এইচ জি ওয়েলস কল্পগল্প সমগ্র
অদ্রীশ বর্ধন অনূদিত
সম্পাদনা সন্তু বাগ
ফ্যানট্যাস্টিক ও কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস যৌথ প্রয়াস
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪
প্রথম যৌথ প্রকাশ: অক্টোবর, ২০১৯
উৎসর্গ – অদ্রীশ বর্ধনের স্মৃতির উদ্দেশে
এইচ জি ওয়েলস
জন্ম থেকে মৃত্যু পুরো নাম হারবার্ট জর্জ ওয়েলস। ব্রিটিশ। জন্ম ১৮৬৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। কমার্শিয়াল অ্যাকাডেমিতে লেখাপড়া করেন ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত। সার্টিফিকেট নেন বুককিপিং অর্থাৎ পদ্ধতিমাফিক হিসাব রাখার বিদ্যায়। ১৮৮০-তে শিক্ষানবিশি করেন উইন্ডসরের এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে। ওই বছরেই ছাত্র-শিক্ষক ছিলেন সমারসেটের একটি স্কুলে। ১৮৮০-৮১ তে শিক্ষানবিশ কেমিস্ট ছিলেন সাসেক্সে। ১৮৮১-৮৩-তে শিক্ষানবিশ বস্ত্র-ব্যবসায়ী ছিলেন হ্যাম্পশায়ারের হাইস্ এম্পোরিয়ামে। ১৮৮৩-৮৪-তে ছাত্র-সহকারী ছিলেন মিডহার্স্ট গ্রামার স্কুলে। ১৮৮৪-৮৭-তে পড়াশোনা করেন লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সায়েন্সে, কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেননি পরীক্ষায়।
শিক্ষকতা করেন ১৮৮৭-৮৮ সালে রেক্সহ্যামের হোল্ট অ্যাকাডেমিতে এবং ১৮৮৮-৮৯ সালে লন্ডনের হেনলি হাউস স্কুলে। ১৮৯০-এ বিএসসি ডিগ্রি পান ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে। দুই বিয়ে। প্রথম বিবাহ হয় খুড়তুতো বোন ইসাবেল মেরি ওয়েলসের সঙ্গে ১৮৯১ সালে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ১৮৯৫-এ। ওই বছরেই দ্বিতীয় বিবাহ হয় অ্যামি ক্যাথরিন রবিন্সের সঙ্গে। দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যান ১৯২৭ সালে। দুই পুত্র। লেখক অ্যান্টনি ওয়েস্ট-ও তাঁর পুত্র–মা ছিলেন লেখিকা রেবেকা ওয়েস্ট। ১৮৯১-৯২-এ শিক্ষকতা করেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি টিউটোরিয়াল কলেজে।
পুরো সময়ের লেখক হন ১৮৯৩ সাল থেকে। ১৯২২ এবং ১৯২৩-এ ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের পক্ষে পার্লামেন্টের লেবার নির্বাচনপ্রার্থী হন। ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত ছিলেন। ফেবিয়ান সোসাইটির সদস্য। ১৯৩৬-এ ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পান ডক্টরেট অব লিটারেচার সম্মান। লন্ডনের ইম্পিরিয়েল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সম্মানজনক সদস্যপদে থাকার পর দেহাবসান ঘটে ১৯৪৬ সালের ১৩ আগস্ট।
কল্পবিজ্ঞানের রচনাবলি
নভেল
দ্য টাইম মেশিন: অ্যান ইনভেনশন, ১৮৯৫।
দি আইল্যান্ড অব ডক্টর মোরো, ১৮৯৬।
