কড়ি দিয়ে কিনলাম (১ম খন্ড) – বিমল মিত্র
১৩৭০ সনের রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত
.
স্বৰ্গত পিতৃদেব সতীশচন্দ্র মিত্র
শ্রীচরণেষু
.
All that I have is a voice
To undo the folded lie,
The romantic lie in the brain
Of the sensual Man in the Street,
The lie of Authority
Whose buildings scrape the sky:
There is no such thing as the State
And no one exists alone;
Hunger allows no choice
To the citizen or the police,
We must love one another or die.
W. H. Auden
[1907-1973]
.
ভূমিকা
ছোটবেলায় আমার প্রিয় গ্রন্থ ছিল রামায়ণ। বলতে গেলে গল্পে সেই আমার প্রথম পাঠ। গল্পের রস যে কত গম্ভীর হতে পারে, তা সেদিন চোখের জলের সঙ্গে যেমন করে হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম, তারপরে আর কোনও গ্রন্থ পড়ে তা করিনি।
এ তো গেল গল্পের দিক। গল্প যতক্ষণ পড়ি ততক্ষণই তার রস। পর মুহূর্তেই গল্পের আবেদন হালকা হয়ে আসে। কিন্তু গল্পের উর্ধ্বে আর একটি তীব্রতর এবং গভীরতর আবেদন আছে যা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হয় না। যা জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকে। যা জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। যা জীবনের অগ্রগতিতে সাহায্য করে। রামায়ণ সেই জাতীয় গল্প যা যুগ থেকে যুগান্তরে প্রসারিত হয়ে জীবনকে জাগ্রত করে। জীবনকে পুনর্জীবন দান করে।
বড় হয়ে দেখছি রামায়ণ শুধু অসার কবি-কল্পনা নয়। এই বর্তমান সংসার জীবনেরও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ রাম সীতা রাবণ আপন মহিমায় বিরাজমান। অযোধ্যা আর লঙ্কা শুধু ভৌগোলিক নাম মাত্রই নয়-কলকাতা শহরের মধ্যেই তাদের অবস্থিতি। এই কলকাতায় এ-যুগেও সীতাহরণ হয়। এ-যুগেও সীতার বনবাস হয়। এবং এই বিংশ শতাব্দীতেও সীতার পাতাল-প্রবেশ হয়।
অনেক দিনের কল্পনা ছিল রামায়ণের গল্প নিজের ভাষায় লিখবো। তা আর হলো না। হলো ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। ইতি–
.
একটি মহান উপন্যাস
বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম হিসাবে দুই খণ্ড ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বিশেষ সুপরিচিত। অতীতের মহাকাব্যের স্থান গ্রহণ করেছে বর্তমান কালের উপন্যাস। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ তেমনি আধুনিক যুগ ও জীবনের এক মহাকাব্য-বিশেষ। কাহিনীর কালপরিধি অতিবিস্তৃত নয়, মাত্র একটি বালকের কৈশোর থেকে যৌবনের মধ্যভাগ পর্যন্ত। কিন্তু সেই স্বল্পকালের গণ্ডিতেই বাংলাদেশের বিপুলতম পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, নবজাগ্রত তরুণ সমাজ, আত্মবিস্মৃত তীব্র আদর্শবোধ, গভীর সত্যপরায়ণতা। কিন্তু মাত্র কয়েকটি বৎসরের অবলেপ দেশের চারিত্রিক দার্চকে নিঃশেষে মুছে নিয়েছে। সংসার ও আদর্শের দ্বন্দ্বে জর্জর মাস্টারমশাইয়ের দল তখন নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছেন। নতুন ব্যবস্থায় স্বাধীনতার চরম অপব্যবহার ঘনিয়ে উঠেছে মিঃ ঘোষাল, হোসেনভাই, ছিটে-ফোঁটার ক্ষমতালিপ্সায়। রাষ্ট্রনৈতিক আর সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যবিন্দু নায়ক দীপঙ্কর। তার ব্যক্তিজীবনে–একদিকে জাতীয় দুর্যোগ, অন্যদিকে যুগ-যন্ত্রণার প্রতিনিধি সতী-লক্ষ্মীদির দল। দীপঙ্কর কেবল কাহিনীর মধ্যবিন্দুই নয়, তার দৃষ্টিতেই সমগ্র কাহিনীর রসভাষ্য। তার চরিত্রে action বা কোনরূপ কর্মভূমিকার আত্যন্তিক অভাব কারও কারও চোখে পড়তে পারে। সে এখানে নিষ্ক্রিয় দর্শকমাত্র, ক্যামেরার চোখের মত কাহিনীর সূত্রগুলি যান্ত্রিক নিপুণতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা গেছে। কিন্তু তার নিজস্ব কোন ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়নি। তবে সেক্ষেত্রে একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, পারিপার্শ্বিক সক্রিয়ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্যে হয়তো এই রকম একরঙা প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন ছিল। ক্যানভাস সাদা না হলে বহুবর্ণের চিত্র ফোঁটানো সম্ভব হয় না।
‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ অনেকাংশে এপিকধর্মী এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এপিক বা মহাকাব্যে ব্যক্তিজীবন বা গৃহজীবন মুখ্য নয়, সেখানে বিশাল এক দেশ-কালের চিত্র ফুটে ওঠে। মোটা তুলির টানে এক বিশাল যুগকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হয়। সেদিক থেকে আলোচ্য গ্রন্থখানি সার্থক। চরিত্র এখানে কাহিনী-ভাগের তুলনায় নিতান্ত স্বল্প। তবে পারিপার্শ্বিক ও যুগ পরিবেশ রচনে কাহিনীকার আশ্চর্য সাফল্যলাভ করেছেন। এখানে দেশ কাল এবং সমাজ ও পাত্রপাত্রী, তারাও প্রাণবন্ত। স্থির-লক্ষ্য এক জাতির আদর্শভ্রষ্টতা আর তার স্বাভাবিক পরিণাম-নিপুণ সহৃদয়তার সঙ্গে লক্ষ্য করা হয়েছে। অবশেষে এক আশাবাদী পরিণাম চিন্তার মধ্যে কাহিনীর সমাপ্তি।
কাহিনীর নামকরণে সংকেতধর্মিতা যুগজীবনের mottoটিকে ইঙ্গিত করছে। অঘোর ভট্টাচার্য বলেছিল–কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়। তার প্রমাণ দিয়েছে মিঃ ঘোষাল আর ছিটেফোঁটার দল। কিন্তু দীপঙ্করের আদর্শবাদ সেই নঞর্থক মতবাদে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছে। তার জীবন প্রমাণ করেছে–কড়ি দিয়ে অন্তত জীবনের আনন্দ কেনা যায় না। আধুনিক যুগের প্রতি লেখকের এটিই ব্যঞ্জনাময় উক্তি।
শ্রীপ্রমথনাথ বিশী
.
সবিশেষ নিবেদন
আমার পাঠক-পাঠিকাবর্গের সতর্কতার জন্য জানাচ্ছি যে সম্প্রতি তিন-চারটি উপন্যাস ‘বিমল মিত্র’ নাম-যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অপরের প্রশংসাও যেমন প্রাপ্য হওয়া উচিত নয়, তেমনি অপরের নিন্দাও আমার প্রাপ্য নয়। অথচ প্রায় প্রত্যহই আমাকে সেই দায় বহন করতে হচ্ছে। পাঠক-পাঠিকাবর্গের প্রতি আমার বিনীত বিজ্ঞপ্তি এই যে সেগুলি আমার রচনা নয়। একমাত্র ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ছাড়া, আমার লেখা প্রত্যেকটি গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় আমার স্বাক্ষর মুদ্রিত থাকে।
বিমল মিত্র
.
“…Bimal Mitra’s encyclopaedic novel ‘Karhi Diye Kinlam’ (1962), sums up the complexities and unsolved riddles of modern life in a representative individual character and studies life against the background of an ever-widening environment. This is truly a novel with a third dimension that packs up the meaning of the lives of all classes of people and events of far-reaching magnitude into the life of a single individual… This is a book which has an intellectual appeal not exhausted at the first reading of the story. With this novel, modern Bengali fiction may be said to have stepped into a new sense of life-values or a new world of cosmic proportions…..”
Dr. Srikumar Banerjee
Amrita Bazar Patrika. Puza special, 1964.
.
তেরো বছরের সালতামামি
বিমল মিত্র
এখন থেকে তেরো বছর আগে এই উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয়। আজ এর ত্রয়োদশ সংস্করণের ভূমিকায় এই সুযোগে এই উপন্যাস সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য রাখার প্রয়োজনের অনিবার্যতা বোধ করছি। কোনও বই-এর সংস্করণ-সংখ্যা দিয়ে তার গুণাগুণ বিচার করা অবিচারেরই সামিল। কিন্তু তবু যে এই ভূমিকা লিখছি তার কারণ এই তেরো বছরে এই বই উপলক্ষে আমি এতে প্রশংসা স্তুতি এবং এত অপপ্রচার ও তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি যে এখানে তা লিপিবদ্ধ না করলে ভবিষ্যৎ বংশীয়দের কাছে সে-সব চিরকাল অজ্ঞাতই থেকে যাবে।
Modern Library (26€ garro Dostoyevskey-1 45 “Brothers Karmazoy”-এর ভূমিকায় সম্পাদক প্রথম লাইনেই একটি চমৎকার কথা বলেছেন “The last and crowning work of Dostoyevskey’s life, The Brothers Karmazov, first appeared as a serial in “Russky Vistnik’, A Moscow maguine, starting 1879-1880. written under severe external and internal pressure, each instalment created a national furore comparable only to the excitement stirred by the appearence, in 1866 of ‘Crime and Punishment.” “কড়ি দিয়ে কিনলাম” উপন্যাস সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য। ১৯৬০, ১লা জানুয়ারি থেকে ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ১০৭টি দীর্ঘ কিস্তিতে সাপ্তাহিক “দেশ” পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিক প্রকাশের সময় যে শশারগোল পড়ে যায়, তার সঙ্গে তুলনা করা যায় একমাত্র ১৯৫২ নভেম্বর থেকে ১৯৫৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রকাশিত “সাহেব বিবি গোলাম” উপন্যাসের সঙ্গে। যে মানসিক যন্ত্রণা, শত্রুতা ও বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতা সে-সময়ে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে তার সাক্ষী নেই কেউই। “দেশ” পত্রিকার অফিসে তখন যে-সব অসংখ্য চিঠি পত্র এসেছে তা যে-কোনও লেখককে বিভ্রান্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। তবু মনে হয় অনুকূল পরিবেশের চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই বোধ করি আমার একাগ্রতার তীব্রতা বৃদ্ধি লাভ করে। মনে আছে উপন্যাস দুটি প্রকাশিত হবার কালে যখন “দেশ” পত্রিকার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো তখন পাঠক-পাঠিকাদের কাছ থেকেও এই মর্মে চিঠি আসতে লাগলো যেন এই উপন্যাস কখনও কোনওকালে শেষ না হয়। অর্থাৎ তাদের ভালো লাগায় যেন কখনও ছেদ না ঘটে! বইটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হওয়ার সময়েই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের অনুমতির জন্যে অনুরোধ আসতে থাকে। ভারতের বাইরে পাকিস্তানে উর্দুভাষার শ্রেষ্ঠ ত্রৈমাসিক লাহোরের “নুকুশ” পত্রিকায়, এবং ভারতের ভেতরে মালয়ালম ভাষায় কেরালার “জনযুগম্” সাপ্তাহিকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দি ভাষায় গ্রন্থটি দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়ে অভূতপূর্ব আন্দোলনের আকার ধারণ করে। তখনকার দিনে যে-কোনও ভাষার পক্ষে যে-কোনও একটি উপন্যাস-এর দাম ৪২ টাকা ৫০ পয়সা দুমূল্যের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দি ভাষা-ভাষীদের কাছে বইটি অভূতপূর্ব সমাদর অর্জন করে। মনে আছে সেই সময়ে অনেক অপরিচিত পাঠক সশরীরে আমার বাড়িতে এসে খবর নিতেন আমি দিনেরাত্রে কখনও ঘুমোই কি না। এ হেন গ্রন্থ যখন প্রথম প্রকাশিত হলো তখন পাঠক সাধারণের মধ্যে অন্তহীন কৌতূহলের সঙ্গে কেবল একটি প্রশ্নই ধ্বনিত হতে লাগলো–সেটা এই যে এই ব্যস্ততার যুগেও এমন এপিক উপন্যাস লেখা সম্ভব হলো কেমন করে! প্রকাশক “মিত্র ও ঘোষ” পাঠক সাধারণের কৌতূহল নিরসনকল্পে একটি বিশেষ পুস্তিকা প্রকাশ করে তাতে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, এবং সেই পুস্তিকাটি দশ সহস্র কপি ছাপিয়ে পাঠকদের কাছে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। এই উপন্যাস আয়তনের দিক দিয়ে যে-কোন ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে বৃহত্তম। পরে এই উপন্যাসটি সম্পর্কে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় Amrita Bazar Patrika Puza special 1964-তে “Recent trends in Bengali literature’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন–Bimal Mitra’s encyclopaedic novel “Karhi diye Kinlam” (1962), sums up the complexities and unsolved riddles of modern life in a representative individual character and studies life against the background of an ever-widening environment. This is truly a novel with a third dimension that packs up the meaning of the lives of all classes of people and events of far-reaching magnitude into the life of a single individual… This is a book which has an intellectual appeal not exhausted at the first reading of the story. With this novel, modern Bengali fiction may be said to have stepped into a new sense of life-values or a new world of cosmic proportions…..” এই তো গেল সমালোচকদের কথা। কিন্তু এ-সম্বন্ধে আমার নিজের কথা এখন বলি। বলি, কেন এবং কেমন করে এ-বই লিখেছিলাম। তবে স্বামী-স্ত্রী দু’জন জীবিত থাকতে যেমন তাঁদের বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে সত্য কথা বলা বিপজ্জনক, লেখকের নিজের লেখা সম্বন্ধেও ঠিক তাই। লেখকের জীবিতাবস্থায় তাঁর লেখা ভাল কিম্বা মন্দ বলা চলে কিন্তু সে-সম্বন্ধে সত্য কথা বলা চলে না। আজ পর্যন্ত সাহিত্যের ইতিহাসে তা কখনো ঘটে নি। সুতরাং সে চেষ্টা করবো না। তবে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ লেখাকালীন যে-সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তা এখন এই তেরো বছর পরে বললে বোধ করি অন্যায় হবে না। আমার অবর্তমানে অন্য কেউ সে চেষ্টা করলে তা অনুমান বলে গ্রাহ্য হতে পারে কিন্তু কোনওদিনই তা প্রমাণ বলে স্বীকৃত হবে না। তাই আমি এখানে এই রচনার উৎস ও রচনাকালীন যন্ত্রণা এবং তার আনুষঙ্গিক ইতিবৃত্তের অবতারণা করি।
সতেরো শ ঊননব্বই সালে কবে একদিন ফ্রান্সে বিপ্লব হয়েছিল। তার স্মৃতি যেন লোকে তখন ভুলতে বসেছে। টাটকা মনে আছে উনিশ শ চোদ্দ সালের বিশ্বযুদ্ধটার কথা। কিন্তু তখনও লুই-দ্য-ফোর্টিন্থ আর ম্যাডাম-দু-ব্যারিরা পৃথিবী থেকে মুছে যায় নি। তাদের কেউ বসেছে ইংলন্ডের সিংহাসনে, কেউ জার্মানীতে, কেউ আমেরিকায়, আর কেউ বা ফ্রান্স-এ। সেই Liberty, Equality আর Fraternity-র বাণী তখন আর কারো কানে ঢোকে না। কে একজন বলেছিল–That government is best which governs not at all. সে-কথাও আর তখন কানে ঢুকছে না কারো। দেখতে দেখতে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রে বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে একদিন শেষও হয়ে গেল। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অপমৃত্যু দিয়েও মানুষ তাদের চাওয়া গভর্নমেন্ট পেলে না। শ্রমিকরাও তাদের শৃঙ্খল ভাঙতে পারে নি তখন। মানুষের সংসারের লক্ষ্মী নিরুদ্দেশ, হয়ে গেছে ঘর থেকে। ইন্ডিয়ার টাকা, ইংলন্ডের পাউন্ড, আমেরিকার ডলার, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক, জার্মানীর মার্ক, রাশিয়ার রুবল, ইটালির লীরা, জাপানের ইয়েন, সকলকে ট্যারিফ বোর্ডের চাবি দিয়ে সেফডিপোজিট ভল্টে আটকে রাখবার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তবু কোথাও স্ট্রাইক বন্ধ হচ্ছে না, হরতাল বন্ধ হচ্ছে না, অসন্তোষ থামছে না। দিন দিন সায়েন্স আর ইন্ডািস্ট্রি কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে আর মানুষের সমাজ স্থাণুর মত হতভম্ব হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তাই দেখছে আর বাঁচবার পথ খুঁজে মাথা কুটে মরছে।
ঠিক এই সময়ে মানুষের ঘরে একটা নতুন নাম জন্মাল। সে দীপঙ্কর।
জন্ম তো হলো। কিন্তু তার পর?
