কল্পবিজ্ঞান সমগ্র – রেবন্ত গোস্বামী
সম্পাদনাঃ সুদীপ দেব
কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস
উৎসর্গ
বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান পড়তে ভালোবাসেন বা ভালোবাসে–সব বয়সের সেইসব পাঠক পাঠিকার উদ্দেশে এই সংকলনগ্রন্থটি উৎসর্গ করলাম।
প্রকাশকের কথা
গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে অদ্রীশ বর্ধন, ‘আশ্চর্য! পত্রিকা এবং ভারতের তথা বিশ্বের সর্বপ্রথম সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবের হাত ধরে বাংলা কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যে জোয়ার এসেছিল। একটা সময় পর সেই স্রোত বহমান রাখতে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, রেবন্ত গোস্বামী তাঁদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম। আটের দশক থেকে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত তাঁর সোনার কলমে ঝরে-পড়া একেকটি অমূল্য রতনকে পাথেয় করে শৈশব থেকে কৈশোরে, যৌবনে প্রবেশ করেছেন অনেকেই। তাঁদের স্মৃতির মণিকোঠায় সযত্নে রয়ে গেলেও পার্থিব জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল সেই অসামান্য গল্পগুলি। রেবন্ত গোস্বামীর লেখা একমাত্র কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস “সোনার তরীর দুই যাত্রী” একটি বহুল প্রচারিত কিশোর পত্রিকার দপ্তর থেকে হারিয়ে যায়। দুঃখের বিষয়, পাণ্ডুলিপির কোনও কপিও লেখকের কাছে নেই। লেখকের একটিমাত্র পূর্বপ্রকাশিত গল্পসংকলনও বহু দিন হল দুষ্প্রাপ্য। অথচ যে কয়েকজন লেখক আজীবন শুধু শিশু-কিশোরসাহিত্যের সেবা করে এসেছেন ও আমাদের শৈশব-কৈশোর তাঁদের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় মায়াময় করে দিয়েছেন, রেবন্ত গোস্বামী তাঁদের একজন অগ্রগণ্য প্রতিনিধি। বাংলা কল্পবিজ্ঞান তো বটেই, বাংলা কিশোরসাহিত্য চিরঋণী তাঁর কাছে। তাঁর সমগ্র লেখালেখি থেকে শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প আর ছড়াগুলিকে পুনরুদ্ধার করে একটি সুতোয় বোনার চেষ্টা এই সংকলনে। এই কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন: অভীককুমার মৈত্র, অশোককুমার মিত্র, ঋজু গাঙ্গুলী, চান্দ্রেয়ী ব্যানার্জী, দেবাশিস সেন, নন্দিতা নাথ, বরুণ রেজ, রূপক চট্টরাজ, সন্দীপ রায়, সোমনাথ দাশগুপ্ত, স্বাগত দত্ত বর্মণ ও ধুলোখেলা ব্লগ। সত্যজিৎ রায়ের অমূল্য অলংকরণের পাশাপাশি স্বর্ণযুগের শিল্পী বিজন কর্মকারকে আমরা পেয়েছি গ্রন্থের অঙ্গসজ্জায়। বাংলা কল্পবিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অমিতানন্দ দাশের ভূমিকায় সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি। সব মিলে এই সংকলন নিঃসন্দেহে পাঠকের সমাদর পাবে–এই বিশ্বাস আমাদের আছে।
.