দি ইনভিজিবুল ম্যান, ১৮৯৭।
দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস, ১৮৯৮।
হোয়েন দ্য স্লিপার ওয়েকস, ১৮৯৯; পরিমার্জিত সংস্করণ,
দ্য স্লিপার ওয়েকস, ১৯১০৷
দ্য ফাস্ট মেন ইন দ্য মুন, ১৯০১।
দ্য ফুড অব দ্য গডস অ্যান্ড হাউ ইট কেম টু আর্থ, ১৯০৪৷
এ মডার্ন ইউটোপিয়া, ১৯০৫৷
ইন দ্য ডেজ অব দ্য কমেট, ১৯০৬।
দ্য ওয়ার ইন দি এয়ার, অ্যান্ড পার্টিকুলারলি হাউ মি. বার্ট স্মলওয়েজ ফেয়ার্ড হোয়াইল ইট লাস্টেড, ১৯০৮।
দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি: এ স্টোরি অব ম্যানকাইন্ড, ১৯১৪৷
মেন লাইক গডস, ১৯২৩
দ্য শেপ অব থিংস টু কাম: দি আলটিমেট রেজোশন, ১৯৩৩ পরিমার্জিত সংস্করণ, থিংস টু কাম (ছায়াছবি কাহিনি), ১৯৩৫।
দ্য ক্রকেট প্লেয়ার, লন্ডন, ১৯৩৬, নিউ ইয়র্ক, ১৯৩৭।
স্টার বিগটস: এ বায়োলজিক্যাল ফ্যান্টাসিয়া, ১৯৩৭।
দ্য হোলি টেরর, ১৯৩৯।
ছোটগল্প সংকলন
দ্য স্টোলেন ব্যাসিলাস অ্যান্ড ইনসিডেন্টস, ১৮৯৫৷
দ্য প্ল্যাটনার স্টোরি অ্যান্ড আদারস, ১৮৯৭।
থার্টি স্ট্রেঞ্জ স্টোরিজ, ১৮৯৭।
টেলস অব স্পেস অ্যান্ড টাইম, ১৮৯৯।
টুয়েভ স্টোরিজ অ্যান্ড এ ড্রিম, লন্ডন, ১৯০৩;
নিউ ইয়র্ক, ১৯০৫৷
দ্য কান্ট্রি অব দ্য ব্লাইন্ড অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, ১৯১১ পরিমার্জিত সংস্করণ, দ্য কান্ট্রি অব দ্য ব্লাইন্ড, ১৯৩৯।
দ্য ডোর ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, নিউ ইয়র্ক ১৯১১; লন্ডন, ১৯১৫। কমপ্লিট শর্ট স্টোরিজ, লন্ডন, ১৯২৭; ‘দ্য শর্ট স্টোরিজ অব এইচ জি ওয়েলস’ নামে– নিউ ইয়র্ক, ১৯২৯।
টোয়েন্টি এইট সায়েন্স-ফিকশন স্টোরিজ, ১৯৫২।
সিলেকটিভ শর্ট স্টোরিজ, ১৯৫৮।
বেস্ট সায়েন্স ফিকশন স্টোরিজ অব এইচ জি ওয়েলস, ১৯৬৬।
অন্যান্য রচনাবলি
নভেল: ৩৮টি।
ছোটগল্পসংকলন: ৬টি।
নাটক: ৩টি।
চিত্রনাট্য: ৫টি।
অন্যান্য ৮৯টি।
এইচ জি ওয়েলস কল্পবিজ্ঞান ছাড়াও ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজবাদ এবং বিবিধ বিষয়ে লেখনী চালনা করে গেছেন অক্লান্তভাবে। কল্পবিজ্ঞানের নামগুলিই কেবল পুরো দেওয়া হল। অন্যান্য রচনাবলির মধ্যে আছে তাঁর নানান বিষয়ের লেখা বই। সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, মার্কসবাদ নিয়েও লিখেছেন। স্ট্যালিনের সাক্ষাত্তারও নিয়েছেন। সম্পাদনাও করেছেন। মৃত্যুর ২০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত এইচ জি ওয়েলস সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর গ্রন্থপঞ্জি ও জীবনী (১৯৬৬, পরিমার্জিত সংস্করণ, ১৯৬৮)।
কৃতিত্ব ও ব্যর্থতা
