কাশবনের কন্যা – শামসুদ্দীন আবুল কালাম
কাশবনের কন্যা – উপন্যাস – শামসুদ্দীন আবুল কালাম
উৎসর্গ – সকল কবিকুল প্রতি
এই গ্রন্থটি পরিমার্জিতরূপে আবারও প্রকাশ সম্ভব হইল প্রথম প্রকাশক এবং আমার বন্ধু ওসমানিয়া বুক ডিপোর স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম সাহেবের অতুলনীয় সৌজন্যে এবং মুক্তধারার অক্লান্ত হৃদয় শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহার আগ্রহে ও সুজনসুলভ উৎসাহে। নানা দেশের বহু ব্যক্তি এই বইটি সম্পর্কে কেবল আগ্রহই প্রকাশ করেন নাই, বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের জন্যও উদ্যোগী হইয়াছিলেন; ১৯৫৬ সালে জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা এজন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়াছিলেন এবং জার্মান ভাষায় প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ হইয়াছিলাম। কিন্তু কোনো বিশেষ কারণে, এবং অন্নদাশঙ্কর রায় ও শ্রীমতী লীলা রায়ের আগ্রহ সত্ত্বেও বইটি আবারও পূর্ণাঙ্গরূপে প্রস্তুতের পূর্বে কোনো অনুবাদ সঙ্গত মনে করি নাই। বইটির অসাধারণ সাফল্যের জন্য কেবল গুণগ্রাহীদের নিকটই আমি ঋণী নহি, আমার দেশ, দেশবাসী এবং তাহার জীবনবাদী জীবনসংগ্রামী সমস্তজনের নিকটও গভীরভাবে ঋণবদ্ধ হইয়া আছি। কতকগুলি ভাব ও ভাবনার গতি-প্রকৃতি লক্ষ করিয়া তাহাদের কাব্যে ধারণের দুঃসাহস দেখাইয়াছি। প্রসঙ্গত আমার এই জাতীয় রচনায় ধ্রুপদী বাংলাভাষার সঙ্গে দেশের আঞ্চলিক ভাষার সমাহার ইঙ্গিতও ইচ্ছাকৃত; আপন জীবন-সত্তাকে খুঁজিয়া লইবার জন্য এই মাধ্যম অতি প্রয়োজনীয় মনে করিয়াছি; নিছক ‘অনাধুনিক’ বলিয়া শ্রেণিভুক্ত করা সময় সময় অত্যন্ত স্কুল অধিকার বলিয়া মনে হয়।
শামসুদ্দীন আবুল কালাম
বৈশাখ, ১৩৯৪
.
ভূমিকা – পবিত্র সরকার
বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করেই যশস্বী এবং জনপ্রিয় হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। শামসুদ্দীন আবুল কালামও (১৯২৬) এই দৃষ্টান্তমালার মধ্যে অন্যতম উল্লেখ্য এক উপন্যাসকার। তাঁর কাশবনের কন্যা (১৯৫৪) উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন তুলেছিল, এবং আমাদের মতে, পূর্ব পাকিস্তান তথা পরবর্তী বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস যে পশ্চিম বাংলা তথা সর্ববঙ্গীয় গল্প-উপন্যাসের ব্যাপকতর ধারার মধ্যে একটি নিজস্বতা অর্জন করতে শুরু করেছিল-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র লালসালু (১৯৪৮)-র পরে তারও এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তখন পূর্ব পাকিস্তান নামাঙ্কিত পূর্ববাংলার ব্যাপকতর বাঙালি জীবন যে সব কারণে বৃহত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি তার প্রতিবেশিক কারণগুলি এখানে সম্পূর্ণ আলোচনা করার অবকাশ নেই। পদ্মা প্রমত্তা নদী ও অন্যান্য গল্প-উপন্যাসের লেখক সুবোধ বসু সে অর্থে জনপ্রিয় ছিলেন না, কুরপালা, গৌরীগ্রাম, শতাব্দীর লেখক রমেশ চন্দ্র সেনও না। প্রমথনাথ বিশীর পদ্মা বা জোড়াদিঘির চৌধুরী পরিবার সে অর্থে জনজীবনের আখ্যান নয়। যদি বলি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ-আশ্রিত উপন্যাসগুলিও ভূমিগত জনজীবনের ছবি হয়ে উঠতে পারেনি, তা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হবে, তবে হয়তো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত হবে না। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটোগল্পে অবশ্য পূর্ববাংলার জনজীবনের দু’একটি ঘনিষ্ঠ ছবি আছে। পরবর্তীকালে উদবাস্তু লেখক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় পূর্ববঙ্গ এসেছে মূলত নস্টালজিয়ার ভেলায় চড়ে। সে ভূমি অল্পবিস্তর অতীতে এবং এক বিষণ্ণ সৌন্দর্যে আশ্রিত। কিন্তু এসব বহু আখ্যানেই প্রধান-ভাবে জুড়ে আছে মধ্যবিত্ত (কখনও বা জমিদার শ্রেণিভুক্ত) হিন্দু সমাজ। অখণ্ড বাংলার খাদ্য-অর্থনীতির যারা প্রাণ ছিল সেই কৃষক-মৎস্যজীবী সমাজের, বিশেষত মুসলমান শ্রমজীবী সমাজের গভীর ও অন্তরঙ্গ ছবি এঁদের লেখায় খুব বিস্তারিতভাবে নেই। দেশভাগ পূর্ববর্তীকালে প্রকাশিত বাঙালি মুসলমান লেখকদের গল্প-উপন্যাস সম্বন্ধেও বহুলত এই কথা বলা যেতে পারে, যদিও কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। তাদের মূল উপজীব্য ছিল জায়মান মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের জীবন।
