এ্যারিস্টটল-এর ‘পলিটিক্স’ – সরদার ফজলুল করিম
[T. A. Sinclair কৃত ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে বাংলা অনুবাদ]
অনুবাদ – সরদার ফজলুল করিম
প্রথম প্রকাশ মে ১৯৮৩
প্রকাশক – আহমেদ মাহমুদুল হক, মাওলা ব্রাদার্স
প্রচ্ছদ – ধ্রুব এষ
POLITICS OF ARISTOTLE : Translated by Sardar Fazlul Karim. Published by Ahmed Mahmudul Haque of Mowla Brothers
এ কালের
এবং
আগামীকালের
জ্ঞানার্থীদের
উদ্দেশে
সূচিপত্র
ভূমিকা
তৃতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
প্রথম পুস্তক – রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এবং সংগঠন
দ্বিতীয় পুস্তক – আদর্শ রাষ্ট্রের প্রশ্ন
তৃতীয় পুস্তক – নাগরিকতা
চতুৰ্থ পুস্তক – শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদ
পঞ্চম পুস্তক – বিপ্লব প্রসঙ্গে
ষষ্ঠ পুস্তক – গণতন্ত্র ও কতিপয়তন্ত্রের পার্থক্য
সপ্তম পুস্তক – ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য
অষ্টম পুস্তক – শিক্ষার প্রশ্ন
পরিশিষ্ট – ‘পলিটিক্স’-এর বিষয়-সংক্ষেপ
.
কিন্তু এক ব্যক্তি একই সঙ্গে ধনবান এবং দরিদ্র হতে পারে না। এবং এ কারণেই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রধান শ্রেণীবিভাগ হচ্ছে সম্পদবান এবং সম্পদহীন-এ দুইএর মধ্যে। (পলিটিক্স ৪ : 8 )
আমাদের বরঞ্চ একথা বলাই সঙ্গত যে, দরিদ্রগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানকার ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং ধনবানগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানকার ব্যবস্থা হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র। (পলিটিক্স ৪ : ৪ )
আইন যেখানে শাসন করে না সেখানে কোন শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। (পলিটিক্স ৪ : ৪)
পিতামাতার বিবাহের কথাও চিন্তা করতে হবে। (পলিটিক্স ৭ : ৬১)
তৃতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
আমার পারিবারিক দেহ থেকে ‘৯৮ সালের মহাপ্লাবনের দাগ এখনো মুছে যায়নি। তবু তার মধ্যেই আমার এই মুখবন্ধটি রচনার চেষ্টা।
দ্বিতীয় সংস্করণটি একেবারে নিঃশেষিত। আমাকে রাস্তাঘাটে এখনো পাওয়া যায়। * থলে কাঁধে খোঁড়া পা নিয়ে জীবনের পথে খুঁড়িয়ে চলছে কৃশদেহ একটি লোক। এপাশের ওপাশের পাঠকবর্গ এবং স্নেহভাজনের দাবী এবং তাগিদ : কই, ‘এ্যারিস্টটল- -এর পলিটিক্স কই? মুখে ম্লান হাসি আসে। কৃতজ্ঞতার হাসি। এই মুহূর্তেও ‘বাসি’ এ্যারিস্টটল-এর অন্বেষণ! তবে আর হতাশার কী আছে?
দেহের বয়স ৭৩। তবু মনের মধ্যে হতাশার অবকাশ নেই : মানুষ হিসাবে। কিন্তু প্রখ্যাত প্রকাশকগণ আপন আগ্রহে এগিয়ে আসবেন, তার ভরসা পাচ্ছিলাম না। সেখানেও ভরসা যুগিয়েছেন স্নেহভাজন মশিউল আলম এবং প্রীতিভাজন আহমেদ মাহমুদুল হক একজন এসেছেন ভরসা নিয়ে আমার কাছে এবং টেনে এনেছেন অপর জনকে। তাঁরা বলেছেন : এ বইকে আমরা আবার ছাপব। নিঃশর্ত এমন উদ্যোগ এবং ভরসার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
আমি বলি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এবং তার প্রকাশের পেছনে অধিকতর এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ থাকে কাহিনী থাকে : লেখক বা অনুবাদকের। তা অবশ্যই ব্যক্তিগত। পাঠকসাধারণ তা জানতে পারেন না। লেখক বা অনুবাদক সে কথা জানাতে পারে না। অথচ অপ্রকাশিত এবং অজানিত এ কাহিনীতেও গ্রন্থখানির আন্তরিকতা এবং গুরুত্বের প্ৰকাশ।
‘এ্যারিস্টটল-এর পলিটিক্স’-এর এই নতুন সংস্করণটিও উৎসর্গিত হল তাঁদের উদ্দেশে যাঁরা বিশ্বাস করেন : জ্ঞান অখণ্ড এবং অজানিত। সেই অখণ্ড এবং অজানিত জ্ঞানকে জানার অনিঃশেষ আগ্রহে তাঁরা নিজেরাও উৎসর্গিত।
আমি সকলের মঙ্গল কামনা করি।
বিনীত
সরদার ফজলুল করিম
অক্টোবর, ১৯৯৮
দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
আজকের ‘৯৬ সাল থেকে তের বছর আগের কথা। ১৯৮৩ সনে ‘এ্যারিস্টটলের পলিটিক্স’ গ্রন্থের বর্তমান বাংলা অনুবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সংস্থাটি বর্তমানে আর ক্রিয়াশীল নেই। ফলে বহুদিন যাবৎ ‘এ্যারিস্টটলের পলিটিক্স’-এর বর্তমান বাংলা অনুবাদ-গ্রন্থ বাজারে আর পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক হিসাবে অবরসর গ্রহণের পরেও আমার স্নেহভাজন ছাত্র সমাজের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটে নি। এটাকে এই বয়সেও বেঁচে থাকার একটা সার্থকতা এবং অনুপ্রেরণার উৎস বলে আমি অনুভব করি। বস্তুতঃ আমার শিক্ষকতা জীবনে আমার সংখ্যাহীন ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে যে-শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা আমি লাভ করেছি তাকে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। বর্তমানের তারুণ্যকে আমরা বৃদ্ধরা যতোই সমালোচনা করিনে কেন, বর্তমানের হাতেই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জীবন। তারাই গড়বে। সবযুগের সব বার্ধক্যেরই প্রবণতা থাকে অতীতকে রোমান্টিকভাবে স্মরণ করে বর্তমানের ‘অবক্ষয়ে’ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার। অথচ অতীতের ‘বর্তমানও’ একদিন তার সংকটকে অতিক্রম করে অতীতে পরিণত হয়েছে : নতুন বর্তমান জন্মলাভ করেছে। আজকের বর্তমানও আগামীকাল অতীতে পরিণত হবে। এই হচ্ছে জীবনের অনিরুদ্ধ ধারা। আমাদের খেয়াল থাকে না। তবু অতীত থেকে বর্তমান এবং বর্তমান থেকে অবিষ্যতের এই ধারার মধ্যে মানুষের সৃজনকর্ম, চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশ ও বৃদ্ধির মধ্যে একটি ক্রমপ্রসারমান ঐক্যসূত্র বিদ্যমান। এই বিকাশমান ধারাটিকে সচেতনভাবে স্মরণ না রাখলে ইতিহাস ও মানুষের জীবন পরিক্রমাকে উদ্দেশ্যহীন একটা আবর্ত বলে আমাদের বোধ হতে পারে। এমন বোধ থেকেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়। আমার স্নেহভাজন ছাত্র-ছাত্রীদের মনে যেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এরূপ হতাশাবোধের সৃষ্টি না হয় তারই জন্য আমি আমার সীমাবদ্ধ শক্তি দিয়ে তাদের মনে আশার আলো দীপ্ত করে রাখার চেষ্টা করেছি। তারই জন্য তাদের বলেছি : সক্রেটিস-প্লেটো-এ্যারিস্টটল যেমন কোন বিশেষ দেশেরই চিন্তাবিদ ছিলেন না, তেমনি কোন বিশেষ যুগেও তাঁরা সীমাবব্ধ নন। ব্যক্তি-মানুষের মৃত্যু থাকে। কিন্তু যথার্থ চিন্তাবিদের কোন মৃত্যু থাকে না। আমাদের স্মৃতিতেই তাঁদের জীবন। এবং তাঁদের জ্ঞান ও চিন্তার ভাণ্ডারের বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের মধ্যেই যে-কোন বর্তমানের অচিন্ত্যনীয় সমৃদ্ধি। আমি বলি : অন্যান্য সকল মহৎ চিন্তাবিদের ন্যায় সক্রেটিস-প্লেটো-এ্যারিস্টটল দেশ নির্বিশেষে আমাদের জ্ঞানের বর্ণমালা।…কিন্তু এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর বাংলা অনুবাদ যদি আমার দেশের গ্রন্থের বাজারে মুদ্রিত আকারে আদৌ পাওয়া না যায়, তবে আমার মতো বৃদ্ধের পক্ষেও একটি তরুণ ছাত্র এবং ছাত্রীকে ধমক দিয়ে বলার অধিকার থাকে না : পড়েছ, এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’? সবাই নয়। তবু এদের কেউ যদি আমার ধমকের জবাবে জিজ্ঞেস করে : কোথায় পাব সে বই, তখন আমি কি জবাব দেব, এই তরুণকে?
