কালকেতু ও ফুল্লরা – সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
প্ৰথম প্ৰকাশ – পৌষ ১৪২৫
.
উৎসর্গ
শামসুল কবির
হাসানুল বান্না ও
ব্রাত্য রাইসু-কে…
.
“পৃথিবীতে এরূপ রমণী আছেন, যাঁহার কোনও ছলনা নাই; কিন্তু এরূপ রমণী দুর্লভ, যাঁহার একখানি-মাত্ৰ ছলনা আছে। অপিচ এমন অনেক মানুষ আছে, যাহারা একটিও বহি লেখে নাই, কিন্তু এমন মানুষ বিরল, যাহারা মাত্র একখানি বহি লিখিয়াছে।”
– লর্ড বায়রন
.
দ্বিতীয় সংস্করণ বলব, নাকি পুনর্মুদ্রণ, বুঝতেছি না। অত্যল্প দুই একটা কাটাছেঁড়া আছে এক-দুই জায়গায়, তবে সেটা কেউ ধরতে পারবে না আশা করা যায়। আর এন্ডনোটও জুড়ে দিছি কিছু, পৃষ্ঠা বাড়ানো আরকি। ছাপাছাপির জগতের সকলে এ-সব বোঝে, পাঠকেরা ছাড়া; তাদেরও বোঝানোর মহতী চেষ্টায় লিপ্ত হলেম।
তসলিম।
নোতুন চাঁদের জন্ম হ’ল নোতুন রাহুর ক্রোড়ে
আমরা মিছে ভিজে মলেম বধ্যভূমির ফ্লোরে
বৃষ্টি প’ড়ে সামনে-পিছে, বৃষ্টি প’ড়ে উপ্রে-নীচে
রক্তে রক্ত তরঙ্গিছে, বিষে বিষক্ষয়
ও গো মা কেমনো বিস্ময়
ও গো মা কেমনো বিস্ময়
.
My dear is angry that of late
I cry all base blood down
As if she had not taught me hate
By kisses to a clown.
—W B Yeats
.
অবতরণিকা
মরার পর অমর হয় অনেকে। কেউ-কেউ এমনকি জীবৎকালেই। তবে জন্মের আগে অমরত্বলাভ ঘটেছে এ-যাবৎ তিনজনের কপালে, দু’জন কবির মারফত। কবিরা হচ্ছেন, বাল্মীকি রত্নাকর এবং মুকুন্দরাম চক্রবর্তী; আর অমরত্বপ্রাপ্তরা : শ্রীরামচন্দ্র, কালকেতু ও ফুল্লরা। আমি এখানে, কালকেতু ও ফুল্লরার জীবনে আসলেই যা ঘটল, তাঁদের অমরত্বলাভের বহু শতাব্দী পর, সেই গল্প বলব। উদ্দেশ্য একটাই : মুকুন্দরামের কাহিনির সঙ্গে এই গল্পটিকে মিলিয়ে দেখে, কপট পাঠক, আপনি যাতে ক’রে শ্রীরামচন্দ্রের জীবনের প্রকৃত ঘটনাবলি আন্দাজ ক’রে নিতে পারেন। কাজেই এই গল্পের আবেদন প্রধানতঃ নৃতাত্ত্বিক, এবং সেই সাথে কিছুটা রাজনৈতিক; কেননা, বিশেষতঃ, বাবরি মসজিদের বিনষ্টিসাধনের পর বিশ্বভারতে শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান নিয়ে যে-মতানৈক্য তৈরি হয়েছে, তাতে, রামচন্দ্র-সমস্যার একটা আশু ও সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো না গেলে, জগচ্ছেষ্ঠ এই মহাদেশটির কপালে খারাপি আছে ব’লে নস্ট্রাড্যামাস মত প্রকাশ করেছেন। এবং যাঁর মতামত-অনুযায়ী বিশ্বে এ-পর্যন্ত চারটি মহাযুদ্ধ এবং অগণিত ঠান্ডা-যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছে, তাঁকে হাল্কাভাবে নেবার কোনও কারণ নাই।
এই গল্পটি (গল্প নামেই, আসলে সত্য ঘটনার ধারাবিবরণী) রচনার আরও কিছু গৌণ উদ্দেশ্যও অবশ্য আছে। এই গল্প-মাধ্যমে, আশা করা যায়, দুই বাংলার (‘দুই বাংলা’ অবশ্য এখন একটি অলীক সংজ্ঞা : গল্পে দ্রষ্টব্য) রেশারেশি, তথা পশ্চিম বাংলার, হীনম্মন্যতা-প্রযুক্ত, নানাপ্রকার চক্রান্তও উদ্ঘাটিত হবে। যেমন, মুকুন্দরাম, পশ্চিমবঙ্গীয় লেখক হওয়ায়, গল্পের নায়ক-নায়িকার জন্মস্থান-যে ঢাকা নগরী, এই তথ্য গোপন করেছেন। উপরন্তু, একজন বন্য ব্যাধরূপে কালকেতুকে