কড়ি দিয়ে কিনলাম – দ্বিতীয় খন্ড – বিমল মিত্র
(১৩৭০ সনের রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত)
স্বর্গত পিতৃদেব সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ
শ্রীচরণেষু
সবিশেষ নিবেদন
আমার পাঠক-পাঠিকাবর্গের সতর্কতার জন্য জানাচ্ছি যে সম্প্রতি তিন-চারটি উপন্যাস ‘বিমল মিত্র’ নাম-যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অপরের প্রশংসাও যেমন প্রাপ্য হওয়া উচিত নয়, তেমনি অপরের নিন্দাও আমার প্রাপ্য নয়। অথচ প্রায় প্রত্যহই আমাকে সেই দায় বহন করতে হচ্ছে। পাঠক-পাঠিকাবর্গের প্রতি আমার বিনীত বিজ্ঞপ্তি এই যে সেগুলি আমার রচনা নয়। একমাত্র ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ছাড়া, আমার লেখা প্রত্যেকটি গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় আমার স্বাক্ষর মুদ্রিত থাকে।
বিমল মিত্র
.
একটি মহান উপন্যাস
বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম গ্রন্থ হিসেবে দুই খণ্ড ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বিশেষ সুপরিচিত। অতীতের মহাকাব্যের স্থান গ্রহণ করেছে বর্তমান কালের উপন্যাস, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ তেমনি আধুনিক যুগ ও জীবনের এক মহাকাব্য-বিশেষ! কাহিনীর কালপরিধি অতিবিস্তৃত নয়, মাত্র একটি বালকের কৈশোর থেকে যৌবনের মধ্যভাগ পর্যন্ত। কিন্তু সেই স্বল্পকালের গণ্ডিতেই বাংলাদেশের বিপুলতম পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, নবজাগ্রত তরুণ সমাজ, আত্মবিস্মৃত তীব্র আদর্শবোধ, গভীর সত্যপরায়ণতা। কিন্তু মাত্র কয়েকটি বৎসরের অবলেপ দেশের চারিত্রিক দার্ঢ্যকে নিঃশেষ মুছে নিয়েছে। সংসার ও আদর্শের দ্বন্দ্বে জর্জর মাস্টারমশাইয়ের দল তখন নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছেন। নূতন ব্যবস্থায় স্বাধীনতার চরম অপব্যবহার ঘনিয়ে উঠেছে মিঃ ঘোষাল, হোসেনভাই, ছিটে-ফোঁটার ক্ষমতালিপ্সায়। রাষ্ট্রনৈতিক আর সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যবিন্দু নায়ক দীপঙ্কর। তার ব্যক্তিজীবনে—একদিকে জাতীয় দুর্যোগ, অন্যদিকে যুগযন্ত্রণার প্রতিনিধি সতীলক্ষ্মীদির দল। দীপঙ্কর কেবল কাহিনীর মধ্যবিন্দুই নয়, তার দৃষ্টিতেই সমগ্র কাহিনীর রসভাষ্য। তার চরিত্রে action বা কোনরূপ কর্মভূমিকার আত্যন্তিক অভাব কারও চোখে পড়তে পারে। সে এখানে নিষ্ক্রিয় দর্শকমাত্র, ক্যামেরার চোখের মত কাহিনীর সূত্রগুলি যান্ত্রিক নিপুণতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে গেছে। কিন্তু তার নিজস্ব কোন ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়নি। তবে সেক্ষেত্রে একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে পারিপার্শ্বিক সক্রিয়ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য হয়তো এইরকম একরঙা প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন ছিল। ক্যানভাস সাদা না হলে বহুবর্ণের চিত্র ফোটানো সম্ভব হয় না।
‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ অনেকাংশে এপিকধর্মী এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এপিক বা মহাকাব্যে ব্যক্তিজীবন বা গৃহজীবন মুখ্য নয়, সেখানে বিশাল এক দেশ কালের চিত্র ফুটে ওঠে। মোটা তুলির টানে এক বিশাল যুগকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হয়। সেদিক থেকে আলোচ্য গ্রন্থখানি সার্থক। চরিত্র এখানে কাহিনীভাগের তুলনায় নিতান্ত স্বল্প। তবে পারিপার্শ্বিক ও যুগ পরিবেশ রচনে কাহিনীকার আশ্চর্য সাফল্যলাভ করেছেন। এখানে দেশ কাল এবং সমাজ ও পাত্রপাত্রী, তারাও প্রাণবন্ত। স্থির-লক্ষ্য এক জাতির আদর্শভ্রষ্টতা আর তার স্বাভাবিক পরিণাম—নিপুণ সহৃদয়তার সঙ্গে লক্ষ্য করা হয়েছে। অবশেষে এক আশাবাদী পরিণাম চিন্তার মধ্যে কাহিনীর সমাপ্তি।
কাহিনীর নামকরণে সংকেতধর্মিতা যুগজীবনের motto টিকে ইঙ্গিত করছে। অঘোর ভট্টাচার্য বলেছিল—কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়। তার প্রমাণ দিয়েছে মিঃ ঘোষাল আর ছিটে-ফোঁটার দল। কিন্তু দীপঙ্করের আদর্শবাদ সেই নঞর্থক মতবাদে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছে। তার জীবন প্রমাণ করেছে—কড়ি দিয়ে অন্তত জীবনের আনন্দ কেনা যায় না। আধুনিক যুগের প্রতি লেখকের এটিই ব্যঞ্জনাময় উক্তি।
শ্রীপ্রমথনাথ বিশী
In the silence one can hear a soft monotonous dripping. It is the dividenda of the capitalist continuously trickting in, continuously mounting up. One can literally hear them multiply, the profits of the rich. And one can hear too, in between, the low sobs of the destitute, and now then a harsher sound, like a knife being sharpened.