কিন্তু কোন গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ বা পুনঃপ্রকাশ লেখক বা অনুবাদকের নিজের আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। আমার তো সে ক্ষমতা আদৌ নেই। এ কারণে আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক বন্ধুবর অধ্যাপক মনসুর মুসার কাছে যে, তিনি এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের চিরায়ত মূল্যকে অনুধাবন করে এর বর্তমান অনুবাদটির পুনঃপ্রকাশের অনুরোধটি প্রত্যাখ্যান করেন নি। আগ্রহের সঙ্গে তিনি অনুবাদটির পুনঃপ্রকাশের প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কৃতজ্ঞ আমি বাংলা একাডেমীর পাঠ্যপুস্তক বিভাগের পরিচালক প্রীতিভাজন গোলাম মঈনউদ্দিনের কাছে এবং তাঁর বিভাগের অপর সহকর্মীবৃন্দ এবং মুদ্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রীতিভাজন অনুজপ্রতিমদের কাছে। এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, কোন গ্রন্থই কারুর একার সৃষ্টি নয় : না লেখকের, না অনুবাদকের। সুন্দরভাবে একখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রকাশনা একটি সামগ্রিক এবং যৌথ সৃষ্টি। বস্তুতঃ প্রত্যেক গ্রন্থের প্রকাশের পেছনে এই যৌথ পরিশ্রমের কাহিনী হচ্ছে অলিখিত অপর একখানি অধিকতর আকর্ষণীয় গ্রন্থ।
বর্তমান অনুবাদটির সীমাবদ্ধতা রয়েছেই। তবু এর যা কিছু বৈশিষ্ট্য এবং আন্তরিকতা ও পরিশ্রম তার কথা প্রথম সংস্করণের ভূমিকাটির উপসংহারে আমি উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। তার আর পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। পূর্ব সংস্করণের ভুল-ত্রুটি যথাসাধ্য সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করেছি। তথাপি একেবারে প্রমাদশূন্য রয়েছে, এমন কথা বলা যায় না। তার সংশোধন এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর আগ্রহী এবং সতর্ক পাঠকরা করে নিতে পারবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি।
সরদার ফজলুল করিম
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬
ভূমিকা
এ্যারিস্টটলের আলোচনা প্রাচীন জ্ঞানের সর্বশাখায় বিস্তারিত ছিল। দর্শন, প্রকৃতিবিদ্যা, যুক্তিশাস্ত্র, জীববিদ্যা, মনোবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি এবং কাব্যরীতি-সর্বক্ষেত্রে এরিস্টটলের অবদান রয়েছে। প্রাচীন জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটল ছিলেন বিশ্বকোষিক।[১] তখন গবেষণা এবং জ্ঞান সাধনার উপায়, অর্থাৎ কলা-কৌশল, যন্ত্রপাতি, দৈহিক যাতায়াত আজকের তুলনায় ছিল অনেক অপরিণত এবং সীমাবদ্ধ। সেদিক থেকে এ্যারিস্টটলের জ্ঞান ও গবেষণার আগ্রহ, উদ্যোগ এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা আধুনিকের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে।
এ্যারিস্টটলের জীবনের বিস্তারিত পরিচয় না দিয়েও কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যায়। এ্যারিস্টটল জন্মেছিলেন মেসিডোনিয়ার নিকটবর্তী স্টাগিরায় ৩৮৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে। তাঁর মৃত্যু ঘটে খ্রি. পূঃ ৩২২ সনে। তাঁর পিতা ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজদরবারে একজন চিকিৎসক। চিকিৎসকের পারিবারিক পরিবেশে তাঁর শৈশব ও কৈশোরকালের অতিক্রমণ। প্লেটোর একাডেমীতে এসে তিনি যোগ দেন ১৭ বৎসর বয়সে, ৩৬৭ অব্দে। তারপর প্লেটোর মৃত্যু, অর্থাৎ ৩৪৭ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বৎসর তিনি শিক্ষালাভ করেন প্লেটোর একাডেমীতে। প্লেটোর মৃত্যুর পরে এথেন্স নগরী ত্যাগ করে তিনি যান এশিয়া মাইনরের নিকটবর্তী দ্বীপ লেসবসে। সেখানে তিনি গবেষণা করেন সামুদ্রিক জীবজন্তু নিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে রাজকুমার আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। কিন্তু যুবক আলেকজান্ডার সিংহাসনে আরোহণ করে দেশ বিজয়ে বার হলে এ্যারিস্টটল এথেন্স প্রত্যাবর্তন করে তাঁর নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাইস্যুম প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ সনে। প্লেটোর একাডেমীর সঙ্গে এ্যারিস্টটলের লাইস্যুমের চরিত্রে পার্থক্য ছিল। একাডেমীর জোর যেখানে ছিল প্রধানত দৰ্শন, সাহিত্য, কল্পনা এবং বিমূর্ত অঙ্কশাস্ত্রের উপর, সেখানে লাইস্যুমের জোর ছিল বাস্তব গবেষণার উপর। ইতিহাসকারগণ বলেন, এ্যারিস্টটল তাঁর শিষ্য আলেকজান্ডারকে অনুসরণ করে তাঁর দেশজয়ের সঙ্গী না হলেও উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। এ্যারিস্টটলের গবেষণাকার্যে আলেকজান্ডারের আর্থিক এবং রাজকীয় আনুকূল্য ছিল। সম্রাটের হুকুম ছিল যেন এ্যারিস্টটলের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার লতা, পাতা, বৃক্ষ, জীবজন্তু সরবরাহ করা হয়।[২] এ কাজে গ্রীস এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে প্রায় সহস্র লোক নিযুক্ত ছিল। বস্তুত জ্ঞান ও গবেষণার সংগঠক এ্যারিস্টটল তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় সেই প্রাচীনকালে দস্তুর মত একটি জীব-গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন। এরূপও কাহিনী আছে যে, এ্যারিস্টটলের পরামর্শে আলেকজান্ডার নীলের বন্যার উৎস সন্ধানে একদল গবেষকের অভিযান সংগঠিত করেছিলেন। এ্যারিস্টটলের অভিজ্ঞতা এবং তথ্য সংগ্রহ কেবল প্রকৃতিবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসন-ব্যবস্থার পরিচয় লাভের জন্য এ্যারিস্টটল ১৫৮টি রাষ্ট্রের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে সংবিধানের একটি গ্রন্থাগারও তাঁর লাইস্যুমে গড়ে তুলেছিলেন।
এথেন্স নগরীতে জীবনের অধিকাংশকাল অতিবাহিত করেও এ্যারিস্টটল যে এথেন্সের রাজনৈতিক জীবনকে একজন সমাজবিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণমূলক এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন তার মূলে নিশ্চয়ই এ সত্যটি রয়েছে যে, এ্যারিস্টটল এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন নি। এথেন্সে তিনি ছিলেন, বলা চলে, বহিরাগত এবং বৈদেশিক এথেন্সের প্রচলিত নিয়মে এ্যারিস্টটল এথেন্সের নাগরিক হতে পারেন নি। তিনি এথেন্সের শাসন পরিচালনায় কোনভাবে যুক্ত হয়েছেন বলে জানা যায় না। শিক্ষার্থী হিসাবে তিনি প্লেটোর একাডেমীতে যোগ দিয়েছেন এবং শিক্ষক ও গবেষক হিসাবেই তাঁর সমগ্র জীবন তিনি অতিবাহিত করেছেন।
এ্যারিস্টটলের মৃত্যুর পরে দুহাজার তিনশত বৎসরের অধিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। জ্ঞানের শাখা তখনকার চাইতে অধিকতরভাবে বিভিন্ন এবং বিশিষ্ট হয়েছে। জীব, জীবন এবং মন—সর্বত্র নতুন নতুন সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। জ্ঞান গবেষণার নব নব উপায় এবং উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের জগতে এ্যারিস্টটলের অনেক অনুমান আজ হয়ত ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত এবং পরিত্যক্ত হয়েছে।
কিন্তু সমাজ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমনটি আজো বলা যায় না। সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠন প্রাচীন গ্রীসীয় নগর রাষ্ট্রের তুলনায় বৃহৎ এবং জটিল হয়েছে, এ কথা সত্য। দেশের সঙ্গে দেশের, মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, ঘনিষ্ঠ হয়েছে। গণনার কমপ্যুটার থেকে সাক্ষাৎ যোগাযোগের তার, বেতার, উপগ্রহ এবং দূর-চিত্রের উপকরণ আজ সর্বত্র মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তথাপি সমাজ-সমস্যার সমাধান যে খুব সহজতর হয়েছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এ্যারিস্টটলের অভিমতসমূহ সর্বক্ষেত্রে যে ভিত্তিহীন বা তাৎপর্যহীন হয়ে গেছে, এমন বলা যায় না। সেদিক থেকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটল আজ যতো না ক্রিয়াশীল, রাষ্ট্র এবং সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবশ্যই তার চাইতে অধিক পরিমাণে ক্রিয়াশীল।
সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ্যারিস্টটলের শ্রেষ্ঠ রচনা নীতিশাস্ত্র এবং রাষ্ট্রনীতি : ‘এথিকস’ এবং ‘পলিটিক্স’।
একে রচনা না বলে আলোচনা বলা উত্তম। গবেষকগণ মনে করেন, এ্যারিস্টটলের প্রায় সব গ্রন্থই তাঁর লাইস্যুমে প্রদত্ত আলোচনার সারমর্ম। এদের কোনটিই পুরাদস্তুর কোন গ্রন্থ নয়। হয়ত এ্যারিস্টটলের নিজের হাতে রচিত লাইস্যুমে আলোচনা হিসাবে উপস্থাপনার পরিকল্পনা-সংক্ষেপ। প্রায় ক্ষেত্রে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত বা অভিমতের উল্লেখ। কিংবা হয়ত লাইসুম্যের শিষ্যদের হাতে গৃহীত এ্যারিস্টটলের শিক্ষাদানের সার-সংক্ষেপ। এখানেই প্লেটোর রচনার সঙ্গে এ্যারিস্টটলের রচনার পার্থক্য। প্রাচীন হলেও প্লেটোর উদ্ধারকৃত রচনা সুসম্পূর্ণ সাহিত্য। এ্যারিস্টটলের রচনা তাঁর প্রজ্ঞার আভাস মাত্র, পূর্ণ পরিচয় নয়।
