এসেছ তুমি রচিত হতে – কোয়েল তালুকদার
(গদ্য কবিতাগ্রন্থ)
উৎসর্গ –
মায়াবতী কে।
কত বড়ো এই পৃথিবী, কত মানুষ এই ব্রহ্মাণ্ডে। এত মানুষের মাঝে থেকে তোমার সাথেই আমার ‘দীর্ঘ বরষ মাস’ কাটাতে হলো, তুমিই এসে রচিত হলে।
১. কোনো গল্প নেই
একদিন এক বর্ষারাত্রে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়ার রাত দেখছিলাম। বাইরে তখন বৃষ্টি ঝরছিল অঝোর ধারায়। অন্তরের গহীনে কী এক অনন্ত দুঃখ রিমঝিম করে বাজছিল। আমি দুহাত বাড়িয়ে জলে ভিজাচ্ছিলাাম হাত। হঠাাৎ বুক কেমন যেন ব্যথিয়ে ওঠে। মনে পড়ে এক নিঃসঙ্গ দুপুরে একটি গল্প লেখার কথা। গল্পটি যার জীবনের, সে চায়নি গল্পটি কেউ জানুক। সে চেয়েছিল কথাগুুুলো লুুকিয়ে থাক তারই বুুুকের তলায়। কিন্তুু কথাগুলো জেনে গিয়েছিল আকাশের তারা। দখিনা বাতাস। পাড় ভাঙ্গা নদীর দুুকুল আর জোছনা বিহবল রাত্রি।
অঞ্জলিতে জল ভরতে যেয়ে সেই গল্পের কথাই মনে হচ্ছিল। কর্মশেষে ঘরে এসে যার সঙ্গে কথা বলি, তার মায়াময় মুুখের স্নিগ্ধতায় কেটে যায় ক্লান্তি। তার মধ্যেই আমার অফুরান শান্তি খুুঁঁজে পাাই। সেই আমার একটিমাত্র আশ্রিত নীড় যেন। কূলহারা নাবিক হঠাৎ যেমন খুঁজে পায় কূল।
আসলে কোনো গল্প নেই। তার সাথেই সব প্রাণ কথা হয়। তার সাথেই গল্প বলি বনমল্লিকার গন্ধ নিয়ে বৃষ্টিস্নাত রাত্রির অন্ধকারে।
২. বিস্ময়ে তাই জাগে
কেন এমন করে ভাঙচুর করো তুমি। কেন এমন করে ফুলের ঘায়ে। যোজন যোজন দূরে কোথায় কার হিয়া কাঁদে। আমি বিক্ষুব্ধ স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকি সারারাত। বিধাতা সব পারে। অপূর্ব যত প্রেম দিতে পারে। আবার বেদনার ঘাও। পৃথিবীর মায়া মমতার কাছে এই জীবন বাঁধা পড়ে যায়। লোভ আমারও হয়। তার সাথে থাকে যদি ভালোবাসার মতো অন্তরের টান।
প্রথম চাওয়া ব্যর্থ হয়েছিল বলে চৈত্রের ঊষা লগ্নে স্বপ্ন ভেঙে যায়। তারপর দ্বিতীয় চাওয়া, সেখানেও দীর্ঘশ্বাস! তারপর তুমি এলে। তোমাকে পাওয়ার প্রাপ্তিতে ভরে গেল প্রাণ।
‘অসীম কালের যে হিল্লোলে
জোয়ার ভাটার ভূবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। ‘
৩. পুরোনো কল্প কাহিনি
শ্রাবণ মেঘের দিনে বৃষ্টি এলেই একটা ছেলের খুব মন খারাপ হয়ে যেত। জানালা খুলে দেখত দূরে তেপান্তরের মাঠ জুড়ে বৃষ্টি ঢলে পড়ছে। হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুঁইত। দুই হাত ভিজাত জলে। তারপর কপাল আর দুই গাল মুছে শীতল করত।
টেবিলে বসে কবিতা লিখতে যেয়ে সারা পাতা জুড়ে তার নাম লিখত। স্বপ্ন এসে তার কাছে ভীড় করত সারারাত। পুরোনো কথা আর গোপণ নিভৃতে লুকিয়ে থাকা সুর এসে গান হয়ে যেত।
ছেলেটি এমনি করেই কখনো তারার আকাশ দেখত। কল্পনায় ময়ুরপঙ্খী নাও ভাসাত দিঘির জলে। কেউ কি যাত্রী হবে তার? কেউ কি ধরবে তার হাত! সঙ্গী হবে তার ?
এইত আমি সেই ছেলেটি।
দুই হাত মেলে কাউকে জড়িয়ে ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
৪. কদম্বকেশরের স্পর্শ
বর্ষা এসেছে কবে। এখনো কোথাও কদম ফুলের দেখা মেলে নাই। এই শহরে আজো কেমন যেন এর ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হই। তাই বর্ষা এলে কদম গাছ খুঁজে মরি পথে পথে।
কুসুমপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে একটি কদম গাছ ছিল। থোকা থোকা ফুল ফুটে থাকত এর ডালে। গাছটির ছায়া পড়ত দীঘির স্বচ্ছ জলে। আমি একবার জলের দিকে তাকাতাম, আরেকবার গাছের দিকে। কোথায় কোন্ বাতাস থেকে বিমুগ্ধ ঘ্রাণ চলে আসত। আর সে ঘ্রাণে মর্মরিত হয়ে উঠত আমার হৃদয়।
বহু শতাব্দী আগে কোনো এক জনমে পুণ্ড্রনগরীর একটি পুষ্করিণী পাড়ের কদমতলে দাঁড়িয়ে কদম ফুলের ঘ্রাণ দিয়েছিল একটি মেয়ে।
কদম্বকেশরের হলুদ কমলার স্পর্শ লেগেছিল আমার ঠোঁটে আর গ্রীবায়। প্রথম কোনো শিহরণও ছিল ঐটি।
কতো শত বছর আগের সেই মধুরম ছায়া-ছায়া স্মৃতি আজও আমার মনকে বিহ্বলিত করে।
৫. সাগর সঙ্গমে
বিয়ের পর নতুন বৌকে বলেছিলাম- সাগর দর্শনে যাবে, নাকি নীলগিরি পাহাড়ে উঠে নীল মেঘ ছুঁবে ? সে বলেছিল — ‘সাগর দর্শনে যাব।’ আমরা গিয়েছিলাম, সাগর সৈকতে।
সাগরের তীর ধরে দু’জন হেঁটেছিলাম। প্রথম সাগর দর্শন ছিল ওর, আবেগ আপ্লূত হয়ে উঠছিল তার প্রাণ, বিহবলতায় কেঁপে উঠেছিল ওর দেহ মন !
