কাকতাড়ুয়া – সায়ক আমান
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০২৪
পত্রভারতী বুকস প্রাইভেট লিমিটেড
.
বাবাকে
বাকিগুলোর মতো এটাও পড়বে না জানি।
তাও এই বইটা তোমার জন্য রইল কমরেড…!
.
দেখুন, আমি যখন প্রথম প্রেম করেছিলাম তখন আমার বয়স পনেরো। আমার দেওয়া প্রেমপত্র সযত্নে ব্যাগে রেখে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে ঢুকেছিল মেয়েটি। তো একফাঁকে তার মা ব্যাগ থেকে সেই প্রেমপত্র উদ্ধার করে এবং পত্রপাঠ মেয়েকে উদোম ক্যালানি দিতে দিতে আমাকে অভিসম্পাত করে, ‘কম বয়সে পাকলে বাল, দুঃখ থাকে চিরকাল।’
সেই মহিলার অভিশাপের জন্যই কিনা জানি না জীবনের যাবতীয় বালপাকনামি করতে আমি নিজের মধ্যে ভয়ঙ্কর তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করেছি। তার ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট আপাতত আপনার হাতের তালুতে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই বইটা। এ বই আমার এখন লেখার কথা নয়, সত্যি বলতে কারোর কখনোই লেখার কথা নয়।
ধরুন আজ থেকে বছর পঞ্চাশ পরে সব শ্বাসই যখন নাভিশ্বাস, অ্যাডাল্ট সাইটের বদলে জীবনে যখন কেবল অ্যাডাল্ট ডাইপার, তখন পেছনে বেডপ্যান আর মাথায় ই-এম-আইয়ের বোঝা নিয়ে নাতিনাতনির পেচ্ছাপের গন্ধের মধ্যে দাঁত বের করে বসে একহাতে ক্যাথিটার অন্য হাতে কলম নিয়ে এরকম একটা কিছু লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এই ভরা যৌবনে…
এ উপন্যাসে কোনও আশার আলো নেই। কারণ আমাদের জীবনে কোনও আশার আলো নেই। আমাদের রাজনীতি ঘৃণা শেখায়, আমাদের প্রেম হিংস্র কামড়াকামড়ি শেখায়, আমাদের শিক্ষা কুচুটে হতে শেখায়, ল্যাং মারতে শেখায়, আমাদের বাপ মা আমাদের নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক, সঁয়োসকিতি…অনেক কিছু শেখায়, আর তারপর শেখায় পেশার প্রয়োজনে কী করে সেসবের মুখে ছাই দিয়ে এমএনসি-র দাসত্ব করতে হয়।
তারপর এইসব যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আমরা আশার আলো বলে খুঁজে নিই বিচ্ছিন্নতাকে। পরিচিত মানুষ, সমাজ, রাজনীতি সব কিছুর থেকে সরে এসে এক বিরক্তিময় অন্ধকারের আগলে মুখ লুকিয়ে ফেলি আমরা। শরীরটুকুনি আলোর মধ্যে জিইয়ে রাখি কেবল।
এই উপন্যাস একটা বিচ্ছিন্ন মানুষ, একটা বিষণ্ণ শহর আর একটা রূপকথার গল্প। এই সবকিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যারা সরে দাঁড়িয়েছিল অনেকটা দূরে। আলোর বদলে রহস্য ঢেকেছিল তাদের। ঘন কুয়াশায় হেঁটে তারা কোথায় হারিয়ে গেছে আমি জানি না।
তবে একটাই আফসোস রয়ে গেল দাদা। অসময়ে এত বালপাকনামি করেও জীবনে তেমন দুঃখই বা পেলাম কোথায়? যে দুঃখে কোনও নির্জন স্টেশনে প্রায় যাত্রীহীন ট্রেনের কামরার দিকে চেয়ে হাত নাড়াতে পারতাম অনেকক্ষণ? কিংবা কোনও ব্যস্ত এয়ারপোর্টের সামনে, যেখানে শেষ দেখেছিলাম তাকে, সেখানে দাঁড়িয়ে বুড়ো হয়ে যেতে পারতাম হাসতে হাসতে?
