কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – স্টিফেন হকিং
(A Brief History of Time)
অনুবাদ – মো: রিয়াজ উদ্দিন খান
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১৯৮২ সালে হার্ভার্ডে লোয়েব (Loeb) বক্ততাবলি দানের পর থেকেই আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম স্থান এবং কাল বিষয়ে সাধারণের জন্য একটি বই লেখার চেষ্টা করব। মহাবিশ্বের প্রথম অবস্থা এবং কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে ইতঃপূর্বে অনেকগুলো বই লেখা হয়েছিল। স্টিফেন উইনবার্গের অত্যন্ত ভাল বই প্রথম তিন মিনিট’ (The First Three Minutes) থেকে শুরু করে অত্যন্ত খারাপ বই পর্যন্ত (তবে অত্যন্ত খারাপ বইয়ের নামটা আমি করব না)। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে সমস্ত প্রশ্ন আমার সৃষ্টিতত্ত্ব (cosmology) এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব (কণাবাদী তত্ত্ব) নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ, কোনও বইয়েই সে প্রশ্নগুলো নিয়ে সঠিক আলোচনা হয়নি। প্রশ্নগুলো হল : মহাবিশ্ব কোত্থেকে এসেছে? কিভাবে এর শুরু? কেনই বা এর শুরু হল? মহাবিশ্ব কি শেষ হয়ে যাবে? যদি হয় তবে কিভাবে হবে? এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আমাদের সবারই ঔৎসুক্য রয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এমন জটিল (technical) হয়ে উঠেছে যে শুধুমাত্র তার বিবরণের জন্য ব্যবহৃত গণিত আয়ত্ত করতে পেরেছেন খুব স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞ। তবুও মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও নিয়তি (fate) সম্পর্কিত মূলগত ধারণাগুলো গণিত ছাড়াই বলা যায়। এবং এমনভাবে বলা যায় যে যাদের বিশেষ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা নেই, তাঁরাও সেটা বুঝতে পারবেন। এ বইয়ে আমি সেই চেষ্টাই করছি। সফল হয়েছি কি না সে বিচার করবেন পাঠকরা।
আমাকে একজন বলেছিলেন : এক একটি সমীকরণ ব্যবহার করার অর্থ হবে পাঠকের সংখ্যা অর্ধেক করে কমে যাওয়া। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম, কোনও সমীকরণই (equation) ব্যবহার করব না। শেষ পর্যন্ত আমি একটি সমীকরণ ব্যবহার করেছি–আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc^2 আমার আশা, এর ফলে আমার ভাবী পাঠকদের অর্ধেক ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবেন না।
এ. এল. এস (ALS) অথবা মোটর নিউরন (Motor Neuron) ব্যাধির মত একটি দুর্ভাগ্য ছাড়া অন্য প্রায় সব ব্যাপারেই আমি ভাগ্যবান। আমার স্ত্রী জেন এবং আমার ছেলেমেয়ে রবার্ট, লুসি আর টিমির কাছে আমি যে সাহায্য পেয়েছি, তার ফলে আমার পক্ষে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব হয়েছে এবং সম্ভব হয়েছে কর্মজীবনে সাফল্য লাভ করা। তাছাড়া আছে আর একটি সৌভাগ্য– আমি বেছে নিয়েছিলাম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা তার সবটাই মনের ভিতরে কাজ। সুতরাং আমার অসুস্থতা একটা কঠিন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার বৈজ্ঞানিক সহকর্মীদের প্রত্যেকেই যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।
আমার কর্মজীবনের প্রথম ক্লাসিক্যাল পর্যায়ে আমার প্রধান সহচর এবং সহকর্মী ছিলেন রজার পেন্রোজ (Roger Penrose), রবার্ট গেরক (Robert Geroch), ব্রান্ডন কার্টার (Brandon Carter) এবং জর্জ এলিস্ (George Ellis)। এঁরা আমাকে যা সাহায্য করেছেন এবং আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে যে কাজ করেছি, তার জন্য আমি এদের কাছে কৃতজ্ঞ।
এই অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসার রয়েছে বৃহৎ মানে স্থান-কালের গঠন’ (The Large Scale Structure of Spacetime) পুস্তকে। সে পুস্তকটি আমি আর এলিস্ লিখেছিলাম ১৯৭৩ সালে। আমার পাঠকদের প্রতি আমার উপদেশ আরো সংবাদ সংগ্রহের আশায় ও বইটা না পড়া। বইটা অত্যন্ত জটিল, বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে পূর্ণ এবং বেশ অপাঠ্য। আমার আশা, কি করে সহজে বোধগম্য হওয়ার মত লিখতে হয়, ঐ বইটা লেখার পর এতদিনে আমি সেটা শিখেছি।
১৯৭৪ সাল থেকে আমার কর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ “কোয়ান্টাম (কণাবাদী)” পর্যায়ে আমার প্রধান সহযোগী ছিলেন গ্যারী গিবস (Gary Gibbons), ড পেজু (Don Page) এবং জিম্ হার্টল Jim Hartle)। তাঁদের কাছে এবং আমার গবেষণাকারী ছাত্রদের কাছে আমার অনেক ঋণ। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় অর্থেই তারা আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করা আমাকে বিরাটভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমার আশা, আমি সেজন্যই কোনও কানা গলিতে ঢুকে পড়িনি।