আমি ধরতে চেয়েছি তার হাত, সে কুঁড়াতে চায় ঝিনুক।
আমি নামতে চাই জলে। সে হাঁটতে চায় বালিয়ারীতে।
আমি কান পেতে রাখি তার বুকে। সে তখন গুনে সাগরের ঢেউ।
আমি ভাসতে চেয়েছি জলে। সে ঘুরতে চেয়েছে সাগর বেলায়।
আমি খুঁজেছি মুক্তা, সে খুঁজেছে প্রবাল দ্বীপের ঘাস ।
আমি তাকে বলি — সাগরের শব্দ শুনতে, সে তখন শোনে সাগরের গান ।
আমি বলি — চলো সাগর সঙ্গমে যাই।
সে তখন বলে — চলো জলের তলে হারিয়ে যাই।
আমরা নেমেছিলাম জলে, উত্তাল ঢেউ এসে ঢেকে দেয় শরীর । আমরা তখন ডুবতে থাকি, ধরি ওর কোমর, খুঁজি ছোট ছোট ঢেউ শরীরের বাঁকে বাঁকে। সে জড়িয়ে রাখে তার বূক আমার বুকে, খোঁজে শ্বেত প্রবাল । ও বলেছিল — তার নাকি মরতে ইচ্ছা করছে। আমি বলেছিলাম — তুমি একাই মরবে ? সে বলেছিল — না, দু’জনে মিলে।
৬. ভালোবাসার উপসর্গ
রাতের বেলায় জানালা খুলে দেখি —
কোথাও জোৎস্নার প্লাবন নেই। নিশীপাখিরা ঘুমিয়ে গেছে প্রথম প্রহরেই।
এপাশে তুমি নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে আছ আমারই দিকে। তোমার শরীর জুড়ে চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ।
কিছু ভালোবাসা পাপ পূণ্য মানে না। খুঁজে ফিরে স্থানু পার্বত্য গুহা। নয়ত উদ্দাম ভরা নদীর বাঁক। জোৎস্না ক্ষুধায় উদোর পূর্ণ করে শুক্লপূর্ণিমার চাঁদ।
প্রতিটি চুম্বনের এপিঠে ওপিঠে থাকে গীতগোবিন্দের শ্লোকের অন্ত্যমিল। ক্রমশ: সুর পায় তার প্রতিটি চরণে। তখন গীতগুলোই কেবল ধ্বনিত হতে থাকে।
৭. পল্লবিত হোক
তোমার অস্তিত্ব আমার ভালোবাসার সুবাস নিক। তোমার পায়ের পাতা স্পর্শ করুক যেখানে আমরা হেঁটেছি এক সাথে। আমি চাই আমার মমতার ছোঁয়া লাগুক তোমার দ্রোহে আর ঘৃণায়।
আমার সমস্ত গীতিকবিতা যাকে নিয়ে, সেই তুমি, আমার গভীরতম ভালোবাসায় নিয়ত পুষ্পিত,পল্লবিত হও।
এভাবেই আমার প্রেমের নির্দেশে তুমি স্পর্শ করো আমার অস্তিত্ব। আমরা একদিন থাকব না, আামাদের পদচিহ্নগলো থাকুক এই পার্থিবে অনন্তকাল।
৮. হিবিজিবি স্বপ্নের কথা
পৃথিবীতে এমন কেউ একজন থাকে
যে জীবনেও থাকে মরণেও থাকে। যাকে দেখতে পাই বহু যুগের ওপাড়ে —
কত স্বপ্ন নিয়ে সে পড়ে থাকে, কত জীবনের স্মৃতির জীর্ণ স্তুপে।
বহু কালের একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনার জন্য কান পেতে থাকি। ফিরে যেতে থাকি সেই অতীত বিন্দুতে, যেথায় অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে কেউ একজন বসে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে।
সব হিবিজিবি লেখার পাতাগুলো সরিয়ে বিনম্র চোখ সেই একটি পাতা খুঁজতে থাকে
যেখানে তার অনেক স্বপ্নের কথা লেখা থাকে-
আমি নির্লিপ্ত দু’চোখ মেলে দেখি তা।
৯. সীমান্ত
বয়স হয়ে গেল এখনও স্বপ্ন দেখা শেষ হলো না। শুক্লপক্ষের রাতেও দেখি, কৃষ্ণপক্ষের রাতেও দেখি। কিন্তু সেই সবই দুঃস্বপ্ন ও ক্লান্ত নিশিচারণের।
আর কয়েকবছর পর মাথার চুলগুলো গুণে বলে দিতে পারব। কপালের ভাজগুলোও আঙুলে ধরা পড়বে। আগে দৌড়ে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলতাম। এখন হেঁটে হেঁটে চলে যাই পার্কে ও লেকের ধারে। চাইলেই আর হাত পা ঝাপিয়ে পুকুরে সাঁতরাতে পারব না।
ছায়া পড়ে উঠোনে। রোদ্দুরে ঢেকে যায় দুপুর। একটি একাকী শালিক চুপচাপ বসে থাকে কার্নিশে। উড়ে গেলে পড়ে থাকে দুই একটি পালক। চাইলেই আগের মতো শিস মেলাতে পারব না কোনও সাদাকালো দোয়েলের সাথে।
পিয়ানোর রিডের উপর আর আঙুল চলবে না আগের মতো। চাইলেই গানও গাইতে পারব না। ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ হবে কণ্ঠে। পারব না একটি গীতিকবিতা লিখতেও।
১০. মন খারাপের দিনে
যেদিন আমার মন খারাপ থাকে সেদিন আমি সুন্দর কাপড়চোপড় পরি। ভাল জুতা পায়ে দেই। ওকেও বলি, তুমি একটি সুন্দর শাড়ি পরো। কপালে একটি টিপ দাও। পরিপাটি করে চুল বাঁধো।
যদি হয় তখন বিকেল। অথবা সন্ধ্যা। কিংবা সন্ধ্যারাত্রি। একটি রিক্সা নিয়ে দুজন কোনও কোলাহলহীন রাস্তা ধরে চলতে থাকি। পথে কোথাও টং দোকানের সামনে রিক্সা থামিয়ে চা খেয়ে নেই। অথবা চলে যাই দিয়াবাড়ির কাশবনে। লেকের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থেকে জল দেখি। বিকেলের রোদ ঝরে পড়ে। পাখি উড়ে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যার অস্তরাগ দেখি।
কোনও কোনওদিন রেস্টুরেন্টে বসে দুজন খাবার খেয়ে নেই। প্লেটে চামচের টুংটাং শব্দ হয়। দুজন গল্প করি। সে অনেক কথা।
কিছু লাবণ্যমুগ্ধ মুহূর্ত বৃষ্টিরেণুর মতো চোখে এসে পড়ে। অনাবিল আনন্দ নেমে আসে যেন আমাদের সমর্পিত জীবনে। খুব সুখ অনুভব হয় । মনটা সত্যি ভালো হয়ে যায়।
১১. স্বপ্ন নয় সত্যি
আমি কী তোমার প্রথম ভালবাসা?
নাকি আমার আগে আরও কাউকে ভালবেসেছ?
তুমি কী মনে কর,
তুমি আমার প্রথম প্রেম?
তা মনে করি না,
আমি প্রথম তোমার কেউ।
প্রাক প্রভাতে রূপবান। তারপর বেহুলা। চম্পাবতী ও কিরণমালা।
রাগ উঠাবে না। আসল নাম বলো।
পার্বতী , রোহিনী, লাবণ্য, মেহেরজান, মাধবীলতা, শেফালী মির্জা।
সত্যি কথা না বললে চলে যাব।
যোধা বাঈ, পদ্মাবতী, মেহেরুন্নেসা, আনারকলি।
সব রূপকথা আর কল্পকাহিনী।
যমুনা ছিল সবসময় যৌবনবতী।
ও আমাকে দুপাড় ভেঙ্গে জল ঢেলে দিত। প্রমত্ত স্রোতের বিপরীতে কিভাবে সাঁতার কাটতে হয়, সে কৌশলও শিখিয়েছিল আমার কিশোর বেলায়।
আমি চিত্রাকে দেখেছি। সুলতানের রং চুরি করে সে রং মেখেছি কতো তার বুকে। উদাসী দুপুরে সাহানার সুর বেজেছে পদ্মাপাড়ে। তারপর সমির্পিত হলাম শকুন্তলার কাছে এক অশ্বথ তলায়।
তারপর —-
কী ছায়া কী মায়া গো। ঠাকুরবাড়ির ঊষা আত্মহত্যা করল শোভন চক্রবর্তীর জন্য। আর গোপনে চোখের জল ফেলতে হল আমাকে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। শহর থেকে রিনি খালা’রা এল। কাঁচা ঢাসা পিয়ারা সে পছন্দ করত। আর পছন্দ করত শ্রাবণের কদম ফুল।
তোমার গল্প কী ফুরাবে না।
না।
এক আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথিতে তোমাকে নিয়ে ঘর হতে বেরিয়ে পড়ব। তোমার পরনে থাকবে সাদা শাড়ি। কপালে হলুদ রঙের টিপ। আমরা চাঁদের দিকে মুখ করে হাঁটতে থাকব। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব ইছামতীর তীরে। হাস্নাহেনার ঝাড়ের পাশে বসব দুজন। রাতভর জোৎস্না ঝরে পড়বে। জোনাকিও জ্বালাবে আলো চারপাশে। গান শুনব ঝিঁঝির। আর শুনব ইছামতী নদীর জলের কুলকুল ধ্বনি।
তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখিও না। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে কাঁদতে হবে।
এ স্বপ্ন দেখানো নয়, এ যে সত্যি।
১২. ওয়ান ফর সরো
পার্কে গিয়েছিলাম হাঁটতে। গেটের পাশে নেড়ি কুকুরটা আজ শুয়ে নেই। গাছগাছালিগুলো চৌচির করছে। ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছিলাম। রাস্তার ওপাশে বৃদ্ধা ভিখারিও আজ দাঁড়িয়ে নেই।
