কহলীল জিবরান রচনাবলি
ভাষান্তর : মোস্তফা মীর
প্রথম প্রকাশ মাঘ ১৪১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
.
উৎসর্গ
আগুনে লাফিয়ে পড়ার জন্য যার জন্ম হয়েছিল
তাকে ঝর্ণার সুশীতল জলের পাশে বসিয়ে
দিয়ে দেখেছি কোনো লাভ হয়নি। সে ঠিকই অনুসন্ধান
করেছে অগ্নিকুণ্ড এবং তাতে লাফিয়ে পড়েছে
যেমন আজকের জন্য, তেমনি আগামীকালের জন্য
এবং চিরকালের জন্য।
সৈয়দ আবু নাসের কর্নেল
আমাদের চোখের ভেতর দিয়ে যে তাকিয়ে আছে
অন্য এক পৃথিবীর দিকে।
.
কহলীল জিবরানের জীবন, সাহিত্য ও প্রেম
[জিবরানের পুরো নাম আরবিতে ছিল জিবরান খলিল জিবরান। নামের মধ্য-অংশ ‘খলিল’ হচ্ছে তার পিতার নাম। নামের প্রথম অংশের পর পিতার নাম ব্যবহার করা আরবের একটা প্রচলিত রীতি। তিনি তার আরবি রচনাগুলিতে পুরো নামই ব্যবহার করেছেন। ইংরেজি রচনায় তিনি নামের প্রথম অংশ হেঁটে ফেলেন এবং ‘খলিলের’ শুদ্ধ বানান ‘কহলীল’ লিখতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, ১৮৯৭ পর্যন্ত বস্টনের স্কুলে লেখাপড়া করার সময় ইংরেজির শিক্ষক তার নামের বানান শুদ্ধ করে দেন।]
১
লেবাননের বিখ্যাত চিরহরিৎ বনভূমির কাছাকাছি বিসাররীতে ১৮৮৩ সালে জিবরান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মা, সৎ ভাই ও দুবোনসহ কৈশোরে আমেরিকায় অভিবাসী হন। প্রথমে থিতু হন বস্টনে এবং পরবর্তীকালে নিউইয়র্কে, যেখানে তিনি ১৯৩১ সালে মারা যান। দীর্ঘ অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতা ‘প্রফেট’-এর রচয়িতা হিসেবে জিবরান কহলীল জিবরান মূলত বেশি পরিচিত। তিনি এমন একজন বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি মাতৃভাষা ও ইংরেজি দুভাষাতেই লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। যাহোক, অন্যান্য লেবানীয়দের মতো জিবরানও তাঁর জন্মস্থানের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন, যদিও তিনি জীবনের অধিক সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায়। কিন্তু কখনই ভোলেননি যে, তিনি একজন লেবানীয়। তাঁর মাতৃভূমির সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও গ্রাম এলাকার দৃশ্য তাঁর অনেক ছবিতেই ফুটে উঠেছে, যেখানে আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির ছোঁয়াও স্পষ্ট। পণ্ডিতেরা তাঁর রচনায় জার্মান দার্শনিক নিটশে, ফরাসি প্রতীকধর্মী কবিতা ও ইংরেজ কবি-চিত্রকর উইলিয়াম ব্লেকের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। এমনকি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন ফরাসি ভাস্কর অগাস্টি রোডিন-এর দ্বারা। এ ছাড়াও প্রাচ্য ও লেবাননের গ্রাম এলাকার অতীন্দ্রিয়বাদী কবিরাও তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভৌগোলিক বিচরণের ক্ষেত্রে সময়হীনতা ও মরমী দার্শনিকের এক অবাস্তব জগৎ-এ যেন লেবাননের ভূদৃশ্য, পাহাড়, পাথর এবং বনভূমির ক্রমাগত দৃশ্য পরিবর্তন। জিবরানের কাছে তাঁর মাতৃভূমির কোনো অস্তিত্ব ছিল না, ছিল শুধুমাত্র ছবির মতো একটা ভাণ্ডার বিশেষ যা গ্রামীণ প্রতিমূর্তিতে আছন্ন, যা তিনি স্থানীয় রঙ মিশিয়ে লেখায় তুলে ধরতে পারতেন। সত্যি বলতে কি তাঁর ইন্দ্রিয় সাড়া দিত ‘মাউন্ট সান্নাই’-এর ওপরে চাঁদ ওঠা, সমুদ্র থেকে বিবলজের দৃশ্য, বরফে চিরহরিৎ বনভূমি ঢেকে যাওয়া ও ধাবমান মেষপালকের পাশে বসে থাকা মেষপালক দেখলে! এমনকি রুপার সুতোর মতো পাহাড়ি পথকে ক্ষতবিক্ষত করে এরকম দৃশ্যের বর্ণনাও তাঁর রচনায় লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাঁর মেধা উৎসাহিত হয়েছিল লেবাননের ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক গাথা কাহিনীর দ্বারা। এছাড়া সাধারণভাবে তাঁকে আরও আকর্ষণ করেছিল সাদা পাথরের ফিনিসীয় মন্দির, আলবেক-এর উঁচুস্তম্ভ এবং ধর্মযুদ্ধে বিবলজ দুর্গের বিশাল ক্ষয়-ক্ষতি। জিবরান বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘লেবানন একটা পাহাড়ের নাম নয়, লেবানন হল কাব্যিকতার ব্যাখ্যা। আমেরিকার প্রযুক্তিগত সাফল্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং অধিক সংখ্যক নাগরিকের। বস্তুগত সাফল্যের বিষয়ে সতর্ক থেকে জিবরান তাঁর অভিবাসিত গৃহকে নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুবিধাজনক দৃষ্টি থেকে গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের ভেতরে তিনি ধীরে ধীরে ঢেলে দিয়েছেন প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদের তরল মিশ্রণ। জিবরান বিশ্বাস করতেন মানবতা হল শ্রেষ্ঠ সেবা এবং তা দুই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যই স্বীকার করে ও তা ডিঙিয়ে গিয়েও করা সম্ভব।
২
