কাঞ্চনগড়ের কোকিলস্যার – প্রচেত গুপ্ত
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: বিজন কর্মকার
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৯
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: বিজন কর্মকার
তিনি আর রিনি নামের দুই চমৎকার মেয়েকে। বেচারিদের মধুর কোকিলকণ্ঠ সবাই বুঝতে পারে না। চেঁচামেচি (ডাকাডাকি) করলেই বকুনি দিয়ে থামিয়ে দিতে চায়।
॥১॥
ঘটনাটা ঘটল বসন্তের এক দুপুরে। ঠিক টিফিনের পর। ফিফথ পিরিয়ড শুরু হবে। কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের মাস্টারমশাইরা তখনও ক্লাসে ঢোকেননি। টিচার্সরুম থেকে সবে চক-ডাস্টার হাতে নিয়ে বেরিয়েছেন। ক্লাসরুমগুলো থেকে ছেঁড়া-ছেঁড়া হইচই ভেসে আসছে। ঠিক হইচই নয়, হইচইয়ের মতো একটা ভাব। টিফিনের পর এরকম হয়। স্কুল পুরোপুরি শান্ত হতে সময় লাগে। ছেলেদের ছোটাছুটি, মারপিট, হাসি-মজা থেমে গেলেও তার রেশ আরও একটু থেকে যায়। মাস্টারমশাইরা ক্লাসে ঢুকলে আবার সব চুপচাপ।
সুশীলস্যার টিচার্সরুমে নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন। তাঁর মুখ কঠিন, চোখ স্থির। তিনি তাকিয়ে আছেন সামনের দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার। আট পাতার এই ক্যালেন্ডারের বিষয় ‘পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য’। এক-একটা পাতায় এক-একটা আশ্চর্য। এখন যে পাতাটা রয়েছে সেটায় পিরামিডের ছবি। ফ্যানের হাওয়ায় পিরামিড দুলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, সুশীল পাত্র ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে পিরামিডের দুলুনি দেখছেন। যদিও আসল ঘটনা তা নয়। ক্যালেন্ডার কেন, কোনও কিছু দেখার মতো মনের অবস্থাই সুশীলবাবুর এখন নেই।
এটা কী হল! নিজের কানে এ কী শুনলেন তিনি! যা শুনলেন তা কি সত্যি?
সুশীলকুমার পাত্র চন্দনপুর বয়েজ স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর ছেলেদের পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, পরিমিতি ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস শেখানোর মধ্যে আছেন। টানা সাঁইত্রিশ বছর অঙ্কের মধ্যে থাকা সহজ ব্যাপার নয়। এতে মনের ভিতর অনেক রকমের বিশ্বাস তৈরি হয়। সেই বিশ্বাস কখনও ঠিক, কখনও ভুল, কখনও আবার উদ্ভট। সেই সঙ্গে চরিত্রের উপরও প্রভাব পড়ে।
সুশীলবাবুর চরিত্রেও প্রভাব পড়েছে। এমনিতেই তিনি একজন রাগি শিক্ষক। এখন হয়ে উঠেছেন ভীষণ খিটখিটে আর ভয়ংকর বদমেজাজি। তাঁর অন্যতম হবি হল, কঠিন অঙ্ক দিয়ে ছেলেদের নাস্তানাবুদ করা। বদমেজাজি হওয়ার পর থেকে অঙ্কের সেই কঠিন ভাব তিনি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাভাবিক কারণেই ছাত্ররা সেই অঙ্ক আবার ভুল করে। তিনি আরও কঠিন অঙ্ক খুঁজে বের করেন। সমানুপাতের অঙ্কে ক্ষেত্রফল ঢুকিয়ে প্যাঁচ দেন। ক্ষেত্রফলের অঙ্কে কোণানুপাতের সমস্যা দিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন। ছেলেরা হাবুডুবু খায়। রাতে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে, বড় বড় নখ-দাঁত নিয়ে তেড়ে আসছে পাটিগণিত।
মজার কথা হল, এখানেই থেমে যান না কাঞ্চনগড়ের অঙ্কস্যার। ছেলেদের এই কষ্টে তাঁর মন বিন্দুমাত্র নরম হয় না। তাঁর স্বভাবে দুর্বলতার কোনও জায়গা নেই। বইয়ের কঠিন অঙ্ক ফুরিয়ে গেলে, বাড়িতে রাত জেগে তিনি নিজেই অঙ্ক বানান। সেই প্রশ্ন দেখে ছেলেদের মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে।
সুশীলবাবু ক্লাস এইটের ক্লাসটিচার। তাদের দুঃখ সবচেয়ে বেশি। তিনতলার এক কোণে তাদের ক্লাসরুম। স্কুলের বাকি ঘরগুলো থেকে একটু দূরে। অন্যরা সাড়াশব্দ পায় না। সেই ঘরে সুশীলস্যার পায়চারি করেন আর গর্জন করেন।
“শোনো ছেলেরা, মন দিয়ে শোনো। অসুখ শক্ত হলে ওষুধও শক্ত হতে হবে। সামান্য সর্দি-কাশি-জ্বরের ওষুধ কি ম্যালেরিয়া সারাতে পারে হে? পারে না। তার জন্য লাগে কুইনাইন। কুইনাইন খেলে মাথা তো ঘুরবেই বাছাধন! তোমাদেরও তাই হয়েছে, শক্ত অঙ্কে মাথা ঘুরছে।”
ঘন রাগ, তিরিক্ষি মেজাজ আর প্রচণ্ড বিরক্তিতে সরু গোঁফ, লম্বা নাক, মোটা ভুরুর ফিনফিনে চেহারার মানুষটির গলা হয়ে গিয়েছে বাঁজখাই এবং খ্যাসখ্যাসে। প্রথম দিকে কিন্তু এরকম ছিল না। স্কুলে যোগ দেওয়ার প্রথম বছরের বার্ষিক অনুষ্ঠানে তিনি মঞ্চে উঠে আবৃত্তি পর্যন্ত করেছেন, ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে…’। সুন্দর গলা। চমৎকার উচ্চারণ। নতুন স্যারের আবৃত্তি শুনে ছেলেরা হাততালি দিয়েছিল প্রচুর। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, যত দিন যাচ্ছে, মানুষটির গলার স্বর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদের অঙ্ক দিয়ে নাস্তানাবুদ করার সঙ্গে গলার কোনও সম্পর্ক আছে কি না জানা যায়নি। তবে এখন উনি কথা বললেই মনে হয়, ধমক দিচ্ছেন। সে ক্লাসেই হোক আর বাজারে ঝিঙে-পটল কিনতে গেলেই হোক। বাড়িতেও এই নিয়ে অশান্তি আছে। সুশীলবাবুর স্ত্রী নমিতাদেবী স্বামীর এই আচরণ একেবারেই বরদাস্ত করেন না। তিনি বিরক্ত হন।
“ধমক দিচ্ছ কেন?”
সুশীলবাবু অবাক হয়ে বললেন, “ধমক! ধমক কোথায় দিলাম? আমি তো ভাত চাইলাম। স্কুলের টাইম হয়ে গিয়েছে, তাই ভাত চাইলাম।”
নমিতাদেবী বললেন, “ভাত কি শান্ত গলায় চাওয়া যায় না?”
সুশীলবাবু খ্যাসখ্যাসে গলায় বললেন, “আমার গলাটাই তো এরকম, আমি কী করব?”
নমিতাদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুমি কিছু করবে না, সকলকে শুধু ধমক দিয়ে বেড়াবে!”
“আমি তো আর গলা বদলাতে পারি না।” সুশীলবাবুও গজগজ করে উঠলেন।
নমিতাদেবী ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন, “কেন পার না? অবশ্যই পারো। রাগ আর খিটখিটে মেজাজটা কমাও, দেখবে গলাটাও নরম হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে ভাল হয়, যদি ক’টাদিন অঙ্ক থেকে সরে থাকো। তাতে তোমার রাগও কমবে। মাথা ঠান্ডা হবে। সারাদিন অঙ্কের প্যাঁচ নিয়ে পরে থাকলে শুধু গলা কেন, শরীরটাও ধীরে ধীরে পাকিয়ে যাবে।”
সুশীলবাবু ধমক দেওয়া গলায় বললেন, “ঠিক আছে, অনেক হয়েছে। এবার থামো দেখি! এইটের ছেলেদের আজ একটা টেস্ট নেব ভেবেছি। বড় কিছু নয়, ছোট টেস্ট। ছেলেদের মাঝেমধ্যে পরীক্ষা না নিলে তাদের ভয় কেটে যাবে। এটা ঠিক নয়। ভয় না থাকলে আর সবকিছু চলে, ম্যাথমেটিক্স চলে না। আজ ভোরের দিকে দু’টো মারাত্মক কোয়েশ্চেন মাথায় এসেছে নমিতা। একটাতে আবার ক্যালকুলাসের একটু টাচ আছে। ক্লাস এইটের ছেলেরা ক্যালকুলাস জানে না। তারা সেই অঙ্ক দেখে মাথার চুল ছিঁড়বে।”
নমিতাদেবী বুঝতে পারেন, এই মানুষটিকে মাথা ঠান্ডা করতে বলার কোনও মানে হয় না। তিনি চুপ করে যান।
এর পর বিশ্বাসের কথা। সম্প্রতি কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের অঙ্কস্যারের মনে এক উদ্ভট বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। তাঁর মনে হচ্ছে, জগতে অঙ্ক ছাড়া বাকি সবকিছুরই দাম শূন্য। এমনি শূন্য নয়, একেবারে মহাশূন্য। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিগ জিরো’। সুতরাং স্কুলের আটটা পিরিয়ডের মধ্যে পাঁচটা পিরিয়ড শুধু অঙ্কের জন্যই বরাদ্দ থাকা দরকার। পারলে ছ’টা। বাকি দু’টোর একটায় পরিবেশ, অন্যটায় স্বাস্থ্য। কবিতা, গল্প, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, ড্রয়িং-এর কোনও দরকার নেই। এতে ছেলেদের অঙ্কের প্রতি ভীতি তৈরি হবে। সেই ভয় থেকে তৈরি হবে এক পাকাপোক্ত শৃঙ্খলাবোধও। ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাই আসল, বাকি সব নকল, সব অর্থহীন।
এই বিশ্বাস সুশীল পাত্র নিজের মনে লুকিয়ে রাখেননি। স্কুলের হেডমাস্টারমশাই শশাঙ্কশেখর ধরের কাছে মুখ ফুটে বলে ফেলেছেন। স্কুলের অন্য শিক্ষকরা তাঁদের এই সহকর্মীর প্রতি মোটেই খুশি নন। পছন্দ তো করেনই না, উলটে বদমেজাজের কারণে ভয়ে এড়িয়েই চলেন। তাঁরা মনে করেন এই খিটখিটে স্বভাবের মানুষটির সঙ্গে যত কম কথা বলা যায় তত মঙ্গল। আড়ালে হাসাহাসি চলে। সুশীলবাবুও এঁদের মোটেই পাত্তা দেন না। তিনি একাই অঙ্কের প্যাঁচপয়জারে ডুবে থাকতে ভালবাসেন। ব্যতিক্রম শুধু হেডমাস্টারমশাই শশাঙ্কশেখর ধর। অঙ্কস্যারের প্রতি তাঁর একটা প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি আছে। তাঁর অঙ্ক পাগলামি মাঝেমধ্যে তিনি বেশ উপভোগই করেন। তা ছাড়া উনি এই স্কুলের একজন সিনিয়র টিচার। অবসরের বাকি রয়েছে মাত্র ক’টা বছর। এত বছর যখন জ্বালাতন সহ্য করা গিয়েছে, আর ক’টা দিন চুপ করে থাকতে ক্ষতি কী? তবে তিন নম্বর এবং সবচেয়ে বড় কারণ হল, এই মুহূর্তে কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলে দ্বিতীয় কোনও অঙ্কশিক্ষক নেই। শিক্ষা বিভাগে জানানো হয়েছে, এখনও উত্তর আসেনি। ফলে সবেধন নীলমণি অঙ্কশিক্ষকটিকে খুব একটা চটাতে চান না তিনি। মানুষটা যতই বদমেজাজি আর খ্যাসখ্যাসে গলায় সকলকে ধমক দিন না কেন!
সব ক্লাস অঙ্কের করতে হবে শুনে শশাঙ্কশেখরবাবু মুচকি হেসে বললেন, “প্রস্তাবটা খারাপ নয়, তবে সমস্যা হল, এত শিক্ষক পাব কোথায়? ছ’টা করে পিরিয়ড বলছেন, এদিকে স্কুলে অঙ্কশিক্ষক তো মোটে একজন, আপনি।”
সুশীল পাত্র বাঁজখাই গলায় বললেন, “সে চিন্তা আমার। শিক্ষকের কোনও অসুবিধা হবে না। বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস আর ড্রয়িংটিচারদের আমি নিজে অঙ্ক শিক্ষার ট্রেনিং দিয়ে দেব। চিকিৎসার জন্য আছে সংক্ষিপ্ত প্যারামেডিকেল কোর্স, তেমনই এটা হবে প্যারাম্যাথমেটিক্স কোর্স। শনিবার হাফ ছুটির পর স্কুলেই ব্যবস্থা করা যাবে। স্টুডেন্টদের বয়স বেশি হওয়ার কারণে সময় একটু বেশি লাগবে এই যা! আপনি বোধহয় জানেন শশাঙ্কবাবু, বয়স বেশি হয়ে গেলে বুদ্ধি শক্ত হয়ে যায়!”
শশাঙ্কশেখরবাবুর পেট থেকে হাসি উঠে এল। তিনি চোয়ালেই সেই হাসি আটকে দিলেন। সিরিয়াস মুখ করে বললেন, “আইডিয়াটা মন্দ নয়। মনে হচ্ছে, মাস্টারমশাইরা সকলেই রাজিও হয়ে যাবেন। এই বয়সে নতুন করে অঙ্ক শেখা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো হবে। আপনি বরং একটা কাজ করুন সুশীলবাবু, পরিকল্পনাটা আরও ডিটেলসে তৈরি করে ফেলুন। ওই যে কোর্সটা, কী যেন নাম বললেন, প্যারাসুট না কী যেন?”
সুশীল পাত্র ভুরু কুঁচকে বললেন, “প্যারাসুট নয়, প্যারাম্যাথমেটিক্স। বাংলায় বলা যেতে পারে ‘প্রায়-অঙ্ক’।”
“বাঃ, তা ওই প্রায়-অঙ্কের সিলেবাসটা কেমন হবে? পরীক্ষা থাকলে ক’টা থাকবে, একটা নাকি দু’টো? রেজাল্টে নম্বর থাকবে, নাকি শুধু গ্রেডেশন? এই সব আপনি তৈরি করে ফেলুন দেখি! তারপর সবটা পাঠিয়ে দিন স্কুল সিলেবাস কমিটির কাছে। শুধু কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলে এটা চালু করলেই হবে না, সব স্কুলে যাতে চালু হয় সেটাও দেখতে হবে, তাই না?”
গোটা লেখাপড়াটাই অঙ্কময় করে তোলার আলোচনা যে এত গুরুত্বপূর্ণ হবে সুশীলবাবু আশা করেননি। তিনি খুশি হলেন। গমগমে গলায় বললেন, “দেখুন শশাঙ্কবাবু, আমার রিটায়ারমেন্টের খুব বেশি দিন আর বাকি নেই। তার আগে এটা যদি চালু করে দিতে পারি, তা হলে শান্তি পেতাম।”
হেডমাস্টারমশাই কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না। মনে হয় সিলেবাস কমিটি আপনার আপনার প্রস্তাব মেনে নেবে। তবে একটা কথা বলি সুশীলবাবু, এসব এখনই স্কুলের অন্য টিচারদের বলতে যাবেন না। সকলেই তো আমার মতো নয়, বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন না। হাসি-ঠাট্টা করবেন। চটেও যেতে পারেন। এই বয়সে অ্যারিতমেটিক্স, অ্যালজেব্রা শেখার কথা শুনলে চটে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।”
অঙ্কস্যার মুখ দিয়ে ‘ফোঁস’ ধরনের একটা আওয়াজ করলেন। রাগের আওয়াজ। বললেন, “আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছেন, যাঁরা অঙ্ক জানেন না তাঁদের সঙ্গে অকারণ কথা বলে আমি সময় নষ্ট করা পছন্দ করি না। আপনার সঙ্গেও করতাম না। নেহাত হেড অফ দ্য ইনস্টিটিউশন বলে করলাম।”
এই সুশীলপাত্র আজ ক্লাস না নিয়ে টিচার্স রুমে বসে আছেন। তাঁর সামনে খাতার পাহাড়। হাই ইয়ারলি পরীক্ষার অঙ্কখাতা। কালই খাতা জমা দেওয়ার শেষ দিন। আজ তিনি একটানা খাতা দেখছেন। কাজ প্রায় শেষ। টিফিনেও মুখ তুলতে পারেননি সুশীলপাত্র। খাতায় চোখ রেখেই দু’টো টোস্ট আর-একটা ডিম সেদ্ধ খেয়েছেন। তারপর চা। না দেখে কাপ তুলতে গিয়ে একবার তো কাপ উলটেই ফেললেন। তবে কাপের আর দোষ কী, উলটোবেই তো! যথারীতি এবারও খাতার অবস্থা শোচনীয়। প্রশ্ন না হয় এবার বেশি কঠিনই করেছিলেন, তা বলে এতটা খারাপ হবে? ক্লাস এইটে হাইয়েস্ট নম্বর উঠেছে তেরো। ওনলি থার্টিন! অন্য ক্লাসগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। এই অবস্থায় চায়ের কাপ ওলটানো কী আর এমন ব্যাপার? তবে সুশীল পাত্র খুশি। ছেলেরা অঙ্ক না পারলে তিনি খুশিই হন। তাদের ব্যর্থতা মানে তাঁর সাফল্য।
খাতা দেখার ঠিক শেষ মুহূর্তে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল!
হাতের লাল কালির কলমটা টেবিলের উপর দু’বার ঠুকলেন সুশীল পাত্র। পাশে পড়ে থাকা ভাঙা চকটা গড়িয়ে দিলেন সামনে। তারপর মুখের কাছে ডান হাতটা মুঠো করে কাশতে চেষ্টা করলেন। কাশিটা ঠিকমতো হল না। জোর করে হাঁচি-কাশির এই এক অসুবিধে। কিছুতেই ঠিকমতো হয় না। বাধ্য হয়ে গলাখাঁকারি দিলেন। তাকালেন চারপাশে। কেউ কি শুনতে পেল? না, টিচার্সরুমে শিক্ষকরা কেউ নেই। এটা একটা বাঁচোয়া। তার মানে কেউ শুনতে পাননি, তিনি নিজেই শুধু শুনেছেন। কিন্তু সত্যি কি শুনেছেন? সত্যি কি তাঁর গলা থেকে…? এ কখনও হতে পারে? অসম্ভব, কখনও হতে পারে না। ভুল শুনেছেন। নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন। ভুলে ভরা অঙ্কের ভিতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকলে ভুল শোনাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরপর হয়তো তিনি ভুল দেখবেনও।
সুশীলবাবু ঠিক করলেন নিজের ভুল নিজেই শুধরোবেন। তিনি ছেলেমানুষ নন। এই বয়সের একজন মানুষ এরকম ভুল একটা ধারণা নিয়ে বসে থাকতে পারে না। খানিক আগে তিনি স্কুলের পিয়ন নবলালকে একগ্লাস জল দিতে ডেকেছিলেন, ঘটনাটা ঘটেছে তখনই। সুতরাং আবার নবলালকে ডাকতে হবে। দেখতে হবে একই জিনিস হয় কি না।
সুশীল পাত্র রেগেমেগে বাজখাঁই গলায় হাঁক দিলেন, “নব, অ্যাই নব, নবলাল, কখন থেকে ডাকছি, কথা কানে যাচ্ছে না?”
কথা আদ্দেকটা বের হল। নিজের গলায়, “নব, অ্যাই নব, নবলাল, কখন থেকে ডাকছি…” পর্যন্ত শুনতে পেলেন সুশীলবাবু। ব্যস এইটুকু। এখানেই তাঁর নিজের গলা শেষ। বাকিটুকু শোনা গেল শুধু কোকিলের ডাক! একবার ডাক নয়, পর পর তিনবার ডাক!
‘কুহু, কুহু, কুহু।’
যতটা বাজখাঁই গলায় হাঁক দিয়েছিলেন সুশীল পাত্র, গলা থেকে বেরিয়ে আসা কোকিলের ডাক ততটাই সুরেলা! সুরেলা আর তীক্ষ্ণ!
কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অঙ্কস্যারের মনে হল, পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠছে। তাঁর ভয় করে উঠল, ভীষণ ভয়। এ কী কাণ্ড! মানুষের গলায় কোকিলের ডাক!
টিচার্সরুমে চেয়ারগুলো বিচ্ছিরি। পিঠ দিলে যেন শক্ত কাঠের খোঁচা লাগে। ভয়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলে সুশীল পাত্র তবু চেয়ারে হেলান দিলেন, পিঠে খোঁচা লাগলেও দিলেন। উপায় নেই, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন এখনই। শক্ত করে চেপে ধরলেন হাত দু’টো। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করছে। শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেল। ডান পায়ের হাঁটুটা কাঁপছে নাকি? নবলাল কখন ঘরে ঢুকে সামনে জলের গ্লাস রেখে গিয়েছে, দেখতে পাননি। কোনওরকমে হাত বাড়িয়ে সেই গ্লাস তুলে লম্বা চুমুক দিলেন। হাত দু’টোও ভারী ভারী ঠেকছে। মানুষ ঘাবড়ে গেলে কি শরীর ভারী লাগে?
সুশীলবাবু মনে মনে বললেন, অসম্ভব। নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোটখাটো মাথা খারাপ নয়, বড় ধরনের মাথা খারাপ। মাথা খারাপ হলে মানুষ অনেক অদ্ভুত আচরণ করে, ভয়ংকর ভয়ংকর সব ভুলে দেখে, ভুল শোনে। যা সত্যি নয়, সেটাকে খুব সত্যি বলে মনে হয়। কিন্তু নিজের গলায় কোকিলের ডাক শুনতে পায় কি? কই, এরকম তো কখনও শোনা যায়নি! পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করতে ভুলে গেলেন সুশীল পাত্র। জামার হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে এলে কেমন হয়? জলের ঝাপটায় অনেক সময় কাজ দেয়। মাথা ঠান্ডা হয়, গুলিয়ে যাওয়া বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করতে শুরু করে। টেবিল ধরে সাবধানে উঠে দাঁড়ালেন অঙ্কস্যার।
টিচার্সরুম লাগোয়া ছোট বাথরুম। বেসিনের উপর আয়না। চশমাটা খুলে সুশীলবাবু সেই আয়নার দিকে তাকালেন। না, চোখে-মুখে অসুখের কোনও ছাপ নেই। লম্বা নাক, সরু গোঁফ, মোটা ভুরু। চোখদু’টো লাল পর্যন্ত হয়নি। যে-কোনও অসুখের প্রথম লক্ষণ হল চোখ লাল। তা হলে?
সত্যি-সত্যি বারকয়েক জলের ঝাপটা দেওয়ার পর যেন খানিকটা যুক্তি-বুদ্ধি ফিরে এল। আচ্ছা, প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও ভুল শোনেননি তো? হতে পারে। মানুষ কি একই ভুল দু’বার করে না? এই তো পরীক্ষার খাতায় ক্লাস এইটের দীপায়ন বৃত্তের অঙ্কটা সাতবার করেছে, সাতবারই ভুল। ছোটদের যদি সাতবার ভুল হতে পারে, বড়দের মাত্র দু’বার ভুল হতে অসুবিধে কোথায়? কোনও অসুবিধে নেই। সবচেয়ে ভাল হত আরও একজনকে নিজের গলাটা শোনাতে পারলে। নবলালকে শোনালে কেমন হয়? কী বলবেন?
“নবলাল, দ্যাখ তো আমার গলাটা মানুষের মতো কি না?”
অবশ্য কিছু না বললেও চলে, এমনই সাধারণ দু’টো-চারটে কথার পরই বোঝা যাবে। তবে এতে ঝুঁকি আছে। সত্যি যদি কথার মাঝখানে আবার কোকিলের ডাক বেরিয়ে আসে? বাপরে! সে এক কেলেঙ্কারি! নিমেষের মধ্যে স্কুলে খবর ছড়িয়ে পড়বে। শুধু স্কুল কেন? গোটা কাঞ্চনগড়ে জানাজানি হয়ে যাবে। তখন?
তখন কী হবে সুশীলবাবু কল্পনাও করতে পারছেন না। মানুষের গলায় পাখির ডাক শোনা গেলে কী হয়, এতদূর কল্পনা করবার ক্ষমতা তাঁর নেই। তবে তিনি এইটুকু বুঝতে পারছেন, মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। জটিল অঙ্ক কষবার মতো মাথা ঠান্ডা দরকার। পরীক্ষানিরীক্ষা যা করার করতে হবে গোপনে। সেইমতো বাথরুমে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা একবার ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিলেন সাবধানে। বেসিনের কলটা খুলে দিলেন পুরো। যাতে বাইরে কেউ কিছু শুনতে না পায়। তারপর ফিসফিস করে শুরু করলেন তেষট্টির নামতা।
“তেষট্টি এক্কে তেষট্টি, তেষট্টি দু’গুণে একশো ছাব্বিশ, তিন তেষট্টি একশো উননব্বই, চার তেষট্টি কুহু, পাঁচ তেষট্টি কুহু, কুহু, ছয় তেষট্টি কুহু কুহু কুহু, সাত তেষট্টি চারশো একচল্লিশ, আট তেষট্টি পাঁচশো চার, ন’ তেষট্টি কুহু কুহু…।”
যে মানুষটিকে দেখলে স্কুলসুদ্ধু ছেলের মুখ ভয়ে আমসি হয়ে যায়, তাঁর মুখটাই এখন হয়ে গিয়েছে ফ্যাকাশে। রক্তশূন্য। এত ভয় তিনি জীবনে কখনও পাননি। ঘটনা তা হলে সত্যি? সত্যি তাঁর গলা থেকে কোকিলের ডাক বের হচ্ছে!
সুশীলবাবু আবার পরীক্ষা চালালেন। শেষবারের মতো পরীক্ষা। গলা সামান্য তুলে, আয়নার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “আমাদের ছোট নদী, চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/পার হয়ে যায় গোরু কুহু/পার হয় গাড়ি কুহু কুহু…।”
না, আর সন্দেহ নেই, ঘটনা একশো শতাংশ সত্যি। কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের ডাকসাইটে রাগি খ্যাসখ্যাসে গলার অঙ্কের শিক্ষক সুশীল পাত্র এখন পাখির মতো ডাকছেন! এমনই পাখি নয়, একেবারে চমৎকার গলায় কোকিলপাখি! কাঁপা হাতে বাথরুমের দরজা খুলতে খুলতে সুশীলবাবুর মনে হল, এই বিপদের মধ্যে একটাই আশার কথা। সবটাই পাখির গলা নয়, কিছু কিছু কথা এখনও মানুষের মতো বলতে পারছেন। এই ক্ষমতাও কি তিনি ধীরে ধীরে হারাবেন? পুরোটাই কোকিল হয়ে ‘কু কু’ করবেন? উফ, কী ভয়ংকর! কী মারাত্মক!
