কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য
অষ্টম সংস্করণ ফেব্রুয়ারী ২০১৩
প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০০৩
.
নবারুণের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন বহরমপুরে। বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান।
কলকাতায় স্কুল কলেজে পড়াশুনা। প্রথমে ভূতত্ব ও পরে ইংরেজি।
১৯৭৩-১৯৯১ বিদেশী সংবাদ সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি। নানা সময়ে নানা বিষয়ে পত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণ প্রজাতন্ত্রী চীন ও জাপান সফর করেছেন। বর্তমানে সর্বভারতীয় সাহিত্যের বাংলা পত্রিকা ‘ভাষাবন্ধন’-এর প্রধান সম্পাদক। বিবাহিত। স্ত্রী প্রণতি অধ্যাপনা করতেন। একমাত্র পুত্র তথাগত সাংবাদিক।
প্রকাশিত বই : এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (কবিতা) , হালাল ঝাণ্ডা (গল্প সংকলন), পুলিশ করে মানুষ শিকার (কবিতা) , হারবার্ট (উপন্যাস) , যুদ্ধ-পরিস্থিতি (উপন্যাস), খেলনা নগর (উপন্যাস) , অন্ধ বেড়াল (গল্প সংকলন)
নবারুণ ভট্টাচার্যের ছোট গল্প ।
‘হারবার্ট’- নরসিংহ দাস , বঙ্কিম ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত।
.
‘পাণ্ডুলিপিরা পুড়ে যায়না ‘
মিখাইল বুলগাকভ
.
১
কাতার দিয়ে কাটা মুন্ডু আদি গঙ্গার পাড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। অর্থাৎ রাতে ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। বস্তা করে মুন্ডুগুলো ডাঁই করে রেখে সটকেছে? ধড়গুলোর তাহলে কী হল? কুপিয়ে কাটা না পোঁচ দিয়ে দিয়ে? মুন্ডুগুলো কি ব্যাটাছেলের না ফিমেল? এরকমই ছিল একটি ভাষ্য। অপরটি হল সাইক্লোনজনিত ঘোলাটে আকাশের তলায় খলবলিয়ে মাথার খুলি নাচছে। আগে অনেকগুলো নাচছিল। কিন্তু যেই পুলিশ এল অমনি বাকিগুলো ভ্যানিশ হয়ে মাত্র তিনটে রইল। আর পুলিশ যখন ভাবছে পা বাড়াবে কি বাড়াবে না, নতুন কোনো কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ার মন্দ-ভালো সাত-পাঁচ ঠিক সেই সময় ওই তিনটে খুলিও মুচকি হেসে উদ্বেল জোয়ারে লোপাট হয়ে গেল। পাবলিক এই সূত্র ধরে উবু হয়ে বসেছিল কিন্তু সন্ধেবেলায় বেসরকারি একটি বাংলা চ্যানেলের সংবাদে দেখা গেল লম্বামুখো এক পুলিশ অফিসার বলছে যে ওই খুলিগুলো শিরিটির শ্মশান থেকে এসেছিল। এক জোয়ারে এসেছিল, পরের জোয়ারে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পুলিশেরই অন্য একটি মহলের মতে তথাকথিত ওই ‘ডান্সিং স্কালস’ শিরিটির মাল নয়, ক্যাওড়াতলার। জোয়ারের টানে পলিব্যাগ, হাওয়াই চটি, কলার খোলা, ফুল ইত্যাদি ইন্যানিমেট অবজেক্টের সঙ্গে ডাউন সাউথ মহাবীরতলায় চলে গিয়েছিল।
মনে হয় এই বিচিত্র ও বিশিষ্ট ঘটনাটি সম্বন্ধে পাবলিক বা পুলিশ যা-ই ভাবুক না কেন আমাদের উচিত হবে একটি স্বতন্ত্র অবস্থানই গ্রহণ করা বা যে কোনো অবস্থানই পরিহার করে চলা। ঘটনাটি ঘটেছিল ২৮ অক্টোবর ১৯৯৯ – শুধু তারিখটা মনে রাখতে হবে। আগে থেকে সব জেনে যারা ঘটনা এলে সেই পরিচিত হাসিটি হাসে তাদের গেঁড়ে মদনা না বলার কোনো কারণ আছে কি? অগণিত করোটি শোভিত এই শতাব্দীর শেষ লগ্নে কী ভেবেছিলেন আপনারা? বুলবুলিপাখি ডিগবাজি খাবে? পাড়ায় পাড়ায় নহবৎ বসবে? সাধনার যে স্তরে ইলবিলা ইড়বিড়া ভেদাভেদ ঘুচে গিয়ে বিশুদ্ধ সত্বপ্রধান অজ্ঞানোপহিত চৈতন্যের আভা দেখা যায় বাঙালি তার ধারে কাছেও নেই। অতএব কেঁদে ককিয়ে লাভ তো হবেই না, উপরন্তু বিপদ বাড়বে। জাতির এরকমই এক মহাসংকট কালে শ্রী কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ (১৮৬১-১৯০৭) হিন্দি ভাষায় একটি গান লিখেছিলেন, যেটি ১৯০৬ সালে কলকাতার কংগ্রেস সম্মেলনে সগৌরবে গাওয়া হয়েছিল-
ভেইয়া দেশকা এ কেয়া হাল।
খাক মিট্টি জহর হোতি সব, জহর হোই জঞ্জাল।
হিন্দি গান শুনলেই সকলেই ভাবে সিনেমার গান। এ গান সে গান নয়। শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কালীপ্রসন্ন সম্বন্ধে আরও জানিয়েছেন। ‘স্বদেশী সভায় তিনি একটি নূতনত্বের আমদানি করেন; উহা – সভার সূচনায় ও শেষে স্বদেশপ্রেমোদ্দীপক সঙ্গীতের আয়োজন। নিজে সুগায়ক না হইলেও সঙ্গীত রচনায় তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা ছিল। স্বদেশী সভায় যোগদানকালে তিনি দুইজন বেতনভোগী সুকন্ঠ গায়ককে সঙ্গে রাখিতেন…’। ঠিক এরকম না হলেও কাছাকাছি কোনো সুরে মন বেঁধে আমাদের করোটি নৃত্যের ব্যাপারটি ভাবতে হবে। তবে যদি কিছু হয়। আপাতত এটুকুই আয়ত্তে থাকলে যথেষ্ট যে, খুলি-ডান্সের অনুষ্ঠানটি আরও বড়, অভাবনীয়রকমের বড় এক প্রকাণ্ড কাণ্ডের ইঙ্গিত।
এই বার আমরা অবলীলায় চার দিন পেছিয়ে যেয়ে ২৪ অক্টোবর, ১৯৯৯-এর আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় চতুর্থ পৃষ্ঠা অর্থাৎ ১২ নং পাতার নিম্নার্ধে মনোনিবেশ করব। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, এরকম আমরা অবশপাঠক হিসেবে করেই থাকি যেহেতু এইটুকু বুদ্ধি আমাদের হয়েছে যে, পিছিয়ে পড়ার চাইতে পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়াও ভাল। কর্মখালির পাঁচটি কলামের মধ্যে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়টিতে একটি বিজ্ঞাপন রয়েছে যার বয়ান,
দেশ বিদেশ ভ্রমণ
২৭ বৎসর সম্মানিত বিশ্ববিখ্যাত যাদুকর আনন্দ-র সাংস্কৃতিক দলের জন্য আকর্ষক সুন্দর তরুণ, তরুণী, কী বোর্ড প্লেয়ার, ড্রামার, বেঁটেমানুষ, অনুভবি ছুতোর মিস্ত্রি লাইসেন্সড পারসন, ম্যানেজার এবং ইলেকট্রিসিয়ান চাই। আকর্ষণীয় বেতন, শিক্ষা, আসা-যাওয়া, খাওয়া-থাকা, মেডিক্যাল সুবিধা। তিনদিনের মধ্যে যোগাযোগ করুন। সময় : সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঠিকানা : যাদুঘর আনন্দ, C/o ম্যাজেস্টিক হোটেল, রুম নং ২০৭, ৪সি ম্যাডান স্ট্রিট, কলি-৭২ (নিউ সিনেমার পাশে)।
প্রথমেই আমরা এই ভেবে সচকিত হই যে, ভোজবাজির চেয়েও রহস্যমণ্ডিত এই কাকতালীয় কাণ্ড। ২৪ তারিখের পর থেকে যোগাযোগের তিনদিন ধরলে ২৫, ২৬ ও ২৭ গেল- চতুর্থ দিবসেই খুলির নৃত্যানুষ্ঠান! ম্যাজিকের কি এই তবে শুরু? আমরা জানি যে, পুলিশ আমাদের আবেদনে কর্ণপাত করবে না; কিন্তু ব্যাপারটি কি যথেষ্ট রহস্যঘন নয়? এ বিষয়ে পুলিশের চেয়ে রসবেত্তা আর কে হতে পারে? এরপরেই সন্দিগ্ধ মনে যে ফ্যাকড়া ক্রমেই আস্তানা গাড়ে তা হল নামের এই মিল অর্থাৎ যাদুকর আনন্দ ও আনন্দবাজার পত্রিকা – আনন্দের ভেতরে আনন্দ- একি নিছকই ভবেশ্বরের খেলা না পিশাচসিদ্ধ হেঁয়ালি না ঘোমটাপরা ওই ছায়ার মায়াময় হাতছানি? তবে আমাদের মনের এই ফ্যাকড়াকে কেউ যেন আনন্দবাজার পত্রিকার মতো সুমহান প্রতিষ্ঠানের পেছনে কাঠি করার অপচেষ্টা বলে না ভাবেন। দুইহাতে সংবাদ ও সাহিত্যের মন্দিরা যে প্রতিষ্ঠান নিয়তই বাজিয়ে চলেছে তার পোঙায় লাগতে যাওয়া মোটেই ফলপ্রসূ হতে পারে না। উল্টে হুলো হয়ে যেতে পারে।
এই হুলো কী বস্তু তার একটি টিপিকাল কেস হল মিঃ বি কে. দাস এর জীবন। ঘটনাটি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে কোনোমতেই জড়িত নয়। মিঃ দাস ইংরেজি ভাষায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের উপন্যাস লিখতেন। মাত্র দুটিই তিনি লিখেছিলেন – ‘দ্যা মিসচিভাস ইংলিশম্যান’ এবং ‘অ্যান অ্যাফেয়ার উইথ অ্যালিগেটরস’। তখন কলকাতার নামী ইংরেজি দৈনিক ছিল ‘দ্যা ডেইলি প্লেজার’ – সেখানে গ্রন্থ সমালোচনার পাতা দেখতেন মিঃ প্যান্টো এবং ওই পাতাতেই ‘লিটেরারি স্নিপেটস’ লিখতেন মিঃ পি.বি.। মিঃ বি.কে. দাস বার বার তাঁর নিজের খরচে বার করা দুখানি চটি নভেল নিয়ে উপরোক্ত পত্রিকার দরজায় কত কড়া নেড়েছেন তা গোনা যায় না। রিসেপশনে একটা গুঁফো গুন্ডা বসত। তার নাম মিঃ শান্টু। এর নামে মার্ডার কেস ছিল বলেও জনশ্রুতি ছিল। এর কাজ ছিল লোক তাড়ানো। মিঃ বি.কে. দাস চার চারবার মিঃ শান্টু-র কাছে মিঃ প্যান্টো ও মিঃ পি.বি.-র জন্য দুখানি করে বই রেখে এসেছিলেন। প্রতিবারই নক্সাদার বিলেতি মার্বেল কাগজের মোড়কে লাল রিবনে বাঁধা অবস্থায়। মোট আট প্যাকেট ‘দ্যা মিসচিভাস ইংলিশম্যান’ ও ‘অ্যান আফেয়ার উইথ অ্যালিগেটরস’ জলে গেল। কী হয়েছিল জানা যায়নি। অনুমান করা যায় যে মিঃ প্যান্টো ও মিঃ পি.বি. ওই দুটি উপন্যাস ফেলে দিয়েছিলেন। অথবা ফেলে দেবেনই এরকম অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা থেকে মিঃ শান্টু রিভিউ সেকশনে বইগুলো পাঠায়নি। এবং মার্বেল পেপারের মোড়ক দিয়ে নিজের সংগ্রহের পর্নোগ্রাফির ফটো বইগুলোর মলাট দিয়েছিল এবং বইগুলো ওজনে ঝেড়ে দিয়েছিল – এমন হতেই বা বাধা কোথায়? কিন্তু মিঃ বি.কে. দাস ফঙ্গবেনে ধাঁচের ছিলেন না, যেমন মোটা ঘাড় তেমন ছিল তাঁর নলেজ ও রোখ। তিনি লেখা ছেড়ে দিয়ে আসামের জঙ্গলে ময়াল সাপের ভয়াল জগতে পাড়ি দিলেন- ময়ালের বাচ্চা ধরে এনে নানা চিড়িয়াখানায় সাপ্লাই দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। এবং এই কাজ করতে করতেই তিনি ফৌৎ হন। ভালুকের ছানা টুপিতে ভরে আনবার সময় সহসা, দুর্ভাগ্যবশত, সেই ছানাটির অভিভাবকরা এসে পড়েছিল। ভালুক শাবক সম্পর্কিত এই নির্মম অথচ যুক্তিসঙ্গত ঘটনাটি ঘটার মাত্র সাত দিন আগে কটকে পোয়েট-ফ্রেন্ড জি.এস. রায়কে তিনি বাংলায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। যা পরে উইতে খেয়ে নেয়। এই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘ মিঃ প্যান্টো-র প্যান্টোমাইম আর টলারেট করা যায় না। রিভিউ যদি নাও হয় ‘লিটেরারি স্নিপেটস’- এ একবার মেনশন হইতে পারিত। এই পি.বি-টি কে? আমি বাংলা ভালো জানি না কিন্তু এটার নাম পরার্থলোভী বকরাক্ষস বা পায়ুকামী বোম্বেটে দিয়াই স্যাটিসফায়েড থাকিলাম। ভাবনা করিয়াছি কয়েকখানি পাইথন লইয়া উহাদের গায়ে দিব। বেষ্টন করিয়া ভক্ষণ করিবে।’
আজকাল কেন বহুদিনই স্বল্প দৈর্ঘ্যের উপন্যাস নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলে আসছে। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত শ্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘কাশ্মীরে বাঙালী যুবক’ একটি উদাহরণ। তবে লেখক এ ঘাটে বেশিদিন জল খাননি। ‘অল্প বয়সে একবার কেবল ইংরাজী শিলিং উপন্যাসের অনুকরণে, কতগুলি ছোট উপন্যাস বাঙ্গালায় লিখিবার ইচ্ছা হইয়াছিল।’ উপন্যাসটি মোটের উপর কেউ কেউ ভালো বললেও লেখকের ভাষায় ‘ঐরূপ বই লিখিয়া কিংবা পড়িয়া, কেহ কি এখনকার দিনে সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছা করে?’ শ্রীসুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বলিলেন বইখানি তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর ভাল লাগিয়াছে, তবে তাঁর কাকা পড়িয়া কিছু বলেন নাই।’ এই কাকাটি রবীন্দ্রনাথ। যাই হোক মিঃ বি.কে দাস-এর মত একেবারেই স্বতন্ত্র ও অভিনব। ‘এখনকার পাঠক খচ্চর ও তালেবর হইয়া উঠিয়াছে। এদের জন্যে নো রাইটার শুড ওয়েস্ট হিজ টাইম। কেহবা বলে পাঠকের সময় কম। মাই ফুট! আমি বলি লেখকের সময় কম।’ তত্ব হিসেবে এটি কতটা ভারালো সে না হয় বিজ্ঞজনেরা বুঝবেন। আমরা জানলাম যে লিটেরারি এসটাব্লিশমেন্ট লেখককে কী করতে পারে। আজ যদি কোনো লেখক আনন্দবাজারকে খচায় তার কী দশা হবে ভেবে আতঙ্কিত হওয়া যাক।
আজকাল বাঙালি জীবনে বিশিষ্ট বাঙালিদের জীবনী পড়ার রেওয়াজ প্রায় নেই। যদি কোথাও থেকে থাকে তাহলে সেই গুণবান পাঠক যেন ঔপন্যাসিক মিঃ বি.কে. দাস-কে বৈমানিক বিনয়কুমার দাস (১৮৯১-১৯৩৫)-এর সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলেন। বৈমানিক মিঃ বি.কে. দাস-এর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল ‘ব্যাঁটরা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামক কারখানা প্রতিষ্ঠা। ১৯৩৫ সালের ২৮ এপ্রিল বেলা ১০টা। ভাবলেই গায় কাঁটা গজায়। দমদমা খপোত ঘাঁটির নিকটস্থ গৌরীপুর গ্রামের আকাশ। বিনাশক শক্তির এমনই গোঁ যে বি.কে.দাস-এর বিমান ও ডি.কে রায়ের বিমানে ধাক্কা লেগে গেল। তখন এখনকার মতো উন্মত্ত বিমান আনাগোনা হত না। আকাশও সস্তা ছিল। পাওয়াও যেত প্রচুর। বাঙালি অবশ্য অচিরেই সেই শোক কাটিয়ে ওঠে। তার জিনগত অভ্যাসই হল আলুথালু হয়ে হাঁউমাঁউ করা, পরক্ষণেই পাল্টি খেয়ে দাঁত ক্যালানো। এই প্যাটার্ন অ-বাঙালি অর্থাৎ নাগা, রুশ, জার্মান বা হাবসি ইত্যাদির মধ্যে দেখা যায় না।
এখান থেকে লেনিনীয় নির্দেশে এক পা আগে-র পরে যদি দুই পা পিছোনো যায় তাহলে সেই আনন্দবাজার প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে। আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এমনই হওয়া বরং শ্রেয় যে আনন্দবাজার পত্রিকা ও ম্যাজিসিয়ান মিঃ আনন্দ আলাদা, দুই-এরই কক্ষপথ ভিন্ন, ডি.এন.এ ইত্যাদি দুরূহ ছকে গঙ্গা গঙ্গা ফাঁক, অতএব একটিকে খপ করে ধরে ক্লোন করলে অন্যটি হবে না। যাদুকর আনন্দ ‘বেঁটে মানুষ’ চেয়েছেন ‘বেঁটে লেখক’ চাইলে বরং সন্দেহের অবকাশ থাকত। তবে একথা না বলা বোধহয় অন্যায় হবে যে আনন্দবাজার না থাকলে মুষ্টিমেয় যে কয়জন বাঙালি লেখক মালদার হয়ে উঠেছেন তাঁদেরও এতটা ফুলে ফেঁপে ওঠা সাধ্যে কুলোতো না। হাতে হ্যারিকেন হয়ে যেত। বাঙালিদের মধ্যে কিন্তু হ্যারিকেন হাতে লেখকের ঘাটতি নেই। সাধারণ রঙ্গালয়ের গোড়ার দিকে যে মাদি ও মদ্দারা থিয়েটারে ভিড়ত তাদের সম্বন্ধে রসরাজ অমৃতলাল বসু যা লিখেছিলেন তা হ্যারিকেন হাতে লেখকদের ক্ষেত্রেও খেটে যাচ্ছে,
নিজ পরিবার মাঝে বিরক্তিকারণ।
কুটুম্ব সমাজে লজ্জা নিন্দার ভাজন।।
দেশের দশের পাশে শ্লেষ ব্যঙ্গ হাসি।
সরে গেছে বাল্যসখা তাচ্ছিল্য প্রকাশি।।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ট্র্যাজিক ফিগার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯ সালের ২১ আশ্বিন আমেরিকার ইলিনয় থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন,
বিদ্যালয়ের আর্থিক সঙ্কটের কথা শুনিয়া দেশে ফিরিবার জন্য আমার মন টলিয়াছিল। কিন্তু আমার এখানকার বন্ধুরা বারম্বার আমাকে আশ্বাস দিতেছেন যে আমার বই ছাপার ভালরূপ ব্যবস্থা করিতে পারিলে বিদ্যালয়ের আয় সম্বন্ধে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাইতে পারে। সেইজন্য আশাপথ চাহিয়া বসিয়া আছি। কিন্তু বই বিক্রি করিয়া কিছু পাইব এ কথা বিশ্বাস করিবার ভরসা আমার চলিয়া গিয়াছে।
আজ কলকাতায় যখন বইমেলা হয় তখন আনন্দ পাবলিশার্স-এর সামনে বাঙালি যেভাবে দীর্ঘ লাইন লাগায় তা দেখলে মনে হয় আহা! এমন একটি নয়নাভিরাম দৃশ্য যদি রবীন্দ্রনাথ দেখতেন তাহলে তাঁর কি সাতিশয় আনন্দই না হত!
আমাদের জানা আছে যে রবীন্দ্রনাথকে ট্র্যাজিক ফিগার বলার জন্য অনেকেই কুপিত হবেন এবং নুলো হলেও আস্তিন গুটোবেন। তাঁদের আমরা আগেভাগেই জানিয়ে রাখি যে, এরপর যে রামধোলাই তাঁরা খেতে চলেছেন তা কিন্তু ঝাপটের ঢাল দিয়ে ঠেকানো সম্ভব নয়।
-নলেন! ন-লে-ন! এই গুয়োর ব্যাটা নলেনের বাচ্চা! কানে কি হোগলা গজিয়েচে?
ভদি ছাদ থেকে চেঁচাচ্ছে। কাকের দল ছাদের এককোণে কাকবলির খৈ খাচ্ছে। ভাঙা টবে মরা তুলসীগাছ। তার গোড়ায় পচাফুল। ন্যাড়া ছাদে শ্যাওলা। খোবলা হঁ×টের ফাঁকে গোল গোল গেঁড়ি। বটের চারা বেরিয়েছে। ছাদে রোজকার মতোই তেলচিটে, ধার ছেঁড়া মাদুর পাতা। তার ওপরে রাখা তুলো ভরা বার্লির পুরনো জং ধরা টিনের কৌটো, মান্ধাতার আমলের একটি ম্যাগনিফাইং লেন্স, লাল নীল কাচের টুকরো, ইঁট চাপা দেওয়া একটি সেইদিনের আনন্দবাজার পত্রিকা যার ফর ফর করে ওড়ার চেষ্টা নিরন্তর। ভদি ন্যাড়া ছাদের ধারে গিয়ে তলায় উঠোনের দিকে তাকায়। নলেন পেতলের সাজিতে টগর ফুল তুলে তুলে রাখছে।
– গাঁক গাঁক করে চিল্লোচ্চি শালা, কানে ঢুকচে না?
– আঁজ্ঞে, শুনতে পাইনি। যাব?
– হ্যাঁ, যাবে! ক্যাওড়াতলায় যকন মুখে নুড়ো জ্বালব তোর তকন যাবি। বেচামণি কী করচে?
– গিন্নিমা তো পাইখানায়।
— বেরুলে বলবি ঝটপট চান-ফান সেরে চাবির গোছটা বের করতে। ক-ঘর ভরল?
— আঁজ্ঞে, দুটো। তিন আর এক।
— আরও আসবে। তুই ব্যাটাও ধোয়া-পাখলা করে চান সেরে ফেলবি। গঙ্গাজল আনতে হবে।
— কেন? এত সকালে।
— যা বলচি তাই কর। আজ শালা চাকতির ঘর খোলা হবে। মা! মা গো! মা!
২৪ অক্টোবর, রবিবার, সকালে এমনটিই হয়েছিল। ভদি যাদুকর আনন্দর বিজ্ঞাপনটি পড়ে এবং গূঢ় নির্দেশ পায় যে চাকতির ঘর খুলতে হবে। হ্যারিকেনের ভূতুড়ে আলোর দপদপানিতে এ পর্যন্তই এখন দেখা থাকল।
শীত পড়তে অল্প বিস্তর দেরি। কিন্তু শীতের কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেছে। একটি স্যাম্পেল দেখা যেতে পারে।
ঐ দ্যাখো ঢুলু ঢুলু গ্রাম,
মাঝে মাঝে হাঁটে জলপিঁপিঁ,
ক্যাঁতামুড়ি চাষা, চাষা-বউ
নাক ডেকে যায় ফুলকপি।
অনবদ্য এ কবিতাটি কার? ভদিই বা কে? চাকতির ঘরে কী আছে? হঠাৎ এই কবিতাটিই বা শান্টিং করা হল কেন?
‘হুজ্জুত-এ বাঙ্গালা, হিকমৎ- এ- চীন!
(চলবে)
২
প্রথম পর্বের মিলেনিয়াম অন্তে চারটি প্রশ্ন উঠেছিল। নেমে গেছে। অথবা সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়াই হল মুরুব্বির কাজ- ওসব জবাব-ফবাব এখন হবে না। এখানে কেউ ইস্কুলের পরীক্ষা দিচ্ছে না যেখানে পরীক্ষার খাতার ওপরে টুকলিবাজদের জন্যে লেখাই থাকত, ‘মনে রাখিবে যে নিজে চেষ্টা করে ঈশ্বর তাহার সহায় হন’। তবে পাঠান ও মোগল সম্বন্ধে যাদের অনুসন্ধিৎসা প্রবল তাদের শ্রী বিমলাচরণ দেব সেই কবেই জানিয়ে রেখেছেন, ‘হুজ্জুত-এ-বাঙ্গালা, হিকমৎ-এ-চীন’ এর অর্থ- … ‘যদি হাঙ্গাম হুজ্জুতের কথা বল, তাহা হইলে বাংলাকে হারানো শক্ত, যদি শিল্পীর শিল্পচাতুর্যের কথা বল, তাহা হইলে চীনে কারিগরকে হারানো শক্ত’। আজ যে রাজ্য বনাম কেন্দ্রের লড়াই আমরা স্বচক্ষে দেখি তা সি.পি.এম. শুরু করেছে বলে অনেকেই মান্য করে। বাংলার রাজারা বরাবরই ডাকাবুকো টাইপের ছিল। মোগল-পাঠানদের হুকুমদারি মানত না। ‘একটা হাঙ্গাম ভালো করিয়া থামিতে না থামিতে আবার একটা হাঙ্গাম আরম্ভ হইত,’ বাংলার এ এক মহান ঐতিহ্য। ১৯৯৯-এর শেষ দিকটায় সেই একই কেলো। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ও চলচ্চিত্র উৎসবের রণবাদ্য শেষ হতে না হতে বাস চাপা ও বাস জ্বালানোর দামামা বেজে উঠল। ফাঁকফোকরে কিছু কিডন্যাপ, কবিতা উৎসব, মার্ডার আর তহবিল তছরুপের টুকটাক প্রোগ্রাম। এইসব থিতোতে না থিতোতে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনের বিউগল ও ব্যাগপাইপ। বাজারে কানাঘুষো নতুন ইংরেজি বছর অবিরাম কেক-ভক্ষণ প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু হলেও আচমকা নাকি অন্যদিকে মোড় নেবে। তাই বুঝি কেমন একটা গা-ছমছমে, কী হয়- কী হয় ভাব। এই স্টেজে খোঁচাখুঁচি না করাই বুদ্ধির কাজ।
বড়িলাল বরাবরই ছোট সাইজের কিন্তু তাকে ঠিক বেঁটে মানুষ বলা যাবে না। হালদারপাড়ায় তার ছোট একটা দোকান আছে যেখানে রঙিন চক, নানা রঙের মার্বেল কাগজ, রাংতা, উপহারের প্যাকেট বাঁধার জরিদার ফিতে, পেন্সিল, নানা আকৃতির গন্ধওয়ালা ইরেজার, স্কেল, খুবই হালকা ও নানা রঙের প্লাস্টিকের বল, প্লাস্টিকের শাটল কক, কাগজের বাক্সে জালি বার্বি পুতুল, খোঁচা-ওঠা টিনের এরোপ্লেন, সেলফোন-সদৃশ পেন্সিল বাক্স, ক্রিকেট প্লেয়ারদের স্টিকার, মিনি ক্রিকেট ব্যাট, লুডো, প্লাস্টিকের ডাইনোসর সেট ‘জুরাসিক পার্ক’, সাবমেশিন গান, পিস্তল, পিচকিরি, একই বাক্সে রান্নাবাড়ি সেট, ঐ ডাক্তারি, টিকটিকি, তেঁতুল বিছে- এইসব ও আরো কত কী পাওয়া যায়। পুরো ঝাড় না হলেও দোকান খুব ভালো চলে না। বড়িলাল যা হয় তাতেই খুশি থাকে। ‘বর্তমান’ কেনে ও আদ্যোপান্ত পড়ে। বড়িলাল জানে যে লজেন্স, বাদাম-বিস্কুট, টফি, চকোলেট রাখলে বিক্রি বাড়বে। এ-বুদ্ধিটা অনেকেই তাকে দিয়েছে।
– রক্ষে করো বাবা! তারপর যকোন পিমড়ে-আঁশোলায় ছেঁকে ধরবে তকোন! এমনিতে তো গ্যাদাখানেক টিকটিকি চারদিকে হেগে ছয়লাপ করচে।
– তা সবাই যা করে তেমন মুখ বন্ধ বয়ামে রাখবে। মালকে মালও থাকল পোকামাকড়ও ঢুকলো না।
– ও তুমি চেনো না। ঠিক ফিকির করবে। শালারা খুব হারামি। আমার খুব ভালো আইডিয়া আছে।
– তোমার যত ফালতু ভয়! লোকে যেন করচে না।
– করবে না কেন? করচে। তেমন মরচে। ডাঁস, আঁশোলা, তারপর তোমার গিয়ে মাকড়সা, উইপোকা। এদের চেনো না। কেউ আড়ালে-আবডালে বই, কাপড় সব খাচ্ছে, টুঁ শব্দটা হচ্ছে না। কেউ-বা আবার চেটে দিল তো হয় ঘা নয় চুল উঠবে না।
মোটের ওপর বড়িলাল যে থিওরিতে দোকান চালায় তাকে স্মল ইজ বিউটিফুল হয়তো বা বলাই যায়। বড়িলাল বিয়ে করেনি। চেতলায় বাপের ভাগের একঘরে থাকে। হোটেলে খায়। কোনো ঝক্কি নেই। তবে ঘরে বজরংবলি হনুমানের ফটো আছে। সেখানে নকুলদানা, জল দেয়। ছোটবেলায় থানায় কনস্টেবলদের কুস্তি দেখে ঠিক করেছিল, কুস্তিগির হবে। তারকদার আখড়াতেও গিয়েছিল কয়েকদিন। আখড়ার দেওয়ালে গোবর গুহ, বড় গামা, ছোট গামা, জিবিস্কো ও স্যান্ডোর ছবি ছিল। দড়িতে সার দিয়ে মরা বাদুড়ের মতো ল্যাঙট ঝুলছে। হুপ-হাপ শব্দ। তারকদার রোগা প্যাঁটকা এক চেলার মিডিয়াম একটা রদ্দা খেয়ে বড়িলালের ঘাড় বেঁকে গিয়েছিল। কুস্তিগির না হয়ে শেষে দোকানদার। তবে হনুমানজীকে ছাড়েনি। তার অন্য কারণও আছে। হনুমানজী বাদে অন্য কোনো ঠাকুরের ভূত তাড়াবার ক্ষমতা নেই। বরং ভূতেরা এমনই খচ্চর যে যার যে ঠাকুর হয়তো সেই চেহারা নিয়েই হাজির হল। তুমি তো আহ্লাদের কাঁকুইদানা হয়ে ভাবছ যে, এমন ডাকা ডেকেছি যে ইষ্টদেবতা বাধ্য হয়েছেন দর্শন দিতে। ভূতেরা এইসব রগড় করে। উল্টোপড়িয়ে সব লন্ডভন্ড করে পালায়। তাছাড়া কিছু ঢ্যামনা লোকও আছে যারা ভূত পোষে। যার ওপর রাগ তাকে ভূত দিয়ে সাইজ করায়। অবশ্য এসবই বড়িলালের শোনা কথা। শোনা কথা যে সহসা সত্যি হয়ে যেতে পারে সেটা বড়িলাল জানত না। আমরাও। অজানাকে জেনে জেনেই আমাদের এগোতে হবে। পাঠক্ষেত্রটিও আখড়াবিশেষ। সেখানে নিয়তই পাছড়াপাছড়ি চলেছে। গাপ হয়ে রয়েছে বলে সবসময় বোধগম্য হয় না। যাই হোক, পোকামাকড় ও ভূত সম্বন্ধে সদাসতর্ক বড়িলালের মধ্যে কিন্তু কোনো মজ্জাগত গর্ভচেটবৃত্তি ছিল না। এই প্রথমে নির্বাক ও পরে সবাক শতকের হাফটাইমের বেশ কিছু আগে জন্মালেও বড়িলাল চাকর, খানসামা বা খিদমদগারের মনোভাব নিয়ে কোথা মনিব, কোথা মনিব বলে কেঁদে বেড়াত না। বরং হয়তো বড় পালোয়ান হয়ে একমনি লোহার মাদুলি পরে গঙ্গাতীরে প্রাতঃভ্রমণ করত বা পাড়ার গবা-ঘন্টে-পল্ট নদের একজোট করে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত করত। জন্মের টাইমের হেরফেরে নানা হেরাফেরি হয়। এই কথা যে কত অকাট্য সত্য তা পরে জানা যাবে।
২৪ অক্টোবর, রবিবার, ১৯৯৯ সকালে বড়িলাল দেখল তার সামনে তিনটি সম্ভাবনা। সে সিনেমা দেখতে যেতে পারে। বেলঘরিয়াতে তার একমাত্র বোন করবী-র শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারে। অথবা কিছুটা আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য ক্যাওড়াতলায় গিয়ে মানবাকৃতির জারিজুরি ফাঁক স্টাডি করতে পারে। কোনো গোপন কারণে বড়িলাল দেখল, ক্যাওড়াতলাই তাকে টানছে। বড়িলাল সেই টানে বডি ছেড়ে দিল।
ক্যাওড়াতলা শ্মশানে কোনো গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা নেই। ‘এবারে পুজোয় ক্যাওড়াতলায় চলুন’ বা ‘চলুন, সবান্ধবে ক্যাওড়াতলা ঘুরে আসি’ বলে কোনো ট্রাভেল এজেন্সি বিজ্ঞাপনও দেয় বলে জানা নেই। কিন্তু বড়িলাল দেখেছে যে, অদৃশ্য কোনো গাইড জীবন্ত দর্শকদের প্রথমেই অবধারিত ভাবে শ্মশানের সেই অংশে নিয়ে যায় যেখানে বিদ্যুৎচুল্লি বডির সাইজ ও ওজন অনুযায়ী হাঁ ও কপাৎ, হাঁ ও কপাৎ করে চলেছে। অবশ্য বিগড়ে না গেলে। এবং কখনোই সব চুল্লি একসঙ্গে চালু এরকম অলৌকিক দৃশ্য কেউ দেখেনি। অন্যদিকে মড়ার কোনো কমতি নেই। এক এক সময় এমন লাইন পড়ে যায় যে, ক্যাওড়াতলায় হাউসফুল দেখে মড়ারা শিরিটি বা গড়িয়ায় বোড়ালে গিয়ে অবয়বমুক্ত হয়। দর্শকরা বিদ্যুৎচুল্লি দেখেই শ্মশান দেখার তৃপ্তি ও মানব-জীবনের অকিঞ্চিৎকর তাৎপর্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে খাবারদাবারের দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। অথচ আগে লোকে মরলে কাঠেই পুড়ত। বিদ্যুৎচুল্লি তো সেদিনের ব্যাপার। এখন অবশ্য মাইক্রোওয়েভ ওভেন নামে ঐ চুল্লিরই একটি মিনি সংস্করণ সম্পন্ন গৃহে গৃহে জায়গা করে নিয়েছে। অবশ্য এই চুল্লি ছাইভস্ম তৈরি করে না, রোস্ট, তন্দুর, গ্রিল, বেক ইত্যাদি করে। এবং সচরাচর মানুষকে নয়। বড়িলাল কখনোই ঐ অদৃশ্য গাইডের ইঙ্গিতে সম্মোহিত হয়ে পড়ে না। সে চেতলা ব্রিজ দিয়ে নেমে রাস্তা পার হয় এবং উল্টোদিকের পানের দোকান থেকে বিড়ি কিনে দড়ি থেকে ধরায় ও ফের রাস্তা পেরিয়ে কাঠের চুল্লির অঙ্গনের দিকে অগ্রসর হয়।
আজ সে অঙ্গনে নজর করে দেখল, ভোররাতে কেউ কাঠে পুড়িয়েছে কারণ ব্যাপক ভস্মের মধ্যে কয়েকটি পোড়া কাঠ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে সেই প্রসিদ্ধ ভারতীয় দড়ির খেলা দেখাচ্ছে এবং পাশেই এত পুরনো, কালো ও অংশত ভেজা একটি ফাটা তোষক পড়ে যে কেউ আর নিয়ে ঝামেলা বাড়ায়নি। সাইড দিয়ে অঙ্গনটি অতিক্রম করে বড়িলাল শ্মশানপ্রান্তের গেট দিয়ে ঢুকে ঘাটের আগেই বাঁদিকে ঢুকল। ইতস্তত জল জমে আছে। গুমোট গন্ধ। দুটি কুকুর আপসে কামড়াকামড়ি করছে। ডানদিকে তাকাতেই,
স্মরণীয়
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
জন্ম মৃত্যু
১৭ই আষাঢ় ১০ই জ্যৈষ্ঠ
১২৭১ সন ১৩৩১ সন।
হায়, রয়াল বেঙ্গল টাইগার। হায়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। হায়, কলকাতা কর্পোরেশন। কী হাল সমাধিমন্দিরের। নোংরা, রংচটা, ফাটল-ধরা, পক্ষীপুরীষে চিত্রিত। ওপরে একটি ধেড়ে বটগাছ। তারই একটি ছানা তলায় গজিয়েছে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে বট কোম্পানির অমোঘ বিধ্বংসী শেকড় গুঁড়ি মেরে মেরে এগোচ্ছে। হায় বাংলার বাঘ যিনি সন্দেশের মাংস খেতে বড়ই ভালোবাসতেন। হালুম!
অবশ্য আশুতোষকে আর বাংলার বাঘ বলা ঠিক নয়। কারণ নিত্যযাত্রীরা অবশ্যই অবহিত যে, ল্যান্সডাউন-পদ্মপুকুর সংযোগস্থলে দুটি বাম্বুতে লাগানো বোর্ডে দীর্ঘ, দীর্ঘ দিন লেখা ছিল,
বাংলার বাঘ
সোমেন মিত্র
জিন্দাবাদ।
এখন লিখন অন্যরূপ-
সোনার বাংলার
সোনার ছেলে
সোমেন মিত্র জিন্দাবাদ।
এরই নাম ম্যাজিক। এই ছিল বাঘ। সাট করে সোনার ছেলে হয়ে গেল। আজ যিনি শার্দূল কাল তিনিই গৌরাঙ্গ। বোঝাই যায় যে, কংগ্রেসিদের মাথার জায়গায় যে লক্ষ্মীর ভাঁড় ছিল সেখানে মা ভবানী গেঁড়ে বসেছেন।
মরুক গে যাক। স্যার আশুতোষের উল্টোদিকে মুখোমুখি রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এনার কেসও গোলমেলে। পাতাখোর ভ্যান্ডালরা বেদি ফাটিয়ে শেকল ঝেড়ে দিয়েছে। খুব যদি ভুল না হয় তা হলে এঁর সম্বন্ধেই শ্রী সুবলচন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন, ‘শ্বেতাঙ্গ বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ইঁহার ন্যায় মর্যাদা ও প্রতিপত্তি কোনো বাঙালীরই নাই।’। শ্বেতাঙ্গ তো দূরের কথা, লর্ড লেডিদের বাদ দেওয়াই ভালো, কৃষ্ণাঙ্গ নেটিভ লুম্পেনরা অবধি এখন তাঁকে পাত্তা দেয় না। এঁর মাথায় একটি ঘোড়ানিম।
বড়িলালের আরো বাঁদিকে ঘোরার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল কারণ বমি, শ্যাওলা, গু ইত্যাদির সংগ্রহ পেরোতে হবে। উপচে পড়া ঐ সমাহারের দিক থেকেই একটা বাতাসের ঝলক আসাতে বড়িলাল ওখান থেকে কেটে পড়াই যুক্তিসঙ্গত মনে করল। বড়িলাল জানে, এখন কী করতে হবে। ডানদিকে গেট তালাবন্ধ। তারা মার মন্দিরে চাবি থাকত। ডুপ্লিকেট শ্মশানের অফিসে। কিন্তু ক্যাওড়াদের ভয়ে এখানে আর চাবিই রাখা হয় না। অতএব ঘাটের পাশ দিয়ে ওপরে উঠে বড়িলালকে ব্যাঁকাত্যাড়া রেলিং টপকাতে হবে। পথের দাবি মেটানো বড়ই দুরূহ।
ঘাটের দুধারে বসার রোয়াক। বাঁ-দিকটাতে তিনজন বসেছিল। একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে-মোটা আর তিননম্বরকে দেখলেই বোঝা যায় পাগলাখ্যাঁচা। উল্টোদিকে লুঙ্গি আর হলদে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা একটা তাগড়াই মাল চোখ বন্ধ করে বিড়ি টানছিল। বোঝাই যায় যে, লোকটা এলিতেলি নয়। ‘আমাকে ঘাঁটিও না, আমিও ঘাঁটাব না’ ধাঁচের। বড়িলাল ডানদিকে ওপরে উঠে গেল। গঙ্গায় জল বাড়ছে। এবারে টপকাতে হবে। কুঁচকিতে খিঁচ না লেগে গেলেই হল।
এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক যে, বাঁ-দিকের তিনজন হল ফ্যাতাড়ু যারা গোপন একটি মন্ত্রের বলে উড়তে পারে এবং নানা ধরনের অনুষ্ঠান বা সুখের সংসারে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে। ফ্যাতাড়ু আরো অনেক আছে। কিন্তু আপাতত এই তিনজনকে চিনলেই কাফি। ঢ্যাঙা মালটা হল মদন। ওর ফলস দাঁত পকেটে থাকে। বেঁটে-কালো-মোটাটা হল ডি. এস। ঐ নামে একটি হুইস্কি আছে – ডিরেক্টরস স্পেশাল। ওর তোবড়ানো-মচকানো ব্রিফকেসের দু-পাশে নাম ও পদবীর আদ্যাক্ষর সাঁটা আছে যদিও পড়া কঠিন। তিন নম্বর স্যাম্পেলটা হল কবি পুরন্দর ভাট। এরা মোটের ওপরে আমোদগেঁড়ে। পুরন্দর বলে উঠল,
কত না ফুলের তোড়া
কত ফটো তোলাতুলি
ভাঙিলে লাগে না জোড়া
কত বৃথা কোলাকুলি।
জয় গঙ্গা, জয় রাম
কবি পুরন্দর দ্যাখে
মড়া আসে অবিরাম।
টুটিছে কত না জোড়া
ফুটিছে কত না শাঁখা
বড়বাবু ও বেয়ারা
দেখি পাশাপাশি রাখা।
মড়া আসে অবিরাম
কবি পুরন্দর বলে
জয় গঙ্গা, জয় রাম।
এই এলিজি গোছের কবিতাটি শুনে ডি. এস ঘাবড়ে গিয়ে খিঁচিয়ে উঠল,
-একটু ঝিমুনি ধরব-ধরব করছিল! কিছুর মধ্যে কিছু নেই — মড়ার কেত্তন শুরু করল।
– তা শ্মশানে মড়ার কেত্তন হবে না তো কি বিয়ের পদ্য লেখা হবে? যেমন তুমি তেমন তোমার আক্কেল।
মদনের ঝাড় খেয়ে ডি. এস. একটু চুপসে গেল।
– না, সে কারণে বলিনি।
– তো কী কারণে বলেছ?
– পুরন্দরের কবিতায় একটা বি. জে. পি. লাইন চলে আসছে, তাই বললাম।
এতক্ষণ পুরন্দর কিছু বলেনি। সে ‘যাঃ বাঁড়া’, বলে স্বগতোক্তি করে একটা বিড়ি ধরাল। বিড়ির প্যাকেটের খচর-মচর শুনে ডি. এস. বলল,
– বেঙ্গল বিড়ি! দেখি একটা ছাড়ো তো!
উল্টোদিকে হলদে স্যান্ডো গেঞ্জি একধারে হেলে প্রবল নাদে এক বাতকর্ম করে উঠে চলে গেল।
– বুড়ীমা-র চকোলেট বোম!
মদন ফের খ্যাঁক করে উঠল,
– সবকিছু নিয়ে কিছু বলতেই হবে।
পুরন্দর এই তালে ঝাল মিটিয়ে নিল।
– মদনদা, ডি. এস.-এর কিন্তু কোনো দোষ নেই। ওরকম হবেই।
– মানে?
– হাফছুটির বারবেলায় পয়দা হলে ওরকম হয়।
বড়িলাল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমাধি-মন্দিরের সামনে দাঁড়াল। বাঙালি জাত ও বাংলা সাহিত্যের দশা এমনই। ধুলোমাখা শরৎচন্দ্রের মাথাটির সামনে গ্রিল না থাকলে গলা কেটে উঠিয়ে নিয়ে যেত। কারো কারো যেমন নিয়ে গেছে। অবজ্ঞা, অপমান ও উপেক্ষার অন্ত নেই। ডানদিকে চোখ রেখে সবই দেখছেন। গলায় একটি শুকনো গাঁদাফুলের মালা। সেই মালা থেকে মাকড়সার জাল ছড়িয়েছে। ভেতরটা ঝুল নোংরায় ভর্তি। সৌধের সামনের দিকটা ভাঙাচোরা। ভেতরটি একটি সংগ্রহশালা বিশেষ। ভাঙা বাঁখারির টুকরো, মরা পায়রার সাদা পালক, শুকনো পাঁচটা মালা, পাতা, কাগজ, পানপরাগের প্যাকেট এবং হাজার হাজার কালো পিঁপড়ের আনাগোনা। এদিকটায় বন্ধ থাকলেও অনেকগুলো কুকুর। এদের সকলেরই নাম ‘ভেলু’ দেওয়া হল।
শরৎচন্দ্রের পাশেই শ্রীশ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব-এর শ্মশানসৌধ। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের গুরুদেবের ভাগ্য অপেক্ষাকৃত ভালো। গন্ধবাবার ভক্তজন আছেন কারণ গ্রিলটি রুপোলি রং করা। তারপর আবার সেই উপেক্ষিতের স্মৃতি। পরপর। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। পরেরটি কার, বোঝার উপায় নেই। চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দেশপ্রেমিক কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়। অজিতেশ্বর ভট্টাচার্য। সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক। সুরবালা ঘোষ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সোনালি জরি, গাঁজার কলকে, মিষ্টির বাক্স, ডাবের খোলা, প্লাস্টিকের জলের বোতল ও গ্লাস ও অসংখ্য নোংরা পলিব্যাগ। এবং সর্বত্রই সেই বিচিত্র গন্ধ।
বড়িলাল ঘাটে এসে দেখল, ভুঁড়ো একটা লোক নানা সাইজের বিলিতি মালের বোতলে গঙ্গাজল ডুগবুগ-ডুগবুগ করে ভরে একটা বিগশপার ব্যাগে ভরছে ও বাঁ-দিকের রোয়াক থেকে বেঁটে-মোটাটা দেদারে আওয়াজ দিচ্ছে।
– ঐ, ঐ পলকাটা বোতলটা হল স্কচ-হুইস্কির। এক বোতল কিনতে গেলে গাঁড় ফেটে যাবে। শালা, কত আর দেখব। মালের গন্ধ যায়নি, ওর মধ্যেই গঙ্গাজল ভরছে। এই, এইটা হল হারকিউলিস রামের। ডিফেন্সের ঝাড়া মাল।
মদন কিন্তু এবারে আপত্তি করেনি। বরং মুচকি-মুচকি হাসছিল।
– ওরে, তোর মনিবটা তো জব্বর মাল। কোনো পাঁইট, নিপ এসবের কারবার নেই। সব বোতল। এত জল দিয়ে কী করবি? হেভি চোদনা টাইপের লোক তো! এত বলছি, কিন্তু রা কাড়ার নাম নেই। ভালো-মন্দ কিছু একটা বল। না হয় দুটো খিস্তিই কর। তিনজনে আছি বলে ভাবছিস, ক্যালাব? শালা, বোধহয় জন্মবোবা। নয়তো হাড়হারামি।
ভুঁড়োর শেষ বোতলটি ভরা হয়ে গেল। বোতলটা বিগ শপারে ভরে সে উঠে দাঁড়াল। অতগুলো জল-ভরা বোতল কিন্তু কোনো ক্যাঁ-কোঁ নেই। যেন তাকিয়া বগলে আসরে চলেছে। লোকটা ব্যাগ হাতে ঘাট থেকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই অদ্ভুত কাণ্ডটা হল। ঠিক দড়ি-বাঁধা কুকুর যেমন হ্যাঁচকা মেরে মনিবমুখো হয় তেমনই তিনজন ঝাঁকুনি খেয়ে রোয়াক থেকে নীচে নামল। তারপর লোকটার পেছনে সুড়সুড় করে রওনা দিল। মুখে কোনো শব্দ নেই। উল্টোদিকে একটা মেয়ে এসে পড়েছিল বলে ভুঁড়ো ডানদিকে হেলল। ঐ তিনটেও ডাঁয়া ভাঁজ মারল। বড়িলাল ওদের ফলো করতে শুরু করল। মড়া নিয়ে একটা কাচের গাড়ি এল। পেছনে দুটো টেম্পো-ভরা লোক। নলেন নমস্কার করল। ওরাও নমস্কার করল। নলেন বাঁদিকের দাবনা চুলকোতে চুলকোতে রাস্তা পেরোল। মদন, ডি. এস. ও পুরন্দর ভাটও নিজের নিজের বাঁদিকের দাবনা চুলকোতে চুলকোতে রাস্তা পার হল। তারপর এ-গলি, সে-গলি পেরিয়ে একটা বড় উঠোনের মতো জায়গা ফেলে, নর্দমা টপকে, হরিণঘাটার দুধ দেওয়ার ভাঙা খাঁচা বাঁ-দিকে রেখে ফের একটা গলিতে ঢুকে যে বাড়িটার দিকে নলেন চলল সেটা যে ভদির একতলা ন্যাড়াছাদ-ওলা বাড়ি তা আমরা জানি। বাড়ির ওপরে একটি লজঝড়ে অস্পষ্ট সাইনবোর্ড কেতরে ঝুলছে। একটু ঘাড় কেলিয়ে পড়তে হয়। বড়িলাল দেখল, লেখা আছে এবড়ো-খেবড়ো অক্ষরে, ‘বিবিধ অশুভ অনুষ্ঠানে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়’।
‘ঐ বুঝি করে হাঁ নাহি যার নাম’।
(চলবে)
৩
আজকাল কোনো শিশুই ‘লাল-কালো’ পড়ে না। অতএব কে অন্ধকারে হাঁ করতে পারে, এই ভয় কেন বিকট-দর্শন ডেয়ে জল্লাদকে ঘর্মাক্ত করে তোলে প্রভৃতি প্রশ্নাবলী ওঠে না। গিরীন্দ্রশেখর স্বপ্নের জগৎ থেকে সুষুপ্তির জগতে নির্বাসিত। যেমন নির্বাসিত দক্ষিণারঞ্জন, ধনগোপাল, হেমেন্দ্রকুমার, সুনির্মল, খগেন্দ্রনাথ, সুখলতা ও খ্যাত-অখ্যাত শত শত সাহিত্যিক যাঁরা শিশুদের জন্য লিখতেন। এখন সাহিত্যিক শিশুদের যুগ। ছোটরা কেবলই ফেলুদা বা টিনটিন পড়ে। বাপ-মা’গুলোও অগা। ছোটবেলা থেকে হাই প্রোটিন, ব্রেনোলিয়া, সুলভ ব্রয়লার, কেলগ ইত্যাদি গিলে অকালেই কেঁদো কেঁদো হয়ে ওঠে। তারপরই দেখা যায় হয় কমপিউটার শিখছে বা লুচ্চামি। বিগ বং-এর বাচ্চারা হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট এমনকি চেঙা-বেঙা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনবহিত। ছোটবেলা থেকেই এত স্বার্থপর ও খচ্চর অন্য কোনো দেশের শিশুরা হয় না। যেমন পাশেই বিহার দেশের কথা ধরা যায়। অথবা নেপাল। সেখানে সরলমতি শিশুদের দেখা পাওয়া যায়। হামেশাই। আপাতত বড়িলাল।
ফলের বাক্সের কাঠের গায়ে বিস্কুট টিন কেটে পেরেক মারা বেঁকাতেড়া দরজাটায় ফুটো ছিল বলে বড়িলাল দেখতে পাচ্ছিল ভেতরে অর্থাৎ ভদির উঠোনে কী হচ্ছে। ভদি ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বেরিয়ে এল।
-এই তিনটে বানচোৎকে আবার নিয়ে এলি কেন?
– খুব দেখি বোলচাল দিচ্ছে। ভাবলুম ধরে নিয়ে যাই। পরে সাইজ করা যাবেখনি।
– দাঁড়া, দাঁড়া। অত সোজা কেস নয়। ভাবচি, এই দিনে হঠাৎ ফাঁদে পা দিল কেন?
-জলছিটে দিয়ে দিন। মাথাগুলো কেটে ফেলি। বলিও হল, ধড়, মুণ্ডু সব সাধনার কাজেও লেগে গেল। কিছুই ফেলা গেল না।
-মন্দ বলিসনি। কী গো, মালে ঝালে একেবারে কন্দর্পকান্তি। খুঁড়ছিল কেঁচো …
-বেরিয়ে পড়ল ঘুরঘুরে। এবারে রা কাড়ছে না যে! ওফ, সে খিস্তির একেবারে খই ফুটোচ্চে।
প্রথম ডি. এস. এবং তার দেখাদেখি পুরন্দর ও মদনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বড়িলাল শুনতে পেল আশপাশে কেউ মন্তর পড়ছে। ন্যাকড়াপোড়া গন্ধ। নলেন এর মধ্যেই গিয়ে ল্যাগব্যাগে একটা টিনের খাঁড়া নিয়ে এসেছে যা দিয়ে কিছুই কাটা সম্ভব নয়। এটা দেখেও ওদের কান্না থামছে না। ভদি তিনজনের সামনে পায়চারি করছে আর থেকে থেকে চেঁচাচ্ছে,
– এসপার ওসপার হবে যখন হয়েই যাক। নিন্দে যখন শালা একবার রটেচে তখন বিয়েই করব। মুণ্ডু নেচেচে। মুণ্ডু নাচবে। উফ, ইয়া বড় চাকতি মাপের মুণ্ডু গাঁথা মালা। এসপার ওসপার। মুণ্ডু নির্বিকার। ধড় শুধু ধড়ফড় করছে। হাত খিঁচোচ্ছে। পায় টান মারছে।
ফ্যাতাড়ুরা এবার সমস্বরে একেবারে রোলারুলি কান্না জুড়ে দিল। এতক্ষণ বড়িলাল ভাবছিল বাজারে মুরগির মুণ্ডুকাটা দেখলেই তার গলায় কেমন শিরশির করে আর তিন-তিনটে জলজ্যান্ত মানুষের মুণ্ডু … এরা কি কাপালিক-টাপালিক… নরবলির দু-একটা খবর তো এখনো কাগজে বেরোয়… নাকি এখনই গিয়ে থানায় খবর দেবে…
বেচামণি একেই বেজায় মোটা তায় পাটভাঙা লাল-সোনালি বেনারসি পরেছে বলে খোলতাই আরো বেড়েছে, স্যাম্পু করা চুল,
-ফের … ফের সেই অশৈল?
ভদির গর্জন।
-ব্যাটাছেলের ব্যাপারে নাক গলাবে না কতবার বলেছি!
নলেনের আবেদন।
-গিন্নি মা, খাঁড়া চুলকোচ্ছে, রক্ত ছেটাছেটি হবে, আপনি থাকবেন না …
বেচামণির মুখে সেই মহামায়াসুলভ হাসি
-পুজোগণ্ডার দিন। ফেতুড়ে অতিথি এয়েচে। তা সে ভয়ডর দেখিয়েচ ভালো করেচ। শান্ত হয়ে বসো তো বাছা তোমরা। কেউ মুণ্ডু কাটবে না। ওসব হল গদির বটকেরা। নলেন, ওদের জলবাতাসা দিয়ে বসা।
-তাহলে বলি দেব না বলচ?
-ফের সেই অলুক্ষুণে কতা। দেখচ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপ ধরেচে।
-বারণ যখন করচ এত করে, তখন … যাঃ, এ যাত্রা ছেড়ে দিলুম। তবে যেখানে সেখানে অজানা অচেনা লোক দেখলে পোঁদে লাগা মোটেও ভালো কতা নয়। এই বলে দিলুম।
ডি. এস. ফুঁপোতে ফুঁপোতে বলে,
-আজ্ঞেঁ গদির বটকেরা কী? ঐটে বুঝলুম না।
বেচামণি ঘোমটা দেয়। ভদির প্রসন্ন ব্যাখ্যা
-আমার নাম হল গে ভদি। তা বউ হয়ে তো সোয়ামির নাম মুখে নিতে পারে না। তাই বলে গদি। এবারে বুঝলে গদির বটকেরা।
পুরন্দর ও মদন বসে। ওদের দেখাদেখি ডি. এস.-ও। তিনটে ভাঁড় আর এক বোতল বাংলা নিয়ে নলেন সামনে রাখে।
-গদির বটকেরা তো দেখলে, এবার একটু নলেনের গুড় চেখে দেখ।
-তখন উল্টোপাল্টা অনেক বলে ফেলেছি। কিছু মনে রেখ না ভাই।
– দ্যাখো ভায়া, তোমরা হলে ফ্যাতাড়ু। ফ্যাতাড়ুর কাজ ফ্যাতাড়ু করেছে … আর …
ভদি নলেনকে হাত নেড়ে থামায়।
– এবারে আমাকে বলতে দে। আজ এক মহাযোগের দিন বুঝলি। লাস্ট এই দিনটা এসেছিল কমবেশি দেড়শো বছর আগে। চাকতির খেলা যখন শুরু হয় তখন চোক্তারের সঙ্গে ফ্যাতাড়ুরা এক পার্টি হয়ে যায়।
– আজ্ঞে, চোক্তার কী? মোক্তার, ডাক্তার হয় বলে জানি …
– আরে উকিল, ডাক্তার, মোক্তার, পেশকার ঐসবের যেমন ফ্যাতাড়ু মেলে না তেমন চোক্তারও মেলে না। আমরা ঠিক বলিয়ে কইয়েদের দলে পড়ি না। তাই কেউ টেরও পায় না যে আমরা আছি। এই যেমন ধর তোরা-তোরা যে ফ্যাতাড়ু সেটা কটা লোক জানে? খবরের কাগজে নেই, খাসখবরে নেই, কোথাও নেই। সেইরকম চোক্তারদের বেলায়। কোথাও নেই। লোকে জানেই না। নে মাল ঢাল। ও নলেন ছিপি খুলেই দিয়েচে। চেতলার মাল। রসা ডিস্টিলারির বলে একটু গন্দ লাগবে। এদিকে আবার ফারিনি-র ছাপটা দেয় না। সব হল গওরমেন্টের হারামিপনা। তা বাবা মদন, মুখের কুলুপটা এবারে একটু খোল।
– আমি অবাক হয়ে ভাবচি আপনাকে কোথায় যেন দেখেচি দেখেচি।
– ওরে চোক্তারের ওপরে ফ্যাতাড়ুর জন্মের টান। এতে অবাক হওয়ার কি আচে। একি এক-দুদিনের সম্পক্ক। নাও, ভাটকবি, এক্ষুণি যে পদ্যটি ভাবলে বলে ফেল তো-
-বলব?
-বলবি না তো কি গিলে বসে থাকবি! বল,
পুরন্দর গলা খাঁকারি দেয়।
– আমার এই কবিতাটির নাম ‘যার যা কাজ’।
ডি. এস. অমনি বলে ওঠে,
-ওরকম নাম কবিতায় চলে না। ‘যার যা কাজ’। দেখলেই লোকে পাতা উল্টে চলে যাবে।
-কেন?
-এই কারণে যে নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এটা জ্ঞানের কবিতা। লোকে কবিতা পড়বে আনন্দ পেতে, ওসব জ্ঞানমারানি ঢপ লোকে শুনতে চায় না।
মদন বলে
-ডি. এস. তুমি থামবে? না শুনেই আগে ঝগড়া!
-বাগড়া দিও না ভাই। আনন্দ তো অনেক পেয়েছ। এবারে ভাবার আগে শুনে নাও, আমার কবিতা হল, ‘যার যা কাজ’
শশধর ধরেছে শশক
মহীতোষ মেরেছে মশক
উভয়েই স্ব স্ব কাজে পটু
পেট থেকে পড়া ইস্তক।
বনমালী করে বন খালি
ডালে বসে গোড়া কাটে কালি
ডাকে তারা যাহা থাকে ঝাড়ে
যমদূত দেয় করতালি।
ভদির মুখে হাসির ময়ান।
-বাঃ বাঃ বেড়ে হয়েচে। এই, এই হল কবিতা। রস আচে, অলঙ্কার আচে, গভীর অর্থ আচে, চনমনে ছন্দ আচে। এই না হলে পদ্য। আজকাল কী যে সব বালের ছাল লেখে। কোনো কাক-কাঁকুড় বালাই নেই। কেমন লাগল, ডি. এস.!
-ভাবতে হবে। জ্ঞানমারানি পদ্য তো, ঝপ করে কিছু বলব না। তবে, মনে হচ্ছে পুরন্দর এর মানেটা বুঝে লেখেনি। পেয়ে গেছে, ছেড়ে দিয়েছে। কী, ঠিক বলিনি!
-নেহাৎ ভদিদা, বৌদি, মদনদা সব সামনে বলে কিছু বললাম না। অবশ্য পুরন্দর ভাটের জীবনে এটা নতুন কিছুই নয়। যুদ্ধ যারা করে তারা মশার কামড় নিয়ে মাথা ঘামায় না।
-তার মানে আমি মশা?
– হ্যাঁ, অ্যানোফিলিস।
-আঃ, তোরা থামবি? বেকার ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। পরে আমি ওকে পদ্যটা না হয় বুঝিয়ে দেব।
টিনের দরজার ফুটোর সঙ্গে চোখ সাঁটানো বড়িলাল হঠাৎ বোধ করল তার পা বেয়ে কী একটা উঠছে। চোখ সরিয়ে দেখল একটা ডেঁও পিঁপড়ে। তাকে সরাতে গিয়ে টিনের দরজায় হাঁটু ঠুকে ডুম করে একটা আওয়াজ হল। অন্য কেউ না খেয়াল করলেও শব্দটা নলেনের কান এড়ায়নি। সে উঠতে যাবে কিন্তু ভদি তাকে থামাল।
-ও কিছু নয়। সাক্ষী। সবকিছুর সাক্ষী থাকে। থাকতে হয়। পাত্তা দেবার দরকার নেই। এবারে তোরা কী জানতে চাস কম কথায় বল।
– আঁজ্ঞে, চোক্তার তাহলে ঠিক কী?
-এ কথার কোনো মানে নেই। ফ্যাতাড়ু কী? তেমনই চোক্তার কী? চোক্তার হল চোক্তার। তবে এটুকু বলতে পারি হুজ্জত লাগাতে চোক্তারের কোনো জুড়ি নেই। তবে ঠিক টাইম না হলে কিচ্ছুটি হবার উপায় নেই।
-খোলসা হল না।
-হবে কী করে! আজকে তো সিরিয়ালের পয়লা এপিসোড। তিনশো পেরিয়ে গেল, ‘জন্মভূমি’-তে ঠিক কি হচ্চে লোকে শালা বুঝতে পারছে না। আর এক নম্বরেই তোরা এত বড় কাণ্ডটা সাইজ করবি সে কী করে হয়? আর আমিই বা গান্ডুর মতো অত বড় ঘোমটা দিতে যাব কেন যাতে পোঁদ বেরিয়ে পড়ে!
বেচামণি লজ্জা পায়।
-গদির মুখটাই ওরকম। খুব অশৈল।
-থামো তো। অশৈল! ভেতরে ভেতরে রাবড়ির জাল দেবার থেকে পেট খুলে দুটো খিস্তি করা সাধুসন্তের লক্ষণ। ঝটপট বলে যা আর কি বলবি।
এবারে পুরন্দর ভাট।
– আচ্ছা ভদিদা, তোমার দরজায় সাইনবোর্ড লেখা ‘অশুভ অনুষ্ঠানে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়’। এর মানে?
-দ্যাখ, রোজ, নিত্য, অন্তহীন অশুভ অনুষ্ঠান চলচে! আজকের জীবনে পার হেড দশ-বিশটা করে শত্তুর। লোক চেনা দায়। মামলা, জালি কারবার, বৌ ভাঙানো, ভোট মারানো, অর্ডার ধরা, খুচরো দুষমনি, চিটিং কেস, টাকা গাপ, চোরকাঁটা দিয়ে ডাকাতকাঁটা তোলা, মাগি চালান, পলিটিক্যাল চুদুড়বুদুড়, নমিনেশন — এই সব কন্মোকাণ্ড নিয়ে মারণ, উচাটন, বশীকরণ, ব্ল্যাক ম্যাজিক নিত্য চলছে। সেই কারণে, স্রেফ এইসব যারা করে তাদের আমি ঘর ভাড়া দিই। বিয়ে, অন্নপ্রাশন তারপর গিয়ে শ্রাদ্ধফাদ্দ-তে আমি নেই। এখনই তো একটা ঘরে চলচে তাকিয়þাচালান, অন্যটায় কী কেস রে নলেন?
-আঁজ্ঞে কিছু বলেনি। দাড়িওলা একটা লোক মাঝবয়সী একটা মেয়েমানুষ নিয়ে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। ঠিক কী করছে জানি না। তবে ন্যাকড়া পুড়িয়েচে।
-গাঁড় মেরেচে। দরজা ধাক্কে বের কর। টাকা বুঝে নিয়ে লাথ মেরে পেছনের দরজা দিয়ে তাড়া।
নলেন উঠে গেল। তারপর ধুপধাপ, কাঁইমাঁই।
-ও নিত্যকার ব্যাপার। ধাওয়া খেয়ে চলে যাবে। এই শালাদের জন্যেই তো পুলিশ খচড়ামির চান্স পেয়ে যায়।
-তাকিয়াচালানটা কী কেস ভদিদা?
-ভেরি ইন্টারেস্টিং। কংগ্রেস, তারপর গিয়ে কংগ্রেস ভেঙে অনেক দল যেসব হয়েছে ওরা তো ফরাস আর তাকিয়া নিয়ে বসে। ভালো তাকিয়াচালান হলে পিঠ হেলাতে গেল কি তাকিয়াও গড়িয়ে সরে যাবে। ঠেসই দিতে পারবে না। চিৎ হয়ে পড়বে। মানেই হ্যাটা। মানেই কেরিয়ারের পুঁটকিজাম। এরকমই কত কী — শ্মশানবন্দ, ভূত লাগানো, পেটপোড়া, ক্ষুর চালা, চুরির তুক, কলেরা বা প্লেগের তদবির, নিশির ডাক কাটানো, হাগা বাণ, রাঁড়-ঢ্যামনা কাটার মন্তর — এইজন্যে ঘর ভাড়া। দিচ্ছে কে? চোক্তার ভদি। মাথায় কিছু ঢুকছে?
-না ঢুকে পারে? একেবারে চাম্পি বিজনেস!
-তবে হ্যাঁ। সব বড় বড় খদ্দের। মিনিস্টার, সিনেমা স্টার, ক্রিকেট প্লেয়ার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার — কেউ বাদ নেই। খুব আবডাল রাখতে হয়। লোক জানাজানি হলে রক্ষে নেই।
-কিন্তু সাইনবোর্ড দেখেই তো জানবে।
-ঐখানেই তো চোক্তারের ফন্দি। হেঁজি-পেঁজি এল তো এল। পেছনে অন্য দরজা আছে। দরকার হলে বোরখা, ছাতার কাপড়ের আলখাল্লা, ফলস দাড়ি, পরচুলা — সব ব্যবস্থা আছে।
-পুলিশ ঝামেলা করে না?
-করবে না কেন? নতুন ও.সি. ফোসি হলে গোড়ার দিকে একটু লপচপানি মারে তারপর সাইজ হয়ে যায় — যেখানকার যা নিয়ম। হাত মে মাল্লু, ঘর যা কাল্লু। ব্যাস, কোনো ঝুটঝামালা নেই। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকো। আর মোলায়েম করে মেরে যাও। চোক্তারের কারবারের এই হল ধম্মো। তবে সি.পি.এম.-এর গওরমেন্ট তো, যে কোনো টাইমে খচড়ামি করতে পারে। করলেই লাইন উপড়ে সাইনবোর্ড পাল্টে দেব।
-কী করবে অমন হলে?
-নার্সিং হোম খুলে দেব। নামও ঠিক করা আছে। ‘মৃত্যুদূত নার্সিং হোম’।
-উরিঃ সাঁটি। ঐ নাম শুনলে কেউ আসবে!
-আসবে মানে? পিলপিল করে আসবে। সকলেই জানে যে রোগী কোথাও বাঁচে না। অতএব মরুঞ্চে মাল হলেই এখানে চালান করে দেবে। নার্সিং হোমেও দেওয়া হল, দাঁত কেলিয়ে পটলেও গেল। নো প্রবলেম। দুটো ডাক্তারও আমি ফিট করে রেখেচি। ওদের হাতে আজ অবদি একটা রোগীও বাঁচেনি। ঐ দুটোকে রাখব। তারপর বেচামণি আচে, নলেন আচে…
-আমরাও আছি, ভদিদা।
-সে তো বটেই। এই রে! বাবা এসে গেচে। এবারে ঝটপট কাজ না এগোলে খচে যাবে।
-বাবা মানে? কোথাও কেউ তো নেই!
নলেন ফিক ও বেচামণি খিলখিল করে হাসি জুড়ে দেওয়ার ফলে আতঙ্কময় মুহূর্তটি অচিরেই প্রার্থিত মাত্রা পেয়ে যায়। বড়িলালও খটকায় দুলছে। ভদিরই কোনো বিশিষ্টার্থক হেলদোল নেই। ন্যাড়া ছাদের আলশের দিকে হাতজোড় করতে ফ্যাতাড়ুর ছটি ও বড়িলালের দুটি চোখ সেইদিকে ধায় — আলশের ধারে একটি সুবৃহৎ, প্রাচীন ও প্রাজ্ঞ দাঁড়কাক বসে চোখ পাকিয়ে সব দেখছে।
-চাকতির ঘর খুলবে। মন্তরে মন্তর, যন্তরে যন্তর — সব মিলে গেল। জানতুম বাবা না এসে পারবে না।
যে বাংলা ভাষা আর কখনোই হাসিল হবে না সেই বাংলায় এই পাখিটিরই নাম দণ্ডকাক। দণ্ডকারণ্যে হয়তো এই ধরনের কাক দেদারে দেখা দেয় এমন হতে পারে। না হলেও কোনো খিঁট নেই। এই টাইপের কাক কলকাতায় বেশি দেখা যায় না। তবে বেগম জনসনের আমলে কলকাতায় দাঁড়কাকের ছড়াছড়ি ছিল বলেই শোনা যায়। বেগম জনসন (১৭২৮-১৮১২) প্রসঙ্গে আমাদের পরে যখন না এসে উপায় নেই তাই একটু আগেই গাওনা গেয়ে রাখা ভালো। এই কলকাতাতেই তিনি সেন্ট জনস চার্চ গোরস্থানে জব চারনক ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের কাছেই কবরস্থ অবস্থায় আছেন। ভূমিকম্প জাতীয় কিছু না হলে ওভাবেই থাকবেন এ আশা দুরাশা নয়। আপাতত ভদির পিতৃরূপী গাঢ় একটি কর্কশ আরাব নিক্ষেপ করল যা আর যাই হোক ‘কা … আ …’ কখনোই নয়।
— কী চাইছ বাবা? আনন্দলাড়ু খাবে?
এইবার দাঁড়কাক নির্ভেজাল মনুষ্যকন্ঠে বলল বা বলিল,
— অতীব আনন্দঘন কাল। মন্তর ও যন্তর সব মিলে গেছে, আনন্দবাজারে আনন্দ, চোক্তারের ঘরে ফ্যাতাড়ু , চারদিন পরে কাটা মুণ্ডুর ভোজবাজি, সবই যখন ডগোমগো তখন আর কালক্ষয় কেন?
-এঁজ্ঞে, আপনি না এলে …
-চোপরাও। ফের কতা বললে মুকে আঁশবঁটি ভরে দেব। খোল, শালা চাকতির ঘর।
ভদি আর কালবিলম্ব না করে বেচামণির কাছ থেকে চাবির গোছাটি নেয়। চাকতির ঘরের তালাটি কোম্পানির গোড়ার দিকের দাসলক। চাবিটিও তেমনই আখাম্বা। দরজার ওপারে বোঁ-বোঁ শব্দ যেন হাজার খানেক ভিমরুল পাখসাট মারছে। ঘর খুলতেই ছোট সাইজের কয়েকটি চাকতি বা উড়ন্ত চাকি সাইরেনের মতো শব্দ করে তেড়ে বেরিয়ে ঘোলাটে আকাশে উধাও হয়ে গেল। বড় চাকতিগুলো বনবন করে ঘুরছে কিন্তু বেরোচ্ছে না।
-দরোয়াজা খোলাই থাক। ওরা ইচ্ছেমতো বেরোবে, ঢুকবে। তোরা তোদের কাজ করে চল। ঠিক টাইমে আমি ফের এসে পড়ব।
দণ্ডকাক হুস করিয়া উড়িয়া গেল।
বড়িলাল দেখল এবারে কেটে পড়াই ভালো কারণ খিদে পেয়ে গেছে। পরে না হয় এসে দেখা যাবে জল কতটা গড়াল। ঠাণ্ডার দাঁত না থাকলেও মাড়ি রয়েছে। আবার গরমও লাগছে। ফেরার রাস্তায় বড়িলালের চোখ পড়ল দেওয়ালের গায় বিরাট এক দাড়িওয়ালা মুণ্ডু এবং তারই পাশে কামান দাগার মতো জাঁদরেল লেখা ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা বিজ্ঞান’। এই লিখন যে নোনাধরা দেওয়ালের গায় সরব তার নীচে নর্দমা। তাতে জমা জলে কালচে তন্বী শ্যাওলা কোমর দোলায় ও হাজার হাজার মশার লার্ভা নাচানাচি করে।
‘সকলি ধ্বংসের পথে! সকলি ধ্বংসের পথে!
কেহ অশ্বে কেহ গজে,
কেহ যায় পদব্রজে,
কেহ স্বর্ণ-চতুর্দোলে, কেহ যায় পুষ্পরথে ;
সকলি ধ্বংসের পথে! সকলি ধ্বংসের পথে!
(চলবে)
৪
এখন চলছে ক্যুইজের যুগ। পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে, কলতলায় কলতলায় চলেছে অবিরাম ক্যুইজ। মানুষের জ্ঞান যত বাড়ছে, মানুষের বাচ্চাদের হেডপিস যত সরেশ হচ্ছে ততই অবধারিত হয়ে উঠছে ক্যুইজের প্রয়োজনীয়তা। কলকাতায় কবে প্রথম পেচ্ছাপখানা চালু হল, লন্ডনে রাস্তায় হাগলে কত পাউন্ড জরিমানা হয়, কপিলদেবের দাদুর নাম কী, শান্তিনিকেতনে কোথায় কোথায় মাল কিনতে পাওয়া যায়, হাতিবাগানের শেষ বেবি-ট্যাক্সির ড্রাইভার কে, ক্রিকেট ব্যাটে ঘুণ ধরে না কেন, এরকম নানা প্রশ্ন ও তদনুযায়ী জবাবও মজুত রয়েছে। কিন্তু এই সিরিয়াল নভেলটি-র গত এপিসোডের শেষে ঐ কবিতাটি কার লেখা? অনেক ক্যুইজ মাস্টারও কেলিয়ে পড়বে। এবং শিশুদের প্রশ্নটি করে লাভ নেই। তাদের বাপগুলিও জানে না। তার আগের কোম্পানি হয়তো-বা জানত কিন্তু তাদেরও বেশিরভাগ অন্তর্হিত। সেই কবি এখনকার কাব্যকারদের মতো ঢ্যামনামি জানতেন না। তবে দুনিয়ায় হারামির হাট তখনো যে বসেনি এমনটি নয়। না হলে তিনি কোন দুঃখে লিখতে যাবেন,
একটুকু ভালোবাসা একটি স্নেহের ভাষা,
এক ফোঁটা আঁখিজল কোথাও না পাই!
সত্যই এ বসুন্ধরা কেবলি রাক্ষস ভরা,
দয়ার সে দেবতারা এ জগতে নাই!
মিছামিছি দেশে দেশে ভ্রমিয়া বেড়াই।
এঁরই সম্বন্ধে ১৩৫৫ সালে শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছিলেন, ইনিই ‘বাঙ্গালাদেশের শেষ, জাতীয় বাঙ্গালী কবি’ এবং তাঁর আশা ছিল কেন, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে ‘একথা সকলেই স্বীকার করিবেন।’ বলাই বাহুল্য যে কেউই এসব কথায় বিশ্বাস করে না। সেটা সম্ভবত আগেভাগেই আঁচ করেছিলেন শ্রী কৈলাসচন্দ্র আচার্য। ঐ কবির কাব্যসংকলনের তিনিই ছিলেন প্রকাশক যার ভূমিকা লিখেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। ঐ ভূমিকাটিতে আর কী কী ছিল জানার বোধহয় আর উপায় নেই কারণ ‘প্রকাশকের কথা’-য় কৈলাসবাবু সাফকথা শুনিয়ে দিয়েছেন ‘কাগজের অভাবের জন্য বিশেষ অনিচ্ছায় ঐ ভূমিকার অধিকাংশ বাদ দিয়া তাহা মুদ্রিত হইল।’ ১৩৫৫ সালে পুঁজিবাদী বাজারে কাগজের ক্রাইসিস হয়েছিল না হয়নি তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিতর্ক চলবেই। যে কবিকে নিয়ে এত কিছু তাঁর কিন্তু অনেক সহজ সমাধান জানা ছিল,
গু মাখিয়া মারি ঝাঁটা যত মনে লয়!
বাঙ্গালী মানুষ যদি, প্রেত কারে কয়?
বাঙালি তাঁকে মনে রাখেনি। রাখবেও না। অবশ্য তাতে স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের কিছু আসবে যাবে না।
জানা আছে যে নানা অভিযোগ উঠবে। বেশ বাঁশবেড়ে-গুপ্তিপাড়া রুট খুলেছিল, আচমকা ধরতাইটা ভারিক্কি ধাঁচের হয়ে গেল কেন ঠাকুর? কিন্তু অনাদ্যন্ত চ্যাংড়ামি চলবে এরকম কোনো গ্যারান্টি কি ছিল? লেখকের মর্জি, তার খোলতাই, প্যাঁচ লড়াবার ধান্দা, বিশেষত আওকাৎ যদি ঠিক থাকে তাহলে ফলানা ডিমকা থেকে এক ডাইভে হেথা নয়, হেথা নয় হয়ে যেতেই পারে। আধুনিক আখ্যান খুবই অনেকান্তবাদী। ঐ হা হা হাসি, এই হু হু হাওয়া। এরকমই এখন চলবে। থেকে থেকে লেখকের নাক ডাকবে কারণ সে লেখার স্বপ্নে বিভোর। পাঠক কিন্তু সজাগ। যে প্রান্তরে পাঠানরা যুদ্ধ করেছিল এখন সেখানে পাঁঠা চরছে। এমতাবস্থায় পাঠককে জেগে থাকতে হবেই। সাহিত্য নামধারী বিশাল জঞ্জালের পাহাড় থেকে একটি কুটোও যেন না হারায়। গেলে রক্ষে নেই। মাত্র কিছুদিন আগে এরকম ছিল না। তখন পাঠক সাহিত্যকর্মকে পাশবালিশ বা বাঁদরটুপি মনে করত। এখন আর তা হওয়ার উপায় নেই। টিকিট কেটে হাতি চড়ার যুগ বিগত। চিরতরেই। এখন টিকিট নয়, খাল কাটার যুগ। এবং খাল কাটলে যা ঢোকার তা ঢুকবেই। বৃহত্তর, চক্রাকার জিলিপির প্যাঁচের মধ্যে এ হল একটি ছোট্ট পয়জার।
সব সিরিয়ালে না হইলেও বেশ কয়েকটিতে রিক্যাপ বলিয়া একটি অংশ থাকে। ইহার ফলে আগে যাহা ঘটিয়াছিল তাহার মর্মসার বুদ্ধিমান দর্শক অচিরেই আত্মসাৎ করিয়া ফেলে এবং মাঝে মধ্যে ক্লাস ‘বাংক’ করিলেও মূল বিষয়টির অসংখ্য ডালপালার কোনো কুসুম হতেই নেশাচুর ভ্রমরের মতো কদাচ চ্যুত হয় না। সেমতোই এমনও নিশ্চয় ঘটিবে যে কোনো পাঠক হয়তো এই পর্ব হইতে বা ধরা যাক, এই বড় করিয়া হইতে এই মেট্রো নভেলটি পড়িতে শুরু করিলেন। এমনও প্রায়শই ঘটিয়া থাকে যে তিনি ইহার পূর্বে ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’ পাঠ করিয়া এমনই তুরীয় আনন্দ উপভোগ করিয়াছিলেন যে ‘মাধবীকঙ্কন’ তাঁহার নিকট নিতান্তই রাবিশ বলিয়া মনে হইয়াছিল। তিনি হয়তো নিতান্তই স্নেহবশত বা আদিখ্যেতা করিয়া নভেলটি-র নাম ভাবিলেন ‘বাঙালী জীবন-নাইট’। অবশ্য এসবই মৃতপাঠ কারণ আগেভাগেই বড় করিয়া আছে। সিরিয়াল নভেলটিতে রিক্যাপ চলিবে? শেষের সেদিন যদি আজ না হয় তাহলে পাঠক তুমি নিরুত্তর কেন? দিবসের শেষে তোমাকে কুমিরে নেবে। কিন্তু তারও দেরি আছে। এত তাড়া কীসের?