এমন হওয়াই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ যে-সময়ে পঞ্চভূত (১৮৯৭)-এর “মনুষ্য” প্রবন্ধে একটি সহজ নৈসর্গিক রূপক ব্যবহার করে লিখেছিলেন যে, বাঙালি লেখকদের মনোযোগর সূর্যালোক প্রথমে পড়েছিল পাহাড়ের চূড়োগুলির উপর-অর্থাৎ উচ্চবিত্ত অভিজাত শ্রেণীর নায়ক-নায়িকার উপর-পরে তা ক্রমশ নীচের উপত্যকাভূমিতে এসে পড়েছে-তা তখনও পুরো সত্য হয়নি। তারা দীর্ঘদিন উপন্যাসে গৌণ ও বিচ্ছিন্ন পার্শ্বচরিত্র হয়ে থেকেছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় গোষ্ঠীর বাঙালি লেখকের রচনাতেই। ছোটোগল্পে অবশ্যই দু’চারটি ব্যতিক্রম দেখা গেছে। আমরা যাকে ‘জনজীবন’ বলি অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত, স্কুল-কলেজে পড়া বাঙালি সমাজের মনোযোগের অবস্তরে নির্বাসিত শ্রমজীবী, বিশেষত ভূমিশ্রমিক সমাজের জীবন, তা আখ্যান-সাহিত্যে তেমনভাবে আসেনি। আজকাল আমরা যে Marginalised কথাটি ব্যবহার করি তা এদের অস্তিত্ব এবং সাহিত্যে তার প্রতিবিম্বনের যে তীব্র দারিদ্রতার অর্থকে যথেষ্ট প্রকাশ করে না।
মুসলমান আত্মস্বাতন্ত্র বোধের উদ্ভবের একটা সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা এদেশের ইতিহাসে যথেষ্ট করা হয়েছে, আমাদের তার যুক্তিযুক্ততার বিচারে যাবার অবকাশ নেই। সব ঘটনারই নানাপার্শ্বিক দৃষ্টান্ত থাকে এবং এর কোনো একটি পিঠ ধরে নিয়ে অনেকেই পুরো ঘটনাটাকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। আমাদের মতে বাঙালি মুসলমান সমাজের এই স্ব-চেতনার জাগরণের ফলে যে-লাভ হয়েছে তা ওইখানে তাঁরা তাঁদের নিজেদের সমাজের জীবনকে তীক্ষ্ণ, ঘনিষ্ঠ ও মমতাময় দৃষ্টি দিয়ে দেখার অবকাশ খুঁজে নিয়েছেন এবং সাহিত্যে তার চিত্রণে মনোযোগী হয়েছেন। এতে অবশ্যই শ্রেণিগত বাধাও ছিল, সকলে সমানভাবে জনজীবনের ছবি আঁকতে পারেননি। সে-সম্ভাবনা একদিক থেকে অনুমানযোগ্য ছিল। যে-অভিজ্ঞতা লেখকের অধিগত নয়, যিনি এমনকি আকাক্ষা এবং সহানুভূতি দিয়েও সে অভিজ্ঞতার ক্ষতিপূরণ করতে পারেন না, তাঁরা এ বিষয়ে লিখতে গেলে রক্তমাংসহীন রোমান্টিক ছবি আঁকবেন-এমন ভয় থেকে যায়। কাজেই আমরা যখন বলি যে, হিন্দু বা মুসলমান জনজীবন বাঙালি লেখকদের রচনায় দীর্ঘদিন আসেনি, তা নিছক ঘটনা হিসেবে নির্দেশ করি, লেখকদের প্রতি অভিযোগ হিসেবে নয়।
পূর্ব-বাংলায় পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় মুসলমান জনজীবন সে দেশের আখ্যানে আসার সুযোগ যে বাড়ল, এতে আমাদের সুনিশ্চিত লাভই হল। আশা করি এ কথাকে কেউ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রীয় সত্তার সৃষ্টির সমর্থন বলে ধরে নেবেন না। লাভ হল এই যে, যারা এতদিন উপন্যাসে নায়ক হতে পারেনি, তারা নায়ক হয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। অন্যদিকে বাঙালি কে ও কারা সে প্রশ্নের সীমানা, বাঙালি জীবনের বিস্তার যে শহুরে মধ্যবিত্ত এবং গ্রামীণ ও দরিদ্র, মূলত হিন্দু জীবনের বাইরেও আরও বহুদূর প্রসারিত তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। এ হল বাঙালির সংস্কৃতি বা সমাজচৈতন্যের ঘনীভবনের দিক থেকে লাভ, যদিও আমরা সকলে এই লাভ বিষয়ে সমান সচেতন নই। সাহিত্যের ভূগোল ও সমাজ-বিস্তার আগেও ঘটেছে, দূর দেশ বা দূর কালের মানুষদের আখ্যান পড়ে আমরা মানুষের অস্তিত্বের মূল কথাগুলি যে অভিন্ন, দেশকালের ভেদরেখা দিয়ে সম্পূর্ণ অবিচ্ছিন্ন নয়-তা অনেক রচনা পড়েই আমরা বুঝতে শিখেছি। কিন্তু এই পৃথিবীব্যাপী মনুষ্যত্বের এক মূল্যবান খণ্ড যে বাঙালি বা বঙ্গভাষী মানুষেরা তাদের সামগ্রিক পরিচয়ই তো আমাদের অনেকের কাছে অস্পষ্ট।(১) ফলে এসব বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানবিক এবং বাঙালিত্বের বোধ আরও সমৃদ্ধ হয়। যারা শিল্পকৈবল্যবাদী তারা এ কথাগুলিকে অবান্তর বলে মনে করবেন। কিন্তু আমরা যারা সাহিত্যপাঠকে আত্মচৈতন্যের প্রসার ও ঘনীভবনের একটা উপায় বলে মনে করি, শুধু বিনোদন-নির্ভর সময়যাপনের নয়, তাদের কাছে এ বিষয়গুলিও গুরুত্বপূর্ণ।
.