‘পলিটিক্স’ গ্রন্থ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের নানা মত। এ্যারিস্টটলের মৃত্যুর চারশ বছর পরে পুস্তকাকারে এর প্রকাশ।[৩] এতদিন ছিল পাণ্ডুলিপি আকারে। তাঁর অনুসারীগণ এর প্রতিলিপি রক্ষা করেছে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা একে ব্যবহার করেছে। বর্তমানে আটটি প্রস্ত বা পুস্তকে এ গ্রন্থ বিভক্ত হিসাবে পাওয়া যায়। কিন্তু এ প্রস্তুক-বিভাগও এ্যারিস্টটল-পরবর্তীকালের ঘটনা। এ যে কোন ধারাবাহিক রচনা নয় তা এ থেকেও বুঝা যায় যে, এ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে বিষয়ের পুনরুক্তি রয়েছে। অসম্পূর্ণতাও আছে। আলোচনার যে বিষয় একস্থানে উত্থাপিত হয়েছে কিংবা পরবর্তীকালে বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে বিষয়ের, তার আলোচনা অসমাপ্ত রয়েছে। তথাপি ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের মধ্যে প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্র এবং সমাজ সংগঠনের, তার জনমানুষের শ্রেণিবিন্যাসের, তার অর্থনীতির, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদের এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদের যে উল্লেখ এবং তথ্য দেখা যায় এবং মানুষের সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে যে সুচিন্তিত এবং দার্শনিক অভিমত পাওয়া যায়, তা ঐকালের প্রাচীন অন্য রচনাতে দুর্লভ। কেবল সমকালীন শ্রেষ্ঠত্ব এবং তা ৎপর্যের বিষয় নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যা নির্ধারণে এ্যারিস্টটলের প্রজ্ঞা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সমাজ ও কালকে অতিক্রম করে নৃবিজ্ঞানের সাধারণ, স্বীকৃত, সার্বজনীন সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে তাঁর ‘এথিকস’, এবং ‘পলিটিক্স’ অদ্যাবধি সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাত্রেরই কৌতূহল এবং গবেষণার আকর।
‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, রাষ্ট্রের উদ্ভব, তার উপাদান, রাষ্ট্রের অধিবাসীদের শ্রেণিবিভাগ, তার শাসনব্যবস্থা, সংবিধান, শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদ, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, শাসক এবং নাগরিকের সংজ্ঞা, দাসব্যবস্থার পক্ষে যুক্তিপ্রদান, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় অস্থিরতা, বিদ্রোহ বা বিপ্লবের সম্ভাব্য কারণ, সে কারণ প্রতিরোধের উপায়-এ সমস্ত বিষয়ের আলোচনা আছে।
এ আলোচনার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে এ্যারিস্টটলের আলোচনাটি বহুমুখী দার্শনিক তাৎপর্যে পূর্ণ। এই আলোচনাটি স্থান পেয়েছে বর্তমানে গ্রন্থখানির যে বিন্যাস পাওয়া যায় তার প্রথম প্রস্ত বা পুস্তকের প্রথম দুটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ে।
এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর একটি ‘পলেমিকাল’ বা প্রতিবাদমূলক ভূমিকা আছে, এটি উল্লেখ করা আবশ্যক। রাষ্ট্র-চিন্তার ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য তাঁর গুরু প্লেটো। প্লেটোর সঙ্গে এ্যারিস্টটলের দর্শনের যে মৌলিক কোন প্রভেদ আছে, তেমন নয়। প্লেটোর নিকট ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র যেমন আদর্শ, এ্যারিস্টটলের নিকটও ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র তার সকল সামাজিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আদর্শ সংগঠন। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রিক নগর-রাষ্ট্রেরই একটি আদর্শ রূপ। প্লেটো ‘রিপাবলিক’ রচনা করেছিলেন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রকে তার সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অন্তর-সংকট থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এ্যারিস্টটলও ‘পলিটিক্স’-এ যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন তার সাধারণ সার্বজনীন রাষ্ট্রীয় চরিত্র সত্ত্বেও সে সব সমস্যা গ্রিক-নগর-রাষ্ট্রেরই সমস্যা এবং প্রচলিত নগর-রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যই তিনি বিভিন্ন উপায়ের উল্লেখ করেছেন। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিকে’ সমাধানের ক্ষেত্রে অধিক কল্পনা-প্রবণ হয়েছেন। এ্যারিস্টটল সমস্যার আলোচনা এবং সমাধানে অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবের উপর অধিকতর নির্ভর করেছেন। কিন্তু প্লেটো তাঁর ‘লজ’ বা ‘আইনসমূহ নামক গ্রন্থে কল্পনার চাইতে বাস্তব সম্ভাব্যতার উপর জোর দিয়েছেন। আবার এ্যারিস্টটলও তাঁর সর্বোত্তম-রাষ্ট্রের চিন্তায় বাস্তবে যা অপ্রাপ্য তেমন আদর্শের কল্পনা না করে পারেন নি। তথাপি ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের বিভিন্নস্থানে এ্যারিস্টটল প্লেটোকে সমালোচনার পাত্র করেছেন। কোথাও প্লেটোর নাম উল্লেখ করেছেন। কোথাও উল্লেখ করেন নি। এ সমালোচনার পেছনে হয়ত প্লেটোর অমিত প্রভাবের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই অধিক ছিল। এ কারণে গুরুর বিরুদ্ধে তাঁর নিজের সমালোচনার যুক্তি কতখানি ক্ষুরধার, ন্যায্য এবং গ্রাহ্য হল তার বিবেচনা এ্যারিস্টটল করেন নি। অনেক ক্ষেত্রে প্লেটোর বক্তব্যকে বেঠিকভাবে উপস্থিত করতেও তিনি দ্বিধা করেন নি। কাজেই মৌলিক পার্থক্যের কারণে নয়, আপন ব্যক্তিত্ব স্থাপনের কারণেই এ্যারিস্টটল প্লেটোকে অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনা করেছেন—এমন অনুমান করা চলে।
‘পলিটিক্স’-এর প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম বাক্যটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য। প্রথম বাক্যটিকে রাষ্ট্রের একটি সংজ্ঞারূপে উপস্থিত করা হয়েছে। “আমাদের নিজেদের পর্যবেক্ষণ এরূপ সাক্ষ্য দেয় যে, প্রত্যেকটি রাষ্ট্র হচ্ছে কোন উত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষের সমবায়ে গঠিত একটি সংস্থা।”
এ বাক্যটিতে জ্ঞানালোচনা এবং গবেষণার এ্যারিস্টটলের সাধারণ এবং উত্তম বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হয়েছে। এ্যারিস্টটলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এ্যারিস্টটল জ্ঞানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের জন্য অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণকে মূল্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণেই কেবল প্রকৃতিবিজ্ঞান নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ইতিহাস এবং প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাই রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনার প্রথম বাক্যে তিনি ‘পর্যবেক্ষণের’ কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে নামের উল্লেখ না থাকলেও প্লেটোকে সামনে রেখে আমরা বাক্যটির মূল্যায়ন করতে পারি। বস্তুত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এখানেই প্লেটোর সঙ্গে এ্যারিস্টটলের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। প্লেটোর রাষ্ট্র-দর্শনের মূল হচ্ছে, রাষ্ট্র-নির্বিশেষ আদর্শ। প্লেটোর দর্শনে বাস্তব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভাব বা আদর্শ। তাই ‘রিপাবলিকে’র একটি বিখ্যাত বাক্য হচ্ছে : দি আইডিয়াল ইজ মোর রিয়াল দ্যান দি রিয়াল : যা আদর্শ তা বাস্তবের চেয়ে অধিক বাস্তব।[৪] প্লেটোর যুক্তি হচ্ছে আমরা ভাব বা আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হই। বাস্তবকে আমরা পরিচালিত করি আদর্শের লক্ষ্যে। ভাব বা আদর্শ হচ্ছে পরিমাপক। পরিমাপক ব্যতীত যেমন কোন বস্তুর মূল্যায়ন সম্ভব নয়, এবং মূল্যায়ন ব্যতীত কোন বস্তুর অস্তিত্ব যেমন মানুষের কাছে নিরর্থক তেমনি আদর্শ রাষ্ট্র হচ্ছে সকল বাস্তব রাষ্ট্রের পরিমাপক। বাস্তব রাষ্ট্র এথেন্স কিংবা স্পার্টা কতখানি ভাল কিংবা মন্দ তা আমরা নির্ধারণ করতে পারি আদর্শ রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে মাত্র। ভাল রাষ্ট্রের একটি ধারণা বা ভাব আমাদের আছে বলেই একটি বিশেষ রাষ্ট্রকে খারাপ কিংবা তত ভাল নয় কিংবা ভাল–এরূপ বলে অভিহিত করি। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে বস্তুর চাইতে বস্তুর পরিমাপক বড়, অর্থাৎ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ রাষ্ট্রের চাইতে আদর্শ রাষ্ট্রের ভাব বড়। ব্যক্তির চাইতে ব্যক্তির মন বড়। ভাববাদ বনাম বস্তুবাদের লড়াই-এর সূত্রপাত এভাবে প্লেটো থেকেই। তাই রাষ্ট্রের প্রশ্নে ‘রিপাবলিক’-এ সক্রেটিসকে যখন প্রশ্ন করা হল : তোমার আদর্শ রাষ্ট্র কি কোথাও বাস্তবায়িত হয়েছে? কিংবা একে বাস্তবায়িত করা কি সম্ভব? তখন সক্রেটিসের জবাব দিতে অসুবিধা হল না : তাতে কিছু আসে যায় না। “তাহলেও আমাদের এই রাষ্ট্র আদর্শ হিসাবে স্বর্গে দীপ্যমান থাকবে।… আমাদের এই রাষ্ট্র কোথাও অস্তিত্বময় থাকুক, কোনদিন সে অস্তিত্বময় হোক কিংবা না হোক-এই হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র যার রাজনীতিতে যে উত্তম সে অংশগ্রহণ করতে পারে।[৫]
মোটকথা, প্লেটোর দর্শনে কোন বাস্তব রাষ্ট্রই যথার্থ অর্থে পরিপূর্ণ রাষ্ট্র নয়। কারণ, পরিপূর্ণ রাষ্ট্র হচ্ছে আদর্শ রাষ্ট্র। যে কোন বাস্তব রাষ্ট্র আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নৈকট্য কিংবা দূরত্বের ভিত্তিতে অধিকতর কিংবা অল্পতর অপূর্ণ রাষ্ট্র, পুরো রাষ্ট্র নয়।
