কবিতাসমগ্র ২ – সুবোধ সরকার
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১৬
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: সুদীপ্ত দত্ত
.
উৎসর্গ: ভারত কবিতা
হিন্দি কবি কেদারনাথ সিং
কন্নড় কবি-নাট্যকার চন্দ্রশেখর কাম্বার
গুজরাটি কবি সীতাংশু যশচন্দ্র
মালয়ালি কবি কে. সচ্চিদানন্দন
মণিপুরি কবি ইবম্চা সিং
.
ভূমিকা না লিখে পারলাম না
গত উনিশ মাস ধরে যত গরল পান করেছি, হাতে গরম আলু ধরে থেকেছি, যত অক থু মেখেছি, পিঠে যত গোপন তির নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি, সেরকম দাহ আর কোনও বাঙালি লেখককে সহ্য করতে হয়নি পঁয়ত্রিশ বছরে। ক্লাস ইলেভেন থেকে লাইনে আছি, সমস্ত জীবিত লেখককে কাছ থেকে দেখেছি, দু’জন বাদে। আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে আমাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে কবিতা পড়তে দেব না, বাপি বাড়ি যা। কাগজে কার্টুনে ছড়ায় এবং টেলিভিশনে আমার ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হয়েছে। ফেসবুকে যত ‘চার অক্ষরের বাণী’ বর্ষিত হয়েছে আমার মাথায় তার একটা সংকলন হলে ‘সুবোধ নিন্দা সমগ্র’ প্রকাশিত হতে পারে। আমার কোনও বই বেস্ট সেলার হয়নি, কোনওদিন হবেও না; কিন্তু সু.নি.স. বের হলে হট কেকের মতো বিক্রি হবে, আমি নিশ্চিত। আমি নরকের আগের স্টেশনে একটা শিংশপা গাছের তলায় একঝুড়ি কমলালেবু নিয়ে বসেছিলাম, বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভেঙে উঠে দেখি প্রতিটি কমলালেবু ফেটে হলুদ রঙের পোকা বেরিয়ে আমার সারা গায়ে উঠে পড়েছে। একটা পোকার নাম চার অক্ষর, একটা পোকার নাম অপমান, একটা পোকার নাম কুৎসা, একটা পোকার নাম ফেসবুক, একটা পোকার নাম পরাস্ত বাম জমানা।
কেন এমন হল, আমি কী করেছি? আমার ভাই আমাকে ছেড়ে গেল। আমার আবাল্য বন্ধু এসএমএস করে বলল, তোর জন্য গর্ব হত, আজ লজ্জা হয়। আমার ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক আমাকে জানিয়ে দিলেন আমার কবিতা আর কোনওদিন পড়বেন না। মল্লিকাদি থাকলে আমি এ কাজ করতে পারতাম না— রায় দিল তিন তরুণ কবি। আমেরিকা থেকে আমাদের পারিবারিক বন্ধু ফোন করে জানাল, কলকাতায় গেলে যেন দেখা না হয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছিলাম রোরোর বন্ধুকে, সে একদিন ফোনে কাঁদো কাঁদো স্বরে জানাল, ‘আমি তোমার ঘনিষ্ঠ বলে আমাকে কম নম্বর দিয়েছে।’
আমি কী করেছি যে আমার ছেলের বন্ধুকে শাস্তি পেতে হবে? আমার দুটো জগৎ— একটা কবিতার; একটা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকজন, ছাত্রছাত্রী। আমি তিরিশ হাজার ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছি গত পঁচিশ বছরে। একজনকেও আমি বলিনি, আমার কবিতার বই কেনো। আমি ইংরেজি কবিতা নিয়ে কথা বলেছি, সেটার জন্য আমি বেতনভুক, আমি কোনওদিন বাংলা কবিতা নিয়ে কথা বলিনি। কিন্তু ছাত্রদের সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িয়েছি। গত উনিশ মাসে বারবার মনে হয়েছে আমাকে যে অপমান করা হচ্ছে সেটা আমার ছাত্ররা দেখছে না তো? আর মনে হয়েছে রোরো। রাতে সে আমার পাশে শুলেও ভুলেও কোনওদিন জিজ্ঞাসা করেনি, বাবা তোমার কী হয়েছে? তুমি চুপ করে আছ কেন? তার বদলে সে আমার সঙ্গে অহরহ তর্ক করে গেছে সিগারেট এবং মিশেল ফুকো নিয়ে। হোক কলরবের সময় আমরা দু’জনে দু’জনের পরিসর খড়ি দিয়ে গণ্ডি করে নিয়েছিলাম, একটা প্যালেস্টাইন, একটা ইজরেইল, মাঝখানে ওপেন চেকপোস্ট।