দরজা খুলে বেরোতেই সুশীলবাবু দেখলেন, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে নবলাল। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ, “স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ? বাথরুমের দরজা এতক্ষণ বন্ধ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
চোখে-মুখে স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টা করলেন সুশীলবাবু। নবলালের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলেন। হেসেই বুঝতে পারলেন, কাজটা ঠিক হল না। তিনি একজন গম্ভীর মুখের মানুষ। হাসি তাঁর মুখে স্বাভাবিক জিনিস নয়। এতে সন্দেহ কমবে না, বাড়বে। ফলে দ্রুত মুখ গম্ভীর করে টেবিলে ছড়ানো খাতাগুলো গোছাতে শুরু করলেন। সেইসঙ্গে ভাবতে লাগলেন, এই মুহূর্তে কর্তব্য কী? আগে স্কুল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে হবে। কেউ কিছু জানবার আগেই পালাতে হবে। বাড়ি বসে শান্ত মাথায় ভাবতে হবে।
নবলাল আবার প্রশ্ন করল, “স্যার, শরীর ঠিক আছে তো? চোখ-মুখ কেমন বসা বসা মনে হচ্ছে!”
নবলাল চিরকালই বেশি কথা বলে। তাকে ধমক দিয়ে থামাতে হয়। সুশীলবাবুর মনে হচ্ছে, আজ কথা আরও বেশি বলছে। কথার মধ্যে আবার হাজারটা প্রশ্ন। ‘চোপ’ বলে কষে একটা ধমক দিলে চুপ করে যাবে। দেবেন? থাক, দরকার নেই। ঝুঁকির কাজ হয়ে যাবে। তা ছাড়া চেঁচিয়ে কথা তো একেবারেই নয়। যেটুকু কথা না বললেই নয়, সেটাও বলতে হবে আস্তে, গলা নামিয়ে। গলা থেকে পশু-পাখি যারই ডাক বেরোক না কেন, সেই ডাক ঠিকমতো যেন শোনা না যায়।
খাতা গোছানো হয়ে গেলে এক টুকরো কাগজে লাল ডটপেনটা দিয়েই খসখস করে কয়েকটি লাইন লিখলেন সুশীলবাবু। হেডমাস্টারমশাইকে চিঠি, ‘খাতা দেখা শেষ। ভেবেছিলাম নম্বরগুলো আলাদা কাগজে টুকে জমা দেব, কিন্তু শরীর খারাপ লাগছে বলে সেটা পারছি না। কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। মনে হচ্ছে, প্রেশারের সমস্যা। তবে হাই না লো প্রেশার বোঝা যাচ্ছে না। আমি বাড়ি চললাম। ইতি সুশীল পাত্র।’
চিঠি ভাঁজ করে সুশীলবাবু উপরে লিখলেন, ‘আর্জেন্ট।’ তারপর এগিয়ে দিলেন নবলালের দিকে।
নবলাল চিঠি নিয়ে বলল, “হেডস্যারকে দেব তো?”
সুশীলবাবু মাথা নাড়ালেন। নবলাল চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। একগাল হেসে বলল, “স্যার, একটু আগে একটা মজার কাণ্ড হয়েছে। বলব?”
সুশীলবাবু টেবিল থেকে নিজের ব্যাগ আর ছাতাটা তুলতে তুলতে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
নবলাল হাসি হাসি মুখেই বলল, “খানিক আগে আপনি যখন আমাকে ডাক দিলেন স্যার, তখন মনে হল, কোথায় যেন কোকিল ডাকে! খুব জোরে ডাকে। এক্কেবারে কাছে। যেন এই ঘরের ভিতরেই! বোঝেন কাণ্ড স্যার! আমি তো ঘাবড়ে গিয়েছি, টিচার্সরুমে কোকিল ঢুকল নাকি! মানুষের ঘরে চড়ুই-শালিখ ঢোকে, কোকিল ঢোকে বলে তো কখনও শুনিনি। তাড়াতাড়ি এসে দেখি, না সেরকম কিছু নয়। আমিই ভুল শুনেছি।”
নবলালের হাসির মাঝখানেই অঙ্কস্যার ব্যাগ আর ছাতা হাতে থমথমে মুখে টিচার্সরুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তা হলে নবলালও শুনেছে? যাক, বিপদ সম্পর্কে আর কোনও সন্দেহ রইল না।
সুশীল পাত্র স্কুল থেকে বেরিয়ে ছাতা না খুলেই কড়া রোদের মধ্যে হাঁটতে শুরু করলেন। মানুষ যখন বড় ধরনের বিপদের মধ্যে পড়ে তখন রোদ-বৃষ্টি খেয়াল থাকে না।
সুশীল পাত্র খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন, তিনি একটা বড় ধরনের বিপদের মধ্যে পড়েছেন।
॥২॥
বেতের চেয়ারে ঝকঝকে চেহারার যে যুবকটি বসে আছে তার হাতে একটা প্লেট। প্লেটে ডবল ডিমের অমলেট। যুবকটি চামচ দিয়ে অমলেট কেটে কেটে খাচ্ছে আর খাটে বসে থাকা সুশীলবাবুর দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসছে।
সুশীলবাবু মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এই যুবকটিকে তিনি এমনিতেই সহ্য করতে পারেন না। দেখলেই কেমন একটা অ্যালার্জির মতো হয়, রাগে গা চিড়বিড় করে। তার ওপর এখন আবার হাসছে। চিড়বিড়ানি ভাব বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। যদি ক্ষমতা থাকত তা হলে মুখ একপাশে না ঘুরিয়ে পুরো পিছন দিকে ঘুরিয়ে নিতেন। পুরো তিনশো ষাট ডিক্রি। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। মানুষ মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরাতে পারে না।
যুবকটির নাম কল্যাণ। সুশীলবাবুর শ্যালক। নমিতাদেবীর একমাত্র ভাই। অতি আদরের ভাই। ফুর্তিবাজ, হাসিখুশি ধরনের ছেলে। সুযোগ পেলেই হইচই আর মজা করে। জামাইবাবুর রাগ, বদমেজাজকে মোটেও পাত্তা দেয় না। মানুষটি যে অঙ্কের মতো একটা সিরিয়াস সাবজেক্টের গুরুগম্ভীর শিক্ষক সেটা যেন তার মাথাতেই নেই! তাঁর সঙ্গেও সমান তালে ঠাট্টা রসিকতা চালায়!
এই কারণেই ছেলেটিকে সুশীলবাবুর এত অপছন্দ। তিনি মনে করেন, কল্যাণ একটি মহা ফাজিল ছোকরা। এই সব ছোকরাকে শায়েস্তা করার পদ্ধতি তাঁর জানা নেই এমন নয়, ভাল করেই জানা আছে। চৌবাচ্চায় নল দিয়ে জল ঢোকা, জল বের হওয়া সংক্রান্ত পাটিগণিতের সঙ্গে চৌবাচ্চা ভরতি হয়ে জল উপচে পড়ার জ্যামিতি মিশিয়ে অঙ্ক দিলেই ছোকরা কাত হয়ে যাবে। হাসি শুকিয়ে যাবে। কিন্তু গিন্নির কারণে সেটা সম্ভব নয়। তার ভাইকে অঙ্ক কষতে বসালে সংসারে একটা কাণ্ড লেগে যেতে পারে।
তাই কল্যাণকে সহ্য করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই সুশীলবাবুর। কিন্তু ও এই সাতসকালে কলকাতা থেকে এসে হাজির কেন? কে খবর দিল? তার দিদি? তাই হবে। শুধু খবর দেয়নি, বোঝা যাচ্ছে, ভাই আসছে জেনে সে একেবারে ডবল ডিমের ব্রেকফাস্ট তৈরি করে রেডি ছিল। আসতেই প্লেট হাতে ধরিয়ে বেডরুমে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
এবার কল্যাণ বলল, “জামাইবাবু, যা শুনছি, ঘটনা কি সত্যি?”
সুশীলবাবু চমকে উঠলেন। মুখ ঘুরিয়ে শ্যালকের দিকে তাকালেন। কী শুনেছে? ভয়ংকর ঘটনা কি কিছু জানতে পেরেছে নাকি? কল্যাণ সবই শুনেছে। নমিতাদেবী আজ কাকভোরে তাঁর ভাইকে ফোন করেছিলেন। কল্যাণ খাটে শুয়েই মোবাইল ধরেছিল। জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে দিদি? এত সকালে ফোন করছিস কেন?” নমিতাদেবী শিউরে উঠেছিলেন, “সর্বনাশ হয়েছে! ভয়ংকর বিপদ হয়েছে। কোন আক্কেলে তুই এখনও ঘুমোচ্ছিস বল তো কলু?”
ভাইকে আদর করে নমিতাদেবী ‘কলু’ বলে ডাকেন। কল্যাণ ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেছিল, “বিপদ! কার বিপদ? কীসের বিপদ?”
নমিতাদেবী কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, “আবার কার? তোর জামাইবাবুর বিপদ।”
“জামাইবাবুর! কী হয়েছে? হার্ট অ্যাটাক?”
কথা বলতে বলতেই কল্যাণ ওদিকে খাট থেকে নেমে পড়েছিল। নমিতাদেবী আরও কঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, “হার্ট নয়, গলা অ্যাটাক। গলায় অ্যাটাক করেছে।”
“গলায় অ্যাটাক! সেটা আবার কী! ঘুম ভাঙিয়ে কী যা-তা বলছিস?”
“যা-তা কিনা নিজে এসে দেখে যা। আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে রে কলু।”
কল্যাণ বলেছিল, “মাথা ঠান্ডা কর দিদি, বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা করতে হয়। তুই আগে বল কী ঘটেছে? গলায় অ্যাটাক মানে? কাশিটাশি? ঠান্ডা লেগেছে?”
ভাইয়ের কথামতো নমিতাদেবী খানিকটা শান্ত হওয়ার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু কাশির কথা শুনে মাথা আরও গরম হয়ে গেল। রিসিভারটা মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “ওসব কিছু নয়। তোর জামাইবাবু কাল থেকে পাখির ডাক শুরু করেছে। কাক, চড়ুই নয়, একেবারে কোকিলের ডাক। দু’টো কথা বলছে আর কুহু কুহু করছে। আমাকে বলছে, এক কাপ চা দাও কুহু, চায়ে আদা দেবে কুহু, ফ্যানটা ছেড়ে দাও কুহু কুহু, আমার তোয়ালেটা কোথায় কুহু, স্নান করতে যাব কুহু কুহু? কী মারাত্মক!”
ওদিকে কল্যাণ সোফার উপর ধপাস করে বসে পড়ল। মোবাইলটা হাত বদল করে ঢোক গিলে বলল, “দিদি, আর ইউ জোকিং? ভোরবেলা ঘুম ভাঙিয়ে আমার সঙ্গে মজা করছিস? তোর কি মনে হল ভোরবেলাটা রসিকতা করার পক্ষে উপযুক্ত সময়?”
“বললাম তো, মজা কি না এসে নিজের চোখে দেখে যা, সরি, কানে শুনে যা। কাল থেকে শুরু হয়েছে। স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এল, তারপর থেকে… একটু আগে দেখে এলাম, মানুষটা বসে বসে কীসব ছাইভস্ম আওড়াচ্ছে, আর মাঝেমধ্যে কোকিলের ডাক ডাকছে। আমি জিজ্ঞেস করতে বলল, পিথাগোরাস না ডাইনোসরাসের থিয়োরি বলছে। থিয়োরি বলে নাকি দেখছিল, মানুষের গলা ফিরেছে কি না। একটাই রক্ষে, যা করছে নিচু গলায় করছে। পাখির ডাক এখনও পর্যন্ত কেউ শুনতে পায়নি। শুনতে পেলে যে কী কেলেঙ্কারি হবে! উফ!”
কল্যাণ উত্তেজনায় প্রায় সোফার উপর উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, “দিদি, তুই যা বলছিস, ঘটনা যদি সত্যি হয়, তা হলে মনে হচ্ছে, জামাইবাবুর অ্যাটাক গলায় নয়, অ্যাটাক হয়েছে মাথায়। অঙ্ক করতে করতে মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছে। এরকম যে একটা কিছু হতই, তা আমি আগেই বুঝতে পারছিলাম। যারা সারা জীবন অঙ্ক নিয়ে থাকে তাদের ক্ষেত্রে দু’টো ব্যাপার হতে পারে, হয় ভাল, নয় মন্দ। দুর্ভাগ্য, জামাইবাবু মন্দের দিকটা বেছে নিলেন। ভাল হলে হয়তো দেখতিস, নোবেল-টোবেল পেয়ে একটা কাণ্ড করেছেন। ‘সুশীলস জিরো’ নামে থিওরেম চালু হয়ে গিয়েছে।”
নমিতাদেবী চাপা গলায় আবার ধমক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “থামবি তুই? ফাজলামি হচ্ছে?”
কল্যাণ বলল, “তাও রক্ষে, জামাইবাবু এখন পাখির ডাক ডাকছেন। এরপর হয়তো বাঘ বা সিংহের ডাক দেবেন। মনে হয় এর পরের স্টেজটাই হবে আঁচড়ে কামড়ে দেওয়ার স্টেজ। আর সেটাই ডেঞ্জারাস।”
নমিতাদেবী টেলিফোনেই আঁতকে উঠলেন। চললেন “অ্যাঁ! আঁচড়ে দেবে? বলিস কী কল্যাণ?”
কল্যাণ শান্ত গলায় বলল, “দেবেনই যে এমন কথা শিওর হয়ে বলছি না। তবে দিতে পারেন, চান্স আছে। তুই রিস্ক নিস না দিদি। জামাইবাবুকে এখন ঘর থেকে মোটে বের হতে দিবি না। আমি সাতটা চল্লিশ বা আটটা কুডির লোকাল ধরে চলে যাচ্ছি। ঘণ্টাখানেকের বেশি তো লাগবে না। তুই ব্রেকফাস্ট রেডি করে রাখ। আজ কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে ব্রেকফাস্ট করব।”
নমিতাদেবী বললেন, “চোপ৷ চোপ একদম। এবার কিন্তু একটা চড় খাবি কলু! জামাইবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আর তুই মজা করছিস? লজ্জা করে না?”
কল্যাণ গম্ভীর গলায় বলল, “লজ্জার কী আছে দিদি? জামাইবাবু তো গোরুর ডাক ডাকছেন না যে, লজ্জা পাব। কোকিলের ডাক খুবই মিষ্টি। যাক, তুই চিন্তা করিস না, আমি আসছি। তুই শুধু মানুষটাকে ঘরে আটকে রাখ। পারলে দরজায় দুটো তালা মার। দেখবি, পাখি যেন উড়ে না যায়!”
ঘরে আটকানোর আলাদা করে দরকার নেই। সুশীলবাবু কাল থেকে নিজেই নিজেকে ঘরে আটকে রেখেছেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় রিকশা নিতে গিয়েও থমকে গেলেন। রিকশাওলার সামনেই যদি ঘটনাটা ঘটে? ভাড়া নিয়ে দরদাম করতে গিয়ে যদি গলা থেকে পাখির ডাক বেরিয়ে আসে? থাক, দরকার নেই। হেঁটেই বাড়ি ফিরছেন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ঘটনাটাকে একটা অঙ্কের মতোই দেখতে হবে। এমন একটা জটিল অঙ্ক, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝার উপায় নেই, অথচ বুঝতে হবে। সুতরাং মাথা শান্ত করা দরকার। কোন ফর্মুলায় এই জটিল অঙ্ক উদ্ধার করা যায় ভাবতে হবে। এর জন্য সবার আগে দরকার খানিকটা সময় আলাদা থাকা। ইংরেজিতে যাকে বলে আইসোলেশন। বাড়িতে স্ত্রী আর রান্নার লোক মায়া ছাড়া কেউ নেই। বাড়ি ফিরে টুক করে বেডরুমে ঢুকে পড়লেই চলবে। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কারও সঙ্গে কথা বলা তো দূর অস্ত, দেখা করারও দরকার নেই। ভেবে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন সুশীল পাত্র। তবে বাড়ির কাছাকাছি এসে মনে হল, স্ত্রীকে ঘটনাটা বলতে হবে। অন্যদের আটকাতে গেলেও তাকে লাগবে। কিন্তু ঘটনা সে কেমন ভাবে নেবে? স্বামী পাখির মতো আচরণ করলে স্ত্রীরা কী করে? অবাক হয়? রেগে যায়? নাকি সুটকেস গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালায়? নমিতা কোথায় পালাবে? তার বাবা-মা মারা গিয়েছেন। বাপের বাড়ি বলতে শুধু একটা ভাই। কলকাতায় তার ফ্ল্যাটে চলে যাবে? কে জানে কী হবে!
নমিতাদেবী ঘটনাটা প্রথমে ঠান্ডাভাবেই নিলেন, “ও তাই নাকি?” বলে এমন একটা ভান করলেন যেন কিছুই হয়নি। আসলে ব্যাপারটা তিনি আমল দিচ্ছিলেন না। ভেবেছিলেন, এটাও অঙ্কের কোনও ব্যাপার। মানুষটি অঙ্ক নিয়ে রাতদিন কত উদ্ভট জিনিসই তো করেন। রবিবারের এক দুপুরে বারান্দায় বসে বেঁটে একটা লাঠিতে তেল মাখাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন, “তেল-লাঠির অঙ্ক কষছি। সেই যে আছে না, একটা বাঁদর তেলমাখা লাঠিতে দু’ ফুট উঠেই পিছলে এক ফুট নামছে? সেটাই হাতে-কলমে দেখার চেষ্টা করছি। বাঁদর নেই বলে অসুবিধে হচ্ছে, তবে কাজটা হয়ে যাবে।”
পরশু না তার আগের রাতে আধোঘুমের মধ্যেই নমিতাদেবী শুনতে পেলেন, কে যেন বিড়বিড় করছে, “ঝিক, ঝিক, ঝিক…।” ছোটরা যেমন মুখে ট্রেন চলার আওয়াজ করে, সেরকম। চোখ খুলে নমিতাদেবী দেখেন, এ কী কাণ্ড! তাঁর স্বামী খাটের উপর বসে মুখ দিয়ে ট্রেন চালাচ্ছেন।
নমিতাদেবী বললেন, “কী হল? এ আবার কী নতুন জ্বালাতন শুরু করলে?”
“জ্বালাতন নয়, পাটিগণিত।”
নমিতাদেবী ঘুম ভাঙা বিরক্ত গলায় বললেন, “পাটিগণিত! পাটিগণিত করতে গেলে মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে হয় নাকি?”
সুশীলবাবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন, “আলবাত করতে হয়। একশোবার করতে হয়। এই ধরো না, একটা ট্রেন দশ সেকেন্ডে একশো পঞ্চাশ মিটার লম্বা প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করে। গোটা স্টেশন অতিক্রম করতে তার সময় লাগে বাইশ মিনিট। তা হলে ট্রেনটার দৈর্ঘ্য আর গতিবেগ কত? এই পর্যন্ত অঙ্ক দিলে ক্লাস এইটের অনেকেই পারবে। অঙ্কে মাথাওলা ছেলে ওই ক্লাসে অনেক আছে। কিন্তু এর সঙ্গে যদি আমি ট্রেনের আওয়াজটা যোগ করে শব্দের কম্পাঙ্কটা জানতে চাই, তা হলেই সবাই চিতপটাং হবে। ছেলেগুলো মাথা খুঁড়ে মরবে। কেমন হবে?” কথা শেষ করে বিজয়ীর হাসি দিলেন সুশীল পাত্র।
নমিতাদেবী পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন, “খুব খারাপ হবে। পাগলামি বন্ধ করে ঘুমোতে দাও।”
এবারও তাই ভেবেছিলেন, এরকম কিছু হয়েছে। বাড়ি ফিরে সুশীলবাবু স্ত্রীকে নিচু গলায় বললেন, “কুহু, একবার বেডরুমে এসো।”
ঘরে ঢুকতে সুশীলবাবু দরজায় ছিটকিনি দিয়ে খাটের উপর বসে পড়লেন। নমিতাদেবীর কেমন সন্দেহ হল, “কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে বড়? শরীরটরির খারাপ নাকি?”
সুশীলবাবুর হাতের ইশারায় ফ্যানটা জোরে চালাতে বললেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, “একটা সমস্যা হয়েছে। তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ, কুহু-কুহু?”
নমিতাদেবী এবার রেগে গেলেন। ভরদুপুরে বাড়ি ফিরে এসে মানুষটির এ আবার কেমন রসিকতা? দরজা আটকে কোকিলের ডাক শোনাচ্ছেন! নিশ্চয়ই অঙ্কের কোনও কারসাজি বের করেছেন। এখনই বলবেন, ‘একটা দারুণ অঙ্ক ফেঁদেছি। একটা কোকিল ঘণ্টায় সতেরোবার ডাকে, তা হলে সতেরোটা কোকিল…।’
এই রসিকতা এখনই থামাতে হবে। নমিতাদেবী চড়া গলায় বললেন, “এসবের মানে কী তোমার? অ্যাঁ! কী মানে? একদিন মাঝরাতে ট্রেনের ঝিকঝিক, একদিন ভরদুপুরে কোকিলের কু-কু, পেয়েছটা কী? তুমি কি চাও আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই? পৃথিবীতে অঙ্কের মাস্টার তো তুমি একা নও, অনেক আছে। তোমার সমস্যাটা কী বলো তো?”
সুশীলবাবু স্ত্রীকে তাঁর সমস্যা বললেন। বললেন, একেবারে ঘটনার গোড়া থেকে। কীভাবে খাতা দেখতে দেখতে স্কুলের পিয়ন নবলালের কাছে জল চাইলেন, তখন কীভাবে কথার বদলে বাজখাঁই গলা দিয়ে কুহু-কুহ বের হল থেকে শুরু করে তেষট্টির নামতা, ‘আমাদের ছোটো নদী’ আবৃত্তি পর্যন্ত সব। নমিতাদেবী চোখ কপালে তুলে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে সব শুনলেন। যতটা ভয় পেলেন, তার চেয়ে ঘাবড়ে গেলেন অনেক বেশি। এ আবার কেমন অসুখ! মানুষটা যে মিথ্যে বলছেন এমনও নয়, একটা-দু’টো কথার পরপরই কু-কু করছেন! সেই কু-কু কোকিলের ডাকের মতোই সুরেলা! পাখি যেন বাড়ির বাগানে, গাছে বসে আছে! যদি বানিয়ে বানিয়ে ডাকও দেন, তা হলেও চিন্তার। যে মানুষটি সারাজীবন গান-বাজনার ধার দিয়ে গেলেন না, তিনি গলায় এত সুর পেলেন কী করে!
আতঙ্কিত মুখে নমিতাদেবী বললেন, “ভাইকে খবর দেব? ও চলে আসুক।”
সুশীলবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, “খেপেছ? ওই বিচ্ছু ছেলে কী করবে? তা ছাড়া ঘটনা সবসময় তো ঘটছে না, মাঝেমধ্যে ঘটছে। কুহু-কুহু। দেখছ না, অনেকটা হেঁচকির মতো। মনে হয়, দু’টো দিন রেস্ট নিলেই সেরে যাবে। তবে একটাই ব্যাপার কুহু, ক’টাদিন কুহু-কুহু একটু আলাদা থাকতে হবে। অন্য কেউ শুনলে…।”
নমিতাদেবী চিন্তিত মুখে বললেন, “বলছ এমন কিছু নয়? ক’টা দিনের মধ্যে সেরে যাবে? কী জানি বাবা! আমার তো ভীষণ ভয় করছে। ডাক্তারবাবুকে ডাকব? তোমার এই ডাক যদি আমাদের মায়ার কানে যায়, তা হলে সর্বনাশ! ওই মেয়ে যেমন ভাল রান্না করে, তেমনই কোনও কথা পেটে রাখতে পারে না। একবেলাতেই গোটা কাঞ্চনগড়ে জানাজানি হয়ে যাবে। তুমি এখন দরজা বন্ধ করে বসে থাকো।”
সুশীলবাবু বাকি দিনটা দরজা বন্ধ করেই রইলেন। বিকেলে সাতজন আর সন্ধেবেলা পাঁচজন ছাত্র এসেছিল। সর্দি-কাশি আর গলা ব্যথা বলে নমিতাদেবী বাড়ির গেট থেকেই তাদের বিদায় করলেন। তারা পড়তে হবে না জেনে খুব খুশি মনে চলে গেল। যাওয়ার সময় মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল, “হে ঠান্ডা লাগার ভগবান, হে সর্দি-কাশির দেবতা, মাস ছয়েকের আগে যেন স্যারের অসুখ না সারে! তুমি দেখো ঠাকুর, আমাদের রক্ষে কোরো।”
বিকেলে একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড করে বসলেন সুশীলবাবু। দরজার ফাঁকে মুখ বের করে হাঁক দিয়ে বললেন, “মায়া, মায়া, চা দাও। কুহু কুহু।”
কাজটা করেই সুশীলবাবু বুঝতে পারলেন ভুল হয়ে গেল। শুধু ভুল নয়, ডাক হয়েছে বেশ জোরে। মায়া তখন ছিল বারান্দায়। সে চমকে মুখ তুলে বাইরে তাকাল। কোকিলের ডাক! এই ভরসন্ধেবেলা কোকিল ডাকে কোথায়? বাড়ির ভিতর নাকি? আওয়াজ যেন বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে এল! এল না? চায়ের জল বসিয়ে এসে সে নমিতাদেবীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যা গো বউদি, দাদার শরীর খারাপ নাকি গো? ঘরে দোর দিয়ে আছে কেন?”
