কবিতাসমগ্র ১ – শামসুর রাহমান
প্রথম প্রকাশ – ২০০৫
প্রচ্ছদ – কাইয়ুম চৌধুরী
উৎসর্গ
আব্বা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী
এবং
আম্মা আমেনা খাতুনের
স্মৃতির উদ্দেশে
.
ভূমিকা
তখন আমি পোগোজ স্কুলের ক্লাশ সিক্সের ছাত্র। একদিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি আমাদের বাড়ি কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। জানতে পারলাম আমার ছোট্ট বোন নেহার বাসায় নেই। আমার অন্তর যেন বিরান প্রান্তর হয়ে গেলো। বসন্তরোগে জর্জরিত ছোট্ট মেয়ে নেহারকে আজিমপুর গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওকে দেখতে না পেয়ে অভিমান, হু হু বেদনায় হাতের বই-খাতা টেবিলে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে খালি চৌকিতে শুয়ে বুক-ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। কাঁদতে-কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, টের পাইনি ।
নেহার হাঁটতে পারতো না, কথা বলতে পারতো না ওর বয়সের কারণে, কিন্তু দু’পা আর দু’হাতে ভর ক’রে এদিক-সেদিক পৌঁছে যেতে পারতো। এভাবে সে আমার পড়ার টেবিলের কাছে এসে বসতো কখনোসখনো । আমার পেন্সিলের প্রতি ওর আকর্ষণ ছিল, পেন্সিল হাতে নিয়ে খেলতো আর আমার দিকে তাকিয়ে কী মধুর হাসিই না হাসতো। জুড়িয়ে যেতো আমার চোখ আর মন ।
নেহারের মৃত্যুর পর কেন যেন আমি ওকে নিয়ে ছোট একটা গদ্য রচনা লিখে ফেললাম । তখন আমার সাহিত্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না । যা হোক, সেই লেখাটি আমি আম্মা এবং আর দু’-তিনজন নারীর সামনে বসে লেখাটি পড়লাম । সেই আসরে নেমে এলো থমথমে স্তব্ধতা আর আম্মা হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন।
আম্মার কান্না দেখে নিজের উপর খুব রাগ হলো আর আমি নিঃশব্দে সেই স্থান ত্যাগ করলাম । বারান্দায় এসে লেখাটিকে কুচি কুচি ক’রে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম । আমার জন্মদাত্রীকে কাঁদিয়েছি ব’লে নিজেকে শাসিয়েছি বটে মনে-মনে, তবে সেই সঙ্গে এ-ও মনে হয়েছে যে, আমার লেখায় এক ধরনের শক্তিও আছে হয়তো। এই ধারণা আরো খানিকটা ভিত্তি পেলো, ক্লাশ নাইনের পরীক্ষার পর। আমাদের ক্লাশ নাইনের বাংলার শিক্ষক বিনয় বাবু আমার পরীক্ষার খাতা খুলে আমার লেখা ‘এক টুকরো কয়লার কাহিনী’ প্রবন্ধটির খুব তারিফ করলেন । ছাত্ররা সবাই আমার দিকে তাকালো । আবার আমার মনে হলো, হয়তো সত্যি-সত্যি লেখার ক্ষমতা আমার মধ্যে বিদ্যমান যা উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে।
কিন্তু এর পরেও আমি অনেক দিন ক্লাশের বাইরের কোনো লেখা দিয়ে খাতার পাতা ভরিয়ে তুলিনি। অনেক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা’ রেখেই লেখা শুরু করি । তখন আমরা মাহুতটুলি থেকে সরে এসেছি আশেক লেনে । সেখানেই আমি আমার প্রথম কবিতা লিখি যেটি ঢাকার প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’য় প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় কবিতা দাখিল করার ব্যাপারে আমার বন্ধু হামিদুর রহমানের পীড়াপীড়ি সক্রিয় ছিলো । তার উদ্দীপনা না থাকলে হয়তো পত্রিকাটির দিকে আমি পা বাড়াতাম না ।
‘সোনার বাংলা’য় আমার কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর আমি পত্রিকাটি আমার মায়ের হাতে দিয়েছিলাম তাঁর পুত্রের কবিতাটি পড়ার জন্যে। ইতিমধ্যে আমার বাবা ঘরে ঢুকে ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন। আমার বাবা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, “এসব আমি ঢের দেখেছি। পারবে সে হুমায়ুন কবিরের মতো কবি হতে?” আমি আমার চরিত্রের বিরুদ্ধে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জোরালো কণ্ঠে ব’লে ফেললাম, “যদি আমি কোনোদিন কবি হই তাহ’লে হুমায়ুন কবীরের চেয়ে বড় কবি হবো।” এই দুর্বিনীত বাক্য উচ্চারণ করার পর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াইনি, পাশের ঘরে চলে যাই । এই কাণ্ডে আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, যে-আমি বাবার সঙ্গে কথা বলতেই কেন যেন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তাম ।
যা-ই হোক, শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন কবীরের চেয়ে বড় কবি হতে পেরেছি কিনা, তবে হুমায়ুন কবীর পরবর্তীকালে আমার কবিত্বশক্তির তারিফ করেছেন, কারো কারো কাছে এবং তাঁর পত্রিকা ‘চতুরঙ্গে’ আমার বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। জানি না, আমার কবিতা কত কাব্যপ্রেমীর কাছে আদৃত, যা-ই হোক এখনো আমি লিখে চলেছি এবং যতদিন বেঁচে আছি, লেখনীর গতিকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেবো না। যদি ভবিষ্যতে কোনো সম্পাদক আমার কবিতা তার পত্রিকায় ছাপতে আগ্রহী না হন, তাহলে আমি স্বেচ্ছায় কোনোদিন কোনো সম্পাদকের দহলীজে গিয়ে ধরনা দেবো না। আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি স্যুটকেশের ভেতর কিংবা বিছানার নিচে রেখে দেবো।
ইতিমধ্যে ধন্যবাদ দিই আমার পুস্তক প্রকাশকদের যারা আমার বই সোৎসাহে প্রকাশ করছেন । এই উৎসাহী প্রকাশকদের মধ্যে অন্যতম মনিরুল হককে ধন্যবাদ ।
শামসুর রাহমান
১/১/২০০৫
Leave a Reply