বড়িলাল কেটে পড়ার ঘন্টাদুয়েক বাদে ফ্যাতাড়ুরাও ভদির বাড়ি থেকে টলমল পায়ে বেরিয়ে এল। যদিও মাথা যথেষ্ট টরটরে।
-উফ এতদিন কী খামকাজটাই না করে এসেচি!
-যেমন?
-ভাবতুম আমাদের কেউ ডিঙোতে পারবে না। ফ্যাতাড়ুদের সঙ্গে টক্কর দেনেওয়ালা কোনো মায়ের লাল পয়দা হয়নি। এখন দেখচি…
-কী দেখচ?
-দেখচি কোথায় বাঘের রোঁয়া, কোথায় ঝাঁটের লোম। চোক্তাররাই তাহলে টপ। যাক বাবা, ভাগ্যে দলে ভিড়িয়ে নিল। ভাবো তো, তিনজনের মুণ্ডু কেটে যদি টগরগাছের গোড়ায় ধড় শুদ্ধু পুঁতে দিত কোনো মামা বাঁচাতে পারত? নো পুলিশ কেস, নো ট্রেস।
-আমার তো বাঁড়া ওদিকে অন্য চিন্তা। লাইফ-টাইফ নিয়ে ডি. এস. ঘাবড়ায় না কিন্তু বউ-এর আট মাস চলচে । ছেলেটাকে একবার বাপের খোমাটা অব্দি দেখাতে পারব না।
-ঢপ মেরো নাতো, সবার আগে ব্রেক ডাউন করল কে? বলো মদনদা।
-মদনদা কী বলবে? ছেলেটার কথা ভেবেই তো কেমন যেন ডুকরে উঠল …
-আহা হা, কে আগে কাঁদল তাতে কী আসে যায়। বাংলা কথা সকলেরই পোঁদে ভয় ঢুকে গিয়েছিল।
-হ্যাঁ, হেভি!
-যাইহোক সে ভয়টয় কেটে গেছে অতএব ওসব নিয়ে ফালতু চুদুড়বুদুড় করে কোনো লাভ নেই।
-একদম না।
-এখন ঠাণ্ডা মাথায় বসে আমাদের ব্যাপারটা একবার ঝালিয়ে নিতে হবে। এতদিন ফ্যাতাড়ুই ছিল বড় তরফ। শের। কিন্তু চোক্তার দেখা যাচ্ছে শেরের বাবা, পাঁচ পো। গপ্পোটা জানো তো?
-আমি জানি।
-আমি জানি না।
-ঠিক আছে, ডি. এস. এক ফাঁকে তোমাকে বলে দেবে। মোট কথা, এখন আমাদের চোক্তারের চামচাগিরি করতে হবে। চোক্তার লিডার, আমরা ক্যাডার। চোক্তার কাঁঠাল, আমরা লিচু।
-চোক্তার তুমি এগিয়ে চলো! ফ্যাতাড়ু তোমার সঙ্গে আচে।
-কুত্তার বাচ্চারা করে ঘেউ ঘেউ।
চোক্তার কেঁদোবাঘ, ফ্যাতাড়ুরা ফেউ।
-এইসব কথার মধ্যে বানালে?
-জানবে।
-মদনদা, পুরন্দর একটা জিনিস। আর ঝগড়া করব না।
-আর একটা বানালুম। তবে জোরে বলা যাবেনা।
-আস্তেই বলো না। কয়েকটা ঝি বাসন মাজচে। কী করবে শুনলে?
-বাগানে শোভিছে কত
সি. পি. এম ফুল
তলায় ঘাপটি মেরে
বাড়ে তৃণমূল
-ঝিগুলো কিন্তু তাকাচ্ছে।
-তাকাবেই তো। এই পাড়ায় আগে কংগ্রেসের হেভি রোয়াব ছিল। পরে মেজরিটি সি. পি. এম হয়ে গেল। এখন আবার তৃণমূল বাড়ছে। যে কোনো টাইমে ক্যালাকেলি লেগে যেতে পারে।
-তুমি এতসব জাহাজের খবর জানলে কী করে?
-আরে বাবা, কবি হলেই তো হল না। চোখকান খুলে রাখতে হয়। আমরা হলুম জানবে পলিটিক্যাল পোয়েট। ওসব ন্যাকড়ামো পদ্য-ফদ্য লিখি না। সবসময়ে তরতাজা। জ্যান্ত ট্যাংরা। একবার কাঁটা মেরে দিলেই সেপটিক। ক্যাপসুল না ঝাড়লে উপায় নেই। মাথায় ঢুকল?
-ওসব পদ্য-ফদ্য মাথায় ঢুকিয়ে মরি আর কি। হাজারটা চিন্তা। এক কান দিয়ে শুনলুম। আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। খেল খতম।
-তাই তো হবে। দু-কানের মধ্যে স্রেফ ফাঁকা। ধরবে কিসে? ভগবান যে কতরকমের গাণ্ডু বানিয়েচে।
মদন বুঝল ফের ক্যাচাল শুরু হবে,
-থামো তো! যে যেমন বুঝেচ তাই নিয়ে থাকো। ভদিদা যা যা বলেচে সেগুলো মনে আচে? ডি. এস বলো তো চোক্তারের গুষ্টির আদিপুরুষ কে?
-শুনেছিলুম। কিন্তু মনে নেই।
-এই যে কোনো কিছু মন দিয়ে শোনো না, এর ফলে কিন্তু একদিন মোক্ষম ফেঁসে যাবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই শুনলে আর ভুলে মেরে দিলে?
-মাল খেলে এরকম হবেই।
মদন রেগে দাঁত খুলে পকেটে ঢোকায়।
-বাল! আমি আজ অব্দি যত মাল খেয়েচি তুমি সাঁতরে পার হতে পারবেনা। মাল খেলে এরকম হবেই!
-ঠিক আচে বাবা। খেয়াল করে শুনিনি, গোক্ষুরি হয়েচে। এবার বলে দাও। আর ভুলব না।
-জানি না বাবা, ভদিদা সব জানতে পারচে কিনা। ভদিদা খচে গেলে কী হবে আন্দাজ আচে?
-আরে বাবা, আচে বলেই তো এই নাও দু কান ধরচি। এমন আর কক্ষুনো করব না।
-ঠিক আচে। পুরন্দর, তোমার?
-মানে তখন বৌদির মাথায় ঐ স্যাম্পু করা চুল দেখে একটা কবিতা ঘুরছিল তাই …
-বাঃ চমৎকার, একেবারে ডুগিতবলা। ওটা কী স্যাম্পু মনে আচে?
-না।
– ওটা হল ডগ স্যাম্পু। সায়েবরা কুকুরদের মাখায়।। সায়েবদের কুকুর দেখেচ? ইয়া বড় বড় সোনালি লোম। ঠাণ্ডার দেশের কুকুর তো। বরফের মধ্যে হাগতে বেরোয়।
-তাহলে ভদিদা বৌদির জন্যে ঐ স্যাম্পু আনতে গেল কেন? নিজের বৌ বলে কতা।
-বলচি। সাধনা করে করে বৌদির মাথায় এমন জট পড়ে গিয়েছিল যে এমনি স্যাম্পুতে হত না। তখন ভদিদা নলেনকে দিয়ে ঐ স্যাম্পু আনাল। গায়ে কুকুরের ছবি। কেরোসিনে গোটা মাথা ভিজিয়ে নিল। উকুন-টুকুন সব হাওয়া হয়ে গেল। জটও আলগা হল। তারপর ডগ স্যাম্পু। এখন চুল দেখো না! চুল তো নয়, যেন পেখম।
এর পরপর যে ঘটনাটা ঘটল তা বড়ই দুষ্প্রাপ্য। বস্তুত, ইন্টারনেটের মশারির মধ্যেও এই ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে তা ভেবে ফেলাও খুবই সাহসের কাজ বটে। এই ঘটনাটিই তখন তার চেতলার বাড়ির ভাগের ঘরে শুয়ে বড়িলাল স্বপ্নে দেখেছিল। তার পেটে তখন প্রায় টেবিল চেয়ার ওল্টানো হোটেলের কুড়িয়ে বাড়িয়ে যোগানো ঠাণ্ডা কাঁটা কাঁটা ভাত আর পুরো ফুটে যাওয়া, সজারুর মতো দেখতে ফুলকপি ও আলুর ডালনা এবং পাকা মাছের লেজের তেলতেলে ছাল সব ওলটপালট খাচ্ছিল। বড়িলালের স্বপ্নটিতে সাউন্ড ট্র্যাক এক থাকলেও দৃশ্যটি সাদাকালো।
ঝুন ঝুন ঝুন ঝুন, টগবগ টগবগ, সাঁই সপাশ সাঁই সপাশ ও ক্যাঁচকোঁচ ক্যাঁচকোঁচ শব্দ। আচমকা এই সশব্দ দৃশ্যটি ফ্যাতাড়ুদের প্রায় ঘাড়ে এসে পড়ায় তারা ত্রস্ত নেটিভের মতো অবিকল দক্ষতার সঙ্গে রাস্তার ধারে ছিটকে সরে যায়। এই হল কলকাতার সেই প্রসিদ্ধ ‘হাওয়া খানা’ বা (‘eat the air’) — ঝকমকে পালিশ করা ফিটন গাড়ি। সামনে চোখ বাঁধা আসল ঘোড়া, বেতো খচ্চর নয়। সহিসের মাথায় পেল্লায় পাগড়ি। মনে হবে রাজ্যপালের এডিকং। খোলা ফিটনে বিশাল আকৃতির এক মেমসাহেব বসে। ইনিই তিনি অর্থাৎ যার কথা আগেই বলা আছে সেই বেগম জনসন। চোখ প্যাঁটপ্যাঁট করে রাস্তার দুধারই নেকনজরে রাখছেন। উল্টোদিকের সিটে তন্বী দুটি কচি মেম। ঘুমন্ত বড়িলাল ও জাগন্ত ফ্যাতাড়ুদের কানে অদৃশ্য কোনো নম্র প্রেত বলে গেল, ‘বাঁ-দিকেরটিকে — চিনলে? উনি মিস স্যান্ডারসন। পাশেই মিস এমা র্যাংহাম।’ চারজনেই ফটাফট সেলাম ঠোকে। উরি গুরুঃ ফিটনের পরেই একেবারে ব্রিচেস ও হাতঢোলা সাদা সার্ট পরা দুই সাহেব। স্ব স্ব ঘোড়ায় দুলকি ঢঙে চলেছে। দুই সাহেবই একযোগে মুখ তুলে সিনেমার হোর্ডিং-এ রাণি মুখার্জির পাগলা করে দেওয়া ছবিটা একবার মেপে নিল। এবং তারপরই দুই কচি মেমের দিকে। এবারে প্রেত-কন্ঠের দরকারই হয় না। চারজনেই বুঝে যায় যে, অবধারিতভাবে একজন যেহেতু মিঃ স্লিম্যান সুতরাং অন্যজন মিঃ শেরউড হতে বাধ্য। ১৭৮১ সালে ক্যালকাটায় এরকম একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় (আনন্দবাজারে নয়) — ‘To be sold by private sale: Two coffree boys, who play reasonably well on the french horn; about eighteen years of age; belonging to a portuguese padre lately deceased’ এই দুটি কাফ্রি যুবককে মিঃ স্লিম্যান ও মিঃ শেরউড খরিদ করিয়াছিলেন। এই ‘হাওয়া খানা’-র শব্দময় দৃশ্যটি যেমন অতর্কিতে এসেছিল তেমনই ভ্যানিশ করে যায়। এ তো সবে শুরু। এরকমই এখন হতে থাকবে। ১০ নম্বর ক্লাইভ স্ট্রিট ছিল বেগম জনসনের ঠিকানা। অন্য দুই মিসিবাবার ঠিকানাও হয়তো একদিন আমরা পেয়ে যাব।
-কী বুঝলে? ডি. এস?
-মেম দুখানা কিন্তু ক্যাঁচা মাল, কিন্তু মুটকিটাকে দেখলে ভয় করে।
-শোনো, ওদের সম্বন্ধে সমঝে কথা বলবে। একবার যদি সায়েবদের কানে ওঠে তাহলে দফারফা। পুরন্দর?
-আমি ভাবচি এসবই কি চাকতির চক্কর। ভদিদা যে বলল সব তুলকালাম কান্ড হবে।
-এ তো কলির সন্ধে। এখন তো আসর সবে বসতে শুরু করেচে। যাত্রাপার্টি এসে পোঁছয়নি।
-মানে, জল আরও গড়াবে বলচ?
-অনেক দূর। সোজা কথা হল চোক্তারি পরোয়ানা একবার জারি হয়ে গেলে আর কেউ থামাতে পারবে না।
স্বপ্ন ফুরোবার পরে বড়িলালের ঘুম আরও গাঢ় হল। একই স্বপ্নে রাণি মুখার্জি, মিস স্যান্ডারসন ও মিস এমা র্যাংহাম-কে পাওয়া যেমন সুখের তেমনই বিরক্তিকর বেগম জনসন ও দুই কামুক সায়েবকে সহ্য করা। এতক্ষণ একটা রুগ্ন মাছি হনুমানজীর সামনে বসে নকুলদানা খাচ্ছিল। এবারে কী খেয়ালে সে বড়িলালের নাকে এসে বসল এবং এর ফলে ঘুমের ঘোরেই বড়িলাল পাশ ফিরে শুল। ঘোড়ার রেস চলছে। বড়িলালের ইতিহাস নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকতেই বা যাবে কেন? কিন্তু এই শিক্ষাপ্রদ ঘুম তাকে ছাড়বে কেন? এবারে আর সাহেব মেম নয়, ঘোড়া। ঘোড়ার জল খাওয়ার চৌবাচ্চা বড়িলাল দেখেছে। এবারে সে জেনে ফেলল যে, ১৮১০ সালে বর্তমান রেস কোর্সটির পত্তন হলেও, এর আগেই, গার্ডেন রিচ-এর শেষ মাথায় একটি রেস কোর্স ছিল। হিকি’স গেজেটে ১৭৮০ সালেই রেস মিটিং ও রেস বল-এর খবর পাওয়া যায়। বেঙ্গল জকি ক্লাব স্থাপিত হয় ১৮০৩ সালে। বলাই বাহুল্য যে জকিগিরির সঙ্গে বাঙালির যোগাযোগ নিবিড় বলে কোনো সোচ্চার তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও ঘোড়ায় চড়ে হাগতে যাওয়া যে বাঙালির হাতের পাঁচ তা কে না জানে? বড়িলাল উপুড় হয়ে শুল।
-তবে একটা কথা। ভদিদা যা বলেচে তা কিন্তু কাউকে বলতে যেও না। মানে এমন ভাবটি দেখাবে যে, তুমি কিচ্ছু জানো না।
-খেপেচ? যার ভরসায় থাকা তার নাম মুখে আনা নেই।
-টুঁ শব্দটি না। ভদিদা বলেচে কয়েকদিন আমাদের ওপর নজর রাখবে। তারপর একটা দুটো করে কাজ দিয়ে শুরু করবে।
-আচ্ছা, ঐ যে কয়েকটা চাকতি যে উড়ে বেরোল সেগুলো এখন কী করে বেড়াচ্চে বলো তো?
-জানবার যো নেই। সব গোপন খেলা। তবে ঐ যে ‘হাওয়া খানা’ ফিটন গেল, এটা চাকতিরই কারবার।
-ছোট করে একটু আঁচ দিয়ে গেল। তাই না মদনদা?
-তা তো বটেই। তবে ভদিদা বলেচে এখন দিন তিনচার বেশি কিছু হবে না। ডি. এস. মালকড়ির খবর কী?
-আজ আমার পকেটে সাকুল্যে চার টাকা।
– পুরন্দর?
-কত লাগবে?
-বেশি না। অন্ধকারটা না জমলে উড়তে পারব না। এই ফাঁকে একটু চা-বিস্কুট প্যাঁদাব ভাবছিলুম।
-সে হয়ে যাবে। টাকা বারো আছে।
-আমি নেই।
-কেন?
-একবার মাল স্টার্ট হয়ে গেলে তারপর চা-ফা খেতে আমার ঘেন্না করে। চার্জিং বলো তো আচি।
-পকেটে তো চার টাকা। কী চার্জিং করবে। পোড়া ডিজেল?
ডি. এস ওর তোবড়ানো ব্রিফকেসটা রাস্তার ওপরে রাখল। তারপর প্যান্ট আর পেটের তলার মধ্যে হাত গলিয়ে জাঙিয়ার ভেতর থেকে সরু করে ভাঁজ করা একটা একশো টাকার নোট বের করল। ভাঁজ খুলতে নোটটা হাওয়ায় দুলতে লাগল।
-আমার নাম ডি. এস, বুঝেচ? পুজোর বাজারে আমার কাছে অল টাইম একটা দুটো বড় পাত্তি থাকবেই।
-উরি শালাঃ হেভি হারামি তো!
-তবে! কীরকম দিলুম মদনদা। বলো!
-শোনো, তুমি যদি জাতক্যাওড়া না হতে, তোমাকে আমি ফ্যাতাড়ু করতুম?
-নতুন এনার্জি এসে গেল। কেমন যেন ন্যাতাজোবড়া লাগছিল।
-কোথায় যাবে? গাঁজা পার্ক না গরচা?
-কোনোটাতেই না। দুটো ঠেকেই নানা উল্টোপাল্টা পাবলিক। তার চেয়ে বরং টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে চলো। জায়গাটা ছড়ানো। ভিড়ভাট্টাও কম।
-এখানে কিন্তু মালটা সবসময় আসলি দেয় না, জানো তো? জল পাঞ্চ করে।
-ছাড়ো না। আমার সঙ্গে জালি করা অত সোজা নয়। ওরা লোক চেনে।
ফ্যাতাড়ুরা খুবই আনন্দময় বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সহযোগে টালিগঞ্জগামী একটি ২৯ নম্বর ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে উঠে গেল। এবং ট্রামটিও কালবিলম্ব না করে সংরক্ষিত ডাঙা দিয়ে ঝ্যাড়র ঝ্যাড়র শব্দ করতে করতে গড়াতে শুরু করল। এই লাইনের দুপাশেই কিছু ঘাস, কিছু বেঁটে মাপের টোপাকুল গাছ, কিছু অজানা গুল্ম ও অনেক পরিমাণে গু-এর পিরামিড দেখা যায়। দুপাশেই পিচ রাস্তা দিয়ে বিস্তর গাড়ি। দূষণের ধোঁয়া সবকিছুতেই এক মায়াময় মলিনতা আনে। আর ঝোড়ো বেয়াড়া বাতাস দিলেই দেখা যায় শান্তির সেই সাদা কবুতরের মতোই নানা মাপের পলিব্যাগ ওড়াউড়ি করছে। যারা পথে তাদের বাড়ির দিকে মন। যারা বাড়িতে তাদের টিভির দিকে। অতএব এসব খুচরো অলৌকিক দৃশ্য দেখার জন্য কারোরই টাইম নেই। অবশ্য পাগল ও চামচিকেরা এ বিষয়ে খুবই সমঝদার। যে কলকাতাকে ভেঙে, দুমড়ে, ঝলসে, গলিয়ে, থেঁতলে, খুবলে অজানা এক ধাতু ও সিন্থেটিক পদার্থের বিকট সমাহারে ঢেলে পাল্টানো হচ্ছে সেই কলকাতার আসল বন্ধু হল পাগল ও চামচিকেরা। সেই সঙ্গে কয়েকটা রঙ-মাখা মেয়ে, কুকুর, বাদুড়, বেড়াল, প্যাঁচা, ইঁদুর, ছুঁচো, আরশোলা, ভিখিরি ও পিঁপড়েরাও রয়েছে। মশা, মাছি ও শেষ কয়েকটি প্রজাতির শ্বাসরুদ্ধ প্রজাপতি ও মথ এবং চড়াই, শালিখ, কাক, চিলরাও এই দলে যোগ দিল। কেউ যদি বাদ পড়ে যায় তাদের জন্যেও এই জায়গাটা খোলা থাকল বলে ছেদচিহ্ন দেওয়া হল না
কারোর মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দেবার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। কেউ শুনুক বা না শুনুক এর জন্যে চেষ্টা একটা চালাতে হবেই। লেখায়, না-লেখায় – সব জায়গায়, সব সময়। তবেই না আসতে পারবে। আরে বাবা, সব থেকে যার গুমোর সেই গনগনে চুল্লির দরজাকেও খুলতে হয়। ফুরসৎ পেলে এসব ভাবনায় তো ফিরে আসাই যায়।
সেই রাতেই টালিগঞ্জ ফাঁড়ির বাংলার ঠেকে ঢোকবার গলিতে ছোলাভেজা কেনার সময় ডি. এস.-এর সঙ্গে একজন গাল তোবড়ানো, খোঁচা দাড়ি আধবুড়ো ড্রাইভারের আলাপ হল। ওর বগলে একটা পাঁইট ছিল। পকেটে একটা প্লাস্টিকের গেলাশ। মুখে নেভা বিড়ি। দাঁতে কামড়ানো। ডি. এস. তাকে বগলদাবা করে বাকি দুজনের কাছে নিয়ে এসে বসাল। লোকটা মালে জল মেশায় না।
– আমি এখানকার রেগুলার খদ্দের। রোজ আসি। একটা পাঁইট খাই। তারপর কেটে পড়ি। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। পাঁইট ফুরোবে, আমিও হাওয়া। এক ফোঁটাও বেশি খাব না। কমও খাব না।
– সব সময় হিসেব ঠিক থাকে?
– রাখতে হয়। সব শিখেছি কাকে দেখে জানেন। আমার মালিককে দেখে। হেভি ঠাণ্ডা মাথার লোক। আজ অব্দি কোনোদিনও বলবে না, বলাই, দেরি হয়ে যাচ্চে। ঐ গাড়িটাকে ওভারটেক করো। ওকে চাপো। বরং বলবে যার বেশি বাপের বিয়ের তাড়া তাকে রাস্তা দিয়ে দে। সত্যিই বলুন। আপনাকেও যেতে হবে, আমাকেও যেতে হবে। এর মধ্যে গাঁড় মারামারি করে কোনো লাভ আছে?
– এই কথাটাই তো লোকে বুঝতে চায় না।
– একেই জানবেন রাস্তা কম। তারপর নিত্যি নতুন গাড়ি বেরুচ্ছে। আনকা ছোঁড়াগুলো স্টিয়ারিং ধরেই ভাবচে কী হনু রে। আরে বাবা, এর নাম কলকাতা। একানে রংবাজি করেচ কি মরেচ।
পুরন্দর মালের গেলাশে আঙুল ডুবিয়ে একটা পোকা তুলল।
– ভাগ্যে আপনার গেলাশে পড়েনি। নিট মালে কখন সাইজ হয়ে যেত।
-সে ওর যা ভাগ্য তাই হবে। সব কপাল।
– আপনি ভাগ্য-ফাগ্য মানেন?
– আগে মানতুম না। আমার চার বছরের ছেলেটা, আজকে থাকলে জোয়ান হয়ে যেত, বুঝলেন, ডাক্তারের উল্টো টিটমেন্টে মরে গেল। সেই থেকে মানি।
-কি হয়েছিল কী?
– ওর আপনার একটা খিঁচ ধরত বুঝলেন। মিগি টাইপের। আমাদের মাতাতে কী যে ভর করল। পাড়ার ডাক্তার ছেড়ে বড় ডাক্তার দেখাতে গেলাম। ছেলেটা তখন সদ্য হাম থেকে উঠেচে।
– এখনকার বড় ডাক্তার মানেই হারামি। খালি পয়সা খ্যাঁচার ধান্দা। গরিব ধরো আর বাঁড়া মুরগি বানাও।
– আমাকে অনেকে তাতিয়েছিল। বলল ডাক্তারের সঙ্গে কেস করতে। আমি বললুম কেস করলে আমরা, গরিবরা, কোনোদিনও পারব? কেউ পেরেচে? উকিল, পুলিশ — সব ওদের হাতের পাঁচ।
– আর কেসে জিতলে কি ছেলে ফিরে পেতেন?
– সেই না কতা। ওর ভাগ্যে যা ছিল হয়েচে। কী করা যাবে?
একটু দূরে একটা ছেলে উবু হয়ে বমি করছে। বমিটা মেঝেতে ঢাল আছে বলে গড়াচ্ছে। বমি টপকে টপকে খদ্দেররা ঢুকছে। বেরোচ্ছে।
– ঠিক আচে ভাই। দেখা হবে। নামটা মনে রাখবেন। বলাই। আমি কখনো মুখ ভুলি না।
বলাই চলে যাবার পরে ডি. এস. একটা চারমিনার ধরাল।
– এই দুককের কতা শুনলে কেমন মুড অফ হয়ে যায়। আমি আর একটা বোতল নিয়ে আসি।
– আবার বেশি নেশা হয়ে যাবে না তো! তারপর বাসট্রামে লোকে খিস্তি করবে?
-কে খিস্তি করবে? কোন ল্যাওড়া খিস্তি করবে?
ডি. এস বেশ জোরেই চেঁচায়। ফলে আশপাশের লোকজন ওকে দেখতে থাকে।
– কী হচ্ছে কী? লোকজন সব দেখচে। মাল আনবে তো মাল আনো, এর মধ্যে আবার। ফালতু হুপহাপ আমি একদম বরদাস্ত করতে পারি না।
এইবার ডি. এস বুক পকেট থেকে মাঝে মাঝে দাঁত ভাঙা একটা ময়লা চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে নিতে নিতে টলমল করে দাঁড়ায়। মুখে প্রায় হাসি।
– খিস্তিটা কাকে করলাম সেটা বলতে পারবে?
– পারব।
-কাকে?
— ঐ বোকাচোদা ডাক্তারকে।
চাকতির ঘরে তুমুল বোঁ বোঁ-র হট্টিচাল্লি। নানা মাপের চাকতি সারা ঘরে চরকি খাচ্ছে। কয়েকটা ম্যানহোলের সাইজের, তারপর বগিথালা, রেকাবি, সোডার বোতলের ছিপি — ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন গোল মালের আদলে। তাজ্জব ব্যাপার হল এই বিকট বোম্বাচাকের মধ্যে কিন্তু চাকতি-চাকতি কোনো ধাক্কাধাক্কি বা ট্যাকলিং নেই। কেবল যখন তারা ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ করতে করতে খুব কাছে এসে পড়ছে তখন নীলচে ফুলকি উড়ছে। চাকতির ঘুঘুচক্কর এখন যেহেতু বহাল থাকবে অতএব আমরা বরং চাকতির ঘরের সামনে বারান্দায় কী হচ্ছে সেইদিকে ধাবিত হতে পারি। একই দৃশ্যে আবদ্ধ থাকলে চোখে ঝিঁঝি ধরে যেতে পারে এমন বিপদও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বারান্দায় পঁচিশ পাওয়ারের একটি নোংরা ছাতাপড়া ডুম জ্বলছে বলে সবই কেমন ঘোলাটে ও ছত্রাকাছন্ন। গায়ে একটি আরশোলায় ফুটো করা চিমসে র্যাপার জড়িয়ে ভদি বসে আছে। পাশেই জবার মালা পরা বেচামণি। মালাটি হল জালি। প্লাস্টিকের জবাফুল, মধ্যে মধ্যে জরির জাঁক। ভদির সামনে গোটা পাঁচেক শুডঢা আর শুডঢি থেকে থেকে ভদিকে স্যালুট করছে এবং তাদের ক-হাত পেছনে ধুনুচিতে হাতপাখা মারছে নলেন। ভদি একতরফা তার ভলান্টিয়ারদের ডেঁটে যাচ্ছে।
– গত বছর পাপনাশিনী মহাদ্বাদশীতে আমি কী বলেছিলুম? কী?
– আঁজ্ঞে, সময় হলেই মহাচক্রপালা শুরু হবে।
– আর কী বলেছিলুম?
যে জবাব দিচ্ছিল সে মশা কামড়ানোর ফলে মাথার জায়গায় পোঁদ চুলকোয়।
– ঠিক স্মরণে নেই।
– গাণ্ডু হলে থাকবে কী করে? আমি বলিনি যে, সেইদিন সমাগত প্রায়।
– আঁজ্ঞে হ্যাঁ।
– যা বলব নামতা না করতে পারলে বাড়ি গিয়ে লিকে রাখবি। শালা! একটা পদ্য পড়েছিলুম। কেউ বলতে পারবি?
– আঁজ্ঞে পারব।
– তো বল।
সেই শুডঢাটি গলা খাঁকারি দিয়ে রেডি হয় কিন্তু আচমকা বেচামণি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠায় ঘাবড়ে যায়।
– ও কিছু না। ভর হচ্ছে তো! এরকম হবে! তুই বলে যা।
– মুন্ডু মারেন উঁকি
ফিক লো কালো খুকি
জয় মহাভয় চাকতির জয়
ধুকপুকি ধুকপুকি
– বাঃ বাঃ তোর হবে। বলে দিলুম তোর হবে।
আনন্দলাড়ুর মধ্যে আনন্দবটিকা
যবন বর্ষশেষ, ঘোর বিভীষিকা।
কী বুঝলি?
– আপনার শাস্ত্রকথা, আমরা কী করে বুঝব?
– বুঝবি। আমাকে বোঝাতে হবে না। পরের ইংরেজি মাসের সাত তারিকে কালীপুজো। ঐদিন দুনিয়া বুঝবে। আর চারদিন পরেই একটু জানান দেবে। নে এবার কেটে পড় তো। একদিকে ভলান্টিয়ার, দিনটা খেল ফ্যাতাড়ু, একন আবার বউ-এর ভর। নকড়াছকড়া করে দিল। নকড়াছকড়া করে দিল। ওরে নলেন। নলেন রে!
পাঠান, পাঁঠা, পাঠক, পাঠ — এইরকমই হবে। যাইহোক, আনন্দলাড়ুর মধ্যে আনন্দবটিকা মানে যে আনন্দবাজারে যাদুকর আনন্দের বিজ্ঞাপন সেটা ক্লিয়ার হল। যবনবর্ষ মানে ১৯৯৯-এর ২৪ অক্টোবরেই আমাদের বলির পাঁঠাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। এরপর নভেম্বর, ডিসেম্বর। ঘোর বিভীষিকা। ২৮ তারিখ যে মুন্ডু-ড্যান্স হয়েছিল তা সকলেই জানে। অতীব সংস্কৃতিবান পাঠক নিশ্চয়ই মুন্ডু-ড্যান্সকে ক্যান্ডি-ড্যান্সের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। ফেললেই বা কী? যাহা ক্যান্ডি তাহাই মুন্ডু। যে কোনো মোমেন্টে বিশৃঙ্খলা বিশালত্ব পেতে পারে। ভদি ভীমনাদে ‘বেচামণে!’ বলে ডেকে উঠতে পারে। এবার দেখা যাক কালীপুজোয় কী হয়। সাহিত্যেও আজকাল বিধিসম্মত সতর্কীকরণ সবিশেষ জরুরি হইয়া পড়িয়াছে।
ওপারে যেওনা ভাই ফটিংটিং-এর ভয়
তারা তিন মিনষে মাথা কাটা, পা-য় কথা কয়।
(চলবে)
৫
(চলবে) বলে যে লেখার এক একটি পক্কড় শেষ হয় তার সঙ্গে তুলনীয় হল অতীব ভয়াবহ ঘাপটি মারা সাবমেরিন। ‘কাঙাল মালসাট’ নামক সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজটি মাসে একবার সুনীল ও ঘোলাটে জলরাশি, জেলিফিশ, টাইটানিকের দীর্ঘশ্বাস ও মরণোপম চৌম্বক মাইনের মধ্যে পিঠ দেখায় এবং তারপরই ক্যাপটেন নিমো-র নির্দেশে পুনরায় তলিয়ে যায়। শুশুকেরাও এরকমই করে যদিও তাদের কোনো পেরিস্কোপ, টর্পেডো ও আক্রমণাত্মক বাসনা থাকে না। এত খোলসা করে বলার টার্গেট একটাই। ডুবোজাহাজ ফুটো হয়ে জল ঢুকে যে কোনো সময় কেলো ও ট্রাজেডি ঘটে যেতে পারে। এই বিপদ এখন আসন্নপ্রায় কারণ পূর্ববর্তী ‘(চলবে)’-র শেষে যে ফটিংটিং- এর ভয় দেখানো হয়েছে তা মোটেই আজগুবি মাল নয়। স্রেফ লেখা বা লেখক নয়, এক একটা গোটা সমাজব্যবস্থা ও সাম্রাজ্য যখনই ফটিংটিং-দের এলাকায় মাজাকি মারতে গেছে তখনই যা ঘটেছে তাকে গন-ফট বলা যায়। অতএব সে বিপদ যে থেকে গেল শুধু তাই নয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধিরও সম্ভাবনা। অনেকেই আশা করেছিল যে ছড়া, প্রবাদ, পুরাণকল্প ইত্যাদি মিলিয়ে কিছু একটা হয়তো বা বলা হবে। কেন নায়করা নির্ভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে অজানা বিপদের পথে যাবেই? প্রথমে ঝাড় খাবে, তারপর জ্ঞানী কোনো শুডঢা গান্ডুর পাঠশালায় কয়েকটা কোচিং নিয়ে ড্রাগন বা রাক্ষসের ব্যবসায় লালবাতি জ্বালাবে এবং মরচে ধরা, ঢপ কোম্পানির ডবল ডানা এরোপ্লেনে করে চাম্পি একটি মাল নিয়ে ব্যাক করবে। এই ঢ্যামনামির গল্পের রকমফের নানা দেশে চালু আছে। এবং আশু বিলুপ্তির কোনো আভাসও নেই। তবে এ বিষয়ে আমরা কিন্তু ঝেড়ে কাশার দলে নেই। পেরিস্কোপে দেখা যায়,
দিকে দিকে জ্বলছে ধুনি,
ভিড় করেছে জ্ঞানী-গুণী
(পুরন্দরের একটা অনবদ্য কাপলেট)
যা বলার ঐ শালারাই বলবে। চিরদিনই বলে আসছে। আমাদের কাজ হল ওদের খচানো, ভুলিয়ে ভালিয়ে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়া এবং তারপর তেরপল চাপা দিয়ে প্যাঁদানো। খেঁটো বাঁশ দিয়ে বেধড়ক ক্যালাও।
কী নির্জীব, কী নির্জীব,
নির্ঘাৎ ওটি বুদ্ধিজীব।
(পুরন্দরের আর একটি)
২৭ অক্টোবর ১৯৯৯ সকাল সাড়ে নটার সময় ভদির উঠোনের কোণে ঝুলন্ত, তলাখোলা বালতির মধ্যে কাকের ঠোঁটে এসে পড়া একটি মান্ধাতার আমলের কাঁটাচামচ নাচানাচি শুরু করাতে ধাতব সংঘাতের আধা সুরেলা শব্দ হতে থাকে এবং বেচামণি ঠাস করে একটি ভাঙা থালা উঠোনে আছড়াতেই ভদি দুড়দাড় করে ছাদ থেকে নেমে এসে ফোন ধরে। বস্তুত পাঠকের পক্ষে এটা হজম করা বেশ কষ্টকরই হবে যে ইন্টারনেট ও সাইবারসেক্সের যুগেও এই টেকনোলজি বেশ বহাল তবিয়তে চালু আছে। এ হল সেই টেলিফোন যা একযুগে বাঙালি শিশুরা বানিয়ে খেলা করত। ভদি প্রাচীন ও জংধরা বেঙ্গল শটি ফুডের টিনটি কানে লাগায় যা একাধারে মাউথপিস ও রিসিভার।
ফোনটির অপরপ্রান্ত গেছে পাশের ফালি, এঁদো জমিটুকু পার হয়ে তেরচাভাবে অবস্থিত বাড়ির দোতলায়। মধ্যবর্তী ফালি জমিটুকুতে বুনোকচু গিজগিজ করছে এবং তার তলায় চার পাঁচ পুরুষের জঞ্জাল। চোর ছাড়া আর কেউ সেখানে ঢুকতে সাহস পাবে না এবং ঢোকার পরে চোরও ঘাবড়ে যাবে কারণ গিরগিটি, ব্যাঙ, বিছে ও সব জাতি ও প্রজাতির মশা সেখানে দুর্ভেদ্য জুরাসিক পার্ক তৈরি করে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। এরই ওপর দিয়ে ডবল তার চলে গেছে। একটি একটু আলগা, অন্যটি টান টান। আলগাটিতে ঠনকালে ফোন বাজে। ও বাড়িতে ঘন্টা দোলে, এখানে বালতির মধ্যে কাঁটাচামচ। কোনো ঝামেলা নেই। এ বললে ও শুনবে। ও বললে এ। একইসঙ্গে দুটো চলবে না।
যে শব্দটি বা কথা আসে তা খুব স্বাভাবিক নয়, একটু খোনা ধাঁচের, একটু ভূত ভূত ভাব। ভদি বলে,
-‘কী হঁল আঁবাঁর?’
-‘কিঁছু নাঁ। অঁল ক্লিঁয়ার।’
-‘কাঁল কঁটা গেঁল?’
-‘অ্যাঁঃ’
-‘বঁলচি কাঁল কঁটা গেঁল?’
উল্টোদিকের থেকে চারটে টোকার শব্দ। ভদি ঠিক শুনল কিনা যাচাই করার জন্যে চারটে টোকা দেয়। উল্টোদিক থেকে,
-‘ছেঁড়ে দিঁলুম।’
-‘আঁচ্চা!’
রোজই সকালে ভদির কাছে ক’ বালতি মাটি সরল সেই খবরটা এসে যায়। সরখেলের সঙ্গে এরকমই ব্যবস্থা চালু আছে। এই মহতী প্রকল্পটিকে ঘিরে ভদি ও সরখেলের উচ্চাশার অন্ত নেই। কিন্তু ভদির থেকে থেকেই প্রামাণিকের সেই সাবধানবাণী মনে পড়ে যায়। ও. এন. জি. সি থেকে অনেকদিনই রিটায়ার্ড। কিন্তু একাধারে ভদির ভলান্টিয়ার ও ক্রিটিক। দেড় বছর আগে সাধনোচিত ধামে গমন করলেও প্ল্যানমাফিক স্বপ্নে সাক্ষাৎকার বহাল আছে। মরার পরে ভাষাও বেশ সাবলীল হয়ে উঠেছে। আগে প্রতিটি বাক্যেই কয়েক কিলো করে ভক্তি থাকত। এখন বড় তিরিক্ষে ও সিনিক।
– সরখেল বানচোৎ কী করছে?
– যা করার। মাটি সরাচ্ছে।
– বাল সরাচ্চে। টপ সয়েলে আঁচড়াচ্চে। বগল চুলকানোর মতো। তখন কত করে বললাম। যে মাল হবার নয় তাই তুমি সরখেল হইয়ে ছাড়বে।
– ছাড়বইতো! আমার নাম ভদি।
– যদি হয় নিজের নাম পাল্টে ফেলব। অনাদি প্রামাণিক হয়ে যাবে চুদির ভাই পরামাণিক। দু কান কেটে ফেলব। চশমা পরতে পারব না। মরে গেছি তো কী হয়েচে — এখনো জার্নাল টার্নাল পড়ি। আপ-টু-ডেট থাকার চেষ্টা করি। সব ছেড়ে দিয়ে, বলা যায় না, হয়তো একটা বিয়েথাই করে বসব। পাগলে কী না করে!
-আজকাল প্রামাণিক বড় অল্পে খচে যাও। মরলে তোমার মত জ্ঞানী গুণী লোক কেমন থুম্বো মেরে যায়। দেখলেই মনে হয় গুলি খেয়ে ঝিমোচ্চে। কেবল তোমারই দেখচি সব সময় ছটফট ছটফট কেমন কুকুরক্ষ্যাপা ভাব! এ তো ভালো নয়।
-তোমার হিসেব তোমার কাছে। এখানে সব ভেন্ন। আর তোমাদের ওখানে কী হল না হল তাতে আমাদের ভারি বয়েই গেল। স্রেফ ছাগলামি দেখলে টেম্পার চড়ে যায়।
– তার মানে তুমি বলতে চাও আমি আর সরখেল ছাগলামি করছি? বলি যে ঐ সন্ধান কে দিয়েছিল? আমরা কি জানতাম।
– আমি বললাম একটা কথার কথা, একটা জ্ঞানের কথা। আর ওমনি ওনারা নেচে উঠলেন।
– চোপ! মরে গিয়ে ভেবেচে মাতা কিনে নিয়েচে!
– ঐ মাথা কেনার থেকে একটা ডাবের খোলা কুড়িয়ে নিলেও লাভ আছে।
এই ধরনের বাদানুবাদের মধ্যেই ভদির গোঁ গোঁ শব্দ ও ভাবভঙ্গি দেখে বেচামণি ধাক্কে ওর ঘুম ভাঙায়।
– অ্যাঁ
– অ্যাঁ আবার কী? পেট গরম হয়েচে। বুঝেচ? পেট গরম।
– অ।
– কী যে কতার ধারা কিচু বুজি না বাবা।
ভদি উত্তর দেয় না। ঘটি থেকে জল গলায় ঢালে। কিছুটা জল হাতে নিয়ে ভুঁড়িতে মাখে। ঘাড়ে, গলায় দেয়। বেচামণি শুয়ে পড়ে।
– কত বলি যে অত মাল খেওনি।
– থামো তো। কী হচ্চে না হচ্চে তা ঐ ঘটে ঢুকবে? প্যাঁকর প্যাঁকর করছে। মাগ মাগের মতো থাকবে।
– ও…ও…কী একেবারে পাটরানি করে রেখেচে আর দুবেলা মাগ, মাগ …
– তা মাগকে মাগ বলবে না তো কী বলবে?
ঘোর কলির এই অন্ধকারে বেচামণির ফুঁপ ফুঁপ শোনা যায়। অনুতপ্ত ভদি অন্ধকারে ওপর দিকে হাত বাড়ায়। সেই হাত বেচামণির শ্যাম্পু করা চুলরাশির ওপরে বিলি কাটার ধান্দা করে। বেচামণি নিজের হাতে ভদির হাতটি ধরে সরিয়ে দেয়। হাতের বালা-চুড়ির শব্দ হয়। ভদি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে। ফুঁপ ফুঁপ। নাক টানার শব্দ করে বেচামণি। ফের ভদির হাত ওপর দিকে বাড়তে থাকে।
অক্টোবর,’৯৯-এর শেষ হপ্তায় — কলকাতায় একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু পাবলিক, বিশেষত বাঙালি পাবলিক আজকাল এত আমোদ-গেঁড়ে হয়ে পড়েছে যে কোনো কিছুই টিভিতে না হলে তাদের নজরে পড়ে না। অতীতে যে মনস্বী বাঙালীরা ছিলেন তাঁদের এক জায়গায় জড়ো করা সহজ নয়। কিন্তু নেতাজী ইনডোর বা সল্টলেক স্টেডিয়ামে তাঁদের একটি জমায়েৎ বানিয়ে ‘ব্রজাঙ্গনা’-র দুটি লাইন (পুরন্দরের নয়, মাইকেলের) প্রশ্ন হিসাবে রাখাই যায়
কেন এত ফুল তুলিলি সজনি, ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে পরে কি রজনী তারার মালা?
যাই হোক, যা হবার তা হবেই। এতে ভগবানের থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু আমাদের কোনো হাত নেই। একটা আস্ত জাত যখন ভোগে যাবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয় তখন তার জন্যে ইনিয়ে বিনিয়ে কোনো ফয়দা নেই। যাচ্ছে নিমতলায়। হাতে সেলফোন। এমন আঁট করে ধরে আছে যে শেষ অবধি ছাড়ানো গেল না। শেষে বাধ্য হয়ে সেলফোনসমেতই।
এই চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি হল টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের পেছনের ফাঁকা জায়গা থেকে যখন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে ঢোকে তখন একটি বিশাল দাঁড়কাক চার নম্বর কামরার ছাদে গুটি হয়ে বসেছিল। একাধিক দিনই এরকম ঘটে। বোঝাই যাচ্ছে যে দাঁড়কাকটি ডানার পরিশ্রম বাঁচাচ্ছে। এবং সে এসপ্ল্যানেড, চাঁদনি ও সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মে নাচানাচিও করেছিল। এই দাঁড়কাকের পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। শুধু মেট্রোরেল নয়, তাকে ট্রামের ছাদে বসেও এদিক ওদিক ট্রিপ মারতে দেখা গিয়েছিল যদিও কারোরই নজরে পড়েনি। আগে ভদির বাবাকে কালীঘাট চত্বরেই হিঁয়া হুঁয়া ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। কখনো খানকিদের ঘরের চালের ওপরে বসে ঠুকরে ঠুকরে পাঁউরুটি খাচ্ছে বা মায়ের মন্দিরের পেছনদিকে ভিড়ভাট্টার ওপরে বসে পাঁঠাবলি দেখছে। একই ট্রেনে চাঁদনি থেকে জালি বার্বি পুতুল নিয়ে বড়িলাল কালীঘাটে এসে নেমেছে। কিন্তু তার কামরার ওপরেই যে দণ্ডকাক আসীন তা সে টেরই পায়নি। নানা আড়াল এইভাবে বিভিন্ন চরিত্রকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে দিকপাল হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এরকম আড়ালই বিবিধ প্রস্রাবাগারে আমরা দেখেছি। অবশ্য এখানেও উঁকি মারামারি চলে। যারা উঁকি মারে তারা যে সকলেই হোমো এমনটিও নয়। এ নিয়ে বরং পরে কিছু ফাঁদা যেতে পারে। তখন কিন্তু ভাই কোনো রাখঢাক থাকবে না।
২৭ অক্টোবর, ১৯৯৯, বিকেল যখন চলছে, তখনই ভয়ানক এক দুর্ঘটনার করাল গ্রাস থেকে কমরেড আচার্য যেভাবে বেঁচে যান তা আর কেউ না জানলেও কমরেড আচার্য জানেন। সেদিন পার্টি অফিসের দোতলায় কোনো ঘরে কেউ ছিল না। এমনটি কমই হয়। টেবিলের ওপর ভলাদিমির ইলিচ লেনিনের কালো পাথরের মুন্ডুটি একদৃষ্টিতে দেখতে দেখতে কমরেড আচার্যের ঝিমুনি ধরেছিল। একে ঠিক ঘুম বলা যায় না। এমনিতেই নানবিধ ধকল ও পার্টির মধ্যে কট্টরপন্থী ও উদারপন্থীদের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের জেরে সব নেতাই অল্পবিস্তর নাজেহাল। তার মধ্যে আবার কমরেড আচার্যের অবস্থাটা একটু করুণ সুরে যেন বাঁধা। তার কারণ এই আভ্যন্তরিক খিঁট-এ ঠিক কোন সাইড নিলে ঠিক হবে এটা তিনি কিছুতেই হদিশ করতে পারছেন না। ঝিমুনির ঘোর ঘিরে এল। এর পরের ধাপটাই হল ঘুমের সেই ভাগ যেখানে চোখের তারা বড় বেশি নড়াচড়া করে। স্মৃতি সততই সুখের। কমরেড আচার্য দেখলেন যে তাঁর মার্কা মারা সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি নয়, গরম প্যান্ট, ঝোলা ওভারকোট ও মাথায় রুশ বনবেড়ালের চামড়ার টুপি পরে তিনি উত্তর কোরিয়ার পিয়ংগিয়ং বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছেন। গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ পড়ছে। সামনেই কমরেড কিম ইল সুং-এর এক মূর্তি। মিলিটারি টিউনিক পরা। কিন্তু জীবন এতই জটিল দ্বান্দ্বিকতায় পরিপূর্ণ যে কমরেড আচার্য এই অনুপম দৃশ্যটি অর্থাৎ কমরেড কিম ইল সুং-এর নিথর, নির্বাক স্ট্যাচুটির দিকে মনোনিবেশ করে ধ্যানস্থ হতে পারছেন না অথচ সেটাই দরকার ছিল। এটাতে বাদ সাধছে একটি গান যার রচয়িতা ইন্দরজিৎ সিং তুলসি এবং সুর রবীন্দ্র জৈন-এর। ‘চোর মচায়ে শোর’ ছবিতে কিশোর কুমারের সেই সুপারডুপার হিট,
ঘুঙ্গুরু কি তরহ বজতা হী রহা হুঁ ম্যায়ঁ
কভি ইস পাগমে কভি উস পাগমে…
চটকাটি টুটে যেতে বিস্মিত কমরেড আচার্য দেখলেন যে কমরেড কিম ইল সুং হাওয়া কিন্তু জানলা দিয়ে কিশোরের কন্ঠস্বরটি আসছে। হায়, ঘুঙুরের কী নিদারুণ যন্ত্রণা। দিল্লিতে বসে কম্পিউটার ঘাঁটাঘাটি করলে যদি সব কিছু বোঝা যেত তাহলে তো চিন্তাই ছিল না। ফোন বেজে উঠল। বাজুক। না ধরলেই হবে। কিন্তু এই ঝিমুনি! সেটার কী হবে? উপায়ান্তর না দেখে কমরেড আচার্য একটি কিংসাইজ সিগারেট ধরালেন এবং এই সিনথেসিসে উপনীত হলেন যে ভেতরের বারান্দায় একটু লং মার্চ করে নিলে কেমন হয়? এই সিনথেসিস যে আলেয়ার আলোর ভৌতিক আয় আয় ডাক তা দ্বান্দ্বিক জড়বাদী প্রজ্ঞা কি কখনো মানতে পারে? কখনোই না। এবং যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সবে হাঁটতে শুরু করেছেন, এমন সময়,
– পড়বি! পড়বি!
সতর্কবাণী যখন কানে ঢুকেছে তখন কিন্তু কোলাপুরি চটিতে ধুতি জড়িয়ে কমরেড আচার্য পতন ও মূর্ছার ঠিক আগের সিঁড়িতে। ভাগ্যে সামনের রেলিংটা ছিল। বিপদ কেটে গেছে। বাঁ হাতই বাঁচিয়েছে তাঁকে। সাবাস। কিন্তু কে বলে উঠেছিল,
– পড়বি! পড়বি!
কেউ তো নেই। তবে রা কাড়ল কে? পরিশুদ্ধ বাংলা। যাকে যোগ্য মর্যাদা দেবার জন্য আজ বাংলা মা-এর কতিপয় দামাল ছেলে উঠেপড়ে লেগেছে। একেবারেই সেই বাংলাতেই, হুবহু, কোনো জর্জিয়ান টান নেই,
– ভেবেছিস ফটো বানিয়ে রেখে দিয়ে পার পেয়ে যাবি?
এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গে কমরেড আচার্যের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে পাইপের ধোঁয়ায়।
– কমরেড স্তালিন!
– থাক। ওসব ন্যাকামি আমি অনেক দেখেছি। ভেবেছ মালটা কিছু বোঝে না। আমি বুঝি না। অ্যাঁঃ আমি বুঝি না, তুই বুঝিস। কালকা যোগী। ঠিক টাইমে হাতে পড়লে তোর এই দোনামোনা ন্যাকড়াপনা ঘুচিয়ে দিতাম।
– সে তো জানি কমরেড।
– ঘেঁচু জানো। আর ফের যদি আমাকে কমরেড বলবি তো এক থাবড়া মারব। বিপ্লব করেছিস? কাকে বলে জানিস?
কমরেড আচার্য মাথা চুলকোন।
– করিস তো শালা ভোট। আর কিছু করতে পারবি বলেও তো মনে হয় না। যেগুলো আলটুফালটু গাঁইগুঁই করছে সেগুলোকে এত তোয়াজ করছিস কেন?
– ঠিক তোয়াজ নয় স্যার। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা আত্মপক্ষ …
– থামলি কেন, বলে যা —
– মানে স্যার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা ওদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যেখানে দু মাস বরাদ্দ সেখানে তিন মাস …
– কেন? সময় কি মাগনা না ফাউ? আর তুই, ওদের কথা বাদ দে, তোর মনটা কোন দিকে? সেটা ঠিক করেছিস?
– আজ্ঞে, আপনিই বলে দিন। কিছু তো ভেবে উঠতে পারছি না।
– আর পেরে দরকার নেই। তোরও ভাগ্যে দেখছি … যাক শোন, যা বলি মন দিয়ে। আমার মতে এটা কোনো প্রবলেমই না। কুকুর যেভাবে বমির কাছে ফিরে যায় সেভাবেই ওরা বুর্জোয়া গলতায় গিয়ে ঢুকবে … তুইও কি ওদের দলে ভিড়ে …
– না স্যার যা ভাবছেন তা না…আমি শুধু চাই যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে …
— আমার কাছে ওসব প্যানপেনে ওজর শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। গণতন্ত্র! হাতি ঘোড়া তল পেল না, কালকা যোগী উনি এসেছেন গণতন্ত্র মারাতে, গণতন্ত্র, তবে শুনবি? শুনবি কীভাবে ব্যাটাদের ঢিট করতে হয়? বুকের পাটা আছে?
— আজ্ঞে ইদানিং হার্টটাই থেকে থেকে ধড়ফড় করে।
— তাই তো করে। করতে করতে এক সময় আর করবে না। খুবই যুক্তিপূর্ণ ও সহজ সমাধান … হাঃ হাঃ হাঃ কীরকম লাগছে? লৌহ মানবের হাসি? একনাগাড়ে ক বোতল ভদকা খেতে পারবি?
— ক বোতল কী বলছেন? একটু খেলেই তো …
— তোদের দৌড় আমার জানা আছে। সাধে কি আর দুনিয়া জুড়ে এই হাল? ভুলটার জন্যে এখনো হাত কামড়াই।
— ভুল, মানে আপনার?
— আমার না তো কার? অতগুলোকে মারলুম, নামের লিস্ট আসত। নামের পাশে লিখতাম — নীল পেন্সিলে ‘For Execution.J.St.’ আর্মিতে যখন পার্জ চলছে তখন একটা নামের পাশে শুধু ‘The camps’ লিখেছিলাম। বুঝলি? অন্য কাজ ঘাড়ে এসে পড়লে লিস্টগুলো যেত মলোটভ, কাগানোভিচ, ভরোশিলভ, শ্চাদেনকো বা মেখলিস-এর কাছে। ওরা ঝুটঝামেলায় না জড়াবার জন্যে ‘For Execution’-ই লিখত। বুঝলি, সে একটা সময় ছিল। সেই তালে ইউক্রেনের মোটকাটাকেও ঝেড়ে দিলে হত।
-মানে, নিকিতা খ্রুশ্চভ?
— লেখাপড়া করেছিস দেখছি। যতটা ছাগল ভেবেছিলাম ততটা নয়। অবশ্য বেশি লেখাপড়া করা ভালো নয়। ট্রটস্কি বা বুখারিন তো কত পড়েছিল। কোনো লাভ হল? বেশি পড়লে মাথা গুলিয়ে যায়। কিছু একটা কড়া সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মনে হয় অ্যা-ও হয় অ-ও হয়। এর ফলে সময় হাতছাড়া হয়। এবং ঐ হাতছাড়া সময়টাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবিপ্লবী ঘোঁট আরো মুঠো শক্ত করে ফেলতে পারে। তাই এখন মনে হয় আমার আরো নির্মম হওয়া উচিত ছিল। আরো। আরো! অথচ আমি ভেবেছিলাম আমার শত্রুর শেষ না রাখার নীতিটা সফল হবে।
— হয়নি?
— হলে এই দশা হত? ১৯৩৫-এর ২৪ আগস্ট কী হয়েছিল জানিস?
পাইপের ধোঁয়া ঘুরপাক খায়। স্লাভ ভাষায় কিছু চিৎকার। গুলির শব্দ।
— আজ্ঞে না।
— জিনোভিয়েভ, কামেনেভ আর স্মিরনভকে গুলি করে মারা হয়। তখনই স্মিরনভের বৌ আর মেয়ে ওলিয়া-কে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৩৭-এ দুজনকেই গুলি করা হয়। ঐ বছরেই জিনোভিয়েভের ছেলে স্তেপান রাদোমিসলস্কি-কে গুলি করা হয়। কামেনেভ-কে মারার কয়েকদিনের মধ্যেই তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে গুলি করা হয়। ১৯৩৯ সালে কামেনেভের বড় ছেলে আলেকজান্দারকে গুলি করা হয়েছিল। অবশ্য এর আগেই, ১৯৩৮-এর ৩০ জানুয়ারি কামেনেভের আর এক ছেলে ইউরিকে গুলি করা হয়েছিল। ছেলেটার বয়স তখন ১৬ বছর ১১ মাস। কামেনেভের নাতি ভিতালিকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৫১ সালে। ওর বয়স তখন ১৯। ২৫ বছরের কারাদন্ড হয় তার। ছেলেটা ১৯৬৬-তে মারা যায়। এত মেরেও এত ধরেও পারলাম না। কোথাও একটা নরম হয়ে পড়েছিলাম। কোথাও একটা ফাঁক থেকে গিয়েছিল। যা বললাম এবার বসে বসে ভাব। আলগা দিবি কি মরবি। বুঝলি?
— আজ্ঞে বুঝেছি।
— যাই হোক, আমি আবার আসব। সামনের ইতিহাসে অনেক স্তালিন আসবে। স্তালিন যেমন আসবে তেমন জানবি হিটলার, তোজো, চার্চিল, রুজভেল্ট, ট্রুম্যান, টিটো সব ফের আসবে। তবে সবই ডামি। আসলি মাল আর হবে না।
— কী হবে তাহলে?
— তোর মতো উটকো কতগুলো ভোঁদড় জল ঘোলা করবে। আবার কী হবে?
পাইপের ধোঁয়া কমরেড জে. ভি. স্তালিনের ফটোর কাচের মধ্যে গিয়ে ঢুকতে শুরু করে। সব চুপচাপ। হাতের কিং সাইজ সিগারেট কখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। মাথা তো নয়, চাকতি।
কমরেড আচার্য ধীর পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন। মাথা ধরেছে। মাথাটাই বোধ হয় একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভালো। ডিপ্রেশন না অ্যাংসাইটি — কী কারণে এমন হচ্ছে?
২৭ অক্টোবর, সন্ধেবেলায় কালীঘাট ট্রাম ডিপোতে একটি প্রাচীন ৩০ নম্বর ট্রাম ঢুকছিল। তার মাথায় সেই দাঁড়কাক বসেছিল। এরপরে সে পার্কের দিকে উড়ে যায়।
গোড়ার থেকে যাঁরা সস্নেহ মেহনত সহযোগে ‘কাঙাল মালসাট’ নামক ডুবোজাহাজ-টি (এখনই ডুবন্ত বা জাহাজডুবি জাতীয় অমাঙ্গলিক শব্দ ব্যবহার ঠিক হবে না) ফলো করছেন তাঁরা কেন, ভূভারতে সকলেই জানে যে, ২৮ অক্টোবর সেই খুলি নাচ হয়েছিল (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য)। এরপর সাবমেরিনটি আবার ভুস করে ২১ কার্তিক অর্থাৎ ৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ভেসে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছেন। যাঁরা অভব্য বাগাড়ম্বর পছন্দ করেন না, খিস্তি শুনলে যাঁদের কানে তালা লাগে তাঁরা স্বচ্ছন্দে এই ঘোরালো ঘটনার জন্যে অপেক্ষা না করে একের পর এক মুহ্যমান ও নেয়াপাতি গাধাবোট দেখে যেতে পারেন। তবে ছোট করে দুটো কথা। বেশি রাত অবধি গঙ্গার ঘাটে বসে না থাকাই ভালো। এবং ২১ কার্তিক অর্থাৎ ৭ নভেম্বর কালীপুজো।
২২ ৬ ৬
১৮ ৪ ৩
১৬ ৪ ৪
২৫ ১০ ৪ ৩ ১
(চলবে)
৬
গত কিস্তিতে বা আগের অধ্যায়ের শ্বাস ওঠার সময় আমরা পর পর চারলাইনে যে রহস্যময় সংখ্যাগুলি সাজিয়েছিলাম তার প্রথম তিনটি পাতি লাল উড়ন তুবড়ির এবং শেষেরটি ইলেকট্রিক উড়নের ভাগ। আজকাল মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে যে নিরামিষ কালীপুজো চলছে তা এক অকহতব্য নিগ্রহ। বুড়িমা-র চকোলেট, বাচ্চু ক্যাপটেন, সাচ্চু ক্যাপটেন, কালীবোম +পটকা + ধানী কলকাত্তাওয়ালীকে, একেই ন্যাঙটো আরও হতশ্রী করে তুলেছে। উড়ন অবশ্য ৬৫ ডেসিবেলের ক্যাচালের আগেই ব্যানড হয়েছিল। তারও আগে আমরা নিষিদ্ধ হতে দেখেছি চটপটি, ছুঁচো বাজি, লোকের পিঠে মারার ভুঁই পটকা। এখনো গরিবদের পাড়ায় একটি দুটি মুহ্যমান চকোলেট বা আশার আলো চাগিয়ে তোলা উড়ন দেখা যায়। আতশবাজি কোনো নক্সাল চক্রান্ত নয়। বছরে একবার ধুন্ধুমার বাজি পোড়ালে ধোঁয়ায় নানা অপকারী ও উপকারী কীটপতঙ্গ-, যেমন শ্যামাপোকা ও মশা, খতম হয়। গন্ধকের ধূম কিছু হিংস্র জীবাণুকে ত্রাসে আক্রান্ত করে। পরন্তু ঐ একটি দিন বাঙালি যুদ্ধের একটু আঁচ পায়। কিন্তু কিছুই হবার উপায় নেই। যারা ছোটবেলা চাবিকামান দিয়ে হাত পাকিয়েছিল পরে তারা সহজেই পাইপগান ধাতস্থ করে ফেলে। মাইখেকো বাচ্চারা অবধি তুড়ি মেরে ৭২-১১-১১ ভাগে বারুদ বানিয়ে দড়ি বোমা বানাত। এই দিয়ে যার অচেনার ভয় কেটেছে সে তো পরে মলোটভ ককটেল না ঘেঁটে ছাড়বে না। নিদেন পক্ষে পাতি পেটো তো বাঁধবেই। সবাই এখন দাদু নাতি নির্বিশেষে ফুলঝুরি জ্বালাচ্ছে বা অসীম সাহসে বাপের মালের বোতলে বসিয়ে রকেট ছাড়ছে। এই বাঙালি ভবিষ্যতে ল্যাকটোজেন দিয়ে ভাত মেখে খাবে আর যৌবনে বগলে পাউডার দিয়ে সরকারি নন্দন চত্বরে গিয়ে ঝোপেঝাড়ে ঠেক খুঁজবে। অথচ এই বাঙালিই হেভি মারাকু টাইপের ছিল। বাঙালি, স্মরণ করো যে পেলের ব্রেজিলের স্বাধীনতার লড়াইতে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের অঙ্গুলি হেলনে কামান গর্জন, স্মরণ করো সেই নমস্য বাঙালিদের যাঁরা নেটিভ রাজাদের জন্য মেশিনগান ও কামান বানাতেন। তুমি কি মউজার পিস্তলের গর্জন বিস্মৃত হয়েছ? লুইস গান, দমদম বুলেট, উইনচেষ্টার রিপিটার ইত্যাদি নাম কি তোমাদের হুঙ্কার ছাড়তে প্রলুব্ধ করে না? তবে তুমি মায়ের ভোগে যাও। বহু জাত যেখানে গেছে। যেখান থেকে কেউই ফেরে না কারণ ভিসা পাওয়া যায় না। অবশ্য এতে করে নিজেদের স্পেশাল টাইপের ঢ্যামনা ভাবার কোনো কারণ নেই। আজ যারা বেশি প্যাঁকপ্যাঁক করছে কাল তারাও একই গলতায় যাবে। সেখানে আগে থেকেই ডাইনোসর ও ম্যামথেরা মালা হাতে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস হল এক ঝকমারি প্রহেলিকা। আগে শুনতাম আরামবাগের গান্ধী। এখন আরামবাগ বললেই বাঙালি জানে যে কেঁদো কেঁদো রাক্ষুসে চিকেনের কথা বলা হচ্ছে। সেই চিকেনের একটি ঠ্যাঙ দেখলেই ভয় করবে। ভাগ্যে তাদের জ্যান্ত দেখা যায় না। তবে হ্যাঁ, বাঙালির ফুড হ্যাবিট খুবই আগুয়ান। সে এখন বাড়িতেই রেঁধে, অবহেলায়, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান খায়।
১৯৯৯-এর কালীপুজোয় এবার ‘কাঙাল মালসাট’ ঢুকবে। এটি বেশ বড়ো স্টেশান। জংশন। তার আগে দুটি টিকিয়াপাড়া মার্কা ছোট স্টেশানে গাড়ি না দাঁড়ালেও বলে রাখা দরকার যে :
১) কবি পুরন্দর ভাট অবজ্ঞার গ্লানি আর সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করেছে। ছিটকিনি-টানা বন্ধ ঘরের থেকে বিকট পচা গন্ধ পেয়ে লোকে দরজা ঠেলে দেখে মড়া নয়, মরা ইঁদুর। দেওয়ালে পুরন্দর ভাটের একটি ছবি। মালা পরানো। এবং তলায় সুতো দিয়ে বাঁধা একটি কাগজ যাতে ব্যর্থ কবি পুরন্দর ভাটের ইহজীবনের শেষ কবিতাটি লেখা। লেখাটি দেখলে অবশ্যই জ্ঞানী পাঠকদের এসেনিন ও মায়াকোভস্কির আত্মহননের আগে লেখা শেষ কবিতাগুলির কথা মনে পড়বে। না মনে পড়লেও ক্ষতি নেই। বক্তব্যটি এই প্রকার।
চুতিয়া পৃথিবী
পুরন্দর ভাট
(১৯৪৮-১৯৯৯)
আমার জীবনে নাই কেন কোনো ড্রামা
তাই দিব আমি কার্পাস ক্ষেতে হামা
আমার জীবনে নাই কেন কোনো ড্রিম
টিকটিকি আমি, পোকা খাই, পাড়ি ডিম
আমার মরণে হয় না তো হেডলাইন
প্রাসাদ গাত্রে মুতিয়া ভাঙিব আইন
আমার মরণে কাঁদিবে না কোনো মেনি
লেডি ক্যানিং-এর নাম থেকে লেডিকেনি
এক পা স্বর্গে, এক পা নরকে, ঝোলা
একটি কামান, দুটি কামানের গোলা।
কবিতাটি পড়ে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় ইস্কুল মাষ্টারের সংলাপ :
— কিছু বুঝলেন?
— মারাত্মক!
— মানে?
— অ্যাসটাউন্ডিং ইমেজ সব। অথচ কোনো রেকগনিশন পায় নি। আমি তো নামই শুনিনি।
— পুরন্দর ভাট? নামটা কী? বেঙ্গলি?
— সে বলা যায় না। বিহার বা উড়িষ্যা বর্ডারেরও হতে পারে। বোধহয় ভট্ট থেকে ভাট হয়েছে।
— বাঃ এই তো একটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট পাওয়া গেল। ফ্রম ভট্ট টু ভাট।
— কিন্তু লোকটা গেল কোথায়?
— ওসব পোয়েট ফোয়েট মানুষের কিছু বলা যায় না মশাই। হয়ত গঙ্গায় ডাইভ দিয়েছে। এতক্ষণে স্যান্ডহেড।
— অসামান্য। কবিতাটি আমি টুকে নেব?
— নিন। বুঝতে পারছি কেসটা সুইসাইড। কিন্তু কনফার্মড না হওয়াতক আমাদের লিখতে হবে ‘মিসিং’।
— বডি পাওয়ার পরে?
— চুকে গেল। ফাইল ক্লোজড।
২) গোড়ার দিক থেকে যারা এই আখ্যানটি স্টাডি করছেন তাঁরা নিশ্চয়ই ভালুকের হাতে নিহত উপেক্ষিত ঔপন্যাসিক মিঃবি.কে. দাসের কথা ভুলে যাননি। তিনি তাঁর ডায়রিতে (যা পরে ইঁদুরে খেয়ে নেয়) লিখেছিলেন :
আমি বড় সাহিত্যিক তাই মাই জব ইজ পাঠককে বানানো ও পরে জবাই করা। মাই পেন ইজ আ নাইফ, ইফ নট আ সোর্ড। ছোটখাটো যে সব ট্র্যাশ অথরস আছে তারা রিডারদের মশা বানায় এবং পরে সেই মশার কামড়েই ম্যালেরিয়া হয়ে মরে। আমি অনলি দুইটা নভেল লিখিয়াছি। আর ইহাদের ওটি পেন না পেনিস কে বলিবে? কেবল পয়দা করিতেছে। গড আমার সহায়। এখন ডেভিল যদি একটু মায়ালু হন তো আই ক্যান শেক দা ওয়ার্ল্ড।
পাঠককে মুরগি বা মশা বলে মিঃ বি.কে.দাস যে ভালো করেননি তা কে না জানে। আসামের জঙ্গলে আচমকা ধৃত ভালুক শিশুর ক্রন্দন, ধেড়ে ভালুকদের ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ আস্ফালন, মিঃ বি.কে.দাস-এর অন্তিম গোঁ গোঁ আর্তনাদ, ভীত বাঁদরদের চ্যাঁ চ্যাঁ চিৎকার — এই ট্রাজেডি ‘হেকটর বধ’ হইতে কোনো অংশে কম যায় না।
অরিজিন্যাল টালিগঞ্জ থানার অবস্থা এখন প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার মতো। মাফিয়া, ছেনতাইবাজ, হেরোইন পেডলার, সাট্টাবাজ, চামড়াচোর (মানে রেপ-এর আসামী, স্মাগলার এবং নতুন গজিয়ে ওঠা লালু ক্রিমিনালদের সঙ্গে রাউডিদের সংখ্যা এমনই কোয়ান্টাম ধাক্কায় বেড়ে চলেছে যে সেসব সামলানো এক থানার কম্মো নয়। ফলে টালিগঞ্জ থানা ভেঙে দু টুকরো করা হয়েছে। কিন্তু শ্মশান সেই টালিগঞ্জ থানারই আওতায়। বেলগ্রেড যেমন অবশিষ্ট এক ফালি যুগোশ্লাভিয়াতেই থেকে গেছে। তা হলেও, পুরনো হাতি বলে কথা।
৭নভেম্বর, ১৯৯৯, মা কালীর পূজা। সকাল থেকে নীরবে নিরুপদ্রবেই কাটছিল সিভিল সোসাইটির কালীপুজো। মালের দোকান বন্ধ। প্রত্যেকবারই থাকে। তাতে কার কী ছেঁড়া যায়, কেউ জানে না। কারণ আগের দিন দোকানে দু-তিন মাইল লাইন পড়ে। শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল। এশীয় বর্বরতার চিহ্নমাত্র নেই। উপরন্তু পরিশ্রমী ব্ল্যাকাররা বস্তা বস্তা মাল নিয়ে গিয়ে স্পেশাল স্টক করে। কলিকাতার কালীপুজোর আগেকার রূপটি আমরা যেমন রসঘনভাবে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘কালীপুজোর রাত’-এ পাই যে তারপর আর কোন পাঁচুকেই ভাবা যায় না। সবই প্রায় আলগা ঠাসা বসন তুবড়ি যা থেকে থেকে ভ্যাঁস ভ্যাঁস করে এবং অচিরেই নিঃশেষিত তামাশায় পর্যবসিত হয়। কলির কলকাতায় হালফিল সাহিত্য ও বাজি বানানো মোটের ওপর একই চেহারা নিয়েছে। সোরা, গন্ধক, কাঠকয়লা বাদেও কতই না পদার্থের যোগান পড়িত। তখন অবোধ শিশুরাও বলিয়া দিত লাল তারা চাহিলে ভূষা কালি ও গন্ধক ছাড়াও পটাস ক্লোরস ও শুকনা নাইট্রেট অফ স্ট্রান্সিরা লাগিবে। এমনই একটি জায়েন্ট লাল তারা ক্রেমলিনের উপরে জ্বলিত। সবুজ তারা চাও? নাইট্রেট অফ ব্যারাইট ও হরিতাল যোগাড় করো। নীল তারা না হইলে মন ভরিতেছে না? কিন্তু ভাই, নিদেনপক্ষে দুই ভরি কাশ্মিরী জাঙ্গাল তো লাগিবেই। অবাক কাণ্ড যে বাজি-বোম ইত্যাদির সঙ্গে কাশ্মীরের যোগ সূত্র কী প্রাচীন! ফুলের মালা, বাতাসা, মতিয়া, লাট্টু, আনারসী, চন্দ্রমল্লিকা, দায়ুদী, হাজরা, গাঁদা, যুঁই, নসরিন — এ সবই নানা ধাঁচের তুবড়ির ডাক নাম। হায়! হায়! তখন দাদুগণ বলিত, ‘বোমা? এতো ছেলেখেলা। নারিকেলের ছোট খোলে ছিদ্র করিয়া বন্দুকের দানা-বারুদ পুরিবে এবং ঐ ছিদ্রে লম্বা পলিতা দিয়া খোলের চর্তুদিকে উত্তমরূপে পাট জড়াইবে। এই বাজি পুষ্করিণীতে ফেলা ভালো। স্থলে পোড়াইলে বিপজ্জনক হইতে পারে।’ আজ বাঙালি এইসব শুনিলে ভ্যাবাচ্যাকা মারিয়া যায়। বাঙালি যে কেবল বোম দিয়া সাহেব বা স্বজাতি মারিত এমনই নয়। দেশ স্বাধীন হইবার পর একটি ভারতীয় সেনা অভিযাত্রী দল পিন্ডারি গ্লেসিয়ারে যায়। সেই দলে ছিলেন ক্যাপটেন শ্রী হেমেন্দ্র চন্দ্র কর, এম-এ। তিনি লিখিয়াছেন — ‘আমাদের রাস্তার পাশেই সরযূ নদী। পথ চলিতে চলিতে আমাদের হঠাৎ মাছ ধরিবার সখ হইল। সময় অল্প। তাই এক অভিনব উপায় অবলম্বন করা গেল। একটা গ্রেনেড (হাত বোমা) জলে ছুড়িয়া ফেলা গেল। অমনি জলের মধ্যে একটা তীব্র আলোড়ন শুরু হইল এবং ছোট বড় প্রচুর মাছ জলের উপর ভাসিয়া উঠিল। মাছগুলি সংগ্রহ করিলাম।’ সেই বাঙালি আজ ত্রস্ত বেড়ালের মতো, ভীত মার্জারের ন্যায় মাছের বাজারে চক্কর মারে ও ম্যাও ম্যাও করিয়া ক্রন্দন করে। বাঙালির লোম পড়িতেছে, লেজ ভিজা ও গোঁফ যা আছে তাহাতে তা-দেওয়া সম্ভব নয়।
সাড়ে সাতটা, পৌনে আটটা — দুটোর একটা হবে — থানার ঘোড়েল ইনফর্মার গগন চুড়ান্ত উত্তেজিত হয়ে টাকলা ও. সি.-র ঘরে ঢুকে পড়ে। মুখে অল্প রামের গন্ধ। হাতে স্তম্ভিত বিড়ি।
-স্যার! স্যার! ওফ ল অ্যান্ড অর্ডারের একেবারে গাঁড় মেরে দিয়েচে স্যার। আপনি ফোর্স নিয়ে না গেলে বানচোৎদের ট্যাকল করা যাবে না।
টাকলা ও. সি. ঘপ করে টুপিটা পরে নিল।
— কোথায়? কোন শালা?
— ওফ শ্মশান পেরোলেই দেখবেন। আদ্যিকালে এপারে ওপারে উড়নের ফাইট হতো। হাজারে হাজারে, মানে অত না হলেও অন্তত শয়ে শয়ে উড়ন ছুটছে। সে কি খিস্তি আর খিল্লি। মাদি, মদ্দা সব লাফাচ্ছে আর ডিং মেরে মেরে চিল্লোচ্চে।
— উড়ন? ইউ মিন উড়ন তুবড়ি। মালটা তো ব্যানড। পাচ্চে কোত্থেকে?
— আপনি মাইরি বড় আলফাল বকেন। ব্যানড। গিয়ে দেখবেন চলুন ঐ বালের ব্যানড কেউ মানছে না। ওপারে জেলেপাড়া ন নম্বর বস্তির সব মাল। এপারে কালীঘাটের যত ক্যাওড়া। সেইসঙ্গে বোম যা ফাটছে। একেবারে ফ্রন্ট বলে মনে হবে স্যার।
— এই। এই, কী যেন নাম তোমার। গাড়ি বের করতে বল তো। আমার জিপ যাবে। সঙ্গে … ফোর্স নেব?
— আগে আপনি দেখুন। গাদাগাদা লোক। হ্যাজাক জ্বেলে নানা দলও আসছে। কেমন যেন ঠেকচে। গায়ে তেল, হাতে কানচাপা লাঠি। ঠিক বুঝতে পারছি না কেসটা। আচ্ছা স্যার, বামফ্রন্ট গওরমেন্ট ফলটল করেনি তো?
— কি যে বকো না তুমি। কথার একটা ছিরিছাঁদ নেই। মালটাল পেঁদিয়ে কি দেখতে কি দেখেছ।
টালিগঞ্জ থানা থেকে জিপটি বেরিয়ে রাসবিহারীর দিকে ঘুরেই বাঁ দিকের গলতা ফুটো করে ঢুকে গেল। টাকলা ও. সি. খোঁচর বা কনস্টেবল কেউই জানল না যে ওপরে কালো জোব্বা পরে মদন ও ডি. এস উড়ে উড়ে ফলো করছে। ডি. এস ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছে।
— শালা পুরন্দরের বাচ্চা। সুইসাইড করে কালীপুজোটা একেবারে ঝুলিয়ে দিল। কত কী ভেবে বাংলা-র স্টক করলাম। আর … আমি কিন্তু ভেতর থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। সুইসাইড অথচ আমরা টের পেলুম না?
— আমার বাবা না আঁচালে বিশ্বাস নেই। ব্যর্থ কবি। সুইসাইড করতেই পারে। করবি তো বাবা বেগন ফেগন কিছু চোঁ চাঁ মেরে দে। তা না, লাশের কোনো পাত্তা নেই। কি জানি, মাথায় ঢুকচে না।
— অপঘাতে মৃত্যু! আবার ভূতফুৎ যদি হয়ে যায় তো বিপদ। কম খচিয়েচি ওকে? এখন বাদ দাও। নীচে দেখ। উরিঃ শালা। একসঙ্গে কতগুলো উড়ন ছাড়চে দেখেচ?
— এঁদো গঙ্গায় রিফ্লেকশন হয়ে আরো বেশি দেখাচ্ছে। বোম কালী।
ডি. এস. এবং মদনের চেয়ে অনেক হায়ার অল্টিচুডে গোয়েন্দা উপগ্রহের মত উড়ছিল বিকট সেই ভদির বাবা দাঁড়কাক। এবং সেও একা ছিল না।
— ডি. এস, আমাদের ভদিদা বলেচে ছাদে বসে সবটা ওয়াচ করতে। কিন্তু সব ছাদে তো লোক!
— বরং আমরা ঐ ঘোড়ানিম গাছটায় গিয়ে বসি। ওখান থেকে বিস্তর দূর অব্দি দেখা যাবে।
— প্ল্যানটা মন্দ বাতলাওনি। এদিকটাও ক্লিয়ার। ওপরটাও। এদিক ওদিক দুদিক দেখে চুমুক মারো দুধের বাটি!
টাকলা ও. সি জিপ থেকে নামতেই অভ্যর্থনা জানাতে যারা দল বেঁধে এগিয়ে আসে তাদের হেডলাইটে দেখে ফিসফিস করে ইনফর্মার বলে,
— এদের ঘাঁটাবেন না স্যার।
— কেন! আর্মড?
— না স্যার, এরা কেউ মানুষ নয়। ভূত। এরা শ্মশানের রংবাজ ছিল। কবে মরে গেচে।
— বল কি ভায়া?
— হ্যাঁ নক্সাল আমলে অনেকে রিটায়ার্ড।
— আসুন স্যার! আসুন! সব কিছু একেবারে শান্তিতে চলছে। কোনো ঝুট ঝামেলা নেই।
ইনফর্মার কানে কানে বলে চলে,
— ওদের পেছনে সব বেপাড়ার মস্তান। আজ ওদের গেস্ট। জগা, ভানু, মংলা, ভুতনি, টালি, লন্ডন আর আর ঐ লম্বা কাবলেটা কে জানেন?