নমিতাদেবী গম্ভীর গলায় বললেন, “হ্যাঁ, গলায় গোলমাল। তুমি চা বানিয়ে কাপটা আমায় দিয়ো। আমি ঘরে দিয়ে আসব। চায়ে কয়েক টুকরো আদার কুচি দিয়ো। আদা গলার জন্য ভাল।”
কাল রাত পর্যন্ত এত একা-একা সামলেছেন নমিতাদেবী, কিন্তু আজ ভোরে আর পারলেন না।
প্রতিদিনই ভোরে তাঁর স্বামী অঙ্কের ফর্মুলা, জ্যামিতির সংজ্ঞা, বীজগণিতের নিয়ম ঝালিয়ে নেন। অনেক বছরের অভ্যাস। আজ ঘুম ভাঙতে নমিতাদেবী দেখলেন, মানুষটি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছেন আর থেকে থেকে কোকিলের ডাক ডাকছেন, “যদি চারটি বিন্দু দিয়ে একটি কুহু অঙ্কন করা সম্ভব হয়, তা হলে ওই বিন্দুগুলোকে সমবৃত্তস্থ কুহু-কুহু বলা হয় এবং যদি কোনও চতুর্ভুজের চারটি শীর্ষবিন্দু দিয়ে একটি চতুর্ভুজ অঙ্কন করা সম্ভব হয়, তা হলে ওই চতুর্ভুজটিকে বলা হবে কুহু-কুহু চতুর্ভুজ…।”
এটা শোনবার পর সোজা পাশের ঘরে গিয়ে ভাইকে ফোনে ধরলেন নমিতাদেবী। নিঃসন্তান নমিতাদেবী বিপদে-আপদে কল্যাণকেই খবর দেন। তাঁর স্বামী পছন্দ না করলেও দেন।
সেই কল্যাণ এখন সুশীলবাবুর সামনে বসে আছে। অমলেট খাওয়া শেষ করে মাটিতে প্লেট নামিয়ে রাখল। হেসে বলল, “দিদির কাছে যা শুনলাম তা সত্যি না মিথ্যে জামাইবাবু? মুখে বলতে হবে না।আপনি শুধু মাথা নাড়ুন।”
পাশেই নমিতাদেবী দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, “আহা, মুখ ফুটে বলোই না, কল্যাণ তো বাইরের কেউ নয়, পাঁচকান করবে না।”
আর পারলেন না সুশীলবাবু। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখ লাল করে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “পাঁচকানের আর বাকি কী রেখেছ? কুহু-কুহু। ভাইকে ডেকে এনেছ। এবার কুহু-কুহু মাসি-পিসি সবাইকে ডাকো। সবাই এসে তোমার কাকিল স্বামীকে দেখে যাক। কুহু-কুহু-কুহু।”
কল্যাণ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল, “স্ট্রেঞ্জ! আশ্চর্য! অদ্ভুত! সত্যি, এ যে একেবারে কোকিলকণ্ঠ!”
॥ ৩ ॥
“ভোঁ, ভোঁ, ভোঁ…।”
“এটা কীসের আওয়াজ?”
“স্যার, এটা স্টিমারের আওয়াজ।”
“পরেরটা কর।”
“গুমগুম, গুমগুম, গুমগুম।”
“এটা?”
“এটা মেট্রো রেল।”
“তারপর?”
“শাঁই-ই-ই, শাঁই-ই-ই, শাঁই-ই-ই।”
“এটা প্লেন?”
“না স্যার, প্লেন নয়, এটা হোভারক্রাফট।”
“হোভারক্রাফট কী?”
“জলেও চলে, মাটিতেও চলে স্যার। ক্যাঁ-অ্যা-আ-অ্যা-চ৷”
“এটা গাড়ি চলছে?”
“না, গাড়ি চলছে না, গাড়ি ব্রেক কষল।”
হাতের স্লেটটা খাটের উপর নামিয়ে চুপ করে বসে রইলেন সুশীলবাবু। তাঁর একপাশে কাগজের তাড়া, নোটবই আর একটা স্লেট। অন্য পাশে একটা ঘণ্টা। বড় নয়, ছোট পুজোর ঘণ্টা। নাড়লে টুং টুং করে বাজছে।
এসবের ব্যবস্থা কল্যাণ করে গিয়েছে। বলে গিয়েছে “জামাইবাবু, যতক্ষণ না আপনার এই কোকিল-অসুখ সারছে, ততক্ষণ আপনাকে অলটারনেটিভ সিস্টেমের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে।”
“অলটারনেটিভ সিস্টেম! সেটা আবার কী? কুহু।” ভুরু কুঁচকে তাকালেন সুশীল পাত্র।
কোকিলের ডাক শুনে আবার ফিচ করে হেসে ফেলল কল্যাণ। গুরুগম্ভীর একটা মানুষ কথায় কথায় সুরেলা গলায় ‘কু-কু’ করলে হাসি না পেয়ে উপায় কী? হাসি মুখেই সে বলল, “অলটারনেটিভ সিস্টেম হল, বিকল্প ব্যবস্থা। কথা বলবার বিকল্প ব্যবস্থা। আপনি তো মানুষের সঙ্গে কোকিলের ভাষায় কথা বলতে পারবেন না। কোকিলের ভাষা শুধু কোকিলই বুঝবে। তাই না?”
সুশীলবাবুর মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। ইচ্ছে করল বিচ্ছু ছেলেটিকে ধরে একটা চড় লাগান। তিনি চোখ পাকিয়ে কল্যাণের দিকে তাকালেন।
কল্যাণ সেই পাকানো চোখকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বলল, “কেউ যদি আপনার এই কুহুধ্বনি শোনে, মারাত্মক ঘাবড়ে যাবে। সামনে থেকে শুনলেও ঘাবড়াবে, আড়াল থেকে শুনলেও ঘাবড়াবে। কুহু-কুহু ডাক বাগানে মানায়, বেডরুমে নয়। এই যেমন আপনার বাড়ির রান্নার, মেয়ে, খবরের কাগজের হকার, দুধের সাপ্লায়ার যদি ঘটনা জানতে পারে, কী হবে? তারা ভয়ে সবাই কাজ ছেড়ে পালাবে। সেটা দিদির পক্ষে খারাপ হবে। বেচারির উপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। সুতরাং এখন আপনাকে যতটা সম্ভব চুপ করে থাকতে হবে জামাইবাবু। একদম স্পিকটি নট যাকে বলে। আপনার উপস্থিতিতে ক্লাসে ছেলেদের যেরকম অবস্থা হয়, সেরকম।”
নমিতাদেবী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু গলায় বললেন, “তা হলে কী হবে কলু?”
কল্যাণ হেসে বলল, “কী আর হবে দিদি? কেউ এলে তুই বলে দিবি, জামাইবাবুর ভোকাল কর্ডে ইনফেকশন হয়েছে। কু-কু-জ ইনফেকশন। ডাক্তারবাবু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। খাওয়ার পর দিনে তিনটে করে। দু’বেলা নুন জলে গার্গল চলছে। ক’দিন কথা বলা একদম বারণ। উনি লিখে লিখে কথা বলবেন। যাওয়ার আগেই আমি সে ব্যবস্থা করে যাচ্ছি।”
সুশীলবাবু ভুরু কোঁচকালেন। লিখে-লিখে কথা! এই ছেলে তো বিরাট ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে। এখনই উচিত সমকোণী চৌপল আর লম্বা বৃত্তাকার চোঙ মেশানো একটা অঙ্ক দিয়ে একে বসিয়ে দেওয়া। ঠেলা বুঝবে তখন। জামাইবাবুকে লিখে কথা বলার জ্ঞান দেওয়া বেরিয়ে যাবে।
কল্যাণ পেরিয়ে গিয়ে মোড়ের দোকান থেকে একগাদা কাগজ, একটা নোটবই, দুটো বাঁধানো খাতা, একটা স্লেট, হাফ ডজন চক আর ডাস্টার কিনে আনল।
“এই নিন জামাইবাবু। এগুলো সঙ্গে রাখুন। খাতা, পেন, স্লেট, যখন যেটা খুশি ব্যবহার করবেন। ছোট ছোট বাক্যে লিখবেন। যেমন ধরুন, মান্যিগন্যি কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এল, আপনি তখন লিখলেন, ‘নমস্কার বসুন। কেমন আছেন? চা খাবেন?’ ছাত্ররা এলে লিখবেন, ‘চোপ, চড় খাবি, কান ধরে ওঠবোস কর।’ গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে নিন। মাফলার দিলে ইনফেকশনের গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হবে। দিদি তোর কাছে ঘণ্টা আছে?”
নমিতাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “ঘণ্টা! কীসের ঘণ্টা? স্কুলের?”
সুশীলবাবু এবার উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেটা তো খুব বাড়িয়েছে। চক-ডাস্টারের পর ঘণ্টা! কল্যাণ হাসতে হাসতে বলল, “আরে বাবা, সেরকম ঘণ্টা নয়। পুজোর জন্য একটা ছোট ঘন্টা ছিল না তোদের? সেটা তুই জামাইবাবুর কাছে রেখে দে। বেলের মতো কাজ করবে। ঘণ্টা নাড়লে তুই চলে আসবি। কেমন প্ল্যান?”
ঘণ্টা শুনলে ছুটে আসবার পরিকল্পনা একেবারেই পছন্দ হল না নমিতাদেবীর। তবু তিনি ঘণ্টা এনে দিলেন। কল্যাণ চলে যাওয়ার সময় শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, কিছু বুঝলি?”
কল্যাণও গম্ভীর মুখে বলল, “হাসি-ঠাট্টা করলাম বটে, কিন্তু অবস্থা মোটেই ভাল নয়। এখনই চিকিৎসার প্রয়োজন। তবে কাঞ্চনগড়ের ডাক্তার দেখিয়ে লাভ হবে না। উলটে ঘটনা ছড়িয়ে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি দেখাতে হবে। রক্ষে একটাই, ডাকটা সব সময় হচ্ছে না। কোনও কোনও সময় হচ্ছে। ওই সময়টা ধরতে পারলে হত!”
নমিতাদেবী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “কীসের বড় ডাক্তার দেখাবি কলু? গলার?”
কল্যাণ বলল, “শুধু গলার কেন হবে? মাথার ডাক্তারও হতে পারে। আমার মনে হয়, জামাইবাবু কাজটা ইচ্ছে করে করছেন।”
“ইচ্ছে করে! ওমা! ইচ্ছে করে করবেন কেন?”
“সেটা জানি না। যাক, তুই চিন্তা করিস না দিদি! ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দে।”
সুশীলবাবু কল্যাণের পরিকল্পনা মতোই চলেছেন। লিখে কথা বলছেন, গলার মাফলার জড়িয়ে বসে আছেন। খয়েরি রঙের বদখত এই মাফলারটা একেবারেই সুবিধের নয়। কুটকুট করে। তবু জড়িয়ে আছেন। নমিতাদেবীকে ঘন ঘন ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকছেন। দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাজাচ্ছেন, টিং, টিং-টিং…। সাড়া দিতে দেরি হলে ঘণ্টা নাড়ছেন জোরে। নমিতাদেবী এতে খুবই বিরক্ত। ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকাটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। অথচ উপায়ও নেই। মায়া রান্না সেরে বাড়ি যায় অনেক রাতে। কাজ শেষ হয়ে গেলে ড্রয়িংরুমে মোড়া টেনে বসে টিভিতে পরপর দু’-দু’টো সিরিয়াল দেখে। এই মেয়ের আবার কৌতূহল বড্ড বেশি। ইতিমধ্যে সে নমিতাদেবীকে জিজ্ঞেস করেছে, “দাদা, এমন ঘণ্টি বাজায় কেন?”
নমিতাদেবী সতর্ক হয়ে বললেন, “উফ মায়া, তোমাকে বললাম না গলায় ব্যথা হয়েছে? এর মধ্যে ভুলে গেলে? ডাক্তারকে আমার ভাই টেলিফোন করেছিল। তিনিই বলেছেন।”
মায়া চোখ বড় করে বলল, “ঘণ্টি বাজাতে বলেছে! বউদি, গলায় ব্যথা হলে হাতে ঘণ্টি বাজাতে হয় এমনটা তো কখনও শুনিনি?”
নমিতাদেবী আরও সাবধান হলেন। শান্ত গলায় বললেন, “তা নয়, ডাক্তারবাবু কথা বলতে বারণ করেছেন। সেই জন্য তোমার ঘণ্টি বাজিয়ে ডাকাডাকি করছেন। তাঁকে কাগজ, স্লেটও এনে দেওয়া হয়েছে। কল্যাণই এনে দিয়েছে। ইস, ছেলেটার একগাদা খরচ হয়ে গেল!”
খুন্তি নাড়ানো বন্ধ করে মায়া আঁতকে উঠে বলল, “অ্যাঁ, স্লেট! অত বড় মানুষটাকে স্লেট এনে দেওয়া হয়েছে? বলেন কী বউদি!”
নমিতাদেবী এবার চাপা গলায় ধমক দিলেন। বললেন, “আঃ, সেই স্লেট নয়, তুমি থামো দেখি মায়া। উনি স্লেটে লেখাপড়া করছেন না, লিখে লিখে কথা বলছেন।”
“কথা! কী কথা?”
“কী কথা আবার। খাতা কই? পাটিগণিত বইটা কোথায় রাখলাম? এই সব কথা। তোমার মতো ডাল, আলুভাজার কথা তো উনি বলবেন না। উনি অঙ্কের মাস্টার, অঙ্কের কথা বলবেন।”
মায়া চুপ করে গেলেও নমিতাদেবী বুঝলেন, এই মেয়ে আরও ঝামেলা করবে। আচ্ছা, একে ক’টা দিন ছুটি দিয়ে দিলে কেমন হয়? রান্না নিজেই সামলে নেওয়া যাবে। মন-মেজাজ ভাল নেই। এই অবস্থায় খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছেও চলে গিয়েছে। রান্না অল্প একটু করলেই চলবে। অসুবিধে কিছু হবে না। কিন্তু কাজটা কি ঠিক হবে? মায়া যদি সন্দেহ করে? যদি কেন, নিশ্চয়ই করবে। কথা নেই বার্তা নেই, হুট বলতে দু’দিন ছুটি! না থাক, ঝুঁকি নিয়ে দরকার নেই।”
শোবার ঘরের দরজায় আবার ঘণ্টি বেজে উঠল, “টিং টিং টিং…।”
নমিতাদেবী দ্রুত পায়ে এসে বললেন, “এতবার ঘণ্টা বাজাচ্ছ কেন?”
সুশীলবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “তা হলে কী করব? তোমার বিচ্ছু ভাই তো ঘণ্টার কথাই বলে গেল। কুহু-কুহু।”
নমিতাদেবী রাগ করে বললেন, “আমার ভাইকে নিয়ে কিছু বলবে না কিন্তু। সে কী করেছে? পাখির ডাক তো সে ডাকছে না, তুমি ডাকছ।”
সুশীলবাবু আরও রেগে গেলেন। তিনি পায়চারি করতে করতে বললেন, “কুহু-কুহু-কুহু। আমি ডাকছি মানে? তুমি এমন করে বলছ যেন আমি ইচ্ছে করে কুহু-কুহু-কুহু…।”
নমিতাদেবী তাড়াতাড়ি মুখে হাত দিয়ে বললেন, “এই চুপ চুপ। আস্তে বলো। মায়া কিন্তু কান খাড়া করে আছে। ইচ্ছে করে না তো কী, তুমি কী বলতে চাইছ, সত্যি সত্যি তোমার গলায় কোকিল ঢুকেছে? তা ছাড়া তুমি অমনভাবে ঘরময় পায়চারিই বা করছ কেন? কীরকম একটা লাগছে।”
সুশীলবাবু থমকে দাঁড়ালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, “কেমন লাগছে?”
“মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি তুমি একটা খাঁচার পাখি। খাঁচার মধ্যে একবার এদিক, একবার ওদিক করছ।”
কথা শেষ করে নমিতাদেবী মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে হাসলেন। সুশীলবাবু আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। খুব জোর একটা ধমক দিতে গেলেন। একেবারে ঘর ফাটিয়ে ধমক। কিন্তু গলা দিয়ে সেই ধমক বের হল না। বের হল, ‘কুহু-কুহু-কুহু…’। ভারী সুন্দর! খুব সুরেলা সেই ডাক।
সুশীলবাবু ধপাস করে জানলার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লেন। বসেই রইলেন অনেকক্ষণ। আর বা রাগ বিরক্তি নয়, হতাশ লাগছে। অঙ্কের মাস্টার যদি ধমক দেওয়ার বদলে সুরেলা গলায় ডেকে ওঠেন, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আর উপায় কী? তা ছাড়া খানিকক্ষণ হল সুশীলবাবু লক্ষ করেছেন, রেগে গেলে, উত্তেজিত হলে ডাকটা যেন বেশি করে হচ্ছে। এটা কেন? রাগের সঙ্গে পাখির ডাকের কী সম্পর্ক? পাখি কি রাগতে পারে?
নমিতাদেবী বললেন, “চা খাবে? আদা-চা খাও এক কাপ, গলায় আরাম পাবে?”
সুশীলবাবু আবার রেগে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলালেন। না, শান্ত হতে হবে। মাথা ঠান্ডা করতে হবে। রাগলে হতচ্ছাড়া ডাকটা পেয়ে বসছে যেন! তিনি এরপর নিচু গলায় স্ত্রীকে অর্কর কথা বললেন।
অর্ক কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র। নাম অর্ক হলেও স্কুলের সকলে তাকে ‘হরবোলা অর্ক’ বলে চেনে। হরবোলারা মুখ দিয়ে খুব সুন্দর পশু-পাখির ডাক নকল করে। সিংহের গর্জন, কুকুরের ঘেউ ঘেউ থেকে শুরু করে কাকের কা কা, শালিকের ঝগড়া পর্যন্ত অনেক কিছু পারে। অর্ক ঠিক কী কী আওয়াজ করতে পারে সুশীলবাবু জানেন না, তবে অনেক কিছু পারে সেটা শুনেছেন। একবার ভূগোল ক্লাসে সে নাকি ঝামেলা পাকিয়ে ছিল। ভূগোলস্যার সেদিন নদ-নদীর উৎস এবং গতিপথ পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ শোনা গেল ছলাৎ ছলাৎ… ঠিক যেন নৌকো চলছে! জলের উপর বইঠার আওয়াজ ছলাৎ-ছলাৎ…! ভূগোলস্যার চমকে পড়া থামিয়ে দিলেন। খোঁজ খোঁজ। কে এমন করছে? অল্পক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ে গেল হরবোলা অর্ক। বইয়ের ভিতর মুখ লুকিয়ে নৌকো চালাচ্ছে। স্যার চোখ পাকিয়ে বললেন, “কেন করলি?”
অর্ক কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “স্যার, আপনি নদী পড়াচ্ছেন বলে নৌকো করলাম। সমুদ্র নিয়ে পড়ালে জাহাজের ভোঁ দিতাম।”
ভূগোলস্যার হেসে ফেলেছিলেন।
এই হাসির খবর শুনে সেদিন খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন সুশীলবাবু। এটা যদি তাঁর ক্লাসে হত, তা হলে ওই ছেলেকে তিনি অবশ্যই সারাদিন বসিয়ে রেখে এক হাজার গুণ-ভাগ করাতেন। হরবোলাগিরি পালাবার পথ পেত না! কিন্তু আজ কেন জানি হরবোলা ছেলেটির কথা বারবার মনে পড়ছে। ওই ছেলে কি পাখির ডাকও ডাকতে পারে? কোকিলের ডাক? ডাকলে কেমন করে ডাকে? এমনও তো হতে পারে তাঁর নিজের মধ্যেও হঠাৎ করে হরবোলা হওয়ার ক্ষমতা দেখা দিয়েছে। হতে পারে না? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই ওই অর্ক দিতে পারবে। মুখ থেকে নানা ধরনের আওয়াজ করার ক্ষমতা তার কীভাবে হয়েছিল? নিজে থেকে হঠাৎ একদিন? নাকি শিখতে হয়েছে? ওকে এখনই ডেকে পাঠাতে হবে। যতদূর মনে পড়ছে, অর্কর বাড়ি বেশি দূরে নয়। বাজারের কাছাকাছি কোথাও একটা হবে।
সুশীলবাবুর কথামতো নমিতাদেবী মায়াকে ডেকে বললেন, “তোমার দাদাবাবুর এক ছাত্রকে খবর দিতে হবে। বলবে স্কুল ছুটির পর সে যেন একবার তার অঙ্কস্যারের বাড়ি ঘুরে যায়। ওই ছেলেটি কাছেই থাকে। বাজারের মুখে হরবোলা অর্কর বাড়িটা কোথায় জিজ্ঞেস করলেই সকলেই দেখিয়ে দেবে।”
মায়া চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “কী অর্ক?”
নমিতাদেবী গলা আরও নামিয়ে বললেন, “আস্তে কথা বলো। হরবোলা, হরবোলা অর্ক। আরে বাবা, ওই যে মুখ দিয়ে পশু-পাখির ডাক দেয় না?”
মায়া শাড়ির আঁচলে হলুদ মাখা হাত মুছে একগাল হেসে বলল, “চিন্তা করবেন না। এক্ষুনি যাচ্ছি।”
আসলে মায়া ভিতরে ভিতরে খুবই উত্তেজনা অনুভব করছে। মজার উত্তেজনা। এ বাড়িতে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে। বাড়ির কর্তা এই গরমে গলায় একটা কুটকুটে মাফলার জড়িয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। মাঝেমধ্যে বন্ধ দরজা ফাঁক করে পুরুত ঠাকুরের মতো ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। সেই আওয়াজ শুনলেই গিন্নি পড়ি মড়ি করে ঘরের দিকে ছুটছেন। কাকভোরে গিন্নির ভাই তার বৃদ্ধ জামাইবাবুর জন্য স্লেট কিনে নিয়ে এসেছে। আর এখন সে যাচ্ছে হরবোলার খোঁজে। এর পরে উত্তেজনা না হলে আর কবে হবে?
সেই হরবোলা অর্ক এখন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সে যখন খবর পেল, অঙ্কস্যার বাড়িতে ডেকেছেন, তখন থেকেই তার ডান পায়ের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল। প্রায় আধঘণ্টা হতে চলল সেই কাঁপা থামেনি। এখানে পৌঁছতেই স্যারের স্ত্রী তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, “শোনো বাবা, তোমাদের স্যারের গলায় একটা সমস্যা হয়েছে। মনে হয় ঠান্ডা লেগেছে, গরমও লাগতে পারে। অনেক সময় বেশি গরমেও সমস্যা হয়। যাই হোক, ক’টা দিন ওঁর কথা বলা বারণ। উনি এখন লিখে লিখে কথা বলছেন। যাও, তুমি ভিতরে যাও! যা জানতে চাইবেন তার উত্তর দেবে ভেবেচিন্তে। একদম ভয় পাবে না। ভয়ের কিছু নেই।”
অর্ক কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল, “স্যার কি বকবেন?”
নমিতাদেবী বললেন, “বকতে পারেন। তবে লিখে বকা তো, খুব একটা জোরে হবে বলে মনে হয় না।”
ঘরে ঢুকে বেজায় ঘাবড়ে গেল অর্ক। সে বুঝতে পারল, একটা নয়, তার দু’টো পায়ের হাঁটুই কাঁপছে। এ কী কাণ্ড রে বাবা! মানুষটির কী হয়েছে? সুশীল পাত্র তার দেখা সবচেয়ে রাগি মানুষ। শুধু তার নয়, তাদের ক্লাসের সকলেই এ বিষয়ে একমত। যে মানুষটি কথা বললেই মনে হয় গরগর করে বাঘ ডাকছে, তিনি মাফলার, হাতে স্লেট! ভয়ংকর ধরনের কোনও অঙ্ক বানাচ্ছেন না তো? ঘণ্টার শব্দতরঙ্গের সঙ্গে মাফলারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ জড়িয়ে কোনও অঙ্ক? হতে পারে। সুশীলস্যার অঙ্ক দিয়ে ছেলেদের ফাঁদে ফেলার জন্য সবকিছু করতে পারেন। ফাঁদে ফেলার জন্য শুধু মাফলার কেন, সেরকম হলে এই গরমে উনি কম্বল মুড়ি দিয়েও বসতে পারেন।
সুশীলস্যার স্লেটে লিখলেন, “অর্ক, আমি লিখে লিখে প্রশ্ন করব, তুমি মুখে মুখে জবাব দেবে, কেমন?”
নার্ভাস অর্ক একপাশের বদলে দু’পাশেই মাথা নাড়ল।
অঙ্কস্যার লিখলেন, “তুমি নাকি মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে জানো?”
অর্ক বাঁ হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, “পারি স্যার, আর কখনও করব না।”
সুশীলবাবু ডাস্টার দিয়ে স্লেট মুছে আবার লিখলেন, “আমাকে কয়েকটা শোনাতে পারবে?”
অর্ক কাঁপা গলায় বলল, “পারব স্যার! ভয় করছে!”
অঙ্কস্যার লিখলেন, “ভয় পেয়ো না!”
এটা খুবই ভয়ের কথা। অর্কর অভিজ্ঞতা বলছে, রাগি মানুষ ‘ভয় পেয়ো না’ বলা মানে বেশি ভয়ের। অভয় দিয়েই তারা বড় বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়। এবারও হয়তো তাই হবে। মাফলার জড়ানো অঙ্কস্যার নিশ্চয়ই তাকে আয়তক্ষেত্রের পরিসীমা অথবা দৈঘ্যের সংখ্যমান সংক্রান্ত দুটো অঙ্ক দিয়ে বসিয়ে দেবেন। যাই হোক, আওয়াজের আদেশ যখন এসেছে তখন না করে উপায় কী? অর্ক মনে সাহস আনার চেষ্টা করল। সে মুখের পাশে দু’ হাত তুলে আওয়াজ শুরু করল। স্টিমার, মেট্রোরেল, হোভারক্রাফট, গাড়ির ব্রেক কষার আওয়াজ শোনার পর সুশীলবাবু স্লেট নামিয়ে অল্পক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর লিখলেন, “অর্ক, তুমি কি পাখির মতো ডাকতে পারো?”
এতক্ষণে অর্ক সহজ হয়েছে। ভয়ও কমেছে। স্যার মুখে কথা না বললেও, হাবভাবটাও অন্যরকম লাগছে। বকুনি তো দূরের কথা, রাগ দেখানোর লক্ষণও নেই। এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। নিয়মমতো এতক্ষণে বাজখাঁই গলায় সতেরোবার ধমক হয়ে যাওয়ার কথা। গলার কারণে ধমক না হোক চোখ পাকানো তো হতে পারত। কিন্তু সেটাও হয়নি। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। অতি সন্দেহজনক। কোনও গোলমাল হয়েছে নাকি?
অর্ক বলল, “পারি স্যার, আমি কাক, ফিঙে, বিড়াল পারি!”
ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন সুশীলবাবু। তারপর স্লেটে লিখলেন, “আর কোকিল?”
অর্ক মাথা চুলকে বলল, “না, পারি না স্যার।”
সুশীলবাবু লিখলেন, “কেন? পারো না কেন?”
অর্ক বলল, “তা জানি না স্যার। কখনও চেষ্টা করিনি। আপনি যদি বলেন, চেষ্টা করে দেখব।”
সুশীলবাবু লিখলেন, “চেষ্টা করলে কি কোকিলের ডাক শেখা যাবে?”
অর্ক উৎসাহ পেল। মনে হল, এই মানুষটি যেন সেই বদমেজাজি, ধমক দেওয়া, চোখ পাকানো অঙ্কস্যার নন! অন্য কেউ।
“কেন শেখা যাবে না? অবশ্যই শেখা যাবে। আমি তো সব চেষ্টা করেই শিখেছি স্যার। শুনে শুনে শিখেছি। তারপর কষে প্র্যাকটিস করেছি। একেবারে রাত জেগে প্র্যাকটিস। নৌকোর ছলাৎ-ছলাৎ তুলতে স্যার আমার পাক্কা এক মাস সময় লেগেছিল। গোটা গরমের ছুটিটা…।”
সুশীলবাবু মুখ ফেরালেন। এটাই তিনি জানতে চাইছিলেন। তা হলে গলা থেকে অন্যরকম আওয়াজ বের করতে হলে মানুষকে প্র্যাকটিশ করতে হয়। পরিশ্রম করতে হয়। অথচ তাঁকে কিছুই করতে হয়নি! একেবারে আচমকাই কোকিলের মতো ডাকছেন! মিষ্টি, সুরেলা ডাক! যে ডাকে তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সে আসছে নিজের ইচ্ছেমতো। কথার আগে, পরে, মাঝখানে যখন যেখানে খুশি! ভয়ংকর!