.
তারপর আমার কথা বলি।
তার পর পলে-পলে অপমান, অত্যাচার আর অপমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমি বড় হতে লাগলাম। দেখলাম আমার চারদিকে শুধু ঘৃণা, শুধু লজ্জা, শুধু কলঙ্ক, শুধু ভয়। দেখলাম অঘোরদাদুকে, চনুনীকে, লক্কাকে, লোটনকে, ছিটে-ফোঁটাকে, দুনিকাকাকে, আর তাদের মত অসংখ্য মানুষকে, যারা ন্যায়-অন্যায়ের বালাই নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দেয় সত্যকে, ধর্মকে আর সুন্দরকে। যারা এক ফু-এ চিরকালের প্রতিষ্ঠিত সমস্ত সত্যকে তুচ্ছ করে দিয়ে মহা-আরামে দিন কাটিয়ে দেয়। অথচ এই সংসারে তাদেরই পাশাপাশি দেখলাম প্রাণমথবাবুকে, সতাঁকে, দাতারবাবুকে। দেখলাম আরো অনেকের সঙ্গে সনাতনবাবুকেও। কিন্তু মানুষের লেখা পুঁথির সঙ্গে সেই সব মানুষের জীবনকে যাচাই করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম। ১৭৮৯ সালের ফরাসী দেশেও ঠিক এমনি অবস্থা ছিল একদিন। অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই পৃথিবীতে যন্ত্র-সভ্যতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সেখানেও আর এক নতুন সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল। সেদিন সেখানকার অবস্থাও ছিল ঠিক এখানকার মত। সেখানকার অঘোরদাদুরাও ঠিক এমনি করে ঠাকুরের ।নৈবেদ্য চুরি করে যজমান ঠকাতো। সেখানকার চনুনীরাও লেখাপড়া শিখতে না পেরে কুৎসিত গালাগালি দিয়ে জীবন কাটাত। সেখানেও ছিল দুনিকাকা, সেখানেও ছিল পঞ্চাদা, ছোনেদা, মধুসূদনের বড়দা। সেখানে সেই ফরাসীদেশেও ছিল কালীঘাটের মতন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। সেখানকার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনেও রোদ ঢুকত না, শিক্ষা ঢুকত না, সভ্যতা ঢুকত না সেদিন। সি-আর-দাস মারা যাবার দিন সেখানেও সবাই নির্বিকার হয়ে আড্ডা দিত। হুজুগের দিন চরকা কাটত আবার হুজুগ চলে গেলে চরকা ফেলে দিত। সেখানেও লক্ষ্মীদির মত মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে দীপঙ্করের মত ছোট ছেলেদের ধরে চকোলেট দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে শম্ভুদের কাছে প্রেমপত্র পাঠাত। সেখানেও কিরণরা রাস্তায় রাস্তায় হাতেকাটা পৈতে বিক্রি করত আর দীপঙ্করের মায়েরা পরের বাড়িতে রান্না করত আর ছেলে মানুষ করার স্বপ্ন দেখত। আর সেখানেও যারা বড়লোক, যারা ব্যারিস্টার পালিতের মতন বড়লোক, যারা অঘোরদাদুর যজমানদের মত বড়লোক, সেই ‘লখার মাঠে’র একাদশী বাঁড়ুজ্জে আর চাউলপটির শশধর চাটুজ্জের দল কড়ি দিয়ে সব কিনে ফেলত-পাপ কিনত, পুণ্য কিনত, অধর্ম কিনত। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি যশ সম্মান কীর্তি অমরত্ব সব কিনে ফেলত!
এই সব পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যেত দীপঙ্কর। কোথাও কোনও নিয়ম পেত না, কোথাও কোনও ফরমুলা পেত না। চিরকাল কি এমনিই চলবে? এমনি অনাচার আর এমনি অরাজকতা? তিন শো বছর আগেকার লেখা বই-এর পাতাতেও দেখলাম Babeuf (বাবা) লিখছেন, “When I see the poor without the clothing and without the shoes which they themselves are engaged in making, and contemplate the small minority who do not work and yet want for nothing, I am convinced that Government is still the old conspiracy of the few against the many, only it takes a new form.”
সেদিন হাজরা রোডের মোড়ে হঠাৎ অমলবাবুর সঙ্গে দেখা।
আশুতোষ কলেজের হিস্ট্রির প্রফেসর অমল রায়চৌধুরী। লম্বা-চওড়া চেহারা। হিস্ট্রিও যে উপন্যাসের মত উপাদেয় হতে পারে তা অমলবাবুর লেকচার শুনেই। বুঝেছিলাম। নানা কলেজের ছাত্ররা আশুতোষ কলেজে আসত তার লেকচার শুনতে। কিন্তু আমাকে তিনি চিনতে পারলেন না।
বললেন–তুমি কে? কোন্ ইয়ারে পড়? তোমার নাম কী?
সব বললাম। তার পরে বললাম–একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার?
বললেন–কী?
শেষ পর্যন্ত কথাটা বলেই ফেললাম। কয়েকদিন আগের কথা। কাসে সক্রেটিসের কথা পড়াচ্ছিলেন। পড়াতে পড়াতে বললেন সক্রেটিসের একটা কথা। সক্রেটিস Th1186919-Be hopeful then, gentlemen of the jury, as to death; and this one thing hold fast that to a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the gods indifferent to his well-being. POTETE মানে সেদিন ক্লাসে বুঝতে পারি নি। দাঁড়িয়ে উঠে মানে জিজ্ঞেসও করতে পারি নি সঙ্কোচে। ক্লাসের সবাই কথাটার অর্থ বুঝতে পেরেছিল কিনা তাও জানি না। তাই রাস্ত য় দেখা হতেই সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম–কথাটার মানে কী? অর্থাৎ কথাটা। কতদূর সত্যি?
অমলবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কোথায় থাক তুমি? ম্যাট্রিকে রেজাল্ট কী হয়েছিল তোমার?
সব প্রশ্নেরই উত্তর দিলাম। তার পর বললাম–আপনি হয়তো এখন খুব ব্যস্ত আছেন স্যার, আমি পরে আর একদিন দেখা করব!
বলে চলে আসছিলাম। কিন্তু অমলবাবু থামিয়ে দিলেন। বললেন–না, দাঁড়াও, তুমি একটা কাজ করো, আমার সঙ্গে লাইব্রেরিতে একবার দেখা করো।
–কখন স্যার?
–যখন ইচ্ছে–বলে অমলবাবু চলে যাচ্ছিলেন। আমিও চলে আসছিলাম।
হঠাৎ যেতে যেতে অমলবাবু আবার ফিরলেন। বললেন–দেখা করো ঠিক, বুঝলে?
বললাম–করব স্যার।
কিন্তু যাব-যাব করেও আর বহুদিন অমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে সাহস হয় নি। ক্লাসের মধ্যেই বই-এর ওপর মুখ দিয়েই পড়িয়ে যেতেন। কারোর দিকে চেয়ে দেখতেন না। কিন্তু সেদিন সব দ্বিধা-সঙ্কোচ এড়িয়ে তার লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তিনি তখন ফোর্থ ইয়ার ক্লাস শেষ করে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন সেই সময়ে দরজার কাছে গিয়ে বললাম–স্যার!
বললেন–কী চাও?
বললাম। সব কথা তাঁকে মনে পড়িয়ে দিলাম। কথাটা শুনে তিনি আমার আপাদ মস্তক আবার ভাল করে দেখে নিলেন। বললেন–মনে পড়েছে, কিন্তু এতদিন কলেজে পড়াচ্ছি, তোমার মত কেউ আমাকে এ-প্রশ্ন তো করে নি! তা তুমি এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা চাও, না ইকনমিক ব্যাখ্যা চাও?
আমি চুপ করে রইলাম।
অমলবাবু বললেন–বুঝেছি, তবে শোন–
বলে তিনি আরম্ভ করলেন বোঝাতে। অনেকদিন আগেকার ঘটনা। সেদিন সেই লাইব্রেরির অন্ধকার ঘরে বসে অমলবাবু যে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা আমার আজো মনে আছে। আজ সেই পুরোন আশুতোষ কলেজও নেই, সেই বিল্ডিংটাও নেই। তার জায়গায় নতুন কলেজ হয়েছে, নতুন বিল্ডিং। কিন্তু কথাগুলো মনে আছে।
সে দক্ষিণেশ্বরের কথা। পরমহংসদেব তখন বেঁচে। এগারো শ ক্রোশ দূর থেকে এক সাধু এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। সাধু হীরাচাঁদ। এসে স্বামী বিবেকানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা বলুন তো, ভক্তের এত দুঃখ কেন?
বিবেকানন্দ বললেন–The scheme of the universe is devilish, I could have created a better world.
সাধু আবার জিজ্ঞেস করলেন–তা দুঃখ না থাকলে সুখ বুঝবেন কী করে?
তখন বিবেকানন্দ বললেন–Our only refuge is in Pantheism-ভক্ত আর ভগবান সবই এক, এই বিশ্বাসটুকু হলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়–অর্থাৎ আমিই সব করছি, এই বিশ্বাস–
গল্পটা বলে অমলবাবু একটু থামলেন। তারপর বললেন–আমি ইতিহাস পড়াই, ইতিহাসেরও একটা দিক আছে, ভারি ইম্পর্ট্যান্ট দিক, সেটা শোন।
-এ তার অনেক পরের কথা। উনিশ শো পাঁচ সালের কথা। একদিন কয়েক হাজার লোক সবিনয়ে এক দেশের রাজার প্রাসাদের সামনে গিয়ে দরবার করলে। গেটের সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল সেপাই-সান্ত্রী। তারা জিজ্ঞেস করলে-কী চাই তোমাদের?
লোকরা বললে–হুজুরের কাছে আমরা একটা দরখাস্ত পাঠাতে চাই
দরখাস্তখানা সেপাই রাজার কাছে নিয়ে গেল। অতি বিনীত দরখাস্ত। দরখাস্তে লেখা ছিল: “We come to thee sire, to seek truth and redress. We have been oppressed; we are not recognised as human beings, we are treated as slaves, who must suffer their bitter fate and keep silence. The limit of patience has arrived. Sire, is this in accordance with the devine law by the grace of which thou reignest? Is it not better to die, better for all the people, and let the capitalists, the exploiters of the working class live? Do not refuse assistance to thy people. Destroy the wall between thyself and thy people and let them rule the country with thyself.”
দরখাস্তখানা পাঠাবার খানিক পরেই এক কাণ্ড হলো। ওপরের বারান্দা থেকে বলা নেই-কওয়া-নেই, তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলতে লাগল, গুলির ওপর গুলি। সেই হাজার হাজার নিরীহ লোকের ওপর লক্ষ লক্ষ গুলির ঝাক এসে পড়তে লাগল। হাজারে হাজারে মরে পড়ল লোক, তারা কাতরাতে লাগল, ছটফট করতে লাগল যন্ত্রণায়–
আর মজা এই, ঠিক তার বারো বছর পরে ঠিক সেই বারান্দা থেকেই ১৯১৭ সালে একদিন আর একজন লোক হাজার হাজার লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন–Comrades, feeding people is a simple task. We will take from the rich and give to the poor. Take milk from the rich and give to the children of workers. He who does not work shall not eat. Workers will receive cards. Cards will bring food.
আরো অনেক কথা বলেছিলেন অমলবাবু। সব ভালো বুঝতে পারি নি। বেশি সময়ও ছিল না। ক্লাসের ঘণ্টা পড়তেই অমলবাবু চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন–পরে তোমাকে এ-সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বলব।
কিন্তু তখন কি জানতাম সেই অমলবাবু অত শিগগির চলে যাবেন। কিন্তু পরে আর একদিন মাত্র এ-বিষয়ে কথা হয়েছিল অমলবাবুর সঙ্গে। ক্লাসের মধ্যে চুপ করে বসেছিলাম এক কোণে।
–রোল নাম্বার সিক্স, রোল নাম্বার সিক্স—
দাঁড়িয়ে উঠে বললাম–ইয়েস স্যার—
অমলবাবু হঠাৎ বললেন–তুমি তোমার সেই কোশ্চেনের উত্তর পেয়েছ?
বললাম–এখনও ঠিক বুঝতে পারি নি স্যার
অমলবাবু বললেন–পাবে পাবে, এর উত্তর কারো কাছে জিজ্ঞেস করে পাওয়া যায় না, এর উত্তর জীবন দিয়ে পেতে হয়, জীবন দিয়ে সন্ধান করলে তবে এর উত্তর পাবে তুমি–
১৯৬০ সালের ১লা জানুয়ারি দেশ পত্রিকায় দীপঙ্কর সেই যাত্রা শুরু করল। আরম্ভ হলো সন্ধান। মানুষের মহাযাত্রার মিছিলে মিশে গেল নগণ্য একটি গ্রামের ছেলে। ছোট, বড়, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র সাহেব মেমসাহেব-কলকাতার তাবৎ জনসাধারণ। ফ্রি-স্কুল স্ট্রীট থেকে শুরু করে একেবারে কালীঘাটের ডাস্টবিন পর্যন্ত পরিক্রমা শুরু হলো তার। কেউ তাকে ভালবাসল, কেউ ঘৃণা করল, কেউ আঘাত দিলে, কেউ আনন্দ। কিন্তু দিনে দিনে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায়, প্রতিমুহূর্তের অনুভাবনায় দীপঙ্কর তখন মানুষ হয়ে উঠছে আর মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি মানুষকে একে একে তার মনের তালুকদারির সমস্ত স্বত্ব উপস্বত্ব সুস্থ চিত্তে বহালতবিয়তে দান করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো সে। সর্বরিক্ত হয়ে দীপঙ্কর তার সর্বস্ব নিবেদনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলে!
কিন্তু আমি মুক্তি পাই নি। দীপঙ্করের যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছি তখন। দীপঙ্করের পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে আমারও পরিক্রমা চলছে তখন স্বর্গ-মর্ত্য-ভুবন। রাত্রে ঘুম নেই। সারা পৃথিবী যখন ঘুমোচ্ছে, তখন আমি আর আমার বাড়ির সামনের বার্লি ফ্যাক্টরিটা জেগে আছি। জেগে-জেগে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছি। মাথার মধ্যে সমস্ত গোলমাল হয়ে যায়। আমিও দীপঙ্করের সঙ্গে ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট, প্যালেস-কোর্ট আর গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এ ঘোরাফেরা করছি। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছি। সব অন্ধকার!
বাড়ির ডাক্তার কানাইলাল সরকার। কানাই বললে–ডাক্তার নীহার মুন্সীকে একবার দেখাও তুমি চোখটা।
জিজ্ঞেস করলাম–কত নেবেন তিনি?
ডাক্তার বললেন–মস্ত বড় ডাক্তার, দুদিন দেখাতে হবে, ষোল ষোল-বত্রিশ টাকা
বত্রিশ টাকা! বত্রিশ টাকার দাম তখন আমার কাছে অনেক। কিন্তু চোখ যদি অন্ধ হয়ে যায়? দেখবো কী দিয়ে? লিখবো কী করে? শেষ পর্যন্ত বত্রিশটা টাকা পকেটে নিয়ে আগের থেকে দরখাস্ত দিয়ে দিন-ক্ষণ স্থির করে গিয়ে হাজির হলাম তার গরচা লেনের বাড়িতে। বহু লোক বাইরে অপেক্ষা করছেন তখন। ভেতরের ঘরে তিনি রোগী দেখছেন। তার পরিচারককে একটা স্লিপে নাম লিখে ভেতরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। ভয়ে ভয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ তিনি বাইরে এলেন সশরীরে। একেবারে নমস্কারের ভঙ্গি। বললেন–আমার বহু সৌভাগ্য–
আমি তো অবাক! সৌভাগ্য তার না আমার!
যাহোক, পরীক্ষা করতে শুরু করলেন তিনি। প্রায় আধঘণ্টা ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা।
শেষকালে চলে আসবার সময় জিজ্ঞেস করলাম–কত দিতে হবে?