একজন মৃত মানুষকে স্বপ্ন দেখে আজ ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনটা বিষাদে তাই জড়িেয় আছে। পাশের স্কুলে একবার মাত্র ঘন্টা বেজে উঠলো। সন্ত্রস্ত হয়ে একটি গিরগিটি ঝোঁপে লুকালো।
ছাতিমের ডালে একাকী বসে আছে একটি শালিক। ‘One for Sorrow’ এই কথাটি বলেছিলো অনেক বছর আগে একটি মেয়ে। সে আজ আর নেই।
ঝরা পাতা ঝরছিলো পার্কে। আরো মানুষ হাঁটছে।কোথাও কোনো শূণ্যতা নেই।
১৩. কেউ অপেক্ষায় নেই
কবি হতে চেয়েছি রাত্রিদিন। দুহাতে পায়রা উড়ায়েছি। অকাতরে প্রেম নিয়েছি । বড়ো করে চুল রেখেছি। আতেল মনে করেছি নিজকে। লেখার টেবিলে কেটেছে সারাবেলা, চেতনায় দিয়েছি শান। রাজকুমারের মতো হেঁটে গেছি সহস্র দৃষ্টির সামনে দিয়ে। পাপবদ্ধতা নয়, একধরণের ভান ছিল, কারোর দিকে ফিরে না তাকানো।
আজ দূর, বহুদূর হেঁটে এসে দেখি কেউ আমাকে অনুসরণ করেনি। দেখি শূন্যতা চারদিক, দেখি কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় নেই ।
১৪. মায়াবতী
তপ্ত দুপুরবেলা কিংবা পরন্ত বিকেলে, সন্ধ্যায়, কিংবা নিশীথ রাত্তিরে যখনই ঘরে ফিরি না কেন, দরজার কড়া নাড়লেই একজন মায়াবতী এসে দরজা খুলে দেয়। আমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না । টেবিলে খাবার রেডি পাওয়া যায়। পরিপাটি থাকে বিছানা। ফুলদানিতে ফুলের সুবাস ঝরতে থাকে। শোবার সময় মশারিটাও টানাতে হয় না ।
অথচ শুক্লপক্ষ কোনো জ্যোৎস্না রাতে এই মায়াবতীর জন্য কখনো আনিনি একটি রজনী গন্ধার বৃন্ত ! কিংবা নীলকন্ঠ পাখির একটি পালক।
১৫. লীলাবতী
খুব ইচ্ছা হয়, কোনো এক শারদ রাতে
যেদিন পূর্ণিমার চাঁদ থাকবে আকাশে, চারিদিক মাতাল করা মল্লিকার গন্ধ ভাসবে। দিব্যভাবে স্নাত করব দেহ।
অলৌকিক এক মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখব আমাকে। ঐ পূর্ণচন্দ্র ধীরে ধীরে রক্তিম থেকে গৈরিক বর্ণ ধারণ করবে। অরণ্য প্লাবিত করবে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে।
বর্ষণমন্দ্রিত বিদ্যুৎ চমকিতের মতো সেই জোৎস্নালোকে, আমার লুকায়িত যত প্রেম আছে, যত মাধুরী আছে, তাই দিয়ে রচিত করব কাব্য গাঁথা।
পৃথিবীর ধূলো পথে তুমি শুয়ে থাকবে। শরীরে তোমার আনন্দ রেণু, বাতাসে চন্দনের গন্ধ। তোমারই পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে আজন্ম সখা, তোমার কবি।
তোমাকে নিয়ে রচিত আমার সেই কাব্য গাঁথার নাম দেব — লীলাবতী।
১৬. এই পথ যেন শেষ না হয়
আমি নিরন্তর পথ চলছি। এ চলার যেন শেষ নেই। কাশবনের ছায়া দিয়ে, পলাশ ডাঙ্গার মাঠ মাড়িয়ে,পদ্মফুলের গাং পেরিয়ে যে পথ চলে গেছে সামনে, সেই পথ দিয়ে আমি দেশ গা্ঁ ছাড়িয়ে চলে গেছি বহূদর !
আমি একাই পথ চলেছি। পথ চলবে বলে যারা আমার সাথি হয়েছিল, তারা মাঝ পথ থেকেই আমাকে ফেলে চলে যায়।
তারপর কখন কোন্ স্বর্নালী প্রভাত বেলায় তুমি আমার পথের প্রান্তে এসে সাথি হলে।
তারপর থেকে তোমাকেই নিয়েই পথ চলছি, আর এই পথ চলা যেন কোনও দিন শেষ না হয়।
১৭. মধুক্ষণ
জীবনের মধুক্ষণ গুলো আসে যৌবনের প্রথম প্রহরে।
কত আনন্দবেদনাবিধুর অপরাহ্নে, ভরা চৈত্রের দ্বিপ্রহরে একা একা পায়ে হেঁটে চলে ফিরে বেড়াতাম। বৃক্ষরাজির ছায়ায় খসে পড়েছে কত শুকনো পাতা। কত আলো ছায়াময় রোদ্দুর।
সময় কী সব কেড়ে নিয়ে যায়? আমি রেখে দিয়েছি, শরীরের নিভৃতে আমার যৌবন বেলার আনন্দ ও বিষাদ। সেই কনক চাঁপার সুবাস এখনও মুছে যায়নি, তাকে কখনই দূরে সরিয়ে রাখতে পারিনি। এখন আমি নাই আর সেখানে, তবুও উৎসব ফুরিয়ে যায়নি। চালচিত্রের মতো জেগে আছে নির্জন পাতা কুসুম আলো বাতাস, বৃষ্টি আর মধুর অপরাহ্ন।
খুব লিখে যেতে ইচ্ছা করে, আমার পুরাতন ব্যক্তিগত প্রণয়কথা। যা হারিয়ে গেছে চিরতরে, শব্দ দিয়ে আমি সাঙ্গ করতে চাই তার পারলৌকিক কাজ, তার মাতৃতর্পণ।
একটি অচেনা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল দূর আকাশের দিকে।
১৮. নক্রান্তিকাল
সে এক ঝিম ধরানো অসুখ। ঘুম আর চেতনার মাঝখানের সময়। হেঁটে যাচ্ছিলাম, আমার বহুবছর আগের চেনা পথ ধরে। কোথা থেকে একটি অপার্থিব আলো এসে পড়ে পথ চিনিয়ে নেওয়ার। একাকী বিকাল সরিয়ে দিয়ে চলেছিলাম দ্রুত পায়ে গহীন চরাচরের দিকে।
কিছু চলে যাওয়া একাকী হয়। কেউ থাকেনা সাথি হয়ে। কত যে অসীমের পথ পারি দেই নিঃসঙ্গে। পাশে কেউ নেই, কেউ নেই। কত বিপন্ন মুহূর্তকাল চলে যায়। আরও আলো খুঁজি পথ চলতে। কিন্তু কোথা থেকে দমকা বাতাস এসে সেই অপার্থিব আলোটিকে নিভিয়ে দিয়ে যায়।
আলো ফুঁড়ে অন্ধকার সরিয়ে ঝিম ধরানো সেই ক্রান্তিকাল যখন কেটে যায়, তখন চোখ মেলে দেখি — তুমি আমার পাশেই আছ।
১৯. শান্তি কোথায় আছে
যখন মন ভালো লাগেনা তখন কোনও কিছুই ভালো লাগেনা। তখন প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজিয়ে শুনি, তাও ভালো লাগে না। প্রিয় লেখকদের বই পড়ি, মন ভালো হয়না।
আমার কেবলই দুপুরের রোদ্রে হাঁটতে ইচ্ছা করে। পার্কে বেঞ্চে বসে একাকী সিগারেট খেতে ই্চ্ছা করে।বাউলের দোতারার সুর শুনতে ইচ্ছা করে। গত সোমবার থেকে ঠাকুরবাড়ির জারুল বনের কথা মনে পড়ছে খালি। ছোটবেলায় সেখানে ঝরা পাতা ঝরতে দেখেছি কত।
আমি হেম করবীর ছায়াতলে একাকী ঘুরে বেড়াই।কোথায় কোন্ প্রান্তরে এক নির্জন কুটিরে মায়াময়ী দুটি চোখ মেলে কেউ অপেক্ষায় আছে। আমি সেই চোখে খু্ঁজে বেড়াই অশ্রুত জীবনের একদণ্ড শান্তি। ঈশ্বরই জানে, আমার শান্তি কোথায় আছে।
২০. আত্মপক্ষ
আগে সাদা কাগজে কবিতা লিখতাম। এখন লিখি কীবোর্ডে। যদি কীবোর্ড সচল না থাকে, তখন ফিরে আসি আবার সাদা কাগজে। ইদানিং খুব ভুল হয়। কাটাকুটি করতে হয় অনেক কিছুই। চোখের জল লিখে, কেটে অশ্রু বারি লিখি। প্রভাতের সূর্য কিরণ না লিখে, লিখি আজ সকালের রোদ্র ছুঁয়েছে তোমার আরক্ত মুখে।
কবিতার খাতার শরীরে অজস্র ক্ষত। রক্ত গড়ায়নি এখনও। সমবেদনার জন্য একটা শব্দও এখনও লিখিনি। অপরাধবোধ জাগে, অনুশোচনা পিছু ছাড়ে না।
একবার মনে হয়, এইসব লিখে কী লাভ? নির্জন রাত্রি দুপুরের নিস্প্রভ জোনাকির আলো, কিংবা নিস্ফল অশ্রু বারিপাত, সবই মূল্যহীন। কে কোথায় কাঁদল, কে কোথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এ নিয়ে কবিতার চরণে কোনো ধারা বইতে চাইনা। যে যেথায় আছে তেমনি থাক। দুঃখে অথবা সুখে।
কেউ যেন আমাকে মনে না রাখে। আফসোস করব না এইজন্য যে,’ মনে রবে কিনা রবে আমারে।’
২১. কি নাম ছিল মেয়েটার
সেই গাঁয়ের বালিকাটির কথা মনে পড়ে। কি ছিল ওর নাম? নামটাও দেখছি ভুলে গেছি! কি মিষ্টি ছিল ঠোঁটের গড়ন। যেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। তীব্র চাহনি ছিল, দৃষ্টিতে মায়া ছিল। কার যেন অন্তর কাঁপাতো । কি নাম ছিল মেয়েটার ?