সুশীলবাবু এবার গোটা গোটা হরফে স্লেটে লিখলেন, “অর্ক তুমি কোকিলের ডাক শিখবে। শিখে এসে শোনাবে আমাকে। এক সপ্তাহ টাইম। এটাই তোমার হোমটাস্ক। তুমি এবার যেতে পারো।”
এতক্ষণ অর্কর পা কাঁপছিল ভয়ে, এবার কাঁপতে লাগল আনন্দে। কোকিলের ডাক শেখার হোমটাস্ক! তাও আবার কে দিচ্ছেন, না খোদ অঙ্কস্যার! কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের রাগি, খিটখিটে মেজাজের অঙ্কস্যার! কথাটা ঠিক শুনল তো? ঠিক শুনলেও ক্লাসের কেউ বিশ্বাস করবে না। অঙ্কস্যার এবার স্লেটে লিখলেন, “যাওয়ার আগে অবশ্যই দুটো রসগোল্লা খেয়ে যাবে। তোমার মাসিমা তোমার জন্য আনিয়ে রেখেছেন?”
ঘরের বাইরে এসে দুটো নয়, একেবারে চারটে রসগোল্লা নিয়ে বসল অর্ক। নমিতাদেবী তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “দেখো বাছা, আজকের এসব কথা যেন কাউকে বলতে যেয়ো না। তোমার স্যার শুনলে রাগ করবেন।”
অর্কর মুখভরতি রস। সে ঘাড় অনেকখানি কাত করল। আর ঠিক তখনই কাছাকাছি কোথায় যেন কোকিল জোরে ডেকে উঠল মিষ্টি গলায়, কুহু-কুহু…।
হরবোলা অর্ক ঠিক করল, আজ থেকেই সে কোকিলের ডাক প্র্যাকটিস করবে এবং কাল স্কুলে গিয়েই বন্ধুদের কাছে সব ঘটনা ফাঁস করে দেবে। চারটে কেন, চল্লিশটা রসগোল্লা খেলেও এমন রোমাঞ্চকর ঘটনা সে চেপে রাখতে পারবে না। এমন মনের জোর তার নেই।
॥ ৪ ॥
কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলে আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যা কখনও কোনও স্কুলে ঘটেনি। স্কুলের প্রধানশিক্ষক শশাঙ্কশেখর ধর আজ পরীক্ষা দিচ্ছেন! ক্লাস এইটের অঙ্ক পরীক্ষা। তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ। দরজার বাইরে গম্ভীর মুখে টুল পেতে বসে আছে নবলাল। গম্ভীর হওয়ার কারণ, সে এই পরীক্ষা দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছে। পুরো দায়িত্ব নয়, শুধু সময় দেখার দায়িত্ব। একঘণ্টা পর হেডস্যারের বন্ধ দরজায় সে প্রথম টোকা দেবে। আরও দশ মিনিট পর দেবে ফাইনাল টোকা। ফাইনাল টোকা শুনে হেডস্যার খাতা বন্ধ করবেন। নবলাল এতেই বিরাট খুশি। সে মাস্টারমশাইদের জন্য চা-জল, টিফিন এনে দেয়, কিন্তু এরকম গুরুতর দায়িত্ব সে তার চাকরি জীবনে কখনও পায়নি। একটাই আপশোশ, এই মুহূর্তে স্কুলে কেউ নেই। ঘণ্টাখানেক হল স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। ফলে নবলালকে কেউ দেখতে পেল না।
গোলমালের শুরু আজ সকালে, হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার অঙ্কখাতা বিলি হওয়ার পর। নম্বরের অবস্থা মারাত্মক! সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ক্লাস এইটের। একেবারে বিপর্যয় যাকে বলে। অনেকেই একশোর মধ্যে তিন, চার পাঁচ করে নম্বর পেয়েছে। খাতা হাতে পেয়ে ক্লাস এইটের ছেলেরা একেবারে ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়বারই কথা। যে ছেলে অন্য বিষয়ে একাশি, বিরাশি, তিরাশি নম্বর পেয়েছে, সে যদি অঙ্কে তিন পায়, তা হলে ভেঙে পড়বে না তো কী হবে? শুধু মনে ভেঙে পড়া নয়, ছেলেরা নম্বর দেখে কান্নাকাটিও জুড়ে দিল। এই নম্বর নিয়ে তারা বাড়ি ফিরবে কি করে? বাবা, মা, ছোটকাকা, কি বুঝবেন প্রশ্ন কত কঠিন এসেছিল? কিছুতেই বুঝবেন না।
শশাঙ্কশেখরবাবু পড়লেন বিরাট সমস্যায়। তাঁর কাছে ছেলেদের কান্নাকাটির খবর পৌঁছেছে। অঙ্কস্যার স্কুলে আসেননি। তিনি নিজেও অঙ্কে তেমন সড়গড় নন। সারাজীবন ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, অঙ্ক তাঁর কাছে চিরকালই ঝামেলার ব্যাপার। দূরে দূরে থেকেছেন। এদিকে অন্য মাস্টারমশাইরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সব বিষয়ে আছেন, কিন্তু অঙ্কে নেই। কাঞ্চনগড় স্কুলে ওটি খুবই গোলমেলে জিনিস। এই স্কুলের অঙ্কস্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন! প্রশ্ন যত দুর্বোধ্য হয় তত তিনি খুশি হন। যেন অঙ্ক নয়, কঠিন ছন্দে কবিতা লিখছেন। এ বিষয়ে অন্য মাস্টারমশাইদের কোনওরকম মতামত শুনতে তিনি নারাজ। বেশি বললে চটে ওঠেন। চোখ-মুখ লাল করে বলেন, “দেখুন মশাই, আমি কি আপনাদের বলেছি আলেকজান্ডার আর পুরুর যুদ্ধটা শক্ত না করে সহজ করে ফেলুন? একবেলাতেই হারজিতের ফয়সালা হয়ে যাক? বলেছি কখনও? নাকি বলেছি, বিপাশা আর শতদ্রু নদীগুলো অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না নিয়ে হাইওয়ে আর ফ্লাইওভার টপকে সোজা সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে? আমার মুখে শুনেছেন এমন কথা? তা হলে আপনারাই বা জ্যামিতি আর বীজগণিত নিয়ে খামোকা মাথা ঘামাচ্ছেন কেন মশাই? এইজন্যই বলি, স্কুলে অঙ্ক ছাড়া আর কোনও সাবজেক্টেরই দরকার নেই।”
এই অপমানের পর আর কিছু বলা যায় না। সুতরাং অঙ্কের মধ্যে তাঁরা একেবারেই ঢুকবেন না বলে হেডস্যারকে জানিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা কেঁদে ভাসালেও নয়।
শশাঙ্কশেখর ধর বুঝতে পারছেন কথাটা মিথ্যে নয়। গত বছরই এরকম ঘটনা ঘটেছিল। সেবার ছিল অ্যানুয়াল পরীক্ষা। নম্বর পর্যন্ত এগোল না, অঙ্ক-প্রশ্ন হাতে পেয়ে পরীক্ষার হলেই ক্লাস সিক্সের এক ছাত্র মাথা ঘুরে পড়ে গেল। হাতে প্রশ্নপত্র, মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ উঠছে। মাথায় জলটল দিয়ে শান্ত করার পর জানা গেল, খাল কাটা আর জল আনা বিষয়ের একটা পাটিগণিতই এর জন্য দায়ী। অঙ্কটা ছিল এরকম—
১,৫০০ মিটারের লম্বা একটা খাল কাটার ১৭ দিনের মাথায় দেখা গেল কাজ হয়েছে তিন চতুর্থাংশ। এই কাটা অংশের অর্ধেক জল ভরতে সময় লাগল সাড়ে তিনদিন। এবার সেই কাটা খাল দিয়ে যদি একটা কুমির ঢুকে পড়ে তা হলে তার দৈর্ঘ্য কত? ঘণ্টা প্রতি তাঁর সাঁতারের গতিবেগই বা কী হবে?
সেদিনই শশাঙ্কশেখরবাবু অঙ্কস্যারকে ডেকে পাঠালেন। নবলালকে চা আনতে বলে ঠান্ডা গলায় বললেন, “আচ্ছা, এটা আপনি কী করেছেন সুশীলবাবু? একেবারে কাটা খাল দিয়ে কুমির ঢুকিয়ে দিলেন?”
সুশীলবাবু একটা লাজুক ধরনের হাসি দিয়ে বললেন, “একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম।”
শশাঙ্কশেখরবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “এক্সপেরিমেন্ট!”
মুখের হাসি মুছে ভারী গলায় সুশীল পাত্র’র উত্তর, “হ্যাঁ, এক্সপেরিমেন্ট। অঙ্কের সঙ্গে বাংলা প্রবাদ মেশানোর এক্সপেরিমেন্ট। শশাঙ্কবাবু, আপনি তো জানেনই, খাল কেটে কুমির আনা খুবই প্রচলিত একটা প্রবাদ। পরের বছর অঙ্কে হিস্ট্রিও ঢোকাব ভাবছি!”
শশাঙ্কশেখরবাবু আঁতকে উঠলেন। মানুষটা কী শুরু করেছেন!
“হিষ্ট্রি! ম্যাথমেটিক্সে হিস্ট্রি ঢোকাবেন মানে?”
সুশীলবাবু উদাসীন ভঙ্গিতে বললেন, “মানে আর কী? কিছুই নয়। মমির বয়স দিয়ে একটা অনির্দিষ্ট সংখ্যার অ্যালজেব্রা যদি করা যায়। অনির্দিষ্ট সংখ্যা কাকে বলে জানা আছে? ধরুন, একটা মমির বয়স ধরলাম এক্স বছর…।”
হেডমাস্টারমশাই হাত তুলে থামালেন। বললেন, “থাক, অ্যালজেব্রাটা না হয় পরেই শিখব সুশীলবাবু, তার আগে বরং যে কারণে আপনাকে আজ ডেকেছি, সেটা সেরে ফেলি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনার অঙ্ক-প্রশ্ন হাতে নিয়ে আজ ক্লাস সিক্সের একটি ছেলে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। দেখুন, আপনি সিনিয়র টিচার, আপনাকে এই বিষয়ে কিছু বলা ঠিক নয়, কিন্তু আজ না বলে পারছি না। পরীক্ষায় এরকম মাথা ঘোরা প্রশ্ন না দিলেই কি নয়? ছেলেদের পাশ তো করতে হবে। তাই না?”
সুশীলবাবু গমগমে গলায় বললেন, “অঙ্কে সকলেই পাশ করবে এরকম আপনি ভাবলেন কেন শশাঙ্কবাবু? সত্যি আমার মনে হচ্ছে, বেশি সংখ্যক ছেলের অঙ্কে ফেল করাটাই ভাল।”
শশাঙ্কশেখরবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “মানে? ফেল করা ভাল মানে? আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি চাইছেন, ছেলেদের রেজাল্ট খারাপ হোক!”
নাক-মুখ দিয়ে ফোঁস-ফোঁস করে দু’টো আওয়াজ করলেন সুশীলবাবু। একটা বিরক্তি, একটা রাগ। বললেন, “না বুঝতে পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনি যদি আমার মতো সর্বক্ষণ অ্যালজেব্রা, অ্যারিথমেটিক্স, জিওমেট্রির মধ্যে থাকতেন, আপনিও বিষয়টা জলের মতো বুঝতে পারতেন। কঠিন বিষয় বুঝতে হলে সর্বক্ষণ অঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়, পৃথিবীর সব জটিল বিষয়ের সমাধানই অঙ্ক। যাই হোক, ইদানীং আমার মনে হচ্ছে, ছেলেরা যত অঙ্ক ভুল করে তাদের অঙ্কের প্রতি আগ্রহ তত বাড়ে। সেই আগ্রহ থেকে তৈরি হয় আকর্ষণ। আকর্ষণ তুলে আনে জেদ। আর সেই জেদই তাদের এক সময় এগিয়ে নিয়ে চলে। আজ যেটা ফেলিয়োর দেখছেন, সেটাই একদিন হবে পিলার অফ সাকসেস।”
হেডমাস্টার বিরক্ত হলেন। বিরক্তি গোপন করে বললেন, “দেখুন, এত বড় কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয় না ছেলেরাও বুঝতে পারবে।”
সুশীলবাবু বাজখাঁই গলায় বললেন, “আসল ঘটনাটা তা হলে আপনাকে জানিয়ে রাখি। ক্লাস সিক্সের ছেলেগুলো অঙ্কে খুবই চৌকশ। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলছে, মাঝেমধ্যে একম হয়। এক-একটা ক্লাসে গাদাখানেক ভাল ছেলে জুটে যায়। অন্য সময় পাজিগুলো হাড়জ্বালিয়ে খায়, কিন্তু লেখাপড়ায় দুর্দান্ত। এরাও সেরকম। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যেভাবেই অঙ্ক দিই না কেন, বিচ্ছুগুলো বেশিরভাগ সময়ই ঝটপট করে ফেলে। তাই এবার প্রশ্ন তৈরির সময় আমি ঠিক করেছিলাম, এদের সহজে ছাড়ব না। সেই জন্যই চাপ দিয়েছি। ভবিষ্যতে এই চাপ আরও বাড়বে। এখন একজন মাথা ঘুরে পড়েছে, তখন ক্লাসসুদ্ধ সকলে মাথা ঘুরে পড়বে।”
এই মানুষের অঙ্ক পরীক্ষার দায়িত্ব অন্য শিক্ষকরা নেবেন কী করে? তবে প্রধানশিক্ষককে তা বললে চলে না। তাঁকে সকলের দায়িত্বই নিতে হয়। ছেলেদের কান্নাকাটি থামাতে হয়। ভাল হত যদি সুশীলবাবু নিজে থাকতেন। তাঁকে দিয়েই একটা সমাধানের পথ বের করা যেত। সবচেয়ে বড় কথা হল, প্রশ্ন কতটা কঠিন হয়েছে সেটা আগে জানা। শুধু ছেলেরা বললেই তো হবে না, শিক্ষককেও বলতে হবে। সে চেষ্টাও হয়েছে, লাভ হয়নি। অঙ্কস্যারের বাড়িতে ফোন বেজে গিয়েছে। সুশীলবাবু মোবাইল ফোন রাখেন না। মোবাইল ফোন নাকি মনঃসংযোগ ব্যাহত করে। বাধ্য হয়ে নবলালকে তাঁর বাড়িতে পাঠানো হল। সুশীলবাবু নেই। স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন। তার উপর নবলাল সুশীলবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে যে খবর বলেছে তার কোনও মাথামণ্ডু নেই। মাথামুণ্ডুহীন সেই খবর দিয়েছে সুশীলবাবুর বাড়ির রান্নার মেয়ে। স্কুলে পিয়নের পদে কাজ করার কারণে সব মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেই নবলালের যাতায়াত আছে। হাজারটা কাজে যেতেই হয়। মাস্টারমশাইদের বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গেও তার চেনাজানা বিস্তর। অঙ্কস্যারের বাড়ির রান্নার মেয়েকেও সে চেনে। সেই মেয়ে নাকি সুশীলবাবুর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার খবর দিতে গিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফিকফিক করে হেসেছে। এতেই সন্দেহ হয় নবলালের। সে কড়া গলায় বলে, “হাসছ কেন? অসুস্থ স্যার ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন, আর তুমি হাসছ! ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা কি কোনও হাসির ঘটনা?”
মেয়েটি তখন আরও হাসতে থাকল। বলল, “অবশ্যই হাসির ঘটনা। এ তো আর জ্বর, পেটব্যথা নয়, কোকিল-অসুখ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে হাসব না তো কী করব? কাঁদব? ডাক্তারও হাসবে। ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে। সেদিন আমাকে পর্যন্ত অঙ্ক নিয়ে পাকড়াও করেছিল। ধমক দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা মায়া, তিনটে পটল আর দু’টো ঝিঙে সমান যদি একটা কাঁচকলা আর আড়াই খানা বেগুন হয়, তা হলে কতটা বরবটি আর শিম নিলে…’ মাসিমা এসে তাড়াতাড়ি বাঁচাল। বলল, ‘ওকে অঙ্ক বলছ কেন? মায়া কি তোমার ইস্টুডেন্ট?’ যাক, এখন বোঝো ঠেলা। কোকিল-অসুখ নিয়ে গলায় মাফলার লাগিয়ে বসে থাকো দরজা-জানলা আটকে। আর সকাল-সন্ধে গলা বের করে ডাক দাও। অন্যকে ধমক-ধামক দেওয়া আর অঙ্কের কাদায় ফেলার সাজা টের পাও।”
নবলাল চোখ বড় বড় করে বলল, “কোকিল-অসুখ! সেটা আবার কী?”
মায়া চট করে চারপাশ দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “কী বলতে পারব না। তবে লক্ষণ ভাল নয়। খুবই খারাপ। আজকাল মাঝেমধ্যেই তোমাদের স্যারের হাঁড়িচাঁচার মতো গলা থেকে কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে গো! আমি নিজে শুনেছি। সর্বক্ষণ মানুষটার ঘর বন্ধ। এই গরমেও গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে, হাতে স্লেট-পেনসিল নিয়ে বসে আছে।”
নবলালের এবার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, “স্লেট-পেনসিল! অঙ্কস্যার স্লেট-পেনসিল নিয়ে কী করছেন?”
“বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে এসে দেখে যেয়ো। যাতে মুখে কথা বলতে না হয় তার জন্য লেখালেখির ব্যবস্থা। কাগজ-পেনও আছে। তবে আমি বন্ধ দরজায় কান পেতে সব শুনে নিয়েছি।”
“কী শুনেছ?”
“শুনেছি, উনি একটা করে কথা বলেন আর দু’টো করে ডাক মারেন, কু-কু, কু-কু। স্কুলের একটা ছেলেকেও তো ডেকে পাঠালেন। জানো না কিছু? কী যেন নাম… হরবোলা অর্ক না কী যেন। আমিই তো বাপু তার বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে এলুম।”
এই পর্যন্ত বলে মায়া নিজেকে থামিয়ে দিল গাড়িতে হঠাৎ ব্রেক কষার মতো। লম্বা জিভ কেটে বলল, “এই রে বলে ফেললাম! না না বাবা, আমি কিছু জানি না। তুমি এখন যাও দেখি। হাতে মেলা কাজ।”
নবলাল স্কুলে ফিরে এল গম্ভীর মুখে। ঘটনা হেডস্যারকে রিপোর্ট করল। শশাঙ্কশেখর ধর বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী বলছ নবলাল? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একেই পরীক্ষা নিয়ে বিরাট গোলমালে পড়েছি, তার মধ্যে এসব কী প্রকারের হাবিজাবি কথা? মানুষের গলায় কোকিলের ডাক হবে কী করে? ওই মেয়ে তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে যা-তা বলল, আর তুমি তাই নিয়ে নাচতে শুরু করে দিলে? খবরদার, স্কুলের ভিতর এসব গুজব যেন কেউ না ছড়ায়।”
বকুনি খেয়ে নবলাল মাথা নামিয়ে বলল, “তাই হবে স্যার। মায়া খুব বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে। একবার…।”
হেডমাস্টারমশাই হাত তুলে নবলালকে থামিয়ে দিলেন। এখন বাজে কথা শোনার সময় নেই তাঁর। ইতিমধ্যেই তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ঠিক করেছেন, অন্য কাউকে দরকার নেই, ক্লাস এইটের অঙ্কের প্রশ্নপত্র নিয়ে তিনি আজ নিজেই পরীক্ষায় বসবেন। পরীক্ষা হবে ছুটির পর, গোপনে। বন্ধ দরজার বাইরে নবলাল পাহারায় থাকবে। হাতে-কলমে দেখবেন, কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের অঙ্কস্যারের প্রশ্ন কত কঠিন। তারপর ঠিক করবেন ছেলেদের কান্নাকাটি কীভাবে থামানো যায়।
সেই পরীক্ষা চলছে।
হেডমাস্টারমশাইয়ের অঙ্ক-পরীক্ষা শেষ হল ঠিক এক ঘণ্টা দশ মিনিট পর। উশকোখুশকো চুলে তিনি দরজা খুলে নবলালকে পরপর দু’গ্লাস ঠান্ডা জল আনতে বললেন। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে কপালের ঘাম মুছে ফিরে এসে বসলেন নিজের চেয়ারে। সুশীল পাত্রের অঙ্ক আজ তিনি হাতে-কলমে নয়, একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। বাপ রে, এ কী কাণ্ড! এগুলো অঙ্ক না থান ইট? মাটির ইট নয়, লোহার থান ইট! হাতুড়ি দিয়ে হাজার পেটালেও কিছু হবে না। ভাঙা তো দূরের কথা, চিড়ও ধরছে না। এতদিন শশাঙ্কশেখরবাবু অন্যদের মুখেই শুধু শুনেছেন, আজ নিজেই বুঝতে পারলেন, কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের অঙ্কস্যার একজন ভয়ংকর মানুষ। ভয়ংকর মানুষ না হলে এমন অতি ভয়ংকর অঙ্ক-প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে। অসুখ সেরে ফিরে এলেই বলতে হবে। এরকম আর চলতে দেওয়া যায় না।
টেবিলের বই-খাতা, কাগজপত্র গোছাতে-গোছাতে শশাঙ্কশেখরবাবু ঠিক করলেন, একটা কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। গ্রেসমার্ক দিয়ে ছেলেদের পাশ করিয়ে দিলে কেমন হয়? কিন্তু সেই নম্বরটাই বা কত হবে? দশ-কুড়ি না তিরিশ? তা হলেও কি তিনি নিজে পাশ করবেন? একেবারেই নয়। তিনি নিশ্চিত, আজ যে পরীক্ষা তিনি দিয়েছেন, তাতে মেরেকেটে পনেরো নম্বর পেতে পারেন। খুব বেশি হলে সতেরো। না না, ওসব নম্বর বাড়ানোর ঝামেলায় গিয়ে দরকার নেই, তার চেয়ে পরীক্ষাটাই বাতিল ঘোষণা করা ভাল। স্কুলের হেডমাস্টারমশাই যেমন পরীক্ষা নিতে পারেন, তেমন নিশ্চয়ই পরীক্ষা বা তিলও করতে পারেন। এ ক্ষমতা তাঁর কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে এ কাজ তিনি অবশ্যই করবেন।
দ্রুত হাতে নিজের পরীক্ষার খাতা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে ফেললেন শশাঙ্কশেখরবাবু। যাতে কেউ দেখে না ফেলে। স্কুলের হেডমাস্টারমশাই অঙ্কে সতেরো পেয়েছেন জানাজানি হয়ে গেলে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে। নবলালকে ডেকে তিনি আরও একবার সাবধান করে দিলেন, “দেখবে, এই পরীক্ষার কথা যেন কেউ জানতে না পারে।”
নবলাল হাত কচলে বলল, “কী যে বলেন স্যার! মুখে কুলুপ মেরেছি। কাক-পক্ষীও টের পাবে না। তবে একটা কথা জানতে পারি স্যার?”
শশাঙ্কশেখরবাবু বিরক্ত গলায় বললেন, “কী?”
নবলাল হাসি হাসি মুখে বলল, “আপনার পরীক্ষা কেমন হল স্যার? ভাল হয়েছে?”
নবলালের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে ড্রয়ারে তালা দিলেন শশাঙ্কশেখর ধর। চিন্তিত, ক্লান্ত শশাঙ্কশেখরবাবু যখন স্কুল ছেড়ে বের হচ্ছেন, তখন সন্ধে হয় হয়। দূরে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠল, কুহু কুহু কুহু…।
শশাঙ্কশেখরবাবু থমকে দাঁড়ালেন। বাঃ, সুন্দর তো! নবলাল কী বলছিল যেন? সুশীলস্যার কোকিলের মতো ডাকছেন! যত্ত সব উদ্ভট গল্প! কাল স্কুলে এসে একবার ওই অর্ক ছেলেটিকে ডেকে কথা বলতে হবে। সেরকম হলে টিফিনের সময় সুশীলবাবুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যায়। তখন না হয় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেওয়া যাবে। যতই হোক পুরনো শিক্ষক!
কোকিলটা ফের ডেকে উঠল। এবার যেন আরও কাছে। শশাঙ্কশেখরবাবু মুচকি হেসে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
॥ ৫ ॥
কল্যাণ মুখে বলেছিল দু’রকম ডাক্তার দেখানো হবে। আসলে সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিল তিনজনের সঙ্গে। এই তিন নম্বর মানুষটির কথা সে তার দিদি-জামাইবাবুকে বলেনি। তার ভয় ছিল, একে নিয়ে একটা গোলমাল হবে। জামাইবাবু রাগারাগি করবেন। ঘটনা তাই ঘটল। তবে জামাইবাবু নন, সমস্যা করল দিদি।
ঠিক ছিল, সকালে দুই ডাক্তারকে দেখানোর পর কল্যাণের ফ্ল্যাটেই দুপুরের খাওয়াদাওয়া হবে। তারপর একটু বিশ্রাম করে বিকেলের ট্রেনে কাঞ্চনগড় ফিরবেন নমিতাদেবীরা। খাওয়ার পর কল্যাণ নমিতাদেবীকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, “দিদি, বিকেলের বদলে তোরা সন্ধেবেলা ফিরিস। সেরকম হলে আজকের দিনটা থেকে যা। বিকেলে জামাইবাবুকে আরও একজনের কাছে নিয়ে যাব।”
নমিতাদেবী চিন্তিত এবং বিরক্ত। দু’-দু’জন ডাক্তার তাঁর স্বামীকে পরীক্ষা করেছেন। মাথা এবং গলার ডাক্তার। কিন্তু দু’জনের কেউই অসুখ ধরতে পারেনি। আরও একজনের কাছে যেতে হবে শুনে বিরক্তি বাড়ল। নমিতাদেবী বললেন, “আবার একজন? দু’জন তো হল!”
কল্যাণ আমতা-আমতা করে বলল, “তা হোক, অধিকন্তু ন দোষায়। বেশিতে ক্ষতি নেই। তা ছাড়া দ্যাখ দিদি, মাথা-গলা, দুই ডাক্তারের কেউই কোনও আশার কথা শোনাতে পারলেন না। ওষুধও দিলেন না, শুধু বলেছেন, অবজারভেশনে রাখতে হবে। সুতরাং হাত-পা ছেড়ে বসে থাকাটা ঠিক হবে না। এটাই লাস্ট। প্লিজ দিদি, আপত্তি করিস না!”