এ্যারিস্টটল যে সর্বক্ষেত্রে প্লেটোর ভাববাদের বলয়কে ভাঙ্গতে পেরেছেন এমন নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের আলোচনার এই সূচনায় তিনি যে গুরুত্বপূর্ণভাবেই গুরু প্লেটোর সঙ্গে পৃথক মত পোষণ করেছেন, এ কথা বলা যায়। প্রথম বাক্যে প্রদত্ত সংজ্ঞায় এ্যারিস্টটলের নিকট প্রত্যেকটি বাস্তব রাষ্ট্রই রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্র অপর একটি রাষ্ট্র থেকে শাসনগত এবং লক্ষ্যগতভাবে যতই ভালো কিংবা মন্দ বলে অভিহিত হোক না কেন, প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই হচ্ছে পরিপূর্ণরূপে রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রই কোন রাষ্ট্রের চাইতে অধিকতর কিংবা অল্পতর রাষ্ট্র নয়। কারণ, পর্যবেক্ষণ থেকে আহৃত তথ্যের সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই মানুষের সমবায়ে গঠিত এমন একটি সংস্থা যার সাধন করার মত একটি লক্ষ্য আছে। বলা চলে একটি উত্তম লক্ষ্য সাধনের জন্য সংগঠিত মানব সংস্থাই হচ্ছে রাষ্ট্র। এ্যারিস্টটল যে কোন লক্ষ্যকে উত্তম বলার কারণ ব্যাখ্যা করে : “আমি উত্তম কথাটি ব্যবহার করেছি। কারণ, মানুষ তাদের কর্মকাণ্ডে বস্তুত তাকেই সাধন করার চেষ্টা করে যাকে তারা উত্তম বলে বিবেচনা করে।” এদিক থেকে যে-রাষ্ট্রকে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করা হবে তার লক্ষ্যও উত্তম। কারণ, স্বৈরতান্ত্রিক শাসক নিজেকে স্বৈরতান্ত্রিক বিবেচনা করে না এবং সে মনে করে না যে, কোন অধম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে রাষ্ট্র শাসন করছে।
সকল বাস্তব রাষ্ট্রই পুরোপুরি রাষ্ট্র এবং আমাদের পর্যবেক্ষণের এই হচ্ছে সিদ্ধান্ত-এ কথা দ্বারা এ্যারিস্টটল আলোচনার ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ ফলক স্থাপন করেছেন। তিনি রাষ্ট্র আলোচনাকে প্লেটোর বিমূর্ত ভাববাদী দার্শনিক আলোচনা থেকে বার করে এনে বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্ভাবনাময় সড়কে দাঁড় করিয়েছেন। এ অবদান তাঁর কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বস্তুত রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ ও তুলনামূলক এবং ইতিহাসভিত্তিক আলোচনার পথিকৃত হচ্ছেন এ্যারিস্টটল।
রাষ্ট্র-আলোচনার গোড়ার সংজ্ঞাটিতে প্লেটোর দর্শনকে খণ্ডন করার লক্ষ্যটি স্পষ্টভাবে উল্লিখিত না হলেও এর কিছু পরে এ্যারিস্টটল যখন বলেন : “অনেকে এরূপ মনে করেন যে,রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে, রাজা এবং প্রজার মধ্যে, পরিবারের কর্তা এবং পরিবারের মধ্যে, দাস এবং প্রভুর মধ্যকার সকল সম্পর্ক এক। এদের মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য বা পার্থক্যের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এরূপ ধারণা ভ্রান্ত। এদের মধ্যে আকারগত পার্থক্য অবশ্য বিদ্যমান। কিন্তু আকারগত পার্থক্যই একমাত্র পার্থক্য নয়। কিংবা আকারই এখানে বিচারের নিয়ামক নয়।” তখন আর বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এ সমালোচনার লক্ষ্য নির্দিষ্টরূপেই প্লেটো।
ব্যক্তি নিয়ে সমাজ। ব্যক্তি নিয়ে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্র কি ব্যক্তির হুবহু প্রতিরূপ? রাষ্ট্র কি ব্যক্তির বৃহত্তর আকার মাত্র। সমাজ সংগঠনের ক্ষেত্রে এটি একটি মৌল প্রশ্ন। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের গঠন এবং প্রকৃতি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। একটি রাষ্ট্রকে তার প্রাথমিক সংগঠন থেকে শুরু করে তার শাসনব্যবস্থা পর্যন্ত তিনি উদ্ঘাটিত করে দেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন। রাষ্ট্র সংগঠনের গোড়ার কথা বলতে গিয়ে প্লেটো সঠিক ভাবেই বলেছেন : ব্যক্তির প্রয়োজন থেকেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। প্রয়োজনের তাগিদে ব্যক্তি ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে রাষ্ট্র তৈরি করে। কিন্তু এই রাষ্ট্রে শাসন ব্যবস্থা কিরূপ হবে? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্লেটো বললেন : “আগে আমাদের স্থির করতে হবে শাসনের নীতি কি এবং ন্যায়-শাসন কাকে বলে?” আর এটা স্থির করার জন্যই তিনি ব্যক্তিচরিত্র বিশ্লেষণ করলেন। ব্যক্তিচরিত্র বিশ্লেষণ করে বললেন : ব্যক্তির চরিত্রে তিনটি ভাগ : “প্রজ্ঞা, বিক্রম এবং প্রবৃত্তি। আর ব্যক্তির জীবনে শাসনের নীতি হচ্ছে : প্রজ্ঞা প্রবৃত্তিকে শাসন করে এবং বিক্রম এ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাকে সহায়তা দান করে।” প্লেটো বললেন, ব্যক্তির চরিত্রে যেমন তিনটি ভাগ, রাষ্ট্রের চরিত্রেও তিনটি ভাগ। রাষ্ট্রের মানুষকেও তিন ভাগে ভাগ করা চলে। এক ভাগের মধ্যে প্রজ্ঞার আধিক্য, এক ভাগের মধ্যে বিক্রমের, আর এক ভাগের মধ্যে প্রবৃত্তির আধিক্য। প্রজ্ঞার আধিক্য জ্ঞানীর মধ্যে, অভিজাতদের মধ্যে। বিক্রমের আধিক্য দৈহিক শক্তির অধিকারীর মধ্যে। প্রবৃত্তির আধিক্য শ্রমজীবী, মানে উৎপাদকদের মধ্যে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা বা আত্মা যেমন হাত, পা ও উদরের প্রবৃত্তিকে শাসন করে এবং দেহের শক্তি আত্মার এই শাসনকে প্রয়োগ করে, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জ্ঞানীরা শাসক হবে এবং শ্রমজীবী বা উৎপাদকরা শাসিত হবে। বিক্রম বা শক্তিধর অর্থাৎ সৈন্যবাহিনী শাসকের এই শাসন উৎপাদকদের উপর প্রয়োগ করবে। ব্যক্তির চরিত্রকে রাষ্ট্রের উপর এমনি সহজ এবং সরল আরোপে প্লেটোর কোন অসুবিধা হয় নি। কারণ, প্লেটে’র যুক্তি হচ্ছে : রাষ্ট্র হচ্ছে ব্যক্তির বৃহৎ আকার। ‘স্টেট ইজ ইনডিভিজুয়াল রিট লার্জ।’[৬] প্লেটোর মূল উদ্দেশ্য অবশ্য দাস ও শ্রমজীবী মানুষের উপর জ্ঞানী তথা অভিজাতদের শাসনকে যুক্তি সহকারে দৃঢ় করা। দাস এবং শ্রমজীবী মানুষের সংশয়, প্ৰশ্ন এবং প্রতিক্রিয়াকে শান্ত করা। এ মূল উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের যুক্তির পার্থক্যের দার্শনিক তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বক্তি দিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলেও, ব্যক্তিই যে রাষ্ট্র নয়, অর্থাৎ রাষ্ট্র যে ব্যক্তির বৃহত্তর আকার মাত্র নয়-এ্যারিস্টটলের এ উক্তি বিশেষ অর্থবহ। এ উক্তির মধ্যে এমন উপলব্ধি স্পষ্ট যে, সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যক্তির সমাহার মাত্র নয়। ব্যক্তি যখন ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হয়, যখন বহু ব্যক্তি পারস্পরিক লেনদেনের, সংযোগ এবং সহযোগিতার, আশা এবং প্রত্যাশার সম্পর্কে জড়িত হয় তখন যে সংস্থার জন্ম ঘটে তার চরিত্র বা প্রকৃতি এ সংস্থার একক বা উপাদান থেকে ভিন্নতর। এ প্রায় যৌগিক রাসায়নিক সংস্থার অনুরূপ। বিজ্ঞানের সাধারণ দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, হাইড্রোজেন অণু এবং অক্সিজেন অণুর সম্মিলনে যে সংস্থা অর্থাৎ পানির সৃষ্টি হয় সেটি চরিত্রগতভাবে না হাইড্রোজেন, না অক্সিজেন। সে উভয় উপাদান থেকে একেবারেই ভিন্ন। একটি জটিল যৌগিক সংস্থার একক এবং সমগ্রের চরিত্রের এই পারস্পরিক পার্থক্য বস্তুজগতের ক্ষেত্রে আমরা যতো সহজে অনুধাবন করতে পারি, আমাদের নিজেদের অর্থাৎ মানুষের সমাজের একক এবং সমগ্রের ক্ষেত্রে সেটি অনুধাবন করা তত সহজ নয়। এ্যারিস্টটলের বৈশিষ্ট্য এবং কৃতিত্ব এই যে, প্লেটোর পক্ষে এই পার্থক্য অনুধাবন করা যেখানে সম্ভব হয় নি, এ্যারিস্টটল সেখানে এটি নির্দিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। এই বোধটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন এ্যারিস্টটল বলেন : “রাজা প্রজার সম্পর্কটি যথার্থই পৃথক। এটি একটি রাজনৈতিক বা শাসনগত সম্পর্ক। এখানে একটি নাগরিক সংস্থার পার্থক্য বিদ্যমান। একটি গুণগত পার্থক্যের অস্তিত্বকে এখানে আমাদের স্বীকার করতে হয়।”[৭]
রাষ্ট্র একটি যৌগিক সংস্থা। এই জটিল যৌগিক সংস্থার চরিত্র সঠিকভাবে বুঝার উপরই নির্ভর করে রাষ্ট্রকে উত্তম রূপে শাসন বা পরিচালনার প্রশ্ন। আদর্শ রাষ্ট্র সংস্থা সকলেরই কাম্য। কিন্তু ন্যায়ের একটি আদর্শ ভাব সামনে রাখাই কি রাষ্ট্রকে উত্তম করার জন্য যথেষ্ট? রাষ্ট্রসংস্থাকে যদি উত্তম করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রসংস্থার সঠিক চরিত্রকে নির্দিষ্ট করতে হবে এবং তাকে অনুধাবন করতে হবে। কিন্তু যৌগিক রাষ্ট্র-সংস্থার সঠিক চরিত্র আমরা কেমন করে অনুধাবন করতে পারি? এ্যারিস্টটলের জবাব যেমন স্পষ্ট তেমনি তাঁর সে জবাব সামাজবিজ্ঞান অনুধাবনের নতুন পদ্ধতি নির্দিষ্ট করার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ্যারিস্টটলের জবাব হচ্ছে : কোন যৌগিক সংস্থার চরিত্র উপলব্ধি করা যায় যৌগিক অস্তিত্বকে তার গঠনগত উপাদানে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে। যৌগিককে ভেঙ্গে তার উপাদানে উপনীত হতে হবে। উপাদানের প্রকৃতির এবং শক্তির উপরই উপাদানের সম্মেলনে গঠিত অস্তিত্বের শক্তি। এখানে দুটো প্রক্রিয়া নিহিত। একটি হচ্ছে, উপাদান দিয়ে যৌগিককে গঠন করা। এ্যারিস্টটলের আলোচনায় এই দুটো প্রক্রিয়ারই স্বীকৃতি স্পষ্ট। রাষ্ট্রসংস্থা সাধারণ বস্তুর ন্যায় বিভাজ্য বস্তু নয়। তবু এ্যারিস্টটলের বৈজ্ঞানিক মনোভাবের প্রকৃষ্ট প্রকাশ এখানে যে, তিনি রাষ্ট্রসংস্থার ক্ষেত্রেও এই দুটি প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব প্রয়োগ করা যে আবশ্যক, দ্ব্যর্থহীনভাবে সে কথা তিনি ব্যক্তি করেছেন। এ্যারিস্টটল বলেছেন : “আমরা সাধারণত কি করি? আমরা একটি যৌগিক বা মিশ্র সংস্থাকে তার অন্তর্গত উপাদানে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। এই বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমরা অগ্রসর হতে থাকি এবং যতক্ষণ না তার অন্তর্গত উপবিভাগগুলি নিঃশেষ করে তার মূল উপাদানে আমরা পৌঁছতে পারি ততক্ষণ বিশ্লেষণের কাজটি শেষ হল বলে আমরা মনে করিনে। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে যদি আমরা তার অন্তর্গত উপাদানগুলিতে বিভক্ত করি তাহলে অধিকতর উত্তমরূপে আমরা এর অংশগুলির পারস্পরিক পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম হব এবং এই উপাদানগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল কোন নিয়মকে স্থির করা যায় কিনা-সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও আমাদের পক্ষে তখন সহজতর হয়ে দাঁড়াবে।”[৮]
