কিরীটী রায় – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
ভূমিকা : কিরীটী রায়
কিরীটী রায়
‘গল্প বল না একটা!’ শিশুকণ্ঠের এই আদিম অনুরোধের সঙ্গে সকলেরই অল্পবিস্তর পরিচয় আছে। গল্প শোনার এই আগ্রহ, কৌতূহল –এ বোধ হয় নিয়েই জন্মায় মানুষ। এর তৃষ্ণা থাকেও শেষ পর্যন্ত। বৃদ্ধ বয়সে রামায়ণ মহাভারত ভাগবতের কাহিনী পাঠ বা শ্রবণের আগ্রহ এই আদিম আগ্রহেরই একটা অভিব্যক্তি বা পরিণতি মাত্র। কোন ধর্মগ্রন্থেই কাহিনীর অভাব নেই। প্যারা বা কাহিনীর মধ্য দিয়ে উচ্চ আদর্শ কি উপদেশ পাঠক ও শ্রোতাদের মনে বদ্ধমূল করে দেবার চেষ্টা শাস্ত্রকারদের মানব-মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে অভিজ্ঞতারই পরিচায়ক। শুধু শুষ্ক উপদেশ মানুষ শুনতে চায় না—গল্পের মধ্য দিয়ে তাকে শোনাতে হয়। এই একই উদ্দেশ্যে হিতোপদেশ পঞ্চতন্ত্র ঈশপের কাহিনীর অবতারণা। জাতক কাহিনীগুলির রচনা এই কারণে। আমার তো মনে হয় গীতার উপদেশগুলি ‘সে’ করার জন্যই মহাভারতের মত চমকপ্রদ কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনীর প্রয়োজন হয়েছিল বেদব্যাসের।
গল্প উপন্যাসে এই কৌতূহল কতকটা মেটে— কিন্তু পুরোটা মেটে না। ভেতরে ভেতরে কৌতূহলের অসহ পীড়নে জর্জরিত হবার যে চিরকালীন প্রবৃত্তি মানুষের, সেই প্রায়-স্যাডিস্ট প্রবৃত্তি মেটাবার প্রয়োজনেই একদা গোয়েন্দা কাহিনী রচনার কথা মনে এসেছিল মানুষের। এতে দুটো কাজ হয়—প্রথমত ‘কী হল’—‘কী হয়েছিল’ এই অদম্য ও পীড়াদায়ক কৌতূহল কতকটা তৃপ্ত হয়—দ্বিতীয়ত শেষ পর্যন্ত পাপী ধরা পড়বেই, পাপের ফল তাকে পেতেই হবে—সমাজরক্ষার জন্য একান্ত আবশ্যক এই ধারণাটাও পাঠকদের মধ্যে গড়ে ওঠে।
তবু, যতদিন গল্প উপন্যাসে আখ্যানভাগের ওপরই বেশি জোর দেওয়া হত – ততদিন গোয়েন্দা কাহিনী বা অপরাধ-কাহিনীর তত চাহিদা হয়নি। যেদিন থেকে নিরতিশয় ইনটেলেক্চুয়াল লেখকরা সাধারণ গল্পের মধ্যে বকুনি, বুকনি ও তত্ত্বের কচকচানি শুরু করেছেন এবং সেই অনুপাতে মানুষের ‘ধান্দা’ বেড়েছে অর্থাৎ সময় কমেছে—সেইদিন থেকেই এই সব অপরাধমূলক কাহিনীর চাহিদা বেড়েছে। বিলেতে তো সৎসাহিত্য বলতে যা সাধারণত বোঝায় সেই পুস্তকের চেয়ে সংখ্যায় অন্তত দশগুণ (হয়তো আরও বেশি) থ্রিলার বা ক্রাইম নভেল্স্ বেরোচ্ছে। রাশি রাশি, নানা ধরন ও নানা বরণের। এর একটা সুবিধা ট্রামে বাসে যেতে যেতে পড়া যায়, পড়ে ভুলে যাওয়া যায়, কর্মব্যস্ত মানুষ তার কাজের ক্ষতি না করেও পড়তে পারে। এ কাহিনীর চাহিদা না বেড়ে উপায় কি?
