেলবে? আজ যদি তুমি দয়া না কর তাহলে তোমার স্বজাতি ও স্বগোত্রের লোকেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।”
এই সময়ে নবী করিম (সা.)-এর চাচা আব্বাস নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এত দিন তিনি কুরাইশদের ভয়ে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেননি। আবু সুফিয়ানকে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখে তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল। এখন তিনি নবী করিম (সা.)-এর সামনে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তারপর হযরত (সা.)-কে বললেন, “মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান এত দিন কুরাইশদের নেতা ছিলেন। আজ তাঁকে তুমি একটা কিছু বিশেষ অনুগ্রহ দেখাও। নতুবা তাঁর মর্যাদা থাকে না। “
নবী করিম (সা.) বললেন, “নিশ্চয় আমি তাকে সে মর্যাদা দেব। “ তারপর আবু সুফিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মক্কা নগরে গিয়ে তুমি ঘোষণা করে দাও, আবু সুফিয়ানের নাম যারা বলবে অথবা যারা তার ঘরে আশ্রয় নেবে তাদের কোনো ভয় নেই। তা ছাড়া নিজেদের ঘরে যারা আবদ্ধ থাকবে অথবা কা’বা ঘরে যারা আশ্রয় নেবে, তাদেরকেও আজ আমি কিছু বলব না। “
আবু সুফিয়ান তাড়াতাড়ি মক্কায় ফিরে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগল, “কুরাইশরা শোনো, মুহাম্মদ (সা.) দশ হাজার সৈন্য নিয়ে আমাদের দুয়ারে এসে পৌঁছেছেন। আজ আর কারও নিস্তার নেই। তবে যে কেউ কা’বা ঘরে অথবা আমার ঘরে আশ্রয় নেবে অথবা নিজের ঘরে আবদ্ধ থাকবে, সেই আজ নিরাপদ জেনে নাও, আমি আর এখন তোমাদের দলপতি নই, আমি এখন মুসলমান।”
আবু সুফিয়ানের কথা শুনে কুরাইশরা আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি কা’বা ঘরে ও আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিতে লাগল আবার অনেকে নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে লাগল।
পরের দিন ভোরে নবী করিম (সা.) মক্কা নগরে প্রবেশের আয়োজন করে বিভিন্ন দলপতিকে বিভিন্ন দিক দিয়া অধীনস্ত লোকদের নিয়ে মক্কায় প্রবেশের আদেশ দিলেন। আর বলে দিলেন, “কেউ যেন কাউকে আক্রমণ না করে।”
সবার শেষে ক্রীতদাস যায়েদ (রা.)-এর পুত্র ওসামার সাথে নবী করিম (সা.) একটা উটের পিঠে চড়ে নীরবে যেতে লাগলেন। কি মোহনীয় এই দৃশ্য। ক্রীতদাসের সমআসনে আজ নবী সম্রাট (সা.)। অন্য কোনো সেনাপতি বা বাদশাহ হলে কী আড়ম্বরেই না নগরে প্রবেশ উৎসব পালন করতেন।
ইসলামের জানি দুশমন আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারল না। পিতৃ হত্যার কথা সে ভুলেনি। তাই হঠাৎ বেশ কিছু সঙ্গী নিয়ে মুসলমান সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালাল। ফলে দুজন মুসলমান অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সৈন্যরা তাদের উপর প্রতি-আক্রমণ চালালেন। ফলে শত্রুপক্ষের ১৪ জন মতান্তরে ২৮ জন কুরাইশ নিহত হল। তখন ইকরামা ও অন্যান্যরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল।
নবী করিম (সা.) রক্তপাত চাননি। এই খবর তাঁর কাছে যেতে তিনি কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বীর কেশরী খালিদ বিন ওলিদ (রা.) তখন ঘটনাটা শোনালেন। শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, “এটাই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছিল।”
এরপর মুসলমানরা বাঁধভাঙা বন্যার স্রোতের মতো মক্কায় ঢুকে পড়লেন। না জানি এবার মুহাম্মদ (সা.) কী করবেন? খুনের বদলা হয়তো সব মক্কাবাসীদেরকে দিতে হবে। সেই ভয়ে সবাই লুকিয়েছে। রাস্তা একদম ফাঁকা। কোনো বাধা নেই। মক্কা আজ বিজিত।
আল্লাহর রাসুল (সা.) মুক্ত কা’বা ঘরের দিকে তাকালেন, দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। মনে মনে ভাবলেন, আহা! এই সেই কা’বা আল্লাহর ঘর, দুনিয়ার কিবলা, যার হিজরত করার জন্য এত দিন তাঁর মন কাঁদত। এই প্রিয় আল্লাহর ঘর কা’বাকে ছেড়ে একদিন চলে যেতে হয়েছিল। আজ সেই পবিত্র ঘর কা’বা মুক্ত। মক্কার অধিবাসীরা একদিন তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, শুধু তাই নয়, তাঁকে হত্যা করার জন্য কতই না ষড়যন্ত্র করেছিল। যারা তাঁকে শহরের বাইরে নির্জন পাহাড়ে নির্বাসন দিয়েছিল, যারা তাঁকে পাগল বলে ঠাট্টা করত, নানা প্রকার জুলুম ও অত্যাচার করে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, আজ তারা করজোড়ে নতমস্তকে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ক্ষমা পাওয়ার আশায়।