নাঃ, জীবনে সুখ এল, দুঃখ এল, প্রেম যন্ত্রণা রোগ এল, শুধু কোনটাই চিরকাল থাকল না। কোনটার সঙ্গেই ঘর করা হল না। আপনার অভিসম্পাত কেন কাজ করল না কাকিমা?
বরাবরই বলে এসেছি ‘এই নাও ১০ লাখ টাকা, আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাও’ গোছের অর্থসমাগম না হলে আমার বই কেনার মানে হয় না। সেলফি কিংবা সই আমি ‘দাদা তোমার হাসিটা কী মিষ্টি’ বললে এমনিই গদগদ হয়ে করে দিই।
ভালো কথা, এই বই লিখতে গিয়ে আমি কোনও রিসার্চ করিনি (রিসার্চই যদি করতে হত তাহলে ‘ছাদে গাঁজা চাষ করে লাখপতি হওয়ার দশটি উপায়’ নিয়ে করতুম না?)। তবে হ্যাঁ? আমরা ছোটবেলায় যেসব খিস্তিখামারি করেছি সেসব এখনকার দিনে আর চলে না। এখনকার কচিকাঁচারা কী ধরনের খেউড় ব্যবহার করে সেটা জানার জন্য কিছু ছেলেপেলে জোগাড় করে তাদের প্রেমিকার বাপ-মা কিংবা প্রেমিকার বেস্ট ফ্রেন্ডের খবর নিতে হয়েছে।
এছাড়া এ বই লিখতে আমাকে তেমন কেউ সাহায্য-টাহায্য করেছে বলে মনে পড়ছে না। তবে আমার ভাইবোন আর কমরেডদের (তমাল, মোহনা, কৌশিক, আর্য্য, অভিব্রত, পৌলমি, টুনটুনি, দোলনকুমারী, পোলো, শালিনি) নামগুলো স্রেফ ‘না লিখলে কী মনে করবে’ ভেবে লিখে দিলাম। জায়গা কম পড়ছে দেখলে সম্পাদক মশাই নির্দ্বিধায় কেটে দেবেন।
পত্রভারতী থেকে এই নিয়ে আমার দুটো বই। বইয়ের দাম কম রাখার বায়না, ‘আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি’ করে ম্যানুস্ক্রিপ্ট ঝোলানো, ‘বইয়ের কভার ঠিক ততটা কালো নয়’ গোছের ট্যান্ট্রামস সহ্য করে এ বছরেও ‘ছলছল নয়নে, হাসিমাখা বদনে’ এই বইটা ছাপতে চেয়েছেন। একমাত্র বিবাহিত পুরুষ ছাড়া এত ধৈর্য আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি।
এই একবছর আমার যাবতীয় প্রশ্নের মুখে, ‘এটা ঠিক এডিটোরিয়ালের দেখার বিষয় না’ ছুড়ে মারা অনিন্দিতাদিকে বিশেষ ধন্যবাদ। বইমেলায় কেউ তাকে, ‘আপনিই ওই বিচ্ছিরি বইটা এডিট করেছেন?’ বলে প্যাঁক দিলে সেটা ‘লেখকের দেখার বিষয় না’।
আর আমার ছোট ছোট ছানাপোনারা—এ বইটা কেনো বা না কেনো, ভালো লাগুক বা না লাগুক, আমার কিছুই যায় আসে না। একটা বা অনেকগুলো বই নয়, গল্প নয়, শিল্প-টিল্প সব বাজে কথা। আমি বছর বছর বই লিখি কারণ আমার তোমাদের মধ্যে থাকতে ভালো লাগে। তোমাদের গল্পগুলো শুনতে আর দু’একটা সস্তার খিল্লি টিল্লি করতে আমি গল্প ফাঁদার ছলনা করি।
চলুন, আপনাদের ঈশানীর গল্প বলি। আর তার স্কুটির পিছনে ঝুলে পড়া একটা গোবেচারা কাকতাড়ুয়ার গল্প…
দুটো পালিয়ে যেতে চাওয়া বিচ্ছিন্ন মানুষের গল্প। এতদিন আমি তাচ্ছিল্য ভরে চেপে রেখেছিলাম। আমি চলে যেতে দিলাম ওদের। আপনারা দেবেন না, কেমন?
.
আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।
—বোধ, জীবনানন্দ দাশ
Leave a Reply