ওয়েটিং ফর গডো – স্যামুয়েল বেকেট
স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো প্রায় সবার পরিচিত, জনপ্রিয়তার দিক থেকে এ নাটকের প্রতিদ্বন্দ্বী মেলা ভার। আধুনিক নাট্যাঙ্গনের যেকোনো অনুষ্ঠানসূচিতে এর স্থান প্রায় সুনিশ্চিত। ওয়েটিং ফর গডো প্রথম মঞ্চস্থ হয় প্যারিসের থিয়েটার ডি ব্যাবিলনে ১৯৫৩ সালের ৫ জানুয়ারি। বেকেট নাটকটি প্রথমে ফরাসি ভাষায় রচনা করেন। ফরাসি সংস্করণ। প্রকাশিত হয় প্যারিসে ১৯৫২ সালে। পরে তিনি তাঁর ইংরেজি অনুবাদ করেন। ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় নিউ ইয়র্কে, ১৯৫৪ সালে। তারপর থেকে বহু জায়গায় ঈর্ষণীয় সাফল্যের সঙ্গে ওয়েটিং ফর গডো অভিনীত হয়েছে, হয়ে চলেছে। অন্তত বাইশটি দেশে এটি পরিবেশিত হয়েছে। বিশটিরও বেশি ভাষায় নাটকটি অনূদিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে পঞ্চাশের দশক থেকেই এই ব্যতিক্রমী নাট্যকার সারা বিশ্বে সাড়া জাগাতে আরম্ভ করেন, যদিও তিরিশের দশক থেকেই তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি প্রকাশিত হয়ে আসছে।
জীবন সম্পর্কে তাঁর বিশ্বের উপলব্ধি এবং চেতনাকে তিনি অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে এক স্বল্প-চেনা শৈল্পিক ভঙ্গিতে পাঠক-দর্শক চিত্তে সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে প্রায় দু-দশক ধরে তিনি বিশ্ব নবনাট্য অঙ্গনের অবিসংবাদিত প্রথম পুরুষ বলে প্রমাণিত হয়ে আসছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
.
ওয়েটিং ফর গডো – স্যামুয়েল বেকেট
অনুবাদ – কবীর চৌধুরী
.
নিবেদন
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাটক ওয়েটিং ফর গডো। নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন খ্যাতিমান লেখক ও অনুবাদক জনাব কবীর চৌধুরী। রূপকাশ্রয়ী, প্রতীকধর্মী এ নাটকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের মানবমনের হতাশা, বেদনা, জীবনের অনিশ্চয়তা, সীমাহীন স্থবিরতা চিত্রিত হয়েছে অল্প কটি চরিত্রের মাধ্যমে। বিষয়টি অনুবাদক কবীর চৌধুরী দক্ষতার সাথে অত্যন্ত সচেতনভাবে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন। মূল নাটকের সুরটি ধরার জন্য তিনি মূলত আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
নাটকটি ইতঃপূর্বে ১৯৮১ সালে মুক্তধারা থেকে গডোর প্রতীক্ষায় নামে প্রকাশিত হয়। আমরা ওই পাঠটিকেই প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। তবে গডোর প্রতীক্ষায় নামটির বদলে নাটকের মূল নাম ওয়েটিং ফর গডো ব্যবহৃত হয়েছে।
নাটকটির মূল পাঠের বানান, বর্তমান সংস্করণে আধুনিক রীতি অনুসারে পরিমার্জিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা মূলত বাংলা একাডেমী ঢাকার প্রমিত বাংলা-বানানের নিয়ম ও বাংলা-বানান অভিধান অনুসরণ করেছি।
বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক কবীর চৌধুরী-কৃত অনুবাদ ওয়েটিং ফর গডো নাটক অনুরাগী বাঙালি পাঠক ও শিক্ষার্থীদের কাছে সমাদৃত হলে আমাদের প্রয়াস সার্থক বিবেচিত হবে।
প্রকাশক
ডিসেম্বর ২০০৬
.
অনুবাদের কথা
আধুনিক নবনাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী স্যামুয়েল বেকেটের সবচাইতে বিখ্যাত নাটক ওয়েটিং ফর গডো বাংলায় অনুবাদ করতে আমাকে সর্বপ্রথম উৎসাহিত করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের খ্যাতিমান নিরীক্ষাধর্মী নাট্য প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরী। অনুবাদ করতে শুরু করে কাজের দুরূহতায় গোড়ায় ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করলেও অনুবাদ শেষ করার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে তৃপ্তি লাভ করি। এরপর ঘরোয়া এক বৈঠকে অনুবাদটি পড়া হল। টেলিভিশনের আতিকুল হক চৌধুরী ছাড়াও দেশের বিশিষ্ট নাট্যগোষ্ঠী থিয়েটার, নাগরিক এবং নাট্যচক্রের বেশ কয়েকজন সদস্য সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলন। অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়াও তাদের সোৎসাহে অনুবাদটি গ্রহণ করায় আমি তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের কথা ভাবি। সমকালীন বাংলাদেশের প্রকাশনা অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মুক্তধারার নির্বাহী পরিচালক শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সাহা গ্রন্থটি প্রকাশে আগ্রহী হওয়ায় তিনি আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
ভূমিকা হিসেবে গ্রন্থের সঙ্গে যা যুক্ত হল আমি তা “প্রসঙ্গ নাটক” নামক আমার একটি প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য রচনা করেছিলাম। নাগরিক নাট্যগোষ্ঠীর আলী যাকের ও আতাউর রহমান উভয়ই ওই রচনাটি বর্তমান অনুবাদগ্রন্থের ভূমিকারূপে এখানে সংযোজন করার পরামর্শ দেন। সুপরামর্শ বিবেচনায়, তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, তাই করা হল।
অনুবদক
ঢাকা
১লা বৈশাখ ১৩৮৮
.