এ্যারিস্টটলের এ অভিমতের শেষ অংশটিও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ প্রকৃতির নিয়ম আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। মানুষ বিশ্বাস করে প্রকৃতি-জগৎ নিয়মের অধীন। প্রকৃতি-জগতের নিয়মকে জেনেই মানুষ তাকে আয়ত্ত করতে পারবে, তাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে। যত অধিক পরিমাণে বিশ্বজগতের নিয়মকে সে জানতে পারবে তত অধিক পরিমাণে বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারবে, তত অধিক পরিমাণে সে তাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে।
কিন্তু মানুষের সমাজ এবং রাষ্ট্র কিরূপ অস্তিত্ব? মানুষই তো সমাজের উপাদান। মানুষ সমাজকে সৃষ্টি করে। সমাজ তার নিজের অস্তিত্বের বাইরের কোন অস্তিত্ব নয়। প্রকৃতি-জগৎ তার বাইরের অস্তিত্ব। প্রকৃতি-জগৎকে মানুষ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তার বস্তুরাজিকে সে ভাঙ্গতে পারে। ভেঙ্গে তার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া দেখতে পারে। সে আকাশকে নিরীক্ষণ করতে পারে। নিরীক্ষণ করতে পারে তার চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাকে। তাদের উদয়-অস্তের নিয়ম সে আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু মানুষ কি পারে মানুষের সমাজকে নিরীক্ষণ করতে, তাকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং তার নিয়ম কানুনকে আবিষ্কার করতে? আসলে মানুষের সমাজের কি কোন স্থির নিয়ম কানুন আছে? প্রকৃতি-জগতের ন্যায়, তার বস্তুর ন্যায়? এ প্রশ্নের অবিসংবাদিত মীমাংসা আজো হয় নি। কিন্তু একথা ঠিক যে, মানুষের সমাজও একটা বিশিষ্ট সত্তাসম্পন্ন অস্তিত্ব, তারও একটা নিজস্ব নিরীক্ষণযাগ্য বিধিবিধান আছে যা কোন ব্যক্তি-মানুষের মনের ব্যাপার নয়, অর্থাৎ যা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না, এরূপ অভিমত পোষণের পূর্বশর্ত হচ্ছে এই ধারণা যে, সমাজ এবং রাষ্ট্র মানুষের সৃষ্টি হলেও সে মানুষ-নিরপেক্ষ প্রকৃতির মতোই এক অস্তিত্ব। তাকে নিরীক্ষণ করা যায় এবং নিরীক্ষণ করে তার অন্তর্নিহিত নিয়মকে নির্দিষ্ট করা যায়। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এরূপ ধারণা আজো যেমন সর্বজনস্বীকৃত নয়, তেমনি এ্যারিস্টটলের যুগে এ ধারণা একেবারেই অচিন্ত্যনীয় ছিল। তাই এ ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের এরূপ ধারণা সামজবিজ্ঞানে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মোচনে বিপ্লবী তাৎপর্যপূর্ণ—একথা যথার্থরূপেই আমরা বলতে পারি।
এই অভিমতের অধিকতর দ্ব্যর্থহীন প্রকাশ ঘটেছে যখন এ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের প্রকৃতি
প্রসঙ্গে বলেন :
“কিন্তু সর্বোচ্চ বা চরম সংস্থা হচ্ছে নগর বা রাষ্ট্র। একাধিক গ্রামের সম্মেলনে গঠিত হয় রাষ্ট্র। বিকাশের যে ধারা আমরা বর্ণনা করেছি তাতে বলা চলে রাষ্ট্রে এই বিকাশের সমাপ্তি ঘটেছে।… আমাদের পূর্বের বক্তব্যের অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্র শ্রেণি বা প্রকারগতভাবে সেই বস্তুরই অন্তর্গত যার একটি প্রাকৃতিক সত্তা রয়েছে এবং প্রকৃতিগতভাবে মানুষ হচ্ছে রাষ্ট্রনৈতিক প্রাণী। মানুষের স্বভাব হচ্ছে রাষ্ট্র সৃষ্টি করা, রাষ্ট্রে বাস করা।”[৯]
‘প্রকৃতি’ বা ‘প্রকৃতিগত বা ন্যাচারাল’ শব্দের ব্যবহার এ্যারিস্টটল তাঁর ‘পলিটিক্স’ আলোচনার একাধিক জায়গাতে করেছেন। সর্বত্র যে একই অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এমনও নয়। কোথাও যা অপরিণত কিংবা আদিম তাকে প্রাকৃতিক বা প্রকৃতিগত বলেছেন। আবার কোথাও যা মানুষের জন্য অনিবার্য এবং মানুষ-নিরপেক্ষভাবে যার অস্তিত্ব রয়েছে ‘প্রকৃতি’ বলতে তিনি তাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু প্রথম পুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্রের মূল চরিত্র নির্ধারণে ‘প্রাকৃতিক’ শব্দের ব্যবহার দ্ব্যর্থহীন এবং দার্শনিক তাৎপর্যে পূর্ণ। মানুষ রাষ্ট্র গঠন করে। কিন্তু তাই বলে আমরা কি বলতে পারি, মানুষ ইচ্ছা করলে সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন নাও করতে পারে? এ্যারিস্টটল বলেন, না, মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। “মানুষের স্বভাব হচ্ছে রাষ্ট্র সৃষ্টি করা।… এমন মানুষ যদি পাওয়া যায় যে রাষ্ট্রহীন… তাহলে আমরা সে মানুষকে হয় অধমের অধম, নয়ত উত্তমের উত্তম, অমানুষ কিংবা অতিমানুষ বলে গণ্য করব।”
সমাজ বা রাষ্ট্র হচ্ছে মানুষের জীবনে অনিবার্য। রাষ্ট্র হচ্ছে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক কারণ, এর ব্যক্তিনিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। একটা পর্বত বা সমুদ্র প্রাকৃতিক। কারণ, পর্বত বা সমুদ্রের অস্তিত্ব ব্যক্তির উপর নির্ভর করে না। ব্যাখ্যা হিসাবে আমরা বলতে পারি, এ্যারিস্টটল এখানে স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল বলতে কৃত্রিমের বিপরীত অর্থ বুঝাতে চেয়েছেন ভাস্করের হাতে তৈরি মূর্তি একদিক থেকে কৃত্রিম বা অপ্রাকৃতিক। কারণ, ভাস্করের মূর্তির অস্তিত্ব ভাস্কর-নিরপেক্ষ নয়। ভাস্কর ইচ্ছা করলে মূর্তিটি তৈরি করতে পারে; ইচ্ছা করলে নাও করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজকে মানুষ তৈরি করে বটে। তবু রাষ্ট্র বা সমাজ এমন অস্তিত্ব নয় যাকে মানুষ ইচ্ছা করলে তৈরি নাও করতে পারে। কারণ, এ হচ্ছে মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। “কোন বস্তু বা সত্তার স্বভাব বা প্রকৃতি বলতে আমরা কি বুঝি? কোন কিছুর স্বভাব বা প্রকৃতি বলতে আমরা তার চরম পরিণাম বা বিকাশকে বুঝি। মানুষ কিংবা পরিবার কিংবা অপর যা কিছুই হোক না কেন, এদের চরম বিকাশই হচ্ছে এদের স্বভাব।” এ্যারিস্টটলের এরূপ উক্তি বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। বীজের স্বভাব বৃক্ষ হওয়া। শিশুর স্বভাব মানুষ হওয়া। কিন্তু এমন স্বভাবেরও দুটো দিক আছে। উপযুক্ত আলো-হাওয়া-মাটিতে বীজ বৃক্ষ হতে বাধ্য। উপযুক্ত পরিচর্যায় শিশুও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হতে বাধ্য। উপযুক্ত অবস্থায় মানুষও রাষ্ট্রগঠনে বাধ্য। কিন্তু বীজের বৃক্ষে পরিণত হওয়ার অনিবার্যতা এবং মানুষের রাষ্ট্রগঠনের অনিবার্যতা কি এক? এক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের চিন্তা অস্পষ্ট নয়। এ দুটি অনিবার্যতা এক নয়। বীজের স্বভাব আছে। পশুর স্বভাব আছে। মানুষেরও স্বভাব আছে। কিন্তু পশু ও মানুষের স্বভাবের পার্থক্য এখানে যে, মানুষের যুক্তিবোধ আছে। আর এ যুক্তিবোধের কারণে তার প্রকৃতিদত্ত স্বভাবের বিকাশে তার নিজেরও একটি সক্রিয় ভূমিকা আছে। তার স্বভাবের অনিবার্য বিকাশ বটে। তবু এ বিকাশকে তার বুদ্ধি এবং যুক্তি দ্বারা সে পূর্ণতর বা সহজতর করতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের অনিবার্য বিকাশে সমাজ বা রাষ্ট্রের উপাদান তথা মানুষের যে একটি সক্রিয় ভূমিকা বিদ্যমান এই উপলব্ধির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়ে এ্যারিস্টটল বলেছেন : “আমরা বলব, সমস্ত মানুষের মধ্যেই রাষ্ট্রের এই অংশীদারিত্বের একটি স্বাভাবিক আবেগ বিদ্যমান। এবং যে ব্যক্তি প্রথম রাষ্ট্রকে গঠন করেছে সে অবশ্যই মানব জাতির প্রভূত উপকার সাধন করেছে এবং এজন্য সে কৃতিত্বের দাবীদার।”[১০]
মানুষের এই ভূমিকার ক্ষেত্রেই এসেছে এ্যারিস্টটলের এরূপ উক্তি : “তাছাড়া রাষ্ট্র যে কেবল পরিণাম, তা নয়। পরিবার এবং ব্যক্তির পূর্বগামীও হচ্ছে রাষ্ট্র। কারণ সমগ্র হচ্ছে অংশের পুরোগামী। সমগ্রের মধ্যেই অংশের অস্তিত্ব।”[১১] এ্যারিস্টটলের এরূপ উক্তির তাৎপর্য এই যে, এ্যারিস্টটল সমাজ বা রাষ্ট্রকে কবেল ব্যক্তি-নিরপেক্ষ প্রাকৃতিক অস্তিত্ব বলে থামেন নি। তেমন হলে রাষ্ট্র উদ্দেশ্যহীন হয়ে যায়। তাহলে প্রাকৃতিক পর্বতের সঙ্গে ‘প্রাকৃতিক’ রাষ্ট্রের কোন পার্থক্য থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র হচ্ছে মানুষের সমবায়ে সংগঠিত সংস্থা। এবং যেহেতু মানুষই রাষ্ট্র গঠন করে সে কারণে রাষ্ট্রের ভাব যদি সূচনাতেই তার মনে না থাকে তাহলে মানুষের পক্ষে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হতে পারে না। ভাস্কর মূর্তি তৈরি করে। পরিপূর্ণ মূর্তিটি তার কাজের শেষ পরিণতি। কিন্তু মূর্তিটির ধারণা যদি সূচনাতে তার মনে না থাকে তাহলে মূর্তি হিসাবে প্রস্তর খণ্ডের পরিণামও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিক থেকে রাষ্ট্র যেমন শেষ, তেমনি সূচনাও বটে। তাছাড়া রাষ্ট্র হচ্ছে একটি সমগ্র সত্তা। ব্যক্তি হচ্ছে তার উপাদান। সমাজের মধ্যেই ব্যক্তির অস্তিত্ব। সমাজের বাইরে ব্যক্তির কোন যথার্থ অস্তিত্ব অকল্পনীয়। এ কারণে বলা চলে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যক্তির পূর্বগামী।