তিনি প্রথমে শিষ্যবৃন্দকে নিয়ে কা’বা শরীফের দিকে এগিয়ে পরম ভক্তিভরে কা’বার চারদিকে সাতবার তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করলেন। তখন কা’বা ঘরের চাবি থাকত ওসমান ইবনে তালহার কাছে। নবী করিম (সা.) তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে নিজে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিতে লাগলেন। শিষ্যবৃন্দের কণ্ঠে সেই ধ্বনি কা’বার আকাশে- বাতাসে উচ্চারিত হতে লাগল। তারপর ৩৬০টি প্রতিমার দিকে লক্ষ্য করে নবী করিম (সা.) বলতে লাগলেন, “সত্য আজ সমাগত, মিথ্যা বিতাড়িত, মিথ্যার বিনাশ অশ্যম্ভাবী।” [সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮১, পারা ১৫] এই কথা বলে তিনি ওমর (রা.)-কে মূর্তিগুলি বাইরে ফেলে দিতে বললেন।
হযরত ওমর (রা.) নবী করিম (সা.)-এর আদেশ পালন করলেন। পাষাণ দেবতাদের থেকে আল্লাহর ঘর আজ মুক্ত হল। তারপর কা’বার দরজা বন্ধ করে ওসমান ইবনে তালহার কাছে উহার চাবি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা সব সময় তোমার কাছে থাকবে। অত্যাচারী ছাড়া আর কেউই এটা তোমার কাছ থেকে নিতে পারবে না।” কা’বা ঘরের বাইরে এসে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন-
তিনি প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা, তারপর নিজের সাফল্যের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে কুরাইশদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের মূর্খতাসুলভ গর্ব এবং বংশমর্যাদার অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। মনে রেখ সমস্ত মানুষই হযরত আদম (আ.)-এর সন্তান। আর হযরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।” তারপর পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন, “হে মানবমণ্ডলী তোমাদিগকে একটি পুরুষ ও একটি নারীর সম্মিলনে সৃষ্টি করেছি, তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছি, যাতে করে তোমরা পরস্পরে একে অন্যের পরিচয় লাভ করতে পার, নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে বেশি ধর্মভীরু।” [সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩, পারা ২৬]
ভাষণ শেষ করে নবী করিম (সা.) ভীত ও সন্ত্রস্ত কুরাইশদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, “বল, আজ তোমরা আমার কাছে কী রকম ব্যবহার আশা কর?”
তারা বলে উঠল, “আমরা আপনার উপর অনেক অত্যাচার ও অবিচার করেছি। তবু আমরা আপনার কাছে উদার ও সদ্ব্যবহার আশা করি। আর যদি আপনি শাস্তি দেন তবু আমরা তারই উপযুক্ত।”
তাদের কথা শুনে নবী করিম (সা.)-এর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। সামলে নিয়ে বললেন, “নবী হযরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইয়েদের সঙ্গে যেই ব্যবহার করেছিলেন, আজ আমিও তোমাদের সঙ্গে সেই ব্যবহার করব। তোমরা সকলেই মুক্ত। আজ তোমাদের প্রতি কোনো কঠোরতা নেই। নেই কোনো প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহা। তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।”
হযরত নবী করিম (সা.)-এর ক্ষমা ঘোষণায় কুরাইশদের সবার বুকে সাহস ফিরে এল। তারা দলে দলে এসে তাঁর পাক কদম মুবারকে লুটিয়ে পড়তে লাগল। অনুতপ্ত হৃদয়ের অশ্রুতে তাদের বুক ভিজে গেল। তারা এবার সত্য ও সুন্দরকে বুঝতে পেরে শত্রু-মিত্র সবাই ইসলাম কবুল করল। এমনকি নবী করিম (সা.)-এর চাচা হামজা (রা.)-এর মাথা যে কেটেছিল সেই ওয়াহশী এসে ইসলাম গ্রহণ করল। তাদেরকে তিনি ক্ষমা করে দিলেন। তারপর প্রতিহিংসাপরায়ণা পাষাণী রমণী আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, যে নাকি হযরত হামজা (রা.)-এর বুক ফেড়ে কলজে বের করে খেয়েছিল তাকেও তিনি ক্ষমা করে ইসলামের কোলে আশ্রয় দিলেন। .
