এবং মার্কেট ভিজিট – অভীক সরকার
এবং মার্কেট ভিজিট – অভীক সরকার / প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০২১
উৎসর্গ
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের করকমলে।
লেখকের কথা
ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী তাঁর ”রোমন্থন” নামের অসামান্য আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনাটির শুরুতে লেখকের বক্তব্যের শীর্ষনাম দিয়েছিলেন ‘প্রারম্ভিক মুখব্যাদান’, যুক্তি ছিল মুখখোলাকে মুখবন্ধ বলা নিতান্তই অর্থহীন। প্রাজ্ঞ পণ্ডিতপ্রবর যে কথা বলে অনায়াসে পার পেয়ে গেলেন, এবং তাবৎ পাঠকেরা ”কেয়াবাৎ, বহোত খুব” বলে সোল্লাসে শাবাসি দিয়ে উঠলেন, এই অর্বাচীন সে কথা বললে অনেক রসিকজনই যে আমার মুখ বন্ধ রাখার পক্ষেই মত দেবেন এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু লেখককে কিছু কৈফিয়ত দাখিল করতেই হয়। যদিও প্রকাশক মশাই এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কয়েকটা পাতা ফালতু ফালতু নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু প্রথা। তাছাড়া জাতে বাঙাল, কথা কইবার সুজুক পাইসি, ছারুম ক্যান?
আমার লেখা বই বার হবে এ স্বপ্ন আমি কোনওদিন দেখিনি। বস্তুত লেখক হবার ইচ্ছে বা লেখক তকমাটির প্রতি মোহ, দুটির কোনওটিই আমার কখনো ছিল না, আজও নেই। আমি চাকরিজীবী ছাপোষা মধ্যবিত্ত। নিজের চাকরি,যৎসামান্য পড়াশোনা আর নিভৃত গৃহকোণটি নিয়ে ভারি সুখেই ছিলাম। এহেন দুর্মতি যে কখনও হবে তার কোনও পূর্বলক্ষণই ছিল না। ছোটবেলায় ভারি রুগ্ন ছিলাম বলে খেলাধূলায় বিশেষ সুবিধা করতে পারতাম না। সেই বয়সে বড়দের চোখরাঙানি তাও মেনে নেওয়া যায়, সমবয়সীদের টিটকিরি মেনে নেওয়া বড়ই দুঃসহ। ফলে আমাকে একটা নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিতে হয়। সেই জগতের একচ্ছত্র অধিপতি রাজা রায়চৌধুরী বলে একটা খোঁড়া লোক, সঙ্গী হিসেবে দুই দাদা, প্রদোষ মিত্র এবং ভজহরি মুখুজ্জে। সে জগতে ষষ্ঠীঠাকুরুন ধরা পড়ার ভয়ে ক্ষীরের পুতুলের বদলে একটি ষেটের বাছা দিয়ে যান, সে জগতে এক বাচ্চা রিপোর্টার আর তার পোষা কুকুর শেখায় যে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই সত্যিকারের সাহস। সেই জগতে আরও ছিল ভারি মিষ্টি কিছু ভূত, কবরে শুয়ে থাকা এক পাগলা সাহেব, পাতালঘরে এক্সপেরিমেন্ট করা এক বৈজ্ঞানিক, পুরোনো মায়াভরা কিছু গ্রামগঞ্জ যেখানে সদাসর্বদাই নানা মজার কাণ্ড ঘটে চলেছে।
আর এসবের মধ্যে ছিলেন গোল চশমা পরিহিত এক ভদ্রলোক, তাঁরই বানানো এক আশ্চর্য দুনিয়া নিয়ে।
সুকুমার রায়।
সেই নিজের বানানো জগৎ থেকে আজও পরিত্রাণ পাইনি, পাওয়ার যে খুব ইচ্ছে আছে তাও নয়। আমি পাঠক, পাঠক হিসেবেই ভারি তৃপ্ত ছিলাম।
এমন সময়ে, আমি তখন ঠিক কচিটি নই, চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছি, এমন সময়ে ফেসবুক নামের সোশ্যাল মিডিয়াটি এসে দুদিনের মধ্যে জনচিত্ত জয় করে বসলো। পোস্ট, স্টেটাস, লাইক, শেয়ার, এই বহুলপ্রচলিত শব্দগুলির সংজ্ঞাই গেলো বদলে।