টাকলা ও.সি বেজায় ভয় পেয়ে গেছে।
— ও হল স্যার মিনা পেশোয়ারি। দাঙ্গার সময়ে মার্ডার হয়েছিল।
মাটি কাঁপিয়ে চকোলেট ও দোদমা ফাটে। একটা বড় হাউই আকাশে উঠে গিয়ে বুম করে ফেটে নেতাজির মুখ হয়ে গেল।
— এসব বাজি আর দেখবেন না স্যার। চিনা বাজারে অর্ডার দিতে হয়। আসুন স্যার।
এর মধ্যেই কাচের গাড়ি করে একটা বডি এল। ও. সি ঘামছে।
— মড়াটাও ভূত নাকি?
— হতে পারে স্যার। সবই হতে পারে। আপনি কোনো ট্যাঁ ফুঁ করবেন না।
— পাগল নাকি! খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমার!
গঙ্গার দুপাড়ে বস্তা বস্তা উড়ন। এপার ওপার চার্জ হচ্ছে। একদিক থেকে অ্যাটাক কমে গেলেই উল্টোদিক থেকে বহুস্বরে ‘দুয়ো! দুয়ো!’ রব উঠছে। উড়ন কখনো ছোঁড়ার দৌলতে ব্যাংবাজির মত জলে বাউন্স করে ওপারে ধাওয়া করছে। মাঝে মধ্যে একটা আধটা পটাশ বা ইলেকট্রিক ঝাড়ের উড়ন, রাতকে দিন করে দিচ্ছে। সেই শৈল্পিক আভায় দীন ও আনন্দময় ভূতগুলিকে স্পষ্টতর দেখায়। বেশির ভাগই খালি গা ও গামছা পরা। এদেরই বাড়ির মেয়ে ভূতেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে মশলা ঝেড়েছে, গুঁড়িয়েছে, ছেঁকেছে, রোদে দিয়েছে। ভূত শিশুরা লাল উড়নের ‘সিটি’ খোল ও ইলেকট্রিক উড়নের ‘মতিয়া’ খোলগুলো ছোট ছোট আঙুলে মশলা দিয়ে ভরেছে যদিও ঠাসার কাজটা সিনিয়ার ভূতদের সাহায্য ছাড়া হয় না। অবশ্য কলকাতার লোকেদের এটা জানা দরকার যে কালীপূজোর পরদিন ভোরে যে শীর্ণ শিশুরা আধপোড়া বা নিভে যাওয়া বাজি কুড়োতে বেরোয় তারা ভূত নয় বরং ছোট সাইজের জ্যান্ত মানুষ। ছেঁড়া প্যান্ট দিয়ে নুনু বা পোঁদ দেখা গেলেও তারা লজ্জা পায় না। ঐ আধা-ন্যাংটো হাড় জিরজিরে শিশুদের প্রতি ‘কাঙাল মালসাট’ এর উপহার।
সোরা গন্ধক কয়লা
১০ ৩।। ৩।
১০ ২ ৪
১৮ ৩ ৩
১৬ ২।। ২
১৫ ২ ২
১৫ ২ ৩
ওপরের এই ভাগগুলো হল বন্দুকের বারুদের। এ বিষয়ে আর যা যা করণীয় তা ঠিক সাহিত্যের আওতায় পড়ে না।
হ্যাজাকের আলোয় লাঠির বোঁ বোঁ ঘুরণ ও ঠকাঠক সংঘর্ষ। তৎসহ লেঠেলদের লম্ভ ঝম্প ও সিংহনাদ।
টাকলা ও. সি.র কানে এবার অদৃশ্য ভৌতিক রেডিও বাজতে থাকে — ‘এরা হচ্ছে সব বাঙালি লাঠিয়াল — নানা আখড়ায় এরা শিক্ষা পেয়েছে। যোগীন্দ্র চন্দ্র, হরিমোহন, কৃষ্ণলাল, নারায়ণচন্দ্র, মতিলাল আর প্রিয়লাল বসুর আখড়াগুলোই আদি। ঐ যারা পাখসাট মারতে মারতে আসছে ওরা সব নতুন নতুন আখড়ায় শিখেছে। নুটুবিহারী দাস, গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক, পাপড়ি আব্দুল, ডেঙো খলিফা, পচা খলিফা — কত নতুন নতুন আখড়া। ঐ, ঐ তো প্রফেসার এন. সি. বসাক। ওঁর বুকের উপরে ১০২৬ পাউন্ডের একটা পাথর রেখে লোহার হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা হয়। ঐ মহিলা হলেন টুকুরানি — বারবেল তোলায় ওস্তাদ, তিরিশটা লোক বসা গরুর গাড়ি বুকের উপরে চালায়।’ একটি চকোলেট বোমা এসে টাকলা ও. সির পায়ের কাছে ফাটে ফলে ও.সি তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে।
— ঘাবড়াবেন না স্যার। ছেলে ছোকরার কান্ড। পুজোগন্ডার দিন বলে কতা, আসুন, আমাদের রাঙ্গাজবা কম্পিটিশনটা একটু দেখে যান। সবে শুরু হয়েচে।
— রাঙাজবা কম্পিটিশন, মানে? কালীপুজোয় আবার ফুলেরও কম্পিটিশন বাঃ বাঃ।
এবারে ইনফর্মার গগন অ্যাকটিভ হয়। এবং তার ব্যাখ্যার সঙ্গে হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দেয় আদি কলকাতার গুন্ডারা।
— না, না, এটা ফুলের ব্যাপার নয়। বলচি। একটা বড় ড্রাম থাকে। বুঝলেন। বড়, গোল, কালো ড্রাম। ওতে যে যা মাল আনবে সব ঢালা হয়।
— ককটেল?
— শুনুন না। ককটেলের বাবা। স্কচ, বাংলা, চোলাই, ব্র্যান্ডি, রাম, ভদকা, জিন, ওয়াইন — সব এক জায়গায়। ভরে গেলে একটা রবারের টিউব ডুবিয়ে দেওয়া হয়। একটা স্কেল লাগানো থাকে। তার গায়ে আলতো করে ঠেকিয়ে একটা রাঙা জবা ভাসানো থাকে।
— তারপর?
— এবার ঐ রবারের টিউব দিয়ে একবারে টেনে রাঙাজবা কে বেশি নামাতে পারে সেটা স্কেলে মাপা হয়। এবারে বুঝলেন?
— বুঝলাম।
— অবশ্য ফার্স্ট, সেকেন্ড, লাস্ট সব ওখানেই গড়াগড়ি যায়। অতরকম মালের মিশেল । বুঝতেই পারচেন। আমি কখনো টেস্ট করিনি তবে শুনেচি হেভি ধক। তাবড়, তাবড় মালখোরকেও ঝট করে ফেলে দেবে।
— চলুন স্যার। একটু না হয় প্রসাদ করে দেবেন। শ্মশানকালী বলে কতা!
— না, না, আমি ওসব খাই টাই না। আপনারা কমপিট করুন। আমি না হয় হাততালি দেব।
— সেকি হয়। আপনি না হয় স্যার আলাদা করে একটু হুইস্কি খান। জাহাজী মাল। এখনো ক্রেট খোলা হয়নি। আর সেই সঙ্গে একটু কষা মাংস। না বললে শুনব না স্যার। আগে স্যার কত মান্যগন্য লোক আসতেন। ওঃ কী যুগ ছিল। গোপালদা এলে তো মেয়েরা উলু দিত।
— গোপালদা, মানে?
— গোপাল পাঁঠার নাম শোনেননি স্যার? তারপর আপনার গিয়ে রাম চাটুজ্জ্যে!
— আরে, শুনব না কেন। কে না শুনেছে? কী গগন, তুমি কী বলো? এনারা এত করে বলচেন।
— তা তো বটেই! তা তো বটেই!
— তাহলে দুপাত্তর টেনে ব্যাক করা যাক। রিফিউজ করলে খারাপ দেখাবে।
— কারেক্ট ডিসিশনটা নিয়েচেন স্যার। ওনলি দুপাত্তর। আপনি যান স্যার। আমরা বরং এখেনে অপেক্ষা করি।
— সেও কি হয়? মায়ের পূজোয় আপনারা সব স্যারের সঙ্গে এসেচেন। সবাই হলেন অতিথি।
থানায় যখন জিপ ফিরল তখন রাত সাড়ে এগারোটা। সকলেই বেশ টম্বুর।
— তাহলে গগন, শেষে ভূতের হাতে মাল খাইয়ে ছাড়লে। কুঁক। মাংসটায় বড় ঝাল দিয়ে ফেলেচে। কুঁক। ভেরি হট!
— তবে মালটা কিন্তু সলিড।
— লেবেলটা পড়েছিলে? কুঁক।
— হ্যাঁ স্যার। হোয়াইট অ্যান্ড ম্যাকে।
— এসব যে সে মাল নয় বুঝলে? আসলি স্কচ। এক একটা ঝরনার জল এক একটা কোম্পানির হুইস্কিতে, বুঝলে? স্কটল্যান্ড! স্কচ! আরে দুর, নামটা গুলিয়ে গেল।
— হোয়াইট অ্যান্ড ম্যাকে স্যার।
— থ্যাংক ইউ। কুঁক। কত ভালো ভূত বলো তো। মাল খাইয়ে কী আপ্যায়ন। অথচ ইচ্ছে করলেই ক্যালাতে পারত। কারো বাপ ছিল না বাঁচায়।
— ঠিক বলেচেন স্যার।
— তবে ভূতের হাতে মাল খাওয়ার কেসটা না জানাজানি হলেই ভালো, বুঝলে? বদনাম হয়ে যাবে।
— আমি তো এই খিল বন্ধ করলুম কিন্তু ঐ শালারা … মানে কনস্টেবল …
— ধ্যুৎ, এমনিতেই বুদ্ধি কম। তা না হলে দুনিয়ায় এত কাজ থাকতে কনস্টেবল হয়? যে রেটে মাল পেঁদিয়েচে তাতে কাল কিস্যু মনে থাকবে না। কুঁক।
— স্যার, একটা কতা বলব।
— কী কতা?
— কেমন স্যার ভয় ভয় করচে।
— মা কালীর নাম করে লেটে যাও। আমরা তো আর ভূতের হাট বসাইনি। কুঁক।
সবারই অলক্ষ্যে বড়িলাল একটা রকে বসে একটা একটা করে মুড়ি-লজেন্স খাচ্ছিল। এবার সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ডি. এস আর মদন হঠাৎ দেখল সব ভোঁ ভাঁ। জিপ যেই গেল অমনি ফুশ করে সব ভ্যানিশ! টিকে পচা, কেলে পচা, লেঠেল, প্রোফেসার বসাক সব হাওয়া। আকাশে যুদ্ধ বিমানের শব্দ। দুজনেই ওপরে তাকাল। গোটা চারেক আলোকিত চাকতি উড়তে উড়তে খেলা করছে। এই চাকতিরই বাহারী নাম ইউ. এফ. ও. বা আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট।
ভদি বারান্দায় বসেছিল। ডি. এস আর মদন উঠোনে নেমে মরা ডুম আলোয় ঝিম মারা বারান্দায় উঠল। নলেন স্ট্র দিয়ে চুক চুক করে ফ্রুটি খাচ্ছে। ভদি মাল সাজিয়ে বসেছে। পাশে বেচামণি গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। উঠোনে একটি বেড়াল বসে।
— কেমন জমেছিল?
— জব্বর। টাকলা ও. সি পুরো ধাঁ হয়ে গেছে।
— হুঁ হুঁ বাবা। বুঝবে। ধীরে ধীরে বুঝবে। এই মালটা কী জানো?
— ফরেন!
— না। এটা হল গোয়ার ফেনি। আজই হাতে এল।
ভদি ঢালে। হঠাৎ বেড়ালটা দুদ্দাড় করে পালায় কারণ বিশাল দাঁড়কাক নেমে আসে।
— আমার জন্যেও ঢাল। বাটিতে।
ভদি নলেনকে বলে,
— যা, বাবার বাটিটা নিয়ে আয়। আপনার ডানার বাত কেমন আছে বাবা? তেলটাতে কাজ হল?
— বাল হয়েচে। যেমন হারামি তুই তেমন তোর তেল। আর একটা গেলাসেও ঢাল।
— কে আসবেন বাবা?
— আসবেন টাসবেন না। এসে ওপরে ঘাপটি মেরে বসে আচে! ওরে। ঢের হয়েচে। এবার নেমে আয়।
হুস করে যে নেমে আসে তার নাম কবি পুরন্দর ভাট। মুখে একগাল হাসি। ডি. এস ভয় পেয়ে মদনকে জাপটে ধরে।
— তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়েছিল। সুইসাইড নোট দিয়ে কেটে পড়লাম। এবারে বুঝুক শালারা। আমার হল এই টেকনিক। কয়েকদিন এক ঠেকে কাটাও। তারপর সুইসাইড নোট ঠেকিয়ে দিয়ে কেটে পড়।
— কিন্তু পুলিশ তো ছাড়বে না। ধরলে ফ্রড কেসে ফেলে দেবে।
— ছিঁচকে চোর ধরতে গেলে যাদের লাল সুতো বেরিয়ে পড়ে তারা ধরবে আমাকে? আই অ্যাম পোয়েট পুরন্দর ভাট। এই জানবে। ভদিদা তোমাকে আমি আগেই সবটা বলে রেখেছিলুম।
— হ্যাঁ, আমি কেসটা জানতাম।
বেচামণি হঠাৎ ঘুমের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে।
— ওঁ নমঃ কট বিকট ঘোররূপিনী স্বাহা
ওঁ বক্র কিরণে শিরে রক্ষ ভয়ে মায়া
হ্যা মৃতা স্বাহা
ওঁ সর্ব্বলোক বশঙ্করায় কুরু কুরু স্বাহা
দাঁড়কাক ডানা ঝাপটে ঝাপটে বৌমাকে হাওয়া করে।
ভদি রাগি মুখ করে ঘপ করে এক গেলাস মেরে দেয়।
— মাগীর গলায় একদিন পা তুলে দেব। এই বলে দিলাম। নয়তো শাবলের এক বাড়িতে মাথা ফাঁক।
ডানার হাওয়া পেয়ে আনন্দিত বেচামণি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ঘুমের মধ্যেই। ভদির বাবা খচে যায়। খ্যাঁচম্যাঁচ করে নখ ঠোঁট নাড়ে। চোখদুটো টর্চের মতো।
— ফের বৌমার নামে একটা কথা বললে কিন্তু আমি আর চুপ করে থাকব না। অন্যায় করবি আবার চোপাও চালাবি! নলেন বানচোৎ সব জানে। জেনে চোদনা সেজে থাকে। দেব, দেব ফ্যাতাড়ুদের সামনে হাটে হাঁড়ি ভেঙে?
— বাবা! আপনি পরিবারের হেড। দাঁড়কাক হলেও। আপনি সব ফ্যামিলি সিক্রেট ফাঁস করে দেবেন?
— বেশি তেড়ি বেড়ি করলেই দেব।
হঠাৎ নলেন চেঁচিয়ে ওঠে,
— ঐ দ্যাখো!
বেচামণিও ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে ওঠে।
— কী হয়েচে? বলবে তো?
কেউই জবাব দেয় না। সবাই যেদিকে তাকিয়ে বেচামণিও সেইদিকে দেখতে থাকে।
হাউইটি উঠে অনেক ওপরে গেল। তারপর ফুটফাট ভুটভাট করে ফাটতে ফাটতে একটা লালচে কাস্তে হাতুড়ির চেহারা নিল। তারপর ধীরে ধীরে নামতে লাগল।
(চলবে)
৭
পর্বে পর্বে চোক্তার ও ফ্যাতাড়ুদের মধ্যমণি বানিয়ে এই যে গেঁতো মালগাড়ি চলেছে তা পাঠকদের মধ্যে, বলাই বাহুল্য, বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে কিছু বলার আছে এবং বলা হবেই। কিন্তু তার আগে কিছু না বলা কথা ট্রাজিক অবলার মতো নির্বাক থেকে বার বার সেমিজে চোখ মুছুক এমনটি নিশ্চয়ই হওয়া বাঞ্ছিত নয়। বাঞ্চতিত তো নেভার-ই নয়।
হাউই আকাশে উঠে কাস্তে হাতুড়ি হয়ে গেল এবং কক্ষপথে চিরতরে প্রোথিত না হয়ে ভস্মাকারে স্থাপিত হওয়ার জন্যে ধরাধামে নেমে এল – এ কাণ্ড অনেকেই মেনে নেবে না। কবুল করা ভালো যে, গত পর্বে একটু ‘তাও’ দর্শন ঢুকে পড়েছিল — যা কিছু ওঠে তা নামে এবং যাহা কিছু নামে তাহা ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি যদি একটি ধানি পটকাও না ফাটিয়ে (যদিও এখানে কলকাতা হাইকোর্টের নিয়ম মানা হয় বলে কোনো পাকা খবর নেই) গোটা দেশটাকে মাফিয়া ও মাগি সাপ্লায়ারদের হাতে তুলে দিতে পারে তাহলে অসম্ভব বলে কিছু থাকল কি? এ মামলায় আর ফুট কাটতে আমাদের বয়ে গেছে। বেচামণি! বেচারি বেচামণি! ঘুমের মধ্যে ডগ শ্যাম্পুতে চুল খোলতাই বেচামণি যে মন্ত্র বলে উঠেছিল এবং যা শুনে ভদি খচে যায় এবং দাঁড়কাক বাবার কাছে থ্রেট খায় তা হল বশীকরণ মন্ত্র। বেচামণির মধ্যে নিরন্তর এই ভয় হিডেন অ্যাজেন্ডা-র মত কাজ করে চলে যে ভদি তার ভক্তদের মধ্যে কয়েকটি ফিমেলকে হুমা করার ধান্দায় আছে। সন্দেহটি অমূলক নয়। অজানা তো নয়ই। অবশ্য এর বিরুদ্ধে ভদি জবাব করতে পারে যে বেচামণিকেও সে ঝাড়ির টার্গেট হতে দেখেছে। নলেন হয়তো তাতে সায়ও দেবে। কিন্তু এই বিবাদে জড়িয়ে পড়লে আমাদের চলবে না। মাগি-মদ্দার কারবারে আদ্যিকাল থেকেই এই ঢং। ঠাকুর দেবতারাও এই লাইনে যথেষ্ট বলশালী। এসব চলবেই এবং এর রকমফের নিয়ে আধবুড়ো কিছু গান্ডু শারদীয় কত কী-তে আধলা নামাবে এবং বাঙালি পাঠকরা মলাঙ্গা লেন বা মঙ্গোলিয়া, যেখানেই থাকুক না কেন সেগুলি পেড়ে ফেলবে। পড়ে তো ফেলেই। এই অসুখের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ট্রিটমেন্ট হল হনুমানের বাচ্চা। কিন্তু সেখানেও ফ্যাকড়া। পশুপ্রেমীরা হাঁউ হাঁউ করে উঠবে। নিরপরাধ, ঐতিহ্যবাহী, রামভক্ত হনুমানের বাচ্চাদের আপনারা কোথায় পাঠাচ্ছেন! জায়গাটা খাঁচা হলেও বা একটা কথা ছিল!
যাই হোক ‘কাঙাল মালসাট’, ইতিমধ্যেই, মানে, ধারাবাহিক পর্যায়েই,অর্থাৎ, গ্রন্থাকারে যন্ত্রস্থ হওয়ার প্রক্রিয়াতে ঢুকে পড়ার আগেই, ফিডব্যাক পেতে শুরু করেছে যার কিছু নমুনা টেস্ট করা যেতে পারে। নাম, ঠিকানা, গুহ্য রাখা হল।
১। …. চোক্তার ফোক্তার নিয়ে এই ক্যাঁচড়াবাজি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ‘আগামী সংখ্যায় সমাপ্য’ — কবে দেখতে পাব? … কলম না বকলম … গর্দভের সন্দর্ভ।
২। লেখা স্মার্ট কিন্তু মার্কসীয় freedom from এর ঘেরাটোপেই খাবি খাচ্ছে, freedom to নিয়ে সেই ভাবনাচিন্তা কোথায় যা আমরা পশ্চিমের অধুনা আখ্যানে…
৩। … চাম্পি! পারি না! … ঘ্যাম হচ্ছে। একটাই অনুরোধ — সহসা, কয়টাস ইন্টেরেপটাস-এর মতো থামিয়ে দেবেন না। অথবা যেমন শীঘ্রপতন ঘটে যায়।…
৪। … মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আর্ন্তজাতিক শোধনবাদী গাঁটছড়া-র দালালি করে হাততালি কেনার এক ঘৃণ্য চেষ্টা…
অবশ্য কেউ যদি বলেন যে এরকম কোনো চিঠি কেউ লেখেনি, পুরোটাই জালি কেস তাহলেও কিছু বলার নেই। সবই হতে পারে। অনন্ত সম্ভাবনা যুক্ত হয়ে রয়েছে অপার রহস্যের সঙ্গে যা আবার অজানার পথ ধরে এগিয়ে চলেছে কালো ছাতা মাথায় — কোথায়? সবটা বলা যাবে না। আপাতত বেঙ্গল ইনডাসট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের খোদকর্তার দপ্তরে।
উপরোক্ত সংস্থাটিকে অধিক বুদ্ধিমানেরা যেন নিম্নোক্ত সংস্থাটির সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলেন –WEST BENGAL INDUSTRIAL DEVELOPMENT CORPORATION (A Govt. of West Bengal Enterprise) 5, Council House Street, Calcutta – 700 001 Phone : 91-33-2105361-65 Fax : 91-33-2483737 E-mail : [email protected], Internet : www.wbidc.com
ফেললেই কিন্তু ক্যাচাল হয়ে যেতে পারে। সকলেই জানে এবং বিশেষত দেশ-বিদেশের শিল্পপতিরা জানেন যে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে নতুন জোয়ার আসছে। এবং এতে আড্ডার গুরুত্ব অপরিসীম।
আড্ডা বলতে আমরা যা বুঝি এটা কিন্তু তা নয়। এখানে গ্যাঁজানো বা গজালি করার কোনো স্কোপ নেই। এই আড্ডা হল ADDA, আসানসোল প্ল্যানিং অর্গানাইজেশন এবং দুর্গাপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এক হয়ে তৈরি হয়েছে আড্ডা বা ADDA যা হল আমাদের অর্থাৎ ভারতের রুর। হাওড়া যেমন ভারতের শেফিল্ড। সুন্দরবন যেমন ভারতের আফ্রিকা। দিল্লী যেমন ভারতের লন্ডন।
আমাদের একান্ত পরিচিত বড়িলাল একবার তার বোনের দ্যাওরের বউ এর বাপের শ্রাদ্ধ খেতে দুর্গাপুর গিয়েছিল। সেখানে হবি তো হ তখন WBIDC-র এক দারুণ মিটিং ছিল। বড়িলাল বাপের জন্মে যা আর দেখবে না তাই দেখল। কলকাতা থেকে স্পেশাল ট্রেনে সব হোমরা চোমরা ও শিল্পপতিরা স্বয়ং বা প্রতিনিধি মারফৎ হাজির। দুর্গাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটি কনটেসা গাড়ি দাঁড়িয়ে যেন সেও ট্রেনে উঠবে। চেয়ারম্যান সাহেব ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা কনটেসায় চেপে বসলেন এবং কনটেসা রওনা দিল। বড়িলাল তখনই অনুভব করল যে অচিরেই পশ্চিমবঙ্গ গোটা দুনিয়ার পুঁটকি মেরে দেবে। Making things happen-এই স্লোগান নির্দোষ বাতকর্মের মতো ফাঁকা আওয়াজ নয়।
ডিসেম্বর ‘৯৯ এর শেষ পাদে যেন বা হাওয়া একটু ঠাণ্ডাটে হয়ে উঠেই থাকবে কারণ তা না হলে বেঙ্গল ইনডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের সামনে বেলা এগারোটা নাগাদ যে ট্যাক্সিটি এসে থামবে তা থেকে কোট প্যান্ট ও হ্যাট মাথায় ভদি, রোঁয়া ওঠা আদ্যিকালের মেমেদের লম্বা কোট পরা বেচামণি ও স্যান্ডো গেঞ্জি ও শর্টস পরা বৃদ্ধ বিদেশী একে একে নামবে কেন? বুড়ো সায়েব এসব কলকাতার শীতফিত নিয়ে যে মাথা ঘামায় না সেটা বোঝাই গেল।
চেয়ারম্যানের কাছে একটি কার্ড গেল। তাতে লেখা —
আ.কু.৪৭
(একটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান)
মালিক শ্রী ভদি সরকার, শ্রীমতী বেচামণি সরকার
ব্যবসায়িক উপদেষ্টা : মিখাইল কালাশনিকভ
হিসাবরক্ষক : শ্রী নলেন
এই ঘটনাটির আগের দিন সল্টলেক এলাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক নিত্যকর্ম’-তে এই মর্মে একটি খবর বেরোয় যে কলকাতার আকাশে একাধিক উড়ন্ত চাকি দেখা দিচ্ছে। মানুষের মনে নানা প্রশ্ন উঠছে। কেন এই চাকতির আবির্ভাব? কী চায় এই চাকতি? এই চক্কর কতদিন চলবে? সরকার নীরব কেন? বিজ্ঞানীরা কেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন? ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’-র এই সরব প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্পাদকীয় সংযোজন– ‘পশ্চিমী মনোবিদ যুং-এর কথা মানিলে মানুষ যাহা দেখিতেছে তাহা ঈশ্বরের চক্ষু। এই চক্ষু প্রতি মানুষের মধ্যেই মুদিত রহিয়াছে। সহস্রাব্দের মুখে কেন এরূপ ঘটিল তাহা জানা যায় নাই। পশ্চিমে উফো-চর্চা প্রবল। পূর্বে বিরল। কেহ যদি গোপনে উফো-চর্চা করিয়া থাকেন তাহলে এ ব্যাপারে আলোকপাত করিতে পারেন। তবে বিনা দক্ষিণায়। নাম ও ঠিকানা গোপন রাখা হইবেক।’ এই প্রতিবেদনটি কোনোই আলোড়ন সৃষ্টি করতে অপারগ হয় কারণ ‘দৈনিক নিত্যকর্ম’-র প্রচার সংখ্যা ৫ হইতে বাড়িয়া এই বছর ৭ হইয়াছে। কলকাতায় বেশ কিছু ছিটিয়াল মাল বাস করে । বরাবরই। বলা যায় এরকমই রেওয়াজ।
ওরা তিনজন ঘরে ঢুকতেই হুমদো চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে ওঠে। হেঁড়ে গলা।
— হাউ ডু ইউ ডু …
ভদিও গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করে,
— নো হাডুডু। আমি বাঙালি। মাই বেটার হাফ বেচামণি বাঙালি। মিঃ কালাশনিকভ রাশিয়ান। কুছ পরোয়া নেই। আপনিও বাঙালি। বাংলাতেই বাৎচিত চলতে পারে।
— ইয়েস! পারেই তো। আচ্ছা, ইনি রাশিয়ান?
— স্পাসিবা। দোবরে উতরো!
— সে কী! বিখ্যাত লোক। আপনি মিঃ কালাশনিকভের নাম শোনেননি?
— ঠিক প্লেস করতে পারছি না। তবে শোনা শোনা লাগছে।
বেচামনি ফট করে কুমিরের চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ খোলে এবং একটি ফটো এগিয়ে দেয়।
— দেখুন তো, চেনা চেনা লাগছে?
— অ্যাঁ এটা তো বন্দুক।
— হ্যাঁ। এ. কে. ফর্টি সেভেন।
— মাই গড।
— এই এ. কে-র ‘কে’ হলেন কালাশনিকভ। মিখাইল কালাশনিকভ। এটা ওঁরই আবিষ্কার।
— ও লর্ড! আপনাকে ম্যাডাম কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।
— অসম্ভব। আমি কোথাও যাই না।
— না, না। একবার হিথরো-তে আলাপ হয়েছিল।
— ভুল করছেন। আমি নয়। অন্য কেউ হবেন। আপনি বোধহয় বম্বের মিসেস পোচখানেওয়ালা-র সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। অনেকেই ফেলে।
— তা হবে। সরি ম্যাডাম।
এইবার চেয়ারম্যানের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত কারণ মিঃ কালাশনিকভ হঠাৎ বলে উঠেন,
— খারাশো! খারাশো! রবীন্দ্রনাথ আমার খুবই প্রিয়। রাজ কাপুর। ভারতকে আমি ভালোবাসে। আওয়ারা। জন-গণ-মন শুনি। মিঠুন। ডিস্কো ডান্সার।
— আরে, আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন।
— খারাশো। অচিন খারাশো। ভডিবাবু, আপনি প্রোপোজাল প্রকাশ করুন। আমড়াগাছি অনেক হইয়াছে।
— হ্যাঁ, ভদিবাবু, বলুন।
— বলচি। ব্যাপারটা টু সিক্রেট। নো গ্যাঁগো বিজনেস। ছুপকে ছুপকে করতে হবে। করলেই সব লাল হো যায়গা।
— ভডিবাবু, আপনি ঐ চুডুড়বুডুড় হইতে বিরত থাকুন। কাজের কথা বলুন।
— ইয়েস মিঃ কালাশনিকভ!
— আমরা একটি রাইফেল কারখানা বানাব।
— রাইফেল! কোথায়?
— এনিহোয়্যার। হলদিয়া, দুর্গাপুর, আসানসোল — ওপরে থাকবে অন্য জিনিস। ডিকয়। তলায় আসলি মাল। এ. কে. ফর্টিসেভেন — টি গিগ — টিগ-টিগ-টিগিটিগিটিগ …
— বলেন কী?
— শুনুন, ওপরে লোকে জানবে ক্যানড জুস বা টমাটো পিউরি তৈরি হচ্ছে বা পিভিসি ব্যাগ অ্যান্ড স্পেশালিটি পলিমারস। তলায় লে ধড়াধধড় …
— ইন্টারেস্টিং।
বেচামণি বলে, এবার আপনি প্রোডাক্ট সম্বন্ধে বলুন …
— ভেরি সিম্পল। রেগুলার আর্মি হোক, গেরিলা গ্রুপ হোক — সবার মন পসন্দ হল এ. কে. ফর্টিসেভেন। আমারই তনয় বলিয়া নয় ইহা অতীব উপাদেয় অ্যাসল্ট রাইফেল। অ্যামেরিকান আর্মালেট এর ধারে কাছেও আসে না। সত্যি বলিতে এ. কে. ফর্টিসেভেন হল এক উন্নত সাব-মেশিনগান যা মিডিয়াম পাওয়ার কার্টিজ ফায়ার করে। যুদ্ধবিগ্রহ সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?
— সে প্রায় না জানালেই ভালো। বিশেষত এইসব অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপার …
— থাক, থাক, আর বলিতে হইবে না। বুঝিয়াছি। আজকাল দরকার র্যাপিড ফায়ার পাওয়ার যাকে আরও মজবুত করিয়া মার্চিং ফায়ার বলা যায়।
চেয়ারম্যান ঢোঁক গেলেন,
— কিন্তু এদিয়ে আমরা কী করব? মিলিটারি তো আমাদের হাতে নয় …
— চোপ, মিলিটারির দরকারটা কী? আশপাশে, এভরিহোয়্যার গেরিলা অ্যাকশন চলছে … এ. কে. ফর্টিসেভেন সকলের মনের কথা।
ভদি মাথা থেকে হ্যাট নামায়
— ফিজি, সেচিলিস, নেপাল, বর্মা, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, বিহার, আসাম, মেদিনীপুর, সাউথ চব্বিশ পরগণা, চেচনিয়া, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ডিম্যান্ডটা একবার ভেবে দেখেছেন? সাপ্লাই দিয়ে কূল পাবেন না। স্রেফ বন্দুক বেচে ওয়েস্ট বেঙ্গল লাল হয়ে যাবে। বাঙালির ঘরে ঘরে নোটের তাড়া আর কার্বাইন — ভাবা যায়?
— সে সব ঠিক আছে। কিন্তু …
চেয়ারম্যান ভদিদের কার্ডটা দেখেন।
— কিন্তু এখানে তো লেখা আ. কু. ৪৭, কেমন আকুপাংচার টাইপের নাম।
— প্রথমত নামে কি আসে যায়? দ্বিতীয়ত …
বেচামণি ভদিকে থামিয়ে দেয়।
— তুমি থামো ডার্লিং, লেট মি এক্সপ্লেন! এই নামটার একটা গভীর অর্থ আছে। ৪৭ হল স্বাধীনতার বছর আর আ. কু. মানে হল আকাশকুসুম।
— অ্যাঁ আকাশকুসুম।
— ঠিক তাই। ডিমের কুসুম নয়। ৪৭ সাল থেকে বাঙালি বন্দুকের স্বাদ পায়নি। প্রথমে আর. সি. পি. আই, পরে নক্সাল — সবই আনপ্রিপেয়ার্ড স্ট্রাগল। অথচ স্বপ্ন দেখা তো থামেনি। সেই বন্দুক আজ আমরা হাতে হাতে, ঘরে ঘরে …
— মিঃ চেয়ারম্যান, আমি করিয়া ছিলাম কি জার্মান এম. পি. ৪৩ ও এম. পি. ৪৪ যা থেকে ৭.৯২ মিমি কুর্জ এমিউনিশন ফায়ার হইত …
— প্লিজ মিঃ কালাশনিকভ ওসব টেকনিকাল ডিটেল আমার মাথায় ঢুকবে না …
— নিয়েৎ, আপনারা চাইলে আমি এ. কে ৭৪ অবধি বানাইতে পারি। ইহাতে এন. এস. পি নাইট সাইট এবং তার কাটার নাইফ-বেয়নেট ফিট হইতে পারে।
চেয়ারম্যান ঘামতে ঘামতে বেল বাজান।
— স্যার!
— চার ঠাণ্ডা লে কে আও। না কি বিয়ারই বলব?
ভদি হ্যাট পরে ফেলে।
— বলবেন না, বিয়ার আমরা খাই না।
— তা হলে স্কচ!
বেচামণি বলে ওঠে,
— আমি শুধু পেপসি।
চেয়ারম্যান একটু হিসু করার অছিলায় সংলগ্ন লাক্সারি টয়লেটে ঢুকে টাকে কোল্ড ওয়াটার স্প্রে করেন। আয়নায় নিজেকে দেখেন। কেউ নেই অথচ কানে ভৌতিক রেডিও বেজে ওঠে,
— নতুন প্লাস্টিক ম্যাগাজিনে ৩০ রাউন্ডই ভরা যায়। প্রত্যেকটা বুলেটের ওজন ৫৩.৫ গ্রেইন, সেকেন্ডে ৯০০ মিটার যায়, ফ্ল্যাট ট্র্যাজেক্টরি ধরলে ৪০০ কেন, প্রায় ৫০০ মিটার …
— ওরে বাবা, এসব জেনে আমি করবটা কী?
— হিসি।
— ঠিক আছে। করছি।
— হ্যাঁ, ঠিক করে করো আর যা বলছি শুনে যাও। কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেলের সব মডেলই হল গ্যাস অপারেটেড।
— তাতে আমার কী?
— এক রাউন্ড ফায়ার করার সময় যে গ্যাস তৈরি হয় সেটা ব্যারেলের মাঝামাঝি জায়গা থেকে ওপরের গ্যাস সিলিন্ডারে চলে যায় ..
— আমি শুনতে চাই না।
— কেউই চায় না কিন্তু শুনতে হয়। সিলিন্ডারে ঐ গ্যাসটা প্রসারিত হয়ে পিস্টনটা পেছন দিকে ঠেলে দেয়।
— আমি শুনব না।
— এবারে একটা ঝাপড়া মারব। শুনব না। মামাবাড়ির আবদার। চোপ! পিস্টনটা লাগানো থাকে বোল্টের সঙ্গে যেটা পেছনে টান খায়। ফলে বুলেটের ফাঁকা খোলটা ইজেক্টর দিয়ে বেরিয়ে যায় এবং ফায়ারিং হ্যামারটি ককড অবস্থানে চলে আসে। বোল্টটা চলার সময় একটা রিটার্ন স্পিং-এ চাপ দেয় সেটা আবার বোল্টটিকে …
— নিকুচি করেছে। এই আমি কানে আঙুল দিলাম।
— দে। কানে কেন। যেখানে পারিস দে। রিটার্ন স্প্রিংটা বোল্টটাকে এনে দেয় সামনে এবং এর মধ্যে ম্যাগাজিন এর থেকে নতুন এক রাউন্ড বুলেট চেম্বারে ঢুকে যায়। বোল্টটি তখন ফায়ারিং পোজিসনে লকড হয়ে যায় …
— বাঁচাও! বাঁচাও
টয়লেটের দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন চেয়ারম্যান। গেলাস-এর ঢাকনাটা হাত দুয়েক ওপরে উঠে বনবন করে ঘুরছে। ঘরে কেউ নেই। কম্পিউটারের পর্দায় একটি এ কে ফর্টিসেভেনের নকশা নানাদিক থেকে দেখা যেতে থাকে। টিভি সেটটি সহসা চালু হয় এবং তাতে দেখা যায় মুখে কালো কাপড় বাঁধা একটি লোক চেয়ারম্যানের দিকে এ. কে. ফর্টিসেভেন তাক করছে, সেল ফোন বাজে, কানে ধরতেই ক্রমাগত ফায়ারিং-এর শব্দ … দ্বিবিধ পানীয়ের বোতল, গেলাস বরফ, চিমটে ইত্যাদি শোভিত ট্রে নিয়ে যে বেয়ারাটি ঢোকার কথা ছিল সে ঢুকল কিন্তু তারও হাতে অগ্নিবর্ষী এ. কে. ফর্টিসেভেন …
গুলিবিদ্ধ না হয়েই চেয়ারম্যান কেলিয়ে পড়লেন। পড়েও স্বস্তি নেই। মিঃ কালাশনিকভের সেই প্রসিদ্ধ রুশী হাসি ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে যার সঙ্গে স্তলিচনাইয়া ভদকার গন্ধ ও জোসেফ স্তালিনের পিঠ চাপড়ানি মিলেমিশে এক তাজ্জব সমাহার বানাইয়াছে … টিগিগ … টিগ … টিগিগ … টিগিটিগিটিগ …
এতক্ষণ যা ঘটল তা-যেমন আকাট সত্যি তেমনই তিন সত্যি হল ঘটনাটা ঘটার সময় ভদি ও বেচামণি কালীঘাটে ছিল এবং মিঃ মিখাইল কালাশনিকভ ছিলেন মস্কোতে। এসব হুজ্জুতিতে মাইরি আমাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু সমালোচকরা ছাড়বে না। ছাড়তে পারে না। কেননা তারা প্রত্যেকেই এক একটি তিলে খ।
প্রায় অন্ধকার বারান্দা। ভূতুড়ে নোংরা ডুমটি জ্বলছে। বলা নিস্প্রয়োজন যে এটি ভদির বাড়ি। রাত এইটিশ বলা ভুল হবে। উত্তরের থেকে হিমেল হাওয়ায় কত মৃত সভ্যতার দুর্বোদ্ধ ই-মেল যে আসে তার ইয়ত্তা নেই। কী বার্তা যে তারা পাঠাতে চায় তা বোঝা শিবের বাপেরও সাধ্যে কুলোবে না। এবং বিশেষভাবে উচ্চারিত হওয়ার দরকার যে পাঠোদ্ধারের কোনো চেষ্টা নেই। সকলেই যখন গা এলিয়ে দিয়েছে তখন আমাদেরও এ নিয়ে গাঁড় মারিয়ে কোনো লাভ নেই।
একটি নড়বড়ে টুল। তেপায়া। তার ওপরে বসে বিশাল দাঁড়কাক। সামনে ভক্তবৃন্দের মধ্যে ভদি, বেচামণি ও অন্য সকলকেই দেখা যাচ্ছে। র্যাপারে কান-মাথা ঢাকা দিয়ে বড়িলালও এক ফোঁকরে ঢুকে পড়েছে। সাক্ষী গোপাল সকলেরই ঘরের লোক। কিন্তু সাক্ষী বড়িলাল?
টুলের ওপরে দাঁড়কাকের সামনে বাটিতে বাংলা ঢালা হয়েছে। দাঁড়কাক ঠোঁট ডুবোয়। গলাধঃকরণ করার জন্য মাথা উঁচু করে। তারপর বলতে শুরু করে — ‘এই যে ভদি বাঞ্চোত গাঁড়ে জটা নিয়ে গুরুগিরি করচে, ওকে আমি বলেছিলুম, দ্যাখ, ভালো যদি চাস তো ভক্তের সংখ্যা বাড়াবি না। কিন্তু শালার হেভি খাঁই — স্রেফ মাল খাওয়ার ধান্দায় এলিতেলি ধরে ধরে শিষ্য বানিয়েচে। দ্যাখ, মাল সাপ্লাই কর বা নলেনকে তেল দে — আমার কিন্তু জানতে বাকি নেই কার পোঁদে গু। ভদি এখনো জানে না কিন্তু সেও একদিন বুঝবে। আমি সোজাসাপটা বলে দিলুম — যে বেইমানি করবে আমি কিন্তু গাঁড় মেরে খাল করে দেব।’
সামনে থেকে আওয়াজ ওঠে —
— ‘না, না, প্রভু, না।’
— ‘আমরা বেইমানি করব না।’
— ‘ছুটকো ছাটকা কিছু অশৈল করে থাকলে ক্ষমাঘেন্না করে দিন।’
দাঁড়কাক ফের চুক চুক করে বাটি থেকে বাংলা খায়। এক পা তুলে ঘাড় চুলকোয়। ফের শুরু করে —
— নতুন যারা এসেচে তাদের বলছি — আমরা হচ্চি আত্মারাম সরকারের বংশধর। বুঝলি? সুবল মিত্তিরের সরল বাঙ্গালা অভিধানে, নামও শুনিসনি বোধ হয়, যা আছে মেমরি থেকে কোট করে যাচ্ছি — ‘আত্মারাম সরকার বঙ্গের বিখ্যাত ভোজবিদ্যাবিশারদ। ইঁহার প্রার্দুভাবকাল সঠিকরূপে জানা যায় না।’ভারতবর্ষ’ পত্রে গঙ্গাগোবিন্দ রায় লিখিয়াছেন যে, আত্মারাম ‘বনবিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রকাশছিলিম নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।’ কিন্তু আত্মারামের বংশধর জীবনকৃষ্ণ সরকার উক্ত পত্রেই লিখিয়াছেন যে, আত্মরামের বাসস্থান হুগলী (বর্তমানে হাওড়া) জেলার অন্তর্গত কমলাপুর গ্রামে ছিল। আত্মারামের পিতার নাম মাধবরাম সরকার। মাধবরামের ৪ পুত্র, ১) বাঞ্ছারাম, ২) আত্মারাম, ৩) গোবিন্দরাম, ৪) রামপ্রসাদ। এক বাঞ্ছারাম ব্যতীত অপর তিন ভ্রাতার বংশ নাই। উল্লিখিত জীবনকৃষ্ণ সরকার বাঞ্ছারামের বৃদ্ধ প্রপৌত্র। ইঁহারা জাতিতে কায়স্থ …
দাঁড়কাক ফের বাংলা খায়। ঘাড়ের পালক ফোলায়।
— ফের কোট ঝাড়চি — মেমরি দেখেছিস … ‘শোনা যায়, আত্মারাম কামরূপ কামাখ্যা হইতে যাদুবিদ্যা শিখিয়া আসিয়াছিলেন, এবং দেশে আসিয়া বাজিকরদিগের কৌশল ব্যর্থ করিয়া দিতেন বলিয়া বাজিকরেরা অদ্যাপি তাঁহাকে গালি দিয়া থাকে। তাঁহার সম্বন্ধে অনেক অদ্ভূত গল্প শোনা যায়। তিনি নাকি চালুনি দ্বারা শিবিকা বহন করাইতেন। শেষে ভূতেরাই নাকি ছিদ্র পাইয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলে।’ আনকোট। কাজেই খুব সাবধান। ভদির বোতলবাজি দেখেচিস কিন্তু খালি বোতলে ভদি কী পোষে, কী বল ভদি — কাজেই খুব সাবধান। খুললেই সব বেরিয়ে আসবে। এইসা কেলাবে যে …
সামনে ফের কলরোল,
— ‘খুলবেন না দোহাই।’
— ‘ভদিদা জিন্দাবাদ। দণ্ডবায়স জিন্দাবাদ। বেইমানি নেহি চলেগা। নেহি চলেগা, নেহি চলেগা।
— চোপ । এত চ্যাঁ ভ্যাঁ করলে সব জানান হয়ে পড়বে। সায়লেন্স। তা আমাদের গুষ্টির নিয়ম হচ্ছে জন্মে জন্মে আমরা একবার করে মহাচক্রের খেলা, মহামণ্ডলের ঘুঘুচক্কর দেখিয়ে যাব। সেইমতোই চলেছে ভদির এই চাকতির মোচ্ছব। বুঝলি? আজ চেয়ারম্যান শালা নার্সিংহোমে গেছে, এর পরে দেখবি কী হয়। কোনো ঢপবাজকে আমরা রেয়াত করব না। কম করে ৫০ হাজার ছোট বড় কারখানা হয় বন্ধ নয় হাঁপের টানে ধুঁকছে। সেদিকে কারও খেয়াল নেই, বাঁড়া, ডাউনস্ট্রিম মারাচ্ছে। ফরমুলা ওয়ান রেসিং। হোটেল! কার পার্কিং প্লাজা! সামলাও এবার চাকতি?’
ফের রব ওঠে।
— ‘চাকতি কা খেল জিন্দাবাদ।
ডাউনস্ট্রিম মুর্দাবাদ’
— ‘বেচামণি বৌদি জিন্দাবাদ।
কমরেড নলেন জিন্দাবাদ।’
— ‘চেয়ারম্যানেরা নিপাত যাক।’
নিপাত যাক। নিপাত যাক।’
এরই মধ্যে পুরন্দর ভাট দুই লাইনের একটি মাল রেডি করে ডি. এস-কে কানে কানে বলে দেয়,
— ‘জয়, জয়, আত্মারাম
চেয়ারম্যানের পুঁটকি যাম।’
— বাঃ বেড়ে হয়েচে। ছাপতে দেবে না কি?
— ভাবচি।
ভাষণের শেষে দাঁড়কাক বলে
— ‘মহাপুরুষের বাণী শোন। এটাও মেমারি থেকে কোট করচি। সাধুসন্তের কথা তো। বলতে গেলেই চোখে জল এসে যায়।’
দাঁড়কাক ডানা দিয়ে চোখ মোছে। ভক্তবৃন্দের মধ্যে ফুঁপিয়ে কেউ, কেউ ডুকরে ওঠে। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ। দাঁড়কাক দুটি ডানাই দুপাশে মেলে দেয়। এ এক, এ এক অপার্থিব স্বর্গলোকেরই যেন বিজ্ঞাপন —
— ‘বৎস! আমি যে ভগবান ভুলিয়া তোদেরই সার করিয়াছি — তবে ভুলিব কাকে? তোদের ভুলিলে আর আমার থাকিবে কী? তোরা যে আমার হৃদয়-নিকুঞ্জের পোষা দোহেলা। সন্ধ্যা-সকালে তোদের কাকলি হৃদিতন্ত্রে না বাজিলে আমি যে অস্থির হইয়া পড়ি। … তোরা দুঃখ পেলেও আমার তাতে আনন্দ হয়, আমি তোদের ভাবে বিভোর হইয়া থাকি।’
এই বাণী কার? মূঢ় পাঠক, তুমি বলিতে পারো? পারার চান্স খুবই মিহি। যাইহোক, চেষ্টা মারানোতে দোষ নেই। ভুলভাল বললেও গর্দান যাবার চান্স নেই। একেই বোধহয় পণ্ডিতেরা বলেন বা বলবেন — গোলকায়নের বোম্বাচাক!
(চলবে)
৮
গত অধ্যায়ে একটি সাধুমার্কা কোটেশন ঝেড়ে পাঠকদের ডিরেক্ট চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। কিন্তু জানাই ছিল যে, ঈশ্বর-বিমুখ বাঙালি পাঠকরা সে-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারবে না। নিদেনপক্ষে কোনো ক্ষীণ প্রচেষ্টাও আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সে ভেলিগুড়ে বালুকার ঢল নামিয়াছে। ঘেন্না ধরে গেছে। আজ বাঙালি কথায় কথায় সেমিনারে বাখতিন, ফুকো ঝাড়ে, ভবানীপুর এলাকায় পাঞ্জাবি ও গুজরাটিদের দাপট ও রোয়াব সম্বন্ধে গ্রামসির হেজিমনি তত্ব আওড়ায়, বিগ ব্যাং হইতে স্মল ব্যাঙাচি সকলই তার নখের ডগায় ডগোমগো হইয়া রহিয়াছে, অথচ সে শালা পরমহংস শ্রী ১০৮ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতীদেবের বাণী সম্বন্ধে কিছুই জানে না। এবিষয়ে আমাদের কিছু করিবার নাই। হিসাব কষিলে দেখা যায় যে, আর কোনো জাতিতে এত সংখ্যক পরমহংস জন্মান নাই। রেলাবাজের সংখ্যাও ততোধিক। কিন্তু অধঃপতনে কোনো জাতই এত পটু নয়।
মহামতি সাহেবরা বাঙালিকে মানুষ করিবার একটি পরিকল্পনা করিয়াছিলেন যাহাকে বলা যায় — ‘বেবুন থেকে বাবু’। হল না। কিছু বেবুন থেকে গেল, কিছু মধ্যপথে বেবুনবাবু বা বাবুবেবুন এবং অবশ্যম্ভাবী কিছু বাবু। পরবর্তী ব্লু-প্রিন্ট বিবেকানন্দের। তিনি বললেন, শাস্ত্র-ফাস্ত্র গঙ্গাজলে ফেলে দিয়ে ফুটবল খেলতে। প্রথম দিকে বাঙালি তাঁর কথা শুনেওছিল। না শুনলে ১৯১১ সালে গোরা একাদশকে মোহনবাগান ক্যালাতে পারত না বা ইয়োরোপের করিন্থিয়ানরা ঢাকায় ল্যাজেগোবরে হত না। কিন্তু খচড়ামি যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাকে বাঁচাবে কে? আজ বাঙালি অন্য নানা খেলার মতো ফুটবলেও কেলিয়ে পড়েছে এবং ক্রিকেট বা টেনিসে গুচ্ছের টাকা বলে বাঙালি বাপ-মায়েরা বাচ্চাগুলোকে হ্যাঁচকা টানে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নাকি হুদো হুদো কোচ, যারা বরং কোচোয়ান হলে আরও ভালো হত। এরপর কংগ্রেস ভেবেছিল বাঙালিরা সবাই ডেকরেটারের ব্যবসা খুলবে এবং নানা কংগ্রেস সম্মেলনে তাকিয়া সাপ্লাই দিয়ে লাল হয়ে যাবে। নকশালদের কোনো পরিকল্পনা ছিল কি? থাকলেও আগেভাগেই তো তারা মরে গেল। এরপর এল সি. পি. এম.। এঁদের পরিকল্পনাটি খুবই মহতী। কারণ শিক্ষা, সাহিত্য, ব্যবসা, প্রোমোটারি ইত্যাদি বিভিন্ন মহলের কৃতী দিকপালদের পরামর্শের সঙ্গে অভ্রান্ত বিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটিয়ে এঁরা বাঙালির সামনে যে মডেলটি রাখলেন, তার নাম ‘বাঁদর থেকে সি. পি. এম.।’ মানেটা খুবই সহজ — প্রথমে বাঁদর, তারপর বনমানুষ। এইভাবে নিয়ানডারথাল-অস্ট্রেলোপিথেকাস-রামাপিথেকাস-পিকিং ম্যান হয়ে হোমো কোম্পানির নানা ঘাটে জল খেয়ে লাস্টে দৃপ্ত সি. পি. এম. — কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালি পুরুষ ও নারী কোনো অজানা কিন্তু মায়াময় রক্তিম ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। পরিকল্পনাটি সাধু। যেমনই সরেস হল ‘বঙ্গ’ বা ‘কলকাতা’ বানানো। কিন্তু এর জন্যে সি পি এম-কে প্রথম যেটা বুঝতে হবে সেটা হল, এই বাঙালিকে দিয়ে অত খাটনির কাজ হবে না। দ্বিতীয়ত, যত ঘটা করেই ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণ হোক না কেন, বাঙালি মজ্জাগতভাবে ভালগার ও খিস্তিবাজ। যেখানে ভালগারিটির তিলমাত্র সুযোগ নেই, সেখানেও সে অপ্রতিরোধ্য। তা না হলে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের সামনে বাস দাঁড়ালে বাঙালি কন্ডাকটর ‘টেস্টিকেল! টেস্টিকেল!’ বলে চেঁচাবে কেন? কেনই বা বালিখালগামী বাসের কন্ডাকটর (অবশ্যই বাঙালি) বর্ণবিপর্যয় ঘটিয়ে ‘খালিবাল’ ‘খালিবাল’ বলে নান্দনিক পরিবেশ দূষিত করবে। কেনই বা বাঙালি রেসের বই বিক্রেতা বনেদিপাড়ায় সাইকেল নিয়ে ‘হোলরেস’ বা আরও সংক্ষেপে ‘হোল!’ ‘হোল!’ বলে গর্জন করবে? জানি না বাপু কি করে কী হবে। বাঙালি সম্বন্ধে তৃণমূলেরও নির্ঘাৎ একটি রমণীয় ছক রয়েছে, যা সম্বন্ধে সুচিন্তিত মন্তব্য করার সময় হয়নি এখনও। আর যে যাই বলুক, মুড়ি দিয়ে চা খাওয়াটা মোটেই নতুন কিছু নয়। বরং এর সঙ্গে তেলেভাজা জুড়লে প্রস্তাবটি জম্পেস আড্ডার প্রারম্ভিক পর্ব বলে ভাবাই যায়। এতই যখন হল, তখন বি. জে. পি-ই বাদ যায় কোন সুবাদে। রাধানাথ শিকদার এভারেস্ট মেপে নাম করেছিল। অপর এক সদাহাস্য শিকদারের কর্মসূচী খুবই সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর — ‘মানুষ থেকে হনুমান।’
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯, যা অবধারিত তাই ঘটল। ঘটাং! ব্যাপারটি যে কী ঘনত্বের, সেটা বুঝতে গেলে এটুকু বুঝলেই হবে ইংরিজি বছরের শেষ দিনে পালে পালে, দঙ্গলে দঙ্গলে ভদির চেলার দল গুরুদেবকে নানা টাইপের মাল এবং চানাচুর, ডালমুট, মুড়ুক্কু, চিপকি ছোলা, ঝালবাদাম, কাজু ভেট দিতে এসে দেখেছিল ভদি নেই। নলেন হেভি ভলুমে এফ.এম রেডিও বাজাচ্ছে এবং ভদির উঠোনে ওল্ড স্টাইল মেমেদের পোশাক-পরা বেচামণি খুবই দক্ষতার সঙ্গে ব্যালে টাইপের কিছু নাচছে এবং তার হাত দুটির বেড় দেওয়ার ভঙ্গি থেকে বোঝা মোটেই কঠিন নয় যে, তার নাচের পার্টনারটি কোনো সাহেবের অদৃশ্য ভূত। নলেন সকলকেই বিষাদ ও হতাশায় নিমজ্জিত করে জানিয়ে দিল যে গত রাতেই জরুরি এত্তেলা পেয়ে সামরিক তৎপরতায় ভদিকে চলে যেতে হয়েছে।
— সেবার জন্যে যে যা এনেচো রেকে মানে মানে কেটে পড়ো। হুড়ুমতাল করেচো কি মরেচো। নতুন বছরে দেখা হবে বলে গেচে। আরও বলেচে …
— কী? কী?
— ‘বলেচে এঁড়ে বাছুরের ছোট ঢুঁ-তে দোষ নেই। কিন্তু গুঁতোগুঁতি করলে শিং ভেঙে গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে দেবে।’
— ‘বছরের শেষ দিনটায় প্রভুর অন্তর্ধান ঘটল। জাপটে ধরে রাখতে পারলে না?’
— ‘এইজন্যেই তো বোকাচোদা বলতে ইচ্ছে করে। যিনি কথায় কথায় সূক্ষ্মদেহ ধারণ করেন, তাঁকে কি জাপটে ধরে রাখা যায় রে পাগল!’
বেচামণি হঠাৎ খিলখিল হাসি-সহ অদৃশ্য ভূত পার্টনারের সঙ্গে ওয়ালজ-এর ঢঙে ঘুরপাক খায়। এটি একটি আত্মারাম সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ম্যাজিক আইটেম (ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়) যার নাম গিলিগিলি পাম্প। কেন এই নাম তা কোনো গবেষক কোনোদিনও হদিশ করতে পারবে না। সে না হয় না পারল, কিন্তু ‘কাঙাল মালসাট’ যে রাবড়ির জালের থিওরিতে ঘ্যাঁতাচ্ছে সেটা লুক্কায়িত কর্মসূচি বা হিডেন এজেন্ডা থাকছে না। বুদ্ধিভ্রংশ পাঠক, তুমি বাবু লুচি বা নুচি কাহাকে বলে জানো? সেই লুচির ফোসকা দিয়ে রাবড়ি প্যাঁদানোর যে নারকীয় আনন্দ তাহা কখনই উপলব্ধি করিয়াছ? এই সান্ধ্য জলখাবারের পর যা অবশ্যকরণীয়, তা হল মাগীবাড়ি যাওয়া। পরের অধ্যায়ে দেখিবে যে সাক্ষী বড়িলাল কী অবলীলায় মাগীবাড়ি যাওয়া রপ্ত করিয়াছে। আরও দেখিবে যে, এমনও মানবশিশু আছে যাহারা ধরাধামে পা রাখিয়াই অধরা মস্করায় লীলাবান হয়। কখনও ঘুণাক্ষরেও ভুলিবে না যে পাগলের হাতে সংসার। যে-কোনো মোমেন্টে হাম্পু চলে যেতে পারে। পরে, আরও পরিপক্ব টুকটুকে মাকাল হইলে বুঝিবে সাহিত্যের শব্দসাধনা এক অলৌকিক ঠগবাজি যাহার পিছনে কাতিন অরণ্যে এন.কে. ভি. ডি দ্বারা নিহত ১৩,০০০ পোলদেশীয় অফিসার গুরুগম্ভীর মুখে বার্লিওজ-সৃষ্ট ‘সিম্ভনি ফ্যানতাস্তিক’-এর ‘মার্চ টু দা স্ক্যাফল্ড’ অংশটি শুনিতেছে, আলী সরদার জাফরি উদাত্ত কন্ঠে ‘লোহু কি পুকার’ হইতে আবৃত্তি করিতেছেন এবং রক্তস্নাত পেশোয়ার এক্সপ্রেস নিরন্তর শব বহন করিতেছে। লেখক বা পাঠক বা প্রকাশক বা সমালোচক — কেহই রেহাই পাইবে না। আপাতত — ঘটাং! কিন্তু তার আগে পায়খানা ধোলাই করার অ্যাসিডের সুইমিং পুলে যে লেখকরা বারমুডা পরিয়া লাফাইতে বদ্ধপরিকর, তাহাদের জন্য রচিত পুরন্দর ভাটের কয়েকটি অমোঘ লাইন —
আজ্ঞাবহ দাস, ওরে আজ্ঞাবহ দাস
সারা জীবন বাঁধলি আঁটি,
ছিঁড়লি বালের ঘাস,
আজ্ঞাবহ দাসমহাশয়, আজ্ঞাবহ দাস!
আজ্ঞাবহ দাসবাবাজী, আজ্ঞাবহ দাস,
যতই তাকাস আড়ে আড়ে,
হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে,
বাম্বু-ভিলার রেকটো-কিলার,
গাঁট-পাকানো বাঁশ,
আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।
ঘটাং শব্দে মাটি খোঁড়ায় বাধাপ্রাপ্ত সরখেল আরও কয়েকবার শাবল চালাল কিন্তু মোদ্দা ফল হল শাবলের ডগা ভোঁতা, সরখেলের হাতে ফোসকা এবং গুবলেট। তখনই সরখেল পূর্ববর্ণিত টেলিকম যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভদিকে খবর দেয় এবং ভদি সরখেলকে অবিলম্বে অপারেশন বন্ধ করতে বলে।
— ‘মাঁটি খোঁড়া বঁন্দ রাঁখো।’
— ‘তাঁরপঁর?’
— ‘অ্যাঁ দাঁতও বাঁদাবেঁ না। কীঁ যেঁ বাঁল বঁলো!’
— ‘বঁলচি, তারপঁর?’
— ‘চুঁপচাঁপ থাঁকো। আঁমি যাঁবো।’
— ‘কঁখন?’
— ‘ভোঁররাঁতে। যঁকন সঁব শাঁলা ঘুঁমোবে।’
— ‘আঁচ্চা!’
একে শীতকাল, তায় ভোররাত। আদিগঙ্গার ধারে তখন শামুক-পচা কুয়াশায় একপাল প্রায় ন্যাংটো মানুষ শুভ কাজে লিপ্ত। এরা প্রেতযোনি প্রাপ্ত নয়। ফ্যাতাড়ু নয়। চোক্তার নয়। স্রেফ মানুষ। এদের কাজ হল আদিগঙ্গার ফাঁকফোকর, নিমজ্জিত টায়ার, ইঁট, জুতো, মালসা, খুরি ইত্যাদির গা থেকে কুচো কেঁচো ধরে লাল-নীল মাছের দোকানে সাপ্লাই করা। এরা কখনো তালা, টাইমপিস ঘড়ি, মরচে-পড়া নেপালা ও চেম্বারও পায়। এরা চালু মাল। ওই জলে নামলে পা কেটে টুকরো হয়ে যেতে পারে। তাই এরা টায়ারের চটি বা শক্তপোক্ত কিছু পরে নেয়। আবার হয়তো দেখা যাবে, কারো পায়ে অ্যাডিডাস, লট্টো বা নাইকি-র স্নিকার। কীভাবে এত দামী জুতো এদের পায়ে আসে? আসলে সব সময় হিঁয়া থেকে হুঁয়া মাল লেনদেন হচ্ছে। জালি, আসলি, চোরাই, লুট — নানা মালে বাজার ছয়লাপ। এমনটিই তো হবে-হবে শোনা গিয়েছিল। হলও এবারে। ঠেলাটা বোঝো। আসলে সব রকমের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধেই লোকের আইডিয়া হল হাতি পাদেগা, হাতি পাদেগা — ফুশ। উল্টোটা যখন হয় তখনও শালাদের চোখ খোলে না। কিন্তু তাহাতে আগচ্ছমান মহাহুলোর একগাছা লোমের ক্ষতিও হয় না।
ভোররাতে সরখেল ভদির পোশাক দেখে অবাক। একেবারেই সামরিক পোশাক। অলিভ গ্রিন প্যান্ট। পায়ে হান্টার জুতো। গায়ে ছোপ-ছোপ দাগ-মারা কম্যান্ডো উর্দি এবং তার ওপরে যে মিলিটারি জ্যাকেট, তা সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে বেড়াবার সময় হামেশাই চোখে পড়ে।
— ‘নো হ্যাংকিপ্যাংকি। নো গাঁইগুঁই। প্রবলেমটা কী?’
— ‘সে তো আমার ঘটেও ঢুকচে না। হাত পাঁচেক খোঁড়ার পরেই ঘটাং।’
— ‘শাবল মেরে ডেপথ চার্জ-এর মতো উড়িয়ে দাও। সাবমেরিনকে যেভাবে ক্যালাতে হয়।’
— ‘হুঁ, শাবলই বলে উড়ে যাচ্চে। এই দ্যাখো না, হাতে গেলে-যাওয়া ফোসকা। বোরোলিন লাগিয়েচি।’
–‘ওরে, ব্যাটলফিল্ডে বোরোলিন-ফোরোলিন চলে না। যেখানে চোট লাগবে অ্যাম্পুট করো। হাত, পা, মুণ্ডু সব পড়ে থাক। শুধু এগিয়ে চলো।’
— ‘তুমি এগোবে তো এগোও। আমার আর ধকে কুলোচ্চে না। তার ওপর ভয়ও আচে।’
–‘কীসের ভয়? কাকে ভয়? যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়! হাসালে তুমি আমাকে সরখেল!’
— ‘ওসব সোনাই দীঘি-মার্কা ডায়লগ আমিও দু-চারটে ছাড়তে পারি।
দূত এসে বলল, মহারাজ! মহারাজ! দুর্গে শত্রু-সৈন্য ঢুকে পড়েচে। মহারাজ বলল, এই রে, গাঁড় মারিয়েচে। প্রম্পটার প্রম্পট করে শোনা নাহি যায়। চলো রাণী, অন্তঃপুরে গিয়ে প্রস্রাব করি।’
ভদি চুলবুলিয়ে হেসে ওঠে। গড়ায়।
— ‘টপ! টপ! ওঃ সরখেল, সলিড ছেড়েচ। এইবার গা-টা গরম হয়েচে। বলো, ভয় পাচ্চো কেন গো?’
— ‘আমি ভাবচি মোটা লোহার পাইপ। হয় শালা ভেতরে ইলেকট্রিকের তার নয়তো সায়েবদের বসানো গু-মুতের লাইন। ভাঙতে গিয়ে হয় কারেন্ট, নয়তো নফর কুন্ডু কেস!’
— ‘শোনো, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক খোঁজপত্তর করে তোমার বাড়ির এই স্পটটা বাছা হয়েছিল। এখান দিয়ে লাইন যেতে পারে না। জল না, কারেন্ট না, গু না, কিচ্ছু না।’
— ‘তবে, ঘটাং করল কীসে?’
দুজনকেই চমকে দিয়ে ফিকে অন্ধকারে কেউ বলে উঠল,
— ‘কামান।’
বিশাল দাঁড়কাক অন্ধকার মেখে এমনভাবে ঘাপটি মেরে আছে যে বোঝবার জো নেই।
— ‘বাবা!’
— ‘হ্যাঁগো ভদিসোনা।’
— ‘এই ঠান্ডায়, একেবারে আদুল গায়ে…’
–‘থাক, আর পিতৃভক্তি মারাতে হবে না। এবার যা বলচি শোন — আমার চোখে হঠাৎ নাইট-ভিশন এসে গেল — পষ্ট দেখলুম ওটা কামান।’
— ‘তাহলে কী হবে?’
— ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। কামানটা বড় নয়, ছোট। বলতে পারিস নুনুকামান।’
— ‘আঁজ্ঞে, দুমদাম কিছু হতে পারে?’
— ‘ভয়েতেই গেলি। ভেতরে গোলা নেই, বারুদ নেই। স্রেফ মাটি। হাত দেড়েক ছেড়ে বাঁদিকে ঝপাঝপ দুজনে মিলে খোঁড়। তাহলেই হারামিটাকে তোলা যাবে।’
ভদি শাবল চালায়। সরখেল ভাঙা গামলায় মাটি সরায়। ভদি ঘেমে গিয়ে জ্যাকেটটা খুলে ফেলে। ঘপাঘপ শাবল চালায়। এদিকে মাটিটা ঝুরঝুরে ছিল, তাই বেশি সময় লাগে না। শাবল ঢুকিয়ে বোঝা যায় যে কামানের একটা দিক শেষ হয়েছে।
— ‘মাথায় তোদের ভগবান বুদ্ধি বাদে সব দিয়েচে। এবার শাবলের কাজ আর নেই। শিক দিয়ে এপাশ ওপাশ আলগা কর। তারপর নেমে টেনে তোল।’
রোগা বলে সরখেলই নামে। কিন্তু শিক চালাবার পরেও কামান নড়াতে পারে না।
— ‘এ তো ঝকমারি হল! মাল নড়চে না।’
— ‘নড়বেও না। তলা দিয়ে দড়ি ঢোকা। তারপর ওপরে উঠে দুজন মিলে দু-দিক দিয়ে টান। ব্যাটা না উঠলেও কেৎরে দাঁড়িয়ে যাবে। তারপর তুলবি।’
আরো বেশ কিছুক্ষণ কসরত করার পরে হাত দুয়েক বেবি কামানটি ডাঙায় উঠে আসে। আকাশে বেশ আলো ধরেছে। রোজই ধরে।
সরখেল চেঁচে চেঁচে মাটি সরায়। গোড়ার দিক, মানে তোপ দাগার দিকটায় ডুমো মতো। মুখটা আবার সিংহের আদলে।
— ‘কাদের মাল এটা বুজলি?’
— ‘ধোয়া-মোছা করলে হয়তো লেখা-ফেখা কিছু বেরুবে।’
— ‘সে বেরুকগে। মালটা পোর্তুগীজ জলদস্যুদের। তখন তো আদিগঙ্গা ওখান দিয়ে বইত না। বিস্তর নৌকাও চলত। পোর্তুগীজ হার্মাদদের বোটে এই কামানগুলো থাকত। বজরা-ফজরা হলে এক গোলাতেই কুপোকাত। যে সে কামান নয়। খোদ লিসবনে বানানো।’
— ‘এখনও মালটা চালানো যাবে?’
— ‘যাবে না কেন? তবে যত্ন-মেহনত করতে হবে। বারুদ চাই। গোলা চাই।’
— ‘তাহলে কি মালটা আমরা স্টক করব?’
প্রশ্নটা সরখেলের। কারণ ভদি গোপনে যে অস্ত্রাগারটি বাড়িয়ে চলেছে তার দেখভাল সরখেলই করে।
— ‘যাদুঘর বা সায়েব ধরে বেচে দিলে ভালো মাল্লু পাওয়া যাবে। সব পুরনো মালের এখন হেভি বাজার।’
— ‘পাত্তি কিছু হবে কিন্তু এই লোহা, এই মেকদার আর হবে না। আমি বলি কি, মালটা ধোলাই-ফোলাই করে কেরোসিন দিয়ে পালিশ কর। আমাদের স্টকেই থাক। এখনও গুছিয়ে ঝাড়তে পারলে একশো হাত দুরে পুলিশভ্যানের বিচি উড়ে যাবে।’
— ‘বাবা যখন বলচেন সরখেল তকন আর কতা বাড়িয়ে লাভ নেই, মালটাকে আমরা স্টক করব।’
দাঁড়কাক ডানা ঝাপটাল।
— ‘তোরা বরং কামানটাকে রেডি কর। বছরের শেষ দিনে ভাল কাজ করলে ফল পাবি।’
— ‘আপনি থাকবেন না! তা হলে আমাদের গাইড করবে কে?’
— ‘আরে বাবা, এখন আমাকে এলিয়ট রোড যেতে হবে। সেখানে বেকারির পোড়া কেক খেয়ে সায়েবদের গোরস্থান। সেখান থেকে নিমতলা। এখন আমার দিনভর কাজ। পরে আমি আসব। এখন তো শুধু সাফসুরৎ করা। দুমদাম সব পরে।’
দণ্ডবায়স প্রশস্ত ডানা মেলিয়া উড়িয়া গেল। কাক, চড়াই, শালিখ ইত্যাদিরা ডাকাডাকি শুরু করিয়াছে। এই প্রভাত বড়ই মঙ্গলময়।
ভদি ও সরখেল পোর্তুগীজ কামানটি বহন করে দ্বিতলের কক্ষে নিয়ে যায়।
— ‘বাবা ঠিকই বলেচে। কত বছর মাটিতে পোঁতা ছিল কে জানে, কিন্তু কোনো মরচেফরচের বালাই নেই।’
— ‘পোর্তুগীজরা ভাল কামানিয়া ছিল বলতে হবে।’
— সে তো ছিলই। কোথায় এক একরত্তি দেশ। সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এসে আদি গঙ্গায় দমাদ্দম কামান দাগচে। টাকা, গয়না, মাগী — সব দুহাতে লুটচে। ভাবলেই ভয় করে।’
— ‘আমি একজন পোর্তুগীজ রংবাজের নাম জানি।’
— ‘কী?’
— ‘কারভালো।’
— ‘দুর! ও তো থিয়েটারের দেওয়া নাম। এককালে কারভালোর পার্ট বলে ভূমেন রায় হেভি নাম করেছিল।’
— ‘তা হবে।’
— ‘হবে না, হয়েচে। যাক আমি তো এদিকে ভেবে হাল্লাক হচ্চি যে মাটি খোঁড়া যদি ভেস্তে যায় তাহলে কীসের জোরে আমরা লড়ব?’
— ‘চিন্তাটা আমারও হয়েছিল। এত বড় একটা যুদ্ধের ছক।’
— ‘যাই হোক, ভগবান সহায়। বুজলে? তা না হলে শালা কিচুর মধ্যে কিচু নেই, হঠাৎ আমাদের হাতে পোর্তুগীজ কামান। ওফ, একেবারে কামাল করে দেব। লাগুক না একবার।’
— কী কী মাল আমাদের যোগাড় হল তার একটা লিস্ট করতে হবে। তবে আমার একটা খটকা লাগছে!’
— ‘কিসের আবার খটকা?’
— ‘বন্দুকের লাইনে আমরা কিন্তু বেশি কিছু করতে পারিনি। একটা দোনলা গাদা তাও সেই মান্ধাতার আমলের। আর দুটো ঢপের পিস্তল।’
— ‘কমটা কি হে? কামান, বন্দুক, পিস্তল।’ এরপর তোমার গিয়ে ছুরি, কাঁচি তারপর তোমার গিয়ে শাবল — সব এক করে ভাবো।’
— ‘কিন্তু যে প্ল্যান আমাদের….’
— ‘রোসো সরখেল, রোসো। কোনো মিলিটারি জানবে একদিনে তৈরি হয় না। আজ আমাদের অস্ত্রাগার দেখলে লোকে বলবে, হাসি পায় রিজিয়ার চাপদাড়ি দেখে। কিন্তু যখন দেকবে আদিগঙ্গায় ডুবোজাহাজের পেরিস্কোপ উঁকি মারচে, ঘাটে ঘাটে মাইন ভাসচে, জাহাজী সব ছ-ঘরা, দশ-ঘরা হাতে হাতে ঘুরচে তখন? ভয়তে পোঁদ শুকিয়ে যাবে। আর আর একটা জিনিস মনে রাখবে। মোক্ষম।
— কী?
— নিজেদের মাল তবিল নিয়ে এমন ক্যামপেন চালাবে যে শত্রুর কানে যখন পৌঁছবে তখন ব্যাটা চমকে উঠবে। কানাঘুঁষো শুরু করে দিতে হবে। তবে টাইম বুজে। যেমন, আমাদের বলতে হবে আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স — সব আমাদের আচে।
— নেভি? এয়ারফোর্স!
— ও কোনো ব্যাপারই না। একটু মাথা খাটালেই সাবমেরিন বানানো যায়। কিচুই না। নৌকো প্লাস ডুবসাঁতার ইজইকুয়ালটু সাবমেরিন।
— কিন্তু এয়ারফোর্স?
— কেন? চাকতি তো উড়চেই। কী ফোর্স! তারপর ফ্যাতাড়ুরা যদি হাই অল্টিচুড থেকে পেটো ড্রপ করে! বাবা আচেন।
— তাইতো। ভুলেই গিয়েছিলাম।
— এইতো সরখেল, নিজের তাগৎ নিজেকে জানতে হবে। এটা হল যুদ্ধের একেবারে গোড়ার কতা। অন্যটি করেচো কি মরেচো। এরপর হল প্ল্যান। শত্রু হয়তো ঢুকচে। আয় বাবা, আয় বাবা করে তুমি ঢুকতে দিচ্চো। সে বানচোৎও ভাবচে যে কেল্লা ফতে করে এনিচি। আচমকা শালা সাঁড়াশি থিওরিতে দুপাশ থেকে ধুমা কেলাও। এইরকম আর কী। আসল ব্যাপার হল ঘটে মাল থাকতে হবে। ইতিহাসে দেকবে বড় বড় সব দেশ — ইয়া আর্মি, তারপর গিয়ে উড়োজাহাজ — ছোট কোনো দেশের পোঁদে লাগতে গেল। তারপর হেগেমুতে একসা। এইসা ঝাড় যে ছোঁচানোর টাইম অব্দি দেবেনা।
কথাবার্তার এই ধাঁচের মধ্যে ক্রমশ সত্যই কি প্রতীয়মান হয় না যে চোক্তারদের পরিকল্পনায় সম্মুখসমর বা ঐ জাতীয় কিছু ভালোভাবেই রয়েছে? তবে এখনই পাঠক কি জানতে চায় যে পোজিশনাল ওয়ারফেয়ার না গেরিলা সংঘর্ষ — কোনদিকে ‘কাঙাল মালসাট’ চলেছে? মাও, লিন পিয়াও, টিটো, গিয়াপ, ফিদেল, চে — কোন কায়দায় লড়াই হবে? দুপক্ষই কি বাঙালি হবে না বিদেশি ভাড়াটে সেনারাও আসরে নামবে? আর যদি সত্যিই একটা বেধড়ক ক্যালাকেলি শুরু হয়ে যায় তাহলে পাঠক কোন দিকে ভিড়বে? এই সব ক-টি প্রশ্নই খুবই খুবই মুল্যবান, মাল্যবান ও জরুরি। কিন্তু এই হিমভোরে সদ্য কামান বেরোবার ঘটনায় রণনীতি বা কৌশল সম্বন্ধে যার তিলমাত্র ধারণাও আছে সে-ই অনুধাবন করবে উপরোক্ত অবস্থান কতটা যুক্তিসঙ্গত। এই বোধ যদি ঘরে ঘরে জাগ্রত হত তাহলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বেঙ্গল রেজিমেন্ট বলে হেদিয়ে মরতে হত না। বাপ বাপ বলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি হত এবং বীরত্বে সকলকে ধুড় বানিয়ে ছাড়ত।
চন্দননগরের জনৈক বিখ্যাত বাঙালি একবার লিখেছিলেন,
‘হারান চক্রবর্তী মহাশয় যথেষ্ট বলশালী ছিলেন। তিনি উদয়চাঁদ নন্দীর বাগানে একটি বড় লিচু গাছ বিনা অস্ত্রসাহায্যে ফেলিয়া দিয়াছিলেন। দুই জনে সজোরে তাঁহার গলা চাপিয়া ধরিলেও তিনি একটি রম্ভা গলাধঃকরণ করিতে পারিতেন। গগনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুরন্ত ঘোড়াকে ভূমি হইতে শূন্যে তুলিয়াছিলেন। প্রায় চল্লিশ বৎসর পুর্বে পালপাড়ার বীরচাঁদ বড়ালের বাটীতে পালপাড়ার দলের উদ্যোগে ফরাসী গভর্নর বাহাদুরকে দেখাইবার জন্য ব্যায়ামক্রীড়ার ব্যবস্থা হইয়াছিল। লাটসাহেব তাহা দেখিয়া বাঙালীর ছেলের বল ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন।’
কে তিনি? তিনি কে গো? কে গা? এর একমাত্র জবাব বাঙালির নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। লজ্জায় আর কত অধোবদন হইতে হইবে?
(চলবে)
৯
যে সন্দেহ এইবার বার বার উঁকি মারিবে ও ফিক করিয়া হাসি করিয়া ফেলিবে তাহা হউক এই যে ‘কাঙাল মালসাট’ কপর্দকহীনদের জন্য এক ব্যাদড়া কুইজ নাকি অন্য কোনো অভিসন্ধিমূলক অভিযান? যে কোম্পানি এই অহৈতুকি ব্যবসা খুলিয়াছে তাহাদের মুখে হয় লুপ নয়তো কুলুপ। এমন কেন হল গো? এও কি চাকতির হুজ্জুতি। ইজ এনিবডি আউট দেয়ার? শুনশান। অনেকটা পায়খানার দরজায় আকুল ধাক্কার মতো? ভেতরে কে? সায়লেন্স। এই ঝুটঝামেলা অত সহজে মেটার নয়। এবং এর সমাধানের জন্য বঙ্গবালক ও বঙ্গবালিকাদের যে পদ্ধতি ইস্তেমাল করতে হবে তা যেমনই দুর্লভ তেমনই অনায়াস। ‘আট’-এর শ্বাস ওঠার সময় চন্দননগরের জনৈক বিখ্যাত বাঙালির একটি গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের কিয়দংশ মুদ্রিত হয়েছিল যদি না প্রেসের ভুলে উড়ে যায়। সেই বাঙালিকে আমরা টুনি লাইটের আলোকসজ্জার মধ্যে গবাক্ষে হাস্যময় বলে ভাবতে পারি। তিনি ছিলেন অথবা হইলেন হরিহর শেট। ভবিষ্যতেও থাকিবেন। যেমন থাকিবে ডাইনোসরের ডিম, তবলার বিড়ের মতো দেখতে একটা জিনিস মাথায় বঙ্কিমচন্দ্রের ছবি ও পৃথিবীর নানান গলতায় প্রোথিত টাইম ক্যাপসুল। কারো কোনো ওজর আপত্তি ধর্তব্যে নেওয়া হবে না। এরই মধ্যে পুনরায় সেই পরিচিত ওঁয়া ওঁয়া ধ্বনি!