জিবরানের সাহিত্যজীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায় শুরু ১৯০৫ সাল থেকে, যখন তার প্রথম আরবি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আরবিতে লেখালেখি চলে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯১৮ থেকে, যে তারিখে প্রথম তাঁর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং এ পর্যায় ১৯৩১ সাল অর্থাৎ তার মৃত্যু পর্যন্ত চলে। প্রথম পর্যায়ে জিবরান শুধুমাত্র আরবিতে লিখতে থাকেন। ইংরেজিতে লেখালিখির পর্যায়ে তিনি আটটি গ্রন্থ লিখেছেন। দুটো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে জিবরানের মৃত্যুর পর।
সাহিত্যজীবনের শুরুতে আরবিতে জিবরানের পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলি হচ্ছে : আল মুসিকাহ (১৯০৫), আরাইজ আল মুরুজ (১৯০৬), আল আরওয়াহ আল মুতামাররিদাহ (১৯০৮) আল আজনিহাল মুতাকাসসিরা (১৯১২), ও দাম আহ ওয়া ইবতিছামাহ (১৯১৪)। দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখালিখির সময় অর্থাৎ ১৯১৮ থেকে ১৯৩১ সালের ভেতরে তিনি আরও তিনখানা আরবি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলি হচ্ছে : একটি অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতা আল মাওয়াকিব (১৯১৯), বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার সংগ্রহ, যথাক্রমে আল আওয়াছিফ (১৯২০) এবং আলবাদাই ওয়াল তারাইফ (১৯২৩)।
প্রথম পর্যায়ের সাহিত্যে জিবরানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যন্ত্রণা ও ভ্রান্তি দূর করার প্রবল চেতনাবোধ, জিবরানের প্রধান উদ্দেশ্য এখানে সমাজকে পুনর্গঠন করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি নারীর ওপর অবিচার করার জন্য তীব্র সমালোচনা করেছেন, যাজকদের অর্থলিপ্সার প্রবণতাকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন এবং বিদ্রোহ করেছেন কুসংস্কারপূর্ণ ও গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন সামাজিক বন্ধনের বিরুদ্ধে।
যাহোক, এসব প্রথমিক কাজ-কর্মের ভেতরে তাঁর পরবর্তীকালের রচনার উপকরণ ছিল। তিনি পুনর্বার দেহ ধারণের ধারণাসহ কাজ করেছেন যুগের ধুলো এবং অনন্ত আগুন নিয়ে এবং এই ধারণাই বছরের পর বছর তাঁর চিন্তায় তৈরি করেছে বিভিন্ন শক্তিশালী উপাদান। তারপরও তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বজনীন ভালোবাসার আরোগ্যকর শক্তি এবং অস্তিত্বের ঐক্য, যা তার আল আজনিহাল-মুতাকাসসিরা ও দামাহ ওয়া ইবতিসামাহ গ্রন্থে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরবি রচনায় জিবরান তার বিভিন্ন ধারণা ব্যাখ্যা করতে ছোট ছোট বর্ণনামূলক আখ্যান ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এসব ছিল মূলত নীতিকথামূলক আখ্যানের প্রতিস্থাপন। শিক্ষামূলক রচনা, প্রবচন, প্রতীকাশ্রয়ী কাহিনী ও শ্লেষসমৃদ্ধ গদ্য কৌতুক এ সবই হচ্ছে জিবরানের ইংরেজি রচনার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। কিন্তু আরবি ও ইংরেজি উভয় রচনাতেই তাঁর অদ্ভুত স্টাইল সালোমনের গান ও স্তুতিগীতির ইঙ্গিতবহ, এমনকি যিশুর উপদেশমূলক আখ্যানের তীব্র প্রতিধ্বনি–এ সবকিছুই প্রচণ্ড বাইবেলীয় প্রভাবের ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করলেও তাঁর রচনাকে দিয়েছে স্থায়িত্ব।
দ্য ম্যডম্যান (১৯১৮) প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জিবরানের সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। এ পর্যায়ে প্রকাশিত অন্যান্য রচনাগুলি হচ্ছে : দ্য ফোররানার (১৯২০), দ্য প্রফেট (১৯২৩), স্যান্ড অ্যান্ড ফোম (১৯২৬), জেসাস, দ্য সান অব ম্যান (১৯২৮), দ্য আর্থ গর্ডস (১৯৩১), দ্য ওয়ান্ডারার (১৯৩২), এবং দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট (১৯৩৩)। শেষের গ্রন্থটি জিবরানের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। দ্য গর্ডেন অব দ্য প্রফেট লেখাটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়ে যায় যখন তিনি মারা যান। পরবর্তীকালে অন্য এক মার্কিনী কবি বারবারা ইয়ং বিক্ষিপ্ত পাণ্ডুলিপি একত্রিত করার পাশাপাশি নিজের কিছু শব্দ জিবরানের রচনায় যোগ করেছেন।
দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট সম্ভবত তাঁর ট্রিওলজি’র দ্বিতীয় গ্রন্থ, যা শুরু করেছিলেন প্রফেট দিয়ে এবং অলিখিত তৃতীয় গ্রন্থের পরিকল্পনা থেকে শুধু জানা যায় তৃতীয় গ্রন্থের শিরোনাম দিয়েছিলেন : দ্য ডেথ অব দ্য প্রফেট।
দ্বিতীয় পর্যায়ের সাহিত্য জীবনে জিবরানের ড্রইং-এর একটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সালে টুয়েন্টি ড্রইং শিরোনামে এ্যলিস র্যাফেল-এর ভূমিকা সম্বলিত এই ছবির বইটিকে অনেকেই সেকালে জিবরানের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে বিবেচনা করেন। তিনি ১৯০৫ সাল থেকে ছবি আঁকতে শুরু করেছেন এবং ১৯১৯ সালের আগেই তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। এই ছবির বইটি জিবরানের মরমী দক্ষতার গুরুত্ব বহন করে। এটা সেই দিক নির্দেশনার ওপর গুরুত্ব দেয় যা তিনি পেন্টিঙে, ড্রইঙে এবং লেখায় মেনে চলেছেন।