‘দি আর্লি এইচ জি ওয়েলস’ নামে একটি নিবন্ধ রচনা করেন বার্নার্ড বারগেঞ্জি। কিঞ্চিৎ শ্লেষভরে এই প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেন, ওয়েলস যদি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে গত হতেন, তাহলে তাঁর তরুণ আমেরিকান বন্ধু স্টিফেন ক্রে-র মতো মুখ্যত সাহিত্য-শিল্পী রূপেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। ১৯০০-র পর থেকেই ৪৫ বছর ধরে অসীম প্রযত্নে ‘পুস্তিকালেখন’-এর (প্যালিটিয়ারিং) সুযোগ তাহলে পেতেন না। উচ্চসংস্কৃতির সমগ্র আকাশ জুড়ে ওয়েলস থেকে যেতেন দৃঢ়তরভাবে। জনসাধারণকে আলোকিত করতে গিয়ে প্রচলিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হত না এবং এই জেহাদের ছায়াপাতও তাঁর জীবনকে ম্লান করে তুলত না। ১৯০০-র পর কিছুটা আনাড়ির মতো মূল সাহিত্য উপন্যাস লেখার সুযোগ পেতেন না। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, বার্গোঞ্জির মন্তব্য ত্রুটিহীন বললেই চলে। ১৮৯৪ থেকে ১৯০১-এর মধ্যবর্তী সময়ে ওয়েলস যা সৃষ্টি করে গেছেন, একদম প্রথমদিকের ছোটগল্প ‘দ্য পলমল বাজেট’ থেকে ‘দ্য ফাস্ট মেন ইন দ্য মুন’ পর্যন্ত, তার প্রতিটিই অত্যন্ত কল্পনাসমৃদ্ধ এবং শিল্পসুন্দর কল্পবিজ্ঞান, সমকালের অন্য কোনও নভেলিস্টের সৃষ্টি তাঁর সৃষ্টির ধারেকাছেও আসতে পারেনি। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যজীবনের যা কিছু শ্ৰেষ্ঠ সৃষ্টি, তা ঘটেছে ওই সময়ের মধ্যেই। ১৯০০-র পরে ওয়েলস লিখেছেন মূল সাহিত্যের উপন্যাস, সমাজতন্ত্র, ভবিষ্য ফতোয়া, সাংবাদিকতা সংকলন, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের বিশ্বকোষসম পর্যালোচনা কিন্তু শিল্পগত তুলনায় কোনওটাই তাঁর প্রথমদিকের কল্পবিজ্ঞানের মতো উঁচুদরের নয়। ১৮৯৪ থেকে ১৯০১-এর মধ্যে কল্পবিজ্ঞানের যে মান উনি নিজেই সৃষ্টি করে গেছেন, পরবর্তীকালে লেখা ওঁর বেশির ভাগ কল্পবিজ্ঞানই সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে রসোত্তীর্ণ হয়নি।
ওয়েলসের সাহিত্যিক সত্তার সৌভাগ্য, বর্ণোজ্জ্বল দিনগুলিতে ওয়েলস যা করেছেন তা প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত, তাই ঠাঁই পেয়েছেন অমর সাহিত্যিকদের পঙক্তিতে। ১৮৯৪ থেকে ১৯০১-এর মধ্যে উনি লিখেছেন ফ্যান্টাসি আর সায়েন্স-ফিকশন–সংখ্যায় বেশি কল্পবিজ্ঞানই। মোট ৬টি উপন্যাস এবং ৩০টিরও বেশি ছোটগল্প। বেশির ভাগই তৎক্ষণাৎ প্রশংসা পেয়েছে পাঠক এবং সমালোচকের। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টাইম মেশিন’। সময় পর্যটন নিয়ে বিংশ শতাব্দীতে যত গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, সব কটিরই মূল আদর্শ এই উপন্যাসটি। দি আইল্যান্ড অব ডক্টর মোরো’-তে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের গল্পকেই নতুন আঙ্গিকে বলা হয়েছে-কাহিনির নিগূঢ় প্রচ্ছন্ন শ্লেষ সুইফটের রচনারীতিকে মনে করিয়ে দেয়। বিজ্ঞানের