দীর্ঘ সময় নবী করিম (সা.) কা’বা চত্বরে অবস্থান করলেন। জোহরের ওয়াক্ত হলে কা’বা ঘরের ছাদে উঠে হযরত বিলাল (রা.)-কে আজান দিতে বললেন। তারপর সমবেত সাহাবাবৃন্দ ও মুসলমানদের নিয়ে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করে সাফা পাহাড়ে উঠলেন। সেখানে বহু কুরাইশ নর- নারী ইসলাম গ্রহণ করলেন। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে নবী করিম (সা.)- এর আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য বাস্তবায়ন হল। এই বিজয় ছিল প্রেমের, ক্ষমার ও মহত্ত্বের।
নবী করিম (সা.) পনের দিন মক্কায় রইলেন। তারপর সাহাবী মায়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে মুয়াল্লিম ও আত্তার (রা.)-কে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে মদিনায় ফিরে এলেন। এরপর মক্কা ও মদিনার বিধর্মীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল।
হুনায়নের যুদ্ধ
মক্কার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তায়েফের কাছাকাছি পার্বত্য জায়গায় একটা বেদুইন গোত্রের বসতি ছিল। তারাও ছিল পৌত্তলিক। গোত্রটার নাম হাওজেন। তারা আগে মক্কার কুরাইশদের হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। যখন মুসলমানরা মক্কা জয় করল এবং সেখানকার কুরাইশরা দলে দলে মুসলমান হতে লাগল তখন তারা বিপদ গণল। ভাবল, মুসলমানরা তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তাই তারা হযরত নবী করিম (সা.)- এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আয়োজন করল। তায়েফের কিন সাকিফ গোত্র হাওয়াজিনদের সঙ্গে যোগ দিল। তারপর তারা দুই গোত্রের এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হল। ফলে হুনায়ন নামক জায়গায় যুদ্ধ শুরু হল।
মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশি থাকায় তারা শত্রুপক্ষকে হেয় মনে করলেন। কারণ মক্কা বিজয়ের পর তাদের মধ্যে অহঙ্কার এসে গিয়েছিল। তাই যুদ্ধের আগে তারা আল্লাহকে স্মরণ করার কথা ভুলে গিয়েছিল।
অহঙ্কারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। তাই তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আল্লাহর ইশারায় প্রথমে মুসলমান সৈন্যরা শত্রুসেনা দ্বারা এমনভাবে আক্রান্ত হল যে, জয়লাভ করা তো দূরের কথা হেরে যাবার উপক্রম হল। তখন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা চেয়ে সাহায্য চাইলেন। আল্লাহপাক তাদের তওবা কবুল করে সাহায্য করলেন। ফলে মুসলমানরা জয়ী হলেন।
এই বছরেই নবী করিম (সা.)-এর এক পুত্র জন্মান। তাঁর নাম ছিল ইবরাহিম। তিনি মাত্র দেড় বছর বেঁচে ছিলেন।
আওতাসের যুদ্ধ
ইহুদীরা হুনায়নের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আওতাস ও তায়েফে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই খবর জেনে নবী করিম (সা.) আমের আশয়ারীর (রা.) নেতৃত্বে একটা বাহিনী পাঠালেন। দুই পক্ষের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হল। এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত তীরে হযরত আমের (রা.)-এর দেহে বিদ্ধ হলে তিনি শহীদ হন। তারপর আবু মুসা আশয়ারী (রা.) সৈন্য চালনার ভার নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। যুদ্ধে বহু শত্রুসেনা হতাহত ও বন্দি হয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে নবী করিম (সা.)-এর দুধমা হালিমার মেয়ে শায়মাও ছিলেন।
বন্দিদের নবী করিম (সা.)-এর সামনে নিয়ে আসা হলে বিবি শায়মা বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমি তো আপনার দুধমা হালিমার মেয়ে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে চিনতে পেরে নিজের চাদর বিছিয়ে দুধ বোনকে তার উপর বসালেন। তারপর বললেন, “তুমি যদি চাও আমার কাছে থাকতে পার। আর যদি তোমার কাবিলার কাছে যেতে ইচ্ছা হয়, তাও যেতে পার।” কথা শেষ করে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য উপদেশ দিলেন।
শায়মাও হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে বললেন, “আমি আমার কাবিলার লোকদের কাছে ফিরে যেতে চাই।”
তখন নবী করিম (সা.) তাকে ঘরে পৌঁছে দিলেন। তারপর নবী করিম (সা.) তাঁর এই দুধ বোনের সম্মানে অন্যান্য বন্দিদেরকে বিনা মুক্তিপণে মুক্ত করে দিলেন।