আমি কী করেছি যে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? অজুহাত দেখাতে হবে? যদিও আমি জানি মানুষের তিনটে হাত, বাঁ-হাত ডান-হাত এবং অজুহাত। তৃতীয় হাতটির দয়া, দক্ষতা ও প্রতিহিংসার ওপর মানবসভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তৃতীয় হাতের ব্যবহার শিখিনি, ফলে আমাকে প্রতিবন্ধী বলা যায়, অথবা ভদ্র করে বলা যায়, ‘ডিফারেন্টলি এবল’। এই না হলে ইংরেজি ভাষা, কী ভাল ঢপের চপ বানায় ওরা।
মাননীয় মন্ত্রী এবং নাট্যকার ব্রাত্য বসু আমাকে ফোন করলেন, ফোনটি গেল দিল্লিতে, তখন আমি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার নিতে দিল্লিতে। আমি ব্রাত্যকে কথা দিলাম, আমি আসব। ১৭ মার্চ ২০১৪, বিকেল পাঁচটায় দমদম থেকে সোজা প্রেস ক্লাবে এলাম। জীবনে এত ক্যামেরা একসঙ্গে দেখিনি আমার মুখের ওপর। আমি বললাম, আমি আর বামপন্থীদের সমর্থন করি না। আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করছি। আমি মমতাকে নিও- কমিউনিজ়মের জননী বলে মনে করি। এরপর আমার মাথায় বামপন্থীরা মল ঢেলে দিল। তবে সেই মল থেকে মাণিক্য পেয়েছি কি না তা ঠিক হবে মহাকালের মগডালে।
যাঁর কবিতা পড়ে বড় হয়েছি সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কী হয়েছিল? তিনি যখন বললেন তিনি আর বামপন্থীদের সমর্থন করেন না, বোমা পড়ল আলিমুদ্দিনেই। প্রথমেই বলা হল টাকা খেয়েছেন, বলা হল ধান্দাবাজ কবি। বাঙালিরা পুরুষের ওপর রেগে গেলে বলে ধান্দাবাজ, মহিলা হলে বলে দুশ্চরিত্রা। কোনও মেয়ের সঙ্গে মেরিটে বা মাত্রায় পেরে না উঠলে বলবেই খারাপ চরিত্র। বিস্ময়কর, সুভাষদাকে টাকা এবং মেয়ে দুটোই খাচ্ছেন বলা হয়েছিল! তা নিয়ে কবিতাও আছে সুভাষদার। আমি তখন পাশের পাড়া লেক গার্ডেন্সে থাকতাম, সন্ধেবেলায় চলে যেতাম, ছোট ছোট আলু সেদ্ধ করে নুন গোলমরিচ মাখিয়ে খেতে দিতেন, বলতেন, জানো তো এটাই মস্কোতে বড়লোকের খাবার। অত বড় কবি কি আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারেন? শাক কেন, মস্কো দিয়েও দারিদ্র ঢাকা যায় না। দু’বেলা দু’মুঠোর ব্যবস্থাও করেনি বাম-সরকার, একা বসে থাকতেন, খুটখুট করে টাইপ করতেন। দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলতেন সারা ঘরে। আমি একজন নিঃসঙ্গ ও অপমানিত কবিকে দেখতাম যাঁর কবিতা একদিন একটা জাতিকে রাস্তায় হাঁটতে শিখিয়েছিল। আমি সুভাষ মুখুজ্জে নই, আমি চুনোপুঁটি, ইতিহাসের বেসমেন্টে শুয়ে থাকা একটি আরশোলা।
তা হলে কী দাঁড়াল? যাঁরা বামপন্থায় বিশ্বাসী তাঁরা আমার কবিতা ছোঁবেন না? জাত যাবে? পাউন্ড পড়বেন না? অডেন পড়বেন না? বুদ্ধদেব বসু পড়বেন না? মিলান কুন্দেরা পড়বেন না? তারাশঙ্কর পড়বেন না? শুধু নেরুদা পড়বেন? সম্প্রতি জানা গেছে, তাঁর মতো মহান কবিও ট্রটস্কির ঘাতককে মেক্সিকোর বর্ডার পার করে দিয়েছিলেন, সারা ইউরোপ মেনে নিল বামপন্থী কবিতা বলে কোনও কবিতা হয় না। আর ক্যানিংয়ের হেডমাস্টারেরা মানতে পারছেন না, ফেসবুকের ‘লাইক’-মারা কবিরা মানতে পারছেন না! কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠল কিনা সেটাই জানতে চাই। প্লেটো থেকে পাওলি দাম পর্যন্ত যে সমাজ, তার জেলখানায় ‘প্যান-অপটিকান’ প্রক্রিয়ায় কবিতা আজও বিচারাধীন। কোনও কবিতা প্রথম পঁচিশ বছরে পাশ করে গেল, দ্বিতীয় পঁচিশ বছরে ফেল। এটা ইতিহাসের নিয়ম।
বিনীত
সুবোধ সরকার
সিরিটি টালিগঞ্জ কলকাতা
১।১।২০১৬
Leave a Reply