কথাটা ঠিক। দু’জন ডাক্তারই ফেল মেরেছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের নাম ডাক্তার দীপঙ্কর মণ্ডল। প্রথমে সবাইকে ঘর থেকে বের করে সুশীলবাবুকে গাদাখানেক প্রশ্ন করলেন। তারপর নমিতাদেবীকে একা ডেকে চিন্তিত মুখে বললেন, “সমস্যাটা জটিল ও ইন্টারেস্টিং। তবে অসুখটা যে গলায় নয়, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। গোলযোগ যা হয়েছে সেটা মাথাতেই। মনের এক ধরনের অসুখ হল, স্পিল্ট পার্সোনালিটি। এই অসুখে নিজের ব্যক্তিত্ব ভেঙে দু’টো সত্তা তৈরি হয়। একটা মানুষ নিজেকে দু’জন মানুষ ভাবতে শুরু করে। এক-একটা সময় এক-একজনের মতো আচরণ করে। আপনার স্বামীর সঙ্গে সমস্যাটার কিছু মিল পাচ্ছি, তবে এক্ষেত্রে মানুষ নয়, উনি নিজেকে পশু-পাখির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। টু বি ভেরি স্পেসিফিক, পাখির সঙ্গে। কখনও কখনও পাখির মতো আচরণও করছেন। ইচ্ছে করে তার মতো ডাক দিচ্ছেন। আচ্ছা, আপনাদের বাড়িতে কি পোষা কোকিল আছে?”
নমিতাদেবী বললেন, “না না ডাক্তারবাবু, উনি জন্তু-জানোয়ার, পশু-পাখি কিছুই পছন্দ করেন না। একবার কোনও এক ছাত্র দু’টো খরগোশ নিয়ে বাড়িতে এসে হাজির। উনি খরগোশসুদ্ধ ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।”
“তা হলে কি আপনাদের বড় বাগানটাগান কিছু আছে? সারাক্ষণ পাখির ডাক শোনা যায়?”
নমিতাদেবী বললেন, “বড় না হলেও বাগান অনেক আছে, পাখিও ডাকে, কিন্তু আপনি তো মানুষটার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললেন ডাক্তারবাবু, ওকে কি আপনার গালে হাত দিয়ে পাখির ডাক শোনার মতো মানুষ বলে মনে হল? রাতদিন অঙ্ক, অঙ্ক আর অঙ্ক। মাথায় যেন অঙ্কের আগুন নিয়ে ঘুরছে!”
“আপনি যতটা বলছেন, পেশেন্টকে ততটা রাগি অবশ্য আমার মনে হল না। হতে পারে প্রবলেমটার পর নার্ভাস হয়ে গিয়েছেন। নার্ভাস হওয়ারই কথা। আচ্ছা, আপনার স্বামী কি কখনও মিমিক হিসেবে পারফর্ম করেছেন? হরবোলা? ওই যে মুখ দিয়ে আওয়াজ করে না?”
“না, ডাক্তারবাবু। ওর ওসব নেই। ছেলেবেলাতেও করেছে বলে শুনিনি। তবে ওর এক ছাত্র পারে। মুখ দিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ করে।”
ডাক্তারবাবু হাতের পেনটা টেবিলে ঠুকতে-ঠুকতে বললেন, “ওঁর যদি হরবোলার গুণ থাকত, তা হলে চিকিৎসাটা অনেক সহজ হত। উনি যে কোকিলের ডাকটা করছেন মনে হচ্ছে, সেটা বেশ পারফেক্ট, ওরিজিনাল ডাকের অনেকটা কাছাকাছি। এতটা পারফেক্ট ডাক উনি শিখলেন কী করে?”
নমিতাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “শিখবেন কেন? গলা থেকে তো নিজেই বের হচ্ছে।”
ডাক্তারবাবু একটু হেসে বললেন, “দুঃখিত, এটা সম্ভব নয়। আপনারা মানলেও একথা বিজ্ঞান মেনে নিতে পারবে না। মানুষের গলা কোকিল কেন, কারও মতোই হতে পারে না। সে নকল করতে পারে, তার বেশি নয়। আপনারা বরং একটা কাজ করুন, ওঁকে আজই আমার ক্লিনিকে ভরতি করে দিন। ক’টা দিন অবজারভেশনে থাকুন। ভাল করে আমরা ওঁর কোকিলের ডাক শুনি। আমিও দেশ-বিদেশের জার্নালগুলো হাতড়ে দেখি, এরকম কোনও কেস পাওয়া যায় কি না। এত বড় পৃথিবীতে কোথায় কী ঘটে সব তো আমরা জানতে পারি না!”
দীপঙ্কর মণ্ডলের কাছ থেকে ক’টা দিনের সময় চেয়ে নিয়ে নমিতাদেবী আর কল্যাণ এর পর সুশীলবাবুকে নিয়ে ছুটলেন ই এন টি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অভিজিৎ মুখোটির কাছে। অভিজিৎ মুখোটি নাক, কান এবং গলার চিকিৎসায় খুব নাম করেছেন। সহজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কঠিন। কল্যাণ অনেক কষ্টে জোগাড় করেছে। তার কাছে খবর আছে, এই ডাক্তার গলা সংক্রান্ত অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তার অফিসেরই এক সহকর্মীর স্ত্রীর গলা ছিল বিচ্ছিরি রকমের হেঁড়ে। তারও পর তার আবার ছিল গানের অভ্যেস। লোকজনকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে গান শোনাত। সহকর্মীর কল্যাণকেও যেতে হয়েছে দু’-একবার। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা! হেঁড়ে গলার গান শুনে বিষমটিষম খেয়ে একাকার কাণ্ড।
সেই গলা ডাক্তার অভিজিৎ মুখোটি বদলে দিয়েছেন। স্রেফ ক’টা ট্যাবলেটে বেসুরো গলায় সুর চলে এসেছে। ইতিমধ্যেই ভদ্রমহিলা টিভির কোনও এক চ্যানেলে অনুষ্ঠান করে ফেলেছেন! সেই আশাতেই কল্যাণের এই ডাক্তারের কাছে আসা। ট্যাবলেটে যদি বে-সুর পালায়, তা হলে সুর পালাবে না কেন? কোকিলের সুর?
গোটা পথ ট্যাক্সিতে জানলার পাশে বসে রইলেন সুশীলবাবু। কাঁধের ব্যাগে কথা বলার কাগজ আর একটা বই। বইটি সংখ্যাতত্ত্বের জটিল বিষয়ের উপর। নাম, ‘থিয়োরি অফ প্রবাবিলিটি, অ্যান আনসলভ্ড মিষ্ট্রি’। বাংলা করলে হয়, ‘সম্ভাবনার তত্ত্ব, একটি অমীমাংসিত রহস্য’। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে, ডাক্তারবাবুর চেম্বারে অপেক্ষা করার সময় সুশীলবাবু মাঝেমধ্যে বইটা ব্যাগ থেকে বের করে নাড়াচাড়া করে দেখছেন, কিন্তু কেন যেন পড়তে ইচ্ছে করছে না। অথচ বইটা এক সময় তাঁর প্রিয় ছিল!
নমিতাদেবী ভেবেছিলেন, এত ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটির কারণে মানুষটা খেপে থাকবে। চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। তারপর আবার ব্যবস্থায় রয়েছে কল্যাণ। ফলে মেজাজ একেবারে সপ্তমে থাকবে। যদিও সেরকম কিছুই হয়নি! রাগ, বিরক্তি দেখানো তো দূরের কথা, সুশীলবাবু খুবই শান্তভাবে রয়েছেন। স্বামীর এই শান্তভাব কাল থেকেই একটু একটু চোখে পড়ছে নমিতাদেবীর। কাল রাতে খানিকটা ভয়ে ভয়েই বলেছিলেন, “কাল সকালে আমরা একটু বেরোব কিন্তু।”
সুশীলবাবু খাটে বসে টিভি দেখছিলেন। অঙ্কের বই-খাতা সব পাশে সরানো। এটাও একটা অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। সুশীল পাত্রকে কেউ কখনও টিভি দেখতে দেখেনি। তিনি মনে করেন, এসব সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। গণিতচর্চায় টিভির কোনও ভূমিকা নেই। হাতে সময় থাকলে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া দরকার। পরদিন যত ভোরে ওঠা যাবে তত ভাল। পুরনো নামতা, ফর্মুলা, সম্পাদ্য, উপপাদ্য, লগ টেবিল, ক্যালকুলাসের নিয়মাবলি ঝালাই করে নেওয়ার জন্য অনেকটা সময় পাওয়া যাবে। মুখস্থ ঝালাই করবার জন্য ভোরবেলা হল অতি উত্তম সময়। এই বয়সেও তিনি নিয়ম করে এই কাজ করেন। ভোর পাঁচটায় ছাদে পায়চারি করতে করতে সমদ্বিবাহু, সমকোণী, সদৃশকোণী ত্রিভুজের সংজ্ঞা আওড়ান। বয়স হয়েছে বলে জোরে জোরে বলতে পারেন না। আশপাশের বাড়ির লোকজন শুনে ঘাবড়ে যেতে পারে, তাই বিড়বিড় করে বলেন।
সেই মানুষটির টিভি দেখা অবশ্যই অবাক হওয়ার মতো একটা ঘটনা। নমিতাদেবী আড়চোখে দেখলেন, টিভিতে খোলা রয়েছে অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট চ্যানেল। পাখি দেখছে নাকি? না, পাখি নয়, পরদায় সিংহের ছবি। একটা ঘুমন্ত সিংহের দিকে দু’টো সিংহশাবক তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে। রাগি অঙ্কস্যার হাসি হাসি মুখে সিংহশাবকের খেলা দেখছেন!
নমিতাদেবী আবার বললেন, “কাল বেরোব কিন্তু! কল্যাণ তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। হেঁচকি বলো আর কাশিই বলো, সারাতে তো হবে!”
সুশীলবাবু মুখ না ফিরিয়ে মাথা নাড়লেন। আজও সেইরকম আছেন। কোনও ঝামেলা করেননি। ডাক্তার অভিজিৎ মুখোটির সামনে প্রথম মিনিট কুড়ি পাখি-ডাক বের হল না। স্বাভাবিক গলায় সব প্রশ্নের জবাব দিতে থাকলেন সুশীলবাবু। গলার জোর কেমন? মাঝেমধ্যেই গলা কি ভাঙে? নাকি চুলকোয়? আরাম কীসে বেশি হয়? ঠান্ডায় না গরমে? পাখির ডাকের আগে-পরে গলায় কোনও বিশেষ অনুভূতি হয় কী? হলে সেই অনুভূতি কেমন? এই সব প্রশ্ন। নমিতাদেবী আর কল্যাণ দুরুদুরু বুকে বসে থাকে। প্রশ্নের দাপটে রেগে না যান মানুষটি। এর পর কপালে আলো লাগিয়ে ডাক্তার মুখোটি সুশীলবাবুর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লেন, “আপনার গলার ভিতরটা একবার দেখে নিই। বড় করে হাঁ করুন তো… হ্যাঁ, এই তো, এই তো ঠিক আছে…! এবার আওয়াজ করুন অ্যা অ্যা অ্যা…।”
সুশীলবাবু ‘অ্যা অ্যা’ করলেন ঠিকই, কিন্তু গলা দিয়ে বের হল ‘কুহু কুহু কুহু…।’
ডাক্তার মুখোটির চোখদু’টো জ্বলজ্বল করে উঠল। বিড়বিড় করে নিজের মনে বললেন, “ওয়ান্ডারফুল! ফ্যানটাস্টিক!”
আরও খানিকক্ষণ পরীক্ষার পর ডাক্তার মুখোটি যখন নিজের চেয়ারে এসে বসলেন, কল্যাণ জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তারবাবু, এ কখনও সম্ভব?”
“আলবাত সম্ভব, একশোবার সম্ভব। কেন সম্ভব নয়? ময়না, কাকাতুয়া যদি মানুষের গলায় কথা বলতে পারে, মানুষ কেন তাদের মতো ডাকতে পারবে না? অসুবিধে কোথায়? কোনও অসুবিধে নেই।”
কল্যাণ কাঁচুমাচু মুখে বলল, “এটা কী বলছেন ডাক্তারবাবু, অসুবিধে নেই! কাকাতুয়া, ময়না মানুষের গলা নিয়ে থাকতে পারে। তাদের স্কুলে পড়াতে হয় না, দোকান-বাজারে যেতে হয় না, কিন্তু আমার জামাইবাবুকে তো এগুলো করতে হয়। সবচেয়ে মুশকিলের কথা হল, কখন যে ভিতরের কোকিলবাবাজিটি ডাক দিয়ে উঠবেন, কারও জানা নেই। মুশকিল কেন, এটা একটা বিপজ্জনক ব্যাপার। ক্লাসে পড়ানোর সময় বা বাজারে পটল দরাদরির মুহূর্তে যদি ডেকে ওঠেন, কী কাণ্ডটা হবে বুঝতে পারছেন?”
“ঠিকই, এটা একটা সমস্যা। সব সময় ডাকলে একটা কথা ছিল। দেখুন, এখনই আমি কিছু বলতে পারছি না। আগে গলায় একটা অপারেশন করে দেখতে হবে ভোকাল কর্ডটার পজিশন কী। ল্যারিংকস কি তার সেপ বদলেছে? যদি না বদলায় তা হলে কোনও কথা নেই, কিন্তু বদলালে সেটা হবে একটা বিস্ময়কর ঘটনা। যে ঘটনার কথা চিকিৎসাবিজ্ঞানে কখনও শোনা যায়নি…।”
সুশীলবাবু চুপ করে থাকলেন। নমিতাদেবী ভয়ার্ত গলায় বললেন, “ডাক্তারবাবু, আমরা তো কিছু বুঝতে পারছি না।”
অভিজিৎ মুখোটি তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “আমিও পারছি না। আসলে কী জানেন, মানুষের কথা বলার ব্যবস্থাটা বড় জটিল। আমাদের প্রধান স্বরযন্ত্রটি হল ভোকাল কর্ড। সেখানে আছে মাত্র দু’টো পেশি। এই পেশিতে হাওয়া চলাচল করে বলেই আমরা গলা দিয়ে আওয়াজ করি, কথা বলি। এই দুই পেশি আবার নিজেদের মধ্যে টানাটানি কমিয়ে-বাড়িয়ে রেডিয়োর নবের মতো স্বরের ভলুম কন্ট্রোল করে। আর গলার আওয়াজ কী রকম হবে সেটা ঠিক করার জন্য আছে ল্যারিংকস, মুখ আর নাক। ল্যারিংকসই হল আমাদের আসল ভয়েস-বক্স। কথা বলার বাক্স। মুখ খোলা-বন্ধ, জিভের পজিশন একটা ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার। তারা কতটা হাওয়া ভিতরে ঢুকতে-বেরোতে অ্যালাউ করছে, কতটা টাইম দিচ্ছে তার উপর অনেকটা নির্ভর করে।”
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন ডাক্তার মুখোটি। তারপর সুশীলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি নিশ্চিত নই, তবে মনে হচ্ছে, এই স্বর-ব্যবস্থাতেই কোনও গোলমাল হয়ে গিয়েছে আপনার। গলা না-কাটলে সেটা বোঝা যাবে না।”
সুশীলবাবু চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে পড়লেন। ছিটকে ওঠারই কথা। কেউ যদি শান্ত গলায় ‘গলা কাটা হবে’ বলে, তা হলে চুপ করে বসে থাকা যায় না। চেয়ার যতই গদিমোড়া আরামের হোক না কেন!
এই তো দুই ডাক্তারের চিকিৎসা। একজন ধরে রাখতে চান, একজন চাইছেন গলা কাটতে। তাই শেষ পর্যন্ত ভাইয়ের কথা মেনে তিন নম্বর ডাক্তারে সায় দিলেন নমিতাদেবী। ঠিক হল, দুপুরে খাওয়ার পর যাওয়া হবে। তবে নমিতাদেবী যাবেন না। কল্যাণ তার জামাইবাবুকে নিয়ে একাই যাবে। হাসিখুশি কল্যাণও মনে মনে ভেঙে পড়েছে। অন্য সময় রসিকতার মধ্যে থাকলেও এখন সে সিরিয়াস। চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে হাসিঠাট্টা মানায় না। তা ছাড়া বড় বড় দু’জন ডাক্তার ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর। দেখা যাক, এবার এই ডাক্তার কী বলেন? তবে দিদি রাজি হলে শুধু হবে না, এঁর কাছে যাওয়ার আগে রোগীরও একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। কারণ, তিন নম্বর ডাক্তার মানুষের ডাক্তার নন।
ফ্ল্যাটে ফিরেই সুশীল পাত্র আগে ব্যাগ থেকে জটিল অঙ্কের বইটা বের করে সরিয়ে রাখলেন। কল্যাণকে ডেকে বললেন, “তোমার কাছে ছোটদের কোনও গল্পের বইটই আছে নাকি হে? এই ধরো, হাসির বা ভূতের? মনে হচ্ছে, থিয়োরি অফ প্রবাবিলিটি একটু ঝামেলা করছে। পড়তে গেলেই মাথাটা টিপটিপ করছে। তাই ভাবছিলাম, হালকা কিছু যদি থাকে, আছে কিছু? কুহু-কুহু।”
কোকিলের ডাক দিয়েই লজ্জা পেয়ে গেলেন সুশীলবাবু, ভুল হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি খাতা-পেন টেনে নিলেন কাছে। গিন্নি পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, ভাইয়ের ওখানে গিয়ে যেন কু-কু না করেন। এটা কাঞ্চনগড়ের নিজের বাড়ি নয়, ফ্ল্যাটবাড়িতে আরও পাঁচটা লোক থাকে। তারা যদি কল্যাণের ওখান থেকে পাখির ডাক শুনতে পায়, সন্দেহ করবে। তাই মুখে কথা একেবারে নয়। যা বলবার লিখে বলতে হবে।
কল্যাণ অবশ্য কোকিলের ডাক খেয়াল করল না। তার জামাইবাবু অঙ্ক সরিয়ে গল্পের বই চাইছেন, এতেই সে যথেষ্ট অবাক হয়েছে। আর গল্প মানে যে-সে গল্প নয়, একেবারে ভূতের গল্প! কিন্তু তার কাছে ছোটদের গল্পের বই তো কিছুই নেই। মানুষটি এ আবার কী নতুন খেলা শুরু করলেন? বড় বয়সে ছোটদের গল্প পড়বেন? কে জানে বাবা, এর পরেই হয়তো বলবেন, ‘কল্যাণ, লুডো আনো তো দেখি, তোমার সঙ্গে একদান খেলি। কুহু-কুহু।’ দরকার হলে তাই আনতে হবে। উনি যে এখনও শান্ত আছেন এটাই আসল কথা। নতুন করে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে যেন মেজাজ বিগড়ে না যায়। কল্যাণ চট করে সামনের ফ্ল্যাটের ছেলেটির কাছ থেকে একটা বই নিয়ে এল। তবে সেটা ভূতের বা হাসির হল না, হল ডাকাতের। ডাকাত ধরার গল্প। দুপুরের খাওয়া সেরে সুশীলবাবু সেই বই নিয়ে পড়তে বসেছেন।
কল্যাণ ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল। তিন নম্বর ডাক্তারের কথা শুনে জামাইবাবুর কী প্রতিক্রিয়া হবে? জামাইবাবু কি চেঁচিয়ে উঠবেন? হাতের বইটা তাকে লক্ষ করে ছুড়ে মারবেন না তো?
“জামাইবাবু একটা কথা ছিল।”
সুশীলবাবু হাতের বই সরিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। না, মুখে নয়। খাতায় খসখস করে লিখে দেখালেন, ‘তুমি কি এই বইটা পড়েছ কল্যাণ? জলদস্যুর গল্পগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং।’
কল্যাণ ঘাবড়ে গেল। জামাইবাবুর এ কী ব্যবহার! এত নরম! সে তাড়াতাড়ি বলল, “না, আমি পড়িনি জামাইবাবু।”
সুশীলবাবু আবার লিখে খাতা এগিয়ে ধরলেন, ‘অবশ্যই পড়বে।’
কল্যাণ গদগদ মুখে বলল, “নিশ্চয়ই পড়ব, অবশ্যই পড়ব। জামাইবাবু, একটা কথা ছিল।”
সুশীল পাত্র ভুরু কুঁচকে পাতার নীচে লিখলেন, ‘তাড়াতাড়ি বলো। আমি চম্বলের ডাকাত নিয়ে ব্যস্ত আছি।’
পরিস্থিতি গোলমেলে মনে হচ্ছে। মানুষটি যদি বলতেন, ক্যালকুলাস নিয়ে ব্যস্ত আছি, তা হলে অসুবিধে হত না। তার বদলে একেবারে চম্বলের ডাকাত! বাপ রে! কল্যাণ আমতা আমতা করে বলল, “জামাইবাবু, বিকেলে আপনাকে আর-একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। অনেক কষ্টে খোঁজ পেয়েছি। আশা করেছিলাম, বাকি দু’জন ডাক্তারের কেউ না কেউ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। তা হলে আর এঁর কাছে যাওয়ার দরকার হত না, কিন্তু…।”
“ইনি কে? কীসের ডাক্তার?” সুশীলবাবু লিখলেন।
কল্যাণ এক পা পিছিয়ে গেল, মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, “এটাই একটু মুশকিলের জামাইবাবু, সেই কারণে আপনাকে বলতেও বাধো বাধো ঠেকছে। ভদ্রলোক পশু-পাখির ডাক্তার। তবে পাখিতে স্পেলাইলেজেশন করেছেন। ওনলি বার্ড। আজকাল শুধু পাখির কেসগুলো দেখেন। এই তো সেদিন সিঙ্গাপুরের কোনও এক স্যাংচুয়ারি থেকে ঘুরে এলেন। কাকাতুয়াদের উপর কাজ ছিল, টকিং প্যারট। পত্রিকায় সেই খবর পড়েই… আমি যখন টেলিফোন করলাম, আমার কথা প্রথমে বিশ্বাস করছিলেন না। পরে যখন শুনলেন, আপনি স্কুলশিক্ষক, তখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন। মনে হল, শিক্ষকদের জন্য ওঁর একটা আলাদা শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে।”
ডাকাতের বই বন্ধ করে সুশীলবাবু স্থির চোখে কল্যাণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কল্যাণের মনে হল, তার জামাইবাবু এবার হুঙ্কার দিয়ে উঠবেন। ওঠাটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষকে যদি চিকিৎসার জন্য পশু-পাখির ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তা হলে তিনি যে হুঙ্কার দেবেন এ আর আশ্চর্য কী? কল্যাণ একটু সরে এল। হাতের বইটা ছুড়ে মারবেন কি?
না, বই ছুড়ে মারলেন না সুশীলবাবু। বই ভাঁজ করে শান্ত গলায় বললেন, “ঠিক আছে চলো।”
চেম্বারটা দেখতে খুব কায়দার। একটা ঢাউস খাঁচা যেন! আলোগুলো এমনভাবে ঝোলানো মনে হচ্ছে, এক-একটা দাঁড়! খাঁচার একপাশে টেবিল-চেয়ার নিয়ে যে লোকটি বসে আছেন, তাঁর গায়ে ঘন সবুজ গাছপাতা আঁকা জামা। একটা জঙ্গল জঙ্গল ভাব।
চেম্বারের বাইরে ভিড়। বেশিরভাগের হাতেই খাঁচা। পোষা পাখি নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছে চিকিৎসার জন্য। ডানা ঝাপটানো, ট্যাঁ ট্যাঁ ডাকে চারপাশ একেবারে সরগরম। মোটাসোটা এক মহিলার কাঁধে বসে আছে লম্বা নাকের সবুজ একটা টিয়াপাখি। মহিলা হাতে একটা লাল লঙ্কা নিয়ে তাকে খাওয়ানোর জন্য খুব সাধ্যসাধনা চালাচ্ছে। “খাও বাছা, লক্ষ্মীসোনা, একটা কামড় দাও! সেই সকাল থেকে পেট খালি…।”
টিয়াপাখি মুখ ফিরিয়ে নিল। কল্যাণ তার মালকিনের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, বেচারির সর্দি-জ্বর হয়েছে। দু’দিন ধরে মুখে কিছু তুলছে না।
সুশীলবাবুদের অপেক্ষা করতে হল না। একটু বসতেই ভিতরে ডাক পেলেন। চেম্বারে ঢুকতেই পক্ষীবিশারদ উঠে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে সুশীলবাবুর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, “বসুন মাস্টারমশাই। সবাই আমাকে ‘পাখিডাক্তার’ বলেই চেনে। আপনার ব্যাপারে আমার দু’টো ইন্টারেস্ট। এক হল, আপনার অসুখ, আর দু’ নম্বর হল, আপনার পেশা। শুনলাম আপনি স্কুলের শিক্ষক। আমার দূর সম্পর্কের এক মামাও স্কুলের সঙ্গে জড়িত।”
কল্যাণ বলল, “তাই নাকি! বাঃ, কীসের শিক্ষক উনি? কোন সাবজেক্টের?”