এই বইটির ব্যাপারে আমার ছাত্র ব্রায়ান হুইটের (Brian Whitt) কাছ থেকে আমি প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। বইটির প্রথম খসড়া করার পর ১৯৮৫ সালে আমার নিউমোনিয়া হয়। আমার ট্রাকিওস্টমি (Tracheostomy শ্বাসনালীর একটি অপারেশন) করতে হয়। ফলে আমার কথা বলার ক্ষমতা লোপ পায় এবং অন্যের সঙ্গে বাক্যালাপও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমি ভেবেছিলাম বইটি আমি শেষ করতে পারব না। কিন্তু ব্রায়ান শুধুমাত্র পুনর্বিচারের জন্য আবার পাঠ করতেই সাহায্য করেনি, উপরন্তু সে আমাকে লিভিং সেন্টার (Living Center) নামক যোগাযোগ পদ্ধতি (communication programme) ব্যবহার করায়। এটা আবার আমাকে দান করেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের ওয়ার্ডস প্লাস ইনকরপোরেটেড-এর (Words Plus Inc) ওয়াল্ট ওলটোজ (Walt Woltosz)। এর সাহায্যে আমি বই এবং গবেষণাপত্র লিখতে পারি। তাছাড়া স্পীচ প্লাস (Speech Plus) আমাকে যে স্পীচ সিনসেথাইজার (Speech Synthesizer) দান করেছেন তার সাহায্যে আমি লোকজনের সঙ্গে কথাও বলতে পারি। এঁরাও ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের। ডেভিড মেসন (David Mason) আমার হুইল চেয়ারে একটা সিনথেসাইজার এবং ছোট একটা ব্যক্তিগত কম্পিউটার লাগিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে– আসলে আমার কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে যা পারতাম এখন তার চাইতে ভাল বাক্যালাপ করতে পারি।
যারা প্রথম খড়সাটি দেখেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই বইটির উন্নতির জন্য উপদেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে উপদেশ দিয়েছেন ব্যান্টাম বুকস (Bantam Books)। আমার এ বইটির সম্পাদক পিটার গাঁজার্ডি (Peter Guzzardi)। যে সব বিষয়ে ভাল করে ব্যাখ্যা করা হয়নি বলে তিনি ভেবেছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে তিনি পাতার পর পাতা মন্তব্য আর প্রশ্ন পাঠিয়েছেন। যে সব জিনিস পাল্টাতে হবে, তার ঐ বিরাট তালিকা পেয়ে আমি রীতিমত বিরক্ত হয়েছিলাম সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি ঠিকই করেছিলেন। আমার নাকটা মাটিতে ঘষে দেয়ার ফলে বইটা অনেক ভাল হয়েছে
এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমার সহকারী কলিন উইলিয়ামস্ (Colin Williams), ডেভিড় টমাস্ (David Thomas) এবং রেমন্ড লাফ্লাম (Raymond Laflamme), আমার সেক্রেটারী জুডি ফেলা Judy Fella), wa 1612€ (Ann Ralph), corso forteta (Cheryl Billington) 478 J TV (Sue Masey) এবং আমার নার্সদের দলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার গবেষণা এবং চিকিৎসা বাবদ গনভিল (Gonville) এবং কাইয়াস কলেজ (Caius College), দি সায়েন্স এ্যান্ড এজিনীয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল (The Science and Engineering Research Council) এবং র্যাফল স্মিথ ফাউন্ডেশান (Ralph Smith Fundations) এরা যদি আমায় অর্থ দান না করতেন, তাহলে এ সমস্ত কাজ সম্ভব হত না। আমি সবার কাছেই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
স্টিফেন হকিং
২০ অক্টোবর, ১৯৮৭
.
ভূমিকা
বিশ্ব সম্পর্কে প্রায় কিছুমাত্রই না বুঝে আমরা দৈনন্দিন জীবন যাপন করি। যে যন্ত্র থেকে সূর্যালোক উৎপন্ন হচ্ছে এবং জীবন সম্ভব হচ্ছে, যে মহাকর্ষ আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে আটকে রাখে তা না হলে পৃথিবী আমাদের লাটুর মত ঘুরিয়ে মহাবিশ্বের স্থানে (space) নিক্ষেপ করত] কিম্বা যে পরমাণু দিয়ে আমরা তৈরি এবং যার স্থিরত্বের উপরে আমরা মূলগতভাবে নির্ভরশীল, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই ভাবি না। প্রকৃতিকে আমরা যেমন দেখি, প্রকৃতি কেন তেমন হল, মহাবিশ্ব কোত্থেকে এল, কিম্বা মহাবিশ্ব কি সব সময় এখানে ছিল, কালস্রোত কি কখনো পশ্চাদ্গামী হবে এবং কার্যকারণের পূর্বগামী হবে কিম্বা মানুষের পক্ষে যা জানা সম্ভব তার কি একটা চরম সীমা আছে? শিশুরা ছাড়া কেউই এ সমস্ত চিন্তায় বিশেষ কালক্ষেপ করেন না। (শিশুদের জ্ঞান এত অল্প যে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো না করে পারে না। আবার এমন কিছু শিশুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, যারা প্রশ্ন করেছে কৃষ্ণগহ্বর দেখতে কেমন, পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ কি? আমরা কেন অতীতই মনে রাখি ভবিষ্যৎ কেন মনে রাখি না? আগে বিশৃঙ্খলা (chaos) ছিল, এখন মনে হয় শৃঙ্খলা রয়েছে, এ রকম কেন হল? একটা মহাবিশ্বের অস্তিত্ব কেন রয়েছে?