২.
যতদূর দেখা যাচ্ছে, শামসুদ্দীন আবুল কালামের মূল সৃষ্টিকাল ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮। কিন্তু ১৯৬৪-র চোদ্দ বছর পর আর একটিমাত্র উপন্যাস লেখেন তিনি, ওই ১৯৭৮-এ প্রকাশিত হয় জায়জঙ্গল। ফলে কার্যত ১৯৬৪ পর্যন্তই তিনি অব্যাহত রূপে সর্জনশীল ছিলেন, একথা বলা যেতে পারে। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলি প্রথমে প্রকাশিত হয়-অনেক দিনের আশা (১৯৫২), পথ জানা নেই (১৯৫৩), ঢেউ (১৯৫৩), দুই হৃদয়ের তীর (১৯৫৫)। তারপর ১৯৫৪ তে কাশবনের কন্যা প্রথমে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উপন্যাসের ধারাবাহিকতার শুরু হয়। তারপরে কাছাকাছি সময়ান্তরে প্রকাশিত হয় আশিয়ানা (১৯৫৫), জীবন-কাব্য (১৯৫৬), কাঞ্চনমালা (১৯৬১), দুই মহল (১৯৬৪), আলম-নগরের উপকথা (১৯৬৪)। জায়জঙ্গল অনেক পরে সেকথা আগে বলেছি।
এ-বিষয়ে যেটুকু আলোচনা আমরা দেখার সুযোগ পেয়েছি, তাতে লেখকের অন্য গল্প-উপন্যাস খুব একটা মনোযোগ পায়নি, মূলত কাশবনের কন্যা-র উপরেই সকলের নজর পড়েছে। তার একটি কারণ, কাশবনের কন্যা প্রথম প্রকাশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। তার একটা ইঙ্গিত আছে বৈশাখ ১৩৯৪ সংস্করণে লেখকের ভূমিকায়-”নানা দেশের বহু ব্যক্তি এই বইটি সম্পর্কে কেবল আগ্রহই প্রকাশ করেন নাই, বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের জন্যও উদ্যোগী হইয়াছিলেন; ১৯৫৬ সালে জাতিসঙ্রে শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা এ-জন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়াছিলেন এবং জার্মান ভাষায় প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ হইয়াছিলাম। কিন্তু কোনো বিশেষ কারণে এবং অন্নদাশঙ্কর রায় ও শ্রীমতী লীলা রায়ের আগ্রহ সত্ত্বেও বইটি আবার পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রস্তুতের পূর্বে কোনও অনুবাদ সঙ্গত মনে করি নাই। বইটির অসাধারণ সাফল্যর জন্য (২) কেবল গুণগ্রাহীদের নিকটই আমি ঋণী নহি, আমরা দেশ, দেশবাসী এবং তাহার জীবনবাদী জীবনসংগ্রামী সমস্তজনের নিকটও গভীরভাবে ঋণবদ্ধ হইয়া আছি।”
বইটির পাঠকপ্রীতির দিক থেকে ওই অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও এটি সমালোচকদের কাছ থেকে তেমন উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনা পায়নি। অন্তত আমার ব্যবহৃত সীমাবদ্ধ কয়েকটি সূত্র থেকে এই ধারণা হওয়া সম্ভব। বিশেষত মননশীল সমালোচক সৈয়দ আকরম হোসেন এক প্রবন্ধে (৩) বাংলাদেশের উপন্যাসের আঙ্গিক আলোচনা প্রসঙ্গে কাশবনের কন্যাকে দূরাঞ্চলের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাসের অন্তর্গত করেছেন এবং “বিষয় ও শিল্পের জৈবিক সমগ্রতা নির্মাণে অধিকাংশ উপন্যাসই অসফল”-এগুলি সম্বন্ধে এই সাধারণ মন্তব্য করেছেন। এ উপন্যাসটি সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ মন্তব্য, অতি রোমান্টিকতার অন্তর্দ্বন্দ্ব উপন্যাসটির সম্ভাবনাটিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে”। (৪) আমরা জানি না অধ্যাপক হোসেন উপন্যাসটির কোন সংস্করণ ব্যবহার করেছিলেন।
.
৩.