পাখিডাক্তার হেসে বললেন, “কোনও সাবজেক্টের নয়, আমার মামা হলেন স্কুল পরিদর্শক। ওই যে স্কুল ঘুরে ঘুরে দেখে না? লেখাপড়া সব ঠিকমতো হচ্ছে কি না, ছেলেদের রেজাল্ট কেমন, মাস্টারমশাইরা ঠিক সময় আসছেন তো, এই সব। শুনেছি, মামা নাকি স্কুলে গিয়ে বেজায় ঝামেলা পাকান।একবার ঠিক করেছি, মামার সঙ্গে ঝামেলা দেখতে যাব। হাঃ হাঃ। যাক, এবার আপনার সমস্যাটা শুনি মাস্টারমশাই।”
শান্তভাবেই ঘটনা বললেন সুশীলবাবু। তবে সমস্যা আলাদা করে বলতে হল না। কারণ, পাখিডাক্তার কথার মাঝখানেই নিজের কানে তাঁর কোকিল ডাক শুনতে পেলেন। বেশি নয়, মাত্র তিনবার। কিন্তু সেটাই তাঁর ভুরু কুঁচকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বললেন, “অসম্ভব। ইমপসিবল্। হতেই পারে না।”
কল্যাণ বলল, “কিন্তু হচ্ছে তো, নিজের কানেই তো শুনলেন।”
“শুনলেও বিশ্বাস করব না। অনেক জিনিস আছে যা চোখে দেখলেও বিশ্বাস করতে নেই। বুঝতে হয়, নিশ্চয়ই অন্য কোথাও গোলমাল আছে। মরীচিকা তো জল দেখায়, তা বলে কি জল আছে? নেই। এটাও সেরকম কিছু। কী সেটা বলতে পারছি না, তবে কিছু যে, সেটা নিশ্চিত।” এরপর পাখিডাক্তার সুশীলবাবুর দিকে ফিরে বললেন, “লাস্ট টুয়েন্টি ইয়ার্স পাখি নিয়ে কারবার করছি, যদি কিছু মনে না করেন তা হলে পাখির ডাকের সায়েন্সটা একটু মনে করিয়ে দিই। তা হলে আমার কথাটা যে সত্যি সেটা খানিকটা পরিষ্কার হবে। পাখির ডাকের রহস্য এখনও পুরোটা উদ্ঘাটিত হয়নি। বিজ্ঞানীরা আজও এই বিষয়ে কাজ করে চলেছেন। তবে এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গিয়েছে তাতে কিছুটা ধারণা স্পষ্ট হবে। বোঝা যাবে, কেন মানুষ পাখির মতো ডাকতে পারে না, ডাকা সম্ভব নয়।”
সত্যি সত্যি এরপর পাখির ডাক নিয়ে ছোটখাটো একটা ভাষণ দিয়ে বসলেন পক্ষীবিশারদ, “পাখির স্বরযন্ত্রটি মানুষের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। মানুষের থাকে ল্যারিংক্স, আর পাখির গলায় তার বদলে আছে সিরিংক্স। এটাই তার স্বর তৈরির জায়গা, যাকে বলে ‘ভয়েস বক্স’। যে পাখির ভয়েস বক্সে পেশির সংখ্যা যত বেশি, তার ডাক তত রকমারি, সুরেলা আর মিষ্টি। এই যন্ত্র পাখির শরীরের অনেক ভিতরে থাকে, একেবারে বুকের কাছাকাছি। ফুসফুসের সঙ্গে দু’ভাবে থাকে যোগাযোগ। আর সেটাই হল পাখির সুর তৈরির আসল কৌশল। দুই ফুসফুস থেকে একই সঙ্গে দু’রকম সুর বের করে দেয়। সুরের ওঠা-নামা, চলাচল সব পারে। তৈরি হয় গান। তবে এটা ঠিক, সব পাখি কিন্তু গাইতে পারে না মাস্টারমশাই।”
এই পর্যন্ত বলে পাখিডাক্তার চুপ করলেন। সুশীলবাবু ফিসফিস করে বললেন, “আর কোকিল?”
“আপনি আসার আগে সেটা নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা করে রেখেছি। কোকিল অনেকরকম ডাকতে পারে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে প্রায় সাতরকমের ডাক আছে ওদের। সাধারণত সকাল আর সন্ধেতেই ওদের যত কু-কু। মজার কথা হল, ধীরে ধীরে শুরু করে কোকিল কিন্তু ডাকের গতি বাড়িয়ে দেয়। ঘন ঘন, একটানা ডেকেই চলে।”
কল্যাণ চোখ বড় বড় করে বলল, “বাপ রে, পাখির ডাকের পিছনে যে এত কিছু আছে কে জানত! আচ্ছা, জামাইবাবুর গলায় যে ডাক শুনলেন সেটা কি অরিজিনাল? পারফেক্ট?”
পক্ষীবিশারদ টেবিলের উপর পেনসিল ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “না, পারফেক্ট নয়। ওঁর ডাকের মধ্যে গতি বাড়ানোর ব্যাপারটা দেখলাম না, ডাক একটানাও নয়। উনি জানেন না গলা থেকে এই আওয়াজ কখন বের হবে। যে-কোনও সময় হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। অর্থাৎ ডাকের উপর ওঁর নিয়ন্ত্রণ নেই। আর সেই কারণেই আমি নিশ্চিত, ঘটনা শুধু কোকিলের ডাক নয়, অন্য কিছু আছে। ডাকটা আসল অসুখ নয়, অসুখের লক্ষণ। তবে যদি জিজ্ঞেস করেন, আসল অসুখটা কী? বলতে পারব না। আমি এখনও সেটা বুঝতে পারছি না।”
কল্যাণ হতাশ মুখে বলল, “একটা কথা, অসুখটা কি পাখির?”
পক্ষীবিশারদ হেসে বললেন, “না পাখির নয়, অসুখটা মানুষের, অবশ্যই মানুষের। তবে লক্ষণটা পাখির। কোনও কোনও সময় মানুষ পশুর মতো বিশ্রী আচরণ করে না? তা হলে পাখির মতো সুন্দর করে ডাকতে পারবে না কেন?”
সুশীলবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, “সুন্দর! কোকিলের ডাক দেওয়া সুন্দর বলছেন! কুহু-কুহু-কুহু…।”
“এটা কী বলছেন মাস্টারমশাই, কোকিলের ডাক সুন্দর নয়? অবশ্যই সুন্দর। একবার ভেবে দেখুন তো, কোকিলের বদলে যদি আপনার গলা দিয়ে কাকের ডাক বেরোত? কী সর্বনাশ হত তখন? মাস্টারমশাই কোকিলের ডাক শুনলে আমরা থমকে দাঁড়াই, মনটা নরম আর শান্ত হয়ে যায়। হয় না?”
সুশীলবাবু বিড়বিড় করে বললেন, “মন নরম! মন শান্ত!”
পক্ষীবিশারদ হেসে বললেন, “অবশ্যই হয়। মনে করবেন না পাখি নিয়ে পড়ে আছি বলে তাদের হয়ে কথা বলছি। কথায় বলে, আহা, কোকিলকণ্ঠ। শুনলে মন ভরে যায়। যাক, স্যার, চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আজই মেলে সিঙ্গাপুরের জুরং বার্ড সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করব। জুরং হল পাখির চিড়িয়াখানা, অনেকটা স্যাংচুয়ারির মতো। পাখি নিয়ে ওখানে গবেষণা চলছে… দেখি, ওরা যদি কিছু বলতে পারে!”
কথা শেষ করে পক্ষীবিশারদবাবু বেলের সুইচ টিপলেন। ঘরের বাইরে হেঁড়ে গলায় কে যেন বলে উঠল, “নেক্সট। এবার পরেরজন ভিতরে আসুন।”
পক্ষীবিশারদ হেসে বললেন, “আমার গলা নয়, গলা আমার পোষা কাকাতুয়ার, তাকে দিয়ে বলিয়ে রেকর্ড করিয়ে নিয়েছি। বেল টিপলেই বলে ওঠে। কেমন হয়েছে?”
সুশীলবাবু উঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা যেন নিচু স্বরেই বললেন, “পাখি কেন ডাকে?”
পক্ষীবিশারদবাবু এবার চোখ সরু করে হাসলেন। ভাবটা যেন, এমন সহজ প্রশ্ন তাঁকে কেন? তারপর বললেন, “অনেক কারণেই ডাকে মাস্টারমশাই, বলা যেতে পারে, সব কারণেই ডাকে। খিদে পাওয়া থেকে শুরু করে, নিজে বিপদে পড়লে, অন্যকে বিপদ থেকে বাঁচাতে, রাগে, ঝগড়ায়, আত্মরক্ষায়, লড়াইতে, সবেতেই ওরা ডাকাডাকি চালায়। তবে কিছু পাখি মাস্টারমশাই, স্রেফ আনন্দ পেতেই ডাকে।”
“আনন্দ পেতে!”
পাখিডাক্তার মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “হ্যাঁ, মনে আনন্দ পেতে। মাস্টারমশাই, আপনি যাওয়ার আগে আপনার স্কুলের নাম, ঠিকানাটা একটু লিখে দিয়ে যাবেন। বলা তো যায় না, যদি কোনওদিন আমার ইনস্পেক্টর মামা ওদিকে যান…।”
পক্ষীবিশারদের কাছে জামাইবাবুর স্কুলের নাম-ঠিকানা লিখে কল্যাণ ফিরল হতাশ মনে। হতাশ হওয়ারই কথা। অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু লাভ হল না। মাথা, গলার মতো পাখির ডাক্তারও অসুখ ধরতে পারলেন না। ‘মাস্টারমশাই মাস্টারমশাই’ করে ভাষণ দিলেন অনেক, কিন্তু কাজের কাজ পারলেন না কিছুই। কী হবে তা হলে? কেউ-ই পারবেন না? মনে হয় না পারবেন।
তবে সুশীলবাবু কিন্তু এসব ভাবছেন না। তাঁর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, নরম আর শান্ত মন। নরম আর শান্ত মন…। সত্যি কি তাই পাখি ডাকলে মন শান্ত হয়? কঠিন মন কি নরম হয়ে ওঠে?
রাতে কাঞ্চনগড় ফিরে নমিতাদেবী এবং সুশীলবাবু চমকে উঠলেন। কারা যেন বাড়ির সামনে একটা খাঁচা রেখে গিয়েছে! ঠিক দরজার মুখে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে আসা আলোয় তারের সেই খাঁচা চকচক করছে। দরজার তালা খোলার আগেই সুশীলবাবু নিচু হয়ে সেই খাঁচা তুললেন। খাঁচার ভিতর এক চিলতি কাগজ। তাতে কাঁচা হাতে লেখা, ‘কাঞ্চনগড়ের কোকিলস্যারকে উপহার।’
দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতে নমিতাদেবী বললেন, “নিশ্চয়ই তোমার স্কুলের ছেলেদের কাণ্ড। খবরটা তা হলে ওরা জেনেছে। সে তো জানবেই। এই ঘটনা কি আর চেপে রাখা যায়? তবে তুমি কিছু মনে কোরো না, ছেলেপিলেরা ওরকম একটুআধটু করে।”
সুশীলবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, “না, আমি কিছু মনে করিনি। কুহু-কুহু…।”
রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লেন সুশীল পাত্র।
॥ ৬ ॥
আজ একটা ঐতিহাসিক দিন। কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের ক্লাস এইটের ছেলেরা সকালে স্কুলে এসে দেখল নোটিশবোর্ডে নোটিশ পড়েছে। সেই নোটিশ এইরকম—
‘এ বছর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার অঙ্ক প্রশ্নপত্রে কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। সম্ভবত প্রশ্নপত্র ছাপবার সময় যান্ত্রিক কারণেই এই ত্রুটি। ছাপার ভুল। আমাদের অঙ্কশিক্ষক সুশীল পাত্র মহাশয় অসুস্থতার কারণে স্কুলে আসছেন না। ফলে ত্রুটির সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে এলে অবশ্যই কারণ অনুসন্ধান হবে। তবে তার আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এইটের এই অঙ্কপরীক্ষা আপাতত বাতিল। অঙ্কশিক্ষক মহাশয় সুস্থ হয়ে ফিরে এলে এই পরীক্ষা আবার নতুন করে নেওয়া হবে। নতুন করে প্রশ্নপত্রও তৈরি হবে।’
নোটিশের তলায় হেডমাস্টারমশাইয়ের সই। ক্লাস এইটের ছেলেরা তো খুশিতে নাচানাচি শুরু করে দিল। এরকমটা হবে তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। চোখের জল দেখে খুব বেশি হলে পাঁচ-দশ নম্বর গ্রেস মার্কস আদায় করা যেত। তাতে যে খুব কিছু লাভ হত এমন নয়। দশ নম্বর যোগ করার পরও অর্ধেকের অনেক বেশি ছাত্র ফেল থাকত। তার বদলে একেবারে পরীক্ষা বাতিল। নিশ্চয়ই বড় ধরনের কিছু ঘটেছে। অন্য স্যারেরাও মুখ খুলছেন না। জিজ্ঞেস করলে কেউ “ওরে বাবা, আমি কিছু জানি না।” বলে চুপ করে যাচ্ছেন, কেউ হাসছেন মিটিমিটি!
টিফিনের সময় কয়েকজন ছেলে অতি উৎসাহে হেডস্যারের ঘরে গেল প্রণাম করতে, পরীক্ষা বাতিলের প্রণাম। এরা কেউই দশের বেশি নম্বর পায়নি। এদের লিডার অর্ক। হরবোলা অর্ক। তার কপালে জুটেছিল ঠিক আড়াই নম্বর। সে শুধু বীজগণিতের একটা ফর্মুলা ঠিকঠাক লিখেছিল, বাকি সব কাটা।
টিফিনের সময় নবলাল হেডস্যারের ঘরে ঢুকে বলল, “স্যার, ছেলেরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।”
শশাঙ্কশেখরবাবু মাথা নামিয়ে স্যারেদের রুটিন বানাচ্ছেন। মনটা খুঁতখুঁত করছে। অঙ্কপরীক্ষা নিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, কিন্তু অঙ্কশিক্ষককেই জানানো হল না। একটা দিন অপেক্ষা করা যেত না এমন নয়। প্রথমে সেরকমটাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন শশাঙ্কশেখর ধর। একবার অন্তত কথা বলে নেবেন। কিন্তু গোলমাল হল কাল রাতে।
শোওয়ার পর যেই হেডমাস্টারমশাই শশাঙ্কশেখর ধর চোখ বুজেছেন তখনই চোখের সামনে নিজের পরীক্ষা দেওয়া খাতাটা ভেসে উঠল। লাল কালি দিয়ে খাতার উপর লেখা ‘সতেরো’! ভয়ংকর! মারাত্মক! একজন এম এ বি এড প্রধানশিক্ষক অঙ্কে মাত্র সতেরো! তাও ক্লাস এইটের অঙ্ক! এই খবর যদি স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে? কেউ যদি ড্রয়ার থেকে ওই খাতা চুরি করে নেয়? এরপরই তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। খাট থেকে নেমে পরপর তিন গ্লাস জল খেলেন। গোটা রাত পায়চারি করলেন ঘরের ভিতর এবং ভোররাতের দিকে সিদ্ধান্ত নিলেন, অঙ্কস্যার আসুন বা না আসুন, স্কুলে গিয়ে প্রথমেই তিনি নোটিশ দেবেন। তারপর অন্য কাজ। সেই মতোই নোটিশ পড়েছে। তবে সুশীলবাবু ফিরে এসে অপমানিত যাতে না হন, তার জন্য একটা ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’র কথা যোগ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন আবার অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেল। ফিরে এসে সুশীলবাবু যদি বেঁকে বসেন? যদি বলেন, না, পরীক্ষা বাতিল নয়। অথবা যদি নতুন করে পরীক্ষা নিতে রাজি না হন? স্কুলে আসার পথে সুশীলবাবুকে একবার সিদ্ধান্তের কথাটা জানিয়ে এলেও মন্দ হত না। অন্তত একটা টেলিফোন করলেও হত। সত্যি কথা বলতে কী, সতেরো নম্বরটা এমনভাবে তাড়া করল যে, আর অপেক্ষা করা গেল না। এখন কি আর সুশীলবাবুকে কথাটা জানানো উচিত হবে? ভেবেছিলেন, আজ একবার বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসবেন। মনে হয় না সেটা ঠিক হবে। অসুস্থ শরীরে যদি শোনেন অঙ্ক পরীক্ষাটাই বাতিল, তা হলে নির্ঘাত অপমানে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তা হলে?
নবলালের দিকে তাকিয়ে শশাঙ্কশেখরবাবু বিরক্ত মুখে বললেন, “আবার কোন ছেলেরা দেখা করবে?”
নবলাল বলল, “স্যার, ক্লাস এইটের ছেলেরা এসেছে।”
“ক্লাস এইট! কেন, তাদের আবার কী হল? পরীক্ষা তো ক্যানসেল করে দেওয়া হয়েছে। নোটিশ পড়েনি?”
নবলাল বলল, “সেই কারণেই তো এসেছে স্যার। আপনাকে প্রণাম করতে চায়।”
শশাঙ্কশেখরবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “পরীক্ষা বাতিলের প্রণাম? তিন, চার, পাঁচ নম্বর পেয়ে সব প্রণাম করতে এসেছে? বাঁদরগুলোকে কান মলে এখনই ক্লাসে পাঠিয়ে দাও। একটা করে নয়, দু’টো করে কান মলবে। একটা মলবে কম নম্বরের জন্য, আর একটা মলবে প্রণাম করতে এসেছে বলে।”
নবলাল গলা নামিয়ে বলল, “স্যার, অর্ক ছেলেটিও এসেছে।”
শশাঙ্কশেখরবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “অর্ক! সে কে?”
নবলাল ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, “ওই যে হরবোলা স্যার! সুশীলবাবু যাকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ডাকব?”
অঙ্ক পরীক্ষার ঝামেলায় শশাঙ্কশেখরবাবুর অর্কর কথাটা ভুলেই গিয়েছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, “হ্যাঁ, ওই ছেলেকে পাঠিয়ে দাও।”
নবলাল ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। বলল, “স্যার, একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“স্যার, কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম, আজ সকালে হঠাৎ মনে পড়ল।”
শশাঙ্কশেখরবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী কথা?”
নবলাল এক পা এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, “অঙ্কস্যার যেদিন অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেলেন, সেদিন একটা কাণ্ড হয়েছিল। সেই সময় টিচার্সরুমে কেউ ছিলেন না। হঠাৎ শুনি ঘরের ভিতর ডাকে…।”
শশাঙ্কশেখরবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “ডাকে! কী ডাকে?”
“কোকিল, স্যার, কোকিল ডাকে।”
শশাঙ্কশেখরবাবু হাতের পেন টেবিলে রেখে বললেন, “উফ নবলাল, তোমাকে কালই বললাম না, এসব উদ্ভট কথা বলবে না। আমাদের স্কুলের চারপাশে কত গাছপালা রয়েছে, সারাদিনই তো পাখির ডাক শুনছি। রোজ বিকেলেই তো টিয়াপাখির ঝাঁক আসছে। তারা ডাকেও। ডেকে কান একেবারে ঝালাপালা করে দেয়। কোকিলও নিশ্চয়ই অনেক ডেকেছে। আজও হয়তো ডাকবে। তুমি এমন একটা ভান করছ যেন কোকিলের ডাক তুমি সেদিনই প্রথম শুনলে।”
নবলাল গাঢ় গলায় বলল, “স্যার, টিচার্সরুম থেকে প্রথম শুনলাম।”
শশাঙ্কশেখর ধর এবার ধমক দিলেন, “চুপ করো। ওটা তোমার ভুল। কাছেপিঠে পাখির ডাক শুনে মনে হয়েছিল, একেবারে টিচার্সরুম থেকে ডাকছে। অঙ্কস্যারের রান্নার মেয়ে তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে কী বলেছে, তারপর থেকে তোমার মাথায় এই উদ্ভট বিশ্বাসটা ঢুকে গিয়েছে। স্কুলে যদি এসব গুজব ছড়ায়, তা হলে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। একেই হাজার রকমের ঝামেলা নিয়ে আছি। যাও এখন, ওই অর্ক ছেলেটিকে ডেকে দাও।”
অর্ক বুঝতে পারছে, তার সময় খারাপ যাচ্ছে। সময় খারাপ না হলে কারও এরকম ঘনঘন বাঘের গুহায়, সিংহের ঘরে ডাক পড়ে না। রাগি অঙ্কস্যার, গম্ভীর হেডস্যার ডেকে পাঠানো আর বাঘ-সিংহ ডেকে পাঠানোর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। অঙ্কস্যারের বাড়িতে যাওয়ার সময় সে একবার ভেবেছিল গুরুজনদের প্রণাম করে যাবে। বিপদ থেকে বাঁচতে হলে গুরুজনদের আশীর্বাদ লাগে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেসব লাগেনি। বরং মিষ্টিমুখেই বিপদ কেটেছিল। এবার কী হবে? নবলালদা চোখ পাকিয়ে সবাইকে ক্লাসে যেতে বলল, শুধু তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ভিতরে যাবে। স্যার তোমায় ডেকেছেন।”
কেন ডেকেছেন? খাঁচার খবরটা কি জানাজানি হয়ে গিয়েছে? হতে পারে। অসম্ভব কিছু নয়। হয়তো কাল সন্ধেবেলা যখন অঙ্কস্যারের বাড়ির সামনে সে জিনিসটা চুপিচুপি রেখে আসে, তখন কেউ দেখে ফেলেছিল। অঙ্কস্যার নিজেও নালিশ করতে পারেন। কোকিল নিয়ে কথা একমাত্র তার সঙ্গে হয়েছিল। সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার করতে আর যার অসুবিধে হোক, অঙ্কস্যারের হবে না। এখন মনে হচ্ছে, ঝোঁকের বশে কাজটা করা ঠিক হয়নি। প্ল্যানটা তার হলেও, কাজটার পিছনে ক্লাসের অনেকেই আছে। অঙ্কস্যার যে তাকে কোকিলডাকের হোমটাস্ক দিয়েছেন, এই গোপন কথা অর্ক পরদিনই বন্ধুদের কাছে ফাঁস করে। গোপনেই করে। কিন্তু কথা খুব দ্রুত গোটা স্কুলে ছড়িয়ে গিয়েছে। ছেলেদের গোপন কথা স্কুলে সাধারণত দ্রুত ছড়ায়। তারপর আবার অঙ্কখাতায় ওই নম্বর! ফলে অঙ্কস্যারকে একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য সবাই মিলে ঠিক করে, বাড়ির সামনে খাঁচা রেখে আসা হবে।
হেডস্যারের ঘরে ঢুকে অর্ক প্রায় কেঁদে ফেলল, “স্যার, আমি কিছু জানি না। সত্যি বলছি স্যার। ওরা বলল… আমি স্যার, বারণ করেছিলাম।”
শশাঙ্কশেখরবাবু রাশভারী গলায় বললেন, “অর্ক, তুমি নাকি মুখ দিয়ে নানাধরনের আওয়াজ করতে পারো? কথাটা কি সত্যি?”
“আর কখনও করব না স্যার।”
শশাঙ্কশেখরবাবু শান্ত গলায় বললেন, “কী ধরনের আওয়াজ করতে পারো?”
অর্ক চোখ মুছল। এসব কী শুরু হয়েছে? মুখ দিয়ে আওয়াজ তো সে অনেকদিনই করতে পারে। স্কুলের সকলেই জানে। কই কেউ তো কখনও এভাবে ডেকে জেরা করেনি! এরপর কি খাঁচার কথা আসবে? সে ঢোক গিলে বলল, “স্যার, আমি একবার জিওগ্রাফি ক্লাসে ভুল করে নৌকোর… স্যার, আমি চাইনি, পিছন থেকে সোমসুন্দর বলল… আর কখনও হবে না স্যার।”
শশাঙ্কশেখরবাবু এবার একটু হাসলেন। বললেন, “আচ্ছা, ও কথা থাক। অর্ক, তুমি কি সুশীলবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলে?”
অর্ক চুপ করে রইল। আর বাঁচার পথ নেই। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে খাঁচা উপহার পাঠানোর জন্য কী শাস্তি হয়? অর্ক মাথা নামিয়ে নিচু গলায় বলল, “গিয়েছিলাম স্যার। অঙ্কস্যারই ডেকেছিলেন আমাকে।”
“কী বললেন?”
অর্ক বলল, “কিছু বলেননি।”
শশাঙ্কশেখরবাবু অবাক হয়ে বললেন, “বলেননি মানে? তোমাকে ডেকে পাঠিয়ে কিছু বললেন না?”
অর্ক এবার সাহস পেল, খাঁচার কথা কিছু আসছে না। বলল, “বলবেন কী করে স্যার? ওঁর গলায় তো অসুখ করেছে, সারাক্ষণ মাফলার জড়ানো। পাশে স্লেট আর চক।”
“স্লেট!”
অর্ক আর সামলাতে পারল না। ফিক করে হেসে ফেলল, “হ্যাঁ স্যার, একেবারে ছোটদের মতো। উনি সব কথা ওই স্লেটে লিখে দেখাচ্ছেন। খাতা, নোটবইও আছে, সেখানেও লিখছেন।”
শশাঙ্কশেখরবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। এটা নিশ্চয়ই ডাক্তার বলেছেন। গলায় সমস্যা হলে ডাক্তাররা অনেক সময় কথা বন্ধ করে দিতে বলেন। প্রেসক্রিপশনের উপর বড় বড় করে লিখে দেন ‘ভয়েস রেস্ট’। তাঁর এক মামাতো বোনকে একবার টানা একমাস এই চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হয়েছিল। গলা ভেঙে গিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড হয়েছিল তার। সুশীলবাবুর অসুখও নিশ্চয়ই সেরকম। তিনি অর্ককে বললেন, “স্যার তোমাকে লিখে লিখে কী বললেন? অঙ্ক দিলেন নাকি?”
অর্ক এবার পুরোপুরি নিশ্চিত, হেডস্যার খাঁচার কিছুই জানেন না। সে আরও একবার পিছন ফিরে ঘরের দরজার দিকে তাকাল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “না স্যার, অঙ্ক নয়, মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে বললেন।”
হেডস্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, “আওয়াজ! মানে ওই হরবোলা…?”
“হ্যাঁ স্যার। প্রথমে ভয় পেলেও পরে আমি অনেকরকম আওয়াজ শোনালাম। স্টিমার, রেল, মোটরবাইক। ঘোড়ার গাড়িও শুনিয়েছি। ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ করা খুব কঠিন। একসঙ্গে গাড়ির চাকা আর ঘোড়ার খুরের শব্দ করতে হয় তো, তাই কঠিন।”
শশাঙ্কশেখরবাবুর ভুরু আরও কুঁচকে গেল। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। বদমেজাজি, রাগি, অঙ্কসর্বস্ব সুশীল পাত্র ছাত্রকে বাড়িতে ডেকে ঘোড়া ছোটার ঠকঠকানি শুনেছেন! ছেলেটা বানিয়ে বলছে না তো? কিন্তু নবলালও তো এরকমই বলেছিল। সবাই বানিয়ে বলবে কেন? “তারপর? তারপর কী হল?”
অর্ক একগাল হেসে বলল, “তারপর উনি আমাকে হোমটাস্ক দিলেন।”
শশাঙ্কশেখরবাবু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, “হোমটাস্ক! এর মধ্যে হোমটাস্কও দিয়ে ফেললেন? বাপ রে, তোমাদের অঙ্কস্যার তো দেখছি খুব সিরিয়াস। অসুস্থ হয়ে বাড়িতে ডেকে ডেকে ছাত্রদের হোমটাস্ক দিচ্ছেন। উনি কি স্কুলসুদ্ধ সব ছেলেকে এক এক করে ডাকবেন নাকি? তা কী হোমটাস্ক দিলেন? অ্যালজেব্রা না জিওমেট্রি?”
অর্ক মাথা চুলকে বলল, “না স্যার, সেসব নয়। উনি আমাকে পাখির ডাক শিখতে বলেছেন। শিখে পরের শনিবার স্কুল ছুটির পর আবার যেতে হবে।”
শশাঙ্কশেখরবাবুর এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়বার মতো অবস্থা হল। ছেলেটি বলছে কী? তিনি ঠিক শুনেছেন তো? পাখির ডাক!