তিনি অঙ্কন করেছেন। অথচ আমরা জানি, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত, শহুরে, মার্জিত, ভদ্রলোকের সন্তান। এতে ক’রে এটাই প্রমাণিত হয়, যে, পশ্চিমবঙ্গীয় লেখকেরা সেই পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক, বা তারও পূর্বে থেকে, পূর্ববঙ্গীয়দেরকে অসভ্য জংলি ব’লে অপপ্রচার ক’রে আসছে। তারই সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ (সম্ভবতঃ), বহির্বিশ্বে এই ধারণা আজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যে, পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে বন্যা জলোচ্ছ্বাস দুর্ভিক্ষ মহামারী অশিক্ষা এবং ক্যানিবলিজম-ব্যতিরেকে আর কিছুই প্রাপণীয় নাই (যা, অবশ্যই, পুরাপুরি সত্য নয়, আমরা জানি; বাংলাদেশে আরও অনেক কিছুই পাওয়া যায়)। অধিকন্তু, কারুর জন্মের আগেই তাকে নিয়ে নভেল রচনার ফলাফল-যে সচরাচর শুভদায়ী হয় না তা ইতোমধ্যে রামচন্দ্রের বেলায় প্রমাণ হয়েছে। কালকেতু-ফুল্লরার ক্ষেত্রে কী হ’তে চলেছে আমরা জানি না। তবে, তাঁদের মৃত্যুর পরদিনই দু’টি দল মিছিল বা’র করেছে শাহবাগ আভন্যুতে। একদল কালকেতুর, এবং আরেকদল ফুল্লরার, ফাঁসির দাবি জানিয়েছে। হিপোক্রিনে পানি কতদূর গড়ায় তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
গল্পটিকে, পাঠকের সুবিধার্থে, ইন্টারনেটে ঢোকাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু নেট সিকিয়রিটির মান্দালয় কার্যালয়, গল্পটিতে সেক্স এবং ভায়োলেন্সের প্রাচুর্যের অজুহাতে, আবেদন নাকচ ক’রে। তারা আরও জানায়, যে, সেক্স ও ভায়োলেন্স দ্বাবিংশ শতকে বাসি-কাসুন্দিতে পর্যবসিত হয়েছে। ইদানীঙ্কার ক্রেজ বরং স্যাক্স, অর্থাৎ স্যাক্সোফোন, ও ভায়োলিনকে কেন্দ্র ক’রেই আবর্তিত হচ্ছে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় জাদুঘরের প্রত্ন- প্রকাশনা বিভাগ এটির মুদ্রণ কবুল ক’রে আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তবে, নানা কারণে, গল্পের কতিপয় অংশ তাঁরা সেন্সর করেছেন। অবশ্য সেক্স-ভায়োলেন্স-সংক্রান্ত অংশগুলিকে রেহাই দেওয়া হয়েছে; কেননা, প্ৰধান সম্পাদক তাজুল হক জানালেন, ‘ওসব’ এখন ডালভাত। বরং নীটশের ‘দাস স্পেক জরাথুস্ত্র’ থেকে উদ্ধৃতিটুকু ছেঁটে দিতে-দিতে তিনি বললেন, যে, ‘এ- সব’ নারীবাদীদের উসকে দিতে পারে।
গল্পের পটভূমিকাটি অবশ্য না-জানলেও ক্ষতি নেই। ধরাবাঁধা ব্যর্থ প্রেমের ব্যাপার—নায়িকা, নায়ককে জিল্ট ক’রে উপনায়ককে বিয়ে করেছেন। তবে, নায়কের প্রতিক্রিয়াটি শুধু যথাযথ হয় নাই। তিনি চুল-দাড়ি বড় বা ছোট করেন নাই, সাইকেডেলিকস ধরেন নাই, আত্মহত্যা করেন নাই, এবং যা-যা ক্রিয়াকর্ম এ-সময় ফরজ, তার কিছুই করেন নাই। বন্ধুরা বরং তাঁর ঔদাসীন্যে তাঁরই উপরে খেপে যায়, ব’লে–মেয়েটির দোষ দিয়ে কী হবে, প্রব্লেম ছিল ওরই—ব’লে—মেয়েটি বাঁচল—ব’লে—শালা হিজড়া ইত্যাদি। জনৈক পরোক্ষ শুভার্থিনী, সমবেদনা জানাতে এলে নায়ক, কালকেতু, বলেন, ‘বাঁচলাম! কী-যে ভাল্লাগে না এখন! কী-যে স্বাধীন!’
