কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত (১৬৮০–১৮৮০) – লোকনাথ ঘোষ
কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত (১৬৮০–১৮৮০) / মূল লেখক লোকনাথ ঘোষ / অনুবাদক শুদ্ধোদন সেন
[ The Native Aristocracy & Gentary নামক পুস্তক থেকে কলকাতা-ভিত্তিক জীবনীসমূহ সংগৃহীত ও অনূদিত ]
মূল লেখক লোকনাথ ঘোষ
অনুবাদক শুদ্ধোদন সেন
সম্পাদনায় অনীশ দাস অপু
প্রথম প্রকাশ ১৮৮১
ভূমিকা
শহুরে-সমাজের বর্তমান যে চিত্রটি খুব সহজেই চোখে পড়ে ‘তা হলো, একদিকে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিজীবী ও বৃহত্বণিকচক্র, ঘুষখোর অকর্মণ্য আমলা ও কর্মচারী, চোরাকারবারী ফাটকাবাজ-স্মাগলার-ভেজালদারদের দৌরাত্ম্য এবং অন্যদিকে এদেরই অনুগ্রহপুষ্ট সমাজবিরোধী মস্তান ও গুন্ডাবাহিনী কালো-টাকার প্রাচুর্যে গা-ভাসিয়ে চলেছে, অনর্জিত অর্থের দাপটে অশালীন প্রতিযোগিতা করে বিলাসব্যসনের পঙ্কে নিজেরা তো ডুবছেই, যুবশক্তিকেও প্রলুব্ধ করে ডোবাচ্ছে আদর্শহীন ভ্রষ্টাচারের পন্ধকুণ্ডে ।
মুঘল যুগের শেষ দিকেও বিদেশী নীতিহীন বণিক-সংস্থাগুলির কৃপাপুষ্ট একশ্রেণির নব্যধনিকের (এবং অভিজাতের) উদ্ভব হয়েছিল । বাংলায়, বিশেষত কলকাতায়, এঁরা মত্ত ছিলেন বাঈনাচ, বুলবুলি ও ঘুড়ির লড়াই, আখড়াই-হাফ- আখড়াই-ফুল আখড়াই দোল দূর্গোৎসব নিয়ে মাত্রাহীন আড়ম্বরে এবং তরল- বিলাসিতার ব্যয়বহুল, লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন প্রতিযোগিতায় । আাজকের তথাকথিত ভারোয়ারী পূজা, দোল-দেওয়ালীর তান্ডবে এবং ভূঁইফোঁড় পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে স্থুল অশালীন বিকৃতরুচির নাচ গান নাটকের রমরমা ব্যবসায়ের মধ্যে যে-যুগের খানিকটা আভাস পাওয়া যেতে পারে ।
এটা বাবু কালচারের একটা দিক । আজিম-উস্-সান পর্যন্ত জন্ কোম্পানির কাঁচ থেকে উপঢৌকনের নামে ঘুষ নিচ্ছেন দেখলে বোঝা যায়, সে-যুগ এবং তার পরবর্তীকালে নৈতিক মানের অধঃপতন কতখানি হয়েছিল। এই নব্য ধনিক-শ্রেণির মানসিকতা অননুকরণীয় ভাষায় হুতোম তাঁর নক্সায় বর্ণনা করেছেন :
“নবাবী আমল শীতকালের সূর্য্যের মত অস্ত গ্যালো। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরাজের প্রতাপ বেড়ে উঠল। বড় বড় বাঁশ ঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো । কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগল । নবো মুসি, ছিরে বেনে ও পুঁটে তেলি রাজা হলো । সেপাই পাহারা, আসা সোটা ও রাজা খেতাব, ইন্ডিয়া রবারের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মত রাস্তার বাঁদাড়ে, ও ভাগাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগল । কৃষ্ণচন্দ্ৰ, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎশেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগল, তাই দেখে হিন্দু ধর্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার ও নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালাল । হাফ আখড়াই, ফুল পাঁচালী আর যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্লো ।
শহরের যুবকদল গোখুরী, ঝকমারী ও পক্ষীর দলে বিভক্ত হলেন । টাকা বংশগৌরব ছাপিয়ে উঠলেন ।
এবং আক্ষেপ করেছেন :
“হায়! যাদের জন্মগ্রহণে বঙ্গভূমির দূরবস্থা দূর হবার প্রত্যাশা করা যায়, যারা প্রভূত ধনের অধিপতি হয়ে স্বজাতি, সমাজ ও বঙ্গভূমির মঙ্গলের জন্য কায় মনে যত্ন নেবে, না সেই মহাপুরুষরাই সমস্ত ভয়ানক দোষ ও মহাপাপের আকর হয়ে বসে রইলেন, এর বাড়া আর আক্ষেপের বিয়ষ কি আছে । আজ একশ’ বছর অতীত হলো, ইংরেজরা এদেশে এসেছেন, কিন্তু আমাদের অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে? সেই নবাবী আমলের বড় মানুষী কেতা, সেই পাকানো কাছা, সেই কোঁচান চাদর, লপেটা জুতো ও বাবরি চুল আজও দেখা যাচ্ছে, বরং গৃহস্থ মধ্যস্থ লোকের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়, কিন্তু হুজুরেরা যেমন তেমনি রয়েছেন!”