–কিছু না।
আমি আরো অবাক! এমন কথা আগে কখনও শুনি নি কোনও ডাক্তারের কাছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তখনও। আমার হতভম্ব দৃষ্টির দিকে চেয়ে তিনি আবার বললেন–তার চেয়ে বরং আপনার একটা বই আমাকে দেবেন, সেইটেই আমি। বেশি দামী মনে করবো!
.
তারপর ১৯৬২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারিতে একদিন শেষ হলো কড়ি দিয়ে কেনা। সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা-স্তুতি মিশ্রিত অজস্র অসংখ্য চিঠিপত্র। ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশ থেকে সহস্রাধিক পত্রাঘাত। কিন্তু আমাকে তা স্পর্শ করেনি। কারণ আমি তখন বোম্বাইতে নির্জন নিরিবিলিতে নিবিষ্ট। আমি জানতে পারি নি, জানতে চাইও নি কড়ি দিয়ে কী কিনলাম আর কী কিনলাম না। দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ একটি চিঠিতে লিখলেন, “গতকাল কড়ি দিয়ে কিনলাম, ১ম খণ্ড, হস্তগত হলো। বইটা হাতে নিয়ে অনুভব করলাম কী বিরাট কীর্তি আর কী অসাধ্যসাধনই না করেছেন। এর পর আছে দ্বিতীয় খণ্ড। প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসছে, আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। অকুণ্ঠ অভিনন্দন। পাঠকদের যে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে এই অগণিত চিঠিই তার প্রমাণ!”
কলকাতায় ফিরে এসে চিঠিগুলো পড়লাম। যারা এই উপন্যাস পড়ে আমাকে পত্রযোগে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তখন তাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। আজকে এতদিন পরে এই সুযোগে তাঁদের প্রত্যেককে আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ উপন্যাস যাদের ভালো লেগেছে সে তাদেরই মহত্ত্ব, আমার কেবল সৌভাগ্য! আমার এই সাহিত্যার্থের বিনিময়ে মাত্র সেইটুকুই আমার প্রাপ্য।
.
কিন্তু এবার এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা কিছু না লিখলে এ ভূমিকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই তেরো বছরে অনেক স্মৃতি যেমন কালের অতল-গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে, তেমনি কিছু সঞ্চয়ও মনের কোণে জমা পড়েছে।
মনে আছে এই বই প্রকাশকালে একজন শ্রদ্ধেয় অগ্রজ লেখক আমার এই গ্রন্থের প্রকাশককে তার শুভাকাঙ্খী হিসেবেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন–তুমি ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ছাপছো বটে কিন্তু এ-বই পাঁচশো কপির বেশি বিক্রি হবে না
কিন্তু তাতেই তিনি নিবৃত্ত হন নি। যখন তিনি দেখলেন তার ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যেয় পরিণত হলো তখন তিনি ‘অমৃত’ সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে এই উপন্যাসের অসারতা প্রমাণ করবার জন্যে একটি অপব্যাখ্যা সূচক প্রবন্ধ লেখার কষ্ট স্বীকার করে আমায় বিব্রত করতে প্রাণপাত চেষ্টা করেছিলেন।
একজন সহযোগী সাহিত্যিক সেই একই ‘অমৃত’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে তিনি নিজে লিখলে এই দুহাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসকে আড়াইশো পাতার মধ্যে সঙ্কুচিত করে লিখতে পারতেন।
যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালের এক মুমূর্ষ রোগী আমাকে পত্রযোগে জানিয়েছিলেন যে আমার এই বই পড়ে তিনি রোগ-যন্ত্রণা ভুলতে পেরেছেন।
সম্প্রতি নাগপুরে থাকার সময় এক বিখ্যাত প্রবীণ ডাক্তার (ডাঃ ব্যানার্জি) আমাকে জানিয়েছিলেন যে তাঁর এক অনিদ্রা-গ্রস্ত রোগীকে তিনি প্রতিদিন তীব্র ওষুধ (পেথিড্রিন) ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়াতে যেতেন। কিন্তু একদিন রোগীটি আর ইনজেশান নিতে অস্বীকার করায় তার কারণ জানতে চাওয়ায় জবাবে জানতে পারেন যে হিন্দি ভাষায় কড়ি দিয়ে কিনলাম” পড়তে আরম্ভ করার পরে রোগীটির ঘুমের ওষুধের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। তার অনিদ্রা-রোগ দূর হয়েছে।
কেরলের একজন কথক শ্রী ভি শম্ভশিব ‘মালায়ালাম্’ ভাষায় এই উপন্যাসের কাহিনী কথকতা করে এখনও শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে চলেছেন।
এ-রকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে।
কিন্তু এই ঘটনাগুলি অত্যন্ত তুচ্ছ। হয়ত বা উল্লেখেরও যোগ্য নয়। তবে আমার বিনীত বক্তব্য এই যে এই তেরো বছরের দীর্ঘ পরিধিতে ওই নিন্দা-প্রশংসা-কুৎসা কটুক্তি-শ্রদ্ধা-আশীর্বাদ-সম্মান সব মিলিয়ে যা কিছু পেয়েছি সমস্তই আমি নতমস্তকে গ্রহণ করেছি। যা আমার প্রাপ্য তাও গ্রহণ করেছি এবং যা আমার প্রাপ্য নয় তাও গ্রহণ করতে আমি কখনও অস্বীকার করিনি। আসলে যে-সমাজে মানুষকে সম্মান পেতে গেলে নিজের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তা পেতে হয় সে-সমাজ আমার কাছে সম্মানীয় নয়। তাই প্রয়োজনবোধে এই উপন্যাসের মধ্যে আমি সেই সমাজকে অনেক স্থানে আঘাত দিয়েছি। আঘাত দিয়েছি বটে কিন্তু তজনিত আঘাত পেয়েছিও আমি অনেক। আমার রচনায় অনেক দোষ-ত্রুটি আছে, এবং সেগুলির রসের বিচারে কতখানি দোষাবহ তাও আমার অপরিজ্ঞাত নয়। এই তেরো বছরের নিন্দা-স্তুতির জঞ্জাল আজ আমার মানসিকতাকে এমন এক স্তরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে যেখানে এই সম্পদগুলি একান্তই আমার নিজস্ব বলে দাবি করবার আর উপায় নেই। এর সমস্ত দায়ই এখন পাঠক-সম্প্রদায়ের। আমি এখানে সেই সম্পদের সামান্য একজন অছি মাত্র।
আজকাল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষতা একটি বিশেষ ধরনের কূটনীতি বলে স্বীকৃত, কিন্তু সাহিত্য-ক্ষেত্রে এই জোটনিরপেক্ষতা চিরকাল ধরেই একটি অপরিহার্য এবং অবশ্যপালনীয় ধর্ম বলে পালিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই জাতীয় একজন জোটনিরপেক্ষ লেখক। সেই কারণেই আমার সাহিত্য-নীতি কখনও অপরের মতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়নি এবং আমার সাহিত্য-যাত্রার পথ সেই কারণেই এত বাধা-বিঘ্নিত ও এত কুৎসা-কণ্টকিত। এবং সেই একই কারণে এই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ একাধারে এত বহু-নিন্দিত ও এত বহু-প্রশংসিত।
রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি লিখেছেন–”যে-সমাজে মানুষ নিজের সত্য আদর্শকে বজায় রাখিয়া নিজের সত্য মতকে খর্ব না করিয়াও শ্রদ্ধা লাভ করিতে পারে সেই সমাজই যথার্থ শ্রদ্ধাভাজন। যেখানে আদর পাইতে হইলে মানুষ নিজের সত্য বিকাইয়া দিতে বাধ্য হয় সেখানকার আদর আদরণীয় নহে। একে আমার দলে, কে আমার দলে নয় সেই বুঝিয়া যেখানে স্তুতি-সম্মানের ভাগ-বণ্টন হয় সেখানকার সম্মান অস্পৃশ্য। সেখানে যদি ঘৃণা করিয়া কেহ গায়ে ধূলা দেয় তবে সেই ধূলাই যথার্থ ভূষণ, যদি রাগ করিয়া কেহ গালি দেয় তবে সেই গালিই যথার্থ সংবর্ধনা।” তিনি আরো লিখেছেন–”যাহা অবহেলায় রচিত তাহা অবহেলার সামগ্রী। যাহাতে কেহ যথার্থ জীবনের সমস্ত অনুরাগ অর্পণ করে নাই তাহা কখনও অমোঘ বলে কাহারও অন্তর আকর্ষণ করিতে পারিবে না।”
আজ এই বই-এর ত্রয়োদশ সংস্করণের ভূমিকা মাত্র এই বলেই শেষ করি যে আমার এই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ অবহেলায় রচিত নয়।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫
.
সূত্রপাত
এদিকটায় আগে বসতি ছিল না তেমন। এই মাঝেরহাট থেকে কালীঘাট, কালীঘাট থেকে বালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ থেকে বেলেঘাটা। বেলেঘাটা থেকে ছেড়ে ট্রেনটা পোড়ো জমি আর শুকনো খালের পাশ দিয়ে বালিগঞ্জে এসে দাঁড়াতে এক মিনিট, তারপর পাখাটা নিচু হলেই ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতো। ঘন্টার শব্দ শুনেই গার্ডসাহেব সবুজ পাখা দেখিয়ে বাঁশি বাজিয়ে দিত। তারপর হুস হুস করে ট্রেনটা ছেড়ে দিত। দু’ধারের পচা ডোবা আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রেল-লাইন। কাকুলিয়ার কাছে এসে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে লক্ষ্মীকান্তপুর আর ডায়মন্ডহারবার। আর একদিকে কালীঘাট-মাঝেরহাট হয়ে বজবজ স্টেশন। ট্রেনটা যাবে বজবজের দিকে। গার্ড সাহেব মাথাটা বাড়িয়ে একবার দেখে নিলে। পাখাটা নিচু হয়ে আছে। রাস্তা ক্লিয়ার। ইঞ্জিনটা একবার হুইসল বাজালো। দু’পাশের পায়ে চলা পথে তখন তরিতরকারির বাজরা মাথায় দিয়ে ব্যাপারীরা চলেছে বাজারে। বেগুনের আঁকা, মাছের আঁকা। শাকসবৃজির আঁকা। ছোট ছোট আশশ্যাওড়া গাছের ঝোপ। একটা লেভেল-ক্রসিং। সবুজ পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুমটিওয়ালা। পাখাটা নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। লোহার গেটটা বন্ধ। দু’পাশে সার সার গরুর আর মোষের গাড়ি দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
-এ গেটম্যান, গেটম্যান!
এ-সব শোনা অভ্যেস আছে গুমটিওয়ালার। কুড়ি বছর চাকরি হয়ে গেল ভূষণের। চুল পেকে গেল কাজ করতে করতে।
-এ গেটম্যান, গেটম্যান!
লোকে অমন তাগাদা দেবেই। নতুন নতুন মোটরগাড়ি চড়ে সাহেবরা যাবে শহর থেকে শহরতলীতে। ওদিকে যাদবপুর, ওদিকে সাহেবদের ক্লাব আছে যোধপুর কাব। সাহেব-মেমদের ভিড়। গাড়ির পর গাড়ি আসে। গাড়ির আর বিরাম নেই। তোরবেলা থেকে শুরু করে বেলা একটা দুটো পর্যন্ত। তারপর আবার বিকেল থেকে শুরু হয়। দলের পর দল চলেছে। লাল লাল মুখ। দেখলে ভক্তি হয়। সোঁ সোঁ করে লাইন পেরিয়ে চলে যায়। ঝড়ের বেগে। আর শনিবার হলো তো কথাই নেই। ঘোড়দৌড়ের মাঠ আছে ওদিকে। দুপুর বারোটা থেকেই গাড়ির ভিড়। সেদিন আর নাওয়া-খাওয়া হয় না। একটু অসাবধান হলেই একটু অন্যমনস্ক হলেই থার্টি-থ্রি আপ এসে যাবে হুড়মুড় করে। মোষের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে হৈ-চৈ বেধে যাবে। তখন হেড আপিস থেকে ডি-টি আই সাহেব এসে যাবে। বেলেঘাটা থেকে রেলের পুলিস এসে যাবে। তখন হাতে হাতকড়া পড়ে যাবে। চাকরি নিয়ে টানাটানি।
-গেটম্যান তো বড় জ্বালালো দেখছি, ইঞ্জিনের দেখা নেই, এক ঘণ্টা আগে থেকে গেট বন্ধ করে রেখেছে–এই গেটম্যান
ওসব কথা শুনতে গেলে গুমটিওয়ালার চাকরি করা চলে না। বাবুদের মেজাজ বিগড়েই আছে হামেশা। ওসব কথায় গুমটিওয়ালা যদি নিজের মেজাজ বিগড়োয় তো তাতে নিজেরই ক্ষতি। অমন কত বাবু দেখেছে, অমন কত সাহেবসুবো দেখা গেছে। চাকরি তো করতে হয় না তোমাদের বাপু। আছ তোফা। তোমাদের কী! পয়সা আছে ফুর্তি করতে বেরিয়েছ, ঘরে বউ আছে, মেয়েমানুষ আছে, কুকুর আছে, পেছনের বাক্সের মধ্যে মদের বোতল আছে, ক্লাবে যাবে আর গান গাইবে নাচবে রাত বারোটা পর্যন্ত। তারপর রাত পুইয়ে শেষ রাত্তিরের দিকে ফিরে এই গেটম্যানের ওপর তম্বি। আমি তো তোমার চাকর নই বাপু। তোমার মাইনেও খাই না, তোমার ধারও ধারি না। তম্বি দেখাওগে তোমার বাড়ির চাকর-ঝিদের ওপর। আমরা সরকারী লোক। কোম্পানীর চাকর। কোম্পানীর খাই, পরি, কোম্পানীর ধার ধারি। কোম্পানী জুতো মারলে সে জুতো মাথা পেতে নেব। কোম্পানীর জুতো মারবার এক্তিয়ার আছে। হাজার বার এক্তিয়ার আছে। ডি-টি-এস যদি বলে–আমার বাগানটা কুপিয়ে দাও তো ভূষণ, আমি কুপিয়ে দেব। ডি-টি-আই যদি বলে–জুতোজোড়া একটু ঝেড়ে দাও তো ভূষণ, আমি জুতো ঝেড়ে দেব। তারা হলেন গিয়ে মনিব। মনিবের হুকুম একশোবার শুনবো। তাঁরা হলেন মা-বাপ। রবিনসন সাহেব একবার এসেছিল লাইন দেখতে। সাত ফুট চেহারার লম্বা-জোয়ান চেহারা। আসল খাঁটি গোরা সাহেব। খাকী হাফ প্যান্ট পরা। কী সব ইংরিজী বলে–মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। কিন্তু দেবতার মতো মানুষটা। ট্রলি করে এসেছিল। বালিগঞ্জ থেকে বেরিয়ে ট্রলি করে বজবজের দিকে যাবে। জমিদারি দেখতে বেরিয়েছে। কেমন সব কাজ হচ্ছে, কেমন সব চলছে এই আর কি। সঙ্গে মেমসাহেব ছিল। আর ছিল একটা কুকুর। আগের দিন খবর পাওয়া গিয়েছে। ডি-টি-আই সাহেব খবর দিয়ে সাবধান করে দিয়েছিল। বড়সাহেব আসছে! জাদরেল সাহেব, কুর্তা-টুর্তা পরে যেন রেডি থাকে সব। দাড়ি-টাড়ি যেন কামানো থাকে। কালো পাখা সবুজ পাখা–সব যেন সাবান দিয়ে কেচে ফর্সা করা হয়। গুমটি ঘরের আশেপাশে যেন জঙ্গল ঝোপ না থাকে। সাহেব গুমটি ঘরের ভেতরে ঢুকে উঁকি মেরে দেখতে পারে। সব ময়লা নোংরা জিনিস দূর করে দাও। বাতিগুলো মেজে-ঘষে সাফ করে ফেলল। বড়সাহেব আসবে, জাদরেল সাহেব। খুঁত দেখলে আর আস্ত রাখবে না। একেবারে বাঘের বাচ্চা।
