কল্কেকাশির গোয়েন্দাগিরি – শিবরাম চক্রবর্তী
কল্কেকাশির গোয়েন্দাগিরি – শিবরাম চক্রবর্তী
সম্পাদনা ও টীকা – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত সৌম্যেন পাল.
বিদেশি গোয়েন্দা-সাহিত্য এডগার অ্যালান পো বা আর্থার কোনান ডয়েল প্রমুখ লেখকের কীর্তিতে সমৃদ্ধশালী হলেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ক্রাইম বা গেয়েন্দা-কাহিনি প্রথম দিকে খুব উঁচু স্থান পায়নি। সেযুগের সাধারণ পাঠক-পাঠিকা বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটির দিকে তাকাতেন। একেবারে প্রথম দিকের বরকতউল্লা, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, কিংবা পাঁচকড়ি দে, বা পরবর্তী যুগের বটতলার বই নামে পরিচিত, এমনকি একালে বিখ্যাত হয়ে ওঠা নানাবিধ ক্রাইম কাহিনি, জনপ্রিয় এবং বহু-পঠিত হলেও, সাধারণ পাঠকের তাচ্ছিল্য এড়াতে পারেনি। বাংলা সাহিত্যে ক্রাইম কাহিনি, বিশেষ করে ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস, সাবালকত্ব অর্জন করে এবং এক বিশেষ স্থান অধিকার করে প্রথমত হেমেন্দ্রকুমার রায়, তারপর নীহাররঞ্জন গুপ্তর হাত ধরে। এই সাবালকত্বের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ব্যোমকেশ বক্সীর আবির্ভাবে।
গোয়েন্দা-কাহিনি বিষয়টি যতই গুরুগম্ভীর হোক এবং মানবচরিত্রের অন্ধকার দিকের সঙ্গে এই সাহিত্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও এই ধরনের গল্প-উপন্যাসের হাল্কা দিক খুঁজে নিতে অসুবিধা হয়নি। গোয়েন্দা সাহিত্যের এই হাল্কা দিকটির চর্চা করতে গিয়েই বিদেশি সমালোচক, সাহিত্য গবেষক বা প্রাবন্ধিকরা লিখতে পেরেছিলেন ‘ওয়াটসন ওয়াজ আ উম্যান’ (রেক্স স্টাউট) কিংবা ‘মার্ডার অ্যাট ডলার ২.৫০ আ ক্রাইম’ (স্টিফেনে লীকক) প্রভৃতি প্রবন্ধ। কিংবা কোনও কোনও গবেষকের অনুমান আমেরিকান গোয়েন্দা নীরো উলফ হলেন শার্লক হোমস এবং তাঁর একদা প্রতিপক্ষ আইরিন অ্যাডলারের অবৈধ সন্তান।
বাংলা ভাষায় লেখা গোয়েন্দা-কাহিনিতে কিছু হাস্যরস আমদানি করেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। জয়ন্ত-মানিকের কাহিনিগুলিতে হাস্যরসের মাধ্যম ছিলেন পুলিশ অফিসার সুন্দরবাবু। আর হেমন্ত-রবিনের উপন্যাসের মজাদার চরিত্র ছিলেন সতীশবাবু। সতীশবাবুও পুলিস অফিসার। নীহাররঞ্জন গুপ্তর কাহিনি আবার আদ্যন্ত সিরিয়াস। তাতে কিরীটি রায় বছরভোর কলকাতা শহরে বা অন্যত্র তদন্ত করে বেড়ান মাথায় ফেল্ট হ্যাট, গায়ে ওভারকোট আর পায়ে গামবুট চাপিয়ে।
বাংলা গোয়েন্দা-সাহিত্যের হাল্কা দিকের সন্ধানে হয়তো সৃষ্টি হয়েছিল গোয়েন্দা কল্কেকাশির। কল্কেকাশির স্রষ্টার অফুরন্ত রস বোধ আর পপ রসিকতা সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। এহেন রসিক-চূড়ামণি গোয়েন্দা-কাহিনি লিখবেন আর তাতে হাস্যরস বা মজা থাকবে না, তা মনে করাই অন্যায়। কল্কেকাশি বাঙালি নন, কোরিয়ার অধিবাসী। তিনি কামচাটকার ভাষা জানেন। বাংলা ইংরেজি তো জানেনই, কোনও কোনও জীবজন্তুর ভাষাও বলতে বা বুঝতে পারেন। তিনি একাধারে আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ, কারণ বহু খুনের কিনারা করেছেন খুনির কিনারায় না গিয়েও। আবার হার্ড-বয়েলড বা পোড়-খাওয়া গোয়েন্দাও, কারণ তিনি ডাকাতকে কাত করেছেন, চোরকে ছেঁচড়ে এনেছেন।
কল্কেকাশি হলেন বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় এবং আপাতত শেষ গোয়েন্দা চরিত্র, যিনি বাঙালি নন। এ বিষয়ে কল্কেকাশির পূর্বসূরী হলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য়ের গল্প এবং উপন্যাসের গোয়েন্দা। হুকাকাশি জাপানি। এঁর গল্প যথেষ্ট সিরিয়াস। কল্কেকাশির গল্পের গোড়াতেই লেখক জানিয়ে দিয়েছেন কল্কেকাশি হলেন বিখ্যাত গোয়েন্দা হুকাকাশির ভায়রাভাই। যে-লেখকের কলম দিয়ে ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’ বা ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী’র মতো লেখা বেরিয়েছে, তিনিই আবার লিখেছেন হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের নানাবিধ কাণ্ডকারখানা আর অজস্র হাসির গল্প।
গোয়েন্দা-কাহিনিতে হাস্যরস এর আগে নিয়ে এসেছিলেন রাজশেখর বসু। ‘নীলতারা’ এবং ‘সরলাক্ষ হোম’ গল্পে সরলাক্ষ হোম নামধারী সরলচন্দ্র হোমকে দেখা গিয়েছিল একটিমাত্র গল্পেই। কিন্তু কল্কেকাশি ফিরে এসেছিলেন। বিদেশি সাহিত্যের চরিত্র পি.জি. ওডহাউসের পিস্মিথ, কিংবা মার্কিন সাহিত্যিক ক্রেগ রাইসের জন জে. ম্যালন বা জেক জাস্টাস-এর সঙ্গে সামান্য হলেও সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় কল্কেকাশির।
কল্কেকাশির গল্পগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে এগুলো আসলে কোন জাতের গল্প— গোয়েন্দা কাহিনি, নাকি হাস্যরসের কাহিনি। উত্তরে বলা যায়, দুটোই এবং এতেই সম্পূর্ণ হয় না কল্কেকাশির গল্পের যথার্থ সংজ্ঞানির্ণয়। কারণ পাঠক গল্পগুলি পড়ার পর একটু খোলামনে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন প্রতিটি গল্পের ভেতরে নিহিত রয়েছে এক অতলস্পর্শী জীবনদর্শন।
প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত / সৌম্যেন পাল
এপ্রিল ২০১৯
Leave a Reply