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কাশবনের কন্যা-র পুনঃপাঠ করছি, মূলত পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের জন্য। প্রথমেই লক্ষ করি, সাধারণ উপন্যাসের আখ্যানবয়নের প্রচলিত রীতি থেকে উপন্যাসটির রচনায় লেখক বেশ কিছু নতুনত্ব এনেছেন। এতে পরিচ্ছেদ পঁচিশটি, কিন্তু পরিচ্ছেদগুলি সংখ্যায়িত নয়, এমনকি ক্ৰমচিহ্নিতও নয়। পরিচ্ছেদ শুরু চিহ্ন হল একটি অতিরিক্ত পৃষ্ঠা, যাতে সম্ভবত জয়নুল আবেদিনের একটি ছবির ফ্রেমে একটি লোকসঙ্গীত বা কবিতার অংশ মুদ্রিত। আমাদের সংস্করণ প্রস্তুত হয়েছে বইটির ‘জয়ন্তী সংস্করণ’ (রজত জয়ন্তী?) থেকে, জানি না এই সংস্করণে ছবির এই বিশেষ সংযোজন ঘটেছিল কি না। অর্থাৎ মামুলি ন্যারেটিভ ধরনের একটি গদ্যবর্ণনা ও সংলাপময় উপন্যাস না লিখে লেখক প্রথমেই এটিকে লোক-বৃত্তান্তের আঙ্গিকে বাঁধবার চেষ্টা করেছেন, লোককথার একটি আবহ তৈরি করেছেন। অজস্র লোকসংগীত, কিছু লোকগল্প প্রচুর গ্রামীণ শব্দ ও গ্রাম্য প্রবাদ-প্রবচন ছড়িয়ে দিয়েছেন। চরিত্রগুলি সম্পূর্ণতই গ্রামীণ, সম্ভবত বরিশাল অঞ্চলের নদী খালবিল কর্ম-পরিকীর্ণ বৃক্ষলতাবহুল মফস্সলের বাসিন্দা, ফলে এক মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ জীবন যেন প্রায় এক গ্রাম্যগাথার মতো পরিবেশিত হয়েছে। বাস্তৃতিনের হেটারোগ্লসিয়া, বা বহুস্বরিকতা সম্বন্ধে লেখক অবহিত ছিলেন কি না জানি না, কিন্তু এ উপন্যাসের নানাবিধ স্বর পাঠকের চোখে না পড়ে পারে না। শুধু বর্ণনা ও সংলাপ দিয়ে এ আখ্যান রচনা করেননি শামসুদ্দীন আবুল কালাম। লোক-সংগীত ও কবিতা থাকছে প্রতিটি পরিচ্ছেদের আগে, ভূমিকা হিসেবে, ভিতরে তো আছেই নানা স্বরবৈচিত্র্য। আখ্যান তো আছেই, আখ্যানের বাইরেও আছে একটি ব্যাপকতর লোকনন্দনতত্ত্বের পরিমণ্ডল।
সম্ভবত এই পরিমণ্ডল রচনার জন্যই খুব সচেতনভাবে লেখক উপন্যাসটি রচনা করেছেন এক কাব্যময় সাধুভাষায়। অনেক আগে থেকেই বাঙালি মুসলমান লেখকের মান্য চলিত ভাষায় লিখেছেন তার মধ্যে সাধুভাষার এই বই যে একটু বিরূপ সমালোচনা পেয়েছিল তার খবর লেখকের ভূমিকাতেই পাই-”প্রসঙ্গত আমার এই জাতীয় রচনার ধ্রুপদী বাংলাভাষার সঙ্গে দেশের আঞ্চলিক ভাষার সমাহার ইঙ্গিতও (ঈস্পিত ও?-প.স.) ইচ্ছাকৃত; আপন জীবনসত্তাকে খুঁজিয়া লইবার জন্য এই মাধ্যম অতি প্রয়োজনীয় মনে করিয়াছি; নিছক ‘অনাধুনিক’ বলিয়া শ্রেণিভুক্ত করা সময় সময় অত্যন্ত স্কুল অধিকার বলিয়া মনে হয়।”
আমরা লেখকের সঙ্গে একমত। এ উপন্যাসের সমগ্র আবহের সঙ্গে সমন্বিত বর্ণনার ভাষা একমাত্র সাধুভাষা হওয়াই সম্ভব ছিল। উপরের ওই বহুস্বরিকতা ছাড়াও লেখক সাধুভাষাকে বর্ণনায় ব্যবহার করে তাঁর রচনাকে প্রমুখিত বা foregrounded করার প্রয়াস পেয়েছেন, ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেছেন।
.
৪.