জিবরানের তথ্য বা বাণীর প্রচুর ব্যাখ্যা রয়েছে তার ইংরেজি রচনায়, বিশেষ করে প্রফেট গ্রন্থে, যেখানে দেখানো হয়েছে মানুষের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবনের দৃশ্য এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ধারণার প্রতিফলন–যেমন বিয়ে, আইন, অপরাধ ও শাস্তি, স্বাধীনতা, উদারতা, ধর্ম, বেদনা এবং আনন্দ। তার দ্য প্রফেট গ্রন্থের বাণী আবেগজনিত বিশ্বাস হিসেবে সংক্ষেপিত হতে পারে এবং তা হল বিশ্বজনীন ভালোবাসার আরোগ্যকর শক্তি এবং অস্তিত্বের ঐক্য। তার মরমী প্রথা অনুসারে–জিবরান যা অনুসরণ করেন–সেই সমস্ত জিনিসের মূল চাবিকাঠি হল ভালোবাসা। এই ভালোবাসা যদি কারও থাকে তাহলে সে লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তিক গর্ব, প্রথার প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তির ত্রাস থেকে মুক্ত হতে পারবে। ঐটাই হল দ্য আর্থ গডস-এর মূলভাব–একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এই ভাব তাঁকে প্রভাবিত করেছে জেসাস, দ্য সান অব ম্যান-এর জেসাসের চরিত্রকে চিত্রায়িত করতে। এই ভাব আকার দিয়েছে ওয়ান্ডারার-এর নায়ককে–যা জিবরানের জীবনের সমস্ত বাণীকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে তোলে। সেইসঙ্গে দৃশ্যগুলো দখল করে মাতৃভূমি লেবাননের মনোভঙ্গি ও আবহাওয়ার পাশাপাশি মার্কিনীদের চিন্তার ধরন এবং ভাষাশৈলী, যা তিনি সফলভাবে রপ্ত করেছিলেন।
৩
মে জিয়াদাহ গত শতাব্দীর প্রথম তিন দশক ধরে আরবি সাহিত্যের মহিলা লেখক হিসেবে খ্যাত। তিনি লেবানীয় পিতা ও ইহুদি মাতার একমাত্র সন্তান। পিতার নাম ইলিয়াস জাখুর জিয়াদাহ এবং মায়ের নাম নুজহা কহলীল মুমার। মে জিয়াদাহ-এর জন্মতারিখ ১৮৮৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, স্থান প্যালেস্টাইনের নাজারেত। জন্মস্থানেই তার লেখাপড়া শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে পাঁচ বছরের জন্য লেবাননে আইনতোওরাহ ইনসটিটিউটে লেখাপড়া করেন। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানে শুধু মেয়েরাই লেখাপড়া করে। ১৯০৮ সালে তাঁর শিক্ষক পিতা মিশরে শিক্ষকতার অধিক সম্ভাবনা দেখে পরিবারসহ কায়রোতে চলে আসেন এবং শিক্ষকতা পেশায় না গিয়ে তিনি আল-মাহরওসাহ নামে একটা দৈনিক সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন কায়রো ছিল শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমি, ফলে মে জিয়াদাহ-এর বয়স কুড়ি হওয়ার আগেই এসব কর্মকাণ্ড তাঁর আগ্রহকে উদ্দীপিত এবং উৎসাহিত করে এবং এই উৎসাহের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়–শিরোনাম : ফ্লেউরস দ্য রেভি। ফরাসি ভাষায় লেখা আইসিসকোপিয়া ছদ্মনামের এই প্রাথমিক কাজে শুধুমাত্র ফরাসি প্রভাবই নয়, বিশেষ করে ফরাসি লেখক ও কূটনীতিক লা মার্টিনির প্রভাব প্রচুর পরিমাণে লক্ষ্য করা। যায়। এমনকি তার অদ্ভুত, উদ্ভাবক ও সৃষ্টিশীল মনকেও মে নিজের ভেতরে ধারণ করেছিলেন।
তিনি নিয়মিত প্রতিবেদক ছিলেন আল-মাহরওসাহ-এর এবং তাঁর সময়ের নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলিতে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। যেমন আল আহরাম, আল-হিলাল, আল-মুকাত্তাম, আল মুকতাতাফ। এছাড়াও ফরাসি পত্রিকা প্রোগ্রেস ইজিপশিয়ান এবং ইংরেজি ইজিপশিয়ান মেইল পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লিখতেন। (ইংরেজিতে লেখার সময় আরও একটি ছদ্মনাম তিনি ব্যবহার করতেন তা হচ্ছে–রিফাত খালিদ)।
কহলীল জিবরানের রচনার ওপর সমালোচনা করার মাধ্যমে মে-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তার প্রায় সবগুলি রচনায় জিবরানের চিন্তা ও স্টাইলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়–যদিও তারা পরস্পরকে জানতেন শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমে। তাদের ভেতরে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর সাহিত্যরুচির বিনিময় হত এবং গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। প্রেমকে যারা খুব অন্তরঙ্গভাবে উপভোগ করে সেইসব মানুষের ভেতরে সেই সাদৃশ্য এবং বোঝাবুঝি বিরল, যা তারা অর্জন করেছিলেন বলে মনে করতেন।