ইংরেজ–রাজ ভক্ত লোকনাথ ঘোষ সে-যুগের ‘হুজুর’ শ্রেণির উল্লেখযোগ্য পরিবার ও ব্যক্তির পরিচিতি দিয়েছেন সানন্দ গৌরবে– দেখা যাচ্ছে হুজুরদের সকলেই বিলাসব্যসনে দিন কাটাতেন না; তাঁদের অনেকেই শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগী, বিদ্যোৎসাহী, সমাজসংস্কারের পক্ষে বা বিপক্ষে আন্দোলনকারী, (খেতাব পাবার আকাঙ্ক্ষায় হলেও) জনতিহৈষণামূলক কাজে বিপুল অর্থব্যয়ে অকৃপণ । সঙ্গে সঙ্গে লেখক ‘গৃহস্থ মধ্যস্থ’ শ্রেণির উল্লেখযোগ ব্যক্তিবর্গের পরিচয় ও কর্মজীবনের (তৎসহ সে-যুগের বিভিন্ন আন্দোলনের) তথ্যভিত্তিক বিবরণ দিয়েছেন । এই দুই শ্রেণির মিলিত চেষ্টায় শিক্ষা সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান ধর্ম দেশাত্মবোধ প্রভৃতি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই নতুন চিন্তা চেতনা ও আন্দোলনে সমাজ ও দেশ উদ্বুদ্ধ ও আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল, যার ফলে ঊনবিংশ শতকে রেনেসাঁ সম্ভব হয়েছিল আশ্চর্য দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল এই একটি শতক : স্বল্প পরিসরে হলেও, গ্রন্থকার যুগটিকে বিভিন্ন জীবনীর মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে আঁকতে পেরেছেন ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় কুঠি স্থাপনের সময় থেকে তাঁদের আশ্রয় প্রশ্রয় সহায়তায় ব্ল্যাক জমিন্দার বা রতন সরকারের মতো যে-সব এদেশীয় হঠাৎ ধনী মানী ক্ষমতাবান হতে থাকেন এবং ঊনিশ শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত ইংরেজ রাজ ও ইউরোপীয় শিক্ষার কল্যাণে যে-সকল জ্ঞানীগুণীর আবির্ভাব হয়, এঁদের বিশেষত মহারাজা, রাজাধিরাজ রাজা, রাজা বাহাদুর, নবাব বাহাদুর, স্যার রায় বাহাদুর, খানবাহাদুর, রায় সাহেব, খান সাহেব প্রভৃতিদের জীবনী নথিভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা ঐ সময় অনুভূত হতে থাকে। বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির জীবনী বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিতও হয় । অন্যান্যের মধ্যে অন্যতম সিভিলিয়ান ডবলু এইচ ডইলি “ইন্ডিয়ান পীয়ারেজ’ নামে একখানি পুস্তক রচনার পরিকল্পনা নিয়ে তথ্য সরবরাহের জন্য ভারতীয় খেতাবধারীদের কাছে অনুরোধমূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন (১৮৭৭); ডইলি সাগ্রহ সাড়া পেতে থাকেন; বহু তথ্য ও সংগৃহীত হয়—-দুর্ভাগ্যবশত ডইলি তাঁর পরিকল্পনা ত্যাগ করেন । এরও পূর্বে লোকনাথ ঘোষ তাঁর ‘The Modem History of Indian Chiefs, Rajas Zamindras Ec.’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড (আংশিকভাবে অনূদিত বর্তমান গ্রন্থ) The Native Aristocracy and Gentry of India’ রচনা ও প্রকাশ করবার উদ্দেশ্যে তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে সংবাদপত্রে (Hindu Patriot, 1876) বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে থাকেন, চিঠি লিখে ও ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেও প্রভাবপ্রত্তিহীন ‘নেটিভ’ লেখক বিশেষ সাড়া পাননি । ১৮৭৯ তে তাঁর গ্রন্থের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হওয়ায়, ডইলি তাঁর পরিকল্পনা ত্যাগ করায় আর গ্রন্থকার ঘোষের অক্লান্ত চেষ্টায় বেশ কিছু তথ্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও পরিবারের কাছে থেকে সংগৃহীত হয়; যাঁরা কোনো সাড়া দেন নি, তাঁদের বন্ধু বান্ধবের কাছে থেকে বা প্রকাশিত পত্র পত্রিকা ও পুস্তক থেকে তথ্য আহরণ করে এই গ্রন্থখানি তিনি ১৮৮১ তে প্রকাশ করেন । এই খন্ডে দেশীয় রাজ্য, প্রদেশ এবং প্রেসিডেন্সি অনুযায়ী ন’টি বিভাগ আছে। প্রথম বিভাগটিতে দেওয়া হয়েছে বাঙলা বিহার উড়িষ্যার “Aristocaracy and Gentry of India”-র পরিচয়। “কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত”-এ প্রথম বিভাগের পঞ্চম পরিচ্ছেদ থেকে প্রধানত কলকাতা কেন্দ্রিক জীবনীগুলি অনুবাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যথাসম্ভব মুলানুগ-অনুবাদ করার চেষ্টা করা হয়েছে ।