কৈফিয়ত
বিজ্ঞান মানে ব্ৰহ্ম হতে কীটপরমাণু–সর্বভূতের সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান। সেই জ্ঞানলাভের পথের যাত্রী না হয়েও, বা তার ক্ষমতা না-থাকা সত্ত্বেও সেই পথের কল্পনা থেকে কল্পবিজ্ঞানের সৃষ্টি। আমি যখন সব ধরনের লেখার মধ্যেই দু-একটা এমন লেখা লিখি, যাকে কল্পবিজ্ঞান বলা চলে, সেই দিন থেকে বিজ্ঞান এখন অনেকটাই এগিয়েছে। সাধারণ বাঙালির কাছে তখন কানে শোনা একটি শব্দ–কম্পিউটার। অনেকের কাছে সেটা ছিল আলাদিনের এক দৈত্য, যে এলে ধনিক ও মালিকশ্রেণি তাকে পুষে সাধারণ কর্মচারীদের কর্মচ্যুত বেকার করে দেবে। তার ঐতিহাসিক সত্যতা অনেকেই জানেন। বিবাদী বাগের এক বেসরকারি ব্যাংকে প্রথম কম্পিউটার আনার প্রস্তাবে তার বিরুদ্ধে কর্মচারীদের আন্দোলন সমস্ত অঞ্চলটাকে অস্থির করে তুলেছিল। আজ সেই কম্পিউটার প্রতিটি অফিস থেকে সেইসব সাধারণ মানুষের ঘরের টেবিলে, টেবিল থেকে কোলে, কোল থেকে পকেটে। সেই কম্পিউটার নিয়েই গড়ে উঠেছে এক নতুন কর্মর্জগৎ, অঞ্চল বা শহর। আমার প্রথমদিকের গল্প সেই আলাদিনের দৈত্যের কল্পনার যুগে লেখা। অন্যান্য লেখাও পরে যখন পড়েছি, সেই বিষয়ে আরও কিছু তথ্য জানার পরে মনে হয়েছে, গল্পটাকে আরও নিখুঁত করা যেত। কিন্তু করিনি। কারণ, এইভাবে সংশোধনের শেষ নেই। তাই আশা করি, বিদগ্ধ পাঠকগণ সেইসব বিচার করেই লেখাগুলি পড়বেন।
সবার শেষে হলেও সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে, যাদের উদ্যোগ ছাড়া এই সংকলন প্রকাশ করা আদপেই বাস্তবায়িত হত না, তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাই আমি কৃতজ্ঞ কল্পবিশ্ব এবং বিশেষ করে আমার স্নেহভাজন শ্ৰীমান সুদীপ দেবের কাছে, যে কল্পনাতীত ক্ষমতাবলে আমার প্রায় বিস্মৃত ও হারিয়ে-ফেলা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখা গল্প ও ছড়া-কবিতা ছড়িয়ে-থাকা অতীতের বিভিন্ন পত্রিকা থেকে উদ্ধার করে একত্রিত করেছে। একমাত্র কল্পবিজ্ঞানের রোবট-হংসই এ কাজ করতে হয়তো সক্ষম।
এই সংকলনগ্রন্থটি যদি পাঠক-পাঠিকাদের ভালো লাগে, তবে এই প্রবীণ বয়সে নিজেকে ধন্য বলে মনে করব।
.
ভূমিকা
এই বইয়ের লেখক রেবন্তদাকে চিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে। বহু বছর আমরা দুজনেই সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা-প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এই সংকলনের চৌত্রিশটি গল্পের মধ্যে উনত্রিশটি গল্পই প্রথমে প্রকাশিত হয় সন্দেশ’, ‘শুকতারা’ বা ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকাতে। প্রত্যেকটিকেই কল্পবিজ্ঞান গল্প বলা যায়। এর মধ্যে ১৭টি গল্প নিয়ে ‘বৃশ্চিক গ্রাস’ নামের একটি সংকলন প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৪ (বাংলা ১৪০১) সালে, আমিই তার প্রকাশক ছিলাম। তবে দুঃখের বিষয়, বহু দিন হল সেই বইটি আউট অব প্রিন্ট।