ভূমিকা
স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো, [গডোর প্রতীক্ষায়] নাটকটি স্পষ্টতই রূপকাশ্রয়ী, প্রতীকধর্মী। কোনো বিশেষ স্থানে কোনো বিশেষ কালে এর ঘটনাবলি সংঘটিত হয় না, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মানুষের মনের হতাশা, শূন্যতাবোধ, অন্তহীন ক্লান্তি এবং একটা মিথ্যা আশা-স্বপ্ন-কল্পনার প্রতীক্ষার প্রেক্ষাপটে তার আবেদন আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বললাম বটে এর ঘটনাবলির কথা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ছোট্ট নাটকটিতে কিছুই ঘটে না। এইখানেই তার আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, চরিত্রের অন্তর্নিহিত টানাপোড়েন ও বিকাশ, ঘটনার আকস্মিক মোড় পরিবর্তনে বিস্ময়ের উদ্ভাসন, উদাত্ত সংলাপ–সচরাচর এগুলোই সফল নাটকের অন্যতম লক্ষণ, কিন্তু গডোর প্রতীক্ষায় নাটকে এর কোনোটিই উপস্থিত নয়। বস্তুতপক্ষে এর তেমন কোনো বিষয়বস্তুই নেই। শূন্যতা, নিষ্ফল প্রতীক্ষা, কথা নিয়ে খেলা, কোনো রকমে সময়টা কাটিয়ে দেওয়া, সীমাহীন ক্লান্তি, ছেলেমানুষী কৌতুকক্রীড়া–এইসব নিয়েই এই নাটক গড়ে উঠেছে। নাটক যখন শুরু হয় তখন এস্ট্রাগন এবং ভ্লাডিমির গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। নাটক যখন শেষ হয় তখনো তারা প্রতীক্ষারত। এই দুই অঙ্কের নাটকের মধ্যে সময়ের ব্যবধান শুধু একদিনের। অর্থাৎ পরপর দু-দিনের কাহিনী পরিবেশিত, কিন্তু সময় যেন থেমে গেছে, সংশ্লিষ্ট চরিত্রাবলি কিছুই নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারছে না, একই জায়গাকেও চিনতে পারছে না। এই অনিশ্চয়তা, এই বিস্মৃতি, স্থান ও কালের এই একাকার বিলুপ্তি মানুষের অস্তিত্বকে অর্থহীন করে তুলতে চায়। কিন্তু এস্ট্রাগন এবং ভ্লাডিমির নানা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে, ভাঁড়ামির মধ্য দিয়ে, শব্দের সকৌতুক দীপ্ত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে, সর্বোপরি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্যে দিয়ে এই শূন্যতার ভেতরে অনিবার্য প্রতীক্ষার কাল কাটিয়ে দিতে বদ্ধপরির। অবশ্য অন্য কোনো উপায় নেই সে কথাও তারা জানে। আত্মহত্যা করাও সম্ভব নয়, অবশ্য যথার্থই আত্মহত্যার আন্তরিক দৃঢ় ইচ্ছা তাদের আছে কি না তাও সন্দেহের বিষয়। যদি এই নাটকের বিষয়বস্তু বলে কোনো কিছুকে চিহ্নিত করতে হয় তা হচ্ছে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে অন্তহীন প্রতীক্ষা। এবং হয়ত আমরা সবাই প্রতীক্ষা করে থাকি, প্রতীক্ষা করে থেকেছি, হয়ত গাছের পাশে নয়, কোনো ঘনিয়ে আসা সন্ধেবেলায় নয়, হয়ত কোনো মেঠো পথের ধারে নয়, কিন্তু প্রতীক্ষা করেছি, প্রতীক্ষা করে থাকি, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে, অন্য কোনো সময়ে। আমাদের সবারই রয়েছে কোনো না কোনো গডো।
এই নাটকের অন্যতম আকর্ষণীয় এবং শৈল্পিক দিক হচ্ছে এর গঠনগত সুষমা, এর কাঠামোর ভারসাম্য। তার পরিচয় ভাষার ব্যবহারে, সংলাপের বিন্যাসে, নাটকের অঙ্ক বিভাজনে। সবখানেই চোখে যা পড়ে তা হচ্ছে স্বল্পতা, হ্রস্বতা, ক্ষয়ে যাওয়া, থেমে যাওয়া। এই প্রধান ভাবধারাটি সুপরিকল্পিত দৃঢ় সংহত শিল্পরূপ ধরে প্রবাহিত হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত সেই অন্তহীন অসহনীয় ব্যর্থ প্রতীক্ষা, আর কিছু কোথাও নেই বিশ্ব চরাচরে। দৃঢ় সংহত কাঠামোতে ভারসাম্যের নিদর্শন হিসেবে একটা অংশ থেকে একটু উদ্ধৃতি দিই :
এস্ট্রাগন : কিন্তু যেহেতু আমরা নীরব থাকতে অসমর্থ, অতএব ইতোমধ্যে একটু শান্তভাবে আলাপ করার চেষ্টা করা যাক।
ভ্লাডিমির : ঠিক বলেছ, আমরা অফুরন্ত।
এস্ট্রাগন : যেন চিন্তা করতে না হয় সেজন্য।
ভ্লাডিমির : সে অজুহাত আমাদের আছে।
এস্ট্রাগন : যেন আমাদের শুনতে না হয় সেজন্য।
ভ্লাডিমির : যুক্তি আছে আমাদের।
এস্ট্রাগন : সমস্ত মৃত কণ্ঠস্বরগুলো।
ভ্লাডিমির : ভ্লাডিমির পাখার মতো শব্দ করে তারা।
এস্ট্রাগন : পাতার মতো।
ভ্লাডিমির : বালির মতো।
এস্ট্রাগন : পাতার মতো।
[নীরবতা]
ভ্লাডিমির : শনশন করে।
ভ্লাডিমির : গুনগুন করে।
এস্ট্রাগন : শনশন করে।
[নীরবতা]
ভ্লাডিমির : কী বলে ওরা?
এস্ট্রাগন : তাদের জীবনের কথা।
ভ্লাডিমির : বেঁচে থেকে তাদের তৃপ্তি হয়নি।
এস্ট্রাগন : তা নিয়ে তাদের কথা বলতে হবে।
ভ্লাডিমির : মরে গিয়ে তাদের তৃপ্তি হয়নি।
এস্ট্রাগন : তা যথেষ্ট নয়।
[নীরবতা]
ভ্লাডিমির : পালকের মতো শব্দ করে তারা।
এস্ট্রাগন : পাতার মতো।
ভ্লাডিমির : ছাইয়ের মতো।
এস্ট্রাগন : পাতার মতো।
[দীর্ঘ নীরবতা ]
ভ্লাডিমির : কিছু বলো!