সাবধান করে দিয়েছিল ডি-টি-আই সাহেব। কিন্তু আশ্চর্য মানুষ ওই রবিনসন সাহেব।
সাহেব নয় তো, দেবতা। হাসি-হাসি মুখ। ট্রলির ওপর বসেছিল আর মোটা একটা চুরুট খাচ্ছিল। আর পাশেই ছিল মেমসাহেব। মনে মনে একটু ভয়ও হচ্ছিল ভূষণের। ট্রলি গুমটিতে থামাতেও পারে, আবার না-ও থামতে পারে। রবিনসন সাহেবের যদি খেয়াল হয় তো সোজা চলে যাবে কালীঘাট পেরিয়ে একেবারে বজবজের দিকে। হে মা কালী, সাহেব যেন না নামে। হে মা মঙ্গলচণ্ডী, সাহেব যেন সোজা পশ্চিম দিকে চলে যায়। কোথায় কোন্ ফাঁকে খুঁত বেরিয়ে পড়বে গুমটি-ঘরের, আর রিপোর্ট হয়ে যাবে ভূষণ মালীর নামে। তখন চাকরি নিয়ে টানাটানি। কিংবা জরিমানা হয়ে যাবে পাঁচ টাকা।
কিন্তু সাহেব নামলো।
ট্রলিটা এসে থামলো একেবারে গুমটি-ঘরের সামনে রেললাইনের ওপর।
গেট আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল ভূষণ। হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল সবাইকে। ট্রলিটা এসে থামতেই গেট আবার খুলে গেল। আবার গরুরগাড়ি, মোষের গাড়ি সব পার হয়ে গেল। মোটরগাড়িগুলো হুস হুস করে বেরিয়ে গেল।
ভূষণ সোজা গিয়ে সাহেবের পায়ের কাছে খোয়র ওপর ঢিপ করে একটা প্রণাম করলে।
সাহেবের সেদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু দেখলেন মেমসাহেব। আহা, মেমসাহেব নয় তো, যেন জগদ্ধাত্রী। যেমন রূপ তেমনি গড়ন। তেমনি চেহারা। ওই শুধু সিগারেটটা না-খেলেই যেন বেশি মানাতো। কিন্তু নেশা করেছেন, এখন আর উপায় কী! তবু মেমসাহেবকে যেন মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করেছিল। মা বলে হয়তো ডাকতোই ভূষণ। মাকেও একটা প্রণাম ঠুকতে যাচ্ছিল–কিন্তু কুকুরটা তখন ভূষণের দিকে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এসেছে–
চেন-ছাড়া কুকুর। একটু ভয় পাবারই কথা। অবোলা জীব, কথা তো বোঝে না।
মেমসাহেব ডাকলেন–জিম্মি-জিম্মি–
ভাগ্যিস মেমসাহেব দেখেছিলেন, তাই বাঁচা গেল। নইলে খেয়েই ফেলতে কুকুরটা। মেমসাহেবের ডাক শুনেই কুকুরটা একেবারে ল্যাজ গুটিয়ে মেমসাহেবের বুকে উঠে আদর করতে লেগেছে। সে-যাত্ৰা ভূষণ বেঁচে গেল বটে, কিন্তু বিপদ হলো আর একটা। বড়সাহেব তখন ডি-টি-আই সাহেবের সঙ্গে কী ইংরিজী কথা বলছে। লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে এটা দেখছে, ওটা দেখছে। গুমটি ঘরটার দিকে আঙুল দিয়ে কী সব দেখাচ্ছে। ছাদ দিয়ে জল পড়ে ভেতরে দেয়ালটার ফাটল ধরেছে, একটা অশ্বথ গাছ উঠেছে গুমটির মাথায়। সব দেখাচ্ছে ডি-টি-আই সাহেব। পাশে একটা নর্দমা আছে, সেখানে বর্ষার সময় জল জমে। সেই বৃষ্টির জল পচে গন্ধ হয়। শরীর খারাপ হয় কোম্পানীর লোকদের। তারপর আছে সাপের ভয়। নাইট ডিউটির সময় কাজ করা বিপদ। ওই যে স্যার, ওদিকে দেখছেন জঙ্গল। পেছনে এই ঢাকুরিয়া যাবার পথটা যা একটু শহরের মতন। একটা দুটো দোকানপাট আছে। সন্ধ্যেবেলা টিম টিম করে একটু যা কিছু আলো জ্বলে তবু। যারা এ-রাস্তা দিয়ে যায়, তারা সবাই যায় মোটরে। ওদিকে যোধপুর ক্লাব, রেসকোর্স, গলফ ক্লাব–এই জন্যেই এত গাড়ির ভিড় এ রাস্তায়।
ডি-টি-আই সাহেব তখন হাত-মুখ নেড়ে রবিনসন সাহেবকে বোঝাচ্ছিলেন।
ভূষণ ইংরিজী বুঝতে পারে না–কিন্তু হাত-মুখ নাড়া দেখে আন্দাজ করতে পারে সব। এই যে বর্ষা আসছে সামনে, এ সময়ে এ-দিকটা একেবারে জলে ডুবে যাবে। এ নিয়ে ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে করেসপন্ডেস হয়েছে। লেভেল-ক্রসিংটা আজকের নয়। যখন প্রথম রেললাইনটা পাতা হলো তখন এখানে শহরতলী ছিল না। পায়ে হাঁটা পথ ছিল একটা। তখন গুমটিও ছিল না, গেটও ছিল না। গুমটিম্যানও ছিল না। তিনটে অ্যাকসিডেন্ট হয় একই রাত্রে। গুডস্ ট্রেনে কাটা পড়ে মরে তিনজন লোক। তারা ভোরবেলা তাড়ি আনতে যাচ্ছিল। তখন তাড়ির কারবার ছিল পাশীদের। ঢাকুরের জঙ্গলে লম্বা লম্বা তালগাছের জঙ্গল। শুধু ঢাকুরেতেই নয়–ওই যে উত্তর দিকে জঙ্গল-ডোবা দেখছেন, ওখানে তালগাছ রয়েছে। আগের দিন ভোরবেলা ভঁড় বেঁধে দিয়ে আসততা পাশীরা তালগাছের মাথায়। খুলে নিয়ে আসততা পরদিন দুপুরবেলা। দুপুরবেলার রসকেই বলে তাড়ি। আপনাদের দেশে যাকে মদ বলে, এদেশে তারই আর এক রকম মদ হলো তাড়ি। তাড়িটা সস্তা। নেশা হয় ভালো। এধারের এই জঙ্গলের ভেতর বহু লোকের তাড়ির ব্যবসা আছে। এদের জন্যেই প্রথম রেল-কোম্পানীর গেট তৈরি করতে হয়। রাত-বিরেতে কখন কে এ-পথ দিয়ে যাবে ঠিক নেই। তখন থেকেই পাহারা বসাতে হলো।
তখন কলকাতা শহরটা আরো উত্তরে। চৌরঙ্গী পর্যন্ত এসে শহর ওইখানে আটকে গিয়েছিল। এদিকটায় লোক আসততা না। এখানে ছিল ডাকাতের আড্ডা। শহরে মানুষ খুন করে লাশ এনে ফেলে দিত এই জঙ্গলে। সে-লাশ পচে গন্ধ উঠতো। দু-তিন দিন কেউই টের পেত না। পচা ডোবা আর জঙ্গলের মধ্যে কে খোঁজ রাখবে কার। মাইলের পর মাইল পোডড়া জমি আর খানা-খন্দ। এদিকে খুন করলে ওদিকে টের পায় না কেউ। হঠাৎ একদিন হৈ-চৈ হল্লা ওঠে জঙ্গলের ভেতর। ওদিকের বসতির লোকদের কানে যায়। লাঠি দিয়ে ক্যানেস্তারার টিনে শব্দ করে। জঙ্গলের শুকনো ঝোপে আগুন লাগিয়ে দেয়। তবু এদিকে আসতে সাহস পায় না কেউ। বলে–ডাকাতের জাঙ্গাল। ডাকাতের জাঙ্গালের দিকে সন্ধ্যের পর আর কেউ আসতে চায় না। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় এর মাইল চারেকের মধ্যে বসতি ছিল না। ইংরেজ কোম্পানীর শহরে যারা কাজকর্মে যেত, তারা ফিরতো দিনমানে। আর দিনমানেও একলা একলা ফেরা নিরাপদ ছিল না। ফিরতো দলবল নিয়ে। ওই হরিনাভি, বারুইপুর। সোনারপুর, ডায়মন্ডহারবার অঞ্চলের লোকরা আসবার সময় লাঠিসোটা, মশাল, সব সঙ্গে নিয়ে আসততা। ইংরেজ কাছারির কাজকর্ম সেরে বেলাবেলি ফিরে যেতে হবে তাদের। সামনে গরুর গাড়ি, পেছনে গরুর গাড়ি-মাঝখানে কিছু পায়ে-হাঁটা লোক। আর শুধু কি ডাকাত! ডাকাতের চেয়েও ভীষণ সব জন্তু-জানোয়ার ছিল। বাঘ থাকতে ওৎ পেতে। বড় বড় মাথা পর্যন্ত উঁচু হোগলা বন। সেই হোগলা বনের মধ্যে শুধু ডাকাত নয়, শুধু বাঘই নয়। ইয়া ইয়া সাপ। সাপের রাজত্ব ছিল চারিদিকে। সেকালে কে জানতো এখানেও একদিন বসতি গড়ে উঠবে! এখানেও একদিন কোম্পানীর রেললাইন বসবে! এখানেও একদিন হু হু করে সাহেব-মেমদের মোটরগাড়ি চলবে! এখানেও বিজলী বাতি, কলের জল, টিউবওয়েল, কলকারখানা বসবে! এখানেই, এই এখানেই একদিন লেক হবে। শহরের গণ্যমান্য লোক এখানে বেড়াতে আসবে হাওয়া খেতে।
যখন প্রথম রেললাইন হলো-সে-ও অনেকদিন আগের কথা। তুমি আমি কেউই তখন জন্মাইনি। ওই বেলেঘাটা থেকে লাইন এসে মিশললা বালিগঞ্জ ইস্টিশানে। প্রথমে ওই পর্যন্তই ছিল। তারপর একদিন বজবজে পেট্রল কোম্পানীর ট্যাঙ্ক বসলো। কোম্পানীর আপিস হলো সেখানে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় তখন সবে নতুন গাড়ি আসতে শুরু করেছে। কয়েকজন সাহেবসুবো গাড়ি কিনলে। সেই গাড়ি শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় এধার থেকে ওধার। লোকে হাঁ করে চেয়ে দেখে। দিশী পাড়ার ছেলেমেয়েরা মোটরগাড়ির শব্দ শুনলেই দৌড়ে আসে গলির সামনে। ভিড় জমে যায় চারধারে। বুড়োরা আপিস যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চারটে রবারের চাকা, তার ওপর একটা বাক্স মতন খাঁচা। মাথার চাটা ইচ্ছে করলে খুলে ফেলা যায়। আবার দরকার হলে ঢেকে দেওয়াও চলে। রোদ-বৃষ্টি হলে চাটা তুলে দাও, তারপর গায়ে রোদ লাগাবার ইচ্ছে হলে খুলে ফেলো।
বি এন আর কোম্পানীর বেভারলি সাহেবই প্রথম গাড়ি কিনলে।
সেদিন আর কাজকর্ম হলো না আপিসে। সারা আপিস ভেঙে বাবুরা গাড়ি দেখতে এলো। চুচড়ো, রানাঘাট, উলুবেড়ে থেকে যারা পায়ে হেঁটে নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে আপিসে আসে, তারা হাঁ করে দেখতে লাগলো। প্রথমে শহরে একখানা-দুখানা গাড়িই ছিল। এধার থেকে ওধারে গেলে পাড়াময় লোক জড়ো হতো। তারপর গাড়ি বাড়লো। নানা ধরনের, নানা রং-এর গাড়ি। গাড়িতে নম্বর লাগাবার নিয়ম হলো। গাড়ির তলায় লোক জন চাপা পড়তে লাগলো। গাড়ির ভিড়ে রাস্তা চওড়া করতে হলো। শেষে টান পড়ল পেট্রলে। পেট্রল আসততা আগে জাহাজে করে। খিদিরপুর জেটিতে তেলের পিপে ভর্তি জাহাজ লাগতো। সেই পিপে সাবধানে নিয়ে যাওয়া হতো গুদাম-ঘরে। একবার সেই তেলে আগুন লেগে সে কী কাণ্ড! সারা জাহাজখানা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। বোমা ফাটার মতো দুমদাম আওয়াজ হতে লাগলো। কত লোক কুলি-কাবারি যে মারা গেল। আর তেল আসততা রেলগাড়িতে। মালগাড়িতে ক্যানেস্তারার টিনে সিল করা তেল আসততা। এসে শালিমারের গুদামে ভর্তি হতো। তারপর সেই টিন কিনে নিয়ে গাড়ির ট্যাঙ্কে ঢালো। তখন আবার গাড়ি গড় গড় করে গড়িয়ে চলবে।
তারপর যেবার পাইপলাইন হলো বজবজে, সেইবার হলো এই লাইন। রেলের বড়সাহেবরা জমি জরিপ করতে এলেন। ইঞ্জিনীয়ারারা এলেন। ওই বেলেঘাটা থেকে বন-জঙ্গল কাটতে কাটতে রেলের ইঞ্জিনীয়ার ওভারসিয়াররা উঁচু-নিচু সমতল করে দিলে। দুপাশে তারের বেড়া লাগিয়ে দিলে। বন থেকে কত সাপ বেরুল। সাপের কামড়ে মরলো কত লোক। বালিগঞ্জ ইস্টিশান হলো। বাবুদের কোয়ার্টার হলো। কুলিদের বস্তি হলো। জলের পাম্প বসলো। বেলেঘাটা থেকে মালগাড়িতে ভর্তি হয়ে এল লোহা-লক্কড়, এল স্কু, এল নাট-বল্ট, এল ফিশ-প্লেট, এল হাতুড়ি, হাপর, কোদাল সব। এই এখানকার তালগাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাইন পাততে পাততে চললো ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। সিগন্যাল বসলো, টেলিগ্রাফের পোস্ট বসলো, স্লিপার বসলো। তারপর এসে পৌঁছুলো এই এখেনে। এই ঢাকুরিয়া আর গড়িয়াহাটার লেভেল ক্রসিং-এর কাছে।
এই যেখান থেকে আমাদের গল্পের শুরু।
আসলে এ জায়গাটা গল্পের শুরুও বটে আবার গল্পের শেষও বটে।
শেষটাই আগে বলে নেওয়া ভালো। তাতে আগ্রহ বাড়ে। বড়বার ধৈর্য থাকে। নইলে শুরু থেকে শুরু করলে কে পড়বে মন দিয়ে! আজকাল, এই ব্যস্ততার যুগে কার এত ধৈর্য! কে পড়বে এত বড় উপন্যাস! কবে কেমন করে নায়ক বড় হলো, কবে লেখাপড়া শিখলো, কবে বিয়ে-থা করলো, কবে মারা গেল–তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিবৃত্ত জানবার দায় নেই কারো। যেমন দায় ছিল না ভূষণ মালীর, যেমন দায় ছিল না ডি-টি আই সাহেবের, আর যেমন দায় ছিল না রবিনসন সাহেবের। বড় থেকে ছোট সবাই কোম্পানীর চাকর। কেউ বড়-চাকর, আবার কেউ ছোট-চাকর। কোন্ দূর দেশ সেটা। স্কটল্যান্ড না ইংল্যান্ড কেউ জানে না। হয়তো লন্ডনের কিংবা বার্মিংহামের কোন রোড সাইড ইস্টিশানের কেবিনম্যান ছিল প্রথমে। তারপর কোম্পানীর দৌলতে এখানে এসে একেবারে এক লাফে ডি-টি-এস হয়ে বসেছে পায়ের ওপর পা তুলে। সঙ্গে জাহাজে করে এসেছে মেমসাহেব আর এসেছে একটা বাঘা কুকুর।
ডি-টি-আই সাহেব তো মন দিয়ে বোঝাচ্ছিল। কিন্তু রবিনসন সাহেব কী বুঝছিল ভগবানই জানে।
শুনছি ওদিকটায় এই উত্তরদিক বরাবর একটা লেক হবে। ওসব জঙ্গল সাফ হয়ে যাবে শিগগির। ওদিকে আর জমি বিক্রী করছে না ক্যালকাটা করপোরেশন। ওদিকে সেই ভবানীপুর পর্যন্ত শহরের চেহারা একেবারে নাকি বদলে যাবে। ওদিকে খিদিরপুর, তারপর কালীঘাট, তারপর এদিকে কস্বা, মাঝখানের এই জঙ্গলটা সাফ করে দিলে কলকাতা শহরের ভোল একেবারে পাল্টে যাবে স্যার। তখন ওই ঢাকুরের দিকেও বসতি হবে, লোক্যালিটি হবে। তখন এই রাস্তায় ট্রাফিক বেড়ে যাবে। এই আমাদের সরু লেভেলক্রসিং-এ আর কুলোবে না। বম্পাস সাহেব সেই রকম নোট দিয়েছে–এই দেখুন স্যার, ফাইল দেখুন। এই প্ল্যান্ এনক্লোজ করে দেওয়া আছে। প্ল্যান্ দেখলেই বুঝতে পারবেন এ-জায়গাটা ফিউচারে কত ইম্পর্টেন্ট হয়ে উঠবে। বম্পাস্ সাহেব লিখেছে–এখানে একটা স্টেশন করলে ভালো হয়। আমাদের প্যাসেঞ্জার ট্র্যাফিকও বাড়বে তাতে। ওদিকে বালিগঞ্জ আর পশ্চিমে কালীঘাট-এই তেরো ফারলং ডিসট্যান্স এর মধ্যে একটা স্টেশন করে সাইডিং তৈরি করলে সেকশন্ ক্যাপাসিটিও বাড়ে।
রবিনসন সাহেব কথাটা বুঝতে পারলেন না। বাঁ হাতটা তেরছা করে নেড়ে বললেন–ইউ মিন্ আওয়ার রেলওয়ে স্টেশন?