মূল গ্রন্থের লেখক লোকনাথ ঘোষের জীবনী লেখা হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই । তবে এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কাঁটাপুকুর (বাগবাজার)-এর দেওয়ান হরিঘোষের পরিবারের বংশ লতিকা থেকে অনুমান করা বোধ হয় অসঙ্গত হবে না যে, লোকনাথ ঘোষের জন্ম এই বংশে । আমাদের অনুমান ঠিক হলে, তাঁর পিতা মুক্তীশ্বর ঘোষ ছিলেন পুরী হাসপাতালের চিকিৎসক । লোকনাথ ঘোষ প্রণীত “Musics appeal to India” শীর্ষক পুস্তিকা ও লেখক সম্বন্ধে মধ্যস্থ পৌষ, ১২৮০, পৃষ্ঠা ৬৪৮) ‘প্রাপ্ত গ্রন্থাদি সম্বন্ধে উক্তি’তে লিখছেন–
“৮। ‘Musics Appeal to India’ অর্থাৎ ভারতবাসীদিগের নিকট সঙ্গীতের আদাশ । এখানি ইংরেজি ভাষায় লিখিত এবং অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে ডিমাই ৮ পেজি ফরমের প্রায় চারি ফরম পরিমাণে মুদ্রিত ।”
“বঙ্গ-সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অন্যতর ছাত্র শ্রীযুক্ত বাবু লোকনাথ ঘোষ ইহার রচয়িতা । ইনি ইংরেজিতে সুপন্ডিত, বাঙ্গাল ব্যাঙ্কের উচ্চশ্রেণির কর্মচারী ।
ইহার স্বভাব ও চরিত্র, যতদূর জানি, বিশেষ প্রতিষ্ঠার যোগ্য । এমন সকল লোক বঙ্গ-সঙ্গীত বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাতে বিদ্যালয়ের বিশেষ গৌরব ও ভাবী উন্নতির চিহ্ন, সন্দেহ নাই ।”
গ্রন্থের আখ্যাপত্রে লেখক পরিচিতি দিয়ে লেখক লিখেছেন :
তিনি ‘Honorary Registrar Bengal Music School, Member of the Family Literary Club, Author of Victoria Stutika: A Sanskrit Hymn Book in Honor of Her Most Gracious Majesty The Queen Empress of India, The Music and Musical Notation of Various Countries, The Modern. History of The Indian Chiefs, Zamindars, Ec. Part 1, Rajas, The Native States Ec. Ee.’
গ্রন্থখানি ‘His Exceleney The Most Honble (sic!), George Frederick Samuel, Marquess of Ripon, K. C., P.C., C. M. S. I., Viceroy and Governor-General of India’-কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও নম্রতার সঙ্গে উৎসর্গ করা হয়েছে ।
‘কলকাতা পুরশ্রী” পত্রিকার সম্পাদক শ্রীসমরেশ চট্টোপাধ্যায় বিশেষ আগ্রহ সহকারে এই অনুবাদগ্রন্থের প্রায় সবটাই ধারাবাহিকভাবে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেন–এজন্য তিনি আমার ধন্যবাদার্হ । বন্ধুবর শ্রীঅশোককুমার উপাধ্যায় (‘সেকালের দারোগা কাহিনীর’ অন্যতম সম্পাদক) প্রেরণা ও উৎসাহ না দিলে এ অনুবাদ সম্পন্ন হত না । কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁকে ছোট করব না । দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থখানির একটি কপি শ্রদ্ধেয় অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে তাঁর পুত্র বন্ধুবর শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ দীর্ঘদিনের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়ায় তাঁর নিকট আমি বিশেষভাবে ঋণী । মূল গ্রন্থে বর্ণিত চরিত্রগুলির কোনো আলোকচিত্র না থাকলেও, অনুবাদ গ্রন্থখানিতে প্রকাশক শ্রীঅমল গুপ্ত বহু আয়াস ও ব্যয় করে ৪° খানি আলোকচিত্র দিয়েছেন; তবে তিনিও, চেষ্টা সত্ত্বেও বেশ কিছু আলোকচিত্র বা প্রতিকৃতি সংগ্রহে সমর্থ হন নি । রাণী স্বর্ণময়ীর প্রতিকৃতি দেবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি । আলোকচিত্রগুলি সংগ্রহে শ্রীসুনীল দাস প্রভূত সাহায্য করেছেন, এজন্য তিনি আমার ধন্যবাদার্হ ।
শুদ্ধোদন সেন
অনুবাদকের উৎসর্গ
বর্তমান সমাজ-সচেতন যুবশক্তির উদ্দেশ্যে অনুবাদপুস্তকখানি উৎসর্গিত হল
Leave a Reply