কায়রোতে তার বাড়ি পরিণত হয়েছিল মিশরীয় রাজধানীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের সমাবেশ কেন্দ্রে। এই বাড়ি ছিল সবার মিলনস্থান। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি এবং প্রাণবন্ত হৃদয়, যা ছিল তাঁর সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং তাঁর বিশাল আকর্ষণে তাঁর সময়ের নেতৃস্থানীয় লেখক–লুতফি সাইদি, ইয়াকুব সাররউফ, তাহা হুসেন, মুস্তাফা সাদেক আল রাফিই, ইসমাইল সাবরি, এডগার জাল্লাদ, এবং আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ পর্যন্ত তাঁর প্রতি আকর্ষিত হয়েছিল। এদের অনেকের কাছে তিনি ছিলেন ‘শিল্পলক্ষ্মী’ এবং উৎসাহদাত্রী। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব এবং বাকপটুতা ছিল অতুলনীয়–যা তিনি লিখেছেন তার চেয়েও।
মে জিয়াদাহ-এর আগ্রহ ছিল সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পাশাপাশি নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রতি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে নারীর ভোটাধিকারের জন্য হুদা সাহারাত্তই-এর নেতৃত্বে এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। মে তিন বছর (১৯১৫-১৯১৮) মিশরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (কায়রোতে) লেখাপড়া করেন। এ সময়কালে হুদা সাহারাত্তই-এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয় তার এবং আন্দোলনে তার ভূমিকাকে তিনি নিশ্চিত করেন। মে, নারীমুক্তি আন্দোলনের পেছনেই তার জীবনটা ব্যয় করেছেন। বলতে গেলে জীবনের বেশি সময়ই উৎসর্গ করেছেন তিনি এই কাজে।
মে জিয়াদাহ ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে তাঁর চারজন প্রিয় মানুষকে হারান; তাঁর পিতা-মাতা, বিশ্বস্ত বন্ধু ইয়াকুব সাররউফ এবং যাকে তিনি প্রকৃতই ভালোবাসতেন সেই কহলীল জিবরান। এতগুলি প্রিয় মানুষের মৃত্যুজনিত শোকে তিনি গভীরভাবে আক্রান্ত হন, যেমন তার চিঠিতে দেখা যায় :
‘এত যন্ত্রণায় আমি কখনও ভুগিনি-আমি কোনো বইতে পড়িনি যে, যন্ত্রণা মানুষের সহ্যক্ষমতার ভেতরেই থাকে, যার ভেতর দিয়ে আমি গেছি।’ [ডা, যোসেফ জিয়াদাকে লেখা চিঠি]
ফলে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায় এবং তিনি দীর্ঘকালীন বিষণ্ণতার শিকার হন, যা অতিক্রম করতে তিনি ১৯৩২-১৯৩৪ সালের ভেতরে উন্মত্তের মতো ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ইটালি সফর করেন। ভ্রমণকালে তিনি বিদেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন–সে এক বিষণ্ণ ও করুণ কাহিনী। আত্মীয়স্বজনের তত্ত্বাবধানে লেবাননে ফেরার পর তাঁকে আজফাওরিয়াহ’ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তাঁর আংশিক মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। তার বন্ধু আমিন রিহানি। তিনি আবার তাঁকে সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন এবং তার উৎসাহেই মে জিয়াদাহ ১৯৩৮ সালের ২২ মার্চ বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবের জীবনযাপন সম্পর্কে লেখকদের বাণী শীর্ষক এক বক্তৃতা দেন এবং তারপর থেকেই ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
লেবাননকে তিনি খুব ভালোবাসলেও তার হৃদয় পড়ে থাকত কায়রোতে। ১৯৩৯ সালের প্রথমদিকে তিনি কায়রোতে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন এবং অল্পকিছু গুণগ্রাহী থাকা সত্ত্বেও নিঃসঙ্গ ও বন্ধুহীন অবস্থায় আড়াই বছর পর সেখানেই তিনি মারা যান।
তাঁর রচনাবলির ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন গদ্যরচনা, প্রবন্ধ, আলোচনা, অনুবাদ, দুটি আত্মজৈবনিক রচনা, অল্পকিছু কবিতা, একটি সময়িক পত্রিকা এবং চিঠিপত্র। বিশ শতকের আরবি সাহিত্যে তার স্থান এখনও পুরোপুরিভাবে চিহ্নিত হয়নি, কিন্তু এটা সহজেই বলা যায়, প্রকৃতার্থে চিত্রকলার ওপর লেখাগুলোই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কর্মকাণ্ড এবং বিশাল অর্জন। তিনিই বিশ শতকের আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা গদ্যকার।
মে জিয়াদাহ-এর জীবন ও শিল্পকর্মকে পার্থক্য করা খুবই কঠিন। একজন কষ্ট-পাওয়া নারী এবং একজন উদ্ভাবক ও সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যদিও শিল্পের সাধারণ ব্যাখ্যায় বলা যায় মে তার সময়ের ওয়ালি-উদদীন ইয়াকিন অথবা আব্বাস আল আক্কাদ-এর মতো মোটেও কোনো পেশাদার লেখক ছিলেন না এবং তিনি নির্ভর করতেন রচনার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং শুদ্ধতার ওপর। তাঁর ক্লান্তিহীন জীবন, অভিজ্ঞতার জন্য আকাঙ্ক্ষা, প্রচলিত প্রথার প্রতি বিদ্রোহ, তার সময় ও তাঁর পরিপার্শ্বের জন্য ছিল একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলোর যন্ত্রণা ও কষ্টভোগের ভেতর দিয়ে তিনি এগোচ্ছিলেন আধ্যাত্মিক ম্রতা ও বাস্তবতার ভেতরের মর্ম উপলব্ধি করার শক্তির দিকে :
‘বিশাল যন্ত্রণার অর্থ হচ্ছে বিশাল শুদ্ধতা।’
৪