কলাপাতায় প্রেমপত্র লিখিছি। চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছি অবলীলায়? প্রেমপত্রও ছিঁড়েছি, ছিছি! গোল্লাছুট খেলতাম। ছো্ঁয়াছুঁয়ির খেলা খেলতাম। কি নিষ্ঠুর খেলাধূলা ছিল তখন। পাপ হয়েছিল নিশ্চয়। গান গেয়েছিল সন্ধ্যা পূজায়। কি নামে ওকে যেন ডাকতাম। ধূপের সুবাসেও সেই নামটি মনে করতে পারছি না আজ আর।
২২. জীবন যদি থেমে যায়
জীবন যদি থেমে যায় ধূলি পথের দীপ্ত প্রান্তরে।
জারুল তমাল নিম নাগেশ্বরের মাঝে ব্যাপ্ত যে মুখখানি দেখতে পাবো নক্ষত্র আলোকে, তাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব।
আমার জীবনের সকল দায়ভার তোমাতেই গচ্ছিত। আমি যাকে চেয়েছিলাম, শেষপর্যন্ত শেষ মুহূর্তে তাকেই কাছে পাইলাম। আমার আর কোনও খেদ রইল না…।
২৩. এসো মায়াবতী
কাল ছিল ঘুমহীন রাত। দুঃস্বপ্ন ধেয়ে এসেছিল খোলা জানালা দিয়ে। সূর্যের এত আলো, সেও নিঃশেষিত হয়েছিল আঁধারের কাছে। অন্ধকারে চেয়ে জীবনকে দেখেছি। সেখানে পৃথিবীর কোনো মায়া ছিল না।
এসো মায়াবতী,
আমাকে এমন বিষণ্ণ করে রেখ না। ভিতরের কান্নার শব্দ নিস্তব্ধ করে দাও। মুখের দিকে চেয়ে দুঃখ ভুলিয়ে দাও।
একটি ফুল ঝরে গেছে তাই বলে কী ফুটবে না আর ফুল সুবাস ঝরাতে?
একটি পাখি মরে গেছে, তাই বলে কী পৃথিবীর সব গান থেমে থাকবে ?
জেগে আছি। ভালোবাসাময় সূর্য একসময় আলো ছড়াবেই।
২৪. ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু
জীবনের পিছনের চলার পথ গুলোর দিকে আর ফিরে তাকাতে পারি না। কোথা’ থেকে যে জীবন শুরু হয়েছিল, আর কোথায় পড়ে আছে সেই শুরুর বিন্দু।পায়ের দাগ গুলোও পথের ধূলায় মিলিয়ে গেছে। এই ছায়া সুনিবিড় দেশটাতে জন্ম হলো। এ মাটির গন্ধে ভরে গেল মন। এই মাটিতেই শিকড় ছড়ালাম। এই মাটিতেই সংসার হলো। ঘরবাড়ি বৃক্ষ সন্তান এই মাটিতেই। জীবনের সেই শুরু থেকে অনেক দূর চলে এসেছি। পিছনের সবই কেমন যেন বিস্মৃত হয়ে গেছে। কতোটুকুই বা পথ চলতে পারব ? পথের শেষ প্রান্তে কি চলে এসেছি ? পা যে আর চলছে না। জীবন থেমে যাচ্ছে। এ কেমন ক্লান্তি আমার!! হায় ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু।”
২৫. গল্প নয়
সোমা ব্যানার্জি, পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের মেয়ে। সে একজন স্কুল শিক্ষিকা। কবে কখন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে যুক্ত হয়েছিল মনে নেই। শিক্ষকতার পাশাপাশি সোমা লেখালেখি করত। গল্প ও কবিতা লিখত।
সোমা, আমার লেখা খুব পছন্দ করত। সে ছিল আমার অপূর্ব সুন্দর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাদের মাঝে কথা যা হতো ফেসবুকেই। কমেন্টের মাঝেই কথা আদান-প্রদান হতো।
সোমা আমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখে ওর ওয়ালে পোস্টও দিয়েছিল। এই মেয়েটি ২০১৭, নভেম্বর ইং থেকে আর ফেসবুকে নেই। ওকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কাকতালীয় কি না জানি না, ঐ দিন ওর জন্মদিনও ছিল।
আমি এই মেয়েটিকে অনলাইনে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও ওকে দেখতে পাইনা। এমন কেউ নেই যে, তার কাছে থেকে সোমার কোনো খোঁজ নেব বা তার কোনও খোঁজ পাবো।
কেন জানি খুব মন খারাপ লাগে সোমার জন্য। খুব মিস করি ওকে। বলা নেই, একটি মেয়ে হঠাৎ এই ভাবে হারিয়ে যায়? না বলে চলে যায়? অজান্তে দুশ্চিন্তাও হয়, সোমা তুমি বেঁচে আছ তো?
আমাকে নিয়ে সোমার লেখা সেই কবিতাটি এখানে পোস্ট দিলাম —
“পূর্বমেঘকে পাঠিয়েছিলুম তোমার কাছে
সে এসে বললে—
তোমার দিশা তার অজানা।
গঙ্গাপারের শীতল হাওয়াকে পাঠালুম
তোমাকে আমার কথা জানাতে
সে বলে পাঠালে–আমি তো যমুনায় হারিয়ে গেছি
ফেরবার কোনো তাড়া নেই আমার।
একা বসে রইলুম নদীপারে
যদি আসে কোনো মেঘ কিংবা আবেগ
যদি আসে কোনো ঢাকাই কিংবা জামদানি
যদি আসে——–
তাকে ভরিয়ে দেবো পলাশ , শিমূলে
একসাথে গাঁথব মালা, খেলব আবির
সোনারঙা বালুচরী পরে বলব–
তুমি মেঘবালক হবে?