ডি-টি-আই সাহেব বললেন–ইয়েস স্যার–
রবিনসন সাহেব খাস বিলিতি রোডসাইড স্টেশনের কেবিনম্যান ছিল। তাঁর সঙ্গে মেমসাহেব আছে, বিলিতি কুকুর আছে। আর ওদিকে সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছিল। টি-টাইমটা উতরে গেছে কাজ করতে করতে।
বললেন—ননসেন্স–
রবিনসন সাহেবের সেই জাঁদরেল গলায় ননসেন্স’ বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন হঠাৎ সমস্ত আবহাওয়াটা একটা বিকট আর্তনাদ করে উঠলো। আর মেমসাহেব ছিল পেছনে। মেমসাহেবও হাউ-মাউ করে উঠেছে। ডি-টি-আই সাহেবও পেছন ফিরে হতবাক। রবিনসন সাহেবেরও এতক্ষণ কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। কাজ করতে করতে নাওয়া-খাওয়া টি-টাইমও ভুল হয়ে যায় তার। তিনিও ফিরে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। ভূষণ মালী এতক্ষণ সাহেবদের পেছনে পেছনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে মাথামুণ্ডু সব শুনছিল। সেও দৌড়ে গেল পেছন দিকে।
পেছন দিকে মানে উত্তর দিকে। একটা কাঁটা ঝোপ, একটু পচা ডোবা মতন সেখানটা। ঠিক সেইখানে রবিনসন সাহেবের কুকুরটা মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। তখন তার গলা দিয়ে আর চেঁচাবারও মতা নেই। ভূষণ দৌড়ে কাছে গেছে। কিন্তু তার আগেই মেমসাহেব সেই সিল্কের গাউন নিয়েই মাটিতে বসে কুকুরটাকে কোলে তুলে নিয়েছেন।
–জিম্মি, ডিয়ারি, জিম্মি–
ডি-টি-আই সাহেব, রবিনসন সাহেব দুজনেই এসে পড়লেন। কুকুরটার দশা দেখে মেমসাহেব হাউ-মাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছেন। রবিনসন সাহেবও মাটিতে বসে পড়ে কুকুরটাকে ধরতে যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ ভূষণ মালী চেঁচিয়ে উঠেছে–সাপ, সাপ–
ডি-টি-আই সাহেবও রবিনসন সাহেবকে হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়েছে–স্নেক স্যার-স্নেক–
একটা কালকেউটে! যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে সাপটা ফণা তুলে দেখলে। খানিকক্ষণ। তারপর আবার এঁকে বেঁকে নিঃশব্দে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভূষণ মালীর এখন আরো বয়েস হয়েছে। সেদিনকার সে-গুমটিও আর নেই, সে গুমটিঘর, সেও নতুন গুমটিঘর হয়েছে। ওখানে রাস্তা চওড়া হয়েছে। ইলেকট্রিক আলো হয়েছে। হাত দিয়ে আর গেট বন্ধ করতে হয় না। এখন বোতাম টিপলেই গেটটা আস্তে আস্তে আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। গুমটিঘরে টেলিফোন হয়েছে। কেবিন থেকে হুকুম আসে টেলিফোনে। টেলিফোনে হুকুম পেলে তবেই গেট বন্ধ করতে হয়। সেই জলাও আর নেই তেমন। ঝোপ-ঝাড় অনেক সাফ হয়েছে, ওধারে পাকা বাড়ি হয়ে গেছে। রাত বিরেতেও আলোয় ঝলমল হয়ে থাকে জায়গাটা। গাড়ির যাতায়াত বেড়েছে। লোকের আনাগোনা বেড়েছে। ওধারে লেক হয়েছে। সাঁতার কাটবার পুকুর হয়েছে। সাহেবদের বাচ খেলবার ক্লাব হয়েছে। একটা মন্দির হয়েছে। বুদ্ধদেবের মন্দির। দেখতে দেখতে কত কি বদলে গেল। চোখের সামনে সারা সংসারটাই বদলে গেল। সে-পৃথিবীটা আর নেই। সেই চাকরির সুখও নেই আগেকার মতো। সেই রবিনসন সাহেবও আর নেই। কুকুরটা মারা যাবার পরই সাহেবের কী যে হলো, সাহেব মেমসাহেবকে নিয়ে দেশে ফিরে গেল–আর এল না। ফিরে এল না সাপের ভয়ে না কুকুরের শোকে তা কেউ জানে না। সে-রকম সাহেব কিন্তু আর হলো না। অনেককে জিজ্ঞেস করেছে রবিনসন সাহেবের কথা। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনি। তার জায়গায় কত নতুন ডি-টি-এস এসেছে গেছে, কিন্তু সে-রকম ডি-টি-এস আর হয়নি। হেড-আপিস থেকে কেউ এলেই ভূষণ জিজ্ঞেস করে–রবিনসন সাহেব ফিরেছে হুজুর?
সবাই বলে–না—
তারপর জিজ্ঞেস করে–কেন, রবিনসন সাহেব তোমার কী করবে?
-না, এমনি জিজ্ঞেস করছি।
–রবিনসন সাহেবই বুঝি তোমায় চাকরি দিয়েছিল ভূষণ?
ভূষণ বলে–আজ্ঞে না হুজুর, রবিনসন সাহেবের কুকুরটাকে এখানে সাপে কেটেছিল কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি–
ভূষণ মালী শুধু একলাই গেটম্যান নয়। আসলে তিনজন গেটম্যান পালা করে ডিউটি করে। আটঘণ্টা করে ডিউটি। সমস্ত দিনের ডিউটি তিনজনের। তিন আষ্টে চব্বিশ। ভূষণ মালী ছাড়া মঙ্গল দেও আছে। আর আছে দেওকীনন্দন। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে। বিকেল চারটে থেকে রাত বারোটা। তারপর রাত বারোটা থেকে সকাল আটটা। এমনি ঘুরে ফিরে ডিউটি পড়ে। কাজ বেশি তেমন কিছু নয়। ওই কেবল। গেট পাহারা দিয়ে পড়ে থাকা। ওইটেই আসল কাজ। তারপর বোতাম টিপলেই গেট বন্ধ হয়ে যাবে। সে তেমন কিছু হ্যাঁঙ্গামের ব্যাপার নয়। তিনজনের ডিউটি। পালা বদল করে কাজ করো। আপোসে মিলে মিশে কাজ। কারো শহরে কাজ থাকে তো আর একজনকে বলে গেলেই হলো। তার হয়ে ডবল ডিউটি করে দেবে। সকাল আটটা থেকে টানা রাত বারোটা পর্যন্ত একজনই ডিউটি করে দেবে।
বালিগঞ্জ ওয়েস্ট কেবিন থেকে হুকুম হবে-থাটি-থ্রি আপ, লাইন ক্লিয়ার—
দেওকীনন্দন ফোন ধরে বললে—হাঁ—হুজুর–
কেবিনম্যানের টেলিফোনটা ছাড়তে গিয়ে হঠাৎ কী যেন একটা সন্দেহ হবে। বলবে-কে রে, দেওকীনন্দন?
–জী হাঁ
কেবিনম্যান বলবে–কেন, এখন তো মঙ্গল দেও’র ডিউটি–মঙ্গল কোথায় গেল?
–হুজুর মঙ্গল কলকাতা গেছে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, আমি ডবল ডিউটি করছি।
–আর ভূষণ?
ভূষণের সেকেন্ড নাইট হুজুর–রাত বারোটায় আসবে–
আসলে তিনজন গেটম্যান হলেও ভূষণের কথাই বেশি করে বলা। কারণ ভূষণের ডিউটিতেই ঘটনাটা ঘটেছিল। তখনও ছিল তার সেকেন্ড-নাইট ডিউটি। সেবার হলো কী, জেনারেল ম্যানেজার লাইন দেখতে বেরোবে। এখন বছরে একবার লাইন দেখা নিয়ম। সেদিন ইস্টিশান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হবে। স্টেশন মাস্টার সেদিন কাঁচানো ইউনিফর্ম পরবে, মাথায় টুপি দেবে। মাল-গুদামে সাজানো-গোছানো থাকবে মালের বস্ত। সেদিন ঝকঝক্ ততক্ করবে প্লাটফরম। একটু ধুলোবালি খুঁজে পাবে না কেউ। কোথাও। স্টেশন মাস্টার নিজে বেরোবে দেখতে। আউটার সিগন্যাল ভালো করে চলছে। কিনা। কেবিনে উঠে লিভার টেনে টেনে দেখবে। জেনারেল ম্যানেজার যদি খুঁত পায় কোথাও তো রিপোর্ট হয়ে যাবে। পার্সোন্যাল ফাইলে দাগ পড়ে যাবে। চাকরির উন্নতির রাস্তা চিরকালের জন্য বন্ধ। সুইপারকে ডেকে হুশিয়ার করে দেবে, কেবিনম্যানকে ডেকে সাবধান করে দেবে। সবারই হর্তাকর্তা-বিধাতাপুরুষ আসছে। কারো রেহাই নেই। সঙ্গে থাকবে সব ডিপার্টমেন্টের কর্তারা। চীফ ইঞ্জিনীয়ার থাকবে, চীফ মেডিক্যাল অফিসার থাকবে। ট্রাফিক ম্যানেজার থাকবে, ডি-টি-এস থাকবে। আরো অনেকে থাকবে। একখানা স্পেশ্যাল ট্রেন ভর্তি বড়সাহেবরা থাকবে। ট্রেনটা বেলেঘাটা ছাড়বে বেলা দেড়টায়। দুপুরবেলার খাওয়া খেয়ে বেরোবে সবাই। তারপর বালিগঞ্জে এসে পৌঁছোবে পৌনে দুটোয়। বালিগঞ্জে হল্ট আছে আধঘণ্টা। আধঘণ্টার মধ্যে ইস্টিশানের যাবতীয় কাজকর্ম দেখা শেষ করে স্পেশ্যাল ট্রেন ছাড়বে দুটো পনেরো মিনিটে। তারপর ঢাকুরিয়া। ঢাকুরিয়ার পর সোনারপুর। এমনি পর পর লাইন দেখতে দেখতে সোজা চলে যাবে ডায়মন্ডহারবার। সার্কুলার বেরিয়ে গেছে সাতদিন আগে থেকে। সারা সেকশানে শোরগোল পড়ে গেছে। যার যা অভাব অভিযোগ এই সময়ে বলবে বড়সাহেবদের। বছরে এই একটা সময়। এই সময়ে কারো প্রমোশন হয়, কারো জরিমানা হয়, কারো নিচু ধাপে নামতে হয়।
ভূষণ কেবিনবাবুকে জিজ্ঞেস করে–এসপেশ্যাল এদিকে আসবে না হুজুর?
কেবিনম্যান বলে–না রে, তোরা বেঁচে গেলি এ-ধাক্কা, ও ডায়মন্ডহারবারের দিকে যাবে প্রথমে, তারপর যাবে লক্ষ্মীকান্তপুর
–আর বজবজ সেকশান?
কেবিনবাবু বলে–সে এখনও সার্কুলার পাইনি–
এদিকে কথা নেই বার্তা নেই, ঠিক ঝোপ বুঝেই কোপ। বর্ষাকাল নয় কিছু নয়। সকালবেলাও কিছু বোঝা যায়নি। একটু একটু কুয়াশা মতন ছিল। সকাল আটটার সময়ও অন্ধকার-অন্ধকার ভাব। যত বেলা বাড়তে লাগলো ততই অন্ধকার হতে লাগলো। বৃষ্টি তখনও পড়েনি, কিন্তু ভিজে ভিজে হাওয়া দিচ্ছে জোরে। বেলেঘাটা স্টেশন তবু জমজমাট। বোয়া-মোছা হয়েছে প্লাটফরম। জাদরেল-জঁদরেল সাহেবরা এসে গাড়ি থেকে নামলো। কিন্তু জেনারেল ম্যানেজার আর আসে না। হাতঘড়ি, প্লাটফরমের ঘড়ি, সব ঘড়ি মিলিয়ে দেখা হলো। ঘড়ির বড় কাঁটাটা ছটার ঘর পেরিয়ে গেছে। এমন তো দেরি হয় না কখনও।
কিন্তু এসে পড়েছেন তিনি।
বালিগঞ্জের নর্থ কেবিন থেকে কেবিনম্যান ফোন তুলে ধরলে-হ্যাল্লো কে? লাহিড়ী? কী হলো? জেনারেল ম্যানেজারের কি হলো? স্পেশাল ক্যানসেলড নাকি?
ওদিক থেকে উত্তর এল–ওই এসে গেছে, এই এখুনি এল হে, বড় সাহেবদের কারবার, এই লাইন-ক্লিয়ার পেলাম
ট্রেন ছেড়ে দিলে। লেট করেই ছাড়লো। কিন্তু ড্রাইভার পাকা। আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস চালিয়েছে একদিন। এই সেবার ভাইসরয়ের স্পেশ্যালও চালিয়েছে। ইঞ্জিনটাও মজবুত। মনের মতো যন্ত্র পেয়েছে–সুতরাং হু হু করে দেখতে-না দেখতে বালিগঞ্জ এসে পড়েছে। স্টেশনে তখন স্টেশন মাস্টার নিজে লালপাখা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চার বোগির স্পেশ্যাল। ঠিক মাপে মাপে দাঁড়িয়েছে ট্রেনটা। বালিগঞ্জ স্টেশনে নামবে সবাই। সব দেখাশোনা করবে। মাল-গুদাম দেখবে। স্টেশন দেখবে। গাড়ি থেমে রইল কিছুক্ষণ। প্লাটফরমের ওপর জলের ছিটে দেওয়া হয়েছে–ধুলো যেন না ওড়ে।
স্টেশন মাস্টার অভ্যর্থনা করবার জন্যে এগিয়ে গেলেন। আজ তিনি রেলের কোট পরেছেন। পুরাদস্তুর স্টেশন মাস্টার।
কিন্তু কেউ নামে না।
কী হলো? হলো কী?
স্টেশন মাস্টার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। চীফ মেডিক্যাল অফিসার বড় ব্যস্ত। এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছেন। হাতে ওষুধের শিশি, গলায় স্টেথিসকোপ।
হঠাৎ তারপর আরো জোরে বৃষ্টি নামলো। অকাল বর্ষণ। অন্ধকার করে এলো। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে দুপুরবেলা। কাঁপুনি ধরে সারা গায়ে।
হঠাৎ সেন-সাহেব নামতেই স্টেশন মাস্টার এগিয়ে গেছেন সাহস করে।
বললেন–স্যার কী হলো, ইনসপেকশান হবে না?
সেন-সাহেব পুরোন লোক। অনেকদিন আগে চাকরিতে যখন নতুন ঢুকেছিলেন, তখন আসতেন মাঝে মাঝে। বেশ সুন্দর চেহারা। বছর পনেরো আগের কথা। স্টেশন মাস্টার তখন সবে নতুন বদলি হয়ে এসেছেন। অনেক ঘাটের জল খেয়ে, অনেক ডুব সাঁতার কেটে এখানে তখন সবে এসেছেন। একদিন এই সেন-সাহেবই এলেন ডি-টি আই হয়ে। তখন জাদরেল সাহেব ছিল রবিনসন। রবিনসন সাহেবের নামে সারা লাইন। কাঁপতো। এক-একদিন সকাল বেলা ডিউটিতে এসেছেন আর বাড়ি গেছেন রাত এগারোটার পর। কেবল স্টেটমেন্ট চাই। ওয়াগনের হিসেব দাও। নানা ফাই, নানা ফরমাজ। হেড-আপিসের জ্বালায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এই যে বালিগঞ্জ ইস্টিশানের দুপাশে এই ভিড়–এসব কোথায় ছিল! গেটের ধারে গোটা দশেক দোকান শুধু। একটা দোকান ছিল–পরোটা আলুর দমের। পরোটা আর আলুর দম লোকটা করতো ভালো। বৈঠকখানার বাজার থেকে আলু-কপি বাজার করে নিয়ে আসততা। আর একটা মস্ত কাঠের পিঁড়ির ওপরে ঘি দিয়ে পরোটা বেলতো উবু হয়ে বসে। ইস্টিশানের পোর্টার গিয়ে এক-একদিন বলতো–দুটো গরম পরোটা দেখি–
পরোটাওয়ালার নাম এখন আর মনে পড়ে না।
–কার জন্যে পরোটা চাই–কে খাবে গো?