হাওজিন নেতা মালিক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে স্বেচ্ছায় সদলবলে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
তায়েফের দুর্গ অবরোধ
হুনায়ন ও আওতাসের যুদ্ধে পরাজিত শত্রুসৈন্যদের বেশ কিছু অংশ তায়েফের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নেয় এবং আবার কিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সৃষ্টি করা যায় সে ব্যাপারে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল।
এই ষড়যন্ত্রের কথা নবী করিম (সা.) জানতে পেরে এর মূল উৎপাটন করার জন্য তিনি নিজেই একটা বাহিনী নিয়ে রওয়ানা দিরেন। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলেন, এক বছরের রসদ নিয়ে তারা দুর্গের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দুর্গটা এত মজবুত ও সুরক্ষিত ছিল যে, দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকা একেবারেই অসম্ভব। তবু নবী করিম (সা.) দুর্গ অবরোধ করলেন। দু’সপ্তাহ অবরোধ করে রাখার পর যখন কোনো কাজ হল না তখন নবী করিম (সা.) নওফেল ইবনে মুয়াবিয়ার পরামর্শে অবরোধ প্রত্যাহার করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, “হে দয়াময় প্রভু! তুমি এই দুর্গবাসীদেরকে ইসলাম ধর্ম নসিব কর।” আল্লাহপাক ওনার দো’য়া কবুল করলেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে দুর্গবাসীরা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল।
তবুক অভিযান ও অন্যান্য ঘটনা
নবম হিজরিতে তবুক অভিযান হয়েছিল এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে এটাই শেষ যুদ্ধ
তায়েফ থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পর নবী করিম (সা.) জানতে পারলেন, রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনি চিন্তা করলেন, রোম সাম্রাজ্যের মতো অত বড় শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে সে রকম সৈন্যবাহিনী, তাদের রসদপত্র, যানবাহন ও বিস্তর অস্ত্রশস্ত্রের দরকার। তাই তিনি সমস্ত সাহবা (রা.)-দের ডেকে তবুক যুদ্ধের ঘটনা জানিয়ে যুদ্ধের খরচের জন্যে দান করার আহ্বান জানালেন।
হযরত ওসমান (রা.) দান করলেন এক হাজার উট, সত্তরটি ঘোড়া ও এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা। হযরত ওমর (রা.) দান করলেন নিজের সব সম্পত্তির অর্ধেক। আর হযরত আবুবকর (রা.) তাঁর যথাসর্বস্ব দান করলেন।
হযরত নবী করিম (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “ তোমার পরিবারবর্গের জন্যে কী রেখে এলে?”
হযরত আবুবকর (রা.) অম্লান বদনে উত্তর দিলেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-কে।”
সংগৃহীত অর্থ দিয়ে হযরত নবী করিম (সা.) যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ও রসদপত্র কিনে চল্লিশ হাজার মুসলিম বীরের এক বাহিনী নিয়ে তবুক অভিযানে চললেন। [তবুক অভিযানই হযরত নবী করিম (সা.)-এর শেষ যুদ্ধ অভিযান। তিনি সর্বমোট ২৭টি যুদ্ধে যোগদান করেন। তার মধ্যে ৯টিতে নিজে অংশগ্রহণ করেন।]
মুসলমানদের এই বিশাল সমর অভিযান দেখে তবুকের খ্রিস্টান দলপতিদের চমক ভাঙল। তারা রোম সম্রাটকে সে কথা জানিয়ে যুদ্ধ করতে আসতে নিষেধ করে দিল। খ্রিস্টান দলপতিদের মতামত জেনে হিরাক্লিয়াস ভয় পেয়ে আর অগ্রসর না হয়ে পশ্চাৎপসরণ করলেন। ফলে যুদ্ধ হল না।
ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের এই তবুক অভিযান ‘গাজওয়াতুল উসরা’ বা কষ্টের যুদ্ধ নামে খ্যাত। কারণ এই অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল গরমকালে। প্রচণ্ড রোদের তাপ ও পানির কষ্টের মধ্যে দিয়ে এই অভিযানের মুসলমানদেরকে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল।
হযরত নবী করিম (সা.) সমস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে তবুকে বিশ দিন থেকে মদিনায় ফিরে আসেন।
বিদায় হজ
দশ হিজরি সালের ঘটনা : এই সালে হুজুর পাক (সা.) মুসলমানদেরকে ইসলামের মূল ইবাদতসমূহ ছাড়া জীবনযাপন পদ্ধতি তথা পার্থিব জীবনযাপনের শরীয়তসম্মত রীতিনীতি, ইবাদতসমূহ আদায় বা পালন করার বিধিমালা ব্যাপকভাবে শিক্ষা দেন। এমনকি সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, ধর্মীয় সমস্যা কুরআনের আলোকে সমাধান করে দিয়েছেন। তা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা, বৈদেশিক নীতি, বাণিজ্য নীতি, শিক্ষা নীতি, যুদ্ধনীতি, শান্তি চুক্তি, প্রজা পালন, নাগরিক অধিকার, নেতা নির্বাচন ও রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব-সব কিছু কুরআনের আলোকে বাতলে দিলেন। একজন মানুষের যতগুলো সৎগুণ থাকা প্রয়োজন সবই তাঁর চরিত্রে বিদ্যমান ছিল।