আমার মতো–ঠিক আমারমতো—
জানো—-
আমার জন্য কেউ এক পৃথিবী লেখেনি
কেউ এক আলোকবর্ষ পথ হাঁটেনি
কেউ একটাও গীতবিতান গায়নি
ফাল্গুনি রাতে অশোক অশ্বত্থ তলে।
কোনো বেনীমাধব কখনো বলেনি
হৃদি কবে ভেসে গেছে পদ্মা,মেঘনায়—-
বৃষ্টিছাড়া মেঘলা আকাশ পাঠালুম–
শুধু তোমার জন্য।
চাঁদের আলোয় নীলশাড়ি,পূর্বরাগে মানিনী হব
শুধু তোমার জন্য।
কবিকে বলব–আমি এখন সময় করেছি
শুধু তোমার জন্য।
আমার খাঁচার অচিন পাখিকে উড়িয়ে দিলুম
শুধু তোমার জন্য।
আমার বটের ঝুরিতেলাল সুতো বাঁধা
অপেক্ষা —
শুধু তোমার জন্য।
শবরীর অপেক্ষায়—
তুমি আসবে তো? কোয়েল —
পাখি হয়ে, মেঘ হয়ে, চাঁদ হয়ে, বৃষ্টি হয়ে
এজন্মে না হলেও পরজন্মে।”
**** **** **** **** **** ****
সোমা,
পাখি হয়ে, মেঘ হয়ে, চাঁদ হয়ে, বৃষ্টি হয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াই, তোমাকে কোথাও দেখতে পাই না।
কোথাও থেকে কোনও সুসংবাদ আসে না।
সোমা ব্যানার্জি তুমি বলেছিলে-
পূর্বমেঘের কাছে শুভাশীষ পাঠিয়ে দেবে
কত মেঘ উড়ে উড়ে এসে জল হলো
সেই মেঘের সাথে সেই জলের সাথে
তোমার কোনো সুভাশীষ নেই।
বলেছিলে গঙ্গা পাড়ের শীতল হাওয়া পাঠিয়ে দেবে
ঈশাণ থেকে কত বাতাস এল, কত ঝড় এল
সেই বাতসের সাথে সেই ঝড়ের সাথে
গঙ্গার শীতল হাওয়ার কোনও স্নিগ্ধতা নেই।
তোমার আছে শান্তি নিকেতন আমার আছে শিলাইদহ
তোমার আছে চুরুলিয়া আমার কাছে পতিসর
তোমার আছে রামগিরি আমার আছে চিম্বুক
তোমার আছে মানস সরোবর, আমার এখানে পদ্মা, ব্রম্মপুত্র যমুনা বহমান…
সোমা ব্যানার্জি-
কী যে আফসোস তুমি আমায় দিয়ে রেখে গেলে —
কোনও নদীর কাছে কোনও মেঘের কাছে তোমার কোনও সুসংবাদ নেই।
**** **** **** ****
শেষ এপিসোড।
উপরের লেখাটুকু দিয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকে আমার ওয়ালে ফেব্রুয়ারি’ ২০২২ । আর তখনই পেলাম সোমার খোঁজ।
সোমা,
এই অন্তর্জালেই তোমার দেখা পেয়েছিলাম, এই অন্তর্জাল থেকেই আজ জানলাম তুমি অনন্তলোকে চলে গেছ.. তাও বছর চারেক হয়ে গেছে।
কে কখন চলে যায় অস্তসূর্যের দিকে মুখ রেখে, কেউ জানে না. পিছনের পার্থিবলোকে কে আঁধারে পড়ে রইল, কে কাঁদছে, কে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে কোন্ গোপন অলিন্দে বসে অঝোরে, কে চেয়ে রইল নিবিড় বেদনায় কে তার খবর রাখে…
জামদানী শাড়িটি রেখে দেব কাঠের তোরঙ্গে।
সাথে মিশিয়ে দেব চন্দনের সুগন্ধি, তোমার ছোঁয়া নেই তাতে, ধূসর ধূপগন্ধ আকুল হয়ে থাকবে বদ্ধ বাক্সের রুদ্ধ কুঠরীগুলি..
পূর্বমেঘের কোনও মেঘ খুঁজে পাবে না আর তোমাকে গঙ্গা পাড়ে, ময়ূরাক্ষী তীরে উড়বে শুকনো ধূলোবালি, রূপনারায়ণের কূলে কাশফুল ঝরে পড়ে থাকবে জীর্ণ হয়ে ..কিছু নেই কেউ নেই কোথাও। তোমার দেহ যে তারও অনেক আগে ছাই ভস্ম হয়ে গেছে…
তবুও তোমাকে যে আমার দেখতেই হবে সোমা।
তোমার দেহ ধূপপোড়ার গন্ধের সাথে মিশে আছে সেখানকার বাতাসে, তোমার স্বরূপ দেখব আমি ..নিতে হবে দেহ গন্ধও..
হয়তো কোনও বসন্তদিনে আমি আসব।
গঙ্গাকূলে একাকী বসে মৃদু তরঙ্গের জলকলধ্বনি শুনব। আমি একা, তবু ভয় পাব না। বুঝতে পারব তুমি দেখছ দূর থেকে৷
নির্জন মৌনতায় প্রার্থনা করব কেবল —
ঐ অমৃতলোকে তুমি ভালো থেকো সোমা অমিয় করুণাধারায়…
২৬. অপ্রাপ্তি
সারাদিন আজ কেবল শব্দ খুঁজেছি ….. গুমোট বাঁধা ক্রন্দন, ঝির ঝির করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে, আশ্বিনী শিন শিন মেঘ, নেরী কুকুরের দৌড়ের মতো দীর্ঘশ্বাস, ধূলো খুঁজি অযথা বৃষ্টি ভেজা মাটিতে, দুপুরের রোদ্দুর চঞ্চল হয় মনের ভিতর, সন্ধ্যা নামে ইমন কল্যাণে, হরিণের গ্রীবার মতো চোখ, কালপুরুষের পাশে বিশাখা, রাত্রি ফুরায় রুপকথার গল্পের মতো, কাঁচা বেলের আঠার মত পিরিতি ……
শব্দ খুঁজতে খুঁজতে কবিতা আর লেখা হলো না। যেমন করে ভালবাসতে বাসতে শুধু ভালবাসাই হয়। তোমাকে আর পাওয়া হয় না।
২৭. জ্বলুক দীপ্তি ঢালা সুধা
তুমি আমার জীবন চরিতার্থ করে দিয়েছিলে, সব ফুলের আগুন নীল দিগন্তে মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই তীব্র ভালোবাসার মুহূর্তগুলো নত হয়েছিল জমিনের উপর। সেইখানেই একই বিন্দুতে তুমি আমি একীভূত হয়েছিলাম। ঠিক সেইখানে শূন্যতা কি রাখা যায়? এতটুকুও কি ম্লান হয়েছে সেই স্বেদবিন্দু? সেই অনাবৃত শিহরণ? অনিঃশেষ প্রেম চিহ্নগুলি কি কখনও মুছে যায়?
জ্বলুক তোমার দীপ্তিঢালা সুধা, ঐ সুধায় ধন্য হোক এই নশ্বরতার সমস্ত আর্তি বেদনা দু:খ ও সুখ। এসো, সর্বাঙ্গ লেহন করো, চির চরিতার্থ হোক এই দুই হৃদয়খানি।
২৮. ব্লু হোয়েলের রাত্রি
কাল সারা রাত জেগে থেকেছিলাম, খুব চেয়েছিলাম, কেউ এসে বলুক – ‘চলো যাই ঐ নীল পাহাড়ে! দেখি দু’জন চোখ মেলে দূরের কৃষ্ণপক্ষের ঐ ক্ষীণ বাঁকা চাঁদ।’ বলুক এক অচেনা মায়াবী কন্ঠে – ‘এই পৃথিবী তোমার আমার জন্য নয়, দেখো, কেমন মায়ামমতাহীন হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ভালোবাসার জন্য আর এই পৃথিবী ভালো নেই।’
‘জীবনকে সুন্দর করার জন্য, ভালোবাসার যত অমৃত স্বাদ আছে, তা পাওয়ার জন্য চলো যাই– অন্য কোনো গ্রহে। দেখো, এই স্বপ্নীল আঁধারে এই রাত্রি আমাদের ডাকছে। দূরে পাহাড়ের পাশে বহমান এক অতল গিরি নদী আছে। এসো আমার হাত ধরো, চলো যাই দু’জনে– হাতে হাত ধরে আত্মাহুতি দেই স্বচ্ছ নীল জলে। এই পৃথিবীতে আমাদের জীবন রেখে কি লাভ? তারচেয়ে উপভোগ করি — এই জগতের বাইরে অন্য কোনো স্বপ্নের জগতের সকল প্রেম সুধা। ‘
ব্লু হোয়েলের এই রাত ব্যর্থই হয়ে গেল। শুভ্র শাড়ি পরে, পায়ে কিঙ্কিনী মল বেজে কেউই আর আসেনি। রয়ে গেলাম আমি আমার পৃথিবীতেই!
হায়!