অর্ক আবার হেসে বলল, “হ্যাঁ স্যার, পাখির ডাক। কোকিলের ডাক। অঙ্কস্যার বললেন, না না, বললেন না, স্লেটে বড় বড় করে লিখলেন, ‘তুই পাখির ডাক পারিস?’ আমি বললাম, ‘পারি না, তবে আপনি বললে চেষ্টা করব। কাক, দোয়েল, টিয়া, এগুলো সোজা। এগুলো চেষ্টা করব?’ উনি লিখলেন, ‘না, ওসব নয়। তুই কোকিলের ডাক শিখবি। এক সপ্তাহ সময়। এটাই তোর হোমটাস্ক। শনিবার স্কুল ছুটির পর আমাকে এসে শোনাবি।’ ”
এতটা বলে থামল অর্ক। কাঁচুমাচু মুখে বলল, “এখনও স্যার তেমন এগোতে পারিনি। মুশকিল হল, কাঞ্চনগড়ে কোকিল মনে হয় খুব একটা বেশি নেই। আমাদের ক্লাসের প্রতিম বলল, ঘোষবাগানের ওদিকটা গেলে হয়তো…।”
অর্ক চলে যাওয়ার পর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন শশাঙ্কশেখর ধর। তারপর টেলিফোনটা টেনে নিলেন। টেবিলের কাচের তলাতেই শিক্ষকদের ফোন নম্বর লেখা তালিকা রয়েছে। সুশীল পাত্র’র ফোন বেজে গেল। উত্তর নেই। শশাঙ্কশেখরবাবু হাতের রিসিভার নামাতে নামাতে সিদ্ধান্ত নিলেন, ছুটির পর নয়, এখনই একবার ঘুরে আসবেন। নিজের চোখে দেখে আসবেন ঘটনা কী? কাউকে জানাবেন না। গোপনে যাবেন। কাগজপত্র গুছিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার মুখে নবলাল একটা খাম দিয়ে গেল। মুখবন্ধ খাম। দ্রুত হাতে খাম খুলে চিঠি পড়ে আঁতকে উঠলেন শশাঙ্কশেখরবাবু। মাত্র দু’লাইনের চিঠি। সেই দু’লাইনই মারাত্মক। ‘কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুল পরিদর্শনের জন্য পরিদর্শক বলাইকান্ত সাঁপুই শনিবার যাচ্ছেন। ওইদিন স্কুলের সব ছাত্র, শিক্ষক, কর্মীরা যেন স্কুলে উপস্থিত থাকেন।’
স্কুল পরিদর্শন? এ যে বিনা মেঘে বাজের মতো! শেষ কবে কাঞ্চনগড় স্কুলে পরিদর্শক এসেছিলেন মনে করতে পারলেন না শশাঙ্কশেখরবাবু। তবে আসল ভয়ংকর কথা হল, পরিদর্শকের নাম বলাইকান্ত সাঁপুই। স্কুল পরিদর্শক বলাইকান্ত সাঁপুইয়ের কথা আশপাশের সব স্কুলই শুনেছে।
কোনও কোনও পুলিশ থানার ওসি হয় খুব জাঁদরেল। অনেক দূর পর্যন্ত তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। এই বলাইকান্ত সাঁপুইও তেমনই। পার্থক্য শুধু তিনি থানার ওসি নন, স্কুলের ইনস্পেক্টর। তাঁকে নিয়ে অনেক রোমহর্ষক গল্প রয়েছে। কোনওটা সত্যি, কোনওটা বানানো। উনি পরিদর্শনে যান খুবই কম, কিন্তু যদি যান, সে হয় এক বিচ্ছিরি কাণ্ড। বিচ্ছিরি কাণ্ডটা ঠিক কী হবে আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। এই ভদ্রলোক আগে থেকে খবর নিয়ে আসেন। গোলমালের খবর। বড় কোনও গোলমাল নয়, ছোটখাটো সব ব্যাপার। স্বাভাবিক কারণেই এই মানুষটি আসছেন শুনলে স্কুলগুলো তটস্থ হয়ে যায়।
বছর দুয়েক আগে বসাকপাড়া গার্লস স্কুলে গিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড হয়েছিল। বলাই সাঁপুইয়ের কাছে খবর ছিল, স্কুলের পূর্ব দিকের বারান্দায় গোলমাল আছে। বারান্দার দেওয়াল অনেকদিন ধরে অপরিষ্কার। কালো দাগ ধরেছে।
স্কুলের সামনে গাড়ি থামতেই সবাই ছুটে এল। বলাই সাঁপুই গাড়ি থেকে নেমে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আগে দোতলা। পুবের বারান্দা।’
সবাই থ। এত বড় স্কুলবাড়ির সব ফেলে প্রথমেই পুবের বারান্দা?
বারান্দায় পৌঁছে কালো দাগের সামনে থমকে দাঁড়ালেন সাঁপুইবাবু। এক বালতি চুন আর কয়েকটি মোটা মোটা ব্রাশের অর্ডার দিলেন। তারপর ধুতিটাকে মালকোঁচা মেরে নিয়ে নিজের হাতে জলে চুন ভিজিয়ে সেই দেওয়াল হোয়াইটওয়াশ করতে শুরু করলেন। পাক্কা একঘণ্টা ধরে চলল। পিয়ন, বেয়ারা, বড়দি আর অন্য শিক্ষিকারা ছুটে এলেন। ছুটে এল ছাত্রীরা। বলাইকান্ত গর্জন করে বললেন, ‘তফাত যাও।’
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এরপর সাঁপুইবাবু চেয়ার আনিয়ে সেই দেওয়ালের দিকে মুখ করে নাকি আরও ঘণ্টাখানেক বসেছিলেন। চা-বিস্কুট, দুটো শিঙাড়া, একটা সন্দেশ খেলেন। তারপর দেওয়াল শুকিয়ে ঝকঝকে সাদা হয়ে গেলে একগাল হেসে বললেন, ‘এবার চলি, আবার আসব। তখন গোটা স্কুলের সব ক’টা দেওয়ালই দেখব। চিন্তা করবেন না, দাগ থাকলে আমি নিজের হাতে হোয়াইটওয়াশ করে দিয়ে যাব। মনে রাখবেন, স্কুলের দেওয়াল হল পড়ুয়াদের মনের মতো। সেখানে ময়লা থাকলে চলবে না। সব হবে সাদা ফটফটে।’
শোনা যায়। পরের দিন থেকে বসাকপাড়া গার্লস স্কুলে শুরু হয়েছিল সাফাই-অভিযান। বড়দি কোমরে আঁচল জড়িয়ে হাতে ঝাঁটা নিয়ে একবার একতলা, একবার তিনতলা করেছেন। টানা সাতদিন এই সাফাই-কাণ্ড চলেছে। সলতেপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনের গল্প আরও ভীতিজনক!
সেখানে পৌঁছেই গেমটিচারের খোঁজ করেছিলেন বলাই সাঁপুই। তিনি কাঁপতে কাঁপতে এলেন। বলাইবাবু বললেন, ‘এ কী, আপনার ভুঁড়ি কেন? গেমটিচারের ভুঁড়ি থাকা তো উচিত নয়। তা ছাড়া কমপ্লেন শুনেছি, আপনি নাকি ছেলেদের সঙ্গে মোটেই মাঠে নামেন না। ছায়ায় বসে হুইশল বাজান। ঘটনা কি সত্যি? আপনি গেমটিচার হুইশলটিচার? শিক্ষক নিজে না খেললে ছেলেরা উৎসাহ পাবে কোথা থেকে? এটা ঠিক নয়, নো না।’
গেমটিচারের কাঁপুনি গেল আরও বেড়ে। এবার সাঁপুইবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে ফুটবলটা নিয়ে আসুন দেখি! হাওয়া ভরে আনবেন।’
ফুটবল এলে বলাই সাঁপুই গেমটিচারকে নিয়ে সোজা চলে যান স্কুলের মাঠে। তাঁকে দাঁড় করান গোলপোস্টে। পেনাল্টিতে বল রেখে গুনে গুনে কিক মারেন বারোটা। বারোটাই গোল!
গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে পরিদর্শক বললেন, ‘না না, এটা ঠিক নয়। গেমটিচারের এক ডজন গোল খাওয়া খুবই খারাপ একটা ব্যাপার। এটা মোটেই ঠিক নয়।’
এরপর অফিসে বসে হেডস্যার স্কুলের ছাত্রদের ভাল রেজাল্ট, মাস্টারমশাইদের বড় বড় ডিগ্রির ফাইল বের করে পরিদর্শকমশাইকে দেখাতে গেলেন, তিনি বেজার মুখে সেসব সরিয়ে রাখলেন। বললেন, ‘আচ্ছা আপনিই বলুন না, এটা কি উচিত? বারোটা কিকে গেমটিচারের বারোটা গোল খাওয়া কি ভাল দেখায়?
এক সপ্তাহ যেতে না যেতে স্কুলে চিঠি এল। সলতেপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের গেমটিচারকে তিন মাসের ফুটবল প্রশিক্ষণে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি যেন দু’দিনের মধ্যে বাগিচাপুর ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়ে যোগাযোগ করেন। চিঠি হাতে পেয়ে গেমটিচারের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। বাগিচাপুর ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবিরে মিলিটারি নিয়ম। প্রতিদিন ভোর চারটের সময় হাফপ্যান্ট আর কেড্স পরে মাঠে পৌঁছে যেতে হয়। দশবার দৌড়ে মাঠ প্রদক্ষিণ দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
সেই মানুষটি এবার এখানে আসছেন, কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলে। রিকশায় বসেই শশাঙ্কশেখরবাবু আরও একবার খাম খুলে চিঠিটা পড়লেন। কী হবে?
॥ ৭ ॥
দরজা খুলে শশাঙ্কশেখর ধরকে দেখে নমিতাদেবী নিশ্চিন্ত হলেন। যাক, তাঁকে আর স্কুলে গিয়ে স্বামীর ছুটির জন্য দরখাস্ত করতে হবে না। কাজটা বাড়িতে হয়ে যাবে।
নমিতাদেবী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, স্বামীর অসুখের খবরটা প্রধানশিক্ষককে বলেই রাখবেন। তিনি জানেন, অন্যরা অপছন্দ করলেও প্রধানশিক্ষকমশাই এই অঙ্কসর্বস্ব, রাগি মানুষটিকে খানিকটা প্রশ্রয়ই দেন। সুতরাং এঁর কাছে আসল ঘটনা গোপন করা ঠিক হবে না।
কাল রাতে সুশীলবাবু ঘুমিয়ে পড়বার পর কল্যাণকে টেলিফোন করেছিলেন নমিতাদেবী, “একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছে রে কলু।”
কল্যাণ বলল, “কী বিচ্ছিরি কাণ্ড?”
“দরজার সামনে একটা খাঁচা ফেলে গিয়েছে।”
“খাঁচা!”
নমিতাদেবী কঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “হ্যাঁ খাঁচা। খাঁচার মধ্যে একটা কাগজে লেখা, ‘কোকিলস্যারকে উপহার’। নিশ্চয়ই স্কুলের বিচ্ছু ছেলেদের কাণ্ড। তোর জামাইবাবু খুব ভেঙে পড়েছে।”
হাসিখুশি ফুর্তিবাজ কল্যাণও ভিতরে ভিতরে খানিকটা ভেঙে পড়েছে। তিন-তিনটে ডাক্তার ফেল করা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সেটা দিদির কাছে প্রকাশ করা চলবে না, তাতে দিদি আরও দুঃখ পাবে। তাই সে জোর করে হেসে বলল, “খাচা তো ভাল দিদি, এরপর দেখবি, কাকের বাসা বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। কোকিল বলে কাকের বাসা।”
ভাইয়ের ঠাট্টা শুনে মনটা একটু হালকা হল নমিতাদেবীর। মুখে যদিও বললেন, “চড় খাবি। মানুষটা মন খারাপ করে রয়েছে, আর তুই ফাজিলের মতো কথা বলছিস? লজ্জা করছে না?”
“করছে দিদি, খুবই লজ্জা করছে! জামাইবাবু অমন চমৎকার ডাক ডাকছেন, অথচ আমাকে দ্যাখ, শিসটা পর্যন্ত দিতে পারি না। লোকে শুনলে ছি ছি করবে। বলবে, এমন জামাইবাবুর কী শ্যালক?”
নমিতাদেবী হেসে বললেন, “এবার কিন্তু সত্যি সত্যি মার খাবি?”
ফোনের ওপাশ থেকে কল্যাণ গলা নামিয়ে বলল, “এবার একটা কাজের কথা শোনো, একটু আগে সেই পক্ষীবিশারদ আমাকে মোবাইলে ধরেছিলেন। কাজ কিছু না পারলেও, দেখলাম, লোকটির পাখিটাখি নিয়ে নলেজ আছে। বললেন, ‘আপনার জামাইবাবুর কোকিলের ডাকটা টেপ করে পাঠান।’ উনি সিঙ্গাপুর না কোথাকার জু-তে ক্যাসেটটা পাঠিয়ে দিবেন। সেখানে খুব বড় বার্ড স্যাংচুয়ারি আছে। বার্ড স্যাংচুয়ারি কি জানিস তো? পক্ষীরালয়।”
নমিতাদেবী আর্তনাদ করে উঠলেন, “জু! মানে চিড়িয়াখানা? তোরা মানুষটাকে চিড়িয়াখানায় পাঠাতে চাইছিস?”
“অসুবিধে কী দিদি? কোনও অসুবিধে নেই। আগে ধর, শুধু ডাকাডাকির ক্যাসেটটা গেল, তারপর জামাইবাবু নিজে গিয়ে ক’টা দিন কাটিয়ে এলেন। জায়গা খারাপ হবে না, খোলামেলাই হবে। পাখিডাক্তার বললেন, ওঁর চেনাজানা আছে।”
নমিতাদেবী দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “থামবি? নাকি ফোন কেটে দেব?”
কল্যাণ বলল, “আচ্ছা থামছি, তুই একটা সিরিয়াস কথা শোন! জামাইবাবুর স্কুল থেকে একটা লম্বা ছুটি নিয়ে নে! তারপর আমার এখানে এসে ক’টা দিন দুজনে মিলে থাক। কাঞ্চনগড় থেকে কিছুদিনের জন্য জামাইবাবুর চলে আসা দরকার। একটা চেঞ্জ হলে শরীরটা ঠিক হয়েও যেতে পারে।আগেরকার দিনে হাওয়াবদল ছিল না?”
এই কথাটা নমিতাদেবীর মনে ধরেছে। তা ছাড়া কলকাতায় থাকলে আরও চিকিৎসার কথা ভাবা যাবে। এই কারণেই ছুটির দরখাস্ত।
নমিতাদেবী শশাঙ্কশেখর ধরকে বললেন, “আসুন আসুন মাস্টারমশাই, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আপনি না এলে আমি নিজেই স্কুলে আপনার কাছে যেতাম।”
জানলার পাশে একটা ইজিচেয়ার নিয়ে বসে আছেন সুশীলবাবু। তাকিয়ে আছে বাইরে। এই জানলাটা কত বছর ধরেই তো দেখছেন, কিন্তু এটা দিয়ে এতখানি আকাশ দেখা যায়, সেটা তাঁর জানা ছিল না। আজ আকাশটা যেন একটু বেশি নীল। নাকি সব সময় এরকমই থাকে? কে জানে। কতদিন যে আকাশের দিকে তাকানো হয় না! ঝাপসা জামরুলগাছটা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জানলার উপর। পাতায় দুপুরের রোদ পড়ে চকচক করছে। যেন তারা কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের অঙ্কস্যারের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে! সুশীলবাবু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাঃ, ভারী সুন্দর তো! হঠাৎ একটু হাওয়া দিতে কোথা থেকে একটা সবুজ পাতা উড়ে এসে সুশীলবাবুর পায়ের কাছে পড়ল। কোনও কারণ নেই, সুশীলবাবু তবু নিচু হয়ে যত্ন করে পাতাটা কুড়োলেন।
সুশীলবাবু বুঝতে পারছেন, ভিতরে ভিতরে একটা অন্য জিনিস শুরু হয়েছে। পাখির ডাকের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পর থেকে বাইরের ছটফটে ভাবটা যেন কমে যাচ্ছে। শান্ত লাগছে অঙ্কের মতো জটিল বিষয়ের বদলে ছোটখাটো, সহজ জিনিস ভাল লেগে যাচ্ছে। সেদিন যেমন ক্যালুকলাস নিয়ে বসেও খাতা সরিয়ে টিভিতে অনেক রাত পর্যন্ত সিংহশাবকদের খেলাধুলো দেখলেন। কাল ‘থিওরি অফ প্রবালিটি” বইটার বদলে কল্যাণের এনে দেওয়া ‘ডাকাতের গল্প’ অনেক বেসি ইন্টারেস্টিং মনে হল। কল্যাণের জন্যও খারাপ লাগছে। যতই ফাজিল হোক, ছেলেটা তো তাঁর জন্য কম দৌড়াদৌড়ি করছে না। এটাও একটা অন্যরকম ঘটনা। সুশীলবাবু নিজেও জানেন, কল্যাণের জন্য মনখারাপ করার মতো দুর্বল মানুষ তিনি নন। স্ত্রীকে বললে বিশ্বাস করবে না, আর কল্যাণ শুনলে তো হেসে গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ঘটনা সত্যি। মন অন্য দিকেও দুর্বল হচ্ছে। মন দুর্বল না হলে তাঁর মতো একজন জাঁদরেল শিক্ষক এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন? পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাতা কুড়িয়ে নেন। পাখির ডাকের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই তো? থাকতে পারে। পাখির কি মন আছে? সেই মন কেমন? দুর্বল? ডাকের পর তিনি কি পাখির মতো মনও পেয়ে বসছেন? সেটা তো আর একটা ভয়ংকর ব্যাপার হবে। পক্ষীবিশারদকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয় না? ওঁর ফোন নম্বরটা কল্যাণের কাছে আছে নিশ্চয়ই।
ঘরে নমিতাদেবী ঢুকলেন। সুশীল পাত্র নড়েচড়ে বসলেন। গলায় মাফলার ঠিক করলেন, “দ্যাখো, তোমাকে দেখতে কে এসেছেন।”
সুশীলবাবু মুখ তুলে শশাঙ্কশেখর ধরকে দেখতে পেলেন।
শশাঙ্কশেখরবাবুর মুখ নার্ভাস। নার্ভাস হওয়ারই কথা। একটু আগে নমিতাদেবী তাঁকে কোকিলের ঘটনা জানিয়েছেন। নবলাল, অর্ক যা বলেছে সেই একই ঘটনা। তবে তিনি বিশ্বাস করেননি। অসম্ভব, হতেই পারে না। এরা অবশ্যই কোনও ভুল করছে। পৃথিবীতে একসঙ্গে অনেকে মিলে ভুল শোনা, ভুল দেখার অজস্র উদাহরণ আছে। মাস হিস্টিরিয়ার ঘটনা তো আকছার শোনা যায়। একজন ভূত দেখলে নাকি অনেকে দ্যাখে! এটাও হয়তো সেরকম। অন্যের বিশ্বাস নিজের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। এর থেকে বাঁচার একটাই উপায়, কোকিল নিয়ে কোনরকম উৎসাহ না দেখানো। শশাঙ্কশেখরবাবু নিজের মনকে শক্ত করলেন।
ঘরে ঢোকার সময় শশাঙ্কশেখরবাবু ভেবেছিলেন, মানুষটি বিরক্ত হবেন। সুশীলবাবু তা তো হলেনই না, উলটে হাসিমুখে চেয়ার এগিয়ে দিলেন। শশাঙ্কশেখরবাবু দেখলেন, কোকিলের ডাক মিছে হতে পারে, কিন্তু মানুষটির আচরণ বদলে যাওয়ার যে কথা নমিতাদেবী একটু আগে তাঁকে বলেছেন, সেটা সত্যি। সেই হম্বিতম্বি, ছটফটে ভাবটা কই? এই ক’টা দিনেই রাগি মানুষটি যেন অনেকটা নরম হয়ে গিয়েছেন। এটা একটা আশ্চর্যের ঘটনা। তবে বড় আশ্চর্যের কথা হল, অঙ্কস্যারের পাশে যে বইটা পড়ে আছে, সেটা। কোনও পাটিগণিত, বীজগণিত নয়, বইয়ের নাম ‘আবোল তাবোল’। লেখকের নাম সুকুমার রায়।
সুশীল পাত্র ‘আবোল তাবোল’ পড়ছেন? বাপ রে!
শশাঙ্কশেখরবাবুর মনে কথা সম্ভবত বুঝতে পারলেন অঙ্কস্যার। লাজুক হেসে সামনের কাগজ টেনে লিখলেন, ‘কাল বাড়ি ফেরার সময় বইটা কিনলাম।’
শশাঙ্কশেখরবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, “ভাল করেছেন!”
সুশীলবাবু লিখলেন, ‘ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, তারপর আবার এই পড়ছি চমৎকার লাগছে। এই বই বৃদ্ধ বয়সেও পড়া উচিত। আপনিও পড়বেন।’
শশাঙ্কশেখরবাবু থতমত খেয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই পড়ব।”
সুশীলবাবু পাতা উলটে লিখলেন, ‘আপনি আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি।’
শশাঙ্কশেখরবাবু গলা নামিয়ে বললেন, “আপনাকে না বলে একটা কাজ করেছি সুশীলবাবু। করাটা ঠিক হয়নি, কিন্তু ক্লাস এইটের ছেলেরা খুব কান্নাকাটি করছিল বলে, করতে বাধ্য হয়েছি।’
সুশীলবাবু অবাক হয়ে খাতার বদলে এবার স্লেট টেনে লিখলেন, ‘কান্নাকাটি! কেন?’
হেডমাস্টারমশাই আমতা আমতা করে বললেন, “অঙ্কে ফেল করেছে, তাই! শুধু ফেল নয়, একেবারে যা-তা রকমের ফেল। আপনি তো জানেনই, নিজেই তো খাতা দেখেছেন, দুই, তিন, চার করে নম্বর পেয়েছে সবাই। এত কম নম্বর পাওয়া খুবই অপমানের বিষয়। সেই অপমানের কারণেই কাঁদছিল। আজ আমি এই অঙ্কপরীক্ষা বাতিল বলে ঘোষণা করে দিয়েছি। বলেছি, আমাদের অঙ্কস্যার সুস্থ হয়ে ফিরলে তিনিই আবার পরীক্ষা নেবেন। নতুন প্রশ্নপত্র তৈরি হবে। কাজটা আপনাকে জানিয়েই করা উচিত ছিল। কিন্তু আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ওদিকে ছেলেরা খুবই মনোকষ্টে ছিল। শুনেছি, অনেকে নাকি রাতে অঙ্ক নিয়ে দুঃস্বপ্ন পর্যন্ত দেখেছে। তাদের নম্বর তাড়া করে আসছে। আমাকে মাপ করবেন সুশীলবাবু!”
শশাঙ্কশেখরবাবু থামলেন। সুশীল পাত্র কী করবেন? কতটা রাগ দেখাবেন? প্রধানশিক্ষককে কতটা রাগ দেখানো যায়? বিশেষ করে তিনি যদি বাড়ি পর্যন্ত এসে ক্ষমা চান?
উলটো দিকে সুশীল পাত্র বসে রইলেন চুপ করে মাথা নামিয়ে। সত্যি তো, এই দুঃখ, অপমানের কথাটা তো মাথায় আসেনি! কঠিন অঙ্ক বানিয়ে ছেলেপুলেদের প্যাঁচে ফেলা যায় তিনি জানতেন, কিন্তু দুঃখেও ফেলা যায় নাকি? ছি ছি! এটা তিনি কী করেছেন এতদিন? মোটেই ভাল কাজ করেননি। অন্যায় হয়েছে। জোর করে বিচ্ছিরি নম্বর দেওয়া আসলে যে একরকম অপমানই করা, এটা বুঝতে এত বছর লেগে গেল? ইস! সুশীলবাবু বুঝতে পারলেন, তাঁর খারাপ লাগছে। ছাত্ররা অঙ্ক না পারলে যে মানুষটি এতদিন খুশি হতেন, আজ তাদের কান্নার কথা শুনে খারাপ লাগছে।
আরও খানিকক্ষণ মাথা নামিয়ে বসে থাকার পর সুশীলবাবু শান্ত ভঙ্গিতে স্লেটে লিখলেন, ‘ঠিক করেছেন, ধন্যবাদ!’
রাগারাগির বদলে ধন্যবাদ-এ শশাঙ্কশেখরবাবু যেমন আশ্চর্য হলেন, তেমন খুশিও হলেন। আচ্ছা, মানুষটি কি জানেন যে, ওঁর স্ত্রী তাঁকে পাখির ঘটনা জানিয়ে দিয়েছেন? যদি না জানেন তা হলেও সবচেয়ে ভাল হয়। বেচারি মিছিমিছি একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়বেন। যে অসুখ সত্যি নয়, যে অসুখ মনের মধ্যে মিথ্যে বাসা বেঁধেছে, তাই নিয়ে অস্বস্তি। তিনি বললেন, “সুশীলবাবু, ছুটি নিয়ে ভাববেন না, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। আপনি নিশ্চিন্তে ক’টা দিন বিশ্রাম নিন। তবে শনিবার একবার স্কুলে যেতে হবে। স্কুলে ইনস্পেক্টর আসবেন। আজই চিঠি পেলাম। বোঝেনই তো, এঁরা আবার সবাইকে না দেখলে রাগারাগি করেন। তবে চিন্তার কিছু নেই, আমি আপনার শরীরের কথা বলে রাখব। মনে হয় না, তারপরেও উনি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন।” কথা শেষ করে শশাঙ্কশেখরবাবু উঠে দাঁড়ালেন, “এবার যেতে হবে।”
অঙ্কস্যার লিখলেন, ‘আবার আসবেন’। একা-একা বন্দি হয়ে আছি, মনে হয় শাস্তি পেয়েছি।’
শশাঙ্কশেখরবাবু ঝুঁকে পড়ে সুশীলবাবুর একটা হাত ধরে বললেন, “বন্দি কেন? বিশ্রাম নিচ্ছেন বলুন! সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কেউ আসে না আপনাকে ভয় পায় বলে।”
কথা শেষ করে আবার একটু হাসলেন শশাঙ্কশেখরবাবু। ডাকসাইটে, বজমেজাজি মানুষটির জন্য এখন কেমন যেন মায়া হচ্ছে তাঁর! কেন হচ্ছে? মানুষটির মধ্যে একটা বদল দেখছেন বলে?
সুশীলবাবুও মৃদু হাসলেন। লিখলেন, ‘ভয় নয়, অপছন্দ।’
শশাঙ্কশেখরবাবু বললেন, “আপনি এসব ভাববেন না, শনিবার স্কুলে চলে আসুন। আর হ্যাঁ, গলার মাফলারটা নিতে ভুলবেন না যেন! ইনস্পেক্টর ভদ্রলোক শুনেছি একজন ঝামেলার মানুষ। গোলমেলে খবর পেলে তবে স্কুলপরিদর্শনে আসেন। কোন খবর পেয়ে যে উনি কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুল বাছলেন কে জানে?”
সুশীলবাবু এসব কথা যেন শুনতে পেলেন না। দ্রুত হাতে লিখলেন, ‘আচ্ছা শশাঙ্কবাবু, বলুন তো কোকিলের ডাক শুনলে মন কি শান্ত হয়? শুকনো, কঠিন ভাবটা কাটে?’