পৃথিবীর দুজায়গায় বসবাস করার পরও এই দুই লেবানীয়কে একত্রিত করেছিল যে প্রেম বন্ধন তা খুবই বিরলতম ঘটনা। এ সম্পর্ক শুরু হয়েছিল চিঠিপত্র লেখালেখির মাধ্যমে। তবে সনাতন পদ্ধতিতে এই প্রেম শুরু হলেও শুধুমাত্র চিঠিতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা একে অন্যকে জানতেন বা চিনতেন শুধুমাত্র চিঠি বিনিময় ও পরস্পরের শিল্পকর্মের মাধ্যমে। কল্পনায় এবং স্বপ্নে ছাড়া তাদের কখনও সাক্ষাৎ ঘটেনি এবং এই প্রেমের ভেতর দিয়ে উভয়েই চিরস্থায়ী বাস্তবতা অনুসন্ধান করেছেন।
জিবরান এবং মে-এর পরস্পরকে লেখা প্রেমপত্রগুলি জিবরান-বিশেষজ্ঞদের কাছে এক মূল্যবান সম্পদ। সে কারণেই ১৯৫৯ সালে এ্যন্থেনি আর ফেরিজ প্রকাশ করেন কহলীল জিবরান : এ সেল্ফ পোর্ট্রেট এবং ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় ভার্জিনিয়া হিলু’র বিলাভেড প্রফেট; দ্য লাভ লেটার অব কহলীল জিবরান অ্যান্ড ম্যারি হাসকেল অ্যান্ড হার প্রাইভেট জার্নাল। জিবরানের অনুভূতির ছায়ার ওপর ফেলা এটা একটা নতুন আলো–এত খোলাখুলিভাবে কখনই নিজেকে ব্যাখ্যা করা হয়নি, যা চিঠিতে পাওয়া যায়। ম্যারি হাসকেলকে লেখা জিবরানের চিঠিগুলোও আবেগে পরিপূর্ণ। যদিও তিনি হাসকেলকে ভালোবাসতেন, তবুও তাদের সম্পর্ক ছিল পুরোপুরি অন্য প্রকৃতির। ম্যারি হাসকেলের ভেতরে তিনি শুধুমাত্র মাতৃত্বের প্রকাশই লক্ষ্য করেননি, কবি ও চিত্রশিল্পী হিসেবে চূড়ান্তভাবে তার আর্থিক ও নৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনও জিবরান অনুভব করতেন। তবে তাদের সম্পর্ক ছিল মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক।
ম্যারি হাসকেল বা অন্যান্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক জিবরান যেভভাবে উপভোগ করেছেন, সেই তুলনায় মে জিয়াদাহ’র সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সবদিক থেকেই একেবারে আলাদা। এ এমনই এক ভালোবাসা যা কোনো শ্রেণীতে বিভক্ত করা অসম্ভব, কারণ এটা ছিল আধ্যাত্মিক এবং নিষ্কাম ভালোবাসার উপাদানে পরিপূর্ণ। জিবরান এবং মে, একত্রিত হয়েছিলেন সুফিবাদের আকাঙ্ক্ষার ভেতরে এবং ঐশ্বরিক আত্মার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য তারা সংগ্রাম করেছেন। জিবরানের চিঠিতে বারবার ‘নীল শিখা’র কথা বলা হয়েছে, যা তিনি মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই শিখাই মে-এর জন্য তার চিরস্থায়ী ভালোবাসার প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। এই দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা যোগ দিয়েছিলেন একটা আধ্যাত্মিক মিছিলে যে-মিছিলটা চলেছে সেই নীল শিখার প্রতি, যা কিনা বাস্তবতার শাশ্বত শিখা। এটা হচ্ছে তা-ই, জিবরান যাকে বলেছেন মে-এর জন্য আকাক্ষা। তার ভালোবাসা ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো শব্দের দরকার হয় না, কারণ তা। ছিল একটা অচঞ্চল প্রার্থনাসংগীত, যা রাতের নীরবতার ভেতরে শোনা যায় এবং সেখানে ধোঁয়াশা ও সবকিছুর জন্য রয়েছে নির্যাস।
লেবানীয় হিসেবে আমেরিকায় অভিবাসিত হয়ে জিবরান যে বিচ্ছিন্নতা বোধ ও বিচ্ছেদের কষ্ট ভোগ করেছেন তা ছিল একেবারেই শারীরিক ও মানসিক। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্বজনীন কর্মশক্তির সঙ্গে নিজের কর্মশক্তি ও জন্মস্থানের পুনর্মিলন ঘটানো, যেখান থেকে এগারো বছর বয়সে তার মূল উৎপাটন করা হয়েছিল। নিজের দেশে থাকার সময়ও তিনি একই বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার হন। আমেরিকায় তিনি নিজেকে দেখতেন একজন আগন্তুক হিসেবে এবং একটা চাকা হিসেবে যা অন্য চাকাগুলির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়–যা তাঁর প্রথম ইংরেজি রচনা দ্য ম্যাডম্যান-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের একমাত্র প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিই মুখোশটা সরিয়ে ফেলতে এবং সরাসরি বাস্তবতাকে দেখতে সক্ষম সেই ব্যক্তির মুখাবয়বে, যার সঙ্গীরা তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। জিবরানের আকাক্ষাও দ্বিধান্বিত হয়েছিল চূড়ান্ত বাস্তবতার স্থায়িত্বে, যার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল তার মাতৃভূমি লেবাননের জন্য কাতরতা। কিন্তু মে-এর ভেতরে তিনি এমন একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান সবকিছুতেই যার আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায় এবং জিবরানের আত্মা তার। পেছনেই ধাবিত হয়েছে।