সুখের আত্মাহুতি আর দেয়া হলো না।
২৯. চোখ
সেই কতকাল ধরে তার দিকে চেয়ে আছি। কত যে আমার নয়নের ছায়া পড়েছে তারই নয়নে। কী সুগভীর সেই চোখ। কী আশ্চর্য সেই আঁখি তারা। এমন নির্নিমেষ আঁখিতে কেবল জীবনের ছবি দেখা যায়। দেখা যায় পৃথিবীর রূপ। যে চোখ কেবল শান্ত দীঘির জল। যে জলে আকাশের নীল এসে পড়ে।
৩০. বিষাদ চিহ্ন
হঠাৎ আকাশ মেঘে কালো হয়ে গেল। বৃষ্টিও হলো। রোদও উঠল। আবার মেঘ হলো। আবার বৃষ্টি। তারপর রোদ আর উঠলো না। আকাশ থমথমে হয়ে থাকলো। ঘুম এলো চোখে। অসময়ের সেই ঘুম।
তখন সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে।
জঙ্গলের ওপাশ দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি মেয়ে।
ঘোমটা দেওয়া ছিল মাথায়। কাপড়ের রং দেখে মনে হয়েছিল তাকে আমি চিনি। সে গন্ধরাজের ঝাড় থেকে একটি ফুল ছিঁড়ছিল।
হঠাৎ একটি বিষধর সাপ তাকে ধ্বংসন করে। মেয়েটি আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
তার কান্নার শব্দ শুনেই তাকে চিনতে পারি। আমি কাছে এগিয়ে যাই।
দেখি, হাত তার বিষে নীল হয়ে আছে। নাহ্ এটি কোনও সত্যি ঘটনা নয়।
এটি একটি দুঃস্বপ্ন ছিল।
ঘুম থেকে জেগে তার হাতখানি আমি কাছে টেনে নেই।
অনেক দিনের পুরনো একটি ক্ষত সেখানে আজও দেখতে পেলাম।
যা আমারই সৃষ্ট করা একটি বিষাদ চিহ্ন।
এখনও নীল হয়ে আছে।
আমি মুখ লাগিয়ে আজকেও ব্যথা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছু ক্ষত কখনো উপশম হয়না।
৩১. অচেনা অলকানন্দা
এই পৃথিবীর দিকে মুখ রেখে ভাবি-
এখান থেকে চলে গেলেও শতবর্ষ পরে আবার এই মাটিতেই ফিরে আসব।
যে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে অমোঘ মৃত্যুর মাঝে, সেই ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন সাথে নিয়ে আবার আসব এই ধূলির পৃথিবীতে।
তখন দেখতে পাবো কি আবার নন্দনকাননে ফুটে থাকা সেই অলকানন্দা ফুল? দেখতে পাবো কি অলস দুপুরে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে আমার জন্য বকুলফুলের মালা গা্ঁথছে কি কেউ? কিংবা যাকে পেয়েছিলাম সারা জীবনে, ফিরে এসে তাকেই কি আবার পাবো পরজীবনে?
এই শস্যক্ষেত এই নদী এই নীল আকাশ সব কি আগের মতোই থাকবে? এই লোকালয়ের, পশু পাখি মানুষ বৃক্ষরাজি এসব ফিরে এসে আবার দেখতে পাবো কি? নাকি অচেনা কেউ হয়ে যাব আমি সেই সময়ে !
৩২. কতদূর
কতদূর! কত কালচে রাত্রির অন্ধকার। কত পথ ঘুরে তবুও যেতে ইচ্ছা করে তোমার কাছে কুসুমপুর। এই প্রবাস বিভূঁইয়ে মরতেও ইচ্ছা করে না।
কার্তিকের পাঁকা ধানের মতো তুমি নুয়ে আছ,
তোমার শরীর জুড়ে শস্যের অপার গন্ধ।
হাত ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, নরম ঠোঁটের স্পর্শ নিতে ইচ্ছা করে। যেতে ইচ্ছা করে তোমার কাছে, খুব তাড়া করে এই হেমন্তেই।
অমাবস্যার রাত্রিতে নক্ষত্রেরা ছুটে আসে এই পৃথিবীতে। সেই সব নক্ষত্ররাজির আলোয় গোপন পথগুলো আমাকে ঠিকই চিনে নিয়ে যাবে একজন অন্তরাক্ষীর কাছে।
হেমন্তের চিবুক ছোঁয়া আলোয় থিতু হবো সেখানে। এসো তোমাকে ছুঁয়ে থাকি।
৩৩. দীপ্ত করো
তোমার নীল নয়নে শ্রাবণ মেঘের বিদ্যুৎ ঝলক। কন্ঠে মধুমঞ্জরির মালা। দেহলতায় পদ্মদামের লাবণ্য। তোমার শরীর অমল ধবল জ্যোৎস্নায় স্নাত। চোখের পাতায় নাগকেশরের স্পর্শ। হে আমার প্রিয়ন্তী, তোমার কেশ কুন্তলের গন্ধে মদির এই ঘর। আমাকে তুমি দীপ্ত করো।
৩৪. বিচ্ছেদ
তোমাকে ফেলে রেখে পুনর্যাপী পাখির মতো দূরে চলে যাব, আর তুমি কী-না ঝরা ফুলের মতো পথের ধুলোয় নির্মোহে পড়ে থাকবে, তাই কী হয়? তোমার ভিতরই পেয়েছিলাম পূর্ণতার অপূর্ণতার বোধগুলো– প্রীতি, কাম, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, ক্রোধ, সমবেদনা ও করুণা। এই সবই অন্ধকার রাতের অসংখ্য তারার মতো জ্বলজ্বলে হয়ে আছে।
তাই যেখানেই যাই — ফিরে আসতেই হবে তোমার কাছে। এখানে না হলেও অন্য কক্ষপথে, জীবনের আর একটি পরিক্রমায়।
৩৫. বিবর্ণ মুহূর্তগুলি
দিয়া বাড়ির কাশবন ছাড়িয়ে, কারুকার্যময় ব্রীজটি পার হয়ে, বেরীবাঁধের উপরে দুজন পাশাপাশি হাঁটছিলাম। ভেবেছিলাম নির্জনতা পাবো পথের উপরে। মনে করেছিলাম, কোনো কোলাহল থাকবে না সেখানে। শব্দহীন নৈঃশব্দ্যের ভিতরে দুজন চরণ মিলিয়ে হাঁটব। কিন্তু তা আর হলো না। মানুষের চলাচল আর গাড়ির হর্ণ আমাদের কাশবনেই ফিরিয়ে এনেছিল।
হেমন্তের শেষ বিকেল। মেঘের কুন্তল চিড়ে রোদ এসে পড়েছিল কাশবনের পাতায়। তুরাগ নদী থেকে আসা ঝালর বাতাসে দুলছিল কাশফুল। ঘাস ফড়িঙ’রা উড়ছে। ফুলের উপর পড়ছে। চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ব্রীজের উপর যেয়ে দাঁড়াই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সিঁদুর রঙের মেঘের ফাঁকে দিয়ে চিল উড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা হয়েছিল আমাদের — অমন করে মেঘের আড়ালে উড়ে উড়ে চিলের চোখে মেঘ দেখি।
কিন্তু দেখা হয়নি। এই রকম কতো কিছুই দেখা হয়নি। পাওয়া হয়নি এমন কতো অনাস্বিত জীবনের স্বাদ। আজ এই স্বপ্নীল বিকেলে কাশবন ঘেঁষে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নীচের লেকের জলে কাগজের নৌকা ভাসাতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু তাও ভাসানো হলো না। ঝরাপাতার মর্মরে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। আঁধারের রূপ আর তারাভরা আকাশ দেখবার আগেই ফিরে আসতে হয়েছিল আমাদের।
খোলা রিক্সায় করে ফিরে আসতে আসতে পথে বিবর্ণ লাগছিল মুহূর্তগুলি। আমরা কী মূঢ়? আমাদের স্বপ্ন আছে। দুঃখ আছে। আমরা জীবনকে ভালোবেসে চলি। আমরা দুঃখ পাই। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো হৃদয় খুঁড়ে রক্ত ঝরাতেও ভালোবাসি। তারপর দুজনের আশ্চর্য দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম — জীবন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে, তুমিও আছ, আমিও আছি।