মালের ধুনকি যদি কাটে, বাগিচায় খোঁয়ারি যদি ভাঙে তাহলে সাহস সঞ্চয় করে পাঠককে ইন্টারোগেট করা যায় যে উপরোক্ত ওঁয়া ওঁয়া-র একটি আগাম সতর্কবাণী আগেই আছে এবং তা কোথায়? কোনো হাত ওঠে না কারণ সবগুলিই চুলকোতে ব্যস্ত। ধিক। শতাধিক। অক্টোবর’৯৯-এর শেষ হপ্তার মুখে ডি. এস-এর কবুলিতে কি জানা যায়নি যে তার বৌ-এর আট মাস চলছে। চলছে মানে শুরু হয়েছে এমনই বা না হবে কেন? বরং দশ মাস দশ দিন, চিনতে না পারলে গলায় দড়ির দাগ, মা হওয়া কি মুখের কথা — সব অঙ্ক মেলানোর জন্যে তেমনই হতে হবে। হলও।
২০০০-এর জানুয়ারিতে, আগেকার কথা মতো, ‘শিশুমার মেটারনিটি হোম’-এ, ড. গজেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরি বা যে নামে তিনি অধিকতর পরিচিত সেই গায়নো গজার নার্সিং হোম-এ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডি. এস.-এর কালো, মোটা, অল্প গোঁফওয়ালা ব্যাঙের মতো বৌ-এর পেট কেটে জালি বা আসলি (দ্বিমত আছে) সহস্রাব্দের প্রথম ফ্যাতাড়ু জুনিয়রকে বের করা হল। নার্সিং হোমটির নাম শুনলে অবধারিতভাবে মনে হবে যে এখানে শিশুদের মেরে ফেলাটাই বিশেষত্ব। তা কিন্তু নয়। ‘শিশুমার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ জলকপি বা শুশুক। গজেন্দ্রকুমার শিশুকালে বাবার কোলে বসে দেখেছিল গঙ্গাবক্ষে শুশুক হু হু করে উঠছে ও তলিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ জলকপির দল এরকমই করেই চলেছে, করে চলেছেই। এই দৃশ্যটি গজেন্দ্রকুমারের শিশু মনে গভীর দাগ কাটে। এভাবেই তাঁর মধ্যে শুশুকের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে ওঠে। তারই ফল পরিণামে হল ‘শিশুমার মেটারনিটি হোম।’
বাইরে দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষমান ডি. এস, মদন ও পুরন্দর ভাট। সেখানে আরো পাব্লিক রয়েছে। শীতের পোশাক কিন্তু উত্তেজনার গরম। ফুটের দোকান থেকে চা আনে পুরন্দর। সে নিজে আনে না। খাঁচাসদৃশ বস্তুটিতে গেলাস বসিয়ে আনে একটি পেটমোটা শিশু শ্রমিক। পুরন্দরের হাতে বাতিল লটারির টিকিটে মোড়ানো তিনটি বিস্কুট।
— ফার্স্ট বাপ হবে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বলির পাঁঠা।
— ‘আঃ পুরন্দর। সংসারধর্ম করনি তো। আলপটকা ওরকম বলা যায়। ডি. এস-এর অবস্থায় পড়লে বুঝতে।
— ক্ষ্যামোতা থাকলে একটা বিয়ে করেই ফেলো না। হিম্মত দেখি!
— তোমাকে হিম্মত দেখাতে গিয়ে গাঁড় মারাবার চক্করে আমি নেই। আর কবিদের কেসটা আলাদা। সব মনে মনে হয়।
— মানে?
— পরে একদিন বুঝিয়ে দেব। আরে বিস্কুটটা কামড়াবে তো!
— ভুলেই গেছি যে হাতে বিস্কুট।
— এরপর হাতে হ্যারিকেন ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
ঠিক এই সময়েই কালো পাথরের কানা উঁচু থালায় জল জমিয়ে ভদি উবু হয়ে বসে দেখছিল। নলেন জমাদারের সঙ্গে নালি পরিষ্কার করা নিয়ে ঝগড়া করছিল। বেচামণি স্নান সেরে পিঠের দিকে গামছা ধরে মাথা হেলিয়ে চুলে সপাট সপাট ঝাড়ছিল এবং ভদির বাবা ছাদের আলসেতে বলে দেখছিল যে বৌমা-র মাথা থেকে জলকণাগণ সহসা উড়িয়া উঠিতেছে ও রোদ্দুরে রামধনুর রং এই আছে, এই নেই।
— যাক বাবা, ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল।
বেচামণি আপনসুখে বলে,
— কী হল গো ভালোয় ভালোয়?
— ডি. এস-এর বাচ্চা হল। তা না তো কি তোমার পিণ্ডি হবে?
— কতা বলার ও কী ধরণ গো?
দাঁড়কাক ঘ্যাঁক করে ওঠে,
— ভালো করে মুখ না ছুঁচোলে অমন হয়। ছেলে না মেয়ে হল সেটা বলবি তো?
— ছেলে হয়েচে! এই নাদাপেটা!
বেচামণি খিলখিলিয়ে ওঠে,
— আমি আগেই বলেছিলুম!
ভদি ফের খিঁচিয়ে উঠতে গিয়ে বাপের কথা ভেবে গুটিয়ে যায়।
দাঁড়কাক ডানা ঝাপটায়।
— বাবা কি চললেন নাকি?
— যাই, বনি বেবি হয়েচে, বেগম জনসনকে খপরটা দিয়ে আসি। আগে হলে গড়ের বাদ্যি বসত। হিজড়ের নাচ হত।
দাঁড়কাক উড়ে চলে গেল।
টাকলা ও. সি.-র টেবিলে ফোন বাজল।
— হ্যালো!
— ওঁয়া! ওঁয়া!
— হ্যালো!
— ওঁয়া! ওঁয়া!
পার্টি অপিসে কমরেড আচার্য-র ফোনও ডেকে ওঠে। কিন্তু কমরেড আচার্য না থাকাতে ফোন বেজে বেজে থেমে যায়। কমরেড আচার্য, আপনি আগামী সম্মেলনের জন্যে খচড়া প্রস্তাব রচনায় লেগে থাকুন। ওদিকে যা হওয়ার তা হয়ে গেল। এর দাম আপনাকে দিতে হবে। আপনি চান বা না চান চোক্তাররা চমকাবে এবং ফ্যাতাড়ুদের বংশবৃদ্ধি ঘটবে। চাকতি উড়বে। বেগম জনসন গ্র্যান্ড পার্টি ডাকবেন। পাতিয়ালার মহারাজা ১০০১ টা নীলচে সাদা হীরের ব্রেস্টপ্লেট পরে উদোম ন্যাংটো হয়ে বছরে একবার করে নগর পরিক্রমায় বেরোবেন। জন স্টুয়ার্ট মিল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে ভারত একটি vast system of outdoor relief for Britain’s upper classes হয়ে উঠেছে। চার্চিল বলবেন, I hate Indians, they are absolutely beasty people with a beastly religion. কাপুরথালায় একবার পালে পালে পঙ্গপাল ঢুকে ফসলের দফা রফা করে দিয়েছিল। এখন যেমন পঙ্গপাল ছাড়াই কাজটা হয়। তখন প্রজাদের হাঁউ মাউ কান্না শুনে কাপুরথালার মহা মাগিবাজ মহারাজা বলেছিলেন, Let the locasts dance, we are going to dance in Paris. কমরেড আচার্য, আপনি খচড়া প্রস্তাব লিখতে থাকুন। আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আপনি আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন। আমরা চোরাবালির মতোই মমতাময়।
গোলাপি লিপিস্টিক চুলবুলে ঠোঁট আবছা ফাঁক করে ট্রেইনি নার্স মিস চাঁপা এসে ফিসফিসিয়ে উঠল,
— মিঃ ডি. এস কে আছেন?
— অ্যাঁ
— আপনি মিঃ ডি. এস?
— ইয়েস।
— ডক্টর রেচাউড্রে কথা বলবেন। প্লিজ কাম উইথ মি।
ডি. এস ঘামতে ঘামতে মিস চাঁপার সঙ্গে গিয়ে দেখে গায়নো গজার হাল খুবই বেসামাল। মালটা ঠ্যাংদুটো টেবিলে উঠিয়ে দিয়ে চেয়ারে কেলিয়ে রয়েছে। মাথায় ভিজে তোয়ালে দেওয়া। এবং সিনিয়র মেট্রন মিসেস পোড়েল গজার বাঁহাতটা মালিশ করচে।
— আপনি?
— কী?
— না, মানে, ঐ যে ছেলেটা হল সেটার বাপ আপনি?
— ছেলে হয়েছে?
— ওপর ওপর দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনি, তারপর গিয়ে আপনার বৌ — আপনারা কী বলুন তো?
— মানে?
— মানে, সোজা, আপনারা কি মানুষ না ভূত-ফুৎ কিছু?
— কেন বলুন তো?
— কেন? দুনিয়ায় যত বাচ্চা পয়দা হয় সব কেঁদে ওঠে। আপনার ছেলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল আর নাভি কাটার পরই, লাইক আ বার্ড, উড়তে শুরু করল —
— কেমন আছে ওরা?
— ভালো আছে। মা-র জ্ঞান ফিরবে একটু পরেই। কিন্তু…
ডি. এস কিছু বলার আগেই পেছন থেকে মদন আর পুরন্দর ঢুকে পড়ে।
— কোনো কিন্তু ফিন্তু নয়। মা, বাচ্চার কোনো এদিক ওদিক হলে কিন্তু গায়নো কোম্পানির তেশ মেরে দেব।
— আপনারা?
— চোপ। কোনো বেগড়বাঁই নেহি চলেগা। আপনি ঠিকই ধরেচেন। আমরা মানুষ। কিন্তু আবার মানুষও নই। দেখবেন ছোট করে একটা ঘুঘুচক্কর?
ড. রায়চৌধুরি ওরফে গায়নো গজা, মিসেস পোড়েল এবং মিস চাঁপার বিস্ফারিত চোখের সামনে তিন ফ্যাতাড়ুই টেক অফ করল এবং হাত পাঁচেক উঠে হেলিকপটারের মতো দাঁড়িয়ে গেল। দুপাশে হাতগুলো ডানার মতো ওঠা নামা করছে। তিনজনেই দাঁত কেলিয়ে দিয়েছে। ডাঙায়ও তিনজন। তাদের প্রায় দাঁতকপাটির যোগাড়। ছটি স্তম্ভিত চোখের সামনে তিনজনেই ল্যান্ড করল।
ডঃ রায়চৌধুরির নির্দেশে তড়িঘড়ি মিসেস পোড়েল ও মিস চাঁপা কেটে পড়ল।
— কদিন লাগবে?
– হপ্তাখানেক তো বটেই। মানে মাদার, একটু বেশি বয়েস তো তাই ভাবছি …
— ও সে যা ভাবাভাবির আপনি করে ফেলুন। আমাদের কিছুটি বলার নেই। ডাক্তারি ব্যাপারে আমরা নাক-ফাক গলাচ্ছি না।
— ‘ডাক্তারি করে ডাক্তার
মোক্তারি করে মোক্তার
ফ্যাতাড়ুরা খেলে হারামির হাটে
চোক্তারি করে চোক্তার।’
কী বুঝলেন?
— আমার বুঝে কাজ নেই। যা বলার আপনারাই বলুন।
— তার মানে আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার।
— শুনুন। অপরাধ নেবেন না। আমাদের হাতে পয়াকড়ি হেভি টাইট বুঝলেন। এদিকে আমাদের আগেভাগেই তো গাঁড়ে হনুমানের বাচ্চা চলে যাওয়ার যোগাড়। আপনার ছুরি ধরা, ও. টি চার্জ, বেড ভাড়া, আয়া — অত খরচা আমরা দিতে পারব না।
— পারলেও দেব না।
গরিবের গাঁড় যারা মারে।
ফ্যাতাড়ুরা হাগে তার ঘাড়ে।
— দোহাই, ঐ টি করবেন না। আমি তো আপনাদের কোনো কথাতেই না বলিনি। আপনাদের যা প্রাণ চায় দেবেন। আমার কিছু বলার নেই।
— আমাদেরও আর কিছু বলার নেই।
— আপনি কি মাল খান?
— আমি?
— হ্যাঁ, তবে কি আমরা?
— আঁজ্ঞে, দিনান্তে সামান্য একটু ধরুন পেগ দেড়েক ব্রান্ডি!
— খুব ভালো। আপনাকে ভালো মাল খাওয়াব, ফরেন। মা বাচ্চাকে ভালো করে দেখুন। দেখবেন আপনার জন্যে কেমন জান লড়িয়ে দেব। কোনো অসুবিধা হবে না। এরপর একদিন আপনাকে ভদিদার ঠেকে নিয়ে যাব। দেখবেন ছপ্পড় খুলে যাবে। মাটাডোরে করে টাকা নিয়ে যেতে হবে। যা কিছু হচ্চে সবই ভদিদার কৃপা।
— যাব। নিশ্চয়ই যাব। ওঁর কি কোনো আশ্রম আছে?
— আরে ওসব ভগবানের বাচ্চা ধরার কেস নয়। ভদিদা হল আপনার আমার মতোই। তবে হেভি কৃপা।
— নিশ্চয় যাব। আসবেন যখন ইচ্ছে।
— না, অন্যায়টা আমাদের করতে বলবেন না। ভদিদার বারণ আছে। আমরা ভিজিটিং আওয়ারেই আসব। বেটাইমে আসতে যাব কেন?
— বেটাইমে এলে দারোয়ান দাঁত খিঁচোবে। আমরাও বেকার খচে লাথ-ফাত ঝেড়ে দেব। মধ্যে থেকে আপনার নার্সিং হোমের বদনাম। কোনো ক্যাচালে আমরা নেই।
— আজ তাহলে আমরা আসি?
— আসুন ভাই। আসুন। কী কপাল যে আপনাদের দেখা পেলাম। ভদিদাকে আমার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানাবেন। একটু যদি কৃপা করে দেন। তেতলায় একটা এ. সি. ওয়ার্ড খুলব বলে মনে ভেবেছি। মাড়োয়ারিরা এ.সি. চায়। পলিটিকাল লিডাররাও।
— সব হয়ে যাবে। ভদিদা একটু ছোট করে একটা মুচকি দিলেই কারো বাপ ঠেকাতে পারবে না।
শিশু ফ্যাতাড়ু ফড়ফড় করিয়া উড়িয়া বেড়ায় ও শূন্যে ডিগবাজি খায়। ডি. এস.-এর বউ-এর জ্ঞান আসে এবং সিজার কেসে সচরাচর যা হয় তেমন নয়। কোনো ককানি ফকানি নয়। বেদনায় কাতর মুখমণ্ডল নয়। উড়ন্ত শিশুর দিকে হাসিমুখে মা দুহাত বাড়িয়ে দেয়। অমনি সেই শিশু বোঁ করিয়া দুধভরা মাই লক্ষ করিয়া ডাইভ মারে।
কলকাতার পোজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের তারাবীক্ষণ যন্ত্রে সহসা বহুত সংখ্যায় উড়ন্ত চাকি দেখা গিয়েছিল। সেন্টারের ডিরেক্টর মিঃ সিকদার স্বচক্ষে একাধিক চাকতি দেখেছিলেন। কিন্তু মানেননি। কারণ আসলি বিজ্ঞান উড়ন্ত চাকি-ফাকি মানে না। কল্পবিজ্ঞান বা পরাবিজ্ঞানকে আসলি মালের সঙ্গে ঘেঁটেঘুঁটে পয়মাল করে দেওয়ার যে অব্যর্থ চক্রান্ত চালু হয়েছে মিঃ সিকদার তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। নানা সেমিনারে, বিতর্ক সভায় ও টিভিতে তাঁর হুংকারে চমকে ওঠার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। অবশ্য এই ‘আমাদের’ মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকরাও কি পড়েন? ছোট্ট বন্ধুদের মধ্যে কেউ বলতে পারবে? ছোট্ট বন্ধুরাই বা কারা? আসরেই কি সব পাওয়া যায়? গল্পদাদুর বউ কি গল্পদিদিমা? এরকম ২০০০টি অসমাধিত হেঁয়ালির বই ‘আনি মানি জানি না’-র চর্তুদশ সংস্করণের কয়েকটি কপি এখনও পুস্তকরাজির ছাইভষ্মের মধ্যে ছুপা রুস্তম হয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে। ‘এটির মধ্যে ওটি দিয়ে, মাগভাতারে রইল শুয়ে।’ এর মানে কিন্তু যা ভাবা স্বাভাবিক তা নয়। এর অর্থ হল খিল। হেঁয়ালির জট খুবই জটিল। রুবিকের কিউব যেমন। ওপথে মহাজনদের শনৈঃ শনৈঃ যাওয়া আসা চলতে থাকুক। রাত বেড়েছে। চাদরমুড়ি দিয়ে বড়িলাল এই শীতের রাতে কোথায় যায়? কেন যায়? কেচ্ছার চান্সটা যেহেতু এই দিকেই তাই সেই দিকেই মনোনিবেশ করা যেতে পারে।
মন্দিরের পেছনের গলি দিয়ে বেরিয়ে বড়িলাল কিন্তু থমকে গেল। আদিগঙ্গার দিক থেকে একটা আঁশটে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। কিন্তু সে কারণে বড়িলাল দাঁড়ায়নি। একটা ভারি গাড়ির আওয়াজ জোরে হচ্ছিল। আর একটা হেডলাইট জ্বলছিল বলে ফুটপাথের এক সাইডেই বেশি আলো এবং হবি তো হ বড়িলাল পড়েছিল সেই দিকেই। গোঁ গোঁ, ঝড়র লঝড় শব্দ আর কার হতে পারে? ক.পু-র একটি ভ্যান যা কালবিলম্ব না করে ওজন দরে ঝেড়ে দিলেও গরিব ও বঞ্চিত সরকারের ঘরে কয়েকটা পয়সা আসবে। ভেতরে ড্রাইভারের পাশে বসে টাকলা ও. সি। পেছনে তিনটে ঝিম মারা কনস্টেবল। এদিকটায় আনকা যারা মাগিবাড়িতে যায় তাদের ডবল ছেনতাই হয় — ছেনতাইবাজরা ঝেড়েঝুড়ে নেওয়ার পরে পুলিশের হাতসাফাই। এসব জৈব ভয় বড়িলালের না থাকলেও সে স্ট্যাচু হয়ে রইল এবং একচোখো ভ্যানটিকে নিরাপদ দূরত্ব অবধি যেতে দিল। চাদরমুড়ি বড়িলালের কাঁধে একটি বিবর্ণ বুদ্ধিজীবী ব্যাগ যার মধ্যে কাগজে জড়ানো একটি রামের পাঁইট। অতিবিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া বড়িলাল মালমুল টাচ করে না কিন্তু যখন খায় তখন ছ্যাঁচোড়ের মতো খায় না। বড়িলালের এই হিসেবী সংযম নিশ্চয়ই পাঠকদের একাংশ অনুকরণীয় বলে মনে করবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব পাঁড় ও টপভুজঙ্গদের অন্তরে কোনো বিবেচনার ঢেউ তুলবে না। তার কারণ কিন্তু হারামিপনা নয়। দেদারে যারা মাল প্যাঁদায় তাদের গুরু ও লঘু মস্তিস্কে কিছু ভাইটাল রদবদল ঘটতে থাকে। সেই নিউরন-সমাহারগুলি অলস তাসা পার্টির সঙ্গে তুলনীয় যারা বায়না ফিরিয়ে দেয়। এর পরিণতি বিবেচনাবোধের হ্রাস, গতরাতের বাওয়াল ভুলে যাওয়া ইত্যাদি নানাবিধ সিনড্রোম যা নিয়ে আর গবেষণা করার কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, গাঁজা নিয়ে গবেষকরা কিন্তু একমত নন। এ পর্যন্ত এর বেশি কেউ জানে না। আর অত জেনেই বা কী বালটা হবে?
কয়েক ঘরের শীতার্ত মাগিপাড়া। সব খানকির পাকা ঘরও নাই। বড়িলাল কিন্তু যে ঘরটির সামনে দাঁড়াইল সেটি কাঁচাপাকা। নানদিক হইতে ত্যারচা গোয়েন্দা আলো ও এলোমেলো তস্কর ছায়া এসে এক অনির্বচনীয় মিশেলের সৃষ্টি করেছে। বড়িলাল দরজায় দুইবার টুকটুক করিয়া গাঁট্টা মারিল এবং অনুচ্চ স্বরে ডাকিল,
— কালী! কা…লী…
ঘুমচোখে যে দরজা খোলে সেই কালী তা আবার নাই বা বলা হল।
— এসো। ভাবলুম আর না হয় এলে না। বসে বসে ঘুম ধরে গেল।
কালী ম্রিয়মান হ্যারিকেনটির শিখা উস্কাইয়া দিল। ফলে অপ্রশস্ত দেওয়ালে নানা ঠাকুর দেবতার ছবির ওপর বড়িলালের রাক্ষুসে ছায়া পড়ল।
— সাবান আর একটা কাচা কাপড় দে।
বড়িলাল উঠানে গিয়া অর্ধ গোলার্ধের ন্যায় কাপড় কাচা সাবানে হাত, পা, মুখ ধুইয়া কক্ষে ফিরিল এবং চৌকাঠে শায়িত চটের টুকরোটিতে পা ঘসিয়া মুছিল। এবং ঘরে আসিয়া নিজের কর্মক্লান্ত বেশভূষা ছাড়িয়া কালীর কাচা কাপড়টি যাহার নমনীয়তা মায়াময় এবং কেমন চাঁদ চাঁদ গন্ধ, লুঙ্গি করিয়া পরিল।
ইতিমধ্যে কালী দুইখানি গ্লাস ও একটি রেকাবিতে ছোট চিংড়ির মাথা ভাজা ও বড় বোতলে জল সাজাইয়া বসিয়াছিল। বড়িলাল কালীর চিরুনি দিয়া চুল আঁচড়াইল। তাহার পর কালীর মেঝেতে পাতা ঢালাও বিছানাতে আধশোয়া হইয়া রহিল। হাতের উপর মাথাটি রাখিয়াছিল বলিয়া তাহার বাইসেপটি ফুলিয়া ওঠে। কালী বলে,
— হাত ব্যতা করবে। ঐ কোলবালিশটা টেনে নাও।
কালী মাপ করিয়া ওল্ড অ্যাডভেঞ্চারার রাম ঢালে। জলের বোতল ধরে।
— আমার দিকে কী দেকচ? জল ঢালচি দেকবে তো!
আমরা জানি যে কালীকে যৌনকর্মী বলা উচিত না উচিত নয় তা নিয়ে সমাজের চিন্তাশীল অংশের মধ্যে বিতর্ক, বাদানুবাদ ও বিতণ্ডা প্রায়ই ঘটে। দুপক্ষই এমন লড়াকু যে পারে তো এখনই এ উহার গুহ্য মারিয়া দেয়। এই ঘোলা জলে ইচ্ছা করিলে দু একটি মৎস্যও যে ধরা যায় না তা নয়। কেবল একটি খ্যাপলা জাল রেডি রাখতে হবে।
কালীর ঘরে লন্ঠন ওরফে হ্যারিকেনের আলো কমিয়া গেল। ‘শিশুমার মেটারনিটি হোম’ হইতে ওঁয়া ওঁয়া শোনা যায়। রাজ্যে যে শান্তি বিরাজমান তা রক্ষা করার দায়িত্ব সকলেরই হইলেও রাজাদেরই বেশি।
এই সত্য উপলব্ধি করিয়াই আলমোড়া হইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় মহারাজকুমার শ্রী ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মা বাহাদুরকে লিখিয়াছিলেন ‘তোমাদের রাজ্যের হিতসাধনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া তোমাকে অত্যন্ত সহিষ্ণু হইতে হইবে। ঘটনাক্রমে অনেক অন্যায় অবিচারও তোমাকে আঘাত করিতে উদ্যত হইবে-তখন তোমার তেজস্বিতা যেন তোমাকে আত্মবিস্মৃত না করে। নীরবে অনেক আঘাত সহ্য করিতে হইবে — নিজের দিকে না তাকাইয়া নিজের কর্ত্তব্যের দিকেই লক্ষ্য রাখিবে। তোমাদের রাজাকে ও রাজ্যকে যাহাতে কোনো প্রকার দুর্বলতা আক্রমণ করিতে না পারে — ক্রমে ক্রমে সুযোগ বুঝিয়া যাহাতে সমস্ত জঞ্জাল দূর করিতে পার সে জন্য তোমাকে অত্যন্ত সতর্কভাবে চেষ্টা করিতে হইবে। হঠাৎ যাহাতে কোনো বিপ্লব বাধিয়া না উঠে, সে জন্যও বিশেষ সাবধান হওয়া আবশ্যক হইবে।’
ওঁয়া ওঁয়া
(চলবে)
১০
দশ ও দেশের মুখোজ্জ্বল করার অভিসন্ধি নিয়েই ‘কাঙাল মালসাট’ শুরু হয়েছিল কিন্তু গত অধ্যায় বা কিস্তিটা ছাপার সময় ভূতের খপ্পর কাকে বলে তা বোধগম্য হল। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে মানুষের কোনো হাত নেই। প্রথম প্রুফ যেই এল তখনই নজরে পড়ল যে শেষে যেখানে (চলবে) বলা থাকে সেখানে বেরিয়েছে (চলবে না)। সংশোধনের পরেও সেই আশাভঙ্গকারী ‘না’। কম্পিউটারের মাউস বা ক্যাট কেউই বাঁদরামি করছে না, তারা শুদ্ধ, ভাইরাস মুক্ত এবং যে পত্রিকায় এক এক পক্কড় করে ধরাশায়ী হচ্ছে সেখানেও কুচোকাচা কেউ ঢ্যামনামি করেনি। (চলবে না) — এর চেয়ে বরং ঢলবে না, টলবে না হলেও মুখরক্ষে হত কিন্তু (চলবে না) অবশ্যই অপমানজনক। লেখকের মধ্যে তখন খুবই প্রাকৃতিক ডাকের মতো যে উপলব্ধি পাওনা হল তা হল এ নিশ্চয়ই সম্পাদকের হারামিপনা। হয়তো তা প্রমাণিতও হত। এই নিয়ে বাদানুবাদের সময় সম্পাদক বরং শেষমেশ অপারগ হয়েই লেখকের দিকে পাণ্ডুলিপির জেরক্স ছুঁড়ে দিয়ে বলল — এটা কি আমার বাপের হাতের লেখা? লেখকের নিজেরই লেখা। অবিকল সেই হস্তাক্ষরে, নির্ভুল বানানে লেখা — (চলবে না)। সম্পাদকের কবুলতি হল চলুক বা না চলুক — কিছুতেই তার এক গাছাও ছেঁড়া যায় না। একই মত লেখকেরও। একইরকম গোঁ সব শালারই। রহস্য সায়ার মতোই রহস্যময়ী। আসল কারণ কেউই জানে না। প্রেতলোক অনেক সময়ই অটোমেটিক রাইটিং বা ওই জাতীয় কোনো ছলের আশ্রয় নিয়ে অপরিবর্তনীয় ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কিন্তু মানুষের ধাতে ভূতের নির্দেশ মানার কোনো সদিচ্ছা নেই। অবধারিত নিয়তি এভাবেই নির্জন জলার কাছে, আলেয়ার হাপসু গ্যাসালো আলোর নিকটস্থ নীরবে অপেক্ষারত দক্ষ ঠ্যাঙাড়ের সান্নিধ্যে ভ্রাম্যমাণ পথিকবরকে নিয়ে যায়। অতএব বোঝা যাক যে এবারেও তার অন্যথা হবে না কিন্তু যতক্ষণ হাতেনাতে না হচ্ছে …
দুই খিলানের ওপরে নির্মিত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ঝুলন সেতুটির টঙে বসে দাঁড়কাক কলকাতার এক একটি বিশিষ্ট এলাকা যেমন খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জ, গঙ্গা নদীর গায়ে ডক চত্বর, একগাছা লোমের মত মিলেনিয়াম পার্ক, ইডেন গার্ডেন, ময়দান, আখাম্বা মনুমেন্ট, চৌরঙ্গী এলাকার হিজিবিজি, ফ্রি স্কুল ষ্ট্রীটের ভার্জিন কলেজ-গার্লদের নগদা বাজার, ভবানীপুর, বিকট ধোঁয়াটে কুহকে ঢাকা উত্তর কলকাতা, বালীগজ্ঞের সেইসব এলাকা যেখান থেকে জীবনানন্দের গল্পের হেমেন প্রমুখ চরিত্ররা মোটা বউ নিয়ে বাসে উঠত বা ট্যাক্সি হাঁকাত তারপর ফারপোতে গিয়ে চপ-কাটলেট প্যাঁদাত, অথবা আরেকটু ঘাড় ঘুরিয়ে বাইপাস, সল্টলেক, কসবা কানেকটর ইত্যকার বিবিধ হুলিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল আর খিস্তি করছিল।
ভদি বানচোৎকে ধরে আড়ং ধোলাই দিতে হবে। এরকম একটা জালি, খুপরি খুপরি শহরে কোথায় গেরিলা হুজ্জুতি ধান্দা করবে, তা না, গাণ্ডুটা একেবারে আর্মির ঢঙে পজিশনাল ওয়ারের ছক কষছে। নুনুকামান দিয়ে পজিশনাল ওয়ার। এঁড়ে চোদা। বললুম লড়ালড়ি পরে করবি আগে লেখাপড়া কর। হদিশও দিলুম। মাও, গিয়াপ, চে, মারিঘেল্লা, টিটো — এগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নে তারপর কাগজ কলম নিয়ে মাদুরের ওপরে পোঁদ উল্টে নিজের মত ছক কর। যুদ্ধ করা সোজা ব্যাপার! হাওদা, হাতি, মাহুত — সব নখদর্পণে থাকতে হবে। তা না ল্যাওড়া কেবল তড়পাবে। দেদারে তড়পাবে। আমার কি! উল্টোপাল্টা দেখলে বাংলা কথা — আমি নেই। এত যদি তোর আম্বা বেগম জনসনের কাছে আরলি যুদ্ধের স্টোরি শোন — টিপু কি করেছিল, হায়দার আলি কি খুঁচিয়েছিল, সিরাজ ফোর্ট উইলিয়ামের পুঁটকি মেরে দিল কিন্তু সাহেবদের সঙ্গে এঁটে উঠবে কি করে? তখন তারা জাহাজে করে মাঝ গঙ্গায় নোঙর মেরে ঘাপটি মেরে আছে। কেটে পড়, ছিপে যাও, তারপর যেই দেখবে এনিমি মাল মাগির ফোয়ারা খুলেছে ওমনি ‘শোলে’-র স্টাইলে ঝাড়, লোহে গরম হ্যায়, লাগা দো হাতোড়া। তা না বাঁড়া কেবল লম্ভ ঝম্ভ। টঙে বেশ ঠাণ্ডা তো। ডানা ঝাপটাবো? হাই অলটিচুড তো, ইংলিশ হাওয়া লাগছে। ওফ এই একটা জাত, কবে হাওয়া ছেড়ে কেটে পড়েছে, এখনও যেমন ফুরফুরে তেমন গন্ধ।
দাঁড়কাক ডানা ঝাপটাল। একটি পালক খসে উড়তে থাকল। পালকটিকে সাধারণ ক্রো ফেদার ভাবাটা বোধহয় ঠিক হবে না কারণ পালকটি পাক খেতে খেতে গঙ্গায় পড়ল এবং শুভ্র ধাবমান সিলভার জেটের গায়ে জলছবির মত আটকে বিনা পয়সায় হলদিয়া চলে গেল। হলদিয়া পেট্রোকেমিকেল কেন লাটে উঠছে তা বুঝতে হলে এই ঘটনাটিকে ধরেই এগোতে হবে। এখানেই রয়েছে ভাইট্যাল ক্লু। এর বেশি বলা বারণ আছে। কারণ আলিমুদ্দিনে খবরটা গেলেই গেঁতো গভরমেন্ট নড়ে চড়ে বসতে পারে। সে হ্যাপা সামলানো ‘কাঙাল মালসাট’-এর ধকে কুলোবে না। অবশ্য এতক্ষণে নিশ্চয়ই রটে গেছে যে আমরা আনন্দবাজার বা সি. পি. এম. অথবা তৃণমূল কিংবা ঘাড়ভাঙ্গা কংগ্রেস কোনো মালকেই খচাতে চাই না। কিন্তু নিজে নিজে, আপন গরজে কেউ যদি খচিয়ান হয়ে ওঠে আমাদের কিছুই করার নেই। এরা তো এলিতেলি — বিশ্বজোড়া যার রোয়াব ছিল সেই ব্রিটিশদেরও জীবনে এই আনন্দের পুড়কি তো পরক্ষণেই নেমে আসত বেদনা বিধূর মূর্ছনা। ভান্ডিভাস Wandi wash, আরকট, পলাশী, বক্সার বা সেরিঙ্গাপত্তনামে যুদ্ধ জয়ের সে কি উল্লাস! কিন্তু যেই ব্ল্যাক হোল (মহাবিশ্বের খতরনাক কৃষ্ণ গহ্বরের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলাই ভালো) বা পাটনা ম্যাসাকার, অমনি ত্রু�দ্ধ ক্রন্দন ও পাঙ্খাওয়ালাকে খিস্তি। ইতিহাস সম্বন্ধে এই ট্র্যাজিকমিক বোধ জাগ্রত করার জন্য আমাদের ইভর এডওয়ার্ডস স্টুয়ার্ট নামধারী এক অতীব খচ্চর সাহেবের হাত ধরে বারংবার বেগম জনসনের গলতায় যেতে হবে কারণ বেগম জনসনই সেই দুর্বার মহিলা যিনি চারটি বিয়ে করার ফাঁক ফোকরে স্বচক্ষে সিরাজৌদ্দল্লাকে দেখেছিলেন, ক্লাইভ ও ওয়াটসনের মত প্রতিভাধরদের সঙ্গে গালগল্প চালিয়েছিলেন এবং গভীর আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন যে হোলকার, সিন্ধিয়া ও এমনকি ভীতিপ্রদ মারাঠাও কিভাবে জন কোম্পানির সামনে সেঁতিয়ে গিয়ে ‘জো হুকুম জো হুকুম’ করছে। এই জন্য বেগম জনসনের কাছে আমাদের চিরকাল নতজানু হয়ে থাকতে হবে। অন্যটি হবার উপায় নেই।
‘জয় মা গ্যাঞ্জেস’ বলে বিশাল দাঁড়কাক দ্বিতীয় সেতুর টঙ থেকে উড্ডয়ন করল এবং তখনই তার নজরে এল কয়েকটি উড়ন্ত চাকতি ঝাঁক বেঁধে খেলা করতে করতে হাওড়ার দিকে যাচ্ছে। বা খেলার ছলে হাওড়ায় চলেছে বললেও অতিকথন হয় না। উড়ন্ত চাকতির খেলা অনেকটা বাজারের আমিষ অংশের আকাশে মাছিদের ওড়াউড়িরই সামিল। কিন্তু কিছুক্ষণ এমত ক্রীড়ায় মাতোয়ারা হওয়ার পর মাছিরা কী করবে সেটা বলে দেওয়া যায় কিন্তু উড়ন্ত চাকতিদের যে কি মতলব তা বোঝা শিবের বাপেরও অসাধ্যি। হঠাৎ হয়ত ভাটিয়ালি গানে মুহ্যমান মাঝির দিকে তেড়ে গেল বা গঙ্গাতীরে স্নানরতা যুবতীদের দেখে মাঝ আকাশে দাঁড়িয়ে গেল। এর কোনটি যে হবে তা কেউ বলতে পারে না। শুধু কোয়ান্টাম জগত নয়, অন্যত্র এইভাবে ওয়ারনার হাইজেনবার্গ-এর আনসারটেনিটি প্রিন্সিপাল প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। দাঁড়কাক উড়ন্ত অবস্থাতেই স্ট্যাটেজিক দক্ষতায় কিছুটা পূরিষ ত্যাগ করিল যা হাওয়ায় ডানা মেলে দিলেও মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ টানে নেমে আসতে বাধ্য হয় এবং পড়বি তো পড় দুঁদে ট্র্যাফিক সার্জেন্টের গগলস-এর ওপরে। দুঁদে সার্জেন্ট ‘শিট’ বলিয়া আক্ষেপ করে ও মোটর সাইকেলটি সাইডে ভেড়ায়। কিছুটা মোটা ভুরুতে বাকিটা রেব্যান-এর গা গিয়ে গড়াচ্ছে। সার্জেন্ট-এর পরবর্তী ডায়লগ হল ‘ভালো রুমালটার গাঁড় মারা গেল।’ দীর্ঘ কালো চঞ্চুতে কৌতুকের ঝিলিক খেলিয়ে দাঁড়কাক উড়তে থাকে এবং আরও বেশ কিছুক্ষণ ফ্লাইটের পর ভিক্টোরিয়ার মাথায় পরীর পাশে নিখুত ল্যান্ডিং করে। সেই সময়েই ঝটকা বাতাস এলো এবং দীর্ঘদিন পরে কাছে আসার অভিমানে পরী মুখ ঘুরিয়ে নিল। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে জায়গাটি অচেনা হবার কথা নয়। অবশ্য ত্রৈলোক্যনাথ আজকাল খুব বেশি পিস পড়ে না। গম্বুজের ওপরে পরী ও দাঁড়কাক। কিন্তু দাঁড়কাকের চোখে পড়ল এক কাণ্ড। এক তরফা গোলকায়নের সুলভ শৌচের পরিবেশে একদঙ্গল ব্রিটিশ টুরিস্ট নানরকম ক্যামেরা ও ভিডিওক্যাম সহ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে বেড়াচ্ছে এবং বাইরে যাবার নুড়ি মারানো পথে দাঁড়িয়ে ভিক্টোরিয়ায় কিউরেটর তাদের ড্যানিয়েল, জোফানি ও ভেরিশ্চেগিনের আঁকা ছবির মহিমা বর্ণনা করছে। ইনি শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর তথা ডিরেক্টরই নন, কলকাতার স্বল্প দৈর্ঘ্যের ইতিহাসের ওপরে যারা ঘ্যাম তাদের মধ্যমণি বলা চলে। নিজের জীবনের উত্তরোত্তর উন্নতির বাঁকে বাঁকে তিনি জায়গা বুঝে একটিই কথা কখনো অস্ফুটে, কখনো সজোরে বলে এসেছেন — ‘সবই চার্নকের দয়া!’ আজও অন্যথা হল না। মূর্খ সাহেবদের দলটি হাহা হিহি করিয়া বিদায় গ্রহণের পর কিউরেটর মহাশয় এই ভাবিতে ভাবিতে নিজ কক্ষে ফিরিয়া আসিলেন যে প্রাচীন কলকাতায় মাগিবাড়ি সম্বন্ধে নানা তথ্য ইতস্তত ছত্রাকার হইয়া রহিয়াছে — সে গুলিকে একত্র করিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ আকর গ্রন্থ সম্পাদনা করিতে বাধা কোথায় — এই গ্রন্থটি বাংলায় হইলে ভাল না যুগপৎ ভাবে ইংরেজি হওয়াও আবশ্যক — মালটাকে ডাগোর করে তুলতে হলে কত কাঠখড় পোড়াতে হবে — এই সাতপাঁচ ভাবনার শেষে চেয়ারে গা এলাইয়া দিয়া তিনি বলিলেন, ‘সবই চার্নকের দয়া’!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানলার দিক থেকে জবাব এল, ‘কেন, তোর বাপ কী দোষ করল?’
এ এক রূপকথার দৃশ্য। ঘরের মধ্যে মহাপন্ডিত ও জানালার বাইরের অপ্রশস্ত অংশটির ওপরে কলকাতার ওলডেস্ট দাঁড়কাক ওরফে ভদির বাবা। মুখর মন্তব্যটি ছুঁড়ে দিয়েই দাঁড়কাকটি ঠোঁট চুলকোয়।
তবে কি দাঁড়কাকই কথা বলিল? না ভূত? কিউরেটর সাহেব লহমাভর এই চিন্তা করিলেন যে তিনি হয়তো বা অজান্তেই মৃত। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই জীবিত ছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁহার ভৌতিক জগতে প্রবেশাধিকার ঘটিয়াছে। প্রেতপুরীতে দাঁড়কাক কেন, মশা, ব্যাঙ, গোসাপ সকলেই অবলীলায় বোধগম্য বাক্য চালনা করে। এমত চিন্তা করিয়াই ধুরন্ধর মাথায় অন্য মতলব খেলিল। এমনও তো হইতে পারে যে আমি জীবিত দন্ডবায়সের মুখে হয়তো নিজেই কল্পিত উক্তি ভাবিয়া তামাশা ফাঁদিয়াছি। অতএব কেঁচে গন্ডুষ করে দেখাই যায়। তাই কিউরেটর ফের বলিলেন — ‘সবই চার্নকের দয়া!’
দাঁড়কাক চোখ পাল্টায়।
— একটা ঠোক্কর খেলেই বুঝবি কার দয়ায় করে খাচ্চিস। হারামির হাঁড়ি কোথাকার। যা, অভিশাপ দিলুম তুই পরের জন্মে গুয়ের পোকা হয়ে জন্মাবি। তাও, এখেনে নয়। ধর বর্ধমান বা মানকুণ্ডুতে। গুয়ের ডাব্বায় গুয়ের পোকা। গু খাবি, গু মাখবি তারপর একদিন গুয়ে ডুবেই পটলে যাবি।
কিউরেটর ভাবিয়াছিল সজোরে একটা পেপারওয়েট ছুঁড়িবে কিন্তু সাহসে কুলায় নাই।
— বুঝেছি আপনি বুলি কপচাতে শিখেচেন। কিন্তু জন্ম-জন্মান্তরে মানুষ যে সুপারম্যানের দিকে এগিয়ে চলেছে সে বিষয়ে কিছুই আপনি জানেন না। অবশ্য কাক-ফাকের এসব জানারও কথা নয়।
— বটে! কাক-ফাক! তাহলে শুনে রাখ, এই শালা কাকই তোর ঐ গণ্ডাকয়েক অরবিন্দ আর নীটশেকে ট্যাঁকে রাখতে পারে। সুপারম্যান মারাচ্চে। সুপার গুয়ের পোকা আগে হ, তারপর সুপার বাল, তারপর সুপারম্যান হবি। তোর মত ছকবাজ যত কম জন্মায় ততই মঙ্গল। সবই চার্নকের দয়া! এক ঝাপড়া মারব ফের ঐ নাম মুখে আনলে! চার্নক! ফাক চার্নক!
— চার্নক ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান। উনি না এলে কলকতা হত? কলকাতার তিনশো বছরে ঘোড়ার টানা ট্রাম চলত? অত পত্র-পত্রিকার স্পেশাল ইস্যু বেরোত? অত সেমিনার হত? এবং সব জায়গাতেই আমি আমার অগাস্ট প্রেজেন্স নিয়ে হাজির থাকতাম? কোথাও সভাপতি, কোথাও প্রধান কোথাও বিশেষ, ভেরিয়াস টাইপের অতিথি — বলুন এসব হত? সব ইমপরট্যান্ট মিনিস্টারদের সঙ্গে।
-চার্নক ওয়াজ এ গ্রেট বাল। ঐ বোকাচোদা এল আর গঙ্গার পাড়ে হেগে কলকাতার পত্তন করল — তোর মতো হারামি না হলে ঐ লুটেরা মাগিবাজটাকে আদিপিতা বলে চালানো যেত? ছাগলের দেশে রামছাগল যা বলে সেটাই অকাট্য যুক্তি। আর তোদের গভরমেন্টেরও বলিহারি যাই। কলকাতার জন্মদিন মারাচ্চে। তেমন তোদের সব মিনিস্টার। তেমন তুই। পাঁঠার সভার সভাপণ্ডিত ! রামপাঁঠা!
— সে আপনি যা বলেন বলুন, তাতে চার্নকের গ্রেটনেসে এতটুকুও আঁচড় লাগে না। যা ট্রুথ আমি তাই তুলে ধরেছি।
— চোপ! ট্রুথ তুলে ধরতে হয় না। ট্রুথ ঝুলঝাড়ু নয়। ট্রুথ শেখাচ্ছে। জোসেফ টাউনসেন্ডের নাম জানিস?
— আজ্ঞে, শোনা শোনা মনে হচ্ছে …
— ঢপ দিস না। টাউনসেন্ড ছিল রেণ্ডিবাজ এক গ্যাঞ্জেস পাইলট। চার্নকের সাগরেদ। মাগিবাজিতে এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।
— আই প্রোটেস্ট। এ কথাটা আপনি আগেও বলেছেন। চার্নক সতীদাহ থেকে একজন বিধবাকে উদ্ধার করে তাকে বিয়ে করেছিলেন! আর তার নামে…
— বেশি প্যাঁক প্যাঁক করিসনাতো। পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি। বিধবা উদ্ধার! তবে শুনবি? ভাইটাল একটা হিস্টোরিকাল ডকুমেন্ট। কবিতার ফর্মে। নে, লিখে নে। অ্যাঁঃ টেপ করবি? তো ক্যাসেট লাগা। ডবকা ফিমেল, ঢলো ঢলো ভাব ঐ মাল চার্নক জিন্দা থাকতে পুড়িয়ে নষ্ট করবে? মাগি কি যুঁইতুবড়ি না নসরিন?
— বলুন, কী হিস্টোরিকাল ডকুমেন্ট?
— বলচি, এটা পড়বি, ভাববি। বলে আমি চলে যাব। তিনদিন পরে আসব। তখন বলবি। নে বোতাম টেপ! জোসেফ টাউনসেন্ডের কবরের ওপরে লেখা — আটটি লাইন, ইংরাজিটা একটু আর্কেইক তবে তোর মত খচড়া ঠিক ধরতে পারবি — নে…
“Shoulder to shoulder, joe my boy,
Into the crowd like a wedge!
Out with the hangers, messmates,
But do not strike with the edge!
Cries Charnock scatter the faggots,
Double that Brahmin in two.
The tall pale widow is mine joe,
The little brown girls for you,”
দাঁড়কাক ঝটিতি উড়িয়া গেল। কিউরেটর টেপ বন্ধ করিলেন। ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করিলেন। প্লে লেখা বোতাম টিপিলেন, দাঁড়কাকের গলায় জোসেফ টাউনসেন্ডের এপিটাফ ধ্বনিত হইল। কিউরেটর ঢোঁক গিলিলেন। জলপান করিলেন।
— অ্যাসটাউন্ডিং!
পরক্ষণেই তাঁহার মনে ঝিলিক দিল যে, পরজন্মে তাঁকে গুয়ের ডাব্বায় গুয়ের পোকা হইয়া জন্মাইতে হইবে।
নলেনের কাছে দুঃখজনক সংবাদটি শুনে ভদি বমকে গেল। চারটে ঘরের মধ্যে মাত্র একটা ভাড়া হয়েছে। তাও এসেছে পাগলাখ্যাঁচা টাইপের একটা পাবলিক এবং তার সঙ্গে নাকি মালসা-ফালসা ছিল।
— এঃ চুলপোড়ার গন্ধ ছড়াচ্ছে। বানচোৎ করচেটা কী?
— হবে তুকতাক। পোড়াচুলের ধোঁয়া শিশিতে ধরচে বোধহয়। ফুটো দিয়ে দেকব?
— দেকে আয়। চুল পোড়ালে ভালো। তবে গায় না আগুন দেয়।
নলেন প্রতিটি ঘরের দরজাতেই সংলগ্ন গোপন ছিদ্রের একটিতে উবু হয়ে বসে চোখ লাগায়। এবং বিশেষ ঐ অবস্থান গ্রহণ করার জন্যই সম্ভবত একটি সহিংস বাতকর্ম ঘটে যায়। অমনি ভেতর থেকে সেই পাগলাখ্যাঁচা খেঁকিয়ে ওঠে,
— দরজায় আড়ি পেতে পাদা হচ্ছে! এরপরে ভাড়া চাওয়ার সময় বুঝিয়ে দেব। চুতিয়া কোথাকার।
নলেন চলে এসেছে ছিটকে। এবং মুখ দেখে বোঝা যায় যে চমকেছে। ভদি মিষ্টি হাসে,
— পয়মন্ত খদ্দের। টনক আচে। দেকলি কিছু?
— ঐ যা ভেবেছিলুম। হোমোপাথির ছোট ছোট শিশিতে চুলপোড়া ধোঁয়া ধরচে আর ছিপি দিয়ে দিয়ে বন্ধ করচে
— ঐ ধোঁয়া দিয়ে কী হয় জানিস?
— কী আবার? তুকতাক!
— কিন্তু স্পেশাল। ঐ ধোঁয়া কোনো বেধবা মাগির ঘরে ছাড়লে তেরাত্তিরের মধ্যে চুম্বকের টানে আলপিনের মতো চলে আসবে। এক এক শিশি হেভি দামে ঝাড়বে। আর খদ্দেরের অভাব নেই। হাজার হাজার লোক বেওয়া মাগি তাক করচে।
— কিন্তু টেনে আনা এক জিনিস আর জব্দ করা, সে তো খুবই ঝামালা। কতায়ই তো বলেচে, গলায় দড়ির গিঁট আর বিধবা মাগের হিট।
— সে যার চিন্তা তার চিন্তা। আগে মদনানন্দ মোদক খেত, ইয়াকুতি হালুয়া খেত, হাকিম বাড়ি যেত। এখন শুনচি আমেরিকা থেকে কী একটা ট্যাবলেট আনচে। এক বাক্স কিনতেই ফতুর। তবে হ্যাঁ, একটা টপ করে গিলে ফেললেই হল। কলকাতার যেমন মনুমেন্ট তেমন তোরও হয়ে যাবে। যেই যে দাঁড়াবে আর শোওয়া বসা নেই।
বিস্ময়ে নলেনের মুখ হাঁ হয়ে যায়,
— সেও তো বিপদ।
— বিপদ বলে বিপদ। ঘোর বিপদ। যা হোক ঐ মালটাকে আর ঘাঁটাসনি। এরপরে বেইমানির ওজর তুলে ভাড়া দিতে গাঁইগুঁই করবে।
— ও আমি ঠিক সাইজ করে নেবখন।
— নিস। আমি এট্টু বেরুচ্চি। জয় বাবা দন্ডবায়সের জয়! জয়, ঘুরঘুরে চাকতির জয়।
ভদি বেরিয়েই যাচ্ছিল কিন্তু বেচামণি ডাকল,
— এই নলেন, এট্টু ডাক তো!
— সেই পিছু ডাকলে। যা ভয় করেছিলুম তাই।
— বৌ পিছু ডাকলে কিছু হয় না। কী বল নলেন।
নলেন গাণ্ডুর মতো মাথা নাড়ে।
– এসব নকড়া ছাড়ো তো। কী বলবে বলো, ঝটপট বলো দিকি।
— বলচিলুম ঠাণ্ডা পড়েচে। চামড়ায় টান ধরচে। গাল চড়চড় করচে। একটা গ্লিসারিন সাবান আনবে তো মনে করে!
— কেন? তেল মেকে হচ্চে না? কী আমার কাননবালা রে, গ্লিসারিন সাবান না হলে চলচে না। একেই মাগগির বাজার। ওসব সায়েবসুবোরা মাখে। কত দাম জানো? মাত্র এক ঘর ভাড়া হয়েচে।
— তোমার ক-ঘরে লোক বসল আমার জেনে দরকার নেই। ও আমি ঢের দেকেচি। এরপর কিন্তু কিস খাবার সময়ে বলবে না যে — বেচু, তোর গালটা অমন খসখসে কেন রে?
নলেন ফিকফিকিয়ে হাসে। চুলপোড়া ধোঁয়ায় সকলেরই নাক জ্বালা করছে। ভদির মুখটা দেখে মনে হচ্ছে হিট উইকেট হয়েছে।
— মুখের একটা আব্রু নেই। ঘরের বৌ কেউ বলবে?
— তো কী বলবে? বলো! লোককে জিগ্যেস করেই দেখো না। কী বলবেটা কী? বাজারখোলার খানকি? একটা গ্লিসারিন সাবান চেইচি, তাই কত চোপা!
বেচামণি যে ভ্যাঁ করে ককিয়ে উঠবে সেটা ভদি ঠিক আন্দাজ করেনি। উপরন্তু ধারে-কাছে দাঁড়কাক বাবা আছে কিনা সে ভয়ও আছে। খচে গিয়ে হয়তো মাথার মাঝখানে ঠুকরে দেবে বা জোড়া ডানার ঝাপড়া।
— আঃ, য্যাতো দিন যাচ্চে তত খুকিপনা বাড়চে। আমি কি বলেচি যে গ্লিসারিন সাবান আনব না? ঠাট্টা বটকেরা কিচুই বুজবে না।
বেচামণি ফোঁপায়।
— থাক। আর সোহাগ দেখিয়ে অ্যাদিক্যেতা করতে হবে না। নলেন, আমি গেলুম। খুকিকে চোকে চোকে রাকিস। চুলপোড়াও না পালায়। কোতায় একটা দরকারি কাজে বেরোব না হাঁউমাউ করে সব ঘেঁটে দিল। গ্লিসারিন সাবান! কত বাঁড়া গ্লিসারিন সাবান দেখলুম।
ভদি চলে যেতে নলেন বেচামণিকে মক বকাঝকা করে।
— আর তুমিও পারো বাবা বৌদিদিমণি। জানো তো, লোকটার মুকই ঐরকম। কিন্তু অন্তরটা। জানবে যে লোকের মুখে মধু তার অন্তরের বিষ কেউ টের পায় না। দাদাবাবুর হল উল্টোটা। ছোবলাবে কিন্তু মধু ঢেলে দেবে।
— সে না হলে কবেই বাপের বাড়ি চলে যেতুম।
— বালাই ষাট! অমন কথা বলতে আচে?
এই ইন্টিমেট, ট্রাসপারেন্ট ও টাচিং কথোপকথনের মধ্যে ঘটাস ঘটাস করে ঘর খুলে, গলা খাঁকারি দিয়ে, কাঁধে ঝোলা, পাগলাখ্যাঁচা টাইপটা বেরিয়ে আসে। ঝোপজাড়ওয়ালা পরপুরুষকে দেখে বেচামণি বড় করে ঘোমটা দিয়ে অন্যদিকে চলে যায় এবং তার পায়ে পরা রুপোর গয়না থেকে ঘুঙুরমার্কা ছমছমা শব্দ হয়। পাগলাখ্যাঁচা আড়চোড়ে বেচামণির ব্যাকটি সার্ভে করে নেয়। এরকম অবশ্য যারা পাগলাখ্যাঁচা নয় তারাও করে থাকে।
পাগলাখ্যাঁচা তেলচিটে বুকপকেট থেকে টাকা বের করে। দুটো কুড়ি টাকা আর ছটা দশ টাকার নোট গুণে গুণে নলেনকে দেয়। ওর ঝোলার মধ্যে শিশিতে ঘষা খেয়ে মিহি কিঁচমিচে শব্দ হয়। নলেন একটা কুড়ি টাকার নোট ফিরিয়ে দেয়।
– কী হল?
– ও জোড়া টাকা চলবে না।
– কোথায় জোড়া?
– মাঝখানে এটা কী? কাগজ সাঁটা জ্বলজ্বল করচে।
— ও ওরকম থাকে। সব চলে।
— চলুক। এখানে চলে না।
— নাও বাবা, পাল্টে দিচ্ছি। মালিক আর মালকিনে খিঁট চলছে বলে ঠাহর হচ্ছে। কী ঠিক বলিনি? এই নাও। ধরো। ভালো টাকা। কী, ঠিক বলিনি?
— টগরগাছতলায় ঐ খেঁটোটা দেখতে পাচ্ছ? ঐটা যখন গাঁড়ে ঢুকিয়ে দেব তখন টের পাবে কী চলছে?
— যাঃ বাঁড়া। কী বললুম আর কী বুঝল?
— ঠিকই বুঝেছি। বাল পুড়োনো ধোঁয়াতে কী হয় জানো?
— আমার আর জেনে দরকার নেই বাবা। পাগলাখ্যাঁচা আর কালবিলম্ব না করে কেটে পড়ে। নলেন এগিয়ে দরজার হুড়কোটা লাগিয়ে দেয়। অন্তরীক্ষে একই সঙ্গে বোয়িং এরোপ্লেন ও চাকতির শব্দ। বোয়িং সেভেন ফোর সেভেনের পাইলট উড়ন্ত চাকতির উন্মত্ত ও স্বচ্ছল খেলা দেখে বিস্মিত হয়। গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করে!
এই যে অত্যন্ত ভূতুড়ে মহাকাশ আমাদের প্রায়ই অনন্ত নশ্বরতার বোধে আকুল করে তোলে এবং হালকা হাতছানি দিয়ে ‘আয়! আয়!’ বলে ডাকে তাতে ওড়াউড়ি করার অধিকার যেমন বোয়িং-এর আছে তেমন ভদির ঘরের উড়ন্ত চাকতিদেরও আছে। ঠিক এই কথা বলার জন্যে না হলেও বাংলার এক কবি লিখেছিলেন,
ক্ষিত্যপতেজব্যোম ও মরুৎ
সকলেরই তরে এই পঞ্চভূত।
এই বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং কয়েক ফার্লং এগিয়ে গিয়ে, – সাম্যের আদর্শে বলীয়ান হয়ে, অপারেশন বর্গার কত আগেই বলেছিলেন,
আকাশ – আলো – জল – বায়ু — চার
— এ সকলে যদি থাকে অধিকার
সব মানুষের, ভূমিতে কেবল
দু-চারজনের রহিবে দখল?
লড়াকু মনোভাবে ভরপুর এই মহান কবিতাটির শিরোনাম — ‘সবৈ ভুমি গোপাল কী’। কিন্তু সেই কবির নাম কী? মালটাকে কেউ আইডেনটিফাই করতে পারবে?
(চলবে)
১১
বাংলার কবিদের যদি একটি আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড আয়োজিত হয় তাহলে উড়ন্ত চাকতির উচ্চতা থেকে দেখলে মনে হবে পিঁপড়েদের এক মহামিছিল চলছে যার সামনের দিকটি অর্থাৎ মুণ্ডু যখন মিশরের পিরামিডের ছায়া পেরোচ্ছে তখন তার ল্যাজ হয়তো ঠনঠনে কালীবাড়ির সামনে। এত কবি পৃথিবীর কোনো দেশে হয় নাই, অদূর ভবিষ্যতে কোথাও হইবে বলিয়াও মনে হয় না। সেই মিছিলে যেমন কাহ্নপাদ ও ভুষুকপাদ চলিতেছেন, তেমনই চলিতেছেন রবীন্দ্রনাথ, হেমচন্দ্র, বিষ্ণু দে ও কে নয়? এই মহামিছিলেই দেখা যাইবে ‘সবৈ ভূমি গোপালকী’-র কবিও আগুয়ান। কিন্তু কেহই সেই গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়কে শনাক্ত করিতে পারিবে না। হয়তো মাইকেলকে চেনা গেল বা কাহাকেও দেখিয়া মনে হইল ইনিই তবে নজরুল কিন্তু বিজয়লালকে কে আইডেনটিফাই করিবে? সেরূপ পণ্ডিত বা কবিপ্রেমী আজ বিরল যেরূপই বিরল আর্মাডিলো বা স্নো-লেপার্ড।
জীবনে বাড়িবে আরোও একগোছা ভুল,
‘চাওয়া আর পাওয়া’ আজও নয় সমতুল।
বলো তো বাছা কার লেখা এইটি? চিনতে পার? পারিলে না তো। উনিটি হলেন গোপাললাল দে।
… কত না নবীন সৃষ্টি — আকাশে ও সাগরের নীলে
রজনীগন্ধার বৃন্তে একান্তে যে কবিতা লিখিলে,
আমারে দেখাবে সেই সংখ্যাহীন কবিতা তোমার
তুমি কবি, আমি কবি — আমার ও কামনা দুর্বার।
কোন হ্যায় ইয়ে পোয়েট? হায়, হায় — আ. ন. ম. বজরুল রশীদ।
খপ করে কোনো আঁতেলকে টুকরো প্রশ্ন করে দ্যাখো। ‘বাউল বাতাস হয়েছে আজ মউলবনে মাতোয়ালা’ বা ‘কুহুর গিয়াছে দিন কেকা আজ কাঁপায় অম্বর’ — বলিতে পার কার কলমের খোঁচায় এই দুটি লাইন খোদিত? শ্রী শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা বলিয়াছেন, ইঁহার ‘কাব্যে সুরার তীব্রতা নাই, শীতল পানীয়ের স্নিগ্ধতা আছে’। কে তিনি? যাঁর কবিতায় বাংলার কিক নাই, পেপসির মোলায়েমতা রয়েছে। কালিদাস রায় জানিয়া যান নাই যে ‘কবিশেখর’ উপাধি তাঁহাকে চিরকাল পাঠক-মুকুরে ধরিয়া রাখিতে পারিবে না।
বাংলা কবিদের মহামিছিল মহাকালের ফলস দাঁত পরা মুখগহ্বরের দিকে ধাবমান থাকুক। আমাদের অন্য গলতায় ডিউটি পড়েছে। আমরা বরং সেইদিকে ভাঁজ মারি …
সন ২০০০-এর বইমেলাতে অন্যান্য সববারের মতোই (অবশ্য আগুন লাগার বছরটি বাদে) আনন্দ ও বাজার, আনন্দ ও বাণিজ্য, আনন্দ ও আইসক্রিম ইত্যাদি কোনোটিই গরহাজির ছিল না। একদিকে ধর্মের ধ্বজা উড়িতেছে তো এই নাও জিরাফের অন্তরঙ্গ জীবনী। তবে বড়ই দুঃখের বাত এই যে, এই মেলায় ‘লন্ডন রহস্য’ পাওয়া যায় না। এবং সারি দিয়া দণ্ডায়মান পুলিশকে কেহ এক সেট এনসাইক্লোপিডিয়া বলিয়া ভুলও করিতে পারে। মধ্যে এই মেলা বুক ফেয়ার না হইয়া কুক ফেয়ারে পরিণত হইয়াছিল। যারই ফল-পরিণামে সেই লেলিহান সার্কাস যাহাতে আগুন ও ধোঁয়া যথাক্রমে ক্লাউন ও ট্রাপিজের খেলা দেখাইয়াছিল। এবং এইসব সম্ভব করিয়াছিল মজুত একখানি ফায়ার ব্রিগেডের নল লাগানো বিকল পাম্প-সহ গাড়ি। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে দুইটি ভাগ আছে। এক দলের মতে ইহা ট্র্যাজিকমেডি। অন্য দলের মত — না, ইহা কমিট্রাজেডি। এই ডেমোরিপাব্লিকান ঢ্যামনামিতে ভাসিয়া গেলে আমাদের বাপু চলিবে না।
‘কাঙাল মালসাট’ যে বৎসরে তার অভিশপ্ত যাত্রা শুরু করে সেই ১৯৯৯ থেকেই কলকাতা বইমেলা লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের তীক্ষ্ণ তত্বাবধানে রয়েছে। কারণ বিদেশী, স্বদেশী — নানা টাইপের হারামি আছে। এবং তারা আছে এবং ভালোভাবেই আছে এটা জেনেশুনে এত বড় মেলাটা অরক্ষিত রাখা যায় না। বলাই বাহুল্য যে, এই নেকনজরের মূলে রয়েছে জনৈক মন্ত্রীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা। মেলায় নানা গোয়েন্দার নানা কাজ। তার মধ্যে প্রতিবারই গোলাপ মল্লিক পুং প্রস্রাবাগারের ডিউটি পায়। ছোট, বড় চোতা পোস্টার নিত্যই পড়ে। নানা মাপের ও ঢঙের। সেগুলির স্যাম্পল যোগাড় করা তার কাজ। অর্থাৎ গোলাপ মল্লিকের ডিউটি।
১৯৯৯তেই গোলাপ মল্লিক মেলার চতুর্থ দিনে একটি জেরক্স করা পোস্টার দেখে হতবাক হয়ে যায় — পোস্টারটির বাঁদিকে রয়েছে —
শ্রীঘৃত সম্বন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণী
এবং ডানদিকে
Santiniketan, Bengal
বাংলাদেশে ঘৃতের বিকারের সঙ্গে সঙ্গে যকৃতের বিকার দুর্নিবার হয়ে উঠেছে। শ্রীঘৃত এই দুঃখ দূর করে দিয়ে বাঙালিকে জীবনধারণে সহায়তা করুক — এই কামনা করি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১ বৈশাখ, ১৩৪৪
পোস্টারটি সযত্নে জল দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খুলে গোলাপ মল্লিক লালবাজারে নিয়ে যায়। সেখানে বড়বাবু দাঁ মালটি স্টাডি করে গোয়েন্দা তারকলাল সাধু-র কাছে পাঠালেন। তিনি গোলাপকে বল্লেন —
— দ্যাখো মিঃ রোজ, এই যে কলকাতা শহরটা দেখছ না এর মধ্যে অন্তত লাখ দশেক পাগলা রয়েছে। তারা নিজেরাও জানে না যে তারা পাগল। যারা তাদের সঙ্গে থাকে তারাও বুঝতে পারে না। ডেইলি ওঠাবসা করছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না। এমনই গাণ্ডু। বুঝলে?
— হ্যাঁ স্যার। আমি ভাবছিলুম গাণ্ডুর নাম্বার তাহলে লাখ পঞ্চাশেক হবেই।
— সে তো হবেই। এছাড়াও উদগাণ্ডু, তেঢ্যামনা, হাড়হারামি রয়েছে পালে পালে। তার মধ্যে কে ক্ষতিকর বা ফরেন সোর্সের এজেন্ট সেটা স্মেল করাই আমাদের কাজ। তোমার এই পোস্টারটা ইন্টারেস্টিং। রচনাবলীতে নেই। তবে এটা কেন জেরক্স করে মারতে গেল — এ, নির্ঘাৎ পাগলা কেস।
— কিন্তু স্যার, আমি ভাবছিলুম যদি কোনো কোডেড মেসেজ হয়? কোনো গোপন নির্দেশ বা কিছু। হতেই পারে সার।
— এই অ্যাঙ্গেলটা তো ভেবে দেখিনি। জব্বর ধরেছ গোলাপ। ফ্যাকড়াতে ফেলে দিলে।
-না, মানে হঠাৎ মনে হল সেয়ানা পাগল বা ট্যাটনও তো হয়।
— সে তো হয়ই। আমি ফালতু রিসক নেব না। কী বলো? একটা নোট দিয়ে ওপরে পাঠিয়ে দিই —
— হ্যাঁ, সেই ভালো স্যার। পরে যদি কোনো ঝুটঝামেলা হয়ে যায়।
তারকলাল নোট-সহ ওপরে পাঠিয়ে দিলেন।। একটি ফাইলে। ফাইল একদিন পরে ফেরত এল — ওপরে স্কেচ পেনে লেখা — ‘বাল’।
এই ঘটনার থেকে গোলাপ এই সিদ্ধান্তে আসে যে ওপরতলাতেই যখন সম্ভাব্য চক্রান্ত বা অন্তর্ঘাত সম্বন্ধে মাথাব্যথা নেই তখন সেই-বা কোন দুঃখে সাপের সন্ধানে কেঁচো খুঁড়ে খুঁড়ে হাল্লাক হবে? তারকলাল সাধুর মতো পোড়খাওয়া ঘোড়েল গোয়েন্দা অব্দি ব্যাপারটার গ্রাভিটি বুঝেছিল। কিন্তু তার ওপরে?
— আমার কী ল্যাওড়া! এরপর যা দেখব চুপচাপ দিয়ে দেব। তারপর বাঞ্চোতরা যা করবি করগে যা। এইসব ছোল দিয়ে দেশ চলবে! পড়ত বাঁড়া ব্রিটিশ সায়েবদের হাতে। গাঁড়ে রুল দিয়ে নাচাত।
এই উপলব্ধি গোলাপকে বড়ই উদাস ও বিবাগি করে তোলে। ২০০০-এর বইমেলাতে এই ধরণেরই একটা হু-হু মনোভাব নিয়ে গোলাপ পেচ্ছাপখানা টু পেচ্ছাপখানা খুবই আলগা পা ফেলে ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বড়ই শ্লথ সে পদচারণা। সন্ধের মুখে গোলাপ ভাঁড়ের চা খেয়ে চা-ওলাকে পাস দেখাল। তারপর ছোট সাইজের একটা ক্যাপস্টেন সিগারেট ধরাল। প্রায় তার ধোঁয়ার ধরতাই ধরে ফোকলা লোকটা গোলাপকে বলল,
— ধরে ফেলিচি। না বললে চলবে না।
— অ্যাঁ!
— গোপাল। টালিগঞ্জ থানার সামনে। সিমেন্টের বেঞ্চিতে। নকশাল টাইম। নিয়ারলি থার্টি ইয়ার্স বাট নো চেঞ্জ।
— সরখেল!
— তবে!
— একটা ভুল করেছ। গোপাল নয়, গোলাপ।
— কুড়ি বছরের গ্যাপ। মাইনর ভুল। হতেই পারে।
— রিটায়ার করেছ?
— কবে?
— হাতে এত কাটাকুটি, কড়া …
— ওই, মাটি খুঁড়তে … খুঁড়তে
সরখেল নিজেকে সামলে নেয়।
— কেন? মাটি খুঁড়ছ কেন?
— আরে, বাগান করচি। চুটিয়ে বাগান করচি। এক-একটা গ্যাঁদা দেকলে ভাববে বাঘের মুণ্ডু।
— তাই বলো। বৌদি?
— সে তো এইট্টি সিক্সেই …
— ও!
দুজনে ফের এক ভাঁড় করে চা খেল। সরখেলই খাওয়াল। তারপর কাঁধে ঝোলানো সাইডব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা চোতা গোলাপকে ধরাল।
— এটা রাকো। বেশি ছাপিনি তো। লোক বুজে বুজে দিচ্চি। ফ্রি। পরে পড়ে নিও এক ফাঁকে। তবে হালকা ব্যাপার নয়।
— তারপর, মেলায় কিছু কিনলে-টিনলে?
— কী কিনব? কেনার মতো কিচু আচে? সবই আলবাল। তবে কিনিনি তা নয়। ভূত সিরিজের তিনটে আমার ছিল না। এই তালে হয়ে গেল।
— দেখি?
তিনটি বই। চল্লিশ-পঞ্চাশ পাতার বেশি নয়। ‘মানুষখেকো ভূত’, ‘মস্তান ভূত’ ও ‘রেলগাড়িতে ভূত’।
– এই বুড়ো বয়সে তোমাকে ভূতে ধরল?
– তা বলতে পার। ওই সাবজেক্টটাই স্টাডি করচি একন। তোমার নির্ঘাৎ ডিউটি চলচে।
– বুঝতেই পারছ।
– আমি তাহলে এগোই। আর গোটা দশেক আচে। বিলি হয়ে গেলে কেটে পড়ব। যা ধুলো উড়চে। লেখাটা পড়বে কিন্তু!
– সে তো পড়ব। কিন্তু ফের দেখাটা হবে কবে?
– সে হবেখন। এই মেলাতেই হবে। পড়বে কিন্তু ভায়া। বড় খেটেখুটে লিখেচি।
সরখেল চলে যাওয়ার পর গোলাপ মল্লিক ভাঁজ করা ফর্দের মতো কাগজটা খুলল।
পিঁপিড়ার ডানা ওঠে …
কে. জি. সরখেল
অবসরপ্রাপ্ত করণিক, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া
‘পিঁপিড়ার কেন ডানা ওঠে তা সকলেই জ্ঞাত হয়। উড়িবার তরে। কবে হইতে এই ডানা গজানো শুরু হইল তা আমার সঠিক জানা নাই। কিন্তু বিভিন্ন প্যালিয়েন্টোলজিস্ট নির্মিত ক্ল্যাডোগ্রাম হইতে এই সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানীরা উপনীত হইয়াছেন যে ডাইনোসরদের নানা প্রজাতির মধ্যে থেরোপড ডাইনোসর হইতেই পক্ষীকুল গজাইয়াছে। জন অসট্রম বলেন যে, অরনিথোলেসটেস, ডেইনোনিকাস ও অরনিথোসুকাস ইত্যাদি থেরোপড ডাইনোসরদের সঙ্গে প্রাচীন পাখি আর্কিওপটেরিক্স-এর বড়ই মিল। ডাইনোসরবিদ গ্রেগ পল বলেন, যে কম্পসগন্যাথাস নামক ডাইনোসরটি আর্কিওপটেরিক্স-কে ধরিয়া ভক্ষণ করিবার জন্য ধাওয়া করিয়াছিল, সেই ধাওয়া সামলাইতেই আর্কিওপটেরিক্স উড়িতে বাধ্য হয়। অবশ্য আমি এ-বিষয়ে ঠিক একমত পোষণ করি না। তাহার কারণ এই যে, ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রাচীন পাখিরা অর্থাৎ আর্কিওপটেরিক্স (উৎপত্তি ১৫০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে) ইত্যাদি লুপ্ত হয়। তাহারা কী করিত না-করিত কেহই জানিতে পারে না। এই ধ্বংসরেখার নাম কে-টি দুর্ঘটনা অর্থাৎ ক্রিটেসিয়াস ও টার্সিয়ারি যুগের সন্ধিক্ষনে এই প্রলয় ঘটিয়াছিল। পাঠকভায়া, তুমি নিশ্চয়ই অবগত আছ যে তুমি সেনোজয়িক যুগের প্রথমাংশে জীবনযাপন করিতেছ। সেনোজয়িক যুগের হিংস্র ও উড্ডিয়ান আর্কিওপটেরিক্স, অ্যাপাটরনিস, প্যালিওকারসনিস, হেসপেররনিস, সিনোসরোপটেরিক্স প্রাইমা ও বহুশ্রুত টেরোড্যাকটিল দাঁড়ের ময়না বা কাকাতুয়া ছিল না। চিল-শকুনও নয়। সেসব অচিন পাখি খাঁচায় আসা-যাওয়া করিত না।
‘প্রথম অনুচ্ছেদে আমি যাহা কিছু বলিলাম তা একই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও অবান্তর। প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে ইহা হইতে ওড়াউড়ি যে মান্ধাতার আমলের ব্যাপার তাহা তুমি বুঝিতে পারিবে। অবান্তর এই কারণে যে আমরা বিহঙ্গের পাখা বন্ধ হইল কি হইল না তা ভাবিয়া কেন মরিতে যাই? আমরা প্রমাণ করিতে চাহি যে, মানুষ কোনো বিশদ বিবর্তন ছাড়াই উড়িতে সক্ষম। উড়ন্ত মানুষের ফসিল পাওয়া যায় না। যাবেও না। কিন্তু জীবন্ত উড়ুক্কু মানুষ আছে। শুধু আছে নয়, ধারে-কাছেই আছে। শুনিয়া তাজ্জব বনিলে তো! এই রচনায় আমি পুরা কেচ্ছা ফাঁস করিব না। কেবল ইঙ্গিত দিব। তাহার কারণ আমি চাই না যে উড়ুক্কু মানুষরা ধরা পড়ুক। অথবা তাহারা বিব্রত হোক। আমি কেবল চাই যে দেশ ও মান্যবর সরকার (রাজ্য ও কেন্দ্র) জানুক যে মানুষ উড়িতেছে। তাহাদের একটি বিশেষ নামও আছে। আমি কয়েকজনকে চিনিও। কিন্তু এই রচনায় সব কিছু প্রকাশ হইয়া যাক — এরূপ ইচ্ছা আমার নাই। কিন্তু আমি, কে. জি. সরখেল, এই প্রথম তাহাদের কথা বলিলাম। আর মাত্র কয়েকটি কথা বলিয়া দায়িত্ব হইতে খালাস পাইব। কিন্তু পাঠক, তোমার ঘাড়ে উড্ডয়নের নেশা ভূতের মতোই চাপিয়া বসিবে। বারংবার তুমি গগনের দিকে তাকাইবে। দেখিবে মেঘ উড়িতেছে। তোমারও উড়িতে ইচ্ছা যাইবে। উটপাখি, মুরগি ইত্যাদি হতভাগ্য কয়েকটি পাখ-পাখালির কথা না ধরিলে দেখিবে কত না পতঙ্গ ও পাখি ওড়াউড়িতে মাতিয়াছে। উড়িতেছে বিমান। কৃত্রিম উপগ্রহ। রকেট। বেলুন এমনকি শ্মশানের ধোঁয়াও উড়িতেছে। আর তুমি ভূ-পৃষ্ঠে দাঁড়াইয়া হাত কামড়াইতেছ। কোমোডো দ্বীপের ড্রাগন-সদৃশ ভয়াবহ গিরগিটি ও তোমার মধ্যে কেমন মিল! সে চারি পায়ে ও তুমি দুপায়ে চরিতেছ। এই জন্যই কবি পুরন্দর ভাট লিখিয়াছেন —
উড়িতেছে ডাঁস, উড়িছে বোলতা, উড়িতেছে ভীমরুল,
নিতম্বদেশ আঢাকা দেখিলে ফুটাইবে তারা হুল।
মহাকাশ হতে গু-খেকো শকুন হাগিতেছে তব গায়,
বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়।
এমন কবি ও কবিতা যে দেশে অনাদৃত থাকে, এই চারিটি লাইন ব্যাখ্যা করিবার জন্য যখন বাংলা এম. এ.-এর প্রশ্নপত্রে দেওয়া হয় না তখন অধিকাংশ বাঙালি ভূ-চর হইয়াই থাকিবে। খ-পোত বন্দরে ক-জনই বা যাইতে পারে বা চড়িতে পারে? উপরন্তু খ-পোত মোটেই নিরাপদ নয়। বিশেষত খ-পোত ছিনতাই-এর বিপদ যখন মড়ার ওপর খাঁড়া হইয়া ঝুলিতেছে। যাই হউক, আমরা আবেগের বশে বেপথু হইতে বসিয়াছি। ফের আমরা বিষয়ের সদর দপ্তরে কামান দাগা বরং শুরু করি।
‘আমি জানি যে একদল পণ্ডিত হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিবে। মানুষ উড়িতে পারে না। আমার কাছে ওই আপত্তি শেয়াল-পণ্ডিতদের হুক্কা-হুয়া ব্যতিরেকে আর কিছুই না। কারণ প্রমাণ হাতে না লইয়া কে. জি. সরখেল আখড়ায় আসে নাই। তাঁহার সহিত মহড়া নেওয়া অত সহজ নয়।
‘শিবসংহিতায় আছে, ‘যিনি সর্বভূত জয় করত আশাহীন ও জনসঙ্গশূন্য হইয়া পদ্মাসনে উপবেশন পূর্বক নাসাগ্রে দৃষ্টিস্থাপন করেন, তাঁহার মনোনাশ হয় এবং তিনি ব্যোম পথে গমনাগমন করিতে সমর্থ হন।’ ঘেরণ্ড-সংহিতায় বায়বীধারণামুদ্রা আছে। এই মুদ্রাও শূন্যদেশে ভ্রমণশক্তি প্রদান করে। অত কথার কী প্রয়োজন? কারাগারে যোগসাধনাকালে শ্রী অরবিন্দ একদিন ভূপৃষ্ঠ হইতে উপরে উঠিয়াছিলেন।
সাহেবদের দেশেও এমনটি ঘটিয়াছে। ‘ফিওরেত্তি’ হইতে জানা যায় লা ভের্না পর্বতে উপাসনাকালে সন্ত ফ্রান্সিস জমি ত্যাগ করিয়া উপরে উঠিয়াছিলেন। সন্ত থেরেসা-র (মূর্খ পাঠক, ইনি কিন্তু মাদার টেরেসা নন) জীবনেও এমন ঘটনা ঘটিয়াছিল এবং সর্বসমক্ষে। নানদের তিনি নির্দেশ দিয়াছিলেন ঘটনাটি যেন তাহারা বলিয়া না বেড়ায়। কুপেরতিনো-র সন্ত জোসেফ শুধু নিজে উড়িতেন এমন নয়, ভারী লৌহ নির্মিত ত্রুস-ও সঙ্গে রাখিতেন। সন্ত আলফোনসাস লিগুয়োরি এবং ব্লেসেড টমাস অব কোরাই সম্বন্ধেও একই কথা শোনা যায়।
‘কিন্তু আমার পরিচিত যে মানুষগুলি উড়িতে পারঙ্গম তাহারা সাধক বা সন্ত কিছুই নহে। বরং উল্টাটি বলিলে খুব একটা ভুল হয় না। আমি তাহাদের কথা এই কারণে বলাবলি করিলাম কারণ আমার উপর তেমনই নির্দেশ আছে যাহা অমান্য করিয়া আমি ইহলোকে আমার বরাদ্দ মেয়াদটুকু আনন্দে কাটাইতে পারিব না। আমার এই বিনামূল্যে বিতরিত রচনাটির লক্ষ্য সরকার ও প্রশাসনকে আগাম হুঁশিয়ারি দেওয়া। কারণ এক প্রলয়াত্মক সংঘাত ক্রমেই নিকটবর্তী হইতেছে। কাহারও ক্ষমতা নাই এই লড়াই হইতে আমার পরিচিতদের মালসাট মারিয়া লাফাইয়া পড়া হইতে ঠেকায়। এই পক্ষে উড়িতে সক্ষম ও অক্ষম — দুই ধরনের পালোয়ানই আছে। আছে যাদুটোনা। কুহকছাতা। ও নানা সাইজের হনুর ছানা যাহারা নানা মাপের রন্ধ্রে ঢুকিতে সক্ষম। সরকার ও প্রশাসন যদি মোকাবিলার পথ বাছিয়া নেয় তাহা হইলে রচনাটির শিরোনাম স্মরণ করিতে বলিব। সেই পাখা যদি গজায় তবে তাহা উড়িবার তরে গজাইবে না। মরিবার জন্য গজাইবে।’
(সমাপ্ত)
এই ‘সমাপ্ত’ যে কে. জি. সরখেলের রচনার, ‘কাঙাল মালসাট’-এর নয়, তা খোলসা করে বলার কোনো প্রয়োজন আছে কী? অবশ্য কোনো পাঠক ওই ‘সমাপ্ত’-কে অন্তিম বা খতম জাতীয় কিছু ভেবে গোটাটাই পড়া বন্ধ করে দিতে পারে। এমন হুমকিও দিতে পারে। অধুনা যেমত সব খাজামার্কা আখ্যান লেখা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার একটি আবশ্যিক অঙ্গ হল যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে টক্কর দেবার মুরোদ রাখা। ‘কাঙাল মালসাট’-এর সে মুরোদ আছে কি নেই তা অচিরেই প্রমাণিত হবে। কুস্তিপ্রিয় বড়িলালের লাল ল্যাঙট দড়িতে ঝুলছে। নুনুকামানও রেডি। তার ভালোর জন্যই পাঠককে সাবধান করা খুবই সাধু প্রস্তাব। পরে ক্যাঁক-ম্যাঁক করে কোনো লাভ হবে না।
গোলাপ রচনাটি পড়ে প্রথমে ভেবেছিল যথারীতি কালই বড়বাবুকে দেবে কিন্তু পরে ভেবে দেখল সরখেল বন্ধুলোক, কী লিখতে কী ছাতা-মাথা লিখেছে! দাঁতফাঁত পড়ে গেছে। ওকে আর ফাঁসানো ঠিক হবে না। বইমেলা থেকে বেরোতে বেরোতে এই সিদ্ধান্তেই গেড়ে বসার দিকে যাচ্ছিল গোলাপ কিন্তু উল্টোদিকের অন্ধকার মাঠে আনকা ছুকরিফুকরি হয়তো বাজারে নতুন এসে নেমেছে এরকম একটা উটকো সম্ভাবনা তাকে ফুঁসলে মাঠের দিকেই টানল।
মাঠের মধ্যে কিছুটা এসে গোলাপের মনে হল, খাম কাজ হয়ে গেছে। সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি – কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বরং মাঠে ঢুকতেই ঠাণ্ডাটা বেড়ে গেছে আর ভয়-ভয় করছে। গোলাপ একটা সিগারেট ধরাল আর মাঠ ছাড়ার মতলব করল। মাঠ ছাড়ছিলই গোলাপ কিন্তু গাছের ওপর থেকে ডায়লগটি তাকে স্ট্যাচু করে দিল।
– সরখেলের চোতাটা কালই দপ্তরে জমা দিবি। বুঝলি?