তবু উপন্যাসে আখ্যান-কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং সাধারণ পাঠকের কাছে ‘গল্পটা কী দাঁড়াল’ সেই বিবেচনাই শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের জনপ্রিয়তা নির্ধারণ করে।
এখানে কাশবনের কন্যা-র জয়ন্তী সংস্করণ নতুন করে পড়তে গিয়ে বর্তমান সমালোচক আখ্যানের বিবর্তন দেখে একটু বিমূঢ় বোধ করে। লেখকের ভাষা ও অন্যান্য প্রকরণ যেমন ঈপ্সিত ও ইচ্ছাকৃত, তার আখ্যানবনও কি তাই? তিনি কি ইচ্ছাপূরক উপসংহার সম্পূর্ণ বর্জন করবেন বলেই এ উপন্যাসের পরিণতি এভাবে নির্মাণ করেছেন? বইটি পড়ে মনে হয় না যে লেখক একদিকে হোসেন-সখিনা বা হোসেন-মেহেরজানের উপাখ্যান, অন্যদিকে শিকদার-জুবেদার উপাখ্যান কোনো একটা সুখকর বা আকাঙ্ক্ষিত সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। বরং মনে হয়, তিনি যেন ইচ্ছা করে ওই পাঠক-মনোরঞ্জক ও তৃপ্তিবিধায়ক পরিসমাপ্তি থেকে পলায়ন করেছেন, বা সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকেছেন। তাঁর লক্ষ্যই তা ছিল না। এসব সত্ত্বেও বইটির ‘অসামান্য সাফল্য’ আমাদের আখ্যান-বিন্যাস ছাড়াও পাঠকপ্রিয়তার অন্যান্য সূত্রের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করে।
আখ্যান খুব জটিল নয়। মূলত দু’জোড়া নায়ক-নায়িকার দুটি প্রায় সমান্তরাল উপকাহিনী এ উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। দুই নায়ক পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও নায়িকাদের পরস্পরের সঙ্গে কোনো যোগ নেই। হোসেনের ক্ষেত্রে দুটি নায়িকা, সময়ক্রমে একে অন্যের অনুবর্তী-সখিনা আর মেহেরজান। শিকদারের ক্ষেত্রে একটি, জুবেদা। হোসেনের উপাখ্যানে হোসেন-সখিনার সম্পর্কের মধ্যে গ্রাম্য প্রেমের চেহারাটাও তত স্পষ্ট হয়নি। সখিনাকে বিয়ে করার কথা হোসেন ভেবেছে অনেকটা হঠাৎ কিশোরী সখিনাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে, নিজের সাংসারিক প্রয়োজনের কথা হিসেব করে। সখিনার বাবা গঞ্জে আলীর প্রতি তার নিজের বাবার অত্যাচারের স্মৃতিতে তার অনুতাপও হয়তো সখিনার প্রতি হোহাসেনের মনকে আর একটু নিবিষ্ট করে। কিন্তু তা ঠিক প্রেমের, এমনকি পূর্বরাগের পুরো বিস্তার পায় না। হয়তো ওই সমাজের বাস্তব তার অনুকূল ছিল না। সখিনার বিয়ে হয়ে যায়, অত্যাচারিত হয়ে স্বামীর ঘর থেকে সে ফিরে আসে, তার পরে সখিনার মা হোসেনের প্রতি মেয়ের অনুরাগের কথা জানতে পারে। কিন্তু ততদিনে হোসেন-সখিনার আখ্যান থেকে ছবদার মাঝির ইতিবৃত্তে ঢুকে পড়েছে। সে আর এ খবর পাবে না। যে এ খবর জানল, সেই বন্ধু শিকদার তাকে এ খবর দেবারও সুযোগ পাবে না। হোসেনের জীবনের এই দ্বিতীয় পর্বে তার সমানে আসবে মেহেরজান, এবং মেহেরজানও স্বামী-পরিত্যক্তা এবং গ্রামের পুরুষপ্রজাতির লোভে তার নিরাপত্তা যথেষ্ট অনিশ্চিত। তখন মুমূর্ষ ছবদার মাঝিকে পৌঁছে দিতে আসা সহানুভূতিশীল শক্তসমর্থ যুবক হোসেনের মধ্যে সে যে একটা মুক্তির সম্ভাবনা দেখবে তাতে কোনো বিস্ময় নেই। এখানে মেহেরজানের দিক থেকেই আকর্ষণের সূত্রগুলি প্রথমে তৈরি হয়। কিন্তু এখানেও সম্পর্ককে কোনো পরিণতিতে পৌঁছে দিতে ঔপন্যাসিকের অনীহা আমাদের বিস্মিত করে। হোসেন মেহেরজানকে এবং ছবদার মাঝির আখ্যান ছেড়ে চলে যায়, হয়তো নিজের এবং সখিনার প্রাক্তন জগতে ফেরার লক্ষ্যে। কিন্তু আমরা আর তার খবর পাই না।
উপন্যাসের শুরুতে মনে হয় এটা সম্ভবত হোসেনের গল্প, শিকদার বুঝি বা এক গৌণ চরিত্র হয়ে থাকবে। কিন্তু আখ্যান একটু এগোলে দেখা যায়, শিকদার-জোবেদার আখ্যান অনেক প্রাধান্য পেয়েছে। উপন্যাসের পঁচিশটি পরিচ্ছেদ। শুরুর দিকে তিনটি পরিচ্ছেদে হোসেন-সখিনার সূত্র আসে, শিকদার গৌণভাবে উপস্থিত থাকে। চতুর্থ পরিচ্ছেদে হোসেনের জীবনে আসে ছবদার মাঝির সূত্র, সেখানে শিকদার নেই। পঞ্চমে শিকদার জোবেদার গল্প একটু প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু এভাবে পৃথক পৃথক নির্দেশ না দিয়ে আমরা হোসেন ও শিকদারের দুটি উপকাহিনীর পরিচ্ছেদ অনুযায়ী তালিকা দিই–