পোর্টার বলতো–মাস্টারবাবু, আমাদের নতুন মাস্টারবাবু–
মাস্টারবাবু তখনও কোয়ার্টার পায়নি এখানে। পরিবারও আনেনি। হোটেল থেকে রুটি-পরোটা খেয়ে দিন কাটছে। আর ওয়েটিংরুম-এর ভেতরে রাত্রে শোবার ব্যবস্থা। তা মাস্টারবাবুর নাম শুনে আর দাম নিতে চায় না বেটা। চেয়েছিল দুখানা পরোটা। দিলে চারখানা। সঙ্গে একথাবা আলুর দম ফ্রি। দেখেই মজুমদারবাবু অবাক।
বললেন–কেন, দাম নিলে না কেন?
খালাসী বললে–দাম নেবে কেন হুজুর, দাম নেবার কি মুরদ আছে ওর–
-কেন, মাল দেবে দাম নেবে না? দানছত্তোর খুলে বসেছে নাকি?
–হুজুর, পরোটার দাম নিলে ও কি আর বিনা-টিকিটে ট্রেনে চড়তে পারবে? বৈঠকখানা বাজার থেকে আলু আনে কপি আনে–কোনও দিন কি টিকিট কেটেছে ও? পরোটার দাম নিলে গলায় গামছা দিয়ে ওর টিকিট আদায় করবো না?
তখনকার কথা আলাদা। পেছনের ওই যেখানে এখন ট্রামলাইন বসেছে, দিনরাত ঘড় ঘড় শব্দে কান পাতা দায়, ওইখানে শেয়াল ডাকতো। ওখান থেকে একেবারে সেই কালীঘাটের কেওড়াতলা শ্মশান-ঘাট পর্যন্ত শুধু জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে শুধু সরু সরু পায়ে চলা মেঠো পথ। সন্ধ্যের পর ওদিকে যেতে ভয় করতো। সস্তায় কত জমি বিক্রি হয়ে গেল ওদিকে। টাকা থাকলে মজুমদারবাবু তখন যদি ধরে রাখতে তো আজ ভাবনা! সেই সময়ে স্যার সুরেন বাঁড়ুজ্জে এসেছিলেন জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতা দিতে। তিনি প্রথম বলেছিলেন–কালীঘাট থেকে বালিগঞ্জে স্টেশন পর্যন্ত ট্রাম চলবে শিগগির–
বালিগঞ্জ স্টেশনের কামরাটার মধ্যে তখন মজুমদারবাবুর সামনে কাজের পাহাড়। কোনও দিকে দৃষ্টি দেবার সময় নেই। টেবিল ভর্তি কাগজ-পত্র ফাইল। কোন্ কাজটা আগে করবেন তার ঠিক নেই। একগাদা ইনভয়েস। একগাদা ইনডেমনিটি বন্ড-চোখে নাকে তখন দেখতে পাচ্ছেন না। রবিনসন সাহেব জাদরেল লোক হোক, মায়া-দয়া ছিল তার। গড়িয়াহাটার লেভেল ক্রসিং-এ সেবার তার কুকুরটাকে সাপে কামড়াবার পর আর এখানে থাকলেন না–রিটায়ার করে দেশে চলে গেলেন। সেই জায়গায় এল ঘোষাল সাহেব। বাঙালী হলে কি হবে! একেবারে জাত-বদমাইশ। রোজ একজনের চাকরি না খেয়ে আর জলগ্রহণ করতে না ঘোষাল-সাহেব। হেড-আপিসে কতদিন দেখা করতে গিয়ে দেখেছে ঘোষাল-সাহেব চীৎকার করছে–গেট আউটগেট আউট–
গড়িয়াহাটার লেভেল-ক্রসিং-এ একবার একটা লোক কাটা যায়। সাক্ষী দিতে হয়েছিল মজুমদারবাবুকে। সঙ্গে ছিল গেটম্যান ভূষণ। আর কেবিনম্যান করালীবাবু। তিনজনেই হেড আপিসের ঘোষাল-সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। ঘোষাল-সাহেবের ওপরই চাকরি নির্ভর করছিল তিনজনের। এক-কলমের খোঁচায় তিনজনের চাকরি চলে যেত।
উঁকি মেরে ঘোষাল-সাহেবের ঘরের দিকে দেখতেই ঘোষাল-সাহেব চীৎকার করে উঠেছিল–গেট আউট। গেট আউট–
গেট আউট-ই ছিল ঘোষাল-সাহেবের বুলি।
করালীবাবু বলেছিলেন–এত সাহেব মরে আর ঘোষাল-সাহেব মরে না রে–
ভূষণ বললে–রবিনসন সাহেব বড় ভালো লোক ছিল হুজুর–রবিনসন সাহেবের মেমসাহেবও ভালো ছিল সেই সাহেব থাকলে আজ আর ভাবনা–আমি তো মেমসাহেবের পা জড়িয়ে ধরতুম গিয়ে–
বাইরে গোলমালের আওয়াজ শুনেই একজন মেয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। বেশ সাজা-গোজা। চমৎকার চেহারা। সিথিতে সিঁদুর। সিল্কের শাড়ি পরনে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
বললে–আপনারা এখানে গোলমাল করছেন কেন, ঘোষাল-সাহেব রাগ করছেন—
মজুমদারবাবু এগিয়ে বলেছিলেন–আমরা ঘোষাল-সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করতে এসেছিলাম, গড়িয়হাটা লেভেল-ক্রসিং-এর রান-ওভারে কেস্টার জন্যে
তিনি বলেছিলেন–তা যখন এনকোয়ারি হবে তখন আসবেন, এখন যান—
বলে আবার ভেতরে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
করালীবাবু বললেন–এঁকে চিনতে পারলেন তো মাস্টার মশাই–
-না তো!
করালীবাবু মুচকি হাসলেন।
বললেন–আরে চিনতে পারলেন না–ইনিই তো সেই ইয়ে-ঘোষাল সাহেবের ইয়ে–
যাক গে, ওসব ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো। সেই একদিনের একটুখানি দেখা। বড় সাহেবদের ঘরের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর অভ্যেস মজুমদারবাবুর নেই। মজুমদারবাবুর নিজের ঘরের ব্যাপার নিয়ে কে মাথা ঘামায় তার ঠিক নেই। চাকরি করতে এসেছেন পেটের দায়ে, চাকরিটা বজায় থাকলেই হলো। কবে সেই বালিগঞ্জের জঙ্গর কেটে তাঁরই চোখের সামনে শহর গজিয়ে উঠলো রাতারাতি তাও তিনি টের পাননি। কবে লেক হলো তাও জানতে পারেননি। একদিন বেড়াতে বেড়াতে ওদিকপানে গিয়ে সব দেখেশুনে তো অবাক। সেই লেভেল-ক্রসিং আর চেনা যায় না। বুদ্ধদেবের মন্দির হয়েছে একটা। কত বাড়ি হয়ে গেছে। হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখতে। লাগলেন। প্রথমে বালিগঞ্জে আসবার পর একবার সাউথ কেবিন-ঘুরে ঢুকেছিলেন তারপর পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন লেভেল-ক্রসিংটা পর্যন্ত। তারপর ওদিকে আর যাবার প্রয়োজনই হয়নি। ভূষণ দেখালে কোনখানটা রবিনসন সাহেবের কুকুরকে সাপে কামড়েছিল–কোন্খানটায় মাটির ওপর বসেছিল মেমসাহেব। আহা সে-সব সাহেবই। ছিল আলাদা। তারা দেবতার মতো মানুষ ছিল, তাদের দরদ ছিল, বাবুদের বাড়ির খবর। নিত।
করালীবাবু বলতেন–আমার মেয়ের বিয়ের সময় অস্বর সাহেব কলাপাতা পেতে লুচি খেয়ে গিয়েছিল, জানেন মাস্টার মশাই–আপনি তখন আসেননি–
ভূষণ বলেছিল-রবিনসন সাহেবের মেমসাহেবকে দেখেছি হুজুর, আহা, কী চেহারা। যেন জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ–
মজুমদারবাবু বলতেন–আমাদের সেন-সাহেবও লোক ভালো করালীবাবু গরীবের ছেলে কিনা, পরের দুঃখুটা বোঝে–
তা সেবার শেষ পর্যন্ত সেন-সাহেবই বাঁচিয়ে দিয়েছিল সবাইকে।
ঘোষাল-সাহেবের পাশের ঘরখানাই সেন-সাহেবের ঘর। সেন-সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন–এখানে কি করছেন আপনারা
মজুমদারবাবু বললেন–সেই রান-ওভার কেস্টা নিয়ে একবার ঘোষাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি স্যার
-আপনি কে?
মজুমদারবাবু বললেন–আমি বালিগঞ্জ স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, আর এই হলো গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর গেটম্যান ভূষণ, আর এ হচ্ছে সাউথ কেবিনের কেবিনম্যান করালীভূষণ সরকার-আপনি যদি ঘোষাল-সাহেবকে একটু বলে দেন স্যার।
-আপনারা ঘোষাল-সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছেন নাকি?
মজুমদারবাবু বললেন–দেখা কী করে করবো স্যার, ওঁর ঘর থেকে কে একজন বেরিয়ে এলেন, ওঁর পি-এ বোধহয়…।
সেন সাহেব বাধা দিয়ে বলেছিলেন–বুঝতে পেরেছি, আপনারা চলে যান, আমি চেষ্টা করে দেখি কী করতে পারিবাড়ি যান এখন
তা সেবার সেই সেন-সাহেবের জন্যেই বিপদটা কেটে গিয়েছিল। সেন-সাহেবের জেরার জোরে সেবার এনকোয়ারিতে খালাস পেয়ে গেলেন তিনজনেই। ভূষণ বাইরে এসে সেন সাহেবের পা জড়িয়ে ধরলে।
বললে–হুজুর, আপনি আমার মা-বাপ হুজুর, আপনার মঙ্গল হবে হুজুর, ভগবান আপনাকে অনেক দেবে হুজুর
সেন-সাহেব অতি কষ্টে পা ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন–ছাড় ছাড় পা ছাড়া ভূষণ, পা ছাড়, আমি কে, আমি কেউ না—
ছোকরা সাহেব, কিন্তু বাপের বেটা বটে। সেন-সাহেবের কাছে যে গেছে, সেন-সাহেবকে যে ধরতে পেরেছে তেমন করে, সে আর খালি হাতে ফেরেনি। সাহেব বটে সেন-সাহেব। সারা লাইনময় সেন-সাহেবের প্রশংসা। ওদিকে রাণাঘাট, বনগাঁ, শিলিগুড়ি, ঢাকা, ময়মনসিং থেকে শুরু করে শেয়াল’দর সব স্টাফ একবাক্যে সেন-সাহেবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সত্যিই সাহেবের বয়েস কম, এখনও বেশি দিনের চাকরি নয়। সামান্য ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিল হেড-আপিসে। কিন্তু দেখতে দেখতে একদিন ডি-টি-আই হয়ে গেল। রবিনসন সাহেবের বড় পেয়ারের ডি-টি আই। যেখানেই রবিনসন সাহেব যাবে, সঙ্গে যাবে ডি-টি-আই সেনসাহেব। রবিনসন সাহেব চলে যাবার পর সেই পোস্টে এল ঘোষাল-সাহেব। কিন্তু বেশি দিন টিকলো না ঘোষাল সাহেব।
করালীবাবু বললেন–শুনেছি—
মজুমদারবাবু বললেন—শুনেছি–
-আর শুনেছেন সেই মাগীটার কাণ্ড? সেই যে সিঁদুর পরা, সেই ফরসা মতন মেয়েটা, আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল–তার কী কাণ্ড শুনেছেন?
মজুমদারবাবু বললেন–কই না, শুনিনি তো কিছু–
তা না-শুনেছেন তো শুনে আর কাজ নেই। পরে সবই শুনতে পাবেন, পরে সবই জানতে পারবেন। শুধু আজ বলে নয়, এমন ঘটনা চিরকালই ঘটে। চিরকাল ধরেই ঘটে আসছে। লাইনের একমুড়ো থেকে আর একমুড়ো পর্যন্ত সেই প্রসঙ্গই চলতে লাগলো কদিন ধরে। একদিন লোহা-ইঞ্জিন-কেবিন-ওয়াগন লাইন ক্লিয়ারের মধ্যেও আবার রোমান্সের মশলার গন্ধে কেরানী-জীবন মুখর হয়ে উঠলো। বেশ রসিয়ে রসিয়ে পান চিবোতে চিবোতে শেয়ালদ’র কন্ট্রোলরুমে, কেবিন-ঘরে, প্লাটফরমে আলোচনা চলতে লাগলো। তারপর সেই ঢেউ এসে পৌঁছলো একেবারে গড়িয়াহাটা লেভেল-ক্রসিং-এর গুমটিঘরে। তখন সেকেন্ড নাইট ডিউটি করছে ভূষণ…
কিন্তু সে-সব কথা এখন থাক।
তা কোথায় গেল সেই ঘোষাল-সাহেব, আর কোথায় গেল সেই সে-সব দিন। রবিনসন সাহেব গেছে, ঘোষাল-সাহেবও গেছে। এখন এতদিন পরে সেই জায়গায় এসেছে সেন-সাহেব। কতদিন সেন-সাহেব ঢাকা না শিলিগুড়ি কোথায় বদলি হয়ে গিয়েছিল। এখন এসেছে ডি-টি-এস হয়ে। এই এতদিন পরে।
হঠাৎ এতদিন পরে সেই সেন-সাহেবকে দেখে মজুমদারবাবু এগিয়ে এলেন।
বললেন–কী স্যার, কেউ নামছেন না কেন?
সেন-সাহেব বললেন–না, স্পেশ্যাল যাবে না আজ, জেনারেল ম্যানেজারের শরীর খারাপ,আপ-গাড়ির লাইন ক্লিয়ার দিতে বলুন–
অভাবনীয় কাণ্ড! এমন কাণ্ড ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। স্পেশ্যাল ট্রেন ফিরে গেল আবার। আবার ঢিলে-ঢালা কাজ। সারা লাইনময় খবর চলে গেল টেলিফোনে। ডায়মণ্ডহারবার লক্ষ্মীকান্তপুর সর্বত্র। ট্রেন ক্যানসেড় হয়ে গেছে। জেনারেল ম্যানেজারের অসুখ। আবার থার্টি-থ্রি আপ এল। আবার টুয়েন্টিওয়ান আপ এল, আবার নাইনটিন আপ এল। ডাউন ট্রেনও আসতে লাগলো পর পর। আবার গড়িয়ে চললো চাকা। ওয়াগন আর ইঞ্জিন, লাইন ক্লিয়ার আর শান্টিং। আবার মার্শেলিং ইয়ার্ডে শান্টিং ইঞ্জিনের ফোঁসফোসানি শুরু হলো–
বেলেঘাটা থেকে ফোন এল কেবিনে-স্পেশ্যাল কী হলো হে–ছেড়েছে?
বালিগঞ্জ থেকে উত্তর এলনা হে, লাইন ক্লিয়ার দিতে হবে ডাউন স্পেশ্যালের
–কেন?
–স্পেশ্যাল ক্যাসেলড!
–দুত্তোর কলা-কচুপোড়া খেলে যা—
বলে ঘচাং করে লিভারটা টেনে দিলে গায়ের জোরে।
স্পেশ্যাল চলে গেছে অনেকক্ষণ। স্পেশ্যালের সঙ্গে অন্য সবাই-ই চলে গেছে। চীফ মেডিক্যাল অফিসার, চীফ ইঞ্জিনীয়ার-কেউ বাকি নেই।
মজুমদারবাবু হঠাৎ দেখে অবাক।
-স্যার, আপনি? আপনি ফিরে যাননি?