এস্ট্রাগন : চেষ্টা করছি।
[দীর্ঘ নীরবতা]
ভ্লাডিমির : [যন্ত্রণাক্লিষ্ট] একটা যা কিছু বলো!
এস্ট্রাগন : এখন কী করি আমরা?
ভ্লাডিমির : গডোর জন্য অপেক্ষা।
এস্ট্রাগন : ওহ!
[নীরবতা]
ভ্লাডিমির : এ অসহ্য!
এস্ট্রাগন আর ভ্লাডিমিরের সংলাপ বেশ কয়েকবার ঠিক একইভাবে এই জায়গায় এসে খানিকক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। উদ্ধৃতাংশে বেকেটের ভাষা সম্পর্কে তীক্ষ্ণ বোধ ও সচেতনতার পরিচয় স্পষ্ট। উন্নত গদ্যের ব্যালান্সের সঙ্গে কবিতার ইঙ্গিতময়তা ও রহস্যঘন আবহকে তিনি একাত্ম করেছেন এইসব অংশে। শব্দেরও যেন ঘাটতি পড়ে যায় কোনো একপর্যায়ে। চারবার, এই ছোট্ট একটুখানি পর্বের মধ্যেই, এস্ট্রাগন একই বাক্যাংশের আশ্রয় নেয়—’পাতার মতো।’ দ্বিতীয়বার ‘পাতার মতো’ উচ্চারণ করার পর স্বল্প নীরবতা নেমে আসে, চতুর্থবার কথাটি উচ্চারিত হবার পর নেমে আসে দীর্ঘ নীরবতা।
সময় কিছুতেই কাটতে চায় না। জীবনের ভার দুর্বহ। তাই সময় কাটাবার জন্য অনেক কিছু উদ্ভাবন করতে হয়–পরস্পরের কথার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে ওরা, পরস্পরকে প্রশ্ন করতে চায়, গালাগাল করে, সৌজন্য ও ভদ্রতার অভিনয় করে, শিশুদের মতো নিজেদেরকে ভিন্ন চরিত্র কল্পনা করে অভিনয় করে। কিন্তু তবু একসময় আর কিছুই করার থাকে না। তখন শুধু গডোর জন্য অপেক্ষা করে থাকা।
সিমেট্রির দৃষ্টান্ত হিসেবে হিউ কেনার অঙ্ক দুটির মধ্যে যে সমান্তরাল ঘটনা সংস্থাপন রয়েছে তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দু-অঙ্কেই বালকের আবির্ভাবের পূর্বে পোজো-লাকির সাক্ষাৎ পাই, আমরা। দুটি ক্ষেত্রেই বালক জানায় যে গডো আজ আসছেন না, কিন্তু আগামীকাল অবশ্যই আসবেন। সিমেট্রি নাটকটির সর্বত্র যেমন বহিরঙ্গে তেমনি অন্তরসত্তায়– মঞ্চ দুই ভাগে বিভক্ত, মাঝখানে গাছ। মানবজাতিও যেন দুটি ভাগে বিভক্ত, প্রথমে ডিডি এবং গোগো, তারপর চারজনের বিভাজন, ডিডি গোগো এবং পোজো : লাকি। এই যে সুষমা তা বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েও উপস্থাপিত। প্রথম অঙ্কে আমরা লাকির কাছ থেকে দীর্ঘ বক্তৃতা শুনি, নাটকের দীর্ঘতম একক ভাষণ। দ্বিতীয় অঙ্কে লাকি মূক, একটি বাক্যও তার মুখনিঃসৃত হয় না।
সিমেট্রিক্যাল স্ট্রাকচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতঃপূর্বে একটি সংলাপের খানিকটা অংশ উদ্ধৃত করেছি। তবু আরেকটি জায়গা থেকে একটুখানি তুলে দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কত সংক্ষিপ্ত বাক্যাংশের মধ্য দিয়ে তা উপস্থাপিত সেটা সহজেই পাঠকবর্গের চোখে ধরা পড়বে।
ভ্লাডিমির : আমাদের ব্যায়ামগুলো করতে পারি আমরা।
এস্ট্রাগন : আমাদের মুভমেন্টগুলো।
ভ্লাডিমির : আমাদের এলিভেশনগুলো
এস্ট্রাগন : আমাদের রিলাক্সেশনগুলো।
ভ্লাডিমির। আমাদের এলঙ্গেশনগুলো
এস্ট্রাগন : আমাদের রিলাক্সেশনগুলো।
ভ্লাডিমির : গরম করে তোলার জন্য
এস্ট্রাগন : ঠাণ্ডা করে দেবার জন্যে।
ভ্লাডিমির : কেয়া বাত! চালাও।
এই সূক্ষ্ম ব্যালান্স গডোর প্রতীক্ষায় নাটকের অন্যতম শিল্পগুণ।
সিমেট্রির দ্বিতীয় অঙ্কেই অধিকতর স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত। দ্বিতীয় অঙ্ক শুরু হবার একটু পরেই ভ্লাডিমির এস্ট্রাগনকে লক্ষ করে বলছে :
ভ্লাডিমির : বলো আমি সুখী হয়েছি।
এস্ট্রাগন : আমি সুখী হয়েছি।
ভ্লাডিমির : আমিও।
এস্ট্রাগন : আমিও।
ভ্লাডিমির : আমরা সুখী।
এস্ট্রাগন : আমরা সুখী। [নীরবতা] আমরা তো সুখী, এবার কী করব?