১ হোসেন প্রধানভাবে বিবৃত, শিকদার গৌণ
২ হোসেন
৩ হোসেন
৪ হোসেন-ছবদার মাঝি সূত্র আরম্ভ
৫ শিকদার
৬ হোসেন-ছবদার প্রসঙ্গ চলছে
৭ শিকদার
৮ শিকদার
৯ শিকদার
১০ জোবেদা (শিকদার-আখ্যানের অংশ)
১১ হোসেন-ছবদার-মেহেরজান
১২ শিকদার
১৩ শিকদার
১৪ হোসেন-মেহেরজান
১৫ হোসেন-মেহেরজান
১৬ শিকদার
১৭ জোবেদা (শিকদার-আখ্যান)
১৮ জোবেদা-শিকদার
১৯ শিকদার
২০ শিকদার
২১ শিকদার
২২ শিকদার
২৩ শিকদার
২৪ শিকদার
২৫ শিকদার
এই তালিকায় লক্ষ করি, ২৫টি পরিচ্ছেদের মধ্যে মোট মাত্র আটটিতে হোসেনের মোটামুটি প্রধান উপস্থিতি, বাকি ১৭টিতে শিকদারের গল্প। এতে পাঠক-সমালোচক সকলেই একটু বিভ্রান্তিতে পড়েন। প্রথম পরিচ্ছেদে এই প্রত্যাশা তৈরি হয় যে, হোসেনই এ উপন্যাসের নায়ক হতে চলেছে, শিকদার বড়ো জোর তার সহনায়ক মাত্র। কিন্তু সপ্তম পরিচ্ছেদ থেকেই হোসেনের গল্পকে পার্শ্বিকতায় ঠেলে আস্তে আস্তে শিকদারের গল্প ছড়াতে থাকে। ফলে কে নায়ক কে উপনায়ক এ সম্বন্ধে ধাঁধা তৈরি হয়ে যায়। এবং দুটি উপাখ্যান আর মেলে না, শিকদার আর হোসেনের জীবনবৃত্ত পৃথক হয়ে যায়, যদিও প্রথম পরিচ্ছেদে অন্যরকম প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত দুটি বা আড়াইখানা প্রেম-সম্পর্কের কোনোটিতেই লেখক পাঠকের প্রত্যাশাপূরণ করেন না। কেন? লেখক কি এর মধ্য দিয়ে কোনো একটা প্রতিবাদ জানাতে চান পাঠক-প্রত্যাশার ছকবাঁধা সূত্রের বিরুদ্ধে? তাঁর চরিত্রগুলির মধ্যে জোবেদা ছাড়া আর কেউ তেমন প্রতিবাদী নয়। জোবেদা সখিনা ও মেহেরজানের তুলনায় অনেক বেশি জটিল, নিজের ইচ্ছা ও শক্তিতে বিশ্বাসী, কারও প্রত্যাশা না করে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তা যদি তার ধ্বংস ডেকে আনে তা হলেও। শিকদারের প্রতি তার ‘হা রে পুরুষ!’ উক্তিটি কবি-দার্শনিক-গায়ক, অর্থাৎ বাউলখ্যাপা শিকদারের প্রতি সংগত ধিক্কার–কারণ ইচ্ছাশক্তির এই প্রবণতা শিকদারের মধ্যেও নেই। বস্তুতপক্ষে সমগ্র উপন্যাসেই জোবেদা একটি অত্যন্ত সজীব চরিত্র। শিকদারের বন্ধু মনসব-সর্দার একটি ভালো টাইপ চরিত্র, খানিকটা কবি-র বন্ধু গুমটিম্যান রাজার মতো, কিন্তু এই একমেটে চরিত্রে জোবেদার জটিলতা নেই। শুধু রাজার চেয়ে তার প্রশাসনিক শক্তি ও সে সম্বন্ধে সচেতনতা অনেক বেশি, তা সে জাহিরও করে।
প্রতিবাদ কি এই ইঙ্গিতের মধ্যেও যে, ওই গ্রামীণ বাস্তবে পাঠকের ইচ্ছাপূরক কোনো ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়, ধর্মশাসিত ও লোকাঁচার পীড়িত ওই গ্রামীণ নিঃস্বতার মধ্যে ওই মানুষগুলির ক্ষেত্রে কোনো ইচ্ছাপূরণ ঘটে না-তাদের জীবন এমনই ভাঙাচোরা থেকে যায়, এবং তাদের নানাভাবে বাস্তব থেকে পলায়ন খুঁজে নিতে হয়-হোসেন যেমন মেহেরজানের সঙ্গ থেকে পালায়, শিকদার যেমন জোবেদার সঙ্গ থেকে। সে এমনিতেই স্থায়ী পলায়নের আশ্রয় পেয়েছিল তার সংগীত ও তত্ত্বচিন্তায়, কিন্তু তা তার ও জোবেদার যুগ্ম জীবনকে কোনো ইতিবাচক সমর্থন দিতে পারেনি।
কিংবা লেখক কি চেয়েছিলেন মৈমনসিংহগীতিকার কোনো একটি ট্র্যাজিক গীতিকার আদলে তৈরি করবেন তার আখ্যান?
আমরা লেখককে ‘সংশয়-সুবিধা বা বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে তাঁর মনের কথাটি বোঝবার চেষ্টা করছি-এর জন্য কেউ কেউ সমালোচক উইম্স্যাট-এর কথা ধরে আমাদের কাজকে intentional fallacy বলে আখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু লেখক কেন এভাবে তার আখ্যানকে গাঁথলেন তা বোঝবার প্রয়োজন আছে।
.
৫.