সেন-সাহেব যেন থতমত খেয়ে গেলেন। বালিগঞ্জ প্লাটফরমের একেবারে শেষ প্রান্তে একা একা দাঁড়িয়েছিলেন।
বললেন–না, আমার এদিকে একটা কাজ ছিল
মজুমদারবাবু আর কিছু না বলে চলে গেলেন। তারপর আর কিছু জানেন না তিনি। তাঁর ডিউটি শেষ হয়ে যাবার পর তিনি বাড়ি চলে গেছেন। পরে শুনলেন সব ঘটনাটা। শুনেই চমকে উঠলেন।
সেই অন্ধকার ঢালু প্লাটফরমের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তখন সেন-সাহেব হঠাৎ যেন নিজেকে গোপন করতে চাইলেন। যেন কেউ না দেখতে পায় তাঁকে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ওদিকে ঢাকুরিয়া স্টেশনের ফেসিং পয়েন্টের কাছে কয়েকটা তীব্র আলোর বিন্দু জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। হঠাৎ তিনি নেমে পড়লেন লাইনের ওপর। বারো বছর নয় তো–যেন সেদিন। পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন চিঠিটা রয়েছে। চিঠিটা সঙ্গেই রয়েছে তার। হঠাৎ তার মনে হলো এ যেন সেদিনের ঘটনা। এই তো সেদিন। এত শিগগির সেন-সাহেব বড় হয়ে গেছেন! কোথায় ছিল সব! কোথায় ছিল সব লুকিয়ে আত্মগোপন করে! ওপাশে একটা লাইট ইঞ্জিন ফোঁস ফোঁস করে শান্টিং করছে। তাকে এই অবস্থায় দেখলে আজ ড্রাইভার-ফায়ারম্যানরাও অবাক হয়ে যাবে। সেন-সাহেব এখানে! এই বালিগঞ্জের স্টেশন-ইয়ার্ডের ভেতরে অন্ধকার রাত্তিরে তিনি এসেছেন কী করতে! কেউ বিশ্বাস করবে না। বললেও কেউ বুঝতে পারবে না। কে-ই বা বুঝেছে। কে-ই বা বুঝতে চেয়েছে। সংসারে কেউ কাউকে বুঝতে পারে না। তাকে সবাই বলে সেন-সাহেব। সেন-সাহেব নামই হয়ে গেছে তাঁর। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সেই দীপু হয়ে গেল কিনা সেন-সাহেব! হো হো করে হাসতে ইচ্ছে হলো সেন-সাহেবের।
একটা জামার জন্যে মা কতদিন এর কাছে ওর কাছে ধর্না দিয়েছে। সেই লক্ষ্মীদি, সেই কিরণ, সেই নির্মল পালিত, সেই প্রাণমথবাবু। সেই বিন্তিদি, ছিটে-ফোঁটা…সবাই যেন এসে ভিড় করে দাঁড়ালো তার চোখের সামনে। বৃষ্টিটা থেকে এসেছে একটু। স্লিপারগুলো ভিজে সঁাতসেঁতে। কী যে হলো। কেন যে এমন হলো! কোথায় সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে একদিন ট্রেনটা ছেড়েছিল–তারপর অনেক কয়লা অনেক স্টীম খরচ করে করে আজ এতদূর চালিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও যেন ট্রেনটা আর চলবে না। যেন স্টেশনে এসে লাইন-ক্লিয়ারটা হাতে নিয়েই ড্রাইভার থেমে গেছে। সেই অন্ধকারের মধ্যেই পা বাড়িয়ে দিলেন সেন-সাহেব–
— দীপু!
এক নিমেষে চমকে উঠেছেন সেন-সাহেব। হঠাৎ কেউ যেন তাঁকে ডাকলো। এই যে, এই যে লক্ষ্মীদি! তোমাদের কত টাকা, কত গয়না। আমরা যে গরীব, আমার মা যে রাধুনীগিরি করে চালায়, আমার যে বাবা নেই! আমি কি তোমাদের সঙ্গে মিশতে পারি। সেই কালীঘাট মন্দির থেকে শুরু করে এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন পর্যন্ত যেখানে যত বাড়ি দেখি, যত লোক দেখি আমরা সকলের চেয়ে গরীব। আমরা আর কিরণরা তাই তো তোমাদের কাছে যেতে ভয় করি লক্ষ্মীদি। তোমরা যদি বকো। তোমরা যদি আমাকে ঘেন্না করো! আমার বড় অভিমান জানো! আমি যেদিন পেট ভরে ভাত খেতে পাই না, সেদিন আমি কাউকে বলি না সে-কথা। কাউকে আমি বলতে পারি না। বলতে আমার লজ্জা করে। সেদিন আমি হাসিমুখে ইস্কুলে যাই। খিদেয় আমার পেট চোঁ চো করে। রাখালরা বড়লোক, ওদের বাড়ি থেকে চাকর আসে ওর জন্যে খাবার নিয়ে। একটা কাঁসার গ্লাসে ঢাকা দেওয়া গরম দুধ, আর একটা বাটিতে দুটো রসগোল্লা।
রাখাল বলতো–এই দীপু খাবি?
তার চাকরটা আমার দিকে কটমট করে চেয়ে দেখতো।
আমি বলতাম–না, আমার পেট ভর্তি।
তোমরাও কেউ জানতে না, পাড়ার লোকেরাও কেউ জানতো না। শুধু জানতাম। আমি আর আমার বিধবা মা। মনে আছে যেবার সেই প্রিন্স-অ-ওয়েলস্ এল কলকাতায়, ইস্কুলের প্রত্যেক ছেলেকে একটা করে কমলালেবু, একটা কদমা আর একটা ছোট্ট লাল-কাগজে ছাপা ইউনিয়ন জ্যাক দিয়েছিল। তখনও তোমরা আসোনি লক্ষ্মীদি, তুমিও আসেনি, সতীও আসেনি। মনে আছে আমি সেই কমলালেবু আর কদমাটা খেতে পারিনি। লুকিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম মাকে দেখাবার জন্যে। রাস্তায় লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা। সে হঠাৎ আমাকে এক চড় মেরে দুটোই কেড়ে নিলে।
বললে–দে, আমাকে দে—
আমি বলেছিলাম–বা রে, ওটা আমি মাকে দেখাব বলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি যে–
কিন্তু তার গায়ের জোরের সঙ্গে আমি পারিনি সেদিন। সে কেড়ে নিয়েছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গিয়েছিলাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। সান্ত্বনা দিয়েছিল। বুঝিয়েছিল–সংসারে সবাই লক্ষ্মণ নয়, সংসারে ভালো লোকও আছে। এমন লোকও আছে যারা কেড়ে নেয় না, যারা দেয়। প্রাণ ভরে দেয়। দিয়েই যারা সুখ পায়। মা-ই বুঝিয়েছিল–বড় হতে চেষ্টা করো তুমি–তখন সকলে তোমায় ভালোবাসবে, সকলে তোমায় শ্রদ্ধা করবে। তা হলেই সুখ পাবে, শান্তি পাবে। সেই দিন থেকে কেবল বড় হতেই চেষ্টা করেছি, ভালো হতেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু সুখ?
কিন্তু মার কথা তো একেবারে মিথ্যে হয় না। সেই লক্ষ্মণ একদিন আবার আমার কাছে এসেছিল। তখন লক্ষ্মণের অনেক বয়েস হয়েছে। আমার কাছে চাকরি চাইতে এসেছিল সে। আমি চাকরি দিয়েছিলাম তাকে। এখনও ডেসপ্যাঁচ সেকশানে কাজ করছে সে। আমাকে এখন সে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আমাকে সেন-সাহেব বলে ডাকে।
তারপর সেই অন্ধকার ভিজে স্লিপারগুলোর ওপর চলতে চলতে দীপঙ্করের সব মনে পড়তে লাগলো আবার। এই বালিগঞ্জ স্টেশন, এই ঢাকুরিয়া, এই সোনারপুর, কালীঘাট, বজবজ–এখানে সবাই তাকে সেন-সাহেব বলেই জানে। যখন সবাই সেলাম করে, নমস্কার করে, তখন হাসি পায়। একদিন ওই ঘোষাল-সাহেবের মতো ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের চণ্ডীবাবুরাও তাকে গেট-আউট বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
স্পেশাল থেকে নামবার সময় অভয়ঙ্কর বলেছিল–এখন কোথায় চললে সেন, এই বৃষ্টির মধ্যে?
সত্যি, এই বৃষ্টিটাই কেমন যেন একটা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিলে। সব যেন নিমেষে ওলট পালট করে দিলে। অভয়ঙ্কর, রামমূর্তি, সোম সবাই স্পেশ্যাল ট্রেনের সঙ্গে আবার বেলেঘাটায় ফিরে গেল। নেমে পড়লো শুধু এই সেন-সাহেব। আজ এতদিন পরে কলকাতায় এসেছে। সেই কলকাতা। একদিন এই কলকাতার নাড়ির সঙ্গে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল সে। আবার এতদিন পরে সেই কলকাতাতেই সেন-সাহেব ফিরে এসেছে। সামনে আউটার-সিগন্যালের লাল আলোর বিন্দুগুলো যেন মিটমিট করে চাইছে তার দিকে। যেন কী ইঙ্গিত করছে। এ কী। পাগলামি তার। একখানা ট্যাক্সি করে সারা কলকাতাটাই তো ঘুরে বেড়াতে পারতো। সঙ্গে টাকা রয়েছে। বাড়িতে কাশী তার জন্যে আজ অপেক্ষা করবে না। সবাই জানি সেন-সাহেব স্পেশ্যাল ট্রেনের সঙ্গে ডায়মন্ডহারবার গেছে, তারপর সেখান থেকে যাবে লক্ষ্মীকান্তপুর। তারপর কাল রাত্রের আগে বাড়ি ফিরবে না আর। তবে? তবে কেন সে এই অন্ধকারে ভিজে পিছল স্লিপারের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে? কোথায় চলেছে?
পকেটে হাত দিয়ে আবার দেখলেন সেন-সাহেব। চিঠিটা রয়েছে। চিঠিটা সঙ্গেই রয়েছে তাঁর।
দীপঙ্কর সেন। ডি সেন। সেন-সাহেব।
অনেকগুলো নাম তার। সেই কবে প্রিন্স-অ-ওয়েলস্ এসেছিল কলকাতায়। কবে সেই উপলক্ষে কমলালেবু আর কদমা বিলিয়েছিল–আর আজ! আজ যেন এত বছর পরে আবার আস্তে আস্তে সেই পুরনো দিনে ফিরে গেছে। সেন-সাহেব আবার এক মুহূর্তে দীপঙ্কর সেন হয়ে গেছে।
হেডমাস্টার সুরেশবাবু ক্লাসে এলেন। আর সঙ্গে এল একজন বেয়ারা। হাতে তার একটা ঝুড়ি। কমলালেবু আর কদমা ভর্তি।
সুরেশবাবু একটা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলেন
-লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার।
লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার উঠে সামনে দাঁড়াতেই বেয়ারা তার হাতে একটা কমলালেবু আর একটা কদমা দিলে। বুকের পকেটে এঁটে দিলে ইউনিয়ন-জ্যাকটা।
তারপর ডাক হলো–নির্মলচন্দ্র পালিত—
তারপর–চারুচন্দ্র ধর–
তারপর–বিমানচাঁদ মিত্র–
এমনি করে করে অনেক নাম উঠলো। যারা মাইনে দিয়ে পড়ে তাদের সকলের নাম ডাকার পর, ফ্রি-স্টুডেন্টদের পালা; ফ্রি-স্টুডেন্ট দুজন মাত্র। একজন কিরণ।
-কিরণকুমার চট্টোপাধ্যায়।
কিরণও গিয়ে কমলালেবু আর কদমা নিয়ে বুকে ইউনিয়ন-জ্যাক এঁটে চলে গেল।
শেষ মাত্র একজন বাকি।
–দীপঙ্কর সেন–
সব ছেলে হো হো করে হেসে উঠেছে।
হেড-মাস্টার গম্ভীর গলায় চীৎকার করে উঠেছেন–স্টপ–
একটা হাই-বেঞ্চির পায়ায় চটিটা লেগে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে ইনফ্যান্ট ক্লাসের ফ্রি-স্টুডেন্ট দীপঙ্কর সেন। রোল নাম্বার–এইটিন।
হেডমাস্টার সুরেশবাবুর সঙ্গে সেই-ই তার প্রথম মুখোমুখি কথা বলা।
ধরে তুলে জিজ্ঞেস করলেন-লেগেছে তোমার?
লেগেছিল অবশ্য খুব। কিন্তু মুখে বললে–না স্যার–
তারপর হাত বাড়িয়ে কমলালেবু আর কদমাটা নিয়ে চলে এল। আর তারপরে রাস্তায় সে-দুটোও কেড়ে নিলে লক্ষ্মণ।
সেদিন ভালোই হয়েছিল যে পড়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। রাজার প্রসাদ নিতে গিয়েই পড়ে গিয়েছিল। রাজ-প্রসাদ কি সকলের ভাগ্যে সহজে জোটে!
আর সেই নাম্বার টু। নির্মলচন্দ্র পালিত! ক্লাসের ফার্স্ট বয়!
নির্মলচন্দ্র পালিত ছিল হরিশ মুখার্জি রোডের ছেলে। ঠিক পুলিসের থানাটার সামনে বাড়ি। বিরাট বাড়ি। বাবা ছিল ব্যারিস্টার পালিত। কারো সঙ্গে মিশতো না। ইস্কুলের ছুটির সময় বাড়ির দারোয়ান এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। দারোয়ান নির্মলকে আগলে আগলে নিয়ে যেত। কারোর সঙ্গে মিশতে দিত না। বিকেলবেলা বোনেদের সঙ্গে মোটরে চড়ে বেড়াতে যেত। হয় গড়ের মাঠের দিকে, নয়তো ঘোড়-দৌড়ের মাঠের দিকে। ইস্কুলে প্রাইজ পেত
কতদিন তার সঙ্গে ভাব করবার ইচ্ছেও হয়েছিল।
কিরণ বলতো–ওরা খুব বড়লোক, জানিস দীপু-একদিন ওদের বাড়ি যাবি?
দীপঙ্কর বলতো–যদিও ওর বাবা বকে?
কিরণ বলতো–যদি বকে তো বলবো নির্মলের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ি—
বিকেলবেলা কতদিন বেড়াতে বেড়াতে কিরণের হাত ধরে সামনের ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেছে দীপঙ্কর। সামনে একজন দারোয়ান বসে আছে। কাঁচের জানালার ভেতরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। ওর বাবা সেখানে বসে বসে লেখা-পড়া করতো। দোতলা থেকে অর্গান বাজাবার শব্দ আসততা। একটা মেয়ে অর্গানের সুরে সুর মিলিয়ে গান গাইত। মনে হতো ওদের অনেক টাকা, ওরা খুব সুখী। তারপর আস্তে আস্তে আবার দুজনেই ফিরে আসতে পাথরপটি ধরে সোজা ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে।
ক্লাসে দেখা হলে কিরণ বলতো–এই, তোদের বাড়ির সামনে আমি আর দীপু কাল গিয়েছিলাম—জানিস–
নির্মল জিজ্ঞেস করতো–কেন? কী করতে গিয়েছিলে?
কিরণ বলতো–এমনি তোর সঙ্গে দেখা করতে–
তারপর আবার বলতো–দেখা হলে তিনজনে বেশ বেড়াতুম, আমরা রোজ বেড়াই, আমি আর দীপু-বেড়াতে বেড়াতে ভবানীপুরে হরিশ পার্কে চলে যাই, সেখান থেকে পোড়াবাজার, তুই একদিন যাবি আমাদের সঙ্গে?
নির্মল বলতো–না ভাই, আমার বাবা বকবে–
নির্মলের সঙ্গে আর কখনও ভাব করা হয়নি। সেভেন্থ ক্লাসেই সে চলে গেল সাউথ-সাবার্বানে। সত্যিই আর দেখা হয়নি। শুধু খবর পেয়েছে সেখানে গিয়েও সে বরাবর ফার্স্ট হয়েছে। ফার্স্ট ছাড়া আর কখনও কিছু হয়নি সে জীবনে। রাজ-প্রসাদ তার জন্যেই অপেক্ষা করছে–এই কথাটাই সবাই বিশ্বাস করেছে। ইস্কুলের ছাত্ররাও বিশ্বাস করেছে, ইস্কুলের মাস্টাররাও বিশ্বাস করেছে। তার বাবাও বিশ্বাস করেছে, তার বোনেরাও হয়তো বিশ্বাস করেছে–
কিন্তু রাজ-প্রসাদ সে পায়নি!