এই দশম হিজরিতে এমন এক আয়াত আল্লাহ পাক নবী করিম (সা.)- এর উপর নাযিল করেন যার দ্বারা তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময় আসন্ন। তাই জীবনের শেষবারের মতো পরিবারের সবাইকে নিয়ে এ বছর হজ করার সংকল্প করলেন। তারপর সবাইকে কথাটা জানিয়ে দিলেন।
২৫ জিলক্বদ হযরত নবী করিম (সা.) পরিবার-পরিজনসহ শিষ্যবৃন্দদের নিয়ে হজযাত্রা করলেন। আজ ধনী-গরিব, ইতর-ভদ্র, বাদশাহ-গোলাম কোনো তফাৎ নেই। সকলেই আজ সমান। সকলেরই আজ সমান পোশাক, সকলের মুখে একই বাণী; একই ভাষা, একই আশা, একই জ্ঞান, একই ধারণা, একই লক্ষ্য ও একই কামনা। যাবার পথে অসংখ্য মুসলমান হজ করার জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। প্রায় দুই লক্ষ মুসলমান সঙ্গে নিয়ে হযরত নবী করিম (সা.) জিলহজ মাসের পাঁচ তারিখে মক্কা শরীফে উপনীত হলেন। মক্কার প্রবেশদ্বারে পৌঁছেই কা’বা ঘরকে দেখতে পেয়ে দু’হাত তুলে ভক্তিগদগদ কণ্ঠে মুনাজাত করলেন, “ইয়া আল্লাহ, এই ঘরকে চিরকল্যাণ ও চিরমহিমায় মণ্ডিত কর এবং যারাই এখানে হজ করতে আসবে, তাদের সুখ-শান্তি ও মান-মর্যাদা বাড়িয়ে দিও।”
জিলহজ মাসের আট তারিখে হুজুর (সা.) সঙ্গীগণসহ মিনায় উপস্থিত হলেন। পরের দিন শুক্রবার নয় তারিখে আরাফাতের ময়দানে কাফেলাসহ উপস্থিত হলেন। তারপর হজের কাজ সম্পন্ন করে তিনি আরাফাতের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সমবেত মুসলমানদিগকে উদ্দেশ্য করে খুৎবা (ভাষণ) দিলেন-
প্রথমে তিনি আল্লাহ পাকের প্রশংসা করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর বললেন, “হে আমার প্রিয় ভক্তবৃন্দ, আজ যেসব কথা তোমাদিগকে বলব, মনোযোগ দিয়ে শুনিও। আমার আশঙ্কা হচ্ছে তোমাদের সঙ্গে একসঙ্গে হজ করার সুযোগ আর হবে না। হে মুসলমানগণ, মনে রাখিও তোমাদের আল্লাহ এক। অন্ধকার যুগের সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভুলে যাও। নতুন আলোতে পথ চলতে শেখো। আজ থেকে অতীতের সমস্ত কুসংস্কার, অনাচার ও পাপ প্রথা বাতিল হয়ে গেল। মনে রেখ, সব মুসলমান ভাই ভাই, কেউ কারও চেয়ে ছোট নও। কারও চেয়ে বড় নও। আল্লাহর চোখে সকলে সমান। পরস্পরের মধ্যে প্রাধান্যের মাপকাঠি হল একমাত্র আল্লাহভীতি ও পরহেজগারী। নারী জাতির কথা ভুলো না। নারীর উপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, পুরুষের উপর নারীরও তেমনি অধিকার আছে। তাদের উপর অত্যাচার কর না। মনে রেখ, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তাদেরকে গ্রহণ করেছ।
দাস-দাসীদের প্রতি সর্বদা ভালো ব্যবহার করবে। তোমরা যাহা আহার করবে তাদেরকেও তাহাই আহার করাবে, তোমরা যাহা পরিধান করবে, তাহাদেরকেও তাহাই পরিধান করাবে। কারণ তাহারাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তোমাদের মতো মানুষ।
সাবধান, ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি কর না। এই বাড়াবাড়ির ফলেই অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের ধন, প্রাণ ও ইজ্জত পবিত্র বলে মনে করবে। যেমন পবিত্র আজকের এই দিন, ঠিক তেমনি পবিত্র তোমাদের পরস্পরের জীবন ও ধন-সম্পদ। হে মুসলমানণ, হুঁশিয়ার, নেতার আদেশ কখনো লঙ্ঘন করিও না। যদি কোনো কাফ্রী ক্রীতদাসকেও তোমাদের নেতা করে দেয়া হয় এবং সে যদি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদেরকে চালনা করে, তাহলে অবনত মস্তকে তার আদেশ মেনে চলবে।
সাবধান, মূর্তিপূজার পাপ যেন তোমাদেরকে স্পর্শ না করে। শিরক কর না, চুরি কর না। মিথ্যা কথা বল না, ব্যভিচার কর না। মনে রেখ, একদিন তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। সেদিন তোমাদের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। বংশের গৌরব করবে না। যে ব্যক্তি নিজের বংশকে হেয় মনে করে অপর বংশের নামে আত্মপরিচয় দেয় তার উপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসে।