অথচ গ্রন্থটি আখ্যাননির্মাণের পুথিগত রাস্তা এবং নিটোল গল্প বলার পথ পরিহার করেও প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জয়ন্তী সংস্করণ যদি পঁচিশতম সংস্করণ হয়, তবে একটি উপন্যাসের পক্ষে তা তুচ্ছ ঘটনা নয়। ওই ‘অসামান্য সাফল্যের উৎস তাহলে কোথায় নির্দেশ করব আমরা? কেন। সমালোচকদের পুথিগত ছিদ্রসন্ধান, সংগঠনগত ভারসাম্যচ্যুতি এবং ইচ্ছাপূরণকে উপেক্ষা করেও বইটি এমন সাফল্য পেয়ে গেল?
আমাদের ধারণা, এর পিছনে মূলত আছে দুটি কারণ। এক, এ উপন্যাসের চরিত্র ও ঘটনাগুলি পূর্ববাংলার জনজীবনের চরিত্র ও স্বভাবকে এমনই সহজ ও বাস্তব করে এঁকেছে যে, ওই নরনারী ও নিসর্গের সঙ্গে পাঠকের যুক্ত হতে মুহূর্ত দেরি হয় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে হোসেন সখিনা জোবেদা ছবদার মেহেরজান শিকদারের জীবন সম্বন্ধে এখন কিছুই জানি না, কিন্তু আমারও এদের অবিশ্বাস্যরকমের চেনা লেগেছে এবং এদের আশা-হতাশা-স্বপ্ন স্বপ্নভঙ্গ ও নানা সুখ-দুঃখের কথা জানবার শুধু ইচ্ছেই হয়নি, মনে হয়েছে সেকথা জেনে আমি মানবিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি। অর্থাৎ আখ্যান নির্মাণে লেখক আমাকে খুশি না করার যে-প্রকল্পই গ্রহণ করুন না কেন, তিনি আমাকে এই আড়ালে থাকা মানুষগুলির তৈরি জীবনকথা পড়তে বাধ্য করেছেন। আরও অনেককেই করেছেন, নইলে বইটি জনপ্রিয় হল কী করে?
কোন উপায়ে বাধ্য করেছেন আমাকে? তা হল তাঁর বয়ান, গল্পটিকে যে ভাষায় এবং যে ভঙ্গিমায় ও প্রকরণে তিনি বলেছেন সেই উপায়টি প্রায় অনিবার্য ছিল। সাধুভাষায় লেখক লিখেছেন, এবং ‘অনাধুনিক হিসেবে সমালোচিত হয়েছেন-তার উল্লেখ আমরা পাই। কিন্তু মনে হয়, লেখক একটি গদ্য গাথাকাব্য হিসেবে উপন্যাসটিকে ভেবেছিলেন, এবং সে পরিকল্পনায় সাধুভাষা-যা কখনও সহজেই কবিত্বময় হয়ে ওঠে-তার সংগত স্থান করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে জুড়েছে-আগেই যেমন বলেছি-লোকগীতি, প্রবচন, গ্রামীণ ভাষা, লোকশিল্পের আঙ্গিকে জয়নুল আবেদিনের ছবি-সব মিলিয়ে এক বিচিত্র বহুস্বরিকতা, কিন্তু গ্রামীণ নিত্যতার মধ্যে আশ্রিত বহুস্বরীয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এর অজস্র উদাহরণ তোলা যায়, আমরা সে চেষ্টা করছি না। পাঠক নিজেই পদে পদে ওই ভাষাবুনোট ও সংগীতময় অন্তঃস্রোতের মুখোমুখি হবেন। শিকদারের ভাষার কদাচিৎ বক্তৃতাধর্মিতাও এই প্রবাহকে ব্যাহত করতে পারেনি। (৫)
আর এটাও ঠিক, লেখক কোনো এক ‘বধূ’-কে বা বঁধূদের সম্বোধন করে তাঁর আবেগঋদ্ধ নিবেদনে যেমন লিখেছেন যে, “এই দেশ, এই মানুষ, এই প্রকৃতি জীবনের এক তুলনাবিহীন রূপ; এই প্রেম জীবনের প্রতি প্রেমেরই কঠোর কোমল অধ্যায়। যদি মন চায়, সময় করিতে পারো, একবার তাকাইয়া দেখ, আমি কেবল তোমাদের সাদর আহ্বান জানাইয়া রাখিলাম।” তখন ওই সাদর আহ্বানটি দরদি পাঠকের চিত্তে অল্পবিস্তর সঞ্চারিত হয়। ফলে এ উপন্যাসটির পাঠ শুধু বিনোদন নয়, তাত্ত্বিক সমালোচনার দৃষ্টান্ত সন্ধান নয়, তা দেশের নিসর্গ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা উজ্জীবনের একটা পাঠও হয়ে ওঠে। শিল্প ও জীবনের মধ্যে একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়।
.
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. এই লেখকের বাঙালিত্বের ধারণা বিষয়ে দ্রষ্টব্য, ‘বাঙালি কে?’ ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ, ২০০৩, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ৯২-১০২ পৃ.
২. আধোরেখা আমাদের।
৩. দ্র. বাংলাদেশের উপন্যাস : আঙ্গিক বিবেচনা খান সারওয়ার মুরশিদ (সম্পা), ১৯৮১, বাংলাদেশের সাহিত্য, ঢাকা, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১০৫-১৮ পৃ.