—Heinrich Heine
(1797-1856)
.
ভূমিকা
‘রামায়ণ’ না-লিখে কেন ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ লিখেছি—তা প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলা আছে। আমি বাল্মীকি নই, বাল্মীকির সে প্রতিভাও আমার নেই। তিনি লিখেছেন সত্যযুগের কাহিনী, আমি লিখেছি কলিযুগের। কিন্তু আসলে কাজটা যত সহজ হবে ভেবেছিলাম তত সহজ হলো না—
লিখতে গিয়ে দেখলাম কলিযুগের চেয়ে সত্যযুগ অনেক সত্য। সত্যযুগের পুণ্যের জয় নিশ্চিত, পাপের পরাজয় অনিবার্য! কিন্তু কলিযুগে সে-বালাই নেই। এ-যুগে মিথ্যে হত্যাপরাধেও বেকসুর খালাস হওয়া যায়। এ-যুগের রাবণের পক্ষে রামকে যুদ্ধে হারিয়ে অযোধ্যার সিংহাসনও দখল করা সম্ভব, এমন কি সমাজে-সংসারে প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার নজীরও আছে। এ-যুগ টাকার যুগ, এ-যুগ কড়ির যুগ। এই কড়ির যুগের কাহিনী লিখতে গিয়ে তাই বার বার আমি মহাকবিকে স্মরণ করে অহঙ্কারের অপহ্নব ঘটাতে চেয়েছি।
কিন্তু এ-সত্ত্বেও ইচ্ছে ছিল উপন্যাসের শেষ পর্বে আমি বাল্মীকির মতই রাবণ-বধ সাঙ্গ করে রামকে অযোধ্যার সিংহাসনে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করবো। এই কলকাতা শহরেই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এই উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটাবো। ভূগোলে না-হোক সাহিত্যে অন্তত গান্ধীজীর স্বপ্ন সার্থক করবো। কিন্তু তা পারলাম না। বিংশ-শতাব্দীর শেষার্ধে অশুভ-বুদ্ধির চক্রান্তে আমার সব পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল।
ওয়াটার্লুর যুদ্ধের পর ১৮১৫ সালে যারা রাবণকে সেণ্ট-হেলেনা দ্বীপে বন্দী করে চিরকালের মত নিঃশেষ করতে চেয়েছিল, তারাই আবার সেই রাবণকে নিজেদের স্বার্থে জীইয়ে তুললো ১৯৩২ সালে। একদিন ফ্রান্সের নেপলিয়ন আবার জার্মানীর চ্যান্সেলর হয়ে বসলো। যে-দেশ মোটা দামে জাপানকে লোহা বিক্রী করেছিল ১৯৩২ সালে, সেই দেশই আবার সেই লোহা সুদের বদলে বোমা হয়ে ফিরে এল ১৯৪২ সালে। অর্থাৎ ইংলণ্ডের পাউণ্ড, আমেরিকার ডলার, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক, জার্মানীর মার্ক, রাশিয়ার রুবল, জাপানের ইয়েন, ইটালীর লীরা আর ইণ্ডিয়ার টাকা পৃথিবীর স্টক-এক্সচেঞ্জের তাবৎ রাবণরা সব ভাগাভাগি করে দখল করে বসলো। এক রাবণ বহু রাবণে পরিণত হলো। সবাই বুঝলো, ন্যুরেম্বুর্গ-ট্রায়ালে যাদের ফাঁসি হয়েছিল, শুধু তাদেরই নয়, তাদের যারা বিচার করেছিল, সেই সব রাবণদেরও ফাঁসি হলে তবেই বেশি সুবিচার হতো। সুতরাং রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে কী হবে, পৃথিবীতে কখন যে রাতারাতি রাবণরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে তা কেউই টের পায়নি। টের যখন পাওয়া গেল তখন আর সময় নেই। সেই সময়েই এ-উপন্যাসের রাবণ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আরো বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসলো। একদিন মানুষের জন্যেই টাকার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন টাকার জন্যেই সৃষ্টি হলো ঘোষাল-সাহেবদের।
আর সীতা? সীতার পাতাল-প্রবেশ?
এ-যুগের সাধারণ মানুষের সাধ-আহ্লাদ বাসনা-কামনার প্রতীক যদি হয় সতী, তো সে সমস্ত কিছুই অকালে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে মহৎ দাবীর খেসারৎ দিতে দিতে। মনুষ্যত্বকেও আজ চিনতে হয় রক্ত-মাংসের মূল্য দিয়ে। ‘দেশ’ পত্রিকায় এ-উপন্যাস ধারাবাহিক প্রকাশকালে অসংখ্য পাঠক-পাঠিকা আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন যেন সতীর কোনও সর্বনাশ না হয়। কিন্তু বাল্মীকিই কি সীতার পাতাল-প্রবেশ রদ করতে পেরেছিলেন? বাল্মীকি যা পারেন নি আমি তা পারবো কেমন করে? আমি অত দক্ষতা কোথায় পাবো?
তবু নিজের মনে এই ভেবেই সান্ত্বনা পেয়েছিলাম যে এও হয়ত কলির মাহাত্ম্য!
কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। মাহাত্ম্যটা কলির নয়, কড়ির।
বিমল মিত্র
Leave a Reply