৩৬. অফুরান
একটাই কথা একটাই গল্প আমাদের জীবনে। একটাই আশা ছোট সে আশা, ভালো সে বাসা আমাদের স্বপ্নে। আমাদের রূপালি মন একদিন স্বপ্ন ডানা মিলবে আকাশের নীল নীল নীলে। আমাদের পথ চলা কখনও ধূলির ধুলায়, কখনও অরণ্যে, কখনও পর্বত গিরিপথে।
আমাদের ঘরের চারপাশে জোনাকিরা জলছবির মতো জ্বলে আর নেভে। রাতের পদ্মগুলি গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে উত্তরের হাওয়ায়।
আমরা চাঁদের দিকে মুখ তুলে ধরি। আলোর বৃত্তে আটকে থাকে চোখ। চিকের দুপাশে উড়তে থাকে চুল। থিরথির করে কাঁপে বুক। অবচেতনে ঝরে পড়ে অশ্রু শিশির। তারপরও আমাদের স্বপ্ন চূর্ণ বিচূর্ণ হতে দিই না। রাত্রিভর আকুল হয়ে বসে থাকি তারাভরা আকাশের নিচে। মুগ্ধতা নিয়ে। কাতরতা নিয়ে।
৩৭. এমনই তরঙ্গ
সংসারে শিকড় গাঁথতে কখনও চাইনি। কিন্তু এক কলেজফেরা বিকালে তার সাথে আমার দেখা হলো। নদীর মতো প্রবাহমান আঁকাবাঁকা জীবনটি হঠাৎই বাঁক বদল করে তারই দিকে মোড় নিল।
এমনই কী আমি চেয়েছিলাম? এমনই উঠতি বয়সি এক নদী, এমনই উচ্ছ্বল ঝর্না। এমনই তরঙ্গ।
৩৮. দূর আকাশের তারা
যারা চিরতরে চলে যায় তারা নাকি দূর আকাশে তারা হয়ে জ্বলে থাকে। এরকম অসংখ্য তারা আমি দেখি সন্ধ্যা রাতে, যে তারায় খু্ঁজে বেড়াই বাবা মা’কে, আপনজনদেরকে। ভাবি, আমরাও একদিন এমনি করে দূর আকাশের তারা হয়ে জ্বলে থাকব।
এও ভাবি, আমাদের ছেলে মেয়েরা অন্তর্জালে বে্ঁধে থাকে। ওরা আমাদের মতো সন্ধ্যার আকাশ দেখে না। হয়তো কাছের কোনও আকাশেই জ্বলে থাকব কিন্তু আমাদেরকে ওরা খু্ঁজবেও না, দেখবেও না।
৩৯. ভালোবাসা
আচ্ছা ভালোবাসা গুলো কেমন হয়? ধরুন, একটি ব্যস্ত রাস্তা পার হবো। সেই ক্ষণে সে যদি এসে আমার হাত ধরে বলে — দুদিকে দেখে সাবধানে রাস্তা পার হবে।
আমার হাতে বেশ ওজনের বাজারের ব্যাগ। সে হতদ্যোম হয়ে কাছে এসে যদি বলে — তুমি নেবে না। আমাকে দাও। তোমার বুকে ব্যথা হবে।
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে। মুখে তুলে ঔষধ খাওয়ার সামর্থ্যটুকু তার ছিল না। কেন ডাকা হলো না আমাকে? এই কথা বলতেই সে যদি বলে — তোমার ঘুম আমি ভাঙ্গাতে চাইনি।
আবার এমনও আছে — সেই কবে তার ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে আইলাইনার বের করে চোখের কাজলরেখা ঠিক করে দিয়েছিলাম। সেই কথাটি সে মনে রেখেছে এখনও যত্ন করে।
এলোমেলো হয়ে যাওয়া তার শাড়ির কুচিগূলো রাস্তার উপর পায়ের কাছে বসে সেই কবে ঠিক করে দিয়েছিলাম, এই কথাটিও সে মনে রেখে আজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে।
আমি টিপ পরা খুব পছন্দ করি — তাই সাজতে গিয়ে এই কথাটি নাকি তার আগে মনে থাকে — টিপ পরতে হবে।
এমন আরও কতো কিছু আছে। ধরুন, হাঁটতে গেছি — উদোম আকাশের নিচে পথের ধারে এক লোক চা বিক্রি করছে। কেটলি থেকে ঢেলে দিল কাগজের কাপে গরম দুকাপ চা দুজনকে। এখানেও নাকি সুন্দর ক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়।
গুগল ঘাটছিলাম আজ। হঠাৎ চোখে পড়ল এই নিউজটি। ভালোবাসার জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার করে মানুষ? বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীকে কিডনি দিয়ে প্রাণ বাঁচালেন স্ত্রী। এ কী মানুষ? নাকি ঈশ্বরী। এইভাবে বেঁচে থাকুক ভালোবাসা।
৪০. ঘুম ঘুম রাত্রি
হেমন্তের বিকেলের শেষ রোদ তার মুখের উপর এসে উপচে পড়েছিল। নোলক পরা মুখখানি সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল। ধূপছায়া রঙের শাড়িটি তার হয়নি বিবর্ণ । বিকাল আর সন্ধ্যার এমনই মায়াবি সন্ধিক্ষণে বুকের উপরে কপাল রেখে সে বলেছিল — ওগো, আমার খুব ভয় হয়। আমাদের ভালোবাসা কখনই যেন ঘৃণায় শেষ না হয়।
৪১. কথা ছিল
কথা ছিল জোনাকি ডাকা রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ব। মাথার উপর ভাসবে হেমন্তের চাঁদ। হাতে হাত ধরে জ্যোৎস্না তলায় হেঁটে হেঁটে চলে যাব রেললাইন পার হয়ে দূরে বহু দুরে। কিন্তু তুমি আমার হাতে হাত রাখলে না। আমার কোনো কথা শুনলে না। পাশ ফিরে শুয়ে রইলে আরেক পাশে। তুমি অন্ধকারের মেঘ হয়ে গেলে। রাতের গহীনে হলে নিষ্প্রভ একটি তারা।
তুমি তো জানতে আমি কখনো একাকী চাঁদের নীচ দিয়ে হাঁটি না। বাঁধ ভাঙ্গা জ্যোৎস্নার রাত হোক, কিংবা ঘোর আঁধারের কোনো অমানিশাই হোক। তোমাকে সাথে নিয়েই হাঁটতাম। আজ তোমার মুখের উপর এক ভ্রান্ত মেঘ ছেয়ে আছে। মেঘ সরাতে যেয়ে দেখি — এ মেঘ কখনো বৃষ্টি ঝরায় না। তুমি এমন মেঘ বালিকা হয়ে কেন রইলে? কিযে এক মন খারাপ করে দিলে তুমি!
দূরে চন্দ্রালোকে একাকী কাঁদছিল এক নিশি বিহঙ্গ। এই রাতেও আমি খুঁজি সিরাজগঞ্জের যমুনা কূলের সেই কাঁশবন।
চলো তুমি এই রাত্রি নিশীথে, চলো তুমি রাতের জোনাকি হয়ে
চাঁদ উঠুক না উঠুক — নদীতে ডিঙ্গি বেয়ে
আমরা চলে যাই সেখানে, যেখানে স্নাত করব জল জোছনায় ভিজে আমাদের দেহখানি।
৪২. টগর ফুলের গন্ধ
মাঝে মাঝে শরীর থেকে কেমন যেন গন্ধ বের হয়।
ঠিক ঘামের নয়। আবার জুঁই ফুলের সুবাসের মতোও নয়। এই গন্ধের স্তরে স্তরে কেমন যেন একটা মাদকতা আছে। এই মাদকতা আমাকে ভুলিয়ে নিয়ে যায় কুসুমপুরের এক টগরফুল ফোটা ভোরের দিকে। খুব দেরিতে সেদিন ঘুম ভেঙ্গেছিল ।
আমি প্রথম সেদিন দেখেছিলাম টগরের ভিতরে শুভ্র রেণু। জলের আস্তরণও ছিল। চারিদিকে মাধুকরী ঘাসের বন। ভোরের কমলা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সকল পাপড়ি মেলে ধরেছিল। আমি উম্মাদের মতো প্রথম ছিন্নভিন্ন করেছিলাম সেই রেণু।
এখন সবকিছুই স্মৃতির নিস্তব্ধতা। সবকিছু নিস্তরঙ্গের। কোনও আবেশ নেই, বুকে ছুঁয়েও নেই মায়ারেণু। এখন যে স্তুপকার আস্তরণ দেখি, তার নিচে পড়ে আছে বহুদিনের পুরনো অতৃপ্তি । বহু বছর আগের মর্মরিত বেদনার গ্লানি।
৪৩. সন্ধ্যা রাতে বৃষ্টি