গোলাপ ফাঁকা ঢোঁক গিলে ‘রাম, রাম’ বলতে শুরু করেছিল কিন্তু তাতে খুব একটা ফয়দা উঠল না।
– আমায় কি শালা ভূত পেয়েচ যে রাম-রাম করচ! ওসব রাম-ফাম আদবানিকে গিয়ে দেখিও। আমরা অনেক হার্ডনাট টু ক্র্যাক।
– আঁজ্ঞে, কিন্তু কে আপনি! ভূত না হলে গাছের ওপরে কেন?
হুম করে যা নেমে এল তা খতরনাক হলেও অন্তত মনুষ্যরূপী ভূত নয়। বিশাল দাঁড়কাক।
-গাছে যদি শুধু ভূতই থাকবে তাহলে পাখি-বাদুড়রা সব কী করবে? লালবাজারে ঘর ভাড়া নেবে?
গোলাপ ভয়েতে কাঠ। মুখে নাহি কথা সরে। কপালে বিন্দু বিন্দু কালঘাম ফোটে।
– স্পিকটি নট দেখচি যে! ওদিকে তো খুব রোয়াব। চা খেয়ে পয়সা দেবার নাম নেই। কাল কী করবি মনে আছে?
– সরখেলের লেখা জমা করে দেব।
– হ্যাঁ, জমা করে দিবি শুধু তাই না, সাধু মালটাকে বলবি যে জম্পেস নোট দিয়ে যেন চোতাটা ওপরে পাঠায়।
– তাই বলব স্যার।
– আবার স্যারফ্যার কেন? এটাও কী লালবাজার নাকি? অনেক বয়েস তো হল। এবার মাগির ধান্দাটা ছাড়। অনেক তো হল। ওদিকে নাতিপুতি হয়ে গেল।
– আর করব না স্যার।
– ফের স্যার! আমাদের টাইমের ক্যালকাটা হলে এতক্ষণ তোর দফা গয়া হয়ে যেত। কেন বল তো?
– আপনার টাইম মানে?
– অত তোকে জানতে হবে না। বর্মা থেকে এক দঙ্গল ফাঁসুড়ে এসেছিল। অন্ধকার মাঠে ঘাপটি কেস। অসহায় পথিক বা তীর্থমারানী হলেই ঘ্যাঁক। ফাঁসে টান আর গ্যাঁজলা তুলে মাল ফিনিশ। পয়াকড়ি যা পাও হাতিয়ে হাওয়া। এরকম রাতে বেশ কিছু মার্ডার করে ব্যাক টু রেঙ্গুন। প্যাগোডা। সাদা হাতি। চুপচাপ মাঠ পেরিয়ে চলে যা।
– সে যাচ্ছি কিন্তু আপনার পরিচয়টা পেলাম না।
– দেখতেই তো পাচ্ছিস দাঁড়কাক। বয়সের কোনো গাছপাথর নেই। আর ঘাঁটাসনি। তেড়ে ফুটে যা। তোরও মঙ্গল। আমিও ঠাণ্ডায় গাঁড় মারানো থেকে বাঁচি।
– যেমনটি বলেছেন তেমনটি করছি। একটু কৃপা করবেন। বুঝেছি আপনি এলি-তেলি নন।
– ঠিকই ধরেচিস। যা, সরখেলের বন্ধু আমাদেরও বন্ধু। কোনো বাঞ্চোৎ তোর একটা বালও যদি ছেঁড়ে আমাকে জানাবি।
– আজ্ঞে, ক্রাইসিসের সময় আপনাকে পাব কী করে?
– ভেরি ইজি। পর পর দুরাত তোর ঐ ছুঁচো কিচকিচে ধচা ছাদে উঠে খুব প্রেমসে আমার কতা ভাববি। এই চেহারাটা মনে করবি। ক্ষ্যাপাটে চোখ, খ্যাজাব্যাজা পালক, চোখ খুবলে নেবে এমন নখ-চোখ বুজে ভাবলেই আমি চলে আসব। প্রথম রাতে সিগন্যালটা পেয়ে যাব। এ তোমার মোবাইল নয়। মোবাইলের বাবা। তবে হয়তো তখন দূরে থাকব। ধর, ব্যাণ্ডেল চার্চের টঙে। তেমন হলে সিগন্যাল রিসিভ করে ডাউনলোড করে রেখে দেব। সেক্ষেত্রে পরদিন। আর ধারেবাড়ে হলে এসে পড়ব। একডাকেই …।
– আমি আসি তাহলে।
– আয়।
এবারেও বড়বাবু দাঁ গোলাপ মল্লিকের হাত থেকে সরখেলের ‘পিঁপিড়ার ডানা ওঠে…’ পড়ে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।
– কী মাল জোগাড় করেচ গোলাপ! এ তো রীতিমতো ডিক্লারেশন অফ ওয়ার। এক কাজ করো। দলিলটা নিয়ে তুমি মিঃ সাধুর কাছে চলে যাও। আমি বলে দিচ্ছি। আমার ব্যাপারটা ভালো ঠেকচে না। সাফ বলে দিলুম।
অতএব মালটি নিয়ে গোলাপ পৌঁছে গেল তারকলাল সাধুর কাছে। শ্রী সাধু তখন খুনের ব্যবহৃত বুলেট এবং খুনের কাছে পাওয়া কানট্রিমেড পিস্তলে টেস্ট ফায়ার করা বুলেট মিলিয়ে দেখছিলেন।
– আরে, রোজ ফুটেচে আজ। কী ব্যাপার!
– আর রোজ ফোটাতে হবে না। কী ফোটে এবার দেখুন। মালটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিন।
পড়তে পড়তে সাধুর নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ে।
– ইন্টারেস্টিং! আমার তো বাবা দৌড় ঐ টিভিতে জুরাসিক পার্ক দেখা অব্দি। এ সব ঘ্যাঁটম্যাট আমার মাথায় ঢুকবে না।
– আপনি বরং শেষ প্যারাটা পড়ুন।
একটু সময় গেল। সাধুর ভুরু কুঁচকোনো। কপালে ভাঁজ পড়ল। চক্ষু হইল চড়কগাছ।
– তার মানে? ফের প্যাঁদাপেঁদি। ফের ব্লাড বাথ। এই সরখেল বাঞ্চোৎ কি নকশাল নাকি? যাক গে বাবা, সে যা হবার হোক। সরকার ও প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। আমি রিসক না নিয়ে নোট দিয়ে ওপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দুদিন পরে ফাইল ফেরত এল। ওপরে স্কেচ পেন দিয়ে লেখা — ‘পাগলাচোদা’।
বেগম জনসন দণ্ডবায়সের নিকট সব শুনিলেন। নিকটে দন্ডায়মান একটি স্লেভ গার্লের পিঠে আপনমনে ঘামাচি মারিতে মারিতে বলিলেন, ‘বাট মিস্টার ম্যাজিশিয়ান, এই যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ইহার কোনো ম্যাচিউরিটি নাই। শালারা এত বড় একটি দলিল হাতে পাইল কিন্তু মর্ম বুঝিল না। আই অ্যাম রিয়্যালি স্যরি। বাংলার ভাগ্যাকাশে এখন সাইক্লোনিক ডিপ্রেশন। আপনি মন খারাপ করিয়া কী করিবেন? ড্যাম ইট। বাই জোভ, এরূপ আহাম্মক কেউ দেখিয়াছে যে পশ্চাতে ধাবমান শূল দেখিয়াও রেকটাম সরাইয়া নেয় না? আমি একাধারে বিউইলডার্ড ও অ্যামিউজড বোধ করিতেছি।’
এরূপ বলিয়া বেগম জনসন স্লেভ গার্লটিকে আদর করিয়া একটি লাথি মারিলেন। এবং সেও এই বটকেরার জবাবে খিল্লি দিয়ে হাসি করিয়া দিল। একেই কী য্যায়সা কী ত্যায়সা বলে? কেউ জানে?
(চলবে)
১২
বিগত ‘এগারো’ নম্বর ঝটকাটিতে একটি ব্যাপার কোনো টাইপের নজর, তা সে শকুনেরই হোক বা পাতাখোরেরই হোক, এড়াতে পারে না। সেটা হল কড়াপড়া মোলায়েম ধাঁচে চোক্তার — ফ্যাতাড়ুস্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স-এর যুদ্ধ ঘোষণা। জুতোর মধ্যে পেরেক ওঠার মতোই নিরীহ কিন্তু যথেষ্ট ঝামেলাদার। সরখেলের ফতোয়া সম্বন্ধে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের ওপরমহল যতই অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য (পাগলাচোদা) করুক না কেন ব্যাপারটি নিরীহ ছিল না। বরং এরকম একটি আগাম হুঁশিয়ারি যে ছাড়া হবে তা নিয়ে কোর কমিটির যে মিটিং হয় সেখানে বৃদ্ধ দণ্ডবায়স, ভদি, বেচামণি, সরখেল, নলেন ও মদন ছিল। এবং দরজায় আড়ি পেতে পুরো মিটিং-এর চাপান-উতোর সবই ‘সাধু! সাধু’ মুখ করে শুনেছিল এবং ব্রেনে টেপ করে নিয়েছিল মহান সাক্ষী বড়িলাল। দীর্ঘকালব্যাপী সেই আলোচনায় ‘ইনসারেকশন’, ‘নামিয়ে দাও’, ‘পার্লামেন্টারি পোঁদ মারামারি’, ‘চট্টলার অস্ত্রাগার লুঠ’, ‘টেগরা’, ‘টুপামারো’, ‘১৯৬৯ তে কারলোস মারিঘেল্লার মৃত্য’, ‘কলম্বিয়াতে এফ. এ. আর. সি-র গেরিলা নীতি’, ‘আশু মজুমদার’, ‘রেজি দ্রেব্রে-র ফোকো ইনজারেসিওনাল বা অভ্যুত্থানের গলনচুল্লি’, ‘সুশীল ধাড়ার মৌন মিছিল’ — ইত্যাদি নানা চিত্তাকর্ষক শব্দবন্ধ ও বিষয় উঠেছিল। মিটিংটি যেহেতু গোপন তাই এর বেশি জানানো এখন সঙ্গত কারণেই ঠিক হবে না। বরং ‘জানি কিন্তু বলব না’ গোছের একটা ভাব দেখাতে হবে। এর সুবিধে ডবল। আগামঘোষিত সেই ক্যাচালে ‘কাঙাল মালসাট’ বড়িলালের কুস্তির ল্যাঙট ধার করে আঁট করে পরে নেমেও পড়তে পারে আবার বেগড়বাঁই দেখলে ‘আমি বনফুল গো …’ গাইতে গাইতে সাইডিং-এও ভিড়ে পড়তে পারে। সর্বত্রগামী না হলেও চলবে। তবে বিচিত্র পথে যাওয়ার সম্ভাবনা খুলে রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও লেখক-শিল্পীদের ঢ্যামনামি নেড়েচেড়ে দেখা যেতে পারে। সাঁতরাগাছির প্রসিদ্ধ ওল-অরণ্যে ‘ওলে! ওলে!’ শোনা যায় না। দমদমার নলবনে দুষ্টু শিশুদের মতো ডাক্তার-ডাক্তার খেলাতেও তারা প্রশিক্ষিত হতে চায় না। সব ব্যাটার ধান্দা হচ্ছে সেই শান্তিনিকেতনে একটি কম্পাউন্ড-ওলা বাড়ি বানানো এবং সেই বাড়ির ভেতরের বারান্দায় গুজরাটি দোলনা লাগিয়ে ফিসচুলা, ভগন্দর, নালি ঘা ও পদ্ম-কাঁটা শোভিত বহু-মারানো নিতম্বগুলিকে দোলানো। উইকেন্ড হলেই অল বোকাচোদাস বোলপুর চলল। এছাড়া পৌষ মেলা, দেদোল দোল, দাড়িপুজো, ভাঙা গানের তালে ফুটো খোল প্যাঁদানো — রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন যে জ্যোৎস্না রাত হওয়ার জো নেই, আগেভাগেই ঢ্যামনার পাল গিয়ে ফরেস্ট পলিউট করবে! এ ব্যাপারে কিছুই কি করণীয় নেই? আছে। সেটা হল এখনও, দেদারে ঝাড় খাওয়ার পরেও, যে সাঁওতালরা আছে তাদের ক্ষেপিয়ে তোলা এবং বডি-ল্যাঙ্গুয়েজের ইঙ্গিতে সব সংগীত থামিয়ে দিয়ে বস্তা খুলে পাগলা বেড়াল ছেড়ে দেওয়া।। জাহাজী ইঁদুর হলেও চলবে। সাধু অভিপ্রায় নিয়ে যা শুরু হয়েছিল তা এখন খজড়ামির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অতএব, যে ব্যামোর যা দাওয়াই। হাইলি কনজারভেটিভ বংদের একটি বৃহৎ অংশ এতে ‘কাঙাল মালসাট’-এর ওপরে খচবে। ‘কাঙাল মালসাট’ যাতে সদাশয় ছত্রাকের মতো পাঠক মনকে বিষমুক্ত করতে না পারে তার জন্য এজেন্ট-অরেঞ্জ ছড়ানো হবে। কিন্তু ডার্লিং, বালের থ্রেট নিয়ে চাকতির ঠেকদারেরা মাথা ঘামায় না। তাই এবার হতে আক্ষরিক অর্থেই মুণ্ডুপাত। মিখাইল বাখতিন (১৮৯৫-১৯৭৫) যুগ যুগ জিও। জালি রাজার মুকুটহরণ (আনক্রাউনিং) হচ্ছে সকল কার্নিভাল ও কার্নিভালের সমগোত্রীয় উৎসবের মূল উল্লাস।
পতনের গতি কারও দ্রুত অতি, কারও কিঞ্চিৎ ঢিমা
সীমা শেষে গিয়া সব হবে ‘হিরোশিমা’।
পরিণামে এক শ্মশানে সবারি ঘর
সাথে রবে শুধু তুমি শ্মশানেশ্বর,
লয়ের আঁধার হতে ফুটাইবে সৃষ্টির অরুণিমা।
জয়, শ্মশানের জয়। জয়, জয়, চাকতির জয়। জয় চোক্তার ফ্যাতাড়ুর জয়। জয়, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জয়।
এবারে একটি মিহি ইন্টেলেকচুয়াল সমস্যা টুক করে ছুঁয়ে নেওয়া যায়। প্রেতাত্মা, স্পিরিট (মেথিলেটেড নহে) বা গোভূত – কাদের চুতিয়াপনা এর পেছনে আছে আমরা সহমত নহি — ‘কাঙাল মালসাট’ ক্রমেই কিন্তু জাগতিক সময়, ভর, মাইধ্যাকর্ষণ, চুদিট্রন -এসবের আওতায় আর থাকতে চাইছে না। ওয়ের্নার হাইজেনবার্গ নামধারী এক ঘ্যাম জার্মান পদার্থবিদের আত্মজীবনীর মলাট-নাম হল ‘ফিজিক্স অ্যান্ড বিয়ন্ড’। ভূতিয়া ললাট-লিখনের ফলে ‘কাঙাল মালসাট’-এ ‘বিয়ন্ড’ এর টান ধরেছে। সে আর ফিজিক্স এর আওতায় থাকিতে চাহিতেছেনা। লেখা বা ছাপা অক্ষরে যেন সে অধরা হইয়া পড়িতে চাহে। ছিল বাড়ির বউ, হয়ে যেতে পারে খানকি। অতএব চরিত্রবান পাঠকেরা সাবধান। রেট-ফেট জেনে ওসব পাড়ায় যেতে হয়। ধারা থেকে মান্ডু-গান্ডুদের তীর্থযাত্রা চলুক। আমাদের পথ ও গন্তব্য অন্য।
ভারতের মোক্ষপ্রাপ্তির ইতিহাসে লাল-বাল-পালের যে গৌরবোজ্জ্বল ও ইতিবাচক অনুঘটকের ভূমিকা তেমনই ভূমিকা হল কলকাতার ক্ষেত্রে নগরপালদের। অর্থাৎ পুলিশ কমিশনার সাহেবদের। আগে তাঁহারা পকেটমার প্যাঁদাইতেন, রহস্যময় বেলুনে আরাকান হইতে অহিফেন প্রেরণের চক্রান্ত ভন্ডুল করিতেন, তালতলা ও অন্যান্য থানায় কমিউনিস্টদের ওপর হিংস্র কনস্টেবল-লেঠেল ছাড়িয়া মজা দেখিতেন (রণদিভে পর্বে), পরে নকশালপন্থীদের ওপরে টর্চার করিবার জন্য ইজ্রায়েলী, দক্ষিণ আফ্রিকান ও সি.আই.এ-র গোপন টর্চার ম্যানুয়াল অধ্যয়ন করিতেন এবং সেই শিক্ষা কাজে লাগাইবার নির্দেশ দিতেন-আজকাল এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁহারা নৃত্যনাট্য, হাফ-ন্যাংটো কেলো বা জীবনমুখো গান, কবি-সম্মেলন কিংবা যৌন-কর্মীদের শুয়ে আঁকো প্রতিযোগিতা -এসবও করেন। কেউ কেউ আরো কয়েক ধাপ অগ্রসর হইয়াছেন। সেসব ঘেঁটে পেটিকেসে ফেঁসে না যাওয়াই ভালো। পাঠকরাও নগরপালদের কর্মকুশলতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়তে পারে। মালদার কেউ নিজেকে স্ব-নিযুক্ত নগরপাল বলে ভাবতেও শুরু করতে পারে। ডাক-বিভাগের পাশে যেমন কুরিয়ার সার্ভিস। আগে টেররিস্টদের বা বে-আইনি বিপ্লবী রাজনীতিতে কুরিয়ার হইত, আজকাল ঘরে ঘরে কুরিয়ার। তাহাদের মধ্যে আবার যাহারা হেকড়বাজ তাহারা ডাকবিভাগের ঘাড়ে হাগে।
আধপোড়া একটি মাঝারি ল্যাটামাছ। মাথা থেকে ল্যাজা সিঁদুর মাখানো। একটি আঁশবটি। ধুনুচি হতে বিদঘুটে গন্ধওলা ধোঁয়ার অন্তিম কুন্ডলি। সাতিশয় আগ্রহে অপেক্ষমান দন্ডবায়স, ভদি, সরখেল ও নলেনের আটখানি (?) চোখ। ভদির বাবাই সেই নারকীয় নিস্তব্ধতার মধ্যে অপার্থিব কন্ঠস্বরে বলে উঠল,
— খাপে খাপ, কেদারের বাপ! নাও, কাটো!
ভদি চেঁচিয়ে উঠল,
— জয়! জয় চাকতির জয়!
সমস্বরে একই রব। দরজার ফুটোয় চোখ লাগানো বড়িলাল বাদে।
বেচামণি ঘ্যাচাং করে ল্যাটামাছটির ধড় হইতে মুন্ডটি বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ অ্যালিয়েনেটেড করিয়া ফেলিল। তখন রাত আধো আধো।
সেই আধো আধো রাতেই দোতলায় প্রশস্ত ভেরান্দায় হুইস্কির গেলাস হাতে ক্যালকাটার নগরপাল মি. জোয়ারদার ভাবছিলেন যে, ওয়েস্টবেঙ্গলে পিপলস ওয়ার ও এম. সি. সি.-র অনুপ্রবেশের সিক্রেট রির্পোটটা তিনি সি. এম-কে কি এখনই দেখাবেন না কয়েকটা দিন ঘাপটি মেরে থাকবেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, লাইক আ বোল্ট ফ্রম দ্য ব্লু বা কঠিন করে বললে বিনিমেঘে বজ্রপাতের মতোই (বীর্যপাত নয়) একটি ফ্লাইং সসার (দ্ব) অক্ষরের মতো অবাঙালি শব্দ করতে করতে তাঁর সাধের লনে ডাইভ মারল। লন সিকিউরিটির প্রয়োজনেই হ্যালোজেন আলোয় আলোকিত। সেই আলোয় মি. জোয়ারদার ওরফে নগরপাল দেখলেন লেটে ফোটা ডালিয়া, হলিহক, পিটুনিয়া — সব ওয়ান্ডার ফুলকেই চাকতিটি কচুকাটা করছে। পুলিশের অভিজ্ঞ ব্রেনে তখনই খেলে গেল নির্ঘাৎ এটি তাঁর একমাত্র ও স্প্যাস্টিক ছেলের জন্যে হংকং-এর মামার পাঠানো কোনো রিমোট নিয়ন্ত্রিত টয়! তাই কি? না কি ড্রোন-জাতীয় কোনো মাল! এই ধন্দ কাটার সময় হয়নি। হুস করে চাকতি লন এবং গার্ডেনের ভুষ্টিনাশ করে হেলায় দোতলার ভেরান্দায় উঠে এল এবং লেসার রশ্মি যেমন চুপিসাড়ে বড় বড় কর্ম ফতে করে তেমনই দক্ষতায় কুচ করে তাঁর মুণ্ডুটি কেটে অন্তরীক্ষে উধাও হয়ে গেল। ড. গিলোটিন (এটি সঠিক ফরাসি উচ্চারণ নয়) দেখিলে অবশ্যই কবুল করিতেন যে খুবই পাকা হাতের কাজ।
এরকম ঘটনা অর্থাৎ মুণ্ডচ্ছেদের অনুষ্ঠান যে নানাবিধ আরবদেশে ঘটে থাকে সেখানে দেখা যায় যে মুণ্ডুটি হাবাগোবার মতো পড়ে আছে। বরং ধড়টিই ছটফট করছে। অবশ্য আলাদা হবার পর মাথাটির মুখ এক আধবার হাঁ করে জিভ ভ্যাঙাতে পারে। ইউ-ছাঁট সহ উত্তমকুমার ভোরের কুয়াশাময় ময়দানে যে মুণ্ডচ্ছেদ দেখেছিলেন তার আগে অবশ্য ফায়ার করা হয়েছিল। সেই ঘটনার বহু বৎসর পরে মনোহরদাস তড়াগ হইতে একটি মুণ্ডহীন স্কেলিটনও পাওয়া যায়। এফ. এম. রেডিওতে তখন রাত দশটায় শুরু হচ্ছিল ‘আজ রাতে’। আজকের বিষয় ‘সমকাম’। প্রথমেই একটি গান — ‘এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি …’
স্তম্ভিত হয়ে নগরপাল দেখলেন যে মুণ্ডচ্ছেদের পরেও উপরোক্ত অনুচ্ছেদে যা কিছু লেখা সেগুলো তাঁরই চিন্তা এবং তিনি নিজের দুই কান অর্থাৎ দোকান দিয়েই এফ. এম অনুষ্ঠান শুনছেন। হাতে হুইস্কির গেলাসও ধরা আছে। চুমুক দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু গেলাসটি অবলীলায় মুণ্ডুর ফাঁকা জায়গায় ব্যালেরিনার মতো গেল ও এল। তখন গেলাসটি রেখে মি. জোয়ারদার নিজের মুণ্ডুটি কুড়িয়ে ধড়ের উপরে বসালেন এক হাতে মুণ্ডুটি ধরে রেখে বাকি হুইস্কিটুকু চোঁ করে মেরে দিলেন। নামলও। কোনো ডিফিকালটি নেই। কিন্তু হাত ছাড়তেই মুণ্ডুটি ফের পড়ে গেল। এবং কী নিষ্ঠুর কাকতাল যে ঐ মোমেন্টেই মিসেস জোয়ারদার ভেরান্দায় প্রবেশ করেছিলেন। প্রথম মুণ্ডুপাতটি তিনি মিস করেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়। বলাই বাহুল্য, তিনি এই গ্রোটেস্ক ও ম্যাকাবর দৃশ্য দেখে কেলিয়ে পড়ে গেলেন।
– ‘ললি! ললিতা। উফ ফেন্ট করে গেল। ন্যাকামির একটা লিমিট আছে। বিহেডেড হলুম আমি আর উনি হয়ে গেলেন সেন্সলেস। লুক, হানি, আই অ্যাম পারফেক্টলি নরম্যাল। শুধু হেডপিসটা মানে মাথাটা হোল্ড করতে হচ্ছে। ললি! ল … লি!’
ভলাদিমির নবোকভ-এর ‘লোলিটা’-র (১৯৫৫) প্রসঙ্গ কারও মনে পড়তে পারে। বিশেষত মধ্যবয়স্ক পুরুষ যাঁরা অজান্তেই হয়তো ‘লোলিটা সিনড্রোম’-এর শিকার। হতেই পারে বা হলেই হল। আটকাচ্ছে কে? হায় কোই রুখনেওয়ালা?
যাই হোক, হচ্ছিল ললিতা জোয়ারদারের কথা। পুলিশের বউ। এরা হল অন্য মেকদারের পয়দা। ধড়, মুণ্ডু, ডাকাতি, চপার, রামপুরিয়া, বস্তায়þ খণ্ড খণ্ড যুবতী, কিডন্যাপ, গুম শুনে এরা নিজেরাই দুঁদে মাল হয়ে উঠেছে। অচিরেই বরফজলের ছিটে ও একটি পাতিয়ালা পেগ ললিতাকে ধাতস্থ করে তুলল। অতি অল্প সময়েই তিনি দু পিস স্বামীর সম্বন্ধে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন। সম্ভবত এই কারণেই হয়তো দাঁড়কাক বলেছিল-খাপে খাপ, কেদারের বাপ।
ডিনার টাইম হয়ে গেছে। নিচে বার্বুচি গং বাজাল। প্রথমে নামলেন মিসেস জোয়ারদার। তিনি পরে আছেন একটি ইংলিশ হাউসকোট। পায়ে জাপানি ঘাসের চটি। পেছনে সিল্কের ওপরে বুটিকের কাজ করা লুঙ্গি ও ফিনফিনে ফতুয়া পরা নগরপাল। কিন্তু ও কী?
নগরপাল সিঁড়ি দিয়ে নামছেন — দুহাত দিয়ে দুটি কান ধরা। মনে হচ্ছে ব্যাদড়া বাচ্চাকে কান ধরিয়ে হেডমিস্ট্রেস স্কুলে দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। বার্বুচিরা এই দৃশ্যে খুবই ভয়চকিত হয়ে উঠল। হওয়ারই কথা। এর আগে বিবিধ কারণে অকারণে নগরপালকে তারা বউ-এর কাছে ঝাপড়া খেতে দেখেছে। কিন্তু এরকম কোনো দৃশ্য তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এবং এর পরে যা ঘটল তা রোমহর্ষক। নগরপাল চামচ ধরে সুপের ঝোলের দিকে ঝুঁকতেই তাঁর মাথাটি নাক বরাবর সুপের ওপরে ঝাঁপ দিল। চেয়ারে কবন্ধ। দুজন বাবুর্চি ও কুক, তখনই অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কারপেটে ট্রে, কাটলারি, রোস্ট চিকেন ও গ্রেভি।
মিসেস জোয়ারদার খেঁকিয়ে উঠলেন।
– ‘হোয়াট স্টুপিডিটি। দুহাতে মাথা অ্যাডজাস্ট করেই তোমাকে চুমুক লাগাতে হবে। ফরগেট কবে স্পুন বা ফর্ক ব্যবহার করেছ। কান থেকে হাত ছাড়া চলবে না। কাল দেখব টুপি, দড়ি এইসব দিয়ে যদি ম্যানেজ করা যায়। নিজের ঝামেলা নিজে সামলাও। সুপটুপ ছিটকে, লোকজনকে ভয় দেখিয়ে — ডিজগাস্টিং।
– ‘সরি ললি! মাথাটা টপল করে যাবে বুঝতে পারিনি। কী যে সব হচ্ছে! প্রোভোকেশন নেই, প্রায়ার কোনো রিপোর্ট নেই — বিহেডেড হয়ে গেলুম।’
– ‘যা হয়েছে, হয়েছে। কালকের আগে যখন কিছু করা যাবে না তখন ফালতু কনজেকচার করে লাভ নেই। দু হাতে কান ধরে স্ট্রেট বসে থাকো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
– ‘দেবে! সেই ভালো। সুপটা বড় ব্ল্যান্ড করেছে আজ। একটু সস মিশিয়ে দাও তো।’
– দাঁড়াও আগে মুখটা মুছে দিই। একজনকে তো খাইয়ে নাইয়ে না দিলে হয় না। আরেকজন বাড়ল। এই মাদারিং করতে করতেই লাইফটা গেল। কোথায় নিজের দিকে একটু নজর দেব।
সস্নেহেই কথাগুলো বলছিলেন মিসেস জোয়ারদার কিন্তু নগরপাল মনে মনে বলছিলেন
– ‘ঐ তো বালের চেহারা। তার দিকে আবার নজর। ভুরু প্লাক করে ডিমের মতো মুখ। তাতে আবার কী সব মাখবে। তাইওয়ান থেকে ক্রিম আনছে! শিশির ওপরে আবার প্রজাপতি আঁকা। কী বিদঘুটে গন্ধ। বিউটি মারাচ্ছে। সেদিনই তো তাজবেঙ্গলে টাবুকে দেখলুম। কী জিনিস। কী ঠোঁট? আর একে দ্যাখো। তাকিয়া। একজ্যাক্টলি তাকিয়া। আগে তাও বয়স কম ছিল। চলত। বান্টি, মিসেস সেন, তারপর গিয়ে হোম সেক্রেটারির বউ হিমানী সোম — এখনও! এখনও! আরে বাবা যে এজে যেমন। আর ইনি, কিলো কিলো এজ-ডিফাইং ক্রিম মাখছেন। এই মাথা-কাটাই তোর জুটবে। বুঝলি? হুমদো মাগী কোথাকার!
এবারে নগরপাল বললেন, মনে মনে নয়,
– আঃ ফিস কাবাবটা ছোট ছোট পিস করে দেবে তো। আস্ত মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গলার কানেকশনটা আনস্টেডি, বুঝতে পারছ না? আবার কী ফ্যাচাং লেগে যাবে!’
– আই অ্যাম সরি ডার্লিং।
– এই আইটেমটাতে নো ফাইভ স্টার ক্যান বিট আবদুল। রোজ খাই। কিন্তু পুরোনো হয় না।
– আমারই মতো। বলো?
– উঁ … ম।
সেই ভয়াল রাতেই মদন স্বপ্নে দেখল বাজারে তাকে মাছের মুড়ো আর ব্রয়লারের চোখ বন্ধ মুণ্ডুর ঝাঁক কামড়াবে বলে তাড়া করেছে। বোয়াল, আড়, শোল ইত্যাদি বিকট মাছের হাঁ মুখে সারি সারি দাঁত। চুনোপুঁটির মুণ্ডুও বাকি নেই। তারাও পায়ে ঠোকরাচ্ছে। ঘুম ভেঙে মদন উঠে পড়ল। অন্ধকারে হাতড়ে বোতলটা খুঁজে নিট বাংলা খানিকটা ঘ্যাঁক করে মেরে দিতে অস্বস্তিটা যেন জুড়োল। ঘটনাচক্রে সেই ভয়ালু রাতে কবি পুরন্দর ভাটও মদনের ঘরে মালফাল খেয়ে গামছা পরে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমোচ্ছিল। নিদ্রার ঘোরেও তার কাব্য রচনায় ক্ষান্তি নেই। মদন তার মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শুনতে পেল, শ্যামাসংগীতের ঢঙেই —
মুণ্ডুমালা পরলো শ্যামা
গাত্রে না হোক পরলি জামা
ভাট কবিতায় পুজব বলে
মুণ্ডু আনি ধামা ধামা।
শ্যামা মায়ের ঠোঁটে হাসি
মুণ্ডু পরতে ভালোবাসি
পুরন্দরের মন যে বলে
পঞ্চাশৎটি বর্ণ দোলে।
মুণ্ডু দেখে যায় না বোঝা
কোনটা ডাকাত, কোনটা ওঝা
কোনটা তাপী, কোনটা পাপী
কোনটা ভাগ্নে, কোনটা মামা
মুণ্ডু আনি ধামা ধামা …
মদন কয়েকবার পুরন্দরকে থাবড়ে যখন দেখল থামবে না তখন বাধ্য হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেই ভয়েল রাতেই পাশে শোয়া মোটা বউ ও গাঁদা বাচ্চা থাকাতেই স্বপ্নে হেলেনের নাচ দেখে ডি. এস-এর স্বপ্নদোষ হল।
বড়িলালের ঘরে রাস্তার আলো ঢোকে বলে সে চোখের ওপর ল্যাঙট চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। তার ওসব কিছু হয়নি।
সেই অস্থির তাড়সে কেঁপে কেঁপে ওঠা রাতেই চোখে চাঁদের স্পট পড়ায় ঘুম ভেঙে মিসেস ললিতা জোয়ারদার দেখলেন বালিশের ওপরে নগরপালের মুণ্ডুর নাক ডাকছে কিন্তু ধড়টি আলাদা হয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। ধড় একবার, ঘুমন্ত অবস্থাতেই,বাতকর্মও করল। চাঁদের সামনে মেঘের মিড কার্টেন পড়তে মিসেস জোয়ারদারও পুনরায় ঘুমন্ত স্টেজে চলে গেলেন।
এরপর যা অবশ্যম্ভাবী তাই হবে। কোনো গেঁড়ে নির্ঘাৎ প্রশ্ন তুলবে যে ‘পঞ্চাশৎ’ বর্ণ বা মুণ্ডুর রহস্যটা কী? সবই কি বাংলা টেনে ঢপবাজি? এর প্রথম উত্তরটি হল মুচকি হেসে স্পিকটি নট। দ্বিতীয় উত্তরটি হল-বাবা মা যখন পয়দা করে কাঁচা ড্রেনে না ফেলে দিয়ে পয়াকড়ি খরচ করে পড়িয়েচে তখন একবারটি বাপু ২ টাকা ৫০ পয়সার মাধুকরীর বদলে ডক্টর মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ‘জগজ্জননী কালীমাতার তত্ব’ বইটি বগলদাবা করে পড়ে ফ্যালো দিকিনি। দুইগোটা সম্ভাব্য উত্তরের কোনটি ইস্তেমাল করা উচিত? কতিপয় গেঁড়েকে মাইনাস করিয়া বাকি পাঠকরা কী বলে?
পরদিন সকালে এগারোটা বাইশে সি. এম তাঁর পি. এ মারফৎ নগরপালকে ডেকে পাঠালেন। আই. এস. আই. কলকাতায় কী খেল খেলছে সে বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান। এইসব এজেন্টরা যেহেতু বনবাদাড়ে ঠেক বানায় ও বীরাপ্পনের স্টাইলে অপারেট করতে পারে তাই বনমন্ত্রী বনবিহারী তা এবং গৃহমন্ত্রী ও আমাদের পূর্বপরিচিত কমরেড আচার্যকেও ডাকা হয়েছে। উর্দি চাপালেই চলবে না। মাথাটিও স্বস্থানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। স্ত্রীবুদ্ধিই নগরপালকে এ যাত্রা বাঁচাল। এক মৃদু ঝাড়েই মোটরসাইকেলওলা ঢ্যাঙা সার্জেন্ট তার ‘স্টাড’ লেখা হেলমেটটি দিয়ে কেটে পড়ল। এবং সেটি পরে দেখা গেল নগরপালের মুণ্ডু যথাস্থানে থাকছে এবং তদুপরি দুটি হাতই তিনি অবলীলায় নাড়াচাড়া করতে পারছেন। অর্থাৎ মাথা কাটা অবস্থাতেও তিনি প্রতিবন্ধী নন। বেরোবার মুখে, দরজার দোরগোড়ায়, ললিতা নগরপালকে একটি পিঙ্ক রঙের গোলাপ দিলেন। এবং ছোট সাইজের একটি খাম। সিল করা।
– পিংক রোজ ইজ অলরাইট। কিন্তু এই খামে কী আছে?
মিসেস জোয়ারদার মুখ টিপে হাসেন।
– সি. এম-এর সঙ্গে মিটিং সেরে বেরিয়ে লালবাজারে যাবে তখন দেখবে। আগে নয়।
– লে হালুয়া।
সি. এম তো নগরপালকে দেখে থ!
– এ কী? তুমি আবার মোটর রেসিং ফেসিং শুরু করলে নাকি?
– না, স্যার। ঘাড়ে ব্যথা। কলার নেব। কিন্তু টাইম পাচ্ছি না। ডক্টরের সঙ্গে দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছি। তাই এটা দিয়েই কাজ চালাচ্ছি।
– ‘কী জানি বাপু। ঐ স্পেসটেসে যারা যায় তাদের কী যেন বলে।’
বনবিহারী তা বলে ফেলে,
– ঠিক বলেছেন সার, পাইলটের মতো।
গৃহমন্ত্রী খিঁচিয়ে ওঠে,
– যা জানো না তা নিয়ে কমেন্ট করো কেন? উনি বলছেন মি. জোয়ারদারকে কসমোনটদের মতো লাগছে।
– ওই হল। পাইলটও ওড়ে, কসমোনটও ওড়ে।
– থামবে তোমরা? ডি. জি-র সঙ্গে পরে আমি মিট করব। তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই। বনবাদাড়ে অনেক ঘুরেছ। হোয়াট ইজ ইয়োর রিডিং।
– তাহলে সার, একটু ডিটেলেই বলি। কাঠমাণ্ডুর ওই আই. এ. সি প্লেন হাইজ্যাকিং-এর পর থেকেই লক্ষ করছি যে,
ফোন বাজে, অফ হোয়াইট ফোনটা তোলেন সি. এম।
– হুঁ? ইউনিয়ন হোম মিনিস্টার ওয়ান্টস টু স্পিক টু মি। আস্ক হিম টু রিং আফটার সামটাইম। আই অ্যাম বিজি। যত্ত সব। চলো।
নগরপাল গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করতে যাবেন কিন্তু বেল বাজল এবং পি. এ. টু সি. এম মি. ঘোষাল ঘরে ঢুকে পড়লেন।
– সার! সার! কাল তো মিস ক্যালকাটা কনটেস্ট ছিল।
কমরেড আচার্য গজরে ওঠেন।
– মিস ক্যালকাটা নয়, মিস কলকাতা।
– আঃ বড় ইন্টেরাপ্ট করো। বলো।
– সার, সেই কম্পিটিশনের সব বিউটিরা একবার আপনার কাছে এসেছে।
– আমার কাছে? হোয়াই? কী চায় ওরা?
– কিছু না সার। আজ বলছে মানে আপনার হল গিয়ে ভ্যালেনটাইনস ডে। ফুল দিয়ে আপনাকে গ্রিট করতে চায়।
– আসতে বলো। আফটারঅল অ্যা গ্রুপঅফ ইয়ং বিউটিজ। বিউটি ইজ ট্রুথ।
চার্পিং পাখির দলের মতোই খিলখিলিয়ে নটি বিউটিরা ঘরে ঢোকে। এর মধ্যে গোলাপের তোড়া যার হাতে সেই হল মিস ক্যালকাটা -রোজা কাপাদিয়া। ওরা সকলকেই ফুল দেয় ও মন্ত্রীদের গম্ভীর মুখগুলিতে মৃদু হাসি কুঁড়ির মতো ফুটে ওঠে।
– জোয়ারদার, তোমার হেডগিয়ারটা খুললে না? মিনিমাম এটিকেট। ঘাড়ে ব্যথা বলে …
ইয়েস সার।
জোয়ারদার পা ঠুকে দাঁড়িয়ে উঠে বাঁ হাত দিয়ে হেলমেটটি ওপরে তোলেন। ফলে মুণ্ডুসমেত হেলমেটটি ওপরে উঠে যায় ও ফুলের গোছা নেবার জন্যে কবন্ধ ডানহাতটি বাড়িয়ে দেয়। রোজা ও অন্য সুন্দরীরা গোলাপের মতোই ঝরে যায়। মানে সহসা ক্লোরোফর্ম করা হল এরকম ভাব দেখিয়ে চোখ উল্টে ধুপ ধাপ পড়তে থাকে। মি. ঘোষাল চিৎকার করে ওঠেন।
– মাথা নেই। সার, মাথা নেই। ভূত!
হেলমেটের ভেতর থেকে জোয়ারদারের মুণ্ডু বেরিয়ে পড়তে যাওয়ার মুখে ডান হাত দিয়ে জোয়ারদার তাকে ধরে ফেলে এবং চুলের মুঠি ধরে গলায় বসায়।
– ভূত-ফুত নয় সার। মাইনর একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট হলেই কি হয়ে যাবে।
সি. এম চটে যান।
– এই অবস্থায় ডিউটি করছেন আপনি? মাথা আলাদা অবস্থায়। এ জিনিস আমি কখনোই সহ্য করব না।
জোয়ারদার হেলমেট ফেলে দেন। বাঁ হাত দিয়ে বাঁ কান ধরে মাথাটি ধরে রাখেন। ডান হাত দিয়ে স্যালুট করেন।
-হেড অর নো হেড, জোয়ারদার কখনও ডিউটিতে ফল্টার করে না।
– দ্যাটস লাইক আ ব্রেভ পুলিশম্যান, বাট …
ঘোষাল ঘর থেকে বেরিয়ে মানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি ডি. জি.-কে নিয়ে ঢোকেন।
কমরেড আচার্য বলেন,
– এসব কী হচ্ছে বলুন তো? আমি রিপোর্ট চাই।
বস্তুত ডি. জি-র দিকে না তাকিয়েই তিনি রিপোর্ট তলব করেছিলেন।
ডি. জি-ও নগরপালের মতোই হেলমেট পরা।
নগরপালের বুক পকেটে মিসেস জোয়ারদারের ভ্যালেন্টাইনস ডে-র কার্ড খামবন্দী। তাতে আঁকা ছিল একটি লাল হৃদয় এবং তলায় দুটি নীল রঙের ফিমেল ঠোট। তলায় লেখা ‘পাগলী’।
(চলবে)
১৩
‘১৩’, সেই অপয়া ও ঢপয়া ১৩ নং অধ্যায় ঘোর অনিচ্ছা তুচ্ছ করে এসেই যখন পড়ল তখন তাকে তাসা পার্টির খুলিফাটানো ঢিং চ্যাক কুড়, ঢিং চ্যাক কুড় সহযোগে আমন্তণ জানানোই ভালো। ইতিহাসের সকল ঘনিষ্ঠ পাঠকই দেখিয়াছেন যে কি ডাইনোসরদের যুগে, কি অ্যামিবার আমলে বা হোমো স্যাপিয়েনদের জামানায় যখনই কোনো সাধু প্রচেষ্টা হইয়াছে অমনি এক দল ডাইনো, অ্যামিবা বা হোমো স্যাপিয়েন বিনা প্ররোচনায় বা খজড়াদের মদতে তাহাকে নস্যাৎ করিবার ঘৃণ্য চক্রান্তে মাতিয়াছে। কাজেই একই জাতের ও পাতের নিন্দামূলক অপপ্রচার যে চোক্তার ফ্যাতাড়ু-কমনম্যান কম্বাইনের বিরুদ্ধে লাগু হইবেক তাহাতে সন্দেহ কী? এর জবাবে অকুতোভয় বাঙালিরা একসময় এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলত,
‘নিন্দে যখন রটেছে তখন শালা বিয়েই করব।’
সে যুগ আর নাই। এখন কবির ভাষায় বহাল হইয়াছে ‘বিষাক্ত যুগ’। এই শিরোনামটি বসাইয়া পোয়েট বিশু দত্ত যদি অবসরগ্রহণ করিতেন তাহা হইলেও চলিত। কিন্তু পোয়েটরা সচরাচর তেমন করেন না। তাই বিশু দত্ত লিখিয়াছিলেন,
কারাপ্রাচীরের অন্তরালেতে এখন জাগিছে কারা?
এ যুগকে শুধু মেনে নিতে হবে, যদি বিষাক্ত তার
বাহু দুটি মেলি করে ফেলে গ্রাস। হে কবি আত্মহারা,
আমাদের তবু তার কাছে আজ নিষ্কৃতি নাই আর।
এই কাব্যাংশের ব্যাখ্যা সহজ নয়। কেবল ফল্টকে খুচরা লোডশেডিং ভাবিলে চলিবে না। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখিয়া শ্রী বিমলচন্দ্র চক্রবর্তী লিখিয়াছিলেন, ‘তাঁহার ছবি হইতে যদি কোনো অর্থ খুঁজিতে যাই তাহা হইলে নিরাশ হইব। আনন্দের প্রেরণায় ছবি আঁকা — এ ছাড়া তাঁহার তুলিকা ধারণের পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই।’ পণ্ডিত কেন, মুর্খরাও এ কথা মানিবে না। খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ একাধিক ভূতুড়ে ছবি আঁকতে গেলেন কেন? যা দেখলে শিশুরা অট্টক্রন্দন জুড়িয়া দিবে। কেন? এর উত্তর ঘোর ঘোরপ্যাঁচের আবর্তে লুক্কায়িত এক মুচকি রহস্য। লুপ্ত গোরস্থানের উপরে শ্মশানের ধূম। ঘাড় মটকানো ঠেকায় কে? যাই হোক, আর প্রসঙ্গান্তরে নানাবিধ চর্চা ছাড়িয়া আমরা বিষাক্ত যুগের নিন্দার কর্দমাক্ত খেলটি বরং পাকড়াই। এ যুগেরই এক ঘটনা। বিশেষ পুরনোও নয়। কংগ্রেস নেত্রী আভা মাইতি মেদিনীপুরের বুভুক্ষুদের মধ্যে সাধু অভিপ্রায়ে চালিত হইয়া মাইলো বিতরণ করিয়াছিলেন। অমনই কং-বিরোধী বাম দেবরা গান বাঁধিল, ‘একটি বালিকা চাইলো’র সুরে
আভাদিদির মাইলো
সবাই মিলি খাইলো
উদরাময় হইল
(ফের) আভাদিদির মাইলো…
সেই ট্রাডিশন চোক্তার-ফ্যাতাড়ু কেন, কাহাকেও ছাড়িবে না। তাই সদাপ্রস্তুত থাকিতে হইবে। প্রস্তুতি সম্বন্ধে জানানও দিতে হইবে। ইতিপূর্বে সরখেল যেমন করিয়াছে। খাপে খাপ, কেদারের বাপ।
দীর্ঘদিন হইল ক্যালকাটায় আর বসন্তকাল আসে না। মধ্য এশিয়াতে সোভিয়েতের কল্যাণে পুঁজিবাদকে বাইপাস করিয়া যেমন বিদ্যমান ও ‘প্রকৃত’ সমাজতন্ত্র চালু হইয়াছিল তেমনই গুটিকয় স্টুপিড কোকিলের আর্তরব হিসাবে না ধরিলে ক্যালকাটায় উইন্টারের পরই সামার আসে। এবং এই সামারেই অর্থাৎ মার্চের গরমে একটি পোস্টারে শহর ছয়লাপ। দিল্লী-বোম্বাই সাবাড় করিয়া এক হাফ-কাবলে সেক্স ভকিল ক্যালকাটায় আসিয়াছে যাহার অসাধ্য কিছুই নাই। পোস্টারটি এইরকম,
সেক্স-ভকিল! সেক্স-ভকিল!
ফরঘানার হেকিমি ঘরানার খলিফা
বাবরাক কামাল কাবুলী
কলকাতায়
সেক্স-ভকিল! সেক্স-ভকিল!
কাবুল, পেশোয়ার, দিল্লী, বোম্বাই টুর খতম
লাস্ট স্টপ! লাস্ট স্টপ!
এ যাত্রায় কলকাতা
ঘর-৩৭। হোটেল গোপাল, ৯৫-এ, লাকি লেন
কলকাতা-১৬
সকাল – আম দরবার সন্ধেবেলা – স্পেশাল
এই মর্মে বিভিন্ন বাংলা (আনন্দবাজার নহে), ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু দৈনিক-এ বিজ্ঞাপনও লোকের নজর কেড়েছিল। আম দরবারে বিপুল জনতা সামলাতে পুলিশ হিমসিম খেয়ে যায়। সবটাই ঘাড়ে গিয়ে পড়ল পার্ক স্ট্রিট থানার। একেবারে হুলো কেস। আগেই আমরা যার কথা জেনেছি সেই শ্মশান পাড়ার থানার টাকলা ও.সি-কে ফোন করে দুঃখের কথা বলতে বলতেই ঘেমে গেল পার্ক স্ট্রিটের বড়বাবু!
— ছিলুম ভালো। মাগির দালাল, ভেড়ুয়া, খদ্দের – চার পাঁচটা ধরো। দুখানা রদ্দা ঝাড়ো। তিন চারটে পেডলার ধরো। ধুমা ক্যালাও। একটা দুটো চামড়াচোর। গাঁড়ে লাথ, লক আপ। কোত্থেকে বাঁড়া এই সেক্স-ভকিল এল। ব্যাস, হালুয়া হয়ে গেল। রোজ সকালে রগড়ারগড়ি ভিড়। আর লোকেরও বাঁড়া খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। বুড়ো হয়ে গেছে। ধুকপুক করচে। তবু খিটকেলের ধান্দা। লাইফে লঙ্কাবাঁটা দিয়ে দিলে মাইরি। কোতায় দুজনে একদিন অলিপাবে গুছিয়ে বসব।
— তবে ভায়া লোকটা শুনচি ধন্বন্তরি। হালুয়া মোরব্বা কী সব দিচ্চে! রেজাল্ট নাকি ফ্যানটাসটিক। এক রাতে সব ঝটাঝট বনমোরগ হয়ে যাচ্ছে। অল টাইম অন।
— বলো কী ভায়া!
— এই জানবে। ঘোড়ার মুখের খবর। আমি তো ভাবচি রাত করে একটা ভিজিট মেরে দেব কিনা!
— দেবে? তাহলে বলো তো একটা ব্যবস্থা করে ফেলি। দুই ভাইতে মিলে না হয় আড়ালে-আবডালে…
— করে ফ্যালো। কদিন থাকবে মালটা?
— বুজতে পারছি না। হোটেলের মালিকটাও গাছহারামি। জানলেও ভাংচে না। বললেই বলচে, দেকুন স্যার এরা হচ্ছে বেদুইনের জাত, মরুভুমিতে সোর্ড হাঁকানো পার্টি। এই দেকচেন আতর চুলবুলিয়ে মাইফেল বসাচ্চে, গালচেতে শুয়ে গড়্গড়া টানচে আবার খেয়াল চাপল কি তেরাত্তির না পোয়াতেই চিচিং ফাঁক করে ভোঁ ভাঁ।
— তবে আর বিলম্ব কোরো না।
— তা করব না। তবে হেভি রাশ। বড় কত্তারা সব আসা যাওয়া করচে। মানে সব মহলেরই আর কি। নামের লিস্ট দেখলে কেলিয়ে পড়ে যাবে। কে নেই?
— আরে তার মধ্যেও একটা ফাঁক ফোঁকর দেখে গলিয়ে দিতে হবে।
— সে ম্যানেজ হয়ে যাবেখন।
— ব্যাস, তারপরই!
— কী তারপর?
— কী আবার! খাপে খাপ, কেদারের বাপ।
এরপরই টেলিফোনের দু প্রান্তেই খলখলিয়ে হাসির হাসনুহানা ফুটল। এ হল সেই হাসির ফুল যা অচিরেই ঝরে পড়ে। সামান্য টোকাতেই।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটরের আজ মহানন্দ। কারণ স্বয়ং ছিন্নমস্তিষ্ক নগরপাল তাঁহাকে ফোনে জানাইয়াছেন যে অদ্য, ১৩ মার্চ, রাত সাড়ে দশটায় কাবলে সেক্স-ভকিলের সঙ্গে তাঁর এক্সক্লুসিভ অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং তিনি কোনো মতেই তাঁর বাল্যবন্ধু মহামান্য কিউরেটর মহাশয়কে সঙ্গে না লইয়া যাইতে নারাজ। বাল্যকাল, পোড়া শিবমন্দিরের ধসা দেওয়ালে বসিয়া তাঁহারা ও উহাকে নিজ নিজ সাধনদণ্ড দেখাইয়াছিলেন। তখন তাহারা সবেমাত্র উসখুস করিতে শিখিয়াছে, সংসার সমরাঙ্গণে মল্লক্রীড়ায় মাতোয়ারা হইবার মতো পাকাপোক্ত হয় নাই। সেই শিহরণ, সেই রোঁয়া রোঁয়া স্মৃতি, সেই অপাপবিদ্ধ হোমোখেলা কি ভোলা যায়? গেল না। এইসব সাতপাঁচ ভাবিতে ভাবিতে কিউরেটর মহোদয় তাঁহার এক প্রৌঢ়া অধ্যাপিকা বান্ধবীকে ফোন মারিলেন যাঁহার বিষয় ভূগোল হইলেও সাহিত্যপ্রীতি উভয়কেই অবুঝবন্ধনে বাঁধিয়াছে।
— বিরক্ত করলাম?
— একটা ক্লাস অফ পেয়ে চুপচাপ বসেছিলাম। ভালোই হল।
— কী ভালো হল?
— সে তুমি বুঝবে না।
(টেলিফোনে নিঃশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ)
— বুঝেছি।
— ভালো।
— এই শোনো, যে কারণে তোমাকে ফোন করলাম। হঠাৎ একটা নতুন আইডিয়া মাথায় এল। সাহিত্যের সমস্যাটা একটা মূল শ্রেণীতে, দুপাশে সাজালেই সব তর্ক মিটে যাবে। কেউ জানে না। তোমাকেই বলছি। কারণ তুমি বুঝবে।
— যদি বুঝতে না পারি? যদি মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়?
— যাবে না। যেভাবে ভেবেছি সেটা পুরোটাই মাথার তলার ব্যাপার।
— কোনো দুষ্টুমি আছে বলে মনে হচ্ছে।
— না, না, নো দুষ্টুমি। একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে বুফে সিস্টেম। ওখানেই আইডিয়াটা মাথায় এল। সাহিত্যকে দুভাগে আমরা দেখতে পারি — ভেজ আর নন-ভেজ।
লাল ল্যাঙট পরে অল্প ভুঁড়িওয়ালা বড়িলাল তার ঘরে, হনুমানজীর ছবির সামনে, দুটো থানকা ইট এক হাত ফাঁক করে বসিয়ে বুক-ডন মারছিল। রোজ দু সেট করে ডন মারে বড়িলাল। কুড়িটা করে এক এক সেটে। এতই আপার বডি টাটিয়ে যায়। এরপর রয়েছে পঞ্চাশ করে দুসেট পাতিয়ালা বৈঠক। লাফিয়ে জোড়াপায়ে এগিয়ে বৈঠক ফিনিস করে ফের লাফিয়ে পেছিয়ে যায়। পুরোনো আমলে এই বৈঠক মল্লবিদ ও বডিবিল্ডারদের মধ্যে সবিশেষ জনপ্রিয় ছিল। এখন চলে, একহারা বৈঠক। উঠ, বয়েঠ। এক এক পক্কড় শেষ করে বড়িলাল চিনির সরবত ছোট ছোট চুমুকে মেরেþ দিতে দিতে বিড়বিড় করছিল।
— সেক্স-ভকিল! আরে বাবা সিনার জোর, টেংরির জোর, আড়ার জোর নেই — এক কাট দিলেই পটকান — সব সেক্স-ভকিলের ঠেঙে চলেচে। সব ধড়কান হয়ে মরবে। এখনও দ্যাকো যেয়ে তোমরা মনোহর আইচ। পড় পড় করে পাঁজি চার টুকরো করে দেবে। পারবি? একনও দুটো কাবলেকে ধরে মাতা ঠুকে বাজিয়ে দেবে। পারবি? ওসব হল গিয়ে তোমার হিড়িক। যেমন পাড়ায় পাড়ায় জিমখেলা বানাচ্চে। সব ফঙ্গ বেনে কারবার।
বিশাল একটি টিকটিকি এই কথার ফাঁকে গোবর গুহর ফটোর পেছন থেকে বেরিয়ে স্যান্ডো-র ফটোর পেছনে চলে গেল। যদিও সেটা ব্যায়ামরত বড়িলালের চোখে পড়েনি। বড়িলাল হনুমানের সামনে যে নকুলদানা রাখে সেগুলো চাটতে আরশোলা আসে। তখন গামা, জিবিস্কো, গোবর গুহ, স্যান্ডো ও মহিলা কুস্তিগির হামিদা বানুর ফটোর পেছন থেকে টিকটিকির পাল বেরিয়ে আসে। আরশোলার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে টিকটিকিদের মধ্যেই ফ্রিস্টাইল বা গ্রিকো-রোমান কুস্তি লেগে যায়। এই দৃশ্যটিই বড় করে দেখলে বোঝা যাবে পুরাকালে ডাইনোসররা কীভাবে এ ওর খবর নিত। সিনেমায় ফাইট কম্পোজারের দরকার হয়। সে না থাকলে সব ফাইটই অচল। কিন্তু এই টিকটিকিদের ফাইটের কম্পোজার স্বয়ং ঈশ্বর। এবং আরও কি তাজ্জব ব্যাপার, এই অর্থসর্বস্ব বিশ্বে, বিনা পারিশ্রমিকেই তিনি এই কাজ করে চলেছেন। হাততালি-ফাততালিরও তোয়াক্কা করেন না। স্রেফ টিকটিকি লড়িয়ে দিয়েই আপন খেয়ালে বুঁদ! এর জন্য যে তারিফ তাঁর প্রাপ্য তা তিনি বাঙালি চোদখোরদের কাছে কোনোদিনও পাবেন বলেও মনে হয় না।
অপয়া ‘১৩’ অধ্যায়েই ১৩ মার্চ বিকেলে, আচমকা হুড়মুড় করে ডি. এস কে দুপাশ থেকে ধরে মদন ও পুরন্দর ভাট যেভাবে ঢুকেছিল তা একমাত্র বড় মাপের ট্র্যাজিক নাটকেই মাঝে মাঝে দেখা যায়। নলেন তখন লন্ঠন পরিষ্কার করছিল। বেচামণি সালোয়ার ও কামিজ পরে উঠোনে কত্থক প্র্যাকটিস করছিল এবং ভদির বাপ বৃদ্ধ বায়স তা ধেই, তা তা এবং লচকতো মচকতো ইত্যাদি বোল ও ধাঁচ বোঝাচ্ছিল এবং অনতি দূরেই বারান্দায় ভদি ও সরখেল এমনই নীচু গলায় কথাবার্তা বলছিল যা শোনে কার বাপের সাধ্যি! এবং এই স্বাভাবিক, দৈনন্দিন ও গতানুগতিক কর্মকাণ্ড ও জীবন প্রবাহের মধ্যেই এক একটি চাকতি সহসা টাল খেয়ে বা কেতরে ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল বা ঘর থেকে বেরিয়ে অন্তরীক্ষে বোঁ বোঁ মিলিয়ে যাচ্ছিল। বড় চাকতি বোঁ বোঁ শব্দ করে। যে গুলো নয়া পয়সা বা সোডার বোতলের ছিপি বা ক্যারামের স্ট্রাইকার সাইজের সেগুলি সাইরেন বাজির মত এক চিলতে খোনা শব্দ করে হয় ঘরে ঘোরে বা গৃহ ত্যাগ করে। চাকতির পেছনে ফুয়েল ছিল কি? থাকলেও তা কি জাতের? কোনোদিনই জানা যাবে না। যেমন জানা যাবে না শ্রী কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন বাদে আর কেউ শ্রী শ্রী কালীর অষ্টত্তোর শতনাম সংকলন করে উঠতে পেরেছিলেন কিনা অথবা পারলেও তা বাজারে নেই কেন অথবা লাল বাইয়ের প্রেমে পাগল রাজা রঘুনাথকে সত্যই তার রানী চন্দ্রপ্রভা খতম করেছিলেন কিনা বা মিশরের পিরামিড নির্মাতাদের সচিত্র পরিচয় পত্র ছিল কি? ভেজ ও নন ভেজরাও এসব গূঢ় রহস্য সম্বন্ধে হয় জানে না বা জানিলেও অন্তত আমাদের ভাষায় তা বলিবে না। ভাবিয়া লাভ নাই।
ডি. এস -এর আছড়িয়া পড়া ও সরব ক্রন্দন যেন সহসা বৃদ্ধ দাঁড়কাক, নলেন, বেচামণি, ভদি ও সরখেলকে নির্বাক ইতিহাসে পরিণত করিল। লেবেডেফ-এর সেই প্রসিদ্ধ থিয়েটারেও এরকম কোনো মুহূর্ত ও মূর্ছনা তৈরি হইয়াছিল কি?
সকলেই হতবাক। ক্রন্দনময় নীরবতা ভেঙে ককিয়ে উঠল বেচামণি।
— আহা, অমন করে কে মারলে গা! সারা পিট ডুমো ডুমো হয়ে উঠেছে। নলেন, এট্টু বরফ নিয়ে আয় তো।
ভদি খচে যায়।
— বরফ দিয়ে ঘেঁচুটা হবে। লেট হয়ে গছে। বাবা, আপনি একটু ডানার বাতাস দিন তো। যে ব্যাথার যা ওষুধ।
আত্মারাম সরকারের ভোজবাজিই যেন বা। ডানার ঝাপটা খেতেই ডি. এস-এর ককানি থেমে গেল। তারপর ঝিরঝিরি ফুঁপোনোটিও ধরল। বিকট ট্যাঁকঘড়ির মতো মুখে চাপা হাসিও ফুটল। দাঁড়কাকের হায়দারি হাঁক,
— কে তোর এই দশা করেছিল? কোন বাঞ্চোত?
— পু … পু… লিশ…।
— কেন? চোর-ডাকাত-মাগচালানী সব থাকতে তোকে পুলিশ হঠাৎ প্যাঁদাতে গেল কেন?
— আঁজ্ঞে, কাবলে সেক্স-ভকিলের কাছে গিয়েছিলুম।
— কী বলল খানকির ছেলে?
— বলবে কী? আম দরবার বলে কতা। সে একেবারে বারো ভূতের মেলার ভিড়। গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। সামলাতে না পেরে ও. সি বলল — চালাও লাঠি। আমিও পড়ে গেচি সামনে। অমনি দমাদম, দমাদম। যত বলচি, আর মেরোনা, মরে যাব, তত মারচে। যত চিল্লাচ্চি তত মারচে।
মদন এরপর যা বলে তাতে পুরন্দর মাথা নেড়ে সাড়া দেয়।
— শুনেমেলে আমি আগেভাগেই বলেছিলুম, তোর কি রথের চাকা খসেচে যে তুই সেক্স ভকিল, সেক্স-ভকিল করে মরচিস। ঘরে বলে ডাকাবুকো বউ, এই সেদিন ছেলে বিইয়েচে — তোর দরকার সেক্স-ভকিলের? আমি গেলেও তা একটা কতা ছিল।
পুরন্দর বলে,
— সে তো আমিও যেতে পারতুম। বলো ভদিদা, গেলে দোষ হত?
— দোষের আবার কী? যার দরকার পড়বে সেই যাবে। লোকে যাতায়াত করে বলেই তো এসেচে। বাবা, কী বলেন?
— আমার কতা হল ঘরের লোকের গায়ে হাত দেবে কেন? তবে কাজটা ডি. এস ঠিক করনি। অবশ্য আমার সঙ্গে শলা-পরামর্শ না করলে এরকম গাড্ডায় ফাঁসতেই হবে।
— গাড্ডা কেন বাবা? কত নামী লোক। কাবলে হেকিম বলে কতা।
— ভ্যাড় ভ্যাড় করিসনা তো। কাবুলে এখন সব তালিবান। এ ব্যাটা কাবলে হেকিম না বাল। জালি মাল। পিওর ইন্ডিয়ান।
— অ্যাঁ!
— সকাল সকাল বেগম জনসনের কাছে গিছলুম। দেখি সেক্স-ভকিলের কথা কোন একটা গোরাসাহেব পেড়েচে কি বেগম একেবারে হেসে কুটিকুটি। বেগম জনসন কী বলল শুনবি?
— বলুন, শুনব তো। ইন্টারেস্টিং।
— বলল মালটা পুরো ফ্রড। আসলে আর্মস ডিলার। রাজস্থানের লোক। বর্ডার দিয়ে মাল আনে। খবর পেয়েচে সামনের বছর ভোট বলে ওয়েস্টবেঙ্গলে এখন হেভি আর্মস-এর খাঁই। ওয়ুধপত্তর, ঐ হালুয়া, মোরব্বা সব ঢপ। আসলি চেক রিভলবার, চিনে রাইফেল, রাশিয়ান রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড – সব কেবল অর্ডার নিচ্চে। আর অর্ডার বাবদ অ্যাডভান্স। মাল পরে লরিতে ঠেকে ঠেকে পৌঁছে যাবে। বুঝলি? ওপর থেকে দেখে বোঝবার জোটি নেই। নেপালে দুবছর জেলে ছিল। সেখান থেকে গেল বাংলাদেশ। সেখানে হুলিয়া অমনি কেটে গেল মিয়ানমার। সেখান থেকে কলম্বো।
— এই এতসব খুঁটিনাটি বেগম জনসন জানেন?
— মুখস্থ। আর ওষুধগুলো কী জানিস?
— সে যাই হোক বাবা, লোকের মুখে কিন্তু ওষুধের বদনাম শুনিনি।
— রাখ। ভায়াগ্রার ইন্ডিয়ান বেরিয়েচে-এডেগরা তারপর আরো কী সব যেন নাম। তাই গুলে দিচ্চে আটার সঙ্গে। সঙ্গে ওকাসা, থ্রি-নট-থ্রি, শিলাজিৎ সব পাঞ্চ। বলচে ইয়াকুতি হালুয়া। এ নাকি মোগলাই ফর্মূলা। আরে বাবা ইয়াকুতি হালুয়াতে আসল ইনগ্রেডিয়েন্ট হল চড়ুইপাখির ব্রেন। অত চড়ুই ধরা কি মুখের কতা নাকি? পাহারের টঙে পাথরের গায় ঘামের মতো শিলাজিৎ। তাই খেতে যত হিটিয়াল বাঁদরেরা পাহাড়ে চড়ে। নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে মুঠোয় ভরে যখন মুখে পুরতে যাবে তখন তলা থেকে গুলি করতে হয়। বাঁদর গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ল। তখন তার থাবা থেকে শিলাজিৎ কেঁকে নিতে হয়। বুঝলি? এসব যোগাড় করা যে সে কাণ্ড নয়। রেওয়াজি মোরব্বা, ইয়াকুতি হালুয়া — নাম শুনেই সব নাচতে শুরু করল। যাই হোক, ওর কারণেই যখন ডি. এস ঝাড় খেয়েচে তখন মালটাকে সাইজ করতে হবে। অ্যায়সা প্যাঁদাতে হবে যে কলকাতায় আর কখনও যেন পুড়কিবাজি না করতে আসে।
স্মিত হাসি মুখে ভদি বলল,
— আপনি আর মেজাজ গরম করবেন না বাবা। আপনি বৌমাকে যেমন নাচ শেখাচ্ছেন শেখান। সেক্স-ভকিলকে আমি দেখচি। কী বলো সরখেল?
সরখেল খিক খিক করে হাসে।
— তাহলে আজ রাতেই ব্যবস্থা করে দিই?
সরখেল মাথা এক দিকে কাত করে সায় দেয়।
— নলেন, ছেলেছোকরারা এসেচে। ভালো করে চা কর দিকিনি। আর ঝপ করে যেয়ে মুড়ি-ফুলুড়ি নিয়ে আয়।
বেচামণি বলে ওঠে,
— আমি আলুর চপ খাব।
দণ্ডবায়সের পছন্দ অন্য।
— গরম দেখে গোটা চারেক বেগুনি আনবি নলেন। ঠাণ্ডা যেন না হয়।
— নলেনকে ওসব বলতে হবে না। তুমি নাচের বোল বলো দিকিনি। দাদাবাবু যেমন বলল।
নলেন তেলেভাজার লিস্ট বিড় বিড় করে মুখস্থ করতে করতে চলে গেল। ভদি আর সরখেল ফের বারান্দায় ফিরে গিয়ে গুঁই গুঁই করে নিজেদের চক্রান্তমূলক আলোচনা শুরু করল। বেচামণি ওড়নায় কপালের ঘাম মুছে নিল। এক হাত কোমরে দিয়ে ও এক হাত বাতাসে মেলে ধরে দাঁড়াল। দুপায়ে ঘুঙুর। মদন, পুরন্দর ও ডি. এস উঠোনের একপাশে থেবড়ে বসে নাচ দেখতে লাগল। ডি. এস বলল,
— এই নাচটা আমি হেভি লাইক করি।
— নাম জানো নাচটার?
— হ্যাঁ। কুচিপুদি।
— বাল জানো। একে বলে কত্থক। টেংরির জোর না থাকলে এ নাচ নাচলে ঠ্যাং খুলে যাবে।
দণ্ডবায়স ধমকায়,
— তোরা চুপ করবি?
তাহলে লচোকতো মচোকতো।
তা, তা তা ধেই, ধেই তা তা, ধেই …
১৩ মার্চ রাত দশ ঘটিকায় হোটেল গোপালে রুম নাম্বার ৩৭-এ পুলিশী আঙুলের গাঁট্টা পড়ল … টুক, টুক … নগরপাল ও কিউরেটর। দরজা খুলিয়া দিল একটি বিচ্ছিন্ন হাত। নগরপাল বিচলিত কিন্তু বিস্মিত নন কারণ তিনি হেলমেট পরা। কিন্তু কিউরেটর। সে কী করে এই রমণীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবে? সোফার ওপরে বসে আছে ধড়। একটি হাত দরজা খুলে দেওয়ার পর সাবলীলভাবে করমর্দন করার জন্য এগিয়ে আসছে। টেবিলে বসানো পাগড়ি পরা সেক্স-ভকিলের মুণ্ডুতে গালভরা হাসি,
— আইয়ে, আইয়ে তসরিফ রাখিয়ে …
ওদিকে অপর একটি হাত একটি চামচ দিয়ে বয়ামের থেকে ইয়াকুতি হালুয়া বের করছে কারণ বয়ামের গায়ে লেবেলে সেরকমই লেখা। নাগরা পরা দুটি পা ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। নগরপাল হেঁকে ওঠেন,
— অ্যাঁঃ এখানেও চাকতি! সেই চাকতিরই চক্কর! দ্যাট ত্রু�য়েল ফ্লাইং সসার। ওহ গড।
কিউরেটর প্রথমে ভেবেছিলেন ঘরটি উল্টে গেছে এবং তিনি ভারহীন অবস্থায় উড়ছেন। তা নয়। ধীরে ধীরে তিনি জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। এমন সময় দরজা ঠেলে পার্ক স্ট্রিট ও শ্মশান পাড়ার ওসিও ঢুকল। দুজনেই মাল চার্জ করে একটু ঢুলু ঢুলু। তাই তারা হেলমেট পরা নগরপালকে চিনতে পারেনি।
— স্কাউন্ড্রেল। স্যালুট করতে অবদি ভুলে মেরে দিয়েছ। ক-বোতল টেনেছ দুটোতে? টাকলা ওসি গলার আওয়াজটা চিনে স্যালুট করবে কি করবে না ভাবছিল। পার্ক স্ট্রিটের ওসি, একে মাথামোটা তায় চার্জড। সে তড়পে উঠল,
— তুই ল্যাওড়া কে যে তোকে স্যালুট মারতে হবে?
— অ্যাঁ আমি ল্যাওড়া কে?
অলৌকিক ঘটনায় বহু সময়েই পুলিশ জড়িত থাকে। যেমন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া করে দেওয়া। পুলিশ কখনোই দাবি করে না যে তারা ম্যাজিক জানে। তবুও ম্যাজিক দেখানোতে পুলিশ যে পারঙ্গম তা সকলেই জানে। আবার পুলিশকেও কখনও সখনও ম্যাজিক দেখতে হয়। তেমনই ম্যাজিক বিষয়েই কবি হরিবর সরকার লিখিয়াছেন,
লোচন গোস্বামী যবে জয়পুরে ছিল।
থানা হতে পরোয়ানা বাহির করিল।
জলে বাহ্য প্রস্রাব কেহই করিবে না।
কৈলে জেল জরিমানা হবে সাক্ষী বিনা।।
গোস্বামী তরীতে উঠি হাতে লয়ে বৈঠে।
করিল পুরিষ ত্যাগ থানার নিকটে।
দেখিয়া দারোগাবাবু ক্রোধে কম্পমান।
বলে ঐ বেটারে থানায় ধরে আন।।
শুনিয়া কনস্টেবল বলিল তখন।
দুর্গন্ধে নিকটে যেতে নারিব কখন।।
নিজেই দারোগাবাবু করিল গমন।
চন্দনের গন্ধ পেয়ে প্রফুল্লিত মন।।
হে পাঠক বাবাজী, বলিতে পারো ঐ লোচন গোস্বামী কে? পুলিশকে গু ও চন্দনের ম্যাজিক দেখাইবার শক্তি তিনি কোথা হইতে পাইলেন? তা তা ধেই … ধেই …
(চলবে)
১৪
মার্কসবাদের বহুল প্রচার ও প্রসারের ফলে বেশির ভাগ পাঠকই আজকাল নাস্তিক। ধর্মচর্চা দেশ থেকে লোপাট হওয়ার যোগাড়। তাই নাস্তিকদের নাস্তানাবুদ না করে বরং ঝেড়ে কাশাই ভালো যে মান্যবর লোচন গোস্বামী হলেন মতুয়া ধর্মের মহাপথিক। তাঁর যে কত লীলা তার লেখাজোখা নেই। সন্দেহের নিরসন এভাবেই ঘটে। শিষ্যরা গুরুদের বাজিয়ে নেয়। গুরুরাও বেজে ওঠেন। এরপর হল কবিদের ডকুমেন্টেশন-এর কাজ। যেটি করে শ্রী হরিবর সরকার আমাদের অশেষ ঋণে আবদ্ধ করেছেন। কেন যে করতে গেলেন সে প্রশ্ন অবশ্য ওঠে। এই অকৃতজ্ঞ ও গোলোকায়িত জাত অর্থাৎ বাঙালির জন্য কিছুই করা উচিৎ নয়। ‘কাঙাল মালসাট’ এর কথাই ধরা যাক। এটি যদি পুস্তু বা কপটিক ভাষায় লেখা হত তাহলে এতক্ষণে ঢি ঢি পড়ে যেত। পালি বা মাগধী অপপ্রাকৃতে লেখা হলেও অন্যরকম কিছু ঘটত বলে মনে হয় না। অবশ্য লেখক এক ভেবে লেখে। হয় আর এক। যেমন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। এ প্রসঙ্গে উপযুক্ত সময়ে বরং ফেরা যাবে। ভদি ও সরখেলের মধ্যে টেলিফোনে যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে সে দিকে মনোনিবেশ করা যাক —
— দুঁদুঁ বার ফোঁন কঁরলুঁম। ভাঁবলুম কীঁ হঁল?
— হঁবে আঁবার কী। পাঁইখানায় গেঁছলুম।
— তাঁই বঁলো। কোঁনো খঁবর আঁচে?
— আঁচে। মঁরচে পঁড়া এঁকটা সোঁর্ড আঁর দুঁটো ভোজালি বেঁরিয়েচে।
— ভেঁরি গুঁড। বাঁট নোঁ আঁসলি মাল।
— নোঁ।
— নুঁনুকাঁমান, সোঁর্ড, ভোঁজালি! পোঁদ মেঁরে দেঁব।
— কাঁর?
— যেঁ লাঁগতে আঁসবে। কেঁরোসিনে ভিঁজিয়েচ?
— কীঁ?
— ওই সোঁর্ড। তাঁরপর গিঁয়ে ভোঁজালি?
— কেঁন?
— মঁরচে ছেঁড়ে যাঁবে।
— কেঁরোসিন নেঁই।
— আঁজ রাঁতে আঁমি নিঁয়ে যাঁব।
— ঠিঁক আঁচে।
— কোঁনো চিঁন্তা নেঁই। এঁকটা এঁকটা কঁরে ধঁরে পোঁদ মেঁরে দেঁব।
— রাঁখলুম।
— তাঁহলে রাঁতে।
— অঁ।
প্রায় এক সরখেল মাটি খোঁড়া হয়ে গেছে। অথচ কত সরখেল খুঁড়লে যে আসলি মাল পাওয়া যাবে তা কে বলতে পারে? আবার এমনও তো হতে পারে যে খোঁড়াকে খোঁড়াই সার হল, হতে রইল খন্তা। ভদির কপালে টেনশনের ঘাম ফুটতে না ফুটতে বেচামণি আঁচল দিয়ে মুছে দেয়।
— কী নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করচ গো?
— সে তুমি বুঝবে না।
— জানিনে বাপু। বললেই ওই অ্যাক কতা। তুমি বুজবে না। তুমি বুজবে না।
— আহাহা এ হল গে মদ্দাদের ব্যাপার। বলি আর তুমি সাতকাহন করে বেড়াও।
–তোমার সব কাণ্ড বাণ্ড আমি বুঝি সাতকাহন করে বেড়াই।
— করনি। করতে কতক্ষণ? মেয়েজাত পেটে কতা রাখতে পারে না। এই জানবে।
— ওরে আমার ব্যাটাছেলেরে। তুমি যে শিশি বোতলে ভূত পোষো আমি কারুকে বলতে গেচি?
ভদি দেখল কেস বেগড়বাঁই হয়ে যেতে পারে। এক হল বেচামণি হাঁউ মাঁউ জুড়ে দিতে পারে। এবং তখন না থাকলেও বাবা সব জেনে যাবে এবং উস্তমপুস্তম করে ছাড়বে। বাপ হয়ে ছেলের বৌ-এর দিকে অত টাঁক কেন? এরকম কথাও যে ভদি কখনও ভাবেনি তা নয়। ভদি কথা ঘুরিয়ে দিল।
— আমি কি তাই বলেচি? এই যে তোমার দিদির বাড়ি ঘুরে এলে দমদমায় — মনে খিঁচ থাকলে কি তোমাকে যেতে দিতুম? বিশ্বাস আচে বলেই না ছেড়েচি।
বেচামণি টোপটা গিলে নিল।
— জামাইবাবু আমাকে কী বলেছিল জানো তো?
— কী?
— এই বেচু, তোর ওই গদি না ভদি রোজ রোজ সায়েবদের কোম্পানীর মাল খায় – কী করে রে? শুনেচি তো অকম্মে কুকম্মে ঘর ভাড়া দেয়।
— খানকির ছেলে। তা তুমি কী বললে?
— আমিও বললুম, দ্যাখো জামাইবাবু, আমরা হলাম ঘরকুনো বউ। পুরুষমানুষ কী মদ খাচ্চে, কী কারবার করচে ওসব নিয়ে ভাবি না। তবে অযত্ন করলে কি অবিশ্বাসের কাজ করলে টের পেতুম। দিদি বলল, দেখলে তো, শালীর মুখের পোঁচড়াটা খেতে হল। এমনিই কি লোকে গুয়ো হাড়কেল বলে।
–ভাল বলেচে তো।
— মায়ের পেটের বড় বোন। ও কি বোজে না দুবেলা ওকে ঠকাচ্চে? তোর গিয়ে বলে ছেলের বিয়ে হয়ে গেচে, নাতিপুতি হবার যোগাড়, আর তুই কিনা…
— আহাহা, ওসব কতা আর তুলো না। সববো দোষের ওপরে জানবে মাগির দোষ। ও ছোঁকছোÒকানি ধরেচে কি মরেচ। তবিল-তক্তপোষ সব নিলেম করিয়ে ছাড়বে। পেটটা ফাঁপচে। একটু তেলজল পুলটিস করে দেবে?