সমাজজীবনে ফেসবুক আদি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার অভিঘাত নিয়ে ইতিমধ্যে গবেষণা চলছে, আরও নিশ্চয়ই চলবে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ফেসবুকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো আমরা যারা স্কুল ও কলেজ জীবনের পর বাংলা ভাষা পড়া বা লেখা ভুলেই গেছিলাম, তাদের ফের ফেসবুকের লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের দিকে টেনে আনা। আমার এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক এর নাম দিয়েছেন মুক্তগদ্য। বস্তুত ফেসবুকের দৌলতে এমন কিছু চমৎকার গদ্য বা পদ্য পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে যা আক্ষরিক অর্থেই মণিমুক্তোর সমান।
এমন সময় নিজেরও বাংলা অক্ষরে ফেসবুকে কিছু লেখার বাসনা দুর্মদ হয়ে ওঠে। কবে এবং ঠিক কি কারণে এই ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ আবেগটির উদ্ভব ঘটে, বলা মুশকিল। তবে মোটামুটি আজ থেকে বছরখানেক আগে হবে, যখন আমি প্রথম বাংলা অক্ষরে কিছু লিখি। ততদিনে আমি বেশকিছু সাহিত্যমূলক গ্রুপেও ঢুকেছিলাম। তাদেরই একটিতে অসীম সাহসে ভর করে আমি দুয়েকটি নিজস্ব অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করি। আমার এক প্রাচীনা বান্ধবী (না তিনি বয়সে প্রাচীনা নন, প্রাচীনকাল থেকে আমার বান্ধবী) ‘তুমি ঠিক যে ভাবে কথা বলো, সেভাবে লেখো’ গোছের পরামর্শ দেন। খুব সম্ভবত আমার আজন্মকালের ছ্যাবলামির ওপর তাঁর ঐকান্তিক আস্থা ছিল। আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম বেশ কিছু লোকজন পছন্দ করছেন। দু একজন গুরুস্থানীয় লোক উৎসাহ দিতে লাগলেন। ফলে এই উদ্বাস্তু গরীব বাঙাল উত্তেজনায় ফেটে পড়ে ‘যায় যদি জীবন চলে’ স্লোগান তুলে মহোৎসাহে লেখালেখি শুরু করে দিলেন!
আদতে আমি সেলসের লোক, দশ বছরের ওপর হলো এ লাইনে আছি। দেশ দেখেছি প্রচুর, লোক দেখেছি আরও বেশি। অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে, ভারতবর্ষ নামের এই ভূখণ্ডকে চিনেছি আরও নিবিড়ভাবে। সেসব অভিজ্ঞতাই এক এক করে ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’ গল্পের আকারে লেখার চেষ্টা করেছি বার বার। এছাড়াও কিছু ছোটগল্প, আমার শিশুকন্যার সঙ্গে আমার কিছু চিত্তাকর্ষক আলোচনাও রয়ে গেছে একইসঙ্গে।
তারপর বছরখানেক কেটে গেছে। নিজের টাইমলাইনে এবং বিভিন্ন গ্রুপে আজন্মসঞ্চিত ইয়ার্কি ফাজলামি গুলো লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করেই চলেছি। অনেকেই বাংলাসাহিত্যের কমলবনে এই মত্তমাতঙ্গের বালখিল্য বিচরণ দেখে শোকসাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন, অজ জাতীয় প্রাণীর পক্ষে হলকর্ষণ যে তেমন সুফলপ্রদ নহে, মিষ্টভাষে এ কথা বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন নি। এহ বাহ্য, যেসব মহাত্মনদের চিন্তা সদাসর্বদাই তূরীয়মার্গে বিচরণ করে, সেই তাঁরা এহেন অপরিসীম ঔদ্ধত্যের পেছনে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের কালো হাত দেখে চ্যাটরুমে চ্যাটচ্যাটে থিসিস অবধি নামিয়ে ফেলতে ছাড়েননি!