মেয়েটি থতমত খেয়ে হতাশার সঙ্গে প্রস্থান ক’রে। আরও কতক কাণ্ড সঙ্গোপনে করতে শুরু করেন তখন কালকেতু, যেমন:
তিনি কাষ্ঠাসনে শোয়ার অভ্যাস করেন—শীতে আদুড় দেহে, আতপে কম্বলে;
তিনি তাঁর একমাত্র মশারিটি দান করেন তাঁর বন্ধু গাভুর সিদ্ধাকে;
তিনি স্নান করা প্রায় বন্ধ ক’রে দেন এবং পানাহারও যথাসম্ভব নামমাত্ৰ ক’রে আনেন;
সর্বোপরি নিদ্রাকালকে সঙ্কুচিত ক’রে-ক’রে তাকে একঘণ্টার ভিতর নিয়ে তিনি আসেন, অথচ সেই উদ্বৃত্ত জাগরণকালে কোনও পুস্তকাদি (মায় লিটল ম্যাগাজিন, মায় পেন্টহাউস) পড়েন না আদৌ, এবং, বলতেকি, সর্বপ্রকার পাঠাভ্যাস থেকে মুক্ত নিজেকে তিনি করেন; সূচিভেদ্য নির্জনতায়, শরীরে মশক-দংশন সইয়ে নিতে-নিতে তিনি নাম জপে যান, হর-রাত এককোটিবার, ‘ফুল্লরা! ফুল্লরা! ফুল্লরা!” অর্থাৎ নায়িকার নাম…
তারপর, এই গল্পের শুরু পর্যন্ত আসতে-আসতে, নাম জপারও প্রয়োজন ফুরায়। কেননা, ততদিনে তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়ে, তাঁর সবগুলি রক্তকণিকায়, দেহের প্রত্যেক কোষে, সেই নাম। তিনি প্রশ্বাসে টানেন ‘ফুল “ নিঃশ্বাসে ছাড়েন ‘লরা’; চোখ খুললে (দেখেন) ‘ফুল্’, চোখ বুজলে ‘লরা’; বাঁ-পা বাড়ালে (শোনেন) ‘ফুল্’, ডান-পা বাড়ালে ‘লরা’; বলা যায়, সুদীর্ঘ সাত বৎসরের তপশ্চর্যার ফলে যে-অদৃশ্য বিদ্যুৎ বিকিরিত হয় তাঁর দেহ থেকে, তারও ইলেকট্রনগুলি ‘ফুল্’, পজিট্রনগুলি ‘লরা”।
ফুল্লরা, পক্ষান্তরে, ছিলেন আলোকবর্তিকা। তিনি যেথায় যখন থাকতেন, তার এক-কিলোমিটার রেডিয়াসের ভিতর মুমূর্ষুর মুখে ফুটত হাসি, খুনেকে দেখা যেত ফুল শুঁকতে। বস্তুতঃ কোনও মহাল্লায় দিগ্বিদিগব্যাপী হাস্য- কোলাহলের শব্দেই জানা যেত, কাছেপিঠে তিনি রয়েছেন। ভবানন্দকে বিয়ে তিনি করেন, এবং ভবানন্দ তারপর প্রায় কথা বলতে ভুলে যান, বা, অন্য একটি ভাষায় কইতে শুরু করেন, যাকে সাদামাটায় বলা যায়, হাস্যভাষ্য।
‘কী রে ভবা, কেমন আছিস?’—হাসি।
‘ঘরকন্না কেমন চলছে?’— হাসি।
‘বিয়ে ক’রে পটেটো-প্রব্লেম কিছু কমেছে?’—হাসি।
এইমতো। ফুল্লরা যাঁহা যাঁহা যান, ভবানন্দ হাস্যমুখে তাঁহা তাঁহা তাঁর পশ্চাদনুসরণ করেন। যেন ফুল্লরা লাটাই, তিনি ঘুড্ডি; বা ফুল্লরা লেত্তি, তিনি লাট্টু।
তো এই ফুল্লরা, কালকেতু, ও ভবানন্দর সকল সখাই আড্ডা দিতেন লোকায়ত পান্থশালায়। সেখানেই এ-গল্পের শুরু, সেখানেই সারা। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার বড়ুচণ্ডীদাস। হোটেলের একমাত্র নিয়মিত ভাড়াটে ইচক চাণক্য।
আমি অতঃপর মূল গল্পে প্রবেশ করব। তবে তার আগে দু’তিনটি প্রাসঙ্গিক বিষয় পাঠকের অবধানে আনা জরুরি। যথা, প্রথমতঃ, বন্ধুরা সম্প্রতি কালকেতুকে অ্যাভয়েড ক’রে থাকে, এবং তিনি পান্থশালায় আর মোটেই আসেন না। তাছাড়া, ম্যানেজার বড়বাবুও খাতির-নদারদ, কেননা, তিনি বড় বেশি বাকি চাহিয়া লজ্জা দেন। ইচক অবশ্য মাঝেসাঝে নীচে নেমে তাঁর তত্ত্ব নেন, এবং তিনি আসেন-নি শুনে নিশ্চিন্তে তাঁর নির্দিষ্ট টেবিলে বসে সিদ্ধির শরবত পান করেন। এইমতো।
Leave a Reply