– ব্যতা নেইতো? অতগুলো পুঁই-চিংড়ি গবগব করে খেলে … তখনই জানি…
— ঘেঁচু জানো। বুজলে, এই সরখেল আর আমি একটা জবর বিসনেস খুলতে চলেচি। সেই চিন্তাতেই পেট ফাঁপছে। একবার যদি লেগে যায়…
– কী হবে গো লাগলে?
– লাগলে? এই ধরো তো বালী বা পুরী যাওয়ার বাই উঠলো বা বিন্দাবন-মথুরা। হাওড়ায় গিয়ে আর ভিড়ভাট্টায় রেলগাড়ি চড়তে হবে না।
— তবে?
— বাড়ির ছাদ থেকে যাবে। সেজেগুজে ছাদে উঠবে। দেখবে বড় ফড়িং-এর মতো দাঁড়িয়ে। হেলিকপটার। মন্ত্রী-ফন্ত্রী সব চড়ে। চড়ে ফড়ফড় করে উড়ে বেড়ায়।
— অ্যাঁ
— এই জানবে। ভদি সরকার যকন খেলতে শুরু করবেনা তখন দেখবে সব শালা পোঁদ সামলাতে ব্যস্ত। সামনে পড়লেই মেরে দেব।
— ও আবার কী কতা।
— এই হল হকের কতা। গাঁড় মারা যাওয়ার ভয় তো লড়তে এসো না। তুমিও ভালো, আমিও ভালো, জয় জগতের জয়! ঘেঁটে দে মা। ভালো করে একটিবার ঘেঁটে দে।
এই বাক্যালাপের কাছাকাছি সময়েই ক্যালকাটার বিখ্যাত জুয়েলার ভি. ডি. দত্ত একটি নক্ষত্র-সন্ধ্যার আয়োজন করে। তাকলাগানো অনুষ্ঠানটি হয় কলামন্দিরে। ওই কলামন্দিরেই বেসমেন্টে একটি ছোট কলামন্দিরও আছে। সেখানে তখন রবিঠাকুরের ভাঙা গান হচ্ছিল। আর বড়টিতে তখন স্টেজজুড়ে ফুটবল, ইতিহাস, চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা, রান্না, ফ্যাশন ডিজাইনিং, পেডিকিওর, দর্শন, রাজনীতি, কুকুরপালন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকপালেরা বসে। চার-পাঁচটি কেবল চ্যানেলের ক্যামেরা চলছে। এমন সময় পাট ভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবি ও ফাইন ধুতি হাঁকিয়ে হাসিমুখে যে মঞ্চে প্রবেশ করেছিল তার নাম হল ডি. এস। এসেই সে অনুষ্ঠানের অ্যাংকার বা নোঙর রহস্যময়ী মিস ম. -র হাত থেকে কর্ডলেস মাইক্রোফোন নিয়ে বলল,
— এসে গেছি। মুম্বাই ফ্লাইট দেড় ঘন্টা লেট। প্লেনে বোমা ছিল। গন্ধ শুঁকে কুকুর বোমা বের করল। সে বহুৎ হরকৎ। কিন্তু স্টেজে চেয়ার কই যে ঠেকাব? চেয়ার! চেয়ার লাও শালা! চেয়া…র!
চেয়ার এসে গেল হুড়মুড় করে। সকলেই ঘাবড়ে গেছে। মিস ম. রসা ডিস্টিলারির বাংলার গন্ধ পেয়েছিল। ঘঁক করে আঁতে লাগে।
— একেনে সব হেক্কড় টাইপের মাল বসে আচে। অন্তত আপনাদের তাই ধারণা। কিন্তু সবই আলফাল। গিদধড়। ওই যে ইতিহাস মারাতে যে মালটা এসেচে ও হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর। ওর মুখটা দেকুন। চোনাঢেকুর গিলচে। কেন বলুন তো? ভাবচে আমি ফাঁস করে দেব যে বাঞ্চোতের পোঁদে গু। কী রে? দেব? কাল দুপুরে কী করছিলি?
কিউরেটরকে নিজের সিটে এলিয়ে যেতে দেখে পাশের বিশিষ্টরা ঘাবড়ে গেল। হলেও গুঁইগাঁই। পুলিশ এগোয়। পার্ক স্ট্রিটের ওসি চেঁচায়,
– আপনি কে? আপনি কি ইনভাইটেড ?
– আমার নাম ডি. এস । কোক শাস্ত্রর ওপরে অথরিটি। ইনভিটেশনের গাঁড় মারি। আর কিছু?
হলে তুমুল হট্টগোল। কেবল চ্যানেলরা ডি. এস-এর ছবি তুলছে। এইসময় হলে আলো নিভে গেল। হেভি গুমুঙ্গুলি। কোনো মহিলার চিৎকার। মারপিট লেগে গেছে। ঢিপ ঢাপ টিক দেওয়ার সাউন্ড। চেয়ার ভাঙছে। পুলিশ ও হলের সিট দেখানোর আশারদের টর্চ। সেই আলোয় দেখা যায় ডি .এস তিন চার মানুষ হাইটে উড়ে বেড়াচ্চে। হাতে কর্ডলেস। সব ছাপিয়ে ডি. এস এর স্টিরিও ভয়েস-
— এবারে বাঁড়া বুঝেচতো আমি কে? ম্যায় হুঁ ডি. এস। সবাই এক কপি করে ‘কোক-শাস্ত্র’ কিনে ফেলুন। জানতে পারবেন কাশ্মিরের রাজাকে কোকা পণ্ডিত মেল-ফিমেল নিয়ে কী বলেছিল। জানলে আপনারাও বর্তে যাবেন। ফোর টাইপস অব কামিনী রয়েচে। সব মাগিই একটা না একটা টাইপে পড়বে। টাইপ বুঝে বন্দোবস্ত – এই চোদনা ও. সি টর্চ মেরে কী করবি — আমাকে ধরবি –
এইসময় ঝপ করে চার পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে আলো ফিরে এল। দেখা গেল কোক-শাস্ত্রের ওপরে অথরিটিই শুধু নয়, ওপরে আরও দুটি মানুষ অর্থাৎ মদন ও পুরন্দর ভাটও উড়ছে। এবং বিশাল দাঁড়কাক। আলো নিভে গেল। এবং ওপর থেকে, অজানা অন্ধকারের অ্যামবিয়েন্সের মধ্যে জলীয় কিছু তরল তিনটি রেখায়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঝিরঝিরি হতে পারে, ছনছন করেও হবে না কেন ফের লাইট অন ও অফ
… কলকাতার হাতবদল এইবার আর সল্টলেকের অদৃশ্য দৈনিকের পাতায় উড়োখবর হয়ে আটকে থাকল না। স্বয়ং সি. এম কেও নড়েচড়ে বসতে হল। নগরপাল ও মহানির্দেশকের শিরচ্ছেদ ও খণ্ড খণ্ড সেক্স-ভকিলের করুণ ঘটনা তাঁর কাছে অজানা ছিল না। কিন্তু এটা ঠিক যে এইসব ঘটনাকে যতটা আমল দেওয়া উচিত ছিল তা তিনি দেননি। তাঁর আমলের নানা বিশিষ্টতার মধ্যে এটাও হয়তো একটি বলে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদেরা মন্তব্য করবেন। কেউ হয়তো বলবেন এই পর্বের নানা ঘটনাবলীকে মার্কসবাদের অমোঘ আওতায় এনে ফেলার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। এনে ফেলতে পারলে বোধহয় ইতিহাস মই ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারত। মই নিয়ে পালানো হয়তো সম্ভব কিন্তু সিঁড়ি সরানো অত সহজ নয়। কেউ হয়তো বাঙালির কোনো জেনেটিক গোলমালই এর জন্য দায়ী বলে মনে করবেন। ঘটনা একটিই — কিন্তু ব্যাখ্যা অসংখ্য। বিশ্লেষণ ও ইঙ্গিতের এই বহুত্ব হতে বাঁচার একটি উপায় হল ক্লোনিং। সব ইতিহাসবিদকে কোতল করে যদি একটিকে ক্লোন করা যায় তাহলে ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু রাজ্য বা কেন্দ্র কারো হাতেই অত অঢেল ক্ষমতা নেই। এটা আত্মস্থ করেই গোয়েবেলস বলেছিলেন যে নিজের আইন ভাঙার ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকা উচিত। সংস্কৃতি — এই শব্দটা শুনলেই নাকি ভদ্রলোকের হাত রিভলবারের দিকে যাওয়ার জন্যে নিশপিশ করত। লোকটা চুতিয়া টাইপের ছিল। এবং এরকম মাল ফুরিয়ে গেছে বলে যেন কোনো নির্বোধ পাঠক বগলে পাউডার দিতে না শুরু করে। খেল এখনও বাকি হ্যায়। পহেলা ঝাঁকির পর আসবে কাশী মথুরা। আসবে ট্রেবলিংকা, বুখেনভান্ড মৃত্যু শিবির। আসবে সাইবেরিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গুলাগ। জামাই ষষ্ঠী আর আইবুড়ো ভাত, মোনামুনির খেলা, সাধ-এর ফাটা পায়েস — কী ভেবেছিলে পাঁচু? এভাবেই চলবে পানসি? ডেস্টিনেশন ইনু মিত্তিরের বেলঘরিয়া? সে গুড়ে মগরাহাটের ফাইন স্যান্ড।
রাইটার্স-এর খুচরো ঘটনাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এবার আমরা স্থায়ী আমানতের দিকে ঠ্যাং বাড়াব। যে কোনো মেজর বা মেজর জেনারেল নভেলের নভেলটি হল তার বিভাগ-চলন। হালের উদাহরণ মানে যা হাতেনাতে ঘোরে তেমনই একটি হল মিলান কুন্দেরার ‘জোক’। এখানেও মজা আছে। ভূমিকায় যাঁকে কুন্দেরা মহান ঔপন্যাসিক বলেছেন সেই প্রখ্যাত কবি লুই আরাগঁর উপন্যাস খুব কমসংখ্যক পাঁচুই পড়েছে। লে হুলিয়া।
মহাকরণ থেকে একটি বুলেট-প্রুফ সাদা অ্যাম্বি বেরোচ্ছিল। তাতে ছিলেন সি. এম, গৃহমন্ত্রী (এঁকে আমরা স্তালিনের খপ্পরে নাস্তানবুদ হতে দেখেছি) এবং সি. এম-এর একান্ত সচিব রাখেকেষ্ট যার একমাত্র কাজ হল সি. এম-এর সর্বাবস্থার ভিডিও একটি হ্যান্ডিক্যামে সঞ্চয় করা। অ্যাম্বি দুলকি গড়ানে এগোচ্ছিল কিন্তু রে-ব্যান সানগ্লাস পরা স্লিম একটি সার্জেন্ট হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিল। সকলেই হতবাক। অতীব বিরক্ত হয়ে কাচ নামিয়ে কমরেড আচার্য গর্জে উঠলেন।
– ব্যাপারটা কী কমরেড সার্জেন্ট?
কমরেড সার্জেন্ট ঘুরে তাকাল। কচি সাহেবটি। মুখে তখনও ডার্বিশায়ারের কাঁচা গরুর দুধের গন্ধ। গোঁফটিও দুধেল যেমন শিশুদের হয়। সাহেব যা বলল তা এই,
– নেটিভ, টুমি চোপ মারিয়া বসিয়া ঠাকো। পহলে গোরা, উসকা বাদ গরু-ঘোড়া-বুঝিলে? নটি করিবে টো এক ব্যাটন খাইবে হারামখোরের বাচ্চা। ক্যাঁচকোঁচক্যাঁচক্যাঁচক্যাঁ
উত্তেজক এই দৃশ্যে শব্দ উঠিল, ক্রমশই উপরে, ঝুনঝুনঝুনঝুন টগবগটগবগ সাঁই সপাশ সাঁই সপাশ ও ক্যাঁচকোঁচক্যাঁচক্যোঁচ। ঘোড়ার টানা হাওদাই বা যেন। বেগম জনসন। মিস স্যান্ডারসন। মিস এমা র্যং হাম। মিস্টার স্লিম্যান। সেই পাঙ্খাবরদারের গাঁড়ে কিক। সেই মিসিবাবার কুকুরদের মেটিং-সিজন। সেই হুমদো সাহেবদের মারাত্বক ডুয়েল ও গুলি মিস। মতিলাল শীলের বোতল ও কর্কের ব্যবসা। ছোবদার, মশালচি, ঘেসুড়ে, খানসামা, খিদমৎগার, হুঁকাবরদার, মালি, ভিস্তি, ধোবি ও আয়াদের প্যাঁকপ্যাঁকানি। ভুটানি ও রোহিল্লা আফগানদের হুমকি। কিন্তু অন্তে একটি সাদা অ্যাম্বাসাডর। বুলেট-গ্রুপ।
রাষ্ট্রের টনক যখন নড়ে তখন যা নড়ে না চড়ে না তেমনদেরও নড়ে বসতে হয়। রাজ্যের টনক নড়াও অন্যরকম নয়। কেন্দ্র যখন নাড়বেই না তখন রাজ্য তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাই গোলাপ মল্লিকের কাছে তলব এল যে কিছুদিন ও বছরখানেক আগে যে দুটি ফাইল সে পাঠিয়েছিল এবং যে দুটি ফাইলের ওপরে ‘বাল’ ও ‘পাগলাচোদা’ লিখে ফেরত পাঠানো হয়েছিল সেই দুটি ফাইল যেন অবিলম্বে পুনরুদ্ধার করে, উপরের মন্তব্যদুটি নির্ভুলভাবে মুছে বা কালি দিয়ে ধেবড়ে ঢাকাচাপা দিয়ে, ওপর মহলে পাঠানো হয় এবং এই তলবটি অতিশয় আর্জেন্ট। তলবটি হাতে পেয়ে গোলাপ তৎক্ষণাৎ সাধুর কাছে চলে গেল ও উভয়ের মধ্যে এই রকম বাক্যালাপ হল,
– দেখচেন স্যার, পুরো গাঁড়ক্যাচাল বোস। সেই দুটো ফাইল, তখন বানচোৎগুলো পাত্তা দিল না। এখন বলচে ফের চাই।
তারকনাথ তখন মন দিয়ে ‘বিষপ্রয়োগে হত্যা-সেকাল আর একাল’ বলে একটি বই পড়ছিলেন। যিনি মুচকি হেসে গোলাপকে বল্লেন,
– পটাসিয়াম সায়ানাইড নয়, ফাইটোটক্সিনও নয়, স্রেফ ওভারডোজ অব জাফরান দিয়েই লোক সাবড়ে দেওয়া যায়। কী বুঝলে?
– জাফরান তো বিরিয়ানিতে দেয়।
– কারেক্ট! চান্স পেলেই তো প্যাঁদাও। ফিউচারে আর খেও না। হয়তো ভুল করেই বেশি পড়ে গেল। কোনো মার্ডারের মোটিভই ছিল না। মধ্যে থেকে তুমি অক্কা পেয়ে গেলে।
– সে না হয় আর খেলাম না। কিন্তু ফাইলদুটোর ব্যাপারে কী করি বলুন তো।
– কোন ফাইল?
– ওই যে সেই রবিঠাকুরের বিজ্ঞাপন আর …
– সরকার নামে পাগলাটার সেই হিজিবিজি, তাই তো?
গোলাপ দেখল যে তারকনাথের মতো দুঁদে গোয়েন্দাও সরখেলকে ভুলে সরকার বলে দিয়েছে। এবং এই ভুলের ল্যাজ ধরেই তার বুকের মধ্যে গোলাপেরই একটি করুণ কাঁটা যেন ফুটে গেল — বেচারা সরখেল। বৌ-মরা দাঁত-পড়া সরখেল। বাঘের মুণ্ডুর মতো গাঁদার চাষ করে। এখন পুলিশ ওকে বেঘোরে ক্যালাবে।
– হ্যাঁ, সার।
– এইটা বলতে যা টাইম নিলে তাতে করে ইনফার করচি তুমি রিয়ালি ওরিড। ঘাবড়িও না। টাইম নিয়ে খোঁজো। চাঁইরা যখন চাইছে তখন তো দিতেই হবে। কিন্তু এটাও ঠিক যে ফাইল হাতের মোয়া নয়। ধুলোপড়া অত দিস্তে দিস্তে ফাইল — খুঁজেপেতে বের করতেও তো টাইম লাগবে। বলেছে যখন লেগে পড়ো।
– সে না হয় লাগলাম। কিন্তু বলুন। তখন ওইভাবে ফেরৎ পাঠাল। গ্যারান্টি দিতে পারি ওরা খুলেও দেখেনি। বলুন, এটা অন্যায় নয়?
– যত পড়ছি বুঝলে তত ন্যায়-অন্যায় গুলিয়ে যাচ্ছে। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিরিয়ানির জাফরান। তাকেও বিশ্বাস নেই। তোমার ক-বছর?
– কিসের স্যার?
– কিসের আবার। রিটায়ারমেন্টের।
– আরো বছর পাঁচেক আছে।
– ভুগবে। আমি তো নেক্সট ইয়ারেই ভাগলবা। যাই হোক লেগে পড়ো। টাইম লাগুক। আমি সামলাবো।
সাধু পুনরায় ‘বিষপ্রয়োগে হত্যা-সেকাল আর একাল’-এ মন দিলেন। গোলাপ ঠিক করল যে ছাদে উঠে দন্ডবায়সবাবাকে ডাকতে হবে। আচ্ছা, কালিঘাটে গিয়ে একবার সরখেলকে সাবধান করে দিলে কেমন হয়?
এর পরদিন গোলাপ দুটো ফাইলই পেয়েছিল। ওপরে লেখা মন্তব্যদুটির ওপরে কালো কালি বুলিয়ে দিয়েছিল। সাধু ফাইলদুটি ওপরে পাঠিয়েছিল। কিন্তু খুলতেই ক্যাচাল।
একটিতে ছিল শ্রীঘৃত সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বাণী। বলাই বাহুল্য যে সেটি নেই। বরং একটি মুদ্রিত কবিতা বা কবিতার অংশ …
… বাকি আছে আর
দোদুল কদম্ব বনে
লোলুপ, লোমশ মনে
নিতম্ব প্রহার
এবং দ্বিতীয় ফাইল, যাতে সরখেলের প্রবন্ধটি ছিল, সেখানে, জেরক্স কপি একটি – (৫ই মার্চ ১৮৩৪। ২৩ ফাল্গুন ১২৪০)
দিল্লী। – অবগত হওয়া গেল যে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু সম্বাদ যখন দিল্লীর বাদশাহের দরবারে পঁহুছিল তখন দরবারস্থ তাবল্লোক একেবারে হতাশ হইলেন। বিশেষতঃ শ্রীযুক্ত মির্জ্জা সিলিং ও তাঁহার পক্ষীয় লোকেরা কহিলেন যে ইঁহার উদ্যোগক্রমে আমাদের বার্ষিক যে তিন লক্ষ টাকা বৃদ্ধি সম্ভাবনা ছিল এইক্ষণে সে ভরসা গেল। কিন্তু তদ্বিসয়ে কিঞ্চিতমাত্র ভয় নাই যদ্যপি গবর্নমেন্ট উক্ত সংখ্যক টাকা দিতে অঙ্গীকার করিয়া থাকেন তবে যে ব্যক্তির উদ্যোগে অঙ্গীকৃত হইয়াছিলেনএইক্ষণে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া কখনও অপহ্নব করিবেন না।
সমূহ বিচলিত গোয়েন্দা কর্তারা শুধু যে নার্ভাস হয়ে পড়েন তাই নয়, তারকনাথ সাধুকে এমনও প্রস্তাব তাঁরা দিয়েছিলেন যে তাঁদের সন্দেহের তীর যেহেতু গোলাপকেই বিদ্ধ করছে অতএব গোলাপ মল্লিককে তাঁরা সদলবলে ‘গ্রিল’ করতে চান। এর জবাবে তারকনাথ গেয়ে উঠেছিল, ‘তবে কেন পায়না বিচার নিহত গোলাপ’ … এবং বলেছিল,
– পোঁদে নেই ইন্দি, ভজোরে গোবিন্দি। কার ঝাঁটে কটা লোম দেখে নেব। গোলাপকে টাচ করে দেখুক না একবার। ওই তো সব যোগাড় করেছিল — রবিঠাকুরের ঘি-এর কোম্পানি, তারপর গিয়ে সরকারের হুমকি। তখন ঢ্যামনাচোদার মতো ফাইলের ওপরে ‘বাল’ আর ‘পাগলাচোদা’ কে লিকেছিল? আপনারা। গ্রিল করচে। গ্রিল করবে। মার্ডার আর মড়া ঘেঁটে ঘেঁটে পুরো জীবনটা গেল, এখন কোত্থেকে ঝাঁটুয়া এসে বলছে রোজ-কে গ্রিল করবে। তুলকালাম লাগিয়ে দেব। লালবাজার, মিনিস্ট্রি, লর্ড সিনহা সব জায়গায় হুড়কালাম লাগিয়ে দেব। দেখবেন? অ্যাসোসিয়েশনের কানে কথাটা তুলব?
– আহ মি. সাধু। অযথা আপনি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছেন। অ্যাকচুয়ালি আমরা ঠিক ওটা মিন করিনি।
– দেখুন। সাফসুৎরো বলে দিলুম। আই অ্যাম তারকনাথ সাধু। আপনারা যখন ল্যাক্টোজেন খাচছেন তখন থ্রি-নট-থ্রি দিয়ে বগল চুলকোচ্ছি-বি কেয়ারফুল। গোলাপের একগাছাতেও যদি কারো হাত লাগে তাহলে আগুন লেগে যাবে।
– সে না হয় হল। গোলাপ যেমন আছে তেমনই থাকবে। কেউ ওকে ট্যাম্পার করবে না। কিন্তু ফাইলদুটোর মধ্যে থেকে মাল হাওয়া নিউ মাল ইন – এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?
– আমি বলব ম্যাজিক অ্যান্ড মিষ্ট্রি। যতক্ষণ না অন্য প্রমাণ পাচ্ছি। ততক্ষণ আমি চুপ। তবে গোলাপ এর কিছুই জানে না। বেচারা। সব ফাইল আমার ঘরে। ধরলে আমাকে ধরুন। করুন, গ্রিল না কী করবেন।
– ঘাড়ে আমাদের কটা মাথা, মি. সাধু?
– একটা করেই তো জানতাম। এখন মনে হচ্ছে এক্সট্রাও গজাচ্ছে।
তারকনাথ দমাস করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল এবং একতরফা ঝাপড়া খেলে যেমন হয় তেমনই থুম্বোমারা হুলোর মতো মুখ করে গোয়েন্দা দপ্তরের চাঁইরা বসে থাকল। দমদম বুলেটের সামনে পড়েও বেঁচে গেলে ফেসকাটিং ওই রকম হয়ে যায়।
ছায়া ঘনিয়েছে। ঝোপে ঝোপে সড়সড় করছে কলিকালের বাতাস। হাফখাওয়া বাতাসার মতো মুন। এবং কালিপড়া, ঝুলে যাওয়া মুনলাইট। ট্রপিকাল অরণ্যের ইনসেক্টদের ঘুনঘুনে শব্দ। এরই মধ্যে, গোলাপ মল্লিক সরখেলের বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির। কোথাও একটা, কেমন একটা ‘খপ খপ’ শব্দ হচ্ছে। অভিজ্ঞ কান বলে দিল শব্দটা লৌকিক। অলৌকিক নয়। গোলাপ চাপা গলায় ডাকল,
– ‘সরখেল? সরখে…ল!
অমনি ‘খপ, খপ’ স্টপ। গোলাপ দু পা এগোল। এবং ওখানেই নির্বিরোধী, সাকার স্ট্যাচু। কারণ তার পিঠে একটি খোঁচা। লেগেছে এবং ঠেকে আছে। এবং একটি হুঁশিয়ারি।
– নড়বি না। নড়লেই খতম। হাত ওঠা … ওঠা।
গোলাপ দুহাত তুলে দাঁড়াল। সামনে থেকে টর্চের আলো। আলোর পেছনে অস্পষ্ট একটি আদল।
– আরে! গোলাপভায়া! অ্যাই, সোর্ড সরিয়ে নাও। দেখচ নাম ধরে ডাকচে। ও আমার ফ্রেন্ড। খুঁচিয়ে ফুঁচিয়ে দাওনিতো?
ভদি বলল,
— এখনও দিইনি। আরেকটু লেট করলে, হাত পা কাঁপছিল, হয়তো খোঁচাই লেগে যেত।
গোলাপ এতক্ষণে কথা বলল,
– হাত কাঁপবে কেন? সোর্ড ফোর্ড ধরে অভ্যেস নেই বুঝি?
– অভ্যেস থাকবেনা কেন? সবই চলে। তবে মোগলাই আমলের মালতো। ওরা হত ছয়, সাড়ে ছয়, সাত – ওজনও নব্বই থেকে শুরু। আমাদের হাতে ঠিক খেলে না।
সরখেল গোলাপকে ঘরে নিয়ে গেল। সরখেল আন্ডারওয়্যার পরা। চিমড়ে। সারা গায়ে ঘাম আর মাটি। গোলাপ বলল,
– বাগান করছিলে?
– মনে রেখেচ তাহলে। বাগানও করছি, সেইসঙ্গে মিউটিনিরও ব্যবস্থা করচি। লেখাটা পড়েছিলে?
– পড়িনি? খুব ক্লিয়ারকাট। তাহলে বলচ যে যুদ্ধ একটা লাগবেই?
ভদি বলল,
– কী মনে হয়? এইসব সোর্ড ফোর্ড, তারপর গিয়ে নুনুকামান, গাদা বন্দুক – এমনি এমনি?
– অ্যাঁজ্ঞে, নুনুকামান মানে?
– ও হল আপনার পোর্তুগীজদের ক্যানন। ছোট সাইজের পোনাকামানও বলা যায়। বজরা টু বজরা হেভি এফেকটিভ।
– থামো তো। বলো গোলাপ ভায়া, কী মনে করে?
– এলাম। তবে উদ্দেশ্য ছিল। সাবধান করা। তোমার সেই লেখাটা বুঝলে …
– বুঝেছি। ওপরওয়ালাদের হাতে পড়ার জন্যেই তোমাকে দিয়েছিলুম। কী বলচে শালারা। পড়ে নিশ্চই পোঁদে ভয় ধরেচে।
– প্রথমে পড়েইনি। বুঝলে? এখন তলব করেছিল। ফাইল দিলুম। সে মাল নেই। কী সব রামমোহন রায় কোথায় মরেচে ফরেচে এইসব …
– থাকবে কী করে। এখন ওই ফাইল খুললে দ্যাখা যাবে রামমোহনফোহনও নেই। ফের নতুন মাল। ফের বন্ধ করে ফের খুললে আবার নতুন লেখা। বানচোৎদের এমন গুলিয়ে দেব যে হেগে ছুঁচোতে ভুলে যাবে।
কন্ঠস্বরটি দন্ডবায়সের। তিনি ভাঙা জানলায় বসে একবার ডানা ঝাপটালেন।
– প্রভু? আপনি?
গোলাপ উঠে গিয়ে দুই ঠ্যাঙের নখে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
– কি রে? আমার সাধের গোলাপকে কেমন শুকনো লাগচে।
– এ কিছু নয় প্রভু। দপ্তরে সব ওপরওয়ালা হারামিপনা করছিল। এখন রসে গেচে।
– যাবেই। তুই আমার আশ্রিত। তোর পোঁদে যে লাগবে উল্টে তারটাই খোলতাই করে মেরে দেব। বল।
– আঁজ্ঞে প্রভু, এসেছিলুম সরখেলকে সাবধান করতে। আর যদি আঁজ্ঞা করেন তো মনের বাসনাটা খুলে পেতে বলি।
– বল। ভদি, ভালো করে শোন। তুই যা আনমনা।
– না, বাবা। মন দিয়ে শুনচি। কিচু মনে করোনিতো ভাই গোলাপ।
– না ভাই মিউটিনিতে এমনটা তো হবেই। মনে করাকরির কী আচে? আঁজ্ঞে বাবা, আমিও আপনাদের দলে ভিড়ব।
– ভিড়বি কিরে? তুই তো ভিড়েই আচিস। তুই আপনার লোক না হলে সরখেল তোকে চোতাটা দিত?
– আঁজ্ঞে লালবাজারে কী চুদুড়বুদুড় চলছে, কে কী ছক করচে সব এসে বলব। শালাদের ওপরে আমার হেভি খার।
– সে তো বলবিই। এই না হলে গোলাপ। ভদি, গোলাপ মিউটিনিতে নাম লেকাল। ওকে একটু আপ্যায়ন করবি না?
– ছি ছি বাবা, তাও কি বলতে হয়? গোলাপ ভাই, কী খাবে বলো, বাংলু না বিলিতি?
সরখেল বলে ওঠে,
– কোনো নজ্জা নেই। সব খোলামেলা। আমি একটু হাতমুখ ধুয়ে আসি। সারাদিন ওই বাগান … কম হ্যাপা?
গোলাপ ঝাঁকে ভিড়ে পড়ে।
– বিলিতিই বলো তবে।
– সরখেল, ফোনে নলেনকে বলে দাও তো।
– দিচ্চি!
– একদিন দিনমানে এসে সরখেলের ফুলবাগানের ফুল দেখতে হবে।
দাঁড়কাক খুক খুক করে হাসল। ভদি বিশেষ উচ্চবাচ্চ করল না। হাতমুখ ধুয়ে সরখেল এসে গেল। নলেন রামের বোতল, গেলাস আর ছোলাভাজা দিয়ে গেল। বড়ই আন্তরিক এই পরিবেশ।
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের আগে দেশের পরিবেশ কি এমনটিই ছিল? অর্থাৎ ভারতের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের আগে। হে মার্কসবিদ পাঠক, তুমি ‘বিদ্রোহে বাঙালী’ পড়িয়াছ? বলো না গো!
(চলবে)
১৫
‘বিদ্রোহে বাঙালী’ পড়তে যাবে কেন? পড়লে যে জেনে যাবে যে, মহাবিদ্রোহে বাঙালি কী যত্নসহযোগে সাহেবদের চামচাগিরি করত। তার চেয়ে সে পড়বে ফুকো যিনি, ভালো বাংলায়, শিঙে ফুঁকে আমাদের বাঁচিয়েছেন। অর্থাৎ পাঠকদের শৃঙ্খলা শেখানো ও শাস্তিপ্রদানের মহান দায়িত্বটি অতীব ক্ষমতাধারী ‘কাঙাল মালসাট’-এর ঘাড়েই বর্তেছে। ‘কাঙাল মালসাট’ কোনো বিদ্রোহী মোষ নয় যে, রক্তচক্ষু করে জোয়াল ফেলে দেবে ও বিপ্লবী গাড়োয়ানদের সঙ্গে প্রাক-পুঁজিবাদী অঘোর নৃত্যে মেতে উঠবে। তাই আমাদের (মানে কাঙাল মালসাট, লেখক ও পাঠকদের) মমজমার রহস্য জানিলেই চলিবে, ৩১৮ পৃষ্ঠার মালটি যেমন অজ্ঞাত রহিয়াছে তেমনই থাকুক। ব্রিটিশদের গুপ্তচরের কাজ। ১৮৫৭ তে ‘পাছে পথিমধ্যে যুবক গুপ্তচর বলিয়া ধৃত হয়, এই জন্য সেই পত্রখানি, দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া রাখিয়াছে। দেহ উলঙ্গ করিয়া, কাপড়-ঝাড়া হইলেও সে পত্র বাহির হইত না। পত্র অবশ্যই মুখের মধ্যে ছিল না। পত্রখানিকে মমজমায় মুড়িয়া, মলত্যাগের দ্বারের ভিতর সুরক্ষিত করা হইয়াছিল। আবশ্যক হইলে, যুবক পত্রখানি খুলিয়া লইত এবং শৌচাদির পর পুনরায় তৎস্থানে রাখিয়া দিত। রস বীভৎস বটে, কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের সময়, বীর-বীভৎসরসেরই বিশেষ বাড়াবাড়ি হইয়াছিল।’ এক হিসেবে ভদির কারবারও বিদ্রোহ বিশেষ। অতএব রসতাত্বিকরা রসমিল লক্ষ করিতেই পারেন। বাধা দেওয়ার কেহই নাই। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মহাকাহিনীর শেষে লিখিয়াছেন, ‘আবার বেরিলিতে ইংরেজের রাজত্ব বসিল। মনে অপূর্বভাবের উদয় হইল। অদ্য এইখানেই আমার জীবন-চরিত শেষ করিলাম। অবশিষ্ট জীবনী আর লিখিবার উপযুক্ত নহে।’ মহান উপলদ্ধি ও তৎসহ কী অকপট স্বীকারোক্তি। কী কন্ট্রোল ! আলফাল অনেক গান্ডুরই নিজের জীবনী রচনা করিবার একটি গুপ্ত বাসনা রহিয়াছে। কোনো কোনো পাঁচু তো লিখেই ফেলেছে। ছাপাও হচ্ছে খোলতাই করে। কিছু বলার নেই। মহাজনেরা যে পথে যেতে যেতে হায়দারি হাঁক ছাড়েন অ্যাং ব্যাং-ও সেই রাস্তায় হাওদায় বসে জাঁকাতে চায়। এদিকে হাতির সাপ্লাই নেই বহুদিন। আজ যদি নেতাজী থাকত!
রাধাবাজারে ডি.এস যে ট্যাঁকঘড়িটা সারাতে নিয়ে গিয়েছিল সেটা দেখে দুঁদে দুঁদে ঘড়িয়ালরা অবধি চুপসে গেল। কারও কাছেই এই বিদঘুটে ঘড়ির স্প্রিং তো দুরের কথা, কোনো পার্টসই নেই।
— তাহলে দাদু বলচেন হবে না।
— হওয়া না হওয়া ভাই আমার নয়, ওপরওয়ালার ব্যাপার। তবে চান্স কম। এসব মালের আর পার্টস-ফার্টস হয় না।
— ঠাকুরদার একটা জিনিস। ফেলে দেব?
— না না, ফেলতে যাবেন কেন? বাক্সপ্যাঁটরায় তুলে রাখুন যত্ন করে। মান্ধাতার মাল। এখন এ সবের মর্ম কেউ বুঝবে?
— কিন্তু মাল তো অচল। কিছু একটা রাস্তা বাতলান?
— কোনো রাস্তা নেই ভাই। তবে হ্যাঁ, অনেক সময় আধবুড়ো পাগলা সাহেবরা এই সব অ্যান্টিক মাল কিনতে আসে। দেখবেন, কাগজে দেয়। পুরনো খেলনা, কলের গান, ঘড়ি তারপর গিয়ে কলম — এইসব।…. ভালো হলে হেভি দাঁও মারতে পারবেন।
— বাংলা কাগজে দেয়?
দোকানে থেকে বেরিয়ে ডি.এস ঘড়িটা পকেটে ঢুকোল। পুরন্দর বলল,
— বেচবে না জানো, সারানো গেলেও সারাবে না। করতেও পারো ভ্যাড়রভ্যাড়র।
— কটা বাজে?
— দোকানে তো আড়াইটে দেখলুম।
— তো! গোলাপ আসবে সোয়া তিনটেতে। টাইম পাস করতে হবে তো! এখনও কড়কড়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
— হেঁটে হেঁটে বেল্লিক বনে লাভ আছে? পায়ের নড়াদুটো টনটন করচে। চলো, একটা চায়ের দোকানে বসি।
— পালকি যার বউ তার। চায়ের খরচ তাহলে তোমার!
— বেশ, তাই হবে। যা ছ্যাঁচড়া হয়ে উঠচ দিন কে দিন।
— আরে, তা নয়। হেভি ক্যাশ সর্ট। বালবাচ্চা নিয়ে তো ঘর করলে না। কবিতা লিখেই লাইফটা কাটিয়ে দিলে।
— আমি আর কবিতা লিখি না। জানো?
— মানে?
— মানে, আবার কী? কবিতা লিখবো না। ছেড়ে দিয়েচি।
— বলো কী?
— দূর। কোনো বাঞ্চোৎ পড়ে না। কেউ ছাপেও না। ও ল্যাওড়া লিখলেই কী আর না লিখলেই কী।
— তবে কী করবে?
— গান লিখব। গান এখন হেভি পপুলার। কাঁড়ি কাঁড়ি ক্যাসেট দেকচ না। হেগো পেদো সব্বাই পুঁক পাঁক করে ক্যাসেট ছাড়চে বাজারে। তাই গান লিখব। রেডি মার্কেট আচে। একটা লিখেচি। শুনবে? চা খেতে খেতে।
— গাইবে?
— না, না। পড়ব। এর ওপর টিউনিং হবে। তারপর আগে পরের বাজনা জুড়বে। মাল রেডি হলে আর্টিস্ট গানটা তুলবে।
পুরন্দর আর ডি.এস যে চায়ের দোকানটায় বসল সেখানে বিরাট ছবি সন্তোষীমার। এফ এম রেডিওতে তালাত মেহমুদের ঢেউখেলানো গলার সুর বাজছে। লোকেরা নোংরা গেলাসে গরম চা ও ঠাণ্ডা নিমকি খাচ্ছে। ড্রাইভারেরা বিড়ি ধরিয়ে মালিকদের মা বাপ তুলে খিস্তি করছে। চোখে ছানি কাটানোর পর কালো ঠুলি পরা একটা বুড়ো উবু হয়ে ফুটপাথে বসে চা খাচ্ছে। তার বুকপকেটে আনেক ময়লা কাগজ ভাঁজ করা এবং সেই কাগজের ফাঁকে একটি ডটপেনের ন্যাড়া রিফিল। দুটো চা অর্ডার দিয়ে ওরা বুড়োটার থেকে একটু দুরে দাঁড়ালো এববং পুরন্দর পকেট থেকে গান লেখা কাগজটা বের করল।
— কী টাইপের গান এটা?
— ফোক। শোনো না। কথাতেই ভাবটা ধরতে পারবে। আচ্ছা না হয় একটু বলেই নিই-এটা হল মাছমারানীদের গান। রাতের বেলায় পাল বেঁধে মেছোমাগিরা মাছ ধরতে যাচ্ছে।
— হেভি তো!
— হ্যাঁ। এবার পড়চি,
গজাল মাছের ভুড়ভুড়িতে কাতলা মারে ঘাই
মাছ মারিতে যাই গো মোরা মাছ মারিতে যাই
ঘোমটা ফেলে, আদুল বুকে
গিরগিটি তেল মাখ লো মুখে
আড়ের ভুঁড়ি, শোলের মুড়ি, কুমীরপানা ঢাঁই
মাছ মারিতে যাই গো মোরা মাছ মারিতে যাই
আবছায়াতে পেত্নি মোরা
পায়ের পাতা পিছনমোড়া
মাছের তেলে মাছটি ভেজে সোহাগ করে খাই
মাছ মারিতে যাই গো মোরা মাছ মারিতে যাই
– পুরো ঝাক্কাস কেস হয়েচে গুরু কিন্তু লাস্টের দিকটায় তো মনে হচ্ছে ওরা ভূত!
— ভূত নয়। ওটা হল মনের ভাব। আঁশটে ভাবনাটা যাতে বেরোয় তাই তো ওরা নিজেদের মেছোপেত্নি বলচে। বুঝলে?
— সে না হয় হল কিন্তু গাইবে কে? আশার গলায় মালটা যা খুলতো না! সঙ্গে খিলখিলে হাসি!
— ওসব ভেবে লাভ নেই। আমার গান তো, ফিউচার ইজ ডার্ক। হেঁজি পেঁজি কোনো ছুঁড়িফুঁড়ি গাইবে। আবার কী হবে? এই বাজারে সি.পি.এম, তৃণমূল, নয়তো কোনো দরাজদিল… কেউ পেছনে লগা না ধরে উঁচু করলে নো চান্স।
— তবে কিছু হয়নি বলে আমি মানি না।
— যেমন?
— আরে বাবা, ফ্যাতাড়ু তো হয়েছ। চোক্তারদের সঙ্গে দোস্তি তো হয়েছে। তারপর গিয়ে কথা বলা দাঁড়কাক, চাকতির চক্কর, এবেলা বেঙ্গল ও বেলা ইংলিশ – এরকমই বা কজনের হয়?
— এদিকটা নিয়ে এত ভাবিনি।
— না চাইতেই তো পাচ্চ। তাই ভাবচ না। এইজন্যেই আমার বউ বলে মিনিমাগনাকে কেউ ইজ্জত দেয় না।
— ঠিকই বলে। ভালোই হল। এই কতা দিলুম এসব নিয়ে আর ভাবব না। ওফ চিড়িক করে একটা সং মাথায় এল।
— এটাও কি জেলেমাগিদের …?
— না, না। এটা হল গিয়ে তোমার শহরের, কলেজে পড়া মেয়েদের গান। মুখড়াটাই পেলুম। শুনবে?
— বলো!
— হব না ননদ, হব না জায়া
হব সরকারি হোমের আয়া …
— হিটিয়াল দাঁড়াবে গুরু। এরপর মিল দেওয়ার জন্যে তোমার হাতে সায়া, মায়া, ছায়া, পায়া – সব আচে।
— পায়া-টা কাজে লাগবে না। অবশ্য খাট বা তক্তপোষ যদি সিনে ঢুকে পড়ে তাহলে আলাদা ব্যাপার।
ডি. এস বলল,
— সামনে দেখো,
— কী?
–ঐ যে, রাস্তাপারের পানের দোকানে।
গোলাপ পান কিনে খেল। তারপর পানের বোঁটার থেকে চুন দাঁতে কেটে বোঁটাটা যখন ছুঁড়ে ফেলল তখন হাতের তেলোতে লুকোনো একটা কাগজের দলাও সেইদিকে পড়ে গড়িয়ে গেল।
— গোলাপটা এখন লালবাজারে ব্যাক করবে। আমি পা চুলকোবার ছকে মালটা ক্যাচ করব। তুমি গার্ড দেবে।
— আমিও পা চুলকোব?
— পাগলা নাকি? দুজনে পা চুলকোচ্চে দেখলেই সব স্পাই অ্যালার্ট হয়ে যাবে। চারদিকে কিলবিল করচে। চলো! কোনো বাঞ্চোৎ হয়তো এক কিকে নর্দমায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে। কাগজের দলা দেখলেই অনেকে ভাবে বল।
গুপ্তচরদের একটি জমজমাট জগৎ রয়েছে। সেখানে নানা দেশের গুপ্তচর সংস্থাই খেলায় মেতে রয়েছে। সি. আই. এ, কে. জি. বি. (বর্তমানে এফ. এস. বি), এম. আই . ফাইভ, মোসাদ, অধুনা বিলুপ্ত স্টাসি, আই. এস. আই — কত শিশুই যে নিকারবোকার পরে এই রহস্যাবৃত ক্রীড়াঙ্গনে আঁকুপাঁকু খেলা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই নিষ্পাপ খেলায় যে চোক্তার-ফ্যাতাড়ুরাও পেছিয়ে নেই তা আশা করা যায় পাঠকের মগজ এড়াবে না। ভদি দলা পাকানো কাগজটি খুলল। একটি হ্যান্ডবিলের উল্টোপিঠ। সেখানে লেখা,
ALL M AND CT UNDER I
— হুঁ হুঁ বাবা। আমার নাম হল ভদি। আমার সঙ্গে টিগড়মবাজি! নলেন কোতায়? নে… লো…!
নলেন দুদ্দাড় করে ছাদ থেকে নেমে এল।
— এই কাগজটাকে উনুনে দিয়ে দে। ভাল করে পুরোটা জ্বলে যেতে দেখবি। তারপর বড় করে একটা বাংলা রাম পাতিয়ালা পাঞ্চ বানা। জানতাম, খেলা জমবে। জমে দই হয়ে যাবে।
সেদিন রাতেই ভদি, দাঁড়কাক ও সরখেল স্পেশাল কোর মিটিং-এ বসে গেল। লালবাজারের গোয়েন্দারা কলকাতার মাগি ও চোলাই-এর ঠেকে হেভি নজর রাখা শুরু করেছে। সরখেল দেখা গেল ব্যাপারটার গ্র্যাভিটি ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
— আমরা মাগিবাড়ি যাই না, চোলাইও খাই না। ও উকুন আমাদের কারো নেই। তবে কেন আমরা উত্যক্ত হতে যাব?
— গোড়াতেই এমন চোদনার মতো কথা বলে বসো যে মটকা গরম হয়ে যায়। তোমার মতো মেজর জেনারেল নিয়ে লড়তে হয়েছিল বলেই হিটলারের খুপড়ি উড়ে গিয়েছিল। ভাবা যায় না। বোকাচোদামির একটা লিমিট থাকে।
— দাঁড়কাক এই স্ট্র্যাটেজিক আলোচনায় এতক্ষণ এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা দিয়ে বাতাসে ইকড়িমিকড়ি আঁকছিল। ভদির মেজাজ টং দেখে সরখেল কথা ঘুরিয়ে দাঁড়কাককে বলে,
— আপনি কী লিখছেন প্রভু?
— ও কিছু নয়।, ডুডলস। যুদ্ধ লেগে যাব লেগে যাব হলেই আমি ডুডলস আঁকি। স্ট্যালিনও আঁকত – শেয়াল।
— আর আপনি?
— কোনো ধরাবাঁধা সাবজেক্ট নেই। কখনো ভূত, কখনো কচ্ছপ, কখনো ঝাড়াঝাড়ি।ভদির সব ভালো কিন্তু বড় অল্পতে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। ওর ঠাকুর্দাও এরকম ছিল। থার্ড জেনারেশন বলে রিপিট করছে। গ্রেগর মেন্ডেলের নাম শুনেছিস।
— আজ্ঞে না।
— ১৮৬৫ সালে কেসটা ধরেছিল। মিউটিনির আট বছর পর। একদিন বলবখন। এই মেন্ডেলকে আবার আংলি করতে গিয়েছিল লাইসেনকো বলে একটা বোকাচোদা। স্ট্যালিনও পুড়কি খেয়ে নিকোলাই ভাভিলভকে ঝেড়ে দিল। ব্যাস — পুঁটকিজাম। কিছুই জানিস না। আর কী করেই বা জানবি! গাণ্ডুর দেশের যত উদগাণ্ডুরা হচ্ছে লিডার। তোর লিডার যেমন ভদি। মগরার বালি দিয়ে চারবেলা পোঁদ মারালে যদি বুদ্ধি খোলে।
— না, না, বাবা। অমন কঠোর দণ্ড দেবেন না।
— ঠিক আচে, দেব না। এবার যা বলবি বল। তবে চোপা দেখলেই এবার কিন্তু হেভি খচে যাব।
— নাক মলচি, কান মলচি, আর হবে না।
— বেশ, এবার বলে যা।
এই সময়েই দরজার বাইরে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে সকলে চমকে গেল।
— কে? হু ইজ দেয়ার?
— আমি। নলেন।
— হোয়াই? কী চাই?
– বৌদিমণি বলল কি যে সেনাপতিরা ফন্দি আঁটচে, যা রে নলেন, এক বোতল মাল দিয়ে আয়, তাই এলুম।
– কাম। গুড।
দরজা খুলে নলেন ঢুকল। থালার ওপরে এক বোতল বাংলা। তিনটে ছোট গেলাশ। এক মগ জল। কুচো চিংড়ির বড়া।
— রাখ। বাইরে কী ফাটল? পাদলি?
— আঁজ্ঞে না। পায়ের তলায় পড়ে আরশোলা ফাটল।
— তাই বল। আমি ভাবলুম ক্যাপ ফাটল। যা, দরজাটা টেনে দিয়ে যেমন এসেচিস তেমনি পা টিপে টিপে চলে যা।
নলেন পা টিপে টিপে চলে গেল।
— বাবা, শুনুন। সরখেল, ধ্যানসে শুনো। মিউটিনির প্রথম দিকটায় আমরা পুরো ক্যান্টার করে দিয়েছি। এমন দিয়েচি যে বাঞ্চোৎদের পোঁদে যমের ভয় ধরে মাথা গুগলি হয়ে গেচে।
— খোলসা করে বল।
— এক নম্বর হচ্ছে যে চাকতিফাকতি উড়ে ওদের তো পিলে চমকে গেচে। বুঝতেও পারচে যে সরখেলের চরমপত্র ফ্যালনা নয়। এ. কে. ফর্টি সেভেনের কারখানা, ভিক্টোরিয়ার চোদখোর কিউরেটর — সব মিলিয়ে কেস গুবলেটিং। কিছু একটা আসচে অথচ কী করবে জানে না। মোটা মাথা তো … হেডপিসে হরতাল … ভাবচে কমন ক্রিমিনালরা গ্যাং আপ করেচে তো … তাই এম অ্যান্ড সি টি মানে মাগি আর চোলাই-এর ঠেকে খোঁচর বসানো … এগুলো হচ্চে পাতি রেসপন্স .. এই দিয়ে যদি মিউটিনি ঠেকানো যেত তাহলে আর কতা ছিল না। একদম চোদু। পিওর চোদু। তবে হ্যাটস অফ টু গোলাপ। একে বলে স্পাই।
— ওফ এইবার বুঝলুম। না, প্রভু, আমরা ঠিক নেতাই বেছেছি। আপনি কী বলেন?
– বাপ হয়ে ছেলের প্রশংসা আমি কখনও করিনি। ওসব ঢ্যামনামি আমাদের বংশের ধাতে নেই। তবে আমি চাই যে ওরা যখন একটা স্টেপ নিয়েচে তখন আমাদের একটা কাউন্টার স্টেপ নিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দরকার যে আমরা বাল কেয়ার করি। ভদিই সেটা ঠিক করবে। চুক করে একটা কড়া ডোজ মেরে আমাকে কাটতে হবে।
— কেন প্রভু?
— বলা বারণ কিন্তু তোরা হলি কোলের গ্যাঁদা। তোদের বলা যায়। আজ ওল্ড পার্ক স্ট্রিট কবরখানায় মি. স্লিম্যান ও মি. শেরউডের মধ্যে ডুয়েল হবে। আমাকে রেফারি থাকতে হবে।
— আঁজ্ঞে, রাজার জাতের মধ্যে কী নিয়ে বিবাদ যে ডুয়েল লড়তে হবে?
— সেই, এজ ওল্ড ফ্যাড, মিস এমা র্যাংহামকে নিয়ে কামড়াকামড়ি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় যার ছড়াছড়ি। রাস্তাতেও তাই। মাদি কুত্তা নিয়ে মদ্দাগুলোর ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক। বাই চান্স হয়তো কোনো ওল্ড কুত্তা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাস সেও সোলডা বের করে ভিড়ে পড়ল। ফিউচারেও এরকম চলবে। কিছু করার নেই।
— আচ্ছা প্রভু, ঐ আপনার গিয়ে স্লিম্যান, তারপর কী যেন, হ্যাঁ শেরউড — এরাতো কবে পটলিফায়েড হয়ে গেচে। এখনও এদের ভূত লড়ে যাচ্ছে?
— নো, নো, সাহেবদের ভূত বলা বারণ। গোস্ট বলতে হবে। কী বাবা, ঠিক বলিনি?
— ঠিকই তবে গোরাভূত বললে দেখেচি আজকাল ওরা মাইন্ড করে না। কতায় কতায় রাত গড়াচ্চে। ওদিকে পিস্তল-ফিস্তল রেডি। মিস এমা র্যাংহাম বার বার মূর্ছা যাচ্ছে। বেগম জনসন একা কতদিন সামলাবে। চলি।
খোলা জানালা দিয়ে ভৌতিক অন্ধকারের মধ্যে ডানা মেলিয়া দণ্ডবায়স ডুয়েল-এ রেফারিং করিতে উড়িয়া গেল। পাঠক, নিপাতনে সিদ্ধ গবাক্ষের বাহিরে মোহিনী মন লইয়া তাকাও। তুমিও দেখিবে পিয়ানোর টুং টুাং শব্দে সেই শিশিরই পড়িতেছে যা তখনও পড়িত। ঘাসে ঘাসফুল ফুটিয়াছে। তখনও ফুটিত। এই দৃশ্যে মগ্ন থাকো। ঐ দ্যাখো মেম-বালিকারা খিলখিল করিয়া মাঠে নামিতেছে। স্নো- মোশানে স্কিপিং করিতেছে। কী সুন্দর সোনলি চুল। কী দুধেল গলা। কী ফুলেল বুক। আরো নামো। যেন লিফটে চড়িয়া তুমি বালিকা মেমের পেট বাহিয়া নামিতেছ। এ লিফট থামিবে না। স্বপ্নদোষ অবধি এই চটকা থাকিবেক। হায় নবোকভ, পৃথিবীর সবকটি রান্নাঘরের ঝুল একত্র করিলেও আপনার ন্যায় একটি ঝুল লেখক মিলিবে না।
— সরখেল, আমিও তাহলে উঠি।
— সে কি? প্রভু যে কাউন্টার স্টেপের কথা বলে গেলেন, তার কিছু করবে না।
— সেই কারণেই তো যাচ্ছি। কাল একটা ঘটনা ঘটবে জানো?
— কী?
— ওয়েস্টবেঙ্গলের টপ সব ক্যাপিটালিস্টরা সি. এম-কে মিট করবে।
— তাতে আমাদের কি ছেঁড়া গেল?
— দেখবে। দেখবে মানে কাগজে পড়বে। টিভিতে দেখালেও দেখাতে পারে।
— একটু আঁচ দাও। এত সাসপেন্স।
— অনেকটা মাল আচে। একাকী চার্জ করে যাও। আমি চাকতির ঘরে ঢুকব। ঘন্টা দুয়েক দরজা বন্ধ থাকবে। আর বলব না। চলি।
ভদি যখন উঠে দাঁড়াল তখন সরখেল দেখল হারিকেনের আলোয় ভদির যে ছায়া পড়েছে তা ফসফোরাসের ঝিকিমিকিতে দ্যুতিময়। কেঁচোর তেল থেকেও এরকম অপার্থিব আলো বের হয়। ভালটের বেঞ্জামিন ইহাকেই বলিয়াছিলেন ‘অরা’। আমরা ‘আভা’ বলতে পারি। এই আভা-কে পাঠক যেন আভাদিদির সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলেন। ফেললেই কেলো।
সেই রাতেই মদনের বাড়িতে বসে পুরন্দর ভাট তার লেখা দ্বিতীয় গানটি কমপ্লিট করল।
হব না ননদ, হব না জায়া
হব সরকারি হোমের আয়া
সুপারের সনে
যাব কচুবনে
রচিতে নধর মিলনমায়া
না রবে পিত্তি, না রবে হায়া
হয় এসপার
নয় ওসপার
দেখিবে জগৎ যুগলছায়া
হব না ননদ, হব না জায়া।
মদন গানের কথাগুলো শুনে বলল,
— তোমার দুটো গানেই দেখচি মেয়েদের হ্যাটা করার একটা ধান্দা। আমার মতো তোমারও বউ পালিয়েছে নাকি?
— বিয়েই করলুম না। বউ পালাচ্চে!
— ও তাহলে হাফসোল কেস। বুঝেচি । নাও, রাত হয়েছে। লেটে যাও।
— সেই ভালো। লেটে একবার গেলে কোনো ঝুটঝামেলা নেই।
রাত ফুরোতে বেশ খানিকটা বাকি তখনও। কালী ও বড়িলাল পাশাপাশি কালীর ঘরে মাদুরের ওপর অন্ধকারে উদোম হয়ে শুয়েছিল। বড়িলাল কাশল।
— ঘুম আসচে না?
— এসে গিয়েছিল কিন্তু চালের ওপর সড় সড় একটা শব্দ।
— ও কিছু না। বাস্তু সাপ।
— অ্যাঁ
— আরে বাবু ক্যাঁওম্যাঁও করার মতো কিচু ঘটেনি। ওকেনেই থাকেন। মাঝেমাঝে রাতে বেরোন। ব্যাঙ, ইঁদুর – যা খেলেন খেলেন, এসে আবার শুয়ে থাকেন। ভালো। এবারে ঘুমোও।
— যা শোনালি তাতে ঘুমের বাপও আর ধারেবাড়ে ভিড়বে না।
— এই নাকি তিনি কুস্তি নড়তেন। কুস্তিগির।
— কুস্তি তো মানুষে মানুষে হয়। সাপখোপ, পোকামাকড়, পিমড়ে – এসব আমার ধাতে সয় না।
— থামো তো। ওরা কেউ কিছু করবে না। যে করবে সে জানান দিয়ে গচে।
— কে?
— পুলিশের লোক। ঘরে ঘরে বলে গেচে।
— কী?
— বলেচে, দ্যাখ মাগেরা, কার ঘরে কোন খদ্দের আসচে, কী বলচে, কী আনচে সব রিপোর্ট দিতে । বড়বাবুর অর্ডার। কিছু গোপন করবিনি। তাহলে মেয়ে-পুলিশ এনে, চাবকে পোঁদের চামড়া গুইটে দেবে। বড়বাবুর হুকোম। যে সে লোক নয়।
— তুই আমার নাম বলবি?
— বলব।
— বলবি?
— থামো তো। রাত বলে ভোর হতে চলল আর ওনার বটকেরা থামে না। কেন বলব? বড়বাবু আমার ভাতার না কে? পুলিশ দেখাচ্ছে। বলি ফি মাসে গুনে গুনে টাকা নিয়ে যাস না? এমনিতেই আমাদের লজ্জাশরম কম। এমন কথা শুনিয়ে দেব যে ধন গুইটে পালাবে।
— ধর আমাকে দেখে ফেলল।
— তো কী হবে?
— বলবে, এই কালী, ডেমনী খানকি, তোর ঘরে খেলনার দোকানের বড়িলাল মৌজ মারতে আসে, শালী, বলিসনি কেন?
— আমিও চুপ করে থাকার লোক না। বলব, বড়িবাবুর ঠেঙে আমি একবেলা নগদ ধার নিয়েছিলাম। সেই টাকা শোধ কোত্থেকে করব? তো গায়ে গায়ে শোধ করে দিচ্চি। তাতে তোর তবিলে জ্বালা ধরচে কেন রে বোকাচোদা! আসুক না।
— বেশ বলিচিস কিন্তু। গায়ে গায়ে শোধ! আয় কাচে চলে আয়।
— কেন, তোমার আসতে বারণ আচে?
— থাকলেই বা মানচে কে?
পাঠক, তুমি কালীঘাটের খানকি কালীর প্রেমে পড়িতে চাও? পাঠিকা যদি হও তো কালীর সম্মানে মাথা নত করো। বরং আইস, আমরা খানকি কালীর বন্দনাতে সমস্বরে গাই, চরাচর শুনুক, দেবতা, মানুষ সকলে জানুক,
কসিয়া কোমর বান্ধে অতি মনোহর ছন্দে
অস্ত্র বান্ধে বহু যত্ন করি।
জড়ির পটুয়া আনি কাঁকলে বান্ধিল রাণী
পটি টাঙ্গি বান্ধে তারোপরি।।
পীঠেতে বান্ধিল তূণ কৈল তায় বাণে পূর্ণ
শেলশূল মুষল মুদগর।
ঝাটি ঝকড়া আনি বান্ধিলা প্রমীলা রাণী
সাজ করি হইল তৎপর।।
শ্রী চন্দনদাস মণ্ডল বিরচিত ‘মহাভারত’ হইতে সমস্বরে যখন কালীর বন্দনা ধ্বনিত হইতেছিল সেই সময়েই, রজনী তখনও আছে, ভদির চাকতির ঘরের দরজা সশব্দে খুলিয়া গেল এবং পূর্বে যেমনটি আমরা দেখিযাছিলাম তেমন নয়, অজস্র অতি সূক্ষ্ম ও প্রায় স্বচ্ছ চাকতি বোঁ বোঁ শব্দ করিতে করিতে বাহির হইয়া আকাশে উড়িয়া গেল।
(চলবে)
১৬
কবিতার (কোনো ফিমেলের নাম নয়) হাত ধরেই নাবালক বাংলা সাহিত্য, যে দিকেই হোক, এগিয়েছিল। এই পক্কড়টির সূত্রপাতেও তাই কবিতার আবির্ভাব। কবি কোনো প্রখ্যাত মিহিদানা নয়, নয় কোনো অভিমানী আন্দামান। বরং আমাদেরই প্রিয়জন পুরন্দর ভাট।
সবই আছে বাংলায় — বউ, ছুঁড়ি, আয়া
তবে কেন বিমর্ষ মুখে বসে ভায়া?
নিশিনাথ, আব্দুল — কাঁদো কেন ভাই?
চলো মোরা রামপাখি ধরে ধরে খাই।
বিশিষ্ট কেউ যদি বলেও না দেন যে এই কবিতায় ‘দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিমডিম রবে’-র মতো সাসপেন্স পাওয়া যায়নি তাহলেও আমাদের খুব একটা মুষড়ে পড়ার কারণ নেই। না হয় সেসব ফাইনার পয়েন্ট আমাদের না জানাই থেকে গেল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশে যেটুকু পাওয়া গেল তা কি কাফি নয়? সেলুকাস! তলা দিয়ে মারচ ফোকাস? যেমন নাটকীয়, তেমনই সাবলাইম। এভাবেই এগোতে হবে। দুদশ পা পিছিয়ে পড়লে ক্ষতি কী? সামনে অগাধ খাদ। বরং উল্টো দিকে দৌড় দিলে কেমন হয়? সবাক থেকে নির্বাক চলচ্চিত্রে?
— স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিট!
কে চেচাঁল? ফুয়েরার না ইয়াহিয়া খাঁ? নাকি মার্শাল জুকভ? কেউই নয়। মিলিটারি টিউনিক পরে এই চিৎকার দিয়ে চিত্রাপির্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ভদি। চেঁচানোর পরেই চোখ বন্ধ। সামনে হাজির ভক্তের দল বাকরুদ্ধ। লন্ঠনের আলো দপদপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোনো খুক খুক কাশি বা অন্যবিধ ট্যাঁ ফুঁ নেই। এই মুগ্ধ নীরবতা ভাঙল কে? মেজর বল্লভ বক্সি। তাঁর বাংলা মান্য নয়।
— ঠিক ঠিক সমঝ তো হইল না। স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিট! একটু যদি খুলেন..
— খুলব? খুলছি। … গভরমেন্ট হাই অ্যালার্ট। মোড়ে মোড়ে স্পাই। এখানেই হয়তো বসে আচে বাগড়া মারার ধান্দায়! একটাও খোঁচড় নেই এমন কোনো গ্যারান্টি দিতে পারবে ক্যাপ্টেন?
বল্লভ বক্সি মেজর ছিল কিন্তু ভদি তাকে সবসময় ক্যাপ্টেনই বলে। বল্লভ গোঁফ নাচিয়ে কিছু ভাট বকার আগেই ভক্তবৃন্দ সরব হইয়া উঠিল।
— না প্রভু। না। আমরা নিজেরা নিজেদের ওপর নজর রাখছি।
— থাকলে ঠিক আইডেন্টিফায়েড হয়ে যেত।
— আপনি নাম বলুন। কাঁচা মুন্ডু নামিয়ে দিচ্ছি।
ভদি গর্জে উঠল,
— চোপ! চোপরাও! একটা কিছু বললাম তো অমনি চেল্লাতে শুরু করল। ওরে পাগলা আমার ভক্ত সেজে কোনো খানকির ছেলে টিকে থাকতে পারত? ফেস কাটিং দেখেই ধরে ফেলতুম। দত্তবাবুর লাটে অঘোর সাধনায় তাহলে শিখলুমটা কী? আর্মির হেডকে এসব বলতে হয়। একে বলে হাওয়া গরমানো। বুঝলি! হাওয়া গরমানো। এর টেকনিক যে ধরে ফেলবে তার মার নেই।
টিনের দরজায় দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল বড়িলাল। বড়িলালকে কেউ যেন আবার আগ বাড়িয়ে নধর স্পাই বা কিম ফিলবি গোছের কিছু ভেবে না বসে। আগেই বলা হয়েছে যে বড়িলাল হল সাক্ষী। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটুক না কেন তার একজন না একজন সাক্ষী থাকবেই। অবশ্য তাকে যে মানুষ হতেই হবে এমন কোনো সরকারি নিয়ম নেই। সে একটা হাঁড়ি পাতিল বা বগিথালা বা পেদো গন্ধপাতার গাছ বা এক চোখকানা হুলো — যা কিছু হতে পারে। দুনিয়াদার নানা কৌশলে কার সঙ্গে কার যে ঘেঁষপোট করে রেখেছে তা বোঝার সাধ্যি কারও নেই। এনিয়ে অধিক উচ্চবাচ্য না করাই ভালো। কীভাবে বা কোনদিকে কেস টার্ন নেবে তা নিয়ে অনেকেই ফতোয়া দেয় এবং হেভি বেইজ্জৎ হয়ে শেষে হয় ঘাপটি মেরে দিন কাটায় বা পাড়ার লোকের কাছে গুপিবাজ বলে নাম কেনে। গুপি দেওয়া অবশ্য অন্য মেকদারের ব্যাপার। হাওড়া জেলার আমতা বলে একটা থানা আছে। এবং এই থানার আন্ডারে খিলা বরুইপুর নামে একটি ভিলেজ এখন আছে কিনা বলা যাচ্ছে না। যাই হোক, সেই গ্রামেই গোপী মোহন ও বিরাজময়ীর একটি ছেলে হয়। তখন গাম্বাট টাইপের নাম রাখার একটা কেতা চালু হয়েছিল — ছেলের নাম রাখা হল সুরেন্দ্রমোহন। এবং শিশু সুরেন্দ্রমোহন দু বছর বয়সেই মিস্টিরিয়াস কোনো অসুখে সকলকে কাঁদিয়ে টেঁসে গেল। তখন সেই শিশু মড়াটিকে নিয়ে গিয়ে প্রচলিত রিচুয়াল অনুযায়ী পুঁতে ফেলার জন্যে মাটি খোঁড়া হচ্ছে — এমন সময় শিশু মড়াটি চোখের পাতা নাড়তে থাকল এবং অচিরেই বেঁচে উঠল। গোপীমোহনের মা তখন বলেছিলেন যে এলা ছেলেকে ওষুধ না দিয়ে চরণামৃত দিতে- বাঁচলে এতেই বাঁচবে। এলা ছেলেকে এই যে ‘এলা’ (উচ্চারণ হবে অ্যালা), ‘এলা’ বলা হতে লাগল তার থেকেই শেষে সুরেন্দ্রমোহন ভায়া অ্যালামোহন লাস্টে আলামোহন হয়ে উঠলেন। ইনিই তিনি। বেঙ্গলের প্রাইড আলামোহন দাশ। এই রিয়াল লাইফ স্টোরিটি জানার পরেও ঢ্যামনা ঘুঘুর দল যদি সবজান্তার মাজাকি ত্যাগ না করে তাহলে স্পিকটি নট। প্রসিদ্ধ দাশ ব্যাঙ্কের মতো তারাও ফেল মারবে এবং বিস্তর লোককে ডোবাবে । দাশ কোম্পানী, ঘুঘু কোম্পানি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি — কোনো কোম্পানিই থাকবে না। অন্তত পূর্বোক্ত তিনটির মধ্যে দুটি এখনই নেই। তৃতীয়টি অর্থাৎ রক্তচক্ষু ঘুঘু কোম্পানি এখন কবে লাটে ওঠে সেটারই ওয়াস্তা।
ভদির লেকচার একটু এখন শোনা খুবই আরামদায়ক হতে পারে।
— গওরমেন্ট নড়ে চড়ে বসচে। বন্দুকের নলে ফুঁ দিচ্ছে। গোলাগুলি যাতে সেঁতিয়ে না যায় তার জন্য রোদ্দুরে দিচ্ছে। পাবলিককে তাতাচ্ছে। শালাদের বন্দোবস্ত আমরা ধরে ফেলেচি। অত সহজে আমাদের সাইজ করা কারও বাপের সাধ্যে কুলোবে না। তাই আমাদের এখন মতলব হয়েচে স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিটের, গুটোতে থাকব। এইসা গুটোন গুটোব যে বারো হাত কাঁকুড় প্রায় দেখা দেয় আর কি। তারপরই শুরু হবে খোলা। পুরোদস্তুর খোলতাই। লে ধড়াদ্ধড়, লে ধড়াদ্ধড়। মাথায় ঢুকেচে?
— হ্যাঁ প্রভু।
— তাই সকলকেই আগড় বেঁধে থাকতে হবে। একদিকে আড়চোখে তক্কে তক্কে থাকা, অন্যদিকে গাঁড়ভোলা গোঁসাই, কদমা কাকে বলে চেনেন না। এই হল যুক্তি। বাবা পটল।
— কর্তা!
— গঙ্গায় যা ছাড়ার কথা ছিল ছেড়েছিস।
— ও রোববারেই সেরে দিয়েচি। ছাড়া পেয়ে কী আনন্দ। দাঁড়া নাচাচ্ছে আর এ ওকে ধাওয়া করচে।
— বাঃ বাঃ এই তো। অর্ডার দিলুম। কাজ ফতে। নলেন,পটলকে ভালো করে এক গেলাস টনিক বানিয়ে দে।
টনিক খাওয়ার জন্যে পটল উঠে গেল। ভদি এমনিতে তার মিলিটারি প্ল্যানের খুঁটিনাটি বলে না কিন্তু আজ তার অন্যথা ঘটল।
— ভেবে দেখলুম ডুবোজাহাজের খরচা অনেক। খোল বানাও। ইঞ্জিন বসাও। পেরিস্কোপ লাগাও। সব করে যে নিশ্চিত হবে সে উপায় নেই। ভাঁটায় হয়তো ছাই গাদায় সেঁটে গেল। কী করবে তুমি? কিচ্ছু করার নেই। তখনই আইডিয়াটা মাথায় খেলে গেল। অমনি বুঝলাম এ বাবা স্বয়ং বাঞ্ছারাম সরকারের মাথা ছাড়া আর কোথাও আসবে না। রেডিওর মতো। তিনি বলচেন, আমি ধরচি, তোরা শুনচিস গান কি হেঁয়ালি হচ্ছে। তা যে কথা সেই কাজ। পটলের তিন পুরুষের মাছের ব্যবসা। দেখলাম ওই পারবে। বলুলম, যা রে পটল — নেনো ভেড়িতে যে ধুমো ক্যাঁকড়া হয় তার বাচ্চা এই মণটাক এনে মা গঙ্গায় মুক্ত করে দে। এই জল তো হাই প্রোটিন — রোজ অন্তত শতখানেক মরা কুকুর বেড়াল পড়চে। বস্তা করে মানুষও ফেলে। খেয়ে দেয়ে কদিনেই ডাগর হয়ে উঠবে। ব্যাস সাবমেরিনের বাবা। যেই পুলিশ জলে পা ফেলবে অমনি ক্যাঁক!
– আজ্ঞে প্রভু, জলে নামলে তো আমাদেরও কামড়াবে।
– ওইখানেই তো বুদ্ধির দৌড়। ফন্দিফিকির করে ওদের জলে এনে ফেলব। কিন্তু নিজেরা বড়জোর পাড় অব্দি। তারপর সামলাও। হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে জল থেকে হয়তো উঠল কিন্তু বাঁচবে কী করে? বেজায়গায় হয়তো কামড়ে ঝুলচে। ধুমো ক্যাঁকোড়, অনেকটা গিয়ে কচ্ছপের টাইপের। কামড়ালো তো কামড়েই রইল। এই রকম ভাবগতিক ছিল সায়েবদের বুলডগ কুকুরের। আজকাল দেখতেই পাই না। তাছাড়া হেগো বাঙালি বুলডগ খাওয়াবার মুরোদ কোথায় পাবে। ডেলি দেড় কেজি, দুকেজি গরুর মাংস খাবে। থ্যাবড়া মুখ। দেখলেই পিলে উড়ে যাবে। বুলডগ পুষবে। তাই দেখি ভাতার, মাগ সব আজকাল শাদা শাদা শেয়ালের বাচ্চার মত কী একটা নিয়ে ঘুরছে, হাগাচ্চে। সবকটা দেখতে একরকম। বাজারের মুরগির মতো।
বড়িলাল আড়চোখে দেখেছিল গলির থেকে ছায়াটা এগোচ্ছে। এই মোড় ঘুরল বলে। ঘুরে তো গেলই। তখনই বড়িলাল মোতা শেষ করার অ্যাক্টো করে প্যান্টের জিপ টেনে রওনা দিল। গোলাপ ও বড়িলাল ত্যারচা মুখোমুখি হল। কার কেমন ব্যাটারির জোর তা টুক করে মাপামাপিও হয়ে গেল। ছায়ায় ছায়ায় টক্করে এরকমই হয়। গোলাপ বুঝে গেল মালটা নাটা কিন্তু সাঁটিশ। বড়িলালও টের পেল যে একটু পেটের দিকে বেড়ে গেলেও খোকন একসময় ডনফন টেনেছে।
গোলাপের ট্রেইনড চোখ। দরজার কাছে পেচ্ছাবের নদ বা হ্রদ কিছুই চোখে পড়ল না। টিনের গায়ে ধাক্কাতে নলেন দরজা খুলে দিল। ভক্ত সমাবেশে তখন অধিবেশন শেষের দোলাদুলি শুরু হয়েছে।
— কী করচ নলেন ভায়া, দোরগোড়ায় এনিমি ওয়াটার মাইনাস করে পালাচ্ছে, কিছু করতে পারচ না?
নলেন দৌড়ে বাইরে দেখতে গেল। অথচ দেখার মতো কিছুই নেই। একটা বেড়াল রাস্তা পেরোচ্ছে। সে নলেনকে চোখ মারল। এবং গোঁফ নাচিয়ে সেই হাসি হাসল যাকে বিশ্বকবি বলেছিলেন ‘মুচুকি’।
— গোলাপ! আমার গোলাপবাগ, আয়রে বুকে আয়।
ভদির সঙ্গে জড়াজড়ি করে দেখা গেল গোলাপ কানে কানে কি যেন বলছে। ভদি চেঁচিয়ে উঠল,
— সরখেল, গোলাপ বলচে খেল জমে গেচে। জমে ক্ষীর হয়ে গেচে।
সরখেল তড়বড় করে এগোয়।
— বলো কী!
এরপরই সরখেল, গোলাপ ও ভদি যারপরনাই আনন্দে টইটম্বুর হয়ে একটা ঘরে (চাকতির ঘর নয়) ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল এবং দরজার সামনে ক্রেমলিন গার্ডদের মতো নলেন দাঁড়িয়ে গেল। শিষ্যবর্গকে সাময়িকভাবে বিচলিত করে ঝটপটিয়ে দণ্ডবায়স এসে পড়তে নলেন দরজা একটু ফাঁক করল এবং বৃদ্ধ কাকটি ভেতরে গ্যারেজ হয়ে গেল।
শিষ্যবর্গ তখন হাউসকোট পরা বেচামণির হাত থেকে একটি একটি করে নকুলদানা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে। মেজর বল্লভ বক্সি নকুলদানা নেওয়ার সময়ে বেচামণিকে আগে স্যালুট করে নিল। ফাঁকা উঠোন। বেচামণির হাত থেকে নকুলদানার থালাটি পাক খেয়ে উড়ে গেল। বাতাস এসে টগরগাছে এমন বেহালার ছড় টানল যে মুহূর্তে উঠোনটি ভিয়েনার নৃত্যাঙ্গনে পাল্টাল ভোল। বেজে উঠল ব্লু দানিয়ুব। আহা কী তালে তালে ফেলে পা বেচামণি আগুপেছু করে। নলেনের চোখদুটি কাচেরই বলে ভুল হয়ে যেতে পারে। দু পা ফাঁক। হাত কোমরে। সামরিক তো বটেই, তদুপরি জালি গামছা পরা।
গোলাপ যে টপ সিক্রেট সফল অপারেশন লোবোটমির কথা ভদি, সরখেল ও দাঁড়কাককে বলছিল তা আমরা তার মুখেও শুনতে পারি। কিন্তু রহস্যময় কোনো তৃতীয় পক্ষের বয়ানই হয়তো বা ঘটনাটির সমকক্ষ হওয়ার মতো পালোয়ান।
সকালেই সেদিন সি. এম-এর ঘরে বঙ্গীয় বণিক সভার প্রতিনিধিবর্গের আসার কথা ছিল। বিষয় বরাবরের মতোই, হলদিয়া পেট্রোকেম এবং বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান তিতিবিরক্ত ও বেপরোয়া মনোভাব, হোসিয়ারি শিল্পে নিউ গিনি ও পাপুয়ার সঙ্গে যৌথ গবেষণা গড়ে তোলা ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঁউরুটি ও চানাচুর শিল্পে আশ্চর্য অগ্রগতি সম্বন্ধেও আলোচনা হতে পারত কিন্তু পারল কই? আলোচনা বানচাল হয়ে গেলে কেমন এক ট্র্যাজিক সুর যেন বেজে ওঠে। আলোচনা যে কেন ভেস্তে যায় এ নিয়ে এক নিরবচ্ছিন্ন লাগাতার সেমিনার কেন যে হয় না তা নিয়ে বিলাপ করার অধিকার আছে কি?
বঙ্গীয় বণিকসভার নেতৃবৃন্দ যে পরিকল্পনাটি করেছিলেন তা বড়ই রমণীয় বললে কমই বলা হয়। পিয়ারলেস ইন থেকে প্রাতরাশ সেরে কিছুক্ষণ আড্ডা মস্করা ও বটকেরার পর ঠিক হয় যে বিশিষ্ট শিল্পপতিরা ব্যাটারি চালিত বাসে করে রাইটার্সে যাবেন। ব্যাটারি-চালিত বাস এই বার্তাই চারদিকে রটনা করবে যে পশ্চিমবঙ্গ দূষণমুক্ত শিল্পায়নের পথে আগুয়ান — চিমনি দিয়ে বিকট কালো ধোঁয়া ছেড়ে আবহমান বাংলার শকুন, চিল ও বকবার্ডদের বারোটা বাজানো হবে না, নির্মল জলে রাসায়নিক হুলিয়া জারি করে খলসে, তেচোখা ও পুঁটিমাছদের ঝাড়েগুষ্টিতে লোপাট বন্ধ থাকবে এবং আশা করা যায় যে বিকট গন্ধময় গ্যাস ছাড়ার যে অভ্যাস বাঙালি রপ্ত করেছে তাতেও কিছুটা ভাঁটা পড়বে। ভাগ্যে ব্যাপারটা মি. বিলিমোরিয়ার মাথায় খেলেছিল এবং তিনি তা মি. সেন বরাটকে কানে কানে বলেন। মি. সেন বরাট তখন মি. ন্যাওটাকে বললেন ব্যাপারটা। ব্যাটারি-বাস রাস্তায় যে কোনো সময় কেলিয়ে পড়তে পারে। তাই নিজ নিজ মোটরযানগুলিও যেন রেডি থাকে। ধন্য মি. বিলিমোরিয়ার সন্দেহ! শিল্পপতিদের দূরদৃষ্টি যে কত জোরালো তা পুনরায় প্রমাণিত। গ্রেট ইস্টার্নের সামনে হঠাৎ ঘঁক ঘঁক শব্দ করে ব্যাটারি বাস কেলিয়ে পড়ল। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। পুলিশরাই দল বেঁধে রাইটার্সের দিকে মিছিল করে কাউকে ক্যালাতে চলেছে বলে কেউ ভুলও করতে পারত। অতএব মি. ন্যাওটা গিয়ে নিজস্ব কোয়ালিস, মি. বিলিমোরিয়া নিজস্ব মার্সিডিজ ও মি. সেন বরাট নিজস্ব সিয়েলোতে উঠতে বাধ্য হলেন এবং এঁদের দেখাদেখি অন্যান্য শিল্পপতিরাও নিজের নিজের টাটা সুমো, ওপেল করসা, ভলভো, মারুতি সুপ্রিম, অ্যাম্বাসাডর ইত্যাদিতে উঠে পড়লেন। গাড়ি ও পুলিশের শোভাযাত্রা এগিয়ে গেল এবং দূষণমুক্ত ব্যাটারি বাস পড়ে থাকল। দু পাশেই উৎসাহী লোকেরা এসব দেখছিল ও মুখ খারাপ করছিল।
— কী রে, চড়বি ব্যাটারি বাসে?
— বাল চড়বে। শালা চলেই না। ধ্বজামাল।
— দাদা, কটা ব্যাটারি লাগে?
— আপনার মতোই দুটো।
— দিল তো, ট্র্যাফিকের গাঁড়টা মেরে। এমনিতেই বলে জাম্প লেগে আছে।
— পুরো বোকচোদ কেস। পোঁদে নেই ইন্দি, ব্যাটারি মারাচ্ছে।
— ফাকিং শিট! হোয়াট ফাকিং মেস ইয়ার!
পাবলিক এসব বলবেই। বলুক। চলৎশক্তিহীন ব্যাটারি বাসের কাছে ক্যালানের মতো দাঁড়িয়ে এইসব অসাধু মন্তব্য শুনে গেলে আমাদের চলবে না। মড়া যাদের ঘাড়ে তারা এগিয়ে যাবেই। যেমন আমরা।
সি. এম-এর আগেই কমরেড আচার্যকে বলেছিলেন যে আলোচনায় তিনিও যেন থাকেন। কিন্তু কমরেড আচার্য গাঁইগুঁই করছিলেন।
— ও স্যর, ক্লাস এনিমিদের সঙ্গে কেন আমায় ডাকেন আপনি। ওই সব ন্যাওটা ফ্যাওটা … জানেনই তো। আমার অলমোস্ট অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন হয়।
— থামবে? ন্যাওটা কি গলদা চিংড়ি না ডিম যে তোমার অ্যালার্জি হবে। সব ব্যাপারে তোমার ওই অর্থোডক্সি। এই করেই গেলে। কাল তুমি আলোচনায় থাকবে। আমার তোমাকে দরকার।
— ওবেলা তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে। তখনই ফাইনাল করা যাবে।
— ওবেলা তোমার সঙ্গে আমি দেখা করব মানে? সে আবার কী?
— আহা, ও বেলা তো আপনি নাট্যোৎসব ইনগুরেট করছেন।
— হোয়াট!
— নাট্যোৎসব। ড্রামা ফেস্টিভাল।
— ও হ্যাঁ, কিছুই মনে থাকে না আজকাল। নাটক-ফাটক কেন যে এসব ননসেন্স ব্যাপারে আমাকে জড়াও।
— তা বললে কী করে হয়।
— দ্যাখো। তোমাদের ওই এখনকার ওসব দেখলে গা জ্বলে যায়। যে সব পারফরমেন্স দেখেছি … ওফ। গিলগুডের হ্যামলেট। বুঝলে? তারপর গিয়ে অলিভিয়ার। এরপর ওই স্টুপিডিটি — ইনটলারবেল। আমি যাব। ফিতে কাটব। ব্যাস …
— আজ্ঞে ফিতে কাটা নয়, প্রদীপ জ্বালাবেন।
— ওই হল, অল দা সেম। তারপরেই আমি আর নেই। নট পসিবল।
দমাস করে রিসিভারটা রেখে দিলেন সি. এম। কমরেড আচার্যও বুঝলেন যে কোনোভাবেই আগামী কালের মিটিংটায় গরহাজির থাকা চলবে না। কোথায় পরিত্রাণ? কমরেড আচার্য দেওয়ালে কমরেড লেনিনের দিকে তাকালেন। লেনিনের ছবির পেছন থেকে ছোট সাইজের একটি টিকটিকি দেয়াল বেয়ে দৌড়তে থাকল এবং জায়েন্ট টিকিটিকি তাকে তাড়া করতে লাগল। কমরেড আচার্য স্বগতোক্তি করলেন,
— ডিসকভারি চ্যানেল। একেবারে ডিসকভারি চ্যানেল? মার্ভেলাস।
রাইটার্সের তলায় যে কনস্টেবলরা থাকে তার মধ্যে একমাত্র নক্ষত্রনাথ হাওলাদারই লক্ষ করেছিল যে , ফুলের তোড়া হাতে যে শিল্পপতিরা বিচক্ষণ ও ভারালো পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে তাদের চোখ স্বাভাবিক নয়। প্রত্যেকেরই দুটি করে চোখ যা দেখছে তা দেখছে না, যা দেখা যায় না বা যাবে না সেদিকেই নিবদ্ধ। হাওলাদার তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্তে পোঁছে গেল যে দিনের আলো ফুটল কি না ফুটল অমনি শুরু হল চুক চুক বিজনেস। হাওলাদারের সঙ্গে অধিকাংশ ঐতিহাসিকরাই একমত নন। তাঁদের মতে সেইদিন সকালে বাংলার শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিরা যে যে লিকুইড খেয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল ত্রিফলা ডোবানো জল, চা, কফি, হরলিক্স, নিম্বু-পানি ও অ্যাপল জুস। ঐতিহাসিকরা হয়তো ঠিক কিন্তু আমাদের বিকৃত সহানুভূতি বারবার হাওলাদারের দিকেই হেলে পড়ছে। বাঙালির সত্যানুসন্ধান এইভাবে ইতিহাসেও বারবার কার্ণিক খেয়ে গোঁত্তা মেরেছে। সবকিছু আমাদের হাতে নয়।
সি. এম-এর ঘরে সি. এম তো থাকবেনই, এছাড়া ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব, কমরেড আচার্য, অর্থমন্ত্রী, শ্রমিক দপ্তরের মন্ত্রী এবং মৎস ও মুরগির মন্ত্রী যাঁর সঙ্গে কমরেড আচার্যের সম্পর্ক মোটে ই সাবলীল নয়। আই. জি আউট অফ স্টেশন। অ্যান্টি টেররিস্ট ব্যবস্থা স্টাডি করার জন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। অতএব সি. এম আই. জি-র পরের অফিসারদের বাইপাস করে ‘নগরপাল জোয়ারদারকে ডাকা করিয়ে নিয়েছেন। জোয়ারদারের মাথায় হেলমেট কারণ তা না হলে বিচ্ছিন্ন মাথাটি বৃন্তচ্যুত বাতাবি লেবুর মতো ধপ করে পড়ে ভীতিজনক বাতাবরণের সৃষ্টি করতেই পারে।
মি. বিলিমোরিয়া লাল গোলাপের তোড়া আলতো করে সি. এম-কে এগিয়ে দিলেন কারণ তলায় মোড়া রাংতা ফুঁড়ে কাঁটা বেরোচ্ছিল। জীবনে বহু গোলাপের তোড়া নিয়েছেন সি. এম। নিতে হবে ভাবলেই গা জ্বলে যায়, কিন্তু উপায় নেই। সেই হাসি তাঁর মুখে যা অতীতে কখনও হাসা আরম্ভ হয়েছিল এবং মাঝে মাঝে ফিরে আসে। এবারে তোড়া-দান সারলেন মি. ন্যাওটা। তারপর সেন বরাট। পরপর সবাই তোড়া ধরবেন বলেই প্ল্যান ছিল কিন্তু পেছন থেকে জুট ব্যারন মি. ঢোলোকিয়ার বাজখাঁই কন্ঠ ফেটে পড়ল,
— ওসব ফুল খেলা করিবার দিন আজ নয়, কবুল করুন যে মিলিট্যান্ট ওয়ার্কারদের উপর দমদম বুলেট ফায়ারিং হোবে — দনাদ্দন, দনাদ্দন একটা লাশ পড়ল — ধপ — আউর ভি এক ধড়াস — লাশ — ফায়ারিং — দনাদ্দন — দনাদ্দন …
সি. এম বিস্মিত এবং হতবাক। জোয়ারদারের মুখ ফ্যাকাশে। কমরেড আচার্য গজরে উঠলেন,
— নো পাসারান, শান্তিপূর্ণ শ্রমিক আন্দোলনের ওপরে ফায়ারিং, এবং সেটাও দমদম বুলেট দিয়ে, আপনি কোথায় কাদের সঙ্গে কথা বলছেন জানেন মি. ঢোলেকিয়া?
মি. ঢোলেকিয়ার মুখে স্বর্গীয় হাসি। র সিল্কের সাফারি সুটটিও যেন হাসির রঙে মাতোয়ারা।
— প্রপার্টি কি সমঝেন? প্রপার্টি হইলো থেফট। লেবর পাওয়ার হইল একটি পণ্য। ইহা মজুরীভোগী শ্রমিক ক্যাপিটালকে বিক্রয় করে। কেন করে? বাঁচিবার জন্য। তাহাকে আপনারা কতদিন বঞ্চিত করিবেন, কতদিন দাবাইবেন? জালিমশাহী নেহি চলেগা …
সমস্বরে অন্য পুঁজিপতিরাও হুঙ্কার ছাড়িলেন,
— নেহি চলেগা। নেহি চলেগা।
— তানাশাহী নেহি চলেগা!
— নেহি চলেগা। নেহি চলেগা।
অর্থমন্ত্রী উচ্চশিক্ষিত। মান্য ভাষা বাদে কিছুই তাঁর মুখে আসে না। সেই তিনিই বলিয়া ফেলিলেন,
— লে হালুয়া!
সি. এম বলেছিলেন,
— এসব জিনিস কী হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কমরেড আচার্য উসকোখুসকো চুল ঠিকঠাক করতে করতে বললেন,
— ভেরি ষ্ট্রেঞ্জ! উইয়ার্ড! বিজার!
মি. বিলিমারিয়া সোবার কন্ঠে বলিলেন,
– অহ, মি. ঢোলোকিয়া, যা বলতে চান লজিক্যালি বলুন, শান্তভাবে বলুন, ভুলবেন না যে উই হ্যাভ গ্রেভ সোশাল রেসপনসিবিলিটি।
মি. ঢোলোকিয়া আড়চোখে মি.বিলিমোরিয়াকে দেখতে দেখতে হিস হিস করে উঠলেন।
– ব্লাডি ক্যাপিটালিস্ট পিগ!
সি.এম প্রায় বাধ্য হয়ে বলে উঠেছিলেন
— আহ, মি. বিলিমোরিয়া, আলোচনা এগোক।
বিলিমোরিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মহলে টি-ম্যাগনেট বলে সর্বজনবিদিত।
— দার্জিলিং অ্যান্ড সারাউন্ডিং থেকে যে রিপোর্ট আমি ডেলি পাচ্ছি স্যর তা খুবই অ্যালারমিং। ওয়ার্কাররা ইমপোর্ডেড সব মেশিন, যেমন ধরুন ড্রাইং মেশিন সব ড্যামেজ করছে। ম্যানেজারদের কোনো ভয়েস নেই। প্রোডাকশন লেভেলে এত বেশি ডিসরাপশন নিয়ে কোন সাহসে আমরা বিগ এক্সপোর্ট অর্ডারগুলো অ্যাকসেপ্ট করব বলতে পারেন?
মৎস্য ও মুরগির দপ্তরের মন্ত্রীটির বয়স কম। ফড় ফড় করে বলে ওঠেন —
— রাশিয়ানরা এখনও আপনাদের চা কিনছে? কাউন্টার রেভলিউশনের পর?
— কিনছে কিছু কিছু তবে আগের মতো নয়।
সি. এম ছোকরা মন্ত্রীটির ওস্তাদি মোটেই রেলিশ করেননি।
— রাশিয়ানরা চা খেল কি না খেল উই কেয়ার আ ফিগ। ইরেলেভেনট কথা কেন যে বলো? মি. বিলিমোরিয়া, আপনি বলে যান…
– বলছি স্যার, কিন্তু তার আগে আপনার ফিশ অ্যান চিকেন মিনিস্টারকে একটু এডুকেট করা দরকার। খুব তো রাশিয়ায় কাউন্টার রেভলিউশন মারাচ্ছো। রাশিয়ান রেভলিউশনারি স্ট্রাগেলের হিস্ট্রি জানো?
— জানি বলেই তো শুনতে পাই।
— একটি থাবড়া মারব টি-ব্যাগের মধ্যে ঢুকে যাবে। ক্যাপিটালিজমের ডেঞ্জার ইন রাশিয়া কে প্রথম বুঝেছিল বলতে পারবে?
— লেনিন।
— ১৮৭৪ সালে লেনিন? চার বছরের বাচ্চা ছেলে। এই ডেঞ্জারটাকে হেরজেন বা বাকুনিন তেমন আমল দেয়নি। প্রথম এটা বুঝেছিল ৎকাচেভ — নাম জানো? জানো না। তাঁর চটজলদি বিপ্লবের আহ্বান নিয়ে এঙ্গেলস-এর সঙ্গে ডিবেট পড়েছ? ওই ৎকাচেভ-এর সঙ্গে প্লেখানভকেও তর্কযুদ্ধে নামতে হয়েছিল। কিন্তু যার যা ডিউ তাকে তো সেটা দিতে হবেই। দ্যাখো ছোকরা, ইতিহাস কিন্তু একটাই এবং সেটাই সত্যি। পড়ো, পড়ো, সব পড়ো। হাবভাব দেখে তো চ্যাংড়া ফক্কড় ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। যাইহোক, স্যার ফরোয়ার্ড মার্কেটস কমিশন যে ফিউচার্স ট্রেডিং করবে ভাবছে সে বিষয়ে … কয়েকজন শিল্পপতি চেঁচিয়ে উঠলেন,
— কমরেড ট্রটস্কি লাল সেলাম। লং লিভ দা রেড আর্মি।
— মাং রহা হায় হিন্দুস্তান।
— লাল কিল্লা পর লাল নিশান।
মি. ন্যাওটা হঠাৎ বিকট চেঁচিয়ে গান ধরলেন,
— কালি কালি আঁখে
গোরে গোরে গাল …
সি. এম চেঁচিয়ে উঠলেন,
— রোগস! স্টপ ইট। স্টপ! ফোর্স বুলাও।
জোয়ারদার, স্টুপিডের মতো দাঁড়িয়ে কী দেখছ? ফোর্স ডাকো। নিয়ে যাক এগুলোকে।
তখন সেন-বরাট ভরাট গলায় চেঁচাচ্ছেন,
— দুনিয়ার পুঁজিপতি এক হও!
— এক হও! এক হও!
— শিল্পে সরকারি খবরদারি চলবে না!
— চলবে না! চলবে না!
— পুঁজিপতিদের কালো হাত!
— ভেঙে দাও! গুঁড়িয়ে দাও!
(চলবে)
১৭
পাঠকপ্রবর, আজ অবধি কখনো শুনিয়াছ যে নভেল বলিয়া বাজারে যাহা চলে তাহা লঘু ত্রিপদী ছন্দে গান গাহিতেছে। ধরা যাউক যে ‘কাঙাল মালসাট’ একটি বালবিধবা হিন্দু যুবতী। আরো ধরা যাউক যে সারাদিন ধরিয়াই টপটপ আঁখিজলে বক্ষদেশ ভাসাইয়া সে বিকাল সন্ধ্যার সন্ধিলগ্নের সেই যাদুমন্ডিত জিন, হুরি, গবলিন ইত্যাদির জাগরকালে গান ধরিয়াছে,
জানিনা লো দিদি, কোন দোষে বিধি,
এই কুলাঙ্গার কূলে।
মোরে পাঠাইয়া, রাখিল গাঁথিয়া,
বিরহ বিশাল শূলে।
এইমত ট্র্যাজিক অবস্থায় আসিয়া পড়িল ‘কাঙাল মালসাট’। তাহাকে সাহারা দিবার কেহই নাই। থাকিলে সে এই গান না গাহিয়া হয়তো গাহিয়া উঠিত, ‘মেরি নাম চিন চিনচু’ বা ‘হাওয়ামে উড়তা যায়ে’… কিন্তু উপায় কই? তাই সে কোনো ধর্মান্ধ রাম-খচড়া রচিত ‘বিধবা-গঞ্জনা’ নামক ‘বিষাদ-ভান্ডার’ হইতে ওই গানটাই কাঁদিয়া উঠিল। সরলা ও তরঙ্গিনী নামধারী দুই বিধবার বিলাপ ওই দুষ্প্রাপ্য ভান্ডারের পত্রে ছত্রে কান্না হইয়া ঝরিতেছে।’ তপস্বী ও তরঙ্গিনী’-র সহিত এর কোনো যোগবিয়োগ নাই। যেমন নাই আনন্দবাজার পত্রিকার সহিত ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত যাদুকর আনন্দ-র বিজ্ঞাপনের যার মাধ্যমে তিনি ”বেঁটে মানুষ” চাহিয়াছিলেন। তবে আমাদের বিচারবুদ্ধি আর কতটুকু গা? এই জগতের ধন্দময়তায় দিশেহারা আমরা ভাবিতেছি যে বাজার সরকার, রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, কোম্পানির সরকার — ইহারাই সর্বেসর্বা। ইহারাই গোদা। কিন্তু ইহাদেরও ওপরে অপারেট করিতেছে অন্য কোনো সরকার। তাহার কেচ্ছা শুরু করা হয়তো যায় কিন্তু শেষ করা যায় না। জাহাজের খবর। সে জাহাজই বা কেমন? জলজাহাজও নয় আবার উড়োজাহাজও নয়। তবে?
সি.এম-এর নির্দেশমতো ফোর্স এসেই বিশিষ্ট শিল্পপতিদের নিয়ে যায়। বলাই বাহুল্য যে এঁদের মতো মান্য ব্যক্তিদের লালবাজারের লক-আপে নিয়ে গিয়ে আড়ং ধোলাই দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সি.এম-এর বিচক্ষণ নেতৃত্বেই যা করার তা করা হয়। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় রায়চকের হোটেল র্যাডিসন ফোর্টে। সেখানে এঁদের প্রথমে টপ টু বটম পরীক্ষা করেন স্বনামধন্য ডঃ ক্ষেত্রী। তিনি বললেন যে প্রত্যেকেই নরম্যাল। নরম্যাল পালস, নরম্যাল প্রেসার, নরম্যাল স্টুল, নরম্যাল ইউরিন। হতে পারে পাগলছাগল। কিন্তু সেটা ধরা ডঃ ক্ষেত্রীর আওতায় নয়। এরপর এলেন বাংগুর ইনস্টিটিউটের একটি বিশেষজ্ঞ দল। সঙ্গে চারজন বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, তাঁদের সঙ্গে নানাবিধ জটিল যন্ত্র। এলেন লাই ডিটেক্টর নিয়ে একজন মারাকু। এঁদের বাঁধভাঙা পরিশ্রমই এনে দিল সেই সাফল্য যার ফলে রহস্যের চাবিকাঠি ঘুরল বটে কিন্তু যা জানা গেল তা অতীব ভীতিজনক। সেই বিশাল রিপোর্ট পড়ে কারও পক্ষেই শেষ করা সম্ভব নয়। তাই ছোটো করেই মালটা সাইজ করতে হবে। সি.এম-ও এই মর্মেই খিঁচিয়ে উঠেছিলেন,
— নো বিটিং অ্যাবাউট দা বুশ, নো ঝোপঝাড়, মোদ্দা ব্যাপারটা কী?
রিপোর্টের সারাৎসার হল, কোনো অজানা পদ্ধতিতে এক রাতের মধ্যেই এঁদের প্রত্যেকের মাথায় লোবোটমি করা হয়েছে এবং শুধু তাই নয় — এঁদের মাথায় যা থাকার কথা নয় সেইসব নানাধরনের র্যাডিকাল চিন্তা ও তথ্য, সাজেশন বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এঁরা প্রত্যেককে দেখতে এক পিস করে হলেও এঁদের মধ্যে দুটি করে শিবির সক্রিয়। একটি ক্যাপিটালিস্ট, অন্যটি বিপ্লবী বা ওই গোছেরই কিছু একটা — মার্কসবাদী, স্তালিনপন্থী, নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কো সিন্ডিকালিস্ট, ট্রটস্কিপন্থী বা বার্নস্টাইন মার্কা, দুবচেক-ঘেঁষা, টিটোপন্থী, মাওবাদী — নানা ধারাই রয়েছে।
কিন্তু লোবোটমি ব্যাপারটা কী?
মস্তিষ্কের মধ্যে অস্ত্রোপচার করে দুভাগে ভাগ করা দেওয়াই হল লোবোটমি বা লিউকেটমি। এঁদের করা হয়েছে প্রি-ফ্রন্টাল লোবোটমি। মস্তিষ্কের সামনের অংশগুলির নিজেদের মধ্যে ও তাদের সঙ্গে থ্যালামাসের যোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। চার-এর দশক ও পাঁচ-এর দশকের গোড়ায় ক্রিমিনালদের ঠান্ডা করার জন্য এই জাতীয় বিস্তর অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল মার্কিন দেশে। এখন প্রায় হয় না বললেই চলে কারণ অনেক জবরদস্ত ওষুধ বেরিয়েছে। এ বিষয়ে ডব্লিউ.এল. জোন্সের ‘মিনিস্টারিং টু মাইন্ডস ডিজিজড’ (১৯৮৩) বইটিতে সব তথ্য দেওয়া আছে। এই বইটিতে যদি না মেটে সাধ তাহলে ‘স্লিট ব্রেন রিসার্চ’ সম্বন্ধে স্পেরি ও অর্নস্টেইন-এর কর্মকৃতিত্ব ঘাঁটা যেতে পারে। এঁরাই দেখেছিলেন যে এই অস্ত্রোপচার হয়েছে এমন এক স্বামীর আজব কারবার। ডানহাত দিয়ে তিনি বউকে কাছে টানছেন এবং বাঁ হাত দিয়ে দূর করে দেবার চেষ্টা করছেন। এটা অবশ্য মানতেই হবে যে লোবোটমি করা হয়নি এরকম বহু বাঙালিই অনুরূপ দ্বান্দ্বিক আচরণ করে থাকে। মিনসেদের এ জাতীয় খেলকুঁদ আজকাল আবার দার্শনিক তাৎপর্যও পায়। সবই নাকি গূঢ়তম কারণে ঘটে। সবই নাকি গভীর অসুখ। টোপাকুলের ডাল দিয়ে বেধড়ক চাবকালেই কিন্তু সবটা না হলেও অনেকটা ঢ্যামনাগিরি হাওয়া হয়ে যাবে।
যাহাই হউক, পাঠকের কী স্মরণে আছে যে পনেরো না ষোলো অধ্যায়ের অন্তে কী ঘটিয়াছিল। কোট করা যাউক — ‘ … ভদির চাকতির ঘরের দরজা সশব্দে খুলিয়া গেল এবং পূর্বে যেমনটি আমরা দেখিয়াছিলাম তেমন নয়, অজস্র অতি সূক্ষ্ম ও প্রায় স্বচ্ছ চাকতি বোঁ বোঁ শব্দ করিতে করিতে বাহির হইয়া আকাশে উড়িয়া গেল।’ এবার কি আঁচ করা যাচ্ছে যে অতীব চুলচেরা লোবোটমি কাদের কাজ? এবারে কি বোঝা যায় যে গত পক্কড়ে গোলাপ ‘সফল অপারেশন লোবোটমি’ বলে কী বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। এর আগে আমরা বড় সাইজের চাকতিকে অক্লেশে ও বিনা রক্তপাতে মুণ্ডু, হাত, পা সবই আলাদা করতে দেখেছি। এবারে দেখা গেল ব্রেন অপারেশনের মতো ঝকমারি কাজও অধিকতর ফাইন চাকতি দিয়ে করা যায়। আরও ফাইন চাকতি হয় যা অদৃশ্য ও শব্দহীন। এরা স্বপ্নজগতের নানাবিধ কাটাছেঁড়া করে এমন কোলাজ বানাতে পারে যার সঙ্গে তুলনীয় কিছুই হতে পারে না। সর্ববিধ ছেদন ও বিভাজনে চাকতিদের অনায়াস দক্ষতা বিস্ময়কেও ছাপিয়ে ওঠে। আধুনিক জীবনধারার একটি গুরুতর বৈশিষ্ট্য হল চড়া আলোয় বসে কৃত্রিম উত্তাপের ওম প্রথম ও শেষ আয়ত্ত বলে মনে করা। কফিনের মড়া যেমন ওই বাক্সটিকেই তার বিশ্রাম কক্ষ ও শেষ বাস্তবতা জেনে আরামে শয়নে থাকে। নিজের পচনও তার কাছে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কাঠ পচে মাটিতে মিশছে, মাটি ছড়িয়ে রয়েছে জলে ও পাথরে, তার ওপরে নিরন্তর আছড়ে পড়ছে মহাজাগতিক রশ্মি ও এইসব নিয়ে এক আনন্দপৃক্ত সার্কাস, তার এই ধরা এই ছেড়ে দেওয়া ট্রাপিজ, এরই মধ্যে কোথাও কোথাও ক্লাউনের পোশাক পরে প্রতীক্ষায় থাকা লেখকদের আত্মা, ডিক্টেটারদের লৌহ-ভূত, নর্তকীদের সলাস্য ঘুরপাক ও নিবিষ্ট পোকাদের স্তম্ভিত গম্ভীর প্রেতজীবনে প্রবেশ ও প্রস্থান — এ কি এক আশ্চর্য প্রদত্ত নয়? এরই মধ্যে কী সেই সম্ভাবনা নেই যাকে আমরা এখনো শব্দে প্রকাশ করতে অপারগ? পণ্ডিত বা বিদগ্ধ বলে কিছুই নেই। আছে বিভিন্ন মাপের বোকা ও তারও বেশি বেশি কিছু।
এরই মধ্যে ভদির ভর হল। একদিকে রাজ্য সরকারের যুদ্ধ প্রস্তুতি, গুমটিতে গুমটিতে সাজো সাজো রব, জি. ও. সি-ইন সি, ইস্টার্ন কম্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব ও অপরপক্ষে সরখেলের কালান্তক গর্ত খোঁড়া, ফ্যাতাড়ুদের টুকটাক খুচরো হারামিপনা, বেগম জনসনের সঙ্গে বৃদ্ধ দাঁড়কাকের বুড়ো বয়সের রোমান্সজাতীয় কিছু আলগা হুঁ হুঁ, ভদি-ভক্তদের ক্রমবর্ধমান উদ্দীপনা, গোলাপের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, কলকাতার সি. আই. এ, এম. আই ফাইভ, আই. এস. আই ও এফ. এস. ভি দপ্তরে ধোঁয়া ধোঁয়া আকাঙ্খা — এই দুই বিপরীত ও আনুষঙ্গিক থার্ড পার্টি নড়নচড়নের মধ্যেই ভদির ভর হল।
ন্যাংটো ভদি তার একতলার ছাদে, আলশের ধারে দাঁড়িয়ে ভুঁড়ি চাপড়াতে চাপড়াতে নানারকম ভালগারিটির বন্যা বইয়ে দিতে লাগল যার মধ্যে অবশ্য কিছু অন্য কথাও ছিল। আমরা তার অসংলগ্ন ও অকথ্য সংলাপের মধ্যে যেটুকুমাত্র মান্য ও শালীন বলে ছাড় পত্র পেতে পারে সেগুলোই বরং জেনে নেব কারণ আধুনিক নভেলের একটি নভেলটি হল নানা তথ্যের একটি ঘাপলা তৈরি করা যার মধ্যে অধিকাংশই হল ফালতু গ্যাঁজা। অনেক সময় আবার তথ্যের বদলে এমনই একটি দার্শনিক দার্শনিকভাব করে নন-স্টপ গ্যাঁজানো চলতে থাকে যে এই ভাটানোকে মহামূল্যবান মনে করে অনেকেই বমকে যায়। ‘কাঙাল মালসাট’ দু নৌকোতেই ঠ্যাং নাচাবে। ভাগ্যে যার সলিল-সমাধি সে অন্যরকমই বা করতে যাবে কেন?
ভদি ভরের বশে বলেছিল,
১) ঐ কর … দিন নেই, রাত নেই টিভির বাক্স খুলে মানষির পালের গাঁড়দুলুনি নাচ দ্যাখ … হবিষ্যিও হবে না, মালসাও কেউ জলচুবুনি করবে না … গাঁড় দুলচে … আহারে আমার বাঙালির ঠাকুর্দার ঝাড় দুলচে … গেল, রোল-মুরগি গেল আর ঐ দ্যাখ … থেকে থেকে হাওয়া খেলিয়ে নে, ফ্যান ছেড়ে হাওয়া খেলা, পেন্ডুল দুলচে … ওরে আমার রাসবাড়ির ঝুলন রে, ওমা, গোপালের মুখ আমার গরম দুধে পুড়ে লাল, হোল রেস, হোল রেস, হোল! হোল!…
২) খলখলে করে দেবে গো, গরিবগুলোর গাঁড় মেরে একেবারে খলখলে করে দেবে, হাওদা করে দেবে .. গরিবদের ওই ঠাটবাট সহ্য হচ্ছে না, গরিব যে আমার বেড়ালমামারে … এদিক ওদিক দুদিক চেয়ে চুমুক মারো দুধের বাটি… গওরমেন্ট দেখেচে গরিবের গাঁড়ে মধুর চাক… একেবারে ভূতোমোল্লার খাল করে ছেড়ে দেবে … সব আস্তানা দেদূর করে দেবে, চোলাই-এর ভাঁড়, পাতিল সব লেথিয়ে ঝেঁটাবে, রেকটোলিকার … রেকটোলিকার …রাতবিরেতে ভিডিও-ভাড়া…রেকটো কিলার … রেকটোকিলার …
৩) অ ঠুঁটো ঠুঁটো! ঘর খালি করে ঠুঁটো গেলি কোতায়?
ঠুঁটো হেঁকে বলে — গুন্ডিচা বাড়ি গো, আমি এখন গুন্ডিচা বাড়ি।
হালুয়াভোগ! হালুয়াভোগ! গবগবিয়ে ঘবঘবিয়ে হালুয়াভোগ! হালুয়াভোগ!
চার আনা পউয়া। চার আনা পউয়া। হালুয়াভোগ; হালুয়াভোগ!
৪) অ বাঁজা বউ! বাঁজা ব..উ! তোর কোল ভরবে কে? ফটকেরাজা। ফটকেরাজা কে? ফটকেরাজা হল ভুক্কাড়। ফটকেরাজা কী খায়? খই-মুড়কি আর লাইনকলের জল। লাইনকলের জলে কেমন ভাত হয়? সাদা, সাদা, ডাগরডোগর। ফটকেরাজাকে মোহর দেবে কে? ভদি দেবে। ভদির বাঁজা বউ কী দেবে গো ফটকেরাজাকে? ভদির বাঁজা বউ মাই দেবে। ফটকেরাজার নুনুর ওপরে কালো কার দিয়ে ভুঁড়ি জড়িয়ে ওটা কী বাঁধা? ফুটোপয়সা। কী বাঁধা? আরে, এ যে দেকি কানফুটো মোহর? অ্যাঁ, ফটকেরাজা মোহরধারী? হ্যাঁ। আর কী? ভদির বাঁজা বউয়ের বুকে ও দুটো কী গা? মাদার ডেয়ারির টোনাদুধের প্যাকেট! ধর শালা নলেনব্যাটাকে ধর। ধর … ধর… নলেনগুয়োকে ধর। কী হে বাবা হাঁড়িকচ্ছপ! ঘপৎ ঘপৎ করতেছো ক্যানো গো! বাবা হাঁড়িকচ্ছপ! যাঃ শালা! ফটকেরাজা মুতে দিল!
ভদির বাবা বুড়ো দাঁড়কাক বেশ কিছুক্ষণ ভদির এই দাপাদাপি দেখে কলতলায় বসে লাইনকলের জলে ভালো করে ডানা ধুয়ে ঝটরপটর করে চান করল, করে বলল
— বউমা, ব্রহ্মতালুতে একটু তেল দিয়ে দাও তো আমার। বেগম জনসন সোহাগ করে এমন ঘেঁটে দিল যে রোঁয়া সব খাড়া খাড়া হয়ে গেচে। সিঁথেটা কোথায় ঠাওর হচ্ছে না। তেল দিয়ে আলতো করে আঁচড়ে দাও। তোমার হাতে যা জোর। নলেন উবু হয়ে বসে টগরগাছতলায় খুঁজে খুঁজে, টিপে টিপে একটা একটা করে পিঁপড়ে মারছিল আর ন্যাংটো ভদি বার বার ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর নামছে যেন দম দেওয়া জাম্বুবান। বেচামণি দণ্ডবায়সের মাথায় রোঁয়া আঁচড়াইয়া দিতে লাগিল।
— খুব আরাম হচ্ছে। কতদিন তেলজল পড়েনি।
— বাবা, একটা কতা বলি?
— বলো বউমা।
— এই ভদির মাতায় ওটা কী ভূত চেপেছে?
— ও কিচু নয়, নেশু। কাল ছেড়ে যাবে।
— নেশু। এ ভূতের নাম তো এ বাড়িতে পা দেওয়া থেকে শুনিনি।
— কতা ওঠেনি। ও একটা বুড়ো ছিল। খুব খচ্চর। কালো ঠুলি পরত। সকাল থেকে নেশাভাঙ করত। সেই থেকে নাম হয়েছিল নেশু। তবে হ্যাঁ, ঘোড়ার খোঁজপত্তরের জন্যে লোকে আসত বলে ওর কাচে। বলত নেশু হচ্ছে রেসের ধন্বন্তরি। যে ঘোড়ার নাম বলবে টিপ লেগে যাবে। জ্যাকপট, কুইনালা, ট্রিপল টোট, প্লেসিং — কত লোককে জিতিয়ে ক্যাপ্টেন করে দিল। আর কিসের বদলে? দুটো পুরিয়া বা একটা বড় বোতল। নেশুর নামডাক যেমন ছিল তেমন আবার বদনাম, ওর ছেলেবয়েসের কেচ্চার জন্যে। ঝি বিয়ে করেছিল। বুকের পাটাও ছিল — আজ কতাটা লোকের মুকে মুকে ফেরে কিন্তু প্রথম বলেছিল নেশু — নিন্দে যখন রটেইচে তখন বিয়েই করব। এই সময়টা ওর একটু ভরের বাসনা হয়। তবে আধার কোতায় যে ভরবে? ভদিকে দিয়ে যা বোল বলাচ্চে তার মধ্যে কিন্তু এমন কতাও থাকবে জানবে তা তেরাত্তিরে না হলেও ফলবে ঠিক।
— কী হবে না হবে আপনি তো বাবা সবই জানেন।
— তা জানি। কিন্তু বলার উপায় যে নেই বউমা।
নলেন খচড়ার ডিম। দাঁড়কাককে খচানোর জন্যে আপন মনে বলে উঠল,
-ওফ জ্ঞানীগুণী সব হেগেমুতে দিল আর দাঁড়কাক হল ব্রহ্মজ্ঞানী!
— তোর মতো চোদনাবুলি না কপচালে ঘোর কলিটা জমবে কেমন করে। বুঝবি, টাইমে সব বুঝবি। তকন মামা বলে চ্যাঁচালেও কেউ আসবে না।
নলেন কম ঘোড়েল নয়।
— তুমি থাকতে মামাকে ডাকতে যাব। তোমাকে ডাকব। পারবে না এসে থাকতে।
উত্তরে দাঁড়কাকের মুখে সেই হাসির স্মিতরূপই ফুটে উঠল যা আমাদের বরাভয় সাপ্লাই দিয়ে চলেছে। প্রায়শই ফটো থেকে যদিও। দুনিয়া জুড়ে দুমদাড়াক্কা চলেছে। কিন্তু বাঙালি জীবন নির্বিকার। কারণ সে জানে যে তার বাড়িতে সর্ববিপদ রক্ষার জন্যে ফটো রয়েছে। এবং আগামীকাল সকালে আনন্দবাজার বেরোবেই। এই কেলো যে কতদিন চলবে তা বলার ক্ষমতা কোনো সুপার কম্পিউটারেরও নেই।
বড়িলাল বড়বাজারে গিয়ে পাঁচটা পাপি-হাউস (কুকুরছানা থাবা দিয়ে টেনে নেয়), তিনটে ডিম পাড়তে পাড়তে চলা হাঁস-পুতুলের ফ্যামিলি এবং একটি হেলিকপ্টার কিনে নিল যা সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে ঘোরানো যায়, পাখা চলে, আলো জ্বলে নেভে। এসব খেলনা সাপ্লাই হচ্ছে চীনেম্যান ল্যান্ড থেকে। খেলনা রপ্তানি বা পাচারের পেছনে ভারতীয় শিশুদের ‘ক্যাচ দেম ইয়ং’ পদ্ধতিতে কব্জা করার কোনো দূরভিসন্ধি আছে কিনা তা কেউ জানে না। কিন্তু বাঙালি যতই চীনেম্যান চ্যাংচুং মালাই কা ভ্যাট বলে আনন্দ পাক না কেন এটা কিন্তু প্রায় মান্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে চীনেম্যানরা হাসিমুখে কী ভাবছে তা বোঝা সহজ নয়। কাঠি দিয়ে তারা যে শুধু ভাতই খায় না তা সকলেই মুখে না বললেও টের পায়।
‘কাঙাল মালসাট’ যখন তার প্রাথমিক পাখসাট মারা শুরু করেছিল তখন প্রকাশ হয়ে পড়ে যে বড়িলালের নানাবিধ পোকা-পিঁপড়ে সম্বন্ধে এক জাতীয় ফোবিয়া রয়েছে। সেইমতোই সে মেঝেতে চারদিকে লক্ষ্মণরেখা দিয়ে দাগ কেটে মাঝখানে বিছানা করে ঘুমোচ্ছিল। চেতলা সাইড থেকে মৃদুমন্দ সেই বাতাস আসছিল যা বাঙালি দ্যাওরদের ঘুম কেড়ে নেয় ও ডোন্ট কেয়ার ভাব এনে দেয়। এতে বড়িলালের কিছু হবার কথা নয়। হয়ওনি। সে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল এবং স্বপ্নলোকের ভারচুয়াল রিয়্যালিটিতে দেখছিল কালী ও তার সংসার-জীবন এতই গা-সওয়া হয়ে গেছে যে দুজনে কালীর ঘরের সামনের চাতালে উবু হয়ে বসে চাল বাচছে এবং রোদের তাড়া খেয়ে শুঁড়-ওলা পোকাগুলো তিড়তিড় করে পালাচ্ছে। বড়িলাল যখন বাজারে গিয়েছিল কালী তখন সেই ফাঁকে স্নানটান সেরে রেখেছে। এই কালী কখনোই খানকি ছিল না। চাতালেই বাঁশ পুঁতে, তাতে তার বেঁধে শুকোতে দেওয়া হয়েছে সদ্য ধোয়া বড়িলালের লাল ল্যাঙট। লাল ল্যাঙট, দে চাবি, চাবি না দিলে মার খাবি। এটি একটি দুরূহ ধাঁধা। পালোয়ানরা কেন যে নিজেদের মধ্যে অশালীন ইঙ্গিতবাহী এই ছড়া বলে অনাবিল আনন্দ পায় তা অজানাই থেকে গেল। দুজনেই চাল বাছা ছেড়ে গগনাভিমুখে তাকায়। দিনের ফটফটে আলোতেই ঘুড়ি-লন্টন উড়িয়েছে কারা। ওমা, ফানুসই বা ছাড়ল কে? তার মধ্যেই আবার উড়ন তুবড়ি টেস্টিং চলছে বলে ফিকে ধোঁয়ার দড়ি একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশ জোড়া এক আনন্দ। ঐ দ্যাখো মোমবাতি ঘুড়িতে কী লম্বা ল্যাজ। ঘুড়ি সুতো পেয়ে লাট মেরে এগোয় তো ল্যাজও মায়াবী রিবনের মতো খেলা দেখায়। এরমধ্যেই আবার পাশ কাটিয়ে উড়ছে কালো বক। এখান থেকে চিড়িয়াখানা আর কতটুকু আকাশ। কী সামান্যই এই ফুরসৎ। আকাশ দেখার।
কিন্তু সেই ফুরসতেই যা ঘটার ঘটল। ল্যাজের কাছে দপদপ করে লাল আলো জ্বলে উঠল। সাঁই সাঁই করে ঘুরতে লাগল ব্লেড। টয় হেলিকপ্টার ঘরে দুটো পাক মারল। তারপর জানালা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে উড়ে গেল। সেই রাতেই জোড়া মার্ডার সাইট থেকে ফিরে টাকলা ও. সি দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে প্রোমোটারের দেওয়া ওল্ড স্মাগলার রাম পাঁইয়া হোটেলের টিকিয়া দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। ও. সি-র ঘরে নোংরা তার থেকে ঝুলছে আধকানা বাল্ব। টিউবটা অকেজো। সেই ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকল হেলিকপ্টার। ঢুকেই বাল্বের পাশে ঘন হয়ে পাক মারতে শুরু করল বলে দেওয়ালে বিদঘুটে চলন্ত ছায়া দেখা গেল। ও. সি খচে গেল।
— মালটা একটু রিল্যাক্স করে খাব তা না বাঁড়া চামচিকের উৎপাত শুরু হল। ঝাড়তো, ওই ব্যাটনটা দিয়ে ঝাড়।
এর উত্তরে হেলিকপ্টার নেমে টেবিলের ওপরে ল্যান্ড করল। আলো জ্বলছে নিভছে। পাখা ঘুরছে। একজন কনস্টেবল হাত বাড়াচ্ছিল কিন্তু ও. সি চিল্লে উঠল,
— হাত সরা। রিমোটে চালাচ্ছে। যে কোনো মোমেন্টে ফাটতে পারে। আমি যেমন করব তোরাও করবি। সাট করে মেঝেতে শুয়ে পড়। ঘরবার উড়ে গেলেও লাইফটা বেঁচে যাবে। জয় বাবা …
ধাড়াম করে চেয়ার উল্টোয়। কনস্টেবলরা উপুড় হয়ে শুয়ে হাত দিয়ে মাথা ঢাকে। লাঠিচার্জের সময় ভুক্কাড়রা এরকমই করে। হেলিকপ্টার টেবিলের ওপরে গড়াচ্ছে। ঠাশ করে বোতল পড়ল। উড়ছে। ব্লেডে লেগে বাল্বটা ফাটল। সারা ঘরে অন্ধকার। বোঁ বোঁ শব্দ। শব্দ নেই। সারা ঘরে রামের গন্ধ। এক মিনিট কাটল। শব্দ নেই।
— মালটা বোধহয় উড়ে গেচে স্যার।
— সে তো আমারও মনে হচ্চে। কিন্তু ঘাপটি কেস নয় কে বলবে? আলোটাও নেই।
— আপনার ড্রয়ারে তো টর্চ আছে। বের করুন না স্যার।
— তাই করি। শালা, কী হ্যাপা মাইরি। ঘামিয়ে ছেড়ে দিল।
টর্চের আলোয় যা দেখা গেল তা এইরকম। হেলিকপ্টারের ধাক্কায় ওল্ড স্মাগলারের বোতল মায়ের ভোগে।
গেলাস উল্টে সব মাল ফাইলের কাগজফাগজ ভিজিয়ে জাব করে দিয়েছে। ছোট সাইজের একটা তছনছ করে হেলিকপ্টার ধাঁ।
— মালের পুঁটকিটা মেরে দিল। তবে ভাগ্য ভালো ফাটেনি। পিওর টেররিস্ট অ্যাটাক। একজন কনস্টেবল তড়িঘড়ি জানালা বন্ধ করে দেয়।
— ভালো করেচিস। কাল রিপোর্ট দিতে হবে লালবাজারে। আমরা কেন, গোটা থানাটাই বেঁচে গেল।
আরেকজন কনস্টেবল মোমবাতি জ্বালল।
— স্যার একটা কতা বলব?
— বল। ঢ্যামনামি করচিস কেন?
— বলছিলাম যে ভালো মালটা তো ভন্ডুল করে গেল। আমার স্টকে দুবোতল বাংলা আচে। আনব?
— অ্যাঁঃ বলিস কি? যা, যা, ঝটপট নিয়ে আয়। প্রাণটা বেঁচে গেল। এবার একটু আরামও পাবে। বাঁচালি মাইরি।
–আচ্ছা স্যার, ওইটুকু হেলিকপ্টার–ফাটলে কী হবে! বড়জোড় চকলেট টাইপের …
— ওরে মুখ্যু, বাঞ্চতরা আজকাল ওসব পেটো ফেটো ঝাড়ছে না। এইটুকু জেলি জেলি মাল। আর . ডি. এক্স.। সেমটেক্স। পুরো বাড়িটা ধসিয়ে দিয়ে চলে যাবে। দেখিস না, কাগজে দিচ্চে। দেখলি বাঁড়া ট্রানজিস্টার রেডিও। দিব্যি গান বাজচে। তুলেচো কি ফিনিশ। এই জানবি। আজ যা বাঁচা বেঁচে গেলুম তা আমিই জানি। বৌদির মুখটা আর দেখতে হত না।
এমন সময় ফোন বাজল।
— হ্যালো, হ্যাঁ, ও সি বলচি। অ্যাঁ সন্ধেবেলা দুটো লাশ পড়ল। তাতে মেটেনি? কী? এপার ওপার বোমচার্জ করচে। করুক না। এতে যদি কয়েকটা মরে। কি হবে? যাব, দু রাউন্ড ফায়ার করব, থেমে যাবে। তার থেকে চলুক না। না মরলেও তো চোটফোট লাগবে। না। না। এখন ফের গিয়ে গাঁড় মারামারি আর ভালো লাগে না। ও কাল দেখবখন। এদিকে যা কেস হয়ে গেল শুনলে ভিরমি খেয়ে যাবে। একদিকে টেররিস্ট অ্যাটাক অন্যদিকে গ্যাংফাইট — একলা আমাকে দিয়ে অত বাঁড়া হবে না। না, না, বডি এখানে রাখতে যাব কেন? পাঠিয়ে দিয়েচি। তোমার পাশে ওটা কে গ্যাঁও গ্যাঁও করচে। তাই বলো। এই হয়েচে এক বালের এফ. এম.। দিন নেই, রাত নেই, ঢ্যামনামি চলচে। হ্যাঁ, ছাড়ো। অনেক ভাটিয়েচো। কী করচি? একটা মালের মিটিং বানচাল হয়ে গেল। আরেকটা অ্যারেঞ্জ করচি। ছাড়লুম।
বড়িলাল তখন কোনো স্বপ্নই দেখছিল না। অসাড়ে কাদা হয়ে ঘুমোচ্ছিল। পুতুল হাঁসগুলো হঠাৎ দল বেঁধে প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে উঠল। দরজা খুলে বেরিয়ে কুকুরছানা একবার জোড়া থাবা দেখিয়ে ঢুকে গেল। জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকল হেলিকপ্টার। ঘরে একপাক উড়ে যেখানে রাখা ছিল অবিকল সেখানে গিয়ে ল্যান্ড করল।
(চলবে)
১৮
এই ঘুঘুচক্করটি যে যুদ্ধের দিকে আগুয়ান বা নিন্দুকের মতে হাগুয়ান তা পাঠকরা বাদে সকলেই জানে। অর্থাৎ নানাবিধ পাখি, অমার্জিত মার্জার ও চাপাপড়া সারমেয়জগৎ – এখানেই শেষ নেই, শেষ কথা কার বাবা বলবে এখনো জানা যায়নি অতএব মাকড়দুনিয়া, মাইক্রোবমহল্লা ইত্যাদি নস্যপ্রায় অথচ নস্যাৎপ্রিয় নয়- তারাও রয়ে গেল। প্রবল বৃষ্টির আগে দেখা যায় কীটকলোনিতে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য। মানুষ তখন কিছুই বোঝে না। কিন্তু পরে এমনভাবে সাজে যে তার মত বুঝদার কেউ নেই। এমতই হল হালের পাঠক। যে লেখা এখনো বাংলায় লেখা হয় (লেখক ইংরেজি জানে না বলেই) তা যদি ছোটবেলায় খেলে যাওয়া নুনু নুনু খেলার মতো সখসাধ্য না হয় তবে চেপে যাও। ওরে গান্ডু, সব লেখক বাঁধা মাসমাইনে, গায়ে গতরে শোধ হয়ে যাওয়া খুচরো হ্যান্ডবল, দুগগো পুজোয় মোটা ন্যাকড়ার পট্টি পয়দা বা লেখো বা না লেখো ফ্রি প্যাকেট (চব্বিশ পঁচিশ তারিখে তারিয়ে তারিয়ে একেবারে খোদ অ্যাকাউন্টেন্টের ঘর থেকে) না পেলেও রেকগনিশনের মাকে ট্রাম লাইনে ফেলে আটপয়সা সুদের তোয়াক্কা না করেও লেখে বা লেখার ভ্যানতাড়া করে। পাঠক চাঁদু, এগুলো বুঝবি কবে? সাহিত্য মড়া হলে তোদের হালকা করার জন্যে কামানো যেত। যেহেতু তোদের ওজন নেই, সিনা নেই, গ্রাভিটি নেই, আওকাৎ নেই তাই তোদের কামিয়ে পেডিগ্রীওলা রিয়্যাল অ্যাললেখকরা ব্লেড ভোঁতা করে না। ভারত ব্লেড/ইন্ডিয়া ব্লেড চকচক করবে। চুকলি চলবে। চাঁচাচাঁচি চলবে। আপাতত ওয়ার। ক্রস বর্ডার টেরো খিল্লি শেলিং শিলিং পাউন্ড ডলার – আঃ হোঃ, ওয়াহঃ, ভঁক, পুঁই, পঁক – পোঁ- লিঃ লিঃ
( )
নিমকি, নিমকিছেনালি, ছকবাহাদুর ছবিলাল, ওয়ে ওয়ে, ওয়ে ওয়ে আঃ
( > )
খুল্লামখুল্লা, ওফ ডার্লিং, বাসনওয়ালী
(< )
উঃ কী দিলি
( Δ)
পিরামিডের এক পিঠ বা একমাত্রিক
অধ্যাস
( = )
ভাংড়াপন + সালসা + লম্ভঝম্প
বা
KM
কিলোমিটার বা কোঁকড়া মালাই নয়
তাহলে কী?
লে বুড়ুয়া, ইয়ে হ্যায়
কাঙাল মালসাট
ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর। এই বলেই ডি. এসকে চমকাবে বলেই প্ন্যান করেছিল মদন বা পুরন্দর। তারপর কাজের কথা। কিন্তু উল্টে যে সিন তারা দেখল তা দেখলে পাবলিক সব চ্যানেলেরই পুড়কি উড়ে যাবে। ঘরের মধ্যে ডি. এস -এর বউ বাচ্চা খিলখিল হাসি সহযোগে উড়ছে এবং নেংটি পরা ডি. এস হাতের দশ আঙুলে দশটা হলদে কলকে ফুল পরে তাদের ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে তাড়া করছে। ডি. এস মুখেও দুটো কলকে ফুল ঢুকিয়েছে যাতে তাকে হলদে গজের দাঁতওয়ালা ড্র্যাকুলা বলেই মনে হচ্ছে। ডি. এস -এর ন্যাংটো ফ্যাতাডু বাচ্চা স্পেসে সাবলীল কসমোনটের মতো ভল্ট মারছে এবং এমন এমন অ্যাঙ্গেলে বাঁক নিচ্ছে যা দেখলে কোমানেচি জিমনাস্টিক ছেড়ে দিত। ডি. এস -এর মোটা, কালো কোলাব্যাঙ বউ নাইটি পরা এবং তার ওড়ার ধাঁচ অত সাহসী নয় কিন্তু যথেষ্ট খেলুড়ে – জলের গভীরে জব্বর কাতলারা যেমন হামেশাই করে থাকে। এবং এই দৃশ্যের সঙ্গেই চলেছে ডি. এস -এর ভৌতিক টিভি যাতে সবকিছুই চারটে করে দেখা যায়। তাতে তখন দেখা যাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় চারজন সি. এম চারটি মাইক্রোফোনে একই কন্ঠস্বরে চলচ্চিত্র উৎসবের সভায় ভাষণ দিচ্ছেন। তার পাশে চার পিস করে একই বুড়ো ফিল্ম ডিরেক্টর, সেই হিরো কিন্তু এখন বুড়ো ভাম এবং প্রাক্তন এক ভ্যাম্প, যার সবই গেছে অবশ্য ট্যারা চোখে ধ্যাবড়া করে কাজল দেওয়ার কামশাস্ত্রীয় হ্যাবিটটি বাদে। কিছুক্ষণ ধরে এই খেলা স্টাডি করার পর মদন ঘ্যাঁক করে উঠল,
– থামবে? তুমি থামবে।
ডি. এস অমনি সুর করে বলল,
– নারে নারে না।
– না এইভাবে কেউ যদি ডিসিপ্লিন ভাঙতেই থাকে তাহলে আমি অন্তত ডিউটি করতে পারব না। আজই ভদিদাকে বলে দেব- যে পারে পারুক, আমাকে দিয়ে হবে না।
ডি. এস যা করে না বলেই সবাই জানে সেটাই করে দেখিয়ে দিল। চাপানের জবাবে উতোর।
-ওসব ভদিদা ফদিদা জানবে ডি. এস কেয়ার করে না। ভরদুপুরে পাঁটার মাথার ঘুগনি -ভাত মেরে ফ্যামিলি নিয়ে খেলা করচি তাতে ভদিদার কী? এখন খেলা জমে গেছে। থামানো যাবে না।
এতক্ষণ পুরন্দর ভাট কিছু না বলে মুচকি হাসি দিচ্ছিল। এবার চোখ বুজে ইনস্ট্যান্ট পোয়েমটি ছাড়ল।
– ঘরের বাহিরে শত্রু খাড়া
ঘরের ভিতরে গরিব বাঁড়া
করিয়া হেলা মারিছে খেলা
সহসা ঘাড়েতে নামিবে খাঁড়া
মেঘের আড়ালে উড়িছে বোমারু
যুদ্ধজাহাজ – নাম পোঙামারু
তবুও ডাকিয়া মেলে না সাড়া
ঘরে বাহিরে শত্রু খাড়া
– সাবাশ! ভাট, সাবাশ! এরকম জ্বালাময়ী কিছু পোয়েম শুনলে যদি এদের টনক নড়ে। ঘেন্না ধরিয়ে দিল।
– ঢের হয়েচে বাবা, ঘাট হয়েচে। খেলা বন্ধ করচি। ড্যাং ড্যাং করে তো এক্ষুনি ভদিদাকে নালিশ করতে যাবে। তোমার আবার যা নিন্দেকুটে স্বভাব।
ডি. এস. হাতের আঙুল থেকে কলকে ফুল খুলতে খুলতে এই কথাগুলো বলল।
– নেহাত বউ-বাচ্চা সামনে তাই বেঁচে গেলে। যা হোক গুলি মারো। মালমুল কিছু আচে স্টকে?
– বলব কেন?
– ফের ভ্যানতাড়া!
– আরে বাবা আচে। বের করচি। প্যাঁটরা থেকে হরিণের ছবি আঁকা গেলাসগুলো বের করোতো। গেস্ট বলে কথা।
– ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে বাংলুফাংলু নয়।
– ওসব গরিবগুর্বো খায়। এটা পিওর কানট্রি মেড ফরেন। অফিসারস চয়েস।
– ট্যাঁক বেশ গরম বলে মনে হচ্ছে।
– না, না। ট্যাঁক কোল্ড। এটা গিফট। আমার শালাকে তো চেনো। পুরন্দর বোধহয় চেনে না।
– জনাকে চিনব না কেন? এই ঘরেই কত পোগ্রাম হল।
– ও সরি। জনা ব্যাটা করেছে কি এই বাজারে একটা বাগানবাড়ির দালালি লড়িয়ে দিয়েচে।
– হয়েচে! বিক্রি?
– হবে। আগাম কথা সব পাকা। সেই থেকে বলচে, জামাইবাবু, ওসব বাংলুমাংলু আর নয়। লিভার ড্যামেজ অনেক হয়েচে। এবার আমি ইংলিশ, তুমিও ইংলিশ, হাজার হলেও একটাই জামাই বাড়ির।
– দিল দরিয়া শালা পেয়েচ তো। লাকি চ্যাপ।
ডি. এস -এর বউ একঝাঁক সাদা দাঁত বের করে বলে উঠল,
– কার ভাই দেখতে হবে। সেটা তো কেউ বলচে না।
– বুঝেচি। খুব গেরমানি হয়েচে। ঘুগনি একটু বেঁচেছে না? দাও না। ভালো চাট হবে। এবার বলো, কাজটা কী?
– বলচি। ছোট করে বললে ইংরিজিতে বলে এরিয়াল সার্ভে। কিন্তু দিনের আলোয় হবে না। সন্ধে অব্দি মৌজ, তারপর, তারপর উড়িতে থাকিবে ফৌজ। কেমন মিলিয়ে দিলাম ভাট?
– হেভি। আসলে সকলেই কবি। এটাই আমি স্টাডি করে দেখলাম। যদিও উল্টোটাই বলা হয়। জে. দাস বলে একটা ছিটিয়াল পোয়েট ছিল। ওই বলেছিল। সেই থেকে চলচে।
– বাঙালি মানেই জানবে তোতা ঢ্যামনা। একবার যা শিখবে কপচেই চলবে, কপচেই চলবে। ভদিদা যে এত বড় একটার পর একটা রদ্দা ঝাড়চে কোনো ভাবগতিক দেখে টের পাচ্চ?
– বরাবরই হারামি জাত। তায় এখন হাড়হারামি হয়ে উঠেচে। যাকগে, ও ব্যাঙের কেচ্ছা ছেড়ে মোটা করে ঢালো তো।
মাল ঢালা হয়। তাতে জল ঢালার বগবগ শব্দও হয়। ভাট আবার জোলোমাল খেতে ভয় পায়। বেশি হিসু হবে।
– আর না। আর না।
– অত কড়া খেও না। লিভারে জং ধরে যাবে।
– ভালো হবে। পোয়েটদের বেশি দিন বাঁচলেই বদনাম। ইয়াং থাকতে থাকতে টেঁসে গেলে সবাই বলে, আহা, মালটা যদি বাঁচত!
– আর বুড়ো হলে?
– হরিবল! ইস্কুলে পড়ানো হবে। রেজাল্ট হল ছোটবেলা থেকেই পাব্লিক মালটার ওপরে খচতে থাকবে। বড় হলে আর টাচ করবে না।
– ওসব জ্ঞানমারানী ছেড়ে একটা ভালো পদ্য বলোতো। ওই গরিব বড়লোক – প্যাঁদাপেঁদি নয়।
– বলচি। একদিন দুপুরবেলা লেকের পুকুরপাড়ে বুঝলে, সে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর, অনেকক্ষণ ধরে একটা একলা মেয়েকে সাইজ করার ধান্দা করলাম। হল না। ঢেমনি মাগি। যেই বড়লোক এল মোটরগাড়ি বাগিয়ে অমনি দেখি ভেতরে ঢুকে গেল। আমিও বললাম শালী, দেখবি, তেতে মেতে লিখেই ফেললাম।
খুলিতেছে ছাতা, বক্র বাঁট
ফুটিতেছে ছাতি, ফাটিছে কাঠ
সহসা দেখিনু স্নানের ঘাট
জলকে চলিছে বধূর দল
দোলায়ে কলসী, নামায়ে ঢল
দেহবল্লরী কী উচ্ছল
দিল না, দিল না তৃষিতে বারি
চাতক চিনিল ঘাতক নারী
ধুতুরার বিষ মিশানো তাড়ি
রৌদ্রে ভাজিছে পুকুরঘাট
তপ্ত কাঁচিতে ছাঁটিছে ঝাঁট
খুলিতেছে ছাতা, বক্র বাঁট
কাব্যপাঠ শেষ। মদনকে বড়ই আনমনা দেখায়। বিকেল ঘনাচ্ছে। ভাট ছোট একটা চুমুক মেরে গলা ঝাড়ল। মদন ডি. এস -কে বলল,
– হাই থট রয়েচে। বুঝলে।
– আমি খালি ওই হারামি মাগিটার কথা ভাবচি। গলা টিপে দিতে হয়।
– আহাহা তা কেন? নো গলা টেপাটেপি! ভাট মনটা কেমন যেন ভিজে নেতিয়ে গেল। হেভি ধরেচ মুখটা। ব্যাঁকা বাঁটওয়ালা ছাতা খুলচে। লিখতে না পারলে কী হবে, ধরতাই, মেজাজ সব ফিল করি। বুঝলে। তবে যারা হার্টে হাফসোল খায়নি তারা ঠিক এ কবিতা বুঝবে না।
– না বুঝল তো বয়েই গেল। আমার কাজ নামানো। নামিয়ে দিলাম। দুনিয়া যদি ছোল হয় আমার কিছু করার নেই।
ওদিকে ভদি ও সরখেলের মধ্যে তখন যা বাক্যবিনিময় হচ্ছিল তার ভারবেটিম প্রতিবেদন পেশ করা হল।
– দেদারে খালি জল উঠচে। বালতি বালতি তুলে বাইরে ঢালচি। কিন্তু জল।
– সে তো উঠবেই। পাশেই ওল্ড গ্যাঞ্জেস রিভার। জলের কালারটা দেখেচ?
– কালচে। আর ভেরি ব্যাড স্মেল।
– হবেই। কয়েকশো বছরের পচা মড়া, গু, কুকুর বেড়াল – তুমি কী ভেবেছিলে! প্যারিসের সেন্ট বেরোবে? না বাগদাদের আতর।
– দ্যাকো, তুমি হলে লিডার। তবুও বলচি কথাটা। বাগদাদ নিয়ে ঠাট্টা কোরো না। অত বোমফোম ঝাড়ল। তারপরেও ঠিক অ্যামেরিকার সঙ্গে তাল ঠুকচে।
– কতায় কতায় তোমারও সরখেল অত ইন্টারন্যাশনাল পলিটিকস টেনে আনলে চলে না।
– এইটাই তোমার বড় ভুল। নিজে যা করচ সেটা চাউর হয়ে গেলে দেখবে তুমিই তখন ইন্টারন্যাশনাল ফিগার। দুবেলা টিভির ক্যামেরা পোঁদে পোঁদে দৌড়বে।
– বলচ? এমনটা হবে?
– না হয়ে যায়? যা প্ল্যান কষেচ দশটা প্ল্যানিং কমিশনের ঘটে কুলোত না।
দুজনের এই কথোপকথনের মধ্যেই বিকেল গড়ায়। আকাশে সেই প্রসিদ্ধ সোনালি রঙ পরতে পরতে অন্ধকারের দিকে ধাবমান। এই টাইমে ঝাঁক বেঁধে ক্রো, গুয়ে শালিখ, বকপাঁতি, হাঁড়িচাঁচা, স্নাইপ, পানকৌড়ি ইত্যাদি এশিয়ান বার্ডরা বাড়ি ফেরে। কবে থেকে যে এইভাবে অফিসের কাজ সেরে তারা ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরছে তা কেউই বলতে পারে না। কেউ আকাশে ইংরেজি ডব্লিউ-এর মতো দল সাজায়। কেউ সাজায় ‘ভি’। আবার লোনলি একটি বার্ড বা ক্লান্ত দম্পতিও চোখে পড়ে। ভেবে সকলেই অবাক ও বোধহয় উদাস হতে পারে যে ব্রিটিশ আমলে বা তারও আগে, সেই পাল আমলেও এমনটি হত। এ সম্বন্ধে হান্টার বা মজুমদার কোনো উল্লেখই করেননি। সিভিলিয়ানদের অনবদ্য স্মৃতিচারণে পাখি শিকার রয়েছে। কিন্তু পাখিদের এই নিত্য যাতায়াত সম্বন্ধে কোনো স্নিগ্ধ অবজারভেশন নেই। যাই হোক, পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে তখন নানা সাইজের চাকতিও তাদের ঘরে ব্যাক করেছিল।
– টাইম হয়ে গেল।
– কীসের?
– আর ঠিক মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফ্যাতাড়ুরা টেক অফ করবে।
– কেন?
– এরিয়াল সার্ভে করতে। গোলাপ যে রিপোর্টগুলো দিচ্চে সেগুলো নিয়ে আমার মনে কোনো আপত্তি সন্দেহ নেই কিন্তু তবু একবার দেখে নিতে চাই। এনিমি এখনো জানে না যে আমাদের একটা স্ট্র্যাটেজিক এয়ার কম্যান্ড আচে। যখন জানতে পারবে তখন পাখি বহুদূরে উড়ে ভাগলবা।
– এক এক সময় ভাবনা হয় যে হঠাৎ তুমি এতবড় কাণ্ডটা ঘটাতে গেলে কেন? থই পাই না।
– পাবে কী করে। আমি কি নিজেও বুঝি। দ্যাখো, কোনোকিচুই আমাদের তাঁবে নেই। এই যে রহস্যময় বিজ্ঞাপন বেরোল আনন্দবাজারে – আমরা তো দিইনি। বাবা হয়তো জানেন। বেগম জনসনও জানতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলবে না। কেবল হেঁয়ালি করবে। দেড়শো বছর পর পর চাকতিবাজি হয়। কেন হয় কেউই জানে না। আমাদের সেই আদিপুরুষ, মানে আত্মারাম সরকারই বা এই ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়ে কী চান? আমার ওপর যেমন যেমন আদেশ আসচে, আর্জি পাচ্ছি তেমন তেমন করে যাচ্ছি।
– খুবই হুড়ুমতাল কাণ্ড।
– হুড়ুমতাল বলে হুড়ুমতাল। জয় বাবা চাকতির জয়! জয় মা চাকতির জয়! শুধু কী চাই জানো? বরাভয়। আর কিছু নয়। ওইটুকু পেলেই এই লাইফটা কেটে যাবে।
– ওফ মাথায় যেন ঘোর লাগচে। এত বড় একটা কাণ্ড। তাতে সরখেলও খেলে যাচ্চে।
– ভেবো না। যত ভাববে তত ঘোর বাড়বে। নলেন সেদিন একটা ছড়া কাটছিল। বেশ মনে ধরেচে।
– কেমন ছড়া শুনি!
– যা ইচ্ছে তাই হোক, এবার পুজোয় চাই কোক। বলো! আমরা স্রেফ কোকের জায়গা চাইচি বরাভয়।
– ঠিক! একেবারে ঠিক!
– এই হল কতা। অনেক সিরিয়াস আলোচনা হল আজ। মাল খাবে একটু?
– একটুই। এখনো ধন্দ লেগে আচে।
আকাশ থেকে লালবাজার বড়ই নরম্যাল চোখে মনে হয়। তা নয়। মদন বলে
– কী দেখচ ডি এস?
– কী আবার নীল সাদা কাপড় শুকোচ্চে।
– বাল। ভালো করে দ্যাখো। র্যাফ টার্গেট শুটিং করচে।
– তাই তো!
– আরো ভালো করে দেখে রাখো। ওই মালটাকে চেনো?
– হাফ পাঞ্জাবী পরা?
– হ্যাঁ।
– ও কে?
– খানকির ছেলে। নক্সালদের উকুনবাছা করে মারত।
– ওরকম খোঁড়াচ্চে কেন?
– স্ট্রোক! চুৎমারানির পক্ষাঘাত হয়ে ডানদিকটা পড়ে গেছে। জানলে?
– ঝাড়ব?
– কী?
– আমার পকেচে একটা দুশো-র বাটখারা আচে।
– এখনই নয়। বম্ব করার কোনো ইনস্ট্রাকশন নেই।
আরো ওপরে আকাশ থেকে খ্যাংরা কথা ভেসে আসে মেঘের বাষ্প ধরে ধরে,
– গুড! গুড!
মদন, ডি. এস ও পুরন্দর ভাট ওপরে তাকিয়ে দেখেছিল কালপুরুষকে আড়াল করে বিশাল ডানা ছড়িয়ে উড়ছে সেই প্রাকৃত দাঁড়কাক।
– ওঃ গড আপনি।
– হ্যাঁ রে বাঁড়া আমি। নীচে তাকা।
চলচে!
– কী?
– লালবাজারে কুচকাওয়াজ!
– বুঝলি কী হচ্ছে!
– কুচকাওয়াজ!
– ল্যাওড়া! গভরমেন্ট ধন দাঁড়াচ্চে কি না দেখচে। কেন করচে জানিস?
– কেন?
– গরিবের গাঁড় মারবে বলে।
পুরন্দর একেই ও.সি. খেয়ে টং। সে বলল,
– আপনার রিডিং ভুল। এটা লেফটিস্ট গভরমেন্ট।
– ওসব ঢপ নিজে খেতে হলে খেও। দুনিয়া চালাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক আর ও লেফট মারাচ্চে।
– মানে? এই পুলিশ তো লেফট!
– ল্যাওড়া। যে মাইনে দেবে তার।
– চেপে যাও। আরগু কোরো না।
এই সাবধানবাণী ভাটের। কিন্তু ডি. এস অকুতোভয়।
– ওই বাড়িটাতে কী হচ্চে? ওই যে আলো জ্বলচে?
– আনন্দবাজার ছাপা হচ্চে। আর কী জানবে, বাঁড়া? কাল সাত লাখ বাঙালী এটা পড়েই সারাদিন বিচি চুলকোবে।
– সে না হয় হল। ওগুলো তবে কী?
– একই কেস। মিডিয়ার আলো। ইংলিশ, হিন্দি, বাংলা …
কিন্তু তারও তলায় ওই যে রোশনাই, ওগুলো কেন ঘটে ঢুকচে?
– চেল্লামেল্লি শুনতে পাচ্চি।
– উৎখাৎ চলচে। হটাবাহার। কলকাতা ছেড়ে ভাগো। যত বাঁড়া খালপাড়, ফুটপাথ দিওয়ানা সব ফোটো। ঝিংচ্যাক বাদে কিছু থাকবে না। ফোট শালা চল, ও হকার ফকার রেন্ডিগেন্ডি কোই লাফড়াবাজি নেহি চলেগা – চল – বুটকা ঠোক্করসে চল – বুলডগবাজারকা খিল্লিসে চল – চলো হে – পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলিলেন – হে অপু। পথের কি কোনো শেষ আছে? চলো এগিয়ে যাই। চরৈবেতি! চরৈবেতি!
– হে বাপ! হে দাঁড়কাক!
– বলে যা!
– বর্ডার দিয়েও তো ঢুকচে।
– ঢুকচে তো। বাংলাদেশ থেকে ঢুকচে। তাড়া খাচ্চে আর ঢুকচে।
– কারা?
– আপাতত হিন্দু বাঙালি। পরে কী হবে আমি জানি কিন্তু বলব না। জমি কাড়ো। তাড়াও। ওদের নাম্বার কম। যদি উল্টো হয়ে যেত কেসটা তাহলে মোল্লারা তাড়া খেত।
– আর ওই যে হেভি আলোর ছররা। গানবাজনা।
– কবে আর হালচাল জানবি? ওখানে চলচে সাহিত্য উৎসব। সবসময় একটা না একটা বাওয়াল লেগে রয়েচে।
– সাহিত্য উৎসব! তাহলে অত পুলিশ!
পুরন্দরের এই বিস্ময় মদনের রাগের উদ্রেক ঘটায়।
– আরে বাবা, কোনো উৎসব, মায় বিয়েবাড়ি অব্দি আজ আর মন্ত্রী ছাড়া হয়? মন্ত্রী মানেই পুলিশ।
দাঁড়কাক বলল,
– হেভি প্রিপারেশন। কলকাতায় যে হিস্টোরিক গাড়োয়ান ধর্মঘট হয়েছিল তখনো ব্রিটিশ পুলিশ এত গা ঘামায়নি।
– গাড়োয়ান ধর্মঘট ? কই, শুনিনি তো।
– শুনবি কী করে? এখনকার ফুটো আঁতেলগুলো কিছু জানে? বলবখন একদিন সময় করে। হেভি গল্প। সব পুরনো আমলের কমিউনিস্টদের ব্যাপার। এখনকার এসব উটকোদের সঙ্গে মিলবে না।
প্রোমোটারদের সঙ্গে লোকাল লেভেলের লিডারদের সম্পর্ক ঠিক কেমন হওয়া উচিত তাই নিয়ে গোপন মিটিং -এ ভাষণের পয়েন্ট নোট করছিলেন কমরেড আচার্য। তাঁর টেবিলে বসেই। আঙুলের ফাঁদে জ্বলন্ত সিগারেটটি স্টাডি করতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর মনে হল যে, ক্যাপিটালিস্টরা কিন্তু কমোডিটিটা মোক্ষম বানায়। একবার তিনি অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে বানানো সিগারেট খেয়েছিলেন। যেমন বিদঘুটে ধ্যাবড়া প্যাকেট তেমনই অখাদ্য মাল। জ্বালতেই মনে হয় ভিজে কাঠের গাদায় আগুন লেগেছে। হায় ব্রেজনেভ যাঁকে বাঁচাতে ওঝা অব্দি ডাকা হয়েছিল। হায় গোরবাচেভ। রাজনীতির অ্যালকেমি বুঝতে গিয়ে নিজেই রহস্যপূর্ণ লিকুইডে হাওয়া হয়ে গেল। চটকা ভাঙার মতোই কাণ্ড। টেবিলের সামনে মিলিটারি টিউনিক পরা লোকটিকে কমরেড আচার্য ভালো করে চেনবার আগেই পাইপ থেকে জর্জিয়ান তামাকের ধোঁয়ায় সবকিছু আচ্ছন্ন।
– ক্যাপিটালটা পড়েছিস মন দিয়ে?
হ্যামলেটের বাপ বা ম্যাকবেথের ব্যাঙ্কোর মতোই স্তালিনের ভূতও সহসা ধাঁ!
বেগম জনসন তাঁর স্লেভ গার্লদের সঙ্গে বাগানে আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট খেলছিলেন। বলটি গড়িয়ে গড়িয়ে ঝোপের পাশে গিয়ে থেমে গেল। বেগম জনসন ঝটপট শব্দ পেয়ে মান্ধাতার আমলের বটগাছটির দিকে তাকালেন।
ভূত নয়। বাদুড়। সারাদিন তারা উল্টো হয়ে ঝুলে হেগেলিয়ান বিশ্ব দর্শন করছিল। ঘনায়মান সন্ধ্যায় তারাই উড়ন্ত হয়ে মার্কসীয় পৃথিবীতে ফল পাকুড়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে উদ্যত হয়েছে।
বেগম জনসন স্লেভ গার্লদের নিয়ে মকানের দিকে রওনা দিলেন। সেখানে ঘরে ঘরে মোমের আলো জ্বলছে।
(চলবে)
১৯
বেচামনি যেভাবে ককিয়ে উঠল তাতে মনে হতে পারে বাংলা সিরিয়াল জমে উঠেছে কিন্তু তা নয়, ঘটনাটা ‘কাঙাল মালসাট’ -এর হাঁপ ওঠার টাইমের একটি আন্তরিক আর্তনাদ,
– এ কী করলে ঠাকুর! এই তোমার মনে ছিল … এত নিদয়া তুমি … ঠাকুর!
রিটায়ার্ড ফৌজি বল্লভ বক্সী তো হাঁকড়ে উঠেছিল,
– মার্শাল ভদি। হুকুম করেন তো কম্যান্ডো পাঠাই। ট্যাট ফর টিট! নেহি তো এনিমি আমাদের বলবে চুহা।
ভদির উঠোনময় কলরোল জাগ্রত হল,
– ডি. এস -এর রক্ত, হবে না তো ব্যর্থ।
– ডি. এস অমর রহে।
– অমর শহিদ ডি. এস যুগ যুগ জিও।
টিনের দরজায় ফুটোয় চোখ সাঁটা বড়িলাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ডি. এস নেই। কুস্তিগির হলেও বুকের ভেতরটায় কেমন যেন এক নিংড়ে ওঠা ভাব … উঠোনে উদ্বেল শোকক্রন্দন … এবং মারাত্মক এই অবস্থায় ভদিও বুঝে উঠতে পারছিল না যে ঠিক কী করা উচিত তাই থেকে থেকে সে কুঁচকি চুলকোচ্ছিল আর আড়চোখে নজর রাখছিল বেচামণির দিকে -এই ক্যাচালের মধ্যে মাগী না আবার ফিটটিট হয়ে যায় …
এবং এই গোটা মায়ের ভোগের পালার জন্যে যে দায়ী সে অর্থাৎ পুরন্দর ভাট দু একবার চিল্লামিল্লি থামাবার সাধু প্রচেষ্টা চালাবার চেষ্টা করেও মাথাটি বোম হয়ে যায় কারণ চারদিকে রোলারুলি চিৎকার, হেভি চ্যাঁও ভ্যাঁও … উপরন্তু নিজেরও ধুম নেশা …
ভদি তার শিষ্যবর্গের কাছে আশু ও অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের ব্যাপারে লেকচার দিচ্ছে তার মধ্যেই পুরন্দর, হেভি বাংলা চার্জ করা অবস্থায় ঢুকে হাঁউ মাঁউ করে ডুকরে উঠেছিল।
– ‘ভদিদা! ডি. এস খতম, হাজরা পার্কে পুলিশ অ্যাকশান!’
– অ্যাঁঃ ফিনিশ!
– পুরো। ঘিরে ফেলল!
– তারপর?
– ফিনিশ। আমি এসকেপ। দেখলাম দুটো ঠ্যাং, দুটো হ্যান্ড ধরে চ্যাংদোলা করে ভ্যানে তুলচে। বডি ভারি তো। তুলতে পারচে না। শেষ অব্দি তুলল।
– মদন? মদন ছিলনা?
– না। আমি আর ডি. এস।
ফের বেচামণির আর্ত আকুতি,
– ঠাকুর। এত নিঠুর তুমি! এত!
নলেনের নাদ,
– বৌদি! বৌদি!
এই করুণ দৃশ্যে আবদ্ধ না থেকে আমরা যদি রিমোটে চ্যানেল পাল্টে এই মোমেন্টে মদনকে ধরি তাহলে দেখব সে তার ঘরে গামছা পরে, উবু হয়ে বসে স্টোভের থেকে ভাতের হাঁড়ি নামাবে ফ্যান গালার জন্যে, কিন্তু কি দিয়ে হাঁড়ির কানা ধরবে, অতএব গিঁট খুলে সে গামছাটাই খুলে নিল, ‘কাঙাল মালসাট’ -ও রিমোটের বোতাম টিপে দিল, এটা কিন্তু জি – টিভি বা আকাশ-বাংলা বা সনি-টিভি নয়, বি বি সি বা সি. এন. এন তো নয়ই, বরং , ধরা যাক কে. এম. টিভি – তাতেই দেখা যায় একটি বড়ই বড় লাল বাড়ি। রাত্তির বেলা। উরিঃ সাঁটি, চারদিকে বাড়ি । লালবাড়ি। কিন্তু কত বড় উঠোন রে বাবা! লে! সার দিয়ে গ্যাঁদাফুলের টব। পেতলের ফলকে ফলকে নাম লেখা। পাঠক ভায়া, আমরা মুখোমুখি দাঁড়ালে, বাঁ দিকের মানে ‘ইন’ লেখা যে গেট দিয়ে ঢুকেছি সেটা দিয়ে লালবাজারে ঢোকে। বুঝলে? ঢুকে বাঁয়া সেকেন্ড বাড়িটাই হল ডিটেকটিভদের। তলায় তলায় ফুলপরী – বম্ব স্কোয়াড, হোমিসাইড … চলো … ডি. এস যাচ্ছে … আমরাও যাচ্ছি। এরপরে ডানদিক দিয়ে ‘আউট’ লেখা গেটটা দিয়ে বেরোনো যাবে কিনা এখনই বলা যাচ্চে না। চলো … ‘কাঙাল মালসাট’ খাবি যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এখনও সাইজ হয়নি। ইভনিং আর একটু গড়াবে।
তার আগে একটা ছোট্ট ব্রেক ! ফেমাস সমালোচক পিশাচদমন পালের নাম কে না জানে? প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এঁকে কেউ যেন কবি পি. ডি. পাল -এর সঙ্গে অভিন্ন বলে না ভেবে ফেলেন। পি. ডি. পাল সম্প্রতি একটি কবিতা সাইক্লো করে বিলি করেছেন যদিও সঙ্গত কারণেই কবিতাটি সাইক্লোন সৃষ্টি করতে পারেনি।
পি. ডি. পাল -এর সাইক্লো করা কবিতা-
নিউক্লিয়ার যুদ্ধে
বিশ্ব যেবার ধ্বংস হয়ে যায়
গোটা মানব সংসারই যখন
ছাই -এর গাদা
সব দেশ যখন শেষ
তারও পরে বেরিয়েছিল
শারদীয়া ‘দেশ’
অপ্রকাশিত, এক আঁটি
রাণুকে ভানুদাদা
কবি পি. ডি পালকে ধিক্কার কে না দেবে? পিশাচদমন পাল কবি পি. ডি পাল হতে পারেন না। তিনি ‘কাঙাল মালসাট’ -এর শেষ অর্থাৎ অষ্টাদশতম পাঁয়তাড়াটি পড়ে টি.ভি -তে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন – ‘ফাক! আমি যদি জার্মান হতাম এবং ‘কাঙাল মালসাট’ ১৯৩০ – ৩১ – ৩২, কখনও জার্মানিতে প্রকাশিত হত তাহলে আমি, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি, পিশাচদমন পাল, সবার আগে গিয়ে নাজি পার্টির মেম্বার হতাম এবং ১৯৩৩ -এর ১০ মে ২০,০০০ বই পুড়িয়ে যে মেগা-ধামাকা হয়েছিল তাতে, উইদাউট ফেইল, ‘কাঙাল মালসাট’ -ও পোড়াতাম।’ বলাই বাহুল্য যে পিশাচদমনের এই চমকপ্রদ উক্তির ভেতরে যে উস্কানির পুর দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আমরা বেকার মাথা ঘামাবো না। এ বিষয়ে আমরা দলাই লামার উপদেশই মেনে চলব – যে যা বলে বলুক, ধরে নিতে হবে এসবই নাথু সংকটে তিব্বতী হাওয়ার ফুসুরফুসুর। যাই হোক, ঐ টিভি সাক্ষাৎকারের দিন পাঁচেক পরে, তাঁর এগারতলাস্থ ফ্ল্যাটের স্টাডিরুমে বসে পিশাদদমন পাল রিডিং ল্যাম্পের মোহিনী আলোয় মন দিয়ে পড়ছিলেন ‘ডিকনস্ট্রাকশন ইন আ নাটশেল: আ কনভারশেসন উইথ জাকস দেরিদা’ – হঠাৎ শুনলেন জানলায় খচরমচর শব্দ। বিশাল এক দন্ডবায়স এবং তার ঠোঁটে ধরা একটি জ্বলন্ত চুরুট। দাঁড়কাক ভুস করে চুরুটের ধোঁয়া ছাড়ল। পিশাচদমন হতবাক। দাঁড়কাক পায়ের নখে চুরুটটি ধরে রাখে। অল্প কাশে।
তারপর বলল,
– এরকমই হয়।
– মানে?