এসব দেখে ভারি দুঃখ হলো। মহাতপাঃ নবারুণ বাঙালি জাতিকে অসহায় ছাড়াও আরেকটি সুচিন্তিত এবং মনোহারী আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অধম অতি দ্রুত সেই আখ্যার সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে বেশি সময় নেন নি। ফলে যাবতীয় খেচর, উভচর এবং জলচর বাঙালির সার্বিক মঙ্গলার্থে ভাবলাম এসব লেখা একত্রে বই হিসেবে প্রকাশ করলে কেমন হয়? কয়েকজন বন্ধুবেশী শত্রু খুবই উৎসাহ দিতে থাকলেন, সেসব শুনে নিজেকে মুজতবা আলি কি নবনীতা দেবসেনের সমকক্ষই বোধ হতে লাগলো।
কিন্তু বই প্রকাশ করতে প্রকাশক দরকার, তদুপরি ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’র যুক্তি প্রকাশনা জগতে চলে না। আর তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকরা আমার মতন অর্বাচীনের বই ছাপাবেন, এহেন দুরাশা স্বপ্নেও করিনি। তবে এই দেখে আশা হয়েছিল যে কয়েকজন উৎসাহী যুবক বাংলা প্রকাশনা ব্যবসার মরা গাঙে তরী ভাসাতে রাজি হয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁদের নিবিড় আগ্রহ সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁদেরই একজন, দ্য কাফে টেবল-এর অরিজিৎ ভদ্র, যেদিন নিজে থেকে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন, যেদিনই ঝট করে মনে পড়ে গেছিলো কবিগুরু একবার বলেছিলেন বটে, প্রকাশকের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ!
যাই হোক অরিজিতবাবুর সৌভাগ্য অক্ষয় হোক, কলেজ স্ট্রীটের সামনে ওঁর মর্মরমূর্তি স্থাপিত হোক, এই নাদান বালকের প্রথম বইটি তাঁরই কৃপায় প্রকাশিত হয়েছিল, এ কথা জীবনান্তেও ভুলব না।
বইটি বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট থাকার পর দীপ প্রকাশনের কর্ণধার দীপ্তাংশু পুনঃপ্রকাশের জন্য বইটি চেয়ে বসলেন। আমি তাঁকে অনেক করে বোঝালাম যে এই বই আর বিক্রি হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। একে এসবের অধিকাংশই সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে লেখা, সেসব কাঁচা হাতের কলমবাজি দেখলে নিজেরই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। তাছাড়া বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে আছি যে চিন্তাশীল সারস্বত সমাজে কল্কে পাব। সেখানে বিভিন্ন তাৎপর্যসন্ধানী তত্বভুবনে আশ্চর্য স্বকীয়তায় ঋদ্ধ বিশ্লেষণপদ্ধতি এবং তৎসন্নিহিত মগ্নচৈতন্যে নিবিষ্ট বীক্ষাভুবন- এসব গুরু গম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে। সেই থেকে নিজের কথাবার্তায় ভাবভঙ্গিতে একটা উদাস ইন্টেলেকচুয়াল ভাব আনার চেষ্টায় আছি। সেখানে এসব সস্তা ছ্যাবলামি করলে ব্র্যাইন্ড ভ্যালু লিক করে যাবে না?
কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই শুনলেন না, রাতবিরেতে ফোন করে খুব কড়া গলায় শাসাতে লাগলেন। ফলে ”তোমার ভুবনে মা’গো এত চাপ” ইত্যাদি ভেবেটেবে মাভৈঃ বলে পাণ্ডুলিপিখান পাঠাতেই হল।
যাই হোক, অলমিতি বিস্তারেণ। অনেক প্যাচাল পাড়ার পর আপাতত এখানেই এই মনোলগ শেষ করলাম। আশা করি সুধী জনগণ বইটা বুকে তুলে নেবেন, বুকে না নিয়ে অন্ততপক্ষে হাতে তুলে নিলেও হবে। ভালো লাগলে জানাবেন, আর খারাপ লাগলে অতি অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকবেন, ঠাণ্ডা লাগাবেন না, দেখে রাস্তা পার হবেন আর হ্যাঁ, পরের বার মার্কেটে গেলে অধমের কথা মনে করতে ভুলবেন না কিন্তু!
Leave a Reply