কিন্তু পড়ে ভুলে যাওয়া যায় না, কখনই ভোলা যায় না—এমন গোয়েন্দা কাহিনীও আছে বৈকি! কোনানডয়েলের শার্লক হোম্স্-এর কাহিনী, ফরাসী চোর-গোয়েন্দা আরসেন লুপ্যার কাহিনী, ফাদার ব্রাউনের গল্প, হাল পোয়ারো বা মিস মার্পল-এর গল্প—এগুলি ভিড়ে হারিয়ে যাবার গল্প নয়। এডগার য়্যালান পো-র গল্পকে ঠিক অপরাধ-মূলক কাহিনী বলা যায় না—কিন্তু তিনিও মানুষের কৌতূহলকে যেভাবে নাড়া দিয়েছেন তার তুলনা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। বাংলা দেশের কথাসাহিত্যে ইংরেজী বা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব স্বভাবতই বেশি। গোয়েন্দা কাহিনীতেও সে প্রভাব না পড়ার কথা নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুরকম প্রভাবই আছে। সাহিত্যের গতি-প্রকৃতির ওপর যে প্রভাব সেটা পরোক্ষ। গোয়েন্দা- কাহিনীর চাহিদা বৃদ্ধি সেই পরোক্ষ প্রভাবের ফল। এ দিকে প্রত্যক্ষ প্রভাবও যথেষ্ট। দীনেন্দ্র- কুমার রায় সোজাসুজি ইংরেজীর অনুবাদ করতেন—কিন্তু অনুবাদ না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে এমন কাহিনীর সংখ্যা কম নয়। পাঁচকড়ি দে’র (সম্পাদিত?) অনেক কাহিনী শেষোক্ত পর্যায়ে পড়ে। তবু পাঁচকড়ি দে আমাদের এদিকে পথ-প্রদর্শক, তাঁর কাহিনীগুলি—যা বিলাতী বই থেকে নেওয়া, তাতেও উগ্র বিলাতী গন্ধটা তিনি ঢেকে দিতে পেরেছেন। পরবর্তীকালে অনেক লেখকই—ইতিমধ্যে ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট অগ্রগতি সত্ত্বেও—তা পারেন নি।
আমাদের কৈশোর যখন অতিক্রান্ত সেই সময় বাংলা দেশের কিশোর সাহিত্যে গোয়েন্দা- কাহিনীর ঝুলি নিয়ে দেখা দিলেন দুই জাত-বৈদ্য—একজন হেমেন্দ্রকুমার রায়, অন্যজন বন্ধুবর ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত। আমরা অবশ্য তখন এসব বই পড়ার বয়স পেরিয়ে গেছি তবু জয়ন্ত-মানিকের এবং পরবর্তীকালে কিরীটী-সুব্রতর আবির্ভাবে বাংলা দেশের কিশোর- কিশোরী মহলে যে চাঞ্চল্য জেগেছিল সে বিষয়ে অনবহিত ছিলুম না। সে সুযোগও যে একেবারে গ্রহণ করিনি তা নয়। তরুণ গুপ্ত নামে এক গোয়েন্দা খাড়া করে কয়েকটি গল্প এবং উপন্যাস, নামে ও বেনামে লিখেছিলাম। তার সবগুলোতেই যে প্রত্যক্ষ বিলিতী প্রভাব ছিল তা নয়—কিছু কিছু স্বকপোল-কল্পনাও ছিল। কিন্তু সে প্রয়াস আমার খুব ক্ষীণ—আজ সে কথা সম্ভবত কারুর মনেও নেই।
তখন না পড়লেও পরবর্তীকালে জয়ন্ত-মানিক এবং কিরীটী-সুব্রতর কাহিনী পড়েছি । আশ্চর্যের কথা, পড়ে ভালও লেগেছে। কিরীটী-সুব্রতর গল্পের একটা বিশেষত্ব তখন যা মনে হয়েছিল তা হল কিরীটী-সুব্রতর কথাবার্তা চালচলনে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স কম। বিশেষত সুব্রত ঠিক ওয়াটসন কিংবা পোয়ারোর বন্ধু সেই মিলিটারি ক্যাপ্টেনটির মতো পাঁড়নির্বোধ নয়—সাধারণ মানুষের মতো তার একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে।