একজন নারীর শরীর রহস্যময় প্রকোষ্ঠ যেন। যেখানে আলো এবং অন্ধকার দুটোই বিরাজমান। এর দরজা খুললেই কেউ আলোকিত হয়, কেউ আবার হয় আঁধারে নিমজ্জিত। একজন রমণী জীবনের সব বিষাক্ত তোলপাড় নিংড়ে দেয় শহরের আবছায়া স্তম্ভ চিত্রে। যখন সে শান্তির আহ্বান পায় নিজের অবচেতনে, আত্মায়।
শহরের সন্ধ্যা বৃষ্টি নিয়ে এলে যে দেহ ভেজে অবলীলায়, যে পুরুষকে ধরে বিশ্ব হয়তো ঋণী থাকে কোনো এক সময় যা মিটিয়ে দেয় সঙ্গমে। সব সঙ্গমে আনন্দ থাকে না। কিছু মূহুর্ত তার জীবন পায়। আর তারা যে পুরুষের কাছে জীবন পায়। তার কাছেই পেখম মেলে। বাকিদের কাছে প্রাণহীন মূর্তি প্রতিমা।
৪৪. অসমাপ্ত কথোপকথন
— আজ কতদিন হয়ে গেল, ঠিক মতো তোমাকে যত্ন নিয়ে কখনো বলিনি, তুমি এখন কেমন আছো? তুমিও বলো না, চিনচিন করা তোমার বুকের ব্যথার কথা।
— আমি ভালো আছি। আমরা আবার এই শহরে ঘুরব। যে অলিগলিতে যাওয়া হয়নি, সেখানে। এখন আগের মতো কোথাও যাই না, তাই এই শহর বিষণ্ন হয়ে আছে।
—- একবারই তুমি নিয়ে গিয়েছিলে, ‘ঘরোয়া’তে খিচুড়ি খাওয়াতে। সেই কবে? মধুমিতায় টাইটেনিক দেখে বের হয়ে গরম,গরম খিচুড়ি খেয়েছিলাম। ভাগ্য কী ভালো ছিল, সেদিন দুপুরে বৃষ্টি নেমেছিল।
—- বুড়িগঙ্গার পাড়ে যাব। সদরঘাট টার্মিনালে রেলিং ধরে দুজনে দাঁড়িয়ে থাকব। লঞ্চের ভেঁপুর শব্দ তোমার খুব ভালো লাগে। তুমি বলতে– দুটো ভেঁপুর শব্দই এক, সুরও একই রকম। একটি বাজিয়ে ছেড়ে চলে যায়। আর একটি বাজিয়ে প্লাটফর্মে ভেড়ে। একটি বিদায়ের, আর একটি কাছে আসার।
— আমাকে তুমি একদিন আবার নবাব বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবে। আমি তোমার গল্পের মেহেরুন হবো। পায়ে পায়েল পরে যাব। শত বছর আগের সেই ওয়াইজ ঘাট। আমরা দেখতে পাব — ঘাট থেকে স্নান করে আসছে নর্তকীরা। নাচ মহলে নাচ হচ্ছে। ঘুঙ্গুরের মুর্ছণা আর তবলার শব্দে আমার পায়ের নুপুর তাল মিলাবে।
—- তোমার মনে আছে, বেইলি রোডে নাটক দেখার কথা? শকুন্তলা নাটক দেখেছিলে তুমি প্রথম। বলেছিলে– কী কঠিন নাটক তুমি আমাকে দেখাতে নিয়ে এলে, কিছু বুঝিনা।
—- আমার একটি খেদ ছিল, আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি। তুমি সেবার আমাকে নিয়ে যেয়ে তোমার স্মৃতি বিজড়িত জায়গা গুলো দেখালে। লাইব্রেরী বারান্দায় বসে কথা বললে। ড্যাসে খাওয়ালে। কলাভবনের কোরিডোর দিয়ে ঘুরালে। টিএসসি তে বসেছিলাম দুজন সারা বিকেল।
—- তুমি বুঝে ফেলেছিলে, রমনা সবুজের চেয়ে আমি সোহড়াওয়ার্দী উদ্যান কেন বেশি পছন্দ করি। কেন করি, সেকথা তুমি বারবার আমাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চেয়েও জানতে পারোনি। কিছু গোপন কথা, কিছু হৃদয়ের ব্যথা শুধু আমার করেই রেখে দিয়েছিলাম।
৪৫. চাঁদনী পরশ রাতে
খুব ছোট একটি ইচ্ছা হয়, যদি ফাগুনের জ্যোৎস্না ঝরা কোনো রাত পাই। যদি পাই ত্রিবেনীর মতো কোনো সঙ্গম স্থল! সেখানে সে রাতের নির্জনতায় তারাদের সাথে কথা বলব।
যদিও নেই গঙ্গা যমুনা স্বরস্বতি, যদি খুঁজে পাই তুরাগ বংশী আর বালু নদীর কোনো সঙ্গম স্থল! যদি তোমার মতো কাউকে পাই — কোনো গ্রহানুপুঞ্জের ছায়াপথে হাঁটব।
সেই আলোছায়ায় চলতে চলতে নিত্য দেহ আর মনের কোনো ইশারা পাই মিলনের, তবে তাই হবে বিরাজিত সেই চাঁদনী পরশ রাতে।
নাকি তুমিও কি সেই ত্রিবেনীর পলল মাটির গন্ধ নিয়ে হারিয়ে যাবে? কিংবা ওই ছায়াপথের আকাশে রাশি রাশি মেঘমালার মতো আমার সাথে উড়ে যাবে সুদুর অন্য গ্রহের কোনো নির্জনে!
৪৬. মনখারাপের কবিতা
তোমার কখনো মনখারাপ হয় ?
মনখারাপ খুব ভালো। কান্নাও ভালো, চোখের জল চোখ পরিস্কার করে। অশ্রু শুকিয়ে ফেলো না যেন।
আমাকে যেতে হবে এবার, একটি নির্জন বাবলাফুলতলা দিয়ে,
ধনিদহ বিল পাড় হয়ে ফাঁকা মাঠের উপর বটতলা ছাড়িয়ে অনেক দূর…
ওই যে নদীর ঘাট দেখছ, ওইখানে আমার ছোট খেয়ানৌকাখানি বাঁধা আছে।
তুমি থাকবে জগতের যত আনন্দের ভিতর। তোমার মাথার উপর পড়বে অনন্ত আকাশের ছায়া।
আমি সেই আকাশেই থাকব একটি অনুজ্জ্বল তারা হয়ে।
৪৭. পার্সোনাল নোট
এই নীল আকাশ, অরণ্যের বৃক্ষরাজি, সাগরের ফেনায়িত সমস্ত জলরাশি সম্ভাষণ জানিয়ে বলেছে —- তুমি চির প্রণয়ীতমা। চির স্বরূপা। এই ধরিত্রীতে প্রবাহিত সকল হাওয়া মৃদুমঞ্জুল স্পর্শ দিয়ে বলেছে– তুমি আনন্দময়ী। তুমি চির অস্তিত্ব। বিশ্বলোকের এক ঝাঁক শুক পাখি উড়ে যেতে যেতে শুনিয়ে গেছে — নির্মল সুখের গান। সেই গানের চিত্রিত অন্তরা তুমি। তুমিই সঞ্চারিণী। তুমিই সকল সুরের মাধুরী।
৪৮. শূন্যতা
কেউ কাছে চলে আসে কেউ দূরে চলে যায়। যে চলে যায় তার পায়ের চিহ্ন পড়ে থাকে। পাখি উড়ে চলে গেলে যেমন পড়ে থাকে দু’একটা পালক। আলনায় এলমেল হয়ে থাকে কিছু পরিধেয় কাপড় । রান্না ঘরে চুলার ধূয়া উড়তে থাকে কিছুক্ষণ, কথার প্রতিধ্বনিও মিলিয়ে যায়।
আর শূন্যতা? যে নতুন করে এলো — সেই ভরিয়ে দেয়।
৪৯. আমার থাকবে জল
তোমাকে নিয়ে সাগরের জলের দিকে চোখ রেখে বলেছিলাম, এ জল সব আমার। তুমি বলেছিলে –
এই জল যদি কখনও আমার চোখের জল হয়, তাও কি তোমার ? বলেছিলাম– চোখে এত জল হয় নাকি ? উদ্দাম সাগরের অতলান্ত জল রাশির দিকে তাকিয়ে সেদিনের সেই বিষণ্ন সূর্যাস্তবেলায় তুমি বলেছিলে —
এই রকমই চোখের জলে সাগর হবে আমার, যেদিন তুমি থাকবে না।
৫০. অশ্রু বিন্দুগুলি
তুমি সুন্দর করে ঘর দুয়ার গোছাও, ঝকঝকে রাখো ঘরের মেঝে। পরিপাটি রাখো আলনা। বারান্দায় ঝুল পড়েনা। আসবাবপত্রে জমে না ধূলো। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি না থাকলে তুমি এমনি করেই কি ঘরদুয়ার গোছাবে ? ফুলদানিতে সাজাবে ফুল ? কিংবা জ্বালাবে সন্ধ্যা বাতি ঠিক আগের মতো করেই ?
আঙ্গিনার ধুলোবালি মুছতে যেয়ে আমার পায়ের চিহ্নগুলিও একদিন মুছে ফেলবে। আমার জন্যে কে্ঁদে থাকা তোমার চোখের অশ্রুবি্ন্দুগুলিও একদিন শুকিয়ে যাবে, মুখে ভাসবে হয়তো তখন তোমার করুণ কোনো হাসি।
Leave a Reply