সেই নির্মল পালিতই যে আবার তার জীবনের সঙ্গে একদিন জড়িয়ে পড়বে কে জানতো! সে অনেকদিন পরের কথা।
তখন দীপু ডি-টি-এস হয়েছে রেলের। ইয়ার্ডটা দেখে বেড়াচ্ছে। বিকেলবেলা। টোয়েন্টি-ওয়ান আপ এসে গেছে। প্লাটফরমের ওপর ভীষণ ভিড়। লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ একটা গোলমাল উঠলো। হৈ-চৈ, হাতাহাতি, মারামারি হবার উপক্রম।
কাছে যেতেই দেখে একটা লোককে ধরেছেন টিকিট-কালেক্টর দত্তবাবু। এক মুখ দাড়ি-গোঁফ। লোকটা টিকিট কাটেনি।
দত্তবাবু সেন-সাহেবকে দেখেই বললেন–দেখুন না স্যার, রোজ আসবে বিনাটিকিটে আবার চোটপাট
সেন-সাহেব বললেন–কেন, চোটপাট কিসের, জি-আর-পি’কে দিয়ে দিন না
দত্তবাবু বললেন–দেখুন না, ভদ্দরলোকের ছেলে এমনি রোজ আসে, প্রথম প্রথম কিছু বলিনি, আজ টিকিট চাইতেই একেবারে মারতে এসেছে–
লোকটার চেহারাটার দিকে আর একবার ভালো করে দেখলেন সেন-সাহেব।
বললেন–কেন, টিকিট কাটেন না কেন? জানেন টিকিট না কেটে ট্রেনে চড়া অপরাধ–
লোকটা বলে উঠলো–ওঃ ভারি নবাব এসেছে একেবারে, নবাবী তো সক্কলের ঘুচিয়ে দিয়েছি, এবার তোমার পালা, যত কিছু বলি না বলে! দাঁড়াও, দিচ্ছি লাটসাহেবকে বলে তোমার চাকরি-করা ঘুচিয়ে–
তারপর পকেট থেকে নোট-বই বার করলে একটা।
পেন্সিল নিয়ে বললে–বল, কী নাম তোর! কোথায় থাকিস, কী চাকরি করিস। কত মাইনে পাস–বাবার নাম কী?
দীপঙ্কর তো অবাক শুনে।
আবার লোকটা চীৎকার করে উঠলো–বল—
দীপঙ্কর বোধ হয় রেগে একটা কাণ্ডই করে বসতো।
দত্তবাবুই হঠাৎ বললেন–দেখছেন তো, অথচ খুব বড়লোকের ছেলে স্যার–ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে–
ব্যারিস্টার পালিত! কোন্ ব্যারিস্টার পালিত! হরিশ মুখার্জি রোডের ব্যারিস্টার পালিত? দীপঙ্কর সেন যেন তখন সামনে ভূত দেখেছে।
বললে–তুমি ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে? তোমার নাম নির্মলচন্দ্র পালিত? হরিশ মুখার্জি রোডে তোমাদের বাড়ি ছিল? কী হয়েছে তোমার?
নির্মলের চোখ দুটো তখন লাল জবাফুলের মতো।
নির্মল পালিত চীৎকার করে উঠলো–আবার ইয়ার্কি হচ্ছে! কী হয়েছে আমার! দেব। লাটসাহেবকে বলে সক্কলকে ধরিয়ে, যত সব চোর জুটেছে। সুরেন বাঁড়ুজ্জেকে ধরিয়ে দিয়েছি, বিপিন পালকে ধরিয়ে দিয়েছি, এবার তোদেরও ধরিয়ে দেব-কাউকে ছাড়বো না-ওই গান্ধী বেটাকেও ধরাবো–বল, তোর নাম বল্–
বলে খোলা নোটবুকে পেন্সিল উঁচিয়ে রইল।
দত্তবাবু বললেন–দেখলেন তো স্যার। বদ্ধ পাগল সেজেছে, টিকিট ফাঁকি দেবার মতলব–
সেদিন সেন-সাহেব নির্মলকে ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু বার বার মনে হয়েছিল এ কেমন করে হয়! এমন তো হবার কথা ছিল না। সেদিন তো এ-কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি! সেদিন সেই ইনফ্যান্ট ক্লাসে কমলালেবু আর কদমা আর ইউনিয়ন-জ্যাক নেবার সময় সে তো দীপঙ্করের মতো বেঞ্চির পায়ায় লেগে হোঁচট খায়নি। তবে রাজ প্রসাদ পেল না কেন নির্মল!
স্লিপারের ওপর পা পেতে পেতে চলবার সময় হঠাৎ মনে হলো যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। যেন মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। কবেকার এই মাটি, কবেকার এই স্লিপার। কবে কোন্ বন থেকে কাঠ কেটে সাপ্লাই করেছে কোন্ কন্ট্রাক্টর কবে কোন্ স্লিপার কনট্রোলার ছেনির দাগ দিয়ে মার্কা মেরে পাস করে দিয়েছে! তবু এতদিন পরে আবার কাঁপে কেন! তবে কি নির্মল পালিত ঠিক কথাই বলেছে! সব চোর, সব ফাঁকিবাজ!
অনেকদিন আগে একবার এই এখানেই, এই কেবিনটার কাছেই একটা গ্যাং-ম্যান কাটা পড়েছিল। সেদিনও এনকোয়ারি করতে এসেছিলেন সেন-সাহেব। আজ এখন এই রাত্রে যেন আবার এনকোয়ারি করতেই বেরিয়েছে দীপঙ্কর। সমস্ত এনকোয়ারি হবে। জেরায় জেরায় সব ফাঁস করে দেবে! সব ফাঁকি ধরে ফেলবে আজ। কোথাও কিছু গোপন থাকবে না। আসামীকে খুঁজে বার করতেই যেন বেরিয়েছে আজ সে। এই বালিগঞ্জ, এই গড়িয়াহাট, এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, এই ভবানীপুর, কালীঘাট, খিদিরপুর-কেউ বাদ যাবে না। সকলের বিচার হবে। এই কলকাতারও বিচার করবে যেন দীপঙ্কর সেন। ডি টি-এস ডি সেন। সেন-সাহেব। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে যেদিন লর্ড ওয়েলেসলী প্রথম কমিটি বসালেন–সেই দিন থেকে জবানবন্দি চাই সকলের। যেদিন থেকে এই কলকাতার মিউনিসিপ্যালিটি হলো, লটারি হলো, লটারির টাকায় রাস্তাঘাট বাজার হলো সেই দিন থেকে। তখন কি এই বালিগঞ্জ স্টেশন ছিল? এই বেলেঘাটা, এই শেয়ালদা, এই হাওড়া? তখন কি রেল-লাইন হয়েছিল! মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে সিমলায় গিয়েছিলেন হাঁটাপথে। সময় লেগেছিল সাত মাস। সনাতনবাবুর এ-সব তথ্য মুখস্থ। মুখে মুখে কত কথা বলেন।
আর আশ্চর্য লোক বটে সনাতনবাবু।
সনাতনবাবু বলেন–আপনারা রেলে চাকরি করেন, আমি চাকরি না-করেও আপনাদের চেয়ে দেখছি বেশি জানি
যখনি গেছে দীপঙ্কর তখনি দেখেছে সনাতনবাবুর মুখে কোনও বিকার নেই। যেন হলেও চলে, না-হলেও চলে। এ সংসারে কিছুরই যেন প্রয়োজন নেই তার।
সতী বলতো–তুমি জানো না দীপু, ওঁর সঙ্গে কথা বলে শুধু সময় নষ্ট—
দীপঙ্কর বলতো–কিন্তু উনি যে কথাগুলো বলেন, সেগুলোতে তো যুক্তি আছে—
সতী বলতো–ওঁর সঙ্গে একসঙ্গে ঘর করা যে কী তা তুমি বুঝবে না–
–কিন্তু ঘর তো করতেই হবে তোমাকে!
সতী বলতো–আমি অনেক পাপ করেছি দীপঙ্কর, তাই ওঁর সঙ্গেই এতদিন আমাকে ঘর করতে হয়েছে–
–অমন কথা বোলো না তুমি!
সতী কাঁদতো।
বলতো–তোমার কাছেও যদি না বলি তো কার কাছে বলবো বলো, কে শুনবে?
একদিন, অনেকদিন আগে ঈশ্বরের এই পৃথিবীতে দীপঙ্কর প্রথম যখন চোখ মেলে দেখেছিল, তখন চারিদিকে শুধু অভাব-অভিযোগই তার নজরে পড়েছিল। দেখেছিল সমস্ত মানুষের বিরাট অভিযোগ আর অভাবগুলো যেন মুখব্যাদান করে আছে বহুদিন ধরে। ভেবেছিল সকলের সব কামনা-বাসনা সব অভাব-অভিযোগ একদিন মিটবে হয়তো। ভেবেছিল মানুষের যারা নেতা, মানুষের যারা ভাগ্যবিধাতা, তারা হয়তো একদিন তার প্রতিকার করবে। তারা রাজা, তারা মন্ত্রী, তারা জজ, তারা ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের হাতে একদিন মানুষ তাদের ভাগ্যের সব ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল। তাদের ওপর নিশ্চিন্ত নির্ভর করবার জন্যে তাদের মাথায় তুলে রেখেছিল। তারপর একটার পর একটা যুগ এসেছে আর যারা বলবান তারা আরো বলবান হয়েছে, আর যারা দুর্বল তারা আরো দুর্বল হয়েছে। দীপঙ্কর দেখেছে, শুধু তাদের জেনারেল ম্যানেজারই নয়, শুধু চীফ মেডিক্যাল অফিসার, শুধু চীফ ইঞ্জিনীয়ারই নয়, মানুষের যারা ভাগ্যবিধাতা শুধু তারাই নয়, ওই সনাতনবাবু, ওই মজুমদারবাবু, ওই লক্ষ্মণ সরকার, ওই নির্মল পালিত, চণ্ডীবাবু, অঘোরদাদু, হেড মাস্টার থেকে শুরু করে ওই কেবিনম্যান করালী সরকার, ওই টিকিট কালেক্টর দত্তবাবু, ওই গেটম্যান ভূষণ–সবাই-ই যেন কোথায় অপরাধী! আর শুধু কি তারাই, আরো আছে! ওই দিল্লীতে যে সাহেবরা সিংহাসনে বসে আছে, ওই গভর্নর হাউসে যারা গদিতে বসে আছে, ওরাও অপরাধী! একজন লোকও যদি না-খেতে পেয়ে মারা যায়-তাহলে সমস্ত দেশের লোকই তো অপরাধী! ও সনাতনবাবু বললে কী হবে, ওই জন্যেই তো জেনারেল ম্যানেজারের অসুখ হলে স্পেশ্যাল ট্রেন ক্যানসেলড় হয়ে যায়, ওই জন্যেই পোষাকুকুরকে সাপে কামড়ালে ডি-টি-এস দেশে ফিরে যায়, ওই জন্যেই প্রিন্স-অ-ওয়েলস্ এখানে এলে ছেলেদের কমলালেবু আর কদমা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হয়, আর ওই জন্যেই তো ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মল পালিত পাগল হয়ে যায়–ওদের জন্যেই তো…
হঠাৎ দীপঙ্কর কেমন যেন সচেতন হয়ে উঠলো।
এখন কটা রাত। সামনেই যেন একটা ডাউন ট্রেন আসছে। সেভেনটিন ডাউন নাকি! এখন ক’টা বেজেছে? এত সকাল-সকাল তো সেভেনটিন ডাউন আসে না। রিস্টওয়াচটা একবার দেখবার চেষ্টা করলে দীপঙ্কর। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে কিছুই দেখা গেল না। চারিদিকে অতল অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই দূরে, অনেকদূরে একটা হে-লাইট দেখা যাচ্ছে ইঞ্জিনের! সেভেনটিন ডাউন! এত সকাল-সকাল আসছে আজ। এই ট্রেনটাই বালিগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে পৌঁছোবার কথা কাল ভোর ছ’টার সময়, হঠাৎ সেটা বারো ঘণ্টা আগে এসে পড়লো নাকি।
কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল দীপঙ্কর। সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাসের ফ্রি-স্টুডেন্ট দীপঙ্কর সেন, রোল নাম্বার এইটিন। সেদিনও ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে কিরণের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সে এখানে এসেছে। সেদিন টালিগঞ্জের সেই লোহার পুলটার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে আছে দেখতো কেমন করে রেলগাড়ি চলে। কেমন করে হেডলাইট জ্বালিয়ে হু হু করে রেলগাড়ি ছুটে আসে। তারপরে কতবার রেলগাড়ি দেখেছে, রেলেতেই চাকরি করছে–ট্রেনে চড়েছে, ব্রেকভ্যানে চড়েছে, ইঞ্জিনে চড়েছে, কোনও তফাৎ নেই। কিন্তু আজ যেন এ-সেভেনটিন ডাউন অন্যরকম। মনে হলো, ও যেন উল্কাপিণ্ডের মতো তার দিকেই ছুটে আসছে একদৃষ্টে। উনিশ শো বারো সালের আঠারোই মার্চ এই সেভেনটিন ডাউন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে একদিন যাত্রা শুরু করেছিল আর এতদিন বাদে এই এখন এই এত রাত্রে বুঝি এখানে এসে পৌঁছলো। অনেক লাঞ্ছনা, অনেক গঞ্জনা, অনেক পরিশ্রান্তি অতিক্রম করে এসেছে–অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি এড়িয়ে এতদিনে এসে পৌঁছেছে। সেই লর্ড ডালহৌসী, লর্ড চেমসফোর্ড, লর্ড লিটন, লর্ড রেডিং পেরিয়ে একেবারে বর্তমানে। এই গড়িয়াহাটার লেভেল-ক্রসিং এর গুমটিঘরের একেবারে দরজায়–
হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো গুমটিঘরের দেওয়ালটায় ঠেস দিয়ে যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে না? অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না। শুধু আবছা-আবছা বোঝা যায়, একজন মানুষের ছায়ামূর্তি। আস্তে আস্তে ট্রেনটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, তারপর সেভেনটিন ডাউন আরো কাছে এসে পড়লো। আরো জোরে শব্দ হচ্ছে। ইঞ্জিনের আর চাকার শব্দ। আর পায়ের তলার মাটি কাঁপতে শুরু করেছে। তারপর সেভেনটিন ডাউন আরো কাছে এসে পড়লো। আরো কাছে। আলোয় আলো হয়ে গেল জায়গাটা। গুমটিঘরে দেয়ালটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সে-আলোয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তিটা যেন দেয়াল ছেড়ে ব্যালাস্ট পার হয়ে লাইনের ওপরে এসে দাঁড়ালো–
–কে?
এক মুহূর্তের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠলো আকাশে।
-কে? কে?—
ঠিক সতীর মতনই চেহারা! ঠিক সতীর মতনই শাড়ি পরা! যে-শাড়িটা এই কিছুদিন আগেই কিনে দিয়েছিল দীপঙ্কর। কিন্তু সতী কেন আসতে যাবে এখানে, এত রাত্রে! তবে কি লক্ষ্মীদি! লক্ষ্মীদিই বা কেন এতদিন পরে আসতে যাবে এখানে?
-কে ওখানে? কে? সরে যাও-সরে যাও-
ছায়ামূর্তিটা মুখ ফেরালো। মুখ ফেরাতেই চেহারাটা যেন স্পষ্ট দেখতে পেলে দীপঙ্কর।
-সরে যাও-কে? কে ওখানে?
সঙ্গে সঙ্গে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করেছে দীপঙ্কর। আর এক মুহূর্ত দেরি করা চলবে না। ট্রেনটা একেবারে সামনে এসে পড়েছে। আর সময় নেই। ব্যালাস্টের ওপর দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে দীপঙ্কর–
আর সঙ্গে সঙ্গে সেভেনটিন ডাউন হুড়মুড় করে এসে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
সাউথ কেবিনে টেলিফোন বেজে উঠলো।
করালীবাবু ছিলেন সেকেন্ড নাইট ডিউটিতে। সেভেনটিন ডাউন চলে গেলেই একটু ফাঁকা। তখন একটু চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নেবেন ভেবেছিলেন। রিসিভারটা তুলে বললেন–আবার কী হলো? জ্বালালে দেখছি
ওপাশ থেকে ভূষণ বললে–হুজুর অ্যাসিডেন্…
লাফিয়ে উঠেছেন করালীবাবু।
-বলিস কী, অ্যাসিডেন্ট? কিসের অ্যাসিডেন্ট? কার অ্যাসিডেন্ট?
হুজুর, সেভেনটিন ডাউন…
Leave a Reply