উপরের আলোচনাতে একটি কথা প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে যে, ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের প্রথম দুটি অধ্যায়ের কয়েকটি উক্তি বিশেষ দার্শনিক তাৎপর্যে পূর্ণ।
এ্যারিস্টটল সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এই দুটি অধ্যায়ে (কিংবা সমগ্র ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে) কোন সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দিষ্ট করেন নি। শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজই রাষ্ট্র। আর তাই রাষ্ট্রের বাইরে তিনি মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারেন নি।
সমাজবিজ্ঞানের আধুনিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য এই যে, সমাজ এবং রাষ্ট্র এক নয়। মানুষের জীবনের বিকাশের এক পর্যায়ে রাষ্ট্র-সংগঠনের উৎপত্তি। রাষ্ট্র মানুষের স্বভাবের প্রকাশ বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে মানুষের অস্তিত্ব অকল্পনীয় নয়। রাষ্ট্র বলতে আধুনিককালে প্রধানতঃ দণ্ড প্রয়োগের ক্ষমতা-সম্পন্ন শাসনকে বুঝায়। এরূপ সংগঠন ছাড়াও সামাজিক জীবন মানুষ হয়ত এক সময়ে যাপন করেছে। কারণ রাষ্ট্র বলতে বিভিন্ন বিভাগে সংগঠিত যে শাসন-ব্যবস্থা বুঝায় সেরূপ জটিল সংগঠন প্রকৃতির উপর এককালে একান্তভাবে নির্ভরশীল অসহায় মানুষের বিকাশ প্রক্রিয়ার আদিতে ছিল, এরূপ কল্পনা করা চলে না। তাছাড়া রাষ্ট্র বলতে যেরূপ জবরদস্তিসূচক একটি ব্যবস্থা বুঝায়, অন্তত যে কোন রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু যেখানে জবরদস্তি, সেখানে বিকাশমান মানুষ তার জীবনের ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে জবরদস্তি ব্যতিরেকে যুক্তির ভিত্তিতে পরস্পরের সঙ্গে যৌথ সামাজিক জীবন যাপন করতে পারবে না, এমনও কল্পনা করার কারণ নেই।
কিন্তু বড় কথা এই নয় যে, এ্যারিস্টটল সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন পার্থক্য নির্দিষ্ট করেন নি। বড় কথা এই যে, এ্যারিস্টটল সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন যে, সমাজ ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক হচ্ছে একটি দ্বৈত সম্পর্ক যেখানে সমাজ যেমন অনিবার্য, তেমনি সে মানুষের সক্রিয় উদ্যোগেরও সৃষ্টি। সে যেমন প্রাকৃতিক, তেমনি সে মানবিক। প্রকৃতি যেমন তাকে তৈরি করে, সেও প্রকৃতিকে তেমনি তৈরি করে।
সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে এরূপ সামগ্রিক চেতনার আভাস দানে এ্যারিস্টটল প্রাচীন ইতিহাসের এক অনন্য সমাজবিজ্ঞানী।
এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস্’ পাঠে আমরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা অনুধাবনে তাঁর আর একটি অন্তর্ভেদী দৃষ্টির পরিচয় পাই। মানুষের সামাজিক জীবনের মূল যে তার জীবনধারণের চেষ্টা তথা তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, এ কথা এ্যারিস্টটল স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। ‘পলিটিক্স’-এর প্রথম পুস্তকের নবম অধ্যায়ে এ্যারিস্টটল অর্থনৈতিক বিকাশের মূল সূত্রকে অনবদ্য সরলতায় বর্ণনা করেছেন। কেবল তাই নয়। মানুষের তৈরি জটিল রাষ্ট্র সংগঠনের শাসনব্যবস্থা তথা তার অদল-বদল, তার উত্থান পতন, তার ভিতরের বিদ্রোহ-বিপ্লব যে নিগূঢ়ভাবে রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে আর্থিক সম্পদের ভিত্তিতে বিভক্ত বিভিন্ন শ্রেণির আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত, এ সত্যও এ্যারিস্টটল তাঁর আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে অস্থিরতা এবং পরিবর্তনের মূল কারণ নির্দিষ্ট করে এ্যারিস্টটল বলেছেন : বিপ্লবের মূল কারণ হচ্ছে সাম্য এবং অসাম্যবোধ তথা অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সাম্য অবস্থা সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদ সম্পর্কে সুবিস্তারিত আলোচনা আছে ‘পলিটিক্স’-এ। ‘রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং পলিটি’-এ্যারিস্টটল-এর এমন শ্রেণিবিভাগ প্রাচীনকালের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার শ্রেণিবিভাগের স্বীকৃতি হলেও শাসনব্যবস্থার এমন বিস্তারিত আলোচনা অপর কোন চিন্তাবিদের মধ্যে দুর্লভ। এবং শাসনব্যবস্থার এই শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রেও এ্যারিস্টটল গুরুত্ব দিয়েছেন শাসকের সংখ্যার স্বল্পতা কিংবা আধিক্যের উপর নয়। এ্যারিস্টটল গুরুত্ব দিয়েছেন শাসকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। তাই গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এ্যারিস্টটল বলেছেন : ‘গণ’ তথা ‘ডিমস’ (Demos) সংখ্যায় যেমন অধিক, তেমনি তারা দরিদ্র। তাই ‘গণতন্ত্র’ বললে ‘দরিদ্রদের শাসন’ বুঝাই সঙ্গত। এমন যদি হয় যে একটি রাষ্ট্রে দরিদ্রের সংখ্যা কম, কিন্তু তারাই তার শাসক, তাহলে এ শাসনকে শাসকের সংখ্যাল্পতার কারণে ‘কতিপয়তন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত যদিচ করা হয়, কিন্তু একে শাসকদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে যথার্থই ‘গণতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করা উচিত। এবং অনুরূপভাবে অর্থবানরা যদি সংখ্যায় অধিক হয় এবং তারাই শাসক হয় তাহলে এমন শাসনকে সংখ্যার কারণে গণতন্ত্র না বলে ধনতন্ত্র বলাই সঙ্গত। এ্যারিস্টটলের নিজের কথায় :
“মনে করা যাক একটি নগরীতে এক হাজার তিনশত নাগরিক আছে। এদের মধ্যে এক হাজার জন ধনবান। এবং শাসনের ক্ষেত্রে অপর তিনশত জন দরিদ্রের কোন অংশ নাই। এ তিনশত জনও স্বাধীন নাগরিক। অপরদের সঙ্গে ধনের ক্ষেত্র ব্যতীত তারা সমান। এমন ক্ষেত্রে কারুর বলা উচিত নয় যে তেরশতের এই নগরীর ব্যবস্থা হচ্ছে গণতান্ত্রিক। অপরদিকে মনে করা যাক, যারা দরিদ্র তারা সংখ্যায় অল্প। তথাপি তারা শাসনক্ষমতা দখল করেছে এবং সংখ্যায় অধিক যে ধনবান তাদের উপর শাসন করছে। এমন ক্ষেত্রেও ধনবানদের যদি শাসনে আদৌ কোন অংশ দেওয়া না হয়, তাহলে এ ব্যবস্থাকেও কতিপয়তন্ত্র বলা সঙ্গত হবে না। আমাদের বরঞ্চ এ কথা বলাই সঙ্গত যে, দরিদ্রগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানকার ব্যবস্থা হচ্ছে, গণতন্ত্র এবং ধনবানগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানকার ব্যবস্থা হচ্ছে ‘কতিপয়তন্ত্র’। অবশ্য বাস্তবে যে বিষয়টিকে আমরা দেখি, সে হচ্ছে এই যে, দরিদ্রগণ সংখ্যায় অধিক এবং ধনিকগণ সংখ্যায় অল্প। অধিক হচ্ছে দরিদ্র, অল্প হচ্ছে ধনিক।’[১২]… কাজেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে সেটি যেখানে স্বাধীন নাগরিকদের মধ্যে যারা দরিদ্র তারা তাদের সংখ্যার আধিক্যের শক্তিতে নগরীর সরকার পরিচালনা করে এবং কতিপয়তন্ত্র হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে সংখ্যাল্প ধনিক এবং অভিজাতদের হাতে সরকার পরিচালনা ন্যস্ত থাকে।[১৩]
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এ্যারিস্টটলের কালজয়ী অবদানের মধ্যে আইনের শাসনের উপর তাঁর গুরুত্ব প্রদানকে অন্যতম অবদান বলে বিবেচনা করেন। এ মূল্যায়নটি যথার্থ। কোন্ শাসন উত্তম, এ আলোচনাও ‘পলিটিক্স’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। একের শাসন, কতিপয়ের শাসন, না বহুর শাসন? প্রথমে এ্যারিস্টটল এরূপ বিভিন্ন প্রকার শাসনের গুণাগুণের আলোচনা করেছেন। কিন্তু অন্তিমে তিনি বলেছেন যে, এক, কতিপয় কিংবা বহুজন-এরা জ্ঞানী, গুণী, মহানুভব যাই হোক না কেন, এরা ব্যক্তি। এবং এক, কতিপয় কিংবা বহুকে যদি রাষ্ট্রে সার্বভৌম বলা হয়, তাহলে তা হবে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রে সার্বভৌম শক্তি হওয়া উচিত আইনের, ব্যক্তির নয়। কারণ, ব্যক্তির মধ্যে আবেগ, ইচ্ছা, অনিচ্ছা আছে। ব্যক্তির শাসন হচ্ছে আবেগের তথা প্রবৃত্তির শাসন। কিন্তু আইনের শাসন মানে যুক্তির শাসন। এ্যারিস্টটলের এই যুক্তি মানুষের রাষ্ট্রবদ্ধ জীবনের এক চিরন্তন লক্ষ্যকে নির্দিষ্ট করেছে। রাষ্ট্র নির্বিশেষে আধুনিক মানুষের নিত্যদিনের সংগ্রাম হচ্ছে ব্যক্তি বনাম আইনের শাসনের সংগ্রাম। মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ক্রমাধিক পরিমাণে ব্যক্তির শাসনের স্থলে আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা।
“ন্যায়ের দাবী হচ্ছে, শাসিত হওয়ার পরিমাণের চেয়ে অধিকতর শাসক কেউ হবে না। শাসনের ক্ষেত্রে পালাক্রমে সকলেরই সুযোগ থাকতে হবে।… পালাক্রমে শাসনের কথা হচ্ছে আইনের কথা। এ থেকে আমরা বলতে পারি : আইনের শাসনই অধিকতর কাম্য, কোন একজন নাগরিকের শাসন নয়।…কাজেই যিনি বলেন, আইনের শাসন করা উচিত, তিনি দেবতা এবং যুক্তিকেই শাসক হতে বলেন, অপর কাউকে নয়। কিন্তু যিনি কোন মানুষকে শাসক বানাতে চান, তিনি তার দ্বারা একটি বন্য জন্তুকেই আমন্ত্রণ করে আনেন। কারণ মানুষের প্রকৃতি বন্য জন্তুর মত। প্রবল আবেগ শাসক এবং মানুষের মধ্যে সর্বোত্তমকে পর্যন্ত ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। কিন্তু আইনের মধ্যে আবেগশূন্য যুক্তির অধিষ্ঠান।[১৪] ….