ভ্লাডিমির : গডোর জন্য অপেক্ষা করব। [এস্ট্রাগন ঝাঁকিয়ে ওঠে। নীরবতা]
এই সিমেট্রির শৈল্পিক ইফেক্ট অনস্বীকার্য। অত্যন্ত সচেতনভাবে বেকেট এখানে ভাষাশৈলীকে ব্যবহার করেছেন। এই ভাষাও কাব্যিক, কিন্তু হ্যামলেট, ম্যাকবেথ কি ওথেলোর কাব্যসুর থেকে এটা পৃথক। জীবনের শূন্যতা এবং সে শূন্যতার সামনে কখনো মানুষের অধৈর্য বিপর্যস্ত মানসিকতা বেকেট নাটকটিতে অত্যন্ত তীব্র আবেগের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। লাকি বোবা হয়ে গেছে মাত্র একদিন আগে প্রথম অঙ্কে যে লাকিকে আমরা ভীষণভাবে কথা বলতে দেখেছি। ভ্লাডিমির এটা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে পোজোকে :
ভ্লাডিমির : বোবা! কখন থেকে?
এস্ট্রাগন : [হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে] তোমার এই অভিশপ্ত সময়ের কথা বলে আর কত যন্ত্রণা দেবে তুমি আমাকে! অসহ্য! কখন! কখন! একদিন, তাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়, যেকোনো দিনের মতো একদিন, একদিন সে বোবা হয়ে গেছে, একদিন আমি অন্ধ হয়ে গেছি, একদিন আমরা বধির হয়ে যাব, একদিন আমরা জন্মগ্রহণ করেছিলাম, একদিন আমরা মরব, সেই একই দিন একই ক্ষণ, তাই কি যথেষ্ট নয় তোমার জন্য? [অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে] কবরের উপরে তারা জন্ম দেয়, মুহূর্তের জন্য আলো ঝলমল করে, তারপর আবার রাত্রি।
এই সংলাপ অবশ্যই নাটকটির একটি অর্থকে স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করে। তা হচ্ছে জীবনের অর্থহীনতা। সব প্রতীক্ষাই নিরর্থক, সব যাত্ৰাই নিল। এবং অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। লাকি বোবা হয়ে গেছে। পোজো অন্ধ। ভ্লাডিমির বুঝতে পারছে না তার যে অভিজ্ঞতা তা কি স্বপ্নজগতের না বাস্তবের। এস্ট্রাগন তাকে ওর জুতো খুলতে সাহায্য করার অনুরোধ জানায়, কিন্তু ভ্লাডিমিরের কানে সে অনুরোধ পৌঁছায় না। সে ভাবছে :
ভ্লাডিমির : অন্যরা যখন কষ্ট পাচ্ছিল আমি কি তখন ঘুমাচ্ছিলাম? আমি কি এখনও ঘুমন্ত? কাল যখন আমি জেগে উঠব, কিংবা ভাবব, জেগে উঠেছি, তখন আজকের কথা কি বলব যে, বন্ধুবর এস্ট্রাগনের সঙ্গে এইখানে, রাত নেমে না আসা পর্যন্ত, আমি গডোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম? যে, পোজো : তার বাহককে নিয়ে, এই পথে গিয়েছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে? হয়ত। কিন্তু ওইসবের মধ্যে কতটুকু সত্য থাকবে? [এস্ট্রাগন জুতো খোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আবার তন্দ্রায় ঢুলে পড়ে। ভ্লাডিমির তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে] ও কিছুই জানবে না। কীরকম পিটুনি খেয়েছে সেই কথা বলবে আমাকে, আর আমি তাকে গাজর দেব। একটু থামে কবরের উপরে, আর কঠিন জন্ম। গর্তের মধ্যে, ধীরেসুস্থে, গোরখোদক ছুরি ধরে। সময় আছে আমাদের বুড়ো হবার। সারা আকাশ আমাদের ক্রন্দনে পূর্ণ। কান পেতে শোনে] কিন্তু সময় সবকিছুকে অসাড় করে দেয়। আবার এস্ট্রাগনের দিকে তাকায়] আমার দিকেও একজন কেউ তাকাচ্ছে, আমার সম্পর্কেও একজন কেউ বলছে, ও ঘুমুচ্ছে, ও কিছুই জানে না, ঘুমাক ও। [একটু থামে] আর আমি পারি না!
নাটক ক্লাইম্যাক্সের দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু এ ক্লাইম্যাক্স ভিন্নধর্মী, অগতানুগতিক। এস্ট্রাগন জুতো খোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভ্লাডিমির তাকে লক্ষ করে। আমরা প্রেক্ষাগৃহে বসে ভ্লাডিমিরকে লক্ষ করি, এবং আর কেউ কোনো অদৃশ্য আসন থেকে আমাদের সবাইকে লক্ষ করছেন। হিউ কেনার এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন “Like music, Beckett’s language is shaped into phrases, orchestrated, cunningly repeated.”
নিপুণ পুনরাবৃত্তির বহু দৃষ্টান্ত আছে নাটকটিতে। ভ্লাডিমির একটু আগে উদ্ধৃত তার স্বগতোক্তিতে পোজোর চিত্রকল্পই ব্যবহার করে “কবরের উপরে, আর কঠিন জন্ম।” তার এই স্বগতোক্তির শেষেই আবার বালকের আবির্ভাব ঘটে, জানা যায় যে গডো আজ বিকেলে আসবেন না, কিন্তু কাল আসবেন। এই তথ্যটিও অবশ্য ভ্লাডিমিরকে প্রশ্ন করে বার করতে হয়। বালকটি এক শব্দে ছাড়া বিস্তৃততর কোনো উত্তর দেয় না। মি. গডোর দাড়ি সাদা না কালো সে প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়, “আমার মনে হয় সাদা, স্যার।” শুধু একবার সে নিজে থেকে একটি প্রশ্ন করে–“মিস্টার গডোকে কী বলব স্যার?” উত্তর পায়:
ভ্লাডিমির : তাঁকে বোলো…[ইতস্তত করে] তাঁকে বোলো যে তুমি আমার সাক্ষাৎ পেয়েছ আর… [ইতস্তত করে] … আর তুমি আমার সাক্ষাৎ পেয়েছ। [চুপ করে থাকে একটুক্ষণ। ভ্লাডিমির দাঁড়ায়, বালকটি দাঁড়ায়। হঠাৎ ভীষণ তীব্র কণ্ঠে।] তুমি ঠিক জানো যে তুমি আমাকে দেখেছ, কাল আবার এসে বলবে না যে তুমি আমাকে কোনো দিন দেখনি!