নীহারবাবু প্রখর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। ইউরোপের ছায়া যে বাংলা দেশে এসে পড়তে দেরি হবে না এটা তিনি পূর্বাহ্ণেই বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন যে আমাদের দেশেও যে রকম উন্নাসিক সাহিত্য দেখা দিয়েছে তাতে সাধারণ পাঠক ওই সব আখ্যানহীন গল্প ছেড়ে তাদের চিরন্তন কৌতূহল মেটাবার জন্য চিত্তের নূতন খাদ্য খুঁজবে। তাই তিনি প্রথমত কিরীটী রায়কে কিশোরদের আসরে নামালেও সেখান থেকে সরিয়ে আনতে বিলম্ব করেননি। কিরীটী রায় পরিণতবুদ্ধি পাঠকদের আসরে দেখা দিলেন এবং দেখতে দেখতে আসর জমিয়ে বসলেন । তাঁর চাহিদা যে বেড়েই যাচ্ছে দিন দিন তার প্রমাণ এই বইগুলির ক্রমবর্ধমান বিক্ৰী নীহারবাবু, যাকে ‘শুদ্ধসাহিত্য’ বলে তাও যে রচনা করতে পারেন তা প্রমাণিত করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক কালের একাধিক জনপ্রিয় উপন্যাসে। ‘অস্তি ভাগীরথী তীরে’ এই শ্রেণির রচনার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু মানব-মনের সেই মৌলিক পিপাসার কথা তিনি ভোলেননি। গল্প চাই, মোটা-সোটা ভারীভুরি নিরন্ধ্র জমাট গল্প—যা পাঠককে রুদ্ধশ্বাসে টেনে নিয়ে যাবে তাঁর লেখনীর সঙ্গে সঙ্গে। তাঁর কি গোয়েন্দা-কাহিনী কি সাহিত্যিক উপন্যাসে—কোনটাতেই তাই গল্পের অভাব নেই। বুকনি বকুনি তত্ত্বকথা ও তর্কের অবতারণা তাঁর রচনাতে নেই—পণ্ডিতম্মন্যতার দাবিও তিনি করেন না—কিন্তু গল্প গাঁথতে তাঁর জুড়ি বাংলা সাহিত্যে আজ বিরল। আর তাঁর সেই অসামান্য শক্তির পূর্ণতার বিকাশ ঘটেছে তাঁর এই গোয়েন্দা-কাহিনীগুলিতে। সেই জন্যই তাঁর কিরীটী রায় এত জনপ্রিয়, ‘রাজার প্রাসাদ হতে দীনের কুটীরে’ তার এত আমন্ত্রণ, এত সাদর অভ্যর্থনা!
বোধ হয় অনেক কথা বলে ফেললাম। আসল উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান গ্রন্থটির পরিকল্পনা ও গ্রন্থনার জন্য তাঁকে বাংলা দেশের অগণন পাঠক-পাঠিকার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানানো । কিরীটী রায়ের এতগুলি ছোট বড় মাঝারি গল্প একসঙ্গে একটি বইয়ে পাওয়া—কিরীটী রায়ের ফ্যানদের পক্ষে একটি স্মরণীয় ঘটনা। এ শ্রেণীর ‘ওমনিবাস্ ভল্যুম’ বিলেতে অনেক আছে, বেরোচ্ছেও প্রায়ই, এদেশে কিন্তু খুব একটা চল হয় নি এখনও। কিরীটী রায় সে অভাবও কিছুটা দূর করলেন। সেজন্য তাঁকে ও তাঁর স্রষ্টা নীহারবাবুকে আর একদফা ধন্যবাদ জানাচ্ছি।।
– গজেন্দ্রকুমার মিত্র
.
সূচীপত্র
সংকেত
বাঘনখ
রক্তমুখী নীলা
রেশমী ফাঁস
পদ্মদহের পিশাচ
পঞ্চমুখী হীরা
নেশা
রহস্যভেদী
কালোহাত
প্রহেলিকা
বত্রিশ সিংহাসন
স্বর্ণমূর্তি
বিবের ধোঁয়া
রহস্যের যবনিকা
বেলেডোনা
ছায়া-মৃত্যু
চিতাবাঘ
১৩নং ঘর
Leave a Reply