ক্ষমতা আছে মানবজাতটাকে লুপ্ত করে দেওয়ার মানুষ নিজেই ধ্বংস টেনে আনবে নিজের–ভয়ংকর সম্ভাবনার বিরুদ্ধেই কল্পবিজ্ঞানের হুঁশিয়ারিস্বরূপ চিরকালের আদর্শ তাঁর “দি ইনভিজিবল ম্যান’। পরে এই ধরনের হুঁশিয়ার কল্পবিজ্ঞানগুলো লেখা হয়েছে এই উপন্যাসটিকেই মডেল করে। আন্তঃগ্রহ সংঘর্ষ নিয়ে লেখা প্রথম কাহিনি ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’। হোয়েন দ্য স্লিপার ওয়েকস’ জামিয়ানতিনকে অনুপ্রাণিত করেছে ‘উই’ এবং হাক্সলিকে ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড লিখতে। বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মহাকাশের পর্যটনের প্রথম স্বীকৃত বিবরণ লেখা হয়েছে ‘দ্য ফার্স্ট মেন ইন দ্য মুন’ উপাখ্যানে।
প্রথমদিকের উপন্যাসসমূহের মতো আদর্শ হওয়ার যোগ্য কয়েকটা ছোটগল্পও। প্রকৃতির ভয়াবহতা ফাঁস করে দিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান–এই উপাদান নিয়েই বর্তমান শতাব্দীতেই লেখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বিপর্যয়-সাহিত্য। প্রথমদিকের কয়েকটা গল্পে এই বিষয়টিকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন ওয়েলস। ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’-কে ডারউইনীয় রূপকথা হিসেবেও পড়া যেতে পারে। কিন্তু এটি ছাড়াও তিনি লিখেছেন মানুষখেকো অর্কিডের গল্প, শুড়ওয়ালা অতিকায় সামুদ্রিক জীব কেফালোপডের গল্প, দানবিক পক্ষী আর মাকড়সার গল্প, বিশ্ববিজয়ের পথে পিপীলিকাবাহিনীর গল্প, এবং ‘দ্য স্টার’ গল্পে উপহার দিয়েছেন জ্যোতিষ্ক বিপর্যয়ের ধ্রুপদী নিয়মানুবর্তিতার কাহিনি। এমনভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যে, পড়বার পর থ হয়ে বসে থাকতে হয়–সম্ভাবনাটা যে অলীক নয়–এই ধারণা নিয়ে শিহরিত থাকতে হয়। আধুনিক নৃতত্ত্ববিজ্ঞানকে কল্পনায় প্রয়োগ করেছেন ওয়েলস তাঁর ‘এ স্টোরি অব দ্য স্টোন এজ’ গল্পে এবং এই প্রচেষ্টার অগ্রগণ্যদের অন্যতম তিনি। সায়েন্স এবং টেকনোলজির বিপদ সম্বন্ধে আবার হুঁশিয়ারি এবং ভর্ৎসনা তুলে ধরেছেন ‘দ্য নিউ অ্যাকসিলারেটর’ এবং এ ড্রিম অব আরমাগেডন’ গল্প দুটিতে–প্রথম হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ‘দি ইনভিজিবল ম্যান’ উপন্যাসে। এ ড্রিম অব আরমাগেডন’ গল্পে স্বপ্নাতুর ব্যক্তি বলছেন কাহিনিকারকে–”আহাম্মকের মতোই মানুষ এইসব জিনিস বানিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎ জীবনের দুঃস্বপ্নে স্বপ্নাতুর ব্যক্তিটি দেখেছিলেন। যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে গবেষণা। বলেছিলেন, “বীবর যেভাবে বাঁধ নির্মাণ করে, কিন্তু একবারও ভাবে না যে, নদীপথ ঘুরিয়ে দিয়ে বন্যায় জমি ভাসিয়ে দিতে চলেছে!