– মানে সব হারামিরই এরকম হয়। স্পেশালি তোর টাইপের।
– হোয়াট?
– ছোটবেলার ডাক নাম যারা ভুলে যায় তাদের তোর দশা হয়।
– তুইতোকারি?
– ভুলটা কোথায়? তোর বাপ মানে কালীয়দমন আমাকে দাদা ডাকতো। সেই ব্যাটাই তো তোর ডাকনামটা দিয়েছিল। মনে আছে?
– স্ট্রেঞ্জ! বিজার!
– ওসব ঢপের কেওন ছাড়? তোর ডাকনাম ছিল পেদো। সেটা ভুলে মেরে আলবাল পড়ে ভাবচিস পার পেয়ে যাবি। এন্টার পাঁচপাবলিককে বলে দেব যে তোর নাম পেদো পাল। তখন বুঝবি। বোকাচোদা কোথাকার।
দাঁড়কাক ফ্লাই করিয়া চলিয়া গেল। চুরুটের গন্ধ। জানলার আলশেতে ন্যাড়ের মত দেখতে চুরুটের ছাই। পিশাচদমন চাকরকে নিচে পাঠিয়েছিলেন সোডা আনতে। ওপরে ওঠার আগে সে লেটার বক্স থেকে চিঠি এনেছে। প্রতিটি খামের ওপরেই লেখা- পেদো পাল। পিশাচদমন ফিল করলেন তাঁর পা দুটো ক্রমেই আইস কোল্ড হয়ে যাচ্ছে। কোনো ভুল নেই। প্রত্যেকটা খামের ওপরেই সেই ডাকনাম উইথ পদবী – পেদো পাল, পেদো পাল!
‘কাঙাল মালসাট’ – এর ভাগ্যে সামান্য যে নন – কমার্শিয়াল ব্রেকটুকু জুটেছিল তা শেষ হয়েছে। সেই সঙ্গে শেষেরও শুরু হয়েছে বলে দাবীও উঠেছে যদিও তা চটজলদি না মানলেও চলবে।
কমিশনারসাহেব জোয়ারদার। ছিন্ন মুন্ড বসানোর হেলমেটটি নেই। মুন্ডু কাটা যাওয়ার পরে অনেক টাইম পেরিয়েছে। এন.আর.এস -এর ডোমদের সঙ্গে স্পেশাল কনসালটেন্সির মাধ্যমে চাঁদনি- তে অর্ডার দিয়ে একটি এলুমিনিয়ামের হালকা কাঠামো বানানো হয়েছে যা মোটের ওপর হেডপিসটিকে ধড়ের সঙ্গে ধরে রাখতে পারে। স্লাইটলি খাঁচা ধাঁচের। তবে সুপ খাওয়ার সময়ে মাথা আর ঝুপ করে সুপের বোলের মধ্যে ডাইভ দেয়না। টাকা পয়সার টানাটানি থাকলেও এই কনট্র্যাপশনটির খরচ বহন করেছে রাইটার্স। প্রথমে শোনা গিয়েছিল সরকার খরচ দেবেনা। জোয়ারদার খচে গিয়ে বলেছিল,
– অন – ডিউটি বিহেডেড হলাম। সেটা যদি কনসিডার না করে তাহলে ঐ হেলমেট দিয়েই চালিয়ে নেব। আর তো দুটো বছরের মামলা। এরপর শান্তিনিকেতনের বাড়িতে যখন দোলনায় বসে বসে সুইং করবো তখন তো ফ্রি অ্যাজ আ বার্ড। মাথাটা না হয় পাশে মোড়ার ওপরে রেখে দেব।
ললিতা জোয়ারদার বলেছিলেন,
– পরের কথা পরে। এখন ও নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমার দোলনা চড়ার যেমন প্ল্যান আমারও একটা আছে।
– কী? বাগান?
– বাগান তো চাকররাই করতে পারে। ভাবছি একটা এন.জি. ও খুলব। সাঁওতালদের মধ্যে কাজ করবো। ব্ল্যাকস! পুওর নিগারস।
– এক একটা কথা বলো না শুনলে গা জ্বলে যায়। কোথায় শেষ কটা দিন টেগোরিয়ান অ্যামবিয়েন্স এনজয় করবো। তা না, উনি চললেন সাঁওতাল ধরতে। সাঁওতাল কী তা জানো? অসম্ভব ভায়োলেন্ট। যখন তখন ক্ষেপচুরিয়þাস হয়ে ওঠে! … বরাবরই এরা এরকম। রিড … রিড … সানতাল রেবেলিয়ন … মিষ্টিরিয়াস ড্রাম বিটস, পয়জনড অ্যারো … বৃটিশদের অব্দি হালুয়া টাইট হয়ে গিয়েছিল আর উনি কি না …
ডি.এস -এর কী হল সেটা এবার জানা যাক। অবশ্য তার আগে জেনে নিতে হবে কেন এমনটি হল। ক্যাপচার তো পরের মামলা।
পুরন্দর সেই বিকেলে যখন ডি. এস -এর সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের সামনে দেখা করে তখন থেকেই দেখেছিল ডি.এস -এর মেজাজ বেশ খাট্টা। ফুটপাথের ফলের দোকানের সামনে হোঁচট খেয়ে ফলওয়ালির সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিল। পানের দোকানে লোকটা অর্ডারি পান সাজছিল বলে পাঁচটা ছোট চারমিনার দিতে দেরি হওয়ায় ঝামেলা পাকালো।
– বড়লোকের অর্ডার বলে গাঁড়ে রস হয়েচে, না? পানের দোকানের লোকটা চালু মাল। না শোনার ভান করে চেপে গেল। ওখানে ডি. এস -কে ধরে প্যাঁদানো তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু পাকা ব্যবসাদাররা খুচরো ঝুটক্যাচালে কখনও যায় না। সেখান থেকে ওরা গেল গাঁজা পার্কের বাংলুর ঠেকে। ভেতরে হেভি ভিড়। সবসময়েই থাকে। আর বেশির ভাগ খদ্দেরই পাঞ্জাবি। ইয়া ইয়া আড়া। ঠেলেঠুলে কাউন্টারে যাও, পয়সা জমা করে গেলাস নাও, বসার জায়গা না পেলে যে কোনো ঘাপচি ঘুপচি দেখে উবু হয়ে বসে যাও – এক কথায় বিস্তর হাল্লাক।
– মদনদার কেসটা কী বলো তো! আসচে না দুদিন হয়ে গেল।
– কি জানি! ভদিদা হয়তো কোনো ডিউটি দিয়েচে। বলা বোধহয় বারণ।
– তা হবে। তবে গত বছরও এই টাইমটা দেখেছিলাম মদনদা কেমন মন মরা মন মরা ভাব। মনে হয় এমন টাইমে ওর বউ পালিয়েছিল।
পুরন্দর কোনো জবাব দেয় না। বাংলার গ্লাসে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সাবজেক্টটা নিয়ে পুরন্দর ঘাঁটাতে ইচ্ছুক নয়। তাই সে অন্য কথা পাড়ে,
– অনেকদিন তোমার বাচ্চাকে দেখিনি। কত বড় হলো মালটা?
– সাইজে বাড়চে কম। তবে খুব হারামি।
– কার পয়দা দেখতে হবে তো। পাঁইটটা জমলোনা। কি বলো?
– একটা পাঁইট, দুজনে জমে? শুনলে লোক হাসবে। যাই, আর একটা নিয়ে আসি।
ডি . এস পাঁইট আনতে গেল। পুরন্দর ভাবছিল মাল যখন ধরেছিল তখন একটা ফাইলেই কেমন মজে যেত। একটা কবিতার প্রথম লাইনটা ঝিলিকও দিয়েছিল – ‘খুললে বন্ধ হবে, এ ফাইল সে ফাইল নয়’। কিন্তু আর এগোনো গেলনা। ভেতরে মানে কাউন্টারের দিকে বাওয়াল। বাওয়ালের মধ্যে ডি . এস -এর গর্জন! পুরন্দর তড়িঘড়ি উঠে সেই দিকে গেল। পুরো কেলো। ঘিয়ে রঙের ঝোলা ফুল সার্ট আর ধুতি পরার সঙ্গে ডি . এস -এর লেগে গেছে। কাউন্টার থেকে মাল নিয়ে ব্যাক করার সময় ধাক্কা লেগে গেছে। লোকটাকে দেখেই পুরন্দর ধরতে পেরেছে – প্লেন ড্রেসে কনস্টেবল। বিহারী মাল। যেমন আড়া তেমনই বহর। অন্যরা ছাড়াচ্ছে, সে বলছে,
– দেখলেন তো, পহেলা হাত চালিয়ে দিল! শুনেন ফির ভি খিস্তি বানাচ্চে।
– স্রেফ তো হাত চলেচে। এরপর আর হাতফাত নয়, মেশিন চলবে – দনাদ্দন, দনাদ্দন!
– শালা পুলিশকা উপ্পর মেশিন। ছাড়িয়ে দিন, মালটাকে থানায় লিয়া যাই। আচ্ছাসে বানাই।
– উঃ পুলিশ দেখাচ্চে। পুলিশের আমরা ঘাড়ে হাগি! বানাচ্চে। উল্টে বানিয়ে দেব। হালুয়া জানতা? হালুয়া!
ক্রমেই ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠা এই ঝামেলার থেকে ডি.এস -কে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে পুরন্দর। ডি.এস ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে, ঘামছে।
– ফালতু বাওয়ালে জড়িয়ে ফয়দা আচে কিচু? কোতায় মাল টানবো, ধুনকি ধরে কেটে পড়বো – ছাড়োতো।
– হাত চালাতাম না। বাঞ্চোতটা ঘপ করে কলারটা ধরলো বলেই তো …
গাঁজা পার্কে রেলিং, মানে মোতাগলির দিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওরা পরে কেনা পাঁইটটা ভাগাভাগি করে খেয়েছিল। সঙ্গে চিংড়ির বড়া। এইসা ঝাল যে দুজনেরই হেঁচকি উঠতে থাকে। এরপর ওরা হাঁটতে শুরু করেছিল বড় রাস্তা ধরে, বাঁদিকে।
এদিকে পুলিশের ওপরে তো কড়া ইনস্ট্রাকশন ছিল যে চাকতি কোম্পানির মাল দেখলেই সাইজ করার। ঘিয়ে ফুল শার্টের ঘোর সন্দেহ হল যে দনাদ্দন দনাদ্দন মেশিন চালাবার থ্রেট যে দিতে পারে সে এলিতেলি নয়। বলা যায় না। নাটকা মালটাকে ক্যাপচার করার জন্যেই হয়তো অ্যাওয়ার্ড ফ্যাওয়ার্ড জুটে যেতে পারে। অতএত ঘিয়ে ফুল শার্ট উল্টো ফুট দিয়ে ডি. এস আর পুরন্দর ভাটকে ফলো করতে শুরু করে। ওদিকে ডি.এস -ও তখন যে কোনো সময়ে ফলো অন হয়ে যাওয়ার অবস্থায় যা ইন্ডিয়ার ক্রিকেট দল প্রায়শই এড়াতে পারে না। এর মধ্যে, যেটা ঘটেছিল সেটা হল সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতা। একদিকে যেমন লড়াই -এর প্রস্তুতি (গেরিলা অথবা পোজিশনাল কায়দায়) অন্যদিকে দেদারে ইনটেলিজেন্স গ্যাদারিং। এ বিষয়ে স্পেশাল কিছু কোডও চালু করা হয়। ডি. এস আর পুরন্দর চক্রবেড়ের ঘোড়ার গাড়ির আড্ডার মোড় পেরলো। দুজনেই তখন জিগজ্যাগ ধাঁচে চলছে ফলে বাংলা সিনেমা দেখে বেরোনো মেয়েরা সভয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। অতীতেও এরকম হত। এই ফুটপাথ ধরেই সুর ভাঁজতে ভাঁজতে হেঁটেছিল সাইগল, রবীন মজুমদার – আর সেই ফুটেই চলেছে ডি. এস আর পুরন্দর ভাট। এরই ফাঁকে ঘিয়ে ফুল শার্ট পকেট থেকে পাস বের করে দেখিয়ে একটা ভ্যাঁটকামুখো লোকের মোটোরোলা মোবাইল থেকে ফোন করেছিল ভবানীপুর থানায়, কোড ল্যাঙ্গুয়েজ জানা গেল এবার,
– হুঁ … অঁ … হ্যালো।
– মুকদ্দর?
– সিকান্দর।
– ছপ্পর পর কৌয়া নাচে …
– নাচে বগুলা …
মেসেজ দিয়ে ঘিরে ফুল শার্ট ভ্যাঁটকামুখো লোকটাকে বলল,
– কিছু শুনেন নাই তো!
– না। ঐ কি ছপ্পড় টপ্পড়।
– ভুলিয়ে যান। চুপচাপ চলিয়ে যান। দিনকাল বহোৎ খারাব আছে।
ভ্যাঁটকা আর ট্যাঁ ফুঁ না করে ফেটে গেল।
ওরা পূর্ণ সিনেমার মোড় পেরোলো।
পুরন্দর ভাট বলল,
– চপ খাবে? একটু বাঁ দিকে হেভি সব ভাজে, কাটলেট …
– কঁক।
– আর একদিন বরং খাওয়া যাবে।
– অঁক!
– বমি পাচ্চে?
ডি. এস হেসে মাথা ঘুরিয়ে জানালো – না। তারপর জড়িয়ে জড়িয়ে বলল
– ধু … ন … কি। ধু … ন … কি!
এরপর ডি. এস কয়েক পা করে এগোয় আর দাঁড়িয়ে যায়।
– র মালটা কেন যে মারতে গেলে …
ডি. এস টলে, সামলায়, ফের টলে,
– ওসব র ফ – তে ডি. এস -এর … জা … ন … বে কিচু হয় না।
– সে তো জানি। ডি. এস বলে কথা।
ওরা ক্যানসার হাসপাতালের ফুটে। শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের খাবারের গন্ধ পেছনে। ঠিক এই সময়ে ক . পু. লেখা ভ্যানটা ফুট ঘেঁষে থামলো , হুইসল এর শব্দ, দুদ্দাড় দৌড়। কোত্থেকে পায় জোর পেয়ে গেল পুরন্দর, ডাইনে বাঁয় টলমলে দুটো আলতো ভাঁজ রোনাল্ডোর স্টাইলে তারপরে উইথ বল খিঁচে দৌড়। পাবলিকও ধুড়। তারাও হুটপাট, আনতাবড়ি দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দেয়। ডি . এস ধরা পড়েও ঝটকাঝটকি করে। এর পরের ঘটনা আমাদের জানা।
ভদির উঠোনে চিৎকার চেঁচামেচি এমন তুঙ্গে উঠতে থাকে যে ভদি দেখল উত্তেজনা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। পুরন্দর উড়ে গিয়ে মদনকে খবর দিয়েছে। মদন উত্তেজিত অবস্থায় দাঁত না পরেই চলে এসেছে। বেচামণি মাঝেমধ্যে, গুমরোনোর ফাঁকে ফাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি বলছে। রিটায়ার্ড মেজর বল্লভ বক্সী ‘চার্জ! চার্জ!’ বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন। নলেন একটি টিনের লগবগে খাঁড়া নিয়ে লাফাচ্ছে। পাঠকের নিশ্চয় স্মরণে আছে যে এই খাঁড়া দিয়েই একদা ফ্যাতাড়ু তিনজনকে বলি দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল। এরকম অবস্থাতেই নেতৃত্বের হাত বদল হয়ে থাকে। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। এক্ষেত্রেও সেটা ঘটল। কিন্তু সাময়িকভাবে। হঠাৎ শোনা গেল গুমরোনো নয়, বিড় বিড়ও নয়, বেচামণি খিলখিলিয়ে হাসছে। ভদি রেগে মেগে বলে উঠেছিল,
– এ কেনে কি রগড় হচ্ছে না বটকেরা? নলেন তোর বউদির মাতাটা কি একেবারে গেচে?
বেচামণি সলজ্জ হাসিয়া ঘোমটা টানিল। সেইসহ মাজায় ছোট্ট একটু ঝাঁকুনি।
– আর চিন্তা নেই। বাবা আসচে।
সত্যি, সেই সময় দাঁড়কাক না এলে ‘কাঙাল মালসাট’ হয়তো বিয়োগান্ত এক সিরিয়াল গাথা হিসেবেই অমর হয়ে থেকে যেত।
– বাবা! বাবা! সব্বোনাশ হয়ে গেছে! ডি .এস নেই।
সকলেই চুপচাপ। দাঁড়কাক খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো।
– সে কি বাবা। ডি. এস মরে গেল আর আপনি …?
– কেন, না হাসার হয়েচেটা কী? কি হয়েচে ডি. এস-এর?
– পুরন্দর সঙ্গে ছিল। হাজরা পার্কে পুলিশ অ্যাটাক। ডি. এস কিলড ইন অ্যাকশন।
– বাল!
– মানে?
– বাল মানে বাল। পিউবিক হেয়ার। কোঁকড়া।
– মুখ খারাপ করচেন করুন তাবলে ইংরিজিতে …
– চোপ। কিস্যু হয়নি ডি. এস -এর। আগে হাফ পাঁইট উইথ পানি তারপর এগেন টু থার্ডস পাঁইট উইদাউট পানি অর সোডা, কোক, পেপসি বগেরা বগেরা – এরপরে খোঁচোরের পেটে টিক – প্রায় আউট হয়ে গিয়ে রাস্তায় – কি রে ব্যাটা পুরন্দর!
– বাবা!
– ভেবেছিলিস তোরাই আচিস, তোরাই খাচ্চিস, আর কেউ নেই?
– আপনি ছিলেন? কই দেখলুম না তো।
– ছিলাম শুধু তাই নয়, একা ছিলাম না। বেগম জনসনও ছিলেন। তবে সূক্ষ্ম দেহে। দেখবি কি করে?
– বলুন বাবা, বলুন। ধড়ে যেন লাইফ ফিরে এল।
– বলচি। নলেন, একটু জল আন তো। নো মাল পাঞ্চিং – পিওর পানি।
গেলাসে জল এল। দন্ডবায়স চঞ্চুতে জল নিয়ে মাথা ওপরে ঝাড়লো তারপর এক পা এক পা করে ডুবিয়ে পা ধুলো।
– ডি. এস -কে ওরা আউট অবস্থায় নিয়ে গেল প্রথমে ভবানীপুর থানা। সেখানকার ও.সি ব্যাটা খবর দিল লালবাজারে যে ভেরি ইমপরট্যান্ট মাল ক্যাপচার্ড। এখন তাকে নিয়ে গেছে লালবাজারে। কাটামুন্ডু জোয়ারদার নাকি তাকে ইন্টারোগেট করবে।
এতক্ষণে ভদি একটু ধাতস্থ হয়েছে,
– লালবাজারে জেরা! কি করে কি হবে তাহলে?
– ওসব আমার ফিট করা হয়ে গেচে। আমি এক লাইনে ভাবছিলাম। কিন্তু বেগম জনসনের বাতলানো রাস্তাটাই দেখলাম ভাল। সব মিটে যাবে। ডি. এস ইজ সেফ অ্যান্ড সাউন্ড। তবে এখনও ধুনকিতে রয়েছে। থাকুক না।
ডি . এস -কে গাড়িতে তোলার পরে ভ্যানের তলাতেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিকট নাক ডাকার শব্দ। ভবানীপুরের ও. সি হটলাইনে জোয়ারদারকে বলেছিল,
– ওয়ান মাল কট সার। বলছিল পুলিশের ওপর মেশিন চালাবে। দনাদ্দন দনাদ্দন। আর একটা ছিল। এসকেপড।
– পকেটে কি ছিল? মেশিন মানে বামাল তো?
– আজ্ঞে হ্যাঁ সার। দেখেচি। নো বামাল। ওনলি চিরুনি।
– গুড। এখন কি করছে? তড়পাচ্ছে? না গাঁইগুঁই করছে?
– কিছুই না সার। মাল খেয়ে আউট।
– বলো কি? তাহলে তেমন ইমপরট্যান্ট এলিমেন্ট বলে মনে হয় না।
– না, না, সার। হেভি ইমপরট্যান্ট। দাম করে একটা ব্লো দিয়েছে আমাদের লোককে। পেটে।
– আ ব্লো ইন দা বেলি?
– ইয়েস সার।
– বুঝেছি।
– কি সার?
– তোমার আর জেনে কাজ নেই। স্ট্রেট পাঠিয়ে দাও। বাকিটা আমি দেখছি।
ডি . এস যখন ভবানীপুর থেকে লালবাজারে চালান হয় তখন সেই ফাঁকে জোয়ারদার কমরেড আচার্যকে জানিয়ে দিলেন যে মিউটিনির একজন সাসপেক্ট পাকড়াও। কমরেড আচার্য বললেন,
– বাঁচলাম। এই তাহলে শুরু হল।
– কী শুরু হল।
– মানে ধরা পড়া আর কি। আমি তো ভাবছিলাম আপনাদের যা হ্যাবিট সেই নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্চেন।
– কি যে বলেন সার।
– যাই হোক, কনগ্র্যাচুলেশন। এবার খাপাখাপ বাকিগুলোকেও ধরে ফেলুন। ল্যাটা চুকে যায়। তবে হ্যাঁ, সাবধানে। কথা বের করতে গিয়ে এমন কিছু করে বসবেন না যাতে হিউম্যান রাইটস কমিশন আবার হাঁ হাঁ করে ওঠে।
– ঐ এক ফ্যাকড়া হয়েছে সার। ধরবো অথচ বানাতে পারবো না। বলুন, এ করে পুলিশের কাজ চলে?
– যাই হোক, শুরু করে দিন তাহলে পেয়েই যখন গেছেন। কাল ডিটেলে শুনব। গুড নাইট।
– গুড নাইট!
এরপরে রাত যে কোনদিকে মোড় নেবে সে সম্বন্ধে তিলমাত্র ধারণা থাকলেও কেউ এমন রাতকে গুড নাইট বলতে পারে না। যাইহোক, সে তো পরের ব্যাপার। এখন এইটুকু গাওনা গেয়ে রাখলেই চলবে যে ‘১৬’ নং পক্কড়ে আমরা ক্ষণিকের জন্যে হলেও লালবাজারের এক অকিঞ্চিৎকর কনস্টেবলের সন্ধান পেয়েছিলাম যার নাম হল নক্ষত্র নাথ হাওলাদার। এতক্ষণ সে সাতটা হাতি মিলে খেতে পারবে না এরকম উঁচু খড়ের গাদায় একটি সামান্য ছুঁচ হয়ে অবহেলা অপমান বহন করে পড়েছিল। নক্ষত্রনাথ হল স্লিপার, পায়ে পরার নয়, ঘুমন্ত অর্থে। এবার তার ঘুম ভাঙবে এবং চোক্তারি মায়ার স্পর্শে সে পরিণত হবে ফালে। তাহলে একটু খুলে বলতে হয় যে গোলাপের ফেরে পড়ে প্রথমে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠেন তারকনাথ সাধু এবং তারপর তারকনাথ সাধুই নক্ষত্র নাথ হাওলাদারকে ‘বিদ্রোহী’ করে তোলেন। তারকনাথের খচে যাওয়ার কারণ ছিল কারণ তাঁকেই বলা হয়েছিল ‘রোজ’ -কে গ্রিল করতে। তিনি দেখেছিলেন যে এত বছরের বিশ্বস্ত যে গোলাম সেই হয়ে উঠেছে সন্দেহের টার্গেট। বলা যায় না তাঁকেও হয়তো ওরা টার্গেট করে ফেলবে যারা ফাইল ফেরৎ পাঠিয়েছিল ‘বাল’ ও ‘পাগলাচোদা’ জাতীয় অশ্রাব্য কথা মলাটে লিখে। হাওলাদারের ছিল সাধুর প্রতি শ্রদ্ধা। ‘সাধু’ পদবীটিই তাকে ম্যাগনেটের মত টেনেছিল। সেই সাধুবাবাই যখন লালবাজারের কাছেই একটি রেষ্টুরেন্টে বসে হাওলাদারকে মামলেট আর টোস্ট খাওয়াতে খাওয়াতে ও খেতে খেতে বললেন,
– হাওলা, এই যে পুলিশের ঘর করে বাল পাকিয়ে ফেললে, কালই যদি টেররিস্ট বা ড্যাকইটের দানা খেয়ে ফুটে যাও ভেবেছো কোনো মামা চোখের জল ফেলবে? কাঁড়ারের কেসটা দেখলে? মালাফালা দিল, পুড়ে গেল, তারপর? ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে ঘুরছে। বৌটার হাল দেখেছ?
হাওলাদারের জিগরি দোস্ত ছিল কাঁড়ার। তার চোখ জলে ভরে ওঠে এবং কপালের ভাঁজগুলো কাঁপতে থাকে।
– বশীরের বেলায় কি হল বলুন?
– ওফ বশীর। অমন একটা মানুষ। অমন তরতাজা। কেঁদোনা। হাওলা। কান্নাকাটি ঐ খানকির ছেলেরা অনেক দেখেছে। কাঁদলে হবে না। এদের দাওয়াই অন্য।
– আছে? দাওয়াই?
চ্যাংদোলা করে ডি. এস -কে লালবাজারে ঢোকানো হল।
ভদির উঠোন। সবাই চলে গেছে। দাঁড়কাক, ভদি, নলেন, বেচামণি, মদন, সরখেল, পুরন্দর ও মেজর বল্লভ বক্সী। দাঁড়কাক একটি কালো পাথরের বাটিতে ভরা জল একটি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখছিল ও বলে যাচ্ছিল,
– এই! এই! লালবাজারে ঢোকাচ্চে। বাসস, ঐ লাশ!
– বাবা! লাশ কেন বললেন? তবে কি?
– চাপ। বাটি দেখার সময়ে ওসব নিমকিছেনালি? হ্যাঁ, লাশ! জিন্দা লাশ। এবার নিয়ে যাচ্চে। যাবে বাবা কোথায়? সেই তো জোয়ারদারের ঘরে।
যদিও এখানে ইন্টারকাট পদ্ধতি লাগু তবু এটি কিন্তু সিনে-রোমাঁ নয়। জোয়ারদারের ঘর। কার্পেটের ওপরে ডি.এস -কে শুইয়ে দেওয়া হল। জোয়ারদার এক্সাইটেড।
– তুমি কে?
– আঁজ্ঞে, আমি হাওলাদার।
– গুড! গুড! বাইরে থাকো।
– স্যার?
– অঁ?
– মাল টেনে আউট কিন্তুক ডেঞ্জেরাস। আপনি একা দেখবেন?
– ওয়েল, মিঃ হাবিলদার, আই অ্যাম জোয়ারদার!
– ইয়েস সার।
নক্ষত্র নাথ হাওলাদার দরজার বাইরে দাঁড়ায় ও বিড়ি ধরায়।
দাঁড়কাক, পাথরের বাটির ভেতরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে,
– নড়চে ! নড়চে!
– কী নড়িতেছে পেভু?
প্রশ্নটি রিটায়ার্ড মেজর বক্সীর।
-তোমার ঐটি! বকরিচোদ।
এই খিস্তিটি মেজর বক্সীর মনে দাগ কাটায় তিনি মৌন হয়ে যান। মিলিটারির এই হল ধাঁচ। ন্যায্য খিস্তিþ তারা সংযতভাবে ভক্ষণ করে। আবার উল্টোটা হলে নল যে ঘুরিয়ে ধরে না এমনটাও বলা যাবে না।
ডি. এস. প্রথমে ভেবেছিল সে হাজরা পার্কে ঘাসের ওপরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু হাজরা পার্ক তো ন্যাড়া। সেখানে আবার এত ঘাস কবে গজালো? এই ভাবনার মধ্যে জোয়ারদারের ইয়া বড় চেম্বারের কার্পেট তার কাছে বাড়ির বিছানা হয়ে গেল। আবার চোখে ঘোলা ঘোলা আলো, তার মধ্যে এলুমিনিয়ামের খাঁচা পরা জোয়ারদারের মুখ, রুম ফ্রেশেনারের গন্ধ, এ. সি. চলার শব্দ, এর মধ্যে আবার ফোন বাজলো।
– হ্যালো ……. ফালতু কেন যে জ্বালাও ……. আই অ্যাম অন ত্রু�শিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট …….. নিকুচি করেছে তোমার মাশরুম সুপের …….. হ্যাঁ, হ্যাঁ, একা একাই গেলো অ্যান্ড ফর গডস সেক এখন ডিসটার্ব কোরোনা ……. হ্যাঁ রে বাবা, গুড নাইট …… ঘুম পেয়ে গেছে তো ঘুমোও ….. গুড নাইট …… উফ – পেস্ট! ধিঙ্গি মাগি ……. ন্যাকামি ……. হান্টার দিয়ে চাবকাতে হয় ……
ডি. এস. হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসেছিল, দেখল জোয়ারদার, এলুমিনিয়াম ফ্রেমের মধ্যে মুন্ডু, হাসছে,
– কাটলো? নেশা! গন্ধটা বোধহয় কানট্রি লিকারের। তাই না?
ডি. এস. এরপর টোটাল তিনটে ডায়লগ দিয়েছিল। সেটা হতেই পারে কিন্তু তিনটি ডায়লগই কেন হিন্দিতে তা কখনও জানা যাবে না।
– কেয়া?
এর জবাবে জোয়ারদার কঠোর বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্টার্ন’ মেজাজে বলেছিল,
– কেয়া এক্ষুণি বুঝবে। মাল খেয়ে আউট, তার ওপর রোয়াব? এবারে ঝেড়ে কাশোতো – আমাদের কাছে যে ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট এসেছে তাতে রেবেলরা দুই পার্টির। চোক্তার অ্যান্ড ফ্যাতুাড়ু। তুমি কোনটা?
– পহলে মাল বুলাও!
– মানে? লালবাজারে বসে মাল খাবে? ইয়ার্কি দেওয়ার একটা লিমিট আছে। আর ইউ চোক্তার অর ফ্যাতুাড়ু?
এইবার ডি. এস. তার নোংরা টেরিকটনের প্যান্টের জিপটা ধরে টানতে থাকে,
– মুতেগা কাঁহা?
ওদিকে দাঁড়কাক আনন্দে ডানা ঝাপটায়। বাকি সকলেই সোৎসাহে তার দিকে তাকিয়ে।
– সলিড জবাব। লে, কী বলবি বল। বেশি তেড়িবেড়ি করলে কার্পেটেই দেবে ছনছন করে …….. চলবে …….. ডি. এস. …….. ব্রাভো ……
জোয়ারদার চেঁচায়,
– হাবিলদার! হাবিলদার!
হাওলাদার ঢোকে।
– সার!
– যাও! আসামীকে মুতিয়ে আনো। ধরে রাখবে। মালটা এসকেপ না করে।
– এখান থেকে পলায়ন। কী যে বলেন। চলেন …….. আপনাকে মুতিয়ে আনি, সাহেবের অর্ডার।
হাওলাদারের সঙ্গে টলমল করে বেরোতে বেরোতে ডি. এস. দেখেছিল জোয়ারদারের হাতে ব্যাটন। বাঁ হাতে ধরে ডানহাতের তালুর ওপরে আস্তে আস্তে, মোলায়েম করে বাজাচ্ছে। দরজা খুলে বিশাল বারান্দায় বেরোয় হাওলাদার ও ডি. এস.। আরও কয়েকজন কনস্টেবল ছিল। হাওলাদার ডি. এস.-এর কলার ধরে ছিল। অজানা ভৌতিক নির্দেশে আলগা করে দিয়েছিল। দেখলে মনে হবে ধরে আছে কিন্তু আসলে ফস্কা গেরো। আচমকা, গুনগুন করতে থাকে ডি. এস., ফ্যাতুড়াদের ওড়ার মোক্ষম মন্তর,
– ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই!
এবং টলমল করতে করতে টেক অফ করে। সাট করে দেড় মানুষ ওপরে উঠে যায়। তারপর দুহাতে ডানা নাড়তে নাড়তে উড়ে বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিছু একটা হবে এটা হাওলাদার জানতো। কিন্তু সেটা যে এত সাবলীল সেটা ভাবতে পারেনি। সে এবং বাকি কনস্টেবলরা দৌড়ে বারান্দার শেষ অব্দি এসেছিল। আকাশে চাঁদনি প্লাস ডিজেল পোড়া ধোঁয়ার কুহকী ককটেল। তারমধ্যে উড়ে গিয়ে ডি. এস. ক্রমশঃ উঠতে থাকে, আরও, আরও ওপরে। অনেকটা ড্র্যাকুলার স্টাইলে।
জোয়ারদার তখন ভাবছিল যে ম্যারাথন মোতা চলছে। কিন্তু এত টাইম ধরে? জোয়ারদার বেল বাজালেন ও সেই সঙ্গেই চেঁচাতে লাগলেন,
– হাবিলদার! হাবিলদার!
হাওলাদার ও অন্যান্য সব কনস্টেবলই হাঁউ মাঁউ করতে করতে দৌড়ে এসেছিল। তাদের দেখতে ভীত ও উৎকন্ঠিত কৌয়া ও বগুলার মত। এর ঘন্টাখানেক পরেই, জোয়ারদার তখন কফিতে মাত্র দুটো চুমুক মেরেছেন, ভবানীপুর থানা থেকে ফোন।
– ওসি ভটচায বলচি স্যার। থানার ওপর বম্বার্ডমেন্ট হচ্চে সার।
– মানে? বম্ব না শেল?
– না সার থানকা ইট, নোংরা কাদা ভরা ভাঁড়, হাঁড়ি, গু, ভাঙা বালতি এই সব পড়চে। একেবারে কার্পেট বম্বিং!
– এর জন্যে আমাকে ফোন কেন? যারা এসব ফেলছে তাদের ধরে লক-আপ করে দাও।
– কাকে ধরব সার? ওপর থেকে পড়চে। কিছু উড়ন্ত ফিগার দেখা যাচ্চে কিন্তু ভিজিবিলিটি এত পুওর, তাছাড়া যে দেখবে তারও তো ডেঞ্জার ……… দমাদম ফেলচে
– মানে বলচো অ্যান অ্যাটাক ফ্রম আউটার স্পেস?
গদাম করে একটি শব্দ।
– শুনলেন সার …….. সাউন্ড?
– কি পড়লো ওটা?
ও. সি.-র চিৎকার শোনা যায়,
– কী পড়লো? ও …… সার, একটা টব ……. গাছ সমেত।
– দেখছি কী করা যায়।
জোয়ারদারের কিছুই করার ছিলনা ফোনটি রেখে দিয়ে চোঁ চোঁ করে বাকি কফিটুকু মেরে দেওয়া ছাড়া। খোদ লালবাজার থেকে আসামী উধাও। এবং তাও স্রেফ উড়ে। কাল রাইটার্সে কী বলবেন জোয়ারদার? সি. এম. এমনিতেই মেজাজী লোক তার ওপরে …….
আবার ফোন। দুরু দুরু বক্ষে ফোন ধরলেন নগরপাল। উল্টোদিকের কন্ঠস্বরটি বেশ জাঁদরেল।
– আপনি নগরপাল সাহেব আচেন?
– ইয়েস, মানে, আপনি কে?
– আমি রিটায়ার্ড মেজর বল্লভ বক্সী। লাইন ধরিয়া রাখেন। মার্শাল ভদি বাত করবেন।
– অ্যাঁ মার্শাল ভদি ……. তিনি কে?
ততক্ষণে ভদি রিসিভার নিয়ে নিয়েছে।
– আমি কে? আমি আমি। মার্শাল ভদি। কারেন্ট বংশধর অফ আত্মরাম সরকার। চাকতি মনে আছে। মুন্ডু কুচ। মনে আছে?
– মনে আর থাকবে না? অন-ডিউটি বিহেডিং। ভাল মনে আচে।
– ঐ চাকতি কোম্পানি আমার। আমি মার্শাল ভদি।
– নমস্কার ভদিবাবু!
– নমস্কার। আজ আমার লোককে আপনারা ক্যাপচার করেছিলেন।
– পারলাম না। রাখতে। উড়ে পালালো।
– যাই হোক, আমি ওয়ার ডিক্লেয়ার করচি।
– ভবানীপুর থানা তে তো ……
– ওতো সবে কনসার্ট! এরপরে আসল লড়াই। কালই ধুড়ধুড়ি নড়ে যাবে।
– মার্শাল! মার্শাল ভদি? মার্শাল!
ফোন চুপ। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন জোয়ারদার। রাত বারটা দশ। লালবাজারের ওপরে আকাশ থেকে দুমদাম পেটো পড়া শুরু হল। বিদঘুটে আওয়াজ। দরজা জানলা সব কাঁপছে। টেবিলের ওপরে কফির পেয়ালা ও প্লেট নাচছে। বম্ব স্কোয়াডের লোক এসে বললো একটা পেটোতেও সচরাচর যা যা থাকে সেই পেরেক, বল-বিয়ারিঙের গুলি বা লোহালক্কড়ের টুকরো ওসব নেই।
– স্ট্রেঞ্জ!
– তবে হেভি সাউন্ড সার!
– অবাক হয়ে যাচ্ছি! বুঝলে। সেই সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে জাপানীরা ক্যালকাটা বম্ব করেছিল। তার পর এই।
(চলবে)
২০
র্যাফ সহ পুলিশের একটি বাহিনী কালীঘাট ট্রাম-ডিপোর দিক থেকে গোটা রাস্তা মানে দুপাশের আপ ও ডাউন রাস্তা ও ট্রামলাইন সংলগ্ন জমি ধরে এগোচ্ছিল। অন্তত দশটি ক.পু লেখা ভ্যান ছিল। এই বাহিনী মার্চ শুরু করে সকাল দশটা নাগাদ। এগোচ্ছে… এগোচ্ছে….।
রাসবিহারী মোড়ের কাছে একটি সেলফোনের কোম্পানীর বিশাল হোর্ডিং লাগানো বাড়ির ছাদে রং-ওঠা মিলিটারির জ্যাকেট, টুপি ও প্যান্ট পরে অপেরা-গ্লাসে লক্ষ্য রাখছিলেন মেজর বল্লভ বক্সী। ছাদের দুটি থামের বুরুজের মধ্যে অপেক্ষারত লিসবনে নির্মিত পর্তুগিজ নুনু কামান। বারুদ ঠেসে গোলা ভরে রাখা।
লক্ষণ-রেখা ছিল শাহরুক খানের পোস্টারে ঢাকা একটি দেওয়াল যার গায়ে ক্লান্ত পথচারীরা মুতে থাকে। এটা পুলিশের জানা ছিল না। আগুয়ান পুলিশ-বাহিনীর একটি ভ্যানে বসে ছিল টালিগঞ্জ থানার টাকলা-ও সি।
মেজর বল্লভ বক্সী মনে মনে গুনছিলেন ১০… ৯ … ৮… ৭ … ৬ … ৫… ৪… ৩… ২…১…
মেজর বল্লভ বক্সী হুঙ্কার ছাড়লেন,
-ফায়ার!
গর্জে উঠলো নুনুকামান! গুড়ুম!
কলকাতায় আম্রবন নেই ভাগ্যিস। তবে মেন গঙ্গা নদী না ডিসটার্বড হলেও আদিগঙ্গা যে কেঁপে উঠেছিল তা তো তার ঘোলা ওয়াটারই জানে। পাঠকেরা সেই জলেই আলোড়ন দেখে থাকবেন হয়তো। সেই বেলায় নভেলিস্ট একটি পোস্টকার্ড-এ ভাঁজ করে বানানো পেপার বোট ঐ জলেই ভাসিয়েছিল। সেটি কেতরে পড়ে ও তার গলুইতে নোংরা জল ঢোকে। এবং এর কিছু পরেই কাঁকড়ারা নৌকোটিকে দাঁড়ায় ধরে জলডোবা করে ফেলে। লেখকদের ভাগ্যে এরকমই সচরাচর ঘটে। ‘কাঙাল মালসাট’-এর বেলাতেও এই নিয়মের অন্যথা না হওয়ারই কথা। যুদ্ধের আস্ফালনে এসব মাইনর ডিটেল কারও চোখে পড়ার নয়। পড়েওনি। অতএব ইহা আপাতত ইগনোর করাই যায়।
প্রাচীন এইসব কামান এখনকার বোফর্স টাইপের নয় সে গোলা ভরো আর চালাও, ভরো আর চালাও। আবার মাল ঠাসতে হয়, নলচে ঠাণ্ডা করতে হয়, তবে না পুনরায় অগ্নিসংযোগ ও উদগীরণ। প্রথম গোলাটি গিয়ে টাকলা ও.সি-র ভ্যানের ছাদে পড়ে এবং তারপর পিং পং বলের মত এ ভ্যান ও ভ্যানের ছাদে ঘুরে ফিরে লাফাতে থাকে। এর ফলে ডুম, ডুম শব্দ হয় যা পুলিশের কানে দুন্দুভি বলেই মনে হয়।
মেজর বল্লভ বক্সীর হাঁকাড় চলে।
-পানি ডালো!
হাড় জিরজিরে গজা নামে এক সৈনিক ছাদের পায়খানার মগ থেকে জল ঢালে।
-পোঁদমে কাঁহে ডালতা? সিভিলিয়ান কুত্তা কাঁহাকা। বডিমে ডালো।
গজা কাঁপতে কাঁপতে নুনুকামানের বডিতে জল ঢালে। কেদার রায়ের আমলে ঠিক যেমনটি হত তেমনই আনন্দে কামানটি গায়ে জল পড়তে ভ্যাঁসভেঁসিয়ে ওঠে।
-ফির ঠাসো। শেল লাগাও। ফায়ার ….
এবারে আরও জমকালো। এই শেলটি কক্ষপথেই বিস্ফোরিত হয়ে অসংখ্য ছোট মার্বেল গোলায় পরিণত হয় এবং তারাও আগের বড় গোলাটির অনুসারী হয়ে ক.পু.র ভ্যানগুলির ছাদে ও বনেটে নাচানাচি শুরু করে।
নুনুকামানের গর্জন, সিটি মারার শব্দ করে গোলার আগমন ও ভ্যানের ওপরে নন-স্টপ নাচানাচি পুলিশ বাহিনীর মধ্যে প্যানিক-এর সৃষ্টি করে। তারা এ ওর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের তলায় ঢুকতে চেষ্টা করে।
-এনিমি স্ক্যাটার্ড। ফিরসে ঝাড়ো। ফায়ার…
এবারে গোলাটি নতুন কেরামতি দেখায়-কামানের মুখ থেকে বেরিয়ে সেটি আকাশ পথে খুবই ধীরগতিতে ভাসতে ভাসতে কিছু দূর এগোয় তারপর পুলিশ বাহিনীর মাথার ওপরে গিয়ে দোতলার হাইটে থেমে দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলে অভূতপূর্ব সাসপেন্সের সৃষ্টি হয়। যে পুলিশরা তখনও হামাগুড়ি দেয়নি তারাও এবার পালাতে শুরু করে। মাথা থেকে টুপি খুলে টাকলা ও.সি টাক চুলকোয় এবং ওয়্যারলেসে লালবাজারে জানায়।
-হেভি শেলিং হচ্ছে স্যার! কেস গুবলেটিং!
-বলো কি ভায়া! শেলিং হচ্ছে!
গুড়ুম! এবারে ব্যাপক কর্ণবিদারী শব্দ হয়।
-শুনলেন সার। আবার ঝাড়লো।
-শুনবনা? মাথা ঝনঝন করছে। ক্যাজুয়ালটি ফিগার কত?
-নো ক্যাজুয়ালটি সার। তবে ফোর্স ঘাবড়ে গেছে।
-এক কাজ করো। কামানফামানের সঙ্গে গাঁড় মারিয়ে দরকার নেই। রিট্রিট করো। ইমিডিয়েটলি।
-থ্যাঙ্ক ইউ সার!
টাকলা ও.সি ভ্যানের জানলা দিয়ে টেকো মুণ্ডু বের করে চেঁচায়,
– ফোর্স ব্যাক করবে। সব ভ্যানে উঠে পড়ো। কামানের সঙ্গে নো গাঁড় মারামারি।
ভ্যানের তলায়, আশপাশের দোকানে, বাড়িতে যে সব পুলিশরা শেল্টার নিয়েছিল তারা দুড়দাড় করে ভ্যানে উঠতে থাকে। ভ্যানের ছাদে বড় গোলা ও ছোট গোলার দল মহানন্দে তাসা বাজাচ্ছে। পুলিশ বাহিনী পিছু হটতে থাকে।
মেজর বক্সী আনন্দে গজার দাবনায় আলতো করে একটা চাপড় লাগিয়ে অপেরা গ্লাসটি এগিয়ে গিয়ে বললেন,
-দেখো ইয়ার, এনিমি পলায়ন করিতেছে। যাও, ফির পানি লাও। টু সেলিব্রেট ভিক্টরি এক রাউণ্ড করে রাম হয়ে যাক।
গজা ফের ছুটলো পায়খানার মগে করে জল আনতে।
যুদ্ধের এই সাময়িক বিরতি পাঠক একটু ঝালিয়ে নেবার জন্যে কাজে লাগালে মন্দ হয় না। ঝালিয়ে নেওয়ার সঙ্গে কিন্তু ঝালাই করার কোনো যোগ নেই। অবশ্য ঝালাই -এর ব্যাপারটাও একটু পরে আসবে। আসবেই। গরচায় কাঠের গুদামের মালিক কারফর্মা গত রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ দেখেছিল যে সে একটি ওভাল টেবিলের একধারে বসে আছে। বেশ খানদানি মহলের একটি বিশাল ঘর। সেই ঘরে একদিকে সাহেবী ফায়ার প্লেস। তাতে কাঠ পুড়ছে। আবার ঘরে টানা পাখাও চলছে। এবং পাখার হাওয়া হাপরের মতই বারে বারে ঐ কাঠের আগুন উস্কে দিচ্ছে। টেবিলে বিশাল একটি মোমবাতি। ভূতুড়ে পরিবেশ। বাঁদিকের দেওয়ালে ন্যাংটো দেবশিশুদের ছবি। নাদুসনুদুস, ডানা লাগানো। ছবির তলায় আবার আড়াআড়ি করে রাখা দুটো বিরাট সোর্ড। কারফর্মা ঘাবড়ে গিয়ে মনে মনে বলেছিল,
-সাতে নেই পাঁচে নেই, এ বাঁড়া কোথায় এসে পড়লুম!
যেই না বলা অমনি ঝটপট করে একটা বিরাট দাঁড়কাক এসে টেবিলের ওপরে ল্যাণ্ড করলো। কারফর্মা ঘাবড়ে গেল।
-ঘাবড়ে গেলি? অথচ তোর তো ঘাবড়াবার কথা নয়।
-আঁজ্ঞে!
-চার জম্মো আগের কথা অবশ্য তোর মনে না থাকতেই পারে। এই এই ঘরে বড়াখানা হয়েছিল, মাইফেল বসেছিল। ভুলে মেরেþ দিয়েছিস। সব সাহেবরা নেচেছিল। মালের ফোয়ারা ছুটেছিল। হেভি খানাপিনা। মনে পড়ছে? ল্যাম্ব রোস্ট!
-একটু একটু ! একটা ঘোড়ার গাড়ি, ছমছমা শব্দ, ঘুঙুর!
-এই তো। তোর ডিউটি পড়েছিল মিঃ স্লিম্যানের জন্যে একটা খানদানি নেটিভ খানকি আনার।
-মনে পড়ছে এবার!
-না পড়ে পারে? এই মেয়েটিই তোকে মার্ডার করেছিল পরে।
-অ্যাঁ।
-হ্যাঁ, মানে বিষ দিয়ে। যা হোক জায়গাটা চিনলি?
– না তো ।
– এটা হল বেগম জনসনের কুঠি।
ম্যাজিক গতিতে মুখোমুখি চেয়ারে, ওভাল টেবিলের ওপারে, গজিয়ে উঠলেন বিশালবপু জনসন। কারফর্মা যাতে ভালো করে দেখতে পায় তাই দাঁড়কাক এক লাফে পাশে সরে গেল। বেগম জনসন ধানাই পানাই করার পার্টি নয়,
-কাল সকালে, কারফর্মা তোমার দুটি ডিউটি। হামি কোন হ্যাংকি প্যাংকি শুনবো না। না করিলে কী হইবে সেও বলিয়া দিব।
-না,না, অবশ্যই করবো । আপনার অর্ডার।
-গুড ! এই কাগজটিতে মার্শাল ভদির অ্যাড্রেস লিখা আছে।
কাল ঘুম হইতে জাগিয়াই তোমার ড্রাইভার বলাইকে এই ঠিকানায় পাঠাইবে, সে মার্শাল ভদি, বেচামণি, নলেন ও সরখেলকে উঠাইবে। তুমি উয়াদের আন্ডারগ্রাউন্ডে রাখিবার ব্যবস্থা করিবে।
-আঁজ্ঞে আর একটা ডিউটির কথা বললেন।
-দ্যাটস লাইক -আ-গুড বয়, তোমার নেক্সট ডিউটি হইবে লালবাজারে ফোন করিয়া কমিশনার জোয়ারদারকে মার্শাল ভদির ঠিকানাটি বলিয়া দিবে। মিউটিনি লাগিয়াছে জানো, নিশ্চয়।
-আঁজ্ঞে না। গদি সামলাতেই নকড়াছকড়া হয়ে যাচ্ছি, কোথায় মিউটিনি -ফিউটিনি….
-চোপ নটিবয়। একটি মাগিও তো রাখিতেছ। রাখেল। লাস্ট মান্থে তাহার তরে একটি কালার টিভিও খরিদ করিয়াছ… আমার হুকুম যদি অমান্য করো তো ওই রাঁড়ই তোমাকে পয়জন করিয়া মারিবে। সেবার যেমন হইয়াছিল।
-না,না, অবশ্যই করব। দুটোই করব!
কারফর্মা ঘুম থেকে ঘেমেচুমে উঠলো । পাশে বউ। নাক ডাকাচ্ছে। কারফর্মার হাতে ধরা এক টুকরো কাগজ।
ওদিকে দাঁড়কাক বেগম জনসনকে বলছিল,
-তোমার এই কনট্রাডিকটরি স্টেপটা ঠিক ক্লিয়ার হলো না।
-খোলসা করিতেছি। ভদিতো ওয়ার ডিক্লিয়ার করিয়াছে। এখন ফেয়ার প্লেইং ফিল্ডে এসপার ওসপার হওয়া ভাল। আমি টিপুকেও লড়তে দেখিয়াছি। খোলা লড়াই। আর সত্যি যদি বলো হাজার হলেও ঐ লালবাজার আমরাই বানাইয়া ছিলাম। একে বলতে পারো ইভেন হ্যাণ্ডেড জাস্টিস। তবে ভদির বাড়িতে উহারা কিছুই পাইবে না। উপরন্তু নাজেহাল হইবে। লালবাজারে ঠিকানা না জানাইলে তামাশাটি হইবে না। তুমি তো জানই যে আই ক্যান নট লিভ উইদাউট ফান অ্যাণ্ড মার্থ।
এইবার কি ড্রাইভার বলাইকে মনে পড়ে? সেই যে গাল তোবড়ান, খোঁচা দাড়ি বলাই। টালিগঞ্জ ফাঁড়ির বাংলার ঠেকে ফেয়ারওয়েল ডায়লগে ফ্যাতুাড়ুদের বলেছিল,
-ঠিক আচে ভাই দেখা হবে। নামটা মনে রাখবেন। বলাই। অমি কখনো মুখ ভুলিনা।
‘৪’নং ঘাপটিতে বলাইয়ের আবির্ভাব ও অন্তর্ধান ঘটেছিল। আবার সে এসেছে ফিরিয়া। হে মহান পাঠক, তুমি কখনো চিড়িয়াখানায় ভোঁদড়দের সিঙি মাছ ছুঁড়ে ছুঁড়ে খাইয়েছ? যদি এমনটি করে থাকো তাহলে মনে রেখো ঐ একই টেকনিকে ‘কাঙাল মালসাট’ তোমাকে ভুলে যাওয়া সিঙি মাছ নয়, এক একটি ভ্যানিস হয়ে যাওয়া চরিত্রকে ফের উপহার দিচ্ছে- যেমন নক্ষত্রনাথ হাওলাদার। যেমন বলাই এটসেট্রা এটসেট্রা।
কাকভোরে টিনের দরজায় ডুমডুম করে ধাক্কা। ভদি ভেবেছিল পুলিস এসেছে। বেঢপ মিলিটারি টিউনিক পরে ভদি মোগলাই আমলের পেল্লায় মরচে পড়া সোর্ড ভুঁড়ির ওপরে রেখে ঘুমোচ্ছিল। নলেন দরজা খুলেছিল। পুলিশ নয়! বলাই এবং একটি বডি তোবড়ানো কালো রঙের, মান্ধাতার আমলের ল্যান্ডমাস্টার এবং একটু পরেই সরখেলের বাড়িতে ফোনের দড়ির ঘন্টা বেজে উঠল।
-বঁলো
-ঝঁটপঁট চঁলেঁ এসোঁ।
-কেঁনঁ?
-গাঁ ঢাঁকা দিঁতে হঁবে।
-পাইখানা হঁয়নি।
-ওঁ হবে। আঁমিও হাগিঁনি।
ল্যান্ডমাস্টারটা যখন পোঁটলায় বাঁধা সোর্ড, ভোজালি, খুরপি ইত্যাদির অস্ত্রাগার ও চারজন অ্যাবস্কন্ডারকে নিয়ে রওনা হয়ে যায় তখন কয়েকটা বাড়ির দূরে দাঁড়িয়ে ছিল বড়িলাল। সে এবারে গঙ্গাঁর দিকে পা চালাল। মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে তাকে কাশীর চিনি দিয়ে ভেজানো ছোলা খেয়ে ডন বৈঠক মারতে হবে। যার যা কাজ। যেমন শশধরের কাজ শশক ধরা ও মহীতোষের কাজ মশক মারা। ল্যাণ্ডমাস্টারে সদলবলে ভদির কেটে পড়ার ঘণ্টা দুয়েক পরে আই.পি.এস অফিসার ডি.সি পীতাম্বর সিং-এর নেতৃত্বে রাইফেলধারী একদল পুলিশ ভদির বাড়ি ঘিরে ফেলে। পোর্টেবল মাইল থেকে ঘোষণা করা হয় ভেতরে যে যে আছে যেন সারেণ্ডার করে। সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে কোনো ফায়দা নেই। লে হালুয়া। সারা বাড়িই ফাঁকা। ন্যাড়া ছাদে শুধু একটা দাঁড়কাক বসে আছে। দাঁড়কাকের পাশেই পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন বেগম জনসন। অবশ্য সূক্ষ্মদেহে থাকার হেতু পুলিশরা তাঁর অস্বিত্ব টের পায়নি। চাকতির ঘর খোলা পড়ে ছিল। কয়েকটা শেকলটানা ঘরে ঢুকে দেখা গেল শুকনো ফুল, চাটাই-এর আসন, মালসা, মরা আরশোলা, খড়ের আধপোড়া আঁটি ইত্যাদি। পীতাম্বরের বাড়ি দারভাঙ্গায় হলেও সে কলকাতারই ছেলে। সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়েছে।
– মনে হচ্ছে এখানে উইচক্রাফট প্র্যাকটিস করা হয়। ইণ্টারেস্টিং। বাট নো রেবেলস। এরপরই তার চোখ পড়ে ভদি-সরখেল টেলিফোন লাইনের উপর।
-মিস্টিরিয়াস! সিমস টু বি আ প্রিমিটিভ কমিউনিকেটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট। দেখতে হচ্ছে।
তার-এর লাইন ফলো করে পুলিশ বাহিনী পৌঁছে যায় সরখেলের বাড়ি। এবং সেখানে আবিষ্কৃত হয় আড়ে বহরে প্রায় এক মানুষ ছড়ানো সেই বিশাল গর্ত যার গভীর থেকে উঠে এসেছিল লিসবনে বানানো পোর্তুগিজ নুনুকামান ও কতিপয় মরচে পড়া মোগলাই সোর্ড। গর্তের ভেতরে টর্চ মেরেছিল পীতাম্বর। অনেক তলায় কালো, দুর্গন্ধ জল জমে আছে। ভন ভন করছে মশা। এর মধ্যেই কেলোটা হয়েছিল। একজন কনস্টেবল ভদির একতলার একটা ছোট্ট ভাঁড়ার টাইপের ঘরে চারপাঁচটা বোতল দেখেছিল। মুখ বন্ধ। ভেতরে লিকুইড। মাল হতে পারে ভেবে একটা বোতলের ছিপি খুলেছিল। বোতলে ভূত পোষা হয় কি হয়না, যায় কি যায়না, এসব নিয়ে সুচিন্তিত কোনো সিদ্ধান্তে আসা আমাদের লক্ষ্য নয়, এক্ষেত্রে যা ঘটেছিল সেটিই আমরা জানতে পারি-কনস্টেবলটি সহসা দেখল শক্ত হাতে চুলের মুঠি ধরে অদৃশ্য কেউ তাকে টেনে উঠোনে এনে ফেলল। ঠাস করে এক থাবড়া বসালো। গালে হাত বোলাতে না বোলাতে পোঁদে এক লাথি। বেগম জনসন ও দাঁড়কাক গিটকিরি দিয়ে হাসতে থাকে। নামজাদা কোনো মাইম আর্টিস্টও এত ভাল করতে পারবে না। অন্য পুলিশরা যেটা দেখেছিল সেটা হল ভদির টিনের দরজা দিয়ে সে হাঁউ মাঁউ করতে করতে বেরোচ্ছে এবং একটি উড়ন্ত বালতি তাকে ধাওয়া করছে। দৃশ্যটি স্বচক্ষে না দেখলেও পীতাম্বর এর মিনিট খানেক পরে সরখেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশদের মধ্যে যে বিপর্যস্ত ভাব দেখল তা যেমনই করুণ তেমনই চিন্তার উদ্রেক করে। উড়ন্ত বালতি ততক্ষণে ঢুকে গেছে বাড়ির ভেতরে। দরজাও বন্ধ হয়েছে সপাটে। যদিও বাড়ির ভেতরে কেউ নেই। কেতরে পড়া সাইনবোর্ডটিতে লেখা ‘বিবিধ অশুভ অনুষ্ঠানে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়।’ ন্যাড়াছাদে জায়েন্ট দাঁড়কাকটি বসে। জিপে বসে আচমকা এক লহমা পীতাম্বরের মনে হল পাশেই বিশাল স্থূলকায়া এক হাস্যমুখ গাউন পরা মেম। থোবড়াটা গামলার মত। পরক্ষণেই নো মেমসাহেব। ওনলি দা ম্যাসিভ দাঁড়কাক। পীতাম্বর বিড়বিড় করতে লাগল,
-মিস্টিরিয়াস! ভূতিয়া চক্কর!
কমরেড আচার্য ফায়ার হয়ে গেলেন।
-ক্যানন-ফ্যানন নিয়ে অ্যাটাক করছে, ক্যানন বলস পুলিশ ভ্যানের ছাদে নাচানাচি করছে, নো ক্যাজুয়ালটি অথচ পুলিশের মধ্যে ওয়াইডস্প্রেড প্যানিক, এসব শুনলে সি.এম. কি বলবেন আপনি ভেবে দেখেছেন?
জোয়ারদার দেখলেন মিনমিন করে হজম করার কোনো মানেই হয়না।
-দেখুন , ষ্ট্রেট-কাট বলে দিচ্ছি এরা যে সে এনিমি নয়। এতো আর এস.ইউ.সি-র মিছিল পাননি যে বেধড়ক লাঠি দিয়ে পেঁদিয়ে দিলাম। ব্যাপারটা সি.এম. কে বোঝান। আমাকে অন ডিউটি বিহেড করে দিল। কিছু করতে পেরেছেন আপনারা? এখন ক্যানন চালাচ্ছে। এরপর ধরুন গাম করে একটা ওয়েপন অফ মাস ডেসট্রাকশন ঝেড়ে দিল। তখন কী করবেন?
-রাগ করবেন না কমরেড জোয়ারদার! রাগ করবেন না।
-সে না হয় না করলাম। তবে ঔ কমরেড ফমরেড না বলে মিস্টারই বলুন। আই হেট কমিউনিজম অ্যাণ্ড দা রেডস।
-কিছু একটা করুন। ফেস সেভিং কিছু একটা। মার্শাল ভদি যদি এইভাবে আমাদের হ্যাটা করতে থাকে….
-দেখছি। এখন লাইন ছাড়ুন। ভাবতে দিন।
পীতাম্বরের রিপোর্ট পেয়ে আরও দমে গেলেন জোয়ারদার। ফ্লাইং বালতি এসে পুলিশ প্যাঁদাচ্ছে। সরখেলের উঠোনে মিস্টিরিয়াস হোল। গত রাত্তিরের এরিয়াল বম্বার্ডমেন্ট। প্লাস ভবানীপুর থানায় দুমদাড়াক্কা!
নতুন একটা প্ল্যান করলেন জোয়ারদার। এবারে কালিঘাট-হাজরা সাইড থেকে নয়। এবারে দেশপ্রিয় পার্কের দিক থেকে ম্যাসিভ একটা ফোর্স এগোবে। তার আগে শুধু ঠিক করতে হবে ক্যানন কোন রুফ-টপে আছে।
ক্যানন যে রুফ-টপে ছিল সেখানে মেজর বল্লভ বক্সী তখন তড়কা-রুটি দিয়ে ওয়ার্কিং লাঞ্চ সেরে ফেলেছেন। সেই সঙ্গে হারকিউলিস রাম। গজা গত পুজোর ভাসানে সিদ্ধি খেয়েছিলো। মিলিটারি রাম তার বড়ই উপাদেয় লাগে। শেষে বলেই ফেলল,
-ছোট করে আর একটু ঢালুন না। মৌজটা ভাল করে জমতো।
-সে না হয় জমাইলাম কিন্তু এনিমি না সারপ্রাইজ অ্যাটাক করিয়া বসে। মাল ঠাসা হইয়াছে তো?
-পুরো রেডি। বলবেন আর প্যাঁকাটি ধরিয়ে আগুন দেব।
-গুড! ভেরি গুড! যাও, পানি লইয়া আসো।
গজা পায়খানার মগে করে জল আনতে গেল।
মেজর বক্সী ভাবলেন দুমিনিটের একটি শর্ট ন্যাপ মেরে দেবেন এই তালে। কিন্তু ব্যোমপথে বোঁ বোঁ শব্দের ক্রমবর্ধমান গুঞ্জরণ তাঁর সিয়েস্তার প্ল্যানটি ভেস্তে দিল। সেই সঙ্গে দেশপ্রিয় পার্কের সাইড থেকে এগোবার পরিকল্পনাটিও ভোগে গেল। ঐ প্রচণ্ড ঘূর্ণির শব্দ হল অসংখ্য নানা সাইজের চাকতির। ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছে। এবং দিনের আলো থাকতে থাকতেই , চাকতির পালের ওপরে উড়ছে ফ্যাতুাড় Åর দল। এবার শুধু মদন, ডি .এস, পুরন্দর ভাট নয়। ডি.এস-এর বৌ, বাচ্চা, শালা জনা কেন আরও অনেক ফ্যাতাড়ু রয়েছে যাদের কথা কেউই জানতোনা। তারা মেজর বল্লভ বক্সীকে হাত নাড়তে থাকে। বল্লভ বক্সী আনন্দে ‘ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই’-এর বিখ্যাত সিটি-সঙ্গীতটি বাজাতে বাজাতে নাচতে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে চাকতির দুর্ভেদ্য বর্মের পাহারায় ফ্যাতাড়ুরা উড়ছে। এভাবেই ফাইটাররা বোমারুদের আগলে রাখে। দিনমানে এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য কলকাতার মানুষ দেখেছিল শুধু তাই নয়, সোৎসাহে দেখেছিল। আকাশে যাই হোক যেমন টোটাল সোলার একলিপ্স বা রাতকাবার করে উল্কা বৃষ্টি-কলকাতার লোক দেখবেই। আর এ দৃশ্য তো স্বর্গীয়-উড়ন্ত চাকতি, তদুপরি উড়ন্ত মানুষ। ফ্যাতাড়ুদের নানাবিধ রণধ্বনি গগন মথিত করে তোলে যেন দৈববাণী হচ্ছে।
-ওয়ে ওয়ে, ওয়ে ওয়ে আঃ
-লায়লা, ও লায়লা!
-লিঃ লিঃ
-ছাঁইয়া, ছাঁইয়া….
কানফাটানো শব্দ। বুদুম। টিগুম! বিভিন্ন রাস্তায় চলমান বা দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানগুলো টার্গেট। পেটো বম্বিং শুরু হয়ে যায়। এবং দুগর্ন্ধ এঁদো কাদা জলে ভরতি পলিব্যাগের বেলুন। এই সরব পরিস্থিতিতে নতুন একটি মাত্রা সংযোজিত করে কলকাতার নানা মহল্লা ও পাড়ার ক্যাওড়ারা। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, ব্রেজিল বা ইণ্ডিয়া-র কারণে যে বিপুল পরিমাণে চকোলেট বোম সব সময়েই মজুত থাকে সেগুলোও মওকা বুঝে ফাটানো শুরু হয়। টাকলা ও.সি দুহাতে কান চেপে ভ্যানের মধ্যে বসেছিল। ভ্যানের ছাদে তখনও নুনুকামানের গোলা ধড়াক ধড়াক করে লাফাচ্ছে।
বিস্ফোরণমুখর সেই কলকাতায় সন্ধ্যা ঘনাইতে শুরু করিল যদিও তাতে থেকে থেকে জ্বলে ওঠা ঝলক ছড়ানো ছিল। মেজর বল্লভ বক্সী বলিলেন,
-মার্শাল ভদির মাস্টার স্ট্রোক এখনও কমপ্লিট হয় নাই। এয়ার অ্যাটাক চলিতেছে। এবারে অন্য খেলা। ফ্লেয়ার ছাড়া করো!
নুনুকামানের মুখ উঁচু করে তাতে একটি বড় হাউই বসিয়ে জ্বালানো হল। হাউইটি আকাশে উঠে গিয়ে ফেটে একটি আলোর গোল চাকতি হয়ে গেল।
কারফর্মার বাড়ির ছাদ থেকে হাউইটির ফেটে যাওয়া দেখে ভদি সরখেলের ঘাড়ে একটা চাপড় মেরে বলল,
-আকাশ থেকে প্যাঁদাবো, ডাঙাতেও ছাড়বোনা। সামলাও এবার।
ঐ হাউই উড়ে গিয়ে গোল চাকতি হওয়াটা ছিল মোক্ষম সিগনাল। এরপরেই দেখা গেল ছোট কি বড়, রোড, লেন, বাইলেনের সব রাস্তাতেই ম্যানহোল খুলে যাচ্ছে। এবং তার গর্ত থেকে যারা বেরিয়ে আসছে তারা চোখ ফুটো ফুটো শিরস্ত্রাণ পরা, গায়ে চকচকে বর্ম, হাতে নানা টাইপের খতরনাক মাল কিন্তু আবছা আলোয় ভাল বোঝা যায় না। রোমের হিংস্র সৈন্য বা আইভ্যান হো-র নাইট টাইপের। এই বাহিনীর আত্মপ্রকাশ পুলিশদের যারপরনাই আতঙ্কিত করে তোলে কারণ পেটো ও অন্যান্য পতনশীল জলীয় ও জলীয় নয় পদার্থের বৃষ্টিতে তারা নাজেহাল হয়েই ছিল। কাছে গেলেই বোঝা যেত যে এগুলো স্রেফ আলকাতরা মারা টিন- কোনোটা তেলের, কোনোটা বিস্কুটের। ভীতিপ্রদ এই নাইটদের ম্যানহোল থেকে বের করার পরিকল্পনাটি মেজর বল্লভ বক্সীর। তাঁর আর একটি উদ্ভাবন হল মেথরদের নোংরা ফেলার বাতিল লজঝড়ে গাড়িতে ঝালাই করে পাইপ বসিয়ে সেগুলিকে সাঁজোয়া কামানের রূপ দেওয়া। একেই বলে সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার। সকাল থেকেই নুনুকামানের দাপট পুলিশের মনোবল অনেকটা ভেঙে দেয়। খ-লোক থেকে নিরন্তর হামলা বাকিটা শেষ করে দিয়েছিল। সব খুইয়ে ফেলার পরেও ছিটেফোঁটা যদি কিছু থাকে সেটাও শেষ করে দিল নাইটবাহিনী ও সাঁজোয়া কামানের গুরু-গম্ভীর আবির্ভাব।
লাগাতার বম্বিং। তৎসহ চাকতির বোঁ বোঁ। কমরেড আচার্য জোয়ারদারকে ফোন করলেন, এই গোলযোগের মধ্যেই,
-কী বুঝছেন মিস্টার জোয়ারদার?
-নো হোপ। খলখলে করে ছেড়ে দিচ্ছে।
-তাহলে বলছেন মিউটিনি থামানো যাবে না।
-রাতটুকু কাটলে হয়। ফোন রাখুন তো। আপনাদের ঐ প্যাঁ পোঁ আর টলারেট করা যায় না।
কমরেড আচার্য ফোন নামিয়ে রাখলেন।
যে রাতটিকে ঘিরে অত ভয় ছিল জোয়ারদারের সেই রাতেই এমন একটা কাণ্ড ঘটেছিল যা পরিস্থিতির সামালের কারণ হয়ে ওঠে। এ কথা কে না জানে যে কোথাও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কালবিলম্ব না করেই সদলবলে একটি ঘোষণাপত্র বা আবেদন বা ফাঁকা থ্রেট প্রকাশ করে থাকেন যাতে বড় থেকে ছোট, শুুডঢা থেকে কেঁচকি , লেখক, শিল্পী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে শুরু করে সকলেই সই দিয়ে নিজেরাও বাঁচেন, অন্যদের ও বারটা বাজাবার রসদ যোগান। শুধু এই ধরণের আবেদনে বা প্রতিবাদপত্রে সই করেই অনেকে লেখক বলে নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছেন। কেউই এই ধরণের ব্যাপারে সই দেওয়া থেকে বাদ পড়তে চাননা। বাদ পড়ে গেলে খচে লাল হয়ে যান। অনেক সময় ফোনেই জেনে নেওয়া হয় যে নামটা দেব তো! এবং কিছু মাল আছে যাদের কিছু বলারই দরকার হয় না। আজ অব্দি এরকম যত আবেদন বা প্রতিবাদ পত্র বাজারে ছাড়া হয়েছে তা এক করে ছাপানোর প্রস্তাব কি উঠেছে? কেউ কি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন বা করার ইচ্ছে আছে?
যাইহোক, যে রাত্তিরের ভয় জোয়ারদারের ছিল সেই রাত ঘোর দড়াম দড়াম করে কেটে যাওয়ার পর, পরদিন সকালে দেখা গেল প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রেই একটি আবেদনপত্র বেরিয়েছে,
‘সরকার-বাহাদুর ও চোক্তার-ফ্যাতাড়ুযুগ্ম শক্তির মধ্যে যে অ-রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে তা আমাদের ঘুমে বড়ই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। আমরা বহুদিন আগেই জেগে থাকা বৃথা, এই সিদ্ধান্তে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। এবং চারদিকে যা হালচাল তা স্বপনচক্ষে দেখে আমরা মনে করি যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ঠিকই করেছিলাম। তাই আমাদের সর্বসম্মত আবেদন এই যে দু পক্ষই একটি শান্তি আলোচনায় বসুক। এবং একটি এমন রফায় আসুক যাতে সাপও না মরে আবার লাঠিও না ভাঙে। সংগ্রাম যেমন দরকার তেমন বিশ্রামেরও দরকার। শেষোক্ত প্রয়োজনটি আমাদের খুবই বেশি। আর্শীবাদ সহ,
কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মিঃ বি.কে. দাস, মিঃ প্যান্টো, মিঃপি.বি, জি.এস.রায়, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিনয়কুমার দাস, অমৃতলাল বসু, বিমলাচরণ দেব, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুবলচন্দ্র মিত্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস, গোপীনাথ কবিরাজ, হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়, অজিতেশ্বর ভট্টাচার্য, সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক, সুরবালা ঘোষ, গিরীন্দ্রশেখর বসু, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুনির্মল বসু, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, সুখলতা রাও, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কৈলাসচন্দ্র আচার্য, গোবিন্দচন্দ্র দাস, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমেন্দ্রচন্দ্র কর, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, আত্মারাম সরকার, গঙ্গাগোবিন্দ রায়, আলী সরদার জাফরি, কৃষণচন্দর, রাধানাথ শিকদার, হরিহর শেঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জন স্টুয়ার্ট মিল, ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মা, জোসেফ টাউনসেন্ড, কাহ্ণপাদ, ভুষুকপাদ, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস রায়, শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ হাল, মিখাইল বাখতিন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, ওয়ের্নার হাইজেনবার্গ, বিশু দত্ত, হরিবর সরকার, মিসেল ফুকো, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দনদাস মণ্ডল, আলামোহন দাস, ভলাদিমির নবোকভ, কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং, নিগমানন্দ…
উপরোক্ত আবেদনটি নিয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে পরে মতভেদ হবে। একদল বলবেন যে ওরকম কোনো আবেদন পত্র আদৌ প্রকাশিত হয়নি। অপরপক্ষের দাবী হবে যে অবশ্যই হয়েছিল। কোনো পক্ষই জয়লাভ করবেনা কারণ ঐ দিনের কোনো সংবাদপত্রই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এই আবেদনটিই অবস্থার ভোল পাল্টে দিল। পরদিন সকালে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। রাত চারটের পর বম্বিং -ও কমে গিয়েছিল। সকালে দেখা গেল যে ম্যানহোল যেখানে ছিল সেখানেই গেঁড়ে বসে আছে। নাইট, ফলস সাঁজোয়া গাড়ি-সব হাওয়া। আকাশও ফুরফুরে।
এরপরের ঘটনা সংক্ষেপে এরকম। উভয়পক্ষের মধ্যে ‘হেকটিক পার্লি’ যাকে বলা হয় তাই চলে। গোলাপ, তারকনাথ সাধু, নক্ষত্রনাথ হাওলাদার এবং বড়িলালও এই প্রচেষ্টায় জড়িয়ে পড়ে। আসলে উপরোক্ত আবেদনটি সকলেরই মনে প্রথমে নাড়া ও পরে দাগা দেয়।
বেগম জনসন বাইবেল স্মরণ করে বললেন,
-টাইম অফ ওয়ার যেমন হয় তেমন টাইম অফ পিস-ও হইবে। লাইক দা ডে ফলোইং দা নাইট। দাঁড়কাক বলেছিল,
-সবই আত্মারামের খেলা। দেড়শো বছর পরপর চাকতি নাচবে। এবার তো ভালই নাচনকেঁাদন হল। এবার গুটিয়ে নে। ভদি গাঁইগুঁই করেছিল,
-বলচেন গুটোতে, গুটিয়ে নেব। তবে এটাও তো দেখতে হবে যে গুটোতে গুটোতে বিচি না বেরিয়ে পড়ে।
দণ্ডবায়স হাসিয়া উঠিল,
-বংশের আর কিছু না পেলেও মুখটা পেয়েচে। কার ছেলে দেখতে হবে তো!
একই কেস ঘটেছিল কমরেড আচার্যের বেলায়। তাঁকে ঝাড়লেন অভিজ্ঞ ও প্রবীণ সি.এম,
-ব্রেসৎ-লিতোভক্স ট্রিটির হিসট্রিটা পড়ো। বুখারিন তো চেয়েছিল জার্মানদের সঙ্গে গেরিলা ওয়ার চালাবে। লেনিন বুঝেছিলেন যে এ কাজ করলে তা হবে ডুবে মরার সামিল। ট্রটস্কিকে সেদিন লেনিনকে মানতে হয়েছিল বুঝলে? দরকার হলে সায়া পরে যাবে। স্টুপিডই থেকে গেলে।
কলকাতার মাঝবরাবর সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের লাগোয়া প্যারিস হলে এই ঐতিহাসিক আলোচনা বসে। পেপসি ও কোক-উভয়েরই ঢালাও সাপ্লাই ছিল। শান্তি আলোচনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। কেউ কাউকে ঘাঁটাবেনা, এই মর্মেই শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। তবে শেষ পাদে, মানে আলোচনার অন্তিম লগ্নে ইণ্টারভেন করেছিলেন নগরপাল জোয়ারদার।
-সবই বুঝলাম মার্শাল ভদি। কিন্তু পীতাম্বরের রির্পোটে সরখেলের উঠোনে যে ব্ল্যাক হোল তার রহস্যটা থেকেই গেল। ক্যালক্যাটায় এটা সেকেণ্ড!
-সরখেল, তুমি বলবে? বলবেনা! ঠিক আচে। আমি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিচ্ছি। সরখেলই আমাকে আইডিয়াটা দেয়। ষাট সাল না কবে যেন সোভিয়েট একাডেমিসিয়ান কালিনিন না কে যেন বলেছিল যে কলকাতা তেলের ওপরে ভাসছে। পুরো কলকাতাটাই ইরাক। তাই সরখেল আর আমি তেলের জন্যে মাটি খুঁড়ছিলাম। এখানে কিন্তু একটা শর্ত থাকবে। নো খাবলাখাবলি। কমরেড আচার্য ভদির বক্তব্য নোট করতে করতে বললেন,
-বলুন, শর্ত বলতে আপনি, মার্শাল ভদি, কী বোঝাতে চাইছেন?
-এই যে তেল, যা বিক্রি করবে, তুলবে একটা কর্পোরেশন, একটা কোম্পানী, তার চেয়ারম্যান হবো আমি, মার্শাল ভদি সরকার।
কয়েক লহমার সাসপেন্স। সে সব স্টার টিভি ও অন্যান্য টিভি কোম্পানির ক্যামেরাতে তোলা আছে।
কমরেড আচার্য বললেন,
-তাই হবে মার্শাল ভদি।
-তাতে সব, ফ্যাতাড়ু , সব চোক্তার, প্লাস বলাই প্লাস সাক্ষী বড়িলাল সকলেরই চাকরি পাকা হবে।
-ইয়েস, আই গিভ ইউ মাই ওয়ার্ড মার্শাল ভদি।
এই সময়ে সি. এন.এন-এর টিভি রির্পোটার প্রশ্নটি ছুঁড়েছিলো,
-মার্শাল ভদি, এমনকী গ্যারান্টি আছে যে আপনি সাদ্দাম হুসেন হয়ে যাবেন না?
(চলবে)
২১
খেল খতম। পয়সা এখনো হজম হয়নি।
বড়িলাল ও কালীর সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে। জয় হনুমান! জোয়ারদারের মুণ্ডু জুড়ে গেছে। ওটা নগরপাল নিজেই খেয়াল করেননি। ললিতা জোয়ারদার নগরপালকে একদিন সকালে চমকে দিলেন, কিস খেয়ে,
-তোমার ঐ কামব্রাস ফ্রেমটা কাবাড়িওলাকে বেচে দিলাম।
-মানে?
-মানে, সিম্পল। বেচে দিলাম। কারণ তোমার মুণ্ডু, বিহেডেড অন ডিউটি, জুড়ে গেছে।
-জুড়ে গেছে?
– ইয়েস মাই লাভ!
মেজর বল্লভ বক্সী আত্মগোপন করেছেন। কোথায় কেউ জানেনা। শোনা গেছে যে আল জাজিরা টিভিতে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিতে পারেন।
ভদির বাড়ির উঠোনে নিয়মিত গালাপার্টি বসছে। মালমোহানা! নলেন থেকে থেকে পাদছে ও ফুট-ফরমাস খাটছে। বেচামনি নাকি আরও খোলতাই, আরও ডবকা হয়ে উঠেছে। সরখেল মাটি তুলছে বালতি বালতি। ফ্যাতাড়ুরা বাংলার ঠেকে রেগুলার ভিজিট দিচ্ছে। এবং এর ওর পোঁদে লাগছে। প্রকাশ থাক,
খুলি নেচেছিল।
আনন্দবাজারে যাদুকর আনন্দ-র বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল।
তাহলে কী হয়নি ?
ওঁয়া ওঁয়া!
যদি না আদি বা মধ্যভাগে বুদ্ধিমান পাঠক বা পাঠিকা, পাঁঠক বা পাঁঠিকা, নানা টাইপের আধাখ্যাঁচড়া ঝটরপটর-সম্বলিত এই বোম্বাচাকটি বিরক্তি সহযোগে বাতিল না করিয়া থাকেন তাহা হইলে তাহার বা তাঁহার সম্পূর্ণ রসাস্বাদন খতম হইল। নিংড়ে নিল। কোনো রাতজাগা পাখি বলছেনা না যেওনা।
তবু সব ছাপিয়ে কেমন একটা মন কেমন করা, মন কেমন করা ভাব। এই ভাবটাই বজায় থাকে। কেন গা?
মনুমেণ্টের ওপরে বুড়ো দাঁড়কাক বসেছিল। কলকাতার পশ্চিমে সানসেটের ঘনঘটা। তারই সোনালী ফোকাস বিশাল ডানার খড়খড়ে পালকে। দাঁড়কাক আপনমনে বলে উঠল,
-যাক! ‘কাঙাল মালসাট’ বই হয়ে বেরিয়ে গেছে। যাই, বেগম জনসনকে খপরটা দিয়ে আসি।
বৃদ্ধ দণ্ডবায়স উড়িয়া গেল।
(চলবেনা)
Leave a Reply