এরপর আবার নাটকটিতে একটি অর্ধ-কমিক, প্রায় গ্রোটেস্ক সুর নিয়ে আসেন নাট্যকার। কমিক সুর অবশ্য প্রায়ই আছে, গোড়া থেকেই। আর তাও একটা ট্রাডিশন অনুসরণ করে, সার্কাসের ক্লাউনের, লরেল হার্ডি কিংবা চার্লি চ্যাপলিনের অভিনয়ের স্মারক যা। যেমন, বুট জুতো নিয়ে টানাটানি, মাথার টুপি খুলে তার মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখা এবং নাটকের শেষ কয়েক মিনিটের এই দৃশ্যে কোমর থেকে প্যান্ট হড়হড় করে পড়ে যাওয়া। এবং দৃশ্যটি তীব্রতা অর্জন করে তার পটভূমি থেকে। দৃশ্যটি কৌতুককর, অথচ প্রয়াসটা কিন্তু আত্মহত্যার, যেখানে কৌতুকের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। তাদের আত্মহত্যার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। দড়িটা ছিঁড়ে যায়। ওরা ঠিক করে, এস্ট্রাগন আর ভ্লাডিমির, কাল আসার সময় একটা ভালো দড়ি নিয়ে আসবে। এবং তখন গলায় ফাঁস দেবে।
ভ্লা : …যদি গডো না আসেন।
এ : আর যদি আসেন?
ভ্লা : তা হলে আমরা রক্ষা পাব।
গোটা নাটকের সুর থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে কালও গডো আসবেন না। অনন্তকাল ধরে হয়ত গডোর প্রতীক্ষায় থাকবে তারা। এস্ট্রাগন : তার প্যান্ট তোলে। যাবার জন্য প্রস্তুত হয় ওরা দুজন। নাটকের শেষ সংলাপ শুনি আমরা
ভ্লা : কী? চলব এখন?
এ : হ্যাঁ, চলো যাই।
[কেউ নড়ে না]
তারপর পর্দা পড়ে। বলছে চলো যাই, কিন্তু কেউ নড়ে না। এই ‘কেউ নড়ে না’-র প্রতীকী তাৎপর্য অবশ্যই লক্ষণীয়।
Francis Doherty ta Sanuel Beckett 973 [Hutchionson & Co. Lid. London, 1971] Waiting For Godot, Endgame, Krupp’s Last Tape প্রভৃতি নাটকের আলোচনায় একে Theatre of Suffering আখ্যা দিয়েছেন। আমরা দেখেছি যে এক স্তরে গডোর প্রতীক্ষায় নাটকের চরিত্রাবলি কমিক, কিন্তু তাদের হাসিঠাট্টা ও কৌতুকের প্রকৃতি বড় করুণ ও ভয়াবহ। তারা এখন বাস করছে সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতির বাইরে। তাদের একমাত্র চিন্তা ও ধ্যান খাবার নিয়ে, জুতো নিয়ে, সময় কাটানো নিয়ে, একটি দিন পার হয়ে পরের দিনে গিয়ে পৌঁছানো নিয়ে, এবং প্রতীক্ষা করা নিয়ে, একটা কিছুর জন্য যা তাদের সমস্ত জীবনকে পাল্টে দেবে। আমরা অনেকেই মাঝে মাঝে বলি বটে যে সবকিছু অর্থহীন– “Life is a tale told by an idiot, full of sound and fury signifying nothig”- fog az অর্থহীনতা যে কী ভয়ংকর তার যথার্থ উপলব্ধি আমাদের নেই, গডোর প্রতীক্ষায় নাটকের চরিত্র ডিডি গোগোরও নেই। তাই তারা প্রতীক্ষা করে থাকে, ‘চলো যাই’ বলেও নড়ে না কেউ। ডোহার্টির ভাষায়, “They are unaccommodated men. Space and time find them, though space is empty, save for a mound and a tree; and time is no longer the measure of motion but an arbitrary imposition through which men crawl 10 a death they can never know”
সমগ্র নাটকটির মধ্যে একটা তর্কাতীত নির্ঘ সুস্পষ্ট অর্থ আবিষ্কারের চেষ্টা করা কিন্তু ভুল হবে বলে আমার মনে হয়। জীবনের অনিশ্চয়তার মতোই লেখক যেন ইচ্ছা করেই অনেক জিনিসকে অস্পষ্ট ধূসর করে রেখেছেন। যেমন, এর খ্রিষ্টীয় আবহ ও মিথের কথা ধরা যাক। যিশুখ্রিষ্টের অস্তিত্ব নাটকের দু-এক জায়গায় পটভূমিতে রয়েছে– দুই তস্করের কাহিনী এবং ত্রাণ লাভ করা অথবা অভিশপ্ত হবার ইতিবৃত্তে তা ধৃত। যিশুখ্রিষ্টের জীবন ছিল পরোপকারের আত্মত্যাগের দুঃখভোগের কিন্তু তিনি মৃত্যুবরণ করেন অপরাধীরূপে, ক্রিমিনাল হিসেবে। আমাদের নাটকের প্রধান চরিত্র দুটির কাছে। যিশুখ্রিষ্টের দুঃখভোগের একটা প্রচণ্ড আবেদন আছে, কিন্তু তার কষ্ট ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ।
Vladimir : But where he was it was warm, it was dry!
Estragon : Yes. And they crucified quick.