….আইন যেখানে শাসন করে না সেখানে কোন শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। সকলের উপরই আইনের শাসন থাকা আবশ্যক।[১৫]
এ্যারিস্টটল যে একটি বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী সহকারে রাষ্ট্রের সকল রোগব্যাধি তথা সমস্যাকে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন এ সত্য তাঁর বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব এবং পরিবর্তনের আলোচনাতে সমধিক প্রকাশিত হয়েছে। সংবিধান বা শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদ আছে। কিন্তু যে কোন শাসনব্যবস্থারই তো ইচ্ছা হচ্ছে টিকে থাকার। সেদিক থেকে যে কোন শাসনব্যবস্থা কি প্রকারে অধিকতর দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারে, তাই হচ্ছে প্রকার নির্বিশেষে সকল শাসনব্যবস্থা এবং তার শাসকদের উদ্বেগের বিষয়। চিকিৎসকের সন্তান এ্যারিস্টটল এক্ষেত্রে চিকিৎিসকের একটি নিরাবেগ এবং নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে প্রত্যেক প্রকার শাসনব্যবস্থার মধ্যকার বিকার তথা অস্থিরতা এবং বিদ্রোহ-বিপ্লব-পরিবর্তনের মূল কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এবং চিকিৎসক যেমন রোগের ‘ভাল-মন্দ’ বিচার না করে তাঁর সহজ-কঠিন প্রত্যেক প্রকার রুগীর রোগের নিরাময়পত্র দান করেন, একেবারে অনুরূপভাবে এ্যারিস্টটল রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র, প্রত্যেক প্রকার শাসনব্যবস্থার অস্থিরতা ও বিপ্লবের কারণ নির্দেশ করেছেন। তাঁর নির্দিষ্ট কারণসমূহ কেবল প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রসমূহের বিশিষ্টতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। সে সকল কারণ আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রীয় জীবনের বিদ্রোহ-বিপ্লবেও প্রকৃষ্টভাবে কার্যরত।
এ্যারিস্টটলের পলিটিক্স-এর পঞ্চম পুস্তকের পুরো আলোচনাটি ব্যয়িত হয়েছে রাষ্ট্রে অস্থিরতা তথা বিপ্লবের বিশ্লেষণের উপর। এটিকে যথার্থভাবে এ্যারিস্টটলের ‘বিপ্লবতত্ত্ব’ বলে অভিহিত করা চলে। রাষ্ট্রে যে কোন-প্রকার পরিবর্তন এবং অস্থিরতার এমন সূক্ষ্ম এবং বিস্তারিত আলোচনা কেবল প্রাচীনকালের ক্ষেত্রে নয়, আধুনিককালেও বিরল।
এ সমস্যার আলোচনা শুরু করতে গিয়ে এ্যারিস্টটল কাল নির্বিশেষে মানুষের জীবনে প্রবহমান বোধের প্রকাশ করে বলেন :
“রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্বের মূলে সাধারণ কারণ হচ্ছে অসাম্য। কারণ, মানুষ যাকে ন্যায়সঙ্গত এবং সমান বলে বিবেচনা করে তার ভিত্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে। দুই রকম সমতা আছে। এর একটি হচ্ছে সংখ্যাগত সমতা। অপরটি হচ্ছে মান তথা গুণগত সমতা।[১৪]…
কেবল যে শ্রেণিগত বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অসাম্য বিপ্লবের উৎস হিসাবে কাজ করে, তাই নয়। স্থায়ীভাবে একই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যদি উন্নতির বৈষম্য ঘটে তবে সে বৈষম্যও যে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে তারও অতি স্পষ্ট আভাস দিয়ে এ্যারিস্টটল বলেন :
“অনেক সময়ে ভৌগোলিক কারণেও অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক বিন্যাস রাষ্ট্রের ঐক্যের অনুকূল না হতে পারে।… এ কথা আমরা জানি, যুদ্ধের মধ্যে অনেক সময়ে নদী কিংবা অপর কোন জলস্রোত পারাপারের কারণে সৈন্যরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও সেরূপ বিভিন্নতা থেকে বিভাগের সৃষ্টি হয়।’[১৭]…
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিষম গঠনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং তার ঐতিহাসিক পরিণাম যে এ্যারিস্টটলের এই বিশ্লেষণের একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কোন সমাজের মানুষের মধ্যকার অসাম্য যে কিরূপ বিসদৃশ হতে পারে তার অনবদ্য প্রকাশ দেখা যায় এ্যারিস্টটলের নিম্নোক্ত ব্যাখ্যাটিতে :
“…সমাজের অপর অংশের তুলনায় বিষম বিকাশ কিভাবে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের দেহের সঙ্গে তুলনাক্রমে দেওয়া চলে। দেহ বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত এবং যাতে সমগ্রের উপযুক্ত ভারসাম্য বিনষ্ট হতে না পারে এবং দেহ বিকল হয়ে না যেতে পারে সেজন্য সকল অংশের বৃদ্ধিকেই আনুপাতিক হতে হয়। বিষম অবস্থা দাঁড়ায় তখন, যখন একফুট উঁচু দেহতে এক গজ লম্বা পা গজিয়ে যায় কিংবা দেহের কোন অংশে মানুষের পশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ উদ্ভূত হতে থাকে।”[১৮]
এ্যারিস্টট্স রাষ্ট্রীয় জীবনের পরিবর্তনকে অস্বীকার করেন নি। বরঞ্চ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিকাশ এবং পরিবর্তন যে প্রকৃতির মতোই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক তা ‘পলিটিক্স’-এর আলোচনাতে স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শাসক বা শাসনব্যবস্থার মানবিক অপর এক স্বভাবও যে পরিবর্তনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করার, তাও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথা ‘রাষ্ট্র-চিকিৎসক’ সিহাবে স্বীকার করেছেন। এবং প্রত্যেক ব্যবস্থার বিকারের নিরাময়ের জন্য তিনি নিরাময়পত্র প্রদান করেছেন। কোন চিকিৎসকই মনে করেন না, তাঁর রোগী অমর কিংবা তাঁর নিরাময়পত্র তাঁর রোগীর রোগকে চিরতরে নির্মূল করবে। এ কেবল রোগীর বেঁচে থাকার প্রয়াসে সাহায্য করা। একই কথা এ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রে সত্য। এমন যে স্বৈরতন্ত্র, যে-শাসনব্যবস্থা সবচাইতে বেশি রোগগ্রস্ত, ব্যক্তি-কেন্দ্রিক, আইনবিহীন এবং অনিবার্যভাবে স্বল্পায়ু তার ক্ষেত্রেও এ্যারিস্টটল নিরাময়পত্র প্রদান করেছেন। তাঁর সে নিরাময়পত্র পাঠে পাঠকমাত্রের মনে যেমন কৌতুক রসের সৃষ্টি হয়, তেমনি তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ্যারিস্টটলের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির পরিচয় প্রকাশ করে। স্বৈরশাসক জ্ঞানীগুণীকে বরদাস্ত করে না। তাদের সকলকে সে নির্বাসিত করে; ঘরে ঘরে সে গুপ্তচর বপন করে; সভা-সম্মেলন অর্থাৎ নাগরিকদের মধ্যে চিন্তার আদান-প্রদানকে নিষিদ্ধ করে এবং নাগরিকদের সর্বদা সে এমন আর্থিক দৈন্যে এবং সর্বগ্রাসী পরিশ্রমে আবদ্ধ রাখে যেন তারা নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির বাইরে শাসন এবং শাসকের বিষয়ে কোন চিন্তা করতে এবং তাঁর প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম না হয়।
“স্বৈরশাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার দুটি উপায় বা নীতির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। উপায় দুটি বিভিন্ন। আমি বরঞ্চ প্রথমে সনাতন উপায়টি নিয়েই আলোচনা করব। কারণ, শাসনের এই নীতিটি অধিক সংখ্যক স্বৈরশাসকই অনুসরণ করেছে। করিন্থ-এর পেরিয়ানডার নাকি এর প্রয়োগের বেশ কিছু কৌশল প্রবর্তন করেছিলেন। তবে পারস্য-সরকারের নিকট থেকেও এর অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এখানেই আমরা স্বৈরশাসনকে রক্ষা করার পুরাতন সকল কৌশলের ইঙ্গিত পাই। এদের অন্তর্গত নীতিমালাগুলো হচ্ছে এরূপ : ‘মাথাগুলোকে ছেঁটে ফেল এবং স্বাধীনচেতাদের সরিয়ে দাও’ এবং সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কোন উপলক্ষে সম্মেলন বা সমিতিতে জনতাকে মিলিত হতে দিও না। কারণ এই স্থানগুলো স্বাধীনচিত্ততা এবং আত্মবিশ্বাসের জন্মকেন্দ্র এবং এ দুটি ব্যাপারেই স্বৈরশাসককে সতর্ক থাকতে হবে। বিদ্যালয় বা শিক্ষালাভের প্রতিষ্ঠানও তৈরি হতে দিও না এবং এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করো যেন প্রজাবৃন্দ পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে জ্ঞাত হতে না পারে। কারণ, পরিচয়ের ভিত্তিতেই তারা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। স্বৈরশাসকের জন্য আর একটি সনাতন উপদেশের কথাও শোনা যায়। এর দ্বারা স্বৈরশাসককে বলা হয় যেন সে নগরবাসীদের সর্বদা নিজদের নজরের মধ্যে রাখে এবং তাদের সময়ের সিংহভাগ যেন তারা স্বৈরশাসকের প্রাসাদের দ্বারে অতিবাহিত করে।
…অনুরূপভাবে স্বৈরশাসকের উচিত হবে তার প্রজাবৃন্দ কি বলছে কিংবা করছে তার প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করা।…আর একটি সনাতন উপায় হচ্ছে স্বৈরশাসনের সম্ভাব্য সকল বিরোধীদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়া। এমন কলহ সৃষ্টির উপায় হচ্ছে বন্ধুর বিরুদ্ধে বন্ধুকে লাগিয়ে দেওয়া, শ্রেনির বিরুদ্ধে শ্রেনিকে এবং এক অর্থবানকে অপর অর্থবানের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা।…স্বৈরশাসকের আর একটি প্রবণতা হচ্চে যুদ্ধ করার প্রবণতা। যুদ্ধ করার জন্য সর্বদাই সে প্রস্তুত। এর কারণ, যুদ্ধ হলে প্রজাবৃন্দ যুদ্ধের মধ্যে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের একজন নেতা আবশ্যক, এই বোধ তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।…স্বৈরশাসকের নীতির একটি অংশ হচ্ছে অপর সকলের চাইতে সুহৃদদের অধিকতর বিপজ্জনক মনে করে তাদের অবিশ্বাস করা।…এগুলি হচ্ছে স্বৈরশাসনের লক্ষণ এবং এভাবেই স্বৈরশাসন বহাল থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরেও নানা উপায় আছে এবং সেগুলিও একইভাবে নিন্দনীয়”।[১৯]
এ্যারিস্টটলের এমন বিশ্লেষণ আধুনিক কালের ক্ষুদ্রবৃহৎ কোন রাষ্ট্রের নাগরিকের কাছে কি ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে? কিন্তু বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতার দিক এই যে, এমন রোগীর উদ্দেশে এ্যারিস্টটলের অভিমত হচ্ছে : তোমার অনুসৃত নীতিতে তোমার জীবনকাল অধিকতর হ্রাস বৈ দীর্ঘ হবে না। তার চাইতে বরঞ্চ তুমি কিছুটা মহানুভব হওয়ার চেষ্টা কর; নাগরিকদের সহায়-সম্পত্তিকে এবং মেয়েদের সম্মানকে নিরাপদ করার প্রতিশ্রুতি দাও এবং জীবনযাত্রায় মিতাচারী হওয়ার উদ্যম নাও। তাতে তোমার জীবন-আয়ু কিছুটা দীর্ঘতর হতে পারবে।
স্বৈরতন্ত্রের অনুসৃত নীতিসমূহের যে বিস্তারিত উল্লেখ এ্যারিস্টটল করেছেন তা তার প্রায় সমকালীন ভারতীয় কুটনীতিজ্ঞ রাষ্ট্রশাসক কৌটিল্যের[২০] কথা সহজেই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’র মধ্যেও শাসকের করণীয় সম্পর্কে সুবিস্তারিত নির্দেশ পাওয়া যায়।