এই সমগ্রের গল্পের মধ্যে প্রায় অর্ধেক উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের সাতটি মহাকাশ বা মহাকাশযাত্রা বিষয়ক; পাঁচটি রোবট নিয়ে ও চারটি অন্যান্য বিষয়ে। গল্পগুলির ভাষা সহজ ও সাবলীল, যা ছোট-বড় সকলেরই ভালো লাগবে। গল্পের প্লটে কিছু বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির কথা থাকলেও তার পাশাপাশি সাধারণ লোকেদের ব্যবহার ও কথোপকথন একেবারেই দৈনন্দিন জীবনের মতো স্বাভাবিক। কয়েকটি গল্পে চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দও গল্পগুলিকে আকর্ষণীয় করেছে।
সমগ্রের মধ্যে আমার মতে পাঁচটি সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক গল্প হল ‘ভাস্কর মিশ্রর পুঁথি’, ‘সুবর্ণদ্বীপ রহস্য’, ‘বাউড়ি পুকুরের বিভীষিকা’, ‘অন্য শোক’ ও ‘কালো আলো’। প্রথম গল্পটি কয়েকশো বছরের এক ‘টাইম-স্লিপ’ নিয়ে, যা ঘটেছে গ্রামবাংলার পরিবেশে। দ্বিতীয়টি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, ইউরোপীয় জলদস্যুদের পুরোনো সংকেতের মানে বুঝে গুপ্তধন উদ্ধারের অভিযানের নিয়ে গল্পের শেষে এক চিত্তাকর্ষক প্যাঁচ আছে, তবে তার বিষয়ে আগে বললে গল্পের মজা মাটি হবে। বাউড়ি পুকুরে দিনদুপুরে লোক জলে ডুবে মারা যাচ্ছে, মৃত লোকেদের দেহও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, পুকুরের জল পাম্প করে বের করে কি জানা যাবে? এখানেও শেষটা বলা যাবে না। অন্য শোক’ ভবিষ্যতের গল্প অভূতপূর্ব নতুন প্রযুক্তির ফলে নতুন জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যার সমাধান আছে কি না জানা নেই। কালো আলো’ একটি ছোট ছেলের ব্যক্তিগত সমস্যার বিষয়ে চমৎকার গল্প, বিজ্ঞানমনস্কতার মাপকাঠিতে হয়তো এই সংকলনের সেরা গল্প।
এই বইয়ের অধিকাংশ গল্পের বৈজ্ঞানিকরা তাঁদের বাড়ির গবেষণাগারে কাজ করেন। শতাধিক বছর আগে ধনী পরিবারের ছেলে স্যার জগদীশ বসু ব্যক্তিগত গবেষণাগারে বহু বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করেন। সত্যজিৎ-সৃষ্ট প্রফেসর শঙ্কু তাঁর গিরিডির বাড়িতে বসেই করেন অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত আবিষ্কার। তাই বোধহয় কয়েকশো বাংলা গল্পের অনেক বৈজ্ঞানিকই নিজের বাড়ির গবেষণাগারেই কাজ করেন। ইউরোপেও এভাবেই গবেষণা হত দু-শো বছর আগে। লর্ড হেনরি ক্যাভেন্ডিশ (১৭৩১-১৮১০) নিজের বাড়িতে পদার্থবিদ্যার ও রসায়নের নানা আবিষ্কার করেন (পৃথিবীর ওজন মাপার সেই অতি-সূক্ষ্ম যন্ত্র তৈরি অবধি)। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ স্যার উইলিয়াম হার্শেল (১৭৩৮-১৮২২) ইউরেনাস গ্রহ ও আরও অনেক আবিষ্কার করেন, শুধু নিজের বোন ক্যারোলিনের সাহায্যে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কাঁচ ঘষে নিজের বাড়িতেই তৈরি করেন তৎকালীন পৃথিবীর সেরা দূরবীক্ষণ যন্ত্র। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে উন্নত গবেষণার যন্ত্রপাতির দাম এতটাই বেশি যে, এভাবে বাড়িতে বসে উন্নত পরীক্ষামূলক গবেষণা করা প্রায় অসম্ভব।
রেবতা ছড়া লেখেনও চমৎকার। নানা বিষয়ে ছড়া, প্রধানত কিশোরদের জন্য। এই সমগ্রে কল্পবিজ্ঞানের ছড়াও আছে কয়েকটি।
—-অমিতানন্দ দাশ
নভেম্বর ২০১৯
Leave a Reply