তা ছাড়া স্যালভেশন আর ড্যামনেশনের মধ্যেকার সীমারেখাও মনে হয় অতি সূক্ষ্ম, অনিশ্চিত এবং নিয়তিনির্ভর। দুই তস্করের কাহিনীকে যেভাবে নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে আশাবাদ আরো জীর্ণ হয়ে পড়ে। যিশুখ্রিষ্টের জীবনের শেষ সময়ের কথা বলতে গিয়ে চারজন সংবাদদাতার মধ্যে মাত্র দুজন এই চোরদের কথা বলেন, তার মধ্যে আবার তাদের একজনের বক্তব্যই সবাই বিশ্বাস করে। ইঙ্গিতটা হচ্ছে এই যে সকল রকম প্রতিকূল সম্ভাবনা সত্ত্বেও মানুষ যেখানে একটুমাত্র আশার আলো দেখতে পায় সেখানেই ছুটে যায়, তাকেই আঁকড়ে ধরে।
গডোর প্রতীক্ষায় নাটকটির অর্থ নানাভাবে করা যেতে পারে। এর একাধিক মাত্রা ও স্তর আছে। এক স্তরে একে ঈশ্বরের মৃত্যুতে বর্তমান যুগের যন্ত্রণা ও হতাশার রূপায়ণ বলে ব্যাখ্যা করা যায়। মানুষের জন্য, বিশ্বের জন্য, ঈশ্বরের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। কিন্তু বেকেট নাটকটিকে অত সহজ রূপক আকারে পরিকল্পনা করেননি। Godot স্পষ্টতই God থেকে উৎসারিত, তার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু সম্পর্কের প্রকৃতিটা ধোঁয়াটে, কুয়াশাচ্ছন্ন। ধরে নিলাম যে ঈশ্বরের সত্যিই প্রয়োজন আছে, আমাদের জীবনের তাগিদেই, কিন্তু কেমন সেই ঈশ্বর? খবর পাই যে তিনি আছেন, যদিও আসি-আসি করেও আসেন না আমাদের সামনে। এস্ট্রাগন এবং ভ্লাডিমির মি. গডো সম্পর্কে যতটুকু খবর সংগ্রহ করে, তাতে বোঝা যায় যে তিনি বেশ ভারিক্কি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাদের কাছে সময় করে আসার পূর্বে তার নিজের কাজকর্ম সিজিল-মিছিল করতে হবে, তার ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে তাকে আলাপ করতে হবে ইত্যাদি। একটি ছোট্ট বালক এসে এসব খবরাখবর সরবরাহ করে, জানায় যে, মি. গডো আগামীকাল আসবেন। তিনি খবরটা দিতে বলেছেন এক মি. এলবার্টকে। কে এই মি, এলবার্ট? এটা কি ভ্লাডিমিরেরই নামের অংশ, না অন্য কারো নাম? বালকটির কাছ থেকে মি. গডোর মেজাজ ও চেহারা সম্পর্কেও কিছু জানা যায়। লম্বা, সাদা দাড়ি, রুক্ষ মেজাজ, মেষপালক ছোকরাকে ধরে পিটুনি দেন তিনি। চেহারাটা ওল্ড টেস্টামেন্টের জেহোভার মতো। কিন্তু বালকটি কি সত্যি কথা বলছে, না তার প্রশ্নকারী যা শুনতে চায় তাই বানিয়ে বলছে ওদের খুশি করার জন্য? সে যে একটু ভয় পেয়েছে এবং সব সময় সত্যি কথা বলে না তার পরিচয় আমরা নাটকের মধ্যেই পাই। তাই কোনো দৃঢ় ইতিবাচক সুস্পষ্ট পথনির্দেশ গডোর প্রতীক্ষায় নাটকে নেই। একসময় যে ইঙ্গিত সুস্পষ্ট বলে মনে হয় পরে তারই বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে। বুর্জোয়া পোজোর কথা ধরা যাক। লাকিকে গলায় শেকল বেঁধে মালপত্রের বোঝা পিঠে চাপিয়ে সে প্রবেশ করে। মনে হয় আমরা এখানে বর্বরতা ও শোষণের ছবি দেখছি। আত্মসন্তুষ্ট, আয়েশি, বাক্যবাগীশ পোজো পাইপ টানে, গলায় স্প্রে ঢালে, সোনার ঘড়িতে সময় দেখে। লাকি নামটি ব্যঙ্গাত্মক। সে-ই একসময় শিক্ষক ছিল পোজোর। তার কাছ থেকেই পোজো সব শিখেছে, কিন্তু এখন তার মন ফাঁকা, সম্পূর্ণ শূন্য, সে জড়, অথর্ব, নিঃশেষিত। এই অবক্ষয়ের ছবি নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে আরো দ্রুততার সঙ্গে উপস্থাপিত। পোজোর হাত থেকে সব যেন খসে পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। এখন সে অন্ধ। প্রথম অঙ্কে বলেছিল যে লাকিকে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রি করার জন্য, কিন্তু এখন আর তার কোনো উল্লেখ নেই। লাকির গলার শেকলটাও ছোটো হয়েছে, তাকে আর আগের মতো চাবুকের আঘাতে পোজো তাড়িয়ে বেড়ায় না, বরং সে-ই পোজোকে পথ দেখিয়ে সামনে নিয়ে যায়। আগে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের যে ছবি মনের মধ্যে গেঁথে উঠেছিল সেটাকে আর এখন ঠিক ধরে রাখতে পারি না আমরা। নিষ্ঠুর প্রভু আর নিপীড়িত দাসের পরিবর্তে একটা পারস্পরিক নির্ভরতার ছবি আমরা দেখি, যে নির্ভরতার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বা পটভূমি আবিষ্কারে আমরা ব্যর্থ হই। এটা কতকটা এস্ট্রাগন-ভ্লাডিমিরের সম্পর্কের মতোই। তাদের ক্ষেত্রে একজনের মুখ থেকে গন্ধ বেরোয়, আরেকজনের পা থেকে। একজন অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও আবেগপ্রবণ, সঙ্গীর জন্য চিন্তাগ্রস্ত, তার প্রতি সহানুভূতিশীল, একটু পুরুষের ভাব তার মধ্যে। আরেকজন কবিত্ব করে, খুঁতখুঁত করে, হঠাৎ চটে যায়। একটু মেয়েলি ভাব তার মধ্যে। একটা দাম্পত্য সম্পর্কের প্যারোডির আভাস সুস্পষ্ট। কিন্তু কোনো মহৎ আবেগ নেই, কোনো সর্বগ্রাসী গাঢ় অনুভূতি নেই। মানুষ শেষ পর্যন্ত এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এরাই আজকের দিনের নায়ক। বেকেট যেন সেটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছেন। তারা শুধুই প্রতীক্ষারত, এক মি. গডোর জন্য, যিনি খবর পাঠান যে আসবেন কিন্তু আসেন না। নায়কদ্বয় বলে, ‘চলো, যাই’, কিন্তু যায় না।