যথার্থভাবেই এ্যারিস্টটলের মত কালজয়ী চিন্তাবিদগণ অমর। আমরা যদিচ তাঁদের দৈহিক মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করি, কিন্তু তাঁদের চিন্তার মৃত্যু ঘটে না। এবং সে কারণে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের শাশ্বত সত্যের উল্লেখকালে আমরা বলিনে, ‘এ্যারিস্টটল এ কথা বলেছিলেন।’ আমরা বলি, ‘এ্যারিস্টটল এ কথা বলেন।’ আমাদের এরূপ উল্লেখ স্বাভাবিক।
কিন্তু কালজয়ী চরিত্রের আর এক বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁরা কেবল যে কাল থেকে কাল অতিক্রম করে অগ্রসর হন, তাই নয়। তাঁরা কেবল যে প্রত্যেককালের মানুষকে প্রভাবিত করেন তাই নয়। প্রত্যেক কাল দ্বারা তাঁরা নিজেরাও প্রভাবিত হন। সমাজ-জীবনে সক্রিয় মানুষদের দ্বারা তাঁরা নিজেরাও প্রভাবিত হন। সমাজ-জীবনে সক্রিয় মানুষদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। তারা পরস্পরের উপর ক্রিয়াশীল হয়। তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করে। এ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। প্রাচীন গ্রীসে এ্যারিস্টটল একভাবে গৃহীত হয়েছেন। যে-এথেন্সে তিনি নিজের শিক্ষালাভ এবং শিক্ষাদানের জীবন অতিবাহিত করেছেন, নিজের জীবনের আশঙ্কায় সেই এথেন্সকে মৃত্যুর একবছর পূর্বে তাঁকে পরিত্যাগ করে যেতে হয়। ইউরোপের নিরঙ্কুশ ধর্মান্ধতার যুগে বিস্মৃতির হাত থেকে সৃজনশীলভাবে এবং সযত্নে এ্যারিস্টটলকে রক্ষা করেন আরবীয় পণ্ডিতগণ। পরবর্তীকালে ইউরোপের খ্রিস্টীয় গোঁড়া পাদ্রীকুল যে-এ্যারিস্টটলকে এককালে পরিত্যাজ্য, অপাঠ্য বলে ঘোষণা করেছেন, আর এক যুগে ধর্মীয় সেই পণ্ডিতবর্গ সেই এ্যারিস্টটলের উচ্চারিত সত্যসমূহকে তাঁদের দেয় ব্যাখ্যা সহকারে অলঙ্ঘনীয় বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যাত এ্যারিস্টটলকে কেউ অমান্য এবং অস্বীকার করলে তাকে তাঁরা পাপী বলে অভিযুক্ত এবং বিচার করেছেন। আবার পুনর্জাগরিত ইউরোপের জ্ঞানান্বেষী ব্যক্তিবর্গের নিকট এ্যারিস্টটল জ্ঞানের নতুনতর প্রেরণার উৎস বলে বিবেচিত হয়েছেন। এমনিভাবে এ্যারিস্টটল কাল থেকে কালকে এবং দেশ থেকে দেশকে অতিক্রম করে অগ্রসর হয়ে আমাদের কালে এবং আমাদের দেশে এসে পৌঁছেছেন। সেদিক থেকে দেখলে, এ্যারিস্টটলকে অনিঃশেষ বিস্ময়ের এক আকর বলে বোধ হয়। এবং এ কারণেই আজ থেকে প্রায় চব্বিশ শত বছর পূর্বে রচিত এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ আধুনিক জগতের সকল দেশের জ্ঞানান্বেষীর চিন্তার ক্ষেত্রে নিত্যসঙ্গী হিসাবে বিরাজ করছে।
এ্যারিস্টটল একদিকে যেমন কালজয়ী তেমনি অপরদিকে তিনি তাঁর দেশ ও কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ। তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে এমন উপাদানের সাক্ষাৎ পাওয়া কষ্টকর নয় যে উপাদান তাঁর এই কাল ও দেশ-সম্পর্কের পরিচয়ের চিহ্নে চিহ্নিত। এ্যারিস্টটলের জীবনকাল হচ্ছে মানুষের ঐতিহাসিক জীবনের সেই দেশের সেই কাল যখন তার সমাজের বিকাশ দাসযুগকে পুরোপুরি অতিক্রম করে তার পরবর্তী এবং অধিকতর উন্নতকালে প্রবেশ করে নি। তারই স্বাক্ষর পাওয়া যায় এ্যারিস্টটলের দাসত্বের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনে। এ্যারিস্টটলের সময়ে যে দাসত্বের বিরুদ্ধে অগ্রসর চিন্তাবিদদের সমালোচনামূলক বক্তব্য উপস্থিত হতে শুরু করে নি, তা নয়। কিন্তু এ্যারিস্টটল তাঁর আর্থিক এবং সমাজগত অবস্থানে ছিলেন প্রচলিত সমাজের সমাজপতিদের অন্তর্গত। চিকিৎসকের সন্তান হলেও এ্যারিস্টটল ছিলেন রাজার চিকিৎসকের সন্তান। পণ্ডিত হলেও এ্যারিস্টটল ছিলেন প্রধানত দাসদের শ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত এথেন্সের শাসন ও সভ্যতারই পণ্ডিত এবং চিন্তাবিদ। তাই এ্যারিস্টটলের নিজের তত্ত্বমতেই প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজ ও শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে তার শাসক ও প্রধানদের পক্ষে স্বাভাবিক। এ্যারিস্টটলের মত পণ্ডিতের পক্ষে দাসত্বের সমর্থনে যুক্তি প্রদানকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের দেখা আবশ্যক। দেখা আবশ্যক দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে। এবং এদিক থেকে দেখলে এই দুর্বলতাকে আর অস্বাভাবিক ভাবার কারণ থাকে না। কালজয়ী চিন্তাবিদ মানে এই নয় যে, কালজয়ী চিন্তাবিদ তাঁর জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর কালকে জয় করেছেন, তাকে অতিক্রম করেছেন। সর্বক্ষেত্রেই যিনি এরূপ জয় করতে পারেন, তিনি আর মানবিক থাকেন না। মানুষ সেই মানুষকে নিয়েই গর্ববোধ করতে চায় যে-মানুষ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কোন কোন ক্ষেত্রে নিজের সচেতন চেষ্টায় তাঁর দেশ ও কালের সীমাকে অতিক্রম করে মানুষের অসীম দিগন্ত বিস্তারি বিকাশমান জীবনকে দূরের দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর এই দৃষ্টিই তাঁর উত্তরপুরুষকে নিজের কালকে অতিক্রম করার চেষ্টায় অনুপ্রাণিত করে।
এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর সবিস্তার ব্যাখ্যা দেওয়া এই স্বল্প পরিসর ভূমিকার উদ্দেশ্য নয়। এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-কে সহজভাবে পাঠ্য হিসাবে বাংলাভাষার পাঠকদের সামনে উপস্থিত করাই বর্তমান অনুবাদ প্রয়াসের লক্ষ্য। বর্তমান অনুবাদকে অনুবাদক যথাসাধ্য প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করেছেন। অনুবাদের মূল ভিত্তি পেঙ্গুইন প্রকাশনার মাধ্যমে ১৯৬২ সনে প্রকাশিত এ. এ. সিনক্লেয়ার-কৃত এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর ইংরেজি অনুবাদ। ‘পলিটিক্স’-এ আলোচিত বিষয়ের সহজ অনুধাবনের জন্য অনুবাদের শেষে পরিশিষ্ট হিসেবে ‘পলিটিক্স’-এর একটি সারসংক্ষেপ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া অনুবাদের মাঝে প্রয়োজনবোধে ব্যাখ্যামূলক দু’একটি বক্তব্য তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়েছে। তৃতীয় বন্ধনীর এমন বক্তব্যেরও প্রধান নির্ভর টি. এ. নিসক্লেয়ারের বক্তব্য। অনুবাদে যে ‘পুস্তক এবং অধ্যায় ক্রম’ উল্লেখ এবং অনুসরণ করা হয়েছে তা সুপরিচিত সকল ইংরেজি অনুবাদেই দেখা যায়। ফলে বর্তমান বাংলা অনুবাদের কোন অংশকে ‘পলিটিক্স’-এর যে কোন ইংরেজি অনুবাদের মধ্যে নির্দিষ্ট করতে কোন অসুবিধা হবে না।
এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর বর্তমান বাংলা অনুবাদ বেশ কয়েক বছরের ধারাবাহিক চেষ্টার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় পশ্চিমবঙ্গে ইতিপূর্বে ‘পলিটিক্স’-এর আর দু’খানি বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান অনুবাদক তা জ্ঞাত আছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এমন অনুবাদ বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী ও পাঠক সমাজের বুদ্ধিগত চাহিদার যথার্থ যোগান দিতে পারে না, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বা এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর ন্যায় চিরায়ত সৃষ্টির অনুবাদ ও ভাষান্তর যত অধিক হাতে সাধিত হয় ততই সেই ভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে। প্রত্যেকটি অনুবাদই অনুবাদকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বহন করে। এ দিক থেকে চিরায়ত সৃষ্টির কোন একটি অনুবাদই অপর অনুবাদের স্থান দখল করতে পারে না। কোন অনুবাদই বাহুল্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। কোন দুটি অনুবাদই এক নয়। একই গুণ ও বৈশিষ্ট্যে তারা মণ্ডিত নয়।
এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর বাংলা অনুবাদের পেছনে আমার স্নেহভাজন জানা-অজানা, চেনা-অচেনা তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ এবং দাবী যেমন প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে, তেমনি সহকর্মী শিক্ষক এবং সাহিত্যানুরাগীদের উৎসাহ দানও অব্যাহত রয়েছে। তাঁদের সকলের নিকট আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থ সংস্থা এবং সুহৃদবর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত শিক্ষাবিদ এবং কর্মীবৃন্দের সাগ্রহ সহযোগিতা ব্যতিরেকে এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর বর্তমান বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হতে অনির্দিষ্টকালের বিলম্ব ঘটত। এ কথারও উল্লেখ আবশ্যক। আমি তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থ সংস্থা এবং তার সকল কর্মীদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ডানা প্রিন্টার্স-এর কর্মীবৃন্দ যত্ন সহকারে আমার পাণ্ডুলিপি মুদ্রণ করেছেন। তাঁরাও আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতাভাজন।
বর্তমান অনুবাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য পাঠকবৃন্দ তাঁদের মতামত জানালে সে মতামতকে অনুবাদক যেমন সাদরে গ্রহণ করবেন তেমনি তা পরবর্তী সংস্করণের অধিকতর উন্নতিতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে।…
সরদার ফজলুল করিম
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১ মে, ১৯৮৩
—
১. Will Durant, Story of Philosophy (Pocket Libry Edn, 1955), P. 56
২. Will Durant প্রাগু., পৃ. ৫৬
৩. George Sabine, History of Political Theory, (London 1963), P. 89
৪. ‘The ideal is more real than the real’, দ্র. সরদার ফজলুল করিম, প্লেটোর রিপাবলিক, ২য় সংস্করণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮২; ৫ : ৪৭২।
৫. ঐ, ৯ : ৫৯২
৬. ‘State is Individual writ large’: G, 2 : 364, & William Boyd, An Introduction to the Republic of Plato, (London, 1962), P. 43
৭. পলিটিকস : পুস্তক ১, অধ্যায় ১
৮. পলিটিক্স : পুস্তক ১, অধ্যায় ১
৯. পলিটিক্স : পুস্তক ১, অধ্যায় ২
১০. পলিটিক্স : পুস্তক ১, অধ্যায় ২
১১. পলিটিক্স : পুস্তক ১, অধ্যায় ২
১২. পলিটিক্স : পুস্তক ৪, অধ্যায় ৪
১৩. পলিটিক্স : পুস্তক ৪, অধ্যায় ৪
১৪ . পলিটিক্স : পুস্তক ৩, অধ্যায় ১৬
১৫ . পলিটিক্স : পুস্তক ৪, অধ্যায় ৫
১৬. পলিটিক্স : পুস্তক ৫, অধ্যায় ১
১৭. পলিটিক্স : পুস্তক ৫, অধ্যায় ৪
১৮. পলিটিক্স : পুস্তক ৫, অধ্যায় ৩
১৯ . পলিটিক্স : পুস্তক ৫, অধ্যায় ১১
২০. কৌটিল্য বা চানক্য প্রাচীনকালের ভারত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার অন্যতম রাজনীতিক ও মন্ত্রজ্ঞ ছিলেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল নির্দিষ্ট হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩২২-২৯৮ অব্দ অবধি। ‘অর্থশাস্ত্র’ প্রণয়নের তারিখ সুনিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা যায় নি।
Leave a Reply