৪. ওই, ১১৬ পৃ.
৫. এ লেখায় আমি অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তী ও গোপা দত্ত ভৌমিকের দু’একটি সহায়তা পেয়ে উপকৃত হয়েছি।
.
প্রকাশকের ভূমিকা
শামসুদ্দীন আবুল কালাম দক্ষিণ বাংলার বৃহত্তর বরিশালের নলছিটি থানার কামদেবপুর গ্রামে ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্পবয়সেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় তাঁর ‘কাকলি মুখর’ কিশোর উপন্যাস পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। পিতা আকরাম আলী পুত্রের লেখাপড়া ও সাহিত্যচর্চার জন্য বরিশালের আলেকান্দায় একটি বাড়ি নির্মাণ। করেছিলেন সেসময়ে। ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ইটালীর রোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
যে গল্পসংগ্রহটি তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করিয়েছে সেই গল্পগ্রন্থও অত্যন্ত অল্পবয়সে যখন তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন প্রকাশিত হয়। এবং তখন থেকেই তিনি বিরামহীন লিখে চলেছিলেন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্যও প্রচুর গল্প এবং নাটক লিখেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে শামসুদ্দীন আবুল কালাম ছিলেন খুবই বিনীত, এবং সবসময়ে ভাবতেন তার পরবর্তী বইটি আগেরটির চেয়ে বিস্তৃত পরিসর ধারণ করতে পারবে ও ভালো হবে। তিনি যে-কোন আধুনিক সাহিত্যিকের মতোই চিন্তা ও কথার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর লেখার গভীরে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতায় বিশ্বাসের বিষয়টি গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। মানুষ এবং সমাজের গল্পের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী সার্বিক মূল্যায়ন তার চিন্তার মৌলিক ধারায় প্রকাশিত। যদিও তিনি এমন একটি দেশে জন্মেছেন যেখানে ধর্মীয় এবং আদর্শিক সংগ্রামের দ্বন্দ্ব কখনো প্রকট কিন্তু তার জীবন-দর্শন প্রধানত মানবিক। নিজের দেশে তিনি এই দুই দলের লোক দ্বারাই অভিযুক্ত, কিন্তু তিনি নিজে না কোন ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী, না তিনি বিশেষ কোন আদর্শিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, শুধুমাত্র গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ছাড়া যেটা আধুনিক মানুষের ইতিহাসের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তার চারপাশের মানুষের সঙ্গে তার বেশিরভাগ আচরনিক ভালো-মন্দ ব্যবহার তাঁর গল্প-উপন্যাসে অঙ্কিত হয়েছে, যার প্রায়ই জীবনের গঠনের ভারসাম্যহীন বৈষম্যের প্রতি তার সমালোচনামূলক মনোভাবসহ প্রকাশিত। প্রান্তিক জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দুঃখ, বেদনা, অনুতাপ, প্রত্যাশা, বাসনা বা সততা তার নজর এড়ায়নি। একদিকে লোকজ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ও সে সংস্কৃতিকে অনুধ্যানের নিষ্ঠা, অন্যদিকে নিরীক্ষাধর্মী ভাষা ব্যবহার, গল্পভাষার কাব্যময়তা এবং প্রকরণে নির্মাণশৈলীতে অনিবার্যতার বুনন পাঠককে তার লেখার মধ্যে নিমগ্ন করে রাখে। তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় শক্তি জীবনকে দেখার ক্ষেত্রে নিয়তির মতো আশ্চর্য নিরাসক্তি। কোন সহজলভ্য অথবা মনোরঞ্জনকারী মিলনান্তক দৃশ্যপটের উদ্ভাবনে তিনি পাঠককে কল্পলোকের সুখময় জীবনে ভ্রমণ করাননি। তার লেখার পাত্র-পাত্রীরা প্রবলভাবে জীবন ঘনিষ্ট, তারা নিশ্চিতভাবে এই মাটিতে পা ফেলা জীবনেরই মানুষ। নিজ সমাজ, দেশ ও মানুষকে আন্তরিকভাবে ভালোবেসেও যে তাঁদের ভুল-ত্রুটি আর নিয়তির ক্রীড়নকবৃত্তির সহজ-সরল আখ্যান রচনা সম্ভব তিনি তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থেই তা প্রমান করে গেছেন। জীবন দ্রষ্টা শিল্পী, জীবনকে অবলোকন করেন গভীরভাবে, বোধ ও মমত্ব মেশানো সেই চোখে ধরা পরে সমাজের যে সত্যরূপ তা মানবিক উপলব্ধির মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং এইভাবে আমাদের করে তোলে আরো বেশি জীবন-সংলগ্ন। প্রাত্যহিক বাস্তবকে ঘিরে সভ্যতার সারসত্তায় পৌঁছে যাওয়ার এমনি শিল্পিত প্রয়াস খুব বেশি দেখা যায় না। যা সভ্যসমাজের সর্বোত্তম ধারা ও ঐতিহ্যের মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং প্রতিষ্ঠা, তাই তাকে প্রণোদিত করে চালিত করেছে। এসব কিছুকে গুরুত্ব প্রদান করে তাঁর কাশবনের কন্যা গ্রন্থ নিয়ে আমাদের এই আয়োজন। শিল্পে ব্যতিক্রমী ভাষা ব্যবহারের এই মাটিলগ্ন লেখক ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
Leave a Reply