১৯০১-এ কল্পবিজ্ঞানের প্রবাহ স্তব্ধ হয়নি ওয়েলসের লেখনীতে, কিন্তু কালদেবতা কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁর সৃজনী ক্ষমতা, অবক্ষয় ঘটিয়েছিলেন শিল্পদক্ষতার, প্রযত্নবিহীন হয়ে উঠেছিলেন ওয়েলস। ১৯০২ থেকে ১৯১৪-র মধ্যে লিখেছিলেন ছ-টা ফ্যান্টাসি আর সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস এবং ডজনখানেক গল্প। ১৯১৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লিখেছিলেন আরও পাঁচটি সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস, তিনটে চিত্রনাট্য, এবং মূল সাহিত্য আর কল্পসাহিত্যের মাঝামাঝি এক্তিয়ারবিহীন অঞ্চলে বেশ কিছু রচনা। প্রথমদিকের গল্প-উপন্যাসে যেসব হুঁশিয়ারি আর উদবেগের প্রকাশ ঘটেছিল, শেষের কিছু লেখায় তাদের পুনরাবির্ভাব দেখা যায় এবং নতুন কথাও বলেন। ১৯০১-এর পর ওয়েলসের লেখা কল্পবিজ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য এবং পার্থক্য অধিকতর রাজনৈতিক সচেতনতা। বিশ্বজোড়া যুদ্ধছবি এঁকেছেন, পৈশাচিক অস্ত্রশস্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন, মাঝে মাঝে বিশ্বব্যাপী যন্ত্রযুগের রামরাজ্য তুলে ধরেছেন। ১৯০৩ সালে ট্যাঙ্ক যুদ্ধের ভবিষ্যকল্পনা করেছিলেন ওয়েলস (দ্য ল্যান্ড আয়রনক্ল্যাডস), ১৯০৮-এ বলেছিলেন, উড়োজাহাজ থেকে বোমাবর্ষণ করে শহরের পর শহর ধ্বংস করে দেওয়া হবে (দ্য ওয়ার ইন দি এয়ার), ১৯১৪-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অ্যাটম বোমা আবিষ্কারের (দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি)। নাতসিবাদকে ব্যঙ্গ করেছিলেন ‘দি অটোক্রেসি অব মি. পারহ্যাম’ কাহিনিতে এবং বিষয়টি প্রয়োগ করেছিলেন ‘দ্য হোলি টেরর’-এ রামরাজ্য বিষয়ক তাঁর তিনটি উপন্যাস তৎকালীন অসাধারণ সমস্যাসংকুল প্রজন্ম পটভূমিকায় স্মরণযোগ্য সৃষ্টি (এ মডার্ন ইউটোপিয়া, মেন লাইক গডস, দ্য শেপ অব থিংস টু কাম)।
১৯৩৪ সালে সমালোচকদের একহাত নিয়েছিলেন ওয়েলস–’সাহিত্য সমালোচকদের এই অভ্যেসটি দুরারোগ্য। আমার প্রথমদিকের রচনাবলিতে যে সরলতা আর শিল্পসৌন্দর্য ছিল, এখন নাকি আর তা নেই। তাঁদের বিলাপেরও অন্ত নেই। শেষের দিকের লেখায় আমি নাকি তর্কপ্রিয় হয়ে উঠেছি। আত্মরক্ষার্থে যা লিখেছিলেন ওয়েলস তা যথার্থ। বরাবরই তিনি সমকালের বিষয় নিয়ে লিখেছেন, “জনসাধারণের জীবনপ্রবাহ’র সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছেন। এই পর্যন্ত ওঁর যুক্তিতে খাদ নেই–সত্যিই বলেছেন। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করেননি যে, আঙ্গিক আর কল্পনাশক্তির ঘাটতিতে সমাচ্ছন্ন থেকেছে তাঁর শেষের দিকের উপন্যাসগুলো। বিতর্কমূলক লেখা লিখেছেন জর্জ অরওয়েল এবং ওয়াল্টার মিলার জুনিয়রও-তর্কপ্রিয়তার জন্যেই তাঁরা বিপুলভাবে স্বনামধন্য। তাঁদের এই খ্যাতির পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায়, বিশুদ্ধ’ সাহিত্য পরিত্যাগ করে পুস্তিকালেখন’ সাহিত্যে আত্মনিয়োগ করে ওয়েলস ভুল সাহিত্য করেননি। অসহিষ্ণুতা আর বিরক্তিপ্রবণতা দিয়ে তাঁর শিল্পের ধার তিনি শুধু নষ্টই করে গেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁর কৃতিত্বের পরিমাণ বিরাট। তুলনা হয় না ওয়েলসের সেরা