জিবরান ও মে-এর ভেতরে চিঠি-লেখালেখি শুরু হয় ১৯১২ সালের দিকে এবং ১৯৩১ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, যে-বছর জিবরান মারা যান। প্রথমদিকে বিশ শতকের আরবি সাহিত্যের এই দুই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের চিঠি লেখালেখি ছিল মূলত সাহিত্য বিষয়ক মতামত আদানপ্রদান, প্রশংসা ও সমালোচনা। জিবরানকে চিঠি লেখার আগে মে তাঁর রচনা ভালোভাবেই পড়েছিলেন। তিনি ১৯১২ সালে প্রকাশিত জিবরানের আরবি উপন্যাস দ্য ব্রোকেন উইংস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জিবরানের স্টাইলের প্রশংসা করতেও ভোলেননি। উল্লেখ্য, উপন্যাসে সেলমা একজন বিবাহিত নারী, যে তার প্রার্থনার ভেতরে গোপন প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হয়। জিবরান অনুভব করেন যে, মানুষের আত্ম উপলব্ধির পথ থাকে ভালোবাসার ভেতরে। মে এসব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কারণ তিনি প্রাচ্যদেশীয় নারী হিসেবে সমস্ত সামাজিক বাধানিষেধের আওতায় বসবাস করতেন এবং যা থেকে পালানোর কোনো উপায় তার ছিল না। তারপরও মে অন্য নারীদের উন্ধুদ্ধ করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে সম্মান করতেন, কিন্তু তার নিজের সমাজের সূক্ষ্ম বন্ধনকে মোটেই আগ্রাহ্য করতে পারতেন না।
ক্রমশ বহু মত বিনিময়ের পর তাদের সম্পর্ক পরিবর্তিত হয় পরস্পারিক বোঝাবুঝি থেকে দৃঢ় বন্ধুত্বে। কিন্তু চূড়ান্ত ভালোবাসায় পরিণত হওয়ার আগে তাঁদের সম্পর্ক দোদুল্যমানতার শিকার হয়। তারপরও মে তার হৃদয়ের উপলব্ধির কথা বলতে অথবা আবেগপূর্ণ শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে বারবার আক্ষেপ করেছেন। ফলশ্রুতিতে জিবরানের সঙ্গে একাধিকবার ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে এবং প্রতীকী ব্যাখ্যার মাধ্যমে পরপর অনেকগুলি চিঠি লিখে মে প্রকাশ করেছেন তার আবেগকে :
‘তোমার প্রতি আমার আবেগোত্মাসকে তুমি কী মনে করো? প্রকৃতপক্ষে আমি জানি না এসবের মাধ্যমে আমি কী বোঝাতে চাই। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার প্রিয়জন এবং আমি তোমার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করি। তবে স্বজ্ঞানে আমি বলছি যে, অল্প ভালোবাসাই। বিশাল এবং মহৎ। দারিদ্র্য ও ক্লেশ ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং ভালোবাসাহীন সম্পদের চেয়ে শুধু ভালোবাসাও অধিক উত্তম। কোন্ সাহসে আমি তা বলি? এসব করে আমি তাদেরকে হারাব… তা সত্ত্বেও আমি তা করব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আমি সবকিছুই লিখছি কিন্তু তা বলছি না, কারণ তুমি যদি এখানে থাকতে তাহলে আমি সঙ্কোচে নিজেকে তোমার কাছ থেকে দীর্ঘসময় দূরে সরিয়ে রাখতাম এবং আমার কথাগুলো ভুলে না-যাওয়া পর্যন্ত পুনরায় আমাকে দেখার অনুমতি তোমাকে দিতাম না।
তারপরও তোমাকে লেখার জন্য নিজেকেই দোষী করছি এজন্য যে, লেখার ভেতরে আমি অতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করছি …. এবং আমি প্রাচ্যের শ্রদ্ধেয় পুরুষদের উচ্চারিত শব্দাবলি স্মরণ করছি, ‘একজন যুবতী নারী কখনই পড়বে বা শিখবে না এবং সেটাই হচ্ছে উত্তম।’ এ বিষয়ে এসে সন্দেহ আমার মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে কী বংশগতির কোনো সম্পর্ক আছে অথবা তার চেয়েও অধিক গভীর কিছু? এটা কী? দয়া করে আমাকে বলল এটা কী? আমাকে বলল আমি সঠিক পথে চলছি না ভুল পথে? কারণ আমি তোমাকে। বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি তুমি যা বলো তা-ই। আমার পথ ভুল বা সঠিক যাই হোক না। কেন আমার হৃদয় তোমার হৃদয়ে পথ খুঁজে পেয়েছে এবং তোমাকে ঘিরে এর আবর্তিত হওয়া উচিত নিজেকে ও তোমাকে রক্ষা করার জন্য।
দূরের দিগন্তরেখার সূর্য ভাসছে এবং আগন্তুক মেঘের ভেতর থেকে অদ্ভুত আকারের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র আবির্ভূত হয়েছে যার নাম ভেনাস-ভালোবাসার সম্রাজ্ঞী। আমি বিস্মিত হই যে, এই নক্ষত্র আমাদের মতো লোকদের প্রতিবেশী, যারা ভালোবাসার আকাক্ষায় পরিপূর্ণ। এটা কখনই হতে পারে না যে ভেনাস আমার মতো এবং তারও নিজস্ব জিবরান আছে–যে দূরে থাকে–বাস্তবতার ভেতরে যার চমৎকার উপস্থিতি এবং সম্ভবত এই মুহূর্তে সে চিঠি লিখছে না, সে দিগন্তে গোধূলিলগ্নে কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। এটা জেনে অন্ধকার অনুসরণ করবে গোধূলিলগ্নকে এবং আলো অনুসরণ করবে অন্ধকারকে এবং সেই রাত্রি অনুসরণ করবে দিনকে এবং দিন অনুসরণ করবে রাত্রিকে এবং এটা চলতে থাকবে তার প্রিয়জনকে দেখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। সুতরাং গোধূলিলগ্নের এবং রাত্রির সমস্ত একাকিত্ব বুকে হেঁটে তার ওপরে উঠে যায়। তখন সে কলম সরিয়ে রাখে একপাশে এবং একটা নামের বর্মের পেছনের অন্ধকারের কাছ থেকে সে প্রত্যাখ্যাত হয়–সেই নামটি হচ্ছে জিবরান।’ [১৯২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি জিবরানকে লেখা মে-এর চিঠি]