আমাদের সমাজে এখনো রীতি হল– বাবা মা কিম্বা শিক্ষকরা এ প্রশ্নের উত্তরে একটু ঘাড় বেঁকান। কিম্বা অস্পষ্ট ধর্মীয় ধারণার সাহায্য নেন। এ সমস্ত প্রশ্নে কেউ কেউ অস্বস্তি বোধ করেন। তার কারণ মানুষের বোধশক্তির সীমারেখা এসব প্রশ্নগুলো বেশ স্পষ্টভবে ধরিয়ে দেয়।
কিন্তু দর্শন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির অনেকটাই হয়েছে এই সমস্ত প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত হয়ে। বয়স্কদের ভিতরে যারা এই সমস্ত প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক তাদের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক সময় তারা কিছু আশ্চর্যজনক উত্তর পান। পরমাণু এবং তারকা থেকে সমান দূরত্বে আমাদের অবস্থান। অতি ক্ষুদ্র এবং অতি বৃহৎকে নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানের সীমারেখা আমরা বাড়িয়ে চলেছি।
১৯৭৪ সালের বসন্ত কালে, ভাইকিং মহাকাশযান মঙ্গলগ্রহে অবতরণের প্রায় দু’বছর আগে আমি ইংল্যান্ডে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির উদ্যোগে আহুত একটি সভায় উপস্থিত ছিলাম। সভার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী বহির্ভূত জীব অনুসন্ধান কিভাবে করা যায় সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা। কফি খাওয়ার ফাঁকে আমি দেখলাম, পাশের হলে আরো অনেক বড় একটা সভা হচ্ছে। কৌতূহলের বশে আমি সেখানে ঢুকলাম। অচিরে বুঝতে পারলাম আমি একটা প্রাচীন রীতি দেখছি। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিদগ্ধ জনসংগঠনগুলোর একটি হল রয়্যাল সোসাইটি (Royal Society)। সেখানে হচ্ছে নতুন ফেলোর অভিষেক। সামনের সারিতে হুইল চেয়ারে বসে একজন তরুণ খুব ধীরে একটি খাতায় নাম সই করছিলেন। সেই খাতার প্রথম দিকটায় ছিল আইজাক নিউটনের স্বাক্ষর। স্বাক্ষর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিরাটভাবে অভিনন্দিত করা হল। এমন কি তখনও স্টিফেন
হকিং (Stephen Hawking) ছিলেন একজন প্রবাদ পুরুষ। হকিং এখন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শাস্ত্রের লুকেসিয়ান অধ্যাপক (Lucasian Professor)। এক সময় নিউটন ছিলেন এই পদের অধিকারী এবং পরে এ পদে ছিলেন পি, এ, এম. ডিরাক (P. A. M. Dirac)। এঁরা দুজনে ছিলেন অতিবৃহৎ এবং অতিক্ষুদ্র নিয়ে বিখ্যাত গবেষক। হকিং তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি। এঁর এই প্রথম বই থেকে সাধারণ পাঠক অনেক কিছুই পাবেন। এ বইয়ের বিরাট ব্যাপকত্ব যেমন আকর্ষণীয়, তেমন আকর্ষণীয় লেখকের মানসিক ক্রিয়া সম্পর্কীয় আভাস। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, মহাবিশ্বতত্ত্ব (Cosmology) এবং সাহসের সীমান্ত এ বইয়ে সহজভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
এ বইটা ঈশ্বর সম্পর্কেও বটে। হয়ত ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সম্পর্কে। এর পাতায় পাতায় ইশ্বর রয়েছেন। আইনস্টাইনের বিখ্যাত প্রশ্ন ছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার সময় ঈশ্বরের কি অন্যরকম কিছু করার সম্ভাবনা ছিল? হকিং এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। হকিং স্পষ্টই বলছেন তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে চেষ্টা করছেন। তার প্রচেষ্টায় তিনি এ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, সে সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত। এ মহাবিশ্বের স্থানে কোন কিনারা (edge) নেই, কালে কোন শুরু কিম্বা শেষ নেই এবং স্রষ্টার করার মত কিছু নেই।
কার্ল সাগান
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়
ইথাকা, নিউইয়র্ক।
Leave a Reply