হে আমার উম্মতগণ, আমি যা রেখে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে ধরে থাক তাহলে কিছুতেই তোমাদের পতন হবে না। সেই সম্পদ দুটি হল আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর উপদেশ। তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে। বছরে এক মাস রোযা রাখবে। ধনের জাকাত দেবে। আল্লাহর ঘর কা’বা হজ করবে। তোমাদের উপর আল্লাহর যে সমস্ত হুকুম নাযিল হয়েছে সেগুলো মেনে চলবে। তাহলে তোমরা বেহেশতে যেতে পারবে। অপরাধী ব্যক্তি এখন থেকে তার নিজের অপরাধের জন্য দায়ী হবে। পিতার বদলে পুত্র কিংবা পুত্রের বদলে পিতাকে দায়ী করা হবে না। নিশ্চয় জেনো, আমার পর আর কোনো নবী নাই। আমি শেষ নবী, যাহারা উপস্থিত আছ তাহারা অনুপস্থিত সকল মুসলমানদের নিকট আমার এই সকল বাণী পৌঁছে দিও। “
হযরত নবী করিম (সা.)-এর মুখমণ্ডল ক্রমশ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠতে লাগল। গলার আওয়াজ ভাবগম্ভীর হয়ে এল। আকাশের দিকে মুখ তুলে তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ, হে আমার প্রভু, আমি কি তোমার বাণী মানবমণ্ডলীর কাছে পৌঁছে দিতে পারলাম? আমি কি আমার কর্তব্য সম্পাদন করতে পারলাম?” লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে উচ্চারিত হল, “নিশ্চয় নিশ্চয় ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনি সঠিকভাবেই আল্লাহর বাণী আমাদের কাছে পৌছাইয়াছেন।”
হযরত নবী করিম (সা.) কাতর কণ্ঠে আবার বলতে লাগলেন, “প্রভু হে, শ্রবণ কর? সাক্ষী থাক, ইহারা বলছে আমার কর্তব্য আমি পালন করেছি।”
এই সময়ে কুরআনের শেষ আয়াত নাযিল হল-
“আজ আমি তোমার জন্য দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম, এবং আমি তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং আমি ইসলামকেই তোমার ধর্ম বলিয়া মনোনীত করলাম।” [সূরা মায়েদা, আয়াত-৩, পারা-৫]
হযরত নবী করিম (সা.) ক্ষণকাল নীরব রইলেন। বিশাল জনতাও তখন নীরব-নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ পরেই তিনি জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়!” হুজুর (সা.)-এর কথা শুনে সবার হৃদয় একটা অজানা বিয়োগ বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
নবী করিম (সা.)-এর ভাষণ শেষ হবার পর বিলাল (রা.) আজান দিলেন। এই দিনে হুজুর (সা.) সবাইকে নিয়ে জোহর ও আসরের নামায একসঙ্গে আদায় করলেন। তারপর উটে চড়ে তাঁবুর দিকে রওয়ানা হলেন।
নবী করিম (সা.) দশ দিন মক্কায় থেকে মদিনায় ফিরে এলেন। হিজরি ১১ সালের সফর মাস শেষে হতে দু’তিন দিন বাকি থাকতে নবী করিম (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ওনার বয়স তখন ৬৩ বছর। মাথার যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। বিবি হযরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে নবীজি (সা.) শুয়ে ছিলেন। সেখানে হযরত আলী (রা.) ও আল-ফজল (রা.) বসে আছেন। একটু পরে জ্ঞান ফিরে এলে তিনি মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢালতে বললেন। মাথায় পানি ঢালার পর একটু সুস্থ বোধ করতেই উঠে বসে বললেন, “আমাকে মসজিদে নিয়ে চল।” তখন জোহরের ওয়াক্ত। হযরত আলী (রা.) ও আল-ফজল (রা.) নবী করিম (সা.)-কে দুই দিকে ধরে মসজিদে নিয়ে গেলেন। খুব কষ্টের সঙ্গে মিম্বরে উঠে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, “আমার নিকট যদি কারও কোনোরূপ প্রাপ্য বা অন্য কোনো দাবি-দাওয়া থাকে, তাহলে এখনও তাহা আদায় করে নাও। আমাকে তোমরা কেহ ঋণী রেখ না। অথবা আমার কোনো কাজ বা ব্যবহার দ্বারা কেহ কোনোরূপ কষ্ট পেয়ে থাকলে, আজ তোমরা আমার নিকট থেকে তার প্রতিশোধ নিতে পার।”
সাহাবীরা (রা.) সবাই অবাক। এমন কথা তাঁরা কখনও শোনেননি 1 রাহমাতুল্লিল আল-আমিন, যিনি নিষ্পাপ নবী, তিনি কি করে কারও উপর কোনো অন্যায় করে থাকতে পারেন?
তখন একজন দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার কাছে আমি তিনটে দিরহাম পাব।”
নবী করিম (সা.) তখনই তাকে তিনটে দিরহাম দিয়ে বললেন, “কিয়ামতের দিন লজ্জিত হওয়ার চেয়ে দুনিয়ায় লজ্জিত হওয়া অনেক ভালো।”
তারপর সাহাবী ওয়াক্কাস (রা.) রসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, “হে আল্লাহর নবী (সা.), আপনি কোনো একসময়ে আমার পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করেছিলেন। এখন এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?”
হুজুর (সা.) বললেন, “ওয়াক্কাস পিছনের ঘটনা আমার মনে নেই। তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছ। সে জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি যদি তোমার পিঠে চাবুকের আঘাত করে থাকি, তাহলে আমার পিঠে তুমি চাবুক মেরে আমাকে ঋণমুক্ত করে দাও।” এই কথা বলে তাকে চাবুক নিয়ে আসতে বললেন।
সাহাবাবৃন্দ (রা.) ওয়াক্কাস (রা.)-এর কথা শুনে বিচলিত ও হতবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, হায় হায়! কী করে ওয়াক্কাস (রা.) কঠিন রোগাক্রান্ত হুজুর পাক (সা.)-এর পবিত্র দেহে আঘাত করবেন? তারা সবাই ওয়াক্কাস (রা.)-এর নিষ্ঠুরতার জন্য তাঁকে ধিক্কার দিতে লাগলেন এবং বললেন, “হে ওয়াক্কাস (রা.) তুমি হুজুর (সা.)-এর বদলে আমাদের পিঠে চাবুকের আঘাত কর।”
হযরত রাসুল করিম (সা.) তাঁদেরকে নিরস্ত করে বললেন, “হে আমার সাহাবাবৃন্দ, তা হয় না। আমার ঋণ আমাকেই পরিশোধ করতে দাও। তোমরা পরিশোধ করলে আমি ঋণমুক্ত হব না।” তারপর ওয়াক্কাস (রা.)- কে চাবুক নিয়ে এগিয়ে আসতে বললেন, সাহাবাগণ তখন কাঁদতে লাগলেন। ওয়াক্কাস (রা.) চাবুক হাতে নিয়ে বললেন, “হে আল্লাহর নবী (সা.), আপনি যখন চাবুক মেরেছিলেন তখন আমার পিঠ খোলা ছিল, এখন আপনার পিঠ কাপড়ে ঢাকা।”
হুজুর (সা.) তাঁকে ঘরে নিয়ে গিয়ে গায়ের জামা খুলে দিলেন।
ওয়াক্কাস (রা.) চাবুকটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হুজুর পাক (সা.)-এর পিঠের উপরে ঘাড়ের মধ্যে পবিত্র মোহরে নবুয়তের উপর চুমো খেয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমি শুধু আপনার পিঠের উপরে মোহরে নবুয়ত দেখার ও তাতে চুমো খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য এই ছলনা করেছি। আপনি আমাকে মাফ করে দিন।”
হুজুর পাক (সা.) মৃদু হেসে বললেন, “যাও আল্লাহ তোমার বাসনা পূর্ণ করেছেন। তোমার জন্য দোজখের আগুন হারাম হয়ে গেল।” তারপর মসজিদে ফিরে এসে দু’হাত তুলে মুনাজাত করলেন। মুনাজাতের শেষে বললেন, “আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাকে দুটো জিনিসের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলেছেন। দুনিয়া ও তার সমুদয় সম্পদ অথবা আল্লাহ ও আখিরাতের সম্পদ। বান্দা আল্লাহর সান্নিধ্যই বেছে নিয়েছে।”
এ কথা শুনে হযরত আবুবকর (রা.) কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, প্রিয় নবীজি (সা.) এবার তাঁদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন। হযরত নবী করিম (সা.) দরদভরা কণ্ঠে হযরত আবুবকর (রা.)-কে বললেন, “শান্ত হও আবুবকর, তোমরা ভয় করছ, তোমাদের নবী ইন্তেকাল করতে পারেন। কিন্তু আমি কি চিরকাল তোমাদের মধ্যে থাকব? আমার আগে যেসব নবী দুনিয়ায় এসেছিলেন, তাঁরা কি আজও আছেন? তারা কি তাঁদের দায়িত্ব শেষ করে আল্লাহর কাছে ফিরে যাননি? প্রত্যেক মানুষ মরণশীল। আমাকে যেমন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, তেমনি তোমাদেরকেও আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে।” তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, “আমার হায়াত যেমন তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক, আমার মউতও তেমনি তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কারণ মউতের পরে তোমাদের আমল অর্থাৎ দুনিয়ায় তোমরা কে কী করেছ তা আমাকে দেখানো হবে। যদি আমার কোনো উম্মতের গুনাহ দেখতে পাই, তখন আমি তার জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইব। “
এমন কথা আর কোনো নবী বলেননি। এই জন্যেই তিনি দয়ার নবী, দ্বীন-দুনিয়ার নবী।
আরও অনেক উপদেশ দিয়ে তিনি ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। তারপর থেকে তাঁর অসুখ ক্রমশ বাড়তে লাগল। আর তিনি বাইরে আসতে পারলেন না।
প্রিয় নবী করিম (সা.)-কে দেখতে না পেয়ে সবাই পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁকে একনজর দেখার জন্য মুসল্লিরা দেয়ালে জানালা কেটে ফেললেন। নবী (সা.)-এর ঘরের অন্যান্য সাহাবী (রা.)-রাও নবীর ঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালে বেশ কয়েকটা ছিদ্র করলেন।
নবী করিম (সা.) এসব দেখে বললেন, “শুধু আবুবকরের ঘরের দিকের জানালা ছাড়া আর সব ছিদ্র বন্ধ করে দাও।
সাহাবারা (রা.) তাই করলেন।
নবী করিম (সা.)-এর অসুখের মূলে ছিল সেই ইহুদী রমণীর দেয়া বিষের প্রতিক্রিয়া, যে একদিন তাঁকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়ে গোশতে বিষ মিশিয়ে খেতে দিয়েছিল। যতক্ষণ নবী করিম (সা.)-এর জ্ঞান ছিল, হাঁটার শক্তি ছিল, ততক্ষণ মসজিদে এসে নামায আদায় করতেন। রোগে যাতনা বেড়ে গেলে বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়ছিলেন। জ্ঞান ফিরলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘নামায কি হয়ে গেছে?”