জিবরানের চিঠি কখনই সাধারণ ভালোবাসার বিশেষণে সমৃদ্ধ ছিল না। তিনি মে-কে চিঠি লিখেছেন–মনে হয় নিজেকেই শোনাচ্ছেন শৈশব, স্বপ্ন ও প্রাচ্যের জন্য তাঁর আকাক্ষার কথা। জিবরানের অনেক চিঠির পাশে আঁকা স্কেচ বা ড্রইং প্রমাণ করে যে, মে-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিনি কত সহজ করে তুলেছিলেন এবং মে তার কত কাছে ছিল। একইভাবে নিমন্ত্রণপত্র ও বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি পাঠাতেন মে-কে এবং এর অর্থ হল, একটা তীব্র ধারণা দেওয়া যে, জিবরান কীভাবে দিনের পর দিন মে-এর সঙ্গে বসবাস করেছেন কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও।
এই চিঠিগুলির সাহিত্যমূল্য মোটেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তবে এ পর্যন্ত একটা অনুমান মৃদু বিতর্কের জন্ম দেয় এবং তা হল জিবরানের জন্মতারিখ। তার জীবনীকারদের কেউ বলেছেন ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাস, কেউ বলেছেন ডিসেম্বর মাস। তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে এই জটিলতার বিষয়টি তিনি তার একটা চিঠিতেও উল্লেখ করেছেন। মে জিয়াদাহ-এর ভেতরে জিবরান প্রাচ্যের গোপন মহত্ত্বকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে মে ছিলেন প্রাচ্যদেশীয় নারীর প্রতিমূর্তি। যদি জিবরান মে-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতেন তাহলে তার সেই সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব সম্ভবত বাতাসে উবে যেত, বরং না-দেখা হওয়ার কারণেই মে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জিবরানের স্বপ্ন ও বাস্তবতার ভেতরে মিলেমিশে ছিলেন।
পাঠকের কাছে মে অবশ্যই একটা ধাঁধার মতো। জিবরান যতগুলি চিঠি লিখেছেন তার প্রায় অর্ধেক এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে মে এর প্রায় হাফডজন চিঠি একবার প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা আরবিতে। বাকি চিঠিগুলি জনসমক্ষে প্রকাশিত হোক এটা তাঁর পরিবারের লোকেরা চায় না। সম্ভবত এমন সময় আসবে যখন সব চিঠিই আমাদের কাছে সহজপ্রাপ্য হবে।
.
ভাষান্তর প্রসঙ্গে
১
কহলীল জিবরানের নাম ও রচনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে সত্তর দশকের শুরুতে। কোনো অগ্রজ কবি বা লেখক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেননি। দিয়েছিল আমার বন্ধু কায়েস, সে জিবরানের ‘প্রফেট’ গ্রন্থটি নিউমার্কেট থেকে আমার জন্য চুরি করেছিল। তার ধারণা আমি সাহিত্যচর্চা করি, বইটি হয়তো আমার ভালো লাগবে। দীর্ঘ অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতা প্রফেট, যেখানে দেখানো হয়েছে মানুষের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবনের দৃশ্য ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ধারণার প্রতিফলন–যেমন, বিয়ে, আইন, অপরাধ ও শাস্তি, স্বাধীনতা, উদারতা, ধর্ম, সৌন্দর্য এবং আনন্দ। যাহোক, কায়েসের দেখাদেখি আমিও একসময় বই চুরি করতে শুরু করি। কারণ ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি যে মেধাবী, জ্ঞানী ও পণ্ডিতেরাই সাধারণত বই চুরি করে–ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য কেউ বই চুরি করে না। সুতরাং বই চুরি কোনো অপরাধ নয়। আর এদিকে আমার প্রফেটগ্রন্থটা কে চুরি করেছে তার হদিসও পাই না অনেকদিন।
তারপর বিচ্ছিন্নভাবে তার কিছু কবিতার অনুবাদ পড়েছি। কিন্তু জিবরান যেহেতু উইলিয়াম ব্লেকের মতো কবি ও চিত্রকর সে-কারণে তার নামটি স্মৃতিতে ছিল খুবই আলাদাভাবে। প্রফেট গ্রন্থের কিছু ছবি আমি তখন মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। ২০০০ সালের অক্টোবরে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য গিয়ে প্রায় দুমাস হাসপাতালে থাকার পর দিল্লি যাওয়ার একটা সুযোগ হল। দিল্লিতে এসে শরীর ভালো না-থাকায় তেমন ঘোরাঘুরি করতে পারিনি। ফলে টেলিফোনে বড় বড় প্রকাশকের দোকানে খোঁজ নিতে লাগলাম জিবরানের ডায়রি, আত্মজীবনী কিংবা চিঠিপত্র পাওয়া যায় কী না। কিন্তু সফল হইনি। দু-একজন প্রফেট প্রাপ্তির কথা বললেও আমি যা চাই তা পেলাম না।
২০০১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় ফেরার তিনদিন পর এক অনুজপ্রতিম তরুণ বন্ধু আমাকে ‘দ্য লাভ লেটারস অব কহলীল জিবরান পড়তে দেয়। আমি তো আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠি, আরে! এই বইটাই তো আমি ভারতের রাজধানী শহরে খুঁজেছি তন্নতন্ন করে। কারণ এই অদ্ভুত মানুষটির জীবনযাপন সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। যাহোক কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতের কাছে পেলাম, শুরু হল পড়ার কাজ। বারদুয়েক পড়ার পর মনে হল, সনাতন প্রেমের কোনো কথাবার্তা এখানে নেই, তবে চিঠিগুলির অসম্ভব সাহিত্যমূল্য রয়েছে যা জিবরান-বিশেষজ্ঞ ও জিবরান-প্রেমিকদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হতে পারে। চিঠিগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এর কথনভঙ্গি এবং বাক্য রচনারীতি। জিবরানের চিঠি পড়লে মনে হবে যেন তিনি এবং মে মুখোমুখি বসে কথা বলছেন।