চমকে উঠলেন শশাঙ্কশেখরবাবু। এই রে, আবার সেই কোকিল? না,মানুষটি কোকিল থেকে বেরোতে পারছেন না মনে হয়। যাই হোক, কোকিলের ডাক বিষয়ে একটা ভাল সার্টিফিকেট দেওয়া দরকার মনে হচ্ছে। তিনি ঢোক গিলে, ঠোঁটে অল্প হাসি এনে বললেন, “দেখুন সুশীলবাবু, আজকাল সেভাবে তো আর পাখির ডাক শোনা হয় না। বয়স হয়েছে, কাজকর্ম বেড়েছে, বসে-বসে পাখির ডাক শোনবার সময় কোথায়? তবে নির্জন বিকেলে কাজকর্মের ফাঁকে হঠাৎ করে যদি এক-আধটা কোকিল ডেকে ওঠে, মন্দ কী? মন শান্ত হয় কি না জানি না মশাই, তবে বেশ ফুরফুরে লাগে। চমৎকার লাগে মনে হয়…।”
এতক্ষণ পরে সুশীলবাবু না লিখে মুখ খুললেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন, “কী মনে হয়?”
শশাঙ্কশেখরবাবু যেন সামান্য লজ্জা পেলেন। বললেন, “মনে হয়, কাজকর্ম ফেলে দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে শুনে যাই। আপনার মনে হয় না?”
সুশীলবাবু এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি খোলা জানলা দিয়ে তাকালেন বাইরে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। একদিন ডাক বুঝতে তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতির ডাকই শুধু বুঝেছেন। তাদের ডাকে সাড়াও দিয়েছেন। এমনকী, না ডাকতেও ছুটে গিয়েছেন। বই, খাতা, পেন, পেনসিল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। মন দিয়ে শোনা তো দূরের কথা, পাখির ডাক বলে যে আলাদা একটা কিছু দুনিয়ায় আছে, সেই ডাক শোনার জন্য মানুষ যে থমকে দাঁড়াতে পারে, এমনটাই তাঁর মাথায় আসেনি কখনও! শশাঙ্কশেখরবাবুর কথা শুনে তিনি চমকে উঠলেন। পাখিরডাক শুনতে ইচ্ছে করে! বাঃ সুন্দর তো! কই, তাঁর কথা শোনবার জন্য তো কারও কখনও ইচ্ছে হয় না! এতদিন এসব খেয়াল হয়নি। আজ হচ্ছে! কেন হচ্ছে? গলায় পাখির ডাক এসেছে বলে? আচ্ছা, তাঁর গলার কোকিলের ডাক শোনার জন্যও কি মানুষ থমকে দাড়াবে?
হেডমাস্টারমশাই চলে যাওয়ার একটু পরেই সুশীলবাবু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। শান্ত মাথা এবং নরম মনে নেওয়া হলেও সেই সিদ্ধান্ত সাংঘাতিক।
তিনি ঠিক করলেন, আর ডাক্তার-বদ্যি নয়। এমনকী, দুশ্চিন্তাও বন্ধ! গলার কোকিল-অসুখের যা খুশি হোক, মনের কোকিল-অসুখ তিনি সারাবেন না। অসুখ সারানোর ওষুধ জানা না থাকলেও, অসুখ রাখবার উপায় তিনি এই ক’দিনে বুঝে গিয়েছেন। টেবিল থেকে ঘণ্টা তুলে জোরে জোরে বাজাতে লাগলেন সুশীলবাবু। নমিতাদেবী ছুটে এলেন, “কী হল আবার?”
সুশীলবাবু এক গাল হেসে, মাফলারটা গলা থেকে খুলে ছুড়ে ফেললেন খাটের উপর। বললেন, “কিছু হয়নি। আমি কাল থেকে স্কুলে যাব। কুহু-কুহু, কুহু-কুহু… হ্যাঁ গো, ডাকটা ঠিকমতো শোনাচ্ছে তো?”
নমিতাদেবী ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বড় করে বললেন, “মানে?”
সুশীলবাবু ফিক করে হেসে বললেন, “মানে আবার কী? কিছুই নয়। তোমার দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করছে, কি না, সেটা বলো। কুহু- কুহু…।”
॥ ৮ ॥
স্কুলপরিদর্শক বলাই সাঁপুই একটা মারাত্মক কাজ করেছেন। কাজটা করে এখন প্রধানশিক্ষকের ঘরে বসে মিটিমিটি হাসছেন।
কাজটা হল, তিনি একদিন আগেই চলে এসেছেন। কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের প্রধানশিক্ষকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছে না। প্ল্যান ছিল, আজ স্কুল ছুটির পর ঝাড়পোঁছই শুরু হবে। গেটে ফুল দিয়ে সাজানো হবে। ফুলের অর্ডার হয়ে গিয়েছে। গাঁদাফুলের মালা। কাল খুব ভোরে সেই মালা আসছে। এমনকী, কলকাতা থেকে মিষ্টি এসে পৌঁছবে আজ রাতে। সব পরিকল্পনাই ভেঙে গেল! কেলেঙ্কারির এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। আজ দু’জন শিক্ষক কামাই করেছেন। জিওগ্রাফি আর ড্রয়িংটিচার। তারপর নাইন-বি আর সিক্স-এ’র ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতি ভাল নয়। সেভেনের কয়েকটা ছেলের জামা পর্যন্ত ইস্তিরি নেই। হতচ্ছাড়া নবলালটাও আজ জুতোর বদলে চটি পরে এসেছে। ছি ছি।
কী হবে শশাঙ্কশেখরবাবু কল্পনাও করতে পারছেন না। অত বড় মানুষটির মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। বলাই সাঁপুই ফিরে গিয়ে কাঞ্চনগড় বয়েজ স্কুলের নামে যে কী জঘন্য রিপোর্ট জমা করবেন তা বোঝাই যাচ্ছে।
সাঁপুইবাবু বসে আছেন শশাঙ্কশেখরবাবুর ঘরেই। এখন অন্যরা খবর পাননি। তাঁকে গরম চা দেওয়া হয়েছিল, তিনি খাননি। তার বদলে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত চেয়েছেন। স্কুলের বাগান থেকে লেবু পেড়ে এনে নবলাল শরবত করে দিয়েছে। বলাই সাঁপুই খুশি মনে সেই শরবত খাচ্ছেন এবং এখনও মিটিমিটি হাসছেন। যেন বলতে চাইছেন, হুট করে এসে পড়ে কেমন বিপদে ফেলেছি?
শরবত খাওয়া শেষ করে বললেন, “ভাল হয়েছে মাস্টারমশাই। আপনাদের বাগানের লেবুর স্বাদ খুবই উত্তম।”
শশাঙ্কশেখর ধর গদগদ গলায় বললেন, “ধন্যবাদ স্যার, আপনি যদি চান আর-এক গ্লাস শরবত খেতে পারেন।”
বলাই সাঁপুইকে দেখলে মনে হয় মজার মানুষ। চেহারা মোটার দিকে। গোঁফটাও বড়। সেই গোঁফে আলতো করে একটা হাসি ঝুলছে সব সময়। কে বলবে মানুষটি কড়া?
“না, আমি আর শরবত চাইছি না। আমার হাতে সময় খুবই কম। আজ আমি কাঞ্চনগড় স্কুলের দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। এঁদের সঙ্গে সামান্য কথা বলেই আমি চলে যেতে চাই।”
বুকটা ধক করে উঠল শশাঙ্কশেখর ধরের। কোন দু’জন? যাঁরা কামাই করেছেন তাঁরা নয় তো? তাঁরাই হবেন। বলাই সাঁপুই খবর না নিয়ে আসেন না। তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন, “কোন দু’জন স্যার? কাদের ডাকব?”
উত্তরে সাঁপুইবাবু যা বললেন তাতে শশাঙ্কশেখরবাবুর হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। এই দুই শিক্ষকের নাম নাকি পরিদর্শকবাবু জানেন না। তবে দু’জনের সম্পর্কেই খবর পেয়েছেন। একজনের কথা শুনেছেন স্কুল সিলেবাস কমিটির কর্তাদের কাছ থেকে। কাঞ্চনগড়ের এই শিক্ষক নাকি সিলেবাস কমিটির কাছে একটা গা ছমছমে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সেই প্রস্তাবের মোদ্দা কথা হল, এখনই উচিত, স্কুলে সব সাবজেক্ট তুলে দিয়ে শুধু অঙ্ক চালু করা! এই ভয়াবহ মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে চান পরিদর্শকমশাই। অন্যজনের খবর পেয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে, দিয়েছেন তাঁর এক ভাগনে। ভাগনে একজন গুণী মানুষ। পশুপাখির চিকিৎসায় বিশেষ নাম করেছেন। গোরু-ছাগলের জ্বরজারি সারিয়ে বিখ্যাত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সাঁপুইবাবু গর্বের সঙ্গে জানালেন, পাখির ট্রিটমেন্টে তাঁর ভাগনে একজন পথপ্রদর্শক। ডানাভাঙা পাখিকে তিন দিনে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কায়দা জানে। সেই পক্ষীবিশারদ ভাগনেই মামাকে কাল না পরশু খবর দিল, কাঞ্চনগড় স্কুলের এক মাস্টারমশাইয়ের গলায় কোকিল ঢুকেছে! জ্যান্ত কোকিল। সেই কোকিল ইচ্ছে হলেই ‘কু-কু’ করে ডাক দিচ্ছে। তিনি নাকি পক্ষীবিশারদের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। গলার কাঁটা তোলার মতো করে কোকিলটিকেও বের করতে চান। কিন্তু এখনই তা সম্ভব হয়নি।
এই কোকিলমাস্টারকেও একবার দেখতে চান বলাইবাবু। একজন শিক্ষক স্কুলে গলায় কোকিল নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন, আর তাঁর সঙ্গে স্কুলপরিদর্শক এসে দেখা করবেন না, এটা কখনও হতে পারে?
শশাঙ্কশেখরবাবু কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারছেন না। মহাবিপদ! ভীষণ কেলেঙ্কারি! দু’জনে তো একজন মানুষ। অঙ্কস্যার সুশীল পাত্র। সিলেবাস বদলের প্রস্তাবটা জানলেও, ভদ্রলোক যে সত্যি-সত্যি ওই জিনিস সিলেবাস কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেবেন, কে ভাবতে পেরেছিল? আর পক্ষীবিশারদদের কাছে যাওয়ার ঘটনা তো কিছুই জানেন না তিনি! সুশীলবাবু পাখির ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলেন নাকি? উফ! এখন কী হবে? সুখবর একটাই, অঙ্কস্যার কাল থেকে স্কুলে আসতে শুরু করেছেন। শুধু আসছেন না, একেবারে বাড়ি থেকে ক্লাস এইটের জন্য অঙ্কের প্রশ্নপত্র তৈরি করে এনেছিলেন! বাতিল হয়ে যাওয়া পরীক্ষার প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন দিয়ে কালই টিফিনের পর তিনটে ক্লাসের সময় নিয়ে পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে।
পরীক্ষা বাতিলের ঘটনা যে এতটা সহজভাবে উনি মেনে নেবেন শশাঙ্কশেখরবাবু ভাবতেও পারেননি। আজ সকালেই দেখে এসেছেন, ভদ্রলোক টিচার্সরুমে বসে মন দিয়ে খাতা দেখছেন। গলায় মাফলার। মুখে কথা নেই। শশাঙ্কশেখরবাবু পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “পরীক্ষা দু’দিন পরে নিলেই কিন্তু হত! আপনি ছুটিতে যাওয়ার আগে না হয় নিতেন। এত তাড়াহুড়োর কোন দরকার ছিল কি?”
পাশে রাখা নোটবইয়ে সুশীল পাত্র লিখলেন, ‘হ্যাঁ, দরকার ছিল। দয়া করে আপনি যদি এখন কথা না বলেন, আমি খুশি হব। আজই ছেলেদের নম্বর জানাতে হবে কিনা!’
স্কুলে এলেও অঙ্কস্যার এখনও মুখ কথা বলা শুরু করেননি। ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ড আর অন্য সময় নোটবই। নবলালকে ডাকছেন হাতছানি দিয়ে।
কিন্তু এই জাঁদরেল পরিদর্শকমশাই কি লিখে কথা মেনে নেবেন?
বলাই সাঁপুই ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হল? ওঁরা নেই? দু’জনেই অ্যাবসেন্ট নাকি? এ আপনার কেমন স্কুল মশাই? আপনি কেমন হেডমাস্টার? দেখলেন তো, কেন আগেই হুট করে চলে আসি? এটা আমার স্কুলপরিদর্শনের একটা কায়দা। সাঁপুই স্পেশ্যাল বলতে পারেন। কে কেমন কামাই করেন, ধরা যায়।”
শশাঙ্কশেখরবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “না, না, অ্যাবসেন্ট নন। তবে…।”
বলাই সাঁপুই এবার চাপা গলায় গরগর করে উঠলেন, “তবে কী? শশাঙ্কশেখরবাবু, আপনি কি আপনার ওই দুই শিক্ষককে আড়াল করতে চাইছেন? এটা করবেন না। সব সাবজেক্ট তুলে স্কুল যেমন অঙ্ক-আতঙ্ক তৈরির জায়গা নয়, তেমনই গলায় কোকিল ঢুকেছে বলে গল্প ছড়ানোর জায়গা নয়। আপনি দু’জনকেই খবর দিন, আমি আলাদা-আলাদা করে কথা বলব। দরকার হলে এঁদের দুজনের বিরুদ্ধেই আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
শশাঙ্কশেখরবাবু বুঝলেন, আর কিছু করার নেই। বেচারি সুশীলবাবু একটা বড় ঝামেলার মধ্যে পড়তে চলেছেন। ইস, ভদ্রলোক কেন যে এসব ঝামেলার মধ্যে জড়ালেন? রাগ আর বদমেজাজ নিয়ে নিজের মতো ছিলেন। সিলেবাস বদলের প্রস্তাব আর পাখির ডাকের গল্পটা কি না করলেই হত না?
শশাঙ্কশেখরবাবু এবার বলাই সাঁপুইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দু’জন কিন্তু একজনই মানুষ।”
এবার সাঁপুইবাবুর ঘাবড়ানোর পালা। অস্ফুট গলায় বললেন, “অ্যাঁ, একজন মানুষ?”
“হ্যাঁ, উনি আমাদের অঙ্কস্যার সুশীলবাবু। সুশীল পাত্র। দাঁড়ান, আমি ওঁকে খবর পাঠাচ্ছি। ভদ্রলোকের শরীরটা ভাল নয়, ক’দিন হল গলার অসুখে…।”
পরিদর্শকমশাই এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “থাক, ডাকতে হবে না। চলুন, আমরা নিজেরা গিয়ে দেখা করি। উনি এখন কোথায়?”
নবলাল ছুটে গিয়ে খবর আনল, অঙ্কস্যার তিনতলায়। ক্লাস এইটে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলাই সাঁপুই বললেন, “শুনেছি, আপনাদের ওই টিচারকে নাকি ছেলেরা খুবই ভয় পায়। শক্ত অঙ্ক দেওয়ায় উনি নাকি সিদ্ধহস্ত। ঘটনা কি সত্যি?”
শশাঙ্কশেখর ধর একটু চুপ করে থেকে বললেন, “হ্যাঁ, সত্যি।”
তিনতলায় পৌঁছতেই ক্লাস এইটের ঘর থেকে হইচই ভেসে এল। শশাঙ্কশেখরবাবু চমকে উঠলেন। সুশীলবাবুর ক্লাসে হইচই! টানাবারান্দা ধরে কয়েক পা এগোতেই বোঝা গেল, হইচইয়ের মধ্যে হাসি, হাততালি আর বেঞ্চ চাপড়ানো!
পরিদর্শকমশাই থমকে দাঁড়ালেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, “এসব কী হচ্ছে শশাঙ্কবাবু? কী হচ্ছে এসব? আপনার স্কুলে ছেলেরা কি পড়তে পড়তে ক্লাসে হাততালি দেয়? বেঞ্চ বাজায়?”
শশাঙ্কশেখরবাবু বিড়বিড় করে বললেন, “অবিশ্বাস্য, অঙ্কস্যারকে সবাই বাঘের চেয়েও বেশি ভয় করে। ছেলেপিলেরা টুঁ শব্দ করতে ভয় পায়। আজ কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না!”
রক্তচক্ষু করে সাঁপুইবাবু হুঙ্কার দিলেন, “কিচ্ছু বুঝতে হবে না। আমি আজই এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব। তার আগে আড়াল থেকে ঘটনাটা দেখতে চাই।”
ক্লাস এইটের কাছে পৌছে দু’জনে আড়াল থেকে যা দেখলেন তা সত্যি অবিশ্বাস্য! নিজের চেয়ারে হাসি-হাসি মুখে বসে আছেন সুশীল পাত্র। টেবিলের উপর পরীক্ষার খাতা। ছেলেরা এসে খাতা হাতে নিজের নম্বর চিৎকার করে সবাইকে জানাচ্ছে। বাকিরা খুশিতে হয় হাততালি দিচ্ছে, নয় টেবিল চাপড়াচ্ছে।
শুধু খুশি নয়, হাততালি না দিয়ে কোনও উপায় নেই। অঙ্কস্যারের নির্দেশ সেরকমই। তিনি পিছনের ব্ল্যাকবোর্ডে বড়-বড় করে লিখে দিয়েছেন, ‘আশির ঘরে নম্বর পেলে দু’বার হাততালি, নব্বইয়ের উপর নম্বর পেলে তিনবার টেবিল চাপড়ানো।’ নীচে সই করা ‘কোকিলস্যার’!
আশ্চর্যের কথা হল, দেখা যাচ্ছে, বাতিল হয়ে যাওয়া পরীক্ষা নতুন করে দিয়ে ক্লাস এইটের ছেলেরা কেউ আশি-নব্বইয়ের কম নম্বর পায়নি! প্রশ্ন এতই সোজা হয়েছে যে, একজন একশোয় একশো পর্যন্ত পেয়ে বসে আছে!
শশাঙ্কশেখরবাবু এগোতে যাচ্ছিলেন পরিদর্শকমশাই তাঁকে টেনে ধরে রাখলেন দরজার পিছনে। এরকম ঘটনা দেখা তো দূরের কথা, তিনি কখনও শোনেননি। চিরকাল বলাই সাঁপুই সব ক্লাসকে ঘাবড়ে দিয়েছেন, আজ কাঞ্চনগড় স্কুল তাঁকে ঘাবড়ে দিয়েছে। দারুণ! একমুখ হেসে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “দাঁড়ান হেডমাস্টারমশাই, শেষ পর্যন্ত দেখি। আচ্ছা, ওই বোর্ডে লেখা ‘কোকিলস্যার’ ব্যাপারটা কী? অঙ্কের কোনও বিষয়?”
শশাঙ্কশেখরবাবু গলা নামিয়ে বললেন, “অঙ্ক কি না বুঝতে পারছি না। তবে হাতের লেখাটা যে অঙ্কস্যারের সেটা চিনতে পারছি।”
খাতা বিতরণ হয়ে যাওয়ার পর সুশীল পাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাত তুলে ছাত্রদের শান্ত হতে বললেন। তারপর ঝরঝরে গলায় বলতে শুরু করলেন, “শোনো ছেলেরা, নতুন করে নেওয়া অঙ্ক পরীক্ষায় তোমাদের পারফরমেন্সে আমি খুবই খুশি। শুধু যে তোমরা বেশি নম্বর পেয়েছ বলে আমি খুশি হয়েছি এমন নয়। খুশি হয়েছি তোমাদের আনন্দ দেখে। সম্প্রতি একটি ঘটনায় আমি অনুভব করেছি, খাতায় নম্বর যেমন দরকার, তেমনই মনে আনন্দও দরকার। সেই কথা মাথায় রেখেই আমি নতুন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিলাম। সহজ প্রশ্ন তৈরিতে সময় লাগল। বুঝতে পারলাম, সহজ প্রশ্ন তৈরি করাটা অত সহজ কথা নয়। কাজটা বেশ কঠিন। ছেলেরা, দেরিতে হলেও কথাটা বুঝতে পেরেছি আমি। এটা কোনও লজ্জার কথা নয়! শুধু তোমাদের মতো ছোটরা নয়, অনেক কিছু বড়রাও পরে বুঝতে পারেন। মনে রাখবে, বুঝতে পারাটাই আসল।”
সব কথার অর্থ স্পষ্ট না হলেও ক্লাস এইটের ছেলেরা কিন্তু অঙ্কস্যারের মেজাজটা ধরতে পারল। কথার মাঝখানেই তারা ঝটাপট হাততালি দিয়ে উঠল। শশাঙ্কশেখরবাবু আড়াল থেকে দেখতে পেলেন, সত্যি-সত্যি আনন্দে ছেলেদের মুখ ঝলমল করছে! ভাগ্যিস এই ক্লাসরুম একটু দূরে, অন্যরা কিছু শুনতে পাচ্ছে না।
সুশীলবাবু আবার শুরু করলেন, “আমি ঠিক করেছি, এবার থেকে যে ছেলে অঙ্কপরীক্ষায় ফুলমার্কস পাবে, তাকে আমি পুরস্কার দেব। প্রথমে ভেবেছিলাম, জ্যামিতি বক্স দেব। সেই সিদ্ধান্ত বদল করেছি, এখন ঠিক করেছি, জ্যামিতি বক্সের বদলে বই দেব। আমার মনে হয়েছে, কবিতা, ছড়া, গল্প পড়ার জন্য তোমরা সকলেই এবার থেকে অঙ্কে ফুলমার্কস পাওয়ার চেষ্টা করবে। আমিও চেষ্টা করব, ফুলমার্কস দেওয়ার। কী, তোমরা রাজি তো?”
ক্লাসসুদ্ধ ছেলেরা হইহই করে উঠল, “রাজি স্যার, খুব রাজি!”
শশাঙ্কশেখরবাবু আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন, সাঁপুইমশাইয়ের চোখ কপালে উঠে গিয়েছে। পলক পড়ছে না। তাঁর নিজের অবস্থাও তো একই রকম। এসব কী ঘটছে? কী করছেন অঙ্কস্যার? সবচেয়ে বড় কথা, উনি কথা বলেছেন ! যে মানুষটি পাখির ডাক বেরিয়ে আসার ভয়ে গত কয়েকটা দিন একেবারে চুপ করে গিয়েছিলেন, সেই ডাক কোথায় গেল? কোকিলকণ্ঠ পালাল নাকি? নাকি মিথ্যে ভয়টাই পালিয়েছে?
হ্যাঁ পালিয়েছে, শশাঙ্কশেখরবাবু জানেন না। কেউই জানে না। খানিক আগে সুশীলবাবু নিজে শুধু বুঝতে জানতে পেরেছেন। যে অঙ্ক খাতা দেখতে দেখতে তাঁর গলায় কোকিলের ডাক এসেছিল, সেই খাতা দেখার সময়ই ডাকটা চলে গিয়েছে। পার্থক্য একটাই সেবার খাতার নম্বর ছিল খুব খারাপ। তিন, চার, পাঁচ। আর এবার আশির কমে নম্বরই নেই। আজও সেই সময় টিচার্সরুম ছিল ফাঁকা। খাতা দেখা শেষ করে অন্যমনস্কভাবে নবলালকে ডেকে ফেলেছিলেন সুশীলবাবু।
“নব, নবলাল, একবার এদিকে এসে খাতাগুলো ক্লাসে পৌঁছে দাও তো।”
কই, কোকিল কই! গলা তো পরিষ্কার! আগের মতো বাঁজখাই না হলেও, স্বাভাবিক!
সুশীলবাবু সোজা হয়ে বসলেন, আরও পরীক্ষা চাই। তবে এবার আর বাথরুমে গিয়ে নয়, নিজের চেয়ারে বসেই নিচু গলায় নামতা আওড়াতে শুরু করলেন তিনি। তেষট্টির মতো কঠিন নামতায় না গিয়ে তেরোর মতো সহজ নামতা আউড়েই পরীক্ষা চলল। একবার, দু’বার, তিনবার। না, নেই। সেই ডাক নেই! উত্তেজনায় সুশীলবাবু উঠে দাঁড়ালেন। গলা খুলে বললেন, “হাঁস ছিল, সজারু (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল ‘হাসজারু’ কেমনে তা জানি না।”
নবলাল ঘরে ঢুকে বলল, “কিছু বলছেন স্যার?”
সুশীলবাবু একগাল হেসে বললেন, “না, মাই ডিয়ার বয়। কিছু বলছিলাম না ছড়া কাটছিলাম।”
তারপর এক টানে গলার বদখত কুটকুটে মাফলারটা খুলে ছুড়ে দিলেন উপরে। সেই মাফলার ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে দিয়ে পড়ল অষ্টম আশ্চর্যের ছবিওলা ক্যালেন্ডারের উপর, পিরামিডের ছবির একপাশে।
নবলাল থ’!
সুশীলবাবু শান্ত গলায় ছাত্রদের বললেন, “এবার তোমাদের ছুটি। তার আগে একটা ছোট্ট জিনিস আমার জানার আছে। সেদিন তোমাদের মধ্যে কেউ একজন আমার বাড়ির সামনে একটা খাঁচা রেখে এসেছিলে। আমি জানি কাজটা কার। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করে তার নাম আমি বের করে ফেলেছি। তবু আমি চাই, সে নিজেই স্বীকার করুক। অন্যায় নিজে স্বীকার করার মধ্যে একটা আলাদা তৃপ্তি আছে।”
সবাই চুপ। ঘর নিঃশব্দ। দরজার আড়ালেও দু’টো মানুষ দমবন্ধ করে আছেন। যেন উইংসের পাশে লুকিয়ে মঞ্চের নাটক দেখছেন। শুধু মুখে হাসি সুশীলস্যারের।
এক মিনিট, দু’ মিনিট, তিন মিনিট। পিছনের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল হরবোলা অর্ক। ছলছলে চোখে বলল, “ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার। আর হবে না।”
সুশীলবাবু এবার হো হো শব্দে হেসে উঠলেন, বললেন, “ঠিক ধরেছিলাম, জানতাম এ কাণ্ড তোর, দূর বোকা, কাঁদছিলি কেন? একটু-আধটু দুষ্টুমি না করলে অঙ্কে আশি পেতে হত না, গতবারের মতো আড়াই নিয়ে খুশি থাকতে হত। তবে আমার বাড়ি যাওয়ার কথাটা ফাঁস করা তোমার ঠিক হয়নি। এর জন্য তোমায় শাস্তি পেতে হবে। রাজি তো?”
অর্ক চোখ মুছে হেসে বলল, “রাজি স্যার।”
হরবোলা অর্ক এর পর অঙ্কস্যারের আদেশে মুখে হাতচাপা দিয়ে ক্লাসের সকলকে কোকিলের ডাক ডেকে শোনাল, “কুহু, কুহু, কুহু..।”
ভারী সুন্দর সেই ডাক! অবিকল কোকিলের মতো! এক টানা, ঘনঘন।
সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল। এমনকী, দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা হেডমাস্টারমশাই শশাঙ্কশেখর ধর এবং ডাকসাইটে স্কুলপরিদর্শক বলাই সাঁপুই পর্যন্ত !
Leave a Reply