স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো এবং এন্ডগেম প্রায় সবার পরিচিত, জনপ্রিয়তার দিক থেকে এ দুটি নাটকের প্রতিদ্বন্দ্বী মেলা ভার, আধুনিক নাট্যাঙ্গনের যেকোনো অনুষ্ঠানসূচিতে এদের স্থান প্রায় সুনিশ্চিত। গডোর প্রতীক্ষায় প্রথম পরিবেশিত হয় প্যারিসের থিয়েটার ডি ব্যবিলনে ১৯৫৩ সালের ৫ জানুয়ারি। নাটকটি প্রথমে বেকেট রচনা করেন ফরাসি ভাষায়, ফরাসি সংস্করণ প্রকাশিত হয় প্যারিসে ১৯৫২ সালে। পরে তিনি তার ইংরেজি অনুবাদ করেন। ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্কে, ১৯৫৪ সালে। তারপর থেকে বহু জায়গায় ঈর্ষণীয় সাফল্যের সঙ্গে গডোর প্রতীক্ষায় অভিনীত হয়েছে, হয়ে চলেছে। অন্তত বাইশটি দেশে নাটকটি পরিবেশিত হয়েছে, বিশটিরও বেশি ভাষায় নাটকটি অনূদিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে পঞ্চাশের দশক থেকেই এই ব্যতিক্রমী নাট্যকার সারা বিশ্বে সাড়া জাগাতে আরম্ভ করেন, যদিও তিরিশের দশক থেকেই তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি প্রকাশিত হয়ে আসছে।
রচনার সংখ্যা ও পরিমাণের দিক থেকে বেকেট অসাধারণ বা খুব উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নন। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বা ব্যাপ্তির ক্ষেত্রেও তার পুঁজিকে তেমন বড় বলে আখ্যায়িত করা যায় না। কিন্তু জীবন সম্পর্কে তাঁর বিশেষ উপলব্ধি এবং চেতনাকে তিনি অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে এক স্বল্প-চেনা শৈল্পিক ভঙ্গিতে পাঠক-দর্শক চিত্তে সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে প্রায় দু-দশক ধরে তিনি বিশ্ব নবনাট্য অঙ্গনের অবিসংবাদিত প্রথম পুরুষ বলে প্রমাণিত হয়ে আসছেন, ১৯৬৯ সালে পুরস্কৃত হয়েছেন সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার দ্বারা।
স্যামুয়েল বেকেটের জন্ম ১৯০৬ সালে, ডাবলিনের কাছে ফক্সর নামক একটি স্থানে। জাতিগত দিক থেকে তিনি আইরিশ, ভাষাগত দিক থেকে দ্বিভাষিক। ১৯২৮ সালে প্যারিসে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন কিছুকাল। তখন আলাপ হয় জেমস জয়েসের সঙ্গে, আরেকজন দেশত্যাগী আইরিশ, আধুনিক উপন্যাসের অন্যতম দিকপাল। বেকেটের সাহিত্যকর্মে ও চিন্তাধারায় জয়েস এবং প্রস্টের প্রভাব রয়েছে, এবং তা নিতান্ত অকিঞ্চিকর নয়। ১৯৩৭ সালে বেকেট স্থায়ীভাবে প্যারিসে বসবাস করতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে তার একাধিক গল্প এবং কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, লন্ডন এবং প্যারিস উভয় শহর থেকে। ১৯৫৩ সালে ওয়েটিং ফর গডো পরিবেশিত হবার পূর্ববর্তীকালের বেকেটের রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল মার্কি [উপন্যাস ১৯৩৮], ওয়াট [উপন্যাস, শুরু করেন ১৯৪২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, প্যারিস থেকে অনধিকৃত ফ্রান্সের এক জায়গায় পালিয়ে গিয়ে], মলয় [উপন্যাস, রচনা করেন ১৯৮৭-এ, প্যারিসে প্রকাশিত হয় ফরাসি ভাষায় ১৯৫১ সালে এবং ইংরেজিতে ১৯৫৫ সালে], ম্যালোনি মারা যাচ্ছে [উপন্যাস, রচনা করেন ১৯৪৭-৪৮এ, প্যারিসে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে এবং নাম করা যায় না [উপন্যাস, রচনাকাল ১৯৪৯-৫০]। এইসব গ্রন্থের অনেকগুলিই বেকেট কর্তৃক দু-ভাষায় রচিত। কোনোটি আগে ইংরেজিতে লিখেছেন, পরে নিজেই ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কোনো ক্ষেত্রে প্রথম রচনা করেছেন ফরাসি ভাষায়, পরে নিজেই ইংরেজিতে তার অনুবাদ করেছেন। যেমন মার্কির মূল রচনা ইংরেজিতে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি বেকেট ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করেন ১৯৩৯ সালে। ১৯৪৫ সাল থেকে তিনি প্রধানত ফরাসি ভাষায় মূল রচনাকার্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। গোর প্রতীক্ষায় বেকেটকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়, যদিও এই নাটকটিতে যা আমরা পাই তার নির্ভুল ইঙ্গিত বেকেটের পূর্ববর্তী প্রায় সব কটি গ্রন্থে উপস্থিত। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ এই তিন বছর বেকেট কোনো উপন্যাস রচনা করেননি, কিন্তু কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক রচনা করেছেন। এর মধ্যে সব চাইতে বিখ্যাত হচ্ছে এভগেম। তা ছাড়াও রয়েছে All that fall, Krapp’s last Tape এবং Embers. এরপর ১৯৬০ সালে আবার তিনি একটি উপন্যাস রচনা করেন, তার নাম How It Is, ভাষা এবং আঙ্গিক নিয়ে বেকেট গোড়া থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তার বিষয়বস্তু এবং জীবনদৃষ্টির সঙ্গে সহধর্মিতা রক্ষা করে তিনি সর্বদা তাঁর রচনাশৈলীকে গড়তে প্রয়াসী হয়েছেন। The unnamable কিংবা নাম করা যায় নাতে তিনি প্যারাগ্রাফ বর্জন করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে, পূর্ণ যতিচিহ্নও প্রায় বাদ দিয়েছিলেন। এবার How li Is-এ প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ রাখলেন, কিন্তু নির্মমভাবে বর্জন করলেন সর্বপ্রকার যতিচিহ্ন। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত মন্তব্য করার অবকাশ এখানে নেই। আপাতত আবার তাঁর নাটকের আলোচনায় ফিরে যাই। ষাট ও সত্তরের দশকেও বেকেট বিশ্ববাসীকে বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ নাটক উপহার দিয়েছেন মঞ্চের জন্য, রেডিওর জন্য, টেলিভিশনের জন্য, চলচ্চিত্রের জন্য। এগুলির মধ্যে বিশেষভাবে নাম করতে হয় Happy days, Gascando, Play, Film, Eh Joe 47 Not I-র।
বেকেটের নাটক কীরকম ব্যাপক আন্তর্জাতিক দর্শক-পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সে সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত এই ভূমিকার পূর্ববর্তী একটি অংশে দেয়া হয়েছে। নিম্নোক্ত তথ্যাবলি এ বিষয়ে আরো আলোকপাত করবে। যেমন এন্ডগেম প্রথমু প্রদর্শিত হয় ১৯৫৭ সালে লন্ডনের রয়াল কোর্ট থিয়েটারে, ফরাসি ভাষায়। হ্যাপি ডেজ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় নিউইয়র্কের চেরি লেন থিয়েটারে, ১৯৬১ সালে। আর প্লে-র প্রথম প্রদর্শনী জার্মান ভাষায়, পশ্চিম জার্মানির উলমে, ১৯৬৩ সালে। বাস্টার কিটন অভিনীত ফিল্ম চলচ্চিত্রায়িত হয় ১৯৬৪ সালে, এবং পরের বছরই পুরস্কৃত হয় ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে। ১৯৬২ সালে ফরাসি ভাষায় রচিত Cascando-র ইংরেজি রূপান্তর বিবিসি থেকে প্রচারিত হয় ১৯৬৪ সালে। এই জাতীয় পরিসংখ্যান আরো দেয়া যেতে পারে, কিন্তু তা নিপ্রয়োজন। বেকেটের সাহিত্যকর্মের মূল সূত্র, সাধারণভাবে বিবেচনা করলে, নৈরাশ্যমণ্ডিত। জীবনের ধূসরতা, বিবর্ণতা, নিরানন্দ গতানুগতিকতা, অর্থহীন পৌনঃপুনিকতা, দুঃসহ ভার এবং জটিল দুর্বোধ্যতা তার মৌল উপজীব্য। কিন্তু তবু কেন এই সাহিত্যকর্মের এ রকম বিপুল জনপ্রিয়তা? এর সহজ উত্তর দেয়া কঠিন। গডোর প্রতীক্ষায় নাটকের কথা ধরা যাক। এর গঠনকৌশল, কাঠামোগত ভারসাম্য, ভিন্নধর্মী কবিত্বময় সংলাপ, এক কথায় এর আঙ্গিকগত দিকের একটা তৃপ্তিদায়ক আকর্ষণ অনস্বীকার্য। দ্বিতীয়ত, এস্ট্রাগন ভ্লাডিমিরের জীবনের ক্লান্তিকর ব্যর্থ প্রতীক্ষা, নিরানন্দ গতানুগতিক পৌনঃপুনিক উক্তি ও ক্রিয়াকলাপ হতাশা এবং বিভ্রান্তি সত্ত্বেও এর মধ্যে এক ধরনের বীরত্বের আভাসও আছে। নিরানন্দ দুর্বহ জীবনের ভার কেমন করে বহন করব আমরা, কীভাবে পাড়ি দেব এই দীর্ঘ পথ যেখানে শুধু নিরন্তর একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে? উত্তরটা খুব কঠিন বা বীরোচিত বা মহৎ নয়, খুব অনুপ্রেরণাদায়কও নয়। আমরা এই ভার বহন করব, এই পথ পাড়ি দেব অভ্যাসের জোরে, ক্লান্তি এবং যন্ত্রণা সত্ত্বেও চালিয়ে যাব জীবন, কথা বলব, নানা ক্রীড়ার উদ্ভাবন করব অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকের মতো, কান দেব না নৈঃশব্দের হা হা রবে, মেনে নেব এই জীবনকে যা উদ্ভট, অসম্ভব, মৃদুতম আশার রশ্বিবর্জিত। “আমরা সেন্ট নই, কিন্তু আমরা আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট রেখেছি। ক-জন মানুষ এই গর্বটুকুইবা করতে পারে?”
বেকেট নিজের বা সাধারণভাবে শিল্পকর্মের প্রকৃতি ও চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো রকম উক্তি করতে বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন। এদিক থেকে তিনি আয়োনেস্কোর বিপরীত কোটিতে অবস্থিত। তবে তাঁর বিরল উক্তিসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ অর্থবহ ও তাৎপর্যময়। আধুনিক চিত্রশিল্পীদের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি নতুন এক আর্টফর্মের কথা বলেছেন যার প্রতি তাঁর পক্ষপাত রয়েছে :
The expression that there is nothing to express, nothing with which to express, nothing from which to express, no power to express, no desire to express, together with the obligation to express. [Quoted by arnold P. Hinchliffe in The Absurd, London, Methuen & Co Ltd. 1969, P. 67] প্রকাশ করার এই যে অবলিগেশন তাই জীবনের অর্থহীনতাকেও এক ধরনের অর্থময়তা দান করে। বেকেট তাঁর নাটকে নিহিলিজমকে তুলে ধরেন না, বরং মানুষ যে নিহিলিস্ট হতে অপারগ সেই সত্যকে রূপায়ন করেছেন। তা ছাড়া শুধু অর্থ অনুসন্ধান নয়, তার নাটকের টোন বা সুরটিও উপলব্ধি করা চাই। সকল ব্যর্থতা বেদনা সত্ত্বেও বেকেটের ক্লাউনদের সঙ্গে আমরা এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করি। এই উষ্ণ অনুভূতি অনেকের জন্য জীবনের অ্যাবসার্ডিটির মধ্যে একটা ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।
কবীর চৌধুরী
১লা বৈশাখ, ১৩৮৮
ইংরেজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply