Kishor Samagra 4 – Shahriar Kabir / কিশোরসমগ্র ৪ – শাহরিয়ার কবির
সূচীপত্র
লেখকের কথা
কিশোর রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডে আট থেকে বারো বছর আগে লেখা আমার পাঁচটা উপন্যাস আছে। আমার যে কোন উপন্যাস লেখার পেছনে অনেক কথা থাকে, কখনও বইয়ের ভূমিকায় সেসব লিখি, কখনও ভূমিকা বা লেখকের কথা লেখা হয় না। অনেক পাঠক উপন্যাসে ভূমিকা পছন্দও করে না। রচনাসমগ্রের পাঠকরা অন্য রকম হয়। তারা নিশ্চয় জানতে চাইবে কখন কী ভেবে এসব লিখেছি।
কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ দিয়েই শুরু করা যাক। কাহিনী শুরু হয়েছে পুরনো ঢাকার এক বদ্ধ গলি থেকে, শেষ হয়েছে ওয়াশিংটনে। মূল কাহিনীর ক্ষেত্র রুমানিয়া। ইউরোপে কার্পেথিয়ান পর্বতের কোলে এই রহস্যময় দেশটির অবস্থান। তোমরা যারা ব্রাম স্টোকারের ভয়াল উপন্যাস ড্রাকুলা পড়েছে তাদের কাছে কার্পেথিয়ান কোন অজানা নাম নয়। কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ এই কার্পেথিয়ান পর্বতের ভেতর, উপন্যাসে যাকে একজন ভ্যামপায়ার হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই ভয়াল কাহিনী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় হেমেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেন মানুষ পিশাচ, তাও প্রায় ষাট সত্তর বছর আগে।
ছোট বেলায় যখন কুমোরটুলির বাড়িতে আমরা আর জেঠুরা সব একসঙ্গে থাকতাম তখন বড়রা আমাদের মজার মজার সব বই পড়ে শোনাতেন। মানুষ পিশাচ শুনতে গিয়ে আমাদের গায়ের রক্ত হিম হয়ে যেতো, চুলগুলো শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যেতো, তারপরও শুনতে মজা লাগতো। বড় হয়ে মানুষ পিশাচ আর ড্রাকুলা পড়তে গিয়ে বার বার ফিরে গেছি কুমোরটুলির বাড়ির ঝুলবারান্দায়, সন্ধ্যের পর সবাই গোল হয়ে বসে যখন গল্প শুনতাম।
ড্রাকুলা প্রথম পড়েছি সম্ভবত কলেজে উঠে। তখনই মনে হয়েছিলো–আহা কখনও যদি রুমানিয়া যেতে পারতাম! রহস্যময় দুর্গ দেখার সখ সেই কৈশোর থেকে। ইউরোপের পটভূমিকায় আমার যে উপন্যাসগুলো লেখা প্রায় সব কটিতেই রহস্যময় দুর্গ রয়েছে। শৈশব ও কৈশোরের সব ইচ্ছা সবার পূরণ হয় না। তবে আমার অনেক স্বপ্ন পরে বাস্তবে রূপ পেয়েছে। ১৯৮৯-এ যখন আমার বয়স ৩৯ বছর তখন রুমানিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম কার্পেথিয়ান পর্বতে কাউন্ট ডাকুলার দুর্গ দেখতে যাবো, সময়ের অভাবে সম্ভব হয়নি। তবে রুমানিয়ান বন্ধুদের কাছে প্রথম শুনলাম, ব্রাম স্টোকার রুমানিয়ার জাতীয় বীরকে পিশাচ বানিয়ে খুব অন্যায় করেছেন। কাউন্ট ড্রাকুলা ইতিহাসের এক বাস্তব চরিত্র যিনি তুর্কীদের হামলা থেকে রুমানিয়াকে রক্ষা করেছেন। আসল নাম দিলো ব্লাদ ড্রাকুলা। এমনিতে রাজা হিসেবে খুব অত্যাচারী হলেও নিজের দেশের স্বাধীনতা রক্ষা জন্য বার বার তুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
রুমানিয়ার প্রতিবেশী বেশ কিছু দেশ সেই সময় তুর্কীদের অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করলেও কাউন্ট ড্রাকুলার কারণে রুমানিয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এ তথ্য জানার পর ড্রাকুলার দুর্গ নিয়ে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। যে কারণে রুমানিয়ার পটভূমিতে লেখা আমার প্রিয় উপন্যাসের একটি কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ ভয়াল কাহিনীর বদলে একেবারেই অন্যরকম হয়ে হয়েছে।
রহস্যময় দুর্গের প্রতি আমার দুর্বলতার পরিচয় অনীকের জন্য ভালোবাসা উপন্যাসে পাওয়া যাবে। এ বইয়ে আলফ্রেড নামের যে মজার বুড়ো আছেন অনেক আগে সে রকম একজনের দেখা পেয়েছিলাম লন্ডনে। শোন তাহলে তার কথা।
লন্ডনে সেবার প্রথম গিয়েছি। উঠেছি আমার বন্ধু ঊর্মির বাড়িতে। ও তখন বিবিসিতে কাজ করে। এক দুপুরে ঊর্মির সঙ্গে বিবিসি গিয়েছিলাম–নাকি আমার সাক্ষাৎকার নেবে ওরা। ফেরার পথে বুশ হাউসের উল্টো দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে পথ হারিয়ে টেমস-এর তীরে চলে গেলাম। লন্ডনের বুক চিরে টেমস নদী বয়ে গেছে, দু ধারে দালান কোঠা, খোলা জায়গাও শান বাঁধানো। হাতে সময় ছিলো, ভাবছিলাম বিলেতের রাজারানীদের প্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেসটা দেখবো। সঙ্গে ম্যাপ নেই, কীভাবে যাবো বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম কাউকে জিজ্ঞেস করি।
এদিক ওদিক তাকিয়ে অল্প দূরে দেখি নদীর ধারে বাঁধানো বেঞ্চে শক্ত সমর্থ এক বুড়ো একা বসে আছেন। কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, দয়া করে কি ভলবেন বাকিংহাম প্যালেস-এ কীভাবে যাবো?
মৃদু হেসে বুড়ো বললেন, লন্ডনে বুঝি নতুন এসেছে?
আমি বিব্রত হয়ে সায় জানালাম। বুড়ো বললেন, সামনে যে রাস্তাটা গেছে ওটা ধরে দুশ গজের মতো যাবে, তারপর বাঁয়ে ঘুরে আরও শ খানেক গজ যাবে, তারপর ডানে যাবে তিনশ গজের মতো ….
এভাবে ডান বাম করে যেভাবে বুড়ো শয়ে শয়ে গজ যেতে বলছিলেন আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না। আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বুড়োর মায়া হলো। বললেন, তোমার যদি তাড়া না তাহলে দশ মিনিট বসো। আমি তোমাকে রাস্তা দেখিয়ে দেবো। বাকিংহাম প্যালেস এখান থেকে অনেক দূরে।
কোন তাড়া ছিলো না। বুড়োর পাশে বসলাম। বুড়ো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার কথা, বাংলাদেশের কথা, আমার কাজের কথা, বন্ধুদের কথা–সব জানলেন। নিজের কথাও বললেন। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে শুধু বাকিংহাম প্যালেস নয়, সন্ধ্যে পর্যন্ত কাছাকাছি যত দর্শনীয় স্থান ছিলো সব দেখালেন, দুপুরে খাওয়ালেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের ক্লাব ভিক্টোরিয়ায়, উপহার কিনে দিলেন। এই বুড়োই আলফ্রেড, এক সময় সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। আলফ্রেড আমাকে বলেছিলেন ওয়েলস-এর কথা। লোভ দেখিয়ে বার বার বলেছিলেন তার দেশের বাড়িতে যেতে। লন্ডনের কিছুই তার ভালো লাগে না। ওয়েলস এর লোকরা দু চোখে দেখতে পারে না ইংরেজদের। আমি তার সব কথা খুব সহানুভূতির সঙ্গে শুনেছি এতেই নাকি তিনি আমাকে বন্ধুর মতো ভালোবেসে ফেলেছেন। তবে এই উপন্যাসের অনীক কিন্তু আমি নই।
ছোটদের জন্য লেখা আমার উপন্যাসগুলোর ভেতর আলোর পাখিরা অন্য ধরনের। স্কুলে পড়ার সময় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা প্রথম শুনি। আমাদের মিশনারি স্কুল যদিও চালাতেন খৃষ্টান পাদ্রিরা। ছাত্রদের ভেতর মুসলমান, খৃষ্টান, হিন্দু বৌদ্ধ সবই ছিল। শিক্ষকরা বেশিরভাগ ছিলেন হিন্দু, তরে সব ছাত্রকে তারা সমানভাবে দেখতেন। স্কুলে মুসলমান ছাত্ররা যখন নবীর জন্মদিনে মিলাদের আয়োজন করতো মিষ্টি খাওয়ার জন্য হিন্দু আর খৃষ্টানরাও যেতো। একইভাবে স্কুলে সরস্বতী পূজোর আয়োজন করতে হিন্দু ছাত্ররা, বড়দিনের উৎসবের আয়োজন করতে খৃষ্টানরা যা অন্য ধর্মের ছাত্রদের জন্য অবারিত ছিলো। আমরা এভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম। প্রথম ধাক্কা খেলাম ৬৪ সালে।
তখন কাশ্মীরে কোন মসজিদে নাকি মহানবীর এক গাছি চুল ছিলো। সেই চুল চুরি হয়েছে–এ কথা জানাজানি হওয়ার পর কাশ্মীরের মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর হামলা করেছিলো। কাশ্মীরের বদলা নেয়ার জন্য ভারতের কোথাও কোথাও হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর হামলা করেছে। এর ধাক্কা লেগেছিলো পাকিস্তানেও। তখন বাংলাদেশ ছিলো পাকিস্তানের অংশ। এখানে মুসলমান গুণ্ডারা নিরীহ হিন্দুদের ওপর হামলা করলো। আমাদের হিন্দু শিক্ষকরা এসে স্কুলে আশ্রয় নিলেন। যে গাঙ্গুলি স্যার আর নলিনী স্যারকে কোনদিন ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য পোশাকে দেখিনি তাদের তখন দেখেছি ভয় পেয়ে পায়জামা আর শার্ট পরতে দেখে ভাষণ কষ্ট পেয়েছিলাম, নিজেকে খুবই ছোট মনে হয়েছিলো।
৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙার অজুহাতে বাংলাদেশের মুসলমান গুণ্ডাদের দল আবার নিরীহ হিন্দুদের উপর হামলা করলো। অনেক মানুষ মরলো, অনেক মন্দির ভাঙলো, অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেলো। ধর্মের নামে মানুষে মানুষে হানাহানি নিয়ে বড়দের জন্য অনেক লেখা হয়েছে, তবে ছোটদের জন্য কোন লেখা চোখে পড়েনি। সাধু গ্রেগরির দিনগুলিতে ৬৪ সালের ঘটনা উল্লেখ করেছি। আলোর পাখিরা আমার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা। এ বিষয় নিয়ে বাংলায় এটাই ছোটদের জন্য প্রথম উপন্যাস। জানি না অন্য ভাষার লেখকরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে ছোটদের জন্য লিখেছেন কি না।
ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়–এটা বোঝাবার জন্য শুধু আলোর পাখিরা নয়, পরে আরও লিখেছি। রত্নেশ্বরীর কালোছায়া তার একটি, তবে অতোটা নিরস নয়। এখানে অ্যাডভেঞ্চার আছে, রোমাঞ্চ আছে, তারপরও বক্তব্য আছে।
আমার অনেক পাঠিকার অভিযোগ ছিলো ছোটদের জন্য আমার লেখাগুলো নায়ক প্রধান, ছেলেরাই সব অ্যাডভেঞ্চারে যায়। ওদের দাবি মেটাতে গিয়ে রত্নেশ্বরীর কালোছায়া লিখেছি। বিপদে পড়েছিলাম মেয়েদের হোস্টেল জীবনের বিবরণ দিতে গিয়ে। ছেলেদের হোস্টেলেই কখনও থাকিনি, মেয়েদের কথা কীভাবে লিখবো? শেষে মনে পড়লো আমাদের নীলা ভাবী (নীলা হাবীব) ছোটবেলায় ভারতেশ্বরী হোমস-এর ছাত্রী ছিলেন, হোস্টেলে থাকতেন আর শ্যামলী ভাবী (শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী)
ভারতেশ্বরীর টিচার ছিলেন। রত্নেশ্বরীর কালোছায়া লেখার আগে এই দুই ভাবীর সাহায্য নিতে হয়েছিলো।
আমার বেশির ভাগ উপন্যাসে খলচরিত্র বা ভিলেন হচ্ছে দেশের শত্রুরা। আমাদের দেশের প্রধান শত্রু হচ্ছে যারা ধর্মের নামে মানুষের উপর অত্যাচার করে, মানুষকে হত্যা করে। ৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। তাদের প্রধান সহযোগী ছিলো জামায়াতে ইসলামী যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে গণহত্যা ও নির্যাতনকে জায়েজ করতে চেয়েছে এবং রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠন করে দেশের নামকরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতির এই মুখচেনা শত্রুদের পরিচয় আমার বহু উপন্যাসে পাওয়া যাবে। তবে ভয়ঙ্করের মুখোমুখিতে এদের হিংস্র কদর্য চেহারা বেশি ধরা পড়েছে।
আট বছর আগে লিখেছিলাম ভয়ঙ্করের মুখোমুখি। বারো বছর আগে লিখেছি কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ। সেখানেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জামাতীদের ষড়যন্ত্রের কথা বলেছি। এই উপন্যাসের নায়ক আকাশ আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি যুবক। রুমানিয়ায় ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে মামাতো ভাই সুজনের সঙ্গে, ঢাকার এক কলেজে পড়ে, ছাত্র সংগঠন করে। উপন্যাসের এক জায়গায় জামাতীদের সম্পর্কে ছোট ভাইকে সাবধান করে আকাশ বলছে এরশাদকে সরাতে গিয়ে তোমরা জামাতে ইসলামী আর ফান্ডামেন্টালিস্টদের একটু বেশি লাই দিচ্ছো। তোমাদের সঙ্গে ওরাও তো দিব্যি আন্দোলনে জুটে গেছে। কেউ কিছু বলছে না।
বারো বছর আগে যে আশঙ্কার কথা লিখেছিলাম সেটা এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। জামাতীরা মন্ত্রী হয়ে ৭১-এর মতো মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যা কিছু করা সম্ভব সবই তারা করছে। দেশের এই শত্রুদের কথা না জানলে তাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবো কীভাবে?
ছোটদের জন্য লেখা আমার উপন্যাসের প্রায় সব কটি অ্যাডভেঞ্চারধর্মী। ছোটরা, অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমিও অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করতাম। তবে আমার লেখা অ্যাডভেঞ্চারগুলো অন্য সবার মতো নয়। অ্যাডভেঞ্চার ও রোমাঞ্চ উপন্যাসের ভেতরও দেশের কথা আছে, দেশকে ভালোবাসার কথা আছে। এ কথা আমি ছোটদের সব সময় বলি–দেশকে যদি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো তাহলে এ দেশকে জানতে হবে, দেশের মানুষদের জানতে হবে, তাদের ভালোবাসতে হবে। আর যারা দেশের শত্রু তাদেরও চিনতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশের শত্রুদের ঘৃণা করতে হবে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম আমাদের শিক্ষক আর গুরুজনরা এভাবেই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, এভাবেই আমরা বেড়ে উঠেছি। যে সময়ের সঙ্গে আমি বেড়ে উঠেছি আমার লেখায় সেই সময়ের ছবিও পাওয়া যাবে।
শাহরিয়ার কবির
বইমেলা ২০০৫
Leave a Reply