এশার সময় হযরত বিলাল (রা.)-এর কণ্ঠে আজান শুনে হযরত (সা.) উঠতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
মুসল্লিরা ওনার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলেন। নবীজি (সা.) জ্ঞান ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “নামায কি হয়ে গেছে?”
সাহাবী (রা.)-রা বললেন, “জি না ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন।”
নবী করিম (সা.) ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন, “আবুবকরকে নামায পড়াতে বল।”
হযরত আয়েশা (রা.) এ কথা শুনে বললেন, “তার দিল খুব নরম, তিনি তো আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়াতে পারবেন না।”
রাসুলুল্লাহ (সা.) তবু বললেন, “আবুবকরকেই নামায পড়াতে বল। “ হযরত আবুবকর (রা.) হুজুর পাক (সা.)-এর কঠিন অসুখের সময় মোট সতের ওয়াক্ত নামাযের ইমামতি করেছিলেন।
রোগশয্যায় নবী করিম (সা.) কারও মতে আট দিন, কারও মতে সাত দিন আবার কারও মতে তের-চৌদ্দ দিন ছিলেন। রোগ যন্ত্রণা যখন খুব বেশি হল তখন হযরত আলী (রা.)-কে কাছে ডেকে তাঁর কোলে মাথা রাখলেন। আহা! নবীজি (সা.)-এর কপাল বারবার ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, চেহারার রঙ পাল্টে যাচ্ছিল।
নবী দুলালী হযরত ফাতেমা (রা.) আব্বার এই কষ্ট দেখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলেন। দুই ছেলে হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.)-কে আব্বার কাছে নিয়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আব্বাজান, আপিনি চলে গেলে কে আর আপনার মেয়ে ফাতেমাকে দেখবে। কে আপনার হাসান হোসাইনকে আদর করবে?”
নবী করিম (সা.) প্রাণপ্রিয় মেয়ের কান্না শুনে ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তারপর ইশারায় কাছে ডেকে গায়ে-মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে অনুচ্চস্বরে বললেন, “ধৈর্য ধর মা, তোমাকে একটা খুশির খবর দিচ্ছি, তুমি সবার আগে আমার সঙ্গে মিলিত হবে।” এই কথা শুনে হযরত ফাতেমা (রা.) কিছুটা শান্ত হলেন।
নবী করিম (সা.) ক্লান্তিতে আবার চোখ বন্ধ করলেন। নবীপত্নীদের কান্নায় ও সাহাবাদের আর্তনাদে তখন ঘরের বাইরে করুণ দৃশ্য। বাইরে জনতা নবীজি (সা.)-কে একনজর দেখার জন্য উদগ্রীব, তারা যেন ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে চান। হযরত ফাতেমা (রা.) আব্বার কানের কাছে মুখ রেখে আবার আব্বাজন বলে কেঁদে উঠলেন।
নবী করিম (সা.) চোখ খুলে বললেন, “কেঁদ না মা, কেঁদ না!” তারপর ফাতেমা (রা.)-এর চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন, “আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আবার আল্লাহর কাছে ফিরে যাব।” তারপর তিনি আবার চোখ বন্ধ করে নিলেন। এমন সময় আল্লাহপাকের তরফ থেকে আদেশ হল, “হে রাসুল, যদি চাও, তাহলে দুনিয়াতেই থাকতে পার। আর যদি না চাও, তাহলে আমার কাছে চলে এস।”
রাসুল (সা.) বললেন, “ইয়া রব, আমি তোমার কাছে যেতে চাই।” সামনে একটা পানির পাত্র ছিল। তিনি তাতে দু’হাত ডুবিয়ে নিজের মুখমণ্ডলে মসেহ করতে করতে বললেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মৃত্যুর যন্ত্রণা সত্য।”
তারপর অতি কষ্টে দু’হাত উপরে তুলে মুনাজাতের মতো করে ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইয়া রফিকে আলা, হে আমার পরম বন্ধু তোমার কাছে”, তিনবার বলা শেষ হতেই নবী করিম (সা.)-এর হাত দুটো নিচে নেমে এল। আর সাথে সাথেই তাঁর রুহু মুবারক মাটির দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহ পাকের দরবারে চলে গেল। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।
.
সাহায্য নেয়া বইগুলি
১। বিশ্বনবী, লেখক গোলাম মোস্তফা
২। আদি ও আসল কাসাসুল আম্বিয়া : এম.এন.এম. ইমদাদুল্লাহ, এমএস, বিএ (অনার্স), এমএ
৩। স্পিরীট অফ ইসলাম : সৈয়দ আমীর আলী
৪। আলোর নবী আল-আমীন : কাজী গোলাম আহম্মদ
Leave a Reply