২
জিবরানের প্রেমেরে চিঠি অনুবাদের পর অনুবাদ করি তার ‘দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট। ক্রমশ তাঁর লেখার প্রতি আমার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একই সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর গ্রন্থগুলি সংগ্রহের কাজ। কিন্তু কোনো প্রকাশকই এই বিশাল রচনাবলি ছাপাতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। অবশেষে ২০০৭ সালে অনিন্দ্য প্রকাশের মালিক আফজাল হোসেন এই রচনাবলি প্রকাশের আগ্রহ দেখালে ২০০৭ সালেই জিবরানের পনেরোটি গ্রন্থের অনুবাদের কাজ শেষ করি। এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলি হচ্ছে, নবী (দ্য প্রফেট), নবীর বাগান (দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট), পৃথিবীর ঈশ্বরেরা(দ্য আর্থ গডস), বালি ও ফেনা (স্যাণ্ড এণ্ড ফোম), পথভ্রষ্ট (দ্য ওয়াণ্ডারার), পাগল (দ্য ম্যাডম্যান), অগ্রদূত (দ্য ফোর রানার), উপত্যকার পরী (নিফ অব দ্য ভ্যালি), কান্না এবং উচ্চহাসি (টিয়ারস এন্ড লাফটার), কহলীল জিবরানের প্রেমের চিঠি (দ্য লাভ লেটারস অব কহলীল জিবরান), রাত্রি ও সকালের মাঝখানে (বিটুইন নাইট এণ্ড মন), হৃদয়ের গোপনীয়তা (সেক্রেটস অব দ্য হার্ট), আত্মার বিদ্রোহ (স্পিরিটস রেবেলিয়াস), ভাঙা ডানা (দ্য ব্রোকেন উইংস) ও মানুষের পুত্র যিশু (জেসাস দ্য সান অব ম্যান)।
ভাষান্তরের ক্ষেত্রে মূলের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করেছি, আরও চেষ্টা করেছি জিবরানের কথনভঙ্গিকে তার মতো করেই পাঠকের কাছে তুলে ধরতে। তবে কোনো কোনো জায়গায় মৃদু আক্ষরিক মনে হতে পার এবং বাধ্য হয়েই তা করতে হয়েছে, তা না হলে অনুবাদে জিবরানকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এছাড়া জিবরানের একটা অদ্ভুত স্টাইল রয়েছে, যাকে আমি জিবরানীয় স্টাইল বলতে চাই। বিশ্ব সাহিত্যে এই স্টাইলে কোনো কবি বা কথা সাহিত্যিককে কথা বলতে দেখি নাই–এ স্টাইল একেবারেই তার নিজস্ব, যা দীর্ঘ বাক্য গঠনের প্রক্রিয়াকে আয়াসসাধ্য করে তোলে চিন্তা ও মননের ঐক্যের ভেতরে। জিবরান মূলত ছিলেন দার্শনিক এবং সেই দার্শনিকতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিত্বের ভেতর দিয়ে।
জিবরান সাধারণ পাঠকের জন্য নয়। সাধারণ পাঠক জিবরান পড়ে মোটেও আনন্দ পাবে না। শুধু মাত্র শিক্ষিত এবং মেধাবী পাঠকেরাই জিবরানের রচনার রস আস্বাদন করতে সক্ষম এবং একমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন যে কালের ধূলোর ওপর দাঁড়িয়ে তিনি খেলা করেছেন মরমী দার্শনিকের এক অবাস্তব জগৎ নিয়ে। জিবরানের রচনা পড়লে তাঁর যে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির স্পর্শ পাওয়া যায় তাকে আমরা প্রথম শ্রেণীর বলতে পারি এবং কবি ও কথাসাহিত্যিকদের জন্য তাঁর গ্রন্থপাঠ অপরিহার্য, কারণ তিনি ছিলেন কবিদের কবি এবং উপন্যাসিকদের উপন্যাসিক-লেখালেখি ও চিত্রকলার পেছনেই তিনি প্রতিটি দিন ও রাত্রির সারাটা সময় কাটাতেন। শিল্পের জন্য নিবেদিত একটি প্রাণ উদ্ভট মানসিকতা নিয়েও নির্মাণ করেছে শিল্পোত্তীর্ণ কাব্য ও চিত্রকলা। সে সময়ের ফরাসি ও ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকেরা তার শিল্পকর্মকে তুলে ধরার জন্য নিজেদের উদ্যোগে জিবরানের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। তাঁর কবিতা ও ছবি উভয়ই প্রশংসিত হয়েছে তার জীবিতাবস্থায়। সবকিছুর পর জিবরান হচ্ছেন দ্বিতীয় ব্লেক, নতুন ব্লেক-যার ছবি ও কবিতা উভয়ই উভয়ের পরিপূরক।
৩
জিবরান আমার প্রিয় লেখকদের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন ধরে। জিবরান হলেন আমার কাছে সেরকম একজন লেখক যার লেখা পড়ে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকা অবস্থায় সুস্থ হয়ে উঠি নিজের ভেতরে। জিবরান তার রচনায় এমন একটা জগতকে আবিষ্কার করেছেন পাঠক যার ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে মুগ্ধ হবে, তারপর আছন্ন হয়ে থাকবে এবং তারপর সে উদ্বুদ্ধ হবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণ করতে। আমার উদ্দেশ্য কহলীল জিবরানকে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অনুবাদে কতটা সফল হয়েছি তা বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। তবে আগামী দিনে যারা লেখালেখি করবেন এই গ্রন্থ তাদেরকে জিবরানের চিন্তা-ভাবনার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। গ্রন্থটি পাঠকের ভালো লাগলে নিজের পরিশ্রম সার্থক মনে করব।
মোস্তফা মীর
ঢাকা ০১.০২.২০০৯
Leave a Reply