কবিতাসমগ্র ১ – শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতাসমগ্র ১ – শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১৫
আমার পুরনো পাড়া, পুরনো বাড়ি আর পুরনো সেই ছোট্ট ঘরটাকে,
যারা এইসব লেখালেখির সাক্ষী থেকেছে
আমার পুরনো বাবা-মাকে, যারা আমার স্মৃতির মধ্যে এখনও একসঙ্গে আছে
আর আমার পুরনো মনটাকে, যার সঙ্গে এখনও মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যায়
.
ঋণ
দূর্বা বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ন কুমার দে
রাকা দাশগুপ্ত, চৈতিপর্ণা রায়
.
স্বীকারোক্তি
‘তাহলে বরং একটা করে কবিতা বলি আমরা, যার যার ভাষায়?’ হঠাৎই প্রস্তাবটা পাড়ল উরুগুয়ের এক মাঝবয়সি ঔপন্যাসিক বন্ধু। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে, আমরা অপেক্ষা করছি শেষ মেট্রোর জন্যে, শিকাগোর কোনও এক পাতাল-টার্মিনালে। আমরা মানে আমি, বাংলাদেশের এক ছোটগল্পকার, প্যালেস্তাইনের এক নভেলিস্ট, আলজিরিয়ার এক নাট্যকার, লেবাননের এক কবি আর উরুগুয়ের এই হাসিখুশি লেখকটি। সদ্য আইওয়াতে লেখক-কর্মশালা শেষ করে আমরা তখন কয়েকটা মার্কিন শহরে ঝটিকা সফররত। শিকাগোয় দিন চারেকের থাকা। তারই মধ্যে এক রাত্তিরে ডাউনটাউন রেস্তোরাঁয় খেয়েদেয়ে ফেরার পথে ট্রেনের জন্যে লম্বা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ক’জন। কিছুক্ষণ পরেই এই প্রস্তাব।
নিজের ভাষায় কবিতা বলা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয় তেমন, বিশেষত যখন ট্রেনটা আসতে আরও মিনিট পনেরো দেরি। লম্বা আলো-আঁধারি প্ল্যাটফর্মে আমাদের এই হুল্লোড়ে জটলা ছাড়া আছে বলতে মোটে একজন মেয়ে। সে আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে আড়চোখে দেখছে আমাদের। টপ আর স্কার্ট পরা, সোনালি চুলের গুচ্ছ পনিটেল করে বাঁধা, পিঠে স্কুলব্যাগ নেওয়া বছর পনেরো-ষোলোর এক ফুটফুটে মেয়ে। দেখে যদ্দুর মনে হল, মার্কিনই হবে। সে দেখুক, আপাতত আমাদের সময় কাটানো নিয়ে কথা।
যেমন কথা, তেমন কাজ। শুরু হল কবিতা বলা। একে একে প্রত্যেকেই যার যার ভাষার প্রিয় কোনও না কোনও কবিতা বলে শোনাচ্ছে। যে বলছে কবিতাটা, সে ছাড়া আর কারও পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। কেবল আমার আর বাংলাদেশি গল্পকার বন্ধুটির ভাষা এক বলে কিছুটা বাঁচোয়া। কিন্তু উচ্চারণের অভিব্যক্তি আর শব্দের ধ্বনি, এই দুইকে সম্বল করেই আমরা তখন বেশ মশগুল। আমিও মনে করে রাখা ছোট আর খুব কাছের একখানা কবিতা বললাম। সকলের বলা শেষ হল যখন, ট্রেন আসতে তখনও পাক্কা পাঁচ মিনিট। ‘এই যে, তুমি এবার একখানা কবিতা শোনাও দেখি আমাদের!’ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোট্ট মেয়েটির দিকে দৌড়ে গেল লাতিন আমেরিকীয় বন্ধুটি। বেচারি এতক্ষণ কানখাড়া করে সবার কবিতা বলা শুনছিল, আচমকা এইরকম হুকুমের স্বরে কবিতা শোনানোর প্রস্তাব পেয়ে বেশ হকচকিয়ে গেল। আমরাও জড়ো হলাম তার চারপাশে। সে তখন মোটামুটি হাতেপায়ে ধরে পালাতে পারলে বাঁচে। যত সে বলে ‘আমি জানি না একটাও কবিতা’, আমাদের সেই অত্যুৎসাহী বন্ধুটি তাকে বলে, ‘এ হতেই পারে না। আর তুমি যখন এই প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছ, তুমিও এই কবিতা বলবার খেলায় অংশীদার। ছাড়াছাড়ি নেই।’
শেষমেশ মেয়েটি বুঝল, পড়েছে মোগলের হাতে। আমরা তার চারপাশে চুপটি করে অপেক্ষা করছি, তার মুখ থেকে তার প্রিয় কবিতা শুনব বলে। সে কিছুক্ষণ দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে আকাশপাতাল ভাবল। তারপর হঠাৎ পিঠের ব্যাগটা প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমি এই একটাই কবিতা জানি কেবল।’ বলে, মিনিট দুয়েকের একটা ছোট ব্যালের পিস নেচে দেখাল। নাচের শেষে প্রায় পাথর হয়ে যাওয়া আমাদের সলজ্জ গলায় বলল, ‘এইটাই আমার প্রিয় কবিতা।’
ট্রেনটা এসেছিল ঠিক তার কয়েক সেকেন্ড পর। আমরা ঠিকঠাক ফিরেওছিলাম হোটেলে। কিন্তু সারা পথ কেউ কারও সঙ্গে একটাও কথা বলিনি আর। এমনকী একই কামরায় উঠে পড়া সেই কিশোরীর নামটাও জানতে চাইনি। কারণ বছর পনেরোর সেই মেয়ে দু’মিনিটে ভেঙে দিয়েছে আমাদের এতজনের এত বছরের কবিতাবিষয়ক সমস্ত ধারণা।
মেয়েটির সঙ্গে সম্ভবত আর দেখা হবে না কোনওদিন আমার। কবিতার সঙ্গে হবে কি? সেই আশাতেই আরও একটা কবিতার দিকে নতুন করে হেঁটে যাওয়া। বারবার ব্যর্থ হবার পরেও। অনেক লেখা হল, বইও বেরল কিছু, তারপর আজ এই সংকলন। কিন্তু শিকাগোয় সেই শীতের রাতটা পেরিয়ে আসার পর থেকে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি, ভাষায়-ভাবনায় কবিতার ওই সৌন্দর্যকে দূর থেকে ছুঁয়ে দেখবার সামর্থ্যও আমার নেই। আমি কেবল কল্পনা করতে পারি তেমন এক কবিতার কথা।
Leave a Reply