রচনাবলির–শব্দরূপসমৃদ্ধির জমকালো দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তাঁর এই লেখাগুলো। প্রথমদিকের অন্য কোনও কল্পবিজ্ঞান লেখক এত পথের উন্মোচন ঘটিয়ে যেতে পারেননি। বিশ্বব্যাপী খ্যাতির দিক দিয়েও তিনি অসাধারণ। পৃথিবীর সব দেশেরই প্রতিটি কল্পবিজ্ঞান লেখক তাঁর লেখা পড়েছেন এই শতাব্দীতে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যা, অথবা আধুনিক কলাশিল্পের দুনিয়ায়। পাবলো পিকাসো যতখানি, কল্পবিজ্ঞানের দুনিয়ায় এইচ জি ওয়েলস ঠিক সেইরকমই কিংবদন্তিসম পুরুষ।
.
প্রকাশকের কথা
বাংলায় এইচ জি ওয়েলসকে নিয়ে চর্চা অনেকদিনের। শুরু হয়েছিল সম্ভবত নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তাঁর অনুবাদ এবং সম্পাদনায় ‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির থেকে ১৯৪৯ সালে প্রকাশ পেয়েছিল দশটি গল্পের একটি সংকলন ‘এইচ জি ওয়েলসের গল্প।
১৯৫৫ সালে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অনুবাদে ‘প্রাচী ভারতী’ থেকে প্রকাশিত হয় ‘অদৃশ্য মানুষ’। ১৯৬৯ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনুবাদে ‘বাক সাহিত্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছিল ‘এইচ জি ওয়েলসের শ্রেষ্ঠ গল্প। একই সঙ্গে ‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির থেকে এক এক করে প্রকাশিত হতে থাকে ‘দি ইনভিজিবল ম্যান’, ‘দ্য ফাস্ট মেন ইন দ্য মুন’, ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডর্স’, ‘দ্য ফুড অব দ্য গডস’ ইত্যাদি উপন্যাস। অনুবাদ করেছিলেন অমিয়কুমার চক্রবর্তী, নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং নিলাদ্রীশিখর বসু। পরে ১৯৮৬ সালে সেগুলি একত্রিত করে অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির থেকেই অমিয়কুমার চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছিল ‘এইচ জি ওয়েলস অমনিবাস’ নামের সুবিশাল বইটি। অমিয়কুমার চক্রবর্তীর অনুদিত গল্প-উপন্যাসগুলি নিয়ে ‘এইচ জি ওয়েলস অমনিবাস’ নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে তুলি-কলম থেকে ২০০১ সালে। এছাড়াও সুধীন্দ্রনাথ রাহা এবং দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে কয়েকটি উপন্যাস সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হয়েছে ‘দেব সাহিত্য কুটির’ থেকে যথাক্রমে ১৯৮৫ এবং ১৯৯৪ সালে।
অদ্রীশ বর্ধন ১৯৬৩ সালে “আশ্চর্য!’ পত্রিকা প্রকাশের সময়েই স্থির করেছিলেন, নিয়মিত বিদেশি গল্পের অনুবাদ প্রকাশ করে বাংলায় কল্পবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলবেন। ভারতবর্ষের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা ‘আশ্চর্য! কয়েক বছরের আয়ুষ্কালে এক গভীর ছাপ রেখে গিয়েছে। কাজটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু অদ্রীশ চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। অথচ আচমকাই এক অনভিপ্রেত বিচ্ছেদ তাঁর জীবনটাই বদলে দিল। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অদ্রীশ বন্ধ করে দিলেন পত্রিকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবারও তিনি ফিরে এসেছিলেন তাঁর স্বপ্নের কাছে। একটি সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, সেই সময়ে ভোের রাতে তাঁর নিয়মিত ঘুম ভেঙে যেত এবং তিনি শোক ভুলতে তুলে নিয়েছিলেন অনুবাদের কাজ। এই ভাবেই এইচ জি ওয়েলসের ‘কল্পগল্প সমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে গ্রন্থপ্রকাশ থেকে। তার পরেও ‘কিশোর মন’ পত্রিকার সম্পাদনা কালে অনুবাদ করেছিলেন ওয়েলসের আরও দুটি কল্পবিজ্ঞান গল্প–’দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ এবং ‘ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ’। সেই দুটি রচনাও এই বইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বইটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিন থেকে অসংখ্য পুরানো অলংকরণ। এই ম্যাগাজিনগুলোতেই প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ওয়েলসের গল্পগুলি। এর মধ্যে ‘দ্য নিউ রিভিউ’, ‘পিয়ারসন’স ম্যাগাজিন’, ‘দ্য পল মল গেজেট’, ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’, ‘দি ইলাসট্রেটেড লন্ডন নিউজ’, ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বাজেট’, ‘দ্য স্ট্যান্ড ম্যাগাজিন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অলংকরণশিল্পীদের মধ্যে ওয়ারইক গোবলে, ফ্রাঙ্ক আর. পল, বেঞ্জামিন এডুইন মিস, কসমো রোয়ি, ডবলু, স্মল, এ. ফরেস্টিয়ার, এল. ডাভিয়েল, এ. ওয়ালিস মিলস, ক্লাউদে এ. শেপারসন, সি. জে. স্ট্যানিল্যান্ড, নিকোলা কিউটি প্রমুখের নাম করা যায়। এদের মধ্যে নিকোলা কিউটি সানন্দে ‘টাইম মেশিন’ উপন্যাসে তাঁর করা অলংকরণগুলি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। এছাড়া বইতে ব্যবহৃত অন্যান্য অলংকরণগুলো স্বত্বাধীন নয়, অর্থাৎ পাবলিক ডোমেনের অন্তর্গত। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পরে পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে বইটি। বইটি পুনঃপ্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছেন অদ্রীশ বর্ধন ও তাঁর পুত্র অম্বর বর্ধন। তাঁদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বেশ কিছু গল্পের ছবি জোগাড় করে দিয়েছেন সোহম গুহ। সুজিত কুণ্ডু একটি নতুন উপন্যাস খুঁজে দিয়েছেন। এ ছাড়াও সোহম গুহ ও অভিষেক ঘোষ কয়েকটি গল্পের বর্ণবিন্যাস করেছেন। বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছেন দেবকুমার মিত্র৷ লে-আউট বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন দেবজ্যোতি গুহ, সুদীপ দেব এবং দীপ ঘোষ। এক হারানো সময়ের উজ্জ্বল জলছাপ এই বইয়ের পাতায় পাতায়। যাঁরা সেদিনের তরুণ, তাঁরা নতুন করে রোমাঞ্চিত হবেন। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও মুগ্ধ হবে অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে এইচ জি ওয়েলসের লেখা কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা এই রচনাগুলি পাঠ করে, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। অদ্রীশ বর্ধন বইটির পুনঃপ্রকাশ দেখে যেতে পারলেন না, এই আমাদের একমাত্র আফসোস। আশা করি অদ্রীশ বর্ধনের স্মৃতির প্রতি মোগ্য সম্মান প্রদর্শন আমরা করতে পারব বইটির পুনঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে।
Leave a Reply